Skip to main content
1
Fri, 07/25/2025 - 20:44

 

যে দুঃখ, যে সমস্যা আমার হাতে নেই, আমার নিয়ন্ত্রণে নেই সে নিয়ে ভেবে আমি কী করব?

পৃথিবীর দুই প্রান্তে, প্রাচ্যে আর পাশ্চাত্যে দুইজন আলোকিত পুরুষ জন্মালেন। বুদ্ধ ও সক্রেটিস। দু'জনেই প্রায় কাছাকাছি। বুদ্ধের যখন যাওয়ার সময় হচ্ছে প্রায় তখন সক্রেটিস জন্মাচ্ছেন। সক্রেটিস আর বুদ্ধের জীবনশৈলীতে সাম্য একটা কেন্দ্রীয় ভাবনা। আগে বুদ্ধের কথা বলে নিই।

প্রাচীন বৌদ্ধ দর্শন তিনটে স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে - এক, সব অনিত্য; দুই, সব কিছুই অনাত্মা; তিন, সব কিছুই দুঃখময়।

বুদ্ধ কোনো করুণাময় স্রষ্টার কথা বলেননি। এ জগৎ দুঃখময়, অনিত্য আর আত্মাহীন এ কথাটা বুঝে নাও। অনেক দুঃখ শোক আছে যা তোমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে তাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা করে নাও। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের 'বোঝাপড়া' কবিতা প্রাসঙ্গিক এখানে --- “ভালো মন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে”।

বুদ্ধ শুধু মৈত্রীবোধের জনক নন, এ সাম্যের বোধেরও জনক। এবারে সক্রেটিসের কথায় আসি। সক্রেটিস সরাসরি এ কথা না বললেও তাঁর জীবন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘জেনো’ নামক এক দার্শনিক স্টোইক দর্শনের সূত্রপাত ঘটান। যে দর্শন এই কথাটিই আরো বিস্তারিতভাবে বলে। সেনেকা, এপিকটেটাস, অরেলিয়াস প্রমুখ যে দর্শনের মহীরুহ এক-একজন। প্রসঙ্গত এই এপিকটেটাসের আলোতেই আজকের মনোবিজ্ঞানের cognitive behavioral therapy এর জন্ম।

আবারও আগের কথাতে আসি। যে সমস্যা, যে দুঃখ আমার হাতের বাইরে তাকে আমার সহ্য করে নেওয়া ছাড়া কি আর কোনো উপায় আছে? নেই। দোঁহাতে আছে, দুঃখ সবাইকেই সহ্য করতে হয়, জ্ঞানী সহ্য করে জ্ঞানের আলোতে, মূর্খ ভোগ করে কেঁদে।

বুদ্ধ অনীশ্বরবাদী ছিলেন। স্টোয়িকরা কিছুটা আমাদের নির্গুণ ব্রহ্মের মত সর্বব্যাপী এক অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখত। কিন্তু সে সত্তার আমার ব্যক্তিগত সুখদুঃখে কোনো দায় নেই। তুমি তোমার ব্যষ্টিসত্তাকে ছাপিয়ে সাম্যে মনকে স্থির করে নাও। এই হল কথা।

গীতার প্রায় প্রতিটা অধ্যায়ে এই সাম্যতে মন স্থির করার কথা বলা হচ্ছে। সুখদুঃখ, লাভক্ষতি, জয়পরাজয়, শীতগ্রীষ্ম, বন্ধুশত্রু ইত্যাদি সব কিছুতেই মনকে সাম্যে স্থির রাখার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এখানেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গীতা ঈশ্বরবাদী। তিনি সবার সুহৃদ। তিনি স্রষ্টা। তিনি অন্তর্যামী। তিনি সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্ম আবার বৃহৎ থেকে বৃহৎ। অর্থাৎ তিনি আছেন। আমাকে ঘিরে বাইরে ভিতরে তিনিই শুধু আছেন।

কিন্তু প্রশ্ন হল তিনি থাকতেও আমার জীবনে এত সমস্যা, এত দুঃখ কেন? গোটা বিশ্বজুড়ে এত নৃশংসতা, অমানবিকতা কেন? যদি ঈশ্বর নেই মানি বুদ্ধের মত, বা থাকলেও ওই নির্গুণ নির্বিকার মানি স্টোয়িকদের মত, তবে একটা কথা হয়। ভাই এতটা আমার হাতে আছে, এতটাতেই "আহা উহু" করব। এরপরে আমার হাতে নেই, সেটা বুঝে নিয়ে যাই ঘটুক চুপ করেই থাকব। সহ্য করে নেব।

যদি সুহৃদ ঈশ্বর থাকেন তবে আমাকে সব সহ্য করে সাম্যে মন রাখতে হবে কেন? এইখানে উত্তর আসলেই নেই। জ্ঞানী বলছেন, আসলে তুমি বলে কিছু নেই, সব আঘাত, দুঃখ তিনিই পাচ্ছেন তুমি হয়ে। তোমার 'আমি' গেলেই সব তুমি - "নাহং নাহং তুঁহু তুঁহু"। ভাবের রাজ্যে এই কথাটা সত্য না করে নিলে উপায় নেই। আমি বলে কিছু নেই। কিন্তু ভক্তির রাস্তায় ভক্ত বলে তুমি প্রভু, আমি দাস। তুমি আমার সঙ্গে যা-ই করো না কেন, আমি রাজী। কিন্তু এই এতখানি ভক্তি ভালোবাসা কতজনের চিত্তে জন্মায়? আমাদের তো জন্মায় না। আমাদের তাই অভিযোগ, অভিমান, ক্ষোভ ইত্যাদির পাহাড় জমতে থাকে বুকে। সঙ্গে অসীম অসহায়তা।

বৌদ্ধ আর স্টোয়িকেরা এ দ্বন্দ্বে নেই। তারা বলবে তোমার ও কান্নাকাটি কেউ শোনার নেই ভায়া, যতটা পারছ নিরাময়ের চেষ্টা করো, বাকিটা বিনা দ্বন্দ্বে সহ্য করো, শেষে হার মানতেই হবে। আত্মা বলে কিছু নেই। নিত্য বলে কিছু নেই। সুখ বলে কিছু নেই।

কিন্তু সুহৃদ ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিলে কি বিনা দ্বন্দ্বে সব কিছু সহ্য করতে মন রাজী হয়? অভিযোগ আসাই তো স্বাভাবিক। একজন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে এ প্রশ্ন করতে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, এ সব লীলা। সে তখন আমাদের মতই বলেছিল, কিন্তু লীলায় তো আমাদের প্রাণ যায়। ঠাকুর বলেছিলেন, খোঁজ নিয়ে দেখো তুমি কোথায়, সবই তো তিনি। রমণ মহর্ষি যেমন বলতেন, জিজ্ঞাসা করে দেখো, কে তুমি? জিজ্ঞাসা করে দেখো, কে তোমার মধ্যে সুখদুঃখ ভোগ করছে?

জিজ্ঞাসা করে কী উত্তর পাওয়া যায় জানি না। কিন্তু দরদী ভগবান আর এ যন্ত্রণাময়, দুঃখময় সংসারের যে কোনো বোধগম্য ব্যাখ্যা হয় না এ আমরা বুঝি। যে অন্তর্যামী, সে পূর্ণ না শূন্য জানি না। কিন্তু নিজের ভিতর যত দ্বন্দ্বমুক্ত হয়, তত একটা প্রশান্তি আসে। বুদ্ধের সাম্যের শিক্ষাই অবশেষে জয়ী হয়। ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেই যদি সে রাস্তা সহজ হয় তবে তাই। আর ঈশ্বরকে স্বীকার করে নিয়ে, তাঁর প্রতি আনুগত্য রেখে সব সহ্য করে নেওয়া, স্বর্গে বা দেহাতীত হলে এ সবের মূল্য চুকিয়ে দেবেন এ আশায়, এ প্রতিশ্রুতিতে…সেও অনেক মানুষের জীবনপুঁজি। আর রইল মধ্যের আরেক রাস্তা, ঈশ্বর চান, আমি তাঁর ভরসায় না থেকে মনকে বুঝ দিয়ে সব সহ্য করে নিই। কেন চান? জানি না। এতে দ্বন্দ্ব বাড়ে না কমে? বুদ্ধই কি তবে বুঝেছিলেন? তাই কি বিবেকানন্দ নির্গুণ ব্রহ্মের কথা বলতে এত উদগ্রীব থাকতেন? তাই কি রবীন্দ্রনাথ 'শেষ প্রশ্ন' কবিতাতে এর উত্তর পেলেন না? আসলেই কি এই দুই বিরোধী তত্ত্বের মীমাংসা হয় না স্বর্গের রূপকথা ছাড়া?

2
Thu, 07/17/2025 - 20:31

 

যত অপরাধ, সে তো আইন আছে বলেই। যদি আইনটাকে দুর্বল করে দেওয়া যায়, তখন অপরাধকে আর কতটা কঠোর লাগে? লাগে না। তাই যে সমাজে অপরাধ অহরহ নানা বেশে ঘটেই চলেছে, সেখানে মানুষ সেটাকেই “নিউ নরমাল” ভেবে নেয়। মাঝে মাঝে দ্বিধাগ্রস্তও হয়—আমি কি বেশি ভাবছি? বেশি প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছি? ঘটনাটা কি এতটাই ভাবার মতো? নিজের মধ্যে নিজের বোধ-বুদ্ধি, মূল্যবোধ—সব কিছু নিয়ে সংশয় তৈরি হতে শুরু করে।

আবারও শুরুর কথাটা বলি, সমাজে অপরাধ তাকেই বলে, যা আইনের বিরুদ্ধে যায়। তবে আইন কী? এই নিয়ে অনেক পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। সে দিকে না গিয়ে বলি—এককালে আইন বলতে বোঝাত দিব্যবিধান। মোটামুটি সব সমাজেই আদিকালে একজন দিব্য বিধানকর্তার ব্যবস্থা থাকত। তাঁর কিছু রক্ষক থাকত, যারা ক্রমে ভক্ষকে পরিণত হতে শুরু করল। পাশ্চাত্যে চার্চ আর রাজার সিন্ডিকেট থেকে শুরু করে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের বিচার—সর্বত্রই নানা কুলীন আইনি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। যেমন মনুসংহিতা—কত নানাবিধ স্মৃতি!

ক্রমে দিন বদলাল। ঈশ্বরীয় আইন, রাজার আইন বদলে বিশ্বের অনেক দেশে গণতন্ত্রের আইন প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু সেই আইনও ত্রুটিহীন হল না, অপব্যবহারের সম্ভাবনামুক্তও হল না। কারণ? কারণ ঈশ্বর বিদায় নিলেন, কিন্তু লোভ তো থেকেই গেল। লোভের বিকার, প্রতিহিংসার বিকার, লালসার বিকার যাবে কোথায়? তাকে আইন-আদালত থামাতে পারে না। তবে আইন-আদালত কী পারে? সমাজকে অপরাধমুক্ত করতে পারে না, কিন্তু অপরাধীমুক্ত করতে পারে—যতটা দূর সম্ভব।

অপরাধ আর অপরাধী—দুয়েরই অস্তিত্ব আইনের অস্তিত্বের উপর নির্ভরশীল। একসময় আমাদের সমাজে সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, পণপ্রথা ইত্যাদি সামাজিক বিধি ছিল। সেগুলো অপরাধ ছিল না, কারণ সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো আইন ছিল না। দেশের কয়েকজন মহানুভবের বিবেকে কথাটা বেজেছিল বলেই তাঁরা সরাসরি আইন আনার ব্যবস্থা করেন, এবং সমাজে তার প্রতিফলনও দেখা যায়।

কিন্তু যেগুলো সামাজিক অমানবিক প্রথা, সেগুলোকে না হয় সেইভাবে আটকানো গেল। যেগুলো মানুষের বিকারের ফল? ক্রিমিনাল প্রোফাইলিং ইত্যাদি অত্যাধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির কতটুকু বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে আমাদের দেশে? হয়, হচ্ছে; না হয়, হচ্ছে না।

কিন্তু আইন? আইনের কাজ কি শুধু শাস্তি দেওয়া? অনেক বড় বড় কঠোর সাজা হয়েছে। কিন্তু যে অপরাধ করে, সে কি শাস্তির ভয় পায়? নাকি তৎপর আইনব্যবস্থার ভয় পায়?

আমার মনে হয়, এখানেই একটা সূক্ষ্ম ফারাক আছে। দু-একটা ফাঁসি বা যাবজ্জীবনের ভয় যতটা না ভয় জাগায়, তার চেয়েও বড় ভয় হচ্ছে এক সতর্ক, সতেজ প্রশাসনিক ব্যবস্থার উপস্থিতি। যে মানুষ প্রতিদিন দেখে সমাজে অপরাধ ঘটছে, এবং আধা-ঘুমন্ত, আধা-জাগ্রত আইনব্যবস্থার ফাঁকফোকর দিয়ে তারা বেরিয়ে যাচ্ছে, তার ক্রমে দুঃসাহস বেড়ে যায়। ধীরে ধীরে সে আরও বড় অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কারণ, অপরাধ করার মধ্যে একটা স্বেচ্ছাচারিতার আনন্দ তো আছেই। সমাজ স্বেচ্ছাচারিতায় বাধা দেয়, আইন বাধা দেয়—অপরাধ বাধা দেয় না। সে কাউকে ভয় পায় না, ভয় পায় কেবল সততার তৎপরতাকে। সেই সততাকে সে দ্বিচারিতা আর ভণ্ডামির ব্যাখ্যায় দেখে বলেই, খাঁটি সত্যকে নিয়েও তার একসময় সংশয় জন্মে যায়। আর সামাজিক নানা ঘটনায় তার উদাহরণের অভাব নেই। তাই আজও আমাদের দেশে সৎ, তৎপর, আইননিষ্ঠ মানুষকে হিরো বলে মনে করা হয়। তাদের নিয়ে সিনেমা হয়। মানুষ বিস্মিত হয়। দেখে ভাবে—সত্যিই যদি এমন হত!

কিন্তু তৎপরতা মানে কী? কোনো একটা অপরাধ ঘটল, আর তড়িঘড়ি কাউকে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা হল—এই কি তৎপরতা? একজন অসুস্থ হলে, তৎপর চিকিৎসক কি হাতের কাছে যেটা পান সেটাই ব্যবহার করে চিকিৎসা শুরু করেন? না কি সংগত ওষুধ ব্যবহার করেন? একজন মাথা ফাটিয়ে এলে, চিকিৎসকের কাছে যদি শুধু হাত ভাঙার সরঞ্জাম থাকে, তবে তিনি নিশ্চয়ই রোগীর হাত ভেঙে চিকিৎসা দেখাবেন না! তেমনই, আইনের রক্ষকের কাছেও সংগত তৎপরতাই আশা করা যায়।

সব শেষে বলি, আইনের দুর্বলতায় অপরাধের গুরুত্বও দুর্বল হয়ে যায়। মানুষ সেই অবস্থাকেই ধীরে ধীরে “নিউ নরমাল” ভাবতে শুরু করে। এখানেই একটি মানুষের, একটি সমাজের নষ্ট হয়ে যাওয়ার বীজ লুকিয়ে থাকে। একজন মানুষ যখন বোঝে—যা ন্যায্য, তার আর কোনো আশাই নেই, তখন অন্যায্যকেই বাস্তব ধরে নেয়। একজন ডায়াবেটিক রোগী যখন নিজের কিংবা আশপাশের কারও পক্ষ থেকে মিষ্টি খাওয়ার কোনো বাধা পান না, এবং শরীরেও কোনো তৎক্ষণাৎ দুর্লক্ষণ দেখা যায় না, তখন তাকেই তিনি স্বাভাবিক অবস্থা বলে ধরে নেন—যতক্ষণ না মৃত্যু শিয়রে এসে উপস্থিত হয়।

আমাদেরও কি গতিপথ সেই দিকেই?

3
Tue, 06/24/2025 - 11:00

 

 

আকাশের নক্ষত্র, আত্মার নৈতিকতা আর মস্তিষ্কের গোপন খেলা -

মহান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের সমাধিতে দুটি বাক্য খোদাই করা আছে যা তাকে সারা জীবন বিস্মিত করেছিল: "আমার উপরে নক্ষত্রখচিত আকাশ, আর আমার ভিতরে নৈতিকতার বিধান।" কী গভীর! আজ যদি কান্ট বেঁচে থাকতেন, হয়তো তিনি কগনিটিভ সায়েন্স আর অ্যাস্ট্রোনমির গভীরে ডুব দিতেন। বার্ট্রান্ড রাসেলও একবার বলেছিলেন, যদি আবার ছাত্র হওয়ার সুযোগ পেতেন, তবে দর্শনের বদলে পদার্থবিজ্ঞানই তাঁর বিষয় হতো।

এগুলো নিছকই কল্পনা। কিন্তু এই কল্পনা কি কম শক্তিশালী? আমাদের মস্তিষ্কের জটিল জালের মধ্যেই তো কল্পনার জন্ম, যা আমাদের বর্তমানের বেড়াজাল পেরিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে উঁকি দিতে সাহায্য করে। কল্পনার আয়নাতেই আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি, আর অতীতের ভুলগুলো থেকে শিখি।

ডোপামিনের বহুমুখী রহস্য: তাৎক্ষণিক সুখ বনাম দীর্ঘমেয়াদী তৃপ্তি -

সম্প্রতি ডোপামিন নিয়ে একটি fascinating আলোচনা পড়লাম। ডোপামিন কী? সহজ কথায়, এটি একটি নিউরোকেমিক্যাল যা আমাদের সুখ, পুরস্কার এবং অনুপ্রেরণার অনুভূতি দেয়। যখন আমরা কোনো কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করি, ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে একটি 'পুরস্কার' হিসেবে কাজ করে, আমাদের উৎসাহিত করে এবং বলে, "আবার করো!" আবার, যখন আমরা ব্যর্থ হই, তখন এটি 'প্রেডিকশন এরর' (অনুমানের ভুল) তৈরি করে, যা আমাদের সেই কাজটি এড়িয়ে চলতে শেখায়।

কিন্তু ডোপামিন এত সরল নয়! বিজ্ঞানীরা বলছেন, ডোপামিন 'মাল্টিপল টাইমস্কেল'-এ কাজ করে। অর্থাৎ, এটি শুধু তাৎক্ষণিক সুখের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যতের বড় সুফল পাওয়ার জন্যও আমাদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। যে কাজ হয়তো এখন আনন্দ দিচ্ছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে বড় ফল বয়ে আনবে, সেই কাজ করার জন্য ডোপামিন আমাদের ধৈর্য ধরতে শেখায়। এই কারণেই মানুষ ত্যাগ স্বীকার করে, কৃচ্ছ্রসাধন করে—কারণ ডোপামিন তাকে ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত সুখের ছবি দেখায়। আমাদের মস্তিষ্ক যে সুদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন আঁকে, তার পেছনেও ডোপামিনের এই সূক্ষ্ম কৌশল কাজ করে! তাৎক্ষণিক সুখ আর দীর্ঘমেয়াদী সুখের মধ্যে বিবেচনার টানাপোড়েন।

উপনিষদে বহুকাল আগে দুটো পথের কথা বলছে - শ্রেয় আর প্রেয়ের পথ। এক তাৎক্ষণিক সুখের পথ, যা প্রেয়। আরেক সুচিন্তিত দীর্ঘস্থায়ী সুখের বিধান, যা শ্রেয়। এর মূলে কি ডোপামিনেরই খেলা?

মহাবিশ্বের টানাপোড়েন, মানুষের চিত্তের প্রতিচ্ছবি -

মানুষের চিত্তে এই কেন্দ্রাভিমুখী (Centripetal) আর কেন্দ্রাতিগ (Centrifugal) বলের টানাপোড়েন চিরন্তন। কোনটা সঠিক, তা সে কোনোদিন সম্পূর্ণ জানতে পারে না। তার মস্তিষ্কে যতই 'মাল্টিপল টাইমস্কেল' থাকুক না কেন, সে আসলে অজানার তিমিরে নিমজ্জিত। এই বিশাল অজানার মধ্যে তার বোধের আলো কতটুকুই বা পথ দেখায়?

একবার মহাজগতের দিকে তাকান! সেখানে আছে ডার্ক ম্যাটার, যা অদৃশ্য হলেও মহাবিশ্বের ২৭% জুড়ে আছে, গতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে এবং গ্রহ-নক্ষত্রকে একত্রে ধরে রেখেছে। এর বিপরীতে আছে ডার্ক এনার্জি, যা ৬৮% জুড়ে আছে এবং সবকিছুকে কেন্দ্রের বাইরে ঠেলে দিচ্ছে। আমাদের চিত্তের মতোই এই মহাবিশ্বও এক অনন্ত টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে চলেছে। আমরা ডার্ক ম্যাটার আর ডার্ক এনার্জিকে জানি, অথচ তাদের স্বরূপ কী, তা জানি না!

অজানার পথে দার্শনিকের অবিচল যাত্রা -

বিশ্বজুড়ে চলছে এক তাণ্ডব, যেন নটরাজের প্রলয়লীলা। কেন? উত্তর আমাদের অজানা। মনে হয় যেন সব শুভশক্তি অশুভের ইন্দ্রজালে আটকা পড়ে আছে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা আছে, তবুও হচ্ছে না। আবার সবকিছু স্থিতিতে আসার সম্ভাবনাও আছে, তবুও হচ্ছে না।

দার্শনিক তার বোধের কল্পনায় তথ্যকে হয়তো স্পষ্ট দেখতে পায় না, কিন্তু কোথাও যেন একটা অস্পষ্ট ছাঁচ দেখতে পায়—ত্রুটিপূর্ণ হলেও সে হাল ছাড়ে না। সে এই টানাপোড়েনকে স্তব্ধ করে শান্তি খোঁজে না, বরং এর মধ্যেই এক সাম্যাবস্থা চায়। তার আসল টানাপোড়েন হলো জানা আর অজানার মধ্যে। তার আকুতি, তার কান্না, তার বিস্ময়, তার সবটুকু জানার সাধ—এসবই তাকে চালিত করে। সে হতাশায় ডুবে যায় না, অপেক্ষা করে, ধৈর্য ধরে। এক বালুকণাকে সে যেমন গভীরে পর্যবেক্ষণ করে, তেমনই মহাকাশের নক্ষত্রমণ্ডলীর সভায়ও সে আসন পাতে—জানতে চায়, তারা কী বলছে।

4
Mon, 05/12/2025 - 11:14

 

বুদ্ধ তৃষ্ণার কথা বললেন। অজ্ঞানতার কথা বললেন। বুদ্ধ অহিংসার কথা বললেন। করুণার কথা বললেন। বুদ্ধ বললেন, আমার প্রজ্ঞা আর করুণাকে আবৃত করে রেখেছে আমার তৃষ্ণা আর আমার অজ্ঞানতা। আমি জীবনে নানাবিধ যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছি। শারীরিক, মানসিক ও অধ্যাত্মিক। শারীরিক ক্লেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারা যায় জীবনশৈলীতে বদল এনে। কিন্তু মানসিক ও অধ্যাত্মিক ক্লেশ কীভাবে যাবে? বুদ্ধ তৃষ্ণা আর অজ্ঞানতাকে চিনতে বলছেন। ধ্যানমগ্ন হও, আত্মমগ্ন হও, খুঁজে দেখো কোথায় তৃষ্ণা আর অজ্ঞানতা তোমাকে বিবশ, জড় করে রেখেছে। বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি। ধম্মং শরণম গচ্ছামি। সংঘম শরণং গচ্ছামি। কীভাবে?

বুদ্ধকে কেন্দ্র করে কাহিনীর পর কাহিনী তৈরি হতে শুরু করল। বুদ্ধের অনুভব পরবর্তীকালে অনুগামীদের বৌদ্ধিক জটিল বিশ্লেষণে জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করল। এত এত শাখাপ্রশাখা তৈরি হয়ে গেল যে এখন মূল বুদ্ধকে আর তাঁর শিক্ষাকে খুঁজে বার করা কঠিন।

তবু বুদ্ধ করুণাবতার। ঈশ্বরহীন করুণা হয় কী করে? কৃপাহীন করুণা হয় কী করে?

বুদ্ধ বললেন, তোমার সত্তার মধ্যে আছে করুণা মিশে। বীজ আকারে। অঙ্কুরিত হলে শান্তিবৃক্ষ স্থাপিত হবে। তৃষ্ণা আর অজ্ঞানতা বীজকে আবৃত করে রেখেছে। সাধনা হবে সেই অঙ্কুরণের পথকে অনাবৃত করে।

ঘন্টা বাজল দূরে। আম্বেদকর আর চণ্ডালিকা দেবালয় থেকে, সমাজ থেকে বহুদূরে বসে। তাদের স্পর্শে পাপ জন্মাবে সমাজে। দেবতা অশুচি হবেন। ব্রাহ্মণ রক্তচক্ষুর সীমানা টেনে দিয়েছেন চণ্ডালিকা আর আম্বেদকরের জন্য।

প্রচণ্ড তাপে বাতাস হল উষ্ণ। উষ্ণ বাতাসে উঠল ঝড়। আম্বেদকর আর চণ্ডালিকা উঠে দাঁড়াল। গোটা সমাজ বে-আব্রু হয়ে যাচ্ছে ঝড়ে। দেবতার আসনে ধুলোর স্তর। ব্রাহ্মণের মস্তিষ্কে যুগান্তরের অন্ধকারে ভয় আর ঈর্ষার চামচিকে। সমাজের এদিক ওদিক পূতিগন্ধময়। সব ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। ব্রাহ্মণ দুই হাত আকাশের দিকে তুলে বলল, কী দিইনি প্রভু তোমায়? আকাশে ভেসে উঠল বুদ্ধের ছবি। বুদ্ধ বললেন, দিয়েছ অনেক কিছু, যা আমি চাইনি কোনোদিন। নাওনি আমি যা দিতে চাই।

ব্রাহ্মণ পুঁথি বার করল। বলল, এই যে অনুশাসন…. সব যে মেনেছি প্রভু!

বুদ্ধ বললন, ও শুষ্ক, নিষ্প্রাণ অক্ষরের অনুশাসন। অক্ষরের অনুশাসন যারা মানে তারা চিরকাল ধ্বংস করে নিজের অন্তরের বুদ্ধত্বকে। আমাকে।

কী চাও তবে তুমি?

বুদ্ধ বললেন, সত্য, প্রেম, করুণা।

কী দিতে চাও তুমি?

বুদ্ধ বললেন, যা নিতে চাই। সত্য, প্রেম, করুণা।

ব্রাহ্মণ হল ক্ষুব্ধ। বলল, তুমি দেবতা নও। তুমি ভ্রম। আমার দেবতা চান ভোগ। আমার দেবতা চান স্তবস্তুতি মন্ত্র। আমার দেবতা চান সমাজের বর্ণাশ্রমে বিভাজিত মানুষের অধিকারভেদ। আমার দেবতা তুমি নও।

বুদ্ধ স্মিত হাসলেন। বললেন,”ব্রাহ্মণ নও তুমি। ব্রাহ্মণ জাতিতে উৎপন্ন হলে, কিম্বা ব্রাহ্মণীগর্ভজাত হলে আমি তাকে ব্রাহ্মণ বলি না। সে যদি আসক্তিমুক্ত, পাপমুক্ত, বৈরিমুক্ত না হয়, তবে বাইরের আবরণে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না। যে নিষ্পাপ, তৃষ্ণারহিত সে-ই ব্রাহ্মণ।”

আম্বেদকর আর চণ্ডালিকা এসে দাঁড়াল ব্রাহ্মণের দুই পাশে। তাদের দুই জোড়া চোখে কীসের জ্যোতি? কীসের আলো? কোন ঝড়ের ইঙ্গিত?

ব্রাহ্মণ চীৎকার করে ডাকল, ওহে সমাজরক্ষক, দূর করে দাও এ অশুচি, নীচকুলেজাত, নিকৃষ্ট মনুষ্যদেহধারী জীবদ্বয়কে। সব হল অশুচি! হায় হায় হায়।

কেউ উত্তর করল না। চণ্ডালিকা বলল, অক্ষরের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে এসো। প্রাণের গভীরে আছে শান্তিনিকেতন। তার চারদিকে চারটে দরজা। মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা। এসো। আমার হাত ধরো।

সেদিন থেকে বুদ্ধের আশীর্বাদী হস্তস্পর্শ সেই সব প্রাণের স্পন্দনে, যারা নিষ্পেষিত, শোষিত, বঞ্চিত হতে হতে শোনে প্রাণের গভীরে কার আহ্বান, হৃদয়ে হতাশায় ঢাকা কালো আকাশে কার দুটো চোখ! তারাই জাগে। গায়, বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি। ধম্মং শরণম গচ্ছামি। সঙ্ঘং শরণম গচ্ছামি।

5
Wed, 04/23/2025 - 10:35

 

জেনারেল ডায়ার যেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে দিনের আলোয় প্রকাশ্যে অতগুলো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষগুলোর উপর গুলি চালিয়েছিল, সেদিন সে ধর্মের দিকে তাকিয়ে কাজটা করেনি। কর্তব্যের দিকে তাকিয়ে কাজটা করেছিল। বিদ্বেষজাত কর্তব্য।

বিদ্বেষ যখন কর্তব্য হয়, তখন সে প্রকাশ্যে আসে নির্ভীকভাবে। কারণ কর্তব্যের নিজস্ব একটা মান আছে। কাশ্মীরে যে জঙ্গিরা হিন্দুদের মেরেছে, তারা সেটাকে কর্তব্যজ্ঞানে মেরেছে। জঙ্গিরা মারার আগে আল্লাহ'র নাম নিতে বলছে, কলমা পড়তে বলছে। এ ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। এমনকি জিনিসটা এমনই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে এই নিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল, বা মিমও আছে। একজন মুসলিমের ছদ্মবেশে এসে একটা ব্যাগ হঠাৎ করে ভিড়ের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলছে “আল্লাহ আকবর”। অমনি সব ভয়ে চারদিকে দিগবিদিক শূন্য হয়ে ঊর্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। এ মিম লজ্জার।

বিদ্বেষকে কর্তব্যে রূপান্তরিত করে, এমন সাংগঠনিকভাবে, আন্তর্জাতিক স্তরে তাকে চালিয়ে যাওয়ার উদাহরণ ইসলাম ধর্মে বারবার এসেছে। এত এত বিদ্বেষমূলক প্রতিষ্ঠান আছে ইসলামে, যাদের মূল কর্তব্য হল বিদ্বেষকে কর্তব্যের স্তরে নিয়ে যাওয়া। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে এমন এক মাত্রায় নিয়ে যাওয়া, যেখানে বিদ্বেষের প্ররোচনাই একমাত্র অবশিষ্ট থাকে। ইরাণের হিজাবকাণ্ড, আফগানিস্তানে আপামর মেয়েদের অবস্থান ইত্যাদি কোনোটাই এর ব্যতিক্রম নয়। ঠাণ্ডা মাথায়, পরিকল্পনা করা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অন্য ধর্মের মানুষকে হত্যা করা, মেয়েদের সীমায়িত করার প্রশিক্ষণ দিয়ে যাওয়া, এমন আচরণ কোনো ধর্মের বিশ্বাসে দীর্ঘদিন দাঁড়িয়ে থাকলে তা একটা প্রথায় পরিণত হয়। এর কারণ হিসাবে অনেক আন্তর্জাতিক ভৌগলিক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা আছে। সে সব খুব স্পষ্ট নয়। দাবী যদি ন্যায্য হয় তবে উপায় কেন অন্যায্য হবে - এ সোজা প্রশ্নটার উত্তর আমি আজও পাইনি। মানুষ বারবার শোষিত হয়েছে, লুণ্ঠিত হয়েছে, বঞ্চিত হয়েছে, কিন্তু ন্যায্য লড়াইয়ের পথে নিজের অধিকার অর্জন করেছে - এই তো মানুষের নানা উত্থান, বিপ্লবের ইতিহাস।

বিদ্বেষ মানুষের প্রকৃতিতে আছে। তাকে নির্মূল করা সম্ভব না। কিন্তু বিদ্বেষকে কর্তব্যের স্তরে যাতে না নিয়ে যাওয়া যায়, সে দিকটাই দেখার। কারণ কর্তব্যবোধটা বৌদ্ধিক, আবেগজাত নয়। ক্রমাগত অর্ধসত্য বা ভ্রান্তিমূলক তথ্য দিয়ে দিয়ে আবেগকে বিষাক্ত করে, বৌদ্ধিক স্তরে তাকেই কর্তব্যের আখ্যা দিয়ে দেওয়া - এ ভালো নয়। মানুষ বৈচিত্র্যময়। গোটা বিশ্বকে একটা বিশ্বাসের নিগড়ে আনার মত বিদ্বেষমূলক মনোভাব আর কিছুই হয় না।

ভিএস নাইপাল থেকে শুরু করে, স্যাম হরিস, তসলিমা নাসরিন অবধি বহু বহু বুদ্ধিজীবী মানুষের লেখায় ইসলামের এ দিকটা আলোচনায় এসেছে। কিন্তু আপামর বিশ্ববাসী মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরাই কি বিশ্বাস করেন বিদ্বেষের বাস্তবায়নই একমাত্র ধর্মীয় কর্তব্য? এ বিশ্বাসযোগ্য নয়।

ধর্মহীন মনুষ্যসমাজ হয় না। এ কথা আম্বেদকর স্পষ্টভাবে বুঝেছিলেন। কিন্তু কোনো ধর্ম যখন বিদ্বেষকে সাংগঠনিক কর্তব্যের স্তরে নিয়ে যায়, তখন তা নিয়ে সোচ্চার হওয়া, বারবার প্রতিবাদ করা সে ধর্মে বিশ্বাসী মানুষেরই কাজ। স্বামী বিবেকানন্দ যদি কোনো ধর্মের কড়া সমালোচনা করেছিলেন সে নিজের ধর্মের। সন্ত কবীর দুই ধর্মেরই সমালোচনা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, রামমোহন বারবার এ কাজ করেছিলেন বলে সমাজ তথা ধর্মবোধ সংস্কার হয়েছে বারবার। কদিন আগের ভারতের প্রেসিডেন্ট এপিজে আবদুল কালাম একই শ্বাসে বিজ্ঞানের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রী অরবিন্দের নাম উচ্চারণ করেছেন। সেও সংস্কারের দৃষ্টিতেই। ধর্মহীন হওয়া যেমন মানুষের পক্ষে সম্ভব না, তেমনই ধর্ম সংস্কারহীন হয়ে থাকাটা ভীষণ অস্বাস্থ্যকর। সমাজে কোনো অস্তিত্বই সংস্কারহীন হতে পারে না।

ভারতের প্রাচীন ধর্ম অনেক বড় বড় মহাত্মাকে জন্ম দিয়েছে। আপনি মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষ বোস, আম্বেদকর প্রমুখের কঠোর সমালোচক হতে পারেন, কিন্তু তাদের দাগী আসামী ভাবতে পারেন না। সে ভাবতে গেলে বা ভাবাতে গেলে সত্যভ্রষ্ট হতে হয়। আর সত্যভ্রষ্ট মানুষ আলোচনার বিষয় হতে পারে না, তার অকথনীয় কিছুই নেই। তারা জানতেন মানুষের মানুষ হিসাবে প্রাথমিক কর্তব্য বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ওঠা। বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে ওঠা মানে কখনোই এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে এড়িয়ে যাওয়া না, তার জন্য যে কঠোর পদক্ষেপ দরকার তা দরকারই, কিন্তু সে কঠোর পদক্ষেপ যেন অন্যায্য না হয়। একই ঘটনা ইজরায়েলে হামাস ঘটিয়েছে। কিন্তু হামাসকে শেষ করতে হিয়ে গাজার যে পরিস্থিতি সেও কি কাম্য? কখনওই না। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের রক্তক্ষরণ ইতিহাস কোনোদিন ক্ষমা করেনি। এ কথাটা মনে রাখার। আজ এই ভয়ংকর রাগের সময়, ক্ষোভের সময়, ভীষণ অসহায়তার সময় অনেকেই অনেক কথা বলছেন, যা অতিকথন, যা হয় তো রাগের মাথাতেই বলছেন। সে স্বাভাবিক। কিন্তু তার জন্য যদি আরো কোথাও আগুন জ্বলে, সে দায়টাও তো আমারই। সামাজিক মাধ্যমে কী লিখছি সে দায় আমার থাকতেই হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, হনুমান রাগের মাথায় গোটা লঙ্কা জ্বালিয়ে দিল, এটুকু বোধ ছিল না সেই লঙ্কায় আমার সীতাও আছেন। আমাদের সীতা হলেন আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। যা সুবুদ্ধি আর সহিষ্ণুতার উপর দাঁড়িয়ে। রাগের মাথায় যেন সেখানে আগুন না জ্বালি। কঠোর বিধান আনুক রাষ্ট্র, কিন্তু নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে না। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধেই।

6
Mon, 04/07/2025 - 11:33

 

ঠিক কী হয়েছে আমাদের? রাজনীতি ক্ষমতার লড়াই। একজন যাবে একজন আসবে। কিন্তু সমাজ? আমরা তো প্রশাসনিক ভবনে বাস করি না। সমাজে বাস করি। প্রশাসনিক ভবনে যাকেই আমরা আনি তাদের সিদ্ধান্তের ঠিক-ভুল আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করে এ সত্য। কিন্তু তারা কেউ চিরস্থায়ী নয়। তারা আসে আবার চলে যায়। আবার নতুন জন আসে। কিন্তু আমাদের জীবন চলে আমাদের সামাজিক নিয়মে, প্রথায়, উৎসবে।

বাঙালির রাজনীতিতে ক্ষমতার উগ্র প্রদর্শন, গোলাবারুদ, বোমাবন্দুক আছেই। ইতিহাস সাক্ষী। কিন্তু বাঙালি সমাজ? তার একটা শান্ত ধারাও আছে। তার উত্থান-পতনের ইতিহাসও আছে। একটা সময় বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার শরণার্থী এল। তাদের নিয়ে বাংলা একটা জায়গায় থিতু হল। সময় লাগল, কিন্তু হল। তারপর খাদ্য আন্দোলন। তারপর একটা সময় বাংলার কিছু মহলে নকশাল আন্দোলন চলল। তাও থিতু হল। তারপর এল ইমার্জেন্সির সময়। বামসরকারের ভূমি সংস্কার। এর বহুদিন পরে আবার এল সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন।

বাঙালি সমাজ তার ভদ্রলোক, বুদ্ধিজীবী, তর্কপ্রিয়তা আর শান্তিপ্রিয়তা - এমন একটা ছবিতে দাঁড়িয়েছিল। মোট কথা বাঙালির সেদিন নিজের কিছু বলার ছিল। নিজের কিছু মত ছিল। সমাজে অনেকবার আলোড়ন এসেছে, বাঙালি নিজের মত করে নিজের আদর্শেই তা সামাল দিয়েছে। বাঙালি সমাজে ধর্ম চিরকালই ছিল। সে ধর্মের ধারাও নানাভাবে বদল হতে হতে তারও নিজস্ব একটা রূপ নিয়েছে। সেখানে বৃহত্তর সমাজে মহাপ্রভু চৈতন্যের ভক্তিরসের প্রভাব, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আন্দোলনের মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবীমহলে প্রভাব, তাছাড়াও আরো অনেক গুরুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছোটো ছোটো গোষ্ঠী। সব ছিল। আছেও। বৈষ্ণবের গোঁড়ামি যেমন ছিল, শাক্তের উদারতাও তেমন ছিল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের শিক্ষায় এক উদার ধর্মবোধে বাঙালির সমাজ জারিত হয়েছে দীর্ঘদিন। জাতপাত নিয়ে ভারতের অন্যান্য জায়গায় যেমন ছবি, বাঙলার ছবিটা ভিন্ন এখানে তাই।

কিন্তু হঠাৎ করে বাঙালি যেন তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলতে শুরু করেছে। সে যেন স্পষ্ট করে কোনো কথাই জোরের সঙ্গে বলতে পারছে না। এত বেশি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে আত্মকলহই কী এর কারণ? অসম্ভব আত্মতুষ্টিতে ভোগাই কী এর কারণ? আজ বাংলার যে কোনো দিক নিয়ে নিন্দা করতে এক শিশুও পারদর্শী। বাংলার সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, সিনেমা ইত্যাদি যাই হোক না কেন ঘরে বাইরে নিন্দার ঢেউ। কিন্তু কেন? আমাদের পরস্পরের প্রতি ঈর্ষা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নির্মাণ করে সেখানে সর্বেসর্বা হয়ে পরম আত্মতুষ্টিতে মাথা ঝুঁকিয়ে দেওয়াই কী এর কারণ?

বাংলা সমাজ তো মুক্তমঞ্চ নয়, যে এখানে এসে যে খুশি তার মত যা খুশি করে যাবে। সব সমাজের একটা নিজস্ব ধারা থাকে। প্রথা থাকে। বিশ্বাস থাকে। তা অবশ্যই বদলায়। সে পরিবর্তন ভালো থেকে আরো ভালোর দিকে গেলেই তো ভালো। গ্রহণযোগ্য। সমাজে ভালো বলতে কী? তার প্রথম উত্তর - ইক্যুয়ালিটি, লিবার্টি এবং ফ্র‍্যাটার্নিটি। সমতা-স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্ব। হ্যাঁ, ফ্রেঞ্চ রিভোলিইশ্যানের কথা। এই বিশ্ব নাগরিক হওয়ার একমাত্র সূত্র। আমার স্বাধীনতা বোধ যেন অন্যের সমতার অধিকার বা আমার তার প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধের অঙ্গীকারকে অস্বীকার না করে। স্বাধীনতা সেই দায়বদ্ধতা নিয়ে চলুক। আমাদের সংবিধানের প্রিয়াম্বেলেও এই কথাগুলোই আছে, সঙ্গে জাস্টিস কথাটাও আছে।

বাঙালি সমাজেই জন্মেছি আমি। লালনগীতি, শ্যামাসংগীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রসাদী, রজনীকান্তগীতি, দ্বিজেন্দ্রগীতি এসব অনায়াসে বিনা বাধায় রক্তে মিশেছে, স্নায়ুতে, হৃদয়ে মিশেছে। আরেকটু বড় হলে দর্শন হিসাবে রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ, গান্ধী, কথামৃত, চৈতন্যচরিতামৃত ইত্যাদি থেকেও একই সুরের ধারা পাচ্ছি। এমনকি প্রবল বামপন্থী এম এন রায়ের লেখাতেও পাচ্ছি অতীতের ভারতে বেদ বেদান্তের গ্রহণযোগ্য কথাগুলোকেও আমাদের নিতে হবে। শূন্যের উপর ভবিষ্যৎ গড়া যায় না। অতীত আর বর্তমানের সঙ্গে সে একসূত্রে গাঁথা। তাকে অস্বীকার করা যায় না। বিবেকানন্দও তাই বলছেন, অতীতের সব ভালো না। কিন্তু যেটুকু ভালো গ্রহণযোগ্য তা-ই নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ সুভাষ গান্ধীরও একই বিধান। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এর পূর্ণ বাস্তবায়িত রূপ।

আসল কথাটা হল অতীতে যা-ই থাকুক না কেন, যিনি যত বড় মানুষই হোন না কেন, ঘৃণা-অসাম্য-প্রশ্নহীন আনুগত্যের কাছে কোনো আধুনিক সমাজ মাথা নোয়াবে না। সবার উপরে এই আদর্শ। সদ্য আমেরিকাতেও যে আন্দোলনে সবাই রাস্তায় নেমেছে তার কারণও খানিক এমনই। ফরাসী বিপ্লবই সেদিন ঠিক করে দিয়েছিল মানুষের সমাজের আসল ছবিটা কী হওয়া উচিৎ। আসলে মানুষের আত্মার আসল সুরটা সেদিন ফরাসী বিপ্লবে ধরা পড়েছিল। রাজা আর পুরোহিতের পায়ের তলায় দীর্ঘদিন নিষ্পেষিত হতে হতে সেদিন মানুষ হুংকার দিয়ে উঠেছিল। তার আত্মার আসল সুরটা মুক্তির রাস্তা খুঁজেছিল।

সেদিন বাংলায় যে নবজাগরণ ঘটেছিল, যা গোটা ভারতের নবজাগরণ বলে বিশ্বাস তা প্রাচ্য পাশ্চাত্যের ভাবধারার মিলনেই ঘটেছিল। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষায় পাশ্চাত্যের শিক্ষার আলো মিশেছিল, প্রাচ্যের সঙ্গে সঙ্গে। বিবেকানন্দর যে নববেদান্ত সেও যে প্রাচ্য পাশ্চাত্যের মিলনের ফল, তা একটু গভীরে পড়লেই বোঝা যায়। বিবেকানন্দ বলেন, যে জাত বলে বা যে মানুষ বলে আমার আর কিছু শেখার নেই, সে জাত বা সে মানুষ মৃত। আজ যে নতুন হিন্দুত্ববোধ জেগেছে সে ধারা রবীন্দ্রনাথের সময়েও জেগেছিল, তিনি লিখছেন,

“বর্তমান সময়ে কতকগুলি বিশেষ কারণে হিন্দু আপনার হিন্দুত্ব লইয়া ভয়ংকর রুখিয়া উঠিয়াছে। সেটা সম্বন্ধে তাহার মনের ভাব বেশ সহজ অবস্থায় নাই। বিশ্ব-রচনায় এই হিন্দুত্বই বিধাতার চরম কীর্তি এবং এই সৃষ্টিতেই তিনি তাঁহার সমস্ত শক্তি নিঃশেষ করিয়া আর-কিছুতেই অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না, এইটে আমাদের বুলি। সাহিত্যের বাস্তবতা ওজনের সময়ে এই বুলিটা হয় বাটখারা। কালিদাশকে আমরা ভালো বলি, কেননা তাঁহার কাব্যে হিন্দুত্ব আছে। বঙ্কিমকে আমরা ভালো বলি, কেননা স্বামীর প্রতি হিন্দুরমণীর যেরূপ মনোভাব হিন্দুশাস্ত্রসম্মত তাহা তাঁহার নায়িকাদের মধ্যে দেখা যায়; অথবা নিন্দা করি, সেটা যথেষ্ট পরিমাণে নাই বলিয়া।”

আজকের হিন্দুত্বও এমনই। সে কারোর কথা শোনে না। তার যেন কোথা থেকে কিছু শেখার নেই। সে নিজেকে শ্রেষ্ঠ দাবী করে। সে আস্ফালন করে।

বাঙালি সমাজের দুটো আদিম সমস্যা আছে। এক, তার হুজুগে মেতে যাওয়া অল্প উদ্দীপনাতেই। দুই, তার ঈর্ষাকাতরতা। কিন্তু কয়েক দশক ধরে বাঙালি সমাজে আরেকটা রোগ দানা বেঁধেছে, সেটা হল সিউডো-ইন্টেলেকচ্যুয়ালিজম। আসল ইন্টেলেকচ্যুয়ালিজমের কথা হল, সে আগে থেকেই মত প্রতিষ্ঠা করে তর্কে নামে না। অথবা ইন্টেলেকচ্যুয়ালিজম মানেই যে শুধু তর্কসর্বস্ব হওয়া তাও তো নয়। কিন্তু এই দুটো বাংলা সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকল। ভীষণ বায়াসড, ন্যারো, কূট তার্কিককে ইন্টেলেকচ্যুয়াল ভেবে ভুল হতে লাগল। যেমন নামাবলী আর কণ্ঠি আছে মানেই বৈষ্ণব, তেমন। তার মধ্যে মহাপ্রভু নির্দেশিত “তৃণাদপি সুনীচেন….” ইত্যাদি গুণ আছে কিনা দেখার দরকার হল না। তেমনই যা কিছু ভারতীয় তাকে নস্যাৎ, বিশেষ করে হিন্দুদর্শন সম্বন্ধীয়, অন্য ধর্ম নিয়ে নীরব বা স্বল্প কনসিডারেট, আগে থেকেই জানে কী মত প্রতিষ্ঠা করতে হবে, ফলে বাদবিতণ্ডার বাদ গেল বাদের খাতায়, বিতণ্ডা, ঈর্ষা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোষ্ঠী নির্মাণ করে হামবড়াভাবে বাংলার বুদ্ধিজীবী মহল ছেয়ে গেল। এবং সব মিথ্যারই যা পরিণাম হয় তাই হল, ক্রমে দুর্বল হল, গোটা ভারতে, তথা বিশ্বে অপ্রাসঙ্গিক হল। কিন্তু তাও স্বীকার করল না তার কোথাও একটা মস্ত ফাঁকি আছে। সেই ফাঁক দিয়ে নানা বেনোজল ঢুকে গেল। তারা চোখ বন্ধ করে চীৎকার করল, ওরা অভদ্র, অসংস্কৃত, আর ওদিকের ওরা গোবলয়ী….ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু তদ্দিনে বড় দেরি হয়ে গেছে।

আজ বাংলা সমাজ আবার এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। তার উপরে যে রামনবমী চাপানো হচ্ছে, সে তার কোনোদিনও ছিল না। কিন্তু তাকে সে না করতে পারছে আপন, না করতে পারছে দূর। কারণ তার মধ্যেই কেউ কেউ ভবিষ্যতের আশার আলো দেখছে। ফলে যে গরু দুধ দেয় তার লাথিটাও যেমন খেতে হয়, এই বিশ্বাসে সেও সহ্য করে নিচ্ছে। অবশ্য তার আর কোনো বিকল্পও নেই। কারণ তার আদর্শ, বিশ্বাস সব মরুপথে হারিয়েছে। তবে উপায়? রবীন্দ্রনাথ তো আর ফিরবেন না। বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, চৈতন্য যে সাজে ফিরবেন তার সঙ্গে মূলের অনেক পার্থক্য হবে। কিন্তু সে পার্থক্য ধরার মত বাঙালির অভাব হবে তার চাইতে বেশি। তবে উপায়? উপায় সেই বুদ্ধিজীবীতাকে ফিরিয়ে আনা। নিজের অহংকার, আত্মতুষ্টি জলাঞ্জলি দিয়ে আবার নিজের জাতের মূলের কাছে ফেরা। সেখান থেকেই আসবে সঞ্জীবনী। পঁচিশে বৈশাখ চাট্টি সেজেগুজে পঞ্চাশটা কবিতা গান গেয়ে নেচে-কুঁদে না। রবীন্দ্রনাথকে আরো গভীরে আবার করে পড়তে হবে। চর্চায় আনতে হবে, শুধু তর্কে না। বিশ্বের বুদ্ধিজীবীমহলে যে যে কাণ্ডকারখানা ঘটে চলেছে তার সম্বন্ধে নির্মোহ ধ্যানধারণা থাকতে হবে। সর্বোপরি ভ্রাতৃত্ব-স্বাধীনতা-সমতার আদর্শে দাঁড়ালে তবেই ভয়হীন, ত্রাসহীন মুক্তসমাজ আবার ফিরে পাব।

আমাদের অনেক সমস্যা। বেকারত্ব থেকে পানীয়জল, স্বাস্থ্য শিক্ষা থেকে দুর্নীতি অনেক অনেক সমস্যা। কিন্তু তার উপায় ধর্মগ্রন্থ বলে না। তার উপায় আছে উদার বৌদ্ধিক চর্চায়। আধুনিক শিক্ষায়। ধর্ম ব্যক্তিগত জীবনে শান্তির খোঁজ দেয়। উৎসবের আয়োজন করে। কিন্তু তার বেশি করতে গেলে ভালোর চাইতে ক্ষতিই করে বেশি। বহুত্ববাদ বা প্লুরালিজম হল নানা ধর্মের সহাবস্থানের একমাত্র উপায়। হিন্দুধর্ম যেহেতু বহুসিদ্ধান্তবাদী চিরকাল, তাই তার মধ্যে এ চর্চা প্রাচীন, অন্য ধর্মের তুলনায়। সেই বহুমত, বহুপথকে এক সংবিধানের শাসনে রেখে সমাজ যদি চলে তবে সে সমাজ শান্তির হবে। আর তার উপর তীক্ষ্ম নজরদারির ভূমিকা আমাদের সবার। একে এড়িয়ে না তো গণতন্ত্র সঠিক অর্থে থাকবে, না সমাজ, না নাগরিক হিসাবে আমি।

7
Fri, 04/04/2025 - 11:08

 

আলো জ্বালা বারণ ছিল। তাই সব অন্ধকার ছিল। কেউ অভিযোগ করত না। কারণ সবার সয়ে গিয়েছিল।

একদিন অন্ধকারে অনেক মানুষ গর্তে পড়ল, আগেও যেমন পড়েছে, তবে একা একা, তাই শব্দ হয়নি, তাই কেউ ভ্রুক্ষেপ করেনি, আর কেউ ভ্রুক্ষেপ করলেও এত অন্ধকারে তা টের পাওয়া যায়নি।

এবারে শব্দ হল জোরে। সবাই বলল, কী হল? কী হল? কিন্তু এত অন্ধকার, রাস্তা কোথায়, পায় কী করে দেখতে?

সবাই বলল, আলো আনো, তবে চোখে যেন জ্বালা না লাগে। যেন সব কিছু অতি স্পষ্ট না দেখা যায়, ওতে ভারি অসুবিধে। যতটা কাজে লাগে ততটাই থাক আলো। তার বেশি না। আলো ভালো, কিন্তু অত বেশি আলো ভালো না।

কেমন আলো সেটা? যেন আমাকে আলো করে থাকে। প্রতিবেশীকে না। আবার সে আলো যেন এত বেশি না হয় যে প্রতিবেশী স্পষ্ট দেখে ফেলে আমার সব কিছু।

সে আলোর দাবী মেটাতে অন্ধকারকে আবার ডাকা হল। যে আলোকে শাসন করে আলোকে চলনসই করে তুলল। অন্ধকার তো লোভী। তাই ক্রমে ক্রমে সে আলোকে আবার গ্রাস করে নিতে শুরু করল। সবাই বুঝল, কিন্তু বলল না কিছু। আলোর সঙ্গে অন্ধকারকে তো তারাই চেয়েছিল। এখন অন্ধকারের দাবীকে যদি না মানে, আলো যদি সবটা অধিকার করে বসে, তবে? সে ভয়ে সবাই বলল, বেশ বেশ, আপাতত অন্ধকারই থাক। পরে কিছু হলে আবার দেখা যাবে।

এইভাবেই যুগে যুগে অন্ধকার কায়েম হয়। সবাই মুখে বলে আলো। সেই নাকি আদর্শ। মনে চায় অন্ধকার বা অন্ধকারের শাসনে ঘেরা আলো, ওই নাকি বাস্তব। ওই নাকি সংসার। ওতেই নাকি সুবিধা।

গোটা আলোতে তো চিরকালই সবার অসুবিধে। তাই ভাষাকে ভাব বুঝে কথা বলতে হয়, সত্য বুঝে না। আর তাই ভাষায় এত অন্ধকার।

8
Wed, 04/02/2025 - 10:58

 

কী ভাবে চিনব?

চিনবে। সময় এলেই চিনবে।

কিন্তু কীভাবে?

তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কেউ একগ্লাস জল এনে তোমার সামনে রাখল। ভাবো একটা কাঁসার গ্লাস, তার মধ্যে টলমল করছে স্বচ্ছ জল। তোমার তৃষ্ণা মেটানো জল। তোমায় তৃপ্ত করার জল। সেই জল দেখেই তোমার যে শান্তি, যে আনন্দ, যে আশ্বাস….এও তেমন।

এ হয়? এ সম্ভব? আমি তো আশা দেখছি না আর। কত রাস্তায় হাঁটলাম। কত পড়লাম, আছাড় খেলাম, হামাগুড়ি দিলাম, দৌড়ালাম। কিন্তু শেষে? মহাশূন্য। কত বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দুলে দুলে কতবার কত কী যে হারালাম। আজ মনে হয় মূলধনটুকুও গচ্চা করে বসে আছি। কিন্তু কিছু সারবস্তু পেলাম কই? ক্রমে বিশ্বাসের উপর বিশ্বাস হারালাম। পথ বলে কিছু আছে, কিছু হতে পারে… এ বিশ্বাসও তো হারালাম। তুমি বলছ তৃপ্তি পাব আমি? আসবে তৃষ্ণার জল?

সবাই পায়। শেষ অবধি যে বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে পারে। সে-ই পায়। ঘাত-প্রতিঘাতে বিশ্বাস হারানো তো খুব সোজা। ভেঙে পড়া, হতাশায় ডুবে যাওয়া সংশয়প্রবণ হয়ে পড়া। এ সবই স্বাভাবিক। কিন্তু শেষ অবধি দাঁতে দাঁত কামড়িয়ে পড়ে থাকাই আসল।

বিশ্বাস যদি অন্ধ হয়?

যে বিশ্বাসের জন্য প্রাণ থেকে “হায় হায়” শব্দ ওঠে না সে বিশ্বাস মৃত বিশ্বাস। সে শুধুই আবর্জনা। কানাই দাস বাউলের গান শুনেছ? অনাথবন্ধু ঘোষের গান? শুনেছ? দুজনেই তো অন্ধ। মানে বাইরে অন্ধ। দুটো চোখেই জাগতিক দৃষ্টি তো অন্ধকার। কিন্তু সে মানুষ দুজনের গানে এমন আনন্দধারা বয় কী করে? চোখে জল আসে কেন? কীসের যাদুতে তারা দুজন প্রাণে প্রবেশ করে? আলোড়িত করে? ভেবেছ? ভেবে উত্তর পাবে না। দেখো। দুজন মানুষের গানের মধ্যে ঢুকে দেখো। রাস্তা আছে। রাস্তা তখনই আছে, যখন ঘর অসহ্য হয়ে ওঠে। বিশ্বাস তখনই জ্বলন্ত হয়ে ওঠে যখন বুদ্ধি বিস্ময়ের পরিধি পেরিয়ে বলে, এরপর কী? তখন সে ঝাঁপ দেয়। নৌকায় আগুন লাগলে যে নদীতে ঝাঁপ দেয় সে বিশ্বাসী বলে না, সে মরিয়া বলে। মরিয়া যে বিশ্বাস নয়, সে বিশ্বাসই নয়। সে বুদ্ধির পঙ্গুত্ব বা ভীরুতা।

মরিয়া হওয়া মানে বিশ্বাসী হওয়া?

যাকে মরিয়া হয়ে ভালোবাসো, সে ভালোবাসার মধ্যেই তাকে পাওয়ার বিশ্বাস।

যদি তাও না পাই।

সে নাই পেতে পারো। কিন্তু তাই বলে বিশ্বাস হেরে গেল না। বাস্তব উপযুক্ত ছিল না। একদিন বাস্তব উপযুক্ত হয়। সেই অপেক্ষাটুকু নিয়েই তো গোটা জীবন! হেরে যাওয়া জিতে যাওয়া বোকার মত কথা। বাস্তবের সব ওঠাপড়া সহ্য করেও, তবু অজানা, অচেনা, অদেখাকে স্পর্শ করার স্পর্ধা! সেই তো সব। জীবন বলতে যে রসটুকু আছে।

(ছবি Debasish)

9
Sun, 03/30/2025 - 10:46

 

জ্ঞান আছে। শান্তি নেই। রামপ্রসাদ সেন গাইছেন, “জ্ঞানসমুদ্র মাঝে রে শান্তিরূপা মুক্তা ফলে” কী ভাবে পাওয়া যাবে? না, শিবযুক্তি মত চাইলে। জ্ঞানসমুদ্রে যদি মঙ্গলের অন্বেষণ না থাকে তবে সব বৃথা। মঙ্গলের ইচ্ছা আর জ্ঞানের শক্তি, এতেই শান্তি।

রবীন্দ্রনাথ ‘'লোকহিত’ প্রবন্ধে লিখছেন, কাউকে সর্বশ্রেষ্ঠ অপমান করার উপায় হল তার উপকার করা অথচ তাকে প্রীতি না করা। রামপ্রসাদের গানেও সেই, ভক্তিতে মঙ্গলের শিখা। সে শিখার আলোয় জ্ঞানসমুদ্রে শান্তির পথের দিশা। কিন্তু ভক্তি কী? ভক্তির সক্রিয় দিক দরদ। দরদী না হলে শান্তি কই? নেই। নিজেকে নিয়ে যত ব্যস্ত হচ্ছি তত ফাঁসছি। কী এক অনন্ত ভুলভুলাইয়া। যেন নিজের খুব উপকার করছি। হচ্ছে লবডঙ্কা। শুধু টেনশান আর অ্যাংক্সাইটি। “যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ, তাহে ভেবে মরি, তাহে কেঁদে মরি”। কেঁদেই যাচ্ছি আর ভেবেই যাচ্ছি। ভাবছি একটা দাগ অবধি পৌঁছে গেলেই নিজেকে নিয়ে শান্তিতে ঘর করব। কিন্তু দৌড়িয়েই যাচ্ছি, দৌড়িয়েই যাচ্ছি, দাগের পর দাগ পেরিয়েও যাচ্ছে, কিন্তু শান্তি কই? নেই নেই নেই। কারণ? ওই যে, না আছে দরদ না আছে শিবযুক্তি আছে। জ্ঞানসমুদ্রেও গরল জন্মাচ্ছে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চুঁইয়ে ঢুকছে জ্ঞানসমুদ্রের গরল। অশিব-যুক্তি আর অদরদী হামবড়া ‘আমি’ সর্বস্ব মন্থনে।

প্রসাদ আরো গাইছেন, “কামাদি ছয় রিপু আছে আহার লোভে সদাই ঘোরে, তুমি বিবেকহলদি গায় মেখে নাও, ছোঁবে না তার গন্ধ পেলে।”

বিবেক বড় মাগ্যি আজকাল। মশায় এই ইনস্টার যুগে বিবেকের কথা পাড়ো? বড্ড সেকেলে ভাবনা তো হে তোমার? যেখানে সোশ্যালমিডিয়ায় চোদ্দো-পনেরো থেকে ষাট-সত্তর বয়সী সমাজের একটা বড় অংশ পুরুষ-নারী, কিশোর-কিশোরী প্রায় নিরাবরণ হয়ে আদিরসে বন্যা তুলে দিচ্ছে, সেখানে এসব কথার মানে কী দাদা? মানলাম আপনি নেটফ্লিক্সে ‘'অ্যাডালেসেন্স’ দেখেছেন। কী আছে সেখানে? তেরো বছরের বাচ্চা ছেলের ছুরির আঘাতে আহত বান্ধবী, এবং ঘটনাক্রমে সে আঘাতে মৃত্যু। বাচ্চা ছেলের মনের অন্ধকার দিক। নারীবিদ্বেষ বা নারী-এলেবেলে বা নারী-দুচ্ছাই এরকম নানা ইন্টারনেট জগতের গ্রুপের সঙ্গে সে বাচ্চা ছেলের জ্ঞান ও পরিচিত। সরল, অবোধ বালকের এমন সব মানসিক প্রবৃত্তির পরিচয় পেয়ে মনোবিদের ভিরমি খাওয়া। এই নিয়ে তো প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। ইনস্টাগ্রামে কীভাবে নানা ইমোজি নানা গুপ্ত সংকেত বহন করে, সে সব বালক মনে কী প্রভাব ফেলে, এইসব নিয়ে আলোকপাত আছে তো! কিন্তু কী হল? সব অভিভাবক বুঝি এখন থেকে স্পাইং করবেন? ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলবেন? ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করবেন? করতেই পারেন। কিন্তু সে গুড়েবালি। আপনি একটা রাস্তা বন্ধ করবেন, সে আরো দশটা খুলবে। মানুষের প্রবৃত্তির যে জোয়ার যখন আসে তাকে কী আর আটকানো যায় রে বাবা? তাও আমাদের মত চুনোপুঁটিদের? আমরা সোশ্যালমিডিয়ার মস্তিষ্ক বিষক্রিয়া থেকে সোশ্যালমিডিয়ার বেলেল্লাপনা আর তার প্রভাব শিশুমনে সব জানি। মায় প্রবন্ধ লিখে দিতে পারি। কিন্তু ঠেকাব কী করে? আমি নিজেও তো…..খ্যাক.. খ্যাক…খ্যাক….থাক এসব কথা।

আচ্ছা রামপ্রাসাদের গান নিয়ে কপচাচ্ছিলাম না? হঠাৎ এদিকে কী করতে এলাম? যা হোক। তো প্রসাদ কবি যা বলছেন, “ধৈর্য খোঁটায় বেঁধে থুবি”, আর তারপর আরো বেয়াড়াপনা করলে “জ্ঞান খড়গে বলি দিবি”। কাকে? ওই যে রিপুগুলোকে। ক্যাটকেটে লোভ আরা টকটকে অহো অহো…হাম হাম….আমিকে। জ্ঞান খড়গে বলি। মানে ধুপিয়ে কাচা। ওসব বলি-টলি শব্দ আজকাল আবার কেমন যেন। “দিনের কাজে ধুলোলাগি, অনেক দাগে হল দাগি, এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার/ আমার এই মলিন অহংকার…..এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে…..”।

শান্তি শান্তি শান্তি। একটু বসার জায়গা। একটু জুড়োবার হাওয়া। একটু ডুব দে রে মন ঘুমসায়রে, বলে ঘুমে ডোবা। একটু বিনা তাপে কাছাকাছি আসা। একটু বিনা ঘর্ষণে কথা বলা। একটু বিনা সূঁচ, কাঁটা বিঁধাবিঁধি ছেড়ে পাশে বসা; পাশাপাশি হাঁটা। একটু বিনা ক্ষোভ, বিনা শোক একা একা হাঁটা। একা একা গান গাওয়া। এই তো। দু দণ্ড হেঁটে, দু দণ্ড দাঁড়িয়ে চলা আর থামা।

প্রসাদ মাকে ভালোবেসেছিলেন। আমার তো জগদম্বা নাই। আমার তো মত আছে। ইজম আছে। বিচার আছে। সংশয় আছে। আমার কী হবে? উপায় নেই? আছে। প্রসাদের যে মা, সে তো প্রসাদের হৃদয় বই কেউ নয়। রবিঠাকুরের যে তিনি, সেও তো তার হৃদয় বই কেউ নয়। যে যার আত্যন্তিক প্রেম, সে তো তার হৃদয়েরই আরেক নাম। আমার আর কিছু না থাক, হৃদয় তো আছে। আর হৃদয় যতক্ষণ আছে ততক্ষণ শান্তির রজ্জুতে গাঁথা সুখের ফুলের মালা চাওয়ার ইচ্ছাও আছে। শান্তি কী পথের শেষে? শান্তি তো পথের দুই ধারে। শিবযুক্তি আর সহযাত্রীর সঙ্গে দুটো দরদী কথায়। প্রসাদ গাইছেন, “দেহের মধ্যে ছজন কুজন তাদের ঘরে দূর করেছি/ রামপ্রসাদ বলে দুর্গা বলে যাত্রা করে বসে আছি”।

দুটো স্টেশান যাওয়ার হলেও মাকে প্রণাম করে, মায়ের শাড়ির গন্ধ মাথায় মেখে যখন দাঁড়াতাম, মা বলতেন, এসো, দুর্গা দুর্গা। সেখানে এতবড় জীবন যাত্রা, এখানে কেউ দুর্গা দুর্গা বলে যাত্রা শুরু করিয়ে দেবে না? এ দুর্গা পুরাণের ততটা না, যতটা মায়ের হৃদয়ের দরদের। মায়ের হৃদয় চেনে না এমন হৃদয় নিয়ে পশুও জন্মায় না, তো মানুষের কী কথা! তাই না? ওই তো শুরুর দাগ। তারপর? ওকে সম্বল করে এগোলেই হয়। সোয়া ঘন্টার পথ তো। কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রাণাঘাট, তিব্বত, ব্যস! সওয়া ঘন্টার পথ। গেলেই হল। জয় মা!

10
Fri, 03/28/2025 - 10:36

 

বুদ্ধি সচল থাকলে প্রশ্ন আসবে, সংশয় আসবে। কিন্তু সংশয় প্রকাশ করলেই যে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় হচ্ছে এটা ঠিক না। আমি যদি কথায় কথা “কিন্তু কিন্তু” করি তবে মুশকিল। সুক্ষ্ম বিচার করছি ভেবে দেখা যাবে বহু জায়গাতেই আমি আত্মপ্রতারণাতে ডুবে যাচ্ছি।

আত্মপ্রতারণার একটা বড় শব্দ “কিন্তু”। আমার নানাবিধ ভয় আছে। বস্তুজগতের ভয়, মনোজগতের ভয়। বস্তু হারানোর ভয়, নিজের অথেন্টিসিটি হারানোর ভয়, নিজের অথোরিটি হারানোর ভয়। এরকম নানা ভয় আছে। আর এ সব ভয়েরই একটা বৌদ্ধিক প্রকাশ আছে - কিন্তু। কিন্তু শব্দটার পর এমন সব যুক্তি আসবে সেগুলো যেন ভীষণ ভ্যালিড। কিন্তু আদতে তা নয়।

যে কিন্তু সাচ্চা সংশয়ের তার জোর আছে। যে কিন্তু ভয়ের তার বাক্যের আস্ফালন আছে। ভাষা বোধের ইঙ্গিত। বোধকে সম্পূর্ণভাবে ভাষায় ধারণ করা সম্ভব নয়। তাই ভাষা সব সময়েই অসম্পূর্ণ। সে ইঙ্গিত করে। যার বোধ যতটা প্রসারিত সে সেই ইঙ্গিত থেকে সত্যটাকে ততটা বুঝে নেয়। ভাষা দুই বোধের মধ্যে একটা দুর্বল সেতুমাত্র। কিন্তু আপাতত ওই দিয়েই আমাদের কাজ চালিয়ে নিতে হয়। আমরা বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ পর্যবেক্ষণ করে, চোখের দিকে তাকিয়ে, বাচনভঙ্গি থেকে কথিত ভাষার থেকে কিছু অতিরিক্ত সত্য আরো পাওয়ার চেষ্টা করি বটে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে, কিন্তু সেও খুব একটা ত্রুটিমুক্ত উপায় নয়। সে সবেরও একটা স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা আছে।

‘কিন্তু’র দোসর হল ‘যদি’। ‘কিন্তু’ সাধারণত নিবৃত্তিবাচক। ‘যদি’ সাধারণত প্রবৃত্তিবাচক। কিন্তু বলে, কিন্তু নাও তো হতে পারে। যদি বলে, যদি হয়। ব্যস, মাথার মধ্যে ‘কিন্তু’’ আর ‘যদি’ মুখোমুখি বসে বকবকানি শুরু করে দিল। এদিকে আমার অবস্থা কাহিল।

‘কিন্তু’ আর ‘যদি’ এমনিতে মানুষ খারাপ না। তারা যখন ভয়জাত হয় তখনই সমস্যার। কারণ অকপট যুক্তিজাত ‘কিন্তু’ আর ‘যদি’ একটা কাণ্ডজ্ঞান যুক্ত রফায় আসে। জীবন এগোয়। আর ভয়জাত ‘'কিন্তু’’ আর ‘'যদি” নিজেদেরকে ঢাল করে রাখে। জীবন একটাই ঘূর্ণিতেই ঘুরঘুর করে মরে। ব্যাডমিন্টন খেলার মত। “কিন্তু’’ মেরে ‘'যদি’র কোর্টে পাঠায়। আবার “যদি’ মেরে ‘'কিন্তু’'র কোর্টে পাঠায়। রফা আর হয় না।

ভয় সহস্রনাগ। তার ছলচাতুরীর অভাব হয় না। সে সব সময়েই কপট। ভয় যদি অকপট হতে চায় তবে তার অস্তিত্ব থাকে না। ভয় সব সময়েই গোপনচারী। যদি কারোর ভয়কে জেনেছি বলে জানি, তবে সে ভয় নেই আর, সে তখন একটা জ্ঞান। আমার মাকড়সায় ভয় আছে, কী ভূতে ভয় আছে, কী ডেন্টিস্টে ভয় আছে - এ সব যদি স্পষ্টভাবে বলতে পারছি, তবে সেটা আমার জ্ঞানের মধ্যে তখন। ভয় হিসাবে ততটা নেই সে তখন আর আমার ইমোশনের জগতে। সে তখন একটা ভৌগোলিক মানচিত্র এঁকে গেছে আমার বৌদ্ধিক জগতে। আমি তাকে চিনি। সে আমাকে আর কন্ট্রোল করে না তখন। যদিও সে আমাকে স্বস্তিও দেয় না, কিন্তু সেটা আলাদা কথা।

ভয়হীন মানুষ হয় না। কিন্তু ভয়সর্বস্ব মানুষও তো হয় না। অন্তত হতে নেই। ভয়কে জড়িয়ে ভীতু হব, না নিজের ভয়কে নিজে জেনে আরেকটু বেশি আত্মজ্ঞানী হব, সেটা আমার সিদ্ধান্ত। তার আগে ওর ওই দুই ছদ্মবেশ ধরে টান দিতে হবে। ‘কিন্তু’ আর ‘যদি’। দুই শাগরেদ। ওদের সরাতে হবে। তবে রাস্তা পরিষ্কার হবে। কোনটা কপট আর কোনটা অকপট, চেনা যাবে।

11
Tue, 03/25/2025 - 20:52

 

(আমি অবশ্যই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউ নই, বিশারদও নই। কয়েকটা জিনিসে কদিন ধরে একটু খটকা লাগছে ভাবাচ্ছে বলেই এসব লেখা। এ নিতান্তই আমার মনের ভাবনার প্রতিফলন। ত্রুটিহীন এমন দাবী করছি না।)

ওয়েবসিরিজে বসত লক্ষ্মী।

2023 সালে পিপ্পা বলে একটা সিনেমা হল। আমাজন প্রাইমে দেখানো হল। এ আর রহমনের সঙ্গীত পরিচালনায় নজরুলের “কারার ওই লৌহকপাট” গান নিয়ে বিতর্ক হল। তারপর? এমনকি উইকিপিডিয়াতে সিনেমার পেজে ‘'কন্ট্রোভার্সি” বলে কোনো অনুচ্ছেদও লেখা হল না, যেমন লেখা হয়ে থাকে সাধারণত। অর্থাৎ এ বিতর্ক প্রসঙ্গটাকে গায়েই মাখা হল না।

২০২৫ সাল। ডাব্বা কার্টেল। আবার নতুন করে রবীন্দ্রনাথের গান “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে” নিয়ে বিতর্ক শুরু হল। কেন ওই গান অমন মত্ত অবস্থায় দুই মহিলা বিকৃত সুরে গাইবেন আর নাচবেন। আপাতত এইসব নিয়ে কিছু হচ্ছে না। অন্তত আমার চোখে পড়েনি।

এখন আইনিগত কারণ হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের গানের কপিরাইট আপাতত নেই। তাই আইনি ব্যাপারে খুব একটা কিছু করার নেই। আর দ্বিতীয় হল বাঙালি সেন্টিমেন্ট। কিন্তু সেটার গুরুত্ব বড় ক্ষীণ।

সদ্য নেটফ্লিক্সে চলছে “খাকি/ দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার“। কে নেই তাতে? শাশ্বত। পরমব্রত। জিৎ। শুভাশিষ। আরো বেশ কয়েকজন বাঙালি। সবাই হিন্দি বলছেন। মাঝে মাঝে বুড়ি ছুঁয়ে যাওয়া বাংলা। কিন্তু আমাদের কারোর মনে এ প্রশ্ন আসাটাও প্রশ্নাতীত হয়ে দাঁড়িয়েছে, দাদা গোটা সিরিজটা বাংলা ভাষায় করলে কী হত? গল্পটা তো পুরোটাই বাংলার। লিখছেন নীরাজ পাণ্ডের সঙ্গে দেবাত্মা মণ্ডল আর সম্রাট চক্রবর্তী। শেষের দুজনেই বাঙালি, নীরাজ পাণ্ডে কে বাদ দিলে। পরিচালনা করছেন দুই বাঙালি, দেবাত্মা মণ্ডল আর তুষার কান্তি রায়। তবে? কী হত যদি গোটাটাই বাংলা ভাষায় হত? বাকি ভারতীয়রা ডাবিং এ দেখত না হয়। যেমন এটারও বাংলা “ডাবিং” আছে। কিন্তু অরিজিনাল নয়। পুষ্পা যেমন আপামর ভারতীয় দেখে ফেলল, সে তো ডাবিং এই।

এখানে একটা কথা আছে, কেউ বলবেন মশায় রিচার্ড অ্যাটেনবোরো যখন “গান্ধী” বানাচ্ছেন তখন তো উনি গোটাটাই হিন্দিতে করতে পারতেন। কেন করলেন না? সে ছিল এক যুগ, ১৯৮২ সাল। আর এখন আরেক যুগ। ওটিটির যুগে কত কী সম্ভব হয়ে গেছে। আর তাছাড়া সেখানে চিত্রনাট্য লিখছেন যিনি জন ব্রাইলি, তিনি কি আর হিন্দি জানতেন? তাছাড়া সে সিনেমাটা হচ্ছিল গোটা বিশ্বের দর্শকের জন্য। যদিও হিন্দি ডাবিং সিনেমাটার হয়েছিল। কিন্তু এখন তো সব কত বদলে গেছে। চাইলে তো কত ভাবে কত কী করাই যেত। যেত নাকি? এত এত টাকা খচ্চা করে বিজ্ঞাপনও তো হচ্ছে সিরিজটার, মায় সৌরভ গাঙ্গুলিকে দিয়েও অবধি। কিন্তু অরিজিনাল ল্যাঙ্গুয়েজ? হিন্দি। গল্প? বাংলার।

আসলে আমরা বোধহয় আমাদের মান হারিয়েছি। সে জোর নেই। আমাদের কাজ দিলে, আমাদের নিয়ে কাজ করলেই এখন আমরা এখন বর্তে যাই। অমুক আজকাল হিন্দিতে কাজ করে! বলতে কেমন গর্ব লাগে না? আচ্ছা, সুচিত্রা সেন যখন ‘মমতা’’, কি ‘আন্ধি’’, কি ‘'দেবদাস’ ইত্যাদি সিনেমাগুলো করেছেন, তখনকার বাঙালিদের মনে হত, আরেব্বাস উনি হিন্দিতেও কাজ করছেন! এমন একটা কৃতার্থ ভাব থাকত? আমি যতটা জানি, থাকত না। কাজটা নিয়ে গর্ব অবশ্যই থাকত, কিন্তু ওই ‘বর্তে যাওয়া’ ভাবটা ছিল না। সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, হেমন্ত প্রমুখ অনেকেই হিন্দিতে কাজ করেছেন। আবার ঋষিকেশ মুখার্জি, বাসুদেব চট্টোপাধ্যায় সেভাবে বাংলা সিনেমা করনেনি, কিন্তু কোনোটা নিয়েই আমাদের এমন আজকের দিনের ‘'কৃতার্থ’ হওয়া ভাবটা ছিল না। বরং সত্যজিৎ রায়, কি মৃণাল সেন, তপন সিনহার কাজে ওদিকের কেউ কাজ করার সুযোগ পেলে নিজেদের ধন্য মনে করতেন, যা ওঁদের নানা সাক্ষাৎকারে ওঁরা খোলাখুলি বলেছেন। প্রসঙ্গত ইদানীং নানা পটেকারের সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কথাগুলো বলা যায়। কিন্তু তাঁদের এই উচ্ছ্বাসের কারণ তো ছিল আলাদা। এ সব মানুষের কাজ মানে অনুপম উৎকর্ষতার কাজ। সত্যজিৎ, মৃণাল, তপন তো কিংবদন্তী। তাঁদের কাজ করাটা তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার।

কিন্তু আজকের এই হিন্দিবলয়ামুখী হওয়ার প্রবণতা তো কাজের মানের উৎকর্ষতার জন্য ততটা না, যতটা মার্কেট ইত্যাদির জন্য। হিন্দির মার্কেট এখন ভীষণ শক্তিশালী। তাকে টেক্কা দিতে পারে একমাত্র দক্ষিণ ভারতীয় ছবি। আর উৎকর্ষতায় এখন মালায়ালম আর মারাঠী ছবি একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে, সে অন্য আলোচনা। সেখানে কতজন বাঙালি যাচ্ছেন সেও অন্য আলোচনা। ইদানীং বেশ কয়েকজন প্রথমসারির বাঙালি কলকাতার অভিনেতাকে বলতে শোনা গেছে মুম্বাইয়ের কাজ অনেক বেশি ডিসিপ্লিনড, অনেক বেশি প্রফেশনাল ওরা। তাই সেখানে কাজের অভিজ্ঞতাও অনেক ভিন্ন মাত্রার। মানে আরো বেশি সিরিয়াস আর লক্ষ্মীজনক।

সিরিয়াস সিনেমায় মারাঠি, মালায়ালম সিনেমা যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পাচ্ছে, কেন আমরা পাচ্ছি না, এ আলোচনা বৃথা। তিনজন মহিলা পরিচালক তিনটে সিনেমা বানালেন, 2024 সালে - ‘সন্তোষ’, ‘গার্লস উইল বি গার্লস’’ এবং ‘'অল উই ইমাজিন দ্যট লাইট’। তিনটে সিনেমাই বিশ্বের সিনেমানুরাগী গুণীজন দ্বারা প্রশংসিত হল। পুরষ্কার পাক চাই না পাক, আলোচনা হল। মজার কথা এই তিন মহিলা পরিচালকই নিজেদের অনুপ্রেরণায় কোনো না কোনো সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ, ঋত্বিকের নাম বলেছেন। মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, তবে আমাদের কী হল? এ প্রশ্ন নিয়ে আমার এ লেখা না। আমার লেখা আমাদের সেন্টিমেন্ট আর ভিত্তিভূমি কি আমরা ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি? ইদানীং কয়েকটা বাংলা সিনেমা বক্স অফিসে ভালো করেছে। কিন্তু আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা আশাপ্রদ মনে হয়নি। অন্তত ভারতের অন্য ভাষায় কমার্শিয়াল সিনেমা যে মাত্রায় পৌঁছিয়েছে সেই তুলনায়। তবে এটা যেহেতু আমার মতামত তাই এ নিতান্তই সাবজেক্টিভ ব্যাপার।

কদিন আগে অনুরাগ কাশ্যপ বাংলা সিনেমা নিয়ে একটা নঞর্থক মন্তব্য করেছিলেন। কদিন আগে গৌতম ঘোষও বললেন। কেউ কেউ মৌখিকভাবে উত্তর দিয়েছেন বটে। কিন্তু আবার সেই হিন্দিবলয়ামুখী কাজে ঝুঁকে গেছেন। ফলে কথার ধারভার কমেছে। অন্য ভাষায় কাজ করাটা নিয়ে আমার ভাবনার জায়গা না, কিন্তু এদিকে তেমন কাজ হচ্ছে না বলে ওদিকে চলে যাওয়াটা ভাবনার। কাজের বৈচিত্র্য, বাজেটের অঙ্ক, মার্কেটের পরিসর - অবশ্যই ওদিকে বেশি।

বাংলা সিনেমার মান একদিন বিশ্বের দরবারে পৌঁছিয়েছিল। সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিকের পরেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের হাতে তৈরি বেশ কিছু সিনেমা বিশ্বের নজর কেড়েছিল, যার মধ্যে “চরাচর” ফরেন ফিল্মের ক্যাটাগরিতেও অনেক দূর এগিয়েছিল। আজ সেদিন নেই। তার নানা কারণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমরা একদিকে হিন্দি আগ্রাসন বলে, আরেকদিকে যদি সেদিকেই ঝুঁকে পড়ি তবে তো ভাবনার। কদিন আগে ‘পাতাললোক’ এর যে দ্বিতীয় সিজন দেখানো হল, সেখানেও দেখা গেল নর্থ ইস্টের ভাষাতেই তাদের অংশটা দেখানো হল, তাদের দিয়ে হিন্দি বলানো হল না। তবে “খাকি”র এতবড় প্রজেক্টও বাংলায় হলে কী ক্ষতি হত? এত এত বড় বড় বাংলার অভিনেতা অমন করে হিন্দি বলে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝে নমো নমো করে দু একটা বাংলা বলছে, দেখে খারাপই লাগল। তাই এইসব বকবকানি।

12
Wed, 03/05/2025 - 19:25

 

যা ঘটে চলেছে কার্যকারণ সুতোয় ঘটে চলেছে। একটার পর একটা। এখানে করুণার প্রশ্ন আসছে কেন? যা ঘটছে, তা অবশ্যম্ভাবী বলেই ঘটছে। অন্যথা হতে পারত নাকি? কিন্তু আমি তো ঘটনা নই। আমার তো ক্রম নেই। আমি এই কার্যকারণ শৃঙ্খলের অনন্ত ক্রম দেখতে দেখতে বিষণ্ণতায় ডুবে যাচ্ছি। এর থেকে বাইরে যাই কী করে? আমি কীসের কারণ? আমার কারণ কী? আমি কে?

প্রজাপতিটা গাছের গুঁড়িতে বসল। রোদ মাখছে। পাহাড়ি কুয়াশা। সদ্য ছিঁড়ে রোদ উঠেছে। এত আয়োজনের মধ্যে আমি কেন? চারদিকে ঘুরে চলেছে লক্ষ লক্ষ কার্যকারণের চাকা। একটা চাকায় নিজেকে জড়িয়ে নিলেই হয়। কিন্তু কেন? চাইছি না তো। এক মুহূর্তের জন্যেও চাইছি না।

গাছের গুঁড়িটায় শেওলা জমে। সবুজ কম্বলের মত। কয়েকটা জায়গা বাদামী। ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। পিছানো যায় না। কিন্তু বলো আমাকে, আমি কীসের কারণ? আমার কারণ কে? কে আমি?

মাথায় বোঝা আটকে পিছন দিকে ফেলা। কী ভার নিয়ে উঠছে বৃদ্ধা উপরে। উপরে ওর ঘর। সংসার। গোটা জীবন কেটে গেল এই পাহাড়ে। ওদের পাহাড়ের সুখ তো আমার মত পর্যটকের সুখ না। নিত্য জীবনের দানা দানা সুখ। অল্পেই গুঁড়িয়ে যায়। উবে যায়। জীবনকে কী পর্যটকের সুখে দেখাই একমাত্র উপায়? “মন চলো নিজ নিকেতনে?”।

আমাকে ঘিরে কর্তব্যের জাল। আমি বানাইনি। ওরা আমাকে বানিয়ে নিতে চাইছে। এর থেকে বেরোতে চাই আমি। এখনই। সব জাল ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে চলে যেতে চাই। প্রজাপতিটা বসে আছে। ডানা দুটো ধীরে ধীরে খুলছে, বন্ধ করছে। রোদটা সরে গেলে, ও সরে যাচ্ছে।

বাজার দিয়ে হাঁটছি। ভীড় অনেক। অচেনা হয়ে হাঁটতে আরাম লাগছে। একা একা কথা বলা যায়। বাইরের কথা জালের মত। নিজের সঙ্গে নিজের কথা ঘাসের মত। সেই ঘাসের উপর ছোটো ছোটো পা ফেলে হাঁটছি। প্রজাপতিটাকে ফিরে গিয়ে দেখব উড়ে গেছে। রোদ চলে গেছে। সবুজ শেওলা জড়ানো গাছের গুঁড়ি নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছে। আমি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নিজের কথা থামিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, কিছু বলবে? আমি বিভ্রান্ত, সংশয়ের দোলাচালে ভাঙা মাথা নেড়ে কিছু একটা বলতে চাইব। গাছের গুঁড়ি বলবে, এই রোদ, প্রজাপতি, শেওলা, পাহাড়ের মাথা, কুয়াশা, নীল আকাশ….এ সবের কোনো ভাষা নেই। তোমার অনুমানের ভাষায় ওদের নিস্তব্ধতা নষ্ট করো কেন? কেন? গর্জে উঠবে গুঁড়ি। আমি কুঁকড়ে যাব ভয়ে। সে বলবে, যা কিছু দেখো সব কিছুকেই তোমার অনুমানের স্বাদে চাখতে চাও কেন? ছেড়ে দিতে পার না? পার না? লোভী! দুর্বল! কামুক!

গতকাল এই কথাগুলোই বলেছে। আমার মনে ছিল না। এই বাজারে হাঁটতে হাঁটতে এখন আবার সব মনে পড়ছে। হাঁটতে হাঁটতে হোঁচট খেলাম। ধাক্কা খেলাম। এই সবের মানে খুঁজতে গিয়ে কার্যকারণ সুতোয় জড়ালাম। গাছের গুঁড়ি আবার বলল, অনুমানের ভাষা…সর্বনাশা…..নীরবতা নেই তোমার, লোভী…. শয়তান…কুটিল?

একটা কুকুর, ঘেয়ো। মৃত্যুর সামনে বসে। মৃত্যু ঘুমিয়ে। কুকুরটা জেগে। কুকুরটার দগদগে ঘা বলল, জীবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বাঁচলে শুধু। জীবনকে বাঁচতে দিলে না। ধিক! ধিক!

আমার জ্বর, এই দেখো, কপালে তোমার নাকটা ঠেকিয়ে দেখো। জ্বরে পুড়ছে কপাল। মৃত্যু ঘুমিয়ে, পালাচ্ছ না কেন? কুকুর বলল, আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যাচ্ছ। কেউ পালাতে পারে না। ওর ঘুম ভাঙলেই আমাকে ডাকবে। তুমি যাও। তোমার জ্বর।

হ্যাঁ আমার জ্বর। গাছের গুঁড়ির পাশ দিয়ে ফিরতে ফিরতে দেখলাম প্রজাপতিটার ডানাগুলো ছিঁড়ে পড়ে আছে টুকরো টুকরো হয়ে। কোনো সরীসৃপের কাজ। বুকের উপর বুকে হেঁটে চলে শীতল বিষাদ। সরীসৃপ। সব টুকরো টুকরো করে ফেলে। আমার ঘরে এলাম। কানের ভিতরটা ভোঁ ভোঁ করছে। কপাল ঘাড় পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বাইরে কুয়াশা নামছে। বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। আমি মোটা মোটা দুটো কম্বলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছি। পায়ের তলা, হাতের তলা হিম শীতল।

আবর্জনার মত স্বাধীন হয় কিছু মানুষ, জানো তো? সংলগ্নতা নেই। দায়িত্ব নেই। শুধুই আবর্জনার মত স্বাধীন। কম্বলের রোঁয়াগুলোর ভাষা সারাটা শরীর দিয়ে ঢুকছে। জ্বরে শরীরের ভাষা গ্রহণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। চুপ করো, চুপ করো। আমার জ্বর। মরে যাচ্ছি।

তুমি লম্পট! তুমি কাপুরুষ! তুমি অলস! জ্বর তোমার আছিলা। আসল তুমি কই? তাকে বনসাই করে বাঁচিয়ে রেখেছ। তোমার ভাবনাগুলো শেকল। তোমার ভালোবাসাগুলো বঁড়শি। তোমার স্বপ্নগুলো সুদকারাবারির দস্তাবেজ। তুমি মরো। তুমি আবর্জনা।

দেওয়ালে প্রচণ্ড আকারের সরীসৃপ দাঁড়িয়ে একটা। শীতল। লেজের ঝাপটা দিচ্ছে কাঠের দেওয়ালে। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে পাইনের জঙ্গলে। আমি সরীসৃপের দিকে তাকিয়ে বললাম, ঈশ্বরকে ডাকবে একবার? আমি মারা যাচ্ছি। তোমার কী নিষ্ঠুর নীল চোখ। ডাকবে একবার? কাছে এসো না, দোহাই।

প্রচণ্ড বৃষ্টিতে প্রজাপতির পাখার টুকরোগুলো ভেসে যাচ্ছে। ঈশ্বর খুঁজে বেড়াচ্ছেন টুকরোগুলো। কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছেন ঈশ্বর। বৃষ্টিতে মিলিয়ে যাচ্ছেন ঈশ্বর। ঈশ্বর আমাকে চেনো? এই যে….একটা বিশাল সরীসৃপের সামনে জ্বরে শুয়ে। ঈশ্বর, ওই কুকুরটা মারা গেছে? ঈশ্বর, বাজারে সব লোক নিরাপদে ফিরে গেছে? ঈশ্বর আমি যে যে পাথরে হোঁচট খেয়েছি তারা ভালো আছে? ব্যথা কমেছে ওদের ঈশ্বর? যাবেন না….মিলিয়ে যাবেন না…..একবার বলে যান…..আমি কী শুধুই লোভী, লম্পট, কাপুরুষ, কামুক ছিলাম ঈশ্বর?.....বৃষ্টি বাড়ছে। ঈশ্বর পেলেন সব কটা টুকরো?

ঈশ্বর হাত বাড়ালেন। বৃষ্টিতে ভেজা হাত। কুয়াশায় ঢাকা হাত। কয়েকটা টুকরো নীল প্রজাপতিটার ডানার। ঈশ্বর আমার বুকের মধ্যে হাত ডুবিয়ে দিলেন। যেন মা হাত ডুবালেন তালের ক্ষীরে। কী খুঁজছ? অবশিষ্ট ডানা? আমি কি চোর ঈশ্বর? নেই কিছু। কিছু নেই আমার। আমি কিছু নই।

13
Mon, 03/03/2025 - 19:17

 

 

শালগ্রাম শিলার মত ভালো মানুষ হয়ে কী লাভ? জাভেদ আখতার একটা সাক্ষাৎকারে বলছেন, ফিশিং একটা দারুণ অবসরযাপন, কারণকে মাছ বঁড়শিতে আটকালে, ধরা পড়লে, ছাল ছাড়িয়ে নুনহলুদ মাখিয়ে তাকে ভাজা হলেও সে চীৎকার করে না। তাই একজন নিরীহ মানু্‌ষও মাছ ধরার সুখে অবসরযাপন করে। কারণ মাছের ভোকাল কর্ড নেই।

সাধু হব বলে আমি সততা ছেড়েছি। তবে সে সাধুত্বের কী মূল্য? দেখেছি আমাদের সমাজে সাধু হওয়া সহজ, সৎ হওয়া না। কোনো থিওলজিতে নিজের বিচারবুদ্ধি সর্বস্ব অর্পণ করলে সাধু হয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু সত্যের কোনো থিওলজি নেই। হৃদয়ের কোনো প্রতিষ্ঠান হয় না। কমোন সেন্স থেকে আনকমোন সেন্সের জগতে ঢুকতে যত ভর্তুকি দিতে হয়, সে সব চুকিয়ে স্বাধীন স্বাভাবিক বুদ্ধি আর তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকে না। যেটুকু পড়ে থাকে, সে নিতান্ত কিছু কেজো, হিসেবী বুদ্ধি।তখন ব্রেন ওয়াশ থেকে হীরকরাজার যন্তরমন্তর সব কিছুর শিকার হওয়া সোজা হয়ে যায়।

সত্যের মধ্যে সব সময় এক নতুনত্বের স্বাদ থাকে। এই সময়ে অনেক গাছে নতুন পাতা আসার সময়। কী সতেজ তারা। সে পাতাগুলো না রঙে এখনও অবধি পুরোপুরি সবুজ হয়েছে, না আকারে গোটা পাতা হয়েছে। কিন্তু সূর্যের আলো এসে যখন পড়ে, তার আনন্দে কোনো খামতি নেই যেন। কিছু একটা হতে হবে এমন কোনো দায় নেই, যতটুকুনি হয়েছে তাতেই তার প্রফুল্লতার সীমাপরিসীমা নেই যেন। তেমনই বৈষ্ণবের পদাবলীতে। সেখানে যে আনন্দ সতেজ হয়ে ফুটে ওঠে, সে ভাব অনেক সময় খুব পাকা কিছু তত্ত্ব নয়, কিন্তু তার মধ্যে একটা সুখ আছে। সেখানে অনেক কিছুই আধো আধো বলা, কিন্তু তাও তার মধ্যে সুখ। কিন্তু বোষ্টুমির “আমার কৃষ্ণকে না মানলে সব মিথ্যা” - এ কথায় সে আনন্দ নেই। জোর আছে। যেখানেই মানুষের স্বাভাবিক আনন্দ নেই, সেখানেই জোর আছে, শাসন আছে, নিয়ম আছে। কোনো না কোনোভাবে সঙ্কীর্ণতা আছেই। আনন্দের সঙ্কীর্ণতা হয় না। লাভ-লোকসান খোঁজা বুদ্ধির হয়।

অনেকের সঙ্গে কথা হয়। অনেকেই বেশ উচ্চভাবের কথা, সাহিত্য-ধর্ম-দর্শন, কত বিষয়ে কথা বলে যান। স্পষ্টভাবে বলে যান। কিন্তু ওই স্পষ্টতার মধ্যেই যেন কোথাও একটা কী ফাঁকি থেকে যায়। স্পষ্টতা আর অস্পষ্টতার মধ্যে যে আলোছায়া, যেখানে সত্যের আনাগোনা, সে ফাঁকিতে পড়ে যায়। সত্যের অতি সামান্য প্রকাশ্য, অপ্রকাশিতই বাকি সবটা। এ জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার সত্যি কী খুব স্পষ্ট করে, জোর দিয়ে, ভীষণ নিশ্চিতভাবে কিছু বলার আছে? আমার তো মনে হয় না।

শালগ্রাম শিলা যত স্পষ্ট, উপনিষদ যখন বলেন, সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম, সে তত স্পষ্ট নয়। শালগ্রাম শিলার সামনে দাঁড়িয়ে বলাই যায়, এই তো আছে। স্পষ্ট, স্বচ্ছ। মাথা নীচু করে, সিন্নি মেখে দিলেই হয়। কিন্তু সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্মকে নিয়ে আমি কী করব? তা তো স্পষ্ট বোঝাই যায় না। তাকে না আস্তিক হয়ে স্বীকার করা যায়, না নাস্তিক হয়ে অস্বীকার করা যায়। সত্য আর জ্ঞানের অসীমতা নিয়ে তো না সংশয় হয়, না বিশ্বাস। সে শুধুই এক বিস্ময়। কিন্তু বিস্ময়ে আমার লাভ কী? ঘর গোছাতে গিয়ে বহুকাল আগে আমারই লুকিয়ে রাখা টাকা যখন হাতে আসে, তার এক বিস্ময়মাখা সুখ আছে টের পাই। কিন্তু এ বিস্ময় নিয়ে আমি কী করব?

কিছু করার নেই। কিন্তু নিত্য জীবনের দাবী মিটিয়ে, সত্যের অন্বেষণ আর সে অন্বেষায় জাগা বিস্ময়ের সুখ - কেবল মানুষেরই সুখ। নইলে গ্রহ-নক্ষত্র থেকে এমন অনেক কিছুই আমাদের বৌদ্ধিক চর্চার উপজীব্য হত না। লাভের মানুষ রাতদিন কানের পোকা খেয়ে ফেলত, আহা, এ সব জেনে কী লাভ বলো তো…..থাক থাক, কিছু কাজের জিনিস খোঁজো।

কিন্তু অ-লাভের খোঁজার আগে হৃদয়কে ওই শালগ্রামী ভালোমানুষি ছেড়ে বেরোতে হয়। আপাদমস্তক অতৃপ্তির চাবুকের আঘাতে আহত হয়ে বলে উঠতে হয়,

"আবার যদি ইচ্ছা কর আবার আসি ফিরে

দুঃখসুখের-ঢেউ-খেলানো এই সাগরের তীরে ॥

আবার জলে ভাসাই ভেলা, ধুলার 'পরে করি খেলা গো,

হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়ননীরে ॥

কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,

আঘাত খেয়ে বাঁচি নাহয় আঘাত খেয়ে মরি।

আবার তুমি ছদ্মবেশে আমার সাথে খেলাও হেসে গো,

নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে।। "

এ গান গুরুদেব লিখছেন বুদ্ধগয়াতে, ১৯১৪ সালের ১০ই অক্টোবর। পরেরদিনই লিখছেন, "এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার"। সে গানে শেষে লিখছেন,

"বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা--

কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা?

বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে,

কার জীবনে প্রভাত আজি ঘুচায় অন্ধকার?।"

সেই নবীন পাতার দিকে ইঙ্গিত.....

[3 March 2025]

14
Tue, 02/11/2025 - 12:30

 

ভালো হওয়া আর ন্যাকা হওয়ার মধ্যে পার্থক্যটা স্বামীজি হাড়েহাড়ে বুঝেছিলেন। স্বামীজির চিঠিপত্রগুলো তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ভালোর উপর অনুরাগ জন্মানো সুশিক্ষার একটা বড় সাধন।

ইদানীং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে শিরোপা পাওয়া ইউটিবারের রুচিবোধ নিয়ে ভীষণ একটা কাণ্ড ঘটেছে। সে একটা “খিল্লি” প্রধান শো-তে পিতামাতার সঙ্গম বিষয়ক “মজাদার” মন্তব্য করে। এবং সবাই হেসে লুটোপুটি খেতে থাকে। ইউটিউবার কিছুক্ষণের জন্য ভুলে যায়, সে একজন আভূষণে ভূষিত “ইনফ্লুয়েন্সার”, যে সে নয়। যা হওয়ার তা হল। হইহই পড়ে গেল। এফআইআর হল। সে ক্ষমা চাইল।

তারপর? হে হে। তারপর কিছু না। আবার যেই কে সেই। সবাই ন্যাকা সেজে যাব। দিনের পর দিন দেখা যাচ্ছে পড়াশোনার বয়সে যৌন বিকার বাড়ছে। আমরা আধখানা চোখ বন্ধ করে আছি। ছেলের মোবাইলে বান্ধবীর স্কার্ট ওড়া ছবি, তাদের ছবি নানা কলাকুশলীতে কদর্য, অশ্লীল করে বন্ধুদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঘুরে যাচ্ছে। কেউ আত্মহত্যা করছে। কেউ লজ্জায় জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। কেউ অবসাদে ডুবে পড়াশোনায় ফোকাস হারাচ্ছে। মেয়েদের অভিভাবকেরা মেয়েদের আরো সাবধান হতে বলছে। ছেলেদের অভিভাবকেরা কেউ জেনেশুনে চোখ বন্ধ, কেউ মেরেধরে অসহায়, কেউ বুঝিয়ে বুঝিয়ে ক্লান্ত। ওদিকে সরস্বতী পুজোর দিন শিক্ষক মদের গ্লাস আর বোতলের ছবি দিয়ে ইনস্টাতে পোস্ট দিচ্ছে - এ-ই আমার দেবীর আরাধনা। তিনি ভাবছেন তিনি উন্নত, উদার, প্রগ্রতিশীল মানসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন। কিন্তু অপরিণত মস্তিষ্কে এর ফল হচ্ছে বিপরীত। এমন উদাহরণ অজস্র।

আজকাল ভালো আর ন্যাকা - সমার্থক শব্দে ব্যবহার হচ্ছে। আমরা এটা মেনে নিয়েছি যে আদতে কেউ ভালো হতে পারে না। পুলিশ তথা আইন-আদালতের ভয়ে, কিছু সামাজিক সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয়ে, বা আরো নানাবিধ চাতুরীতে আর ভয়েই মানুষ ভালো সেজে থাকার ভান করে। ভিতরে ভিতরে সবই ওই লুচ্চা প্রকৃতির। একটা অদ্ভুত সিনিসিজমকে আমরা রিয়েলিজম বলে চালিয়ে যাচ্ছি। আর সেখানে সাহায্য করছে আমাদের অধুনা আবিষ্কৃত বিনোদনের মাধ্যমগুলো। ওটিটিতে নানা সিরিজ, যার অধিকাংশই অন্ধকার জগতের গল্প। ওদিকে রিলস, শর্টসে যৌনতার লাগামছাড়া সুড়সুড়ি। অন্যদিকে আবার ধর্ম জগতে নতুন হাওয়া। সংস্কারি হওয়ার হাওয়া। সেটা যে কী জিনিস আজও স্পষ্ট নয়। এর মধ্যে বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে।

রামকৃষ্ণদেব বলতেন, চারাগাছে বেড়া দিতে হয়। পরে সেটা গুঁড়ি হয়ে গেলে হাতিও বেঁধে রাখা যায়।

এখন এই বেড়াটা কী?

বাচ্চারা প্রভাবিত হয়, অনুকরণ করে - এ ওদের ধর্ম। কিন্তু একটা বাচ্চাকে বাজে প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা কদ্দূর সম্ভব আজকের দিনে? তাকে তো বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। তবে?

তার উপর একটা সজাগ-সতর্ক, দরদী খেয়াল রাখা ছাড়া সত্যিই কী কোনো উপায় আছে? যদি কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ছে সঙ্গে সঙ্গে সজাগ হওয়া। তার সঙ্গে কথা বলা। কিন্তু সে বলতে না চায় যদি?

এইখানেই একটা বড় সমস্যা। নিজেকে তার আস্থাভাজন শ্রোতা হিসাবে উপযুক্ত করা। সে এমন কিছু বলবে যা শুনে প্রথমে আমি হয় তো ধাক্কা খাব, বিচলিত হব। কিন্তু সেটা বাইরে প্রকাশ করা যাবে না। মুখের হাবভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতেই হবে। মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। এটা বুঝতে হবে আমাদের ছোটোবেলা আর তাদের ছোটোবেলার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। স্মার্টফোন যে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে সমাজের সব স্তরে, তার সঙ্গে যুঝে যাওয়ার কৌশল আমরা এখনও শিখে উঠতে পারিনি অভিভাবক হয়ে। আমাদের নতুন করে অভিভাবকত্ব শিখতে হবে। পুরোনো ছাঁচ ফেলে নতুন ছাঁচ গড়তে হবে।

একটা বাচ্চার ভিত কী হতে পারে চরিত্রগঠনের শিক্ষার?

আমার মনে হয় একটা উদার মূল্যায়নের শিক্ষা। তাকে নিন্দা করার প্রবণতা থেকে মুক্ত করতে হবে। সেটা তখনই সম্ভব যদি নিজে নিন্দা করার প্রবণতা থেকে মুক্ত হই। যে জিনিসে সে আকর্ষণ অনুভব করছে, সেটা তার পক্ষে কতটা ভালো বা মন্দ। কোনটা তার জীবনের লক্ষ্যের জন্য অনুকূল আর কোনটা প্রতিকূল? এ মূল্যায়ন তখনই সম্ভব যদি সে অযথা নিন্দা করার প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে। নিন্দার আড়ালেই প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে যত বিকার এসে জড়ো হয়। কোনো কিছুকে ক্ষতিকর জানা, তার মূল্যায়ন। কিন্তু কোনো কিছুকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ছোটো দেখানো নিন্দা। এই মূল্যায়নের অভ্যাস অনেকভাবে হয়। বড়দের দেখে হয়। বই পড়ে, সিনেমা দেখে হয়।

অচেতনভাবে সব কিছুর মূল্যায়ন তো সবাই সব সময় করেই যাচ্ছে। কিন্তু সেটাকে সঠিক অর্থে করার শিক্ষা খুব কম বাচ্চার কপালেই জোটে। যাকে আধুনিককালে ক্রিটিকাল থিংকিং বলা হচ্ছে। আমাদের সমাজে নিন্দা আর নেগেটিভ সমালোচনার প্রবণতা লাগামছাড়া। আর ইন্টারনেটে নানা সামাজিক মাধ্যমে এসে সেটা আরো বেশি ক্ষুরধার এখন। এই অযথা নিন্দা আর নেগেটিভ সমালোচনার অভ্যাস যদি নিজের ছাড়ানো না যায়, তবে মৌখিক বা প্রহারের সঙ্গে প্যাকেজে নীতিশিক্ষায় কোনো লাভ হবে না। মনে রাখতে হবে শিক্ষা মানে আলো। আলোর কাজ প্রকাশ করা, প্রকাশিত হয়ে। সেকি নিন্দা আর নঞর্থক সমালোচনায় হবে?

15
Thu, 12/26/2024 - 11:34

 

কল্পনা ব্যতীত আনন্দের জন্ম হয় না। বিপরীতটাও সত্য, কল্পনা ছাড়া মানুষের উদ্বেগের জন্মও হয় না।

প্রথমে আনন্দের দিকটা দেখি। রাশি রাশি জলরাশির সামনে দাঁড়ালে মনের মধ্যে যে আনন্দ, শান্তি, মুক্তির অনুভব হয়, সে চোখের বাইরের ওই জলরাশির দৃশ্যের সঙ্গে কল্পনাকে মিশিয়েই। যাকে আমি সমুদ্র দর্শনের আনন্দ বলি।

ঠিক তেমন, বিশাল উঁচু ভূখণ্ডের উপর বরফ পড়ে আছে, এটুকুর জন্যেই মানুষের আনন্দ হয় না, ওর সঙ্গেও তার কল্পনা মেশে। তবেই সেটা কাঞ্চনজঙ্ঘা বা অমন কোনো পাহাড় পর্বত দর্শনের আনন্দ বলা যায়। ঠিক তেমন জঙ্গল, ঐতিহাসিক শহরের ধ্বংসাবশেষ ইত্যাদিতে মানুষের চিত্তের আনন্দ, ছুটি, মুক্তি।

কল্পনা করছি - এ বোধটা যখন সচেতনভাবে আমরা করি, তখন তাকে ঠিক খাঁটি কল্পনা বলা যায় না। তার মধ্যে আমার অতৃপ্ত বাসনার রঙ লাগে। সে কখনও তাই দিবাস্বপ্নের সুখ জাগায়, কখনও উদ্বেগে প্রাণ অস্থির করে তোলে। সে কল্পনা বাসনারই রঙিন পোশাক। হঠাৎ দেখলে চেনা যায় না, কিন্তু তলিয়ে দেখলেই ধরা পড়ে।

তবে আমাদের মধ্যে দুটো কল্পনা আছে কী? একটা বাসনার দ্বারা রঙিন, আর একটা আমার সত্তার স্বভাবের দ্বারা? একটু উদাহরণে দেখা যাক। একটা গোলাপ ফুল চোখে পড়ল, আমি তাকালাম। ভাবলাম ফুলটা তুলব, অমুককে দেব, তারপর কী হবে? এই শুরু হল বাসনার আগ্রহে জাগা কল্পনার ধারাবিবরণী। কখনও দিবাস্বপ্নের সুখ, কখনও অঘটনের ভয়। দুই-ই জাগে আমার কল্পনায়।

আবার অন্যভাবে যদি ভাবি? গোলাপটা চোখে পড়ল। তার লালরঙ দৃষ্টিতে আসা মাত্র মনের মধ্যে কী যেন শুরু হয়ে গেল। মাধুর্য জাগল। এক বিন্দু বালিকণা যেমন ঝিনুকের বুকে জমে থাকা মুক্তোর আবেগকে মুক্ত করে দেয়, ধীরে ধীরে মুক্তো গড়ে ওঠে, এও তেমন। একটা গোলাপ মনের মধ্যে জমে থাকা মাধুরী, যা কল্পনাই আদতে, বিশুদ্ধ কল্পনা, তাকে জাগিয়ে তুলল। মনের মধ্যে আনন্দ জন্মালো।

এই মাধুরীকে আমাদের বৈষ্ণবসাহিত্য বড় দরদ দিয়ে ফুটিয়েছে তার কাব্যে। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। সংস্কৃত জানা পণ্ডিত হতে হবে না, শুধু একবার মন দিয়ে যদি পড়ি, দেখি কী অদ্ভুত মাধুর্যে সব মধুময় করে তুলেছেন কবি।

 

অধরং মধুরং বদনং মধুরং

নযনং মধুরং হসিতং মধুরম্ ।

হৃদযং মধুরং গমনং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 1 ॥

বচনং মধুরং চরিতং মধুরং

বসনং মধুরং বলিতং মধুরম্ ।

চলিতং মধুরং ভ্রমিতং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 2 ॥

বেণু-র্মধুরো রেণু-র্মধুরঃ

পাণি-র্মধুরঃ পাদৌ মধুরৌ ।

নৃত্যং মধুরং সখ্যং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 3 ॥

গীতং মধুরং পীতং মধুরং

ভুক্তং মধুরং সুপ্তং মধুরম্ ।

রূপং মধুরং তিলকং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 4 ॥

করণং মধুরং তরণং মধুরং

হরণং মধুরং স্মরণং মধুরম্ ।

বমিতং মধুরং শমিতং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 5 ॥

গুংজা মধুরা মালা মধুরা

যমুনা মধুরা বীচী মধুরা ।

সলিলং মধুরং কমলং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 6 ॥

গোপী মধুরা লীলা মধুরা

যুক্তং মধুরং মুক্তং মধুরম্ ।

দৃষ্টং মধুরং শিষ্টং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 7 ॥

গোপা মধুরা গাবো মধুরা

যষ্টি র্মধুরা সৃষ্টি র্মধুরা ।

দলিতং মধুরং ফলিতং মধুরং

মধুরাধিপতেরখিলং মধুরম্ ॥ 8

তেমনই মাতৃভক্ত সাধক-কবি, শিবভক্ত সাধক-কবি প্রত্যেকেই নিজ নিজ রুচি অনুযায়ী জগতকে নিজের মাধুরীর কল্পনায় রাঙিয়ে নিয়েছেন। কোনো বাসনার প্ররোচনা নেই বলে সেখানে না আছে ভয়, না ক্রোধ।

কিন্তু জীবনে সব সময় তো এমন মাধুরীর জোগান থাকে না চিত্তে। তখন? রবীন্দ্রনাথের গানে আছে এর কথা - “সকল মাধুরী লুকায়ে যায়, গীতসুধারসে এসো।”

জীবনে সব চাইতে বড় সম্পদ দাদা মনের মধ্যে এ মাধুরীটুকু। নইলে সব থাকে আমাকে ঘিরে, সম্পদ-সৌভাগ্য-স্বাস্থ্য-পরিজন ইত্যাদি ইত্যাদি… কিন্তু আমিই থাকি না।

কেউ বলবে, কিন্তু কল্পনা মানে তো মিথ্যা। মানুষ কি শেষমেশ মিথ্যার বেসাতি নিয়ে থাকবে?

এর উত্তর আরেকটু কঠিন দার্শনিকের মত। আমার এই যে আমি, যে নানা মাধুরীতে ডুবে কল্পনায় মজেছে, সে নিজেও তো এক অকৃত্রিম কল্পনা। চিকিৎসকের কাছে যে আমি, আদমশুমারীর কাছে যে আমি, সে আমি কী আর আমার আমি? চিকিৎসক আমাকে অজ্ঞান করেও আমার অস্তিত্বকে বস্তুজগতে খুঁজে পায়। কিন্তু অজ্ঞান হয়ে গেলে সে কল্পনাকারীই বা কই, আর সে মাধুরীর ধারকই বা কই?

তাই ভারতীয় দর্শনে একদল এ সত্যের দিকে তাকিয়ে বলছে সব মায়া, আরেকদল বলেছে সব লীলা। দুই-ই সত্য, অবস্থাভেদে, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন।

মহানাদের জটেশ্বর শিবমন্দিরে দাঁড়িয়ে আছি যখন, একজন বয়স্ক মহিলা কাঁসর বাজাচ্ছেন, দুজন মধ্যবয়সী পুরুষ ঢাক, মাদল বাজাচ্ছেন, পূজারী আরতি করছেন পঞ্চপ্রদীপে….সব মিলিয়ে সন্ধ্যের সেই মুহূর্তটায় এ কথাগুলোই মনে হচ্ছিল। মানুষ রাতদিন তার মধ্যে এক মহামানবের অস্তিত্বকে খুঁজছে। না পেলে গ্লানিতে জর্জরিত হচ্ছে। নিজের মধ্যে মহতের শূন্যতাকে মহতী বিনষ্টি বলছে। সে যে-ই হোক না কেন। সংসারের সম্পদ আর মানের প্রতিযোগিতায় যত তুচ্ছ হোক না কেন সে, সেও চায় নিজের মধ্যে মহতের সার্থকতা। রবীন্দ্রনাথের বাণীতে…

“……তিনি রহিয়াছেন— ভয় নাই, ভয় নাই! সম্মুখে যদি অজ্ঞান থাকে তবে দূর কর, অন্যায় থাকে তবে আক্রমণ কর, অন্ধ সংস্কার বাধাস্বরূপ থাকে তবে তাহা সবলে ভগ্ন করিয়া ফেল; কেবল তাঁহার মুখের দিকে চাও এবং তাঁহার কর্ম্ম কর। তাহাতে যদি কেহ অপবাদ দেয় তবে সে অপবাদ ললাটের তিলক করিয়া লও; যদি দুঃখ ঘটে সে দুঃখ মুকুটরূপে শিরোধার্য্য করিয়া লও; যদি মৃত্যু আসন্ন হয় তবে তাহাকে অমৃত বলিয়া গ্রহণ কর! অক্ষয় আশায়, অক্ষুণ্ণ বলে, অনন্ত প্রাণের আশ্বাসে, ব্রহ্ম-সেবার পরম গৌরবে সংসারের সঙ্কট পথে সরল হৃদয়ে ঋজু দেহে চলিয়া যাও! সুখের সময় বল, অস্তি—তিনি আছেন, দুঃখের সময় বল, অস্তি—তিনি আছেন, বিপদের সময় বল, অস্তি— তিনি আছেন! পরমাত্মার মধ্যে আত্মার অবাধ স্বাধীনতা, অপরিসীম আনন্দ, অপরাজিত অভয় লাভ করিয়া সমস্ত অপমান দৈন্য গ্লানি নিঃশেষে প্রকাশিত করিয়া ফেল!”

16
Sun, 12/22/2024 - 11:21

 

 

হারারি বারবার AI নিয়ে সাবধান করছেন। বলছেন, সে শুধু অ্যাটম বোম বানাতে পারে তাই নয়, সে কোথায় সেটা ফেলতে হবে সে সিদ্ধান্তও নিতে পারে। এটাই ভয়ের।

AI এর কোন জিনিসটা নিয়ে ভয়? সে হল তার মনুষ্যত্ববোধহীন পাণ্ডিত্যকে নিয়ে। AI পণ্ডিত সেই নিয়ে সংশয় নেই, কিন্তু সেই পাণ্ডিত্যের ব্যবহার নিয়ে ভয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকহীন পাণ্ডিত্যকে ভয়ের বলেছিলেন। শুষ্কজ্ঞান। শুকনো পাতায় আগুন লাগলে দাবানল হয়। শুষ্ক পাণ্ডিত্যকে তাই ভয় পেয়েছিলেন ঠাকুর সেদিন। সাবধান করেছিলেন। বিবেক ছাড়া মানুষ হয় না। মানুষ মানে চেতনা আর মানের সমন্বয়। চেতনা মানে মঙ্গলের অনুরক্তি তাও বলেছেন। কিন্তু শুধু পাণ্ডিত্যে কি সে দরজা খোলে? AI শুষ্ক পাণ্ডিত্য। যদিও তার মধ্যে নকল আবেগের ভাষা আছে। কিন্তু সে নকল।

আজ মা সারদার জন্মতিথি। সে জীবনটার দিকে একবার ফিরে তাকানো যায় যদি কী দেখা যায়? পাণ্ডিত্য না দরদ?

পাণ্ডিত্য দরকার। তার নির্দিষ্ট ক্ষেত্র আছে, তার সীমাবদ্ধতাও আছে। কিন্তু পাণ্ডিত্য তো মানুষকে এক করে না। মানুষকে এক করে দরদ। সে দরদকে বাইরে থেকে শেখানো যায় না। বরং বাইরের অতিশিক্ষা বা ভুল শিক্ষা সে দরদকে শুষ্ক করে তাকে অমানুষ করে তুলেছে, এ উদাহরণ অনেক অনেক আছে সমাজে।

তবে দরদকে শেখায় কে? ধর্ম। সেও না। অতি পাষণ্ড ধার্মিকের উদাহরণও আছে। ধর্মকে যদি সাধারণ অর্থে দেখা যায়।

মানুষের ধ্বংস কে বেশি করে? পাণ্ডিত্য, না অজ্ঞতা? যদি হিসাব করে দেখা যায় হয় তো দেখা যাবে পাণ্ডিত্যের দ্বারা আবিষ্কৃত নানাবিধ আয়ূধ মানুষকে যেভাবে শেষ করেছে, তার তুলনায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুই না।

সিসিটিভি পাপের সাক্ষী হতে পারে, কিন্তু পাপ নিবারক হওয়ার ক্ষমতা তার নেই। পাপকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে, ভয় অথবা চেতনা। আগে ছিল নরকের ভয়, এখন আছে কারাগার, কি মৃত্যুদণ্ডের ভয়। কিন্তু ভয় কতদিন পাপকে আটকে রাখবে? যদি না চেতনার আলোতে নিজেকে আনা সম্ভব হয়?

যদি হতাশার হাত ধরে ভাবি, তবে জগতের দিকে তাকিয়ে চেতনার স্বপ্ন অসম্ভব একটা আশা। কিন্তু আশা ছাড়া মানুষ বাঁচে কি? মানুষ নিশ্চয়ই ভাববে তার মধ্যে একদিন চেতনা আসবে। সে যা কিছু অমঙ্গল তার থেকে নিজেকে বাইরের কোনো ভয়ের চাবুক ছাড়াই নিজেকে সংযত করবে।

সেই স্বপ্ন দেখার ভরসাই যোগান কিছু কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ। আজকে যাঁর জন্মতিথি, সেই মহাপ্রাণের দিকে ফিরে তাকালেও একই বিশ্বাস জন্মায়। মানুষ এমনও তো হয়। এমন ভাবেও তো বাঁচা যায়। বস্তুগত পাণ্ডিত্য না, ধর্মীয় পাণ্ডিত্য না, শুধুমাত্র সহজ বোধে জাগা সহজ দরদই পারে মানুষের প্রাণে আশা সঞ্চার করতে। মানু্‌ষকে এক করতে পারে সে-ই শুধু। মা, সুর আসুক মানুষের শ্রীহীন, দরদহীন জীবনে। তুমি এক করো।

শ্রী শ্রী মায়ের চরণে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম আজকে শুভ জন্মতিথিতে।

17
Fri, 12/20/2024 - 19:07

 

যে ভীষণ খারাপ, তাকে নরকে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর তাকে কুচিকুচি করে কেটে, নুন মাখিয়ে গরম তেলে ভাজা হয়।

এরকম গল্প শতাব্দীর পর শতাব্দী শুনে শুনে মানুষের সমাজ চলে আসছে। ভালোমন্দের বিচারটার পিছনে তাই ধর্মীয় কাহিনীপুষ্ট দেবতা বনাম অসুর আর স্বর্গ-সুখ বনাম নারকীয় অত্যাচারের গল্পের ছায়া থেকেই যায়। আমার যাবতীয় আবেগের মশলা মানব সভ্যতার অভিব্যক্তির সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়েছে। কোনোটাই মৌলিক নয়। নির্ভুল নয়।

ধর্মীয় অনুষঙ্গ প্রভাবিত বিচারের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞান। তথ্য, পরীক্ষানিরীক্ষা, প্রমাণ ইত্যাদি পুষ্ট বিচার। সেগুলো আবেগহীন। যুক্তি আর ফ্যাক্টসম্মত।

আমি সব চাইতে বিপন্ন দেখেছি শৈশবকে। যতদিন যাচ্ছে শৈশবকে আরো বেশি বিপন্ন দেখছি। আত্মহত্যার প্রবণতা, নেশা, নানারকম অপরাধে নাবালকদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। ভারতে তা রীতিমতো চিন্তার জায়গায়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলেই দেখা যায় কী বিপন্ন শৈশবের মধ্যে দিয়ে সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বেড়ে উঠছে। সে নিয়ে কাজ হচ্ছে না এমন নয়, কিন্তু যতটা রোগ ছড়িয়েছে আর যে দ্রুততার সঙ্গে ছড়াচ্ছে তার তুলনায় সেটা ভীষণ কম। জুভেনাইল ক্রাইমকে হালকাভাবে নেওয়ার মাশুল গোটা সমাজকে আগামী দিনে দিতে হবে। শুধুমাত্র ধর্মীয় গল্পের মত অসুর নিধন করে পার পাওয়া যাবে না। অপরাধ বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে। আর তাকে বুঝতে গেলে আরো পরিণত হতে হবে সমাজের মানসিকতাকে।

একদিন সমাজে ওঝা, ভূতে ধরার মত নানারকম বিধান ছিল মানসিক ব্যাধির। জলাতঙ্কের মত সংক্রমণকেও শয়তানের ভর করা বিশ্বাস করে, আক্রান্তকে চার্চে রেখে ভয়ানক অত্যাচার করে তার প্রতিকার করা যাবে বিশ্বাস করা হত। সে বেচারা রোগের তাড়নায় আর নানাবিধ ধর্মীয় অত্যাচারের দাপটে করুণ মৃত্যুর সম্মুখীন হত।

সে সব দিন নেই আর। ওঝা, ভূতপ্রেত কমছে। মানসিকরোগ আর অপরাধ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ বাড়ছে। এ নিয়ে প্রথম বিশ্বে নানাবিধ কাজ হচ্ছে। উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে। ক্রমে এদিকেও সে কাজের প্রসার প্রচার হবে বলে আমার বিশ্বাস।

আর রইল দুর্নীতির বিষয়টা। সমাজে অর্থনৈতিক অবস্থান আর বিচারব্যবস্থার অদ্ভুত সমীকরণ গোটা দুনিয়ায় নতুন কিছু নয়। কমবেশি আছেই। সে নিয়ে প্রতিবাদ হবে, আওয়াজ উঠবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এতে আশ্চর্য হওয়ার মত শিশু তো আর নেই। সুতরাং “আসল অপরাধী/অপরাধীরা” বনাম, “স্কেপগোট” এর ধোঁয়াশা থাকবেই। আমরা ছোটোবেলা থেকেই জানি না যে - “অত সৎ হলে সমাজে টেকা যায় না। বেঁচে থাকা যায় না।” “সতীত্ব মারাতে এসো না”। ইত্যাদি ইত্যাদি। ওরা হবে সৎ, আর আমি হব চলনসই চালাক - এ ভাবটা ভালো, কিন্তু কাজের নয়। মাঝে মাঝেই স্বপ্নভঙ্গ হবে। হাতের কাছে যাকে পাব তার শাপশাপান্ত, বাপবাপান্ত করব। তারপর ক্লান্ত হয়ে যাব একদিন। এ দুনিয়া কোনোদিন সততার ছিল না। হবেও না। এর মধ্যেই আশা করব যতটুকু সততা পাওয়া যায়, অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে, এবং যদ্দিন সে স্বচ্ছতা টিকিয়ে রাখা যায়। আশা তো করব, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে?

নানারকম তত্ত্ব আসবে। কিন্তু কেউ বলবে, দাদা সমাজ বলতে তো আমি, আপনিও। আমাদের মধ্যে ওই জিনিসটা কদ্দূর টিকে আছে? সুযোগ পেলে কজন আর ছাড়ে দাদা? না পাওয়ার লোকেদের চীৎকারকে ওরা থোড়াই আমল দেয়। জানে তো, একটু ভাগ দিলেই সব শান্ত হয়ে যাবে। উঁহু, তাই বলে ওসব মেরুদণ্ডের কবিতাটবিতা আওড়ানোর দরকার নেই। সৎ থাকাটা একটা বাধ্যতা। যে পারে সে পারে, যে না পারে তার ছলের অভাব হয় না। ওর সঙ্গে মেরুদণ্ডের সম্পর্ক নেই। নির্ভেজাল শুদ্ধ বিবেকবুদ্ধির দরকার আছে। যা বাজারে পাওয়া যায় না। কোথায় পাওয়া যায়, কেউ জানে না। শুধু এতটা বলতে পারি, সৎ হতে গেলে ধর্মবিশ্বাস লাগে না, বড় ডিগ্রি ত্যাগ করে সাধু হওয়া লাগে না, লাগে একটা সহজ বোধ - সমাজ অশুদ্ধ হলে আমিও বিপন্ন হই। আমাকে দিয়েই সমাজ শুরু, তাই সংশোধন আমাকে দিয়েই শুরু করতে হবে। নিঃশব্দে। নিভৃতে।

18
Wed, 12/18/2024 - 13:02

 

 

“বালকের মত বিশ্বাস। সরল বিশ্বাস।”

কার হবে? কী করে সম্ভব? যতক্ষণ জেগে থাকা ততক্ষণ স্বার্থচিন্তা। ঈর্ষা। দলাদলি। ষড়যন্ত্র। বিষোদগার নিভৃতে। গভীরে গভীরে অর্থ, শরীর, খ্যাতির তৃষ্ণা পুড়িয়ে যাচ্ছে। বাইরে অভিনয়। ভিতরে গ্রীন রুমে সাজের পর সাজ বদলে যাচ্ছে। এর মধ্যে বালকের মত স্বভাব? ঘুষ নিচ্ছে। দিচ্ছে। চোরাপথে, উপরিপথে টাকা ঢুকছে, বেরোচ্ছে। সেও নাকি কাঞ্চনত্যাগী। সব নাকি মনে মনে। তাই? দাদা তাই? নিজের ভিতর আয়নার উপর পর্দা। অভ্যাসের পর্দা। আমি পবিত্র, মোহমুক্ত, শুদ্ধ-বুদ্ধ…..ঢপ। দাদা সব ঢপ।

কিতকিত খেলা হচ্ছে। এদিকে আমি। ওদিকে আমি। আমাতে আমাতে কোস্তাকুস্তি। আমার প্যাঁচে আমি। আমাকে ফেলছি আমি। বাইরের কাউকে দোষী ঠাওরে কী লাভ দাদা? আমি শকুন। সাজতে চাইছি চাতক। চাতক কই? চাতকের সাজে শকুন। বৃষ্টির জলও চলে। ভাগাড়ও চলে। ভাগাড়ের দিকে এক চোখ। মেঘের দিকে আরেক। আমি কে? ভণ্ড। ভণ্ড না, সোজাসাপটা শব্দ সেটা। আমি ধূর্ত। যুক্তিজীবী। হৃদয় বিষাক্ত হলেও বাঁচে না। যুক্তি বিষাক্ত হলেও বাঁচে। রক্তবীজ হয়। খুনের রক্তকে বলে বীরত্ব। ঈর্ষাকে বলে পৌরুষ। কাপুরুষতাকে বলে অহিংসা। কামনা-লালসাকে বলে জীবনের স্বাদ। ঈশ্বরকে বলে বিশ্রামের উপবন। আলোকে বলে ধাঁধা। অন্ধকারকে বলে পথ।

“যে কোনো একটা পথ ধরে গেলেই হয়। তবে সে পথ যেন সত্যনিষ্ঠ হয়। মন মুখে এক হয়।”

মন মুখ এক তো পাগলের। কী এমন জেনেছি যে মুখের সঙ্গে মনের মিল হবে? মনের কথা মুখে বলি যদি? “সে সব কথা বলি যদি আমায় ঘৃণা করে লোকে/ বসতে দেয় না এক বিছানায়, বলে ত্যাগ করিলাম তোকে। তাই পাপ করে হাত ধুয়ে ফেলে, আমি সাধুর পোশাক পরি/ তখন বলে লোকটা ভালো/ ওর মুখে সদাই হরি”।

মন মুখে যত ফারাক থাকে সমাজে শান্তি তত থাকে। যত পার্থক্য তত ভদ্র। যত কাছাকাছি তত স্যাভেজ। তত পাষণ্ড। মন মুখে মিল কখন হয়? ঝগড়ার সময়। যখন রাগের নেশা। যখন মদের নেশা, আড্ডার সময়। বাকি সময়? মনের বাড়ি জিভ যায় না। জিভের পাড়ায় মন যায় না। বেঁচে থাকা মানে আধা-আধি।

গুরুর কাছে একজন এল, বলল, গুরুদেব, আমি অন্ধ, আমাকে চক্ষু দান করুন। শাস্ত্রে আছে গুরু চক্ষু দেন। চক্ষুরুন্মিলীতিং যেন তস্মৈ শ্রী গুরবে নমঃ….শাস্ত্র আওড়ালো হবু শিষ্য।

গুরু বলল, তুমি অন্ধ, সে নিয়ে সংশয় নেই….তুমি শান্তি চাও…আমি তোমাকে শান্তি দেব। এসো।

গুরু সাধন গৃহে নিয়ে গেল। একটা বড় ঘর। লক্ষাধিক অন্ধ। গুরু সাধন দিয়েছে। সবাই গোল গোল ঘুরে যাচ্ছে। যে যত জোরে, যতবার ঘুরছে, সে-ই নাকি সত্যের তত কাছাকাছি। নতুন যে, সেও ভিড়ে গেল দক্ষিণা দিয়ে। গুরু বলল, তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে শুধু ঘুরে যাও। এ রাস্তায় কোনো ভাবনা নেই, খানাখন্দ নেই, উঁচুনীচু নেই। ঘুরতে ঘুরতে একদিন মনে আনন্দ না পেলেও, দেখবে ঘুরতে না পারলে মনে অশান্তি আসছে। সে-ই হবে তোমার সিদ্ধি। গুরু পুলকিত হয়ে ফিরে গেল। শিষ্য শান্ত হল। ভাবল, যাক এই তবে পথ, শুধু ঘুরে যাও, ঘুরে যাও, ঘুরে যাও।

সাচ্চা গুরু অপ্রাতিষ্ঠানিক। সে বলে, আমাকে ভোলো। নিজেকে পাও। নিজেকে পেলে জগত পেলে। আমি কী বাইরে ওহে, ভিতরে ডোবো, তোমাতে আমাতে নিত্য লীলা, মজার খেলা। তুমিই আমি। আমিই তুমি। বাধা কী? ভয়। অজ্ঞান কী? “আমি অজ্ঞান” - এই বোধের গাছে, জড়তার নীড়ে, বিষাদের কাঠি জড়ো করে কাল কাটানো। জাগো বন্ধু, জাগো। আর সাবধানে থেকো, যে রাস্তা দেখাবার প্রতিষ্ঠান খুলে বসে, সে-ই রাস্তা আটকায় কিনা, খেয়াল রাখো। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ক্লিয়ার ইওর ওন শিট….নিজের গু নিজে সাফ করো….মনে রেখো।

19
Sun, 12/15/2024 - 12:33

 

 

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, লেখাপড়া করে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।

তবে কি হিমালয়ের গুহায় যেতে হয়?

শ্রীরামকৃষ্ণ কোনোদিন হিমালয় দেখেননি। শান্তি পেতে কোনো গুহায় গিয়ে সেঁধিয়ে বসেননি। এমনকি তীর্থে গিয়েও শান্তি পাননি।

ঈশ্বর কি আছেন? সত্যিই কি ভগবান বলে কিছু হয়? জীবন রহস্যের পর রহস্যে আবৃত। এ অনুভব করা যায়। কিন্তু সত্যিই কি এ রহস্যের গভীরে কোনো সত্য আছে? কোনো সংহতি আছে?

চুপ করে বসে থাকা একটা পশু আর মানুষের মধ্যে তো কী ভীষণ পার্থক্য। মানুষ বাইরে চুপ করে ভিতরে সাম্রাজ্য বানিয়ে ফেলছে। বাড়ি-ঘর-দোর সব বানিয়ে ফেলছে। বাইরের মানুষকে ভিতরে এনে শত্রু, বন্ধু, উদাসীন, সুহৃদ, প্রতিবেশী, আত্মীয়, পরিবার ইত্যাদি ইত্যাদি কত পরিচয় তৈরি করে নিচ্ছে। সম্পর্ক বাইরের জিনিস তো না, ভিতরের জিনিস। সে সম্পর্কের আয়নায় নিজের অস্তিত্বকে পরখ করছে। নিজের মূল্য নির্ধারণ করছে। নিজেকে কখনও সুখী, সার্থক, সফল অনুভব করছে। আবার কখনও ব্যর্থ, দুঃখী, বঞ্চিত অনুভব করছে। সব কিছুকে সুখের দিকে নিয়ে যেতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করছে। আবার সব কিছু দুঃখের দিকে গড়িয়ে গেলেই কপাল চাপড়াচ্ছে।

এ তো গেল তার ভিতরের পরিস্থিতি। বাইরের পরিস্থিতি আরো সঙ্গীন। সেখানে সে কোথাও অনুগত, কোথাও বিদ্রোহী, কোথাও নম্র, কোথাও বিরক্ত, কোথাও স্বাচ্ছন্দ্য, কোথাও সংকটে, কোথাও ফাটা বাঁশে, কোথাও বাঁশের ডগায়, কোথাও আনন্দের ঢেউয়ে, কোথাও ক্রুদ্ধ আগ্নেয়গিরি, কোথাও মরণের কাছাকাছি, কোথাও জীবনের হাত ধরে।

এত কিছুর মধ্যে তার উপর একটাই আদেশ, ভারসাম্য রেখে চলো। ব্যালেন্স করো।

কে করবে? যে করবে, সে কে? তাকে জন্ম থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে চলনসই একজন বানানো তো হয়েছে। কিন্তু কী সে শিখেছে? সে সিলেবাসের অঙ্ক-ইতিহাস-ভুগোল-সাহিত্য ইত্যাদি শিখেছে, সে চালাকি-দুষ্টুমি-ধ্যাষ্টামো শিখেছে, কদাচিৎ মাঝে মাঝে সততা, করুণাও দেখেছে, ধর্মীয় বিশ্বাসের কাছে, নানা আচারের কাছে নত হয়েছে, মেনে নিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে, সামাজিক প্রথার নামে যা কিছুর সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করেছে। যত জেনেছে তত কনফিউজড হয়েছে। যত কনফিউজড হয়েছে তত কম ভাবার চেষ্টা করেছে। যত কম ভাবার চেষ্টা করেছে তত যান্ত্রিক হয়েছে। যত যান্ত্রিক হয়েছে তত মিথ্যা হয়েছে। মিথ্যা হতে হতে বিষণ্ণ হয়েছে। অসংবেদনশীল হয়েছে। একদিন পাগল হয়েছে, না তো পাথর হয়েছে।

এই মানুষ ব্যালেন্স করবে? কতদিন করবে? কতটা করবে? কতদিক করবে? কোনটা তার সংহতিপূর্ণ? কোনটা তার ভূমিস্থ, মানে গ্রাউণ্ডেড? সব তো জট পাকিয়ে তাকে নিয়ে ঝুলে আছে। সে দাঁড়াবে কোথায়? তার যেতেও দ্বন্দ্ব, দাঁড়াতেও দ্বন্দ্ব। সুখেও দ্বন্দ্ব, দুঃখেও দ্বন্দ্ব। তার প্রেমেও দ্বন্দ্ব, অপ্রেমেও দ্বন্দ্ব। তার জাগরণ মানেই দ্বন্দ্ব। জীবন মানেই দ্বন্দ্ব।

এ ব্যালেন্স করবে? কী করে করবে? তার কী যাদুকাঠি আছে? কিচ্ছু নেই। আজীবন সে যাদুকরের অপেক্ষায় থাকে। আজীবন সে আশঙ্কায়, আতঙ্কে থাকতে থাকতে কাল্পনিক আনন্দময় বিভুর দিকে তাকিয়ে বাঁচে। কিন্তু কই সে? শেষে একটা একটা করে সুতো ছেড়ে দেয়। জীবনকে বলে যেদিকে নিয়ে যাও, যাও। আমার আর কিছু বলার নেই। চাওয়ার নেই। শুধু আমাকে পাগল করে দিও না।

যদি সৌভাগ্য হয়, তবে কোনো একদিন সে তার অবশিষ্ট বোধের টিমটিমে শিখাটুকুকে প্রশ্ন করে, কে তুমি? আকাশের মত উদাসীন, আমার সব কিছুর সাক্ষী, নিরুত্তর, কে তুমি?

এইখান থেকে শুরু হয় তার মধ্যে একটা নতুন যাত্রা। সে যাত্রার ট্যুর কন্ডাকটর যে কেউ হতে পারে। এ লেখায় শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণ উপদেশ দেন না। গল্প বলেন। গল্পের মধ্যে ভিসা-পাসপোর্টের কোড আছে। এনক্রিপ্টেড। লুকানো। গোটা জগতই এনক্রিপ্টেড। পারবে বুঝতে? এসো, আমার কাছে এসো। আমি গুরু নই, কর্তা নই, ঈশ্বরটিশ্বর কিচ্ছু নই, আমি আদতে কিচ্ছু নই। তোমার মধ্যে একটা ঘাপটি মেরে থাকা গুটিসুটি চেতনা আছে। ওই চেতনার কাছাকাছি যত আসবে, তত জুড়াবে। বাইরে কিচ্ছুটি পরিবর্তন করতে হবে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে তুমি বদলে যাবে। আসবে?

গঙ্গা বয়ে চলেছে। শান্ত শীতল হাওয়া বইছে। হিমালয়ের গুহা না, কোনো গভীর অরণ্যের মধ্যে কুটির বানানো কেউ না, প্রাচীন বইয়ের কোনো ধোঁয়া ধোঁয়া বিশ্বাসে অবিশ্বাসে মেশানো চরিত্র না। একজন সরল সহজ ভাষায় কথা বলা মানুষ বসে আছে। শুধু একটু কাছে এসে বসলেই হয়। কথাগুলো প্রাণের মধ্যে নিয়ে, নির্জনে, নিভৃতে একটু নাড়াচাড়া করলেই হয়। প্রাণে এক সুগন্ধ ছড়াতে শুরু করে। তার কোনো দাবী নেই। তার কোনো কর্তৃত্ববোধ নেই। তার কিছুই চাওয়ার নেই। তোমাকে শুধু গল্প শোনানোর আছে। যে গল্প জীবনের জটিল এনক্রিপ্টেড কোডগুলো ভাঙবে। তোমাকে কিচ্ছু বিশ্বাস করতে হবে না, শুধু একটা গল্প শোনার মন নিয়ে আসতে হবে, আগুনের ঝলসানো বেগুনের ভর্তার মত জ্বলেপুড়ে যাওয়া, লঙ্কানুন মাখানো জীবনটাকে নিয়ে আসতে হবে। এটুকু পারা যাবে না? ওটুকুতেই হবে।

20
Fri, 12/13/2024 - 11:21

 

মানুষের চিন্তার একটা বড় ভ্রম হল সে বিশ্বাস করে ভিতরটা না বদলিয়ে বাইরেটা বদলাতে পারবে। তার সমাজ, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি সব যে তার অন্তর্জগতের প্রতিফলন তা সে জানলেও স্বীকার করে না। কারণ তার একটা বদ্ধমূল ধারণা অন্তর্জগতের যা কিছু অ-সভ্য প্রবৃত্তি, সে সবকে সে বাইরের শাসনে আটকে রাখতে পারে, তাকে বেশ করে “ডিসিপ্লিন” শিখিয়ে কষে বেঁধে রাখতে পারে, তবেই সে সায়েস্তা হয়, সমাজ নির্বিঘ্নে চলে। সে কুপ্রবৃত্তির পরিবর্তনের কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না।

এই তাত্ত্বিক বিশ্বাসের জন্যেই বালির উপর আমাদের সমাজের প্রাসাদ। সব সময় ভয়, এই বুঝি আসল চেহারাটা সামনে চলে এলো। এই বুঝি শাসনের আগল ঠেলে সেই আদিম বর্বর দিকটা বাস্তবে চলে এলো। ভয় অমূলক নয়। এ-ই নিয়েই তো আমাদের সমাজ।

কিন্তু এর মধ্যেও আমাদের পূর্বতন সমাজসংস্কারকেরা শিক্ষার উপর আস্থা রেখেছিলেন। শিক্ষা অর্থে তারা সেই বিশুদ্ধ জলের কথা ভেবেছিলেন, যা নিজে দূষিত না বলে অন্তরে গিয়ে অন্তঃকরণকে বিশুদ্ধ করে মানুষকে শুদ্ধ করে তুলবে। অন্তত আংশিক হলেও। কিন্তু কীভাবে?

যে শিক্ষার কথা তাঁরা ভেবেছিলেন, আর আজ শিক্ষা বলতে যা বুঝি ঠিক তার বিপরীত। আজ শিক্ষা একটা কমোডিটি, একটা ইনভেস্টমেন্ট। ফেল কড়ি মাখো তেল। সে শিক্ষায় কেরিয়ার তৈরি হয়, কিন্তু নিজেকে সংশোধনের ক্ষেত্র হয় সীমিত, নয় শূন্য। স্কুলের পাশাপাশি চলে টিউশান। সে জানে টিউশান কাকে বলে। ভারতের একটা শহুরে পরিবার ১২% আর গ্রামের পরিবার ১৫% পড়াশুনা বাবদ বরাদ্দ খরচের ব্যবহার করে শুধু টিউশানের জন্য। টিউশান অর্থে তোমাকে আরেকটা থার্ড পার্টি সফটওয়্যার জুড়ে দিলাম যাতে তোমার “পারফর্ম্যান্স” আরো ভালো হয়। টিউটর তোমাকে মনোরঞ্জনের সঙ্গে, মেরেধরে যে কোনো উপায়ে তোমার কাছ থেকে কাজ আদায় করে নেবে, কারণ সেটা তার ব্যবসা, নিজের স্বার্থেই সেটাকে তার টিকিয়ে রাখতে হবে। তারা ভালো পারফর্ম্যান্স দেখাতে পারলে তারা আরো ফুলেফেঁপে উঠবে। আজ তাই স্কুলের পাশাপাশি আরেকটা সমান্তরাল প্রাইভেট টিউশান প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে নিজেদের অপরিহার্য প্রমাণ প্রায় করেই ফেলেছে। তাদের পুঁজি মানুষের স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার ভয় আর স্বপ্নকে বাড়িয়ে লোভকে ভর করে। (দুর্ভাগ্য হল এই লেখাটা যে লিখছে সে নিজেও সেই তন্ত্রেরই অংশ। এ সাফাই না। স্বীকারোক্তি। তার চেষ্টা এই কাজটাকে কী করে কেরিয়ার গড়া সর্বস্ব না করে পাশাপাশি আরো কিছু শেখানোর ব্যবস্থা রাখা, চর্চার ক্ষেত্র গড়ে তোলা যায় সেটা। সিম্পোজিয়ামের মত। কিন্তু সে আত্মকথনের জায়গা এটা না।)

যারা একটা নির্দিষ্ট সময় আয়ু পেয়েছেন, এবং আনবায়াসড, অবজেক্টিভ খোলা দৃষ্টিভঙ্গি রাখেন, তারা জানেন সরকার বদলালে সমাজ বদলায় না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে সরকার বদলের দরকার নেই। অবশ্যই আছে। তাতে সমাজের মেশিনারিগুলো কিছুটা অদলবদল হয়। আবার ধুলো জমতে থাকে। কারণ যারা সরকারের সেই বিরাট কর্মকাণ্ডের মেশিনারি চালায়, তারা বদলায় না।

তবে বদলায় কীসে? আঘাতে। সেন্টিমেন্টের আঘাতে না। চেতনায় আঘাতে। সেণ্টিমেন্টের আঘাত সাময়িক। তাতে আন্দোলন তৈরি হয় না। আলোড়ন তৈরি হয়। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিত হয়ে যায়। সেন্টিমেন্টকে জাগিয়ে রাখতে হয়, উস্কিয়ে রাখতে হয়। চেতনা একবার জেগে গেলে সত্যপ্রতিষ্ঠ না হওয়া অবধি থামে না।

আঘাত মানুষকে কী দেয়? সীমাবদ্ধতার জ্ঞান। যাকে বা যে সিস্টেমকে সে নির্ভুল, বিকল্পহীন ভাবছিল, তাকে প্রশ্ন করার সাহস জাগে। একদিন সমাজে মেয়েদের যে জায়গায় রাখার চেষ্টা হয়েছিল, সমাজকে নানা কুসংস্কারে বেঁধে জড়পিণ্ডে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছিল, তার থেকে বাঁচিয়েছে তাকে প্রশ্ন, সংশয়। প্রতিষ্ঠিত নানা ধর্মীয় মতের, নানা অমানবিক আচারকে প্রশ্ন করার দুঃসাহস তাকে দিয়েছে আঘাত। ভয় তাকে দমাতে পারেনি। কারণ সে সত্যকে স্পষ্ট দেখেছে বলে না, মিথ্যাকে স্পষ্ট দেখেছে বলে। জেনেছে বলে। যে সত্যকে স্পষ্ট দেখাতে চায়, সে চিরকাল মানুষকে কোনো না কোনো তত্ত্বে বাঁধে, ডগমায় জড়ায়। কিন্তু যে মিথ্যাকে স্পষ্ট করে দেখায় সে মানুষের নিজের হাতে গড়া কারাগারকে স্পষ্ট করে দেখায়। সে বাইরেটা কী স্বচ্ছভাবে না জানলেও, মুক্তির আসল রূপকে অবজেক্টিভলি না জানলেও কারাগার যে মিথ্যা সেটাকে স্পষ্ট করে জানে, তাই দাপিয়ে ওঠে। গর্জন করে ওঠে।

একদল মানুষ সমাজের মূল চালিকাশক্তি করতে চাইছে ভোগকে। যে যত বেশি নিজের বাসনা চরিতার্থ করতে পারে সে যেন তত স্বাধীন। তত সফল। বাসনার, লোভের চরিতার্থতাই যেন মানুষের জীবনের চরম মাপকাঠি। এই বোধটাই কারাগার। যার পায়ে আমাদের শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, বিজ্ঞান দাসখত লিখে দিয়ে বসে আছে। এর বাইরে আরেকটা কাজ যে তার অপেক্ষায় আছে, সে ভুলে আছে । মনুষ্যত্বের প্রাথমিক দায়িত্ব তার নিজের আর সমষ্টির মঙ্গলের প্রতি তার কর্তব্যবোধ। যা ঠিক, যা সত্য, যা ন্যায় তা যদি তার বাসনা-লোভের কাছে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তৎক্ষনাৎ তাকে ত্যাগ করা। এ শক্তি সে নিয়েই জন্মেছে। একে চিরকালের জন্য যে আটকানো যে যায় না বাংলার মানুষ তার সাক্ষী শেষ কয়েক মাসে।

তবে কী সে আন্দোলনে কিছুই হয়নি? হয়েছে। আজ আমাদের এখানে ভোট। যখন ভোটের বুথে ঢুকছি, তখন বারবার আমার চোখ ভিজে আসছে। আমি যখন ইভিএম মেশিনের সামনে দাঁড়িয়ে, আমার দৃষ্টি ঝাপসা আমারই চোখের জলে। একটা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। লোভ যার চালিকাশক্তি। স্বার্থান্ধতা যার উকিল। তাকে বদলাতে গেলে এই যে স্কুলে দাঁড়িয়ে আছি, এই যে বিদ্যার্থীরা বছরে বছরে হাফপ্যান্ট থেকে ফুলপ্যান্ট, ফ্রক থেকে শাড়ি হবে, তাদেরকে বদলাতে হবে। তাদের সামনে বারবার মনে করাতে হবে তাদের মানুষ হিসাবে কর্তব্যবোধের কথা। নিজেকে দূষণমুক্ত রাখতে পারার ইমিউনিটি গড়ে তোলার কথা। জীবন যে মামুলি স্বার্থসুখী হওয়ার চাইতে আরো বড় কারণে বাঁচা যেতে পারে সে সম্ভাবনার কথা। মনে রাখতে হবে একজন দূষিত শিক্ষক যতটা একজন শিশুকে নষ্ট করতে পারে, সে ক্ষমতা সমাজের হয় তো আর কারুরই নেই। তার বিপরীতটাও সত্য। সুশিক্ষা সু-সিলেবাসে হয় না, সুশিক্ষকের হাত ধরে আসে।

একজন দূষণমুক্ত মানুষের বোধ একটা সমাজের জন্য যে আলো জ্বালাতে পারে, তা কোনো বিজ্ঞান, কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পারে না। আর মানুষকে দূষণমুক্ত করে তার সংশয়। বিশ্বাস না। যা কিছু ধ্রুব বলে দেখানো হচ্ছে তাকে প্রশ্ন করার সাহস। নিজের লোভকে আর বাইরের দূষিত অথোরিটিকে অস্বীকার করার ব্রতে।

21
Tue, 12/10/2024 - 12:31

 

Liberal শব্দটা জন্মেছে ল্যাটিন liber শব্দ থেকে, যার অর্থ free, অর্থাৎ মুক্ত। আর flexible শব্দটা এসেছে ল্যাটিন flectere শব্দ থেকে, যার অর্থ, to bend, নমনীয় হওয়া।

একজন মুক্তচিন্তক আর একজন নমনীয় মানুষের মধ্যে সম্পর্ক কী? একজন মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না। কোনো সামাজিক রীতিনীতিতে বিশ্বাস করে না। কোনো অথোরিটিতে আস্থা রাখে না। সে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে চায়। কিন্তু এসব সে গর্বের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে তাও নয়। সে নিজেকেও নিজের অথোরিটি মানে না। সে নিজের চিন্তাভাবনার নানাবিধ সীমাবদ্ধতা (limitations), সংস্কার (conditionings), পক্ষপাতিত্ব (biasness) ইত্যাদি নিয়েও সচেতন। সে জানে মানুষ এক্কেবারে মুক্ত হতে পারে না। আর কোথাও না হলেও নিজের স্বভাবের ঝোঁকের কাছে (innate nature) অসহায়। কিন্তু সে সবের থেকে নিজেকে মুক্ত করে দাঁড়াতে চায়। অনেকটা ১৯০৩ সালে প্রকাশিত বার্ট্রান্ড রাসেলের A free man's worship বইয়ের আদর্শের মত। সে জানে এক্কেবারে মুক্ত হওয়া অসাধ্য ব্যাপার, কিন্তু তাও সে যতটা পারা যায় প্রাণপণে করতে চায়।

আরেকজন মানুষ তার জন্মলব্ধ সমাজব্যবস্থা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদিকে অস্বীকার করে না। কিন্তু কোথাও তাকে নির্ভুল, ধ্রুব বলেও মানে না। তার সমাজের প্রথা, ধর্মের বিশ্বাসই একমাত্র ঠিক আর বাদবাকি সব ভুল, এ কথা সে বলে না। সে নমনীয়ভাবে দেখতে চায় নিজের বিশ্বাসের সীমাবদ্ধতাকে। সে জানতে চায় নিজের নানাবিধ মূল্যবোধের পাশাপাশি সমাজের অন্যান্য ধারার ধর্ম বিশ্বাস, সমাজ বিশ্বাসের প্রথাগুলোকে। সে নমনীয় বলেই তার অমতের, তার বিশ্বাসের বিপরীত বাস্তবকে সে তুচ্ছ করে না। হেলা করে না। সে প্লুরালিজমে বা বহুত্ববাদে বিশ্বাসী হয়। সহনশীলতায় বিশ্বাসী হয়। গ্রহণে বিশ্বাসী হয়।

একজন স্বার্থবুদ্ধিহীন বা অন্যভাবে বললে, কোনো মতলবহীন মানুষের মুক্তচিন্তক হওয়াতে, কী নমনীয় হওয়াতে সমাজের লাভ। কিন্তু স্বার্থবুদ্ধিতে উদার সাজলে, কী নমনীয় সাজলে, সিউডো-লিবারাল, কি সিউডো-ফ্লেক্সিবল সাজতে গেলে তীরে এসে তরী ডুবে যায়। সমাজের ভীষণ ক্ষতি তাতে।

ভারতের নবজাগরণে প্রাচীনকে নমনীয় করে নবীনের সঙ্গে মেলাবার প্রচেষ্টা হয়েছিল। প্রাচীন ভারতের যা কিছু সঙ্কীর্ণ, ভেদবুদ্ধিতে দুষ্ট, সেগুলোকে সরিয়ে রামমোহন রায় ভারতকে একটা নতুন আলোয় দেখার চেষ্টা করেছিলেন। উপনিষদের সত্য রামমোহনের নানাবিধ ধর্ম-দর্শনের প্রভূত পাঠের মণিমাণিক্যে নতুন আলোয় দেখা দিয়েছিল। তার আগেও ভক্তি আন্দোলনের যুগে একই ঘটনা ঘটেছিল যদিও। শাস্ত্রের কাঠিন্য ভেঙে তাকে মানুষের হৃদয়ের কাছে আনার চেষ্টা করেছিলেন অনেকেই। নানক, কবীর, চৈতন্য, দাদু প্রমুখেরা সেই একই সাধনার পথের পথিক।

সক্রেটিস সেদিনের সমাজের ধর্মবিশ্বাসকে মেনে নিয়েছিলেন, কিন্তু নিজের চিত্তের মুক্ত ভাবনাকে সে সবের দ্বারা জড় করে ফেলেননি। মূল সত্যটাকে ধরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, নিজেকে জানাই মানুষ হয়ে জন্মানোর প্রধান কাজ। ঘাতেপ্রতিঘাতে, আনন্দে-বিষাদে, সফলতা-ব্যর্থতায়, জীবন-মৃত্যুতে ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যে দিয়ে নিজেকে চিনতে হবে। এ এক অসীম পথ। কোনোদিনই সম্পূর্ণ নিজেকে জানা হবে না। কিন্তু নিজেকে জানা ছাড়া নিজেকে শান্ত করার, সার্থক করার আর কোনো উপায় নেই। আছে কি?

একজন মুক্তচিন্তক মানুষ অনেকটা লড়াই করার পর বুঝতে পারে, সে বাইরের সব ধর্মীয়, সামাজিক, নানা প্রাতিষ্ঠানিক অথোরিটিকে অস্বীকার করলেও, নিজের বোধের সীমাবদ্ধতা, সংস্কার আর ত্রুটিপ্রবণতা থেকে মুক্তি কোনোদিন পাবে না। ঠিক তেমনই একজন নমনীয় বিশ্বাসী মানুষও বুঝতে পারে অন্যান্য ধর্ম আর সমাজের বিশ্বাসের সঙ্গে তার ধর্ম-সমাজের তুল্যমূল্য বিচার, সহনশীল আদানপ্রদান ইত্যাদিরও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। তারপর?

মুক্তচিন্তার সীমাবদ্ধতা আর নমনীয়তার সীমাবদ্ধতায় পৌঁছে, দুজন মানুষই দুদিক থেকে একই শূন্যতার সামনে এসে দাঁড়ায়। যে শূন্যতার আরেকটা নাম humbleness. যে humble শব্দটা ল্যাটিন humus শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ভূমি বা মাটি।

অবশেষে মাটিই সত্য, সে তার বুকে রক্তমাংস হাড়মজ্জায় মিশে গিয়েই হোক, অথবা পুড়ে ছাই হয়ে তার বুকে পড়েই হোক। অবশেষে মাটিই সত্য। এই নিজেকে জানার ভিত্তিভূমি।

22
Thu, 12/05/2024 - 10:58

 

আজকাল খুব শিরদাঁড়া নিয়ে কথা হয়। শিরকে যে দাঁড় করিয়ে রাখে সে-ই তো শিরদাঁড়া।

ঝুঁকে পড়া আর নম্রতা কি এক জিনিস? যে বাধ্য মানুষ, আজ্ঞাবহ মানুষ, ওবিডিয়েন্ট মানুষ, সে কি নম্র মানুষও? বিনয়ী কি চাইলেই হওয়া যায়, যদি সত্য অর্থে নিজের সীমাবদ্ধতার, ক্ষুদ্রতার জ্ঞান না থাকে? যে মানুষ কথায় কথায় ঝুঁকে পড়ে, সে মানুষের ভয় আছে, নয় মতলব আছে। ভয় বা মতলব থাকলে কি নিজেকে স্বচ্ছ দেখা যায়? আর নিজেকে স্বচ্ছ না দেখতে পেলে কি সত্য অর্থে নম্রতা জন্মায়? যে মানুষ বিনয়ী, সেকি জানে সে বিনয়ী? যদি জানে, সেটা আদৌ বিনয়? নাকি ফিগার অব স্পিচের মত ফিগার অব বিহেভিয়ার?

খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণ... কেউ বাধ্য হতে বলছেন না। নম্র হওয়ার শিক্ষা দিচ্ছেন। ঈশ্বরের কাছে বাধ্য হওয়া যায় না। নম্র হওয়া যায়। বাধ্য হওয়া যায় অরগানাইজড রিলিজিয়ানের কাছে। নানা মাঝারি গুরু, প্রতিষ্ঠান, নিয়মাদির কাছে। বাধ্য হওয়া যায় আইনের কাছে। কিন্তু নম্র একমাত্র হওয়া যায় ঈশ্বরের কাছে। যদি ঈশ্বর অর্থে বুঝি সত্য। নম্রতা সত্যি সত্যি না জন্মালে সত্যকে অনুভব করা যায় না। না যুক্তিতে, না চিত্তে। অহমিকার মোহে একটা আইডিয়াকে সত্য বলে মনে হয়। যার সঙ্গে বাকি সব কিছুর সঙ্গতি স্থাপন হয় না বলে সংঘাত বাধে। সত্যের ধর্মই সঙ্গতি। সামঞ্জস্য।

বাধ্যতা আর দাম্ভিকতা একই কয়েনের এপিঠ আর ওপিঠ। কথায় বলে শক্তের ভক্ত আর দুর্বলের যম। একই কথা। যে যত দাম্ভিক সে তত বাধ্য। নম্রতা প্রার্থনার বস্তু। আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে। নম্রতা সাধনার সম্পদ।

আমরা সমাজে বাধ্য মানুষ চাই। নম্র মানুষ না। যার লোভ নেই তাকে বাধ্য করা যায় না। যার ভয় নেই তাকে আজ্ঞাবহ করে তোলা যায় না। আমরা ম্যানারিজম এর আছিলায় স্বার্থসিদ্ধির রাস্তা দেখিয়ে দিই। আজ্ঞাবহতা যত বাড়ে দাম্ভিকতাও তত বাড়ে। একদিকে খাওয়া চাবুকের আঘাত, আরেকদিকে ফিরিয়ে দেয় অহং। ঘরের লোক যাকে অত্যাচারি, দুর্মুখ বলে জানে, কাজের জগতে তাকেই মানুষ নম্র, ভদ্র বলে জানে। বলাবাহুল্য যে এখানে নম্রতা মানে আমি অবশ্যই ফিগার অব বিহেভিয়ার বোঝাতে চাইছি।

কোনো বাচ্চাকে শাসনের নাম করে, তার যুক্তিবুদ্ধি, প্রশ্নের ঝঞ্ঝাবায়কে অবরুদ্ধ যদি না করে দেওয়া যায়, তবে ধীরে ধীরে তার মধ্যে একটা সুন্দর, স্বাস্থ্যকর নম্রতার বোধ তৈরি হয়। ভারতীয় দর্শনে একটা সুন্দর শব্দ ব্যবহার হয়েছে এর জন্য, শ্রদ্ধা। এর কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ স্বয়ং স্বামীজি, অরবিন্দ করতে চাননি, আমি আর স্পর্ধা দেখালাম না। শ্রদ্ধা চিত্তকে সত্যকে ধারণ করার যোগ্য করে তোলে। কঠোপনিষদে আছে নচিকেতার মধ্যে শ্রদ্ধা প্রবেশ করল। উপনিষদ বলেন যা দাও শ্রদ্ধার সঙ্গে দাও। যা করো শ্রদ্ধার সঙ্গে করো। শ্রদ্ধার মধ্যে যে ভাবটা সেটাই নম্রতার পূর্ণতা। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা ইংরেজির দৌরাত্ম্যে শ্রদ্ধাকে রেসপেক্ট শব্দে নামিয়ে এনেছি। ফলে একটা সামাজিক আচারের বেশি যেন তার আর কোনো মানে নেই।

শ্রদ্ধা নকল বস্তুতে জন্মায় না। শ্রদ্ধাকে মোহগ্রস্থ করা যায় না। শ্রদ্ধাকে সত্য বিমুখ করা যায় না। মানুষের যা কিছু চরিত্রবল এই একটা শব্দের মধ্যেই আছে - শ্রদ্ধা। স্যামুয়েল জনসন বলতেন, জ্ঞানহীন ইন্টিগ্রিটি দুর্বল, আর ইন্টিগ্রিটিহীন জ্ঞান বিপজ্জনক আর ভয়ংকর।

শ্রদ্ধা এই ইন্টিগ্রিটির জননী। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে যদি আত্মশ্রদ্ধাহীন একটা বৌদ্ধিক কুশলী রক্তমাংসের স্নায়ুচালিত যন্ত্র করে তুলতে না চাই, তবে এখন থেকেই এ নিয়ে তৎপর হতে হবে। নইলে আপেল কেন মাটিতে পড়ল এ প্রশ্ন করার কেউ টিকে থাকবে না। কারণ আপেল গাছই থাকবে না। পরিবেশ-প্রকৃতি দূষণ থেকে চিত্ত দূষণ - একমাত্র রোধ করতে পারে শ্রদ্ধা। শ্রদ্ধা বাজারজাত না, সাধনজাত। ছাপা অক্ষর বদ্ধ না। জ্বলন্ত চিত্তের শিখা থেকে জাত। এর শিক্ষা ঘন্টা মিনিট ধরে ক্লাসরুমে হয় না। আঘাতে আঘাতে, জাগতে জাগতে আসে। যত আঘাত তত জাগরণ। যত জাগরণ তত আনন্দ। তত সঙ্গতি, তত সংহতি।

23
Tue, 12/03/2024 - 10:55

 

আবদারকে সেলিব্রেট করা যায়? যায়। এই একটা দিনে যায়। ভাইফোঁটার দিনে। সেদিন প্রয়োজন মুখ চুন করে ঘরের কোণায় বসে থাকে। সারা ঘর দাপিয়ে বেড়ায় আবদার। প্রয়োজন বলে, লাফাও লাফাও... এই একটাই তো দিন। আবদার বলে, এই একটা দিনের মাহাত্ম্য তুমি বুঝবে না। তুমি হিসাব বোঝো, মাধুর্য বোঝো না।

আজ ফেসবুক জুড়ে অনেক অনেক ছবি। ভাইবোনের ছবি। চোখেমুখে আবদারি আবদারি ভাব। কেউ নাচের ভিডিও দিচ্ছে। কেউ গানের। কেউ হুল্লোড়ের। ভালো লাগছে। তৃপ্তি লাগছে।

আজ একটু বেরিয়েছিলাম। রাস্তাঘাটে ভাইবোনদের সাজ। একসাথে বেরোনো। একসাথে হুল্লোড় দেখলাম। মায়ের মন্দিরে দাঁড়িয়ে, আরতি হচ্ছে। বোন দাদার পাশে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দাদার কাছে গিয়ে, দাদার বাঁ কাঁধটার উপর নিজের মাথাটা রেখে বলল, কদ্দিন পর এলাম বল।

বোনের পরনে নতুন শাড়ি। ভাইয়ের গায়ে নতুন পাঞ্জাবি। তাদের ছেলেমেয়েরা, স্বামী, বউ সবাই আছে এদিক ওদিক ছড়িয়ে। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের ওই আবদারের ওমটাই ঢাকের আওয়াজ, কাঁসরের আওয়াজ, উলুধ্বনি ছাপিয়ে বেজে উঠল।

মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার ভাই নেই? কিম্বা দাদা? শাস্ত্রে পুরাণে কী লেখে সে দরকার নেই.... এমনি এমনি জিজ্ঞাসা করছি.... আছে তোমার?

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি নাট মন্দিরে হইহই করে এলো কচিকাঁচার দল। দারুণ সেজে তারা। আদিবাসী। হাতে থালা বাসন আর চালের প্যাকেট। কোথাও নাচের অনুষ্ঠান ছিল। সেই কর্তৃপক্ষ থেকে ওরা দিয়েছে। বাচ্চাগুলোর আনন্দে ডগমগ চোখের মধ্যে ভেসে উঠল কী মধু! ওদের হাসিতে প্রাণের সবটুকু রস ঝড়ে পড়ছে। শেষ হচ্ছে না তবু। মাকে প্রণাম করে অন্ধকার রাস্তায় মিলিয়ে গেল।

মানুষ সম্পর্ক ছাড়া বাঁচে না। কারুর না হয়ে বাঁচে না। ভালোবাসায় অধীন না হতে পারলে সবটুকু অধীনতার অভাব অর্থহীন হয়ে ব্যঙ্গ করে যেন। সাধক বলে, ঈশ্বরও অধীন হবেন বলে সৃষ্টি করেন। সৃষ্টির অধীনে অধীন হবেন। মাধুর্যে। ভক্তবৎসল নাম হবে। ভক্ত গাইবে, "আহা তোমার সঙ্গে প্রাণে খেলা.... তুমি সাধ করে নাথ ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিও...... "। কী অসম্ভব স্পর্ধা!

ওই যে বললাম, মাধুর্যের কথা। মাধুর্য হিসাবের বাইরের কথা। রসিকের কথা। সেও সত্য। বুদ্ধির অহংকার বোঝে না। বুদ্ধির মুকুরে বোধের উপলব্ধি বোঝে। মোহনায় না এলে সাগর নেই। মোহনা তার অস্তিত্বের অবসান না। পূর্ণতা। আবদার সেই মাধুর্য। আবদার না থাকলে জীবনে রইলটা কী? শুধুই দাবীদাওয়া?

[2 November 2024]

24
Sat, 11/30/2024 - 12:24

 

মানুষের প্রকৃতিতে অব্যবস্থা নতুন কিছু নয়। অব্যবস্থা মানে বলছি ডিজর্ডার। মানুষের প্রকৃতিতে ডিজর্ডার আছে বলেই প্রোভোকেশান মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে একটা মুখ্য ভিলেন। মানুষকে প্রোভোক করা যেতে পারে - এ একটা অবাঞ্ছিত সত্য।

আজকে দুই দেশের মধ্যে যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে তার বহুলাংশ জুড়ে এই প্রোভোকেশান। বিপ্লব, আন্দোলোন, প্রতিবাদ - এই শব্দগুলো ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে। তার যথাযথ কারণ থাকে। একদল অত্যাচারিত হতে হতে, দীর্ঘদিনের লাঞ্ছনা সহ্য করতে করতে তার মধ্যে একটা শক্তি তৈরি হয়, তার জোরে সে রুখে দাঁড়ায়। তার একটা জাস্টিফিকেশান আছে। কিন্তু প্রোভোকেশানের মূল সম্বল - ঘৃণা। বিদ্বেষ।

সংঘাত যখন বিদ্বেষজাত, তার পরিণাম কোনোদিন মঙ্গল হয় না। সংঘাত যখন ন্যায়জাত, তার পরিণাম অবশ্যই শুভ। তার কারণ তার উদ্দেশ্যই ন্যায়গত।

দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ভাগ্য হল তার ধর্ম উন্মাদনা। ধর্ম থাকবেই। কিন্তু তাকে ঘিরে উন্মাদনা সৃষ্টি করা মানে মানুষের ওই অব্যবস্থিত প্রকৃতিকে নিয়ে ধ্বংসাত্মক খেলায় নামা। দক্ষিণ এশিয়া যার সাক্ষী বারবার।

আমার ধর্মবিশ্বাস আমাকে দুই দিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। এক বাইরের দিকে, দল-গোষ্ঠী নির্মাণ করে। দুই, ভিতরের দিকে নিজের প্রকৃতিকে মার্জিত, সুসংযত করার প্রেরণা দিয়ে। মহাপুরুষেরা বলে গেলেন দ্বিতীয়টাই হল আসল ধর্ম। কিন্তু মধ্যমেধা আর স্বার্থবুদ্ধিতে অন্ধ চেতনা বলল, দল বাড়াও, দলে আনো, এই হল জগতের স্রষ্টাকে তৃপ্ত করার আদর্শ উপায়। আর এই আদর্শই হল উৎকৃষ্টতম আদর্শ। সাধারণের ধর্ম সব সময়েই সুপারলেটিভ ডিগ্রিতে চলে। আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ, এই হল মূল চালিকাশক্তি। মহাজনের ধর্মের মূল চালিকাশক্তি প্রজ্ঞা, করুণা, স্বার্থহীনতা। ক্ষুদ্রজনের ধর্মের মূল চালিকাশক্তি ঘৃণা, বিদ্বেষ, নিজেকে নির্ভুল অথোরিটি বিশ্বাস করার চূড়ান্ত মোহ।

বর্তমানে সমাজ দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হল - ইন্টারসেকশনালিটি। সমাজ মানুষের অন্তঃকরণের প্রতিফলন। যেখানে অন্তঃকরণই অব্যবস্থিত, সেখানে হাজার একটা পাঁচিল উঠবেই সমাজে এ অবশ্যম্ভাবী। রবীন্দ্রনাথ অত বছর আগে উগ্র ন্যাশেনালিজম এর নিন্দা করেছিলেন। ধর্মের উন্মাদনার মত, জিঙ্গোইজম একটা উন্মাদনা, যা দেশাত্মবোধের হাত ধরেই জন্মায়। কিন্তু ক্রমে তা অন্য দেশের উপর তীব্র, ঘৃণা আর বিদ্বেষে প্রতিফলিত হতে থাকে।

নানা ধর্মের সমন্বয় আর পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সহবাস নিয়ে ভারতের মাটিতে যত প্রচেষ্টা হয়েছে আমার জ্ঞানত বিশ্বের অন্য কোথাও এই মাত্রায় তা হয়নি। ধর্মের প্লুরালিজম আর বৈচিত্র্য নিয়ে আলোচনা পাশ্চাত্যে পণ্ডিতদের কাজ। কিন্তু এদেশে নিরক্ষর সাধক থেকে শুরু করে সাধক-কবিদের গানেও বারবার সমন্বয় আর সহনশীলতার কথা উঠে এসেছে। আধুনিক যুগে শ্রীরামকৃষ্ণ, রমণ মহর্ষি, শিরডির সাঁইবাবা প্রমুখ জনমানসকে প্রভাবিত করা সাধকদের জীবনেও একই সত্য প্রতিফলিত হয়েছে। এঁরা কেউ কোনো বই লেখেননি, কিন্তু জীবনের মূল কাজটাই ছিল মানুষের প্রকৃতির মধ্যে অন্যের আদর্শকে ছোটো দেখানোর নিম্নবৃত্তিকে দূর করা। মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, সুভাষ বোস, অনুকূল ঠাকুর প্রমুখ লোকনেতাদের জীবনে, সিদ্ধান্তেও ভীষণভাবে একই সত্য প্রতিফলিত হয়। ফলে ভারতের মাটিতে একদেশী ধর্মকে কায়েমি করার চেষ্টায় কয়েকটা বিচ্ছিন্নমূলক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটলেও মূল ভাবটা সহনশীলতারই।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারত গুরুত্ব দিল একটা বলিষ্ঠ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে। যার মূল কথা হল সর্বধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা। কিন্তু দুই প্রতিবেশী দেশে স্বাধীনতার পর থেকে সঠিক অর্থে গণতন্ত্রই প্রতিষ্ঠিত হতে পারল না। সেক্যুলারিজম নিয়ন্ত্রিত সংবিধান আর ধর্ম শাসিত সংবিধানের মধ্যে যে পার্থক্য তা-ই ভারতের সঙ্গে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে হল। দুর্ভাগ্য যা, তা হল ওদিকে কোনো বাবাসাহেব আম্বেদকর জন্মালেন না। যে বাবাসাহেব হিন্দুধর্মের অত্যন্ত কড়া, কিছু ক্ষেত্রে রূঢ় সমালোচক ছিলেন, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে তাঁর হাতে পড়ল আমাদের স্বাধীন দেশের ভিত্তি রচনার ভার। তার প্রতি ভারতের যে আনুগত্য তা যিনিই গত লোকসভা নির্বাচনকে কাছ থেকে লক্ষ্য করেছেন তিনিই অনুধাবন করতে পারবেন।

আজকে ভারতের মাটি ভীষণ দৃঢ় দুই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে, এক, ধর্মের নানাবিধ সমন্বয়ের সাধনায় অর্পিত জীবনের সত্যে আর দুই বাবাসাহেবের দ্বারা রচিত সংবিধানের প্রাণশক্তিতে।

রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার দায় সংবিধানের, আইনের। যদি তা সদুদ্দেশ্য নিয়ে বাস্তবায়িত করার শুভ ইচ্ছা থাকে। নইলে আফগানিস্তান আর নর্থ কোরিয়াও তো আছে উদাহরণ হিসাবে, রাষ্ট্রকে অমানবিক, বর্বরোচিত প্রবলের দ্বারা নির্মিত স্বেচ্ছাচারিতায় চালালে কী পরিণাম হয় তার। চীন, রাশিয়াও উদাহরণ আছে। গণতন্ত্র যদি ধর্ম অথবা কোনো দলীয় ক্ষমতার পায়ের নীচে বসে তবে তা দুর্দিনেরও বেশি।

আর একটা কথা হল, যদি রাষ্ট্রের নির্মাতাকে নির্লজ্জের মত গোটা বিশ্বের সামনে প্রকাশ্যে অপমান করতে না বাধে, তবে যে কাউকে অপমান করা অনেক সহজ হয়ে যায়। ওই যে বললাম, দুর্ভাগ্য সে দেশগুলো একজন আম্বেদকর পায়নি, পেলে হয় তো ইতিহাসটা অন্যরকম হত। কিন্তু প্রশ্ন আরেকটাও, আম্বেদকরকে ধারণ করার মাটিও কি আদৌ ছিল?

25
Thu, 11/28/2024 - 12:19

 

ন্যারেটিভের বাংলা করি ব্যাখ্যাপট। জীবনটাকে কী ব্যাখ্যাপটে দেখছি? আনন্দে, না বিষাদে? আনন্দ বলতেই কি হাসি হাসি, ঢলো ঢলো মুখ? আর বিষাদ মানেই কি গম্ভীর, খোঁচা খোঁচা দাড়িওয়ালা ঝুলে পড়া মুখ? উঁহু। এগুলো থিয়েটারি এক্সপ্রেশান। বাস্তবিক না। অভিনয়ে বোঝাবার জন্য ওসব। জীবন বাঁচার জন্য। বাঁচতে গেলে কাকে আর কী বোঝাব? নিজেই কিছু বুঝে উঠতে পারা যাচ্ছে না, আবার অন্যকে নাকি বোঝাব!

তবে আনন্দ আর বিষাদকে কি বাইরে থেকে জানা যায়? সাধারণভাবে এর উত্তর - না। হাসিমুখের আড়ালে বিষাদ লুকিয়ে থাকে। আবার গম্ভীর মুখের আড়ালে আনন্দ পেঁজা পেঁজা জমে থাকে। পাহাড়ের কোলে কোলে কুয়াশার মত।

এই আনন্দ আর বিষাদ কি ব্যাখ্যাপটের উপর নির্ভর করছে? সাধারণভাবে উত্তর দিলে, করছে। আমি আমার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে কী আঙ্গিকে দেখছি? অতি-মূল্যায়ন করছি, না অব-মূল্যায়ন করছি? কিম্বা আদৌ মূল্যায়নই বা করতে চাইছি কেন? যা ঘটেছে তার যদি কোনো মূল্যায়নই না করি, খুব কি অসুবিধা হবে? মূল্যায়ন করতে গেলেই কোনো না কোনো একটা ব্যাখ্যাপট তো এসেই যাবে। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির জগতে কোনো ব্যাখ্যাপটই কি নির্ভুল, সামঞ্জস্যপূর্ণ? জীবনটাকে যদি সব ধরণের ব্যাখ্যাপট থেকে সরিয়ে বাঁচতে চেষ্টা করি, কেমন হবে? যা ঘটেছে, ঘটেছে। যা লাভক্ষতি হওয়ার, হয়েছে। ব্যস। সুখ-দুঃখ যা পাওয়ার পেয়ে চলেছি। এরপর আবার কী? এর জন্য নিত্যনতুন ব্যাখ্যাপট আমদানি করে কী হবে?

যদি সব ব্যাখ্যাপট সরিয়ে দিই তখন কী হবে? মন জেটির মত শান্ত হবে। দুলবে, কিন্তু ছিঁড়ে ভেসে যাবে না। একটা দাঁড়ানোর জায়গা হবে।

অ-সাধারণ জীবন নিয়ে হবেটা কী? তার চাইতে একটা সাধারণ জীবনের সুখ তো ঢের। চিন্তা সব সময় নিজেকে অসাধারণ, ব্যতিক্রমী ভাবতে চায়। নইলে তার গুমোর থাকে না। এই চিন্তার দোসর হল নানা অনুভব আর তার অভিজ্ঞতার মালা। মুখে বলছে আমি অতি সাধারণ, কিন্তু মনে মনে ঠিক জেনে বসে আছে এমন চিন্তা, এমন অনুভব এ শুধু আমারই হচ্ছে। কারণ আমি কোথাও সবার থেকে একটু আলাদা!

এই এক মজাদার ব্যাখ্যাপট। আমি নিজেকে অসাধারণ বলছি না, আমি নিজেকে বলছি, আমি একটু আলাদা। সবার মত ঠিক নই। ব্যস, ইঁদুর কলে ঢুকেও পড়েছে আর কল বন্ধও হয়ে গেছে। এবার ঠেলা সামলাও।

কিন্তু আমি যদি আমার চিন্তাজাত, মনের দীর্ঘদিনের অভ্যাসগত ঝোঁকজাত নানা ব্যাখ্যাপটকে আমল না দিই? সে সব আসবে আসুক, কিন্তু আমি যদি আমল না দিই? একটা ম্যাজিক ঘটে যাবে অন্তঃকরণে। জেটির উপর সাদা পায়রা এসে বসবে। মন শান্ত হবে।

জেটি কেন বলছি? তা জেটি বলব না তো কী বলি? কত মানুষ এলো গেলো। কার নৌকা, কি জাহাজ, কি ডিঙি কদ্দিন আমার কূলে বাঁধা থাকবে আমি কি জানি? সুখদুঃখের ডেলিভারি আমার জেটিতে কখন কোন জাহাজে আসবে আমি আগে থেকে জানতে পারি? কিচ্ছু জানতে পারি না। যা ডেলিভারি আসবে কাগজে সই করে সে নিতেই হবে। আর যে চলে যাওয়ার তার নৌকার বাঁধন আলগা করে তাকে বিদায় দিতেই হবে। তার নৌকার বাঁধনের ফেলে যাওয়া রশির টান বুকে মোচড় দেবে ঠিকই, কিন্তু কতদিন? একদিন না একদিন তো মেনে নিতেই হবে!

সেই জন্যেই বললাম, জেটি। জেটি থাকুক। কিন্তু কোনো নৌকার আসা যাওয়ার ব্যাখ্যাপট না থাকুক। মন এক অসীম শূন্যের প্রেক্ষাপটে সব দেখুক। সে শূন্যকে সে ঈশ্বর, মহাকাল, কি শুধুই শূন্য বলুক না হয়। কিন্তু একটা কথা সত্য, সে আকাশের মত নির্বিকার। বাতাসের মত অনাসক্ত। জীবনটাকে সাধারণ থেকে অসাধারণ বানানোর চক্করে তো এতগুলো দিন নষ্ট হল। কী হল? শেষে বাঁশ আর কাদা কাদা ঘরময়। বিসর্জনের বাজনাও গেছে থেমে। থাক থাক ওসব। সব ব্যাখ্যাপট মহাশূন্যে হোক লীন। যা আছে, এই তো সামনে আছে। যা ঘটছে, এই তো সামনে ঘটছে, স্পষ্ট। সুখদুঃখ, লাভক্ষতি সব তো স্পষ্ট। এর ওর সঙ্গে তুলনা করে, এর ওর ব্যাখ্যাপটে নিজের জীবনের ঘটনাবলীর সারাংশ খুঁজে লাভ কী? কিস্যু মিলবে না। শেষে সব ফাঁকি মনে হবে।

যখন সেই শূন্যের ব্যাখ্যাহীন প্রেক্ষাপটে নিজেকে দেখব, তখন কি সে বিষাদের ধুন বাজাবে অবিরাম জীবনে? একদম না। বাউলের একতারার মধ্যে একটা ভীষণ সহজ সুর আছে। সে আর কিছু না, প্রতিদিন সকালে এই ধুলোকাদা মাখা পৃথিবীর উপর এসে পড়া আলোর মত, সহজ আনন্দ। সেটুকু থাকবেই। যদি না চিন্তাকে লোলুপ হাঙরের মত আবার মাথার মধ্যে ছেড়ে দিয়ে বলি, বল তো চিন্তা আমি অসাধারণ নই?

26
Sun, 11/17/2024 - 11:36

 

আজ টাইমস অব ইন্ডিয়ায় সোশ্যাল মিডিয়ায় হিন্দুধর্মের ধ্বজাধারী হিসাবে শিশুদের ব্যবহার করা নিয়ে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এসবের বাড়বাড়ন্ত বেশ কয়েক বছর ধরে হচ্ছে এটা স্পষ্ট। তরুণরা ডেইলি ব্লগ না ভ্লগ কী একটা বানাচ্ছে। ঘুম থেকে কাকভোরে উঠছে, স্নান করছে, ঠাকুরঘরে যাচ্ছে, কীর্তন করছে, মালা জপ করছে, নিরামিষ খাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

এককালে বিজ্ঞাপনে বাচ্চাদের ব্যবহার করা নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। কেউ শোনেনি। আজও বহু বিজ্ঞাপনের শিশুদের ব্যবহার করা হয়। কারণ? ওতে মানুষের মনে ছাপ পড়ে বেশি।

আসলে যা কিছুই কোনো -ইজম এর চোখে দেখা হয় সেখানেই একটা অর্ধসত্য ধরা পড়ে। রিলিজিয়ন, ফেমিনিজম, কমিউনিজম ইত্যাদি ইত্যাদি যা-ই বলি না, সেখানে আগ্রহটা প্রি-ডিটারামাইণ্ড, অগত্যা সত্যের খণ্ডাংশ দেখাই বাস্তব।

আশঙ্কা, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা ইত্যাদির সঙ্গে যোঝার পদ্ধতি সবার তো একরকম নয়। সব কিছুর মূলে আছে মানুষ আর তার বিচিত্র মন। বিচিত্র বলতে বলছি বৈচিত্র্যময় মন। তার গতিবিধিকে একটা দাগে টেনে এই হল ঠিক, আর বাদবাকি সব ভুল বলা সম্ভব নয়। মানুষের সুখ, আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু আশঙ্কা, অ্যাংজাইটি? সেটা চিরকালের। কারণ ওই মন। আশঙ্কা, অ্যাংজাইটি তৈরি করে মন। তার অসম্ভব কল্পনাশক্তি।

মানুষ তার বাস্তব সমস্যার সমাধান বাস্তবেই খুঁজে নেয়। বাড়ি ভাঙলে মিস্ত্রী ডাকে। অসুস্থ হলে হাসপাতালে যায়। কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে কোনো অমঙ্গল না হয় তার জন্য? সে তার কাল্পনিক দেবতার শরণাপন্ন হয়। হোমযজ্ঞপুজো করে। তার কাল্পনিক আশঙ্কার জন্য কাল্পনিক দেবতার আবাহন। এ মনোবিজ্ঞানের বোঝার জিনিস। নিন্দামন্দ করে এর থেকে মানুষকে বার করা যায় না। যে মানুষ তার প্রিয়জনকে হারিয়ে দেবতার কাছে তার দেহান্তরিত অস্তিস্ত্বের জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছে, সেও মনোবিজ্ঞানের বোঝার জিনিস। তাকে নিন্দা করে, মূর্খ দেগে কিছু হয় না। কারণ এটাই ধ্রুব যে কোনো মানুষ কোনোদিন সার্বিকভাবে মূর্খত্বের ঊর্ধ্বে হতে পারবে না। মানুষ এমনভাবেই কণ্ডিশণ্ড। আমি সব বুঝে ফেলেছি, আর তুমি ব্যাটা মূর্খ কিচ্ছু জানো না - এ মানসিকতা একজন ডিক্টেটর হওয়ার মানসিকতারই লাইট ভারসান।

সোশ্যাল মিডিয়ায় যা হচ্ছে, সেগুলো আত্মপ্রচার আর অর্থলাভের টেকনিক। তবে এ নতুন কিছু না। ধর্মকে পুঁজি করে অর্থলাভের প্রথা বিশ্বজুড়ে বহু প্রাচীন। যে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের পার্থিব ঐশ্বর্য দেখলেই তা সহজে অনুমেয়। কিন্তু আমরা সে সবের দিকে চোখ বন্ধ করে রাখি। আমরা ভাবের ঘরে চুরি করে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ, ও হতেই পারে। যে মানুষ একটা দামী গাড়ি চেপে এসে জগতের সব পার্থিব সুখ ত্যাগ করতে উপদেশ দেয়, আমরা অনায়াসে তার পা ধোয়া জল খেয়ে তাকে তার দামী গাড়িতে চাপিয়ে তাকে গুরু বলে মেনে নিই, কারণ আমার বিশ্বাস সে মানুষটা অধ্যাত্মিক ক্ষমতাসম্পন্ন।

হ্যাঁ, এই আরেকটা সুত্র - ক্ষমতা। আমি যেহেতু ক্ষমতা ভালোবাসি, তাই আমি অর্থ ভালোবাসি, রাজনৈতিক উচ্চপদ ভালোবাসি, কর্মক্ষেত্রে উচ্চপদ ভালোবাসি, তেমনই অধ্যাত্মিক আধিকারিক পুরুষকেও ভালোবাসি। কারণ আমার লোভ। ক্ষমতার প্রতি আমার লোভ।

লোভ কি বাস্তব নয়? আলবাত বাস্তব! তবে সমস্যা কী? সমস্যা হল শিক্ষা।

একজন মানুষের দুটো জিনিস শিখতে হয়। একটা স্মৃতি নির্ভর নানাবিধ তথ্যজ্ঞান এবং নানা স্কিল বা প্রযুক্তির কৌশল, যা দিয়ে সে প্রফেশনাল হয়ে ওঠে। আরেকটা জীবনকে শেখা। বাঁচতে শেখা। ঘাতেপ্রতিঘাতে বাঁচতে শেখা। ধর্মীয় নানা প্রচলিত মত, নানাবিধ সামাজিক, রাজনৈতিক ইজম, অ্যাজেণ্ডা ইত্যাদি সরিয়ে খাঁটি জিনিসটা জানতে শেখা। বুঝতে শেখা। সেই আলো অনুযায়ী বাঁচতে শেখা।

এই শেখার রাস্তা আটকে দাঁড়ায় আমার লোভ, আমার ভয়, আমার অন্তহীন চাহিদা। আমার কিছু হোক আর আমি কিছু হই। আমি হই সফল। ওরা হোক লুজার।

আমার কিছু হোক, আর আমি কিছু হই - এ এক মায়াবী ফাঁদ। গোটা বিশ্ব এর বাইরে তার বাস্তবতা নিয়ে দাঁড়িয়ে। আমার তাতে কোনো আগ্রহ নেই। আমার ইচ্ছা এগুলোতে, আমি কিছু হই আর আমার কিছু হোক।

এ কি অন্যায়?

কেন অন্যায় হবে? কিন্তু এর সঙ্গে প্যাকেজে ওই অ্যাংজাইটি আর আশঙ্কার পুনঃ পুনঃ আগমন কোনোদিনই শেষ হবে না। আমার আমাকে ঘিরে সাধ যত তীব্র ওদের দংশন ঠিক ততটাই তীব্র।

এর বিপরীতে আছে জীবন শিক্ষা। যেখানে জীবন খোলা মঞ্চে আহ্বান করে বলছে, ফাঁকা স্লেট নিয়ে এসো। যে স্লেটে কোনো হিসাব, কোনো মন্ত্র, কোনো তত্ত্ব থাকবে না। সব আমি হাতে ধরে শেখাব। তুমি অনুভব করবে তুমি আর বাদবাকি এই মানবজাতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এ এক সমুদ্র। তুমি তার ঢেউমাত্র। গোটা মানবজাতটাই তোমার রক্তে স্পন্দিত হচ্ছে। তুমি গোটা মানবজাতির মধ্যে স্পন্দিত হচ্ছ। তোমার ও ব্যক্তিগত লাভলোকসানের হিসাব বড্ড তুচ্ছ। যদি সহ্য করে নিতে পারো বাইরে এসো। গোটা জীবন বাঁচো। নইলে রাতদিন এক টুকরো সুখ আর সুখের চারপাশে ঘেরা হাজার লক্ষ দুশ্চিন্তা, ভয় আর অ্যাংজাইটির বাদুড় চামচিকে নিয়ে বাঁচতে হবে। বাইরে দেখাবে তুমি সুখী। কিন্তু অন্তরে জানো কীসে পুড়ে যাচ্ছ তুমি রাতদিন। তুমি ঠিক করো তুমি কী করবে।

মন প্রবল ভাবনায় পড়ে। বুদ্ধি দিয়ে বুঝছি ঠিক। কিন্তু আমার চিত্ত কি এতটাই প্রস্তুত? কোনো মধ্যপথ নেই?

জীবন বলে, ভালোবাসলে সবটাই সোজা। কিন্তু আসক্ত হয়ে থাকলে ভীষণ দোটানা। ওদিকে প্রাতিষ্ঠানিক গুরু বলে, আমার কাছে এসো, এই নাও মন্ত্র, এতে তোমার সার্বিক মঙ্গল হবে। যাও নিজের ঘরে যাও। তোমার মঙ্গল হবে বলেই আমার আসা।

কিন্তু সবার মঙ্গল না হলে আমার মঙ্গল হয় কী করে?

এ প্রশ্ন কেউ করে না। যে সবার মঙ্গল চায় সে দেবালয়ে দাঁড়ায় না। সবার মধ্যেই তার বাস। কারণ যার মঙ্গল চাইছে আর যে মঙ্গলময় তাকে সে এক করে দেখছে। সেই দেখাতেই মঙ্গল। নইলে সবার মঙ্গল করো কথাটা মুখের কথা হয়ে দাঁড়ায় বা ক্ষণিক আবেগের। রাশিয়া ইউক্রেনকে তার মঙ্গলের বাইরে জেনেছে। ইজরায়েল প্যালেস্টাইনকে। প্রতিবেশী প্রতিবেশীকে। আত্মীয় অন্য মানুষকে। এক পাড়া আরেক পাড়াকে। এক প্রতিষ্ঠিত ধর্ম আরেক ধর্মকে। এক দেবতা অন্য দেবতাকে। ফলে মঙ্গল শতধা হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে কোথায় নীতি? কোথায় সততা? এ তো মতলব আর ক্ষুদ্র প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ! “হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান”?!

27
Thu, 11/14/2024 - 11:29

 

এখন অতিথি মানে তো আর অ-তিথি না। সেলসম্যান, চাঁদাম্যান ইত্যাদিরাই অ-তিথি। বাকি অতিথির আনাগোনা আর কই? নিজের লোকই বাড়ি আসার কারণ খুঁজে পায় না, তো দূরের লোক।

মোদ্দাকথা তিথিহীন আগমন নেই আর। দু'দিন আগে ছটপুজোর দিন দুই বৃদ্ধ গল্প করছেন, সন্ধ্যেবেলা চায়ের দোকানে বসে... বলছেন, আচ্ছা, ওদের যেমন ছটপুজোয় এত এত বিশেষ ট্রেন দেওয়া হয় দিল্লি, বোম্বে, আমেদাবাদ.. এইসব জায়গা থেকে... বাঙালিদের দুর্গাপুজোয় কী এইভাবে এত এত পুজো স্পেশাল ট্রেন দেওয়া হয়? এইভাবে মারামারি করে বাঙালিরা ট্রেনে ওঠে বাড়ি ফেরার জন্য? বাড়ি ফেরার তাগিদ এইভাবে পদপিষ্ট হয় বাঙালিরা?

আমি শ্রোতা। চায়ের দোকানে কত কথাই তো হয়। ওসব নিয়ে তর্ক করতে নেই। ওসব যুক্তির কথা তো নয়, এমনি এমনিই কথা। নইলে এইবারে পুজোয় এয়ারপোর্টে কত রেকর্ড 'ফুটফল' হয়েছে খবরের কাগজে বেরিয়েছে না? তারা আবার সার বেধে পরিযায়ী পাখির মত এয়ারপোর্টে ভর করে উড়ে গেছে তাও তো বেরিয়েছে। বাঙালিরা কী আর যে সে কাজ করে এদেশ ওদেশ? তাদের জন্য থোড়ি অমন শামিয়ানা খাটাতে হয় স্টেশানের বাইরে? তারা কত আগে রিজার্ভেশন করে প্লেনে, ট্রেনে। মোট কথা বাঙালিদের আবেগের মূল্য আলাদা। সে একটা ক্লাসে বিরাজমান। এই তো ক'দিন ধরে বাঙালি উচ্চমানের বুদ্ধিজীবীরা কি সুন্দর ছটপুজো, ঠেকুয়া নিয়ে মজা-তামাশা করা পোস্ট দিচ্ছিল। বুদ্ধিজীবীরা শ্রমজীবীদের অকৌলিন্য নিয়ে তামাশা করবে, নইলে ওদের কথা ভেবে রাজনীতি করবে, এই তো প্রথা। নইলে সমান সমান ভাবার কী মানে? তাই কী ভালো লাগছিল পোস্টগুলো দেখে। সত্যিই তো, আমার শিক্ষা, আমার উদারতা অন্যকে ছোটো, অপাঙক্তেয় করে দেখানোর মত করে যদি বড় না-ই হল, আন্তর্জাতিক না-ই হল, তাহলে চুনকালি অমন মান-খ্যাতির মুখে।

যা হোক, সেই বৃদ্ধ দু'জন বলছিল, তাদের পরিচিত কারা কারা ফিরে এসেছে পুজোয়। চা শেষ হল, কিন্তু তাদের গল্প শেষ হল না।

একজন উঠতে উঠতে বলল, উঠি, তোমার বৌদির ইচ্ছা হয়েছে আজ মোমো খাবে। খাক্‌। গোটা পুজোটা তো বুড়ো-বুড়ি একাই কাটালাম।

আরেকজন বৃদ্ধ বললেন, শীতে তো যাও.... এবার যাবে না?

দেখি.....

একরাশ অভিমান ছুঁড়ে রেলের কারখানার পাশ দিয়ে সাইকেলটা গড়িয়ে দিল। অন্ধকারে মিশে গেল সাইকেল। গেট পড়ছে। ট্রেন আসবে।

আরেকজন বৃদ্ধকে চাওয়ালা বলল, যাও.... চোখে তো ভালো দেখোও না.....

সে বলল, হ্যাঁ রে যাই..... কিন্তু ওর তো তাও অপেক্ষা করার লোক আছে.... আমার তো....

শেষের কথাগুলো সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে। আমার অস্বস্তি লাগতে শুরু করল। আমি জানি উনি এমনিই আমার দিকে তাকালেন। একা মূল উৎপাটিত মানুষ যে কোনো মানুষের দিকে তাকিয়েই নিজের কথা বলতে পারে। কিন্তু মনে হল এতক্ষণের সব কথা যে শুনছিলাম সেটাই যেন ধরা পড়ে গেছি। আমি তাড়াতাড়ি পকেট থেকে মোবাইলটা বার করে মন দেওয়ার চেষ্টা করলাম। উনি সাইকেলটা ধরে দাঁড়িয়ে। বলছেন, গেটটা উঠুক... আপ শান্তিপুর মনে হয়..... যাক, যাচ্ছি....

ফিরতে চাইছে না। বুঝলাম। এতবড় জীবনের, এত সংগ্রামে, শখে, ইচ্ছায় বানানো সংসারেও মানুষের একদিন ফিরতে ইচ্ছা হয় না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই, নইলে যাবে কোথায়? আর ভাঙাবাসার, ডানাভাঙা মানুষের জায়গা কোথাতেও হয় না। সে কি ও নিজেও জানে না?

28
Mon, 10/28/2024 - 12:18

 

বাঙালি ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের ব্যাখ্যায় মা কালী বহুবার চর্চিত হয়েছেন। মা কালীর স্তন, নগ্নতা, বীভৎসতা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রেক্ষাপট থেকে আলোচনা হয়েছে। কথামৃততেও আছে, ডাক্তার বলছেন কালী তো একজন সাঁওতালি মাগী। ঠাকুর হাসছেন।

গতকাল ‘এই সময়’ কাগজেও এক পাতা জুড়ে মা কালীর নাকে মাছি বসিয়ে কী সব দুর্গন্ধ, ঘাম, শ্রমজীবী ইত্যাদির সঙ্গে আগমবাগীশ, তন্ত্র ইত্যাদি মিলিয়ে ইয়াব্বড় একটা লেখা হল দেখলাম। ছবিটা যদিও ভালো লাগল না। কিন্তু এ ভাবে দেবদেবী নিয়ে বিকৃতভাবে ছবি তো আমাদের আজকে বলে না, আগেও আঁকা হয়েছে। সাধারণত এগুলো নিয়ে খুব একটা কেউ মাথা ঘামায় না। ঠিক যেমন প্রতিবেশী দেশে হিন্দুদের সঙ্গে কী হচ্ছে সে নিয়েও এদিকের লোকজন অত ঘামান না। সেই জন্যেই সেই নন-ইন্টেলেকচ্যুয়াল সংক্রান্ত ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার সংলাপটা আমার খুব ভালো লাগে। আসলেই এই সব নন-ইন্টেলেকচ্যুয়াল ইস্যু নিয়ে কথা বলতে আমরা বাঙালিরা ভালোবাসি না। মানে ভদ্রলোক শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন বাঙালিদের কথা বলছি।

কিন্তু মা কালীর এই শাস্ত্রীয় অ্যান্থ্রোপলজিকাল ব্যাখ্যা ছাড়া ইন্টেলেকট এটা বুঝে পায় না, এত বীভৎস রসের দেবী কী করে নন-ইন্টেলেকচ্যুয়াল বাঙালির মা হয়ে গেলেন। বাঙালি আর যা হোক, মারকুটে, দাপুটে বলে তো পরিচিত নয়। হিংসুটে, ঝগড়ুটে, তর্কুটে, মায় কুচুটে বলেও নিন্দুকেরা বলে। কিন্তু প্রশংসকেরা শান্ত, ভদ্র, ইন্টেলেকচুয়াল, সংস্কৃতি প্রিয় মানুষ হিসাবেই দেখে। কিন্তু এমন একটা জাতের মা কী করে হয়ে গেলেন কালী। যিনি নগ্না। যিনি মুণ্ডমালা গলায়। খাঁড়া হাতে। ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা কোমল মাতৃরূপ তো নয় মোটেই। বাংলায় কী করে দেবীপুজোর প্রাধান্য হল, বৌদ্ধযুগের পরে পরে তন্ত্র কীভাবে বাংলায় ছড়িয়ে ছিল, কী ভাবে সে সব আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হল, এ সব আছে। কিন্তু বাংলার সেন্টিমেন্টে “মা” ডাকের জায়গা কী করে তৈরি হল, সেটা কি ইন্টেলেক্ট জানতে পারে? তারাদেবী তো বৌদ্ধমতের থেকে। কই বৌদ্ধদের জগতে তো কোনো কমলাকান্ত, রামপ্রসাদ, প্রেমিক জন্মালো না। কেন? মাতৃভাবের এমন কোমল, ঘরের ডাক তো মা মেরীও শুনলেন না। কেন তবে কালী শুনলেন? কেন মা জগদ্ধাত্রী, মা লক্ষ্মী, মা দুর্গা যিনি নাকি বাঙালির সব চাইতে বড় উৎসবের কেন্দ্র বিন্দু, তিনিও সে ডাকের কাছাকাছি এলেন না, যা মা কালী এলেন। কেন?

এর উত্তর নেই। তর্ক আছে অনেক। কিন্তু উত্তর নেই। আগমনীতে দুর্গা ঘরের মেয়ে হলেন। কিন্তু মা কালী আদতে মা'ই হলেন। কী করে?

একবার দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের নাটমন্দিরে বসে আছি। সন্ধ্যার সময়। গান হচ্ছে। শনিবার। বেশ ভিড়। একজন গাইছেন “মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে, মা'কে মনে পড়ে আমার মা'কে মনে পড়ে।”

একজন ভদ্রলোক, বয়স্ক, সস্ত্রীক বসে আছেন। গানটা হতে হতে দেখলাম, সেই ভদ্রলোক নাটমন্দিরের থামে হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। পাশে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে গেছে। অদূরে গঙ্গা। দক্ষিণেশ্বেরের মন্দিরের মাথায় আধখানা চাঁদ। সামনে ভবতারিণী দাঁড়িয়ে। পুজো চলছে। কিন্তু এ গান তো শ্যামাসংগীত নয়। তবে? এত অনায়াসে এ গান কী করে গাওয়া হচ্ছে এখানে? এর উত্তর বুদ্ধি জানে না। হৃদয় জানে। কিন্তু হৃদয়কে জানি - এ কথা কোন পাগলে বলবে?

কদিন আগে দুর্গাপুজো গেল। কাঁচরাপাড়ায় ভিড় থিকথিকে বাজার দিয়ে হেঁটেছি, নিয়মমাফিক সেই বাঁধাধরা গান বেজে যাচ্ছে কিশোর, মান্না, আরো আরো সব। কানে আসছে, প্রাণে তেমন কিছু সাড়া নেই। বরং শব্দের উৎপাতই লাগছে। কিন্তু দুদিন আগে সেই বাজার দিয়েই হাঁটছি। সেই ভিড়। কোনো এক বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাঝে মাঝেই শ্যামাসংগীত চালাচ্ছে। আমি খেয়াল করলাম যে দোকানি ফাঁকা বসে আছে, যে টোটোওয়ালা একা বসে আছে, যে মানুষ একা হাঁটছে, তাদের কারুর কারুর ঠোঁটের চলনে গানের অনুপ্রাস। অবশ্যই সবাই কোরাসে গাইছেন না। কিন্তু কোথাও যে একটা সাড়া জাগছে এ ভাবটা স্পষ্ট। কালীপুজোয় চাঁদার জুলুম, বাজির উৎপাত, নেশাভাঙের উৎপাত - সব আছে। আবার মা ডাকের একটা আনন্দও আছে। কী করে হল এটা? কালী কলকত্তেয়ালী হল কী করে? ভারতের এখানে সেখানে বাঙালিকে ঘিরে কালীবাড়ি, বাঙালির পরিচিতি তৈরি করল কী করে? বৈষ্ণবের কীর্তন। ব্রাহ্মের ব্রহ্ম। সব ছিলেন। আছেন। কিছু আবার নেইও। কিন্তু এই “মা” ডাকটা কি গোটাটাই শাস্ত্রীয়? তা তো নয়। বাঙালি দুর্বল বলে “মা মা” করে না। বাঙালি তো মা'কে আনন্দময়ী, চৈতন্যময়ী বলে ডেকেছে।

তবে? আবারও বলছি, বাইরে থেকে এ পুজোর দৈবী-অ্যান্থ্রোপলিজকাল ব্যাখ্যা, তর্ক অনেক আছে। কিন্তু প্রাণের ডাকের কাছাকাছি কী করে এলো, সে জানা যায় না। প্রাজ্ঞ মানুষেরা বলেন জ্ঞানহীন অবস্থা ভ্রান্ত জ্ঞানের থেকে অনেক ভালো। তাই “জানি না” শব্দটা অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয়।

হতে পারে আমি এই সেন্টিমেন্টের অংশী নই। হতে পারে আমি এ সবকে বাইরে থেকে জানি। তথ্যগতভাবে জানি। পরিংসখ্যানগত ভাবে বুঝি। কিন্তু চট করে একটা বিকৃত ছবি আঁকার আগে যেন এইটুকু ভাবি, এই সংস্কৃতিটা একটা বৃহদাংশ মানুষের নির্দোষ অনুভবের সঙ্গে জড়িয়ে। অন্যের উদারতা যেন আমার সংযমের কারণ হয়, স্বেচ্ছাচারিতার না। এইটুকুই বলার। আর শৈল্পিক স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্য যদি এইটুকু ক্ষেত্রই অবশিষ্ট থেকে থাকে, তবে বলব, ভালো, কিন্তু আরেকটু সংবেদনশীল হলে আরো ভালো। নইলে কাজটা সমীচীন হয় না। একরোখা হয়ে যায়।

(ছবিটা হালিশহর রামপ্রসাদ ভিটের প্রসাদময়ী মায়ের ছবি। ওঁদের পেজ থেকে প্রাপ্ত।)

29
Sun, 10/27/2024 - 12:15

 

“Minds, however, are conquered not by arms, but by love and nobility” - Spinoza

জীবনের নিজস্ব একটা আবেগ থাকে। ঠিক ইমোশান, সেন্টিমেন্ট বলতে যা বোঝায় তা নয়। নিজের মধ্যে নিজের একটা আবেগ। হয় তো একেই রবীন্দ্রনাথ “আনন্দ” বলেছিলেন। উপনিষদ থেকে শব্দটা ছেনে এনেছিলেন। শুধু ছেনে আনেননি, সুখের থেকে যে এ আলাদা সেটাও গানে, নাটকে, কবিতায় বুঝিয়েছিলেন। জীবন দিয়েও বুঝিয়েছিলেন।

এ আনন্দ জীবনের সঙ্গে সমার্থক। আমি যে আছি, এই থাকার সুরটাই এ আনন্দ। হয় তো আমি সুখী নই, হয় তো আমার অনেক অনেক অভাব। কিন্তু এ আনন্দকে আমার কাছ থেকে কেউ কাড়তে পারে না যদি না আমি নিজে একে নষ্ট করি। দুরাশায়। ক্ষোভে। লোভে।

এক তরুণ স্টেশানে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে। তার বাঁশিতে যে খুব একটা সুর আছে, তেমন নয়, কিন্তু আন্তরিক চেষ্টা আছে। সে সুস্থ না। না মানসিকভাবে। না শারীরিকভাবে। বাইরে থেকে দেখলে সে শুধুই কুরূপ। সে সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। বাঁশি বাজাচ্ছে। সবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছে। কেউ-ই প্রায় সাড়া দিচ্ছে না। দেবেই বা কেন। স্টেশানে সবার তাড়া। তায় ভিখারি, অপ্রকৃতিস্থ পঙ্গু। কে দাঁড়াবে ওর জন্য?

সে বসে আছে। খানিকবাদে একজন মহিলা এসে ওর পাশে বসলেন। অপুষ্ট চেহারা। একটা ছেঁড়া ময়লা শাড়ি গায়ে। বসেই ছেলেটাকে বললেন, জল খেয়েছিস? বাঁশি বাজাতে গেলে অনেক জল খেতে হয়। নইলে বুকে রোগ হয়।

ছেলেটা শুনল না। উঠে গিয়ে স্টেশানের একটা বেঞ্চে বসল। সে মহিলাও উঠে গেলেন। ব্যাগ খুলে জলের বোতলটা বার করে, তার ছিপি খুলে, ছেলেটার মাথাটা বাঁহাতে ঠেলে, মুখটা উঁচু করিয়ে, তার মুখে জল ঢালতে লাগলেন। ছেলেটা প্রায় অর্ধেক বোতল জল খেল। মহিলা আঁচলে তার মুখটা মুছিয়ে আবার এসে বসলেন আগের জায়গায়।

যে ছেলেটাকে এতক্ষণ অবান্তর লাগছিল, এত পারফেক্ট, সচ্ছল সমাজের উঠানে, সে এই ক্ষুদ্র খণ্ড চিত্রে হয়ে উঠল একজন গোটা মানুষ। যাকে কেউ ভালোবাসে। তার সব পঙ্গুত্ব, অপ্রকৃতিস্থতা ছাপিয়ে ভালোবাসে।

এই ভালোবাসাই সে আনন্দের প্রকাশ। যার আনন্দ নেই, তার ভালোবাসাও নেই। জগত সংসার নিখুঁত, চ্যুতি মুক্ত নয়। কিন্তু আনন্দ নিজেই নিজেতে পূর্ণ। কী করে এ আনন্দ আছে, সে ব্যাখ্যা কেউ কোনোদিন খুঁজে পাবে না। কিন্তু এ আছে। একে সজ্ঞানে লাভ করার সাধনাকেই উপনিষদ বলছেন ভূমাকে পাওয়া। এ কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। শিখিয়েছেন। নইলে “রাজার অসুখ” এর যে কোনো চিকিৎসা নেই। সব নিখুঁত করে দাও, তবে আমি তৃপ্ত হব - এ পাগলের প্রলাপ, নয় তো মতলবীর কথা। স্বাভাবিক মনের কথা তো নয়। তাই প্রাজ্ঞরা বলেন, আনন্দের চেষ্টাকেই বলে মঙ্গল। লোভের চেষ্টায় অমঙ্গল।

“Though man, therefore, generally directs everything according to their own lust, nevertheless, more advantages than disadvantages follow from their forming a common society. So it is better to bear men's wrongs calmly and apply one's zeal to those things which help to bring men together in harmony and friendship.” - Spinoza

30
Sat, 10/26/2024 - 12:12

 

 

বাঙালিকে রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন একজন অ্যাবস্ট্র‍্যাক্ট ভগবান। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ দিয়েছিলেন কংক্রিট ভগবান, মা।

রবীন্দ্রনাথের দর্শনে, বিশেষ করে গানে বাঙালি যে অন্তর্যামী, জীবনস্বামী, ভুবনেশ্বরকে পেয়েছে, তাঁর রূপ নেই। মাধুর্য আছে। এ নতুন কিছু না অবশ্য। বাঙালি তার আগে বাউলের গানে, দর্শনে ইতিমধ্যে এ স্বাদ পেয়েছিল। কিন্তু সেখানে সে নিরাকার মাধুরীর সঙ্গে একটা দূরত্ব ছিল। বাউল ছিল এক ভিন্ন সম্প্রদায়। তাই সে ঘরের লোক হয়ে ওঠেনি। রবীন্দ্রনাথ সে নিরাকার মাধুর্যকে ঘরের লোক করে তুললেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ যেমন মা কালীকে করে তুললেন ঘরের লোক। স্বয়ং শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদা হলেন সচল কালী। জ্যান্ত দুর্গা। অর্থাৎ ভগবান আর অ্যাবস্ট্রাক্ট রইলেন না। হলেন এক্কেবারে মূর্ত। শিবজ্ঞানে জীবসেবা বলে যে আদর্শটা বিবেকানন্দ বাঙালির মধ্যে আনতে চাইলেন সেটা যদিও জনপ্রিয় হল না। কিন্তু, সচল ভগবান কনসেপ্টটা জনপ্রিয় হল। সেবা স্তিমিত হল, পুজো আড়ম্বর বেড়ে উঠল। বাঙালি রবীন্দ্রনাথের অ্যাবস্ট্রাক্ট আর রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের “মা” - এই দুই কনেসেপ্টেই ভাবুক হল।

মা। বেদান্ত না। তন্ত্র না। পুরাণ না। বাঙালির নিজের মা। তাঁর সঙ্গে তন্ত্র-মন্ত্রের যোগ থাকতে পারে। কিন্তু সেটা বড় কথা না। বড় কথা সে বাঙালির প্রাণের ডাক - মা। এই মা ডাক এমন প্রধান ডাক হয়ে উঠল, যে দেখা যায় রামকৃষ্ণোত্তর যুগে খুব গোঁড়া বৈষ্ণব নন, অথচ বৈষ্ণবধর্ম প্রচার করছেন যেমন ওঁকারনাথ ঠাকুর প্রমুখের প্রচারেও “মা” ডাক স্থান পাচ্ছে শুধু না, মায়ের মন্দিরও হচ্ছে।

এর আগেও বাঙালির গানে মা ডাক এসেছে। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, প্রেমিক প্রমুখের গানের মা-ও শাস্ত্রের মা নন, প্রাণের ডাকের মা। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সে তত্ত্বকে মাটির মূর্তির মা থেকে সচল “মা” করে তুললেন। শ্রীরামকৃষ্ণ হয়ে উঠলেন মা কালীর অবতার। কীভাবে?

সেদিন কালীপুজো। ঠাকুর অসুস্থ। কিন্তু ঠাকুরের ইচ্ছাতেই কালীপুজোর আয়োজন হয়েছে। পুজোর সামগ্রী এসে গেছে সব। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হচ্ছে। ভক্তেরা ঠাকুরকে ঘিরে বসে আছেন। কিন্তু কী করবেন বুঝতে পারছেন না। ঠাকুরও স্থির বসে আছেন। এমন সময় এক ভক্ত উঠে গিয়ে ঠাকুরের পায়ে ফুল দিয়ে পুজো শুরু করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুর সমাধিস্থ। বরাভয় মুদ্রায় দাঁড়িয়ে। সবাই তখন ঠাকুরের শরীরেই মায়ের আবির্ভাব জেনে পুজো শুরু করলেন। এখানে আরো পরে ঠাকুরের কল্পতরু হওয়ার ঘটনাও উল্লেখ্য, যেখানেও ঠাকুরের শরীরকে অবলম্বন করে মায়ের আবির্ভাবের কথা আছে।

এগুলো সব ডক্যুমেন্টেড ঘটনা। “কথামৃত” বাঙালির ঘরে ঘরে মা'কে প্রতিষ্ঠিত করল ঠাকুরের অমৃতবাণীকে অবলম্বন করে।

বাঙালির প্রাণের শাস্ত্র এখন দুটো - গীতবিতান আর কথামৃত। অ্যাবস্ট্রাক্ট ভগবান আর কংক্রিট ভগবান। দুইতেই বাঙালি তার প্রাণের আরাম খুঁজে পায়। সান্ত্বনা পায়। আরাম পায়। আশ্বাস পায়। আগে অবিশ্যি বাঙালির “চৈতন্যচরিতামৃত” ছিল। কিন্তু এখন সে সম্প্রদায়ের বই হয়ে গিয়েছে। আপামর বাঙালি সেটা পড়ে না। গীতবিতান আর কথামৃত হল অনেকটা সেকুলার পরা-আনন্দের সম্পদ। যদিও কথাটা একটা অক্সিমোরনের মত শোনালো। তবু এটাই বাস্তব। এই দুইয়ের মধ্যে তুলনা করলে গীতবিতান একটু বেশি সেকুলার।

বাংলা ভাষা যেদিন কী একটা ভাষার তকমা পেল বলে খবর হল। সেদিন আমার মনে হয়েছিল, চৈতন্যচরিতামৃতের কথা। আপামর হিন্দিভাষীর ‘রামচরিতমানস’ আর আমাদের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’র বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না। কিন্তু হিন্দিভাষীরা সে বইটাকে তাদের প্রাণের সম্পদ করে রেখেছে। আজও উত্তর ভারতের নানা জায়গায় তার পাঠ হচ্ছে। ব্যাখ্যা হচ্ছে। নিত্য। তাদের অন্তত কিছু কিছু চৌপাইও মুখস্থ। আর আমাদের? ওসব ছেড়ে গেছে। ধর্মীয় গ্রন্থ কি শুধু ওটা? কী অসামান্য কাব্য সেটাও কী অনায়াসে ভুলে গেলাম আমরা। ভাষা ভাবকে দ্রবীভূত করে। স্নিগ্ধ করে। রামচরিতমানস যেমন তা পারে। চৈতন্যচরিতামৃতও তা পারে। কিন্তু কই, সেটা যে আমার ভাষার ঐতিহ্য, তাকে সেভাবে সম্মান দিয়ে ধরে থাকলাম কই? এমন একটা বই যখন শুধু সম্প্রদায়ের বই হয়ে ওঠে তখন মুখ্য আর গৌণ স্থান বদল করে। সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যা প্রবল হয়ে ওঠে সম্প্রদায়ের কৌলিন্য আর শুচিতা রক্ষার দায়ে। তার উদারতার দিক নিয়ে আর কেউ কথাও বলে না। ক্রমে লোকের বিশ্বাস হয় ওটা একটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর কাব্য। ক্ষতি কাব্যের হয় না, আমাদের পরম্পরার হয়। ছিন্নমূল হই।

যা হোক, বাঙালির তো ভোলার ক্ষমতা সাংঘাতিক। নইলে ছোটোবেলায় উদযাপিত বিজয়া উৎসব, যা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাতায়াতের আনন্দ উৎসব ছিল, তা মাত্র এ কটা দশকেই শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বিজয়া সন্মিলনী হয়ে উঠতে পারে? আমরা বড় সহজে ছেড়ে দিই।

এক যুগে বাঙালির শাক্ত বৈষ্ণবের দারুণ কোন্দল ছিল। যে যাকে যতটা পারে হীন দেখাত। যে যতটা পারে নিজেকে নির্ভুল দেখাত। এখন বাঙালির শাক্ত বৈষ্ণবের সেই লড়াইটা রাজনীতির ময়দানে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়া চণ্ডীমণ্ডপ হয়েছে। রাতদিন চলছে হইহই রইরই। গালিগালাজ, ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিরাম নেই। পক্ষ-বিপক্ষ হওয়ার রাতদিন মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলছে।

কিন্তু এ সবের মধ্যে বাঙালি একটা অভূতপূর্ব চরিত্রকে পেয়েছে মা। যে কথাটা দিয়েই এ লেখার ইতি টানি। মা সারদা। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে, শাস্ত্রীয় বিধানকে শিথিল করে শুধুমাত্র মানবধর্মকে সম্বল করে একজন তথাকথিত অশিক্ষিত গ্রাম্য নারী কী করে “মা” হয়ে ওঠেন, এ এক বিস্ময়। বাঙালি চৈতন্যদেবের মধ্যে যে সঙ্কীর্ণতা ভাঙার ডাক শুনেছিল, আধুনিক যুগে মায়ের মধ্যেও সে-ই ডাক। তবে ভীষণ স্নিগ্ধ। শান্ত। ঘরের ভিতর থেকে ডাক। এমনকি ধর্মীয় অনুসঙ্গ পর্যন্ত মুক্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ যে মা'কে সাধনায় অনুভব করেছিলেন, সে-ই মা'কে রক্তমাংসের শরীরে স্থাপন করেছিলেন ফলহারিনী কালীপুজোর দিন রাতে। রামকৃষ্ণদেব চোখের আলোর বাইরে গেলেন। স্বামীজী গেলেন। মা রয়ে গেলেন। এতটুকু ভাঙলেন না। বিহ্বল হলেন না। স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন। আশ্রয় হলেন গৃহী সন্ন্যাসী উভয়ের। সেদিন মহাপ্রভু দিয়েছিলেন মহামন্ত্র, কৃষ্ণ নাম। ঠাকুর দিলেন “মা” মন্ত্র। মায়ের নাম। মা সারদা সে নামে প্রাণ সঞ্চার করলেন। আত্মসঞ্চার করলেন।

এ যুগ তড়িঘড়িতে সব পাব, এমন ভাবধারার যুগ। আমাদের হতাশা বিষাদ হুশ করে আসে। আমাদের ধৈর্য্যচ্যুতি পদে পদে হয়। আমাদের রাগ মুহুর্মুহু হয়। ক্রমে রাস্তা হারাই। ক্রমে নিজেকে হারাই। কে ফেরাবে আবার? মা ফেরাবেন। মায়ের জীবনী ফেরাবে। মায়ের অস্তিত্ব ফেরাবে আমাদের আবার রাস্তায়। সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে শুধুমাত্র মায়ের দিকে তাকিয়েই রাস্তা পাওয়া যাবে। দিনের শেষে যখন মনে পড়বে দক্ষিণেশ্বরের ওইটুকু ঘরে একজন “আনন্দঘট” স্থাপন করেছিলেন নিজের হৃদয়ে, তখন নিজের ঘরের দেওয়াল আরো প্রসারিত হবে। দিনের শুরুতে যখন মনে পড়বে জয়রামবাটির মত এক ক্ষুদ্র অখ্যাত গ্রাম কী সাধনায় বিশ্বের অন্যতম তীর্থস্থান হয়ে উঠল, তখন মায়ের প্রসন্ন শান্ত মুখটাই মনে পড়বে, চিত্তশুদ্ধি হবে। রাস্তা পাবে দিশাহারা প্রাণ। যে রাস্তা উদার। শান্তিদায়ী। আনন্দদায়ী। সামর্থ্যদায়ী। সার্থকতাদায়ী।

31
Fri, 10/04/2024 - 13:02

 

তখন জিয়া উল হকের ডিক্টেটরশিপ চলছে পাকিস্তানে। তো তেনার কী মর্জি হল উনি বললেন, আজ থেকে পাকিস্তানের মেয়েরা শাড়ি পরতে পারবে না। সেটা ইসলাম বিরুদ্ধ।

সাল ১৯৮৬। দু বছর হল পাকিস্তান, তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ফৈজ আহমদ ফৈজের মৃত্যু হয়েছে। ফৈজের জন্মদিন ১৩ই ফেব্রুয়ারি। সেদিন আল হামরা হলে ফৈজের জন্মদিনের জন্য বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যদিও ফৈজ নিষিদ্ধ কবি তখন। ১৯৭৯ সালে, জিয়া উল হকের ভয়ংকর অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ফৈজের হাত ধরে জন্মে গেছে সেই যুগান্তকারী কবিতা, হাম দেখেঙ্গে।

ইকবাল বানো। প্রসিদ্ধ সঙ্গীত শিল্পী। পাকিস্তানের ঘরে ঘরে ওর অনুরাগী। শুধু পাকিস্তান কেন, উর্দু ভাষার কাব্যের অনুরাগী বিশ্বের যে কোনো প্রান্তের মানুষ ওঁর গানের ভক্ত। গালিব, নাসির কাজমি প্রমুখ কবির গজল ওঁর কণ্ঠের যাদুতে, গায়কিতে শ্রোতাকে পাগল করে দেয়। কিন্তু ফৈজের গজল অন্য মাত্রায় এসে পৌঁছে যায় মলিকা-এ-গজল ইকবাল বানোর কণ্ঠে।

১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬ সাল, প্রায় পঞ্চাশ হাজার শ্রোতায় ভর্তি হলে ইকবাল বানো এসে দাঁড়ালেন কালো শাড়ি পরে। কালো শাড়ি ওঁর প্রতিবাদের ভাষা। ফৈজের লেখা একটার পর একটা গজল শোনালেন। কিন্তু গোটা হলে আগুন জ্বলে উঠল শ্রোতাদের হাততালিতে আর উচ্ছ্বাসে যখন ইকবাল বানো ধরলেন, হাম দেখেঙ্গে। যারা যারা সেদিন শ্রোতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন তাদের স্মৃতিকথা পড়লে আজও গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় এই ভেবে কী করে পেরেছিলেন সেদিন ইকবাল বানো? এত আগুন এত নিঃশব্দে লালন করে এসেছেন কী যাদুতে!

ব্যস। বানো রোষানলে পড়লেন জিয়াউল হকের। নিষিদ্ধ হলেন পাকিস্তান রেডিওতে। কিন্তু কদিনের জন্য? হকের ডিক্টেটরশিপ শেষ হল ১৯৮৮। অনেকে বলেন, এই "হাম দেখেঙ্গে' হকের ধ্বংসের সুত্রপাত ঘটিয়েছিল। পাকিস্তানের ওয়ারক্রাই, বা স্লোগানে পরিণত করেছিলেন বানো এই গানটাকে। বলা যায় আমাদের সাউথ এশিয়ার "বেলা চাও" যেন।

গানটা হালে পাকিস্তান কোক স্টুডিওতে দারুণ উপস্থাপন করেছে। সে লিঙ্কটা দিলাম। আর দিলাম বানোর গাইবার সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের লিঙ্কও। কমেন্টস বক্সে।

এসব গান হারিয়ে যেতে দিতে নেই। মানুষ হয়ে জন্মে যে মানুষ হতে পারার অনেকটা বাকি থাকে এ গানগুলো মনে করিয়ে দেয়। ফৈজ আর বানোকে আমার অন্তরের গভীরতম স্থল থেকে কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধা জানাই। এমন সাহসের জন্য। এমন সৃষ্টির জন্য।।

 

[4 October 2024]

32
Thu, 10/03/2024 - 12:59

 

বহুকাল হল মহালয়ার দিন সকালে রেডিও চালাই না। না তো ইউটিউবে মহালয়া চালাই। চালালেই বুকের মধ্যে করাত চলে। সময়ের পর সময় ভেঙে ভেঙে সে সময়টা জ্বলজ্বল করে ওঠে যখন হাওড়ার সালকিয়ায় থাকতাম। ছোটো ছোটো তিনটে ঘর। ঠাকুমার। জেঠুর। আমাদের। অত ছোটো ঘর। চারদিকে থইথই কত মানুষ। অন্ধকার ভোরে তিনটে ঘরে রেডিও চলছে। আমি আর দিদি আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে ঠাকুমার কোলের কাছে গিয়ে শুয়েছি। ঠাকুর্দা গেছেন গঙ্গাস্নানে। তর্পণ করে ফিরবেন। দেওয়ালের ওই উঁচুতে চৌকো খোপে রাখা বড় রেডিও। মহালয়া চলছে। আমি দস্যি দুর্গার সঙ্গে দুষ্টু অসুরের লড়াইটা কল্পনা করে ভীষণ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মত কিছু অনুভব করছি। সঙ্গে ভাবছি এই তো সামনে পুজো.... কী কী করতে হবে।

একটু যেই আলো ফুটল, অমনি সামনের টানা এক চিলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াই। সামনের জানলাটা পুবদিকে। জানলার লোহার রডগুলোর ফাঁক দিয়ে দিয়ে ওদিকের খাটাল আর অশ্বত্থগাছটা পেরিয়ে রোদ এসে পড়েছে মেঝেতে। এই মেঝে দিয়ে একটু পর হুটোপুটি চলাচল হবে। ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, জেঠু, জেঠিমা, মা, বাবা আর আমরা চারভাইবোনেদের। রান্নাবান্না হবে। কাগজ পড়বে বাবা জ্যাঠা ঠাকুমা। চা খাওয়া হবে। পাড়ার কেউ কেউ আসবে। হইহট্টগোল হবে। গল্প হবে।

তারপর? আজ? হঠাৎ সব ফাঁকা। কত মানুষ নেই। আছে মহালয়া। আর বাকিদের সঙ্গে শুধু তর্পণের সম্পর্ক। এমনকি ছোটো ভাইটার সঙ্গেও। করোনা তো বয়েস বাছেনি। বয়েসের সঙ্গে মৃত্যুর ধারাপাতের নামতা তো ছিল আমার বানানো। ভাগ্য তা শুনবে কেন? শোনেওনি। সব তছনছ করে ছিন্নভিন্ন করে চলে গেছে।

আজ আর তাই মহালয়া শোনা হয় না। শুনতে পারি না। সেদিনের বারান্দায় এসে পড়া একফালি রোদ যে এমন উজ্জল হয়ে স্মৃতির বারান্দায় কাঙালের মত বাঁচবে, কে জানত? কে জানত, সেদিনের ঘুঁটে কয়লার উনুনের আঁচের ধোঁয়ায় আজও আমার চোখ জ্বালা করবে। গলার কাছে অসহায়ের মত কান্না দলা পাকিয়ে থাকবে?

স্মৃতি বড় স্বার্থপর। যেখানে যা কিছু ভালোবাসা, সুখ পেয়েছে, সে সব হারিয়েছে যখন, সে সব কিছুর জন্য তার হাহাকারের শেষ নেই। কিন্তু একবারও তার মনে পড়ে না, যাকে যা দেওয়ার ছিল দেওয়া হয়েছে কি? জানি না। যার কাছে ক্ষমা চাওয়ার ছিল, যার কাছে যা বাকি ছিল সেকি পূরণ হয়েছে? হয়নি। ঋণ না থাকলে বেঁচে থাকার তাগিদটাই তো ফুরিয়ে যায় মানুষের। পার্থিব জগতের টাকাকড়ির ঋণ গলার ফাঁস, যত তাড়াতাড়ি তার থেকে মুক্ত হওয়া যায় তত শান্তি। অপার্থিব জগতের ঋণের হিসাব উলটো, সে গলার ফাঁস না, প্রাণের আশ। সে যত বাড়ে জীবন তত অর্থময়। যত কমে জীবন ততটাই অর্থহীন। প্রতিটা দিন অল্প অল্প করে সে ঋণ শোধ করার খেলা। পূরণ হবে না জেনেও। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর কালজয়ী মহাগ্রন্থ, 'চৈতন্য চরিতামৃত' তে লিখছেন, চৈতন্যদেব হলেন অসীম আকাশ। আমি আমার ক্ষুদ্র ডানায় ভর করে যতটা উড়তে পেরেছি ততটাই মহাপ্রভুর কথা লিখেছি। আমার ডানার শক্তিতে, আমার উড়বার ক্ষমতার উপর শ্রীমহাপ্রভুর অসীম ক্ষমতার পরিমাপ করবেন না যেন। আমার পক্ষে সে মাধুর্য অধরাই।

জীবনের মাধুর্য এমনই অধরা। জীবন আঘাতের পর আঘাতে এটুকুই শেখায়, যে কান্নাহাসির মাঝ দিয়ে একটা সিলভার লাইন আছে। সেটুকু ধরতে পারলেই খেলা জমে যায়। সে সিলভার লাইনটা কী, সে ভাষায় বলা যায় না। তোমাকে নিজেকে খুঁজে বার কর‍তে হবে। খেলাটা শিখতে হবে।

রোজ চাইছি অল্প অল্প করে খেলাটা শিখতে। সব শোক, সব দুঃখ, সুখের আস্পৃহা থেকে ঊর্ধ্বে উঠে জীবনের যে উদাস ছন্দ তার সঙ্গে চলতে। অলকানন্দা মন্দাকিনীর সঙ্গমের সামনে দাঁড়াতে, যেখানে সসীমের মধ্যে অসীম এসে মেশে। পথ কঠিন। কিন্তু এটাই তো রাস্তা। হাঁপিয়ে পড়ছি থেকে থেকে। আবার হাঁটছি। জন্ম থেকে মৃত্যু এই হেঁটে চলাটাই তো আদ্যোপান্ত তীর্থ। সঙ্গে চলেছে কয়েকজন তীর্থযাত্রী। এইটুকুই তো সম্বল। বাকি কী আছে? বাকির খোঁজ নেই আর। শুধু পথটুকুই আছে। তুষারাবৃত নিষ্ঠুর জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে চলা আছে। ব্যথা আছে। আর আছে গভীর শূন্যতার মধ্যে জেগে থাকা একজোড়া চোখ। সে চোখে দরদ, না উদাসীনতা, কে বলবে?

33
Tue, 09/17/2024 - 14:48

 

আগে বেড়াতে না গিয়ে বেড়াতে যাওয়ার স্বাদ মেটাত ভ্রমণ কাহিনী। এখনও মেটায়। তবে এখন আরেকটা স্বাদ নতুন যোগ হয়েছে। নানা মানুষের বেড়াতে যাওয়ার ভিডিও। কী চমৎকার সব ভিডিও করেন। দেশের নানা জায়গা তো আছেই, আরো আছে বিশ্বের নানা অজানা ছোটো-ছোটো জায়গার ভিডিও। ট্রেন জার্নির উপর আমার ভীষণ আকর্ষণ। অনেকে কী ডিটেইলসে সে ভিডিওগুলো বানান। আগে ভাবতাম বোধহয় আমার একারই কি এই পাগলামি ট্রেন নিয়ে? এখন দেখি, না তো, অনেকেরই এ নেশা আছে। যেমন ট্রেনের কোচ কম্বিনেশন কেমন, কবে প্রথম চালু হয়েছিল, কোন মডেলের ইঞ্জিন টানে, কোন কোন ট্রেনের সঙ্গে রেক শেয়ারিং হয়, কী ধরণের কোচ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রচুর কৌতুহল আমার ট্রেন নিয়ে। আগে ভাবতাম বুড়ো হলে কমবে, এখন দেখছি উলটো, যত দিন যাচ্ছে আরো বাড়ছে।

আমি আগেও কোনো একটা লেখায় লিখেছিলাম, ভারতকে জানতে হলে রেলস্টেশানে এসো, মন দিয়ে দেখো, সময় কাটাও। সমাজের কত কত শ্রেণীর মানুষ। কত মানুষের তো জন্ম থেকে মৃত্যু স্টেশানেই কেটে গেল। একবার একজন স্টেশানবাসী মানুষের ঠাকুরঘরও দেখেছিলাম প্ল্যাটফর্মের এক কোণায়। পিজবোর্ড দিয়ে বানানো। তার মধ্যে মহাদেবের ছবি। সঙ্গে ক'টা ফুল। দু হাত জড়ো করে প্রণাম করেছিলাম, আজও করি মনে এলেই। করব না? চারদিকের এত চঞ্চলতায়, এমন প্রাচুর্যের মধ্যে, এমন স্থির কৈলাস, কী কাশী যে নির্মাণ করতে পারে সেকি সামান্য মানুষ?

অনেকেই কী যত্নের সঙ্গে ভিডিওগুলো বানান। লাইক করি। সাবস্ক্রাইব করি। উদাস হই। কতটুকু জীবন, কত স্বল্প জানা হল। ট্রেন ছাড়ে, আমি আমার অলিখিত সিটে সেই ভিডিও নির্মাতার সঙ্গে বসি। ট্রেন হাওড়া, কি শিয়ালদা, কি কলকাতা, শালিমার ছেড়ে বেরোয়। মন কেমন করে ওঠে, এক উত্তেজনা হয়, নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা। ভিডিও নির্মাতা দেখিয়ে চলেন, আমি দেখতে দেখতে ভেসে যাই, ডুবে যাই।

ভিডিওর আরো যে জিনিসগুলো ভালো লাগে সে হল তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসকেও সামনে আনা। যে মন একটা প্যাটার্নে সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত সে বলে ধুর, এসব কেন বলছে, দেখাচ্ছে? কিন্তু যদি নিজের দিকে তাকাই, ভ্রমণ পিপাসু মনের সঙ্গে সঙ্গেই কী আরেক মন ঘোরে না? যে ঘরের কোণার জন্য হাপিত্যেশ করে চলতে চলতেও? পাহাড়ি রাস্তায় চলতে চলতে কোথাও গাড়ি দাঁড়ালো। ছোটো একটা দোকান। দোকানের সঙ্গেই লাগোয়া বাড়ি, তার পাতানো সংসার। এদিকে যেমন চায়ের জল ফুটছে, ম্যাগির প্যাকেট ছিঁড়ে থালায় রাখা আছে, তেমন পাশের ঘরেই একটা বাচ্চা শুয়ে খাটে, বই পড়ছে, বাড়ির গৃহিণী রান্না চাপিয়েছে। ঘরের মধ্যে একটা আলমারি, ক্যালেন্ডার, জানলার উপর রাখা টুকিটাকি কৌটোবাটি, ব্রাশ, মাজন। জানলার ওপারে সবুজ পাহাড়। গৃহিণী মাঝে মাঝে পর্দা উড়িয়ে দোকানে আসছে, আবার ঘরে যাচ্ছে। তখন পথিক মন আবার ঘরের জন্য ছটফট করে না? সে বলে না, আমিও ফিরব, আমার জন্যেও অপেক্ষা করছে একটা শান্তিমাখা পৃথিবীর অতি তুচ্ছ কোণা।

খাওয়া হল, দোকানের বাইরে রোদে এসে দাঁড়ালাম। একটা ছোটো ফুলগাছ। সে গাছে যত্নের হাতের ছাপ। চোখে তো পড়ে? ঠিক যেমন চোখে পড়ে দুটো লাইনের মাঝে জন্মানো নামগোত্রহীন একটা ছোট্টো জংলী গাছ। ট্রেনটা মাঝ রাস্তায় সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে। চারদিকে জঙ্গল। পড়ন্ত রোদ বলে, “হাম কো মিলি হ্যায় আজ, ইয়ে ঘড়িয়া নসীব সে/ জী ভরকে দেখ লিজিয়ে হাম কো করীব সে/ ফির আপ কে নসীব মে ইয়ে বাত হো না হো/ শায়দ ফির ইস জনম মে মুলাকাত হো না হো”.....

রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে এক অদ্ভুত তত্ত্ব শিখিয়েছেন। একজন আট বছরের শিশুর চোখে দেখা হাওড়া স্টেশানের বয়সও তো আট বছর। আবার তার পঞ্চাশ বছরের হাওড়া স্টেশানের বয়েসও পঞ্চাশ বছর। এভাবেই তো আমরা দেখি না? যা দেখি আর যা মনে থাকে, সেকি আমার হাতে? কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ মুহূর্তেরাই ভ্রমণের স্মৃতি আটকে থাকে। অসংলগ্ন স্মৃতি। ছাড়া ছাড়া দৃশ্য। কিন্তু সম্পূর্ণ দৃশ্য। তার মানে নেই। কিন্তু অস্তিত্ব আছে।

আমার ক্ষুদ্র “আমি” কী অনায়াসে হাওড়া স্টেশানে এসে দাঁড়ালেই ছেড়ে যায়। কোনো মন্দির না, কোনো মন্ত্র না, কোনো মহাপুরুষের সঙ্গ না, কোনো দেবতার ধ্যান না। শুধুমাত্র হাওড়া স্টেশান। সব বদলে যায়। কোথায় নিজেকে নিয়ে ভাবনা চিন্তার অবসর তখন। এই যে সামনে, এ কী! এই তো জনসমুদ্র। এতে ডুব দেব না? এতে ডুব না দিয়ে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে শুদ্ধ হতে চাওয়া নিতান্ত পাগলামি। মনের দুষ্টুমি। ফাঁদ সে। দরকার কী?

যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, মনের মধ্যে মনের বন্দীদশা ঘোচাতে এইসব ইউটিউব চ্যানেলগুলো আমার কাছে আশীর্বাদ। বইয়ের পাতার থেকে বেরিয়ে সামনে সচল ভ্রমণের ধারাভাষ্য। শুধু শব্দের তো না, চোখেরও তৃপ্তি। প্রাণের দরজা খোলা অজানার দিকে।

34
Sun, 09/15/2024 - 12:33

 

 

পুরাণে আছে যেদিন শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন কারাগারে দেবকীর সন্তান হয়ে, সেদিনই যশোদার গর্ভ থেকে জন্মান যোগমায়া। কৃষ্ণের কারাগারে আসেন যোগমায়া, শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে প্রতিস্থাপিত হতে। এবং কংস যখন তাঁকে দেবকীর আগের সন্তানদের মত হত্যা করতে যান তাঁকে মাটিতে আছাড় মেরে, ঠিক তখনই কংসের হাত থেকে সরে গিয়ে যোগমায়া দুর্গারূপ ধারণ করেন, এবং বলেন, তোমাকে যে বধ করবে, সেই শ্রীকৃষ্ণ ইতিমধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। তুমি প্রস্তুত হও।

আজ মাইকে কোথাও বেজে উঠল, “আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জীর….”। এ শব্দ ক'টা শুনলেই এতদিন নিজের গোটা ছোটোবেলা যেন কেউ উপুড় করে সামনে মেলে ধরত। কান্না পেত। যে সুখ হারিয়ে গেছে সে সুখের জন্য।

আজ কান্না পেল অন্য কারণে, মনে পড়ল, যে অভয়া, যে তিলোত্তমা, সে প্রতি বছর দুর্গাপুজো করত নিজের বাড়িতে। পরম আনন্দের সঙ্গে করত। গোটা পাড়াকে ডেকে আনত বাড়িতে! কিন্তু এ বছর?

অশৌচ মানি না আমি। শোক মানি। তার চলে যাওয়া যদি স্বাভাবিক চলে যাওয়া হত, শোককে মেনে নিতাম। কিন্তু এ তো স্বাভাবিক চলে যাওয়া নয়! তবে অশৌচ কীসের?

বরং একটাও পুজো বন্ধ না হোক। যতগুলো পুজো হবে, সঙ্কল্প হোক তার নামে। যাকে কেউ বলছেন অভয়া, কেউ বলছেন তিলোত্তমা। আমি বলছি অপরাজিতা। যদি কেউ বলেন, তার নামে সঙ্কল্প হয় কী করে? শাস্ত্রের বিধান নেই যে!

তাকে বলবেন, শাস্ত্রের যে বিধানে তার নামে সঙ্কল্প হয় না, সে বিধানের কথা আপাতত থাক। শাস্ত্রের যে বিধানে অবিনশ্বর আত্মার কোনো আসা যাওয়া নেই, সেই বিধানে হোক তার সঙ্কল্প। তবে এ বছরের সব ক'টা দুর্গাপুজো হবে সার্থক।

অভয়া ক্লিনিক সে-ই কাজটাই করছে বলে আমার বিশ্বাস। কারণ চিকিৎসাকে সে তার ব্রত, তার একান্ত সেবা হিসাবে নিয়েছিল। অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সে তার কর্তব্য করেছে, এমনকি শেষদিন অবধি। অভয়া ক্লিনিক সে-ই কথাই বলছে। তার সে বিশ্বাসকেই মর্যাদা দিয়েছে। আমার বিশ্বাস, যে চিকিৎসকেরা তার সঙ্গী ছিলেন, তারা যেদিন আবার আগের মত কাজে ফিরবেন, তখনও তাদের মনে পড়বে অপরাজিতার নিষ্ঠার কথা। তাদের অনুপ্রেরণা জাগাবে আজীবন অপরাজিতা।

তাই ভাবছিলাম, এ বছরে মায়ের কোনো পুজো যেন বন্ধ না হয়। সব পুজোর সঙ্কল্প হোক তারই নামে। তবেই মা পুজো নেবেন, এ আমার স্থির বিশ্বাস। কিন্তু পুজো বন্ধ হলে, সে কষ্ট পাবে, যার কাছে পুজো ছিল কাজেরই মত প্রাণের শ্রদ্ধার। তার বিশ্বাস, তার শ্রদ্ধাকে শ্রদ্ধা জানানোর সময় এটা।

আজ অশৌচের সময় নয়। সঙ্কল্পের সময়। অপরাজিতা সঙ্কল্পের। গোটা বিশ্ব জানুক, বাংলার মেয়ের গায়ে হাত পড়লে বাঙালি কী কী করতে পারে।

বাংলা, বাংলার মেয়েকেই চায়, স-সম্মানে, সমর্যাদায়। বুকের মধ্যে - বোধনের মন্ত্রে, অষ্টমীর অঞ্জলিতে, দশমীর কান্নায়, বিজয়ার ভূমিষ্ঠ প্রণামে। সে হৃদয়ের মধ্যে আসন পাতে হিমালয়ার কন্যার জন্য। যে পর্বতের কন্যা পার্বতী, সে-ই বাংলার ঘরে এসে উমা, যাকে নিয়ে বাঙালি কবি আগমনী লেখেন। মা কৈলাস থেকে আসতে আসতে দেখেন, বাংলার ঘরে বাইরে আসন পাতা তাঁর জন্যে। তাঁর কৈলাসের সুখের থেকেও কোটিগুণে খাঁটিসুখ এই বাঙলা মায়ের সবুজ আঁচলে। যে আঁচল অপেক্ষা করে আছে, শুধু পুজোর জন্যে না, তাকে আগলে রাখার জন্যেও।

আজ পুজো বন্ধের দিন না। অশৌচের দিন না। আজ সঙ্কল্পের দিন। অপরাজিতা সঙ্কল্পের দিন। এই ভাবনা আমার।

35
Wed, 09/11/2024 - 12:17

 

কথায় আছে জলে কুমীর, ডাঙায় বাঘ।

জুনিয়ার ডাক্তারদের অবস্থানটাও তাই। দুটো শক্তিশালী রাজনৈতিক ক্ষমতাধারীদের মধ্যে, একজনের দিকে ক্ষুব্ধ চোখে আর আরেকজনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে থাকাটা চাট্টিখানি কথা নয়।

প্রতিবাদ শুধু না। প্রতিরোধের দায় বড় দায়। তারা শুধু যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন তা তো নয়, সঙ্গে সে অন্যায়ের শিকড়ের গতিকেও উপড়ে ফেলার শপথ নিয়েছেন। প্রতিবাদ একটা দূর অবধি এসে শান্ত হতে পারে, কিন্তু প্রতিরোধের দায় প্রবল। তাকে যেখানে সেখানে থামলে হয় না। এমনকি যখন কেউ এসে বলছে, এসো না আমিও সে শিকড় তুলে দিতে তোমাদের সাহায্য করছি... তাকেও তারা বলছে, গো ব্যাক। কারণ তার উদ্দেশ্য আর অভিসন্ধি নিয়ে তারা সন্দিহান।

প্রতিবাদ যারা করছেন সেখানে অনেকে এসে অপমানিত হয়েছেন। কারণ বড় জটিল কিছু নয়। কারণ নয় যে তারা কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে এসেছেন। কিন্তু ফেসবুকীয় দলাদলিতে তিনি প্রতিপক্ষ হওয়াতে তার গায়ে হাতও প্রায় উঠেছে। তিনি মহিলা হলেও। আবার প্রতিবাদ না করলে বা প্রতিবাদের বিরুদ্ধে কিছু বললে যেমন তাদের ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে হুমকি দেওয়া চলছে, তেমন প্রতিবাদ করলে ফটো বিকৃতি করে টাঙিয়ে দেওয়ার কথাও উঠছে। এটা স্বাভাবিক। ডাক্তারদের লড়াইটা প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের সমন্বয়ে দাঁড়িয়ে মরণ-বাঁচনের লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। বাকিটা অনেক ক্ষেত্রেই ফেসবুকের কল্যাণে। সেখানে "আমি" এসেই পড়ে। যে কোনো লড়াইয়ে "আমি"র থেকে, "আমরা" থেকে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যটা সৎ আর ন্যায়সঙ্গত হওয়া উচিৎ। নইলে বড় অসঙ্গত অভিমান আর আক্রোশ তৈরি হয়। "আমি-আমরা" বড় হয়ে গিয়ে আসল কাজ পণ্ড হয়। আমি-আমরা মোক্ষমার্গ বলে শুধু না, যে কোনো কল্যাণের কাজে বড় সমস্যার। দল বাস্তব, কিন্তু দলাদলিটা ন্যাক্কারজনক।

ডাক্তারদের লড়াইটা আরো কঠিন হয়ে উঠছে আদালতে। কারণ গণতন্ত্রে বিচারের সেটাই অন্তিম আশ্রয়। এবং সর্বোচ্চও বটে। সেখান থেকে খুব একটা দরদী কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকের ক্ষোভ। সে ক্ষোভ অসংগতও নয়। সেখানে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে, আরো অনেক বিধান যোগ হয়েছে। কিন্তু সব বিধান নির্ভর করে একজন মানুষের উপর, যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত। তাই চিকিৎসকেরা আগে সেই মানুষের শুদ্ধিকরণের রাস্তায় নেমেছেন। এ ন্যায্য দাবী।

নোম চমস্কিকে একজন একটা সভায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ভায়োলেন্সের পথে যাচ্ছি না কেন। নোম বলেছিলেন, তাহলে সবাই সবার গালে একটা চুমু খেয়ে চিরকালের মত গুডবাই বলে বেরিয়ে যাও। কারণ শাসক সেটাই চায়। তুমি ভায়োলেন্ট হলে সে তার সৈন্যবাহিনী সাজিয়ে লড়াইয়ে নামে। তার সে ক্ষমতা তোমার থেকে অনেক বেশি। মণিপুর থেকে ইজরায়েল, রাশিয়া সেই রাস্তায় হেঁটে কী পাচ্ছে?

জুনিয়র চিকিৎসকদের পাশে দাঁড়ানোর সময় এখন। ভূয়ো খবরকে নস্যাৎ করে দেওয়ার সময় এখন। মিথ্যা যা কিছু তাকে ফ্যাক্ট দিয়ে চৌচির করে দিয়ে সত্যের রাস্তাটা সহজ করে দেওয়ার সময় এখন। এটা করতে গেলে এমন কিছু করতে হবে না, একটু ভালো করে খবরগুলো ফলো করা, অসঙ্গত যা তাকে সামনে তুলে ধরা, সেটাই সব চাইতে বড় কাজ এখন। এটা যদি সবাই মিলে করি, তবে মাইলকে মাইল জাস্টিস চেয়ে হাঁটার থেকে বড় কাজ হয় সেটা। এত মিথ্যা প্রচার কী করে হয় যদি জনগণ সচেতন হয়ে ওঠে? গণতন্ত্রের সব চাইতে বড় অস্ত্র ননভায়োলেন্স লড়াই। আর তার সঙ্গে চোখ কান খোলা রেখে সঠিক তথ্য খুঁটিয়ে পড়া, জানা আর মিথ্যা এলেই সামনে তুলে ধরা। জানি এ কাজটা কঠিন। আশু বাহবা পাওয়ার রাস্তাও নেই। কিন্তু এটাই করতে হবে। শুধু ফেসবুকে না, পাশের কেউ মনগড়া তথ্য দিলেই খ্যাঁক করে চেপে ধরতে হবে অথেনটিক তথ্য দিয়ে। আরো অথেনটিক হয়ে বাঁচতে শিখতে হবে। মনে রাখতে হবে প্রতিবাদ বিবেকের বলিষ্ঠ সন্তান, আবেগের তরলমতি লঘুচিত্ত বালক নয়।

36
Sun, 09/08/2024 - 12:15

 

তাই নারায়ণ হলেন দুর্লভ, তিনিই হলেন সুলভ, নারায়ণ শিলা হয়ে। যিনি সর্বব্যাপী উদার, তিনি হলেন পুরোহিতের শাস্ত্রের বিধান বন্দী। নারায়ণ শিলার শিলা হল প্রধান, নারায়ণ হলেন গৌণ।

ইতিহাস সাক্ষী, মুখ্যের চাইতে গৌণ যখনই প্রধান হয়, তার অত্যাচারও হয় লাগাম ছাড়া। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় - কথায় আছে না।

আসল যা কিছু জন্মায় তাগিদ থেকে। নকল জন্মায় লোভে। আসলের আত্মাটা থাকে না সেখানে। আসলের গৌরবছটাতে তার লোভ। তাই নকলের মধ্যে আসলের ভঙ্গিটা থাকে, সত্যটা থাকে না। ক্রমে সে ভঙ্গির দাপট থাকে বাড়তে। দাপট হয় প্রায় অত্যাচারের সামিল। অতি আচার থেকেই না অত্যাচার!

আজ চারদিকে এত অনুকরণের অতি-আচার, এত উচ্চকলরব, এক এক সময় ভয় হয়, আসলটা তাগিদটা কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে, এ কথাটা চাপা দেওয়ার জন্য এত আয়োজন নয় তো?

অনুকরণ ক্রমে অভ্যাসে পরিণত হয়। অভ্যাস কালে হয় প্রথা। প্রথা থেকে জন্মায় দল। দল থেকে আমরা তোমরা। এবং সব শেষে পড়ে থাকে আমরা তোমরা। তেমন কিছু দেখছি কি চারদিকে?

নারায়ণে কোনোদিন ভয় পাইনি, কিন্তু বামুনের ঘরে জন্মেছি বলেই কিনা জানি না, ওই নারায়ণ শিলায় আমার বড় ভয়। কারণ ওই যে বললাম, নারায়ণ সেখানে হন গৌণ, শিলা হন প্রধান। আর বামুন হন সে শিলার কর্তা! ব্যস, আর পায় কে!

37
Fri, 09/06/2024 - 12:08

 

ভীষণ বহুশ্রুত বোকা বোকা একটা কথা লিখতে ইচ্ছা করল। এমনি এমনিই। আমি তো লিখে কাউকে ট্যাগ করি না সাধারণত, তাই আমার পোস্ট পড়তে কেউ বাধ্য নন, অনায়াসে এড়িয়েই যাওয়া যায়।

দীর্ঘদিন শিক্ষকতা আছে। খুব সামান্য কাজ করি। জন্মসূত্রে পাওয়া, নাকি অন্য কোনো কারণে জানি না, কিছু প্রাথমিক আদর্শে বিশ্বাস করি। সেই বিশ্বাসের অনুকূল যা কিছু গ্রহণ করি, প্রতিকূল যা বর্জন করি। খুব সামান্য কথা এগুলো।

যে কথাটা লেখার জন্য এই অনর্থক বকে যাওয়া সেটায় আসি। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ অবধি বিজ্ঞান পড়ানো আমার কাজ। কিন্তু ওই যে বললাম কয়েকটা প্রাথমিক আদর্শের উপর একটা আনুগত্য আছে। তার একদম প্রথমটা আমার কাছে সহমর্মিতা। কোনো বাচ্চার মধ্যে যদি সহমর্মিতা দেখি সে পড়াশোনায় ভীষণ ভালো না হলেও আমার ভালো লাগে। আবার যার মধ্যে ভীষণ চাতুরী, স্বার্থপরতা দেখি সে স্কুলের প্রথম দ্বিতীয় হলেও আমার মনে অতটা ছাপ ফেলে না। নানা বিষয়ে আগ্রহ, তর্ক, স্বাধীন চিন্তা, এ সব বাকি দিকগুলো, যা আমার ভালো লাগে। যার মধ্যে এ বোধ দেখি তাকেও ভালো লাগে।

কিন্তু, এখানে একটা বড় কিন্তু আছে। যখনই আমি কোনো অভিভাবককে বলি, পড়াশোনাটা হয়ে যাবে ধীরেসুস্থে, ওটা মেরেধরে অপমান করে হয় না, কিন্তু খুব ভালো ছেলে, কি মেয়ে আপনার। অনেক গুণ আছে।

তখন অনেকেই খুব স্থির সিদ্ধান্তে বলেন, দেখুন ও ভালো ছেলে, ভালো মেয়ে হয়ে কী হবে? যদি ভালো চাকরিই না পেল? যদি মাথা উঁচু করে বাঁচতেই না জানল একটা ভালো পোস্টে গিয়ে?

আমি আজ অবধি এর কোনো উত্তর কাউকে দিতে পারিনি। কারণ আমি এর উত্তর জানি না।

আজ যে সব মান্যবরেরা নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে, সেই সব ডাক্তার, পুলিশ, নেতামন্ত্রী, আরো অনেক অনেক ছোটোবড় পদাধিকারী মানুষেরা.... অনেকেই তো ভালো ছাত্র ছিলেন। তবে?

আসলে এই তবেটা একটা সঙ্কট। জীবনে ভালো নাম্বার, ভালো চাকরি, ভালো পোস্ট এসবের উপর দাবিদাওয়া থাকা খুব স্বাভাবিক। অন্তত সমাজের বর্তমান পরিকাঠামোতে। কিন্তু তারপর? যে মানুষ সহমর্মি নয়, সে তো গোটা জগতকে তার স্বার্থসিদ্ধির সরঞ্জাম হিসাবে দেখবেই। তাতে তার দোষ কী? সে যা যা পড়ে মুখস্থ করে ভালো নাম্বারের জন্য। সে যে বিদ্যায় পারঙ্গম হয় সেও নিজের শখ-আহ্লাদ-দাবিদাওয়া মিটিয়ে বেঁচে থাকার জন্য অর্থ উপার্জনের উপায় মাত্র। তার কাছে গোটা জগতই উপায়। উদ্দেশ্য এক - নিজের স্বার্থসিদ্ধি।

যিনি আমার বাড়ির সামনে বিকেলে উচ্চারণ করে গেলেন, ভালো হয়ে কী হবে, যদি ভালো চাকরি পাওয়ার যোগ্যই না হল সন্তান, তিনিই যখন রাতে কোনো জমায়েতে মোবাইলের আলো উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে জাস্টিস চাইছেন…. সৎ ডাক্তার, সৎ পুলিশ, সৎ শিক্ষক, সৎ প্রতিবেশী, সৎ পথচারী, সৎ নেতামন্ত্রী, সৎ ব্যবসাদার, সৎ উকিল, সৎ বিচারক, সৎ সাংবাদিক...... ইত্যাদি ইত্যাদি চাইছেন.... কোথাও একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে না?

ভালো হয়ে কী হবে, যদি উচ্চপদস্থই না হল…… এই ভাবনাটা ভীষণ ক্ষয়কারী। সব নষ্ট করে দেয়। সে-ই তখন ভাবে, ভালো হয়ে কী হবে যখন পদস্থ হয়েই গেছি। ভালো হয়ে কী হবে যখন আশেপাশে কেউ-ই ভালো থাকাটাকে খুব একটা বুদ্ধিমানতা বলে ধরে না। ভালো হয়ে কী হবে যদি নিজেকে বাঁচিয়ে আরো মাথা উঁচু করে হাঁটার মত আরো আরো টাকা জমিয়ে নিই অ-ভালো রাস্তায়। ভালো হয়ে কী হবে? ওটা তো বোকা লোকেদের সান্ত্বনা। ওটা লুজারদের আত্মগরিমার শেষ অবলম্বন। আমাদের তো দরকার নেই ভালো হওয়ার। ছোটোবেলা থেকেই তো মা বাবা শিখিয়েছেন, ভালো হয়ে কী হবে যদি না আমি অন্য কিছু হই?

আমাদের দেশে প্রায় সব কিছুই গ্র‍্যাণ্টেড বা সংস্কারবশত ধরে নেওয়ার চল আছে। এ জন্মের ব্যাখ্যা যে জাতি গতজন্মের সূত্রে খুঁজে এসেছে, কিম্বা জাতপাতের কৃত্রিম মানবচরিত্রের বিভাগে খুঁজে এসেছে সেখানে দায়িত্ববোধ একটা বড় বালাই। নৈতিক জীবন পূর্বজন্মের সংস্কার আর জন্মসূত্রে পাওয়া জাতপাতের বিচারে হয়। “ওদের জাতটাই তো ওরকম” ... ”কোন বংশে জন্মেছে দেখো”..... ”গতজন্মের অনেক সুকৃতি না থাকলে এমন স্বভাব হয়?”..... ইত্যাদি ইত্যাদি। পাশ্চাত্য যখন মরাল সায়েন্স, মরাল শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করছি, আমরা তখন দৈব আর নকল বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে সব কিছুর সমাধান খুঁজে পাব আশা করছি। আমরা বলছি যত পাপ ঈশ্বরের নামে ধুয়ে যাবে, যত পাপ নির্দিষ্ট তিথিতে স্নানে ধুয়ে যাবে। যত পাপ বিশ্বাসে মিটে যাবে। এ সব আমাদের রক্তে ঢুকে গেছে। আমরা জানি শুধু বৈধ পথে স্বার্থসিদ্ধির জন্য এই স্কুলকলেজ এর ব্যবস্থা। সে যদি কেউ নিজের মত করে অন্য পথে কেউ করে নিতে পারে সেখানেও আপত্তির তেমন কিছু নেই। যদি ধরা পড়ে যায় সে তার ভাগ্য, কোনো পূর্বজন্মের পাপের ফল।

সুতরাং সত্য বলো, সুপথে চলো - আমাদের প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায়, অভিভাবকত্বে, সুদুর্লভ। সেখানে কার কাছে কী চাইছি? কিছু বোকা, সৎ, সাহসী লোক? যারা হিরো হওয়ার জন্য সামনে চলে আসবে? ধুস! সেও বা কদ্দিনের? গোড়ায় গলদ ঢুকে আছে দাদা, গোড়ায় গলদ, ভীষণ গলদ! ভালো হয়ে কী হবে? যদি টাকাপয়সা না হল, মায় হিরো হওয়াও না হল? বেকার সৎ হয়ে বাঁচতে যাব কেন দাদা?

দাওয়াই, সহমর্মিতা। সে শুধু আজকের এই জনগণ আবেগে না। প্রতিদিনের নিত্য জীবনচর্চায় যদি দায়িত্ব নিয়ে সে শিক্ষার চর্চা করা না গেল, সব বৃথা দাদা, সব বৃথা……

38
Sun, 09/01/2024 - 11:28

 

যে জগতে কোনো নোটিফিকেশনের লাল দাগ, শব্দ নেই…. যে জগতে কোনো রিয়্যাক্ট দেওয়ার হাতছানি নেই, বাধ্যতা নেই….. যে জগতে কোনো অক্ষর নেই…. নাচ, গান, অভিনয় নেই……

সেই জগতে আমি কতটা সৎ? কতটা উদার? কতটা সংবেদনশীল?

ভার্চুয়াল শব্দের মানে অভিধান করেছে, “not physically existing as such but made by software to appear to do so”.

অর্থাৎ প্রযুক্তি নির্মিত জগত। আগে ছিল জগতের সম্বন্ধে পরিমাপযোগ্য, পরীক্ষাযোগ্য জ্ঞানের পদ্ধতি বিজ্ঞান। জগতের বিজ্ঞান। বিজ্ঞানকে ধরে জন্মালো প্রযুক্তি। তারপর প্রযুক্তি বানালো বিনোদনের‍, নিত্য জীবনের সুবিধার, চিকিৎসার, জ্ঞান আরোহনের নানা উপাদান। এখন প্রযুক্তি বানাচ্ছে সমাজের অনুকরণে আরেকটা সমাজ। সিটিজেন থেকে নেটিজেনে উত্তরণ। প্রযুক্তি বদ্ধ সমাজ না, প্রযুক্তি নির্মিত সমাজ। প্রযুক্তি আগেও সমাজকে বেঁধেছে দ্রুত যানবাহনে, ফোনে ইত্যাদিতে। কিন্তু প্রযুক্তি চিন্তা-আবেগকে নিয়ন্ত্রিত করার ক্ষমতা রাখত না। আজকে AI যা পারছে।

এর থেকে মুখ ফেরানোর কথা বলা মানে প্রলাপ বকা। এ লেখাটাও এইখানেই লিখছি। ওই শঙ্করাচার্যের মত বলতে চাইছি, শব্দজালং মহারণ্যং চিত্তভ্রমণকারণম - শব্দের জাল গভীর অরণ্যের মত যা চিত্ত বিভ্রমের কারণ।

এ কথাও শঙ্করাচার্য শব্দের মাধ্যমেই বুঝিয়েছিলেন। তেমনই এ কথাগুলোও এখানে বললে দোষের হয় না, কারণ মহাজনের পথ অনুরসরণ করাই বিধান।

কিন্তু এ কথা হঠাৎ কেন বলছি?

প্রযুক্তি নির্মিত জগত অসীম। কিন্তু বাস্তব জগত সীমাবদ্ধ। খুব ছোটো পরিমণ্ডলে যাতায়াত সেখানে। যদি না তিনি সেলিব্রিটি হন। কিন্তু সাধারণ মানুষের গোটা জীবনে আর ক'টা মানুষ সঙ্গে ওঠাবসা হয়? নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের একটা ছোটো বৃত্তে জীবন কেটে যায়। আনন্দে কেটে যায়। পরিপূর্ণতায় কেটে যায় যদি বাঁচতে জানি তো। সেই ছোটো পরিবৃত্তে আমি কতটা সৎ? কতটা অ্যাভেইলেবল? কতটা অ্যাপ্রোচেবল? সেখানে কি আমি দায়সারা? নিজেরটুকু হলেই হয়ে যায়? সেখানে কি আমি অন্যের কথা শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক? সেখানে কি আমি সাফোকেটিং?

ছোটো জায়গায় হীন চিন্তা, হীন উদ্দেশ্য খুব জোরে বাজে না। নিজের একটা ছোটো ঘর নোংরা করেও রাখা যায়, আবার পরিষ্কার করেও রাখা যায়। কিন্তু শপিংমলের বেলায় তা হয় না। তেমনই ছোটো বৃত্তে আনায়াসে হীন হতে পারা যায়। কিন্তু প্রযুক্তির মঞ্চে সেটা সম্ভব হয় না। সেখানে সম্পর্কহীন হাজার মানুষের অহর্নিশি খুঁতখোঁজা শোঁকাশুঁকি চলছে। সেখানে সাবধানী মানুষ। অতিসাবধানী। তাই কৃত্রিম। সেখানে নকলে-আসলে পার্থক্য করার দায় নেই, সেখানেই তুবড়ির মত জ্বলে থাকার সময়সীমাই আসল। সেটাই বাহবা পাওয়ার মূল মাপকাঠি।

যে পুরোহিত নিজের বাড়ির পুজো নমো নমো করে সারে, তাকেই দেখেছি দুর্গাপুজোর প্যাণ্ডেলে মাইকের সামনে অতি সাবধানী হয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করছে। এটাই স্বাভাবিক মানুষের প্রকৃতি।

কিন্তু এরপরেও কিছু কথা আছে। তা হল ওই ছোটো বৃত্তটায় খাঁটি না থাকলে বাকি সব জায়গায় বানানো প্রাসাদ অল্প হাওয়াতেই ভেঙে পড়ে। মানুষে মানুষে খাঁটি সম্পর্ক যে গুণের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার নাম - আস্থা। আস্থা ছাড়া কোনো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক মানসিক সাম্য রাখাই কঠিন, বাকি সুখ-আনন্দ তো দূরের ব্যাপার।

এইখানে একটা ফাঁক তৈরি হতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে আস্থা চর্চার অভ্যাস কমে আসছে। প্রযুক্তি নির্মিত জগতে বা ভার্চুয়াল জগতে আস্থা শব্দটা গৌণ, সেখানে অনুসরণকারী, ফ্যান, ফলোয়ার ইত্যাদি লাভ-লোকসানের সংখ্যার হিসাব। আস্থা চর্চা সেখানে সম্ভব না। তাই দেখছি আধুনিক প্রজন্মের বাচ্চাদের মধ্যে যারা ভীষণভাবে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা, তাদের বাস্তবজগতে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করতে আস্থা বা ট্রাস্ট একটা ইস্যু হচ্ছে। এটা কিন্তু মানবপ্রকৃতি না। একটা আস্থাভাজন সম্পর্ক হাজার একজন ফলোয়ারের তুল্যও নয়। একটা আস্থাভাজন সম্পর্ক না থাকলে, লক্ষ লক্ষ ফলোয়ারও আমার মানসিক সাম্য ঠিক রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। আমার প্রকৃতিতে বিকার জন্মাবেই।

মানুষ চাইলে অনেক কিছু বদলাতে পারে কিন্তু মানবপ্রকৃতির বাইরে যেতে পারে না। এই মানবপ্রকৃতির ধারণায় সন্দেহ করে এক সময়ে কিছু অতিবুদ্ধিজীবী বৌদ্ধিক জগতকে অনেকটা বিভ্রান্ত করেছেন এক সময়ে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সে যুগ আমরা ফেলে এসেছি। কিন্তু আজ এই প্রযুক্তি নির্মিত জগত মানুষের পারস্পরিক আস্থা চর্চার অনুশীলনকে গৌণ করে যে ইগোকেন্দ্রিক বিনোদনের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে তা মানুষের প্রকৃতির জন্য একদমই স্বাস্থ্যকর নয়।

আমার চারপাশের বাস্তব জগতের কয়েকটা সম্পর্ক নিয়ে তৈরি ক্ষুদ্র গণ্ডী আমাকে হীন হওয়ার অবকাশ দিলেও, আমাকে হীন হওয়ার পরামর্শ দেয় না। আমি যদি এই ক্ষুদ্র গণ্ডীতে সৎ থাকি, সংবেদনশীল থাকি, দায়িত্ববান থাকি তবে সে-ই আমার আসল কর্তব্য। আমার জীবনের সার্থকতা। সে আমি সেলিব্রিটি হই চাই না হই, পুরষ্কার, উপঢৌকন, নাম, খ্যাতি ইত্যাদি পাই চাই না পাই। ওইটুকুই আমার দাবিদাওয়ার জগত। আমার আমিকে গড়ে তোলার জগত ওই কজন মানুষের উপর সৎ থেকে, সংবেদনশীল থেকে। গোটা জগতের উদ্ধারকর্তা হওয়ার দায় আমার নেশা। স্বয়ং খ্রীষ্টই এসব সোশ্যালমিডিয়া আসার আগে বলছেন শুধু পাশের মানুষটাকে ভালোবাসার কথা, সেই তার চূড়ান্ত আদেশ। কমেন্ডমেন্ট। জগতকে ভালোবাসা তো কাব্যিক আবেগ, নয় তো ফ্যাটি ইগো সিণ্ড্রোম। বাস্তব না। স্বাস্থ্যকর তো নয়ই।

আজ সমাজের ভিতটাই প্রশ্নের মুখে। আস্থা একটা ধ্রুব অচল কিছু না। আস্থা একটা অনুশীলনের গুণ। অর্জন করতে হয়। আমার জীবনে যাবতীয় যা কিছু অর্জন অর্থহীন হয়ে যেতে পারে শুধু সম্পর্কের আস্থাহীনতায়। শারীরিক মৃত্যুর থেকে ভয়ংকর সে মৃত্যু। হাজার মানুষের মধ্যে থেকে একাকীত্ব যে কী কঠিন মৃত্যু সে আশেপাশে ভালো করে তাকালেই দেখা যায় কীভাবের এর শিকারের পরিমাণ বাড়ছে সমাজে।

এত কোলাহল ছাপিয়ে এইটুকুই শুধু বলতে চাই, নিজেকেও বলতে চাই, ওই ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে যদি নিজেকে আস্থাভাজন করে বাঁচতে না পারি, তবে শেষে সবটাই ফাঁকি। ফাঁকির ফল কখনও মিঠেও হয় না, তিতেও হয় না, শূন্য হয়। মৃত্যুর আগে শূন্যতার সঙ্গে সহবাস কোটি মৃত্যুতুল্য।

39
Thu, 08/29/2024 - 11:17

 

বিদ্যাসাগর এক ধনী মানুষের বাড়িতে বসে গল্প করছিলেন। এমন সময় এক ভিখারি আসে। গৃহকর্তা অপমান করে তাকে তাড়িয়ে দেন।

বিদ্যাসাগর, "আসছি" বলে উঠে যান। দৌড়ে গিয়ে রাস্তায় সেই ভিখারিকে ধরেন, তাকে বলেন, তোকে একটা টাকা দিতে পারি, তুই যদি ওই বাড়ি আর যাবি না কথা দিতে পারিস!

রবীন্দ্রনাথ যে গাড়িতে উঠছেন পাহাড়ে, সেই গাড়ির চালক কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে পিছনে আসা গাড়ি থেকে একজন নেমে বলেন, আপনি এ গাড়িতে চলে আসুন।

রবীন্দ্রনাথ আসেননি। কারণ ওতে ওই ড্রাইভারের অপমান হয়।

এমন অজস্র ছোটো ছোটো ঘটনার স্মৃতি আমাদের আছে।

বড় মানুষ অন্যের তুচ্ছতম অপমানও সহ্য করতে পারেন না। নিজের পর্বতসদৃশ অপমান হজম করে যান। এইটুকুতেই ওঁদের সঙ্গে সাধারণের যা পার্থক্য। বড় মানুষেরা বারবার দেখান, তুচ্ছ অপমান বলে কিছু নেই, যদি সেটা অন্যের সঙ্গে আমার সামনে করা হয়।

আমাদের সমাজের ইতিহাসে দেখেছি যে, জ্যান্ত একজন মানুষকে যাতে চিতায় পুড়িয়ে না ফেলা হয় সেটা নিয়ে শাস্ত্রের প্রমাণের সঙ্গে সঙ্গে কোর্টকাছারি করতে হয়। একজন বাল্যবিধবার বাঁচার অধিকারের জন্য শাস্ত্রমন্থন করে প্রাণপাত করতে হয়। এত এত অতিচেষ্টা করতে হয় সবার বোধগম্য এক সাধারণ মানবিক অধিকারকে কায়েম করতে। ওদেশে যেমন সাদাকালোর বৈষম্য নিয়ে কিং-এর আত্মবলিদান। অন্যান্য প্রাণীর ইতিহাস অস্তিত্বের জন্য সংগ্রামের ইতিহাস কেবল। মানুষ ইতিহাস ক্ষমতার শুধু নয়, আত্মসম্মানের জন্যও সংগ্রামের ইতিহাস।

আমাদের সমাজে এ অপমান অহরহ ঘটে। সেই স্কুলজীবন থেকে শুরু হয়। 'শিক্ষকতা' আর 'মাষ্টারি'র মধ্যে যেন একটা বিশাল পার্থক্য আছে। শিক্ষকতা যে উদারতা, সহনশীলতা, সাম্যের উপর দাঁড়ায়, মাষ্টারি দাঁড়ায় না। সে এর বিপরীতে দাঁড়িয়ে, 'কাজ আদায় করে'। 'মার্ক্স আর্নিং' সেখানে মুখ্য, 'লার্নিং বাইপ্রোডাক্ট'। কথায় কথায় তুলনা, অপমান। বাবা-মায়ের ক্ষোভ, ক্ষোভজাত আক্রোশ। সে যে কী ভয়ংকর জায়গায় পৌঁছাতে পারে সে যার অভিজ্ঞতা আছে সেই জানে।

যে কোনো প্রতিযোগিতা মানুষকে কিছুটা হলেও অসংবেদনশীল করে তোলে। আর সেখানে প্রতিযোগিতা যখন ভীষণ অস্বাস্থ্যকর জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে লাভ-ক্ষতি ছাড়া নীতি নির্ণায়ক আর কোনো ম্যাক্সিম নেই, সেখানে তো ব্যাপারটা আরো হতাশাজনক। জন ডুইয়ের মত প্র‍্যাগমাটিজিম দর্শনের প্রবক্তাও শিক্ষাকে এমন সঙ্কীর্ণ অর্থ করেননি প্রয়োগবাদের।

কিন্তু আমাদের অভ্যাস আছে ছোটো-ছোটো অপমানকে অগ্রাহ্য করার। যে সভ্যতা যত উন্নত সে ব্যক্তিবিশেষের মানরক্ষাতে তত সংবেদনশীল আর তৎপর। সে সভ্যতা একটা শিশুর বেড়ে ওঠার সময় তার মানসিক বিকাশ যাতে কোনোভাবে কোনো বিরূপ সমালোচনা, নিন্দা বা অতিশাসনে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে নিয়ে সজাগ। সে দেশে আইনও আছে সে নিয়ে যা আমাদের কাছে 'বাড়াবাড়ি'।

সমাজের ছবিটা যদি বদলাতে হয়, তবে এই ছোটো-ছোটো অপমানগুলোর ব্যবস্থা আগে করতে হবে। কোনো বড় কিছু ঘটলে বড় আন্দোলন অবশ্যই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রতিদিন আমরা এমন অনেক কিছু এড়িয়ে যাই, যা এড়িয়ে না গেলে অনেক বড় ঘটনাকে ঠেকানো হয় তো যেত।

কোনো বড় মানুষের বিশেষত্বই হল, সে দুর্বলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে অপমান করে না। তার অসহায়তার সু্যোগ না নেওয়া। আর এ শিক্ষা স্কুল থেকেই শুরু হওয়া উচিৎ। শিক্ষা বিকশিত করে একজন মানুষকে। আর মাষ্টারি শুধুমাত্র যে করেই হোক আখের গোছানো শেখায়। আখের গোছানোতে কোনো খারাপ কিছু নেই, কিন্তু সারাটা জীবন শুধু আখের গুছিয়েই কাটালে গোটা মানুষ হয়ে ওঠা যায় না, এই ব্যর্থতাটা না বুঝতে পারাটা যে কী ভীষণ ব্যর্থতা তা তারা বোঝে না।

আলোচনা দীর্ঘ করে লাভ নেই। বড় মানুষের বড় দিকটার থেকে ছোটো-ছোটো দিকগুলো আমাদের কাছে অনেক বেশি আলো আনে। সে আলোয় যতটা রাস্তা নিজের জন্য আর পাশের মানুষটার জন্য আলোকিত করা যায়, এইটুকুই চেষ্টা আরকি।

40
Mon, 08/26/2024 - 13:21

 

মনুষ্যজাতির প্রতি প্রেম নিয়ে কোনো রোম্যান্টিসিজম রামকৃষ্ণদেবের ছিল না। সংহতি, সম্প্রীতি, সমন্বয়ের প্রতি অনুরাগ ছিল, কিন্তু “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ” - এ মতে বিশ্বাসী ছিলেন না।

সব মানুষ কি বিশ্বাসযোগ্য?

রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে, না। সব জল পানযোগ্য নয়। বাঘের মধ্যেও নারায়ণ আছে, তাই বলে বাঘকে আলিঙ্গন করা যায় না।

বেদান্তদর্শন অনুযায়ী অস্তিত্বের প্রতিটা কণা সচ্চিদানন্দের প্রকাশ। কিন্তু সে তো তত্ত্ব। বাস্তব?

এইখানে রামকৃষ্ণদেবের দর্শন বলে, তুমি যাকে বাস্তব বলছ, ওটা লীলা।

লীলা মানে কী? মানে হল যা ঘটছে। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য মাথায় রেখে ঘটছে না। কাম্যু এককালে জগতকে অ্যাবসার্ডিজম তত্ত্বে দাঁড় করিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। অর্থাৎ যা কিছুই ঘটে তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। রামকৃষ্ণদেব কাম্যুর গালটা টিপে দিয়ে বলবেন, এ মায়ার জগত, এটির পর উটি হবে, এখানে অত নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এটা তুমি ঠিক বুঝেছ। ভীষ্মও মৃত্যুর আগে শরশয্যায় শুয়ে কেঁদেছিলেন। কারণ জিজ্ঞাসা করা হল, মশায় কেন কাঁদছেন, আপনি তো জ্ঞানী।

তখন ভীষ্ম হাতজোড় করে কৃষ্ণের দিকে ফিরে বলেছিলেন, এত এত বিদ্যায় পারঙ্গম হলাম, কিন্তু তোমার কার্য কিছুই বুঝতে পারলাম না। যে তুমি পাণ্ডবদের এত সহায়, তাদেরই বিপদের অন্ত নেই।

শ্রীগোবিন্দ হেসেছিলেন।

======

শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন, মানুষ একটা ভয়ংকর জীব। তার মধ্যে এক অসম্ভব বিধ্বংসী ক্ষমতা লুকিয়ে আছে।

একটা মামুলি চকোলেট বোম মানুষ কত সাবধানে ফাটায়, একটা গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে মানুষ কত সতর্ক থাকে। কিন্তু সে সবের থেকে লক্ষগুণ ভয়ংকর মানুষ। চাইলে সে কী না করতে পারে। বর্তমানে বাংলা সাক্ষী। কী ভীষণ পণ্ডিত মানুষেরা কী ভয়ংকর হতে পারে। কিন্তু সেই মানুষকে নিয়ে মানুষের ভাবনা কত কম। কী জানছি সেটাই বড় বিষয়, কে জানছে, তার দিকে তাকিয়ে দেখার সময় নেই।

রামকৃষ্ণদেব সেটার দিকে তাকাতে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ওহে তোমরা কী কী জানছ সে নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই, কিন্তু কে জানছে সে খেয়াল রাখছ তো? শুদ্ধখাঁটি দুধ রসুনের বাটিতে রাখছ না তো? গন্ধ হবে কিন্তু।

তখন যদি প্রশ্ন করো, কে জানছে, সেটা কী করে জানব?

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, হুঁশ আছে? কী করছ হুঁশ আছে? হুঁশ মানে জাগা অবস্থা না। সে তো পাগলেও জেগে থাকে। হুঁশ মানে তুমি যে জেগে আছ সে খেয়াল আছে? বোধের গভীরে যে বোধ তোমার বোধকে দেখে যাচ্ছে সে বোধ হয়েছে? ওই গভীরতম বোধকেই আমি “মা” বলি। চৈতন্যময়ী। অখণ্ড চেতনার স্রোতে চৈতন্য, বুদ্ধই একটা বিন্দুমাত্র, তুমি কী তবে, ভেবে দেখেছ?

কী জানছ সেটা বড় কথা নয়, কে জানছে সেটাও খেয়াল রেখো। যে জানছে তাকে পরিশুদ্ধ করার কী পদ্ধতি বার করেছ? ধর্ম মানে চিত্তশুদ্ধি। তা সেই চিত্তশুদ্ধির জন্য কী ব্যবস্থা করেছ? কোন ডায়গনেস্টিক সেন্টারে তার পরীক্ষা হয়? শরীরের পরীক্ষার তো একটার পর একটা যন্ত্র বার করেই যাচ্ছ। মনের গতিও ঠাহর করতে শিখেছ। কিন্তু মন তো জড়। ধোপা ঘরের কাপড়। যে রঙে ছুপাবে সেই রঙ ধরবে। যে সঙ্গে মনকে রাখবে সেই সঙ্গের রঙ ধরবে, তবে? মনের মালিকের খেয়াল রাখো?

তাকে পরীক্ষা করার উপায় হল সাধুসঙ্গ। না না, সাধু মানে সেইন্ট, বা মঙ্ক না। কোনো ড্রেসকোড বা কোনো লাইফস্টাইল না। ব্যাধগীতা পড়োনি? সেখানে এক ব্রহ্মচারীকে শুদ্ধজ্ঞান দিচ্ছেন এক গৃহিনী আর এক ব্যাধ। ওই হল সাধুসঙ্গ। যে জেগে আছে বোধে, তার সঙ্গ। করো?

=======

সাপে ছোবলায়, বাঘে কামড়ায়, আরশোলায় চাটে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু মানুষ?

মানুষের ক্ষতি করার ক্ষমতা সহস্রনাগের মত। তার ছলচাতুরীর শেষ নেই। সংসারের মধ্যে ঢুকে দেখ সবাই সবাইকে ব্যবহার করে যাচ্ছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মা-বাবা অবধি। কেউ বাদ যাচ্ছে না। কেউ এক ইঞ্চি স্বার্থ ছাড়ছে না। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশি সবার মধ্যে চলছে ছলচাতুরীর গুপ্ত খেলা। কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সবাই সবাইকে আড়চোখে দেখে। কবি বলেছিলেন।

মানুষের শরীর মনের সঙ্গে গিঁট দিয়ে বাঁধা। মন বিশ্বাসের তেলে চলে। বিশ্বাস নেই তো মন নেই। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সব চাইতে দীর্ঘমেয়াদি যে ক্ষতিটা করতে পারে, সে হল তার বিশ্বাসকে ভেঙে চুরমার করে দিতে পারে। তার বিশ্বাস করার ক্ষমতা যত দুর্বল হয়, তার বেঁচে থাকার পরিধি ক্রমে তত সঙ্কীর্ণ হয়। শেষে তার এক কারাগারবদ্ধ জীবন হয়ে দাঁড়ায়। কেন? বিশ্বাস করার ক্ষমতা হারানোর পঙ্গুত্বে।

প্রথমে বিশ্বাস অর্জন। তারপর তাকে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করা। তারপর তাকে সুযোগ বুঝে ভেঙ্গে ফেলা। মানুষটাকে পঙ্গু করে দেওয়া।

ভবনাথের মন খারাপ। কেন? বন্ধুর সঙ্গে মনোমালিন্য হয়েছে। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তা দু একবার কথা বলার চেষ্টা করে দেখ, যদি কথা বলে তো ভালো। না হলে কি সেই নিয়ে বসে থাকবি? না না। যে মন ঈশ্বরকে দিবি সে মন এইভাবে কেউ বাজে খরচ করে?

রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে এই এক অদ্ভুত প্রশ্ন? বারবার এ প্রশ্ন কথামৃতে ঘুরে ফিরে আসছে। মন কোথায় তোমার? হ্যাঁ গো, তোমাকেই বলছি, মন কোথায় রেখেছ?

মন পুষ্ট হয় কীসে? বুদ্ধি সমৃদ্ধ হয় কীসে? অনুরাগে। কী সেই অনুরাগ? সব জানতে পারবে। আগে রাজী হও। নিজেকে পরিশুদ্ধ করবে বলে যদি স্নানের ঘরে আসো, আমি তোমার ছোঁচাবার জলেরও ব্যবস্থা করে দেব। কিন্তু তোমাকেই নিজেকে নিজে শুদ্ধ করতে হবে। অনুরাগে।

কিন্তু কার উপর অনুরাগে?

নিজেকে জানতে জানতেই সে টের পাওয়া যাবে। আগে কলকাতায় এসো, এলেই কোথায় মনুমেন্ট, যাদুঘর খোঁজ পাবে। আগে নিজেকে শুদ্ধ করো। নিজের শুদ্ধমুখটা নিজের বোধের আয়নায় ধরো। তারপর একদিন খুঁজে দেখো সে আয়নাটা কী? কিন্তু আপাতত এসো।

ধীরে ধীরে অনুরাগে জন্মাবে দরদ। দরদ ধী জাত। সে দরদ ফোঁস করতেও জানে, ক্ষমা করতেও জানে। কিন্তু সে দুই কাজ করার ক্ষমতা জন্মায় ধারণা শক্তির উপর। সে ধারণা শক্তি জন্মায় সাধুসঙ্গের উপর। সাধুসঙ্গ করো মন, সাধুসঙ্গ করো। ডুব দাও যে ডুবে আছে তার সঙ্গে। যে ভাসছে তার হাত ধোরো না, ভাসিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেব। যে ডুব দেয় আর ওঠে, তার হাতটা ধরো, সে পায়ের তলায় মাটি দেবে। এ বিষাক্ত সংসার থেকে বেরোবার ডুব সাঁতার শেখাবে। ডুব সাঁতার শিখে নিলে মূলের সন্ধান পাবে। মূল ছেড়ো না মন। মূল ছাড়লে সব ভুল।

41
Thu, 08/22/2024 - 12:51

 

 

আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের উপর দরদ দেখানো যায়, তার দাবী নিয়ে রোম্যান্টিসিজমের দিন গেছে। তারা রুগীই হোক, কি শ্রমিক, তাদের জন্য একজোট হয়ে কথা বলার মানুষের এখন আকাল। এককালে এক ধরণের রাজনীতির মানুষেরা বলতেন তাদের কথা। এখন ওসব অতীত।

আমাদের বাংলা সিনেমায় অনেক নায়কের উপার্জন কম হত, স্ত্রী নিয়ে বড় পরিবারে নানা গঞ্জনা সহ্য করতে হত, এমন অনেক সিনেমা আমরা দেখেছি। চোখের জল ফেলেছি। তারপর চিনাবাদাম কিনে বাড়ি ফিরেছি। কারণ এ সব সিনেমা যখন হত তখন সিনেমা হলে পপকর্নের যুগ আসেনি।

দরদ দুটো হয়, এক খাঁটি, দুই হিসাবি। খাঁটি দরদ দুর্লভ। কিন্তু হিসাবি দরদ না। হিসাবি দরদ অর্থলাভ আর প্রচারলাভ - এই দুই খাতে হয়। প্রচার বা অর্থ এ দুটোই যখন দুর্লভ, তখন বিষয়টা অনায়াসে আনদেখি করে রাখা যায়।

জগত কীসের বশ? টাকার বশ। ধর্ম থেকে রাজনীতি, খেলা থেকে শিক্ষা ব্যবসায়ীর হাতে। অর্থ লাভের দাবী বোঝে, ন্যায়ের দাবী না। একটা সমাজে যখনই মানবাধিকার কমিশন বসাতে হয় তখনই বোঝা যায় মানবাধিকার বস্তুটা বড় সংকটে। কিন্তু কী সেই মানবাধিকার? হো হো হো। থাক সে কথা।

হেলদি স্কেপটিসিজম ভালো জিনিস। কিন্তু সেটা যখন সিনিসিজমের দিকে যায় তখন মানুষ বড় অসংগত কথা বলে। তখন সবেতেই ভুরু কোঁচকায়।

কিন্তু গরীবের দাবীটা না তো স্কেপটিসিজিমের আওতায়, না তো সিনিসিজমের আওতায়। সেটা এমনই স্থূল, এমনই অকাব্যিক, এমনই রূঢ় আর এমনই বৌদ্ধিক জগতে মিসফিট যে তাকে নিয়ে না তো চলে আলোচনা-তর্ক, না তো চলে রোম্যান্টিক দেখনদারি কিছু।

তবে? আসলে গরীবের দাবীটা অনেকটাই মনুষ্যত্বের প্রাথমিকদাবীগুলোর কাছাকাছি। অর্থ যেখানে, সেখানে যত্ন, মিষ্টিভাষা, তাড়াতাড়ি একটা কম্প্রোমাইজের রাস্তা পেতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু দরদ দিয়ে কী করা যায়? কিস্যু না। কয়েকটা নাটকীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কিন্তু তাদের দাবীকে সম্মান জানিয়ে, তাদের অজ্ঞতা, তাদের অসংস্কৃতভাবে বেঁচে থাকার ইচ্ছা, দুটো টাকা জমানোর বেয়াড়া লোভকে একটু কনসিডার করে কাছে ডাকা যায়? যায় না।

তাই তারা এই এত আলোর আড়ালে অন্ধকারেই পড়ে থাকে। সে রুগীই হোক, কী শ্রমিক। চামড়ায় পিন ফোটালেও লাগে, আদলা ইঁট লাগলেও লাগে, কিন্তু চিত্ত বড় সিলেক্টিভ। কীসে দরদ জাগে, কাতে দরদ জাগে, কোন হাওয়ায় পাল তোলে আর কোন হাওয়ায় পাল তোলে না, সে কম্পাসের গতিবিধি বোঝা বড় শক্ত। সবার তো আর দল গঠনের বুদ্ধি-অর্থ বল থাকে না, না! তাই তাদের ক্ষীণ কণ্ঠের যন্ত্রণার ডাক এত কোলাহলে পৌঁছায় না উঁচুমহলে। সে অন্ধ তুলাদণ্ডীর কাছে যদিও বা পৌঁছায়, তার দুর্বল আবেদনকে নস্যাৎ করেই দেওয়া যায়। আপাতত তারা যেমন আছে থাকে। পরে যে কজন বেঁচেবর্তে থাকে, তাদের নিয়ে কাজ শুরু করা যাবে। গরীব এক আশ্চর্য রক্তবীজ, ওরা থেকেই যায়..... নিঃশেষ হয় না। ডাকলেই আবার সুড়সুড় করে চলে আসবে দেখবেন। এমন মেরুদন্ডহীন জাত একটা! শালা লোভী, অসংস্কৃতের দল!

42
Wed, 08/21/2024 - 12:46

“ছেলেদের ছোটোবেলা থেকে মেয়েদের সম্মান করতে শেখাতে হয়।’’

এই কথাটার মানে বড্ড অস্পষ্ট। সম্মান করতে কি শেখানো যায়? কাউকে বাইরে থেকে একটা সম্মান করার ম্যানারিজম শেখানো যায়। কিন্তু আদতে সম্মান তো ভীষণ আন্তরিক আর পার্সোনাল জিনিস, ওটা শেখানো কী করে যায় কাউকে?

যেমন নম্রতা। নম্রতার ম্যানারিজম বা ভানটুকু শেখানো যায়। কিন্তু নম্রতাটা তো ভীষণ আন্তরিক আর পার্সোনাল জিনিস, ওটা কি শেখানো যায়?

সম্মান করতে শেখাটা ভীষণ পরোক্ষ শিক্ষা বলে আমার মনে হয়। আমি কী পরিবেশে বড় হচ্ছি, সেই পরিবেশে বন্ধ দরজার পিছনে মেয়েদের সঙ্গে পরিবারের লোকজন কেমন ব্যবহার করছেন, কী ভাষায় কথা বলছেন, সেটা ভীষণ ম্যাটার করে বলে আমার মনে হয়। আমি যদি দেখি বাবা মাকে কথায় কথায় অসম্মান করছেন, বাড়ির আরো বড়রাও কথায় কথায় বাড়ির মেয়েদের অসম্মান করছেন, তখন আমাকে যতই উপদেশ শিক্ষক, মহাপুরুষের বাণী, সিনেমা, সমাজের হোতারা দিন না কেন, আমার কাছে ওটা একটা অর্থহীন, লোক দেখানো স্টেটমেন্ট ছাড়া কিছুই নয়। অন্তঃসারশূন্য ম্যানারিজম।

আসল হল আমার পরিবেশের, আমার চারপাশের লোকের আচরণ। প্রথম আমার পরিবারের। আমার মনে হয় যেখানে যত অ্যাবিউজার জন্মেছে তারা এমন পরিবেশে বড় হয়েছে যেখানে মেয়েদের সম্মান নিয়ে কোনো স্পষ্ট ধারণা অনেকেরই নেই। আসল সমস্যাটা তাদের শৈশবের।

আসলে শিশুদের যতটা সরল, একমাত্রিক বলে আমাদের মনে হয়, আদৌ তা নয়। একজন ভণ্ড মানুষের ভণ্ডামিটা সে দারুণভাবে বুঝে যায়, আর কপি করে নেয়। আমি এমন পরিবার দেখেছি আপাতভাবে মনে হবে মেয়েদের যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া হয়, গুরুত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু কদিন সে পরিবারের সঙ্গে থেকে দেখেছি সেটা আসলে একটা মুখোশ। আদতে সেখানে খুব সুক্ষ্মভাবে একটা পুরুষতন্ত্র চলে। মজার কথা হচ্ছে পরিবারের বাচ্চাগুলোও ধীরে ধীরে সে চাতুরীটা শিখে নেয়। কেউ কেউ বড় হয়ে অতটা চাতুরী রাখার মত কৌশলবিদ না হওয়ায় তার রুক্ষতাটা সবার সামনে ধরা পড়ে যায়। আশেপাশের মানুষ বলে তোর পরিবারে তো এমন কাউকে দেখিনি….তুই কী করে এমন হলি….?

আমি অবাক হয়ে যাই কী ওপরসা দৃষ্টিতে ভুলে থাকে মানুষ। কী সহজে সাদা-কালোয় বিচার করে নেয় মানুষ। একটু তলিয়ে, নেড়েঘেঁটে ভাবার অভ্যাসটাই হয়নি যে আমাদের। শেখানো বুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম আওড়িয়ে যাচ্ছি। একই কাঁচে দেখতে দেখতে কাঁচটা যে ঘষা কাঁচ হয়ে গেছে, সে বোধটাও রাখছি না।

মেয়েদের সম্মান করতে শেখো, বললেই আমার মনে হয় যেন, সম্মান করা বা না করা নিয়ে আমার যেন কোনো চয়েস আছে। না, আমার কোনো চয়েস নেই। আমার এটা স্পষ্ট দেখার আছে, বোঝার আছে। আমার চয়েস না এটা। এটাই সত্য। তার ডিগনিটিটাকে নিজের ডিগনিটি দিয়ে দেখতে শেখাটা আমার বোধবুদ্ধির সুস্থতার লক্ষণ। সেটা শেখানো যায় না, সেটা একজন সুস্থ মানুষ সুস্থ পরিবেশে বড় হলে আপনিই চারপাশ থেকে ইম্বাইব করে নেয়। ওভাবেই তার সুস্থ জীবনের ভিত গড়ে ওঠে।

কিন্তু আমরা যতটা মৌখিক শিক্ষায়, বাইরের শিক্ষায় ভরসা রাখি, ততটা আচরণের শিক্ষায় ভরসা রাখি না। মুখের ভাষা স্থান-কাল অনুযায়ী বদলানো যতটা সহজ, আচরণ না যে। কিছুক্ষণ অভিনয় করা যায়। তারপর? তাই এই আচরণের দিকটাকে আমরা গুরুত্ব কম দিই, আর ভাবি আমার মহামূল্য যুক্তিবান বাণীর আলোতেই আমার সন্তানের বিবেক দীপ প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠবে। কাঁচকলা হবে। আমার আচরণ যদি আমার বাক্যের অনুরূপ না হয় সে বাক্য বন্ধ্যা। তার দ্বারা কোনো কাজই হয় না।

প্রথম কথা এটাই, শেষের কথাও এটাই, কাউকেই সম্মান করতে শেখাটা আমার কোনো চয়েস না। ওটা কোনো ম্যানারিজম না। ওটা আমার মধ্যে যদি স্বাভাবিকভাবে না জন্মায়, না আসে, তবে বুঝতে হবে আমার পার্সোনাল লাইফে কোনো গুরুতর সমস্যা আছে। আগে তার সমাধানের রাস্তা যেন খুঁজি।

আর রইল সম্মান আর মহিলার উপর নিপীড়নের যোগাযোগ। সেও খুব স্পষ্ট বলে আমার মনে হয় না। আমি সদ্য ঘটে যাওয়া কল্পনাতীত ঘটনাটা ছেড়েই দিলাম। রাস্তাঘাটে, ট্রেনেবাসে মহিলারা যে বিকারের শিকার হন সেটা সেই পুরুষেরা তথাকথিতভাবে “মেয়েদের সম্মান” করতে পারে না বলে করছে, এ যুক্তিটা আমার অতি-সরলীকরণ মনে হয়। অনেক অ্যাবিউজারই ভীষণ সুইট-মাউথ, জেন্টল হয় লোকালয়ে। তাদের স্বরূপ বেরোয় গোপনীয়তায়।

আমার যেটা মনে হয়, সেই সব পুরুষেরা প্রথম যেটা খুইয়ে বসে সেটা আত্মসম্মানবোধ। কাউকে সম্মানের কথা পরে আসে। কেন খুইয়ে বসে? কারণ তার প্রবৃত্তির তাগিদ এমনই হয় যে স্বাভাবিক বিবেক-বিবেচনা বোধ কাজ করে না তখন। তার সমস্ত আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ওই প্রবৃত্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে তখন।

এই আত্মনিয়ন্ত্রণও একটা অভ্যাস। যার ভিত্তি আত্মসম্মানের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। আমি বাইরের প্রেস্টিজের কথা বলছি না। আমি তার পার্সোনাল জীবনের আত্মসম্মানের কথা বলছি। যেখান থেকে কোনো দুষ্প্রবৃত্তি মাথায় এলেই সে বলে, আমাকে এটা মানায় না….ছি ছি….একি ভাবছি আমি!

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এই শতাব্দীপ্রাচীন মানব সমাজেই এই দুষ্প্রবৃত্তিকে উৎসাহ দেওয়ার অনেক রাস্তা আছে। অনেক গোপন রাস্তা আছে। আমরা তাদের দেখেও দেখি না। আমরা ভাবি ওর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক?

নানা ঘটনা মনে করিয়ে দেয় আমাদের সম্পর্ক আছে। আমরা হঠাৎ করে উঠে পড়ে সমাজসংস্কারে লাগি। পাহারার পর পাহারা বসাই। আবার আমাদের শৈথিল্য আসে। পাহারা কমে। আবার একই খেলা শুরু হয়।

সত্যি যদি কোনো শিশুকে সত্যিকারের কোনো শিক্ষা দিতেই হয়, তবে আসল শিক্ষাই হল তাকে নিজেকে সম্মান করতে শেখানো। ঠিক-ভুল, ভালো-মন্দের মধ্যে সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে, নিজেকে সম্মান করতে, নিজের মর্যাদাকে নিয়ে সোজা রাস্তায় চলতে শেখে যেন সে। এ খুব কঠিন কাজ কিছু না। কিন্তু এতে আশু গ্ল্যামার নেই, বা বাহবা নেই বলে আমাদের এই আসল শিক্ষা দেওয়াটাই অবহেলিত থেকে যায়। নিজেকে সম্মান করতে শিখলেই অন্যকে সম্মান করাটা আপনিই এসে যায়। তাই দয়া করে কোনো শিশুর আত্মসম্মানকে নষ্ট করবেন না। ওটা সে নিয়েই জন্মায়। তার সেই জন্মলব্ধ আত্মসম্মানবোধকে আলোকিত আর সচল করে তোলাটাই বাইরের শিক্ষক করতে পারেন। কিছু নতুন করে যোগ করার কোনো দরকার নেই।

43
Sun, 08/18/2024 - 12:37

 

শান্ত থাকার মধ্যে কোনো কাপুরষতা নেই। বরং ক্রমাগত অস্থির হয়ে পড়লে স্নায়ুদৌর্বল্য দেখা দিতে পারে। যদি ইতিহাস পড়ে দেখা যায়, দেখা যাবে এই মাটিতেই অনেক বড় বড় সংস্কারক শান্ত থেকেই অনেক প্রাসঙ্গিক, সঙ্গত, মূল্যবান কাজ করে গেছেন। তাদের অনেকের ছবি অনেকের দেওয়ালে আজও টাঙানো আছে।

নইলে কী হয়, বলতেই থাকলে, বলতেই থাকলে, ক্রমে বলার নেশা চাপতে থাকে। তখন কিছুক্ষণ কিছু না বললেই, না ভাবলেই মনে হয়ে, এই যা, আমি কি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি তবে? হারিয়ে যাচ্ছি?

শান্ত থাকার অভ্যাস করতে হবে। যে যাই বোঝাক, শান্ত থাকার মধ্যে কোনো কাপুরষতা নেই। শান্ত থাকা মানে নিষ্ক্রিয় থাকা না। শান্ত থাকা মানে মাথা ঠাণ্ডা রাখা। কোনোরকম উস্কানি, প্রোভোকেশানে নিজেকে সঙ্গত আর সংযত রাখার মত যোগ্যতা অর্জন করা।

হিংসা আর দ্বেষাত্মক উক্তিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে চারদিক। চারদিকে এ ওর দিকে আঙুল উঁচিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু আদতে এগুলো সবই বিভ্রান্তিকর। সোশ্যালমিডিয়া বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য অগ্রণী ভূমিকায় থাকে। তার দোষ সোশ্যালমিডিয়ার না, সমস্যাটা আমাদের। দেখা যায় নেগেটিভ নিউজ যতটা পপুলারিটি পায় পজিটিভ নিউজ অতটা না। "ফাস্ট অ্যান্ড স্লো থিংকিং" বলে যে বইটা বিশ্বের দরবারে ভীষণ প্রশংসিত সেটা একবার উলটে দেখা যেতে পারে। ডিফল্টে যে চিন্তাটা এলো সেটাই যে খাঁটি চিন্তা না, এটা জানা জরুরি। যে কোনো সময়েই ক্রিটিকাল থিংকিংটা জরুরি। চীৎকার করে গলা ফাটিয়ে, আছাড়িপাছাড়ি খেয়ে যে কাঁদল সে-ই আসল শোকটা পেয়েছে, আর যার চোখে শুধু এক বিন্দু জল এসে আটকে আছে সে শোকই পায়নি, শোকের বাড়িতে এমন হিসাব আমাদের অভ্যাসে স্বাভাবিকভাবেই আসে। কিন্তু বাস্তবে কি তাই?

শান্ত থাকার মধ্যে, সংযত থাকার মধ্যে কোনো কাপুরুষতা নেই। একটা প্রশ্ন প্রায়ই শুনি, আপনার মেয়ে যদি হত.....

প্রশ্নটা ভীষণ অসঙ্গত। কারণটা একটু ধৈর্য নিয়ে দেখি। জানেন তো অনেক চিকিৎসক নিজের নিকটাত্মীয়ের অপারেশান নিজে করেন না। কেন বলুন তো? কারণ প্রজ্ঞা, ধৈর্য তখন আবেগ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যাবে বলে। বোমান ইরানি সেই চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে বলছেন না, আজ যদি আমার মেয়ের জন্য আমি অপারেশন করতে ছুরি ধরি তবে আমার হাত কেঁপে যাবে।

এটাই হয়। অর্জুন যখন ওই ভীষণ যুদ্ধে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েছেন, কৃষ্ণের তখন প্রথম সাজেশানই হল মনকে আগে শান্ত করো। নির্ভয়ার মা সেদিন অত্যন্ত সংযত হয়ে লড়ে গিয়েছিলেন বলেই অতদিনের লড়াইটা চালাতে পেরেছিলেন। আবেগ তাড়িত হয়ে সব শক্তি কয়েক মাসে খরচ করে ফেললে অত কঠিন লড়াইটা লড়া যায় না। বাড়িতে কোনো বড় শোক উপস্থিত হলে তাই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুরা তাকে ঘিরে থাকে। কারণ শোক আর ক্রোধ মানুষকে পাগল করে দেয়। কথাটা আমার সঙ্গে ঘটেছে, না অন্যের সঙ্গে ঘটেছে অতটা ম্যাটার করে না, যদি আমি সত্যি সত্যিই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চাই। সেখানে আমার মূল অস্ত্র আবেগ না, আমার মূল অস্ত্র আমার প্রজ্ঞা, আমার ধৈর্য আর সঙ্গত চিন্তা করার অভ্যাস।

শান্ত থাকার মধ্যে, সংযত থাকার মধ্যে কোনো কাপুরুষতা নেই। পরীক্ষা হলে বসে ভীষণ কঠিন প্রশ্নপত্রের সামনে যেমন নিজেকে শান্ত করে নিই আগে, যাতে কোনো জানা প্রশ্ন ভুল না করে আসি, এও তেমন। আসলে আমাদের এই সামাজিক মাধ্যমে কোনটা যে ফ্যাক্ট আর কোনটা ফিকশান বোঝা শক্ত। তেমনই কোনটা অনুভবটা জেনুইন আর কোনটা ফেক, অ্যাজেণ্ডা লুক্কায়িত। কিন্তু নিজেকে শান্ত রাখলে, নিজের চিন্তার কলটাকে সঙ্গতির অনুপানে পুষ্ট রাখলে হঠাৎ করে কোনো প্রোভোকেশানে পা দেওয়া থেকে নিজেকে বাঁচানো হয় তো যায়। এটাই এখন সব চাইতে বেশি দরকার। কাউকে অনুকরণ করার দরকার নেই। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানেই দাঁড়িয়ে নিজের বিবেকবুদ্ধির আলোয় যদি দেখি আমার মত করে হাঁটার রাস্তাটা আমি পেয়েই যাব। এটুকু বিশ্বাস তো নিজের উপর রাখতেই হবে।

44
Thu, 08/15/2024 - 14:41

 

দেখুন আমরা মধ্যবিত্তেরা, সাধারণ মানুষেরা অনেক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ন্যায়-নীতি, সততা ইত্যাদির সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে নিই শুধু নিরাপদে থাকব বলে। শান্তিতে থাকব বলে। আমাদের কাছে নিরাপত্তা আর শান্তি একই কথা। আমাদের এই নিয়ে অনেকে অনেক বিদ্রুপ করে ছাপোষা, ভীতু, সুবিধাবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি বলে। কিন্তু ওই যে ‘'কাঞ্চনজঙ্ঘা’’ সিনেমার ওই ডায়লগটার মত আমাদের লাইফে সিকিউরিটিটাই সব চাইতে বড় কথা এবং শেষ কথা। “আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে” - এই দুধভাতটা আমাদের পুষ্টিবিজ্ঞানের দ্রব্য ততটা না, যতটা আমাদের শান্তি ওরফে নিরাপত্তার পরিচায়ক।

আমরা ভীতু, ভীষণ ভীতু। আর আমরা রাস্তায় নামছি কেন জানেন ওই একটাই কারণে, আমরা ভীতু বলে। আমাদের নিরাপত্তায় থ্রেট এসেছে বলে। আমাদের ঘরে ঘরে লোকনাথবাবার আহ্বান কেন জানেন? আমরা ভীতু বলে। উনি আমাদের রণেবনে ইত্যাদিতে রক্ষা করবেন কথা দেন বলে। আমরা গ্রামের লোকেরা মা মনসা, দক্ষিণারায়, শীতলা প্রমুখ দেবদেবীদের পুজো কেন করি জানেন? হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা ভীতু বলে। আমরা বাঙালিরা ওই যে মাতৃমুখী….দুর্গা, কালী ইত্যাদি পুজো করি, সেও আমরা ভীতু বলে। মায়ের দেওয়া নিরাপত্তার মধ্যে কোনো শর্ত নেই, বাবার আছে। তাই আমরা মাতৃঘেঁষা। এতে আমাদের কোনো লজ্জা নেই। মাইরি বলছি, হ্যাঁ আমাদের কোনো লজ্জা নেই। আমরা গুচ্ছের গুচ্ছের ব্লাড টেস্ট করাই, প্রেসার মাপাই, ইসিজি করাই, ইউএসজি করাই….সব আমরা ভীতু বলে। এই যে মধ্যবিত্তের একটা বড় অংশ পারতপক্ষে খ্যাঁটে টান না পড়লে সরকারি হাসপাতালে না গিয়ে নামী অনামী নার্সিংহোমে যাই, সেও আমার ভীতু বলে। (লেখক যদিও সে গোত্রের না। তার ভরসা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে জওহরলাল হাসপাতাল)। আসলে আমাদের মধ্যে একটা গুজব আছে সরকারি হাস্পাতালে গেলে নাকি চিকিৎসা পাওয়া যায় না, অল্প সময় নিয়ে দেখে ডাক্তারেরা, অনেক লাইন ইত্যাদি।

এই দেখুন না, আমার বাবা তো রেলের কর্মচারী ছিলেন। তো একবার যখন বাবা ভীষণ অসুস্থ হলেন ২০১৭ সালে, আমি বিআরসিং রেলের হাসপাতালে দিলাম। সবাই বললে বাবাকে নাকি মারার ধান্দা করছি। নইলে রিট্যায়ারড মানুষকে কেউ সরকারি জায়গায় দেয়? ওরা তো পেনসান দিতে হবে না বলে আগেই মেরে দেবে। কী আশ্চর্য না? এই গুজবে জানেন বহু রেলের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী রেলের হাস্পাতালেই ভর্তি হন না। সিরিয়াসলি বলছি, ঠাট্টা না। তো বাবা কোমায় চলে গেলেন। লোকে বলল, আর কেন এবার শ্রাদ্ধশান্তির আয়োজন করে ফেল, বাবাকে তো মারার কল করেই ফেলেছ। কিন্তু বাবা সেই হাস্পাতালের ডাক্তারদের চিকিৎসায় আর বাইরে থেকে আমার এক অত্যন্ত সুহৃদ সরকারি চিকিৎসকের চেষ্টায় ফিরে তো এলেন। তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আজ অবধি বাবাকে দেখলেই তাঁদের মুখ মনে পড়ে। ধন্যবাদ জানাই, কৃতজ্ঞতা জানাই।

তো যেটা বলছিলাম, সেই আমরাই আবার বিপাকে পড়লে এসএসকেএম এ একটা বেড পাওয়ার জন্য নেতামন্ত্রী কী না ধরি। এ সব করি দাদা আমরা একটু সুরক্ষিত থাকব বলে। আমাদের মানইজ্জত, ডিগনিটি ইত্যাদি নিয়েও ভাবি না একটু নিরাপদে থাকব বলে।

দাদা, দিদি, আজকে আমাদের সেই নিরাপত্তার বোধটা ভীষণ নড়বড়ে হয়ে গেছে গো। তাই আমরা রাস্তায়। তাই আমরা অস্থির। তাই আমরা বেসামাল। দেখুন আমরা এমনিতে রাজনীতিটীতি নিয়ে সিরিয়াসলি মাথা ঘামাই না। উচ্চৈস্বরে আলোচনা করি, তর্ক করি ওসব আমাদের বাহ্যিক ব্যাপারস্যাপার। আসলে আমরা একটু সুরক্ষা চাই।

আমি বলতে শুধু এই আমি না, আমার ভালোবাসার, আমার পরিবারের সবাইকে নিয়ে আমি একটু নিরাপদে থাকতে চাই, তার জন্য সব কিছু কম্প্রোমাইজ করতে রাজী আমরা। কিন্তু ওইখানে হাত দিলে আমাদের থেকে ভয়ংকর কিছু নেই জানেন তো! এটা হুমকি না, এটা সাবধান বাণী। আত্মপরিচয়জ্ঞাপনও বলতে পারেন।

দেখুন, আমরা এখন ভীষণ নড়বড়ে জায়গায়। আমরা বুঝতে পারছি কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে, কিন্তু কী যে হচ্ছে বুঝছি না। হোয়াটসঅ্যাপে, সোশ্যালমিডিয়ায় নানা ক্লিপিংস ঘুরছে। আমাদের আরো অস্থির করছে। ওই যে বললাম, আমাদের ল্যাজে পা পড়েছে। আমরা আর ঘুমাতে পারছি না। সব বেকার লাগছে। নিরাপদ ফিল করছি না তো আর। ফলে সব হজম করে যাওয়া অপমান, বঞ্চনা ইত্যাদি বদহজম হয়ে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। ঠেকাবেন কী করে আমাদের?

একটা উদাহরণ দিই। ধরুন আমার এক আত্মীয়ের অপারেশন চলছে। আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ একজন এসে বলে গেল, ওহে যারা অপারেশন করছে তারা কিন্তু কেউ চিকিৎসক না। আমরা ঘাবড়ালাম। আরেকজন এসে বলে গেল, ওহে এইমাত্র দেখলাম কিডনিটা বার করে নিল। আমরা আরো ঘাবড়ালাম, এবং বিচলিত হলাম। তারপর একজন এসে বলল, এই দেখলাম একজন দুটো চোখ উপড়ে নিল….ব্যস….আর আমরা স্থির থাকতে পারলাম না। এদিকে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকতে বাধা, ওদিকে আসল কথা কিছুই জানা যাচ্ছে না। এবার?

এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। দেখুন আমাদের এই ভীষণ সংকটে আমাদের ক্ষেপিয়ে দিয়ে অনেকে অনেকরকমের কার্যসিদ্ধিতে মাতবে এ স্বাভাবিক। রাজনীতিতেও আমাদেরকেই ঘুঁটি করবে এও আমরা জানি। করে নিন যার যা প্রাণে চায়, পরে আমরা সব সামলে নেব, যেমন আগেও নিয়েছি। কিন্তু দয়া করে আমাদের নিরাপত্তারবোধকে চ্যালেঞ্জে ফেলবেন না হাতজোড় করে বলছি। আমরা জানি বিচার রাস্তায় হয় না, আমার সেন্টিমেন্টের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সব জানি। সে অবশেষে কঠোর নির্মমভাবে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নির্ভর সেও আমরা জানি। কিন্তু জানা আর মেনে নেওয়া এক না। আমরা মেনে নিতেই পারছি না যে আমাদের নিরাপত্তাবোধের সঙ্গে আপনারা ছিনিমিনি খেলছেন।

দেখুন আমরা জানি আমাদের বাংলা নিউজ চ্যানেলগুলোতে যাত্রাপালার মত করে নিউজ পড়ে, তাদের অ্যাপিলটা আমার যুক্তির কাছে ততটা না, যতটা আমার আবেগের কাছে। ওরা জানে আমাকে নিরাপত্তাহীন বোধ করাতে পারলে আমি ওদের টিআরপি আরো বাড়িয়ে দেব। আমি প্যানিক করলেই ওরা সফল। সেটা ওরা জানে। সেটা সোশ্যালমিডিয়াতেও অনেকেই জানে যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মানুষকে রাগিয়ে দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি, হিংসিয়ে দেওয়া যায় তাড়াতাড়ি। ওরা সব জানে। আর তাই আমাদের ব্যবহার করে। আমরা জানি সব। কিন্তু ওই যে বললাম, পরে সব আমরা সামলে নেব, আমাদের নিরাপত্তাবোধটা ফিরিয়ে দিন প্লিজ।

কী ভাবে?

আসল দোষীকে খুঁজে বার করে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে। আমাদের নিরাপত্তার বেড়াটাকে আবার বেঁধে দিন প্লিজ। নইলে কিন্তু আমরা যা কিছু হতে পারি, সুনামি থেকে কালবৈশাখী সব। শুধুমাত্র আমাদের নিরাপত্তার জন্য, আমার ছেলেমেয়েদের নিরাপত্তার জন্য আমি সব করতে পারি। বুঝেছেন তো। সময় নিন। কিন্তু ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না প্লিজ। ওদের সামনে আনুন। শাস্তি দিন। আমরা আবার শান্ত হয়ে খালবিল হয়ে যাব দেখবেন। কিন্তু প্লিজ, আমাদের ল্যাজে পড়া পা'কে তুলুন। বিচারকে স্বচ্ছ, সঙ্গত করুন। ব্যস।

45
Wed, 08/14/2024 - 14:36

 

যে মানুষ হরগঞ্জ বাজারে, কি বড়বাজারে হইহই করে বাজার করে, তাকেই দেখেছি সেন্ট্রাল এসি চালিত ধোপদুরস্ত শপিংমলে কী শান্ত হয়ে কেনাকাটা করছে।

একই মানুষের এই দুটো রূপই সত্যি। মানুষের মধ্যে একটা ভীষণ ক্ষমতা আছে পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার। যে কথাটা সব চাইতে জোরে শোনা যাচ্ছে তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করে নেওয়ার। যে সন্দেহটা সবাই করছে সেই সন্দেহটাকেই একমাত্র সন্দেহ বলে ধরে নেওয়ার।

প্রচণ্ড উত্তাল যখন চারদিক তখন শান্ত রোজকারের জীবনে একটা প্রচণ্ড উত্তেজনা এসে ধাক্কা দেয়। কীভাবে সেই উত্তেজনাকে প্রশমিত করবে, প্রকাশ করবে কিছুই ঠিক করতে না পেরে হুড়মুড় করে একদিকে ঝুঁকে পড়ে মানুষ। বিশ্বাস করে সবাই যেটা বলছে সেদিকেই চলাই নিরাপদ। এই উত্তেজনাটাই এখন সত্য।

মনের মধ্যে প্রতিবাদের স্বর কোনটা আর সোশ্যালমিডিয়া আর নিউজচ্যানেল দ্বারা প্রণোদিত উত্তেজনা কোনটা স্বাভাবিকভাবেই আলাদা করে উঠতে পারে না মানুষ। যে বাইরে থেকে শান্ত হয়ে থাকে, তাকে কাপুরুষ বলে। যে মনের মধ্যে কঠোর অপেক্ষায় একটা সঠিক বিচারের অপেক্ষায় আছে, তাকে অলস অসংবেদনশীল ভাবে।

এ ভ্রান্তিটাও স্বাভাবিক। প্রবল উত্তেজনায় নিজের স্বভাব নিজের স্ব-ভাবে থাকে না।

কিন্তু প্রতিবাদটা জন্মায় অনেক গভীর থেকে। সেখানে অনুকরণের কিছু নেই। সেখানে একটা গভীর জ্বালা, অসন্তোষ আছে। একটা অসম্ভব নিদ্রাহীন যন্ত্রণা সত্যের জন্য চাতকের মত তাকিয়ে বসে আছে। অন্যে তাকে নিয়ে কী বলছে তার আসে যায় না, সত্যের উদয় কখন কোন মুহূর্তে হবে তারই প্রাণান্তকর প্রতীক্ষা তার। অতন্দ্র প্রহরা তার।

দুর্বল মন উত্তেজনায় বিবশ হয় সহজে। বিভ্রান্ত হয় সহজে। সে তখন সাঁতারুর প্রবল বেগে হাত পা ছোঁড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যে যত জোরে হাত পা ছোঁড়ে তাকে সে তত বড় মাপের সাঁতারু মনে করে। যে অত্যন্ত সংযত হয়ে ওপারে সাঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করছে, তাকে সে ভাবে দুর্বল।

গভীরে অসন্তোষ যদি সত্যি হয়, গভীরে সত্যের প্রকাশের জন্য আগ্রহ যদি আন্তরিক হয়, মিথ্যার আস্ফালনকে যদি মনের সবটুকু শক্তি দিয়ে ধিক্কার জানানোর বল থাকে, তবে প্রকাশের উপায় আপনিই বেরিয়ে আসবে। সাচ্চা প্রতিবাদী কখনও অপ্রতিবাদী-মৃদুপ্রতিবাদী-কঠোর প্রতিবাদীর বিচার করে বেড়ানোর সময় পায় না। যে ভিতর থেকে জেগেছে তার রাস্তা নিয়ে সংশয় নেই, সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে না সে। কিন্তু যে বাইরের উত্তেজনায় মেতেছে, বাইরে থেকে প্ররোচিত হয়েছে, বাইরে থেকেই সবটুকু তাগিদ জন্মেছে….সেই মনের মধ্যে হঠাৎ জাগা উত্তেজনাকে নিয়ে বিভ্রান্ত হয়। কারণ উত্তেজনার মধ্যে অনুকরণের দিকে যে ঝোঁক থাকে তার সঙ্গে সত্যের সঙ্গে সঙ্গতি ভীষণ কম থাকে। অসংগত আবেগ, অসংগত আক্রোশ, অসংগত চরিত্রহননের ছবিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিকে। “এদের চিনে রাখুন, এরা এই সময়েও রিল বানিয়েছে, কবিতার অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিয়েছে…..” ইত্যাদি ইত্যাদি। এ অসংগত আক্রোশের ভাষা উত্তেজনার ভাষা। অতন্দ্র জেগে থাকা হল সত্যের জন্য প্রাণপাতী অপেক্ষা, সাধনা। তাকে উত্তেজনায় পাওয়া যায় না। ফেয়ারনেস, ন্যায় যা-ই বলি না কেন, নিজের অন্তর্দৃষ্টিকে উত্তেজনায় বিবশ করে, বাইরের উত্তেজনায় সবটুকু সমর্পণ করে বসে থাকলে চোখের সামনে দিয়ে ফাঁকির রাস্তা বার করা সহজ হয়ে যায়। এ উদাহরণও আমাদের সমাজেই আছে। প্রবল উত্তেজনা একদিন শান্ত হয়ে যায় ক্লান্তিতে, অবসাদে। তারপর আর কেউ খোঁজটুকু নেয় না, আচ্ছা তার বিচার কী হল?

তবু এ হবে। ওই যে শুরুতেই বললাম, মানুষের মধ্যে প্রভাবিত হওয়ার আর প্রভাবিত করার এক প্রবল ক্ষমতা আর বাসনা আছে। তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের অন্তর্দৃষ্টি নির্ভর চলতে শেখা স্বচেষ্টা নির্ভর। অট্রেণ্ড্রীয়।

46
Sun, 08/11/2024 - 14:21

 

প্রবলেম অব ইভিল - এক সময়ে ধর্মের জগতে, দর্শনের জগতে খুবই আলোচ্য বিষয় ছিল। সর্বমঙ্গলময়ের জগতে অমঙ্গল কেন? শয়তান, অসুর ইত্যাদি নানা তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়েছিল।

তারপর ধর্মের জগতের পর এলো ফরাসী বিপ্লবের যুগ। মানুষ রিজনবল হতে শিখল। নিজের যুক্তির উপর দাঁড়াতে চাইল, প্রমাণের উপর দাঁড়াতে চাইল। সাহিত্যে জন্মালো ভিলেন, বদলোক।

এরপরে এলো বিজ্ঞানের যুগ। মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান ক্রমে সবল হতে শুরু করল। এলো ফরেনসিক সাইকোলজির যুগ।

“Forensic psychology in India is an evolving field with significant potential to impact the criminal justice system. While it currently faces challenges such as limited resources, lack of awareness, and cultural diversity, there are growing opportunities for education, research, and professional practice. As the field continues to develop, it is likely to play an increasingly important role in legal proceedings, criminal investigations, and the rehabilitation of offenders in India.” (by AI)

কমাস আগেই একজন অপরাধীকে জেল থেকে ছুটি দেওয়া হল। এক শিশুকে ধর্ষণ করে জেলে গিয়েছিল। জেল থেকে বেরিয়ে মাস না পেরোতেই সে একই অপরাধে আবার জেলে গেল। টাইমস অব ইণ্ডিয়ায় ছোট্টো একটা খবর বেরিয়েছিল।

উত্তর প্রদেশের সিরিয়াল কিলার ধরা পড়ল। জানা গেল তার ছোটোবেলার সৎমায়ের অত্যাচারের গল্প। তার আক্রোশের গল্প। কীভাবে তার মনোজগতে এর প্রভাব পড়েছে তার গল্প।

আর জি করের অপরাধে অভিযুক্ত অপরাধীরও আগে বিকৃত যৌনাচার সংক্রান্ত অপরাধের উল্লেখ আছে পড়লাম।

একবার নয়, বহুবার পড়লাম একই জিনিস, সে এরকম অপরাধ আগেও করেছে। ক্ষমা চেয়ে বা কোনোভাবে পার পেয়ে গেছে। “ডার্লিং” সিনেমা মনে করুন যেখানে সে বারবার ক্ষমা চাইত। “মাইন্ড হান্টার”, “থ্রু দ্য ডার্কনেস” ক্রিমিনাল প্রোফাইল তৈরির বাস্তব ঘটনা নিয়ে বানানো সিরিজ। ক্রিমিনাল প্রোফাইলিং না হয় অত্যাধুনিক, অত্যন্ত সুক্ষ্ম একটা পদ্ধতি। কিন্তু ভারতে ফরেনসিক সাইকোলজির কী অবস্থা? আমাদের বিচারের আগে বিশ্বাস দৌড়ায়। আমাদের নতুনের আগে পুরোনো অভ্যাস সংস্কার আর ঐতিহ্যের নামে দরজা আটকায়। আমাদের আবেগ ধৈর্য নির্ভর গবেষণার থেকে সরে গিয়ে শর্টকাট কিম্বা আধিভৌতিক তত্ত্বে সমাধান খোঁজে। ai নির্ভর কিছু তথ্য দিলাম।

১) Lack of Awareness and Understanding: There is limited awareness and understanding of forensic psychology among legal professionals, law enforcement, and the general public in India. This can lead to underutilization of psychological expertise in the criminal justice system.

২) Resource Constraints: The field faces significant resource constraints, including a shortage of trained forensic psychologists, limited funding for psychological services in the criminal justice system, and inadequate infrastructure for implementing forensic psychological interventions.

৩) Cultural and Social Diversity: India’s vast cultural, linguistic, and socio-economic diversity poses challenges for forensic psychologists, who must account for these factors when conducting assessments and providing interventions.

৪) Legal and Ethical Challenges: Forensic psychologists in India must navigate complex legal and ethical issues, particularly regarding confidentiality, consent, and the use of psychological assessments in legal proceedings.

সেন্টিমেন্ট বাস্তব। ক্ষোভ, রাগ, প্রতিবাদ অবশ্যই হওয়া উচিত। কিন্তু পাশাপাশি এও মনে রাখতে হবে সেন্টিমেন্ট শান্ত হয়ে যায়। ক্ষোভের আগুন মিলিয়ে যায়। রাস্তাঘাট, সোশ্যাল মিডিয়া আবার আগের ছন্দে ফিরে আসে। কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণ গবেষণা চলতেই থাকে। আর আমাদের সভ্যতার ভবিষ্যৎ সেই বিজ্ঞানের হাতেই। মস্তিষ্ককে আরো গভীরে বুঝতে হবে। মানুষের প্রকৃতিকে অবজেক্টিভলি, এম্পেরিকালি, পরীক্ষামূলকভাবে আরো আরো জানার আছে। সেই অনুযায়ী কোনো মানুষ আচরণের মধ্যে কোনো রেড ফ্ল্যাগ দেখতে পেলে তাকে চিহ্নিতকরণ আর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার রাস্তা তৈরি করতে হবে। শুধুমাত্র “দুষ্টুলোক” বলে দায় সারলে চলবে না। মনোবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান এখন অতটাও দুর্বল তো নয়!

একজন মানসিকভাবে বিকৃত মানুষের কাছ থেকে সব সময় যে সিসিটিভি আর পুলিশ বাঁচাবে তার কী মানে আছে? কত কত পরিবারের মধ্যে, ঘরের মধ্যে এ ঘটনা ঘটে চলেছে। সেখানে উপায় কী হবে? শিশুদের উপর যৌন নির্যাতন ৯৬% শতাংশ বেড়ে গেছে। কেন বাড়ছে? কেন এমন মানসিক বিকৃতি আসছে? তার থেকে বাঁচার উপায়, সমাজকে সুস্থতার রাস্তা দেখানোর ভার অবশ্যই এখন বিজ্ঞানের। সেই বিজ্ঞানের প্রয়োগ, আগ্রহ যাতে আরো আরো বাড়ে সে বিষয়ে আমাদের আরো তৎপর হওয়া উচিৎ। বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত সম্পদকে কী করে কর্মকুশলতায় আনা যায় সেও দেখার। প্রয়োগের দিকটা আরো স্মার্ট না হলে আধুনিক সমাজের জটিলতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা দুষ্কর হবে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজের আরো নানা স্তরে এ সম্বন্ধে সচেতনতা আনতেই হবে। কথাটা ভালো-খারাপ না, কথাটা সুস্থ- অসুস্থতার। প্রথমটা সাবজেক্টিভ। মূল্যায়ন সেভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু পরেরটা অবজেক্টিভ। শুধু গুলি করে মেরে ফেলে সে সমস্যা থেকে সমাধানের রাস্তা পাওয়া যাবে না।

47
Wed, 08/07/2024 - 12:39

 

শান্তির আকাঙ্খা দুর্বল করতে পারে। প্রেমের আকাঙ্খা বিকারগ্রস্ত করতে পারে। রুদ্র প্রেমকে সবল করে। শান্তিকে বলিষ্ঠ করে।

রবীন্দ্রনাথের দর্শনে রুদ্রের আহ্বান আছে। রুদ্র যা কিছু দুর্বল, মোহগ্রস্ত, আসক্ত.... তাকে ভেঙে তছনছ করে দেয়। রুদ্রের প্রকাশ ত্যাগে, বৈরাগ্যে। "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি সে আমার নয়" যিনি লিখছেন, তিনিই "বৈরাগ্য" বলে প্রবন্ধটা লিখছেন "শান্তিনিকেতন" গ্রন্থে।

যা কিছু দুর্বলতা আনে, সে পাপ। যা কিছু সংকীর্ণতা আনে, সে পাপ। রুদ্রের তেজ তাকে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে। সবাইকে জীবনে কোনো না কোনো এক সময় রুদ্রের সে তেজকে সহ্য করতে হয়। করতেই হয়। রুদ্রের সাধন থেকে পালালে নিজেকে দুর্বল, বিকারগ্রস্ত করে জীবনটাকে অন্ধকারে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হয়।

আজ বাইশে শ্রাবণ। রবীন্দ্রনাথের কথা বিশেষ আবেগে মনে আসবে, সে স্বাভাবিক। কিন্তু সে শুধু লঘু অগভীর আবেগের কয়েকটা গান-কবিতায় না। সে দুর্বলতা। বারবার মনে রাখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাঁদুনে, আবেগসর্বস্ব, নিজেকে নিজের হাজার একটা দুর্বলতার দাস করে, রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে দুর্বলতার শীতল মর্গে বাঁচতে বলেননি। সব দুর্বলতা রুদ্রের তেজে ছিন্নভিন্ন করে বাঁচার রাস্তা দেখিয়েছিলেন। শুধু রবীন্দ্রনাথের কাজ তার সাক্ষ্য বহন করে না, তাঁর জীবনও।

ঈশ্বর রবীন্দ্রনাথের কাছে শুধু সুখ নন। নাচগানের উন্মাদ আবেগ নয়। শান্তিনিকেতন বইতে “ভাবুকতা ও পবিত্রতা” প্রবন্ধে লিখছেন স্পষ্ট করে ভাবুকরা কীভাবে একটা চরিত্রকে নষ্ট করে দেয়।

সুখ নয়, প্রেম নয়, শান্তি নয় - সবার আগে দরকার একটা পাত্র। বলিষ্ঠ পাত্র। যা এ সবকে কলুষিত করবে না।

বলিষ্ঠ চরিত্র একমাত্র সম্ভব রুদ্রের আদেশের কঠোরতা সহ্য করে। যখন যা ত্যাগ করতে হবে, করতেই হবে। যখন যা সহ্য করতে হবে, করতেই হবে। আর এ সবই করতে হবে সত্যের কঠোর আদর্শের পায়ে আত্ম-আহূতি দিয়ে। “আত্মহোমের বহ্নি জ্বালা”।

দুর্বলতা আছে। ঈর্ষা, ক্রোধ, ক্ষোভ, ভয় সব আছে। সবার মূলে আছে মোহ। বৃহৎকে ক্ষুদ্র করে দেখার ভ্রম। সত্যকে মিথ্যার পিলসুজে জ্বালার স্পর্ধা। চাতুরীকে প্রজ্ঞার বিকল্প মনে করার ভুল। যেখানে কঠোরতা নেই, যেখানে আত্মত্যাগ নেই, যেখানে নিজের বিরুদ্ধে নিজের লড়াই নেই, সেখানে সবটাই অন্তঃসারশূন্য শূন্যকূম্ভের আওয়াজ। ওর কোনো অর্থ নেই, দিশা নেই।

রবীন্দ্রনাথের উপাস্য রুদ্রকে স্বীকার করলে জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জিনিসের উপর দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। বুকের খাঁচায় আরো বেশি করে অক্সিজেন আসে। দৃষ্টি আরো স্বচ্ছ হয়। জীবনের কঠোরতাকে এড়িয়ে, জীবনকে ব্যর্থ করার হাত থেকে নিজেকে রক্ষার দায়িত্ব আমারই। জীবন একটা চয়েস। তা গন্তব্যের উপর ততটা নির্ভর করে না যতটা নির্ভর করে যাত্রাপথটার উপর। কোন রাস্তায় হেঁটেছিলাম। দুর্বলতা, না কঠোরতার? শ্রেয়, না প্রেয়ের রাস্তায়।

আজ বাইশে শ্রাবণ বিশেষভাবে বাঙালির কাছে বাইশে শ্রাবণ। আজ আবার শ্রেয়কে প্রতিষ্ঠা করার দিন। অনেকদিন ঘুমিয়েছি আমরা। জেগে উঠলে বোঝা যায় জীবনটা সুখের অন্বেষায় বাঁচার না, জীবনটা কঠোরতায় আত্মত্যাগের। সত্যের জন্য। ধর্মের জন্য। ধর্ম কী? যে উত্তর রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন। যখন দুর্যোধনকে ত্যাগ করার উপদেশে দিয়েছলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বলেছিলেন দুর্যোধনকে ত্যাগ করলেই রক্ষা পাবে ধর্ম। যা সুখ দেবে না। দেবে “দুঃখ নব নব”। রুদ্র কোনো দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেয় না, এমনকি ঔদ্ধত্যকেও নয়। তাই সে রুদ্র।

আজ রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। বিশেষ করে প্রণাম করার দিন।

48
Wed, 07/17/2024 - 14:29

 

 

যুক্তিবুদ্ধির পাশাপাশি, একজন খেয়ালি মানুষও থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক। যুক্তিবুদ্ধির নিয়ম আছে। খেয়ালের একটা ধর্ম আছে। সে খেলতে ভালোবাসে। সে বিশ্বাস করে। কল্পনা করে। ভয়কে সৃষ্টি করে, ভয়কে ভাঙে। এ সব খেয়ালেরই খেলা।

আমাদের সমাজ রাতদিন বলছে, ওই খেয়ালি মানুষটাকে বেঁধে আনো। আমি উপঢৌকন দেব। তোমায় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে দেব। খেয়াল তোমায় কী দেবে? হয় তো বা শেষে গোটা জীবনটাই নষ্ট হবে! তার চাইতে এসো, একটা সুরক্ষিত জীবনযাপন করো। খেয়ালকে একটা বারান্দা ছেড়ে দাও। যে বারান্দায় দশদিকে দশটা সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাও। কড়া পাহারায় রেখে, খেয়ালকে বলো, এই তো দিলাম জায়গা, খেলে বেড়াও।

========

যুক্তিবুদ্ধির নিয়মমাফিক সফলতা এলে মানুষের মধ্যে যে গর্ব জন্মায়, সে গর্বকে অনুভব করতে একটা সমাজ লাগে। সমাজ মানে ঈর্ষা করতে পারে এমন প্রতিবেশী অন্তত লাগে কয়েকজন। সামাজিক সফলতার বোধের সঙ্গে প্রতিবেশীর ঈর্ষার একটা যোগসূত্র আছে। সে কাউকে ছোটো না করে, কাউকে বশে না এনে নিজেকে সফল ভাবতে পারে না। অনেকাংশেই পারে না।

কিন্তু খেয়ালের সে দায় নেই। সে যদি গভীর জঙ্গলেও থাকে তবু সে নিজের আনন্দের সামগ্রী খুঁজে নেয়। হয় তো খেলার সাথীর না পেয়ে মন তার মাঝে মাঝে কেঁদে উঠতে পারে। কিন্তু খেয়াল নিজেই নিজের রাজা। নিজেই নিজের প্রজা।

======

আমাদের সমাজে এই খেয়াল বড় উপেক্ষিত। আসলে আমরা একটা বিরাট কল চালাতে চাইছি যার মুনাফা মোটামুটি ন্যায্য-অন্যায্যভাবে ভাগবাটোয়ারা করে সমাজটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে চাইছি। এখন একটা কলে নিয়ম নিষ্ঠার যে ডাক, সেখানে খেয়াল তো বড় বালাই। কথা বাস্তব, কিন্তু সত্য নয়।

কিন্তু খেয়াল কী এতটাই অকেজো, অবান্তর? মজার কথা হচ্ছে মানুষের আসলে ভালো থাকার সূত্রই এই খেয়ালের মধ্যে রয়েছে। মানুষ সব নিয়ম মেনে নেয়, সব পরাধীনতা স্বীকার করে নেয়, একদিন সে নিজের খেয়াল মত বাঁচবে এই স্বপ্নে।

ক্রমে সে স্বপ্ন যায় হারিয়ে। ভালো থাকার সংজ্ঞা বদলাতে থাকে। নিজের খেয়াল থেকে নিজের দূরত্ব বাড়ে। নিজেকে যত বাঁধে, নিজেকে যত শাসনে রাখে নিজেকে তত সফল মনে করে। গভীরে আত্মার শূন্যতা বাইরের নামযশ, প্রতিপত্তি দিয়ে ভরিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু তা হবে কেন? অবশেষে গ্রাস করে এক বিকার।

======

কিন্তু এই খেয়ালের একটা স্বধর্ম আছে, সেটা মরমী বোঝে। খেয়াল মাত্রেই দিশাহীন খেয়ালিপানা না, যা আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। এই খেয়ালেরও যে একটা ধর্ম আছে সেটা দেখায় অন্তর্দৃষ্টি। খেয়ালকে যদি অন্যের ক্ষতিতে, অন্যের বিরুদ্ধে না লাগানো যায়, তবে খেয়াল এক মহাসম্পদ। খেয়ালকে যদি নিজের দম্ভের বাঁধন থেকে মুক্তি দিই, তবে খেয়ালও আমাকে নানা ক্ষুদ্রতা থেকে মুক্তি দেয়। খেয়ালের সব চাইতে বড় শত্রু, নকল খেয়াল, যা দম্ভের শরীর থেকে জন্মায়। “আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই করেছি, বেশ করেছি”, এই তার ভাষা। খেয়ালের একটা ধর্ম আছে। কিন্তু দম্ভের কোনো ধর্ম নেই।

দম্ভ আর খেয়াল একসঙ্গে থাকতে পারে না। দম্ভ তার কাজ হাসিলের জন্য বুদ্ধির চাতুরী আর খেয়ালের স্বভাবসিদ্ধ সাহসকে কাজে লাগাতে চায়। কিন্তু শেষে নিজের জালে নিজেই আটকায় বুদ্ধি আর খেয়ালকে দূষিত করে।

======

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, ঈশ্বরদর্শন হলে তার স্বভাব পাঁচ বছরের বালকের মত হয়ে যায়। অর্থাৎ তার দম্ভ থাকে না। থাকে খেয়াল। তার খেলা। কবি যখন “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে” গানে “বিরাট শিশু” র কল্পনা করেন, সেও এক দম্ভহীন সত্তার কল্পনাই করেন।

সমস্ত ধর্মে ঈশ্বরের যে শুদ্ধ ধারণা আছে, সে দম্ভহীন এক দরদী, সর্বশক্তিমান, আনন্দময় সত্তার। দম্ভকে সরিয়ে প্রজ্ঞা আর করুণায় মানুষের জীবনকে সার্থক করার কথা বলেন বুদ্ধ। এ করুণাও খেয়ালের ধর্ম থেকে জন্মায়। নইলে সুপরিকল্পিত করুণা বলে কিছু সোনার পাথরবাটির মত অবাস্তব একটা কথা হয়ে দাঁড়ায়।

এখন এই দম্ভহীন হওয়ার শিক্ষা কি কাউকে দেওয়া যায়? না। তবে যে কোনো সৎ শিক্ষাই অবশেষে মানুষকে এই জায়গায় নিয়ে আসে - মানুষের প্রকৃতির ইতিহাস তাই বলে। দম্ভকে জানাই দম্ভকে নাশের একমাত্র উপায়। বাকি সব দম্ভনাশের উপায় দম্ভেরই নানা ছদ্মবেশ মাত্র।

খেয়াল যদি মুক্তি পায়, তবেই আমি মুক্ত। আর খেয়াল যদি দমবন্ধ অনুভব করে, তবে আমিও বন্ধ। ভীষণভাবে বদ্ধ।

49
Sun, 07/14/2024 - 14:14

 

 

You shall not covet your neighbor's house; you shall not covet your neighbor's wife, or his male servant, or his female servant, or his ox, or his donkey, or anything that is your neighbor's" (Exodus 20.17)

Enveloped by the Lord must be This All — each thing that moves on earth. With that renounce, enjoy yourself. Covet no wealth of any man.(Isha Upanishad, Hymn 1)

প্রথম উদ্ধৃতিটা বাইবেলের। দ্বিতীয়টা উদ্ধৃতিটা উপনিষদের। প্রথম উদ্ধৃতিটা বাইবেলের টেন কমেন্ডমেন্টেস এর শেষ কমেন্ডমেন্টস। আর দ্বিতীয়টা, ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকের। দুটো বাণীর মধ্যে একটাই সুর - মা গৃধঃ - লোভ কোরো না। অন্যের সম্পদে লোভ কোরো না।

লোভ কোরো না। কী সে লোভ কোরো না? অন্যের স্ত্রী, দাসদাসী, পশুপাখি কিছুতেই না। অন্যের কোনো সম্পদেই লোভ কোরো না।

কেন করব না? বাইবেল বলছে, কারণ এই ঈশ্বরের আদেশ। উপনিষদ বলছে, কারণ এ গোটা জগত ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত। লোভ আর ব্রহ্ম একসঙ্গে থাকে কী করে? ব্রহ্মকে জানতে গেলে লোভ ত্যাগ করতে হবে।

একজন শিরডিতে এসেছে সাঁইবাবার কাছে ব্রহ্মজ্ঞান নেবে বলে। সাঁই বললেন বোসো। এরপর সাঁই হঠাৎ আশেপাশের মানুষের কাছে টাকা চাইতে শুরু করলেন। তার নাকি ভীষণ দরকার। যারা প্রায়ই আসেন তারা একটু অবাক হলেন, কিন্তু সাঁই যে পরিমাণ টাকা চাইছেন তা তো তাদের কাছে নেই। সব গরীব মানুষ গ্রামের। কোথায় পাবে অত টাকা? এদিকে ব্রহ্মজ্ঞান নিতে আসা ভদ্রলোক অস্থির হয়ে পড়ছেন। বলছেন, ও মশায় একটু তাড়াতাড়ি করুন না, আমি ঘোড়াগাড়ি দাঁড় করিয়ে এসেছি যে, ব্রহ্মজ্ঞানটা নিয়েই টুক করে গাড়িতে উঠে বাড়ি যাই। অনেকটা রাস্তা।

সাঁই হাসলেন। বললেন, ভাই রে, এতক্ষণ ধরে যে পাঁচটা টাকা আমি চাইছি, তোমার কাছে তো তার থেকে বেশিই আছে, তা তো তুমি একবারও বলছ না যে এই নিন.... ভাই রে, যদি লোভ না ছাড়তে পারো তবে ব্রহ্মজ্ঞান হবে কী করে?

এই বলে সাঁই তাকে উপনিষদের শিক্ষা দিতে শুরু করলেন।

ব্রহ্মজ্ঞান একটা দূরের শব্দ। কঠিন শব্দ। কিন্তু 'গীতবিতান' কি দুই খণ্ডে 'শান্তিনিকেতন' বড় কথা হলেও, দূরের তো না। রবীন্দ্রনাথের দর্শনের মূল সুরই হল - 'লোভ কোরো না। সে পথে তোমার হয় তো অনেক বৈষয়িক লাভ হবে, তবু বলছি সে পথ তোমার না হোক।'

এ কথা বন্ধুর কথা। সুহৃদের কথা। মঙ্গলের কথা। শান্তির দিশা। সেই প্রাচীনকালে মনুষ্যপ্রকৃতির জটিলতা থেকে মুক্তির জন্য এ বাণী উচ্চারিত হয়েছিল এ পৃথিবীর দুই ভূখণ্ডে, দুইকালে। যত দিন যাচ্ছে তার প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে বই কমছে কই? লোভ কোরো না। অন্যের সুখ-সম্পদ-সমৃদ্ধি যেন তোমার দীর্ঘশ্বাসের কারণ না হয়। আমার অ-সুখের কারণ না হয়। তোমার মনস্তাপের কারণ না হয়। পরিশেষে নিজের মনকে যেন নিজেই বিষাক্ত করে না তুলি।

রবীন্দ্রনাথের বহু লেখায়, ভাষণে এ শ্লোকটার উদ্ধৃতি আছে। ধর্মের বাস্তব দিক এটাই। ধর্মের সু-রাহার দিক এটাই। রবীন্দ্রনাথের গোটা জীবন এ শ্লোকের ধারাভাষ্য। হতে পারে আমি অতীন্দ্রিয় জীবনের কথা বুঝি না। হতে পারে আমার জীবনে মরমী অনুভব নেই। কিন্তু শান্তি চাই না, এ কথা বলি কী করে? আমার জীবনবোধ যদি আমায় শান্তি-আনন্দ-সংহতিমুখী না করে, তবে সে শিক্ষা কি আদৌ আমায় সার্থকতার দিকে নিয়ে যায়?

রবীন্দ্রনাথের গানে যে শান্তি পাই, সে এই শান্তিরসের বাণী। সারাদিনের শেষে শান্তি চাই, এ মিথ্যা কল্পনা। জীবনের শেষে একটু শান্তিতে কাটাতে চাই, এ আরো বড় অলীক কল্পনা। শান্তি দিয়ে শুরু না করলে শান্তি দিয়ে শেষ হয় না। শান্তি গন্তব্য না, শান্তি পথ। আমি যদি নিজে শান্তির রাস্তায় না চলি, নিজের মধ্যে শান্তির আখড়া তৈরি না করি, তবে কাশী-মক্কা-ভ্যাটিকান সিটি কোথাও পাব না। খানিক বিরাম পেতে পারি। কিন্তু শান্তি আরো মূল্যবান জিনিস। শান্তির সঙ্গে তুল্য কিছুই নেই।

কিন্তু শান্তি এমন এক জিনিস তাকে চাইলে পাওয়া যায় না। ইম্যানুয়েল কান্ট লিখছেন আমি তোমায় সুখী করতে পারব না, কিন্তু তোমায় সুখী হওয়ার যোগ্য করে তুলতে পারি। কীসে আসে আসে যোগ্যতা? ওই এক কথা, সব সদগুণের যা মূল আকর - নির্লোভত্ব। লোভ থাকলেই ঈর্ষা থাকবে। ঈর্ষা থাকলেই বুদ্ধি কুটিল-জটিল হবে। বুদ্ধি কুটিল-জটিল হলেই জীবন কানাগলিতে নিঃসংশয়ে ঢুকে যাবে। ব্যস, তারপর "আমি চোখ বুজে পথ পাইনে বলে কেঁদে ভাসাই পাড়া"।

রবীন্দ্রনাথ "শান্তিনিকেতন" প্রবন্ধটার এক একটা অধ্যায় প্রতিদিন উপাসনার পর পড়ে শোনাতেন। একদিন বলছেন, এই যে আমি তোমাদের সামনে রোজ পড়ি, এ আমার লোভ নয় তো? ভালো ভালো শব্দ গেঁথে তোমাদের বাহবা পাব বলে রোজ বসছি না তো?

এইভাবে সচেতন হতে থাকতে শেখাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। এতটাই সচেতন। বাইরের জগতকে আমি ভোলাতেই পারি, কিন্তু মনে মনে আমি কী সে তো কেবল আমি একাই জানি। আমার কাজের উদ্দেশ্য লোভ নয় তো? নামযশ-খ্যাতিপ্রতিপত্তি-টাকাপয়সা ইত্যাদি নয় তো?

আজ যে যুগে আমরা বাঁচছি তা অর্থবলের দ্বারা নিয়মিত। সদ্য ঘটে যাওয়া এক অতিধনী পরিবারের বিয়ে দেখিয়ে দিল অর্থ থাকলে কাকে না নিজের আঙিনায় পাওয়া যায়। বিত্তের অসংযত প্রকাশ সুশিক্ষার, সু-রুচির পরিচায়ক কখনও নয়। কিন্তু এ আজকের ঘটনা তো নয়। চিরটাকাল এইভাবেই হয়ে এসেছে। কিন্তু তারা জানে কাকে টাকার টানে টানা যায়, কাকে যায় না। সূত্র সেই লোভ।

এতো গেল ধনীর লোভের কথা। যে লাইমলাইট চাইছে। কিন্তু যে মানুষ দারিদ্র্য থেকে উঠতে চাইছে তাকে যদি লোভের ভূত বশ করে তার পরিণাম কী ভয়ংকর হয় তাও তো দেখছি। ক্রমে সোজা রাস্তা ছেড়ে সে বাঁকা পথের দিকে আকর্ষিত হচ্ছে। যদি বা বাঁকা পথ নেওয়ার মত দুঃসাহস না থাকে তবে ক্ষোভ-অধৈর্য্য তে এত বেসামাল হয়ে পড়ছে যে পায়ে পায়ে হতাশা বিষাদের পাঁকে আটকাচ্ছে। পরিশ্রম আর ধৈর্যকে ছেড়ে সে শর্টকাট খুঁজছে। না পেলে জীবন শেষ করে দিচ্ছে।

জীবনে শুধু একটা চেষ্টা থাকলেই হয় না। একটা সাধনও দরকার। চেষ্টা নিজের দিকে তাকিয়ে করা হয়। তার সবটুকুই নিজের জন্য। সাধন বড়র দিকে তাকিয়ে করা হয়, মহতের দিকে তাকিয়ে করা হয়, নিজেকে উদ্ধারের জন্য। নিজেকে অধগতির থেকে উদ্ধারের প্রয়াসই সাধন। দুর্ভাগ্যবশত সে সাধনের জন্য পরিবেশ বা উৎসাহের একান্ত অভাব চারদিকে। অবশ্য সে দিন কোনো কালেই কি ছিল? হয় তো না।

টেন কমেন্ডমেন্টসের শেষ আদেশ আর উপনিষদের প্রথম বাণীর সুরটা এক। খ্রীষ্ট বলছেন এ জগতে যে শান্তির প্রতিষ্ঠাতা সে-ই আমার প্রিয়। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তুমি সংসারে আছ বলে খানিক শান্তি আছে, এ খুব বড় কথা। শেষে আবার বলি, শান্তি গন্তব্য না, পথ। শান্তি বাইরে থেকে পাওয়া যায় না। ভিতর থেকে জন্মায় সে। শান্তিকে প্রত্যক্ষ পাওয়া যায় না। লোভকে সবিবেক সরালেই দেখা যায় সে চিরটাকাল আছে। আর চিরন্তন আছে বলেই মানুষের এতবড় আশা - একটু শান্তিতে মরতে চাই। অর্থাৎ শান্তি এমনই মহার্ঘ্য, তাকে মৃত্যুর পাশেও চাই। তাকে কি এমনিই ফাঁকিতে এলেবেলে ভাবে পাওয়া যায়? সাধনহীন হয়ে কাটিয়ে দেব? দশটা মানুষকে ভুলিয়ে কী হবে, যদি নিজের ভিতরেই আনন্দ-প্রবাহিনীকে খুঁজে না পাওয়া গেল? বাইরের শতসহস্র উপঢৌকন, শিরোপা, নামযশ সব তুচ্ছ হবে যে!

50
Tue, 07/09/2024 - 15:00

 

যা জানলাম, না জানলে কী হত?

যা দেখলাম, না দেখলে কী হত?

জানার আগে বেশি শান্তিতে ছিলাম? না জানার পর শান্তিটা বিঘ্নিত হল?

দেখার আগে মানসিক অবস্থা যা ছিল, এখন তার চাইতে খারাপ, না ভালো?

এ প্রশ্নগুলো বারবার করতে হবে। যতবার হাতে মোবাইল নিচ্ছি - রিল, শর্টস, নানা পোস্ট, ছবি, তথ্য ইত্যাদি ইত্যাদি যা কিছুই দেখি না কেন…..এ প্রশ্নটা বারবার করতেই হবে।

হাতে মোবাইল তুলে নেওয়াটা অভ্যাস। বুড়ো আঙুলের চলনটা অভ্যাস। চোখ আর কানের “অন মোড” এ থাকাটা অভ্যাস। কোনোটাই এগুলো এখন আর সিদ্ধান্ত নয়। হাতে তুলে নিলেই অভ্যাস “অন মোড” এ চলে এলো। চারপাশ ঝাপসা। আসলে চোখেরও তো মনের মত একটা উপযোজন বা অ্যাকোমোডেশান ক্ষমতা আছে। চোখের সামনে রাখা তর্জনীর দিকে দৃষ্টি নিবেশ করলে যেমন চার পা দূরের জিনিস ঝাপসা, আবার দশ পা দূরের জিনিসের দিকে তাকালে যেমন কোলের উপর রাখা বইয়ের মলাট ঝাপসা, মনের বেলাতেও তো তেমন। কাকে কাছে রাখি, কাকে দূরে…. এ একটা সিদ্ধান্ত। আমার সিদ্ধান্ত।

কিন্তু মোবাইলটা হাতে তুলে নেওয়া থেকে শুরু করে বাকিটা আমার সিদ্ধান্ত নয় আর, বাকিটা অভ্যাস।

খারাপ সিদ্ধান্ত আর ভালো সিদ্ধান্তের একটা হিসাবনিকাশ আছে। পরিশোধন, পরিমার্জনের একটা ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু অচেতন অভ্যাসের কোনোটাই সুবিধার না। কেউ কথা বললেই যদি অজান্তেই শাস্ত্রের শ্লোক আওড়ায় সে যেমন সুবিধার না, তেমনই কেউ মুখ খুললেই যে গালিগালাজ শুরু করে, সেও সুবিধার না। আসলে কোনো কিছুর উপর অগোছালো চৈতন্যটাই ভয়ানক খারাপ। “আপনিই হয়ে যায়” - এমন জিনিস ক্ষতিই বেশি করে।

সমস্যা হল আরো চাট্টি নানা অভ্যাসের একটা দেশ-কাল-পাত্র সাক্ষীসাবুদ আছে। কিন্তু মোবাইল আর আমার মধ্যে আমার আঙুলের নখ আর চামড়ার মধ্যে যে ফাঁক তেমনই তো ফাঁক। বলা যায় মোবাইলের স্ক্রিন মনেরই একটা এক্সটেন্ডেড অঙ্গ। আমি মনে মনে কী চিন্তা করছি যেমন কেউ টের পায় না, ঠিক তেমন এই মুহূর্তে আমার মোবাইল স্ক্রিনে মনের কোন রস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কেউ জানে না। কেউ এলেই টুক করে সরিয়ে দেওয়া যায়। আড়ালের এমন প্রবল সাম্রাজ্যের অধিকারী হয়ে আমাদের খুব একটা সুবিধা হচ্ছে কী না এটা দেখতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এ আড়ালের নেশা এত এত প্রবল দেখছি যে রীতিমতো আতঙ্ক লাগে। তাদের সব “লক” করা। হোয়াটসঅ্যাপ থেকে গ্যালারি ইত্যাদি যা কিছু। আমি এগুলোকে ‘'প্রাইভেসি’’ র অজুহাতে চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু মজার কথাটা হল মানুষ কখনও গোটাটা ‘'প্রাইভেট’’ সত্তা না। সেদিকে ভার বেশি জমলে অন্যদিকে সাম্যের সমস্যা হবে। সে হচ্ছেও। আড়ালের পর আড়াল জমে মনের থেকে স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিকের, স্বাস্থ্যকর আর অস্বাস্থ্যকরের সীমারেখা পাতলা করে দিচ্ছে। এ বড় ভাবনার।

আমি আছি। আমার দায়িত্ব আছে। আমার এই একটা হালে আমদানি ‘মোবাইল অভ্যাস’ আছে। বেশি গোলমাল দেখলেই আমার এই মোবাইল অভ্যাসকে একটা ইশারা দিলেই হবে। মুহূর্তে ‘আমি’ নেই। সে ডুবে গেছে। ব্যস, আমি নেই, তাই আমার সমস্যাও আর নেই।

এমন প্রকাণ্ড তথ্যনুৎপাতের আয়োজন জগতের ইতিহাসে আগে ছিল না। এক মিনিটে দর্শন থেকে রান্না, ভক্তিরস থেকে আদিরস, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা থেকে কলতলার ঝগড়াঝাঁটি, নিষিদ্ধপল্লীর স্বাদ থেকে মহাকাশের বিস্ময়…. সব এক কয়েক মুহূর্তে। বিস্ময়…বিস্ময়…. বিস্ময়…. .বিষাদ…. বিষাদ…. বিষাদ…।

একটা বিরাম দরকার। ব্যস। আর কিচ্ছু না। শুধু একটা বিরাম। ব্যস। কিচ্ছু ছাড়াছাড়ির দরকার নেই। বিরাম। সেই বিরামে আমি আমার চারপাশের দিকে তাকাই। মনের উপযোজন বা অ্যাকোমোডেশান ক্ষমতাটা ঠিক করি আবার। কাছের জিনিস আর দূরের জিনিস, নাগালের জিনিস আর না-নাগালের জিনিসের মধ্যে পার্থক্যটা স্বচ্ছ করে নিই আবার।

তার জন্য, ওই একটাই জিনিস একটু দরকার। বিরাম। আর বিরামের আগে ওই দুটো প্রশ্ন….

মোবাইলটা অভ্যাসগতভাবে দেখার আগে ভালো ছিলাম, না দেখার পর ভালো আছি।

তথ্যনুৎপাতের সামনে দাঁড়ানোর আগে সাড় বেশি ছিল, না এখন?

কারণ সমস্যা-ঝুটঝামেলার বোধ আছে মানে এখনও মনে সাড় আছে। দীর্ঘক্ষণ তথ্যনুৎপাতের সামনে দাঁড়ালে গোটা সত্তা অবশ হয়ে যায়। কোনো সাড় থাকে না। সেটা স্বাস্থ্যকর কিছু নয়।

একটু শান্ত হই। ততটাই খাই যতটা সহজে হজম করতে পারি। এত এত জানার দরকার কী?

 

51
Thu, 07/04/2024 - 14:43

 

“সর্বোপরি, পবিত্র ও দৃঢ়চিত্ত হও এবং মনে প্রাণে অকপট হও—ভাবের ঘরে যেন এতটুকু চুরি না থাকে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। যদি তোমরা রামকৃষ্ণের শিষ্যদের কারও ভেতর কোন জিনিষ লক্ষ্য করে থাক, সেটি এই—তারা একেবারে সম্পূর্ণ অকপট। আমি যদি ভারতে এই রকম এক-শ জন লোক রেখে যেতে পারি, তাহলে সন্তুষ্ট চিত্তে মরতে পারব—আমি বুঝব, আমার কর্তব্য শেষ হয়ে গেছে। অজ্ঞ লোকে যা তা বকুক না কেন, তিনিই জানেন—সেই প্রভুই, জানেন কি হবে। আমরা লোকের সাহায্য খুঁজে বেড়াই না, অথবা সাহায্য এসে পড়লে ছেড়েও দিই না—আমরা সেই পরমপুরুষের দাস। এই সব ক্ষুদ্র লোকের ক্ষুদ্র চেষ্টা আমরা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনি না। এগিয়ে যাও। শত শত যুগের কঠোর চেষ্টার ফলে একটা চরিত্র গঠিত হয়।” স্বামী বিবেকানন্দ

       শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, মন মুখ এক করাই আসল সাধনা। সমস্ত ধর্মগ্রন্থ সত্যপরায়ণ হওয়ার উপদেশ দেয়। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, চৈতন্য, কবীর, নানক সবারই এক কথা, সত্য সাধনের চাইতে বড় সাধন নেই।

    কিন্তু বিশ্বাসের জগত আর বাস্তবের জগতে তো বিস্তর ফারাক। ন্যায়ের মূল্যবোধে বিশ্বাস, ভালোবাসার মূল্যবোধে বিশ্বাস, মঙ্গলময় ঈশ্বরে বিশ্বাস… এ সবের সঙ্গে বাস্তবের অভিজ্ঞতার সাযুজ্য কোথায়?

   হচ্ছে না। লিওন ফেস্টিংগার, ১৯৫৭ সালে একটা বই লিখলেন, কগনিটিভ ডিসোনেন্স। কী হবে বাংলায়? চেতনার অসংগতি? না, প্রতীতির অসংগতি? না বোধের অসংগতি?

    ‘'চণ্ডালিকা” নৃত্যনাট্যে প্রকৃতি তার এই বোধের অসংগতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল….

 যে আমারে পাঠাল এই

                           অপমানের অন্ধকারে

          পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।

                কেন দিব ফুল, কেন দিব ফুল,

                            কেন দিব ফুল আমি তারে--

                      যে আমারে চিরজীবন

                                রেখে দিল এই ধিক্‌কারে।

          জানি না হায় রে   কী দুরাশায় রে

             পূজাদীপ জ্বালি মন্দিরদ্বারে।

                  আলো তার নিল হরিয়া

                       দেবতা ছলনা করিয়া,

                            আঁধারে রাখিল আমারে

   বোধের অসংগতি কী সুখকর? না। এবং স্বাস্থ্যকরও না। অহর্নিশি দ্বন্দ্বে বাঁচতে বাঁচতে মানুষ অসংবেদনশীল হয়ে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে যায়। বায়াসড হয়ে যায়। মনের মধ্যে ক্ষোভের উপর ক্ষোভ জন্মায়। নিজের উপর ধিক্কার অন্যের উপর নিষ্ঠুরতা হয়ে বেরিয়ে আসে।

    বিখ্যাত উপন্যাস, “ব্রাদার্স কারামোজভ” এ দস্তভয়েস্কি লিখছেন,

        "সর্বোপরি নিজেকে মিথ্যা বলার অভ্যেসটা ছাড়ো। যে নিজেকে মিথ্যা বলে আর নিজেই নিজের তৈরি মিথ্যাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে সে এমন একটা জায়গায় এনে নিজেকে দাঁড় করায় যে, সে নিজের মধ্যে, কি নিজের চারপাশের, কোনো কিছুতেই আর সত্যকে আলাদা করে চিনতে পারে না। ফলস্বরূপ নিজের আর অন্যের উপর শ্রদ্ধাবোধ হারায়। যেহেতু সে কাউকে শ্রদ্ধা করতে পারে না, তাই ভালোবাসতেও পারে না, তখন এই শুষ্কতার থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য, স্ফুর্তির জন্য সে নিজেকে নিজের পাশবিক স্বভাব আর বিকৃত উল্লাসের হাতে সঁপে দেয়, সম্পূর্ণ একটা পশু হয়ে ওঠে দিনে দিনে, আর এ সবেরই সূত্রপাত হয় সেই নিজেকে মিথ্যা বলার অভ্যাস থেকে।

      এই ধরণের মানুষেরা খুব অল্পেতেই অপমানিত বোধ করে। আসলে অপমানিত বোধ করার মধ্যে তারা একটা আনন্দ পায়, তাই না? কারণ তারা নিজেরাও জানে যে আসলে কেউই তাকে অপমান করেনি, সে নিজেই এই অপমানটা বানিয়েছে, নিজেকে মিথ্যা বলে, অতিরঞ্জিত করে কোন তুচ্ছ একটা শব্দকে তিল থেকে তাল বানিয়ে, কারণ সে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তার মধ্যে আনন্দ পেতে চায়। যদিও এসবই সে খুব সচেতনভাবে করে, নিজের মধ্যে সব কিছু সম্বন্ধেই সে জ্ঞাত, তবু এই অপমানিত বোধ করার আনন্দটা পাওয়ার জন্য সে মরিয়া, এর মধ্যে সে একটা তৃপ্তি পায় আর এভাবেই তার মধ্যে ধীরে ধীরে সত্য অর্থে বিদ্বেষের ভাব লালিত হতে থাকে।"

     প্রাচীনের সঙ্গে নবীনের। আদর্শের সঙ্গে বাস্তবের। বিশ্বাসের সঙ্গে অভিজ্ঞতার অহর্নিশি বিরোধে এই অসংগতির ভার ক্রমে জমছে তো জমেই চলেছে।

   রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যায় লেখা কবিতাও এই অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি।

“তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনা-জালে,

হে ছলনাময়ী।

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে।

এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;

তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।

তোমার জ্যোতিষ্ক তারে

যে পথ দেখায়

সে যে তার অন্তরের পথ,

সে যে চিরস্বচ্ছ,

সহজ বিশ্বাসে সে যে

করে তারে চিরসমুজ্জল।

বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,

এই নিয়ে তাহার গৌরব।

লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।

সত্যেরে সে পায়

আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।

কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,

শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে

আপন ভাণ্ডারে।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।”

    এ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যেন সে বোধের অসংগতি থেকে উত্তরণের একটা রাস্তা দেখাচ্ছেন, “সহজ বিশ্বাসে করে তারে সমুজ্জ্বল….সত্যেরে সে পায়, আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে”।

=========

     কিন্তু আমাদের বোধের অসংগতি কি এত সহজে যাওয়ার? আমাদের নিজেদের নিজেদের মানসিক গঠন, একের পর এক মোহভঙ্গ….অবশেষে কি এক গভীর বিষাদের দিকে নিয়ে যায় আমাদের? নিজের কপটতায়, নিজের ভণ্ডামিতে ক্লান্ত হয়ে গিয়ে সব যুদ্ধত্যাগ করে মাঝপথে বসে পড়ি?

    সংশয় থেকে ত্রাণ পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মছলনা থেকে ত্রাণ পাওয়া যায় না। সে সত্যকে অস্বীকার করতে শিখে গেছে। মিথ্যা থেকে আরো মিথ্যার দিকে যায় শুধু বাইরের লাভের দিকে তাকিয়ে। সে যখন হারায়, একেবারেই হারায়। সে যখন ভাঙে, একেবারেই ভাঙে।

      বোধের অসংগতি থেকে বাঁচার জন্য কেউ স্বেচ্ছা-বধিরতা, কেউ স্বেচ্ছা-অন্ধত্ব নিজের উপর আরোপ করে। একটা ছোটো সংকীর্ণ কমিউনিটি তৈরি করে নেয়। একটা কনফারমেশন বায়াসনেসে অভ্যস্ত করে নেয়। তা-ই দেখে যা দেখতে চায়। তা-ই শোনে যা শুনতে চায়। কিন্তু বোধের অসংগতি থেকে সংগতির রাস্তায় যাওয়ার পথ তো এটা নয়! তবে উপায়?

======

     আপাততভাবে যা সত্য বলে মনে হচ্ছে তা ইচ্ছানুরূপ, বিশ্বাস অনুরূপ, ভালোলাগা অনুরূপ না হলেও তাকেই মেনে নেওয়া। সত্যের চাইতে বড় কিছু হয় না। সত্যই আশ্রয়। সত্যই আশা। আলো। জোর। সব কিছুই সত্য থেকে জন্মায়।

       অসংগত বিশ্বাস আমাকে কোথাও নিয়ে যাবে না। যদি অসংগতির বোধ হয় আগে সংগতি খোঁজাই সব চাইতে মূল্যবান কাজ। কারণ সত্য দাঁড়িয়ে থাকে সঙ্গতির মধ্যে, বিরোধের মধ্যে না। দিন রাত্রির বিরোধ যেমন দাঁড়িয়ে থাকে আহ্নিকগতির সত্যের উপর। অকপটতাই একমাত্র উপায়। এই অকপট হওয়ার সাধনাই মানুষের বোধের সব চাইতে কঠিন সাধনা। শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, যে সমন্বয় করেছে, সে-ই লোক। আমাদের দর্শনে একে বলেছে “সমাধান”। ভাবের সমাধান। চিত্তের সমাধান। বোধের সমাধান। সেকি আপনিই হবে?

52
Thu, 06/27/2024 - 12:18

শ্রীরামকৃষ্ণের খুব কাছাকাছি কয়েকজন সাধারণ মানুষ কতদিন কাটিয়ে গেল। জ্ঞানের তাপে দগ্ধ হল না। মাধুর্যে পরিপূর্ণ হল। আজীবন।

মাধুর্যের প্রফেসি হয় না। কারণ মাধুর্যের কোনো বাণী নেই। ভবিষ্যৎ নেই। অতীত নেই। মাধুর্যের শুধু "এখন" আছে। এই মুহূর্ত আছে। শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গেলে তাই সবই "এখন" এর কথা। আশা ভবিষ্যতের দিকে কাঙালের মত তাকিয়ে থাকায় নয়। বর্তমানের সবটুকু নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলার মাধুর্যে। শ্রীরামকৃষ্ণ সেই মাধুর্যের ভাণ্ডার নিয়ে বিলিয়েছেন। তাঁর ঈশ্বর মাধুর্যের ভাণ্ডারী। সে নানা রঙে ছুপায়। যে যে রঙে ছুপতে চায়। কাউকে রঙহীন করে তোলা সে ভাণ্ডারীর কাজ নয়।

জীবনে মাধুর্য চলে গেলে মানুষ বড় শুষ্ক তাত্ত্বিক হয়। তাত্ত্বিক তার্কিক হয়। তর্ক তথ্যের পর তথ্যের ভাণ্ডার খোলে। রসের সন্ধান পায় না। ভালোবাসাকে ভাবে একটা অনুভব শুধু। একটা আবেগ। জাল ফেলে। কাদা মাখে। ভাবে এই সার।

শ্রীরামকৃষ্ণ ভালোবাসছেন। মাধুর্য ছেনে আনছেন হৃদয় নিংড়ে। বলছেন "মা" দিচ্ছে উপুড় করে। "মা" কে? যাকে গড়ে ভেঙে শেষ করা যায় না। যার ইতি করা যায় না। তাঁকে শূন্য করা যায় না। কোনো একটা বিশ্বাসকে, মতকে শূন্য বলা যায়। অস্তিত্বকে শূন্য বলা যায় না। মানুষ কোনোদিন শূন্যকে অনুভব করতে পারে না পূর্ণভাবে। কারণ যে অনুভব করে সে থেকেই যায়। তাকে সরানো যায় না। তাই মানুষের সব অনুভব আংশিক। সব জ্ঞান আংশিক। কিন্তু মাধুর্য পরিপূর্ণ। কারণ চিনির রুটি আড় করেই খাও সোজা করেই খাও, মিষ্টি। মাধুর্যের অংশ হয় না। কতটা ডুববে তার পার্থক্য হয়। গঙ্গার যেখানেই ডোবো সেখানেই গঙ্গা।

তাই মানুষ শূন্যকে অনুভব করতে পারে না। যে অনুভব করে তাকেও যদি সরিয়ে দিই? নির্বিকল্প সমাধি? বিকল্প নেই। এক আছে। জ্ঞাতা জ্ঞান এক। সেখানে ভাষা নেই। অনুভব নেই। চিন্তা নেই। কী আছে? কে বলবে? নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিয়েছিল। শূন্য নিমজ্জিত পূর্ণে। তাজ্জব তাজ্জব!

এত খবরে কাজ নেই। মদের দোকানে কত মদ জেনে কী হবে? ভালোবাসা, মাধুর্য, চেতনা, আনন্দ, ঈশ্বর..সব এক কথা।

গলায় ক্যান্সার। মৃত্যু শিয়রে। চারদিকে হাহাকার করা চোখ এত এত। কোথায় যাচ্ছ ফেলে? সব কী শেষ হবে?

খোলটা যাবে এবার। সময় হয়েছে। একটা নতুন মাধুর্য দিয়ে গেলাম। মা শব্দের মাধুর্য। চেনা ডাক। মন্ত্র না। ডাক। মা নামের মাধুর্যে তরী ভাসাও। পার হও কী না হও দেখোই না। ভয় নেই। এ জীবনটা রয়ে গেল। ছাঁচ। এক একবার এসে মিলিয়ে নিও। হারিয়ে যাবে না। মা নামের মাধুর্যে ডোবো। সব পাবে।

53
Sun, 06/16/2024 - 13:31

বাউল গাইল - “অরসিকে জানবে কেনে?”। “দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না”।

কথা কী উচ্চারণ করলেই মরমে বেঁধে? তুবড়ির মত ফেটে গিয়ে অর্থের আলোয় আলোকিত করে অন্তর?

না রে ভাই। অত সোজা নয় ব্যাপারটা।

বিবেকানন্দ বলছেন, তুমি একটা বিশালাকায় গোটা লাইব্রেরি মুখস্থ করে নিতে পারো। কিন্তু বুঝলে কী?

না। তুমি ততটাই বুঝবে যতটা বোঝার শক্তি তুমি অর্জন করেছ।

========

আমি কিছু একটা ভাবলাম। সেই ভাবনাকে শব্দের সংকেতে বাতাসে ধ্বনি তুলে তোমার সামনে বললাম। তোমার কানে গিয়ে শব্দগুলো সংকেতের পোশাক ছেড়ে অর্থের আকার ধারণ করল। কিন্তু তারপর? সে অর্থগুলো সঠিক সজ্জায় সেজে, বক্তার বক্তব্যের অনুরূপ আকার কি তোমার চিত্তে ধারণ করল? উঁহু। সে আকার ধারণ করবে তোমার চিত্তের গঠনের খাঁজ আর গঠনের অনুরূপ। তাই লোকে বলে না, ধান বললে কান শোনে। বলি এক, বোঝে এক। রামকৃষ্ণ ঠাকুর বলছেন, কারেই বা বলি, কেইই বা বোঝে!

“কোথা তুমি মোর অজানা সাথি, কাটাও বিজনে বিরহ রাতি/ এসো এসো উধাও পথের যাত্রী/ তরী আমার টলোমলো, ভরা জোয়ারে”।

ওগো দরদী! এসো এসো। তুমি না এলে আমার কথা বুঝবে কে?

=======

ধরো তুমি বললে, পুজো তো এসে গেল।

এখন যাকে বললে, সে যদি “পুজো” মানে দুর্গাপুজো না বোঝে, সেকি আদৌ বুঝবে তুমি কী বললে? না বুঝবে না।

তাই তোমার কথা সে-ই বুঝবে যার জ্ঞানের ধারা তোমার জ্ঞানের ধারার সঙ্গে মেলে। যার রসের ধারা তোমার রসের ধারার সঙ্গে মেলে।

নইলে কী হবে?

সে আর ব্যাখ্যা করতে হবে গো? রাতদিন দেখছ না চাদ্দিকে। “দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে, বোঝাতে নারে আপনায়”।

এই হচ্ছে চাদ্দিকে। তুমি খোঁজো তোমার কথা কেউ বুঝুক। এ চার আনা বোঝে। ও আট আনা বোঝে। সে এক আনা বোঝে। তোমার ষোলো আনা কেউ বোঝে না। বুঝবেও না। কারণ ভাষার সে ক্ষমতা নেই। ভাষা শুধু অর্থহীন সংকেত। সে সংকেত ভেঙে বোধ অর্থ করে। সে বোধের সঙ্গে বোধের যদি মিল না হয়, তুমি গোটা মহাভারত লিখেও তাকে বোঝাতে পারবে কী গো?

=======

আমি যখন চুপ করে আমার ঘরে বসে থাকি। আমার জানলার বাইরে গোটা জগতের দিকে তাকাই। দেখি, গাছের পাতা, আকাশের রঙ। অনুভব করি বাতাসের স্পর্শ। আমার ভিতরের দিকে তাকাই যখন, সেখানে নানা ভাবনা, অনুভব। আমার বাইরে ভেতরে কত ভাষা। গাছের পাতায়, আমার সুখ-দুঃখে…কে যেন কী বলতে চাইছে এই বাইরে ভিতর সবটা মিলিয়ে। আমি কী বুঝতে পারছি?

প্রাচীনকালে উপনিষদের ঋষিরা বুঝেছিলেন ভাষার সীমাবদ্ধতা। বলেছিলেন, মন আর বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে। কিন্তু আনন্দ তাঁকে আনন্দের মধ্যে খুঁজে পায়। যে আনন্দের রূপ সংসারে শান্ত-শিব-অদ্বৈতের মধ্যে। আমি যদি শান্ত হই তবে আমার মধ্যে মঙ্গলের প্রতিচ্ছবি জাগবে। সেই প্রতিচ্ছবিতে দেখব গোটা সংসার “এক”-এর মধ্যে জাগ্রত চিরটাকাল। স্বামীজি গাইছেন, “অবাঙমানসগোচরম্”/ বোঝে - প্রাণ বোঝে যার।”

======

পাশ্চাত্য দর্শন যখন ভাষার গভীরে গিয়ে ভাষার সঙ্গে ভাষার সঙ্গতির দিশা খুঁজছে, সেখানেই প্রাচীন প্রাচ্যের দর্শন উপনিষদে, তাও-দর্শনে জগতের সঙ্গে বোধের সঙ্গতি খুঁজেছে। “বেসুর বাজে রে/ আর কোথা নয়, কেবল তোরই আপন-মাঝে রে”।

আমাদের দুই সত্যকেই দরকার। ভাষার সঙ্গতি আর বোধের সঙ্গতি দুই-ই।

পাশ্চাত্যের দুই বিজ্ঞানী, অসামান্য একটা বই লিখেছিলেন, Meaning and Relevance, লিখেছেন, Deirdre Wilson and Dan Sperber. এ বইটা পড়তে পড়তে মনে হল তাই তো প্রাণের গভীরে যে ভাষাকে জীবন্ত করে অর্থ উপহার দেয়, সে কে? “কে গো অন্তরতর সে”?

জানি না আমরা। শুধু জানি শুধু ভাষা নয়, ধ্বনি নয়, নীরবতারও এক সঙ্গতিপূর্ণ অর্থ সে জানে। তাই মাঝে মাঝে বাইরে যখন ঝড়, তখন সে আমার মধ্যে কী গভীর নীরবতা গড়ে তোলে। আমি সেই সাগরে পাড়ি দিই, একা। জানি সে আমায় কোথাও না কোথাও নিয়ে যাবেই।

======

তবু থেকে যাবে অসীম অব্যক্ত। যা বলা হয়নি। যা বলা হয় তো বা কোনোদিন সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথের গান দিয়েই শেষ করি এ লেখা তাই….

 

হেথা        যে গান গাইতে আসা আমার

                        হয় নি সে গান গাওয়া--

    আজো      কেবলি সুর সাধা, আমার

                        কেবল গাইতে চাওয়া।

                        আমার      লাগে নাই সে সুর, আমার

                                  বাঁধে নাই সে কথা,

                        শুধু প্রাণেরই মাঝখানে আছে

                                      গানের ব্যাকুলতা।

                        আজো      ফোটে নাই সে ফুল, শুধু

                                      বহেছে এক হাওয়া।

 

আমি        দেখি নাই তার মুখ, আমি

                    শুনি নাই তার বাণী,

কেবল      শুনি ক্ষণে ক্ষণে তাহার

                    পায়ের ধ্বনিখানি।

আমার      দ্বারের সমুখ দিয়ে সে জন

                    করে আসা-যাওয়া।

 

                    শুধু      আসন পাতা হল আমার

                                      সারাটি দিন ধ'র--

                    ঘরে      হয় নি প্রদীপ জ্বালা, তারে

                                      ডাকব কেমন ক'রে।

                    আছি        পাবার আশা নিয়ে, তারে

                                      হয় নি আমার পাওয়া

 

(ছবি Joydeep Ghosh)

54
Sat, 06/08/2024 - 12:01

আমার ভালো থাকা দুই রকমের হতে পারে। আমার আপাতভাবে ভালো থাকা। আর আমার গভীরে, দীর্ঘস্থায়ী ভালো থাকা।

পাশ্চাত্যের স্টোয়িক দর্শন বলেছিল, যা তোমার নিয়ন্ত্রণে নেই, তা নিয়ন্ত্রণ করতে যাওয়ার অতিচেষ্টার মধ্যে তোমার খারাপ থাকার বীজ লুকিয়ে। আরো আগে সে দেশের দর্শন বলেছিল, তোমার ভালো থাকা মানে তোমার মূল্যবোধের ভালো থাকা।

তুমি তোমার ভিতরে প্রবেশ করে দেখো, তোমার মূল্যবোধ ভালো আছে কী? মূল্যবোধ চৌকাঠের মত। তোমার চৌকাঠ ভালো আছে কী?

তোমার মূল্যবোধ ভালো থাকলে তোমার প্রাণে প্রসন্নতা থাকবে। সুখের চেয়ে স্বস্তি থাকবে। কিন্তু যদি মূল্যবোধ ভালো না থাকে তবে যা-ই করো, যত সুখের আগারেই ডুবে থাকো, কোথাও একটা স্বস্তির অভাব অনুভব তো করবেই।

সেদিন একটা বাচ্চাকে নিয়ে তার বাবা মা এসেছিল। সে বাচ্চাটা অনেক কিছু জানে। কিন্তু কোনোটাই তার প্রাণের সম্পদ নয়। সে কবিতা মুখস্থ বলে যাচ্ছে, গান গেয়ে যাচ্ছে, কুইজের মত নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে…আরো কত কী। কিন্তু কোনোটাই তার চোখে মুখে উজ্জ্বল হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।

যেন তার বাবা মা তাকে একটা অসীম জ্ঞান আর কলাকৌশলের ভাণ্ডারে ঢুকিয়ে বলেছে, যা বাচ্চা, যা পারিস লুটে নিয়ে আয়। তোর হাতে, কোঁচড়ে, সর্বত্র ভরে নিয়ে আয়। যতটা আনতে পারিস ততটাতেই তুই সফল। তুই অ্যাচিভার।

সত্যি বলতে বাচ্চাটাকে দেখে আমার ভয় লাগল। শুনেছি আমাজনের জঙ্গলে এমন ঘন জায়গা আছে সেখানে নাকি সূর্যের আলো পৌঁছায় না। আমাদের তথ্যরাশির ভাণ্ডার এমন ঘন হয়েছে জায়গায় জায়গায় যে সেখানে প্রজ্ঞার আলো পৌঁছাচ্ছে না। আমরা সেই বাচ্চাটাকে সার্থকতার মানে শেখাচ্ছি না। বলছি না যে তোমার যতটুকুতে আনন্দ, যতটুকুতে সার্থকতার বোধ ততটুকুতেই তুমি সফল। আমরা সফলতার পিছনে সার্থকতা শব্দটা দাসের মত জুড়ে দিতে চাইছি। কিন্তু সার্থকতার অনুগামী যে সফলতা তাকে ভ্রান্ত করছি, ব্যর্থ করছি।

আমার মূল্যবোধ আমার চৌকাঠ। আমার স্বস্তি। আমার শান্তি। আমার আনন্দের উৎস। আমার দুর্দিনের আশ্রয়। আমার সুদিনের নম্রতা। আমার ঈশ্বর আমার মূল্যবোধেরই প্রতিচ্ছবি। যার মূল্যবোধ যেমন তার ঈশ্বরের, আদর্শের প্রতিচ্ছবিও তেমন। যা তার বাকি সব সিদ্ধান্ত, অনুভবকে নিয়ন্ত্রণ করে চলবে আজীবন।

কিন্তু মূল্যবোধ কী? এর কি কোনো সার্বজনীন গঠন আছে?

আছে। নইলে এত এত মানুষের মধ্যে এক যোগসূত্র তৈরি হল কী করে? নইলে এত এত যুদ্ধ-হানাহানি থেকে, বর্বরতা থেকে আমরা সভ্যতার রাস্তায় এতটা রাস্তা এলাম কী করে? তার কোনো একটা মানচিত্র তো আছেই। কিন্তু তার সম্পূর্ণ রূপ আজও বিকশিত নয়। তবে নানা উত্থানপতন দিয়ে আমরা সেইদিকে চলেছি বলেই আমাদের বিশ্বাস। নইলে মহত্বকে চিনি নিজের মধ্যের কোন সত্তার প্রতিচ্ছবিতে? সে ছবি যদি নিজের মধ্যে না-ই থাকত, তবে ইতিহাসের মহান ব্যক্তিদের সামনে নত হতাম কিসের প্রেরণায়? শ্রদ্ধা শব্দটা মানুষের ভাষায় জন্ম নিত কীভাবে?

প্রাচীন গ্রীসে সেদিন সক্রেটিস ঘোষণা করেছিলেন, ভালো থাকার যোগ্যতা আসে মূল্যবোধের অনুশীলনে। মূল্যবোধ জন্মায় আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে। আত্মানুসন্ধানহীন মানুষ শুধু সুখের সন্ধানের রাস্তায় হাঁটলে বাঁচবে কি? আমার সুখের উৎস তো আমারই মধ্যে। তাকে উপেক্ষা করে, তাকে অচর্চিত রেখে, সে ‘মানবজীবন আবাদ’ না করে, শুধু লোভের ভ্রান্ত কম্পাসে ভর করে উন্মাদের মত দৌড়ে বেড়ালেই হবে?

মানুষের ইতিহাস এই মূল্যবোধের লড়াইয়ের ইতিহাস। মানুষের যাবতীয় তর্ক, সমাজ-ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি-যুদ্ধনীতি ইত্যাদি সব সব শুধু এই উচিত আর অনুচিতকে নিয়ে। মানুষের যাবতীয় তর্ক যদি শুধু লাভ-ক্ষতি নিয়ে হত তবে কাজটা অনেক সহজ হত। তবে জাস্টিস বলে কোনো শব্দ থাকত না মানুষের অভিধানে। গান্ধারী কোনোদিন বলতেন না অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে, সব গেলেও যা থেকে যাবে সে তোমার ধর্ম! ভারতীয় দর্শনে ধর্ম মানে মূল্যবোধ। রিলিজয়ন না।

ব্যক্তি মানুষের, কি রাষ্ট্রের, ভালো থাকার উপায় তার মূল্যবোধের ভালো থাকাতেই। যে মূল্যবোধ আত্মানুসন্ধানজাত। আমাদের পুরাণের গল্পে আছে, একদিন দেব আর অসুরের মন্থনে অমৃত উঠেছিল, সে এই আত্মানুসন্ধানজাত মূল্যবোধ বলেই আমার বিশ্বাস। দেব আর অসুর দুই-ই আমারই মধ্যে। ভারতীয় দর্শনে ধর্ম, তথা মূল্যবোধের আরেক নাম অমৃতও তো। গীতার দ্বাদশ অধ্যায় লক্ষণীয়। বিবেকচূড়ামণি লক্ষণীয়। যেখানে মূল্যবোধকে অমৃতের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। ইদানীংকালে আমরা রামকৃষ্ণদেবের বাণীকেও অমৃত বলছি।

কিন্তু সেদিন মন্থনে অমৃত শুধু ওঠেনি, বিষও উঠেছিল। মহাদেব যাকে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন। মহাদেব মানে ধৈর্য। অশুভকে নাশ না করতে পারি, তাকে ধৈর্যের কারাগারে ধারণ না করে রাখলে সব বিনষ্ট। সে রূঢ়ভাষ হোক, কি নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত।

ঘুমন্ত মানুষের সুখ আর জাগ্রত মানুষের সুখ আলাদা। “কুঁড়ি চায় আঁধার রাতে/ শিশিরের রসে মাতে। ফোটা ফুল চায় না নিশা/ প্রাণে তার আলোর তৃষা/ কাঁদে সে অন্ধকারে”।

আমি যদি জেগে না উঠি আমার আত্মানুসন্ধানে, না খুঁজে পাই আমার মূল্যবোধকে, না স্বস্তি দিই তাকে, আমাকে কি কেউ ভালো রাখতে পারবে?

আত্মানুসন্ধান ছাড়া প্রাচীনকালে কোনো পথ ছিল না। আজও নেই। সেদিনের থেকে আমাদের রাশি রাশি জ্ঞানভাণ্ডার বেড়েছে, আয়ু বেড়েছে, আরামের সামগ্রী বেড়েছে, সুবিধার আয়োজন বেড়েছে। কিন্তু আত্মানুসন্ধানের চেষ্টা দেউলিয়া হয়েছে।

রামকৃষ্ণ ঠাকুর পড়াশোনা না জানা মানুষ। কিন্তু তিনি আঁশচুপড়ির সুখ আর ফুলের গন্ধের সুখের পার্থক্য করেন। উনি বলছেন, তুমি আঁশচুপড়ির সুখে সুখী হতেই পারো। কিন্তু এটুকু শুধু জেনো তার উপরেও আরেক ধরণের সুখ আছে। ফুলের গন্ধের সুখ।

আত্মানুসন্ধানহীন মানুষ অন্ধ। সমাজ অন্ধ। রাষ্ট্র অন্ধ। অন্ধের সুখ গেঁজিয়ে ওঠে। সে সুখের মদের কারবার আজ চারদিকে। সে ফেনিল সুখে আত্মানুসন্ধান নেই। আছে বিধ্বংসী আত্মবিস্মরণ। অবক্ষয়। সাধু সাবধান!

55
Wed, 05/29/2024 - 14:45

 

মনের একটা আঁশময় দিক আছে, যা হল চিন্তা। আরেক রসময় দিক আছে, যা হল আবেগ। আঁশ বেশি জড়ালে, বেশি ছড়ালে পেঁচিয়ে, জট পাকিয়ে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটে। তেমনই রস বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করলে গেঁজিয়ে গিয়ে, ফেনা উঠে, ভুড়ভুড়ি কেটে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে বসে।

আঁশ চায় নিজের জালে জগৎলীলা ধরতে। মানে চিন্তা করে করে জগতের সব রহস্য বুঝে ফেলতে। জগৎলীলাকে তার আপন মুকুরে ধরতে।

আর রস চায় থিতু হতে। যে ভীষণ রেগে আছে সে ভাবছে একটা চড় মারলে, কি খুন করলে মনটা শান্ত হবে। যে লোভে আছে সে ভাবছে এই পরিমাণ সম্পদ জোগাড় করলে বেশ থিতু হয়ে যায় মনটা। যে প্রেমে আছে সে ভাবছে, প্রেম ছুটেছে যার দিকে তাকে সম্পূর্ণভাবে পেলে মনটা থিতু হয়।

আবেগ অনেকটা জলের মত। ততক্ষণ গড়িয়েই যাবে যতক্ষণ না স্থির হচ্ছে একটা জায়গায় গিয়ে। আবার বাইরে থেকে কিছু একটা ঘটল। তার স্থিতাবস্থা টলল, আবার শুরু হল নতুন যাত্রাপথ।

এই যে এত এত অপরাধ থেকে এত এত গোলাপ-চকোলেটের বিক্রি, সবই এই আবেগ থিতুকরণের উদ্দেশ্যে। কেউ অন্যের ক্ষতি করে। কেউ অন্যের ক্ষতি না করে। সবাই চাইছে আবেগের পাকাবাড়ি। যেখানে সে নিরুপদ্রব কাটাবে। হায় রে হায়। কী মায়া!

=======

এখন কথা হচ্ছে, এই থিতুকরণ কি মন একা একাই করতে পারে? তার আঁশালো দিক আর রসালো দিককে সঙ্গে নিয়ে? না পারে না। এখানে আরেকজনের সাহায্য লাগে। সে হল বুদ্ধি।

বুদ্ধি চাঁদের আলোর মত আঁশের মধ্যে দিয়ে এসে রসকে পথ দেখায়। কখনো শুভ পথ, কখনও অশুভ পথ। নির্ভর করছে বুদ্ধি আর আঁশের অবস্থানের উপর। যে বুদ্ধি বলছে, ওর গলায় খুর চালিয়ে, ওকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলেই তুই থিতু হবি, সে অশুভ। শুভ সে-ই, যে আর যাই বলুক, অন্যের ক্ষতি চায় না, এমনকি নিজেরও না।

মনের থিতু হওয়ার দুটো দিক আছে। এক বিভ্রান্তিকে অচল ধ্রুব জেনে তার মধ্যে বিশ্রাম। যা হল বিষাদ। আরেক হল শান্তির মধ্যে, যা হল প্রসন্নতা। তুষ্টি। কিন্তু পথ কে নির্ধারণ করবে? বুদ্ধি।

আমরা কথায় বলি, লোকটার বুদ্ধিশুদ্ধি নেই। অর্থাৎ বুদ্ধি একা থাকলেই হয় না। সঙ্গে একটা শুদ্ধির অনুপান চাই। তবেই মনের আঁশে শুভবুদ্ধি চাঁদের আলোর মত পড়ে অলঙ্কারের মত উজ্জ্বল হবে, আর রসে শান্তিমুক্তোর মধ্যে পূর্ণতা বোধের আনন্দে ডুবে যাবে।

কিন্তু এতই কি সোজা? উঁহু। সঙ্গ করো মন হে। সঙ্গ করো। সাধন ভজন সব মিথ্যা। সঙ্গ করো। বাউল কেঁদে কাঁদাবে। ময়লা যাবে। আলো স্বচ্ছ হবে। "বিদ্যাবধূ জীবনম"। সব হবে। সঙ্গ ছেড়ো না। ডুবে যাবে। বাউল কে? যার হাতে একতারা। মানে যার মন এক তারে বাঁধা। “এক মন যার সেই যেতে পারে”। জল থিতু হবে প্রসন্নতায়। চিত্ততুষ্টিতে। বিষাদে ডুবে কী হবে? ওতো ভ্রান্তি। ওকি তোর আপন? একদম নয়। ও ছল। সরে আয় মন, সঙ্গ কর। সঙ্গ কর। যে প্রসন্ন, যে চিত্ততুষ্টিতে জগত তুষ্টি করেছে তার সঙ্গ কর। সেই সার। বাকি সব অসার!

56
Sun, 05/26/2024 - 14:42

 

অপমান অনেক সময়েই যোগ্য অযোগ্য বিচার করে না। যদিও বিশুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানে কেউ-ই অপমানের যোগ্য নয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে অমন বিশুদ্ধভাব আচরণে পাওয়া কঠিন।

এক সময়ে আমি মাঝে মাঝে এক অভূতপূর্ব চরিত্রের মানুষের কাছে গিয়ে বসতাম। তিনি বৈষ্ণব সন্ন্যাসী। বয়েস প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই। অমন নির্লোভ, পণ্ডিত, রসজ্ঞ, নিরভিমানী মানুষ সত্যিই বিরল। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা লাভের সুযোগ হয়েছিল। তিনি এ মরজগতে নেই বহুকাল হল। কিন্তু তাঁর স্মৃতি বহু কঠিন সময়ে আমাকে শান্ত রাখে।

আমি ওঁকে অপমানিত হতে দেখেছি বহুবার। ওঁরই সন্ন্যাসী সেবক শিষ্যের কাছেই। কারণ কী? সেই শিষ্যের মতে, “যদি এনার বুদ্ধি থাকত, তবে এই ছোটো আশ্রমে না থেকে বিরাট আশ্রম উনি করতে পারতেন। অমুক তমুক যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও কত বড় বড় আশ্রম বানিয়েছে, সেখানে কত সুযোগ সুবিধা, আর ইনি এত পণ্ডিত, এত এত জ্ঞানীগুণী ধনী মানুষ আসে এনার কাছে, অথচ উনি…”

এইসব কথা সেই সেবক-শিষ্য সেবা করতে করতেও বলে যাচ্ছে বহুবার শুনেছি। তিরস্কারের পর তিরস্কার করে চলেছে। আর গুরু যিনি তিনি হয় তো কয়েকটা মৃদু প্রতিবাদ করে চুপ করে গেলেন।

পরে যখন জিজ্ঞাসা করেছি, সহ্য করেন কেন?

উনি বলছেন, আমি যদি সহ্য না করি, ও যাবে কোথায়?

এরকম আরো নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে আমি দেখেছি ওই ক্ষুদ্র সন্ন্যাসীর কী দাপট! মানুষটার বয়েস, চরিত্রের মহত্ব, শুদ্ধতা কিছুই ওকে স্পর্শ করত না।

আরেক দিনের ঘটনা। একদিন সন্ধ্যে হব হব কিছু নিত্য কাজে সে সন্ন্যাসীর কোনো দেখা নেই। আমাকে ইনি বললেন, তুমি একবার দেখবে গিয়ে, ও ঘুমিয়ে পড়ল কিনা….

আমি জানি আমি হঠাৎ তার ঘরে গিয়ে পৌঁছালে সে ভালোভাবে নেবে না। ইতস্তত করেও গেলাম। যথারীতি সে ঘুমাচ্ছে। ডাকলাম। সে, মুহূর্তের অপদস্থ ভাবটা কাটিয়েই গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি গৃহী মানুষ, ভোগী, আপনি আমাদের কঠোর জীবন সম্বন্ধে কী জানবেন? ভাবছেন আমি অলস…খাইদাই আর বেশ থাকি…কটায় উঠে জপে বসি জানেন…..

আমি কিছু বলার সাহস দেখালাম না। মানুষের চরিত্র নিয়ে অভিজ্ঞতা কম নেই। বাইরের মানুষ আর ভিতরের মানুষের দ্বন্দ্ব যেখানে যত বেশি জটিলতাও সেখানে তত বেশি। আমি নম্র কণ্ঠে বললাম, আজ্ঞে, আপনাকে উনি ডাকছেন।

যান যান…. বলুন গিয়ে আমি আসছি…..

আমি আবার বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পাশে এসে বসলাম। বললাম, আসছেন।

মিনিট চারেক পর এসেই সে বৃদ্ধ সন্ন্যাসীর পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। তারপর দুটো নয়নতারা ফুল পায়ে দিল। একটা ঘটি থেকে এক আঁজলা জল দিয়ে পা ধুয়ে দিল। তারপর গামছা দিয়ে মোছাতে মোছাতে বলল, যা সব লোক আশ্রমে যাতায়াত করতে দিচ্ছেন এ আশ্রমের শুদ্ধতা কদ্দিন থাকবে বলতে পারি না….গৃহীদের সব যায়গায় যাওয়া….

বৃদ্ধ মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন, কিন্তু ও তো অবিবাহিত….

সে যাই হোন গৃহীই তো।

ওদিকে মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠল। শ্রীরাধাগোবিন্দের আরতি হবে। বৃদ্ধ সন্ন্যাসী উঠতে পারেন না। তিনি যেখানে বসেছিলেন সেখান থেকেই দুটো হাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। সেবক গেলেন মন্দিরের দিকে। আমি উঠলাম না। একবার শ্রীবিগ্রহ প্রণাম করে ওঁর কাছে বসলাম।

সন্ধ্যার অন্ধকার ক্রমে রাতের দিকে যাচ্ছে। আমি অপমানের অনেক রূপ দেখেছি। আজও দেখলাম। অপমান অবহেলার জন্য অনেক মানুষ যোগ্য নন। তবু হন।

কিন্তু কেন?

এর উত্তর কে দেবে? যা আছে তাই আছে। যা ঘটছে তা-ই ঘটছে। যা নেই তা কেন নেই, যা ঘটল তা অনুচিত হতেও কেন ঘটল, এর উত্তর কে দেবে? এই উচিত আর অনুচিতের হিসাব কার কাছে মিলিয়ে নেব?

উত্তর নেই। সান্ত্বনা আছে। কোনো মহৎ প্রাণের সান্নিধ্যে যে সান্ত্বনা সে কোনো বই পড়ে, হাজার হাজার যুক্তিবুদ্ধি খাটিয়ে পাওয়া যায় না। রুমি বলছেন একজন মরমী বই খোঁজে না, মরমী খোঁজে। মরমীই পারে সব বিষ সংসারের কণ্ঠে ধরে রাখতে, অমৃত বচন বলতে। অথচ সে বচন কন্ঠে ধরা বিষে বিষাক্ত হয় না। কেন হয় না? জানব কী করে? সে মহত্বে আমার অধিকার কই?

 

57
Sun, 05/05/2024 - 01:29

সন্তান ঘরে না থাকলে সে ঘরে মা নেই। সে ঘরে তখন কেবল একজন মহিলা আছেন। রসিক ঘরে না থাকলে একটা ধাতব তার বাঁধা যন্ত্র আর ধাতব ধ্বনি আছে, সেতার নেই, মালকোষ কি মল্লার নেই। তেমন ভক্ত না থাকলে ভগবানের কোনো অস্তিত্ব নেই। ভক্ত ভালোবাসার পরাকাষ্ঠা। ভক্ত, যে জানতে চায় না। ভালোবাসতে চায়। তার আদর্শ কে? হয় তো রুমি, কিম্বা চৈতন্যদেব, কি নানক, কি রামপ্রসাদ, কি রবীন্দ্রনাথ, রজনীকান্ত বা লালন কি কবীর।

কিন্তু তাঁকে কী জানা যায়? এই জানার ঘরানাটা দর্শনের। ভক্তের না।

পাশ্চাত্য দর্শন মানুষের জ্ঞানের সম্ভাবনার সীমাবদ্ধতা, ভাষার সীমাবদ্ধতার কথা বারবার বলেছে।

পাশ্চাত্য দর্শনের এক মহীরুহ ইম্যানুয়েল কান্ট তার মহাগ্রন্থ ‘ক্রিটিক অব পিওর রিজন’ এ দেখাচ্ছেন জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে। আধুনিক অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ভিটগেনস্টাইন দেখাচ্ছেন ভাষার সীমাবদ্ধতা। প্রভাবিত হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথে। তাঁর ‘'রাজা’ নাটকে।

কান্ট বলছেন আমরা যা কিছু বুঝি সে হল কনসেপ্টকে কেন্দ্র করে। কনসেপ্ট আমাদের মনের গঠন। সেই গঠনকে নানা ক্যাটাগরিতে ভাগ করে কান্ট আমাদের জ্ঞানের সৃষ্টির পথ দেখাচ্ছেন। সীমাবদ্ধতা দেখাচ্ছেন। আধুনিককালের জীবিত সক্রেটিস, নোম চমস্কির দর্শনেও এ তত্ত্ব স্বীকৃত। আমরা তা-ই জানতে পারি যা জানার ছাঁচ আমার মনে আছে। ধারণা বা কনসেপ্ট একটা ছাঁচ। কিন্তু দেশ-কালের অতীত, সময়ের অতীত কোনো সত্ত্বাকে জানার ছাঁচ কি আমার মনে আছে? নেই। তাই ঈশ্বর আমাদের বোধের গম্য নন। কারণ তত্ত্বগতভাবে তিনি এ সবের অতীত।

এ কথাই জানিয়েছেন উপনিষদ। “যাঁকে বাক্য ও মন না পেয়ে ফিরে আসে।” বাক্যমনাতীত তিনি।

মানুষের যে কগনিটিভ ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার সামনে ঈশ্বর নেই। শূন্য। কারণ ঈশ্বরকে ধারণা করার ক্ষমতা তার নেই। ভিটগেন্সটাইন দেখাচ্ছেন ভাষারও কোনো ক্ষমতা নেই জটিল ভাবকে বোঝাতে যথাযথ ভাবে।

ঈশ্বর নেই। এ সত্য। আছেন। এও সত্য। যেমন সন্তান না থাকলে মা নেই। মহিলা আছেন একজন। তেমন। ভক্ত থাকলে ঈশ্বর আছেন। নইলে নেই। চিত্রকর থাকলে ছবি আছে, নইলে সবটাই স্থূল রঙ আর আকার।

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, “ধারণা” শব্দটার কথা। বলছেন, শুধু জানলে হবে না। ধারণা চাই।

কিন্তু তাঁকে ধারণা করা যায় না, এই কথাই তো হল এতক্ষণ। তবে?

শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, যায় যায়। তিনি শুদ্ধ বুদ্ধি, মনের গম্য। শুদ্ধ বুদ্ধি, শুদ্ধ মন আর শুদ্ধ আত্মা একই কথা।

এখন এই ‘শুদ্ধ’ কথাটার মানে কী?

দর্শন আর অধ্যাত্মকিতার পার্থক্য এখানেই। দর্শন সময়ের স্রোতে ভেসে এক যুগ থেকে আরেক যুগে আসতে পারে। দর্শন মূলত কনসেপ্টকে নিয়ে কাজ। সে কনসেপ্ট জ্ঞান সংক্রান্ত, নীতি সংক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু অধ্যাত্মিকতা কনসেপ্ট নিয়ে নয়। অনুভব নিয়ে। দর্শন চায় সত্য। অধ্যাত্মিকতা চায় শান্তি। পরমের সঙ্গে সাযুজ্য। আনন্দ।

উপনিষদের যে শ্লোকে বলা হল তিনি বাক্যমনাতীত, সেই শ্লোকের বাকি অংশে বলা হচ্ছে তিনি আনন্দের দ্বারা নিজেকে জানান। সেই আনন্দে তাঁকে জেনে মানুষ ভয় মুক্ত হয়।

এর যুক্তি কী? এর যুক্তি নেই। এ কাব্যময়তা। দর্শন, বিজ্ঞান আলোচনা মেধাসম্পন্ন যে কোনো মানুষের সঙ্গে হতে পারে। কিন্তু রসের আলোচনা রসিকের সঙ্গে ছাড়া হয় না। মল্লারে কেন চোখে জল আসে, পুরবীতে কেন মন উদাস হয়, এ যার হয় তার হয়। এ যুক্তির উপর নির্ভর করে না। এ এক রসগ্রাহীতার উপর নির্ভর করে। উপনিষদ বলছেন, তিনি রসস্বরূপ। আনন্দস্বরূপ। এ আনন্দ মানে সুখ না। এ আনন্দ মানে নিজেকে ছাপিয়ে নিজের অস্তিত্বের আরেক পরম অস্তিত্বে ডুবে যাওয়ার তন্ময়তা। হয় তো দুঃখেই। “সুখের খেলায় বেলা গেছে পাইনি তো আনন্দ”।

ঈশ্বর যদি কাব্যময়তা হবেন, আনন্দস্বরূপ হবেন, ব্যক্তিগত উপলব্ধি হবেন, তবে এই চারদিকে এত ধর্ম কী?

ও হল সমাজবিদ্যার অংশ। ও হল নৃতত্ত্ববিদ্যার আলোচনার বস্তু। ও হল সামাজিক অর্থনৈতিক চর্চার জিনিস। সেও বাস্তব। কিন্তু অধ্যাত্মিক হিসাবে বাস্তব নয়। সমাজের উন্নতির কাজে যেমন নানা আন্দোলন, সেবা ইত্যাদিতে কাজে এসেছে। তেমন হিংসা, মৌলবাদের জন্মও দিয়েছে। দুই-ই সত্য।

তবে কথাটা দাঁড়ালো তিনি জ্ঞানের গম্য নন। কিন্তু আনন্দে প্রকাশিত। তাঁকে ধারণা করা মানে, শুদ্ধমন-বুদ্ধির গম্য মানে কী তবে? মানে তিনি আনন্দের ধন। শুদ্ধতা মানে আনন্দের আরেক নাম। সুখ বেশি হলে বিষ। সে খাওয়াদাওয়াই হোক, কী হৈ-হুল্লোড়ই হোক। কিন্তু আনন্দ? সে আরো গভীরে, আরো গভীরে নিয়ে যায়।

পাশ্চাত্য দর্শন আনন্দকে একটা অস্তিত্বময় স্বাধীন সত্ত্বা বলে মানে না। তারা ভাবে আনন্দ নানা মানসিক উপাচারের লব্ধফল। কিন্তু প্রাচ্য দর্শন আনন্দকে এক স্বাধীন অস্তিত্ব হিসাবে জানে। সচ্চিদানন্দ তত্ত্বে। এ তত্ত্ব চিন্তালব্ধ না। কারণ চিন্তা ভাষার শরীরে শরীরী। আনন্দ ভাষার অপেক্ষা রাখে না। নীরবতার অপেক্ষা রাখে। তন্ময়তার অপেক্ষা রাখে। নির্জনতার অপেক্ষা রাখে। নিজের ক্ষুদ্র একার মধ্যে পরম একের ডাক কান পেতে শোনে। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে যে ডাকে। যে কোনো চিন্তা নয়। সিদ্ধান্ত নয়। যে আনন্দ। আলোয় আলোকময় করে আসা আনন্দ। যে আনন্দের উপর নির্ভরশীল আমার জীবন। শ্বাস চললে যেমন শরীরের বাকি সব কাজ চলতে পারে। তেমনই আনন্দের আশ্রয়েই প্রাণ-মন-বুদ্ধির সব কাজ চলতে পারে। বিপরীতে জন্ম হয় বিকারের।

কল্পনা করুন দক্ষিণেশ্বরের ছোটো ঘরটায় বসে আছেন। সামনে চৌকিতে বসে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কেউ কোনোদিকে নেই। কোথাও নেই। তিনি আপনার দিকে তাকিয়ে। আপনি তাঁর দিকে তাকিয়ে।

এই ঘরে কত আলোচনা, কত গান, কত নাচ হয়েছে। এই ঘর থেকে কোনো বিদ্বেষ, কোনো প্ররোচনামূলক একটা কথাও উচ্চারিত হয়নি। হলে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে তর্ক হয়েছে, চোখের জলে ভালোবাসার আনন্দহাট বসেছে। এখান থেকে এমনকি এও বলা হয়নি যে আমার ধর্ম, আমার বিশ্বাসই শ্রেষ্ঠ। বলা হয়নি মা আমাকে বলেছেন মাকে যে না মানবে তাকে আঘাত করো। মায়ের ধর্ম শ্রেষ্ঠ প্রচার করো। বলা হয়নি। বলা হয়েছে উলটো। সব ধর্মেই গোলমাল আছে, সবাই ভাবে আমার ঘড়ি ঠিক চলছে, গিরগিটি যে যেমন দেখেছে সে এই এক রঙের কথাই বলছে, হাতিকে চার অন্ধ চার রকম অনুভব করে চার রকম কথা বলছে, চারঘাটে জল নিতে বসে কেউ অ্যাকুয়া, কেউ পানি, কেউ জল, কেউ ওয়াটার বলছে।

তিনি এক। তিনি নানা হয়েছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ একের কথা বলছেন, কিন্তু একাধিপত্যের কথা বলছেন না। তাই ভয় আর বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে না। তিনি এক, কিন্তু তিনিই নানা। একাধিপত্য মিথ্যা। সৃষ্টির আনন্দ বৈচিত্র্য। সানাইয়ের নানা সুরেই আনন্দ। শুধু পোঁ ধরে থাকা আবার কী?

সব শুনে যদি স্বামীজির মত করে আমিও বলি, আমি এখন নাস্তিক মত পড়ছি। আমি নাস্তিক হয়েছি।

উনি হেসেছিলেন শুনে। বলেছিলেন, সেও হয়। সেও এক পথ। আছে, নেই দুই-ই পথ। ভাব অভাব দুই-ই পথ।

শুধু উদ্বিগ্ন হোয়ো না। কাউকে উদ্বিগ্ন কোরো না। যা জেনেছ তাতেই শান্তিতে থাকো। নিজেকে নিয়ে শান্তিতে থাকলে সবাই এসে পড়ে। ফুল ফুটলে ভ্রমর আপনিই আসে।

 

58
Sun, 04/28/2024 - 13:26

আরেকবার ‘রাশিয়ার চিঠি’ পড়ার দরকার মনে হচ্ছিল। কেন মনে হচ্ছিল সেটা একটা কথায় বলা শক্ত। তবে মনে হয় ‘'রাশিয়ার চিঠি”টা একবার পড়ে নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান সময়েও খুব দূরের লেখা বলে মনে হবে না। অবশ্যই এটা আমার ব্যক্তিগত মত। এ নিয়ে তর্ক করার ইচ্ছা নেই।

রাশিয়ার চিঠি প্রকাশিত হয় ১৯৩১ সালের বৈশাখ মাসে। মানে বাংলায় ১৩৩৮ সালের বৈশাখে। প্রায় একশো বছর হতে গেল। ‘রাশিয়ার চিঠি’’ পড়তে পড়তে বেশ কিছু জায়গায় আমার নোম চমস্কির কথা মনে পড়ল। বিশেষ করে দুটো জায়গায়, যেটাতে পরে আসছি।

ডিক্টেটরশিপ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন উপসংহারে। আমি কয়েকটা উদ্ধৃতিও উপসংহার থেকেই দিচ্ছি।

অনেকে বলেন, এই তো দারুণ আছি। আসুক ডিক্টেটরশিপ। আমার সুখের আরামের তো খামতি হচ্ছে না। তাদেরকে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন?

“সবলে চালিত হওয়ার অভ্যাস চিত্তের ও চরিত্রের বলহানি করে--এর সফলতা যখন বাইরের দিকে দুই-চার ফসলে হঠাৎ আঁজলা ভরে তোলে, ভিতরের শিকড়কে দেয় মেরে।

জনগণের ভাগ্য যদি তাদের সম্মিলিত ইচ্ছার দ্বারাই সৃষ্ট ও পালিত না হয় তবে সেটা হয় খাঁচা, দানাপানি সেখানে ভালো মিলতেও পারে, কিন্তু তাকে নীড় বলা চলে না, সেখানে থাকতে থাকতে পাখা যায় আড়ষ্ট হয়ে। এই নায়কতা শাস্ত্রের মধ্যেই থাক্‌, গুরুর মধ্যেই থাক্‌, আর রাষ্ট্রনেতার মধ্যেই থাক্‌, মনুষ্যত্বহানির পক্ষে এমন উপদ্রব কিছুই নেই।”

এখন কেউ যদি বলে, “আমার মনুষ্যত্ব যায় যাক। ও নিয়ে আমি ভাবি না। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে আমি কিছুকেই সত্য বলে জানি না।” তবে তার সঙ্গে তর্ক চলে না। সে বাঁচার মানেই জানে না। সিলেবাসে অদলবদল হলেও তাদের কোনো তাপ উত্তাপ নেই। তারা বলে ওতে আমার কিছু আসে যায় না।

কিন্তু যে জানে সে জানে যে একনায়কতন্ত্রর ভিত্তি পাকা করতে গেলে সিলেবাসকে নিজের হাতে রাঙিয়ে নিতে হয়। হীরকরাজাও যেমন নিয়েছিল। কারণ, এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে। আর রবীন্দ্রনাথ কী লিখছেন,

“নিজের একনায়কত্বের প্রতি যারা লুব্ধ, নিজের চিত্ত ছাড়া অন্য সকল চিত্তকে অশিক্ষা-দ্বারা আড়ষ্ট করে রাখাই তাদের অভিপ্রায়সিদ্ধির একমাত্র উপায়।”

যে কোনো সফটওয়্যার একটা হার্ডওয়্যারের উপর চলে। তেমনই মানুষের যে কোনো নীতিই মানবপ্রকৃতিরূপ হার্ডওয়্যারের উপর চলে। এই জায়গাটাতেই রবীন্দ্রনাথ আর নোম চমস্কির ভাবনার বুনিয়াদি ছাঁচে কী ভীষণ মিল। রাসেল ও চমস্কি দুজনেই সাম্যবাদের অর্থনীতির অন্ধভক্ত কোনোদিন ছিলেন না। আমাদের দেশে যেমন মুক্তচিন্তার মানুষ বললেই, একটা বাম আদর্শ ঘেঁষা মানুষের ভাবমূর্তি কল্পনা করে নেওয়া হয়, পাশ্চাত্যে তেমন নয়। সেখানে দর্শন আরো বেশি বৈচিত্র্যময়। যার ফসল রাসেল ও চমস্কি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

“সোভিয়েট রাশিয়ায় মার্ক্‌সীয় অর্থনীতি সম্বন্ধে সর্বসাধারণের বিচারবুদ্ধিকে এক ছাঁচে ঢালবার একটা প্রবল প্রয়াস সুপ্রত্যক্ষ; সেই জেদের মুখে এ সম্বন্ধে স্বাধীন আলোচনার পথ জোর করে অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এই অপবাদকে আমি সত্য বলে বিশ্বাস করি…….

…… যেখানে মানুষ তৈরি নেই, মত তৈরি হয়েছে, সেখানকার উচ্চণ্ড দণ্ডনায়কদের আমি বিশ্বাস করি নে। প্রথম কারণ, নিজের মত সম্বন্ধে আগেভাগে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা সুবুদ্ধি নয়, সেটাকে কাজে খাটাতে খাটাতে তবে তার পরিচয় হয়। ও দিকে ধর্মতন্ত্রের বেলায় যে জননায়কেরা শাস্ত্রবাক্য মানে না তারাই দেখি অর্থতন্ত্রের দিকে শাস্ত্র মেনে অচল হয়ে বসে আছে। সেই শাস্ত্রের সঙ্গে যেমন করে হোক মানুষকে টুঁটি চেপে ঝুঁটি ধ'রে মেলাতে চায়-- এ কথাও বোঝে না, জোর করে ঠেসে-ঠুসে যদি কোনো-এক রকমে মেলানো হয় তাতে সত্যের প্রমাণ হয় না; বস্তুত যে পরিমাণেই জোর সেই পরিমাণেই সত্যের অপ্রমাণ।”

তবে উপায় কী? রবীন্দ্রনাথ যা ১৯৩১ সালে লিখছেন। চমস্কি তাই ১৯৭৩ সালে একটা বক্তৃতায় বলছেন। দুজনের বক্তব্যে মিলটা কোথায়? মানবপ্রকৃতির উপর আস্থা। তাকেই আসল কষ্টিপাথর হিসাবে দেখা। “মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ” যখন ‘'সভ্যতার সংকট’ এ লিখছেন তখনও এই মানবপ্রকৃতির কথাই লিখছেন। স্মরণযোগ্য যে মহাত্মাও একই কথা বলছেন - মানুষের বিকার ও বীভৎসতায় যেন মানবপ্রকৃতি থেকে মুখ না ফেরাই, আস্থা না হারাই। মানবপ্রকৃতি একটা মহাসাগরের মত, তার কিঞ্চিৎ অংশ দূষিত হতে পারে। কিন্তু গোটা মানবপ্রকৃতি নয়।

আসল কষ্টিপাথর হল মানবপ্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,

“প্রয়োগের দ্বারাই মতের বিচার হতে পারে, এখনো পরীক্ষা শেষ হয় নি। যে-কোনো মতবাদ মানুষ-সম্বন্ধীয় তার প্রধান অঙ্গ হচ্ছে মানবপ্রকৃতি। এই মানবপ্রকৃতির সঙ্গে তার সামঞ্জস্য কী পরিমাণে ঘটবে তার সিদ্ধান্ত হতে সময় লাগে। তত্ত্বটাকে সম্পূর্ণ গ্রহণ করবার পূর্বে অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু তবু সে সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে, কেবলমাত্র লজিক নিয়ে বা অঙ্ক কষে নয়-- মানবপ্রকৃতিকে সামনে রেখে।”

আমাদের দেশের, তথা বিশ্বের পলিসিমেকাররা যদি এই কথাটা মনে রাখতেন। মানবপ্রকৃতিকে জানতে গেলে ভাবনা আর করা দুটোর মধ্যে দিয়েই যেতে হবে। যে কথাটা রুশো আর হিউম বারবার মনে করান। তাই হিউম বলেন যে শুধু যুক্তির নির্ভুলতাতে কিচ্ছু আসে যায় না, যতক্ষণ না সেটা মানবপ্রকৃতিতে সচল হচ্ছে। ওঁর ভাষায় যেটা ‘'কাস্টম’।

নোম চমস্কির কথাটা দিয়েই শেষ করি এ লেখার,

“A vision of a future social order is in turn based on a concept of human nature. If in fact humans are indefinitely malleable, completely plastic beings, with no innate structures of mind and no intrinsic needs of a cultural or social character, then they are fit subjects for the “shaping of behavior” by the state authority, the corporate manager, the technocrat, or the central committee. Those with some confidence in the human species will hope this is not so and will try to determine the intrinsic human characteristics that provide the framework for intellectual development, the growth of moral consciousness, cultural achievement, and participation in a free community.”

 

59
Sat, 04/27/2024 - 13:08

পণ্ডিত বলল, যে একই সঙ্গে দুটো খরগোশ ধরতে যায়। সে একটাও পায় না। বাউল বলল, এক মন যার সেই যেতে পারে।

পাণ্ডিত্যে দ্বন্দ্ব আছে। বিরোধ আছে। বাউলে মিলন আছে। অনুভব আছে। রবীন্দ্রনাথ বাউলের সামনে বসেছিলেন। ‘মানুষের ধর্ম’ নিয়ে বিদেশে বলতে গিয়ে বাউলের ধর্মের কথা বলেছেন। গোটা জগৎ যখন ঈশ্বরকে তত্ত্ব করতে ব্যস্ত, আস্তিক নাস্তিকতার জ্বরে আক্রান্ত, বাউল তখন মানুষ খোঁজে। বাউল বলে, এ মানুষে সে মানুষ আছে।

বাউলের ধর্ম বাংলার মূল। মহাপ্রভুর অনুভবের নির্যাস। মানুষ তো পাগলই। ইদানীং পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের মধ্যে মানুষের ‘ইর‍্যাশেনাল’ দিকটা নিয়ে খুব চর্চা হচ্ছে। ইর‍্যাশানেল মানে এখানে অপ্রকৃতস্থ না। বেহিসাবি। অর্থনীতির লোকেরাও বলছে, মানুষের মধ্যে একজন বেহিসাবি মানুষ আছে। বাউল সেই বেহিসাবি।

বেহিসাবি মানে কী? মানে হিসাবের নাগালের বাইরে হিসাবকে আর না টানা। এইখানেই মরমী বসে। এখানেই মুক্তির আনন্দ। বুক ভরা শ্বাস। হিসাব মিলাতে গেলে হিসাব মেলে না। হিসাবের আঙিনায় হিসাবকে রেখে এলে হিসাব আপনিই মিলে যায়। দম্ভ বোঝে না। দরদ বোঝে। মানুষ যখন দম্ভপাগল, তখন হিসাবকে টেনে টেনে ‘মিথ অব সিসিফাস’ এর গল্প ফাঁদে। বাক্য, যুক্তির চাকচিক্যতে মানুষ ধন্দে পড়ে। দম্ভের ফাঁদে পা দেয়। বিষাদগ্রস্ত হয়। বলে এই যেন কিছু একটা হল। এই যে আমি বিষাদগ্রস্ত হলাম। এর মানে আমি জ্ঞানী হলাম।

বাউল বলে, জ্ঞানী হলে। এবার বিজ্ঞানী হও। দম্ভ ছাড়ো। দরদে এসো। কোনো পাথরকে উপরে তুলতে হবে না সিসিফাসের মত। পাথরকে পাথরের মত থাকতে দাও। পাহাড়কে পাহাড়ের মত। প্রাণে অহেতুক আনন্দের ধারা আছে। এ মানুষে সে মানুষ আছে। তার কাছে এসো। দম্ভতে এসো না। ধুলোতে এসো। গড়াগড়ি দাও। দেখো কোনো পাথর কোনোদিন উপরে তোলার ছিল না। তোমার দম্ভ তোমায় ভুল বুঝিয়েছিল। তুমি হিসাবে ভুল করোনি। হিসাবের আঙিনায় ভুল করেছ। জগতজোড়া কি তোমার হিসাবের ব্ল্যাকবোর্ড গো? নোঙর তোলো। চলো ঘুরে আসি। সংসার থাক। তোমার দম্ভের সংসার থাক। তোমার হিসাবের সংসার থাক। তুমি এসো। আমার সঙ্গে এসো। আমি নিয়ে যাব। আমি তাকে চিনি। আমি তাকে দেখেছি। আমার সঙ্গে তার নিত্য আলাপ। চেতনা মানে তুমি বলো রোগ। কারণ তোমার ওইটুকুন বুদ্ধির কলমে, তুমি বিশ্বজোড়া স্লেটে আঁক কষতে চাও বলে। চেতনা মানে মধু। আনন্দ। চেতনা মানে মুক্তি। কী যে বলো তুমি, চেতনা মানে নাকি রোগ! বালাইষাট।

তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না? প্রথম প্রথম হবে না। ওগুলো পুরোনো অভ্যাসের জড়। তোমায় বিশ্বাস করতে হবে না। আবার জোর করে অবিশ্বাস করার ধকেও যেও না। কিছুতেই জোর কোরো না। জোর করাটা তোমার দম্ভের তাগিদ। এখানে জোর করাটা ব্রাত্য। এখানে কেন্দ্রকে খুঁজতে যেও না। এখানে সূত্রকে খুঁজতে যেও না। এখানে কেন্দ্র নেই। সূত্র নেই। সময় নেই। তাড়া নেই। এখানে শুধু আছে শুধু সহজ। সহজের কোনো কেন্দ্র হয় না। ঘাসের যেমন বাগান হয় না। সহজের কোনো সূত্র হয় না। ভূমির যেমন ভূমি হয় না। তুমি কেন খুঁজতে যাচ্ছ ওসব। তুমি আনন্দ। কারণ তুমি সহজ। তুমি চেতনা। কারণ তুমি সহজ। জগত জোড়া দম্ভের গোলে কঠিন। তুমি দম্ভ নও। দম্ভ তোমার বিকার। সহজ তোমার স্বভাব। সহজ থেকেই জন্মায় কঠিন। আবার সহজে এসেই সে মেলে। এই রহস্যকে বোঝো। সহজের ভূমি সহজ। কঠিনের ভূমিও সহজ। শুধু সে তার বোধে জন্মায় না। সে থাকে ভ্রমে।

আমাদের এখানে তাই বলে সিদ্ধ হলে সহজ হয়। আর পাশ্চাত্য বলে, সিদ্ধ হলে নাকি বিষাদগ্রস্ত হয়। বালাইষাট! এদিকে এসো। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চাইতে বড় জিনিস সংসারে আছে। তাকে হেলায় হারাও কেন? সে হল মানুষের সত্য। সব সত্যের ভূমিই হল মানুষের সত্য। আর সেই মানুষের সত্যের গভীরে যে সত্য সেই হল সহজ। তাকে পাওয়া যায় না। যাকে পাওয়া যায় সে হল কঠিন। সহজকে পেতে গেলে সহজ হতে হয়। যেমন জলকে পেতে গেলে জল হতে হয়। সাগরের মধ্যে নুড়ি হয়ে লাভ কি? সে কোনোদিন মেশে না। সেই তার দম্ভ। সেই তার বিকার। কিন্তু এক বিন্দু জল, সাগরে মিশে সাগর হয়। সেই তার গতি। সেই তার সুখ। সেই তার কৃতকৃত্য হওয়া। এসো। দম্ভ থাক। তুমি এসো। এ মানুষের মধ্যে সে মানুষকে খোঁজো। সেই তোমায় সাগরে নিয়ে যাবে। তারপরে? আর বলা যায় না। যে বলবে সে মগ্ন তখন। দুনিয়া জুড়ে খেলাঘর বাঁধছে সে। তোমার হিসেবি ডাকে সাড়া সে দেবে কেন?

60
Tue, 04/23/2024 - 11:57

একটা সময় ছিল যখন অ্যাড দেখতে ভালো লাগত। তখন অবশ্য অ্যাড বলা অভ্যাস ছিল না। তখন বলতাম ‘অ্যাডভ্যাটাইজমেন্ট’। সিনেমার মধ্যে মধ্যে, সিরিয়ালের মধ্যে মধ্যে, খেলার মধ্যে মধ্যে দেখাত। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।

আজকের দিনে এই রিল বা শর্টস একই জিনিস, কিছুটা মডিফায়েড। অ্যাড বা রিল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে, বা মিনিটের মধ্যে একটা গল্প বলে দেয়, যা দর্শককে অ্যাপিল করার ক্ষমতা রাখে। পার্থক্য হল অ্যাডগুলোর অ্যাজেন্ডা ছিল জিনিস বিক্রি করা, রিলের অ্যাজেন্ডা হল আমাকে এন্টারটেইন করা। এবং সেই সুবাদে কিছু মানুষ টাকা উপার্জন করছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

মুশকিল হল অ্যাড কোনো জিনিস বিক্রি করার জন্য যে ধরণের মিথ্যার আশ্রয় নিত, সেই মিথ্যাগুলো ছিল অনেকটা নিরীহ প্রকৃতির বা কম ক্ষতিকারক। অতিরঞ্জিত। যেমন সে ওয়াশিং পাওডারে “দুধের মত” সাদা হওয়ার কথা, আদতে তা হয় না। যে শ্যাম্পুতে চুল ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, তা হয় না ইত্যাদি। এই মিথ্যাগুলো ছিল লোকালাইজড মিথ্যা। একটা সীমার মধ্যে মিথ্যা। কিন্তু রিলের মাধ্যমে মনোরঞ্জন করানোর জন্য যে মিথ্যা প্রচার চলছে সেটা ভয়ানক। সুদূরপ্রসারী ক্ষতি তাতে।

হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি এখন একটা প্রচলিত শব্দ। তার মাধ্যমে কী বলতে চাওয়া হচ্ছে সেটা আমরা বুঝি। কিন্তু রিলের ইউনিভার্সিটিও এই মিথ্যা প্রচারে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। হোয়াটসঅ্যাপে মাথা বিগড়াচ্ছে বয়স্কদের বেশি, রিলে ভ্রান্ত তথ্যে বিপথগামী করছে অল্প বয়েসীদের।

কদিন আগে সিউডোসায়েন্স নিয়ে লিখেছিলাম। সিউডোসায়েন্স আর সায়েন্স ফিকশানের মধ্যে পার্থক্যটা ঘুচিয়ে দিতে বসেছে এই রিলের ছদ্মজ্ঞানীর দল। কী তার ফলাফল আমি প্রায় রোজই সম্মুখীন হচ্ছি আমার ছাত্রছাত্রী আর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের ছেলেমেয়েদের কাছে। তারা এমন সব জিনিসকে বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত বলে জানছে যার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্কই নেই।

আমাদের দেশে সঠিক অর্থে সেক্স এডুকেশনের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু রিল আছে। পডকাস্ট আছে। আর সিউডোসায়েন্সর রমরমা বাজার আছে। কদিন আগে মেনস্ট্রুয়েশান সাইকেল পড়াচ্ছি, একজন ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র বলল, মেয়েদের শরীর থেকে এই সময়ে একটা নেগেটিভ এনার্জি বেরোয় না? যার জন্য কোনো ভালো কাজ এই সময়ে করতে নেই বলে, ঠিক তো?

চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। জিজ্ঞাসা করলাম, কে বলেছে? উত্তর এলো রিলে দেখেছে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে।

আমি একটা উদাহরণ দিলাম। আরো রিল-জাত তথ্য আছে। মাস্টারবেশন করলে নার্ভ সেল ড্যামেজ হয়। সেরিব্রাল কর্টেক্স কুঁচকে যায়। শুক্রাণু ঘাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার বিষয় এর মধ্যে সদগুরুর মত জনপ্রিয় মানুষের ভিডিও আছে। যেখানে তারা আমিষ, নিরামিষ, মাস্টারবেশান, মেনস্ট্রুয়েশান সাইকেল ইত্যাদি সবার শুচি-অশুচিবাইকে শরীরবিজ্ঞানের সঙ্গে মিশিয়ে একাকার করে দেখাচ্ছে। এরপর আছে নানা অলৌকিক বস্তুর ব্যাখ্যা। কেউ কেন কৈলাসে ওঠে না। কারণ শিবের অভিশাপ লাগে। রামসেতুর প্রমাণ ইত্যাদি তো আছেই।

এই বিপদটা সেদিনের অ্যাডের জগতে ছিল না। এই সিউডোসায়েন্স, ভ্রান্ততথ্যের সচেতন মার্কেটিং সেদিন ছিল না। আজ আছে।

এখন কথা হল এই অভ্যাস থেকে ছেলেমেয়েদের সরানো সম্ভব নয়। আমি একদম শিশুদের কথা বলছি না। বা বয়স্কদের কথা বলছি না। আমার বলার উদ্দেশ্য কিশোর আর সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে। যারা বাড়িতে ভয়ে না দেখলেও টিউশান ব্যাচে বা স্কুলে অনায়াসে দেখছে আর ভ্রান্ত হচ্ছে।

এর থেকে বাঁচার উপায় কী?

সে প্রসঙ্গে আসছি। কিন্তু তার আগে এই লেখার মাধ্যমেই ভারতের একজন কৃতী মনোবৈজ্ঞানিক সুধীর কক্কড় প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যিনি গতকাল মারা গেলেন। তিনি প্রথম যিনি ভারতের ধর্ম চেতনায় যৌনতার দিকটা নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন এবং অনেক অগম্য, অনালোকিত, অনালোচিত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ওঁর জীবনের শেষের দিকে কয়েকটা বিষয় নিয়ে ওঁর সঙ্গে ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে, দেখেছি ওই বয়সেও কী তীক্ষ্মতার সঙ্গে ও দরদের সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ও সংশয় দূর করেছেন।

যৌনতা এমন একটা জিনিস যাকে শাসনে দাবিয়ে রাখলে, ধর্মের অলীক যুক্তিতে ধোঁয়াশা করে রাখলে হিতে বিপরীত হয়। মুশকিল হচ্ছে যে, যে সময়টাকে আমরা ভারতের নবজাগরণ বলছি, সেই সময়েও যৌনতা নিয়ে ঢাকাঢাকি চলেছে ও তাকে বিজ্ঞানের আলোয় না দেখে, ধর্মীয় নানা মতামতকে অভ্রান্ত ও ধ্রুবসত্য জেনে সেই অনুযায়ী ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। ফলে অন্ধকার আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। যার থেকে বেরিয়ে আজও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিণত একটা দৃষ্টিকোণে আসতে পারেনি। যার জন্যে ‘'ও মাই গড- ২” সিনেমায় মাস্টারবেশন ও যৌনশিক্ষার প্রসঙ্গকে বিষয় করতে হচ্ছে। কিন্তু এ-তো সিনেমার বিষয় নয়, এ শিক্ষার বিষয়।

পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরি, উপায়টা কী তবে? এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের হাত থেকে কিশোর বয়সকে আর প্রথম যৌবনকে বাঁচানোর উপায় কী?

আবার আগের দিনের অভ্যাসে যাই। আগে কী হত, আমাদের অনেকেরই ডিকশনারি দেখার অভ্যাস তৈরি হত না। ফলে কোনো ইংরেজি শব্দের মানে আটকালেই যাকে হাতের কাছে পাওয়া যায় তাকেই জিজ্ঞাসা করে নেওয়া হত। হয় তো সঠিক উত্তর সব সময় পাওয়াও যেত না। কিন্তু কাজ চালিয়ে নিত অনেকে। কিন্তু তার মধ্যেই অনেকের আবার ডিকশনারি দেখার অভ্যাস গড়ে উঠত, শিক্ষকদের আর অভিভাবকদের প্রেরণায় বা বকাঝকায় যেভাবেই হোক।

ঠিক ওইটাই আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। রিল দেখা বন্ধ করা সম্ভব না। কিন্তু ক্রস চেকিং বা ফ্যাক্ট চেকিং করাটা শেখাতে হবে। যে ইন্টারনেটের সাহায্যে, যে মোবাইলে সে রিল দেখছে, সেই মোবাইলেই গুগলের মাধ্যমে বা এ-আই এর মাধ্যমে সঠিক তথ্যটা খুঁজতেও শিখতে হবে। ঠিক ঠিক বুকলেট ডাউনলোড করে পড়ার অভ্যাসটা করতে হবে। এটাই রাস্তা এখন। সবাই কী করবে? একদম না। সেদিনও যেমন ডিকশনারি খোঁজায় অলসতা ছিল তেমন অনেকেরই আজও থাকবে ফ্যাক্ট চেকিং করাতে। যা করতে কয়েক মিনিট লাগে। কিন্তু তবু আমাদের বারবার বলতে হবে এই কাজটা করার জন্য। আত্মদীপ ভব - এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন সেই কাজটাই অনেক সহজ করে দিচ্ছে এ-আই। শুধু সঠিক অভ্যাসটা ওই বয়সেই গড়ে তোলার শিক্ষাটা দিতে হবে। কয়েকজন যখন সঠিক তথ্যটা জানবে তারাই ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে কথা বলবে। মজার কথা হল আলোটাকে প্রচার করতে হয় না, অন্ধকারটাকে দূর করতেই যা বেগ পেতে হয়, আর আলোটা সামনে রাখলে সেটা আপনিই মিলিয়ে যায়। তাই তাদের অভ্যাসটা যাতে গড়ে ওঠে সে চেষ্টা করতে হবে। আর এ দায় আমাদের সবারই।

61
Mon, 04/22/2024 - 11:54

সব সিদ্ধান্তেই সংশয়ের জন্য একটা আসন রাখা খুব জরুরি। যার সংশয় নেই, তার রাস্তা নেই, জানলা নেই, দরজা নেই। বিশ্বাস স্থবির করে। সংশয় সচল করে।

ফরাসী বিপ্লব যখন ঘটেছিল তার আগে সে দেশে দুটো প্রধান স্তম্ভ ছিল রাজা আর ধর্মগুরুর। এদের উপর সাধারণ মানুষের প্রশ্নহীন আস্থা আর আনুগত্য ছিল। রাজা আর ধর্মগুরু নির্ভুল হবে, মঙ্গলময় হবে এমনই একটা ধারণা নিয়ে সে দেশ চলছিল। বিশ্বাসে স্থবির। অন্ধ।

বলা হয় মেয়েরা নাকি ভীষণ সরল বিশ্বাসী। কিন্তু ফরাসী বিপ্লবে ভিত ধরে নাড়াবার প্রথম কাজটা করে মেয়েরাই। মিছিল করে গিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে এসেছিল মসনদ। চমকে দিয়েছিল শুধু ষোড়শ লুইকে নয়, গোটা ইউরোপকে।

সেদিনের বিপ্লবে দার্শনিকদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। ভলতায়ার, রুশো, দেকার্ত প্রমুখেরা মানুষের মধ্যে সংশয় জাগাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজ অব এনলাইটেনমেন্ট, এজ অব রিজ্ন ইত্যাদি যাই বলি না কেন, আসলে সে যুগ ছিল সংশয়কে জাগানোর যুগ। সেই সংশয় জেগেছিল বলেই ফরাসী বিপ্লব হয়েছিল, গোটা বিশ্বের ইতিহাস বদলেছিল।

সত্য কী, এটা জানি না, এটাকে স্বীকার করাই একটা বড় সত্য। সত্যটাকে না জেনে তার জায়গায় কল্পনা নির্ভর একটা ধারণাকে মেনে নিতে না চাওয়াই সংশয়বাদীর একটা বড় দায়। একদিন যখন পক্স রোগের কারণ আমরা পাচ্ছিলাম না, তখন মা শীতলাকে কারণ হিসাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথ বললেন, তাই আমাদের দেশে পক্স আর মা শীতলা দুই-ই থেকে গেল। ওদেশে ওরা রোগের কারণ খুঁজল, ত্রাণের উপায় খুঁজল।

সংশয়ী মানে দুর্বল না। সবল বুদ্ধি যার, সে-ই সংশয়ী হতে পারে। কারণ সে একটা জিনিসকে অনেকগুলো দিক থেকে দেখতে পারে। সিনিক বা অসূয়াপর হয়ে গেলে সে আলাদা কথা, কিন্তু সংশয়ই চিরকাল মানুষকে রক্ষা করে এসেছে, অন্ধবিশ্বাস নয়, এর সাক্ষী ইতিহাস।

প্রশ্ন উঠতে পারে, সব বিশ্বাসই তো অন্ধ, তবে? অবশ্যই বিশ্বাস অন্ধ। যেমন আমি বিশ্বাস করলাম যে, শিয়ালদা থেকে ট্রেনে উঠলাম এটা আমাকে হালিশহরে নিয়ে যাবে। এত অবধি আমার বিশ্বাস খাঁটি। কিন্তু যখন দেখছি একটার পর একটা স্টেশান আসছে যা হালিশহর অভিমুখী নয়, তখনও যদি আমি আমার বিশ্বাসকে ধরে বসে থাকি, তবে সে আমাকে ভুল জায়গায় নিয়ে যাবেই। একেই অন্ধবিশ্বাস বলে। নইলে মানুষকে একটা না একটা বিশ্বাসের জায়গা থেকে তো শুরু করতেই হয়। এ বাস্তব। কিন্তু সেই বিশ্বাসপ্রণোদিত যাত্রাটাকে মনিটরিং করতে করতে নিয়ে যায় সংশয়। সেটা না থাকলে সব ভেজাল।

ধরা যাক একটা ওষুধ কোম্পানির কথা। সেখানে অটোমেটেড যন্ত্রে ওষুধ বানানো হচ্ছে। এখন সেই যন্ত্রের উপর একদম প্রশ্নহীন আনুগত্য রেখে যদি কর্মচারী বসে থাকে তবে যে কোনোদিন ভুল ওষুধ তৈরি হতে শুরু হবে। তাই কোয়ালিটি কন্ট্রোলের ব্যবস্থা রাখা। তার কাজটা শুরুই হয় যন্ত্রের নির্ভুলতায়, বা Inerrancy বা Infallibility-র উপর সংশয় জাগিয়ে। সেই যন্ত্রের নির্মাতা কোম্পানি যতই গুণগান গেয়ে যাক, কোয়ালিটি কন্ট্রোলারের কাজটাই হল তবু তাকে সংশয় করা।

প্রশ্নহীন আনুগত্য বিষ। শ্রদ্ধা আর সম্মান যখন গুণের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে চলে তখন সে একটা ভালো জিনিস। কিন্তু যখন সে গুণদোষ বিচার না করে আপনিই ঝাণ্ডা উঁচিয়ে ঘোরে তখন সে গুণ্ডামি। শ্রদ্ধা-সম্মান বড় উঁচুদরের জিনিস। কিন্তু তার ভেক ধরে অনেক গুণ্ডামি সমাজের অলিতে-গলিতে হয়ে চলেছে। সেটা কাজের নয়।

সিদ্ধান্তের ঘরে তাই সংশয়ের আসন থাকা চাই-ই চাই। এই যে দেশের নির্বাচনের সময় চলছে, এখনও এই সংশয়ই আমাদের পথপ্রদর্শক। আমাদের এদিকে রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়ায় যে ধরণের 'গণতন্ত্র' চলছে তেমন আনুগত্যপরায়ণ গণতন্ত্র চাই, না সঠিক অর্থে গণতন্ত্র চাই সেটা ভেবে দেখার। আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের কাছে সবাই প্রশ্নহীন আনুগত্য দাবী করে। সে মাজনের ব্র‍্যাণ্ড থেকে সরকার অবধি। সবাই দাবী করে তাদের মত শুভাকাঙ্ক্ষী কেউ আমাদের নেই। সে দেওয়াল ফুঁড়ে মাজনে নুন আছে কিনা জিজ্ঞাসা করতে আসুক, কি কে শত্রু আর কে মিত্র ট্যাগ করে করে চিনিয়ে দেওয়ার কৌশল হোক। আমরা যেন কোনো ব্র‍্যাণ্ডের না হই। আমরা যেন কোনোভাবেই না তো কোনো প্রোপাগাণ্ডিস্ট হই, না তো কোনো প্রোপাগাণ্ডার শিকার হই। আমরা সবসময় সংশয়ী যেন হই। ওটাই আমাদের রক্ষার একমাত্র মন্ত্র।

তবে যে কথায় আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর?

কথাটায় ওই 'বস্তু'টি কী আসলে? ওটা হল নির্ঝঞ্ঝাট অজ্ঞতার স্বর্গ। তাই হাতের কাছেই সে মেলে। কিন্তু তর্কে বহুদূর বলেছে। পাব কি পাব না সেটা বড় কথা না, বড় কথা হল বহুদূর যেতে হবে সেই নিয়ে ভয় দেখিয়ে আতঙ্কিত করার কৌশলটি। আসলে এটা অলসদের মন্ত্র। যারা দূরে যাওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করে 'বস্তু মিলেছে' বিশ্বাস করবে আর করাতে চাইবে। কিন্তু কোনো কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হবে না। হতে দেবেও না। "জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই" বলে দেবে। তখন চাঁদ গম্য হয়ে উঠবে, হয় তো বা মণিপুর অগম্য হবে।

আমাদের ভাবায় সংশয়। আমাদের চালায় সংশয়। আমাদের জন্য নতুনের বার্তা আনে সংশয়। এর বাইরে যা আছে সে ডিজনিল্যাণ্ড, লা লা ল্যাণ্ড। এখন প্রশ্ন আমাকে, আমি কোন রাস্তাটা বেছে নেব।

 

62
Wed, 04/17/2024 - 20:34

আজ একটা প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিকে দেখলাম, "Science behind Surya tilak" কথাটা। ধর্মীয় ভাবাবেগ ধর্মের জায়গায়। সেখানে নিশ্চয়ই অন্যের ভাবের প্রতি আমার শ্রদ্ধা থাকবে। আছেও। কারুর ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত করা অন্যায়, যদি না তা অন্যের ক্ষতি করে। কিন্তু সেখানে জোর করে বিজ্ঞান শব্দটাকে আনা কি খুব যুক্তির?

বিজ্ঞানের শত্রু ধর্মীয় কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস ততটা নয়, যতটা সিউডোসায়েন্স। কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস তবু বা ভাঙে। কিন্তু সিউডোসায়েন্স থেকে মুক্তি পাওয়া যে কী দুঃসাধ্য ব্যাপার!

সিউডোসায়েন্সের বাংলা কী? অপবিজ্ঞান? আমার মতে না। আমার মতে চাতুরী বিজ্ঞান, কপট বিজ্ঞান। এই সিউডোসায়েন্স দিয়ে কী না হতে পারে। একজন মানুষের মৃত্যু থেকে শুরু করে ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানি অবধি। অনেকেই এই চাতুরী বিজ্ঞানের ফাঁদে ফেলে নোংরামি করে মহিলাদের সঙ্গে। সে বেনজির ঘটনা নয় নিশ্চয়ই!

ইমানুয়েল কান্ট একটা অসামান্য কথা বলেছিলেন। দুটো জিনিস আমাকে বিস্মিত করে। এক জ্যোতিষ্কতে ভরা রাতের আকাশ। দুই, মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে ন্যায় বোধের গভীর রহস্যময়তা।

এই দুটোই পাশাপাশি যাওয়া সম্ভব। আমি একজন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী হয়ে আমার ভালোবাসার মানুষটার জন্য ফুলের স্তবক কিনে নিয়ে যেতেই পারি। কিন্তু তখন ফুলকে আমার উদ্ভিদের জননাঙ্গ মনে হবে না। মানুষের মস্তিষ্কের এই অসামান্য ক্ষমতা আছে। দুটো সত্যকে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পৃথক করে দেখার ক্ষমতা। রসের সত্যকে আর যুক্তির সত্যকে আলাদা করে দেখার ক্ষমতা।

কিন্তু চাতুরীবিজ্ঞান, কি কপটবিজ্ঞান এই দুই পৃথক প্রেক্ষাপটের মর্যাদা রাখে না। গুলিয়ে দেয়। কনফিউজড করে দেয়। আমি যা সত্য বলে মানতে বা দেখতে-শুনতে চাই, তা বাস্তবের কঠোর বিধানে অনেক সময়ে সম্ভব হয় না। সেই জায়গাটাকে অনেক সময় আমরা আমাদের কল্পনায় ভরিয়ে তুলি। সেখানে দোষের কিছু নয়। কিন্তু সেই শূন্যতাকে যদি আমি বৈজ্ঞানিক ক্ষমতার আয়ত্তে বলে প্রচার করি তবে সেটা মনুষ্যত্বের সঙ্গে ভীষণ বেইমানি করা হয়।

বর্তমানে এই সিউডোসায়েন্স নানাভাবে বিকোচ্ছে। কেউ পুরাণের মধ্যে বিজ্ঞান দেখছেন। কেউ পুরাণের মধ্যে ইতিহাস দেখছেন। আরো কে কে কী কী দেখছেন ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। মাঝখান থেকে পুরাণের মধ্যে যেটুকু সুন্দর, কাব্যময় সেটা নষ্ট হচ্ছে। “শতেক বরষ পরে বঁধুয়া মিলল ঘরে / রাধিকার অন্তরে উল্লাস”। এ গানে “শতেক বরষ” অর্থে নিশ্চিয়ই সংখ্যার একশো বছর নয় সে কাব্য রসিক মাত্রই জানেন। যা কাব্যের রসের বস্তু তাকে যদি রোজ বাস্তবের কাঠগোড়ায় দাঁড়াতে হয় মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে, তবে তো মুশকিল। রাবণের দশটা মাথার ডারউইনের সংগ্রহশালায় কোনো প্রমাণ না পাওয়া গেলেও কাব্য সুষমায় কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। বাল্মিকীর আদিকবি হিসাবে মর্যাদাও ক্ষুণ্ণ হয় না। কিন্তু তাকে যদি অ্যান্থ্রোপলজির দরবারে সাক্ষ্য হিসাবে হাজিরা দেওয়ার জন্য অহরহ ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তবে তাকে বিব্রত করা হয় শুধু না, অপমান করাও হয়।

এটাই হয়ে চলেছে চারদিকে। আজব সব নাম দিয়ে ইতিহাস, কি বিজ্ঞানের সঙ্গে কাল্পনিক সব যোগসূত্র বার করার চেষ্টা চলছে পুরাণের। বেস্টসেলার হচ্ছে। মগজগুলো না সাহিত্যের রসে ডুবে চিত্তের স্বাধীনতা পাচ্ছে, না বিজ্ঞানের আলোয় চিত্তের মুক্তি ঘটাচ্ছে।

বিজ্ঞানের আসল সমস্যা তাই বলছিলাম ধর্মীয় কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস নিয়ে নয়। আসল সমস্যা এই চাতুরী বিজ্ঞান বা কপট বিজ্ঞান নিয়ে।

 

63
Wed, 04/17/2024 - 12:38

বাঙালির ইষ্টচেতনা একটা জটিল প্রশ্ন। রামনবমী উপলক্ষ্যে দেখলাম বাংলা কাগজেও শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে লেখা হয়েছে। আগে লেখা হত হিন্দি কাগজগুলোতে। প্রেক্ষাপট অবশ্যই থাকত রামচরিতমানস।

একদিন বঙ্কিমচন্দ্র মহাশয় ‘কৃষ্ণচরিত্র’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। চেয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ হোক কেন্দ্রীয় চরিত্র। বঙ্কিমবাবুর বাড়িতেও শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ ছিল। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আগ্রহ ও চর্চা যে দীর্ঘদিনের সেটা প্রবন্ধটা পড়লেই অনুভব করা যায়।

যদিও বাঙালির অধ্যাত্মিক ইতিহাসের সব চাইতে বড় অধ্যায় বলে আমার মনে হয় শ্রীমহাপ্রভু। শ্রীমহাপ্রভু রাজদর্শনে যেতেন না। অনেকবার কাঙ্ক্ষিত হলেও চাননি। ইদানীং মহাপ্রভুকে একজন সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব করে লেখার চেষ্টা হচ্ছে। তার উপাদান ইতিহাস ঘেঁটে নিজের মত ব্যাখ্যায় আনা হচ্ছে। শ্রীরামকৃষ্ণের গল্প আছে, যার যেমন পুঁজি। একজন হীরে নিয়ে দরদাম করতে বেরিয়েছিল বাজারে। কেউ বলল দুই ঝুড়ি বেগুন দেব। কেউ বলল কয়েকটা গামছা দেব। এরকম আরকি। শেষে জহুরি বলল, আসল দামটার কথা। এখন মহাপ্রভুকে বুঝতে গেলে ওঁর কর্মকাণ্ডকে যেমন দেখা দরকার, তেমনই ওঁর যে শিক্ষা, চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত, তাছাড়াও রূপ সনাতনের লেখাগুলো যা আছে, সেগুলোও গভীরভাবে অধ্যয়নের দরকার। তবে বোঝা যাবে মহাপ্রভুর দ্বারা অনুষ্ঠিত কাজগুলোর প্রের‍ণা কী ছিল। নইলে আমাদের বুদ্ধিতে সেগুলোর বর্ণনা করতে গেলে আবার ওই শ্রীরামকৃষ্ণের গল্পের মত এক গোয়াল ঘোড়া হয়ে যাবে। হচ্ছেও।

মহাপ্রভুর শ্রীকৃষ্ণ চেতনা। শ্রীরামকৃষ্ণের জগদম্বা চেতনা। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম চেতনার সঙ্গে বৌদ্ধ আর বৈষ্ণব-রসের চেতনা। এই বাঙালির অধ্যাত্মিক চেতনার মূল তিন স্তম্ভ। বাকি অনেক ছোটো ছোটো রাজ্য আছে। তবে তার বেশিরভাগটাই মহাপ্রভু থেকে শুরু,একটু খোঁজ নিলেই জানা যাবে। কেন?

কারণ হল মহাপ্রভু যে স্বচ্ছতায় সাধনপথটাকে ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করেছেন তেমন উদাহরণ বাংলায় আগে নেই। হিন্দুধর্মের তিনটে প্রধান স্তম্ভ। এক, শঙ্করাচার্য। দুই, রামানুজ। তিন, মধ্বাচার্য। অদ্বৈতবাদ। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ। আর দ্বৈতবাদ। মহাপ্রভুর শিক্ষা দ্বিতীয় আর তৃতীয়ের মধ্যে একটা বিন্দুতে। অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব। যা অত্যন্ত গভীর আর সুপরিবেশিত এক দর্শন। রূপ, সনাতন প্রমুখ ওঁর শিষ্যদের লেখনী ও জীবনীতে সে ধারা আরো স্পষ্ট।

আসলে মহাপ্রভুতুল্য যখন একজন ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব হয়, তখন শুধু মাত্র তাঁর ব্যক্তিজীবনটায় তাঁকে ধরা যায় না, তাঁর শিষ্যদের মধ্যে যে আদর্শটা প্রকাশিত হয় তাকেও গভীরভাবে অনুধ্যান করতে হয়। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণর ক্ষেত্রেও। শুধু স্বামীজি নন, শ্রীরামকৃষ্ণের বাকি গৃহী ও সন্ন্যাসী শিষ্যদের জীবনী, লেখালেখি অনুধ্যান না করলে শ্রীরামকৃষ্ণের সম্বন্ধে ধারণাও অস্বচ্ছ থেকে যাবে।

যেমন একজন বাজারে যখন যায়, সে বাজারটাকে নিজের পুঁজি অনুযায়ীই দেখে। তেমনই বড় পুঁজিওয়ালা মানুষের দিকে তাকালে বাজারের ব্যাপ্তি সম্বন্ধে একটা সম্যক জ্ঞান জন্মায়। শ্রীরামকৃষ্ণর সময় এমন মানুষও ছিলেন যাদের কাছে শ্রীরামকৃষ্ণ একজন স্নায়ুরুগী ছাড়া বিশেষ কিছু ছিলেন না। ওই যে বললাম, যার যেমন পুঁজি।

আগের প্রসঙ্গে আসি আবার, শ্রীরামকৃষ্ণ দর্শনে যেমন শঙ্করাচার্য ধারা, রামানুজ ধারার প্রভাব বেশি। অর্থাৎ অদ্বৈতভাব আর বিশিষ্টাদ্বৈতভাব। বিশিষ্টাদ্বৈতভাবকে বেলের সঙ্গে তুলনা করছেন। বলছেন বেলের শাঁসটাই আসল, কিন্তু গোটা বেল বলতে গেলে ও বিচি, খোল সব সমেত বলতে হবে।

বাঙালির চেতনায় সে অর্থে শ্রীরামচন্দ্র আলোচনায় আসেননি। সাহিত্যের কথা বলছি না, আমি অধ্যাত্মজগতের কথা বলছি। যদিও কথামৃতে, রবীন্দ্রনাথের লেখায় শ্রীরামচন্দ্রর প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে। রবীন্দ্রনাথের লেখাতেও শ্রদ্ধার সঙ্গেই এসেছে।

কিন্তু বাঙালির ইষ্টচেতনা জুড়ে আছেন জগদম্বা, শ্রীকৃষ্ণ আর বৌদ্ধ-বৈষ্ণব চেতনায় সিক্ত ব্রহ্ম। এ ছাড়া বাঙালি বিপদ থেকে বাঁচার জন্য লোকনাথবাবা থেকে শুরু করে শীতলা সব পুজোতেই আছে। কিন্তু সেটাকে অধ্যাত্মিক চেতনা বলতে চাই না। সেটা তার উৎসব। সেটা তার বিশ্বাস। কিন্তু অধ্যাত্মিক চেতনার মধ্যে একটা চর্চা শব্দ আছে। সেই চর্চা পাঁচালি পাঠ নয়। মননে উপস্থিতি, যা তার অবচেতনে থেকে তার ভাবনা চিন্তাকে প্রভাবিত করে চলেছে। তাকে বুঝতে গেলে এই গভীরতায় ডুবতেই হবে।

আমেরিকান সামাজিক মনোবিজ্ঞানী রিচার্ড ই নিসবেটের বই ‘দ্য জিওগ্রাফি অব থট’’, এই চিন্তার প্রভাবকগুলোর দিকটা নিয়ে আলোচনা করে। তার কাজ অবশ্যই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার বৈশিষ্ট্য নিয়ে, যে কাজটা স্বামী বিবেকানন্দ বহু বছর আগে শুরু করেছিলেন, সেই একই কাজ কিন্তু আরো বেশি তথ্য নির্ভর এই যা।

ইষ্ট শব্দটার শুরুর শব্দ ইচ্ছা। আমি যাকে ইচ্ছা করেছি বেছে নিতে। আমি যাকে বেছে নিই, পরে সে-ই আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। শেষে এইটুকুই বলার আজ যে শ্রীরামের আবির্ভাব ভারতীয় রাজনীতিতে হয়েছে, সে রামের সঙ্গে ভারতের অধ্যাত্ম জগতের রামের অনেক পার্থক্য। কী করে? রামচরিতমানস যে বইটাকে মূলত আধার করে লেখা হয়েছিল সেটা হল ‘'অধ্যাত্ম রামায়ণ’। যা অত্যন্ত উন্নত মানের দর্শন। মূলত অদ্বৈতবাদের ভিত্তিতে ভক্তি আর জ্ঞানের সমন্বয়। শ্রীরামকৃষ্ণর ভীষণ প্রিয় গ্রন্থ। স্বামীজিকেই বিশেষত পড়তে দিতেন। আলোচনাও করতেন স্বামীজির সঙ্গেই।

যে রামের ছবি ‘'অধ্যাত্ম রামায়ণ’’ এ পাওয়া যায়, সেই রামের সঙ্গে পতাকা, মিছিল যায় না। শ্রীরামচন্দ্রর সাধনার রাস্তা বৈষ্ণবের সাধনার রাস্তা। সেখানে বৈষ্ণব বলতে কী বোঝায় আমরা নিশ্চয়ই জানি। আমার ধর্ম নিয়ে আমি আছি, সেখানে তুমি বাধা দিতে এলে আমি গর্জে উঠব, কিন্তু অকারণে গর্জন-তর্জনের আদর্শ শ্রীরামচন্দ্রর না।

দস্যু রত্নাকর রাম নাম জপ করে সাধু হয়েছিলেন। তর্জন গর্জন করে হননি। মহাত্মা বলতেন, মুখে রামনাম আর বগলে ছোরা। এ ঠিক রাস্তা না। রামকে পাওয়ার একমাত্র সাধন তুলসীদাস বলছেন, ভালোবাসা। প্রেম। তার জন্য কি মিছিলে বেরোতে হয়?

64
Tue, 04/16/2024 - 12:33

মানুষও তাপগ্রাহী আর তাপমোচী হয়। তাপগ্রাহী দুর্লভ। তাপমোচী সুলভ। যত কাছে যাবে তত আঁচ গায়ে লাগবে। যত দূর থেকে দেখবে তত শীতলতা থাকবে।

অনেকে বলেন, সম্পর্ক দূর থেকেই ভালো। বেশি কাছে গেলেই ঠোকাঠুকি। স্বাভাবিক। দুই তাপমোচী যদি পাশাপাশি আসে, যা হওয়ার তাই হবে।

মানুষ যে তাপমোচী প্রাণী সেটা লকডাউনে হাড়েহাড়ে সব বুঝেছিল। সবাই এত কাছাকাছি চলে এসেছিল যে সম্পর্কের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল। রাতদিন ঠোকাঠুকি। মনোবিদরা বুঝিয়েসুঝিয়ে হেদিয়ে গিয়েছিল। ওই যে একটা পশ্চিমী শব্দ আছে না - স্পেস দাও সম্পর্কে। ওর মানে কী? মানে একদম ঘাড়ের উপর দুটো বাড়ি পাশাপাশি কোরো না। এক প্লটে বাড়ি কিনেছ, ভালো কথা। কিন্তু তবু মাঝে স্পেস রাখো। যাতে জানলা খোলা যায়। জানলা দিয়ে গরম বাতাস বেরিয়ে যেতে পারে।

মন তাপমোচী। তাই মানুষ তাপমোচী। মন তাপ উৎপন্ন করে, তারপর সেই তাপ জুড়াবে বলে জল খুঁজে বেড়ায়। গুরু, ভজন, তত্ত্বকথা, গান, নাচ, মদ, ক্লাব, বন্ধু ইত্যাদি, কেউ একজন একটু আমার মনের তাপ কমিয়ে দে রে ভাই, এই বলে দৌড়ে বেড়ায়। কখনো হয় তো কমে, তবে স্বল্পক্ষণের জন্য।

দেখেন মনের স্বভাব যে তাপমোচী সে আমাদের কামারপুকুরের ঠাকুর আগেই বুঝেছিলেন। তিনি পঁইপঁই করে বলে গেলেন, ভাই রে মন কুকারের মত। একটা সেফটিভালভ লাগাও। মাঝে মাঝেই সিটি দেবে, ভয়ে কাছের লোক দূরে যাবে, ওতে ক্ষতি অত নেই, যতটা তুমি বার্স্ট করলে। তোমার ও একটা “আমি” আছে না? মানে আরকি তোমার ইন্ডিভিজুয়ালিটি। যার নামে একটা আধারকার্ড নাম্বার আছে। একটা, কি দশটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। জমির দলিল আছে। বাড়ি গাড়ির কাগজে তার নাম আছে। ক্লাবে যার নামে মেম্বারশিপের চাঁদা দেওয়া আছে। ওই আমিটাকে একটু সামলে রেখো। সেই আসল তাপমোচী। কী ভাবে হবে? তো কামারপুকুরের ঠাকুর বলছেন, ‘আমি’’ তো যাবে না, যতই তাড়াও আবার আসবে। তার চাইতে থাকুক শালা “দাস” হয়ে। ওকে সামলানো মানে, মাঝে মাঝে ওকে ভ্যাক্সিন দাও। সাধুসঙ্গ করাও। উদারতা আসুক। মনে জমা তাপ খানিক হলেও বেরোক। মা সারদা বললেন, বাবা নিজের দোষ দেখো, অন্যের দোষ দেখে বিশেষ লাভ নেই। যত খোঁজো, তত বেরোবে? তারপর? রাখবে কোথায়? অন্যের বাড়ির সেফটিট্যাঙ্ক কি তোমার জমিতে করতে দেবে? তবে অন্যের মনের হাগামোতা খুঁজে খুঁজে আমার মনে জমিয়েও বা কী করবে?

দাঁড়ান, একটা তো বিপজ্জনক কথা বলে বসেছি। সাধুসঙ্গ। তা এর মানে কী? না, সাধুসঙ্গ মানে গেরুয়াসঙ্গ না। আজকাল গেরুয়াও তাপমোচী। বলা যায় অনেক বেশি তাপমোচী অগেরুয়া থেকে। সে কথা না। তবে সাধুসঙ্গ মানে কী? যে সঙ্গে নিজেকে তুচ্ছ বলে মনে হয়। খোলা মাঠ। সমুদ্র। হিমালয়। এ সব তো আছেই। কিছু না হলে রবীন্দ্ররচনাবলীর ধুলো ঝাড়ি আমি। ধুলো না জমলেও ঝাড়ি। কথামৃতের পাতার পরে পাতা উলটে যাই। পড়ি না। চোখকে মনের সাথে বেড়াতে নিয়ে যাই। চুম্বকের পরীক্ষা লোহার সামনে। তেমন আসল সাধুর পরীক্ষা তাপিত মনের সামনে। মন যেখানে শীতল হয়, সেই আমার সাধুসঙ্গ। সে যদি দরজা দিয়ে টয়লেটে বসে গান শুনলেও হবে, তবে তাই আমার সাধুসঙ্গ। কিন্তু এই সাধুসঙ্গটা খুব দরকার।

দেখুন মানবতাকে সহজেই ভালোবাসা যায়। অনেক সহজেই হিউম্যানিস্ট হওয়া যায়। কিন্তু একজন মানুষকে ভালোবাসতে ধক চাই। ওই জন্যে যীশু বলছেন, পাশের মানুষটাকে ভালোবাসো। মানবিকতা তো হাওয়াই মিঠাই। মুখে দিলেই গলে যাবে। ওতে হবে না। একজন গোটা মানুষকে আস্ত ভালোবাসো। কঠিন কাজ। কিন্তু ওই সাধুসঙ্গ করতে করতেই সহজ হবে। হতেই হবে।

মন তাপমোচী। ভাষা তাপমোচী। অনেকে মন আর ভাষার মধ্যে একটা ইনসিলুটেড ফিল্টার লাগিয়ে কাজ চালান। মনের তাপমাত্রা যখন নিরানব্বই ছুঁই ছুঁই, ভাষাকে সেই কৌশলে হয় তো বিয়াল্লিশ, তেতাল্লিশে নামিয়ে আনা গেল। ভালো কৌশল। কিন্তু বেশিদিন কাজ করে না। উপায়? সম্পর্ক থাকুক। কিন্তু মাখামাখিটা যতটা এড়িয়ে যাওয়া যায় ততটাই স্বাস্থ্যকর। এই মাখামাখিতে জটিল একটা ওয়ারিং তৈরি হয়, একের তাপে অন্যে পুড়ে মরে। তার চাইতে আলাদা মিটার বক্স, আলাদা ইনভার্টারের ব্যবস্থা থাকা ভালো। ওতে সম্পর্ক মধুর থাকে। সেই এক স্পেসের তত্ত্ব চলে এলো। সব থাকুক, অবশেষে হাতের মুঠোয় শুধু ঘামই জমুক। মাঝে মাঝে ঘাম মুছে নিলেই হবে। হাত শুকনো হলেই বিপদ। ওকে বিষাদ বলে। থাক। অদ্দূর না। শূন্য হাতে, শূন্য মুঠোয় ঘাম জমুক। আমি সামলে নেব।

65
Sun, 04/14/2024 - 12:39

অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শনে ভয় পেয়েছিলেন। “ভয়েন চ প্রব্যথিতং মনো মে”। আমার মন ভয়ে ব্যথিত হয়েছে। ভয়ে ব্যথা জন্মায় মনে।

সোনার লঙ্কায় সব ছিল। সঙ্গে ভয়ও ছিল। সেদিন নবদ্বীপেও ভয় ছিল, সচ্ছলতা থাকতেও, জগাইমাধাইয়ের ভয়। মুহম্মদ যখন শেষবার মক্কায় গেলেন, তিনি দুই যুযুধান সম্প্রদায়ের মধ্যে যেটা মিটিয়ে দিতে চাইলেন সেটা হল একে অন্যের প্রতি ভয়। খ্রীষ্ট ধর্মগুরুদের যথেচ্ছাচার থেকে, নানা অমানবিক বিধানের ভয় থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। বুদ্ধ ধর্মের নামে মানুষকে নানা কৌশলে, আচারে-অনুষ্ঠানে মানুষকে পিষে ফেলার যে সব কায়দাকানুন চলছিল তার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন।

রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা নাটকের কথা যদি মনে করি, রক্তকরবী। অচলায়তন। মুক্তধারা। সেখানেও সেই একই কথা ঠাকুর্দা, ফকির, বাউলের মুখে। ভয়ের থেকে বেরিয়ে আসার কথা। ভয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা।

ভয় মানুষের অভিব্যক্তির একটা আদিম আবেগ। তার আগে যতটা কাজ ছিল, এখন ততটা নেই। নানা বিপদজনক, ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের হাত থেকে বাঁচিয়েছে ভয়। শিকারী প্রাণীর হাত থেকে বাঁচিয়েছে ভয়। আজও শারীরিক অনেক ঝুঁকিপূর্ণ কাজে সচেতন করে ভয়ই। অতিরিক্ত অ্যালার্ট হয়ে যাই আমরা। ফলে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ক্ষিপ্র তৎপরতায় নিজের সবটুকু ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেরিয়ে আসতে পারি।

কিন্তু এই আদিম ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সভ্যতায় আরেকটা ভয়ের আমদানি হয়েছে। ভয়কে ব্যবহার করার ভয়। মানুষের আত্মায় স্বাধীনতার জন্য স্পৃহা আছে। সে বিশাল বাড়িতে, সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেও অন্যের অধীনে থাকতে চায় না। নিজের নিতান্ত ছোটো একটা ঘরে, নিজের ইচ্ছামত থাকতেই সে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। এটাই মানুষের প্রকৃতি। কয়েকজন যে এর ব্যতিক্রম নেই তা নয়, কিন্তু তাদের নিয়ে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস লেখা হয় না। তাদের নিয়ে মানুষের কোনো গৌরবও নেই।

রক্তকরবীর নন্দিনী রঞ্জনের অপেক্ষা করেছিল। রাজা তাকে নিজের মত করে ভালোবেসেছিল। রাজার সব দিকে নজরও ছিল। রাজাকে মানুষ ভয় পেত। সে ভয় শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় নয়। ক্ষতির আশঙ্কাজনিত ভয়।

ভয় শব্দটার তাই ভালো খারাপ দুটো ব্যবহারই আছে। রাশভারি মানুষকে দেখে যে ভয়ের কথা আমরা বলি, সে শ্রদ্ধা মিশ্রিত সমীহ। এখানে সমীহ করাকেই ভয় বলছি। কিন্তু একজন প্রবল ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষের যথেচ্ছাচারের সামনে যে ভয় পাচ্ছি, সে নিজের ক্ষতির আশঙ্কার ভয়। সে সমীহ নয়। নিজের কাছে নিজে যদি স্পষ্ট, স্বচ্ছ উত্তর চাই, আমি কি তাকে সমীহ করছি? না। আমি তাকে পাতি ভয় পাচ্ছি।

সমীহ চাইলেই করা যায় না। সমীহ জন্মায়। সমীহ যার প্রতি জন্মায় সেখানে তার কৃতিত্ত্ব আর তার কৃতিত্বকে অনুধাবন করার আমার ক্ষমতার সমীকরণে সেটা জন্মায়।

সমীহের বিপরীতে আরেকটা শব্দ আছে। যুক্তিজাত ভয়। সামনে একজন বন্দুক নিয়ে এলে অতি নির্বোধ ব্যক্তিও ভয় পায়। কিন্তু ভুল শিক্ষায় কী ভয়ংকর দিন আসতে পারে সেটা যুক্তিজাত ভয়। সেদিন রবীন্দ্রনাথ ইংরেজের শিক্ষাব্যবস্থায় সে ভয় পেয়েছিলেন বলেই শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কোনোভাবেই ইংরেজের অ্যাফিলিয়েশন না নিয়েই করেছিলেন। এই যুক্তিজাত ভয়কে অনুধাবন করতেও তাই একটা নির্দিষ্ট মানের বোধশক্তির প্রয়োজন হয়। চাতুরী ধরতে যে বুদ্ধিমত্তা লাগে তা প্রকৃতিপ্রদত্ত ক্ষমতা না। তা সঠিক শিক্ষার চর্চায় জন্মায়।

ভয়ের ব্যবহার হল অতিক্ষমতা সম্পন্নের সব চাইতে নিকৃষ্ট ব্যবহার। যে শিক্ষকের নিজের শিক্ষার উপর ভরসা যত কম বেতের উপর নির্ভরতা তত বেশি। সে ক্লাসরুমে এসে আগেই বেতটা টেবিলের উপর রাখে। তাতে কাজ হয় না তা নয়, হয়। বেতের ভয়ে চুপ করে যাওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। কিন্তু এই সংখ্যা ভীষণ অস্থায়ী। ইতিহাস সংখ্যার ইতিহাস হলে আজও সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরত, আজও ঈশ্বর সাতদিনে পৃথিবী সৃষ্টি করত, আজও সতীদাহ হত, আজও হিটলারতন্ত্র জার্মানকে গ্রাস করে থাকত। সেদিনও বেতের শাসনে শাসিতের সংখ্যাই বেশি ছিল। কিন্তু মানুষের ইতিহাস সংখ্যার ইতিহাস না। সত্যের ইতিহাস। সে সত্য হল, ভয়ের বিরুদ্ধে যে দাঁড়ায়, ঝুঁকি নিয়ে হলেও তার পাশেই মানুষ এসে দাঁড়ায়। নইলে ডাণ্ডি মার্চে ওই নিরস্ত্র মানুষটার পিছনে এত সহস্র মানুষ হাঁটত না। মার্টিন লুথারও আমেরিকার রাস্তায় একাই হাঁটতেন।

ভয় প্রভাবশালীর শেষ অস্ত্র। আর মানুষের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মানুষ সব চাইতে বেশি ঘেন্না করেছে এই ভয়কে। মেরুদণ্ডহীন, নেতিয়ে পড়া মানুষ নেই বলছি না। কিন্তু তারা এতটাই নীচে, অন্ধকারে, ধর্তব্যের বাইরে যে তারা মন্দ-ভালো কোনো আলোচনাতেই থাকে না। তাদের যুক্তিবুদ্ধি, হিসাবনিকাশ সব থাকে। কিন্তু এমনই হীন তারা যে নিজের জ্বলে ওঠার সামর্থ্য নেই শুধু না, অন্যের আগুনে জ্বলে ওঠার ক্ষমতাটাও নেই।

ভয়কে যে ব্যবহার করে তার সে ভয়ের অধীন হতে ভয় পাওয়া মানুষের প্রথম কর্তব্য। পরের কর্তব্য হল সেই ভয়ের বাইরে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালানো। মানুষের বিবেকেরও একটা রুচিবোধ আছে। সে রুচিবোধই তাকে সে শক্তি জোগায়।

রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলো আবার করে পড়ার, ভাবার সময় এসেছে। কেন নন্দিনী রাজার ভালোবাসা, রাজার দাবী এড়িয়ে রঞ্জনের অপেক্ষায় ছিল তা আবার করে পড়ার সময় এসেছে। প্রত্যেক যুগেই আসে এমন একটা সময় যখন রঞ্জনের জন্য অপেক্ষা তাগিদে পরিণত হয়। ভয়ের অধীনে বাস করার থেকে অপমানজনক অভিজ্ঞতা মানুষের আত্মার আর কিছুই নেই। তাই ভয়ের অধীনে থাকা মানুষদের উপর করুণা জন্মাতেও বিবেকের রুচিবোধে লাগে।

সত্য কোনো তত্ত্ব না। সত্য জীবনের গভীরতম আলো। যা অধীন হয় শুধু নিজের। গীতায় মানুষের সদগুণ আলোচনা করতে গিয়ে প্রথম শব্দ বলে, অভয়। অভয় মানে যে ভয় দেখায় তার অধীন হতে অস্বীকার করা। তারপর কী হবে? গানে আছে।

 

আনন্দেরই সাগর হতে এসেছে আজ বান।

দাঁড় ধ'রে আজ বোস্‌ রে সবাই, টান রে সবাই টান॥

বোঝা যত বোঝাই করি করব রে পার দুখের তরী,

ঢেউয়ের 'পরে ধরব পাড়ি-- যায় যদি যাক প্রাণ॥

কে ডাকে রে পিছন হতে, কে করে রে মানা,

ভয়ের কথা কে বলে আজ-- ভয় আছে সব জানা।

কোন্‌ শাপে কোন্‌ গ্রহের দোষে সুখের ডাঙায় থাকব বসে।

পালের রশি ধরব কষি, চলব গেয়ে গান॥

 

66
Mon, 04/01/2024 - 12:46

প্রথম কথা এটা মনে রাখতেই হবে, মানুষ হয়ে জন্মেছেন মানে বোকা হবেন বলেই জন্মেছেন। “আমি কোনোদিন বোকা হব না” এই বোকামিটা করবেন না প্লিজ। বোকা হতে হতে বড় হবেন। বুড়ো হবেন। বোকা হয়েই একদিন ঠকাস করে মরে যাবেন। বোকার মত ভালোবাসবেন। বোকার মত কষ্ট পাবেন। বোকার মত চালাকি করবেন। বোকার মত পস্তাবেন। বোকার মত দীর্ঘশ্বাস ফেলবেন। বোকার মত খুশী হবেন। বোকার মত সফল হবেন। বোকার মত ব্যর্থ হবেন। বোকার মত ঈর্ষাকাতর হবেন। বোকার মত গর্বিত হবেন। বোকার মত বিশ্বাস করবেন। বোকার মত সন্দেহ করবেন। এ চলতেই থাকবে।

মানুষ যত যত দিন সেলিব্রেট করে তার মধ্যে এই দিনটা সব চাইতে সৎ। কোনো ভণ্ডামি নেই। একদম খাঁটি কথা। বোকা হয়ে জন্মেছি। বোকা হয়েই মরব। মাঝে অজস্র বোকামি করব। পালাবার পথ নাই।

সক্রেটিস কেমন আসল কথাটা বলে রেখেছেন দেখুন, “আমিই সব চাইতে বুদ্ধিমান, কারণ এক আমিই জানি, আমি কিছুই জানি না”।

আহা, প্রাণে যে কী শান্তি। কী আরাম লাগে এ কথাটা শুনলেই। নিজের বোকামিকে জানতে পারার মত সুখ জগতে আর একটিও নেই। যে যত গভীরে জানে সে আসলে একটি নিরেট বোকা, সে তত শান্তিতে, আনন্দে জগতে বাঁচতে পারে। আমাদের বোকা হওয়ার পূর্ণ ছাড়পত্র দিয়েই এ জগতে পাঠানো হয়েছে।

তবে নিজের বোকামিকে কী কী ভাবে উদযাপন করা যায়? তার একটা লিস্টি আমি আমার মত করে নিয়েছি।

 

১) ঘুম থেকে উঠেই ভাববেন, আমার সমস্ত বোকামিকে আমি স্বীকার করে নেব। আজকে তার মধ্যে একটা দিয়ে শুরু করি। দিনে একটা বোকামিকে আবিষ্কার করা মানে প্রায় মধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিস্কার করার সামিল মনে রাখবেন।

 

২) যদি বোকামিকে চিনতে পারার পর দুঃখ হয় মনে মনে, তবে জানতে হবে সব বোকামিটা জানা হচ্ছে না, আসলে তলে তলে লাভ-লোকসানের হিসাব চলছে। বিশুদ্ধভাবে বোকামির অন্বেষণ করতে হবে। চালাকি দিয়ে নয়।

 

৩) জগতে অন্যের বোকামির পাশে নিজের বুদ্ধির দিকটা রেখে তুলনা করবেন না। ওটা একটা পচা খেলা। সে যেখানে বোকা, আপনি হয় তো সেখানে একটু কম বোকা। কিন্তু সে যেখানে একটু কম বোকা, আপনি হয় তো সেখানে একদম ছড়িয়ে বোকা।

 

৪) প্রতিদিন নিজের বোকাসত্ত্বাটাকে ভালোবাসতে শিখুন। কারণ সে অনন্ত। সে অসীম। আপনার বুদ্ধি নিতান্ত সীমিত। ও দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যায় না। নিজের মধ্যে যে ভুঁইফোড় বোকাসত্ত্বা আছে, সে-ই আমি। মানে আসল আমি।

 

৫) কাউকে বোকা বানাতে যাবেন না। অসীম এ বোকামির সাগরে একটা নিজের তৈরি বোকামির ঘূর্ণি বানাতে গেলে শেষে নিজেকেই সেই ঘুর্ণির মধ্যে পড়তে হয়। এবং ততক্ষণ সে স্বরচিত ঘুর্ণিতে ঘুরে যেতেই হয় যতক্ষণ না নিজেই আবার সেই ঘুর্ণিকে নিজের হাতে শেষ করে দেন। বড় জ্বালা।

 

৬) মাঝে মাঝে নিজের বোকামিকে সেলিব্রেট করুন। একা একা বসুন। নিজের একটা বাজখাঁই বোকামিকে স্মরণ করুন। তারপর প্রফুল্লচিত্তে ভাবুন, তারপরও আপনি আজকের দিনটা অবধি টিকে আছেন। নিজের সেই বোকামিকে স্মরণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। কৃতজ্ঞ হোন।

 

৭) অন্যের বোকামিকে ক্ষমা করুন। কারণ নিজের ও অন্যের বোকামিকে ক্ষমা করতে করতে এগোনোই আসল তপস্যা। যেমনভাবে আমরা দুটো বিশ্বযুদ্ধকে ক্ষমা করেছি, হিরোশিমা ক্ষমা করেছি। অন্তত চেষ্টা চালাচ্ছি, তেমন আরকি। তবু তো ওসব ভুলে সামনের দিকে এগোনোর চেষ্টা চালাচ্ছি। তেমনভাবেই অন্যের বোকামিকে ক্ষমা করুন। নিজের অসীম বোকামির দিকে তাকান, সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা করার শক্তি পেয়ে যাবেন।

 

৮) প্রচুর পড়াশোনা করুন। সিনেমা দেখুন। কিন্তু বদহজম না হয় যেন। হলেই শুরু হবে অন্যকে আঘাত করার খেলা। নিজের ক্ষমতার নিষ্ঠুরতম দিকটির পূর্ণশক্তিতে ব্যবহার। কিন্তু বাস্তবে এ সবই হচ্ছে এক বিন্দু বোকামিকে ম্যানিপুলেট করে সাজিয়েগুছিয়ে নানা সঙ্কীর্ণ অ্যাজেন্ডা হাসিল করার মতলব। সময় যদ্দিন সাথ দেবে এ খেলা চলবে, তারপর বোকাহাঁদার মত জগত থেকে বিদায় নিতে হবে। যেমন অনেক নিষ্ঠুর রাজাউজির নিয়েছে বিদায়।

 

৯) বোকামি স্বাভাবিক। বোকাহাঁদামিটা বদহজমীয় পণ্ডিতি। অস্বাভাবিক। এই যে বোমাবারুদ নিয়ে একের পরে এক প্রাণ নষ্ট করে দেওয়া। এ বোকামি না। এ বোকাহাঁদামি। এ দেখলে বোকার চোখে জল আসে। বোকাহাঁদের সব সময় রক্তচক্ষু।

 

১০) রামকৃষ্ণদেব বলছেন, চিনির পাহাড় আছে। একটা পিঁপড়ে এক দানা মুখে করে নিয়ে যেতে যেতে বলছে, পরেরবার সবটা নিয়ে চলে যাব।

 

একজন বলছেন, কিন্তু তা শুকদেব ইত্যাদিরা পণ্ডিতেরা?

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তারা হদ্দ ডেঁয়ো পিঁপড়া। বড়জোর আরো দুটো দানা বেশি নিতে পারে। ওর বেশি না।

রামকৃষ্ণদেব বোকামিকে স্বীকার করে নিতে বলছেন। সক্রেটিসের মত। কারণ জ্ঞান মানেই অজ্ঞানের অসীমত্বকে জানা।

উপসংহার। জীবনটা বোকামির। মরণটাও। মাঝে শুধু বোকাহাঁদামি না করে মরি, এটাই দেখার। জয়গুরু।

 

67
Tue, 03/19/2024 - 12:41

মাধ্যমিক শেষ হয়ে গেছে। এখন উচ্চমাধ্যমিক পড়ার মরশুম শুরু হয়ে গেছে। কোনো কোনো স্কুল নাকি উচ্চমাধ্যমিক পড়াতেও শুরু করেছে বা পড়ানোর কথা ভাবছে এমনও শুনছি।

এই সময়টা মাধ্যমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিকের দিকে আসা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক অস্থিরতা দেখি বিষয় নির্বাচন নিয়ে। যার বেশিরভাগটাই খুব অগভীর, পরিকল্পনাহীন, "ভালো স্কোরিং", "ওটা পড়তে ভয় লাগে", "এটা ভীষণ সোজা" ইত্যাদি অবৈজ্ঞানিক ভাবনাচিন্তা থেকে আসে।

যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কী নিয়ে পরে পড়তে চাও?

বেশিরভাগেরই উত্তর অজানা। আপাতত একটা সাবজেক্ট কম্বিনেশন হলেই হল। যে সকালে কেমিস্ট্রি নিচ্ছে, সে বিকেলে সেটাকে ছেড়ে নিউট্রিশান নিচ্ছে। যে আজকে কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে দুদিন পড়ে এলো, সে তারপর বায়োলজি নিয়ে নিল। কেউ ইকনমিক্স আর বায়োলজি নিচ্ছে। আরো সব অসঙ্গত কম্বিনেশন।

কম্বিনেশনে বৈচিত্র্য আসুক। সেটা ভালো। কিন্তু সেটা যদি এটা পড়তে সোজা লাগে, আর ওটা পড়তে কঠিন লাগে, শুধু এইটুকুর উপর নির্ধারণ করে হয়, তবে সেটা সম্পূর্ণভাবেই ভুল দিকে নিয়ে যাবে। আমাকে তো ঠিক করতে আমার আগ্রহ কোনদিকে, কোন বিষয়টা নিয়ে আমি ভবিষ্যতে পড়তে চাইছি।

উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা সেমিস্টার অনুযায়ী করা হবে। ভালো। কিন্তু কাদেরকে নিয়ে করা হবে? যাদের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীরাই জানে না তারা ভবিষ্যতে কি করতে চাইছে। কোনো যথাযথ কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে আপাত ভালোলাগা, না-লাগাকে ভিত্তি করে সাবজেক্ট ধরা ছাড়ার প্রক্রিয়া তো আছেই। গোটা বিষয়টাই ভীষণ অব্যবস্থিত।

আমি বিজ্ঞান পড়াই বলে বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীদের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা আছে। সেই থেকেই বলছি, বাংলা বোর্ডের ছেলেমেয়েদের মধ্যেই কিন্তু এই সমস্যাটা বেশি। সিবিএসই, আইসিএসই র ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই সমস্যাটা এত প্রবল নয়।

বাংলায় ছেলেমেয়েদের কাছে ডাক্তারি পড়তে পারাটাকে মহার্ঘ্য। ইঞ্জিনিয়ারিং তারপর। আর বাদবাকি সব “ওগুলো আমার দ্বারা হবে না” বলে আসা। এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু তার সংখ্যাটা কম। আমরা প্রতি বছর পড়ছি, কলেজে অনেক সিট ফাঁকা থাকছে, ভর্তি হচ্ছে না। সায়েন্স পড়ার ছাত্রছাত্রী কমে যাচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং এর সিট ফাঁকা থাকছে।

আমার একান্ত অনুরোধ আপনারা যারা শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত তাদের কাছে। কতগুলো বিষয়কে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই।

 

১) বিজ্ঞান বিষয়টা একে অন্যের উপর নির্ভরশীল বলে আমার বিশ্বাস। কেউ অঙ্ক ছাড়া ফিজিক্স টেকনিক্যালি নিতেই পারে। সেক্ষেত্রে অঙ্কটা আলাদা করে তাকে শিখে নিতে হবে। কিন্তু কতজন সেটা করে? পাঁচটা বিষয় নিয়ে স্কুল আর টিউশান পড়তে পড়তে অনেকের বেলাতেই খুব কম সময় বা আগ্রহ থাকে যে আলাদা করে অঙ্কটা শিখি।

তেমনই কেমিস্ট্রি আর বায়োলজিও। খুব বেশি নির্ভরশীল না হলেও অনেকটাই নির্ভরশীল। বেশ কয়েকটা অধ্যায় পড়াতে রীতিমতো বেগ পেতে হয় যাদের কেমিস্ট্রি না থাকে তাদের। তাদের শুধু মুখস্থের উপর পড়ে যেতে হয়।

 

২) বিজ্ঞানের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। আর আছে নিজস্ব যুক্তির পরিকাঠামো। অঙ্ক তার কেন্দ্রগত। কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, বায়োলজি তারই উপর দাঁড়িয়ে। অন্তত এইটাই আমার বিশ্বাস। অনুভব। আমাকে বিজ্ঞানের ছাত্র হতে গেলে আমাকে বিজ্ঞানের এই যুক্তির পরিকাঠামো আর ভাষার সঙ্গে পরিচিত থাকতেই হবে। যদি বিষয়টা নিয়ে আমি সিরিয়াস হই। যদি আমি আমার পড়াশোনার গতিপথ নিয়ে সিরিয়াস হই।

 

৩) এইখানেই সমস্যাটা তৈরি হচ্ছে বলে আমার বিশ্বাস। অনেকেই বর্তমানে অদ্ভুত সব অসঙ্গত কম্বিনেশানে বিজ্ঞান পড়ে। সেটা না হচ্ছে বিজ্ঞান, না হচ্ছে আর্টস। কারণ সে সেই বিষয়ের “ঘরানা”টার সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে না। সে বিষয়টার অন্দরমহলে প্রবেশের ক্ষমতা অর্জন করতে শিখছে না।

 

৪) বৈচিত্র্য আর গভীরতা কি একে অন্যের পরিপূরক হতে পারে? জ্যাক অব অল ট্রেড হতে গেলে সে মাস্টার অব নান হতে হয়, সেটা খুব কাজের?

আমি বলছি না বৈচিত্র্যপূর্ণ কম্বিনেশান থাকবে না। থাকুক। আমি দর্শন আর ডাক্তারি একই সঙ্গে পড়াই না কেন, কিন্তু সেই পরিকাঠামো, সিলেবাস কি পাচ্ছি? সেটা কতটা বাস্তবসম্মত? আমি তর্কের খাতিরে বলতেই পারি অমুক দেশে হচ্ছে, তবে এদেশে হবে না কেন? কিন্তু অন্য কোনো একটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিকাঠামোর সঙ্গে কি আমাদের দেশ মেলে?

যা হোক সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু আমার উদ্বিগ্নতার জায়গাটা হল অন্য। এই যে আমরা একটা জগাখিচুড়ি মার্কা কম্বিনেশনে পড়িয়ে দিচ্ছি, তারপর কি হবে? যখন তারা গ্র‍্যাজুয়েশানের দিকে যাচ্ছে তখন আবার আরেক নতুন কম্বিনেশানের নিয়মের মধ্যে এসে পড়ছে। যে অঙ্ক আর ফিজিক্স ছাড়া কেমিস্ট্রি পড়ে এলো এগারো বারো ক্লাসে, তাকে বিভিন্ন কলেজ বলে দিচ্ছে এই কম্বিনেশানে কেমিস্ট্রি নিয়ে স্নাতক হওয়া যাবে না। এইবার? অর্থাৎ তার দু বছর পড়ার আদতে কোনো মূল্য নেই? তার কেমিস্ট্রিতে প্রাপ্ত মান যাই হোক না কেন, এরপর তাকে সে এনে শূন্যের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল।

 

৫) অনেকে বলবেন, দারুণ সব নাম্বার তো পাচ্ছে।

আমার উত্তর, পাচ্ছে। এবং যদি ধরে নিই এই প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতেই আমরা তাদের আহরিত জ্ঞানের একটা সোজা সরল সমীকরণ বানিয়ে ফেলেছি, তবে সে নিতান্তই অগভীর, অনভিজ্ঞ সরলতা। নাম্বার বাড়ানো আর কোনো বিষয়ে নিজের গভীরতা বাড়ানো অনেক সময়েই এক আসনে বসে না। আজকাল তো আরো বসে না। ছাত্র নিজের নাম্বার দেখে নিজেই চমকে যায়, এত পেলাম কি করে! এ ঘটনাও আজকাল বেশিই ঘটছে।

অনেক অনেক নাম্বার। তারপর সেই নাম্বারের ভিড় ঠেলেঠেলে নিজের পছন্দের বিষয় আর কলেজ খোঁজা, ভীষণ কঠিন কাজ। এবং যদি শুরুর দিকে আমার কথাটা মনে রাখেন, যে অনেকেই জানে না তারা কি নিয়ে পড়বে, অগত্যা একটা যা হোক পাওয়া যাচ্ছে সেটা নিয়েই পড়লে হবে, এই হয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ। যারা যে কম্বিনেশনে উচ্চমাধ্যমিক পড়ল, পরে জানল সেই কম্বিনেশনে কোনো বিশেষ এক বিষয়ে অনার্স পাওয়া যাবে না। এবার?

 

৬) এখান থেকেই আমার মনে হচ্ছে, এই যে বিজ্ঞানের প্রতি অনাগ্রহ, এটা এই অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক কম্বিনেশানের জন্য নয় তো? আসলে তো সে এমন একটা বিষয় পড়ছে, যার বেশ কিছুটা সম্বন্ধেই তার ধারণা অস্পষ্ট হয়ে থাকছে কারণ সেই বিষয়টা বোঝার জন্য সাপোর্টিভ সাবজেক্টে তার জ্ঞান নেই বলে। এর দায় কার?

 

৭) বাংলা স্কুলগুলো ধুঁকছে। এ বলাবাহুল্য। এখনও মাতৃভাষার মাধ্যমে উচ্চতর শিক্ষায় বিজ্ঞানশিক্ষা বাস্তবায়িত নয় আমাদের দেশে। এরই মধ্যে আরেক ধরণের ছাত্রদের মধ্যে ইংরেজিতে অনীহা নিয়ে বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার প্রবণতা থেকে যাচ্ছে।

বাস্তবটা হল, উচ্চতর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বাংলা পরিভাষা ভীষণ দুর্বল। এর মধ্যে বেশ কিছু বই ছাপানো হচ্ছে যেখানে বাংলা পরিভাষার পাশাপাশি ইংরেজি টার্ম দেওয়া থাকছে না। এবং ইদানীং নজরে এলো বাংলা বোর্ডের ইংরেজি মাধ্যমের জীবনবিজ্ঞান বইতে কি ভীষণ সব ভুল বানান আর বাক্য ছাপানো হচ্ছে। কিছুই কি প্রুফ সংশোধন হচ্ছে না? জানি না।

বাস্তবটা স্বীকার করে আমি এখনও অন্তত উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের শুধু বাংলা পরিভাষায় পড়াতে স্বস্তি বোধ করি না। কারণ সামনেই একের পর এক প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা, সেখানে শুধুমাত্র বাংলা পরিভাষায় উচ্চমাধ্যমিকের বিজ্ঞান, বিশেষ করে বায়োলজি পড়ে গেলে যে কি বিপদ সে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষই জানেন। যদিও অনেকের আপত্তি শুনি, “আপনি শুধু বাংলাতেই পড়ান না”। অভিভাবকদের থেকে আসে এ সাজেশন। হয় তো আমার মফঃস্বলে থাকার জন্য এটা হয়, আর্থসামাজিক কারণে। কিন্তু সব সময় তা নয়ও। কিন্তু বিশুদ্ধ বাংলা পরিভাষায় বিজ্ঞান পড়ানো কি করে যায় আমি এখনও জানি না।

 

৭) অভিভাবকদের অতিসক্রিয়তা বা নিষ্ক্রিয়তা। এই দুটোই ভীষণ ক্ষতিকারক।

অতিসক্রিয়তা।

এক, কোনো বিষয়ে একদিন, দুদিন ক্লাস করেই বোঝা যায় না সেটা কঠিন না সোজা। তার জন্য ধৈর্য লাগে। দুই, সোজা-কঠিনটা ভীষণ আপাত। আমার আগ্রহ আর কতটা ডিটারমাইন্ড সে ক্ষমতার উপর সেটা নির্ভর করে। সব চাইতে বড় কথা, আমি একই সঙ্গে সব হতে পারব না। আমাকে বেছে নিতে হবে। সে বাছাটা যতটা রিজিনবল হয়ে তত মঙ্গল। নইলে এমনও তো দেখছি, যার পড়াশোনা শূন্যের কাছাকাছি, সে মেধার কারণেই হোক, কি অনাগ্রহের কারণে, তাকেও মা-বাবা ডাক্তার করার জন্য শিক্ষক থেকে জ্যোতিষী সবার কাছে দৌড়াচ্ছেন। অবশেষে প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বিকল্প রাস্তার জন্য দৌড়াচ্ছেন।

নিষ্ক্রিয়তা।

যা ইচ্ছা করুক। এটা কোনো কাজের কথা নয়। ঠিক তেমনই যেমনটা কোনো একটা বিষয় চাপিয়ে দেওয়াও কাজের কথা নয়। বর্তমানে যে ভয়ংকর আত্মধ্বংসী কম্বিনেশান পদ্ধতি চলছে, সেখানে একটা ঠিকঠাক কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা দরকার। স্কুলের সঙ্গে যুক্ত অনেক সহৃদয় শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন যারা এ কাজটা খুব আগ্রহের সঙ্গে করেন। তাদের সঙ্গে কথা বলা যেতে পারে। অথবা ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজেকে এই ব্যাপারে কিছুটা আলোকিত করে তুলতে হবে। যদি সেটা সম্ভব না হয় তবে সঠিক মানুষের কাছে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। অবশ্যই সেখানে স্কুলের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক শিক্ষিকারা আছেন।

যুগ বদলেছে। দ্রুত বদলাচ্ছে। আমি আর কোনো বিষয় নিয়ে বলার যোগ্যতা রাখি না। শুধু বিজ্ঞান নিয়ে বলি। দয়া করে বিজ্ঞান নিয়ে এই ছেলেখেলাটা করবেন না। অসঙ্গত কম্বিনেশনে বিজ্ঞান পড়াবেন না। হয় অন্ধকার, নয় আলো। আধাজ্ঞান ভীষণ ভয়ানক। আমরা যা করি একটু দূরের দিকে তাকিয়ে যদি করি আমার মনে হয় ভালো হয় সেটা। অবশ্যই অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা আছে যারা এর মধ্যে থেকেও নিজেদের রাস্তা বার করে নিচ্ছে। আমার উদ্বিগ্নতা তাদের নিয়ে নয়। আমার উদ্বিগ্নতা “যে জন আছে মাঝখানে” তাদের নিয়ে। তাদের সংখ্যাটাই তো বেশি। একটু সিরিয়াসলি ভাবব না আমরা?

 

68
Wed, 03/13/2024 - 12:03

চিন্তা করে কেউ পায় না। বিশ্বাস করেও না। পায় তাকিয়ে। খোলা চোখে তাকিয়ে। তাকায় না। ভয় পায়। যা দেখবে তার সঙ্গে তার ইচ্ছা মিলবে না। তাই তাকায় না। বেশিরভাগ মানুষই তাকায় না। তাকানোর ভান করে থাকে। তাই দেখে, যা ইচ্ছা করে দেখতে। কিন্তু তবু তাকাবে না।

একবার যদি চারদিকটা তাকিয়ে দেখত, তার ধর্ম, তার বিজ্ঞান, তার টাকাপয়সা, তার রাজা-মন্ত্রী, চিন্তাবিদ-বুদ্ধিজীবীরা কী কাণ্ড করে বসে আছে। একবার যদি তাকিয়ে দেখত মানুষ।

সত্য ভাবনার জিনিস না। তাকানোর জিনিস। আপেল মাটিতে পড়েছিল। নিউটন তাকিয়ে দেখেছিলেন। তারপর নিজের ভিতরে তাকিয়েছিলেন, ভাবার তত্ত্ব খাড়া করেননি। তাকিয়ে দেখেছিলেন নিজের যুক্তির দিকে। একের পর এককে রেখেছিলেন পাশাপাশি। কিন্তু যদি ভাবতেন, তবে হয় তো একটা গল্প ফাঁদতেন। পৃথিবীর মধ্যে এক বড় রাক্ষুসী আছে। সব কিছুকে সে নিজের পেটের মধ্যে টানছে।

আমাদের দেশে সব পাঁজি অনুযায়ী হয়। পুজো-আচ্চা, ভিতপুজো, অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ে, এমনকি গর্ভাধান। পাঁজিতে সবের বিধান আছে। চাঁদের পৃথিবীকে আবর্তন আর পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে এই ছোট্টো ভুখণ্ডের উপর যে যে ঋতু-মাস যায়, সে সব অনুযায়ী পবিত্র-অপবিত্র, ঠিক-ভুল সবের হিসাব হয়ে যায় আমাদের। এইভাবেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা নিজেদের খেয়ালের দাসত্ব করেছে, বাইরের জগতটাকে নিজের বুদ্ধির চোখে খোলা চোখে তাকিয়ে দেখেনি।

আমাদের বুদ্ধির খোলা চোখ আজও নেই। আজও লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নরনারী সকাল ঘুম ভেঙে চোখ খুলে থেকে ঘুমাতে যাওয়া অবধি 'সংস্কার', 'ঐতিহ্য' মেনে চলে। যার উপর তার আর তার গত চোদ্দোগুষ্ঠি আর আসন্ন চোদ্দোগুষ্ঠির 'ভালো' নির্ভর করছে। আসলে আমাদের মজ্জাগত এসব। আমরা হাত পাততে ভালোবাসি। স্বনির্ভর হতে হবে, এ কথাটাও আমাদের দেশে স্লোগান হয়ে হাওয়ায় ভাসে। সেটাও আমাদের শেখাতে হয়। আমার কী কর্তব্য আছে সমাজের কাছে, দেশের কাছে বড় কথা নয়, প্রথম কথা নয়। আসল কথা আমি কী কী পেতে পারি? আমার ভাগ্যের কাছ থেকে, দেব-দেবীর কাছ থেকে, গ্রহ-নক্ষত্রের কাছ থেকে, পাথর-শিকড়বাকড়ের কাছ থেকে, পঞ্চায়েত কি মিউনিসিপালিটির মেম্বার থেকে প্রধানমন্ত্রী অবধি সবার থেকে কী পেতে পারি সেটাই আমার প্রধান বিবেচ্য। আমার কর্তব্য শুধু 'ভক্ত' হয়ে থাকা। আমার ওইটুকুই শুদ্ধভাবে করতে হবে। কার কখন কতটা ভক্ত হয়ে থাকলে আমার আখেরে লাভ হবে সেটাই আমার প্রধান ভাবনার জায়গা। এমনকি যারা বিজ্ঞানের ছাত্র, কি গবেষক, তাদেরও এই একই কৃষ্টিপন্থী ভাবধারা দেখে অবাক হতে হয়। যতক্ষণ বিজ্ঞানের ক্লাসে, কি পরীক্ষাগারে, ততক্ষণ প্রথাগত যুক্তির অনুসারী। যেই বাইরে, অমনি সমাজের নানা বিধিনিষেধ, নিয়মকানুন যা যুগান্তরের অন্ধবিশ্বাসে লালিত, তার কাছে নতিস্বীকার হয়ে গেল। কারণ ওতে আমার লাভ। আমার সুখের জীনের সুরক্ষা। আমার বিলাসের নিরাপত্তা।

তবু তাকাবে না। তবু নিজের বুদ্ধিটাকে স্বচ্ছ করে, স্পষ্ট করে তাকিয়ে দেখবে না কী হচ্ছে চারদিকে। সাধু থেকে নেতা, শিক্ষক থেকে বুদ্ধিজীবী কী সাংঘাতিক দ্বিচারিতায় ভরা, সে দেখবে না। সে শুধু ভক্ত হবে। ওইটাই আমার জীবনের লক্ষ্য। আমি যে কোনো প্রভাবশালীর ভক্ত হতে পারি, তুমি শুধু বলো যে সে টিকে থাকবে। আমার ওই একটাতেই ভয়। টিকবে তো? আমার তাই এত দেবদেবী, কে কখন কতদিন টিকে থাকবে কে বলতে পারে? আমার বিশ্বাস আমার স্বার্থবুদ্ধির সঙ্গে মিশে আমায় এমন বহুমুখী করে রেখেছে যে এক-একসময় আমি আমার নিজের মুখই চিনতে পারি না।

আজ সে রাস্তাতেই হাঁটছি, আর আমাদের এ স্বভাব আরো পাক্কা হচ্ছে। আমাদের রঙ আরো পাক্কা হচ্ছে। কেন আমরা ভক্ত হতে চাই? কেননা আমাদের যে করেই হোক শান্তি চাই। আমি জানি না আমাদের মত করে এত ভীষণ করে শান্তি আর কেউ চায় কিনা। যে কোনোভাবেই আমি এক জড়তায় পৌঁছে গেলে আমার শান্তি। যেখান থেকে আর সামনে এগোতে হয় না। এই জড়ত্বলাভকে আমরা শান্তিলাভ বলি। যে ভাবেই হোক আমি এই জড়ত্বলাভ করতেই চাই। বুদ্ধির জড়ত্ব।

জীবনের ধর্মই হল বাধাবিপত্তি কেটে সত্যের রাস্তা খোঁজা। তার মধ্যে অনেক ভুলভ্রান্তি। অনেক অপূর্ণতা। অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি। কিন্তু আমি একটা 'পবিত্র', 'পূর্ণ', শান্তিময় স্থিতি চাইছি। পড়ুন আমি একটা জড়ত্বের অবস্থা চাই। এমন এক জড়ত্ব অবস্থা যেখানে আমার বুদ্ধি পর্যন্ত এমন অবশ হবে যে সেও কোনো প্রশ্ন করা থেকে বিরত হবে। এ এক অদ্ভুত মানসিকতা। আর যুগান্তর ধরে আমরা এই 'সেটল্' হওয়ার রাস্তাই খুঁজে যাচ্ছি। একদিন 'রায়বাহাদুর' হয়ে, কোনো রকমে একটা অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করে 'শান্তিময়' জীবন কাটানোর। আজও সেই প্রথা চলছে। আমাদের দেশের শতকরা প্রায় একশোভাগ ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে, কারণ ওতে ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকে। চাকরি পেতে সুবিধা হয়। তাই আমাদের এখানে যত ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান শাখায় পড়াশোনা করে, যত সংখ্যক ছেলেমেয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি শাখার নানা পদে চাকরি করে, সে তুলনায় বিশ্বের দরবারে গবেষণায় আমাদের পদচিহ্ন কই? কারণ বিজ্ঞান আমার জীবিকার উপজীব্য, প্রাণের খাঁটি প্রশ্ন বা সাধনা তো না। আমাকে সত্য খুঁজতে হবে না, আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক মানপত্র পেলেই হবে। ওতে আমার সামাজিক জীবনকে একটা মর্যাদাময় স্থিতিতে এনে দিলেই সে শান্ত।

ওই যে বললাম, আমরা জানি না খোলা চোখে তাকাতে। যে মানুষ অতীতকে ধ্রুব, ত্রুটিহীন জেনে রাস্তায় নেমেছে, সে কেন খোলা চোখে সামনের দিকে তাকাবে? আমরা ধর্ম থেকে ধর্মান্তরে যাই। এক ডগমা থেকে আরেক ডগমায় যাই। কিন্তু গোটাগুটি সব ডগমা ছেড়ে সত্যিকারের প্রাণের ধর্মে কোনোদিন আমরা হাঁটব কিনা কে জানে? আজও আমরা পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানের সবটুকু রস শুষে তাদের খাঁটি সাধনা, তাদের সততাকে দূরে ফেলে 'সংস্কারি' সমাজের কথা ভাবছি। যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে খোলা চোখে তাকিয়ে দেখতে চাইছি না, বুঝতে চাইছি না যে, গোটা বিশ্বে মানুষের জাত একটাই। সে হাজার হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে রূপে, আকারে, আকৃতিতে, সংস্কৃতিতে আলাদা আলাদা হলেও মূলে আদতে এক। কেউ কোনো কিছু ধ্রুব, ত্রুটিহীন আবিস্কার করিনি। বুদ্ধির জড়ত্বকে যদি আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য করে তুলি, তবে যে লাঞ্ছনা, গঞ্জনা, গ্লানির মধ্যে দিয়ে যাব, তাতে আমার কোনো গৌরব নেই। কিন্তু তাতে আমার কি? আমার না তাকিয়ে দেখলেই হল খোলা চোখে।

 

69
Wed, 03/06/2024 - 11:53

ধর্ম রচনা করা যায় না। ধর্ম রচিত হয়। মানুষকে বেঁধে রাখার জন্য ধর্ম লাগে না। মানুষ বোধের স্বচ্ছতায় এসে পৌঁছালে নিজে থেকেই সবার সঙ্গে ধরা পড়ে। একসূত্রে। তাই কোনো আলোকিত, উদারচেতা মানুষ হিংসার কথা বলেননি আজ অবধি, এবং এও সত্য, কোনো বাণী, বা কোনো পবিত্র বই, বা কোনো পবিত্র মানুষ নির্ভরও নয় ধর্ম। ধর্ম স্ব-প্রকাশ। স্বচ্ছ বোধের কাছে একমাত্র।

'স্বচ্ছতা' আর 'স্পষ্টতা'র মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। আমি কিভাবে একটা জাতকে ধ্বংস করে দেব প্রতিষ্ঠিত কোনো গোষ্ঠীবদ্ধ বিশ্বাসের জন্য, যাকে প্রচলিত ভাষায় ধর্ম বলে, সে বিষয়ে আমার স্পষ্ট ধারণা থাকতে পারে। কিন্তু তা আমার স্বচ্ছ চেতনার মাপকাঠি নয়। অথচ ইংরেজিতে দুটো শব্দেরই অর্থ, 'ক্ল্যারিটি'।

মানুষের মধ্যে সেই বড় আমি'টাই স্বচ্ছতা। তার ছোটো আমি'টা সমস্যা। ছোটো আমি যখন বড় আমি'কে কল্পনা করে, তখন সে ভাবে তার দশটা হাত, তার অমানুষিক শক্তি। সে তখন ‘বিগ ব্রাদার’ সিন্ড্রোমের শিকার। তার একজন বড়দা আছে। যাকে তুষ্ট করে চললেই জগত তুষ্ট হয়। তখন সেই ছোটো আমি যাতে সে নিজে তুষ্ট, তারই পরিমাণ বড় করে, তার কল্পনার বড় আমি'কে তুষ্ট করতে যায়। তাই তার সব কিছুই আড়ম্বরপূর্ণ। সরল, সহজ কিছু নেই।

কিন্তু যদি কোনোদিন, কোনো শুভপ্রেরণার বশে সে নিজের ক্ষুদ্রত্ব সেই বড় আমি'র পায়ে সমর্পণ করতে চায়, তখনই সে অনুভব করে স্বচ্ছতা কাকে বলে। অভয় কাকে বলে। ভালোবাসা কাকে বলে। কারণ সে সব দিক থেকে স্বার্থবুদ্ধিরহিত তখন। একি একেবারে সম্ভব? নয়, কিন্তু যতটা পারি, ততটাতেই আমার লাভ। “তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে” কান্নাও তাই সত্য সেখানে।

আজ ইতিহাস বিজ্ঞানের দরজায় এসে নিজেকে আরো প্রসারিত করেছে। আমি বিজ্ঞান অর্থে বিজ্ঞানই বলছি। যদি পদার্থ বিজ্ঞান অর্থে কেউ বলে যা দিয়ে পারমাণবিক বোম বানানো যায়, কিম্বা কম্পিউটার সায়েন্স মানে যা দিয়ে ডিপফেক বানানো যায়, সে বিজ্ঞান নয়।

ইতিহাসের অন্বেষণ বিজ্ঞানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মানুষ নিজের উৎস খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছে পৃথিবীতে সব মানুষই আদতে সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে আফ্রিকা থেকে বেরোনো মানুষেরই বংশধর। সবারই উৎস এক। তার ওয়াই ক্রোমোজম আর মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রোমোজম সেই সাক্ষ্যই বহন করছে।

কিন্তু এই জ্ঞান কি আমাদের হিংসা, দ্বেষ কমাতে বিন্দুমাত্র সাহায্য করেছে? আজও আমার জাত, আমার ধর্ম, আমার শিল্প-সাহিত্য তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার লড়াই চলছে। চলবেও। এর কারণ আমাদের মধ্যে সেই আদিকাল থেকেই একটা ছোটো আমি আছে। আগে লোহায় মরচে পড়ত না, আজকাল পড়ে বলা যেমন অজ্ঞতা, ঠিক তেমন আগে মানুষ সব সভ্য ছিল, আজকাল সব বর্বর হয়েছে বলাও ঠিক তেমন।

মানুষের ক্রোমোজমের মধ্যে নিহিত যে একত্বের সূত্র, তার থেকেও গভীরের সূত্র তাই মানুষের আত্মায় নিহিত একত্রের সূত্র। আত্মা অর্থে কোনো বস্তু না। আত্মা এই চিত্তের স্বচ্ছতা। তাই তাকে আগুন দহন করতে পারে না। অস্ত্র আঘাত করতে পারে না। জল সিক্ত করতে পারে না। কিন্তু লোভ-ক্রোধ তাকে ঢেকে ফেলতে পারে। বিদ্বেষের উন্মাদনা কালবৈশাখীর মেঘ যেমন নির্মল নীল আকাশকে ঢেকে দেয়, তেমন ঢেকে দিতে পারে।

এ স্বচ্ছতাতে উপনীত হতে গেলে কি সাধনা করতে হয়? প্রশ্নটাই ভুল। তাই এর সব উত্তরগুলোও ভুল। স্বচ্ছতাতে উপনীত হওয়া যায় না। নিজের মধ্যের মলিনতা গেলেই সে আপনি নিজেকে প্রকাশ করে। মরমী কবি বলেন চোখের জলে সে আসে। অবশ্যই সত্য। আজ যে যুদ্ধের পৈশাচিকলীলা দেখছি, তা দেখে যাদের চোখে জল আসার কথা আসছে না বলেই এ থামছে না। নইলে যুদ্ধ থামার কত তত্ত্ব, যুদ্ধ চলার কত কারণ পাতার পাতা লেখা হচ্ছে, বই ছাপা হচ্ছে, তার মার্কেটিং চলছে, পুরষ্কার দেওয়া নেওয়া চলছে। কত শক্তিশালী ছোটো আমি'র বোধ ভারতের মাটিতেই বিয়ের বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে উল্লাসে মাতছে, যেখানে কয়েক কিলোমিটার দূরে শিশুর রক্তে ভিজে আছে মাটি। হা ঈশ্বর! এতটাই নির্লজ্জ আমরা। আর আমাদের শিক্ষা-সভ্যতার গর্ব।

বড় আমি'তে থিতু হওয়া মানে সমাধিতে যাওয়া না, অতীন্দ্রিয় অনুভবের মাদকতায় ডুবে যাওয়া নয়, নানা অলৌকিক দর্শন আর ক্ষমতার ভুলভুলাইয়ায় হারিয়ে যাওয়া নয়। বড় আমি'তে থিতু হওয়ার অর্থ অন্যের যন্ত্রণা নিজের যন্ত্রণায় অনুদিত হওয়া। তারপর তার প্রতিকারের জন্য সরব হওয়া। এটাই ধর্মের অন্তিম স্টেশান। আত্মলাভ। আত্মসাক্ষাৎকার। সেই স্বচ্ছতায় স্থিতিলাভ করা।

অ্যানার্কিজম একটা বড় কথা। যাকে অনেকভাবে ব্যবহার করা যায়। যার একটা বড় অর্থ, সমাজের এই নানা ভ্রষ্ট অথোরিটি থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস। সত্যজিৎ তার শেষ তিনটে সিনেমায় যা বলতে চেয়েছিলেন। ওই তিনটে সিনেমা আমার কাছে ততটা সিনেমা না যতটা এক দার্শনিক অন্বেষণ। গণশত্রুতে ধর্ম আর তাকে ঘিরে রাজনীতির অথোরিটি। শাখা প্রশাখাতে সমাজের বড় বড় মাথাদের অথোরিটি। আর সব চাইতে চূড়ান্ত তর্ক হল, আগন্তুক, যেখানে আধুনিক সমাজের এক কপট নিরীহতার মুখোশের অথোরিটির বিরোধ। যেখানে শেষ দৃশ্যে আদিবাসীদের কাছে ফিরে দাঁড়াচ্ছে আধুনিক সমাজ। নব্বই সালে একটা দার্শনিক তর্ককে ঘিরে সিনেমা হচ্ছে, হয় তো ভাবা যায় না!

ডেভিড গ্রেবিয়ার আর ডেভিড ওয়েংরোর আলোড়ন জাগানো লেখা, ‘দ্য ডন অব এভরিথিং’ যে অ্যানার্কিজম-এর কথা বলে, নোম চোমস্কি যে অ্যানার্কিজম এর কথা বলে, সে ধ্বংসলীলায় মেতে সব লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া না। বরং নিজের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে যা মিথ্যা, যা তথ্য আর পরিসংখ্যানের চাতুরী তার মুখোশ খুলে ফেলা। সত্যজিৎ রায় অনেকটা এই ধরণের ইঙ্গিতই দিচ্ছেন, কি হবে না দাদুভাই? কূপমণ্ডূক। যত এক্সপ্লয়েটিভ অথোরিটেটিভ অ্যাটিচিউড, তাই এক কূপমন্ডুকতাতেই জন্মায়। কারণ কুয়োর মধ্যে এক তামসি নিশ্চিন্ততা আছে, আশ্বাস আছে। কিন্তু স্বচ্ছতা নেই। স্পষ্টতা আছে। আবারও মনে করিয়ে দিই, দুটোর অর্থই ইংরাজিতে 'ক্ল্যারিটি'। অনেক সময়েই স্পষ্টতা দিয়ে স্বচ্ছতাকে ঢেকে দেওয়া হয়। যেমন বর্তমানের এক পণ্ডিত ব্যক্তি স্টিভেন পিঙ্কার স্ট্যাটেস্টিকস-এর স্পষ্টতা দিয়ে বর্তমান যুগকে সুখের স্বর্গ প্রমাণ করে, যাবতীয় বাকি যা কিছুকে ঢেকে দিয়েছেন।

আমাদের ওয়াই ক্রোমোজমে পিতৃপক্ষের একত্বের সূত্র থাক, আমাদের মাইটোকন্ড্রিয়ায় মাতৃপক্ষের একত্বের সূত্র থাক, কিন্তু বোধের স্বচ্ছতায় না এলে সব অর্থহীন।

আফ্রিকাগত সেই মানবগোষ্ঠীর এক অংশ এই ভারতের মাটিতে একদিন অনুভব করেছিলেন এই সত্যকে। বলেছিলেন,

 

অয়ং নিজঃ পর বেত্তি গননা লঘুচেতসাম।

উদারচরিতাং তু বসুধৈব কুটুম্বকম।।

 

ক্ষুদ্রচিত্তের কাছে 'আমি' আর 'তুমি'র ভেদ। কিন্তু উদার চিত্তের কাছে গোটা বিশ্বই এক আত্মীয়তার সুতোয় বাঁধা।

এর পরের শ্লোকের উপদেশ, সব সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্মের মধ্যে পরম স্বাধীনতায় থিতু হও।

ব্রহ্ম অবশ্যই কোনো অতীন্দ্রিয় শব্দ নয় এখানে, একটা বোধের নির্দেশ, যা নিজেকে সঙ্কীর্ণতা থেকে মুক্ত করলেই পাওয়া যায়।

 

(ছবি: আন্তর্জালতন্ত্র)

 

70
Thu, 02/29/2024 - 11:43

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে কঠিন সময় এখন। কোনদিকে যাবে, কার দিকে ভরসায় তাকাবে, এ ভেবে আকুল, বিশেষত ভদ্রকূল।

সবাই জানেন, বঙ্গে ‘ভদ্রলোক’ বলে এক বিশেষ শ্রেণী আছে। বাঙলার তথা বিশ্বের যাবতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসাবে যাদের এককালে খ্যাতি ছিল। এখন খ্যাতি হারিয়েছে, যে যা খুশী এসে বলে যাচ্ছে বাইরে থেকে। মায় ঘরে ঢুকে বলে যাচ্ছে। ভদ্রশ্রেণী প্রতিবাদ করছে। কিন্তু আওয়াজ পাশের পাড়া অবধি পৌঁছাচ্ছে না।

তো কথাটা হল, ভীষণ সংকটের সময়ে দাঁড়িয়ে বঙ্গ। বঙ্গে রাজনীতিতে একটা বড় মুদ্দা হল, সংস্কৃতি। আমাদের সংস্কৃতি কি ওরা বোঝে? ইত্যাদি। বেকারত্ব নয়, দুর্নীতি নয়, স্বাস্থ্য নয়। যতবারই ভোট আসে ততবার এই একটা জিনিস নিয়েই বাঙালি গেল গেল রব তোলে, সেটা হল তার সংস্কৃতির গর্ব। সে যতই এখন 'জলসাঘর’ সিনেমার ছবি বিশ্বাসের মত অবস্থায় পড়ুক না কেন, তবু গর্ব আছে। আমাদের সত্যি অর্থে এখন সংস্কৃতি সে অর্থে নেই, কিন্তু তার জীবাশ্মটা আছে। আর মাঝে মাঝে সেই জীবাশ্মে আমাদের বাৎসরিক দীপ-ধুপ দেখানোর রেওয়াজও আছে।

এখন বাঙালি সমাজে অনেক আয়রনির মধ্যে দুটো আয়রনি ভীষণ প্রবল।

এক, বাঙালি দুর্গা অন্ত প্রাণ। তাই দেখা যায় অবাঙালি যত সিনেমা-সিরিয়ালে বাঙালিদের দেখায় বাড়িতে দুর্গাপ্রতিমা, পাড়ায় পাড়ায় দুর্গামন্দির ইত্যাদি।

আরেকটা হল, বাঙালির রাজনীতি অবসেসান। কথাটা হল আমাদের মধ্যে রাজনীতি বিশেষজ্ঞ যে মাত্রায় আছে, সে মাত্রায় সক্রিয় রাজনীতির লোক কোথায়?

বাংলায় অনেক বদল এসে গেছে। সমাজে। একদিন বাংলায় রাজনীতে বাম আদর্শে বহু শিক্ষিত ছেলেমেয়ে এসেছিল। বাঙালির একটা নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় তৈরি হয়েছিল। তার ছাপ সঙ্গীতে, সিনেমায়, সাহিত্যে পড়েছিল। তাই হয়। কোনো সামাজিক পরিবর্তনই একমাত্রিক হয় না। ভালো-মন্দ দু'দিকেই তার প্রভাব পড়ে। পড়েওছিল তাই।

ক্রমে দিন বদলালো। সে আদর্শের উপর তরুণ তরুণীর আস্থা বা রোম্যান্টিসিজম আগের মত আর থাকল না। কেন থাকল না তার জন্য একটা বিশদ আলোচনা হতে পারে। অনেক অনেক ফ্যাক্টর কাজ করল। কিন্তু যে পরিবর্তনই হোক না কেন, শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকের ছেলেমেয়ে আর আগের মত সক্রিয় রাজনীতিতে এলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডীর মধ্যে অনেক কিছু হল, কিন্তু সে আর পরিণত রাজনীতিতে এলো না। আমাদের মানসিকতা তখন ঝুটঝামেলা এড়িয়ে, একটা নিশ্চিত জীবনে বাস করার উপর। বছরে দু' কি একবার বেড়াতে যাওয়া, মাঝারি মাপের নার্সিংহোমে চিকিৎসা করাবার মত আর্থিক সঙ্গতি, আর কিছু বাৎসরিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, যেমন রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা, দুর্গাপুজো, কালীপুজো ইত্যাদি।

ক্রমে আইটিমুখী তরুণ প্রজন্ম হল। আরো সহজ হল মধ্যবিত্তীয় জীবনধারাকে কায়েম রাখা। যেহেতু আরো সহজ হল, আরো তথাকথিত গ্লোবাল মার্কেটে যাতায়াত হল, তত ‘সংস্কৃতির’ উপর টান কমল। রইল কিছু মধ্যবিত্তীয় বিলাস, শখ। কিন্তু এর মধ্যে রাজনীতি নিয়ে তর্কাতর্কি বন্ধ হল না। সে চলতেই থাকল। যদিও তরুণ প্রজন্মের এক বৃহৎ অংশ এই ব্যাপারে উদাসীন।

এখন সমস্যা হল আমি রাজনীতি নিয়ে উদাসীন হলে কি হবে? রাজনীতি তো আমাকে নিয়েই। আমি ডিঙিই চালাই, কি বিলাসবহুল বজরা, নদীর স্রোতের গতি আমাকে প্রভাবিত তো করেই। সেটার উপর উদাসীন থেকে আমি নিজেকে কিভাবে সুরক্ষিত রাখতে পারি?

এখন সারা বিশ্বে এক দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান হচ্ছে। কেন হচ্ছে, তার ব্যাখ্যাও এক-এক দেশে এক-এক রকম। যে কারণে মার্কিন মুলুকে দ্বন্দ্বটা বাইডেন বনাম ট্রাম্প হয়ে এসেছে। সে অবস্থাও খুব আশাপ্রদ নয় তাদের সমাজেও।

এখন ভারতের এক-এক রাজ্যে রাজনীতির রসায়ন এক-এক সমীকরণে চলে। বঙ্গে দীর্ঘদিন বামপন্থী রাজনীতি একটা কাঠামো তৈরি করেছে। তারপর তৃণমূল এসেছে। যতটা নতুনের আগমনের সমাজ উৎফুল্ল হয়েছিল, তার থেকে বেশি আমোদিত হয়েছিল পরিবর্তনে। কিন্তু যে সময়ে এই পটভূমিকা বদলাচ্ছে তার কয়েক দশক আগে থেকেই শিক্ষিত তরুণ প্রজন্ম সক্রিয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। কোনো আদর্শগত ভাবধারা দিয়ে বাঙালি সমাজ তখন পুষ্ট নয়। সবটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে।

এমন সময় কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য সরকারের সংঘাত। যা কোনো সাংগঠনিক ইস্যু নিয়ে নয়। সবটাই দুর্নীতি নিয়ে। করাপশন নিয়ে।

এইখানে বাংলার সমাজের সঙ্গে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় ভাবধারার একটা বড় অমিল। বাঙলায় ধর্মের ব্যাপারটা অন্য ধারার। বেশ কয়েক বছর ধরে হিন্দিভাষী তরুণদের মধ্যে একটা বড়সড় পরিবর্তন এসেছে। তারা পোশাকে, আচার-আচরণে, সাজে অনেক বেশি হিন্দু সেন্টিমেন্টের কাছাকাছি আসছে। যেমন তারা পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে রিল বানাচ্ছে, মন্দিরে বেশি বেশি যাচ্ছে, মিডিয়াখ্যাত নানা সাধু, বাবাজী, গুরুদের আশীর্বাদ নিচ্ছে, নানা বিষয়ে নিজের অধ্যাত্ম বিশ্বাস, চিন্তাকে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করছে। হয় তো একেই প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ভারতীয় তরুণ প্রজন্ম হীনমন্যতা ছেড়ে আত্মবিশ্বাসী হচ্ছে।

কিন্তু এই কাজটার সঙ্গে বাঙালির ভাবনার পার্থক্য আছে। এক, বাঙালির দেশাত্মবোধ আর হিন্দুত্ব সেন্টিমেন্টের বোধ এক সমীকরণে বসে না। বাঙালির দেশাত্মবোধে রবীন্দ্রনাথ, নেতাজী, চিত্তরঞ্জন প্রমুখের উপস্থিতির জন্য তার সেণ্টিমেন্টটা অনেকটা সেক্যুলার। দেশকে মা বললেও, তাকে চণ্ডীর আদ্যাশক্তির সঙ্গে এক করে দেখে না।

দ্বিতীয়, বাঙালির ধর্মবোধ কোনো কেন্দ্রীয় গ্রন্থে গ্রথিত নয়। যেটা হিন্দীভাষীদের ক্ষেত্রে রামচরিতমানস। তার দোঁহা সে দিকে ভীষণ জনপ্রিয়। লোকের মুখে মুখে জীবন্ত। আমি ধর্ম বলতে সেন্সাস বলছি না, সক্রিয় ধর্মের অনুষ্ঠান বলছি। বাঙালি সেখানে কোনো কেন্দ্রীয় গ্রন্থের অনুশাসনে নেই। নানা গুরুতে বন্টিত সমাজ। রামকৃষ্ণ, অনুকূল ঠাকুর, লোকনাথবাবা, হরিচাঁদ, চৈতন্যদেব প্রমুখদের নানা গোষ্ঠী আছে। এবং কথামৃত আর চৈতন্যচরিতামৃত বাদ দিয়ে সে অর্থে তেমন কোনো গ্রন্থও বাঙালি সমাজকে প্রতিষ্ঠিত ধর্মের দিক দিয়ে প্রভাবিত করেনি।

আরেকটা কথা হল, হিন্দিভাষী সমাজের অধ্যাত্মিক তৃষ্ণা যেমন তুলসীদাস মিটিয়ে চলেছেন, বাঙালি সমাজের সে তৃষ্ণা তেমন মিটিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। তার গান দিয়ে। কিন্তু সে তো কোনো প্রতিষ্ঠিত ধর্মমত না যা দিয়ে লোককে বাঁধা যাবে।

শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজকে তাই রাজনীতির কোনোদিকই আজ আর আকর্ষণ করে না। না, বাম আদর্শ। না তুলসীদাসের ধর্মীয় আবেগ। এই শূন্যস্থানকে কতদিন আর রঙ্গমঞ্চ থেকে বিনোদনমঞ্চের কলাকুশলীদের দিয়ে কাজ চালানো চলবে? বাঙালির স্বপ্ন এখন আগের মধ্যবিত্তীয়তা থেকে যেভাবে ঊর্ধ্বগামী, যেখানে এসি থেকে, গাড়ি, আইফোন তার হাতের নাগালে সেখানে আচমকা ‘সর্বহারা’ ইত্যাদি, সম্পদের সমবণ্টন ইত্যাদি বড় কানে শোনায়। ধর্মের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, বিশেষত হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলে সহজে পার পাওয়াও দিনে দিনে কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে?

তবে একটাই রাস্তা পড়ে থাকল, সংঘাত। ভায়োলেন্স। আদর্শ না। শিক্ষিত মানুষের ইস্যু বা মুদ্দাকেন্দ্রিক সাংগঠনিক তর্কবিতর্ক নয়। জোর যার মুলুক তার। ভায়োলেন্স সব সময়েই মিথ্যা থেকেই জন্মায়। মিথ্যা থেকে ভয়। ভয় থেকে ভায়োলেন্স। এই আদি পথ। তাই সবাই আজকাল জোর গলায় বলে, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে যা ভায়োলেন্স হয়, তা দেশের আর কোথাও হয় না।

কথাটা সত্যি। কিন্তু এটা লক্ষণ। কারণ আমরা। আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের সাবধানী করে বিদেশে পাঠাচ্ছি, দক্ষিণভারত, পশ্চিমভারত পাঠাচ্ছি। জানি সেখানে সব “সিকিওর”। এখানে কি আছে? বলে হাপিত্যেশ করছি। কিন্তু তার দায় যে আমাদেরও, সেটা কি ভেবেছি? এখন আমরা তুলসীদাসের ভাবাবেগকে আপন করব, না বর্তমান সরকারকে আধাবিশ্বাসে মেনে নেব, না আর কোনো বিকল্প ভাবব? চণ্ডীমণ্ডপে বসে রাজনৈতিক তরজাতেই শিক্ষিত তরুণ সমাজ থাকবে, না কি সংসদে প্রবেশের লড়াইয়ে নামবে? বড্ড দেরি হয়ে গেছে না?

 

71
Sun, 02/25/2024 - 23:42

"একটাও বৃক্ষকে উৎপাটিত না করে, অরণ্যকে ধ্বংস করে ফেল। অরণ্য হতেই ভয়ের উৎপত্তি হয়"। ~ বুদ্ধ

শূন্যস্থান বলে কিছু কি রাখা যায়? যায় না। বাড়ি দীর্ঘদিন ফাঁকা রেখে গেলে ঝুল, পোকামাকড়ে ভরে থাকে। তেমনই আমাদের মন-বুদ্ধি। যেটা ধরো স্পষ্ট করে বুঝল না, অমনি সেই ফাঁকা জায়গাটাকে কল্পনায় ভরে নেবে। তার জন্য যে একটা সচেতন চেষ্টা করতে হবে তা নয়। নিজের অজান্তেই করে নেবে। আমি নিজেও স্পষ্ট করে বুঝব না কতটা আমার সত্যিকারের জ্ঞান আর কতটা কল্পনা। কল্পনা বলো, অনুমান বলো, সবই এক।

এখন দেখো, এই কাজটা তো আমাদের স্বভাবসিদ্ধ কাজ। এমন তো নয় কোনো বিশেষ রাজার আদেশে, কিম্বা কোনো সরকারের নির্দেশে, কিম্বা বিশেষ কোনো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য আমাদের এমনটা হয়। এ আমাদের জন্মলব্ধ ব্যাপার। তাই সেই আদিকাল থেকে আমরা যেটাই স্পষ্ট জানতাম না, স্পষ্ট বুঝতাম, অথচ আমাদের সেই ক্ষেত্রে একটা জানার, বা বোঝার তাগিদ এসেছে, আমরা কি করতাম, ফস করে কল্পনা করে নিতাম। এক্কেবারে সত্যিকারের মত করেই।

দিন যত এগোতে লাগল, মানে এই আমাদের পৃথিবীতে থাকার দিন আর কি, সেটা যত এগোতে লাগল, আমাদের দেখা-শোনা বাড়তে লাগল, সেই সাথে আমরা “ভাষা” বলে একটা বেশ লেখা-বলার ব্যাপার দাঁড় করিয়ে ফেললাম, হিসাবনিকাশ করতে শিখলাম, তত আমাদের জ্ঞানের জমি বাড়তে লাগল। আর কল্পনার জমি কমতে লাগল। শুরুতে শুরুতে পৃথিবীর কয়েকটা জায়গায় অবশ্যি এই নিয়ে বেশ মারামারিও হয়েছিল। মানে কল্পনার লোকেরা নিজেদের কল্পনাটাকে এমন সাধারণ সত্য মানতে শুরু করেছিল যে তার বিরুদ্ধে যেই না সত্যজ্ঞানের লোকেরা কিছু বলতে গেল, ব্যস, অমনি হাঁইহাঁই করে তেড়ে গেল। একে তাকে মেরে, কারাগারে বন্দী করে কি সব ছ্যা ছ্যা কাণ্ড করে বসল। গ্যালিলিও, ব্রুনো এদের নাম আছে না?

আমি একটা কথা ফস করে লিখে ফেললাম দেখলে, ‘সাধারণ সত্য।’ কিরকম বলো তো, এই যেমন ধরো আমার বর্ণান্ধতা আছে। আমি একটা বিশেষ রঙ দেখতে পারছি না। সে রঙটাকে বলছি, নেই তো! কথাটা মিথ্যে নয়। রঙটা সত্যি সত্যিই আমার কাছে নেই। সেটা আমার ব্যক্তিগত সত্য। কিন্তু সাধারণ সত্য তো নয়! মানে সবার সত্য তো নয়। এই যেমন যদি বলি বাংলা ভাষাটাই সব চাইতে মিষ্টি ভাষা। কথাটা সত্য। কিন্তু সে আমার কানের জন্য, প্রাণের জন্য সত্য। সাধারণ সত্য তো নয়। তেমন আমি যদি বলি, এই ধরো, কৃষ্ণই হল একমাত্র ভগবান, কি আল্লাহ হল একমাত্র, বাকি সব মিথ্যা, সে-ও হল তেমন নিজের নিজের জন্য সত্য, কিন্তু তাকে সাধারণ সত্য বানাতে গেলেই ভুল হবে। বড্ড ভুল। ওই রামকৃষ্ণদেব বলছেন না, “সবাই ভাবে আমার ঘড়িটাই ঠিক চলছে। বাকি সবারটা ভুল।” কি দামী কথা ভাবো। আবার বলছেন, “সবাই নিজের নিজের মতটাকেই বড় করে বলেছে।” এও কী খাঁটি ঠিক কথা।

এই আমি আবার কোথায় চলে এলাম। দাঁড়াও আবার শুরুর কথাটায় যাই। তো যেটা বলছিলাম। আমাদের দেখা-শোনা, ভাষা নির্ভর যুক্তিবুদ্ধি-অঙ্কেটঙ্কে যত মাথা খুলতে লাগল, তত আমাদের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের ঠাঁই ঠাঁই লাগতে লাগল। তো এমন সময় একজন মানুষ জন্মালেন না? সক্রেটিস। কি পদবী ছিল মনে নেই। ঘোষ, কি মুখুজ্যে, কি বারুই, পাল তো হবে না। কিছু একটা ওদের দেশের হবে। তো, সেই মানুষটা বলল, এই দেশে আমিই একমাত্র জ্ঞানী। কারণ, এক আমিই জানি যে আমি কিছুই জানি না।

এইখানে আবার এই সক্রেটিসের সঙ্গে আমাদের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের খুব মিল। দুজনেই একই কথা বল তো। আসলে আমাদের অহমিকা যখন বলে আমি এটা, কি সেটা জানি না, তার সঙ্গে একটা দু:খ থাকে। ইস, ও জানে, বিশ্বশুদ্ধ লোক জানে, আর আমি জানি না! কিন্তু আমাদের প্রজ্ঞা যখন নিজের সীমানাকে জেনে বলে, আমি কিছুই জানি না, তার মধ্যে দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ কিছুই থাকে না। সে কথা সে আনন্দের সঙ্গেই বলে। কারণ ওটাই সত্যজ্ঞান।

তো সক্রেটিস আমাদের এই এক ছটাক সত্যজ্ঞানের সঙ্গে কয়েক বালতি কল্পনা-অনুমান মেশানো কেসটা বুঝতে পেরেছিল। তাই যখনই সক্রেটিস প্রশ্নবাণে সামনের “আমি সব জানি” মার্কা লোকগুলো কোনঠাসা করে দিত, তারা পালাবার পথ পেত না। সক্রেটিস আমাদের কল্পনা-অনুমানকে প্রশ্নের ফুঁ দিয়ে দিয়ে এমন জ্বাল দিত যে অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যেত একটা ভুল তথ্যের উপর কল্পনার মেঘ জমিয়ে সে বাঁচছিল।

তো ভ্রমটা তবে কী? কল্পনা, আর অনুমান কি ভ্রম তবে?

না। ভ্রম হল কল্পনা-অনুমানকে সত্যজ্ঞান হিসাবে জানার অবস্থা। সে অবস্থাটা বাইরে থেকে যতটা সরল মনে হয়, আদৌ তো তা নয়। আমাদের কত ধ্রুবজ্ঞান যে এই সংকরে তৈরি তা কেউ-ই জানি না আমরা।

দেখো, কল্পনা-অনুমানের একটা সুবিধা হল সে আমার ইচ্ছার পরোয়া করে। কিন্তু বাস্তব সেটা করে না। বাস্তব মানে সাধারণ সত্য। এখন বর্তমানে আমাদের এই স্বভাবের দোষটা নিয়ে ভীষণভাবে ছেলেখেলা করছে মিডিয়া। আমি নিন্দা করতে চাইছি না। কিন্তু তাদের অনেকেই ভয়েই হোক, কি আর কোনো স্বার্থের জন্যেই আমাদের আধপাকা গল্প, অর্ধসত্য গিলিয়ে যাচ্ছে। আমি নিন্দা করছি না, কিন্তু একটা চালাকি তো ওরা করছেই না! সব মানুষেরই দুর্বলতা থাকে নিজেকে ক্ষমতাবান ভাবার। আমি যা জানি সঠিকটা জানি, সত্য আমার দিকেই, এরকম একটা ভাব থাকা মানে তো একটা ক্ষমতার কথাই হচ্ছে নাকি! নলেজ ইজ পাওয়ার। কথাতেই তো আছে না? তো এরা সবাই মিলে এমন একটা গল্প আমাদের বোঝাতে চাইছে, যে আমরা স্পষ্ট করে বুঝতেই পারছি না।

এখানে একটা খেলা অবশ্য আছে। যখনই দেখবে কেউ তোমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করছে, মানে তুমি যাই প্রশ্ন করো, সে শুধু তোমাকে যে করেই প্রত্যয় জাগানোর চেষ্টা করছে, তখনই বুঝবে কোথাও কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। কারণ একটাই, জগতে শতকরা একশোভাগ কনভিন্সড হওয়ার মত ব্যাপার প্রায় কিছুই নেই। স্কেপটিক না হলে সত্যের ধারেকাছেও যাওয়া যায় না। অনেক স্পষ্ট কথার মধ্যে অস্পষ্ট সত্যের একটা আভাস থাকে, সেই আভাস নিয়েই আমাদের চলতে হয়। অন্তত আশু আর কোনো উপায় আমরা জানি না। অনেক জ্ঞানী মানুষ এই জন্যে গোটা জগতকে ছলনার জাল ইত্যাদি বলেছেন। কিন্তু যো হ্যায় সো হ্যায়। এই নিয়ে কান্নাকাটি করে কি হবে?

আর একটা কথা বলেই থামি। ভ্রম দাদা অনেক আছে। জগত জোড়াই ভ্রমের কারাখানা। কিন্তু ভ্রম আপনি জন্মানো, আর ভ্রমকে বেশ কায়দা করে জন্ম দেওয়ানোর মধ্যে যোজন যোজন ফারাক। বাঁচার উপায় কি? সক্রেটিস। প্রশ্ন করতে শেখা। সব উত্তরকে প্রশ্ন করতে শেখা। সব ধ্রুবকে প্রশ্ন করতে শেখা। সব নিশ্চিতকে প্রশ্ন করতে শেখা।

এত কথা বললাম, কারণ মিডিয়ার বাজার এখন গরম। যত ভোটের দিন এগোবে আরো গরম হবে। এখন তো আবার ইউটিউব খুললে অনেক স্বনির্ভর, স্বাধীন মিডিয়াও আসছে। ভালোই কাজ করছে তারা অনেকেই। বেশ অল্প বয়েসী ছেলেমেয়েরাই করছে। তো এই সময় আমাদের প্রশ্ন করার অভ্যাসটাকে আবার করে ঝালিয়ে নিতে হবে। কোনটা স্বয়ম্ভু ভ্রম আর কোনটা বাজারি ভ্রম, সেটা বুঝে নিতে হবে।

 

72
Tue, 02/20/2024 - 23:21

রাস্তাটা কালকেই ঝাঁট দিয়েছে। আজ আর এদিকে আসিস না। যা যা ওদিক দিয়ে হাঁট।

কথাটা বলতে বলতে মিনি হাঁটছে। মিনি এ পাড়া, সে পাড়া দিয়ে যেতে যেতে সব ক'টা কুকুরকে বলে, যা যা, ঘরে যা। ঘুরিস না এদিক ওদিক।

মিনি জানে সব কুকুরের নিজস্ব ঘর আছে। ঘর নেই শুধু তার। তার প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানেও অনেক কুকুর। তাদেরও মিনি বাড়ি যেতে বলে। নইলে লাইনে কাটা পড়বে। যেমন পড়েছে অনেকে। লাইনে কাটা পড়লে মিনির অসহ্য লাগে। কারণ ডাকলে আর সাড়া দেয় না।

কেউ সাড়া না দিলে মিনির অসহ্য লাগে। তার বাবাকে দেখেনি। মাকে অনেক ডেকেও যখন সাড়া পায়নি, যখন ভোরের প্রথম কল্যাণী লোকালটা খবরের কাগজের ডাঁই নিয়ে এসে দাঁড়ালো, যখন মিনির দিকে না তাকিয়ে ট্রেনটা চলেও গেল, মিনির অসহ্য লেগেছিল। মাকে অনেক বেলায় অনেকে নিয়ে গেল সামনের হাসপাতালে। ডাক্তার বলল, পুড়িয়ে দিতে। ওরা নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে দিল। মিনিকে কেউ কেউ মিষ্টি খেতে টাকা দিল। মিনি কয়েকদিন মিষ্টির দোকানে কচুরি আর মিষ্টি খেয়েছে পর পর। বমি করেছে। পায়খানা করেছে। তারপর টাকা ফুরিয়েছে। মা ফুরিয়েছে। কদিনের খিদের সুখ ফুরিয়েছে।

মিনি কুকুরদের বাড়ি যেতে বলে, একটু আগেই বললাম না, কারণ মিনি একমাত্র কুকুরদের ভাষা বোঝে। এটা যদিও আলাদা করে বলিনি, তবু এটা ঠিক যে বিচক্ষণ পাঠক এতক্ষণে বুঝে গেছেন, মিনি পাগল। আর মিনি কুকুরের ভাষা বোঝে।

আমিও একটা সময় অনেকের মত বিশ্বাস করতাম, আমি কুকুর মানে কি জানি, পাগল মানে কি জানি, ভিখারি মানে কি জানি। আমি নিজেকে সুস্থ, দায়িত্বশীল, কর্তব্যপরায়ণ মানুষ হিসাবে বিশ্বাস করতাম। নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করতাম।

এর মধ্যে অনেক কিছু বদলে যেতে লাগল। খবরের কাগজে মানুষের গল্প বেরোয় বেশি। আমি প্রতিদিন বদলে যাওয়া মানুষের পৃথিবীর ছবি দেখছি। কিভাবে নিজের ভাইবোনের গলা কাটছে মানুষ। অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র কি নিপুণ দক্ষতায় হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছে। আমি প্ল্যাটফর্মে বসে বসে খবরের কাগজ পড়ি, আর মিনির দিকে তাকাই। দেখি মিনি সবক'টা কুকুরকে সাবধান করছে। পাগল কে?

আবার আমি আমার দিকে তাকাই। আমার সূক্ষ্ম, তীক্ষ্ম বুদ্ধির দিকে তাকাই। (আত্মস্তুতি গাইছি না নিজের বুদ্ধি নিয়ে। অন্তত যা আমাদের বিশ্বাস করানো হয় নানা অঙ্কের মার্কশিট দিয়ে তাই বলছি। সে অর্থে তো আমি বুদ্ধিমান)। কিন্তু সে বুদ্ধির গোড়া খুঁজতে গিয়ে হতাশ হই। কিছু মুখস্থ শব্দ, সংখ্যা আর স্বার্থ চরিতার্থ করার ছল ছাড়া তার কোনো উপজীব্য নেই। আমি হতাশ হয়ে মিনির দিকে তাকাই। এক পাতাঝরা বসন্তের বিকেলের উপলব্ধি নিয়ে তাকাই। আমি জানি এ হত্যালীলা স্তব্ধ করা, বুদ্ধির অগম্য। কারণ উন্মত্ত জলরাশিকে থামাতে আরেকটা উন্মত্ত জলরাশি লাগে না, লাগে বাঁধ। বন্যার প্লাবনকে ঠেকায় বাঁধ।

সে বাঁধ কই? যে বাঁধ রাস্তায় নেমে আসবে রাজ সিংহাসন ছেড়ে, অঙ্গুরিমালকে বলবে, থামো। যে বাঁধ বলবে, ওরা কি করছে ওরা জানে না। যে বাঁধ মানুষের কল্যাণের রাস্তা খুঁড়তে খুঁড়তে হাতে হেমলক নিয়ে দাঁড়ায়। যে বাঁধ পাত্রের আঘাতে ঝরা মাথার রক্ত মুছে বলবে, তবু ঘৃণা থামা। যে বাঁধ নোয়াখালির রাস্তায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলে, শান্ত হও, যে অনশনে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে, কুঁকড়ে যাওয়া শরীরকে বলে, আরেকটু, ওরা শান্ত হবে, আমার বিশ্বাস মানুষের বিবেকের কাছে, আছে।

আমাদের বাঁধ নেই। আমাদের পরিসংখ্যান আছে। প্রমাণ আছে। আর সেই অনুপানে বাঁচা সভ্য সমাজের দুলালি বুদ্ধি আছে। তার সব আছে। শুধু পাগলামিটুকু নেই। যে পাগলামিতে আরেক পাগলামিকে থামানো যায়। বাঁধের মত।

আসলে বিশ্বজোড়া শপিংমল বানিয়েছি। বিজ্ঞানের এক এক পরতের আবিষ্কার, শপিংমলের এক এক তলা তৈরি করছে। মায়ের উঠানের মত, মায়ের রান্নাঘরের মত, মায়ের শোওয়ার ঘর, বসার ঘরের মত পৃথিবীটা ভাবতে পারিনি তো। ওকি আমাদের এই মার্কশিটে বাঁচা, সার্টিফিকেটে বাঁচা বুদ্ধির কম্ম?

বরফে হাত রাখলে যেমন বুঝি ঠাণ্ডা, গরম ভাতের মধ্যে হাত ডোবালে যেমন বুঝি গরম, তেমন যুক্তিবুদ্ধি ছাড়াই বুঝি কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। বোঝাতে না পারলেও বুঝি। যেমন দুদিনের খিদের কষ্ট ভাষার অগম্য, তেমনই।

কিন্তু সে পাগল কই? যে মিনির মত রাস্তার কুকুরদের হাতে করে পার করিয়ে দেবে রাস্তা? নিজের আধপেটা খাবারকে ভাগ করে নেবে ওদের সঙ্গে?

তবে কি আমি প্রতিবাদ করছি না? তবে কি কেউ সেই যুদ্ধের, হিংসার পরিসংখ্যান রাখছে না? সব হচ্ছে।

এতটা এসে পাঠক নিশ্চয় আমার মত নিশ্চিত হয়ে গেছেন। তবে তো যে সব মানুষদের কম্ম সে আমি নই।

কিন্তু ভাবো, আগামীকাল কি বার? একুশে ফেবরুয়ারি। কারা ছিল তারা? কোন দৈবী ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ? সাধারণ তোমার আমার মত তারা। কিন্তু তারা বাঁধ হতে পেরেছিল। বুদ্ধির পরিসংখ্যান আর শব্দের হাজার সতর্ক বার্তা উপেক্ষা করেছিল তো তারা? যে ভাষাটাকে প্রতিদিন অপদস্থ করছি তার জন্যেই তো?

যে ধর্ষক ভুলে যায় যে, ধর্ষক হয়ে জন্ম নিতে গেলেও ওই একই রাস্তা দিয়েই আসতে হয়, যেখানে রড থেকে শুরু করে না জানি আর কি কি ঢোকাবার সাধ হয় তার, সে ধর্ষককে আমি তত ভয় পাই না, যে ভয় পাই আমি পরিসংখ্যান আর শব্দের উজ্জ্বলতায় যারা সভ্য সমাজকে বলে, ভুলে যাও, অন্যদিকে তাকাও। তাকে দেখলে আমার হাড় হিম হয়ে আসে ভয়ে।

ভয় হয় এই বিশাল জনতাকে পরিসংখ্যান আর শব্দ দিয়ে ভুলিয়ে দেওয়া যায়, এই জন্যে। ভরসা এই যে, এই বিশাল জনতা জেগে উঠলে পরিসংখ্যান আর শব্দের সামন্ততন্ত্র ছেড়ে ফোঁস করে জেগে ওঠে বলে। তখন সে বোঝে হৃদয় একটা অনুভব। অনুভব একটা বিশ্বাস। বিশ্বাস একটা প্রেরণা। যে প্রেরণায় বাঁধ হওয়া যায়। উন্মত্ত বন্যাকে ঠেকাতে আরেকটা বন্যা হতে হয় না, বাঁধ হতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এই কথাটাই আবার জানিয়ে গিয়েছিল, সেই ভাষাটার জন্য, যে ভাষাতে মিনি সব কুকুরকে সাবধান করে, আর যে ভাষাকে অপদস্থ করছি প্রতিদিন আমরা, লোভের সামন্তবাদকে যুক্তি আর পরিসংখ্যানের বরমাল্য পরিয়ে।

 

(ছবিটা সদ্য Netflix এ আসা আইনস্টাইন সিনেমার শুরুর দৃশ্য। আইনস্টাইনের ঘরের টেবিল। সিনেমাটা গোটা দেখা হয়নি, তাই জানি না কেমন হয়েছে আগেভাগেই বলে রাখলাম।)

 

73
Mon, 02/19/2024 - 11:12

অবশেষে কী চায় মানুষ? অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে, অনেক ঝড়জল, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসে কী চায়? যদি তাকে তার ভাগ্য মানসিকভাবে সুস্থ রাখে শেষদিন অবধি, তবে সে কী চায়? মুক্তি? স্বর্গ?

সব ডাঁহা মিথ্যা কথা। চায় ছুটি। যে ছুটি মানে শান্তি। মানে আনন্দ। সে শান্তি মানে কি স্বর্গীয়, অধ্যাত্মিক শান্তি? সেও ডাঁহা মিথ্যা কথা। যদ্দিন মনে নানা আশা থাকে, যদ্দিন মনে রঙবেরঙের স্বপ্নের ফুলঝুরি ফোটে তদ্দিন ওসব অধ্যাত্মিক শান্তি, পুজোপাঠ, তীর্থ, জপতপ, প্রার্থনা, শুচি-অশুচি, আমি শুদ্ধ, তুমি অশুদ্ধ, আমি ঠিক, তুমি ভুল - ইত্যাদি ইত্যাদি করে দিন কাটায়। ওসবই ফক্কাবাজি। মনে হয় কিছু একটা হচ্ছে। আসলে কিচ্ছুটি হচ্ছে না।

কেমন জানো? মানে যেন সে একটা বড় মেলায় এসেছে। সেখানে নানা ধরণের খেলা। আমোদ। যার যেমন রুচি সে তেমন নাগরদোলায় চড়ে বসেছে। এটা ওটা চেখে দেখছে। একবার ভালো লাগছে, একবার ভালো লাগছে না। তিতা-মিঠা, মান-অপমান, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ সব এই মেলার গণ্ডীর মধ্যে। ওই ধম্মকম্মো, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষাদীক্ষা, জগত উন্নয়ন, আত্মউন্নয়ন ইত্যাদি ইত্যাদি যা বলো না কেন, সব এই মেলার চৌহদ্দির মধ্যে।

তারপর? দেখোনি, একটা বাচ্চা, যে মেলায় এসে নানা খেলায় মেতেছিল, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনোদিন এই মেলা ছেড়ে সে যেতে চাইবে না, যেন এইখান থেকে গেলেই সে মারা যাবে, সেও একসময় সব নাগরদোলা থেকে নেমে কেঁদেকঁকিয়ে বলে, মায়ের কাছে যাব।

ওই, ওই, ওই হল অবশেষে যা চায় মানুষ। মুক্তি নয়, স্বর্গ নয়, চায় শুধু ফিরতে। কোথায়? যে ছবিটা সে বুকের সব চাইতে তলার কোঠরে নিজের অজান্তেই এদ্দিন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, সেথায়। তার ছোটোবেলার কাছে। তার মায়ের কাছে। তার যাবতীয় সুখের খনি সে ছোটোবেলা। যত পা ক্লান্ত হয়, যত সে পশ্চিমপ্রান্তের দিকে আসে, তত সে বোঝে তার বুকের সেই ভিত্তি কোঠরের মধ্যে তার প্রাণভোমরা গুনগুন গান শুরু করেছে। “ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে, কী সঙ্গীত ভেসে আসে”। সে লক্ষ-কোটি স্বপ্ন, বাসনাকামনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর বেলায় রোদ উঠে কেটে যাওয়া কুয়াশার মত ধীরে ধীরে সে সব ফিকে হতে শুরু করে। সে চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে নিজেকে, আমি কোথায়? কার কাছে ফিরব? আবার সে পিছনের দিকে তাকায়। নিজের শৈশবের দিকে তাকায়। সেই তার স্বর্গ, সেই তার মুক্তি, সেই তার আদর্শ।

কিন্তু সবার ভাগ্যে এ উপলব্ধি আসে না। ভাগ্য ভীষণ নিষ্ঠুর হয় অনেকের জীবনে। সে মেলায় ঢোকে বটে। কিন্তু সে মেলার গভীরে নানা মানুষের ব্যবহারে, শোষণে নিষ্পেষিত হতে হতে ক্রমে বোধ-বুদ্ধি হারিয়ে বসে। পাগল হয়। এমন মানুষ অনেক দেখলাম সংসার প্রান্তে দাঁড়িয়ে। তার হাত ধরে পার করে দেওয়ার কেউ নেই। ফ্যালফ্যাল চোখে, শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে। তার শান্তি-অশান্তি, সুখ-দুঃখ কিছুই নেই। কারণ সে নিজেই নেই। যদি তুমি তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করো, তুমি কী চাও? সে তোমার হাত দুটো শক্ত করে ধরবে। আঁকড়ে। সভয়ে। তার সব গেছে। সব তার কাছে অস্পষ্ট। অস্বচ্ছ। সংসার পিষে দিয়েছে তাকে। অতিমূল্য চুকিয়েছে সে সংসারে। কিন্তু কেন চুকাতে হয়েছে তা সে নিজেও জানে না।

তাই, যদি তুমি অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসে থাকো সংসারে। যদি দেখো তারপরেও তোমার বোধ-বুদ্ধি কাজ করছে, তবে ভাই নিজেকে ধন্য মনে কোরো। সংসারে এর চাইতে বড় পাওয়া কিছু নেই। শেষদিন অবধি বোধবুদ্ধি সজাগ থাকা ছাড়া বড় অ্যাচিভমেন্ট সংসারে কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। যাওয়ার আগে অন্তিমবার এই ধরিত্রীর মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বোলো, এই যে এসেছিলাম, আর এই যে ফিরছি, এই এতটা রাস্তা যে আমি আমাকে হারাইনি, এই আমার কাছে পরম পাওয়া।

আর একটা কথা জানো তো, ওই সব হারানো মানুষগুলো, মানে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোর কাছে দাঁড়িয়েও যদি একবার কানে কানে বলো, মায়ের কাছে ফিরবে? কিম্বা তার ছোটোবেলার স্মৃতির কোনো তন্ত্রীকে যদি ছুঁয়ে ফেলতে পারো, দেখবে ওই অগোছালো বোধবুদ্ধির ভিতর থেকেও তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠবে। আমি দেখেছি। বহুবার দেখেছি। এত কিছু মধ্যেও ওটা হারায়নি সে। তার ছেলেবেলার স্মৃতি।

তাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, যদি শেষদিন অবধি এই বোধবুদ্ধি নিয়ে যেতে পারি, সে-ই হবে আসল যাত্রা, সার্থক জীবনযাত্রা। আর যদি হারিয়ে ফেলি, তবে ব্যর্থ বলব না, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক তো অবশ্যই। দুর্ভাগ্যও তো বাস্তব। কিন্তু তাকে দুর্ভাগ্য হিসাবে বোঝার মানুষটা আর নেই, এইটুকুই যা সান্ত্বনা।

74
Sat, 02/10/2024 - 10:51

“আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে

কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।”

 

রবীন্দ্রনাথ এ লাইনটা লিখছেন ১৯১১ সাল নাগাদ। ছেলেটা মারা গেল কদিন আগে। আত্মহত্যা করল। একটা চিঠি লিখে আত্মহত্যা করল। বাবা, মা সবার কাছে ক্ষমা চাইল। কেউ কেউ হয় তো পড়েছেন। না, কোটা সিন্ড্রোমে আত্মহত্যা না। সেটা সমাজের আরেকদিক। আরেক ব্যাধির দিক। এ আত্মহত্যা সে ধরণের আত্মহত্যা নয়। ছেলেটা স্নাতকস্তরে পড়ছিল। গভীর অবসাদে চলে যাচ্ছিল, চারদিকে এত দুর্নীতি, ধর্ষণ, ধর্মীয় খেলায় রাষ্ট্র থেকে নাগরিকের উন্মাদনা, বিচারব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা ইত্যাদি এই সব নিয়ে।

না, খুব একটা আলোচনা আমাদের এই সমাজমাধ্যমেও আমার অন্তত চোখে পড়েনি। কারণ এ প্রশ্ন, “হার্ড কোয়েশ্চেন”, “আনকম্ফোর্টেবল কোয়েশ্চেন” এর মুখোমুখি হতে আমরা অস্বচ্ছন্দ বোধ করি। ভাইরাল হতে গিয়ে, খবরের কাগজে প্রথম পাতায় থাকতে হলে যে ক'টা “ইজম” এর আওতায় পড়তে হয়, এ আত্মহত্যা সে ধরণের কিছু নয়। ফলে ফেমিনিজম থেকে নানা ধরণের রাজনৈতিক-ইজম তেমন মাথা ঘামায়নি।

কদিন আগে “টাইমস অব ইণ্ডিয়ায়” একটা সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। বিষয় ছিল আত্মহত্যার পরিমাণ কমানো। সেখানে বলা হয়েছে, আমাদের মধ্যে একটা ধারণা হল, আমরা ধরে নিই যারাই আত্মহত্যা করছে তারাই মানসিকভাবে দুর্বল। ফলে সে নিয়ে গভীরে আলোচনা করতে আমরা অনীহা বোধ করি। সংসারে হিরোদের নিয়ে যে আলোচনা সম্ভব, “লুজার”দের নিয়ে সেই মাত্রায় সিরিয়াস আলোচনা কি সম্ভব? না। অবশ্যই না।

কিন্তু ছেলেটা মারা গেল। একজন মেধাবী ছেলে সমাজের অবক্ষয়ে অবসাদে ডুবে গিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। কারণ সে দুর্বল ছিল বলে নয়। ভীষণ সংবেদনশীল ছিল বলেই। না, এই সিদ্ধান্ত আমি টানতে চাইছি না যে সংবেদনশীল হলেই আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিতে হবে। আমি কাম্যুর অ্যাবসার্ডিজমে আদৌ বিশ্বাসী নই যে জীবনে প্রতি মুহূর্তে আত্মহত্যা না করার কারণ খোঁজাটাই একটা বড় কাজ। না, আমি এ সবে বিশ্বাসী নই। যে ছেলেটি মারা গেছে তার প্রতি আমার হৃদয়ের গভীরতম অংশ থেকে সমবেদনা থাকলেও আমি তার সিদ্ধান্তকে কখনওই সমর্থন জানাই না।

এখন স্ট্যাটেসটিকস অনুযায়ী এ মৃত্যুকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দেখাই যায়। কিন্তু যদি না দেখতে চাই? মৃত্যুর থেকেও কম ভয়ংকর নয় - মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে, সম্পূর্ণভাবে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে বেঁচে থাকা। তার নিদর্শনও কি কম চারপাশে?

ব্যক্তিগত জীবনে নানা চ্যালেঞ্জ, ব্যর্থতা আর অসাম্য-দুর্নীতিতে ভরা সমাজ, কোনোটাই নতুন নয়। কিন্তু অবসাদ কেন বাড়ছে এত? আমাদের শিক্ষায়, আকাঙ্খায়, বেড়ে ওঠায় কোন জিনিসটার অভাব আমাকে এমন দুর্বল করে দিচ্ছে?

আমার মনে হয় আমাদের শিক্ষায়, বেড়ে ওঠায় একটা নির্মম ইনসুল্যেশান ফ্যাক্টর ভীষণভাবে দায়ী এর জন্য। আত্মকেন্দ্রিকতা চিরকাল আছে আমাদের মনের গঠনে। কিন্তু তাকে ড্রাইভিং ফোর্স হতে বাধা দিয়েছে আমাদেরই নানারকমের সামাজিক, ধর্মীয় শিক্ষা। হ্যাঁ, ধর্মীয় বলতে আমি বলছি সেই উপাসনা গৃহের কথা, যেখানে বসে এক গভীর তত্ত্বদর্শী, মরমদর্শী কবি গাইছেন “বসিয়া আছ কেন আপনমনে, স্বার্থ নিমগন কি কারণে? চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয়প্রসারী/ ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি/ প্রেম ভরিয়া লহ শূন্য জীবনে”। যে অবসাদ ক্লিনিকাল, আমি তার কথা বলছি না। তার জন্য চিকিৎসা অবশ্যই কাম্য। কিন্তু যে অবসাদ আমার ভুল বিশ্বাস, আমার ভুল আকাঙ্খা, আমার ভুল ভালোবাসা তৈরি করে, আমি তার কথা বলছি। ভুল সফলতার, ভুল শিখরকে ছুঁয়ে যে গর্বোদ্ধতভাব, আর ভুল বিফলতা আর তার ভুল আত্ম-ধিক্কারের যে অবসাদভাব, আমি তার কথা বলছি।

একটা সময়ে পাশ্চাত্য দর্শনে মন টেনেছিল। ফরাসি দার্শনিকদের আধুনিকোত্তর দার্শনিকতা মনকে নানা কৌতুহলে আবিষ্ট করেছিল। একদিন সে মোহ কাটল। ভারতীয় নানা দর্শনের আবেশও কাটতে শুরু করেছে ততদিনে। সদ্য কলেজ পেরিয়ে উপার্জনক্ষম হওয়ার লড়াই শুরু হব হব। শুরু হল আমার পরিবারে একের পর এক দুর্যোগ। আত্মজীবনী লেখার কোনো ইচ্ছা নেই আমার, কিন্তু আমার নিজের উপলব্ধ সত্যকে জানাতে হলে এটুকু ভূমিকা দরকার। আমায় ক্ষমা করবেন যদি মনে হয় আত্মকথনের ছুতো খুঁজছি।

সেদিন আমার বাইরের জগতে চূড়ান্ত দু:সময়, আর আমার অন্তরের জগতে গভীর শূন্যতাবোধ। ওই যে বললাম, মোহ আর আবেশ দুইই কেটেছে তখন। জীবনবোধের গভীর জিজ্ঞাসা পাগল করে দিচ্ছে। কিন্তু বাইরের নানা ঝঞ্ঝায় সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটা সময়ে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা আমিও ভেবেছিলাম। আমার সেদিনের সে সব ডায়েরি আজও তার সাক্ষ্য বহন করছে। মনে হয়েছিল গোটা জীবন একটা প্রহসন বই কিছু নয়।

এমনই একটা দিনের বিকেলে আমি উত্তরপাড়া স্টেশানে বসে। ট্রেনের অপেক্ষা করছি। সঙ্গে নিজের জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নেওয়ার উপযুক্ত সময়েরও অপেক্ষায়। এমন সময় চোখে পড়ল এক বুড়িকে। আমি ইচ্ছা করেই বুড়ি লিখলাম, বৃদ্ধা নয়। ভিখারি সে। তার বোঁচকাবুচকি নিয়ে ঘুমাচ্ছিল। ঘুম ভেঙে উঠে বসল। চারদিকে তাকিয়ে দেখল। তার আচার আচরণে কোথাও পাগলামি নেই। শান্ত স্থিরভাবে চারদিক তাকিয়ে দেখছে। কি প্রসন্ন দৃষ্টি। একটু পর উঠল, উঠে চায়ের দোকানের সামনে এলো। এক ভাঁড় চা নিয়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে গেল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে কি সন্তোষে চারদিক দেখতে লাগল।

আমি যে সে বুড়িকে এতক্ষণ ধরে খেয়াল করছি, আমি নিজেও জানতাম না। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। স্টেশানের মধ্যে যে পাখিদের বাসা তারা হইহই করতে করতে ফিরে আসছে, আমার ট্রেন অ্যানাউন্স হল। হঠাৎ আমার মনে হল, আমি কি এতই দরকারি? আমার স্বপ্ন, আমার কেরিয়ার যা সব ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল, ওগুলো ছাড়া কি আমার অস্তিত্বের কোনো মূল্য নেই? এই বুড়িটার চাইতে কি আমি খুব কিছু মূল্যবান? কিছু বই পড়েছি বলে আর কিছু ডিগ্রি আছে বলে?

বিশ্বাস করুন, সব বদলে গেল। সব। আমার চারদিকে আবার সব কেমন নিজের জায়গায় এসে স্থির হয়ে গেল। মন বলল, যাই ঘটুক, নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মত কিছু ঘটেনি। আর হা হুতাশ করে বাঁচার মধ্যেও কোনো মানে নেই। শান্তিতে বাঁচব। সুখ আসুক, চাই না আসুক জীবনে।

প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হয়ে গেল। কিন্তু সেদিনের সে বিকেল আমার কাছে আজও স্পষ্ট। স্বচ্ছ। তারপর থেকে আরো আরো দুর্যোগ, দু:সময় পার করেছি। এটুকু বুঝেছি, ঘরে খিল টেনে, অন্যকে তাড়িয়ে, শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচা এক বিশুদ্ধ আত্মহত্যা বই কিছু নয়। বাঁচতে গেলে নিজের বাইরে আসতেই হবে। আমাকে অনেকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনার গল্পে শুধু এক বিশেষ শ্রেণীর মানুষের কথা আসে কেন? কারণ একটাই, ওখানেই আমি আমার বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই। পোস্টমডার্নিজম দর্শনে না, মিস্টিসিজমের মধ্যেও না। মহাত্মা গান্ধী একটা রক্ষাকবচ দিয়েছিলেন, ইংরেজিতে যাকে বলে, talisman, সেটি হল -

"I will give you a talisman. Whenever you are in doubt, or when the self becomes too much with you, apply the following test:”

"Recall the face of the poorest and the most helpless man (woman, child) whom you may have seen and ask yourself, if the step you contemplate is going to be of any use to him (her). Will he be able to gain anything by it? Will it restore him to a control over his own life and destiny? … Then you will find your doubts and yourself melting away.”

এই কথাই স্বামীজির বিখ্যাত কবিতা “সখার প্রতি” তে আছে। যে কবিতাটা কাশীর সেবাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূল প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছিল। যে কবিতাটা স্বামীজির উপলব্ধির প্রধান সুর বলা যায়।

“পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার

বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?

ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;

দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।

রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;

হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।

ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?

দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।

অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,

‘দাও’, ‘দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।”

এ কথাগুলো ভীষণ ক্লিশে মনে হতে পারে। কিন্তু দর্শনের হাজার লক্ষ শব্দের ঘানি টেনে সুস্থ বেঁচে থাকতে, এই উপলব্ধিতেই ফিরতে হয়। “স্বার্থমগ্ন যে জন বিমুখ/ বৃহৎ জগত হতে, সে কখনো শেখে নি বাঁচিতে”, রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধিই কি সারা জীবনের তপস্যা ছিল না?

আমি যা পেয়েছি, তা হারাতে মুহূর্ত লাগে না। স্বাস্থ্য, সম্পদ, সম্পর্ক - ভেঙে যাওয়ার আগে কোনো আগাম নোটিস দিয়ে আসে না। জীবনের বাঁচার পরিসর কমিয়ে এনে, সঙ্কীর্ণ করে নিজেকে যতই সুরক্ষিত সফল ভাবি না কেন, সে উপলব্ধি ভুল। ভ্রম। কোনো জটিল তাত্ত্বিক দর্শন না, কোনো মিস্টিসিজমের আলোছায়া রাস্তা না, যুগে যুগে এই একটা রাস্তাই সুস্থ, স্বাভাবিক বেঁচে থাকার উপায়। নান্য পন্থা বিদ্যতে।

মাঝে মাঝে আবারও ঘোরে পড়ি। তথাকথিত ইন্টেলেকচুয়াল জগতের হাতছানি, নামযশের জগতের হাতছানি, নানা ব্যর্থতার, অবসাদের কুহেলিকার কুটিল পরামর্শ কানে এসে বাজে। “আবার এরা ঘিরেছে মোর মন, আবার চোখে নামে আবরণ” দশা হয়। আবার বেরিয়ে আসি সে ফাঁদ কেটে। যেখানে জীবন, যেখানে উৎসাহ, যেখানে মহাজীবন সাগরে লক্ষ-কোটি ঢেউ উঠছে পড়ছে সেখানে এসে দাঁড়াই। আবারও বেঁচে যাই।

75
Thu, 02/08/2024 - 23:25

আত্মপ্রচারসর্বস্ব "আমাকে দেখুন" বইমেলা শেষ হল, "ভ্যানিটিব্যাগ" সদৃশ বহু বই বিকিকিনি শেষ হল, বহু "নর্দমায় আছাড়ামারার যোগ্য" হুজুগে পাঠকের বার খেয়ে তোলা লেখকরাও বাড়ি ঢুকে গেল।

মেলায় রোদ বাড়ছে। শীত যাচ্ছে। ফেসবুকে প্রতিবাদ হচ্ছে। এক বিশাল অংশের নেটিজেন নিন্দুক-প্রতিবাদী, এই দুই পক্ষের পোস্টেই "দারুণ বলেছেন" বলে লাভ / কেয়ার ইত্যাদি ইমোজি দিয়ে আসছেন।

এখন এমন তো শিশু নই যে বেশ কিছু মানুষের ব্যবহারে সততা, ইন্টিগ্রিটি, দায়বদ্ধতা ইত্যাদি দেখছি না বলে হাহুতাশ করে মরব।

আপনারা মানুন, না মানুন, আমার আম্বেদকরের একটা কথা খুব মনে হয়। ভারতে আমাদের রক্তে শ্রেণী সচেতনাটা মারাত্মক। আমাদের বেদ-বেদান্তে যাই লেখা থাকুক না কেন, আমাদের মনীষীরা যাই বলে থাকুন কেন, আমাদের বর্ণাশ্রম-জাত-কাস্ট এর ফ্রেমওয়ার্কের ধারণাটা মজ্জাগত। আম্বেদকর যাকে বলতেন, "স্টিলের ফ্রেম"। আমরা এক একটা গোষ্ঠী বানিয়ে, তার একটা হায়ারার্কি মনে মনে ছকে নিই। এগুলো কোনোটাই সচেতনভাবে আমরা করি না। কিন্তু করি। এগুলোতে যে কোথাও মনুষ্যত্বের প্রাথমিক শর্তগুলোকে অবমাননা করছি, সেও আমাদের মনে হয় না। রেলকলোনিতে বড় হয়েছি। সেখানে আউটহাউস বলে, কোয়াটার্সের বাইরে, একটা করে ঘর-বারান্দায় বাস করা কাজের লোকেদের জন্য বাড়ি থাকত। এখনও আছে। অফিশিয়ালি থাকার কথা না। তবু আছে। আমি দেখতাম তাদের কেউ যদি কোনো দামী শাড়ি পরে কোনো অনুষ্ঠানে যেত, অমনি কোয়াটার্সের "মালকিন" রা সেই জাতের শাড়ি আর পরতেন না। নাক কুঁচকিয়ে বলতেন, ইস, ও ওই ধরণের শাড়ি পরেছে। আমিও পরব? ওরা ওই রেস্টুরেন্টে যায়, আমরাও যাব? কেন আমাদের একটা জাত নেই?

আমাদের ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে এই “জাত” শব্দটা ভীষণ ধ্রুব। একটা স্বত:সিদ্ধান্ত। আম্বেদকর এই সত্যিটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই আজীবন হিন্দুধর্মের, তথা সমাজে এই বিষযন্ত্রটাকে থামাতে চেয়েছিলেন। না পেরে অবশেষে বৌদ্ধধর্ম নিয়েছিলেন। সঙ্গে হাজার হাজার মানুষকেও নিয়ে গিয়েছিলেন।

আমাদের রক্তে রক্তে এই “আনটাচেবেলিটির” বীজ আছে। কেন, রমাপদ চৌধুরীর “বাড়ি বদলে যায়” মনে নেই? শেষে যখন নিজেদের বাড়ি হল, তারা নিজেরা বাড়িওয়ালা হল, মানুষটা বলল, ভাড়াটাদের জাতটাই এরকম হয়।

একবার ভেবে দেখবেন আমাদের ভাবনা, চিন্তা সব কিছু কি সাংঘাতিকভাবে এই “জাত” শব্দটা দিয়ে প্রভাবিত। এটা যে অন্যায়, এ বোধটাও আমাদের আসে না। এই হাজার হাজার বছরের অভ্যাসে এতটাই এই বিষয়ে অসংবেদনশীল হয়ে আছি আমরা।

বইমেলাতেও তাই বইমেলার মত করে “আনটাচেবিলিটি” শব্দটা আছে। নইলে একজন অমন ক্ষমতাসম্পন্ন লেখিকার মনে এত বিদ্বেষ, এত ঘৃণা, এত তাচ্ছিল্য জন্মায় কেন? কারণ আমাদের “আনটাচেবেলিটি” ধারণার মধ্যে একটা বিবেকীয় লেজিটিমিটি আছে। আমরা জানি আমাদের এই বোধটা ধর্মসম্মত। ওর “ওউকাত” এর বাইরে ও যাবে কেন?

বর্ণাশ্রমের বিষটা বহু হাজার বছর আগে খুব নিষ্পাপ মুখোশে, সংজ্ঞায় আমাদের সমাজে জন্মেছিল। তারপর বর্ণ মানে জাত নয় - ইত্যাদি সুক্ষ্ম তর্কে আরো কায়েমি হল। তারপর সে বিষ শুধু ধর্ম না, পুজো-আচ্চা না, আমাদের সব বিচার, আচারে, সামাজিকতায় ঢুকে পড়ল। আমাদের মধ্যে এক নতুন ধরণের “আদারিজম” চালু হল। এক নতুন ধরণের “আনটাচেবিলিটি”।

বইমেলা নিয়ে পোস্টে আমার কিছুই মনে হয়নি। বিখ্যাত লেখিকা প্রমুখদের পোস্টেও আমার কিছুই মনে হয়নি। কিন্তু যখন আমার বন্ধুতুল্য বেশ কিছু মানুষকে দেখলাম ব্যথা পেয়েছেন, প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, আমার মনে হল আমিও আমার ভাবনাটা রাখি। বলি যে, রোগের বীজ অনেক গভীরে। আমাদের এখানে গ্রহণের চাইতে বর্জনের দামামা বেশি জোরে বাজে। আমাদের এখানে হাত বাড়ানোর চাইতে, হাত গুটিয়ে নেওয়া ঘেন্নায় অনেকে সহজে করা যায়। আমাদের যুগান্তরের অভ্যাস এ। আমাদের ধর্ম শিখিয়েছে।

শুধু আম্বেদকর নয়, হরিচাঁদ ঠাকুর-গুরুচাঁদ ঠাকুরও এ বিষের খবর পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের সমাজে তাদের কথা কোনোদিন গ্রাহ্য হবে বলে আমার অন্তত মনে হয় না। কিন্তু এনারা তো ইতিহাস এখন। কিন্তু “জাত” নিয়ে আমাদের নিজেদের মত করে “আমরা - ওরা” গড়ে তোলার খেলা চলতেই থাকবে। পৃথিবীর সব দেশেই এটা আছে কমবেশি। কিন্তু ভারতেই একমাত্র এই অমানবিক আচার শাস্ত্রের সমর্থন পেয়েছে। যুগ যুগ ধরে আমাদের কাউকে মহান, কাউকে তুচ্ছ করার অদ্ভুত সমীকরণ শিখিয়েছে। আজও চলছে। অন্যভাবে। তার একটা উদাহরণ এই বইমেলা ঘিরে পোস্টগুলো। এগুলো চলবেই। হতাশ হবেন না। বরং যতটা পারা যায় আমাদের মধ্যে থাকা এই কুলীনতার বিষাক্ত বীজটাকে মারা যায়, সে চেষ্টা করে দেখা যেতে পারে।

76
Fri, 01/26/2024 - 12:22

বাস্তবতা আর ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ধরা যাক আমার শরীরে কোনো রোগ ধরা পড়ল। সেটা ঘটনাপ্রবাহ। কিন্তু সেই রোগের সঙ্গে আমি কিভাবে লড়ব, সেটা আমার বাস্তব। বাস্তবটা ব্যক্তিগত। ঘটনাপ্রবাহ নৈর্ব্যক্তিক। একই ঘটনাপ্রবাহে এক একজনের বাস্তবটা এক এক রকম হয় তাই। বাস্তবটা সাবজেক্টিভ। ঘটনাপ্রবাহটা অবজেক্টিভ।

লাভ-ক্ষতি, সুখ-দুঃখ সাবজেক্টিভ। ভীষণভাবে বাস্তব। কিন্তু এগুলো যে যে ঘটনাপ্রবাহজাত, সেগুলো অবজেক্টিভ। নৈর্ব্যক্তিক। আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। এই পার্থক্যটা দেখেই হয় তো ভারতীয় দর্শনে একদিন পুরুষ - প্রকৃতির ধারণা হয়েছিল। পুরুষ সাবজেক্টিভ। প্রকৃতি অবজেক্টিভ। পুরুষ ভোক্তা। প্রকৃতি নিত্য ঘটমানা। আরো বলা হল, এই দুই-ই নিত্য। পাশ্চাত্যের স্টোয়িক দর্শনও তার মত করে এই দুটো করে আলাদা করে বলতে চাইল, নির্বিকার থাকো। নিরাসক্ত থাকো। বাস্তব হোক পুকুরের স্থির জলের মত। ঘটনাপ্রবাহ হোক তার উপর অবিরাম বয়ে চলা ধারাবাহিক প্রতিচ্ছবির মত।

বলা সোজা। ভাবা সোজা। কিন্তু জীবনে রূপদান করা কঠিন। কঠিন মানে যতটা সিরিয়াসনেস, সময় আর মনোযোগ লাগে, আমি আমার স্বাভাবিক রুচি অনুযায়ী দিতে রাজি নই। যতক্ষণ না বাধ্য হচ্ছি। মরমী সাধক বললেন, ‘'জিন্দেগী কি ভোগ হি ভোগতে সবকো হোয়ে / জ্ঞানী ভোগত জ্ঞান সে, মূরখ ভোগত রোয়ে।”

ঘটনাপ্রবাহ আর বাস্তবতার এই পার্থক্যটা, বা আরো ভালো ভাষায় বললে দ্বন্দ্বটা পশুদের নেই। তাদের সবটাই ঘটনাপ্রবাহ। সে নিজেও। সে বর্ষা নিয়ে অভিযোগ করে না। মাথার ঘা নিয়ে অভিযোগ করে না। কষ্টে কাঁদে। অন্য সময় স্ফূর্তিতে বাঁচে। মরবার সময় অনায়াসে মরে।

মানুষের সে ভাগ্য নেই। যত বুদ্ধিমান হয়, যত চিন্তা সুক্ষ্ম হয়, তত তার মধ্যে এই পার্থক্য প্রবল হয়। সে ঘটনাপ্রবাহর চাপে মরে না। নিজের বাস্তবতার চাপে মরে। আসন্ন বিপদ, আসন্ন মৃত্যুকে অনুমান করে। ভয় পায়। আশঙ্কিত হয়। ছটফট করে। প্রার্থনা করে। আরো এটা সেটা করে। অবশেষে মরে যায়। বাস্তব শূন্য হয়। ঘটনাপ্রবাহ চলতেই থাকে।

এ অভিশাপ। আবার এই আশীর্বাদ। একটা তার এনে যদি কেউ বলে, এতে সুর তোলো তো দেখি। অরসিকের কাছে সে এক আপদ। কিন্তু সুর রসিকের কাছে সে এক সাধনা। চ্যালেঞ্জ। সে ধাতুতে সুর তুলবে।

দ্বন্দ্ব না থাকলে প্রাণ অসাড়। প্রাণ অসাড় হলে আমি অসাড়। রবীন্দ্রনাথের “ঝুলন” কবিতাটা মনে করা যাক। কেন হঠাৎ নিশীথরাতে অমন মরণখেলা খেলবার ইচ্ছা হল? কারণ প্রাণ অসাড় হয়ে এসেছিল। সুখের আলসে।

কিন্তু আমি তো রবীন্দ্রনাথ নই। আমার সে টেম্পারামেন্ট নেই। মানুষে মানুষে পার্থক্য তো এই টেম্পারামেন্টে। টেম্পারামেন্ট তৈরি করে বাস্তবতা, ঘটনাপ্রবাহ ছেঁচে। কেউ কাঁদে। কেউ হাসে।

উপায় কি? গোটা সংসার এর একটাই উপায় চিরটাকাল বলেছে - বৈরাগ্য। রাগ মানে রঙ। রঙ লাগুক, কিন্তু কোনো রঙই পাকা হতে দিও না। কিন্তু সংসারে আমার যে এত অনুরাগ? উত্তর এলো, ভালো তো। যদ্দিন অনুরাগের সুখে হাসছ, অনুরাগের তাপে কাঁদছ, চালিয়ে যাও না ভাই। কেউ বারণ করেনি। কিন্তু যদি কোনো সময় মনে হয়, আর তো ভাল্লাগছে না। কিম্বা এমন একটা আঘাত খেলে যে এ খেলা থেকেই মন উঠে গেল, তখন শুনবে ঘটনাপ্রবাহ আর বাস্তবতার ফাঁক দিয়ে আসা এক টুং টাং একতারার সুর। ডাকছে তোমায়। কান পেতে কবি শোনে, “ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে কি সঙ্গীত ভেসে আসে…. কেন কারাগৃহে আছিস বন্ধ, ওরে ওরে মূঢ়, ওরে অন্ধ, ভবে সেই সে পরমানন্দ, যে আমারে ভালোবাসে/ কেন ঘরের ছেলে পরের কাছে পড়ে আছিস পরবাসে”।

একি মিছে সান্ত্বনার কথা? ফাঁকা আশার কথা? না হে না। তীর থেকে তরী ভাসালে বোঝা যায় সাগর শুধু ডোবায় না, ভাসায়ও। ডোবার ভয়ে এতদিন যে তীরে তীরে কাটালাম, সে ভয়টুকুর আসলেই কোথাও কোনো অস্তিত্ব নেই। প্রতিদিন চিতায় লক্ষ মানুষ পুড়ছে, প্রতিদিন মাটিতে লক্ষ মানুষ কবরে যাচ্ছে…. আমিও যাব। ভয়ে চোখকান বন্ধ করে রাখলেই কি রক্ষা পাব? কবি গাইছেন, “দুদিন দিয়ে ঘেরা ঘরে তাইতে যদি এতই ধরে, চিরদিনের আবাসখানা সেই কি শূন্যময়, জয় অজানার জয়/ কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়, ও তোর পার হতে সংশয়”।

 

(ছবিঃ Debasish Bose)

 

77
Thu, 01/25/2024 - 12:46

ধর্ম কখনও মূল্যবোধ শেখায় না। কখনও কখনও মূল্যবোধের বহিরাবরণ গড়ে দিতে সাহায্য করে। তাও বাস্তবে খুব কমক্ষেত্রেই। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় অন্তঃসারশূন্য বহিরাবরণ নিয়ে এত মোহ, এত দলাদলি।

মানুষ মৃত্যুতে ফুরিয়ে যায় না। মূল্যবোধহীন হলে বেঁচে থাকতেই ফুরিয়ে যায়। মূল্যবোধ জন্মায় যন্ত্রণায়। খিদের মত, তেষ্টার মত যন্ত্রনায়। একটা সময় সব কিছুর উপর বিশ্বাস হারিয়ে, উদ্দেশ্যহীন হয়ে, একে তাকে, সব ঈশ্বর-দেবতাকে প্রশ্ন করে ক্লান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে, তবে দাঁড়াই কোথায়। বাইরের কাউকে না, নিজেকে জিজ্ঞাসা করে। আর তখনই ভিতর থেকে নির্দেশ আসে এক অনাদিকালের মূল্যবোধের উপর - শ্রদ্ধা। জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা। বাকি যা কিছু ভালো সেখান থেকে শুরু। সেই শ্রদ্ধাকে হারিয়ে ফেললে সব ফাঁকি। যত ঢক্কনিনাদ করি না কেন, যতই দলবল নিয়ে এসে সময়ের চাকা ঘোরাতে চাই না কেন, যতই কথার চাতুরীতে ভুলাতে চাই না কেন। অবশেষে সব মিথ্যা। যদি জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাটা না থাকে। জীবনের কোনো ধর্ম হয় না। জীবন থেকে ধর্মবোধ জন্মায়। তাই সনাতন ধর্মের সংজ্ঞা বুদ্ধ দিচ্ছেন, বৈরিতা দিয়ে বৈরিতাকে জয় করা যায় না, বৈরিশূন্যতা দিয়েই বৈরিতাকে জয় করা যায় - এই সনাতন ধর্ম।

আমি শত্রুতা ছাড়লে শত্রুতা নাশ হয় না। কিন্তু আমার ভিতর শত্রুতা শূন্য হলে আমি জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাকে গ্রহণ করি। সেই আমার মূল্যবোধ। সেই থেকেই যা কিছু সত্য, মঙ্গল। তার নাম যদি দিই ঈশ্বর, তবে সে সত্যিই অবিনশ্বর। কারণ এ মূল্যবোধ অবিনশ্বর। জীবন যত বড় ঘূর্ণিতেই ফেলুক না কেন ধ্রুবতারা তো এই, জীবনের উপর শ্রদ্ধা, তাই যে করেই হোক আবার সেদিকে ফেরার রাস্তা খুঁজে বার করতেই হবে। জীবনই একটা শব্দ, যেখানে আমি তুমি থেকে শুরু করে দুর্বলতম প্রাণীটকেও যুক্ত করে নিই।

সৎ সাহিত্য এই কাজটাই করে। সৎ সাহিত্যের কাজ মূল্যবোধকে চাপিয়ে দেওয়া না। সৎ সাহিত্যের কাজ মূল্যবোধকে আবার নতুন করে অন্বেষণ করা। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ঠিক সেইখান থেকেই খোঁজা। সে প্রাচীন থেকে নবীন, ধর্ম থেকে শিল্প যা-ই হাতের কাছে পায় নেড়েচেড়ে দেখে। খোঁজে কোথাও পথের কোনো সূত্র আছে কিনা। যতটুকু পায়, রাখে। যতটুকু না পায়, সরিয়ে দেয়।

মূল্যবোধ যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। এক সময় প্রয়োজনবাদ বা utilitarianism সে কথা বলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। আসলে মানুষের মূল্যবোধ মানুষ হিসাবে পূর্ব নির্ধারিত। কিসের উপর নির্ধারিত তা আমরা জানি না। কিন্তু জানি না বলেই সেই ক্ষুব্ধ অহংকারে তাকে আমার সৃষ্টি বলে দাবী করা মূঢ়তা। মানব সভ্যতার যাত্রাপথ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা তৈরি হয়নি শুধু, তার গভীরে থাকা মনুষ্যত্ববোধই আসল কারিগর। যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না, কিন্তু যা দিয়ে জীবনকে ব্যাখ্যা করা যায় সদর্থে।

সৎ সাহিত্যের কাছে ঋণ আমাদের তাই অপরিসীম। কোনো মূল্যবোধকেই চাপাতে চায়নি। বারবার খোঁজ করেছে বলেই। যার মূল সুর জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা।

আজ কৃষ্ণা সোবতির মৃত্যুদিন। আশাপূর্ণা দেবী থেকে কৃষ্ণা সোবতির এই অন্বেষণ আমাদের দীর্ঘদিন সঞ্জীবিত রাখবে। বারবার বলবে, শুধু একটা স্বচ্ছ দৃষ্টিই দরকার। আলো দেখা যাবেই।

 

78
Tue, 01/23/2024 - 23:31

রাবণ রম্ভাকে ধর্ষণ করেছিল। বাল্মিকী সে কথা লিখেছেন রম্ভার প্রতি দরদ নিয়ে। কিন্তু কৃত্তিবাস তা করলেন না। অগস্ত্য মুনি রামকে বলছেন, ওই ধর্ষণে সুখ পেয়েছিল রম্ভা। রাবণকে নিরস্ত করার অনেক চেষ্টা করেও যখন রাবণকে থামানো গেল না, তখন রম্ভা চুপ করে রইলেন।

 

“রাবণের হস্তে বুঝি পরিত্রাণ নাই।

মৌন হয়ে থাকি তবে যা করে গোঁসাই।।

এত ভাবি মৌনভাবে থাকে রম্ভাবতী।

রাবণ বুঝিল রম্ভার হইল সম্মতি।।”

 

এ রাবণের কামুক মনের কথা। এরপর কৃত্তিবাস বর্ণনা দিচ্ছেন কিভাবে রাবণ রম্ভার সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হল।

 

“একে দশানন তাহে শৃঙ্গারে প্রবীণ।

একাসনে শৃঙ্গার করয়ে সপ্তদিন।।

রাবণের শৃঙ্গার না সহে কোনো নারী।

সহে মাত্র সবে রম্ভা আর মন্দোদরী।। “

 

এরপর কৃত্তিবাস নারীর কামবাসনার ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অগস্ত্য মুনির ভাষ্যে।

 

“হাত পা আছড়ে রম্ভা রাবণের কোলে।

রাবণ শৃঙ্গার করে ধরি তার চুলে।।

রহ রহ বলি রম্ভা বলে রাবণেরে।

মুখেতে তর্জন করে হরিষ অন্তরে।।”

 

এ কথা কিন্তু বাল্মিকী লিখছেন না। তিনি লিখছেন রম্ভাকে লাগছিল যেন নদীতে নেমে পড়া কোনো মত্ত হস্তী। বা যেন ফুলে সুশোভিত কোনো লতা যেন ঝড়ে তছনছ হয়ে পড়েছে।

কৃত্তিবাস এখানেই থামছেন না। নারীর কামচরিতকে আরো গভীরে বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছেন।

“স্বভাবে পুরুষ হতে কামে মত্তা নারী” …… ”হৃদয়ে আনন্দ মুখে করয়ে তর্জন”.... ”পুরুষ অধিক নারী কামেতে পাগল / তথাচ পুরুষ মন্দ স্বভাবে পাগল”....... ”কেহ না বুঝিতে পারে স্ত্রীলোকের ছল / পুরুষ ভুলাতে নারী ফাঁদে নানা কল”...... ”শৃঙ্গারেতে রমণী বাড়ায় অভিলাষ / জনম অবধি তার নাহি পুরে আশ”।

গীতায় আছে কাম অপূরণীয় আগুনের মত। কৃত্তিবাস তা নারীর স্বভাবে দেগে দিলেন। এরা সব অসতী। তবে সতী কে? কৃত্তিবাস লিখছেন,

 

“শত সহস্রতে নারী মিলয়ে একটি।

সতী পাওয়া দুর্লভ অসতী কোটি কোটি।।”

 

অসতীর প্রধান দোষ কি?

 

“প্রধান এক দোষ তার অধিক ভোজন”.....

”যাহা দেখে তাহা খাইতে হয় সাধ।

রাত্রিদিন খায় তবু করয়ে বিষাদ।।

যত খায় ক্রমে ক্রমে তত বাড়ে আশ।

যার ঘরে হেন নারী তার সর্বনাশ।।”

 

কৃত্তিবাস নাকি বাঙালির মত করে রামায়ণ লিখেছিলেন। জানি না বাঙালির এ ধরণের নারীচরিতাভিধান ছিল কি না। না, সমাজে এই প্রচলিত বিশ্বাস ছিল। মাঝে মাঝে এ ধরণের যুক্তি আজও যে শোনা যায় না, তাই বা হলফ করে বলি কি করে?

প্রসঙ্গত তুলসী রামায়ণে এ প্রসঙ্গে আসেনি। সেখানে উত্তরকাণ্ড দর্শন ও সাধনার কথা নিয়েই মূলত আলোচনা। এ যা উদ্ধৃতি দিলাম, তা কৃত্তিবাসী রামায়ণের উত্তরকাণ্ড থেকে।

 

79
Sat, 01/13/2024 - 00:52

           আন্তরিক হলে হবেই হবে।

দক্ষিণেশ্বরের সকাল। কুয়াশা কুয়াশা গঙ্গা। ওপার দেখা যাচ্ছে না। একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। আন্তরিকতায় ভর করে দাঁড়িয়ে। কোনো কৌশল না। কোনো গুপ্ত তন্ত্রমন্ত্র না। কোনো দল সম্প্রদায় না। বলছেন, আন্তরিক হও, সব ভুল শুধরে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

উপায় কি? এ জীবন বড় জটিল। যা ভাবি, যেমন ভাবে হবে ভাবি, কিছুই হয় না। কোনোদিকে দিশা পাই না। আমিও বদলে যাচ্ছি। আমার চারপাশও বদলে যাচ্ছে। কি হবে? উপায় কি?

উত্তর, আন্তরিক হও।

আন্তরিক হতে গেলে অন্তরকে দেখতে হয়, জানতে হয়। আমার রাগ-হিংসা-ঈর্ষা-অভিমান আন্তরিক। আমার অভিশাপ আন্তরিক। কিন্তু আমার ভালোবাসা? আমার সহ্যক্ষমতা? আন্তরিক কি? মতলবী মানুষ কি আন্তরিক হয় ঠাকুর? আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মতলব। আমি কি চাইলেই আন্তরিক হতে পারি?

নিজেকে একটু আলগা দাও। মাকে দেখো। এত বড় সংসার। তোমাদের মত শিক্ষিত মানুষের ঢল। গ্রামের ওই পড়াশোনা না জানা, তোমাদের মত শহুরে আদবকায়দা না জানা মানুষের ঢল। সব সামলে দিচ্ছেন। কি করে? কি মন্ত্রের জোরে? ওই আন্তরিকতা। আন্তরিক, কিন্তু আসক্ত নয়।

নহবতে মা আছেন। এই একটা শব্দেই সব বলা হয়ে গেল। মা আছেন। বলছেন, কায়দায় ফেলে মানুষকে দিয়ে কিছু করানো যায় না।

কিন্তু মানুষকে ব্যবহার করেই তো আমাদের জগত। আরো ভালো করে বললে অপব্যবহার করে। ঠকিয়েই আমার লাভ। আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে এই বুঝেছি। সৎ হতে গেলে সব ঠকিয়ে যায়। বিপদে পড়তে হয়।

তাই কি?

জানি আমার এ ভ্রান্তি। লাভের পথ আর শান্তির পথ আলাদা। লাভের নেশায় নীতি-দুর্নীতির খেয়াল থাকে না। কিন্তু শান্তি আন্তরিক না হলে পাওয়া যায় না। জানি। কিন্তু সাহস নেই। আন্তরিক হওয়ার সাহস নেই। তাই আনুষ্ঠানিক হই। যেখানে আন্তরিকতা যত কম আনুষ্ঠানিকতা তত বেশি। আমার গোটা জীবন আনুষ্ঠানিক। আমার স্বপ্নও আর আগের মত অকৃত্রিম নয়। স্বপ্নও লোভী। স্বপ্নও মতলবী।

স্বামীজি জানেন। “যত উচ্চ তোমার হৃদয়, তত দুঃখ জানিও নিশ্চয়…… লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর মুরতি তাকি সয়?... হৃদিবান নিঃস্বার্থ প্রেমিক… এ জগতে নাহি তব স্থান। হও জড় প্রায়। অতি নীচ। মুখে মধু। অন্তরে গরল। তবে পাবে এ সংসারে স্থান।”

স্বামীজি জানতেন। আন্তরিক হলে জীবন দুঃসহ হয়ে যাবে। মানুষ ঠকিয়ে যাবে। আঘাত করে যাবে। অন্তরকে যদি দাও, ক্ষতবিক্ষত করে যাবে। তবে আর আন্তরিক কেন হব? তার চাইতে হিসাবি হই। মেপে পা ফেলি। মেপে কথা বলি। দাবার চালের মত গোটা জগতকে দেখি। কিন্তু দাবার শেষে তো শুধুই হারজিৎ। জীবন কি শুধুই হারজিৎ? তাতে ভরে উঠবে জীবন? লাভের অঙ্ক ভরবে। জীবন না।

কুয়াশা কাটছে। ওপার স্পষ্ট হচ্ছে। রোদ উঠছে। শূন্য গঙ্গাতীর। কেউ নেই। হিমালয় গলা জল সামনে দিয়ে যেতে যেতে প্রশ্ন করছে, শুধুই কি জাল ফেলে বসে থাকবে? ভাসবে না? যাবে না সাঁতরে মোহনার দিকে? নাকি সময় ফুরালে জড়ের মত ভেসে থাকবে জোয়ারভাটায়।

কিন্তু আমি তো সাঁতার জানি না।

জল বলল, সব জানো। জলে নামো। আন্তরিক হও। হাতে পায়ে জাগবে ছন্দ। সাঁতরে যাবে। আঘাত পাবে। ঝড় পাবে। ঘূর্ণি পাবে। কিন্তু ডুববে না। শুধু আন্তরিক মোহনার দিকে এগোবে চলো। নিজের জালে নিজেই আটকে বসে থেকো না। সময়ের জালে বাঁধা পড়বে যে!!

ওপারে কুয়াশা কাটা আলোয় দাঁড়িয়ে কে? আকাশে বাতাসে ঠাট্টার সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ছে..... শেষে কি দৃষ্টিকানা, কানে কানা হলি? অনুভব মেলে দাঁড়া। মস্তিষ্ক যা পারে না, হৃদয় পারে। "ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ। কৃপাপাত্র হয়ে কি বা ফল। দাও। আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল। অনন্তের তুমি অধিকারী। প্রেম সিন্ধু হৃদে বিদ্যমান। দাও দাও - যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু, বিন্দু হয়ে যান।"

সিন্ধুতে সাঁতার দিতে চাস, না বিন্দু ঘিরে হতাশ্বাস রে?

80
Fri, 01/12/2024 - 00:49

একজন ইন্টারকাস্ট বিয়ে করেছে, সেই অপরাধে তার জগন্নাথ মন্দিরে ঢোকা বারণ। তবু সে ঢুকেছে। তাই বাকি পাণ্ডারা গোঁসা করে শ্রীজগন্নাথ ও তাঁর ভাই-বোনকে সকাল ৮.৩০ থেকে বিকেল ৫.৩০ অবধি অভুক্ত রেখেছেন। ধর্মঘট করেছেন। তারপর মন্দিরের কর্তাব্যক্তিরা এসে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে সবাই কাজে ফিরেছে। শাস্ত্রমতে অবশ্যই তার মন্দিরে ঢোকা উচিত হয়নি।

রামমন্দির এখন বড় ইস্যু। শঙ্করাচার্যরা বেঁকে বসেছেন তাঁরা কেউ উপস্থিত থাকবেন না। কারণ সেখানে যা হচ্ছে তা অশাস্ত্রীয়।

আদি শঙ্করাচার্য হিন্দুধর্মের কিছু শাখা প্রশাখা তৈরি করে, কয়েকটা পদ সৃষ্টি করে অরগানাইজড করার চেষ্টা করেছিলেন। ভারতের চার কোণায় চারজন শঙ্করাচার্য থাকবেন। হিন্দুধর্ম অনুয়ায়ী শঙ্করাচার্যদের গুরুত্ব যথেষ্ট।

রিলিজিয়ন আর শাস্ত্রের উৎপত্তিগত একটা মিল আছে। রিলিজিয়ন শব্দটা ল্যাটিন Religare শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ বাঁধা, to bind. শাস্ত্র শব্দটা এসেছে শস ধাতু থেকে, যার অর্থ শাসন করা।

মানুষকে বাঁধা যায় ভয় দেখিয়ে, আর ভালোবাসায়। প্রথমটা মানুষের ক্ষমতার মধ্যে আছে। দ্বিতীয়টা নেই। তাই একদিন রিলিজিয়ন বা শাস্ত্র মানুষকে বেঁধেছিল। আর এখন আইন আর শাস্তির ভয় মানুষকে বাঁধে। যাকে আমরা ডিসিপ্লিন বলি, অনেক অর্থেই সেখানে আমরা মানুষের নিঃশর্ত আনুগত্য দাবী করি। রিলিজিয়ন বা শাস্ত্র সেটাই করতে চেয়েছিল।

প্রশ্ন হল মানুষকে বাঁধার চেষ্টা মানুষ করেছিল কেন? কারণ মানুষের অসীম ক্ষতি করার ক্ষমতা। নিজের ও অন্যের। তাই ক্ষতি করার ক্ষেত্র কমানোর চেষ্টায় ‘'বিধি” আর “নিষেধ” এর রাস্তা বানিয়েছিল মানুষ। যদিও কালের গতিতে সে নিজেই ক্ষতির অস্ত্র হয়ে উঠেছে এও বাস্তব। আসলে যা-ই মানুষ নিজের আওতায় পায় তাকেই সে নিজের ক্ষতি করার ক্ষমতার হাতিয়ার বানিয়ে ফেলে। সে যাই হোক, শিক্ষা থেকে শুরু করে খেলা-রাজনীতি-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যাই হোক না কেন, তার ক্ষমতা থাকলেই মানুষের সভ্যতায় তার অপব্যবহারের ইতিহাস থাকবেই থাকবে। তাই রিলিজিয়ন বা শাস্ত্রও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকের বিশ্বব্যাপী রণংদেহি ছবিও সেই কথারই প্রতিধ্বনি করে। আমাদের সব শিক্ষা ছাপিয়ে নিজের ক্ষতিসাধনের অসীম ক্ষমতার সত্যকে প্রমাণ করে।

রাণী রাসমণি যখন মন্দির বানাতে চান তখনও সেদিকে শাস্ত্রজ্ঞরা “গেল গেল” রব তুলেছিলেন। তারপর শাস্ত্রীয় মধ্যস্থতায় মন্দির তৈরি হয়। শাস্ত্র জয়ী হয়। কিন্তু পূজারী পাওয়া যাচ্ছিল না বলে সেই কামারপুকুর গ্রাম থেকে পূজারীর ব্যবস্থা হল। বাকিটা তো ইতিহাস।

সাধারণ হিন্দু তাই রামমন্দির নিয়ে পড়েছেন ভীষণ বিপাকে। যারা একনিষ্ঠ রাজনীতির ব্যক্তিদের ভক্ত-অনুরাগী তাদের দ্বন্দ্ব নেই। যারা তা নয়, তারা প্রশ্ন তুলছেন, এবার? ওদিকে শঙ্করাচার্যরা ভয় দেখাচ্ছেন দেশে অনর্থ হবে। আসলে ভয়টা শাসনের বা শাস্ত্রের বড় অস্ত্র। আমরা আজও মেনে চলি তাই। আর সেই জন্যেই অফিসে কড়া অফিসার চাই, স্কুলে কড়া হেডস্যার চাই। এই ‘কড়া’ শব্দের আড়ালে যে মনোভাবটাকে ঢাকছি সে মনোভাবটা আদৌ খুব পরিমার্জিত কি? জানি তো, মানুষ সুশিক্ষা, সুনীতিতে চলার জীব নয়। তাকে ‘'কড়া” হাতে শাসন না করলেই সে অনর্থ ঘটাবে।

এর মধ্যে সাধারণ বাঙালি অবশ্য অতটা উৎসাহিত নয়। তার কারণ আমাদের ভাষায় রামচরিতমানস লেখা হয়নি। উত্তর ভারতের তুলসীদাস আর দক্ষিণের ত্যাগরাজের পদে রাম বারবার এসেছেন। কবীর প্রমুখের পদেও এসেছন। সাধারণ মানুষ শাস্ত্র জানে না, কবিতা জানে। গান জানে। আমাদের গানে-কবিতায় কৃষ্ণ আর কালী বারবার এসেছেন, তাই আমাদের সেন্টিমেন্টে তারা আছেন। কিন্তু রাম নেই। যদিও বাংলার ঘরে ঘরে রামমন্দিরে যাওয়ার আমন্ত্রণলিপি বিলি প্রক্রিয়া চলছে, কিন্তু এতে প্রাণ জাগে না। উৎসুকতা জাগে, কৌতুহল জাগে, এত অবধিই। প্রাণ জাগে কবিতায় আর গানে।

ভারতীয় ধর্মের প্রবাহে এ এক আশ্চর্য দিক। আমাদের পথে শাস্ত্রীয় পথ আর মরমীর পথ দুই আছে। এক পরম্পরার বাইরে কিস্যু মানে না। আরেক প্রাণ না ছুঁলে হাঁ বলে না। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী যখন ব্রাহ্মমত ছেড়ে বৈষ্ণব মতে এলেন, শিষ্যের অভাব হল না। কিন্তু গোঁড়া বৈষ্ণবেরা, মানে শাস্ত্রীয় বৈষ্ণবেরা মান্যতা দিল না। কারণ গুরু পরম্পরা নেই।

এখন মরমীর পথ সাধারণের পথ না। সাধারণের ধর্মের পথ শাস্ত্রীয় পথ। গীতা বলছেন কর্তব্য-অকর্তব্য স্থির করতে শাস্ত্রই তোমার প্রমাণ হোক। যদিও সেই গীতাতেই আবার সব ধর্ম ত্যাগ করে হৃদয়স্থিত নারায়ণের শরণাগত হতে বলার উপদেশও আছে। কিন্তু সে ডাকের চাইতে শাস্ত্রের ডাকের উপর ভরসা অনেক। কারণ সে চলা পথ।

আজ শাস্ত্র আর রাজনীতির যে দ্বন্দ্ব এসে দাঁড়িয়েছে তাতে কে জিতবে সে অনুমেয়। দেখা যাক কি হয়। মধ্যস্থতার রাস্তা খুলবে, না উপেক্ষার, সেই দেখার। কিন্তু হিন্দু যে কোনোদিন এক হয়ে ছিল না, অন্তর্দ্বন্দ্ব তার যে আছেই, সে আবার প্রমাণিত হল। সে জাতিবিদ্বেষ হোক, কি শাস্ত্রের সংঘাত। শাস্ত্রীয় সংঘাতে উপায় বলা হচ্ছে মহাজনের রাস্তায় চলা। মহাজন কে? অনুভবে, না ক্ষমতায়?

 

81
Wed, 12/27/2023 - 00:46

মানুষের নিজেকে দুঃখ-শোক থেকে বাঁচানোর ক্ষমতা আছে। কিন্তু দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার ক্ষমতা নেই। দুশ্চিন্তার সাগরে উদ্বেগের ঢেউ। সে সামাল দিতে দিতে আত্মশক্তির অনর্থক অপচয়। অতিষ্ঠ জীবন। এর থেকে ত্রাণের রাস্তা নেই। কারণ এ আমারই সৃষ্টি। সৃষ্টি? না, তা হয় কি করে। সৃষ্টির সঙ্গে একটা আত্মনিয়ন্ত্রণ আর সংযম শব্দের যোগ থাকে। কিন্তু দুশ্চিন্তার অভ্যাসের সঙ্গে তার কোনো যোগ নেই। সে অনিয়ন্ত্রিত, অসংযত, এবং সর্বোপরি অবাস্তব।

দুশ্চিন্তার বড় যুক্তি হচ্ছে সে নাকি সাম্ভাব্য বাস্তবতাকে আগাম কল্পনা করে নিতে পারে। তার সমান্তরাল বাস্তবতা তৈরি করার ক্ষমতা। তার সে ক্ষমতার পাল্লায় পড়ে ইমোশনাল আমি, আর র‍্যাশেনাল আমি দুই-ই কুপোকাত তখন। দুশ্চিন্তা তো আর যাবে বলে আসে না। সে জ্বালাবে বলেই আসে।

সাপ নিজের বিষে মরে না। মাকড়সা নিজের জালে আটকায় না। কিন্তু মানুষ নিজের বিষে নিজেই মরে। তার দুশ্চিন্তার বিষ। তিলে তিলে মারে। “চিন্তা চিতা সমান”। কিন্তু এ চিতা বৈদ্যুতিকও না, কাষ্ঠলও না। এ চিতা ধিকিধিকি।

এ বিষ মহাবিষ। কেউ কম আক্রান্ত। কেউ বেশি। কেউ অতিরক্তি বেশি। এ মহাবিষ আছে বলেই মানুষ অমৃতের পরিচয় পেয়েছে। সে অমৃত হল শান্তি। সে জিনিসটা যতক্ষণ আছে টের পাওয়া যায় না। চলে গেলে টের পাওয়া যায়। সংসারে যত মাধুর্য, যত আনন্দ, যত মঙ্গল সব এই এককে ভিত্তি করে, তা অবশ্যই - শান্তি।

শান্তিই অমৃত। শান্তিই সঞ্জীবনী। শান্তিই আনন্দ। শান্তিই সত্য আর মঙ্গলের মূল। কিন্তু শান্তি জীবনের উদ্দেশ্য নয়। শান্তি জীবনের উপায়। গোলমালটা হয় এইখানে। আমরা শান্তি চাই। শান্তি চাওয়া যায় না। শান্তি আশীর্বাদ। শান্তি কৃপা। সে পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হয় নিজেকে। যেমন বুকের খাঁচাটা নিজেকে বাইরের বাতাস থেকে অক্সিজেন নেওয়ার যোগ্য করে তৈরি করে, তেমন। শান্তি উপায়। শান্তি পথ। শান্তি উদ্দেশ্য হতে পারে না।

বুদ্ধের একটা অমোঘ বাণী আছে ধম্মপদের শুরুতেই। সেটা হল -

মনই শ্রেষ্ঠ। যদি কেউ দূষিত অন্তঃকরণে কথা বলে বা কোনো কাজ করে, তবে গরুর গাড়ির চাকা যেমন গরুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে, তেমন দুঃখও তাকে অনুসরণ করে। (ধম্মপদ)

আমি অপমানিত, আমি তিরস্কৃত, আমি লুণ্ঠিত-বঞ্চিত - দিনরাত যে এ চিন্তায় অতিবাহিত করে তার বৈরভাব, রাগ কখনও শান্ত হয় না। (ধম্মপদ)

এ বাণী পীযূষ। অমৃত শরীরের আকাঙ্খা নয়। শরীরের আকাঙ্খা সুখ। অমৃত চিত্তের আকাঙ্খা। সে অমৃত হল শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। তারপর তাকে যে নামেই ডাকি না কেন। শান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হতে গেলে শান্তির রাস্তাতেই হাঁটতে হবে। যতবার শান্তি আর সুখের দ্বন্দ্ব সামনে আসবে, “সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো” এই কথা মনে রেখে শান্তিকেই বেছে নিতে হবে। খ্রীষ্ট বলছেন, সেই ধন্য যে শান্তিপ্রতিষ্ঠাতা, তাকে ঈশ্বরের সন্তান বলে আখ্যায়িত করা হবে।       

সংসারে শান্তি নেই তা নয়। নিজেকে শান্তির যোগ্য করে তুলিনি “লোভে আর ভয়ে লাজে” এই হল কথা।

 

82
Sun, 12/24/2023 - 23:57

গীতা কি সহস্র কণ্ঠে আবৃত্তি করার বই? গীতায় দেখানো হচ্ছে ভগবান ও তার কনফিউজড ভক্ত কথা বলছেন নিজেদের মধ্যে। ভক্তের কনফিউশান টেম্পোরারিলি কাটল। টেম্পোরারিলি এই জন্যে বলছি তিনি যুদ্ধের পর সব ভুলে গিয়েছিলেন। ভগবানকে আবার গোটাটা বলতে বলেছিলেন। ভগবান বলেন সে আমার যোগাবস্থায় বলা, এখন আর পারব না।

কিন্তু সে অন্য কথা। এমনিতে আমরা বাঙালিরা যে খুব ঘরে ঘরে গীতাপাঠ করি তা তো দেখি না। হ্যাঁ মারা গেলে বুকের উপর একটা গীতা থাকে। শ্রাদ্ধতে একটা গীতা দেওয়া হয়। সঙ্গে পৈতে, সুপারি, সন্দেশ আর একটা টাকা সোনালি পাতলা ফিনফিনে একটা থালায় করে দেওয়া, এই তো দেখেছি। আর শ্রাদ্ধের সময় কেউ একজন গীতাটা গোটা পাঠ করেন। মাঝে মাঝে লিকার চা খান। কারণ খালি পেটে দুধ চা খেলে গ্যাস হবে। আর যে গীতা পাঠ হয় আর যে গীতা দেওয়া হয় তার মধ্যেও বিস্তর ফারাক এও দেখেছি। যেটা দেওয়া হয় সেটার মধ্যে কোনো অনুবাদ থাকে না। একটা বড় পিনে আটকে, খুব ম্যাড়মেড়ে একটা ছবি সামনে দিয়ে বইটা ছাপা হয়। অনেক জায়গায় বিস্তর ভুলভ্রান্তি, মায় কিছু সময় কোনো অধ্যায় বাদ পড়ে যায়।

এ ছাড়া গীতাপাঠ তো তেমন বাঙালির ঘরে দেখিনি। তাই গীতাপাঠ হবে শুনলেই কানে “মধু বাতা ঋতায়তে” এইসব বাজতে থাকে। কি করব, অভ্যাস যে!

তবে বাঙালি ভীষণ সুন্দর চণ্ডীপাঠ করে, এ আমি বহুবার শুনেছি। কিছু কিছু জায়গায় পড়তে গিয়ে গলা বুজে পাঠকর্তা সাশ্রু নয়নে “মা মা” করে উঠেছেন এও দেখেছি। মহালয়াতে বীরেন্দ্র স্যার এমন একটা সুর আর আবেগ বেঁধে দিয়েছেন না, অনেকটা সেই পঁচিশে বৈশাখে “হে নূতন” এর মতন। শুনলেই কান্না পায়। মনটা সোজা উদাস। তো সেই চণ্ডীপাঠ যদি সহস্র কণ্ঠে হয় তবে সে পরম সুন্দর হয়। কারণ সে তো মায়ের স্তব। মেলা স্তব আছে। গীতায় যেখানে এগারো নাম্বার অধ্যায়ে “স্থানে হৃষীকেশ”… ইত্যাদি একটাই স্তব।

তো যেটা বলছিলাম বাঙালির গীতাচর্চা। তো শ্রাদ্ধ ছাড়া আর কি মনে পড়ছে? ওই যে গো, সেই বিপ্লবীরা গীতা পড়তেন না? সে আছে। কিন্তু সে বিপ্লব, ফাঁসি এখন আর কই?

বাঙালিদের বইয়ের দোকানে সব চাইতে পপুলার যে গীতাটা পাওয়া যায়, সেটা হল জগদীশ চন্দ্র ঘোষের গীতা। তার নানা সংস্করণ আছে। আমি ছোটোবেলায় বুঝতাম না “রাজসংস্করণ” মানে কি? রাজারা যেটা পড়তেন? কোন রাজা? পরে অবশ্য বুঝলাম সব চাইতে মোটা বইটাকেই রাজসংস্করণ বলে। তাছাড়া রামকৃষ্ণ মিশনের লাল মলাট গীতা। ইস্কনের “যথার্থ” গীতা, যা গাড়িতে করেও বিক্রি হয়। এই সব আছে। আর আছে প্রচুর পদ্যগীতা। বেশ কয়েকটা পড়ে দেখেছি, অনেকগুলো কৃষ্ণ নিজে পড়েও কনফিউজড হতেন। তবে বেশ কিছু ভালোও আছে। তবে সেগুলো বেশিরভাগই সিংহাসনে চন্দনের টিপে মাখা হতে হতে আর পাঠযোগ্য থাকে না।

আরেকটা মজার কথা আছে দেখেছি। বাঙালির অনেক মনগড়া তত্ত্বকথা গীতায় আছে, এমন ধারণা দেখেছি। আমাকে একজন যেমন বললেন, একি তুমি বিয়ে করোনি কেন? গীতায় লেখা আছে অবশ্যই বিয়ে কর‍তে হয়! তিনি বাবার রক্তপরীক্ষার জন্য রক্ত নিতে এসেছিলেন, বয়েস পাঁচের ঘরে। আমি আর কি বলি? হাত কচলে বললাম, এ হে, ওটা পড়া হয়নি তো… অথবা আমার পড়া সংস্করণে হয় তো ওটা ছাপা হয়নি!

তাছাড়া বাঙালির সেলুনে, মিষ্টির দোকানে, বাড়ির দেওয়ালে একটা এক পেজে গীতা তো থাকেই। ”তুমি কি হারিয়েছ যে কাঁদছ” ইত্যাদি। উপরে লেখা থাকে “গীতার সারাংশ”। সে যে কোন গীতার সারাংশ তা ব্যাসদেব কি যিনি বা যাঁরাই গীতার লেখক হয়ে থাকুন তা তাঁর বা তাঁদেরও বোঝার বাইরে।

বাঙালি মহাপুরুষের মধ্যে আসলে তেমন কি কেউ গীতার ভাষ্য লিখেছেন? উঁহু। মহাপ্রভু ভাগবতে জোর দিয়েছিলেন। তাঁর শিষ্যেরাও তার উপর কিছু কিছু টীকা লিখেছেন। চরিতামৃতে গীতার থেকে উদ্ধৃতি আছে কিছু কিছু যদিও। বঙ্কিমবাবু কৃষ্ণচরিত্র লিখতে গিয়ে গীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তের যে চরিত্র বর্ণন আছে, তার প্রশংসা করেছেন আর ওই কান্নাকাটি মার্কা ভক্তিকে এক হাত নিয়েছেন। শ্রী অরবিন্দ গীতাভাষ্যে করেছেন বটে, কিন্তু সে তো ইংরেজিতে। রবীন্দ্রনাথ অল্প কিছু জায়গায় গীতার কথা লিখেছেন। বিশেষ করে চারুচন্দ্রবাবুর করা “ধম্মপদ” এর অনুবাদের মুখবন্ধ লিখতে গিয়ে। এ ছাড়া গীতা নিয়ে বাঙালি সাধক কি পণ্ডিতকূল খুব কিছু লিখেছেন বলে মনে পড়ছে না। করে থাকলেও আমার জানা নেই, বা বাইরে তেমন আসেনিকো। ওদিকে মহাত্মা গান্ধী, তিলক যেমন গীতার ভাষ্য-টীকা লিখেছেন। এত ব্যস্ততাতেও। জেলে বসে।

তবে দাঁড়ালোটা কি? বাঙালি গীতাটা কখন পড়ে? না শ্রাদ্ধশান্তিতে। বাঙালি নানা গুরুর সম্প্রদায় যা আছে, মানে দীক্ষিতেরা, যেমন রামকৃষ্ণ মিশন, ইস্কন ইত্যাদিরা তারা কেউ কেউ পড়েন। তবে আপামর বাঙালির সঙ্গে তেমন মিশ খায়না। হিন্দি বলয়ে যেমন রামচরিতমানস বহুমানুষের স্মৃতি-জিহ্বাতে অবস্থিত। বাঙালির তেমন কোনো শাস্ত্র নেই।

আমাদের রামকৃষ্ণদেব বলছেন গোটা গীতাটা পড়ার কি দরকার? ওটা বারবার বললেই ওর সবটা মানে আছে ওতে। মানে গীতা গীতা দশবার বললে যে তাগী তাগী হয়ে যাচ্ছে কথাটা, ওটাই আসল। মানে সব ত্যাগ করো।

হাই সব্বনাশ! বলি ও ঠাকুর, ওই সহস্রকণ্ঠে যদি ত্যাগের বাণীই প্রধান হবে, তবে এত সন্ন্যাসী যাবে কোথায়? আর যদি বলো মনে ত্যাগ… তবে অমন উদাসী সংসারী নিয়ে হবেটাই বা কি!

যদি বলো পুণ্য হবে। তবে সে একটা কথা হল। সে না তো চোখে দেখা যায়, না মাপামাপির কোনো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু গীতার শেষে অর্জুনকে যে কৃষ্ণ ঠাকুর একটা সতর্কীকরণ বাণী দিয়েছিলেন, যে এই শাস্ত্র তুমি তপস্যাহীন, অভক্ত আর আমাতে অসূয়াযুক্ত মানুষকে বলবে না। এ অত্যন্ত গোপনীয় শাস্ত্র। তার বেলা কি হল? বলি আমাদের ঠাকুরের কপিরাইট নেই বলে যা ইচ্ছা তাই করবে? হ্যাঁ গা, ঠাকুর যে একে একান্তে, সশ্রদ্ধায়, গভীরে শুনতে বলেছিলেন। মাঠে মাইক লাগিয়ে সহস্রজনে কবে পড়তে বললেন গো?

 

83
Thu, 11/30/2023 - 23:09

ঘটনাটা মর্মান্তিক। কিন্তু অস্বাভাবিক নয়।

ছেলেটা গ্র‍্যাজুয়েশান পাস করল। অতি সাধারণ পরিবার থেকে আসছে। একটা নাম করা কোম্পানিতে যোগ দিল কাজে। ওরা বলল, আমরা যতদিন ট্রেনিং দেব ততদিন মাইনে দেব না। খাওয়া-পরা দেব।

তার সেই মুহূর্তে কোনো অপশান নেই আর। সে জয়েন করল। হাড়ভাঙা খাটুনি। তার মা একমাস পর দেখতে গেল। তার জন্মদিন সেদিন। ছেলের চেহারা দেখে চমকে উঠল। কিন্তু উপায় কই? বাবা নেই, নিজের পায়ে যত তাড়াতাড়ি হোক দাঁড়াতে তো হবেই। সবাই তো আর অত মেধাবী হয় না যে মাধ্যমিক, কি উচ্চমাধ্যমিক রেজাল্ট বেরোনোর পরের দিনই কাগজ জুড়ে তার ফিল্মি ভাষায় জয়যাত্রার গল্প লেখা হবে…. বাবা রিকশা চালায়, মেয়ে মাধ্যমিকে ৯৯% নাম্বার। তার দু'চোখ জুড়ে ডাক্তার হবার স্বপ্ন। সে স্বপ্ন পূরণ হবে? আসুন শুনে নিই তার মুখ থেকেই…. তার আত্মীয়স্বজনের মুখ থেকে… ইত্যাদি ইত্যাদি।

দু'রকম সত্য হয়। এক ভিজিবল ট্রুথ। আর এক রিয়েল ট্রুথ। রেজাল্ট বেরোনোর পর ওই সব গরীবঘরের মেধাবীরাই হয়ে যায় ভিজিবল ট্রুথ। বাকিটা? কে শুনবে সে গল্প?

যা হোক, ছেলেটা দাঁতে দাঁত চিপে কাজ করে যায়। এভাবে ও বড় হয়নি। যতই অতি-সাধারণ ঘরে জন্মাক, দাদু-দিদা-মায়ের আদরযত্নেই তো বড় হয়েছে। অবশ্যই তাতে গোটা জীবন কাটে না। কিন্তু এখানে যা হচ্ছে? না খাওয়ার সময়ের ঠিক, না খাবারে মানের ঠিকঠাক কিছু, না কোনো হেলথ্ স্কিম, না কোনো সিকিউরিটি স্কিম। কি হচ্ছে? কিন্তু বলেছে ওরা যে কয়েকমাস টিকে গেলেই কোম্পানি নিয়ে নেবে।

হঠাৎ একদিন রাতে ফোন এলো। মা আমাদের অমুক রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক'দিনের মধ্যেই।

বাড়ি আসবি না?

জানি না। তুমি কিছু জামাপ্যান্ট আমায় দিয়ে যেও।

মা আবার গেল। বুকে পাথর রেখে ছেলের সঙ্গে দেখা করল। ছেলে দু'দিন পরে ট্রেনের আনরিজার্ভ কম্পার্টমেন্টে উঠে বসল আরো অনেকের সঙ্গে। গন্তব্য, পশ্চিমবাংলার একদম অন্যদিকে আরেক রাজ্য।

এও ট্রেনিং-এর অংশ। এখানেও মাইনে নেই। এখানেও কোনো হেলথ্ স্কিম নেই, কোনো সিকিউরিটি স্কিম নেই। কাজ করে যাও।

মাঝে মাঝে খবর পায় মা। একদিন শুনল তাদের এবার জয়েনিং দেবে, গন্তব্য জানিয়ে দেওয়া হবে।

ক'দিন বাদে মা খবর পেল ছেলে আরো অনেকের সঙ্গে উঠেছে আবার এক দূরপাল্লার আনরিজার্ভ বগিতে। গন্তব্য দক্ষিণের এক রাজ্য।

তাদের নিয়ে যাওয়া হল পাণ্ডববর্জিত এক গ্রামে। সেখানে কাজ, রাস্তা বানানো। খাবার তো দূর, খাবার জলের অবধি কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেই।

সে সেখানকার ভাষা বোঝে না। খাবার-শোয়ার ঠিকঠাক ব্যবস্থা নেই। রোজ সকালে ট্রাক আসবে, তাদের নিয়ে যাবে কাজের জায়গায়, আবার এই গ্রামে ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।

কিন্তু এতদিন তো ওই নামী কোম্পানির লোগোওয়ালা টুপি ইত্যাদি দেওয়া হত, ওরা কই?

জানিয়ে দেওয়া হল, এই জয়েনিং হয়েছিল থার্ডপার্টি থেকে। ওই কোম্পানির এখন লাগবে না। তাই তাদের মালিক এখানে এনে ফেলেছে। আপাতত মাইনে নেই। বড় বড় অনেক কোম্পানি এইভাবে থার্ডপার্টি দিয়ে লোক নিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়।

সে টিকতে পারল না। মা এখান থেকে তৎকালে টিকিট করে দিল। সে ফিরে এলো। অনেকেরই অবশ্য এই ফেরার চিন্তাটাও বিলাসিতা।

ধুরন্ধর তার্কিক বলবে, তার তো আগেই খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। তাদের আমার একটাই কথা বলার, এই ধরণের উচিত ভাবার সময় সবার সবসময় থাকে না। এই গেল এক নম্বর। আর দুই, নানারকম স্ক্যামে কত ধুরন্ধর লোক আজকাল ফাঁসছে সে তো পেপার খুললেই দেখা যায়। যার জন্য সরকারকে ভাবতে হচ্ছে যে বেশি টাকার অঙ্ক পাঠাতে গেলে চারঘন্টা একটা উইন্ডো পিরিয়ড রাখা হবে।

যে ছেলেটা ফিরে এলো, এইভাবেই সে ফিরে এলো, পরিযায়ী শ্রমিক হতে হতে ফিরে এলো। কিন্তু এটা-একটা গল্পের একদিক মাত্র।

লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের কি অবস্থা হয়েছিল সে অনেকেরই হয় তো স্মৃতিতে থাকবে। যদিও সে স্মৃতি ম্লান হতে বেশি সময় লাগেনি আমাদের। জীবন তো নদী। আমরা সে নদীতে বড় বড় জাহাজের চাকচিক্য দেখব, নাকি ডিঙির ডোবা ভাসা দেখব?

পরিযায়ী শ্রমিক সারা ভারতে কোথায় কত পরিমান যায়, কোথাও কারোর কাছে কোনো সঠিক ডেটা ছিল না। এখনও আছে বলে মনে হয় না। হাওড়া-শিয়ালদায় গেলে দূরপাল্লার ট্রেনে আনরিজার্ভ বগির সামনে সে বিশাল লাইন থাকে, যাদের উপর বিরক্ত হয়ে, ঠেলে গুঁতিয়ে নিজেদের উচ্চশ্রেণির ক্লাসের দিকে যেতে হয় তাদের অনেকেই এই শ্রেণীর। একবার মনে আছে জ্বরে বেঁহুশ এক ছেলে ট্রেনে পড়ে আছে, সে ব্যাঙ্গালোরে যাচ্ছে কাজে, প্রায় আট-দশ ঘন্টা হয়ে গেল কোনো সহযাত্রীর কোনোরকম কোন হুঁশ নেই। একটা প্যারাসিটামল দেওয়ার মানুষও নেই।

এরকম বহু বহু অভিজ্ঞতা সবার আছে। ক্রিকেট আর সিনেমা অবসেসড্ একটা দেশের কাছে সবটাই যতক্ষণ না একটা রোমহষর্ক নাটকীয়তায় রূপ নিচ্ছে ততক্ষণ সাধারণ পাব্লিক এটাকে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিস বলে মনেও করে না। অনেক তথাকথিত শ্রমজীবী রাজনৈতিক ভাবাদর্শ মানুষ আবার এই ফাঁকে ধর্ম ইত্যাদি নিয়েও তার ব্যঙ্গবিদ্রূপ করার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চান না। কারণ টানেলের সঙ্গে চারধাম শব্দটা জুড়ে আছে।

পরিযায়ী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, সঠিক স্ট্যাটেসটিকস ইত্যাদি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার কথা এখনও আমাদের অভ্যাসে দাঁড়ায়নি। নইলে সত্তর ঘন্টা কেন, আশি-নব্বই ঘণ্টা কাজ করেও নিজের পরিবার চালাতেই হিমশিম খাওয়া মানুষ কি করে উজ্জ্বল দেশ গড়ার কথা ভাববে আমার জানা নেই।

আজ সুড়ঙ্গবন্দী শ্রমিকদের নিয়ে হঠাৎ করে যে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সে মিডিয়ার কাজ। সে আমাদের সত্যকারের ছবি নয়। আমাদের সত্যকারের ছবি যদি একবার সামনে আসে তবে আমাদের নিজেদেরই নিজেদের দিকে তাকাতে লজ্জা করবে। অনেক ছবি এড়িয়ে আমরা ভালো আছি। অনেক সত্যকে অস্বীকার করে আমরা সুস্থ আছি। সেসব সামনে না আসাই ভালো। সমাজের সেসব দিক নিয়ে আলোচনা করা নিতান্ত শৌখিনতা আমার কাছে, যদি না সে মানুষদের সঙ্গে আত্মিক যোগাযোগের ব্যবস্থা করি নিজের চিত্তে। নইলে শুধু টি-আর-পি বাড়ানোর জন্য সুড়ঙ্গবন্দী বাড়ির লোকদের দুশ্চিন্তার ছবি, মুখ, কান্না ইত্যাদির মশলা তো আছেই। অনেকের তো অনেক বাড়ির লোকের মুখ নাকি চেনাও হয়ে গেছে। রোজ দেখা হয় যে। কিন্তু কেন? কারণ এটাই আমার কাছে জ্বলন্ত ইভেন্ট একটা। আবেগটা অসৎ বলছি না। বড্ড অগভীর আর তাৎক্ষণিক।

 

84
Sun, 11/19/2023 - 10:48

 

 

রবীন্দ্রনাথ কখনও ছটপুজো নিয়ে লেখেননি। বিবেকানন্দ কখনও ছটপুজো ও বেদান্ত নিয়ে ভাষণ দেননি। যদিও অনেক বাঙালি আজকাল দেখি ছটপুজো করেন, তবে সে অন্য বাঙালিরা। যারা অত ‘সাংস্কিতিক মনোস্কো’ নন, তাঁরা করেন। কিন্তু অনেক বাঙালি পরিবেশ নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েন। “খোঁট্টা”-দের বিচার-বিবেচনাহীনতায় সোশ্যালমিডিয়া জুড়ে গ্রেটা থুনবার্গের বাঙালি সংস্করণদের পোস্টে রীতিমতো মেলা বসে যায়। প্রতি বছর রবীন্দ্রসরোবর আলোচনায় চলে আসে। এবং কিভাবে কলকাতা দূষণের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সে নিয়ে আলোচনার পর আলোচনা হয়।

আমি সেগুলো সব মেনে নিয়ে আমার দেখা ছটপুজো নিয়ে লিখতে চাইছি। কেন চাইছি? তার একটা গপ্পো আছে। কদিন আগে, একটা অবাঙালি পাড়া দিয়ে যেতে যেতে প্যাণ্ডেল বাঁধা দেখে আমার এক বন্ধু বলে, এটা হয় তো বা ছটপুজোর জন্য হচ্ছে।

আমি বললাম, তা কেন হবে? এদিকে তো কোথাও পুকুর-টুকুর নেই। তাছাড়া এটা ঘাটে আর বাড়িতেই হয় সাধারণত। ঘাটের পাশে মঞ্চ হয়, মূর্তি বসে এসব হয়, কিন্তু তার তো কারণ আছে, পুজোর সঙ্গে জলাশয়ের যোগ আছে যে!

ওকে এই কথাগুলো বলতে গিয়ে জানলাম ছটপুজো নিয়ে আমার একটা ধারণা আমার অজান্তেই তৈরি হয়েছে।

ছটপুজো অবশ্যই বিহারের সব চাইতে বড় উৎসব। উত্তর প্রদেশেও হয় যদিও। সেইভাবে দেখতে গেলে এখন সারা ভারতে তো হয়ই, তাছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নানা ডায়াস্পোরাতে হয়।

ছটের মত এত বড় একটা উৎসবে ব্রাহ্মণ লাগে না, পুরোহিত লাগে না। এইটা আমার সব চাইতে ভালো লাগে। সমাজে সব স্তরের মানুষের এই উৎসবে নিয়মকানুন এক। জাতপাতের ভেদ ছাড়া এতবড় উৎসব আর কি আছে? অনেক সেক্যুলার প্রগ্রেসিভ দুর্গাপুজোতেও দেখেছি ব্রাহ্মণ ছাড়া পুজো করানো হয় না। সেখান এতবড় উৎসব বিনা মন্ত্রে শুধু লোকগানের ভাষায়, এটা আমার ভীষণ ভালো লাগে।

আমাদের যেখানে তর্পণের দিন নিজের বাপ-মাকে স্মরণ করতে পুরুতের খুঁটো ধরতে হয়, যেখানে আমরা মেনে নিই যে, যে মানুষটা আমার সঙ্গে রীতিমতো বাঙলা চলিতে কথা বলে জীবন কাটালো, সে-ই নাকি আত্মা হয়েই তার ভাষা ভুলে গেল, সংস্কৃত ছাড়া আর কোনো ভাষার ডেটা নেই তার কাছে। কি তাজ্জব না? আপামর হিন্দু ভারতীয়েরই এই বিশ্বাস।

কিন্তু এইখানে, এই পুজোয় ভক্ত বিশ্বাস করে ছট মা তার দেহাতি ভাষার গান বুঝছেন। সে গানে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি, সুখদুঃখ, জিনিসের দাম সাধ্যের বাইরে যাওয়া ইত্যাদি কি নিয়ে না কথা নেই!

ছটের অনেক পৌরাণিক মত আছে। কেউ বলেন শ্রীরাম ও সীতা লঙ্কা থেকে ফেরার পর এই পুজো করেছিলেন। কেউ বলেন, দ্রৌপদী এই পুজো করেছিলেন। কোনো মতে কোনো রাজার পুত্র হচ্ছিল না বলে এই পুজো করেছিলেন। আবার এও আছে যে কর্ণ, নিজের পিতা সূর্যদেবকে যে জল অর্পণ করতেন সেই থেকে এই পুজো চলে আসছে। আরো আছে, ছট মা ব্রহ্মার মানসকন্যা, সূর্যের বোন। কেউ বলেন তিনি কাত্যায়নীর রূপ। এরকম নানা গল্প তো আছেই। যত মানুষ তত ভাব। এই তো সত্য।

পুজোর অনেক অনুষঙ্গ। একদিন লাউভাত খাওয়া। একদিন ক্ষীরপুরী খাওয়া। তারপর প্রায় চল্লিশ ঘন্টা উপোস থেকে সন্ধ্যার্ঘ ও প্রভাত অর্ঘ্য দেওয়া জলে দাঁড়িয়ে।

পঙ্কজ ত্রিপাঠি আমার খুব প্রিয় অভিনেতা। তিনি আজকে একটা দৈনিক পত্রিকায় খুব সুন্দর লিখেছেন নিজের ছটের অনুভবের কথা। লিখছেন যখন ছোটো ছিলাম আমার বাড়ির ঠিক পিছনেই একটা নদী ছিল, তার পাড়েই আমরা ছটে যেতাম। তখন এত বাজারদোকান তো ছিল না। ফলে আমাদের ক্ষেতের আঁখ আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতাম। তাদের ক্ষেতের ফল তারা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিত। ছটের বিশেষত্বই হচ্ছে এ পুজোয় ক্ষেতের জিনিসই লাগে। ফসল, ফল ইত্যাদি। তখন আমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা করে জামা তো বাবা আনতেন না, বড় ছিট কিনে আনতেন, সেটা কেটে কেটেই আমাদের জামা হয়ে যেত। আমরা যখন একসঙ্গে নদীর ধারে যেতাম সবাই দেখত সবারই এক ধরণের জামা। অনেক পরিবারেই তাই হত। আমরা ছেলেরা পুজোর আগেই নদীর ধার পরিষ্কার করার কাজে লেগে যেতাম। নদী ধার, পুকুরের ধার পরিষ্কার করা। সাজানো। সব আমাদের কাজ ছিল। আসলে পাড়াপ্রতিবেশি সবাই মিলে না এক হলে এ পুজো করা যায় না। মাকে দেখতাম যখন সন্ধ্যা বেলা নদীর জলে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য দিচ্ছেন, গান গাইছেন, সেই গানে পরিবারের সবার নাম করছেন। বৃহৎ পরিবারের কথা বলছি। এমনকি যার সঙ্গে মায়ের কিছু মনোমালিন্য হয়েছে তার নামও বাদ যাচ্ছে না।

পঙ্কজ ত্রিপাঠি শেষে লিখছেন যদি আমরা এইভাবেই সারা বছর আমদের রাস্তাঘাট, নদী-পুকুর-দীঘি পরিষ্কার রাখতে পারি কতই না ভালো হয়।

ভালো তো হয়, কিন্তু আমাদের নদী পুকুর তো দূরের কথা, মন্দিরের ভিতরে বাইরে যা অবস্থা করে রাখি! মহাত্মা গান্ধী তো কাশী ইত্যাদি ধর্মস্থানে গিয়ে আঁতকে উঠতেন যে, যে স্থানকে আমরা এত পবিত্র বলি, সেই স্থানকেই এত নোংরা করে রাখি কি করে!

কাঁচরাপাড়া বড় শহর। আজ বাজারে গিয়ে দেখি রাস্তার দুই ধারে আঁখ আর নানা ফল নিয়ে কত কত দোকান। অবাঙালি মানুষের ঢল। রাস্তায় যেতে যেতে ছটের গান কানে আসছে। আমাদের রামপ্রসাদী গানের মত, সুর শুনলেই চেনা যায়। টানা টানা গায়কীতে কি এক দরদ। পদ্মভূষণে ভূষিতা বিখ্যাত লোকগীতি গায়িকা ও বিশেষজ্ঞ ডক্টর শারদা সিনহা এক পত্রিকায় লিখছেন ছটে গানের অনুষঙ্গের কথা। কিভাবে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে গানের ভাষায় বদল হয়েছে। নিত্য জীবনের টুকিটাকি কথা উঠে আসে। যে কথা খানিক আগেই লিখছিলাম।

ছটে রাস্তায় দণ্ডি কাটতে দেখি প্রত্যেকবার। একবার লিখেছিলাম কাঁচরাপাড়া স্টেশানের এক ভিখারির দণ্ডি কাটার কথা। তখন আমি ছোটো। সে রাস্তায় দণ্ডি কাটছে আর তার পিছনে পিছনে তার দুই ছেলে আর বর যাচ্ছে, মাথায় ফলের ঝুড়ি নিয়ে। আমার বিস্ময় লেগেছিল দেখে, ওরও পরিবার আছে! আমার অনভিজ্ঞ কিশোর মনে ধারণা জন্মেছিল সে একা! নিতান্ত বেচারি। তার যে পরিবার আছে শুধু না, তার রাস্তায় সর্বসমক্ষে নত হওয়ার মত এমন বিশ্বাসও আছে ওই রুগ্ন শরীরের বুকের মধ্যে জেনে আশ্চর্যই হয়েছিলাম।

মানুষ যখন ভালোবেসে নত হয়, তার মধ্যে একটা সৌন্দর্য থাকে। ছোটো শিশুকে কোলে তুলে নিতে যখন নিজে নত হই, কাউকে নত হতে দেখি, আমার চোখে বুকে মাথায় কি আরাম লাগে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে লিখছেন, যদি বলি মানুষ স্বাধীনতা চায়, তবে মিথ্যা কথা বলা হয়, সে অধীন হতেই চায়।

রবীন্দ্রনাথ বলছেন ভালোবাসার অধীন হওয়ার কথা। যে অধীনতাটুকু গেলে এমন কাঙাল হতে হয় যে গোটা বিশ্বের সব সম্পদও সে কাঙালপনা দূর করতে পারে না। আর এমন দুর্মতি ভর করে যে শিশুদের হত্যা করতেও বুদ্ধির কোনো কোণায় বাধে না।

যখন এ লেখা লিখছি, দূর থেকে ছটের সুর ভেসে আসছে। বেদবেদান্তে ছটের কথা লেখা থাকুক চাই না থাকুক, কিন্তু এই ঘর, ঘাট আর মহাকাশের জ্যোতিষ্কের মধ্যে যে মেলবন্ধন সে আমাকে বিস্মিত করে। মুগ্ধ করে। এ ততটা পুজো নয় যতটা আত্ম-নিবেদন আর সামাজিক মেলবন্ধনের উৎসব। মধ্যাহ্ন প্রীতিভোজের মেলবন্ধন বা প্যাণ্ডেল হপিং না। এ উৎসবের মেল বন্ধন। বিনা ব্রাহ্মণ্যবাদ, বিনা সামাজিক ছুঁৎমার্গ!

 

(ছবি: Debasish Bose এর আর্কাইভ থেকে।)

 

85
Fri, 11/17/2023 - 00:02

 

ঘোর। অবসেসান। অবসেসান কখনও অন্যকে নিয়ে হয় না। সব অবসেসানের মূলে আমি। এই যে নিজেকে বোঝাচ্ছি তোমাকে নিয়ে অবসেসড আমি। এ ডাঁহা মিথ্যা কথা। যদি তুমি বিশ্বাস করো, তবে তুমি বোকা। আস্ত গোটা বোকা।

তোমাকে নিয়ে অবসেসড? বিশ্বাস করো? তোমাকে দেখলে আমার যে সুখ জন্মায়, কফির অ্যারোমার মত… আমি সেই সুখে অবসেসড। তুমি আমার সুখের অ্যারোমা। একটা কথা জেনে রেখো অবসেসান কখনও ভিন্ন পাত্রে হয় না। হয় স্বপাত্রে। নিজেকে নিয়ে।

আমার ভয় নিয়ে অবসেসান, আমার প্রেম নিয়ে অবসেসান। আসলে আমার সব অবসেসান আমার ভয়কে নিয়ে। আমার সুখ হারাবার ভয়। প্রবল ভয়। এও জেনো, ভালোবাসা নিয়ে কখনও অবসেসান হয় না। সব অবসেসান ভয় নিয়ে। ভালোবাসা হারানোর ভয়। সুখ হারানোর ভয়। এই করতে করতে একদিন আসে ভয়কে হারানোর ভয়।

অবাক হলে? অবাক লাগে শুনতে, কিন্তু আসলে অবাক হওয়ার মত কিছু নেই। যে মানুষ ভয়কে হারানোর ভয় নিয়ে বাঁচে, আসলে সে অবসেসানের অনেক গভীর ঘরে। তার কাছে তার ভয়ই তার পরিচয়, তার অস্তিত্বের নূপুরধ্বনি। সেই ভয়কে হারালে সে বাঁচবে কি নিয়ে? এ তার ভ্রম।

সব অবসেসানের গভীরে আছে ভয়। অনিশ্চয়তার ভয়। জীবনে কোনো মুহূর্ত নিশ্চিত নয়। মোহ তা বিশ্বাস করতে চায় না। সে পাঁচিল গাঁথে। ভাবে দুর্ভেদ্য হবে সে পাঁচিল। মোহ মেঘ। মেঘের অন্ধকারে জন্মায় অবসেসানের ঘোর।

আমার গোটা জীবন কাটছিল এই অবসেসানে। ঘোরে। ভয়ের ঘোরে। আমার বায়াসনেস, আমার জাজমেন্টাল হওয়া, আমার যাবতীয় যা কিছু অসূয়া খোলা বাতাসের অভাবে। আমার গোটা জীবন কাটছিল দরজা-জানালা বন্ধ করে।

একদিন বললাম, আর না। আর কিছুতেই না। আমার ভাবনার জালে গড়ে তোলা জীবনে আমার বিতৃষ্ণা। আমি চাই না এ জীবন। এত ভয়, এত ভয়, এত ভয়!

ঘুণপোকার বাসা খুঁজে পাওয়ার মত ভয়ের বাসা খুঁজে বেড়ালাম। দেখলাম ভয়ের কোনো বাসা নেই। ভয়ের বাসা আমি। ভয় গেল না। ভয়ের বাসা গেল। আমার গায়ে যত সাজ ছিল, একে একে খুলে ফেললাম। বললাম নিজেকে, যত সাজবে তত ভয়ের বাসা হবে। কান্নার আওয়াজ পেলাম। নিষ্ঠুর হলাম। তার সব সাজ জলাঞ্জলি দিয়ে বললাম, এভাবে বাঁচা অভ্যাস করো। কেউ বলল, আমার সাজের সুখ?

নিশিডাক। সাড়া দিতে নেই। সাড়া দিলে আবার শুরু হবে খেলা। ভয় ভয় খেলা। অবসেসানের খেলা। তুমি শুধু জেনো, তোমায় আমি ভালোবাসি। এর অতিরিক্ত যদি কিছু বলি, সে যতই আলঙ্কারিক হোক, জেনো সে মিথ্যা। অবসেসান অন্যকে নিয়ে হয় না। নিজেকে নিয়েই হয়। নিজের ভয়কে নিয়েই হয়।

 

|| Fear ||

Khalil Gibran

===============

It is said that before entering the sea a river trembles with fear.

She looks back at the path she has traveled, from the peaks of the mountains, the long winding road crossing forests and villages.

And in front of her, she sees an ocean so vast, that to enter there seems nothing more than to disappear forever.

But there is no other way. The river can not go back.

     Nobody can go back. To go back is impossible in existence.

The river needs to take the risk of entering the ocean because only then will fear disappear, because that's where the river will know it's not about disappearing into the ocean, but of becoming the ocean.

(ছবি ইন্টারনেট)

 

86
Mon, 11/06/2023 - 23:59

১) সূচনা

=======

যদি বলি, এমন একটা গান বলো, যাতে রবীন্দ্রনাথের বহির্মুখ জীবনের আদর্শকে ধরতে পারি, তবে সে কি গান হয়?

আমার মনে হয়, সে গান হতে পারে, "আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া।"

যদি বলি, রবীন্দ্রনাথের অন্তর্মুখ জীবনের এমন একটা গান, যা সে জীবনের আদর্শকে তুলে আনে?

আমার মনে হয় সে গান হতে পারে, "আমার মন চেয়ে রয় মনে মনে, হেরে মাধুরী"।

এ গান আমি যতবার শুনি ততবারই মনে হয় মনের উপর থেকে একটা পরত খুলে গেল। আরেকটু কি যেন বুঝলাম। তা স্পষ্ট নয়, কিন্তু তা তুচ্ছও নয়।

বালখিল্যতা হল? অতিসরলীকরণ হল? হতে পারে। কেউ বলবেন, এক সমুদ্র জল কি এক চামচে ধরে? আমি উত্তরে বলব, একটা রাগের যেমন পকড় হয়, বাদী-সমবাদী হয়, তেমন এই দুটো গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের দুই জীবনের মূল সুরের ছায়া যেন পড়ে আছে।

কিন্তু আজকে অন্য একটা বিষয়ে গল্প বলার ইচ্ছা। রবীন্দ্রনাথের ওই "আপন হতে বাহির হয়ে" সুরের অববাহিকায় ভেসে একটা নদীর গল্প বলার ইচ্ছা। যে নদীর জন্ম চীনে। কিন্তু তার শাখাপ্রশাখা আজ ছড়িয়ে গিয়েছে নানা দিকে। যার একটা শাখা কেরালাতেও আছে। শিল্পের আরেক হাত ধরে।

রবীন্দ্রনাথ স্তাবক পরিবৃত হয়ে দিন কাটিয়ে যাননি। গেলে ওঁর বাহ্যিক জীবন হয় তো অনেক মসৃণ হত। বসার ঘরে বসে শৌখিন সাহিত্য, সঙ্গীত, ভাস্কর্যচর্চায় অনায়াসে দিন কাটানো গেলে এত টানাপোড়েন বাহ্যিক জীবনে কি হত?

রবীন্দ্রনাথ কর্মী খুঁজেছিলেন। স্তাবক খুঁজে বেড়াননি। আজকের দিনে এ বুদ্ধিগতভাবে বোঝা যায়, কিন্তু মজ্জাগতভাবে অনুভব করা কঠিন।

রবীন্দ্রনাথের অন্বেষণ ছিল, ব্রত ছিল। অন্বেষণ তাঁকে অন্তর্মুখে নানা ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়ে নিয়ে গেছে। আর ব্রত তাঁকে বাইরে নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেছে। দুইয়ের মধ্যে একে অন্যকে প্রভাবিতও করেছে।

তবে শুধুই কি রবীন্দ্রনাথ? তাঁর আশেপাশে যে মানুষদের তিনি আবিষ্কার করেছেন, সে মানুষেরাও কি তাঁদের অন্তঃস্থলে এক অন্বেষণ নিয়ে বেঁচেছিলেন না? আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে তাঁদের সেই অন্বেষা উজ্জীবিত হয়েছে। রূপ পেয়েছে রবীন্দ্র ধারায় মিশে। রবীন্দ্রনাথ যেন এক মহানদী, যার মধ্যে এসে মিশেছে এক একটা ছোটো ছোটো নদী। তারা নিজেদের সর্বস্ব দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাধনাকে সফল করতে। তবেই শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছে "বিশ্ববিধাতার যজ্ঞশালা আত্মহোমের বহ্নিজ্বালা"। সেই যজ্ঞে আহুতি দিয়েছেন বহুজন। তাঁদেরই মধ্যে একজনের গল্প প্রফেসার তানের। তান য়ুন সান।

 

২) তান য়ুন সান - প্রাক্ অধ্যায়

======================

জন্ম ১৮৯৮ সালে। ১০ই অক্টোবর। তান অনেক অল্প বয়েসেই বাবা-মা'কে হারান। বারো বছর বয়সের মধ্যে অনাথ হয়ে পড়েন তান। হয়তো এত অল্পবয়সে বাবা-মা'কে হারানোর ফলেই জীবন নিয়ে গভীর জিজ্ঞাসা জন্মায় তানের। যা ওঁর শেষ জীবনে জীবনের মূল সুর হয়ে ওঠে। তান গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন চীনা সাহিত্য, বিশেষ করে প্রাচীন চৈনিক সাহিত্য। কনফুসিয়াসের দর্শন। লাও ৎসু'র দর্শন। এবং সর্বোপরি বৌদ্ধদর্শন। ক্রমে সুপণ্ডিত হয়ে ওঠেন। এরই সঙ্গে পাঠ নেন পাশ্চাত্য শিক্ষার ও দর্শনের বিষয়গুলোরও।

১৯২৪ সাল নাগাদ তানের লেখা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু করে। লেখার মধ্যে তানের দর্শন, সমাজ নিয়ে সুচিন্তিত গভীর ভাবনা ফুটে ওঠে। কিন্তু তানের মধ্যে ছিল নতুনকে জানার এক অদম্য তৃষ্ণা। সে হোক তাঁর বর্তমানের বিশ্বাসের প্রতিকূল, তবু সেটাকে জানার প্রতি সৎ গভীর অন্বেষণস্পৃহা তানের আজীবন ছিল। মাও ৎসে-তুং'এর বামপন্থী দর্শন ও আন্দোলনে নিজেকে জড়ান তান। 'নিউ পিপল লার্নিং সোসাইটি', 'নিউ কালচার সোসাইটি'-তে যোগ দেন। লেখালেখি করেন, সম্পাদনার কাজ করেন।

কিন্তু বেশিদিন এ সবের মধ্যে থাকলেন না তান। চীনে এই সময় চলছিল দুই ধারার আন্দোলন। একটি ধারা রাজনৈতিক। আরেকটি ধারা সামাজিক। তানের মন সায় দিল দ্বিতীয় ধারার আন্দোলনে। সে আন্দোলনে চৈনিক সমাজে পাশ্চাত্যের শিক্ষা-দর্শন-ভাবনার প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। বিশেষ করে ফ্রান্সের ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল একদল তরুণ। সেই মুক্তভাবনা তানের জীবনকে আলোড়িত করেছিল। যদিও তানের জীবনের মূল অন্বেষণ ছিল এক অদ্ভুত টানাপোড়েনে। এই সময়ে বিখ্যাত বৌদ্ধপণ্ডিত, তাই জুয়ের কাছে বৌদ্ধদর্শনের পাঠও চলছিল পাশাপাশি।

তখন মালয় উপদ্বীপ চারটে অংশ নিয়ে গঠিত ছিল ব্রিটিশ শাসনাধীনে। বর্তমানের মালয়েশিয়া আর সিঙ্গাপুর সেদিন একসঙ্গেই ছিল। তান অধ্যাপনার কাজ নিয়ে সেখানে যান। এবং বলা যায় চৈনিক সাহিত্যের গোড়াপত্তন উনিই করেন সেখানে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। সিঙ্গাপুর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি চৈনিক সংবাদপত্রে তানের লেখা তার আধুনিক চিন্তাভাবনার কারণে বেশ সাড়া ফেলে। তান জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন প্রবাসী চৈনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে।

এই সময়ে তানের সঙ্গে পরিচয় হয় শিক্ষিকা চেন নাই ওয়াইয়ের। চেনের জন্ম চীনের ইয়ুন্নানে। পরিচয় গভীর হয়। এবং তান অনুভব করেন চেন তাঁর জীবনের সঙ্গী হতে পারেন, তাঁর ব্রত উদযাপনের সহায় হতে পারেন। তানের অনেক ইচ্ছা, ভারতে যান, গভীরে বৌদ্ধদর্শন নিয়ে পড়াশোনা করেন; ইউরোপে যান, সেখানকার চিন্তাভাবনা, সেখানকার সমাজকে নিজের মত করে অনুভব করেন, জানেন; তারপর এসে নিজের দেশে ফিরে শিক্ষাব্রতে অংশ নেন।

কিন্তু কি ছিল বিধাতার মনে। ১৯২৭ সালের জুলাই মাসে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন সিঙ্গাপুরে। তানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়। কথা হয়। রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রণ জানান তানকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতার জন্য। তান সাড়া দেন। তান চেনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

 

৩) তান য়ুন সান - শান্তিনিকেতন

=======================

তান শান্তিনিকেতন আসেন ১৯২৮ সালে। এসে পড়েন সাগরে। এ কি শুধুই রবীন্দ্রনাথ? এক-একজন বিদগ্ধ পণ্ডিতের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনায় তান ক্রমে বুঝতে পারেন শিকড় প্রবেশ করছে অনেক গভীরে। ভারতকে আরো গভীরে বুঝতে গেলে ভারতের প্রাচীন ভাষাকে বুঝতে হবে। জানতে হবে। তান পণ্ডিতপ্রবর ক্ষিতিমোহন সেনের তত্ত্বাবধানে সংস্কৃত পাঠ শুরু করেন। সঙ্গে নানা বিষয়ে কবিতা, প্রবন্ধও লিখতে শুরু করেন তান যা চীনের নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে।

কিন্তু তানের স্বপ্ন আরো বড়। তিনি শান্তিনিকেতনে এক নতুন অধ্যায় শুরু করতে চান। চীনের শিক্ষাকে এখানে আনতে চান। ভারতের শিক্ষাকে চীনে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু অর্থ কোথায়? বিশ্বভারতীর ভাঁড়ারের হাল তো দেখছেনই, যে কারণে দীর্ঘদিন তিনি এক পয়সা পারিশ্রমিকও নেননি শিক্ষাদানের জন্য।

কি আশ্চর্য লাগে, না? তিনি যদি সিঙ্গাপুরে বা মালয়েশিয়ায় থেকে যেতেন? অন্তত অর্থের দিক থেকে তো কোনো বেগ পেতে হত না? বাইরের জীবন কি নিশ্চিন্তভাবে কাটাতে পারতেন, অল্প একটু নিজের আত্মার ডাকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিলেই চলত। কিন্তু তিনি তা করেননি। অমন নিশ্চিত জীবন ছেড়ে চলে এসেছিলেন এমন অনিশ্চিত জীবনের টানে। যে প্রতিষ্ঠানের থেকে তিনি পারিশ্রমিক অবধি নিলেন না কতগুলো বছর। কি ছিল রবীন্দ্রনাথের ডাকে! সে এক তানের অন্তরাত্মাই জানবেন।

স্বপ্নকে সফল করতে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে ১৯৩১ সালের শুরুতেই বিদায় নিলেন তান। টাকা জোগাড় করতে হবে তো।

সিঙ্গাপুরে দু'মাস থেকে চলে এলেন রেঙ্গুনে। রেঙ্গুনে এক চৈনিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজে যোগ দেন। সেখানেই তিনি শান্তিনিকেতনে 'চীনা ভবন' গড়ে তোলার বিষয়ে প্রথম লেখেন।

এরপর সেই কাজে ইস্তাফা দিয়ে, চীনের দূত শী গুয়োলিয়ং-এর সঙ্গে তিব্বতের উদ্দেশ্য রওনা দেন। উদ্দেশ্য ছিল ত্রয়োদশ দলাই লামা, থাপতেন গ্যায়াতসো-র সঙ্গে দেখা করা।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে যাত্রাপথেই শী মারা যান। তান একাই তিব্বতে পৌছন। দলাই লামা'র সঙ্গে দেখা করেন। দলাই লামা মহাত্মা গান্ধী'র উদ্দেশ্য একটা বার্তা দেন, যা নিয়ে তান কালিংপঙ ফিরে আসেন। শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেন মার্চ মাসে। ফিরেই ভারতের বৌদ্ধতীর্থ স্থানগুলো দর্শনের জন্য বেরিয়ে পড়েন। মন তোলপাড়। রাস্তা পাচ্ছেন না, কিভাবে গড়ে উঠবে শান্তিনিকেতনে 'চীনা ভবন'। টাকা আসবে কিভাবে? এ স্বপ্ন তো তার একার না এখন, রবীন্দ্রনাথেরও তো স্বপ্ন এটা। গুরুদেবের স্বপ্ন।

সবরমতীতে মহাত্মা'র সঙ্গে দেখা করেন। দলাই লামা'র বার্তা দেন। মহাত্মা কি সে বার্তা বুঝতে পেরেছিলেন? জানি না। একটু সন্দেহই হয়। কারণ তিনি ওই বছরেই মে মাসে একটা চিঠি লেখেন, যেখানে লেখেন,

 

Dear friend,

I thank you for your gift. I am sorry I cannot understand your language. My desire and hope is that Tibetans should understand and follow the secret of the message of Ahimsa given by Buddhadeva.

Your friend, M. K. Gandhi

 

৪) তান য়ুন সান - চীনা ভবন নির্মাণ

=========================

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে ভারত-চীন সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনার পর তান শান্তিনিকেতন ফেরেন। একটা মজার ঘটনা হল মহাত্মা তানকে বারবার নিরামিষাশী হতে বলেন। যার ফল আমরা তানের জীবনের শেষের দিকে দেখব।

১৯৩১ সালে তান চীনে ফেরেন। সাংহাইয়ের লীডা অ্যাকাডেমিতে পড়াতে শুরু করেন। সেখানেই চীন-ভারত অ্যাকাডেমি সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। যদি তা বাস্তবায়িত হয় তবে তা দুই দেশের সুপ্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদানের পথও দেখাবে। যা রবীন্দ্রনাথেরও স্বপ্ন।

তানের অধ্যবসায় বিফলে যায় না। ১৯৩৩-এ নাঞ্জিং-এ চীন-ভারত সাংস্কৃতিক সোসাইটি গড়ে ওঠে, সাই-য়ুয়ান-পেই যার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন, আর তান হন প্রথম সেক্রেটারি। তান ১৮-ই ফেব্রুয়ারী চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথকে। অবশ্যই গুরুদেব হর্ষিত হন।

১৯৩৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তান ভারতে ফেরেন। ভারতে চীন-ভারত সাংস্কৃতিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয় সেপ্টেম্বরে। রবীন্দ্রনাথ যার প্রথম প্রেসিডেন্ট হন, আর রথীন্দ্রনাথ হন প্রথম জেনারেল সেক্রেটারি।

কিন্তু কাজ তো সবে শুরু। দুই দেশের সংস্কৃতির মেলবন্ধনে লাগবে অনেক অর্থ, আর অনেক তথ্য। তথ্য দেবে বই। কিন্তু বই কোথায়?

অক্টোবরেই তান আবার চীনে যান। এবারে যাত্রা ভীষণভাবে সফল হয়। ১৯৩৬ সালে তান ৫০,০০০ টাকা, এবং ১,০০,০০০ বই সংগ্রহ করে ফেরেন। রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হন। চীনা ভবনের জন্য জমি নির্ধারিত হয়। সুরেন করের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে 'চীনা ভবন'। বীরেন সেন ছিলেন কন্ট্রাক্টর। তান, নন্দলাল বসু ও বিনোদবিহারী মুখার্জী'র সঙ্গে মিলিত হয়ে চীনা ভবনকে সাজান। ১৯৩৭ সালের ১৪ই এপ্রিল দ্বারোদঘাটন হয়। কথা ছিল মহাত্মা গান্ধী'র দ্বারা দ্বারোদঘাটন সমাধা হবে। কিন্তু তিনি তখন বেলগামে থাকাতে ও জওহরলাল নেহেরু অসুস্থ থাকাতে ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা দ্বারোদঘাটন পর্ব সমাধা হয়। মহাত্মা শুভেচ্ছা বার্তায় লেখেন, "May the Chinese Hall be a symbol of living contact between China and India"।

তান প্রথম ডিরেক্টর হিসাবে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু তিনি বিশ্বভারতীর আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে কোনো অর্থ নিতে অস্বীকৃত হন। চীন সরকার সম্মানী হিসাবে কিছু অর্থ পাঠাবেন, এমনই ব্যবস্থা হয়।

এর মধ্যে নানা রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে চীনে। জাপানি আগ্রাসানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জওহরলাল ও সুভাষ তানকে বলেন ভারতের বার্তা চীনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, যে ভারত চীনের পাশে আছে। রবীন্দ্রনাথও সেই মর্মে চীয়াং-কাই'কে চিঠি লেখেন। চীয়াং রবীন্দ্রনাথকে ধন্যবাদ জানিয়ে চিঠি লেখেন এই নৈতিক সমর্থনের জন্য। এরপরে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমর্থনের জন্য নেহেরু যখন চীনে যান ১৯৩৯ সালে, তখন ভারত-চীন সাংস্কৃতিক সোসাইটি বড় ভূমিকা পালন করেছিল। তান এবং নেহেরুর বন্ধুত্ব গভীর হয় এবং তা আজীবন ছিল।

ডক্টর তাই, সুপ্রসিদ্ধ বৌদ্ধপণ্ডিত তানের সুবাদেই শান্তিনিকেতন আসেন। তিনি ছিলেন মহাত্মা ও রবীন্দ্রনাথের একান্ত অনুরাগী। তিনি ১০,০০০ টাকা অনুদান দেন। যার ৬০০০ টাকা তানের বাড়ি নির্মাণের জন্য, ৩০০০ টাকা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের স্মৃতিসৌধ নির্মাণের জন্য আর ১০০০ টাকা বিশ্বভারতীর ত্রাণ তহবিলের জন্য ধার্য হয়। তান যদিও ওনার জন্য বরাদ্দ টাকা নিজে না নিয়ে স্টাফ কোয়াটার্স বানানোর জন্য দিয়ে দেন।

এরপর থেকে চীনা ভবনের জন্য না তো অনুদানের অভাব হয়েছে, না তো জ্ঞানীগুণীজনের পদধূলির দৈন্য দেখা গেছে।

 

৫) তান য়ুন সান - অন্তিম পর্ব

=====================

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুশয্যার পাশে তান বসে প্রার্থনা করে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন। তান বিধ্বস্ত হয়ে ফিরলেন চীনা ভবনে।

এরপর অনেক অনেক ঘটনা ঘটেছে। তানের মধ্যস্থতায় ভারত-চীনের মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল সেই সময়ে তার জন্য ১৯৪৫ সালে তান-কে চীন সরকার ভিক্টরি মেডেলে ভূষিত করে। 'চীনা ভবন' বেড়ে ওঠে। নতুন নতুন মানুষ যোগদান করেন। এরই মধ্যে ভারত স্বাধীন হয়। ১৯৪৯ সালে তান সপরিবারে পাকাপাকি শান্তিনিকেতনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি মাও-কে চিঠি লেখেন, যেখানে তিনটি দিকের প্রতি মাও-র দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

১) সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকতে। ২) ভারত-চীন সম্পর্ককে মজবুত করতে। ৩) তাইওয়ানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সমঝোতায় আসতে।

এদিকে তানের জন্য বিধাতা অন্য কিছু লিখছিলেন। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় সরকারের হয়ে যায় অফিসিয়ালি। তান খেয়াল করেন চীনা ভবনে এমন অনেক পরিবর্তন হচ্ছে যা রবীন্দ্রনাথের ভাবনার সঙ্গে অনুকূল নয়। ওদিকে ১৯৪৯ সাল থেকে চীনের থেকে যে টাকাটা পেতেন তান সেটা চীন বন্ধ করে দেয়। অনিল চন্দের অনুরোধে তিনি বিশ্বভারতী থেকে পারিশ্রমিক নিতে স্বীকৃত হন। কিন্তু বিশ্বভারতী বদলে যাচ্ছে অনুভব করেন। কষ্ট পান।

তানের চিত্তে সেই আত্মদর্শনের খোঁজ, যা জীবনের প্রারম্ভে দেখা দিয়েছিল আবার জ্বলে ওঠে। তান ভারতের অধ্যাত্মিকতার সম্পদের অন্বেষক হলেন। মহাত্মার কথা মনে এলো। খাদ্যাভ্যাস বদলালেন। শ্রীঅরবিন্দ থেকে শুরু করে স্বামী শিবানন্দ অবধি নানা অধ্যাত্মপথের পথিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় নিজেকে নিয়োজিত করলেন। পথ কোথায়?

১৯৭১ সালে বিশ্বভারতী থেকে অবসর নিলেন। যেন কোথাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এইভাবে অর্ধেক হৃদয় দিয়ে কাজ কতদিন করা যায়? প্রাণ যেন বিশ্বভারতী থেকে উঠে গেছে।

বুদ্ধগয়ায় চলে এলেন। সেখানে গড়ে তুলবেন বিশ্ব বৌদ্ধ অ্যাকাডেমী। ওই বয়সে আবার গেলেন হংকং, সিঙ্গাপুর টাকা তুলবার জন্য। অনুদান এলো। ইতিমধ্যে ১৯৭৯ সালে বিশ্বভারতী দিল 'দেশিকোত্তম'। গড়ে উঠল বিশ্ব বৌদ্ধপীঠ। ১৯৮০ সালে জীবনসঙ্গীকে হারালেন। ভীষণ আঘাত পেলেন। ১৯৮৩ সালে বুদ্ধগয়াতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

তান য়ুন সানের পরিবার অনেক বড়।

১) তান চেং - বড় ছেলে। মালয় দেশে জন্মান। পরবর্তীকালে দিল্লী ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক।

২) তান চেন - দ্বিতীয় ছেলে। আমেরিকায় থাকেন।

৩) তান লি - তৃতীয় ছেলে। চীনেই থাকেন।

৪) তান ওয়েন - বড় মেয়ে। চীন থেকে প্রথম তিনিই বাংলায় পি.এইচ.ডি করেন।

৫) তান য়ুন - ছোটো মেয়ে। শান্তিনিকেতনেই জন্মান। রবীন্দ্রনাথ নাম রাখেন, চামেলি।

৬ ও ৭) তান অজিত এবং তান অর্জুন - শান্তিনিকেতনেই জন্মান।

পরবর্তী গল্প, চামেলিকে নিয়েই।

 

৬) চামেলি

========

একটা বাচ্চা কেরলের মন্দিরে বসে। পুজো চলছে। প্রদীপের আলোয় দেবতার ছায়া পড়ছে দেওয়ালে। সে মুগ্ধ হয়ে দেখছে দেবতার অবয়ব।

সে পরবর্তীকালে ঠিক করল ছবি আঁকবে। মূর্তি বানাবে। আদিম মূর্তি। তার পড়ার বিষয় 'সাহিত্য'। কিন্তু সৃষ্টি করতে চায় ছবিতে নিজেকে। কিন্তু কিভাবে? রাস্তা কি?

কেরালা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক তাকে দেখালো এক সাঁওতাল পরিবারের স্থাপত্যের ছবি।

সে তখন যুবক। চমকে উঠল দেখে। বলল, এ কোথায় আছে?

অধ্যাপক বললেন, যাও শান্তিনিকেতনে। সেখানে পাবে এ অত্যাশ্চর্য সৃষ্টিকে চাক্ষুষ করতে প্রত্যক্ষ। সেই হবে তোমার সাধনপীঠ।

এ রামচন্দ্রন। ভাবীকালের বিখ্যাত শিল্পী। সেদিন এলেন শান্তিনিকেতনে। কলাভবনের ছাত্র হলেন। রামকিঙ্কর বেজ, বিনোদবিহারী মুখার্জি'র ছাত্র হলেন।

কিভাবে শেখানো হত শান্তিনিকেতনে? কেউ একজন জিজ্ঞাসা করল পদ্মভূষণপ্রাপ্ত রামচন্দ্রনকে।

তিনি বললেন, বিশ্বের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে শান্তিনিকেতনের ওই তো পার্থক্য ছিল। সেখানে শেখানো হত না। সেখানে স্বাধীনতা দেওয়া হত। বিশ্বের মহান সৃষ্টির সামনে দরজা খুলে দেওয়া হত। এবার তোমার কাজ বেছে নেওয়ার। তুমি বেছে নাও।

রামচন্দ্রনকে প্রভাবিত করল আরেক মণীষা। দস্তয়েভস্কি। রামচন্দ্রন বললেন, আমি আমার সৃষ্টিতে দস্তয়েভস্কিকে অনুবাদ করব। ওই সব পীড়িত, নীচুতলার মানুষদের কথা বলব ছবিতে।

তখন তিনি জামিয়া ইসলামিয়াতে কাজে যোগ দিয়েছেন। সালটা ১৯৬৫। সেখানকার উপাচার্য মহম্মদ মুজিব বললেন, তুমি এই প্রতিষ্ঠানকে শান্তিনিকেতন গড়ে তোলো। তোমাকে দিলাম পূর্ণ স্বাধীনতা।

চিত্তের পূর্ণ স্বাধীনতাই তো চাই। চিত্তের সুর ততদিনে বেঁধেছে চামেলির সঙ্গে রামচন্দ্রনের। সেই চামেলি, যিনি তানের কন্যা, শান্তিনিকেতনে যার জন্ম, রবীন্দ্রনাথ যার নামকরণ করেন।

রামচন্দ্রনের জেদ পাশ্চাত্য না, ভারতীয় আদিম সংস্কৃতিকে আনবেন কাজে। অনেকে নিন্দা করল। কেউ কেউ বলল, তবে তুমি কুলীন জগতে ঠাঁই পাবে না। অনেক টানাপোড়েন চলল এই নিয়ে। ভারতের গ্রামে গ্রামে গিয়ে আদিবাসীদের চিত্রশিল্পকে বুঝতে চেষ্টা করলেন। মনে দাগ কেটে আছে কলকাতার নকশাল আন্দোলনের ভয়াবহ ছবি। দেশভাগের ছবি, শিয়ালদহ স্টেশান জুড়ে অসহায় মানুষের বাস, সব মিলিয়ে অস্থির করে তোলে রামচন্দ্রনকে। একে একে ছবি জন্ম নেয়। পরবর্তীকালে কেরলের মন্দিরের মুরালের উপর কাজ নিয়েও একটা বই বার করেন। সঙ্গে আসে বাচ্চাদের জন্য ছবির বই। যা বাচ্চাদের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাবে। সেই কাজে সঙ্গ দিয়েছেন চামেলি। তিনি ছবি আঁকেন। সেই সব ছবিতে গাছে ওঠার গল্প থাকবে, পুকুরে ঝাঁপ দেওয়ার গল্প থাকবে, কাকা-জেঠা-ঠাকুর্দা-ঠাকুমার গল্প থাকবে। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে বড় হয়ে ওঠা বাচ্চাদেরকে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটাতেই এই কাজ।

সেদিন চীনে যে আলো জ্বলে উঠেছিল, আজ তারই শিখা ভারতের মাটির সঙ্গে মিশে ভারতের আগামী প্রজন্মের কাছে ভারতীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজে ব্রতী হয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে মিলে ভারতের নাড়ির কাছাকাছি যে ভাষা তাই খুঁজে চলেছেন। রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী'র দেখানো পথে। এইভাবেই জাল তৈরি হয়। নিবেদিতা লিখেছিলেন 'ওয়েব অব ইন্ডিয়ান লাইফ'। এইভাবেই ওয়েব অব কালচার তৈরি হয়। মূলকে রেখেই ডালপালা বাড়ে। এ বিশ্বাস ভূগোলের কাছে ততটা নেই, যতটা হৃদয়ের কাছে আছে।

ওই সেই গানে আবার ফিরে যেতে হয়, "আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া"।

বিশ্বলোকের সাড়াতেই জন্মায় মাধুরী। যা অন্তরের অন্তঃস্থলকে জাগিয়ে সৃষ্টিতে নিজেকে প্রকাশ করে।

 

87
Fri, 11/03/2023 - 23:38

আজ অমর্ত্য সেনের জন্মদিন। তিনি নব্বই হলেন। সেটা বড় কথা নয়। কারণ তিনি শাহরুখ খান নন।

দুজনেই তাদের জায়গায় মহারথী। কিন্তু জনপ্রিয়তা আবার ক্ষেত্র বিশেষে ভিন্ন হয়। এককালে দেখতাম বাংলার তথাকথিত ইন্টেলেকচ্যুয়ালরা হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বিষয়ে নীরব থাকতেন। এখন বলেন। এটা ভালো কথা। এখন সেটা ঘরের আলো কমেছে বলে বাইরের আলো চোখে পড়ছে, নাকি বাইরের আলোর প্রতি আপনিই এক উদারতা জন্মেছে সে বলা কঠিন এত তাড়াতাড়ি।

বিবেকানন্দ একটা কথা বলতেন, মা যাকে বড় করে সে-ই বড় হয়, এটা যদি কেউ জীবনে অন্তত কয়েক মুহূর্তের জন্য বোঝে তবেই তার জীবনে শান্তি আসে। যদিও একদম উদ্ধৃতি দিলাম না, তবে মোদ্দা কথাটা এমন ধারারই ছিল।

এই যেমন ধরা যাক বছর দুয়েক তো লকডাউনে কাটল। মানে কড়া লকডাউন। অনেক মানুষ প্রায় বিনা পরিশ্রমেই, বা খুব স্বল্প পরিশ্রমেই অন্তত বেশ কিছুটা সময় গ্রাসাচ্ছদনের চিন্তা ছাড়াই সময় কাটানোর সুযোগ পেলেন। মানে সময় মত মাসে মাসেই মাইনে ঢুকে গেল ব্যাঙ্কে। উঁহু, না, না, আমি কাউকে কটাক্ষ করছি না, যেটা ঘটেছিল সেটা বলছি। তা অনেকেই বলেন, বা ভাবেন না, যে পর্যাপ্ত সময় পেলেই একটা বিশাল কিছু সৃষ্টিশীল কাজ সে করে ফেলতে পারত। কিন্তু কই হল? এই লকডাউনের পর একটা "পুতুলনাচের ইতিকথা", "নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ", মায় একটা "প্লেগ" কি লেখা হল? কি সিনেমায়, বা ছবিতে, বা গানে, বা যে কোনো সৃষ্টিশীল কাজের ধারায় এই বিশ্বজোড়া লকডাউনে, যারা নাকি শুধু "সময়ের অভাবে" কিছু করতে পারছিলাম না, তারা পেরেছি কিছু? হ্যাঁ, নিজের নিজের শখ পূরণ হয়েছে মেলা। কিন্তু ক্ল্যাসিক বলতে যা বোঝায়, তার কি কিছু হল?

হল না। অর্থাৎ এই লকডাউন আমাদের গোটা মানবজাতিকে দেখিয়ে দিয়ে গেল যে সময়াভাবটা আসলেই অজুহাত। সে আর যাই হোক সে মূল ভিলেন তা নয়।

"উপযুক্ত সময় সুযোগ পেলে আমিও দেখিয়ে দিতাম" - একটা মহা ভ্রম আসলে। বাংলা থেকে শুরু করে গোটা বিশ্বের সৃষ্টিশীল মানুষদের অনেকেরই জীবনী সে সাক্ষ্য দেবে যে কথাটা সময় সুযোগের নয় শুধু।

রামকৃষ্ণদেবের একটা গল্প আছে। গ্রাম্য ভাষায় বলা গল্প। ছেলে শুতে যাওয়ার আগে মাকে বলছে, মা আমার হাগা পেলে আমায় তুলে দিও। তখন মা বলছেন, বাবা হাগা পেলে আমায় তোমাকে তুলতে হবে না, তোমার হাগাই তোমায় ঠেলে তুলবে।

এই হল কথা। তবে এই নিয়ে আমার একটা মজার গল্প মনে পড়ল। আমার এক আত্মীয়ের কথা। তিনি বিয়ের পর স্বামীর কর্মক্ষেত্রে সংসার করার জন্য পৌঁছালেন। তো কর্তা তো তাকে কোয়াটার্সে পৌঁছে দিয়েই কাজে চলে গেলেন। নব বিবাহিতা বধূটি দেখেন, শৌচাগারে কোনো দরজা নেই। একটা বস্তা টাঙানো আছে। সে বস্তাটা যতক্ষণ প্রাকৃতিক কাজটা চলবে, এক হাতে ধরে থাকতে হবে।

তো নববিবাহিতা বধূর যথেষ্ট অভিমান, রাগ, ক্ষোভ হল। সে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন দুপুরে কর্তাটি আসবেন আর তিনি একহাত নেবেন।

কর্তা এলেন। সব শুনলেন। তারপর তিনি প্রসন্ন হেসে বললেন, ওগো, তোমার সত্যিকারের বড় বাইরেটা পায়নি, পেলে ও সব বস্তা-টস্তা মাথায় থাকে? লোকে বনে-জঙ্গলে চলে যায়……

আসলে এটাই হল কথা। নিজের ক্ষোভ আর জগতের ক্ষোভ - বাস্তবটা না মেনে যাই কোথায়?

এই যে প্রতিদিন গাজা গাজা গাজা শুনে যাচ্ছি। এত এত নীতি, চুক্তি, প্রতিষ্ঠান, রথী-মহারথী…. কি হচ্ছে? কিস্যু হচ্ছে না। এই হয়। সে মহাভারতই বলুন আর ইজরায়েল, রাশিয়া। শান্তিচুক্তি কেউ শুনতে চায় না স্বার্থে ঘা লাগলে। সে শান্তি চুক্তি স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণই যে না নিয়ে যাক। যুদ্ধ হবেই। তাই ইউএন যখন প্রতিষ্ঠা হচ্ছিল হয় তো আমাদের ব্যাসদেব অলক্ষ্যে হেসেছিলেন। আমাদের বলেছিলেন, মূঢ় বালক!

মর্মান্তিকভাবে মারা যাচ্ছে সব। আমরা সবাই জানি কি করলে কি হত। কে থামলে, কে অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করলে, কে উস্কানি বন্ধ করলে সব থামে… সব জানি। আমাদের চিন্তায় সে সবই সত্য। কিন্তু বাস্তবে নয়। বাস্তবটা সব কিছুর বাইরে। আমাদের কতটুকু নিয়ন্ত্রণ সত্যি বলতে তার উপর? কিস্যু নেই। নোম চোমস্কি জীবনের অর্ধেকটা সময় ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইন নিয়ে কথা বলে কাটিয়ে দিলেন। কিন্তু হল কি? লবডঙ্কা।

এগুলো কি হতাশার কথা? না। এগুলো হতাশার কথাও না, আশার কথাও না। বাস্তব কথা। মানুষের ক্ষমতা ভীষণ ভীষণ সীমিত। মানুষের বোধ-বুদ্ধি অত্যন্ত সীমাবদ্ধ শুধু না, অত্যন্ত ত্রুটি ও চ্যুতিময়। কিন্তু মানুষের ভ্রম আর অজ্ঞানতা অসীম।

আবার শেষে বিবেকানন্দকে স্মরণ করি। উনি লিখছেন একটা চিঠিতে, গোটা জীবনটা আর কি, ধারাবাহিক মোহভঙ্গ বই তো কিছু নয়!

যদিও আমি এ কথাটা আবার আমার স্মৃতি থেকে আমার ভাষায় বললাম। কিন্তু কথাটা এই।

তবে কিসের আশায় ভালো কাজ করব?

বিবেকানন্দ বলছেন, জগতটা কুকুরের লেজের মত। ও যতই চেষ্টা করো ভালো যতটা বাড়বে, মন্দও ততটাই বাড়বে। এ এক অদ্ভুত সমীকরণ। শুধু ভালোটা বাড়াবো, এ এক ভ্রম। কোনোদিন হবে না। জগতে ভালো মন্দ সমান সমীকরণে অনন্তকাল ধরে থেকে যাবে। এটাই বিধান।

তবে আমি বেকার কুকুরের লেজ সোজা করে মরি কেন?

বিবেকানন্দ বলছেন, কারণ, ওই কুকুরের লেজ সোজা করতে করতে তোমার আত্মজ্ঞান হবে। তুমি মোহমুক্ত হবে। ধীরে ধীরে।

গীতায় আছে না, কর্মে তোমার অধিকার, কিন্তু ফলে নেই। কিন্তু তাই বলে কাজ ছেড়ে বসে থাকার অনুমতিও তোমার নেই।

কি ভয়ংকর আয়রনি না? কি ভীষণ ছল! তবু এই তো সত্য। এর বাইরে যাওয়ার রাস্তা কোথায়?

88
Wed, 11/01/2023 - 19:30

মূল - 'অকোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনি মং, অহাসি মে', যে চ তং উপনয হস্তি, বেরং তেসং ন সম্মতি ।

অনুবাদ - আমাকে আক্রোশ করিল, আমাকে প্রহার করিল, আমাকে জয় করিল কিংবা আমার [সম্পত্তি] হরণ করিল, — যাহারা এইরূপ চিন্তা পোষণ করে তাহাদের শত্রুতার উপশম হয় না।

মূল - ‘অকোচ্ছি মং, অবধি মং, অজিনি মং, অহাসি মে, ' যে চ তং ন উপনয, হস্তি, বেরং তেপসম্মতি ।

অনুবাদ - আমাকে আক্রোশ করিল, আমাকে প্রহার করিল, আমাকে জয় করিল, আমার [ সম্পত্তি ] হরণ করিল, — যাহারা এইরূপ চিন্তা পোষণ করে না তাহাদের শত্রুতার উপশম হয়।

মূল - নহি বেরেন বেরানি সম্মম্ভী’ধ কুদাচনং,

অবেরেন চ সম্মস্তি এস ধৰ্ম্মে সনস্তনো ॥

অনুবাদ - জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনও শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়; ইহাই সনাতন ধর্ম ।

মূল - পরে চ ন বিজানন্তি ময়মেখ যমামসে,

যে চ তখ বিজ্ঞানস্তি, ততো সম্মত্তি মেধগা ডি

অনুবাদ - আমরা এখানে [কলহে] নষ্ট হইতেছি অর্থাৎ অনুক্ষণ মৃত্যুর দিকে যাইতেছি, [কলহপ্রিয়] লোকেরা ইহা বুঝে না; যাহারা ইহা উপলব্ধি করে তাহাদের কলহ প্রশমিত হয় ৷

এ বুদ্ধের বাণী। বাণী চিত্তের ভালো মন্দের দ্বন্দ্বজাত সিদ্ধান্ত। যা মঙ্গলে প্রতিষ্ঠিত। রোগ হলে যেমন চিকিৎসক। তেমন স্বার্থান্ধতার মোহের থেকে ত্রাণের পথ দেখায় বাণী।

গান্ধীজী যখন বলছেন, চোখের বদলে চোখ নিলে জগত অন্ধ হয়ে যাবে। তখন সে বাণী।

সত্যজিৎ রায় যখন লিখছেন, "রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল", তখনও সে বাণী।

বাণীতে দরদ থাকে। সহমর্মিতা থাকে। আলো থাকে। জীবন থাকে।

স্বার্থে উন্মাদনা থাকে। অন্ধত্ব থাকে। বীভৎসতা থাকে।

ইজরায়েল প্যালেস্টাইনের শত্রুতা প্রাচীন। কিন্তু যে মানুষগুলো প্রতি মুহূর্তে মারা যাচ্ছে তারা শতাব্দী প্রাচীন না। সে মায়েরা তাদের শিশুদের হাতে শিশুদের নাম লিখে দিচ্ছে, যাতে কবরে চেনা যায়, তারা কেউ ইতিহাস নয়, রাজনীতি নয়, কূটনীতি নয়। তারা মানুষ। শরণার্থী শিবিরে যারা গতকাল মারা গেল, তারাও মানুষ। কোনো নীতি না, তত্ত্ব না।

মানুষের চিত্ত সুব্যবস্থিত নয়। তার মধ্যে সু আর কু দুই-ই আছে। এ আর রহমন যখন অস্কার গ্রহণের মঞ্চে, তখন এই কথাটাই বলে বলেছিলেন, এই দুইয়ের মধ্যে আমি সু- কে বেছেছি। মঙ্গলকে বেছেছি।

কিন্তু নেতানেয়াহুর চিত্ত ব্যবস্থা সহজ নয়। সে হামাসের প্রতিশোধ নিতে প্যালেস্টাইনকে নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাতে কার মঙ্গল সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা প্রতিশোধ। বলছেন, যদি হঠাৎ করে আমি এই যুদ্ধ থামিয়ে দিই, তবে সেটা হামাসের কাছে নতি স্বীকার হবে।

তাই হয়। এত এত নিরীহ প্রাণের কথা তার আর মাথায় নেই এখন। চোখেও পড়ছে না। তার চোখে একটাই লক্ষ্য, হামাস। গোটা প্যালেস্টাইন এখন হামাস। অনেক রাজনৈতিকদের মতে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগাবলী এসেছিল, তিনি এই সুবাদে তার থেকে বেরোবার একটা রাস্তা পেয়েছেন। নিজের জমি শক্ত করছেন। বেশ কিছু খবরে এসেছে যে শেষ কয়েক বছর ইজরায়েল তার সীমান্ত প্রহরায় কি অযৌক্তিক শিথিলতা এনেছিল। সেকি অবাস্তব আত্মতৃপ্তির জন্যে? নিজেদের অপরাজেয় ভাবার কারণে?

কিন্তু সে আলাদা কথা এখন। কথামৃতে একটা কথা আছে। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, হনুমান যখন লঙ্কা জ্বালিয়ে দিল, তখন তার খেয়াল হল না যে ওই লঙ্কায় সীতাদেবীও আছেন। ক্রোধ এমনই অন্ধ করে মানুষকে।

নেতানেয়াহুর ক্রোধ, প্রতিশোধস্পৃহা এখন এমন এক বীভৎসতায় পৌঁছেছে যে তা লঙ্কা জ্বালানোর সামিল।

রণনীতি আগে ছিল। এখন নেই। এও অনেকের মত। এখন যে যত নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে সে তত শক্তিশালী। হামাস যা করেছে তা নৃশংস বর্বরোচিত। গাজার সাধারণ মানুষ এতদিন ধরে হামাসের শাসনাধীনে। তাই তারা সবাই হামাস এখন, নেতানেয়াহুর সহজ সমীকরণ।

অনেকে লিখছেন এ সমস্যা আরো কয়েক শতাব্দী ধরে চলবে। হয় তো চলবে। ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে। কে ঠিক, কে ভুল তা নিয়ে কেউ-ই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাবে না। কিন্তু একটা সহজ বাস্তব কথা আমাদের তথ্য বোঝাই শিক্ষা আমাদের কিছুতেই বোধের সামনে আনবে না, যারা মারা যাচ্ছে তারা সাধারণ মানুষ। তারা ইতিহাসের পাতা না, রাজনীতির কূটনৈতিক চাল নয়।

একদিন যুদ্ধক্ষেত্র স্থির ছিল। যুদ্ধ হত সেনায় সেনায়। এখন গোটা জগতকে যুদ্ধক্ষেত্র বানিয়ে, অসহায় নিরস্ত্র মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে নিজের শক্তি-ক্ষমতার প্রদর্শনের লালসাকে চরিতার্থ করতে চাইছি।

সেদিনের বুদ্ধ থেকে, আজকের মহাত্মা, লুথার কিং হয়ে রাসেল, নোম চমস্কি অবধি যে অহিংসাকে, আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকেই সভ্যতাকে রক্ষা করার বুনিয়াদ বলেছেন, তাদেরকে অস্বীকার করাই যায়। টয়েনবির ভাষায় তবে সে নিজের রিস্কে। কারণ তারা অসহায় নয়। কারণ সত্য তাদের সহায়। কোনো শাস্ত্র নয়। মানুষ নিজের হৃদয়ে সত্য-শুদ্ধ উদ্দেশ্যে কান পাতলেই শুনবে, শান্তিই পরম সুখ। সব সুখের মূল। শান্তি আর হিংসা, শান্তি আর ক্ষুদ্রতার কোনোদিন সহাবস্থান হয় না। হিংসা নির্মূল হয়ে যাবে না। তবে হিংসার মূল্য দিতে দিতেই মানুষ অহিংসার সত্যকে আবার আবিষ্কার করবে। রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, নিজেকে জানলে মানুষের হিংসাবৃত্তি চলে যায়, সোনার তরবারি হয় সে। যা দিয়ে হিংসা চলে না।

হয় তো একদিন তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও আবিষ্কার করবে এ সত্য যে, শত্রুতার দ্বারা শত্রুতার সমাধান হয় না, যখন তারা তাদের পূর্বপুরুষকৃত ক্ষয়ক্ষতির পরিণাম দেখবে। তারাও হয় তো বা চাইবে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তের মর্যাদা রক্ষা হোক। হয় তো তাদের দেশেও একদিন শান্তির কথা বলার মানুষ জন্মাবে। দুই দেশের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন হবে। ইতিহাসকে পুনরাবৃত্তি করাই দুর্বলের যুক্তি। কিন্তু ইতিহাসের মোড় ঘোরানোই সবলের সিদ্ধান্ত। আর ইতিহাসের গৌরবের অধ্যায় তো তাদের নিয়েই। আশা করতে দোষ কি?

অবাস্তব? তা হোক। এত এত নিরীহ মানুষের হত্যার মধ্যে যদি গোটা জগত নিশ্চিন্তে নিজের নিজের বেড়াজালে আমোদে-প্রমোদে দিন কাটাতে পারে, সে যদি অবাস্তব না হয়, তবে এ প্রত্যাশাও অবাস্তব নয়।

89
Thu, 10/26/2023 - 20:58

 

জগন্নাথের সামনে দাঁড়িয়ে। জীবন্ত দুটো চোখ। কি চাওয়ার আছে?

একদিন খুব বৃষ্টি। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে। সন্ধ্যে হয়ে গেছে। রাত বাড়ছেই বলা চলে। সামনের ধানক্ষেতটা ঝাপসা হয়ে আছে। পিঠে ব্যাগ। পড়ে ফিরছে। হঠাৎ খুব জোরে বাজ পড়ল। তখন তো মোবাইল ফোন ছিল না। তার মনে হল সে মরে যেতে পারে এখনই। এই মুহূর্তে।

বৃষ্টি থামল। কিন্তু তার সারাটা শরীর অবশ। নড়তে পারছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে সে তো মরে যেতেও পারত। এখনই বাজ পড়ে সব শেষ হয়ে যেতে পারত। বাড়িতে মা, বোন, ভাই, ঠাকুমা, ঠাকুর্দা… কারোর সঙ্গে আর দেখা হত না!

মেঘ কেটে চাঁদ উঠেছে। সামনে ক্ষেতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। সে গাছতলায় দাঁড়িয়ে অবশ। কে বাঁচালো তাকে? কেন বাঁচালো?

এরপর আরো কয়েকবার মৃত্যুকে সামনাসামনি দেখেছে। আজ চোখের সামনে জীবন্ত দুটো চোখ। জগন্নাথের চোখ। চোখের আশ্রয় বলে কি কিছু হয়? শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন হয়। একটা সাক্ষাৎকারে শুনেছিল সে। তিনি বলছেন, জীবন বিষণ্ণতায়, অবসাদের ঘোর বিপন্নতায় এসে ঠেকেছিল। একজোড়া চোখের দৃষ্টি তাঁকে বাঁচিয়েছিল। বাঁচার আশা জুগিয়েছিল। দেওঘরে। তাঁকে সেইদিনই তিনি মনপ্রাণ সব সঁপে দিয়ে এসেছিলেন। কিছু অনুভব তর্কাতীত হয়। এখন যেমন হচ্ছে। জীবন্ত দুটো চোখ যেন ওই গর্ভগৃহে নয়, তার বুক ফুঁড়ে জেগে আছে। তার মন-প্রাণ-বুদ্ধি সব ভেদ করে তাকিয়ে আছে। সে যেন মিশে যাচ্ছে চোখের মধ্যে। দৃষ্টির সাগর হয়? কারোর দৃষ্টি বড় সঙ্কীর্ণ। কারোর দৃষ্টিতে সাগর। সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিতে সঙ্কুচিত প্রাণ। ভয়, অবসাদ আর বিষাদের বাসা। ভালো না সে। বড় দমবন্ধের। এ দৃষ্টি সমুদ্রের মত বিশাল। গভীর।

শীর্ষেন্দুবাবু বলেছিলেন, সে দৃষ্টিতে তাঁর মনে হয়েছিল যেন গাভী যেমন তার বৎসকে জিভ দিয়ে চেটে দেয়, শুশ্রূষা করে, তিনি তেমনই শুশ্রূষা পেয়েছিলেন। শান্ত হয়েছিলেন। যে মানুষ আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে ডানহাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে ঘুরছে, সে মানুষের মুঠো খুলে গেল। গড়িয়ে গেল সিদ্ধান্ত। হারিয়ে গেল। আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত হয় না। মনে হয় ওটা বিকল্পহীন পথ। পেরোতেই হবে। সব মানুষই আত্মহত্যার পথ বাছে পেরিয়ে যাবে বলে। কিন্তু পেরিয়ে তো যাওয়া যায় না কোথাও, আচমকা থেমে গিয়ে।

জীবন্ত চোখদুটোতে কি আছে? এই যে সামনে সমুদ্র। ওই যে ওপারে বিস্তীর্ণ অন্ধকার। এই যে ঢেউয়ের পর ঢেউ ভাঙছে। এর কি কোনো মানে আছে? যুগের পর যুগ এ ঘটেই চলেছে। এমনভাবেই সারাটা আকাশ নিত্য তারার মজলিস সাজিয়ে বসছে। এর কি কোনো মানে আছে? আসলে মানে খোঁজার দায় তো আসলে মানুষেরই! কিন্তু যদি মানে না খোঁজে? শুধুই তাকিয়ে দেখে। সেই অর্থ না খোঁজার দৃষ্টির সামনে ধরা দেয় এক রহস্য। কি সেই রহস্য? তার অর্থ খোঁজা যায় না। সে বোধের মধ্যে চাবি ঘোরায়। একটার পর একটা তালা খুলে যায়। গভীরতা বাড়ে। শান্তিজল এসে প্রাণের তটে ছোঁয়। যে শান্তিতে তার জন্মগত অধিকার। যে শান্তিকে ফিরিয়ে দেওয়াও তার জন্মগত ক্ষমতা।

ওই যে বাচ্চাটা বালি তুলে মুঠো ভরে ঘর বানাচ্ছে। রাস্তা বানাচ্ছে। পুকুর বানাচ্ছে। ওর ওই মুঠোতে কতটুকু বালি ধরে? কতক্ষণের স্থায়িত্ব তার ওই নির্মাণের? তবু তার এই ক্ষুদ্র সুখের অনুমতি আছে। ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডীতে।

কতটুকু মুঠো তোমার? জানো কি কতটুকু সময়ের অনুমতি তোমার? কেউ জানে না। ওই যে দুজোড়া চোখ, সেও ব্যস্ত নয় তার মহাকালের জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে। সে শুধু ক্ষণকালে মহাকালের নূপুর বাজিয়ে ফিরছে। সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের। রুদ্র তাণ্ডবে, বাঁশির মাধুর্যে। তার কোনো অর্থ হয় না, মুঠোয় ভরার। না তো সে অর্থহীন, সুতো ছেঁড়া ছড়িয়ে পড়া মুক্তোর মত।

90
Thu, 10/05/2023 - 20:31

সত্য, সত্যের প্রলেপ? এই যে বলে না রাতদিন লোকে, এ মায়া, সে মায়া, এটা নাকি মোহ, সেটা নাকি মোহ… যেন সব শুদ্ধ একটা মিথ্যার কারখানা। আর আমরা রাতদিন ঠকে মরছি। কথাটা কি তাই?

আপাতভাবে তাই বলা হয়। আর যারা নাকি এসবের পারে গেছে তারা গোঁফে চাগাড় দিয়ে বলে, হে হে… এখনও মায়ায় বদ্ধ!

একজন আলপনা দিল। তুমি সেই আলপনাকে কি চালের গুঁড়ো বলবে, না সে আলপনার মাধুর্যে মুগ্ধ হবে? একদল বলবে, ওই মাধুর্যটা হল গিয়ে মিথ্যা, আর চালের গুঁড়োটাই সত্য। কথাটায় মিথ্যা কিছু নেই। আবার সত্যও সবটা নেই। চালের গুঁড়ো যা মেঝেতে বিস্তারিত হয়ে আছে, সেটুকু যখন মানুষের চোখের ভিতর দিয়ে মাথায় যায় তখন মানুষের মস্তিস্ক তাকে এক মাধুর্যে দেখে। এ তো স্বতঃপ্রমাণ।

একজন গয়না বিক্রি করতে এসে বলছে, হ্যাঁ গো গয়না নেবে? মানুষের গয়নাও আছে, আবার ভগবানের গয়নাও আছে। নেবে?

কথাটা কানে বাজল। হাসিও পেল, আবার বিস্ময়ও লাগল। মানুষের কল্পনা কতদূর তাকে নিয়ে যায়। এই কল্পনার আকরিকেই তার সুখ। আবার এই কল্পনার আকরিকেই তার ভয়। ঈশ্বরকে গয়না পরাবে। এ তার সুখ। আবার ঈশ্বরকে নির্দিষ্ট তিথিতে সময় মত আদরযত্ন না করলে তিনি চটবেন, এ তার ভয়। দুই-ই তার কল্পনায়। কিন্তু সে কল্পনা তার এমন নিজস্ব যে সে তাকে তর্কাতীত, অনির্বচনীয় সত্য বলে জানে।

এই কথাটাই সংসারে এক বড় কথা - নিজস্ব। আমার। সাধকেরা বলেন, এই "আমি আর আমার" এই হল মায়া। আমাদের সব দুঃখের মূল। কিন্তু এও গোটা কথাটা নয়। এ আমাদের সব দুঃখের মূল তো বটেই, আবার সুখেরও মূল। এককে ছেড়ে আরেক থাকে নাকি?

মানুষের সত্য তাই দুটো। এক তার নিজস্ব সত্য। আর দুই এই জাগতিক সত্য। জাগতিক সত্যে সে আধার কার্ডের একটা নাম্বার। একজন ভোটার। একজন রুগী। একজন শিক্ষক। একজন ব্যাঙ্কের কর্মী ইত্যাদি। কিন্তু নিজস্ব সত্যে সে নিজের কাছে নিজে কি? একটা গোটা জগত। তার নিজস্ব পরিবার, বাড়ি, গাড়ি, বাগান, শখ, বিশ্বাস ইত্যাদি সবই তার নিজস্ব সত্য। যা তার সিদ্ধান্তকে, জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে।

সেকি জানে না তার নিজস্ব সত্য ভঙ্গুর। খুব জানে। কিন্তু সে চিরস্থায়ী কোনো কিছুর চাইতে, তার আয়ত্তের মধ্যে এই ভঙ্গুর সত্যকেই চায়। এ তার নিজের। এইতেই তার সুখ। নিজেকে আত্মীয়স্বজন, স্থাবর-অস্থাবরের মধ্যে প্রসারিত করে তাকে রক্ষা করার গুরুদায়িত্ব নিয়ে সে জীবনের একটা মানে খুঁজে পায়। এসব কেড়ে নিয়ে তাকে শুধু চালের গুঁড়ো দেখালে জীবন কাটবে তার? তার আলপনাকে ব্যঙ্গ করে, একটানে মুছে ফেলে তাকে অপদস্থ করে কি সুখ? বরং যে একদিন আলপনা মুছে যাবে জেনেও নিত্য আলপনা দেয় সে-ই তো আসল বীর। নইলে প্রকৃতিও যদি জ্ঞানীপণ্ডিতের মত শুধুই নিত্যে স্থির হবে সিদ্ধান্ত নিত, তবে গাছে ফুল ফুটত না, সমুদ্রে ঢেউ উঠত না, আকাশে রামধনু উঠত, কোনো প্রাণ মরণশীল শরীর আশ্রয় করে জন্ম নিত না।

আলপনার এই সুখকে একদল বলল, লীলা। মানে এক খেলা। তারা আরো এগিয়ে বলল, জগতের যে নিত্য সত্য, তাকেও তোমার খেলায় অংশ নেওয়াতে পারো। তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক বানাতে পারো। এই যেমন, দুর্গা তোমার মেয়ে; এই যেমন, মা কালী তোমার মা; এই যেমন, কৃষ্ণ তোমার সখা, প্রভু; মহাদেব তোমার পিতা। আবার মরমী সুফী বলল, সে আমার প্রিয়তম। আমার প্রেম। কবীর বলল, হ্যাঁ। বুদ্ধ বলল, না না, এসব থেকে বেরিয়ে এসো। বৌদ্ধ বলল, সে হবে না, তবে তুমিই আমার প্রভু। আমার আশ্রয়। বুদ্ধং শরণম্ ইত্যাদি। খ্রীষ্ট বলল, সে প্রভু। মহম্মদ বলল, সে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। এই তার বাণী।

এই শুরু হল গোল। কার আলপনা শ্রেষ্ঠ যখন এই নিয়ে গোলমাল শুরু হল, তখন আবার আগের পক্ষ এসে বলল, দেখেছ, এই জন্যেই বলেছিলাম সব আসলে চালের গুঁড়ো, তাই বলো না কেন?

তখন আরেকদল এসে বলল, আরে ভাই তোমরা গোঁড়ামি ছাড়ো। মাধুর্য যদি নানা বৈচিত্র‍্যে আসে, নেবে না কেন? অন্ধের হাতি দর্শনের গল্প এলো। অনেকে বুঝল। অনেকে বুঝল না। অনেকে বুঝেও না বোঝার ভান করল। আবার অনেকেই বুঝতেই চাইল না।

যাক গিয়ে এসব কথা। কিন্তু আমার সুখ-দুঃখের যে কথাটা হচ্ছিল সেটায় আসা যাক আবার। এই যে বলছিলাম না নিজস্ব সত্যের কথা, তো নিজস্ব সত্যকে কি মানুষ ধ্বংসাত্মক বানাতে পারে? পারে তো। আর পারে বলেই মানুষ মাঝে মাঝে এত বিধ্বংসী খেলায় মেতে ওঠে। যারা প্রকৃতি বিজ্ঞান পড়েছে তারা জানে মানুষের কুকীর্তির জন্য জগতে যে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ও হয়ে চলেছে তাকে 'সিক্সথ্ এক্সটিনশান' বলে। মানে ষষ্ঠ মহাবিলুপ্তি। বাকি পাঁচটা আমাদের জন্য হয়নি, সেগুলো প্রকৃতির নিজের খেয়াল ছিল। কিন্তু আমাদের দায় তো আমাদের নিতেই হবে বলো। আমাদের ওই আলপনা দেওয়ার হাত যখন লোভের হাতে চলে যায় তখন আর আলপনা মাধুর্য সৃষ্টি করে না। সে তখন আঁকে বিধ্বংসী সংকেত। জ্ঞানী বলেন, মোহ হল সব রোগের মূল। মিথ্যাকে সত্য বলে জানা। ক্ষুদ্রকে বড় করে জানা। কেন্দ্রকে পরিধি আর পরিধিকে কেন্দ্র করে জানা। ঢেউকে সমুদ্র বলে জানা। শিখাকে আগুনের উৎস বলে জানা। এ সবই মোহ।

মোহ আছে বলেই এত ধ্বংসলীলা চলছে জগত জুড়ে। সে রাশিয়া-ইউক্রেনই বলো আর নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগই বলো। মানুষ চাইলেই কি আর দায় এড়াতে পারে এখন? পারে না। যাদের মোহ ভেঙেছে তারা বারবার সতর্ক করে চলেছে। কিন্তু কে শুনবে কার কথা? সেদিন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে এত ক্ষয়ক্ষতিই হত না যদি কৃষ্ণের সমঝোতা শর্তে ওরা রাজী হত। হল না। কোনোদিনই কেউ রাজী হয়নি।

তবে এই নিজস্ব সত্য আর মোহের মধ্যে পার্থক্য কি? একটা নরম বোধের পার্থক্য। নিজস্ব সত্য যখনই ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে, আমাদের মধ্যে এক নরম বোধ আমাদের সতর্ক করে দেয়। যদি শুনি, তবে আমাদেরই ভালো। আর যদি শুধু "আমার" ভালো বলে সে সতর্কবাণী অতিক্রম করি তবে সে-ই হয় মোহের ধ্বংসলীলা।

এই 'নরম বোধ' কি? কেউ বলে 'বিবেক'। কেউ বলে 'মানুষের ধর্ম'। কেউ বলে 'তাঁর বাণী'। নাম যাই হোক, এই নরম বোধেরই রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে আরেক নাম এসেছে, সফট্ পাওয়ার। এ-ও শক্তি। এ-ই চিরকালের শক্তি।

"ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ—

কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ।"

 

91
Thu, 09/28/2023 - 19:57

"ঠাকুর মোরে ক্ষীর দিল সর্বলোকে শুনি।

দিনে লোক ভীড় হবে মোর প্রতিষ্ঠা জানি।।

এই ভাবি রাত্রিশেষে চলিলা শ্রীপুরী।

সেই স্থানে গোপীনাথে দণ্ডবৎ করি।।"

 

প্রচলিত এই গল্প শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু-র গুরু ঈশ্বরপুরী-র গুরুদেব মাধবপুরীকে নিয়ে। গল্পে আছে যে ক্ষীরচোরা গোপীনাথ মাধবপুরী-র জন্য ক্ষীর আলাদা করে রেখেছিলেন এবং পুজারীকে স্বপ্নে সে ক্ষীর মাধবপুরী-কে দিয়ে আসার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

শ্রীভগবানের এ হেন নির্দেশ পেয়ে যখন পুজারী ক্ষীর মাধবপুরীর কাছে নিয়ে যান, তখন মাধবপুরীর উক্ত অনুভব হয়। এবং তিনি সেই রাত্রেই সে স্থান ত্যাগ করেন। পাছে লোকে জানাজানি হয়ে যায়। ভিড় হয়।

মাধবপুরী আত্মমগ্ন। স্বার্থমগ্ন না, আত্মমগ্ন। অনুভবে মগ্ন। হিসাবে মগ্ন না।

গভীরে বাজছে সুর। বাইরে সে সুর আসছে না। আটকে রাখছি। মোহে। ভয়ে। দুশ্চিন্তায়। বারবার বলছি, ভালো নেই, ভালো নেই। সব খারাপ। সব মিথ্যা। সব দূষিত।

গভীরে কান পাতছি না। গভীরে পাতাল। গভীরে আঁধার। গভীরে হারাবার ভয়।

ঘটনা সামান্য। কিন্তু গভীরতায় অপরিমেয়। সবাই বলছে, তুষ্ট হও। শান্ত হও। এত প্রশ্নে, এত ক্ষোভে, এত দুশ্চিন্তায় জর্জরিত কোরো না নিজেকে। নিজেকে লোভের হাত থেকে বাঁচাও।

কিছুতেই পেরে উঠছি না। কত যেন দায়িত্ব আমার! অথচ এতটুকু স্বার্থহানিতে জগত অন্ধকার। সব ছল ছল ছল। নিজের বাইরে কাউকে চিনি না। জগত উদ্ধার, সেবা, দরদ…সব ছল। মুখোশ। এতটুকু স্বার্থে আঘাত লাগুক, আমি কে বুঝিয়ে দেব। বুঝিয়ে দেব আমার আসল চেহারা কি! এতটুকু নিজের অস্তিত্ব-সংকট দেখা দিক, আমার সব মহত্ত্ব শূন্য। আমার সবটুকু শূন্য। তখন আপনি বাঁচলে বাপের নাম!

এই ছলের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাই কি করে? নিজেকে এই যে রাতদিন কেউকেটা সাজিয়ে রাখার ব্রত নিয়েছি, এর থেকে আমায় বাঁচায় কে?

মাধবপুরীর প্রাণে সে উত্তর আছে। সে উত্তর - আনন্দ। অভয়। নিজেকে শূন্য করে, নিজেকে আড়ালে রেখে নিজের আরাধ্যকে উজাড় করে সবটুকু দেওয়া।

আরাধ্য কে? যে আমার আরাধনার। যে আমার প্রাণের আনন্দস্বরূপ। শান্তিস্বরূপ। মুক্তিস্বরূপ। তাকে বাইরে ভিতরে দু'দিকে না পেলে সার্থকতা নেই। মাধবপুরী যেখানে যায় লোকে ভিড় করে আসে।

 

"প্রতিষ্ঠার স্বভাব এই জগতে বিদিত।

যে না বাঞ্ছে তার হয় বিধাতা নির্মিত।।

প্রতিষ্ঠার ভয়ে পুরী গেল পলাইয়া।

কৃষ্ণভক্ত সঙ্গে প্রতিষ্ঠা চলে গড়াইয়া।।"

 

মাধব চান না লোকে তাঁকে জানুক। কিন্তু লোকে মাধবের মধ্যে যে আলো দেখেছে সে কি? এমন স্বার্থগন্ধহীন, আত্মহীন আত্মা, আনন্দময় পুরুষ…. এ কে? কে ইনি?

এক পরিচয় বুদ্ধিগত। আরেক পরিচয় হৃদয়গত। মাধবকে চিনেছে মানুষ হৃদয় দিয়ে। এত ছোটাছুটি, এত হিসাব-নিকাশ তবু শান্তি কই? এত উদ্বেগ, এত মারামারি হানাহানি, এ সবের থেকে রেহাই কে দেবে?

একজন তুষ্ট মানুষ। একজন সম্পৃক্ত মানুষ। যে কপট নয়।

মাধবপুরীর জীবনীর শুধু এইটুকুই আজকের দিনে আমাদের কাছে এক বিরাট আলো। আজ এই গুরুর ছদ্মবেশে নানা গডম্যানদের যুগে, যেখানে অলৌকিক ক্ষমতা, বিশেষ ক্ষমতা, রাজনৈতিক ক্ষমতা, সর্বোপরি তাদের বিশাল প্রভাবের বিজ্ঞাপন, ধনসম্পদের ইস্তাহার সেখানে এমন নিরহংকার, এমন অলোকসামান্য মানুষের স্মৃতি স্বস্তির।

মানুষের ভাবের জগত আর বিচারের জগত। এই দুইয়ের মধ্যে ভাব দূষিত হলে বিচারও দূষিত হয়, চিন্তাও দূষিত হয়। আবার বিচার সঙ্কীর্ণ হলে ভাবও সঙ্কীর্ণ হয়। তবে দেখা যায় প্রথমটার প্রভাবই সব চাইতে বেশি। যে মানুষ হাওড়া স্টেশন অবধি ক্ষুন্ন, নানা চিন্তায় জর্জরিত, সে-ই পরেরদিন পুরী-র সমুদ্রের সামনে বসে ভাবছে, সে পারবে, সে লড়াইয়ে জিতবে। তার বিচার বদলে যাচ্ছে। কারণ তার ভাব বদলে যাচ্ছে। এই বৃহতের সামনে এসে দাঁড়িয়ে।

মাধবপুরী ভাবের জগতে এমনই এক সাগর। খুব বড় বড় বই পড়ার দরকার নেই। এই এতটুকু ঘটনাই আমাদের আত্মকেন্দ্রিকতার ডিটক্সিফিকেশানের জন্য যথেষ্ট। অন্তত কিছুটা হলেও। কিছুক্ষণের জন্য হলেও।

মাধবপুরী মানুষকে অলৌকিক ক্ষমতায় আকর্ষণ করেননি, করেছেন ভালোবাসায়। মানুষকে অতিমানবিক ক্ষমতায় আসীন করেননি। না তো জীবনের জটিল সব রহস্যের সমাধান করেছেন। শুধু বলেছেন ভালোবাসো, এমন কিছুকে ভালোবাসো সব ছলচাতুরী সরিয়ে দিয়ে যেন সে তোমার আনন্দ হয়, শান্তি হয়, মুক্তি হয়।

92
Tue, 09/26/2023 - 14:51

সান্ত্বনা নেই। শান্তি আছে। যদি সান্ত্বনা চাই, তবে অনেক ব্যাখ্যা, অনেক গল্প, অনেক তত্ত্বের আয়োজন লাগবে। যদি শান্তি চাই, তবে শুধু চাইলেই হবে। জোর করে বললেই হবে, শান্তি চাই।

কিন্তু মনের বড় সমস্যা। সে শান্তিকে চায় সান্ত্বনার মধ্যে দিয়ে। সান্ত্বনা চাই তার আগে। সব কিছুর একটা তার অনুকূলে ব্যাখ্যা চাই। তাই কি হয় বলো? যখন একটার পর একটা দুর্যোগ যেতে লাগল, তখন মনের মধ্যে পাগলের মত সান্ত্বনা খুঁজে বেড়াতে লাগলাম। কত শাস্ত্র, কত দর্শন, কত মহাপুরুষের বাণী। কিন্তু কোনো সান্ত্বনাই ধোপে টিকল না। সব সান্ত্বনারই একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে বুঝলাম। সান্ত্বনা নেই বলে হাজার একটা অভিযোগ করে কোনো লাভ তো নেই।

আসলে সরল সহজ একটা সত্যিকে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, তাই এত কৃত্রিম সান্ত্বনার প্রয়োজন ঘটছিল। যা আমার সঙ্গে ঘটছে, তাকি শুধুই আমার সঙ্গে ঘটছে? আর কারোর সঙ্গে কি ঘটেনি আগে? তা তো নয়। আশাপাশে তাকালেই দেখা যায় আমি একা নই। কিন্তু আমার একটা অজ্ঞ দাবী আছে। যেন আমার একারই একটা বিশেষ ভাগ্যের অধিকার আছে, বিধাতার কাছ থেকে বিশেষ প্রিভিলেজড হওয়ার দাবী আছে….এমন একটা ভাব মনের মধ্যে থেকে যায়। সেই হয় যত নষ্টের মূল।

সান্ত্বনার চাইতে শান্তি অনেক বেশি স্থায়ী। শান্তি মানে একটা সাম্যাবস্থা। তার মধ্যে সত্য আছে। কিন্তু সান্ত্বনা একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিতে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করা। তার মধ্যে সত্য নাও থাকতে পারে।

শান্তি আর সান্ত্বনার দ্বন্দ্ব এতটাই গভীর যে একটার সঙ্গে আরেকটা নিবিড়ভাবে মিশে থাকে। সান্ত্বনাকে শান্তি ভেবে গুলাই। শান্তির আসার রাস্তা, সান্ত্বনা পাচ্ছি না বলে, নিজেই অভিমানে আটকে রাখি। ফলে যা যায় তার চাইতে আরো কষ্টের হয় তাকে যেতে না দেওয়ার প্রবল জেদ আমার।

বারবার নিজের কাছে হেরেছি। বারবার নিজের বানানো গল্প, নিজের বানানো কৃত্রিম বিশ্বাস আমাকেই বিদ্রুপ করে গেছে। দুঃসময়ে। সান্ত্বনা নেই। এ কঠিন জগতে সান্ত্বনা বলে কিছু হয় না। যা হয় তা হল শান্তি। সান্ত্বনা শিশুর চুষিকাঠির মত। তাকে সত্যে নির্মাণ করা যায় না, কল্পনায় সৃষ্টি করা যায়।

শান্তির রাস্তা চিরকালই মাটিকে মাটি বলে, জলকে জল বলে। যা সত্য, তাকে অস্বীকার করে, তাকে কোনো বিশেষ রঙে রাঙিয়ে শান্তি পাওয়া যায় না। আর সান্ত্বনা পাওয়ার ইচ্ছা থাকলে তো শান্তি কয়েক হাজার মাইল দূর দিয়ে চলে যায়। তার ছায়াটুকু ভাগ্যে জোটে না।

কিন্তু যা বাস্তব, যা সত্য তাকে স্বীকার করা তো এত সোজা কাজ না। মনের লক্ষ বাসনার রঙ। সে সবকে ধীরে ধীরে তুলে তাকে সত্যের রঙে রাঙানো কি চাট্টিখানি কথা! মন বাস্তব জগতকে তত সত্য বলে জানে না যতটা নিজের চিন্তার জটকে সত্য বলে জানে। নিজের আবেগের ঘূর্ণিকে সত্য বলে জানে। তার হাত থেকে তাকে রক্ষা করে তার মধ্যে শান্তির বীজ বুনতে গেলে তাকে সত্যের দিকে আনতেই হবে।

এই সত্যকে ঈশ্বরের ইচ্ছা, ভাগ্য, বিধাতার বিধান, কর্মফল ইত্যাদি যে তত্ত্বেই সান্ত্বনার রাস্তা খুঁজি না কেন, আসলে সত্যটাকে স্বীকার করে নেওয়াই আমাদের একমাত্র পথ। শান্তির পথ। তাই ধৈর্যর চাইতে বড় কোনো সহায় আমাদের এই ভীষণ দুর্গম রাস্তায় আছে বলে আমরা জানি না। ধৈর্য্যের সঙ্গে সত্যের প্রভুতায় আস্থাই একমাত্র চলার কড়ি। পাথেয়। সান্ত্বনা পেয়ে কি হবে! সে চুষিকাঠির দিন তো গেছে! অবশেষে জিতে যাবে তো সত্যই, সত্যমেব জয়তে। আমি চাই আর না চাই।

93
Sat, 09/16/2023 - 23:17

স্ত্রী জানে তার স্বামীর সঙ্গে তার বাড়ির পরিচারিকার প্রণয় আছে। স্ত্রী সারাদিন কড়া নজরে রাখে স্বামীকে, পরিচারিকাকে। একদিন এক ভুল হল। ওই "কি ছিল বিধাতার মনে"।

স্ত্রী স্নানে এসেছে, পাব্লিক স্নানাগারে। সঙ্গে পরিচারিকা। হঠাৎ স্ত্রীয়ের মনে হল, সেরেছে, তোয়ালে তো আনা হল না। তাড়াতাড়ি পরিচারিকাকে হুকুম করল, যাও বাড়ি, তাড়াতাড়ি নিয়ে এসো আমার তোয়ালে। (গপ্পে যদিও সিলভার ওয়াশবেসিন বলেছে। আমি বলছি তোয়ালে। এটা আমার বুঝতে সুবিধা হয় বলে।)

পরিচারিকা তো এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। সে দিল দৌড়। কি দৌড়, কি দৌড়! আজ তার প্রেমিককে পাবে ঘরে একা!

এদিকে কথাটা বলেই স্ত্রীয়ের মনে হয়েছে, এ আমি কি করলাম! হায় হায়, এতো তুলোকে আগুনের কাছে পাঠালাম! হায় হায়! অগত্যা সেও লাগালো দৌড়।

এ গল্পের প্লট আমার নয়। রুমির। রুমি বলছে দেখো দুজনে দৌড়াচ্ছে। কিন্তু দুটো দৌড়ের কারণ ভিন্ন। একজন প্রেমের অনলে পুড়তে পুড়তে। আরেকজন ঈর্ষা, ক্রোধ, নিরাপত্তাহীনতায় জ্বলতে জ্বলতে।

গপ্পে আরো অনেক কিছু ছিল। আমি সেসব বাদ দিয়ে আমার মত করে গল্পটা বললাম।

এখন কথা হচ্ছে, নীতিবাগীশ মার্কা আলোচনা না। পরকীয়া ইত্যাদির তত্ত্বকথা নয়। কিন্তু এই যে দৌড়, ঈর্ষায় আর ভালোবাসায়। এ এক অদ্ভুত দৃষ্টিকোণ রুমি আমাদের দেখাচ্ছে না? আমরাও তো দৌড়াচ্ছি। রাতদিন দৌড়াচ্ছি। কতটা ভালোবাসায় আর কতটা ঈর্ষায়, লোভে, ভয়ে?

ভয়! রুমি বলছে তুমি ভয়ে তোমার মুখকে বন্ধ রেখেছ কেন? মুখকে চিরকালের জন্য বন্ধ করার জন্য মৃত্যু তো আছেই।

রুমি ভালোবাসার কথা বলতে গিয়ে কত কাউকে শত্রু বানিয়ে ফেলছে। ভয়, অতিরিক্ত বুদ্ধিমত্তা, সমাজের নানা নিয়মকানুন, আইনশৃঙখলা, সব সব সব। সবাই শত্রু রুমির প্রেমের সামনে। কিন্তু একজন ছাড়া। আত্ম-অনুশাসন। রুমি বলছে আত্ম-অনুশাসনহীন মানুষ নিজের ভিতরের আগুনে বাইরে দাবানল লাগিয়ে দেয়। আত্ম-অনুশাসন মানুষকে সে গভীর ভালোবাসায় ডোবার ক্ষমতা দেয়। তাকে আর বাইরের শাসনে পদে পদে ঠেকতে হয় না। তার আর ভয় নেই। আলো আছে। স্বাভাবিক আলো।

গুরু শিষ্য সূর্যোদয়ের বর্ণনা করতে করতে সারাটা রাত কাবার করে দিল। যখন সত্যিই সূর্যোদয়ের সময় এলো, তখন সবাই গভীর ঘুমে।

ভালোবাসা বর্ণনাতীত। ভাষাতীত।

রুমির জন্ম নাকি এই মাসেই। তিরিশ তারিখে। সে তো রুমির ইতিহাসের জন্ম। রুমি কি আদৌ জন্মায় বা মরে? মনে তো হয় না। সব প্রেমেরই শর্ত থাকে। প্রেম শর্ত ছাড়া দাঁড়ায় না। সংসারের বেশিরভাগ প্রেমের এমন সব শর্ত থাকে যা প্রকাশ্যে আনা যায় না। দুপক্ষই জানে। এড়িয়ে চলে।

রুমির প্রেমেরও শর্ত ছিল। সে শর্তও প্রেম। শুধুই প্রেম। সেখানে রুমি বলছে, আমার অস্থি, মজ্জা, রক্তমাংস সবটুকুই তো তোমার। এমনকি তোমার উপর আমার আস্থার প্রশ্নও অবান্তর, কারণ আমার ভিতর একটাই অস্তিত্ব। তোমার অস্তিত্ব। শুধুই তোমার অস্তিত্ব।

হঠাৎ কেন রুমির কথা বললাম? এমনিই। যা কারণ ছাড়াই হয়, সে নেশা। নেশার জন্যেই নেশা। এও তাই। এমনিই।

94
Sat, 09/16/2023 - 23:12

"কি হবে না দাদুভাই? কূপমণ্ডূক"

সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' এর প্রায় শেষ দৃশ্য। সত্যজিৎ রায়ের চেতাবনি। মজার কথা হল এ চেতাবনি কথামৃতে, স্বামীজির ভাষণেও বারবার এসেছে। একই উদাহরণ।

কূপ তো অনেক ধরণের হয়। কুসংস্কারের কূপের থেকে বড় কূপ ভ্রান্ত ধারণার কূপ। আগেভাগেই মতামত, সিদ্ধান্ত টানার কূপ।

চিন্তাতত্ত্ব জগতে একটা তত্ত্ব নিয়ে খুব আলোচনা হয়। সিস্টেম ১ পদ্ধতি। সিস্টেম ২ পদ্ধতি। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বাঙালির সব চাইতে বড় উৎসব কি... দুই দু’গুণে কত হয়.... রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা নোবেল পেয়েছিল.... ইত্যাদি ইত্যাদি.... আমরা চট্‌ করে না ভেবেই বলে দেব। একে বলে সিস্টেম ১ চিন্তাপদ্ধতি। আর যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ১৯ কে ১৭ দিয়ে গুণ করলে কত হয়? আমাকে ভাবতে হবে। এ হল সিস্টেম ২ চিন্তাপদ্ধতি।

আমাদের কূপমন্ডুকতায় এই প্রথম ধারার চিন্তাপদ্ধতির বিশাল প্রভাব। যেখানে কোনো ক্রিটিকাল থিংকিং নেই, যেখানে খতিয়ে দেখা নেই, যেখানে সরজমিনে নেমে দেখা নেই। সেখানে সবটাই চলছে আমার ভাসা ভাসা খেয়ালে, ভাসা ভাসা ভ্রান্তধারণায়।

বাস্তব এক জিনিস, আর বাস্তবের আমার চেতনায় প্রতিভাসিত হওয়া আরেক জিনিস। বাস্তব আমার চেতনায় কি রঙে জন্মায় সে ঠিক হয় আমার মনের গঠন অনুযায়ী। আমার যাবতীয় সুখ-দু:খ - এই বাস্তব আর আমার মনের গঠনের মিশ্রণের ফল। অর্থাৎ বাস্তব আমার চেতনায় যে রঙ ধরালো তা তার উপর নির্ভর করে। আমার সুখ-দু:খের জন্য তাই অনেকাংশে আমি নিজেই দায়ী। অবশ্যই এ সুখদুঃখ মানসিক সুখদুঃখর কথাই হচ্ছে। বাস্তব আমায় সুখী বা দুখী করে না। করে আমার চেতনায় তার প্রতিভাস। যা আমার পূর্বাভ্যাস, আমার শিক্ষা, আমার সংস্কার, আমার আশেপাশের সামাজিক গঠন ইত্যাদি অনেকটা স্থির করে দেয়।

কিন্তু এই বিবশতাই তো মানুষের ভাগ্যের শেষ কথা নয়। তবে আর অ্যামিবা থেকে বুদ্ধ অবধি এতটা রাস্তা আসা কি সম্ভব ছিল? মানুষেরই একমাত্র ক্ষমতা আছে নিজের বোধের ব্যপারে বোধযুক্ত হওয়ার। আমার বোধকে দেখারও আরেকটা বোধ আমার আছে। তাকে যাই নাম দেওয়া যাক না কেন, আত্মসমীক্ষা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম ইত্যাদি। আসলে তা নিজের চোখে নিজেকে দেখার ক্ষমতা। নিজের বাহ্যিক আচরণ শুধু না, ওই যে প্রতিভাসের কথা হল, সে প্রতিভাসকেও দূর থেকে দেখার ক্ষমতা মানুষের আছে। আর আছে বলেই আমার মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধও আছে।

সব কিছুর গভীরে থাকে এক সর্ব ধারক ভালোবাসা। যাকে চিত্ত নামে ডাকা যায়। যাই আদতে আমি। চিত্ত। পুরোনো নাম। গভীর ভাব। ভালোবাসায় চুবিয়ে নিলে অনেক কিছু আবর্জনা মুক্ত হয়। এখানে ভালোবাসা মানে আবেগসর্বস্ব সুখের অন্বেষণ নয়। এখানে ভালোবাসা মানে আন্তরিকতা। সুখ না, গঠনমূলক সমীকরণের অন্বেষণ। সাম্যের খোঁজ। ধৈর্যের খোঁজ। স্থিতির খোঁজ, ধ্বংসের না। সে কাজ করে চিত্ত। মর্ম।

ওই যে চিন্তাপদ্ধতি, সিস্টেম ১ আর সিস্টেম ২ বললাম, আর যে প্রথমের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম, তার থেকে রেহাইয়ের উপায়ও এই, আন্তরিক চেষ্টা। আর এর থেকে রেহাই পাওয়া মানেই নিজেকে উদ্ধার করা নানা পাঁকের থেকে।

তবে এর মানে এ নয় যে সব কিছু ভ্রান্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। শেষে সেই গান গাইতেই হবে, "মাগো আমার সকলই ভ্রান্তি"। কিন্তু সে তো দার্শনিক অতৃপ্তির কথা। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলতেন, এক নৌকা পাকা ধান ডুবে যাওয়া আর বুদ্ধের আর্য সত্যের দু:খ তো আর এক নয়। এও তেমন, নিজের চারপাশকে, বাস্তব সমাজকে নিজের চেতনার উদার প্রতিভাসে দেখা আর নানা জটিল আবেগের ক্ষুদ্র সংকীর্ণ প্রতিভাসে দেখার মধ্যে তো পার্থক্য আছেই। নিজের সুখদুখের জন্য কদ্দিন আর একে-তাকে, ঈশ্বর, ভাগ্যকে দায়ী করা চলে। নিজেকে নিজের ভার তো নিতেই হবে।

সেই জন্য এর থেকে মোক্ষম চেতাবনি আর কি হতে পারে-

কি হবে না দাদুভাই?

কূপমণ্ডূক।

95
Mon, 09/04/2023 - 23:33

উপেন্দ্রনাথ দলাইকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রীতিমতো বকাঝকা করলেন, একলাখ টাকা জরিমানা করলেন। এই গত বছরের ডিসেম্বর মাসের ঘটনা। তো সেই উপেন্দ্রনাথ দলাই কি করেছিলেন? তিনি সুপ্রিম কোর্টে একটি PIL করেছিলেন, মানে জনস্বার্থে মামলা করেছিলেন যেন শ্রী শ্রী অনুকূল ঠাকুরকে "পরমাত্মা" ঘোষণা করা হয়। এবং ভারতের বাকি সব সম্প্রদায় সেটা যাতে মেনে নেয়।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বললেন, আপনি আপনার গুরুকে পরমাত্মা ভাবুন, সেটা আপনার বিশ্বাস, সেখানে কারুর কিছু বলার নেই, কিন্তু মশায় সবাইকে ঘাড় ধরে মানাতে চাইছেন কেন? আর তার জন্যে কোর্টের সময়ই বা কেন নষ্ট করছেন? আর আপনার এই মামলায় জনস্বার্থই বা কোথায়? আর আমরা তো এখানে আপনার ভাষণ শোনার জন্যে বসে নেই! আপনি এক লাখ টাকা জরিমানা দেবেন যা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে, যাতে করে লোকে এভাবে কোর্টের সময় অপচয় না করে।

এ হল সদ্য ঘটনা। একই ঘটনা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গেও ঘটেছে। তারা একটা পৃথক ধর্মের দাবী করে কোর্টে কেস করেছিলেন। এবং হেরে গিয়েছিলেন।

কথা হল হিন্দুর ধর্মে তো কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই যারা এসব ঘোষণা করবেন। যেমন মাদার টেরেসা যে সেন্ট ছিলেন সে না হয় সাক্ষীসাবুদ জোগাড় করে বেশ আড়ম্বরপূর্ণভাবে ঘোষণা করা হল। তাদের সে প্রথা আছে। আমাদের নেই। এই যেমন এখন মাইকে শুনলাম যে লোকনাথবাবাকে নিয়ে গান হচ্ছে, সেখানে বলা হচ্ছে তিনি পূর্ণ ভগবান। এখন কথা হচ্ছে চৈতন্যদেব, সাঁইবাবা, রামকৃষ্ণদেব, ওঁকারনাথ ঠাকুর, আনন্দময়ী মা, স্বামীনারায়ণ ইত্যাদি সব সম্প্রদায়ের মানুষই ঘোষণা করেন যে তাদের গুরুদেব ঈশ্বর স্বয়ং। বিবেকানন্দ তো আরো এগিয়ে গিয়ে রামকৃষ্ণদেবকে অবতার বরিষ্ঠায় ঘোষণা করলেন। মানে শ্রেষ্ঠ অবতার। এখন এ কথা বাকিরা মানবে কেন? তাই অন্য সম্প্রদায়ের কাছে কান পাতলে শোনা যায় তারা এই প্রণাম মন্ত্রের ঘোরতর বিরোধিতা করছে।

এখন এর মধ্যে স্টালিনের ছেলে বলে বসলেন সনাতন ধর্ম হল ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার মত। একে নিবারণ করা যাবে না, একে উৎখাত না করলে শান্তি নেই। কারণ কি? কারণ সনাতন ধর্ম বৈষম্যকে সমর্থন জানায়।

কথা মিথ্যা নয়। শাস্ত্র ঘাঁটলে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। আর সে সব ঘাঁটতে না চাইলে আম্বেদকরজী প্রমুখের অনেক অনেক অথেনটিক লেখা আছে। সনাতন ধর্মে বৈষম্যের প্রথা তো আছেই। রামচরিতমানস তো হালে লেখা। সেখানেই তুলসীদাস বলছেন যে নারী মাত্রেই জন্ম অপবিত্র। একমাত্র পতিসেবায় সে শুদ্ধ হতে পারে। গীতায় একই সঙ্গে পণ্ডিতে কুকুরে সমদর্শন বলেই, আবার নারী, শুদ্রকে নীচকূলে জাত ঘোষণা করছে। কিন্তু ভগবান সে সবার জন্যেই উদার সে কথাও পাশাপাশি বলা হচ্ছে। তবে ওই কথাটা আগে বলার পর। মজার কথা হচ্ছে এখনও একটা বড় অংশের মানুষ এ দেশে মেয়েদের খুব একটা উন্নত চোখে দেখেন না। সে নানা নিউজের কমেন্টস বক্স, নির্ভয়ার মত তথ্যচিত্র দেখলেই বোঝা যায়। আশেপাশে কান পাতলেই বোঝা যায়।

বিশিষ্ট সমাজবিদ এম এন শ্রীনিবাসের একটা বড় তত্ত্ব ছিল ভারতীয় সমাজের পলিউশন-পিউরিটি থিওরি। অর্থাৎ কথায় কথায় আমাদের সমাজে এই শুদ্ধতা আর অশুদ্ধতার তত্ত্ব। মাসিকচক্র থেকে নাপিত,জমাদার ইত্যাদি সব অশুচি। অশুচির তালিকা বার করতে গেলে পাড়ায় পাড়ায়, পরিবারে পরিবারে এত বৈচিত্র্য পাওয়া যাবে সুপার কম্পিউটারও হয় তো ফেল করবে। শ্রীনিবাসের সেই তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে ডগলাস একটা বই লিখে ফেলেন যা নিয়ে গোটা বিশ্বে বেশ আলোড়ন হয়, "পিউরিটি অ্যাণ্ড ডেঞ্জার"।

তবে সনাতন ধর্মে বৈষম্য যেমন আছে তেমন তার থেকে বার হবার আন্দোলনের ইতিহাসও আছে। যেমন ভক্তি আন্দোলনের একটা বড় অংশ, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী ছিল। চৈতন্য মহাপ্রভু তো ছিলেনই, কবীরও যাবতীয় জাতপাতের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন। নানকও। নানক তো মেয়েদের মাসিকচক্রকেও অপবিত্র আখ্যার বিরোধী ছিলেন। এখানে অবশ্যই হরিচাঁদ ঠাকুরের নামও উল্লেখ্য। সেদিন বৈষম্যের বিরুদ্ধে যে লড়াই তিনি করেছিলেন, তার গুরুত্বও সমাজে কম নয়।

তবে শ্রীনিবাস মহাশয়ের সঙ্গে একমত আমি যে, সেই আন্দোলন ও সমাজে তার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়নি। আধুনিক ভারতের পথিকৃৎ যারা, রামমোহন রায়, যিনি ১৮২৮ সালেই সংস্কৃততে শিক্ষার বিরোধী ছিলেন, চেয়েছিলেন যে ইংরেজিতে শিক্ষা দেওয়া হোক ও আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করা হোক। তারপর রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিবেকানন্দ, রাধাকৃষ্ণণ প্রমুখেরাও লড়াই করেছিলেন একই কারণে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধেই তাদের মত করে।

বৈষম্য তত্ত্ব সত্য। তার বিরোধিতাও সত্য। দুই-ই আছে আজও। আমি কোন রাস্তাটা নেব সেটা আমার উপর। সুপ্রিম কোর্ট যেতে হবে কেন? নিজের বিশ্বাস নিজের কাছে, তার সঙ্গে বিচার মুক্ত, বাস্তবানুগ হলে এত দৌড়াদৌড়ির কি আছে?

আমি আধুনিক কিনা সে আমি কি কি অস্বীকার করছি শুধু তার উপর নির্ভর করে না তো। অনেক ক্ষেত্রেই দেখেছি শুধু বাহবা পাওয়ার জন্য, নিজেকে ব্যতিক্রমী প্রমাণ করার জন্য আজীবন নিজের না মানাকে বিজ্ঞাপন করে যায় কিছু মানুষ। আমার আধুনিকতার পরিচয় অন্যের বিশ্বাস, শ্রদ্ধাকেও মর্যাদা দিয়ে নিজের কাজটুকু শান্তভাবে করে যাওয়া। বিবেকানন্দর একটা কথা বেশ লাগে, অন্ধকার অন্ধকার বলে চীৎকার না করে আলোটা নিয়ে এলেই হয়। তবেই অন্ধকার দূরীভূত হয়। আমার কাউকে চেপে ধরে আধুনিক প্রগতিশীল করতে হবে কেন? আমি নিজে যদি নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে খাঁটি থাকি আর নিজের কাজের সঙ্গে সৎ থাকি, তবে কারুর বিশ্বাস-অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায় আমার!

তবে কি প্রতিবাদ করব না? নিশ্চয়ই করব। তবে সেটা বিজ্ঞাপনের জন্য না, আত্মপ্রচারের জন্য না, যদি কোনো মানুষের উপর অত্যাচার দেখি অন্যায় দেখি, যদি সেটা আমাকে সত্যি সত্যিই ব্যথিত করে, উদ্বিগ্ন করে, রাতের ঘুম কেড়ে নেয়, তবেই যেন প্রতিবাদ করি। তবে সেখানে আমার আত্মপ্রচার থাকবে না। তবে আমার সে লড়াই শৌখিন হবে না। তবে আমি প্রতিবাদের নামে অযথা শোরগোল তুলে ক্যামেরা আর হাততালির দিকে চেয়ে থাকব না, স্বীকৃতির জন্য লালায়িত হব না। সত্য প্রতিষ্ঠা না পাওয়া অবধি লড়ে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প তখন আমার আপনিই আসবে। আর তা পূরণ হলে নিজেকে সবার অলক্ষ্যে সরিয়ে আনার নম্রতাও থাকবে।

 

(এ লেখার প্রসঙ্গে মন্তব্য যদি করতে ইচ্ছা হয়, অনুগ্রহ করে কোনো বহুজন পূজিত ব্যক্তির নামে অশ্রদ্ধাসূচক কিছু লিখবেন না।)

96
Sun, 09/03/2023 - 15:19

কোনো মানুষের সঙ্গে, কি পরিবেশের সঙ্গে যত সহজে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা যায়, তত সহজে আপন হওয়া যায় না। না তো সে মানুষ, সে পরিবেশ আমার আপন হয়, না আমি হই তার আপন।

আসলে এই আপন হয়ে ওঠা আর আপন করে নেওয়ার মধ্যে একটা পূর্বশর্ত থাকে। এক একটা মানুষ এক একটা ধাঁচের হয়। সে চাইলে, চেষ্টা করলে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারে, মানিয়ে নিতে পারে তাই, কিন্তু আপনবোধটা আপনি না এলে তাকে জোর করে জন্ম দেওয়া যায় না।

আমাদের ধর্মে ইষ্ট নির্বাচন বলে একটা প্রথা আছে। সেখানে গুরু শিষ্যকে প্রশ্ন করেন, তোমার কাকে নিজের বলে বোধহয়? মানে ঈশ্বরের কোন রূপকে তোমার আপন বলে বোধহয়?

এই তত্ত্বটা বেশ। এর গভীর সত্যটা হল, যাকে আপন বলে বোধ হবে, তাকে শুরু থেকেই আপন বলে বোধ হবে, সেখানে অভ্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। রামকৃষ্ণদেব একটা গান গাইতেন,

"মনের মানুষ হয় যে জনা, ও তার নয়নেতে যায় গো চেনা,

   ও সে দুই-এক জনা, ভাবে ভাসে রসে ডোবে"

যে গান শিখতে চায় না, সেও দীর্ঘ দিনের অভ্যাসে সুরে-স্বরে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিন্তু গানকে কোনোদিন নিজের বলে বোধহয় না। বড়জোর বলে, এখন আগের থেকে ভালো লাগে। কিন্তু এই ভালোলাগাটার মধ্যে একটা ফাঁকি থেকেই যায়। কোনো বিকল্প রাস্তা না থাকা, অপশানলেস হয়ে যাওয়া… এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনে একটা কিছু আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়ার তাগিদ জন্মায়। সেখান থেকেই সে এই "ভালোলাগা" কে খুঁজে বার করে। কিন্তু জীবনের শেষ মুহূর্ত অবধি বিকল্প রাস্তা খোঁজাটা চলতেই থাকে, নিজের অজান্তেই। কারণ সে মনের ভিতরে ভিতরে তো জানেই তার এই 'ভালোলাগা' আপাত ভালো লাগা, এ একধরণের সমঝোতা নিজের পরিস্থিতির সঙ্গে।

নিজের উপর স্বাভাবিক বিশ্বাস না থাকলে আপনকে খুঁজে পাওয়া যায় না। যে মানুষের কথায় কথায় ভয়, সে সারাদিন নিরাপত্তার খোঁজে পাগল হয়। নানা কৃত্রিম নিরাপত্তার আড়ালে আবডালে নিজেকে বাঁচিয়ে চলে। তার ক্ষোভের শেষ নেই, ঈর্ষার শেষ নেই, সন্দেহের শেষ নই। ভয় যতক্ষণ বুদ্ধিকে চালায় ততক্ষণ বুদ্ধির স্বাবলম্বী হওয়ার জো নেই। ততক্ষণ তার অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতারও শেষ নেই। যেই সে আপন হয়ে ওঠার সত্যিটাকে খুঁজে পেল, অমনি সে নিজের হাত থেকে নিজে ত্রাণ পেল।

বুদ্ধি যখন মোহমুক্ত হয়, তখন ভয়মুক্তও হয়। গোটা জীবনে অন্তত কয়েক মুহূর্তও যদি এই মুক্তাবস্থার অভিজ্ঞতা হয়, সে বুঝতে পারে সে যাতে অভ্যস্ত হয়ে আছে সে তার আপন ক্ষেত্র না। সে বুঝতে পারে তার আপনজনকে, তার জীবনের আপনক্ষেত্র কোথায়! নিজের জীবনে নিজেকে পরবাসী করে আর বাঁচতে হয় না। সত্যিকারের শান্তি তার জীবনে আসে। জীবনে দায়িত্ব-কর্তব্য পার করে নানারকম সৃষ্টির রাস্তা খোলে। নিত্য দিনের সাধারণ কাজকেই সে অন্য আলোতে আরো স্পষ্ট করে দেখে। সে অনুভব করে যে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার মধ্যেই জীবনের সার্থকতা নেই, যতক্ষণ না আপন জায়গার সন্ধান জীবনে পাওয়া যায়। তখন আর ভান করে, নিজেকে সুখী প্রমাণ করে বাঁচতে হয় না। কারোর কাছেই কিছু প্রমাণ করার দিন শেষ। এখন শুধু নিজের সঙ্গে নিজের জায়গায় আপন হয়ে বাঁচা। তখন নানা ওঠাপড়া সুখদুঃখকেও আর অতিরিক্ত, অবহ মনে হয় না। সে সবও নিজের বলে মনে হয়। তবেই না আলো-অন্ধকারের রাস্তায় হাঁটার সার্থকতা আসে, জীবন ভরে ওঠে! সেকি ফাঁকি দিয়ে হয়? না ভয় আর লোভের দাসত্বে হয়?! ভয় আর লোভের চিরকালের শাগরেদ চাতুরী। চাতুরীতে গোটা বিশ্বসংসারের রাজাও হয় তো হওয়া যায় কিছুকালের জন্য, কিন্তু নিজের পায়ের তলার সত্যিকারের মাটি অধরাই থেকে যায়। ভয় আর লোভের থেকে ত্রাণ না চাইলে রাস্তা পাওয়া শক্ত, নিজেকে পাওয়া দুরূহ। এ সত্যটা যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করে নেওয়া যায় তত সময়ের অপচয় কমে। নইলে ওই গানে আছে,

  তুমি    বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া

তাই ভয়ে ঘোরায় দিক্‌বিদিকে,

                শেষে অন্তরে পাই সাড়া ॥

যখন    হারাই বন্ধ ঘরের তালা--

যখন    অন্ধ নয়ন, শ্রবণ কালা,

তখন   অন্ধকারে লুকিয়ে দ্বারে

                শিকলে দাও নাড়া ॥

যত  দুঃখ আমার দুঃস্বপনে,

সে যে   ঘুমের ঘোরেই আসে মনে--

          ঠেলা দিয়ে মায়ার আবেশ

                কর গো দেশছাড়া।

আমি    আপন মনের মারেই মরি,

শেষে   দশ জনারে দোষী করি--

আমি    চোখ বুজে পথ পাই নে ব'লে

                কেঁদে ভাসাই পাড়া ॥

97
Sat, 09/02/2023 - 13:40

সমাজকে না জানলে নিজেকে জানা সম্পূর্ণ হয় না। সমাজের ভিত্তি মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব কি সে নিয়ে বাচিক তর্কে গিয়ে লাভ নেই। কাকে সবুজ রং বলে, কত প্রকারের সবুজ হয় - সে নিয়ে তর্ক অনেক দূর গড়ায়, কিন্তু চোখের সামনে সবুজ রং এলে তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না যদি না বর্ণান্ধতার সমস্যা থাকে।

মনুষ্যত্বও একই জিনিস। সে নিয়ে বাচিক তর্কে মীমাংসা হয় না। কিন্তু সামনে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা মনুষ্যোচিত কি না, সে নিয়ে মীমাংসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনিই হয়। নইলে একটা মর্মান্তিক মৃত্যুও কিভাবে বাচিক তর্কের ময়দানে অমানবিক হয়ে উঠতে পারে তা তো দেখলাম আমরা কয়েকদিন ধরেই।

মনুষ্যত্বের একটা প্রাথমিক পরাকাষ্ঠা অন্যের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ না করা। লকডাউনের সময় 'চা কাকু' বলে একজন মানুষ ভাইরাল হন। তাঁর অর্থনৈতিক দুরাবস্থার দিকটা সামনে আসাতে অনেকে অর্থ সাহায্য করেন। আমার এক পরিচিত মানুষ উক্ত চা কাকুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় রোজ ঢুকে কত টাকা জমছে সেই নিয়ে আশেপাশের মানুষদের মধ্যে খবরাখবর দিতে থাকে। কারণ উক্ত চা কাকুর অ্যাকাউন্ট যে ব্যাঙ্কে, সে সেই ব্যাঙ্কের কর্মচারী। এই অভ্যাসটা অসামাজিক। সে যখন যুক্তি দিচ্ছে এত টাকা হয়ে যাচ্ছে তাও কেন লোকে টাকা পাঠাচ্ছে, অর্থাৎ সে নীতির প্রশ্ন আনছে। কিন্তু সে নিজে যখন ভুলে যাচ্ছে সে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর সন্তান হয়েও শুধুমাত্র রিজার্ভেশন এর সুযোগেই চাকরিটা পেয়েছে। সেখানে সে নীতির কথা বলছে না। সেখানে সে অপার্চুনিস্ট। সুযোগসন্ধানী।

সমাজকে শুধু যদি সুযোগের নিরিখে দেখি, তবে অনেক দায় এড়ানো যায়। যে সমাজে আমার যত বেশি সুযোগ সেই সমাজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে অনায়াসে হাজির হওয়াই যায়। কিন্তু সমাজ বলতে তো শুধু সুযোগ উৎপন্নের কারখানাই নয়, সমাজ বলতে নিজের মনুষ্যত্বের বিকাশের ব্যায়ামাগারও তো বটে। যেখানে নিজেকে বাস্তবিক অর্থে আরো শক্তিশালী, আরো সার্থক করা যায়।

দুদিন আগে গৌরী সাওয়ান্ত আর রভি কান্ননকে নিয়ে কথা হচ্ছিল খবরের নানা মাধ্যমে। কারণ আছে অবশ্যই। গৌরি সাওয়ান্তকে নিয়ে কথা হওয়ার কারণ 'তালি' সিনেমাটা। আর রভি কান্ননকে নিয়ে কথা হওয়ার কারণ তিনি সদ্য ম্যাগসেসাই পুরষ্কারে ভূষিত হলেন, আসামে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে ক্যান্সারের চিকিৎসা করে যাওয়ার জন্য। রভি লিখছেন,

"There is nothing wrong with air or water which is a popular myth. People in the Northeast consume tobacco, betel nuts, and alcohol a lot. There is a lack of exercise and proper food. People are not even aware of the severity of cancer. Once it is detected, they become helpless and some people hide it. We have to fight this mindset and have been doing it for over a decade.”

এই জানাকে বলা হয় সমাজকে জানা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আমরা যেন রাস্তায় নেমে সমাজকে জানি। তবেই আমাদের কল্পনার ভারতমাতার আসল ছবিটা জানতে পারব। যে কথা গোখলে গান্ধীকে বলেছিলেন। বিবেকানন্দ পায়ে হেঁটে অনুভব করেছিলেন।

গৌরি বলছেন, "I adopted a daughter to show that even we can become mothers. I did it for my justice, for my rights so that people can recognise us,"............

“It is always the society that clichés us as being different. In my growing years, I did not feel like a Hijra or like a girl, back then I really did not even understand what a Hijra meant. But the society christened me as 'Hijra'.

পারস্পরিক শ্রদ্ধা ব্যতীত কোনো ধর্ম নেই, মনুষ্যত্ব নেই এবং ফলস্বরূপ কোনো সুস্থ সমাজও নেই।

মানুষের সত্যটা হল মানুষ প্রভূত উন্নতমানের যান্ত্রিকতায় নিজেকে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যুক্ত পরিবেশে করে। যদিও নানা সময়ে নানা অসহায়তার সামনে দাঁড়িয়ে নিরুপায় হয়ে নিজেকে অসম্মানিত হতে দেখাকেও সে মেনে নেয়, কিন্তু সে মেনে নেওয়া। সেখানে তার মান নেই, স্বাচ্ছন্দ নেই, ভালোবাসা নেই, শ্রদ্ধা নেই। আসলে আমরা আমাদের পদমর্যাদার অভিমানে, পাণ্ডিত্যের অভিমানে ভুলে যাই যে একজন মানুষের সঙ্গে 'ভালো ব্যবহার' করাটা আমার কোনো অপশান নয়, আমার সভ্য হওয়ারই প্রথম শর্ত।

সেদিন এক ধর্মগুরু টিভির চ্যানেলে প্রকাশ্যে বললেন, ভারতের রাষ্ট্রগ্রন্থ হওয়া উচিৎ রামচরিতমানস ও ভারতের পিতা হওয়া উচিৎ রামচন্দ্রের।

তার কথাটা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়েই দেওয়া যেত, কিন্তু দেওয়া যায় না যখন তারা সমাজের একটা বড় অংশকে নানা কৌশলে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তখন তাদের কথার বিরোধিতা করতেই হয়। না করাটাই অন্ধকারের পক্ষ নিয়ে দাঁড়ানো।

নিজের সমাজকে জানা প্রতিটা মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য। এ তার শিক্ষার অঙ্গ হওয়া উচিৎ। সমাজকে সুস্থ গড়ে তোলার দায়িত্ব সবার। তার প্রাথমিক পাঠই শুরু হয় সমাজকে জানা দিয়ে। তার বৈচিত্র্যকে আর বৈচিত্র্যময়তার কারণগুলোকে বোঝার মাধ্যমে। তবেই জন্মায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা।

তবে শুধু নিজের সমাজ নয়, অন্যান্য সমাজের ইতিহাস গঠনকেও জানা দরকার নির্মোহের দৃষ্টিতে। নইলে আবার খ্রীষ্টকে সম্মান জানানো আধুনিকতা হয় আর লোকনাথবাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো গ্রাম্যতা হয়। খ্রীষ্টের জীবনের নানা ঘটনা মীর‍্যাকল হয় আর লোকনাথবাবার জীবনের ঘটনা গাঁজাখুরি হয়।

বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি সবটুকুই থাক, কিন্তু সামাজিক শিক্ষাটাকে হেলা করলে আদতে কোনো শিক্ষাই মঙ্গলময় হয়ে উঠবে না। বিজ্ঞান অভিশাপ হবে, ধর্ম নানা বিকার আর কুসংস্কারের ঘড়া হবে আর ইতিহাস কয়েকজন সুচতুর মানুষের পক্ষপাতদুষ্ট দলিল হবে।

সমাজকে জানার দুটো পথ। এক সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা। দুই, নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর নানা সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা।

প্রথমটার অবকাশ সঙ্কীর্ণ। দ্বিতীয়টা নানা বালিতে চিনিতে মেশানো। এককালে সাহিত্যের দায় ছিল সমাজের দর্পণ হওয়ার। এখন যুগ এসেছে ডক্যু ফিল্ম, ডক্যুমেন্টারি, খবর ইত্যাদির। এখন কোনো কিছুকেই "সত্য ঘটনা অবলম্বনে" না আখ্যায়িত করলে কল্কে পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে অবশ্যই বালিতে চিনিতে মিশছে। কিন্তু তবু এই দলিলগুলো মূল্যবান। কোনো কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে না বলে এই যে বাস্তবের মানুষটা সামন আসছে, নিজের কথা বলছে, এ খুব গুরত্বপূর্ণ।

লেখা দীর্ঘ হল। উদাহরণ আরো অনেক অনেক দেওয়া যায়। কিন্তু আমি দুটোতেই সীমাবদ্ধ থাকলাম। মনে হয় যা বলতে চেয়েছি তা এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে বলতে পেরেছি।

পরিবেশের সংকট, পানীয়জলের সংকট আর নানাবিধ সামাজিক বৈষম্য - এগুলো ফ্যাক্ট। এর বিরুদ্ধে লড়াই প্রাক্তনীদের কাজ নয়। আমাদের এখনের কাজ। যত তাড়াতাড়ি আবর্জনা সরানোর কাজে হাত লাগানো যায় নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ততই মঙ্গল। আবারও বলি শুরুর কথাটাই, নিজেকে জানা কখনওই সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না সমাজকে জানছি। অনুভব করছি। নানা মিথে আর সত্যেতে মিশে এ জটিল সমীকরণের ধাঁধার সমাধানের দায় আমারই। এই দুই নিয়েই তো সমাজ!

98
Thu, 08/17/2023 - 20:56

"Physical science will not console me for the ignorance of morality in the time of affliction. But the science of ethics will always console me for the ignorance of the physical sciences." ~ Pascal

একটা কথা বারবার গুলিয়ে যাচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে তো মেধার কোনো সম্পর্ক নেই। 'চরিত্র' আর 'মেধা' কি এক জিনিস? তা তো নয়। সমাজে নিশ্চয়ই মেধার প্রয়োজন আছে। এই যে আমি টাইপ করে এখন লিখছি, সেটা মুহূর্তে একটা আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে চলে আসছে, এ তৈরির জন্যে অবশ্যই মেধার প্রয়োজন। কিন্তু আমি এখানে প্রোভোকেটিভ, নিন্দাত্মক, অবমাননাকর, অপমানসূচক কিছু লিখব, না পজিটিভ কিছু লিখব সেটা তো আমার চরিত্রের উপর, আমার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করছে।

আজ যে সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে রাজ্য জুড়ে সেখানে বারবার মনে হচ্ছে 'মেধা' আর 'চরিত্র' দুটো আপাত যুযুধান বস্তু। যেন একে অন্যের সম্পূরক। তা তো নয়। দুটোরই দরকার আছে। আমি ভীষণ মেধাবী হতেই পারি, না-ও হতে পারি। কিন্তু ভালো মানুষ না হলে সবটাই জলে। ভালো মানুষ হওয়াটা সামাজিক হওয়ার প্রথম শর্ত। আমি যদি সামাজিক মনটাকে সুস্থ গড়ে তুলতে না পারলাম, দুর্বলকে দেখলেই যদি আমার সমস্ত সত্তা জুড়ে বিকার জেগে ওঠে, তবে আমি কি নিজের জন্যেই নিরাপদ? তা তো নয়! এরকম বিকারগ্রস্ত কিছু মানুষ যদি আমরা দল পাকিয়ে একটা স্বতন্ত্র কিছু গড়ে তুলি তবে সেটা ভয়ংকর কিছু হবেই। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অদ্ভুত সব ধর্মীয় সংগঠন গড়ে উঠেছে মাঝে মাঝে যারা নিজেদের সব আইনকানুন, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদির ঊর্ধ্বে ভেবেছে। তারা নিজেদের আলাদা নিয়ম বানিয়েছে, গোষ্ঠী বানাতে চেয়েছে। ক্রমে কিছু মানুষের স্বেচ্ছাচারিতায়, ব্যভিচারিতায় ভরে উঠেছে তাদের গোষ্ঠী। খুন-খারাপি তো ঘটেইছে, এমনকি গণ-আত্মহত্যাও ঘটেছে সে সব ধর্মীয় সংগঠনে।

একদিন রবীন্দ্রনাথ একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। সেও আবার পরাধীন ভারতে। আজকের কথা বলছি না। সেদিন তিনি যে কয়েকটা দিককে প্রাথমিক, মূল জেনেছিলেন তার মধ্যে অগ্রগণ্য ছিল মানুষ গঠন। সেদিন সে প্রতিষ্ঠান থেকে যত মৌলিক ভাবনা নানা পরিসরে জন্মেছিল তা ইতিহাস। মেধা আর চরিত্রের সমন্বয় না ঘটালে যে আমাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই, সেটা সময়ে কেন, আজও চিন্তাশীল মানুষমাত্রেই মনে করেন। 'হু' যখন স্বাস্থ্যের সংজ্ঞা তৈরি করে তখন তাই ব্যক্তিগত, সামাজিক, মানসিক স্বাস্থ্যের কথা উল্লেখ করে বলে যে শুধু নীরোগ থাকা মানেই স্বাস্থ্য নয়। তুমি সামাজিকভাবে ও ব্যক্তিগত জীবনে কতটা সমীচীনতায় প্রতিষ্ঠিত সেটাও দেখার।

নোম চোমস্কিকে যখন মানুষের মূলগত চরিত্রের প্রশ্ন করা হচ্ছে, উনি বলছেন, একটা বাচ্চা রাস্তায় বসে ক্যাণ্ডি খাচ্ছে, তুমি যতই ক্ষুধার্ত হয়ে থাকো না কেন তুমি ওটা কেড়ে নেবে না এটাই তোমার মনুষ্যত্ব।

মানুষের প্রকৃতিতে বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা আছে। কিন্তু সেটাই তার সবটুকু নয়। বারবার সেটাকে সরিয়ে সে নিজের ধর্মে ফিরতে চেয়েছে বলেই সমাজ এগিয়ে চলেছে। নানা রাজনৈতিক আদর্শ, ধর্মীয় আদর্শ আছে, সামাজিক ভাবনারও নানা বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু কেউ-ই মানুষের একান্ত অমঙ্গলকে তার কেন্দ্রীয় ভাবনা বলে ঘোষণা করে না। সবারই লক্ষ্য মানুষের সার্বিক স্বাধীনতা আর মানুষের সামগ্রিক বিকাশের অনুকূলতা। সেটা গড়ার জন্য আমাকে বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠী বানাতে হবে কেন? বারবার নিজের মেধার বিজ্ঞাপন করতে হবে কেন? মেধার ঔজ্জ্বল্যে কি অপরাধপ্রবণতা ঢাকা যায়? যা অন্যায় তা অন্যায়। তা কি মেধার মাত্রা দীর্ঘ হলে শাস্তির মাত্রা কমে যায়? একজন অশীতিপর নোবেলবিজয়ী দার্শনিক তথা অর্থনীতিবিদকেও আমরা থানা-পুলিশ, আইন-আদালতের কাগজ ধরাচ্ছি শুধু আইনের যুক্তি দেখিয়ে। তবে একটা প্রতিষ্ঠানে এতদিন ধরে এত এত অন্যায় ঘটে চলেছে নাকি, অথচ সবাই চুপ! রামকৃষ্ণদেব বিবেকহীন-দয়ামায়াহীন পাণ্ডিত্যকে শকুনের সঙ্গে তুলনা করতেন। বলতেন, শকুন অনেক উঁচুতে ওড়ে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে ভাগাড়ে। যদি গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা থাকে, তবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মেধাও তার জ্বালা আর অপমান ঢাকতে পারে না। তোমার মেধাকে আমার সম্মান জানাতে ধিক্কার!

99
Thu, 08/03/2023 - 20:38

আজকের টাইমস অব ইণ্ডিয়ার এডিটোরিয়াল পেজে দুটো আর্টিকেল আছে, হরিয়ানার ঘটনার উপর। দুটো আর্টিকেলেরই মত, এ ধরণের ঘটনা আগে থেকে ঠেকানো যেত, আর দুই প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আরো কঠোর করার জন্য।

খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই সেই একই পাতায় শ্রীরামকৃষ্ণদেবের সেই অতি উদ্ধৃত উপমাটিও ছাপা হয়েছে, যেখানে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, একই পুকুরে চারটে ঘাট, একই জল, কেউ বলছে পানি, কেউ জল, কেউ ওয়াটার, কেউ অ্যাকুয়া। বস্তু একই। সব ধর্মই সত্য। সবাই সেই একই ঈশ্বরকে নানা পথে, নানা মতে চাইছে।

রামকৃষ্ণদেব সক্রেটিসের মত রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেননি, কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক কলকাতার সে সময়ের কিছু তরুণ ও কিছু পণ্ডিত-বিদগ্ধ মানুষকে অবশ্যই আকর্ষণ করেছিলেন। অবশ্য বঙ্গের বাইরে থেকে পশ্চিম থেকেও কেউ কেউ এসেছিলেন ওঁর কাছে।

কিন্তু কথা হচ্ছে শ্রীরামকৃষ্ণ উপলব্ধ ধর্ম আর সাধারণের বোধের ধর্ম কি এক? দাঙ্গার উৎস কি ধর্ম, না ঘৃণা?

চৈতন্যদেবের জীবনী লিখতে গিয়ে কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন, "ঈশ্বরত্বে ভেদ মানিলে হয় অপরাধ"। নানক, কবীর সব এক কথাই তো বারবার বলে গেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রায় সমসাময়িক শিরডির সাঁইবাবার জীবনীতেও একই দর্শন। এমনকি ওঁর জীবনীতে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গাও উনি থামিয়েছেন, এও প্রামাণ্য তথ্যও আছে। তবে?

আসলে আমাদের বাণীর অভাব নেই, মহাত্মার মত মানুষের নানা ঘটনার উদাহরণেরও অভাব নেই। অভাব আমাদের সদিচ্ছার। অভাব আমাদের মূঢ়তার থেকে বেরোনোর স্ব-শিক্ষার প্রতি আগ্রহের। অভাব আমাদের সঠিক শিক্ষার। নইলে বাণী আছে, উদাহরণ আছে, আর কি চাই? উপায় তো আছে! এমন কোন সামাজিক সমস্যা আছে যার সমাধানের জন্য কোনো না কোনো উপায় নেই? রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা তো কোনো জটিল তত্ত্বের রাস্তা দেখাননি, সহজ শিক্ষার রাস্তা দেখিয়েছেন। কিন্তু সে আমাদের রক্তে মিশল না কেন?

কারণ আমাদের বিদ্বেষের ভাব যতটা গভীরে বাস করে, শিক্ষার আলো হয় তো অতটা গভীরে যায় না। শিক্ষাকে হয় তো আমরা শুধুমাত্র বাহ্যিক বৌদ্ধিক অলঙ্কারের বেশি ভাবতে পারি না। নইলে পাশ্চাত্যে এত আইনকানুন শিক্ষার উন্নয়নের পরেও কেন সাদা কালোয় এত দ্বন্দ্ব? প্রায়ই অমন পাশবিক অত্যাচারের কথা কেন পড়তে হয়? দিন যত বাড়ছে সেখানেও সাদা কালোর দ্বন্দ্ব বাড়ছে। কর্নেল ওয়েস্ট, নোম চোমস্কি, মার্থা ন্যুসবাম প্রভৃতি মানুষের কথায় উঠে তো আসছে।

মানুষের মধ্যে এক আত্মধ্বংসী ক্ষমতা আছে। কিন্তু তার গভীরে তার একটা জন্মগত নৈতিক বোধও তো আছে। দুটোই প্রমাণিত। এখন আমাদের সামনে রাস্তা দুটো, কিন্তু দেখার হল আমার চারপাশের পরিবেশ কোনটাকে বেশি উৎসাহিত করছে?

বিদ্বেষকে চালিকাশক্তি হতে গেলে একটা উন্মাদনার দরকার। ইন্ধন জোগানের জন্যে গুজব অথবা ভুয়ো খবর, বৃহৎসংখ্যার দলবদ্ধতা, অস্ত্রের যোগান, কোথাও কোনো বৃহৎশক্তির সমর্থন…. এর একটা বা দুটো বা বেশ কয়েকটা তো কাজ করেই।

তারপর শুরু হয় রাজনৈতিক তর্জা। সমস্যা হল গণতন্ত্র অনেক সময়েই দলতন্ত্রের প্রতি আনুগত্যে এসে ঠেকে। গণ - যে নিরপেক্ষভাবে, জনকল্যাণের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে, সে-ই গণ নানাভাবে নানা দলীয় মতের আদর্শের প্রতি বিচার-চিন্তাহীন অভ্যাসগত আনুগত্যে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়। ফলে সত্য থেকে যায় অধরা, নানা হাফ-বেকড তত্ত্ব, একে অন্যকে দায়ী দোষী ইত্যাদির আবর্তে আইন-শৃঙ্খলার দিকে না এগিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল, সোশ্যালমিডিয়া ট্রায়ালে ঢুকে যায়। পোস্টট্রুথের মত গরল উৎপন্ন হয়। সেই গরল অপসারণ করতে আবার আরো সময় বয়ে যায়।

তবু অবশেষে সমাজ তো সাধারণ মানুষেরই। তাই সাধারণ সরল সত্য একদিন আবার নানা কুয়াশা, ঘূর্ণি সরিয়ে দেখা দেয়, আবার মানুষ নিজের ভুল উপলব্ধি করে, আবার কিছুটা আত্ম-মার্জনের রাস্তায় হাঁটে।

মানুষের মূলগত প্রকৃতিতে শান্তিতে, সংহতিতে বেঁচে থাকার এক নৈতিক ঝোঁক আছে। কিন্তু সেই প্রকৃতির বিপরীতে রীতিমতো ক্ষেপে ওঠারও ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে তো তার স্বাভাবিক অবস্থা নয়। সাধারণ মানুষ যখনই নিজের এই আত্মবোধে জেগে ওঠে তখনই সে আবার শান্তি - সংহতির রাস্তায় হাঁটে, যে তাকে এই রাস্তায় নিয়ে আসে তাকে সে শান্তভাবে বিনা কোনো ক্ষুদ্রস্বার্থের প্ররোচনায় অনুরসরণ করে। কিন্তু যখনই সে নিজের আত্মবোধ থেকে বিচ্যুত হয় তখনই সে নানা আসুরিক প্রবৃত্তির খপ্পরে পড়ে, এবং আসুরিক প্রবৃত্তিতে মত্ত মানুষের অধীনে এসে পড়ে। ক্রমে উন্মাদ হয়ে ওঠে।

নিজেকে রক্ষা করার তাই প্রাচীনতম রাস্তা সেই এক, আত্মবোধের জাগরণ। যা সেদিন প্রাচ্যের উপনিষদে লেখা হয়েছিল, পাশ্চাত্যের ডেল্ফির মন্দিরে লেখা হয়েছিল - নিজেকে জানো।

সাধারণ মানুষের আত্মবোধের জাগরণই সঠিক সুষ্ঠু গণতন্ত্রের ভিত্তি। বৈচিত্রের মধ্যে সংহতি গড়ে ওঠার প্রেরণার উৎসই হল এই আত্মবোধের চর্চা। যে কথাটা সেই প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগের মহাপুরুষদের একটাই শিক্ষা - তোমাদের চৈতন্য হোক।

এ দীক্ষা সাধারণ মানুষের আত্মবোধ জাগানোর জন্যেই তো। আর উপায় কি? সাধারণ মানুষের হাতেই তো আইন থেকে সমাজ সবটুকু। নিজে না জাগলে, নিজে অন্ধ হয়ে থাকলে কে কাকে পথ দেখাবে? শুধু কোলাহলই সার হবে যে!

100
Mon, 07/31/2023 - 23:30

যখন জেগে থাকি, তখন কয়েক ভাগে ভেঙে জেগে থাকি। বাইরের জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন। মাল্টিপল প্লাগের মত, একই চেতনা থেকে এতগুলো দিকে স্রোত বইছে। চেতনার স্রোত।

কিন্তু এইসব ছেড়েও আরেক ধারা আছে। কারোর কারোর জীবনে প্রকট, কারো জীবনে প্রচ্ছন্ন। যার জীবনে প্রকট, তারও আবার তারতম্য আছে। কারোর অতি প্রকট, কারো মৃদু। সেই ধারার কি নাম দেওয়া যায় ভাবছি। হয় তো এইভাবে বলা যেতে পারে, সে এক অন্তর্লীন জীবন।

এই অন্তর্লীন জীবন কি তবে সাব-কনশাস বা মগ্নচৈতন্য ধারার কিছু? ঠিক তা নয়। এ এমন এক জীবন, যার সঙ্গে বাদবাকি কোনো জীবনের তালমিল নেই। তার বাহ্যিক জীবন, পারিবারিক জীবন, এমনকি ব্যক্তিগত জীবনের চাইতেও এ আলাদা। ব্যক্তিগত জীবন তাও নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, কিন্তু এই অন্তর্লীন জীবন আমার নিয়ন্ত্রণের অতীত। তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়, কিন্তু তাকে অন্য কোনো জীবনে না তো ব্যাখ্যায় ধরা যায়, না তো প্রকাশে। সে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমার হাঁ-তে হাঁ, বা না-তে না মেলানোর তার কোনো দায় নেই। সে কেবল নিজের ছন্দে নিজে জেগে থাকে। হয় তো ঘুমের মধ্যেও জেগে থাকে। সব ব্যথা, বেদনাকে নিয়ে নিজের মধ্যে ছবি আঁকে, সুর গড়ে। কিন্তু সেকি এতটাই কাব্যময়? সেকি কখনও বিষাক্ত করে তোলে না সব কিছু কে?  

হ্যাঁ, সেও সে পারে। একজন মানুষের বাহ্যিক জীবন, পারিবারিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন…. সব সচ্ছল চলছে। কিন্তু তার অন্তর্লীন জীবনে যদি ছন্দপতন ঘটে, সে ছন্দপতন বাঘা বাঘা ভূমিকম্পের মত সব কিছু তছনছ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

এতটা লিখে আমার মনে হল, হয় তো ব্যক্তিগত জীবন আর এই অন্তর্লীন জীবনের মধ্যে পার্থক্যটাকে আরেকটু বলা দরকার।

আসলে আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ পার্থক্যকে অনুধাবন করা ভীষণ শক্ত। অধ্যাত্মিক ভাষায়, কবিতার ভাষায় হয় তো বা কিছু ইঙ্গিত দেওয়া যায়, কিন্তু আমি তা চাইছি না। আমি যতটা সম্ভব বাস্তবিক যা অনুভব করেছি তাকেই লিখতে চাইছি।

ব্যক্তিগত জীবনে একটা ব্যক্তিগত আমি থাকে। তার সুখ-দুঃখ, অভাব-অভিযোগ, স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্খা ইত্যাদির কথা থাকে। চিন্তাভাবনা থাকে। সেখানে নিজেকে কখনও সক্রিয়, কখনও নিষ্ক্রিয় করে রাখা যায়। কখনও অভিমানে বুক ভরে ওঠে, কখনও দুশ্চিন্তার কালোমেঘ ঘনিয়ে থাকে, কখনও আসন্ন সুখের ভাবনায় চিত্ত মশগুল থাকে। এরকম অনেক কিছু যা শুধু আমিই জানি।

কিন্তু অন্তর্লীন জীবন এর বাইরে। সে যেন সব সময় ধ্যানমগ্ন। বাইরের কোনো কিছুর সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ কোনো যোগাযোগ নেই। সে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন নয়, আবার যেন বিচ্ছিন্নও। সবটাই তার যেন বাইরে। এমনকি আমার ব্যক্তিগত আমিও। সেও ত্যাজ্য। বড্ডবেশি ত্যাজ্য সে। সেই অন্তর্লীন চেতনার দিকে ফিরলে ব্যক্তিগত আমি শিশিরের মত মিলিয়ে যায়, অথবা জড়ের মত নিষ্ক্রিয় হয়।

ব্যক্তিগত আমি যেমন বাইরের সুখ-দুঃখের ঘটনায় সাড়া দেয়। নিজেকে রিলেট করতে চেষ্টা করে। কখনও পারে, কখনও পারে না। আর যা পারে না তার প্রতি উদাসীন হয়, এই অন্তর্লীন যে জীবন, সে তেমন নয়। তার সংবেদনার পথ যে কি তা বোঝা যায় না। সে কোনো কিছুর ব্যাখ্যা চায় না। দেয় না। সে কি যেন গড়তে চায় একটা। সেই গড়ার সাধনায় তার কোনো কিছুই ফেলনা নয়, আবার কোনো কিছুই আবশ্যিকও নয়। সে দাবী জানায় না, ডাক পাঠায়। সে অভিযোগ জানায় না, অপেক্ষা করে। সে বিষণ্ণ হয় না, পর্বতের মত গম্ভীর হয়ে থাকে। সে উচ্ছ্বসিত হয় না, শরতের পূর্ণিমার আকাশের মত প্রসন্ন হয়ে থাকে।

কিন্তু এ সবের পরেও তার মধ্যে এক বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যখন সে বিনষ্ট হয়, তখন সে বিদ্রোহী আত্মঘাতী অবধি হতে পারে। বাকি সব জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে। দেয়ও। বাইরে থেকে কোনো কারণ পাওয়া যায় না। তার কারণ, সাধারণত 'কারণ' যে যুক্তি-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতার ধাতুতে জাত, এ সে ধাতুতে জাত নয়। এ এমনই এক গভীর সংবেদন, এমনই এক গভীর বালাই। আমি-হীন অস্তিত্ব, যার কেন্দ্র আছে পরিধি নেই, যার স্বঃপ্রমাণ অস্তিত্ব আছে, কিন্তু গতিপথের কোনো নির্দেশিকা নেই।

 

(ছবি - গুগুল ইমেজ)

 

101
Sat, 07/29/2023 - 23:38

কতটুকু জমায় মানুষ অবশেষে? বাইরে যা জমে সে বাইরের জিনিস। নিজের ভিতরে যা জমে, সে কতটুকু? ক্ষোভ, অভিমান, দু:খ, শোক। আর কিছু অভিজ্ঞতা, যাকে সে বলে জীবনবোধ। আর কি জমায় মানুষ? যে সব জিনিসের দিকে তাকিয়ে সে গর্ব করে বলতে পারে, এ আমার!

মানুষ নদীর তীরের মাটির মত। রোজ ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। সে বিশ্বাস করে তার এই রোজকার ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া কোথাও হয় তো গিয়ে জমছে। আবার সে বিশ্বাসও হারিয়ে যায় অনেক মানুষের। তার মনে হয় সে শুধুই ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে। রোজ অল্প অল্প করে ভাঙন ধরছে। চিড় ধরছে। একটা বড় স্রোতের ধাক্কায় হয় তো বা সে গোটাটাই হারিয়ে যাবে।

এই ভাঙন লাগা মাটির উপর এক চিলতে তার সাম্রাজ্য। খুব চায় আগলে রাখুক সে সবটুকু। সে এই নড়বড়ে মাটির উপর অক্ষয় দেবতার মন্দির বানায়। বলে আমার এই ভাঙনকে রক্ষা করো। আমি তোমায় তুষ্ট রাখব। তুমিও আমায় দেখো। কেউ কেউ নানা দর্শনের বেড়া দেয়। বলে এই আমার সত্যজ্ঞান, এই বেড়া ভেঙে কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না আমাকে।

তবু সব ভেসে যায়। তত্ত্বের বেড়া ভেঙে যায়। দেবালয় ভেসে যায়। তার মনে হয় এ বিশ্ব সংসারের নেপথ্যে এমন এক শক্তি আছে যে তার প্রার্থনা, সাধনা, উপবাস, আত্মত্যাগ… কিচ্ছুর পরোয়া করে না। সে নিজের খেয়ালে চলে। চাইলেই সব তছনছ করে দেয়। আবার চাইলেই শরতের আকাশের মত নিরীহ সরল সাজে সেজে আসে। ছলনা! কি দু:সহ ছলনা। কখনো আবার তার মনে হয় আসলেই সব শূন্য। কোথাও তো কিছুই নেই। গোটা সৃষ্টি কেবলই ঘটনার পারম্পর্য মাত্র। অর্থ বলতে শুধু কার্যকারণ সূত্র, তার কোনো উদ্দেশ্য নেই। উদ্দেশ্য শূন্যতার ক্ষোভ চিত্তকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সে বিশাল শূন্যতার উপর বড় একটা শূন্য এঁকে বলে, এই আমার তত্ত্ব তবে। সব অর্থহীন।

অবশেষে কি জমায় মানুষ তবে? এক রাশ শূন্যতা? অর্থহীনতা? বুদ্ধি, অস্তগামী সূর্যের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ওঠে, বলে কিছুই বুঝলাম না। হৃদয় মৃত আশার কঙ্কালসার হাতের মুঠোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কিছুই ধরা দিল না তো!

মানুষ হারায় না। অন্তত যতদিন না পৃথিবী তাকে অবলুপ্ত ঘোষণা করছে সে হারাবে না। মানুষ হারায় না, একটা পরিচয় হারায়। অতি যত্নে গড়া এক মুঠো ধুলো হারায়।

মরমী চিত্ত এ শূন্যতার দিকে তাকায়। হাত থেকে সরে সরে যাওয়া সময়ের দিকে তাকায়, যেন বালির স্রোত। কোনো একটা বালিতে মহাকাশচারী সূর্যের আলো ঠিকরে তার চোখে লাগে। চোখে জল আনে। সে বলে, মহাকাশচারী এ আলোর নাম কি জানো, দরদ! বাইরের অসীম আকাশ যেমন নক্ষত্র ছাড়া অন্ধকার, মহাশূন্য শুধু, তেমনই চিত্তের এ মহাকাশ দরদের আলো ছাড়া মহা অন্ধকার। বাইরের অন্ধকারের থেকেও আরো বেশি অন্ধকার। চিত্ত, তুমি আত্মকেন্দ্রিকতা ভোলো।

একটা প্রজাপতি তখন হয় তো কোনো ফুলের উপর বসে, মকরন্দে আটকে পা, একটা তারা খসে পড়ছে আকাশ থেকে, কোথাও পাড় ভাঙার শব্দ……

তবু এ শূন্যতার ভয়াল, উদাসীন ছদ্মবেশে কে যেন এসে দাঁড়ায় ছায়ার মত, মরমী তাকে চেনে দয়াল, সোনার মানুষ বলে…. সে বলে ভয় নেই মাঝি….. নাও খোলো….. ভাসতে ভাসতেই ভয় কাটে…. নোঙর তোলো….. নিজেকে ভুলে নিজেকে পাও….

102
Sat, 07/15/2023 - 19:47

ভারতীয় সন্তানদের মধ্যে কি অপরাধবোধ বেশি হয়? সন্তান হিসাবে? ভারতীয় বাবা মায়ের আশা পূরণ করতে পারা কি অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি কঠিন? আমি সুস্থ সম্পর্কের কথা বলছি না। বলছি টক্সিক সম্পর্কের কথা।

আমরা নানা টক্সিক সম্পর্ক আলোচনা করি। সবটাই মূলত পুরুষ-নারীর সম্পর্ক ঘিরেই আলোচনাটা গড়ায়। কিন্তু টক্সিক প্যারেন্ট শব্দটার সঙ্গে আমরা কতটা পরিচিত?

আমার মনে হয় ভারতের সামাজিক পরিকাঠামোর আড়ালে, ভারতীয় পারিবারিক মূল্যবোধের আড়ালে এই টক্সিক পিতামাতারা অনায়াসে নিজেদের টক্সিসিটিটাকে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।

টক্সিক প্যারেন্টের কয়েকটা লক্ষণ যা মনোবিদেরা করেছেন। তা মোটামুটি হল।

১) ভীষণরকম ম্যানিপুলেটিভ হবেন তারা। সন্তানের সব কিছুকেই নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইবেন। আপাতভাবে মনে হবে ভালোর জন্য, কিন্তু সেটা আসলে তাদের অস্বাস্থ্যকর স্বভাব।

২) সন্তানের লাইফস্টাইল, পছন্দ অপছন্দ নিয়ে ভীষণ ভোকাল হবেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমর্থন জানাবেন না।

৩) সন্তানকে সর্বক্ষণ একটা অপরাধবোধের মধ্যে রাখতে চাইবেন, নিজের দাবী না মিটলেই। নানা ধরণের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল তো আছেই সঙ্গে সঙ্গে। আর টক্সিক পিতামাতার দাবীরও অন্ত নেই।

মোটামুটি এগুলো কয়েকটা লক্ষণ। যেটা হবে সেটা হল এই যে, এই ধরণের পিতামাতার সান্নিধ্য কখনওই সুখকর নয়। যেহেতু তারা ভীষণ জাজমেন্টাল, এবং স্বাভাবিকভাবেই ভীষণ ডিজরেসপেক্টফুল, ফলত এদের সঙ্গ বেশিক্ষণের হলেই সন্তানের মধ্যে একটা সব কিছু নিয়ে কনফিউশজড দশা চলে। নিজেকে নিয়ে ভীষণ আত্মবিশ্বাসের অভাব। কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এতদিক থেকে ভাবতে বসে যে আদতে কোনো কাজই নিজের সিদ্ধান্ত, পছন্দ অনুযায়ী হয়ে ওঠে না। এসব সন্তানদের মূল ধর্মই হল বাবামা-কে তুষ্ট করা। জীবনে নিজের মেরুদণ্ডের জোর বাঁকতে বাঁকতে এমন জায়গায় এসে ঠেকেছে যে মেরুদণ্ড কোনোদিন যে ছিল কিনা সেটাই প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়ায়।

মনোবিজ্ঞানীরা কিছু কিছু টিপস দেন এই সব সন্তানদের নিজের নিজত্ব বাঁচিয়ে বাঁচার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য। কারণ কখনওই ঠিকটাকে বুঝে চলার জন্য তত দেরি হয়ে যায় না। টিপসগুলো হল ---

১) বাবা-মাকে খুশী করাই জীবনের উদ্দেশ্য নয়। সব সিদ্ধান্তের নিয়ামক হতে পারে না। অবশ্যই বাবা মায়ের উপর শ্রদ্ধা সম্মান থাকবে, তবে সেটা যেন পৌরাণিক গল্পের অনুসারী না হয়। বাস্তবানুগ হয়। কারণ দেখেছি বহু মহাপুরুষই বাবা-মাকে ঈশ্বরতুল্য জ্ঞানে সেবা করার জ্ঞান আজীবন দিয়ে যাওয়ার পরও নিজের সন্তানদের আর সু-নাগরিক গড়ে তুলতে পারেননি।

২) সম্পর্কের মধ্যে একটা সীমারেখা গড়ে দেওয়া। এবং তাকে আচরণে প্রতিষ্ঠিত করা। একটা বয়সের পর যদি ব্যক্তিগত জীবনে, বৈবাহিক জীবনে, কাজের জীবনে, কি সামাজিক জীবনে বাবা-মা "ভালো করার" জন্য উপদেশ দিতে আসেন, তবে সসম্মানে তাকে সীমারেখা বুঝিয়ে দেওয়া। এটা খুব দরকার।

৩) বাবা মা-কে পরিবর্তন করতে যাওয়ার চেষ্টা করতে যাওয়া বোকামি। একটা বয়সের পর তারা আর বদলাবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। আর অকারণে তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েও লাভ নেই। কারণ খানিকবাদেই যুক্তির থেকে আবেগের দৌরাত্ম শুরু হবে, যুক্তির ছদ্মবেশে, সঙ্গে নানা ধরণের ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল। অগত্যা স্থান ত্যাগ করো। বেরিয়ে এসো। অল্পদিনের জন্য, না বেশিদিনের জন্য সে পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।

৪) নিজের যত্ন নিতে শেখা। এটা খুব দরকার। প্রথমেই আবার প্রথম কথাটা, নিজের ভিতর থেকে যাবতীয় অপরাধবোধ, হীনমন্যতাবোধ যা টক্সিক বাবা-মা থেকে পরোক্ষভাবে পাওয়া, সুকৌশলে চারিয়ে দেওয়া, তার থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। নিজের সামাজিক পরিমণ্ডল নিজের রুচি অনুযায়ী বানিয়ে নিতে হবে। নিজেকে নিজের দায়িত্বে শিক্ষিত করতে হবে, ইমোশনালি স্বাবলম্বী করতে হবে।

ওয়েবমেড, সাইকোসেন্ট্রাল, উইকিহাও ইত্যাদি পেজের থেকে মোটামুটি এ ধরণের পরমার্শ আছে।

এখন আমাদের কালচারে এ সব কথা অনেক সময়েই "স্বার্থপরতা"..." রুডনেস"... "অকৃতজ্ঞ"...." যেমন বউ শেখাচ্ছে, বন্ধুবান্ধব শেখাচ্ছে".... ইত্যাদি নানা অবাস্তব নিন্দামন্দের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায়। ফলে এক একজন মানুষের নিজের সন্তানের কলেজ পাশ করার বয়সেও নিজের বাবা মায়ের এই টক্সিসিটি বোঝার ক্ষমতা থাকে না।

ভালো করে বুঝে দেখতে হবে টক্সিসিটিটা বাবা মায়ের মধ্যে দিয়ে এলে সেটা কি ভয়ানক হতে পারে। বহু মানুষের জীবন আজীবনের মত পঙ্গু হয়ে যেতে দেখেছি, এই অতিভালোবাসা, অতিদাবীদাওয়া, অতিঘনিষ্ঠতা, প্রাইভেসির মা-বাপ এক করে দেওয়া বাবা মায়ের কল্যাণে।

বাবা মায়ের উপর শ্রদ্ধা ভালোবাসা কর্তব্য সব থাকবে। কিন্তু পাশাপাশি এটাও খেয়াল রাখতে হবে সে টক্সিক বাবা মায়ের সন্তানদের সমালোচনার আগুনে আরো না সেঁকে, তাদের ভালো করে বুঝতে চেষ্টা করা যে কি ভাগ্যহীন তারা। যে ভালোবাসার সম্পর্কের আশ্রয়ে জীবনের প্রথম চোখ ফোটে, সেই ভালোবাসাই যখন টক্সিক হয়, সে দুর্ভাগ্য কি সাংঘাতিক দুর্ভাগ্যই না হয়!

যদি উদাহরণ দিতে বসি, তবে মহাভারত লেখা হয়ে যাবে। মোদ্দাকথা এই, একটা বয়সের পর নিজের সম্মানের সঙ্গে আপোষ কোনো কাজের কথা নয়। আর সেটা যদি বাবা মায়ের থেকে আসে তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের হলেও, বাস্তব। তাকে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটাই নিজের প্রতি নিজের সুবিচার। নইলে মেরুদণ্ডহীন, স্বাতন্ত্র্যবোধহীন "বাবা মায়ের বাধ্য ও ভালো সন্তান" হয়ে বেঁচে থাকা নরক যন্ত্রণার সামিল হয়ে দাঁড়াতে পারে।

"আমার সব ঘরে ঘরে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা করে, তোমার মত এরকম কত মা তাদের কত মেয়ের জন্য এরকম করে.... তোমাদের ভালো করার এই মারাত্মক ভুলে সমস্ত জ্বলে পুড়ে সব শেষ হয়ে গেল।"

 

(ছবিটা কালজয়ী বাংলা সিনেমা 'সাত পাকে বাঁধা'-র। শিরোনামটাও এই সিনেমারই একটা সংলাপ।)

103
Sat, 07/08/2023 - 12:16

কয়েকদিন ধরে দেখছি বাঙালিরা বাঙালিদের কাছেই দেশে-বিদেশে বড় অপমানিত হচ্ছেন। প্রতিবাদ, মান-অভিমান এই সবও হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বিদেশে গিয়ে বাঙালি শিল্পীরা বাঙালি শিল্পরসিকদের কাছে অপমানিত হচ্ছেন। এদিকে নিজের মাটিতে নিজের ভাষার সঙ্গে দুষ্টু সৎমায়ের মত ব্যবহার করছে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কি গেরো! ফলে অভিমান, ক্ষোভ, অপমান মিলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

এখন বাঙালি প্রতিবাদটা করবে কার কাছে? কেউ কেউ কথায় কথায় বলেন, বয়কট করো। এখন অমন ফস্ ফস্ করে বয়কট করলে তো আর কাজ চলে না। তাই একজন নামী সঙ্গীতশিল্পীর চোখ অভিযোগ অভিমান ভরা লাইভে আরেকজন নামী অভিনেত্রী কমেন্টেসে লিখলেন, ওহে তুমি ভাই নিজের কথাই শুধু বলো, কারণ তুমি যখন অন্যের অপমানের ফিরিস্তি গাইছ, তখন সে হয় তো আবার ভিসার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সব অপমান ভুলে।

কথা বাস্তব। সব দিকেই বাস্তব।

এদিকে সেদিনও বেশি দেরি নেই যেদিন বাংলা মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালি সন্তান পেতে বিদেশী আতসকাঁচ আমদানী করতে হবে। জীববিদ্যায় যোজক প্রাণী বলে একটা ব্যাপার আছে। মানে যে প্রাণীতে দু'জাতের প্রাণীর বৈশিষ্ট্য আছে। এই যেমন আর্কিওপটেরিক্স বলে একটা পাখি ছিল তার মধ্যে সরীসৃপ আর পক্ষীর উভয়েরই বৈশিষ্ট্য ছিল। এখন আমাদের বাংলা মাধ্যমের বেশ কিছু স্কুল ছাত্র টানার জন্য আর্কিওপটেরিক্স হচ্ছে। মানে দুই ভাষাতেই পঠন পাঠন চালাতে চাইছে। ফলে হচ্ছে কি যারা ইংরাজি স্কুলের অতি-খরচের বোঝা বইতে পারছেন না, এদিকে ভাবছেন বাংলা ভাষায় শিক্ষা পেলে সন্তানের ভবিষ্যৎ শুকনো চরে গিয়ে ঠেকবে, তারা সন্তানদের এইসব স্কুলে, কম বেতনে ইংরাজিতে পড়িয়ে, উপযুক্ত ইংরাজি জানা ভবিষ্যতের চাকুরীজীবী বানাবার স্বপ্নকে সাকার করবার সম্ভাবনা দেখছেন। আজকাল তো অনেকেই সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজও বাংলাকে সরিয়ে হিন্দি করে নিচ্ছেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য।

কিন্তু এ হল তলাকার কথা। যা দেখা যায়। বলা যায় না। তবে কি বাংলা ভাষার কোনো ভবিষ্যৎ নেই? তা কেন? বইমেলায় রাশি রাশি বাংলা বই বিক্রি হচ্ছে। যারা ইংরাজি মাধ্যমে পড়েছে তারা বুঝি সবাই বাংলা ভুলে যাচ্ছে? বালাইষাট! তা কেন হবে? দস্তুর মত গড়গড় করে ভাষাটা বলে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে এদের সংখ্যা কি কমবে? মোটেও না! থাকবে। কিন্তু গৌরবটা থাকবে না। যেমন এখন নেই। এখন কর্পোরেটের দুনিয়ায় হিন্দী আর ইংরেজি এসে বাংলা ভাষাকে অপশনাল করে ফেলেছে। বাংলা ভাষার শিকড় সরু হয়ে গিয়েছে। সে শিকড় দিয়ে কর্মজগতের জন্য পুষ্টিরসের আমদানি বন্ধ। কারণ কর্মজগতে তার আর ডাক পড়ে না। শুধু বিনোদন আর আটপৌরে ব্যবহারের জন্য ক্ষীণধারা আসে। তাহলে কি গেছে? এক কথায় 'সিরিয়াসনেস'টা গেছে। কমিটমেন্টটা দুর্বল। মায় বৃহৎ পরিসরে ঠিকঠাক মানের খবর, আলোচনা, বিশ্লেষণের জন্যেও ইংরাজি কাগজই ভরসা। সেখানে যে সিরিয়াসনেসটা আছে, এখানে তা যেন কোথাও একটু পানসে।

তবু কিছু মানুষ এ ডুবন্ত তরীকে বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রেরণা একটাই, বাংলা ভাষার প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি, ইতিহাসের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তারা মিছিলে গলা ফাটান না, উত্তেজক স্লোগান লেখেন না, "আপনি বাংলায় থেকে বাংলায় কথা বলুন" বলে কলার ধরে ঝাঁকি দেন না, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ ফ্যান্সি তর্কেও গা ভাসিয়ে দেন না।

তারা শুধু নিরলসভাবে নিজের জীবিকা সামলে যতটুকু সময় বাঁচে, কি নিষ্ঠার সঙ্গে ভাষাটার জন্য কাজ করে চলেছেন দেখি। এটা একটা আশার কথা। আমার ভরসা জাগে এনাদের দেখলেই। এইসব মানুষদের হারানো খুব শক্ত। কারণ এনাদের তাগিদটা না তো রক্ষণশীলের মত, না তো ছুঁৎমার্গীর মত, না তো অবাস্তব আকাশ কুসুমের। এনাদের কাছে নিজের ভাষাকে শ্রদ্ধা করা মানে অন্য ভাষা, বা সংস্কৃতিকে অশ্রদ্ধা করা না, বা তাদের প্রতি উদাসীন থাকাও না। এনারা ভীষণ ইনক্লিউসিভ। এরকম খাঁটি উৎসাহ, খাঁটি ভালোবাসা, খাঁটি তাগিদের জয় অবশ্যম্ভাবী।

হয় তো কয়েক প্রজন্ম খুব কনফিউশানের ভিতর দিয়ে যাবে। কিন্তু তারপর এনাদের বোনা বীজেই আবার নতুন করে এ ভাষার, এ সংস্কৃতির নতুন অঙ্কুর বেরোবে। যে ভাষার ইতিহাসে এত বড় বড় গুঁড়ি, এত গভীরে যে ভাষার মননের শিকড়, সে ভাষা আজ ভীষণ প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাইরের পল্লব-শাখা-ফুল-ফলে ম্লান হয়েছে নিশ্চয়ই, সে কি শুধু বাইরেই? মাটির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। যারা সেটা টের পান তারা জানেন কোনো ভাষাই কেবল ছাপাখানার উপর নির্ভর করে চলে না, চলে হৃদয় আর কণ্ঠের যুগপৎ আলিঙ্গনে। যাকে প্রাণবায়ু জীবিত রাখে। ছাপাখানার কালিই শুধু নয়। সেখান থেকেই আবার জন্মাবে ভবিষ্যতের বাংলা ভাষা। যার জোর হবে অকৃত্রিম, স্বপ্ন থাকবে দশদিক ছাওয়া, মাটিতে পা রেখেই। তাকে অপমান করবে কে? তার চোখের দিকে তাকালেই তো সে দেখবে আত্মনির্ভর, খাঁটি উজ্জ্বল আলো। যে প্রাণের আনন্দে বলে, আমি আছি। এই তো। ছুঁয়ে দেখো। হাত পাতো, এনেছি নতুন প্রাণের উপহার, নকল নেই, সবটাই আসল, অধ্যবসায়ে পাওয়া, সাধনার ধন, আমার অ আ ক খ…. আমার প্রাণে প্রবেশের পথ, তোমার হাতে হাত রাখার আমার আত্মবিশ্বাস।

104
Tue, 06/27/2023 - 20:36

প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য দর্শনের খোঁজের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য আছে। একজনের খোঁজ শান্তির। একজনের খোঁজ সুখের। সুখ আহরণের বস্তু। শান্তি অর্জনের। সুখ মানসিক, পারিপার্শ্বিক, সামাজিক পরিস্থিতির জটিল সমীকর‍ণের উপর নির্ভর করে। শান্তি নির্ভর করে বোধের উপর। ত্যাগের উপর।

আমি সুখ অহর্নিশি চাই। কিন্তু শান্তি আমি কদাচিৎ চাই। আমি সুখকে ঘিরে শান্তির সাম্রাজ্য চাই। কিন্তু শান্তির ভিত্তিতে সুখকে প্রতিষ্ঠা দিতে চাই না। কারণ শান্তির দাবী এক। সুখের দাবী অনেক।

সক্রেটিস বললেন, সুখ সদগুণের অনুশীলনে। অ্যারিস্টটল বললেন, দুই চূড়ার মধ্যবর্তীতে, 'দ্য গোল্ডেন মিন' অর্থাৎ ওই বাংলা প্রবাদের মতো --- 'অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি ছোট হয়ো না ছাগলে মুড়ে খাবে'। জন লক প্রমুখেরা সুখের আরো নানাবিধ তত্ত্ব দিলেন। সুখ যুক্তি অনুগামী হবে, বুদ্ধি অনুগামী হবে, নীতি অনুগামী হবে। নীতি আবার অনুভবজাত, নাকি যুক্তিবিচারজাত সে নিয়েও অনেক দ্বন্দ্ব আছে। পাশ্চাত্যে সুখের খোঁজের অন্যতম আধুনিকতম বই হয় তো বা রাসেলের "কনকুয়েস্ট অব হ্যাপিনেস", সেখানে তিনি সব শেষে বলছেন জীবনটাকে বিলিয়ার্ড বোর্ড না করে ফেলার জন্য। ক্রমাগত সংঘর্ষ, নিজের মধ্যে দ্বন্দ্বের শতধা, এতে সুখ পাওয়া যায় না।

সে অর্থে আব্রাহামিক ধর্মগুলোতে শান্তির কথা থাকলেও, সেই যে প্রধান ভাব তেমন নয়। সেখানে মুক্তি, স্বর্গীয় সুখ, পরকালের প্রতিশ্রুতি এবং সেখানে সুখময় জীবনের কথা বারবার এসেছে।

হিন্দুধর্মেও সে প্রসঙ্গ আছে। কিন্তু একই সঙ্গে পাশাপাশি স্বর্গ, পরকালের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদির নিন্দাও আছে। এমনকি কোনো পুণ্যবশে স্বর্গপ্রাপ্তি হলেও সেও যে ক্ষণস্থায়ী সে ভাবনাও বলা হচ্ছে।

"বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ, উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদি সকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই।" [গীতা ২ || ৪২ - ৪৩]

তবে স্থায়ী কি? যতক্ষণ না মন সাম্যে স্থিত হচ্ছে। তার জন্য পরকালের অপেক্ষা না করে এখনই করা উচিৎ ও কর্তব্যও। গীতার এই দর্শন। গীতাতে আত্মার শ্রেষ্ঠতম গতি যা বলা হচ্ছে সেখানে শুধু সাম্য প্রতিষ্ঠা, শান্তির কথা বলা হচ্ছে। এমনকি যে স্থিতপ্রজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে, যা গীতায় মানুষের চিত্তের শ্রেষ্ঠতম অবস্থান সেখানেও শান্তিই প্রধান সুর।

"যাঁদের মন সাম্যে অবস্থিত হয়েছে, তাঁরা ইহলোকেই জন্ম ও মৃত্যুর সংসার জয় করেছেন। তাঁরা ব্রহ্মের মতো নির্দোষ, তাই তাঁরা ব্রহ্মেই অবস্থিত হয়ে আছেন।" [গীতা ৫ ||১৯]

এ ছাড়াও গীতাতে ভক্তি, জ্ঞান ও কর্মে সাধকের মূল লক্ষ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বারবার এই সাম্যাবস্থার কথা এসেছে। স্বামী বিবেকানন্দও নিজেকে এই সাম্য দর্শনের অনুরাগী বলছেন।

বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্মের পথেরও মূল উদ্দিষ্ট লক্ষ্য শান্তি। সুখ নয়। আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কিনা, তার সঙ্গে আমার জীবনের মূল উদ্দেশ্যের কোনো ভিত্তিগত পার্থক্য নেই। আমি শান্তির খোঁজ করছি কিনা, এই মূল কথা। ভারতীয় দর্শনে এ সত্য বারবার প্রচারিত হয়েছে। আধুনিককালে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তাঁর দিকে যত এগোবে তত শান্তি পাবে।

এইবার কথাটাকে বিপরীত দিক থেকে ভাবা যাক। আমার মনে যদি হিংসা থাকে, লোভ থাকে, ঈর্ষা থাকে, নানাবিধ কুটিলতা থাকে, কোনোভাবে কি আমি শান্তিতে অবস্থান করব?

গীতার পরেই আরেকটি বইয়ের নাম উল্লেখ্য যেখানে বেদান্তদর্শনের অপরূপ ব্যাখ্যা আছে, সে হল 'বিবেকচূড়ামণি'। সেখানে বলা হচ্ছে, যদি তোমার মুক্তির ইচ্ছা থাকে, তবে সন্তোষ, দয়া, ক্ষমা, সারল্য, শম ও দমকে অমৃতের মত আদরে গ্রহণ করো।

তবে আমার নীতি স্থির করতে যদি শান্তি মাপকাঠি হয়ে থাকে তবে আমার পক্ষে নীতি নির্ধারণ করা এমন কিছু কঠিন না। কিন্তু আমার নীতি নির্ধারণের পরাকাষ্ঠা যদি সুখ হয়ে থাকে তবে আমার পক্ষে নীতি স্থির করা ভীষণ কঠিন। কিসে আমার সুখ সে অধ্রুব। কিন্তু কিসে আমার শান্তি, সে সুপ্রতিষ্ঠিত সত্য। আমার নিজের নানাবিধ প্রবৃত্তিকে শান্ত করে আমার বোধবুদ্ধির সেই শান্তিময় অবস্থানের জন্য আমাকে চেষ্টা করতে হবে, সেই আমার সাধন। "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি" --- রবীন্দ্রনাথ গাইছেন। অর্থাৎ শান্তি পেতে গেলে বিশ্বের কেন্দ্রের সেই ধ্রুবপদের সঙ্গে আমাকে যুক্ত হতে হবে। আমাকে লাভে-ক্ষতিতে-হার-জিতে-শোক-সুখে শান্ত থাকতে হবে। সহজ নয়। তাই এ সাধনা। তাই এ তপস্যা। গীতা ১৭নং অধ্যায়ের, ১৪/১৫/১৬ শ্লোকেতে তপস্যার কথা বলতে এই শান্তিতে অবস্থানের কথাই বলছেন।

পাশ্চাত্যে কান্টের দর্শনের ক্যাটাগরিকাল ইম্পারেটিভ খানিকটা এই "যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি"-র কথাই বলে। 'মানুষই যেখানে মানুষের মূল লক্ষ্য' বলা হচ্ছে। মানুষ যেন উপায় না হয়, উদ্দেশ্যই হয়।

শান্তি তর্কের দ্বারা লভ্য নয়। শান্তি যুক্তির দ্বারা লভ্য নয়। শান্তি আত্ম-অভিনিবেশ দ্বারা লভ্য। শান্তির অন্টোলজিক্যাল ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু নানাবিধ আপাত অগভীর নীতির অ্যাগনটোলজিক্যাল খোঁজ দরকার। জ্ঞান কি, এ প্রশ্ন যতটা দরকারী, যা নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শন যতটা ভেবেছে, অজ্ঞান কি তা নিয়ে ভাবেনি। অজ্ঞানের কথা বারবার এসেছে প্রাচ্য দর্শনে। অজ্ঞান তা-ই যা আমাকে আমার এই শান্তির পথ থেকে বিচ্যুত করে।

"অমানিত্ব, দম্ভশূন্যতা, অহিংসা, সহিষ্ণুতা, সরলতা, সদগুরুর সেবা, শৌচ, সৈর্য, আত্মসংযম, ইন্দ্রিয়-বিষয়ে বৈরাগ্য, অহঙ্কারশূন্যতা, জন্ম-মৃত্যু-জরা-ব্যাধি-দুঃখ আদির দোষ দর্শন, স্ত্রী-পুত্রাদিতে আসক্তিশূন্যতা, স্ত্রী-পুত্রাদির সুখ-দুঃখে ঔদাসীন্য, সর্বদা সমচিত্তত্ব, আমার প্রতি অনন্যা ও অব্যভিচারিণী ভক্তি, নির্জন স্থানপ্রিয়তা, জনাকীর্ণ স্থানে অরুচি, অধ্যাত্ম জ্ঞানে নিত্যত্ববুদ্ধি এবং তত্ত্বজ্ঞানের প্রয়োজন অনুসন্ধান-এই সমস্ত জ্ঞান বলে কথিত হয় এবং এর বিপরীত যা কিছু তা সবই অজ্ঞান।" [গীতা ১৩ || ৭ ~ ১১]

আজকের এই ভয়ংকরভাবে আলোকিত অন্ধকার যুগে, এই উচ্চকিত অস্থিরতা, অহমের আস্ফালনের যুগে নীতি কি স্থির করা জটিল। আইন স্থির করা অনেক সহজ বরং। তার জন্য নানা প্রকারের নিয়ম বিধি আছে। কিন্তু একা মানুষ যেখানে নানাবিধ চিন্তার বিক্ষেপে দিকনির্ণয়ে অসমর্থ হচ্ছে বারবার, আমার মনে হয় ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের সেখানে একটা বড় কথা বলা আছে। শান্তির খোঁজ শুরু হোক। কিসে সুখ, এ প্রশ্ন না, কিসে শান্তি, এর অন্বেষণ হোক।

শান্তি কোনোদিন সাম্য, অহিংসা, উদারতা, পৈশুন্যহীনতা, গ্রহনীয়তা ছাড়া আসা সম্ভব নয়। তখন আলাদা করে কোনো নীতির অনুশীলন করতে হবে না। শান্তির তৃষ্ণাই সেই সবের মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবে যা আজকের মানবসভ্যতার টিকে থাকার জন্য বিকল্পহীন।

যা কিছু লিখলাম, এখানে নতুন কথা একটাও নেই। প্রচলিত কথায় যখন বলি, 'সুখের চেয়ে স্বস্তি ভাল', তখন গোটা দর্শনটাকেই লোকায়তভাবে বলি।

আরও কেন এ কথা পুরোনো নয়, কলকাতা থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে আজ থেকে মাত্র কয়েক দশক আগে রবীন্দ্রনাথ যে চেষ্টাটা, আরও ভালো শব্দার্থে বললে যে 'সাধনা'কে সফল করে তুলেছিলেন, গোটা বিশ্বকে যে শান্তির নীড়ে দেখতে চেয়েছিলেন সে শান্তি শুধু মাধুর্য নয়, অপরিসীম শক্তির একটি মানবিক অবস্থান।

 

(ছবি - অন্তর্জাল)

105
Sun, 06/18/2023 - 00:25

তুমি আদিকবি কবিগুরু তুমি হে....

এই আদিকবি কে গা? দেখেন, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন। মানে উপনিষদের ভাব থাকতে পারে। আচ্ছা, গানটা একবার পড়ে দেখা যাক।

 

     প্রথম আদি তব শক্তি--

আদি পরমোজ্জ্বল জ্যোতি তোমারি হে

          গগনে গগনে ॥

 

তোমার আদি বাণী বহিছে তব আনন্দ,

জাগিছে নব নব রসে হৃদয়ে মনে ॥

 

তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয চন্দ্র তারা,

     প্রাণতরঙ্গ উঠে পবনে।

 

তুমি আদিকবি, কবিগুরু তুমি হে,

    মন্ত্র তোমার মন্দ্রিত সব ভুবনে ॥

 

কতবার 'আদি' কথাটা লিখছেন তিনি? চারবার।

আদি শক্তি। আদি পরমোজ্জ্বল। আদি বাণী। আদি কবি।

 

আচ্ছা, এই আদি কবি কি পুরুষ? মনে হয়। কারণ কবিগুরু বলছেন। গুরু বললেই কেমন একটা পুরুষ পুরুষ শোনায় না? তাছাড়া রবি ঠাকুর থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় সব্বাই লিখেছে মেয়েদের কবিতাটা ঠিক আসে না। এই নিয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে এসে লাভ নেই। পড়েচি, তাই বলেচি। আমি অবশ্যি সহমত নই। কিন্তু আমার মত চুনোপুঁটির আবার মত। যাক গে। তো কথা হল ইনি কি সেই আদিশক্তি, মানে আদিকবি, মানে আদিপুরুষ?

উপনিষদে আদিপুরুষের কথা আছে। গীতায় পুরুষোত্তমের কথা আছে। মানে যিনি সমস্ত সত্তার মূল সত্তা। মানে ইঞ্জিরিতে বললে অন্টোলজিকালি আর কি। সেই গীতায় আছে না, আমিই সূত্রের মত গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে আছি। এইসব কথা উপনিষদে আছে তো। পড়িচি তো। এখন কথা হল এই আদিপুরুষ যিনি তিনি আবার পৌরাণিক যুগে অবতার হয়ে এলেন। তাঁদের জীবনকে বলা হল লীলা। কিন্তু সেইখানেও কথা আছে। গীতায় আছে, ওসব গপ্পো পড়ে গেলে হবেনি বাপু…. আমাকে তত্ত্বের মধ্যে জানতে হবে।

"Those who understand the divine nature of My birth and activities, O Arjun, upon leaving the body, do not have to take birth again, but come to My eternal abode." 4/9

তবে সেই উপনিষদের নিরাকার আদিপুরুষ, যদি আকার মানুষ শরীরধারীও হন, লীলার জন্য, তাঁকে আর পাঁচটা মানুষের মত দেখলে তো হবে না, এই শাস্ত্রীয় মত।

তত্ত্বের মাধ্যমে মানে কি? না তিনি এই সমস্ত সৃষ্টির মূল সত্য, এ জানতে হবে। এই জানা আবেগের জানা নয়, এই জানা তত্ত্বের মাধ্যমে জানা। মায় অতবড় পৌরাণিক ভক্ত নারদজী, যাকে কেন্দ্র করেই এতবড় বৈষ্ণব আন্দোলনের তত্ত্ব, তিনিও বলছেন যে যদি গোপীরা কৃষ্ণকে পরমসত্য না জানতেন তবে তাদের তো অবৈধ সম্পর্কে জড়ানোর জন্য ব্যাভিচারিণী বলা হত….

22. in the case of the gopīs, one cannot criticize them for forgetting the Lord's greatness.

23. On the other hand, displays of devotion without knowledge of God's greatness are no better than the affairs of illicit lovers. (Naradiya Bhakti Sutra)

তবে কথা হচ্ছে তত্ত্বত জানতে হবে। রাতদিন আবেগে ভাসিয়ে বা ভেসে লাভ নেই। এখন এই তত্ত্বত জানা মানে ওই যে বললাম অন্টোলজিক্যালি জানার দরকার। অন্তত আমাদের সমাজে যারা দেশে-বিদেশে স্বীকৃত মহাপুরুষ তাদের সবারই এক কথা। রামভক্ত ত্যাগরাজ, কবীর, তুলসী, কৃষ্ণভক্ত মীরা, সুরদাস, দাদু…নির্গুণ নিরাকার ভক্ত নানক, আবারও কবীর। আধুনিক যুগের রামকৃষ্ণদেব, রমণ মহর্ষি, প্রমুখেরাও একই কথা বলেছেন, সাধনার মাধ্যমে তত্ত্বত জানতে হবে। এ ছেলের হাতের মোয়া নয়। এ গল্প নয়। এ শরীরের পরিচয়ের জন্য না, এ আত্মার পরিচয়ের জন্য। শরীর দেশ-কাল ইত্যাদিতে বিভক্ত। আত্মা নয়। সেই আত্মাকে, অর্থাৎ সর্ব ভূতের অন্তর্যামী সত্যকে জানতে হবে। এই হল গিয়ে শাস্ত্রীয় কথা।

এখন কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় খাওয়ার জিনিস যদি মাথায় পড়ে তবে তা বিরক্তির কারণ হয়। আরো দুষ্টু উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। প্রেমিক প্রেমিকা যদি চিকিৎসক হন কর্মসূত্রে, এবং ঘনিষ্ঠ আবেগী মুহূর্তে যদি নিজেদের চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখেন, তবে কি পরিণাম হবে বলাই বাহুল্য। তা বলে কি চিকিৎসাবিজ্ঞানের গুরুত্ব নেই? বেশ আছে। কিন্তু নিজের নিজের জায়গায় আছে।

এখন শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্যকে সরিয়ে যদি তাদের উপাদানগুলো নিয়ে অন্য কাজে লাগানো হয়, তবে তো সমস্যা। পৌরাণিক গল্পকে গল্পের মত করে দেখালে কোনো গোল হয় না। কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে সে কাজে নামলে তো গোল হয়। সেই যে সুকুমার রায়ের 'মামা গো' গপ্পে আছে না, মামা ভাগ্নেকে একটা প্রাইজ দেবে বলেছিল। কিন্তু ভুলে গেছে। ভাগ্নে তখন নানা অপ্রাসঙ্গিক গল্পের সূত্রপাত করে প্রসঙ্গে আসতে চাইছে। মোদ্দাকথা সে প্রাইজ নিতে চায়।

তবে আমার মোদ্দাকথাটা কি দাঁড়ালো। আমি আদিপুরুষ বলতে কার গল্প শুনতে যাব? আমাদের উপনিষদ গীতা ইত্যাদির যিনি আদিপুরুষ, নাকি এই আধুনিক আদিপুরুষ? কারণ আমি যদ্দূর পড়েছি বাল্মীকি বেদ-উপনিষদের আদিপুরুষতত্ত্বকেই খাঁড়া করতে চেয়েছেন। ব্যাসদেবও তাই। আর তুলসীদাস যদিও ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাফাই গাইতে দু এক জায়গায় সর্ব ভূতের মূল সত্য তত্ত্ব থেকে সরেছেন, তাও সামলিয়ে নিয়েছেন মোটামুটি।

আসলে কথাটা হচ্ছে, তত্ত্ব অনুযায়ী নাম পরিচয়? না, নাম পরিচয় অনুযায়ী তত্ত্ব? যদি তত্ত্ব অনুযায়ী নাম পরিচয় হয়, তবে রাম-কৃষ্ণ-আল্লাহ-গড ইত্যাদিতে পার্থক্য নেই, যা রামকৃষ্ণদেবের জীবনীর মূল সুর। আর যদি নাম পরিচয় দিয়ে তত্ত্ব খাঁড়া করতে যাই, তবে তো গোড়ায় গোলমাল।

আর যদি বলেন, আমি তো নাস্তিক, এ সব মানি না। তবে কথাটা সত্যি হয়, কিন্তু বাস্তব হয় না। আসলে বাস্তবটা হল, আমার মানা, না মানার কথা নয়, আমি কি যথাযথ শিক্ষাটা পেয়েছি, নাকি আমাকে সিলেবাস বদলিয়ে যা কিছু শেখানো যায়? নিজেকে শিক্ষিত করার কোনো দায়িত্ব আমি নিইনি।

106
Sun, 06/04/2023 - 23:33

আজ কবীরের জন্মতিথি। কবীরের জীবনী, বাণী নিয়ে অনেক কাজ যে হচ্ছে, বা হয়েছে, আমার তা মনে হয় না। আধুনিক ভারতে কবীরকে নিয়ে বোধহয় সিরিয়াসলি ভাবনা চিন্তা শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। হাজারীপ্রসাদ দ্বিভেদীকে কবীরের জীবনী লিখতে অনুপ্রাণিত করা, ক্ষিতিমোহন সেনের মাধ্যমে কবীরের বাণী সংগ্রহ করা, যার কিছু নিয়ে একশোটা কবিতাকে অনুবাদ করা। সব বইগুলোই পাওয়া যায়। এটা অবশ্যই খুব আশার কথা।

কবীর চর্চায় বর্তমান ভারতে অগ্রণী ভূমিকায় আছেন Purushottam Agrawal মহাশয়, যাঁর কবীরের উপর কয়েক বছর আগে বেরোনো ইংরাজি ভাষায় 'কবীর কবীর' নিয়ে লিখেছিলাম, আমায় মুগ্ধ করেছিল। আজ আরেকটা বই প্রকাশিত হতে চলেছে, এই বইটা শ্যামসুন্দরজী'র কবীরের সংকলন, ১৯২৮ সালে প্রকাশিত, পুরষোত্তমজী আবার বইটাকে নতুন করে পরিমার্জিত করে প্রকাশিত করছেন, রাজকমল প্রকাশনী থেকে, হিন্দিতে।

কবীরের দর্শনের ঈশ্বর আর স্পিনোজার দর্শনের ঈশ্বর এক অনেকাংশে। নির্গুণ, নিরাকার। জগতের স্রষ্টা হিসাবে না, তাঁদের দর্শনের মূল হল তিনি এই জগত নিজেই। সর্বস্ব তিনি। স্পিনোজা যেমন সব ধর্মীয় অথোরিটিকে অস্বীকার করেছেন প্রামাণ্য হিসাবে, ঠিক তেমনভাবেই কবীরও। কবীর যেমন ভারতের সাধকদের মধ্যে এক ভিন্ন পঙক্তিতে, স্পিনোজাও পাশ্চাত্যের দার্শনিকদের মধ্যে ভিন্ন পঙক্তির। দু'জনের জীবনই ভীষণ আড়ম্বরহীন, খুব যে আর্থিক আনুকুল্যের মধ্যে তা নয়। একজন তাঁতি, অপরজন চশমার লেন্স সারিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন। আরো একটা উল্লেখযোগ্য মিল হল দু'জনকেই সেদিনের ধর্মীয় অথোরিটিরা ব্রাত্য করেছিল। কিন্তু দমাতে পারেনি।

কবীরের মোটামুটি ২৩৪ বছর পর স্পিনোজা জন্মগ্রহণ করেন। দু'জনের অনুভব, বিচারই বলে, সমগ্র এক-এর মধ্যে 'একত্ব'কে অনুভব করাই আসল কথা। সার কথা। সেখানে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই। যে কথাটা আবার এই কদিন আগেই গোটা জীবন দিয়ে বলে গেলেন জে কৃষ্ণমূর্তি — Truth is a pathless land. আগল সরাও, অনুভব করো। কোনো অবতার, পুরোহিত, মোল্লা ইত্যাদি কারো মধ্যস্থতা লাগবে না। নিজেকে নিজেই সব রকম মোহ থেকে মুক্ত করো নিজের তাগিদে। নিজের সঙ্কীর্ণতা দূরে সরিয়ে। ইম্যানুয়েল কান্ট একেই পরে বলছেন এনলাইটেনমেন্ট। আশ্চর্য দর্শন নয়, সত্য দর্শন, সত্য বোধে।

কবীর কোনোদিনই ভারতের মণীষায় খুব একটা চর্চিত হননি, দুর্ভাগ্যবশত। উদার মত নিয়ে দল গঠন করা যায় না। যদিও কবীরপন্থী সাধক আছেন, তবুও সে অর্থে ব্যবসাকারী দল পেকে ওঠেনি। কবীর জাতপাত স্বীকার করতেন না, কোনো বইকে সে অর্থে অথোরিটি মানতেন না, সে অর্থে কোনো গুরু, অবতার মানতেন না। কবীর সত্যকে প্রেমের সঙ্গে মিলিয়ে এক-এর সাধন করতে বলতেন। যে সুর লালনের মধ্যে পাই --- সত্য বলো, সুপথে চলো। ভালোবাসা ছাড়া সুপথ হয় নাকি? কবীর বলছেন প্রেমের আড়াই অক্ষরকে জেনে নিলেই তুমি জ্ঞানী। জ্ঞান মানে অনুভবের মাধ্যমে জানা। যে অনুভবের উদ্দেশ্য সবের মধ্যে এক-কে দেখা, এক-এর মধ্যে সবকে দেখা। এক-এর অন্বেষণ - ভালোবাসায়, যুক্তিতে, উদারতায়। অনুভব তোমাকে সে আলোর দিকে নিয়ে যাবে, যুক্তি সমাজের নানা ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে তোমায় রক্ষা করবে, আর উদারতায় ভিন্নতার পাঁচিল ভেঙে মিলনের রাস্তা খুলবে।

বলাবাহুল্য, কবীরেরও শত্রু হয়েছিল বেশ কিছু। সত্যকে সত্যের আলোতে খুঁজলে দলের লোকেদের অসুবিধা হয়। সেদিনও হয়েছিল। হিন্দু-মুসলমান দুই-ই পক্ষের বেশ কিছু মানুষ ভালোভাবে নেননি কবীরকে। তাদের মনে হয়েছিল কবীর সমাজের সমীকরণ নষ্ট করে ভারসাম্য বিঘ্ন করছেন। আজও অনেকের মনে হয়, তথাকথিত নীচু জাতের মানুষ যখন উঁচু কাজের দায়িত্ব পায়। সদ্য দেখা সিনেমা 'কাঁঠাল', হিন্দিতে, নেটফ্লিক্সে, এই নিয়েই।

ধর্মীয় কূটকচালি থেকে সরে এসে চিত্তের অধ্যাত্মবোধকে জাগানোর কথাকে অনেকেই সেদিন শুনেছে, আমল দেয়নি। অনেক অনেক ধর্ম নিয়ে কোন্দল বেঁধেছে তারপরেও। খুব কাছাকাছি যুগে রামকৃষ্ণদেবের কথাকেও খুব একটা সিরিয়াসলি কেউ নিয়েছে বলে মনে হয় না।

রামকৃষ্ণদেব, কবীর প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে সমস্যা হল তাঁদের জীবনী আর বাণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। আমাদের থাকে। রামকৃষ্ণদেব, কবীর কোনো ধর্ম, মতবাদ ইত্যাদি 'প্রচার' করেননি, জীবনে যেটাকে সত্য বলে অনুভব করেছেন সেটাকেই সারাটা জীবন দিয়ে যাপন করেছেন। তাই-ই বলে গেছেন, আজীবন। এর পিছনে কোনো মতলব ছিল না। এর আগে একটা সাধন ছিল। যে সাধনের মূল কথা, ভেদ নেই ভাই... ভেদ নেই.... সব ভেদ তোমার মনে। মন আলোকিত করো। সব আলোকিত হবে।

রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৭ সালে, মার্চে, রামকৃষ্ণদেবের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে যে সর্বধর্মসভার আয়োজন করা হয়েছিল রামকৃষ্ণ মিশনের তত্ত্বাবধানে, সেখানে ভাষণ দিতে গিয়ে একদম শেষ পর্বে কবীরকে উল্লেখ করে বলেছিলেন,

"Let me concluded with a few lines from the great mystic poet of medieval India, Kabir, whom I regard as one of the greatest spiritual geniuses of our land:

 

The jewel is lost in the mud, and all are seeking for it;

Some look for it in the east, and some in the west;

Some in the water and some amongst stones.

But the servant Kabir has appraised it at its true value,

And has wrapped it with care

In a corner of the mantle of his own heart."

 

107
Sat, 05/27/2023 - 23:34

উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর পরই প্রত্যেক পাড়ায় একটা করে ফায়ারিং স্কোয়াড খোলা উচিৎ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, ফায়ারিং স্কোয়াড। যারা মোটামুটি সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়ে অথচ ভালো রেজাল্ট কর‍তে পারেনি, বা আশানুরূপ রেজাল্ট করতে পারেনি, যারা সামনের দিনে রাস্তায় ঘাটে ঘেয়ো কুকুরের মত মরে পড়ে থাকবে.... মানে যে গল্পটা শোনানো হচ্ছে... তাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাক। চালানো হোক গুলি।

ঠাঁই... ঠাঁই... ঠাঁই.... গগনভেদী শব্দ উঠুক.... পাড়াপ্রতিবেশি, রাষ্ট্র, সমাজ সবাই জানুক.... মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের অনেক অনেক অকৃতকার্য ছেলেমেয়েগুলো সমাজে আর নেই.... শান্তি তো!

একদম, এইভাবে তিলে তিলে না মেরে আসুন না আমরা এক কোপে সেরে ফেলি। তারপর না হয় একটা শান্তি পাঠের আসর হোক। কান্নাকাটি আর কদ্দিন, ওসব সয়ে যাবে।

হাজার হাজার বাবা মা আছেন, যারা সারাদিন পরিশ্রমের পরও সবটুকু প্রয়োজন মেটাতে পারেন না, তবু ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন, ভালো স্কুলে পড়াচ্ছেন, ভালো টিউশান দিচ্ছেন…. তাও ভালো রেজাল্ট হচ্ছে না। হয় না। তাদের সংখ্যাটা অনেক অনেক বড়।

আর বাড়ির পরিস্থিতি অনেক সচ্ছল বলেই, তার রেজাল্ট ভালো হতেই হবে, এ সমীকরণটার সঙ্গে রাজী হওয়ার তেমন কোনো কারণ তো দেখি না।

বাড়ির পরিবেশ মানে শুধু টাকাপয়সাই নয়। অনেক জটিলতা। বাবা-মায়ের অশান্তি, নানা সাংসারিক জটিলতা তো আছেই। মানসিক অবস্থা সেও আছে।

আর সবার উপর আছে মেধা আর আগ্রহের সমীকরণ। বিষয়টা এত সরলীকরণ কি করে হয়ে যায় আমার তাজ্জব লাগে। একজন মানুষ, তাকে একটা নিয়মে ফেলে দেওয়া হল, একটা অথোরিটি ঠিক করে দিল, কি কি যোগ্যতার মাপকাঠিতে সে এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে। সবাই ঢাকঢোল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।

এগুলো সবটাই বাস্তব। কিন্তু একটা বাচ্চার মানসিকদিক নিয়ে কোনো স্কুল, কোনো পরিবার, কোনো শিক্ষক শিক্ষিকার নিয়মিত খেয়াল রাখার কোনো পরিকাঠামো নেই। সুইসাইড করল তো চোখের উপর জ্বলে উঠে নিভে গেল, তারা খসার মত, কিন্তু প্রতিদিন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোর মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণের জন্য পরিকাঠামো নিয়ে আমাদের ভাবনা চিন্তার অবসর নেই। আমাদের স্পিডি ট্রেন দরকার, ঝাঁ চকচকে শপিংমল দরকার, গোটা জীবন ডিজিটালাইজড করার দরকার…. কিন্তু প্রতিটা স্কুলে নিয়মিত মনোবিদের, মনোবিশেষজ্ঞের দরকার যে, সেটা আমরা বুঝি না। বাচ্চাদের আবার ওসব কি?

একটা বাচ্চা কি চায়? কিসে সে কম্ফোর্ট ফিল করে? কিসে সে আনন্দ পায়, কি করতে তার ভালো লাগে…. এ সবের খোঁজ ক্যাডবেরি খাওয়ার মত সোজা না। এর জন্য একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের দরকার হয়। প্রতিটা মানুষ যদি সম্পদ হয়, তবে সে সম্পদকে আকরিক অবস্থা থেকে যত্ন না নিলে অনেক অনেক সম্পদ যে হেলায় নষ্ট হয় সে আমাদের রাষ্ট্র কবে বুঝবে কে জানে! সোনা উৎপন্ন হয়ে গেলে তা দিয়ে গয়না বানানো এমন কি গৌরবের কাজ? আকরিককে চেনা আর তাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিষ্কাশনের উপায় খোঁজাই বিবেচনার কাজ। দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমরা পেষণের রাস্তা জানি, নিষ্কাশনের রাস্তা জানি না। আমরা বিশ্বাস করি বাচ্চাগুলো সরষের মত, ঘানিতে যত পেষা যাবে তত তেল বেরোবে। চালাও ঘানি, চালাও পেষণ….. বার করো তেল।

আমি জানি না আর কোন শিক্ষিত দেশে একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর এইভাবে তা নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হয়। দিনের পর দিন তা নিয়ে এমন সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর বিশ্লেষণ চলে। তিলকে তাল করে, সূচকে খাঁড়া করে কত কত নিরীহ, নিরপরাধ প্রাণকে বিপন্ন করে তোলে। তাদের অপরাধ, তাদের সামাজিক অথোরিটির চাহিদা অনুযায়ী মেধার অভাব, মেধার সঙ্গে আগ্রহের অমিল… আরো আরো অনেক ফ্যাক্টর আছে। কিন্তু আমরা তো বিজ্ঞানের রাস্তায় চলি না, আমাদের চালিকাশক্তি তো আবেগ!

কথাটা খানিক অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, আমরা আজও বিশ্বাস করি অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকলে কিভাবে তার মেধাকে করুণার চোখে দেখে তাকে "পাইয়ে" দিতে হয়। সামাজিক পীড়ন, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইটা, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর যে শুধু রিজার্ভেশনের হাত ধরে হবে না, তার মাধ্যমে এক শ্রেণীর মানুষের মেধাকেই যে ঘুরিয়ে অপমান করা, সেটা আমরা মানতে নারাজ। রিজার্ভেশান নিয়ে যে আমাদের সত্যিই ভাবার সময় হয়েছে, তার যে প্রচুর অপব্যবহার হচ্ছে, সেটা আমাদের জেগে থাকা চোখে ধরা পড়লেও, আমাদের চেষ্টার দিকে হাত পা সরে না। তার কারণ আমাদের ওই অদ্ভুত অযৌক্তিক সমীকরণের অভ্যাস। যেমন চলছে চলুক।

কে কি রেজাল্ট করেছে, তার সঙ্গে তার বাবা মা কি করেন, এ গল্পটা জুড়ে এক অদ্ভুত কাহিনী সৃষ্টি কবে বন্ধ হবে? কবে বুঝব আমরা, এক বিশাল সংখ্যক বাচ্চাদের সামনে একপেশে এক আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য বলে চালানোর চেষ্টা করছি।

যারা নানাবিধ আর্থিক কষ্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে তাদের অবশ্যই অভিনন্দন, কিন্তু বারবার সেটাকেই হাইলাইট করা এক আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা। এ অন্যায়। অপরাধ। তার কৃতিত্বকে এভাবে ছোটো না করাই ভালো একপেশে করে দিয়ে।

দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় থেকে, দীর্ঘদিন সমাজের নানাস্তরের ছাত্রছাত্রীকে পড়িয়ে যা উপলব্ধি হয়েছে, ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষক এগুলোর গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে নিজের জায়গায়, কিন্তু এর পরেও আছে বাচ্চার মেধা, মানসিক গঠন আর আগ্রহের জটিল সমীকরণ। মানুষ অমন একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক নয়। আর রইল ভালো পরিবেশের কথা, সেটা শুধুই আর্থিক সচ্ছলতার উপর নির্ভর করে কি? যিনি রিকশা চালান, কি বাজারে সব্জী বেচেন, তিনি রোজ মদ খেয়ে এসে বউকে মারেন, চীৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলেন, বাচ্চারা রাস্তার আলোয় পড়াশোনা করে…. এ যেমন একটা মিথ…. তেমনই সচ্ছল পরিবারের রাতদিন অখণ্ড শান্তি বিরাজ করে তপোবনের মত… এও মিথ।

প্রাচীন ভারত একদিন শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছিল শিক্ষাদানের আর শিক্ষাগ্রহণের প্রধান শর্ত অর্থসম্পদ না…. সমমনস্কতা, সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ আর ভালোবাসা।

"ব্রহ্ম আমাদের উভয়কে সমভাবে রক্ষা করুন ও উভয়কে তুল্যভাবে বিদ্যাফল দান করুন; আমরা যেন সমভাবে বিদ্যালাভের সামর্থ্য অর্জন করতে পারি; আমাদের উভয়ের বিদ্যা সফল হোক; আমরা যেন পরস্পরের বিদ্বেষ না করি। ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।" উপনিষদের শান্তি পাঠ।

108
Thu, 05/25/2023 - 00:04

আমাদের অন্তর্জগতের নিজস্ব একটা সময়সারণী আছে নিশ্চয়ই। অনেক সময় দেখেছি খুব কাছাকাছি সময়ের লেখা, পড়লাম, ভালো লাগল, কি হয় তো তেমন ভালো লাগল না, মনের উপর বাতাসের মত বয়ে চলে গেল। আবার বহু প্রাচীন কোনো লেখার সঙ্গে আমার এই মুহূর্তের মনের জগতের সুরটা ধরা পড়ে গেল। আমায় ভাবালো। আমার সারাদিনের কাজের মধ্যে একটা শব্দ, কি একটা বাক্য, কি একটা অনুভব, গাছের পাতার শব্দের মত বেজেই চলেছে, বেজেই চলেছে। যা লেখা হয়েছে হয় তো বহু বছর আগে।

কয়েকদিন আগে, সন্ধ্যেতে নামল তুমুল ঝড়, সব অন্ধকার, এত বাজ পড়ছে ইনভার্টার ইত্যাদি বন্ধ করে দিতে হল। কিন্তু কি করব, ভীষণ পড়তে ইচ্ছা করছে কিছু একটা। বই তো কত। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের সাহায্যে এটা সেটা নাড়াচাড়া করতে করতে হাত পড়ল মলাট ছেঁড়া উপনিষদাবলীর উপর। বইটা নিলাম। টেবিলের উপর চায়ের ডিস উলটে, তার উপর মোমবাতি জ্বালালাম, পাতা উল্টাতে শুরু করলাম। পড়তে শুরু করলাম কেন উপনিষদ। এমনিই। মন এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। হঠাৎ একটা শব্দে এসে দাঁড়িয়ে বলল, আরেকবার পড়ো তো…. বলো আরেকবার…..

পড়লাম, সত্যমায়তনম্। সত্য তাঁহার নিবাসস্থল।

চোখ সরতে চাইলেও মন আর সরতে চাইল না। বলল, তুমি এবার বইটা বন্ধ করে চুপ করে বোসো। আমায় ছেড়ে দাও।

দিলাম। মোমবাতি নিভিয়ে চুপ করে বসলাম। বাইরে তুমুল ঝড়বৃষ্টির শব্দ। মাথার মধ্যে, সারাটা শরীর দিয়ে বয়ে বয়ে যাচ্ছে শব্দ - সত্যমায়তনম্।

আমি নিজে কাকে দিতে পেরেছি সত্যাশ্রয়? চারদিকে মিথ্যা আর ছলনার দৌরাত্ম। ছাপা অক্ষরে, উচ্চারণে, গণমাধ্যমে, প্রচারে, আচারে, সম্পর্কে, ভালোবাসায়, আদরে - সর্বত্র মিথ্যার কি প্রবল আস্ফালন। আমার মধ্যেই বা কতটুকু সত্য? আমার ভালোবাসা, বিশ্বাস, চেষ্টা… আমার ভাষা, অনুভব… কোনটাকে আমি সত্যের আশ্রয়ে রাখতে চাইছি? আমার মন, আমার বুদ্ধি, যাবতীয় সব কিছু মিলে এই যে আমি, এর কতটাকে আমি সত্যাশ্রয়ী করে তুলতে পেরেছি?

আমার রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইনগুলো মনে পড়ল,

হেনকালে সত্যকাম---

 

কাছে আসি ঋষিপদে করিলা প্রণাম--

মেলিয়া উদার আঁখি রহিলা নীরবে।

আচার্য আশিষ করি শুধাইলা তবে,

"কী গোত্র তোমার সৌম্য, প্রিয়দরশন?'

তুলি শির কহিলা বালক, "ভগবন্‌,

নাহি জানি কী গোত্র আমার। পুছিলাম

জননীরে, কহিলেন তিনি, সত্যকাম,

বহুপরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে,

জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে--

গোত্র তব নাহি জানি।'

শুনি সে বারতা

ছাত্রগণ মৃদুস্বরে আরম্ভিলা কথা

মধুচক্রে লোষ্ট্রপাতে বিক্ষিপ্ত চঞ্চল

পতঙ্গের মতো--সবে বিস্ময়বিকল,

কেহ বা হাসিল কেহ করিল ধিক্কার

লজ্জাহীন অনার্যের হেরি অহংকার।

উঠিলা গৌতম ঋষি ছাড়িয়া আসন,

বাহু মেলি বালকেরে করিয়া আলিঙ্গন

কহিলেন, "অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত।

তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।"

 

'ব্রাহ্মণ' কবিতার এ অংশ যতবার পড়েছি ততবার চোখে জল এসেছে। আজও এলো। কি সরল সত্য। জীবন কি সত্যই এই জটিল?

     সত্য কি? এর সংজ্ঞা আমি বহুবার খুঁজেছি। পাইনি। আসলে খোঁজার আগেই জানি বলেই পাইনি। মানুষ হয়ে জন্মানোর মধ্যে যেটুকু মান, যেটুকু গৌরব সে সবটুকুই শুধু সত্যকে আশ্রয় করেই তো। খুঁজে পাওয়া তাত্ত্বিক সত্য নয়, সে তো মত, সে তো ব্যাখ্যা। মানুষ আজ অবধি যা খুঁজে পেয়েছে সবই তো মত আর ব্যাখ্যা। সত্য যখন নিজেকে মানুষের চেতনায় বোধে ধরা দিয়েছে, তখনই সে ঋত, সূত্র। সেই খোঁজাখুঁজির আগেই হৃদয়ে জাগা যে সত্য, তার আশ্রয়ে কতটুকু নিজেকে স্থির করতে পেরেছি? বাইরের সব ঝড়জল তো ওই আশ্রয়েই তরে যাওয়া যায়। সে অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকবার। কাল্পনিক বহু দেবদেবী যখন নিরুত্তর, জীবনের ভীষণ উথাল-পাতাল মুহূর্তে কে হাল ধরেছিল? নিজের ভিতরেই এই সত্যই তো! সত্যমায়তনম্।

ঝড় থামল। কারেন্ট এলো খানিকবাদে। আবার কাজের ছন্দে ফেরা। মন বলল, ও তো চেনা রাস্তা, তুমি এগোও আমি আসছি, একটু অবকাশ চাই, শব্দটার গভীরে বড় একটা কথা আছে, সেটাকে একবার স্পর্শ করে আসি।

বললাম, বেশ, তাই হোক। তোমার ছোঁয়াই আমারও ছোঁয়া। কিন্তু তুমি পাবে কি? সে নিজে না ধরা দিলে?

মন বলল, সে ডেকেছে বলেই তো ডাক কানে এসেছে…রাজার চিঠি রাজার হাতের ছোঁয়া নিয়েই তো আসে গো….

109
Tue, 05/23/2023 - 22:33

অনলাইনে ঘরে বসে পুজো দেওয়ার ব্যাপারে এইমত আমায় ভাবালো। চাইলে ঘরে বসে পিণ্ডি দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে শুনেছি। সত্যিই কি কৃচ্ছসাধনের সঙ্গে পুণ্য সমানুপাতিক? তার সঙ্গে চিত্তের অবস্থার কোনো সংযোগ নেই? রামকৃষ্ণদেব বলতেন ভাবগ্রাহী জনার্দন। অর্থাৎ ঈশ্বর শুধু মন দেখেন। মেয়েদের উপোস আমি সহ্য করতে পারিনে, বলতেন। তার মানে এই নয় যে দক্ষিণেশ্বরে সব পুরুষকে খালি পেটে আসতে বলতেন।
    

এককালে সন্ন্যাসীরা পদব্রজে ভ্রমণ করে, যেখানে যা ভিক্ষা পাওয়া যেত তাই খেয়ে সন্ন্যাস ধর্ম পালন করেছেন। এখন সন্ন্যাসীরা বাতানুকূল গৃহে বাস করে, রেলে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ করে, উড়োজাহাজে ভ্রমণ করে যাতায়াত করে থাকেন। মানে যাদের সামর্থ্য আছে আর কি। সৎসঙ্গ, প্রচারটচারও অনলাইনে হয়ে যাচ্ছে। ভিক্ষা, দক্ষিণা সব জায়গাতেই অনলাইনে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তবে? লাইনে দাঁড়িয়ে, না খেয়ে, রোদে ঘেমেনেয়ে নাস্তানাবুদ হলেই ঈশ্বর তুষ্ট হয়ে আমার অ্যাকাউন্টে কিছু পুণ্য ডোনেট করবেন, এ তো ভীষণ মেটেরিয়ালিস্টিক স্পিরিচুয়ালিটি হয়ে গেল না? ভারতের নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে অর্থের মূল্য বাড়ালে বিশেষ সুযোগসুবিধা দেওয়ার চল বহুযুগ থেকেই শুরু হয়েছে। সেগুলোকে ভি-আই-পি ব্যবস্থা বলা হয়ে থাকে। সে ক্ষেত্রে পুণ্য কমে বলে কেউ তো সন্দেহ করে না!
    

এগুলো সবই বাহ্যিক। এখন বলা যেতে পারে সবই যদি ভাবের খেলা হবে তবে অনলাইনই বা কেন? হলেই বা ক্ষতি কি? সুইগিতে খাবার অর্ডার দিয়ে হোক, কি প্রবীণাকে অনলাইনে পুজো দিয়ে মানসিক শান্তি পাইয়ে দিয়েই হোক, শান্তিটাই কি বড়কথা নয়?
    

দুটো কথা আছে। এক, পুরোনোর প্রথার প্রতি অযৌক্তিক শুদ্ধতার মোহ। দুই, কৃচ্ছসাধনের তত্ত্ব।
    

কলাপাতায় খেলে শুদ্ধতা। মাটির প্রদীপ জ্বাললে শুদ্ধতা। ভারতের অনেক মন্দিরে এখনও বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা নেই কারণ তা নাকি শুদ্ধতা, ঐতিহ্য নষ্ট করবে। এটা আসলে আমাদের মনস্তত্ত্বের একটা গভীর বৈশিষ্ট্য, আমরা পুরোনো যা কিছুকে ভীষণ শুদ্ধ মনে করি। যেমন আমরা আমাদের শৈশবের অবস্থাকে আমার শুদ্ধাবস্থা মনে করি, যখন আমার চেতনা কামগন্ধহীন ছিল, নানাবিধ জটিলতার বোধহীন ছিল। এই ধরণের বিশ্বাস থেকে আমাদের মধ্যে একটা শুদ্ধতার প্রতি মোহ তৈরি হয়। যার থেকে ঘটে বিকার। যা কিছুকে বিশ্বাস করতে শুরু করি তখন আমরা। যা কিছু পাপ করেও কোনো একটা বিশেষ তিথিতে, বিশেষ নদীতে স্নানকেও শুদ্ধ হওয়ার পন্থা বানাই। মজার কথা সেখানেও অনলাইনের ব্যবস্থা আছে। সারদাদেবী বলছেন, যার আছে সে মাপো আর যার নেই সে জপো। এর গভীরেও তো ওই একই ইঙ্গিত না? আছে মানে ধনসম্পদ, সে দানধ্যান করো, আর যার নেই হরিনামই করো।
    

আর রইল কৃচ্ছসাধন। এ শব্দটাকে আমি ভীষণ ভয় পাই। গতকাল যে মহাত্মার জন্মদিন ছিল, সেই ভারতের নবযুগের প্রথম আলো রামমোহন রায় আমাদের চিত্তের জড়ত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। জাতপাত, গুরু-অবতার সব কিছু থেকে সরিয়ে এক পরম বিশ্বপিতার বোধ জাগাতে চেয়েছিলেন, উপনিষদকে আশ্রয় করে। আমাদের স্বাবলম্বী করতে চেয়েছিলেন। কৃচ্ছসাধনের নামে মানুষের উপর মানুষ যে কি অত্যাচার করতে পারে, এমনকি নিজের উপরেও পুণ্যের লোভে, সে বোধহয় ধর্মের ইতিহাসের বাইরে এত উদাহরণ আর কোথাও নেই। কৃচ্ছ অর্থে কষ্ট। নিজেকে শাস্ত্রীয় ব্যবস্থায় কষ্ট দিলে আর অন্যকে কষ্ট দেওয়ার পথ সুগম করলেই যদি পুণ্যলাভ হত তবে ভারতের দলিত আর ভারতীয় মহিলাদের যা পুণ্য এতদিনে সঞ্চয় হয়েছে এতদিনে তাতে করে এই ধরাধামই স্বর্গ হয়ে যেত। কিন্তু সে গুড়েবালি। কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। এ সব কথারই চূড়ান্ত পরিণাম ওই নির্জলা একাদশী, সতীদাহ ইত্যাদি ইত্যাদি। বলে শেষ করা যাবে না। শাস্ত্রীয় কুসংস্কারে যে যত নীচুজাত হবে তাদের জন্য নিয়মও যে কি সাংঘাতিক হতে পারে তা মনুসংহিতার পাতা উল্টালেই দেখা যেতে পারে।


     একবার একজনের অমন ধর্মীয় সংকট দেখা দিয়েছিল। মহাপ্রভুর সময়ের কথা। তাকে পণ্ডিতেরা বিধান দিয়েছিলেন গরম ঘি খেয়ে প্রাণত্যাগের জন্য। কি সাংঘাতিক কথা! মহাপ্রভু বলেছিলেন শুধু নামের মাধ্যমেই হবে। যদিও সেই মহাপ্রভুর কঠোরতাতেই ছোটো হরিদাসকে আত্মহত্যা করতে হয়, এও বাস্তব। সে অন্যপ্রসঙ্গ।
    

তপস্যার সংজ্ঞা দিতে গীতা বলছেন,
     শারীরিক তপস্যা, দেবতা, ব্রাহ্মণ, গুরুজন ও প্রাজ্ঞজনের পুজো, শৌচ, সরলতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা।
     বাচিক তপস্যা, অনুদ্বেগকর বাক্য, সত্য ও হিতকর প্রিয় বাক্য ও বেদাদি পাঠ।
     মানসিক তপস্যা, প্রসন্নতা, সৌম্যভাব, বাকসংযম, মনের নিরোধ ও ছলনারহিত ব্যবহার।
     তুলসীদাসও বলছেন সরলস্বভাব, সন্তোষ আর কপটতারাহিত্যই সাধন।

     এখন যুক্তি হতে পারে, এগুলো তো সব জানাই, তাও লোকে তো লোকাচার মতে নানা পুজো-আচ্চা করেই থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি।
 

     কথা হচ্ছে করুক। মানুষের মধ্যে এ ধর্মবোধ এত গভীরের স্বভাব যে তার থেকে তার মুক্তি নেই। এ বাস্তবকে মেনে নেওয়াই কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কিন্তু কথা হচ্ছে তাকে যতটা সরল, সুবিধাজনক করে নেওয়া যায় ততটাই ভালো নয়কি? সবটাই তো আচার-আচরণ, অনুষ্ঠান সর্বস্ব। আগের সব কিছুই তো শুধু আকার মাত্র, বহিরঙ্গ রেখেই করা হচ্ছে। এর সঙ্গে পুণ্যের তত্ত্ব জুড়ে দেওয়া কি খুব দরকার? শুয়ে বসে, এসি চালিয়ে যে যেভাবেই হোক করুন না কেন, আমাকে তাতে কটাক্ষ করার দরকার কি? অন্তত পুণ্যের মত অমন ভয়ংকর তত্ত্বকে আবার টেনে এনে? এই পুণ্যের চক্করে কি অত্যাচার হয়েছে এ দেশে আমরা কি জানি না? আবার সেই কথা? কেন?

     প্রসাদ মানে প্রসন্নতা। এখন হয়েছে মিষ্টিফল। হোক। দুই-ই থাকুক। চিত্তের প্রসন্নতা যে করেই হোক যদি এসে থাকে তবে আর ক্ষতি কি? আর সত্য অর্থে চিত্তের প্রসন্নতা পাওয়া স্বার্থহীন হওয়া ছাড়া আর কি কোনো উপায়ে আছে? পুণ্যায় পরোপকারায়, পাপায় পরপীড়নম - সে তো আদি কথা আছেই। বাদবাকি এসব ছেড়ে যদি কেউ অনলাইনে একটু আচার অনুষ্ঠান করে, আমরা যেন তা সাদরে গ্রহণ করেই নিই। এই গরমে হাঁটুতে ব্যথা, সিঁড়ি চড়ে চড়ে বয়স্কদের ওঠা যে কি সাংঘাতিক দেখেছি তো। না পুরোহিত নেমে আসেন, বা নামার অবস্থায় থাকেন, না দেবতা। তবে? হোক অনলাইনে। যিনি অন্তর্যামী তিনি তো জিমখানার মাষ্টার নন, তিনি অন্তরের আন্তরিকতাই দেখবেন। সে নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলবে। শুধু ওই ধর্মের নামে কৃচ্ছসাধন আর পুণ্য আরহণের গল্পটাকে আর টেনে টেনে বড় না করাই ভালো। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।

(আজকের 'এই সময়' খবরের কাগজের অংশ ছবিতে)

110
Tue, 05/16/2023 - 01:07

স্বামীজী চিঠিতে লিখছেন, "ভোগের নামে সবাইকে পিত্তি পড়িয়ে বাসি কড়কড়ে ভাত খাওয়াবে না। দুটো ফিল্টার তৈয়ার করবে। সেই জলে রান্না খাওয়া দুই-ই। ফিল্টার করবার পূর্বে জল ফুটিয়ে নেবে, তাহলে ম্যালেরিয়ার বাপ পলায়ন। সবার স্বাস্থ্যের উপর প্রথম দৃষ্টি রাখবে।"

আমার খটকা লাগল। ম্যালেরিয়ার সঙ্গে জল ফোটানোর কি সম্পর্ক? ম্যালেরিয়ার তো 'ম্যাল এয়ার' মানে দূষিত বায়ু শব্দ থেকে এসেছে। তবে জলের প্রসঙ্গ কেন?

স্বামীজী চিঠিটা লিখছেন 1895 সালে । যেখানে ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে প্রথম জানাচ্ছেন ডাক্তার অ্যালফানস্ ল্যাভেরন 1880 সালে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দুটো আলাদা লেখায় একাডেমী অফ্ মেডিসিন "Parasite Found in the Blood of Several Patiatients Suffering from Marsh Fever." 'Marsh fever' বলতে ম্যালেরিয়া বোঝানো হত। কারন Kent & Essex নামক জায়গায় অত্যধিক জলাভূমিজনিত কারণে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ অনেক বেশি ছিল।

কিন্তু ল্যাভেরানের কথা তখনকার ইতালির বিজ্ঞানীরা মানতে নারাজ হন। তাদের ধারণা ছিল ম্যালেরিয়া জল ও মাটিবাহিত কোন ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়। 'ব্যাসিলাস ম্যালেরি' নামে এক ব্যাকটেরিয়ার কথাও উল্লেখিত হয়। অবশেষে ল্যাভেরান লুই পাস্তুরের দ্বারস্থ হন, এবং তিনি স্বীকার করেন। 1907 সালে ল্যাভেরণ তার কাজের জন্য নোবেল পান, যদিও তার আগে 1902 সালে রোনাল্ড রস নোবেলে ভূষিত হয়েছেন ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মশার ও মশা-বাহিত প্রোটোজোয়ার সম্পর্ক প্রমাণিত করে, যা ল্যাভেরান দ্বারা প্রস্তাবিত ছিল। অবশ্য আরেকজনের নাম উল্লেখ্য --- প্যাট্রিক ম্যানসন।

রোনাল্ড রস কবি মানুষ ছিলেন। বাইবেলের দুটো লাইনের অনুষঙ্গ যা তার কবিতার শেষে ব্যবহার করেছেন সেকি ম্যালেরিয়া জয়েরই অনুষঙ্গে?

 

This day relenting God

Hath placed within my hand

A wondrous thing; and God

Be praised. At his command,

Seeking his secret deeds

With tears and toiling breath,

I find thy cunning seeds,

O million-murdering Death.

I know this little thing

A myriad men will save,

O Death, where is thy sting?

Thy victory, O Grave?

 

রবীন্দ্রনাথ ম্যালেরিয়ার উপরে দুটো ভাষণ দিয়েছিলেন ম্যালেরিয়া নিবারণী সভাতে, যথাক্রমে 1922 এবং 1923 সালে। ডাক্তার গোপালচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই সময় ম্যালেরিয়া নিবারণের জন্য বিশেষভাবে তৎপর হন। উনি স্বনামধন্য ব্যাক্টিরিওলজিস্ট ছিলেন। লান্সেট-এর মতো পত্রিকাতেও ওনার লেখা প্রকাশিত হত। 1918 সালে 'ম্যালেরিয়া নিবারণ সভা' প্রতিষ্ঠা করেন। রোনাল্ড রস-কেও আমন্ত্রণ জানানো হয়, যিনি গোপাল বাবুর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন।রবীন্দ্রনাথ এই সভাতেই পৌরহিত্য করতে গিয়ে বলেন---

"এইটে আপনারা বুঝতে পারেন, পতঙ্গে মানুষে লড়াই। আমাদের রোগশত্রুর বাহনটি যে ক্ষেত্র অধিকার করে কাছে সে অতি বিস্তীর্ণ। এই বিস্তীর্ণ জায়গায় পতঙ্গের মতো এত ক্ষুদ্র শত্রুর নাগাল পাওয়া যায় না। অন্তত ২/৪ জন লোকের দ্বারা তা হওয়া দুঃসাধ্য, সকলে সমবেতভাবে কাজ না করলে কিছুই হতে পারে না। আমরা হাৎড়াচ্ছিলাম, চেষ্টা-মাত্র করছিলাম, এমন সময় আমার একজন ভূতপূর্ব ছাত্র, মেডিকেল কলেজে পড়ে, আমার কাছে এসে বললে, "গোপালবাবু খুব বড়ো জীবাণু-তত্ত্ব-বিদ্‌, এমন-কি ইউরোপে পর্যন্ত তাঁর নাম বিখ্যাত। তিনি খুব বড়ো ডাক্তার, যথেষ্ট অর্থোপার্জন করেন। আপনারা ম্যালেরিয়ার সহিত লড়াই করতে যাচ্ছেন, তিনি সে কাজ আরম্ভ করেছেন; নিজের ব্যবসায়ে ক্ষতি করে একটা পণ নিয়েছেন -- যতদূর পর্যন্ত সম্ভব বাংলাদেশকে তার প্রবলতম শত্রুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য চেষ্টা করবেন।' যখন এ কথা শুনলাম, আমার মন আকৃষ্ট হল। আমাদের এই কাজে তাঁর সহায়তা দাবি করতে সংকল্প করলুম। মশা মারবার অস্ত্র পাব এজন্য নয়; মনে হল এমন একজন দেশের লোকের খবর পাওয়া গেল যিনি কোনরকম রাগ-দ্বেষে উত্তেজনায় নয়, বাহিরের তাড়নায় নয়, কিন্তু একান্তভাবে কেবলমাত্র দেশের লোককে বাঁচাবার উপলক্ষে, নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে, নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন করে কাজ করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন -- এইরূপ দৃষ্টান্ত বড়ো বিরল। আমার মনে খুব ভক্তির উদ্রেক হল বলে আমি বললাম, তাঁর সঙ্গে দেখা করে এ বিষয় আলোচনা করতে চাই। এমন সময় তিনি স্বয়ং এসে আমার সঙ্গে দেখা করলেন, তাঁর কাছে শুনলাম তিনি কী ভাবে কাজ আরম্ভ করেছেন। তখন এ কথা আমার মনে উদয় হল, যদি এঁর কাজের সঙ্গে আমাদের কাজ জড়িত করতে পারি তা হলে কৃতার্থ হব, কেবল সফলতার দিক থেকে নয় -- এঁর মতো লোকের সঙ্গে যোগ দেওয়া একটা গৌরবের বিষয়।

উনি আরও বলেন, "দেশে মশা আছে এটা বড় সমস্যা নয়, বড় কথা এই দেশে লোকের মনে জড়তা আছে, সেটা আমাদের দোষ, বড় রকম দুঃখ বিপদের কারণ সেখানে…. কতরকম ব্যাধি-বিপদ আছে যদি ব্যক্তিগত কয়েকজন লোকের উদ্যমকে একমাত্র উপায় বলে গ্রহণ করি তাহলে আমাদের দুর্গতির অন্ত থাকবে না।"

হঠাৎ ম্যালেরিয়া নিয়ে পড়লাম কেন? কথাটা আসলে ম্যালেরিয়া নয়। ম্যালেরিয়া একটা উপলক্ষ। স্বামীজী, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা প্রমুখেরা তখন যে শুধু দেশের অধ্যাত্মিক তথা জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি নিয়েই মাথা ঘামাছেন তা তো নয়। একদম প্রাথমিক স্তরে এসে মানুষের স্বাস্থ্য নিয়েও সচেতন হতে বলছেন। মহাত্মার বহু-ব্যবহৃত শব্দ 'সর্বোদয়' এই অর্থেই সার্বিকভাবে একজন মানুষের উন্নতির উদ্দেশ্যে।

এনারা প্রত্যেকেই ভারতীয় সমাজের যে সমস্যাটার কথা বলেছেন তা হল এই মানসিক জড়ত্ব এবং আত্মশক্তির উপর একান্ত অশ্রদ্ধা। দৈনিক জীবনে বাহ্যিক শুচিতা এবং আত্মশক্তির বিকাশে নৈতিক শুচিতাই যে একমাত্র অনুশীলনী সে এদের লেখায় বারবার উঠে এসেছে। নাহলে অণুজীব বিশেষজ্ঞ গোপাল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিশ্বকবি তথা ঋষি দার্শনিক রবীন্দ্রনাথের কাজের ক্ষেত্র এক হয়ে যায় কি করে?

স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে গ্রামে গ্রামে সচেতনতা আরো দরকার। শহরেও এখানে ওখানে পিক ফেলবেন না, থুতু ফেলবেন না, ডাস্টবিন ব্যবহার করুন ইত্যাদি সবই এই একই স্বাস্থ্যবিধির উল্লেখ। আরো অনেক রাস্তা বাকি। বিজ্ঞানের কাজ শুধু নয় এটা, সঙ্গে দরকার শুভ ইচ্ছা আর সচেতনতা। এখন যেমন সব চাইতে বড় থ্রেট, ডেঙ্গু। শুনলাম ডেঙ্গু নিয়ে নাকি গান বাঁধা হচ্ছে। সচেতনতার জন্য। এত এত মহাপুরুষ অতীত হয়ে গেলেন, কিন্তু মশা আর মশা নিয়ে আতঙ্ক আমাদের ছেড়ে গেল না।

 

111
Thu, 05/11/2023 - 14:59

 

ইংরেজিতে নামটা দেখে আমি উচ্চারণ করতাম, কার্ল জেস্পার। জার্মান-সুইস বিখ্যাত মনোবিদ তথা দার্শনিক। পরে শুনলাম, উচ্চারণ হবে কালা জেস্পাস। যা হোক উচ্চারণ, বানান নিয়ে আমার অত খুঁতখুঁতেমি নেই, ওতে মুখ্য ছেড়ে গৌণের দিকে ঝোঁক চলে যায় বেশি।

বিবিসি একটা তথ্যচিত্র বানায়, প্রাচীন আর আধুনিক যুগের তিনজন তিনজন করে প্রখ্যাত চিন্তাবিদদের উপর। প্রাচীন যুগে আসেন বুদ্ধ, সক্রেটিস আর কনফুসিয়াস। আধুনিক যুগে নীৎজে, ফ্রয়েড ও কার্ল মার্ক্স।

প্রাচীন যুগের ওই সময়টা পড়তে গিয়ে আমি একটা তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হই, 'অ্যাক্সিয়াল যুগ' বলে। এই ধারণার প্রবক্তা হলেন এই জেস্পাস মহাশয়। বেশ ইন্টেরেস্টিং লাগল তত্ত্বটা। ওঁর মতে পৃথিবীতে একটা নির্দিষ্ট যুগে মানুষের চিন্তার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন এসেছিল। মানুষের চিন্তায় মিস্টিসিজম্, পরাজাগতিক সত্য, অতীন্দ্রিয় সত্যের দিকে একটা ঝোঁক জন্মায়। ন্যায়নীতি নিয়েও ভাবনার ভিত্তি পরিবর্তন হয়। প্লেটোর গুহাতত্ত্ব, উপনিষদের ব্রহ্ম, বুদ্ধের পঞ্চস্কন্ধ ও চেতনার ভাবনা যা জন্মান্তরবাদে বিশ্বাসী, জৈন দর্শন, কনফুসিয়াসের নীতিতত্ত্ব, খ্রীষ্ট, মুহম্মদ ইত্যাদি নানা ভাবনার একটা যুগ নিয়ে, এই অ্যাক্সিয়াল যুগ। আজ অবধি যত যত দর্শন, ধর্মের তত্ত্ব সব কিছুরই উদ্ভব ওই সময়টায়। আমাদের এই সময়ে জেস্পাসের এই অ্যাক্সিয়াল যুগ তত্ত্বটাকে নিয়ে ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর একটা দারুণ বই আছে 'দ্য গ্রেট ট্রান্সফরমেশন'।

=====

জেস্পাসের জীবনে যে ক'জন দার্শনিক ওঁকে প্রভাবিত করেছেন তাঁরা হলেন, স্পিনোজা, কান্ট, নীৎশে ও কিয়ের্কেগার্ড। জেস্পাসের দর্শনকেও অনেকে গভীরভাবে অস্তিত্ববাদের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যদিও উনি মানতেন না সে কথা। কিন্তু নিজের মত করে সত্যের অন্বেষণ কি মনোবিজ্ঞানে, কি দর্শনে ওঁর অবদান অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। কিয়ের্কেগার্ড অনেকের মতে অস্তিত্ববাদের জনক। স্ব-অস্তিত্বের বোধ ছাড়া আসলে কোনো দর্শনই দাঁড়ায় না। কিন্তু, সেই স্ব-অস্তিত্বের বোধকে যিনি এক স্বাধীন দর্শনের জায়গায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন অবশ্যই কিয়ের্কেগার্ড। এখানে আরেকজনের নাম উল্লেখ করাও অবশ্যই আমার মতে উচিৎ, জে কৃষ্ণমূর্তি, যিনি স্ব-অস্তিত্ববোধের নিঃসঙ্গ, নির্মম নির্জনতায় সত্যকে অনুভবের রাস্তা দেখিয়েছিলেন এক অত্যন্ত অস্থির সময়ে। অল্প কিছু মানুষ সেদিন ওঁর গুরুত্ব বুঝেছিলেন, এখন অনেকেই অনুভব করছেন, আবার করে চর্চাও শুরু হচ্ছে।

=====

জেস্পাসের শেষ প্রবন্ধ মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে। সম্পূর্ণ প্রবন্ধটা ইউনেস্কোর ডিজিটাল লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়। সেখানে মহাত্মার অহিংস আন্দোলনকে তিনি আরেক দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি লিখছেন, "Gandhi's self-discipline is not without inner violence. But this violence against one's own self is not a free coming- to-oneself. Therefore it is that, whoever inflicts violence on oneself only causes subjugation of others. Subjugating others by means of moral pressure is an element of Gandhi's effectiveness."

গান্ধীর স্ব-ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণে, নিজের উপর আরোপিত 'ভায়োলেন্স'-এর কথা যখন বলছেন জেস্পাস, তখন ভারতীয় অধ্যাত্মিক সাধনার সুপ্রাচীন ইতিহাসের কথাও উল্লেখ করছেন জেস্পাস। যেখানে এইভাবে আত্মপীড়নের সমর্থন আছে, অবশ্যই কিছুদূর অবধি। গীতাতেও যখন বলা হচ্ছে নিজেকে এইভাবে ইন্দ্রিয়সুখের থেকে বঞ্চিত করে মানুষ শুষ্ক হয়ে যেতে পারে, কিন্তু আত্মার দর্শনের আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে সে শুষ্কতা কেটে যায়। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ে, ৫৯ নং শ্লোক বলেন, "Aspirants may restrain the senses from their objects of enjoyment, but the taste for the sense objects remains. However, even this taste ceases for those who realize the Supreme."

এ ভারতীয় প্রাচীন সাধনতত্ত্ব। বুদ্ধ এর চূড়ান্ত অবস্থা থেকে সরিয়ে মধ্যপন্থায় এসেছিলেন। এবং সে ঘটনাও উল্লেখ্য যে বুদ্ধ যখন মধ্যপন্থায় আসতে চান, তখন ওর সঙ্গীরা ভাবেন যে বুদ্ধ সাধনপথ ভ্রষ্ট, তাই তারা বুদ্ধকে ত্যাগ করেন। আমাদের আধুনিক যুগের সাধকদের মধ্যেও এই অত্যন্ত কঠোরভাবে ইন্দ্রিয়সংযমের ইতিহাস আছে। গীতার দর্শনও মধ্যপথানুগামী। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৬/১৭ নম্বর শ্লোক দেখলেই বোঝা যায়---

O Arjun, those who eat too much or too little, sleep too much or too little, cannot attain success in Yog. [16]

But those who are temperate in eating and recreation, balanced in work, and regulated in sleep, can mitigate all sorrows by practicing Yog. [17]

রবীন্দ্রনাথ এই আত্ম-অনুশাসনের রাস্তাকে স্বীকার করেছেন। এক জায়গায় বলেছেন, নরম ঘাসের নীচে কঠিন মাটি আছে বলেই সে ঘাসে হাঁটা সম্ভব। এ উপমাটা বেশ। 'শান্তিনিকেতন' প্রবন্ধগুচ্ছে রবীন্দ্রনাথ শুধু দার্শনিক নন, সাধকও। তাই সাধনার কাঠিন্যের দিকটাও জানাচ্ছেন।

কিন্তু ভারতীয় সাধনায় আরো এমন দিক আছে যা আমাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মনের কাছে বড্ড কিম্ভুত শুধু না, দুরাচারসদৃশ্য। মহাত্মার যৌন সংযমের পরীক্ষা, যা অবশ্যই গোপনে না, বহু বিতর্কিত তাই। এমনকি একবার স্বপ্নদোষে বীর্যস্খলনের ঘটনাও প্রকাশ্যে হরিজনে লিখতে চেয়েছিলেন যাতে সবাই জানে তিনি ইন্দ্রিয় সংযমে দুর্বল। সুভাষের বেলপাতা খেয়ে খেয়ে কামসংযমের ঘটনাও জানা। আবার ওদিকে রামকৃষ্ণদেবের উলঙ্গ হয়ে উলঙ্গ যুবতীর কোলে বসে সাধনার অঙ্গও লিপিবদ্ধ। সেক্স নিয়ে একটা মারাত্মক অবসেসান ভারতীয় সাধনায় আছে। যা নিয়ে বিখ্যাত মনোবিদ সুধীর কক্করের অসামান্য গবেষণা আছে। যার মধ্যে রামকৃষ্ণদেবের যৌনতা নিয়েও কাজের একটা অধ্যায় আছে। অবশ্য কোনো কাজই নিন্দাত্মক, প্রশংসাত্মক নয়, কাজগুলো সবই সত্যের অন্বেষণ। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

=====

মহাত্মার সাধনার কথা ও যৌনজীবনের গুরুত্ব বৈবাহিক জীবনে আরেকটা চিঠিতে স্পষ্ট হয়। ১৯২২ সালের, মার্চের ১৭ তারিখ মণিলালকে লিখছেন---

"Now about your personal problem. Both Naidu and Ramdas tell me that I should write to you about your marriage. They believe that deep down in your heart there is the desire to marry, but that you would marry only if I absolve you from your promise. I do not consider you to be under any promise to me. It would be proper for every man to be under binding to himself. One is one’s own enemy or friend. You have bound yourself and you alone can free yourself from it.

It is my opinion that whatever peace you get is because of your self-imposed binding. You can be sure about this. As long as you do not think of marriage, you stand absolved from your past sins. This atonement of yours keeps you pure. You can stand up as a man before the world. The day you marry you will lose your lustre. Take it from me that there is no happiness in marriage. To the extent Ba is my friend, I derive happiness from her, no doubt. But I derive the same happiness from all of you and from the many men and women who love and serve me. I derive more [happiness] from the man or woman who understands me. If, at this moment, I get enamored of Ba and indulge in sexual gratification, I would fall the very instant. My work would go to the dogs and I would lose in a twinkling all that power which would enable one to achieve swaraj. My relation with Ba today is that of brother and sister, and the fame I have is due to it.

Please do not think that I got this wisdom after I had my fill of pleasure. I am simply painting before you the world as I find it from experience. I cannot imagine a thing as ugly as the intercourse of man and woman. That it leads to the birth of children is due to God’s inscrutable way. But I do not at all believe that procreation is a duty or that the world will come to grief without it. Suppose for a moment that all procreation stops, it will only mean that all destruction will cease.

Moksha is nothing but release from the cycle of births and deaths.

This alone is believed to be the highest bliss, and rightly.

I see every day that all our physical enjoyments, without exception, are unclean. We take this very uncleanliness to be hap-piness. Such is the mysterious way of God. However, our purushartha lies in getting out of this delusion.

Having said all this, I regard you as quite free [to act as you please]. I have written this merely as a friend. I have not given any command as a father. “Be you good” this is my only injunction.

However, do what you wish, but not what I wish. If you simply cannot do without marrying, do think of marriage by all means. Please write to me in detail what your innermost thoughts are."

এখানে আরেকটা দিক উল্লেখ্য, বাবা হয়ে ১৯২২ সালে নিজের ও নিজের স্ত্রী'র যৌন জীবন নিয়ে এত স্পষ্ট করে বলতে পারার ক্ষমতাটাও আশ্চর্যের নয় কি? আজও যেখানে ভারতে যৌনশিক্ষা বলে কোনো শিক্ষার প্রবর্তন প্রাথমিক স্কুলশিক্ষায় সঠিক মাত্রায় আনা সম্ভব হয়নি, আজও যেখানে শিক্ষক থেকে অভিভাবকেরা, বিশেষ করে পুত্রসন্তানের সঙ্গে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করেন, সেখানে অতদিন আগে এসব কথা স্পষ্ট তখনই বলা সম্ভব যখন তার একটা স্বচ্ছ ধারণা বক্তার মধ্যে আছে।

এক্ষেত্রে বাঙালি বাবা-মায়ের সন্তানের উপর স্নেহ-আসক্তি অনেকটা অসুস্থতার পর্যায়ে গিয়ে পড়ে, এ আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। তাদের সন্তানের যে যৌনজীবন বলে কিছু থাকতে পারে…. "বাবু আমার ওসব কিচ্ছু বোঝে না".... "মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকায় না"..... এ কথা বিয়ের আগের দিন অবধি চলে… কোনো কোন ক্ষেত্রে তাও ছাপিয়ে যায়। সেখানে এত স্পষ্ট করে আলোচনার আদর্শ একটা মৌলিক উদাহরণ অবশ্যই।

মহাত্মার এই কাঠিন্য তার বোধবুদ্ধির যে সর্বগ্রাসী নয়, তার একটা মজার উদাহরণ নেওয়া যাক---

সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খানের সঙ্গে তার ছেলে ঘনি খানের চুড়ান্ত মতবিরোধ চলছে। ঘনি খান তখন শান্তিনিকেতনে। স্থাপত্য, ভাষ্কর্য ও শিল্পকলায় মন দিতে চান। কিন্তু সীমান্ত গান্ধী চান না ছেলে সেদিকে যাক। বরং অন্যভাবে সে দেশসেবায় নিযুক্ত হোক। মহাত্মার কাছে মধ্যস্থতায় বাপ-ছেলে গেলেন। মহাত্মা দু'পক্ষকে শুনলেন। তারপর বললেন, ঈশ্বর যখন ওকে শিল্পকলার ক্ষমতায় ভূষিত করেছেন, তখন সে সেই নিয়েই থাকুক না কেন। নন্দলালের কাছে শিখুক। তাকে আর অন্যদিকে টানাটানি কেন।

বলা বাহুল্য, সীমান্ত গান্ধী মেনে নেন এবং ঘনি খান ভবিষ্যতে দার্শনিক, কবি ও স্থাপত্যকার হিসাবে যথেষ্ট বিখ্যাত হন।

=====

মহাত্মার স্ব-ইন্দ্রিয় পীড়নের আরেকটা উদাহরণ হল অনশন। এতদিনের টানা অনশনের ইতিহাস হয়তো খুব কম নেতার জীবনেই আছে। এর মূলেও সেই আত্ম-অনুশাসনের প্রবল চেষ্টা।

এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। ঘটনাটাকে মজার ঘটনা হিসাবে দেখাই শ্রেয়।

ওশো'র সঙ্গে একবার আম্বেদকরের দেখা হয়। যে দলিত আইন নিয়ে মহাত্মার সঙ্গে অম্বেদকরের মতপার্থক্য হয় ও মহাত্মা অনশন শুরু করেন সে নিয়েও কথা হয়। আম্বেদকরকে বলেন ওশো, আপনি আন্দোলন তুলে নিলেন কেন? আম্বেদকর বলেন, আরে যদি মহাত্মার কিছু হয়ে যেত তখন সারা বিশ্ব আমাদের দায়ী করত।

কথাটা সত্য। মহাত্মার তখন বয়েস হয়েছে শুধু না, এই অনশনে শারীরিক ভাঙনও যথেষ্ট শুরু হয়েছিল। তো ওশো ঠাট্টা করে বলেন, তা আপনি মশায় পাশে একটা মাদুর পেতে শুয়ে পড়ে অনশন শুরু করে দেননি কেন?

ঘটনাটা মজার অবশ্যই। কিন্তু কথাটা তো তাই। মহাত্মার অনশন ততদিনে এক অভ্যাসে পরিণত। শরীর যতটা চাপ নিতে সক্ষম ছিল সে তো অভ্যাসেরই ফল। জেস্পাসের মতে যা নিজের উপর ভায়োলেন্স।

=====

সেই জেস্পাস তার প্রবন্ধ শেষ করছেন এই বলে যে, "Gandhi has become the unique example in our day of the religious politics of a self-revealing man. A man who was humiliated in South Africa because of his race, who was inspired by his Indian origin and educated in English, is driven by a love for a free India which would regain its res- pectability, driven as well by a readiness for suffering and for unlimited sacrifice, thereby permanently stalling a sense of guilt which goads on to new determination.

Today we face the question: How can we emerge from physical power, and wars, so that we do not all perish under atom bombs? Gandhi provided the true answer through deed and word: only from higher politics comes the strength that would rescue us from our political crises. It is inspiring that this answer is provided in our times by an Asian."

আমি শেষ কর‍তে চাই রবীন্দ্রনাথের ভাষণের একটা অংশ দিয়ে….

"Today in our determined effort let us join Mahatmaji in his noble task of removing the burden of ages, the burden of disrespect upon the bent back of those who have been stigmatized for the accident of their birth, and the sin of wilful denial, to a large body of our countrymen, of sympathy which is the birth-right of all human beings. We are not only casting off the chain of India's moral enslavement but indicating the path for all humanity. We are challenging the victimization, wherever and in whatever form it may exist, to stand the test of relentless questioning of the conscience which Mahatmaji has brought to bear upon our day.

When Mahatmaji began his penance there were cynics in our own country and abroad who mocked and jeered at him, and yet before our very eyes the wonder has happened. Hard rocks of tradition have been blasted. Irrational prohibitions, cramping our national life, are already showing signs of tottering. Great has been the achievement due to his penance, but it will be a greater glory to him and to us if we can fulfil his vow by fighting to a finish the evils of untouchability, of intolerance, of all that hinders the comradeship of man and man and obstructs our path to freedom and righteousness.

My friends, I appeal to you, do not betray your Great Man and your own humanity by any deviation of your initiative from the pursuit of justice and love towards your fellowmen who have suffered humiliation for ages and remained dumb in a pathetic apathy of resignation, never even blaming Providence and their own cruel destiny. But the angry voice has at last come from the Divine Guide of our history with its warning message that they cut at the root of freedom who, in their unreasoning pride, obstruct the freedom of social communication among their own kindreds."

 

112
Sat, 04/22/2023 - 14:03

কোভিডের কারণে যখন সংক্ষিপ্ত সিলেবাস করা হল তখনও অভিব্যক্তি বাদ গিয়েছিল। আমি হাউমাউ করে এটা সেটা লিখেছিলাম। যা হোক, পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে আবার ডারউইন ফিরে এসেছেন। শান্তি!

রিচার্ড ডকিন্স, জ্যান্ত বিজ্ঞানী, মেলা বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন, ধর্ম নিয়ে তর্কবিতর্ক করেন, খোঁচাটোঁচা মারেন, তিনি একটা বড় প্রোগ্রাম করেছিলেন স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে ডারউইনের ক্রমবিবর্তন তত্ত্ব বোঝানোর জন্য। আমাদের স্কুলের না, অগো দেশের। তাদের স্কুলে অভিব্যক্তি তত্ত্ব পড়ানো হয় না কারণ ক্যাথলিক পণ্ডিতেরা আপত্তি করেন। তো গ্যালাপাগোস দ্বীপে নিয়ে গিয়ে টিয়ে ডকিন্স সাহেব বাচ্চাদের হাতে করে প্রমাণ করাতে সচেষ্ট হলেন যে, দেখ ভাই এসব ঘটনা আদতে ঘটেছিল।

তারা বুঝল কি বুঝল না জানি না, অন্তরের কথা আর ক্যামেরার কথা কি এক দাদা? তো ডকিন্সের মাথা ঘাড়েই থাকল। ডারউইন ডারউইনেই থাকল। আজকাল আর ক্যাথলিকেরা অমন ব্রুনো, গ্যালিলিও-র মত করে না। আপত্তি জানায় এত অবধিই। যেমন অ্যাবর্সান, কণ্ডোম নিয়ে জানিয়েছিল। কিন্তু ঘাড়ে কোপ মারাটারা হয় না। সে সব তারা মোটামুটি ছেড়েছে বড় অংশে। কোনো গলিঘুঁজিতে কি হয় সে আমি জানি না অবশ্য।

=====

এই যে গোটা ফরাসী বিপ্লব ঘটল, তখন হচ্ছিলটা কি? একবার রাজার হাত ধরে ক্যাথলিকের পণ্ডিতেরা, আবার ক্যাথলিক পণ্ডিতদের হাত ধরে রাজারা। মোদ্দাকথা সাধারণ মানুষদের নাজেহাল করে দিচ্ছিল। একদম পুজোপাঠ করবে না, আর পুজোপাঠ করতেই হবে…. এই দুটোই তো বড় বালাই। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে দুই পক্ষই এসেছে। আছে। এ বলে, ধর্ম না করলে প্যাঁদাব। ও বলে, ধর্মের নাম শুনলে প্যাঁদাব। উফ্..., মানুষের উপর এ তো গা জোয়ারি কি ভালো?

কিন্তু কথা হচ্ছে ভারতে তো অমন ধারা কোনোদিন ছিল না বাপ! চার্বাক, বেদান্তী, বৌদ্ধ, জৈন সব একসঙ্গে ছিল, আছে, থাকবেও। এই বুদ্ধগয়ার কথাই ধরো না কেন। বুদ্ধগয়া আর গয়া, কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব। বুদ্ধ বলল, ঈশ্বর নাই, আত্মা নাই, কিস্যু নাই। ওদিকে গয়াতেই দেখ, লোকে আত্মা আছে জেনে তাদের পিণ্ডি দিচ্ছে। এই বিশ্বের একজন পিতা আছে এমন বিশ্বাস করে বিষ্ণুর পাদচিহ্নে প্রণাম জানাচ্ছে। ঐতিহাসিক বলবে, ওটা বুদ্ধের পা। আর হলই না হয়, ভাগবতে বুদ্ধকেও তো করুণাবতার করে আপন করে নিয়েছে নাকি? তবে? আবার কাশী আর সারনাথ। পাশাপাশি। এক কেস। এদিকে আদিদেব মহাদেব। অটো চড়ে কিছুদূর যাও, বুদ্ধের দর্শন। প্রথম ধর্মচক্র শুরু হল যেখান থেকে। তবে? কই কেউ তো ভাই মারামারি করে না? আবার কিছুদূর যাও, পরেশনাথ। জৈন মন্দির। তিনিও ঈশ্বর আছেন বলেন টলেন না। বলেন, তুমি অনেকান্তবাদী হও না কেন। মানে এক সত্যকে অনেকভাবে দেখো না কেন?

=====

এট্টু জ্ঞানের কথা বলব? ধরো একটা অসীম আয়না আছে। তো হল কি, তাতে যদি প্রতিবিম্ব না পড়ে তুমি বুঝবে কি ওখানে একটা আয়না আছে? তেমনই আমাদের যে চেতনায় এত বড় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ছবিছায়া পড়ছে, তবেই যে না জানি একটা চেতনা বলে বস্তু আছে! কান্ট সাহেব তাঁর সুকঠিন, সুবিশাল গ্রন্থে কেমন গাঁট্টা মেরে মেরে আমাদের এ সব কথা বুঝিয়েছেন! তো আমাদের আত্মা আছে নেই তত্ত্বটাও অমন। কঠিন হল? মেলা কঠিন। মায় গীতাতেও বাসুদেব বলে বসলেন, আচ্ছা ভাই যদি আত্মা নাও থাকে, তবু কর্তব্য তো আছে! তুমি ভাই উঠে যুদ্ধুটা করে নাও না কেন? এমনকি শুরু থেকে শেষ অবধি অনেকবার বুদ্ধির শরণে গিয়ে কাজ করার পরামর্শও দিয়েছেন। মায় পুরো গীতাটা বলে নিজের বোধগম্যি অনুযায়ী কাজ করতেও বলেছেন। রামকৃষ্ণদেব যেমন বলতেন, আমি বলে রাখলাম, তুমি এবার ল্যাজামুড়া বাদ দিয়ে নিও তোমার মত করে।

=====

উদার হও, ভায়া উদার হও। ধর্ম চিত্তবৃত্তির ব্যাপার, বিজ্ঞান বুদ্ধিবৃত্তির ব্যাপার। চিত্তবৃত্তিকে ইনটুইশানও বলতে পারো, বিবেকবুদ্ধিও বলতে পারো। তুমি যদি চোখ খুলেই মুসলমান, খেষ্টান, বৌদ্ধ ইত্যাদি এইসব দেখো, তবে তো বুঝতে হবে তোমার শাস্ত্রজ্ঞানই হয়নি ঠিক করে। গীতা বলছে যে, সত্যিকারের তত্ত্বদর্শী সে বিদ্যাবিনয়সম্পন্ন পণ্ডিত, কুকুরে, হাতিতেই কোনো পার্থক্য দেখে না, আর তোমরা মানুষে মানুষের এত ভেদ টানো? জানো না ওগুলো মত! চিত্তবৃত্তি অনুযায়ী মানুষ দু'প্রকার হয়, এক পাষণ্ড, আর এক বিবেকী। এর বাইরে সব ভাগ অশাস্ত্রীয়। ভালো করে পড়ো। তোমার কোন পুরাণে কি লেখা আছে সে প্রামাণ্য নয়। এ কথা বিবেকানন্দ, রাধাকৃষ্ণাণ প্রমুখ বহু পণ্ডিতে বলেননি? তুমি কোথা থেকে সব অদ্ভুত তত্ত্ব আবিষ্কার করছ!

দেখো আধুনিক কালের বিজ্ঞানী কালাম সাহেব থেকে ক'দিন আগের রবি ঠাকুর, মহাত্মা, সুভাষ, রাধাকৃষ্ণাণ ইত্যাদি ধর্মকে যে আলোতে দেখেছেন সেই আলোতেই দেখো না বাপ আমার!

ধরো একজন সুপণ্ডিত শারীরবিদ্যার বিজ্ঞানী কি চিকিৎসক। তিনি যখন কোনো মানুষকে সামাজিকভাবে, আত্মিকভাবে ভালোবাসেন, তখন কি সেই শারীরিকজ্ঞান নিয়ে ভালোবাসেন? মানে তার কোলে নাতি এসে বসলে কি তিনি ভাবেন, আহা একটি নানা কোষ-কলা সমৃদ্ধ, নানা তন্ত্রযুক্ত একটি সচল জীব আসিয়া আমার অঙ্কে উপস্থিত হইল? ভাবেন? ভাবেন না। অন্তত সুস্থ স্বাভাবিক হলে ভাবেন না। কারণ সেটি তার চিত্তবৃত্তির জায়গা। কিন্তু তিনিই যখন নাতির পিঠে ফোঁড়া দেখবেন, তখন আবার বুদ্ধিবৃত্তিকে অবলম্বন করবেন। তখন নাতি কাঁদলেও আপাতভাবে তার ভালোর জন্যেই কঠিন হবেন। এই তো জীবন দাদারা!

এখন দেখুন সব কিছুরই একটা সঙ্কীর্ণ ব্যাখ্যা আছে, আবার উদার ব্যাখ্যাও আছে। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই যেমন বিজ্ঞানী, এ সংকীর্ণ অর্থে। তেমন গলায় কণ্ঠি, তিলক মানেই বৈষ্ণব। কিন্তু উদার অর্থে বৈজ্ঞানিক আর সঠিক বৈষ্ণব দুটো আলাদা তত্ত্ব। সত্যের অন্বেষণে একান্ত অনুরাগী বুদ্ধিবৃত্তি, আর তৃণাদপি সুনীচেন চিত্তবৃত্তি দুই-ই বিরল এ সংসারে। ডারউইন সিলেবাসে থাকুক চাই না থাকুক, বোর্ডের প্রশ্নপত্র আর নানাবিধ চাকুরির প্রশ্নপত্র কিসে আগ্রহী ছাত্রছাত্রী সমাজের বৃহদংশ তাতেই আগ্রহী।

অবশেষে বলি, ওহে অল্পদর্শী সিলেবাস জনক-জননীরা, তোমাদের আহাম্মকিতে খাঁটি ধর্ম, খাঁটি বিজ্ঞান কারোরই ক্ষতি নাই অন্তত আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে। জ্ঞান এখন আগ্রহ নির্ভর। সুযোগ অর্থ নির্ভর তত নহে। জ্ঞান কৌলিন্য ত্যাগ করিয়া সবারে গ্রহণ করিতেছে। তোমরা এটা-সেটা বাদ দিয়া নিজেদের বাতিল করিবার প্রয়াসে লাগিয়াছ। ইহাই উপসংহার।

113
Thu, 04/20/2023 - 13:34

শ্রীরামকৃষ্ণ ছবি আঁকতেন। শ্রী নন্দলাল বসু ওঁর আঁকা দুটো ছবির প্রতিলিপি করেছেন, যে দুটো ছবি দেওয়া এখানে, একটা জাহাজ, একটা আতা গাছে তোতা পাখি।

যে মানুষটা জন্মাবধি ঈশ্বর পাগল, সে মানুষটা ছবি আঁকছেন জাহাজের, আতাগাছে তোতাপাখির। ঠাকুর দেবতা এঁকে দেওয়াল, খাতা ভরিয়ে দিচ্ছেন না। যাঁর প্রতিটা শ্বাসে, প্রতিটা কথায় দিব্য চৈতন্যের স্ফুরণ, তাঁর পোশাকে-আশাকে, গলায়-কপালে কোথাও কোনো চিহ্ন নেই। চিহ্ন একটাই, তাঁর আচরণ। করুণার প্রলেপ। রসিক মেথর থেকে শুরু করে মুখে বুট ঘঁষে দেওয়া, পিঠে উত্তপ্ত চারকোল ঠেসে ধরা খাজাঞ্চি ইত্যাদিরা, অবাধ্য উগ্র হৃদে --- সবার জন্যেই করুণা। করুণাই ধর্মের বোধের একমাত্র লক্ষণ, পৃথিবীর সব মহাপুরুষ, সাধু, শাস্ত্র বলেন। করুণার বোধে মানুষ শান্ত হয়, তৃপ্ত হয়, স্তব্ধ হয়।

আজ এ সব কথা চর্চিত হওয়ার দিন নয়। অবকাশ নয়। আজ ধর্মকে অনুভবের আগ্রহের থেকে বেশি ধর্মের স্বার্থানুগত ব্যবহারের তাগিদ। আমি মিছিল বার করব, আমি মন্দিরের পর মন্দির গড়ব, উৎসব করব। প্রত্যেকটাকেই বলব 'ধর্ম'। মানুষের মিছিল দেখে বলব, মানুষ ধর্মপ্রাণ হচ্ছে। আদৌ যা সত্যি না, আমি তুমি সবাই জানি, তবু চুপ থাকি।

=======

মানুষ তার চিত্তবৃত্তির সব ক'টা তারে সুর তুঙ্গে বাজিয়ে দেখেছে, কোনো সুরেই তার চরম সার্থকতা বোধ নেই, যতক্ষণ না তার চিত্তে করুণা জন্মাচ্ছে, ততক্ষণ সে নিজের বুদ্ধি-বিচার, নিজের আবেগ, প্রবৃত্তি সবার দাস, প্রতি মুহূর্তে নিজের হাতে নিজে শিকার হচ্ছে, ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। অশান্ত হচ্ছে। বিকারগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষুব্ধ হচ্ছে। সর্বোপরি দু:খ পাচ্ছে।

এ সবের হাত থেকে রক্ষা পায় একমাত্র করুণার বোধে। করুণার অর্থ নিজের অহমিকাকে সরিয়ে, অন্যকে গুরুত্ব দেওয়া। একটা বিশাল হলঘরে যদি অসীম জানলার অবকাশ থাকে, তবে শুধু নিজের জানলায় মুখ বাড়িয়ে না বসে, অন্যের জানলা দিয়েও একবার জগতটাকে দেখার ইচ্ছাকে বলে উদারতা। যা বৌদ্ধিক করুণা। আমি তখন সব সময় আমার ইচ্ছা-রুচিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি না, তুমি কি বলতে চাইছ সেটাও শুনতে চাইছি, তোমার মতো করে জিনিসটা দেখতে চাইছি, আলোচনা করতে চাইছি, তোমার আর আমার দেখার মধ্যে একটা সমন্বয় ঘটাতে চাইছি। আর এ সবের মূল কারণ হল কি? আমি তোমায় ভয় পাই না। তোমায় ভয় পাই না মানে হল তোমার রুচি, ইচ্ছা, পছন্দ, যুক্তিকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে আমি থ্রেট মনে করি না।

শ্রীরামকৃষ্ণ এই বৌদ্ধিক করুণার মূর্ত প্রতীক। একজন রঙের গামলা নিয়ে বসে আছে। যে যে রঙ চায়, তাকে সেই রঙেই ছুপিয়ে দিচ্ছে। একজন এসে বলল, তুমি নিজে যে রঙে ছুপেছ আমায় সেই রঙে ছুপিয়ে দাও।

তাঁরই বলা গল্প।

=======

সত্য অস্তিত্ববান অস্তিত্বের সত্যতাতেই। আর মিথ্যা অস্তিত্ববান প্রচারের জোরে। সত্যের প্রচারকের দরকার হয় না। সত্যের শিক্ষার দরকার হয়। আপাত মিথ্যাকে সরিয়ে সত্যকে দেখার শিক্ষা নিয়েই সভ্যতা এগিয়েছে। সূর্যকে স্থির জেনেছি, আপাত জড় পদার্থের কেন্দ্রে মহাশক্তিমান পরমাণুর সত্যতাকে জেনেছি। সেভাবেই নিজের চিত্তের দিকে তাকিয়ে আপাত নঞর্থক ভাবাবেগগুলোকে সরিয়ে সত্য শিব সুন্দরকে দেখার শিক্ষাকে বলে 'তপস্যা'। আপাতভাবে হিংসা, ক্রোধ, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা সত্য হলেও, তাকে অতিক্রম করে আরো গভীরের সাংগঠনিক সত্যের দিকে মানুষ যেতে পারে, এ বিশ্বাস জন্মানোই অধ্যাত্ম বিশ্বাস। তা যদি সমগ্র মানবজাতির বিশ্বাস না হত তবে কোনোদিনই সভ্যতার অগ্রসর বলে কোনো কথা আমরা বিশ্বাসই করতে পারতাম না। সামগ্রিকভাবে, সম্মিলিতভাবে সে রাস্তা অনেক বাকি, কিন্তু মাঝে মাঝে কয়েকজন মহাত্মা এসে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যান, নিজের ক্ষুদ্রতাকে জয় করে সঠিক মনুষ্যত্বে আসীন হওয়া মানুষের পক্ষেই সম্ভব। শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রার্থনা, মা আমার পশুভাব কমিয়ে দাও। এখানে পশুভাব অর্থ অবশ্যই 'অবিবেচনাবশ্যতা'।

করুণার বৌদ্ধিক দিক যেমন উদারতা, তেমনই তার প্রয়োগের দিক বিবেচনাশীল হওয়া। বিবেচনা নিজের আলোতে। নিজের বোধের করুণার আলোতে। যে বোধ স্বার্থসর্বস্ব নয়। সে-ই করুণাময় বোধ। সেই বিবেচনাজাত ব্যবহারকেই আমরা বন্ধুসুলভ ব্যবহার বলি। যার উপর আস্থা রাখি ভবিষ্যতের।

======

শ্রীরামকৃষ্ণর যে ছবি নিয়ে বলা শুরু করেছিলাম। যিনি ঘর দেওয়াল সব দেবদেবীর ছবিতে ভরিয়ে তো দেননি। তিনি তো সাকারে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি তো তা করতেই পারতেন। জীবনের শেষ লগ্নে যখন শ্যামপুকুরবাটি, কি কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আছেন তখনও তো ভক্তদের বলতে পারতেন আমার জন্য একটা কালীমূর্তি বানিয়ে নিয়ে এসে এখানে একটা মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দাও। বলেননি।

অপপ্রচার, ব্যঙ্গ, মিম, ক্যারেক্টর অ্যাসাসিনেসান, ট্রোল…. সবের মূল বৃত্তি তো একটাই, দ্বেষ। হিংসা। অসহিষ্ণুতা। একটা শত সহস্র ছিদ্রের জলাধারকে হয় মেরামত করতে হয়, নয় সে জলাধারকে পরিত্যাগ করতে হয়। দ্বিতীয়টা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথমটা নিয়ে কাজ করতে গেলে আগে খোঁজা দরকার এত ছিদ্র বাড়ছে কেন? মধ্যমেধার মিস্ত্রি প্রতিটা ছিদ্রকে রোধ করার জন্য আলাদা আলাদা ব্যবস্থা করবে। বলাইবাহুল্য তার কাজ কোনোদিন শেষ হবে না। যে উন্নত মেধার মিস্ত্রি, সে খুঁজবে কারণটা কি?

যখন রেলকলোনীতে থাকতাম তখন প্রায় প্রতি বছর বর্ষাকালে ছাদ ফেটে জল পড়ত। যতবার খবর দেওয়া হত, ততবার কর্মচারীরা এসে পিচচট লাগিয়ে চলে যেত। পরের বছর আবার পিচচট, তার পরের বছর আবার। এই করে করে ছাদে পিচচটের আস্তরণের পর আস্তরণ পড়ে যেত, কিন্তু সমস্যার কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান হত না।

আমাদেরও তেমন নীতিশিক্ষার, উপদেশের শেষ নেই। পিচচটের মত। হিংসা কোরো না, নেশা কোরো না ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোন মনকে বলা হচ্ছে? যাকে বলা হচ্ছে সেকি এসব শোনার অবস্থায় আছে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নীরব। যেন যেভাবে মানুষকে দুয়ে দুয়ে চার শেখানো যায়, তেমনভাবেই মানুষকে হিংসা, দ্বেষের মূল ধরে উৎপাটনের পদ্ধতি সেখানো যায়। এতে করে মানুষকে আরো চালাক, আরো ভণ্ডই বানানো যায় শুধু। এ না তো মানসিক বিশ্লেষণে সাধ্য, না নীতিমালা পড়িয়ে। এ শুধুমাত্র সম্ভব এক দরদী শিক্ষাদানের রীতিতে। যে আসক্তিকে স্বীকার করবে, কিন্তু আসক্তিই যে চরমাবস্থা নয় তাও অস্বীকার করবে না। যে চূড়ান্তভাবে নিন্মবৃত্তিতে আসক্ত, তার চিত্তেও শ্রেয়ের প্রতি বোধ, শ্রদ্ধা থাকে। দুর্বলভাবে থাকে। তাকে শক্তিশালী করে তুলতে যে পথ লাগে, সে দরদী পর্যবেক্ষণ, ধৈর্যের পথ। একজন জেগে থাকলে সে আধাঘুমে থাকা মানুষের হাত ধরতে পারে। কিন্তু ঘুমন্ত, কি আধাঘুমন্ত মানুষের হাতে ম্যাপ ধরিয়ে যদি বলা হয় চলে যাও এই পথ ধরে, কিম্বা মাঝে মাঝেই তার পিঠে চাবুক মেরে বলা হয়, কই গেলে না যে? তবে একদিন সে বিকারগ্রস্থ, উদ্ধত হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু সত্যাগ্রহী হতে পারে না।

======

শ্রীরামকৃষ্ণ বলে গেলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক। একটা জীবন রেখে গেলেন। আরো কয়েকজন শিষ্য ও মা সারদা রয়ে গেলেন সে-ই পথের আলোকস্তম্ভ হয়ে। "ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক'জন?" মা বললেন। গড়লেনও। ধৈর্যে, ভালোবাসায়।

আজ শুধু 'অন্ধকার, অন্ধকার', বলে এই যে চেঁচামেচি করা পণ্ডিতদের দেখি, আশ্চর্য হই। রাতের অন্ধকারে আলো জ্বালতে আগে সলতে পাকাতে হত, তেলের ব্যবস্থা করতে হত, চিমনির কাঁচ মুছতে হত। আজ রাতদিন এক করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানায় কাজ করতে হয়। তবেই হয়। এও কি এমনি এমনিই হবে?

আবারও বলি। সত্যের জ্ঞানের জন্য শিক্ষার প্রসার লাগে। আর মিথ্যার বাড়বাড়ন্তের জন্য প্রচার লাগে। প্রচারের পথ বন্ধ করা যাক না যাক, শিক্ষার রাস্তাটা প্রশস্ত করা চাই-ই চাই। মানুষ সত্যকে জানলে তাকে নেবেই। এ চিরকালীন সত্য। বড় সত্যকে পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্র-আপাত সত্যকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম। মনুষ্যত্বের গৌরব। একে অপমান করে কোনো মানুষ, সমাজ, সভ্যতা আজ অবধি টেকেনি। টিকবেও না। ভ্রান্তি আবরণ, ক্ষণস্থায়ী। চিরকালীন নয়।

114
Mon, 02/20/2023 - 21:17

সারদাদেবী বরাবরই আমাকে বিস্মিত করেন তাঁর সাধারণ অথচ গভীর অন্তর্দৃষ্টি এবং তাৎক্ষণিক সঙ্গতিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতায়।

একজন এসে সারদাদেবীকে রামকৃষ্ণদেবের সুখ্যাত করতে গিয়ে বলছেন রামকৃষ্ণদেবের অভূতপূর্ব ধর্মসমন্বয়ের কথা।

মা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলছেন, "তিনি তো মতলব করে কিছু করেননি, ওসব হয়ে গেছে। তার আসল শিক্ষা, দৃষ্টান্ত হল ত্যাগ।"

ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে ভুলটা সেদিন উনি শুধরে দিয়েছিলেন সে ভুলটা আজও চলছে, বিভিন্ন পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণায়, আলোচনায়।

সমন্বয় করতে গেলে একটা উদ্দেশ্য থাকে --- সামাজিক, কি রাজনৈতিক। রামকৃষ্ণদেবের প্রশ্ন ছিল, কৌতূহল ছিল, জিজ্ঞাসা ছিল, কিন্তু কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাই রামকৃষ্ণদেবের চেষ্টায় কোনো সচেতন সমন্বয়ের চেষ্টাও ছিল না।

তবে রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে কি ছিল? ছিল বহুত্ববাদ। রামকৃষ্ণদেব ধর্মের সমন্বয় করেননি, করতে চানও নি। তিনি যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা হল ধর্মের বহুত্বের বাস্তবতা।

 

উদাহরণ এক - মা বাড়িতে মাছ এনেছেন, যার পেটে যা সয় তাই রাঁধছেন, কারোর জন্য কালিয়া, কারোর জন্য ঝোল, কারোর জন্য ভাজা।

উদাহরণ দুই - একটা পুকুরের চারটে ঘাট, কেউ বলছে ওয়াটার, কেউ বলছে পানি, কেউ বলছে জল, কেউ বা অ্যাকোয়া।

উদাহরণ তিন - বিভিন্ন উপদেশ ও গল্প বলার পর বলছেন, আমি যা বলার বললুম, তোমরা লেজা-মুড়ো বাদ দিয়ে নেবে।

উদাহরণ চার - একটা গাছে একটা গিরগিটি থাকতো। সেই গিরগিটিটা এক-এক সময়ে এক-এক রঙ ধারণ করতো। যে যে রঙে দেখেছে সে সেই রঙকেই চূড়ান্ত বলে মেনেছে।

উদাহরণ পাঁচ - এখানকার ভাব একঘেয়ে নয়।

 

কোথাও রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে সমস্তকে মিলে এক করার প্রবণতা নেই। বরঞ্চ রামকৃষ্ণদেবের আরেকটা উদাহরণ টেনে বলা যায়, "যে যেই রঙে ছুপতে চায়, তাকে সেই রঙেই ছুপাই"।

বিখ্যাত পাশ্চাত্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদ John Rawls একটা শব্দ আবিষ্কার করেছিলেন, reasonable pluralism, যার অর্থ অক্সফোর্ড রেফারেন্স অনুযায়ী, "Rawls uses the term to denote the fact of a plurality of reasonable, though irreconcilable, moral, religious, or philosophical doctrines". রামকৃষ্ণদেবের 'প্লুরালিজম্' বা বহুত্ববাদেও এক সূত্র অনুযায়ী 'একঘেয়ে' হওয়ার কথা নেই। বৈষ্ণব ধর্মের শুদ্ধাভক্তিবাদের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের শূন্যবাদকে কখনই এক বলছেন না। বলছেন, মানুষের রুচিগত, ভাবগত, বৈচিত্র‍্যতা অনুযায়ী দুই-ই সত্য। এ সমন্বয়বাদ নয়, বহুত্ববাদ।

অন্যের জিনিস যেমন ধার করা যায় তেমনই অন্যের যুক্তিও ধার করা যায়। নানাবিধ পান্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ, ভাষণ ইত্যাদি লেখা দেওয়াও যায়। কিন্তু সামগ্রিকতার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ না হলে সেটা অর্ধপাচিত বা অপাচিত হয়ে অস্বাস্থ্যের কারণ হয়। রামকৃষ্ণদেবের দর্শন ধর্মজগতে এক সামগ্রিক দর্শন, সেটা যে জগতের সম্ভবনার আশা জাগায়, সে জগত সঙ্গতিপূর্ণ বহুত্ববাদের।

জন রলস্ যখন এই 'রিজনেবল প্লুরালিজম' প্রয়োগের জন্য একটা সাধারণ ভিত্তিভূমি খুঁজছেন সেখানে তিনি বলতে চাইছেন মানুষের সত্তা ও ব্যবহারের ফান্ডামেন্টাল দিকের কথা। রলস্ বিশ্বাস করেন, স্বভাবগতভাবে মানুষ সহনশীল। এই সহনশীল স্বভাবই "রিজিনবল প্লুরালিজিম" এর ভিত্তি।

মাস্টার মশাইকে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, "আমি ঠিক আর সবাই ভুল এ বুদ্ধি কোরো না, এতে হানি হয়।"

এ হিংসা, অসহিষ্ণুতা, দ্বন্দ্ব, কলহপূর্ণ সময়ে দাঁড়িয়ে রামকৃষ্ণদেবের এ দর্শন আশার কথা। কারণ এ শুধু তত্ত্ব নয়, প্রয়োগ উপযোগীও। এ দর্শনকে তিনি ও তাঁর শিষ্যেরা, ভক্তেরা নিজের জীবনে অনুসরণ করেও দেখিয়েছেন।

115
Fri, 02/10/2023 - 23:30

কতটা অসহায় লাগে তার মাপ পরিমাপ হয়কি ? একটা মহামারী পেরিয়ে এলাম, তাও মৃত্যুর খবর সহজ তো হল না। আজ যখন শুনলাম একজন প্রাক্তন ছাত্রের বাবা হঠাৎ চলে গেছেন, শুনে তো মনে হল না এই কয়েক বছর ধরে কত মানুষ তো চলে গেলেন। এই তো আজও ছাদে উঠলে বাড়িগুলো হাতে গুনে গুনে বলা যায়, এই বাড়ি, ওই বাড়ি…. মহামারীতে সব চলে গেলেন। কিচ্ছু সহজ হল না। শুধু জীবনের স্থায়িত্বের উপর আস্থাটা আরো দুর্বল হল, আর আসক্তি আরো বেড়ে গেল। জীবন পদ্মপাতায় জলের মত চঞ্চল, সত্যি। কিন্তু পদ্মপাতায় জলের মত নিরাসক্ত হলাম কই? হতে চাইলামই তো না। চাইও না।

পুরীতে বেড়াতে গেলে প্রায়ই বিকেলে সমুদ্রের ধারে বালিতে বসে থাকতাম। সমুদ্রের পর সমুদ্রের ঢেউ। ওসবে অত মন টানত না। মন টানত তীরের মানুষগুলো। চেয়ারে বসে যারা। ঘুরে বেড়াচ্ছে যারা। কেনাকাটা করছে যারা। বিক্রি করছে যারা। সবাই। উদাস চোখে প্লাস্টিকের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা মানুষগুলোর মুখ। চোখগুলো সমুদ্রের চেয়েও গভীর। মানুষের চোখের গভীরতার কাছে মহাকাশের অসীমত্ব আর সমুদ্রের গভীরতা দুই-ই তুচ্ছ। মানুষ প্রথমে আঁকড়াতে যায়। তারপর ধীরে ধীরে যখন বুঝতে পারে সে কিছুই ধরে রাখতে পারবে না, অসহায় হয়, ক্ষুব্ধ হয়। একদিন আর অসহায় লাগে না। বোঝে সমুদ্রের ঢেউ যেভাবে সত্যি, সমুদ্র সেভাবে নয়। নিজেকে ঢেউয়ের মত লাগে। ওঠাপড়া কোনোটাই নিজের ইচ্ছায় নয়। তার নোনতা স্বাদ, তার আকার কোনোটাই মৌলিক নয়, এই সাগরের থেকেই জন্মানো। সাগরেই লীন হবে। সে কোথাও কোনোভাবে বিশেষ নয়। মাঝে মাঝে ক'টা বড় বড় ঢেউ ওঠে না যে তা নয়, অবশেষে তাদের পরিণামও তো এক।

তবু নির্বোধ মন প্রশ্ন করে কেন? কেন এ প্রবল নিষ্ঠুরতা? তবে কি সংসারে কার্যকারণ সূত্রের বাইরে কিচ্ছু নেই? এত এত হাজার হাজার মানুষ যে চক্ষের নিমেষে মারা গেল, তার কার্যকারণ সূত্র আছে, কিন্তু মানবিক ব্যাখ্যা কি? কিচ্ছু নেই? ভাগ্যের হাতে, প্রকৃতির হাতে এমন পুতুল আমরা? কেন?

কারোর কাছে কোনো উত্তর নেই। নির্বোধ মন বোঝে না, এই 'কেন' প্রশ্নটাই অবান্তর। 'কি করে' তার ব্যাখ্যা আছে, 'কেন' এর কোনো ব্যাখ্যা নেই।

মনের গভীরে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়। শৌখিন শূন্যতা নয়! যে শৌখিন শূন্যতা একটা আর্থসামাজিক নিশ্চিত সুরক্ষিত জীবনে, শৌখিন বৌদ্ধিক বিষাদ থেকে জন্মায়। তা নিয়ে 'বুদ্ধিজীবীয়' সভা করা যায়। কিন্তু তাতে মশাল তো ছাই, স্ফুলিঙ্গও ওড়ে না।

এ শূন্যতা, বোধের শূন্যতা। যুক্তির নয়। আবেগের নয়। মানুষের এমনই স্বভাব যে, সে বোধের শূন্যতাকে মেনে নিতে পারে না। তাই কল্পনার রঙে সে শূন্যতাকে ভরিয়ে নিতে চায়। জন্ম নেয় পুরাণ, বা মিথোলজি। যেমন ভূমিকম্প মানে বসুমতীর পাশ ফেরা। গ্রহণ মানে রাহুর গিলে খাওয়া ইত্যাদি।

যুক্তির তৃষ্ণা তথ্যে মেটে। আবেগের তৃষ্ণা আরেক আবেগে মেটে। কিন্তু বোধের তৃষ্ণা? সে যত স্পষ্ট হয়, তার গভীরের শূন্যতাকে তত অনুভব করা যায়। কত দর্শন, কত নীতি, তত্ত্ব যুগে যুগে আসে। বালির ঘরের মত ভেসে যায়। কোন দাঁড়ায়, কোন নিক্তিতে সবটাকে দাঁড় করায় মানুষ? সে খোঁজে সমীচীনতা। পায় না। হাতড়ায়। যত দিন যায় যুক্তির সীমাবদ্ধতার উপলব্ধিতে, আবেগের অসীম মূঢ়তার বোধে নিজের অসহায়তা আরো গভীর হয়। অবশেষে মানুষ শূন্য হাতে সময়ের সামনে দাঁড়ায়। সমস্ত অভিমান, অসহায়তার বোধকে সময়ের হাতে তুলে দিয়ে বলে, কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু বুঝি না, যেদিকে নিয়ে যাবে যাব। আর কোনো গতি নেই।

সময় উদাসীন। কার চাকার রথ সে কেউ জানি না। কেউ কোনোদিন জানবেও না। জানার জিনিসই সে নয়। সে চাকার অনুবর্তী হয়ে মনে প্রাণে এটুকুই প্রার্থনা জন্মায়, সম্পদে-বিপদে, সুখেদু:খে চাকাটা যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, নিজের মনের ঘূর্ণিতে নিজের বুদ্ধিকে বিহ্বল করে বিভ্রান্ত যেন না হই। ঝুলন সাজিয়ে কালবৈশাখীর ভয়ে যেন না বাঁচি। কালবৈশাখীকে ঠেকাতে পারব না জানি। কিন্তু সে কালবৈশাখীও তো সে রথের চাকার একটা আবর্তন মাত্র, সবটাই ধ্বংস নয়, বিষাদ নয়, অন্ধকার নয়। একমাত্র সময়ই জানে সত্য কি, আমরা জানি সময়ের ক্ষুদ্রতম অংশকে। সময়ের এই রহস্যের গভীরে আমার মূঢ়তার অস্তিত্ব। দুই-ই অসীম। এই বোধটুকুই যা হাতের নাগালে পাওয়া সত্য।

116
Thu, 02/09/2023 - 23:41

ইউনিভার্সাল ভালোবাসার কোড বলে কিছু হয় না। ভালোবাসা ভীষণভাবেই আর পাঁচটা অনুভবী অস্তিত্বের মত আর্থসামাজিক আর ভৌগোলিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত। আমি 'ভালোবাসা' শব্দটা রোজকার ব্যবহারের অনুষঙ্গে বলছি। ভালোবাসা মানে যদি করুণা হয়, তবে সেটা ইউনিভার্সাল। সে অন্য প্রসঙ্গ।

ভালোবাসার ফাণ্ডামেন্টাল দিকটার অনুভব তাত্ত্বিকভাবে এক থাকলেও, বাস্তবিকভাবে তার প্রকাশ, তার আশা-আকাঙ্খা ভীষণভাবেই আর্থসামাজিক, ভৌগোলিক। সমাজ বদলায়। অর্থনৈতিক অবস্থা বদলায়। ভালোবাসার প্রকাশও বদলায়। প্রত্যাশাও বদলায়। তবু প্রতি বছর শুনি, আগে সব ভালো ছিল। দিন যত যাচ্ছে, খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা বড্ড শারীরিক হয়ে যাচ্ছে নাকি। কথাটা আংশিকভাবে সত্যি।

একজন মানুষ আরেকজন মানুষের উপর যখন আকর্ষণ অনুভব করছে, 'ভালোবাসা' অনুভব করছে, সেখানে কি শরীর নেই? আসলে এই শারীরিক, মানসিক, আত্মিক - এই বিভাজনগুলোই ভীষণ গোলমেলে। ওভাবে ভাষায় আলাদা করা যায়, বাস্তবিকভাবে অনুভবে আলাদা করা আদৌ কি সম্ভব?

একটা সহজ ইকুয়েশন অনেককে টানতে দেখেছি, 'ইনফ্যাচুয়েশান' মানে শারীরিক টান শুধু। আর 'আসল ভালোবাসা' হল ভীষণ পবিত্র। মানে শরীরগন্ধরহিত।

বাস্তবিক সত্যি কি তাই? তবে 'কম্প্যাটিবিলিটি' কথাটার মানে কি? আমার সঙ্গে যদি তোমার কম্প্যাটিবিলিটি ঠিক যায়, তবে আমার ইনফ্যাচুয়েশান থেকে দীর্ঘস্থায়ী ভালোবাসায় উন্নীত হতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু যদি কম্প্যাটিবিলিটি ঠিক না যায়, তবে একে ওকে তাকে, ভাগ্যকে, বিধাতাকে দোষারোপ করে, হাজার একটা তত্ত্ব খাঁড়া করে আসল সত্যিটাকে ঢাকার কোনো মানেই হয় না। যেখানে কম্প্যাটিবিলিটি ঠিক, সেখানে শরীর মন আত্মা মিলেমিশে সঠিক অনুপাতে দাঁড়ায়। আসলে আমার মধ্যে এইসব বিভাগগুলোই কাল্পনিক, ভাষা দিয়ে তৈরি করা যায়, কিন্তু বাস্তবে সবটা মিলিয়েই এক অখণ্ড, ইনডিভিসিবল অস্তিত্ব।

এখন এই কম্প্যাটিবিলিটি যাচাই না তো হাতের রেখা মিলিয়ে হয়, না তো মনোবিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী এই জাতীয় চরিত্রের সঙ্গে এই জাতীয় চরিত্র যায় ইত্যাদি তত্ত্বে করা যায়। জলে না নেমে সাঁতার শেখা যেমন যায় না, এ ক্ষেত্রেও তাই। ভুলের মাধ্যমে ঠিকটা চিনতে হয়। এখন যে সমাজ এই ভুল শোধরানোর সুযোগ যতটা দেয় সেখানে সম্পর্কের সত্য হয়ে ওঠা ততটা হয়, নইলে "আগে সব ভালো ছিল, এখন সব বাজে" এইসব বলে দিন কাটাতে হয়। মেয়েদের দারুণ একটা শিক্ষা দেওয়া হয় না, "যাই হোক মুখ বুজে সহ্য করে নিবি, মেয়েমানু্ষের অত চাহিদা, ইগো থাকতে নেই" ইত্যাদি। এখন দেওয়া হয় না এ ভুল যেন না করি, এখনও দেওয়া হয়, তবে কিছুটা আগের চাইতে কম। তবে ততটা কম নয় যতটাতে স্বস্তি পাওয়ার মত কিছু আছে।

এখন এই কম্প্যাটিবিলিটি কথাটাও ভীষণ বায়োলজিক্যাল। মানে শারীরিক আর আবেগগত, দুই দিক থেকেই এর একটা সামঞ্জস্য হয়। যদিও বাংলা সিনেমায় এক অভূতপূর্ব পরিচালক জুটির দেখা মিলেছে আজকাল, যাদের সিনেমায় সমকামী পুরুষের সঙ্গেও নাকি এক বিপরীতকামী নারীর সহাবস্থান হতে পারে দেখায় তারা, স্বামীর সব দুষ্টুমি "একটু সহ্য" করে নিলেই সুখের সংসার গড়া যায় দেখায় তারা। তারা যে করে হোক দর্শককে খানিক সুড়সুড়ি দিয়ে সব গিলিয়ে দিতে চায়।

সে কথা থাক। কথাটা হল, এই "কম্প্যাটিবিলিটি' শব্দটা জটিল। বেজায় জটিল। দুয়ে দুয়ে চার করার মত নয়। এর কাছাকাছি একটা শব্দ আছে, কম্প্রোমাইজ। তাই দিয়েই সংসারের সিংহভাগ চলছে। তবু আমাদের আকাঙ্খা থাকে সম্পূর্ণ কম্প্যাটিবিলিটির। মনে হয় আজ না হয় কাল আসবেই। কিন্তু সে আমাদের অতৃপ্ত আবেগের কল্পনা। কারণ যত বোধ পাকা হয়, তত বোঝা যায় সংসারে আমার সঙ্গে শতাংশে কম্প্যাটিবিল হওয়ার মত একজনই আছে, সে আমি। এ বোধ যত বাড়ে মানুষ তত একা হয়, তবে সে একাকীত্বের মধ্যে একটা বোঝাপড়া হয়ে যায় ইতিমধ্যে। কিন্তু এ অন্য প্রসঙ্গ।

কিন্তু তবু কম্প্যাটিবিলিটি শব্দটা বাস্তব। কেন বাস্তব? কেউ কারোর গোটাগুটি মনের মত হয় না। সেটাকে কম্প্যাটিবিলিটি বলেও না। সেটা একটা ইউটোপিয়ান ধারণা। কম্প্যাটিবিলিটি মানে যার সঙ্গে চলা যায়। সহাবস্থান দু:সহ হয়ে ওঠে না।

আজকাল নাকি মানুষ ভীষণ শরীরের কথা বলছে। ভীষণ কামগন্ধ নাকি সর্বত্র।

কথাটা অবশ্যই আংশিক সত্য। আগে ছিল না, এখন আছে, তা নয়। আগে বলার মত পরিবেশ ছিল না, এখন আছে। সেদিন শুনলাম এক মেয়েদের স্কুলে, একজন ইলেভেনের মেয়ে একজন নাইনের মেয়েকে প্রেমপত্র লিখেছে বলে তাকে সাসপেণ্ড করা হয়েছে। ঘটনাটা বিপরীত লিঙ্গে ঘটলে কি ঘটত? 'স্বাভাবিক' ঘটনা বলে হয় তো মেয়েটা এতবড় শাস্তি পেতো না, তার কাউকে ভালো লেগেছে বলে। এরপর থেকে মেয়েটা হয় তো এক 'বিশুদ্ধ ভালোবাসার' প্রকাশ ঘটাবে। নিজের স্বাভাবিক অনুভবকে চেপে সামাজিক অনুভবের অনুকরণ শিখে নেবে। এবং নিশ্চয়ই তার "শিক্ষা সম্পূর্ণ" হবে।

ভালোবাসা মানে কি শরীর? না। ভালোবাসা মানে শরীর সর্বস্বও নয়, ভালোবাসা মানে শরীর বিবর্জিতও নয়। দুই সত্য। প্রথম সত্যিটাকে দীর্ঘদিন ধরে অস্বীকার করা হয়েছিল বলে আজ সে তার শোধ তুলছে সে সুদে আসলে।

আমাদের শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে আমাদের পবিত্রতা বোধ অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে। এখনও আমরা বলি, শিশুর মত পবিত্র। আরে ভাই পিটুইটারি পুরো মাত্রায় সজাগ হয়নি বলেই সে না এরকম? আসলে পিটুইটারি জেগে উঠলে শুধু যে "কোন্ মহা রাক্ষসীরে দিয়েছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি" হয়, তা তো নয়! "অঙ্গে অঙ্গে বাঁশি" বাজালে শুধু কথা ছিল না, তার সঙ্গে অনেক দায়িত্ব বেড়ে যায় যে। সাইকেল শিখে নিজের বাড়ির উঠানে নিশ্চিন্তে চালানো আর ভরা বাজারের মধ্যে চালানোয় পার্থক্য তো আছেই না? সেই ম্যাচিউরিটি যদি ব্যক্তিত্ব না জন্মায় তবে ভালোবাসা শরীরে জাগলে অবশ্যই এক অশান্তি লাগে। যেখানে সমাজে আদর্শ ভালোবাসা নাকি হৃদয়ে জন্মিয়ে আর কোথায় চারায় না। চারালেই সে পাপ। এতো মহামুশকিল!

আজ সে বেড়া ভাঙছে। এখন প্লাবন হবেই। এত তাড়াতাড়ি সামঞ্জস্য চাইলে হবে কি করে? দাঁড়াও রে ভাই। অপেক্ষা করো। আগে থিতোক সব। আপসেই সব আবার সামঞ্জস্যে গিয়ে দাঁড়াবে। কোনো ধর্মনেতা, কোনো অনুশাসন, কোনো প্রবল আইন মানুষের প্রাণের গতিকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। যেখানেই সে তা করতে গেছে সেখানেই সে জন্ম দিয়েছে বিকৃতির। পার্ভাশানের।

আধুনিক প্রজন্মের ভালোবাসার প্রকাশে শরীরের ভাষা জাগছে। জাগুক। নিজেকে স্পষ্ট করে চিনুক। বুঝুক। তাকে সঠিক জিনিসটা না শিখিয়ে কিছু প্রাচীন নীতিমালা শিখিয়ে লাভ নেই। বরং তাকে বিজ্ঞানসম্মত সুরক্ষিত, সুস্থ যৌনশিক্ষা দেওয়া হোক। এক্সপ্লয়টেশান শুধু তো শরীরের হয় না, ইমোশান নিয়েও হয়। তাই সব দিক থেকে নিজেকে একজন কিভাবে সুরক্ষিত রাখবে, সুস্থ রাখবে সে শিক্ষাই দেওয়া হোক। যৌনরোগ ইত্যাদি সম্বন্ধে বলা হোক। জননগতস্বাস্থ্য বলতে কি বোঝায় সে সব জানানো হোক।

নিজেকে না চিনলে নিজের অধিকার, সম্ভাবনা, পোটেনশিয়ালিটি সম্বন্ধে জ্ঞান অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। রাতে পর্ণসাইটের খদ্দের আর দিনে নীতিনিপুণ সমাজরক্ষক ভণ্ডদের সংখ্যা যত কমে তত মঙ্গল। সত্যিটা যত স্পষ্ট, স্বচ্ছভাবে সামনে আসে সে-ই মঙ্গল। প্রত্যেককে নিজেকে ঠিক করে নেওয়ার স্বাধীনতা থাক সে কার সঙ্গে কতটা কম্প্যাটেবল। তাকে হাজারবার ভুল করার স্বাধীনতা দেওয়া থাক। তবে যদি একটা সংবেদনশীল, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সমাজ হয়। শুধু নীতিপাঠ দিয়ে, সংস্কারের গল্প শুনিয়ে কার্পেটের নীচে ধুলোই জমানো হয়। আর কিছু হয় না।

117
Tue, 02/07/2023 - 20:31

যখন নিজের ক্ষুদ্র বৃত্তে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে নিয়ে লড়েছি, লড়ে যাচ্ছি, সে অনুভব একরকম। আর এই যে এক লহমায় হাজার হাজার মানুষের জীবন শেষ হয়ে যাওয়া, সে আর এক রকমের। আবার মনে করিয়ে দেওয়া, কি বালির স্তূপের উপর ঘর বানিয়ে আমাদের 'চিরকালের সংসার' বানিয়ে আছি।

যে মৃত্যু তিলে তিলে চোখের সামনে স্বজনের উপর অধিকার বসায়, তাকে সহ্য করার যন্ত্রণা, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস --- ভাষাতীত। ক্রমশ মানুষটার চেহারা বদলিয়ে যায়, তারপর তার ব্যক্তিত্ব। ক্রমে সে প্রায় যেন অন্য দুনিয়ার মানুষ হতে শুরু করে। একটা সময়ে তার নিজের বানানো সংসারকেই, নিজের মানুষদের চিনতে পারে না। আমার চেনা জগতে সে অচৈতন্য। জানি না কোন জগতে সে জেগে উঠছে। চেতনার উল্টোপিঠ বলে হয় কি কিছু? জানি না। সে একদিন চলে যায়। পাশের মানুষগুলো? এতদিনের লড়াইয়ের পর? তারা ক্লান্ত, অবসন্ন। সে দীর্ঘ লড়াইয়ের স্মৃতি কোনোদিন তাদের গভীরের মন থেকে মুছে যায় না। বাইরের মন স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে। কিন্তু একটু নাড়া পড়লেই সে গভীরের মনে ব্যথার পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। সে ঘুমায়নি। পাশের মানুষগুলো বদলে যায়, যারা চলে যাওয়া মানুষটার খুব কাছের ছিল।

আর এই অতর্কিতে এত মানুষের চলে যাওয়ার স্মৃতি? সেও কি যায়?

বিশ্বাসের নিজস্ব রাজত্ব থাকে মনের উপর। সে সেই রাজত্বের উপর শাসন চালায়, কর আদায় করে, জীবনকে এক পথে চালিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করে কোনো ঘটনা যখন তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসে, তখন সে প্রথমে তাকে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে অস্বীকার করে। ক্রমে ধীরে ধীরে রাজ্য ছেড়ে দেয়। অভিমানে। আবার দিন যায়, আবার এক বিশ্বাস আসে। জমিটা আলগা করে ধরে। জানে যে কোনোদিন ছেড়ে যেতে হবে। মানুষের বয়েস যত বাড়ে, তার বিশ্বাস তত কমে, অভিজ্ঞতা তত বাড়ে। কোন বিশ্বাসকে আঁকড়ে বাঁচব তবে? কোনো বিশ্বাসই নেই।

আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কি! শেষ শ্বাসটুকু পড়া অবধি চ্যালেঞ্জ। তাকে স্বীকার করি, চাই না করি। সে আছেই। হয় আমি তাকে অস্বীকার করছি, নয় তাকে স্বীকার করছি। যত তাড়াতাড়ি স্বীকার করি, স্বপ্নের ঘোর তত তাড়াতাড়ি কাটে। বিশ্বাস যদি আড়াল হয়, তবে এমন কোনো বিশ্বাস নেই। বিশ্বাস যদি নম্রতা হয়, তবে আছে, সে আশ্রয় হিসাবে আছে। অবশ্যম্ভাবী চ্যালেঞ্জকে মাথা পেতে নেওয়ার নম্রতা। নম্রতা অর্থে দুর্বলতা নয়। দুর্বল নম্র হয় না, নম্রতার ভান করে। নম্রতা বীরের শৌর্য। আন্তরিকতা তার অস্ত্র। তার রণকৌশল। আন্তরিক না হলে কোনো চ্যালেঞ্জকেই তার সত্যিকারের রূপে দেখতে পাব না। আর নম্র না হলে, কোনো চ্যালেঞ্জকেই সম্পূর্ণভাবে স্বীকার করতে পারব না। চালাকি আর ঔদ্ধত্য আসলে চ্যালেঞ্জের আগেই হেরে যাওয়া। বাইরে তার যতই আস্ফালন থাকুক না কেন।

রবীন্দ্রনাথের অনেক গানে আছে এই চ্যালেঞ্জের কথা। একটা গান তার মধ্যে বারবার মনে আসে,

ও নিঠুর,        আরো কি বাণ তোমার তূণে আছে?

                   তুমি    মর্মে আমায় মারবে হিয়ার কাছে ॥

আমি   পালিয়ে থাকি, মুদি আঁখি,   আঁচল দিয়ে মুখ যে ঢাকি গো--

                             কোথাও কিছু আঘাত লাগে পাছে ॥

                   আমি    মারকে তোমার ভয় করেছি ব'লে

                             তাই তো এমন হৃদয় ওঠে জ্বলে।

যে দিন সে ভয় ঘুচে যাবে   সে দিন তোমার বাণ ফুরাবে গো--

                             মরণকে প্রাণ বরণ করে বাঁচে ॥

 

আত্মশুদ্ধির রাস্তা বলতে গিয়ে গীতা তিনটে শব্দ উচ্চারণ করে --- আসক্তি, ভয় আর ক্রোধ। এই তিনটে থেকে মুক্ত হতে না পারলে বারবার রণক্ষেত্রে হেরে নাস্তানাবুদ হতে হবে। ভয় আর রাগ যে ভীষণ প্রবল, সে তো বুঝি। কিন্তু আসক্তি? তাকে ছাড়িয়ে যাব কি করে? মহাভারতেই এর উত্তর। শুধু যে মহাভারত কেন, যে কোনো সার্থক উপন্যাসেই তার বর্ণনা। হাঁসুলি বাঁকের উপকথা, পুতুল নাচের ইতিকথা থেকে শুরু করে নি:সঙ্গতার শতবর্ষ, প্লেগ, ফল (পতন), হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস --- সব সব। এই আসক্তি থেকে নিরাসক্তির ধারাভাষ্য। আঘাতে আঘাতে নিজেকে চেনার গল্প। নিজেকে হারানোর আখ্যান। সব আছে। জীবনের মুখোমুখি না হয়ে ত্রাণের পথ আছে নাকি? নেই। মুখোমুখি হতে পারলে জীবন একটাই উপহার দেয়, যার কোনো সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমি জানি না, সেটা হল - Wit - বাংলা করলে যা হয় তো হবে 'বিদগ্ধ প্রজ্ঞা'। সেকি ফাঁকি দিয়ে পাওয়া যাবে, না সেকেন্ড হ্যাণ্ড পাওয়া যাবে? সব সহ্য করেই পেতে হবে। অবশেষে ঝলসে গিয়ে। বাইরের আঘাতে জর্জরিত হতে হতে ক্রমশঃ আরও নিজের কেন্দ্রের দিকে যাওয়া --- এই তো আসক্তি থেকে মুক্তির পথ। যে পথ ফকির দেখিয়েছিল অমলকে, ক্রৌঞ্চদ্বীপ যাওয়ার পথ, যেখানে সবকিছু হালকা হয়ে যায় --- ডাকঘরে। ভাগবতে আছে, শুকদেব মৃত্যুপথযাত্রী পরীক্ষিৎকে জীবনের গভীরতম সত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ভক্তির মাধুর্যে। এ যুগে ডাকঘর সেই ভাগবত, অমল পরীক্ষিৎ, ফকির শুকদেব।

 

 

 

118
Thu, 02/02/2023 - 00:10

রামকৃষ্ণদেব কোনো বিশেষ ধ্যানকক্ষ চাইলেন না। কিম্বা মথুরকে বললেন না, 'ওহে সেজোবাবু, হরিদ্বারে কি হিমালয়ের গুহায় আমার জন্য একটা সাধন কুটি বানিয়ে দাও তো হে! আমি ঈশ্বর চিন্তা করব। মায়ের নামগান করব।'

সেজোবাবু, ওরফে মথুর কি না করতেন? না। অর্থ, ইচ্ছা, শ্রদ্ধাভক্তি কিছুরই কম ছিল মথুরের। হয়েই যেতে পারত। কিন্তু হল না, কারণ ঠাকুর চাইলেন না।

দক্ষিণেশ্বর। শ্যামপুকুরবাটি। কাশীপুর বাগানবাটি। তিনটিই কলকাতায়। তিনটিতেই নিজের ইচ্ছায় এলেন না। দক্ষিণেশ্বরে এলেন দাদার আদেশে, বা ইচ্ছায়। বাকিদুটোতে ভক্তদের ইচ্ছায়, চিকিৎসার সুবিধা হবে বলে।

দক্ষিণেশ্বরের ঘর, বাঁধানো উঠান, গঙ্গার ধার, আর মাঝে মাঝে গিরিশ ঘোষের বাড়ি, কি বলরাম বসু'র বাড়ি, কি কোনো ভক্তের বাড়ি। কেন? কি চাইছেন? মানুষের সঙ্গ। কথা, গান, নাচ। আনন্দ। খাওয়ার সুখ না, পরার সুখ না, বিলাসিতা না। কিন্তু চাই কথার সুখ। গানের সুখ। নাচের সুখ। আনন্দ দিচ্ছেন, অকাতরে বিলিয়ে যাচ্ছেন।

এত আনন্দের উৎস কি? কেন তুমি হাঁপিয়ে উঠছ না? কেন তুমি পাহাড়ে, জঙ্গলে, সমুদ্রের ধারে যেতে চাইছ না? তোমার চারধারে যারা আছে সবাই কি তোমার অনুগত? কেউ কি কষ্ট দিচ্ছে না? মনস্তাপের কারণ হচ্ছে না? হচ্ছে তো। কষ্ট দিচ্ছে তো। তবু এতো আনন্দের উৎস কোথায়? সঙ্গ। মানুষের সঙ্গ।

যে মানুষ ত্যাগের কথা বলে, সে মানুষ কলকাতায় পড়ে থাকে কেন? ঠাকুর বলছেন, "বজ্জাৎ আমি-কে ত্যাগ করো।"। যে আমি বলে, "আমায় জানে না!?".... "এত বড় স্পর্ধা!"

কিন্তু এ তো গেল উপদেশের কথা। সে আছে। কিন্তু তোমার তো ওসবের বালাই নেই। তোমার তো 'বজ্জাৎ আমি' নেই। তো তোমার এতসবের মধ্যে থাকার কি দরকার? তোমার তো জীবনের লক্ষ্য পূরণ হয়ে গেছে। এবার? যাও সে-ই মহৎ অনুভব নিয়ে হিমালয়ে। যাও, গিয়ে বোসো একটা আশ্রম বানিয়ে। যাও, তা না, গলায় ক্যান্সার, শরীরে ক'টা হাড় বই কিছু নেই, একজন নতুন মানুষ এসেছে, তাকেও উপদেশ দেওয়া হচ্ছে, আবার বলা হচ্ছে এখানে মাঝে মাঝে এসো, এখানে প্যালা পড়ে না! মানে পয়সা লাগে না আর কি! কেন, সে তো আর দিগ্বিজয়ী নরেন হবে না, নিতান্ত ছা-পোষা লোক। তার কি হল না হল তোমার কি দরকার? তোমার লোকের দোরে দোরে ঘোরার কি দরকার? তুমি তো দেখেছ, কিভাবে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, সময় মেনে, নানা নিয়ম-কানুন মেনে ধর্ম প্রচার করা হয়। লেকচার দেওয়া হয়। তো নিজের জন্য একটা অমন ব্যবস্থা করে নিলেই হত!

কিন্তু এর কোনোটাই রামকৃষ্ণদেব চাইলেন না। না তীর্থ, না শান্তি, না মানযশ, না খ্যাতি।

বার্ট্রান্ড রাসেল একদম শেষের দিকে একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "কাইন্ডনেস" না থাকলে কোনো বড় মাপের দর্শন জন্মায় না। দরদী না হলে মানবিক সত্যের নাগাল পাওয়া যায় না। রামকৃষ্ণদেবের আধ্যাত্মিক বিলাসিতা ছিল না বলেই হিমালয়ের গুহায় চলে যেতে চাইলেন না। অবশ্য যারা গেলেন তাদের নিন্দাও করলেন না, একটু ঠাট্টা করলেন। অনেকে কুয়ো খুঁড়ে কোদাল-টোদাল কুয়োয় ফেলে দেয়….. কেউ কেউ আম খেয়ে মুখ মুছে ফেলে…. ইত্যাদি এই সব বলে।

মানুষে মানুষে দিন যত বাড়ছে সংঘাত তত বাড়ছে। কেউ কাউকে যেন একটু থেকে একটু হলেই সহ্য করতে পারছে না। ক্রমশ চক্ষুলজ্জা অবধি ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি নিজেকেও সহ্য করে উঠতে পারছে না। আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে কি এমন পার্থক্য ছিল। সুনীল গাঙ্গুলির লেখায় সেও তো পড়েছি আমরা। রামকৃষ্ণদেব, মা সারদা ছবি, বাণীর থেকে অনেক বড় একটা দিক দেখিয়ে গেছেন। মানুষের সঙ্গে কিভাবে থাকতে হবে শিখিয়ে গেছেন। সারদাদেবীর জীবনে সে উদাহরণ ছত্রে ছত্রে। জীবনের প্রতিটা দিনেই প্রায়। সে কলকাতার শিক্ষিত শহুরে লোক, কি জয়রামবাটির তথাকথিত অশিক্ষিত লোক। তিনিও তাঁর দীর্ঘ জীবনে মানুষের থেকে ছুটি চাইলেন না। এক এক সময় হাঁপিয়ে ওঠেননি যে তা নয়। "তামাক কাটার" মত করে কাটলেও আর ফিরব না, তাও বলছেন। কিন্তু বাস্তবিক ছেড়ে যাননি। চলে যাননি।

মানুষে মানুষে সহাবস্থানের সূত্রকে, ভালোবাসার সূত্রকে, সহ্য করার, মানিয়ে নেওয়ার সূত্রকে তাঁরা ঈশ্বর বলেছেন। জীবন্ত ঈশ্বর। যে বাঁধনে সব বাঁধা। যে সূত্রে সবটা গাঁথা। আমার 'আমি'টাও বাঁধা। শুধু বজ্জাৎ আমিটা সেটা মানতে চায় না, সে নিজে সুতো হতে চায়, নিজেকে কেন্দ্র করে জগতকে ঘোরাতে চায়। ওটিই ভুল।

ঠাকুরের নশ্বর শরীর দাহ হল কলকাতায়। মায়ের হল হাওড়ায় বেলুড়ে। গঙ্গার এদিক ওদিক। পাহাড়, জঙ্গল, সমুদ্র না, দুটো জীবন। এইখানেই, এই মানুষের মধ্যেই থেকে বুঝিয়ে গেলেন, চাইলে এইখানে থেকেও হয়। শুধু খুঁজতে হবে নতুন করে, তোমার সঙ্গে আমার বাঁধনটা কিসে? টাকার দরকারে, শরীরের দরকারে? নাকি সেসব ছাপিয়েও আরো কিছু আছে?

মা বললেন, দরদ। ঠাকুর বললেন, মা।

119
Fri, 01/20/2023 - 23:56

হু এর সংজ্ঞায়, জননগত স্বাস্থ্য বলতে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক সুস্থতা বোঝায়। সমাজে যারা আর্থিকভাবে, শিক্ষাগত দিক থেকে পিছিয়ে তারাও যেন সঠিকভাবে জননগত স্বাস্থ্যের পরিষেবা পায় সেটা দেখার।

কিন্তু এই সামাজিক দিকটাকে ভাবার জন্য অনেকগুলো দিক আছে। তার একটা প্রধান হল ধর্মীয় সংস্কার। মানুষের মধ্যে একটা ধর্মীয় সংস্কারজাত শুদ্ধতার বোধ আছে। যেটা হাইজিনগত নয়। মনের ভাবনাগত। সেই ভাবনার একটা দিক জন্ম দেয় ভায়োলেন্সের। কাজে ভায়োলেন্স পরে হয়, আগে হয় ভাবনায় ভায়োলেন্স। ভায়োলেন্স মূলক কাজকে শাস্তি দেওয়া হয় ঠিকই অনেক ক্ষেত্রেই, কিন্তু ভাবনাকে পাল্টাতে পারে সঠিক শিক্ষা।

সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের শুরু হয় পুরুষের অবচেতনে লালিত, আমি উন্নত, এ ভাবনা থেকে। সমাজের ইতিহাসে মেয়েদের উপর সেক্সুয়াল ভায়োলেন্সের তথ্য ঘাঁটলেই পাওয়া যায়।

মেয়ে মানেই অশুদ্ধ। নরকের দ্বার। এসব ভাবনা নানাভাবে আছেই। এখানে একটা জিনিস খেয়াল করার, ধর্মীয় শুদ্ধতার ভাবনা একটা ক্ষমতায়নের উপায়। আমি তোমার থেকে বেশি শুদ্ধ মানে, আমি জগত স্রষ্টা ও পালকের বেশি কাছাকাছি। ফলে আমি বেশি ক্ষমতাশীল। হাইজিনের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক নেই, যোগ্যতা অর্জনের সম্পর্ক আছে। কিন্তু ধর্মীয় শুদ্ধতা বোধের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। প্রভাবের সম্পর্ক আছে।

হাইজিন মানে যোগ্যতার সম্পর্ক অর্থে, একটা সদ্যজাত বাচ্চাকে ছোঁয়ার অধিকার তখনই জন্মায় যখন আমি আমার হাতটা সাবান দিয়ে ধুয়ে নিয়েছি। এখানে আরেকটা জিনিস খেয়াল করার যে এই যোগ্যতা অর্জন সার্বিকভাবে মঙ্গলের। কোনো মানুষ, পরিবার, পাড়া যদি হাইজিন পালন করে তবে তা সবার জন্য ভালো।

কিন্তু ধর্মীয় শুদ্ধতার সুবিধাটা ব্যক্তিগত। আমি যত শুদ্ধতা অর্জন করছি, আমি তত স্রষ্টার কাছাকাছি যাচ্ছি। অর্থাৎ আমি বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হচ্ছি।

ধর্মের ইতিহাসে মেয়েদের অশুদ্ধ করে দাগিয়ে দেওয়ার কারণ এটাই, তাদের ক্ষমতাকে কমিয়ে আনা। তাদের তাই নিজের শুদ্ধতাকে কায়েম রাখতে এত চেষ্টা। এবং এই শুদ্ধতার ধারণার বীজ ওই যৌনতার সঙ্গে সম্পর্কিত। ধর্ষণ তাই এক আদিম অস্ত্র। সেটা যতটা না শারীরিক ভায়োলেন্স, তার থেকে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে ওই শুদ্ধতার বোধকে ধুলোয় মিশিয়ে একজন মেয়েকে সম্পূর্ণ অসহায় করে তুলতে।

দিন বদলিয়েছে। কিন্তু মনের গোপনে এই ধর্মীয় শুদ্ধতার প্রতি আসক্তিটা যায়নি। যার মূল যৌন জীবনের সঙ্গেই। আজও অনেক মানসিক বিকার এই অযৌক্তিক পাপবোধ তথা অশুদ্ধবোধ থেকে জন্মায়। যার বাইরের প্রকাশ কোনো না কোনোভাবে ভায়োলেন্স। ধর্মীয় অনেক আচারও এই ভায়োলেন্সরই নামান্তর। মোড়কটা শুদ্ধতার। এবং দেখা যায় তার বেশিরভাগই মেয়েদের জন্য প্রযোজ্য। অনেক প্রকার OCD এই ধর্মীয় শুদ্ধতার প্রতি অযৌক্তিক আসক্তি থেকে জন্মায়। প্রথমে জন্মায় অযৌক্তিক ভয়। ক্রমে সেই ভয় ডালপালা মেলে হয় ভায়োলেন্স। ভয় নিজেকে রক্ষা করতে সব সময়ই ভায়োলেন্সকে ব্যবহার করে। সে কুকুর হোক চাই মানুষ। ভয় আর ভায়োলেন্সের যোগাযোগ আদিম।

পুরুষ পেশীর জোরে যৌনতায় প্রিভিলেজড। তাই শুদ্ধতাবোধেও প্রভিলেজড। সে নির্ধারণ করে দেয় শুদ্ধতার মাপকাঠি। যা ক্ষমতায়নের আরেকটা অস্ত্র। আপাতভাবে যা সফট অস্ত্র।

আজ এই যৌনতার ভায়োলেন্স আরেক দিকে বইছে। আমরা বেশ কিছু দশক ধরে সবাই জানতে পারছি মানুষের যৌনতা বৈচিত্র্যময়। এবং সে সবকটাই স্বাভাবিক ও সুস্থ। আমরা এখন এগুলোকে হেনস্থা করার নানা উপায় খুঁজছি।

দুদিন আগে টাইমস অব ইন্ডিয়ায় পড়লাম, চলন্ত ট্রেনে এক মহিলার প্রসবযন্ত্রণা উঠেছিল। কোনো "সাধারাণ" মানুষ এগিয়ে আসেননি। এসেছেন "ট্রান্সজেন্ডার" মানুষেরা। এবং তারা প্রসব করিয়ে দেওয়ার পর কিছু আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব দিয়েছিল, সেটাও খুব নম্রভাবে প্রত্যাখান করেন সদ্যজাত বাচ্চাটির বাবা।

খবরটার মধ্যে ওই "আমরা ওরা" ভাগটা স্পষ্ট ছিল। ভাষায়। মানুষের দুটো শরীর হয়। চামড়া ঢাকা রক্তমাংসের শরীর আর ভাষার শরীর। আমাদের ভাষার ভায়োলেন্সকে ঢাকা খুব শক্ত। কারণ আমাদের ভাবনার ভাষায় ভায়োলেন্স। আমরা জানি আমরা শুদ্ধ, ওরা অশুদ্ধ। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এখানে খেলাটা বদলে গেল। শুদ্ধতার দ্বন্দ্বটা নারী-পুরুষ না হয়ে মেজরিটি বনাম মাইনরিটি হয়ে গেল। এবং সেই এক মূল, যৌনতা। তাদের অন্য রকম। তাই তারা অশুদ্ধ। "ওদের হাতে খাওয়া যায়? ওদের পাশে বসে খাওয়া যায়".... ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। সংশয়। আপাত ভাবে নিরীহ। কিন্তু ভীষণ সাংঘাতিক।

অনেক লিখে ফেললাম। আবারও বলি, এই ধর্মীয় শুদ্ধতাবোধটা আসলে যৌনতার বোধজাত। পুরুষের পেশীর প্রিভিলেজে কখনও পুরুষ বেশি শুদ্ধ, কখনও মেজরিটির জোরে মেজরিটি বেশি শুদ্ধ, মাইনরিটি অশুদ্ধ। এবং আবারও বলি, এই শুদ্ধতা ক্ষমতায়নের একটা অস্ত্র। সামাজিক ক্ষমতায়ন। পশুর যেমন আছে জঙ্গল, আমাদের তেমন আছে সমাজ। লড়াই তো চলবেই দখলের। তার অস্ত্র এই "হোলিয়ার দ্যন দাও" এর লড়াই।

এই সম্বন্ধে সচেতন হওয়াই এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রাস্তা। মনে রাখার আছে, আমাদের ভাবনায় ভায়োলেন্স আছে বলেই আমাদের কাজে ভায়োলেন্স আছে। আমাদের ভাবনা বদলাবে শুদ্ধবুদ্ধি আর সৎসাহসের প্রয়োগে। একদম গ্রাউণ্ড লেভেল থেকে।

শেষে একটা কথা দিয়ে শেষ করি। আমি অনেকবার ধর্ম শব্দটা লিখলাম। এখানে অবশ্যই তা প্রচলিত অর্থে। একটা প্রাতিষ্ঠানিক আচারবিচার অর্থে। ধর্ম যেখানে জাস্টিস আর সৎ জীবনের প্রেরণাদায়ক সেখানে সে আলাদা। কিন্তু সে অন্য আলোচনা। সেখানে সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে দেখতে শেখাটাই মূল সত্য।

120
Fri, 01/13/2023 - 00:30

"Without courage, we cannot practice any other virtue with consistency. We can't be kind, true, merciful, generous, or honest."

কথাটা স্বামীজির নয়। মায়া অ্যাঞ্জেলিউ-এর।

এ কথাটা সবাই বলেছেন, জীবনে কোনো না কোনো একটা সময়ে। সাহসের কথা। নির্ভীকতার কথা। অভয়ের কথা।

প্রাণে ভালোবাসা না জন্মালে কেউ অকুতোভয় হয় কি?

ত্যাগ করতে না শিখে কে কবে ভালোবাসতে শিখল? আগে তুমি, আমি পরে। এর বাইরে ভালোবাসা বলে কিছু হয় নাকি?

ভালোবাসা আর ত্যাগ, একই কয়েনের এপিঠ, ওপিঠ। বাকি তো ব্যবসা। লাভ লোকসানের হিসাব।

বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস যখন গাইছেন, "মোর মনে হেন করে/ কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া/ আনল ভেজাই ঘরে"। এ তো সেই ত্যাগের কথা। চরম ত্যাগের কথাও বলছেন অনায়াসে, "বঁধু যদি তুমি মোরে নিদারুণ হও/ মরিব তোমার আগে, দাঁড়াইয়া রও।"

স্বামীজির ত্যাগের আহ্বান এই ত্যাগের কথা বলে। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যের প্রাণ নেওয়া না। আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকায়। অন্যের প্রাণের বিনিময়েও না। এ ত্যাগ শুদ্ধ ভালোবাসার ত্যাগ। এ ভালোবাসা মানেই ত্যাগ। স্বামীজির এ ভালোবাসা, এ ত্যাগের শিক্ষা বৈষ্ণব পদকর্তাদের অনুভবের সঙ্গে এক। স্বামীজি আর বৈষ্ণব পদাবলী, শুনলে প্রথমেই মনে হয়, ধুস, তাও কি হয়? স্বামীজির জীবনকে গভীরভাবে দেখলে বোঝা যায়, দুই-ই এক। নইলে কীর্তন গাইতে গিয়ে অমন দুচোখের ধারায় ভেসে যায় কেউ? গোপীদের কথা, রাধার কথা বলতে ওভাবে গলা বুজে আসে? স্বামীজির লেখায় ছড়িয়েছিটিয়ে আছে এ সব লেখা। তবে তিনি অগভীর ভাবাবেগের তীব্র নিন্দা করেছেন। ওগুলো মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। রবীন্দ্রনাথের "ভাবুকতা ও পবিত্রতা" প্রবন্ধে এ নিয়ে বিশদে ব্যাখ্যা আছে। তখন এক রকমের ভাবলোলুপতা জন্মায়। সে হীন করে মানুষকে। স্বামীজি যখন চিঠিতে লিখছেন, সব ছাড়তে পারো দাদা শান্তির আশা ছাড়তে পারো না…. তখন বোঝা যায় মানুষটাকে ভালোবাসায় পেয়েছে। যে ভালোবাসে সে নিজের শান্তি চায় না, সুখ চায় না। সে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসাকে জয়ী করতে চায়। "মরণেরে করে চির জীবন নির্ভর"... রবীন্দ্রনাথ।

বড় বড় বাণী নয়। স্বামীজির জীবনী মানেই ভালোবাসার কথা। মানুষটা শুধু ভালোবাসার কথা বলতে চাইলেন। তাঁর সব তত্ত্ব ভালোবাসার উপর আধারিত। সারা জীবনের অনুভবের সার যে কবিতাটা, সে-ই কবিতাটাও আমার কাছে বৈষ্ণব পদাবলীর চাইতে কম কিছু নয়,

"ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;

দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম—অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।

রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;

হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।

ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?

দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।

অনন্তের তুমি অধিকারী প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,

‘দাও’, ‘দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।

ব্রহ্ম হতে কীটপরমাণূ সর্বভূতে সেই প্রেমময়।

মন প্রাণ শরীর অর্পণ করো সখে, এ সবার পায়।

বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?

জীবনে প্রেম করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"

 

সেদিন গীতায় কৃষ্ণ যাকে শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তিনি তাঁকে বন্ধু জেনে শিক্ষা দিচ্ছিলেন। উদ্ধব ও অর্জুন দুজনেই ছিলেন বন্ধু। তাই দুটি গীতাতেই বন্ধুর উদ্দেশ্যে বাণী।

এ যুগে স্বামীজি সেই একই সম্বোধনকে নিলেন, "সখা"। সখার প্রতি - কবিতাটার ছত্রে ছত্রে তাই দরদ, আলো। গোটা স্বামীজির হৃদয় এই একটি কবিতায়। আলো। প্রেম। ত্যাগ। সবটাই একটাই কথা। শুধু জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই না, ত্যাগের বিহনেও প্রেম নেই। ত্যাগহীন প্রেম বিকার আনে মনে। সে বড় বালাই। স্বামীজি সাবধান করেছেন।

প্রণাম।

121
Fri, 01/13/2023 - 00:18

আত্মহত্যার খবর আচমকা পাওয়া যায়। কিন্তু আত্মহত্যার প্রস্তুতি?

কারণ তো অনেক জানা যায়। পরে। আর্থিক অনটন। অবসাদ। পারিবারিক অশান্তি। ব্যর্থতা। আরো আরো নিশ্চয়ই অনেক আছে।

একজন মানুষ হঠাৎ করে আর বাঁচতে চায় না। হতে পারে একটা প্রতিবাদ করে যায় এইভাবে। হতে পারে অভিমানকে জানিয়ে দিয়ে যায়। কিন্তু যে মানুষ জানে সে চলে গেলে কারোর কোথাও কোনো আঘাত লাগবে না, সে হয় তো আত্মহত্যা করতে চায় না। আত্মহত্যা করতে গেলেও হয় তো মনুষ্যত্বের উপর একটু বিশ্বাস থাকা চাই। নইলে কিভাবে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথা ভাবে সে? সে কোথাও একটা নিশ্চয়ই বিশ্বাস করে তার চলে যাওয়াতে সমাজের বিবেকে কোথাও হয় তো আঘাত লাগবে? পরিবার পরিজন কোথাও হয় তো বুঝবে সে সত্যিই সমস্যায় ছিল। আগে বারবার ইঙ্গিত দিলেও যেটা কেউ বুঝছিল না। যদি না সে আত্মহত্যা করে শারীরিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।

অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ আত্মহত্যা করেছেন। কেউ শারীরিক রোগের জন্য। কেউ অবসাদে।

কারণ যাই হোক, একজন মানুষ কেন নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়? নিজের ক্ষমতা, সমাজের সহমর্মিতা সব কিছুর উপর বিশ্বাস চলে গেলেই তো। এমনকি ঈশ্বরেও। তার যখন মনে হয়, আদতে ঈশ্বর বলে কেউ একজন থাকলেও তিনি তার সুখ-দুঃখ নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। তখনই কি?

নিজের ক্ষমতা নেই। কারোর সাহায্য নেওয়ার রুচি নেই। কোনোদিকে কোনো আশা নেই। সে মানুষটা কোথায় যাবে?

তার চাইতে কি ঘ্যানঘ্যানে মানুষ ভালো? তার চাইতে কি সে ভালো যে বারবার নিজের অক্ষমতার জন্য হাত পাতে? মনের কষ্ট, অশান্তি শুনতে না চাইলেও রাতদিন প্যানপ্যান করে বলতেই থাকে? বুকের মধ্যে অভিমান জমিয়ে রাখা কি ভালো? নাকি সব অভিমান জলাঞ্জলি দিয়ে সাহায্য চাওয়াই ভালো?

যদি আর্থিক অনটন, জীবনে অস্বাচ্ছন্দ্য আত্মহত্যার কারণ হত তবে দেশে গরীবী হটাও স্লোগানের দরকার হত না। সব আপনিই হটে যেত। দেশের জনসংখ্যা নিয়েও ভাবতে হত না। গণ আত্মহত্যা হত। মন্দিরের বাইরে যে মানুষেরা হাত পেতে বসে থাকে তাদের চাইতে বড় বস্তুবাদী, নাস্তিক কে আছে? তার জন্য অক্সফোর্ড, হাভার্ডে গিয়ে দর্শন ইত্যাদি পড়ার দরকার হয়নি তাদের। তারা জানে হাত কোথায় পাততে হবে। মন্দিরের দরজায় মানুষ এসেছে মানেই সে দুর্বল হয়েছে কোনো না কোনো ভাবে। কিছু না কিছু দেবেই। সব মানুষের মধ্যেই অন্তঃশীলা অপরাধবোধের স্রোত থাকে। গণচেতনা মানেই তো অন্তঃশীলা অপরাধবোধ। নইলে এত সহজে অন্যকে বঞ্চিত, বুভুক্ষু জেনেও নিজেকে এত আরামে রাখা যায়? ভিখারি এ মনস্তত্ত্ব জানে। আর জানে বলেই মন্দিরের সামনে ওইভাবে অন্তঃশীলা অপরাধের স্রোতকে আঘাত করে। ভিতরে ভিতরে সবাই কমবেশি ঝলসে উঠি। হয় খুব জোর করে এড়িয়ে যাই। নইলে কম্প্রোমাইজ করে কিছু পয়সা দিয়ে নিজেকে রক্ষা করি।

ভিখারি এ মনস্তত্ত্ব জানে বলেই শপিংমলের বাইরে, মাল্টিপ্লেক্সের বাইরে ভিড় জমায় না। একজন দুজন থাকতে পারে। কিন্তু লাইন ধরে বসে থাকে না। কারণ ওখানে অন্তঃশীলা নিজেকে গুটিয়ে রাখে। ওটা মোটা দাগের অহংকারের চরে খাওয়ার জায়গা। ভিখারিকে এ মনস্তত্ত্ব বুঝতে ফ্রয়েড, ইয়ুং পড়তে হয় না। প্রকৃতিই সব শিখিয়ে দেয়। প্রাণে প্রাণে এ সত্য অনুভব হয়।

সমাজে এক ধরণের শিক্ষা পেতে পেতে জগতের বাস্তুতন্ত্রটা ভুলে যেতে হয় আসলে। সবাই আজন্ম শেখাচ্ছে আত্মনির্ভরশীল হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, নিজেকে নিয়ে নিজে গর্বিত হও ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সব কথা গাঁঠরিতে বেঁধে যাত্রা শুরু তো হল। দেখা গেল দিন যত যেতে লাগল গাঁঠরির বাঁধন আলগা হতে শুরু করল। এক একটা বিপর্যয় এক্কেবারে পঙ্গু করে দিতে শুরু করল। সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে। ভাগ্য এমন বিরূপ হল সোনাতে হাত দিলে সে লোহা হয়ে যায়। নিজের নানা অক্ষমতা জন্মাতে শুরু করল। মানসিক, শারীরিক, আর্থিক, পারিবারিক। জর্জরিত অবস্থা। কোনোভাবে ঠেকানো যাচ্ছে না। শুধু সাক্ষী থেকে যেতে হচ্ছে। এদিকে নিজের মান, নিজের অহংকার ডানায় পালকের এই দুর্দশা দেখে এত অস্থির হয়ে উঠছে যে নিজেকে স্থির রেখে ভাবাও দায়। সে খালি বলছে আমাকে যেভাবে হোক ওড়ার ব্যবস্থা করে দাও। আমি কি অমুক তমুকের মত হব শেষে? আমি কি ভিখারি হব শেষে?

তখন সে যায় তো যায় কোথায়? আশাবাদী, নিরাশাবাদী সব অর্থহীন। ঈশ্বর, ধর্ম, জ্যোতিষী ইত্যাদি গুপ্ত সাহায্যকারীরাও মরীচিকা হয়ে মিলিয়ে গেছে তদ্দিনে। এই প্রচণ্ড দেউলিয়াপনা, এই অসম্ভব অভিমান… এ নিয়ে কি করে সে? মরে। নিজেকে শেষ করে দেয়। ওই যে বললাম বাস্তুতন্ত্র। এইভাবেই ভিখারিকে ঘেন্না করার, পঙ্গুকে করুণা করার, সমাজের শেষ ধাপে বসে থাকা মানুষটাকে আন্তরিকভাবে সম্মান না করতে পারার কুশিক্ষার পরিণামে সে পৌঁছায়।

আসলেই এ খুব শক্ত। জগতে সব শিক্ষা, ধারণা, অভ্যাস একদিকে আর জগতরূপী বাস্তব জগতটা অন্যদিকে। যে কোনো সময়ে যে কোনো পরিণতির জন্য তৈরি না থাকলে সে ছেড়ে দেবে না তো। আইনসম্মত আত্মহত্যাই হোক, আর আইনবিরুদ্ধ। আদতে হেরে যাওয়াকে মেনে নিয়ে রাস্তায় এসে বসার সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া কি এত সোজা? একদম নয়। তার চাইতে বিষ খাওয়া, গলায় দড়ি দেওয়া, রেললাইনে শোয়া অনেক সোজা। অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অনেক সোজা।

এই রূঢ়, তেতো বাস্তবের শিক্ষাটা কোনো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোনো শৌখিন ধর্ম কেউ দেয় না। এ শিক্ষাটা চিরকাল দিয়ে এসেছে কিছু মানুষ। যাদের প্রাণে প্রাণে অনুভব হয়েছে, জগতে যে কোনো সময়ে যা কিছু হতে পারে, সে এমন কিছু মূল্যবান নয় যে নিজের মান-অপমান, অবস্থা ইত্যাদিকে নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হবে। বরং জীবনটাকে জীবনের মত দেখা যেতে পারে। যতক্ষণ না মরণ আপনিই এসে প্রদীপটা নিভিয়ে দিয়ে যায়। ক্ষোভ, অভিমান, অশান্তি, জ্বালাপোড়া সব থাকবে। কোনো যোগ্যতা না থাকাটাও যোগ্যতা। আসলে যোগ্যতার প্রশ্নটাই ভীষণ মেকি। অহং মানুষী। বাস্তবিক নয়। সব নিয়েই থাকতে হবে। না থাকলেও ক্ষতি নেই। তবে থাকাটাও যেতে পারে। চয়েস আমার। এ নিয়ে তর্ক চলে না। ঈশ্বরের অস্তিত্বের মত। জগত তার নিজের নিয়মে চলে। তাল রাখতে পারলে থাকো। নইলে যাও। চয়েস তোমার, আমার।

122
Sun, 01/01/2023 - 23:42

নতুন বছরের সক্কাল হল। বাল্যকালের স্কুলের বন্ধু, দীর্ঘকাল যোগাযোগ নেই, হঠাৎ ভজন পাঠালো হোয়াটসঅ্যাপে। ওই অ্যাটেনবোরোর 'গান্ধী' সিনেমার শেষ অংশটুকু। শুনলাম। ভালো গান।

জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছিস? উত্তর এলো, খাসা আছি। বললাম, ভালো কম্পোজিশন, সে বলল হুঁ।

ব্যস কথাবার্তা নেই আর। বুঝলাম এ নিতান্তই বাল্ক মেসেজে আমি ঢুকে গেছি হয় তো, অথবা সক্কালবেলা জীব উদ্ধারের জন্য হয় তো বা আমার প্রতি এই অনাকাঙ্ক্ষিত করুণা। নইলে কুশল জিজ্ঞাসাটা তো উভয়পক্ষের হওয়াটাই ভদ্রতা। হল না কেন?

রবিবারের সকাল। তায় নতুন বছর। ছোটোবেলার বন্ধুর এমন শীতল ধর্মীয় যোগাযোগ। ভালো লাগল। নানা ভাবনা এলো। আজ আবার কল্পতরু উৎসব। মানে আর কি রামকৃষ্ণদেব যেদিন আশীর্বাদ করেছিলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক।

হৃদে বলে একজন দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে থাকতেন। তিনি আবার রামকৃষ্ণদেবের আত্মীয়ও বটে। তিনি ঠাকুরকে নানাভাবে, নানা সময়ে বেশ উৎপীড়ন করেন যা রামকৃষ্ণদেবের নিজের কথাতেই আছে। আবার পরক্ষণেই বলছেন, তবে ও আমার সেবাও করেছিল অনেক।

রামকৃষ্ণদেব নিন্দা করা অপছন্দ করতেন। প্রার্থনা করতে বলতেন যেন আমি পোকাটারও নিন্দা না করি। তো তিনি হৃদের নিন্দে কেন করবেন? শুধু সত্যিটুকুই জানাতেন, তাও তুল্যমূল্য। "সেবাও করেছিল অনেক"।

এক ঘটনায় হৃদেকে মন্দির কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করল। বহুদিন পর হৃদে দেখা করতে এসেছে। ঠাকুর তাঁর নিজের ঘরে বসে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলছেন। একজন এসে খবর দিল হৃদে এসেছেন।

ঠাকুর উঠলেন। দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন হৃদে দাঁড়িয়ে। মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। তাই বাইরে থেকে কথা হচ্ছে। ঠাকুর কুশল সংবাদ নিচ্ছেন। হৃদে কাঁদছে। ঠাকুরও কাঁদছেন। এ ঘটনা যিনি লিখছেন সেই মাষ্টার মহাশয় অবাক হয়ে দেখছেন যে মানুষটা এত কষ্ট দিয়েছেন, সে মানুষটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন রামকৃষ্ণ। অবাক হচ্ছেন। আগামী প্রজন্মের জন্য লিখে যাচ্ছেন এ সব ঘটনা। জীবন একটু হাল্কা হয় যদি ক্ষমা করে। কেঁদে। প্রার্থনা করে। দোষ যেন না দেখি।

আরো আগের ঘটনা। তখন হৃদে মন্দিরে। হৃদের হঠাৎ একদিন কি হল, বললেন, ওগো রামকৃষ্ণ তুমিও যে, আমিও তো সে….চলো আমরা জীব উদ্ধার করি।

রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, তারপর শালার বুকে হাত দিয়ে তাকে শান্ত করি।

রামকৃষ্ণদেব কি শান্ত করছেন? জীব উদ্ধারের ইচ্ছা। অহংকারের ইচ্ছা। রামকৃষ্ণদেব মেথরের বাড়ির পায়খানা নিজের চুল দিয়ে পরিষ্কার করছেন। কেউ ডাকলে তার বাড়ি যাচ্ছেন। নিজে থেকেও যাচ্ছেন। অপমান করলেও যাচ্ছেন। ভালোবাসলেও যাচ্ছেন। কেশব, বিদ্যাসাগরের বাড়িও যাচ্ছেন, আবার কোনো এক অতিসাধারণ বিধবা মহিলার বাড়িও যাচ্ছেন। যেখানে যাচ্ছেন উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বিধবা কেঁদে কুটিপাটি। "ওগো আমার এত সৌভাগ্য যেন সহ্য হয়, ওগো তোমরা আমায় আশীর্বাদ করো।" বিধবা আনন্দে পাগল হচ্ছেন। ভিড় করে আসা প্রতিবেশীদের বলছেন এ সব কথা। তারাও আনন্দে মত্ত। ঘরে আনন্দময়ীর আগমন, আনন্দময় রামকৃষ্ণ হয়ে।

রামকৃষ্ণদেবের অনুভবে জীব উদ্ধারের গল্প নেই। "জীবে দয়া" কথাটাও ভালো লাগেনি। বলেছেন, শিবজ্ঞানে জীবসেবা।

তাই তো দয়া কি? সেবা। নিজের মানুষকে আবার দয়া করা যায় নাকি? সে তো সেবা! দেহত্যাগের প্রাক্কালে সারদাদেবী যে কথাটা বলবেন, "কেউ তোমার পর নয়"। রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে সব নিজের। সব এক। নিজেই বলছেন, আমি সব এক দেখি।

রামকৃষ্ণদেবের আঙিনায় শুধু বিবেকানন্দ প্রমুখেরাই তো নেই। হাজরা আছেন, হৃদে আছেন, খাজাঞ্চি আছেন… যারা ঠাকুরের জীবনে ঠাকুরের ভাষায় 'জটিলে-কুটিলে' ছিল। ঠাকুরকে যন্ত্রণা দিয়েছেন। ক্ষমা পেয়েছেন। ভালোবাসা পেয়েছেন। সব যে এক। সব যে মা। এই তো রামকৃষ্ণদেবের দর্শন। সোজা দর্শন। এক করার দর্শন। এক হওয়ার দর্শন। শান্তি, ভালোবাসা, আনন্দের প্রস্রবণ সেদিন দক্ষিণেশ্বর থেকে বয়েছিল। এমনকি শ্যামপুকুরবাটি, কাশীপুর থেকেও বয়েছিল, যখন গলায় কঠিন রোগাক্রান্ত, ক্যান্সার।

আজ কল্পতরু উৎসবের দিন। তিনি শুভবুদ্ধি দিন, নিজেকে একজন হনু, কি কেউকেটা ভাবার দুর্বুদ্ধি থেকে রক্ষা করুন, তবেই জীবন সার্থক হয়।

সবাই ভালো থাকবেন। আনন্দে থাকবেন। শুভ নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।

123
Sun, 12/25/2022 - 00:21

বড় অসময়ে চলে যাওয়ার ধুম উঠেছে। কেউ নিজেই দরজা ভেজিয়ে চলে যাচ্ছে। কেউ নাচতে, নাচতে, ব্যায়াম করতে করতে, হাঁটতে, বসতে চলে যাচ্ছে। রিলে ভিডিও দেখা যাচ্ছে। লক্ষ লাইক পড়ছে। লোকে বলছে, ইস.. এই রে.. রিপ... কি যে হচ্ছে!

যদিও কিভাবে কিভাবে যেন আমিও জানি কি হচ্ছে। মরতে তো আর কারোর অনুমতি নিতে হয় না। ধুম করে মরে গেলেই হল। আমি ইচ্ছা করে মরে যাওয়ার কথা বলছি। জীবনটাকে কুড়ি ওভারে সাল্টে দেব ভাবতে চাইছি কি? টেস্ট আর ভাল্লাগছে না। যত্তাড়াতাড়ি পাওনা-গণ্ডা মিটে যায় তত্তাড়াতাড়ি তল্পিতল্পা গুটিয় পালাই আরকি। আকাশে একটু সিঁদুরে মেঘ দেখলাম কি "চল্লাম ভাই" বলে টাটা হয়ে যাচ্ছি।

খুব মুশকিল। বাচ্চাবুড়োকচিকাঁচা সব্বাই তেড়ে মরতে লেগেছে। ইচ্ছা করে। ওদিকে আবার হঠাৎ হার্টফেল হওয়াটাকে কেউ বলছে কোভিডের জন্য, কেউ বলছে ভ্যাক্সিনের অ্যাকশান। সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারি না। অত জ্ঞান নেই। হলে হবে। অপশান নেই।

বেঁচে থাকাটার কোনো মানে তো একটা চাই। অবশ্যই চাই। কিন্তু সেটা যুক্তির কম্ম নয়। সেটা বিশ্বাসের কম্ম। ইচ্ছা বিশ্বাস থেকে জন্মায়। ইচ্ছা তো একটা ফিলিংস। একটা অনুভব। একটা পজিটিভ অনুভব। এই যে আমি আছি, এই যে আমি কাজ করছি এর একটা মানে আছে। এমন একটা বিশ্বাস না জন্মালে মানুষ বাঁচে কি করে?

একটা লোক নৌকা চড়ল। কিছুটা এগোনোর পর বুঝল নৌকায় ফুটো। চুকচুক করে জল ঢুকছে। সে এদিকে সাঁতারও জানে না। এইবার? বলি এই চুকচুকে জলে তো আর সেতারের সুর কানে আসবে না! কি করবে? মাঝনদীতে বসে প্রাণপণে দাঁড় বাইবে ওপারে যাবে বলে। যত জোর টানে তীর তত দূর গিয়ে চোখে ঠেকে। তবে? এবার সে যায় কই? ঈশ্বর চিলের মত ছোঁ করে নিয়ে যাবে? নাকি পাশের নৌকায় জায়গা হবে? নাকি অলৌকিকভাবে সাঁতার শিখে যাবে?

কিস্যু হবে না। নৌকা ডুববে। কিন্তু ডোবার পর বুঝবে সে ডুবছে না। কিন্তু নিজেকে ডোবানোর ক্ষমতা তার আছে, এটা বেশ বুঝতে পারছে। ভেসে আছে। দু-এক পা হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতারের মত কিছু একটা করছেও। সে বুঝতে পারছে ভেসে থাকাটা তার কপালে আছে। কিন্তু সাঁতার কাটার ভীষণ ক্ষমতা তার নেই। জলের স্রোতে ভেসে থাকতে হবে। কখনও অনুকূল, কখনও প্রতিকূল। চাদ্দিকে কাতারে কাতারে নৌকা। কারোর আজ ডুববে, কারোর কাল। তীর বলে কিছু নেই। কেউ মিনিটে কুড়ি বার হাত পা ছুঁড়তে পারে, কেউ একবার। জলের মধ্যে তুমুল হইহট্টগোল। সবাই হাত পা ছুঁড়ে সাঁতর কাটছে। সবাই ভাবছে আমি বুঝি পিছিয়ে গেলাম। কিন্তু কোথায় যে যাচ্ছে সবাই কেউ জানে না। আসলে সম্মিলিতভাবে কেউ যে কোথাও যাচ্ছি না এটা তো শুরুতে বোঝা যায় না। সবাই ভাবে আমি ক এর থেকে আগে, খ এর থেকে পিছিয়ে, গ ওই তো দেখা যাচ্ছে… ঘ ওই যে ডুবে যাচ্ছে…

এই চলছে। আদিকাল থেকেই চলছে। যদি বলো মানুষের গড় আয়ু কত, টক করে উত্তর দিয়ে দেবে বই। যদি বলো ক এর আয়ু কদ্দিন? কোনো উত্তর নেই। যদি বলো মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য কি? কোনো সঠিক স্থির উত্তর নেই। কিন্তু যদি বলো ক এর জীবনের উদ্দেশ্য কি? আছে। ওই জলে ভাসতে ভাসতে, যতটা সাঁতারের ক্ষমতা সেই অনুপাতে কিছু একটা আঁকিবুঁকি কাটার চেষ্টা আরকি! কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে একটা!

যীশুর জন্মদিন এসে গেল। কত মানুষ কত ভাবে জানল মানুষটা জন্মালো কেন। কারণ অনেক। যাতে আমি কেক কিনতে পারি, পিকনিক করতে পারি তাই। পাদ্রী বললেন, উঁহু, তাঁর রক্তে বিশ্বাস করলে তুমি উদ্ধার পাবে তাই। দার্শনিক বলল, ভালোবাসো, এই কথাটাকে জীবনে পালন করবে তাই। কারোর কথাতেই কিছু আসে যায় না। তবে হ্যাঁ যীশুর কথাতে সেই মৃত্যুর কথাটা আসে। কেমন একটা জাঁদরেল মৃত্যু। বড়দিন তো আজ।

এমন মৃত্যু বড়দিনের সঙ্গে লেগে গেল কেন? কারণ মনে হয় যীশু জীবনকে বড় আদর করে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলেন। মানুষকে জ্ঞানের কথা বলে কান পাকিয়ে হদ্দ করেননি। মানুষের রাগ, হতাশা, অভিমান, দুঃখের উপর হাত রেখে বলেছিলেন, এ সবের একটা মানে আছে। বিশ্বাস করো। জীবন আকস্মিক নয় গো। ভালোবাসো, বুকের মধ্যে বীজ অঙ্কুরিত হবে। সেই বীজ থেকে বিশ্বাসের গাছ হবে। সেই গাছের শিকড় জীবনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখবে। হড়পা বান, কি ভূমিকম্প এসে পড়লেও ধ্বসে যাবে না। একটু বিশ্বাস করো।

জীবনের উপর বিশ্বাস হারিও না। প্রচুর দুঃখ, হতাশার মধ্যে যুক্তি দিয়ে পালাবার কোনো রাস্তা পাবে না। কিছু বুঝবে না। বিশ্বাস করো, জীবনকে জীবনের মত মেলে ধরো। ভালোবাসো বীজকে। গাছকে ভালোবাসাই হবে তবে। ভালোবাসার বীজে ভালোবাসাই জন্মায়। মানে জীবনের উপর বিশ্বাস। নইলে এক চোখের বদলে এক চোখ নিলে জগত একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। চোখ দেখে না, দেখে বিশ্বাস।

এইটুকুই বলছি, জগতকে ভালোবাসতে হবে না। বীজকে ভালোবাসলেই হবে। বীজ অঙ্কুরিত হলে দেখো ধড়াস করে আওয়াজ হয় না। বাদ্যি কাঁসর বাজে না। নিঃশব্দে অঙ্কুরিত হয়, নীরব ভালোবাসায় কারোর। তারপর তো গাছটাছ হয় কত কি হয়…. আসল কথাটা কিন্তু মনে রেখো। বিশ্বাস। জীবনের উপর বিশ্বাস।

124
Sun, 12/18/2022 - 23:41

কোনো মানুষই কি আদতে ত্রুটিমুক্ত হয়? মহৎ মানুষের ত্রুটি কি তার মহত্বের ক্ষুণ্ণতা, নাকি সেটাই বাস্তবতা?

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, কাজলের ঘরে থাকলে যতই সেয়ানা হও, কালি লাগবেই।

কাজলের ঘর কি?

মানুষের বোধে দুটো সত্য আছে, এক, ব্যবহারিক সত্য। দুই, চিত্তগত সত্য। নদীর জল, যে মানুষ শুধু ব্যবহারের জিনিস বলে জানে, সে মিথ্যা জানে না, সে অসম্পূর্ণ জানে। পরিবেশবিদ জানেন, নদীর সত্য মূল্য আমার কাপড়কাচা, স্নান, শৌচাদি সত্যের মূল্যে নয়, নদীর মূল্য এ সবের চাইতে অনেক বড়। একটি বাচ্চা একদিন পরিবেশের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। সে আমাদের প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে পরিবেশকে দেখতে পেয়েছিল বলেই। অনুভব করেছিল বলেই।

মানুষের জীবনের গভীরে এই একটি সত্য খুব বড় সত্য। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ছোটো আমি - বড় আমি; রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, কাঁচা আমি - পাকা আমি; প্লেটোর ভাষায়, সাধারণ মানুষ - দার্শনিক; কান্টের ভাষায়, সাধারণ মানুষ - এনলাইটেন্ড মানুষ; উপনিষদের ভাষায়, ক্ষুদ্র সুখ - ভূমা সুখ কিম্বা দুটো পাখির গল্প; শান্তিদেবের বোধিচর্যাবতারের ভাষায়, সাধারণ মানুষ - বোধিসত্ত্ব; বাইবেলের ভাষায়, বাইরের জগৎ - ঈশ্বরের রাজ্য।

এই দুই সত্য নিয়েই মানুষের জীবন। আজকের দিনে যাকে বলছি শিক্ষিত, বোধসম্পন্ন, ম্যাচিওর মানুষ বনাম অশিক্ষিত, কাণ্ডজ্ঞানহীন, স্বার্থপর মানুষ।

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, মান আর হুঁশ নিয়ে মানুষ। রামকৃষ্ণদেব শেষ আশীর্বাদ করছেন, চৈতন্য হোক।

এই হল কাজলের ঘরে থেকে কালিকে চেনার শিক্ষা। প্লেটোর দর্শন অনুযায়ী গুহা থেকে বাইরে বেরোবার শিক্ষা। ছায়াকে ত্যাগ করে কায়াকে অন্বেষনের শিক্ষা।

যতদিন যায় মানুষ আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হতে থাকে। ক্রমে মানুষের উপর অবিশ্বাস, হতাশায় গোটা সংসারটা বিষিয়ে ওঠে। এ আজকের দিন বলে না, এ-ই চিরকাল হয়ে এসেছে। কথামৃতে গানের উদাহরণে আছে, সংসার ধোঁকার টাটি, জ্ঞান হলে মজার কুটি।

যে মানুষই দীর্ঘদিন সংসারে মানুষকে নিয়ে আছে তার মানুষের উপর অবিশ্বাস আসবে এ স্বাভাবিক। মনুষ্যত্বকে প্রশ্নের চিহ্নে দেখবে, এও স্বাভাবিক। মহাত্মা বলছেন, মনুষ্যত্ব এক অসীম সমুদ্র। তার ক্ষুদ্র অংশ দূষিত হলেও সমগ্রটা নয়।

কিন্তু এই সমগ্রটাকে দেখব কি করে?

এই সমগ্রটাকে দেখার সাধনাকেই বলে শিক্ষা। জগতকে সত্য দৃষ্টিতে দেখার সাধন যেমন বিজ্ঞান, তেমনই মানুষকে তার স্বমহিমায় সত্য দৃষ্টিতে দেখার সাধনকে বলে দর্শন-ধর্ম।

প্লেটোর ভাষায় সক্রেটিস বলছেন, মানুষের ত্রুটিকে ব্যঙ্গ করে, উপহাস করে রাস্তা দেখানো যায় না। মানুষের প্রতি সহনশীলতা দরকার। স্পিনোজা বলছেন, আমি বুঝেছি, আর সব বোকা - এ অহংকার। এ ঠিক নয়। ঠিক এই একই কথা রামকৃষ্ণদেব বলছেন হাজরাকে, আমি বুঝেছি, আর সব বোকা, এ বুদ্ধি কোরো না। সবাইকে ভালোবাসতে হয়। সবার মধ্যেই তিনি।

রামকৃষ্ণদেবের এই 'তিনি', উপনিষদের ভূমা। মানুষের জীবনে সব চাইতে বড় অলৌকিকত্ব এই - এই দুর্বিষহ জীবনের কেন্দ্রে এক মহত্বের প্রতি তার আকর্ষণ। বাইরের জীবনে যাকে বলা হয় অ্যাডভেঞ্চার। নইলে সেদিন অমন আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকসম্প্রদায় কি কারণে সেই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষটার জীবনব্রত নিজেদের কাঁধে নিয়েছিল? একজন সুপণ্ডিত মানুষের দুর্দান্ত ক্ষুরধার ব্যাখ্যায় শিক্ষিত মানুষ আকর্ষিত হবে, এ বোধগম্য। কিন্তু সে মানুষটার কথায় তা তো ছিল না। তবে কি এমন ছিল যে অতগুলো শিক্ষিত যুবক পার্থিব জগতের সব সুখের সম্ভবনা জলাঞ্জলি দিয়ে অমন নিবেদিত প্রাণ হয়েছিল? সে আকর্ষণ ভূমার আকর্ষণ। মহত্বের আকর্ষণ।

মানুষের জীবনে এই অ্যাডভেঞ্চারের তৃষ্ণা, কঠিনকে জয় করে মহত্বের দিকে এগোনোর তৃষ্ণাকেই বলছি মনুষ্যত্ব। যা অর্জনের বস্তু। অনেক দুঃখ, অনেক ত্যাগ, অনেক কঠিন রাস্তাকে স্বীকার করে নিয়ে। যদি বলো, কেন এত কঠিন রাস্তায় যাব? তবে এর কোনো উত্তর হয় না।

মানুষকে ভালোবাসব, এ কথাটা খুব সোজা কথা না। কবীর যখন বলে, প্রেম, এ শব্দটার মধ্যেই সমস্ত ধর্মের মূল, যে কথাকে এ যুগে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বলছেন, জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর.. সে কথা কোনো স্লোগান নয়। সে কথা একটা অনুভব। যে অনুভব সেই মানুষগুলোর জীবনে ছড়িয়েছিটিয়ে মাঝেমধ্যেই ধরা দিয়েছে।

আবারও বলছি, মানুষকে ভালোবাসব, এ কথাটা বড় সোজা কথা নয়। এ কোনো বায়বীয় রোম্যান্টিসিজম নয়। এ কথা সাধনার কথা। চাইলেই পাওয়া যায় না। সারদাদেবী যখন বলছেন, ঈশ্বরলাভ করলে কি মাথায় দুটো শিং গজায়? না। হৃদয়টা মাঠ হয়ে যায়।

বড় কথা আর ছোটো কথার দ্বন্দ্ব চিরকাল আছে। থাকবেও। প্রয়োজনের চেষ্টা আর চিত্তের উদার মুক্ত জ্ঞানের অনুভবের মধ্যে আপাত দ্বন্দ্বও চিরটাকাল থাকবে। "ফোটা ফুল চায় না নিশা, / প্রাণে তার আলোর তৃষা, / কাঁদে সে অন্ধকারে…. যে থাকে থাক্-না দ্বারে, / যে যাবি যা-না পারে"।

রবীন্দ্রনাথ তার গানে এ ডাক প্রতিদিন আমাদের সামনে আনছেন। আমরা কেউ সাড়া দিচ্ছি, কেউ দিচ্ছি না, কেউ 'দেব দেব' ভেবেও দিয়ে উঠতে পারছি না।

মানুষের মধ্যে সঙ্কীর্ণতা আছে, স্বার্থপরতা আছে, শোষণ পীড়ন করার ক্ষমতা আছে, সব আছে। এগুলো বাস্তব। কিন্তু মানুষের মধ্যে এ সবের ঊর্ধ্বে ওঠার ক্ষমতাও আছে। তাই শিক্ষা আছে, চর্চা আছে, সাধন আছে, চেষ্টা আছে, আত্মত্যাগ আছে, দুর্বিষহ দুঃখ স্বীকার করার তাগিদ আছে।

তা বলে কি নকল নেই? আছে। কিন্তু নকল মহতেরই হয়। চোরের নকল কেউ করে না। করে সাধুর। দ্য ভিঞ্চির ছবি, পিকাসোর ছবি নকল বিক্রি হয়। কোনো সামান্য মানের ছবির নকল হয় না। তেমনই মহতের নকল হয়, কিন্তু তার অর্থ মহত্ব নকল নয়। নীৎশের মত নৈরাশ্যবাদী দার্শনিকও এক কল্পিত মহামানবের সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে অহং প্রতিষ্ঠিত। চেতনার মহত্ব সাধ্য নয়। বার্ট্রান্ড রাসেল সেই কথাতেই নীৎসের দর্শনকে সরিয়ে অন্য দর্শনের দিকে এগিয়ে গেছেন।

যে ক'জন মানুষের নাম উল্লেখ করলাম, তারা কি সব ত্রুটিমুক্ত? না। বিবেকানন্দ একটা কথা মনে রাখতে বলেছিলেন, মনে রাখিস, ত্রুটিগুলো সমস্ত মানুষজাতির, কিন্তু তার উৎকর্ষতাটা তার সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়।

যে মানুষদের নাম উল্লেখ করলাম তাঁরা বহু মানুষের কাছে মহাপুরুষভাবে স্মরণীয়। কারণ তাঁরা ত্রুটিহীন ছিলেন বলে নয়, কারণ তাঁদের সেই রক্তমাংসের শরীরের জীবনেই সেই মহত্বের ছায়া পড়েছিল বলে। তাঁরা আয়নার মত। আয়নার গঠন শতাংশে ত্রুটিমুক্ত হয় না, কিন্তু সেখানে যে মহাকাশের প্রতিবিম্ব পড়ে সেখানে আমরা আমাদের মুক্তির রাস্তা পাই। আস্থা পাই। তাই তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় হন। পূজ্য হন। তাঁদের অস্বীকার করলে তাঁদের কোনো ক্ষতি হয় না। আমরা আমাদের ক্ষুদ্র করে ফেলি আরো।

 

অন্ধকারের উৎস-হতে উৎসারিত আলো

    সেই তো তোমার আলো!

সকল দ্বন্দ্ববিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো

    সেই তো তোমার ভালো ॥

পথের ধুলায় বক্ষ পেতে রয়েছে যেই গেহ

    সেই তো তোমার গেহ।

সমরঘাতে অমর করে রুদ্রনিঠুর স্নেহ

    সেই তো তোমার স্নেহ ॥

সব ফুরালে বাকি রহে অদৃশ্য যেই দান

    সেই তো তোমার দান।

মৃত্যু আপন পাত্রে ভরি বহিছে যেই প্রাণ

    সেই তো তোমার প্রাণ।

বিশ্বজনের পায়ের তলে ধূলিময় যে ভূমি

    সেই তো স্বর্গভূমি।

সবায় নিয়ে সবার মাঝে লুকিয়ে আছ তুমি

    সেই তো আমার তুমি ॥

 

125
Tue, 11/29/2022 - 00:05

বাঙালিকে ভ্রমণ পিপাসু যদি বলা হয়, তবে পুরো কথাটা সত্যি হয় না। শীতে পরিযায়ী পাখি আসে কলকাতায়। সে এক আসা। দুর্গাপুজোয় হাজার হাজার বাঙালি এদিক ওদিক বেড়াতে যায়, সে এক বেড়ানো। কিন্তু মানুষ তো পাখি নয়, পশু নয়। মানুষের আরেক ভ্রমণের পথ আছে, তার বিগত মনীষার হেঁটে আসা পথ। তার 'ধী'-এর আলোয় নানা দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে আসার পথ। এ ভ্রমণে বাঙালি কতটা উৎসাহী?

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় একটা বই লিখেছিলেন, 'বৌদ্ধধর্ম'। কি দুর্গম পথকে সহজ করে তুলেছিলেন। গীতার উপমাকে স্মরণ করে বলা যায়, পঙ্গুকে গিরি লঙ্ঘন করানোর মত সে লেখা। ইংরাজি ভাষায় লেখা, বহু বিক্রীত হওয়া তথাকথিত বেস্টসেলার বই, যা বৌদ্ধধর্মের নানা জটিলতার উপর লেখা, সে সবের সমতুল্য এ বইয়ের উপস্থিতি, আলোচনা আমাদের মধ্যে কত কম! যে হারে বাঙালি বুদ্ধগয়া পরিভ্রমণ করে, তার ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম অংশও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মনীষার জগত পরিভ্রমণ করে না। রবীন্দ্রনাথ মনীষাকে মনের চরিত্রবল বলছেন, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় লিখছেন,

"যে-কোনো বিষয় শাস্ত্রীমশায় হাতে নিয়েছেন তাকে সুস্পষ্ট করে দেখেছেন ও সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন। বিদ্যার সংগ্রহ ব্যাপার অধ্যবসায়ের দ্বারা হয় কিন্তু তাকে নিজের ও অন্যের মনে সহজ করে তোলা ধীশক্তির কাজ। এই জিনিসটি অত্যন্ত বিরল। তবু, জ্ঞানের বিষয় প্রভূত পরিমাণে সংগ্রহ করার যে পাণ্ডিত্য তার জন্যেও দৃঢ় নিষ্ঠার প্রয়োজন; আমাদের আধুনিক শিক্ষাবিধির গুণে তার চর্চাও প্রায় দেখি নে। ধ্বনি প্রবল করবার একরকম যন্ত্র আজকাল বেরিয়েছে তাতে স্বাভাবিক গলার জোর না থাকলেও আওয়াজে সভা ভরিয়ে দেওয়া যায়। সেই রকম উপায়েই অল্প জানাকে তুমুল করে ঘোষণা করা এখন সহজ হয়েছে। তাই বিদ্যার সাধনা হাল্কা হয়ে উঠল, বুদ্ধির তপস্যাও ক্ষীণবল। যাকে বলে মনীষা, মনের যেটা চরিত্রবল সেইটের অভাব ঘটেছে।"

শাস্ত্রী মহাশয় যা লিখেছেন, তার মধ্যে ইতিহাস আছে, সমাজ আছে, ভাষা আছে, মনুষ্যত্বের কথা আছে। আরো অনেক অনেক কথা আছে। কিন্তু ক্ষুদ্রতা নেই। মহৎকে কালিমালিপ্ত করার বাচনশৈলী নেই, চাতুরী নেই।

শাস্ত্রী মহাশয়ের একটা প্রবন্ধ আছে, মনুষ্যত্ব বনাম 'সাইন' করা নিয়ে। সাইন করা মানে সই করা নয়, সাইন করা মানে নিজেকে উজ্জ্বলভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা। মানুষের ধর্ম, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, সাধ-ইচ্ছা যা কিছুকেই মনুষ্যত্বের বিনিময় সংগ্রহ করতে হয়, যুগে যুগে প্রত্যেক বিবেকবান মানুষই তার উপর সংশয় প্রকাশ করেছেন। উদারতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা কোনোদিন এক জায়গায় অবস্থান করতে পারে না। আর উদারতা না থাকলে সত্যের "অনেকান্ত" দৃষ্টিও সম্ভব নয়। তখন সবাই এক পক্ষের সংজ্ঞা চায়, কারণ সেখানে তার স্বার্থসিদ্ধ হয়। উদারতায় স্বার্থসিদ্ধি হয় না। নিজেকে সার্থক মনে হয়। কিন্তু আমি সার্থক হতে চাই, না সফলতায় "সাইন" করতে চাই শাস্ত্রীজীর ভাষায়, সে তো আমার প্রকৃতি, আমার শিক্ষা-রুচির উপরেই নির্ভর করবে।

রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীজীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে আরেক জায়গায় লিখছেন,

"অনেক পণ্ডিত আছেন, তাঁরা কেবল সংগ্রহ করতেই জানেন, কিন্তু আয়ত্ত করতে পারেন না; তাঁরা খনি থেকে তোলা ধাতুপিণ্ডটার সোনা এবং খাদ অংশটাকে পৃথক করতে শেখেন নি বলেই উভয়কেই সমান মূল্য দিয়ে কেবল বোঝা ভারি করেন। হরপ্রসাদ যে যুগে জ্ঞানের তপস্যায় প্রবৃত্ত হয়েছিলেন সে যুগে বৈজ্ঞানিক বিচারবুদ্ধির প্রভাবে সংস্কারমুক্ত চিত্ত জ্ঞানের উপাদানগুলি শোধন করে নিতে শিখেছিল। তাই স্থূল পাণ্ডিত্য নিয়ে বাঁধা মত আবৃত্তি করা তাঁর পক্ষে কোনোদিন সম্ভবপর ছিল না। ভূয়োদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এই তীক্ষ্ণদৃষ্টি এবং সেইসঙ্গে স্বচ্ছ ভাষায় প্রকাশের শক্তি আজও আমাদের দেশে বিরল। বুদ্ধি আছে কিন্তু সাধনা নেই এইটেই আমাদের দেশে সাধারণত দেখতে পাই, অধিকাংশ স্থলেই আমরা কম শিক্ষায় বেশি মার্কা পাওয়ার অভিলাষী। কিন্তু হরপ্রসাদ ছিলেন সাধকের দলে এবং তাঁর ছিল দর্শনশক্তি।"

এই 'ভূয়োদর্শন' শব্দটার যথার্থ ইংরেজি প্রতিশব্দ আমি জানি না। আমি এই জিনিসটার পরিচয় শুধু যে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত মানুষের মধ্যেই পেয়েছি তা নয়, বরং অনেক বিপরীত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। অনেক তথ্যের ভারে সে তার সংকীর্ণ মতকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে চলেছে, শীততাপনিয়ন্ত্রিত ঘরে অনেকবার দেখেছি। আবার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ানো, ভিক্ষার ঝুলি হাতে বাউলের মুখে, কি ক্ষেতে চাষ করতে করতে চাষীর মুখেও এমন কথা শুনেছি, তার মধ্যে জীবনের এক ভূয়োদর্শন পেয়েছি। ধন্য হয়েছি।

কিন্তু এই সংকীর্ণতার, আমি-সর্বস্ব দুনিয়ায় মরুভূমিতে আসা ছিঁটেফোঁটা বৃষ্টির মত সে ভূয়োদর্শন সে যুগেও বিরল ছিল, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, আজও বিরল।

গগন হরকরার গান শুনে ক্ষিতিমোহন সেন বাংলায় এসে শোনেন যে তিনি ততদিনে দেহ রেখেছেন। ক্ষিতিমোহন সেন লিখছেন কিভাবে গগন হরকরার একটা গান 'ডাকঘর' নাটককে প্রভাবিত করেছিল। 'ঘরে ঘরে বিলাই চিঠি - আমার চিঠি পাব কবে'। এখন রবীন্দ্রনাথের দর্শনে বাউলের দর্শনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা অকারণ লেখাটাকে বড় করে ফেলা। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বহুবার বাউলের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। বাউলের দর্শনে সেই ভূয়োদর্শনের আলোকে দেখেছেন বলেই তো।

আরেকজনের কথায় এসে শেষ করি, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ। একই কথা এখানেও। পাশ্চাত্যের কাব্য, দর্শন নিয়ে এমন রসসিক্ত বিদগ্ধ আলোচনার ক'টা বই পাওয়া যায় আমি জানি না। যেখানে তিনি লিখছেন, "মানুষের মেধা বা মনীষা সম্ভবত অতিজান্তব। কিন্তু এও মর্ত্যেরই মহিমা", সেখানে মনীষাকে আর এক ব্যাখ্যায় দেখা যায়। আমি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রসঙ্গ আনলাম, 'কুলায় ও কালপুরুষ' নামক আশ্চর্য গ্রন্থটির কথা আনলাম এই জন্যেই যে, আগের মতগুলি আস্তিকভাবাপন্ন, সুধীন্দ্রনাথ নাস্তিকভাবাপন্ন। কিন্তু মনীষার প্রতি শ্রদ্ধা, আনুগত্য ও উদারতা দুই ক্ষেত্রেই সমান। বার্ট্রান্ড রাসেল ও লালনের দেখা হলে দু'জনে মতে ভিন্ন হলেও, স্বীয় প্রকৃতির উদারতায় মনীষার জ্যোতিকে একে অন্যের মধ্যে দেখে শ্রদ্ধা করবেন এ অবশ্য সত্য। শিবনারায়ণ রায় মহাশয়ের লেখার সঙ্গে যারা পরিচিত তারাই অনুভব করবেন কথাটা কেন আমি সত্য বলে অনুভব করেছি, জেনেছি।

ধীশক্তি যখন নিজের মধ্যে নিজের আয়োজন সম্পূর্ণ করে দাঁড়ায়, তখন সে সব কিছুকে এক স্বাভাবিক সাম্যে দেখে। অসাম্যের কারণ আরেক অসাম্য নয়, কোনো এক চেষ্টার দ্রোহী হয়ে ওঠা। রবীন্দ্রনাথের গান, "নৃত্যের তালে তালে" এ সত্যের এক অসামান্য প্রকাশ।

রবীন্দ্রনাথের গায়ত্রী মন্ত্রের উচ্চারণে চোখে জল আসত। কারণ সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে চিত্তের মুক্তির সুরকে উনি ওঁর ওই কিশোর বয়সেই অনুভব করেছেন। যে মুক্তি ধীশক্তির আলোয় উজ্জ্বল। আনন্দিত। সার্থক। চিত্তলোকের যেন মহাবিশ্ব ভ্রমণ - এভাবেই রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছেন।

মানুষের সমাজে দুই সত্য। ধী অনুভব আর যুক্তি দুইকে নিয়েই। ফরাসী বিপ্লবে তাই রুসো আর ভলতেয়ার, দু'জনেরই উজ্জ্বল উপস্থিতি। রুসোর সত্য অনুভবে, ভলতেয়ারের সত্য যুক্তিতে। বিরোধও হয়েছে। কিন্তু কেউ হারিয়ে যাননি। আমার ভয় হয়, আমরা না হারিয়ে যাই। মানুষ তার মানস সত্যকে সে তার প্রকৃতির ধাঁচ অনুযায়ী পায়। তারপর সেই প্রকৃতির সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে লাগে রুচি, শিক্ষা। এক চেষ্টা। যা উদার করে।

মাষ্টার মশায়কে রামকৃষ্ণদেব বলছেন, তুমি পরজন্ম মানো না মানো তাতে দোষ নেই, কিন্তু আমি যা জেনেছি সে-ই একমাত্র সত্য, এ ভাব ভালো না।

এই আধুনিক কথা। তর্কের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা নয়, সত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াস থাকুক। যুক্তির উদারতা থাকুক, ধারের সঙ্গে। সক্রেটিসের মত। যে উদারতায় বিষকেও বিষ বলে মনে হয় না অবশেষে।

126
Sat, 11/26/2022 - 00:18

 

সান্ত্বনা, না শান্তি?

প্রতি পদে পদে যদি সান্ত্বনা চাই, শান্তি পাই কি? ক্ষতি, আঘাত, শোকতাপ অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সান্ত্বনা নয়।

মন্দিরের প্রবেশদ্বারের বাইরে রাস্তার দুপাশে পুজোর ডালা সাজানো থাকে। বিক্রির জন্য। সে ডালায় ফুল, মালা, ফল সব থাকে। প্লাস্টিকে মোড়া। টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে ঢুকলেই হয়। সেই ডালার ফুল আমার তোলা নয়, মালা আমার গাঁথা নয়। আমার যে পরিমাণ টাকা আছে, আমার ডালা সেই অনুপাতে নানা উপাদানে ভরে নেওয়ার ক্ষমতা আছে। সান্ত্বনার জন্যেও আমরা মাঝে মাঝে ওরকম রেডিমেড ডালা খুঁজি। নিজেকে ঠকাই। ঠকানোর ব্যবসা খুলতে সাহায্যও করি।

সান্ত্বনা ওভাবে রেডিমেড পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষতি, অনেক শোকের সান্ত্বনা নেই। এ সত্য। নির্মম সত্য। সময় ধীরে ধীরে প্রলেপ লাগিয়ে যায়। ক্ষত সবটা না সারলেও মোটামুটি চলনসই হয়ে যায়। কিন্তু নকল সান্ত্বনায় না পাওয়া যায় শান্তি, না থাকে দুঃখের, শোকের মর্যাদা। নিজেকে প্রতারণা করে কে কবে এগোবার রাস্তা পেয়েছে? সে তো একটা ঘূর্ণি।

দুর্বল মন নকল সান্ত্বনায় নিজের একটা প্রসাধনী কক্ষ খোঁজে। সেখানে সে শোক নিয়ে বিলাস চায়, ক্ষতিপূরণ চায়। শোক, দুঃখকে উপজীব্য করে আরো বড় আঘাত থেকে বাঁচার ফিকির খোঁজে। সে বলে, দেখো আমি ইতিমধ্যে অনেক শোকে জরজর, আমায় রেহাই দাও।

রেহাই নেই। যখন সে দেখে তাও রেহাই নেই, তখন সে ক্ষোভ উগরে, রেগেমেগে সমস্ত সংসারকে এক বিশ্বাসঘাতকের আড্ডা ভাবে। এ হয়। ভাগ্যের মারে মরে যারা সান্ত্বনাদেবীর আঁচলের ছায়ায় আশ্রয় চায়, তারা ক্রমে নিজেকে আরো দুর্বল করে নিজেকে নিজেরই বিড়ম্বনা করে তোলে। মানসিক দুর্বলতা এক চোরাবালির মত।

সান্ত্বনা নয়, শান্তি নয়, শুশ্রূষা নয়, যা চাই সে হল এগিয়ে যাওয়ার জোরটুকু। সান্ত্বনা, আর শান্তির জন্য প্রার্থনা - দুটো চাওয়াই নিজেকে দুর্বল করার প্রকারান্তরে চেষ্টা। সহ্য করতে হবে। কেন সহ্য করব, এ অবোধের মত প্রশ্ন। বাচ্চারা যেমন জিজ্ঞাসা করে, কেন স্কুলে যাব? কেন পড়াশোনা করব? সেরকম।

শোক-দুঃখ, ক্ষতি সব কিছুর মধ্যে নিজের বোধবুদ্ধিটুকু যতক্ষণ টাল না খায়, টাল খেয়েও যদি আবার স্থির হয়ে যায়, তবে আর চিন্তা নেই। চোখ থাকলে আলো যেমন দেখতে পাবই আজ না হয় কাল, তেমনই শুভবুদ্ধি জেগে থাকলে আলোর রাস্তা আজ না হয় কাল দেখতে পাবই, নিস্তারের পথ পাবই। এ সান্ত্বনা, বা শান্তির চাহিদা নয়, এ আশার কথা। আশা মানে শুভচিন্তার শ্বাসপ্রশ্বাস। যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ আমিও আছি, আমি হয়ে।

127
Fri, 11/18/2022 - 23:51

একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকালো, সারদা দেবীর উপর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা বই, 'পরমাপ্রকৃতি' এরকম কিছু একটা নাম। সঙ্গে লেখা এই বইটা পড়ে জানুন, কে এই করুণাময়ী পরমাপ্রকৃতি। সঙ্গে একটা হোয়াটসঅ্যাপের নাম্বার।

মোবাইলটা বন্ধ করে একটা বই হাতে নিয়েছি, হঠাৎ মেসেজ ঢুকল,

"শীতকালে কুয়াশার মধ্যে যাতায়াতের সময় সতর্ক থাকুন। ছিঁড়ে পড়ে থাকা বা নীচু হয়ে ঝুলে থাকা বিদ্যুতের তার বিপজ্জনক, স্পর্শ করবেন না।"

বিদ্যুৎ বিভাগের মেসেজ। কি দরদী মেসেজ। মস্তিষ্কের কোষগুলো তখনও 'করুণাময়ী' শব্দটা থেকে বেরোতে পারেনি, এরই মধ্যে বিদ্যুৎবিভাগ থেকে মেসেজ ঢুকল। দরদী মেসেজ। যেন জয়রামবাটি থেকে কোনো একজন ভক্ত বেরোচ্ছেন, মা তাকে কথাগুলো বলছেন। অবশ্য ঐতিহাসিক দিক থেকে কথাটা খাটবে না, কারণ ওই সময়ে জয়রামবাটিতে বিদ্যুৎ বলতে আকাশ থেকে নামা বেয়াড়া গোছের বিদ্যুৎই ছিল। এমন ধাতু বেয়ে গড়িয়ে আসা বিদ্যুতের সংযত স্রোত ছিল নাকি!

তো মেসেজটা দেখে ভাবলাম কত সতর্কবাণী সারাদিন চোখে পড়ে, সামনে স্কুল ধীরে চালান, অ্যাক্সিডেন্ট প্রোন অঞ্চল, ধীরে চালান। ওষুধের প্যাকেটের গায়ে বারবার লিখে দেয়, ডাক্তার না দেখিয়ে খাবেন না, প্রেসক্রিপশন ছাড়া বেচবেন না। আরো কত কত কি! এগুলো কি করুণা না? দরদ না? এই সব সামাজিক করুণা।

আমরা রাতদিন আমাদের ছোটোদের বলে যাচ্ছি, এরকম করিস না, ওভাবে এটা হয় না, এরকম করলে ভুগবি ইত্যাদি ইত্যাদি। বলেই যাচ্ছি। না শুনলেও বলেই যাচ্ছি। পাত্তা দেবে না জেনেও বলেই যাচ্ছি। কারণ? স্পষ্ট নয়। আসল কথাটা কারোর ক্ষতি হোক আমাদের ভালো লাগে না। যতই শত্রুতা করি, যতই কাউকে শাপশাপান্ত করি না কেন, আদতে কারোর ক্ষতি কি সত্যিই ভালোলাগা আনে মনে? আনে না। পীড়াই দেয়। আমি সাধারণ মানুষের কথা বলছি। সাধারণ মনের কথা বলছি। বাংলা সিরিয়ালগুলো যে বিশেষ ধরণের মানব-মানবী জন্ম দিচ্ছে শুটিং এর ফ্লোরে রাতদিন, তাদের কথা বলছি না। আমরা কতবার আফসোস করি, এতবার করে বললাম, শুনলো না। এত করে বোঝালাম, বুঝল না। আবার এও বলি, এতবার করে বলল, আমি কেন শুনলাম না, বুঝলাম না।

একজন মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে গেছে। ফাঁকা ফাঁকা একটা গ্রামে গিয়ে উঠেছে। সকালবেলা চুপ করে কফির কাপ হাতে বসে আছে। দূরে। নির্জনে। পাখি ডাকছে। অনেক দূর থেকে কারোর গলার আওয়াজ ভেসে আসছে। সে চুপ করে শুনছে। আবার শুনছেও না। সে সব বাঁধন আলগা করে দিয়ে নিজের শুশ্রূষা করছে। সংসারে চলতে অনেক আঘাত নিরাময় হওয়ার সময় পায় না, তার আগেই আরেকটা আঘাত এসে পড়ে। সেগুলোতে পট্টি লাগিয়ে মোটামুটি চলনসই করে আবার কাজে নেমে পড়তে হয়। পড়তেই হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে আঘাতগুলো জানান দেয় তার একটু খোলা বাতাস লাগবে। আর যে পারা যাচ্ছে না। তখন সে মানুষটা নির্জনতা খোঁজে। যে করে কোথাও একটা। পাহাড়ি গ্রাম না হলেও, নির্জন সৈকত না হলেও, বাড়ির আশেপাশে কোনো খোলা মাঠ, খোলা আকাশ। নিদেন পক্ষে ছাদ। রামকৃষ্ণদেব সংসারের এইসব চাপা ফোস্কার খবর রাখতেন বলেই হয় তো বারবার মনে করাতেন, ওহে একটু নির্জনবাসে যাও। মনের একটা শুশ্রূষা দরকার।

ওই যে মানুষটা নির্জনে বসে আছে, দগদগে ঘা গুলো আলোবাতাস পাচ্ছে, ও কিন্তু নিজের কথা ভাবছে না শুধু। কোনো মানুষই খালি নিজের কথা ভাবে না। ঘর ভাবলেই যেমন অবশ্যম্ভাবী ভাবে ছাদ আর দেওয়াল এসেই পড়ে, তেমনই মানুষ নিজেকে ভাবলেই অনেকের কথা এসেই পড়ে। অনেক সময় ঘর ভাবলে যেমন মেঝের কথা মনে আসে না, তেমন অনেক সময় নিজেকে নিয়ে ভাবতে গেলে হয় তো নিজের কথাই মনে আসে না। আসে ভালোবাসার মানুষগুলোর মুখ।

নিজেকে নিয়ে নিজের এই যে নির্জনবাস এও করুণা। নিজের উপর নিজের করুণা। সে নিজেকে নিয়ে যতটা গভীরে যাওয়া যাক না কেন। নিজের মধ্যে এতগুলো মানুষ বেরিয়ে পড়বে, এক সময় মনে হবে, এক একটা মানুষের 'আমি' যেন এক একটা পাখির নীড়। সেখানে অনেক মানুষ। তার ভালোবাসায় অনেক বাঘা ধেড়ে মানুষও শাবক হয়ে। সে খড়কুটো জোগাড় করে নীড় সামলাচ্ছে। সবাইকে ভালো রাখতে চাইছে। অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইছে।

তবে এও সত্য, ভাগ্য এমন নিষ্ঠুরও হয়, নীড়শূন্য হয়। শূন্য নীড় আঁকড়ে কে আর থাকে। যা ছিল মহামূল্যবান আগল, সে সত্যিই হয়ে যায় খড়কুটো। সে মানুষটা তখন ভেসে যেতে চায়। হারিয়ে যেতে চায়। অনেক দুর্ভাগা তো মৃত্যুকেই করুণার আশ্রয় করে বসে। তাকে বারণ করারও কেউ থাকে না। অথচ যে হয় তো চাইছিল তাকে কেউ বারণ করুক, বলুক, আমার নীড়ে একটা ছোট্ট জায়গা আছে তোমার জন্য, এসো।

128
Thu, 11/17/2022 - 20:23

কুসংস্কার ছাড়া আমাদের আরেকটা সংস্কার আছে, ধ্যাষ্টামো সংস্কার। এদিকে মুখে বলছি মানি না, ওদিকে সব নাকি করা হচ্ছে বাড়ির লোকের তোষণের জন্য, সমাজের জন্য ইত্যাদি।

এদিকে ভোল্টায়ার থেকে লেনিন-মার্ক্স মুখস্থ, তাও ছেলের ঘটা করে পৈতের অনুষ্ঠান দেওয়া হচ্ছে। নইলে নাকি সমাজে থাকা যায় না। আরে আজকাল ধোপা নাপিত তো কেউ বন্ধ করে না। কেউ গা খুলে পৈতেও দেখায় না। তবে?

তারপর গুষ্ঠির পিণ্ডি করে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। কেন? আপনি তো আত্মা, পরলোক মানেন না। আরে বাবা সমাজ আর পরিবার বলে একটা ব্যাপার আছে না? এ সব করতেই হয়।

কেউ সমাজের দোহাই দেয়, কেউ পরিবারের, কেউ বলে যুগ যুগ ধরে সবাই করে আসছে… ইত্যাদি ইত্যাদি।

এগুলো হল ধ্যাষ্টামো সংস্কার। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এরকম ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ড নিয়ে আধসেদ্ধ মন নিয়ে বেঁচে।

কেউ যদি আন্তরিক বিশ্বাস থেকে কিছু করে, সে করুক। সে দণ্ডি কাটুক, ব্রত-উপবাস যা খুশি করুক। কারণ বুঝি। যুক্তি মানুষের বুদ্ধিকে সতেজ করতে পারলেও, ভবিষ্যতের অনিশ্চিতয়তার কাছে যুক্তিবুদ্ধি অনেকাংশেই অসহায়। আজ যেমন দেখছি কোনো এক অভিনেত্রীর জন্য অতিবাম মানুষেরাও 'মিলিত প্রার্থনা' করতে বলছেন। অবশ্যই এও অন্ধবিশ্বাস যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস না থাকে তবে। কিন্তু দুর্বল মুহূর্তে এ সব হয়। আমাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতা এক। প্রিয়জন সংকটাপন্ন হলে আমাদের অনেকেরই সব গোলমাল হয়ে যায়। সে আলাদা কথা, বুঝি। কিন্তু এটা তো তা নয়।

বাঙালি প্রজাতির বহু ছেলেমেয়েই শুনি "বাড়ির চাপে" আর "মাকে কে দেখবে" এই যুক্তিতে বিয়ে করে। তারপর মা নার্সিংহোমে শ্বাস উঠে "বাবু বাবু" করছেন, আর বাবু বউ নিয়ে জন্মদিনের পার্টি করতে ব্যস্ত, এ সব দেখে দেখেও চুলে পাক ধরে গেল। কিন্তু এই ধ্যাষ্টামোটা আর বন্ধ হল না। আমার অনেক বন্ধু, দাদা, কাকা 'বাড়ির চাপে' বিয়ে করল, যেন বাড়ির সেই চাপটা না থাকলে সব সাধুসন্ত হয়ে হিমালয়ে গিয়ে সেঁধিয়ে বসে থাকত এমন ভাব। আজও দেখি এই প্রজন্মের বেশ কিছু ছেলে একই যুক্তি দেখিয়ে যাচ্ছে। আরে বাবা এখন তো ছোটো বাচ্চারাও বলে না ঠাকুর এসে বাচ্চা দিয়ে গেছে, এখন তো এ সব অপযুক্তি ছাড় রে বাবা!

আমাদের রেলকলোনিতে এক কাকিমা আসতেন, মুড়ি বিক্রি করতে। তা তার বাড়ির সামনে কেউ কার্তিক ফেলে গিয়েছিল। সে কাকিমাকে মা জিজ্ঞাসা করলেন, কি করলেন দিদি?

তিনি বললেন, কেন? তুলসীতলায় বসিয়ে দিয়ে এলাম। আরে আমার বউমাকে নিয়ে মাসে একবার করে গাইনি দেখাতে যেতে হয় দিদি কলকাতায়। বছর দুই হল বাচ্চা হচ্ছে না। সে খরচ কি কম দিদি যে আমি এ আদিখ্যেতা করব? ওতেই যদি হত দিদি তবে ডাক্তারবদ্যি ছেড়ে লোকে কার্তিক পুজো করেই সব কাজ সারত… ঠাকুর মানি দিদি, কিন্তু এসব গাজোয়ারি আমার ভালো লাগে না। আমি কার্তিকঠাকুর তুলসীতলায় বসিয়ে বললাম, এখানেই থাকো বাবা, যারা আমার বাড়ির দরজায় দিয়ে গেছে পারলে তাদের ডেকে তাদের বাড়ি যাও গিয়ে।

আমার এই কথাটা, সেই কাকিমার মুখটা অনেক শিক্ষিত মানুষের ধ্যাষ্টামো সংস্কারের সামনে দাঁড়ালে মনে পড়ে। আসলে একটা জিনিস তো হাড়ে হাড়ে বুঝছি, এই ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড, কি আমি যাকে ধ্যাষ্টামো সংস্কার বলছি সে সব স্কুল-কলেজ সিলেবাসের উপর নির্ভর করে না। নইলে শিক্ষিত বাবা-মা কি করে ছেলেমেয়েকে গ্রহণের সময় আজও অনেক বাড়িতে না খাইয়ে রাখে? এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। বরং দেখেছি স্কুল-কলেজ যাওয়া অভিমানী মানুষেরাই এই ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড আর ধ্যাষ্টামো সংস্কারের পক্ষে অপযুক্তি সাজাতে পারে। সে চালাকিটা তারা শিখে নেয় বেশ। তারপর কপট অসহায়তার হাসি হেসে, হাত কচলিয়ে বলে, "বুঝতেই তো পারছেন"।

সমস্যাটা কি বলুন তো, বৈজ্ঞানিক সত্যটা জেনেও তাকে অস্বীকার করার মত সামাজিক সমর্থন যে সমাজে অনুষ্ঠান করে পালন করা হয়, সে সমাজে এমন ধ্যাষ্টামোটাকে লোকে সামাজিক আচরণ বলে ভুল করে। তাতে মেরুদণ্ডে একটা একটা হাড় দুর্বল হতে থাকে। উপার্জনে, ব্যবসায়, চাকরিতে ক্ষতি কিছু হয় না, কারণ ওখানে ব্যক্তিত্বের চাইতে কৌশলের প্রাধান্য। ক্ষতিটা যেখানে হয় সেটা হল সমাজে শাসক থেকে প্রজা কেউ-ই আর সংকটের সময় বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে পারে না। হয় বেড়ালটাকেই অস্বীকার করে, নয় বলে ঘন্টাই নেই, বাঁধব কি?

লোকাচারের নামে, সংস্কারের নামে, ঐতিহ্যের নামে যে সত্যনারায়ণকে ক্ষণে ক্ষণে, পদে পদে অস্বীকার করে চলি আমরা, ওতে আমাদের পায়ের বেড়িই শক্ত হয় আরো। নরের অন্তঃস্থলে যে সত্য আচরণে, অনুভবে, বাক্যে প্রকাশিত হবার জন্য উন্মুখ, বৈজ্ঞানিক সত্য আর ভাবগত সত্যের হাত ধরে, সে আর হচ্ছে কই? সত্যনারায়ণ আমাদের ডাবল ষ্ট্যাণ্ডার্ড আর ধ্যাষ্টামো সংস্কারের তলায় তলিয়ে, আমাদের ফাঁকিবাজির উপাদানে গড়া সিন্নিতেই ভাবি তুষ্ট হয়ে যাবেন। ফাঁকি দিয়ে ফাঁকিই পাই আমরা। আর ফলে দুর্বল থেকে দুর্বল হই। তারপর হাত কচলিয়ে, কপট অসহায়ের হাসি হেসে বলি, "বুঝছেন তো সবই"।

129
Sun, 11/13/2022 - 14:03

অবশেষে এক দীর্ঘকালীন মাইক উৎসব শেষ হল। দেবী কখনও দশভূজা, কখনও চতুর্ভূজা, কখনও দ্বিভূজা হয়ে নানা বাঁশবাটিকায় পুজো নিয়ে ফিরলেন। কখনও হিন্দি, কখনও বাংলা, কখনও ভোজপুরি… ইত্যাদি কোন গানে দেবী বেশি প্রসন্ন হন ঠাহর করতে না পেরে পুজো কমিটিরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টাও করল। অবশ্যই সেই আদিকাল থেকে শুধু সংস্কৃত মন্ত্রে যে কারোর মন ভরে না সেটা তো যে কেউই বুঝতে পারে, তাই না?

কথা হচ্ছে এইবার কি হবে? সামাজিক দায়িত্ব বলতে যে চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য মাঝারি কি ছোটো ইত্যাদি ধরণের যাই হোক না কেন, তার বাইরে এবার কি করার আছে? জীবিকা নির্বাহ এক বড় কাজ। তারপরে নানা ওয়েব সিরিজ, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদিতে চিত্তের তৃপ্তির রাস্তাও না হয় খোঁজা গেল, কিন্তু এরপর কি হবে? খেলা আসছে, হ্যাঁ। বিশ্বকাপ ফুটবল। ক'দিন কয়েকটা বিদেশী দেশের নাম নিয়ে বেশ কোন্দল হবে। হোক। আদতে তবে আমরা ঠিক কোথায়?

কিন্তু এই যে পুজো পুজো বাতিক বাঙালিকূলের ঠিক অবস্থানটা এখন কোথায়? শ্যামাপোকারা শীতের আগে কোথায় থাকে সৌমিত্র?

বাঙালির আগে একটা পরিচয় ছিল, শাক্ত বনাম বৈষ্ণব। এখনও এদিক ওদিক তাকালে দেখা যায় সে প্রজন্মের বাঙালি যে নেই তা বলি না, আছে তবে কম। কিন্তু এখন বাঙালির লোকাচার, কি ধর্মাচারের ঠিক অবস্থানটা কোথায়?

এক কথায় বলা মুশকিল। যদি ভাবি বাঙালি দর্শন এখন ঠিক কোন জায়গায়? দর্শন বলতে আমি ধর্মীয় দর্শনের কথা বলতে চাইছি। স্পষ্ট তেমন কিছু নেই আজ। এক কালে বাঙালি ন্যায়দর্শন চর্চা করেছে। তারপরে বৈষ্ণব দর্শন। তারপরে কতিপয় শহুরে বাঙালি খ্রীষ্টধর্মের আঙ্গিকে ব্রাহ্ম দর্শনে মেতেছে। যা কিছুটা উপনিষদ আর বাইবেলের ককটেল ধরণের। পিতার উপাসনা হয়েছে। মায় কেশব সেনের জীবনেও শেষের দিকে বাইবেল শোনার কথা পড়েছি কোথাও। তারপর?

রামকৃষ্ণ ঠাকুর আর বিবেকানন্দের মাধ্যমে বাঙালির প্রাণে এক দেশাত্ববোধক ধর্মীয় দর্শন এককালে ভালো প্রভাব ফেলেছিল। আমাদের অনেক বিপ্লবী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হল। স্বামীজির “শিবজ্ঞানে জীব সেবা” ততটা বাঙালি জীবনের মূল ধারাকে অনুপ্রাণিত করল না, যতটা করল রামকৃষ্ণ ঠাকুরের অবতারতত্ত্ব। দলে দলে মানুষ দীক্ষা নিতে শুরু করল। এক নতুন সম্প্রদায় গড়ে উঠল। যারা নিজেদের অত্যাধুনিক মনে করল। কারণ স্বামীজির মতে রামকৃষ্ণ ঠাকুর বিষ্ণুর নবতম সংস্করণ। এখন স্বামীজি যে উদ্দেশ্যেই বলুন, ‘ভদ্রলোক’ বাঙালি জাতির মনে এই ভাবটা বেশ একটা নতুন ধারা নিয়ে এলো। তারা গত বৈষ্ণবদের কিছুটা অশিক্ষিত ম্লেচ্ছ ইত্যাদি হিসাবে দেখতে শুরু করল। নিজেদের অত্যন্ত যুক্তিবাদী, প্রগ্রেসিভ, উন্নতমনা আধুনিকভাবে দেখতে শুরু করল।

কিন্তু ইতিমধ্যে বাঙালি সমাজে আরো অনেক গুরু এসে গেছেন, রামকৃষ্ণ উত্তর যুগে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ে বাঙালি ভাগ হতে শুরু করল। যেমন রামকৃষ্ণ মিশনগামী বাঙালি, সৎসঙ্গী বাঙালি, ইস্কনীয় বাঙালি, গৌড় মঠীয় বাঙালি, ওঁঙ্কারনাথীয় বাঙালি, আনন্দময়ী মা অনুগামী বাঙালি…..

এখন একটা কথা এখানে উল্লেখ্য যে এরা সব কিন্তু একটা অরগানাইজড ধারায় ভক্ত। এখানে সব সম্প্রদায়ের কিছু আচার অনুষ্ঠান আছে, নির্দিষ্ট উৎসব আছে, যেমন নিজের নিজের গুরু জন্ম উৎসব ইত্যাদি। এখানেও একের প্রতি অন্যের “আমি বেশি ঠিক” ভাব বর্তমান।

তবে বাঙালির ধর্মীয় দর্শনটা ঠিক কি আজ?

এখানেই একটা মজার দিক আছে। উপরি উক্ত সবই শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত আর কিছুটা উচ্চবিত্ত বাঙালির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এখানে তেমন কোনো দর্শন নেই। যে যার সম্প্রদায়ের কিছু কিছু বইকে, যা সাধারণত সেই সব সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় পুরুষ বা নারীর বাণী, কিছু স্তব-প্রার্থনা ইত্যাদিকে নিয়ে আছেন।

এর বাইরে আছে এক বিশাল সম্প্রদায়, যারা সতীমায়ের অনুগামী, মতুয়া, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বাঙালি। আর আছে বাউল।

এখানে একটা দিক অবশ্য করে বলার, এই যে ‘ভদ্রলোক’ সম্প্রদায়ের বাইরে যে বিশাল ধর্মীয় দিক, তার প্রধান প্রাণপুরুষ অবশ্যই শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ। বাউলের গানে, মতুয়ার লেখায়, সতীমায়ের ভাবগীতিতে সেই এক মহাপ্রভুর শিক্ষা দেখা যায়। কারণটা অবশ্যই স্পষ্ট। বাঙালির ইতিহাস পড়তে গেলে শ্রীচৈতন্য অধ্যায়কে বাদ দিয়ে যেহেতু যাওয়া যায় না।

বাঙালির এই ‘ভদ্রলোক’ স্তর চিরটাকাল বারবার পরিবর্তন হয়েছে। এক গুরু থেকে আরেক গুরুতে এসেছে। কোনো ভাবই তেমন গভীরে স্পর্শ করেনি তাদের। তারা ভীষণ স্ব-জাতি সচেতন। আবার এমন অনেক উদাহরণও দেখেছি যে তথাকথিত অভদ্রলোকীয় স্তর থেকে আসা মানুষ ভদ্রলোকীয় স্তরে ঢুকে নিজেদের পরিবর্তন করে নিয়েছেন। তারা নিজেদের মতুয়া ইত্যাদি পরিচয় থেকে বার করে আনার চেষ্টা করছেন। আবার অনেকে করছেন না, এমন উদাহরণও আছে।

বাঙালির ধর্মীয় দর্শন বলতে তবে দাঁড়ালো, একদম সাধারণ স্তরে মহাপ্রভু প্রচারিত জটিল দার্শনিক তত্ত্বহীন মানবিক শিক্ষা। তারও বিকৃতি যে হয়নি তা ঠিক নয়, হয়েছে, তবু একরকম টিকে আছে।

আরেক দর্শন হল কলোনিয়াল যুগের সংঘাতে জেগে ওঠা নানা ধরণের দেশাত্ববোধক চিন্তা। সেই দেশাত্মবোধক ধর্মীয় দর্শনকে জাগাতে অনেকে কিছুটা মনুসংহিতা নির্দেশিত বর্ণাশ্রমের সঙ্গে আধুনিকতাকে মিশিয়ে এক তত্ত্বও দাঁড় করাতে চেয়েছেন। পরবর্তীকালে তা অবশ্যই নানাবিধ জীবিকার কারণে বাঙালিকূলের পক্ষে মেনে চলা সম্ভব হয়নি সব অর্থে। একমাত্র পাত্রপাত্রীর বিজ্ঞাপন আর পুজোবিধি ছাড়া তার নিদর্শন খুব একটা চোখেও পড়ে না।

তবে এর মধ্যে বেশ কিছু দিকে রামকৃষ্ণ ঠাকুরের চিন্তার মধ্যে একটা স্বকীয়তা ছিল। মৌলিকত্ব ছিল। ভাষাতেও। সে আলাদা প্রসঙ্গ। কারণ রামকৃষ্ণ ঠাকুরের দর্শনকেও আন্তরিকভাবে নিলে বাঙালির আজ এই উগ্র সার্বজনীন মাইকোৎসব হত না। রবীন্দ্রনাথ একবার খুব ক্ষোভের সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে লিখছেন যে, বাঙালি না তো মহাত্মার অহিংসাকে আন্তরিকভাবে নেওয়ার উদারতা দেখিয়েছে, না তো সশস্ত্র বিপ্লবে খুব জোরের সঙ্গে রাস্তায় নেমেছে। আরো লিখছেন যে মারার বেলায় যাদের চালাকির অভাব হয় না, আর মার খাবার বেলায় যাদের নালিশ আকাশকে ছোঁয় তাদের খুব একটা উচ্চাসনে জগত বসায় না।

তবে এর মধ্যেও অসম্প্রদায়ভুক্ত, বামচিন্তাবিদ, অধর্মীয় বাঙালিকূলও আছে। কিন্তু সে বাম জামানাই হোক কি আজকের সরকার, বাঙালির প্রাণঘাতী মাইক সর্বস্ব উৎসব, বাঙালির পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনে জাতকুল বিচার চলে এসেছে। অনেক নাস্তিক বাড়িতে ঘটা করে পৈতেও দেখেছি। শ্রাদ্ধও দেখেছি। আসলে নাস্তিকতা যতটা প্রচারের জিনিস ততটা আচরণে আর বিশ্বাসের জিনিস হয়ে ওঠেনি। নইলে একমাস ধরে প্রায় কর্মনাশা উৎসব করে অর্থনীতি চাঙ্গা করার কথা তো ভাবাই যেত না, না?

এরপরে আসে একে তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ। দেখেছি ভদ্রলোক গোষ্ঠী অভদ্রলোকীয় সম্প্রদায়ের উৎসব নিয়ে, আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে অদ্ভুত উন্নাসিক ভাব দেখাতে। তাই গণেশ পুজো যতটা আপন হয়, ছট হয় না। কারণটা আর্থসামাজিক, ধর্মীয় দর্শন বা পরিবেশ দূষণ নয়। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যে আসলে পরোক্ষ আত্মপ্রচার আছে, আমি ওদের মত নই, বা আমি অনেক প্রগ্রেসিভ গোছের কিছু একটা ইমেজ বোঝানোর চেষ্টা। এদিকে বাঙালি কি অনায়াসে তার বিজয়ার শুভেচ্ছা ভুলেছে। বাড়ি গিয়ে প্রণাম করা ভুলেছে। কিন্তু অহংসর্বস্ব তর্ক ভোলেনি। সঙ্কীর্ণ উদ্দেশ্যে মহৎ দর্শনের কুৎসিত ব্যবহার ভোলেনি। এক বইতে দেখলাম, মহাপ্রভু নাকি “নিঃস্বার্থ উদারতার” জন্য ওনার বিপ্লবটা করেছিলেন, যা নাকি “মতলব”, আর “সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি” গোছের। হাসিই পেল এমন গবেষণা দেখে। আসলে গবেষণা প্রমাণ ছেড়ে বিচারের রাস্তায় গেলেই সেই বিচারকারীর নিজের ম্যাচিউরিটি আর অনুভবের সীমাবদ্ধতার দোষে দুষ্ট হয়ে যায়। ফলে দাঁড়ায় সেই শকুনের গল্প, উড়ছে উঁচুতে, দৃষ্টি ভাগাড়ে।

তবে বাঙালির দর্শনের উদারতা এক রামকৃষ্ণ ঠাকুরের রাস্তা চেয়ে ছিল না। কোনো মহত্বই ব্যক্তি মুখাপেক্ষী তো নয়। বাঙলায় এককালে যে বাউল সম্প্রদায় এসেছিল তারাই কি তবে আদতে বাঙালির আসল দর্শনের কাণ্ডারি? যার প্রাণ প্রতিষ্ঠাতা অবশ্যই মহাপ্রভু। মহাপ্রভুই কি বাঙালির সে অর্থে নবজাগরণের প্রথম শিখা? বাউল যার মাটির সব চাইতে কাছাকাছি ধারা? মাঝে কালিকাপ্রসাদের জন্য বাঙালির প্রাণে হুজুগে বাউল ভালোবাসা জেগে উঠেছিল। কারণটা অবশ্যই টিভির গানের রিয়েলিটি শো। আজ? মূল ধারার বাঙালিকূল খোঁজও নেয় না।

বাঙালির দর্শন, গৌরব মাইক বাজিয়ে পাড়া কাঁপিয়ে ইউনেস্কোর বদান্যতায় নয়। বাঙালির দর্শন কীর্তনে, বাউলে, উদারতার ভাব নিয়ে লেখা শ্যামাসঙ্গীতে। কোনো সম্প্রদায়ে নয়। কোনো আশ্রমে নয়। সব আশ্রম উবে গেলেও, সব সম্প্রদায় মুছে গেলেও, বাঙালি নিজেকে ফিরে পাবে উপনিষদে, বেদে নয়, মহাপ্রভুর আকুতিতে, বাউলের একতারায় আর কীর্তনের খোলে। সেখানে মানুষের ডাক, মানুষের প্রাণের ডাক। চোখের জলের সঙ্গে প্রাণের উদারতায় বিশ্বমানবের আবাহন। কিছু যায় আসে না ইউনেস্কো তার খোঁজ রাখুক কি না রাখুক। আপামর মাটির কাছাকাছি বাঙালিকে খুঁজতে গেলে সেখানেই যেতে হবে। কাদাজল মেখে ডিঙ্গিতে উঠতে হবে। ভাটিয়ালির সুরে, কীর্তনের সুরে, বাউলের সুরে মানুষকে জাগাতে হবে।

উৎসব কি হবে? উৎসব হবে, বাউলের আখড়ায়। কীর্তনের আখড়ায়। বাঙালি আবার প্যাণ্ডেল বেঁধে, ভাষণ দিয়ে মানুষকে নিয়ে মাতার কথা ভাবল কবে? সে তো গেয়েছে। সে তো নেচেছে। বিশ্বতানে সুর মিলিয়েছে তার অতি অল্প সহজ আয়োজনে, একটা একতারায়, কি মাটি দিয়ে বানানো খোলে। উদারতা জেগেছে কাব্যে। সহজ হয়েছে সুর। আজ সে বাঙালি কোথায়?

130
Wed, 11/02/2022 - 00:46

খট করে একদম বাইরের গেটে আওয়াজ হল। ঘড়ির দিকে তাকালাম, পড়তে আসার সময় হল। নিশ্চয়ই এসেছে কেউ। ঘরের দরজা তো খোলা, আসছে না কেন, দু'মিনিট তো হল।

উঠে বাইরে গেলাম। সে বাগানে দাঁড়িয়ে, টিফিন বক্সটা সাইকেলের কেরিয়ারে রেখে গোগ্রাসে গিলছে। আমি থ হয়ে গেলাম। সে আমায় দেখে থতমত খেয়ে টিফিনবক্সটা তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, আসলে স্কুল থেকে আসছি তো সরাসরি...

আমি বললাম, তো বাইরে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে খেতে খাচ্ছিস কেন? আমরাও তো খাই... বাড়িতেই বসে খাই... আয়...

আমার গলায় কপট ধমকের সুর ছিল। কারণ দৃশ্যটা দেখে কষ্টটা চাপা দেওয়ার ওটাই একমাত্র উপায় তখন আমার।

সে কয়েকবার "না, না", বলে ঢুকল ঘরে। ডাইনিং টেবিলে বসতে বললাম। হাজার জড়তা নিয়ে বসল। নিজেকে যতটা সঙ্কুচিত রাখা যায় ততটাই চেষ্টা করল। জলের বোতল পাশে রাখলাম। সে আরো কুঁচকে গেল। আমি আমার ধমকের সুর আর ভাষাকে প্রাণপণে টিকিয়ে গেলাম। এত সংকোচ কেন? কারণ আমি তার শিক্ষক বলে নয়, তার সঙ্গে আমার আর্থসামাজিক ব্যবধান আছে বলে।

খাওয়া শেষ হল। সব কিছুর পর জিজ্ঞাসা করলাম, এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন বল তো...

সে বলল, রুটি তরকারি খেতে গিয়ে কোনো এক স্যারের বাড়ির মেঝেতে পড়েছিল। স্যার নাকি ব্যাচের মধ্যেই ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ম্যানার্স শেখায়নি বাড়িতে?

মেয়েটার চোখে জল এলো। আমি উঠে গেলাম। আমারও তো সহ্য করার ক্ষমতা আছে।

ফিরে এলাম। ব্যাচে তখন অনেকে এসে গেছে। কথার ধারা বদলে গেছে। তার চোখের কোলও শুকনো। সে ব্যস্ত বন্ধুদের সঙ্গে।

একবার এক আয়ার মুখে শুনেছিলাম, এক বাড়িতে কাজের জন্যে গিয়ে, রাতের খাবার আনেনি বলে সে বাড়ি থেকে খাবারও জোটেনি তার। অথচ রুটি বেলা থেকে সবই তাকেই করে দিতে হয়েছিল।

এগুলো হয়। অনেক উদাহরণ নিজের চোখেই দেখেছি। কেন হয়? জানি না। তবে হয়। আহা রে, বেচারা রে… ওরা দুষ্টুলোক… ইত্যাদি আলোচনায় যাচ্ছি না। আসলে কথাটা অন্য। যাদের কথায় কথায় ইংরাজিতে "নিডি" ফ্যামিলি বলি, সেই 'নিড'টা কি একতরফাই শুধু? আমার মানবিক কোনো তাগিদ নেই?

কি হয় জানেন? মানুষ অপমানিত হতে হতে সমাজের একটা বড় স্তরকে ছিন্ন করে ফেলে আরেক স্তর থেকে। বিদ্বেষ একদিনে জমে না। তাচ্ছিল্য একদিনে ফল দেয় না। দিনে দিনে বিষাক্ত বাষ্প তৈরি হয়। তা সমাজের সব স্তরকে গ্রাস করে এসে। মানুষকে ছোটো দেখানোর ফিকির আমাদের দেশে বহু প্রাচীন। সে মহাভারতের কর্ণ, শূর্পণখা থেকে মনুসংহিতা হয়ে আধুনিক কালের নানাভাবে টিকে থাকা বর্ণাশ্রমপুষ্ট ছুঁৎমার্গ অবধি। এতো আছেই, সঙ্গে আর্থসামাজিক ছুঁৎমার্গ। শিক্ষিত অশিক্ষিতের ছুঁৎমার্গ। আজও বাংলার বহু আশ্রমে ব্রাহ্মণ আর অন্যজাতের মানুষদের খাবারের পঙ্‌ক্তি আলাদা হয়। এটা সংস্কৃতি না, এটা অসুস্থতা। মানসিক বিকার। কাউকে অপমান করতে একটা মানসিক বিকারের দরকার হয়। নইলে ধুম করে কাউকে অমন অযথা অপমান করা যায় না। এর মধ্যে সব চাইতে ঘৃণ্য পাপ বাচ্চাদের অপমান করা!

এক বাড়িতে আয়া তার অসুস্থ বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়েছিল বলে বাড়ির অধ্যাপক মালিক বলেছিলেন, বাচ্চার খাবারটা বাড়ি থেকেই এনো। আমার বাড়ির চাল দানছত্র খোলার জন্য নয়।

কথাটা ভীষণ তথাকথিত প্র্যাক্টিকাল নিশ্চয়ই। কিন্তু অমানবিক। কারণ কথাটা বাচ্চাটার সামনে বলা হয়েছিল। বাড়িতে বাড়িতে তো আর বিদ্যাসাগর জন্মান না যে দুটো চড় কষাতেন গালে। তাঁর অবশ্য হাত লাগত না, চোখের আর মুখের ভাষাই যথেষ্ট হত।

বাচ্চাদের অপমান করা ঘৃণ্যতম অপরাধের মধ্যে একটা। সে বাচ্চাটা যতই প্রতিভাশালী হোক না কেন, কিন্তু তার আত্মমর্যাদাবোধ ধুলোয় এসে মেশে। ইংরাজিতে যাকে সেল্ফ-এস্টিম বলে, সেটা ছাড়া বেঁচে থাকা যে কি দুঃসহ, নারকীয় জীবন হয়ে ওঠে, সে যার হয় সে-ই জানে। সে কাজের জগতে যতই উঁচুতে উঠুক না কেন। নিজেকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে সে কিছুতেই পারে না। প্রশংসা পেলে ভাবে অতিরিক্ত পাচ্ছে কিছু, নিন্দা পেলে ভাবে এটাই সে ডিজার্ভ করে।

যারা আমরা শিক্ষকতা করি, কি কোনোভাবে বাচ্চার অভিভাবক, সে যেভাবেই হই না কেন, এইটুকু যেন খেয়াল রাখি তার আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত করা সব চাইতে সহজ বলে সেটাকেই যেন ব্যবহার না করি। তার মধ্যে নরকের বীজ যেন না বুনি, তার ভালো করতে গিয়ে। তাকে তথাকথিত শাসনের মাধ্যমে।

জানি না আমি বলতে পারলাম কিনা। ভীষণ অস্বস্তি হয় এ ধরণেরর প্রসঙ্গের অবতারণায়। অনেক কথা, অনেক মুখ ভিড় করে আসে মাথার মধ্যে। সে সব সামলিয়ে গুছিয়ে লেখা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে এই যে আমরা কথায় কথায় বলি না যে মানুষ হল সামাজিক জীব, কথাটাকে তলিয়ে ভাবি না। মাছ যেমন জলজ প্রাণী। জলটা দূষিত হলে মাছটার রক্তেও বিষ ঢোকে, বিষাক্ত হয়ে ওঠে সে, তেমনই মানুষও। সমাজ দূষিত হলে মানুষও দূষিত হয়ে ওঠে। সমাজ মানে রাস্তাঘাট, হাস্পাতাল, মিউনিসিপালিটি, পঞ্চায়েত তো নয়। সমাজ মানে মানুষ। সহমর্মিতায়, উপযোগিতায় দলবদ্ধ মানুষ। সেই সহমর্মিতা আর উপযোগিতার সূত্রই যদি নড়বড়ে হল, একে অন্যকে শোষণ, পীড়ন করার জন্য ভিড় জমানো মানুষ যদি সমাজের সংজ্ঞা হয়, তবে তো সত্যিই বিপদ।

অসংবেদনশীল মানুষ সমাজে থাকবে না, তা বলছি না। থাকবেই। কিন্তু কিছু মানুষ যেন শুশ্রূষার জন্যেও থাকেন। সমাজে সবাই থাকে বলেই সমাজ। একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি, এই যে এতগুলো পুজো গেল, বহু জায়গায় পাড়া থেকে খিচুড়ি প্রসাদ রাঁধা হয়, যে চায় তাকেই দেওয়া হয়। এর জন্যে কোনো পরিচয়পত্র লাগে না। কি ধর্ম, কি জাত এ প্রশ্নও আসে না। কারণ সেটা শুধু কোনো পুজোর প্রসাদ নয়, সেটা উৎসবের প্রসাদ এইটাই বড় কথা। উৎসব মানুষের মিলনের আনন্দ। সেখানে সব মিলে একাকার হয় বলেই আবার ধাক্কা লাগে সমাজে। সব সচল হয় আবার।

মানুষে মানুষে এক হলেই উৎসব হয়। যদি সেখানে বিকার না থাকে। সেই উৎসবের আনন্দেই বড়ছোটোর মধ্যে ব্যবধান ঘুচে যায়। সেই উৎসবের আয়োজনই চাই। নিত্য। বাচ্চারা সেই উৎসবেই বড় হোক। প্রাণের আলো নেভানো অন্ধকারে নয়।

131
Tue, 11/01/2022 - 13:50

যীশুখ্রীস্টকে যারা মেরেছিল আর যে মারার আদেশ দিয়েছিল, তারা সবাই জানত তারা ঠিক নয়। এমনকি তার নামে যারা নালিশ করেছিল তারাও জানত তারা ঠিক নয়। কিন্তু ঠিকটা কি তাও তারা বুঝতে পারছিল না। স্বার্থবুদ্ধিতে বিবেক দুর্বল ছিল বলে। বিবেক দুর্বল ছিল, ঘুমিয়ে তো ছিল না। তারা বুঝেছিল যে মানুষটাকে তারা মারতে চাইছে সে তাদের সবার থেকে উন্নত। কিন্তু তাও তারা মারতে চাইছে কারণ ঠিকটা কি তারা বুঝতেই পারছে না। যদিও জানে তারা নিজেরা ঠিক নয়।

এমন সময় আমাদের সবার জীবনে আসে। যখন আমরা জানি আমরা যেটা ভাবছি, কি বলছি, কি করছি, সেটা ঠিক নয়। কিন্তু ঠিকটা কি সেটাও তো জানি না স্পষ্ট করে। খ্রীষ্ট সরল চোখে তাকিয়ে থাকে আমাদের বিবেকের দিকে। ভালোবাসা শোনা শব্দ। কিন্তু বিবেকে জাগে কই? সহিষ্ণুতা, ক্ষমা জানা শব্দ, কিন্তু প্রেরণা আসে কই? ওগুলো বড্ড বোকাবোকা সেকেলে ধারণা যেন। বড্ড বইয়ের মত ঠিক, কিন্তু জীবনের মত ঠিক তো নয়। কিন্তু এও জানি আমিও ঠিক নই গোটাগুটি।

যেটা আসলে ঠিক, সেটা এত সরল যে তাকে মেনে নেওয়া যায় না। এত সরল যে ভাবতেই হাসি পায়। আমি নাকি সব ক্ষমা করে দেব? আমি নাকি সব সময় সত্যি কথা বলব? আমি নাকি ভালোবাসব, যে ক্ষতি করেছে তাকেও?

বোকার মত কথা। বোকার মত ভাবনা। বইয়ের মত সত্যি। জীবনের মত নয়। তবু আমিও যা করছি জানি সে জটিল, সেও পুরোপুরিভাবে ঠিক নয়।

কিন্তু একটা কিছু তো ঠিক করে নিয়ে চলতে হবে। তখন আসে সুবিধার ঠিক। কিন্তু যাতে আমার সুবিধা তাই যে সব সময় ঠিক নয়, সেকি আমি জানি না? জানি তো। কিন্তু ঠিকটা কি যখন জানি না, তখন সুবিধাটাই দেখি না কেন? ধীরে ধীরে এইভাবে আমি ঠিকের খোঁজ ছেড়ে সুবিধার দিকে ঝুঁকে পড়ি। সুবিধা ধীরে ধীরে আমায় কোমল করে তোলে। নরম করে তোলে। আমি ঠিক আর সুবিধা গুলিয়ে একাকার হয়ে তখন। আমার বিদ্যাবুদ্ধি সব তখন সুবিধার দিকে ঝুঁকছে। আমায় মারণ বেগে টানছে।

সমস্যা হল মানুষের স্বভাবকে নিয়ে। সে সুবিধার দিকে চূড়ান্ত মেরুতে পৌঁছে গেলেও ঠিকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। ঠিকটাকে খুঁজে বার করা তার ধর্ম। সে সুবিধার বিপরীতে গেলেও। অতিবড় পাষণ্ড হলেও সে ঠিকের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য। যদি না সে উন্মাদ হয়। যদি না সে বিকারগ্রস্থ হয়। আমাদের শিক্ষা, সভ্যতার বুনিয়াদ বলে সুবিধা ছাড়ো, ঠিকের দিকে ফেরো। আমরা আমাদের চলতি শিক্ষা, ক্ষীণদৃষ্টি বিষয়বুদ্ধিকে উস্কে বলি সে সবের জন্য অন্যলোক আছে। আমি সে নই। মুখে বলি। কিন্তু প্রাণে জানি শুধু সময়ের অপেক্ষা। সুবিধার মেয়াদ ফুরাবে। ঠিক যা সে আবার জেগে উঠে তলব করবে, কৈফিয়ৎ চাইবে খুঁটিনাটি সব হিসাবের। কিন্তু সে তো শেষের কথা, তার আগে সুবিধার মধ্যে সুযোগ বুঝে ঘর বানাতে অসুবিধা কোথায়?

ততদিনে খ্রীষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়ে গেছে। যা ঠিক, তা নানা জটিলতায় গেছে হারিয়ে। এদিকে কি যেন মিলছে না। হিসাব? নাকি ঋণের বোঝা?

একদিন অপঘাতে সব শেষ হয়। নইলে প্রাণে জন্মায় গ্লানি। বিন্দু বিন্দু গ্লানি সহ্য করতে করতে বুকে জমেছে গ্লানির মেঘ। যে কোনো মুহূর্তে মেঘভাঙা বৃষ্টির মত ভাসিয়ে নেবে আমায় যেন। ক্লান্ত আমি। গ্লানির বোঝা সব চাইতে ভারি বোঝা। একদিনে জন্মায় না। তাই প্রথমে হিসাব পাওয়া যায় না। যখন অনুভবে ধরা দেয় তার ভার হয় অসহ্য। ক্লান্ত আমি তখন নিজের বিষণ্ণ দেহ-মন নিয়ে আসি সেই ক্রুশবিদ্ধ রক্তাক্ত বেদীর সামনে। হাতজোড় করে জিজ্ঞাসা করি তুমি আছ? আমি যে সরল সত্যটা অস্বীকার করে গিয়েছিলাম সেদিন, সেটাই আসলে সব চাইতে ঠিক সত্য ছিল। সরল সত্য। স্বাভাবিক সত্য। স্বাভাবিককে স্বাভাবিক জানতে কত জটিলতা পেরিয়ে এলাম। কি আশ্চর্য ছলনাময় জীবন!

অন্ধকারে প্যাঁচা ডেকে ওঠে। ক্রমে আকাশের সব তারা চলে যাওয়ার পর অবশিষ্ট থাকে শুকতারা, একা, এমনকি মিলিয়ে যায় ধ্রুবতারাও। পুবদিক আলোকিত হয়। অবশিষ্ট আয়ুটুকু সম্বল করে শিশিরে গলে যেতে যেতে তখন সে ভাবে, কেউ কোনোদিন বিশ্বাস করবে না জগতে একটা সরল সত্য আছে। অনন্তকাল ধরে আছে। সে আছে বলেই অনন্ত আছে। কি সে? আবার খৃষ্টের চোখের দিকে তাকায়। সরল সত্য দৃষ্টিতে সব স্নিগ্ধ হয়। অথচ এই একটা সরল সত্য বুঝতে কি অপরিসীম শক্তি নিয়ে সহজ হতে হয়। সূর্যের মত।

132
Fri, 10/28/2022 - 12:25

“না চাহিতে মোরে যা করেছ দান - আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ

দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহা দানেরই যোগ্য করে”

 

দানের জন্য যোগ্য হতে হয়? শুনেছিলাম তো উপার্জন করার জন্য যোগ্য হতে হয়। দান পাওয়ার জন্যেও যোগ্য হতে হয়?

     অহংকার বুঝতে চায় না। চেতনা অনুভব করে, সে যা পেয়েছে, দান হিসাবেই পেয়েছে। আকাশ, আলো, তনু, মন, প্রাণকে আমি কি অর্জন করেছি? আমি তো পেয়েছি। দান হিসাবে পেয়েছি। ভিক্ষা নয়, দান। ভিক্ষা সম্পূর্ণ নির্ভর করে যে ভিক্ষা দিচ্ছে তার উপর। কিন্তু দান? সে নির্ভর করে যে দান গ্রহণ করবে তার উপর। শিক্ষক যা শেখাতে চান, সে তিনি আন্তরিকভাবে সবটুকুই শেখাতে চান সবাইকে। কিন্তু সে শিক্ষা কি সবার অন্তরে সমান মাত্রায় গিয়ে দাঁড়ায়? না, সে নির্ভর করে যে শিখছে তার উপর। সে কতটা প্রস্তুত তার উপর।

সংসারে রাতদিন খেটে মরছি শান্তি আর সুখের জন্য। সুখ কিনতে পাওয়া যায়। কিন্তু শান্তি? শান্তি কেনা যায় না। কারণ শান্তি হল দানের বস্তু। শান্তি উপার্জন করা যায় না। আজকাল যদিও কর্পোরেট অধ্যাত্মিকতার জগতে তাও বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। কিন্তু সে তো শান্তি নয়, সে ক্ষণিকের জন্য বিরাম। আরেক নতুন অভ্যাসের মাধ্যমে। সে প্রাণায়াম, কি ধ্যান, কি যোগ, কি আরো নানা অভ্যাসের মাধ্যমে কিছুক্ষণের জন্য মনকে অন্যভাবে বিশ্রাম দেওয়ার ব্যবস্থা। কিন্তু শান্তি তার চাইতে অনেক গভীরের বস্তু। আরো গভীরে তার শিকড়। শান্তি দানের বস্তু, উপার্জনের নয়। এটা আগে বুঝতে হবে। শান্তি ফাঁকি দিয়ে পাওয়া যায় না। শান্তি পাওয়ার জন্য মনকে প্রস্তুত করতে হবে। সে শিক্ষা পেতে হবে। তার জন্য কোনো পাহাড়ের গুহা, সমুদ্রের তীর, কোনো মন্ত্র, কোনো গুরু, কোনো গুপ্তবিদ্যা কাজে লাগবে না। হ্যাঁ, এরা প্রত্যেকেই হয় তো কিছুটা সহায়তা করতে পারে, কিন্তু আদতে এরা কেউ শান্তি দিতে পারে না। শান্তি আসে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে। তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত হতে হবে।

রামকৃষ্ণদেব বলছেন, “আমি”রূপ ঢিবিতে কৃপারূপ জল দাঁড়ায় না। “আমি”কে চোখের জলে ডুবিয়ে দাও। আরো বলছেন, “উঁচু জমিতে জল দাঁড়ায় না। নীচু জমিতে দাঁড়ায়”। তুলসীদাস বলছেন, তুমহরি কৃপা, তুমহহি রঘুনন্দন… তোমার কৃপা তুমি নিজেই হে রঘুনন্দন। এই কৃপা মানে কি? ধন সম্পদ, নামযশ, স্বাস্থ্যসুখ… কিছুই না। এর অর্থ শান্তি। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, গঙ্গার দিকে যতই যাবে ততই শীতল হাওয়া গায়ে লাগবে, অর্থাৎ শান্তি পাবে।

আজ যে জিনিসটার সব চাইতে অভাব, সে হল শান্তি। শান্তি চাই কি? শান্তির জন্য কি আমি সব ছেড়ে দিতে রাজী? সব ছেড়ে দেওয়া মানে কি? বাইরে থেকে সব? রামকৃষ্ণদেব সাবধান করছেন, বলছেন, দেখো বাড়িতে অশান্তির ভয়ে যে সংসার ছাড়ে সে মর্কট বৈরাগী। সে ভীতু। সে কাপুরুষ। বড় সংসারের ডাক যার ছোটো সংসার ভাসিয়েছে সে অন্য মানুষ। সে কথা অন্য কথা।

সুখের চেয়ে স্বস্তি ভালো। কিন্তু সব সময় সুখ আর স্বস্তি বিরোধী কি? নয়। শান্তির নিজের একটা স্বভাবগত সুখ আছে। আজ যে এত স্ট্রেস নিয়ে কথা হচ্ছে। উঠতে বসতে সবাই বলছে স্ট্রেস কমাও, নইলে হার্ট, কিডনি, নার্ভ, রক্তের রসায়ন সব গড়বড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ কি বলছে যে এই স্ট্রেস জিনিসটা আদতে কি? কমবে কিভাবে? চিন্তা করবেন না… আরে মশায় চিন্তা করব না বললেই কি চিন্তা বন্ধ হয়ে যাবে? একি আমার মোবাইলের ফ্লাইট মোড? অন করে দিলেই সব থেকে বিচ্ছিন্ন?

স্ট্রেস মানে আমার মন যখন শান্তিহীন। শান্তি কি পাব কি করে?

প্রথম কথাই হল, শান্তি কি পেতে চাই আদতে? আমার প্রায়োরিটির তালিকাটা আবার শুরু থেকে সাজাতে হবে। আমাকে বুঝতে হবে শান্তি আমার প্রায়োরিটির তালিকায় প্রথমে থাকতে হবে। আমি শান্তিতে থাকলে আমার চারপাশকে শান্তিতে রাখা যাবে। শান্তি সব চাইতে বড় শক্তির উৎস। শান্ত মাথা যত কাজ ঠিকঠিকভাবে করতে পারে, অস্থির, উদ্‌বিগ্ন মাথা তা পারে না। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ভুড়ি-মুড়ি ঠাণ্ডা রাখবি। মানে মাথা আর পেট ঠাণ্ডা রাখবি। বাঙালি যখন পেটে ঠাণ্ডা রাখার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা বাহুল্য।

দ্বিতীয় কথা আমায় বুঝতে হবে, শান্তি উপার্জন করা যায় না। শান্তি পরোক্ষ বস্তু। সে নিজে এসে বসে। নিজেকে শান্তি পাওয়ার যোগ্য করে তুলতে হয়। আদিকাল থেকে একই নিয়ম, ত্যাগ ছাড়া শান্তি পাওয়া যায় না। কিন্তু কি ত্যাগ? সংসার, অফিস-কাছারি, ব্যবসা-বাণিজ্য? না। রবীন্দ্রনাথ আর রামকৃষ্ণদেব সহজ করে বলছেন, ছোটো আমিকে ত্যাগ, কাঁচা আমিকে ত্যাগ। ‘ছোটো আমি’ অথবা ‘কাঁচা আমি’ যাই বলো না কেন, সে জীবনকে বিষাক্ত করে তুলছে, বোঝো না কেন? ওকে ত্যাগ করো। রামকৃষ্ণদেব সস্নেহে কেশবচন্দ্র সেনকে বোঝাচ্ছেন। “কেশব কাঁচা আমিকে ত্যাগ করো”। কাঁচা আমি বা ছোটো আমি মানে জেদী, ঘাড়ত্যাঁড়া, ঘ্যানঘেনে, খুঁতখুঁতে, প্যানপেনে, হিংসুটে, লোভী, অবুঝ আমি।

সব শেষে আরেকটা কথা। মজার কথা। শান্তির আশা ত্যাগ না করলেও শান্তি পাওয়া যায় না। কেমন উল্টো কথা হল না? হ্যাঁ, এটা একটা মজার প্যারাডক্স। কিন্তু সত্যি। কেন সত্যি? কারণ শান্তি যদি বাসনার বস্তু তবে ওই কর্পোরেট গুরু, বাড়িতে শান্তিমন্ত্রপাঠ, এই মন্দির, সেই তীর্থ, এই ওই করতে করতে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘেমেনেয়ে ক্লান্ত হয়ে যেতে হবে। সেই ক্লান্তকর অবস্থাকে কেউ কেউ শান্তি বলে ভুল করে বসে। ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। ‘শান্তি চাই’, বলে হামলিয়ে পড়লে শান্তি পাওয়া যায় না, নিজেকে শান্তি পাওয়ার যোগ্য করে না তুললে। তাই বলছিলাম, শান্তি না চাইলেই আসে শান্তি। শান্তির জন্য কাজ করা, আর শান্তিকে নিয়ে কাজ করার মধ্যে পার্থক্য আছেই। যদি শান্তির জন্য কিছু করতে যাই, নিজেকে ঠকানো হয়। আর যদি শান্তিকে নিয়ে এই সংসারের রণক্ষেত্রে ঢুকি, তবে শান্তি ছেড়ে যায় না। সেই সব চাইতে বড় শক্তির উৎস তখন আমার সে।

শান্তিও দুটো হয়। এক কাঁচা শান্তি, যা আজকাল স্পিরিচুয়্যাল মেটেরিয়ালিজমে বিকোচ্ছে। আর এক খাঁটি শান্তি, যা নিজেকে প্রস্তুত না করলে হবে না। প্রথমটা দুর্বল করে, ভীতু করে, পলায়নমুখী করে। দ্বিতীয়টা শক্তিশালী করে। স্থির করে। সত্য দৃষ্টিতে নিয়ে আসে। রবীন্দ্রনাথ শেখাচ্ছেন, শান্তং শিবম অদ্বৈতম। বলছেন, শান্ত হলেই সংসারে মঙ্গলের বা শিবের দর্শন হবে, তবেই ভেদভাব ঘুচে যাবে। অভয়ে প্রতিষ্ঠা হবে।

নিজেকে বোঝানোর সময় এসেছে… ওহে মন, রিলে, শর্ট ভিডিওতে, সোশ্যাল মিডিয়ার নানা নিউজ ফিডে, ইনফ্লুয়েন্সারে, সেলিব্রিটিতে, ছবিতে, ভিডিওতে, জোক্সে, মিমে, ট্রোলে ইত্যাদি ইত্যাদি কোত্থাও শান্তি নেই কো। ওতে বিক্ষেপ আর বিক্ষেপ। রামকৃষ্ণদেবের ভাষাকে অনুকরণ করে বলি, তুমি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকো ক্ষতি নেই, তোমার মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া থাকলে বিপদ। (আসল কথাটা ছিল, নৌকা জলে থাকলে ক্ষতি নেই, নৌকায় জল থাকলে বিপদ।)

কোনো শর্টকাট নেই। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। শান্তি বিশ্বাসের বস্তু। ঈশ্বরে, ধর্মে বিশ্বাসের কথা বলছি না। সে থাকলেও ভালো, না থাকলেও ক্ষতি নেই। বিশ্বাস মানে, নিজের মধ্যে শান্ত থাকার ক্ষমতায় বিশ্বাস। নইলে বাজার নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়ে মারবে। আমিও ঘুরে মরব। আমায় কোথাও একটা বিশ্বাস করতেই হবে - না, বাজারের থেকে বাইরে আমার এক অস্তিত্ব আছে। লাভ-ক্ষতির বাইরে আমার একটা আমি আছে। যে আমি বিশ্বাসের আমি। আনন্দের আমি। শান্ত, স্নিগ্ধ আমি। তাকে না পেলে সারা পৃথিবীর সবক’টা শপিং মলের মালিকানা পেলেও আমি ব্যর্থ। কারণ আমি শান্তি পাইনি। স্বস্তি পাইনি। চাকা ঘুরুক। শুধু কেন্দ্রের স্থির বিন্দুটা না ছাড়ুক। সেই বিন্দুর নাম ভালোবাসা। বিশ্বাস। আস্থা। জীবন।

133
Mon, 10/24/2022 - 18:30

ধর্মে বিশ্বাস করা মানে কি?

একটা বইকে ধ্রুব সত্য বলে জানা। সেই বইয়ের প্রণেতা বা কেন্দ্রীয় চরিত্রকে নির্ভুল, সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ বলে জানা। সেই সম্প্রদায়ের সমস্ত আচার-অনুষ্ঠানকে সব চাইতে পবিত্র বলে মানা। এই কি মোদ্দা কথা?

না। এর একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও আছে। অন্য ওই গোত্রের বইকে অধ্রুব বলে জানা। অন্য বইয়ের প্রণেতা বা চরিত্রকে সংশয়ে জানা। অন্য সম্প্রদায়ের আচার অনুষ্ঠানকে অসত্য, অযৌক্তিক বলে জানা।

এই দুইয়ের এক মিশ্র অনুভূতিতে ধর্ম দাঁড়িয়ে। যার উপর ভিত্তি করে দুটো মানুষ থেকে দেশ বিভক্ত হয়। হানাহানি হয়। এসব কথা আমরা জানি।

আবার সেই ধর্মকে কেন্দ্র করেই উৎসব হয়। তাতে অর্থনীতির চাকা ঘুরে যায়। সেই উৎসবে সিনেমা রিলিজ হয়। বই ছাপা হয়। আরো কত কত কি হয়। তখন আমরা বলি, ওটা ধর্ম নয়। ওটা উৎসব।

এই জটিলতায় সমাজ দাঁড়িয়ে থাকে। অর্থনীতি আর ভোটব্যাঙ্ক নিয়ে যেহেতু আস্তিক কি নাস্তিকের কোনো দ্বন্দ্ব নেই তাই এই উৎসবে যতটা মানুষের মধ্যে প্রচার চালানো যায় সেই সুযোগ নেওয়ার জন্যে সবাই কাছা খুলে রাস্তায় নেমে পড়ে।

আচ্ছা যদি কেউ কোনো বইকে ধ্রুব না মানে, কোনো চরিত্রকেই সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ না মানে, কোনো আচার-অনুষ্ঠানেও না জড়ায় নিজেকে, তার কি কোনো ধর্ম বিশ্বাস থাকতে পারে?

না, আমি বাউল, সুফি, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি কারোর কথা বলছি না। একজন সাধারণ মানুষের কথা বলছি। তার কি কোনো ধর্ম বিশ্বাস থাকতে পারে এ সবের বাইরে গিয়ে? সে কি নিজের সব চেষ্টাকে মঙ্গলমুখী করে তোলার প্রেরণা নিজের ভিতর থেকে আপনিই পেতে পারে? কোনো স্বর্গ, নরক, মুক্তি, নির্বাণ ইত্যাদিতে বিশ্বাস না করে? সে কি একা দাঁড়িয়ে বলতে পারে আমার কাজের দ্বারা কারোর কোনো ক্ষতি না হোক। আমার কথায় কেউ আঘাত না পাক। আমি কারোর জীবনে কোনো অশান্তির কারণ না হই। সে কি নিজের যাবতীয় মানসিক, বাচিক আর কায়িক চেষ্টাকে এইরকম শান্ত, নির্দ্বন্দ্ব মঙ্গলের দিকে নিয়ে রাখতে পারে?

আবার একজন সাধারণ মানুষকে তো নানা আঘাত, অপমান, ভয়ের মুখোমুখিও হতে হয়। যে কোনো ধর্মে ওইভাবে বিশ্বাস করে না, সে কি এই সবের মধ্যে নিজেকে শান্ত রাখতে পারে আপনা থেকেই? জীবনের পথে চলতে নানা অন্ধকারের মধ্যে আলোর দিকে মুখ করে থাকতে পারে? যে আলো মানে তার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একটা আশার অনুভব? কোনো গল্পে বিশ্বাস না করে, কোনো পরিত্রাতাতে বিশ্বাস না রেখে, কোনো আচার অনুষ্ঠানে নিজেকে না জড়িয়ে শুধুমাত্র নিজের চেষ্টাকে উদার, যুক্তিপূর্ণ, সহমর্মি রেখে বাঁচতে পারে সে একা নিজেকে নিয়ে? নিজের বোধকে অখণ্ড রেখে?

এর উত্তর নিজেকে খুঁজতে হবে। শান্ত হয়ে, নির্মোহ হয়ে, অভয় চিত্তে।

তবে হয় তো একদিন এই পৃথিবীতে সত্যিকারের শান্তি আসবে।

134
Wed, 10/19/2022 - 19:53

কিছু মানুষ ক্রিকেট খেলছে। আমরা মানুষ দেখছি না। আমরা দেশ দেখছি। আমরা দেখছি দুটো দেশ ক্রিকেট খেলছে। আবার তারাই যখন অন্যভাবে ক্রিকেট খেলছে, আমরা দেখছি দুটো রাজ্য ক্রিকেট খেলছে।

কয়েকজন মানুষ ক্রিকেট খেলছে। এটা বাস্তব। দেশ আর রাজ্য জুড়ে দেওয়াটা সেন্টিমেন্ট।

বাস্তবকে সেন্টিমেন্ট লেভেল অবধি নিয়ে যাওয়াটা মার্কেটিং। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ এক মহাস্ত্র। বলা যায় ব্রহ্মাস্ত্র। ব্র‍্যাণ্ড সেন্টিমেন্ট করার চেষ্টা অনেক আগে থেকেই মার্কেটিং-এ, বিশেষ করে বাচ্চাদের ব্যবহার করে। এখন ধর্ম, সংস্কৃতি, জাতীয়তাবোধ এসবও ঢুকে পড়ছে।

আমরা আদতে কতটা বাস্তবে আর বস্তুজগতে বাঁচি? মানুষের চেতনার গায়ে সেন্টিমেণ্টের আবরণ না থাকলে মানুষ মারা যেত। রূঢ় বাস্তবকে সহ্য করা সারা জীবনে বিশেষ কয়েক মুহূর্তের জন্য হয় তো সম্ভব, সাধারণ মানুষের পক্ষে, কিন্তু সর্বক্ষণের জন্য হলে মানুষ পাগল হত।

প্রাচ্যে জ্ঞান ও ধ্যানভিত্তিক যতগুলো দর্শন ও ধর্ম আছে তার প্রধান কথাই হল এই সেন্টিমেন্টকে স্থির রাখার চেষ্টার কথা। বাইরের নানা ঘটনায় সেন্টিমেন্ট যেন অস্থির না হয়। সক্রেটিসের পর পাশ্চাত্যে যে stoic দর্শন শুরু হয়, Epictetus, Seneca, Aurelius প্রমুখেরা যে রাস্তার পথিক, সেখানেও এই একই কথা। ভক্তি সেন্টিমেন্টকে স্থির রাখতে না বলে, বলল একমুখী করতে। কাজটা একই। চেতনার উপর সেন্টিমেন্টের স্তরটা যতটা সম্ভব পাতলা করার। যেখানে চেতনা সেন্টিমেন্টের অধীন হবে না, আবার সেন্টিমেন্টহীনও হবে না। কারণ দ্বিতীয়টা মানুষের পক্ষে ক্ষতিকর, অসহনীয়।

এই সেন্টিমেন্টের আবরণের জন্যেই চেতনা কখনও সত্যকে সত্যের মত করে পায় না। চেতনা আর সেন্টিমেন্টের নিটফল আমার বাস্তব। যার ফলে সেন্টিমেন্টহীন হওয়া অসম্ভব মানুষের পক্ষে। যাকে আমরা বলি সেন্টিমেন্টহীন, আদতে সেও আরেকটা সেন্টিমেন্ট। কারোর কারোর আবার সেন্টিমেন্টের নিম্নচাপ হয়। কিছু হয় তো বাইরে ট্রিগার করল, ব্যস তৈরি হল নিম্নচাপ। তাদেরকে আমরা বলি সেন্টিমেন্টাল। যেমন বাতাসের উপস্থিতি যখন বাতাস টের পাওয়ায় আমরা তাকে বলি ঝড়, এও তেমন। আমরা তাকেই বলি সেন্টিমেন্টাল যার সেন্টিমেন্ট বারবার নিম্নচাপের হুমকি দেয়। কারণ বারবার সে ট্রিগারড হয়।

যেমন ধরা যাক, আমি রামবাবুকে শ্রদ্ধা করি। অমুকে করে না। এখন এই শ্রদ্ধা করা আর না করা দুটোই সেন্টিমেন্ট। তাই দু'পক্ষের যখন দ্বন্দ্ব লাগে, তখন তা চেতনার নয়। সেন্টিমেন্টের। মত তৈরি হয় বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। আর বাস্তব অভিজ্ঞতা তৈরি হয় সেন্টিমেন্ট আর চেতনার যুগ্ম রসায়নকে ভিত্তি করে। আমি দেখেছি আমাদের নানা তথাকথিত গবেষণামূলক বই এই দোষে দুষ্ট। যে শ্রদ্ধাহীন সে ভাবছে সে ভীষণ বাস্তবের কাছাকাছি। আসলে সেও যে আরেক সেন্টিমেন্টের আওতায় সে তার কাছে স্পষ্ট নয়। ফলে হয় ভক্তির অতিকথন, নয় অশ্রদ্ধার সেন্টিমেণ্টে তিলকে তাল করার প্রবণতা। এই নিয়েই যত বই। যত জীবনী। আসলে সেন্টিমেন্ট কখনও উদার হয় না। জ্ঞান উদার হয়। সে জ্ঞান যদি সত্যজ্ঞান হয়।

এর মধ্যে থেকে একটা সরু রাস্তা আসে, সেটা নিজেকে জানার রাস্তা। সবটা নিয়ে। নিজেকে খণ্ড খণ্ড করে না দেখে সবটা নিয়ে যে নিজেকে দেখা তাকে বলে আত্মজ্ঞান। সে কোনো 'মিস্টিক' বা 'অতীন্দ্রিয়' ব্যাপার নয়। একদম খাঁটি ধরাছোঁয়ার মধ্যেকার বস্তু। আমরা যখন কোনো মনোবিদের কাছে যাই সে তো মনোবিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব বুঝতে না রে বাবা, আমরা যাই নিজেকে বুঝতে। এ-ও তাই। আমার সেন্টিমেন্ট, আমার চেতনা, আমার স্মৃতি ইত্যাদি যাবতীয় সবকিছু মিলে যে 'আমি' তাকে সবটা জানার চেষ্টা করলে তবে সেটা জ্ঞান হয়। সত্য জ্ঞানের মধ্যে একটা পারম্পর্য, সংগতি আর সামঞ্জস্য থাকে। তখন দ্বন্দ্ব থেমে যায়। আলো আসে।

135
Mon, 10/17/2022 - 00:34

তিনি কোনো ভারতীয় পুরষ্কার পাননি। তাঁকে বহু শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত ভারতীয় চিনতেন না। সে বড় কথা নয়, কৈলাস সত্যার্থীকেও সিংহভাগ ভারতীয় চিনতেন না, তিনি নোবেল পাওয়ার আগে অবধি। আমাদের পত্রপত্রিকাতেও বড় করে কোনো প্রতিবেদন আমি অন্তত পড়িনি। সেও বড় কথা নয়, ওসব নিয়ে লিখলে পড়বে কে?

    এখন বাঙালি হিসাবে লজ্জার এত কিছু আছে যে এটা আলাদা করে ভাবার কিছু নেই। আমাদের একটা একটা শব্দ ইংরাজি শব্দের স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন করে ভাঙনে বাড়ি নদীর স্রোতে তলিয়ে যায়, আজকাল প্রচুর ভিডিও দেখা যায়, তেমনই। ইংরাজি ভাষাকে ভালোবেসেছি বলে যে হয়েছে তা ঠিক নয়। ইংরেজি ভাষার মার্কেট অনেক বড়, তাই। কাল যদি হিন্দি ভাষাও কোনো ক্রমে এরকম মার্কেট ধরে ফেলে, যা ধীরে ধীরে ঘটছেও, আমাদের হিন্দির জলে ভেসে যেতেও অসুবিধা হবে না। ধীরে ধীরে তা যে হচ্ছেও আইটি ইত্যাদি ফিল্ডের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারছে। যেমন কোনো এক রাজ্যে হিন্দিতে ডাক্তারি পড়ানো নিয়ে আমরা যতই ব্যঙ্গ করি না কেন, এটা তো সত্য তারা অতটা ভাবতেও পেরেছে। আমরা তো ভাবতেও পারি না। বাংলায় ডাক্তারি!! হয় না, হয় না, হয় না। যেমন অভিজিতবাবু নোবেল পাওয়ার পর বললেন, তিনি যে বিষয়ে বই লেখেন সেই বিষয়ে বাংলায় বই লেখা যায় না।

    দুদিন আগে কলেজস্ট্রিট গিয়েছিলাম। কিভাবে বাংলা বইগুলো ইংরাজি বই আর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার বইয়ের তলায় হারিয়ে যাচ্ছে, তাই দেখলাম। যেভাবে আমাদের ভাষায় গান, ওয়েবসিরিজ আমাদের আর টানছে না, হয় তো আমাদের ভাষার লেখাও টানছে না। অবশ্য আর কয়েক দশক পরে বাংলা মিডিয়ায় পড়া ছেলেমেয়ে ছাত্র খুঁজতে আতসকাঁচ লাগবে।

    সেদিন একজন অত্যন্ত গুণী, শ্রদ্ধেয় মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম খুশবন্ত সিং যেমন অসামান্য একটা বই লিখেছেন শিখেদের ইতিহাস নিয়ে, তেমন মহাপ্রভু ও তারপর বাংলা সমাজের উপর প্রভাবের ধারাবাহিকতা নিয়ে কোনো প্রামাণ্য বই আছে কিনা। কিছু পড়েছি যা আমার খুব ভালো লাগেনি।

    তিনি অত্যন্ত ক্ষোভ আর দুঃখের সঙ্গে জানালেন, লেখা হয়নি। তিনি বাংলা সাহিত্য ও সমাজ নিয়ে পড়াশোনা করা এমন একজন মানুষ যে তাঁকে বিশ্বাস করা ছাড়া আমার উপায় রইল না। আর নিজের অভিজ্ঞতাতেও দেখেছি খুব তথ্যসমৃদ্ধ বই সত্যিই নেই। অথচ সেই সময়ে ভাষা ও সমাজে কি দারুণ জোয়ার এসেছিল। অনেকের মতে বাংলার নবজাগরণ বলতে যা বোঝায় সেদিনই তা ঘটেছিল। কিন্তু নিত্যানন্দের বাংলায় অবদানের উপর বই, কি গবেষণা সে অর্থে কই? মহাপ্রভু কিভাবে মারা গেলেন সে নিয়ে কত রোমাঞ্চকর বই। কিন্তু বাংলায় ধারাবাহিক প্রভাব নিয়ে? সে অর্থে সত্যিই কিছু নেই।

    শ্রদ্ধেয় দিলীপ মহলানবীশের চিকিৎসকেরাও নাকি জানতেন না, তিনি কে ছিলেন। পেপারে এমনই পড়লাম। যদিও আমি সৌভাগ্যবান যে আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর কাছেই আমি ওঁর অবদানের গল্প শুনেছিলাম।

    আমি যেহেতু শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িয়ে তাই প্রতিদিন সাক্ষী থাকি কি নিদারুণভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজের শিকড় থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সরিয়ে দেওয়া হচ্ছেও বলা যায়। "আপনি বাংলা গান শোনেন?", " আপনি বাংলা সিনেমা দেখেন?", "আপনি বাংলা বই পড়েন!"। এ তো শুনতেই হয়।

    একদিন হয় তো আর কেউ বাংলায় লিখবে না, গাইবে না। কথা হয় তো বলবে। বাঙালি আন্তর্জাতিক হবে না, বাঙালি জগাখিচুড়ি হবে। আজ যেমন বিজয়ার প্রণাম, চিঠি, বাড়ি যাওয়া সব উঠে গেছে, এত তাড়াতাড়ি, এত নিঃশব্দে, এত বিনা বিপ্লবে…এভাবেই একটা একটা করে ইট খসে যাবে।

    এতে ভয়ের কিছু নেই। মানুষ যদ্দিন থাকবে আমরাও নিশ্চয়ই থাকব। অন্য ভাষায়, অন্য পরিচয়ে। তাকে উন্নতি না বৈচিত্র্য বলা হবে সে নিয়ে হয় তো তর্কও হবে, হিন্দি বা ইংরাজি নয় তো তামিলে। আমাদের অসুবিধা হবে না। আমাদের আন্তর্জাতিক সত্তাটুকু শুধু বাঁচিয়ে রাখতে হবে যে করেই হোক। জগত যাকে নোবেল দেয়নি, জগত যাকে গ্র‍্যামি দেয়নি, অস্কার দেয়নি তাকে নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামায় না, যদি না সে আবার বিশেষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে। তসলিমা তো বিদেশে গিয়ে নির্বাসিত। শম্ভু মিত্রকে তো আমরা এই মাটিতেই নির্বাসিত হতে বাধ্য করেছিলাম। আর বিদ্যাসাগরের কথা আর কি বলব! রবীন্দ্রনাথও চিঠিতে লিখেছিলেন তিনি আর এ দেশে বাঙালি হয়ে জন্মাতে চান না!

    যা হোক স্বীকৃতি শেষ কথা নয়। যারা এসব কাজে নিয়োজিত থাকেন তারা বসার ঘরে সার্টিফিকেট আর পুরষ্কার সাজাবেন বলে তো আর করেন না। ভালো কাজের প্রসন্নতা চিত্তে আপনিই জন্মায়। অবহেলায় সেখানে খেদ বা ক্ষোভ জন্মায় না। অভিমান জন্মাতেই পারে। কিন্তু কাজটুকুকেও সঠিকভাবে করতে না দিয়ে টেস্ট টিউব সন্তানের ভারতের জনক শ্রদ্ধেয় সুভাষবাবুর মত মানুষকে আত্মহত্যার রাস্তাতেও তো আমরা ঠেলেছি। ভুলেছিও। তাও আজকাল কিছু কিছু বইয়ে ওনার নাম দেখি।

    শেওলা স্রোতবাসী। তার মূল নেই, ঘর নেই। আমরা ক্রমশ সেই অর্থেই মূল হারাচ্ছি। স্রোতে ভাসছি। বাংলা প্রাবন্ধিক হারাচ্ছি। এইটা আমাকে ভীষণ পীড়া দেয়। আমরা রাতদিন প্রাসঙ্গিক নিবন্ধ পড়ে যাচ্ছি খবরের কাগজে, পত্রিকাতে। কিন্তু এত প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকাও তো একটা সীমাবদ্ধতা। আমরা আমাদের তাৎক্ষণিক বর্তমানের বাইরে গিয়ে কেন প্রবন্ধ লিখতে পারছি না আজকাল! অশীন দাশগুপ্ত, অম্লান দত্ত, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, শিবনারায়ণ রায়, হোসেনুর রহমন, আবু সৈয়দ আইয়ুব, দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় প্রমুখদের মত প্রাবন্ধিকেরা কোথায়? আমাদের ভাষায় মনন যেন আর ভাষা পায় না। সব শক্তি যেন শুধু খবর আর তাৎক্ষণিকতাতেই ক্ষমতা নিঃশেষ করে নিজেকে শেষ করে ফেলছে।

    ইতিহাস ভুললে ভার কমে। দায় কমে। ক্ষুদ্র হতে বাধা থাকে না। কোনো সঙ্কোচ থাকে না। কিন্তু সমস্যা হল ঝড় উঠলে ছিন্নমূলেরাই আগে উড়ে যায়। শেষ হয়ে যায়। আমাদের শারীরিক বৈশিষ্টবহনকারী জিন হয় তো থেকে যাবে কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতিতে, কিন্তু আমাদের চিন্তাভাবনারা যাদুঘরের ধুলোয় ঢাকতে ঢাকতে একদিন এত নীচে তলিয়ে যাবে ইতিহাসও হয় তো মনে রাখবে না।

136
Wed, 10/12/2022 - 21:15

সুখের সময় মনের খোঁজ কোথায়? যেমন দাঁতে ব্যথা না হলে দাঁত কোথায়? মন মানে তো দুঃখ। যখন বুকের মধ্যে টান। খামচা। তখন বুঝলে মন আছে। আবার তুমিও আছো। দুঃখকে বলো মন। নইলে মন বলে আবার কিছু হয় নাকি?

যখন খুশীতে আছি, তখন পুরোটা জুড়েই আমি। কোথাও কোনো ভাগ-বাটোয়ারা নেই। যেই দুঃখ এলো, অমনি নিজেকে আলাদা করা। যেন বৃষ্টির ছাঁট বাঁচিয়ে ছাদের তলায় এসে দাঁড়ানো। আমি দুঃখ নই। আমার দুঃখ আছে, আমি দুঃখ নই। কিন্তু আমার সুখ আছে বোধ নেই। আমি আর সুখ একই। কিন্তু আমি আর দুঃখ আর এক হলাম না।

এখন কথা হল, দুঃখ কে চায়? গালিব বলছে হৃদয় ব্যথা হলে ওষুধের ব্যবস্থা করো, কিন্তু ব্যথাই যখন হৃদয়, তখন? তখন দুঃখকেই পান করো।

দুঃখকে পান করে আমি নিজেই যদি দুঃখ হয়ে উঠি? কোথাও আর নিজেকে দুঃখ থেকে যদি আড়াল না করি? মানে কি দুঃখ বিলাসিতা? শখের দুঃখ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে মনের মধ্যে যে বিকৃত সুখ, সে হতে পারে বিলাসিতা। কিন্তু সত্যকারের দুঃখকে স্বীকার করে নিয়ে মনের মধ্যে যে শান্তি, সে বিলাসিতা হয় কি করে?

নদীতে যখন ভীষণ ঝড় তখন নিজের নৌকাকে সেই ঝড় থেকে আলাদা ভাবা মূর্খামি, আবার সেই ঝড়ের মধ্যে গা ভাসানো আরো মূর্খামি। কিন্তু ঝড়ের মধ্যে নৌকাকে ভাসিয়ে রাখার যে চেষ্টা, ঝড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই সে চেষ্টা। সে সামঞ্জস্য মানে শান্তি। উদ্বেগহীনতা।

গালিবের দুঃখে উদ্বেগ নেই। রবীন্দ্রনাথের দুঃখে উদ্বেগ নেই। শ্রীহীন হাহাকার নেই। আছে ঝড়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরির সাধন।

আমরা যাকে পোড় খাওয়া মন বলি, এ সেই মনের গল্প। যে বাড়ির ছাদে দু বছর আগে নিজেদের সন্তানের শ্রাদ্ধের শামিয়ানা দেখলাম, সে বাবা মাকেই যখন রাস্তায় দেখি, কোনো অনুষ্ঠান বাড়ি দেখি, বুঝি ঝড় থামেনি, ঝড়ের সঙ্গে সমঝোতা হয়েছে। নৌকার দুলুনিতে উদ্বেগ নেই, সামঞ্জস্য এসেছে ঝড়ের সঙ্গে।

কঠিন? অবশ্যই কঠিন। নইলে গালিব গালিব হবেন কেন? আর যুগান্তরের পর সে এসে আজও ধাক্কাই বা দেবে কেন? সেকি শুধু ছাপাখানার দৌলতে? না, না, বোধের মধ্যে সে কঠিন সত্যের দিকে ঝোঁক আছে বলেই তা যুগান্তর পেরিয়ে আমার আঙিনায় এসেছে গালিব, রবীন্দ্রনাথ। দুঃখকে পান করে মানুষ দুঃখী হয় না, সত্য হয়। নইলে গীতবিতান আজ আশ্বাস হত না, আশ্রয় হত না, দুর্বলের প্রশ্রয় হত।

137
Wed, 09/28/2022 - 11:51

ঈশ্বর ঐশ্বর্য বিলাসী। ঈশ্বর যদি ভোট দিতেন অবশ্যই তিনি ক্যাপিটালিস্ট হতেন। কেন?

কদিন আগে তিরুপতি ট্রাস্ট তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছে, ৮৫,৭০৫ কোটি টাকার। এ তো না হয় গেল তিরুপতির কথা। বাকি ভারতের বিখ্যাত দেবস্থানগুলো দেখলেও বোঝা যায় ঈশ্বর, তিনি দেবতা বা দেবী যে রূপেই পূজিত হোন না কেন, ঐশ্বর্যে তাঁর আপত্তি নেই। নইলে অত মূল্যবান অলঙ্কার সারা গায়ে শোভা পেত না নিশ্চয়ই।

আর যদি সে সবও ছেড়ে দেওয়া যায় তবে এই যে বাংলায় মহা উৎসব শুরু হতে চলেছে, সেখানে সপরিবার দেবী দুর্গার আবাহনে সরকার থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্লাব যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে অতি তৎপর, সেখানেও বোঝা যাচ্ছে ঈশ্বর নিশ্চয়ই ক্যাপিটালিস্ট। নইলে আমাদের মত দেশে, এত দারিদ্র যেখানে, সেখানে তিনি কি করে এত এত ঐশ্বর্য আড়ম্বরের আতিশয্য মেনে নেন?

ঈশ্বর ষড়ৈশ্বর্যবান। তার প্রথমটিই হল ঐশ্বর্য। অনেকের মত ধনসম্পদ, আবার অনেকের মতে অনেক দার্শনিক আলোচনাও আছে। বাকি কি কি? না, বীর্য, যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। অর্থাৎ বলা হচ্ছে যে তিনি ষড়ৈশ্বর্যবান হলে কি হবে, তিনি বৈরাগ্যবান।

একবার মন্দিরে গয়না চুরি হল। তো ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবকে একজন বললেন, কি তোমার ঠাকুর গো, নিজের গয়নাটুকু রক্ষা করতে পারলেন না?

তো ঠাকুর উত্তরে বলেছিলেন, সে তোমার আমার কাছে সোনাদানা, মায়ের কাছে ওসব মাটির ঢেলা বই আর কিছু নয়।

উত্তর তো খাসা। কিন্তু এ উত্তর রামকৃষ্ণদেবকে মানায়, যিনি টাকা আর মাটি সমান করে ফেলেছেন। কিন্তু আমাদের কি আর সে উত্তর মানায়? আমাদের দেবালয়ে ঢোকার আগে হাজার একটা তনুপরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, প্রমাণ করতে যে কোনো অসদ উদ্দেশ্যে আমি ঢুকছি না। এখন যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা ঠাকুর, এত সিকিউরিটি কেন দক্ষিণেশ্বরে মন্দিরে ঢুকতে, তোমার ঠাকুর কি ভক্তদের রক্ষা করতে পারেন না? আর তখন উত্তরে ঠাকুর যখন বলবেন, ও বাঁচা মরা তাঁর কাছে সব সমান, তোমার কাছেই কিছু একটা…. তখন? সে উত্তরে কি আমাদের প্রাণপাখি স্বস্তি পাবে, নাকি ডানা ঝাপটে বাবা গো, মাগো বলে উঠবে!

অগত্যা আমাদের অজ্ঞতায় কি আর সে লীলা ধরে পড়ে? আমরা দেখি ঈশ্বর ক্যাপিটালিস্ট। ঈশ্বর ডন। ঈশ্বর ডিক্টেটর। ভক্ত বলে, ডিক্টেটর, কিন্তু দরদী ডিক্টেটর। আমরা বলি হবেও বা! নাস্তিক বুঝে পায় না ঈশ্বর কোনো ক্যাম্পেনিং না করেও এত বড় ভোটব্যাঙ্ক পেয়ে যায় কি করে?

এখন দেখুন, আমরা যতই শাস্ত্র পড়ি, মহাপুরুষদের বাণীটানি মুখস্থ করি, ভাবাবেগে ভাসিটাসি, কিন্তু আমাদের বোধ তো অবশেষে আমাদের বোধই। সেখানে তো আমরা আটকেই।

এখন দেখুন ভণ্ড তো আমরা কমবেশি সবাই। তবে এই ধর্মের বেলায় এসে আমাদের ভণ্ডামিটা ঐতিহ্যমন্ডিত হয়ে ওঠে। কারণ এক, আমার বাপ ঠাকুর্দা আগের যুগ থেকে করে এসেছে। দুই, আমার চারদিকে দল বেঁধে করে যাচ্ছি। তো হল কি, এক যুগান্তরের ধারাবাহিকতা, দুই, গণ যোগদান, আমাদের ভণ্ডামির অনুশীলনটা সহজ করে দেয়।

কারুর বিপদে যখন শাস্ত্রের দোহাই দিচ্ছি, "কপালের ফের", "ঈশ্বরের ইচ্ছা" এইসব বলে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছি, সেই বিপদ আমার ঘাড়ে এলে আগে কি কি জাগতিক উপায় আছে তার খোঁজে পাগল হয়ে যাচ্ছি।

ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে রক্তের জন্য লাইনে রিকুইজিশন অনুযায়ী রক্ত পেলেই ধন্য মনে করছি, কিন্তু সমাজে এসে বিয়ে ইত্যাদিতে হাজার একটা গোষ্ঠীতে ভেঙে দল ভাগ বলছি, এ আমাদের আর্যকৃষ্টি।

নানা জায়গায় দীক্ষাটিক্ষা নিয়ে অধ্যাত্মক্লাবে নাম লিখিয়ে ফেলছি। সোশ্যালমিডিয়ায় গুরু, দেবতা ইত্যাদির ছবি আর বাণীর বন্যা বইয়ে দিচ্ছি, এদিকে আত্মপ্রচারে ক্ষণমাত্র বিপন্নতায়, কি স্বার্থে কিঞ্চিৎ আঘাতে জগত মাথায় করে নিচ্ছি!

এদিকে পাড়ায় হাড়ি চড়ে কি চড়ে না কোন বাড়ি, চিকিৎসা কি পড়াশোনার জন্য কোন বাড়ির কি অবস্থা জানা নেই, কিন্তু পুজোর আগে চাঁদার বিল এসে হাজির সে বাড়ির দরজায়। মাইকে তারস্বরে রাত্রদিন গানের শ্রাদ্ধ করে ছাড়ছি, কার কি অসুবিধা, কার স্বাস্থ্যের কি গতি…. ওসব নিজের কাঁথার তলায় রাখুন। আসুন আলো দেখুন, প্যাণ্ডেল দেখুন, ভোগ খান, প্রতিমা দেখুন মোচ্ছব করুন। সমস্যা? সে তো বারোমাস? তার সমাধানের জন্য পরিকল্পিত চেষ্টা? আরে তার জন্য সরকার আছে…আমরা কে? আপনি কে? এখন মাতুন, মেতে যান, "মাতল যে ভুবন".... আসুন আসুন মাতুন। গরীব? বাহ রে, বস্ত্রদান, কম্বলদান…. আছে না? ওতেই হবে… আসুন, মাতুন।

তবে এত এত মহাপুরুষেরা কি শেখাতে এলো? ভদ্র ভাষায় সোনার পাথরবাটি। আর লৌকিক ভাষায়.. থাক।

কিচ্ছু শিখিনি আমরা। আর শিখবই বা কেন? ওসব কথা মেনে চলতে গেলে বারোটা মাস লাগে, জীবনের অর্ধেক সময়ের বেশি চলে যায়। অতটা অপচয় কেন করব? ক'টা বই, কিছু মুখস্থ কথা, ক'টা ছবি, কিছু যাতায়াত…. ব্যস… আবার কি?

জীবনে এক খাঁটি মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। পরম বৈষ্ণব। তিনি বলেছিলেন, ধর্ম যা মানুষের চরিত্রে পরিবর্তন আনে। তাকে আরো দরদী, আরো সংযত, আরো সাধারণ জীবনে নিয়ে আসে। সে আর কি আছে বাবা? এখন গলায় কণ্ঠি, চন্দনের ফোঁটাকাটা আর নানা উপাদেয় নিরামিষ খেলেই বৈষ্ণব। তৃণাদপি সুনীচেন…. ওসব মুখের কথা… প্রাণের বিশ্বাস আর কই?

হরিদ্বারে একজন বয়স্ক মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখানে কেউ আছেন এখন যাকে অনুভবী মানুষ বলা যায়? তিনি বলেছিলেন, কেউ নেই বাবা…. সব শুধু টাকা চেনে… আমাদের মত ব্যবসায়ীদের বলে গাড়ি পাঠাও, টাকা দাও… এইসব।

তবু জগত মহানুভবশূন্য নিশ্চয়ই নয়। কিছু মানুষ নিশ্চয়ই আছেন, নিজের মত করে লোকচক্ষুর অগোচরে। চলতে ফিরতে তাদেরও তো চোখে পড়ে!

শেষ করি সদ্য যে মহাপ্রাণ মানুষের জন্মদিন গেল তাঁর মায়ের কথা স্মরণ করে। বিদ্যাসাগর মাকে জিজ্ঞাসা করছেন বড় করে দুর্গাপুজো করতে চান কিনা। মা বলেছিলেন, গ্রামে অনেক ছেলেমেয়ে না খেয়ে স্কুলে যায়, তাদের জন্য যদি একটা অন্নসত্র খুলে দেওয়া যায় তবে সে-ই হবে তাঁর কাছে দুর্গাপুজো।

হায়! এসবই আমাদের কাছে গল্প শুধু। আবেগের গল্প। কাজের না। অনুপ্রেরণার না। আমাদের শিক্ষা থেকে শুরু করে সবই এখন বৈভবের দাসত্ব করে। বিত্ত হতে চিত্ত বড়, এ কথা রবীন্দ্রনাথ আমাদের বোঝাতে চেয়েও পারেননি। কারণ আমরা বুঝতে চাই না। আমরা আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে, সোনার পাথরবাটির।

138
Sat, 09/24/2022 - 12:53

যদি বৃন্তের সৌন্দর্য না বুঝি তবে পাপড়ির সৌন্দর্যকে বুঝি কি করে? ফুল মানে কি কেবল পাপড়ির রঙ, রূপ, সজ্জা? 

     ওই যে মালা গাঁথা হচ্ছে, বৃন্তের বুকের মধ্যে সূঁচ বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে, সুতো পরিয়ে। বৃন্ত নির্বিকার। বৃন্ত জানে মালা গাঁথতে হলে এ তাকে সহ্য করতেই হবে, পাপড়ি সহ্য করতে পারবে না, ছিঁড়ে যাবে সে! 

     মানুষের মধ্যেও দুটো সৌন্দর্য থাকে। পাপড়ির আর বৃন্তের। পাপড়ি বাইরের। সেখানে কখনও কখনও নকল জিনিসও চালিয়ে দেওয়া যায়। বৃন্ত অন্তরের। সেখানে নকল চলে না। সেখানে ফাঁকি চলে না। মানুষে মানুষে এক হতে হলে বৃন্তের মতই হৃদয়কে সূঁচবিদ্ধ হতে হয়, অন্যকে নিজের মধ্যে অনুভব করে। তবেই মালা গাঁথা হতে পারে। বাইরে থেকে দল গড়ে সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করা যেতে পারে, এক করা যায় কি? 

     আজ তেহেরানে মানুষ যে ভাবে রাস্তায় এসে নেমেছে, প্রাণ দিচ্ছে, তার কারণ 'মাথা ঢাকব না' তো নয়। তার কারণ মনুষ্যত্বের অপমান হয়েছে বলে। মানুষ সব কিছু সহ্য করে নেয়, কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে মনুষ্যত্বের অপমান সে সহ্য করে নেয় না। গর্জে সে উঠবেই। কোনো লোভ, কোনো ক্লীব নিরাপত্তা, কোনো সুখের ফাঁদে মানুষের মনুষ্যত্বকে অপমান করে আটকে রাখা যায় না। তাই সে তার ধর্ম নিয়ে মত বদলেছে, সমাজ নিয়ে মত বদলেছে, রাজনীতি, শিক্ষা, অর্থনীতি সব নিয়ে মত বদলেছে। যে নীতি মনুষ্যত্ববোধের সব চাইতে কাছে তাকেই নিতে চেয়েছে। প্রকাশ করতে চেয়েছে।

     কিন্তু বাস্তব জীবনে সে কাজ সহজ নয়। অনেক বাধা। আর বাধা আছে বলেই লড়াইও আছে। আর লড়াই আছে বলেই মনুষ্যত্ববোধের মূল্যকেও যুগে যুগে নতুন করে অর্জন করতে হয়েছে। 

     আজ যে 'ভারত জোড়ো' আন্দোলন হচ্ছে সেখানে ভঙ্গী আছে, কিন্তু তাগিদ নেই। কারণ আসল কথাটা ভারতকে জোড়া তো নয়, নিজের দলের পায়ের নীচে মাটি খোঁজা। কিন্তু এই নকল ভঙ্গীতে কি আসল বস্তু লাভ হয়? দলের নিজের ভিতরের সমস্যার কারণ না খুঁজে তাকে বাইরে খোঁজা অনেকটা নাসিরুদ্দিনের গল্পের সেই চাবি খোঁজার গল্পের মত। যেখানে নাসিরুদ্দিন উঠানে বেশি আলো আছে বলে চাবি খুঁজছে, ঘরে না খুঁজে, যেখানেই চাবিটা হারিয়েছে আসলে, কারণ ঘরটা অন্ধকার।

     রামকৃষ্ণদেবের গল্পে আছে, ছেলে মা-কে বলছে, মা আমায় হাগা পেলে তুলে দিও। মা বলছেন, বাবা হাগা যখন পাবে ওই হাগাই তোমায় ঠেলে তুলবে, আমায় ডাকতে হবে না। 

     ব্যক্তি হোক, দল হোক, দেশ হোক --- মূল একটাই, মনুষ্যত্বের বোধ। তার প্রকাশে উগ্রতা নেই। সৌন্দর্য আছে। সে সৌন্দর্য রঙের না। সংযমের। বৃন্তের সৌন্দর্য। বৃন্তই ঠিক করে পাপড়ির প্রকাশের পরিধি। বৃন্তই জানান দেয়, পাপড়ি ঝরে গেলেও সে আছে। মূলের সঙ্গে যুক্ত আছে সে।

     আমরা যখন সত্যিই অনুভব করব আমার কাজে, আমার ব্যবহারে, আমার নিষ্ক্রিয়তায় মনুষ্যত্বের অপমান হচ্ছে তখন আমি আপনিই জেগে উঠব। সভাসমাবেশ করে আমায় জাগাতে হবে না। ব্যক্তি আমি না জাগলে, না সতর্ক হলে ভাঙচুর করে, পথঘাট আটকে আদতে কিচ্ছু হবে না। তখন সেগুলো শুধুই হট্টমেলা। আর মনুষ্যত্ব জাগলে একা মানুষই যে হাজার মানুষের সমান তার সাক্ষীও ইতিহাস হয়েছে বারবার। সে রাস্তায় একা নামলেই হাজার একটা মানুষ তার সঙ্গে এসে দাঁড়ায়। 

     মনুষ্যত্ব বনাম লোভ, এই তো ইতিহাসের সার। চরিত্রগুলো বদলে বদলে গেছে বারবার দুই পক্ষেরই। আমাদের শুধু ঠিক করে নিতে হয় আমরা কোনো পক্ষ নেব। লোভের রাস্তায় পাপড়ি জড়ো করি, আর মনুষ্যত্বের রাস্তায় বৃন্তের যত্ন নিই। প্রথমটায় সুখ, দ্বিতীয়টায় আনন্দ। 

     আনন্দ আত্মিক, তার কোনো প্রতিপক্ষ নেই। তাই ফেডেরারের বিদায়ে নাদাল কেঁদে ভাসায়। আনন্দের প্রতিপক্ষ নেই বলেই সে প্রতিশোধ না চায় না, ন্যায় চায়। মনুষ্যত্বের প্রতিষ্ঠা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠাতে। কোনো এক বিশেষ জজের হাতে সে ভার না দিয়ে, রাতদিন তাকে স্তুতি না করে, নিজের চারপাশটা ভালো করে দেখে, সেখান থেকেই কাজটা শুরু না করলে অবশেষে সব কথাতেই শেষ হবে। 

     বৃন্তে প্রতিষ্ঠ হই। পাপড়ি আপনিই জাগবে। না জাগলেও ক্ষতি নেই। পরের প্রজন্মের হাতে যেন সুস্থ ক'টা বৃন্ত অন্তত দিয়ে যেতে পারি, নকল পাপড়ি না ধরিয়ে। তারা ক্ষমা করবে না।

139
Thu, 09/22/2022 - 23:23

তুমি সান্ত্বনা পেতে চাও? যে কোনো কিছুর সহজ ব্যাখ্যা পেতে চাও? জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে চাও? জীবনের অর্থ পেতে চাও?

অথোরিটি খোঁজো। সে অথোরিটি যা কিছু হতে পারে। যে কেউ হতে পারে। গুরু, দল, মত, নীতি, ভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এর কোনোটাই যদি নাও পেতে চাও, যদি ভয় থেকে মুক্ত হতে চাও…. তবুও তুমি আমি অথোরিটি খুঁজি। যেখানে আমি আমার ইণ্ডিভিজুয়ালিটির ভার থেকে নিজেকে মুক্তি দিই।

ইণ্ডিভিজুয়ালিটির ভার আমি কাকে দেব? এসো গুরু, আমায় নাও। এসো ঈশ্বর, আমায় নাও। এসো দল, আমায় নাও। এসো মতাদর্শ, আমায় নাও। এসো ভাব, আমায় নাও।

আমার মধ্যে যতক্ষণ ইণ্ডিভিজুয়ালিটি থাকবে ততক্ষণ হাজার একটা কুসংস্কার থাকবেই। সে যতই উপাদেয়, লাভজনক, চলনসই হোক না কেন, থাকবে। কারণ আমি নিজেকে একজন ইণ্ডিভিজুয়াল দেখছি। ইণ্ডিভিজুয়াল মানে আমাকে আর ভাঙা যায় না, নট ডিভিসিভল। আমি একটা মৌলিক সত্তা।

এখন এত বড় চলমান, ঘটমান সংসারে এমন একটা নিরেট, অবিভাজ্য সত্তা নিয়ে আমি করবটা কি? তাকে নাম, খ্যাতি, সফলতা, বিত্ত, সুখ সব দিয়েও তো দেখি তার ভার কমানো যায় না। টম অ্যাণ্ড জেরির সেই পুচকে 'অলওয়েজ হাংগ্রি' ক্ষুদে ইঁদুরের মত সে সব সময় খাই খাই করেই যাচ্ছে। যার যা আছে সব তার চাই। যেখানে যা হচ্ছে সব তার জানা চাই। সারা জগতকে সে তার মত করে চায়। এ তো মহাজ্বালা। তবে?

এইখানেই তো গোলমালের শুরু। তো এই ভয়ানক অবিভাজ্য ইণ্ডিভিজুয়ালিটির হাত থেকে নিস্তার কি নাই? আছে। মানুষ এক অবিভাজ্য ইণ্ডিভিজুয়ালিটির হাত থেকে বাঁচতে আরেক বড় ইণ্ডিভিজুয়ালিটিকে ডেকে আনল। ঈশ্বর, দল, গুরু, ভাব। সে বলল, এই দেখো, তুমি ভাঙবে না বলছিলে না? এই দেখো এই হল আসল মৌলিক পদার্থ। একে ধরে থাকলেই তোমার যাবতীয় সমস্যা মিটে যাবে। কি সমস্যা? না এই জগদ্দলস্বরূপ ইণ্ডিভিজুয়ালিটির সমস্যা। না না, কোনো বস্তুজগতের সমস্যা নয়। এ মানবিক মানসিক সমস্যা। এই হল সান্ত্বনার পথ। পা গুটিয়ে পথে নামার ছক। পুব আকাশে সূর্যাস্ত দেখার শখ।

দেখো সেই আদিম কবিতা, আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেউ অবনী পরে… ইত্যাদি ইত্যাদি..

কিন্তু বাস্তবে তো আমরা আমাদের এই অতিজাগতিক ইণ্ডিভিজুয়ালিটির চাপেই পিষে যাচ্ছি। ত্রাণের রাস্তা খুঁজছি। রিল / শর্ট ভিডিও দেখিয়ে ভোলাচ্ছি, দুষ্টুমি করে ভোলাচ্ছি, পাপ-পুণ্যের হিসাবে মেতে ভোলাচ্ছি, সমাজে নানা কাল্পনিক বিধিনিষেধ বানিয়ে ভোলাচ্ছি, কালচারের নামে ভোলাচ্ছি, মানুষকে নানা কাল্পনিক তত্ত্বে আলাদা করে করে, একে ওকে এই তাকে সেই তাকে সাজিয়ে ভোলাচ্ছি, মাটির উপর দাগ টেনে "আমরা তোমরা" করে ভোলাচ্ছি…. এ লিস্ট শেষ হবে না। মোটকথা ভোলাচ্ছি। কাকে? না আমার কখনও ইতর, কখনও মহাপুরুষতুল্য ইণ্ডিভিজুয়ালিটিকে ভোলাচ্ছি।

এখন কথা হল অনেকে তো এই ইণ্ডিভিজুয়ালিটিকেই আলাদা করে টের পাননা। এই ইণ্ডিভিজুয়ালিটির যে প্রাক কণ্ডিশনিং এই সে জীবন পথে গড়ায়মান সেটাই সে স্পষ্ট করে বোঝে না। তড়বড় তড়বড় করে গড়িয়ে যায় আর ভাবে আমি একটা কেউকেটা, আহা আমি কি স্বাধীন। ঘোড়ার ডিম। হঠাৎ করে যেই না গ্যাসবেলুনটা ফুস করে ফেটে যায়.. ব্যস…. সব ফুস!

ইণ্ডিভিজুয়ালিটির হাত থেকে আমরা নিস্তার পাই ঘুমের মধ্যে। শান্তির ঘুম। কোনো দায় নেই। স্বপ্ন আমার চিত্তপটে হলেও প্রত্যক্ষভাবে তো আর আমার ইচ্ছাধীন নয়! অগত্যা দায়মুক্ত। আমি এই ঘুমের তত্ত্বটা জানি। তাই আমি জেগে থেকেও আরেকটা ঘুম চাই। জাগা ঘুম। তখনই ওই ঈশ্বর, গুরু, মত, দল, ভাবের ডাক পড়ে। দে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দে। মানে আর কি আমার এই কণ্টকাকীর্ণ ইণ্ডিভিজুয়ালিটির কানে কানে ঘুমপাড়ানি গান গা রে! আমি ঘুমাই।

আর যদি না ঘুমাই। তবে যন্ত্রণা। তবে ছটফটানি। তবে অ-স্বস্তি। তবে অতৃপ্তি। তবেই জীবন। আমরণ জীবন। যদ্দিন না প্রকৃত জ্ঞান বা উপলব্ধি এসে আমার ইণ্ডিভিজুয়ালিটিকে গলিয়ে দিচ্ছে। আমি সীমার মধ্যে অসীমের বাঁশি শুনছি। আগেরটা ছেড়ে পরেরটা পাওয়া যায় না। যারাই চেষ্টা করেছে, নিজেকে ঠকিয়েছে, অন্যকে ঠকিয়েছে, অন্যের দ্বারা ঠকেছে। তাই যারা সত্যি চলেছে, পুড়েছে। আর যারা তাদের নকল করেছে, শুধুই ঘুমিয়েছে। আজও ঘুমাচ্ছে। আর যারা ঘুমাতে চায় তাদের সঙ্গে, তাদেরও কাঁথাবালিশ পেতে পাশে ঘুমাতে ডাকছে।

সাধু সাবধান!

140
Tue, 09/20/2022 - 23:54

সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বোঝা যায় না অনেক কিছু। না, আমি উচ্চস্তরের পড়াশোনার কথা বলছি না। আমি সমাজের কথা বলছি। আমাদের কথা বলছি।

এই যে মাঝে মাঝেই পড়ছি না, মেয়েটাকে প্রথমে ধর্ষণ করছে ক'জন মিলে, চাষের ক্ষেতে বা পরিত্যক্ত কোনো জায়গায়। তারপর তার গায়ে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তারপর সে মারা যাচ্ছে ক'দিন বাদে। ইংরাজি দৈনিকের প্রথম পাতায় মাঝে মাঝেই ছাপা হচ্ছে। এগুলো পড়ে যে অসহায়তা লাগে, যন্ত্রণা হয়, সেগুলো কেন হয় বুঝি। মানুষ হিসাবে যে ছবিটা আমাদের মধ্যে থাকে সেটা সম্পূর্ণ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি আসে বলে। কিন্তু যারা করে এগুলো, তারা কেন করে এ কি আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে আসে? আসে না। আমরা পশু, বর্বর এমন কিছু শব্দ বানিয়ে ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারি। কিন্তু তার মানে কি হয় তা কি জানি? না। খবরের কাগজে একজন মুখ্যমন্ত্রীর নাম দেগে দেওয়া হয়, কি কোনো একটা রাজ্যের নাম। ব্যস, আমাদের কাঁচা বুদ্ধি ভাবে এই তো ব্যাখ্যা পেয়ে গেলাম। কোনো কোনো অতিপণ্ডিত ক'টা মনোবিজ্ঞানের টার্ম শিখে 'সাইকোপ্যাথ', 'সোশিওপ্যাথ' ইত্যাদি দাগে দেগে দেয়, আমরা ভাবি এও বেশ।

সাধারণ বুদ্ধি এও জানে না কেন একজন মানুষ লোনের টাকা ফেরত না পেয়ে একজন অন্তঃসত্ত্বাকে ট্রাক্টরে পিষে চলে যায়, কেন স্নানরতাদের ছবি ভাইরাল করার ইচ্ছা হয়। এগুলো তো সব হালের ঘটনা নয়, এগুলো সব পৌনঃপুনিক ঘটনা। আমরা নানা ব্যস্ততায় ভুলে যাই তাই। ওয়েব সিরিজ আর কত অপরাধের কথা রসিয়ে রসিয়ে মনে রাখাবে! আসলে আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে কুলায় না যে, এত এত নিরীহ, নির্দোষ মানুষের অধিকার কেড়ে, স্বপ্ন পিষে লক্ষকোটি টাকা জমিয়ে জমিয়ে কি করে মানুষ সুখে থাকে!

এতদিন জানতাম প্রচুর পড়াশোনা করিনি, যাক্ বাবা আমার নিতান্ত সাধারণ মোটা বুদ্ধি নিয়ে আর বড় বড় বিদ্যালয়ে নাস্তানাবুদ হতে হবে না। কিন্তু তা তো হল না দেখি। এখন তো কাগজ পড়তে গিয়েই নিজেকে বড্ড নিরেট মাথামোটা লাগে। এত এত বিচিত্র ইচ্ছা মানুষের মনে জাগে কেন?

মেয়েরা সম্ভোগের বস্তু যে নয় এ কথা আমাদের শাস্ত্রে, নীতিতে এত শেখানো হয় কেন? মেয়েদের শ্রদ্ধা করতে হয়, সম্মান করতে হয়, এ কথাই বা এত আলোচনা হয় কেন? মানে কি কোথাও আমরা জানি এ আমাদের চরিত্রগত নয়? তাই বাক্যের ঢালে আটকে রাখার ইচ্ছা?

যৌন আকর্ষণ থাকবে। এ প্রকৃতির নিয়ম। তা চরিতার্থ করার নানা উপায় সমাজ করেও রেখেছে। তারপরও কি বাকি থাকছে তা কি আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে কুলাচ্ছে? 'মণ্ডি' সিনেমা, যা একটা যৌনপল্লী নিয়ে বানানো, যার প্রধানের অভিনয়ে শাবানা আজমি, যিনি বুক ঠুকে বলেছিলেন, "আরে হাম হ্যায় তো সমাজ হ্যায়"। নইলে তোমাদের মনের বিকৃত বাসনা, অতৃপ্ত বাসনা কোথায় চরিতার্থ হত?

এ তো খাঁটি কথা। এই প্যাণ্ডেমিকে ইন্টারনেটে সব চাইতে বেশি খোঁজা হয়েছে পর্ণ সাইট। হ্যাঁ, অক্সিজেনের সিলিণ্ডারের থেকেও বেশি! মানুষের যৌন চাহিদার নানা কাল্পনিক রূপের পসার সেখানে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। যার যেমন রুচি তেমন খুঁজে নাও। সুবিশাল তার তালিকা। সবই তো আমাদের জন্য। আমাদের সুখী করার জন্য।

আরেকটু সফট চাও তো নানা সোশ্যাল মিডিয়ায় এসো। সাধারণ মানুষ কি চমৎকার আগলহীন হয়ে নিজেকে মেলে ধরছে দেখো। কেউ বারণ করছে না। সবার লাভ হচ্ছে। তোমার গোপন সুখকে উস্কে, চাগিয়ে কারোর লক্ষ্মীলাভ যদি সমাজের অর্থনীতির দিক থেকে তা ক্ষতি কি?

বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া আরো আরো কুবের হচ্ছে। যে দুর্নীতি নিয়ে এত এত বাংলা কাগজে পড়ছ, সে তো নস্যি গো! আরো কত বড় ভয়ংকর নীতি নিয়ে আদিম রিপুদেরকে উস্কে ব্যবসা চলছে সে ভাগ্যে আমরা জানি না! কেউ আত্মহত্যা করছে, কেউ সর্বস্বান্ত হচ্ছে, কেউ বুদ্ধিহারা হচ্ছে, কেউ মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে। সব চলছে। আমরা দেখেও দেখছি না। কারণ? ওই যে মাঝে মাঝে সেমিনার হচ্ছে তো! বই লেখা হচ্ছে।

এক অনুল্লিখিত প্রতিযোগিতায় নেমেছি যেন। আমরা কে কত না দেখে থাকতে পারি! কে কত অসংবেদনশীল হয়ে বাঁচতে পারি। ডারউইন বলেছিলেন, যোগ্যতমের উদবর্তন। মানে যে যোগ্য হবে সেই টিকে থাকবে। হয় তো তারাই বেঁচে থাকবে যারা আরো আরো বেশি অসংবেদনশীল হতে পারবে। যারা অনেক অনেক বেশি নিজেকে নিয়ে নিজের মত করে ব্যস্ত রাখতে পারবে। তারাই হবে নব্যযুগের চালক। যারা মানবতাবাদী ছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই আশাবাদী ছিলেন, মানুষের একদিন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে, একদিন ফিরে আসতে চাইবে মানুষ হয়ে। হবে কি?

141
Sun, 09/18/2022 - 23:50

মঙ্গলের উপর আস্থা হয় তো মানুষের একসঙ্গে থাকার প্রাথমিক আস্থা। এত অমঙ্গল, এত ক্ষয়ক্ষতির পরও মানুষ বিশ্বাস করে, আস্থা রাখে, ভালো হবে। অবশেষে সব ঠিক হয়ে যাবে। এ বিশ্বাস হারিয়ে যাওয়া মানে মানসিক অসুস্থতার দিকে চলে যাওয়া। অবসাদ, বিষাদ। সে সব মানে অবশেষে আস্থা হারানো জীবনে। 

     এই মঙ্গলের উপর আস্থায় মানুষ মনে মনে এক মঙ্গলময়ের মানবিক রূপের ছবি আঁকে। সে ছবি এতটাই প্রবল যে এতবড় একটা অতিমারিও তাকে ম্লান করতে পারেনি। ক'দিন আগে পড়ছিলাম এবারে নানা ধর্মস্থানে মানুষের ভিড় রেকর্ড সংখ্যা ছাড়িয়েছে। 

     না, এত লক্ষকোটি মানুষের আস্থাকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেব, এতটা স্পর্ধা আমার নেই। একি পরীক্ষিত সত্য? অবশ্যই নয়। তবু এ কল্পনার সত্য। মঙ্গলের প্রতি আস্থাটুকু হারালে তো সবই হারালো। আর কিসে যে মানুষের মঙ্গল সে উত্তর নিশ্চিতভাবে কার কাছেই বা আছে? নেই যখন তখন অন্যের শ্রদ্ধার প্রতি শ্রদ্ধা রাখাকেই শ্রেয় বলে মনে হয়। 

     আজ গঙ্গার ঘাটে এসে জানলাম আজ 'জিতিয়া'। বিহার, উত্তর প্রদেশের উৎসব এটা। মায়েরা উপোস থাকেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়। নানা উপাচার নিয়ে খালি পায়ে আসেন নদীর তীরে পুজোর জন্যে। সন্তানের মঙ্গলের জন্য। 

     এর কি ইতিহাস সে গল্প থাক। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যা অনুভব করছিলাম তা এক নম্র শ্রদ্ধা। কোথাও কোনো উদ্ধতভাব নেই। মা সন্তানকে ভিড়ের মধ্যে বসে স্তনপান করাতে করাতে ব্রতকথা শুনছেন। ছোটো ছোটো হাতপাখা নিয়ে বাচ্চাদের মাথায় হাওয়া দিচ্ছেন। মোবাইলে ছবি উঠছে। সেল্ফি উঠছে। গান হচ্ছে একসঙ্গে। 

     পিচের রাস্তার উপর সার দেওয়া খালি পা। খালি পা আমাদের সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর উপায়। মন্দিরে খালি পায়ে ঢুকতে হয়। পৃথিবী তখন সেই মুহূর্তে পবিত্র। রোগশোক, ভয়, দুঃখ --- সব আছে। কিন্তু সবার উপর আছে আমার সে সব মাড়িয়ে যাওয়ার তৃষ্ণা। আমার সে সব মাড়িয়ে এগোবার স্পৃহা। এ কেউ কেড়ে নিতে পারেনি। পারবেও না। নইলে এত এত ভয়ংকর উগ্রপন্থীর হামলার পরেও মানুষ রাস্তায় নামত না। যদি বলো সে কাজের তাগিদে? তবে বিনোদনের জায়গাগুলোয় এত মানুষ কেন? না, মানুষ কোনো সিসিটিভি-র ভরসায়, হাজার একটা নানা উপায়ের সিকিউরিটি চেক ইত্যাদির ভরসায় বাইরে বেরোয় না। মানুষ অদম্য বলেই বাইরে বেরোয়। ভয় মানুষকে চিরকালের জন্য দমিয়ে রাখতে পারে না বলেই মরণশীল মানুষ অমর আত্মার কল্পনার স্পর্ধা দেখায়। নইলে মানুষই তো একমাত্র প্রাণী যে জ্ঞান হওয়া থেকেই জানে সে মরণশীল। ভয়ে কুঁকড়ে বাঁচে না কেন সে? কারণ মানুষের আত্মায় চিরকালই ভীরুতার উপর এক তীব্র ঘৃণা আছে, 'না' আছে।

     মানুষ বিশ্বাসে হাঁটে, যুক্তিতে ভাবে, ভালোবাসায় আর ভয়ে কল্পনা করে। সে ভাবনাকে করার দিকে এগিয়ে দিতে বিশ্বাসের হাত ধরতে লাগে। মানুষের পবিত্রতম বিশ্বাস, মঙ্গলের উপর আস্থা। একজন ঠাকুমা নাতির হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে উঠছেন সিঁড়ি দিয়ে। মাথা ভিজে। গঙ্গা স্নান করেছেন। নাতির বয়েস দশ পেরোয়নি। কিন্তু ঠাকুমা সে-ই হাতেই তাঁর আস্থা রেখে উঠছেন। আমি একটু উপরে দাঁড়িয়ে। আমার থেকে দুটো সিঁড়ি আগে একবার মনে হল মাথাটা ঘুরে গেল ওনার। পাশের দেওয়াল ধরে দাঁড়ালেন। ক্ষণিকের জন্যে চোখ বন্ধ করেই আবার খুললেন। আমার চোখে চোখ পড়ল। হাসলেন। কি অপূর্ব সে হাসি। ওনার মাথার পিছনে গঙ্গার ওইপারে সূর্য ডুবছে। ওনার জীবনও পশ্চিমের দিকে ঢলে। জীবন যে সচ্ছল ছিল না, আজও নেই সে ছাপ স্পষ্ট। 

     আমি এগিয়ে হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলাম, ঠিক আছেন? 

     উনি একগাল হেসে বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছি। 

     হাতটা এগিয়ে বললাম, উঠে আসুন। 

     উনি আরেকবার হেসে, উদ্বিগ্ন খুদে মুখটার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যে নাতি আছে। 

     নাতি আবার তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে ঠাকুমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, আও। 

     আমার সামনের সব কিছু মুহূর্তে ঝাপসা হল। "আও"-এ আস্থার ডাক। বিশ্বাসের ডাক। ভালোবাসার ডাক। 

     মানুষের যুক্তি, বিশ্বাস, কল্পনা সব থাকুক, ভালোবাসার হাত ধরে। ভালোবাসা না থাকলে বিজ্ঞানও কুসংস্কারের মতই ধ্বংসাত্মক। মঙ্গলের তৃষ্ণা না থাকলে সত্যও তথ্যের প্রাচীরে আবদ্ধ হয়ে অচল। আমার আভূমি প্রণাম মানুষের সমস্ত মঙ্গলের ইচ্ছায়, যেখানে মানুষ হাত বাড়িয়ে বলছে, "আও"।

 

 

142
Sat, 09/17/2022 - 15:04

বাঙালি সব সময়েই দ্বিধাকূল জাত। সৌমিত্র, না উত্তম; সত্যজিৎ, না ঋত্বিক; রবিশঙ্কর, না নিখিল ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু চপ না চিতা? কি নিয়ে খিল্লি হবে, এ এক জটিল ধাঁধায় আজ বাঙালিকূল। এমনিতে দেশে খুব একটা কলকে আজকাল আমরা পাই না। সাহিত্য-সংস্কৃতি সব পশ্চিমে দক্ষিণে গড়াচ্ছে। মায় রাজনীতিতেও দেশের মাটিতে বেশ একটা বলিয়ে কইয়ের জায়গায় নেই। অনেকেই দেখি আনন্দবাজার, এই সময় — এইসবের অনলাইন ভার্সানে গিয়ে তলায় ফুট কেটে আসেন। কিন্তু ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস, টাইমস, ইণ্ডিয়া টুডে ইত্যাদিতে খুব একটা উপস্থিতি দেখা যায় না। আসলে আমরা আমাদের নিয়ে একটা আস্ত সংশয়ে ভুগছি। খুব একটা স্বস্তির জায়গায় নেই। একের পর এক কেলেঙ্কারি রাজ্যজুড়ে বেরোচ্ছে। তায় বিকল্প ভাবার জায়গাতে কেউ দাঁড়ায়নি। এখন করে তো করে কি বাঙালি?

বাঙালি জানে সে চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। সে চাইলে নোবেল পেতে পারে, চাইলে অস্কার পেতে পারে, চাইলে গ্র‍্যামি পেতে পারে। জাতীয় পুরষ্কার তো জলভাত। কিন্তু হচ্ছে না কেন? অবশ্যই ষড়যন্ত্র তো আছেই দেশের, দশের। তা ছাড়া বাঙালি জ্যোতিষেও বিশ্বাসী। সময় হলেই হবে।

তো এ হেন উচ্চগ্রামে বাঁধা যে জাতের সুর, সে জাতের কানে যখন কাঁচা বাদাম, টুনির মা, টুম্পাসোনা আসে, তখন সে কি করে? তখন সে নাচে-গায়। গালাগাল দেয়। সংস্কৃতির দফারফা হল বলে, কিন্তু বারবার শোনে। বারবার রিলে দেখে। আর বলে, এ সবও হচ্ছে!

আবার দ্বিধায় পড়ে বাঙালি। স্রোতে ভাসবে, না প্রতিকূলে সাঁতরাবে। উচ্চগ্রামে উড়ে উড়ে বেড়াবে, না মাটি-কাদা মেখে রাস্তায় নামবে। এত দ্বিধা এত দ্বিধা! যাকে মুখে নিন্দা করি, কাগজে-কলমে নিন্দা করি, প্রাণে প্রাণে তাকেই শ্রদ্ধা করি, তার যা কিছুকে ঈর্ষণীয় ভাবি, অনুকরণীয় ভাবি। এদিকে যে আদর্শ, যে ভাবকে মুখে মুখে, কাগজে-কলমে, বক্তৃতায়-আলোচনায় মুখরিত করে তুলি, তাকেই মনে প্রাণে জানি অকাজের, অচল, মানহীন, অকিঞ্চিৎকর হিসাবে।

দ্বিধা যত আমাদের আঁকড়ে ধরতে চায়, আমরা তত হড়বড় করে, তরতরিয়ে আমাদের সোচ্চারে ঘোষণা করতে চাই। নিজেকে নিয়ে যে আমাদের কোনো সংশয় নেই সেটা বোঝানোর জন্য আশু কোনোদিকে ঝুঁকে পড়ে অন্যদিকের গুষ্টির পিণ্ডি চটকাতে থাকি। ভাবি এইটাই আমার সব চাইতে বড় কাজ।

এখন দ্বিধাকে জয় করতে যে আত্মবিশ্লেষণের দরকার, তার সময়, সুযোগ কই? সোশ্যাল মিডিয়া রেডিমেড উত্তর দিয়ে দিচ্ছে দিনে-রাতে। সেদিন শুনলাম মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, এতদিন মুম্বাই এগিয়েছিল, আজ আমরা বাঙালিরাও পিছিয়ে নেই। আমি মাইকে শুনতে শুনতে উৎসের কাছে গিয়ে দেখি বিরাট করে গণেশ পুজোর উৎসবের আয়োজন। অর্থাৎ, আমরা মুম্বাইকে ধরতে পেরেছি। উল্টোটা কিন্তু কোনোদিন হবে না। মুম্বাই শারদোৎসবকে পাড়ায় পাড়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু ভাববে না। কারণ আজকের বাঙালি তাদের অনুকরণের যোগ্যতাও হারিয়েছে।

মানুষ ভাষা হারাতে শুরু করলে নিজের অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে। নিজের মধ্যে সংকর অবস্থা উৎপন্ন হয়। সংশ্লেষ আর সংকর অবস্থার মধ্যে ফারাক অনেক। সংশ্লেষিত হয় বোধ-বুদ্ধি-উদ্যম-আত্মশক্তির জোরে। আর সংকর উৎপন্ন হয় দুর্বলতা, হীনমন্যতা আর ক্লীবতাকে আশ্রয় করে। আমরা বৈচিত্র বলতে যা বুঝি আজকাল সে দড়কাঁচা সংকর অবস্থা ছাড়া কিছু নয়। পাত্র হারালে যেমন পাত্রস্থ সব কিছুই হারিয়ে যায়, কিম্বা অন্য পাত্রস্থ করলে যেমন সে পাত্রের রঙ, গন্ধ মিশে এক বিদঘুটে জিনিস তৈরি হয় --- আমাদেরও সেই অবস্থা। আমাদের ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ সব কিছুই ভীষণ স্থূল। কারণ দ্বিধার ভিতর দিয়ে তাকে অতিক্রমের পথ না পেলে অলস, তামস হাসি-তামাশায় সে সমস্যাকে আশু ভুলে তো থাকা যায়।

মূল কথা হল আমাদের ভাষাটা আমরা অনেক যত্ন করে, অনেক গুরুত্ব দিয়ে হেলায় হারিয়েছি। কোনো মারকাটারি দল তৈরি করে গায়ের জোরে তাকে বাঁচানো যাবে না। কারোর গলায় পাড়া দিয়ে তাকে বাঙলা বলিয়ে হেনস্থা করে নিজের দুর্বলতাকে আরো নগ্ন করে দেখাতে পারি মাত্র, কিন্তু শেষে নিজেকেই হাস্যাস্পদ করে তুলি।

আমরা আমাদের ভাষার উপর শ্রদ্ধা হারিয়েছি। আমাদের বিদ্যালয় থেকে তাকে আগাছার মত তুলে ফেলেছি। শ্রদ্ধা ছাড়া চিত্তে কোনো কিছু স্থায়ী হয় না। গতিশীল হয় না। আমরা সেই শ্রদ্ধাকে তিলে তিলে নষ্ট করেছি। শ্রদ্ধার অভাব যত বেড়েছে, আমাদের বাইরের আস্ফালন তত বেড়েছে, উগ্র হয়েছে। আমাদের অধঃপতনের বেগ আরো দ্রুত হয়েছে। আমরা "মধ্যমেধা" শব্দের ঘাড়ে সবটুকু দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছি। এ যেন সূর্য বলছে, এত এত তারা আকাশ জুড়ে উঠেছে যে আমার আলোটা কারোর চোখেই পড়ছে না! হা ভাগ্য! কোথায় এসে আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি দাঁড়িয়েছে! মধ্যমেধা চিরটাকাল আছে। থাকবেও। তাদের সংখ্যাই সব দেশে, সব কালে গরিষ্ঠ। কিন্তু তারা কখনও উচ্চমেধার উৎকর্ষের বাধা হতে পারেনি। হয়ও না।

দোষটা মধ্যমেধার নয়। দোষটা আবারও বলছি, আমরা আমাদের ভাষার উপর স্বাভাবিক শ্রদ্ধাকে হারিয়েছি। তাই সে ভাষাকে জড়িয়ে যা কিছু আমাদের হাত থেকে বাইরে চলে যাচ্ছে। আমরা দ্বিধান্বিত হচ্ছি। এই দ্বিধাবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংসের আগের অবস্থা। এই আসল-নকল একসঙ্গে নিয়ে চলার চাতুরী, আত্মশ্রদ্ধার শেষ ধাপের ইঙ্গিত। জানি না আমাদের ভবিষ্যৎ কি। জানি না আমরা ভারতে দ্বিতীয়, কি তৃতীয় শ্রেণীর অধিবাসী হয়ে থাকব কিনা! সম্পূর্ণ সত্তা বিসর্জন নিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়ে যাব কিনা একটা অন্য জাতে! হয়ে গেছিও হয় তো অনেকটা। নাকি আবার কেউ আসবে। নাকি আবার আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে ঘুরে দাঁড়াব। নচিকেতার মত বলব, না তো আমি সর্বোচ্চ, না তো আমি সর্ব নিকৃষ্ট, আমি আমিই। আমার শ্রদ্ধা আমার ভাষার উপর ফিরিয়ে দেবে সে। আমার ভাষাকে নিয়ে যাবতীয় যা কিছুকে আমি প্রাসঙ্গিকতায় দেখতে শুরু করব আবার। আমি আবারও বলতে পারব যে আমারও এই মহাযজ্ঞে কিছু দেওয়ার আছে যা আমারই ভাষায় জন্মেছে, ধার বা নকল করে আনিনি!

জানি না কি হবে। কিন্তু যা হচ্ছে তা যে ভীষণ ক্লান্তিকর হয়ে উঠছে!

143
Thu, 09/15/2022 - 19:59

No one to anyone - এই অনুভবটা কেমন? যার হয় সে জানে। সব আছে অথচ যেন কিছুই নেই। সবাই আছে, তবু যেন কেউ নেই। আমি দীর্ঘদিন এই অনুভবটার মধ্যে দিয়ে গেছি। মা চলে যাওয়ার পর। সবাই আছে, সব আছে, তবু কিছুই যেন নেই। কথাটা অবশ্য ঠিক মা চলে যাওয়ার পর নয়, আরো আগে থেকেই, যখন বুঝতে শুরু করলাম, মা আর থাকবেন না।

     তারপর এক নিরবচ্ছিন্ন শূন্যতা। এদিকে সব কাজ তো করতে হবে। শুরু হল নিজের আবেগকে অস্বীকার করা। তাকে সামনে না আসতে দেওয়ার ছল। দায়িত্ব, কর্তব্য --- কোন কিছুই তো থেমে থাকবে না। কারোর জন্যেই দাঁড়ায় না। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল, যত নিজের আবেগের থেকে নিজের দূরত্ব বাড়তে শুরু করল, তত ভিতরে ভিতরে শুষ্ক হয়ে যেতে শুরু করলাম। নকল অনুভব, নকল আবেগে আর কদ্দিন টেনে নিয়ে যাওয়া যায় নিজেকে। ভিতরে ভিতরে যেন মরে যাচ্ছি, শেষ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন নিজেকে চলতে দেওয়া যায় না। একটা কিছু তো করতে হবে। কি করতে হবে?

     খুব কঠিন কাজটা - নিজের মুখোমুখি হতে হবে। নিজের আবেগের সমস্ত আঘাতকে সহ্য করতে হবে as it is. ভাষা বদলালে চলবে না, কোনো কপট বৌদ্ধিক ব্যাখ্যায় শর্টকাট খুঁজলে চলবে না, কোনোভাবেই ফাঁকি দেওয়া যাবে না। নিজের এই loss-কে নিজেকে স্বীকার করে নিতেই হবে। আবার হাঁটতেই হবে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ে। আধা-আধি আর নয়।

     কিন্তু ভাগ্যে আরো কঠিন পরীক্ষা ছিল। করোনার দ্বিতীয় ওয়েভে ভাই চলে গেল। আবার মুখ থুবড়ে পড়লাম। কিন্তু এবার আর আগেরবারের ভুলটা করলাম না। এবার নিজের আবেগকে মাটি চাপা দিয়ে তার উপর নকল খুশীর মসনদ বানালাম না। একটা জিনিস এতদিন চলতে চলতে শিখে গিয়েছি যে মনের জোর বলে কিছু হয় না। মন অনেকটা আটা বা ময়দার লেচির মত। তার মধ্যে সত্যের পুর ভরলেই মন শক্ত হয়। সত্যকে মেনে নেওয়া ছাড়া মনের জোর বলে আলাদা কোনো কৌশল আমি জানিনি। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের বহু চর্চিত কবিতা, ‘বোঝাপড়া’ আছে। কিন্তু বইয়ের পাতায় থাকা আর জীবনে থাকার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। সত্য যা, বাস্তব যা তাকে as it is স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। সে আমি নাস্তিক হই, কি আস্তিক হই। ওতে কিচ্ছু এসে যায় না। সত্যিকারের আস্তিকতার পরীক্ষাই হল, “তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক”। সত্যিকারের নাস্তিকতার পরীক্ষাই হল, “যা বাস্তব তাই মেনে নেব”। দুর্দিনে অনেক নাস্তিককে আস্তিক আর অনেক আস্তিককে নাস্তিক হতে দেখেছি। ও করে আদতে কোনো লাভ হয় না। কোনো দর্শনই স্বস্তি দেবে না, যদি সব দর্শনের মূল কথাটাকে অস্বীকার করি। সে মূল কথাটাই হল, যা আছে তাকে স্বীকার করে নেওয়া তার মত করেই।

     শোক বাইরে কোথাও নেই। সে আমার মনে আছে। আমি বাইরে আর ভিতরে ছড়িয়ে আছি। আমার বাইরে যেমন অনেক দায়িত্ব, অনেক কর্তব্য আছে, তেমনই আমার নিজের আবেগ, অনুভবের উপরেও নিজের দায়িত্ব আছে। সংসারে আমার শোক সত্য নাও হতে পারে, কিন্তু আমার মনোজগতে তা বাস্তব। তাকে স্বীকার করে নেওয়ার সাধনা আমার। নিজের ভালোবাসার মানুষটার চলে যাওয়ার শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হয় না। শুধু সেই শূন্যতাকে প্রতিদিন দেখতে দেখতে সয়ে যেতে শুরু করে। তার থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখলে জগৎ জোড়া শূন্যতার ভয় এসে গ্রাস করে নিজেকে।

     তবে এই 'no one to anyone' অনুভবটা কেন? কারণ 'মা'। মা এমন একজন মানুষ, যিনি আমাদের চরম দুর্দিনেও ছেড়ে যাবেন না --- এমন আস্থা, আশ্বাসে আমরা বড় হই। বাকিরা চাইলে যেতেও পারে, এ আশঙ্কা আমাদের থাকে। এমনকি পরিণত বয়সেও ভালোবেসে কি সামাজিক তাগিদে ঘর বাঁধতেও আইনের দ্বারস্থ হতে হয় আমাদের। সেখানে বাঁধনের শর্ত থাকে। “আসা যাওয়া দুদিকেই খোলা রবে দ্বার” - এ দিয়ে কাব্য হয়, কিন্তু সংসার হয় না। সেই জন্যে অকালে মা চলে গেলে মনের মধ্যে এই অনিশ্চয়তার ঝড় ওঠা স্বাভাবিক। আর মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী এ প্রমাণিতও। ‘আগন্তুক’ সিনেমায় যখন নাড়ির টান, কি রক্তের টানে একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ শুধুমাত্র পারিবারিক যোগসূত্রকে সম্বল করে আত্মীয়তার বাঁধনকে জাগিয়ে তুলতে আসছেন, অনেক সংশয়, অপমানের আশঙ্কা নিয়েই, তখনই এই একই কথা মনে হয়। মানুষ কোথাও নিজেকে সম্পর্কিত জানতে, সম্বন্ধিত অনুভব করতে ভালোবাসে। এমনকি গোটা বিশ্বের সঙ্গেও যে তার একটা সম্বন্ধ আছে, সেটাও সে ধর্মে, দর্শনে ঘোষণা করতে চায়। প্রাণপাত করতে চায় সে সত্যকে বাইরের জগতে রূপ দিতে।

     তবু এ সব কথা থাক। মনের বিশ্লেষণ এক, আর ক্ষতবিক্ষত মনকে সজাগ, সচল করে নিয়ে সংসারের রাস্তায় নামা আরেক। সে জোর মনের মধ্যে থেকেই জন্মায় যদি নিজেকে সত্য স্বীকারের সাধনা থেকে দূরে সরিয়ে না রাখা যায়। এ কথা আগেই লিখলাম। কোনো বিশ্লেষণ, কোনো দর্শন, কোনো ধর্ম, কোনো মত তখন সাহায্য করে না। শূন্য দুপুরগুলো যেন গিলে খেতে আসত, সারা বাড়িটা যেন অপরিচিতের মত ঘিরে দাঁড়িয়ে আমায়। মন সারাদিন বলে চলেছে --- পালা, পালা। মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া বুক খামচে থাকা শোকের স্তূপ। কে সাহায্য করবে? পরেরদিন সকাল থেকেই তো আবার কর্তব্যের পালা। নিজের ভাগ্যের উপর রাগ। নিজের ভাগ্যের উপর আক্রোশ। তার উপরে সমাজের চাপিয়ে দেওয়া এক বছরের অশৌচের ভার। তুমি অশুচি। কারণ তুমি শোকগ্রস্থ। এও দুর্বল মনকে কি করে ঘিরে ধরে দেখেছি। মা চলে যাওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই আমার এক অত্যন্ত কাছের মানুষের মেয়ের বিয়ে। আমি না যাওয়ার অজুহাত খুঁজছি। তাকে বলি কি করে আমার মনের মধ্যে এক অযৌক্তিক ভয় দানা বেঁধেছে, আমি গেলে যদি আপনার অমঙ্গল হয়! আমি যে অশুচি! আমার যে মাতৃশোক! সমাজ এমনভাবে দুর্বল করে। আমি কোনোদিন তর্পণ করিনি। করবও না। আমার প্রাণের ভাষা আর প্রাণের আবেগই আমার তর্পণ। তার জন্যে কোনো পুরোহিত বা সংস্কৃত মন্ত্র বা গঙ্গাজলে আমার আস্থা নেই।

     একদিন মেঘ কাটে। অল্প অল্প করে আলোর রেখা দেখা যায়। যখন বোধ হয়, আমি শুধু না, যুগ যুগ ধরে মানুষ এমনই শোক বুকে নিয়ে সংসারে হেঁটে আসছে। আরো আরো গভীর শোক, সান্ত্বনাহীন আরো কত কত দুঃখকে অতিক্রম করে হেঁটে আসছে। তখন মনে হয় তাদের ধৈর্য, স্থৈর্যের পায়ে মাথাটা নীচু করে তাদের সঙ্গে আমিও পা মেলাই। যা ক্ষতি হয়েছে তা হয়েছে। হয় তো আরো অনেক ক্ষতি, অনেক দুঃখ সামনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু জীবনটাকে বাইপাস করে তো বাঁচা যায় না। নিজের বোধের আগুনে নিজেকে না পুড়িয়ে নিলে ধার করা কথায় আর ধার করা অনুভবের উপর ভর দিয়ে কি চলা যায়? ভরাডুবি হয়। কপটাচারী হয়। দুঃখের হাত থেকে ত্রাণের উপায় খোঁজা মূর্খামি। জীবনকেই অস্বীকার করতে চাওয়া প্রকারান্তরে। তা আরো দুর্বল করবে। জীবনের মূল স্রোতে নিজেকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলবে। সে থাক বরং। সুখ না থাকুক, স্বস্তি থাকুক। চিন্তা, অনুভব, সিদ্ধান্ত, ভালোবাসা মঙ্গলানুগামী হোক। যা ভালো তাই হোক। যা শুভ তাই হোক। সেটুকুই তো মানবিকতার পায়ের তলার মাটি।

144
Wed, 09/14/2022 - 19:48

"এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর", বিদ্যাপতি লিখলেন। সুর তিনি কি করেছিলেন জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ যে সুরটা করলেন, সেটা জানি। 

     বিদ্যাপতির লেখায় বিরহের সুর। শেষে প্রশ্ন, কি করে হরি বিনা দিন রাত কাটাবি? “বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া”। 

     গভীর রাত। বৃষ্টি পড়ছে আকাশ উপুড় করে। ভরা বাদর। বৃষ্টি পড়ে চলেছে অবিরাম। পাশে স্তব্ধ স্মার্টফোন। এত রাতে কে আর ফোনকে জাগায়? এখন ফোন জাগলে জগত জেগে যায়। আঙুলের ছোঁয়ায় এ লোক থেকে সে লোকে মন, চোখ আর কান ভেসে যায়। বুদ্ধি কখনও বিস্মিত, কখনও মোহাচ্ছাদিত, কখনও বিমূঢ়, কখনও বিভ্রান্ত। থাক। বরং বৃষ্টি হোক। বরং বিদ্যাপতিকে ডাকি। কণিকার কন্ঠস্বর মাথার মধ্যে থাকুক। “বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া”। হরি বিনা দিনরাত কি করে কাটাবি? প্রশ্ন বিদ্যাপতির। রবীন্দ্রনাথের অনুভবে --- বড় কথাটা প্রশ্নে নয়, বড় কথাটা হল দিনরাত কাটানোর মত এমন একটা সম্পদ আমার আছে, হরি, এই কথাটা। রবীন্দ্রনাথ ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ প্রবন্ধে লিখছেন এই কথাগুলো, এই গানের উল্লেখ করে।

     বিরহ আকুল বিদ্যাপতির মন। কৌতুহল নয়। বাসনা নয়। বিরহ। যন্ত্রণা। শূন্যতার সদর্থক যন্ত্রণা বিরহ। বিষাদ নয়। 

     বিদ্যাপতি যে আকুলতা নিয়ে রাত জাগছেন, আধুনিক যুগে সে আকুলতা কি আমাদের একদম হারিয়েছে? সম্পদ, পরিজন, সফলতা --- সব কিছুর মধ্যে কি আমাদের প্রাণে কখনও এক শূন্যতার ব্যথা জন্মায় না? ভাদ্রের রাতের অন্ধকারের বর্ষা তো সে ব্যথাকে আরো নিবিড়ভাবে জাগিয়েছে কেবল। “ব্যথা আমার কূল মানে না, বাধা মানে না। / পরান আমার ঘুম জানে না, জাগা জানে না”। সব ‘হ্যাঁ’-এর মাঝে এই ‘না’, আর সব ‘না’-এর মাঝে ‘হ্যাঁ’-কে শোনাই তো অভিসার। বাঁশির শূন্য শরীরে সুর ওঠে, সেই তো অভিসারের ডাক। যেখানে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ মিলেমিশে একাকার। ‘আমি’ আর ‘তুমি’ মিলে এক। 

     চিকিৎসক ততক্ষণ আশা রাখেন যতক্ষণ শরীরে শ্বাসবায়ুর যাতায়াতে কোনো বাধা ঘটছে না। আমার সম্পদ, সফলতা, পরিজনের মধ্যে একটা ফাঁক থাকুক। যেমন আমার শরীরে শ্বাসবায়ুর যাতায়াতের পথ। নইলে যে দম আটকে আসবে! বিদ্যাপতি সেই ফাঁক, সেই শূন্যতাকে আহ্বান করছেন। জাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রশ্ন করছেন। কি এমন সম্পদ আছে, যার ভার নেই? কি এমন সফলতা আছে যাতে অহমিকা নেই? কে এমন পরিজন আছে যে বেঁধে নেই? তাকে ছাড়া তোমার দিনরাত কাটবে কি নিয়ে? এই প্রশ্ন বিদ্যাপতির। 

     রুমি বলছেন, পাত্রের অন্তরে শূন্যতা বলেই তুমি সেখানে তোমার কাঙ্খিত জিনিস রাখতে পারো। শূন্যতা মানে অপেক্ষা। শূন্যতা মানে আলিঙ্গনের পূর্বাবস্থা। বিদ্যাপতি সেই শূন্যতাকে ডাকছেন। শূন্য মন্দির মোর। কার জন্য শূন্য? যে আমার চিরকালের তার জন্য। 

     আধুনিকোত্তর যুগ আমাদের শূন্য হতে শেখায়নি, নিঃস্ব হতে শেখাচ্ছে। দিনে দিনে আত্মহননের রাস্তাকেই একমাত্র পরিত্রাণের রাস্তা বাছছে মানুষ। আধুনিকোত্তর যুগের মানুষ। সফলতা, সম্পদ আর পরিজন --- এর মধ্যে সাম্য হারাচ্ছে। সফলতার স্পৃহা, সম্পদের স্পৃহা আর পরিজনকে বাদ দিয়ে অনুগামীর স্পৃহায় পাগল হচ্ছি। সামাজিক মাধ্যমে আমি অবতার হচ্ছি। আমি ডিভা হচ্ছি। আমি যে অনুসরণীয় তা যে করেই হোক তোমাকে বুঝিয়েই ছাড়ব। প্রতিভা ছাড়া মানুষ হয় নাকি? প্রতিভার বিজ্ঞাপন আমার এখন রাতদিনের রোগ। বহুকাল আগে 'ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ' বলে একটা সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। সৎ পথে সফলতা-সম্পদ-পরিজন আবৃত হয়েও চিত্তের বাধাহীন প্রসারের জন্য একটা মুক্তির রাস্তা খুলে রাখার কথা বলা হয়েছিল। যাকে 'মোক্ষ' বলা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা যেমন বলেন, ভরপেট খেয়ো না, পেটের কিছুটা খালি রাখো স্বাস্থ্যের জন্যে, এও সেই। সৎ পথে সম্পদ-সফলতা-পরিজন লাভ করলেও চিত্তের সবটুকু এতেই ব্যয় করে বোসো না। ওতে মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হবে। একটা 'ফ্রি স্পেস' রাখো। মোক্ষ মানে পালিয়ে যাওয়া নয়, মোক্ষ মানে সব কিছুর মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর ফ্রি স্পেসে অভ্যস্থ হওয়া। যেমন দুটো শব্দের মধ্যে একটা শূন্যস্থান না রাখলে বাক্য হয় না, এও তেমন। 

     বাইরের জগত আমাদের দরিদ্র করতে পারে। কিন্তু নিঃস্বতার বোধ চিত্তের অনুভব। সবল চিত্ত নিঃস্বতা অনুভব করে না, সমস্যা অবশ্যই অনুভব করে। তার থেকে বেরোবার যুক্তিগ্রাহ্য উপায় খোঁজে। ধৈর্য ধরে। 

     সফলতা-সম্পদ-পরিজনের বাইরে গিয়ে নিজের মধ্যে বিদ্যাপতির এই ডাক। কিভাবে দিনরাত কাটাবি? আমি ভাববো কেন? আমার এত এত সম্পদ আছে, এত এত ফলোয়ার আছে, এত এত গেজেট আছে… আমি সেই নিয়ে মেতে থাকব! 

     বিদ্যাপতি জিজ্ঞাসা করবে, এ তো বাইরের, ভিতরে কি কোনো শূন্যতার অনুভব নেই? 

     আমি বলব, সে নিয়ে ভাবার আমার সময় নেই। আমি ভীষণ ব্যস্ত যে, দেখতে পাচ্ছ না?! 

     বিদ্যাপতি হাসবেন হয় তো ঈষৎ। বলবেন, একদিন এই বাইরের জগতে পর্দা পড়বে, মৃত্যুর কথা বলছি না, বলছি অবসাদের কথা। অবসাদের পর্দা। কিচ্ছু ভালো লাগবে না। সব অনর্থক লাগবে। সেদিন নিজের চিত্তের মধ্যে ডুবো। একটা ফাঁকা রাস্তা বানিয়ে নিয়ো। সে রাস্তায় অপেক্ষা কোরো। চিত্তের মধ্যেই মুক্তো বানানোর উপাদান আছে। ঝিনুকের বুকে যেমন থাকে। তোমার অন্তরে তুমি যত শূন্যতাকে অনুভব করবে তত জানবে সে আসছে, আরো কাছে। শূন্যতাকে ভয় কোরো না। ভয় পেয়ো নিঃস্বতাকে, যে বলে, তোমার কিছু নেই, তুমি দীনহীন। শূন্যতা বলে, তুমি তৈরি হও, বুক পেতে অপেক্ষা করো। আমি এসেছি তাকে ধারণ করব বলে। আমি ধারণের প্রাক যন্ত্রণা। আমায় স্বীকার করো। পূর্ণ হও। আনন্দিত হও। সার্থক করো নিজেকে।

 

(ছবি Aniket)
 

145
Fri, 08/26/2022 - 20:21

সে জায়গাটায় নিজেকে আসতে দাও, যখন মনে হবে, নাহ্, এ মানুষটা আর যা হোক, আমায় ঠকাবে না। 

     মানুষের যতগুলো তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়, তার মধ্যে একটা অন্যতম তিক্ত অভিজ্ঞতা হল, যখন সে বুঝতে পারে সে ইউজড হয়েছে। এই ইউজড হওয়াটাকে অনেক ভাষায়, অনেক আঙ্গিকে বলা যেতে পারে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, ঠকে যাওয়া। ইউজড হওয়া। 

     কারোর সঙ্গে আমার সময় কাটে, আর কারোর সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য আমি সময় তৈরি করে নিই। এ দুটোতেই সম্পর্কের মূল সুরটা বাঁধা থাকে। যখন আমি কারোর জন্য সময় তৈরি করি তখন সেখানে আমার একটা প্রত্যাশা জন্মায়। সে প্রত্যাশা নির্ভর করে আমি কার জন্য কতটা সময় তৈরি করছি। যখন জীবনের সব সময়টুকু দেওয়ার জন্য সময় বুনতে থাকি, তখন প্রত্যাশা হয় অনেক গভীর। বাসনার প্রত্যাশা নয়। তাকে ছাপিয়ে একটা মানবিক প্রত্যাশা। সে আমার সঙ্গে সম্পর্কে স্বচ্ছ হবে। আমায় ঠকাবে না। ব্যবহার করবে না। এ আমাদের এক প্রাথমিক দাবী - স্বচ্ছতা। বিচ্ছেদ অত যন্ত্রণার নয়, যতটা অস্বচ্ছতার সংশয়ে বেঁচে থাকার। আমি যখন জানি মানুষটা স্বচ্ছ নয়, তখন ভালোবাসা এক বিড়ম্বনা। 

     অস্বচ্ছতাকে স্বীকার করে নেওয়া ঘৃণ্য দুর্বলতা। দিনের পর দিন নিজের প্রাথমিক অধিকারটুকু থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে দেওয়া কোনো সম্পর্কে, নিজেকে চূড়ান্ত অপমান করা। ক্রমে নিজের উপর নিজের শ্রদ্ধা বিশ্বাস সব যেতে শুরু করে। আশপাশের উপর সন্দিহান হয়ে উঠি। কথায় কথায় অভিমান, অভিযোগের গুদামঘর হয়ে উঠি। সবাইকে অভিযুক্ত করি। অথচ মনে থাকে না যে এ সবই শুরু করেছি আমি, নিজেকে অপমানিত হতে দিয়ে। একটা অস্বচ্ছ সম্পর্কের জালে নিজেকে জড়িয়ে। দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়ে।

     মানুষ ঠকে। রাতদিন ঠকে। জিনিসে ঠকে, দামে ঠকে, অফিসকাছারি-নার্সিংহোম-স্কুলে ঠকে, সাইবার ক্রাইমে ঠকে, রাজনীতিতে ঠকে, খেলায় ঠকে, প্রতিবেশীর কাছে ঠকে, পারিবারিক নানা সম্পর্কে ঠকে, বন্ধুদের কাছে ঠকে…. এ চলতেই থাকে। কিন্তু সে তাকে অতটা বিপর্যস্ত করে না, যতটা তাকে তার ভালোবাসায় ঠকে যাওয়া করে। প্রয়োজনের জগতে ঠকে যাওয়া, যে সম্পর্ক আমি নিজের হাতে গড়িনি, সেই সম্পর্কে ঠকে যাওয়া, মেনে নেয় মানুষ। কষ্ট হলেও। কিন্তু যেখানে সে সব চাইতে উন্মুক্ত, ডিফেন্সহীন, সেইখানে ঠকে যাওয়টা তাকে পেড়ে ফেলে। কারণ এখানে তার বিশ্বাস হেরে যায়নি শুধু, এখানে তার ভরসা হারিয়ে গেছে। বিশ্বাস হারালে দাঁড়ানো যায় আবার, কিন্তু ভরসার জায়গা, যা নিজের হাতে বানানো, নিজের হাতে গড়া, সেটা হারালে মানুষ প্রকারান্তরে নিজেকেই দায়ী করে। নিজের উপর আস্থা, বিশ্বাস, ভরসা হারিয়ে ফেলে। সে অবস্থায় নিজেকে আবার গুছিয়ে দাঁড় করানো অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ। কেউ পারে, কেউ পারে না। 

     যে সম্পর্কের ভাঙন নিজের উপর নিজের ভরসাকে বিপন্ন করে তোলে সে ভাঙন সব চাইতে বিপজ্জনক, এ বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সে কি একদিনে হয়ে যায়? না। মানুষ অন্যের উপর ভরসা এক লহমায় হারাতে পারে। কিন্তু নিজের উপর ভরসা তিলে তিলে নষ্ট করে। অনেক ইঙ্গিতকে, লক্ষণকে অস্বীকার করে, স্বেচ্ছায় আরোপিত অন্ধত্বে। সে প্রথমে পাত্তা দেয় না, তুচ্ছ মনে করে। কারণ সে তার ভরসার সুখটা থেকে নিজেকে বঞ্চিত দেখতে চায় না। সে ভরসার মানুষটার সব অযোগ্যতার উদাহরণগুলোকে উড়িয়ে দেয়। ভাবে অবশেষে তার সাধই জিতে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। 

     আদতে ঠিক হয় না। যখন সবটা ভেঙে পড়ে তখন প্রথমে প্রচণ্ড আকস্মিকতায় কিছু স্পষ্ট বোঝা যায় না। ধীরে ধীরে তার স্মরণে সব আসে কিভাবে সে নিজেকে প্রতারিত করেছে। নিজেকে ঠকিয়েছে। নিজেকে নিজেই ইউজ করেছে। নিজের উপর শ্রদ্ধা বিশ্বাস ভরসা তখন তলানিতে এসে ঠেকে। বাইরে থেকে সাহায্য এলেও তাকে ভরসা করার মত মানসিক অবস্থাও সে জুটিয়ে উঠতে পারে না। হারিয়ে যেতে শুরু করে। বারবার নিজেকে সব কিছুর জন্য দোষারোপ করে, দায়ী করে। বারবার আত্মবিশ্লেষণে মন তিক্ত, রুক্ষ, রুগ্ন হয়ে পড়ে। যেন বারবার নিজেকে খুঁড়ে দেখলেই সব সমস্যার হাল সে পেয়ে যাবে এমন একটা অবাস্তব ঘোরে বাঁচতে শুরু করে। এ আরো অন্ধকার। আরো গভীর অন্ধকার। 

     যদি এর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে, তবে নিজের ভুলগুলোকে শুধু নিজের ভুল বলেই মেনে নিয়ে, স্বীকার করে আবার উঠে দাঁড়াতে পারে। ভুল হয়। এ স্বাভাবিক। কিন্তু ভুলকে চুলচেরা বিশ্লেষণে বা ভুলকে ক্রাইম বানিয়ে, এর কোনোটাতেই রাস্তা পাওয়া যায় না। ভুলটাকে ভুল জেনে এগিয়ে যাওয়াটাই মন্দের ভালো। 

     আর সব চাইতে ভালো? অমন অস্বচ্ছ, ঘোর তৈরি করা সম্পর্ক থেকে সময় থাকতে বেরিয়ে আসা। সংসারে সব ক্ষতিরই ক্ষতিপূরণ কিছু না কিছুভাবে হয়েই যায়, কিন্তু নিজের উপর নিজের শ্রদ্ধা-ভরসা হারানোর মত দৈন্য যে কি করুণ অবস্থায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করায়, তার ক্ষতিপূরণ হয় না। ক্ষত থেকেই যায়। 

     তপ্ত বালি বরং ভালো, পিচ্ছিল শ্যাওলার চাইতে।

146
Tue, 08/09/2022 - 11:00

আফসোস মাঝে মধ্যে এটা সেটা নিয়ে হবে। এ স্বাভাবিক। কিন্তু আফসোস যখন স্বভাবে দাঁড়িয়ে যায় তখন সে এক বালাই। 

     অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যা হয় তো না নিলেই ভালো হত। কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি সম্পূর্ণ আমার নিজের হাতে ছিল? কোনো সিদ্ধান্তই সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে হয় কি? পারিপার্শ্বিকতা, সেই সময়ে আমার ম্যাচিউরিটি লেভেল, আমার মানসিক পরিস্থিতি এরকম অনেক কিছু কোনো একটা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। সেটাই স্বাভাবিক। আমরা যত পরিণত হই তত আমাদের অতীতের ভুল, ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা সম্বন্ধে বোধ জম্মায়। কিন্তু সেই বোধও চরম নয়। যত এগোব, যত অভিজ্ঞ হব, তত বোঝা যাবে কোন সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক ছিল আর কতটা ভুল। 

     সমস্যা হচ্ছে বোধের ম্যাচিউরিটি লেভেল বাড়লেও যে সিদ্ধান্ত একবার নিয়ে ফেলেছি তাকে কি আর বদলানো যায়? না। সে সিদ্ধান্তে একটা নির্দিষ্ট সময়ের শিলমোহর লেগে গেছে যে! সেই সিদ্ধান্তের ফল আমি প্রতিদিন পাচ্ছি, তার থেকে নিস্তারের পথ নেই। তবে সেই ফলকে আমি কিভাবে নেব সে আমার নিজের উপর। আফসোস করে করে, না সহজভাবে মেনে নেওয়ার সাধনায়। 

     সহজ হওয়াকে আমরা সিদ্ধিলাভ বলি। যে প্রথম সাইকেল চালাতে শিখতে শুরু করছে তার নিজেকে নিয়ে আর সাইকেলকে নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। সাইকেলের প্যাডেল, হ্যাণ্ডেল, বেল সব তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। যেদিকে গেলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, না চাইতেও হ্যাণ্ডেল সেদিকেই যায় ঘুরে। ক্রমে সহজ হয়। এমন সহজ হয়ে আসে যে ভিড় রাস্তা, দুর্গম রাস্তা কিছুতেই তার সাইকেলকে আটকাতে পারে না। সাইকেলে সে সিদ্ধিলাভ করেছে, মানে সহজ হয়েছে।

     গান শেখাতেও তাই। যখন প্রথম প্রথম রেওয়াজে বসল তখন নিজের কণ্ঠের সঙ্গে সুরের মিল ঘটানো কি কঠিন এক কাজ। হয় তো প্রতিবেশীরা ঘরের জানলা বন্ধ করে দিল। সেই মানুষটাই যখন সুরে সিদ্ধিলাভ করল, প্রতিটা পর্দায় অনায়াসে বিচরণ তার কণ্ঠের, তখন সেই প্রতিবেশীই জানলা খুলে দিল। অর্থাৎ সুর তার কাছে সহজ হয়েছে। 
জীবন বোধকে সহজ করে নেওয়াও এক সাধনা। সব চাইতে বড় সাধনা। হতে পারে আমি ভীষণ পণ্ডিত মানুষ, হতে পারে পৃথিবীর সব জ্ঞান আমার নখদর্পনে, কিন্তু জীবন বোধ কি সহজ হয়েছে? নাকি বিদ্যাবোঝাই বাবুমশায়ের মত ঝড়ের সামনে সব বিদ্যাশক্তি শূন্য হয়ে পড়েছে?

     যদি জীবন বোধ সহজ না হল, তবে আসল কাজটাই রইল অসম্পূর্ণ। আফসোস করে করে, ক্ষুব্ধ থেকে থেকে জীবনের সব রসটুকুকে যদি বিষাক্ত করে তুলি, তবে আমার চারপাশটাও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। সব কিছুর উপর আমার ক্ষোভ, রাগ উগরে ওঠে। ভাবি সবাই বুঝি আমার শত্রু, সব কিছুই আমাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যেই ঘটে চলেছে। কি যন্ত্রণাময় জীবন আমি নিজের হাতে নিজের জন্য গড়ে তুলি তখন। 

     কিন্তু যদি সহজভাবে মেনে নিই নিজের ভুল ত্রুটি সবকিছু। যদি নিজেকে ক্ষমা করে, নিজের ফেলে আসা রাস্তার যাবতীয় যা কিছু অসম্পূর্ণতাকে মার্জনা করি নিজের প্রতি সত্যিকারের করুণায়? তবে নিজের ভিতরের কর্কশ শব্দ কমে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসতে শুরু করে মন। আজকাল ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি নিয়ে প্রভূত চর্চা হচ্ছে। এই ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি নিয়ে চর্চা একদিন ভারতে আর গ্রীসে অধ্যাত্মবিদ্যা তথা দর্শনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল সেই প্রাচীন কালে, যা নানা সাহিত্যে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে আজও। তাঁরা বুঝেছিলেন, মানুষের আসল কাজ জানা নয়, বাঁচা। সেই বাঁচাটাকে কি করে সহজ করা যায় সেই রাস্তা খুঁজতেই নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়েছিলেন। পথ পেয়েছিলেন। শান্তির পথ, আনন্দের পথ, সংহতির পথ।

     লালন গাইলেন,

সহজ মানুষ ভজে 
দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।।
ভজ মানুষের চরণ দু’টি
নিত্য বস্তু হবে খাঁটি।
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।।

     রবীন্দ্রনাথ গাইলেন, 

সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি--
কাছের জিনিস দূরে রাখে তার থেকে তুই দূরে র'বি ॥
কেন রে তোর দু হাত পাতা-- দান তো না চাই, চাই যে দাতা--
সহজে তুই দিবি যখন সহজে তুই সকল লবি সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি
আপন বচন-রচন হতে বাহির হয়ে আয় রে কবি।
সকল কথার বাহিরেতে ভুবন আছে হৃদয় পেতে,
নীরব ফুলের নয়ন-পানে চেয়ে আছে প্রভাত-রবি॥

147
Sat, 07/23/2022 - 00:35

নেক ইনশান। মানে কি বুঝি? না, সাদামাটা ভালো মানুষ। এখন সেই 'নেক' শব্দ থেকে বাংলায় কি শব্দ জন্মালো? না, ন্যাকা, বা নেকা। কোনো মানে হয়? বলি ভালো মানুষ আর ন্যাকা মানুষ এক হল? 

     তো শব্দের উৎস যাই হোক না কেন, এখনের মানে হল, যে জেনেও না জানার ভান করে। তবে কথা হচ্ছে, 'ন্যাকা সাজা' কথাটার মানে কি দাঁড়াবে? মানে আরকি ওই এক, জেনেও না জানার ভান করা। খুব পার্থক্য কিছু হচ্ছে না। 

     তবে ভালো মানুষ মানে কি? গুরুচরণ দাস মহাশয় একটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছেন এই নিয়ে, দ্য ডিফিকাল্টি অব বিং গুড। কথাটা তো আমাদের বার্ণাড শ মশায়ও বলতেন, ইট ইজ ডেঞ্জারাস টু বি টু গুড। খুব ভালো হওয়া খুব ভয়ংকর। ভালো হওয়া মোটেই সোজা কাজ নয়। ওর কোনো বাঁধাধরা সংজ্ঞাও হয় না। অন্যের বা নিজের ক্ষতি না করলেই তা ভালো। এই মোটামুটি বলা যায়।।

     তবে ন্যাকা হওয়ার সুবিধাটা কি? সুবিধা হল যে, আদতে আমি ভালো নই, কিন্তু ভালো হওয়ার ভান করতে তো অসুবিধা নেই। নীতিজ্ঞানের মধ্যে ক্যামোফ্লাজ করে থাকা আরকি। বাইরে থেকে মনে হবে আমি কিচ্ছুটি জানি না, মানে ভাজা মাছ উল্টে খাওয়া কি, আমি মাছ ভাজা হচ্ছে তাইইইই জানি না! এতটাই ন্যাকাষষ্ঠী, ন্যাকাবোকা আমি। সাত চড়ে রা কাটি না! ধরা পড়লেই দোষ স্বীকার করে নিই। বলি, আহা, আমি কি আর জেনেবুঝে করেচি! অজান্তে হয়েছে গো। ক্ষমা চাই। আবার একই কাজ করি। আবার দোষ স্বীকার করে নিই। আবার ক্ষমা চাই। কারণ আমি ন্যাকা। ভীষণ ন্যাকা। আমি আসলে যে কিছুই জানি না, বুঝি না গো। রামকৃষ্ণ, মহাপ্রভু, খ্রীষ্ট হতে হতে একটুর জন্যে আটকে গেছি আর কি! 

     এটা আসলে একটা ডিফেন্স মেকানিজম। প্রাণীকূলে দেখা যায় না? যায় তো! সে সাপের বিষ নেই, সেই সাপ বিষধর সাপের মত আচরণ করছে। গাছের ডগা এমন ফণা তুলে আছে, গরু দেখে ভাবছে আসলে সেটা সাপ। গিরগিটি কেমন রঙ বদলে নিচ্ছে। তো এমন কালারেশান, মিমিক্রির উদাহরণ প্রচুর আছে প্রাণী জগতে। বেশির ভাগই দুর্বলের আত্মরক্ষার জন্য। তো মনুষ্য সমাজেও তাই। দুর্বল যে, সে ভালো তো হতে পারবে না। অত আত্মবিশ্বাস তো নেই। আসলে সে তো জানেই না যে ভালো হওয়া মানে ঠিক সে যেরকম ভালো হওয়া বোঝে সেরকম তো আদতে নয়। কিন্তু সে আর কবে প্র্যাক্টিস করে দেখল। 

     দুরকমের শিক্ষা হয়। এক কগনিটিভ লার্নিং। তাত্ত্বিক জ্ঞান আরকি। বইটই পড়ে যা হয়। আর এক শিক্ষা হল আচরণগত শিক্ষা। সে তো অনুশীলন না করলে হবে না বাবা! সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটার মত নিজের আবেগ, প্রবৃত্তিকে বশে আনার শিক্ষা। তো সে তো মহা ঝকমারির কাজ! কে করে! তার চাইতে ভালো হতে না পারি, ভালো সাজতে অসুবিধা কোথায়? 

     অসুবিধা তো আছে। সাজতে গিয়ে এতটা সেজে ফেলে যে বাস্তবে অত ভালো মানুষ হয় না! এরও উদাহরণ আছে। এমন কিছু ডাই দেখেছি লোকে মাথায় করে, যে তার যৌবনে চুলের অমন ধারা কালো রঙ কোনোদিন ছিল না! প্রকৃতি যা দিতে পারেনি, কোম্পানি তা-ই দিয়ে দিচ্ছে! চোখে ঠেকছে। বড়ই বেমানান। তেমনই অত অসংগত ভালোত্বও বেমানান।

     তো ন্যাকা মানুষের ভালোত্ব সহ্য করা তাই এমনই দুষ্কর এক সমস্যা। বেশ বুঝতে পারছি হদ্দ ন্যাকামি করছে, কিন্তু প্রোটোকল ভেঙে কিছু বলাও যাচ্ছে না। অগত্যা উপায়? এড়িয়ে যাওয়া। তার সঙ্গে যতটা দূরত্ব রেখে চলা যায় ততটাই মঙ্গল। 

     তবে এ হল গিয়ে হদ্দ ন্যাকার কথা। বাকি অল্পস্বল্প ন্যাকামি আমাদের তো সব্বাইকেই করতে হয়। কিন্তু সে ন্যাকামিকে স্বভাবে না গড়ে তুললেই হল। নইলে 'ন্যাকা আমি' আর 'আসল আমি' ঘেঁটে এমন এক টক্সিক আমি তৈরি হবে ধীরে ধীরে যে নিজেকেই অসহ্য লাগতে শুরু করবে। কিন্তু প্রয়োজন বিশেষে ন্যাকা হতে দোষ নেই। সে ছোটোবেলার চানাচুরের শিশি খালি করে ন্যাকা সাজা হোক, কি বড়বেলায় ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে হোক। ন্যাকা ক্ষেত্র বিশেষে সাজতেই হয়। শুধু স্বভাবে না গড়ালেই হল।

148
Thu, 07/21/2022 - 12:29

"আমার মনে হয় ওকে বিয়ে করলে ও আমাকে ভালো রাখবে…."

 

     আমার কানে লেগেছিল শুনে কথাটা। প্রথম কথা আমি কুকুর বা গাভী নই যে আমাকে কাউকে ভালো রাখতে হবে। সময়ে সময়ে মাংসভাত মেখে মুখের সামনে দেবে কি খড়বিচালি কেটে দেবে। আমি নিজে যদি নিজেকে ভালো রাখতে না জানি তবে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর কারোর সাধ্যি নেই আমায় ভালো রাখে। আর আমাকে কেউ ভালো রাখবে এই প্রত্যাশায় একজনকে পরিবারে আনা আর একটা ওয়াশিংমেশিন কি ফ্রিজ কিনে ঘরে আনার মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে বলে আমার মনে হয় না।

     আমেরিকার একটা প্রথম সারির দৈনিকে খবর বেরোলো যে পুরুষেরা নাকি প্রচণ্ড একাকীত্বের শিকার হচ্ছে। তাদের জীবনে তাদের স্ত্রী বা বান্ধবী ছাড়া আর কেউ থাকছে না। তারা সমাজ জীবন থেকে নিজেকে এমন বিচ্ছিন্ন করে ফেলছেন যে স্ত্রী আপিস থেকে দেরি করে ফিরলেও একাকীত্বের যন্ত্রণায় নাকি বার পাঁচেক ফোন করে ফেলছেন অস্থির হয়ে। স্ত্রী নাকি মা, বোন, বান্ধবী ইত্যাদির ভূমিকায় এমন দড়। সে নাকি স্বামীকে হাতে ধরে পার্কে নিয়ে যাওয়া থেকে গভীর আবেগে আদরের তুঙ্গ শিখরে নিয়ে যাচ্ছে। ফল কি হচ্ছে? পুরুষ মানুষ নাকি একা হয়ে যাচ্ছে! 

     এখন স্ত্রী মা-বোন-বন্ধু সব হোন। হতেই পারেন। এ গল্প শুনতে আমাকে তো মার্কিন মুলুকে যেতে হয়নি, এখানেই শুনে শুনে চুলে পাক ধরে গেল। কিন্তু সমস্যা হল এর পরেও এত একাকীত্ব কেন বাপু? একাকীত্বকে কোমর্বিডিটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। একাকীত্বের যন্ত্রণায় মানদিক অবসাদ, তার থেকে হৃৎপিণ্ডের ব্যামো, তার থেকে আত্মহত্যা করার প্রবণতা ক্রমে ক্রমেই বেড়ে চলে। 

     আমার মনে হয় আসলে এ সবই ভুল ব্যাখ্যা। অতিকথন। কাগজগুলো বিক্রি করার ধান্দা। বলি একাকীত্ব মানুষের চয়েস না অবস্থা? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেক ক্ষেত্রেই চয়েস। এই যেমন আজ একুশে জুলাই, কাতারে কাতারে লোক যাচ্ছে কলকাতায়। আমি রাজনীতির কথা আনছি না। কিন্তু বেশ কিছু পোস্ট দেখলাম, তাদের ধারণা তারা সবাই নাকি ডিমভাত খেতেই যাচ্ছে। সবাই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক কারণে আসছে না যে এ সত্য। কিন্তু এত এত সহস্র মানুষের ঢলকে যারা তুড়ি মেরে অপমান করে দিতে পারে, তারা নিজেদের মনের মধ্যে যে অতিশুদ্ধতার বেড়াজাল তৈরি করেছে, সে কার দোষে? কোনো কিছুকেই একপেশে করে দেখা অপরিণত মানসিকতার লক্ষ্মণ। বিদ্বেষ অবশ্য সব সময়েই একপেশে। আর সেই বিদ্বেষ তাকে এত লক্ষ মানুষ থেকে মুহূর্তে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। একাকীত্বের পিছনে বড় একটা মানসিকতা এই বিদ্বেষ। আমি উন্নত, আমি সঠিক, আমি নির্ভুল, আমি নীতিবান। ওরা সব আমার বিপরীত। অগত্যা আমি কার সঙ্গে মিশব? কার সঙ্গে একাত্ম অনুভব করব? আমার যোগ্য কে আছে? কে আমায় বোঝে? ইত্যাদি ইত্যাদি।

     যা হোক, এখন কথা হচ্ছে পুরুষের তবে একাকীত্ব কাটানোর নিদান কি? আমিও ঘরে বাইরে দেখেছি, একজন মহিলা এমনকি পরিণত বয়সেও স্বামীকে হারানোর পর নিজেকে নানা কাজে, নানাভাবে ব্যস্ত রাখেন। কিন্তু একজন পুরুষ একটা বয়সের পর স্ত্রীকে হারালে সম্পূর্ণ নিজেকে গুটিয়ে নেন। যেন অস্তিত্বটুকুই নেই আর নিজের। এ কি ভালোবাসা? না, আপাত দৃষ্টিতে মনে হলেও এ ভালোবাসা নয়। এ মানসিক পঙ্গুত্ব। ভালোবাসা মানুষকে পঙ্গু করে না। অযৌক্তিক আসক্তি মানুষকে পঙ্গু করে তোলে। আনরিয়েলিস্টিক অ্যাটাচমেন্ট, ভীষণ ক্ষতিকর। অ্যাটাচমেন্ট মানে তো আর ভালোবাসা নয়, অ্যাটাচমেন্ট মানে অ্যাটাচমেন্টই। 

     আমার আসক্তি আর আমি। এই দুইজনের মধ্যে কে কারাগার, কে বন্দী? আসক্তি কারাগার। আমি বন্দী। আমারই তৈরি আসক্তি। তাই আমি কেটে বেরোতে পারছি না। চাইছি না। ভালোবাসতে যে শক্তি দরকার, যে সহনশীলতা দরকার তা আমার নেই। আমার আসক্তি আছে। আমার আত্মসম্মান নেই। আমার আসক্তি আছে। আমার নিজেকে নিয়ে কোনো স্বাধীন স্বপ্ন নেই, কোনো স্বনির্ভর দায়িত্ব নেই। আমার আসক্তি আছে। আমার অভিমান আছে। আমার মান আছে। কিন্তু আমার স্বমত, বা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেই। কারণ আমার আসক্তি আছে।

     আসক্তি থেকে জন্মায় বায়াসনেস। বা পক্ষপাতদুষ্ট বুদ্ধিবিচার। পক্ষপাতদুষ্ট বিচার থেকে জন্মায় অবাস্তব, অসত্য দৃষ্টিভঙ্গী। সেই বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গী থেকে জন্মায় কারাগারের শিকল। যে শিকল মায়াময়। কিন্তু সেই বিকারগ্রস্ত দৃষ্টিতে তা-ই সত্য। ফল, একাকীত্ব। যন্ত্রণা। 

     যদি একাকীত্ব থেকে বেরোতে হয়, তবে সব আসক্তিকে আগে দূর করতে হবে। সে যে ছদ্মবেশেই আসুক। ভালোবাসা, রাজনীতি, ধর্ম, ঈশ্বর, গুরু, আদর্শ, মতামত ইত্যাদি যা কিছুই তার আধার হোক না কেন, আসক্তি মানেই আসক্তি। আদতে ভীষণ ক্ষতিকর। জীবনে স্রোত থাকুক, আসক্তির নোঙর ফেলে কি লাভ? কোনো মানুষের সাথে, কি কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে, কি আদর্শের সাথে, কি কোনো ধর্মের সাথে, কি কোনো মতের সাথে নিজেকে আসক্ত রাখব কেন? তবে সত্য তো আমার নাগালের বাইরেই থেকে যাবে চিরটাকাল! আর সত্য যেখানে নেই, সেখানে গতি নেই, স্রোত নেই। যেখানে আসক্তি নেই। সেখানে স্রোত আছে। আর স্রোতে যে ভেসে চলেছে তার পক্ষে একাকীত্বে ভোগার অবসর কোথায়? সে আজ এই কূলে, তো কাল সেই কূলে। সে তো পথিক। পথিক কোনোদিন একা হয় না। কারণ সত্যের পথ অনন্ত। ফুরায় না যে!

149
Wed, 07/13/2022 - 11:03

মানুষের সব চাইতে বড় গুরু কে? তার শুভবুদ্ধি। শুভবুদ্ধি, ভালোবাসা, অনুকম্পা, কৃপা, উন্মুক্তমনা, সহজতা… এ সব সমার্থক শব্দ। শুভবুদ্ধি থাকলেই আত্মনিয়ন্ত্রণ আসবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকলেই সুখ শান্তি আসবে। আত্মনিয়ন্ত্রণ মানে কোথায় থামতে হবে জানা। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা মেরেছে মানে সে থামতে পারেনি। এই তো! 

     এখন এই শুভবুদ্ধির উদয় কিসে হয়? এর উত্তর কোথাও নেই। একটা ভিডিও খুব ফেসবুকে ঘুরছে। রামকৃষ্ণ মিশনের বরিষ্ঠ পণ্ডিত সন্ন্যাসী স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ বলছেন ভাষণে, এত যে দীক্ষা হচ্ছে সমাজে তার ছাপ কোথায়? 

     খুব সঙ্গত প্রশ্ন। দীক্ষা হলেই যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে এমন আশা খুব অসঙ্গত না হলেও, বাস্তব অভিজ্ঞতা সে সাক্ষ্য দেয় না। 

     অগত্যা শুভবুদ্ধির উদয় হয় না কেন? রবীন্দ্রনাথের একটা গানে আছে, "থেকেও সে মান থাকে না যে, লোভে আর ভয়ে লাজে/ ম্লান হয় দিনে দিনে যায় ধুলাতে ঢেকে ঢেকে"।

     শুভবুদ্ধিকে আবৃত করে রাখে ভয়, লোভ আর কুণ্ঠা। আসলে শুভবুদ্ধিকে যা-ই আবৃত করে রাখুক, তাকেই বলি রিপু। মানুষের আসল শত্রু। আজকাল যাকে বলা হচ্ছে নেগেটিভ ইমোশান।

     প্লেটো তার যুগান্তকারী গ্রন্থ, 'দ্য রিপ্লাবিক' এ লিখছেন চারটে মানুষের প্রাথমিক সদগুণ - সাহস, সংযম, ন্যায়পরায়ণতা ও প্রজ্ঞা। আবার গীতাতেও বলা হচ্ছে সমস্ত সদগুণের প্রথমটি হল - অভয়। আধুনিক কালের কবি মায়া অ্যাঞ্জেলিউ বলছেন তোমার যদি সাহস না থাকে তবে বাকি কোনো গুণই নেই। স্বামীজির সেই বাণী, দুর্বলতাই পাপ।

     তবে আমার এই দুর্বলতাই আমার শুভবুদ্ধির জাগরণের প্রধান বাধা। যুগান্তকারী দার্শনিক, ইমানুয়েল কান্ট মহাশয় তাঁর 'এনলাইটেনমেন্ট' বইতে লিখছেন তুমি চাইলেই সৎ হতে পারো, কিন্তু হচ্ছ না কারণ তুমি ভয়ে বা লোভে নিজেকে হতে দিচ্ছ না। সবাই জানে ঠিকটা কি, কিন্তু ভয়ে সে অবশ।

     এখন এই ভয়কে "যাও" বললেই তো যায় না। অমন বীর অর্জুনের দুর্বলতা কাটাতেই শ্রীকৃষ্ণকে টানা আঠারোটা অধ্যায় বলতে হয়েছিল শুধু না, বিশ্বরূপটুপ দেখিয়ে তবে কাজ হয়েছিল। তবে আমাদের উপায় কি?

     না, আমাদের কাজটা অত কঠিন তো নয়। আমাদের তো আর কুরুক্ষেত্রে যেতে হচ্ছে না রে বাবা! আমাদের ভয় দূর করতে হবে ভয়কে দূর করেই। শারীরিক ভয় থাকবেই। সেটা আমাদের আত্মরক্ষার জন্য একান্ত আবশ্যক। আগুনে হাত না দেওয়া, রেললাইনে কম্বল পেতে শুয়ে না পড়া ইত্যাদি। কিন্তু মানসিক ভয়? সে-ই থেকেই তো জগতে এত এত বিকার।

     মানসিক ভয় কাটানোর একটাই উপায়, প্রতিদিন একটা একটা করে অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করে নেওয়া। সত্যের দিক থেকে পিঠ ফিরিয়ে থাকাকে বলে মোহ। একটা একটা করে মোহকে ঝেড়ে ফেলা। যেমন যার সঙ্গে কথা বললেই ঝগড়া, তার মুখোমুখি বসে একবার সাহসের সঙ্গে দেখা, সমস্যাটা কোথায়? না, বিশ্লেষণ না। ওসব বিশ্লেষণ ভুলভুলাইয়া। যে ঢুকেছে সে আর বেরোয়নি। বিশ্লেষণ না, সরাসরি দেখা। আসল বাস্তবটাকে দেখা। আমার কোথায় বিঁধছে, আসলে আমার অহংকার বা ইগো বলতে যা বলি, সেটা কি? এইরকম ভাবে যদি নিজের একদম মুখোমুখি হওয়া যায়, তবে জীবনে চলতে আর ট্রাফিক পুলিশ বা বাহ্যিক গাইড লাগবে না। নিজের জিপিএসই ঝাক্কাস একদম। শুধু কাঁচটা পরিষ্কার রাখতে হবে। নিজের প্রতিফলনে নিজেকে নিয়ে যেন কোনো আবছায়া না জন্মায়। আবছায়া মানে মোহ। নিজেকে নিয়ে মোহ কাটলে জগতকে নিয়ে মোহ কাটে। তখন মানুষ সন্ন্যাসী হয় না, বাস্তববাদী হয়। যে যত বাস্তবের কাছে সে তত শান্ত, নির্ভীক। যে যত বাস্তবের থেকে দূরে, সে পার্থিব সুখ নিয়েই হোক, কি অপার্থিব, আসলে একই কথা, সে মোহতে। অনুপ্রেরণা বাইরে থেকে হাজার একটা আসতে পারে। কিন্তু আসল কাজে তো কাউকে দিনমজুরি খাটানো যাবে না। সেখানে নিজেকেই নামতে হবে। তাই বাণী তো ওই একটাই -
       "সত্যেরে লও সহজে"

150
Tue, 07/12/2022 - 20:10

তুমি বলো ধর্ম তোমায় শান্তি দেয়। তোমার বাইরে ভিতরে এত বিরোধ, এত দ্বন্দ্ব। তোমার ধর্ম তোমায় এত যে দ্বন্দ্ব বুঝতে দেয়? নাকি সব দ্বন্দ্ব-বিরোধে প্রলেপ দেয়? 

     দ্বন্দ্ব নিয়ে শান্তিতে আছো। একি হয়? এও কি হয়? দ্বন্দ্ব নিয়ে ঈশ্বরকে ডাকো। ঈশ্বর যদি শুনে ফেলেন! ধরো তুমি নির্দ্বন্দ্ব হলে, কি হবে? ধরো ধরো সত্যি সত্যিই শান্তি পেলে। পালিয়ে গিয়ে, আড়াল করে, ভুলে গিয়ে খুচরো শান্তি না গো না, সত্যিকারের শান্তি পেলে। কি হবে? বুঝতে পারছো কি সর্বনাশটাই হবে তোমার? দ্বন্দ্ব গেলে সব যাবে। তোমার মুঠো খুলে জমানো যা কিছু "আমি - আমার" গণ্ডী ছাড়িয়ে ভেসে যাবে। সব যাবে সব যাবে। স্বপ্নগুলো ছাইকাদা মেখে ধুলোয় কাদায় গড়াগড়ি খাবে। সব্বনাশ! সইতে পারবে! দ্বন্দ্বহীন জগত তোমার আগুপিছু ঘুরে বেড়াবে। বাইরে ভিতর, তোমার আমার, সব হারিয়ে ঘোল খাওয়াবে! কে গুরু! কে ঈশ্বর! কি শাস্ত্র! কি মত! কি পথ! সব গুলিয়ে ঘেঁটে যাবে। দলাদলি, স্বার্থসুখ, সব ঘেঁটে গিয়ে বেড়া খুলে গিয়ে মাঠ হয়ে যাবে! সব্বনাশ হবে! সব্বনাশ হবে! 

     তাই বলি ভাই, যাই করো না, মন থেকে শুধু তাঁকে চেয়ো না। বইপড়া সব ধম্মো করো, প্রতিষ্ঠানের পায়ে পায়ে ঘোরো, সবাই মিলে দল পাকিয়ে আমার তোমার ধম্মো করো। কিন্তু খবরদার! বুকের মধ্যে উঁকি মেরো না। ফুরফুরে হাওয়া টের পেলেই জানলা-দরজা বন্ধ করো। মাথার মধ্যে পাণ্ডিত্যের কাঁসায় ধাইধপাধপ ধাক্কা মারো। হঠাৎ যদি পিছলে পড়ো, হৃদয়গুহার কাছাকাছি এক শান্তস্রোতে এসে পড়ো। খবরদার! হামলে পড়ে দৌড়ে গিয়ে, বাইরে এসো। কোনো দলে নাম লিখিয়ে, দল পাকিয়ে, জলে কাদায় মিশিয়ে নিয়ে প্রতিষ্ঠানের নক্সা আঁকো। সব থেকে যাবে। সব রয়ে যাবে। তোমার হাজার দ্বন্দ্বের খাঁজে খাঁজে সব সুখ-সাধ গুছিয়ে নিয়ে হাজার বছর সংসার করো। গালাগাল দাও, গালাগাল খাও, বুদ্ধি করে মধুর ভাষায় নিন্দে করো, সুকৌশলে ল্যাং মারো। কিন্তু দোহাই, সত্যিই বলে কেউ কিছু কাছে, প্রাণের ভিতর সন্দেহ করো। শান্তি না, সত্যি না…কি হবে ওতে? নিজেকে নিয়ে, নিজেতে মেতে সব দুনিয়াটা গিলে ফেলো। চালাক হও। বুদ্ধিমান হও। দিনের শেষে একলা বসে খতিয়ে দেখো, ক'টা লোককে ঠকানো গেল। তুমি সার্থক, তোমার বিদ্যেবুদ্ধি সব সার্থক। কোন বোকা সে হৃদয়বাসীকে এ সংসারে খুঁচিয়ে তোলে, তারপর সব হারিয়ে মোলো? হদ্দবোকা কেউ হবে সে! একূল ওকূল সব খোয়ালো! তাও হাসে? আরে পাগল যে গো! পাগল পাগল করে মায়, পাগল গেল কার নায়? দুধমাখা ভাত কাকে খায়! 

     বালাইষাট! এ সব ছড়া বোকা লোকের। তুমি দ্বন্দ্বানন্দে সুখে থাকো। সুখে থাকো। সুখে থাকো।

151
Thu, 07/07/2022 - 23:47

ধর্মের দুটো অন্ধকার আছে। এক, ধর্মের কিছু কুসংস্কারের দিক, বা অন্ধবিশ্বাসের দিক। রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় সব ধর্মেই কিছু না কিছু গোলমাল আছে। আর এক অন্ধকার হল, ধর্মকে না জানার অন্ধকার। 

    সমাজে বাস করতে গেলে যেমন ন্যূনতম আইনকানুন, হিসাব নিকাশ, ইতিহাস-বিজ্ঞান-সাহিত্য ইত্যাদি সম্বন্ধে জেনে সমাজে থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, তেমন ধর্মের বহুত্ব নিয়েই সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার বলে আমার মনে হয়। 

    বিজ্ঞানের এমন তুমুল অগ্রগতির পরেও যখন ধর্ম আছে তখন এটা মেনে নেওয়ার সময় এসে গেছে যে ধর্ম থেকেই যাবে। অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের সত্য ও নানাবিধ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই থেকে যাবে। কেন থাকবে, সে ব্যাখ্যায় গিয়ে লাভ নেই। বাস্তব সত্য হল, ধর্ম আছে। বহু বহু মানুষের জীবনে অনুশীলন হয়ে আছে। এ বাস্তব। 

    আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি বললে আসলে কিছুই বোঝায় না। ওটা আলগোছে বলা কথা। আমি রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, মুহম্মদ, যীশু, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, রামকৃষ্ণ, লালন, সাঁই ইত্যাদি কারোর না কারোর ভাবের ঈশ্বরকে মানি। এখন অনেকের ঈশ্বরের সঙ্গেই অনেকের ঈশ্বরের ভাব মেলে না। যে কারণে আমাদের ধর্মে বৈষ্ণব ও শাক্তের কোন্দল। একজনের পূজায় যা ব্রাত্য, আরেকজনের পূজায় তা-ই আবশ্যিক। 

    এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে যে কথাটা বলতে চাইছি, তা হল সব ধর্মের মধ্যে একটা সার্বজনীনতা অনর্থক না খুঁজে, ধর্মের মধ্যে বহুত্বকে জানাই দরকার। যেমন, ক্রিকেট আর দাবা দুটোই খেলা। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র একটা ক্যাটাগরিতে ফেলার জন্যেই 'খেলা' শব্দটা নির্বাচন করা, এও তেমন। বুদ্ধের নির্বাণের সঙ্গে ইসলামের স্বর্গের কোনো মিল নেই, না তো বৈষ্ণবের ঈশ্বর প্রেমের। কিন্তু আলগোছে বললে, সবটাই ধর্ম। আসলে না তো। এই বহুত্বকে তার পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী না জানলে আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে, যেখানে একজনের, একদেশের ফিসফিসানি সারা বিশ্বে মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে, সেখানে শান্তিতে বাস করা খুব শক্ত। অসম্ভব। 

    অনেকে বলে থাকেন, সব ধর্মের মূল কথাই হল, ভালো হওয়া ও ভালো করা। স্বামীজির আদর্শ অনুযায়ী এ কথা বহুবার উদ্ধৃতও হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষ হিসাবে ভালো হওয়া আর একটা সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে ভালো হওয়ার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। এক-এক সম্প্রদায়ের ভালো হওয়ার সংজ্ঞা বা বিধিনিষেধ এক-একরকম। 

    তবে যদি বলা হয় মানুষ হিসাবে ভালো হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, মানে সে অন্যের ক্ষতি করে না, চুরি করে না, মিথ্যা বলে না ইত্যাদি, তো সেগুলো তো কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে জন্মাতে হবে এমন কোনো কথা নেই, বা কোনো এক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই আছে এমনও কোনো কথা নেই। ওটা সামাজিক ধর্ম। বিশ্বাসের ধর্ম না। সমাজে বাঁচতে গেলে কিছু নীতি মেনে চলতে হয়, নইলে পুলিশে ধরে, মামলা-মোকদ্দমা হয়। তার সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগাযোগ নেই। বহু অসামাজিক, দুর্নীতিপরায়ণ মানুষকে আমরা ধর্মের রাজ্যে জানি, যাদের সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস তাদের অসামাজিক আচরণকে ঢেকে রাখতে সাহায্য করে। কিম্বা হয় তো সে যে অপরাধ করেছে সে বোধটাও হতে দেয় না। 

    আবার আগের কথায় ফিরি। এই ইন্টারনেটের যুগে আমরা এত কাছাকাছি যে আমাদের এখন ধর্মের বহুত্ব সম্বন্ধে একটা প্রাথমিকবোধ শিক্ষা দেওয়া খুব দরকার। যাতে কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করলেই আমি বলতে পারি এটা ভুল বলা হচ্ছে। যেমন কেউ যদি বলে, দাবা খেলায় চারটে ছয় না মারলে জেতা যায় না, বা হাডুডু খেলায় বল হারিয়ে গেল বলে খেলা হল না, বা ক্রিকেটে বোড়ের আগে হাতির চাল দিতে নেই --- এ সব কথা যেমন আমাদের কানে অসংগত ঠেকে, ধর্মের বেলাতেও যেন তা-ই হয়। আমাদের প্রতিবেশীর ধর্ম নিয়ে অজ্ঞতা যেন কারোর আগুন জ্বালানোর ইন্ধন না হয়। আমরা যেন জানি অন্তত মূলভাবটুকুও। 

    এখন প্রশ্ন হতে পারে, জানা এক, আর হিংসা এক। তার বেলা? সেক্ষেত্রে আমার সাধারণ বুদ্ধি আর এদ্দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে এত এত যুগ ধরে এত লক্ষকোটি মানুষ এত এত বৈচিত্র আর বহুত্ব নিয়ে যে বেঁচে আছে সে আমাদের স্বভাবে শান্তিপ্রিয়তা আছে বলেই। সে শান্তিপ্রিয়তা কখনও কখনও বিগড়ে যায় না বলছি না, কিন্তু সে বিগড়ানোর জন্য কিছু না কিছু অনুঘটক কাজ করেই। নইলে এ জগৎ শুধু কয়েকজন মহাপুরুষের বাণীর দিকে তাকিয়ে বেঁচে নেই। মানুষ আদতে শান্তিপ্রিয় বলেই বেঁচে আছে। এই শান্তিপ্রিয়তাকে কায়েমি করতে গেলে আমাদের নিজেদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে, নানা ধর্মের প্রাথমিক জ্ঞান আর দেশে দেশে ধর্মের বহুত্বকে স্বীকার করে।

152
Tue, 07/05/2022 - 14:42

বিষের কাজ শুরু হল। মারা যেতে যেতে সে জিজ্ঞাসা করল, আমায় বললে না কেন তুমি আমায় বিষ দিচ্ছ? 

     ভালোবাসার মানুষ বলল, শুনে যদি কষ্ট পাও, তাই বলতে পারিনি। 

     এটা গপ্পো? গপ্পো বটে, আবার না-ও বটে। 

     মানুষ অ্যাডভ্যান্টেজ নেবেই। যত দেবে তত নেবে। এ স্বাভাবিক। শরীর, মন, সুযোগ-সুবিধা, অর্থ --- যা দেবে বিকিয়ে, তা-ই নিয়ে নেবে। হ্যাঁ, সব বিকিয়ে দিয়ে হাহুতাশ করে তো লাভ নেই। তবে ওই মিষ্টি কথায় বিষই জুটবে ভাগ্যে। 

     ইংরাজিতে একটা কথা আছে, বর্ডারলাইন টানতে শেখা। একবার কাউকে বর্ডারলাইন পার করে ভিতরে ডেকেছ কি গেছ। বাইরে গেলে যেমন দরজায় তালা লাগিয়ে না গেলে বিপদ, তেমনই সীমারেখা না টেনে রাখলে যে কোনো সম্পর্কেই বিপদ। 

     একজনের স্বামী ছেড়ে গেল। পরিবার, সমাজ বলল, ধর্মে মন দাও। সে ধর্মে মন দিল। একবার নিজেকে জিজ্ঞাসাও করল না সে নিজে কি চাইছে। এদিকে দিন যত যায় ধর্মের সামাজিক গ্ল্যামার তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে। ক্রমে সে সাদা লালপেড়ে শাড়ী ছাড়া আর কিছু পরতেই চাইল না। সমাজে কি তার মান! সাধিকা!! 

     কিন্তু এ তো বাইরের গল্প। জোয়ার-ভাটার গল্প। কিন্তু মনের গভীরে যে সিঁড়ি, সেখানে না যাতায়াতে জমছে শ্যাওলা। রাস্তা হচ্ছে পিচ্ছিল। 

     ক্রমে তার বয়েস যত বাড়ল, তার আচার বাড়ল। আচার যত বাড়ল তার শুচিবাইতা তত বাড়ল। আগে যেখানে মন সবেতেই প্রসন্ন থাকত এখন মন কেমন যেন তিরিক্ষি। কিন্তু কোথা থেকে এত অসন্তোষ? কোথা থেকে এত ক্ষোভ? সে জেনেও জানতে চাইল না। এদিকে তার বাড়ি মানুষের ঢল। নানা অনুষ্ঠানে, নানা শুভকাজে তার ডাক পড়ে। সে যত যায় তত চোখে পড়ে এর-তার দোষ। রাগ হয়। আগে চেপে রাখত। এখন বলে দেয়। মানুষ রেগে যায়। দূরে যায়। সমীহ করে দূর থেকে। তবু মানুষটা খুঁজে দেখল না কেন এত ক্ষোভ তার! এখন সে বয়েসের আগেই বয়স্ক। শুচিবাই। ধার্মিক। পূজাপাঠে দিন যায়। 

     আমার এক এক সময় তার আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশীদের জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, এতে কার কি লাভ হল? একটা মানুষকে এভাবে বঞ্চিত করে আদৌ সমাজের কি উন্নতি হল? মানছি সে মানুষটা আরো সবল হতে পারত, নিজের ইচ্ছাকে সজোরে ঘোষণা করতে পারত। কিন্তু সবাই কি সমাজে এত প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে জন্মায়? সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে সমাজ কি তার পাশে দাঁড়াতে পারে না? না, পারে না। মহাপুরুষ বানাবার আর মহাপুরুষ হওয়ার এক অদ্ভুত লোভ আমাদের! 

     আরেকটা ঘটনা। একজন পুরুষ। আরেকজন পুরুষকে ভালোবাসল। যাকে ভালোবাসল, সে যথেচ্ছভাবে তাকে ভোগ করে, সময় মত সমাজের নিয়ম মেনে একজন মেয়েকে বিয়ে করে তথাকথিত 'স্বাভাবিক' জীবনে ফিরে গেল। যে থেকে গেল, সে ক্রমে পাগল হল। তার পরিবার তাকে মনোবিদের কাছে নিয়ে গেল, তান্ত্রিকের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু একদিনও স্বীকার করল না যে তার সঙ্গে যা হয়েছে সেটা অন্যায়! বিশ্বাসঘাতকতার যন্ত্রণা এক, কিন্তু সে যন্ত্রণাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা আরো যন্ত্রণার, আরো অপমানের। মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দিল সে মানুষটাকে। সে-ও ধর্মের আশ্রয় নিল। স্বস্তি চাইল ঈশ্বরের কাছে, যা মানু্ষের কাছে পাওয়ার কথা ছিল। কি পেল জানি না, আমি যখন তাকে দেখেছি, সবটা জেনেছি, সে একটা আধমরা, প্রাণহীন, আবেগ-অনুভূতিহীন রক্তহাড়মাংসের অস্তিত্ব একটা। তার সঙ্গে কথা বলে যতটা বুঝেছি তাকে পীড়া দিয়েছে তার আত্মীয়স্বজনের অস্বীকার করাটাই বেশি। তার আত্মমর্যাদাকে তছনছ করে দিয়েছে। সবাই তো আর উঠে দাঁড়াতে পারে না, অনেকেই তাই ছদ্মবেশের আড়ালে নিজেকে ক্রমে ক্রমে শেষ করে দেয়। 

     প্রথম কথাই হল নিজেকে জানা। নিজেকে স্বীকার করা। সাহসের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে। একটা কথা তো মানতেই হবে, নিজেকে না জানলে নিজের স্রষ্টা বলে যদি কেউ থাকেন তাকে জানব কি করে? নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে মিথ্যার আড়ালে কোন সত্যের খোঁজ করে চলেছি? সে তো আমার বানানো কল্প সত্য, অন্য অর্থে যা মিথ্যা। 

     সাহস, আত্মবল, উদ্যম --- সব কিছুর মূলেই হল নিজেকে জানা। নিজেকে সম্মান করতে শেখা। নিজেকে জানলে, নিজেকে সম্মান করতে শিখলে কোথায় কার সীমারেখা টেনে দিতে হবে সে বোধটা স্পষ্ট হয়ে যায়। সেটা কোনো বই পড়ে বা কোনো বাইরের মানুষের কাছে শেখা যায় না। নিজেকে জানতে জানতেই সে স্বাভাবিকবোধ তৈরি হয়। 

     এই মূল কাজটা যদি বাকি থাকে তবে আমি নিজে আর আমার প্রাপ্ত যা কিছু অন্যের অ্যাডভ্যাণ্টেজের উপাদান। তারা নেবেই। আর আমি অন্তরের দৈন্যকে ঢেকে আমার যা কিছু সব নিয়ে আর আমার আমিকে নিয়ে বাইরের ভ্যালিডেশানের বা বৈধতার ভিক্ষায় ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দৌড়ে দৌড়ে একদিন রাস্তাতেই প্রাণবায়ু ফুরিয়ে পড়ে থাকব। সে আমার ভবিতব্য হবে না, হবে আমার স্ব-আরোপিত অজ্ঞতা।

153
Sat, 06/04/2022 - 23:31

KK বনাম রূপঙ্কর থামতে চায় না, এদিকে আবার শুরু হল হার্ট অ্যাটাকের পাঁচালি। এমনিতেই বাঙালির ঘরে ঘরে ডাক্তার, সে এমবিবিএস পাস করুক চাই না করুক। স্বাস্থ্য ও ওষুধ নিয়ে নিজের কোনো বিধান নেই এমন বাঙালি দুর্লভ। তার উপর মেডিক্যাল ক্লাস এখন খবরের কাগজের পাতার পর পাতা জুড়ে শুরু হয়েছে। বিষয় --- হার্ট অ্যাটাকের সাতকাহন। কি করে বুঝবেন, আপনার কখন হার্ট অ্যাটাক হবে, কি কি করবেন, করবেন না ইত্যাদি। ওরে ভাই, UN থাকতেও যেমন একশো দিন ধরে যুদ্ধ চলে, তেমন হাজার একটা বিধিবিধান জানা থাকলেও ও হবেই। কতদিক সামলায় মানুষ! তাছাড়া স্বাস্থ্য নিয়ে অতি আদিখ্যেতা আর বাড়াবাড়ি করার সময় ক'জন মানুষের আছে?

    একবার আমার এক আত্মীয়ের ভীষণ শরীর খারাপ। তার বয়েস হয়েছিল। তো একজন পাড়ার ডাক্তারকে ডাকা হল, যিনি আদতে কম্পাউণ্ডার ছিলেন, কিন্তু তারপর চেম্বার করে বসেন এবং অনেকের অগতির দুর্গতি হন। তো তিনি স্টেথো, ব্যাগপত্তর নিয়ে তো এলেন। এসে আমার সেই আত্মীয়কে ভালো করে দেখেশুনে বললেন, ওনার মনে হচ্ছে আজ বা কাল বা পরশু'র মধ্যে একটা হার্ট অ্যাটাক হবে, আপনারা তৈরি থাকবেন।

    ব্যস! বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রিস্ক না নিয়ে ওনাকে একটা নার্সিং হোমে ভর্তিও করে দেওয়া হল। আমার সেই আত্মীয় এবং আমরা সবাই অপেক্ষা করছি কখন টুক্ করে হার্ট অ্যাটাক হয়। তো সে আর তিনদিনেও যখন হল না তখন আমার সেই আত্মীয় ভীষণ বিরক্ত হয়ে, বণ্ড সই করে বাড়ি চলে এলেন। তবে ওনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল সে আরো বছর চারেক পর।

    এখন কথা হচ্ছে মানুষকে ভয় দেখিয়ে কাগজের বিক্রি বাড়ানো কি ভালো কথা? এমনিতেই বর্তমানে সাইবারকণ্ড্রিয়া বলে একটা মানসিক গড়বড় বাজারে ঘুরছে। মানুষ যা-ই হয় গুগল করে ফোঁড়া থেকে ক্যান্সারে পৌঁছায়, নানাবিধ প্যানিক অ্যাটাকে ভুগতে ভুগতে ডাক্তারের পর ডাক্তারের কাছে যায়। ডাক্তারের মাথাটা চিবিয়ে খায়, সঙ্গে নিজের, আত্মীয়-স্বজনের, সে এক বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। তার মধ্যে এই এক শুরু হল খবরের কাগজের প্রোভোকেশান। মানুষ যায় তো যায় কোথায়? 

    আসলে এই 'বাজার বনাম আমি', না 'আমি বনাম বাজার', এ দ্বন্দ্বের এখন তুঙ্গবস্থা। তুমি জন্ম হইতেই বাজারের জন্য বলিপ্রদত্ত --- এই হল এখনকার স্লোগান। আমার হাতের মোবাইল থেকে শুরু করে শোয়ার ঘরের টিভি অবধি বাজার। আর মোবাইলের যাতায়াত কোথায় নেই? সেই অর্থে আমার শৌচালয়েও বাজার। এই বাজারে আমার স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ধর্ম, দর্শন, সুখ, সাহিত্য, সিনেমা, শিল্প সব দাঁড়িয়ে। কেউ বাদ নেই। কিছুই বাদ নেই। বাজারকে ছাড়িয়ে দাঁড়ানো যাবে না। সে আত্মহত্যার খবর হোক, কি অর্থনীতির। সব পণ্য হবে। সমান আগ্রহ গড়ে তুলতে হবে বাজারে। বাজারে চাহিদা উৎপন্ন করাটাই মূলমন্ত্র। সে চাহিদা কৃত্রিম কি আসল কে দেখবে? আর দেখতে চাইলেই বা দেখতে দেবে কেন? 

    মুক্তি? ওরে মুক্তি কোথায় পাবি? আপনি প্রভু বাজারের লাভ-ক্ষতিতে বাঁধা! শান্তি? সে কি জিনিস? সে তো মহামূল্যবান বস্তু। গুরুর আশ্রমে সিট বুক করো। শ্বাসের গতি নিয়ে ইতিউতি করো। তারপর শান্তির সাদা পায়রাকে খাঁচায় ভরে বাড়িতে নিয়ে যাও। প্রতিবেশীকে দেখাও, এই দেখুন আমার শান্তিলাভের সুখ। আসুন আপনি আমি দু'জনেই জ্বলি। হিংসায়। প্রাণ জ্বালিয়ে, তৃষা জাগিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও লোভ। আরো ঈর্ষা, আরো হিংসা, আরো ষড়যন্ত্রের দীক্ষা... আরো আরো আরো দাও লোভ। 

    বাজার খেয়ে নিচ্ছে সব। তবু, বাজারের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। বাজারকে কোলে করে হয় মাটি, নয় আগুন। আমাদের বাজারে জন্ম, বাজারে জীবন যৌবন, বার্ধক্য, শেষে বাজারেই মৃত্যু। উপায়? লোভহীনতা? সেটা কি জিনিস? ওতে কেউ বাঁচে নাকি? বাজার বলে, ওসব অলসের কথা। বিবেক দোকানের তলায় রুগ্ন কুকুরের মত শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে বলে, ওটাই খাঁটি কথা। কিন্তু তার ঘেউ ঘেউ কেউ শোনে না। একটা লাথি দিয়ে ক্ষীণ চীৎকার থামিয়ে দেয়। বাজার জিতে যায়।

154
Thu, 05/05/2022 - 23:04

নৃশংস খুন। প্রতিহিংসা। ভালোবাসা।

 

যতবার শুনি ততবারই চমকাই। ভাগ্যে ভালোবাসা অদ্দূর গড়ায়নি ভেবে নিশ্চিন্ত হই। চারপাশে ভালো করে মন বুলিয়ে নিই, এমন ধারা ভালোবাসার গন্ধ পাচ্ছি না তো কোনো বন্ধুর জীবনে!

যাকে ভালোবাসবে সে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে না, এ খুব কম জনের ভাগ্যে হয়। তার জন্যে হেদিয়ে মরার কোনো কারণ দেখি না। কাউকে নিজের দুর্বলতার কথা জানানো মানেই তো তার হাজারটা হাঙ্গামা 'অ্যাকসেপ্টেড' অঙ্গীকার করা। সে যেই জেনে গেল তুমি তার উপর দুর্বল, অমনি সে তার সামাজিক ভদ্রতার মুখোশ খুলে এক্কেবারে স্ব-স্বরূপে এসে জীবনে ল্যাণ্ড করবে। ব্যস ঝক্কি সামলাও এবার।

এখন "এ উচিৎ নয়"... "এটা আনফেয়ার"..."তোর এসব থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ ".... এ সব বন্ধু হিসাবে জ্ঞানের কোনো ভ্যাল্যু নেই আর তখন। যে মজে সে সব বোধশোধ হারিয়েই মজে। হাবুডুবু থেকে ভুড়ভুড়ি কেটে মাঝে মাঝে মাথা তোলে। "আমার সঙ্গে এই করেছে, সেই করেছে" বলে হাপুসহুপুস কেঁদেকেটে একশা করে। তুমিও কোমর বেঁধে বোঝাতে গেলে তার ভবিষ্যৎ - টবিষ্যৎ যাচ্ছেতাই টাইপের রিস্ক জোনে ঘুরঘুর করছে ইত্যাদি টিত্যাদি বলে…ও বাব্বা! দুদিন যেতে না যেতেই আবার দেখলে তার টিকির নাগাল পাচ্ছ না। সে আবার ডুব দিয়েছে। "ওরকম ও মাঝে মাঝে একটু করে রে.. এমনিতে মানুষটা ভালো। ভীষণ ভালো।" তুমিও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, লাভ ইজ ব্লাইন্ড-টাইণ্ড ভেবে বাড়ি চলে এলে। "তোরা ভালো থাকলে আমার কি" উদাসীন দার্শনিক টাইপের কথা নিজেকে বলে টলে আবার নিজের জীবনে ফিরে এলে।

এ হতেই থাকে। একটা ব্রেক-আপ হতে না হতেই সিজন টু স্টার্ট। এপিসোডের পর এপিসোড। মাঝে মাঝে গুলিয়েও ফেলতে পারো এক সিজনের এক এপিসোডের সঙ্গে আরেক সিজনের আরেক এপিসোড। ও গুলিয়েও কোনো লাভ নেই। যা হবার হবেই।

এখন এই যে ভালোবাসার মধ্যে একটা গ্র‍্যাণ্টেড এক্সপ্লয়টেশান, ইমোশান নিয়ে খেলা চলে, এগুলো কি অ্যাভয়েডেবল?

পাতি বাংলায়, না। এগুলো ওয়ান ওয়ে ট্রাফিকের মত। কেন, এর ব্যাখ্যা পাওয়া ভার। সব রিলেশানে এটা হয় না। টক্সিক রিলেশানে হয়।

এখন এই টক্সিক রিলেশানটা কি? রিলেশানটা টক্সিক, মানে টক্সিক। ভালো না। হেজে যাওয়া সম্পর্ক। বাপ-মা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, কেরিয়ার একদিকে। আর সে সম্পর্কের টাগ অব ওয়ার আরেক দিকে। কে জিতবে আর কে হারবে প্রশ্নটাই অবান্তর না একটা সম্পর্কে? সম্পর্ক কি খেলার ময়দান? না জুয়াড়ির টেবিল? কিন্তু টক্সিক সম্পর্কে সারাদিন ইগোর টাগ অব ওয়ার চলেই। হার জিতের প্রশ্ন প্রচ্ছন্নভাবে ডমিনেট করতেই থাকে। এই মন্থনে অমৃত বেরোয় না, বেরোয় বিষ। অল্প ঝাঁঝালো আর বেশি ঝাঁঝালো, এই যা পার্থক্য। আদতে বিষই। কে জিতবে, কে হারবে। এই লড়াই। কে কাকে কতরকম কৌশলে ডমিনেট করবে, ট্র‍্যাক থেকে সরাবে, ইনফ্লুয়েন্স করবে, কন্ট্রোল করবে, ইত্যাদি ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে সুখ কোথায়? আর সুখ। এখন তো নেশা। কোনো নেশাখোরকে যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, মশায় আপনার এ উদ্ভট নেশা করে সুখ কোথায়? সে উত্তর দেবে একটা। কিন্তু সে উত্তর সুস্থ স্বাভাবিক মানসিকতায় হজম হবে না। এখানেও তাই। এক লড়াই শুরু হয়ে যায়। ইগোর বিকৃত লড়াই।

কেউ কেউ কার বেশি দোষ, কার কম দোষের বিচারে যায়। সেটা খুবই অপ্রাসঙ্গিক। সম্পর্কে যেমন হারজিতের প্রশ্ন নেই, তেমনই দোষগুণের প্রশ্নও আসে না। দুজন মানুষ, দোষেগুণে ভরা হবে। নিজেদেরকে নিজেরা স্পষ্ট জানবে। মানিয়ে নেবে। এই তো হল কথা। সেই মানানোর মধ্যে টক-ঝাল-মিষ্টি সবই থাকবে, কিন্তু বিকার থাকবে না। ভালোবাসা আসলে যখন ইগোর অনারে ওঠেবসে তখন বিকার জন্মাবেই। আর ভালোবাসা যখন কাণ্ডজ্ঞানের হাত ধরে চলাফেরা করে তখন খাদের ধারে পৌঁছানোর আগেই তাকে সামলে ফেলা চলে।

এই কাণ্ডজ্ঞান আর বিকার দুটো বড় শব্দ সম্পর্কে। কাউকে গ্রাস করে ভালোবাসা যায় না। কাউকে কামড়ে ধরে থেকে ভালবাসা যায় না। কাউকে শুধু শারীরিক আকর্ষণে, অর্থের ঔজ্জ্বল্যে, সামাজিক সুখসুবিধায় বশ করে ভালোবাসা যায় না। ভালোবাসা কোনো আবেগ না। বিচার না। ভালোবাসা একটা পজিটিভ সচল কাণ্ডজ্ঞান। বাধা পেলে রাস্তা খোঁজে। চাপতে গেলে ফোঁস করে ওঠে। দাবাতে গেলে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দূরে ঠেললে অপেক্ষা করে। কাছে আনলে আশ্রয় হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো মতেই বিকার হয়ে ওঠে না, যদি না একটা অস্বাস্থ্যকর ইগোর বিষবাষ্প শিরায় শিরায় এসে মেশে।

উপায়? নেই। বিকার একটা স্ব-আরোপিত অন্ধত্ব। একমাত্র নিজে চাইলেই এর থেকে বেরিয়ে আসা যায়। শুধু চাওয়াটা আন্তরিক আর ঐকান্তিক হতে হয়। সব চাওয়া আন্তরিক হলেও, ঐকান্তিক হয় না। ঐকান্তিক চাওয়া মানে মরিয়া হয়ে ওঠা। কিন্তু টক্সিক সম্পর্কে ইগো এমনই কর্কটরোগের মত হয়ে ওঠে যে, সে যার সত্তাতে বেড়ে ওঠে তাকে শেষ না করা অবধি শেষ হয় না যে। সে অন্ধ তখন। সে জানে যে করে হোক তার ইগোকে জেতাতেই হবে, তাতে তার সত্য অর্থে মরণ হলেও। মরণ হয়ও। ইগো যতবার জিতে যায় সে যে ততবার নিজের বাকি সুস্থ সম্ভাবনাগুলোকে একটা একটা করে হত্যা করে, সে আর কে বোঝাবে তাকে? অবশেষে সব দরজা বন্ধ হয়। এক ইগোর দরজা খোলা থাকে - মৃত্যুর দিকে। কি আত্ম-লাঞ্ছনাময় সে মৃত্যু!

155
Thu, 05/05/2022 - 22:51

কি অক্ষয় হবে? আজ অবধি কি অক্ষয় হয়েছে? কিছু না। এই সত্য - কিছু অক্ষয় হয়নি। না রামের রাজত্ব, না কৃষ্ণের বৃন্দাবন। অক্ষয় হয়েছে কি? না ধর্ম, না সম্পদ। না পুণ্য, না সঞ্চয়। না স্বাস্থ্য, না সুখ। শুধু বাসনাটুকু অক্ষয় থেকে গেছে, সব কিছু হোক অক্ষয়।

তবু অক্ষয়ত্ব চাই। প্রার্থনা, তপস্যা, কান্না, কত কি উঠল। কিন্তু কিছুই অক্ষয় হল না। রামকৃষ্ণদেব গল্প বলছেন,

"একজন লোকের পাহাড়ের উপর একখানা ঘর ছিল। কুঁড়েঘর। অনেক মেহনত করে ঘরখানি করেছিল। কিছুদিন পরে একদিন ভারী ঝড় এল। কুঁড়েঘর টলটল করতে লাগল। তখন ঘর রক্ষার জন্য সে ভারী চিন্তিত হল। বললে, হে পবনদেব, দেখো ঘরটি ভেঙো না বাবা! পবনদেব কিন্তু শুনছেন না। ঘর মড়মড় করতে লাগল; তখন লোকটা একটা ফিকির ঠাওরালে; — তার মনে পড়ল যে, হনুমান পবনের ছেলে। যাই মনে পড়া অমনি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল — বাবা! ঘর ভেঙো না, হনুমানের ঘর, দোহাই তোমার। ঘর তবুও মড়মড় করে। কেবা তার কথা শুনে। অনেকবার 'হনুমানের ঘর' 'হনুমানের ঘর' করার পরে দেখলে যে কিছুই হল না। তখন বলতে লাগল, বাবা 'লক্ষণের ঘর!''লক্ষণের ঘর!' তাতেও হল না। তখন বলে বাবা, 'রামের ঘর!' 'রামের ঘর!' দেখো বাবা ভেঙো না, দোহাই তোমার। তাতেও কিছু হল না, ঘর মড়মড় করে ভাঙতে আরম্ভ হল। তখন প্রাণ বাঁচাতে হবে, লোকটা ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার সময় বলছে — যা শালার ঘর!"

সব ক্ষয়ে যাওয়ার ভয়। অক্ষয়ের বাসনায় ভয়। ভয় থেকে হিংসা, নিষ্ঠুরতা, অশান্তি, ঈর্ষা। শান্তি নেই। শান্তি কই? রামকৃষ্ণদেব আবার গল্প বলছেন,

“শ্রীমদ্ভাগবতে আছে যে, অবধূত চব্বিশ গুরুর মধ্যে চিলকে একটি গুরু করেছিলেন। এক জায়গায় জেলেরা মাছ ধরছিল, একটি চিল এসে মাছ ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। কিন্তু মাছ দেখে পেছনে পেছনে প্রায় এক হাজার কাক চিলকে তাড়া করে গেল, আর সঙ্গে সঙ্গে কা কা করে বড় গোলমাল করতে লাগল। মাছ নিয়ে চিল যেদিকে যায়, কাকগুলোও তাড়া করে সেইদিকে যেতে লাগল। দক্ষিণদিকে চিলটা গেল, কাকগুলোও সেইদিকে গেল; আবার উত্তরদিকে যখন সে গেল, ওরাও সেইদিকে গেল। এইরূপে পূর্বদিকে ও পশ্চিমদিকে চিল ঘুরতে লাগল। শেষে ব্যতি ব্যস্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে মাছটা তার কাছ থেকে পড়ে গেল। তখন কাকগুলো চিলকে ছেড়ে মাছের দিকে গেল। চিল তখন নিশ্চিন্ত হয়ে একটা গাছের ডালের উপর গিয়ে বসল। বসে ভাবতে লাগল — ওই মাছটা যত গোল করেছিল। এখন মাছ কাছে নাই, আমি নিশ্চিন্ত হলুম।"

তবে অক্ষয় কি হবে? কিচ্ছু না। সব যাবে। সময়ের অপেক্ষা শুধু।

কিন্তু এ তো ভয়ের কথা। এতে শান্তি কই?

শান্তি নেই। শান্তি কি অভিজ্ঞতা? এই যে ছুটে ছুটে যাওয়া শান্তির খোঁজে। আসলে কি সে শান্তি? না গোলমালের ক্ষণিক বিরতি। বিরতি মানে কি শান্তি?

তবে শান্তি কি? শান্তি মানে যেখানে দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্বহীন অস্তিত্ব কি সম্ভব? সংঘাতহীন মন কিরকম? মন মানেই তো স্ববিরোধ। স্ববিরোধী যা, সে কখনও শান্ত হয়কি? সে কোনো একটা চুক্তিতে কিছুদিন চুপ থাকে। আবার সাম্য বিগড়ায়, আবার শুরু হয় বিরোধ। বিরোধহীন মন হয় না। বিরোধকে বুঝতে বুঝতে মানুষ বিরোধের পারে যায়। তাই আমি কি জানি, আমার কি অভিজ্ঞতা, আমার কি উপলব্ধি এসব কিছুতেই কিছু আসে যায় না। প্রশ্নটা হল, আমাকে আমি কতটা বুঝি? আমার মধ্যে ওঠা হাজার একটা স্ববিরোধীভাবের মনকে আমি কতটা নির্মোহভাবে দেখতে পারি। যতটা দেখতে পাই, ততটাতেই শান্তি। খাঁটি শান্তি। কারণ তখন আমার হাতে আর কোনো বিকল্প নেই। বিকল্প মানেই ভ্রান্তি। ভ্রান্তি মানেই অশান্তি। অক্ষয় অশান্তি।

156
Sun, 05/01/2022 - 00:56

অ্যাদ্দিন মদনভস্মের গপ্পো পড়েছিলাম। শিবের ধ্যান ভাঙাতে মদন এয়েচিলো। যেই না একটা তীর মেরেচে কি মারেনি, অমনি গেল মহাদেবের ধ্যান ভেঙে। ব্যস, এমন ক্ষ্যাপা ক্ষেপলেন, দিলেন ভস্ম করে মদনদাকে। তারপর তো রতি, মানে মদনের বউ, অনেক আপিল টাপিল করে সিদ্ধান্ত হল, মদন থাকবে অনঙ্গদেব হয়ে। মানে মদনদা থাকবে, কিন্তু শরীর থাকবেনিকো। মানে নো অঙ্গ, অর্থাৎ অনঙ্গ।

তো এই হল গিয়ে আমাদের পুরাণের গপ্পো। আজ আর সে পুরাণ নয়, এক্কেবারে পরাণ পুড়িয়ে অনুভব করছি গো। সদ্য বসন্ত গেল। পলাশ ফুটল, শিমূল ফুটল। চারদিক লাল লাল হল। আবীর নিয়ে দোলটোল খেলা হল। বেশ একটা প্রেম প্রেম ভাব, মানে অনঙ্গদেবের নানা অঙ্গে আগমনের সময়। কিন্তু একি! তা বলে চল্লিশ ডিগ্রী! সব পুড়িয়ে ছাড়বি! মদন অনঙ্গ হয়েও কি রক্ষা পাচ্ছে! ত্রাহি ত্রাহি রব চারদিকে। তবে সেদিনের কবিরও একই হাল হয়েছিল? রক্তিম বসন্ত গ্রীষ্মের রক্তচক্ষুতে এমনই ঝলসে গিয়েছিল? তাই হবে, তবেই নিশ্চয়ই এই মদনভস্ম উপাখ্যান তৈরি হয়েছিল।

প্রেম আর তাপ সংসারে এ দুটোর সহাবস্থান কে না জানে। যে-ই প্রেমিয়েছে নিজের হৃদয়, সে-ই পুড়িয়েছে নিজেকে। কিন্তু হৃদয়ের তাপ তবু সহ্য হয়, কিন্তু এ সৌর্যিক তাপ যে বড়ই শুষ্ক। প্রেমের তাপ চোখের জল হয়ে বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ল। বালিশ ভিজল কি রুমাল ভিজল। কিন্তু এই তাপ! এ যে হইহই রব, ঘোল খাও, লস্যি খাও, টকদই খাও, এ সব তো প্রেমের তাপে হয় না। আজ অবধি শুনিনি রাধিকার কেঁদে ডিহাইড্রেশান হয়েছে বলে সখীরা তাকে নুন-চিনির জল গুলে এনে বলছেন, "ধরো ধরো সখী, এ সরবত পান করো/ কেষ্ট আসিবেন ঠিক, আগে নিজেকে হাইড্রেট করো"। না শুনিনি।

একবার ভেবে দেখুন রাধিকা বিয়াল্লিশ ডিগ্রি টেম্পারেচারে কুঞ্জবনে বসে আছেন। চারদিকে হল্কা। লু বইছে। রাধিকা কি আর বাঁশির অপেক্ষা করবেন? অসম্ভব। সে প্রেম যতই তুঙ্গে থাকুক না কেন, কোনো বৈষ্ণব কবিকে একবার বিয়াল্লিশ ডিগ্রী টেম্পারেচারে এনে দাঁড় করালেই পদ পরিবর্তন হবে। "চলো চলো রাই, গৃহপানে যাই / গোবিন্দ আসিবার আগে যম আসিবেক, চলো চলো ধনী, ধড়ে প্রাণ রাখা চাই"।

তবে মোদ্দাকথা হল হৃদয়ের তাপ তবু সহ্য হয়, কিন্তু এ তাপ বড়ই অকাব্যিক। প্রেমের জন্য বসন্ত দরকার। একান্ত দরকার।

একবার ভীষণ গরমে হেদিয়ে ক্লান্ত হয়ে দুপুরে লোকাল ট্রেনে কলেজ স্ট্রিট থেকে ফিরছি। খানিকবাদেই সামনে এসে বসল কলেজ পড়ুয়া যুবক যুবতী। পাশাপাশি। ঘেঁষাঘেঁষি। মেয়েটা ছেলেটার হাতটা নিজের হাতের উপর রাখল। ছেলেটা আরেকটা হাত দিয়ে শরীরটাকে মুড়িয়ে জিন্সের পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছল। মেয়েটা বলল, আজ বিকেলে পড়তে আসবি?

ছেলেটা বলল, আসব। মেয়েটা বলল, মেজো মাসির মেয়েটার সঙ্গে ওই ছেলেটারই বিয়ে ঠিক হল জানিস!

ছেলেটা আরেকবার কপাল মুছে বলল, তাই?

আরে কোন ছেলেটা বল তো.. সেই মুম্বাইতে থাকে, সে নয়… যার ছবি তোকে দেখিয়েছিলাম… একটু ডার্ক সে নয়… এ ব্যাঙ্গালোরে থাকে….

ছেলেটা ঘামছে। আরো ঘামছে। আমি সিওর ছেলেটার মনে পড়ছে না। সে আদৌ আগ্রহীও নয় মেয়েটার মাসির মেয়ের কার সঙ্গে বিয়ে হবে তাই নিয়ে। কিন্তু "হ্যাঁ হ্যাঁ" বলে যাচ্ছে। বলে যেতেই হয়। নইলে প্রেম বাঁচে না। খানিকবাদেই মেয়েটার ফোন এলো। ছেলেটা মাথাটা এলিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে বলল, উফ!

অবশ্যই গরমের জন্যেই বলেছে। আর কি কারণ থাকতে পারে? কিছুই না। এ হল মহাদেবের সঙ্গে মদনের আদিম যুদ্ধ। মহাদেব আর মদনের সহাবস্থান কিছুতেই যে হয় না এই বসন্ত আর গ্রীষ্মই বুঝিয়ে দিচ্ছে হাড়েমজ্জায়। ছেলেটার হৃদয়ে শেষে কে জয়ী হয়েছিল জানি না, মদন কদ্দূর অবধি মরাল সাপোর্ট দিয়েছিল সেও জানি না। আমার নামার স্টেশান আগেই এসে গিয়েছিল। নেমে সাইকেলে করে ফিরছি। রেল কলোনির ফাঁকা রাস্তা। চূড়ান্ত দাবদাহ। হল্কা এসে পুড়িয়ে দিচ্ছে হাত মুখ। এরই মধ্যে ভর দুপুরে প্রাণ কাঁপিয়ে ডেকে উঠল এক কোকিল। আহা, কোকিল ডাকল মানেই কি বসন্তের ডাক রে মন… কোকিল তেষ্টাতেও তো ডাকে…. কোকিল বলে কি মানুষ নয়? বসন্তের কোকিল নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু গ্রীষ্মের কোকিল নিয়ে কোনো লেখা তেমন চোখে পড়েনি। সুচতুরভাবে কবিরা কোকিলের জৈবিক অধিকারটুকু কেমন অবহেলা করে গেছে। শুধু অমন একপেশে হ্রৈদিক অধিকার নিয়ে থাকলে চলে? ওরকম একপেশে হলেই মহাদেবের কোপে পড়তে হয়, পুড়তে হয়।

 

157
Wed, 04/20/2022 - 00:26

না হয় তাই হল। না হয় কিছুই মনের মত হল না। না হয় সবাই এগিয়ে গেল। না হয় আমিই রয়ে গেলাম একা। সম্পূর্ণ একা।

যখন আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই, নিঃশব্দে খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়াই। কিম্বা দরজায় খিল দিয়ে চোখটা বন্ধ করে চুপ করে বসি।

তারপর খুঁজি, এই যে আমার একাকীত্ব, একে অনুভব করছে কে? যে অনুভব করছে সে আমার খুব কাছে বসে, কি এক অনির্বচনীয় আলো আমার মধ্যে জ্বেলে দিয়ে বলছে, এই হল তোমার একাকীত্বের অনুভব। এই যে বলছে, তবে সে কে?

সে আমার মধ্যের আরেক আমি, গোটা আমি। সব কিছু মিলিয়ে গোটা একটা আমিই তো আছি। কিন্তু সে আমিটাকে, মানে গোটা আমিটাকে খুঁজে পাওয়া ভারী শক্ত। সে এক খেলা। খণ্ড খণ্ড আমি যখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরছে, কিছুতেই একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারছে না, তখন এই গোটা আমিটা সে সবকে সামাল দিয়ে চলেছে, অসীম ধৈর্যে। নিজের দিকে একটু ভালো করে তাকালেই বেশ বোঝা যায়, এই ভালোবাসা, রাগ, অভিমান, অসন্তোষ ইত্যাদি ইত্যাদিতে গড়া, এই টুকরো টুকরো আমিগুলোকে ছাড়িয়ে আরো কিছু নিশ্চয়ই বাকি আছে। এইতেই সব ফুরিয়ে যায় নাকি? তাহলে হিসাবে মিলবে না যে!

সেই গোটা আমিটাকে খুঁজতেই মাঝে মাঝে একাকীত্বের অনুভবটা ভালো। খুব দরকারি। এ যেন আলমারি গোছানোর মত। মাকে দেখতুম, মাঝে মাঝে সব জামাকাপড় নামিয়ে, ঘেমে-নেয়ে আলমারিটা গোছাচ্ছেন, আর বলছেন, উফ, কি করে রেখেছিস, শুধু হাগতে বাকি রেখেছিস, দরকারে একটা জিনিসও খুঁজে পাবি…

নিজে যখন ভীষণ এলোমেলো হয়ে যাই। সব আছে, কিন্তু মনে হয় যেন আমার ভিতরে কোথাও একটা তাল কেটে গেছে, সুর উঠছে না। আমার মায়ের ওই আলমারি গোছানোর দৃশ্যটা চোখে ভাসে। মনে হয় সত্যিই তো, নিজেকে এত এলোমেলো করে ফেলেছি যে এখন দরকারের সময় মন বিভ্রান্ত, অনুভব ধোঁয়াশাময়। দূর দূর, এমন করে নিজেকে নিয়ে বাঁচা যায়? জগতে একটা জিনিসও তো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু নিজের নিজেকেও যদি নিজের অবহেলায় হারাই, তবে তো দাঁড়াবার জায়গা থাকে না।

অগত্যা আলমারি গোছাতে বসি। খণ্ড খণ্ড আমিগুলোকে আবার কুড়িয়েবাড়িয়ে এনে, তাদের গায়ে লেগে থাকা ক্ষোভ, অভিমান, দুরাশার হতাশাদের ঝেড়েঝুড়ে, বাবা-বাছা করে বুঝিয়ে বাঝিয়ে আবার ঘরে তুলি। এ সম্ভব হয় এই গোটা আমির হাতে তৈরি এক পরমান্নের জন্য। সে পরমান্নের নাম, আত্ম-করুণা। সে পরম যত্নশীল। ধৈর্যশীল, মমতাময়। তার তাড়া নেই কোনো। তার সামনে শুধু আমিই আছি।

এর জন্য প্রথম শর্তই হল একটু সরে দাঁড়াও, একটু একা হও। সমস্ত রকমের দোষদৃষ্টি মুক্ত হও। একাকীত্বকে মোহের আবরণে ঢাকে বিষম বিষাক্ত এই দোষদৃষ্টি। একে সরাও, বিশ্বাস করো তুমি তোমার হাজার একটা খণ্ড খণ্ড আমি হারিয়ে ফেললেও, ওই গোটা আমিকে কোনোদিন হারাতে পারবে না। ওটা হয় না। আকাশ যেমন তার নীলকে হারায় না, এও তেমন। আলমারি থেকে কত জামাকাপড় সরে যায়, আবার কত জামাকাপড় নতুন আসে। এও তেমন। খণ্ড খণ্ড যে আমিগুলো সময়ের নানা খণ্ডে বুদবুদের মত জন্মেছে, তারা তো মিলাবেই, সময় হলে। কিন্তু যে জলাধারে এই নিত্যনতুন বুদবুদের জন্ম, সে হারিয়ে যায় না। সে নিত্য, শ্বাশত আমি। গোটা আমি। কোনো জোড়াতাপ্পি দিয়ে বানানো না সে। সে গোটা আমি বানানো অসীম করুণায়। নইলে নিজের এত এত ত্রুটিকে সহ্য করেও, মার্জনা করেও, কার করুণায় আবার নিজের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পেয়ে চলেছি? সে আমার এই গোটা আমির। যে আমায় সবটা নিয়ে বোঝে। তাই এত গভীর সে, এত আপন আর এত নির্ভরতার জায়গা। তাকে খুঁজে পেতেই হবে। সে-ই পরম শান্তি। স্থির আনন্দ। গভীরতম শাশ্বত আশার বাণী - আমি আছি।

সে সত্যই আছে। আমার হাজার একটা ত্রুটিযুক্ত খণ্ড খণ্ড আমিকে একত্রে নিয়ে, সে আমারই গোটা আমি। শুধু যে করেই হোক, দোষদৃষ্টি মুক্ত হও। আগল সরে যাবে। মেঘ কেটে যাবে।

158
Mon, 04/18/2022 - 05:30

 

না হয় তাই হল। না হয় কিছুই মনের মত হল না। না হয় সবাই এগিয়ে গেল। না হয় আমিই রয়ে গেলাম একা। সম্পূর্ণ একা।

যখন আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে যাই, নিঃশব্দে খোলা আকাশের নীচে এসে দাঁড়াই। কিম্বা দরজায় খিল দিয়ে চোখটা বন্ধ করে চুপ করে বসি।

তারপর খুঁজি, এই যে আমার একাকীত্ব, একে অনুভব করছে কে? যে অনুভব করছে সে আমার খুব কাছে বসে, কি এক অনির্বচনীয় আলো আমার মধ্যে জ্বেলে দিয়ে বলছে, এই হল তোমার একাকীত্বের অনুভব। এই যে বলছে, তবে সে কে?

সে আমার মধ্যের আরেক আমি, গোটা আমি। সব কিছু মিলিয়ে গোটা একটা আমিই তো আছি। কিন্তু সে আমিটাকে, মানে গোটা আমিটাকে খুঁজে পাওয়া ভারী শক্ত। সে এক খেলা। খণ্ড খণ্ড আমি যখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করে মরছে, কিছুতেই একটা বোঝাপড়ায় আসতে পারছে না, তখন এই গোটা আমিটা সে সবকে সামাল দিয়ে চলেছে, অসীম ধৈর্যে। নিজের দিকে একটু ভালো করে তাকালেই বেশ বোঝা যায়, এই ভালোবাসা, রাগ, অভিমান, অসন্তোষ ইত্যাদি ইত্যাদিতে গড়া, এই টুকরো টুকরো আমিগুলোকে ছাড়িয়ে আরো কিছু নিশ্চয়ই বাকি আছে। এইতেই সব ফুরিয়ে যায় নাকি? তাহলে হিসাবে মিলবে না যে!

সেই গোটা আমিটাকে খুঁজতেই মাঝে মাঝে একাকীত্বের অনুভবটা ভালো। খুব দরকারি। এ যেন আলমারি গোছানোর মত। মাকে দেখতুম, মাঝে মাঝে সব জামাকাপড় নামিয়ে, ঘেমে-নেয়ে আলমারিটা গোছাচ্ছেন, আর বলছেন, উফ, কি করে রেখেছিস, শুধু হাগতে বাকি রেখেছিস, দরকারে একটা জিনিসও খুঁজে পাবি…

নিজে যখন ভীষণ এলোমেলো হয়ে যাই। সব আছে, কিন্তু মনে হয় যেন আমার ভিতরে কোথাও একটা তাল কেটে গেছে, সুর উঠছে না। আমার মায়ের ওই আলমারি গোছানোর দৃশ্যটা চোখে ভাসে। মনে হয় সত্যিই তো, নিজেকে এত এলোমেলো করে ফেলেছি যে এখন দরকারের সময় মন বিভ্রান্ত, অনুভব ধোঁয়াশাময়। দূর দূর, এমন করে নিজেকে নিয়ে বাঁচা যায়? জগতে একটা জিনিসও তো নিজের নিয়ন্ত্রণে নেই, কিন্তু নিজের নিজেকেও যদি নিজের অবহেলায় হারাই, তবে তো দাঁড়াবার জায়গা থাকে না।

অগত্যা আলমারি গোছাতে বসি। খণ্ড খণ্ড আমিগুলোকে আবার কুড়িয়েবাড়িয়ে এনে, তাদের গায়ে লেগে থাকা ক্ষোভ, অভিমান, দুরাশার হতাশাদের ঝেড়েঝুড়ে, বাবা-বাছা করে বুঝিয়ে বাঝিয়ে আবার ঘরে তুলি। এ সম্ভব হয় এই গোটা আমির হাতে তৈরি এক পরমান্নের জন্য। সে পরমান্নের নাম, আত্ম-করুণা। সে পরম যত্নশীল। ধৈর্যশীল, মমতাময়। তার তাড়া নেই কোনো। তার সামনে শুধু আমিই আছি।

এর জন্য প্রথম শর্তই হল একটু সরে দাঁড়াও, একটু একা হও। সমস্ত রকমের দোষদৃষ্টি মুক্ত হও। একাকীত্বকে মোহের আবরণে ঢাকে বিষম বিষাক্ত এই দোষদৃষ্টি। একে সরাও, বিশ্বাস করো তুমি তোমার হাজার একটা খণ্ড খণ্ড আমি হারিয়ে ফেললেও, ওই গোটা আমিকে কোনোদিন হারাতে পারবে না। ওটা হয় না। আকাশ যেমন তার নীলকে হারায় না, এও তেমন। আলমারি থেকে কত জামাকাপড় সরে যায়, আবার কত জামাকাপড় নতুন আসে। এও তেমন। খণ্ড খণ্ড যে আমিগুলো সময়ের নানা খণ্ডে বুদবুদের মত জন্মেছে, তারা তো মিলাবেই, সময় হলে। কিন্তু যে জলাধারে এই নিত্যনতুন বুদবুদের জন্ম, সে হারিয়ে যায় না। সে নিত্য, শ্বাশত আমি। গোটা আমি। কোনো জোড়াতাপ্পি দিয়ে বানানো না সে। সে গোটা আমি বানানো অসীম করুণায়। নইলে নিজের এত এত ত্রুটিকে সহ্য করেও, মার্জনা করেও, কার করুণায় আবার নিজের মুখোমুখি হওয়ার সাহস পেয়ে চলেছি? সে আমার এই গোটা আমির। যে আমায় সবটা নিয়ে বোঝে। তাই এত গভীর সে, এত আপন আর এত নির্ভরতার জায়গা। তাকে খুঁজে পেতেই হবে। সে-ই পরম শান্তি। স্থির আনন্দ। গভীরতম শাশ্বত আশার বাণী - আমি আছি।

সে সত্যই আছে। আমার হাজার একটা ত্রুটিযুক্ত খণ্ড খণ্ড আমিকে একত্রে নিয়ে, সে আমারই গোটা আমি। শুধু যে করেই হোক, দোষদৃষ্টি মুক্ত হও। আগল সরে যাবে। মেঘ কেটে যাবে।

159
Tue, 04/12/2022 - 22:30

 

একজন নাইনের ছাত্রী। বাবা খুব টানাটানির মধ্যে সংসার চালান, তাও চান মেয়েটা পড়ুক। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন মেয়েকে। ক'দিন আগে ব্যাচে পড়তে এসেছে। মাস্কটা নাকের নীচে পরা। স্যার তাকে দু-একবার বললেন, মাস্কটা হয় নাকের উপরে তুলে নাও, নয় খুলে বোসো। ছাত্রী গা করল না। আরেকবার স্যার বলাতে, এক ব্যাচ ছেলেমেয়ের মধ্যে স্যারকে বলল, আপনি আমার মুখটা দেখতে চান... নিন দেখুন... সেটা বললেই পারেন..., এই বলে সে মাস্কটা খুলে ব্যাগে ঢোকালো।

স্যার অপ্রস্তুত। লজ্জায় সংকোচে নিজেকে সামলে নিতে তার কয়েকটা দিন লেগেছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর? সে মলিন হেসে বলেছিল, দিনকাল ভীষণ পালটে যাচ্ছে রে। আমি কিছু বলতে পারিনি, আমার মেয়ের বয়েসী সে।

সব কিছুই ভীষণ দ্রুত গতিতে বদলে যাচ্ছে। মূল্যবোধ বদলাচ্ছে। এটাই বড় কথা। মূল্যবোধ মানে কি? সেকি শেখানো যায়? জানি না পণ্ডিতদের কি মত, সামনে কি সত্যিই এক মহাশূন্যতা? মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ছাত্রীটাও হয় তো শুধরে যাবে একদিন। কিন্তু সে তো আশার কথা। আদৌ কি সত্যিই উজ্জ্বল কিছু দেখতে পাচ্ছি সামনে? এ প্রশ্ন নিজেকে করতে হবে। যে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে চার দেওয়ালের মধ্যে দিন কাটায়, তার উত্তর তারা ইচ্ছাগামী হবে, অভিজ্ঞতাগামী না। কিন্তু যারা রাতদিন কাজের মধ্যে আছেন, তাদের কি মত?

মানুষের সব মূল্যবোধের জনক - দরদ। দরদশূন্য প্রজন্মের প্রজন্ম জন্মে যাবে? মানুষ তারায় তারায় রকেট পাঠাবে, আশ্চর্য কুশলী সব যন্ত্র বানাবে, দ্রুত থেকে দ্রুততর জীবনযাত্রা হবে… সুখ, বিলাসিতার সরঞ্জামে ভরে যাবে চারদিক... চিকিৎসাশাস্ত্র এমন উন্নতি করবে যে মারা যাওয়া কঠিন হয়ে উঠবে। সব হবে। কিন্তু যদি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দরদ হারিয়ে যেতে শুরু করে?

মানুষ অন্যের যন্ত্রণা, অসহায়তা, ভিন্নতা যাবতীয় যা কিছু অনুভব করে দরদে। স্বীকার করে অন্যকে দরদে। আত্মীয় হয় দরদী হয়ে। চারপাশ যদি দরদশূন্যই হল তবে মানুষ কি শুধু সোশ্যালমিডিয়ার ভার্চুয়াল জগতে আর নানাবিধ পার্থিব উন্নতির সুখে বাঁচবে? জীবনে সুখ, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব দরকার আছে। কিন্তু নিজের আত্মা বিষিয়ে গেলে এ সবের আর কি দরকার? এর কি কোনোটাই কাজে লাগবে?

মানুষ দরদশূন্য হলে কঠিন, অপ্রিয় কথাকেও.. 'সত্য'... 'ফ্যাক্ট'... 'বাস্তব'... ইত্যাদির নামে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আমরা কানাকে কানা বলে ডাকি না, সেটা সত্যের পরোয়া করি না বলে না, সেটা বস্তুজগতের বাস্তবের চাইতে মনুষ্যত্বের বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিই বলেই তো! আর মনুষ্যত্বের বাস্তবতাই হল দরদী হওয়া। মানুষের যা কিছু মঙ্গলময় সে সব কিছুর জননী এই একটা শব্দ - দরদ। একটা অবিনশ্বর সনাতন অনুভব।

উচ্চাকাঙ্খা, ক্ষমতার আকাঙ্খা মানুষের দরদকে ব্যঙ্গ করে, নইলে তাকে শূন্য করে। ধর্ষকের দরদ থাকে না, ঘাতকের থাকে না। কিন্তু শাসকের দরদ না থাকলে সে আঘাত আরো বেশি। যে অত্যাচারিত সে ন্যায়মহলের কাছে ন্যায় চায়, আত্মীয়ের কাছে চায় দরদ। শাসক আত্মীয়, পালকের মত হবে, এই বিশ্বাসে আঘাত লাগলে ক্ষোভ আরো বেশি হয়। যা আজ হচ্ছে। সে আরো মর্মান্তিক!

সবাই পড়লাম ইউক্রেনে শিশুদের ধর্ষণ করে পুড়িয়ে গায়ে স্বস্তিক চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে রাশিয়ার সেনারা। ক্ষমতার লোভ, উচ্চাকাঙ্খা মানুষকে এমনই পাষাণ বানায়, বর্বর বানায়। গোটা বিশ্ব ধিক্কার দিল। আজ আবার রাশিয়ার রাজা ঘোষণা করল, এ যুদ্ধ ইউক্রেন তথা বিশ্বের মঙ্গলের জন্যেই। মানুষ কতটা স্বার্থান্ধ হলে এমন বিশ্বাস রাখতে পারে যে, এ কথাও বিশ্বাস করবে জগত।

আমি আধুনিক প্রজন্মকে অত্যন্ত স্মার্ট দেখছি, অত্যন্ত কুশলী দেখছি। এ সবই এই দ্রুতগামী জগতে দরকার। তবে কোথাও একটা আশঙ্কার মেঘও দেখছি। আমাদের জীবন মূল্যবোধের শেষ সীমানায় এসে ঠেকছে প্রায়। এ ধরিত্রী জলশূন্য, অক্সিজেন শূন্য, জঙ্গলশূন্য হতে চলেছে, এ অবশ্যই দুশ্চিন্তার কথা। কিন্তু মানুষ যে মূল্যবোধ শূন্য হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে, এই দীনতা ঠেকাবে কোন শিক্ষা? বাইরে থেকে কিছু কাজের অনুকরণে দরদ জন্মায় না, অভ্যাস জন্মায়। অভ্যাস অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। অনুষ্ঠান ভণিতায়। দরদ জন্মায় অন্তর থেকে, আশেপাশে ক্ষেত্র পেলে। যেমন উপযুক্ত পরিবেশে অঙ্কুরিত হয় বীজ কোমল সবুজ পাতা মেলে। দরদই দরদকে জাগায়।

বস্তুজগতের বুক চিরে মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতা অভিনব কাজ করে চলেছে। মানুষের সব অনুভবের ব্যাখ্যাও হয় তো করে ফেলবে কদিন পর মস্তিষ্কের রাসায়নিক গঠনের ব্যাখ্যায়। কিন্তু দরদের ব্যাখ্যা আর দরদকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা কি এক? আমি রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার ব্যাখ্যা করতে পারি পূঙ্খানুপুঙ্খ, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কি বানাতে পারি একটা? হয় না। মানুষ কি অবশেষে নিজের কাছে নিজেই হেরে যাবে?

সম্পদ ভাগ করলে কমে, অনুভব ভাগ করে নিলে বাড়ে। বাঁচতে দুই-ই চাই। কিন্তু যদি জেদ ধরে বসি যে সম্পদেই জীবন চালিয়ে নেব, আমার চাই না অনুভবের সজীবতা! তবে? সে মূর্খামির হাত থেকে কে বাঁচাবে আমাদের?

জগতের কেন্দ্রে এক শক্তি আছে। বিবর্তনের শক্তি। আমরা প্রতিনিয়ত তারই ইচ্ছাধীন। সে শক্তি আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাচ্ছে এই মুহূর্তে বলা শক্ত। তবে সে শক্তি যদি মনুষ্যজাতির সুহৃদ হয়, তবে নিশ্চই মানুষের জন্মলব্ধ যে ধন - তার দরদী মন, তাকে সুরক্ষিত করবে সে। কারণ মানুষের সামনে শান্তি আর সুরক্ষার একটাই পথ, তার অর্থ, সম্পদ, শক্তিকে মানবিক অনুভবের অধীনে সমাজকে গড়ে তোলা। যে লেখক বেশ কিছুকাল আগে ভীষণ বিখ্যাত হয়েছিলেন মানুষের ইতিহাস লিখে, যিনি ক্ষণে ক্ষণে মানুষের জীবনের সব কিছুকে তথ্যে আর বিশ্লেষণে এমন ব্যাখ্যায় এনেছিলেন যেন তিনিই আধুনিক জগতের ঈশ্বরের দূত (এমন প্রশ্ন একটি সাক্ষাৎকারে জনতা তাকে করেছিল। তিনি খুব হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, না না।), তিনিও এই যুদ্ধ আর প্যাণ্ডেমিকের পরে কিছুটা কনফিউজড যেন। তথ্যে না, আত্মবিশ্বাসে। অপ্রাসঙ্গিকও যেন কিছুটা। কারণ মানুষের হেঁটে আসা পথেই শুধু মানুষের আগামীদিনের কথা লেখা থাকে না, মানুষ মাঝে মাঝে নিজের ইতিহাসের উপরও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। 'দ্য রিবেল' -এর লেখক এ কথা লিখেছেন তো।

মানুষ কি সত্যিই বিদ্রোহী হয়ে উঠবে? যে দরদকে নিয়ে সে জন্মায় তাকে নিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারবে কি, সব কিছুকে আবার প্রাণিত করে তোলার জন্যে? সে ছাড়া তো পথ নেই আর! আগামী প্রজন্ম যদি দরদী বিজ্ঞানীনুগামী না হয়ে ওঠে, তবে আমাদের দিন শেষের কাছাকাছি। যদি পথ বাইরে খুঁজি, তবে পথের হিসাব মিলবে, গতি মিলবে না। যদি অন্তর দিয়ে খুঁজি, তবে গতিই পথ বানিয়ে নেবে।

 

160
Fri, 04/08/2022 - 23:00

 

বিজ্ঞান বলে কি কিছু আলাদা বিষয় আছে? সত্য আর বিজ্ঞান কি সমার্থক নয়? তেমনই কল্পনা আর ধর্মীয় গল্পগুলো কি একই নয়? কল্পনার সত্য আর পরীক্ষিত সত্যের মধ্যে বিরোধ কেন হবে? কল্পনা মানেই কি মিথ্যা? অবশ্যই নয়। কল্পনার সঙ্গে মানুষের ইচ্ছা, ভালোবাসা, কামনা বাসনার যোগ নেই? মানুষের যা কিছু সৃষ্টি সে তো আগে তার কল্পনায় এসেছে, তবে তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। তবে কল্পনা বলেই তাকে মিথ্যা বলে চালানোর কারণ তো দেখি না। না, কারণ আছে। কল্পনার সত্যকে যখন আমি পরীক্ষিত সত্যের দরবারে নিয়ে যাই তখন তার মান সম্মান নিয়ে টানাটানি হবেই। পরীক্ষিত সত্যের দরবারে সবাই প্রমাণ পত্র চায়। এখন কল্পনা যদি বলে আমার সব সত্য অনুমানের, আমার কাছে তো প্রমাণপত্র নাই, তখনই শুরু হয় সমস্যা। কারণ সে যেখানে প্রবেশাধিকার চাইছে সেখানে প্রমাণের প্রমাণপত্র না দেখালে ঢোকার অনুমতিই নেই। কত মানুষের কত প্রমাণপত্র এ ও খারিজ করে দিল, কেউ তা নিয়ে গোঁসা করেছে বিজ্ঞানের জগতে শুনেছ? কারণ সেখানে ব্যক্তির ইগোর চাইতে প্রমাণিত সত্যের মান বেশি। তাই একের প্রমাণ অন্যের বিরুদ্ধ প্রমাণের সামনে না টিকলে, সে বিনা ইগোর লড়াইয়েই বলে, তোমারটাই সত্য।

আসলে বিজ্ঞানের সত্য তো ব্যক্তিগত সত্য নয়। সে সার্বজনীন সত্য। তাই ইগো পাত্তা পায় না। কিন্তু আমার কল্পনার সত্য তো আমার আমি থেকে সৃষ্টি করেছি, ফলে সে আমায় ছাড়া দাঁড়াতে পারে না, আমিও তাকে ছাড়া চলতে পারি না। ফলে কেউ আমার কল্পনার সত্যের বিরুদ্ধে কিছু বললেই সে সরাসরি আমার অহমিকায় এসে লাগে। মনে হয় আমায় এত অবিশ্বাস!

আসলে দেখো, প্রমাণ আর অনুমান। এতেই তো জগত চলছে। এখন বিজ্ঞান আর ধর্ম এই দুটোকে নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হল। এই জগত হল তাদের ক্ষেত্র। তা জগত তো আর দুটো নয় গা। একটাই। এক কালে এ জগত নিয়ে যা যা অনুমান করা হয়েছিল বিজ্ঞান এসে প্রমাণ করল তা তা আসলে তা নয়। অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে শুরু করল। এখন দেখো বিজ্ঞান তো আর আমার অনুমানগুলোকে মিথ্যা করবে বলে আদাজল খেয়ে লাগেনি। তার কাজের মধ্যে দিয়ে আমার অনুমানগুলো একে একে ভুল প্রমাণিত হয়ে গেছে। সে তার কি করবে?

তবে কল্পনা আর অনুমানের মধ্যে পার্থক্য কি? সেই পার্থক্যই যা সাহিত্য আর রাজনীতির মধ্যে। দেখো কল্পনা থেকে সাহিত্য জন্মায়। কল্পনা জন্মায় অনুভব আর বাস্তবের মধ্যের অভাবটুকু পূরণ করতে। যেমন কাঠবেড়ালির গায়ে দাগ দাগ দেখলাম, এ বাস্তব। কিন্তু আমি আর কারণ তো জানি না। আমি তাই কল্পনা করলাম যে সীতার আঙুলের দাগে অমন হয়েছে। যে কারণে হনুমানের মুখ কালো হয়েছে, লেজ মুখে পুরে দিয়ে। তৈরি হল মিথোলজি। মানে বাস্তবের কাল্পনিক ব্যাখ্যা। তাই দিয়ে তৈরি সাহিত্য। বেশ লাগে পড়তে। যদি খোলা মন নিয়ে পড়া যায়। যদি স্মরণে রাখা যায় সে সময়ে মানবসভ্যতার অবস্থান। কিন্তু সেই সাহিত্যকে যদি অকাট্য প্রমাণ ধরে নিই, আমার বাপঠাকুরদা মেনে এসেছে বলে, তবে তো আমার বাপঠাকুরদাকেই লজ্জা দেওয়া। ধরা যাক এক বাড়ির লোক দারিদ্র্যর কারণে মাটিতে খাবার রেখে খেত। তারপর তাদের অবস্থা ফিরল, কিন্তু বাপঠাকুরদার প্রতি সম্মানে তারা যদি আবার মাটিতে খাবার রেখে খায় তবে সে বাপঠাকুরদাকে সম্মান করা হল, না তাদের অসহায়, উপায়হীন অবস্থাকে ব্যঙ্গ করা হল সেও তো ভাবতে হবে। সেকি লজ্জার কথা নয়!

অনুমান আর কল্পনা নির্ভর সাহিত্য মানুষকে ভালো মন্দ দুই দিয়েছে। এর কল্পনার সঙ্গে ওর কল্পনার বিরোধ হয়েছে। এক জগতে নানা জগদীশ্বর হয়েছে। তাই নিয়ে রক্তগঙ্গাও বয়েছে। অনুমান আর কল্পনা মানুষের এমন মজ্জাগত। এমন টান, আসক্তি তার উপর। কেন? আরেকটা তত্ত্ব আসে। অভ্যাস।

মানুষ অভ্যাসের দাস। এ আমরা কথায় কথায় বলি। আমাদের কল্পনা আর অনুমানের প্রতি এত আনুগত্য থাকার কারণ দুটো। এক চলে আসা অভ্যাস, দুই, বুঝতে সোজা। এখন আমি যদি বলি আপেল মাটিতে কেন পড়ল, কারণ হল মাটির মধ্যে একটা রাক্ষস আছে, সে সব কিছুকে নিজের মধ্যে টেনে নেয়। ব্যস, বোঝা কত সোজা হল। মানুষ রাক্ষস দেখেনি। কিন্তু লোভ, হিংসা, নিষ্ঠুরতার অভিজ্ঞতা তার আছে। সেই তাকেই সম্বল করে সে ধাঁ করে একটা রাক্ষস কল্পনা করে নিল। মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব বুঝতে হল না। সে তো কঠিন। তার তো নানা মাপঝোঁক আছে।

আরেকটা কথা আছে। কল্পনা সব সময় ব্যক্তি তৈরি করে। কল্পনা কখনও নৈর্ব্যক্তিক হয় না। পরীক্ষিত সত্য, যাকে বিজ্ঞান বলি, সে সব সময় নৈর্ব্যক্তিক। অনুমান আর কল্পনা সব সময় সব কিছুর ব্যাখ্যায় ব্যক্তিতে এসে মেশে। তাই না মানুষ এক কালে আগুন, বৃষ্টি, পক্স ইত্যাদি সবের স্রষ্টা তথা নিয়ামক ব্যক্তি বানিয়েছিল কল্পনায়। ব্যক্তি মানেই ইচ্ছা, দ্বেষ, অহমিকা। সেখানে নিয়ম বলে কিছু নেই। হয় কৃপা, নয় ক্রোধ। কারণ সব কিছুর উৎস ব্যক্তি। কল্পনার উৎস যেহেতু ব্যক্তির রুচি, তাই তার শেষও ব্যক্তি। রাগী মানুষের ভগবান ভীষণ নীতিশীল। কোমল মানুষের ভগবান ক্ষমাশীল। শৈল্পিক মানুষের ভগবান শিল্পী। এমন নানা ভাগ তাই। ব্যক্তির রুচিজাত কল্পনা সমান রুচি সম্পন্ন ব্যক্তিকেই তো তার ঈশ্বর বলবে। এই স্বাভাবিক।

তবে কথা হচ্ছে, এই দুটো কি একসঙ্গে চলতে পারে না? জগত যেহেতু একটাই, আর বিজ্ঞান একের পর এক সব কিছুর পরীক্ষিত ব্যাখ্যা দিয়ে যাওয়ার পর কল্পনার হাতে অবশিষ্ট জগত বড় কম। তাই ধর্ম দিন দিন এত সেন্টিমেন্টাল হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় সেন্টিমেণ্টে আঘাত লাগছে। আসলে এ অভিমানের কথা। তারাশঙ্করের লেখা জলসাঘরের সেই জমিদারের মত অভিমানী হয়ে উঠছে সে। অভিমান মানে তো সেন্টিমেন্ট।

তবে এই সেন্টিমেন্টকে সামলাবো কি করে? এর উত্তর আছে সাহিত্যে। কল্পনা আর অনুমানকে ঘিরে সাহিত্য সৃষ্টি চলুক না। শিল্প হোক। সেখানে তো কেউ প্রমাণ চায়নি। রুমি, রবীন্দ্রনাথ, কবীর, রামপ্রসাদ প্রমুখদের কাছে তো কেউ প্রমাণ দাবী করেননি। তারা গান লিখেছেন, কবিতা লিখেছেন। নিজের ভাবে নিজে মজেছেন। মজিয়ে চলেছেন। দাবী করেননি প্রমাণপত্রের। আনন্দ সৃষ্টি করেছেন, আনন্দ দিয়েছেন। মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তার আনন্দের সম্পদ। আনন্দ স্বতঃপ্রমাণ। তাকে প্রমাণ করতে হয় না। আমার কল্পনা, আমার অনুমান আমায় যদি আমার সৃষ্টিতে আনন্দ দেয়, সে আনন্দ যদি আমি আমার কবিতায়, গানে ছড়িয়ে দিই তবে তো সমস্যা নেই। তাই যে রাধার পদধ্বনি শুনছে নিজের কল্পলোকে, তাকে যদি গিয়ে বলা যায়, ওহে ও রাধাকে মানে না, চলো বোম বেঁধে ওকে উড়িয়ে দিই। সে কানে নেবে? নেবে না। যে আনন্দ পেয়েছে, যে নিজের সৃষ্টির সুখে মজে আছে, সে আনন্দের এমন স্রোতে অবগাহন করেছে রাজ্যের ধনরাশি, মান-সম্পদ তার কাছে তুচ্ছ। সে তৃপ্ত। সমস্যা হল, যারা বীণা হাতে ঘোরে অথচ না পারে বাজাতে, না পারে শ্রোতা হিসাবে মগ্ন হতে। সে মূর্ছনায় মজে না বলে, বীণার আঘাতে বীণার অস্তিত্বকে জানান দিতে চায়। সব কিছুকেই সে তাই শত্রুময়, বৈরিময় দেখে। আনন্দ আর নৈর্ব্যক্তিক সত্যের কোনো বৈরী নেই। বৈরী আছে অহমিকার। আর অহমিকাজাত সব কিছুর। যত সমস্যার মূলও তো সে। তাই না?

161
Thu, 04/07/2022 - 20:00

 সোশ্যাল মিডিয়া না থাকলে সত্যিই আমরা জানতাম না, আমরা এত এত বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতা এত সযত্নে লালন করি গোপনে, সব শিক্ষা সুবিচার এড়িয়ে। সব চাইতে বেশি বোঝা যায় নিউজলিঙ্কগুলোর নীচে চোখ বোলালে। একটা মৃত্যুর খবর, দুর্ঘটনার খবর, ধর্ষণের খবর কি অনায়াসে হাসির খোরাক হয়, টীকাটিপ্পনীর খোরাক হয়, রাজনীতির রঙ লাগানো হয়। ধর্ম, দেশ, খেলা, রাজনীতি, সিনেমা ইত্যাদি যাই হোক না কেন, এ যেন অনন্ত বিদ্বেষ মন্থন। এত এত বিষ বছরের পর বছর বেরিয়েই যাচ্ছে, বেরিয়েই যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধব কিসের কিসের মধ্যে না এই বিষ ছড়াচ্ছে। আমি "সোশ্যাল মিডিয়া আশীর্বাদ না অভিশাপ" টাইপের কিছু বলতে চাইছি না, স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে যে রচনা লিখে আসছি যুগ যুগ ধরে। নিশ্চয়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক ভালো কাজ হয়। আমার বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়া না, সে তো আয়না শুধু, আমি অবাক হই মানুষের নির্মম মন্তব্যগুলো পড়ে। একটা শিশুর ধর্ষণের খবরেও হাসির রিয়্যাকশান দেখি শুধু ধর্ম বা দেশের ফারাক আছে বলে। যারা সে রিয়্যাকশানগুলো দেয় তারা অনেকেই নিজেদের আসল প্রোফাইল থেকেই দেয়। কি সুন্দর ভদ্র ছবি। পারিবারিক ছবি। বেড়াতে যাওয়ার ছবি। যে ধর্মে বিশ্বাসী সেই ধর্মের নানা পোস্ট। নানা মহাপুরুষের বাণী। কি নেই তাদের টাইম লাইনে। কিন্তু কি হীন, অমানবিক মন্তব্য তারা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর এই বিদ্বেষকে লালিত করে এত যত্নে!

আমার কি ভয় হয় জানেন? আমরা যা-ই চর্চা করি তা-ই দিন দিন সুক্ষ্ম হয়, আরো শক্তিশালী হয়। তবে আমাদের এই সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে, নানা কৌশলে, নানা আকারে-ইঙ্গিতে করে চলা এই বিদ্বেষের চর্চা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাবে?

আমি শিক্ষকতা করি। ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভ অবধি বাচ্চারা যারা কোনো না কোনোভাবে সোশ্যাল মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত আমি তাদের স্বভাবের মধ্যে একটা বিশেষ দিক দেখেছি। তারা কি ভীষণভাবে নিজেদের বায়াসনেসকে সাপোর্ট করতে শিখে যাচ্ছে। বাকচাতুরী কি সাংঘাতিক মাত্রায় বাড়ছে। কোনো বিপরীত ভাবনাকে গ্রহণ করার ক্ষমতা কমছে। আগেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। যেন সব বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়াটাই একমাত্র কর্তব্য। অথবা জাস্ট ইগনোর বা অন্য মতামতকে 'নেই' করে দেওয়া।

আমরা যেন নিজেদের অজান্তে এক ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি তৈরি করছি। সেখানে নিজেদের মত করে আগুনের ব্যবস্থা করছি। আমার আগুন, তোমার আগুন। আলাদা আলাদা করে রাখছি। যেন আমার আগুনে শুধু পুড়বে তুমি, তোমার আগুনে আমারই শুধু পোড়ার ভয়।

সারাদিন কাজের মাঝে মাঝেই নিউজে চোখ রাখা আমার স্বভাব। আজকাল যত দিন যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় আসা কোনো নিউজ থ্রেডে কোনো সংবেদনশীল নিউজ দেখলে আমার অবচেতনে একটা ভয়, সঙ্কোচ জন্মায়। কোনো রকমে নিউজটা পড়ে বেরিয়ে যাই, যেন কোনোভাবেই কমেন্টস বক্সে আঙুল না ছোঁয়। তবু দেখি। দমে যাই। হতাশ হই। বাঁচতে গেলে কি নিজেকে এতটা স্পষ্ট মেরুকরণ করে রাখতেই হয়? এতটা একপেশে বাঁচা মননে ক্লান্তি আসে না? এত এত ঘেন্না, বিদ্বেষ, আক্রোশ নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে হাঁফ ধরে না? নাকি বাঁচার মানেটাই বদলে যাচ্ছে ক্রমশ আমাদের।

ভালো ঘটনাও আছে। চিরটাকাল ভালো মন্দের সাম্যতে জগত সংসার। আজও তাই। কিন্তু আজকের দিনে চিন্তার কারণটা হল নিজেদের সঙ্কীর্ণতাকে নির্লজ্জের মত সামনে আনতে লজ্জা পাচ্ছি না। যে মানুষটা এইমাত্র কোনো একটা সামাজিক ভালো পোস্টে ভালো কিছু লিখে এলো, সে-ই কোনো একটা সংবেদনশীল নিউজে একটা প্রোভোকেটিভ কিছু লিখে ফেলল কয়েক মিনিটের ব্যবধানে। কারণ কি? অন্য কমেন্টসগুলোর প্রোভোকেশান?

মেরুকরণের দিকে এই প্রোভোকেশান দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমরা এক গভীর জঙ্গলের দিকে যেন হাঁটছি। সবার কাছে গুপ্ত অস্ত্র। গোটা মানব সভ্যতা যেন এক বিশাল ধ্বংসের মহড়ায় মেতে উঠেছে। আমরা কি ভয়ানক অবসেসানে ভুগছি। প্রোভোক করতে আর প্রোভোকড হওয়ার অবসেসানে।

মানুষের চিত্তে বিষ জন্মাবে। আগেও জন্মিয়েছে। কিন্তু সেই বিষকে এমন গ্লোরিফাই করে পরিবেশন করার মাধ্যম আমাদের ছিল কই? আজ আছে। তাই পসরা সাজিয়ে বসেছি। বোমাবারুদের। তাচ্ছিল্য করা, নোংরামি করা, সঙ্কীর্ণ অসভ্য ইঙ্গিত করা, অত্যন্ত নিম্নরুচির অবমাননাকর সব কিছুকে শিল্প নামে চালাতে চাইছি। নতুন নতুন নামের আড়ালে নিজেদের স্মার্ট প্রমাণ করার চেষ্টায় আছি। আদতে কি করছি? আদতে দুটোই ভাব মানুষের আছে, বিদ্বেষ আর সহিষ্ণুতা। বিদ্বেষকে আমি যে কোনো স্মার্ট নামের মোড়কেই ঢাকি, আদতে তা বিদ্বেষ। তা বিষ। আমাদের চারদিকে কোনো গুপ্ত সমিতি না, কোনো চোরাকারবারি না। খোলা বাজারে আমরা এই বিদ্বেষ আর অসহিষ্ণুতার কারবার শুরু করেছি। এর পরিণাম কি? সবাই তো জানি। সেখানেই আরো সমস্যা। তবু চুপ করে আছি।

162
Wed, 04/06/2022 - 13:30

 

 

 

 

 

 

তবে আনন্দ কি? সুখ? শান্তি?

 

কোনোটাই নয়। আনন্দ একটা শক্তি। উদ্যম। যার বিপরীতের শব্দ বিষাদ। আনন্দলাভ করার উপায়? কিছু নেই। আবার আছেও। যেমন ধরা যাক আমি দিল্লী যেতে চাই। আমি আছি কলকাতায়। আমি কিভাবে যাব? আমায় কলকাতা থেকে একটা একটা স্টেশান ছেড়ে ছেড়ে দিল্লীতে পৌঁছাতে হবে।

আনন্দও তেমন। আনন্দকে পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা সুখ। তার একটা ডিউরেশান পিরিয়ড আছে। আমার পানীয়ের সুখ, আমার চুম্বনের সুখ, আমার মিলনের সুখ, আমার ভ্রমণের সুখ, আমার নতুন আবাসনের সুখ, আমার নতুন যানের সুখ, নতুন পোশাকের সুখ, নতুন কাজের সুখ, নতুন সম্পর্কের সুখ ইত্যাদি সবের একটা ডিউরেশান আছে। অর্থাৎ এ সবেরই সুখ হিসাবে থাকার একটা আয়ু আছে। পুরোনো হলেই আবার মন উসখুস, আবার উচাটন। আবার নতুনের খোঁজ।

আনন্দ নতুনও না, পুরোনোও না। আনন্দকে পাওয়া যায় না। আনন্দতে পৌঁছাতে হয়। যেমন যে গান গাইছে, সে সা, রে, গা কে তৈরি করতে পারে না, শব্দবিজ্ঞান অনুযায়ী সে তৈরি হয়েই আছে। তাকে শুধু সেই তরঙ্গ অবধি নিজের কণ্ঠস্বরকে পৌঁছাতে হবে। কিভাবে? বাকি তরঙ্গকে একে একে বর্জন করে করে। তবে গিয়ে সঠিক সুরটায় গিয়ে পৌঁছানো যাবে। এও তেমন। আনন্দ হয়েই আছে। তাকে পেতে হবে। আনন্দ কিভাবে হয়েই আছে তাকে দেখার জন্য কোনো গুহায় সেঁধিয়ে বসার দরকার নেই। ঘোর কলি চলছে, ওতে আরো বিকার বাড়বে। তার চাইতে একটা শিশুর সঙ্গলাভ অনেক অনেক পুণ্যের। তখনই বোঝা যায় আনন্দের বিচ্ছুরণ কি স্বাভাবিক, কি সতেজ, কি নিঃশর্ত।

তবে আমি পাব কিভাবে? আমায় খুঁজে বার করতে হবে আমার আনন্দের আবরণ কিসে কিসে হচ্ছে? আনন্দ আমার স্বাভাবিক অবস্থা। আমার সহজাবস্থা। আমি যখন গভীর ঘুমে যাই, আমার বাড়িগাড়ি, টাকাপয়সা, সম্পর্ক ইত্যাদি সব ঘুমিয়ে পড়ে। এবং অবশ্যই তাদের জড়িয়ে যাবতীয় সমস্যার ইতি ক্ষণিকের জন্যে হলেও। আমি ঘুমের মধ্যে আমার আনন্দময় অবস্থায় স্থিতু হই। উঠে বলি, আহা, কি ফ্রেশ লাগছে। যদি এ ঘুম স্বাভাবিকভাবে না আসে তবে ওষুধের সাহায্যে নিজেকে নিস্তেজ করে ফেলি খানিক। ক্রমে চিন্তারা আমার থেকে দূরে যায়, আমি ঘুমে ডুবি। কিন্তু এ তো অস্বাভাবিক অবস্থা। স্বাভাবিক ঘুম থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে হলে জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়ে। ঘুম চাই, ভালো থাকার এ প্রথম অত্যাবশ্যক শর্ত। ঘুমই হল নিত্য বরাদ্দ স্বাভাবিক আনন্দের প্রশান্তসাগর।

আমায় খুঁজে বার করতে হবে আমার নিরানন্দের কারণ কি কি? দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার দৃষ্টিভঙ্গী। যে উপন্যাস আমার আনন্দের কারণ হতে পারে, সেই উপন্যাসই পরীক্ষার বিষয় হলে আমার পীড়নের কারণ হয়ে পড়ে। কারণ উপন্যাস তখন আর আমার কাছে উদ্দেশ্য নয়, উপায়। আমার ভালো মার্ক্স তোলার সিঁড়ি।

যে মানুষটাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করি, তাকে নিয়ে আমার মনে ভীষণ অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা। কারণ আমার তার উপর দখল চাই। সে সব সময় আমায় সময় দিক, আমার কথা ভাবুক, আমার ফোনের উত্তর দিক, অর্থাৎ সর্বক্ষণ সে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁচুক ইত্যাদি ইত্যাদি। আনন্দ গেল। কারণ আমি প্রেম চাইছি না, খাঁচা চাইছি। তাকে দখল করে আমার ভালোবাসার খাঁচায় ভরে রাখতে চাইছি। এতে হয় তো সিউডো নিরাপত্তার বোধের সুখ কিছুদিনের জন্য পাওয়া যায়। কিন্তু আনন্দ? কদাপি নয়।

এরকমভাবে ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে আমার আনন্দকে আমি নিজেই মাটি করছি নিজের ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে। আনন্দ মুক্ত উদার চিত্ত না হলে ধরা দেয় না। আমরা অন্তরের অন্তঃস্থলে সে কথা জানি। তাই আমরা ছুটি কাটাতে কেউ কেষ্টপুরের খাল দেখতে বা পানায় ভরা হাঁটুজলে নাইতে যাই না। আমরা পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল মরুভূমি খুঁজি। তাই খুঁজি যে আমায় আমার বানানো হাজার শর্ত থেকে মুক্তি দেবে। আমি আমার আনন্দকে আবার ফিরে পাব। সে বিশাল হবে, উদার হবে, গভীর হবে - তবেই আমার বেড়িয়ে আনন্দ। সে আনন্দ জন্মায় কি জঙ্গলে, জলে না পাহাড়ে? মনে। আমার সত্তার গভীরে। কারণ আমি কিছু দিনের জন্য সব ভুলব বলে গেছি। আমার এই চেষ্টাটাই আমার মধ্যের চিরকালীন আনন্দের প্রস্রবণটা খুলে দিয়েছি। আমি দু হাত ছড়িয়ে বলছি, "আহা, শান্তি, বাঁচা গেল।" কি আশ্চর্য না? যা যা জমিয়ে পাহাড় করে তুলে বাঁচার অর্থ খুঁজেছি, নিজের অহংকে নাইয়ে খাইয়ে বড় করেছি, এক এক সময় তার হাত থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে শান্তির রাস্তা খুঁজছি। সুখ আর শান্তির পার্থক্য বুঝতে পারছি।

অনেকে আনন্দের লোভে ঈশ্বরের থানে বাসা বেঁধে বসে। নিজের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের আনন্দেরও দফারফা করে বসে। যে আনন্দকে অনুভব করতে উদার, মুক্ত, নির্ভীক সতেজ চিত্ত দরকার হয়। সেই আনন্দের জন্যেই তারা ঠিক এর বিপরীতের অভ্যাস করে। সঙ্কীর্ণ, নানা কুসংস্কারবদ্ধ, ভীরু, দুর্বল চিত্তে মিনমিন করে বাঁচে। ভাবে খুব ভক্ত হচ্ছে। আর তা নইলে কি এক নেশায় হুঙ্কার দিয়ে পাড়া কাঁপায়, একে তাকে ভয় দেখিয়ে ফেরে। যার মনে যত বিকার তার তত বাঁধন, তত নিয়ম, তত কৌশল। সে যত ভয় পায় দেখায় তার দ্বিগুণ। এ নিয়ম।

এ সবের থেকে দূরে যদি থাকতে চাই, নিজেকে বাঁচাতে চাই, তবে নিজের ভালো থাকার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। যেমন কি কি খাবারে আমার শরীর বিগড়ায় সে সে খাবারকে বর্জন করে স্বাস্থ্যের আনন্দকে কায়েম করি, তেমনই যা যা আমার নিরানন্দের কারণ সেই সেইকে একেবারে বর্জন করে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। নইলে বিষাদের ছোবল একবার যদি নেশা ধরায় তবে ভালোভাবে বাঁচা সত্যিই দায়। এ দায় আমার হয়ে কোনো গুরু, কোনো ভগবান, কোনো দাদাদিদি নেবে না গো, এ দায় নিজেকেই নিতে হবে।

"আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ!

খুলে দেখ দ্বার অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।।"

 

(ছবি Debasish Bose)

 

163
Sun, 04/03/2022 - 11:30

নারদীয় ভক্তিসূত্র, গীতবিতান আর কথামৃত। কি মিল? সেখানে সব "তুমি" অথবা "তিনি"। রবীন্দ্রনাথ না হয় কবি। সাধক কবি। মরমীয়া কবি। কিন্তু রামকৃষ্ণদেব বললেই তো আপাতভাবে জানা যায় তিনি কালীর সাধক। তবে কই, কথামৃতের পাতায় পাতায় তো "কালী কালী" শব্দ নেই। একেবারে নেই তা নয়, তবে যা আছে তা অতি নগণ্য। আছে শুধু - 'তুমি, তিনি, তাঁকে'।

'তুমি' মানে অস্তিত্ব না, সম্পর্ক। কেমন করে হবে? হয় তো। মানুষের সব কিছুর সঙ্গে সম্পর্ক হয়। সাবান কেস, টুথব্রাশ, বালিশ, বিছানা, দেওয়ালের রঙ, ঘরের গন্ধ, ছাদের কার্ণিশ, ল্যাপটপ, মোবাইল, চিরুনি, জুতো-চটি সবের সঙ্গে একটা আত্মবোধ থাকে। আমার বোধ থাকে। টবের গাছ, বাগানের গাছ, পোষা বেড়াল, কুকুর এদের তো কথাই নেই। মানুষ সম্পর্ক ছাড়া বাঁচে না। পাড়া, জেলা, দেশ, ভাষা এসবের সঙ্গেও তো নিবিড়ভাবে আমার 'আমি' যুক্ত হয়। সেও সম্পর্ক।

তেমনই কথামৃতের 'তিনি', গীতবিতানের 'তুমি', নারদীয় ভক্তিসূত্রের 'তুমি' ও সম্পর্ক।

একি তত্ত্ব? না, অনুভব। অনুভবের পরিধি হয় না। সীমা হয় না। আকার হয় না। রূপ হয় না। অনুভবের শুধু অনুভব হয়। এ 'তুমি' সেই অনুভবের 'তুমি'। এ 'তুমি' আমার 'আমি'-র থেকে বড়। এও অনুভব। আমার আমি-কে তুমি-র নীচে রাখি না উপরে? সংসার বলবে, উপরে রাখো। অহংকার বলবে, সবার উপর আমি সত্য তাহার উপর নাই। কিন্তু সম্পর্কের টান বলবে, আমি নীচুতে বসি। তুমি উপরে বোসো। কেন? কারণ ওতেই আমার সুখ।

"তব পদতললীনা আমি বাজাব স্বর্ণবীণা / বরণ করিয়া লব তোমারে মম মানসসাথী"। তুমি-র নীচে আমি-র বাস। তুমি মাধুর্যময়। তোমার মাধুরী চুঁইয়ে চুঁইয়ে আমায় ঘিরে থাকছে। আমায় স্নিগ্ধ করছে। আমার আমি জুড়ে যত ক্ষোভ, তাপ সব শান্ত হচ্ছে। শান্ত হবে কখন? যখন তুমি থাকবে আমার আমি-র উপরে।

তুমি জন্মায় কোথায়? আকাশে? ওই উপরে? না। তুমি জন্মায় আমি-র বুকে। সেই তুমি বীজ। ক্রমে সে তুমি অঙ্কুরিত হয়। সবুজ দুটো পাতা জন্মায়। সে মাধুর্য আর আনন্দ। অচেনা গন্ধ। অচেনা সুখ। অচেনা স্বস্তি। ক্রমে সে ডালপালা মেলে আমি-কে আড়াল করে দাঁড়ায়। এখানে উপনিষদের সেই গল্প জন্মায়। এক গাছে দুই পাখি। এক পাখি উপরের ডালে বসে। স্থির, শান্ত। আরেক পাখি নীচের ডালে বসে। চঞ্চল। সে এক-একবার মিঠে ফল খায়। নেচে ওঠে। উপরে তাকায়। আবার টক ফল খায়, যন্ত্রণা পায়। উপরে তাকায়। সে উপরের পাখি স্থির বসে। স্নিগ্ধ, সৌম্য, প্রসন্ন। ক্রমে নীচের পাখি ধীরে ধীরে উপরের পাখির কাছে আসে। শান্ত হয়। তৃপ্ত হয়।

এও আমি আর তুমি-র গল্প। দুই পাখি। আমি আর তুমি। 'তুমি' পাখিটাই তো গীতবিতান, কথামৃত। তত্ত্ব কে চায়? মানুষ চায় অনুভব। অনুভবের গভীরে জাগা এক অনির্বচনীয় অনুভব আছে, যাকে বলে 'চেতনা'। যে সব অনুভবকে ধারণ করে। তাই অনুভব হঠাৎ নিজেকে যখন জিজ্ঞাসা করে, কে আমি? তখন পুবাকাশ লাল হয়। তার গভীরে বেজে ওঠে সুর। 'আমি'র বুকে বীজ বপন 'তুমি'র। তত্ত্ব না, সংজ্ঞা না। অনুভব। অনুভবের প্রশ্নে জাগা চেতনা। অনুভবের আত্মানুসন্ধানকে বলে অভিসার। বাঁশি বাজে। নূপুরে কান্না জাগে। কে বলে, আসছি? কে বলে ওঠে? এসো.. আমি তো তোমার জন্যেই জেগে আছি।

গোটা সংসার এই আমি-তে তুমি-তে জড়িয়ে। আমি-র বুকে ঘুমানো তুমি-তে জাগে ছোটো সংসার। তুমি-র বুকে খেলে বেড়ানো আমি-তে জাগে বিশ্বসংসার। দুই সত্য। একটা অখণ্ড সত্য, একটা খণ্ড। শান্তি চাও, তো বুকে তুমি-কে জাগাও। গীতবিতান বলল। আনন্দ চাও তো আমি-র প্রদীপে তুমি-র শিখা জ্বালো। কথামৃত বলল। প্রেম চাও? তো নিজের সুখে ছাই দিয়ে তুমির সুখের সুখী হও। ভক্তিসূত্র বলল।

আসলে সবাই সম্পর্কের কথা বলল। পুবাকাশের সঙ্গে সূর্যের যে সম্পর্ক, সেই সম্পর্কের কথা বলল। মনে করালো, অন্ধকারের পারে আলোতে যাওয়ার কথা, নিরানন্দের পারে আনন্দে যাওয়ার কথা। মন্ত্র দিল একটাই - তুমি বা তিনি। তাকে জাগাও।

 

164
Wed, 03/30/2022 - 13:00

 

মতুয়া শব্দটা আমি প্রথম শুনি ‘শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত’ তে। মতুয়ার বুদ্ধি - রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়। সে মতুয়ার বুদ্ধি মানে কি? নিজের মত সম্বন্ধে অন্ধবিশ্বাস। অবশ্যই রামকৃষ্ণদেব যতবার মতুয়া শব্দটা উচ্চারণ করছেন, ততবারই নিন্দাত্মক ভাবেই উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে আমার ধারণা জন্মেছিল খুব সঙ্কীর্ণ অন্ধবিশ্বাসী কোনো সম্প্রদায়ের কথা রামকৃষ্ণদেব নিশ্চয় বলছেন।

 

এরপর গত কয়েক বছর ধরে শুরু হল রাজনৈতিক মহলে মতুয়াদের নিয়ে চর্চা। আগ্রহ বাড়ল। হঠাৎ মতুয়ারা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? পড়তে গিয়ে বিস্মিত হলাম। যা জানতাম তা সম্পূর্ণ ভুল।

আমাদের অধ্যাত্মিক জগত যতই সমস্ত ব্রহ্মময়ত্বের কথা বলুক, আসলে আমাদের ধর্মে, বিশেষ করে হিন্দুধর্মে বর্ণবিভেদের বিষ কতটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজে ঢুকে আছে, সে নিজের ‘কম্ফোর্ট জোন’ এর বাইরে না গেলে অনুভব করা সম্ভব নয়। অনুমান অভিজ্ঞতা নির্ভর। অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গেলে কিছু করতে হবে। না করতে চাইলে বর্ণ বিভেদের তথা কথিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, সুফল ইত্যাদির উপর সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রবন্ধ লিখে আত্মতুষ্টির রাস্তা সব সময় খোলাই আছে।

কোনো কিছুই শূন্য থেকে জন্মায় না। ধর্মও না। মানুষ সত্যকে দিনের আলোর মত করে পায় না। আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনের মত করে পায়। মানুষ সত্যকে পায় না, অর্জন করতে হয়। তাই মানুষের সমস্ত কল্পনা, আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা, সুখ, দুঃখ, স্বপ্ন, ভয় ইত্যাদিকে সত্য করে ধর্মের উদ্ভব হয়। ঈশ্বর সত্য কিনা সে নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরকে খোঁজার জন্য মানুষের মধ্যে যে অসহায়ত্বের বোধ, সে নিয়ে তর্ক চলে না। সে সত্য। বাস্তব।

আধুনিক ভারতে নতুন করে যখন নবজাগরণ হল, নতুন করে ধর্মের সংজ্ঞা খোঁজার চেষ্টা হল বেদ উপনিষদ ঘেঁটে, নতুন অবতারবাদের সূচনা হল, তখন আমরা খেয়াল করলাম না সমাজের একটা বড় অংশ এই তত্ত্ব থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেদিন তাতে আমাদের কিছু যায় আসেনি, কারণ তারা চিরটাকালই বাদের খাতাতেই থাকত। তাই নতুন করে কিছু আমাদের অনুভবে আসেনি। সেই কিছুটা অজ্ঞাতে আর সজ্ঞানে উপেক্ষাই জন্ম দিয়েছে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ ঠাকুরের, আম্বেদকরের, জ্যোতিরাও ফুলের। তাই আশ্চর্য লাগলেও যে রামকৃষ্ণের কথায় ‘মতুয়া’ শব্দটা উঠে আসছে, সেখানে বিবেকানন্দের লেখায়, ভাষণে ‘শূদ্রজাগরণ’ ইত্যাদি কথা এলেও, একবারও হরিচাঁদের উল্লেখ সসম্ভ্রমে আসছে না। না তো রবীন্দ্রনাথের কোনো লেখায়। অন্তত আমি পড়িনি। আমাদের ইতিহাসেও এই নামটা কি সচেতনভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে, যে সমাজসংস্কারকদের নাম উচ্চারণের সময় রামমোহন রায়, বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর প্রমুখের নামের সঙ্গে সঙ্গে একবারটিও হরিচাঁদ ঠাকুরের নাম উচ্চারিত হয় না। অথচ যে মানুষটা বাল্য বিবাহ রোধের প্রচার করছেন, শিক্ষা বিস্তারের কথা বলছেন, নারী পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলছেন, জাতপাতের বিরুদ্ধে বলছেন, দীক্ষা-তীর্থভ্রমণ নানা বাহ্যিক আচারসর্বস্ব ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বলছেন, যিনি সহজ শিক্ষা দিচ্ছেন, “জীবে দয়া, নামে রুচি আর মানুষে নিষ্ঠা/ ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা”। কথা হল, “হাতে কাম, মুখে নাম”।

হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্ম ১৮১২ সালের ১১ই মার্চ আধুনিক বাংলাদেশে, মৃত্যু ১৮৭৮ সালের ৫ই মার্চ। জন্ম বৈষ্ণব পরিবারে। হরিচাঁদের মধ্যে মহাপ্রভু প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মের মানবতাবাদ ঢুকল, কিন্তু ততদিনে বৈষ্ণব ধর্মে যে সঙ্কীর্ণ শুচিবাইতা, আচারসর্বস্বতা ঢুকে পড়েছে, সেটাকে তিনি বাদ দিলেন। জোর দিলেন শিক্ষা, চরিত্র গঠনে আর সরল মনে দীক্ষানুগামী না হয়ে ‘হরিবোল, নামকে সর্বস্ব করে মেতে থাকতে। যদিও সে শিক্ষা পেতে নাভিশ্বাস উঠেছিল সেদিনের সমাজে নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষের। কে দেবে তাদের বিদ্যালয়ে, টোলে জায়গা? সে নিয়ে পরবর্তীকালে বড়সড় আন্দোলন হয়েছিল গুরুচাঁদের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু সে অন্য ইতিহাস।

হরিচাঁদের শিক্ষায় চরিত্র গঠন মানে কি? “পবিত্রতা, সত্যবাক্য, মানুষের বিশ্বাস/ তিন রত্ন যার আছে হরি তার বশ”। আরো আছে, “যত যত তীর্থ আছে অবনী পরে/ সত্যবাক্য সমকক্ষ হইতে না পারে”।

ঠাকুর তবে কে? “যে যাহারে ভক্তি করে সেই তার ঈশ্বর।”...”যে যাহারে উদ্ধার করে, সেই তার ঈশ্বর”। শেষের কথাটা ভেবে দেখলে বোঝা যাবে কেন মহারাষ্ট্রে বুদ্ধের জায়গায় ক্রমে আম্বেদকর প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যে অত্যাচারিত হয় সেই জানে “উদ্ধার” শব্দটা মানে কি। যে অত্যাচার করে, সে জানবে কি করে? সে নিজেকে নিজের অধিকারকে চরিতার্থ করেছে এই জানে।

 

হরিচাঁদ ঠাকুরের দ্বাদশ আজ্ঞা ছিল।

১. সদা সত্য কথা বলবে;

২. পিতা-মাতাকে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করবে;

৩. নারীকে মাতৃজ্ঞান করবে;

৪. জগৎকে ভালোবাসবে;

৫. সকল ধর্মের প্রতি উদার থাকবে;

৬. জাতিভেদ করবে না;

৭. হরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করবে;

৮. প্রত্যহ প্রার্থনা করবে;

৯. ঈশ্বরে আত্মদান করবে;

১০. বহিরঙ্গে সাধু সাজবে না;

১১. ষড়রিপু বশে রাখবে এবং

১২. হাতে কাম ও মুখে নাম করবে।।

 

মজার কথা হল এই দ্বাদশ আজ্ঞার পঞ্চম আজ্ঞায় কোথাতেও বলা হচ্ছে না যে অন্য ধর্মকে অসম্মান করবে। তবে মতুয়া কেন ব্রাত্য হল তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ এর ধর্মে? কারণ হরিচাঁদ ঠাকুর বেদের অথোরিটিকে অস্বীকার করলেন, ব্রাহ্মণ্যবাদকে অস্বীকার করলেন। এতেই গোল বাধল।

তবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল কেন পরবর্তীকালে, মানে গুরুচাঁদের সময়ে। এখানে বুঝতে হবে, আম্বেদকরের আন্দোলনের ধারাকে। আম্বেদকর গান্ধী তথা গোটা স্বাধীনতা আন্দোলনকে উচ্চ সম্প্রদায়ের আন্দোলন হিসাবে দেখেছিলেন। গুরুচাঁদের মতও তাই ছিল। সমাজে তারা এতটাই ব্রাত্য, পীড়িত শোষিত ছিল যে বাইরের শত্রু আর ঘরের শত্রু আলাদা করার ক্ষমতা তাদের ছিল না। বরং মতুয়ার শিক্ষা বিস্তারে ইংরেজ মিশনারীরাই এগিয়ে এসেছিল এমন তথ্যও আছে। গুরুচাঁদের পর মতুয়ার মধ্যে ভাগ দেখা যায়, রাজনীতি, বঙ্গভঙ্গ ইত্যাদি নানাভাবে সে আন্দোলন বিভ্রান্ত হয়, এও সত্য। তবে দোষ শুধু যে সেদিকের ছিল তাই নয়, আমাদেরও কম ছিল না। আজও আমাদের আচরণ সে প্রমাণ দেয়। আমাদের এই উদাসীনতা। আমাদের এই ‘ভদ্রলোক’ এর মুখোশ, আমাদের সমাজের তলায় যে কি পচন ধরিয়ে চলেছে, সে হিসাব কে রাখে? তাদের ক্ষোভ, অপমানের হিসাবের কিছু খবর দেবেশ রায়ের সাহিত্য দিয়েছে, কিন্তু সেকি খুব যথেষ্ট? “নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার, অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার?” এই যদি অবতার বিচারের পরাকাষ্ঠা হয়ে থাকে তবে আধুনিক ভারতের অনেক অবতারই তাদের অবতারত্ব হারাবেন, যারা ভদ্রলোকের গণ্ডীর বাইরে পা না রেখে আধ্যাত্মিক নানা বিলাসিতায় দিন কাটিয়েছেন। যতই “যেথায় থাকে সবার অধম সবার অধীন” গানে বাজুক না কেন, সেই “সবার নীচে, সবার পিছে, সব হারাদের মাঝে” সত্য অর্থে দাঁড়িয়েছিলেন যে হরিচাঁদ ঠাকুর, আজ তাঁকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। ক্ষমা চাই। আরো অনেক অনেক কথা লেখা বাকি হয়ে থাকল। সে লেখা টুকরো টুকরো হয়ে আমার “গোঁসাই”তে ফুটে উঠুক, এই প্রার্থনা। আমাদের যুগ যুগ ধরে এত উপেক্ষা, অপমানের বিপরীতে আজ যে তাদের মাদল, কাঁসা, ডঙ্কা, শিঙা তীব্র স্বরে বেজে ওঠে, আজ যে মত্ততায় “হরিবোল” ধ্বনি বেজে ওঠে, মনে রাখতে হবে, সে ওদের মত করে প্রতিবাদের ভাষা। সে আমাদের ‘ভদ্রলোক’ এর কানে কর্কশ শোনালেও, তাদের আচরণ আমাদের মত ‘ভদ্রলোক’ এর চোখে ‘লাউড’ লাগলেও, সে সত্য। কিন্তু সে সত্যকে উপলব্ধি করতে গেলে তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। কৌতূহলী হয়ে নয়, আত্মীয় হয়ে।

165
Thu, 03/24/2022 - 19:30

চেতনা মানে ড্যাবডেবিয়ে খবরের কাগজ গেলা বা ব্রেকিং নিউজে হাবুডুবু খাওয়াই শুধু নয়। চেতনা মানে গুচ্ছের তথ্য মুখস্থ করে পরীক্ষা পাশ দেওয়াও নয়। চেতনা মানে জেগে থাকা, তাকিয়ে দেখা, কানে শোনা, চেখে দেখা, ছুঁয়ে বোঝাও শুধু নয়। চেতনা মানে অনুকম্পাও। চেতনা মানে সহমর্মিতাও।

আমার মর্ম যখন তোমার মর্মকে বুঝতে চায়, যে আলো গিয়ে তা সম্ভব করে সেও চেতনা। কার খিদে পেল, কে ব্যথা পেল, পাশের মানুষটার সুবিধা অসুবিধা বোঝাও চেতনা। সে চেতনা জাগার অনেক বাধা আছে। তার মধ্যে অহংকার যেমন, তেমনই আরেকটা হল হীনমন্যতা।

যে মানুষ সব সময় লো সেল্ফ এস্টিমে কষ্ট পায়, সে আর চারপাশে তাকাবে কি করে? সে শুধু 'আমি ঠিক আছি' এইটাই বোঝাতে চায়। এই 'বোঝাতে চায়', 'দেখাতে চায়' এইখানেই যত গোলমাল। মানে সে নিজে তা নয়, সবটাই ওই চাওয়াচাওয়ি।

লো সেল্ফ-এস্টিম তৈরি করতে পরিবেশ আর বাবা-মায়ের ভূমিকা অসামান্য। বিশেষ করে যে সব বাবা-মায়েরা নিজেদের অপরাজেয় পার্ফেক্ট মানুষ বিবেচনা করেন তাদের সন্তানদের এ দুর্গতি হয় সবচাইতে বেশি। যখন বাবা বা মা সবসময় সবকিছুতে নিজেকে প্রশ্নাতীতভাবে নির্ভুল ভাবতে শুরু করেছেন, তখন একই ছাদের তলায় বড় হওয়া আরেকটা প্রাণী ভিন্নমত পোষণ করলেই নিশ্চয়ই সে ভুল হবে। তাকে সেটা বুঝিয়েও দিতে হবে যে সে ভুল। কেন ভুল? যুক্তি একটাই, কারণ 'আমি' কখনও ভুল হতেই পারি না! এটা সবসময় মনে রাখবে, বাবা কখনও ভুল হন না। মা কখনও ভুল হন না।

আমি এমন বাবাও দেখেছি যিনি নিজেকে ঈশ্বরের অবতার দাবী করেন। বাবা ঈশ্বর হলে বাড়ির বাকিরা তো অনীশ্বর হতে বাধ্য। এক বাড়িতে ক'টা ঈশ্বর থাকবে! অতএব তিনি যা বলেন তাই ধ্রুবসত্য জেনে বাড়ির সবাই শিরোধার্য করেন। এই পরিবেশে সন্তান বড় হতে হতে অনুভব করে তার বিচার, যুক্তি, ইচ্ছা, অনুভব, বিশ্বাস সব ভুল। বাবা-ই ঠিক। অতএব অন্ধভাবে বাবা যা বলে চলেছেন তা-ই চালিয়ে যাও। বাবাও চালাক মানুষ। ছেলের দুর্বলতার খোঁজ রাখেন। ছেলের দুর্বলতাকেগুলোকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে নিজের অবতারত্ব কায়েমি রাখেন। পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বারবার বলেন, ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে একি ছেলেখেলা করছেন! বাবা নিশ্চিন্ত মনে বলেন, ও সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুই ঠিক হয় না। ছেলে মেরুদণ্ডহীন নেশাখোর তৈরি হয়। বাবা টাকা জুগিয়ে যান। ছেলের বাবার প্রতি অন্ধভক্তি। ছেলের সংসার হয়। ভেঙে যায়। একদিন ছেলেও কালের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।

এই সব বাবাদের কোনো শাস্তি হয় না। যারা দিনের পর দিন নিজের সন্তানদের উপর এইরকম অস্বাভাবিক এক্সপেরিমেন্ট করেন, নিজের অস্বাস্থ্যকর মানসিকতার শিকার তৈরি করেন, তাদের নিতান্তই দুর্ভাগা ছাড়া আর কি-ই বা বলা যায়!

এই লো সেল্ফ-এস্টিম তৈরির আরো কারণ থাকতে পারে। বারবার টিজ করা শিক্ষক, প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনেরাও হতে পারে। সবার মানসিক গঠন সমান হয় না। কেউ কেউ অতিরিক্ত সংবেদনশীল হয়। ক্ষতিটা তাদের উপর হয় দীর্ঘস্থায়ী।

এখন এই লো সেল্ফ-এস্টিমকে দূর করার উপায় কি?

প্রথম কথা, অন্যায্য, অযৌক্তিক, অবাস্তব অপরাধবোধ থেকে মুক্ত করা।

এর জন্যে একজন বন্ধুস্থানীয় মানুষের সাহচর্য খুব কাজের। সে বিচার করবে না, তিরস্কার করবে না। সে শুনবে। যে কোনো অবাস্তব, অযৌক্তিক, অন্যায্য অপরাধবোধের সঙ্গে একটা ধোঁয়াশা ভাব থাকেই। কনফিউশান থাকেই। সেই কনফিউশানটাই তার মনোজগতে প্রবেশের পথ। তার কাছে আসার উপায়। তাকে বিশ্বাস করাতে হবে সে এমন কিছু করেনি যা অস্বাভাবিক। যদিও তাকে তা বিশ্বাস করতে শেখানো হয়েছে ভীষণ চতুরতার সঙ্গে।

দ্বিতীয়ত, তার পজিটিভ দিকগুলো খুঁজে বার করা। এ ক্ষেত্রেও একজন সহানুভূতিশীল মানুষের বন্ধুত্ব বিশেষ কার্যকরী। মানুষের সদগুণ খুঁজে বার করতে চাওয়া আর চোখে পড়ার মধ্যে পার্থক্য আছে। অন্যের দোষ যত সহজে চোখে পড়ে, না চাইলেও দেখা যায়, অন্যের গুণ অত সহজে চোখে পড়তেই চায় না। নিজের গুণাবলীর প্রতি এমন মোহ আমাদের।

তাই এমন মানুষের সঙ্গ দরকার, যার চোখে সহজেই তার গুণগুলো চোখে পড়ে। যে তার গুণ আতসকাঁচ লাগিয়ে খুঁজে বেড়ায় না। আর সহজে চোখ পড়ে বলেই সে মানুষটার বিশ্বাসও জন্মায় সহজেই। সে জানে এ বানানো নয়, এ স্বাভাবিকভাবেই তার মধ্যের ভালো দিকগুলোকে জানে। একজন কবির কথা মনে পড়ল, তিনি বলতেন, তুমি ভালো বলে তোমার কাছে আসতে ইচ্ছা করে তা নয়, তোমার কাছে এলে আমার নিজেকে ভালো মনে হয় বলেই আসি। এ বন্ধুত্ব মহার্ঘ্য।

তৃতীয়ত, তাকে অবাস্তব, অযৌক্তিক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত করা। অন্যভাবে বলতে গেলে তাকে নানা কুসংস্কার বা মিথ থেকে বাঁচানো। যেমন ভালো হতে গেলে এরকম চাকরি করতে হয়, ঈশ্বরে ভক্তিপরায়ণ হতে হয়, বাবা-মায়ের প্রতি অন্ধ শ্রদ্ধালু হতে হয়, এই এই জিনিসে রুচি থাকতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা নিজেদের যারা খুব বিবেকবান, দায়িত্ববান, পড়াশোনা জানা শিক্ষিত নাগরিক মনে করি আমাদের নিজেদের দিকে তাকালেও দেখব আমাদের মধ্যে নানা মিথে ভরপুর। এগুলোতে নাকি আমাদের ভালো হয়। এ মোহ। এ মিথের মোহ। মিথ আর কুসংস্কারের মধ্যে পার্থক্য হল, মিথের পিছনে একটা দীর্ঘদিন লালিত সামাজিক অপযুক্তির গল্প থাকে। কুসংস্কারে সেটা প্রবল নয়। ভয়টাই প্রবল।

সে মানুষটা যাই হোক না কেন, আস্তিক, নাস্তিক, বামপন্থী, ডানপন্থী, সমকামী, অসমকামী, উভকামী, আবেগপ্রবণ, যুক্তিবাদী যাই হোক না কেন, তাকে নিজেকে স্বীকার করে নেওয়ার উৎসাহটা বন্ধু হয়েই তাকে যোগাতে হবে। তাকে এইভাবেই তার কল্পনার, তার মনগড়া জগতের হাত থেকে সরিয়ে বাস্তবে আনতে হবে। অজ্ঞান থেকে বিজ্ঞানে আনতে হবে।

এইভাবে তার লো সেল্ফ-এস্টিম দূর হবে ধীরে ধীরে। নিজের বোধে নিজে স্বাভাবিক, স্বাধীন গতিমান হবে। তখন তাকে আর বলতে হবে না তুমি চেতনাস্থ হও। সে আপনিই হবে। তার অন্তরাত্মাই তাকে সহমর্মিতার বোধের শিক্ষা দেবে। তার চেতনা আপনিই তখন নানা প্রশ্নে কৌতুহলে নিজেকে বিকশিত করবে। সে সম্পূর্ণ হয়ে উঠবে ধীরে ধীরে।

166
Tue, 03/22/2022 - 11:00

সম্রাট অশোক, শিবাজী থেকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কেউ বেঁচে নেই জেনে সজনীকান্ত ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। কেউ থামাতে পারে না। বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান কে না এলো। কিন্তু সজনীকান্ত কখনও হাউমাউ করে, কখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে।

আসলে সজনীকান্ত ছাত্র হিসাবে ভীষণ মেধাবী ছিল। বাড়ির লোকের চাপে সে মেধার সংক্রমণ এত দ্রুত ছড়াতে শুরু করেছিল যে সামনে যাই পেত অমনি বুঝে মুখস্থ করে একশা করত। অগত্যা তার বাবা মা তাকে একটা বড় লাইব্রেরীর আজীবন সদস্য করে দিয়ে ক্ষান্ত হল না শুধু, চব্বিশঘন্টা বারোমাস লাইব্রেরিতে থাকার অনুমতিপত্রও বার করে এনেছিল।

তো সজনীকান্ত সেই যে কিশোর বয়সে লাইব্রেরি ঢুকেছিল, এই বেরোলো প্রায় যৌবন শেষ করে। বেরিয়েই শোনে জগতে এত বড় বড় পরিবর্তন হয়ে গেছে। এতবড় ধাক্কা, তার একটা প্রতিক্রিয়া হবে না?

তো যা হোক। তাকে আবার পাঁজাকোলা করে সবাই লাইব্রেরিতে দিয়ে এলো। কারণ সে হাঁটতে পারে না। পায়ের বুড়ো আঙুল অবধি মেধা টনটন করে এমন তীব্র সংক্রমণ।

লোকে বলে একবার নাকি কোনো রমণী লাইব্রেরিতে ভুল করে ঢুকে পড়েছিল। চোখে পড়ে সজনীকান্তকে। সজনীকান্ত চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়েই বলেছিল, তোমায় দেখে প্রকৃতি আমার শরীরে যে বিকার উৎপন্ন করেছে, সে নিতান্তই ছলনা, তুমি যাও, মেধাহীনের প্রবেশ আমার হৃদয়ে নেই। সেখানে জ্ঞানের প্রদীপ জ্বলে জ্বলে এমন কালি পড়েছে যে কোমল অনুভব নিয়ে ছেলেখেলা করা সময় আমার নাই। সে কালি আমার গর্ব। আদিরসের কালিমায় আমি লিপ্ত হতে চাই না, চাই না, চাই না।

সজনীকান্তের সে চীৎকারে লাইব্রেরির দেওয়ালগুলো এমন কেঁপে উঠেছিল যে প্রায় চিড় ধরার জোগাড়। যা হোক রমণী কোনো ক্রমে অজ্ঞান হতে হতে নিজেকে সামলে বার করে এনেছিল এই রক্ষে।

সজনীকান্ত লাইব্রেরিতে বসে। সবাই দূর থেকে দেখেছে সে কি করে। আবার কাঁদে কিনা। নাহ্, কান্নাকাটি নেই আর। এইবার? কি করবে?

দেখতে দেখতে সজনীকান্ত একটা বলের মত কুঁকড়ে গোল হয়ে গেল। হাত পা সব এমন হল, যে হাজারটা হাত পা। না না, যেন বড় কাঁকড়া একটা। মেধা সবটা খেয়েছে, একজন বলল ফিসফিস করে। গোল বলটা লাইব্রেরির এই তাক, সেই তাক ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে বলল, একটা খাব, দুটো খাব, সব ব্যাটাকে চিবিয়ে খাব... দুনিয়া জুড়ে তাক লাগাব.... কিন্তু দুনিয়া জুড়ে মূর্খের দল... কাকেই বা মেধার খেল দেখাবো.... অমনি সজনীকান্ত গানের পদ বদলে নিল, একটা খাব, দুটো খাব সব ব্যাটাকে চিবিয়ে খাব... মূর্খ দুনিয়াকে পায়ের তলায় পিষে দেব...

সবাই ভয়ে পালালো। কিন্তু পালালে কি হবে, সবাই নাকি তারপর থেকেই মাঝে মাঝেই স্বপ্ন দেখে একটা হাজার হাত পা, মুখওয়ালা গোল বলের মত মেধা সারাটা জগত পায়ে পিষে দিচ্ছে, চিবিয়ে খাচ্ছে। রস গড়িয়ে সমুদ্র হচ্ছে। আর সেই সমুদ্রে আকাশের নীল আর বনের সবুজ মিশে কালো হয়ে যাচ্ছে। পাখির ডাকের মত ডাক ছেড়ে আকাশের নীল আর বনের সবুজ বলতে বলতে মিলিয়ে যাচ্ছে, বাঁচাও... বাঁচাও... বাঁচাও..

কিন্তু কে কাকে বাঁচাবে। সবার একটু একটু লোভ হচ্ছে তো মেধা পাওয়ার। সেই নিয়ে কি কালোবাজারিই না শুরু হয়েছে। কিন্তু কে ঠেকাবে বলো? তাই কালোবাজারি মেধা আর সাদাবাজারি মেধাকে আলাদা করতে না পেরে সব মিশিয়ে একটা নতুন মেধা বাজারে ছাড়া হয়েছে - স্মার্টবাজারি মেধা। সবাই বলছে সারাটা জগত নাকি সে-ই চালায় এখন।

167
Thu, 03/17/2022 - 22:30

'অখণ্ডতা' আর 'সততা'র মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি? রামকৃষ্ণদেব যখন বলছেন, টেলিগ্রাফের তারে ফুটো থাকলে খবর যায় না, তখন বলতে চাইছেন তো এই অখণ্ড অনুভবের কথাই?

নিজের মধ্যে এই অখণ্ড অনুভব আমাদের কতক্ষণ স্থায়ী হয়? আমরা যাই করি না কেন, যে কাজের সঙ্গেই যুক্ত থাকি না কেন, সুখ মানে আদতে তো এই অখণ্ড অনুভব।

প্রশ্নটা কি অধ্যাত্মিক, না দার্শনিক? আসলে কোনোটাই নয়। প্রশ্নটা আত্মিক। আমরা এমন একটা মুহূর্ত বাঁচতে সবাই চাই যে মুহুর্তটাতে আমার এই ছড়ানো-ছেটানো 'আমি'টা এক হয়ে একটা অখণ্ড সত্তা হবে। আমি ডুবে যাব। আমি পূর্ণ হব। সেই ক্ষণটায় পৌঁছাতে চাই বলে সারাদিন কত না কত আঘাত, যন্ত্রণা, কষ্টকে মেনে নিই। প্রাণের গভীরে বিশ্বাস তো অবশ্যই করি এত বড় জীবনটা ফাঁকি কিছুতেই নয়। যা চাইছি নিশ্চয়ই তা পাব। কিন্তু কিভাবে?

শুরুতেই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না আসলে কি চাইছি? কি পেলে নিজেকে সার্থক মনে হবে? জীবনে সফল তো ছোটো-বড় অনেক কিছুতেই হয়েছি, সেই নিয়ে সেলিব্রেশানও হয়েছে। তবু কি প্রাণের গভীরে সে আশটা মিটেছে? না মেটেনি। প্রাণের গভীরে নিজেকে পূর্ণ করে পাওয়ার সাধ সে তো অধরাই থেকে গেছে। নিজেকে অখণ্ডভাবে অনুভবের তাগিদ, সে বারবার ডেকে যাচ্ছে। সে ডাকের অনুভবকে কি নামে চিনি? ভালোবাসা।

মানুষ ভালোবাসা পেতে পেতে সেই অখণ্ড অনুভবে গিয়ে পৌঁছায়? না, ভালোবাসতে বাসতে?

উত্তরটা সবাই জানি। কিন্তু ঝড়ের গতিতে ছুটি বলে স্বীকার করি না। ভাবি গতির ঘোরে সত্যের দাবীটা চাপা পড়ে যাবে। যায় না। গতি কমে আসে। ক্লান্তি লাগে। অবিশ্বাস জন্মায়। সিনিক হই। ঈর্ষায় দগ্ধ হই। আরো নানা বিকারে মনটা বিষাক্ত হয়ে ওঠে এমন যে যেন নিজের হাত থেকেই নিজে পরিত্রাণের পথ খুঁজি। বাইরে ঈশ্বর বানাই, ক্লাব বানাই, হাজার একটা আয়োজন করে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। হয় না। সেও ব্যর্থ হয় অবশেষে। প্রাণে অখণ্ডতা জন্মায় না, জন্মায় শূন্যতা।

উপায় ভালোবাসা পাওয়া না, ভালোবাসার ক্ষমতা। ভালোবাসা মানে শুধু সুখ না। এও জানি আমরা। সুখ, দুঃখ, আঘাত --- সব ভালোবাসার দরজা দিয়ে আসে। সব আসবে না? সব না এলে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করব কিভাবে? অখণ্ড অনুভবে জন্মাব কিভাবে? সব চাই তাই। মনীষীরা তাই আমাদের দুঃখকে অসম্মানের বলেননি, অবাঞ্ছিত বলেননি, বলেছেন ক্ষুদ্রতাকে। ভালোবাসতে না পারার ভয়কে। আঘাতকে সহ্য করতে না পারার মানসিকতাকে। বলেছেন, এভাবে নিজেকে ব্যর্থ কোরো না। বুক চিতিয়ে ভালোবাসো। শুধু ভালোবাসার জন্যেই ভালোবাসো। আঘাত পাও। যন্ত্রণা পাও। সুখ পাও। কিন্তু কোনো পাওয়াটাকেই বিশেষ পাওয়া বলে আঁকড়ে ধরে বোসো না। স্রোত রুদ্ধ হবে। অখণ্ডের সাধনায় পড়বে ছেদ। গোঁজামিল জায়গা করে নেবে। মাঝরাস্তায় ছেদ পড়বে যে!

আমার গভীরে যে পূর্ণ হওয়ার তাগিদ, তাকে এই রাস্তাতেই সার্থক করে নিতে হয়। আর অন্য কোনো রাস্তা নেই, শর্টকাট নেই। একি আদৌ সহজ? কে বলল জীবন সহজ? জীবন কঠিন। ভীষণ কঠিন। তাই এত খাঁটি। এত সত্য। এত প্রাণবন্ত। সহজ বলে যদি কিছু থাকে, গতির ছন্দ, পথ নয়!

168
Tue, 03/08/2022 - 11:00

 

 

বাংলায় নারীশক্তি বললে প্রথমেই যার কথা মাথায় আসে আমার, তিনি হলেন মা কালী। কোনো আধ্যাত্মিক বা শাস্ত্রীয় বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছি না। একদম খাঁটি বিশুদ্ধ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছি। আমার বোধবুদ্ধির বয়েস হল বাম শাসনের যুগে। সে যুগেও দক্ষিণেশ্বরে পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, কালীপুজো, মায় পঁচিশে ডিসেম্বরেও যা ভিড় দেখেছি, আজও সেই। বাম এলো গেল, কিন্তু সমাজে বামের নিরীশ্বরবাদের দর্শনের কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি এত বছর ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চবিদ্যালয়ের সিলেবাস চালিয়েও কোনো পরিবর্তন সমাজে হয়নি।

তাই বলছিলাম, বাঙালী সমাজে কালীই হলেন সব চাইতে শক্তিশালী নারীশক্তি। দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠ এগুলো হাইপ্রোফাইল কেন্দ্র। তার সঙ্গে কঙ্কালীতলা, রামপ্রসাদের ভিটে, শ্যামনগরের কালীবাড়ি এসব তো আছেই।

এরপরে বাঙালি সমাজে সব চাইতে বড় উৎসবের কথা দেখা যায় যদি, সেখানে দুর্গাপুজো। তারপর বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসা এ সবের পুজো তো আছেই। বাঙালি সমাজে নারীশক্তির কাছে শিব, কৃষ্ণ গৌণ। রাম তেমন কল্কে পাননি কোনোদিন। যদিও বাঙালি সমাজে গোঁড়া বৈষ্ণব সম্প্রদায় আজও আছেন, তারা আবার কোনো নারীশক্তি মানেন না। তারা আসলে কিছুটা প্রাচীন সমাজের সূত্রধরে চলেন। আধুনিক বৈষ্ণবেরা, মানে যেমন ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, কি মহানামব্রত ব্রহ্মচারী - এনারা আবার শক্তির কথা বেশ মানেন। এদের সম্প্রদায়ে নারীশক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া আছে।

আবার শব্দের চক্করে গুলিয়ে যাওয়া সম্প্রদায়ও আছে। যেমন পুরুষোত্তম শব্দটা যখন উচ্চারিত হল, তখন এক সম্প্রদায়ের মানুষ ধরে নিলেন, পুরুষ মানে এখানে শুক্রাশয়, প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড, পুরুষাঙ্গধারী মানুষের ভাগটার কথা বলা হচ্ছে। ফলে তারা আবার নারীশক্তির দিকটাকে গৌণ করে দেখতে চান। পুরুষ মানে যে গীতায়, বা বেদান্ত দর্শনে একটা তত্ত্ব, সে বোঝানো তাদের দুঃসাধ্য।

বাঙালি সমাজে এরপর মা সারদা, আনন্দময়ী মা, মাদার টেরেসা --- এ সবও সেই এক নারীশক্তির কথাই। মানে বাঙালি সমাজ নারীশক্তি অনুগামী। অধ্যাত্মিক দিক থেকে।

কিন্তু মানুষের সমাজে বাঙালি নারীরা কি ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা কিছু উপকার পেয়েছেন এই দর্শনে? না। বাঙলায় মেয়েদের মধ্যে কিছুটা খোলা হাওয়া এনে দিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ। আসলে আমরা যতই আমাদের কালী, দুর্গা ইত্যাদির দোহাই দিয়ে বাঙালিদের নারীশক্তির প্রতি অনুরাগের কথা বোঝাই না কেন, আমার মনে হয় বাঙালি পুরুষতন্ত্র কোথাও নারীশক্তিকে নিজেদের বশে এনে নিজেদের নানা বাসনার চরিতার্থতার পথই খুঁজেছিল। বাঙালি যে কৃষ্ণকে আহ্বান করেছিল মহাপ্রভুর সাধনায় সেখানেও পরের দিকে রাধাভাব, গোপীভাব এসে বাঙালির নৈতিক দিকটা খুব একটা উৎসাহ দিতে পেরেছিল বলে এমন কোনো প্রমাণ দেখি না। আর বাঙলার পুরুষ সে অর্থে কোনোদিনই পুরুষ শক্তির কাছে নৈতিকভাবে মাথা নত করেনি। বাঙালি সমাজে শিবের চরিত্রও খুব সুবিধার না।

রবীন্দ্রনাথ এই দোষটা ধরেছিলেন। পিতার মধ্যে শাসন আর মাতার মধ্যে প্রশ্রয়ের বায়না, এ আমাদের সামাজিক বোধে আছে। তাই ডাকাতি করতে কি খুনোখুনি করতেও শক্তিসাধনায় আমাদের বিবেকে লাগেনি, বরং মান্যতা পেয়েছে। পিতা মানে শাসন, আর মাতা মানে প্রশ্রয়, এ আমাদের মজ্জায় মিশে যাওয়া বিশ্বাস। ব্যতিক্রম এসে দাঁড়ালো, যতক্ষণ না আমরা বিদ্যাসাগরের জননীকে নিয়ে আলোচনা করছি।

বাঙালি মাতৃচরিত্রের উজ্জ্বলতম মণি বিদ্যাসাগরের জননী। সত্যি বলতে আমার অল্প বিস্তর পড়াশোনায় আমি ওঁর থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সন্ধান আজও পাইনি। মানুষের সাহস তার পেশীতে না, তার বিবেচনাশক্তিতে। আমি স্তব্ধবাক হয়ে যাই ভগবতীদেবীর বিবেচনা শক্তিতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের সপক্ষে সূত্র হাজার একটা শাস্ত্রের মধ্যে পেলেও, সত্যকে পেয়েছিলেন মায়ের সম্মতিতেই। “একবার কাজ যখন শুরু করেছ, সমাজের কর্তাদের ভয়ে পিছিয়ে এসো না, উপায় একটা বেরোবেই”... “আমি প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করছি, এই জন্মদুঃখিনীদের যদি কোনো গতি করতে পারো, তা বাবা এখনই করো”।

আচ্ছা, এ কোন মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়? তিনি কি জানতেন না এ কাজে তার ছেলের জীবনসংশয় অবধি ঘটে যেতে পারে! পণ্ডিতসমাজ কি কম পিছনে লেগেছিল মানুষটার? তবু তিনি বলেছিলেন।

ভগবতীদেবী শিখাতেই জ্বলেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাল। যে মানুষ গয়না চান না, আড়ম্বরে পুজো চান না, গ্রামের ছেলেদের জন্য অবৈতনিক স্কুল চান, অন্নসত্র চান, গ্রামের সবার জন্য লেপ-কম্বল চান, তিনি কোন স্কুলে পড়েছিলেন? কোন ম্যানেজমেন্ট ক্লাস করেছিলেন? কোন মোটিভেশানাল কোর্স করেছিলেন? কোন গুরুর আশ্রমে গিয়ে দীক্ষা নিয়ে সাধন করেছিলেন?

এর সবক'টারই উত্তর তো, না। কিন্তু বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর ও ভগবতীদেবী ব্যতিক্রমই রয়ে গেলেন। প্রাতঃস্মরণীয় হলেন না। কারণ তারা কেউ অবতার নন। তাদের মধ্যে কোনো অধ্যাত্মিক শক্তি নেই। বাঙালি সমাজ নৈতিক শক্তি, মানবিক সম্পদ থেকে অধ্যাত্মসম্পদকে বেশি মানে। তিনি মনসা থেকে কালী হোন, তিনি নানা গুরু মা হোন, বাঙালি প্রশ্রয় চায়, সেবা চায়, আদর চায়, অভিমান চায়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের অনুগামী হতে চায় না। ভগবতীদেবীকে নিয়ে চর্চা চায় না।

সমাধি, কীর্তন, পুজো, সাধন, ভাবভক্তি, হাজার হাজার জ্যোতিষীতত্ত্ব - এ সবের অনেক উর্দ্ধে যে মনুষ্যত্বের ভিত্তিভূমি, সেদিকে কবে হাত বাড়াবো আমরা? যেদিন বাঙালির জননীর আদর্শ হবেন ভগবতীদেবী। যা পাঠে পুণ্যের ঝোলা ভর্তি হয় তো হবে না, কিন্তু পবিত্র হবে, সবল হবে চিত্ত। সমাজ দাঁড়ায় মানুষের শুভবুদ্ধির চর্চায়। সে শুভবুদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে, জপে-কীর্তনে কোনোদিন কেউ পায়নি। পেয়েছে সদিচ্ছার জোরে। শুভবুদ্ধি, নিঃস্বার্থবুদ্ধি নিয়ে ধর্মচর্চা আর আত্মপ্রশ্রয়ের ধর্মচর্চার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা ভগবতীদেবী জানতেন। বিদ্যাসাগর সেই শিক্ষাই পেয়েছিলেন মায়ের কাছে। আর রবীন্দ্রনাথ তাই বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে সেদিন ভগবতীদেবীকে স্মরণ করেছিলেন অত বিস্তারিতভাবে, আবেগে, গভীরতায়। আমারও প্রণাম আজকের নারীদিবস উদযাপনের দিনকে উপলক্ষ্য করে আবার ভগবতীদেবীর স্মৃতিকেই।

169
Fri, 03/04/2022 - 13:00

 

 

আজ ঠাকুরের জন্মতিথি। রামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি। আমি ঠাকুরকে নিয়ে কি লিখব? ঠাকুরকে নিয়ে লেখার যোগ্যতা কই আমার? অভিমানের পাহাড় যে সামনে। বিদ্যা বিনয় দেয়। কিন্তু সে কোন বিদ্যা? আদৌ কি বিনয় আছে? আদৌ কি নম্রতা আছে? নীচু জমিতেই জল জমে, ঠাকুর বলেন। জমি নীচু কি গো, হাজার একটা অভিমানে সে পাহাড়। যে মানুষটা বলে, আমি তোমার লোমের একগাছিও নই, সে মানুষের সম্বন্ধে পাণ্ডিত্য ফলিয়ে লাভ কি? রামকৃষ্ণদেব একটা অনুভব। সেকি তত্ত্ব? সে অনুভব ধারণ করব যে আমি কি প্রস্তুত করেছি নিজেকে? করিনি। হাজার একটা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অহংকারে আলাদা আলাদা খোপ বানিয়েছি হৃদয়ে। সেখানে মানের ফাঁদ পেতে বসে আছি। মান সম্মান চাই। খ্যাতি চাই। ধন চাই। আরো কত কি কি চাই। এ হৃদয়ে রামকৃষ্ণ চন্দ্র উঠবে? তৃণাদপি সুনীচেন…তরোরপি সহিষ্ণুনা…তৃণের থেকে দীন, গাছের থেকে সহনশীল? হয়েছি? হইনি। নিজেকে যোগ্য করিনি। সে মানুষের মুখ জুতো দিয়ে মাড়িয়ে গেল খাঞ্জাঞ্চি। সে চুপ করে সহ্য করল। সে নিজের মাথার চুল দিয়ে পায়খানা পরিষ্কার করে এলো অভিমান যাওয়ার জন্য, সমাজে যাকে নীচুজাত বলেছিল সেদিন, তার বাড়ি গিয়ে। গিরিশ হাত ধরে তুলে দিল। কখন? যখন মানুষটা খেতে বসেছে তখন। সদ্য দুটো লুচি মুখে দিয়েছে কি দেয়নি তখন। গিরিশ মাতাল তখন। ঠাকুরের সঙ্গে কথায় মিল হল না। হাত ধরে দিল তুলে। ঠাকুরের সাঙ্গপাঙ্গরা গেল রেগে। অপমান! ঠাকুরকে!

পরের দিন সকাল। ঠাকুরের ঘরে আলোচনা হচ্ছে। গিরিশকে শিক্ষা দিতে হবে। এমন মানুষকে অপমান! যাকে নিয়ে এত ক্ষোভ, এত উষ্মা, এত আলোচনা, সে চুপ। সবার কথা শুনছে। নিজে কিছু বলছে না। একবার অস্ফুটে বলেছে, কিন্তু মা যে বলেছেন অপমান হয় না!

হয় না তো। কিন্তু সে চেতনার আলো কই আমাদের? রাম এসে দাঁড়ালো। ঠাকুরের ভক্ত। ঠাকুর বললেন, বলো তো রাম, এরা যা বলছে তা কি ঠিক!

রাম হাসল। ঠাকুরের মন বুঝল। ঠাকুরের মন! সে তো হাতে নেওয়া যায় না, সে তো কোনো রঙে রাঙে না! সে মনে আবার অপমান! রাম বলল, কালিয়া যখন বিষ ঢালছিল কৃষ্ণের পায়ে, কালিয়াদমনের সময়, কালিয়াকে কৃষ্ণ বলেছিলেন, কালিয়া আমায় মানুষ কত ননী মাখন দেয়, তুমি বিষ দিচ্ছ? কালিয়া বলেছিল, প্রভু আপনি যা দিয়েছেন তাই তো দেব, অমৃত দিলে অমৃত দিতাম।

ঠাকুর হাসলেন। মনের কথা তো এই। চলো গিরিশের বাড়ি। এখনই চলো।

ওদিকে গিরিশের কি অবস্থা? নেশা ছুটে গেছে মাঝরাতে! কি করলাম আমি! যাকে জলজ্যান্ত ভগবান দেখি! ধুর ভগবান তো তুচ্ছ কথা, যাকে প্রাণের সব মাধুর্য দিয়ে বসে আছি, যে আমার প্রাণকে কানায় কানায় পূর্ণ করে দিয়েছে, যে আমার সমস্ত সত্তার মালিক, তাকে না খেতে দিয়ে তাড়িয়েছি! গিরিশ সারারাত পায়চারি করছেন!

সকাল হচ্ছে। গিরিশ সকালের আলোয় যেন মুখ দেখাতে পারছেন না। রাতের অন্ধকারে যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন, দিনের আলোয় তাই লজ্জা, চরম লজ্জা! ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে গিরিশ ভাবছেন, তবে এ জীবন রেখে লাভ কি! অমন সোনার মানুষকে অভুক্ত তাড়িয়ে দিয়ে বেঁচে থেকে লাভ কি! এ প্রাণ গঙ্গায় যাক।

এমন সময় দরজায় টোকা। "গিরিশ আমি এয়েচি, দরজা খোলো"।

গিরিশ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার রুদ্ধ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিশ্বেশ্বর! হায় হায়, এত করুণা! গিরিশ দরজা খুলে পায় পড়ল। বলল, আজ যদি তুমি না আসতে তবে জানতুম তুমি অনেক বড় সাধক হতে পারো… কিন্তু তুমি ভগবান নও!

ঠাকুর হাসলেন।

অহং তো কালিয়া। তার হাজার মাথা। একটা কাটলে আরেকটা জন্মায়। সারা শরীর জুড়ে বিষ। যেদিকে তাকায় সব বিষাক্ত দেখে। তাকে দমন করবে কে? যে নিজে অহং শূন্য। আমি শূন্য।

পাণ্ডিত্যের অভিমান, ধনমানের অভিমান, সাফল্যের অভিমান, সাধনার অভিমান, দীক্ষার অভিমান, মন্ত্রের অভিমান…এর কি শেষ আছে ঠাকুর! শেষ নেই। একের জাল ছাড়াই তো আরেক এসে ধরে। জানি কোথায় বাধছে। তবু ছাড়া যায় না। ওই যে, গানে আছে না? "যাহা রেখেছি তাহে কী সুখ, তাহে কেঁদে মরি, তাহে ভেবে মরি".... আরো আছে, "তবু যা ভাঙাচোরা ঘরেতে আছে পোরা, ফেলিয়া দিতে পারি না যে".... আরো আছে, "আমি জেনেশুনে তবু ভুলে আছি"।

যে বিদ্যায় নম্রতা আসে সে স্কুলে পড়িনি যে ঠাকুর। তাই তোমার পাঠশালায় এসেছি। এই পাঠশালাই আমার বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষিণেশ্বরের ছোটো একটু ঘর। অনেক লোক। বাইরে বসি। গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়া লাগুক গায়ে এসে। তোমার কথা ভেসে আসুক যুগান্তরের পার থেকে। মনের মধ্যে কালিয়ানাগকে পুষেছি দীর্ঘদিন হল। অভ্যাস হয়ে গেছে বিষাক্ত বাষ্পে শ্বাস নেওয়া। ছোবল মারা। ছোবলের আতঙ্কে বাস করা। তুমি তাকাও। তোমার কটাক্ষে আমি পুড়ি। আমি ছাই হই। আমি শূন্য হই। আমার সব যাক। তুমি ছুঁলে আমি চুম্বক। নইলে লোহা। তুমি ছুঁলে আমি বিষহীন কালিয়া, নইলে আমি বিষাক্ত। সংসার মান কেড়ে নিয়ে অপমান দেয়। তুমি মান হরে প্রেম দাও। আমি মনে মনে গাই, তুমি শোনো।

পিপাসা হায় নাহি মিটিল, নাহি মিটিল

   গরলরসপানে জরজরপরানে

       মিনতি করি হে করজোড়ে,

জুড়াও সংসারদাহ তব প্রেমের অমৃতে ॥

170
Sun, 02/27/2022 - 13:00

কে কখন কোথায় কিভাবে আত্মহত্যা করবে তার কোনো অ্যাপ্স বানানো যায়? মানে ধরুন কোউইনের মত। না, বানানো যায় না। তবে তো তার ব্যক্তিগত জীবনের গতিবিধির উপর চোখ রাখা হবে। সে কি সার্চ করছে, কি চ্যাট করছে, কি আঁকিবুঁকি কাটছে - এ সব তো ভীষণ ব্যক্তিগত, তাই না?

এই যে আজ আলুচাষীর আত্মহত্যার খবর আছে, এই যে এক বাচ্চা মেয়ের শ্লীলতাহানির পর আত্মহত্যার খবর আছে। এই যে লিখছে কাগজে, ভারতেই নাকি সারা বিশ্বের আত্মহত্যার পরিসংখ্যানের মোট ২০%, তবে?

পরীক্ষা ফেল, ব্যর্থ সম্পর্ক, ঋণ, রোগ, প্রিয় মানুষের মৃত্যু, আরো অনেক কারণ থাকে যা জানা যায় না, কিন্তু অবশেষে মানুষটা নিজে থেকে চলে যেতে চায়।

আমি প্রথম কবে আত্মহত্যার কথা শুনেছিলাম মনে নেই। কিন্তু জানি আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করতে মানুষ ভয় পায়। নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে সংশয় হয়। যেন কোথাও সব আত্মহত্যায় আমাদের সম্মতি থাকে, আমরা যেন বুঝি কেন সে চলে গেল। যেন মনে মনে বলি, ঠিকই করেছে, কি হবে বেঁচে। তাই হয় তো আমরা যারা মনোবিজ্ঞানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষ না, যারা মানুষের মনের শুশ্রূষা করাকে পেশা হিসাবে নিইনি, তারা মাঝে মাঝেই নিজের দুর্বলতার কাছে হেরে গিয়ে বলি, বেশ করেছে! মনে মনে বলি। মুখে বলি অন্য কথা। সে তো আমাদের কবেকার অভ্যাস। মনের কথা মুখে না আনার অভ্যাস। বরং বিপরীত কথা বলার অভ্যাস। আমাদের প্রকাশিত 'নকল মন' আর গুপ্ত 'আসল মন' এর মধ্যে কোনো সেতু থাকে না।

সে যত ভাগেই আমরা নিজেদের ভাগ করে রাখি না কেন, বাঁচতে যে একটা বিশ্বাস লাগে, এ কথা অস্বীকার করতে পারি না। বিশ্বাস একটা সদর্থক আবেগ। সেই আবেগে অনেক অন্ধকারকে অস্বীকার করা যায়। সেই আবেগে অনেক কঠিন বাধাকে অতিক্রম করা যায়। সম্পূর্ণ হতাশজনক অবস্থাতেও আশা রাখা যায়। মূলে এক আবেগ। বিশ্বাসের আবেগ।

যে মানুষটা শেষ ধাপটা বেছে নিচ্ছে, সেও এক বিশ্বাসেই বেছে নিচ্ছে, এই একমাত্র রাস্তা। হতাশার মধ্যেও এক বিশ্বাস আছে। শূন্যের উপর বিশ্বাস। অন্ধকার গহ্বরের উপর বিশ্বাস। নিজের অনস্তিত্বের উপর বিশ্বাস। বিশ্বাস ছাড়া মানুষ একটা শ্বাসও নিতে পারে না। কোনো কিছুকে বিশ্বাস করি না - এ কথাটা বলা মানুষটাও এক বিশ্বাসেই এ কথা বলে।     

তবে শূন্য হয় কেন সব? বিশ্বাস তো হারায় না দেখলামই। বিশ্বাসের সঙ্গে আরেকটা আবেগ আছে। আস্থা। আস্থা আর বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য হল, যে মানুষটা বিশ্বাস করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করছে, সে আদতে বিশ্বাস হারায়নি, হারিয়েছে আস্থা। আস্থা আর বিশ্বাস দুটো শব্দ বড় কাছাকাছি। পার্থক্যটা কি তবে? আস্থা হল ভালোবাসামাখা বিশ্বাস। বিশ্বাস সব সময়েই সদর্থক আবেগ। সে সদর্থ আবেগ মৃত্যুকেও সদর্থ ভাবাতে পারে। কিন্তু আস্থা পারে না। আস্থা মাধুর্য মাখা সদর্থ আবেগ। সে মৃত্যুকে বরণ করলেও সে হয় "মরণেরে করে চির জীবন নির্ভর", এই দর্শনে। সে প্রেমের মধ্যে লীন হতে চাওয়া, অনস্তিত্বের অন্ধকারে শূন্য হওয়া নয়।

ভারতীয় দর্শনে মায়া আর লীলা এই দুটো শব্দ আছে। একে অপরের পরিপূরক। সব যে ক্ষণস্থায়ী, এক অপ্রকাশিত সত্যের ছায়ামাত্র, এ মায়ার দর্শন। সেই ক্ষণস্থায়ী ছায়ার উপর যে মাধুর্যের রামধনু, সে লীলার দর্শন। দুইকে নিয়েই সত্য। বিশ্বাস মায়ার দিকে। আস্থা লীলার দিকে। মানুষের হাঁটতে লাগে বিশ্বাস, হাত ধরতে লাগে আস্থা। তাকাতে লাগে বিশ্বাস, দেখতে লাগে আস্থা।

মানুষ আস্থা হারালে ভ্রান্ত। ভ্রান্ত মন, ভ্রান্ত মতি, ভ্রান্ত বিচার, ভ্রান্ত ভাবনা, ভ্রান্ত দিগবিদিক। অনেকেই পারে দাঁতে দাঁত চিপে টিকে থাকতে। ধৈর্য ধরতে। চিত্তের স্থৈর্য না হারাবার ক্ষমতা অনেকের থাকে। কিন্তু কেউ কেউ পারে না। সে যে আর কোনোদিন আস্থা ফিরে পেতে পারে, এ ভাবনাই হারিয়ে যায় তখন।

মানুষের জীবনের ভিত্তিস্বরূপ আস্থা হল নিজের উপর আস্থা। নিজের উপর মাধুরী মাখানো ভালোবাসা। সে তার জন্মপ্রাপ্ত ধন। তার নিজের উপর নিজের মান। যাকেই বললাম আস্থা। আস্থার কার্যকরী দিক ভরসা। ভরসা জীবনকে গতিময় করে। গতি ফিরে এলে সব ফিরে আসে।

এই আস্থা কি অন্যের জীবনে চারিয়ে দেওয়া যায়? যায়। বৈষ্ণব শাস্ত্রে একটা কথা আছে, সাধুসঙ্গ। সঙ্গগুণ। সাধু - যার সঠিক অর্থ হল, যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখেন না, যিনি আস্থা রাখেন। যিনি আগামীদিনে ঈশ্বর তাকে স্বর্গে নিয়ে যাবেন এ বিশ্বাসে বাঁচেন না, যিনি প্রতি মুহূর্তকে আস্থার উপর রেখে নিজের জীবনের গতি নির্ধারণ করেন। তাই আস্থা মানুষকে সাধক বানায়, অন্বেষক বানায়। বিশ্বাস শুধুই অন্ধ বানায়, গোঁড়া বানায়।

বৈষ্ণব সাধক বলছেন, এ আস্থা তোমার মধ্যেও চারিত হবে। আমাদের বৈষ্ণব শাস্ত্র নিতে হবে না, এ তত্ত্বটুকুকে নিয়ে ভাবলেই হবে। অর্থাৎ একটা জীবনের আস্থা আরেক জীবনে চারিত হয়।

একবার ভারতের হ্যাপিনেস ইণ্ডেক্সে দেখা গিয়েছিল ভারতীয়দের মধ্যে সব চাইতে যেটার বেশি অভাব সেটা হল পারস্পরিক আস্থাবোধ। এ খুব বড় বিপদের কথা। মানুষ টাকাপয়সা, সুখে, সমৃদ্ধিতে বাঁচে না শুধু। মানুষ দারিদ্র, যুদ্ধ, ঝড়বন্যা, মহামারী সব কিছুর সঙ্গে লড়ে যায়, শুধু যদি তার চিত্তে অমৃতস্বরূপ এই আস্থাটা থাকে। তার অভাবে মানুষ বাঁচে কি করে?

'আগন্তুক' সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্র 'অন্ধজনে দেহ আলো' গানের পর বলছেন, কে দেবে আলো?

মানুষই দেবে আলো, যদি মানুষই আলো নিভিয়ে থাকে। সেল্ফ-পিটি বা আত্ম-দরদের বিষময় সাগরকে অহংকারের দাঁড়া দিয়ে মন্থন করে করে শিল্প-সাহিত্যের আঙিনা ভরালে পরবর্তী প্রজন্ম একদিন দুর্গন্ধে এ রাস্তা মাড়াবে না আর। একটা কবিতা মনে পড়ল,

 

Self Pity/ D H Lawrence

I never saw a wild thing

sorry for itself.

A small bird will drop frozen dead from a bough

without ever having felt sorry for itself.

 

আস্থাকে খুঁজতে হবে কি? একদম না। প্রত্যেকটা মানুষের ভিতরে আজীবন একটা শৈশব থেকে যায়। যে কুঁড়ি বাইরের আলো, বাতাসে চোখ মেলে সে শুধু বাইরের আলো বাতাসের ভরসাতেই চোখ মেলে না, তার ভরসার মূল জায়গা তার সবুজ বৃন্তটা। আমাদের বৃন্ত সেই আমাদের শৈশবের সারল্যমাখা মনটা। সে মরে যায় না, সে চাপা পড়ে থাকে। তাকে জাগালেই আস্থা আবার গুটি গুটি পায়ে পাশে এসে দাঁড়ায়। জগত জোড়া আবার খেলার মাঠ হয়। খেলা মানে তাচ্ছিল্য নয়, খেলা মানে হারজিৎ যাই হোক না কেন, আবার মাঠে ফেরার তাগিদ। সে তাগিদই আস্থা। নিজের মধ্যে সে আস্থাকে আমরা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি, অন্যের মধ্যে চারিয়ে যাবে তবে অজান্তেই। একটা জীবনকে আগলানোও আরেকটা জীবন দান করা। আরো প্রাণ আসুক, আরো প্রেম, আরো নামুক আমি। শান্তি আসুক জীবনে।

171
Mon, 02/21/2022 - 02:00


সবাই চায় তার জীবনে একজন সুপারম্যান আসুক, যে তার পাশে দাঁড়িয়ে তার সব সমস্যার সমাধান করে দেবে।

আমিও চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আসে না। না ঈশ্বর, না মানুষ। দিন যত যায়, নিজের সহ্যশক্তি বাড়তে থাকে খালি খালি। কি অনায়াসে সব সহ্য হতে শুরু করে। ক্রমশ নিজেকে সেই সুপারম্যানের মত লাগতে শুরু করে। অন্যের জীবনে সুপারম্যানের ভূমিকা নিতে ইচ্ছা করে, নিজের হাজার একটা খামতি জেনেও। শুধু অন্যের স্বপ্নটাকে সত্যি করার জন্য। নিজের রক্তক্ষরণ, নিজের স্নায়ু ছিঁড়ে যাওয়া যন্ত্রণাকে নিজেই শুশ্রূষা করে নিতে হয় তখন, নিঃশব্দে। কারণ কারোর কারোর জীবনে আমার উপস্থিতি সান্ত্বনা তখন, সে ভীষণ মিথ্যা হলেও।

একদিন সুপারম্যানের যাওয়ার সময় হয়। সে চলে গেলে তার দেহের খড় বিচুলি সব বেরিয়ে পড়ে। সবাই বলে, এ বাবা, এ তো আমাদের মতই সাধারণ মানুষ ছিল। হাজার একটা ভুলভ্রান্তিতে ভরা। তবে কি আমায় ঠকিয়েছিল?

না না, কোনো সুপারম্যানই ঠকায় না। সে শুধু নিজেকে মস্ত করে দেখায়, নিজের ভাঙা স্বপ্নের যন্ত্রণা, নিজের জীবনের হাজার একটা অভাবের পীড়া থেকে তোমায় আড়ালে রাখবে বলে। পৃথিবীতে সব আড়াল, সব সুরক্ষাই অবশেষে মিথ্যা হয়ে যায়। তবু তারা সত্যি যতক্ষণ না তারা পুরো মিথ্যা হয়।

আমি সংসারে এমন অনেক বাবা, মা, স্বামী, স্ত্রী, বন্ধু দেখেছি, যারা নিজেরা সুপারম্যানের ভূমিকায় অভিনয় করে কিছু মানুষকে শান্তিতে রাখতে চায়। তারা কেউ অভিনয় করে না, ঠকায় না। তাদের একটাই অপরাধ তারা দস্তুর মত ভালোবাসে। সেই ভালোবাসায় সত্যিকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্যি করে ফেলেও, সে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে কারোর কারোর স্বপ্নকে, আশ্বাসকে জীবিত রাখতে চায়। সে কপট নয়, সে শুধু বোকা নকল সুপারম্যান একটা।

আমিও হয়তো তাই করে যাচ্ছি। নিজের সমস্ত খামতি, সীমাবদ্ধতা, অপারগতাকে ঢেকে রেখে মহীরুহ হয়ে হাজার একটা ঝড়ঝাপটা থেকে কাউকে কাউকে বাঁচাতে চাইছি। সবটা মিথ্যা জেনেও সরে দাঁড়াতে পারছি না। নিজের ভালোবাসার কাছে কি তীব্র ভীষণ অসহায়ত্ব। বড় হওয়ার মান চাইছি যে তা নয়, বড় হওয়ার দায়িত্বটা চাইছি পালন করতে নিজের থেকে বেশি নিজেকে দিয়ে।

একদিন সব শেষ হবে। সবাই যখন বলবে, এই দেখো কি নগণ্য মানুষটা কি মহীরুহ সেজে আমাদের আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকার অভিনয়টা করেছিল। কি মিথ্যা, কি মিথ্যা। সেদিন আমার শূন্যতার নীরবতা লজ্জা পাবে। যে লজ্জাটা হয় তো তার অনেক আগে পাওয়ার কথা ছিল। সব মিথ্যা হবে সেদিন। সব খামতি ধরা পড়ে যাবে। শুধু একটা কথাই সত্যি হবে সেদিন, আমি ভালোবেসেছিলাম। দস্তুর মত ভালোবেসেছিলাম। আর কোনো যোগ্যতা ছিল না আমার।

172
Sun, 02/20/2022 - 16:00

মেয়েদের মত করে হাঁটিস না… মেয়েদের মত করে কথা বলিস না… মেয়েটার কেমন মদ্দা মদ্দা ভাব… ওরকম হিজড়েদের মত হাততালি দিস না…

এগুলো আমাদের সমাজের স্বীকৃত সতর্কীকরণ বাণী। রাস্তায় যেমন “ধীরে চালান, সামনে স্কুল”... ”ধীরে হর্ণ বাজান, সামনে হাস্পাতাল”... লেখা থাকে, এও তেমন। ফেসবুকে একজনের ভিডিও দেখছিলাম, তিনি একটা গানের স্কুলের বিজ্ঞাপন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, তার হোয়াটস অ্যাপ, ফোনে রাতবিরেতে যখন তখন কল, ভিডিও কল আসা শুরু হয়েছে, বন্ধুত্ব চাইছে, জেন্ডার আইডেণ্টিটি নিয়ে প্রশ্ন করছে। কারণ সে মানুষটার কথাবার্তা, সাজপোশাক তার চিরাচরিত ধারণা থেকে কিছুটা আলাদা।

এটা হয়। আমি পড়াতে গিয়ে দেখেছি, বহু ছেলেরা প্রশ্ন করে “ওদের কি থাকে?... দুটোই থাকে?... ওদের বাচ্চা হয় না?... ওদের সেক্সলাইফ হয় কি করে”... এরকম গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন আসে।

সমস্যাটা জটিল কিছু নয়। হিজড়ে বলতে তারা ছোটোবেলা থেকে দেখে আসে - ট্রেনে, রাস্তায় টাকা চাইতে আসা কিছু অন্যরকম মানুষের দল, বাড়িতে বাচ্চা হলে আসা সেই মানুষের দল, যারা অন্যভাবে, অন্যভঙ্গীতে, অন্যভাষায় কথা বলে। যা তাকে শেখানো সামাজিক ভদ্রতার মানদণ্ডের বাইরে। আর অবশ্যই তার সেই বয়সে সমাজকে বিশ্লেষণ করে দেখে তাদের ওরকম হওয়ার কারণ বোঝার সামর্থ্য থাকে না। বাড়ির বড়দেরও সে বিষয়ে জানানোর আগ্রহ থাকে না। তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাচ্চাদের “ওদের” থেকে দূরে সরাতেই তৎপর থাকে। যাতে কোনো ‘কুপ্রভাব’ শিশু মনে না পড়ে।

কিন্তু কৌতুহল থেকেই যায়। ওরা কিরকম, ওরা কারা। একটা মজার কথা দেখুন ভারতীয় হিন্দু সংস্কৃতিতে লিঙ্গের সীমারেখা কিন্তু ততটা একরোখা নয়। বিশেষ করে আমাদের অধ্যাত্মিক জগতে। যখন আমরা বলছি রামকৃষ্ণদেব দীর্ঘদিন শাড়ি পরে মেয়েদের মত সেজে সখীভাবে সাধনা করেছেন, এমনকি তাঁর মেয়েদের মত সাজ দেখে মথুরবাবু পর্যন্ত চিনতে পারেননি, তখন কিন্তু আমাদের মানতে অসুবিধা হচ্ছে না। মহাপ্রভুর জীবনী লিখতে গিয়ে ওনার মধ্যে গোপীভাব, রাধাভাব নিয়ে ব্যাখ্যা শুনতে কারো অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু নিত্য জীবনে অন্যভাব দেখাতে গিয়ে আমাদের যত সংস্কারে বাধে। এমনকি তপন সিংহ মহাশয়ও ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ সিনেমায় ‘নুসু’ কে নাকি পুরোদস্তুর নারী চরিত্র দেখিয়েছেন পড়লাম ক’দিন আগে।

একদিন মানুষের পক্স হলে তাকে নগরের বাইরে ফেলে আসা হত। কুষ্ঠ হলে একঘরে করা হত। আজ কম হয়। আজও ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা হয়, দুদিন আগেই হয়েছে, তবে কম। এবং সে ঘটনা অবশ্যই কলকাতার বুকে হবে না, হলে হবে প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে শিক্ষার আলো স্কুল অবধি কোনো রকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলেও জীবন অবধি এসে পৌঁছায়নি।

শিক্ষার আলো কোনো একটা জেনারেশান থেকে আরেক জেনারেশানে আত্তীকরণ হতে সময় লাগে। কোনো পরিবর্তনই রাতারাতি হয় না। সেটা আশা করা মূর্খামি। আমাদের সমাজেও কিছু পরিবর্তন হয়েছে, আরো অনেক পরিবর্তন হওয়া বাকি। কিন্তু যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো শুরু তো কেউ না কেউ করেছেন। শুরুর কাজটা নিশ্চয়ই খুব সুখের ছিল না।

আমাদের যেটা প্রথম করতে হবে, মানুষের লিঙ্গভেদ প্রকৃতিতে যে নানা বৈচিত্ররূপ ধরে আছে সেটা অনেক ছোটো বয়েস থেকে সিলেবাসে আনা। আপেল কেন মাটিতে পড়ে বা আলোর কটা রঙ বা সালোকসংশ্লেষ কি করে পাতায় হয় - এ সব জানা দরকার। তবে সে সবের থেকে বেশি দরকার সমাজে নানা মানুষ কেন নানারকম হয়, আর প্রত্যেকের যে সমান মর্যাদা নিয়ে বাঁচার অধিকার আছে, সে শিক্ষাটা তাকে দেওয়া। মজার কথা কি জানেন, আমাদের বাচ্চাদের প্রাণীরাজ্যের শ্রেণীবিভাগ কি বিশদে পড়ানো হয়, মেরুদণ্ডী, আদ্যপ্রাণী, মোলাস্কা, একাইনোডার্মাটা, স্তন্যপায়ী, পাখি, উভচর ইত্যাদি ইত্যাদি, কিন্তু মানুষের বৈচিত্রগুলো পড়ানোর দরকার আমরা মনে করি না। সে বিষয়টা ছুঁয়ে যাওয়ার চেষ্টা আছে দায়সারাভাবে, কিন্তু বিশদে তাকে বোঝানোর চেষ্টা নেই।

একটু অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, এবারের মাধ্যমিকে যখন অভিব্যক্তি অধ্যায়টা বাদ পড়ল, আমি মনে মনে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। কারণ মানুষের সভ্যতার ইতিহাস যতটা সেই আগুন জ্বালার কাছে কৃতজ্ঞ তেমনই তার বোধের ইতিহাস ডারউইন মহাশয়ের কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের বহু ভ্রান্ত ধর্মীয় ধারণা এই একজন মানুষ দূর করেছিলেন তার প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বে। যে কারণে আজও বেশ কিছু পাশ্চাত্য স্কুলে এই অধ্যায়টাকে অস্বীকার করা হয় বলে আজও রিচার্ড ডকিন্সের মত বরিষ্ঠ প্রাণীবিজ্ঞানীকে স্কুলে স্কুলে গিয়ে তাদের নিয়ে প্রমাণ করানোর চেষ্টা করতে হয় যে ঈশ্বর সাতদিনে জগত সৃষ্টি করেনি, জগতের প্রাণীকূল সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘদিনের বিচিত্র গতিপথে। অথচ হাজার হাজার ছেলে মেয়ে পাশ করে যাবে মাধ্যমিক এই মানুষটার নাম শুধু না, এই মানুষটার যুগ বদলানো ইতিহাসটা না জেনে, যা হয় তো তার ব্যক্তিগত অনেক ভ্রান্ত ধারণাও দূর করত ভবিষ্যতে। আমি নিজে আমার ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করে, কিছুটা জোর করেই অধ্যায়টা পড়িয়েছি, তাদের আগামী জীবনের কথাটা ভেবে। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস অভিব্যক্তি তত্ত্ব বুঝলে অনেক অন্ধবিশ্বাস মূল থেকে উৎপাটিত হয়ে যায়।

মূল কথায় আসি, আমরা আমাদের পঠনপাঠনকে আরো একটু পরিণত করতে পারি না এই স্মার্টফোন আর ইন্টারনেটের যুগে এসে? আমরা মানুষের যৌনতার প্রকৃতি নির্মিত নানা বৈচিত্রকে ব্যাখ্যা করে, তাকে যথাযথ মর্যাদায় স্বীকার করে নেওয়ার রাস্তা দেখিয়ে আমরা সমাজটাকে সব মানুষের আরো বাসযোগ্য করে তুলতে পারি না? কাউকে যাতে নিজেকে বিকিয়ে, নিজেকে লুকিয়ে বাঁচার রাস্তা খুঁজতে না হয় সে কথাটা ভাবতে পারি না? সময় কিন্তু এসে গেছে শুধু না, দেরি হয়ে যাচ্ছে বলা যায়। “ওদের সঙ্গে ওরকম করতে নেই, ওরা ভগবানের অভিশপ্ত” এমন কথাও তো শুনেছি, এ সবই বিজ্ঞানরহিত চিন্তাভাবনার ফল। আর কবে শুধরাবো আমরা?

173
Tue, 02/08/2022 - 11:30

ওগো নিঠুর দরদী.. অতুলপ্রসাদ লিখলেন। এই নিঠুরতা কে অনুভব করে? যে কেউ? না, যে ভালোবাসে। ভালোবাসার ব্যথা অনেক। না ভালোবাসার ব্যথা নেই। ভালোবাসার ব্যথা মাটির গন্ধের মত। সে যেমন থেকেও নেই। কিন্তু যেই না বৃষ্টির জল এসে পড়ল, সে জেগে গেল, এও তেমন।   

ভালোবাসা যদি আবহাওয়া অফিসে খবর দিয়ে আসত? কত ভালো হত। যেমন ঘূর্ণিঝড়ের খবর আসছে শুনলেই লোকজনকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়, তেমন নিজের যা কিছু দামী, মূল্যবান সব সরিয়ে নেওয়া যেত! বাঁধ দেওয়া যেত!

কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। দেখতে দেখতে মেঘ জমে যাবে, কত কিলোমিটার বেগে বাতাস বইতে পারে সে আন্দাজ পাওয়ার আগেই সব তছনছ হতে শুরু। সে সুখ, না দুঃখ সেও বোঝার উপায় নেই। শ্রবণজুড়ে কেবল সাঁ সাঁ শব্দ। দৃষ্টিজুড়ে শুধু কি ভয়ংকর সুন্দর মুখ, ঝড়ের মুখ। সব নাও, সব নাও। মৃত্যু তখন কুশাঙ্কুর। মৃত্যু তখন নেশা। মৃত্যুর চোখের উপর চোখ রেখে বলা, আয় আয়, নে আমাকে।

তারপর হঠাৎ একদিন ঝড় শেষ। সব এলোমেলো। তছনছ। নিজের সারাটা শরীর ছিন্নভিন্ন এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। সদ্য জন্মানো শিশুর মত কুঁকড়ে একদিকে পড়ে আছে ও কে? হৃদয়।

কেউ কেউ এই সময়ে হেরে যায়। বলে সব যখন গেল, আমিও যাই। সে ঝড় খুঁজতে বেরোয়। ঝড়ের কাছে নালিশের খাতা নিয়ে যেতে চায়। হিসাব করে দেখাতে চায় তাকে, কি কি ক্ষতি সে করে গেল। কিন্তু ঝড় কি খোঁজার জিনিস! সে তো অনাহূত। সে তো আমায় খুঁজে নেবে। আমি তাকে খুঁজলে সে হবে এক চিলতে হাওয়া। সে অভিমানী। সে বলে, আমায় খুঁজে নেবে তুমি? বেশ আমি তোমার বশে থাকব আজ থেকে। উফ, কি অসম্ভব একঘেয়ে, প্রাণহীন সে মুহূর্তগুলো হতে থাকে। পোষা কুকুরের মত সে আশেপাশে ঘোরে, বল ছুঁড়ে দিলে নিয়ে আসে। কখনও 'না' বলে না কোনো কিছুতেই। ক্লান্তি ঘিরে ধরে। মালিক আর কুকুর একই সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে কখন। ভালোবাসাকে খুঁজে নিলে, সে এভাবেই শাস্তি দেয়, নিজেকে অধীন করে দিয়ে, সব কিছুকে মিথ্যা করে দেয়।

আবার আগের দৃশ্যে আসি। সব কিছু তছনছ পড়ে। চারদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। গর্ভছিন্ন ভ্রূণের মত কুঁকড়ে শুয়ে, হৃদয়। কেউ কেউ হেরে যায় না। সে উঠে বসে মায়ের মত। এক একটা অঙ্গ জড়ো করে। হৃদয়কে খুব আলতো হাতে তুলে, পরম স্নেহে তার শুশ্রূষা শুরু করে। শুশ্রূষা মানে তাকে চোখে চোখে রাখা। কেউ ডাকতে এলে বলে, এখন আমার সময় নেই। কেউ সান্ত্বনা দিতে এলে, সে হেসে বলে, আগে ঝড় তোমার অতিথি হোক বন্ধু, তবে এসো সান্ত্বনা দিতে। তখন সে সান্ত্বনাদাতা কখনও কখনও বলে, আমার পরম সৌভাগ্য আমার ঘরে ঝড় আসে না। আমার ক্ষেতজুড়ে সোনার ফসল। আমার গোলা ভরা ধান। আমার পুকুরজোড়া মাছ। আমায় গোয়াল ভরা গরু। আমি সুখী। ঝড় যে আসবে আমি সে সুযোগই দিই না। আমার হৃদয়ের গন্ধ আমি ঘুঁটের ধোঁয়ায় আড়ালে রাখি। সে গন্ধ না পেলে ঝড় আসে না, জানো না যেন!

জানি। তুমি সুখী হও। তোমার সুখে আমার সুখ নেই। আমার হৃদয়ের গন্ধ আবার বেরোবে বন্ধু। সে আবার ঝড়কে টেনে আনবে। তুমি আমার থেকে থাকো দূরে। ঝড়ের পরিধির হাওয়াও যেন না লাগে তোমার সুখে। তুমি সুখ বাঁচাও। আমি মরি।

সময় যায়। সব আবার আগের মত হয় না, তাই কি হয়! আগের ঝড়ের দাগ তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে। ততদিনে হৃদয় আবার উঠানজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। চলতে ফিরতে তার মাঝে মাঝে হাঁপ ধরে, সে আগের ধাক্কার স্মৃতি। সে নিজেকে বলে, আমি ফুরিয়ে যাব, কিন্তু পাঁচিল তুলে নির্জীব হব না, পঙ্গু হব না। ঘায়েল হব বারবার।

আবার ঝড় আসে। ওই যে বললাম, এ ঝড় কখনও আবহাওয়া অফিসে খবর দিয়ে আসে না। এলে কি ভালো হত? কোনোদিন না।

174
Sat, 02/05/2022 - 16:00

ধর্মবোধকে জাগিয়ে তোলা, আর ধর্মবিশ্বাসকে উস্কানি দেওয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। প্রথম কাজটা করেন কোনো আলোকপ্রাপ্ত পুরুষ; দ্বিতীয় কাজটা করেন সাধারণত কোনো উদ্দেশ্যদ্বারা চালিত মানুষ। সে উদ্দেশ্য রাজনীতি হতে পারে, জীবিকা হতে পারে, আরো কোনো গূঢ় স্বার্থ বা উদ্দেশ্য হতে পারে।

প্রাচীন ভারতের কথা থাক, রামকৃষ্ণদেবের কথায় আসি। তিনি বললেন না - তোমরা হিন্দু, একি করছ? তোমরা গেরুয়া রং পরে রাস্তায় ঘোরো, সেই নিয়ে স্কুলে-কলেজে গিয়ে হুজ্জুতি পাকাও, পুজোয়-উৎসবে মাতিয়ে দাও সবাইকে। বললেন না। তিনি বললেন, তোমার মধ্যে এক অনির্বচনীয় সত্য আছে, যাকে চেতনা বলে, তাতে স্থিত হতে পারলে তুমি শান্তি পাবে, তোমার মধ্যে থেকে ভয়, হিংসা যাবে। “সোনার তরবারিতে হিংসা হয় না”।

যিনি ধর্মবোধকে জাগাতে আসেন, তিনি মানুষের মধ্যে কোনো সীমানা তোলা প্রাচীর দেখেন না। বৈচিত্রতা দেখেন। এক-এক মানুষ এক-এক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এই বৈচিত্রকে স্বীকৃতি দেন। কারণ তিনি বোধকে জাগাতে এসেছেন, কোনো বিশেষ রুচি বা মতকে নয়। যে সুরের বোধকে জাগাতে চায়, সে নানা বাদ্যযন্ত্রের বৈচিত্র দেখে সঙ্কোচ করে না বা দ্বেষ করে না। সে জানে সব যন্ত্রেই সেই সাতটা সুরই বাজবে, সুরের বিজ্ঞান একই, শুধু বাজানোর ধরণ আর বাদ্যের আওয়াজ পৃথক হবে। আর তাতেই সুরের সংহতি তৈরি হবে। এক যাত্রাওয়ালা এসেছেন রামকৃষ্ণদেবের কাছে, রামকৃষ্ণদেব তাকে বলছেন, দেখো, তোমাদের যাত্রার সময় নানা বাদ্যযন্ত্রে সুরের মিল থাকলেই তবে যাত্রা হয়, কিন্তু সবাই আলাদা আলাদা বাজালে যাত্রাই নষ্ট।

এই সংহতি তখনই সম্ভব যখন বোধের জাগরণ হয়। বোধ বৈচিত্রকে স্বীকার করে। অন্যদিকে বিশ্বাসের মধ্যে শুধুই বিরোধের ভয়। বিশ্বাস একটা মত, একটা উপায়। বোধ একটা জাগ্রত অবস্থা। ধর্মবোধ ইতিহাসের নানা সময়ে নিজেকে নানা ধর্মবিশ্বাসে বারবার প্রকাশ করেছে। কোনো বিশ্বাসই নিখুঁত, সম্পূর্ণ নয়। সেগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। তাকে আঁকড়ে ধরে থাকা শুধু বোধে অন্ধ হলেই সম্ভব। ধর্মবোধ মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে প্রথম দিন থেকে আজ অবধি নিজেকে ক্রমে ক্রমে বিকশিত করছে। নইলে সেদিনের জঙ্গলের সভ্যতা থেকে আজকের দিন অবধি আমরা আসতে পারতাম না যখন আমরা 'হিউম্যান রাইটস' বলে একটা কিছু অবধি ভাবতে পেরেছি অন্তত। বলা হয় অহিংসা পরমধর্ম। এই অহিংসার বোধ মৈত্রী, ভালোবাসা, করুণা, ভ্রাতৃত্ববোধ --- এরকম নানা নামে সমাজে চলে আসছে। আমরা দিনে দিনে বুঝতে পারছি যুদ্ধ, হিংসা আমাদের কিছু ভালো দেয়নি। আমাদের যা কিছু ভালো তা দিয়েছে আমাদের মধ্যের এই অহিংসাবোধ।

সেদিন খ্রীষ্ট এসে যে কথাগুলো বলেছিলেন তার মূল সুর, বুদ্ধ যে কথাগুলো বলেছিলেন তারও মূলসুর এক। কেউ বলেননি যে হানাহানি কাটাকাটিতেই তোমাদের রাস্তা। এই বোধকেই ভাগবতে বলা হল 'ভাগবত ধর্ম'। প্রহ্লাদ তাঁর অসুর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বলছেন, যদি মানুষে মানুষে, তথা জীবের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হয়, সেই হল শ্রেষ্ঠধর্ম।

তবে কি শাসন, শাস্তি, বিচার থাকবে না? থাকবে। কিন্তু সেটাই মূলসুর হবে না। সে আমাদের আদর্শ হবে না। সে হবে আমাদের প্রয়োজন। যে মানুষ দার্জিলিং-এ বেড়াতে যাচ্ছে, সে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়িতে উঠছে, পাকদণ্ডী বেয়ে উঠছে, নানা সুবিধা অসুবিধার মধ্যে দিয়ে গিয়ে তার ভ্রমণকে সার্থক করছে, কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে বলছে, বাহ্! আসা সার্থক হল। এই কাঞ্চনজঙ্ঘাটাই হল আদর্শ, যা আমাকে এতটা রাস্তা নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সমস্যার সম্মুখীন হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। মানুষের ধর্মবোধও তাই। 'ধর্ম' শব্দে যদি আপত্তি থাকে তবে এই ধর্মবোধের নতুন একটা শব্দ ইদানীং ব্যবহৃত হচ্ছে সেটাও ব্যবহার করা যেতে পারে, মনুষ্যত্ব। রামকৃষ্ণদেবের বিশ্বাসে চৈতন্যযুক্ত মানুষ শেষে সোনার মানুষ হয়। বিবেক-বৈরাগ্য যুক্ত মানুষ হয়। যে টাকার লোভ, অহমিকার দাপট সামলে মানুষ হয়। গীতার মতে যে তার প্রজ্ঞাকে স্থির করে, স্থিতপ্রজ্ঞ হয়, সেই মানুষ। মনুষ্যত্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্লেটো বলেন, সাহস, সংযম, প্রজ্ঞা আর ন্যায়ের বোধ - এই হল মনুষ্যত্ব।

এখন বলুন তো কোন ধর্মবোধ মানুষকে এর বিপরীতটা শিখিয়েছে? কেউ শেখায়নি। তবে কি বলতে চাইছি রামকৃষ্ণদেব, খ্রীষ্টকে অন্ধের মত অনুকরণ করাই ধর্ম? না, কোনো মানুষই স্বয়ংসম্পূর্ণ না। যে কোনো মানুষের শিক্ষায় মুখ্য আর গৌণ --- দুটো দিক থাকে। আমাদের দরকার হয় তাদের উচ্চারিত সেই মুখ্য ধর্মবোধের দিশাকে অনুধাবন করতে চেষ্টা করা। "তোমার ঠাকুরত্ব না জাগলে কেহ তোমার কেন্দ্রও নয়, ঠাকুরও নয় – ফাঁকি দিলেই পেতে হবে তা" --- সত্যানুসরণের এই কথাটা যার জন্যে আমার ভীষণ প্রিয়।

কিন্তু এতো গেল ধর্মবোধের জাগরণের কথা। আজ যা চলছে সে হল ধর্মবিশ্বাসের জাগরণের কথা। আমার গেরুয়া, তোমার হিজাব; আমার রাম, তোমার রহিম; আমার দূর্গোৎসব, তোমার ঈদ; এ বিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলে, এই নিয়ে 'তু তু ম্যায় ম্যায়' করে আখেরে কোনো লাভ নেই। কিন্তু সেটা আমরা বুঝি না। কারণ বোধের জাগরণে উত্তেজনা নেই, কোলাহল নেই, হাতেনাতে তপ্ত নগদ ফলাফল নেই। সে শিশিরপাতের মত শান্ত, স্নিগ্ধ। কোনো মহাপুরুষ থাকুন চাই না থাকুন, বলুন চাই না বলুন, মাধ্যাকর্ষণ যেমন নিউটনের বলার অপেক্ষা রাখে না, তেমনই আমাদের মধ্যেই মনুষ্যত্বের বোধ কি ধর্মবোধ কারোর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিবেকানন্দ'র ভাষায় সে চরম ঈশ্বরনিন্দার তুল্য। আমাদের শিক্ষা, আমাদের সমাজ যদি এই বোধকে জাগ্রত করার দিকে এগোয়, যদি সেই সৎসাহসটা আমরা দেখাতে পারি, তবে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অধুনা রামকৃষ্ণদেবতুল্য সকল মহাপ্রাণ আমাদের দু'হাত তুলে আশীর্বাদ করবেন, আমরা কোনো ধর্মবিশ্বাসে বিশ্বাসী না হলেও। নইলে রামকৃষ্ণদেব “তোমাদের চৈতন্য হোক” বলে জগৎ ছাড়তেন না। এই চৈতন্যই তো ধর্মবোধ, মনুষ্যত্বের বোধ।

 

 

175
Wed, 02/02/2022 - 20:15

উনি চলে যাওয়ার পর অনেকেই বলল, তেমন কিছু করলেন না জীবনে….

উনি রেলে কাজ করতেন। অল্পবয়সে বাবা মারা যান। ভাই-বোনেদের বড় করেন। বিয়ে দেন। নিজে খেলতে ভালোবাসতেন, বেড়াতে ভালোবাসতেন। সেগুলো করেই গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। সংসার করলেন না। চলে যাওয়ার পর আশেপাশে অনেকে বললেন, উনি কিছু করলেন না জীবনে।

দুটো কারণে বললেন বলে মনে হল। এক, গোটা জীবন ভাই-বোনেদের দায়িত্ব শেষ করে শুধু নিজের জন্য বাঁচলেন বলে। দুই, কেউকেটা, বা কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠলেন না বলে।

আসলে আমরা করাটাকে যত গুরুত্ব দিই, না করাটাকে ততটা গুরুত্ব দিই না। একজন মানুষ প্রতিদিন সংসারে, সমাজে হাজার একটা প্রতিকূলতা সামলে, নিজের হাজার একটা অপূর্ণ বাসনা সামলে, নানা ক্ষোভ, রাগ, অশুভ অসামাজিক ইচ্ছা সামলে যে ভদ্রভাবে বেঁচে আছে, শালীনভাবে বেঁচে আছে, কমোন সেন্স না হারিয়ে, কাণ্ডজ্ঞান না হারিয়ে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি নিয়ে বেঁচে আছে, এই বা কম কি!

আমরা দিনরাত প্রচুর ক্ষোভওয়ালা মানুষ দেখছি, প্রচুর উচ্চাশার লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষ দেখছি। সারাক্ষণ বিরক্ত মানুষ দেখছি। সারাক্ষণ রেগে থাকা মানুষ দেখছি। আমরা নিজেরাও তো তাই। আমাদের অপ্রকাশিত ‘আমি’কে কি আমরা চারদিকে ঘুরেফিরে বেড়াতে দেখি না? এর মধ্যে যদি কোনো মানুষ শান্ত থেকে, নীরবে, কাউকে বিরক্ত না করে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়, সেকি খুব কম কথা?

বহুকাল আগে একবার এক বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি একটা দারুণ কথা আমায় বলেছিলেন, তিনি আমায় বলেছিলেন, তুই কথামৃত পড়েছিস? আমি বললাম, হ্যাঁ পড়েছি। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বল তো আমরা যারা রামকৃষ্ণদেবের খুব ভক্ত বলে নিজেদের জাহির করি, তারা আগে গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা কেন নিই? আমি বললাম, কেন? উনি হেসে আমার পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, যাতে কথামৃতে বলা কথাগুলো আমরা এড়িয়ে যেতে পারি... বেশ দু’বেলা আসন পেতে আরাম করে বসে পনেরো মিনিট কি আধঘন্টা মনে মনে আগডুম বাগডুম করে নিজেকে বোঝাতে পারি, এই তো বেশ শিষ্য হলাম। আমরা কি আর ওই নাগমশায় ইত্যাদির মত হতে পারব? আমাদের গলা অবধি ভোগের ইচ্ছা... মাথাভর্তি স্বার্থপরতা, বদমায়েশি, মতলবী বুদ্ধিতে, আমাদের কি আর রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য হওয়ার যোগ্যতা আছে রে? তাই দীক্ষা নেওয়াটা আমাদের একটা চাল... বুঝেছিস কিনা… ফাঁকি... ফাঁকি আর ফাঁকি…. আবার জোর গলায় বলি আমরা, এখানে দীক্ষা নিলে অতশত মেনে চলার কোনো বালাই নেই... হো হো হো...

আমি হাসলাম। উনি হাসলেন, আর গাইলেন, তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি…..

যার কথা দিয়ে শুরু করলাম, উনি ধম্মকম্মের ধার ধারতেন না। আসলে উনি কিছুই হতে চাইতেন না। শুধু নিজেকে নিয়ে খুশি থাকতেন, কাউকে না ঘাঁটিয়ে।

এরকম বহু মানুষ দেখেছি, ভবিষ্যতেও দেখব, যত বয়েস হচ্ছে তত আশ্চর্য হচ্ছি এত ডামাডোলের মধ্যে এদের ভয়ানকভাবে সুস্থ মাথায় বাঁচার ক্ষমতা দেখে। কিছু করার চাইতে, কিছু না করার ক্ষমতা যে কি প্রবল এদের, কাউকে গালিগালাজ না, ক্ষোভ উগরে রাতদিন এক অসন্তোষের পাঁচালি পড়া না, একে ওকে দোষী প্রমাণিত করে মানুষ উত্যক্ত করে তোলা না। শুধু নিজের কর্তব্যটুকু সমাধা করে কেমন সুন্দর নিজেকে নিয়ে মজে থাকার ক্ষমতা এনাদের! দুর্ভাগ্য এই মানুষদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কিছু না করার ক্ষমতাটা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে যেন। আমাদের জিভ, আমাদের টাইপের আঙুলকে যেন কি ভূতে ধরে থাকে সারাক্ষণ। সে যেন আমাদের বশে থাকে না। তাকে কিছু একটা কাজ না দিলেই সে অনর্থ ঘটাবে, স্বামীজির সেই গল্পের মত। গল্পে আছে না? একজন ভূত, তাকে কাজ না দিলেই সে মালিকের ঘাড় মটকাতে চাইত? শেষে তাকে কুকুরের লেজ সোজা করতে দিয়ে মালিক বাঁচল। আমাদের জিভ আর হাতকে যেন সেই ভূতে পেয়েছে। কিছু না করা মানে কোনোরকম ধ্বংসাত্মক কাজে না জড়িয়ে, মাথাটা ঠাণ্ডা, জায়গায় রেখে, কিছু না হতে চেয়ে, কেউকেটা না হতে চেয়ে বাঁচাটা কি এতই কঠিন?

জানি আমাদের মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকে রাতদিন বলবে, আমার যেন কিছু হওয়ার আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে যদি জিজ্ঞাসা করি, সত্যিই কি আমার কিছু হওয়ার আছে? সে যদি বলে, না। আমি কি সত্যিই লজ্জা পাব? একদম না। একটুও না। বরং এই হইহট্টগোল ছেড়ে বেরোনোর রাস্তা খুঁজব। পিছনের দিকে কোথাও সরু একটা রাস্তা পেয়েও যাব। বাইরে এলেই সেই নিঃশব্দে চলে যাওয়া মানুষটাকে দেখব সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে একা। আমায় দেখেই বলবেন, পালিয়ে এলি? আয়। সব উস্কানি ছেড়ে পালাতে পারলে বেঁচে যাবি। শুধু তোকে ঠিক করে নিতে হবে, কি কি করবি না, ঠিক করে নে আগে। দেখ কেউ তোর শান্তি কাড়তে পারে কিনা!

 

176
Fri, 01/21/2022 - 13:30

বোকা হওয়া দোষের কিছু নয়। সমস্যার। যখনই বুঝতে পারবেন বোকা হয়ে গেছেন, নিজের কোনো খামতির জন্য বা অন্যের চালাকির জন্য, অনুতপ্ত হবেন না বা ক্ষুব্ধ হবেন না। স্বাভাবিক ঘটনায় ক্ষুব্ধ হওয়াটা অপ্রত্যাশিত বোকামি। যেই না বোঝা গেল, বোকা হলাম, তখনই দেখতে হবে বোকা হওয়ার জন্য যে ক্ষতিটা হল সেটাকে কি করে সামাল দেওয়া যায়।

এখন দেখুন, টাকাপয়সা বিষয় আশয় ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে অবশ্যই আইনি রাস্তায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। এখন যেমন খুব করে সাইবার ক্রাইম নিয়ে সতর্কীকরণ চলছে। আসলে সেখানে সমস্যা হচ্ছে যে এক্ষেত্রে যারা বোকা বানায় তারা মানুষকে বোকা বানাবার জন্য রীতিমতো সাধ্যসাধনা করছে। প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মানে তারা প্রফেশনাল আরকি। এখন প্রফেশনালদের সঙ্গে যুঝতে যাওয়া তো অবশ্যই বেশ কঠিন কাজ, তাই এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা যায় তার চেষ্টাটা করে যেতেই হবে।

এরপর আসে মানসিকভাবে বোকা হয়ে যাওয়ার পর করণীয়। থেকে থেকেই শুনি, অমুক আমাকে বোকা বানিয়ে গেল, আমার সঙ্গে ছল করে গেল, অভিনয় করে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এইক্ষেত্রে কি করবেন?

দেখুন, এই লেখাটা আপনি মোবাইলে পড়ছেন মানে ধরে নিতেই পারি যে মোবাইলের কিছু কিছু বেসিক জিনিস আপনার জানা। যেমন ধরুন ইনস্টল, আনইনস্টল করার ব্যাপারটা আপনি জানেন নিশ্চয়। সেটাকেই উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক।

যে কোনো মানুষের ছল, অভিনয়, চাতুরী বুঝে যাওয়ার পর, প্রথম করণীয় হল, নিজের ভেতর থেকে তার ফ্র‍্যাঞ্চাইজিটা তুলুন। মানে আরো সহজ করে বলি আপনার মানসিক জমিতে তার দেওয়া স্টলটা তুলে ফেলুন। তার পোঁতা বাঁশগুলো তুলতে আপনার একটু কষ্ট তো হবেই, কারণ তার ফ্র‍্যাঞ্চাইজি খোলার স্টল তৈরি করতে আপনিই সাহায্য করেছিলেন আপনার মানসিক জমিতে স্টল বসাতে দিয়ে। এবার তুলুন। কোয়ালিটি কন্ট্রোলে যখন ফেল করেছে তখন আর রাখার দরকার নেই। ঠিক যেমন ভাবে কোনো অ্যাপ আনইনস্টল করার পর তার কুকিজগুলো তুলে ফেলতে হয়। এও তেমন।

এখন দেখুন সম্পর্ক মানেই হল একজনের মানসিক জমিতে আরেকজনের ফ্র‍্যাঞ্চাইজি। এখন আমরা আপাতভাবে বিশ্বাস করে নিই ব্যাপারটা মিউচুয়াল। মানে তার জমিতে আমার ফ্র‍্যাঞ্চাইজি, আমার জমিতে তার। কিন্তু ক'দিন পর ক্রসচেকে ধরা পড়ে গেল যে তার জমিতে আসলে আপনার কোনো ফ্র‍্যাঞ্চাইজিই নেই, শুধু সামনে একটা প্ল্যাকার্ড ঝোলানো, ভিতরে সব ফক্কা। তখন? তখন সোজা ওই যা বললাম, বিনা দ্বিতীয় চিন্তায়, নির্দ্বিধায় তার ফ্র‍্যাঞ্চাইজি তুলে ফেলুন। নিজের মানসিক জমিতে আপনার পূর্ণ অধিকার। মায় পরমাত্মাকে সেখানে আসতে গেলেও আপনার অনুমতি লাগে, তো কোথাকার কোন কেষ্টবিষ্টু রে? বাদ দিন তো! এক্কেবারে ঝেড়ে ফেলুন।

হুম বুঝলাম, এই ঝেড়ে ফেলায় প্রধান সমস্যা সে নয়, আপনি নিজে। তার ফ্র‍্যাঞ্চাইজিতে লাগানো স্টলের বাঁশগুলো। কারণ সেগুলো আপনারই জমিতে হওয়া। আপনারই মাটিতে গাঁথা। কিন্তু দেখুন আখেরে অন্যকে নিজের মনের জমি লিজ দিয়ে লাভটা কি যদি সে তার অপব্যবহার করে? আপনার স্বপ্ন মরুক ক্ষতি নেই, আপনি সুস্থ থাকুন। আর সুস্থ থাকা মানে শুধু শরীরের হেঁটেচলে বেড়ানো নয়, মনেরও হেঁটেচলে বেড়ানো, মনেরও নানা কিছু হজম করে নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি ইত্যাদি আরকি। শরীর আর মন একই বস্তু, প্রশ্রয় দিলে কুঁড়ে, খাটালে চনমনে। নিয়ম এক।

প্রশ্ন করতে পারেন, লাভক্ষতির হিসাব কি ভালোবাসায় আসে? এ প্রশ্ন ন্যায্য, কিন্তু বাস্তব না। আমরা কেউ-ই মহৎ প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে ধরাধামে আসিনি। সুতরাং নিজের এই প্রেম-প্রেম, ভালোবাসা-ভালোবাসা, স্নেহ-স্নেহ ইমেজটাকে এত প্রায়োরিটি দেওয়ার কোনো দরকার নেই। নিজের একটা কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা সত্তা আছে। তাকে প্রায়োরিটি দিন। তাতে হয় তো আপনার কাছে আপনার ওই হৃদয়ওয়ালা ইমেজটা একটু টাল খাবে। খাক। কিন্তু অমন ভাঙা মেলা বুকে বয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে ওসব আবর্জনা সরিয়ে খোলা বাতাসে চারটি ভালো গাছ লাগানোর অভ্যাস অনেক ভালো।

এইটা বলেই শেষ করি। মনের জমিতে একে তাকে ফ্র‍্যাঞ্চাইজি দিতেই হবে এমন কোনো মানে নেই জানেন। ভালো গাছ লাগান। ভালো বই, ভালো গান, ভালো সিনেমা, ভালো ওটিটি, ভালো রিল, ভালো স্বপ্ন (যে স্বপ্ন নিজেকে নিয়েই অবশ্যই), ভালো খাবার, ভালো ছাদ, ভালো সাবানের গন্ধ, ভালো চা, ভালো রাস্তা... এরকম অনেক ভালোগুলো বেছে নিন। জীবন যেখানে যেখানে আমাদের বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় সেখানে ঘাওড়ামি করার তো কোনো কারণ দেখি না। ঘাওড়ামি মানে হল অযৌক্তিক জেদ। বেশ নরম আর সজাগ মনে একটা ভালো কিছু বেছে নিলেই হয়। অনেকে বলেন ভালো কাজ করতে। আমি এই ভালো কাজ মানে কি আজও বুঝি না। সব কাজই ভালো যদি মন ভালো থাকে। মন ভালো রাখতে মনে বাগান করতেই হয়। সার দিতে হয়। মাঝে মাঝে একা একা কেঁদে সে বাগানে বর্ষাকাল আনতে হয়। বাহ রে, মীরার গানে শোনেননি, আঁশুয়ন জল সিঁচ সিঁচ প্রেম বেল বোয়ে…. এ প্রেম আত্মপ্রেম। স্বার্থপ্রেম না। সে তো নিজেকে নিয়ে ভুল হিসাব। নিজেকে নিয়ে ঠিক হিসাবে জন্মায় আত্মপ্রেম। তবেই হল কথা।

আর একটা ক্ল্যারিফিকেশন দিয়ে নিই, কেউ বলতে পারেন, ভালোবাসায় আবার ফ্র‍্যাঞ্চাইজির কথা কেন... সে তো ব্যবসার কথা।

আমি রবি ঠাকুরের গানের দোহাই দিয়ে সে কথার উত্তর দিই,

"ব্যবসা মোর তোমার সাথে চলবে বেড়ে দিনে রাতে... আপনা নিয়ে করব যতই বেচাকেনা…"

 

 

177
Tue, 01/11/2022 - 13:30

অভিমান দুর্বলের রাগ। সে যতই কাব্যিই অভিমান নিয়ে হোক না কেন, আদতে যে দুর্বল, অভিমান তারই হয়। যে নিজেকে ভাবে অশক্ত, অক্ষম তারই অভিমান হয়। সে নিজেকে উপেক্ষিত, বঞ্চিত ইত্যাদি নানা কিছু ভেবে ভেবে রোষানলে পুড়ে মরে। কিন্তু কাজের কাজ কি কিছু হয়? হয় না।

অভিমান করার স্বভাব আমাদের এমন চারিয়ে ছিল যে এক সময় সাহেবদের উপরেও আমাদের থেকে থেকে অভিমান হত। রবি ঠাকুর গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে আমাদের দিতেন কান ধরে নাড়া। তাতে কাজ কিছু হত কিনা জানি না অবশ্য। তবে অভিমান করা বাঙালিদের মনে হয় এক জাতীয় দোষ।

আমাদের সবার উপর অভিমান। ঈশ্বর থেকে শুরু করে নেতা, আত্মীয়, প্রতিবেশী, প্রেমিক, বাবা-মা, শিক্ষক-শিক্ষিকা, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি ইত্যাদি। কার উপর না অভিমান হয় আমাদের। সবার উপর। মায় নিজের উপর অভিমানও দেখেছি।

অভিমান হলে কি হয়? শান্তি নষ্ট হয়। তিলকে তাল করে, দেওয়ালকে এভারেস্ট করে, নিজেকে নিশ্চল, নিশ্চেষ্ট করে, কি এক তামসিক অভিভূতিতে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা হয়। এতে কি কিছু মঙ্গলের হয়? হয় না।

অভিমানের মধ্যে একটা মিথ্যা আছে। আর মিথ্যার মধ্যে একটা মিথ্যা সুখ আছে। মিথ্যাটা কিরকম? অভিমানের মাধ্যমে অভিমানী নিজের একটা গুরুত্ব খুঁজে বার করে। মানে আমায় যতটা গুরুত্ব তোমার দেওয়া উচিৎ ছিল, ততটা দাওনি, তাই আমার অভিমান হয়েছে। এই অভিমান হল সেই না-গুরুত্ব পাওয়ার অনুভবকে যুঝে নেওয়ার জন্য নিজের মধ্যে নিজের গুরুত্ব নিয়ে একটা আবেশ সৃষ্টি করা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবের চাইতে বেশি হয়ে পড়ে স্বাভাবিক। কারণ মানুষের স্বভাবে এ দোষটা আছেই, সে নিজের মূল্যায়ন নিজে করতে গেলে অতিরিক্ত মান দিয়ে ফেলে, আবার অন্যের মূল্যায়নের বেলায় কম দিয়ে ফেলে। এ স্বাভাবিক। কিন্তু ন্যায্য নয়। অগত্যা অভিমানের মধ্যেও অনেকটাই অন্যায্য হিসাবনিকাশ ঢুকে এক অবাস্তব অনুভবের রাজ্যে অভিমানীকে নিয়ে যায়, আর সে রাজ্যের অলীক সুখে অভিমানী ভাসতে ভাসতে ভাবে, আহা, এ অবস্থাটা না কাটলেই তো ভালো। আমার মান ভাঙাবার যত চেষ্টাই করা হোক কেন, আমি আমার অভিমানের কণামাত্র হলেও রেখে দেব। সংসারে অন্যভাবে আমি আমার গুরুত্ব বোঝাতে না পারি, অন্তত এই প্রকার গুমোর দেখিয়ে তো পারি।

অভিমান ক্রমে ক্রনিক জেদে পরিণত হয়। থেকে থেকেই অভিমানের সুখে অভিমানী ডুবে যায়। গোটা সংসার যে তাকে কেন্দ্র করেই ঘুরে বেড়াচ্ছে, এ নিয়ে তার সংশয় থাকে না। বাস্তব জগতের থেকে সরে গিয়ে এমন এক জগতে সে বাস করে যেখানে সবটাই শীততাপনিয়ন্ত্রিত। মানে সে চাইলেই সে জগতের সব কিছুকে নিজের মত করে নিতে পারে। কারণ সে জগতে সবাই তার নিয়ন্ত্রণে, যদিও তা কল্পনায়।

সংসারে অল্পবিস্তর অভিমান তো থাকবেই। কিন্তু সে নিয়ে কথা না, অভিমান করাটা যখন অসুস্থতায় দাঁড়িয়ে যায় তখন তা আর সুখকর থাকে না। যে প্রত্যক্ষ ভোগে, আর তার জন্যে যে বা যারা পরোক্ষভাবে ভোগে, তাদের কারোর পক্ষেই সেটা আর কাব্যিক জায়গায় থাকে না। সে রীতিমতো অসুস্থতার জায়গায় নিয়ে যায়। সার্ত্রে তার বিখ্যাত বই, 'বিং অ্যাণ্ড নাথিংনেস'-এ যে 'ব্যাড ফেথ'-এর কথা বলেছেন, আমার মনে হয় কিছুটা এই বোধের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার কিছু হবে না, আমার দ্বারা এটা সম্ভব নয়, এ যেন কোথাও নিজের উপর অভিমান থেকে জন্মায়।

সমস্যাটা হল তথাকথিত 'ছোটোখাটো' সমস্যাকে আমরা ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। বাড়তে দিই। যতক্ষণ না সেটা আরো গভীরে শিকড় চারিয়ে নিত্য জীবনকে প্রায় অকেজো করে ফেলে। অভিমান শব্দটা আপাত যতটা নিরীহ মনে হয়, আদতে কি ততটাই? কত মানুষ অকালে চলে যাওয়ার পর আমরা বলি, ওনার ভীষণ অভিমান ছিল অমুকের প্রতি, তমুকের প্রতি। যেন এই অভিমান শব্দটা দিয়েই তার অকালে অস্বাভাবিকভাবে চলে যাওয়াটাকে জাস্টিফাই করে ফেললাম। সেটা কি ঠিক?

আপাত নিরীহ এই স্বভাবকে নিয়ে যতটা ভাবনাচিন্তা আবশ্যক, যতটা গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক, তা যদি সময়ে না দেওয়া যায়, তবে তা অবশ্যই তার পরিণাম আখেরে ভালো হয় না। অভিমান শুধু গান, কবিতা বা প্রেমের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়, এ রীতিমতো একটা মানসিক ব্যাধির জায়গা নিতে পারে, বা অন্তত সিরিয়াস কোনো মানসিক ব্যাধির দিকে নিয়ে যেতে পারে, এ ভাবনাটা মাথায় রাখা আবশ্যক।

 

178
Sat, 01/08/2022 - 23:30

কিছু মোহ মানুষ বড় হলেও ছাড়তে পারে না। তার মধ্যে একটা, ভয়ের প্রতি মোহ। ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা, শিক্ষক, গুরুগম্ভীর আত্মীয়,পাড়ার দাদা-জেঠু-কাকা, নানা দেবদেবী প্রমুখদের ভয় পেতে পেতে, ভয়ের উপর একটা দুর্বলতা জন্মে যায়। সে ভয় পেতে চায়, ভয় দেখাতে চায়, ভয় নিয়ে ব্যবসা করতে চায়। যে কোনোভাবেই হোক ভয়ের নাগাল পেরিয়ে বাঁচতে চায় না। ভয়ও তাই ছাড়তে চায় না।

কোভিড নিয়ে মিডিয়া থেকে শুরু করে বহু তথাকথিত বিজ্ঞ মানুষকেও দেখে আসছি ঘুরে ফিরে সেই এক ফর্মুলা ব্যবহার করে যাচ্ছেন। মানুষকে ভয় দেখালেই মানুষ বশে আসবে, এ বিশ্বাস মনের মধ্যে এমন গেঁথে বসে আছে না! ভাবাই যায় না যে ভয়ের ছড়ির জোর যতটা ভাবা যায় আসলে ততটা নয়। ভয়ের ভয় কেটে গেলে আসল মানুষটা নিজের খোঁজ পায়। সত্যের জোরে, সত্যের আলোয় কোনটা মঙ্গলজনক আর কোনটা অমঙ্গলকর সেটা সে অনুভব করে। কিন্তু মানুষকে সত্যে আনার ধৈর্য আর ভয়ের চাবুক চালানোর তাৎক্ষণিক লোভ, এই দুটোর মধ্যে ভয়ের চাবুকই জিতে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।

সিগারেটের গায়ে ভয়ংকর ছবি দেওয়া হল। তাতে কি সিগারেট বিক্রি কমল? কিন্তু ভয়ের তত্ত্ব নিয়ে যে মোহ, সে জিতল। সে তার জায়গা করে নিল। বেতের ভয়ে যে ছাত্র পড়া করে আসে সে তদ্দিন সার্থক হয় না, যদ্দিন না পড়াশোনাটা তার স্বাভাবিক বোধে সহজ হয়ে আসে। মারের ভয়ে পাশ করানো যায়, শিক্ষিত করে তোলা যায় না সত্য অর্থে।

এমনকি দুর্ভাগ্য এতটাই যে WHO এর মত সংস্থার আধিকারিকেরাও এই এক মিথে বিশ্বাস করেন দেখা যাচ্ছে। বিজ্ঞানের মানুষ যারা, তারা ভয়ের ভরসায় সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন। ভয়ের সুরটা চড়ছে। সত্যের সুরটা ঢেকে যাচ্ছে। আদতে লাভও কিছুই হচ্ছে না। হু হু করে সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। শুধু যে অজ্ঞ, সাধারণেরা আক্রান্ত হচ্ছেন তা তো নয়, চিকিৎসক থেকে শুরু করে বহু জ্ঞানীগুণী, বিশিষ্ট, বুদ্ধিজীবী মানুষেরাও আক্রান্ত হচ্ছেন।

এই অতিমারীর নিজস্ব যে ভয়ের একটা স্বাভাবিক সীমা আছে তাকে বিকারের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। কি বীভৎস, রুচিহীন, সংযমহীন উচ্চারণে, দৃশ্যায়নে এক বিভীষিকার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শুধু কোভিড বলে নয়, বন্যা ঝড়ের উগ্ররূপ দেখিয়ে মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টির জন্য কতরকম কৌশলের সাহায্য নিচ্ছেন তথাকথিত সাংবাদিকেরা সে সত্যও উঠে আসছে।

আতঙ্ক তৈরি করা আর সত্য পরিবেশন করার মধ্যে যে বিবেচনাগত পার্থক্য আছে সে বিষয়টা নিয়ে ভাবাটা হয় তো এই চূড়ান্ত প্রতিযোগিতার যুগে অর্থহীন হয়ে গেছে। সব বিষয়ে প্রতিযোগিতার প্রথা আমাদের দিন দিন কিভাবে নিঃস্ব করে যাচ্ছে তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। কে কত কম ইঞ্চি হার্ট কেটে আপনার চিকিৎসা করে দেবে সে নিয়েও রাস্তায় রাস্তায় বড় বড় বোর্ডে বিজ্ঞাপন চলছে। ডাক্তারেরা বা ডাক্তারের পোশাক পরা মডেলরা দাঁড়িয়ে পোজও দিচ্ছেন সে ছবিতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিযোগিতা এতটাই দৈন্য এত গর্বের সঙ্গে আমাদের এনে দেয়। সাংবাদিকতা আর আতঙ্কাবাদিতা তো কখনওই এক নয়! একটা উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। সৌরভের আক্রান্ত হওয়ার দুদিন পর যখন সৌরভের মেয়েও আক্রান্ত হল তখন একটা বাংলা খবরের কাগজ লিখল, "ছারখার হল সৌরভের পরিবার"। কি সাংঘাতিক বিশ্রী অতিকথন!

ভয় মানুষের মোহ। স্বভাব নয়। বিকার। ভয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছুদিনের জন্য ফল পাওয়া যায় বটে, কিন্তু সে-ই ভয়ই যখন ব্যাকফায়ার করে তখন তাকে সামলানো দায় হয়। কোভিড ফ্যাটিগনেস নাম দিয়ে যাকে চালাচ্ছি, আদতে সে কি? আদতে তা মানুষের আদিম অকুতোভয় সত্তার গর্জন। যাক সব শেষ হয়ে, তবু আমি ঘরে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব না। এ ভাব মঙ্গলজনক নয়, কিন্তু এ অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া। মানুষ বেপরোয়া হয় এই ভয়ের অতি ব্যবহারের অত্যাচারেই।

পাঠক এতদূর পড়ে বলবেন, কিন্তু এ তো আইডাল অবস্থার কথা। বাস্তবে তা হয় না। আমি বলি বাস্তবে যা হয় সেটা ভয়ের ছড়িতেও হয় না বেশিদিন। ফাঁস আলগা হয়ে গিয়ে আরো দ্বিগুণ ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা যায়।

উপায়? আমার মনে হয় শিক্ষা। একই কথা বারবার বলে যাওয়া। বারবার, বারবার বলে যাওয়া। ভয় বা ত্রাসের মোড়কে নয়। ধৈর্য আর সদিচ্ছার জোরে। বিজ্ঞানের যে স্বাভাবিক বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের জোরে। মানুষ মানবেই। ধৈর্য ধরতে হবে। বারবার একই কথা বলতে বলতে ফল ফলেই। গায়ের জোরে ফলাতে গেলে দুদিন পর আরো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়।

কিন্তু ওই যে আমাদের বিশ্বাস। আমাদের মোহ। ভয় আর শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে নাকি এক অদৃশ্য যোগাযোগ আছেই। যে মাদুলির ব্যবসা করে, ধর্মের ব্যবসা করে তারা সবাই কিন্তু এই ভয়টাকেই উপজীব্য করে নেয়। সুতরাং আমার মধ্যে যদি এক রত্তিও এই ভয়ের ক্ষমতার প্রতি অন্ধ মোহ থাকে, তবে আমি যেন নিজেকে ওই জ্যোতিষ, বাবাজীদের থেকে আলাদা করে না দেখি। আমিও একই কাজ করছি, আমার মত করে।

ভয় উপায় নয়। উদ্দেশ্য আর উপায় যেখানে আলাদা সেখানেই মানুষ দুর্নীতিগ্রস্থ। ভয় তাই কখনওই উপায় নয়। বারবার ভুলটা ধরিয়ে দেওয়া, বারবার ঠিকটা বলে যাওয়া, ক্রমাগত বলে যাওয়া, এইটাই রাস্তা। একমাত্র রাস্তা বলে আমার মনে হয়।

179
Tue, 12/07/2021 - 16:56


সত্যের আনুগত্য শেখাবেন, না ব্যক্তির আনুগত্য শেখাবেন - এ সিদ্ধান্তটা কিন্তু আপনাকে আপনার সন্তানের ব্যাপারে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

      বাবাকে কি মাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই যদি সন্তানের সাত খুন মাফ হয়ে যায়, তবে আপনি যে ওর কি সর্বনাশ করছেন সে এখনই হয় তো স্পষ্ট বুঝতে পারবেন না, না তো সে নিজেও বুঝে উঠতে পারবে। 

     আমাদের ভক্তিধর্মের দেশ। বাবা মা ঈশ্বরের আরেক রূপ, ইত্যাদি নানা ধরণের আদর্শকথা শুনতে শুনতে আমরা বড় হই। আর সর্বনাশের বীজও সেইদিন থেকেই বোনা হয়। আমি দেখেছি বাবা মাকে তুষ্ট করে বেড়ে ওঠা সন্তান ধীরে ধীরে কেমন মেরুদণ্ডহীন, জড়পিণ্ডের মত হয়ে যায়। নিজের বিচারবুদ্ধি শক্তি, নিজের বিবেচনা শক্তির কোনো বিকাশ হয়ে ওঠে না। কি বিষাদে, অসুখে জীবনযাপন করতে তারা অভ্যস্ত হয়ে যায়, সে ভীষণ কাছ থেকে দেখেছি। যখন সে বুঝতে পারে যে তার ডানা ছাঁটা হয়েছে জন্মলগ্নেই তখন তার মধ্যে তার মধ্যে বাবা-মাকে নিয়ে বিদ্বেষ তৈরি হয়। সে বুঝতে পারে তাকে তার মত করে সত্যটাকে, ঠিকটাকে বুঝে চলার মত পরিবেশ কোনোদিন দেওয়া হয়নি। কিন্তু সে যে বাবা মায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে, কিভাবে দাঁড়াবে? নিজের ব্যক্তিত্বই তো গড়ে ওঠেনি সঠিকভাবে। সে গুমরে গুমরে মরে। ভিতরে ভিতরে বিষাক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পায় না নিজেকে প্রকাশ করার। যদি বা করতে যায়, সে এমন বিশ্রী বিকারযুক্ত রাগ, অভিমান ইত্যাদিতে প্রকাশ পায় যে সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না, এর পরের ধাপটা কি হবে। 

     আমাদের দেশ ব্যক্তিপূজার দেশ। গুরু, অবতার, নেতা, কবি, লেখক, নায়ক, গায়ক, অভিনেতা, খেলোয়াড় ইত্যাদি সবাই আমাদের পূজ্য হতে পারে। ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই আমাদের জীবন সার্থক। এ ভাব আমরা জন্মসূত্রে লাভ করে থাকি। নিজের যুক্তি-বিচার বোধকে খুব বিশ্বাস করি না আমরা। নৈর্ব্যক্তিক সত্য না নীতিতে আমাদের আস্থা নেই। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম - আমাদের এই আদর্শ বলেই আমরা জানি যিনি কোনো পদে আসীন, তিনি তার ইচ্ছায় সে পদকে নিজের মত ব্যবহার করতেই পারেন। সেই পদের প্রোটোকল অনুযায়ী তিনি যে বাধ্য হতে পারেন, সে আমাদের ভাবনাতেই আসে না। যদি কেউ প্রোটোকল মেনে চলেন, তবে তিনি ভীষণ ‘অন্যরকম’। তাই আমরা ঘুষে বা বক্তিগত অনুগ্রহে যতটা বিশ্বাস রাখি ততটা কোনো নীতিতে না। 

     আসলে আমাদের মজ্জায় ঢুকে গেছে ‘সর্ব ধর্ম পরিত্যাজ্যং মামেকম শরণম ব্রজ’, অর্থাৎ গীতার যে চূড়ান্ত কথা, সব ধর্ম ত্যাগ করে আমার শরণাগত হও, আমি তোমায় তোমার সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত করব। 

     এ ছিল গীতার কথা। এর দার্শনিক ব্যাখ্যা বা ভক্তিতত্ত্বে ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, আমাদের নিত্য সংসারে এ সমস্ত গোলোমালের মূল হতে পারে। পুলিশ, নেতা, পদস্থ অফিসার, ভণ্ড গুরু, ভণ্ড অবতার ইত্যাদিরা যখন বলেন, ‘আহা তোমায় অত সাধ্যসাধনা করতে হবে কেন? তুমি আমায় সন্তুষ্ট করো, আমি তোমার জন্য সব করে দেব।’ তখন সে ভীষণ গোলমেলে কথা হয়ে যায়। ভারতের দর্শনে ও ধর্মে এমন ফাঁকিবাজি বাইপাস করা তত্ত্ব ছাড়া পুরুষকারের কথাও ছিল, যা আমাদের বুদ্ধ শেখাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আমাদের মনে ধরেনি। আমরা বুদ্ধকে অবতার বানিয়ে বুদ্ধকে ভোলাতে চেয়েছি, নিজেকে ঠকাতে চেয়েছি। বুদ্ধ যে ভোলেননি সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই, কিন্তু আমরা যে যুগে যুগে নিজেকে ঠকিয়ে চলেছি সে নিয়েও কোনো সংশয় নেই। এক একজন অবতার জন্মাচ্ছেন, তাকে কেন্দ্র করে, তাকে পুঁজি করে এক একটা সম্প্রদায় তৈরি হচ্ছে, নতুন করে আবার মগজ ধোলাই কল খোলা হচ্ছে। গীতায় যখন কৃষ্ণ বুদ্ধের রাস্তা ধরে বললেন, ‘নিজেকে নিজেই উদ্ধার করো, তুমিই তোমার সব চাইতে বড় শত্রু, আর তুমিই তোমার সবচাইতে বড় বন্ধু’, তখন সে কথা নিয়ে আমাদের সমাজ চলল না। আমাদের সমাজ চলল ওই ফাঁকিবাজীতে, তস্মিন তুষ্টম, জগত তুষ্টম, অর্থাৎ তোমায় তুষ্ট করতে পারলেই জগত তুষ্ট। 

     সন্তান বাবা মায়ের উপর নির্ভরশীল হবে, এ বাস্তব। কিন্তু তাকে নিজের মেরুদণ্ডে দাঁড় করানোর শিক্ষা দিতে হবে, এ বাবা মায়ের প্রথম কর্তব্য। আমায় খুশী করলেই যদি সে পার পেয়ে যায়, বা অমুক গুরুকে তুষ্ট করলেই যদি সে পার পেয়ে যায়, তবে মানুষ হিসাবে তার একান্ত দুর্গতি। আমার নিজের বিচার চিন্তায় আমার মত করে সত্যকে খুঁজে নেব, সেই অনুযায়ী চলব বলেই নিশ্চয় জগতের মালিক আমায় একটা স্বাধীন বোধ বিচারের শক্তি দিয়েছেন। তাকে প্রতিদিন হাজার একটা লোভ, মোহ, ভয় থেকে বাঁচিয়ে চলব, এই তো আমার মানুষ হয়ে জন্মানোর সাধনা। সেই চলার জন্য আমার মধ্যে যে আত্মপ্রসাদ জন্মাবে, সেই তো আমার মধ্যে দিব্যবোধের অনুভব। লোভের কাছে, মোহের কাছে, ভয়ের কাছে মাথা নীচু না করলে যে চিত্তপ্রসাদ, যে আত্মশক্তি নিজের মধ্যে জন্মায়, সেই তো ঈশ্বরত্ব। কোনো একজন ব্যক্তিকে তুষ্ট করে চলাই কি আমাদের একমাত্র ভবিতব্য, সে তিনি যেই হোন না কেন?

     আমরা আমাদের সন্তানকে আর যেন যেখানে সেখানে মাথা নীচু করতে না শেখাই আমাদের সংস্কৃতির অজুহাতে। সেদিন দশরথের অমন উৎকট বায়না না শুনে রামচন্দ্র যদি দেশে থেকে সুশাসন কায়েম করতেন, সে অনেক বেশি কাজের হত। রাবণ নিজের কুকর্মের ফলে আপনিই নিঃশেষ হয়ে যেত। বা অযোধ্যা থেকে সৈন্য নিয়ে গিয়েও তাকে মারা যেত। কিন্তু এমন অন্যায্য অনুরোধ শুধু বাবা হওয়ার সুবাদে যদি কেউ করতে পারেন, তবে সে খুব উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নয়। সীতা বা লক্ষ্মণ শুধু নন, রামচন্দ্রের মায়েরও দায় ছিল সত্যটা বলার। যেমন দায় ছিল ধৃতরাষ্ট্রের সভায় ভীষ্মের প্রতিবাদ করার। তিনি করেননি বলেই মহাভারতের শেষে শান্তিপর্বে ওনার কথা অপ্রাসঙ্গিক। 

     কিন্তু এ তো গেল মহাকাব্যের কথা। এ প্রসঙ্গ এই জন্যেই আনা যে আমাদের সমাজে আদর্শ নির্বাচনে আমরা এখনও এ দুটি মহাকাব্যকেই ধ্রুব মেনে থাকি অনেকেই। 

     কেউ আমার কাছে শ্রদ্ধেয় হয়ে উঠুন তার চরিত্রের জোরে, কোনো সম্পর্ক, ক্ষমতা, পদ ইত্যাদির জোরে নয়। আমি অনুপ্রাণিত হই লক্ষাধিক মানুষের কাছ থেকে, কিন্তু কাউকে অন্ধের মত অনুসরণ করা মানে নিজের ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষতিও ডেকে আনা। ক্রিটিকাল থিংকিং বা জোর করে বাংলা করলে যদি বলি তুল্যমূল্য বিচার বা সার্বিক বিচার করতে ছেলেমেয়েদের শেখান। শ্রদ্ধা করার শক্তি থেকে বিচার করার শক্তিতে মানুষ সত্যকে বেশি করে পায়। শ্রদ্ধাবানই জ্ঞান লাভ করে - গীতার এ কথা হয় তো কোনো মিস্টিক জীবনে প্রযোজ্য হলেও হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে দেখা যায় যেখানে যত প্রশ্ন, যেখানে যত সংশয়, সেখানেই জ্ঞানের তোরণ খোলা। 

     সম্মান আর শ্রদ্ধা কথাটার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সম্মান আমার ও অন্যের ব্যক্তি স্বাতন্ত্রক্যকে মেনে নেওয়া সদর্থকভাবে। আমার ব্যক্তি হিসাবে অধিকারকে অস্বীকার না করা। কিন্তু শ্রদ্ধা আমার আনুগত্য দাবী করে। সে বলতে চায় আমি তোমার থেকে উন্নত, তাই তুমি আমার অনুগত হও। আমার থেকে উন্নত তুমি হতেই পারো, কিন্তু তার জন্য আমি আমার ব্যক্তিসত্তা তোমার কাছে বন্ধক দিতে যাব কোন দুঃখে?

     তাই যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটাই আবার বলি। আপনার সন্তানকে ভুল করার সুযোগ দিন, নিজের বোধবুদ্ধিকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করার সুযোগ দিন। আপনি নিজেকে পার্ফেক্ট ভেবে ওর ইম্পার্ফেকশানকে অপমান করবেন না অনুগ্রহ করে। তাকে ক্রমে বড় হতে দিন। সে বুঝুক সত্যিটা আপনাকে কনভিন্স করাতে পারলে আপনি জেদ ধরে তাকেই ভুল প্রমাণ করতে চাইবেন না, বরং আপনি খুশী হবেন। এ বিশ্বাস, এই ইমেজ আপনাকে নিয়ে তার মনে তৈরি হোক যে আপনি আর সে দুজনেই সত্যিটা, বা ঠিকটারই সমর্থক। কেউ কারোর ইগো নিয়ে লড়াই করার জন্য মুখিয়ে নেই। এতেই সে দিনে দিনে স্বাবলম্বী হবে সত্য অর্থে, শুধুমাত্র আর্থিক দিক থেকে নয়। কারণ ওরকম উপার্জনক্ষম মেরুদণ্ডহীনের উদাহরণও কম নেই আমাদের সমাজে। সে কার অনুগত হবে ঠিক করতে না পেরে, একজনের দিকে ঝুঁকে পড়ে আরেকজনের উপর অনায়াস অবিচার করেই চলে। এবং সে যে অবিচার করছে, এ বোধও তার চিত্তে জন্মায় না, এমনি অসাড় হয়ে যায় সে। 

     এ না ঘটুক। আত্মশক্তি লাভের চাইতে বড় লাভ সংসারে দুটি নাই।

180
Mon, 11/29/2021 - 17:43

এই তোদের এতদিন হল বাচ্চা হচ্ছে না কেন রে? দেখ ওদের তো তোদের পরে বিয়ে হল, তা-ই হয়ে গেল, তোদের?

 

প্রশ্নটা স্বাভাবিক। কারণ আমাদের সমাজে সীমারেখার বোধটা খুব অস্পষ্ট। কোন প্রশ্ন করতে হয় আর কোন প্রশ্ন করাটা অস্বাভাবিক, সেটার বোধ আমাদের খুব একটা স্পষ্ট নয়। আমার কি জানার অধিকার নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু কৌতুহলের অধিকার নেই।

আজকে একটা খবর আছে, একজন মানুষ, সে মোটা বলে আর তার বাচ্চা হচ্ছিল না বলে বাড়ির লোকে এত এত কথা বলত যে সে আত্মহত্যা করেছে। অবশ্যই এটা বড় খবর নয়। এর চাইতে অনেক বড় খবর দেশে ঘটে। কিন্তু দেশ আর সমাজের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সমাজে যা ঘটে তার অনুমোদন থাকে বলেই ঘটে। আর সে অনুমোদন বিবেক দেয় না, দেয় অভ্যাস। একদিন আমাদের সমাজে অনেক অনেক অমানবিক ঘটনা ঘটে যেত, সে সবের প্রতিবাদ আমাদের চিত্তে জাগলেও, করা অবধি ঘটে ওঠেনি, কারণ করাটা সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়।

বাচ্চা না হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। এক, নিজেদের সিদ্ধান্ত; দুই, শারীরিক সমস্যা। দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের বেশ কিছুটা অগ্রগতি হলেও সে পদ্ধতিগুলো শতাংশে সফলতা দেয় না।

কিন্তু কারণ যাই হোক, প্রশ্নের সামনে পড়তেই হবে। একজন মহিলা কেন দীর্ঘদিন অবিবাহিত থেকে গেল, এ নিয়েও যেমন অনেক হাইপোথিসিস তৈরি হয়, তেমনই বাচ্চা না হওয়ার কারণ হিসাবেও অনেক হাইপোথিসিস দাঁড় করানো হয়। কিছু হাতে গোনা পরিবার সহজে মেনে নেয়, বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই গলার কাঁটার মত বিঁধে থাকে। রাস্তায় বেরোলে পাড়া-প্রতিবেশীরা জিজ্ঞাসা করে, কি গো নাতিপুতি কবে হবে? ওরা কি ভাবছে? প্রশ্নটা অনেক সময় না করেও সুকৌশলে করা যায় তাও দেখেছি। কোনো একটা অনুষ্ঠানে কোনো বয়স্ক দম্পতির সামনে ঘটা করে নাতি-নাতনিদের গল্প শুরু হয়ে গেল। যারা শুনছে তারা বিব্রত বোধ করছে। যারা বলছে তারা এক অনির্বচনীয় সুখ পাচ্ছে।

এর কারণ মানুষের মধ্যে অন্যকে বিব্রত করায় এক সুখ আছে। অন্যকে বিড়ম্বনায় ফেলা, অন্যকে অপদস্থ, অপ্রস্তুত করার মধ্যে একটা সুখ আছে। যার লাইট ভারসান আমরা আমাদের বন্ধু মহলে 'লেগ পুলিং' বলি। সেটা অবশ্যই আমোদের জন্য। সে মাত্রাবোধ আমাদের আছে বলেই সেখানে একটা সুখ, মজা। কিন্তু প্রবৃত্তিটা একই, অন্যকে বিব্রত করার সুখ। রবীন্দ্রনাথ 'পঞ্চভূত' প্রবন্ধে কৌতুকের সংজ্ঞায় বলছেন না, যা আমাদের কৌতুকের বিষয়, মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে তাই আমাদের অত্যাচারের কারণ হয়ে ওঠে। উদাহরণ হিসাবে বলছেন, চড়ুইভাতি যেমন, অসময়ে, অরন্ধিত খাবার, কিন্তু তার মধ্যে আমোদ আছে, যদি না সে মাত্রা ছাড়িয়ে রোজকার ঘটনা হয়ে ওঠে।

সেই দাদু-দিদা, ঠাকুমা-ঠাকুর্দা এবার বাড়ি এসে সেই বিব্রত হওয়ার শোধ তুলবে অভিমানে, প্রশ্নের পর প্রশ্নে, অপমানে। কারণ তাদের কাছে প্রতিবেশীর প্রশ্নগুলো অস্বাভাবিক লাগবে না, কারণ সেটা সমাজ অনুমোদিত। অস্বাভাবিক লাগবে বাড়ির সেই নিঃসন্তান দম্পতিদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে, তাকেই দৃষ্টিকটু লাগবে।

আমাদের পৌরাণিক উপাখ্যানগুলো যদি দেখা যায়, সেখানে দেখা যাবে যে, তাদের সব সুখ ছিল, কিন্তু ঈশ্বর তাদের সন্তান না দেওয়ায় তারা ভীষণ দুঃখী ছিলেন। দশরথ থেকে শুরু করে ঠাকুমার ঝুলি অবধি কেউ মুনিঋষির কাছে যাচ্ছে, কেউ অসুর দেবতার কাছে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, এ রীতিমতো চর্চার বিষয়। আলোচনার বিষয়, এতো আমাদের আদিকাল থেকেই।

এখন আমার প্রশ্ন আন্তরিক হলেও অন্যকে বিব্রত করার জন্য হয় তো যথেষ্ট, যদি সে নিজে থেকে এ নিয়ে আলোচনা করতে না চায় তো। আজকের যে খবরটা দিয়ে শুরু করলাম, সে ঘটনাটা তো আমাদের অজানা নয়।

"আমি তো চিন্তিত বলেই প্রশ্নটা করছি", এ কথাটা নিশ্চয়ই মিথ্যা নয়। সত্যিই কারোর মনে হতে পারে, ভীষণ জেনুইনভাবেই মনে হতে পারে। কিন্তু তবু সেই জেনুইন সার্টিফিকেটও এই ক্ষেত্রে অচল। আমাদের সব জেনুইন আবেগ, ইচ্ছা কি ভালো? নয় তো। এক সুগারের রুগীর জেনুইনলি মিষ্টি খেতে চাওয়ার ইচ্ছাটা কি ভালো? নয় তো। সেরকম ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে যে অনেক অনেক জেনুইন ইচ্ছাই আদতে ঠিক নয়। এ ক্ষেত্রেও তাই।

সীমারেখা মানা অভ্যাস করতে হবে। শুরুতেই যে বললাম না, আমাদের সীমারেখার বোধটা ভীষণ অস্পষ্ট। আমাদের ধর্ম সমাজে ঢুকে বিধান দেয়। আমাদের সমাজ ধর্মের নীতিকে লাভের নীতি বানাতে তৎপর হয়ে ওঠে। আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন থেকে থেকেই দিক বদল করে। অন্দরমহলের প্রশ্ন বাজারে আলোচনার বস্তু হয়। বাজারের তত্ত্ব বিজ্ঞানের, ধর্মের, নীতির ছদ্মবেশে অন্দরমহলে ছড়ি ঘোরাতে আসে। মুশকিল হল সবাই বলে, সে আমার আপনজন বলেই যে না এত ভাবছে, এত প্রশ্ন করছে। কিন্তু আদৌ এই আপনজনকে সংসারে বুঝতে পারা কি এতই সোজা ব্যপার রে ভাই? নিজে নিজের আপনজন না হতে পারলে, এ বিশ্বসংসারে কেউ-ই আপনজন হয় না - স্বয়ং ভগবানও না, এ কথাটা না বুঝলে নিজেই নিজের জীবনে সাইডরোলে অভিনয় করে যেতে হবে, নইলে ত্রাণ নেই সমাজের আপনজনদের হাত থেকে আর।

181
Fri, 11/19/2021 - 13:32

 

নানককে নিয়ে অনেক গল্প। একটা গল্প আছে বাচ্চা নানক ঘরে বসে দেখছেন অনেক লোক, অনেক উপাচার নিয়ে চলেছে রাস্তা দিয়ে। নানক দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কোথায় যাচ্ছ গো?

তারা বলল, বৃষ্টি হচ্ছে না তো অনেকদিন। আমরা চাষ করতে পারছি না। তাই আমরা ঈশ্বরের আরাধনায় যাচ্ছি বৃষ্টির জন্য।

নানক শুনে বললেন, বেশ, তোমরা দাঁড়াও, আমিও যাব।

এই বলে নানক দৌড়ে বাড়ি গেলেন। একটা ছাতা নিলেন। তারপর তাদের দলের সঙ্গে হাঁটা লাগালেন। কেউ ভাবল ছোঁড়া তাদের সঙ্গে ব্যঙ্গ করছে, এই ভেবে সে ধমক লাগালো। কেউ মজা পেয়ে নানকের সঙ্গে একটু ফাজলামি করল। কিন্তু নানক তার নিজের মনে ছাতা হাতে পরামাত্মার নামগান করতে করতে চলতে লাগলেন।

গল্পে আছে ফেরার সময় নাকি তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল। নানক পরমানন্দে ছাতা মাথায় ফিরেছিলেন।

নানক ঈশ্বরকে সত্য বলে বিশ্বাস করেছিলেন। ঈশ্বরকে পরম দাতা বলে বিশ্বাস করেছিলেন।

দুটো কথা আছে, ঈশ্বরকে সত্য বলে জানা, আর ঈশ্বরকে নিজের নানা সুবিধার উপকরণ বলে জানা। দ্বিতীয় জনের বিশ্বাস একটু এদিক ওদিক হলেই টলে যায়। "এরকম হল আমার সঙ্গে, ঈশ্বর তবে নেই!"। জগতের সব ঘটনার ব্যাখ্যা তার বোধ অনুযায়ী পারম্পর্য ও তাৎপর্য মেনে চললেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সত্য তার কাছে।

আমাদের ঈশ্বর বায়বীয়। আমাদের ঈশ্বর সম্প্রদায়ের। আমাদের ঈশ্বর আলো আঁধারিতে।

নানকের ঈশ্বর স্থির আলোকময়। নানকের ঈশ্বর আনন্দময়। নানকের ঈশ্বর সর্ব জগতের দাতা। নানকের ঈশ্বরের নাম সত্য। নানকের ঈশ্বরের নাম জগত গুরু। নানকের ঈশ্বর মানুষে মানুষে ভেদ মানে না।

আমাদের ঈশ্বর হিংসুটে। আমাদের ঈশ্বর লোভী। আমাদের ঈশ্বর ধোঁয়াশায়। আমাদের ঈশ্বর স্বার্থপর, একচোখা।

নানক আমাদেরকে আমাদের ক্ষুদ্র ঈশ্বরের হাত থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। আমাদের নানা কাল্পনিক প্রথা থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। আমাদের তর্পণ ইত্যাদি নানা ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্রিয়া প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিতে চাইলেন। তাদের বানানো হাজার একটা থিওলজিকাল অমানুষী অত্যাচারকে বললেন, মূল থেকে উপড়ে ফেলো। এমনকি মেয়েদের শরীর নিয়ে যে অসম্ভব ছুঁৎমার্গীতা, তাকেও ছুঁড়ে ফেলে বললেন, প্রাকৃতিক যা তাকে শুদ্ধ অশুদ্ধ বলার অধিকার কে দিল তোমাদের? কল্পনা যখন যুক্তির অনুগামী হয় তখন হাইপোথিসিস হতে পারে। কিন্তু যুক্তি যখন কল্পনার অনুগামী হয় তখন ময়ূরের চোখের জলে শুক্রাণু জন্মায়, গোবরে ক্যান্সার সারে, গোমূত্রে প্রসব বেদনা হ্রাস হয়। এ যুগেও হয়।

নানক আমাদের কুসংস্কার আর আধ্যাত্মিকতার মধ্যে পার্থক্য শেখালেন। জগতের মালিক যিনি তাঁকে চাইতে বললেন সহজে, মন্ত্রতন্ত্র কৌশলে না। মানুষের সেবায়, সৎ জীবিকায় আর নামগানে। এখানে ফাঁকি কিছু নেই। নানক বললেন, অল্প অল্প অভ্যাস করো, হয়ে যাবে। মনে শান্তি আসবে। মনে শান্তি এলে মাধুর্য জাগবে। মাধুর্য জাগলে জীবন ডালপালা মেলে অন্যের ছায়া হবে। নিজের হৃদয় নিজের তীর্থ হবে।

নানক বললেন, যা কিচ্ছু পাচ্ছ, মনে রেখো দাতা এক। দেবার মালিক এক। এ সংসার যার থেকে প্রতি মুহূর্তে হচ্ছে, সেই তিনিই দিচ্ছেন যা কিছু। যা পাচ্ছ তাঁর হাত থেকেই পাচ্ছ। এটুকু মনে রাখলে, যা দেবে সবটুকু তাঁর হাতেই পৌঁছাবে।

গলাবাজি, তর্কবাজি, ক্ষমতাবাজি - এসবের মধ্যে শান্ত থেকে নিজের কাজটুকু করে যাওয়া সাধনা। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়ার খেয়োখেয়ি লড়াই থেকে বেরিয়ে এসে নিজের অনুভূত, স্বার্থগন্ধহীন মহৎ সত্যের প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই অনেক কঠিন। নানক মর্দানাকে নিয়ে হাজার হাজার মাইল হেঁটে ফেললেন শুধু এই কাজটার জন্য। কোনো লড়াই না। কোনো রক্তক্ষরণ না। কোনো কূটকৌশল না। কোনো সুক্ষ্ম তর্ক না। একটি শক্তিতেই তিনি জগতকে জয় করলেন, নিজের চরিত্রবলে। সংসারে তাঁর আগে যারা এসেছিলেন, এবং পরেও যাঁরা মানুষের চিত্তজয় করেছেন, জগত গুরুর আসনে আসীন করেছে যাকে মানুষ, তাঁদের শক্তি বলতে এই একটাই, চরিত্রবল।

আবার দিন যায়, তর্ক ফেনিল হয়, স্বার্থবোধ সুক্ষ্ম হয়। অনেক কপটাচারী আবার গুরুর আসনে বসতে জগতে এসে দাঁড়ায়। অন্ধকে অন্ধ পথ দেখানোর মত। তারা ভাবে নানা কৌশলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। বিনা চরিত্রবলে যে তা সম্ভব নয়, সে বিশ্বাসই করে না। ভাবে মানুষকে মুগ্ধ করতে পারলেই তার কাজ সমাধা হয়। সাময়িকভাবে হয় বটে। মানুষ মুগ্ধ হয়। সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিতও করে কিছুকালের জন্য। কিন্তু মহাকাল এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

নানকেরা থেকে যান। সুক্ষ্ম তর্কে না, কূট যুক্তিতে না। অসীম ভালোবাসা আর আত্মত্যাগের চরিত্রবলে। যে আলো চায় সে পায়। যে রঙমশাল খোঁজে, সে বাজারে এ দোকান সে দোকান ঘুরে মরে। সবই আছে সংসারে। আমার চাওয়ার আন্তরিকতার উপর নির্ভর করে সবটুকু। নানকের মত জগত শিক্ষকেরা এইটুকু বিশ্বাসের কথাই বলে যান কানে কানে বারবার।

 

182
Tue, 11/16/2021 - 22:00

 

প্রাণের মানুষ আর কাজের মানুষ। কাজের মানুষ দরকারের মানুষ। সে দরকার যতই কিনা গুরুত্বপূর্ণ হোক, তার একটা মেয়াদ আছে। কিন্তু যে প্রাণের মানুষ সে যতই কিনা অকাজের হোক, গোলমেলে হোক, যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন, তার মেয়াদ আর ফুরোবার নয়। অনেক মায়েরা যেমন ভীষণ জ্বালাতনকারী সন্তানকে 'পেটের শত্রু' উপাধিতে ভূষিত করেন, এও তেমন।

এই যেমন ধর্ম দিয়েই শুরু করা যাক। এই যে এত এত অবতার, গুরু, মন্দির ইত্যাদিকে অনেকে আমরা প্রাণের সঙ্গে জুড়িয়ে রাখি, নাস্তিকেরা আবার যেমন নানা রাজনৈতিক দার্শনিক, নেতাদের ফটোতে মালা দিয়ে প্রায়ই ভালোবাসা জানান, এতে দোষের কিছু আছে? নেই। কিন্তু যে প্যারাসিটামল আবিষ্কার করেছিল, কি সেফটিপিন, কি মোটর সাইকেল, কি ওয়েবসাইট, কি কণ্ডোম, কি রান্নার গ্যাস, কি কমোড ইত্যাদি আবিষ্কার করেছিল, তাদের নাম কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করুক দেখি, অমনি গুগুল খুলে খুঁজতে হবে। সেও যেনা আজকাল গুগুল আছে বলে। আগের দিন হলে সিধু জ্যাঠাকে খুঁজে বার করো। অথচ দেখো রাতদিন এদের নিয়েই বেঁচে থাকা।

তবে কি মানুষ অকৃতজ্ঞ? একদিক থেকে হ্যাঁ হলেও, গোটা দিক থেকে না। যে চিকিৎসক আমায় কঠিন রোগ থেকে বাঁচালেন তাকে ভুলতে বেশিদিন লাগে না। কিন্তু কোনো এক কবিকে স্মরণ করে হয় তো মাঝে মাঝেই আমি বিগলিত হই।

এর কারণ একটা আছে। মানুষের কাজ, প্রয়োজন, একটা সীমায় আবদ্ধ। মানুষের অনুভব তো নয়। কাজের মানুষ তাই আমাদের বৈঠকখানা অবধি এসেই, আমার নানাবিধ সৎকারে, আপ্যায়নে, তাৎক্ষণিক কৃতজ্ঞতায়, আবেগে যা পাওয়ার পেয়ে চলে যান। কিন্তু প্রাণের মুগ্ধতা তো অন্দরমহল ছাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু অন্দরমহলে আসবে কে?

বাঙালি একদম প্রফেশনালিজম বোঝে না। সব ক্ষেত্রেই সে দাদা-কাকা-মেসো-পিসে বানাতে চায়। সে ভালো ব্যবহারকারী ডাক্তার, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, অফিসের বড়বাবু, হাসিমুখ টিকিট চেকার - এইসব খুঁজে বেড়ায়। কাজটার চাইতে ভালো ব্যবহারের ওপর টান তার বেশি। তাই ঠকেও বেশি। ঠকায়ও বেশি। তবে এ নয় যে শুধু ব্যবহারেই, কাজেও ঠকেছে এমন উদাহরণও আছে। সে অন্য প্রসঙ্গ।

এখন কথা হল, সংসার কাজের জায়গা না ভাব-ভালোবাসার জায়গা, এই নিয়ে মেলা বিতর্ক আছে। কি একটা শ্যামাসংগীত আছে, "পৃথিবীর কেউ ভালো তো বাসে না, এ পৃথিবী ভালোবাসিতে জানে না, যেথা আছে শুধু ভালোবাসাবাসি সেথা যেতে প্রাণ চায় মা"। এখন এরকম একটা স্থান মায়েরও জানা আছে বলে আমার বিশ্বাস হয় না। সেখানেও তো দেবতাদের কোন্দল, অসুরদের উৎপাত কম নয় বাবা!

তবে কাজের মানুষ হয়ে থাকা আর কাজের মানুষদের নিয়ে চলাতেই কম হ্যাপা দেখি। ও ভালোবাসাবাসি হলেই যত ঝামেলা। মান অভিমান এসবের হাজার একটা ফ্যাঁকড়া সামলাও। কাজের মানুষের খারাপ কথা, কাজের মানুষের দ্বিচারিতা, কাজের মানুষের ঠকানোর ইচ্ছা - এ সবই সয়ে যায়। প্রাণে লাগার কোনো দায় নেই। বরং যেই আপনি কারোর প্রাণের মানুষ হতে গেলেন অমনি আপনাকে বাগে পেয়ে সে আপনাকে যে তার কাজের মানুষ করে তুলবে না এ কথা কেউ দিতে পারে না। 'শ্যামা' নাটকটা মনে নেই? বেচারা উত্তীয়'র কথাটা ভাবুন। শ্যামা ভালোবাসল বজ্রসেনকে। কিন্তু ভালোবাসলে কি হবে, সে তো মিথ্যা চুরির দায়ে ফেঁসেছে। তাই শ্যামার মন উচাটন। এদিকে উত্তীয় শ্যামার প্রাণের মানুষ হওয়ার জন্য পাগল। ব্যস, শ্যামার কাজের মানুষ হয়ে গেল সে, বজ্রসেনের দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে প্রাণটা দিল বেঘোরে। কাজে লাগালো কে তাকে? না সেই শ্যামা! হায়, "হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান?"

শাস্ত্র বলে সংসারে নিজেকে কাজের মানুষের বেশি আর উঠিও না। ওসব ভালোবাসাবাসির চক্কর ছাড়ো। শেষে সব একগাল মাছি হবে। তখন সবাই আমায় ধোঁকা দিল, কেউ আমায় বোঝে না, সবাই অকৃতজ্ঞ, বেইমান - এইসব বস্তাপচা কথাগুলো বলে জগত হেদিয়ে বেড়াবে। এই নিয়ে মেলা মেলা দার্শনিক বই লেখা হয়ে গেল। রোমান্টিক সিনেমাগুলো দেখো না, ওইজন্য বিয়ের পর আর এগোয় না। তবে তো আবার প্যারালাল সিনেমা বানিয়ে ফেলতে হবে। দর্শক কই তার? ক'টা পুরষ্কার আর ক্রিটিকের ভরসায় সবাই কি আর সিনেমা বানায় বাছা?

কেউ কেউ আবার এই ঝক্কি সামলাতে অমানুষী বা ফটোমানুষীকে প্রাণের মানুষ করে ফেলে। কেউ কুকুর-বেড়াল, কেউ বাগান-বই, কেউ দেবতা-গুরু-অবতার, কেউ ডুগি-তবলা, আঁকা-নাচা-গানকে প্রাণের মানুষ করে। বললে বলে, আমি এই নিয়েই আছি, বেশ আছি। মায় বিদ্যাসাগরকে দেখুন। আজকাল তো দেখি অনেকেই বিদ্যাসাগরের ওই কার্মাটাড়ের জীবনের উপর বই লিখছেন। লোকে আসলে বুঝছে, বিদ্যাসাগর যা করেছেন, তার চাইতে ঢের সত্য যা করতে পারেননি। তাই ওদিকে মানুষে টান বেড়েছে আজকাল এত।

যা হোক, লেখা অনেক দূর গড়ালো। আর বেশি কথায় কাজ নেই। প্রাণের মানুষ লালন খুঁজে পায়নি যখন আমাদেরও বিটা ভারসান নিয়েই কাজ চালাতে হবে এটা মেনে নিলেই ভালো। "তুমি আমার আমি তোমার" - এর একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে। কিন্তু সংসারে কাজের আর শেষ থাকে না। তাই বৃন্দাবনে কৃষ্ণের লীলার দিন শেষ হয়, কিন্তু হতভাগা, বাড়ি খেদানো বিধবাদের দরকার আর শেষ হয় না। এক মুঠো চালের জন্য সারাদিন নামসঙ্কীর্তন করে তবে বেঁচে থাকে। নইলে মরতে হবে। এই নিয়ম। কঠিন। কিন্তু সত্য। বাকি সব মায়া হে নন্দলাল।

 

183
Sun, 11/14/2021 - 13:00


আমার কিশোর বন্ধুরা, এ লেখা বিশেষ করে তোমাদের জন্য। আমি পর পর কয়েকটা আত্মহত্যার খবর পেয়ে একটু বিচলিত, তাই কিছু কথা একটু আলোচনা করতে চাই। দেখো, নেশা শব্দটা তোমরা শুনেছ। আমি এই নেশা নিয়েই কয়েকটা কম আলোচিত দিক নিয়ে কথা বলতে চাই। 

    দেখো, তোমরা শুনেছ যে মানুষ সিগারেট, মদ, গাঁজা এরকম নানা নেশা করে। তোমরা জানো এগুলো বাইরে থেকে মানুষ কিনে বা জোগাড় করে নিজের নেশার ইচ্ছাকে তৃপ্ত করে। এখন একটু ভেবে দেখো তো, নেশা আর অভ্যাসের মধ্যে ঠিক পার্থক্যটা কি? নেশার জিনিসটা আমার উপরে তার কন্ট্রোলিং পাওয়ার পেয়ে বসে। এটাই হল সব চাইতে খারাপ দিক নেশার। বাকি শরীরের উপর কি প্রতিক্রিয়া সেই নিয়ে আমার এখানে আলোচনা করার দরকার নেই। আমার কথা হল যে সেটা তোমার উপর তার কন্ট্রোলিং পাওয়ারটা পেয়ে বসে। তুমি সম্পূর্ণ তার কন্ট্রোলে চলে যাও। 

    এখন দেখো, কারুর কন্ট্রোলে যাওয়াই কি ভালো? দেখো তোমরা ইতিহাসে পড়েছ যে অনেক আগে মানুষ ভাবত যে নানা দেবতা এই ঝড়, বৃষ্টি, আলো, বাতাস ইত্যাদি এইসব চালাচ্ছে। মানে মানুষ ভাবত যে তার সব কাজ নানা দেবতাদের নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে। তোমরা জানো কিনা জানি না, অনেকেই আগে মনে করতেন, দুর্ভাগ্যবশত এখনও মনে করেন যে পক্স মানে হল শীতলা মায়ের ইচ্ছা। যেমন আগে পাশ্চাত্যে ভাবত যে জলাতঙ্ক হল শয়তানের ভর। তাকে চার্চে নিয়ে গিয়ে যা তা করে মেরে ফেলা হত। তো এরকম অনেক অনেক উদাহরণ তোমরা ভাবলেই পেয়ে যাবে যে আগে আমরা আমাদের জীবনটাকে কত কিছুর নিয়ন্ত্রণে ভাবতাম। কিন্তু বিজ্ঞান যত এগোলো তত আমরা বুঝলাম যে কোনো নির্দিষ্ট কিছুর একটা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কিচ্ছু নেই। সবই একটা তন্ত্র বা সিস্টেম। যেমন ধরো তোমার শরীরটা। তোমার প্রেসার, সুগার যাবতীয় কাজ চালাতে কি দারুণ একটা সিস্টেম বানানো হয়েছে। সেরকম আমাদের রাজনীতিও দেখো। আগে একজন রাজা থাকত। তার কথা অনুযায়ী সব হত। এখন দেখো গণতন্ত্রের যুগ এলো। আবার সেই তন্ত্র কথাটা এলো। একার নিয়ন্ত্রণে হবে না, জনগণের নিয়ন্ত্রণ সব চলবে। মানে সব কিছুই একটা সিস্টেম। তোমার শরীরের এই সিস্টেমের সাম্যাবস্থাকে বলে হোমিওস্ট্যাটিক অবস্থা। 

    তো যেটা আমি বলতে চাইছি, দেখো তোমার জীবনটাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করবে এটা ঠিক নয় তাই। নেশা ঠিক সেই কাজটাই করে। তবে কি সব নিয়ন্ত্রণ খারাপ? তা ঠিক নয়। যদি মনে হয় যে তুমি কারোর পরিচালনায় থাকতে চাও, সে আলাদা। যেমন স্কুলে প্রধান শিক্ষক, দেশে মন্ত্রী, বাড়িতে অভিভাবক - এরকম। দেখো আমি শব্দটাকে চেঞ্জ করলাম। আমি কিন্তু নিয়ন্ত্রণ বললাম না। আমি বললাম 'পরিচালনা'। সেখানে একটা সম্মতির ব্যাপার আছে, সেখানে আলোচনার জায়গা আছে। কিন্তু নেশা সে সুযোগটা আমায় দেয় না। এই যেমন ধরো করোনা ভাইরাস। সে শরীরে ঢুকে পড়ে আমাদের সিস্টেমটার কন্ট্রোলিং পাওয়ারটা নিতে চাইছে বলেই যে না এত সমস্যা, আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি! 

    নেশার আরেকটা দিক দেখো, একটা বিবেচনাহীন সুখ। এর আকর্ষণ মারাত্মক। যে সিগারেটটা খাচ্ছে, সে সুখটা পাচ্ছে বলেই তো খাচ্ছে। সে সুখটা কোথায় জন্মাচ্ছে? তার শরীরে, সিগারেটের গায়ে না কিন্তু। সব নেশার সুখ জন্মায় আমাদের শরীরেই তো। সেই সুখ বিবেচনাহীন। কেন? না, তাতে আমার খারাপ হচ্ছে জেনেও আমি সেই সুখটাকে ছাড়তে পারছি না। মানে আমি আমার শরীরে জন্মানো সুখের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছি। এটা খুব খারাপ। 

    তবে জানো, সিগারেট, মদ এসবের থেকেও আরো কিছু খুব ক্ষতিকারক নেশা আছে। যেমন একটা সিগারেট দেওয়া যায় হাতে হাতে, তেমন একটা চিন্তা দেওয়া যায় কাউকে নানা পদ্ধতিতে। জিনিসটা একটু বুঝিয়ে বলি। এই যে বিভিন্ন রকমের গেমের নেশা দেখছ। এখানে কি শারীরিক সুখ হয়? না, এটা চিন্তার সুখ। এই চিন্তাটা একটা গেমের মাধ্যমে তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তুমি ওদের মত করে ভাবছ, ওদের মত করে খেলছ, ওদের মত হয়ে যাচ্ছ। ক্রমশ তুমি তোমার ওই বিশেষ ধরণের চিন্তার সুখে পড়ে গেলে। আমাদের যেমন চামড়ার শরীর হয়, তেমন আমাদের একটা মনের শরীর হয়। চামড়ার শরীরে যেমন মদ, সিগারেট ইত্যাদি সুখ দেয়, নেশা ধরায়, তেমনই মনের শরীরে বাইরের চিন্তারা এসে সুখ দেয়। নেশা ধরায়। তবে কি গেম খেলবে না? আলবাত খেলবে। শুধু দেখবে যে সেটা যেন তোমায় নিয়ন্ত্রণ না করে। তবেই বিপদ। নিজেকে ঠকাবে না। যখনই দেখবে তোমার ইচ্ছাটাকে তুমি চাইলেও আটকাতে পারছ না, তোমার রাগ হচ্ছে, ভীষণ রাগ হচ্ছে, তখনই বুঝবে তুমি নেশার অধীনে চলে গেছ। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়ছ। নেশা তোমায় দিয়ে যা খুশী করিয়ে নিতে পারে এখন। এমনকি তুমি নিজের জীবন নিয়ে নিতে পারো শুধু না, তুমি অন্যের জীবনও নিয়ে নিতে পারো। পেপার পড়লেই জানতে পারবে এমন হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

    আরেক নেশা আছে, টক্সিক সম্পর্কের নেশা। দেখো তোমার কাউকে না কাউকে ভালো লাগবেই। তাকে ভাবলে, সে কাছে এলে মনের মধ্যে আর শরীরে মধ্যে নানারকম সুখের অনুভব হবেই। এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ভেবে দেখবে যে সে সম্পর্কটায় তুমি ক্রমশ সেই মানুষটার কন্ট্রোলে চলে যাচ্ছ কিনা। কাউকে ভালোবাসা মানে কিন্তু নিজের জীবনের রিমোট কন্ট্রোল তার হাতে তুলে দেওয়া নয়। নিজের জন্য স্পেস রেখে যে ভালোবাসা, সেই আসল ভালোবাসা মনে রেখো। ভালোবাসা মানে অন্যের মত হওয়া না। ভালোবাসা মানে একে অন্যকে বোঝা, তার ভালোতে সাহায্য করা, তার খেয়াল রাখা। ভালোবাসা মানে একটা দায়িত্ব। সেটা সুখের একটা কারণ শুধু না কিন্তু। যদি তাই হয়, তবে তুমি নেশায় পড়ে গেলে। জীবনে এমন অনেক টক্সিক সম্পর্ক তৈরি হবে। দেখবে তুমি অন্যমনস্ক থাকছ দিনের বেশিরভাগ সময়ে, তুমি বাড়ির লোকের উপর অকারণে রেগে যাচ্ছো, ভালো বন্ধুদের উপর রেগে যাচ্ছ তারা কিছু বোঝাতে গেলেই, তোমার কিছুতে মন বসছে না, এমনকি তোমার নিজেকেও ভালো লাগছে না। তোমার রাতদিন মনে হবে কি করলে ওকে খুশী করা যায়, তোমার দিকে আরো অ্যাটেনশান আনা যায়। আর তোমার সেই ভালোবাসার মানুষটাকে নিয়েও তোমার মধ্যে নানা দোলাচাল শুরু হবে। তোমার কখনও মনে হবে সে ভালো, কখনও মনে হবে সে খুব অস্বচ্ছ। তাকে খারাপ তুমি ভাবতেই পারবে না। কারণ তুমি তার নেশায় অন্ধ। এটাকে কিন্তু ভালোবাসা ভেবে ভুল করে বোসো না। আখেরে ক্ষতি তোমার হবে। 

    তো মোদ্দা কথাটা হল দেখো, নিজের জীবনটার কন্ট্রোল কাউকে দেবে না। নিজেকে সব সময় নিজের চিন্তা-ভাবনা-বিবেচনাশক্তির মধ্যে রাখবে। সে-ই আমাদের জীবনের লক্ষণরেখা মনে রেখো। আর প্লিজ নিজের জীবনটাকে নষ্ট হতে দিও না। জীবন মানে অনেক অনেক অভিজ্ঞতা। অনেক অনেক সম্ভবনা। খামোখা কাউকে নিজের জীবনের গডফাদার বানিয়ে লাভ কি? তবে কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে না? করতেও পারো, নাও পারো। তবে ঈশ্বর সম্বন্ধে একটাই কথা আজীবন বিশ্বাস করতে পারো, তোমার মধ্যে যা কিছু ধৈর্যবান, সেই ঈশ্বর, সেই ভালো। ঈশ্বর কাউকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। তিনি শুধু আলো। শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, ঈশ্বর তোমায় পরিচালিত করতে পারেন তাঁর আলোকিত পথে, কিন্তু তোমায় তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া তাঁর কাজ না। 

    আর যদি তুমি ঈশ্বরকে না মানো, তবে সবসময় ভালো ভাবনাকে সঙ্গে রাখবে। সে যেখান থেকেই আসুক। ভালো যা কিছু তাকে কখনও ছাড়বে না। সেই তোমার সারা জীবনের সম্বল জেনো। ভালো থেকো সবাই। আত্মদীপ ভব। নিজেই নিজের আলো হও। আমার অনেক ভালোবাসা জেনো।

184
Wed, 11/03/2021 - 18:05

 “ — মল্লিক, আমার খেতে বেলা হয় বলে, রাঁধবার বামুন ঠিক করে দিছল। একমাস একটাকা দিছল। তখন লজ্জা হল। ডেকে পাঠালেই ছুটতে হত। — আপনি যাই, সে এক।…. এই অবস্থা যাই হলো, রকম-সকম দেখে অমনি মাকে বললাম — মা, ওইখানেই মোড় ফিরিয়ে দাও! — সুধামুখীর রান্না — আর না, আর না — খেয়ে পায় কান্না!”

    এ কথাটা এক স্বাধীনচেতা মানুষের। যে ভালোবাসার দান নেয়। যে ন্যায্য উপার্জন নেয়, কিন্তু নিজের সুবিধার জন্য কারোর কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিতে রাজী নয়। 

    অগত্যা কি হল, রাঁধুনিকে আর রাখা হল না। খেতে দেরি হয় হোক, কিন্তু বশ্যতা নয়। 

    মজার কথা হল দেশটা তখন স্বাধীন নয়। হাজার হাজার মানুষ সাহেবি বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা শুধু না, নিজের সুখ বিলাসের ব্যবস্থাও করছে। সে সময়ে দাঁড়িয়ে এত আত্মসম্মানের বোধ এনার জন্মালো কি করে? এমন তো নয় উনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, ওদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ইত্যাদি মত সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল। তা তো নয়! জম্মেছেন তো কামারপুকুর নামক ওই অজ গ্রামে। আর যে কাজ করতে কলকাতায় আসা সেও যে খুব উঁচুস্তরের তাও তো নয়। তবে এত স্বাধীনসত্তা জন্মায় কি করে? এত আত্মমর্যাদার মূল কি?

    এর কারণ রামকৃষ্ণদেব তাঁর উপলব্ধিকে সত্য করে জেনেছিলেন। কোনো কিছু পাওয়ার উপযোগী মাধ্যম হিসাবে না। তিনি কোথাও বলেননি ধর্মের মাধ্যমে সমাজে অমুক হবে, তমুক হবে। তিনি বলেননি যে অমুক বিজ্ঞানী, কি তমুক বড় মানুষ ধর্মকে সত্য বলেছেন বলে এটা সত্য। এ সব উনি বলতেন না। বরং ধর্মকেই বলতেন বালিতে চিনিতে মেশানো। বলতেন, সব ধর্মেই গোলমাল আছে। আমি আমার গভীরের সত্যকে অনুভব করেছি। তাকে 'মা' বলে জেনেছি। তোমায় যে আমার সঙ্গে মিলতেই হবে তার কোনো মানে নেই। শুধু বোলো না যে তোমারটাই সত্য আর আমারটা মিথ্যা। তবেই হল। 

    বার্ট্রান্ড রাসেল বলছেন, যিনি ধর্মকে সত্য বলে জানেন আমি তার সঙ্গে কথা বলতে রাজী, কিন্তু যিনি ধর্মের দ্বারা সমাজে অমুক তমুক উপকার হবে বলে চালাতে চান, আমি তার সঙ্গে কদাপি কথা বলতে রাজি নই। 

    কোনো কিছুকে যদি আমি সত্য বলে অনুভব করি তবে সেই অনুভবের সঙ্গে সঙ্গে আমার মধ্যে এক আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি হয়। যিনি অর্থকে সত্য বলে জানেন, তিনি অর্থনীতিবিদ হন, তিনি ধনসম্পদ জমিয়ে কুবের হয়ে যান না। যে কুবের হয় তার কাছে অর্থ লোভের বস্তু, সত্যবস্তু নয়। আমি যাকে ভালোবাসি সে যদি আমার ভালোবাসার সত্য হয় তবে আমি সুখে-দুখে রোগে-স্বাস্থ্যে, সম্পদে-বিপদে তাকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারি না। কিন্তু সে যদি আমার সুখের বস্তু হয়, ভোগের বস্তু হয়, তবে কিছু সমস্যা হলেই আমি তাকে ছাড়তে পারি অনায়াসে। যাকে ভালোবাসি দরকার হলে তার থেকে দূরত্ব রাখতে পারি ভালোবাসার মান রাখতে। কিন্তু সে যদি ভোগের হত তবে সে দূরত্বে আমার ক্ষোভ হত, রাগ হত, বিরহ জন্মাত না। 

    রামকৃষ্ণদেব সত্যকে অনুভব করেছিলেন। তাই অর্থ, মান, সম্মান, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির তোয়াক্কা করেননি। কারণ সত্যেই সত্যের প্রয়োজন শেষ হয়। যিনি মহাকাশ নিয়ে গবেষণা করেন যদি ভাবি তার কাজ শুধুমাত্র জোয়ারভাঁটার হিসাব রাখা, যাতে আমার স্নানে যেতে সুবিধা হয়; কিম্বা গ্রহণের খবর রাখা, বা ধূমকেতু এসে কবে আমাদের ধংস করবে সে-ই খবর রাখা, তবে আমরা সেই মহাকাশবিদকে অপমান করি না শুধু, তার অধীত বিদ্যাকেও অসম্মান করি। সত্যের খোঁজ সত্যতেই শেষ। সে কোনো কিছুর উপযোগী হোক চাই না হোক তাতে কিছু আসে যায় না।

    আবার দুজন মহান দার্শনিকের কথায় আসি। বার্ট্রান্ড রাসেল তার শেষ সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই সত্যই শেখাচ্ছেন, সত্যকে সত্য হিসাবেই মেনে নেওয়ার। আর রাসেলের বহু আগে আরেক যুগান্তকারী দার্শনিক ইম্যানুয়েল কান্ট বলছেন যে, সব নীতির মূল কথা ও শেষ কথা নীতিই। ক্যাটাগোরিকাল ইম্প্যারেটিভ শেখাচ্ছেন কান্ট। কিছু সুবিধা অসুবিধা হবে বলে নীতি না। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, খানদানি চাষার কাজই হল চাষ করে যাওয়া, সে বৃষ্টি হোক চাই না হোক। "কি দিবে ধর্ম তব? দুঃখ নব নব", রবীন্দ্রনাথ গান্ধারীর মুখ দিয়ে বলিয়ে নিলেন। 

    জীবনকে যদি রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় মানে আর হুঁশে সত্য বলে জানি, তবে যে কোনো অবস্থায় নিজেকে নিয়ে চলায় কোনো ক্ষোভ জন্মায় না। নিজের মান আর হুঁশকে জাগিয়ে রাখাই তখন আমার প্রধান কর্তব্য। কিন্তু জীবনকে যদি নানা ভোগের নিমিত্ত এক উপায় ভাবি, তবে আমার ক্ষোভের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না। আজ সুখের উত্তুঙ্গ শিখরে, তো কাল বিষাদের ঘন অন্ধকারে। সে জীবনে সহজ আনন্দ কোথায়? তখন এক বিষাদ থেকে আরেক বিষাদে জীবনের সুড়ঙ্গগামীতা। সত্য সাধনায় আত্মমর্যাদাবোধ আছে। সে কঠিন। তাই সে সত্য। "সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা।" রবীন্দ্রনাথ। "সত্যতে থাকলে ঈশ্বরলাভ হয়"। রামকৃষ্ণদেব।

185
Tue, 11/02/2021 - 19:30

 

ইচ্ছে ! –ইচ্ছে !

সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,

সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।।

সেই তো আঘাত করছে তলায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়–

বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে।।

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

মানুষ বলে কিছু হয় না। সব মন। মনই দেখে, শোনে, বলে, ভাবায়, ভাবে, রাগায়, রাগে, নাচায়, নাচে। সবই মন।

যদি বলো মন মানে কি? মন মানে ইচ্ছা, মন মানে চিন্তা, মন মানে অনুভব, মন মানে বোঝার আঁকিবুঁকি। মূলে হল গিয়ে ইচ্ছা। আমার ইচ্ছা যেমন আমি ভাবি তেমন, ভাবাই তেমন, দেখি তেমন, দেখাই তেমন। ইচ্ছা যদি মূলে না থাকত তবে জগৎজোড়া সত্যিই কলের কারখানা হত। ইচ্ছা আছে বলেই না এত বৈচিত্র্য। এক এক মানুষ। এক এক মন। এক এক মন, এক এক ইচ্ছা।

ইচ্ছা আবার দু'রকম। 'দেখানো ইচ্ছা' আর 'আসল ইচ্ছা'। আরশোলার ডানার মত। বাইরের বাদামীটা দেখানো ডানা। ভিতরের সাদাটা আসল ডানা, যা দিয়ে ওড়ে। সেরকম ইচ্ছা হল গিয়ে দু'ধরণের। লোককে দেখাই আমার এই এত এত ভালো ইচ্ছা। মনের ভিতর তাকালেই দেখো, হাজার হাজার আরশোলার মত ফড়ফড়ানো অন্য ইচ্ছা।

ইচ্ছার মালিক কে? আমি তো ইচ্ছা করলে অনেক কিছু করতে পারি রে, আবার পারিও না। কিন্তু ইচ্ছাটারে ইচ্ছা করি কি করে? এ তো একটা সমস্যা! মন কি শুধু ভালো ইচ্ছার কারখানা নাকি? তবে আর এত খুনী-ডাকাত হয় কেমনে? ইচ্ছা কখন লোভ হয়, ইচ্ছা কখন ঈর্ষার কথা শুনে খুনী হয়, ইচ্ছা কখন বদলা নেওয়ার জন্য উগ্রপন্থী হয় - সেকি আমার হাতে নাকি রে দাদা! কতজনরে আজ অবধি যে আমরা মনে মনে অ্যাদ্দিন খুন করে ফেলেছি রে দাদা, সে যদি এই বাস্তব জগতে হত তবে জজসাহেব আমায় ফাঁসি দিয়ে দিয়ে থকে যেত না রে! খুব যেত!

তবে এই ইচ্ছাগুলোরে থামাই কি করে রে বাপ! সে তো আকাশের চাঁদ চায় থেকে থেকে। চড়-থাপ্পড় মাইরাও তো ফল পাই না নে। ক'দিন ঠিক থাকে তারপর আবার ফড়ফড়ায়। আমায় ডাকে। কি মোহিনী সে ডাক দাদা গো! জ্যোৎস্নারাতে নীল শাড়ি পরে কোনো এক পরী যেন আমার উঠানে সুগন্ধি মেখে আমার অপেক্ষায়। হায় রে হায়, এই তো ইচ্ছার রকম দাদা। এদের পাঠায় কে? নিষিদ্ধ ইচ্ছা, অতিইচ্ছা, অবাস্তব ইচ্ছা - এসবের জন্ম কে দেয় দাদা? ইচ্ছা কি স্বাধীন? আপনি আপনিই জন্মে যায়? এরকম একটা জিনিস আল্লাহ্, ঈশ্বর, গডে কি করে সৃষ্টি করে দাদা! তাঁর সৃষ্টিতে এরকম একটা উটকো অশান্তি ডেকে আনা কি উচিৎ কাম হয় তাঁর? আর যদি আপনি নাস্তিক হন, মানে আপনি যদি বিবর্তনের তত্ত্বে বিশ্বাসী হন, তবে আমারে বলুন দেখি এইরকম একটা উটকো মাল প্রকৃতি অ্যাদ্দিন ধরে সহ্য করে কি মতলবে? বলি আমাদের লেজ, অ্যাপেণ্ডিক্স, কানের পেশী ইত্যাদি ইত্যাদি কিসেরে না প্রায় হাপিশ করে দিল, আর এই উটকো ইচ্ছাগুলানরে ফেলাইতে পারল না! মানুষ ভাবলেই যেন ভালো ইচ্ছা জম্মায়, এমন কেন হল না বলতি পারেন?

কেউ পারে না। শাস্তি দেওয়ার লগে কোর্টে, আসমানে, পরজন্মে সব ব্যবস্থা দেওয়া আছে। কিন্তু উটকো ইচ্ছা কোত্থেকে জন্মায় কেউ বলবারে পারে না। কি আশ্চর্য!

আমি ফ্লাইওভারে চড়ে জগতের দিকে তাকাই আর হাঁ হয়ে যাই। এক এক মানুষ, এক এক ইচ্ছার কল। কে যে দম দিয়ে ছাড়ি দেলো রে দাদা আমার, মানুষ শুধু ঘুরেই মরে, ঘুরেই মরে...। লোকে বলে, আমার ইচ্ছা তাই এমন করলাম, বললাম, ভাবলাম। যেন ইচ্ছাটা সে-ই জন্ম দিয়েছে। যেন সে চাইলেই ইচ্ছাগুলো হুস্ হুস্ করে জন্ম দিতে পারে! এমনই মোহে থাকি গো আমরা দাদারা।

আচ্ছা বাইরের ইচ্ছাগুলো কি কি? এই যেমন সেখানে আসলে বাঁধ দেওয়া আছে। হাজার একটা নিয়মের গুঁতোয় আমার ইচ্ছাগুলোর পায়ে শিকল দেওয়া আছে। লোকে বলে, ইচ্ছানুযায়ী চললেই যেন সবাই স্বাধীন। বোকা, তবে আর সভ্য জগতে থাকা কেন বাপু! জঙ্গলে গেলেই হয়। সভ্য জগতে এসে পড়েছি বলেই না আমার ইচ্ছাদের শাসন করার একটা ফিকির বার করা গেছে। শাস্তি মানে কি? ইচ্ছার ডানা ছাঁটা। সমাজ আমাদের বলে বলে দেয়, এই ইচ্ছাগুলো ভালো, মানে সামাজিক। এগুলো বাজে, মানে অসামাজিক। আবার দেখো, সমাজ বদলায়, ইচ্ছাদের ছাড়পত্রও বদলায়। এই যেমন আগেকার দিন বলে সমাজে কত কত বিধিনিষেধ, অমুক তমুককে বিয়ে করতে পারবে না, অমুকের তমুক হলে আর বিয়ে হবে না, অমুক তমুককে ভালোবাসতে পারবে না। এরকম হাজার একটা নিয়ম ছিল। যে যে ইচ্ছা আটকাতে পারবে, সে যেন তত ভালো সমাজ বানাতে পারবে, এমন একটা মারাত্মক গোঁড়ামি ঢুকেছিল আমাদের মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে আমরা বুঝলাম, আসলে সব ইচ্ছাতেই অত ক্ষতি নেই, তখন অল্প অল্প করে ছাড় দিয়ে দিয়ে দেখতে শুরু করলাম। কেউ কেউ ভয়ানক ভয় দেখালো, বলল সব্বোনাশ হবে! ও দিদি, ও দাদা, একি করলেন! কিন্তু আদতে দেখা গেল সব্বোনাশ হল না। এই করে করে অল্প অল্প মানুষ তার ইচ্ছা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করছে আর গণ্ডী বড় করছে। তবে আমাদের আবার আরেক বায়নাক্কা আছে। আমাদের সাধ আছে আমরা আমাদের খুব স্পর্শকাতর করে রাখব। সে-ই হয় না, কিছু বাচ্চা থাকে অ্যাটেনশান চায়, কেঁদেকঁকিয়ে যে করেই হোক। তাই আমাদের সবার মাঝেমধ্যে ইচ্ছা হয় আমরা অপমানিত হব, আমরা ঠোঁট ফুলিয়ে এর ওর দিকে আঙুল তুলে বলব, "ওর ওই বিজ্ঞাপন আমার ভাবাবেগে আঘাত করেছে। আমার মনে ভীষণ দাগা দিয়েছে।" সব্বাই তখন আমার দিকে তাকাবে, আর ভাববে, বাব্বা! কি দামী একটা মন নিয়ে জম্মেছে গো, একটু বেশি নাড়াচাড়া পড়লেই কি আওয়াজ!

বোকাগুলো বোঝে না, যত বেশি প্রাণশক্তি যার তত বেশি সব কিছুকে আত্মস্থ করার ক্ষমতা তার। ভারতের সংস্কৃতি মানেই তো ইনক্লুসিভ। সে আবার কবে, "আমায় ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না ছি, আমি বেদব্যাসের ঝি", বলে পাড়া কাঁপালো?

আমার একটা গপ্পো মনে পড়ছে। একবার হল কি রামকৃষ্ণ ঠাকুরের ইচ্ছা হল গীর্জায় কেমন করে আরাধনা করা হয় তিনি দেখবেন। কিন্তু গোঁড়া মানুষের ভয় তো আছেই। তো তিনি জগদম্বাকে বলছেন, মা, আমি না হয় বাইরে থেকেই দেখব, ভিতরে গেলে যদি কালীঘরে আবার ঢুকতে না দেয়!

নাও, বোঝো! ওনার মত মানুষেরও ওই গোঁড়াগুলোকে কি ভয়! তা কি হয়নি? হয়েছিল তো, স্বামীজিকে কালী মন্দিরে ঢুকতে দিচ্ছিল না তিনি বাইরে ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মিশেছেন বলে! এও আছে। এদের ইচ্ছা হল নিজেদের চারদিকে পরিখা কেটে নিজেদের বেশ জানান দেয়। এ সব দেশে, সব ধর্মেই আছে। কোথাও বেশি, কোথাও কম।

দেখো দেখি, ইচ্ছার গল্প করতে করতে কোথায় এসে পড়লাম। তাহলে আমাদের কতরকম ইচ্ছা দাঁড়ালো? প্রথমত দুটো, 'লোক দেখানো' আর 'আসল'। তারপর এলো, 'সু' আর 'কু'। কিন্তু আসল কথাটার কোনো হদিস পাওয়া গেল কি? মানে এসব ইচ্ছারা জন্মায় কোত্থেকে? দাদা শোপেনহাওয়ার জ্যেঠু এত্ত বড় একটা বই লিখে ফেললেন গো, কিন্তু তাও কি কিছু ঠাহর করতে পারলেন? কিস্যু না! "ইচ্ছাময়ী তারা তুমি" বলে তো না হয় সাধক পার পেল? তেনারই বা এত গণ্ডগোলের ইচ্ছা কেন বুঝি না বাপু! কিন্তু আমাদের ইচ্ছার সূত্রটি কি তবে?

যদি বিজ্ঞানের কথা বলা যায়, তবে সে অনেক জটিল ধাঁধা। ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলেম আর পেলেম না। তাহলে তো বেশ হত না! সব খারাপ ইচ্ছাগুলো ট্রান্সপ্লান্ট করে ভালো ইচ্ছা ভরে দেওয়া যেত! সেই মগজ ধোলাইয়ের মত? খানিকটা তাই, তবে ভালোর জন্য। কার মতে কি ভালো বেরোবে, সে এক জ্বালা হবে। উঁহু সে হবে না, সেও ভালো কথা নয়। তবে আসল ভালোটা কি? রবি ঠাকুর সে আসল ভালো কথাটা বলে থুয়েছেন, "সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ-মাঝে জাগ্রত যে ভালো, সেই তো তোমার ভালো।"

এতএব মানে গিয়ে দাঁড়ালো, কুরুক্ষেত্র ছাড়ার জো নেই। তবে কোন ইচ্ছার সারথি কে, সেটা একবার দেখে নিলেই হল।

186
Tue, 10/26/2021 - 12:30

দেখুন, আমরা আপনাকে প্যানিক করার কারণ দেব। কিন্তু আপনি প্যানিক করতে পারবেন না। আমরা আপনাকে ঘৃণা, রাগ, বিদ্বেষ - এগুলোর খবর জানাব। আপনি স্থিতপ্রজ্ঞের মত থাকবেন। যদি না পারেন, আপনি কি করে কি করে স্থিতপ্রজ্ঞ থাকবেন সেও নানা টিপসের মাধ্যমে জানাব। আপনি শুধু আমাদের কিনুন। আমাদের দেখুন। 

    আসলে আপনার মধ্যে ঢোকার সহজতম রাস্তা কি বলুন তো? আপনার সেন্টিমেন্ট। তথ্য, সত্য, ন্যায়-অন্যায় - এইসব নিয়ে পাগলে ভাবে। আমরা না। আমরা এসবের উপর এমন আস্তরণ চড়াই যাতে আপনার সেন্টিমেন্টকে হিট করে। আপনার সেন্টিমেন্টই আমাদের টার্গেট। আপনি নন। 

    মনোবিজ্ঞানের ব্যাখ্যা রাখুন, আমরা দেখেছি আপনার সেন্টিমেন্টকে জাগিয়ে দিলেই আপনার বিবেচনা শক্তি অফ হয়ে যায়। দেখুন আমরা জানি মানুষ বিবেচক বাধ্য হয়ে হয়। মানুষ বিবেচক হতে ভালোবাসে না। মানুষ মনে মনে ঘৃণা করে বিবেচনার নগ্ন দৃষ্টিকে। নিরপেক্ষ সত্য সুখের নয়। বড় বেশি দাবী তার। তাই আমাদের ধর্ম আমাদের বোঝায় ঈশ্বরের আমার উপরেই একটা স্পেশাল দৃষ্টি আছে, স্পেশাল কেয়ার আছে যদি এই এইগুলো করি। সমদর্শী ঈশ্বরে আমাদের ক্ষোভ। আমি আর ওই পাপী একই হবে তোমার চোখে? কেন তুমি কি পাব্লিক টয়লেট? তুমি কি শপিংমল? তুমি কি খোলা ফুটপাত? সমদৃষ্টি?!! আমি ঘেন্না করি। তুমি আমার সেন্টিমেন্টকে বোঝো। আমিও তোমার সেন্টিমেন্টকে বুঝি। এটা যদি না বোঝো তবে তুমি হয় পাথর, নয় বায়বীয় তত্ত্ব। 

    তাই বললাম না, মানুষ বিবেচক হয় বাধ্য হয়ে, সেন্টিমেন্টাল হয়ে স্বভাবসুখে। আমি রাতদিন সেন্টিমেন্টাল থাকতে ভালোবাসি। আমার ধর্ম, আমার রাজনীতি, আমার দেশ, আমার পাড়া, আমার অভিনেতা, আমার অভিনেত্রী, আমার ঘুরতে যাওয়ার জায়গা, আমার প্রিয় খাবার, আমার পেস্ট-পোশাক-গাড়ি এ সবের ব্র‍্যাণ্ড - আমি সব বিষয়ে সেন্টিমেন্টাল। আমি আঘাত পাই। নইলে সুখ পাই। সেন্টিমেন্ট আমায় স্পষ্ট করে দুই দেয়। নয় আঘাত, নয় সুখ। আমি গ্রে জোন বুঝি না। আমি অতশত আনবায়সড ইত্যাদি প্রিটেনশানে যাব কেন? আমি জানি মানুষ সেন্টিমেন্টাল। ব্যস। ওতেই আমার কাজ গুছিয়ে নেওয়া যাবে। 

    তুমি বলবে যদি সেন্টিমেন্ট না থাকত তবে পৃথিবী নিষ্প্রাণ, বর্ণহীন হত। 

    তুমি একদম ঠিক বলেছ। সমস্যা তোমার সেন্টিমেন্ট থাকা নিয়ে নয়। সমস্যা তোমার সেন্টিমেন্টের এক্সপ্লয়েটেড হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে। এক্সপ্লয়েট করতে চাওয়া আর ছুঁতে চাওয়া কি এক? এক নয়। 

    এক্সপ্লয়েটেড সেন্টিমেন্টের ভার অনেক। সে যত এক্সপ্লয়েটেড হয় সে তত পাতি বাংলায় ঝাঁঝরা হয়। ঝাঁঝরা হতে হতে সিনিক হয়। সিনিক হতে হতে ভুলে যায় যে সেদিন দরজা খোলা হয়েছিল নির্বিচারে। সেন্টিমেন্ট তখন বিষ। তখন বিষের নেশা। আরো কড়া সেন্টিমেন্টের জিনিস দাও। আরো চড়াও নেশা। আরো আরো কঠিন নেশা চাই। 

    সেন্টিমেন্টের একটা বড় সমস্যা হল সেন্টিমেন্টের স্মৃতি ভীষণ কাস্টমাইজড হয়। রামকৃষ্ণদেব বলছেন একটা রসগোল্লা, যেই গলা দিয়ে নেমে গেল আর কোনো স্বাদ নেই। কি মারভেলাস এক্সাম্পল। তাই তো! সেন্টিমেন্টের সব কিছুই তো "এখনই"। তাৎক্ষণিক। নগদ সুখ, নগদ দুঃখ। হারাতে আর পেতে কতক্ষণ। এই নিয়ে কি আর শক্ত জীবন ভিত গড়া যায়?

    তোমাদের জীবন ভিত নাড়িয়ে উড়িয়ে দেব বলেই আমরা। তোমাদের সেন্টিমেন্টের ঘুড়িতে উড়িয়ে নিজের হাতে লাটাই রাখব বলেই আমরা। আমরা কারা? আমরা সমাজের প্রভাবক। আমরা সকাল থেকে রাত তোমার সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলি। তোমায় দরকার আমরা ঠিক করে দিই। তোমার শত্রু কে, মিত্র কে আমরা ঠিক করে দিই। কখন তুমি কাঁদবে, হাসবে সব আমরা ঠিক করে দিই। তুমি শুধু সেন্টিমেন্ট বাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমরা তোমায় জাগিয়ে রাখব সেন্টিমেন্টে। শুধু তুমি জেগে যেও না হঠাৎ করে তোমার বিবেচনা শক্তি নিয়ে। তবেই আমাদের ভীষণ বিপদ।

187
Sun, 10/24/2021 - 10:30

সত্য বহুমাত্রিক। জৈন তীর্থঙ্কর বললেন, সত্য অন্ধদের হস্তী স্পর্শনের মতন। কেউ লেজ ধরে বলবে, সরু। কেউ পা ধরে বলবে থামের মত। কেউ পেট ধরে বলবে, মোটা। এই উদাহরণটি পরে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন। 

    সত্য বহুমাত্রিক শুধু না, সত্য বাস্তবাচ্ছাদিতও। একটা খুনের ঘটনা বাস্তব। তার পিছনে খুনীকে খুঁজে বার করে তার মোটিভটা জানাই হল খুনের পিছনে সত্য। আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক। একটা লাঠি জলের মধ্যে ডুবে বাঁকা দেখায়। এ বাস্তব। এর পিছনে কারণটা জানতে পদার্থবিদ্যার সত্যকে খুঁজতে হবে। 

    এরকম নানা ভাবে বাস্তবের আড়াল সরিয়ে সত্যের সন্ধানে দার্শনিক, বিজ্ঞানী আর গোয়েন্দাদের কাজ চিরকালের। বাস্তবকে আমরা তাই বলি, আপাত সত্য। সব বাস্তবই আপাত সত্য। 

    যা জানার সত্য, আর যা অনুভবের সত্য, এরা তো আবার স্ববিরোধীও হয়ে দাঁড়ায়। যে জানে আর যে অনুভব করে, সে এক না দুই? যে জানে আর যে অনুভব করে দুজনকেই জানে চেতনা। নিজের ভিতরে সামঞ্জস্য তৈরি করতে হিমশিম খায় মানুষ। যদি না, সে মেনে নেয় সবটাই সত্য। অনুভবের সত্যকে উপেক্ষা করলে মানুষ কপট হয়, জানার সত্যকে উপেক্ষা করলে হয় বোকা। 

    পাথরের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে। তথ্য বলছে এ পাথর। অনুভব বলছে আমার ভক্তির এ মাধুর্যময় রূপ। এ পাথরের বেশি। একজন মানুষ। শারীরবিদ্যার জানা সত্য বলছে, এ নানা রাসায়নিক পদার্থের জটিল সংমিশ্রণ। অনুভবের সত্য বলছে, এ আমার সন্তান, এ আমার ভালোবাসা, এ আমার ভাই। এ রাসায়নিক পদার্থের থেকে অনেক বেশি কিছু। ধাতব তন্ত্রীতে লাগছে আঙুলের টোকা। উঠছে ধ্বনি। পদার্থবিদ্যার জানা বলছে, এ ধ্বনিবিদ্যা। অক্টেভ সূত্রে বাঁধা। অনুভব বলছে, এ যে মিঞা মল্লার, আমার চেতনা জুড়ে জমেছে মেঘ। এই দেখো আমার সজল আঁখি।

    তবে সত্য কি? সত্য সহস্রদল পাপড়ি। তবে মিথ্যা কি? মিথ্যা তাই, যা আমার জানাতেও নেই, আমার অনুভবেও নেই। যা নেই, তা-ই মিথ্যা। যা আছে, সে অনুভবে কি জানায়, যেখানেই থাকুক, তা সত্য। তাই তাজমহল কবরস্থান নয়। একটা লাঠি আর একটা বলকে ঘিরে অতগুলো মানুষের দৌড়ঝাঁপ পাগলামি না, ওটা ক্রিকেট। আমার দেশের অনুভব জড়িয়ে। তাই সে সত্য। 

    তবে মিথ্যার শরীর জন্মায় কিসে? সে তো একটু আগেই বললাম, না আমার জানায় সে আছে, নাতো আমার অনুভবে। তবে সে কোথায় থাকে? সে থাকে ভাষায়। মানুষের মধ্যে শারীরিক চোখের দৃষ্টি, বোধের দৃষ্টি ছাড়া আরেকটা দৃষ্টিশক্তি আছে। সে ভাষার চোখ। ভাষায় সে গল্প বলে। গল্প দেখে। মনের মধ্যে ভাষার মানচিত্র গঠন হয়। সেই ভাষার শরীর জুড়ে জন্মায় মিথ্যা। যে জ্ঞান আমার জানাতে নেই, আমার অনুভবে নেই, তাকে আমি আমার ভাষায় জন্ম-দিতে পারি স্বার্থ চরিতার্থের জন্য। এই 'জন্য' শব্দটা এখানে খুব জরুরি। 

    মিথ্যার কোনো সংশয় থাকে না, মিথ্যার কোনো 'কারণ' থাকে না, 'জন্য' থাকে। 

    যে কোনো ঘটনার দুটো ব্যাখ্যা হয়। এই কারণে এটা ঘটল। এর জন্যে এটা ঘটল। যখন বলি মহামারী ঘটল আমাদের পাপের জন্য, তখন সেটা আমার জানা বা অনুভব থেকে বলছি না, আমার মধ্যের অনুমান শক্তি দিয়ে বলছি। যে অনুমান শক্তি কাউকে দোষী না করে কোনো কিছুর কারণ পায় না। কারণ সমাজে সে ন্যায্য অন্যায্য কারণে বারবার দোষী হয়েছে। যদি বলি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিসের জন্য সৃষ্টি হল, তবে এই 'জন্য' এর কোনো অর্থ হয় না। ধর্ম নানা গল্প শোনায়। সে অনুমান। সে জানার বা অনুভবের কিছুর সত্যই নয়। এতো জোর দিয়ে কি করে বলা যায়? কারণ আমাদের সবার জানার বা অনুভবের একটা প্যাটার্ন হয়। সেই প্যাটার্ন অনুযায়ী সব কিছুকে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি। সেই প্যাটার্ন অনুযায়ী আমরা নানা বিদ্যাকে আলাদা আলাদা করি। সেই প্যাটার্নের বাইরে গেলে আমরা তাকে অস্বাভাবিক বলি। আগুনে হাত দিয়ে কেউ জ্বালাপোড়া অনুভব না করলে আমরা সেটাকে স্নায়বিক রোগ বলি। রসগোল্লাকে তেতো বললে সে রোগের লক্ষ্মণ হয়। 

    ভাষা আর অনুমানশক্তি - এরা সংসারে বেশিরভাগ সমস্যার মূল। ইতিহাস আর অভিব্যক্তি - একই বিষয়। ডারউইন যখন সৃষ্টির ইতিহাস শোনালেন, তখন অনেক অনুমান আর তার স্যাঙাত ভাষার আয়ু ফুরালো। কিছু মানুষ মানতে চায় না বলে আজও তারা দুজন পাশ্চাত্যের অনেক শিক্ষালয় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শুনি রিচার্ড ডকিন্সের কাছে। 

    তবে এই অনুমান ও ভাষার স্যাঙাতপনায় শুধুই কি খারাপ হয়েছে? তা ঠিক নয়। কারণ হাইপোথিসিস দাঁড়ায় কি করে তবে। সমস্যা হয় অনুমান যখন জ্ঞানের ভান করে। সে যখন কিছুতেই মানতে চায় না যে সে আসলে অনুমান, জ্ঞান নয়। ভাষা তাকে সে কাঠিন্য দিতে অবশ্যই সাহায্য করে। 

    তবে সত্যের এই যে অনন্তরূপ, এর কি কোনো প্যাটার্ন আছে? আছে। ক্রমবিবর্তনের সত্য। ক্ষুদ্র সত্য থেকে বৃহৎ সত্যের দিকে যাওয়ার রাস্তা। সে বৃহৎ মানে সু-উচ্চ নয়। সে আরও আরও উদার। দিন রাত্রির বিরোধীতা যেমন এক আহ্নিকগতি বুঝলেই মেটে। তেমনই আমাদের দরকার সেই উদার সত্যের দিকে যাওয়া, যে সত্য আমায় ক্ষুদ্রতার হাত থেকে রক্ষা করবে। 'অসতো মা সদ্গময়' - তাই মানুষের প্রাচীন প্রার্থনা।

 

188
Thu, 10/21/2021 - 15:00

রেপ অনেক বড় একটা কথা। কিন্তু প্রতিদিন অল্পস্বল্প যে অ্যাবিউজমেন্টগুলো ঘটে চলে তার দিকে তাকালে একটা কমোন ঘটনা পাওয়া যায়।

    আমি যতগুলো ঘটনা শুনলাম আজ অবধি, খুব কাছের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় পরিচিত, শিক্ষক ইত্যাদির থেকে, আমার মনে হয় আমি একটা টার্ম বলতে পারি, ম্যারিনেটিং ফেজ।

    যে অ্যাবিউজ করতে চায়, সে প্রথমেই তার শিকারে ছোবল মারে না। শিকারকে নিয়ে সে খেলবে। আমি মনোবিদ নই। কিন্তু দীর্ঘদিন মানুষের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে, কথা শুনতে শুনতে যেটা আমার সব চাইতে দরকারি আর কম আলোচিত অংশ মনে হয়েছে সেটা হল এই ম্যারিনেটিং টাইমটা। আমি আবারও বলছি এটা কোনো মনোবিজ্ঞানের ভাষা নয়, আমি একটু লিবার্টিই নিচ্ছি এই শব্দটার মাধ্যমে আমার কথাটা বোঝানোর জন্য।

    যে অ্যাবিউজ করে আর এক্সপ্লয়েট করে, তার মধ্যে এই একটা ক্ষমতা থাকেই। ম্যারিনেট করার। ম্যারিনেট করার সময় শিকার নিজের অজান্তেই তার শিকারীকে লিড করে। কিভাবে?

    আমি কয়েকটা দিক নিয়ে একটু কথা বলব।

 

১) অতিরিক্ত বন্ধুতাপ্রবণতা

=================

    যে কোনো বিষয়েই এই 'অতিরিক্ত' দিকটা খুব সন্দেহের। আমাদের চলতি কথাতেই আছে 'অতিভক্তি চোরের লক্ষণ' ইত্যাদি। কেউ যখন অতিরিক্ত আগ্রহ দেখাবে আমার সব কিছুতে তখন বুঝতে হবে কিছু একটা সমস্যা আছে। তবে এই অতিরিক্ত দিকটা বুঝব কি করে? আমার মনে হয় একটা সহজ পরীক্ষা আছে এর।

    কেউ যখন তার নিজের মতামত, ভালোলাগা, মন্দলাগা সমস্ত উপেক্ষা করে শুধুমাত্র আমার হাঁ-তে হাঁ আর আমার না-তে না মিলিয়ে যাচ্ছে, তখনই সাবধান হওয়া। তার নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।

    এখন কথা হচ্ছে কেউ যদি আমার প্রেমে হাবুডুবু খায় সে-ও তো একই ব্যবহার করতে পারে।

    হয় তো পারে। আমায় ইমপ্রেস করার জন্য সে আমার পছন্দ অপছন্দকে নিজের থেকে বেশি গুরুত্ব নিশ্চয়ই দিতে পারে। সেখানে এ দুটোকে আলাদা করার উপায় হল, অপেক্ষা করা।

    সময় একমাত্র দিশা দেখাবে। ভালোবাসার ডাক সমগ্র সত্তার ডাক। যে ভালোবেসেছে তার কোনো অপশান নেই ভালোবাসা ছাড়া। সে অপেক্ষা করবে বিনা অস্থিরতায়। সে কোনো বিকল্পের দিকে যাবেই না। সে একান্তভাবে অপেক্ষা করবে আমার সম্পূর্ণ সত্তার সাড়া পাওয়ার।

    কিন্তু যে শিকার করতে এসেছে, সে আমার পাশাপাশি আরো চারদিকে নজর রাখবে কাদের জন্য আরো জাল বিছিয়ে রাখা যায়। কারণ শিকারী নিজের জৈবিক প্রবৃত্তি দ্বারা পরিচালিত। সব জৈবিক প্রবৃত্তিই ভীষণ তীক্ষ্ণ, অধৈর্য আর চাতুরীসম্পন্ন, অতৃপ্ত। ভালো করে খেয়াল রাখলে, নিজেকে নির্মোহ রাখার চেষ্টায় রাখলে শিকারীর কয়েকটা লুজ বল চোখে পড়বেই পড়বে। যদি নিজেকে না ঠকাতে চাই।

    কিন্তু সেটা করা খুব কঠিন। এই প্রেমহীন, স্বার্থকেন্দ্রিক সংসারে কারোর 'মেঘ না চাইতে জল' নিয়ে আসা ছদ্মবেশী ভালোবাসাকে চিনেও না চেনার দুর্বলতা মানুষের প্রকৃতির মধ্যেই। মানুষ মিথ্যাকে দেখতে পায় না তা নয়, মানুষ মিথ্যাকে দেখেও নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, ছলনার সঙ্গে তাকে সত্য বলে মেনে নেয়। এ মানুষের চরিত্রের বোধহয় সব চাইতে দুর্বল দিক। নিজের সঙ্গে এ ছলনাটা মানুষ নিজের অজান্তেই করে ফেলে। অবশ্যই সব ক্ষেত্রে নয়। অনেক সময়েই একটা জেনুইন ইনোসেন্স এক্সপ্লয়েটেড হয়, অ্যাবিউজড হয়। ইম্যানুয়েল কান্ট তাই হয় তো আক্ষেপ করে বলেছেন যে ইনোসেন্স জিনিসটা অবশ্যই ভীষণ স্বর্গীয়, কিন্তু ভীষণ মিসলিডিং।

    এই দোলাচালেই শিকারীর ম্যারিনেশানের সময় শিকার অজান্তেই লিড করে শিকারীকে নিজের দিকে। শিকারী তাই বলার সুযোগ পায়, "তুমি যেন চাওনি"। আসলে এই "চাওনি" কথাটা ভীষণ জটিল। বহুমাত্রিক। শরীরকে তো অনেকেই ছোঁয়। চিকিৎসক, বন্ধুদের ইয়ার্কি ফাজলামি, রাস্তাঘাটে গুঁতো-ঠেলা, ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু সে ছোঁয়ায় অপমান জন্মায় না। নিজেকে রিক্ত করে যায় না। অ্যাবিউজ মানুষকে রিক্ত করে। আর এই সুক্ষ্ম খেলায় শিকার বুঝে উঠতেই পারে না, তার নিজের এ খেলায় কতটা অবদান ছিল বা ছিল না। তার মনে এই ধোঁয়াশা যে অত্যন্ত সুচতুরভাবে শিকারী দ্বারা সচেতনভাবে সৃষ্ট, সে কথা সে স্বপ্নেও কল্পনা কর‍তে পারে না অন্তত প্রথম দিকে। পরে যখন বোঝে তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। ঘোর কাটতে সময় তো লাগে।

    দেখুন এই হালকা ফুলকা ম্যারিনেট আমাদের অনেকেই করে। কাজটা গুছিয়ে নেওয়ার আগে সবাই মিষ্টি ব্যবহার করে থাকে, সে সেলসম্যান হোক, নেতা হোক, অনেক ভুঁইফোড় টুরিস্ট সংস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি তো আছেই। স্বয়ং রামপ্রসাদ ম্যারিনেশানের বিরুদ্ধে জগদম্বার কাছে নালিশ জানাচ্ছেন, "নিম খাওয়ালে চিনি বলে"। যা হোক এবার দ্বিতীয় পয়েন্টে আসা যাক।

 

২) শিকারের দুর্বলতার খোঁজ

====================

    এই আরেক জায়গা যেখানে তুমি শিকারীর হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারো নিজেকে শক্ত রেখে।

    ভালোবাসার মানুষ আমার গুণ খোঁজে। আমার পজিটিভি দিকটাকে এনকারেজ করে। সে এমন কিছু সদগুণ দেখতে পায়, যা আমার ছিল আমি জানতাম কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল না। ভালোবাসার মানুষ সে আত্মবিশ্বাসটা তিল তিল করে গড়ে দেয়। আমি অধৈর্য হলেও সে অধৈর্য হয় না।

    শিকারী আমার দুর্বলতা খোঁজে। যেখানে আমি সহানুভূতির মলম চাই সে সেই খাঁজ, ক্ষতগুলো খুঁজে বেড়ায়। সে সারাদিন মলম নিয়ে ঘোরে। সে দুটো খেলা খেলবেই, এক, আমায় বিশ্বাস করিয়ে ছাড়বে যে তার চাইতে আমায় কেউ ভালো বোঝে না শুধু না, সে আমায় বোঝাবে যে আমায় কেউ বোঝে না এটা নিয়ে সে নিশ্চিত। আর দুই, সে আমায় আমার পরিবেশ থেকে, আমার আশপাশ থেকে আমায় বিচ্ছিন্ন করবে।

    এ দারুণ টোপ। সবাই নিজেকে স্পেশাল ভাবতে চায়। সবাই মনে করতে চায় তাকে কেউ বোঝে না। যদিও এর খানিকটা সব সময় সত্যি কারণ আমরা কেউ-ই কাউকে স্পষ্ট করে বুঝি না। শিকারী এই টোপটায় আমাকে আমার পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে চায়। সে আমার পরিবেশ নিয়ে আমার মনকে নেগেটিভ করে তুলতে চায়। সে চায় আমি যেন তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করি। আমার চারপাশের শিকড়টাকে খুব সুচতুরভাবে কেটে দিয়ে সে শিকারকে নিয়ে গিয়ে বনসাই করে রাখতে চায়। অবশ্যই এ বিশ্বাস জাগানোর ক্ষমতা বা আর্ট সে অত্যন্ত অধ্যবসায়ের সঙ্গে রপ্ত করে। আর তাকে সে ইন্ধন জোগায় তার অতৃপ্ত বিকৃত জৈবিক লালসা।

    শিকারী এইভাবে সব সময় শিকারের দুর্বলতাকে জাগিয়ে রাখে। দুর্বলতাকে নিজের কপট সহানুভূতির মলম লাগিয়েই যায় যতক্ষণ না শিকার অবশ হয়ে নিজেকে আত্মসমর্পণ করে দেয়।

    এখানে আরেকটা ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট আছে। যদি সৌভাগ্যক্রমে শিকার টের পেয়ে যায় খেলাটা, তৎক্ষনাৎ যে আক্রমণটা তার দিকে ধেয়ে আসে, "তোমার মত অকৃতজ্ঞ আর দুটো নেই। আমি তোমার জন্য এত করলাম, তোমায় কে চিনত? আমি না থাকলে তুমি কে? কোথায় পড়ে থাকতে?".... ইত্যাদি তীব্র বিষ বর্ষণে শিকারকে বিধ্বস্ত করে তোলা। শিকারের আত্মসম্মানবোধ, শিকারের বিবেকবোধকে যন্ত্রণার চরম সীমা অবধি নিয়ে যায়, যাতে শিকার নিজেকে ঘৃণ্য, ওয়ার্থলেস, অকৃতজ্ঞ, নীচ ফিল করে। এতে দুটো সুবিধা। এক যদি শিকার আবার এই টোপটা খেয়ে যায়। যে কৃত্রিম খাদের ধারে নিয়ে এসে দাঁড় করাতে চায় শিকারী, একবার যদি তাকে সত্যি বলে মেনে নিয়ে ফিরে আসে। অন্যথায় যদি নাও বা ফেরে শিকারী অন্তত নিজের ইগোটাকে তুষ্ট করতে পারে। অবশ্যই ছলনায়।

    এবারে তৃতীয় পয়েন্টে আসি। যা কিছুটা তাত্ত্বিক।

 

৩) অ্যাবিউজ শুধু শারীরিক হয় না

========================

    শরীর আর মনের এমন পৃথক অস্তিত্ব আর কোনো প্রাণী মানুষের মত অনুভব করে কিনা আমরা জানি না। আর ভালো করে ভেবে দেখলে শরীরকে কখনও অ্যাবিউজ করা যায় না। অ্যাবিউজড হয় মন। প্রমাণ, গভীর ঘুমের মধ্যে আমি অনুভব করি না কোনটা ব্যাড টাচ, কোনটা গুড।

    মনের যে শরীরবোধ, সে আত্মসম্মানের। মনের যে আবেগবোধ, সেও আত্মসম্মানের। কথাটা কিন্তু মন নিয়েই। তাই অ্যাবিউজ যে শুধু শারীরিকভাবে হবে তা নয়। আমার আবেগ, আমার বিশ্বাস, আমার অনুভব, আমার অর্থনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, সাম্পর্কিক - আমার যে সত্তাই থাকুক না কেন সে আমার মনের সঙ্গে যুক্ত। আমার মনকে যে অন্ধকারে রাখে সে-ই অ্যাবিউজার। আমি যদি আমার যে কোনো সত্তার কাছে কাউকে আসতে দিই, অবশ্যই যা বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে, কোনোভাবেই অফিসিয়াল কারণে নয়, ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিশ্বাসে, সেখানে প্রথম শর্তই হল দুজনের উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতাবোধ। সেখানে যেন কোনো ধোঁয়াশা বা আড়াল না থাকে।

    মানুষের সব অ্যাবিউজের যন্ত্রণাই হল বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণা। সে-ই বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রণাকেই এড়িয়ে চলার শিক্ষা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের নতুন করে শিখতে হবে। বিশেষ করে এই সোশ্যালমিডিয়ার যুগে নতুন করে।

    তার প্রথম ধাপই হল ম্যারিনেশানের ফেজটাকে চেনা। আইডেন্টিফাই করা। এবং সতর্ক হওয়া। এতে যদি কিছুটা স্কেপটিক হতে হয় সেও ভি আচ্ছা, কিন্তু কোনোভাবেই নিজেকে ম্যারিনেট হতে দেওয়া নয়। কয়েক বছর আগে এক মহাত্মা, স্বামী রামসুখদাসজী দেহত্যাগ করলেন। তাঁর কোনো ছবি পাওয়া যায় না। কারণ তিনি তুলতে দেননি। তিনি বর্তমান ভারতের অধ্যাত্মজগতের মানুষদের উপর এতটাই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন যে বলেছিলেন, "আপনাদের কারোর কাছে, কোনো গুরুর কাছে যাওয়ার দরকার নেই। বিশেষ করে আমি মা বোনদের বলছি। আপনারা বাড়িতে বসেই প্রভুকে ডাকুন। কোনো দীক্ষার দরকার নেই। নিজেকে প্রতারিত হতে দেবেন না।"

    এই উদাহরণ আমি এই জন্যে দিলাম যে, যে জগতটার প্রথম শর্তই শুদ্ধতা, সে জগতই বর্তমানে কতটা কলুষিত বলে তিনি এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার আশঙ্কা যে মিথ্যা নয় সে প্রতিদিন খবরের কাগজে চোখ বুলালেই বোঝা যাবে।

    অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় তার পুওর ইকনমিক্স বইতে 'সুগার ড্যাডি'র কথা বলেছেন। অ্যাবিউজিভ বাবার ঘটনা অবশ্যই কল্পনা কিছু না। অর্থাৎ এ যুগই হল কপটতা আর চাতুরীর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার। সবটা হবে না। তবু যতটা সম্ভব। নিজেকে ম্যারিনেট হতে যতটা না দেওয়া যায় আরকি। আর কিছুটা হয়ে ফেললেও সঙ্গে সঙ্গে কলের তলায় দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নেওয়া। যতটা নিজেকে বাঁচিয়ে চলা যায়। আর কি!

189
Sun, 10/17/2021 - 12:00

মহানামব্রত ব্রহ্মচারী বলতেন, রিলিজিয়ন ইজ ফর জেন্টলম্যান। এ কথাটা ওঁর বক্তৃতায়, ভাষণে, লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে আসত। রিলিজিয়ন ইজ ফর জেন্টলম্যান। বলতেন আগে ভদ্র হও, মার্জিত হও, সুসংস্কৃত হও, তারপর এসো ধর্মে। তবে ধর্মের মর্ম বুঝতে পারবে।

    এখন এই জেন্টলম্যান তৈরি করতে কি ধর্মীয় শিক্ষা লাগে? লাগে না। সুশিক্ষার সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। ঘৃণার বিপরীত শব্দ ভালোবাসা নয়, ঘৃণার বিপরীত শব্দ বোঝা। বুঝতে চাওয়া। তবেই মানসিক বিকাশ সম্ভব।

    মানসিক বিকাশ কোনো দেশের জাতীয় সম্পদ নয়। মানসিক বিকাশ সমগ্র মানবজাতির সম্পদ। বেদব্যাস, শঙ্করাচার্য, রামানুজ, বুদ্ধ, মহাবীর, চৈতন্য, কবীর, নানক, মীরা, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, অরবিন্দ, রামকৃষ্ণ, গান্ধী, রমণ মহর্ষি প্রমুখেরা কোনো একটা জাতির সম্পদ নন। যেমন খ্রীস্ট, মুহম্মদ, রুমি, কনফুসিয়াস, জরাথ্রুষ্ট্র, সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট লরেন্স, মার্টিন লুথার, মাদার টেরেসা প্রমুখেরাও কোনো একটা দেশের সম্পদ নন। এনারা মানব সম্পদ।

    পৃথিবীতে এমন কোনো ধর্ম নেই যে ধর্ম থেকে কোনো না কোনো মহাত্মা জন্মেছেন। বিবেকানন্দ বারবার এ কথা বলতেন। যে প্রবল ক্ষমতা নিয়ে আধুনিক সময়ে বিবেকানন্দ ভারতের মাটিতে এসেছিলেন, যে ভীষণ শক্তি ও প্রভাব সেদিন ভারতের মাটিতে ওঁর ছিল চাইলে সেদিনই এ দেশ একটি বিশেষ ধর্মের দেশে পরিণত হতে পারত। কিন্তু তা হয় নি। কারণ তিনি ভারতের আত্মার যে ভাষা সেই ভাষাকে বলার জন্য দায়বদ্ধ ছিলেন। সারাটা জীবন সহিষ্ণুতা আর গ্রহণযোগ্যতার বাইরে কোনো কথা তিনি উচ্চারণ করেননি। কারণ অবশ্যই তাঁর গুরু রামকৃষ্ণদেব।

    সারা পৃথিবীর ধর্মের ইতিহাসে যা হয়নি, সেদিন বাংলার মাটিতে তা হয়েছিল। যেদিন গদাধর চট্টোপাধ্যায় থেকে একজন রামকৃষ্ণ হয়ে উঠছিলেন। যিনি শুধু নিজের জন্মলব্ধ ধর্ম নয়, অন্য ধর্মকেও সত্য অনুভব করলেন। শুধু অনুভব করলেন না, বললেন, সব ধর্মেই বালিতে চিনিতে মেশানো আছে। বালিটুকু ফেলে চিনিটুকু নিতে হয়।

    সমস্যা হল যারা এই বালিচিনির পার্থক্যটা না বোঝেন। বালিকেও চিনির মূল্যে চালাতে চান। তা কি হয়? বালিচিনি পৃথক করার কৌশল কি তবে? ওই যে বললাম, মহানামব্রতজীর কথা, রিলিজিয়ন ইজ ফর জেন্টলম্যান। উইল ডুরান্ট লিখছেন যে তোমরা এতদিন একটা দেশকে এত এত অত্যাচারের মধ্যে রেখেও, বন্দুকের নলের সামনে রেখেও রামকৃষ্ণ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর মত মানুষ জন্মাতে আটকাতে পারলে না। অতএব হার স্বীকার করো, আর যত তাড়াতাড়ি পারো এ দেশ ছাড়ো।

    অহিংসা আর শান্তি যে কোনো ধর্মের মূল কথা। সে যুক্তির কথা, সে তথাকথিত 'প্র‍্যাক্টিকাল' কথা নয়, সে নিতান্ত মানবীয় আদর্শ। সে পশুর আদর্শ নয়। রাজনীতির তুরুপের তাস নয়। সে জ্বলন্ত আদর্শ। খ্রীষ্টের শৈলপোদেশ কোনো বিশেষ ভৌগলিক অঞ্চলের মানুষের জন্য না, সে মানবিক সম্পদ। ঠিক একই ভাবে নানকের জপজী, রুমির কবিতা, বুদ্ধের ধম্মপদ ইত্যাদি সবটাই যেমন আমার। যেখানেই অহিংসা আর শান্তির কথা, সেই সমগ্র মানবজাতির উত্তরণের কথা। আজ পুলিশ দিয়ে, প্রশাসন দিয়ে যে শান্তি যেখানে যেখানে রাখা হচ্ছে সে শুধুমাত্র সাময়িক পরিস্থিতিকে সামাল দিয়ে রাখার জন্যেই। সে রাস্তা নয়, সে ঠেকনা। ঠেকনায় বাড়ি দাঁড়ায় না, বাড়ি দাঁড়ায় ভিতের উপর। ভিত হল অহিংসা আর শান্তি।

    যেখানে যেখানে অহিংসার শিক্ষা নেই, সেখানে সেখানেই মানবজাতি বিপদের মুখে। রামকৃষ্ণদেবের শিক্ষাধারার এক বর্তমান যুগের সন্ন্যাসীর সঙ্গে এক ঘরে বসে সময় কাটানোর সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাঁকে গুরুদেবের আসনে বসিয়েছিলাম সেদিন। আমি আগেও লিখেছি তাঁর কথা, তিনি সেদিন বন্ধ ঘরে বসে বলেছিলেন যে, "যেখানে যেখানে যেভাবে ঈশ্বর পূজিত হচ্ছেন, জানবে এক সত্যই পূজিত হচ্ছেন। তুমি রামকৃষ্ণমন্ত্রে দীক্ষিত হচ্ছে মানে সব ধর্মকে আজ থেকে সমান দৃষ্টিতে দেখা তোমার ধর্ম। এক এক ধর্মের উপাসনার ধারা এক একরকম, যেমন ঠাকুর বলতেন, মা মাছ এনেছে, কিন্তু এক এক সন্তানের জন্য এক এক রকমের রান্না করছেন, কারোর জন্য ঝোল, কারোর জন্য ঝাল, কারোর জন্য কালিয়া। যার পেটে যা সয়। তাই কারোর ধর্মের নিন্দা করতে নেই।"

    এই বলে সেদিন শ্রদ্ধেয় আত্মস্থানন্দজী বলেছিলেন, "তোমার মসজিদ, গুরুদোয়ারা, চার্চ কোথাও যেতে বাধা নেই। মনে রেখো ঠাকুর কোনো সঙ্কীর্ণ আদর্শ শেখাতে আসেননি। যদি হৃদয় সঙ্কীর্ণ হচ্ছে দেখো, তবে জেনো তুমি ভুল রাস্তায় যাচ্ছো।"

    ধর্মের মতামত, থিওলজি যাই হোক না কেন, আমি আজ অবধি কোনো ধর্মকে হিংসা, মিথ্যা ও নিষ্ঠুরতার পক্ষে কথা বলতে শুনিনি। আমি যে শিক্ষার কথা একটু আগে বললাম, সে শিক্ষা তো একটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বসেই শুনলাম। তবে কেন কোনো ধর্মীয় শিক্ষালয় হিংসা আর বিদ্বেষের শিক্ষা দেওয়ার স্পর্ধা রাখবে। সে-ই সবার আগে বন্ধ হওয়া উচিৎ।

    রবীন্দ্রনাথ যেদিন লিখেছিলেন, কবিতায়…. আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে… সেই তার শেষ কথা ছিল না, পরে তিনিই বদলে নিয়েছিলেন তার শেষ প্রবন্ধে, সভ্যতার সংকটে, কিন্তু তবু মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, এ কথা বলে।

    ব্যাধগীতায় আছে, অহিংসা পরমোধর্ম, স চ সত্যে প্রতিষ্ঠিতাহ… অহিংসাই পরমধর্ম যা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। কোন সত্যে প্রতিষ্ঠিত? তৈতেরীয় উপনিষদে আছে, সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। সেই সত্য, যা জ্ঞান ও অনন্তের অভিমুখী।

    আর রইল মূর্তিপুজো নিয়ে কথা। সেদিন রামকৃষ্ণদেবের সময়েও ব্রাহ্মধর্মপন্থীদের মধ্যে এ সংশয় এসেছিল। কিন্তু মূর্তিপূজার মধ্যে দিয়েও যদি রামকৃষ্ণদেব, রামপ্রসাদ, চৈতন্যদেব প্রমুখ উদার হৃদয়ের উদাহরণ জন্মে থাকে, তবে বোঝাই যায় সমস্যাটা দেখায় না, দেখতে চাওয়ায়।

    অহিংসা আর সহমর্মিতাকে আদর্শ করেই মানবাধিকারের সত্য উঠে এসেছে আজ আধুনিক সভ্যতায়। সেদিকে আমরা এখনই যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছি তা বলছি না, তবে রাস্তা সেদিকে না ঘোরালে আর কোনো উপায় নেই এও সত্য। যে মানুষ সাগরে বেড়াতে যাবে সে যেমন সমুদ্রস্নানের সরঞ্জাম জোগাড় করে, যে মানুষ পাহাড়ে বেড়াতে যাবে সে যেমন শীতের পোশাক জোগাড় করে, তেমনই যে মানুষ অহিংসা আর সহমর্মিতাকে আদর্শ করবে তার বর্তমানও সে আদর্শের অনুকূলেই বড় হবে। অহিংসার রাস্তা ছাড়া যে রাস্তা নেই সে কথা বলতে গিয়ে মার্টিন লুথার কিং মহাত্মাকে উল্লেখ করে বলেছিলেন, we may ignore him at our own risk.

    এ কথা উপেক্ষা করার মাশুল আজ গোটা বিশ্ব দিচ্ছে। যে কোনো ধরণের হিংসাকে উৎসাহিত করা মানেই ভবিষ্যতের হিংসার বীজ ছড়ানো। ভারতবর্ষ হারিয়ে গেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিন্তার বীজগুলো সব হারিয়ে যাবে - এ কথার প্রতিধ্বনি বহু পাশ্চাত্য মনীষীর কথায় বারবার ধ্বনিত হয়েছে। সে কোন ভারতের কথা? যে ভারত সগৌরবে ঘোষণা করে - সমস্ত জগত এক নীড়ের মত, বসুধৈবকুটুম্বকম।

    প্রতিপক্ষ যতই নিষ্ঠুর, বর্বর হোক না কেন, অবশেষে যদি প্রশাসনের উপরেই নির্ভর করে ধর্মকে বেঁচে থাকতে হয়, সে ধর্মের জোরের জায়গাটা কোথায়? আর যে ধর্মের নামের সঙ্গে 'ফোবিয়া' উপাধি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত হচ্ছে আজ, সে ধর্মের সঙ্গে শান্তি আর কল্যাণের যোগই বা কোথায়?

    বার্ট্রান্ড রাসেল আগামী প্রজন্মকে ফ্যাক্ট আর টলারেন্স - এই দুটো রত্ন দিয়ে গেছেন নিজের সারাজীবনের মননজাত সম্পদের সার জেনে। রামকৃষ্ণদেব তাকেই আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, উপনিষদের সত্যকে নতুন করে আবার, মত মানে পথ। নানা পথ যেমন একই গন্তব্যের দিকে থাকে, তেমনই নানা মত থাকবেই। এ ফ্যাক্ট। আর এই ফ্যাক্টের অন্তর্গত সত্যকে অনুভব করলে দেখবে, জল, অ্যাকুয়া, পানি আর ওয়াটার মানে একই কথা। তখন দ্বেষহীনতা আপনিই আসবে। শুধু পাণ্ডিত্যে কিচ্ছু হবে না। যদি বিবেক না জাগে। বিবেক মানে সত্যের খোঁজ। আর বৈরাগ্য মানে অসত্যে অনাসক্তি।

    পৃথিবী জুড়ে শান্তি নামুক, এই প্রার্থনা। শান্তি, শান্তি, শান্তি।
 

190
Tue, 10/05/2021 - 21:00

মানুষের সঙ্কীর্ণতার বিশ্বে কোথাও কোনোদিন পাকাপাকি জায়গা হয় না, এটা মানুষ বুঝতে কতদিন সময় নেয় কে জানে। এটা বুঝে গেলেই যে কত ঝক্কি, কত চালাকি আপনি খসে পড়ে, সে যদি আগে জানতে পারে তবে সংসারে রাতদিন সে নিজের পায়ে নিজে এভাবে কুড়ুল মেরে চলতে পারে না।

    এটা খুব কমোন গল্প। আমি যে কষ্টটা পেয়েছি, আমি যেমন অনেক অসুবিধার মধ্যে বড় হয়েছি, ও-র যেন না হয়। তাই ও যা চাইছে সেটাই মুখ থেকে উচ্চারণের আগেই বাড়িতে চলে এলো। 

    এ খুব কমোন ঘটনা। বাবা খুব কষ্ট করে বড় হয়েছেন, তিনি চান না ছেলে সে অভাব, কষ্টের ভিতর দিয়ে যায়। ছেলে নেশা করুক, ছেলে বাজে সঙ্গে মিশুক, ছেলে অল্পস্বল্প অসামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলুক --- বাবা অন্ধ। বাবা সেটা দেখেও দেখবেন না। দেখলেও তার নানারকম ব্যাখ্যা থাকবে... 

    ও বয়েস হলে, বুঝতে শিখলেই ঠিক হয়ে যাবে... ভগবান ওকে ঠিক রাস্তায় একদিন না একদিন নিয়ে আসবে…. ওর দোষ না, ও তো ওরকমই তবে ওকে ওসব দায়িত্ব দেওয়া কেন, দায়িত্ব দিয়েছেন যিনি তারই তো দোষ….

    ছেলে বড় হল। লুচ্চা হল। বিয়ে হল। ডিভোর্স হল। বউয়ের দোষ। শ্বশুরবাড়ির দোষ। সঙ্গের দোষ। গ্রহের দোষ। মানসিক সমস্যা আছে ওর…

    এ সব খুব খুব চেনাজানা ঘটনা। পাড়ায় পাড়ায়। ছেলে নেশার টাকা না পেয়ে বাবা-মাকে মারধর করেছে। চুরি করেছে। খুন করেছে। এও নিত্য ঘটনা। 

    কথাটা শাহরুখ খানের ছেলে বলে না। সে তো মিডিয়া ঘটনাটা ধুয়ে ব্যবসা করছে। একটু ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, এ আমাদের আশেপাশে নিত্য ঘটনা কিনা?

    আসলেই এ নিত্য ঘটনা। নানা কাজের চাপ। সংসারে হাজার একটা ঝামেলা। মনমেজাজ ভালো থাকে না। মোবাইল হোক যা হোক ধরিয়ে দিয়ে ছেলেমেয়েদের সরিয়ে দাও। টাকাটা বড় কথা না। চাপ নেওয়া যায় না অত। আর সারাদিন কত ওদের পিছনে ঘুরঘুর করে লেগে থাকা যায়? আমাদেরও তো একটা জীবন আছে নাকি? আমরা কি যা চাই জীবনে সব পেয়েছি? অন্তত কিছুটা পূরণ করে তো নিতেই হবে। ছেলেমেয়ের জন্ম দিয়েছি বলেই কি ওদের দাসীবাঁদী হয়ে জীবন কাটাব নাকি?

    এও আছে। এও হয়। এও সত্য। 

    আজকাল বলে নয়, শরৎচন্দ্রের গল্প থেকে শুরু করে উড়তা পাঞ্জাব, নেশা করা বকে যাওয়া ছেলের গল্পের কি অভাব আছে?

    কিন্তু যেটা নেই সেটা হল, এগুলো কি আটকানো যায়? অবশ্যই যায় না। ছেলেমেয়ে বকে যাবে, এক অংশ এই হট্টগোলের বাজারে হারিয়ে যাবে - এ বাস্তব। তবে যেটা করা যেতে পারে, কিছুটা হলেও ভাবা যেতে পারে, সেটা হল প্রশ্রয় দেওয়া। 

    প্রশ্রয় দেওয়া মানে ঠিক কি? একটাই বুঝি, তার অন্যায়কে মেনে নেওয়া। কোনো অন্যায়কে একবার যদি মেনে নিই তার মধ্যে অন্যায় করার উপর ভীতি চলে যাবে। এর থেকেও যেটা বড় কথা, অন্যায় করার উপর প্রীতি জন্মাবে। 

    আমি এমন একজন মানুষকে ভালোবাসি যে মানুষটা অন্যায় সহ্য করে না, অগত্যা আমি অন্যায় করব না। এটা হল স্বাভাবিক মনের কথা। শাসনের ভয়ে অন্যায় না করা আর ভালোবাসার মানুষটার ভালোবাসা হারানোর ভয়ে অন্যায় না করার মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য আছে। 

    যে বাচ্চাটা শাসনের ভয়ে অন্যায় করছে না, সে যে কোনো মুহূর্তে অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে যেতে পারে, যদি সুযোগ পায় তো। এ যেন টিটির ভয়ে টিকিট কেটে ওঠার মত। মানে আমার নিজের ব্যক্তিত্বের উপর এমন মর্যাদাবোধ জন্মায়নি যে আমি টিকিট না কেটে উঠলে আমার কিন্তু কিন্তু লাগে, সে আমি উঠতেই পারি, কিন্তু লোকের সামনে হেনস্থা হতে আমার লজ্জা লাগে। কারণ আমার আত্মসম্মানবোধ না থাকুক, চক্ষুলজ্জাবোধ তো আছেই। বলা বাহুল্য, সমাজের একটা বড় অংশ এই চক্ষুলজ্জার দোহাইতেই অন্যায়, অপরাধ থেকে বিরত থাকে। 

    কিন্তু এর থেকে বড় আরেকটা দিক হল, আমি যাকে ভালোবাসি সে এমন মূল্যবান আমার জীবনে যে সে অন্যায়কে ভালোবাসে না বলে আমার মনও অন্যায়ের দিকে যায় না। এ অনেক গভীরে রেখাপাত করে মনের মধ্যে। আমার বাবা বা মা আমি অন্যায় করলে কষ্ট পাবেন। তারা কষ্ট পেলে আমি কষ্ট পাব। তাই আমি ওসব করব না। এই বোধটা মনের গভীরে ধীরে ধীরে একটা আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করে। অবশ্যই করে। আগে খুব বলা হত আজকাল বড় মানুষের জন্ম হয় না, কারণ সে মা নেই বলে। কথাটা কিঞ্চিৎ অতিকথন হলেও কথাটা সর্বাংশে যে মিথ্যা তা নয়। 

    বাবা, মা বা অভিভাবকের ভালোবাসা আর আদিখ্যেতার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ভালোবাসা সহনশীল, প্রয়োজনে কঠোর, আবার নিজেকে ভুল বলে জানলে ক্ষমা চাইতেও দ্বিধা করে না। কারণ তার মধ্যে সত্যবস্তু আছে। 
    
    আদিখ্যেতার সে দায় নেই। সে সন্তানের কাছে বা ভালোবাসার পাত্রটির কাছে প্রিয়মুখ থেকে যেতে চায়। তার ভালোবাসায় এই যে ভিক্ষাবৃত্তি সে-ই তাকে নীচু করে ফেলে। সব অন্যায়কে মেনে নিতে দ্বিধা করে না আর, কারণ সে জানে অন্যায়কে যে ভালোবাসে, তার ভালোবাসায় হ্যাঁ-তে হ্যাঁ না মেলালে সে যদি বিরূপ হয়ে যায়। এই বিরূপতাকে সে মেনে নিতে পারে না। তাই ক্রমে দু'জনেই নীচের দিকে নামে। অন্ধকারে সেঁধোয়। দায় পড়ে সঙ্গের, ভাগ্যের, আত্মীয়ের, সব শেষে ভগবানের। 

    ভালোবাসার মধ্যে যাদুশক্তি আছে। আদিখ্যেতার মধ্যে আছে মোহ। অভিভাবকের এই ভালোবাসায় বেড়ে ওঠা বাচ্চাদের মানসিক গঠন অন্যরকম হয়। কিন্তু ভালোবাসাটা যেন সত্য অর্থেই ভালোবাসা হয়। সে হওয়াটা সত্যিই শক্ত। এত এত দুর্বলতা বাসা বেঁধে মনের কোণায় ওঁৎ পেতে থাকে যে, তাদের এড়িয়ে ভালোবাসাটা বড় কঠিন কাজ। তবে তারও একটা সূত্র আছে। যাকে ভালোবাসি সে যদি আমার কেবল ভোগ্য না হয়ে মানের সম্পদও হয়, তবে তার অধঃপতন দেখা আমার পক্ষে সোজা নয়। সে বাচ্চা হলেও তার মানের দিকটা যদি খেয়াল রাখি, তবে সে মানের দিকে তাকিয়েই আমার ভালোবাসা শুদ্ধ হয়। আমি বারবার তাকে তার মান সম্বন্ধে সচেতন করে তুলি আমার অজান্তেই। সেও সচেতন হয়ে ওঠে। যা তার ভবিষ্যতের সম্পদ - সুস্থ আত্মসম্মানবোধ। 

    একটা ঘটনা দিয়ে শেষ করি। বেশ কয়েক বছর আগে আমার কাছে পড়ত ভীষণ দুরন্ত একটা ছেলে। ক্লাস টেনে পড়ে। তার নানা দুষ্কর্ম্মের কথা তার বন্ধুরা আমার কাছে বলে বলে রেখেছে। তার অনেকটা অতিরঞ্জিত হলেও বুঝেছিলাম সবটা নয়। সে অনেক অভাবের মধ্যে বড় হচ্ছে এটা সত্যি, কিন্তু সব চাইতে বড় অভাব যেটা বুঝেছিলাম ভালোবাসার অভাব। তার স্বভাবে একটা রুক্ষতা তার বাইরের শুষ্কতার সঙ্গে মিলেমিশে ছিল। 

    একদিন সে ব্যাচে এলো একটা অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়ে। রক্তারক্তি পা। পড়া থামালাম। নানা সরঞ্জাম নিয়ে বসলাম ড্রেসিং করতে। সে কিছুতেই তার পায়ে হাত দিতে দেবে না, আমি দেবোই। অগত্যা সে আমার বকা খেয়ে চুপ করে বসল। আমি ড্রেসিং করে, একটা বন্ধুকে দিয়ে টিটেনাস দেওয়া করিয়ে ব্যাচে আবার আসতে বললাম। 

    এরপর কিছু একটা চেঞ্জ হল। সে এতদিন দূরে বসত। এবার কাছে আমার চেয়ারের কাছে বসতে শুরু করল। আগে আগে আসতে শুরু করল। বদলাতে লাগল। 

    অনেক পরে, সে এখন অনেক বড়, বাঁদরামি ছাড়েনি, কিন্তু দুষ্টুমিগুলো ছেড়ে দিয়েছে। তার নিজেরও পিতা হওয়ার দিন এলো বলে। একদিন সে আমায় বলেছিল, "আমি কিছু ভুল করতে গেলেই মনে হত তুমি জানতে পারলে কষ্ট পাবে, তাই করিনি। তুমি একটুও ভেবো না আমি ভালো হয়ে গেছি।"

    এই দর্শনে আমি খুব বিশ্বাস করি। আমার জীবনেও এমন কেউ ছিলেন বা আছেন, যিনি অজান্তেই আমায় রক্ষা করে এসেছেন, হয় তো আজও করে চলেছেন। কারণ একটাই, তিনি কষ্ট পাবেন। রবীন্দ্রনাথের একটা লেখায় আছে, "তবু বলি ও পথ তোমার না হোক।" এই কথাটার সুরে শাসন নেই, একজন প্রাণের ভালোবাসার মানুষের আবদার আছে। মানুষের সংশোধন হয় ভালোবাসায়। যে ভালোবাসা অপেক্ষা করে, উপেক্ষা করে না আমার আত্মমর্যাদাবোধকে, আমাকে ভোগ্য করে। আমায় সময় দেয়। আমায় আত্মমর্যাদাবোধ শেখায় নিজেকে মিশিয়ে। একাকার হয়ে।

    এর বাইরে কোনো চালাকি, কোনো শর্টকাট, কোনো ঘুরপথে বড় রাস্তার খোঁজ মেলে না। ভালোবাসাকে ভালোবেসে আত্মনিয়ন্ত্রণ আর ভয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্যে পার্থক্য অনেক।

191
Fri, 10/01/2021 - 11:30

ভাষা ব্যষ্টির অভিজ্ঞতাকে সমষ্টির সামনে নিয়ে আসে।

    মত ও অভিজ্ঞতা দুটো আলাদা শব্দ। মত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাজাত। যেমন রসগোল্লা মিষ্টি। এ সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা। কিন্তু রসগোল্লা সব চাইতে ভালো মিষ্টি --- এ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। মত। "আমার মনে হয়" --- এই কথাটা বেঁচে আছে, ভাষা আছে বলেই। নইলে আমার কি মনে হয়, তাকে পৃথকভাবে জানার বা জানানোর উপায় ছিল না।

    ব্যষ্টি অভিজ্ঞতা আর সমষ্টিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে একটা জায়গা আছে --- গোষ্ঠীগত অভিজ্ঞতা। কোনো একটা দল যখন ভালো খেলছে, তখন সেই দলের সমর্থকদের যে সুখকর অভিজ্ঞতা, তা গোষ্ঠীগত অভিজ্ঞতা। গোষ্ঠী তখন একটা ব্যষ্টির মত আচরণ করছে। মানুষের মধ্যে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে অন্যকে আনার প্রবণতা আছে। দল ভারী করা। আমার যেমন অভিজ্ঞতা হচ্ছে তোমারও হোক। এ বাসনা থেকে নানা দলের উৎপত্তি। রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, খেলা, শিক্ষা, পেশা ইত্যাদি কোন জগতে না এই দলের অস্তিত্ব আছে। আমাদের অভিজ্ঞতা একরকম হোক।

    ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিল নিয়ে যে গোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে যে টান, তা ভালোবাসা। রোমান্টিক না। ভ্রাতৃত্ববোধের। তার বাইরে ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে আরেক অনুভবের ডাক পড়ে, করুণা। তোমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমার সঙ্গে না মিললেও আমি তোমায় মেনে নিচ্ছি, স্বীকার করছি, এ হল কনসিডার করা।

    তবে সত্য কি? সেকি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা না সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা? একজন লেখক যখন সাল-তারিখ-পরিসংখ্যান ইত্যাদি দিয়ে কোনো কিছু বর্ণনা করেন, আমরা ধরে নিই তিনি যা বলছেন তাই ঘটনা, মানে ইংরাজিতে যাকে বলি 'ফ্যাক্ট'। কিন্তু আমরা কতটা নিশ্চিত হতে পারি যে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সে ঘটনাকে রঞ্জিত করছে না? এই কারণেই কোনো ঐতিহাসিকই সর্বজনগ্রাহী হন না। কারণ আমরা কেউ-ই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে বেরোতে পারি না সর্বাংশে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমাদের সংস্কারে তৈরি করে ব্যক্তিগত সত্যের বুনিয়াদ। ব্যক্তিগত বুনিয়াদ আমাদের বাকি চিন্তাভাবনাকে নিয়মিত করে। সেখানে আমাদের কোনো স্বাধীনতা নেই।

    তবে কি একেবারেই স্বাধীনতা নেই? আছে। আমাদের চিন্তার স্রোত যখন সর্বাংশে না হলেও অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় তখন আমাদের অবস্থাকে আমরা বলতে পারি অনেকটা স্বাধীন অবস্থা। চিন্তা শুরু হলেই বিচার আসবে। তুলনা আসবে। বাসনা সক্রিয় হবে। চিন্তার নানা রঙে আবার সব কিছু রাঙিয়ে যাবে।

    তবে প্রশ্ন আসে, বিজ্ঞানের জায়গা কি তবে?

    সেখানে যতক্ষণ তা তাত্ত্বিক ততক্ষণ তা অনেকাংশে এক। অন্তত যতটা প্রমাণ নির্ভর। কিন্তু যখনই তা প্রকল্প নির্ভর বা ব্যবহারিক তখনই আবার নানা 'স্কুল অব থট'। চিকিৎসাক্ষেত্র এর সব চাইতে বড় উদাহরণ আমাদের অভিজ্ঞতায়। যখন আমরা সেকেন্ড ওপিনিয়ন, থার্ড ওপিনিয়নের কথা ভাবি তখন আমরা ওই একই ঘূর্ণিতে আটকে --- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। কার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নির্ভর করব? কার সিদ্ধান্তে হ্যাঁ-তে 'হ্যাঁ' বলব। এ এক সংকট। এরকমভাবে অর্থনীতি, পরিবেশ বিজ্ঞান ইত্যাদি নানা বিষয়ে দেখব এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জন্মানো নানা পূর্ণ বিরোধী, আধা বিরোধী ইত্যাদি দলের অবস্থান।

    জীবন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা। কিছুটা এর-ওর-তার সঙ্গে মিলল, কিছুটা মিলল না --- এই নিয়ে সমাজ। এই নিয়ে গোষ্ঠী। এই নিয়েই উপগোষ্ঠী।

    আমার সুখ, আমার দুঃখ, আমার আনন্দ, আমার সার্থকতাবোধ, আমার বিশ্বাস, আমার উপলব্ধি, আমার ভালোবাসা, আমার ঘৃণা, আমার দ্বেষ, আমার মোহ, আমার বাসনা, আমার লোভ…. এ তালিকা দীর্ঘ। এত সব নিয়ে এই যে 'আমি', এই যে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার শিকল পরানো আমার 'আমি', তার কতটা বাস্তব? কে বলবে? কে আছে যে নৈর্ব্যক্তিক অভিজ্ঞতায় অরঞ্জিত? ভারতের দর্শন কল্পনা করেছিল এক সত্তাকে - বলেছিল সে নির্গুণ ব্রহ্ম। বুদ্ধদেব বললেন, সব শেষ করে ফেলো, নির্বাপিত হোক। জড়বাদী বলল, সুখ চাই। আর কিছু চাই না। আমায় মত্ত থাকতে দাও আমায় নিয়ে। তারপর যা হবে হোক।

    শেষে সব এসে ঠেকলো সেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাঁচিলে। স্বপ্নের মধ্যেও সে। রমণ মহর্ষি জিজ্ঞাসা করছেন, তোমার যাবতীয় অভিজ্ঞতার দ্রষ্টা কে? উত্তর খোঁজো।

    তবে এই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাঁচিল পেরিয়ে, আমার 'আমি'কে পেরিয়ে যাই কোথায়? দাঁড়াই কোথায়?

    স্বামীজি একটা সূত্র দিলেন। স্বার্থশূন্য হতে চেষ্টা করো। জ্ঞানে, প্রেমে, আচারে, ব্যবহারে নিজেকে ভুলে যাও। একেবারে কি সম্ভব সে? স্বামীজি বললেন, না। তোমার অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্যের অভিজ্ঞতা মিলুক না মিলুক, তোমার অস্তিত্বের মধ্যে অন্যের অস্তিত্বের মান্যতা জাগুক। আমার থাকা যে অনেক কিছুর থাকায় থাকা হয়ে ওঠে, একে স্বীকার করো। পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে দেখতে শেখো। তবে জানবে আমার একার অভিজ্ঞতাই শেষ কথা নয়, আমার একার টিকে থাকাই শেষ কথা নয়, সবার মধ্যে এই যে আমি সে-ই আসল। যা অভিজ্ঞতা নয়। যা বাস্তব নয়। যা ধারণা নয়। যা সময়। আমরা প্রত্যেকে এক টুকরো সময়ের বুদবুদ।

    আমাদের অভিজ্ঞতার ধারাও তো সেই বুদবুদ ঘেরা গল্পমালা। ব্যস, আর কি? তার চাইতে অভিজ্ঞতা থাক। অনুভবী হও। অনুভবের স্রোতে চিন্তার জাল না বিছালে অভিজ্ঞতার শিকল জন্মায় না। অনুভব বয়ে যাক, চিন্তা জাল না ফেলুক। অনুভব সদা বর্তমান। চিন্তার জালে আটকানো অভিজ্ঞতা তো ক্রমশ অতীত থেকে অতীতের দিকে যাওয়া। সে চাই না।


"চাহিয়া দেখো রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।

চেয়ো না চেয়ো না তারে নিকটে নিতে টানি॥

রাখিতে চাহ, বাঁধিতে চাহ যাঁরে,

আঁধারে তাহা মিলায় মিলায় বারে বারে--

বাজিল যাহা প্রাণের বীণা-তারে

সে তো কেবলই গান কেবলই বাণী॥

পরশ তার নাহি রে মেলে, নাহি রে পরিমাণ--

দেবসভায় যে সুধা করে পান।

নদীর স্রোতে, ফুলের বনে বনে

মাধুরী-মাখা হাসিতে আঁখিকোণে,

সে সুধাটুকু পিয়ো আপন-মনে--

মুক্তরূপে নিয়ো তাহারে জানি॥" 

~ রবীন্দ্রনাথ।

192
Sun, 09/26/2021 - 12:00

সংসারে বিদ্যাসাগরের অভাব হয়নি কোনোদিন। আজও নেই। বরং বিদ্যাসাগরের সুনামিতে সমাজের প্রাণান্তকর অবস্থা হয় মাঝে মাঝে। বিদ্যাসাগরেরা প্রাচীনকালেও ছিলেন, আজও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। বিদ্যাসাগরের ঢেউয়ের গর্জনে কান ঝালাপালাও হবে।

    করুণাসাগরের অভাব বড় বেশি। করুণাসাগর কথাটার মধ্যে না আছে গ্ল্যামার, না আছে আভিজাত্য, না আছে গৌরব। তাই করুণাধারার কুলকুল শব্দ, সাগরের গর্জনে চাপা পড়ে থাকে।

    আজ করুণাসাগরের জন্মদিন। আজ খবরের কাগজের প্রথমপাতা জুড়ে কমলা ভাসিনের চলে যাওয়ার কথা। কমলা ভাসিনের জীবন বোঝায়, করুণাসাগরের কাজ শেষ হওয়ার নয়। একজন মহাপুরুষ যদি মশাল হন, তিনি যদি জ্বলেই নিভে যান, তবে আরো গভীর অন্ধকার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা হয় না। আরো আরো অনেক প্রদীপ জ্বলে ওঠে। আলোর ধারাস্রোত চলে।

    কমলা ভাসিন চেয়েছিলেন সমান মর্যাদা। পুরুষতন্ত্র থেকে শুধু নারীকে বাঁচাতে চাননি, চেয়েছিলেন পুরুষকে বাঁচাতেও। লিখেছিলেন - একজন কি করে বলবে, আমি এটা পারি না, আমার দ্বারা এটা সম্ভব নয়, কি করে বলবে? সে তো পুরুষ, তাকে তো সব পারতে হয়! হ্যাঁ, পুরুষতান্ত্রিকতা এইভাবেই সগর্বে, ঔদ্ধত্যের সঙ্গে পুরুষকেও তিলে তিলে শেষ করে। যাকে পুরুষ গর্বের সঙ্গে বলে, বলিদান।

    বিদ্যাসাগর কাঁদতে পারতেন। হ্যাঁ, আমাদের সমাজ যাকে মেয়েদের মত কাঁদা বলে, সেরকমভাবেই কাঁদতে পারতেন। এ ক্ষমতা ওঁর ছিল। কারণ অভেদ্য, দুর্গম পৌরুষত্ব রাখার দায় ছিল না ওঁর, ছিল মনুষ্যত্বের সীমাহীন অনুকম্পায় ডাকে সাড়া দেওয়ার দায়বদ্ধতা।

    কমলা ভাসিন বলতেন, প্রকৃতি ভেদ সৃষ্টি করে, ভেদভাব নয়, সমাজ সৃষ্টি করে ভেদভাব। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সমাজে দুই স্তরের মানুষের মধ্যে পার্থক্যটাকে বড় করে দেখলে সম্পর্ক গড়ে ওঠে কি করে? মৈত্রী, ভালোবাসার চাদরে ঢাকা পড়ে সেই পার্থক্যের গর্তগুলো।

    ভারত, বাংলাদেশ থেকে যে চারজন মানুষ অর্থনীতি ও শান্তির সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত, সেই, অমর্ত্য সেন, অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, কৈলাশ সত্যার্থী, মহম্মদ ইউনুস - এঁদের প্রত্যকের কাজ অতি সাধারণ মানুষকে নিয়ে। যাদের মধ্যে একটা বৃহৎ অংশ নারীরা। যা নিয়ে তাঁদের কাজ, সেই, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদিতে নীতি শব্দটা এসে দাঁড়ায়। অভিধান শব্দের বুৎপত্তি যাই বলুক না কেন, শব্দের মর্মার্থ জানে মর্ম। শ্রদ্ধেয় এই চারজন মানুষ সম্পূর্ণ সত্যকে দেখতে চেয়েছেন। মর্মে জেনেছেন। মনুষ্যত্বর অধিকারকে জাগ্রত করতে নারী ও শিশুদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও শিক্ষার অধিকার নিয়ে ভেবেছেন। রাস্তা খুঁজেছেন। একি শুধু বিদ্যার কাজ? মানুষকে হারিয়ে যাওয়া থেকে আটকানো, সেকি এত সোজা কাজ? আমরা কতজন জানি যে মানুষ হারিয়ে যায় অতি সহজেই? Poor Economics বইতে ১৮৪ পাতায় অভিজিত মহাশয় লিখছেন - In the 1980s, in a now classic article in the New York Review of Books, Amartya Sen calculated that there were 100 million 'missing women' in the world.

    এত মানুষ হারিয়ে যায়?! বিস্ময় লাগে। স্তম্ভিত হই। এই চারজন মানুষের সবার লেখা তো পড়া সম্ভব হয়নি, তবে অমর্ত্য সেন ও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা যতটা পড়েছি, ততটা বুঝেছি, যা দেখি, যা জানি, তা কতটা সীমিত। মানুষ চোখ ফিরিয়ে, মুখ ফিরিয়ে রাখলেই কি সবশুদ্ধ 'নেই' হয়ে যায়? আমরা তাকাতে চাই না। আমরা শুনতে চাই না। আমরা আমাদের বিদ্যাসাগরে ডুব দিয়ে ঝিনুক কুড়াই, বাড়ি সাজাই, নিজের জীবনকে আরো কিসে মনোহর করে তোলা যায় সেই চেষ্টায় বিদ্যাসাগরের তীরে তীরে ঘুরি, জাল নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিই, ব্যক্তিগত লাভের আশায়। কিন্তু কিছু মানুষ জেগে থাকেন। বারবার মুখ ফেরানোর জন্য ডাকেন। শুনি বা না শুনি তোয়াক্কা করেন না, ডেকেই যান, ডেকেই যান।

    কমলা ভাসিন বলেন, আবার মূল ধরে নাড়া দেব, ওদের অত্যাচার আর শোষণের প্রাসাদের ভিত্তিভূমি নাড়িয়েই ছাড়ব। এই কথা শুনে মনে পড়ে মায়া অ্যাঞ্জিলেউ এর কবিতা Still I Rise. একই কথা, একই কথা। বিশ্বের দুই আলাদা প্রান্তের মানুষ। কিন্তু সে পার্থক্য শুধুই ভৌগোলিক।

    মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে যে প্রাসাদই বানানো হোক না কেন, সে কোনোদিন চিরকালীন হয় না। এ বোধ পাণ্ডিত্য জন্ম দেয় না। এ বোধ অন্তরের আলোকের। রামকৃষ্ণদেব বলতেন বিবেক-বৈরাগ্যহীন পাণ্ডিত্যর কোনো মূল্য নেই। চিল অনেক উপরে ওঠে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে ভাগাড়ে।

    বিদ্যাসাগরের কাজ শেষ হয়নি। এখনও অনেক অনেক রাস্তা বাকি। কমলা ভাসিনের কাজ শেষ হয়নি। এখনও অনেক অনেক রাস্তা চলা বাকি। কমলা ভাসিন বুঝিয়েছেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন, পুরুষতান্ত্রিকতা লিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কহীন এক প্রাচীন অস্বাস্থ্যকর মানসিকতা। তিনি বারবার বলেছেন, আমি পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস রাখা নারী যেমন দেখেছি, তেমনই নারীবাদী পুরুষও দেখেছি।

    ভাসিনের মেয়েদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়া, বিদ্যাসাগরের সেদিনের সমাজে রুখে দাঁড়ানো, রামমোহন রায়ের সতীদাহপ্রথা রোধের লড়াই, কি আজকের দিনে অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত মানুষদের নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থার জন্য লড়াই - এ চলতেই থাকবে, যতদিন না সাম্যাবস্থায় আসে সমাজ। তবে এইটুকুই মনে রাখার, সে কাজ বিদ্যাসাগরের শুধু নয়, সে কাজের সিংহভাগ প্রেরণা জন্মায় করুণাসাগরের হৃদয় থেকে। যার শিক্ষা বইয়ের পাতায় নেই, সজাগ মনুষ্যত্বর ডাক সে। 

193
Fri, 09/24/2021 - 15:00

একজন আমার কাছে খুব দুঃখ করত, "দেখো আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আজকাল তো দেখাই যায় না এরকম। কিন্তু কেমন যেন সব ছাড়াছাড়া। কেউ কারোর ঘরে আসে না। সব আলাদা আলাদা রান্না। ভালো লাগে না।"

    আমি শুনে, 'হাঁ, হুঁ' বলতাম।

    এখন হল কি, তাদের পরিবারে এক ঘরে করোনা হল। শুধু সেই ঘরের লোকেদেরই পজিটিভ এলো। পরিবারের বাদবাকি সবার নেগেটিভ।

    সে আবার যখন এলো, আমি বললুম, দেখো, সব কিছুরই একটা ভালো দিক থাকে। এই যে তোমাদের বাড়িতে সবাই ছাড়াছাড়া বলে দুঃখু করো, কিন্তু সেই বলেই না গুষ্টিশুদ্ধ পজিটিভ হলে না! নইলে সব শুদ্ধ বিছানায় শুয়ে থাকলে কে কাকে দেখতো বলো? সব সময় ভালো দিকটা দেখতে হয়। নয় কি?"

    সে কটমট করে আমার দিকে তাকালো। চলে গেল। আমিও আমার সুক্ষ্ম দর্শনের উদ্ভাবনের আনন্দে পুলকিত হয়ে অদ্বৈত বেদান্তটা আবার পড়ব কিনা ভাবছি, হঠাৎ স্বামীজির একটা লাইনে চোখ গেল।

    জগত সংসার রান্নাঘরের আগুন। রাঁধতেও পারো, ছ্যাঁকা খেতেও পারো।

    বেশ লাইন। মায় মশারি টাঙানোর না অভ্যাসে কত কত প্রাণ ম্যালেরিয়ায় চলে যায়, শুধুমাত্র ORS -এর ব্যবহার না জানাতে কত কত বাচ্চা অকালে প্রাণ হারায়, কিম্বা জলে ক্লোরিন দিয়ে শুদ্ধ করার অভ্যাসের অভাবে কত কত বাচ্চা মারা যায় পৃথিবীতে, এ কথা পরিসংখ্যান দিয়ে অভিজিৎবাবু লিখেছেন তো 'Poor Economics' বইতে। এ সবই হল জগত সংসারের ছ্যাঁকা। বিজ্ঞান হল বাইরের ছ্যাঁকার ঠেকান, আর দর্শন হল অন্তরের ছ্যাঁকার হাত থেকে বাঁচার উপায়। অন্তরের দর্শন বলে, মানে প্রাণে কিঞ্চিৎ বৈরাগ্য না থাকলে সংসারে ল্যাজেগোবরে হয়ে বাঁচায় আর কি সুখ? রামকৃষ্ণদেব বলতেন, তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙো। ভাগবতে আছে, জুতো পায়ে কাঁটাবনে হাঁটো। জুতো মানে কি? সন্তোষ। মানে কি? আধুনিক মনোবিজ্ঞান বলছে, ভাই ক্রিটিকালি ভাবো? সম্পূর্ণ হৃদয় ডিপোজিট করে বোসো না ধুম করে। শেষে দেউলিয়া ঘোষণা করতে হবে। বাইরে ফকির মনে রাজা, এ বেশ। এই যে দেখলে না, গুরু-শিষ্য'র জমি নিয়ে কোন্দলে, গুরু গলায় দড়ি দিয়েই মারা গেলেন। আরে নরেন্দ্র গিরির কথা বলছি। ওদিকে শিষ্যের যা ঠাটবাট বাবা! তো অমন বৈরাগ্যের মুখে ঝাঁটা।   

    কিন্তু সংসারে চলতে গেলে অল্পস্বল্প বৈরাগ্য না থাকলে বুদ্ধি খোলতাই হয় না। বাড়াবাড়ি কিছুরই ভালো না, সে অতিরিক্ত মাখামাখাই বলো, আর একদম শ্মশানবাসীই হওয়া বলো, দুই কি ভালো? এই যে নোবেল পাওয়া দাদা-বৌদি বিশ্বসংসার ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছেন, মায় তথ্য, পরিসংখ্যান দিয়ে দেখাচ্ছেন, গরীব মানুষদের অবিমৃশ্যকারীর মত খচ্চাপাতির কথা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি নিয়ে নানা কুসংস্কার, অসহায়ত্ব ইত্যাদির কথা। আমরা ক'জন জানতাম যে ভারতের অমন পশ্চিমপ্রান্তে হাতুড়ে ডাক্তারদের 'বাঙালি ডাক্তার' বলে? কারণ তখন বেশিরভাগ বাঙালিরাই নাকি সারা ভারতে এখানে সেখানে ডাক্তারি করতে যেতেন। কারণ প্রথম মেডিকেল কলেজ তো কলকাতাতেই হয়েছিল না! তো সে যাই হোক, মানুষকে গভীরভাবে দেখতে গেলে, জানতে গেলে তাকে বৈরাগ্য আর অনুকম্পা - দুইয়ের নিরিখেই দেখা লাগে। নইলে ভুল জাজমেন্ট হয়ে যায়। অভিজিৎবাবু'র কাজ অন্তত তাই বলে। কর্তব্যটা কর্তব্যই। সেখানে গদগদ আবেগের চাইতে অন্তর্দৃষ্টি আর বিচার বিশ্লেষণ শক্তির ডাক বেশি পড়ে।

    তো যদি স্বামীজির চিঠিগুলো পড়া যায়, দেখা যায় ওখানেও উনি বারবার শুদ্ধ পানীয়জল ইত্যাদির কথা বলছেন। এমনকি ওঁর শেষদিনেও সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় বলে গেলেন, মঠের জন্য মশারি কিনতে হবে, নইলে ম্যালেরিয়া ঠেকানো যাবে না। এ প্রসঙ্গে অনেকেই নিশ্চয়ই জানেন রবীন্দ্রনাথেরও ম্যালেরিয়া নিয়ে বেশ বড় একটা প্রবন্ধ আছে। মানে কথা হল শুধু দার্শনিক হলে হয় না, ম্যালেরিয়াতত্ত্বও জানা লাগে।

    তবে এই হল কথা। যদিও সংসার একান্নবর্তী পরিবার। একে অন্যের সুখদুখ নিয়ে যেমন ভাবনা চিন্তা করা দরকার, তেমনই একটু দূরত্বও রাখতে হবে। যাকে এখন বলে 'স্পেস দিতে'। ওই স্পেশটুকুই হল বৈরাগ্য। এটা-একটা নো চিন্তা, নো স্বার্থ, নো পরমার্থ জোন। সেখানে শুধু ফুরফুরে হাওয়া, আর মুক্ত বাতাস থাকবে। হাঁপিয়ে গেলে, মধ্যে মধ্যে সেখানে দাঁড়িয়ে আসতে হবে। এ স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। এর পরিসংখ্যান অর্থনীতিতে পাওয়া যায় না। জীবন হল পরিমাপযোগ্য আর অপরিমাপযোগ্য তত্ত্বের মিশ্রণ। একটাকে বড় করে দেখলে আরেকটা তো বেসামাল হবেই। তাতে গোটা জীবনই বেসামাল। নয় কি? নইলে স্বামীজি কেন বলছেন, আগে গ্রামে গ্রামে যাও, গিয়ে গ্লোব, রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে মানুষকে প্রাথমিক বিজ্ঞান আর স্বাস্থ্যের শিক্ষাটা দাও। ফি বছর কাতারে কাতারে বাচ্চা পেড়ে জনক রাজা না হয়ে একটু স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবা দরকার।

    এই হল কথা। কাণ্ডজ্ঞান না হারিয়ে সংসারে চললে সবটুকুই থাকে --- ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ। মানে নীতি, টাকা-পয়সা, বাসনা-ইচ্ছা-শখ-আহ্লাদ আর স্বীয় সত্তার সার্থকতামণ্ডিত অনুভব, ইংরাজিতে যাকে বলে 'সেল্ফ অ্যাকচুয়ালাইজেশান'। 

194
Fri, 09/17/2021 - 16:30

বিশ্বকর্মা পুজো মানে দারুণ উত্তেজনা। উঁহু, এই আজকের কথা না, সে বহুযুগ আগেকার কথা, যখন আমার উচ্চতা কম ছিল, দাড়িগোঁফ হয়নি, কেশ কৃষ্ণবর্ণ ছিল, চোখে চালসে পড়েনি, এবং সর্বোপরি সংসারে নানা বস্তুর উপর কুতুহল ছিল বেজায়।

    তখন হাফপ্যান্ট পরে, সেজেগুজে, বাবার সঙ্গে আমি আর ভাই বেরিয়ে পড়তুম কাঁচরাপাড়া রেল কারখানায়। কোয়াটার্স থেকে কতটা আর দূর? বেশি নয়। রোজ ভোর সকাল দুপুর সন্ধ্যে কারখানা থেকে ভোঁ পড়ে। বাড়ির শার্সি অবধি ঝনঝন করে ওঠে। সিনেমায় দেখেছি বোমারু বিমান আসার আগে অমন ভোঁ পড়ত নাকি। এখানে ভোঁ পড়লে বোম পড়ত না, তাড়াহুড়ো লাগত, নয় যাওয়ার, নয় ফেরার।

    কারখানার সামনে মেলা। পুতুল, খেলনা উজাড় করে বসে আছে সব। কিন্তু এখন না, আগে ঘুরে নিই, তবে তো। পিলপিল করে মানুষ ঢুকছে। দু'রকম মানুষ। এক, আমরা বাঙালিরা। যারা শিক্ষিত, যারা ভদ্র, যারা উচ্চবর্ণ, যারা ভীষণ মার্জিত, যারা রুচিশীল, এবং যাদের জন্যেই নাকি ভারতের যাবতীয় মান আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে আছে। আর ওরা, হিন্দীভাষী, যারা ক্যাটকেটে রঙের শাড়ি পরে, যারা যেখানে সেখানে থুতু ফেলে, যাদের ভাষায় কেউ নোবেল পায়নি, যাদের ভাষায় কেউ অস্কার পায়নি, যারা এমনি আছে বলেই আছে, যাদের ভাষার, অস্তিত্বের কোনো আভিজাত্য নেই, যাদের গানে রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত এরা নেই, যাদের গান ভীষণ প্রাকৃত, সুক্ষ্মভাব নেই, যাদের সিনেমা শুধুই মনোরঞ্জনের জন্য, বুদ্ধির কিছু নেই, তারা। আমরা ভীমরুল। তারা পিঁপড়ে। যাক গে, এ ফিরিস্তির শেষ হবে না। বিশ্বশুদ্ধ বাংলা মাধ্যমের স্কুল ডকে তুলে, এমনকি স্কুল থেকে রাজার দরবারে সব ফর্ম ইংরাজিতে ফিল আপ করে, চিঠির ঠিকানা ইংরাজিতে লিখে, নিজের নাম সোশ্যাল মিডিয়ায় ইংরাজি অক্ষরে লিখেও আমরা বাংলা ভাষা গব্ব করা কি ছাড়তে পারি? পারি না তো। আমরা বুক চাপড়ে বলি এ সব ভুল যুক্তি।

    উফ্, সে সব কথা কেন? তবে এই বিভেদটা ভীষণ প্রকার ছিল। এটা রেসিজম না, এটা বর্ণবিদ্বেষ না, এটা ভাষা ও সংস্কৃতি বিদ্বেষ। এ আছে। তবে আজকের দিনে অনেকটা কমেছে। কারণ ওরা বেড়েছে, আমরা কমেছি। শুধু কি আর আমাদের হ্যান ছিল, ত্যান ছিল বলে দিন কাটে দাদা! এই যেমন রোজ রোজ শুনি হিন্দী আমাদের ন্যাশেনাল ল্যাঙ্গুয়েজ নয়। অবশ্যই নয়। ভারতে সব ভাষাই রাষ্ট্রীয় ভাষা। এ যেমন সত্যি, তেমন হিন্দীই আমাদের আন-অফিসিয়ালি রাষ্ট্রভাষা হয়ে আছে এও সত্যি। আপামর বাঙালি যখন ভারত ভ্রমণে বেরোয় তখন সে রাস্তাঘাটে, হোটেলে, বাসেট্রেনে, দোকানে, পথচারী ইত্যাদি অতিসাধারণ মানুষদের সঙ্গে কি ভাষায় কথা বলে? বিহারী? ছত্তিশগড়ি? গুজরাটি? মারাঠি? অসমীয়া? মৈথেলি? কাশ্মীরি? অবধি? ব্রজ? বাঘেলি? কনৌজি? ভোজপুরি? যদিও আমাদের কাছে সবই হিন্দী।

    আসলে হিন্দী আমাদের ন্যাশেনাল ল্যাঙ্গুয়েজ না হোক, কিন্তু হিন্দী অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের যোগসূত্রের ভাষা হয়ে আছে এ বিলক্ষণ। ভাষার চূড়ান্ত মর্যাদা সেখানেই। সে অবশেষে যোগসূত্র স্থাপন ছাড়া আর কি করে? সেটুকু সে করে ফেলেইছে।

    এ সব কথা এইজন্যেই বলে ফেললুম ছোটোবেলায় এই উন্নাসিকতাটা আমায় ভীষণ পীড়া দিত। কারা কি করে আমার জানার দরকার নেই, কিন্তু নিজের মধ্যে এত এত বিষাক্ত আলোচনা অসহ্য লাগত। বিরক্ত লাগত। মনে হত, এত অহংকার এদের কিসের? আজও উত্তর পাইনি। তবে এও সত্যি আমাদের কলকাতাকে আমরা ধীরে ধীরে হিন্দীভাষীর কাছে হারিয়ে ফেলছি। তার একটা কারণ আমার মনে হয় আমরা যত নিষ্ঠার সঙ্গে বিদ্বেষ করেছি, ততটা যত্ন নিয়ে নিজেদের গড়িনি। শর্টকাট খুঁজে, আর অতীতের গর্বে দিন কাটিয়ে ভেবেছিলাম সবাই আমাদের প্রধান আসনে বসাটা পাকাপাকি করে রাখবে। তা তো হল না যখন এখন অভিমানে হাত-পা ছুঁড়ে কি লাভ ভাই? নিজেকে সম্মান করলে লোকে সম্মান করতে শেখে। আমরা কি আদৌ সে সম্মানটা নিজের ভাষাকে করেছি? একটা তুচ্ছ উদাহরণ দিয়ে এই প্রসঙ্গটা শেষ করি, প্রতি বছর শিক্ষক দিবসে একটা পোস্ট ঘটা করে বাঙালীকূলকে দিতে দেখি, শিক্ষক রাধাকৃষ্ণাণ, ছাত্র যদুনাথ সিংহের থিসিস কপি করে ভীষণ একটা হেয় কাজ করেছেন। আমি সে বিতর্কে গেলাম না। কেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী মধ্যস্থতায় সেটা রদ হল, কেন দু'জনেই মামলা তুলে নিলেন, সে অন্য ইতিহাস। কিন্তু বাপু হে, সেই যদুনাথ সিংহের ভারতীয় দর্শন, দিল্লির মোতিলাল প্রকাশনা হিন্দী আর ইংরেজি দুই ভাষাতেই ছেপেছে বহুকাল হল। যদুনাথের লেখা ভারতীয় দর্শনে মনোবিজ্ঞানের ভূমিকা, যা নিয়ে বলা চলে তাঁরই প্রথম কাজ। যে কাজ প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্যের প্রকাশক রুথলেজ, যাদের হাতেই রাসেলের সব কাজের সত্ত্ব, তারা ছেপে বার করেছে। সে সব নিয়ে আলোচনা শুনি না কেন? নাকি আমাদের ওই চাটনি মার্কা খবরেই আসক্তি? বাপু হে, যদুনাথের বইটা পড়ে, সে মানুষটা যে সব অসামান্য কাজ করে গেছেন সে সব নিয়ে আলোচনা না করে শুধু রাধাকৃষ্ণান দুষ্টু লোক ছিল ফি বছর চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বললে শুধুমাত্র নিজের কলহপ্রিয় ও ছিদ্রান্বেষী ক্ষুদ্র সত্তাটারই কেবল সুখ হয়। এত বড় জগতে তোমার ও কেচ্ছা শোনার জন্য কেউ মুখিয়ে নেই। বরং আসল কাজটা করলে মান বাড়ত। কিন্তু ওই যে বললুম, আমাদের গড়ার শব্দের চাইতে, ভাঙার আওয়াজে সুখ বেশি। পরের নিন্দাতে যে সুখ, আত্মসমালোচনায় সে সুখ কই?

    যা হোক, পূর্ব প্রসঙ্গে আসি, তো কারখানায় গিয়ে ইস্তক বড় বড় খোলামেলা ট্রেন দেখে মজে যেতুম। এত এত বড় বড় চাকা খুলে খুলে রাখা। বড় বড় বগি সারানো হচ্ছে, মেরামত হচ্ছে। ট্রেনগুলো দেখলে মনে হত ট্রেনেদের শোয়ার ঘরে ঢুকে পড়েছি যেন। সাজসজ্জাহীন দাঁড়িয়ে আছে সবাই। যেন লজ্জাই পেয়েছে এত এত লোক দেখে একসঙ্গে। আমাদের সবাইকে যেন ট্রেন চেনে। চিনবে না? কোলেপিঠে করে নিয়ে বেড়াচ্ছে না রাতদিন?

    তারপর কারাখানায় কত কত যে ঠাকুর সে গোনা যায় না। যতগুলো শপ, ততগুলো ঠাকুর। আমার আবার বিশ্বকর্মা, শনিঠাকুর আর কার্তিক ঠাকুর গুলিয়ে যেত। যাবে না? এনাদের সবারই গোঁফ আছে না? রাম বা কৃষ্ণের গোঁফ নাই। কেন? তাঁরা হলেন গিয়ে অবতার। দেবতা তো নন। অবতার মানে স্বয়ং ভগবান। ভগবানে গোঁফ নেই কেন? জানি না। শাস্ত্র ঘেঁটে পরে বলব।

    একটা গপ্পো মনে পড়ে গেল। মুরারি বাপু আছেন না? আরে প্রসিদ্ধ রামচরিতমানস এর কথক ঠাকুর গো! উনি একবার একটা বেশ মজার গল্প বললেন। একবার একজন একটা মাটির ঠাকুর গড়ার অর্ডার দেবে। তো সে এসে কারিগরকে বলেছে মঙ্গলমূর্তি গড়ে দিতে একটা।

    কারিগর একটা হনুমানজীর মূর্তি বানিয়েছে বেশ যত্ন করে। এদিকে যে অর্ডার দিয়েছে সে তো ঠাকুর নিতে এসে একেবারে ক্ষেপে আগুন। সে এসে বলল, আরে মশায় আপনি এ কি কাজ করেছেন? আপনি কি কালা? আমি যে মঙ্গলমূর্তি বানাতে বললাম?

    কারিগর ক্ষেপে বলল, আমিও তো তাই বানালুম, দেখছেন না, আপনি কি কানা?

    বায়নাকারী বলল, আরে মশায় গণেশ... গণেশজী'র কথা বলেছি…. তিনি কি মঙ্গলমূর্তি নন?

    তখন কারিগর শান্ত কন্ঠে বলল, ও আমি ভুল বুঝেছি, দাঁড়ান এক্ষুণি সমাধান করে দিচ্ছি। এই বলে সে হনুমানজী'র লেজটা খুলে মুখের উপর বসিয়ে দিয়ে বলল, ব্যস, হয়ে গেল। মুখটা নিজের কেরামতিতে বদলিয়ে পুরো গণেশজী হয়ে গেল।

    এই গল্পের জন্য কেউ অবশ্য মুরারি বাপুকে বকাঝকা করেননি। সাধারণত তা করাও হয় না, তবে তো মধুসূদন, সুকুমার, মায় রবীন্দ্রনাথ তো অবধি দেশছাড়া হতেন।

    যাই হোক, কারখানা ঘুরেটুরে বাইরে এলাম। এইবার তো আসল উত্তেজনা। কতরকম খেলনারে বাবা! আমি হামলে পড়ে খেলনায় ঝুঁকতাম। সঙ্গে আরো কত কত বাচ্চাকাচ্চা। বাবা বলতেন, তাড়াতাড়ি। আমিও মনকে বলতাম, তাড়াতাড়ি। তারপর ঘন্টাবাজা গাড়ি, কি প্লাস্টিকের লাইনে চলা ট্রেন, কি সুতো টেনে ছেড়ে দেওয়া হুস্ করে চলে যাওয়া গাড়ি ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই সব কিনে সোল্লাসে বাড়ি ফিরতাম। তারপর পুজোর অপেক্ষা। মানে দুগ্গা পুজো।

    এই হল গল্প। এখন আর রেল কারখানায় যাই না। তবে খেলনার দোকানগুলো খুব মিস করি। বড়দের খেলনা একটাই সংসারে, নিজের ইগো। তার পিছনে সুতো ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বিশ্বজুড়ে হইহই মাতিয়ে রেখেছে। দমও শেষ হয় না, আর নেশাও কাটে না। 'টিন ড্রাম' উপন্যাসে অবাড়ন্ত ছেলেটার হাতে একটা ড্রাম ধরিয়ে দিয়েছিলেন গুন্টার গ্রাস দাদা। সে ছেলের গলার চীৎকারে সব শার্সি ফেটে চৌচির হয়ে যেত। অমন একটা গলাফাটানো চীৎকার করলে হয় না, সব দেমাকি মানুষগুলোর পিলে চমকে? বেশ মজা হয়। সবাই আবার বাচ্চা হয়ে ঝুঁকে পড়ে ঘন্টা বাজানো খেলনা কিনবে। মাটির দিকে তাকাবে। আর বুঝতে পারবে দাঁড়াতে গেলে শুধু পা লাগে না, মাটিও লাগে।

195
Tue, 09/14/2021 - 22:34

কয়েকটি কথা আবশ্যক বিবেচনা করিয়া লিখিবার প্রয়াস পাইতেছি। আমি নানাবিধ বিষয় লইয়া লিখি। যে বিষয় আমায় পাইয়া বসে সেই বিষয়ই আমায় দিয়া লিখাইয়া ছাড়ে। কিন্তু কোনো বিষয়েই আমি নিজেকে অথোরিটি মনে করি না। অথোরিটির কোনো বাংলাই মনোমত না হওয়ায় অথোরিটিই লিখিলাম। 

    সংসারে ভ্রমণ করা বাধ্যতামূলক। আমি চলিতে না চাহিলেও সময় না চলিয়া থাকিতে পারে না। এবং যেহেতু সময়ের সহিত শ্বাসাদি নানা জৈবনিক ক্রিয়া সহ আমার জীবন, অগত্যা আমাকেও চলিতে হয়। চলিতে গেলেই পঞ্চেন্দ্রিয় বাচাল হইয়া উঠে। শুধু ইন্দ্রিয় বাচাল হইলে একপ্রকার হইত, মন ততোধিক বাচাল, সে বুদ্ধির হস্ত হইতে লাগাম কাড়িয়া, এমন হেস্তনেস্ত বাধাইয়া বসে যে তাহাকে সামলায় কার সাধ্যি। সে এইদিকে উঁকি দিয়া, সেইদিকে বেড়া ভাঙিয়া ঢুকিয়া, সোজা পথকে বাঁকা করিয়া, বাঁকা পথকে কুটিলজটিল করিয়া একটি দক্ষযজ্ঞ বাধাইয়া থাকে। সুবোধ হইবার কোনো লক্ষণ এই বয়েস অবধি হইল না যখন আর হইবে বলিয়া আশা রাখি না। 

    তো পথে চলিতে চলিতে যাহা দেখি তাহাকেই সম্পূর্ণ অথবা যাহা শুনি তাহাই সম্পূর্ণ - এমন বলি না। শুধু বলি না তাহাই নহে, যখনই কেহ বলেন, এই হইল সম্পূর্ণ কথা, তখন তাহাকেও দূর হইতে নমস্কার করিয়া পালাইবার পথ খুঁজি। কারণ সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি, সম্পূর্ণ হইলে বাদ পড়িবার মত কিছু অবশিষ্ট রহে না। আমি এমন শিষ্ট নহি যে অবশিষ্টকে ছাড়িয়া শুধু এক কাল্পনিক সম্পূর্ণ লইয়া কোথাও স্থির হইব। "অন্ত কে তার সন্ধান পায়, ভাবিতে লাগায় ধন্দ"। রবি ঠাকুর গাইলেন। আমার প্রাণে ধরিল। এমনকি রামকৃষ্ণ ঠাকুর যখন বলিলেন, "আমার বলিবার আমি বলিলাম, এবার তোমার ল্যাজামুড়া বাদ দিয়া লও", সেও মনে ধরিল। গীতা যখন সমস্ত তত্ত্ব বলিবার পর বলিলেন, "যথা ইচ্ছসি তথা কুরু" - সেও মনে ধরিল। নইলে গীতা বলিবার পর যুদ্ধ বাধাইবার উপক্রম করিলে কৃষ্ণ যদি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের মত বেত্র হস্তে লইয়া দুর্যোধনাদির প্রতি ধাবিত হইতেন, ও হুঙ্কার দিয়া বলিতেন, "ওরে মূঢ়, অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাম... ইহাই ধর্ম, ইহাই অমৃত এত করিয়া বলিলাম, মায় বিশ্বরূপ অবধি দেখাইলাম, তাও যুদ্ধ করিবি….."। তবে কৃষ্ণকে ভয় পাইতাম, তাহার বংশীকে নিতান্তই সৌজন্য বলিয়া বোধ করিতাম, সত্য নয়। 

    অগত্যা দেখিলাম, কেহই আপনার অথোরিটিত্ব লইয়া সংসারে মাথা ঘামান না। এতাদৃশ মহৎ ব্যক্তিত্ব যদি আপনাকে অথোরিটি বলিতে ইচ্ছুক না হয়েন, তাহা হইলে অ্যামিবা সদৃশ আমিই বা কি করিয়া কয়েকটি পুস্তককে আঁকড়িয়া চীৎকার করিয়া জগত মাতাই, ওহে আমি সত্যকে জানিয়াছি তোমরা আমার নিকট আইস। 

    ঠিক এই কারণে আমি তর্কাদিতে স্বচ্ছন্দবোধ করি না। খুচরা ব্যবসায়ী আমি, আড়তের হিসাব রাখাকে দায় মনে করি না। কিন্তু আমাকে আড়তদার বানাইয়া, কেহ যখন কোমর বাঁধিয়া তর্কে ডাকেন, আমি বাঁধন খুলিয়া পালাইবার রাস্তা খুঁজি। কারণ তর্ক করিবার মানুষেরা প্রায়শই আপনাকে অথোরিটি ভাবিয়া গোঁফে চাড়া দিয়া বসিয়া আছেন দেখিতে পাই। জগতে নানা বিষয়ে তাহাদের সংশয় রহিলেও দেখিয়াছি নিজেকে লইয়া তাহারা মৃত কাষ্ঠের ন্যায় দৃঢ় ও সুনিশ্চিত। ইহা ভুল অবশ্যই, কিন্তু সে ভুল ভাঙাইয়া কি লাভ। তাহা হইতে ভ্রমের সঙ্গে সহবাস যে যাবৎকাল সুখের অনুভব আনে তাহাই না হয় রহুক। 

    ভারতের দর্শনের ইতিহাস বিচিত্র। তাহাতে ডুবিয়া একটি কথা সার বুঝিয়াছি, সত্য আছেন বটে, তবে তাহা সত্য বলিয়া নাই। আছেন রহস্য হইয়া। একই মাটিতে আত্মা সত্য ও মিথ্যা হইয়াছে। একই মাটিতে সত্য অবিনশ্বর আবার সত্য সদাবহমান পরিবর্তনশীল - ইহাও আছে। চার্বাকের বস্তুবাদ যেমন রহিয়াছে তেমনই কবীর-তুলসী-চৈতন্য-মীরার রোম্যান্টিক মিস্টিসিজম রহিয়াছে। তুমি কে হে, ইহার একটিকে তুলিয়া, ইহাই সর্বস্ব বলিবে? পাণিনি, জৈমিনি, বুদ্ধ, মহাবীর, কুমারিল, গৌতম, বাদরায়ণ প্রমুখ যাহারা স্বমহিমায় আজও ভারতের চিদাকাশে ভাস্বর হইয়া রহিয়াছেন, তাহারা এক একটি স্তম্ভ। সত্যের রহস্যময় অস্তিত্বের এক একটি স্ফুলিঙ্গ। তাহাদের শ্রীচরণকমলে শতকোটি প্রণাম।

    অগত্যা সংসারে অথোরিটি হইতে চাহি নাই। "দু তিন দিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে, সেই কর্তারে দেবে ফেলে কালাকালের কর্তা এলে", গানে রহিয়াছে। অর্থাৎ কেহই অথোরিটি নয়। সময় বিশেষে আজ যাহা প্রামাণ্য, কাল তাহাই ফিরে তাকাইবার বস্তু নহে। ইহাই রীতি। সময় নিষ্ঠুর। তাহার অনন্ত ছলিবার কৌশল, মোহে ফেলিবার লীলা। সে কাটাইয়া উঠিব ভাবিলেই কাটানো যায় না। এক ছলনা হইতে আরেক ছলনায় গমন মাত্র হইয়া থাকে। মিথ্যা হইতে মিথ্যায় গমন একটি প্রবল মিথ্যা। তাই সমস্ত গমনাগমনের ভ্রান্তি হইতে নিষ্কৃতি লাভের উদ্দেশ্যকেই ভারত মুক্তি বা নির্বাণ বলিয়াছে। কিন্তু ছলনাকে ক্ষতির বস্তু ভাবিয়া তাহা হইতে দূরে পলায়ন করিতে গেলে পথ আরো জটিল হইয়া যায়। ছলনা লাভ বা ক্ষতি কোনোটিই নহে। ভ্রান্তি কেবল ভ্রান্তিই। কিন্তু তাহাতেও সুখ। সে সুখের আয়ুষ্কাল সীমিত জানিয়াও সুখ। তাই এই ভ্রান্তিকেই ধরিয়া চলিতেছি। ভ্রান্তিহারী যিনি সময় করিয়া আসিয়া নিশ্চয়ই ভ্রম ভাঙাইবেন। কারণ ভ্রান্তি অনন্ত হইলে ভ্রান্তি সত্যের গুণবাচ্য হইয়া উঠে। তাহা স্ববিরোধী। অগত্যা এমনই চলুক। কেবল নিজেকে অথোরিটি না জানিলেই হইল। যাহা জানি তাহার সীমা আছে, গলা বাড়াইলেই বেড়া দেখা যায়। দু পা জোরে হাঁটিলেই পরিখায় আসিয়া দাঁড়াই। তাহার পর রহিয়াছে অসীম অজানা। তাহা আমার প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমা কিম্বা গ্রন্থ প্রমাণের বাহিরে। ইহাই শান্তির কথা। ইহাই বিস্ময়। ইহাই পরম আনন্দ। আমি আমাতে শেষ হইলেও, সত্য আমাতে শেষ হয় না। জয়গুরু।

196
Sun, 09/12/2021 - 12:37

পরিবার মানেই কি ভালোবাসার ক্ষেত্র? "মায়ের ভায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?"... এ পুরো ঢপের কেত্তন। এত অত্যুক্তি বাপু খুব কম গানেই শোনা যায়। পদে পদে অতিকথন। সে যাক, গীতা মনে আছে? আর ধুর, পুরো গীতাটা কে মুখস্থ বলতে বলেছে, কনটেক্সটটা নিশ্চয়ই জানা আছে। সেটা কি পারিবারিক সুখকর কিছু ভাবভালোবাসার উদাহরণ?

    পরিবার মানেই মিনি যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে পদে পদে ইগোর লড়াই। ইগো মানে আমি। আমি মানে আমার মত, আমার পছন্দ, আমার সুবিধা, আমার স্বার্থ। আমার জমি মানে আমার ইগো। আমার জমি আমি সামলাচ্ছি, তোমার জমি তুমি সামলাও। যদি বলো ইগো মানে ছায়া। ছায়া মানে শূন্য। মানে আদতে অমন জমি বলে কিছু হয় না। তারা মুখ ঝামটিয়ে বলবে, ওসব জ্ঞানের কথা। আমাদের মোদ্দা কথাই হল এই জমি। ইগোর জমি। বিনাযুদ্ধে নাহি দিব তিলমাত্র মত। মত মানে আমি। 

    সংসারে জ্ঞান কাজের বস্তু না। সে তার জায়গার থাকুন। শাশুড়ী বউমা ভাগবত শুনতে গেছেন। কিছুক্ষণ পর শাশুড়ী বউমাকে বললেন, বউমা তুমি গিয়ে ভাতটা চাপাও, আমি পুরোটা শুনে আসি। ভালো কথা। বউমা চলে এলেন বাড়ি। শাশুড়ী পুরো ভাগবতকথা শুনেটুনে রাত্তিরে বাড়ি ঢুকতে গিয়ে তো চিত্তির। একি! সারা বাগান মুড়িয়ে গেল কে? বউমা…. ও বউমা….

    বউমা রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে বললেন, কি মা?

    শাশুড়ী বললেন, একি দেখি বউমা? সারা বাগান মুড়ানো দেখি.. কে করিল এক কাজ! (শাশুড়ীর ভাষায় তখনও ভাগবতের ঘোর)

    বউমা বললেন, কৃষ্ণ…

    অ্যাঁ…. কি বলিস রে মুখপুড়ি... কৃষ্ণ খেয়ে গেল আমার গোটা সাজানো বাগান…!! (শাশুড়ীর ঘোর কাটতে বেশি সময় লাগল না).... তা কোথায় কৃষ্ণ….

    বউমা আঙুল দিয়ে দেখালেন….

    শাশুড়ী দেখলেন তাদের বাড়ির ছাগলটা…. এখনও মুখে শেষ গাঁদাপাতাটা লেগে…. সে মনের সুখে চিবোচ্ছে…

    শাশুড়ী ভাগবত থেকে মহাভারতে নামলেন... ওরে হতচ্ছাড়ি মাগী... এ যে ছাগল…

    বউমা হাতজোড় করে বললেন, কেন মা... কথক ঠাকুর যে বললেন, প্রহ্লাদ বলছেন ভাগবতে, কৃষ্ণ জীবে জীবে অধিষ্ঠিত… আমি বাড়ি ঢুকেই দেখি... আমাদের বাঁধা কৃষ্ণ আমাদের সরেস বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে... সেকি করুণ চাহনি মা গো... কৃষ্ণ রাধিকার দিকেও অমন চাহনিতে চেয়েছিলেন কিনা জানি না মা….. আমি আর থাকতে পারলাম না…. দিলাম খুলে….

    শাশুড়ী বাক্যহারা... একবার ছাগলের দিকে তাকান... একবার বউমার দিকে… রাগে মাথায় আগুন জ্বলছে…. বুক জুড়ে প্রেশার কুকারের তাপ... নিজেকে সংযত করলেন... শান্ত দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, দেখো বউমা... এখন থেকে ভাগবতের সমস্ত জ্ঞান এই গেটের বাইরে রেখে সংসারে ঢুকবে, কেমন?

    তো এই হল গল্প। আরেকটা গল্প। আমার নিজের। শীতকালে মা বাথরুমে সরষের তেল রাখতেন। তাকের উপর রাখা। আমার হাত লাগল। সেটা টুক করে মাটিতে আর্তনাদ করে আছড়িয়ে পড়ে কয়েক টুকরো হল। মা এলেন। বুঝলাম আমার কপালে দুঃখ আছে। সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। জ্ঞান স্মরণ করলাম। মাকে বললাম, দেখো মা, অজান্তে আমার হাতের সঙ্গে শিশির ধাক্কা লেগেছিল এ সত্য... কিন্তু নীচে পড়ে যাওয়াতে এবং ভাঙাতে আমার কোনো হাত নেই…. ওটা নিতান্তই মাধ্যাকর্ষণের কারণে….

    বাকিটা পাঠককে আর বোঝাতে হবে না আশা করি। মোদ্দা কথা হল সংসারে জ্ঞান বস্তুটি একান্ত বাড়তি। আরশোলার বাইরের বাদামী ডানার মত। সে খালি কাজের সাদা ডানাটাকে ঢেকে রাখার জন্যেই আছে। 

    তো এখন কথা হল এ যুদ্ধে জয়লাভের পথ কি? নেই। সে ভাগ্যের হাতে। কোন্দলের পর কোন্দল হবে। বেশির ভাগই ঠাণ্ডা লড়াই। তবে জেতার কোনো সূত্র নেই। হারজিত দুই মেনে নিতে হবে। 

    ইগো মানে ঘুমন্ত সাপ। শান্ত কুকুরের লেজ। পা না দিয়ে টিপে টিপে চলুন। কথা বলুন। হাসুন। হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলান। না তে না। যতক্ষণ সম্ভব আরকি। যতটা সম্ভব লেজ বাঁচিয়ে চলাই ভালো। কিন্তু তাই কি হয়? শঙ্কা যেথায় করে না কেউ সেইখানে থাকে লেজ পাতা। ধুম করে দিয়ে ফেললেন পা। ব্যস। এবার সামলাও। মহাঝামেলা। কার লেজ যে কোথায় পাতা সে বোঝা বড় দায়। এ ব্রহ্মজ্ঞান হওয়ার মত। কারণ সংসারে স্থূল লেজ এড়িয়ে যদিও বা চলা যায়, সুক্ষ্ম লেজ এড়িয়ে চলা রীতিমতো আর্ট। আর সংসারে সুক্ষ্ম লেজের সংখ্যাই বেশি।

    এই ধরুন, মা যদ্দিন ছিলেন, তদ্দিন প্যাভিলিয়নে বসে দিব্যি সুখে দিন কাটিয়েছি। গপ্পোগাছা করেছি। হাসিমজা করেছি। সংসারময় ব্রহ্ম দেখেছি। হঠাৎ মা ব্যাট নিয়ে প্যাভিলিয়নে এসে বললেন, যাও এবার খেলায় নামো। তিনি হাপিস হলেন। আমি আমাকে নিয়ে উদয় হলুম।

    নাও। আচমকাই মাঠে। কার কি ধরণের বল করার অভ্যাস জানি না। আম্পায়ার নিরপেক্ষ কিনা তাও জানি না। কিন্তু মাঠ ছেড়ে যাওয়ার তো যো নেই। মাঝে মাঝে মেলা লুজ খেলা খেললাম। প্রাণপণে উইকেট রক্ষা করে যাওয়ার চেষ্টা। ক্রমে বুঝলাম কে কোথায় ফিল্ডিং এ আছে। সংসারে সব হাসি হাসি নয়। পাছার কাছে হাত পেতে যে, মায় সেও আমার নয়। এই হল গিয়ে জীবন। সব হাসি হাসি নয়। সব রাগ রাগ নয়। সব মিষ্টি মিষ্টি নয়। সব তেতো তেতো নয়। সব ভালোবাসাও ভালোবাসা নয়। সংসার জুড়ে চায়না মাল... থুড়ি নকল…. আপনাকে আসল বাছতে হবে না, ও আপনিই ধরা দেবে, খালি নকল বাঁচিয়ে চলুন। 

    তবে কি এই শেষ কথা? তা নয়। এ সব সামলিয়ে যদি গভীরে সেঁধিয়ে দেখেন, দেখবেন সবাই আমার আপনার মত একই সমস্যায়। নইলে সংসারে এত এত মহাপুরুষ এলোগেলো, মনে ধরল আমার সারদাদেবীকে এত্ত কেন জানেন? উনি বাপু মেলা কঠিন কঠিন সমাধান দেননি। কিন্তু যা করে দেখিয়ে গেলেন সংসারে সেই হল গিয়ে রাস্তা। তাঁর সংসারে পাগল থেকে শুরু করে হীনবুদ্ধি, স্বার্থপর কি নেই? ও যতই ঠাকুর বলুন না কেন তিনি নাকি অষ্টসখী পরিবৃত হয়ে স্নানেটানে যাচ্ছেন। ওসব ভাবের কথা। আমাদের সিলিণ্ডারের হিসাব, ইলেকট্রিক বিলের হিসাব, বাজারদোকান, এসবের জগতে ওর কোনো মূল্য নাই। আসল কথা হল সবাইকে নিয়ে, কিভাবে চলা লাগে উনি দেখালেন। জীবন বটে মাইরি একটা। মারা যাওয়ার আগে মহাপুরুষেরা কত কত দামী কথা বলে যান। যেগুলো ঘরে সাজানো যায়, কাজে লাগে না। ইনি কিন্তু কি সোজা একটা মন্ত্র দিয়ে গেলেন, "যদি শান্তি চাও তবে কারো দোষ দেখো না, দোষ যদি দেখতেই হয় তবে সে নিজের। সংসারে কেউ তোমার পর নয়, জগতকে আপনার করে নিতে শেখো।"

    আসলে জগতের মালিক বুঝেছিলেন, মেলা পুরুষ পাঠিয়ে পাঠিয়ে খুব একটা লাভ হয়নি, তারা সংসারে আসল ধর্মটা কেউ বোঝাতে পারেনি। তাই এইবার একজনকে পাঠানো যাক যিনি হেঁশেলের ভাষায়, হেঁশেলেই শান্তির কথা বলবেন। তাই উনি এলেন আরকি। মহাপুরুষ না, মহানারীও না। মা। নিজের। আবার সবার।

197
Wed, 09/08/2021 - 21:30

 

“Christ furnished the spirit and motivation while Gandhi furnished the method” - Martin Luthar King

    মার্টিন লুথার কিং এসেছেন ভারতবর্ষে। ফেব্রুয়ারী মাসের ঠাণ্ডায় এসে নামলেন ভারতে, ১৯৫৯ সাল। দশ তারিখ। থাকলেন এক মাস। থাকতেই হবে তো। এ তো তীর্থক্ষেত্রে আসা। মহাত্মা গান্ধীর কাছে আসা। তীব্র যন্ত্রণা বুকে। নিজের মানুষদের অত্যাচারিত হতে আর দেখতে পারছে না।

    সদ্য বাস আন্দোলন শেষ হয়েছে। কালো চামড়ার মানুষ সিট ফাঁকা থাকলেও বসতে পারবেন না বাসে। কারণ তা সাদা চামড়ার জন্য সংরক্ষিত। সে আন্দোলন শেষ। বই লিখলেন সেই আন্দোলন নিয়ে। ১৯৫৮ সাল। বইয়ের নাম Stride Toward Freedom. সই করছেন বইয়ে। ঘিরে আছে অসংখ্য অনুরাগী। একজন মহিলা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনিই কি কিং?

    মার্টিন উত্তর দিলেন, হ্যাঁ।

    ব্যস, কিছু বোঝার আগেই ছুরি বিঁধে গেল বুকে। হৃৎপিণ্ডের যে ধমনীকে মহাধমনী বলে, যে একটা বাঁক তৈরি করে জন্ম দেয় অনেকগুলো ধমনীর, সেই বাঁক ঘেঁষে চলে গেল ছুরি। ডাক্তার ঠাট্টা করে বলেছিলেন, আপনি যদি হেঁচে দিতেন সেই সময়ে তবে নিজের রক্তের প্লাবনে নিজেই ডুবে মারা যেতেন।

    মারা যাননি। কিন্তু মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেই মনে হয়েছিল, আর না, বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু এত গোপনচারী, এত অনিশ্চিত, এত অতর্কিতে আসা অতিথি? আর দেরি নয়, ভারতে যেতেই হবে। বারবার নানা কাজে আটকে যাচ্ছে ভারতে যাওয়া। আর দেরি নয়। সেদিনের কথা মনে পড়ল। চার্চে একজন মহাত্মা গান্ধী সম্বন্ধে বলছেন। তিনি সদ্য ভারত থেকে ফিরেছেন। শ্রোতার আসনে বসে মার্টিন লুথার কিং। নিজের স্বজাতির অপমান দেখতে পারছেন না আর, কিন্তু উপায়? লড়বেন কি ভাবে? প্লেনে সপরিবার বসে আছেন। প্লেন খারাপ হল। গোটা প্লেনে একমাত্র তারাই নিগ্রো পরিবার। প্লেন কর্তৃপক্ষ থেকে খাওয়ার ব্যবস্থা হল পাশের এক হোটেলে। সবাই ঢুকছে। দারোয়ান বাধা দিল লুথার কিং আর তার পরিবারকে। কি অপমান, পিছনে যেখানে ময়লা সেখানে খেতে হবে!

    একবার বোম পড়ল। বাড়িতে বাচ্চা আর স্ত্রী। লুথার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে করতে ফিরছেন, কি হবে? গিয়ে কি ওদের মৃত দেখবেন? না। বেঁচে আছে ওরা। গভীর রাত, লুথার কাঁদছেন। হে ঈশ্বর, এ গুরুভার বইবার শক্তি কই? তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। হে ঈশ্বর আমি দুর্বল। আমি পারলাম না। আমি ছেড়ে দিলাম সব।

    লুথার কাঁদছেন। অসহায়ের মত কাঁদছেন। রাস্তা কই? হঠাৎ বুকের মধ্যে কে যেন জেগে উঠল। কার ভাষা? কার চোখে পড়ে গেল চোখ? কার সে নয়ন পরে নয়ন যায় গো ঠেকি... মহা আপন সেকি!

    চার্চে বক্তা বলে চলেছেন মহাত্মা গান্ধীর কথা। আবেগে গলা ধরা আসছে। এও সম্ভব! এও সম্ভব! আইনস্টাইন বলছেন, আগামী দিনের মানুষ বিশ্বাস করবে না, এরকম একজন মানুষ রক্ত মাংসের শরীর নিয়ে হেঁটে গেছেন এই মাটিতে।

    লুথার কিং পুরো ভাষণ শুনতে পারলেন না। উঠে এলেন। সোজা বাজারে গেলেন। মহাত্মা গান্ধী সংক্রান্ত প্রায় আধডজন বই কিনে বাড়ি ফিরলেন। ডুবে গেলেন। রাস্তা পেলেন। লিখলেন, -

    “The intellectual and moral satisfaction that I failed to gain from the utilitarianism of Bentham and Mill, the revolutionary methods of Marx and Lenin, the social contracts theory of Hobbes, the “back to nature” optimism of Rousseau, the superman philosophy of Nietzsche, I found in the nonviolent resistance philosophy of Gandhi.”

    ভারতে তো আসতেই হবে। দেখা করলেন পণ্ডিত নেহেরু সহ নানা জ্ঞানী-গুণী তথা গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারিকদের সঙ্গে। ভারতের সমস্যা দেখলেন। বুঝতে চেষ্টা করলেন। ভীষণ দরিদ্র বেশ কিছু গ্রাম দেখবার সময় জানতে পারলেন একটা শব্দ - অচ্ছুৎ। কেরালার এক স্কুলে সস্ত্রীক গেছেন লুথার কিং। স্কুলের স্যার তাদের পরিচয় দেওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীদের বললে, ইনি আমেরিকা থেকে এসেছেন, ইনি জাতে অচ্ছুৎ। চমকে উঠলেন কিং, তিনি কি সত্যিই অচ্ছুৎ? ভেবে দেখলেন, তাই তো! তার ছেলেমেয়েরা সাদা চামড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতে পারে না। প্রতিপদে তাদের ছোঁয়া, তাদের অস্তিত্বকে মাড়িয়ে যাচ্ছে যারা, তাদের চোখে সত্যিই তো তারা অচ্ছুৎ।

    ২২শে ফেব্রুয়ারী। কিং সস্ত্রীক বসে কন্যাকুমারিকার একটা পাথরের উপরে। সূর্য ডুবছে পশ্চিমাকাশে। অন্ধকার নামছে ধীর পায়ে। তিনটে সমুদ্রের সঙ্গমস্থলকে বিস্ময়ের চোখে দেখছেন লুথার। কি অপরূপ সৌন্দর্য! কি রূপ প্রকৃতির! কয়েক দশক আগে এই একই জায়গায় এসে বসেছিলেন আরেক বিশাল হৃদয় মানুষ। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ থেকে ভারতাত্মার দাস বিবেকানন্দ’র জন্ম হয়েছিল এখানে। ভারতের মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন মানবাত্মার মুক্তির পথ। “মানুষকে পাপী বলাই শ্রেষ্ঠ পাপ”। “নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর”। এমন সব বাণী মানুষের অন্তরের কোন জ্যোতিকে দেখে উনি বলেছিলেন? সে তিনিই জানেন।

    অন্ধকার হল। সূর্য ডুবতে না ডুবতেই পুব আকাশ জুড়ে উঠল বিশালাকায় শ্বেতশুভ্র চাঁদ। অন্ধকারে ঈশ্বরের প্রসন্ন হাসির মত চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল তিনটে সাগরের বুকে। কি গভীরভাবে শান্ত হল ক্ষণিকের জন্য লুথারের হৃদয়। কেউ কোনো কথা বলছেন না। শুধু সমুদ্রের আওয়াজ আর ঘরে ফেরা পাখিদের ডাক। এই প্রশান্তির মধ্যে এক গভীর উপলব্ধি জন্মালো মার্টিন লুথারের চিত্তে। তিনি স্ত্রীকে বললেন, দেখো, সমস্ত অন্ধকার হলেও যেমন চাঁদের আলো এই অন্ধকারকে স্নিগ্ধতায় ভরিয়ে তুলল, তেমনই ঈশ্বরের করুণায় সব অন্ধকার, সব অত্যাচার সব কেটে যাবে তুমি দেখো, এ কি গভীরতম সত্যের উপলব্ধি হল আজ আমার!

    লুথার কিং এই উপলব্ধি নিয়ে ভারত ছাড়লেন। বিস্মিত হলেন নেহেরু প্রমুখ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে। তিনি ভাবলেন, ভারতেও বৈষম্য আছে, বর্ণবিদ্বেষ আছে। কিন্তু দেশের প্রমুখ নেতারা এর বিরোধিতা করছেন, এমনকি নীচুস্তরের জনপ্রতিনিধি যিনি তিনিও পর্যন্ত বিরোধিতা করছেন। কিন্তু আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরাই বিশ্বাস করেন, এবং গর্বের সঙ্গে বিশ্বাস করেন যে এই পৃথকীকরণের নীতি দেশের জন্য ভালো। বাস আন্দোলনের পর পরই এক সাদা চামড়ার বৃদ্ধা বাসে উঠে দেখেন সামনের সিটে কিং বসে আছেন। তাকে পিছনের সিটে বসতে বলা হলে তিনি বললেন, আমি মরে যাব সেও ভালো, কিন্তু একজন কালো চামড়ার পিছনে বসব... থু!

    কি ঘৃণা!

    ভারতে জন্ম হয়েছে চারটে ধর্মের। প্রাচীন ধর্ম সনাতন, তারপর বুদ্ধ, জৈন ও শিখ। নানা উত্থান-পতনের পর সহাবস্থানের সূত্রও আবিষ্কার হয়েছে। গয়া আর কাশীতে বৌদ্ধ আর হিন্দুধর্মের যে সহাবস্থান আজ আছে, সে সহাবস্থান শান্তির। বুদ্ধগয়াতে হিন্দু যাচ্ছে, নানকের মন্দিরে হিন্দু যাচ্ছে, জৈন মন্দিরে হিন্দু যাচ্ছে। কোথাও কোনো বাধা মনে হচ্ছে না। প্রতিটি ধর্মের অনেক সঙ্কেত, প্রথাতেও মিল আছে। কয়েক দশক আগে এই দর্শন, আদর্শের কথা বলতেই গিয়েছিলেন সেই মানুষটা শিকাগোতে এবং যিনি যে বাণীর জোরে সে দেশে সর্বজনবিদিত হলেন সেও কি এই অহিংসার বাণী নয়? গান্ধীর ধর্মের আদর্শ, সর্বধর্মের মিলনের আদর্শ। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মধ্যেও একই সুর, একই ঐক্যের কথা শোনালেন বিবেকানন্দ, গান্ধী যা হয় তো এতটা স্পষ্ট করে তারা নিজেরাও বলতে পারেননি। লুথার বিস্মিত হচ্ছেন। এত বড় দেশ। এত বড় গণতন্ত্র। অনেক অনেক সমস্যা। কিন্তু সে সমস্যাকে অতিক্রম করার জন্য কি নিদারুণ তপস্যা! বিবেকানন্দ বলছেন এত প্রাচীন একটা জাতের খুঁত বার করতে একটা পাঁচ বছরের শিশুও পারবে, কিন্তু সংস্কার তো করতেই হবে। সেই সংস্কারের পথে হাঁটতে হবে। নিন্দার পথে নয়। এই সেই বিবিধের মাঝে দেখো মিলনমহান!

    লুথার ভারতকে এই অন্তরের আলোতে দেখে বললেন, এত এত মতের, সম্পদের, ধনের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও কেউ কারোরটা কেড়ে নিচ্ছে না, এক অখণ্ড শান্তি কিভাবে দেশের গভীরে বয়ে চলেছে? অশান্তি জন্মালেও সে সেই নিজের শক্তিতে তাকে মিটিয়ে নিচ্ছে! এই কি সেই শক্তি, সেই সত্য? অহিংসা! যে মন্ত্রে দীক্ষা নিতে তিনি মহাত্মার দ্বারে এসেছেন আজ! সেই মন্ত্রেই ভবিষ্যতে জন্ম হবে সেই যুগান্তকারী ভাষণের - I have a dream. এ স্বপ্ন সংস্কারের। চিত্তের সংস্কার বন্দুকের শাসনে হয় না, হয় ভালোবাসায়। চিত্ত প্রভুর আসন। অহংকে বিসর্জন দেওয়ার সাধনের ক্ষেত্র সে। তবেই জন্মাবে যা মহৎ, যা শ্রেয়, যা শান্তির। যার মূল কথা - অহিংসা।

 

198
Mon, 09/06/2021 - 00:28

সেদিন খাঁচার পাখি আর বনের পাখির মধ্যে তুমুল তর্ক হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের গান কি কবিতা যাই বলুন, আমরা পড়েছি। তাদের মধ্যে যে একটা মিলনের পিয়াস ছিল, তাও পড়েছি। কিন্তু তা হয়নি। বিধাতার মনে কি ছিল সে জানি না, কিন্তু বনের পাখিটার মনে কি হয়েছিল তারপর, বনে ফিরে গিয়ে? তার কি একবারও মনে হয়নি যে খাঁচার পাখি যা বলেছে সে তার প্রাণের কথা নয়? নইলে সে কেন শেষে আক্ষেপ করে বলবে, "হায়, মোর শকতি নাহি উড়িবার!"

    মানে তার উড়বার ইচ্ছা ছিল। এতক্ষণ যা বলেছিল সে নিতান্তই তর্কের জন্য। সে তার প্রাণের কথা নয়। বনের পাখির কি মনে হয়েছিল? তার মনে হয়নি সে ফিরে যায়? তার মনে হয়নি তার মৃতপ্রায় ডানায় সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দেয়?

    সংসারে ঢুকে এমন খাঁচার পাখি হয়েছে এমন অনেককে দেখেছি। তাদের সারাটা জীবন সমাজ, শাস্ত্র, পারিবারিক আচার, অনুষ্ঠান এমন ঘিরে থেকেছে, সে ভুলেই গেছে তারও একটা ইচ্ছা কোনোদিন ছিল। সে সুখ পেয়েছে, সুরক্ষা পেয়েছে, কিন্তু স্বাধীনতা পায়নি। ডানা যত নির্জীব হয়ে আসে খাঁচা তত সুরক্ষিত, আরামের জায়গা বোধ হতে থাকে। এ স্বাভাবিক। তাই ডানাকে নির্জীব করাকেই আমরা অনুশাসনের নাম দিয়ে চালাই। সমাজের স্থিতি নাকি তাতেই। ডানা নির্জীব হয় শুধু অত্যাচারে যদি বলি, তবু পুরোটা বলা হয় কই? ডানা নির্জীব হয় অতিস্তুতিতেও। আমাদের সে ব্যবস্থাও আছে। 

    এতদূর পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে আমি সমাজের কোন স্তম্ভের কথা বলছি, হ্যাঁ, আমি মেয়েদের কথাই বলছি। বনের পাখি যদি পুরুষ হয়ে থাকে, তবে কল্পনা করে নেওয়া যেতে পারে খাঁচার পাখিটি নারী। 

    স্বাধীনতার সঙ্গে অর্থের দিকটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বাড়ি যিনি কাজ করতেন, একদিন আমায় বলেছিলেন, "দাদা, এই যে আমার শাড়িটা, কি ব্লাউজটা ছিঁড়ে গেলে, কি কোনো কিছু আমার নিজের জন্য লাগলে আমায় কারোর কাছে হাত পাততে হয় না, এ আমার কাছে খুব শান্তির বিষয় একটা। তোমার দাদার কাজ ছিল না, আমিই দাদাকে বললাম, যাও পুজোগণ্ডার দিন, একটা প্যান্ট কিনে নাও তোমার জন্য। দাদা লজ্জা পেল, কিন্তু নিল। এটা ভালো না দাদা?"

    হ্যাঁ এটা ভালো। এটাই ভালো। আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়াটা দরকার। আজ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের অনেক সমালোচনা হতেই পারে। তার সব পয়েন্ট ভিত্তিহীন আমি তাও বলব না। কিন্তু শুধু "দেখ মাত্র পাঁচশো টাকার জন্য দাঁড়িয়েছে..".. "বাপ রে! এই ক'টা টাকার জন্য এত মারামারি! এত লাইন!"....." কি হাড় হাভাতের দল রে বাবা!" এ সব শুনলে আমার মনে হয় এ বিষয়টাকে খুব ছোটো চোখে দেখা। তারা লোভে, মানসিক বিকারে এসে দাঁড়িয়েছে তা তো নয়। অনেকে একে ভিক্ষা হিসাবে দেখেও লজ্জা দিয়েছেন তাদের। অথচ সেই মানুষই গ্যাসের ভর্তুকির কথা শুনে লজ্জা পান না। ডাক্তারি পড়াতে সরকারকে কত টাকা থেকে দিতে হয় জেনে লজ্জা পান না। সরকারি হাস্পাতালে ফ্রি চিকিৎসা নিতে ভিক্ষা মনে হয় না। এমনকি বিশেষ কাস্টের হলে পরীক্ষার টাকায় ছাড় ইত্যাদিকেও ভিক্ষা মনে হয় না। ভিক্ষা কেবল এই টাকার জন্য লাইনে দাঁড়ানোতে?

    আসলে মহিলারা এটাকে নিজের অধিকার হিসাবে দেখছেন। পাঁচশো টাকাটা বড় কথা নয়, বড় কথা তার নিজের অর্থ বলতে কিছু তো আছে! যা কারোর অনুগ্রহ না, ভালোবাসার না, দায়বদ্ধতার না, যা শুধু তার, একার তার। ওইটুকুর মধ্যে একটা আত্মসম্মান আছে। তার মানে সরকারের কাছে তার অস্তিত্বের একটা মূল্য আছে। সে যা কিছু করতে পারে সেটা দিয়ে। কারোর কাছে কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। বাকি সব টাকার জন্য সে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য। দিতে না হলেও, দেওয়ার জন্য তাকে তৈরি অন্তত থাকতেই হয়। 

    আসলে আমাদের মেয়েদের অসুবিধা কিছু তো আছেই। মেয়েদের কাজের জন্য কতটা রাস্তা প্রশস্ত করতে পেরেছি আমরা? ধরুন এক শ্রেণীর মানুষ ঠিকে ঝি, আয়া, হোটেলে রান্না করা --- এরকম নানা কাজ করতে পারেন। আরেক শ্রেণীর মানুষ পড়াশোনা করে একটা চাকরি করতে পারেন। কিন্তু একটা বড় শ্রেণীর মানুষ কোনো কাজেই ঠিক সুযোগ করে উঠতে পারেন না। অবশ্যই মেয়েদের কথা বলছি। সেখানে রিজার্ভেশনের কথা উঠেছে। কিন্তু ক'টা বাড়ির লোক তাদের বাড়ির বউকে সেলসের কাজে, কি জোম্যাটো ইত্যাদিতে বাইকার হিসাবে, কি চট্ করে কোনো দোকানে, শপিং মলে কাজে পাঠাতে চাইবেন? আমাদের কথায় কথায় পরিবারের মানসম্মানে টান পড়ে। আর বাড়ির সম্মান তো মেয়েদের সম্মানের সমার্থক। সেখানে আরো মুশকিল। এ ছবি আগের থেকে বদলেছে। তবে আরো অনেক অনেক বেশি বদলানোর দরকার। সে আমরা সবাই জানি। এখনও আমাদের সমাজে অনেক কাজ "মেয়েদের মানায় না"। এই ছবিটা যেদিন বদলে যাবে সেদিন লক্ষ্মী বলে কোনো শব্দই আলাদা করে খুঁজে পাওয়া যাবে না, তো সে আইডিয়া নিয়ে ভাণ্ডার তো অনেক দূরের কথা। 

    সবার আগে দরকার আকাশটার পুরোপুরি উন্মুক্তকরণ সবার জন্য। আগে গোটা মাঠটাই খুলে দিয়ে তাদের খেলতে ডাকি, তারপর না হয় তুল্যমূল্য বিচার হবে। তারপর এমন দিন আসবে যখন একজন গর্ভবতী মহিলা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই জেনে যাবেন যে কন্যা না পুত্র সন্তান হতে চলেছে। 

    একটা কথা ঠাট্টা করার আগে মনে রাখবেন, আমাদের সমাজে প্রতিটা নারী আত্মগোপন করে অপরাধীর মত জন্মেছেন, যে কোনো মুহূর্তে গর্ভেই নাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা নিয়ে। তখনই বুঝতে হবে খুব আশাপ্রদ সমাজে তারা আসেননি। তাই সেখানে যদি তারা কোনো অতিরিক্ত অতি সামান্য প্রাপ্তিকে প্রভূত উল্লাসে উদযাপন করেন, তবে সে লজ্জাটা কার একটু ভাববেন। ব্যস, এইটুকুই বলার। খাঁচার পাখিটাকে প্লিজ যা বলছে বিশ্বাস করবেন না। ওর মুখে, আচরণে বৃহদাংশ আপনার আমার বানানো সমাজ বলে। সে নিজে কতটুকু তার ওই শেষ দীর্ঘশ্বাসটা ছাড়া?

199
Thu, 09/02/2021 - 21:30

সত্যের সমস্যা মিথ্যাকে নিয়ে ততটা নয়। মিথ্যা সত্যের সতীন। তাদের মধ্যে কোন্দল আছে যেমন, তেমন পাশাপাশি অবস্থান করে সংসার চালানোও আছে। সত্যে মিথ্যায় মিলে জগৎ সংসার। এ আমরা একপ্রকার মেনেই নিয়েছি। এইতেই স্বাভাবিক ছন্দ আমাদের। কে আর বেছে বেছে খাঁটি সত্যে জীবন ধারণ করবে রে বাবা, অমন পরমহংস হলে আমাদের পেট ছেড়ে দেবে। তাই মানুষের আরেকটি আবিষ্কার হল, অতিশয়োক্তি। 

    সত্যের সমস্যা একে নিয়েই বেশি। কারণ সে সত্যের ছদ্মবেশী। তিলকে তাল করতে যে অল্প পরিমাণ তিল লাগেই, সেইটেকেই সে কাজে লাগায়। অতিশয়োক্তি, অত্যুক্তির সঙ্গে লড়া বেশ শক্ত তাই। মানে বিশেষ করে তর্কের সময় যারা এই অতিশয়োক্তির সাহায্য নেয় তাদের নিয়ে মহাঝামেলা হয়। ক’দিন আগেই যেমন তালিবানদের সঙ্গে সব এক হয়ে যাচ্ছিল, মায় মেয়েদের সিঁদূর পরা অবধি। সে নাকি আমাদের সমাজ তালিবান শাসনের সমান। কেউ একজন লিখলেন, তালিবানেরা আর আমেরিকানরা নাকি একই রকমের বর্বরতা চালায়। অথচ বাস্তবে মানুষ কাবুলের ভিসা না বার করে আমেরিকা যাওয়ার জন্যে পড়িমরি করে জাতে উঠতে চায়। তারপর ‘হিন্দুত্বা’ আর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদ নাকি একই রকম। এখন এই কথাগুলোর মধ্যে যে হোয়াইট লাই আছে তা তো নয়, সবই অতিকথন দোষে দুষ্ট। এগুলো সব তথ্য হিসাবে সত্য। কিন্তু যে ভাবে উপস্থাপিত করার চেষ্টা হচ্ছিল তা নিতান্ত অতিশয়োক্তি। এবং সত্যকারের সেই মাত্রায় ভয় নেই বলেই তারা যে পাব্লিকলি এইসব কথা সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছেন এও সত্য। সে তারাও ভালো করেই জানেন। অনেকে আবার দেখেছি, "জানেন আমায় থ্রেট করেছে" লিখে বেশ গর্বও অনুভব করেছেন। পরে জানা গেল কেউ থ্রেট করেনি। উনি চেয়েছিলেন বা আশঙ্কা করেছিলেন। হল না দেখে হতাশ হয়ে ওসব লিখেছেন। এ সবই অতিশয়োক্তির উদাহরণ। তিল নেই বলছি না, তবে তা তালে পরিণত হয়নি এখনও তাই বলছি। 

    তবে অন্য ক্ষেত্রে এই অত্যুক্তির মধ্যে একটা বেশ সামাজিক গোবেচারা, ভালো মানুষ ইমেজ আছে। মানে, "আরে আমি তো ভালোবেসেই বললাম.. আরে ইচ্ছা করেই তো বাড়িয়ে বললাম, যাতে উনি খুশী হন"... ইত্যাদি ইত্যাদি। সমাজে ভদ্রতার নামে যে কত অতিশয়োক্তি চলে আর নিন্দার জন্য যে কত অল্পোক্তি চলে সে বলাই বাহুল্য। কথাটা বাড়িয়েই বলি আর কমিয়েই বলি, দুটোতেই সমস্যা। সে অত্যুক্তিই হোক, কি অল্পোক্তিই হোক। সত্য থেকে সরে এলো তো অবশ্যই।

    তবে কাব্যে এ বড় দরকারি বস্তু। আর ধর্মে। প্রেমে আর ভক্তিতে অতিশয়োক্তির জয়জয়কার। এ ছাড়া ও দুটিকে টিকিয়ে রাখা বেশ কঠিন। তবে সে নিয়ে লোকে খুব একটা মাথা ঘামায় না। সে কাব্যের জগতে আর ভক্তির জগতে আপন মতে নিজের মত করে থেকেই যায়। বুদ্ধ যখন বলেন, জগতে শুধুই দুঃখ, এ যেন অতিশয়োক্তি। আবার বেদান্ত যখন বলেন, জগৎ আনন্দময়, তখন মনে হয় এও অতিশয়োক্তি। জগত আসলে জগতের মতই। রামকৃষ্ণদেব এসে যখন বলেন, জগতটা বালিতে চিনিতে মেশানো, তখন মনে হয়, বাহ্, এই তো খাঁটি কথা। এ অতিশয়োক্তি হল না। একজন এসে রামকৃষ্ণদেবকে বললেন, আপনি জগৎ ত্যাগ করতে বলেন, তবে সংসারের সৃষ্টিলীলা চলবে কি করে? রামকৃষ্ণদেব বললেন, তা সবাইকে তো বলি না। আমি বলি মনে ত্যাগ করো। 

    তখন সে বলল, কিন্তু তিনি সৃষ্টি করবেন বলেই না এই জগত সৃষ্টি করেছেন, এই তো তাঁর ইচ্ছা!

    ঠাকুর বেশ উষ্মার সঙ্গেই বললেন, তা মহামারী, বন্যা, ভূমিকম্প --- এই সবে তাঁর ইচ্ছা দেখো না কেন বাপু! 

    কথামৃতে এ এক অদ্ভুত বিষয়। অতিকথন ওনার মুখে একটাও নেই। রামকৃষ্ণদেব একজনকে রাজা বলে ডাকতে পারলেন না, সেটা তার উপাধি ছিল যদিও। কারণ হিসাবে বললেন, এটা তো মিথ্যা কথা বলা হত, তুমি তো আসলে রাজা নও। 

    আরেকটা ঘটনা, কোথাও একটা উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। একজন ওনার সামনে বলল, দেবী নাকি ওইখানে রান্না করেছিলেন। রামকৃষ্ণদেব শুনলেন, কিন্তু মানলেন না। কারণ এটা ভক্তির অতিকথন। মাষ্টারের দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, কারণটা কি গা? মাষ্টার তখন তাঁকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার কারণটি বোঝালেন। আবার কোনো একটি ভক্তিগ্রন্থ একজন পড়ে শোনাচ্ছেন। ভক্তিমাল। উনি শুনে বললেন, একজনকে বড় করে দেখাবে বলে বেশি বেশি লিখেছে। 

    এটা ওঁর স্বভাবের একটি বৈশিষ্ট্য। অন্যমনস্ক রাণীর গালে চড় মারতেও ভয় পাননি, আবার অধর, বঙ্কিম প্রমুখ উচ্চপদস্থ মানুষদের মুখের উপর উচিৎ কথাটা বলতেও বাধেনি। ভয় পাননি ওর ভবিষ্যৎ কি হবে ভেবে। রাণী ক্ষিপ্ত হননি। কারণ সে চড়ে শাসন ছিল, অপমান ছিল না। রাণীর অনুচরেরা ক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু সে মানুষটা তো কি খাব, কোথায় যাব, কি পরব, রোগ হলে চিকিৎসা করার টাকা কোথায় পাব --- এই সব ভেবেও নিজেকে সংযত রাখতে পারতেন? মানে আমাদের মত চালাক নীতিবান হতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। শুধু সত্যের অমার্যাদা হবে বলে। 

    কথামৃতে রামকৃষ্ণদেবের মুখে নিজের স্তুতি শুনে স্বামীজি, মানে তখনকার নরেন সঙ্কুচিত হতেন। ঠাকুর কেশব সেনের চাইতেও তার প্রশংসা এত কেন করেন? কোথায় কেশব সেন, যিনি দেশ বিদেশ খ্যাত আর কোথায় চালচুলাহীন নরেন। বিবেকানন্দের মনে হত এ বুঝি ঠাকুরের ভালোবাসার অতিকথন। কিন্তু বাকিটা তো আজ ইতিহাস। সবাই জানে। 

    রামকৃষ্ণদেবের কথা বলার দুটো ধরণ আছে। এক আপনি কি শুনতে চান, আর দুই উনি কি বলতে চান। যে মানুষ নানা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে চান, তিনি তাকে সেই আলোচনায় ওই তুঙ্গে নিয়ে যাবেন। যে যে ভাবের হবেন তার সেই ভাবকে অক্ষুণ্ণ রেখেই। ঠাকুরের নিজের দেওয়া উদাহরণ, ধোপাঘরের কাপড় রাঙানো গামলা উনি। যে যে রঙে রাঙতে চান, সে সেই রঙেই রেঙে যাবেন। মানে উনি রাঙিয়ে দেবেন।

    কিন্তু যদি আপনি জিজ্ঞাসা করেন আপনি কি বলতে চান। উনি বলবেন, শুধু একজন ভালো মানুষ হও। আন্তরিক হও। ঈশ্বর কেমন এত কথা জানতে চাওয়ার দরকার নেই। আন্তরিক আর শ্রদ্ধাশীল হলেই হল। সৎ আর অসৎ দুটো রাস্তা, সৎ রাস্তাটা দিয়ে চলে যেতে হয়। জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ঈশ্বর কি? কথামৃতে কোনো সংজ্ঞা নেই। একটাই কথা আছে, তাঁর ইতি করা যায় না। তিনি ভালোমন্দ মিশিয়েই অস্তিত্ব। যদি বলেন, ঈশ্বর মঙ্গলময়। রামকৃষ্ণদেব বলেন, জানি না, এক এক সময় আমার মনে হয় তাঁকে ভালো, আবার এক এক সময় মনে হয় তিনি মন্দ। অর্থাৎ, কোনোদিকেই ঝোল টেনে উনি কথা বলবেন না। ওঁর কথায় থাকবে সত্য। সে সত্য ধারণের যোগ্যতা আসবে মান আর হুঁশে। মান আর হুঁশ যদি ছেড়ে গেল, তবে সব ছেড়ে গেল। ঈশ্বর তো গল্প তখন। রামকৃষ্ণদেবের উপলব্ধি না। একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে শেষ করি---

    একজন গরীব মানুষ কাজ করতেন আমাদের বাড়ি। বিশেষ কারণে কাজ ছেড়ে দিতে হল। বেশ কিছু মাস পরে ওনার বাকি টাকাটুকু নিতে এসেছিলেন। সামনে পুজো, মা তাই বোনাসের টাকাটাও দিলেন। উনি চমকে উঠে বললেন, আপনারা ভুল হিসাব করছেন, এত টাকা বাকি ছিল না। 

    এইটাই ধর্ম। এই সততটাই ঈশ্বরের আরাধনা। যার মধ্যে নিজের সততা নিয়ে না আছে গর্ব, না আছে অহংকার। একেই সে স্বাভাবিক জীবন যাত্রার নিয়ম বলে জানে। রামকৃষ্ণদেবের ঈশ্বর এদের সবাইকে নিয়ে, সমস্ত অতিশয়োক্তি আর অল্পোক্তির থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে।

200
Tue, 08/31/2021 - 16:30

Every passion is mortified by it (scepticism), except the love of truth - David Hume


    ‘শ্রদ্ধা’র বিপরীত শব্দ ‘সংশয়’। সংশয় বলে, তাই কি? শ্রদ্ধা বলে, তাই। একবার বলছেন, ‘সংশয়তিমিরমাঝে না হেরি গতি হে’, আবার বলছেন, ‘সংসারের এই দোলায় দিলে সংশয়েরই ঠেলা’। আবার বলছেন, “যেদিন সংশয়ের ক্রন্দন আমাদের মধ্যে সত্য হয়ে ওঠে, সেদিন আমরা সম্প্রদায়ের মত, দর্শনের তর্ক ও শাস্ত্রের বাক্য নিয়ে আরাম পাই নে; সেদিন আমরা একমুহূর্তেই বুঝতে পারি প্রেম ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই --- সেদিন আমাদের প্রার্থনা এই হয় যে, "প্রেম-আলোকে প্রকাশো জগপতি হে।"

    দুটো কথা হয়, এক, সংশয়ের দহন, আর এক সংশয়ের সুখ। সংশয় যদি সত্য অন্বেষণের জন্য হয়, তবে অবশ্যই তা সুখাবহ নয়। কিন্তু সংশয় যদি শুধু যা আছে তাকেই সংশয় করি, তাতেই আমার সুখ - এই হয়, তবে সেখানে গোলমাল। তখন তা বাতিক। তখন তা কুতর্ক। “আমি কিছুই বিশ্বাস করি না” - এও এক বিশ্বাস। “আমি সংশয়বাদী” - এও এক বিশ্বাস। যে কোনো ‘বাদ’-এ বিশ্বাস করাই একপ্রকার বিশ্বাস। যা কিছুকে সংশয় করা এবং সত্য উপনীত হওয়ার তাগিদ হল সত্য অর্থে সংশয়বাদের তাগিদ।

    সংশয় আর বিশ্বাস - অবশেষে দুই একটা অভিজ্ঞতায় এনে দাঁড় করায়। সংশয়বাদের খুব কাছাকাছি একটা শব্দ ‘ক্রিটিক্যাল থিংকিং’।

    বুদ্ধ তাঁর দর্শনের তিনটি খুব বড় স্তম্ভ রাখলেন। এক, অনিত্যতা। সব কিছুই অনিত্য। এই বোধকে নিজের চিত্তে ধারণের অভ্যাস। দুই, দুঃখ। এটি আর্যসত্যও বটে। জীবন মানেই দুঃখ। তিন, অনাত্মা। কোনো কিছুই আত্মা নয়, 'আমি' নই। সব ক্ষয়িষ্ণু, ভঙ্গুর।

    শঙ্কর যখন সব কিছুকে ‘নেতি নেতি’ করে দেখতে চাইছেন, তখন এই শেষের কথাটা প্রকট হয়ে যায়। কিছুই আমি নই। আমার অস্তিত্ব একটা সিন্থেটিক অস্তিত্ব। এর কোনোটাই 'আমি' বলতে যা বুঝি তা নই। শঙ্করকেও তাই বৌদ্ধ বলা হল। সরাসরি না বলে ‘প্রচ্ছন্ন’ শব্দটা যোগ করে দেওয়া হল।

    ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কি সংশয় সম্ভব? না। যা আমার বোধের বাইরে তা নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব নয়। কিন্তু নানা মত, যা ধর্ম নামে প্রচলিত, তা নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব। তার প্রতিটা খুঁটিনাটি নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব। নানা মতাবলম্বী পবিত্র গ্রন্থ নিয়ে আমার সংশয় সম্ভব। পবিত্রতা শুদ্ধতার ধারণা এক-এক দেশের আচার প্রথা অনুযায়ী এক-একরকম। সে সব নিয়েও প্রশ্ন চলতে পারে। কিন্তু যদি প্রশ্ন করি নিজেকে ঈশ্বর আছেন কি নেই, তবে এর উত্তর একটাই - নীরবতা।

    সংশয়, বিশ্বাস - দুটোই ততক্ষণ মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর নয়, যতক্ষণ সে আমাদের কমোন সেন্সকে অতিক্রম করার চেষ্টা না করছে। অন্ধবিশ্বাসকে অতিক্রম করা আর শুভ আর মঙ্গলকে বিশ্বাস করা, দুটোই দরকার। যা কিছু শুভ, যা কিছু মঙ্গলজনক তার সঙ্গে অতীন্দ্রিয় কিছুর যোগাযোগ নেই। সব সত্য তৎক্ষণাৎ ভেরিফায়াবেল নয়, সব পদক্ষেপ আশু লাভজনক নয়, তবু বিশ্বাস করতে হয় যে মানুষের মঙ্গল তাতেই। অর্থনীতি, সমাজের নানা নীতি এরকম একটা বিশ্বাস থেকেই শুরু হয়, নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর তা দেখা হয় আদৌ বাস্তবসম্মত হচ্ছে কিনা। তবেই তা কার্যকর হয়। কিন্তু প্রথম পদক্ষেপ একটা বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় - এতে মঙ্গল হবে।

    আমরা যে গণতন্ত্র, যে সমাজতন্ত্রের মধ্যে বাস করছি সেটা পার্ফেক্ট তো নয়। কিন্তু এই বিশ্বাস আছে যে এতেই আমরা আমাদের জীবন থেকে সর্বোচ্চ সার্থকতা খুঁজে নেব। এ বাস্তব না হলেও, এ বিশ্বাস। এ না হলে মানুষ পাগল হয়ে যেত। নিত্য জীবন ধারণের প্রতি পদক্ষেপে আমাদের বিশ্বাস করতে হয়। ট্রেনের ড্রাইভার, প্লেনের পাইলট, ওষুধের কোম্পানি, দোকানের খাবার, বাড়ির স্থায়িত্ব, ব্রীজের স্থায়িত্ব --- এসব যেমন বাহ্যিক বিশ্বাস। যা শুনছি, যা দেখছি, যা বুঝছি, যা যুক্তি সাজাচ্ছি, তাছাড়াও নানাবিধ শারীরবৃত্তীয় প্রণালীর উপর বিশ্বাস ইত্যাদিও আমাদের নিত্য বিশ্বাসের অঙ্গ।

    এরপর নানা সামাজিক বিশ্বাস তো আছেই, বাবা, মা, ভাই, বন্ধু, শিক্ষক, চিকিৎসক তো আছেনই।

    এ সবে সংশয় করে মানুষ বাঁচে কি করে? হয় তো শারীরিকভাবে বাঁচে, কিন্তু মানসিকভাবে তো সে নিঃস্ব। তার উদাহরণই যে নেই সংসারে তা তো নয়। সেও আছে। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হলেও আছে।

    তবে সংশয়ও দরকার। কোথায় বেশি দরকার? যে অথোরিটি হতে চাইছে, তার সামনে মাঝে মাঝেই ভুরু কুঁচকে দাঁড়ানো দরকার। আলফা মেলকে মাঝে মাঝেই চ্যালেঞ্জ জানানো দরকার। যদি সে চ্যালেঞ্জ স্বীকার করে, সে আমার নেতা হওয়ার যোগ্য, যদি সে আমার চ্যালেঞ্জকে অস্বীকার করে, তবে সে আমার নেতা হওয়ার যোগ্য নয়।

    চীন, রাশিয়া বা কিমের কোরিয়া যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে বিশ্বাসের জায়গায়। সেখানে বিশ্বাস করতেই হয় যে আমার আলফা মেল সেই শ্রেষ্ঠ। সে আমার সংশয়কে ভালো চোখে দেখে না। সেদিন আমাদের বিচারপতি ভারতের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। এই প্রশ্ন করার সাহসটাই, সংশয় জাগার সাহসটাই আমার অধিকার। অথোরিটির সামনে দাঁড়িয়ে অবশ্যই। যারা শুধুই সংশয় প্রকাশ করে, করবে বলেই করে, খবরের কাগজে তাদের বক্তব্য আমরা এড়িয়ে যাই। কারণ জানি যে সত্যের অবস্থানের চাইতে সংশয়ের অবস্থানকে শ্রেয় বলে মনে করে বসে আছে। সংশয়জীবী সে। সত্যজীবী নয়।

    আমাদের আজকের যুগে ঈশ্বরে বিশ্বাস বড় কথা নয়। আমাদের যুগে বড় কথা হল, নানা সোশ্যাল মিডিয়াসহ, নানা ইন্টারনেটের বিষয়ে অগাধ বিশ্বাস। যদি কেউ দণ্ডী কেটে তার পেটের ব্যামো সারবে বলে সারা রাস্তা যায় আমার ভয় লাগে না তত, যত কিনা এই সব 'সোশ্যাল মিডিয়ায় যাহাই পড়ি তাহাই সত্য' গোছের পাব্লিকদের দেখলে ভয় করে।

    এত বিশ্বাসী হলে তো বিপদ। আমাদের যুগে একটা বড় সমস্যা এই ফেক নিউজ, পোস্ট ট্রুথ, কালারড ট্রুথ, বায়াসড ট্রুথ, ফেক ট্রুথ। হুম, সবই অক্সিমোরন। কিছুরই স্থায়িত্ব নেই। কিন্তু ঘূর্ণি সৃষ্টির ক্ষমতা প্রবল। কিছুই পড়ব না, মূল বই পড়ব না, এদিকে সব নিয়ে গলা ফাটিয়ে তর্ক করব, এ হয় তো এই সোশ্যাল মিডিয়াতেই সম্ভব। ছোটো ছোটো কলতলা; ছোটো ছোটো গ্রুপ; ছোটো ছোটো আহ্লাদ; ছোটো ছোটো সুখ। এ বড় সমস্যা।

    অগত্যা স্বামীজির কথাটা মনে রাখবেন, "ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে যাহাই পড়িবে তাহাই বিশ্বাস করিও না", এটি উনি শিকাগো স্পিচ দেওয়ার পর, রমণ মহর্ষিকে টেক্সট করেছিলেন। হল?

    বিশ্বাসে মিলায় পার্ক, সংশয় মহাডার্ক

    সোশ্যাল মিডিয়া রূপ ধরি আসিয়াছে নোয়ার আর্ক।

201
Sat, 08/28/2021 - 13:30

ধর্ম পুস্তকবাহী না। চিত্তবাহী। ধর্ম মানে বিবেক। ধর্ম মানে নীতি। ধর্ম যা মঙ্গল, সত্য আর শান্তির স্থাপক হবে।

    ধর্মগ্রন্থ কথাটা অক্সিমোরোন। ধর্ম কখনও গ্রন্থ হতে পারে না। ধর্ম ঈশ্বরেরই ধার ধারে না তো গ্রন্থের।
 
১) ধর্ম কাস্টমস না, প্রথা-আচার-আচরণ-অনুষ্ঠানাদি না।

২) ঈশ্বরে বিশ্বাস ধর্ম নয়।

৩) কোনো কিছুতে বিশ্বাসই ধর্ম নয়।

৪) কোনো থিওলজি ধর্ম নয়।

৫) কোনো ধর্মগ্রন্থ ধর্ম নয়।

৬) কোনো পুরুষ বা নারী ধর্ম প্রণেতা নন সম্পূর্ণভাবে, তিনি যত ক্ষমতাশালীই হোন না কেন।

৭) ধর্ম কোনো গাইডলাইন না।

৮) প্রাচীনত্বের হিসাব ধর্মের প্রমাণের নিয়ামক নয়।

    ধর্ম একটা প্রতিক্ষণের অন্বেষণ। সত্য, মঙ্গল আর শান্তির দিশা অন্বেষণ। সে যদি আমার চিত্তের নিমিত্ত হয় তবে সে আমার স্বধর্ম। সে যদি আমার পরিবারের জন্য হয়, তবে সে আমার পারিবারিক ধর্ম। সে যদি আমার রাষ্ট্রের জন্য হয়, তবে সে আমার রাষ্ট্রধর্ম।

    ধর্ম শব্দটা ছোটো হতে হতে, রিলিজিয়ন হতে হতে, এখন কাল্ট হয়ে ওকাল্ট এর দিকে যাচ্ছে। যা আদৌ তার মূল অর্থ নয়।

    যখন বলি ধর্মের নামে অনেক রক্ত বয়ে গেছে, তখনও ভুল বলি। ধর্মের নামে না, কোনো মতের নামে। কোনো রিলিজিয়ানের নামে। কোনো কাল্টের নামে। যা ঔদ্ধত্য, অহংকার আর স্পর্ধার তাণ্ডব। এই শব্দগুলো ধর্মের সঙ্গে যোগ করা মানে সোনার পাথরবাটি বলা।

    বিজ্ঞান মানুষকে সত্য, মঙ্গল আর শান্তির দিশা দেখাতে পারে না। সে দিশা দেখায় মানুষের শুভবুদ্ধি, বিবেক। যা ভালোবাসা বা সহমর্মিতা ছাড়া জন্মায় না। যখন বলা হয় অহিংসা পরমধর্ম, তখন তা অসীম সম্ভাবনাময় সত্য কথা হয়। অহিংসার অর্থ কোনোদিন নন ভায়োলেন্স হতে পারে না। অহিংসা একটা চিত্তস্থিতি, যা কর্তব্যের সঙ্গে গুলিয়ে যায় না। যে সৈনিক দেশের সীমা রক্ষার দায়িত্বে আছেন, তিনিও অহিংস হতে পারেন। কিন্তু সময় বিশেষে কর্তব্যের জন্য হত্যার রাস্তা নিতেই হয়। তার জন্য তার রাতের ঘুম নষ্ট হয় না। দুষ্টদমন আর অহিংসা একই সঙ্গে থাকতে পারে, কিন্তু নিরীহ মানুষ হত্যা আর অহিংসা একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। কর্তব্য আর চিত্তস্থিতি দুটো আলাদা শব্দ, যা আপাতভাবে স্ববিরোধী হলেও বাস্তবে নয়।

    সত্যানুসন্ধান বিনা সত্যানুসরণ সম্ভব নয়। অন্য কেউ আমাকে সত্য দিতে পারে না। ব্যাখ্যা দিতে পারে। মত দিতে পারে। তথ্য দিতে পারে। সত্য দিতে পারে না। সত্য আমার চিত্তে জন্মায়। আমার চিত্ত যখন বৈরিমুক্ত হয়। আমার চিত্ত যখন চঞ্চলতা মুক্ত হয়। আমার চিত্ত যখন ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতা মুক্ত হয়। আমার চিত্ত যখন জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়। সেই সময়ে আমার চিত্তে সত্য প্রতিভাত হয়। সে কোনো বইয়ের তত্ত্ব নয়, সে সম্পূর্ণ আমার।

    শিশুর কান্নার আওয়াজের অর্থ শুধু মা বোঝেন। সে কান্না খিদের, না পেট ব্যথার, না ঘুমের। মা যেমন শিশুকে বোঝেন, তেমনই প্রতিটা মানুষ বোঝে তার চিত্তের পক্ষে কোনটা মঙ্গলের রাস্তা, শান্তির রাস্তা। যেটাই মঙ্গলের রাস্তা, শান্তির রাস্তা সেটাই সত্যের রাস্তা। বুদ্ধির সত্য মানে তথ্য, তত্ত্ব। যা বিজ্ঞান। চিত্তের সত্য মানে মঙ্গল, সংহতি, ভালোবাসা। যা ধর্ম।

    পৃথিবীতে দুর্দিন কোনো নতুন ঘটনা নয়। মানুষের জীবনে সব চাইতে বড় অন্ধকারের সময় চিত্তের, বোধের অন্ধকারের যুগ। আজ সেই দিন নয়। আজ এইটুকু অন্তত আমরা জানি কে মানবতার শত্রু, কে নয়। এই বোধকে কোনো মত, কোনো কাল্ট, কোনো রিলিজিয়ন আমাদের আর অন্ধ করে দেবে না। এ নিশ্চিত। যুদ্ধ সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। সে নিজের পাশবিক প্রবৃত্তি, অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে হোক কি বাইরের শত্রুর বিরুদ্ধে হোক। সংঘাত ছাড়া রাস্তা পাওয়া যায় না। তবে সে সংঘাত কর্তব্যের বোধজাত হোক। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি বা বৈরিবুদ্ধিজাত না হোক। তবেই রাস্তা পাওয়া যাবে। কারণ সবার শেষ কথা অবশ্যই, অহিংসা পরম ধর্ম। এই একটি শব্দে চিত্তমন্থনের সবটুকু বলা আছে। কিন্তু খুঁজতে হবে নিজেকেই। নিজের মত করে। নিজের ব্যাখ্যায়, নিজের ভালোবাসায়, নিজের স্থিতিতে। ধর্ম প্রতি মুহূর্তে খোঁজার জিনিস, বিশ্বাস করে স্থবির হওয়ার নয়, এ মনে রাখতে হবে।

202
Fri, 08/27/2021 - 15:00

মানুষের গভীরের একটা শব্দ - গোঙানির শব্দ। গভীর যন্ত্রণার শব্দ। সে শব্দের কোনো শ্রোতা নেই। তার কোনো বৈচিত্র্য নেই। তার আঘাত আছে। বারবার বুকে এসে লাগা ঢেউয়ের মত, পৌনঃপুনিক অস্তিত্ব আছে।

    আইসিইউ -এর বাইরে বসে সারাদিন গোঙানির শব্দ শুনেছি। তার মধ্যে একজন ছিলেন মা। এখনও সেই গোঙানির শব্দ হঠাৎ কখনও কখনও মনের কোন কোণা থেকে জেগে ওঠে। স্তব্ধ হয়ে যাই কিছুক্ষণ। গভীর দুঃখ আরেকবার নিজেকে জানিয়ে মিলিয়ে যায়। বলে যায়, আমিও আছি।

    গোঙানির কোনো মানে নেই। প্রকাশ আছে। সেই প্রকাশে সুখ আছে। মানুষ শব্দের কাছে এতটাই ঋণী। সব শেষ হলেও এইটুকুকে হলেও অন্তত সে আঁকড়ে থাকতে চায়। যন্ত্রণা সেইটুকুতেই নিজেকে জানান দেয়। ওতে যন্ত্রণা কম হয় না, কিন্তু মনের মধ্যে একটা আরাম হয়। আত্মপ্রকাশের আরাম।

    যে মানুষ দীর্ঘদিন কথা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়, তার পাশে বসে থেকেছি। গোঙানির শব্দই তার অবশিষ্ট ভাষা। সেই তার প্রকাশ। চোখ বন্ধ করে কি অদ্ভুত শব্দ জন্ম দিয়ে চলেছে। ওইটুকুই তার সম্বল।

    সুস্থ মানুষ গোঙানির শব্দে বিরক্ত হয়। তার তো অনেক শব্দ। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটা সেটা নিয়ে থাকলেই হয়। কিন্তু যে মানুষ প্রান্ত সময়ে এসে ঠেকেছে অথবা যার যন্ত্রণায় দিকভুল হয়েছে সে কি করবে? তার ওটুকু যে না থাকলেই নয়। এমন অনেক বয়স্ক মানুষ দেখেছি, সারাদিন শুয়ে শুয়ে গোঙিয়ে যান। তার বাড়িতে তার সঙ্গে ও অন্যান্যদের সঙ্গে দেখা করে রাস্তায় নেমে গেছি, জানলা দিয়ে তার গোঙানির শব্দ আসছে। আমি অটোর জন্যে অপেক্ষা করছি। আশেপাশে কাকের ডাক, রিকশা-সাইকেল-গাড়ি কত কিছুর শব্দ। মানুষের কত কথা। তার মধ্যে একজন কেউ গোঙিয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন শব্দ। কিন্তু কি গভীর যন্ত্রণা। অসহায়তা। কারোর সময় নেই শোনার।

    হাসপাতালে এ অভিজ্ঞতা হয় সব চাইতে বেশি অবশ্যই। মাথার কাছে মা বসে, বাচ্চাটা গোঙিয়ে যাচ্ছে। মা অসহায়ের মত অন্যদিকে তাকিয়ে বসে। সারা পৃথিবীর সব শব্দ অর্থহীন সেই মুহূর্তে তার কাছে। তার কানে শুধু ওই একটি গোঙানির শব্দই শব্দ। মাঝে মাঝে বাচ্চাটার মাথায় হাত রাখছেন। আবার বাইরের দিকে তাকাচ্ছেন। এক করুণাহীন সময়ের আবর্ত ঘুরেই চলেছে। যার একমাত্র বাঙময় প্রকাশ - গোঙানি।

    আমি জানি সবার ভাগ্যে গোঙানিতে সাড়া দেওয়ার মানুষ থাকে কই? মানুষ যখন আর কোনো মানবিক শব্দ না পেয়ে শুধুমাত্র একটি আদিম শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছে, যে শব্দের মানে খুঁজতে কোনো অভিধান লাগে না, যে শব্দের অর্থ মানুষ কিছুতেই ভোলে না, সে শব্দের যে অসহায় হাত, সেটা ধরার মানুষ কি সবাই পায়? পায় না। গোঙানি ব্যর্থ হয়ে ফিরে ফিরে তারই কাছে আসছে, এও তো দেখেছি।

    মানুষ কেন? এই গোঙানিতে আমরা সবার সমান। রাস্তার পাশে পা ভেঙে কুকুরের গোঙানি শুনেছি। কাতরভাবে তাকাচ্ছে এদিক ওদিক। যদি কেউ সাহায্য করে। অথবা হয় তো কোনো সাহায্যই চায় না। শুধু জানিয়ে যাচ্ছে নিজের গোঙানিতে নিজের গভীরতম যন্ত্রণার কথা। জানি না। তবে সে গোঙানির শব্দ ভুলেছি কই?

    সব কান্না শেষ হলে জন্মায় গোঙানি। কান্নার তবু কিছু দাবী থাকে, অভিমান থাকে, কিন্তু গোঙানির সেটুকুও থাকে না। তার নিঃসঙ্গতাতেও কোনো ক্ষোভ নেই। তার অভিমান নেই। সে শুধু আছে।

    উপনিষদের ঋষিরা শুনেছিলেন, সমস্ত সৃষ্টির আদিতে নাকি ছিল এক শব্দ। সেই নাকি আদি সত্য। বুদ্ধ বললেন, দুঃখ, সেই সত্য। তবে কি বুদ্ধ এ সমস্ত সৃষ্টির গভীরে কোনো গোঙানির শব্দ শুনেছিলেন। এক গভীর যন্ত্রণা, এক অব্যক্ত ব্যথা থেকে মুক্তির আকুতি। গোঙানি মুক্তি চায়।

    দুঃখ আছে - এ সত্যকে নিয়ে সংশয় জাগে না। সে আছে, আছে, আছে। পৃথিবীর গভীরে এক গোঙানি তো আছেই। আদিম শব্দ অথবা শেষ শব্দ।

203
Thu, 08/26/2021 - 16:00

রাগ করতে নেই। ওভাবে বলতে নেই। ভালো হতে হয়। শান্ত হতে হয়। ভালো কথা বলতে হয়। মিষ্টি কথা বলতে হয়। মনকে উত্তেজিত হতে দিতে নেই।


    এ সবগুলোই হয় তো আপনার আমার দীর্ঘদিনের রোগের কারণ হতে পারে। হয়তো আপনি কোনো কিছুতে মন দিতে পারছেন না, সব সময় মনের মধ্যে বিরক্তি। কাউকে ভিতর থেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ফিল করতে পারছেন না। যা-ই দেখছেন শুনছেন সাময়িক ভালো লাগলেও আবার নিজের মধ্যে নিজের সঙ্গে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। মানসিক উদ্বেগ সারাক্ষণ। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না যে কেন এই উদ্বেগ। সব সময় মনে হচ্ছে হয় তো খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে আমার সঙ্গে। নয় তো একটা গিলটি ফিলিংস চলছে। হীনমন্যতা, অবসাদ ছাড়তেই চায় না। সব সময় নিজেকে মনে হচ্ছে, ধুর আমার দ্বারা কিছু হবে না। সবাইকে দেখে ঈর্ষা হচ্ছে আপনার। হয় তো নিজেকে ভাবছেন, কই আগে তো এরকম ছিলাম না, কিন্তু এখন কেন? এটা মনে হতেই আবার মন বিষণ্ণ। দমে যাওয়া।

    ক্রমশ সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। কাজের জায়গা নষ্ট হচ্ছে। অথচ আপনার মনে হচ্ছে কিছুই যেন আপনার হাতে নেই। সব কিছু আপনার বিরুদ্ধে ঘটে যাচ্ছে। সময়টাই খারাপ। আপনি হয় তো জ্যোতিষী দেখালেন। বাড়ির নক্সা বদলালেন। আরো নানা কিছু করে দেখলেন আদতে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ক্রমশ আপনি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। অনেকে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, কেউ দীক্ষা নিলেন; কেউ বেশি করে সৎসঙ্গ, পাঠচক্র ইত্যাদিতে যাতায়াত শুরু করলেন; মহাপুরুষের বাণী মুখস্থ করে করে হদ্দ হয়ে গেলেন --- কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। মনের মধ্যে যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার। 

    এ সবেরই কারণ আপনার ওপরসা ভালোত্ব। আপনার ভালো হতে যাওয়ার অতিচেষ্টা। যার বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে আপনার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমেছে ক্ষোভ, চাপা রাগ। চাপা রাগ, ক্ষোভ ভিতরে ভিতরে কালো শিকড় বানিয়ে ফেলেছে। আপনার সমগ্র অস্তিত্বটার মালিকানা তার হাতে এখন। আপনার চোখে সবাই শত্রু। সবাই খারাপ এখন। আপনি কাউকে বিশ্বাস করছেন না। সুযোগ পেলেই কাউকে কোনো খারাপ কথা বলে দিচ্ছেন, যদি সে আপনার থেকে দুর্বল হয়। খারাপ না হলেও কঠিন কথা তো অবশ্যই। বলে নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন। কারণ কথাটা সঙ্গত ছিল না। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেও পারেন না আজকাল আগের মত। যখন তখন কেঁদে ফেলেন। অল্প আবেগে চোখে জল আসে। অল্প কথায় হেসে ফেলেন এমন যখন এতটা হাসি হয় তো স্বাভাবিক অবস্থায় আপনি হাসতেন না। আপনি বুঝতে পারছেন আপনি স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। কিন্তু কোথায় যে এসবের সূত্রপাত ধরতেও পারছেন না।

    আসলে আপনি ক্ষমা করার ভান করেছেন। নিজেকে মিথ্যা কথা বলেছেন যে আপনি ক্ষমা করেছেন। আপনি ক্ষমা করেননি, কারণ অনেক হতে পারে। হতে পারে, অপরপক্ষ বেশি শক্তিশালী ছিল। হতে পারে সম্পর্ক নষ্ট হোক আপনি চাননি, কারণ হয় তো সে সম্পর্কটার উপর আপনি হয় ভীষণ আসক্ত, না হয় নির্ভরশীল। নির্ভরশীল অর্থের দিক থেকে বা মানসিক দিক থেকে যা কিছু হতে পারে। অথবা এমন হতে পারে যে রাগটা প্রকাশ করলে আপনার কাজের বা কেরিয়ারের পক্ষে তা থ্রেট হতে পারত। 

    এইভাবে সামাজিক, পারিবারিক, কাজের জগতে আমরা বহুবার নিজেদের অজান্তে রাগ 'হজম' করে নিই। মনের মধ্যে জন্মানো উষ্মাকে গিলে ফেলি। তারপর ভাবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এই তো আমি আবার আগের মত হয়ে গেছি। আর এখনকার দিনে নিজের মনকে ডিস্ট্র‍্যাক্ট করার উপায় অগুনতি। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ওটিটি, রিল, মিম - যা কিছুতে একটা ডুবে গেলেই হল। মনে মনে ভাবছি সব মিটে গেল। আদতে কিন্তু কিছুই মিটল না। হিলিং হল না, গুহায় চামচিকের বাসার মত, ওরা সংখ্যায় বাড়তে শুরু করল। ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করল। নিজেকে ডিস্ট্র‍্যাক্ট করে আপনি মনের সুপারফিশিয়াল দিকটার কিছু সাময়িক পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু মনের কোর অঞ্চলে সে পদ্ধতি কোনো কাজে লাগে না। 

    মনের গভীরে গিয়ে মনের শুশ্রূষা দরকার। সে কি করে হবে?

    দেখুন আমাদের সামাজিক হয়ে ওঠার ট্রেনিং-এ নিজেকে সমাজের পোষ্য, বাধ্য করে তোলার সিলেবাস আছেই। নিজেকে চলনসই করে না তুললে অনেক সমস্যা। সে আছেই। কিন্তু সমাজ আপনার যত্ন নেবে না। ক'দিন আগে মহাত্মা গান্ধীর একটা উক্তি অনুবাদ করেছিলাম, যেখানে উনি বলছেন সমাজ ফলের জন্য আগ্রহান্বিত, মূলের দেখভালের দায়িত্ব আমার একার। তো এই মূলের দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে। 

    যীশুখ্রীষ্ট থেকে সারদাদেবী সবাই বলেছেন ক্ষমা করার কথা। সমাজে এই 'ক্ষমা' অবশ্যই একটা পজিটিভ সাংগঠনিক দিক। কিন্তু এটাও মনে রাখার দরকার, ক্ষমাকে বুদ্ধ, সারদাদেবী, সবাই তপস্যা বলেছেন। 

    তপস্যা' শব্দের অর্থ একভাবে হয় যা তাপ উৎপন্ন করে। তাপ উৎপন্ন হয় তখনই যখন মুখোমুখি সংঘাতে নামি। এড়িয়ে যাই না, বা বাইপাস করে দিই না। সেটা কি এতটাই সোজা? আজকের সামাজিক জীবন অনেক বেশি জটিল, এ যেমন সত্যি, আজকের সামাজিক জীবনে আমরা অনেক কিছু নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি এও সত্যি। 

    শুরুতেই সব উচিৎ শিক্ষাকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে রাখুন। নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করান। খুব শক্ত কাজ এটা। যমের মুখোমুখি অনেক কনফিডেন্সের সঙ্গে দাঁড়ানো যায় হয় তো। কিন্তু নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো ভীষণ শক্ত। কিন্তু এ কাজটা করতেই হবে। 

    প্রথম যেটা খুঁজে বার করতে হবে, কোথায় কোথায় আমার নিজের উপর নিজেকে নিয়ে রাগ, ক্ষোভ। এই জায়গাটা ভীষণ সেনসিটিভ। তাড়াহুড়ো করে এ কাজ হওয়ার নয়। অনেক জায়গায় আমি অক্ষম, ব্যর্থ, নির্বোধ, বোকা --- হতেই পারে। সেগুলোকে খুব সহমর্মিতার সঙ্গে দেখুন। বৌদ্ধধর্মে একটা খুব চমৎকার কথা আছে --- সেল্ফ কমপ্যাশান। নিজের প্রতি নিজে নরম হোন। বুঝদার হোন। নিজেকে ক্ষমা করুন সবার আগে। কাজটা একটুও সোজা নয়। নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারলেই অন্যকে ক্ষমা করা সহজ হয়ে যাবে অনেকটা। তখন যে রাগটা অবশিষ্ট থাকবে সেটা বিষ হবে না। 

    কোন আবেগটা আমাদের মধ্যে বিষ হয়ে যায় জানেন? যেটা আনজাস্টিফায়েড থাকে। যেটা সত্যি অর্থে জাস্টিফায়েড হয়ে যায় সেটা আর আমাদের মনের মধ্যে বিষ তৈরি করতে পারে না। যেমন ধরুন আপনার খুব নিকট একজন মানুষ মারা গেলেন। স্বাভাবিক মৃত্যু, কিন্তু অকালমৃত্যু। আপনার মনের মধ্যে সারাদিন কুরে কুরে খাচ্ছে, হয় তো এটা করা যেত, হয় তো সেটা করা যেত। এই আবেগটা বিষাক্ত করে দেবে আপনার বেঁচে থাকা, সারাক্ষণ অপরাধবোধ একটা। এটা ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না আপনি ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখবেন যে আপনার সত্যিই কিছু করার ছিল না। তাই বলছি, আনজাস্টিফায়েড ইমোশান, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাপা থেকে যায়, মানে সাপ্রেসড থেকে যায়, তারাই বিষ হয়ে ওঠে। 

    আপনি যখন নিজেকে ক্ষমা করতে অনেকটা সক্ষম হলেন, তখনই আপনার আত্মবিশ্বাস, আত্মসন্মানের বোধটা সুস্থ অবস্থায় আবার কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। সে তখন নিজের মধ্যে জমে থাকা অনেক হিডেন ফোল্ডার বার করে নিজেই সমাধান করে ফেলতে পারবে সব এক এক করে। যা কিছু আনজাস্টিফায়েড, তা ধীরে ধীরে ট্রু জাস্টিফিকেশানের আলোয় এসে ধরা দেবে। আপনি অল্প অল্প আলোকিত হবেন। সুস্থ হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে। 

    দেরি করবেন না। এ কাজটা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় তত নিজের জন্য, নিজের চারপাশের পরিবেশের জন্য মঙ্গল। কোনো কিছুকেই বাইপাস নয়। যাই আসুক, 'সত্যেরে লও সহজে' বলেই মনের গোডাউনে আর চালান করে দেওয়া নয়। সহজে কিচ্ছু হয় না। সত্যরে লও জাস্টিফিকেশানে। এই হল কথা। তবেই সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন।

204
Sat, 08/21/2021 - 16:30

"The purpose of education is not just the acquisition of knowledge or information. The purpose of education is to teach students to think independently, critically and to not accept given knowledge unquestioningly. Today, Japan is the world leader in making several kinds of appliances. Computers finish the tasks they are given quickly and accurately; but the questions of the next century are going to be, what tasks do we assign computers? How do we satiate their endless hunger? These questions will require independent thinking. Our education system has neglected to nurture this quality, and we will feel its absence painfully in the next century."

~ Narendra Dabholkar
 

    আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা বাজাতে, সাজতে যতটা পছন্দ করি, নিঃশব্দে আত্মমগ্ন হতে ততটা পছন্দ করি না। আমি এই ক'দিন অনেকের মুখে দাভোলকার ও গৌরি লঙ্কেশের হত্যার কথা শুনেছি। কিন্তু যখন তাদের প্রশ্ন করেছি, আপনারা কি দাভোলকারের লেখা দুই খণ্ড ‘দ্য কেস ফর রিজ্ন’ বা শেষ লেখা ‘প্লিজ থিংক’ পড়েছেনে? আমি এখনও অবধি কাউকে পেলাম না যিনি বললেন, হ্যাঁ পড়েছি। এতদিন কথা মেসেঞ্জারে হয়েছে, এইবার হয় তো এই লেখার পর কাউকে পাব যিনি বলবেন, হ্যাঁ পড়েছি। আশা করব তিনি সত্যি কথাই বলবেন।

    দাভোলকারের কথাতেই আসি, তাঁকে নিয়ে লিখব বলেই এই লেখা। দাভোলকারের দুর্ভাগ্য হল তাঁর মৃত্যু নিয়ে ভারত যত আলোড়িত, তার কর্ম নিয়ে নয়। একই দুর্ভাগ্য কৈলাশ সত্যার্থীর মত নোবেলজয়ীরও, যিনি ফেসবুক পেজে উপস্থিত থাকলেও তাঁকে অনুসরণ করার মত মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। আমার বন্ধু তালিকার কয়জন সেখানে আছেন দেখতে গিয়েও হতাশ হয়েছি। এখন তিনি খবর হবেন কেন? তাঁর না আছে গ্ল্যামার, না আছে তাঁকে নিয়ে আপাতত কোনো মশালাদার খবর। তবে? আমাদের মনোরঞ্জন নিশ্চয় শুকনো পাণ্ডিত্যের কচকচানিতে হবে না। আমাদের সুখ তো অন্যখানে।

    দাভোলকারের দুর্ভাগ্য তাঁর মৃত্যু নয়। যে মানুষই অকপট নির্মল সত্য বলতে গেছেন তাদের বেশিরভাগ মানুষের কপালেই জুটেছে একই শাস্তি। তিনি খ্রীষ্ট হোন, কি খ্রীষ্টকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আরেক কুসংস্কারময় চার্চের বিরুদ্ধে বলা স্পিনোজা হন। স্পিনোজাকে হত্যা করা হয়নি, তবে তার থেকে অনেক বেশি করা হয়েছে। অমন আদ্যন্ত ঈশ্বরমগ্ন মানুষ, যিনি প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেই সেই বিপদে পড়েছিলেন। স্পিনোজা রাসেলের সব চাইতে প্রিয় দার্শনিক ছিলেন। এবং আইনস্টাইনের প্রাণপুরুষ ছিলেন। আইনস্টাইন এতটাই মগ্ন ছিলেন স্পিনোজার ভাবনায় যে ওনার বাড়ি গিয়ে ওনাকে নিয়ে একটা কবিতাও লিখে এসেছিলেন।

    যে কথাটা বলছিলাম, দাভোলকারের মৃত্যু ততটা দুর্ভাগ্য নয়, যতটা দুর্ভাগ্য তার লেখাগুলোকে এইভাবে ভুলে যাওয়া। আমি এখনও দেখিনি কোনো বাঙালিকে যে তার লেখাগুলোর অনুবাদের বিষয়ে কিছু লিখছেন। আমার বিশ্বাস কেউ না কেউ তো অবশ্যই ভেবেছেন। হয় তো প্রকাশ্যে আসেননি এখনও। দাভোলকারকে ভুলতে আমাদের বেশিদিন লাগবে না। কিন্তু দাভোলকারের মৃত্যুর প্রসঙ্গ আমাদের তর্কের বিষয় থেকে যাবে। আমাদের ওতেই সুখ যে। যেমন নেতাজীকে নিয়েও। নেতাজী রচনাবলী নিয়ে বাঙালির ততটা মাথাব্যথা নেই, যতটা মাথাব্যথা তাঁর মৃত্যু নিয়ে। নেতাজীকে তো ছাড়ুন, বাঙালির একটাই বই নোবেল পেয়েছিল। বইটার আকার ও মূল্যও তেমন কিছু নয়। কিন্তু ক'টা বাঙালির বাড়িতে সেই বইটা থাকে? তবে রবীন্দ্রনাথের ভাগ্য এনাদের থেকে অনেক ভালো। অবশ্যই সুনীলবাবুকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলতে হয়, সে ওনার গানের জন্য।

    সত্যিই তো তাই, নইলে যদি জিজ্ঞাসা করি ‘মানুষের ধর্ম’ বা ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ কতজন পড়েছেন? অমনি হাতের সংখ্যা কমে যাবে। রবীন্দ্রনাথ তো আমাদের চিত্তের ভারহরক এখন, জ্ঞানের আলোকবহক কোন দুঃখে হতে যাবেন? তাই না?

    যদি দাভোলকারের রচনাবলী পড়া যায়, মানে যে ক'টা ইংরাজিতে অনুবাদ হয়েছে আর কি, সুপাঠক বাঙালিরা নতুন কথা কিছু পাবেন না। কেন বলুন তো? আমাদের মাটিতে আর একজন মানুষ জন্মেছিলেন, আমার বলতে লজ্জা লাগছে, কষ্ট হচ্ছে তার কথা, যার রচনাবলীই এখন তত ‘জনপ্রিয়’ নয়, তিনি হলেন - আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বলুন তো তার কোন লেখাটা আমাদের পাঠ্য ছিল স্কুলে? তার কোন লেখা পড়ে আমাদের মনে হয়েছে, না এই মানুষটাকে আমাদের আলোকস্তম্ভ করা যেতে পারে? মনে হয়নি। কারণ আমাদের সামনে তাঁকে সেভাবে আনাই হয়নি।

    প্রফুল্লচন্দ্র পড়লে আপনি যে স্পিরিটটা অনুভব করবেন, সেই একই স্পিরিট আপনি অনুভব করবেন দাভোলকারকে পড়লে। শুধু তার ভাষা আলাদা, তার উদাহরণগুলোতে নতুন করে যোগ হয়েছে অধুনা গডম্যানদের কথা।

    সমস্যা হচ্ছে, শব্দ নিয়ে। আমরা হঠাৎ করে দাভোলকারকে র‍্যাশেনালিস্ট বলে দিচ্ছি। এখন কথা হচ্ছে, 'র‍্যাশেনালিস্ট' শব্দটার মাধ্যমে আমি যদি নাস্তিকতা বোঝাচ্ছি, তবে ভুল বলছি। কারণ, দেকার্ত, স্পিনোজা, কান্টকে র‍্যাশেনালিস্ট বলা হয়, যারা নাস্তিক ছিলেন না। আবার যদি শুধু 'যুক্তিবাদী' বলি, তবে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিবেকানন্দ, রমণ মহর্ষি, অরবিন্দ, রাধাকৃষ্ণাণ, জে কৃষ্ণমূর্তি প্রমুখ প্রত্যেকেই একই গোত্রের হবে, যারা কেউ নাস্তিক ছিলেন না। 'র‍্যাশেনালিস্ট' মানে কিন্তু 'মেটেরিয়ালিস্ট' নয়। মানে একজন মানুষ যুক্তিবাদী হবেন বলেই যদি বস্তুবাদী হবেন ধরে নিই, তবে সে আমার বোঝার ভুল। আর যিনি শনিমন্দিরে পুজো দেন ছেলের ভালো রেজাল্ট হবে বলে - তার ঈশ্বরে বিশ্বাস, আর রমণ মহর্ষি বা রামকৃষ্ণ বা জে কৃষ্ণমূর্তির ঈশ্বরের উপলব্ধিকে যদি এক গোত্রে ফেলতে চাই, তবে যুক্তিমননকেই প্রশ্ন করতে হয়।

    দাভোলকার কুসংস্কার, অকাল্ট প্র্যাক্টিসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি প্রফুল্ল রায়ের মত একই সুরে আক্ষেপ করে গেছেন, যে এত এত বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও মানুষ কেন কুসংস্কারমুক্ত হচ্ছে না? কেন মানুষের ভাবনা যুক্তিগামী হচ্ছে না? দাভোলকারের বিস্ময় আক্ষেপ প্রফুল্ল রায়ের থেকে আরো বেশি কারণ বিজ্ঞানের ছাত্র আমাদের এখন আরো অনেক অনেক। তবে কেন এত কুসংস্কার? দাভোলকার বিবেকানন্দ থেকে কোট করছেন তাঁর বইতে,

    "Should religion use the same kind of logic that every branch of science uses to establish itself? Should religion use the same tools and methods that science uses to make sense of the world around us? My answer to both these questions is yes, the sooner the better. If doing so causes the religion to collapse, then that religion was never a religion—it was a meaningless, useless superstition. I have not the smallest doubt that it is glorious for such superstition to crumble and fall. All weeds must be uprooted and the real core of religion ought to be revealed, refined and shining, in this process. Religion ought to have the same scientific approach that physics or chemistry has. This will let it become more adept. (বিবেকানন্দ)"

    তার কারণ অবশ্যই লোভ আর ভয়। মানুষের সত্তার সঙ্গে এ দুটো ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। এন রাম, দ্য হিন্দুর এডিটর, দাভোলকার আর গৌরি লঙ্কেশকে নিয়ে লিখতে গিয়ে লিখছেন, বিবেকানন্দ যখন শিকাগো স্পিচে বলছেন যে, ‘বেদান্ত দর্শন শুধু অন্যধর্মের প্রতি সহিষ্ণু নয়, সে সব ধর্মকে সত্য বলে জানে’... এই উদার চেতনার ভারতবর্ষ কি হারিয়ে যেতে পারে 'হিন্দুত্বা'র চেতনায়? আসলে এই চেতনা আর লোভ আর ভয়ের প্রবৃত্তি তো এক নয়। চেতনা এক জিনিস আর প্রবৃত্তি আরেক জিনিস। লোভ আর ভয়কে দিয়ে যা করিয়ে নেওয়া যায়, চেতনা দিয়ে তা কি সম্ভব?

    যখন স্কুলের সিলেবাস বানানো হচ্ছিল, তখন কেন সব ধর্মের মূল শিক্ষাগুলোকে নিয়ে একটা ক্লাস হল না, যে কথা গান্ধী বহুবার বলেছিলেন? ব্যক্তি ঈশ্বরে বা প্রতিষ্ঠিত ধর্মে বিশ্বাসী হই চাই না হই, সমাজে ধর্মের অস্তিত্বকে না মানার তো কারণ নেই। যা আছে তাকে আরো স্পষ্ট করে জানাতে অসুবিধাটা কোথায় ছিল? তবে তো রামকৃষ্ণের সেই শিক্ষা - একই জল, কেউ বলে পানি, কেউ বলে ওয়াটার, কেউ বলে অ্যাকুয়া - এ সবার সামনে আসত! কবীর, নানক, লালন, তুকারাম - এদেরই বা বাদ দেওয়া কেন হল?

    ঈশ্বরবোধে ব্যক্তি ঈশ্বর ও নৈর্ব্যক্তিক ঈশ্বর দুইয়ের কথা আছে। রমণ মহর্ষি থেকে রামকৃষ্ণ, খ্রীষ্ট থেকে বুদ্ধ, প্রত্যেকে জগতে সেই নৈর্বক্তিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব বলতে মানুষের চেতনায় জাগা শুভবোধকে বলেছেন। যা ধর্মের সত্যকারের রূপ। যাকে স্পিনোজা, কান্ট নিজের চেতনায় উপলব্ধি করেছেন। আজকের মনোবিদেরাও মানুষের চিত্তে এক সার্বজনীন বিবেকবোধের অস্তিত্বকে মেনে নেন, যার উপর দাঁড়িয়ে হিউম্যান রাইটস্, নোয়াম চোমস্কির মতে।

    আজ দেবদত্ত পট্টানায়েক লড়ে যাচ্ছেন হিন্দুত্বার আইডিয়ার বিরুদ্ধে। না, কোনো বাঙালিকে দেবদত্ত পট্টানায়েকের মত ক্ষুরধার যুক্তিতে লড়ে যেতে দেখছি না। তিনি গালাগাল খাচ্ছেন, সত্যিকারের হিন্দু ধর্মের আসল রূপটা সামনে আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। অক্লান্তভাবেই করে যাচ্ছেন। আমরা শুধু লাফাঝাঁপি করছি, ধুলো ওড়াচ্ছি, না নিজে স্পষ্ট দেখছি, না অন্যকে স্পষ্ট দেখতে দিচ্ছি। তিলকে তাল করছি। তালকে সার্বজনীন ফল বলছি, কিন্তু আলোর মশালটা হাতে নিতে চাইছি না। গভীরে গিয়ে খুঁজে দেখতে চাইছি না, আপাত বলে যা চোখে ঠেকছে, সেই কি আসল? এ প্রশ্নও করছি না।

    না, সে সবে আমাদের মতি নেই বলে দাভোলকারের লেখা নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। আমাদের আগ্রহ কোন্দলে। আমাদের আগ্রহ মুড়িমিছরি এক করায়। তিলকে তাল করায়।

    এইটুকু বলে শেষ করি, দাভোলকারের উক্ত বই তিনটে আমাজনে পাওয়া যায়। কিণ্ডলেও পাওয়া যায়। একটু দেখবেন।

    আর একটা কথা, আশারাম, রামরহিম এত কিছুর পরেও জেলে যায়। সুপ্রিম কোর্ট ঝাঁঝিয়ে বলে, এ দেশ শাস্ত্র দিয়ে শাসিত নয়, আইন দ্বারা শাসিত। এগুলো আশার কথা। এ দেশ বেদান্ত দর্শনের - এক সত্য, যার বহুভাষ্য। এ দেশ রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, তুকারাম, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বিদ্যাসাগরের। এ দেশেই শিরডির সাঁই, যিনি মসজিদে সারাটা জীবন কাটিয়েও লক্ষকোটির হিন্দু ভারতীয়ের ইষ্টদেবতা, যার বিরুদ্ধে স্বয়ং বর্তমানের শঙ্করাচার্য বলেও কিচ্ছুটি করতে পারেননি। যুক্তির উপরে জাগে প্রজ্ঞা। যাকে ইংরাজিতে 'ইনটুইশান' বলে। শোপেনহাওয়ারের মতে বেদান্ত শ্রেষ্ঠ দর্শন। কারণ প্রজ্ঞার আলোকে আলোকিত। যার মূল ভালোবাসা ও অনুকম্পা। হিন্দুত্বা'র ঢেউ ভারতে আগেও উঠেছে, এখন উঠছে, আবারও আসবে। কিন্তু বিজ্ঞান যেমন ম্যাজিক না। ধর্ম তেমন ম্যাজিক না। বিজ্ঞান মানুষের যুক্তিবোধের সার্বজনীনতা। ধর্ম মানুষের নৈতিকবোধের সার্বজনীনতা। কোনোটাই সহজলভ্য নয়। আবার দুর্লভও নয়। ভারত হাঁটুক যুক্তিতে, জাগুক প্রজ্ঞায়।

"While doing this work, it will not do to get angry at people, or make fun of them for being stupid. We need to constantly and empathetically engage with people. The road is long but it is the right path. Ultimately, our struggle is to change people in society. And that requires compassion rather than anger; belonging rather than belittling."

~ Narendra Dabholkar

205
Thu, 08/19/2021 - 12:54

মানুষ অনেকভাবে একা হয়। আদর্শবোধে একা হয়। ঔচিত্যবোধে একা হয়। নীতিবোধে একা হয়। যন্ত্রণায় একা হয়। ভাবনায় একা হয়। 

    মানুষ অনেকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়। লোভে বিচ্ছিন্ন হয়। ঈর্ষায় বিচ্ছিন্ন হয়। আতঙ্কে বিচ্ছিন্ন হয়। আশঙ্কায় বিচ্ছিন্ন হয়। ষড়যন্ত্রে বিচ্ছিন্ন হয়। স্বার্থপরতায় বিচ্ছিন্ন হয়। 

    মানুষ এক হয় ভালোবাসায়, সহানুভূতিতে, অনুকম্পায়, সহমর্মিতায়। 

    এই যে প্রতিমূহুর্তে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি। এই যে এতগুলো মানুষকে গুলি করা হল। এই যে এতগুলো মেয়েকে তুলে নেওয়া হল, এই স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল, এই যে শুনছি। এই যে মানসিক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। অসহ্য অসহায় লাগছে। এই যে বারবার নানাভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চাইছি। বারবার ব্যর্থ হচ্ছি। এই আমার ভবিতব্য। এই আমার শিক্ষার, বিশ্বাসের, অভিজ্ঞতার শাস্তি। মা, মেয়েকে বন্দুকের সামনে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এই যে আমি স্নান করছি, খাচ্ছি, পড়াচ্ছি, কথা বলছি, লিখছি, শুতে যাচ্ছি - এ আমার শাস্তি। আমার উপার্জিত যন্ত্রণা। বিজ্ঞান আমার বোধের দরজায় এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে হাজার মাইল দূরের এক দেশকে। কিন্তু মানুষে মানুষে দূরত্ব তো মাইলে নয়। মানুষে মানুষে দূরত্ব শুধু আত্মপরতায়, তাকে না জানার অন্ধকারে। তাই পাশের মানুষও আমার অজ্ঞতায় থেকে যায় কয়েক আলোকবর্ষ দূরে। মানুষের অসহায়তা, স্বাধীনভাবে বাঁচার ইচ্ছা তো দেশ-কাল-ধর্ম-বিশ্বাস নিরপেক্ষভাবে এক। আমার অনুভবে তাই সব এক। দেশ-কাল-পাত্র ভেদ কই সেখানে?

    আজ তাই যন্ত্রণায় এক হচ্ছি। মানুষের আয়ু কতটুকু? যে মানুষটা প্লেনের চাকায় পিষে নিজেকে অসময়ে শেষ করে দিল, তার একান্ত মানুষের মত বাঁচার ইচ্ছাকে কি আমি জানি না? সে ইচ্ছা কি আমার বুকের মধ্যেও অহরহ জেগে নেই? যে মানুষগুলোর দেহাবশেষ পাওয়া গেল প্লেনের গায়ে, তাদের সঙ্গে আমারও দেহাবশেষ লেগে, যে দেহকে আঘাত থেকে রক্ষা করি আমার সাধ্যে নেই। 

    মানুষের অর্জিত সম্পদ শুধুমাত্র ভালোবাসা। শুধুমাত্র অনুকম্পা। শুধুমাত্র সহানুভূতি। এর বাইরে মানুষ যা পায়, তা ফুরিয়ে যায়। তাকে আগলে রাখতে রাখতে সে সঙ্কীর্ণ, ক্ষুদ্র হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব হারায়। ক্ষমতা, সম্পদ, প্রতিপত্তিকে শকুনের মত আগলাতে আগলাতে মানুষ ভুলে যায় অবশেষে তার মানুষ হওয়ার কথা ছিল। নিজেকে বলিদান দেওয়ার কথা ছিল, অনেক মানুষের ভালোর জন্য। অনেক মানুষের মঙ্গলের জন্য। বলিদান দেওয়ার অর্থ মৃত্যুকে বরণ না। জীবনকে আলোর মধ্যে নিয়ে হাঁটা। সমস্ত ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতাকে ত্যাগ করা। 

    এই বিশ্বাস কি কোনোদিন ছাড়তে পারব? না পারব না। যদি বাকি জীবন এই চূড়ান্ত অমানবিক দৃশ্যাবলীর সাক্ষী থাকতে থাকতে পাগল হয়ে যেতে হয়, তবুও সেই আমার ভবিতব্য ধরে নেব। সব কাজ করতে করতে প্রতিদিন নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করতে করতে ভাবব, এই আমার অর্জিত ধন - আমার মানসিক অত্যাচার। যে আমায় অত্যাচার করছে তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা আছে আমায় অত্যাচার করার, তাতে আমার সমর্থন নেই, এইটুকুই সত্য শুধু।

    শুরুতে অভিমান হয়েছিল, কেন মানুষ এই অমানবিকতাকেও সমর্থন করবে? আজ বুঝি, সে প্রশ্ন করার আমি কে? যার মনে হয় সেখানে যা হচ্ছে তা যথার্থ, তবে তার সঙ্গে আমি এক সারিতে দাঁড়াব না শুধু। কিন্তু তাকে শত্রু মনে করার কারণ দেখব না। না তো যারা সেখানে সে বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে, মনে মনে বলব তারা শেষ হয়ে যাক। তারা শেষ হলেও কি এই অন্ধকার বিশ্বাস শেষ হয়ে যাবে? কোনোদিন যাবে না। শুধু চাইব তারা নিজেদের এভাবে সমস্ত জগতের শুভবুদ্ধি থেকে বিচ্ছিন্ন না করুক। জগতে ঘৃণ্যতম পাপ করার ক্ষমতা পাওয়া যায়, কিন্তু শুভ চেতনার সমর্থন পাওয়া যায় না। এই বোধ অবশেষে আসুক। এ আপাতত দুরূহ আশা হলেও, এই একান্ত চাওয়া। পৃথিবীতে এর উদাহরণও তো আছে। নইলে আজ এদেরকে নিঃশেষ করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? যাবে না। আজ যে নামে তাকে ডাকছি, কাল আরেক নামে সে আসবে। তবে আসবেই। তাকে শত্রু ভেবে নিজেকে সঙ্কুচিত করে ফল? সে বর্বরতা শত্রু। -ism টাই সমস্যা, -ist তো ফলাফল। 

    সংঘাতের রাস্তা যদি হত্যা হত, তবে এতদিনে সব পাপ পৃথিবী থেকে মুছে যেত। সব অপরাধীর কঙ্কালে পৃথিবী ঢেকে ফেললেও অপরাধ প্রবণতাকে নিঃশেষ করা কোনোদিন যাবে না। যায় না। 

    বুদ্ধ এক শপথ শিখিয়েছিলেন। সমস্ত অপরাধ, হিংসা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতার মধ্যে আমি ধর্ম নিয়ে বাঁচব। বুদ্ধের শিক্ষার আলোয় যে সনাতন ধর্মের মূল কথা - হিংসার দ্বারা হিংসার নাশ হয় না, হিংসার নাশ হয় ভালোবাসায়। ভালোবাসা মানে সহিষ্ণুতা, ক্ষমা, তিতিক্ষা। এই শক্তি। দুর্জনের অত্যাচার থামাতে যদি না পারি, তবে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে যাওয়া আমার প্রাপ্য। যতদিন না মানুষের চিত্তশুদ্ধ হয়। আলো আসে। আরো বেশি স্থৈর্য্য আসে। ধৈর্য্য আসে। বর্বরতার সামনে মনুষ্যত্বই একমাত্র চওড়া রাস্তা। তাদের হাতে প্রাণ/মান দেওয়ার চাইতে নিজেকে শেষ করে দেওয়া অনেক বেশি সম্মানের, যদি পৃথিবীর সমস্ত শুভশক্তি নিরুত্তর থাকে। তবে অত্যাচার করবে কার উপর? কোনো সাহায্য যদি না পাওয়া যায়, অন্তত নিজেকে অপমানিত হতে না দেওয়ার ক্ষমতা আমার হাত থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারে না। লড়াইটা মানুষে মানুষে কোনোদিন হয় না, লড়াইটা হয় আলো আর অন্ধকারের। অন্ধকারকে নাশ করতে আলোই লাগে, আরো আলো।

206
Fri, 08/13/2021 - 12:30

গল্পটা পুরুষতন্ত্র, ধর্ম, রাজনীতি, কুসংস্কার, আবেগ, দুর্নীতি ইত্যাদি যাই বলো না কেন, ব্যাপারটা অত জটিল কিছু নয়। মোদ্দা কথাটা হল, কে ডমিনেট করবে আর কে ডমিনেটেড হবে। যে ডমিনেট করবে, সে দুষ্টু, খারাপ, লোভী, অবিবেচক ইত্যাদি তকমা পাবে। আর যে ডমিনেটেড হবে সে বেচারা, নিরীহ, নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ ইত্যাদি তকমা পাবে। যে ডমিনেট করে, মানুষ তাকে মনে মনে ফুলচন্দন দিয়ে, যে ডমিনেটেড হচ্ছে তাকে সমবেদনা জানায়। দুমুখো ঢ্যামনা সাপ। মানে আমরা!

    যে ডমিনেটেড হচ্ছে সে চায় সব ঠিক হোক। তার কিছুটা মানে সেও ডমিনেট করুক। আর যে ডমিনেট করছে সে চায় এ অনন্তকাল চলুক। মোদ্দাকথা এই উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে আর বুধোর পিণ্ডি উধোর ঘাড়ে। এই তো হল গল্প।

    তবে কে কখন ডমিনেট করবে, এর উত্তর কেউ দিতে পারে না। দিতে গেলেই সে মহাভারতের কালের চাকা ঘুরতে শুরু করবে, ম্যায় মহাকাল হুঁ। নে ঠেলা সামলা এবার।

    আরে স্বগ্গে এরকম প্রায়ই হয় না? এই অসুররাজ চলে এলো, আবার দেবতারা তাদের খেদিয়েটেদিয়ে আসনে বেশ গোছ করল বসল। আবার গেল গেল.. আবার অসুর চলে এলো। আবার দেবতা। এই তো হল কথা। মাঝখান থেকে একে তাকে গালাগাল দিয়ে লাভ নেই বুঝলেন, মায় রাশিয়া আর চীনের দিকে তাকিয়ে বুঝেছেন না? ও সার কথা হল যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ।

    তবে উপায়? উপায় আছে আবার নেইও। 'নেই' বললে তো খেলাই শেষ। যদি বলো উপায় কি? আমি বলব, দুটো। একটা মিছিমিছি উপায়। একটা সত্যিকারের উপায়।

    আগে বলি মিছিমিছি উপায়ের কথা। মিছিমিছি উপায় হল, মনকে প্রবোধ দাও। যে ডমিনেট করছে, সে হল দুষ্টুলোক। মানে তুমি ভাবলে পুরুষতন্ত্র চলে গিয়ে মহিলাতন্ত্র এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি অমুক পার্টি গিয়ে তমুক পার্টি এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি ধর্ম গিয়ে বিজ্ঞান এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি করোনা গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে, কি বৃষ্টিগেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে...... উফ বাবা রে বাবা.... কিচ্ছুতেই "সব ঠিক" হবে না দাদা। কাঁধের ব্যথা হাতে যাবে, হাতের ব্যথা কোমরে, কোমরের ব্যথা পায়ে। এবার কি ভাবছেন? পায়ের ব্যথা মাটিতে? ধুস! পায়ের ব্যথা আবার মাথায় কি ঘাড়ে চাপবে। মোট কথা ঘুরেফিরে আবার সেই 'ধুর ভাল্লাগে না' তে ফিরতে হবে।

    তবে এই হল মিছিমিছি উপায়ের কথা। সারা পৃথিবীজুড়ে বিশ্বকে ঠিক রাস্তায় আনার জন্য, মানুষকে সুবোধ করার জন্য কম বই লেখা হল? মায় সব বই জোগাড় করলে চীনের পাঁচিল গোষ্পদ তুল্য হবে গা। তারপর আলোচনা তো কত হল। কত খাবার, কত মদ, কত ধোঁয়া উড়ে গেল তার ঠিক ঠিকানা নেই। কি হল? লবডঙ্কা। জেলে কি কম মানুষ ভরছে? অপরাধ কি কমে যাচ্ছে? বলি বিশ্বের কথাটাই ধরেন, দূষণে আর উষ্ণায়নে তার প্রাণটাকেও যাচ্ছেতাই রকমে রগড়ে রগড়ে কি অবস্থা করেছি আমরা! এদিকে দেখো কত কত বই লেখা হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ নিয়ে। কত কত হাইফাই আলোচনা। এই সমুদ্দুরের মধ্যে সেঁধিয়ে, তো উই আকাশে উঠে। বাবা রে বাবা। কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়।

    আসলে দাদা এও ডমিনেটের ইচ্ছা। দেখো আমি কত ভালো, দেখো আমি কত জ্ঞানী, দেখো আমার কত টাকা। দেখছ না? এসো আমি তোমার বন্ধু হই। বন্ধু হয়ে ডমিনেট করি। একে কি নাম দেওয়া যায়? একে নাম দেওয়া যায় ধরো অ্যানেস্থটিক ডমিনেন্স বা সিইডো ফ্রেণ্ডলি ডমিনেন্স বা ডমিনেন্স অব বেনিফিট?

    যা হোক আমার তো কাজ নাম দেওয়া নয়। ওসবের জন্য ডিগ্রীধারী মোটা মাইনে করা লোক আছে। আমার মত আত্মপোষা (আসলে আমার ছা নেই কিনা, তাই মিথ্যাটা বললুম না, ছাপোষা আর হই কি করে?) মানুষের আর কি কাজ বলো? তো এরকম মেলা টাইপের ডমিনেন্স আছে। প্রথমে মনে হবে উইন উইন সিচুয়েশান হচ্ছে। তারপর মনে হবে যে উঁহু, কোথায় যেন কি গোলমাল হচ্ছে। এই যেমন ধরো, আমি মার্গারেট দিদার 'দ্য টেস্টামেন্ট' বইটা পড়ছি। কি ভালো লেখনী দিদার। কিন্তু হলে কি হবে, দিদার চোখে যদি একটাও ভালো পুরুষ পড়ছে গো! আমি অবিশ্যি অর্ধেক পড়েছি সবে। খুব ভালো বই। কি কথার বাঁধুনি দিদার। কিন্তু হলে কি হবে গা, মায় ডেন্টিস্ট থেকে শুরু করে সব পুরুষ যেন ওই অঙ্গটির তৃষ্ণা নিবারণ আর ক্ষমতাবাজী ছাড়া আর কিছুই জানে না। এও এক ধরণের প্যাসিভ ডমিনেন্ট আইডিয়া দিদা মাথার মধ্যে ঢুকাচ্ছে কিনা? দুর্দান্ত লেখার হাত বলেই ওসব করতে হবে? বলি সব কি তাই দিদা? অমন একপেশে ভাবনা কি ভালো? তুমিও যে ডমিনেট করতে চাইছো পাঠকের মাথায় এক আইডিয়া দিয়ে!  

    তো এই হল কথা। ডমিনেশন চলবেই। যে কোনোভাব হোক হবেই। এর থেকে ত্রাণের জন্য যতই আইনকানুন বানাও, তার ফাঁক দিয়েও ওসব হবেই। না যদি হত তবে হিরো বলে কোনো শব্দই এই যুগে তৈরি হত না। হিরো মানেই তো আমি আছি সর্বহারাদের দলে...ইত্যাদি ইত্যাদি। কে জানে কি মতলবে মানুষ হিরো হয়?

    যাক গে, তবে আসল উপায় কি?

    সে ভীষণ কঠিন। হয় বৈরাগী হও, নয় সিনিক-উদাস-পাগলা গোছের একটা কিছুর সংমিশ্রণ হও। সব মায়া বলো, না হয় সব লীলা বলো, না হয় সব অ্যাবসার্ড বলো। প্রথমটা বলেছিল শঙ্করাচার্য, দ্বিতীয়টা রামানুজ আর শেষটা কাম্যু। হ্যাঁ হ্যাঁ বুদ্ধিজীবী মহোদয়গণ আপনাদের দেশের কাম্যু। আপনারা তো আবার ভুল করে ভারতে জন্মে সারাদিন বুদ্ধিটাকে দুই হাতে ধরে জ্বলে গেল.. সব জ্বলে গেল... করে ছুটে বেড়ান কিনা! যত্তসব আদিখ্যেতা।

    যা হোক সবটা খোলামেলা বলে দিলুম। নরেন অবশ্য আগেই বলেছিল, এ জগত হল কুকুরের ল্যাজের মত। যতই সোজা করতে যাও না কেন, শেষে সব এক। বাইরেটাই বদলায়, সময়ের জেনেটিক্স একই থেকে যায় কত্তা! নরেন বলল, ও সুখ বাড়ালেই দুঃখ বাড়বে। রেশিও একই থাকবে। তবে কিছু নিয়ে একটা মেতে থাকা ভালো। যেমন কেউ বিশ্বাস করেন সব লোক সিগারেট মদ ছেড়ে দিলেই সব সমস্যা ঠিক হয়ে যাবে। কেউ ভাবেন নিরামিষ খেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। হয় না কি আর? কিছু হয়। তবে হরেদরে কেস একই থেকে যায়। নইলে এত্ত এত্ত যন্ত্রপাতি, যানবাহন আবিষ্কার করেও মানুষ বলে সময় নেই! ভাবুন দাদা ভাবুন….

    ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়... আমি এই গানটা বরং গাই…. ডমিনেন্স সিন্ড্রোমের এর চাইতে ভালো গান আমি শুনিনি… "দু তিন দিনের জন্য ভবে কর্তা বলে সবাই মানে... সেই কর্তারে দেবে ফেলে কালাকালের কর্তা এলে"… আহা কি লাইন! কি ব্যাখ্যা!

    আপনারা বুদ্ধিজীবীরা এ সব গান নিয়ে তো গবেষণা করেন না... লোরকা, নেরুদা ছাড়া তো কতাই শুনিনা মুখে… যা হোক মায়া কাটা মন... মায়া কাটা... সবই মায়া... জয়গুরু...

207
Mon, 08/09/2021 - 11:30

ছল চাতুরী শিখতে হয় না। সে মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে একটা। একটি ছেলের আর্থিক অবস্থা খারাপ। সে পড়তে এসেছে। তার মা অনুরোধ করলেন একটু দেখতে। দেখা হল। মাস তিনেক বাদে খোঁজ পাওয়া গেল, সে আরো একজনের কাছে একই বিষয় পড়তে যায়, অর্থের সম্পূর্ণটা দিয়েই। এদিকের ছাড়, ওদিকে ব্যবহার হয়ে গেল। এক ঢিলে দুই পাখি। আরেকটি উদাহরণ, একজন একদিন পড়তে এলো না। তাদের সচ্ছল অবস্থা। মা বাবা বললেন, তার ভীষণ জ্বর। পরেরদিন খবর পেলাম সে একজন এমন স্যারের খোঁজ পেয়েছে যে তাকে ডাক্তার না বানিয়ে ছাড়বে না। এক পাড়ায় বাড়ি বলে তারা জ্বরের অজুহাত ছাড়া হয়তো অন্যকিছু ভাবতে পারেনি; এ অবশ্য আমার কল্পনা। আমি কাউকে কিছু বানিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিই না যে। আমার বাধে। 

    ছোটো-ছোটো এরকম নানা ছলচাতুরী নিয়ে চলা তো আমাদের পাথেয়। রামকৃষ্ণদেব জীবন সার্থক করার উপায় বলতে গিয়ে বলছেন, মন মুখ এক না করলে উপায় নেই। বলছেন, কপটতা ছাড়ো। তুলসীদাস বলছেন, ছোড়িয়ে কপট চতুরাই। 

    এত সোজা? আমাদের আচার আচর‍ণে নানা বেশে কপটতা যে! কপটতা ছাড়লে সমাজে বাঁচা যায় নাকি?

    শম্ভু মিত্র নাটক শেখাচ্ছেন। বলছেন, এই ধরুন আপনার বাড়িতে একজন কেউ এলেন, আপনি চান না সে আসুক বা আপনি তাকে পছন্দ করেন না, তবু আপনি হেসে তাকে আপ্যায়ন করেন না? এ অভিনয়। আমরা সারদিন অভিনয় করি। ওটা আমাদের রপ্ত করতে হয়।

    শম্ভু মিত্রের কথাটা সত্যি। কিন্তু এই সামাজিক অভিনয়ের কারণ তো কিছু থাকবে? তার কারণ একটা আছে। কি কারণ?

    কারণ আমাদের স্বভাব। আমাদের স্বভাবের সবটুকু কি আলোকিত? সবটুকু কি ভালো? না। আমাদের স্বভাবের যেদিকটা বর্বর, যেদিকটা অসভ্য, যেদিকটা কুৎসিত, সেদিকটাকে নিয়ে তবে কি করব? আমরা এত যুগের সামাজিক জীবনযাপন করতে কর‍তে দেখেছি আমাদের স্বভাবের কিছুদিক সমাজের জন্য ভালো, কিছুদিক ভালো নয়। আমরা ভালো দিকগুলোকে উৎসাহিত করেছি, চর্চা করার সুযোগ দিয়েছি। শিক্ষা, ধর্ম, নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে সহবত শেখাতে চেয়েছি। 

    কিন্তু কুৎসিত দিকটা? সে তো আমি চাইলেই যাবে না। তবে? তাকে ঢেকে রাখা ছাড়া উপায় কি? একজন মানুষ তার চিত্তের সমস্ত মল নাশ করে সমাজে এসে বাঁচবে এতটা আয়ু কি আছে? কিম্বা সেদিকটাকে যে সম্পূর্ণ নির্মূল করা যাবে তারই বা কি গ্যারান্টি আছে?

    অতএব আমরা আমাদের কুৎসিত, বর্বর, অসংস্কৃত দিকটাকে আচ্ছাদিত রেখে তাকে আমল না দিয়ে বাঁচতে শিখেছি। তবে রবীন্দ্রনাথের 'পৃথিবী' কবিতার মত সে কি মাঝে মাঝেই শৃঙ্খল খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে না? পড়ে তো। সে তার আশপাশকে ক্ষতবিক্ষত করে একাকার কাণ্ড করে। সত্য-মিথ্যা, শুভ-অশুভ সব গুলিয়ে ফেলে সুপ্ত আসুরী শক্তি জেগে ওঠে। সংসারে দুই বাস্তব, আসুরী শক্তি আর দৈবী শক্তি।

    মহাত্মা গান্ধী একটি লেখায় লিখছেন, ব্যাসদেব ও বাল্মিকী - এমন দুই শুদ্ধ আত্মা, সংস্কৃত, শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন কবিও দুই মহাকাব্য লিখতে গিয়ে যুদ্ধকে এড়াতে পারলেন না। যুদ্ধ, সংঘাত, সংঘর্ষ হবেই। 

    কথাটা কি খাঁটি সত্য। আমাদের প্রাচীন মানুষেরা মানুষের মধ্যের আসুরী শক্তির বীজ খুঁজতে গিয়ে ষড়রিপুর কথা বলেছেন। যার মূল বলতে গিয়ে বলেছেন মোহ। তুলসীদাসী রামায়াণে কাকভূশণ্ডীর সঙ্গে গরুড়ের কথোপকথন নিয়ে উত্তরকাণ্ডের কিছুটা অংশ। সেখানে কাকভূশণ্ডী বলছেন মানু্ষের মোহ সব পাপের মূল। মোহ কি? না সত্যকে মিথ্যা বলে বা মিথ্যাকে সত্য বলে জানা। এককে অন্য ভেবে ভুল করাকে বলে মোহ। আমরা জানি আমার জানা সত্য নয়। কিন্তু বাস্তবকে এড়িয়ে অনুরাগ আর দ্বেষের রঙে রাঙিয়ে দেখলে আমার সুখ। কাউকে ভালো, কাউকে মন্দ বানিয়ে আমার মোহের সংসার। আজ যেই মুখে তার শত সহস্র প্রশংসা করছি, কাল সেই মুখেই আবার নিন্দা করব। আবার পরেরদিন তার স্তুতি গাইব। মোহ এমনই চঞ্চল, ভঙ্গুর, ভীত, অভিমানী। তাই তাকে নিয়ে আমাদের নাস্তানাবুদ হওয়ার শেষ নেই। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, লোক না পোক। লোকনিন্দাকে উপেক্ষা করার ইঙ্গিত শুধু নয়, প্রশংসাকেও উপেক্ষা করার শিক্ষা। প্রশংসার লোভ বড় নীচু করে দেয় মনকে। মন দাস হয়। তাকে তাড়াতে পারলেই নিন্দা বেশিদূর অবধি মনের গভীরে কাজ করতে পারে না। 

    তবে ছল চাতুরী আর স্বভাবের কুৎসিত দিককে আড়ালে রাখার ইচ্ছা তো এক হল না। কেউ পোশাক পরে আছে বলে তাকে কি কপট বলা ঠিক হয়? এও তেমন। আমার মনের কদর্য দিককে সামনে এনে বেড়ানোতেই কি আমার সততা? তবে নিজের জীবনের লুকানো পাপ, অপরাধগুলোকে স্বীকার করে সোচ্চারে বলতে আমাদের এত বাধে কেন? রাগ, আক্রোশকে যতটা স্পষ্টভাবে বলি, নিজের হাজার একটা পাপ, অপরাধকে ঢেকে রাখি কেন? সেই বেলায় আমার সাংঘাতিক সততার ইচ্ছা কোথায় যায়? মহাত্মা গান্ধী নিজের আত্মজীবনীতে নিজের এক একটা অপরাধ বিনা জাস্টিফিকেশান লিখে গেছেন। সত্যের জোর সেইটাই। 

    ছল চাতুরী আর সামাজিক অভিনয়ের মধ্যে পার্থক্য এইখানেই। ছলচাতুরীর একটা উদ্দেশ্য থাকে। মতলব থাকে। স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা থাকে। সে স্বার্থ যতই সুক্ষ্ম হোক না কেন। সামাজিক অভিনয়ের মধ্যে আমাদের নিজেকে নিয়ে এক বিড়ম্বনা থাকে। ভালোকে টিকিয়ে রাখার এক দায় থাকে। নইলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় 'লাগিয়ে দিত তুর্কিনাচন'। এর মধ্যে দিয়ে গেলেই জীবনের সার্থকতা। এখন সার্থকতাও তো নানা রকমের। নিজেকে সত্য করে তুলে? না নিজেকে নিয়ে নিজের যে তুমুল মোহ, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায়? সময়ই তার উত্তর দেয়।

208
Fri, 08/06/2021 - 11:30

বিয়ে হল। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই মনে হতে শুরু করল, না, এ মানুষটা ঠিক আমার মনের মত মানুষ না। মানে আমি যেমন চাইছিলাম ঠিক তেমন না। 

    আবার এমন হতে পারে, বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই মনে হল, আমরা সংসারটা যেভাবে চেয়েছিলাম ঠিক সেভাবে হচ্ছে না। 


    আমি হঠাৎ এই বিষয় নিয়ে কেন লিখতে শুরু করলাম তার অবশ্যই কিছু কারণ তো থাকবেই। আমি দুটো ঘটনাই খুব কাছ থেকে দেখলাম। এও দেখলাম অনেক সমস্যার সমাধান সময়ের সঙ্গে, সুবিচার বিবেচনার সঙ্গে খুঁজলে পাওয়া যায়। খুব জটিল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা থাকলে সে আমার বোঝার ক্ষমতার বাইরে। কিন্তু সমাধান হয় না, এরকম সমস্যা হয় তো সত্যিই কম। 

    প্রথম ঘটনাটায় আসা যাক। দেখাশোনা করে বিয়ে হল। ছেলে ভালো চাকরি করে। মেয়ে এখনই কিছু করে না। আপাতত কিছু করার ভাবনা চিন্তাও নেই। বিয়ের পর পরই মনে হতে শুরু করল সব ঠিক হচ্ছে না। সমস্যাটা যেটা নিয়ে শুরু হল, সেটা হল আগের জীবন বনাম বর্তমানের জীবন। 

    ছেলেটার মনে হতে শুরু করল, সে যেন স্বাধীনতা হারাচ্ছে। তার আগের জীবনের অভ্যাসগুলোর সঙ্গে কোথাও যেন কম্প্রোমাইজ করতে হচ্ছে। কেন করব? মনের মধ্যে একটা বিরোধ তৈরি হতে শুরু করল। যে কাজগুলো আগে অনায়াসে হত, এখন সেগুলো জেদের সঙ্গে করা শুরু করল। বেশিক্ষণ বন্ধুদের সঙ্গে থাকা। বেশিক্ষণ বইপড়া, কি সিনেমা দেখা, কি খেলা দেখা, কি খেলতে যাওয়া। আসলে কোথাও একটা আইডেন্টিটি ক্রাইসিস শুরু হচ্ছিল। মানুষের আইডেন্টিটি মানুষের নানা কাজের সঙ্গে গড়ে ওঠে। যেমন আমি যদি রোজ সকাল আটটায় জিমে যেতে অভ্যস্ত হয়ে থাকি, তবে কোনো একদিন না গেলে আমার অবশ্যই ফাঁকা ফাঁকা লাগবে। সেটা যদি শরীর খারাপ বা ওয়েদার খারাপ বা জিম বন্ধ কোনো কার‍ণে এসবের জন্য হয় তবে সমস্যাটাকে জাস্টিফাই করতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যদি কারোর জন্য হয়, এবং যেখানে ইতিমধ্যে নিজেকে 'ট্র‍্যাপড' বলে মনে হতে শুরু করেছে, সেখানে আরো বেশি বেশি হয়। আমি স্যাক্রিফাইসটা কেন করব? এই কথাটা মাথার মধ্যে ঘুরতে শুরু করে। 

    এখানে একটা কথা বলে নেওয়া যাক। আমাদের এই মাথার মধ্যে ঘোরা ব্যাপারটা অনেকটা চোরাবালির মত। যে চিন্তাটা আমার পক্ষে স্বাস্থ্যকর না বলে বুঝতে পারছি, সেই চিন্তাটাকে প্রশ্রয় দেওয়া অনেক সমস্যার মূল। সে কথায় পরে আসছি। ছেলেটার মনে হতে শুরু করল তার জীবনে আরেক মানুষ ইন্ট্রুডার হিসাবে ঢুকেছে। অনধিকার প্রবেশ। 

    শান্ত ছেলেটা ক্রমশ মেজাজ হারাতে শুরু করল। প্রথম প্রথম নিজের ভিতরে ভিতরে, তারপর খুঁটিনাটি অল্প অল্প ব্যাপারে। একটু রুড কথা বলা। একটু উপেক্ষা করে যাওয়া, এবং সেটা বুঝিয়ে দেওয়া। অপমান না করতে চাইলেও করে ফেলা। বাজে ব্যবহারের জন্য নিজের মধ্যেও অনুশোচনা হওয়া। আবার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার জন্য নিজের উপর রাগ। নিজে মানিয়ে নিতে না পারার জন্য রাগ --- এগুলো সবই আনুষাঙ্গিকভাবে সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়। জটিলতা বাড়ে। 

    আমার মনে হয় এর কয়েকটা কারণ হয় তো ভাবা যেতে পারে। 

    আমাদের সমাজে মেল ইগো একটা বালাই। বেশ যত্ন করে লালন করে বড় করা হয়। ছোটোবেলা থেকে দেখতে শিখি যে মা আমার জন্য স্যাক্রিফাইস করছেন। বাবার জন্য করছেন। বাড়ির অতিথিদের জন্য করছেন। মা স্যাক্রিফাইস করে। বোন বা দিদি একটু বড় হলে সে স্যাক্রিফাইস করে। খুব সামান্য উদাহরণ, যেমন বাড়িতে লোক এলো, ভাই বোন দু'জনে বসে থাকলে বোনকে গিয়ে জলের গ্লাসটা এনে দিতে হবে। চা-টা করে আনতে হবে। এমনকি আপ্যায়নের অনেকটা দায়িত্ব নিতে হবে, ইচ্ছা না হলেও। এই কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, ইচ্ছা না হলেও। মানে ভাই বা দাদার যদি আঁকার ক্লাস থাকে, কি খেলা থাকে সে অনায়াসে উঠে যেতে পারে, কিন্তু বোন বা দিদি পারে না। 

    সব পরিবারে একই মাত্রায় না হলেও মোটামুটি এটাই আমাদের সামাজিক রীতি। এটা বাস্তব। এর ফলে যে মেল ইগো তৈরি হয়, সে জানে যে অ্যাডজাস্টমেন্টের প্রধান কথা হল মেয়ের। আমি আগেই বলেছি এই লেখাটা আমি এই জন্যে লিখছি যাতে ছোটোখাটো সমস্যাগুলো থেকে একটা রাস্তা পাওয়া যায়। ভীষণ জটিল মনস্তাত্বিক বা পারিবারিক সমস্যার আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। 

    যখন ছেলেটার সমস্যার মূল উৎসটা খুঁজতে চাইলাম, আমার মনে হল প্রধান সমস্যাটা হচ্ছে মেল ইগোকে নিয়ে। ভালোবাসা বললেই যেমন জন্মে যায় না, তেমন ভালোবাসা একটা যত্নেরও জিনিস, এমনি এমনিও জন্মে যায় না। ভালোবাসা জন্মানোর জন্য নিজের কিছু ধারণার, অভ্যাসের পরিবর্তন দরকার হয়। 

    প্রথম কথা হল, মেল ইগো সহজে যায় না। তাকে সরাতে চেষ্টা করলে হিতে বিপরীত। সবার আগে দরকার তাই নিজের ইগোটাকে বোঝা। নিজেকে ভালো করে দেখা যে কোথায় কোথায় আমি আনরিজিনবল ডমিনেট করতে চাইছি। আরো ভালোভাবে বললে, কোথায় কোথায় আমি অসংবেদনশীল হচ্ছি। সে প্রশ্নটা নিজেকে না করলে উত্তর পাওয়া যাবে না। যতক্ষণ না আমি নিজে নিজের সম্মুখীন হচ্ছি ততক্ষণ রাস্তা কিন্তু বেরোবে না। আমি যতই গোলগোল ঘুরি, যতই এড়িয়ে এড়িয়ে যাই, গায়ের জোরে সমাধানের রাস্তা খুঁজি, ততদিন হাল বেরোবে না। প্রথম কথাই নিজেকে বুঝে নিতে হবে কোনখানে আমি আমার ইগোর জন্য সংবেদনশীলতা হারাচ্ছি, আর যার জন্য নিজেকেও খারাপ লাগছে, নিজেকেও ছোটো লাগছে, তাও ছাড়তে পারছি না। 

    এরপর আসে ইগো ছাড়া রুচি আর ভাবনার পার্থক্যের জায়গা। আমরা যদি আমাদের চারদিকে তাকাই, আমাদের বন্ধুবান্ধব, পরিবার পরিজনের দিকে তাকাই, তবে দেখব প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমাদের ভাবনা আর রুচির পার্থক্য আছে। কিন্তু তাও আমার সেগুলো নিয়ে খুব একটা সমস্যা হয় না। কেন হয় না? কারণ দুটো, এক, তাদের নিয়ে আমার কোনো ইগোর সমস্যা নেই; দুই, তারা আমার দায় নয়। প্রথম বিষয়টা নিয়ে কথা তো বললাম, দ্বিতীয় বিষয়টা নিয়ে বলা দরকার। আসলে এই দায় কথাটা চাপানো একটা ধারণা। দায়িত্ব আর দায় --- এদের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম বোধগত পার্থক্য আছে। সব সম্পর্কের মধ্যে একটা দায়িত্ববোধ, যত্ন নেওয়ার দরকার থাকে। একটা মোবাইলকেও ঠিক মত চার্জে বসানো, ক্যাশে ক্লিয়ার করা, সময়মত আপডেট করা --- ইত্যাদি নানা দায় থেকেই যায়। সেখানে একটা নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠছে যেখানে সেখানে অনেক দায়-দায়িত্ব থাকেই। আমরা যতই রুচির পার্থক্য, ভাবনার পার্থক্য বলি না কেন, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি এমন কিছু অগম্য নয়, একে অন্যের কাছে আসার বা বোঝার। কারণ, আমরা সাধারণ মানুষেরা এমন কিছু বিশেষ রুচি বা ভাবনার অধিকারী নই যে আমার সঙ্গে অন্য মানুষের যোজন যোজন তফাৎ। বরং ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় যে যোজন দূরত্বের ভাবনায় দাঁড়ানো ইতিহাসের আইকনতুল্য মানুষেরা বিনা অভিযোগে সে দূরত্ব কাটিয়ে জীবনটা কাটিয়ে গেছেন। এখানেও নিজের ইগোকে বুঝে, তার ছায়া উপচ্ছায়াকে সরিয়ে যদি বিচার বিবেচনা নিয়ে নিজের অবস্থানটাকে দেখা যায়, তবে দেখা যায় এমন কিছু বিশ্বযুদ্ধ জয়ের মত ঘটনা না এটা। 

    আর কিছু অভ্যাসের কথা থাকেই। কিছু অভ্যাস নতুন করে গড়ে নিতেই হয়। তার জন্য কিছুই হারায় না। কিছু পরিবর্তন হয়। যে পরিবর্তনটাও ভালোর জন্যেই হয়। যে সম্পর্কগুলো খাঁটি, যে ইচ্ছাটা আমার গভীর --- সে কারো জন্য ছেড়ে যায় না, কারোর জন্য অপূর্ণও থেকে যায় না। নিজের ফ্লেক্সিবিলিটি বাড়ালে সম্পর্কের মধ্যে স্পেস অনেকটা বেড়ে যায়। তখন আর সম্পর্ককে বোঝা না লেগে বুঝতে শুরু করা যায়। 


    এবার আসি দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। যখন মনে হচ্ছে যে আমরা যেমন চেয়েছিলাম ঠিক তেমন হচ্ছে না। 

    এখানে প্রথমে আসি মেয়েটির কথায়। সে ছেলেটিকে রাস্তায়, সিনেমাহলে, হোয়াটসঅ্যাপে দীর্ঘ চ্যাটে, উৎসবে, বিপদে যেভাবে দেখেছে, বিয়ের পর পরিবারের মধ্যে এসে অনেক ক্ষেত্রেই আগের ছবির সঙ্গে মেলে না। একটা দ্বন্দ্ব, অস্বস্তি হতে শুরু করে। তবে কি আমি যতটা উদার, যতটা প্রগ্রেসিভ ভেবেছিলাম ততটা নয়? এ সংকট মনে ক্ষুণ্ণতার সৃষ্টি করে। ছেলেটার অনেক আচরণের সে ব্যাখ্যা পায় না। মেলে না। 

    কিন্তু এটাই বাস্তব। মানুষের আচরণ ভীষণভাবে চারপাশ আর চারপাশের সঙ্গে তার সম্পর্কের গভীরতা, রঙ ইত্যাদির উপর নির্ভর করে। আমাদের নিজেদের দিকে যখন তাকাই তখন দেখি, এক এক মানুষের সঙ্গে আমাদের ব্যক্তিত্বের এক একদিক প্রকাশিত হয়। নিজেকে এক এক রকম লাগে। যে কথাটা একজনকে কিছুতেই বলা যায় না, সেই কথাটা আরেকজনকে কি অনায়াসে বলে ফেলা যায়। ছেলেটার ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। সে যে বাড়িতে বড় হল, যাদের সঙ্গে বড় হল, তাদের সঙ্গে তার একটা টিউন ফিক্সড হয়েই আছে। তাকে ধুম করে বদলে ফেলা যায় না। সেটা সম্ভব নয়। 

    তবে উপায় কি? উপায় নিজেই দেখেছি, কি অদ্ভুত প্রচেষ্টায় কয়েকজন করে নিয়েছে। কিছুটা সে নিজেকে বদলেছে, কিছুটা সে সেই পরিবারকে ধীরে ধীরে বদলাতে পেরেছে। অবশ্যই এগুলো খুবই ছোটোখাটো জিনিস নিয়েই হয়। সকালে চায়ের সময় ডিসে চা পড়বে কিনা, বাথরুমে চটি পরে যাওয়া উচিত কিনা, সাবানের ব্র‍্যাণ্ড বদলে নেওয়া, তরকারিতে তেল আর নুনের পরিমাণ ঠিক করে নেওয়া…. এরকম অজস্র উদাহরণ আছে। তবে দেখেছি তারা আগে নিজেকে অল্প অল্প করে বদলে নিয়েছে। আমি এতটুকু বদলাবো না, সমস্ত বদলের দায় শুধু তোমার - এ যে পক্ষই বলবে সেই পক্ষের হারই নির্ধারিত অবশেষে। কারণ বদল জীবনের মূলমন্ত্র। তবে যে বাড়িতে মেয়েটা আসে সে বাড়ির "আমি কিছুতেই বদলাব না" এ জেদ স্বাভাবিকভাবেই থাকে। সেটা উচিৎ কি অনুচিত বলছি না, তবে সেটা থাকে। আর তার সেই জেদের মধ্যেই তার দুর্বলতাটার বীজটাও লুকানো থাকে। মেয়েটা যখন নিজেকে বদলাতে শুরু করল অল্প অল্প তারা টেরও পেল না তাদের জেদের তলার মাটিও খসতে শুরু করেছে। আমি যখন দীর্ঘদিন পরে কোনো পরিবারে গেছি, আমার সে পরিচিত মানুষটাকে জানতে চেয়েছি, কেমন আছিস, সব কি আগের মতই আছে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর পেয়েছি, না গো। অনেক বদলে গেছে সব।

    আমি তাকে আর মনে করাই না এ বদলের শুরুটা সে নিজেকে দিয়েই করেছিল। সাধারণত কারোর বেশি সময় লাগে, কারোর কম। আবার কিছু দুর্ভাগার সারাটা জীবনই কিছু হয় না। তবে তাদের সংখ্যা কম বলেই সংসারটা টিকে আছে এখনও। 

    এবারে আসি ছেলেটির কথায়। এখানেও সে অনেক সময় মাঝখানে। সে নিজের পরিবার আর তার স্ত্রী-কে - দু'জনকেই আলাদা করে গভীরে চেনে। সে জানে অনেক ভুল বোঝাবুঝিতেই শুধু দুটো আলাদা স্বভাবের, ভাবনার সংঘর্ষ। কেউ কাউকে আঘাত করার জন্য কোনো বিশেষ আচরণ ইচ্ছাকৃত মতলব এঁটে করছে না। এমনকি সে যে আরেকজনকে আঘাত করেছে সে বোধও থাকে না। এখন ছেলেটি কার পক্ষ নেবে? এখানেও দেখেছি সেই সময়ই প্রধান ভূমিকা নেয়। ছেলেটি দু'পক্ষের কাছেই কখনও অপরাধী হয়। যদি উত্তর না দেয় সেই মঙ্গল। যে ভুল বোঝাবুঝি অভিমানের তাকে ভাঙাতে যাওয়া আরেক অভিমানের জন্ম দেওয়া। সব চাইতে ভালো চুপ করে থাকা। অপেক্ষা করা। মেঘ আপনি কেটে যায়। একজন মানুষের একজন মানুষকে চিনতে সময় লাগে। সেই সময়টা দেওয়া সবার সবাইকে ভীষণ দরকার। সে সব ক্ষেত্রেই। নতুন কাজের জায়গা হোক কি নতুন সংসার। সময়ের থেকে বড় বন্ধু কেউ নেই। সময়কে স্বীকার করে নেওয়া মানেই ধৈর্যতে আস্থা রাখা। 

    আমাদের কারোর জীবনই আমাদের কাঙ্ক্ষিত ছন্দে হয় না। আমাদের জীবনের চিত্রনাট্যে লেখকের ভূমিকা যতই ছলেবলে আমাদের মন নিতে চাক না কেন, সে চিত্রনাট্যের রচয়িতা, যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করা হয় তবে তিনি, অথবা ভাগ্য। মোট কথা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে সে। তবে উপায়?

    উপায় অবশ্যই নিজেদের স্বপ্ন, অনুভবকে ছাপিয়ে নিজেদের বোধকে প্রশ্ন করা। আমার কাছে কি সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষটার সঙ্গে জীবন কাটানো, না নির্দিষ্টভাবেই মানুষটার সঙ্গে কাটানো।

    যদি সত্যিকারের মানুষটাকে চাই, তবে একজন একজনের সঙ্গ'র চাইতে আর বেশি কি চাইবার আছে? যতক্ষণ সে সঙ্গে আছে ততক্ষণ সব আছে। মান অভিমান, ভাঙাগড়া সব আছে। কারণ দু'জনে দু'জনের সঙ্গে আছে। এর বাইরে সব অতিরিক্ত। বাড়তি। মন খারাপ হওয়া, মন ক্ষুণ্ণ হওয়া, সব আছে। সব বাস্তব। তবে তাদের বেশি প্রশ্রয় দিলে সংসারে আগাছাই বাড়ে। কোনটা আগাছা আর কোনটা সত্যিকারের মূল, সেটা যদি বুঝে নিই, তবে আগাছায় জল না ঢেলে মূলেই জলটা দেওয়া যায়। 

    সম্পর্কে, জীবনে কোনটা মুখ্য আর কোনটা গৌণ এ বোধটা খুব পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার। তবে আর আগাছায় সম্পর্ক ঢাকে না। একের অন্যের প্রতি আস্থা, সহযোগিতার বোধটাই বাড়ে। জীবন আর সম্পর্ক বাহুল্যবর্জিত হতে থাকে। চলাটা সহজ হয়ে আসে। ক্রমশ বোঝা যায়, জীবন মানে আর কিছু না - সম্পর্কের জাল। জীবন মানেই সম্পর্ক। সে যত সহজ, সব তত সহজ। প্রথম সম্পর্কটা নিজের কল্পনার 'আমি'র সঙ্গে নিজের বাস্তবের 'আমি'র। তাদের মধ্যে দূরত্ব যত কমে বাকি সম্পর্কের মধ্যেও জটিলতা তত কমে।

209
Tue, 08/03/2021 - 11:18

রামমোহন রায়কে নিয়ে স্টেটসম্যানে রবিবার (01/08) এবং সোমবার (02/08) -- এই দু'দিন ধরে ভালো একটা আর্টিকেল বেরোলো। 

    ভারতের ঈশ্বর চেতনা নিয়ে আলোচনা নেই সেখানে। থাকার কথাও নয়। তবে লেখকের ঈঙ্গিতটা বেশ স্পষ্ট। উপনিষদকে কেন এতটা গুরুত্ব দিলেন রামমোহন রায়। আমাদের সমাজে সেদিন যত কুসংস্কার ছিল, সেসব যে সে উপনিষদজাত নয় তাও দেখিয়েছিলেন। 

    কথাটা অবশ্যই সম্পূর্ণ সত্য নয়। কোনো সৃষ্টিই সমাজের অভ্যাসের আর বোধের সীমাকে ছাপিয়ে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে পারে না। তাই উপনিষদেও এমন কিছু কথা নিশ্চয়ই আছে যা উদার মানবিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটাকেই সব ধরে বসে থাকলে সমস্যা। 

    উপনিষদের চেতনা অবশ্যই মানব মনের বিকাশের এক উচ্চতম শৃঙ্গ। নইলে শোপেনহাওয়ারের মত অমন তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন মানুষকে তা স্পর্শ করত না। আমাদের সভ্যতার নবজাগরণের উন্মেষও তো ঘটল উপনিষদের বোধের মাধ্যমেই। বলা যেতে পারে নব বেদান্তের যুগের যেন সূচনা হয়েছিল। 

    উপনিষদ ততটা সৃষ্টি রহস্য নিয়ে কথা বলে না, যতটা অস্তিত্বকে প্রশ্ন করে। উপনিষদে অনেক বিষয় আছে। আমি যে অংশটুকু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক তা হল - সৎ চিৎ আনন্দ বা 'সচ্চিদানন্দ' শব্দটিকে নিয়ে। 

    রামকৃষ্ণের ভাষায়, বেদে বলেছে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। পুরাণে বলেছে সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ। তন্ত্রে বলেছে সচ্চিদানন্দ শিব। এই সচ্চিদানন্দের ভুমা প্রকাশের সংকেত বেদ বলছে, ওঁ। 

    এই 'সচ্চিদানন্দ' কি তবে?

    প্রথম কথা - সৎ। এর প্রথম অর্থ - আছে। মানে হ্যাঁ। অস্তি। 

    আছে তো আমিও জানি। আমি আছি। জগৎ আছে। আমার সঙ্গে এই জগতের একটা ভৌত সম্পর্ক আছে। শুধু কি এইটুকু? আর কিছু নেই?

    আছে। আমার মন আছে। সে শরীরের থেকে আলাদা ব্যবহার করে। সে নিজের মত সুখ চায়। সে কার্যকারণে ডুবে নিজের অস্তিত্বের মূলকে জানতে চায়। কিন্তু পায় না। 

    উপনিষদ বলবেন, ওভাবে পাওয়া যায় না। তিনি তর্কের দ্বারা, মেধার দ্বারা, বাক্যের দ্বারা, মনের দ্বারা লব্ধ নন। তিনি যাকে বরণ করেন সে পায়।

    সে কিরকম? তার সাধন কি?

    উপনিষদ বলবেন, প্রথমে শোনো সমস্ত সংসার ঘিরে পরম এক অস্তিত্ব আছে। এ কথা বারবার শোনো। আর জানো যে সে অস্তিত্বের আভাস তোমার হৃদয়ে আছে। এ কথা বারবার ভাবো। আরো এগোও। সে অস্তিত্বের আনন্দে তোমার চিত্তের গভীরে সুখের মাণিক্য লুকিয়ে আছে। একে ধ্যান করো। 

    তবে কি দরজায় খিল দেব?

    না। এইখানে আমাদের মস্ত এক ভুল হয়। আমাদের অল্পভাসে মনে হয় ফোনের মধ্যে যেমন সিম ভরা থাকে, তেমন আমার মধ্যে এক আত্মা বলে কিছু ভরা আছে। এ ভুল ধারণা। 

    আমার আমি বোধের মধ্যে যে অনুকম্পা আছে, অনির্বচনীয়, অনির্দিষ্ট যে অনুকম্পার বোধ আছে- সেই সে। কি করে বোধের মধ্যে আসবে?

    একজন দুঃস্থ মানুষের মুখ কল্পনা করলে, বা রাস্তাঘাটে একজন অসহায় মানুষকে দেখলে যে যন্ত্রণা আমি অনুভব করি, সেই যন্ত্রণাই সে। কারণ সে আমার শরীরজাত নয়। আমার চিত্তের গভীরের কোনো ইঙ্গিতজাত। সে ইঙ্গিতের উৎস কেউ কোনোদিন জানতে পারে না। কিন্তু তার অস্তিত্ব অনুভব করে মানুষ। যেখানে যেখানে সে তাকে স্বীকার করে, সেখানে সেখানে সে সার্থক, সুখী, আনন্দময়; যেখানে যেখানে তাকে অস্বীকার করে মানুষ, সেখানে সেখানে সে ভীত, সন্ত্রস্ত, বিকারগ্রস্ত, দীন, অসুখী। শরীরের সুখের মাত্রা বাড়িয়ে চিত্তের সুখের বিকল্প খোঁজা মূর্খামি। তবে আর এত দীর্ঘ অভিব্যক্তির পথের দরকার হত না। 

    উপনিষদ মানুষের জীবনের সার্থকতা ঘোষণা করছেন একটি বাক্যে - যখন সমস্ত জগতকে নিজের মধ্যে ও সমস্ত জগতের মধ্যে নিজেকে অনুভব করা যায় তখনই সে মানুষের জ্ঞান পূর্ণতা পেয়েছে বলা যায়।

    এই মানুষের আত্মদর্শন। আত্মদর্শন মানে টিভিতে যেভাবে দেখায় সেরকম নিজের মধ্যে ষাট ওয়াটে জ্বলা কোনো দিব্য এল.ই.ডি. বালবের দর্শন না। সহস্র ওয়াটে জ্বলা পাশের মানুষটাকে অনুভব করার ক্ষমতা। এ ক্ষমতাকে এত বিস্তৃতভাবে সেদিন দেখতে চাওয়া হয়েছিল বলেই মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে শুরু করে বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, নদ-নদী, সমুদ্র, আকাশ-বাতাস - সবার কথাই বলা হয়েছিল। যখন বলা হল এ দেহ পঞ্চভূতে গড়া, তখন 'কি বলা হল' থেকে যদি ভাবি 'কি বলতে চাওয়া হল' তবে তার অর্থ আরো স্পষ্ট হয়। উপনিষদ বলতে চেয়েছিলেন যে আমাদের যাবতীয় যা কিছু এই জগত থেকেই আহরিত। নিজেকে পৃথক অস্তিত্ব ভেবে যেন ভ্রমে না পড়ি। পঞ্চভূতে গড়া এ অস্তিত্ব চেতনার সমুদ্রে ক্ষণকালের জন্য। উপমা দেওয়া হচ্ছে, যেন সমুদ্রের তলায় রাখা এক পাত্র। যার মধ্যে জল, বাইরে জল। তবু এক আকারগত অস্তিত্ব।

    এই 'চিৎ' বা 'চিদ্' মানে বলতে তবে বুঝি জ্ঞান, বা জানা। ততটা জানা নয়, যতটা জানার ক্ষমতা। আমাদের মধ্যে এ জগতকে জানার ক্ষমতা দেওয়া আছে। নইলে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রকে জানতাম কি করে? এরকম হাজার একটা জটিল সূত্রকে জানি কি করে? ওই চিৎ বা চিদ তত্ত্বের জন্য। অর্থাৎ, আমাদের জানার ক্ষমতা আছে। সে অসীম নয়। তাকে সামনের দিকে ছুটিয়ে আমরা যা পাই তাই জাগতিক নানা রহস্যের সমাধান। আবার সেই জানার ক্ষমতাকেই তার উৎসের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে আমরা করি প্রজ্ঞার অনুসন্ধান। যা মানুষ কোনোদিন পায় না। কিন্তু বোধের মধ্যে এক গভীর অনাদি বোধের অস্তিত্বের আভাস পায়। যাকে সে সার্বজনীন বলে অনুভব করে। তাই সারাজগতে 'মানবধর্ম' বলে এক ধর্মকে আধুনিক মন আবিষ্কার করে ফেলেছে। যার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের নানা অধিকারগত আইন। বন, জল, মাটি, বায়ু, প্রাণী ইত্যাদি যা কিছুকে আমরা সংরক্ষণ করতে চাইছি সে আমাদের লাভের জন্য না। এগুলো কোনোভাবেই আমাদের ইনভেস্টমেন্ট নয়। এগুলো আমাদের ঔচিত্যবোধ। 

    আর রইল আনন্দের কথা। যত পুরাণ বা ঈশ্বরের নানা গল্প, উপকথা ইত্যাদি, তার উৎস এই আনন্দ। এমন এক আনন্দ যা আমার দেহনির্ভর নয়। সে আমার চেতনায় আমার বোধে সজীব। সেই আনন্দ। যে আনন্দকে ভেঙে আবার বলা যায়, আমাদের মধ্যে এক চিত্তগত সুখ পাওয়ার ক্ষমতা আছে। আমরা শিল্পে, বিজ্ঞানে, নানা আবিষ্কারে, নানা সৃষ্টিতে সুখ পাই। আমরা নানা আইডিয়া, নানা কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে, এক বিমূর্ত অস্তিত্বে সুখ পাই। আমাদের মধ্যে সে ক্ষমতা আছে। অন্যকে আঘাত করলে সে আঘাতে সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। আমাদের চেতনা স্বার্থে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়। আমাদের আনন্দ সরে গিয়ে আসে লোভ, উন্মাদনা। পৃথিবীর যত সাহিত্য আছে, সব সাহিত্যেই তাই বীর যারা তারা সর্বাঙ্গীণ অস্তিত্বকে রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে চেয়েছে বলেই তারা বীর। সেদিনের 'দন কিহোতে' থেকে আজকের 'বাহুবলী' অবধি, প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সব সাহিত্যে বীরেদের কাজ একটাই। এর অন্যথাকে আমরা দুর্বলতা বলি। 

    এইভাবে সত্যে, চেতনায় আর আনন্দে মহত্বকে অনুভব করার ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ পরম সত্তাকে নাম দিয়েছে - অনন্ত। অনন্ত মানে যার শুরু আর শেষ নেই নয়, অনন্ত মানে যার মধ্যে অনন্ত শুরু আর শেষ। তবু কিছু যা বাকি থাকার তাই থেকে যায়, এবং তা হল সবটাই। ভর ও শক্তি যেমন নিত্য। এও তেমন নিত্য। আবার প্রতি মুহূর্তে কালের খণ্ডে খণ্ডিত। যেমন যে ছাত্র ইতিহাস ক্লাসে বাবরের জীবনী পড়ছে, সেই ছাত্র যখন জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানুষের বিবর্তন পড়ছে তখন বাবর বা আকবরকে আলাদা করে খুঁজে পাচ্ছে না; আবার যেমন যে ছাত্র ভুগোল পড়ছে সেই যখন রসায়ন বা পদার্থবিদ্যা পড়ছে তখন আলাদা করে দেশের সীমা-পরিসীমা খুঁজে পাচ্ছে না; আবার যে ছাত্র সাহিত্যে নানা চরিত্রের কথা পড়ছে, সেই যখন মনোবিজ্ঞান পড়ছে তখন সে আর আলাদা করে কোনো চরিত্রর নাম খুঁজে পাচ্ছে না। এও তেমন। মাটির মধ্যে পুতুল হওয়ার ক্ষমতা আছে বলেই সে আমার ইচ্ছায় সাড়া দেয়। এই হল মূলতত্ত্ব।

210
Sat, 07/31/2021 - 13:09

ইন্টেলেকচুয়াল অ্যারিস্ট্রোকেসি আর সোশ্যাল অ্যারিস্ট্রোকেসি - দুই-ই যত গর্জায় তত বর্ষায় না। সত্যজিৎবাবু হয় তো হাঁপিয়ে উঠেই 'আগন্তুক' সিনেমার স্ক্রিপ্টটা লিখে ফেলেছিলেন। সিনেমা মানে তো আদতে স্ক্রিপ্ট। স্ক্রিপ্টটাই তো ভাবনা। সেই ভাবনাটা নিশ্চয়ই কোনো এক যন্ত্রণা থেকেই উঠে এসেছিল। নইলে শেষ দুটো সিনেমায়, 'শাখা-প্রশাখা' আর 'আগন্তুক'-এ এমন দুটো চরিত্রকে দাঁড় করাতে চাইলেন কেন? যেখানে একজনকে বাইরে থেকে দেখলে মানসিক ভারসাম্যহীন আর একজন মনেপ্রাণে জংলী হতে চেয়েও না হতে পারার আক্ষেপ বুকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়। কেন? 

    শাখা-প্রশাখা’র চরিত্র খাবার টেবিলে উন্মাদের মত আচরণ করে। কেন করে? কখন করে? যখন তার প্রতিষ্ঠিত দাদারা একে অন্যের দিকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি শুরু করল, তখন। কিভাবে প্রতিবাদ শুরু করল? বিনা ভাষায়। আদিম আচরণে। কি সুক্ষ্মভাবে সত্যজিৎ ভাষাকে ত্যাগ করলেন সত্যকে সামনে আনার জন্য! ভাষা মনের ভাব প্রকাশের উপাদান না এখন, ভাষা চাতুরীর উপাদান। সক্রেটিসের ভাষায় আমরা সফিজ্‌ম-এর জন্ম দিয়েছি। মনের ভাবকে গোপন করে বাক চাতুরীতে সত্যকে ঢাকার জন্য। শঙ্করাচার্যও বুঝেছিলেন। তাই বলেছিলেন, শব্দজাল মহারণ্যং - শব্দজাল মহা অরণ্যের তুল্য। পথ হারাবে। শাখা-প্রশাখা’র সেই চরিত্র পথ হারায়নি। মানুষের জীবনে দুটো সত্য হয়, বস্তুগত আর মানবিক। সত্য আর ঋত। সে চরিত্র কোনো সত্যই হারালো না। সে ভাষাহীন অস্তিত্বে শুধু সুরের মধ্যে জীবনের প্রাণকেন্দ্র খুঁজে যাচ্ছে। অথচ সে-ই ছিল সব চাইতে প্রমিসিং। কিসের জন্য? অ্যারিস্ট্রোকেসির মোড়কে মোড়া আরেকটি কৃত্রিম জীবন হওয়ার জন্য। সে হল না। জীবন তাকে নিজেকে নগ্ন করে দেখার সুযোগ দিল। সেই ছেলে, প্রশান্ত, শেষ দৃশ্যে যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো, বাবার প্রতি উদ্বেগ, ভালোবাসা আর যন্ত্রণায় ভরা মুখ - সে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে ডাকল - বাবা! বুকে এসে বেঁধার মত সে ডাক। সে ডাক আদিম মানবিক জগত থেকে ভেসে আসা মৃতপ্রায় এক মানুষের কাছে শান্তির ডাক। তাই বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে বলছেন, তুই আমার শান্তি রে প্রশান্ত। সত্যজিৎ ব্যবহার করছেন এক রাগ, কণ্ঠসঙ্গীতে। বাবা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে উপনিষদের শান্তিপাঠের মত উচ্চারণ করছেন - শান্তি, শান্তি, শান্তি... 

    মানুষের সব সত্য মানবিক সত্য। কে এই প্রশান্ত? একি আধুনিক যন্ত্রদাস, অ্যারিস্ট্রোকেট সভ্যতার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়া রবীন্দ্রনাথের নাটকের ঠাকুর্দা? নাকি ফকির? কে এই প্রশান্ত, যে বিনা ভাষায় নিজের অস্তিত্বে গর্জে ওঠে - তোরা সব কাজের মানুষ! 

    কিসের কাজ? স্বার্থপরতা, আত্মপরতার কাজ। আমাদের বিত্ত নিজের জন্য, আমাদের বিদ্যা অন্যকে ঘায়েল করে নিজেকে জেতানোর জন্য, আমাদের সাধনা নিজের বায়বীয় মূর্তি বানিয়ে সংসারে চিরকালের জন্য প্রতিষ্ঠার লোভে। 

    বাইরে থেকে দেখতে অমন সাহেবী মানুষটার প্রাণে তবে কি যন্ত্রণা জন্ম দিয়েছিল প্রশান্তকে? একি শুধু আর্ট? শুধু সিনেমা? না। তার থেকে অনেক বেশি। এই আদিম দর্শন। মানুষকে মানুষের কাছে ফিরে আসতে বলার দর্শন সহজ বেশে। সমস্ত আভিজাত্য, পাণ্ডিত্যের অভিমান ত্যেজে।


    এবারে ছুটদাদুর কথা। ছুটদাদু জংলী হতে না পারার আক্ষেপ নিয়ে বাঁচেন। তিনি সভ্যতাকে প্রশ্ন করেন। উত্তর পান না। তর্কে জিতেও সুখ পান না। বাদ বিতন্ডা। বাদ হল সত্যের অন্বেষণ আর বিতন্ডা হল আত্মপ্রতিষ্ঠার লোভ। ছুটদাদু সত্যকে সামনে আনতে চান। নিজেকে না। সারা বিশ্ব ঘুরতে ঘুরতে, আদিবাসীদের সঙ্গে থাকতে থাকতে নিজের আভিজাত্যপূর্ণ অহং নিঃশেষপ্রায়। জীবনটাকে আদিম প্রাণের আয়নায় দেখেন। আদিম বলতেই যদি হিংসা, লোভ, অসভ্যতা বুঝি - সে ভুল। ছুটদাদু ধাক্কা দিয়ে বলেন। সে ধাক্কা আভিজাত্যপূর্ণ অহং সহ্য করতে পারে না। সে অহং কৃত্রিম সভ্যতার মুখোশ খুলে বর্বর হয়ে আক্রমণ করে। সন্ত কবীর বলেন, মানুষের সব চাইতে ধারালো অস্ত্র জিহ্বা। সেই জিহ্বার অস্ত্রে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে সেই উন্মুক্তমনা জাগ্রত মানুষটাকে। একজন আভিজাত্যপূর্ণ অহং হার স্বীকার করতে পারে না। আর ছুটদাদু মেনে নিতে পারেন না নিজের জিতকেও। তিনি তো জিততে আসেননি, এসেছিলেন নাড়ির টানে। ভালোবাসা খুঁজতে। সে ভালোবাসায় এত জটিলতা জমেছে বুঝবেন কি করে? তাই যাওয়ার আগে পরামর্শ দিয়ে যান, কি হবে না দাদুভাই? কূপমণ্ডূক। 


    আরেক গল্প। রামকৃষ্ণদেব দেখা করতে এসেছেন দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে। দেবেন্দ্রনাথ ভালো ব্যবহার করেননি। রবীন্দ্রনাথ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতেও লিখেছেন সে কথা। তার জন্য রবীন্দ্রনাথ বলছেন তাঁর বাবার ধর্মবিশ্বাসে আর চরিত্রে একটা আভিজাত্যবোধ ছিল। তিনি বৈষ্ণব-শাক্তদের ধর্মীয় উচ্ছ্বাসে ঠিক সাড়া পেতেন না। 

    হয় তো বা। তাই। কিন্তু সেই রামকৃষ্ণ আভিজাত্যের মোড়ক থেকে বাঁচলেন কই? আজ রামকৃষ্ণ স্টেটাস সিম্বল। নানা মহারাজের দীক্ষিত হওয়া, তাদের ছবি টাঙিয়ে শেয়ার করে নিজেকে রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষিত প্রমাণ করা স্টেটাস সিম্বল। তার মানে কি সত্যিই তারা কামকাঞ্চন ত্যাগী হতে পেরেছেন? রামকৃষ্ণদেবের মূল শিক্ষা ছিল ঈশ্বরের ভালোবাসায় অন্তর থেকে সমস্ত আসক্তি ত্যাগ করে সরল সহজ জীবনযাপনের। সে ভীষণ কঠিন কথা। তাই সে আদর্শ থেকে সরে এসে রামকৃষ্ণদেবকে ঘিরে যে অ্যারিস্ট্রোকেসি, আজকে সেই জোয়ারে গা ভাসানো অনেক সোজা। 

    সত্যজিৎ রায়ের যে ইমেজ আমাদের তৈরি হচ্ছে আজকে, সেও সেই শাঁস ছেড়ে আঁশ নিয়ে মাতামাতি। সমস্ত কিছুর গভীরে যে প্রাণের স্পন্দন থাকে, তার রূপ হল দর্শন। মানুষের ইতরতম কাজেও থাকে ইতর দর্শনের প্রভাব। বিপরীতে থাকে উচ্চ দর্শনের প্রভাব। 

    কিছু উদ্ভিদ আছে যারা নিজেদের পাচকরসে জারিয়ে প্রাণীদের নিস্তেজ নিস্প্রাণ করে তোলে। অথবা মিউজিয়ামে রাখা নিষ্প্রাণ অবয়বগুলোর কথাও ভাবতে পারা যায়। রামকৃষ্ণ আমাদের আধুনিক সমাজে ইতিমধ্যে তা হয়ে গেছেন। এবার সত্যজিতের পালা। মাঝখানে শুরু হয়েছিল বাউল নিয়ে এই খেলা। এখন সে হুজুগ কিছুটা হলেও কমেছে। আভিজাত্যবোধ ছেড়ে মাটিতে না নেমে দাঁড়ালে গতি নেই। "দুঃখ কিসে যায়? প্রাসাদেতে বন্দী রওয়া বড় দায় / একবার ত্যাজিয়া সোনার গদি রাজা মাঠে নেমে যদি হাওয়া খায়! / তবে রাজা শান্তি পায়"

    সত্যজিৎ সাহেবিয়ানার মোড়কে এক অদ্ভুত সংবেদনশীল মানুষ একজন। তার মনের মধ্যেও এক বাউল, এক ঘরছাড়া আছে বলেই তিনি "কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়" গাওয়া বাউলকে খুঁজে পান। আমাদের সস্তার আদেখলাপনা আভিজাত্যের মোড়কে যেন সত্যজিৎকে সেই বাউলের থেকে দূরে না ফেলি।

211
Sat, 07/24/2021 - 11:17

ভারত অর্থনীতিতে উন্নতি লাভ করছে শুধু না, ভারতীয়ের প্রতি যে আগে দুর্নাম ছিল, এরা বড্ড পরকালমুখী চিন্তাভাবনা করে দিন কাটাতে ভালোবাসে, একদম ইহকালের ভোগসুখ নিয়ে, জাগতিক উন্নতি নিয়ে ভাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি, সে কলঙ্ক ঘুচেছে। 

    কি করে? দেখুন আমি ওইসব অর্থনীতির গভীর বিশ্লেষণ ইত্যাদির দিকে যাব না। আমি আমাদের বর্তমান অধ্যাত্ম সম্পদের দিকে তাকাতে বলব। আহা, দাঁড়ান, অধ্যাত্ম সম্পদ শুনেই শাস্ত্র খুলে মাথা চটকাবেন না, সে সব অনেক হয়েছে। আমি বলতে চাইছি বর্তমান যুগের গুরুকূলের দিকে তাকান। আজ দেখি বিশাল দামী একটা বাইক চড়ে সদগুরু, কালো চশমা চোখে লাগিয়ে, সাদা দাড়ি হাওয়ায় উড়িয়ে কি চমৎকার ভেসে চলে গেলেন। মুগ্ধ হলাম। যে মানুষ জীবন্মুক্ত, তার কাছে বাইকই বা কি আর হেঁটে যাওয়াই বা কি। 

    এরপর দেখুন অন্যান্য গুরুদের, তাদেরও মঠ-মিশন, বৈভব কেমন ছড়িয়ে পড়ছে। এ উন্নতির লক্ষণ না? আজকাল যতই 'কামিনী-কাঞ্চন' ত্যাগের শিক্ষা দেওয়া হোক না কেন, তা এসি ঘরে হাত-পা ছড়িয়ে না বসলে হয়? হয় না। যত যত গুরু দেখবেন এখন অধ্যাত্ম সম্পদ ঝরে ঝরে পড়ছেন দেখতে পাবেন। আগে অধ্যাত্ম সম্পদ বলতে ওই কি সব বিবেক-বৈরাগ্য হাবিজাবি বোঝাতো। রামকৃষ্ণদেব, মহাপ্রভু, শিরডীর সাঁই, রমণ মহর্ষি - কি অদ্ভুত সেকেলে চিন্তাধারার মানুষ! কেউ টাকা দিতে গেলে বাঁশ নিয়ে তাড়া করে, কেউ রাজা দেখা করতে চাইলে সটান না বলে দেয়, কেউ মারা যাওয়ার আগে দশ-কুড়ি টাকাও জমিয়ে যেতে পারে না। কি বোকামি মাগো! বলি হ্যাঁ গা, ঈশ্বরচিন্তা করবে বলে একটুখানি বিষয়বুদ্ধি থাকবে না? তা তাদের শিষ্যেরা সে ভুল শুধরে নিয়েছে। দেখুন আজ ওইসব বিবেক-বৈরাগ্য শুকনো কথায় চিঁড়ে ভেজে না। চারদিকে বৈভব ঝরে ঝরে পড়ছে। ঈশ্বরচিন্তা করে করে আগে মানুষ কেমন শুকিয়ে যেত, মায় লোকনাথ বাবাকেই দেখুন। এখন কেমন সব চকচকে গুরু, চকচকে শিষ্য, দেখলেও চোখ জুড়িয়ে যায়। তা বাপু যিনি জগৎ সংসারের মালিক, তাঁকে নিয়ে রাতদিন ভাবনাচিন্তা করলে তিনি কি তাঁর সম্পদ থেকে ভক্তকে বঞ্চিত করবেন? কেউ মন্ত্রী হল, আর তার ছেলেমেয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি যাবে? এটা কোনো কাজের কথা হল? তবে? অধ্যাত্ম সম্পদ জমবে না? সেকি শুধুই লোকচক্ষুর অন্তরালে বায়বীয় হয়ে থাকবে? না। সেদিন আর নেই। 

    অবিশ্যি দেখুন ভক্তের চাহিদাও তো বদলেছে। আগে বেশিরভাগ ভক্তেরা কি খুঁজতে গুরুর কাছে যেত? নানা তত্ত্বের অন্বেষণে। যেমন ঈশ্বর আছেন কি নেই? তিনি সাকার না নিরাকার? তাঁকে ভক্তিতে পাওয়া যায় না জ্ঞানে? যোগাভ্যাস করতে হলে কি কি নিয়ম মেনে চলতে হবে? এই সব নানা হাবিজাবি তত্ত্ব। আর গুরুরাও তেমন ছিলেন, আপনি কথামৃত, কি Talks With Ramana Maharshi, কি চৈতন্যচরিতামৃত খুলুন, পাতায় পাতায় এইসব হাবিজাবি বায়বীয় কথায় ভর্তি। আসলে হবে নাই বা কেন? সেকালে না জেনেটিক্স, না কসমোলজি, না স্ট্রিং থিওরি, না কোয়ান্টাম ফিজিক্স, না বেশ চলনসই অর্থনীতি ইত্যাদি ছিল। তাছাড়া ওটিটি, কেবল্ চ্যানেল, স্মার্টফোন ইত্যাদির কথা তো বাদই দিন। আজকাল মানুষ জেনে জেনে পাগল, তথ্যের ভারে এক একজন ভিসুভিয়াস হয়ে আছে, যখন তখন যেখানে সেখানে ফেটে পড়ছে। 'লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ' হয়ে যাচ্ছে। তবে এখনের জন্য দরকার কি? প্রেসার, সুগার, থাইরয়েড কমানো। তার জন্য কি দরকার? শান্তি। কিরকম শান্তি? না গুরুদত্ত শান্তি। কেন গুরুদত্ত শান্তি? যাতে কিনা আমাদের নিত্য সংসারের বাইরের এই গুরুমুখী সোর্সটাকে কেউ আটকাতে না পারে। একটা সার্টেনিটি আছে। 

    তবে শান্তি কি বললেই পাওয়া যাবে? না। সে আজকাল মহার্ঘ্য বস্তু। আপনাকে তার জন্য সিট বুক করতে হবে। যত গুরুর কাছে বসতে চান তত দামী প্যাকেজ। এ অবশ্য সব জায়গায় নয়। তবে এই গুরুর পপুলারিটিতে আমাদের বাংলা এখন অনেক পিছিয়ে। তেমন পপুলার ফেস নেই কেউ। আসলে এনাদের সমস্যা হচ্ছে এরা না প্রাচীন ত্যাগের বৈভবে ভূষিত, না অত্যাধুনিক শ্রোতাদের চাহিদা অনুযায়ী বাগ্মিতায়। ইস্কনের গৌর গোপাল দাসের ইউটিউব যতবার হিট হয় তা খুব কম মোটিভেটারেরই হয় এখন। স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দ বেদান্তের চর্চাকে কিছুটা জনতার কাছাকাছি নিয়ে আসার চেষ্টায় আছেন যদিও। তবে সে বড্ড এলিট ক্লাসের জন্য, খুবই বৌদ্ধিক ব্যাপার স্যাপার। ফলে আধুনিক গুরুদের প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে। 

    এ সব বাদ দিলে উত্তর ভারতের বেশ কিছুটা অংশে কথকের ভূমিকায় আবার অনেকেই ভীষণ জনপ্রিয়। মুরারিবাপু তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তবে সেখানেও আমাদের বাংলায় তেমন কল্কে কেউ পান না। আমাদের কথক ঠাকুরেরাও আজকাল আসর জমাতে অক্ষম। 

    তবে কি বাংলা যুক্তিবাদী হয়ে পড়েছে ভীষণ? উঁহু, সে গুড়ে বালি। বাংলা না হয়েছে যুক্তিবাদী, না জড়বাদী, না ভাববাদী। বাংলার এখন মতিগতি যে কোন দিকে তা বোঝা ভার। রাজনীতি ভারতে কোথায় আর নেই, কিন্তু তার পাশাপাশি আরো কিছু আছে। আমাদের ওটিটি, লেখালেখি, গান থেকে কবিতা খুব একটা সুদিনের রাস্তায় হাঁটছে না। 

    যে কথায় ছিলাম, আমাদের ভক্তকূল এখন যা নিয়ে আকুল তা হল চিত্তের শান্তি। তা নিয়েও একটা কথা বলা যায়। দেখুন আগে ছিল এই নশ্বর জগৎ, তার নানা অশান্তি। এখন হয়েছে এই নশ্বর জগতের মধ্যে আরেক নশ্বর চঞ্চল জগৎ, এই সোশ্যাল মিডিয়া। মানুষ যায় কোথায়? আগে শুধু জগতের মায়া কাটাতে পারলেই মোক্ষ করতলাগত। এখন আগে এই সোশ্যাল মিডিয়া নামক উপজগতের মায়া কাটাও। তারপর আসল জগতে কিছুদিন নিজেকে খাপ খাইয়ে নাও। তারপর মোক্ষ হলেও হতে পারে। কিন্তু সে হওয়ার নয়। জগতিক মোহ তবু ছাড়লেও ছাড়া যায়, উপজাগতিক মোহ ছাড়াবার উপায় না আগমে না নিগমে লিখেছে। মায় অত অত অধ্যাত্ম বলে বলশালীরা পর্যন্ত এই মায়ায় হাবুডুবু খাচ্ছে গা? তা আমাদের মত মানুষদের আর কি গতি?

    এখন তাই অলিতে-গলিতে, আকাশে-বাতাসে কান পাতলেই শুনতে পাবেন শান্তির খোঁজ। কোন গুরুর কোন প্যাকেজে কতদিনের শান্তি, সেই খোঁজ চলছে। আর ওদিকে অধ্যাত্ম সম্পদ জমেই যাচ্ছে, জমেই যাচ্ছে, জমেই যাচ্ছে... লোকের নজর যাতে না লাগে তার জন্য আবার হরেকরকম জনহিতকর কাজও করা হচ্ছে, ওই চোখের পাশে মায়েরা যেমন কাজলের টিপ পরিয়ে দেন তেমন আর কি।

    তবে এত এত এত প্রাণায়াম করে শান্তি কি পাওয়া যাচ্ছে? উঁহু, খানিক বিরতি, আবার সেই এক। তবে উপায়? হে হে, উপায় কিস্যু নাই। আপনি যতই গুরু খুঁজুন, সাধ্যসাধনায় ঝাঁপ দেন। নিরামিষ খান। প্রাণায়াম করুন। জপ করুন। তীর্থে যান। সব পাবেন, কিন্তু সব হারাবেন। কেন বলেন তো? পাত্র তৈরি হয় নাই যে! পাত্র কি? পাত্র হল চিত্ত। সে চিত্তে শান্তি জল দাঁড়ায় না কেন? দক্ষিণেশ্বরের খুড়ো বললেন, ওরে ও 'আমি' ঢিবিকে নামা, নীচু কর। তবে শান্তিবারি দাঁড়াবে। এখন তাকে নামাই কি করে? ভায়া, উঠল কি করে? কোন গ্যাসবেলুনে ফোলাইসো তারে? সেটায় ছ্যাঁদা করো আপনি নামবে। হুস হুস করে নামবে। যত নামবে তত প্রাণে শীতল বাতাস লাগবে। শেষে বুকের মধ্যে তাকিয়ে বলবে, হঃ... মশায় আপনি এইখানে… আপনার লগে কই কই দ্যাশ না ঘুরে বেড়ালুম কত্তা….'সব নিয়ে শেষ ধরা দিলে গভীর সর্বনাশে'.... এই সর্বনাশটুকু না হতে দিলে যে শান্তি নেই বন্ধু….. বীজ মরলেই যে না গাছ!….

212
Fri, 07/16/2021 - 17:40


গীতায় বলা হল হৃদয়ের দুর্বলতা ছেড়ে দাঁড়াও। আবার বলা হল হৃদয়ের মধ্যেই ঈশ্বরের অবস্থান। প্রথম কথাটা ব্যাসদেব প্রথমেই বললেন কৃষ্ণের বয়ানে। দ্বিতীয়টা একদম শেষে, সেও কৃষ্ণের বয়ানে।


    এখন কথা হল একই হৃদয় দুর্বল আবার ঈশ্বরের অবস্থানে সবল হয় কি করে? তবে কি আমাদের দুটো করে হৃদয় আছে?

    মনোবিজ্ঞানী বলবেন, আছে। একটা 'False Ego', আরেকটা 'True Ego'। একখানা 'কাঁচা আমি', একখানা 'পাকা আমি'। একখানা 'ছোটো আমি'। একখানা 'বড় আমি'।

    এদ্দূর এসে জট পাকালো, তা দুটো আমির দরকার কি ছিল বাপু? একটা থাকলেই বা ক্ষতি কি ছিল? পশুপাখির তো এই সংকট নেই। যেমন ধরা যাক একটা গরুর কথা, যার নাম হল গিয়ে পটলা। এইবার তার ইচ্ছা হল কচি কচি ঘাস খাবে। কিন্তু আয়রনি হল সেই ঘাস জন্মেছে যার বাড়ির উঠানে সে বাড়ি তার মালিকের শত্রুপক্ষের। তার মনে কি আদৌ সঙ্কোচ হবে? হবে না।

    আর একটা উদাহরণ ধরা যাক। পটলা নামক গরুটার, পেটে গোলমাল হয়েছে। এখন এদিকে মন টানছে কচি কচি ঘাসে মুখ ডুবিয়ে খায়। তার মধ্যে কি কোনো দ্বন্দ্ব আসবে? বা ভবিষ্যতে আরো পেট খারাপ হবে এমন আশঙ্কা করে সেকি পিছিয়ে আসবে? আসবে না।

    কিন্তু এইবার ধরা যাক সেই পটলা নামক জীবটি অভিব্যক্তির নানা ধারা বেয়ে হল মানুষ। এইবার মানুষ হলে তার নানা সঙ্কট। নীতির সংকট, ধর্মের সংকট, বিবেকের সংকট। পৃথিবী জুড়ে এত এত মানুষের যে ইতিহাস লেখা হল, সে আদপে এই সংকটেরই তো গল্প। কে কোথায় কতটা অমানবিক হয়েছে, কে কোথায় কতটা মানবিক হয়েছে। এখানে 'মানবিক' শব্দটা আমি সদর্থে considerate মানুষের স্বভাবের কথা মাথায় রেখে বলছি।

    মানে মানুষের এই যে ঝামেলা, এটা আছে, আর এটা করা উচিৎ বা হওয়া উচিৎ, যাকে হিউম মহাশয় is/ought -এর দ্বন্দ্ব আখ্যা দিয়েছেন।

    বিষয়টা আরো তলিয়ে ভাবলে দেখুন আজকালের মনোবিজ্ঞান নানাভাবে দেখাচ্ছে যে মানুষ ফাঁকা সাদা ব্ল্যাকবোর্ড হয়ে জন্মায় না। তার মধ্যে আগে থেকেই থাকে জিন আর নিউরোনের গঠনের পূর্বশর্ত। তবেই হল। একজন সাইকোপ্যাথ যদি বলে আমার জেনুইনলি খুন করতে সাধ হয়েছিল ধর্মাবতার, মাইরি বলছি, কোনো মোটিভ ছিল না, আপনি বিশ্বাস করুন, এই যেমন আমার এখন সাধ হচ্ছে টুক্ করে গিয়ে আপনার গলার নলীটা কেটে দিয়ে, একটা টুলে বসে আপনার ছটফটিয়ে মরে যাওয়াটা দেখি একটা ডার্ক চকলেট চুষতে চুষতে।

    দেখুন, মনোবিজ্ঞানী বলবেন, ইয়ে মানে লোকটি সত্য কথাই বলেছে। তাই বলে কি তাকে সমাজে ছেড়ে দেওয়া হবে? হবে না। তার মত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাই কিনা? এরকম আমাদের অনেক খারাপ কাজের অনেক মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, যেখানে বোঝা যায় ঘটনাটা ঘটানো সম্পূর্ণ আমার ইচ্ছাধীন ছিল না। এটা হল হিউমের ভাষায় 'is', মানে বর্তমান, আর সমাজতত্ত্বের ভাষায়, 'fact'। কিন্তু গপ্পো কি আর এইখানেই শেষ দাদা? হিউম বলবেন, তবে 'is' এই সব ডামাডোলের হলেও, ওসব করা কি উচিৎ? এই এলো ওনার ভাষায় 'ought' বা ঔচিত্যবোধের সংকট। তখন সমাজ বিজ্ঞানী বলবেন, বটেই তো, যতই এইটা মনোবিজ্ঞানের fact হোক না কেন, এই স্বভাবের 'value' কি? দেখলেন, সেই হিউমের সংকটকেই সমাজবিদেরা নিজের ভাষায় কেমন 'fact/value' দ্বন্দ্ব করে নিয়েছে।

    এখন এই মূল্যবোধ, ঔচিত্যবোধের আলোচনা চলেছে বিশ্বজুড়ে। যা হোক কেউ না মেনে চললেও একটা হিউম্যান রাইটস্ বা মানবাধিকার তত্ত্ব গড়ে তোলা গেছে। অন্তত বড় অংশে একটা সিদ্ধান্তে আসা গেছে। যদিও সে নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও আমাদের অজানা। মুশকিল হল গিয়ে কগনিটিভ সায়েন্স যত এগিয়ে যাচ্ছে, তত আমাদের আধুনিক যুগের অনেক তত্ত্ব খালাস হয়ে যাচ্ছে। আবার নতুন করে ভাবাচ্ছে সব।

    তবে কি ধর্মের একটা দিক মানুষের এই is/ought -এর দ্বন্দ্বের সমাধান একটা প্যারালাল ওয়ার্ল্ড বানিয়ে করতে চেয়েছে। যেখানে ঈশ্বর একজন সম্পূর্ণ ঔচিত্যবোধের পরাকাষ্ঠার মানবিক বা ধারণার রূপ। আর is বা যা আছে সে হল আমাদের এই দোষেগুণে ভরা জগত সংসারের রূপ। এই কি তবে মোদ্দা দর্শন? আমি ধর্মের থিওলজিকাল দিকটা বলছি। সমাজে তার কুফল বা সুফল নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না। মানুষের মনের, জ্ঞানের তথা বোধের যে ক্রমবিকাশ ঘটে চলেছে আমি সেই ক্রমবিকাশের একটা অংশকে প্রশ্ন করতে চাইছি। আমি এও বলতে চাইছি না যে সেই সমান্তরাল বা প্যারালাল জগতের তত্ত্বটা বা থিওলজিগুলো সম্পূর্ণ নির্ভুল। আমি তাদের চেষ্টার বৈশিষ্ট্য বলতে চাইছি।

    মানুষের এই সংকট অনন্তকাল ধরে চলবে। আজকে বিজ্ঞান যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা কর‍তে চাইছে তার সব ফল নিশ্চয়ই মঙ্গলজনক হবে না। আমাদের সময়েও তাই এই is/ought -এর দ্বন্দ্বে আমাদের মত করেই উত্তর খুঁজতে হবে। is -টা সব সময়েই অবজেক্টিভ। ought -টা সব সময়েই সাব্জেক্টিভ। তাই নানা মত জন্মাবেই। এর মধ্যে থেকে "সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো" তাকে খুঁজে পেতেও হবে। সেই চেষ্টাটা চালিয়ে যাওয়াই তো মানবিক সাধনা।

    যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। একই হৃদয় কি করে দুর্বল আবার সবল হয়? গীতায় ব্যাসদেব বলছেন, মোহ থেকে। মোহ মানেই মিথ্যাকে সত্য বলে জানা। fact আর value -র দ্বন্দ্বও সেই। fact, information এর সুনামি যেন আমাদের মোহগ্রস্ত করে না তোলে। আমাদের অবশেষে দরকার নির্মোহ হয়ে মঙ্গলের রাস্তাটা একসঙ্গে খোঁজার। এবং তা অবশ্যই শুভবুদ্ধির আলোতে। শুভবুদ্ধি মানেই হল গিয়ে সেই পাকা আমি বা বড় আমি।

213
Sat, 07/10/2021 - 19:30

এমন মানুষের সামনে তো আমাদের বসতেই হয় যে মানুষটা হয় তো আর কয়েক মাস পরে মারা যাবে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন। যে মানুষটা মারা যাবে সে অনেক সময় স্পষ্টভাবে জানে, অনেক সময় আন্দাজে জানে। বেশির ভাগ সময়েই সে তথ্যে জানে না, কিন্তু অনুভবে জানে, সে আর থাকবে না। আমি দেখা করতে গেছি, যেমন আপনারাও কখনও না কখনও দেখা করতে গেছেন, 'অন্য কথা' খোঁজার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। 'স্বাভাবিক আচরণ' করার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু কি কঠিন। যেন অলক্ষ্যে আমার অভিনয়ের পরীক্ষা হচ্ছে। নিখুঁত অভিনয় করতেই হবে। হাসিটা মুখের কোনায় থাকতেই হবে। 

    হাস্পাতালে এই সংকটটা নেই। কারণ সেখানে আসন্ন মৃত্যুর মঞ্চ বাঁধা। যে মানুষটাকে কেন্দ্র করে সব কিছু সে হয় জ্ঞানে নেই, না হয় বোধে নেই। যদি থাকেও বা, সেখানে কোনো কথা বলার অবকাশ নেই। কারণ সে খুব 'সিরিয়াস', আইসিইউ এর বাইরে তার নামের পাশে লেখা আছে, অবস্থা সংকটাপন্ন। 

    সংকট হয় সেই মানুষটা যখন হেঁটে চলে বেড়ায় সামনে। আপনার সামনে হয় তো চায়ের কাপটা এগিয়ে রাখল। একটু হেসে বলল, "পরের বছর পাব কিনা তো জানি না।" নিজেকে তখন অপরাধী লাগতে পারে, অস্বস্তি হতে পারে, কারণ আমার জীবনের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে তো কিছু বিপন্নতার আশঙ্কা নেই, মানে আমি অন্য তটে আপাতত। তখন এক লহমায় মিথ্যা কথা ছুঁড়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচাতে হয়, পরিস্থিতিকে সত্যের হাত থেকে রক্ষা করতে হয়, "আরে ধুর, এরকম রোগে আমার অমুক ভালো হয়ে চলে এলো, আজকাল কতরকম চিকিৎসা বেরিয়ে গেছে, আপনার/ তোমার কিচ্ছু হবে না দেখে নিন/নিও। আমার অমুকের তো তোমার/আপনার থেকে খারাপ অবস্থা ছিল".... ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি বলেই যাচ্ছি। থামতে ইচ্ছা করছে না। মনে হয় আরও কত জোর দিয়ে বললে মিথ্যাকে সত্যের মত শোনায়? আরো আবেগ দিয়ে বলব না আরো স্বাভাবিকভাবে বলব? নিজের কানেও বিশ্বাসযোগ্য লাগতে হবে তো। বারবার চোখের উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে হয়। সেও চোখ সরিয়ে নেবে। কারণ সেও জানে এই কথাগুলো আমরা দুজনেই শুনতে চাইছি, ভাবতে চাইছি, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছি না। শরীরের একের পর এক বদলক্ষণ বুঝিয়ে যাচ্ছে - প্রস্তুত হও। 

    হাস্পাতালের বাইরে এই 'প্রস্তুত থাকবেন' শোনা মানুষেরা বেঞ্চে, মেঝেতে শুয়ে বসে দিন কাটায়। পাশের মানুষের সঙ্গে গল্প করে। গল্প করতে করতে খেই হারিয়ে যায়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ডাক্তার এলে উদ্বিগ্ন চোখে দৌড়ে যায়। আবার এসে বসে। চরম সংকটে যাওয়া রোগীর বাড়ির লোকেদের ছোটাছুটি দেখে। তাদের প্রস্তুতির সময় শেষ হয়ে গেছে বুঝতে পারে। তাদের বাড়ির লোকের আছাড়িপাছাড়ি কান্নার দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নখ কাটে। চা খেতে ওঠে। বিড়ি বা সিগারেট ধরায়। তাকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। চেনা রাস্তাঘাট, লোকজন সব অচেনা লাগে। সবাই যেন সুতোর উপর ঝুলছে। একটু এপাশ ওপাশ হলেই ছবিটা বদলে যাবে। আবার এসে আগের জায়গায় বসে। ওদের বাড়ির লোক তাদের সংসারের দুয়ার পেরিয়ে যাওয়া মানুষটার সাদা চাদরে ঢাকা জীবনের পরম আশ্রয় শরীরটাকে নিয়ে ঘড়ঘড় করে চাকার আওয়াজ তোলা ট্রলিতে সাজিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে দেওয়ালের বাঁকে। আবার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকা। 

    খানিক বাদেই আবার চঞ্চলতা। নতুন রোগী এলো। অবস্থা ভালো নয়। কোথায় ওষুধের দোকান, কোথায় মেঝেতে শোয়ার প্লাস্টিক পাওয়া যাবে, কোথায় ভালো চা বানায়, কোন ডাক্তারের কথা খুব ভালো, কে খিটখিটে… এইসব আলোচনা শুরু হবে। একটু একটু করে পরিচয় হবে। তারপর হঠাৎ সব ফুরিয়ে যাবে। আর অপেক্ষা নেই। আর উদ্বেগ নেই। শুধু কয়েকটা নিয়ম। হাস্পাতাল থেকে বেরোনোর সময় অন্যদের আশঙ্কায় বাঁচা মানুষদের শুভাকাঙ্ক্ষা জানিয়ে যাওয়া। আবার একরাশ মিথ্যা বলা। ঈশ্বরের উপর আস্থা রাখা। যে ঈশ্বর অতিব্যবহারে, অপব্যবহারে ক্ষয়ে ক্ষয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছে। তারপর দিন যায়, আর কেউ কাউকে চিনি না। আবার নতুন অধ্যায় শুরু। আমরা আর কথা বলি না শেষ অধ্যায়ের দিনগুলো নিয়ে। 

    আর যারা শেষদিনের মানুষটার নিত্যসঙ্গী থাকে? তারাও প্রতিদিন অল্প অল্প করে মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে শিখে যায়। জানে একদিন ধরা পড়ে যাবে। তবু রাতদিন মিথ্যার পর মিথ্যা, আশার পর আশা জাগিয়ে ছোটোবেলার মত খেলার দুনিয়া বানিয়ে নিতে হয়। সেখানে সব মিছিমিছি। কিন্তু সব ভীষণ দরকারি। চলমান, ঘটমান জগতের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ নেই সেখানে। কারণ সেখানে একজন মানুষ অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যাচ্ছে। তার অল্প অল্প ফুরিয়ে যাওয়ার সাক্ষী থাকা মানুষেরাও, খুব কাছের মানুষেরা অল্প অল্প করে ফুরিয়ে যায়। প্রতিদিন মাথায়-বুকে জমা আবর্জনা দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠার আবর্জনা সরিয়ে রোজ আবার নতুন করে দাঁড়াতে শিখতে হয়। সে লড়াই একার লড়াই। মিথ্যাই তখন সঞ্জীবনী। তারপর একদিন সত্য উৎকট শোকে সব শান্ত করে দিয়ে যায়। তারপর শুধু শূন্যতা। ঝরা পাতার স্তুপ জমিয়ে আগুন লাগানোর অপেক্ষা। আগুনের হল্কায় পুড়ে আবার নতুন করে বাঁচার চেষ্টা। 

    কোনো মৃত্যুই শুধু একটা প্রাণ নিয়ে ফিরে যায় না, সঙ্গে আরো কিছুও নিয়ে যায়, আমরা সে সবের হিসাব রাখি না, মানে রাখতে চাই না। মৃত্যুর কাছে আমরা জন্ম থেকেই সবটুকু ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ যে! 

214
Tue, 07/06/2021 - 15:00

জগৎ সংসারটা আমার বুদ্ধি-বোধের ক্যানভাসে? না আমার বুদ্ধি-বোধ জগৎ সংসারের ক্যানভাসে? এই নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে দীর্ঘদিন লড়াই চলেছে। আজও চলছে। যারা বলেন, আমার বুদ্ধি-বোধের ক্যানভাসে জগৎ তারা হলেন 'মেটাফিজিসিস্ট'। আর যারা বলেন, আমার বুদ্ধি-বোধ জগতের ক্যানভাসে তারা হলেন 'এম্পিরিসিস্ট'। লড়াই প্রাচীন। পথ সুগম্য নয়। ভারতীয় দর্শনের মূলধারা মেটাফিজিসিস্টের দিকে, নিজের মত করে।

    সত্য কি? প্রাচীনতম প্রশ্ন। উত্তর নেই। কারণ প্রশ্নটা ভুল। যদি বলি, এ শরীরের সত্যটা কি? বলব সেল থিওরির কথা। যদি বলি, এই এক বিন্দু জলের সত্য কি? বলব এইচ টু ও -এর কথা। যদি বলি, আকাশ যে নীল, তার সত্যটা কি? বলব আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের কথা। 

    তারপরেও যদি হঠাৎ করে জিজ্ঞাসা করা হয় আবার, সত্যটা কি? তখন বুঝতে হবে, সত্যের সত্যটা জানতে চাওয়া হচ্ছে। সত্যের সত্য কি? প্রশ্নটা কি হেঁয়ালি মাত্র? কোনো কনটেক্সট ছাড়া কি সত্যের সংজ্ঞা, গুণগতমান হয়? হয় না। তবে প্রশ্নটার আরো গভীরের অর্থ হল, আমার অস্তিত্বের সত্য কি? অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। তার কারণ আমাদের মন। আমরা আমাদের মনের অস্তিত্বকে পৃথক স্বনির্ভরভাবে জানি। যদি শুধু শরীরের জ্ঞানই আমাদের যাবতীয় জ্ঞানের সবটুকু হত তবে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমাদের মনের স্বনির্ভর অস্তিত্ব আমাদের সংশয়ে ফেলে। তবে কি আমাদের শরীরের শর্ত ছাড়া অন্য কোনো অস্তিত্ব আছে? কগনিটিভ সায়েন্স, নিউরোসায়েন্সের এই নিয়ে কোনো অবিসংবাদিত মত নেই আজ অবধি।

    আমাদের বস্তুজ্ঞান আর আত্মজ্ঞানের একটা সাম্য রাখার কথা ছিল। আমাদের বস্তুজ্ঞান শিখর ছুঁয়েছে। আমরা পদার্থকে বিশ্লেষণ করে, শরীরকে বিশ্লেষণ করে, অজস্র ঘটনার পারম্পর্য (Cause and Effect) খুঁজে পেয়ে আমাদেরকে বস্তুজগতে অনেক অনেক বেশি প্রভাবশালী তৈরি করে ফেলেছি অবশ্যই; কিন্তু আমাদের আত্মজ্ঞানের দৈন্য দিন দিন এত প্রকট হয়ে পড়ছে যে, আমাদের সমাজনীতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ক্রমশ যেন একটা জড়ের নিয়মের বশবর্তী হয়ে পড়ছে। আমরা সর্বত্র বিশ্লেষণাত্মক হয়ে পড়ছি, আমরা সর্বত্র পারম্পর্য খুঁজছি, কিন্তু আমরা সবকিছুর মধ্যে সমন্বয় খোঁজার তাগিদ হারিয়ে ফেলছি। মানুষ নিজেকে বিশ্লেষণ করে ততটা জানতে পারে না, যতটা অন্যের সঙ্গে সমন্বয়ের যোগসূত্র খুঁজে নিজেকে আবিষ্কার করে। 

    আমার মধ্যে বিশ্লেষণের তাগিদ আর যোগসূত্র খোঁজার তাগিদ একসঙ্গেই আছে। যোগসূত্র খোঁজার তাগিদকে আমরা বলি ভালোবাসা, সহানুভূতি, অনুকম্পা, সহমর্মিতা ইত্যাদি। এ মানুষের নৈতিকবোধ। একে বিশ্লেষণ করা যায় না। এ সার্বজনীন। নোম চোমস্কি বলছেন, হাত-পায়ের মত নীতিবোধ সার্বজনীন, কিন্তু কোথাও পুষ্ট, কোথাও পুষ্ট নয়। তা ছাড়াও তা নির্ভর করছে কিভাবে আমি তা ব্যবহার করছি। ক্রিস্টোফার তার ‘মরাল অরিজিন’ বইতে দেখাচ্ছেন কিভাবে নীতিবোধ অভিব্যক্তির হাত ধরে ধীরে ধীরে জন্মিয়েছে। অ্যাডমস স্মিথ তার ‘মর‍্যাল সেন্টিমেন্ট’ বইতে, হিউম তার ‘এনকুয়ারি অন প্রিন্সিপল অব মর‍্যালস’ বইতে, কান্ট তার ‘মর‍্যাল জাজমেন্ট’-এ একই কথা বলছেন। আমাদের নীতিবোধের একটা সার্বজনীনতা আছে। 

    আমি ভালো হব কেন? এর উত্তর ধর্ম 'পাপের শাস্তি, পুণ্যের পুরস্কার' বিধান দিয়ে একরকম সমাধা করেছে। মানুষ দেখেছে ভালোত্বের মধ্যে এক শান্তি আছে। যা কিছু শান্তি আর সুরক্ষার পক্ষে তাই আমাদের বিধানে ভালো - হিউমের মতে। মানুষ যখন ভালোর প্রতি সামাজিক আর আত্মিক সমর্থন লাভ করে তখন তার অন্তর্দ্বন্দ্ব থেমে যায়। শান্তি পায়। 

    কিন্তু সত্যিই কি সেই শান্তি গভীর? তার মূল কি এতটাই শক্ত? না। অনেক সময়েই সামাজিক রীতিনীতির উপর বিশ্বস্ততাটাই আমাদের নীতি হয়ে দাঁড়ায়। মানে একটা কাস্টমসকে মেনে চলাই আমার মনে হতে শুরু করে যেন নিজেকে শান্তিতে আর সুরক্ষিত রাখার একমাত্র উপায়। কিন্তু সত্যিটা কি তাই? নীতি কি সত্যিই দেশ-কাল দ্বারা সীমাবদ্ধ?

    এইখানেই বাংলা শব্দের যাদু আছে একটা - 'রীতিনীতি'। 'রীতি'টা দেশকালে সীমাবদ্ধ, 'নীতি'টা নয়। নীতি একটাই - সহানুভবী হও, নিষ্ঠুর হোয়ো না। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসটা এই নানা রীতি বদলে বদলে এই মানবিক উদারতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার ইতিহাস। আমরা সভ্য বলতে বুঝতে চাইছি সে বর্বর নয়। সে নিষ্ঠুর নয়। সে তার অন্ধ প্রবৃত্তিদ্বারা চালিত নয়। কিন্তু সে লড়াই এখনও সাবালক হয়ে ওঠেনি। লড়াই এখনও অব্যহত। সেই লড়াইয়ের পথপ্রদর্শক চিরকালই দার্শনিকেরা, যারা তাদের মণীষার গভীরে মনুষ্যত্বের উদার সম্ভাবনার খোঁজ পেয়েছেন, ঘোষণা করেছেন। খ্রীষ্ট যখন বলছেন, তোমরা তোমাদের পিতার মত হও, তিনি যেমন আমায় ভালোবেসেছেন তেমনি তোমরাও একে অন্যকে ভালোবাসো, তখন তিনি মানুষের মধ্যের সেই সম্ভাবনার কথাই বলছেন, তাকে জাগাতে বলছেন। 

    নানা সামাজিক রীতি, প্রথা আদি অকৃত্রিম নৈতিকবোধের গলা টিপে ধরতে চায়। তাকে হত্যা করে নিজেকে তার সিংহাসনে বসিয়ে বলতে চায়, আমিই আদি, আমিই শাশ্বত। আমার সভ্যতার নিয়মগুলিই হল সত্য, নির্ভুল; বাকি যা কিছু সব অর্থহীন, ভুলে ভরা। সমাজ তখনই আবার স্থবির হতে শুরু করে। আবার অচলায়তন গড়ে ওঠে। আবার একজন দার্শনিকের আসার সময় হয়ে পড়ে, যে আবার হারানো যোগসূত্রটা খুঁজে দিয়ে বলে, এই যে, এইটাই ছিল মূলকথা, নিজের ভিতর থেকে পাশবিকতা যতটা পারো ঝেড়ে ফেলো, নিষ্ঠুর হোয়ো না। এই হল নীতি। হিংসার দ্বারা হিংসার নিবৃত্তি হয় না, হিংসা নিবৃত্তি পায় প্রেমে, এই হল সনাতন ধর্ম। বুদ্ধ বললেন। 

    আমাদের নানা বিরোধ, বৈচিত্রের মধ্যে এই একটাই তো দাঁড়াবার জায়গা আছে - আমরা একে অপরকে বুঝতে না পারলেও, সহমত হতে না পারলেও যেন তার অধিকার থেকে তাকে বঞ্চিত না করি, ক্ষমতা আছে বলেই। মানুষের ক্ষমতা তো একটাই, বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার। ন্যায্য ব্যবহার। যাকে 'জাস্টিস' বলে।

215
Wed, 06/23/2021 - 18:40

মানুষ মানেই ভয়। 'সাহস' ঠিক ভয়ের বিপরীত শব্দ নয়। সাহস হল ভয়কে প্রতিরোধ করার শব্দ। বা আরো সাদা ভাষায় ভয়ের সঙ্গে যোঝার শব্দ। 'অভয়' শব্দটা ভয়হীনতা, সে সবার আসে না। সক্রেটিস, ব্রুনো, চৈতন্য, খ্রীষ্ট, স্পিনোজা, গ্যালিলিও প্রমুখ যেসব বিখ্যাত মানুষদের কথা ইতিহাসে শোনা যায়, যারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে হলেও একটা আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। তাদের নিয়ে কথা নয়। ভয় হয় তো তাদের প্রাণেও জন্মেছিল। শোনা যায় খ্রীষ্ট ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগে ভয় পেয়েছিলেন। পিটারের কথায় তা পাওয়া যায়। হিস্ট্রি চ্যানেলে সেন্ট পিটারকে নিয়ে যে তথ্যচিত্র হয়েছিল সেখানে পিটারের মুখ দিয়ে এই কথাটা বলানো হয়। গান্ধী বলতেন, ভয় পাবে এটা স্বাভাবিক, তবে ভীতু হবে কিনা এটা তোমার চয়েস। 

    দেখুন, একটা পশু কেবল তার সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যেই জন্মায়। কিন্তু একটা মানুষ জন্মায় একটা সমাজের মধ্যে। যে সমাজ একটা ধারাবাহিক স্মৃতি, প্রথা, বিশ্বাসের ধারা। মোট কথা সে জানে যে তার মধ্যে অনেক অপূর্ণতা, সে আদিম, তাকে সভ্য হওয়ার জন্য কিছু বছর দেওয়া হবে স্কুল ইত্যাদির মাধ্যমে। তাকে নিজেকে সমাজে চলমান হিসাবে তৈরি করে নিতে হবে। সে ব্যষ্টি হিসাবে যদিও অপূর্ণ, অন্যদিকে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা সমাজটা পূর্ণ, খাঁটি। শৈশব-কৈশোর-বয়ঃসন্ধিকাল জানল বড়রা সবাই পারফেক্ট। সমাজের সব ব্যবস্থা পারফেক্ট। তাকে ধীরে ধীরে এ সবের মধ্যে নিজেকে গড়েপিটে নিতে হবে। অবশ্যই তার জন্য নানারকম সাহায্যের ব্যবস্থা আছে। এই শুরু হল তার সাইকোলজিক্যাল ভয়ের গোড়াপত্তন। ভয় মানে আদতে তো নিজের অপূর্ণতা, অক্ষমতার বোধ। মানুষ ভূতকে ভয় পায়, অন্ধকারকে ভয় পায়, রাজাকে ভয় পায়, রাজার পেয়াদাকে ভয় পায়, সমাজকে ভয় পায় ইত্যাদি নানা কিছুকে ভয় পায় কারণ সে জানে এগুলো সবার সামনে সে অক্ষম, অপূর্ণ। 

    এরপরে আসে একজন পারফেক্ট সর্বদ্রষ্টা সিসিটিভিতুল্য ঈশ্বরের ভয়। তিনি যদিও বন্ধুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনিও তাঁর শর্ত ছাড়া এক পা নড়েন না। শর্ত মেনে চললেই বন্ধু, নইলেই শাস্তি, শাপ, বিচার ইত্যাদি। এক এক ক্রিডে এক এক ধরণের শর্ত। আমি 'ধর্ম' কথাটা না বলে 'ক্রিড' কথাটাই বললাম। কেন বললাম একটু বলে নিই। দেখুন আমরা সবাই যেমন ভোট দিতে যাই, কিন্তু গণতন্ত্র নিয়ে আর কতজন সিরিয়াসলি মাথা ঘামাই? ওই ভোট দেওয়াটা আমাদের একটা ওপরসা ওপরসা গণতান্ত্রিক আচারের মত। সেরকম ধর্মও। বেশিরভাগের কাছেই একটা আচার-অনুষ্ঠানের প্রথা। সেখানেও যদিও ভয় আছে, তবে অতটা গভীরে নয়। আমি যদি জানি আমার ঈশ্বর শনিবারে নিরামিষ খেলেই খুশী তবে তাকে তুষ্ট রেখে চলতে আমার অসুবিধা হয় না। কিন্তু যেখানে যুক্তি সেই সমাজ স্বীকৃত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যাচ্ছে তখন একটা ক্রিডের ক্ষেত্রে সেটা তো 'ব্লাশফেমি', অর্থাৎ ঈশ্বরনিন্দাতুল্য। তখন মানসিক সংকটটা অনেক গভীরের। ঈশ্বর নিন্দার তো একটাই পথ, ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। যুক্তি কিছুতেই মানছে না, অন্যদিকে মনের মধ্যে জমা সামাজিক শিক্ষা-প্রথার ছাপ, যা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, এ ভয়ংকর। এই দুই লড়াইয়ের সহজ সমাধান আসে না মোটেই। দেখেছি যাদের মধ্যে নাস্তিকতাটা স্বভাবগত বোধের সঙ্গে সহজ হয়নি, তার নাস্তিকতাটা বড্ড লাউড। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে সে নিজেকে কারণে-অকারণে ঘোষণা করে ফেরে। বাইরের আস্তিকতার সমস্ত অলঙ্করণকে সন্তর্পণে এড়িয়ে যায়, পাছে তাকে কেউ আস্তিক ভেবে বসে। কিন্তু যার মধ্যে সত্যি অর্থে নাস্তিকতা এসেছে তার কিছুতেই ভয় নেই। খুশবন্ত সিং যখন বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা নিয়ে একটা বই লিখছেন, বা শিখদের ইতিহাস নিয়ে বই লিখছেন, বা প্রজাপতি ব্রহ্মকুমারীর আশ্রমে গিয়ে সেখানে তাদের কার্যকলাপের প্রশংসা করছেন তখন খুশবন্ত সিং-এর নিজেকে নিয়ে কোনো সংশয় জন্মাচ্ছে না। সুনীলবাবু যখন ‘সেই সময়’-এ রামকৃষ্ণ-বিবেকান্দের জীবনের অংশ বা কি ‘মনের মানুষ’-এ লালনের জীবন লিখেছেন তখন সেখানে কোনো বাড়াবাড়ি নেই কোনো পক্ষ নিয়েই। কিন্তু মাঝারিদের নিয়ে বড় সমস্যা। কিছুদিন আগে কোনো একটা ফেসবুকীয় গ্রুপে কেউ একজন বিদ্যাসাগরের জীবনী লিখতে গিয়ে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দকে নিয়ে যা সব একপেশে নেগেটিভ সিদ্ধান্ত লিখছেন দেখলাম, তাতে বোঝা যায় সমাজের “নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান” লেখকের বোধের সঙ্গে সম্পৃক্ত না হতে পারায় বদহজম হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন সে জীবনীটা নাকি ভীষণ বস্তুনিষ্ঠ জীবনী হচ্ছে। মুশকিল হল কোনো মানুষেরই জীবনী বস্তুনিষ্ঠ হলে বিপদ, সেটা ডাইনোসরের জীবনীর ক্ষেত্রে খুব বড় কথা। সেখানে প্রতিভাসম্পন্ন মানুষের জীবনী আরো জটিল। সে জীবনীতে ঘটনাপঞ্জী থেকে তাদের মানসিক নানাবিধ স্ববিরোধ আর সামঞ্জস্যের বিধানের ধারাবিবরণীতেই হয় আসল জীবনী। যাকে সময়ের সঙ্গে, তার আশেপাশের পরিবেশের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার করে দেখতে হয়। 

    যা হোক অন্য দিকে চলে গেলাম। যেটা বলছিলাম, মানুষের একটা ভয় জন্মায়, পারফেক্ট ঈশ্বরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার নানা চ্যালেঞ্জে ভয়।

    এতটা যদি অনুগ্রহ করে পড়লেন, তবে এবার দৃষ্টিটা একটু অন্যদিকে নিয়ে আসতে চাইব। পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ের অধ্যায়টা স্বাভাবিক। কিন্তু ভয়ের এক্সপ্লয়টেশানের ইতিহাসটা বড় নির্মম। 

    এক্সপ্লয়েটেশানে প্রথমেই যা আসে, তা হল ধর্ম। খুব অল্প কথায় দেখুন মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের ধারণা যুগে যুগে বদলিয়েছে। আগে মানুষ প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ, নানা ঘটনা, নানা রোগব্যাধি ইত্যাদিকে ঈশ্বরের কার্যকলাপ বলে জানত। ক্রমে 'একেশ্বরবাদ' এলো। তারপর 'অন্তর্যামীভাব' এলো। 'কিংডাম অব গড ইজ উইদিন ইউ', বা 'ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জুন তিষ্ঠতি', বা 'চিত্তশুদ্ধি'ই হল সমস্ত ধর্মের সার। আর হৃদয়কে শুদ্ধ করার নীতি হল - "সবারে বাসরে ভালো নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে"। সব ধর্মের মূল নীতিটা এটাই। এখানে ভয় নেই। এখানে স্বাধীনতা। আনন্দ। সুখ। চেতনা। 

    কিন্তু এ হল ধর্মের হৃদয়। আমাদের শরীরে যেমন হৃদয়কে ছেড়ে হাত-পা-চোখ-নাক-মুখ ইত্যাদির প্রবল বিত্তাপ চোখে পড়ে ধর্মেও তাই, মুখ্যকে ছেড়ে গৌণদের আস্ফালনই বেশি চোখে পড়ে। যীশু ফরীসীদের ভর্ৎসনা করছেন এই বলে যে, তোমরা কেন মানুষের ঘাড়ে নানা কৃত্রিম নিয়মের বোঝা চাপিয়ে তাদের দুর্বল, তাদের ভীতু করে তুলছ? তিনি শ্রেষ্ঠ আদেশ বলতে বুঝলেন, ঈশ্বরকে তোমার মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসো আর তোমার প্রতিবেশীকে তোমার মত করে ভালোবাসো। একে অন্যকে ভালোবাসো যেমন আমি তোমাদের ভালোবেসেছি। 

    এই হল মূল কথা। কিন্তু খ্রীষ্ট সে কথা বললেও, খ্রীষ্টধর্ম সে কথা বলে না। দস্তয়েভস্কি'র 'দ্য ব্রাদার্স কারামোজভ' -এর 'দ্য গ্রেট ইনকুইজিটার' অধ্যায়টা পড়ার অনুরোধ রাখলাম, সেটা নিয়ে ইউটিউবে একটা ছোটো নাটিকাও আছে সেটাও দেখে নেওয়ার প্রস্তাব রেখে গেলাম যদি বই না পাওয়া যায় তো। সেখানে পোপের সঙ্গে যীশুর কথোপকথনেই সবটা বলা আছে। যদিও উনি শুধু নন, টলস্টয়ের 'দ্য কিংডাম অব গড ইজ উইদিন ইউ', বা কাহলিল জিবরানের 'প্রফেট' সহ অন্যান্য লেখা এ সত্যের সাক্ষী বহন করে। যেখানে জিবরান এতটা এগিয়ে বলছেন যে, একদিন জেরুজেলামের যীশুর সঙ্গে ভ্যাটিকানের যীশুর দেখা হয়েছিল, কেউ কাউকে চিনতে পারেননি। 

    বুদ্ধ, চৈতন্য, নানক, কবীর, রামকৃষ্ণ, শিরডি সাঁই প্রমুখ যারাই এসেছেন তারাই কোনো না কোনোভাবে মানুষকে ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার কথাই বলেছেন। নইলে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শুধু একটা বিশুদ্ধ আত্মহত্যা পথের শিক্ষার জন্য কেউ বুদ্ধের কাছে যেত না। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, সে শুদ্ধতা আর পরের প্রজন্ম অবধিই টিকে থাকেনি নিজের স্বীয় শুদ্ধতায়, সরলতায়। যে হাত মানুষের বাঁধন খোলার জন্য ব্যবহার হয়েছিল, সেই হাতের ধারক বাহকেরাই নতুন শৃঙ্খল তৈরি করে বসল। 

    এর পর আসে সমাজনীতি আর রাজনীতি। সেখানেও সক্রেটিস থেকে শুরু করে রুশো, ভল্টেয়ার; এদিকে রামমোহন থেকে শুরু করে বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ অবধি একই কথা বলা হল। মানুষের সমাজে মানুষের স্বাধীনতার কথা। 'চিত্ত যেথা ভয় শূন্য' উচ্চারিত হল। মার্ক্সের দর্শনেও সাধারণ মানুষের নির্ভীক জীবনের কথা বলা হল। কিন্তু বাস্তবে সে সবের পরিণতি? কোনো সমাজেই আজ অবধি উদাহরণ নেই। কোনো বাস্তব রাজনীতিতেও নেই। সাম্যবাদের যে ছবি আজ রাশিয়া আর চীন দাঁড় করিয়েছে তাতে মার্ক্স বেঁচে থাকলে নিজেকেই হয় তো ক্রুশবিদ্ধ করতেন। 

    মোদ্দা কথাটা হল মানুষের ভয়কে ব্যবহার করা যায়। মানুষ নিজের ভয়কে অনুভব করে আর অন্যের ভয়কে জানে। জানা আর অনুভবের মধ্যে অনেক পার্থক্য। অনুভব যতটা বাস্তব হয়, জানা ততটা নয়। বুদ্ধির তীক্ষ্মদৃষ্টি থাকলে জানা ক্রমে অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। অভিজ্ঞতার উপর বিশ্বাস করে তৈরি হয় আত্মবিশ্বাস। সে আত্মবিশ্বাসে সে অনুভব করে যে ভয় একটা সাধারণ অনুভব। অপূর্ণতার বোধ, অক্ষমতার বোধ তার একার কেবল নেই। এ সার্বজনীন অনুভব। একে এক্সপ্লয়েট হতে দিতে নেই। 

    হিটলারের কথায় আসুন। হলোকাস্টের মত আমাদের সময়ে আর একটাও নৃশংসতা নেই হয় তো। হিটলার বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল যে ইহুদীরা সারা পৃথিবীর পক্ষে একটা থ্রেট। পৃথিবীকে ইহুদিশূন্য না করতে পারলে সবাই শেষ হয়ে যাবে। এ ভয় যদি মানুষের মনে সত্য হয়ে দানা না বাঁধত তবে একা হিটলারের পক্ষে এত প্রবল আকারে নৃশংসতাকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হত? আসলে তো বিশ্বযুদ্ধ দুটো হচ্ছিল। এক দেশে দেশে, আর এক ইহুদিদের বিরুদ্ধে। হিটলার যখন নিজে বুঝতে পারছে সে হেরে যাচ্ছে তখনও সে এক ক্যাম্প থেকে আর এক ক্যাম্পে ইহুদিদের নিয়ে গিয়ে শেষ করে দিচ্ছে। এমনকি এও ঘোষণা করছে যে সে মরে গেলেও যেন এই ইহুদি নিধন কর্মকাণ্ড থেমে না যায়। 

    শুধু হিটলার না। যুগে যুগে ধূর্ত মানুষেরা, অসৎ মতলবী মানুষেরা সাধারণ মানুষের জন্য ছলেবলে এরকম নানাবিধ কৃত্রিম শত্রু তৈরি করে যাচ্ছে। কেউ বুঝিয়ে দিল আমাদের ধর্ম, আমাদের সভ্যতা, আমাদের সংস্কৃতি ইত্যাদির পক্ষে অমুকরা থ্রেট হয়ে যাচ্ছে। ব্যস, যে ভয় আমার মধ্যে আজন্ম নৈর্ব্যক্তিক আকারে ছিল, সেই এবার নিজের বাইরে স্পষ্ট একজন শত্রুর মুখ দেখে আরো তীব্র তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। ভয় মানুষকে নির্মম, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর করে তুলতে পারে অনায়াসেই। যুক্তির পর যুক্তি সাজিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য তাকে এমন তাতিয়ে তুলবে যে ভয়কেই সে নিজের ধ্রুবতারা মেনে নেবে। আরো গভীরের কথা হল, ভয়ের এমন একটা এমন স্পষ্ট আকার দেখে নিজের ভিতরে সদা বহমান ভয়ের চাপা ভার থেকে মুক্ত হওয়ার আনন্দে, সে এমন একটা কৃত্রিম উল্লাস অনুভব করে যে সাধারণ চেতনা লুপ্ত হয়ে যায়। হনুমানের লেজে আগুন লাগতে সে এমন ক্ষেপে গেল যে সারা লঙ্কায় আগুন লাগিয়ে দিল, খেয়ালই রইল না যে সে লঙ্কায় স্বয়ং তার আরাধ্যা সীতাদেবী আছেন। 

    ভয় জাত ক্রোধ, উদ্বেগ, কাল্পনিক অস্তিত্ব সংকটের বোধ মানুষকে দিয়ে যা কিছু করিয়ে নিয়ে পারে। আর তাই জন্যেই হলোকাস্ট সম্ভব হল। নইলে এত এত মানুষকে এক সঙ্গে এমন বিকারগ্রস্ত করে তুলে ফেলা যায় যে ইহুদি শিশুদের পা ধরে দু'ফালা করে শয়ে শয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিতে পারে? লক্ষ লক্ষ মানুষকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মেরে ফেলতে পারে? আরো আরো কত নৃশংসতা তা বলে শেষ করা যায় না। 

    এ সবই সম্ভব শুধু একটা স্বাভাবিক নিয়মে জাগা ভয়কে বিকারগ্রস্ত করে তুলে। আবার কেউ একজন আসে, যে প্রাণপণে বলতে শুরু করে পৃথিবীতে সব চাইতে বড় পাপই হল চিত্তের দুর্বলতাকে স্বীকার করে নেওয়া। “নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে ভয় শুধু তোর নিজের মনে”। সমস্ত ভয়কে তুচ্ছ করে মাথা উঁচু করে না দাঁড়াতে পারলে যে আমার কোনো মন্ত্রে, কোনো নীতিতে, কোনো রাজার শাসনে মুক্তি নেই - এ অনুভব না জন্মালে বাকি সব কিছুই বড় অগভীর। অনর্থক।

216
Mon, 06/21/2021 - 17:45

মানুষ দুঃখ থেকে ত্রাণ চায়। সে কোন দুঃখ? খিদের দুঃখ, পরাধীনতার দুঃখ, অপমানের দুঃখ।

 
    বাকি যা কিছু শোক, মানুষ মেনে নেয়। সেটা তার কপাল জেনেই মেনে নেয়। আমার এক নিকট আত্মীয় মারা গেলেন। যে বয়সে মারা গেলে মানুষ বলে, হায় রে, সেই বয়সেই মারা গেলেন। খবর পেয়ে হাস্পাতালে গেলাম। শুনলাম এখনও বেশ কিছুটা দেরি আছে "বডি পেতে"। কানে বাজল। এই বাজাও দুঃখ।

    বাইরে চায়ের দোকানে বন্ধুরা এলাম। সকাল থেকে কিছু না খাওয়া। দুপুর গড়ালো। খিদের দুঃখ। দোকানে বয়স্ক মানুষ। হাস্পাতালের বাইরের দোকান। শোক, উদ্বেগ, দুঃখ দেখে দেখে সয়ে যাওয়া মানুষ। ছোটো দোকান। টালির চাল। উনুনে দুধ ফুটছে। পাত্রটা বহু ব্যবহারে স্বীয় আকার, রং হারিয়েছে। দোকানের সামনে চিপস, কেকের প্যাকেট ঝুলছে। দোকানির মুখে ব্যবসায়ী মানুষের হাসি। জগতে সমস্ত দুঃখকে সামনের দরজা দিয়ে না আসতে বলার সাইনবোর্ড। কিছু মানুষ হয় এমন। দুঃখকে ঠেকানো যাবে না জেনে সামনের দিকের দরজাটা তার জন্য আর খোলা রাখে না। পিছনের দিকের দরজাটা খুলে দিয়ে ভিতরে ডেকে নেয়। বাইরের দিকে আসতে বারণ করে। চোখের জানলায় উঁকি দিতে বারণ করে। বলে, তুমি থাকো। সমস্ত সুখ শিকড়হীন জানি। তবু সে বাইরে থাক। মানুষ শিকড় খোঁজে না, ফুল খোঁজে। মিথ্যা ফুলের স্বপ্নে ভুলিয়ে রাখে নিজেকে। আমিও সেই কাজে সাহায্য করি না হয়। তুমি গোপনে থাকো। সত্য হয়ে থাকো।

    কেক আর চায়ের জন্য বলা হল। সামনে অটোর সারি। কিছুদূরে সস্তা কাঠে বানানো খাটের সারি। ফুলের দোকান। ওষুধের দোকান। সুখ কোথায়? দুঃখ মানে অনেক শব্দ। অভাব, যন্ত্রণা, বিষাদ, অবসাদ, অভিযোগ - অনেক শব্দ। দুঃখের সহস্রনাম। সহস্ররূপ। মানুষ সব দুঃখ সহ্য করে নেয়, শুধু অপমান আর পরাধীনতার দুঃখ সহ্য করে না। যদি সহ্য করে তবে সে আর মানুষ পদবাচ্য থাকে না। এই যে এত লড়াই, এই যে বেঁচে থাকার এমন লড়াই, একি শুধু টিকে থাকার না বেঁচে থাকার? টিকে থাকা আর বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য বোঝায় দুঃখ। অপমান আর পরাধীনতার দুঃখকে পায়ে দলে যে দাঁড়াতে যায় সেই জানে বেঁচে থাকার মানে কি? টিকে থাকাতেই তুষ্ট থাকতে চায় যে তার উপর তার ঘৃণা। কারণ সে জানে যে টিকে থাকাকে জীবন বলে ভুল করে সে নিজের মেরুদণ্ডকে যে কোনো মূল্যে একবার না, হাজারবার বিক্রি কর‍তে পারে। সে দুঃখের মূল্য বোঝে না। ভয় আর লোভের চাবুকে জর্জরিত প্রাণে সে শুধু ঝুঁকে ঝুঁকে পড়তে চায়। একটু মাথা নীচু করে থিতু হতে পারলেও ভাবে, এই তো আমি আছি!

    এমন মানুষের সংখ্যা বেশি হয় না। এই যে বৃদ্ধ মানুষটা চায়ের জল চাপিয়ে খদ্দের সামলাচ্ছে, একি সুখের জন্য? না, নিজের স্বাধীনতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। মানুষ যত বৃদ্ধ হয় তার শরীর তত দৃঢ় হয়, শিথিলতা কমে। পায়ের ভাঁজ, হাতের ভাঁজ, পেশির সচলতা ক্রমে কঠিন হয়ে আসে। চলাফেরায় গতি কমে। কিন্তু সে তো শরীরের কথা। শরীরের দুঃখকে মানুষ দুঃখ বলে না, বলে রোগ, বলে অসুবিধা। কারণ শরীর তার আত্মসম্মানকে ছোঁয় না। তার আত্মা তার মনের গভীরে। তার বোধের গভীরের নীলশিখা। তার গায়ে কেউ হাত দিতে এলে সে চীৎকার করে ওঠে। প্রতিবাদ জানায়। দরকার হলে শরীরটাকে শেষ করে দিয়েও সেই নীলশিখাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়। তাকে সে বলে "বলিদান"। সে পশুর থেকে আলাদা এই বোধেই। আকাশে উড়েছে বলে না, জগত সংসারের গভীর রহস্যের কিছু কিছু সন্ধান পেয়েছে বলে না। সে তো অনেক প্রাণী প্রকৃতির অনেক রহস্য মানুষের থেকে আগে বোঝে। মানুষের গর্ব সেখানে না, তার গর্ব তার গভীরে জেগে থাকা ওই নীলশিখার উজ্বলতায়।

    শ্মশানে অনেক লাইন। মৃত মানুষের সংখ্যা অনেক। জীবিত মানুষের ভিড় মৃত মানুষদের ঘিরে। চলছে নানা ক্রিয়া-অনুষ্ঠান। শরীর আর মৃত্যুকে তুচ্ছ বোধ করানোর অনুষ্ঠান। মৃত্যু শোকের। দুঃখের। কিন্তু এ তার নীলশিখা দ্বারা অনুমোদিত। তাই এই শোকে তার অপমান হয় না। সেই শোকে অপমানিত হয় শুধু তারা যারা টিকে থাকাকেই জীবন বলে জানে। তাই টিকে থাকাটা বিপন্ন হলে সে হেরে যায়। সে দুঃখ বা সুখ কিছুই অনুভব করে না। তার সারা জীবন জুড়ে কি ঘিনঘিনে অসাড়তা শুধু একটা!

    ইলেকট্রিক চুল্লী হাঁ হচ্ছে। শরীর দগ্ধ হবে বলে ঢুকে যাচ্ছে। ছাই হয়ে বেরিয়ে আসছে। নাভি ভেসে যাচ্ছে গঙ্গায়। তবু থেকে যাচ্ছে মানুষটা। শরীরে না, তার মানে, তার আত্মমর্যাদায়। মানুষ মৃত শরীরকেও তার গভীরে জেগে থাকা আত্মসম্মানের মূল্যে মূল্য দিয়ে যায়। অন্যথা হলে ক্ষুব্ধ হয়। বিগত কয়েকমাসে যে কয়েকটা ঘটনায় মানুষ ক্ষুব্ধ হল তাই। সে সব দুঃখ সহ্য করে নেয়, কিন্তু অপমানের দুঃখ না।

    গঙ্গার ঘাটে এসে বসলাম। দুঃখ থেকে ত্রাণ পায় মানুষ? পায় না। দুঃখকে নিয়েই বাঁচে। যদি বলে আমার দুঃখকে চাই না। তবে রাস্তাটা ঘূর্ণির মত হয়ে যায়। মন এ গলি, সে গলি খুঁজে মরে। ভাবে বড় রাস্তাটায় না হাঁটলেই হল। তবেই আর ধরা পড়ার ভয় নেই। যত গলিতে এসে ঢোকে তত নিজেকে ক্ষুদ্র করে, নিজের মানুষ হিসাবে প্রাপ্ত মানের থেকে সুখী প্রাণী হিসাবে টিকে থাকার লোভ যায় বেড়ে। ক্রমে লজ্জা পেতে আর তার লজ্জা লাগে না। ক্রমে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকানোর আর সাহস থাকে না। তার গভীরে যে সমস্ত দুঃখকে সঙ্গে নিয়ে চলার অসীম ক্ষমতা, তাকে অস্বীকার করে। নিজেকে দেহসুখসর্বস্ব প্রাণী বেশি আর কিছু ভাবতে পারে না।

    দাহ শেষ হল। ভোর হল। রাস্তাটা এতক্ষণ ঘুমন্ত সাপের মত পড়েছিল। ক্রমে জেগে উঠল সে। মানুষের হাঁকডাকে চারদিকে আবার সব কিছু দিনের চিরকালের ছবির মত হয়ে উঠতে শুরু করল। দোকানি দোকান খুলছে। বাস, স্কুটার, অটো, টোটো রাস্তায় ভিড় করে। বাজার বসে গেছে। সেখানেও হইহই। প্রতিটা মানুষকে যদি আলাদা আলাদা করে দেখি তবে তার জীবনে দুঃখের অবধি নেই। তবু সে মাথাটা উঁচু করে বাঁচতে চাইছে।

    একজন বৃদ্ধা সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাত পাতলেন। এ অসম্মানের। ভিক্ষা চাইছেন বলে না, ভিক্ষা চাইতে হচ্ছে বলে। মানুষের মানের বোধ দুই ধারার। এক, তার সত্তার মান, তার অস্তিত্ব্যাভিমান; দুই, তার শ্রমযোগ্যতার মান।

    দুর্ভাগ্য আমরা নারীদের এই দুই মানেই বঞ্চিত রেখেছি আদিকাল থেকে। পরিবর্তন হয়নি তা নয়, তবে সে পরিবর্তন আশানুরূপ হয়েছে কই? খ্রীষ্ট তার শিষ্যদের হাত-পা মুছিয়ে দিতে দিতে বলেছিলেন, এই আমি তোমাদের হাত-পা মুছিয়ে দিলাম এই জন্যে যাতে তোমরা জানো আমার পিতা আমায় যেভাবে ভালোবেসেছেন, আমিও তোমাদের সেই ভাবেই ভালোবাসছি। তোমরাও একে অন্যকে সেইভাবেই ভালোবাসো।

    এই ভালোবাসায় মানুষ আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। নিন্দায়, অশ্রদ্ধায় মানুষ নিজের অস্তিত্বকে সংকুচিত করে ফেলে। বাকিটুকু বিষাদ এসে তাকে শেষ করে ফেলে। পুরাকালে ধর্ম আর আধুনিককালে মানবাধিকারের নানা নিয়ম এই মর্যাদারক্ষার কাজে যুক্ত। কিছুটা তো অবশ্যই সফল। যদিও নারীদের ক্ষেত্রে ধর্ম বড় একপেশে। এই দোষে সব ধর্মই কম-বেশি দুষ্ট। সেই প্রাচীন যুগে নীতিবিধানের আর কোনো বিকল্প উপায় ছিল কই?

    এরপরের কথাটা হল তার শ্রমকে মর্যাদা দেওয়া। যে আমার অধীনে কাজ করছে মনে রাখতে পারি না যে সে মানুষটা আমার অধীনে না, তার শ্রমটাই শুধু আমার অধীনে। সে মানুষটা না। আমার ক্রয়ক্ষমতা যত বেশি হোক না কেন, তা দিয়ে শ্রম কেনা যায়, হয় তো বা অনেক মানুষের শ্রম কেনা যায়, কিন্তু একজন মানুষকেও কেনা যায় না। দাসপ্রথা আসলে উঠে যায়নি, ভিন্নভাবে আছে। কারণ দাস করে রাখার প্রবৃত্তিটা আছে।

    যখন শ্রমনিযুক্তকর্তা বলে, তোমার শ্রম আমি নিচ্ছি তাই তোমার ও তোমার পরিবারের সুখ-সুবিধার সমস্তটা দেখার দায়িত্বও আমি নিচ্ছি। তখন আসলে সে সোনার শিকলে আমায় কিনে নিচ্ছে। আমি জানি আমি তার হয়ে বাঁচব। সে শুধু আমার শ্রমের মূল্য দেবে না, আমায় অধিগ্রহণের মূল্যও দেবে। এও পরাধীনতা। আধুনিক সুবিধামূলক পরাধীনতা। অমুক কোম্পানীতে আমার শ্রমের মূল্য একই হলেও পাশাপাশি আনুষাঙ্গিক আরো সুবিধা অনেক বেশি, অগত্যা আমি এটি ছেড়ে ওটিতে যাব। আমিও সেই প্রাচীনযুগের ক্রীতদাসের মত ব্যবহার করছি। যে আরো সুবিধাদাতা মালিকের খোঁজ করে। আমিই 'বণ্ড'-এ সই করছি। আমিও নিজেকে বিকিয়ে দিচ্ছি আমার শ্রমের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও। আমিও বণ্ডেড, নানা সুবিধাভোগী দাস। এ দুঃখের। কিন্তু এই দুঃখকে অনুভব করার শিক্ষা থেকে আমরা বঞ্চিত। আমরা ব্যক্তিগত শারীরিক জীবনে সুবিধা আর বৌদ্ধিক জীবনে স্ট্যাস্টেস্টিক্স-এর দাস এখন। কোনো মানুষকে, ঘটনাকে, পরিস্থিতিকে কেবল তথ্যের আতসকাঁচে দেখা অভ্যাস, তাকে মৌলিকভাবে বিশ্লেষণ করার অভ্যাস নেই আর। যদি থাকে, তবে তুমি ব্যতিক্রম। সত্য যে সবসময় রাশিতত্ত্বের পরিসংখ্যানে নেই, সে যে আলাদাও দাঁড়ায় সে ভুলতে বসেছি যেন।

    এই দুঃখকে আমরা অনুভব করতে পারছি না আর। এই স্বেচ্ছা আত্ম-অবমাননা মেনে নেওয়ার এক অদ্ভুত আধুনিকোত্তর যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। আমাদের নেশা আছে, নানা বিকার আছে, নিত্যনতুন মনোরোগ বাড়ছে। আমাদের অসম্মান করার, হেয় করার, তুচ্ছ দেখার নানা উপায় বাড়ছে। এ আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে জানি না। তবে এটা যে ঠিক হচ্ছে না কোথাও এটা আমরা সবাই কম-বেশি বুঝি। বৈষম্য তো থাকবেই। বৈষম্য অপমান করে না। অপমান করে বৈষম্যের সুযোগ নিয়ে শোষণ করার তাড়না।

217
Thu, 06/10/2021 - 17:07

দিল্লী থেকে ফিরছি, ট্রেনে খুব অসুস্থ হয়ে পড়লাম। বেড়াতে গিয়েছিলাম বন্ধুরা সবাই, সঙ্গে কয়েকজন বন্ধুর পরিবারের লোকেরাও ছিলেন। দুরন্ত এক্সপ্রেস। থামার জায়গা কম। বন্ধুরা বেশ একটু উদ্বিগ্ন, কি হবে আমার এই নিয়ে। যা হোক রাতের দিকে সুস্থ হতে শুরু করলাম।

    রাত তখন ক'টা মনে নেই, আমার ঘুম আসছে না, নীচের বার্থে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে। অন্ধকার চারদিক। মনটা বড় উদাস হয়ে গেল। জীবনে সব চাইতে মূল্যবান কি? আমি এখানে অল্প একটু লেখালেখি করি। কিছু মানুষ ভালোবাসেন। কিছু মানুষ চেনেন। পড়াই, সেখানেও কিছু পরিচিতি আছে। এইগুলোই কি জীবনের সম্পদ? মন বলল, না। এগুলো না হলেও আমার জীবন দিব্যি চলে যেত। চলে যায়। কিন্তু যা না হলে চলে না সে হল আমার আশেপাশের মানুষজনেরা। আপনাদেরও নিশ্চয় তাই। দেখুন, একটা ফুলগাছে ফুল হবে, সেটাই স্বাভাবিক। সে ফুল নিয়ে হাটে এলে কেউ পছন্দ করবে, কেউ করবে না --- এও স্বাভাবিক। কিন্তু যে গাছটায় ফুলটা ধরল, সে গাছটা কি শুধুই ফুল? তার কি এমন মরশুম আসে না, যে সময়টায় তার ফুল ধরে না। কিম্বা ফুল হয় না এমন গাছও তো আছে। কিন্তু সে গাছেরও পরিচর্যা লাগে। আগাছারও পরিচর্যার ভার নেয় প্রকৃতি। কিন্তু মানুষের বেলায় তা হয় না। মানুষকে আগাছা বানাতে চাইলেও সে আগাছা হয় না। সে মানুষই থাকে। তার পরিচর্যা লাগে। খুব লাগে। আমরা প্রত্যেকেই একে অন্যের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ পরিচর্যায় বেঁচে থাকি। যদি কোনো মানুষ অবহেলায় মারা যায়, তাকে আমরা তাই শুধু দুর্ঘটনা বলে এড়িয়ে যাই না, তাকে আমরা আমাদের সামাজিক লজ্জাও বলি। সমাজ মানেও আমি। এমন দরদী মানুষও আছেন, যিনি একটা পথের কুকুর অবহেলায় মারা যেতে বসেছে দেখলে তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। কারণ এই পারস্পরিক পরিচর্যাতেই জীবন ছন্দ পায়।

    আমার বাড়িতে দু'জন বয়স্ক মানুষ আছেন, আমি ছাড়া। আমার বাবা আর আমার জেঠিমা। মা নেই, জেঠুও নেই। আমি যখন ওদের কাছাকাছি বসি, বিশেষ করে ওদের খাওয়ার সময়, মাঝে মাঝে কান্না পেয়ে যায় ওদের চোখের শূন্যতা, অসহায়তা দেখে। প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যান, বাবা মায়ের কথা বলেন, জেঠিমা জেঠুর কথা, আমার মায়ের কথা, ঠাকুমার কথা বলেন। আমি চুপ করে শুনি। যখন প্রচণ্ড বৃষ্টি, বাবা নিজের ঘর ছেড়ে বেরোতে পারেন না, টিভিও চলছে না, বা মোবাইলও চালাতে পারছেন না, একা ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছেন, আমি ঢুকলে চমকে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। আমি বুঝি আমি ওনার স্মৃতির যাত্রায় হুট করে ঢুকে পড়েছি। কথা খুঁজে আমিও পাই না, উনিও পান না। কিছুক্ষণের জন্য, আবার সব কেটে যায়, স্বাভাবিক কথার ছন্দ খুঁজি। কিন্তু সত্যি বলতে, পারি না। এই দু'জন জীবনসঙ্গী হারানো মানুষের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন আজও আমার স্বাভাবিকভাবে হল কই? অতটা যন্ত্রণা আমার প্রাণে কই? বাবা ও জেঠিমা পুরোনো ভাবধারায় বিশ্বাসী। বাবা দোতলায় থাকেন, জেঠিমা একতলায়। কদাচিৎ দু'জনের সঙ্গে কথা হয়। সেও খুব ফর্ম্যাল। দু'জনেই দু'জনের অতীতের প্রসঙ্গ তোলেন না। টিভিতে ঠিক ছবি আসছে কিনা, গরম পড়েছে কিনা, এসি চালালে ঠাণ্ডা লাগবে কিনা --- ইত্যাদি প্রসঙ্গের বাইরে কথাই হয় না। এমনকি দু'জনে দু'জনের চোখের দিকে তাকিয়েও কথা বলেন না। এক একদিন এমন হয় আমরা তিনজনে তিনজনের ঘরে, কেউ কাউকে ডাকছি না। আমি দূর থেকে গিয়ে দেখে আসি ঠিক আছেন কিনা। কিন্তু কথা বলা হয় না, ওনারা একা একা যে রাজ্যে থাকেন, সেখানে আমি কই? দু'জনে যে পরিচর্যার দু'জনকে খুঁজছেন, তারা অন্য পারে। বাবা আর জেঠিমার কাছে নিঃশব্দে বসলে বুঝতে পারি, মৃত্যু কত পাতলা একটা আড়াল। স্মৃতিরও একটা পরিচর্যা আছে। আত্মাকে শান্ত করে যা।

    রাস্তাঘাটে যে মানুষগুলোকে দেখেছি, খেয়াল করলে দেখবেন সেখানেও পরিচর্যা আছে। পর্যাপ্ত না হলেও আছে। উত্তরপাড়া স্টেশানে বসে আছি। চায়ের দোকানে এসে একজন ভিখারি তার পোঁটলা বুকে নিয়ে হাত বাড়ালো। দোকানি একটা চা ভর্তি ভাঁড় এগিয়ে দিয়ে বলল, ক'দিন আসোনি কেন? বুড়ি বলল, জ্বর এসেছিল। সেই কথাটা শুনে চায়ের দোকানের লোক একটা কেক বার করে বলল, খেয়ে নাও। বুড়ি হাত বাড়িয়ে নিল। এ পরিচর্যা ছাড়া কি বলবেন বলুন? রাস্তাঘাটে পোঁটলা বস্তা জড়িয়ে বসা ভিখারির চারদিকে কুকুরের মেলা দেখেননি? আমি অনেকবার দেখেছি। ওখানে জীবন হাত-পা ছড়িয়ে বসে। শ্বাস নেয়। ওখানেই স্বাভাবিক প্রাণের স্পন্দন।

    মানুষ আধপেটা খেয়েও হাতে হাত রেখে পাশাপাশি বেঁচে থাকতে পারে, কিন্তু চারবেলা খেয়েও বিনা পরিচর্যায় বাঁচে না। শ্বাস নেওয়া মানে বেঁচে থাকা যদি বলেন সে আলাদা কথা অবশ্য। আসলে দেখেছি মানুষ মানুষকে কিছু না দিয়ে যায় না। শুধু ভালোবাসা না। উপেক্ষা, অপমান, বিশ্বাসঘাতকতা, ছলনা --- কিছু না কিছু সে দেয়ই। আমি এ সবই পেয়েছি। কিন্তু ফেলে দিইনি বলেই হয় তো এরা প্রত্যেকে আমাকে অল্প অল্প গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আমি একটা জিনিস মানি, এই জীবনটা তো আমি এই প্রথমবার বাঁচছি। সুতরাং এরকম হয় না, হতে পারে না - এ কি করে বলি? আমার জীবনটা তো কোনো রিভিসন কোর্স না। তাই সব হাত পেতে নিই। সব কিছুর কাছেই ঋণী থাকি। শুধু যে মানুষটা আমার দোষগুণ মিলিয়ে আমায় ভালোবাসে তার কাছে একটু সহজ হয়ে বাঁচি। বাকি জায়গায় গম্ভীর হয়ে। শান্তি আদতে খুড়োর কল। দোষে-গুণে, ভালোয়-মন্দে, উদ্বিগ্নতা-অনুদ্বিগ্নতায় এ খরস্রোতে বয়ে চলে যেতেই হয়। যা আছে তাকে নিয়ে ভাবি না, যা নেই তাকে ভেবেও বানাই না --- এই তো কথা।

    ইংরাজিতে দুটো শব্দ আছে --- শো আপ আর শো অফ। 'শো আপ' মানে হল নিজেকে দৃশ্যগোচর করা, আর 'শো অফ' মানে হল নিজের দম্ভকে দেখানো। আমি প্রথমটায় বিশ্বাসী। নিজেকে লুকিয়ে আড়াল করে বেঁচে লাভ কি? নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে অন্য মানুষ সেজে বেঁচে থাকব কেন? রুমি বলতেন, কেউ হাত তখনই ধরে যখন কেউ হাতটা বাড়িয়ে দেয়। আমার হাতটা হ্যাঁচকা টানে টেনে নিয়ে কেউ আমার হাতটা ধরল না কেন, এ অভিমান তো মেন সুইচ অফ্ করে লাইটের সুইচের উপর অভিমান করার সামিল। তবে কি ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ, তিরস্কার ইত্যাদি নেই? আছে। ওদেরও দরকার আছে বলেই আছে। জীবন কি আর যে সে মালি, জাত মালি। সে যখন বাগানে আসে তখন শুধু সার আর জল নিয়ে আসে না, কাঁচি-ছুরিও নিয়ে আসে, ডাল কিছু ছেঁটেকেটে ফেলার জন্য। সেও পরিচর্যারই অঙ্গ। নইলে অকারণ অভিমান বেড়ে গিয়ে শুঁয়োপোকার ঢিবি বানিয়ে দেয় সারা শরীরে। নিজেরও জ্বালা, অন্যেরও জ্বালা তাতে।

218
Sat, 06/05/2021 - 13:00

ভাগবত একটা কথা বলে বসলেন, দেখো, এই যে মাটি, এই যে মাটিকে শুকিয়ে তুমি নানা বাসন বানাও, কাউকে বলো থালা, কাউকে বলো ঘটি, কাউকে গ্লাস, আদতে তো সব মাটি, তাই তো? এখন যদি বলো মাটি সত্য না বাসনগুলো সত্য? আমি বলি কি, তুমি সব কিছুকে মাটি বলে খেলাটাকে মাটি করে দিও না, মাটি যে যে রূপ ধারণ করেছে, সেই সেই রূপে না হয় ডাকলে তাকে। সেই হোক বাস্তব। 

    কথাটা তবে কি দাঁড়ালো, বাস্তব মানে কি? বাস্তব মানে তবে দাঁড়ালো, যা আছে তার সঙ্গে আমার চিন্তা বা কল্পনা। ইংরাজিতে বললে, ফ্যাক্টের গায়ে আমার কল্পনার কোটিং। যেমন ধরো সিমেন্ট, ইট দিয়ে বানানো একটা ঘেরা স্থানকে আমি কখনও বলছি বাড়ি, আবার কখনও বলছি মন্দির। বাড়ি বা মন্দির - যাই হোক, সে বাস্তব। ফ্যাক্ট কি? না একটা নির্মাণ। তার সঙ্গে আমার চিন্তা যোগ হয়েই হল বাড়ি। আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি। আমার মন্দির, তোমার মসজিদ, আমার চার্চ, তোমার গুরুদোয়ারা।  

    এটাই খেলা। আমার কল্পনায় তুমি আমার প্রেমিকা, তুমি আমার ভাই, তুমি আমার বন্ধু। চিকিৎসকের কাছে তোমরা সবাই মানুষ। এক হাস্পাতালে এক এক মানুষের জন্য এক এক মানুষের চিন্তা। চিকিৎসকের কাছে সব সমান। শুধু শরীর। শুধু ফ্যাক্ট। তবে কি শুধু ফ্যাক্ট দিয়ে জীবন চলে? না তো। তাই আমাদের কল্পনা আমাদের চিন্তার জগতেই আমরা আমরা হয়ে দাঁড়াই। আমাদের সুখ, আমাদের দুঃখ সব ওইটুকুতেই তৈরি হচ্ছে, ওইটুকুতেই ভেঙে যাচ্ছে। 

    কথাটা কঠিন। ভীষণ কঠিন। মন যুক্তি সাজায়। কল্পনা করে। পার খোঁজে। এমন কিছু খোঁজে যা অমর, যা নিত্য, যা ধ্রুব। একে তাকে আঁকড়িয়ে বসে। সমস্ত কিছু তার হাত থেকে খসে খসে যাচ্ছে। কিছু তার মনের মত হচ্ছে না। তার অভিযোগ জন্মাচ্ছে। ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। কাউকে বলার পাচ্ছে না। একজন কাউকে তো সব বলতে হবে নাকি? বলার মত কাউকে বানিয়ে নিচ্ছে। তার জন্য ঘর বানিয়ে, তাকে নানা সাজে সাজিয়ে, তাকে নানা উপঢৌকনে সাজিয়ে বলছে, তুমি আমার কথা শুনে চলো, তুমি আমার ইষ্ট। আবার খেলা ভেঙে যাচ্ছে। আবার সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার সব ফুরিয়ে যাচ্ছে। তবে কি কিছুই ধ্রুব নয়?

    এমন সময় জন্মালো বাঁশি। সে বলল, আমার প্রাণের কেন্দ্রে যে সুর, সে নিত্য। কিন্তু তাকে তো এমনি এমনি পাওয়া যায় না। এমনি পেতে গেলে আমি শুধু ছিদ্র, আমি শুধু বাঁশের এক টুকরো। কিন্তু যে সাধক সে জানে আমার প্রাণে জাগে সুর। সে সুর নিত্য। এ বিশ্বসংসার সৃষ্টিই হল সেই সুরে। সব রঙ, সব রূপ, সব রস সেই সুরের নানা প্রকার। সুরে জন্মাচ্ছে আবার সুরেই গিয়ে মিশছে। সেই সুর কি তুমি তুলতে পারো আমার প্রাণে? বাঁশি এই বলে মুখের দিকে তাকালো। 

    কিন্তু আমার যে অনেক কাজ বাঁশি! আমার সে সুর খোঁজার সময় কোথায় বলো? তার চাইতে এসো তোমায় একটা ঘর বানিয়ে দিই, তোমায় মালাচন্দন দিয়ে পুজো দিই, তোমার নামে স্তব বানাই। তোমায় আরতি করি, ধুপধুনো দিই। 

    বাঁশি বলল, সে তুমি দিতেই পারো। এ সব করতেই পারো। কিন্তু এতে তো আখেরে তুমিই পড়বে ফাঁকিতে। ঢক্কানিনাদ হবে। সুর উঠবে কি?

    কিন্তু আমার যে সময় নেই বাঁশি! আমার স্বরে উষ্মা, আমার চিত্ত বিক্ষিপ্ত, আমার মস্তিস্ক ধুমায়িত। মন স্থির হল কই যে বসে সুর সাধি?

    বাঁশি বলল, তবে আমি আজ আসি। যেদিন সব মিটে যাবে সেদিন আমায় খুঁজো। আমি আনাচে কানাচে সর্বত্র ছড়িয়ে আছি। এমনকি তোমাদের বানানো নর্দমার জলের স্রোতেও ওঠে সুর, তোমাদের ব্যস্ত কানে সে গিয়ে পৌঁছায় না। 

    এই কথা বলেই ভাগবতকারকে শুরু করতে বললেন ভাগবত রচনা। বললেন, দেখো সুরকে শুধু সুরের জন্যেই খোঁজো, আমোদের জন্য না। যেদিন নিজের প্রাণে সুরের অভাব জাগবে সেদিন বুঝবে সুরের নিজের মধ্যে নিজের কি মাহাত্ম্য! "শূন্য করিয়া রাখ তোর বাঁশি, বাজাবার যিনি বাজাবেন আসি"। এই শূন্যতা না জাগলে সুরের সাধন শুরু হয় কি গো?

    তবে আমার সংসার, আমার নিজের বেড়া দেওয়া এই ছোট্টোখানি আয়োজন, সব হারিয়ে যাবে যে?

    বাঁশি বলল, তাই কি হারায়? তোমার আঙিনায় যখন চাঁদের আলো এসে পড়ে, সূর্যের আলোয় তোমার বাগান হয়ে ওঠে পুষ্ট, তুমি কি সব হারানোর ভয় করো? সে তো লক্ষ যোজন দূর থেকে কত গ্রহ-তারকা ছাপিয়ে এসে দাঁড়ায় তোমার আঙিনায়। তবে? এই যে সেদিন, মেয়েটা যখন বলল, একমাসের জ্বরে সে কাবু হয়ে একা একা দিনরাত কাটালো। কখনও বারান্দায় বসে, কখনও শুয়ে, ক্লান্তিতে, দুশ্চিন্তায়…. তোমার বুকে বাজল না কথাটা? সে তোমার কে হয়? আপাতদৃষ্টিতে কেউ না। কিন্তু আপাতদৃষ্টি আপাত বলেই এত অগভীর। গভীরের কথাটা হল বুকে বাজে গভীর সুর। গভীর প্রাণে গভীর কান্না ওঠে, গভীর তাগিদ ওঠে ডানা মেলার, তা দাবিয়ে রাখ আপাত কিছুর অজুহাতে। তাই এত ভয়, এত আড়াল। নয় কি? একদিন সব আপাত ভেঙে পড়বে, সেইদিন আমায় ডেকো, আমি আসব, আমার প্রাণে সুরের দ্যোতনা খুঁজো। আমি সাড়া দেব। মিথ্যা বাইরে আর এটা সেটা বানিয়ে আমার খণ্ডিত করে নিজেকে ব্যর্থ কোরো না।

219
Thu, 05/20/2021 - 11:01

যখন ছোটোবেলায় মামাবাড়ি যেতুম, মানে উড়িষ্যায়, আমার মামারা প্রবাসী বাঙালি, সেখানে রাস্তায় কারোর সঙ্গে দেখা হলেই, হয় "জুহার আঁগিয়া" বা "রাম রাম" এরকম কোনো একটা সম্ভাষণ আসত। বড়দের মধ্যেই অবশ্য। এর পর ভারতের নানা জায়গায় দেখেছি দেখা হলেই প্রথমে হয় "রাম রাম" নয় "রাধে রাধে" ইত্যাদি বলে সম্ভাষণের একটা প্রচলন আছে। 

    বাংলায় সেরকম কিছু আছে? বাংলায় আছে,"ভালো আছেন"? যার উত্তর শুনতে হয় আমার সত্যিকারের কোনো উৎসাহ নেই, বা সময় নেই। ওই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া আরকি। অথবা যারা নিজেকে পাশ্চাত্যের ছিন্নমূল ভাবে তারা সাহেবি কেতায় 'গুড মর্নিং' গোছের প্রহর অনুযায়ী সম্ভাষণ করেন। আবার কেউ কেউ তার তর্জমা করে, শুভ সকাল বা সুপ্রভাত বলেন। অবিশ্যি এই সম্বোধনের অত্যাচার অনেকেই মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে রাতদিন নিশ্চয়ই পান। 

    আমাদের সেই অর্থে কোনো সম্ভাষণ নেই। হয় কপট প্রশ্ন নয় সাহেবি কেতা। কোনো কোনো সম্প্রদায় নিজেদের মধ্যে একটা 'জয়গুরু' সম্বোধন করেন যদিও, তবে সেটা খুবই মুষ্টিমেয়। সেটা ঠিক এখনও বাঙালিয়ানা পায়নি। 

    আমি বাংলা মিডিয়ামে পড়েছি। শিক্ষক মশায় ক্লাসে আসলে উঠে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু আমাদের 'গুড মর্নিং স্যার' বলতে কেউ শেখাননি। আমরা বলিওনি। এখন সব বাচ্চারা শুনেছি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সেইভাবেই 'গ্রিট' করে। এটা বেশ ভালোই। 

    আসলে আমি পড়াতে গিয়ে দেখেছি আমাদের মধ্যে মিউচুয়াল রেসপেক্টটা ভীষণ কম। না হয় এক অদ্ভুত সমাজসিদ্ধ জড়তা। আরো টের পাচ্ছি এই অনলাইনের চক্করে এসে। ধরুন আপনি ক্লাসে জয়েন করলেন। এইবার শুরুটা কি দিয়ে করবেন? আপনি যদি গুড মর্নিং বলেন, একজন দু’জন বলবে, বাকিরা মিউট মোডে। অগত্যা "শুনতে পাচ্ছিস কিনা" এরকম ধরণের অবজেক্টিভ কথায় শুরু করতে হয়। যেখানেও তারা মারাত্মক নন রেসপন্সিভ। আমি মফস্বল এলাকায় থাকি বলে কিনা জানি না, এত অদ্ভুত ব্যবহার ক্লাস নাইন থেকে টুয়েলভের বাচ্চাদের দেখে অবাক হতে হয়। ধরুন আপনি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কিছু একটা জানতে চাইলেন, এই বইটা আছে কিনা, বা এই নোটস আছে কিনা। কারোর কাছে থাকলে উত্তর পাবেন, না থাকলে তারা চুপ করে থাকবে। এটা যদি একজন দুজনের ক্ষেত্রে হত ভাবতাম এটা তার স্বভাব, কিন্তু আদতে এটা আপামর ছেলেমেয়েদের স্বভাব। এটা কি দোষের?

    আদৌ তা নয়। এটা দোষগুণের কথাই নয়। ওই যে বললাম আমাদের মিউচুয়াল রেসপেক্টটা ভীষণ কম। গভীর শ্রদ্ধাবোধ আমাদের মধ্যে সব সময় রেডিমেড মোডে থাকবে তা নয়। আমাদের নানা মুড নানা অবস্থায় হতেই পারে। সৌজন্য কথাটার জন্মই সেই জন্যে। সে ওই তাৎক্ষণিক যোগাযোগের রাস্তা বানিয়ে সে অভাবটা পূরণ করে দেয়। আমরা একটা স্বাভাবিক সুস্থ রাস্তা পাই। কিন্তু এই সৌজন্যবোধ কথাটাও খুব সম্মানের না আমাদের কাছে। "আমার সঙ্গে ওসব সৌজন্যতা দেখাতে হবে না"... এ খুব বহুশ্রুত কথা। সৌজন্যবোধটা যে শেখার জিনিস, নিত্য জীবনে রপ্ত করার জিনিস এটা আমাদের সামাজিক বিধানে খুব একটা কোনোদিনই নেই। ভক্তিবোধ আছে। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম ইত্যাদি আছে। কিন্তু সে বড় অতিরিক্ত। স্বয়ং রামকৃষ্ণদেবও বারণ করে বলেছেন ওসব মানসেই ভালো। কিন্তু সৌজন্যবোধটা সম্পূর্ণ আলাদা। সৌজন্যবোধ দিয়ে সামাজিক আদানপ্রদানের রাস্তাটা সোজা হয়। কিন্তু সেটা তো আর ধুম করে বিনা অভ্যাসে জন্মায় না। তার জন্য রীতিমতো একটা মানসিক, সামাজিক অনুশীলন দরকার। 

    তো যেটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, একজন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাতে একজন মানুষ কি কথাটা দিয়ে শুরু করবেন সেটা নিয়েই আমাদের কোনো প্রথা তৈরি হয়নি। খুব পরিচিত হলে এ সমস্যা হয় না। কিন্তু যার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বের বা আত্মীয়তার সম্পর্ক, সেখানে আপনি কিভাবে সম্ভাষণ করবেন তাকে? নমস্কারটা খুব দূরের সম্পর্কে হয়। খুব কাছের সম্পর্ক হলে? ওসব দরকারই হয় না। কিন্তু যে জন আছে মাঝখানে? হয় সাহেবি কায়দা, প্রহর অনুযায়ী অথবা কপট প্রশ্ন, "কেমন আছেন?" যদিও সাহেবি কায়দায় এর একটা হাও ডু ইউ ডু এর তর্জমা হয়। তবু সে যেন সম্ভাষণ হল না। অথচ আমাদের সংস্কৃত সাহিত্যে কি দারুণ সব সম্ভাষণ থাকত না? সেকি তবে শুধু সাহিত্যেই ছিল? বাঙালির সম্ভাষণ নিয়ে সমাজ বিশেষজ্ঞদের কি মত তবে? 

220
Tue, 05/18/2021 - 13:00

অন্ধকারে ভূত কল্পনা করে যেমন ভয় হয়,তেমনই এ বিশ্বসংসারের একজন চালক আছে কল্পনা করে ভক্তি হয়। 

    মজা হল, কল্পনাটা কল্পনাই, কিন্তু অনুভবটা তো বাস্তব। তাই অনুভবটা বাস্তব বলে মানুষ এরপর কল্পনাটাকেও বাস্তব বলে ভ্রমে পড়ে। ফলে ভগবান আর ভূত দুই-ই সত্যি হয়ে দাঁড়ায়। 

    একি ভুল কিছু? আদৌ নয়। কল্পনা আর বিশ্বাস খুব দূরের কথা নয়। আমি যাকে আমার বন্ধু বলে বিশ্বাস করি, তাকে দেখলে আমার অনুকূলভাবের অনুভব হয়। সেই অনুকূলভাবের অনুভবকে আমি ভালোবাসি। কারণ সে আরামদায়ক। স্বস্তিদায়ক। এইবার বাস্তবে কখনও যদি সেই বন্ধুটির সম্বন্ধে জানতে পারি যে সে আসলে আমার বন্ধু ছিল না, তখন আমার অনুভব হয় প্রতিকূল। আমি আমার স্বস্তিদায়ক অনুভব হারিয়ে ফেলি বলে আমার রাগ হয়। নিজেকে ঠকে গেছি বলে বোধ হয়। আরো রাগ হয়। 

    এরকম নানা বিশ্বাস আর কল্পনাজাত অনুভবে তৈরি আমাদের ঠুনকো জীবন। শঙ্করাচার্যের ভাষায় পদ্মপত্রের জলের মত টলটলায়মান। যে বিশ্বাস আর যে কল্পনা সদর্থক, সে বিশ্বাস ও কল্পনাজাত অনুভবেরাও সদর্থক; যে বিশ্বাস ও কল্পনা নঞর্থক, সে বিশ্বাস ও কল্পনাজাত অনুভবও নঞর্থক। এক-একজন মানুষের জীবনে এই সদর্থক আর নঞর্থক ভাবের এক এক অনুপাত থাকে। সেগুলো অবশ্যই পরিবর্তনশীল। মনের রোগ হলে, মনোবিদেরা এই সাম্যকেই নতুন বিশ্বাস বা নতুন কল্পনায় রাঙিয়ে সদর্থক অনুভবকে জাগিয়ে তুলতে চান। কারণ অনুভবটাই আমাদের অন্তর্জগতে বাস্তবতার পরিচায়ক। 

    তবে কি আমরা বাস্তবটা বাস্তব হিসাবে জানতে পারি না? না পারি না। আমরা আমাদের কল্পনা আর বিশ্বাসে রাঙিয়েই দেখি। তা যদি না হত তবে আমাদের সঙ্গে পশুদের পার্থক্য আর কি হত? তারাই আসলে ঘোর বাস্তবে আটকে। আমরাও আটকে, তবু আমাদের কিছুটা পারমুটেশান কম্বিনেশন করার সুযোগ আছে কল্পনা আর বিশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওদের সে সৌভাগ্য তাদের মস্তিষ্ক হতে দেয়নি। 

    তবে এই চক্রের হাত থেকে মুক্তি কিভাবে চাই আমরা? আমাদের অনুভবের ঢেউ কমিয়ে তাকে শান্ত করে। শান্তচিত্তে কেউ দুশ্চিন্তা করে না। আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কেউ অন্তরে শান্ত থাকে না। তবে? কোনটা আগে সামলাবো? অনুভব না কল্পনা? অনুভবটা বাইপ্রোডাক্ট। ওটা আমাদের সরাসরি হাতে নেই। আমাদের হাতে আছে কল্পনা আর বিশ্বাস। এই দুইকে নিয়ে আমরা কিছুদূর অবধি নাড়াঘাঁটা করতে পারি। আপনি যেমন ভাববেন, তেমন অনুভব হবে। মনের থেকে বৈরীভাব কমালে মন শান্ত হয়। এটা পরীক্ষিত সত্য। এই ভাবটা কমানোর জন্যেই এত এত ধর্ম তথা মহাপুরুষের আগমন। কিন্তু আমাদের সে সব শুনতে বয়েই গেছে। কারণ আমাদের বৈরিতার মধ্যে যে অনুভব তাকে ভালোবাসি। বেশ একটা যুদ্ধু হবে মত ভাব থাকলে মনে হয় এই তো বেঁচে আছি। মনে মনে হাজার একটা শত্রুপক্ষ বানিয়ে নিলে যে একটা চিড়বিড়ে অনুভব হয় তাকে আমরা বীরত্ব বলি। পুরুষাকার বলি। শান্ত অনুভবকে ম্যাদামারা বলি। ও আমরা চাইনে। আসলে আমরা চাই আমাদের মধ্যে অশান্তির অনুভব থাকুক। তবেই আমরা নিজেকে জীবিত বোধ করি। লালনের ভাষায় 'জ্যান্তে মরা' হয়ে আমার লাভটা কি? তাই আমরা মুখে যাই বলি না কেন, মনে মনে বেশ টকঝাল স্বাদের ভাবনা এনে, সেই থেকে চুঁইয়ে পড়া অনুভবে বাঁচতেই তো ভালোবাসি। রামকৃষ্ণ ঠাকুরের সেই আঁশচুপড়ির গল্প মনে নেই? সেই যে গো, একজন মাছ বিক্রি করে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। তো এক ফুল বিক্রেতার বাড়ি রাতে আশ্রয় নিল। তো সে মেছুনীর ঘুম কিছুতেই আসে না। অত ফুলের গন্ধে তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে যে! তবে উপায়? তখন সে কি করল, সেই আঁশ চুপড়িটা মাথার পাশে রেখে তাতে জল ছিটিয়ে ভোঁসভোঁস করে ঘুমাতে লাগল। 

    তো এই তো হল রামকৃষ্ণ ঠাকুরের গল্প। এখন যদি বলো, সেই আদিম প্রশ্নটা আমায় জিজ্ঞাসা করো, তা তোমার বাপু কি মনে হয়, ঈশ্বর আছেন কি নেই?

    আমি বলব, আমাদের অন্তরের জগতে বাস্তব বলতে যতটুকু আমাদের অনুভব, যেমন চোখের অনুভবে জগত শোভনে অশোভনে; কানের অনুভবে জগত সুরে অসুরে; জিভের অনুভবে জগত খাদ্যে অখাদ্যে ইত্যাদি ইত্যাদি; তেমনই চিত্তের অনুভবে জগত মঙ্গলে অমঙ্গলে। জগত বলে আমরা যা বুঝি প্রকারান্তরে সে আমার অনুভব শুধু। আমার স্ত্রী-স্বামী-পুত্র-কন্যা-আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-দেশ-রাজনীতি ইত্যাদি সবই আমার অনুভবের বাস্তবতায় বাস্তব। নইলে তারা আর পাঁচটা মানুষের মত শুধুই মানুষ। সম্পর্ক সূত্রহীন। তখন উকিল ডেকে ভালোবাসার মানুষকেই দূরে ঠেলার জন্য উঠে পড়ে লাগি। কারণ যে আমার অনুভবের অন্তরের বাস্তবতায় নেই তাকে বাইরের শুষ্ক জানার বাস্তবতায় বয়ে বেড়ানো অসহ্য। এইভাবে নানা মোড়ে আমাদের নানাভাবে ডিভোর্স হয়। এমনকি নিজের সাথেও? কিভাবে? বলছি। 

    আমাদের প্রত্যেকের নিজেকে নিয়ে একটা কল্পনা আছে। সেই কল্পনাজাত অনুভবও আছে। এখন সেই কল্পনা যখন কোনো কারণে ভেঙে যায় তখন নিজেকে নিয়ে নিজের অনুভবটুকুও নষ্ট হয়ে যায়। মানে এতদিন আমার অনুভবে বাস্তবে আমি যা ছিলাম তা হঠাৎ ভেঙে গেল। "আবার কোথা চলতে হবে গভীর অন্ধকারে"। এমন সময় মানুষ দিশা না পেয়ে আত্মহননের রাস্তাও বেছে নেয়। কারণ নিজের ইমেজ আর সেই ইমেজজাত অনুভব শূন্য হয়ে গেছে বলে তার বাস্তবতাই শূন্যতে এসে ঠেকেছে যেন। 

    এতো গেল কল্পনা আর বিশ্বাসের কথা আর তার সঙ্গে জন্মানো অনুভবের কথা। কিন্তু তথ্যে যা জানি? সে শুধুই স্মৃতিতে জমা নানা অকামের মণিমাণিক্য। জগত বলতে আমার অনুভবের প্রতিবিম্ব। সে অনুভবে তিনি থাকলে তিনি আছেন, তিনি না থাকলে তিনি নেই। এ তর্কের বিষয় নয়। তাই তর্কে এর সমাধান মেলে না। নিজের পথে নিজের মতে চললেই গোল মিটে যায়।

221
Thu, 05/13/2021 - 21:00

একটা সময় ছিল কুঁজো, ওয়াটার বোতল নিয়ে ট্রেনে উঠতাম। স্টেশান এলেই দৌড়ে গিয়ে জলের বোতল ভরে নিতে হত। বা অনেকক্ষণ ট্রেন থামার থাকলে কুঁজো নিয়েও দৌড়াতে হত। এ স্মৃতি অনেকেরই থাকবে। 

    একটা সময় ছিল যখন চাপাকলের জল ভারী এসে ড্রামে ঢেলে দিয়ে যেত। সেই ছিল কলের জল, রান্নার জল। 

    এই পানীয় জলের ধারণাই এখন কত বদলে গেছে। এখন প্রায় কেউই দৌড়ে গিয়ে স্টেশানের কলে জল ভরে না। এমনকি আনরিজার্ভড বগির যাত্রীরাও নয়। বোতলের জল কিনে নেওয়া হয়। ওটুকু খরচকে এখন মানুষ দরকার বলে জানে। বাড়িতেও আজকাল নানা ওয়াটার পিউরিফায়ার, নইলে কুড়ি লিটারের জল ইত্যাদি আসে। অবশ্যই পুরো ভারতবর্ষ তাই হয়ে গেছে তা অবশ্যই নয়। পানীয় জলের সমস্যা এখনও একটা জ্বলন্ত সমস্যা। কিন্তু আমি যা বলতে চাইছি তা হল পানীয় জলের প্রতি মানসিকতাটা আমাদের কিছুটা হলেও বদলেছে। 

    কি করে? অবশ্যই শিক্ষার মাধ্যমে। কি শিক্ষা, বিজ্ঞান? না, বাস্তবমুখী জীবনশৈলীর শিক্ষা। বিজ্ঞান তার সাধন, সাধ্য না। যদি তাই হত, বাঙালিকূল অন্তত যে পরিমাণ বিজ্ঞান পড়ে সেই পরিমাণে জ্যোতিষী চ্যানেলে চ্যানেলে, মোড়ে মোড়ে কল্কে পেত না। বিজ্ঞান নয়, জীবনশৈলী শিক্ষার প্রচার ভারতে হয়েছে। বেশ অনেক জায়গায় হয়েছে। রান্নাঘর, শৌচালয়, যৌনস্বাস্থ্য ইত্যাদি বেশ কিছু জায়গায় পরিবর্তন খানিক হলেও এসেছে। 

    তবে এই গোবরমাখাকূল, নানা জ্যোতিষীর চেম্বারে লাইন লাগানো কূল কারা? এই নানা কুসংস্কারের মূল কি? বিজ্ঞান শিক্ষার অভাব? আমার তা মনে হয় না। বিজ্ঞান একটা বিষয়। তার আলো আমাদের চিন্তার জগতে প্রভাব ফেলে না, সে আলো আমাদের বস্তুজগতে নানা সুবিধা তৈরিতেই ব্যবহৃত হয়। যেমন আমি একটা অত্যন্ত উন্নতমানের মোবাইল ব্যবহার করেও রাশিফল দেখতে পারি ওই মোবাইলের স্ক্রীনেই। আমি একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হয়েও একটা বিশেষ দিনে অপারেশান নাও করতে পারি ক্ষতির সম্ভাবনায়। কারণ বিজ্ঞান আমাদের বাইরের জিনিস, ভিতরের জিনিস নয়।          

    কেন নয়? আমাদের ভিতরের জগতে দুটো দিক আছে। এক বুদ্ধি-প্রজ্ঞা-যুক্তি-বিচার, যা কগনিটিভ দিক। আর একদিক হল, আবেগ, অনুভূতি যা নন-কগনিটিভ দিক। আমাদের এই কগনিটিভ রাজ্য আবার নন-কগনিটিভ রাজ্যের সঙ্গে এমন জড়িয়ে যে তাকে আলাদা করা মানে রামকৃষ্ণের ভাষায় দুধ আর তার ধবলত্বকে আলাদা করা। ভাষায় দুটো আলাদা করাই যায়। যেমন আমি বলতেই পারি সাদা দুধ। যেন সাদা একটা বস্তু আর দুধ একটা বস্তু। বাস্তবে তা না হলেও ভাষায় সব কিছুকেই আলাদা করে অস্তিত্ববান করে তোলা যায়। শাব্দিক অস্তিত্ব দেওয়া যায়। তা দিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু জীবন চলে না। 

    জীবনশৈলী - একে প্রভাবিত করতে পারে যে, সেই ব্যক্তিগত জীবনে কি সমাজ জীবনে স্থায়িত্বলাভ করে। এই জীবনের শিক্ষা কি বিজ্ঞান দিতে পারে না? পারে, তবে ক্লাসরুমের মধ্যে ভাষায়, বইতে না। বাস্তবে। যেমন ক্লাস নাইনের বিজ্ঞান বইতে হাত ধোয়ার কৌশল নিয়ে একটা অধ্যায় আছে। ওটা এতদিন তেমন গুরুত্ব পায়নি। নাম্বার তোলা ছাড়া। জীবনে গুরুত্ব দিল কোভিড। এখন অনেকেই বুঝেছেন ওই তিরিশ সেকেণ্ড ধরে নানা কৌশলে হাতটা পরিষ্কার করার পদ্ধতিটা আসলে শুধু নাম্বার তোলার সিলেবাস না। ওটা জীবনশৈলী। 

    তবে কথাটা সেই রবীন্দ্রনাথের কথাতেই ফিরে আসে, "জীবনে জীবন যোগ করা, না হলে কৃত্রিম পণ্যে ব্যর্থ হয় গানের পসরা"। এ কথা শুধু গানের ক্ষেত্রে না, সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। একটা কুসংস্কার, একটা অন্ধবিশ্বাস জীবনের সঙ্গে এমন মিশে আছে যে বুদ্ধি ঢাকা সরিয়ে ঢুকতে চাইলেও ঢুকতে পারছে না। ঢুকবে কি করে। বুদ্ধি ব্যাখ্যা করতে পারে। উপলব্ধি তো করতে পারে না। ব্যাখ্যা মানে তো বোঝা নয়। আপাত বোঝা। তাই অনেকেই না বুঝেও ব্যাখ্যা করে। কিন্তু যে বুঝেছে সে অনেক সময়েই ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারে না। উপলব্ধি করে জীবন। বোধ। যেমন যে মানুষটা বিজ্ঞানের ছাত্র সে যখন সিগারেট ধরায় তার মানে সে বুঝিয়েই দেয় বিজ্ঞান তার জীবনের সঙ্গে মিশ খায়নি। সেও ওই গোবরামাখা দলের থেকে বা আঙুলে এক বিশেষ পাথরের মহিমায় জীবন বদলে যাওয়ার আশা নিয়ে ঘোরা মানুষের থেকে আলাদা নয়। 

    বিজ্ঞান আর মহাপুরুষের উপদেশের বই, দুটোই আমাদের জীবনের সঙ্গে মেশেনি। ওভাবে মেশেও না। জীবনের সঙ্গে মেশাতে গেলে বই না, লেকচার না, নানা সামিট না, মিটিং না, যা লাগে তা হল জীবন একটা। জীবন শুধু জীবনের ভাষা বোঝে। বাকি যা কিছু তর্ক-বিতর্ক শুধু রাস্তার ধুলো ওড়াউড়িতেই শেষ হয়। কেউ আসেও না, যায়ও না। 

222
Tue, 05/04/2021 - 12:00

রাসেল বলতেন পুলিশ আর বিচারক, গণতন্ত্রের দুটো বড় সমস্যা। যদি এ দুটো ঠিকঠাক না হয় তো।

    জাস্টিস এর ক্ষেত্রে এই দুটো স্তম্ভ তো সত্যিই অপরিহার্য। যেখানে হাস্পাতাল আর মেডিক্যাল অক্সিজেনের এ হেন বেসামাল অবস্থা, প্রতিদিন মানুষের কি অসীম ধৈর্যের পরীক্ষা, এর থেকে বেরোনোর উপায় কি? শুধুই যদি বাইরের দেশের সাহায্যের প্রত্যাশায় থাকছি তবে আর এত এত কথা, আস্ফালনের মানে কি ছিল? দ্বিতীয় ঢেউ তো অপ্রকাশিত নয়, এক প্রকার ঘোষিতই তো ছিল।

    প্রতিদিন অক্সিজেনের অভাবে, বেডের অভাবে মৃত্যু পড়তে পড়তে অসাড় হয়ে যাচ্ছি। কোনো সান্ত্বনা আছে? নেই। কোনো জাস্টিস আছে? নেই। শুধু কথা আর কথা। এমনকি ভ্যাক্সিনের পর্যাপ্ত যোগানের কথাও শোনা যাচ্ছে না।

    আমি না হয় কড়া সমালোচনা করলাম। কিন্তু যে পরিবারগুলো সব হারিয়ে ফেলল, বা হারিয়ে ফেলার পথে, তাদের কি হবে? এর মধ্যে শুরু হয়েছে কালোবাজারি অক্সিজেন আর ওষুধ নিয়ে। গতবারে বারবার বলা হত থানায় ফোন করতে। এবারেও সেই কাজটা হচ্ছে না কেন? কেন বারবার ফেসবুকের পেজ জুড়ে এমন আবেদন হাহাকার? এমন সংকটে ফেসবুক টুইটারের তো সামাল দেওয়ার কথা না! কথা তো একটা সিস্টেমের। এমন ঘেঁটে যাচ্ছে কেন সব? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। মানে আমার হঠাৎ কোনো সমস্যা হলে আমায় ফেসবুকে বা টুইটারে লিখতে হবে। আর যারা, মানে যে শ্রেণীর মানুষরা এতটাও পারেন না, তারা? তারা কোথায় যাবেন? কোনো সহৃদয় ব্যক্তির মুখ চেয়ে পড়ে থাকবেন? এটা কোনো ব্যবস্থা হল? ফেসবুকে ফলাও করে নামীদামী মানুষেরা লিখে চলেছেন কোন ব্যক্তিবিশেষের তত্ত্বাবধানে হাস্পাতালে বেড পেয়েছেন, কি অক্সিজেন পেয়েছেন। আমার ওগুলো পড়ে আরো আতঙ্ক জন্মাচ্ছে। এটা তো কোনো উপায় হতে পারে না। এটা নিয়ে গর্ব করারও তো কোনো কারণ দেখি না। গত বছর পুলিশের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট প্রশংসনীয়। এ বছরে ভোটের জন্য সব ঘেঁটে যা তা অবস্থা। তারাই বা কি করেন!

    কিন্তু যেটা আমার সব চাইতে ভয় লাগছে, আতঙ্ক লাগছে, এ মহামারী ছেলেখেলা তো না। কিছু কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ সাংঘাতিক সমস্যার দিশা তো পাওয়া যাবেই না, আরো জটিল হয়ে যাবে। এটা রাস্তা না। রাস্তা হল একটা সিস্টেম দাঁড় করানো। এত বড় দেশে এত এত লক্ষকোটি মানুষের জন্য সুচারুভাবে ভোট নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়, আর তার মরণসংকটে জনসংখ্যার আর রুগী প্রবল সংখ্যার দোহাই দিয়ে ত্রাণ পাওয়া যায়? যায় না। আরো মাইক্রোভাবে প্রতিটা জোনকে ভেঙে দিয়ে না ব্যবস্থায় আনলে এ সম্ভব না। যে কোনো বড় সমস্যাকে ছোটো ছোটো ধাপে ভেঙে রাস্তা খুঁজতে হয়। যথামাত্রায় টেস্ট, আইসোলেশান, মনিটরিং - এর মধ্যে দিয়ে যদি ঠিকভাবে যাওয়া যায়, তবে এত বড় বড় বিপত্তি হওয়ার আগেই তো ঠেকানো যায়। নানা স্তরের মানুষকে কাজে লাগানো হোক না বেসিক মনিটরিং এর জন্য। অল্প কিছু প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিয়ে কি কাজটা শুরু করা যাচ্ছে না? যদি ভোটের ডিউটিতে এত এত কাজের মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়, তবে আজ এই শতাব্দীর মহাসংকটে মানুষ পাওয়া যায় না বলে আমার বিশ্বাস হয় না। অন্তত বেসিক মনিটরিং, লোকাল চিকিৎসক, আশাকর্মী ইত্যাদি সবাইকে নিয়ে একটা সিস্টেম তৈরি করে, মাইক্রো জোনে ভাগ করে নিয়ে, কাজটা শুরু করা যায় না?

    আবারও বলছি। শুধুমাত্র কয়েকজনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ ভয়ানক দাবানল নিভবে না। আপনি যদি বাড়ি থেকে এক বালতি জল এনে থাকেন তবে আপনার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এ যে দাবানল। একে নেভাতে এক শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মসূচি চাই। আবেগ না, বিচক্ষণতা চাই। আর কবে হবে?

223
Mon, 05/03/2021 - 18:35

কিছু নিন্দুক আমাকে ভৎর্সনা করিয়া বলিতেছেন ধর্মে আমার মতি নাই, তাই এ হেন ভৌটিক ফলাফলে কোনো আসন্ন স্বজাতি অবলুপ্তির আশঙ্কা করিতেছি না। অপরদিকে বামাচারী রাজনীতির বন্ধুরা চক্ষু রাঙাইয়া বলিতেছেন আমি আমার বৌদ্ধিক ক্ষমতার যথোপযুক্ত ব্যবহার করিতেছি না। অতএব এমত অবস্থায় আমায় আত্মপক্ষ সমর্থনে গুটিকয়েক কথা না বলিলেই নয়।

    প্রথম কথা আমি তো আস্তিক বটেই। যেইদিন হইতে জানিয়াছি জগতে ঈশ্বরের পাদপদ্ম হইতে শ্রেষ্ঠ আর কোনো সম্পদ নাই, সেইদিন হইতে ওনার শ্রীচরণযুগলের মাপ জগৎ সংসারে প্রশ্ন করিয়া ফিরিতেছি। শাস্ত্রের পর শাস্ত্র ঘাঁটিয়া চশমার কাঁচের ওজন ও প্রস্থ বাড়াইয়াছি, সৎসঙ্গ করিয়াছি, কিন্তু কেহ আমায় জানায় নাই। আমায় বলা হইয়াছে, ওঁর চরণে আমার হৃদয় ধরিয়া দিলেই সমস্ত সমস্যার সমাধান হইবে আপনিই। সেখানেও আমি প্রশ্ন করিয়াছি, উনি কোন প্রকোষ্ঠে ওঁর শ্রীচরণযুগল রাখিবেন? হৃদয়ে একটি বাম প্রকোষ্ঠ ও ডান প্রকোষ্ঠ আছে পড়িয়াছি। বামে কি উনি রাজি হইবেন? কিন্তু ডানে শুনিয়াছি দূষিত রক্ত প্রবাহিত হইয়া থাকে। তো এ হেন জটিল দ্বান্দ্বিক অবস্থায় কি করিয়া হৃদয় ওঁর চরণে দান করি?

    কেহ কোনো উত্তর করিল না। আর দেখুন, যেহেতু আমি সমস্ত সংসারে সবাইকে ব্রহ্ম দ্বারা আচ্ছাদিত দেখি, অগত্যা আমি যে সাম্যবাদী ইহা লইয়া কোনো সংশয় রহিতেই পারে না। মায় শ্রীকৃষ্ণ অবধি গীতায় বলিয়াছেন সাম্যে মন স্থির রাখাই জীবনের উদ্দেশ্য। তবে? এখন কাহারো পার্শ্বে দাঁড়াইতে চাহিলে সে যদি তাহার পার্শ্বে দাঁড়াইতে না দেয়, তবু জোর করিয়া দাঁড়াইতে চাহিলে তাহাকে ‘গায়ে পড়া’ মানুষ বলে না? সাম্যবাদী হইব বলিয়া কি গায়ে পড়া হইতে হইবেক? বিশেষ করিয়া এই সামাজিক দূরত্ব রাখিবার কালে?

    অগত্যা আমি ভীষণভাবেই একজন আস্তিক সাম্যবাদী মানুষ এই লইয়া কোনো গোল থাকিল না। পূর্বে ভাবিতাম কিছু পুস্তক অধ্যয়ন করিয়াছি, তাহাতে কিছু হইলেও জ্ঞান হইয়াছে। কিন্তু এই ফেসবুকে আসিয়া নানা ব্যক্তির সহিত পরিচয় হইয়া বুঝিয়াছি উহাদের পাঠ তালিকার কাছে আমি ভাইরাস অপেক্ষাও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। অগত্যা একে নানা সংশয়, তাহার উপরে পঠিত জ্ঞানের পরিমাণ এতই সামান্য যে সে সব ছাড়িয়া এখন নানা প্রকার ওটিটিতে মনোনিবেশ করিয়াছি। এই যেমন নেটফ্লিক্সের নানা ওয়েব সিরিজ দেখিয়া আমার জ্ঞান হইয়াছে, দুটি পুরুষের মুখোমুখি দেখা হইলেই গোলাগুলি হইবার সম্ভাবনা, আর একজন পুরুষ ও একজন নারী মুখোমুখি হইলেই বিবস্ত্র হইয়া আদিম যোগে যাইবার সম্ভাবনা। অর্থাৎ বুঝিতেছেন, আপনাদের কারোর মনের মত উত্তর সাজাইয়া লিখিবার অবকাশ ও ইচ্ছা দুটোই আমার নাই। প্রতিদিন যে শ্বাস গ্রহণ করিতে সক্ষম হইতেছি, এবং আশেপাশের আত্মীয়-বন্ধুবান্ধব-প্রতিবেশী যাহারা স্বাভাবিকভাবে শ্বাস গ্রহণ করিতে পারিতেছেন তাহাদের সবার সৌভাগ্যকে স্বীকার করিতেছি নতমস্তকে। কিন্তু আজ ভীষণ দুর্দিনে এত হাহাকারে কাহারো গর্বের আত্মস্ফীতি দেখিয়া লজ্জায় মাথা নীচু হইতেছে। তিনি নেতা হোন, চিকিৎসক হোন, কোনোরূপ সাহায্যপ্রণেতা হোন, “মনে রেখো, আমিই ছিলাম” গোছের উক্তিকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইতেছি। একে অন্যকে তুচ্ছ করিবার প্রবৃত্তি দেখিয়া স্তম্ভিত হইতেছি। সদ্য শ্রী সত্যজিৎ রায় মহাশয়ের শতবর্ষ গেল। তিনি তাঁহার একটি সিনেমায় 'Floccinaucinihilipilification' শব্দটি ব্যবহার করিয়াছিলেন। অন্যতম দীর্ঘ ইংরাজি শব্দ যাহার অর্থ কাহাকেও তুচ্ছ করা। এই প্রবৃত্তিটি তো স্বাস্থ্যকর নহে, এই দুঃসময়ে।

224
Tue, 04/13/2021 - 00:49

এই যে মাঝে মাঝেই বলতে শুনি, ও এসব বোঝে না, ওকে যা দাও ও খেয়ে নেবে, সে তোমার রান্নায় নুন হোক না হোক, সিদ্ধ হোক না হোক, মিষ্টি হোক না হোক... ও কিচ্ছু বলবে না, চুপ করে খেয়ে উঠে যাবে

ওকে তুমি যা দাও পরে নেবে। পুজোপার্বণ বলো, কি যে কোনো অনুষ্ঠান বলো, যা কিছু একটা পরে চলে যাবে, ওর ওসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

এই কথাগুলো যে বলে আর যাকে বলে তারা দুজনেই মনে মনে জানে কথাগুলো কতটা মিথ্যা। কতটা অতিরঞ্জিত। একটা কুকুরও বুঝতে পারে কোন খাবারটা তার রুচি অনুযায়ী আর কোন খাবারটা না। একটা মাকড়সাও জানে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে তার ভালো লাগে থাকতে। আর একটা মানুষ জানে না? তাও হয়!

আসলে এর মধ্যে একটা সুক্ষ্ম অভিনয় আছে। বা বলা যেতে পারে ডিফেন্স মেকানিজম। দেখেছি যে বাচ্চাটা বা যে মানুষটা কিছুটা অবহেলায় বড় হয় তাদের স্বভাবে এইদিকটা জন্মে যায়। সব সময় এমনও নয় যে বাবা বা মা নেই। এমন হয় যে মা বা বাবা হয় তো উদাসীন। অথবা আর্থিকভাবে অপারগ। তবে দেখেছি আর্থিক অপারগতা ততটা বড় কারণ হয় না, যতটা উদাসীনতা হয়। তখন সেই বাচ্চাটার মধ্যে এমন একটা ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি হয়ে যায় সে নিজেকে এগুলো থেকে একটা ডিনায়াল মোডে নিয়ে চলে যায়। কিন্তু মনের গভীরে একটা পুঞ্জীভূত অভিমান থেকেই যায়।

আমার কথা এই অভিমানটা নিয়ে। সে মানুষটাকে একটু যত্ন করলে, একটু খেয়াল রাখলে তার চোখের কোল ভরে আসে এমন দেখেছি তো। ওরকম মিথ্যা কাউকে মহত্বের আসনে বসিয়ে কাজ গুছিয়ে নেওয়ার মানুষের অভাব নেই চারপাশে। বিশেষ করে খুব কাছের লোকদেরই বলতে শুনেছি, বাবা ওকে নিয়ে আমার কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। আসলে স্পষ্ট করে কেউ সংসারে বলে না ওকে নিয়ে ঝঞ্ঝাট আমার পোষায় না। তাই সে কথাটাই এইভাবে ঘুরিয়ে বলা। আর এই মিথ্যার অভিনয়ে যদি সংসারে শান্তি থাকে তবে আর কি, তাই সেই মহৎ মানুষটিও নিজের মহত্বের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে রাস্তাটা সুগম করার বৃথা চেষ্টায় কাল কাটিয়ে দেয়। কিন্তু কোনো মিথ্যার আয়ুই সংসারে বেশিদিনের তো নয়। তাই এই মিথ্যাও যেদিন হঠাৎ করে বে-আব্রু হয়ে পড়ে সেদিন ঝড় ঠেকানো দায় হয়। যে এতদিন মহত্বের প্রশংসা করে আসছিল সে সেই মহৎ ব্যক্তিকে হঠাৎ নীচ, কপট ইত্যাদি সোচ্চারে বলতে শুরু করে। আর যে সংসারে শান্তি রক্ষার জন্য এতদিন চুপ করেছিল, সে সমস্ত অভিমান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমস্ত পৃথিবীর সব মানুষকে মতলবী স্বার্থপর ভাবতে শুরু করে। দুই পক্ষই ভুল করে। কিন্তু কোনো মিথ্যাকে দীর্ঘদিন লালন করার মূল্য তো দিতেই হবে।

আসলে মানুষ অনেক সময় থই পায় না তার গভীরে জমা দুঃখকে সে কিভাবে মোকাবিলা করবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় উপেক্ষায় না অভিমানে? সে বুঝে উঠতে পারে না। শোক, দুঃখ গভীরে গভীরে তাকে কুরে কুরে খায়। শোক বা দুঃখকে যেহেতু সংসার খুব ভালো চোখে দেখে না, তাই তাকে মহৎ সেজে সুখী মানুষের অভিনয়ে জগতে নামতেই হয়। কিন্তু শোক ভিতরে ভিতরে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তার ঈশ্বরে বিশ্বাস, মানুষে বিশ্বাস ইত্যাদি সমস্ত বিশ্বাস করার ইচ্ছা বা আস্থা রাখার ক্ষমতাকে বিবশ করে দেয়। নিজের ভিতরে এক গভীর অন্ধকারে ডুবতে থাকে। কাকে বলবে? কার সঙ্গে কথা বলবে যে আমার শোক আমার দুঃখ আমায় নিঃস্ব করে দিচ্ছে ভিতরে ভিতরে। আমি অসংবেদনশীল, আত্মেকেন্দ্রিক, চতুর হয়ে উঠছি দিনে দিনে। আমি ঈশ্বরকে অবিশ্বাস করি কিন্তু ঈশ্বরের সামনে আমি কপট ভক্তের অভিনয় করে চলি। কারণ আমার যেন মনে হয় ঈশ্বর একজন চরম ক্ষমতাশালী নীতিহীন মানুষের মত। যে জগতটাকে তার ইচ্ছা মত এক্সপ্লয়েট করেই যাচ্ছে।

সে বলতে পারে না, আমার ঈশ্বর সম্বন্ধে এই নীচ ধারণা আমায় আরো নীচ করে তুলছে। আমি অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছি। সবটা বুঝতে পারছি, কিন্তু নিজেকে আটকানোর ক্ষমতা আমার যেন নেই। এই সমস্ত শুরু হয় আমার গভীরে আমার নিজের দুঃখের আর শোকের প্রতি চূড়ান্ত দুর্বলতার জন্য। আমি ওদের ভালোবাসি যেন। কি ভীষণ অনৈতিক অমানবিক এটা, কিন্তু তবু এটাই আমি হয়ে উঠছি দিনে দিনে। আমি কপট, স্বার্থপর, চতুর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছি। আর সবটাই হচ্ছে আমার গভীরে আমারই প্রশ্রয়ে লালিত আমার দুঃখনুরাগ, শোকের জন্য।

এ কথাগুলো বলার মানুষ নেই। আমাদের সমাজ এই ধরণের কথা বলার সুযোগ করে দেয় না। পাশ্চাত্য দেশে শুনেছি এরকম মানুষদের নিয়ে ছোটো ছোটো গ্রুপ তৈরি হয়। তারা নিজেদের মধ্যে দেখা করে। এক সঙ্গে আলোচনা করে। বুঝতে পারে এই বিশেষ সময়ে সে একা নয়। তার অনুভূতিগুলো অস্বাভাবিক নয়। সে নিজের হাতটা বাড়িয়ে দেয়। সে হাত ধরার মানুষকেও পায়। বিপন্নতায় নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে না সে।

আমাদের এখানে তাকে কপট মহৎ হতে হয়। নিজের ভিতরে জমা পুঞ্জীভূত অভিমান, দুঃখ, বিপন্নতার বোধকে চেপে চলত শিখতে হয়। সঙ্গে জন্মায় মহত্বের মোহ। আমাদের সমাজে আসলের থেকে নকলের দাম বেশি। সাচ্চার থেকে ভণ্ডামির আদর বেশি। এ আমার কথা না, কবীরের উপলব্ধি। তো সেই নকল মহত্বের লোভ চেপে বসলে আরো বিপদ। আর যেদিন থেকেই এই মহত্বের অভিনয় বন্ধ করা হবে সেদিন থেকেই আশপাশের মানুষদের শ্লেষাত্মক কথায় বেঁধা শুরু হবে। "ওর তো আজকাল খুব মুখ হয়েছে,... আজকাল কি কথা শিখেছে…. আজকাল খুব বুঝতে শিখেছে….".....

এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আশেপাশের নকল আত্মীয়-বন্ধু বিয়োগ বা বিরূপ হলেও খাঁটি বন্ধু আত্মীয়ের পরিচয়ও পাওয়া যাবে সঙ্গে সঙ্গে। যারা মুখোশের চিরস্থায়ীত্বের ভরসায় পাশে আসেনি, মুখোশটা খুলে ফেলার অপেক্ষাতেই যেন ছিল।

গভীরে দুঃখ থাকুক, শোক থাকুক, সে যেন আমার শিকড়ে প্রবেশ করে আমার প্রাণরস শোষণ না করে এ খেয়াল রাখাটা আমাদের কর্তব্য। আর মানবিকতা হল, আমার পাশের মানুষটাকে মহত্বের আড়ালে না ঢেকে তার অভিমান বা ডিফেন্স মেকানিজমটা ভেদ করে আসল মানুষটাকে খুঁজে নিয়ে, নিজের ভালোবাসায়, সহমর্মিতায় তাকে আসল মানুষ হতে সাহায্য করা। আমাদের জীবনটা মহাপুরুষ না হলেও চলে, কিন্তু দোষেগুণে ভরা মানুষকে পাশে না পেলে চলে না, এইটা বুঝতে হবে। তাই ঈশ্বর নিজের নির্ভুল ঈশ্বরত্বকে আড়ালে রেখে দোষেগুণে ভরা মানুষকেই পাশে রেখেছেন। রাস্তাটা ওর মধ্যে দিয়েই খুঁজে নিতে বলেছেন। নিখুঁত হওয়ার চেষ্টায় নয়, বরং সমস্ত খুঁতকে ভালোবাসায় ঢেকে নেওয়ার সাধনায়। একটা গান দিয়ে শেষ করি…..

 

নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা।

মন রে মোর, পাথারে হোস নে দিশেহারা ॥

 

বিষাদে হয়ে ম্রিয়মাণ বন্ধ না করিয়ো গান,

সফল করি তোলো প্রাণ টুটিয়া মোহকারা।।

 

রাখিয়ো বল জীবনে, রাখিয়ো চির-আশা,

শোভন এই ভুবনে রাখিয়ো ভালোবাসা।

 

সংসারের সুখে দুখে চলিয়া যেয়ো হাসিমুখে,

ভরিয়া সদা রেখো বুকে তাঁহারি সুধাধারা ॥

225
Wed, 03/31/2021 - 23:30

ভালো দু’প্রকার। 

    এক, সোজা ভালো। যেমন ফুল, সুস্বাদু খাবার, মিষ্টি কথা, সুগন্ধ, শ্রুতিমধুর সঙ্গীত ইত্যাদি। 

    দুই, লব্ধ ভালো। খুব কঠিন এটা। এটা মানে যেমন ধরুন আকরিক থেকে ধাতু বার করা। জমি চাষ করে, রীতিমতো জমির সঙ্গে, খরার সঙ্গে লড়াই করে ফসল আনা। এই ভালো সব সময় মন্দের সঙ্গে মিশেই থাকে। আলাদা করা খুব কঠিন কাজ। শ্রমসাধ্য কাজ। ধৈর্য ও সংযমের কাজ। 


    খারাপ, দুই প্রকার। 

    এক, সোজা খারাপ। যেমন দুর্গন্ধ, বাজে কথা, পচা খাবার ইত্যাদি ইত্যাদি। 

    দুই, অচর্চিত খারাপ। যেমন মানুষের ভাষা, রুচি, অভ্যাস ইত্যাদি ইত্যাদি। এরা ডিফল্ট মোডে খারাপই থাকে। অসংস্কৃত, অমার্জিত, অসভ্যই থাকে। এদের চর্চা করলে ভালো হয়। সেই যে গো, "এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা".... এই আবাদ না করে রেখে সেই অমার্জিত, অসংস্কৃত, অসভ্য অবস্থাকেই অনেকে বলে আসল অবস্থা। সে বিশ্বাসই করে না ওগুলো আসল অবস্থা না, ওগুলো অচর্চিত অবস্থা। কেউ কেউ গানের গলা নিয়ে জন্মালে মোটামুটি সবাইকেই চর্চা করেই গানের গলা তৈরি করতে হয়। " ওই অ-রেওয়াজি গলাই আমার আসল অবস্থা" বললে কথাটা অসম্পূর্ণ সত্য বলা হয়। 

 
    এতো কথা কেন বলছি? আসলে হয়েছে কি, আমাদের মাটিতে দীর্ঘদিন খাঁটি চর্চার জায়গায় ভণ্ডামি বা অলীক আত্মতৃপ্তিতে পেয়ে বসেছিল। ফলে এদিকে অমার্জিত, অসংস্কৃত মাটি, কিন্তু তার উপরেই কৃত্রিম কালচারের চাদর ঢেকে বেশ চলে আসছিলাম। ভাবছিলাম সবাই যখন এতেই মজেই আছে এইভাবেই চলে যাবে। 

    কিন্তু তা হল না। হুস করে চাদর গেল উড়ে। আমরা সবাই টের পেলাম আমরা আসল অমার্জিত মাটির উপর নকলের চাদর বিছিয়ে এতদিন গর্ব করে আসছিলাম। একজন বিজ্ঞজন বলছেন শুনলাম, আমি তো ভাবতেই পারি না যে অমন অশালীন কথা শুনে জনতার মধ্যে এত হর্ষধ্বনি ওঠে কি করে?

    আমার কথাটা শুনে হাসি পেল। এ যেন সেই ঠাকুরের গল্পের মত। একজন যাত্রা শুনবে বলে সবার আগে এসেছিল। সামনে জায়গা নিয়ে মাদুর পেতে শুলো। ভাবল দেরি আছে যখন ঘুমিয়ে নিই। ওমা! সে ঘুম ভাঙল যখন যাত্রা শেষ হয়ে গেছে তখন। 

    আমার মনে হল তাকে জিজ্ঞাসা করি, ওহে বুদ্ধিজীবী, আপনি কি ঘোর নিদ্রায় ছিলেন? গঙ্গা দিয়ে কত জল যে বয়ে গেল!

    আজ আমাদের প্রতিপদে লজ্জা। ওদের মুখোমুখি হই সে সত্যের জোর নেই। কারণ আমাদের বুলি ছাড়া আর সম্বল কিছু নেই। সত্যকারের কাজ আমরা করিনি। গর্ব করেছি কষে আর অন্যদের হেয় করেছি পরম ঔদ্ধত্য নিয়ে। 

    আজ যখন দেখছি নিজেকেই চিনি না, ওরা বাইরে থেকে এসে আমাদের চিনে নিয়ে আমাদেরই উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তখন আমাদের আসলেই আর লজ্জা রাখার জায়গা নেই। নিজের দুর্বলতা বুলি আর বক্তৃতা দিয়ে মেটানো যায় না। কাজ কই? মানুষকে চেনা কই? কিস্যু হয়নি। মূর্খের স্বর্গে বাস করে ভেবেছি সারা বাংলা রবীন্দ্রনাথ আর সত্যজিতে একেবারে হেউঢেউ হয়ে আছে। আদতে কিস্যু হয়নি। নিজেকেই নিজে চিনিনি। মুখটাকে সুসজ্জিত করতে গিয়ে সারা গায়ে ছ্যাদলা পড়ে গেছে। এখন নিজের গা কে অস্বীকার করে শুধু মুখটুকু নিয়ে কি বাঁচা যায়? তাই ওরা আজ যখন গা ধরে টানছে, আমরা তখন ওদের নানা রকম বিদেশি ফ্যাসিস্ট ট্যাসিস্ট শক্ত গালাগাল দিয়ে ভাবছি বেজায় একটা কাজ করছি! এও নিজেকে ঠকাচ্ছি। আর হাস্যকর করছি। আসলে আচমকা ঘুম ভাঙা তো, তাই সামলাতে পারছি না আর কি।

226
Mon, 03/29/2021 - 16:30

ওদের দেশে এই নিয়েও গবেষণা হয়! ধ্যান করে কি হচ্ছে এই নিয়ে কোন গবেষণা মানে মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা, অবজেক্টিভলি ভারতে হয়েছে কি না জানি না। এই যে এত দীক্ষা, এত নানা ধরণের যোগ-কৌশল --- এতে কি আদৌ কোন স্থায়ী মানসিক পরিবর্তন ঘটে? ধরুন, এমন কোন নিয়ম হল, কোন একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তিন হাজার জন দীক্ষিত মানুষকে নিয়ে একটা সমীক্ষা করা হল। বারো বছর পর তাদের চেতনা, বিকাশ এবং অদীক্ষিত মানুষদের চেতনার বিকাশের মধ্যে কি কি পার্থক্য এল? বারো বছর ধরে লাগাতার কোন কিছু করলে অবশ্যই একটা অভ্যাসের বিবশতা তৈরী হয় বটে, তবে সেই বিবশতাকে বাদ দিয়ে সত্যিই কি চিত্তের ঔদার্য, বিচারক্ষমতা, মানবিক উৎকর্ষতা ইত্যাদি বাড়ে? যদি বলি ধর্ম ও অধ্যাত্মিকতা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র মনসংযম শিক্ষার কথা, তবে সে শিক্ষার মুল্য স্বীকার করা যায়। পৃথিবীতে নানা পেশা অনুযায়ী মনোনিবেশের নানা মান গুরুত্ব পায়। কিন্তু ধর্মীয় ও অধ্যাত্মিক অনুশীলনগুলো?

    মুশকিল হল, ধর্মপ্রমাণস্বরূপ মহাপুরুষেরা অন্যের ভালোর জন্য নরকে যেতে প্রস্তুত, কিন্তু তার শিষ্যেরা স্বর্গ কিম্বা ততোধিক উচ্চধাম ব্যতীত অন্য কোন ধামে যেতে প্রস্তুত নয়। যীশুখ্রীষ্ট বারবণিতাদের মধ্যে চলে যাচ্ছেন; কবীর, দাদু অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষের কাছে পৌছে যাচ্ছেন; বিবেকানন্দ অন্যের ভালোর জন্য নরকে যেতে প্রস্তুত না থাকলে তাকে রামকৃষ্ণের শিষ্যত্ব দিতেই নারাজ, কোনোরকম রামকৃষ্ণলোকের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন না, কিন্তু পরবর্তীকালে স্বর্গ ও নানা লোকে গমনের উদ্দেশ্যই প্রধান হয়ে গেল। তবু এ-ও বাহ্য।

    একটা সময় নানা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ও নানা সম্প্রদায়ে, পাঠচক্রে গিয়ে মানুষের চড়া আমিত্ববোধ দেখে বিস্মিত হয়েছি, যে আমিত্ববোধ ছদ্ম বিনয়ের মোড়কে ঢাকা। যেন তিতো ক্যাপসুলে চকলেটের মোড়ক। কার গুরু অবতারের মধ্যে বরিষ্ঠ, কার ভগবান একমাত্র ভগবান, কার সম্প্রদায় শ্রেষ্ঠ সম্প্রদায় --- এই নিয়ে বিতর্ক চলছেই। আরোও আছে, যেমন ধরুন, যে সম্প্রদায় নিরামিষ খায় তারা আমিষ যারা খায় হয় তাদের ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট অথবা কনসিডারেবল নিকৃষ্ট --- এই দু’ভাবে দেখে। নিজের সমপর্যায় ভাবার ক্ষমতা তাদের নেই। নিরামিষ খাওয়ার গর্ব কি সাংঘাতিক! প্রচ্ছন্নভাবে এই অহংকার দ্বারা তাদের ব্যক্তিত্ব যে নিয়ন্ত্রিত তা তারা নিজেরাও বোধ করি টের পায় না। তেমনই যে একঘন্টা জপ করে, কিম্বা উপোষ করে, কিম্বা ধ্যান করে, অথবা তীর্থে যায় --- এদের বহু মানুষের মধ্যে এই চড়া আমিত্ব’র প্রচ্ছন্ন অবস্থান অনুভব করা যায়। কিছু বললেই তাদের ভাবাবেগে আঘাত লাগে, হাত-পায়ের নখ বেরিয়ে যায়।

    কথামৃতের একটা ঘটনা আছে, একবার আদি ব্রাহ্মসমাজ ও সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ নিয়ে তর্ক চলছে। তর্কের বিষয় --- নানা অসঙ্গতি। রামকৃষ্ণদেব শুনছেন। কেউ একজন আপত্তি তুলে বললেন, এসব আলোচনা আবার কেন? রামকৃষ্ণদেব বলেন, না না। এসব আলোচনার দরকার আছে। কারণ অন্যায় ও অসত্য দেখলে চুপ করে থাকতে নেই।

    এবারে বর্তমানে আসুন। যখন সেই মানুষটির নামাঙ্কিত প্রতিষ্ঠানের নানা অসঙ্গতি নিয়ে লিখতে গেছি, তখন নানা আক্রমণের মুখোমুখি পড়তে হয়েছে। বন্ধুবিচ্ছেদ হয়েছে, কুকথা শুনতে হয়েছে। কারণ, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে তাদের ইগো জড়িয়ে। কি আয়রনি! এদিকে রোজ ‘খন্ডন ভব’ গাওয়া হচ্ছে, ওদিকে সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার নিরহংবোধও জন্মাচ্ছে না।

    একজন চিকিৎসক, একজন লেখক, গায়ক, অভিনেতা, উকিল, শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদির যে কেউ অহংকারি হতে পারে। না হলে ভাল, কিন্তু হওয়াটা অসঙ্গত কিছু নয়। কিন্তু একজন যিনি নিজেকে আত্মবোধ জাগরণের সাধক বলেন, মানে অধ্যাত্মিক পথের পথিক বলেন, তার অহমিকা থাকা সোনার পাথরবাটি তুল্য। যে ‘আমি’রূপ ঢিপি নিচু না হলে রামকৃষ্ণের ভাষায় ‘কৃপারূপ জল দাঁড়ায় না’, সে ‘আমি’রূপ ঢিপিকে নানা অলঙ্কারে সুসজ্জিত করে রাখলে তা তার শোভা না বাড়িয়ে, গৌরব না বাড়িয়ে তাকে লজ্জাই দেয়। কারন, সে পথের প্রথম শর্তই হল স্থূল আমিত্ববোধের ত্যাগ। সে শেষের কথা নয়, সে-ই শুরুর কথা। 

    একবার ভাবুন, সত্যিই যদি এমন সমীক্ষা হয়, সত্যিই যদি দেখা যায় বারো বছরের গবেষণার পরে কোন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই আর অহমিকার বিষটা নেই, তবে তা কত ভালই না হয়? কিন্তু বাস্তবটা আমরা জানি। সেই সমীক্ষা অনুসারে যদি সেই ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলোর কপট গুরুগিরির ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়, এবং বলা হয় তোমাদের প্রদর্শিত পথে শুধুমাত্র মোটা মোটা অহংকারযুক্ত মানুষই তৈরী হয়ে যাচ্ছে, বিবেকী নিরহংকারী মানুষ তৈরী হচ্ছে না, এতএব তোমরা ব্যর্থ, তাই তোমাদের সে অধিকার থেকে সরিয়ে দেওয়া হল, তখন? তারা বলবে, আমরা সবাই ভাল, পথও ভাল, শিষ্য ভাল না। তখন তাদের বলা হবে, ভাল শিষ্য খারাপ শিষ্য বোঝার ক্ষমতা যদি তোমাদের না থাকে, সে-ও কি তোমাদের লজ্জা নয়?

    এর বিপরীতে এমন অনেক তথাকথিত অধ্যাত্মিক জীবনহীন নম্র ভদ্র মানুষ আমরা দেখি। তাদের কোন গুরু নেই, প্রতিষ্ঠান নেই, কিন্তু তাদের একটা সাধারণ বুদ্ধি আছে। সাধারণ বুদ্ধি যদি কোন মানুষের বিকৃত না হয়ে থাকে তবে তার আলাদা করে নানা কৌশলে আমিত্ব হননের রাস্তা বাছতে হয় কি? আমার বিশ্বাস হয় না। নানা কৌশল ইত্যাদি কোন মহাপুরুষই শেখান নি। কেউ বলেছেন, নাম কর; কেউ বলেছেন, প্রার্থনা কর; কেউ বলেছেন, সেবা কর --- কিন্তু সে সবই ভালবেসে কর। বাকি যা কিছু পড়ে থাকে সে ব্যবসা, সে কৌশল। ‘সত্য বল, সুপথে চল’ লালন গোঁসাইয়ের একথা, সাধারণ বুদ্ধিকে ডাক। মানুষের সাধারণ বুদ্ধি মানুষের শ্রেষ্ঠতম আশীর্বাদ। বাদবাকি সব অলংকরণ, আভরণ। সাধারণ বুদ্ধিটাকে মেরে শুধু ঐসব কৌশল নিয়ে পড়ে থাকা সজ্জিত মৃতদেহ বৈ আর কিছু নয়। প্রাণ নাই শুধু কথা, আর কথা, আর কথা আছে...

227
Thu, 03/18/2021 - 15:00

লোক নিয়ে অনেক কথা রামকৃষ্ণদেবের অবজারভেশানে আছে---

 

১) লোক না পোক

===============

ধরুন রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে যদি দার্শনিক নীৎজের দেখা হত, যিনি ফস্ করে বলে বসেছিলেন, 'God is Dead', সেই মানুষটির যদি রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে দেখা হত তবে এই অবজারভেশনে দু'জনের দারুণ মিল হত। নীৎজের ভাষায় মানুষের দল হল, পশুর পালের মত। আজ যে আমরা এই 'হার্ড ইম্যুউনিটি' করে চিল্লাচ্ছি। এই সেই 'heard' শব্দ, শব্দটা নিঃসন্দেহে 'hard', তবে এই শব্দটাতে দু'জনের মিল আছে।

কখন বলতেন এই কথা, যখন মানুষের অগভীর মতামতের প্রসঙ্গ উঠত। মানে অগভীর জনতার মতামতের মূল্য আর কি। সে নিয়ে তো চন্দ্রিল মহাশয়েরও একখানা জবরদস্ত বক্তব্য আছে না, যেখানে উনি বলছেন 'পথের পাঁচালী'-র চাইতে 'বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না' সিনেমার পাব্লিক রেটিং বেশি!

এই নিয়ে সক্রেটিসের মতামতও এক। সেই যে গো, ওনার মৃত্যুর আগের দিন ওনার এক শিষ্যের সঙ্গে সারারাত কথা হল না? শিষ্য বারবার করে বললেন, চলেন দাদা পাইলে যাই…. আর সক্রেটিস ওকে বারবার করে বোঝালেন যে, না বাবা ওসব প্ল্যান করে লাভ নেই। সেখানেই তো বললেন, ওসব জনতার মতামতের গুরুত্ব কিছু নাই।

আজকাল অবশ্য আমরাও বলি, 'এক্সপার্টস্ ভিউ'। অর্থাৎ 'তবে একলা চলো রে'-এর বেলায় 'লোক না পোক' না ধরলে লোকের কথার জবাবদিহি করতে কর‍তে জীবন জেরবার। সেই যে কামিনী রায়ের কবিতাটা মনে করুন, "পাছে লোকে কিছু বলে"। কি খাঁটি একখানা কবিতা না?

 

২) মনুমেন্টের মাথায় চড়লে লোকগুলো এই ক্ষুদে ক্ষুদে, সব মিশে এক

========================================================

এও এক কথা। উচ্চদর্শনের কথা। ভাবের কথা। যখন মানুষ কোনো শিক্ষার, কোনো সত্যের বড় ধাপে এসে দাঁড়ায় তখন ভেদবুদ্ধি আপনিই সরে যায়।

আচ্ছা এ কথাটা কি শুধু অধ্যাত্মবোধ প্রসঙ্গেই খাঁটি? তা নয়। দেখুন যে মানুষটা চিকিৎসক, সে মানুষটার কাছে কি আমাদের এই আপাত শ্রেণীবিন্যাসের কোনো মানে আছে? নেই। একটা বড় মঞ্চে নানা বৈচিত্র‍্যের সমাগম সেখানে। যেমন ধরুন রক্তের বিভাগ আছে, কিন্তু রক্তহীন মানুষ তো বলার জো নেই। কারো হৃৎপিণ্ড বাঁদিকে, কারোর ডানদিকে, কিন্তু হৃৎপিণ্ড নেই এ কথা তো কেউ বলবে না! তাই ঠাকুর বলতেন, সব মিশে এক হয়ে যায় গভীর দর্শনে বা তত্ত্বে। ব্যবহারিক জীবনে ভিন্নতা থাকবেই। যেমন, সব জলই জল। কিন্তু কোনোটা নর্দমার, কোনোটা পানীয়, কোনোটা কাচাকাচির, কোনোটা আচমনের ইত্যাদি। আরো উদাহরণ দিচ্ছেন, যেমন সবার মধ্যেই নারায়ণ আছেন। কিন্তু বাঘ নারায়ণকে দূর থেকে নমস্কার কর‍তে হয়। কি খাঁটি কথা দেখুন। কয়েকটা মানুষ বাঘের খাঁচায় ঢুকে কি বেঘোরে প্রাণটা দিল দেখেছেন না ইউটিউবে? সেই তো, কেউ অমন টপ্ করে খাঁচায় ঢুকে মালা পরাতে যায় বাঘকে?

 

৩) ক্ষীরের পোর, কলাইয়ের পোর

===========================

এও আছে। কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বললে কি হয়? প্রাণ জুড়িয়ে যায়। আর কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বললে প্রাণ জ্বলে যায়। তুলসীদাসজী বলছেন না, সাধু অসাধু দু'জনেই দুঃখ দিতে ওস্তাদ। সাধু দেখা না দিয়ে, আর অসাধু দেখা দিয়ে। তো ঠাকুরের অবজারভেশানে, “মানুষগুলি দেখতে একরকম, কিন্তু ভিন্ন প্রকৃতি। ... পুলিগুলি দেখতে সব একরকম। কিন্তু কারু ভিতর ক্ষীরের পোর, কারু ভিতর নারিকেলের ছাঁচ, কারু ভিতর কলায়ের পোর।"

তা বলে কি দুষ্ট লোকের দরকার নেই? রামকৃষ্ণদেবের অবজারভেশান অনেক বাস্তবমুখী। উনি বলছেন, দেখো দুষ্ট লোক না হলে তালুক শাসন হত কি করে?

কি বাস্তব কথা, তাই তো! কূটবুদ্ধি, প্যাঁচালো বুদ্ধি ইত্যাদি না থাকলে কি আর রাজনীতিতে টেকা যায় বাপ! বলি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের হেডমাষ্টারি করা আর একটা দেশের হেডমাষ্টারি করা কি এক নীতিতে হতে পারে? একজন হেডমাষ্টার যেভাবে ভালো মানুষ হতে পারেন, একজন দেশের প্রধান সেই অর্থে ‘ভালো মানুষ’ হলে কি হয়? তবে আর কূটনীতি বলা হচ্ছে কেন? তাই রামকৃষ্ণদেবের অবজারভেশানে কূটনীতির মানুষকেও দরকার। আরেক জায়গায় বলছেন, দেখো মূলটা কোনদিকে থাকে? অবশ্যই আমাদের উত্তর হবে নীচের দিকে থাকে। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, মানুষের যেটা মূল, অর্থাৎ কিনা মাথাটা, সেইটাই গেল উপরের দিকে। কি আজব সৃষ্টি!

তবে গোলমেলে মানুষের সঙ্গে পাল্লা পড়লে কি করব? এখানে দুটো দাওয়াই দিচ্ছেন। প্রথম কথা, বাবা, কূটস্থ বুদ্ধি হতে হবে। কেমন? না কামারের ঘরে দেখোনি, অত জোরে জোরে নেহাই পড়ছে গরম লোহার উপর, তবু সে তা সহ্য করে যাচ্ছে। সেরকম। ঠাকুর আরেকটা উদাহরণ দিচ্ছেন, মানুষ যখন বনে থাকত, কি সাধুরা যে বনে-জঙ্গলে ধ্যান করে, সেখানে কি হিংস্র প্রাণী নেই? তবে সেরকম সমাজেও হিংস্র মানুষ থাকবে এ আর নতুন কথা কি? আমায় সতর্ক হতে হবে। কিভাবে? না বুদ্ধিকে স্থির রেখে। বুদ্ধি গুলিয়ে গেল তো হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। তখন তো আমি অন্ধকারের খপ্পরে পড়েই গেলাম না? তাই হাতটা শক্ত রাখতে হবে, মানে বুদ্ধিটা স্থির রাখতে হবে। যেন টর্চ হাত থেকে পড়ে না যায়। বুদ্ধি যেন যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে ভেসে না যায়। বুদ্ধি স্থির রাখলে কি হবে? ফোঁস করবে কিন্তু বিষ না ঢালার ক্ষমতা জন্মাবে। কালেভদ্রে ফোঁস যে করতেই হবে সে কথা ঠাকুর আমাদের ভালো করে শিখিয়েই গেলেন। রম্যাঁ রলাঁ বলছেন, এক গালে চড় খেলে আরেক গাল বাড়িয়ে দিয়ে চড় খাওয়ার যে শিক্ষে খ্রীষ্ট দিয়েছেন, সেকি আর সব জায়গায় কাজে আসে? তাই রামকৃষ্ণদেব, রম্যাঁ রলাঁ'র ভাষায় “খ্রীষ্টের ছোটোভাই”, এই শিক্ষা দিয়েছেন যাতে করে সংসারে নিজের রাস্তাটা নিজে বুঝে নিয়ে চলা যায়। ওই যে বললাম, বাস্তবমুখী শিক্ষা।

 

৪) বালিশের ওয়াড় ও উদ্দীপন

======================

এ এক অদ্ভুত দর্শন। মানুষগুলো যেন বালিশের ওয়াড় পরানো এক চৈতন্য, ঠাকুরের মা, সচ্চিদানন্দ। ভিতরে তুলো সব এক। মানুষ প্রকৃতিতে যা কিছুর পোরই হোক না কেন, ক্ষীর কি কলাইয়ের, সব শেষে তো সব মা! এই জায়গায় বুঝি না। সে তো আকাশ অসীম, অণু-পরমাণু কিছুই বুঝি না। অ্যাদ্দিন যা পড়াশোনা করে বড় হলাম, তার কতটুকু বুঝলাম? হিসাব করে দেখলে হয় তো কিছুই না। কিন্তু আমার বোঝাবুঝির উপর নির্ভর করে তো আর জগতে মহতের অস্তিত্ব নয়। তাই ঠাকুরের এই কথা, এই চরিত্র বড় অদ্ভুত। কাউকে বলছেন, তোমার তো অত টাকা ওদের গ্রামে এত জলের কষ্ট, একটা পুকুর খুঁড়ে দাও না। আবার নিজের স্ত্রী-কে জিজ্ঞাসা করছেন, তোমার ক'টা রুটি লাগে, সেই অনুযায়ী রাসমণির ভবতারিনী মন্দিরের খাজাঞ্চিকে বলে যেতে হবে না, নইলে তিনি চোখ বন্ধ করলে সারদাদেবীর যদি খাওয়ার কষ্ট হয়?

আবার এও আছে, “অনেক মানুষ একসাথে দেখলে আমার উদ্দীপন হয়।” আমার মনে হয় ভারতের অধ্যাত্মিক জগতে এ এক নতুন কথা। যেখানে মানুষ গুহায়, জঙ্গলে গিয়ে একা থাকার, নির্জনে থাকার উপায় খুঁজছে, যাতে করে সে তার সাধন আর সাধনার উপলব্ধিকে অসংক্রামিত রাখতে পারে জনসংযোগ এড়িয়ে গিয়ে, ইনি সেখানে মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, নাটক-থিয়েটার দেখে বেড়াচ্ছেন। আবার বলছেন, এত মানুষ একসঙ্গে দেখলে আমার যে উদ্দীপন হয় গো।

আমরা বলব, কেন তোমার বিরক্ত লাগে না? তোমার ঘৃণা লাগে না?

রামকৃষ্ণদেব হেসে বলছেন, কই লাগে না তো। সবই তো মা। এত মানুষ একসঙ্গে মানে তো বিরাটের সংস্পর্শ। কেন তুমি শোনোনি, গীতায় আছে, “সর্বতঃপাণিপাদং তত্সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্। / সর্বতঃশ্রুতিমল্লোকে সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠতি।।"... সর্বত্র যাঁর পাণিপাদ, সর্বত্র যাঁর চক্ষু, মস্তক এবং মুখ, সর্বত্র যাঁর কর্ণ, তিনি ইহলোক সমস্ত ব্যাপ্ত করে অবস্থান করে আছেন। আমি তো তাঁকে দেখি, স্পষ্ট দেখি। তাঁতে তোমাতে আমাতে কোন ভেদ দেখি না তো!

আমি বলব শুনেছি তো, কিন্তু এমনভাবে কাউকে মিশে যেতে তো দেখিনি। লোকে লোকের মেলা খোঁজে নিজেকে বড় করবে বলে, নেতা কি গুরু হবে বলে, কিন্তু লোকের সমুদ্রে ডুবে যাবে বলে লোক খুঁজতে তো দেখিনি ঠাকুর কাউকে আগে!

রামকৃষ্ণদেবের কথায় আছে, যে ছাদে উঠেছে, সে দেখে ছাদ যা দিয়ে তৈরি সিঁড়িও সেই চুন-সুড়কি দিয়েই তৈরি। ছাদে ওঠার প্রথম সিঁড়ি থেকে ছাদ অবধি রামকৃষ্ণদেব হাত ধরে থাকেন যদি হাতটা বিনা শর্তে বাড়িয়ে দেওয়া যায়।

রামকৃষ্ণদেব প্রচারবিমুখ শুধু ছিলেন না, প্রচারক্ষুব্ধও ছিলেন। কেশব চন্দ্র সেনের সদ্য ছেলের বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা উপহার পাঠিয়েছিলেন ঠাকুরের কাছে। তার কয়েকদিন আগে আবার ঠাকুর সম্বন্ধে কাগজেও ছাপিয়ে ছিলেন। ঠাকুর তাঁকে কি মিষ্টি মিষ্টি করে ঝাড়ছেন শুনুন। এ ঝাড় আমাদের সবার জন্য। আজ এই ২০২১ সালে বসে যখন এই লেখাটা লিখছি তখনও মনে হচ্ছে, কি সত্য কথা, কি সোজা দিশা। চোখে পড়ে না কেন?

“আমার নাম কাগজে প্রকাশ করো কেন? বই লিখে, খবরের কাগজে লিখে, কারুকে বড়ো করা যায় না। ভগবান যাকে বড় করেন, বনে থাকলেও তাকে সকলে জানতে পারে। গভীর বনে ফুল ফুটেছে, মৌমাছি কিন্তু সন্ধান করে যায়। অন্য মাছি সন্ধান পায় না। মানুষ কি করবে? মানুষের মুখ চেয়ো না - লোক! পোক! যে মুখে ভাল বলছে, সেই মুখে আবার মন্দ বলবে। আমি মান্যগণ্য হতে চাই না। যেন দীনের দীন, হীনের হীন হয়ে থাকি!”

228
Wed, 03/17/2021 - 12:30

উইলিয়াম ডালরিম্পলের লেখা একটা বই কয়েক মাস আগে পড়েছিলাম - নাইন লাইভস্। নয়জন মানুষের উপর লেখা বেশ সুখপাঠ্য গভীর দরদী একটা বই। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষের ন’টা জীবন। প্রত্যেকেই জীবনটা কিনারা বরাবর হাঁটছেন বা হেঁটেছেন তাদের বিশ্বাস, বিচিত্র রীতি ইত্যাদির উপর গভীর আন্তরিক আস্থা রেখে। ডালরিম্পল কারোর আস্থাকে সংশয়ের চোখে দেখছেন না, বিদ্রুপ করছেন না। তিনি তাদের সবার সামনে একটা জীবন জিজ্ঞাসা নিয়ে এসে দাঁড়াচ্ছেন। তিনি মৃত্যুমুখী দেবদাসীই হোন, কি জৈনধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসিনীই হোন যিনি অন্নজল ত্যাগ করে ধীরে ধীরে মৃত্যুকে বরণ করে নিচ্ছেন, কি বাংলার অন্ধ কানাইদাস বাউলই হোন।

অসামান্য একটি বই। পড়তে পড়তে আমার বারবার কালকূটের কথা মাথায় আসছিল। বারবার মনে হচ্ছিল যেন আমি ইংরাজি ভাষায় কালকূট পড়ছি। মানুষের অন্তঃস্থলকে এমন আন্তরিকভাবে, এমন দরদের সঙ্গে ছোঁয়ার ক্ষমতা তো সবার থাকে না। সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস তো আমাদের প্রাথমিকভাবে জন্মেই যায়, তার জন্যে তো আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি লাগে না। কিন্তু সে সবকিছুকে সরিয়ে একজন মানুষকে শুধু মানুষ হিসাবে ছুঁতে পারার কি অসামান্য জ্বলন্ত দলিল এই বইটা! বইটা শেষ হল একটা মন খারাপ নিয়ে। আন্তরিক, সহজ, সরল যা কিছু হারালেই মন খারাপ লাগে। মন উদাস হয়।

প্রতিটা ধর্ম বা সম্প্রদায়ের তিনটি প্রধান স্তম্ভ থাকে। এক যিনি প্রতিষ্ঠাতা বা প্রবর্তক; দুই, তার লেখা বা তার কথা কি জীবনী নিয়ে লেখা একটি বা কয়েকটি মূল বই; তিন, তাকে ঘিরে একটা সঙ্ঘ বা সম্প্রদায় বা সমাজ। সেও আবার দুই রকম --- এক সন্ন্যাসী বা ব্রহ্মচারীদের নিয়ে; দুই, সাধারণ মানুষদের নিয়ে যারা আবার সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয়ভাগে বিভক্ত। ইংরাজিতে যাদের বলি প্র্যাক্টিসিং হিন্দু / মুসলিম ইত্যাদি, আর নন-প্র্যাক্টিসিং।

মানুষ জন্মায় যখন অবশ্যই কোনো না কোনো সম্প্রদায়েই জন্মায়। সেই সম্প্রদায়ের শিক্ষা-রীতিরেওয়াজের মধ্যে বড় হতে হতে যখন সে পূর্ণাঙ্গ পূর্ণ বিকশিত মানুষ হয় তখন সে দেখে অনেক কিছু সে মেনে আসছে যার যুক্তিগত ভিত্তি সে পাচ্ছে না। হিন্দুধর্মে অনেক উপসম্প্রদায়ের ব্যবস্থা আছে। অনেক অনেক বিচিত্র বিশ্বাস, অনেক অনেক গুরু, তাদের ঘিরে এক একটা সঙ্ঘ তথা সমাজ, সে তখন সেই সবের মধ্যে নিজের বিশ্বাসের নতিকে পরীক্ষা করে দেখে কোনটা তার পক্ষে ঠিক। সেই মতে সে তখন দীক্ষা নেয়। আবার কেউ কেউ কোনো মতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে না পেরে সব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে সম্প্রদায়হীন একক কোনো এমন মানুষকে খোঁজেন যিনি তার চিত্তের আর যুক্তির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য ঘটাবেন। বাঙালির ক্ষেত্রে এ কাজটি অনেক সহজ হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের মাধ্যমে। ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা, ঈশ্বরপ্রেমের তৃষ্ণাকে কোনো বিশেষ একটি সমাজের অধীনে না থেকেও উপলব্ধি করার এবং শান্তি ও আনন্দ লাভ করার পথ সহজ হয়েছে। সে ঈশ্বরের ধারণা অরূপ নিরাকার হওয়াতে নিজের বোধের সঙ্গে একটা অনির্দিষ্ট প্রজ্ঞার সুষমা গড়ে তোলাও সহজ হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের আগে যে পথটি দেখিয়ে এসেছেন বাউলেরা। আর ভারতের অন্যপ্রান্তে কবীর বিশেষ করে। পরবর্তীকালে বাউলের রাস্তায় অনেক সংকীর্ণতা এসেছে। যা মহৎ ছিল তা ক্ষুদ্রের সীমানায় প্রতীক হয়ে বদ্ধ হতে চেয়েছে। মানুষ তার অসীমের তৃষ্ণাকে প্রতীক আর গোষ্ঠীসুখের মাধ্যমে পূরণ করতে গিয়ে নিজেকে সংকীর্ণ করেছে, ঈর্ষা আর হিংসার দাসত্ব করে চলেছে। গোষ্ঠী তৈরি হলেই সংকীর্ণতা জন্মাবেই। এ অবশ্যম্ভাবী। কয়েকজন মানুষ হঠাৎ করে নিজেদের নিয়ে দল পাকালেই সে অন্যদের থেকে নিজেকে পৃথক ভাববে, নিজেকে বেশি পবিত্র, বেশি উচ্চমার্গের, বেশি ঠিক ভাববেই। এ হতে বাধ্য। রুচির পার্থক্যে মানুষ পৃথক হবেই। সমস্যা সেখানে হয় না। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, বাড়িতে মাছ আনা হয়েছে, মা যার যেমন পেটে সয় সেই অনুযায়ী এক এক ছেলের জন্য এক এক পদ রান্না করেছেন। কাউকে ভাজা, কাউকে ঝোল, কাউকে কালিয়া ইত্যাদি।

এ অবধি বাস্তব। কিন্তু যেই কেউ বলে বসে যে কালিয়াটাই মাছের সর্বশ্রেষ্ঠ পদ, ভাজাটা না, অমনি সংকীর্ণতা এসে পড়ে, তার থেকে ঈর্ষা আর হিংসা। কেউ বলে না আমি আমার রুচি অনুযায়ী চলছি ভাই তুমিও তোমার রুচি অনুযায়ী চলো। এইটা কেউ বলে না। রমণ মহর্ষিকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল নানা মতে এত বিবাদ কেন? উনি উত্তর দিয়েছিলেন, যে যার নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে না বলে। আরো সোজা ভাষায় যে যার নিজের চরকায় তেল দেয় না বলে। অন্যের চরকার বিচার করতে গিয়েই আমাদের যত সমস্যা। আসলে বিচার তো নয়, তুলনা। তুলনা করার ইচ্ছা প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে জন্মায়। আর প্রতিযোগিতার মনোভাব ক্ষমতার লোভ বা ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার মনোভাব থেকে জন্মায়। কিন্তু সত্যকে অনুভব করবার সাধনা আর ক্ষমতার লোভ কি একসঙ্গে যায়? যায় না। তাই প্রয়োজনের চাইতে আয়োজন বড় হয়ে ওঠে। মন্দির ক্রমে আকারে আয়তনে বেড়ে ওঠে, সম্প্রদায়ে সদস্যপদ বাড়ানোর জন্য প্রকল্প হয়, নিজের প্রবর্তকের বা গুরুর আসন আর সবার আসনের থেকে উঁচুতে রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। আড়ম্বরের চাপে সেই ‘তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলে থাকি’ দশা হয়।

কিন্তু এ সবের বাইরে যাওয়ারও রাস্তা থাকে। সে রাস্তায় একা হাঁটতে হয়। অথবা কালেভদ্রে কাউকে হয় তো মেলে। সেই রাস্তা খোঁজার ডাক জন্মায় প্রাণের গভীরে। সে তখন দল না, বই না... কিছুতেই শান্তি পায় না। সে মানুষের মধ্যে মানুষ খুঁজে বেড়ায়। সে পাগল হয়। সে ক্ষ্যাপা হয়। সে সাঁই হয়। সে বাউল হয়। ডালরিম্পলের মধ্যে কোন বাউল লুকিয়ে সে ডালরিম্পলই জানেন। কিন্তু বাউল তো আছেই একজন, নইলে এ ভাষা, এ ভাব জন্মায়?

 

229
Mon, 03/15/2021 - 13:47

আজ রামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি। অবশ্যই এ বছরে এ তিথির গুরুত্ব অন্যরকম। রামকৃষ্ণদেব মানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা। কথা ক্রমে স্লোগান হল। স্লোগান ক্রমে ব্র্যাণ্ড ভ্যালু হল। ক্রমে অবতারে পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠ ঘোষিত হলেন - অবতার বরিষ্ঠায়। তারপরে সব কিছু প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে গেল। মানুষ সোজা সাপটা দীক্ষা পেল, সিরিয়াল পেল, সিনেমা পেল। একটা ব্র্যাণ্ড তৈরি হয়ে গেল। একটা নির্দিষ্ট ছাঁচ তৈরি হয়ে গেল, ব্যস, সব শেষ হয়ে গেল।

    কি শেষ হয়ে গেল? স্পিরিটটা শেষ হয়ে গেল। এল নিয়ম, এল কৃষ্টি, এল প্রথা। কথামৃতের বিক্রি যথেষ্ট ভালো। নানা প্রকাশনী থেকে বের হয়। ওনার জীবন নিয়ে লেখা দুটো বই, এক, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ আর দুই, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ। প্রথমটির রচয়িতা স্বামী সারদানন্দজী। দ্বিতীয়টির রচয়িতা সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত। দ্বিতীয় বইটি রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক ত্যজ্য, ওনাদের স্টলে পাওয়া যায় না, কারণ ওটা সাহিত্য প্রামাণ্য নয়। এরকম নানা কোন্দলে, নানা মতে, নানা দর্শনে মূল কথাটা চাপা পড়ে গেল দেশ জুড়ে যে তিনি আসলে সব ধর্মকে এক জায়গায় দেখেছিলেন

    কোনটা প্রধান হল? তিনি লেটেস্ট মডেল অফ অবতার, এবং তাই শুধু না, তিনিই শ্রেষ্ঠ। এ গোলমালটা যে হবে তা বিবেকানন্দ আঁচ করতে পেরেছিলেন, তিনি চিঠিতে বারবার লিখেছিলেন, "তবে একঘেয়ে গোঁড়ামি দ্বারা তাঁর ভাবের ব্যঘাত হয়-এইজন্য চটি। তাঁর নাম বরং ডুবে যাক - তাঁর উপদেশ (শিক্ষা) ফলবতী হোক। তিনি কি নামের দাস?" বিবেকানন্দ আরও বলছেন যে, "সর্বদা মনে রেখ যে, পরমহংস দেব জগতের কল্যানের জন্য এসেছিলেন - নামের বা মানের জন্য নয়। তিনি যা শেখাতে এসেছিলেন তাই ছড়াও।".... "everything must be sacrificed, if necessary, for that one sentiment-universality"

    কিন্তু বিবেকানন্দের শঙ্কাই সত্যি হল। আজ দেশে রামকৃষ্ণের শিক্ষার কোনো জীবন্ত ছবি নেই। কয়েকজন ব্যতিক্রমী মানুষের বিশ্বাসে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে সে শিক্ষা সজীব হয়ে ওঠেনি। ‘রামকৃষ্ণ মিশন’ সেই অর্থে মানুষের চিত্তের পরিবর্তন ঘটিয়ে উঠতে পারেনি। আজ গোটা বাংলা সেই প্রমাণ দিচ্ছে। এ বাংলা কার? কিন্তু দীক্ষা হচ্ছে হাজার হাজার, পাঠচক্র হচ্ছে, ভাষণ হচ্ছে, বই লেখা হচ্ছে সব হচ্ছে, কিন্তু মানুষের চেতনার যে পরিবর্তনের কথা ঠাকুরের মুখ থেকে উচ্চারিত হল সেই চেতনা উধাও হয়ে গেল। আজ বহু লোভী, অসৎ, চতুর মানুষের বাড়ি বাড়ি রামকৃষ্ণদেবের ছবি, মার্বেলের সিংহাসন, অমুক মহারাজের দীক্ষায় দীক্ষিত হওয়ার স্টেটাস সিম্বল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের আঙিনা ছাপিয়ে রামকৃষ্ণের শিক্ষার অস্তিত্ব আজ কোথায়? আমাদের শিক্ষাঙ্গনে তিনি আজ অবধি অস্পৃশ্য। ধর্মের মানুষ করে রেখে তাঁর যে এই একটা ইমেজ তৈরি করে রাখা, এতে ফল তো ভালো হল না। 

    সাহিত্যিক কমলকুমার মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও বর্তমান যুগের স্বনামধন্য দর্শনের অধ্যাপক অরিন্দম চক্রবর্তী প্রমুখেরও একজন রামকৃষ্ণ আছেন। যিনি কোনো মঠের না, অবতার না, তিনি একজন দার্শনিক, একজন চিন্তাশীল মানুষ। সেই রামকৃষ্ণকে আজ ভীষণ দরকার আমাদের। 

    দীক্ষা হোক, মন্দির হোক, পূজা প্রার্থনা সব চলুক। যার যেমন বিশ্বাস সে নিয়েই সে চলবে, কিন্তু এর বাইরে একটা বড় রামকৃষ্ণ আছে। বৃহৎ, অপ্রাতিষ্ঠানিক, উদার, একা রামকৃষ্ণ। সেখানে তিনি কোনো প্রস্তরমূর্তি নন, তিনি জীবন্ত, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - তীর্থক্ষেত্র। রবীন্দ্রনাথ কেন রামকৃষ্ণকে বলছেন,

“বহু সাধকের
   বহু সাধনার ধারা,
ধেয়ানে তোমার
   মিলিত হয়েছে তারা;
তোমার জীবনে
   অসীমের লীলাপথে
নূতন তীর্থ
   রূপ নিল এ জগতে;
দেশ বিদেশের
   প্রণাম আনিল টানি
সেথায় আমার
   প্রণতি দিলাম আনি।।"

    রামকৃষ্ণকে অনুধাবন করতে প্রথম শর্তই হল একটা বড় চিত্ত। কোনো সংকীর্ণতা, একঘেয়েমি ওনার ভাবের সঙ্গে যায় না। ওনার দর্শনের সঙ্গে খাপ খায় না। কিন্তু আমি যতগুলো পাঠচক্রে ঘুরে দেখেছি, কী অসীম সঙ্কীর্ণ মানসিকতা নিয়ে ওনাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সেখানে ওনার উদার শিক্ষার একটাই সমাধান - “ওসব আমাদের জন্য না”... “ওসব অনেক উঁচু কথা”। কি স্পর্ধা আমাদের, আমি ছোটো হয়েছি বলে তুমিও ছোটো হও। তুমি যদি ছোটো না হও তবে তোমায় আমি ছোটো করে আমার ছাঁচে বেঁধে নেব। কি ভয়ানক ঔদ্ধত্য আমাদের, রামকৃষ্ণের কাছেও নাকি আসব, আবার বড় কথা শোনার মত চিত্তকেও তৈরি করে আসব না। কি সাংঘাতিক স্পর্ধা! যেন এভারেস্টকে একটা ঢিবি বানিয়ে দাও আমি ওর উপরে উঠে একটা পতাকা পুতে আসব, আমার বলে ঘোষণা করে আসব। বড় জিনিসকে নিজের করে পাওয়া যায় না, সেখানে নিজেকে বড় হওয়ার শর্ত লাগে, সে শর্ত পূরণে আমি নারাজ, তাই দাও আমার জন্যে একটা রামকৃষ্ণ পার্ক বানিয়ে, আমি নেচেকুঁদে আমোদ করে বেড়াই। 

    এ নিতান্ত আমাদের হতভাগ্য। আমাদের সবার হতভাগ্য যে রামকৃষ্ণোত্তর যুগেও এ দেশে দাঙ্গার ভয় থাকে। এ দেশে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের বীজ নষ্ট হয় না। কারণ আমরা অবশেষে রামকৃষ্ণকে একজন হিন্দু, কিছুটা ব্যতিক্রমী হিন্দু সাধক-অবতার --- এর বেশি দেখতে শিখলাম না। এ ক্ষতি শুধু হিন্দু বলে না, সমস্ত ধর্মের মানুষেরই ক্ষতি। কবিতার যেমন ভাবটাই আসল, ভাষাটা তার বাহক, ধর্মের তেমন উপলব্ধির মাধুর্যটাই আসল, বাকি সব শুধু বাহ্যিক। সে মাধুর্য যে পথেই আসুক আমার লাভ, আমার শান্তি, আমার সার্থকতা। রামকৃষ্ণের দর্শন যে কোনো ধর্মের মানুষের জন্যেই আলোকস্তম্ভের সমান। কোথাও এতটুকু সঙ্কীর্ণতা নেই। এমনকি নিজেকেও সম্পূর্ণ শূন্য করে তবে ছেড়েছেন। নিজের মুখের কথা - গুরু, কর্তা, বাবা বললে আমার গায়ে কাঁটা বেঁধে। নিজেকে ‘আমি’ না বলে ‘এখানকার’ বলতেন। এ ঢং না, এ ন্যাকামি না, এ বাড়াবাড়ি না - এটাই আদতে রামকৃষ্ণ। অপ্রাতিষ্ঠনিক দলহীন, একাকী আলোকের মত রামকৃষ্ণ। কাছে গেলে আমারই শান্তি। কিসের থেকে শান্তি? চিত্তে চলা নানা বিরোধের থেকে শান্তি। 

    দুর্ভাগ্য ভারতের। শিরডির সাঁইবাবা আর বাংলার রামকৃষ্ণ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিধারী মানুষ ছিলেন না। দু’জনেই সমসাময়িক ছিলেন। দু’জনেই কোনো ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশানের মাধ্যমে ধর্মের নামে নানা বিরোধের সমাধান করতে চাননি, করেছেন নিজেদের জীবন আর উপলব্ধি দিয়ে। কিন্তু অবশেষে দু’জনেই প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে পড়লেন। দু’জনের ক্ষেত্রেই তাদের শিক্ষা থেকে তাদের ছবি, জন্মস্থান, পূজাপদ্ধতি প্রধান হয়ে পড়ল। নানা আনুষাঙ্গিক গৌণ প্রসঙ্গের চাপে মূল কথাটা চাপা পড়ে গেল - সমস্ত সংসার জুড়ে এক সত্যই বিরাজমান - তাঁর ধর্ম নেই, সাধন নেই, প্রথা-রীতি-রেওয়াজ নেই, গুরু নেই, শিষ্য নেই, অবতার নেই, মন্ত্র নেই। তবে কি আছে? তোমার চিত্ত আছে, যাকে মহতের স্পর্শে আনলে সে মহৎ হয়ে উঠবে, আর সে মহৎ তোমার চিত্তের কেন্দ্রে আছে, তোমার মন থেকে বৈরিতা গেলেই যা পরিস্ফুট হয়ে উঠবে। বাদ বাকি ধর্ম যা, সে কিছুটা ব্যবসা, আর কিছুটা রাজনীতির প্রচ্ছন্ন রূপ। নানা গোষ্ঠীবদ্ধ ক্ষমতার চাতুরী। যদি বলো তোমরা তবে কে? রামকৃষ্ণ বলবেন, তোমার একগাছি বড় লোমের সমানও নই, আর সাঁই বলবেন, তোমার বিষ্ঠায় ঘুরে বেড়ানো পোকার চাইতেও অধম। যদি বলো, তোমাদের ধ্যান করব না তবে? তাঁরা বলবেন, অবশ্যই করবে, তবে যতটা নীচে নেমে এলে চিত্তে আমার ধ্যানের আসন পাতা যায়, ততটা নেমে এসো আগে।

230
Sat, 03/06/2021 - 22:30

শিরডি'র সাঁইবাবাকে নিয়ে লেখা 'সাঁই সৎচরিত্র' বইতে একটা ঘটনার বর্ণনা আছে। আমি গল্পটার অলৌকিক দিকটার দিকে মন না দিয়ে ঘটনাটার কথা বলি---

 

ঈশোপনিষদের প্রথম শ্লোকে আছেঃ

ঈশা বাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগৎ্যাং জগৎ।

তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌।।

অর্থাৎ, সমস্ত জগৎকে ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত বা ঈশ্বরময় দেখবে, ত্যাগের দ্বারা ভোগ করবে, এবং কারোর ধনে লোভ করবে না।

 

ব্রাহ্মধর্ম স্থাপনার পিছনেও এই শ্লোকটির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু সে কথা আপাতত থাক।

ঘটনায় লেখা হচ্ছে সাঁইকে এই শ্লোকটির অর্থ একজন জিজ্ঞাসা করেন। সাঁই স্পষ্ট উত্তর বলেন না, তবে প্রশ্নকর্তা একটা বিশেষ ঘটনার মাধ্যমে এই শ্লোকের অর্থ বুঝে যাবেন সেটা উল্লেখ করেন।

সেই প্রশ্নকর্তা কয়েকদিন পর একজন ধনী বন্ধুর পরিবারে অতিথি হয়ে এসেছেন। কয়েকদিন থাকবেন। সেই পরিবারে একজন অল্পবয়েসী মেয়ে বাড়ির কাজের জন্য আসত। তার সদাপ্রসন্ন ব্যবহারে ইনি ভীষণ খুশী হন। সেই মেয়েটার ছেঁড়া শাড়ি দেখে একদিন বাজার থেকে বেশ ভালো একটা শাড়ি উপহার দেন। মেয়েটা ভীষণ খুশী হয় উপহার পেয়ে। পরেরদিন সেই নতুন শাড়ি পরে সে কাজে আসে। বেশ উচ্ছ্বসিত সে। অতিথিও মেয়েটার আনন্দ দেখে খুশী হন। কিন্তু দু'দিন পর খেয়াল করেন মেয়েটা আবার সেই পুরোনো ছেঁড়া শাড়ি পরে কাজে এসেছে। কিন্তু তার জন্যে মুখে কোনো মলিনতা বা অপ্রসন্নতা নেই। সেইরকম গুনগুন করে গাইতে গাইতে বাসন মাজছে, ঘর পরিষ্কার করছে। অতিথি কিছু বিস্ময়েই তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তুমি নতুন শাড়িটা পরলে না আজ?

মেয়েটা বলে, সে শাড়িটা বাক্সে তুলে রেখেছি, পরে পরব, আপাতত এই শাড়িটা তো আছে আমার, এতেই হয়ে যাচ্ছে।

অতিথি তার নির্লোভ প্রসন্নতায় অবাক হয়ে যান ও সঙ্গে সঙ্গে উপনিষদের সেই শ্লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। ত্যাগের দ্বারা ভোগ ও লোভ না করে সন্তুষ্ট থাকার কথাটাও বুঝতে পারেন।

হঠাৎ এই গল্পটা মনে পড়ে গেল আজ। চলতে ফিরতে এমন কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় তো হয়েই যায়, তাই না? কি অল্পে তুষ্ট থাকার ক্ষমতা তাদের! আশ্চর্য লাগে। নিজের মনের মধ্যে সযত্নে রাখা আগামী ইচ্ছা-বাসনা-সাধের লিস্টের দিকে তাকালে নিজেকে কি ক্ষুদ্র অনুভব হয়। ইংরাজিতে 'স্যাটিসফেকশন' আর 'কন্টেন্টমেন্ট' বলে দুটো শব্দ আছে। বাংলায় তো দুটোকেই বলে 'সন্তুষ্টি'। কিন্তু অর্থে তো দুটোর মধ্যে বিস্তর ফারাক। 'স্যাটিসফেকশান' মানুষকে বড় অসংবেদনশীল, আত্মকেন্দ্রিক করে তোলে দেখেছি। কিন্তু 'কন্টেন্টমেন্ট' তা করে কি? কন্টেন্টমেন্ট কেউ অর্জন করতে পারে না... এর কোনো আলাদা প্রয়াস হয় না, এ এক অদ্ভুত বোধ। অন্তর থেকে জন্মায়। নির্বোধ মানুষ স্যাটিসফায়েড হতে পারে, কিন্তু কন্টেন্ডেড থাকার জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অন্তর্দৃষ্টি না থাকলেই নয়।

এইরকম সন্তুষ্ট, শান্ত মানুষেরা আছে বলেই সংসারে জিরোবার জায়গা পাওয়া যায় কিছু। যাদের পাশে বসলে মনের মধ্যে শান্তির শীতল বাতাস বয়ে যায়। একেই হয় তো সাধুসঙ্গ বলে, জানি না। আজকাল তো সাধুরাও তুষ্ট নয়, বড় ক্ষুব্ধ, রাগী বেশিরভাগই। কিন্তু সংসারে গেরুয়াহীন এমন কিছু কিছু মানু্ষের সংস্পর্শ তো অবশ্যই পেয়েছি। যারা কেবল জমায় না, যারা হাঁটে শুধু না, আরো কিছু মানুষের জন্য রাস্তা বানিয়ে হাঁটে।

মুরারিবাপু'র মুখে একটা গল্প শুনেছিলাম, যেটা বলেই এ প্রসঙ্গ শেষ করি। একটা রেস্টুরেণ্টে একটা সিংহ আর একটা শেয়াল বসেছে পাশাপাশি। ওয়েটার এসে খাওয়ারের অর্ডার নিচ্ছে। শেয়াল খাওয়ারের অর্ডার দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে। পুরো অর্ডার নিয়ে ওয়েটার সিংহের দিকে ইশারা করে শেয়ালকে বলল, চাচাজী কুছ নেহি লেঙ্গে?

তখন শেয়াল একটু হেসে বলল, চাচাজীকো ভুখ নেহি হ্যায়, ইসিলিয়ে তো ম্যায় ইঁহা পর ব্যায়ঠা হুঁ না!

সেই হল কথা। এমন চিত্তে শান্ত, তুষ্ট, আনন্দিত মানুষ হারিয়ে গেলে মানুষ জুড়াবে কোথায়? দিশাই বা পাবে কোথায়? সবাই যদি দৌড়াবে কাউকে তো স্থির হয়ে আম্পেয়ারিং বা রেফারিং-এর কাজটা করতে হবে। সেই মানুষগুলোই আমাদের শান্তির আলো, আমাদের ভোরের আগমনী, আমাদের সন্ধ্যের শাঁখের আওয়াজ। বাকি তো শুধু কোলাহল আর ধুলো।

 

 

 

231
Fri, 03/05/2021 - 17:30

দুশ্চিন্তা কিসের এত? আমার ভাবনাই শেষ কথা? তা তো নয়। আমার ভাবনার পরে আরো কিছু আছে। সে ভাবনা না, সে ঘটনা। যা ঘটে চলেছে। সেকি আমার ভাবনার অপেক্ষা করে? ঘটনা যা ঘটে চলেছে। অনাদিকাল থেকে শুরু করে আজ অবধি চলে যাচ্ছে। এই ঘটনাপ্রবাহকে একসঙ্গে বলা হল - সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়। তৈরি হচ্ছে, টিকে থাকছে কিছুকাল, তারপরে কালের স্রোতে ডুবে মিশে যাচ্ছে। একি আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে হচ্ছে? একি আমার সংকল্প-বিকল্প ভাবনার ধার ধারে? এই ঘটনাপ্রবাহের কোনো ক্ষুদ্র আবর্তে আমার এ জীবন। কয়েক পাকে এ-ও মিশে একাকার হয়ে যাবে।

এই ঘটনাপ্রবাহকে যদি ভালো করে কাছ থেকে বুঝতে যাই তবে তাকে বলি 'বিজ্ঞান'। 'বিজ্ঞান' আমার অস্তিত্বের গভীরে এমন কিছু সাংকেতিক নির্দেশ পেয়েছে যা আমার জন্মানোর আগে থেকেই ছিল, আমার ভাগ্যকে স্থির করেই এসেছি আমি, যাকে নাম দেওয়া হল জিন। সেই নির্দেশে কালের স্রোতে এই ‘আমি’ ঘূর্ণীতে কি খেলা খেলে চলেছে তার কতটা আমার হাতে? ক'টা খেলার উপর ছড়ি ঘোরানোর ক্ষমতা আমার আছে? এদিক সামলাতে গেলে ওদিক আলগা হয়ে যায়। এদিক মুঠো করে আনলে ওদিকে সব ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়ানো কুড়ানোর খেলাও আমারই খেলা।

'বিজ্ঞান' একের পর এক তত্ত্ব আবিষ্কার করে আনে, আর ঘটনাপ্রবাহের দিকে আঙুল তুলে বলে, এই দেখো, এই দেখো, এ-ও এমন একটা সত্য, এমন একটা তত্ত্ব যা তোমার ভাবনার বাইরে। কত সূত্র, কত নিয়ম, কত বিধিব্যবস্থা। এর মধ্যে কেউ কেউ বলে বসে, এগুলো যখন জেনে গেছি তবে এসো না আমরা এই সূত্র দিয়ে ওই সূত্রকে নিয়ন্ত্রণ করি, এই তত্ত্ব দিয়ে ওই তত্ত্বকে দিই চেপে, এই বিধি দিয়ে ওই বিধিকে দিই বদলে।

শুরু হয়ে গেল আরেক খেলা। এই খেলায় আমাদের কত কি গেল বদলে। আমাদের সভ্যতা, আমাদের সাহিত্য, আমাদের জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গী... সব গেল বদলে। আমরা বিজ্ঞানের নানা সূত্র, বিধি, নিয়মের মধ্যে এক খেলা নিয়ে মেতেছি। এতে আমাদের সব মিলে ভালো হচ্ছে না মন্দ হচ্ছে আমরা স্পষ্ট বুঝছি না। ছোটো করে দেখলে মনে হচ্ছে এই দেখো কত সুখ, এই দেখো কত সুবিধা, এই দেখো কত আমোদ। অমনি বড় করে দেখার চোখ বলছে, সত্যিই কি ভালো হচ্ছে? দেখো কত ক্ষতি হয়ে চলেছে সমস্ত পরিবেশ, পৃথিবীজুড়ে। তোমার আয়ুষ্কাল আর অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই বুঝি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি? ছোটো চোখ অভিমান করে বলে, তা না তো কি? বড় চোখ বলে, তার বাইরেও যে আছে কত কি। ভাববে না?

না ভাবব না। আমরা শুধু দুশ্চিন্তা করব, আমরা শুধু আমাদের লাভক্ষতির হিসাব করব। আমরা বড় চোখকে আমাদের লোভের রঙিন বসনে ঢেকে বলব, হুস! ম্যাজিক!

কিন্তু আমাদের আজ গভীর অসুখ। আমাদের মনে শরীরের নানা সূত্র, নানা তত্ত্ব, নানা বিধি জানতে জানতে আমরা নিজেকে এত জেনে ফেলেছি যে আমাদের বুকের মধ্যে সেই সুড়ঙ্গের মুখটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। সে সুড়ঙ্গ দিয়ে ‘জানা’ দিয়ে প্রবেশ করা যায় না, সে সুড়ঙ্গ দিয়ে প্রবেশের পথ করে দেয় - অনুভব। যে অনুভব ধরা দেয় না, ধরা দিতে বলে। যে অনুভব কান্না, যে অনুভব হাসি, যে অনুভবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারলে সমস্ত জগতটাকে হাতের নাগালে এনে দেয়, সেই অনুভবের রাস্তাটা গেছে বন্ধ হয়ে। আমাদের শুধু এখন জানার খেলা। এই জানা দিয়ে ঘর সাজানো। শুধু সাজিয়ে যাওয়া, শুধু সাজিয়ে যাওয়া... রঙের পর রঙ। তোলার সময়টুকুও নেই আর। আর সেই সুড়ঙ্গের মুখ চাপা পড়ছে তো পড়ছেই।

সেইদিনে আমাদের বাড়ির দরজার সামনে এক পাগল এসেছিল। সে পাগল আমাদের বলে গেল টাকার সুখ আর দেহের সুখের বাইরে আরেক সুখ আছে, কেন বুঝবে না? তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, কিসের সুখ? সে বলল, মা-কে জানার সুখ। সবাই বলল, কে তোমার মা? সে চারদিকের সমস্তটা দেখিয়ে বলল, এই সমস্ত জুড়ে যে নিয়ম বিধি, সে সবের মধ্যে যে যোগসূত্র সেই তো আমার মা। তাকে বলা হল, সেই বিধিকে আমরা জেনে যাচ্ছি তো তিলে তিলে, একদিন সবটা জেনে যাব। সে হেসে বলল, একটা পিঁপড়ে চিনির পাহাড়ের থেকে একদানা চিনি মুখে নিয়ে ফিরছিল, আর মনে মনে ভাবছিল যে, একদিন গোটা চিনির পাহাড়টাই নিয়ে যাবে মুখে করে, তোমার তো কথা সেই রকম। যে নিয়ম বিধি খণ্ডে জানছ, সেই নিয়ম বিধি'র মধ্যে যে অনাদি যোগসূত্র, যে চেতনা, সেই তো আমার মা।

তাকে বলা হল, আমরা ওসব মানি না। সে পাগল তখন বলল, সে না হয় না মানো, কিন্তু বড় সুখ তো মানো? তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, বড় সুখ মানে কি গো? সে বলল, আনন্দ, ওগো তোমাদের এত দুশ্চিন্তা দেখে আমার মনে বড় কষ্ট হয়, কই আমার তো পেছনের কাপড়টুকু পর্যন্ত ছিল না, না ছিল তোমাদের মত এত সুখের জীবন, কিন্তু আমার তো এত দুশ্চিন্তা ছিল না। তোমাদের জীবনে সুখ আছে অঢেল, আনন্দ নেই। আমার মা-কে মানো চাই না মানো, আনন্দকে নাও, আনন্দকে নিতে গেলে বড় হও, ভাবনার বাইরে এসো, তাই তো আমার মায়ের আরেক নাম আনন্দময়ী, শুনেছ তো, এই খেলাও একটু খেলে দেখো না, মাইরি বলছি, ঠকবে না, এসে দেখো, একান্ত না পারো তো আমায় ডেকো মাঝে মাঝে, শিখিয়ে দেব।

 

232
Thu, 02/18/2021 - 17:30

'ভক্ত' শব্দটা খুব কানে আসছে। প্রচুর মানুষ ভক্ত বলে নিজেকে দাবী করছেন। এখন আমার কয়েকটা প্রশ্ন আছে, 'জয় শ্রীরাম' বললেই কি ভক্ত হওয়ার যোগ্য হচ্ছি? একটু ঘেঁটে দেখি হিন্দুধর্ম কি বলে। হিন্দুধর্ম নিয়েই যখন কথা বলছি তখন একেবারে গীতা দিয়েই শুরু করা ভালো। কি বলেন? এখন এমন কে আছেন যে বলে বসবে, ওসব গীতা-টীতা আমি মানি না। তবে গীতায় কি বলে ভক্তের সম্পর্কে? এখন আমি যখন ধর্ম নিয়ে, থুড়ি ভক্তি এবং ভক্ত নিয়ে আলোচনা করতে এসেছি, তখন অকারণ যুক্তি, ইতিহাস এই সব নিয়ে কিন্তু মাথা ঘামাচ্ছি না। তো গীতায় কৃষ্ণ কি বলছেন শোনা যাক। এই 'কৃষ্ণ' কথাটা বলতে গেলেও একটা কথা আছে। হিন্দুধর্মের ভাগবতে দশাবতারের কথা আছে। অন্যান্য গ্রন্থে অন্য পরিসংখ্যান থাকলেও আমি বিশেষ করে ভাগবতের কথা বলছি, কারণ ভাগবত হল পুরাণের মধ্যে প্রধান। এই মহাপুরাণকে অনেকে স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের বিগ্রহ বলে ধারণা করেন। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন - ভক্ত-ভাগবত-ভগবান, একে তিন, তিনে এক। অর্থাৎ তত্ত্বমতে এই তিনজনই এক। তো এই ভাগবত পুরাণে কৃষ্ণকেই একমাত্র বলা হচ্ছে - কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ম। অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ হলেন স্বয়ং ভগবান।

      এবার গীতায় আসা যাক। গীতায় মোট আঠারোটা অধ্যায়। সেখানে বারো নম্বর অধ্যায় হল ভক্তিযোগ। মহাত্মা গান্ধী ওনার গীতা ব্যাখ্যা এই অধ্যায় দিয়েই শুরু করেছিলেন। তো গীতায় ভগবান কৃষ্ণ স্বয়ং বলতে চাইছেন ওনার ভক্তের চরিত্র কিরকম হবে।

 

অদ্বেষ্টা সর্বভূতানাং মৈত্রঃ করুণ এব চ।

নির্মমো নিরহঙ্কারঃ সমদুঃখসুখঃ ক্ষমী।।১৩।।

সন্তুষ্টঃ সততং যোগী যতাত্মা দৃঢ়নিশ্চয়ঃ।

ময্যর্পিতমনোবুদ্ধির্যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।।১৪।।

অনুবাদঃ যিনি সমস্ত জীবের প্রতি দ্বেষশূন্য, বন্ধু-ভাবাপন্ন, কৃপালু, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহঙ্কার, সুখে ও দুঃখে সমভাবাপন্ন, ক্ষমাশীল, সর্বদা সন্তুষ্ট, সর্বদা ভক্তিযোগে যুক্ত, সংযত স্বভাব, দৃঢ় সংকল্পযুক্ত এবং যাঁর মন ও বুুদ্ধি সর্বদা আমাতে অর্পিত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।

যস্মান্নোদ্বিজতে লোকো লোকান্নোদ্বিজতে চ যঃ

হর্ষামর্ষভয়োদ্বেগৈর্মুক্তো যঃ স চ মে প্রিয়ঃ।।১৫।।

অনুবাদঃ যাঁর থেকে কেউ উদ্বেগ প্রাপ্ত হয় না, যিনি কারও দ্বারা উদ্বেগ প্রাপ্ত হন না এবং যিনি হর্ষ, ক্রোধ, ভয় ও উদ্বেগ থেকে মুক্ত, তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয়।

অনপেক্ষঃ শুচির্দক্ষ উদাসীনো গতব্যথঃ।

সর্বারন্তপরিত্যাগী যো মদ্ভক্তঃ স মে প্রিয়ঃ।।১৬।।

অনুবাদঃ যিনি নিরপেক্ষ, শুচি, দক্ষ, উদাসীন, উদ্বেগশূন্য এবং সমস্ত কর্মের ফলত্যাগী, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।

যো ন হৃষ্যতি ন দ্বেষ্টি ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।

শুভাশুভপরিত্যাগী ভক্তিমান্ যঃ স মে প্রিয়ঃ।।১৭।।

অনুবাদঃ যিনি প্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না এবং অপ্রিয় বস্তুর প্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না, যিনি প্রিয় বস্তুর বিয়োগে শোক করেন না, অপ্রাপ্ত ইষ্ট বস্তু আকাঙ্ক্ষা করেন না এবং শুভ ও অশুভ সমস্ত কর্ম পরিত্যাগ করেছেন এবং যিনি ভক্তিযুক্ত, তিনি আমার প্রিয় ভক্ত।

সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ।

শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জিতঃ।।১৮।।

তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনী সন্তুষ্টো যেন কেনচিৎ।

অনিকেতঃ স্থিরমতির্ভক্তিমান্মে প্রিয়ো নরঃ।।১৯।।

অনুবাদঃ যিনি শত্রু ও মিত্রের প্রতি সমবুদ্ধি, যিনি সম্মানে ও অপরমানে, শীতে ও গরমে, সুখে ও দুঃখে এবং নিন্দা ও স্তুতিতে সম-ভাবাপন্ন, যিনি কুসঙ্গ-বর্জিত, সংযতবাক্, যৎকিঞ্চিৎ লাভে সন্তুষ্ট, গৃহাসক্তিশূন্য এবং যিনি স্থিরবুদ্ধি ও আমার প্রেমময়ী সেবায় যুক্ত, সেই রকম ব্যক্তি আমার অত্যন্ত প্রিয়।

যে তু ধর্মামৃতমিদং যথোক্তং পর্যুপাসতে।

শ্রদ্ধানা মৎপরমা ভক্তাস্তেহতীব মে প্রিয়াঃ।।২০।।

অনুবাদঃ যাঁরা আমার দ্বারা কথিত এই ধর্মামৃতের উপাসনা করেন, সেই সকল শ্রদ্ধাবান মৎপরায়ণ ভক্তগণ আমার অত্যন্ত প্রিয়।

 

        তো এই হল গীতার মত অনুযায়ী ভক্তের চরিত্র। কোথাও বলা নেই যে আমার নাম করে যেখানেই তুমি চীৎকার করে গলা ফাটাবে, আমার নাম করে বড় বড় মন্দির বানাবে তখনই তুমি আমার ভক্ত হিসাবে পরিগণিত হবে। এরকম কথা কিন্ত কোথাও লেখা হল না। 

 

এবারে আমরা আসি গীতার পরেই যে গ্রন্থটি সব চাইতে পড়া হয়, রামচরিতমানস। বাংলায় বইটির প্রভাব না থাকলেও সমগ্র উত্তর ভারতে এর প্রভাব ভীষণ। সেখান একটা রামগীতা আছে। আমি মূল হিন্দীটাই তুলে দিচ্ছি। সঙ্গে বাংলা অনুবাদও করে দিচ্ছি। যেখানে রাম স্বয়ং নিজের মুখের নিজের ভক্ত হওয়ার পথ বলে দিচ্ছেন।

कहहु भगति पथ कवन प्रयासा। जोग न मख जप तप उपवासा।

सरल सुभाव न मन कुटिलाई। जथा लाभ संतोष सदाई॥1॥

(বলো তো, ভক্তিপথে পরিশ্রমই বা কি আছে? যেখানে জপ, তপ, যোগ, যজ্ঞ, উপোস কিছুই লাগে না। শুধু অকপট সরল স্বভাব আর যা পাওয়া যায় তাতেই সর্বদা সন্তুষ্টি। আর কি চাই?)

मोर दास कहाइ नर आसा। करइ तौ कहहु कहा बिस्वासा॥

बहुत कहउँ का कथा बढ़ाई। एहि आचरन बस्य मैं भाई॥2॥

(তোমাদের কেমন বিশ্বাস বুঝি না, এদিকে আমাকে ভক্তি কর, অথচ মানুষের সাহায্যের অপেক্ষায় বসে থাকো আমাতে নির্ভর না করে। অনেক কথা বলেছি, আর কি বলি এই কয়েকটা আচরণেই আমি বশীভূত হই। তুল্য ‘চৈতন্যচরিতামৃত’,

“কৃষ্ণেরে ভক্তি করে, করে লোকাপেক্ষা।

কৃষ্ণ না করেন কৃপা তারে, করেন উপেক্ষা।।”

এখন দেখা যাক কি সেই আচরণসমূহের কথা বলা হচ্ছে---)

बैर न बिग्रह आस न त्रासा। सुखमय ताहि सदा सब आसा॥

अनारंभ अनिकेत अमानी। अनघ अरोष दच्छ बिग्यानी॥3॥

(সে না কারোর কাছে কোনো আশা রাখে, কি শত্রুতা বা ভয় রাখে। তার সবদিকই সুখময়। সে কোনো কিছুর প্রারম্ভ করে না, গৃহহীন হয়, অমানী হয়। সে পাপহীন, ক্রোধহীন, দক্ষ ও বিজ্ঞানী হয়।)

प्रीति सदा सज्जन संसर्गा। तृन सम बिषय स्वर्ग अपबर्गा॥

भगति पच्छ हठ नहिं सठताई। दुष्ट तर्क सब दूरि बहाई॥4॥

(সে সব সময় সজ্জনদের সঙ্গে প্রীতি সম্পর্কে যুক্ত। বিষয়াদি, স্বর্গসুখ, এমনকি মুক্তির ইচ্ছাও যার কাছে তৃণসম তুচ্ছ। ভক্তির দিকে তার অনুরাগ, কিন্তু অন্যান্য মতের প্রতিও তার শ্রদ্ধা, তাই সবরকম দুষ্টতর্ক থেকে নিজেকে মুক্ত রাখে।)

दोहा -

मम गुन ग्राम नाम रत गत ममता मद मोह।

ता कर सुख सोइ जानइ परानंद संदोह॥46||

(সে সর্বদা আমার নামগুণগানে রত, মোহ, অহংকার, 'আমি ও আমার' বোধ থেকে মুক্ত। এবং যে পরমানন্দ সুখে মত্ত সেই কেবল জানে সে সুখ কি সুখ। তুল্য রবীন্দ্রনাথ, “তোমার ধ্যানে, তোমার জ্ঞানে, তব নামে কত মাধুরী, যেই ভকত সেই জানে, তুমি জানাও যারে, সেই জানে, ওহে তুমি জানাও যারে সেই জানে")

 

        অর্থাৎ, যে রামচন্দ্র নিয়ে এত কথা হচ্ছে চারদিকে, সেই রামচন্দ্র কোথাও বলছেন না যে আমার নাম নিয়ে চীৎকার করে পাড়া কাঁপালেই তুমি আমার ভক্ত হলে। আমার নাম করার যোগ্যতা অর্জন করে নাও। কিভাবে? আসুন দেখা যাক আমাদের বাংলাকে যিনি ভক্তিরসে ডোবালেন সেই চৈতন্য মহপ্রভু কি বলছেন?

 

তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা ।

অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ ।।

      অর্থাৎ, যিনি নিজেকে সকলের পদদলিত তৃণের থেকেও ক্ষুদ্র বলে মনে করেন, যিনি বৃক্ষের মতো সহিষ্ণু, যিনি মান শূন্য এবং অন্য সকলকে সম্মান প্রদর্শন করেন, তিনি  সর্বক্ষণ ভগবানের দিব্যনাম কীর্তনের অধিকারী।

অতএব মহাপ্রভুর শিক্ষা অনুযায়ীও ভক্ত হতে গেলে রীতিমতো শ্রমের তপস্যা করতে হবে।

আর ইদানীং রামকৃষ্ণের ভাষায় তো ভক্ত মানে সোনার তরবারি, যা দিয়ে হিংসা করা যায় না।

তবে এই যে ভক্ত বলে ইদানীং যে শব্দটা এসেছে, সে মতে শাস্ত্রপ্রমাণ কিছু আছে? নেই। কারণ এই ভক্তের কথা শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘হিঁদুয়ানি’ আর ভারতের অন্যান্য জায়গায় ‘হিন্দুত্‌ভা’ চর্চায়। তবে কি 'হিঁদুয়ানি' আর 'হিন্দু' দুটো আলাদা বিষয়? একদম তাই। কেউ কেউ বোকা বলে বুঝতে পারে না। কেউ কেউ বোকা সেজে বুঝতে চায় না। তাই নিজেকে কেউ 'ভক্ত' বললেই আগে জেনে নিতে হবে সে কোন পথের? সনাতন ধর্মের ভক্ত হওয়া যে সোজা কথা নয় সে তো অনেক প্রমাণ দিলাম। কিন্তু ইদানীং মতে ভক্ত হওয়াটা অবিশ্যি খুব একটা কঠিন কাজ নয়। এই পার্থক্যটা মাথায় রাখা ভালো। ভালো হজম হবে। শরীরে মনে পুষ্টি আসবে। জয়গুরু।

233
Tue, 02/09/2021 - 18:00


চ্যারিটি ভালো জিনিস। সভ্য মানুষ চ্যারিটি করবে এ ভালো কথা। মহাপুরুষেরা বলে গেলেন, সব চাইতে বড় দান হল জ্ঞানদান। 

    এখন এই জ্ঞান বস্তুটা আজকাল দিনে বড় মাগ্যি। অনেকটা 'ফেল কড়ি মাখো তেল' ধরণের। যদিও নানা ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তবুও আমার মনে হয় আমাদের যুবসমাজের সেদিকে নজর খুব একটা পড়ে না। বেশির ভাগ উত্তর হল গ্র্যাজুয়েশন, তারপর চাকরির পরীক্ষা। নইলে উচ্চমাধ্যমিকের পর ইঞ্জিনিয়ারিং, কেউ কেউ ডাক্তারি। বাকি সব গ্র্যাজুয়েট হবে। কাতারে কাতারে গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে, কেউ পাশে, কেউ অনার্সে। তার মধ্যে অতি অল্প সংখ্যক মাস্টার ডিগ্রীতে। তারপর কেউ কেউ আবার সেই ‘চাকরির পরীক্ষা’, নইলে অতি অল্প সংখ্যক গবেষণা। 

    কিন্তু এই এত এত গ্র্যাজুয়েট না হয়ে যদি নানা কারিগরি শিক্ষার দিকে আমাদের ঝোঁক হত, তবে কেমন হত? যদি আমরা ‘চায়ের দোকান দেওয়া’, ‘রিকশা চালানো’ ইত্যাদি কথাকে নিন্দনীয়, অপমানজনক মনে না করে বড় হতে শিখতাম তবে কি হত? আমি বহু বহু ছেলেমেয়েকে দেখেছি মূল বই না পড়ে শুধু নোটস মুখস্থ করে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাচ্ছে। সত্যি বলতে আমাদের এত এত গ্র্যাজুয়েট কি সত্যিই চাই? এত এত সাহিত্যের গ্র্যাজুয়েট, নামমাত্র বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট, কমার্সের গ্র্যাজুয়েট কি সত্যিই আমাদের সমাজে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় কাজে লাগছে? যারা কোনো একটা বিষয়কে ভালোবেসে পড়ছে তাদের কথা বলছি না। তারা হয় তো সেই বিষয়ে অনেকদূর অবধি পড়াশোনা করতে চায়। সে আলাদা কথা। কিন্তু কতজন আমাদের তাই হয়? “তুই কিসে অনার্স পেলি?” এইতেই তো কত শিক্ষার্থী ওরফে সার্টিফিকেটার্থী গড়ে উঠছে। এরা কতটা কুশলী? কতটা উপযোগী সমাজের নানা কাজে? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যা নিয়ে পড়াশোনা করছে তার সঙ্গে তার কর্মজীবনের কোনো মিল নেই। তবে ওই অতগুলো সময় আর অর্থ - অপব্যয় হল না?

    হল। কিন্তু আমাদের এগুলো গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে নানা কাজে যখন নানা মানুষ আসেন, যাদের সার্টিফিকেট যোগ্যতা আমার থেকে কম, সত্যি বলতে আমার ভীষণ লজ্জা লাগে। বাড়িতে নানা কারণে যারা যারা আসেন, ধরুন, ইলেকট্রিকের কোনো কাজ করতে; বা এসি বা ফ্রিজ সারাতে; বা জলের লাইন বা পাম্পের কাজে; বা বাবার বা জেঠিমার রক্ত নিতে --- এনারা কেউ সঠিক পথে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। সবাই “করতে করতে শিখে গেছি”। এটা অপচয় বা অপব্যয় নয়? আমার মনে হয় অপচয় ও অপব্যয়। কয়েকটা প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ টাকা নিয়ে সরকারি চাকরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, এটা হাস্যকর না? আমার কাছে খুব অযৌক্তিক। অর্থাৎ, আমি এত এত সময় ধরে নিজেকে স্নাতক করে নিয়ে, সে সব জলাঞ্জলি দিয়ে আবার একটা প্রতিষ্ঠানে ঢুকলাম যারা শুধু সেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি দেবে। অর্থাৎ, যা আমাকে আমার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় শেখায়নি। যদিও এর উপযোগিতা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। তবে সরকারি চাকরি পাওয়ার পর তাদের নিয়ে যখন অনুষ্ঠানের ছবি দেখি কাগজে, এবং সেখানে মন্ত্রী থেকে সাধু অনেকের উপস্থিতি দেখি, আমার মনে হয় আমরা বড্ড বেশি চক্ষুলজ্জাহীন হয়ে পড়েছি। অর্থনৈতিক বৈষম্যকে এমন নগ্নভাবে উদযাপন করার মধ্যে একটা পৈশাচিক বর্বর উল্লাস দেখি। গ্যাদগেদে অহংকার। 

    সে যাক, সে অন্য কথা। সে নিয়ে নানা বিতর্ক হতে পারে আগেই বললাম। কিন্তু যেটা বলছিলাম, এই যে মানুষগুলো নানা কাজে আমাদের বাড়ি এসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ কাজগুলো করে সমাজকে চালু রেখেছে সেদিকে বেশি মনোনিবেশ করা যায় না?

    আমরা যদি আমাদের ছেলেমেয়েদের শুরু থেকেই হাতের কাজ, নানা কারিগরিতে উৎসাহ বেশি দিই তবে কি খুব ক্ষতি হবে? হ্যাঁ, প্রথমত আমাদের সংস্কারে, ভাবার গতিতে ধাক্কা লাগবে, এ সত্য। কিন্তু উপকার অনেক হবে জানেন। অন্তত আমার তা মনে হয়। 

    প্রথমত, তারা এমন কিছু শিখবে জানবে যা তাদের আরো বেশি আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। উপযুক্ত সিলেবাসে, যথাযথভাবে, মানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তারা যা শিখবে তাতে তাদের আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ আরো বাড়বে। 

    দ্বিতীয়ত, 'আত্মনির্ভরতা' শব্দটা নিয়ে যতই হাসাহাসি বা ব্যঙ্গ করি না কেন, ওই শব্দটার একটা মর্যাদা আছে। তাকে কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিতে না দেখে যদি বাস্তব শিক্ষাঙ্গনের আঙিনায় দেখি তবে তার একটা প্রবল সম্ভাবনা আছে শুধু নয়, সমাজে একটা আমূল পরিবর্তন আনার ক্ষমতা সেটা রাখে। 

    তৃতীয় পয়েন্টটা এই দ্বিতীয় পয়েন্টের হাত ধরেই আসে। সব কাজকে আমরা শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শিখব। কারণ একটাই যে যে কাজই করুক না কেন সে সেটি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পেয়ে আসছেন। এই পরিবর্তন আনাটা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভীষণ জরুরি। পেপারে পড়েছিলাম, কারোর একজন তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত ছেলে ডেলিভারি বয়ের কাজ নিয়েছিল বলে বাবা-মা আত্মহত্যা করেছেন। দোষটা সেই বাবা মায়ের শুধু নয়। এই গোটা সমাজের। আমাদের মানুষকে ছোটো করার, অপমান করার কৌশলের, উপায়ের অভাব নেই। কত মানুষ যে আমাদের চোখে মানুষই না, সে হিসাব করতে বসলে অর্ধেক ভারতবাসীই অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বেন। 

    “এরপর তো তোকে মোবাইল রিপিয়ারিং-এর কাজ করতে হবে”, আমিই বলেছিলাম, বহুকাল আগে কোনো ছাত্রকে। আজ প্রতিদিন এই কথাটা আমার মনে পড়ে, নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য লাগে। একি ভর্ৎসনা করার ভাষা আমি সেদিন উচ্চারণ করেছিলাম! শিউরে উঠি আজ ভাবতে গেলে। অথচ এমন সমাজে বাস করি যে কেউ আমার গালে সেদিন এসে একটা চড় মারেনি, বা আমায় ফিরিয়ে ভর্ৎসনা করেনি যে, স্যার আপনি অত্যন্ত হীন কথা বলছেন একটা। কেউ বলেনি। আমি আজ জানি এত এত সার্টিফিকেট নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় এত এত চাকুরী সন্ধানীরা জীবন পেয়ে যেত, হতাশায় না ডুবে অল্প থেকেই জীবন শুরু করে দিতে পারত, শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদায় ভর করে। কিন্তু আমাদের সমাজ বাড়ি বসে থাকা বেকার স্নাতককে সম্মান করে, কিন্তু একটা খারাপ পাম্প, কি এসি, কি বাইককে নিখুঁত দক্ষতায় ঠিক করে দেওয়া ছেলেটাকে সম্মান জানাবে না। আবাসনের দরজায় লিখে রাখতে লজ্জাবোধ করে না ‘সেলসম্যান আর নট অ্যালাওড”। ওই লেখাটা আবাসনের বাইরে দেখলে আমার কান্না পায় আজকাল। মানুষকে অপমান করার সহস্র কৌশল সত্যিই আমাদের কাছ থেকে শিখতে হয়। 

    আমাদের ভাবনার পথটা বদলাতে হবে। হাত পাতার অভ্যাসটা ছেড়ে, 'আপনা হাত জগন্নাথ' বানাতেই হবে। নইলে কতদিন আর অন্যদেশের জন্য সস্তার শ্রমিক হয়ে, শুধুমাত্র টাকার দিকে তাকিয়ে নিজের সমস্তটুকু বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জ গ্যাদগেদে অহংকারী হয়ে দিন কাটাব? আমার শ্রমের ক্ষমতায়, নিজেকে কুশলী করে গড়ে তুলে নিজের জীবনের সময় আর নানা শখ ইচ্ছাকে মর্যাদা দিয়ে বাঁচতে কবে শিখব? অনেক পেয়ে সে হওয়ার নয়, সে সম্ভব শুধু মাথা উঁচু করে বাঁচার স্বক্ষমতায়, স্বমর্যাদায়।

234
Thu, 01/28/2021 - 23:30

১) “স্যার বেশি মাস্টারবেট করলে আর বাচ্চা হয় না?"

২) “দিনে ক'বার মাস্টারবেট করা যায়?”

৩) “স্যার আমার মনে হয় আমার একটা টেস্টিস বড়, একটা ছোটো।”

৪) “স্যার কত ফোঁটা রক্ত জমে যেন এক বিন্দু বীর্য তৈরি হয়?”

৫) “স্যার ও কি রোগা হয়ে যাচ্ছে দেখেছেন...? আমার মনে হয় ও দিনে সাত-আটবার...”

৬) “স্যার আমার জ্বর আসছে, গায়ে ফুসকুড়িও আছে, আমার কি এইডস হচ্ছে?”
 

    এরকম প্রশ্নের সংখ্যা লিখলে সে লিস্ট বেড়েই চলবে। দীর্ঘদিন হল বায়োলজি পড়াচ্ছি। সে সিলেবাসে নারী পুরুষের যৌনাঙ্গের বিবরণ, মাসিকচক্র, নানা যৌনরোগের বিবরণ ইত্যাদি আছে। অগত্যা নানা প্রশ্ন, সংশয়, আতঙ্ক মনে জন্মানোটাও অস্বাভাবিক না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যৌনশিক্ষাটা হয়ে যাচ্ছে ‘half baked’, অর্ধপক্ক। 

    আমি এ আলোচনাটায় যৌনশিক্ষা নিয়ে ঠিক লিখব বলে ভাবিনি। ভাবছি যৌনতা আর ছেলেদের বিষয়ে লেখার। ছেলে মানে বিশেষ করে যারা কিশোর। তাদের নিয়ে আলোচনাটা করব ভাবছি, জানি না কতটা স্বচ্ছভাবে লিখে উঠতে পারব। 

    মেয়েদের যৌনতার শিক্ষাটা শুরু হয়ে যায় বাড়ির বড়দের থেকেই, যখন তার মাসিকচক্র শুরু হয়। অবশ্যই যৌনতার বোধ আর মাসিকচক্র দুটো আলাদা বস্তু, কিন্তু তবু তারা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফলে বাড়ির বড়দের থেকে একটা “স্বাভাবিক” ঘটনার ব্যাখ্যা হিসাবে এটাকে মেয়েরা পেয়ে যায়। যদিও ‘অশুচি’ ইত্যাদি শব্দ জড়িয়ে থাকে, কিন্তু সেটা সামাজিক একটা প্রথা বলে মেনে নেয় বেশিরভাগ মেয়েরাই। যেমন বাঁহাতে শৌচকার্য করতে হয়, যেমন এঁটো কাপড় ছেড়ে ফেলতে হয় ইত্যাদি নানা সামাজিক প্রথার সঙ্গে একেও একটা অঙ্গ হিসাবে অনেকেই মেনে নেয়। সেটা ঠিক না ভুল সে তর্কের জন্য এ লেখা নয়। আমি যে পয়েন্টটা বলতে চাইছি, তারা অন্তত যৌনতা, মাসিকচক্র ইত্যাদিকে স্বাভাবিক ঘটনা বলে জানে। 

    কিন্তু একটা ছেলের যৌনতাবোধ শুরুই হয় ‘অন্যায়’, ‘পাপ’, ‘অস্বাভাবিক’ ইত্যাদি অনুভব দিয়ে। তার লিঙ্গ উত্থিত হওয়া অন্যায়, তার স্বপ্নদোষ অপরাধের, তার হস্তমৈথুনের ইচ্ছা পাপ ইত্যাদি ইত্যাদি। সেগুলো কেন অপরাধের? কেন পাপ? কেন অন্যায়? কারণ সেগুলো বড়দের সামনে বলতে নেই। এগুলো সব অস্বাভাবিক, এগুলো শুধু বাজে ছেলেদের হয়। এসব ভাবতে নেই। ওই সময় ঠাকুরের নাম করতে হয়। ভালো ভালো কথা ভাবতে হয়। মায়ের মুখ মনে করতে হয়। বাবা শুনলে প্রচণ্ড রেগে যাবে। মা শুনলে ভাববে, ছি ছি, আমার পেটে এই ছেলে জন্মালো? সব ভুলে যাও। কোনো ভদ্রবাড়ির ছেলের এসব হয় না। লুকাও, লুকাও, সব লুকিয়ে ফেলো। 

    কিন্তু যা আমার ইচ্ছা, আমার সামাজিক নীতিবোধের পরোয়া না করে থেকে থেকেই জেগে উঠছে, তাকে আমি আটকাবো কি করে? এ যে চিত্রাঙ্গদার সেই মোক্ষম লাইন – “কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়েছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি?” এতে যে আমার সুখ! বিষাক্ত সুখ। আমার গোপন বিলাস। আমার লোভ। তীব্র আকর্ষণ এতেই যে আমার। তোমরা যত বারণ করো, তোমরা যত পাপ বলো, তোমরা যত একে অন্যায় বলো, আমার এর উপর কৌতুহল যে আরো বেড়ে যায়। তোমরা এটা বোঝো না কেন, এটা আমি ইচ্ছা করে করি না...।

    উপরের প্যারাগ্রাফের কথাগুলো সব স্বগতোক্তি। কে উচ্চারণ করবে? কাকে বলবে? শুধু একটা শব্দেই সব কিছুকে স্বাভাবিক করে দিতে পারত – এটা খুব স্বাভাবিক, সবার হয়। একে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যা কিছু আমাদের আদিম ইচ্ছা তাকে বুদ্ধি-বিবেকের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। কেউ রাগলেই যেমন কাউকে খুন করে দেয় না, কি পায়খানা পেলেই যেমন যেখানে সেখানে করে দেয় না, এও সেরকম। তবে এর সঙ্গে লজ্জা, অপরাধবোধ, পাপবোধের কোনো সম্পর্ক নেই। 

    এই কথাগুলো বেশিরভাগ ছেলে তার প্রাক-কিশোর বয়েস, কিশোর বয়েস, বয়ঃসন্ধিতে শোনার সুযোগই পায় না। মনের মধ্যে একটা হীনমন্যতা নিয়ে ধীরে ধীরে পরিণত বয়সের দিকে এগোয়। অনেকের সে হীনমন্যতার বোধ কাটাতে সারাটা জীবন কেটে যায়, তাও কাটে না। অনেকের মধ্যে বিকৃতি জন্মায়। নানা অস্বাস্থ্যকর পরিণতি হয় শুধু একটা কথার অভাবে – সবটা স্বাভাবিক। এ প্রবৃত্তি নিয়েই মানুষ জন্মায়। একে নিয়ে লজ্জার যেমন কিছু নেই, তেমনই একে নিয়ে বাড়াবাড়ি করারও কিছু নেই। এর সঙ্গে শুচিতা-অশুচিতা, ভালোছেলে-মন্দছেলে, পাপী-পূণ্যবান হওয়ারও কোনো সম্পর্ক নেই। 

    এর পরের প্রশ্ন আসে মানুষের যৌনতার নানা রূপের প্রভেদ নিয়ে। সে অন্য আলোচনা। সে যদি মাইনরিটি গ্রুপের মধ্যে পড়ল তবে তো সমস্যা আরো গভীর। এখানে নারী-পুরুষের সমস্যা প্রায় সমান সমান। কোথাও হয় তো নারীর সমস্যাটা আমাদের মত সমাজে আরো বেশি। কিন্তু সে আলোচনা অন্য। 

    তবে ছেলেগুলো জানে কি করে, কোনটা ঠিক, কোনটা বেঠিক? সবটাই প্রথমত নিজের ইনস্টিংক্ট, তারপর নিজের বুদ্ধি-বিচারে যতটা কুলায়। বলাই বাহুল্য, মানুষের এতবড় একটা আদিম শক্তিকে আত্মনিয়ন্ত্রণে রেখে সুচারু জীবনযাপনের পাঠ আমাদের সঠিক মাত্রায় আজও দেওয়ার কথা ভাবা হল না। যা হচ্ছে তা ওই যে শুরুতেই বললাম, অর্ধপক্ক। ছেলেরা তাই বন্ধুবান্ধব, ইন্টারনেট, পর্ণ ইত্যাদির দিকে ঝুঁকে সেই অবশ্যম্ভাবী, অপরিহার্য প্রবৃত্তির একটা গতিপথ খোঁজে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নানা ভুল, নানা অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার মাশুল দিতে হয়। ক্রমে মানসিক অবস্থাটা জটিল হয়। নিজেকে লুকিয়ে রাখাটা একটা অত্যাবশ্যক সামাজিক বিধান হিসাবে মেনে নিয়ে জীবনের জটিল আবর্তে প্রবেশ করে। একটা অর্ধপক্ক শিক্ষা, একটা অর্ধপক্ক ধারণাকে সম্বল করে জীবনে পথ চলা শুরু হয়। এ ভীষণ দুর্ভাগ্যের। আমার শুধু এইটুকুই বলার, আপনারা প্লিজ ছেলেদের সঙ্গে কথা বলুন। শুরুটা না হয় পরোক্ষভাবেই হোক, ক্রমে প্রত্যক্ষভাবে কথা বলার দিন আসবে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম শুধু চান্স, আন্দাজ, অস্বচ্ছ ধারণা আর পর্বতপ্রমাণ অপরাধবোধ নিয়ে জীবন শুরু করবে, এ হয় না। একটা কথা মনে রাখতেই হবে, সবার মানসিক গঠন সমান হয় না, সবার মনের জোরও সমান হয় না। এগোতে আমাদেরই হবে নানা অযৌক্তিক, হানিকর সংস্কার থেকে মনকে মুক্ত করে। 

235
Tue, 01/19/2021 - 11:34

মানুষের তো শুধু মহিমাই নেই, মানুষের তো সঙ্কীর্ণতা, অসহায়তাও রয়েছে। সে সঙ্কীর্ণতাকে আমি যে নামেই ডাকি না কেন – স্বার্থপরতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ক্ষুদ্রবুদ্ধি – ইত্যাদি যাই বলি না কেন, আছে তো। এত যে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, খুনোখুনি, অত্যাচার, ধর্ষণ – এ সবই মানুষেরই কাজ। এ তো মহত্ব নয়। যে মানুষটা ঠাণ্ডা মাথায় কারোর ক্ষতির জন্য, নিজের লালসা তৃপ্ত করার জন্য চক্রান্ত করছে, ষড়যন্ত্র করছে – সেকি নিজের মনুষ্যত্বের মহত্বের কথা মনে রাখছে? রাখে না। আমি বড় বড় উগ্রপন্থী চক্রান্তের কথা বলছি না, আমি বলছি আমাদের নিত্য জীবনে ছোটো ছোটো বিষয়ে অন্যকে ডিঙিয়ে যাওয়া, মাড়িয়ে যাওয়ার চক্রান্তের, ষড়যন্ত্রের কথা। সেকি কম! সে কথা কাগজে ছাপা হয় না, টিভিতে দেখানো হয় না সত্যি, কিন্তু প্রতিদিন সংসারটাকে পাঁকে পাঁকে জড়িয়ে রাখে, এ তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সেই পাঁক তৈরিতে কি আমারও অবদান নেই? আমি কি কেবলই অন্যের তৈরি ফাঁসে জড়িয়ে, তা কেটে বেরোনোর লড়াই করি? আমি কি নিজের হাতে, নিপুণ কৌশলে অন্যের জন্য ফাঁদ পাতি না, সে ফাঁদে কি নিজেই পড়ি না? সে ফাঁসে কি নিজেই জড়াই না?

      একদিন যাকে খুব ভালোবাসতাম, তার সমস্ত দোষগুণ স্বীকার করে নিয়ে, কিছুটা প্রশ্রয়ে, কিছুটা মানিয়ে নিয়ে তাকে নিয়ে বেশ চলছিলাম। কারণ সেদিন সে ছিল গুরুত্বপূর্ণ আমার আবেগে অনুভবে। হঠাৎ আমার মনের কি যে হল, তাকে আমার আর মনে ধরল না। হঠাৎ করে মনে হতে শুরু করল সে যেন একটা মূর্তিমান আপদ আমার জীবনে। তার যে স্বভাব-অভ্যাসকে একদিন না শুধরিয়ে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছি, আমার ভালোবাসাকে কায়েমি রাখব বলে, কারণ আমি জানি তার দুর্বল জায়গাগুলোকে যদি আমি মেনে নিই, তবে সে আমারই রইল। কিন্তু আজ আর তা যে পোষাচ্ছে না! আজ আমার তাকে না হলেও চলে। তাই আজ প্রতি মুহূর্তে তাকে অপদস্থ করে, ছোটো করে, অপমান করে, দিশাহীন করে – কি এক অবিবেকি মুক্তির আনন্দ পাচ্ছি। নিজেকে প্রতি মুহূর্তে বোঝাচ্ছি যে, যা ঠিক বলে মনে হচ্ছে আমি তো তাই করছি, সেদিন অনেক অসুবিধা ছিল তাই বলিনি, আজ বলছি, কারণ আজ আমি অনেক বেশি স্বাবলম্বী। কি করে এত স্বাবলম্বী হলাম? আজ যে আমার হৃদয়ে তার জন্যে কোনো বিশেষ জায়গা নেই, তাই হঠাৎ করে সব কিছু সহজ আমার জন্য। এ-ও নীতি, এ-ও এক পথ, তবে সঙ্কীর্ণ পথ। মানুষের ভালোবাসা, বিশ্বাস, রুচি নিয়ে কোনো তর্ক চলে না। সে যুক্তির রাজ্য নয়, সে অনুভবের রাজ্য। সেখানে দুটো শব্দই যায় – এক উদার, দুই সঙ্কীর্ণ। হয় আমার বিশ্বাস, ভালোবাসা, রুচি উদার, নয় সঙ্কীর্ণ। তাকে অকারণে যুক্তির শিখরে চড়িয়ে তার মহিমা বাড়ানো যায় না। অতি নিম্ন স্বার্থকেন্দ্রিক রুচির জন্যেও বড় বড় যুক্তির সমর্থন পাওয়া যায়। অবশেষে তা মূল্যহীন।

      আবার আরেক দিকও তো আছে। আমার ভালোবাসাকে নিয়ে নাস্তানাবুদ হওয়া। আমি যাকে ভালোবাসি সেও যে আমায় একই মাত্রায় ভালোবাসবে এ তো হয় না। আর হয় না বলেই যত গোল। ভালোবাসা আর ভালোলাগার মধ্যে একটা শব্দের দূরত্ব আছে – নিজের করে চাওয়া। এমন তো অনেক কিছুই আমার ভালো লাগে, যা আমি চাই না, কিন্তু ভালো লাগে। তেমন অনেক মানুষও আছে যাকে আমি আমার ব্যক্তিগত পরিসরে আমার করে চাই না, কিন্তু তার সঙ্গ, তার আলাপ আলোচনা আমার ভালো লাগে। সেরকম আমাকেও অনেকের ভালো লাগতেই পারে, কিন্তু আমাকে কি সে তার নিজের করে চায়? চায় না। অথচ আমি তাকে চাই। আর আমার অশান্তির সূত্রপাতও এখান থেকেই। আমি তাকে চাইলেও সে কেন আমায় চায় না? আমি যদি একটা বস্তু চাইতাম তবে সেই বস্তুর আমাকে চাওয়ার অপেক্ষায় না থাকলেও হত, কিন্তু আমি যাকে চাই সে তো মানুষ! অহংকারী মানুষ আমরা। নিজের চাওয়ার উন্মাদনায় অনেক সময়েই মানুষ আর বস্তুর মধ্যেকার ফারাকটা ভুলে যাই। তাই একজন মানুষ আমাকে না চাইলে, আমার চাওয়াটা যে অপূর্ণ থেকে যায়, সে আমায় পীড়া দেয়, যন্ত্রণা দেয়, আমি মেনে নিতে পারি না। আমি তখন নানা ভাবে তার মন পাওয়ার চেষ্টা করি। তার জীবনে নিজেকে অপরিহার্য করে তোলার নানা সাধনে মাতি। কিন্তু তবু তার আমাকে চাওয়াটাকে যদি জন্মাতে না পারি? নিজেকে ব্যর্থ মনে হয়। তখন আমি বলপ্রয়োগ শুরু করি, তখন আমি নানা কৌশল চাতুরীর আশ্রয় নিই। নিজেকে লজ্জিত করি নিজের কাছেই। এইভাবেই একটা রেসিপ্রোকেশানের অভাব সমস্ত কিছুকে বিষিয়ে দিয়ে চলে যায়, যদি আমি আমার সীমারেখা না বুঝে থাকি তো। সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হয়, যেখানে চক্রান্ত শব্দটাই ছিল অবাঞ্ছিত। সে আরো বড় জ্বালা। জঞ্জাল আছে, অথচ ডাস্টবিন নেই। স্মৃতি কি ডাস্টবিন? না হৃদয় ডাস্টবিন? হৃদয় বিরহ বোঝে, কিন্তু ব্যর্থ চক্রান্তের মৃতদেহের ভার বইতে পারে না।

      কিন্তু এর মধ্যেও চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র চলে সুক্ষ্মস্তরে। কেউ যখন বোঝে তাকে কেউ চাইছে, সে এক অস্বাস্থ্যকর খেলায় মাতে। সে অন্যের সেই চাওয়াকে কপটভাবে রেসিপ্রোকেট করে। যেন সে-ও তাকে চায়। অনেকের চাওয়াকে কপট রেসিপ্রোকেশানের অভিনয়ে নিজেকে বাস্তবের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, নিজেকে নিয়ে অসৎ খেলায় মাতে। যেন অনেকের তাকে চাওয়ায় তার নিজের বিশেষ কৃতিত্ব আছে, নইলে এত মানুষ তাকে চাইতো কেন? ক্রমে সে আরো চাতুরীতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। যত চতুর হয় তত একা হয়। কারণ অন্যকে প্রতারণা করে বেশিদিন রাখা যায় না, কিন্তু অন্যকে প্রতারণার খেলায় একবার নেমে পড়লে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো মানুষ হয়তো কয়েক বছর খুব বেশি হলে তার দ্বারা প্রতারিত হতে পারে, কিন্তু যে মানুষ নিজেকে ভোলাতে শুরু করেছে তার আর ঘোর কাটেই না। আজীবন সে নিজে যা নয়, নিজেকে তাই ভেবে জীবন কাটিয়ে দেয়। এ বড় দুর্ভাগ্যের। ওই যে বলছিলাম না, নিজের তৈরি ফাঁসে নিজেই জড়িয়ে পড়া, এ হল তারই উদাহরণ।

      এরকম নানা চক্রান্ত রাতদিন ঘটে চলেছে চারপাশে। ভাইরাসের থেকেও সূক্ষ্ম। সে সব এড়িয়ে চলা কি চাট্টিখানি কথা? রামকৃষ্ণদেব বলতেন, কাজলের ঘরে থাকলে একটু কাজল লাগবেই। চারজন মানুষ একত্র হলেই এ সূক্ষ্ম চক্রান্ত ষড়যন্ত্রের খেলা চলবেই, কারণ এ মনুষ্যস্বভাবোচিত। এর থেকে মুক্ত কেউ নয়। কেউ শিকার হবে, কেউ বা হবে শিকারী। কিন্তু ত্রাণ কারোর নেই। তা বলে মহত্ব নেই মানুষের স্বভাবে? আছে। সেও আছে। আমার বাড়ির ছাদ যেমন আছে, আকাশও আছে। খুব কম লোক সেদিকে তাকায়, এই যা।

236
Fri, 01/08/2021 - 18:55

স্নেহ অতি বিষম বস্তু। স্নেহবস্তু যত সুক্ষ্ম তাকে নিয়ে সমস্যাও তত গুরুতর। যেমন ধরুন LDL এর কথা, যেই না রক্ত পরীক্ষায় এল যে সেই সুক্ষ্ম স্নেহ আপনার রক্তে ঘোরাফেরা করে বেড়াচ্ছে তখন আর নিশ্চিন্তে থাকার জো রইল না। যখন তখন যেখানে সেখানে জমে এক বিদিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে বসাবে। চিকিৎসকের স্নেহদৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবেন। ঘরের লোকের দ্বারা রন্ধিত স্নেহমিশ্রিত খাদ্যতালিকা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসবে। যখন তখন আপনাকে বাইপাসের ভয় দেখানো হবে। আর এখন তো আবার দাদার নামটা জুড়লই – ওরই যখন এই অবস্থা, এত জিম করে এত ব্যাটবল খেলে, তখন...

      যাক, সে স্নেহের তবু একটা মাপকাঠি আছে। কতটা বরদাস্ত করা ঠিক হবে কতটা হবে না, সেও একটা হিসাব করে বলা যায়। কিন্তু ভাবুন যে স্নেহ হৃদয়ে ধমনীতে জমে না, হৃদয়ে উৎপত্তি লাভ করে ক্রমে মস্তিষ্ককে আচ্ছন্ন করে ফেলে, বিভ্রান্ত করে তোলে, সেই স্নেহের কথা? এই সেই স্নেহ যাহা সতিই অতি বিষম বস্তু। যার কবল থেকে মুক্তির জন্য বাইপাস কেন, কোনো উপায়ই নেই, শুধু পাশের পর পাশ বেড়েই যায়। এ পাশকেই শাস্ত্রকারেরা বলেন অষ্টপাশ। সেই মহাভারতের যুগে দেখুন। ধৃতরাষ্ট্র বললেই লোকে বলে স্নেহান্ধ। আচ্ছা বলুন, কোন স্নেহটা অন্ধ নয়। স্নেহ মানেই ঝাপসা দৃষ্টি। সে অন্ধত্ব অবধি পৌঁছাক বা না পৌঁছাক, ছানি অবধি তো যাবেই। স্নেহ মানেই একদিকে গোঁত্তা খেয়ে চলা মনের গতিবিধি। গোটা মহাভারতটাই হয়ে গেল এই এক স্নেহের চক্করে। মায় গান্ধারী ম্যাডাম অবধি অত করে বোঝালেন না স্যারকে। তিনি আর বুঝেছেন, তা কি করে বুঝবেন? মস্তিষ্কের যে স্নেহ জমে জমে পাহাড় হয়ে আছে। ছেলেকে নিয়ে ভাবনাগুলো সব মাখো মাখো। এমনকি আমাদের রবি ঠাকুরও কি সুন্দর পদ্য লিখে গান্ধারীকে দিয়ে বলালেন। হল কি কিছু? হবে না তো। এক গোঁ। আসলে ঠিক গোঁ নয় জানেন, ওটা একটা মাখো মাখো অবস্থা। আর ওদিকে দশরথের কথা ভাবুন। সব দিক রাখতে গিয়ে প্রাণটাই খোয়ালো মানুষটা। একদিকে স্নেহ, অন্যদিকে প্রেম। যায় কোনদিকে মানুষটা?

      এই দেখুন না আমাদের কালে লোকে কত কি বলে – কার জানি ভাইপোর জন্য দলে নাকি এত সমস্যা। ভাইপো স্নেহ। কার জানি স্নেহের জন্য দেশের একটা প্রধান রাজনৈতিক দলের আজ ভরাডুবি। ছেলেটা বিয়েও করল না, রাজা হওয়ার জন্য লড়াইটাও ঠিকঠাক করল না। শুধু মায়ের আর দলের দাদু-দিদার স্নেহে লুতুপুতু খেয়ে মাখো মাখো হয়ে আছে থেকে থেকেই বিদেশে চকোলেট খেতে চলে যাচ্ছে। যায় ভাগ্যি মেয়েটার বিয়ে থা হয়ে গিয়েছিল। নইলে দলের লোকগুলোর নাওয়াখাওয়া ভুলে ভাইবোনের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতেই প্রাণ যেত। পার্লামেন্টে যে শান্তিতে পাছা ঠেকিয়ে বসবে সে সময় পেত?

      আজকাল আমার আবার নানা জাতের ওয়েবসিরিজ দেখে দেখে পেরায় দিব্যজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। কি বলি বাপু, বিশ্বের যত তাবড় তাবড় ডাকু-খুনী-ঠগ-জোচ্চর এইসবের গপ্পো ফেঁদে ফেঁদে সিরিজের পর সিরিজ বানিয়ে যায়। আর আমি দেখেই যাই, দেখেই যাই। ওয়েবসিরিজে দুটো লোক কথা বললেই আমার প্যালপিটিশান হয় জানেন, এই বুঝি প্যান্টুলুনের পিছন থেকে একটা বন্দুক বার করে ঠাঁই করে গুলি চালিয়ে দিল। বলি জগতে এত প্রতিভাধর গুণ্ডা-বদমায়েশ ছিল তা এই ওয়েবসিরিজগুলো না থাকলে জানতে পারতুম? তাদের জীবন কি নিখুঁত দেখায় মা গো মা! কেন? দেশে সাধু মহাপুরুষ নেই? সেই বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, ব্যাসদেব কি সেন্ট পিটার, সেন্ট অগাস্টিন, সেন্ট থমাস এদের জীবনী দেখা! তা না, পাবলো এস্কোবার বলে এক কলোম্বিয়ান কোকেন গুণ্ডা ছিল সে প্যান্টুলুন খুলে কমোডে বসে হাগছে আমায় তাও দেখতে হবে। না দেখলেও হয়, কিন্তু ওসব না দেখলে আপনি আবার অসামাজিক হয়ে গেলেন যে। লোকে মায় সারাদিন এখন ওইসব কুখ্যাত গুণ্ডাগুলোনরে নিয়ে কি গালগল্প করে গা! মনে হয় হাতে ধানদুব্বা দিয়ে বসিয়ে দিই।

      তা এই স্নেহ’র কথা বলতে গিয়ে কেন এই সব প্যাঁচাল পাড়তে বসলাম? আরে ওই যে পাবলোর কথা বললাম না, সে তার মেয়ের ঠাণ্ডা লাগছিল বলে কত কত টাকার বাণ্ডিল জ্বালিয়ে দিল জানেন? আমি তো দেখেই থ! অথচ কত কত রাস্তার বাচ্চাগুলোকে হাতে বন্দুক দিয়ে এই মানুষটাই নিজের স্বার্থসিদ্ধির পথ তৈরি করেছে। স্নেহ এমনই একচোখা।

      আমি দেখেছি তো, এমন মানুষ দেখেছি। যে মানুষ তার কাজের জায়গায় একটা নয়া পয়সা ঘুষ নেয়নি, সে নিয়ে সবাই ধন্যি ধন্যি বলে, সেই মানুষ নিজের অসৎ, হাড়েবজ্জাৎ, লোকঠকানো ছেলের প্রতি স্নেহে অন্ধ হয়ে তার বউ-বাচ্চাকে পর্যন্ত অস্বীকার করে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমায়! মা গো মা! বলি একটু বিবেক দংশন হয় না গা? হয় না। বিবেক আর মস্তিষ্কের উপর এমন পুরু স্নেহের আবরণ। এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ সংসারের ঘরে ঘরে। মা এক ছেলের উপর স্নেহে অন্ধ হয়ে আরেক ছেলেকে পথে বসিয়ে দিল, এও দেখলাম। বলি কত কত গল্প, উপন্যাস হয়ে গেল না এই স্নেহের অত্যাচারের উপর ভর করে।

      এখন লোকে বলে নেপোটিজম। এই নতুন শব্দ আজকাল লোকের মুখে মুখে ফিরছে। যেন স্নেহান্ধ কথাটা আমরা জানি না। আসলে জানি তো সবই। ভাবটাও একই যুগে যুগে, শুধুমাত্র ভাষাটা বদলে বদলে যায়। সেদিনের লুচ্চামিকে এখন বলি ওপেন রিলেশানশিপ।

      স্নেহের সমস্যা শুধু কি এই একপেশেমি গোলমালেতেই? না। সে সব তো বহির্মুখী সমস্যা। এর সঙ্গে আছে অন্তর্মুখী জ্বালা। কিভাবে বলি। আসলে স্নেহের সঙ্গে মর্যাদাবোধের একটা আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক। কথাটা একটু খোলসা করে বলা যাক। যেমন ধরুন কারুর প্রতি আমার বেজায় স্নেহ জন্মে গেছে। এই স্নেহ জন্মে যাওয়ার উপর তো কারোর হাত থাকে না বলুন। অতএব কি আর করা, যখন জন্মেই গেছে তখন উৎপাতও শুরু হল। বাইরের নয়, ভিতরের। স্নেহ প্রথম যেটা সরিয়ে দেয় তা হল আত্মমর্যাদাবোধ। স্নেহের বস্তুটির সামনে এলেই নিজের সমস্ত মর্যাদাবোধ যেন সেই মানুষটার কৃপাদৃষ্টির উপর দাঁড়িয়ে। তার মধু ব্যবহারেই, তার সান্নিধ্যেই আমার সুখ, আমার সব কিছু। সে দূরে গেলেই আমার সব শূন্য বোধ। এখন সমাজে তো অধিকারবোধের একটা হিসাব নিকাশ করে রাখা আছে। স্নেহ সে কথা মানবে কেন? আপনার যদি অন্যের বাচ্চার উপর স্নেহ জন্মায়, তবে সে স্নেহের ব্যথার উপশমের জন্য তাকে আপনি সবসময় কাছে পাবেনই তার কি মানে আছে? যেখানে অধিকার আছে সেখানেই মানুষ বঞ্চিত হয় যখন তখন আর অন্য ক্ষেত্রের বিষয়ে কি কথা। কত দাদু-দিদা, ঠাকুমা-ঠাকুর্দার কাঙালপনা দেখেছি। যেন তাদের ভালোবাসা আর স্নেহের চাইতে বড় বাধা সংসারে আর কিছুতেই নেইকো। কিসের বাধা? আরে বড়মানুষ হওয়ার বাধা গো। যতদিন যাচ্ছে দাদুদিদিমারা যেন ভুলেই যাচ্ছে যার প্রতি তাদের স্নেহ সে একটা মানুষ শুধু না, সে একটা ভয়ংকর সম্ভাবনা। তাকে শুধু স্নেহের বস্তু করে রাখলেই হয় না। উচ্চমানের মান-যশ-অর্থের উপার্জন তালিকায় তার নাম নথিভুক্ত করতে না পারলে সংসারে আসাটাই তার ব্যর্থ বলে গণ্য হবে যে! অগত্যা উপোসি স্নেহ নিয়ে দাদু-দিদা-ঠাকুমা-ঠাকুর্দার দিনাতিপাত। নাতি-নাতনীদের কল্পনা, ছবি, ক্ষণিক ভিডিওকল, ক্ষণিক কাছে পাওয়া ইত্যাদিতেই সমস্ত স্নেহের দাবি মিটিয়ে নিতে হবে, এমন চুক্তিপত্র লেখা হয়ে গেছে। এ হল অতৃপ্ত স্নেহের যন্ত্রণা।

      আর যার উপর আপনার অধিকার নেই? তখন তো আপনি ভিখারি। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম তখন। ক্রমে অবশ্য বোঝা যায় কারোর উপরেই আমার সে অর্থে অধিকার নেই। মনের মধ্যে একটা চিনচিনে বৈরাগ্য জন্মায়, এ হল অভিমানী বৈরাগ্য। শাস্ত্রে এ কথা নেই।

      ওই যে মর্যাদাবোধের কথা বলছিলাম না? ওটা স্নেহের সঙ্গে ব্যাস্তানুপাতিক। স্নেহ অতি হলে মর্যাদাবোধ ঠিক মাত্রায় রাখা দায়। অন্যথায় মর্যাদাবোধ অতিরিক্ত হলে স্নেহকে তবু অন্তত বুকের উপর খিল আটকিয়ে হাসিমুখে ঠেকিয়ে রাখা যায়। হাসিমুখে বললাম কিন্তু, জ্বলন্ত হৃদয়ের কথা না। খিল খাপে খাপে বসাতে কতটা জোর দিতে হয়, সে যে দেয় সেই জানে। আসলে মানুষ তো যতটা শরীরে বাস করে তার চাইতে অনেক বেশি মর্যাদায় বাস করে। বাড়ির মানুষ যদি মর্যাদা নিয়ে থাকে তবেই তার থাকাটা থাকা আসলে বাড়িতে থাকা। নইলে সে বাড়ি শুধুই আশ্রয়। তার জন্যে তো রেলের স্টেশানের শেডই যথেষ্ট। যেখানে মানুষ অন্তত মর্যাদার আশাটুকুও রাখে না। যা মেলে তাইতেই পুষিয়ে যায় তখন। মানে পুষিয়ে নিতেই হয়।

      শাস্ত্রে যে গাম্ভীর্যতার সঙ্গে কাম-ক্রোধ-লোভকে রিপু বলেছে, সতর্ক করেছে, সেই অর্থে স্নেহ সম্বন্ধে করেনি তো। ফলে ভালোবাসা, অনুকম্পা, ভালোলাগা ইত্যাদির মুখোশে কখন যে সে স্নেহ সারাটা বুক শিকড় ছড়িয়ে বসে তা জানতেও পারা যায় না। যখন বোঝা যায়, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাই কি বাণপ্রস্থের কথা বলা হল? হবেও বা। যখন বারবার স্নেহের নিগড়ে ক্ষোভ জন্মাচ্ছে, তখন মানুষ যতটা না ঈশ্বরের জন্য ব্যকুল হয়, তার চাইতে ব্যাকুল হয় নিজের সেই নিগড় ভেঙে ফেলার জন্য। ওকেই নাম দেয় - মুক্তি। সে তো বোঝে তার যন্ত্রণার কারণ বাইরের কেউ না, সে নিজে। তার বুক উছলে ওঠা স্নেহের ভার সে আর বইতে পারছে না। সে মুক্তি চায়। এই স্নেহ থেকেই সে মুক্তি চায়। সংসার থাকবে আর স্নেহের পাশ থাকবে না তা কি হয়? ও যতই নিরাসক্তির কথা বলো না কেন? মনের একদিক যখন বলে আমি সব ছেড়েই যেতে পারি, তখনই আরেকদিক বলে, "ওর কি খাওয়া হল? জ্বর হল কি? ওর চোখটা কি ছলছলে? রোগা হয়ে যাচ্ছে কি?" - এ প্রশ্নগুলো তো আর বাণপ্রস্থাভিমুখী না। এগুলো যে বড় বালাই। ভীষণ বালাই। দুর্ভাগ্য আরো ঘনীভূত হয় যদি এর সঙ্গে জোটে অপর দিক থেকে শীতল অমর্যাদা। মানুষ যায় কোথায়? কোথাও যায় না। মানুষ তখন বলে আর কিছু না থাকুক, আমার মৃত্যু তো আছে। মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান... তুঁহু নেহি বিসরবি, তুঁহু নেহি ছোড়বি... রাধা হৃদয় তু কব হুঁ না তোড়বি...

      এ অভিমানে সত্যি চিতা জ্বলে ওঠার আগে কত চিতা বুক জ্বালিয়ে জ্বলে গেল, অনেক দেখলাম। আবার সত্যি মরণ যখন এলো সে আবার বাঁচতে চাইল। কিন্তু মরণ সে সময় দিল কই? তাকে পুড়িয়ে কি মাটির মধ্যে মিশিয়ে সংসারে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দিল না? দিল তো। সে তাও মেনে নিল। তার হয় তো কোথাও আশা জন্মালো সে তার স্নেহ তার মৃত্যুর পর নিজের মর্যাদাটুকু পাবে। নির্বোধ হৃদয়ের এ সাধটুকুও শুধুই মরীচিকা। স্নেহ সত্যিই এক বিষম বস্তু। এইটুকুই সার সত্য।

237
Fri, 12/25/2020 - 12:00

মানুষের চিন্তার বিরাম আছে। অনুভবের বিরাম নেই। “শুধু আমার হিয়া বিরাম পায় না গো”। আমি যে কিছু অনুভব করছি না, এও এক অনুভব। শুষ্কতার অনুভব। “জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণাধারায় এসো”। শুষ্কতার অনুভবের চাইতে বড় বালাই মানুষের হৃদয়ের কমই আছে। শ্রী অরবিন্দ বলছেন, একবার নিজেকে এমন করে ফেললাম, যেন কোনো দুঃখ আমায় স্পর্শ করতে না পারে। আমি দেখলাম সব সুখের অনুভবও আমায় ছেড়ে চলে গেল। আমি আবার আমার বুক পেতে দিলাম, বললাম আমার বুকের উপর দিয়ে তোমার ভালোবাসার হাল চষে যাও। আমি সহ্য করে নেব।

 

আমি হৃদয়েতে পথ কেটেছি,

সেথায় চরণ পড়ে,

তোমার সেথায় চরণ পড়ে।

তাই তো আমার সকল পরান

কাঁপছে ব্যথার ভরে গো

কাঁপছে থরথরে।

ব্যথা-পথের পথিক তুমি,

চরণ চলে ব্যথা চুমি,

কাঁদন দিয়ে সাধন আমার

চিরদিনের তরে গো

চিরজীবন ধ'রে।

নয়নজলের বন্যা দেখে

ভয় করি নে আর,

আমি ভয় করি নে আর।

মরণ-টানে টেনে আমায়

করিয়ে দেবে পার,

আমি তরব পারাবার!

ঝড়ের হাওয়া আকুল গানে

বইছে আজি তোমার পানে,

ডুবিয়ে তরী ঝাঁপিয়ে পড়ি

ঠেকব চরণ-'পরে,

আমি বাঁচব চরণ ধ'রে।

 

এই তো কথা। ওই যে বললাম, শুষ্ক হৃদয়ের চাইতে ভার আর কিছুর যেন নেই। তখন যে করে হোক আমার কোনো অনুভব চাই। এমনকি আমি তখন নানা পাপ আচরণের আগলও খুলে দিতে পারি। আমি তীব্র অনুভব চাই। আমি যে আর এ শুষ্কতা সহ্য করতে পারছি না। আমি যেন বেঁচে নেই। আমি যেন নেই। কোথায় আমার অনুভব। কোথায় আমি?

রবীন্দ্রনাথ নাটকে লিখছেন, প্রকৃতির বরাদ্দ মদে যে অধিকার হারায় তার জন্যে তখন অবশিষ্ট থাকে শুঁড়িখানার মদ। প্রকৃতির বরাদ্দ মদ কি? “মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ”...

 

এই-যে তোমার প্রেম,ওগো হৃদয়হরণ,

এই-যে পাতায় আলো নাচে সোনার বরন॥

এই-যে মধুর আলসভরে মেঘ ভেসে যায় আকাশ-'পরে,

এই-যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ॥

প্রভাত-আলোর ধারায় আমার নয়ন ভেসেছে।

এই তোমারি প্রেমের বাণী প্রাণে এসেছে।

তোমারি মুখ ওই নুয়েছে, মুখে আমার চোখ থুয়েছে,

আমার হৃদয় আজ ছুঁয়েছে তোমারি চরণ॥

 

কিন্তু আমার হৃদয় যে শুষ্ক। আমার প্রার্থনা কি তবে? “শুষ্ক হৃদয় মম কঠিন পাষাণসম, প্রেম সলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান”।

খ্রীষ্টের জীবন আর বাণী এই শুষ্কতার বিরুদ্ধে। খ্রীষ্টের বাণীতে ইন্দ্রিয়দ্বার রুদ্ধ করে ধ্যানের কথা বলা হল না। বলা হল না যে সমস্ত ত্যাগ করে জঙ্গলে যাও, কি পর্বত গুহায় যাও, কি লোকালয়ের বাইরে যাও। বলা হল নিজেকে সিক্ত করো। করুণায়। ভালোবাসায়। “আমি যেমন আমার ভাইয়ের অপরাধ ক্ষমা করেছি, তেমন তুমিও আমার অপরাধ ক্ষমা করো পিতা”। এ প্রার্থনা খ্রীষ্ট শেখাচ্ছেন। আগে নিজে ক্ষমা করো, তবে ক্ষমা চেয়ো। কে কৃপাপাত্র হতে পারে? যে নিজেকে পিতার কৃপার যোগ্যও মনে করে না সে-ই। খ্রীষ্ট গল্প বলছে।

একজন খাজনা মুকুবের জন্য রাজার দরবারে আর্জি জানাতে গেল। রাজা তার তার কাতরতায় মুকুব করল খাজনা। সে ব্যক্তি মহানন্দে রাজদরবারের বাইরে এসে যেই দাঁড়িয়েছে, দেখে এক ব্যক্তি যাচ্ছে যার কাছে সে কিছু টাকা পায়। সে তড়িঘড়ি করে গিয়ে বলল, যে টাকা তুমি ধার নিয়েছিলে, সে টাকা এখনই দাও। সে বলল, আমার কাছে নেই, আমি খুব খারাপ অবস্থা দিয়ে যাচ্ছি। লোকটা শুনল না, সে তার গলা টিপে ধরতে উদ্যত হল। অমনি রাজার লোক এসে তাকে ধরে নিয়ে রাজার কাছে গেল। রাজা সব শুনে বলল, আমি এতগুলো টাকা তোমার মুকুব করে দিলাম, আর তুমি এইটুকু টাকার জন্য ওকে মারতে পর্যন্ত উদ্যত হলে!

খ্রীষ্ট বলছেন, তোমরাও কি তাই করো না?

খ্রীষ্টের দ্বিতীয় গল্প।

একজন উপাসনা গৃহের মধ্যে দাঁড়িয়ে বলছে, ওগো প্রভু, আমি কত উপবাস করি, আমি কত নাম করি তোমার, আমি কত দয়াদাক্ষিণ্য করি। আমার উপর তো তোমার কৃপা হবেই। আর ওদের দেখো, যারা তোমার নাম করে না, যারা তোমার গৃহে আসে না, তাদের কোনোকালে কিছু হবে?

ঠিক সেই সময় উপসনা গৃহের বাইরে দাঁড়িয়ে আর একজন প্রার্থনা করছে, হে প্রভু, আমি লোকের টাকা ধার নিয়ে সুদের ব্যবসা করে পেট চালাই। আমার যোগ্যতা নেই তোমার উপাসনা গৃহে প্রবেশ করে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করি। তবু যদি পারো আমায় ক্ষমা কোরো।

খ্রীষ্ট বলছেন, তোমরাই বলো, কে সত্যিকারের ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য?

শুষ্ক হৃদয় কেন? কারণ আমি স্বার্থপর বলে। আমি আত্মকেন্দ্রিক বলে। আমার চারদিকে আমারই তৈরি পাঁচিল। সে পাঁচিল ডিঙিয়ে আমি বাইরে যাই না। কেউ আসতেও পারে না। মাঝে মাঝে যদিও মনে হয় দিই এ পাঁচিল ভেঙে। কিন্তু ভয় করে। আমার এ পাঁচিলের উপর কেমন যেন আসক্তি। যেন এ পাঁচিলটাই আমি। তবে উপায়? ক্ষমা করার সাহস।

 

আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া,

বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া ॥

এই-যে বিপুল ঢেউ লেগেছে তোর মাঝেতে উঠুক নেচে,

সকল পরান দিক-না নাড়া ॥

বোস্‌-না ভ্রমর, এই নীলিমায় আসন লয়ে

অরুণ-আলোর স্বর্ণরেণু মাখা হয়ে।

যেখানেতে অগাধ ছুটি মেল সেথা তোর ডানাদুটি,

সবার মাঝে পাবি ছাড়া ॥

আমি কেন ক্ষমা করব? নিজেকে বাঁচাবো বলে। নিজের হৃদয়ের শুষ্কতাকে বাঁচাব বলে। আমার মধ্যে যে জন্মলব্ধ চিরন্তন এক ভালোলাগার অনুভূতি ধীরে বয়ে যায়, তাকে রক্ষা করব বলে। সেই তো আদতে আমার জীবন। সে যদি না থাকে কোনো কাজে আমার উৎসাহ নেই। কোনো বিষয়ে আমার কোনো আশা নেই। কোনোদিকে আমার যেন ডাক নেই। আমি যেন এতবড় বিশ্বে সম্পূর্ণভাবে অবাঞ্ছিত। তা হয় কি করে? কিন্তু ক্ষমা করব কিসে? করুণায়। একই কথা। যেই ক্ষমা, সেই করুণা। তার রসদ চিন্তার ঘূর্ণীতে নেই, প্রাণের স্রোতে আছে। বড়দিনের এইটাই তো বড় কথা। আসল চ্যালেঞ্জ।

প্রাণে খুশির তুফান উঠেছে।

ভয়-ভাবনার বাধা টুটেছে ॥

দুঃখকে আজ কঠিন বলে জড়িয়ে ধরতে বুকের তলে

উধাও হয়ে হৃদয় ছুটেছে ॥

হেথায় কারো ঠাঁই হবে না মনে ছিল এই ভাবনা,

দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।

যতন করে আপনাকে যে রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,

আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে ॥

 

238
Wed, 12/23/2020 - 13:00

 

 

 

 

 

 

রমণ মহর্ষি উত্তর দিতেন না। প্রশ্ন করতেন। একজন এসে বললেন, আমি দীর্ঘদিন জপ করছি, কিন্তু আমার প্রাণে কোনো শান্তি নেই। রমণ মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন, কে জপ করছে?

      প্রশ্নকর্তা হয় তো বুঝতে না পেরে রমণ মহর্ষির মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন; রমণ মহর্ষি বললেন, তুমি খোঁজো কে জপ করছে।

      এই ছিল মূল পথ। প্রশ্ন করো – “আমি কে?”। রাতদিন এই প্রশ্ন করো। যে কাজ, যে চিন্তা, যে অনুভব – যার মধ্যে দিয়েই যাও, সে মুহূর্তকে ভেসে যেতে দিও না, নিজেও ভেসে যেও না। প্রশ্ন করো – “কে চিন্তা করছে?”... ”কে অনুভব করছে?”... ”কে দুশ্চিন্তা করছে?”... ”কে সংশয়ে ভুগছে?”... ”কে প্রশ্ন করছে?”...

      এ এক খেলা। রমণ মহর্ষি বলছেন না তুমি দীক্ষা নাও, গুরুকরণ করো, সন্ন্যাস নাও, পুজা করো। তোমায় কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি শুধু এই খেলাটা শিখে নাও। যখন সংসারে জট পাকাচ্ছে, তখনই এই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ করো। যখন সব কিছু মোলায়েম আনন্দলহরীতে বয়ে চলেছে তখনও এ প্রশ্ন করো। ঈশ্বরকে দরকার নেই, নিজেকে খোঁজো। তোমার গভীর ঘুমের মধ্যে কে জেগে থাকে? কে স্বপ্ন দেখে? কে স্বপ্নকে অনুভব করে? এ তর্কের বিষয় নয়। এ প্রশ্নের বিষয়। এ প্রশ্ন বাইরের কাউকে কোরো না। এ আত্মজিজ্ঞাসা। আত্মজিজ্ঞাসার উত্তর বাইরে থেকে আসে না।

      তবে কি গুরুর দরকার নেই?

      রমণ বললেন, তুমি তবে বাইরের গুরুর কথা বলছ। বাইরের গুরুর একটাই কাজ, ভিতরের গুরুকে জাগিয়ে তোলা। ভিতরের গুরু তখন তোমায় ভিতরে ডাকবে। তুমি স্থির হবে। সংসারে দাঁড়াবার পাটাতন পাবে। সংসারে দাঁড়াবার পাটাতনের নাম ঈশ্বর।

      কৃপা হয় কি করে?

      গুরু, কৃপা, ঈশ্বর – একই সত্তার নাম। তুমি আমায় দেখো। আমার সেই অর্থে গুরু কই? আমি তখন তোমাদের ভাষায় টিন এজার। একদিন কি এক অনুভব হল। মনে হল আমি যেন মৃত। আমার দেহ থেকে আমি বাইরে। আমি আর আমার দেহ আলাদা। আমি বাড়ি ত্যাগ করলাম। এখানে ওখানে ঘুরে এই অরুণাচলম পাহাড়ে এলাম, তামিলনাড়ুতেই। কি এমন সৌন্দর্য যেন এই পাহাড়ের! আমায় তীব্র আকর্ষণ করল। আমি সেই টানে এসে পড়লাম। ধ্যানে বসলাম। মন্দিরে আমায় নিয়ে কৌতুহল হল। আমি মন্দিরের তলায় গুদোম ঘরে ধ্যানে বসলাম। আমার নাকি সারা শরীর পিঁপড়ে-কাটা দাগে ভরে গিয়েছিল। তাতে কি? আমার তন্ময় ধারা রইল নিরবচ্ছিন্ন। আমি আমায় পেলাম। তাই বললাম, গুরু, ঈশ্বর, কৃপা --- সবই এক কথা। নিজেকে প্রশ্ন করো। নিজের খোসা ছাড়াও। 'হো হো' করে বেড়িয়ে সময় নষ্ট করো কেন?

      আমার দেবপূজা ভালো লাগে..., একজন এসে বলল।

      রমণ বললেন, তাই করো।

      একজন এসে বললেন, আমি ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকি। তোমায় বারবার দেখার সাধ, দেখি কি করে?

      রমণ বললেন, বোকামি করো কেন? ভিতরে ডোবো। নিজেকে জানো। বাইরের সব পার্থক্য ঘুচে যাবে।

      একজন এসে বলল, আমায় ব্রহ্মজ্ঞান দাও।

      রমণ হেসে বললেন, ব্রহ্মজ্ঞান আমি দেব কি করে?

      সে বলল, কেন, আপনি যে ব্রহ্মজ্ঞানী!

      রমণ বলল, যদি আমি ব্রহ্মজ্ঞানী হয়ে থাকি, তবে আমার কাছে সব ব্রহ্ম, তুমিও, তোমায় আমি কি যুক্তিতে ব্রহ্মজ্ঞান দেব? আর যদি আমি ব্রহ্মজ্ঞানী না হয়ে থাকি, তবে তুমিও যা, আমিও তাই। এসো বরং নিজেরাই নিজেদের রাস্তা খুঁজি। নিজেকে খোঁড়ো। খোঁজা মানে খোঁড়া। আঁশ ছাড়াও।

      মহর্ষির তখন স্কিন ক্যান্সার। কোনো বিশেষ চিকিৎসায় না বলে দিলেন। তখন তাঁর পরিচিতি বিশ্বজোড়া। টাইমস্ ম্যাগাজিনে তাঁকে নিয়ে লেখা হয়েছে। কার্ল ইয়ুং -এর মত মনোবিদ তাঁর কথা উল্লেখ করলেন। মহাত্মা গান্ধী মাঝে মাঝেই কাউকে না কাউকে পাঠান পরামর্শ চাইতে। মহর্ষির সবার জন্য অবারিত দ্বার। মহর্ষি কথা বলেন না বেশি। কিন্তু বাচ্চারা ভীষণ প্রিয়।

      কয়েকজন আশ্রমের বাচ্চা তাঁর সামনে ধ্যান করছে। আসলে মজা করছে। একটা দুষ্টু ছেলে মহর্ষির সামনে ধ্যানরতা এক বাচ্চা মেয়েকে বারবার খুঁচিয়ে উত্যক্ত করার চেষ্টা করছে। মহর্ষি মজা দেখছেন, মুচকি মুচকি হাসছেন। এক সময়ে মেয়েটাকে বললেন, তোকে যে খালি খালি খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করছে, কিছু বল...

      মেয়েটা শান্ত গলায় মহর্ষিকে বলল, আপনি ভুল করছেন মহর্ষি, ও নিতান্তই আমার শরীরকে স্পর্শ করছে, আমার আত্মাকে না।

      মহর্ষি হো হো করে হেসে বললেন, বাব্বা! তোর এত দূর হয়ে গেছে...

      একজন এসে বলল, মহর্ষি আমার মনে হয় আমার জন্য আত্মজিজ্ঞাসার পথ নয়, তবে আমি কি করব?

      মহর্ষি বললেন, তুমি নিজেকে সম্পূর্ণ ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণ করো।

      সে বলল, সেও করেছি, কিন্তু তাতেও কিছু হচ্ছে না।

      মহর্ষি বললেন, যদি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে থাকো, তবে কোন অংশ থেকে এ অভিযোগ, ক্ষোভ উঠে আসছে তাকে খোঁজো, তাকেও সমর্পণ করো। তবেই হবে পূর্ণ আত্মসমর্পণ।

      রমণ মহর্ষিকে নিয়ে কোনো সম্প্রদায় তৈরি হয়নি। কোনো বিশেষ মত তৈরি হয়নি। কোনো গুরুবাদ তৈরি হয়নি। রামকৃষ্ণ মিশনের অনেক বরিষ্ঠ সন্ন্যাসী মহর্ষির আশ্রমে কাটিয়েছেন, যাদের মধ্যে স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর নাম উল্লেখযোগ্য।

 

      আজকে এক নতুন গুরুবাদ। সেখানে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, সঙ্কীর্ণ রাজনীতি ছায়ায় মত ঘোরে। কেউ নিশ্চয় ভাবতেই পারেন না মহর্ষির সঙ্গে দেখা করতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে, বা রামকৃষ্ণদেব জনসভা করছেন। সেখানে অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি, ক্ষমতালোভী মানুষগুলো কল্কে পেত না। হুড়কো দিয়ে বের করে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকত। অন্তরে সম্পদ পেলে তবেই যে না বাইরের সম্পদকে তুচ্ছ করার ক্ষমতা মেলে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, ফলের ভারে আনত বৃক্ষের নত হওয়া দৈন্যের বশে না, আত্মলাভের বশে। আজকের গুরুরা বড় বেশি ভুল জায়গায় থেকে থেকে নত হয়ে পড়ছেন। অন্যের উপলব্ধির মার্কেটিং করে কি আর নিজের উপলব্ধির পথ খোলা যায়? আজ শুনি গীতা, উপনিষদেরও ক্লাস হয়। আমি ওরকম বেশ কিছু ক্লাস করে দেখেছি। ওতে শুধু “আমি গীতা জানি। আমি উপনিষদ জানি।” এর বেশি বোধ কিছু হয় না। কারণ ও বস্তু ক্লাসের বস্তু না। ভাবের বস্তু। এও সেই পাশ্চাত্যের অনুকরণ। যা অনুভব করার, তাকে বুদ্ধি-যুক্তির ছাঁকনিতে ছেঁকে, নেড়ে ঘেঁটে যা পাওয়া যায়, তা ঘোল। নিজের মধ্যে নিজেকে শান্ত করতে কত বই পড়তে হয়? জানি না। বুদ্ধিবিলাস বা অধ্যাত্মিক ডিজনিল্যাণ্ডের ছড়াছড়ি আজ চারদিকে। চারপাশে বেশ একটা শান্ত শান্ত ভাব। ধূপের গন্ধ, গাম্ভীর্য ইত্যাদিতে বেশ একটা ঘন মাখোমাখো পরিবেশ। কিন্তু আদতে সবটাই ফাঁকি। যা চিত্তের বস্তু, তাকে শুধু চরিত্রে পাওয়া যায়। তাকে না লেকচারে, না কূটব্যাখ্যায়, না গেরুয়ায়, না সুরে, না তীক্ষ্ণ লেখনীতে পাওয়া যায়। সে শুধু বিনোদন। উচ্চস্তরের বিনোদন।

      কিন্তু ভারতের সত্যিকারের গুরুতত্ত্বে আপাত মধু যতটা না ছিল, তার চাইতে বেশি ছিল কঠোর শাসন, অনুশীলন। কিন্তু সে পথে চলে তো আর অধ্যাত্মিক ডিজনিল্যান্ড বানানো যায় না, শিষ্য পালাবে যে, তাই চারদিকে কেবল ফাঁকি আর ফাঁকি। গুরুও ফাঁকি দিচ্ছেন মধু মাখিয়ে, শিষ্যও ফাঁকি নিয়ে আসছে পরমানন্দে। আর আজ তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাজনীতির সার্কাস। ব্যস, আর কি চাই! তবে খাঁটি বস্তু কই?... আসলে স্বাদের খিদে আর খিদের খিদে'র মধ্যে যে পার্থক্য আছে। আমাদের ভোজবাড়ির ব্যবস্থা রসনার তৃপ্তির উদ্দেশ্যে। আর কাঙালি ভোজনের ব্যবস্থা খিদের নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে। কাঙাল হতে না পারলে কি আর সত্যিকারের মহাজনের দেখা মেলে?

 

“আপনাতে আপনি থেকো মন... তুমি যেও না কো কারো ঘরে,... যা চাবি তা বসে পাবি... শুধু খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে”...

(আগামী বুধবার, ৩০শে ডিসেম্বর ওনার জন্মদিন)

 

239
Mon, 11/30/2020 - 13:00

ধ্যানের জগত আর কাজের জগত। নানকের শিক্ষায় এই দুই জগতকে মেলাবার বাণী। সংসার শুধু ধ্যানের জগতে না, আবার শুধু কাজের জগতেও না। এই দুইয়ের মধ্যে সঙ্গতির পথ নানকের শিক্ষায়। ঈশ্বরের নামগান করলেই কি মুক্তি? নানকের উত্তর, না। শুধু তা দিয়ে হয় না, হুকুম মেনে চলো। কিসের হুকুম? সৎ পথে জীবিকার আর সেবার।

      জীবিকা ব্যতীত মানুষের জীবন চলে না। কিন্তু সে যেন কাউকে প্রতারিত করে না হয়। আর সেবা? নানক দর্শনের শিক্ষা --- দাতাকে মনে রাখো। মনে রেখো, সংসারে দাতা একজনই হয়, যিনি এক, নিরাকার, নির্বৈর, নির্ভয়। সেবা দাও, অন্ন দাও, শ্রম দাও। কেন দেব? কারণ আমার দেওয়ার স্রোতের সঙ্গে সেই এক পরম এক-এর দানের ধারা মিলবে তবে। আমি পথ রুদ্ধ করলে, সেদিকের উৎসমুখও বন্ধ হবে।

      এ হল তত্ত্ব। চিত্তের শুদ্ধি হোক নামে আর কর্মে। চিত্তে আমি একা। সংসারে আমি অনেকের মধ্যে। অনেক মানে বৈচিত্র। বৈচিত্র মানে বিরোধের আশঙ্কা। বিরোধের অবসানে মঙ্গল।

      আজ কৃষকের সঙ্গে রাজশক্তির ঘোরতর বিরোধ। যারা নিয়ম বানান আর যারা সেই নিয়মের আওতায় পড়েন – এর মধ্যে বিরোধ জেগেছে। যারা নিয়ম বানিয়েছেন সে নিয়ম কতটা কৃষকের স্বার্থে আর কতটা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর স্বার্থে – সে উত্তর স্পষ্ট নয়। আর স্পষ্ট নয় বলেই একপক্ষের সঙ্গে আরেকপক্ষের বিরোধ চরমে।

      গণতন্ত্রে নেতা জনগণ দ্বারা নির্বাচিত হন, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত হন না। যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবেন, তিনি বৃহত্তর জনগণের স্বার্থে নিয়ম বানাবেন --- এই ন্যায়ের পথ। রাজা প্রজাদরদী হতেও পারেন, না-ও পারেন। তিনি জনগণ দ্বারা নির্বাচিত নন। তিনি স্বীয় ক্ষমতায় শত্রুকে পরাজিত করে, নিজের প্রবল শক্তিতে জনগণের উপর নিজের রাজশক্তি কায়েম করেছেন। তাই তা একনায়কতন্ত্র। তাই কিম নামক রাজা করুণা প্রদর্শন করলে সে দেশের মানুষ তা উপরি পাওনা বলে দেখে। তার খামখেয়ালিপনাকেই প্রাপ্য বলে মানে। কিন্তু নেতার প্রজাদরদী হওয়াটা কোনো বিকল্প না। ওটাই প্রথম শর্ত। তোমাকে আমরা আমাদের শক্তির, ক্ষমতার নেতৃত্বের ভার দিয়েছি, এই জন্যে না তুমি প্রবল বলশালী বলে, সে বল যদি এসে থাকে তবে তা আমাদের মিলিত সমর্থনে; আমরা তোমায় নির্বাচিত করেছি শুধুমাত্র এই জন্যে যে তুমি আমাদের সঠিক দিশায় নিয়ে যাবে, আমাদের সবার স্বার্থের কথা মাথায় রেখে।

      কৃষকের এ আন্দোলন হঠাৎ করে আজকে নয়, যেদিন থেকে নতুন নিয়মের ধারা প্রকাশিত হয়েছে সেদিন থেকে। কিন্তু শুরু থেকেই তা নিয়ে রাজশক্তির কোনো গম্ভীর, আন্তরিক পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি, না তো আমাদের আমোদ আর উচ্চনিনাদ গল্পপ্রিয় সংবাদমাধ্যমগুলোর কোনো ধারাবাহিক উল্লেখ পেয়েছি। সে আন্দোলন ক্রমে প্রবল হতে শুরু করেছে। রাজশক্তি বল প্রয়োগ করে তা ঠেকিয়ে রাখার উপায় খুঁজলেন প্রথমে। তারপর কথা বলার প্রস্তাব এলো। কোনো গণ আন্দোলনকেই শুরুতে উপেক্ষা করলে তার ফল ভালো হয় না, এ উদাহরণ আমরা হালে অনেকবার দেখেছি। উপেক্ষা করলে দুর্বলের জোর কমে, সবলের জেদ বাড়ে। উপেক্ষায় মিথ্যা নিজের অস্তিত্বসংকটে হীন হয়ে পড়ে; সত্য আরো ক্ষিপ্র, আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

      তবে ভারতের বাকি কৃষকরা এতে সেইমাত্রায় কেন যোগ দিচ্ছেন না? যেমন চাষ-আবাদের ক্ষেত্রে যে রাজ্যের নাম প্রথম আসে সে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ। কেন আমাদের রাজ্যের কৃষকের এই উদাসীনতা, কেন তারা আন্দোলনে নেই, এর উত্তর আজানা। তারা কি তবে কেন্দ্র সরকারের প্রস্তাবিত আইন নিয়ে সন্তুষ্ট? জানি না। এই নিয়ে কোনো সমীক্ষা বা আলোচনা আমার চোখে পড়েনি এখনও।

      কোনো মানুষকে বা শ্রেণীকে রাজনীতি বা ধর্মের রঙে রাঙিয়ে দেখাটা অসম্পূর্ণ দেখা। আদতে আছে দুই শ্রেণী – এক শোষক, দুই শোষিত। কম ক্ষমতাশীল আর বেশি ক্ষমতাশীল। বেশি ক্ষমতাশীল হলেই যে সে শোষক হবে তার কোনো অর্থ নেই, কিন্তু সে সম্ভাবনা অস্বাভাবিক নয় সে ইতিহাস বারবার জানিয়েছে।

      মানুষের ধর্মবোধ আছেই। সে ধর্মবোধ অর্থে জগত কি করে সৃষ্টি হয়েছে, বা স্বর্গস্থ পিতার বর্ণনা না। সে ধর্মবোধ বলতে বুঝি মানুষের ন্যায়ের বোধ। নানক যখন বলেন, পরমাত্মার তুষ্টির একমাত্র রাস্তা তাঁর হুকুম মেনে চলা; সে হুকুম বলতে তিনি কোনো সঙ্কীর্ণ নীতির বোঝা চাপিয়ে মানুষকে অপমান করেন না। সৎপথে, সহমর্মিতায় বাঁচার কথা বলেন। জীবন প্রতি মুহূর্তে শিক্ষা দেয়। সে শিক্ষাকে সৎ চিত্তের পাত্রে ধারণ করে, সৎ উদ্দেশে চালিত করে যেন সত্যি অর্থে ‘শিখ’ হতে পারি, সেই শিক্ষাই নানকের শিক্ষা। তাই আজ যে ছবি সারা বিশ্ব দেখল যে, মারমুখী রাজার পেয়াদার সামনে খাবার পাত্র হাতে সেই কৃষক দাঁড়ান যাকে মারতেই সেই পেয়াদা খানিক আগে কুণ্ঠিত হননি, তখন সে নানকের শিক্ষায় সত্য অর্থে গুরুমুখী; মনমুখী নয়। এর আগেও নানা দুর্যোগে শিখদের সেবাব্রতের উদাহরণ সারা বিশ্ব দেখেছে। কারণ নানকের শিক্ষা ভারতের সে প্রান্তের মানুষে মানুষে ছুঁয়েছে। বাংলায় মহাপ্রভুর পর আপামর সব শ্রেণীর বাঙালিকে প্রভাবিত করেছেন এমন বাঙালি ধর্মের জগতে কাউকে আমার চোখে পড়ে না। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আন্দোলন অনেকটা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল, আজও আছে। সেই অর্থে লোকনাথ বাবা বাঙালির ঘরে ঘরে এলেও সেখানে কোনো আত্মশুদ্ধির ব্রত নেই, সে লক্ষ্মীপুজোর মত আত্মস্বার্থেই পুজিত।

      মানব সভ্যতায় প্রথম ও প্রধান ঋণ কৃষকের কাছে। সেই কৃষকের পা যদি ক্ষেত থেকে রাজদরবারমুখী আজ তবে তা চিন্তার। তাকে উপেক্ষা করার অর্থ সভ্যতার মূলকে উপেক্ষা করে বৃক্ষের পাতায় জল সিঞ্চন। আজ রামের প্রতি আগ্রহ দেশে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। রামভক্তকূলের মনে থাকা উচিৎ সীতাকে ভারতবর্ষ পেয়েছিল মাটি থেকে কর্ষণ করতে গিয়ে, এমনই লেখেন আদিকবি। সেই সীতার উপেক্ষার ফলও আদিকবি দেখিয়েছিলেন।

      আজ গুরু নানকের জন্মদিনে আমার একান্ত প্রার্থনা, কৃষকদের ক্ষোভ, অসন্তোষ সুরাহা পাক। সীতার অপমান নতুন করে আর না হোক। সীতা যদি ভারতের উর্বর মাটির রূপক হন, তবে তা যেন এমনই সুজলা সুফলা থাকে, কৃষকের তৃপ্তিতে। তবে আমার মুখে যে অন্ন উঠবে তাতে রক্ত লেগে থাকবে না। গুরু নানক এক ধনী কপট ব্যবসায়ীর দ্বারা প্রদত্ত দান আপন ধী দৃষ্টিতে গরীবের রক্তমাখা দেখেছিলেন এবং প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আমার দেশের অন্ন শুদ্ধ হোক, কোনো দীর্ঘশ্বাস না লেগে থাকুক তাতে, এই প্রার্থনা।

240
Fri, 11/27/2020 - 22:00

রামকৃষ্ণদেব বললেন, মন আর মুখ এক করাই হল আসল তপস্যা।

 

      এখন কথাটার মানে হল কি? আমার এক রসিক বন্ধু এক পাগলকে রাস্তায় অনর্গল কথা বলতে দেখে বলেছিলেন, এই এক মানুষ দেখলাম যার মন আর মুখ এক হয়েছে।

      স্বামীজি কি মন আর মুখ এক করার কথা বললেন? বরং সংসারের কপটতার দিকটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, "হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল---, / সত্যহীন, স্বার্থপরায়ণ, তবে পাবে এ সংসারে স্থান।"

      যারা ইদানীং কয়েকটা বিদেশী সাহিত্য পড়ে আমাদের বোঝাতে চান যে সংসারের অন্ধকার দিকটাকে নিয়ে লেখা যেন তারাই প্রথম লিখছেন, তাদেরকে স্বামীজির 'সখার প্রতি' কবিতাটার প্রথম কয়েক স্তবক পড়ে দেখার অনুরোধ জানাই। যেখানে শুরুতেই বলছেন, "পিতা পুত্রে নাহি দেয় স্থান, / হেথা সুখ ইচ্ছ মতিমান?"... তবে সে আলোচনার জায়গা এটা না। কথা হচ্ছিল মন আর মুখ এক করা নিয়ে। তা মন আর মুখ এক হলে এ সংসারে যে ঠাঁই পাওয়া মুশকিল সে তো বড় সত্য কথাই। 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা' গল্পটা মনে নেই? আচ্ছা সে না হয় গল্প হল, ভাবুন রামকৃষ্ণদেবের বাবার কথা। একটা মিথ্যা সাক্ষ্য দেবেন না বলে ভিটেমাটি ছেড়ে গাছতলায় সপরিবার নিয়ে দাঁড়াতে হল! একবার ভেবে দেখুন তিনি তো আর কেষ্টবিষ্টু কেউ নন, আমাদের মত সাধারণবোধের মানুষ। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তা তাঁর পুত্র যখন বলেন "সত্যের আঁট থাকলে ভগবানলাভ হয়", তখন মনে হয় তিনি যেন রাসমণির আঙিনায় বসা রামকৃষ্ণ নন, তিনি যেন শুধুই কামারপুকুরের গদাধর, তাঁর স্মৃতিতে যেন গাছতলায় সপরিবারে দাঁড়ানো নিজের বাবা, ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের মুখটাই ভেসে ওঠে। অবশ্যই তিনি তখনও জন্মাননি, কিন্তু সে গল্প নিশ্চয় হাজার একবার শুনেছেন! একজন মানুষের মেরুদণ্ডের জোর কতটা হলে এ সম্ভব তাই ভাবি! ঈশ্বর মানে যদি শুধু যাদুকর হন তবে সেখানে নীতির কথা আসে না, কিন্তু ঈশ্বরের বোধ যদি সত্যানুরাগের ব্রত নিয়ে আসে তখন তার অর্থ বদলে যায় বইকি।

      তবে স্বামীজি যে বললেন তার অর্থ কি? আরেকটা গল্প। স্বামীজি এক ভাষণে বলছেন, একজন এসে তাকে জিজ্ঞাসা করছেন, মুক্তি কিসে হবে? স্বামীজি তাকে বলছেন, তুমি দিনে কয়েকটা করে মিথ্যা কথা বলা অভ্যাস করো। বলে স্বামীজি বলছেন, আসলে লোকটা এত জড়, এত তামসিক যে মিথ্যা কথা বলার জোরটুকু পর্যন্ত নেই। শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, বাইরের জগতে যদি লড়াইয়ে জয়ী হতে না পারো তবে অন্তরের জগতে লড়াইয়ে টিকবে কি করে? সেখানে তো বিরোধীশক্তি মূর্ত, এখানে তো সব অদৃশ্য! স্বামীজি গল্পটা বলেই বলছেন, অবশ্যই আমি আপনাদের মিথ্যাকথা বলতে প্ররোচিত করছি না, কিন্তু আমাদের স্বভাবের জড়ত্বের কথা বলছি। "গরুকে কখনও মিথ্যা কথা বলিতে শুনি নাই, কিন্তু উহা চিরকাল গরুই থাকে, কখনই মানুষ হয় না।"

      যে কবিতাটার কথা দিয়ে শুরু করলাম স্বামীজির সেই কবিতাটার শেষই হচ্ছে সেই বিখ্যাত লাইন দিয়ে, "জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর"। এই কবিতাটাতেই বলছেন, "'প্রেম', 'প্রেম' - এই মাত্র ধন"। জপ-তপ, যাগযজ্ঞ, তীর্থ উপবাস সব ছাড়তে বলছেন, কিসের জোরে? ভালোবাসা। কিরকম ভালোবাসা? "দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম-অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।" - এমন সর্বগ্রাসী ভালোবাসায়। আরো বলছেন, "ভিক্ষুকের কবে বলো সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল? / দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল"..।

      তবে এত কথার সঙ্গে মন আর মুখ এক করার কি সম্পর্ক? আছে। আমাদের প্রাণ আছে, মন আছে, বুদ্ধি আছে। প্রাণে নানা ভাব ওঠে, যাকে বলে instinct, জন্মগত স্বভাব - সে সবই কি মার্জিত? না তো। রামকৃষ্ণদেব এক প্রার্থনা শেখাচ্ছেন, "মা আমার পশুভাব দূর করো।" এ পশুভাব মানে কি? ওই অমার্জিত প্রাণিক ঢাল। আলগা দিলেই গড়িয়ে পড়ে। মন মুখ এক করা মানে কি সেই অমার্জিত স্বভাবের গতিকে 'হ্যাঁ' বলা? না তো।

      এরপরে আসে মানুষের বিচার করার ক্ষমতা। ভালোমন্দ বিচার করার ভাব। সেই ভাবের সঙ্গে যেন আমার আচরণের বিরোধ না ঘটে। রবীন্দ্রনাথ তার বিখ্যাত প্রবন্ধ 'বিদ্যাসাগর'-এ বলছেন, "আমরা আরম্ভ করি, শেষ করি না; আড়ম্বর করি, কাজ করি না; যাহা বিশ্বাস করি তাহা পালন করি না;" আমাদের স্বভাবের এই অস্পষ্টতা, চাতুরীর দিকটাকে রবীন্দ্রনাথ ঘৃণা করতেন। তাই তিনি বলেই ফেলেছিলেন, "...মাঝে মাঝে বিধাতার নিয়মের এরূপ আশ্চর্য ব্যতিক্রম হয় কেন, বিশ্বকর্মা যেখানে চার কোটি বাঙালি নির্মাণ করিতেছিলেন সেখানে হঠাৎ দুই-একজন মানুষ গড়িয়া বসেন কেন, তাহা বলা কঠিন।"

      অবশ্যই আশ্চর্যের। বার্ট্রাণ্ড রাসেল তার বিখ্যাত বই 'Conquest of Happiness' -এ বলছেন, সুখে থাকার মূলসূত্র হল, harmony, সংহতি। সেই কথাই তথাকথিত অশিক্ষিত মানুষটাও বলছেন, এই মন আর মুখ এক করাই হল তপস্যা। বললাম আর হয়ে গেল তা তো নয়।

      আজকে মানুষের যতগুলো সমস্যা তার মধ্যে এই সমস্যাটা সর্বাধিক। আমরা আমাদের চারপাশের উপর আস্থা হারাচ্ছি। আমরা জানি ভাষা মনের ভাব প্রকাশের না, আড়ালের উপায়। এত অনাস্থা, এত অবিশ্বাস, এত রাতদিন স্ক্যানার নিয়ে ঘোরার চাপ কি কম? এইভাবে দিন কাটাতে কাটাতে এমন হয়েছে যে নিজে যা বলছি তাও বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না। কারণ জানি যা অন্যকে বলছি তা আমার উদ্দেশ্য আর অনুভবের সঙ্গে সঙ্গতিহীন। অবশেষে মনে হয় যা নিজেকে বলছি সেও কি তাই? নিজেকে নিয়ে শুরু হয় সংশয়।

      অগত্যা রামকৃষ্ণদেবের এই ছোট্টো কথাটি শুধু যে নেংটিপরা গুহাবাসীর জন্য বলে তো মনে হয় না। সামাজিক জীবনটাও কি দুর্বিষহ হচ্ছে দিন দিন। সেই এক সাধক কবি গাইছেন না, আমার জিভের সঙ্গে মনের দেখা হয় কখন? না শুধু খাওয়ার বেলা। তবে এ রোগ খুব প্রাচীন। নইলে উপনিষদের শান্তিপাঠে কেন বলবে, আমার বাক্যে মন প্রতিষ্ঠিত হোক? আর কবিই বা কেন লিখবেন, "বাক্য যেথা হৃদয়ের উৎসমুখ হতে"?

241
Mon, 11/23/2020 - 17:44

 যা কিছু জেনেছি, সে আমার বাস্তব। যা জানি না, সে আমার অনুমান। হাসপাতালে যখন যাই, নানা রোগে আক্রান্ত মানুষের কষ্ট আমার জানার মধ্যে পড়ে না, কারণ আমি চিকিৎসক নই, তাদের কষ্ট আমার জানার মধ্যে পড়ে না, কারণ আমি সে রোগে আক্রান্ত নই। রুগীর প্রতি আমার সহানুভূতি জন্মাতে পারে, আবার না-ও পারে। আবার ভয়ও জন্মায় – আমার যদি হয়?

ভয়, আতঙ্ক, কুন্ঠা, সংশয় – সব এই অজানা, অস্পষ্ট জানাকে নিয়ে। বেশ কয়েক বছর আগের কথা। বাড়িতে কয়েকদিনের জন্য যিনি আসবেন বাবার দেখাশোনা করতে তিনি মুসলমান। মনে সংশয়, সে কেমন? কেউ কেউ সহজ হিসাব টেনে ফেললেন, “মুসলমান মানেই হয় তো কোনোভাবে সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত হবে, সারা পৃথিবীতেই তাই! এই একটি ধর্ম না থাকলে পৃথিবীটা কত শান্তির হত ভাবুন! কত ধ্বংস, কত আতঙ্ক, কত সন্ত্রাস শুধু এই একটি ধর্মের জন্য। আপনি বৌদ্ধ, খ্রীষ্ট ইত্যাদি ধর্মানুলম্বী মানুষের দিকে তাকান, এরকম ভয়ংকর নয়।“ থামিয়ে বললাম, কিন্তু দুটো বিশ্বযুদ্ধ? তিনি বললেন, “থামুন তো মশায়, সে দুটো রাজনৈতিক জটিলতা। তারপর থেকে আর হয়েছে? হয়নি তো। হব হব করেও হয়নি। তবে? আসলে এই সহজ সত্যটা আপনারা মানতে পারেন না। দেখুন দুটো প্রতিবেশী দেশ নিজেদেরকে কিরকম ইসলামিক বলে ঘোষণা করেছে, মানে আত্মপরিচয় দিয়েছে যে তাদের আগে ধর্ম পরে বাদবাকি যা কিছু। মানে ধর্মের পরিচয়ে আত্মপরিচয়, ওসব সেক্যুলারিজমের ভণ্ডামি ওরা রাখেনি। এরা সব ওখানে গিয়ে থাকলেই পারে, আমাদের এখানে থাকার তো কোনো দরকার দেখি না। আজ অবশ্য আমরা যোগ্য জবাব দিতে শিখেছি। দেখুন না ওই সব CAA আইন চালু হলে কি হয়।“ কথা থামালাম। আসলে এই যে আক্রোশ, এর মূলেও সেই অজানা। আমরা পাশাপাশি থেকেও নিজেদেরকে চিনতে শিখিনি। এ কথা মহাত্মা থেকে রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকে জোর দিয়ে বলেছেন, আমরা গায়ে মাখিনি। আমাদের অনেকেরই মুসলমান পরবগুলোর সম্বন্ধে অজ্ঞ বা ভাসা ভাসা ধারণা। তা কেন? কেন আমাদের আগ্রহ জন্মায়নি আমাদের প্রতিবেশীর ধর্মকে ভালো করে জানার বা বোঝার? আমাদের তাদের সম্বন্ধে অস্পষ্ট ধারণা ভয় আর আতঙ্কের জন্ম দিয়ে চলেছে। আজ ‘লাভ জিহাদ’ বলে যে শব্দটা শুনছি সে আসলে ভয়জাত দুর্বলতার শব্দ। যে কয়েকটা বিজ্ঞাপন নিয়ে খুব আলোড়ন হল সে আমাদের অজ্ঞতার পরিচায়ক। যাকে অল্প জানি তাকে একমাত্রায় জানি। যেমন একদিন আমাদের সম্বন্ধে কি সব সাংঘাতিক ধারণা ছিল পাশ্চাত্যের! আমাদের সমগ্র সাহিত্য নাকি তাদের লাইব্রেরীর একটা তাকও সম্পূর্ণ করার যোগ্যতা রাখে না। আমাদের নীতি নেই, ধর্ম নেই, ভাষা নেই, দর্শন নেই, আভিজাত্য নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। ম্যাকুলে, জেমস্ মিল প্রমুখ ব্যক্তিরা এই ধারণাকে উস্কানি দিয়ে দিয়ে আরো বাড়িয়ে তুলেছিল। ভারত নাকি সব অলৌকিক সাধুতে ভর্তি, মেয়েদের জন্মের পরেই আমরা সমুদ্রে নিক্ষেপ করি ইত্যাদি ইত্যাদি সে কত গল্প! কিন্তু তাদের সেই অজ্ঞতা ঘোচে যত আমাদের মধ্যে জ্ঞানের বিনিময় হয়। ম্যাক্স মুলার, এডুইন আর্নল্ড প্রমুখ নানা মানুষের আন্তরিক অন্বেষনে নিবেদিতা, পণ্ডিচেরীর শ্রীমা প্রমুখ মানুষের ভারতের মাটিতে আত্মদানে; ক্রমে বিবেকানন্দ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের লেখায়, চরিত্রে সে অন্ধকার ঘোচে। ভারতের সম্বন্ধে তাদের ধারণা অস্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছ হয়। তারা যদি আগের ধারণাকেই আঁকড়ে ধরে থাকতে চাইত, তারা যদি তাদের সন্দেহের ভ্রূকুটিকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইত, তবে তো কোনোভাবে আমাদের মধ্যে যাতায়াতের যোগাযোগের পথটা সুগম হত না। আমরা একে অন্যকে ভয় পেতাম, দূরত্ব রেখে বাঁচতাম। যেমন এক সময় সমস্ত আমেরিকানকে শুধু বুর্জোয়া, পুঁজিবাদী আর শ্রমিকের রক্তশোষকের দৃষ্টিতে দেখার খেলায় মেতেছিলাম। আজ সে খেলা নেই। এখন সত্যকে, বাস্তবকে ভালোয়-মন্দ'য় মিশিয়ে দেখতে শিখেছি। এই একমাত্রিক জানায় কোনোদিন কোনো মঙ্গল নেই। যেমন বাংলার বাইরে কোনো সাহিত্য রচনা হয় না তেমন, এও এক ধারণা ছিল, আজও অনেকের মনে সে ধারণা আছে। বাংলা সিনেমার বাইরে কোনো সিনেমা সে অর্থে ক্ল্যাসিক নয়। বাংলায় যা লেখা সবই ক্ল্যাসিক হয় কি? বাংলায় যা সিনেমা বানানো হয় সবই কি সেই উচ্চমানের? এ সব ধারণাই একমাত্রিক ধারণার ফল। উড়িষ্যা মানেই দুর্ভিক্ষ; বিহার মানেই নোংরা, শাসনহীনতা; দক্ষিণ ভারত মানেই শুধু ইডলি-ধোসা রাতদিনের খাওয়া; আফ্রিকা মানেই শুধু জঙ্গল আর সিলেবাসের বাইরের জন্তু-জানোয়ার, গাছপালা; ডিটেকটিভ মানেই ছিপছিপে শরীর, সংসারের আর সব বিষয়ে উদাসীন শুধু অপরাধী খোঁজা মানুষ --- এরকম আরো আরো কত যে আছে তা বলে শেষ হবে না। এই অল্প জানা, অস্পষ্ট জানায় কোথাও দোষের পরিমাণ অল্প, কোথাও বেশি। ইদানীং মার্কেণ্ডেয় কাটজু কিছু অজ্ঞাত কারণে তার এই একদেশী আলোচনায় সারা ভারতের বিরাগভাজন হয়ে চলেছেন সে আমাদের অনেকেরই জানা হয় তো। দোষ আমাদের অনেক। আমরা দু'পক্ষই আমাদের নিজেদের চিনতে চেষ্টা করিনি। আজও করি না। আমার দেশে যদি নদী আর মরুভূমি দুই-ই থাকে, তবে দুটো পথের সম্বন্ধেই আমার সম্যক জ্ঞান থাকা কাম্য। গীতার জ্ঞান যদি থাকে তবে কোরাণের জ্ঞান থাকাও বাঞ্ছনীয়। একদিন আমাদের এক বৃহৎ শ্রেণীর মানুষকে আমরা আমাদের ধর্মগ্রন্থগুলো পড়তে দিইনি, এবং তাদের সেই অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র তাদের যথেচ্ছ নিপীড়ন শোষণ করে এসেছে, আজও কয়েকটি রাজ্যে তা হয়ে চলেছে। এর থেকে বেরোনোর উপায় অবশ্যই শিক্ষা। কিন্তু মস্তিষ্কের শিক্ষা আর চিত্তের শিক্ষা এক পথে হয় না। আমাদের সমস্ত শিক্ষাই মস্তিষ্কের শিক্ষা, আমাদের বুদ্ধিকে, আমাদের তথ্যের ভাণ্ডারকে শাণিত, সমৃদ্ধ করার শিক্ষা। কিন্তু ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্র জানলে আমার চিত্তের অন্ধকার তো দূর হয় না। চিত্তের অন্ধকার দূর হয় মানুষকে জানলে। একটা সভ্যতাকে জানলে, একটা সংস্কৃতিকে জানলে। নিজের চোখে না, তাদের চোখে। সদ্য ছটপুজো হয়ে গেল। সমস্ত বাঙালির উল্লাস দেখলাম সরোবরে তারা নামেনি, ঠেকিয়ে রাখা গেছে, এই মর্মে। এর মধ্যে একটা আমরা-ওরা বিভাজন আছে। কাউকে দেখলাম না যারা বাড়ির উঠানে কিম্বা টবে দাঁড়িয়ে, কিম্বা কৃত্রিম জলাশয় বানিয়ে তাদের আচারটা পালন করছেন তাদের প্রশংসায় তেমন কিছু বলতে। তারা যেন সেটা বাধ্য হয়েছেন করতে। আর আমরা যে কম কম পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি সেটায় যেন পুলিশের তৎপরতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সচেতনতার উদযাপনও ছিল। ইদানীং আমেরিকায় কয়েকজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মানুষ প্রশাসনের উচ্চবিভাগে স্থান পেয়েছেন। সারা ভারতে সেই নিয়ে কি প্রবল উচ্ছ্বাস! কিন্তু কয়েক দশক আগে যখন এক বিদেশী বংশোদ্ভূত মানুষের ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা উঠেছিল সারা দেশ জুড়ে কি বিদ্বেষমূলক কথার ঢেউ উঠতে দেখেছিলাম! যদিও আমেরিকায় কমলা হ্যারিসের ভারতীয় হওয়ার যোগসূত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের দেশের আত্মগরিমায় কোনো আঘাত আসতে পারে ভেবে কোনো আলোড়ন আমার অন্তত চোখে পড়েনি এখনও। আমাদের বিদ্বেষের একটি মূল কথা হল অস্পষ্ট জানা, অল্প জানা। আর একটা ছোটো উদাহরণ দিয়ে এ লেখা শেষ করি। একটা অনুষ্ঠানের রিহার্সাল হচ্ছে, রামকৃষ্ণের জন্মমহোৎসবের উৎসব। আমিও আছি। যার বাড়িতে হচ্ছে সে বাড়ির সবাই অনুকূল ঠাকুরের ওখানে দীক্ষিত। ওনাদের একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রার্থনার রীতি আছে। রিহার্সাল বন্ধ হল। তারা সবাই তাদের প্রার্থনায় যোগ দিতে গেলেন, অবশ্যই পরিবারের সবাই, আর বাকি রামকৃষ্ণ ভক্তকূলকে দেখলাম আড্ডায় মত্ত হতে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনারা যাবেন না? তারা কেউ খানিক তাচ্ছিল্য, খানিক উদাসীনতা ইত্যাদি মিলিয়ে বললেন, কেন? আমি নিজে গিয়েছিলাম। তারপর ওনাদের সেই তাচ্ছিল্যের ভাবই আমায় বাধ্য করল অনুকূল ঠাকুর সম্বন্ধে পড়তে। পড়তে গিয়ে দেখলাম অনেক মতের সঙ্গে আমি সহমত না হলেও এমন অনেক কথাই আছে যাকে তাচ্ছিল্য করার মত নয়। কিন্তু সে আলোচনার জায়গাটা এটা নয়। কারোর বিরুদ্ধে আক্রোশ, তাচ্ছিল্য, ভুল ধারণা – ইত্যাদি শুধুই তাকে পরিপূর্ণভাবে না জানার ফল। অজ্ঞতা। আজ সেই অজ্ঞতার প্রাচীরে বারুদ জমা হচ্ছে। ভয়টা সেখানে। এ বারুদ শুধু যে প্রাচীরের একদিকে ফাটল ধরাবে আর বাকি দিককে অক্ষত রাখবে এমন ধারণা করা বাতুলতা। এ অজ্ঞতাকে নাশ করতেই হবে। ধর্মের অজ্ঞতা ধর্মের সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান থেকেই দূরীভূত হয়। আমরা আমাদের যেন জানতে চেষ্টা করি, গ্রহণ করতে চেষ্টা করি। যত বুঝব, তত কাছাকাছি আসব। আমি জানব সে আমার বিপরীতে নেই, সে আমার থেকে ভিন্নতায় আছে। ভিন্নতাকে জানার মধ্যে নিজের ব্যাপ্তি, নিজের প্রসার। নইলে সঙ্কীর্ণ আর সঙ্কুচিত হতে থাকলে আমাদের দুই পক্ষেরই বিপদ। খ্রীষ্টধর্মের উৎসবকে যেমন ঘরের উৎসব করে তুলেছি, তেমনভাবে শিখ, বৌদ্ধ, মুসলমান ধর্মের উৎসবকে পারিনি। পারিনি, কারণ জানি না বলে। যদি জানি তবে সে উৎসবে যোগ দিতে আমারও কোনো বাধা থাকবে না। একমাত্র সেই পথেই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখি। নইলে বারুদ জমাকে ঠেকিয়ে রাখা দায়।
242
Sat, 11/21/2020 - 22:00

 

 

 

 

 

রামকৃষ্ণদেবের মিশন কি ছিল? তিনি কি সত্যিই সর্বধর্মসমন্বয় বেশ পরিকল্পনা করে করেছিলেন? সে সব আলোচনা থাক।

 

      আমাদের আজকের জীবনে কি সেদিনের সংশয় আছে? অবশ্যম্ভাবীভাবেই নেই। সেদিন ক্রিশ্চান মিশনারী, ব্রাহ্মধর্ম ইত্যাদির সংঘাতে ঈশ্বরের সাকার নিরাকার নিয়ে দোলাচাল আজকের দিনে আছে? মূর্তিপুজো ঠিক কি ঠিক নয়, এইসব নিয়ে ভাবনা আজকের মানুষের কই? দরকার নেই। সে তো ভালো কথা।

      আমরা জীবনটাকে যদি অন্যভাবে একটু দেখতে চেষ্টা করি। যখন তিনি অবতার নন। কে তাঁর সম্বন্ধে কি বলেছেন, সে কথাও থাক। আমাদের নিত্যজীবনে যে রামকৃষ্ণ এসে দাঁড়ান, তিনি কে হতে পারেন?

      একজন মানুষ যিনি সম্পূর্ণভাবে নিজের খুশীতে মগ্ন। সে খুশীর স্রোত অহরহ তাঁর অন্তঃস্থল থেকে নিঃসৃত হচ্ছে। তিনি নিজে স্নাত হচ্ছেন, আশপাশকে স্নান করিয়ে দিচ্ছেন। কি সেই খুশীর উৎস? অবশ্যই ঈশ্বর। যিনি তাঁর মা। যিনি তাঁর সর্বস্ব। যিনি জগত। যিনি জগত ছাপিয়ে সব কিছু। রামকৃষ্ণ সেই জগত নিয়ে, জগত ছাপিয়ে সবসময় অস্তিত্বের মধ্যে ডুবে। যে অস্তিত্ব অনুভবের প্রকাশ – আনন্দ। উপনিষদ যে আনন্দের কথা বলেন – এ সেই আনন্দ। কোনো কিছু পেয়ে নয়, কোনো কিছু হারিয়ে নয়। আনন্দ সাগরে আনন্দের ঢেউ। কথামৃতের পাতা উল্টে যান, প্রতিটা পাতায় শুধু এই আনন্দের কথা। শুধু আনন্দের প্রকাশ। শুধুই আনন্দের গান। আনন্দের নৃত্য। আনন্দের অশ্রু। আনন্দের হাসি। ভোরের আনন্দ। গভীর রাতের আনন্দ। দুপুরের আনন্দ। সকালের আনন্দ। সন্ধ্যার আনন্দ। এক আনন্দময় আত্মমগ্নতা, কিন্তু স্বার্থমগ্ন না, এমন একজন মানুষ ছোটো একটা ঘরে, মন্দিরের চাতালে, গঙ্গার ধারে বছরের পর বছর বিচরণ করে চলেছেন।

তাঁর দাবী কি?

      আনন্দ। নিজের মুখের কথা – কেউ তাঁকে গুরু, কর্তা, বাবা ইত্যাদি ডাকলে তাঁর গায়ে কাঁটা বেঁধে। জ্বালা ধরে। অসহ্য লাগে। তবে আমি কেন যাব? শুধু আনন্দের ভাগীদার হতে? গিরিশ ঘোষের সুরার নেশার আনন্দ যে আনন্দের সঙ্গে মিশে গিয়ে একাকার হয়ে যায়। এক রাতে গিরিশ ঘোষ তার সব নটীদের নিয়ে এলেন। তখন অনেক রাত। যারা এল তারা সমাজে পতিতা। হতে পারে। কিন্তু তা সেই আনন্দময় পুরুষের কাছে না। সারারাত ধরে হল নাচ, গান। কেন্দ্রে ঈশ্বর। যে ঈশ্বর মানে আনন্দ। যে ঈশ্বর মানে চেতনা। চেতনা আকাশের নীলের মত। সে নীলে আনন্দের মধু। অহরহ ঝরে পড়ছে। রামকৃষ্ণের চিত্তে সে ধারা বন্যার মত আছড়ে পড়ছে। রামকৃষ্ণ পাগল হচ্ছেন। বলছেন “ঈশ্বরের ইতি করা যায় না”। এ ঈশ্বরের শরীরের আয়তন নেই। মতের সীমারেখা নেই। স্বপক্ষ-বিরোধীপক্ষ নেই। এ ঈশ্বর অনন্ত। “মানুষ কি কম গা? মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে”, রামকৃষ্ণ বলছেন। অনন্তের বুকে ঈর্ষা জন্মায় না। অনন্তের বুকে বেদনা। যে বেদনায় রামকৃষ্ণ কাঁদেন। কাঁদান। খাঁচার ভিতরে থাকা মানুষকে খাঁচা খুলে উড়ে যাওয়ার পথ দেখান – আনন্দে। আনন্দের অশ্রুতে অসীমের দরজার আগল খুলে যায়।

      তাই রামকৃষ্ণের কানে আরেকটা শব্দ বিষের মত বাজে – পাপ। কিসের পাপ? কার পাপ? এ সামাজিক ধর্মব্যবসায়ীদের বানানো হিসাব। আনন্দের সাগরে পাপ কই? সাগরের ঢেউয়ে উত্থান পতন আছে। সেকি পাপ? না। আগল খুলে দিলাম, এসো, শুধু তোমাদের মতলবি বুদ্ধি বাইরে রেখে এসো। আমার সামনে উন্মুক্ত হও। উলঙ্গ হও। তোমার ধর্মের সংজ্ঞা, ধর্মের হিসাব-কিতাবের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার কোনো আগ্রহ নেই জানার যে মানুষ মরলে কোন লোকে যায়। আমার কোনো আগ্রহ নেই জানার যে ঈশ্বরের কত ঐশ্বর্য। আমি মাধুর্য বুঝি। তুমি রাধাকৃষ্ণের ঐতিহাসিক সত্য মানো না মানো, “টানটুকু নাও”। ওই ভালোবাসায় ডুবে যাও। ওই আনন্দে মগ্ন হও। যে আনন্দ তোমায় ডুবিয়ে না দেয়, শুধু হাঁটু অবধি ভেজায়, সে আনন্দে কি লাভ? তোমার জীবনে আশ্বিনের ঝড় আসেনি এখনও, তাই এত হিসাব তোমার। গভীর আঘাতে যেমন মানুষের স্বার্থবোধ, মতলবী বুদ্ধি থাকে না, সেরকম গভীর আনন্দেও থাকে না। তুমি অন্ধকারের গভীরতায় আলোর উদ্দীপনার তুলনা আনো, বুঝবে। যার আলোর জ্ঞান আছে, তার অন্ধকারের জ্ঞানও আছে। সুখের বোধ থাকলে দুঃখের বোধও থাকবে। তুমি আমার কাছে এসো, আমি তোমায় আনন্দের সাগরে নিয়ে যাবো।

      রামকৃষ্ণ বলতেন, আমি খালি দোসর খুঁজি। কেমন? এক ভুত একটা গাছে একা থাকত। তার খুব একা একা লাগে। কেউ শনি-মঙ্গলবার গাছ থেকে পড়েছে শুনলেই ছুটে যায়, কারণ শনি-মঙ্গলবার অপঘাতে মরলে ভুত হয়। কিন্তু সে ব্যাটা আবার পাছা ঝেড়ে উঠে পড়ে। মানে মরেনি। রামকৃষ্ণ সেরকম আকুল হয়ে নিজের ভাবের মানুষ খোঁজেন। কিন্তু পেলেন কই? 'এক'কে কেউ নানায় চায় না। একঘেয়ে ভাবে ডুবে থাকতে চায়। কিন্তু তাঁর যে একঘেয়ে ভাব একদম ভালো লাগে না। কিন্তু সেরকম নানা ভাবের ভাবে নাচে-গায় এমন মানুষ কই? যে বৈষ্ণব সে শুধুই বৈষ্ণব। যে শাক্ত সে শুধুই শাক্ত। যে শৈব সে শুধুই শৈব। যে খ্রীষ্টান সে শুধুই খ্রীষ্টান। যে মুসলমান সে শুধুই মুসলমান। যে শিখ সে শুধুই শিখ।

      কিন্তু রামকৃষ্ণ তো তা নন। তিনি শুধু আনন্দ বোঝেন। আনন্দের ধারাপাতে স্নান করেন। চিনি হতে ভালোবাসি না, চিনি খেতে ভালোবাসি। সে চিনির ব্র্যাণ্ডে চোখ পড়ে না তো তাঁর। তিনি শুধু তাকিয়ে থাকেন সে মাধুর্যের দিকে। মুগ্ধ হন। মুগ্ধ হয়ে সবাইকে মুগ্ধ করতে চান। অমৃত ঢেলে দিতে চান। যে যতটুকু নেয়। যে যেভাবে নেয়। কিন্তু তাঁর মত কেউ নেই। রামকৃষ্ণ তাই একা। কিন্তু নিরানন্দ নন। মা আছেন তো। নহবতেও আছে, মন্দিরেও আছে। নহবতের যিনি তিনি বোঝেন। কিন্তু সে তো বাইরে আসতে পারে না। সামাজিক নিয়ম। দুর্বল মানুষের চলতে গেলে নিয়ম লাগে, কি ধর্মে, কি সমাজে। অল্প বুদ্ধি, অল্প অনুভব। ঠিক-বেঠিক স্থির করতে পারে না। তাই বারবার হাত ধরে নিতে হয়। রাস্তার দু'দিকে ঘের দিয়ে রাখতে হয়।

      রামকৃষ্ণের কোনো অভিযোগ নেই। কারোর প্রতিই নেই। মানুষের অনেক অভিযোগ ঈশ্বরের প্রতি। রামকৃষ্ণের নিজের দারিদ্র্য, পারিবারিক অসুবিধা, অপমান ইত্যাদি কিছু নিয়েই কোনো অভিযোগ নেই মায়ের কাছে। একবারও বলছেন না, আমি এমন শুদ্ধজীবন কাটালাম, এমন 'মা মা' করে তোকে সারাজীবন ডাকলাম, ভাবলাম, গাইলাম, নাচলাম – অথচ আমার গলায় দিলি এমন মারণ রোগ? একবারও বলছেন না। এ তো তুচ্ছ। যখন তাঁর ভাগ্নে হৃদেকে মন্দির থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ এলো, সে বার্তা ভুল করে আগে এলো রামকৃষ্ণের কাছে। তিনি যখনই শুনলেন এ মন্দির ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে তখনই বিনা বাক্যব্যয়ে, কোনো প্রতিপ্রশ্ন ইত্যাদি না করে নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে হাঁটা দিলেন। ভাগ্যে একজনের চোখে পড়ল, সে তাড়াতাড়ি দৌড়ে এসে বলল, আপনি কোথায় যাচ্ছেন? রামকৃষ্ণ বললেন, কেন, আমায় চলে যেতে বলেছে যে। সে বলল, আপনাকে না, হৃদয়কে। এ ঘটনা যেমন আছে, তেমন আছে নেমন্তন্ন করে খেতে না ডাকার গল্পও। যাও বা বলে-কয়ে খাওয়ার জায়গা পাওয়া গেল তাও যেখানে সবাই জুতো খুলে রেখেছে তার পাশে। কোনো অভিযোগ নেই এ আনন্দময় পুরুষের। অন্যেরা অপমানিত বোধ করলেও তিনি ভাবছেন না যে তিনি ঈশ্বরের প্রথম সারির ভক্ত বলে তাঁর অতিরিক্ত কিছু খাতিরযত্নের ব্যবস্থা হওয়া উচিৎ, মানুষের তরফ থেকে না হলেও অন্তত ঈশ্বরের উচিৎ ছিল সবচাইতে উচ্চাসনটা তাঁর জন্য আগে থেকে সংরক্ষিত করে রাখা। গিরিশ খেতে খেতে উঠিয়ে দিলেও তাঁর আনন্দের সাগর সঙ্কুচিত হয়ে যায় না। পরেরদিন আবার নিজের থেকেই গিরিশের বাড়ি উপস্থিত হন; অনুশোচনায়, আত্মধিক্কারে মরমে মরে যাওয়া গিরিশকে আবার নিজের প্রাণের আনন্দে ডেকে আনেন আনন্দের উৎসবে।

      খেতে পাচ্ছেন না, তবু কোনো অভিযোগ নেই। অনেকে বলাতে একবার খালি বললেন, মা আমি খেতে পাচ্ছি না, গলায় বড্ড ব্যথা। মা দেখালেন শত-সহস্র মুখ দিয়ে তিনি খাচ্ছেন। ব্যস, আর কোনো কথা নেই, দুঃখ নেই সেই নিয়ে। মা কি দেখালেন আমরা জানি না, কিন্তু আমরা আবার দেখি অত কষ্টের মধ্যেও সেই আনন্দময় ছবি। এমনকি এও বলছেন, মাকে বললেই এই দেহত্যাগ হয়ে যায়, কিন্তু তোমাদের কষ্ট হবে, তাই বলতে পারি না, বলি আর কিছুদিন থাক এ শরীর। কথাটা এখানে ওনার আধ্যাত্মিক ক্ষমতার না, ভালোবাসার দিকটা। যিনি এমন যন্ত্রণাকেও মেনে নিয়েছেন শুধু ভালোবাসার দায় স্বীকার করে। গেলেও যাওয়া যায়, তবু ক'দিন থাক।

      সত্যিই কি এ মানুষটার কোনো মিশন ছিল? সত্যিই কি উনি কারোর গুরু হতে এসেছিলেন? যিনি গুরুগিরিকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আক্রমণ করে বলেছিলেন – ও বেশ্যাগিরি। তবে কিসের জন্য রামকৃষ্ণের কাছে যাওয়া? এই আনন্দময় সত্তার কাছে শুধু আনন্দ নিয়েই যাওয়া। অনেক অভিযোগ, অভাব নিয়ে রামকৃষ্ণের কাছে গেলে কিছু মেলে কিনা জানি না, কিন্তু আনন্দের জন্য, শুধু আনন্দের জন্যেই বারবার যাওয়া। সে আনন্দময় সত্তায় অবগাহনের জন্য। আনন্দেই মানুষ পূর্ণ। আনন্দেই মানুষ সার্থক। আনন্দেই কৃতকৃত্য।

 

(শিল্পী ~ নন্দলাল বোস)

243
Sat, 10/31/2020 - 09:51

      ধর্মানুগামী, ধর্মদ্বেষী, ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মোন্মাদ।

      ধর্মানুগামী – সাধারণত শান্তিপ্রিয়। খুব ঝুটঝামেলায় যাওয়া পছন্দ করেন না, অন্যের বিশ্বাসের সাথে সহমত না হলেও তীব্র বিদ্বেষ ইত্যাদি পোষণ করেন না। নিজের ও নিজের প্রিয়জনের সুখ-শান্তি-নির্বিঘ্ন জীবনের বাইরে বেশি কিছু চাওয়ার নেই। ধর্মের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তর্কে, আলোচনায় মাথা ঘামান না।

      ধর্মদ্বেষী – সমস্যার। এনারা হয় বিজ্ঞান অথবা নাস্তিকবাদকে একমাত্র সত্যজ্ঞান করেন। এদের অনেকের ধারণা বিজ্ঞান সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। মানুষের বৌদ্ধিক সত্তার উপর এদের ঝোঁক অনেক বেশি। সমস্ত জগৎ যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক হয়ে উঠুক, এরকম একটা টোটালাট্যারিয়ান আদর্শের ভাব পোষণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই ধর্ম প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, ফলত একটা বিদ্বেষভাব জন্মে যায়।

      ধর্মনিরপেক্ষ – কোনো ধর্মেরই অলৌকিক, অতিলৌকিক তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ধর্মের অস্তিত্ব স্বীকার করেন মানব সভ্যতায়। ধর্মের ইতিহাস, সমাজে তার প্রভাব ইত্যাদি নিয়ে সচেতন। কিন্তু নিজের ভাবনাকে স্বাধীন রাখেন, যুক্তি আর আবেগের একটা সামঞ্জস্য এ ধরণের চরিত্রে দেখা যায়। কোনোভাবেই টোটালাট্যারিয়ান নন। বলেন, আমি হয় তো বিশ্বাস করি না, কিন্তু অনেকে করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্মের অধ্যায় বাদ দেওয়া যায় না।

      ধর্মোন্মাদ – এ এক বিশেষ ধরণের আসক্তি। একটা বিশেষ মতের, তত্ত্বের সমস্তকে ধ্রুবসত্য বলে গ্রহণ করা। এবং সেই ধাঁচে নিজের সমস্ত অস্তিত্বকে জড়িয়ে ফেলা। ফলত সেই বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যা কিছু তা তার অস্তিত্বের সংকট, একটা থ্রেট। সমস্ত জগত কেন তার এই ধ্রুব বিশ্বাসের পথে হাঁটছে না – এ তার একটা গভীর ক্ষোভ, রাগ। এই স্তরের মানুষ সব সময় রাজনীতির খুব একটা বড় স্তম্ভ, অবশ্যই বিশেষ ধরণের রাজনীতির।

      সমস্যা হল ধর্মবিদ্বেষ ও ধর্মোন্মাদ নিয়ে।

      তবে শেষ এক ধাপ আছে। ভীষণ অল্প সংখ্যক। ধর্ম অন্বেষী। এরা খোঁজেন। ধর্ম কি? এখানে ধর্ম মানে মিস্টিক কিছু না। এখানে ধর্ম মানে এথিক্স। নীতি। সে নীতি যদি মিস্টিসিজম নির্ভর হয়, তবু তা নীতি।

      মূল কথা হচ্ছে রামকৃষ্ণের ভাষায় - জগতসংসার বালিতে চিনিতে মেশানো - বালি সরিয়ে চিনিটা নিতে হবে।

      চোখে বালি ছুঁড়ে বেশিদিন চলে না - এটা বুঝতে হবে।

244
Wed, 10/21/2020 - 18:08

 

মানুষ নৌকায় চড়ে, পারে হবে বলে, এ বিশ্বাস। সে জানে যে পারে নাও পৌঁছানো হতে পারে, মাঝনদীতে কত নৌকা ডুবে গেল, সেকি জানে না? জানে তো, সে বাস্তব। তবু সে নৌকায় ওঠে।

 

অতুলপ্রসাদ সেন লিখছেন,

কী আর চাহিব বলো, হে মোর প্রিয়,

তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

বলিব না রেখো সুখে, চাহ যদি রেখো দুখে,

তুমি যাহা ভালো বোঝ তাই করিয়ো।

শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

যে পথে চালাবে নিজে, চলিব, চাব না পিছে;

আমার ভাবনা প্রিয়, তুমি ভাবিয়ো।

শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

দেখো সকলে আনিল মালা– ভকতি-চন্দন-থালা,

আমার যে শূন্য ডালা, তুমি ভরিয়ো।

আর তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিয়ো।

 

গানটা কি আকুলভাবে গেয়েছেন কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়। কত ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, শুধু তুমি যে শিব তাহা বুঝিতে দিও।

      শিব মানে তো মঙ্গল। মঙ্গল শব্দটা আসলে কি? বিশ্বাস। মানুষ বিশ্বাসে বাঁচে, বাস্তবে না। বাস্তবে বাঁচে পশু। মানুষ পারে না। আছে বা নেই, মঙ্গল বা অমঙ্গল, আশা বা নিরাশা - কিছু একটাকে বিশ্বাস করে তাকে দাঁড়াতেই হয়। কিন্তু বিশ্বাসহীন কেউ হতে পারে না। তবে সে সুস্থ থাকতে পারে কি করে?

      ত্রিযামা সিনেমায় ছবি বিশ্বাস বেশ প্রসন্নমুখে বসে নিজের তীর্থযাত্রার গল্প বলছেন। এমন সময় উত্তমকুমার মানে ওনার ছেলে এসে উদ্বিগ্নতার সঙ্গে জানালো ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, অর্থাৎ সমস্ত জীবনের সঞ্চয় শূন্য।

      ছবি বিশ্বাস একবার, ও, বলে আবার পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। উত্তমকুমার অস্থির হচ্ছেন, রেগে যাচ্ছেন বাবার এই নির্বিকারভাব দেখে। তখন ছবি বিশ্বাস বললেন, যিনি দেন, তিনিই নেন, আমার ভালোর জন্যেই নেন, এইটুকু বিশ্বাসেই আমাদের লাভ।

      অতুলপ্রসাদ সেনের এই মঙ্গলকে খুঁজতে চাওয়ার আকুলতা একি প্রাগৈতিহাসিক? সে যুগের কথা বলে এড়িয়ে যাব? তাই কি হয়? মানুষ যখন একা, তখনই সে নানা ভাবনায়। ভাবনায় ভাবনায় সংঘাতে ভালো থাকা যায়? "রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল, তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল"... সে সংঘাতের মধ্যে সত্যিই তো মঙ্গল নেই। আমার কুটকুটে অহম না বুঝলেও, আমি তো বুঝি। রাত জেগে নিজের মনের মধ্যে বিরুদ্ধ ভাবনাদের সন্ধিস্থাপন যজ্ঞকর্ম কি কম বড় একটা কাজ? হয় তো তার আশু কোনো ফল হাতেনাতেই পাওয়া যায় না, কিন্তু দুর্দিনে বোঝা যায়। সন্ধিস্থাপন দরকার। খুব দরকার একটা বোঝাপড়া। ভাবনাদের সংহতিকরণ।

      হয় কিভাবে? চাইলেই হয়। একবার দীর্ঘক্ষণ ছাদের ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি ভাবছিলাম স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না, তবে এইটুকু বুঝছিলাম ভিতরে কিছু একটা চলছে। আলোড়ন চলছে। কিচ্ছু ভাবতে চেষ্টা করলাম না। নিশ্চুপ রইলাম। ধীরে ধীরে মন শান্ত হতে শুরু করল। এতটাই শান্ত হল যে নিজের অস্তিত্বকেই যেন হারিয়ে ফেলছি। না সুখ, না দুঃখ, না ভাবনা, না দুশ্চিন্তা, না উদ্বেগ।

      তখন বুঝলাম মনকে যদি নিজের মত ছেড়ে দেওয়া যায় তবে মন নিজে নিজে একটা সাম্যাবস্থা তৈরি করেই নেয়। একটা বলকে গড়িয়ে দিলে যেমন সে গড়াতে গড়াতে একটা স্থির জায়গায় নিজের থেকেই দাঁড়িয়ে যায়, এও তেমন। তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ালে অকারণে অনেক শক্তির অপচয়। তাকে স্থির করে রাখতে চাইলে সে স্থির থাকে না। তাকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় চড়িয়ে রাখলেও সে সুখকর নয়। তার থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে চলতে পারলে, কিছুটা উদাসীন থেকে যেতে পারলে সে নিজের মত করে নিজেকে গুছিয়ে নেয়।

      সকালে চায়ের কাপ নিয়ে বসেছি। দুটো বাড়ির মাঝখানের ফাঁক দিয়ে আকাশটা দেখা যাচ্ছে। কি অপূর্ব রং। মনে হচ্ছে এক গামলা নীল কেউ গুলে রেখে গেছে। শাসন করে গেছে, কেউ যেন এদিকে না আসে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছি, কি রঙ, কি স্নিগ্ধতা, আহা!

      আর স্নিগ্ধতা, দেখতে দেখতেই কোথা থেকে একপাল কালো মেঘ হুড়মুড় করে রঙের গামলায় পড়ল লাফিয়ে। সব রঙ তছনছ। গামলা উল্টে একাকার। মাঠ ঘাট বাড়ি মুহূর্তেই আশ্বিনের বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করে দিল।

      এই যে এতবড় একটা অনর্থ ঘটে গেল, কাকে অভিযোগ করব? কার কাছে নালিশ জানাব? কেউ তো কোনো আপত্তি জানালো না এই এমন সুন্দর ব্যবস্থার মধ্যে অব্যবস্থা ঘটে গেল বলে! এত বড় সংসারে ক্ষুব্ধ হল কে? শুধু আমার মন। তার হাজার নালিশ, হাজার অভিযোগ।

      কিন্তু সে মনকে যদি ছাড়াধরার বাইরে রেখে দিই, সে বুঝে যায় তার অভিযোগ শোনার কেউ নেই, তার কাঁদুনি শোনার কেউ নেই, তার নালিশ জানানোরও কেউ নেই। সে শান্ত হয়। তার উপদ্রব কমে।

(ছবি - Aniket Ghosh)

245
Mon, 10/12/2020 - 22:00

অ্যাদ্দিন বাঙালিদের নামে অনেক নিন্দামন্দ শুনেছি। ট্রেণ্ডে গা ভাসিয়ে আমিও কিছু লিখেছি, বলেছি। কিন্তু আজ এমন একটা উপলব্ধি হচ্ছে যে না উল্লেখ করে পারছি না। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাত, হুজুগে জাত - এ সব আসলে মিথ্যা, ডাহা মিথ্যে কথা। আসলে বাঙালিকে বুঝতে গেলে আপনার গভীর আত্মবোধ থাকা দরকার। একটু বুঝিয়ে বলি। ধৈর্য থাকলে পড়বেন, নইলে স্ক্রোল করে পরের পোস্টে বা ছবিতে বা ভিডিওতে চলে যান, আমার কিস্যু মনে হবে না, আজ আমার তৃতীয় নয়ন খুলে গেছে।

      আলোচনায় আসা যাক। দেখুন বাঙালির ঈশ্বরচেতনা জন্মগত, ইতিহাসগত তো বটেই। বেশি প্রাচীনে যেতে পারব না, আমার স্পণ্ডাইলোসিস আছে, মাথা না তো বেশি উঁচু করতে পারি, না বেশি নীচু করতে পারি। তো মোদ্দা কথা হল বেশি পুরোনো ফাইল ঘেঁটে লাভ নেই, হালের মহাপ্রভুকে ধরুন। তিনি কি বলছেন? দেহাত্মবুদ্ধি থাকলে সাচ্চা ভক্তি আসা দুর্লভ। এর মানে কি? এর মানে হল দেহতে 'আমি' বোধ ত্যাগ করতে হবে। দেহের উপর 'আমি' বোধ আনাকে বলে অধ্যাস। মায়া। মিথ্যা। কুহক। হীনবুদ্ধি। অন্ধবুদ্ধি। নিজেকে ভাবতে হবে মহাচেতনার ক্ষুদ্র চেতনা, অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব। সে অনেক বড় আলোচনা, কিন্তু এই হাইপারলিঙ্কে ক্লিক করলাম না, আমি একটা ছোট্টো পপ-আপ তুলে এইটুকু বলি যে সেই মহাচেতনার একটা ক্ষুদ্র চেতনা আমি-আপনি-আপনার বউ-শাশড়ি-মেনি-টমি-চেতক ইত্যাদি সবাই। কিভাবে? সে আপনি ভেবে পাবেন না, ধরতে পারবেন না। অনুভবে জানতে হবে। তাই অচিন্ত্য। বুঝলেন? না বুঝে থাকলে না বুঝবেন, সে আপনার কর্মফল। তো এই চেতনা আপনার মনে এসে গেলেই কি হবে? অমনি আপনি দেহের থেকে মনটা টুক্ করে তুলে নিতে পারবেন।

      এই গেল মহাপ্রভুর তত্ত্ব। এরপর আসলেন আমাদের দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর। রামকৃষ্ণদেব। দেখুন তিনিও বলছেন, দেহটা হল খাঁচা। আসল হল আমাদের সেই আত্মা। এই দেখুন, একজনের নাম করতে তো ভুলেই গেসলাম, আমাদের লালন ফকির গো! সুনীল, গৌতম আর কালিকাপ্রসাদের সৌজন্যে শিক্ষিত মানুষ, মানে ওই আর কি যারা সাপকে স্নেক, কুকুরকে ডগ, ভাতকে রাইস, ঝোলকে গ্রেভি বলে তারা অবধি সিডিতে, ইউটিউবে লালনের গান শুনছে আজকাল, চাট্টিখানি কথা, এ কি কম কথা! তো সেই লালন অবধি কি বলেনি, "খাঁচার ভিতর অচিনপাখি কমনে আসে যায়"? বলেছে তো। তারপর আরো আছে, "পাখি কখন উড়ে যায়, বদ হাওয়া লেগেছে গায়", আছে না? তো লালনেরও সেই এক তত্ত্ব, মানে দেহ খাঁচা, আত্মা পাখি।

      আর আমাদের ঠাকুর কি বলছেন? সাধন করতে করতে বোঝা যায় ঝুনো নারকেলের অবস্থা, ভিতরে নারকেল খড়খড় করছে। অর্থাৎ, ডাব আর নারকেলের আলাদা হওয়ার অবস্থা। নারকেল আত্মা, ডাব দেহ। আরো আছে - একজনের ছেলে মারা গেছে, মা কাঁদছে। ছেলের বাবা বাইরে থেকে আসতেই যখন বউ হাউমাউ করে কাঁদছে তখন স্বামী বলছে, "আমি দেখলাম আমি রাজা হয়েছি আর আমার সাত ছেলে হয়েছে। তারা সবাই মরে গেল। এখন আমি স্বপ্নের সাত ছেলেগুলোর জন্য কাঁদব, না এই এক ছেলের জন্য কাঁদব? দুই-ই তো স্বপ্ন গো।" জানি না তার বউ কোনো মনোবিদের অ্যাপো নিয়েছিল কিনা স্বামীর জন্য, কিন্তু তত্ত্বকথা কি দাঁড়ালো, যে এসব স্বপ্ন।

      এখন এই তত্ত্বটা প্রথম মার্কেটে সাধারণের জন্য লঞ্চ কে করে বলুন তো? কেষ্ট ঠাকুর গো। গীতায়। মনে নেই? কেন মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা 'ন হন্যতে' পড়েননি বুঝি? তার মানে কি? আত্মা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, 'ন হন্যতে, হন্যমানে শরীরে' - অর্থাৎ কিনা এই মরণশীল দেহে আত্মা অমর। আত্মা পাখি অমর। সত্যজিতের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' সিনেমার সেই দাম্ভিক ছবিদাদু যদি কৃষ্ণকে এই সময় জিজ্ঞাসা করতেন, "এ পাখিতে রোস্ট হয়?", যেমন সিনেমায় তেনার শালাবাবু পাহাড়িদাদুকে, অমন ভালোমানুষটাকে, কি অপদস্থ করল ভাবুন...! সে যাক, তো কৃষ্ণকে এ কথা বললে তিনি কি বলতেন? বলতেন, উঁহু ছবি, একে অগ্নি দহন করে না, জল সিক্ত করে না, বায়ু শুষ্ক করে না।

      এখন শাস্ত্রজ্ঞেরা আমার এ কথার খুঁত ধরতে পারেন, তারা বলবেন, কিন্তু এ তত্ত্ব তো উপনিষদে আগে থেকেই ছিল! কৃষ্ণ বলেছেন তো পরে।

      ঠিক কথা। উপনিষদে ছিল বটে, তবে তা প্রাইম কাস্টমারদের জন্য। কৃষ্ণ এক্কেরে বিগডিল ধামাকায় খোলা ময়দানে সে সব কথা বলে ফেললেন। তাই না?

      এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সব কথা কেন? মোদ্দা কথাটা হল, এইবার বোঝা যাচ্ছে বাঙালির রক্তে রক্তে গোপনে ছিল আত্মতত্ত্ব - সে জানে আসলে সে অমর শুদ্ধ মুক্ত আত্মা। অ্যাদ্দিন সে নিজেকে গোপনে রেখেছিল। আজ তার আত্মপ্রকাশের দিন। আসন্ন দুর্গাপুজোয় সবাই যখন ভয় দেখাচ্ছে, হো হো হো, তুচ্ছ মৃত্যুভয় দেখাচ্ছে; হো হো হো, অর্থাৎ, কিনা এই নশ্বর, কাঁচা বাঁশে বাঁধা তুচ্ছ দেহের ভয় দেখাচ্ছে, তখন বাঙালি "হা রে রে রে" করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। করোনা, কোভিড দেহকে পীড়া দেয় রে পাগলা, আত্মাকে নয়। মৃত্যু দেহের হয় রে গবেট, আত্মার নয়। নাস্তিকের দল যত! মায় মেডিক্যাল কলেজেও শুনলাম পুজো হচ্ছে। হোক। কারণ তারাও বুঝেছে এক অধ্যাত্মতত্ত্ব ছাড়া বাঙালির চিকিৎসাতত্ত্বে তেমন শ্রদ্ধা নেই। চিকিৎসা নিতে হয় তাই নেওয়া। যখন পুজোর শেষে লাখে কোটিতে আসবে, সব এসে জড়ো হবে, তখন বেড কোথায়? অত চিকিৎসক কোথায়? নার্স কোথায় অত? তখন সব্বাইকে ওই প্যাণ্ডেলের নীচে শুইয়ে দেওয়া হবে। এরকম আরো কত কত প্যাণ্ডেল যে করতে হবে সে কেউ জানে না। বাঙালি প্যাণ্ডেলকে সত্য বলে জানে, হাস্পাতালকে নয়।

      এই হল গিয়ে আমার উপলব্ধ তত্ত্ব। যদিও আমার আত্মতত্ত্ববোধ এখনও ততটা পাকা হয়নি। ঈশ্বর না জগত - কোনটা যে মায়া এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। চারবার হাগু হলেই বিছানায় লটকে 'চিঁহি চিঁহি' করে ডাকি। তবু অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই। বাঙালি বীরতনয়গণ, এগিয়ে যাও। আমি সাথে নেই। বাঙালি বীর তনয়, তনয়া, মধ্যম, মধ্যমাগণ আপনার প্রমাণ করুন, কোটি কোটি বাঙালিরে মা রেখেছ তত্ত্বজ্ঞানী করি, মানুষ করোনি।

246
Fri, 10/09/2020 - 18:22

একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি, উচ্চপদস্থ কর্মচারী মন্দিরে গেলেন। রাতে সবার সাথে খেতে বসলেন। খাওয়ার পর নিত্য অভ্যাস অনুযায়ী ধ্যানে বসলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে পাওয়া গেল নিজের শোয়ার ঘরে, ঝুলন্ত অবস্থায়। লিখে গেলেন, আমার জীবন পূর্ণ হয়েছে, আমি এখন অন্য জীবনে চললাম।

      ভারতীয় দর্শন আর ভারতীয় সমাজব্যবস্থা দু-মুখো। একপক্ষ ব্রহ্মে লিঙ্গ নেই, জাতিভেদ নেই ইত্যাদি বলে বলে সারা বিশ্ব এক সত্তার প্রকাশ বলে হেদিয়ে মরল। অন্যপক্ষ মানুষে মানুষে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিভাজন টেনে, নানা নিয়মকানুনে জীবনকে অতিষ্ঠ করে, কারাগারতুল্য করে ফেলল। এর নানা তত্ত্ব, ইতিহাস, পক্ষ-বিপক্ষ বাদানুবাদ তত্ত্ব আছে। কিন্তু মোদ্দা কথা কোথাও একে অন্যের পরিপূরক তো হয়ই নি, উল্টে তুমুল বিপরীতমুখী। সে সব ইতিহাস।

      আর এখন? নানা গুরু, নানা মোটিভেটর। একজন সন্ন্যাসীকে দেখলাম তিনি সারা জগতকে ব্রহ্মময় দেখতে বলছেন। কেউ বলছেন, সমস্ত শ্বাস-প্রশ্বাস ত্যাগের ক্রিয়া শিখে সমস্ত দুঃখ থেকে বেরিয়ে এসো। কিন্তু মোদ্দা কথা হল আমি যদি নানা উপায়ে আমার সমস্ত দুঃখের উপরে উঠে যাই, তবে কি পারিপার্শ্বিকের সমস্ত দুর্দশা ঘোচে?

      এইখানেই প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের চিন্তাধারার একটা বড় পার্থক্য হয়ে দাঁড়ায়। প্রাচ্যের সমস্ত ব্যক্তিকেন্দ্রিক – আমার মুক্তি, আমার ভক্তি, আমার সিদ্ধাই, আমার জীবনের কৃতকৃত্য হওয়া। পাশ্চাত্যে সমষ্টিগত উন্নতির কথা। সাধারণ বোধ ভিত্তিভূমির উপরে দাঁড়িয়ে সত্যকে খোঁজার চেষ্টা। কান্ট, স্পিনোজা, দেকার্তের মত মেটাফিজিক্সের উপর দর্শন দাঁড় করানো মানুষেরাও বলছেন না যে তোমায় এই এই পালন করতে হবে, ঈশ্বরের কৃপা পেতে হবে, এই এই অভ্যাস করলে তবে গিয়ে সত্য দর্শন হবে। আমাদের সেই সত্যের সার কি? – সমগ্র জগতের একত্ব। তোমার আত্মায় ব্রহ্মদর্শন। আর আয়রনি হচ্ছে, এই সমগ্র জগতের একত্বের কথা না হয় বাদই দিলাম, মানুষে মানুষে যে ভেদ নেই, এই তত্ত্বের উপর সমাজ প্রতিষ্ঠা করছে কারা? পাশ্চাত্যেরা। আমরা সতীদাহ থেকে শুরু করে নানা আজগুবি, বর্বরোচিত সিদ্ধান্তকে সমাজে নিয়ম বানিয়ে যখন নিশ্চিন্তে বেদ-বেদান্তের পন্ডিতি আওড়াচ্ছি, তখন যুক্তি আর সাম্যের উপর সমাজব্যবস্থা বানাতে চাইছে কারা? পাশ্চাত্যের সভ্যতা। তার মানে এ বলতে চাইছি না যে তারা নিখুঁত, বলতে চাইছি তারা আমাদের মত অতীন্দ্রিয় বিভাজন অন্তত টানেনি। তাই সমস্যাটা যখন ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যে তখন তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যেই করা সম্ভব হয়েছে। কালো মানুষের ওপর ঘৃণা, যা তাদের সমাজের একটা গুরুতর সমস্যা, তার সাথে আধ্যত্মিকতত্ত্বজাত বিভেদের কোনো কারণ নেই। সে রাজনৈতিক, সামাজিক, ভৌগলিক। কিন্তু আমাদের উপনিষদ বর্ণিত ব্রহ্মের তত্ত্ব আমাদের সমাজের সাথে কতটা সম্পৃক্ত? সেই সাম্যের কথা, সেই সমত্বের কথা বইয়ের বাইরে এল কই? সেদিন থেকে আজ অবধি সেই ব্রহ্মজ্ঞাত মানুষদের সমাজের এত অন্যায়, এত বর্বরতাতেও শান্ত থেকে, নিরুত্তাপ থেকে যখন ঠাণ্ডা ঘরে বসে লেকচারের পর লেকচার দিতে দেখি বা শুনি, হাসিই পায়। মনে হয় এরা একটা বিশেষ জাতের মনোরঞ্জনকারী ভিন্ন অন্য কিছু নয়। আমার যা বিশ্বাস তা যদি আমার কাজের উদ্দীপক না হয়, তা যদি শুধুমাত্র নিরাপদ বেষ্টনীর মধ্যেই কার্যকরী হয়ে থাকে, তবে সে তত্ত্ব আদতে আমার কোন কাজে আসে?

      পরলোক আর আধ্যাত্মিক শান্তির জন্য যে আকুতি আমার সমাজের শিরা-উপশিরায় বয়ে বেড়াচ্ছে, তার মোহ থেকে বেরিয়ে সত্যকারের যে অবস্থায় এই ব্রহ্মময় জগতকে দেখি, তাকি আদৌ সুখকর? তাকি আদৌ শান্তির? এই সব প্রশ্নের উত্তর হল, এই জগত নাকি সবটাই মায়াময়। আমাদের আত্মাই আসল, দেহ মায়া, ছায়া। এ তত্ত্বে বুদ্ধি ভ্রান্ত হয় শুধু, সত্য অধরাই থেকে যায়। তাই এই ব্রহ্মজ্ঞানীদের দেশের হীনতা, নীচতা, দীনতা সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে জ্ঞাত। কয়েকদিন আগে একটা ভিডিও শুনছিলাম। একজন কেউ স্বামীজি সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছিলেন, স্বামীজি আমেরিকা যাওয়ার আগে তারা নাকি নারী আর পশুকে তাড়নার যোগ্য মনে করত। তারপর স্বামীজির বেদান্তের ব্যাখ্যা শুনে নাকি আমেরিকার বুদ্ধিজীবী মহল সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেল।

      এ গল্প আমিও ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি। বড় হয়ে নিজে পড়াশোনা করে জানলাম যে কিছুটা প্রভাব নিশ্চয় পড়েছিল, কিন্তু সে দেশের আপামর জনসাধারণের চিন্তাভাবনা বদলিয়ে দিয়েছিল, অর্থাৎ প্রকারান্তরে বলা যে আমরাই শ্রেষ্ঠ দর্শনে ভাবনায় – এ মিথ্যা কথা। গুজব। শোপেনহাওয়ারের মত মাত্র কয়েকজন সেই চিন্তায় অনুপ্রাণিত হলেও, এবং সেই শোপেনহাওয়ারই নিরাশাবাদী দর্শনের প্রবক্তা হয়ে কিছুকাল কাটালেও পাশ্চাত্যের ভাবধারা পাশ্চাত্যের মতই বয়ে চলেছে। যদিও মাঝে মাঝে প্রাচ্যের বক্তাদের কথা তারা শোনেন, এ একটা উদারতা, যেমন ঠিক ঠিক আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সিনেমার মর্যাদা তারা দেন। তেমনই আমাদের দর্শন, সঙ্গীতের মানও তারা দেন। কিন্তু এ মনে করার কোনো কারণ নেই যে আমাদের দর্শন তাদের থেকে অনেক উন্নত। মোটেও না, ভিন্ন। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে আমাদের দর্শনের অতীন্দ্রিয়তা ওদের নেই। বিনা আচমনে, সাধারণ বুদ্ধি দ্বারা বোধগম্য। কোনো আত্মা, অনাত্মা, ইত্যাদি তত্ত্বের ধোঁয়াশা নেই।

      তবে সে দেশের কোনো কোনো রথী-মহারথী আমাদের এখানে কেন আসেন, আমাদের ধর্মের দিকে ঝোঁক? সে ঋষীকেশে গেলে মুড়িমুড়কির মত দেখা যায়, ইস্কনেও দেখা যায়। কিন্তু সে আমাদের দর্শনের তাগিদে নয় অবশ্যই, আমাদের ম্যাজিকাল আধ্যাত্মিক জগতের মোহে। হ্যাঁ, স্পষ্টভাবেই বলছি, মোহে। যা ঘোরে রাখে, জাগিয়ে রাখে না, তা মোহ ছাড়া কি? তারা সমস্ত জগতের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে একটা তথাকথিত অন্তর্মুখী জগতের দিকে ঝুঁকে পড়ে কি সার্থকতা পান তারাই জানেন, কিন্তু আমার কাছে তা উৎকৃষ্টমানের স্বার্থপরতা আর কাপুরুষতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

      গীতা অবশ্যই ব্যতিক্রমী। কিন্তু গীতাতে এত বিরুদ্ধমতের অবস্থান যে সেখানে একটা কোনো দিশা পাওয়া ভার। আর রইল আমাদের মহাভারত। তার অবস্থা বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটার মত। তার যে মূল কোনটা, কোনটা প্রক্ষিপ্ত, তায় ব্যাখ্যার পর ব্যাখ্যা ইত্যাদি তো আছেই।

      তবে আমাদের হাতে পড়ে রইল কি? আমাদের বর্তমান অবস্থা কি? আমাদের সমাজব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, সঙ্গীত, শিল্প, বিনোদন, রাজনীতি, বিজ্ঞান, গবেষণা – সব পাশ্চাত্যের জ্ঞানোন্মুখী। পাশ্চাত্যের কষ্টিপাথরের দিকে তাকিয়ে। আর আমরা তাদের কি দিচ্ছি? আধ্যাত্মিক জ্ঞান, যোগা। তাতে কি হয়? অন্তর্মুখী হয়ে শান্তি পাওয়া যায়। কিন্তু সেই শান্তির ব্যবস্থা যদি দুরূহ জটিলতার মুখোমুখি হয় তখন? তখন আসে মনোবিজ্ঞানের চর্চা। মনোবিজ্ঞানের উৎস খুঁজতেও সেই পাশ্চাত্য। চিকিৎসাপদ্ধতিও সেই পাশ্চাত্য। তবে আমাদের বলে রইল কি? শুধুই ভাবের চর্চা? আমাদের মনীষার খোঁজ কি? শুধুই বৈরাগ্যের দ্বিচারিতা? শুধুই আকাশকুসুম? শুধুই কিছু অতিচালাক মানুষের নানা কথার ধাঁধাঁয় সব গুলিয়ে দিয়ে একটা শব্দের ঘোর তৈরি করা? তারপর কাজের বেলায়? এমনকি এই যে সেবা করার আদর্শ? এও কি সত্যিই ভারতীয়? আমাদের তত্ত্বে সে কথা থাকলেও আমাদের বাস্তবজীবনে কি তা কোনোদিন ছিল? না তো। আমরা ধ্যানের কথা বলেছি, ডুব দেওয়ার কথা বলেছি, সমষ্টিগতভাবে সার্থকতার রাস্তা খোঁজার কথা কখন বললাম? তবে কি সত্যিই আমাদের ভাঁড়ারে বর্তমানের উপযোগী কিছু কথাই নেই? এমনকি আমাদের আইনি ব্যবস্থাও তো পাশ্চাত্যর অনুগামী। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্ত ছাড়া। তবে আমাদের ধ্যান ভাঙলে আমরা কোথায় দাঁড়াই? কল্পনায়, না ধ্যানের বিপরীত কোনো বাস্তব রূঢ়তায়? জানি না। এর উত্তর আমাদের শ্রমের মাধ্যমে, বিনা ফাঁকি দিয়ে খুঁজতে হবে। নইলে মেনে নিতে হবে আমরা ক্রমশ পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে থাকা এক জাতি, যা যত উন্নত হবে তত সে পাশ্চাত্য ভাবধারায় বুদ্ধিগামী হবে, বিচারগামী হবে। আর কিছু ছুটকো ছাটকা ধ্যানের কেন্দ্র থাকবে যেখানে আমরা পশ্চাতমুখী হব, বা জিমে যাওয়ার অভ্যাসের মত অন্তর্মুখী হওয়ার অভ্যাস করব। এর উত্তর কি?

 

247
Tue, 10/06/2020 - 13:30

জিম করবেট কোনো অব্যবস্থা বা অরাজকতা বোঝাতে যদি কেউ 'জঙ্গলরাজ" শব্দটা উপমা হিসাবে ব্যবহার করত, তবে উনি বিরক্ত হতেন। ওনার আজীবন জঙ্গলে ঘুরে মনে হয়েছে জঙ্গলের আইন মানুষের আইন থেকে অনেক বেশি সহনশীল, বোধগম্য। মানুষের সভ্যতা তা নয়। বড় বেশি নিষ্ঠুর আমাদের সভ্যতা।

      আমি জানি না এই কথাটা লেখার জন্য জিম করবেটকে কেউ 'আগন্তুক' সিনেমার সংলাপের মত বলেছিলেন কিনা, "তবে জঙ্গলে গিয়েই থাকলে পারেন"!

      করবেট খুব মিথ্যা তো বলেননি বলুন, বাঘ-সিংহ-ভাল্লুকের জন্য কোনো জঙ্গল হরিণশূন্য বা আর খরগোশ, কি কাঠবেড়ালি কি বাঁদর হনুমানশূন্য হয়েছে বলে তো শুনিনি। মানুষের জন্য যা হতে বসেছে। জঙ্গলই শূন্য হয়ে যাচ্ছে তো জঙ্গলের প্রাণী!

      আসলে কথাটা কয়েকদিন হল উত্তর প্রদেশ নিয়ে এত শুনছি যে মনে এলো। কেউ কেউ তো আবার দেখছি তুলসীদাস অবধি পৌঁছে গেছেন। আবার কিছু গীতার শ্লোক তুলেও বলেছেন ওগুলোর জন্যেই নাকি এইসব। আমি শ্লোকগুলো বা উদ্ধৃতিগুলোকে সমর্থন করছি না, সে নিয়ে আগেও লিখেছি। কিন্তু কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে বলেই যে আজ উত্তর প্রদেশের এই হাল, সে আমার অতিসরলীকরণ লাগে। বাঙালি মধ্যবিত্ত যে হারে কথামৃত পড়ে সে হারে সমাজে প্রভাব পড়লে তবে রামকৃষ্ণদেব যে হারে সত্যকথার গুণগান বা কামিনীকাঞ্চন ত্যাগের কথা পাতায় পাতায় বলেছেন তবে এদ্দিনে বাংলায় মিথ্যাভাষণ বলে কিছু থাকতই না, কিম্বা কণ্ডোমের চাহিদা বাংলায় সব চাইতে কম হত। কথাটা আসলে তা নয়। কথাটা বহুমাত্রিক। মানুষ কিসের অর্থ কি করবে তা তার রুচির উপর নির্ভর করে। যেমন একটা গল্প আছে, মহাভারত শুনে দাদু যখন জিজ্ঞাসা করল নাতি তুমি কি শিখলে? নাতি বলল সূচ্যগ্র জমির জন্যেও ভাইয়ের সাথে যুদ্ধে নামা যায়। দাদু খাবি খেয়ে নাতনিকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি শিখলে? নাতনি বলল, ইচ্ছা করলেই পাঁচটা স্বামী রাখাই যায়।

      ইতিহাস বড় জটিল। বহুমাত্রিক। লোকধর্ম আর চিরন্তন ধর্মের বাণীর মধ্যে পার্থক্য অনেক। একটা ইতিহাস। আরেকটা মানুষের ভাবের আদর্শ। রবীন্দ্রনাথ বলতেন গাছের পাতাগুলো ঝরে যায়, কিন্তু গাছটা থেকেই যায়। অনেক অনেক অপ্রাসঙ্গিক প্রথা সমাজে বেঁচে আছে আজকের দিনেও। পৈতে থেকে শুরু করে গর্ভবতী মহিলাকে সাধ দেওয়া অবধি। আজ তার দরকার নেই। যেমন একদিন ভারা বেঁধে বাড়ি বানানো হলেও সেই ভারা বাড়িটা বানানোর পর অপ্রাসঙ্গিক, এও তেমন। বাড়িটা সম্পূর্ণ হলে মিস্ত্রীরা ভারাটা খুলে নেন। সেইটাই স্বাভাবিক। ভারাটা বাঁধা না হলে বাড়িটাই তৈরি হত না - এই শ্রদ্ধায় যদি কেউ ভারাটা না খুলতে চায়, তা পাগলামি বলা চলে। সেরকমই সেদিন সমাজে নানা কারণে নানা আচার অনুষ্ঠান এসেছিল। যা আমাদের চোখে নিষ্ঠুর। অমানবিক। যেমন আজকের সমাজেও অনেক অমানবিক নিষ্ঠুরতা শিক্ষার নাম করে, স্বাস্থ্যসেবার নাম করে, শ্রেণী বৈষম্য বজায় রেখেই মেনে চলেছি, পালন করে চলেছি। এক পরিযায়ী শ্রমিকদের অমানবিক মৃত্যুলীলা ও সামাজিক উদাসীনতাই বুঝিয়ে দিল ভিতরে ভিতরে আসলে আমরা কতটা সভ্য। বাণিজ্যবোধে আর বিজ্ঞানের ব্যবহারে যা উন্নতি করেছি তাইতেই ধরাকে সরা দেখছি। অথচ কি নির্লজ্জতাকে স্বাভাবিক নিয়ম করে দেখছি, বলছি সমাজে ওরকম চলেই। নইলে সমাজ টেকে না। ক্ষমতার শোষণ সে যুগেও ছিল, এ যুগেও আছে। লড়াই সে যুগেও ছিল। এ যুগেও আছে। এর আরো ভালো ব্যাখ্যা হারারি আর সোশ্যাল ডিলেমা দেখিয়েছে।

      ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার লড়াই কুকুরের লেজ সোজা করার মত। বিবেকানন্দর ভাষায়। তবু করে যেতেই হবে। কারণ সেটাই ধর্ম। মানু্ষের দুই ধরণের নম্রতা আছে। এক দোকানির নম্রতা বা আধুনিক ভাষায় ফুটেজ খাওয়ার জন্য পরিবেশনযোগ্য নম্রতা আর নিজের সীমারেখার উপলব্ধিজাত ঠিক ঠিক নম্রতা। প্রথমটার চক্করে সত্যকেই যেন গিলে না বসি রাহুর মত সে খেয়াল রাখতেই হবে। তবেই কুকুরের লেজ সোজা করার কাজটায় শ্রদ্ধা জন্মাবে। আর বিবেকানন্দর ভাষায় বলব, পৃথিবীতে একদিন স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে এ সব গল্প বাচ্চাদের মানায়, আমাদের না।


      আমাদের পক্ষ নির্বাচনটা করে নিতেই হবে। নিরপেক্ষ বলে জগতে মৃত্যু ছাড়া কেউ নেই। জীবন সব সময়েই পথ বেছে নেয়। জীবন মানে যখন সংগ্রাম হয়।

 

 

248
Fri, 10/02/2020 - 16:00

সামনে উৎসব। কিন্তু 'না' বলা যাবে না। বলা যাবে না যে পুজোটা ভারচুয়াল হোক। কিন্তু স্কুল, কলেজ, আদালত, ট্রেন ইত্যাদি সব বন্ধ করে রাখা যাবে। কেন বলুন তো? কারণ পরেরগুলো মানুষের বুদ্ধির সাথে মিশ খায়। উৎসব আর ধর্ম বুদ্ধির সাথে মিশ খায় না, আবেগের সাথে মিশ খায়। যা-ই আবেগের সাথে মিশ খায় তা নিয়েই আমাদের বিপদ। আমাদের বলতে ঠিক কি বোঝাচ্ছি, আমি আপনি? হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। আপনি যদি চিকিৎসক হন বা কোনোভাবে স্বাস্থ্যসেবার সাথে যুক্ত থাকেন তবে আমি আপনার কথা বলছি। নতুবা নয়।

দেখুন ক'দিন আগে একটা খবর পড়লাম যে মহালয়ার পর থেকে আবার বঙ্গে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। আসন্ন দুর্গাপুজোতেও বাড়বে। কিন্তু দেখুন তাতে আপনি বা আমি যদি অস্বাস্থ্যকর্মী হই, আমাদের ঠিক কি অসুবিধা বলুন তো? আমাদের আতঙ্ক বাড়বে, নিজের পরিবার-পরিজন এবং অবশ্যই নিজেকে নিয়ে। পেপারে পড়ব। চমকাবো। ভয় পাব। ব্যস এদ্দূর। এর বেশি কিছু হবে কি? না হবে না। বিপদের সামনে মুখোমুখি হবে কিন্তু ওই স্বাস্থ্যসেবীরাই, অবশেষে যাদের উপর আমাদের শেষ ভরসা।

এখন কেউ কেউ বলবেন তোমার ধর্মীয়, উৎসবীয় আবেগ নেই বলে এভাবে ভাবা সোজা হচ্ছে।

কিন্তু আদতে কি তাই? ট্রেন চলবে না, বাড়িতে বসে থাকব, এত এত মানুষের কাজ চলে যাবে, পঠন-পাঠন রীতি বদলে যাবে, প্রায় থমকে যাবে, এমন অনেক মানুষ যারা এই নতুন রীতিকে নেওয়ার মত আর্থিক সামর্থ্য নেই তাদের অনেকে আবার আত্মহত্যা করবে – এত এত সব ভাবা কি সোজা ছিল আমাদের মত যাদের ধর্মীয় আবেগ নেই, তাদের পক্ষে? তবু মেনে নিয়েছি। কেন বলুন তো? কারণ নইলে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা ভেঙে পড়বে। মানুষ রাস্তাঘাটে বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। এ ভয়াবহ দৃশ্য কল্পনা করে।

অথচ দেখুন ধর্মীয় আবেগের বেলায় এ কাজটা করা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। কেন বলুন তো? কারণ অন্যান্য আবেগের বেলায় কিছুটা হলেও মানুষের কমোন সেন্সের জায়গা থাকে। ধর্মীয় আবেগের বেলায় তা সম্পূর্ণ শূন্য হয়ে যায়। তাই ধর্মে যেভাবে মানুষকে দিয়ে অনায়াসেই ভালো কাজ আর মন্দ কাজ দুই-ই করানো যায়, অন্য কিছু দিয়ে তা করানো যায় না। কেমন? দাঁড়ান বলছি।

ভালো কাজ। যখন আপনি কাউকে বলছেন যে মানুষের সেবা করলে ঈশ্বরই সেবা পান, এবং মানুষের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর আপনার সেবা চান, এ খুব একটা বড় কথা হয়। এ কথা আমার বুদ্ধিকে নয়, আমার আবেগকে নাড়া দিয়ে যায়। আবেগ সাড়া দিলে আমি আমার সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ি সেবার কাজ। সেবার কাজ তখন আমার কর্তব্য না, আমার পুণ্যের কাজ। সমাজে বহু ভালো কাজ এই আবেগের সঞ্চালনে হয়েছে। আজও হচ্ছে।

       এইখানে বুদ্ধির একটা অপারগতা আছে। যদি বুদ্ধিকে জিজ্ঞাসা করি যে কেন আমি স্বার্থহীন হয়ে অন্যের সেবা করব, বুদ্ধি কোনো জুতসই উত্তর দিতে পারে না। আসলে আমাদের নৈতিক কর্তব্যগুলোর কোনো ব্যাখ্যাই যুক্তি ঠিক দিয়ে উঠতে পারে না। কারণ তা নেই। শুধু যদি মেনে নেওয়া যায় এটা কর্তব্য বলেই কর্তব্য, তবে একটা কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা হয়। গীতায় একটা কথা আছে, যদি সম্মান পাবে বলে, বা ফিরে উপকার পাবে বলে, বা মানুষের শ্রদ্ধা পাবে বলে সৎকাজে হাত দাও, তবে তা অর্থহীন। নিঃস্বার্থভাবে যদি করতে পারো তবেই তা ধর্ম। গীতায় আবেগের কথাটাকে উস্কানি দেওয়া হল না। বলা হল নিষ্কাম কাজ করে যেতে হবে। এবং স্বর্গ-নরকের গল্পগুলোও মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। যদি নিষ্কামভাবে কাজ করে যেতে পারো তবে বোধবুদ্ধি এমন একটা স্থিরতা লাভ করবে যে মনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। গীতায় একটা দর্শন ও নীতির কথা একই সাথে বলল। পাশ্চাত্যে কান্টের নৈতিক দর্শনও একই কথা বলে, কান্ট বললেন, কর্তব্যের জন্যেই কর্তব্য করার কথা।

       কিন্তু ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্য যদি আমি সেবার কাজে যোগ দিই, তবে আমার উল্টো দিকে আরেকটা তত্ত্ব দাঁড়ায়, যাকে অ্যাণ্টিথেসিস বলে, ঈশ্বরকে তুষ্ট করার জন্যেই তুমি এই সম্প্রদায়কে হত্যা করে ফেলো। এ সম্ভব হয়, কারণ আবেগের মধ্যে গতি থাকে প্রবল, কিন্তু চেতনা থাকে না। কমোন সেন্সকে যখন আবেগের বল ছাপিয়ে যায় তখন মানুষের বিনাশ ঠেকানো খুবই কষ্টকর। কোন পক্ষ কাকে বিশ্বাস করে সে বলা কঠিন। কিন্তু দুই পক্ষই যে আছে সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই।

       এই আবেগ মানুষকে বুদ্ধিভ্রষ্ট করে শুধু না, ভালো করে তলিয়ে ভাবলে দেখা যায়, মনের মধ্যে নিষ্ঠুর হওয়ার বীজও বুনে দেয়। যে কোনো অথোরিটি মানুষকে ভালোয়েন্ট করে, মানুষকে নিষ্ঠুর করে। মানুষকে অন্ধ করে, যদি সে অথোরিটির কোনো অপরীক্ষিত মান্যতা লাভ করে থাকে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে একটা সংস্থা অথোরিটির ভূমিকা পালন করতেই পারে, কিন্তু সেই যোগ্যতাটা তাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গিয়েই পেতে হয়েছে। কিন্তু যে স্বঘোষিত অথোরিটি মানুষের আবেগের উপর জাল বিছিয়ে বসে থাকে, সে অথোরিটি ক্রমে মানুষকে আবেগপ্রবণ, অসংবেদনশীল, নিষ্ঠুর, অন্ধতার দিকে চলে।

       আমি যাকে সেবা করব তাকে মানুষ জেনেই সেবা করব, তাকে ঈশ্বর ভাবার দরকার যখন আমার হবে তখন বুঝব আমার মনের স্বাভাবিক অনুকম্পাবোধ হারিয়ে গেছে বলেই তাকে জাগাতে আমাকে বাইরে থেকে একটা আবেগের ডোজ নিতে হচ্ছে। সেকি স্বাভাবিক? যে মানুষটা স্বাভাবিকভাবে প্রকৃতিদত্ত অক্সিজেন নিতে পারে, সেকি বিছানায় শুয়ে অক্সিজেনের সিলিণ্ডারের নল নাকে গুঁজবে? না তো। তাই যখন বলা হয় অনুকম্পাই ঈশ্বর, তখন তা বুঝি, কিন্তু যখন বলা হয় অনুকম্পায় ঈশ্বর বলে কোনো অতিজাগতিক সত্তা তুষ্ট হন, তখন নিজেকে অপমান করি। লজ্জা দিই। সাথে নিজের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে জাত শুভবোধকেও।

       তবে কি দুর্গাপুজোয় ভিড় হবে না? হবে। মহালয়ার দিন দেখেননি? কেন হবে? কারণ আমাদের ধর্মীয় আবেগ, আমাদের উৎসবীয় আবেগ আমাদের নিষ্ঠুর, অন্ধ হওয়ার ছাড়পত্র দেয়। কেউ তাকে রোধ করতে গেলে প্রলয় বাধে। অথচ সেই মানুষই স্কুল-কলেজ-ট্রেন-আদালত বন্ধ মেনে নেয়, কারণ সেখানে বুদ্ধি তাকে অজ্ঞ, নিষ্ঠুর হতে বাধা দেয়। কারণ সে জানে আদতে সবটা গিয়ে পড়বে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর। এত এত চিকিৎসক মারা যাচ্ছেন আপনার আমার সেবা করতে গিয়ে, সেকি সরকারি ক্ষতিপূরণের ভরসায়? অর্থের জন্যে? না। সেটা কর্তব্য বলে। এটা একটা জীবিকার এথিক্স বলে। নইলে মেডিক্যাল কলেজে যখন শুধুমাত্র কোভিডের রুগী আসছিল, তখন ছাত্রেরা কেন আন্দোলন করেছিলেন যাতে সব ধরণের রুগীকে ভর্তি নেওয়া হয়, কারণ তাদের শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বলে। এই দায়টা, এই এথিক্সটাই একটা জীবিকার প্রাণ। সেটাই তার পরিচয়।

       যদি লকডাউন করে জোর করে ধর্মীয় উৎসব আটাকানো যায়, তবে তা গণ-ভাবাবেগে আঘাত করা হয়। আর যদি সে সব বাধা খুলে দিয়ে সাধারণ মানুষের বিচার-বিবেচনার হাতে ছেড়ে দিয়ে একটা মোটামুটি নিয়ম বেঁধে চালানোর চেষ্টা করা যায়? তবে? আমরা উত্তরটা সবাই জানি। কিন্তু আমাদের আবেগ আমাদের সেই নির্বোধ আর আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার ছাড়পত্র দেয়, অন্তত বাজারের ভিড় দেখেই তা অনুমান করা যায় কি হতে চলেছে। আশঙ্কা হয় আর কত চিকিৎসককে হারাতে হবে আমাদের নির্বোধ আবেগ-যাপনের জন্য কে জানে।

 

249
Sun, 09/27/2020 - 18:30

বৃষ্টির জল রেনপাইপ দিয়ে নামবে, না হাঁ মুখ সিংহ দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় পড়বে? আজকাল হাঁ মুখ সিংহ আর দেখি না। নৈহাটিতে আগে বেশ কিছু পুরোনো বাড়ির ছাদে দুটো তিনটে করে হাঁ মুখ সিংহকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। তাদের বাকি শরীরটা ছাদে মিশে। মানে নেই আরকি। শুধু মুখটাই ছাদের বাইরে বার করা। শুকনো খটখটে আকাশে বোঝা যাবে না ওদের কি মহিমা। যেই না বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, অমনি দেখা যাবে প্রথমে সরু হয়ে, তারপর ধীরে ধীরে বড় মোটা জলের ধারা হুড়মুড় করে মাটিতে এসে পড়ছে।

      এখন রেনপাইপ। ছাদের জল সবার অলক্ষ্যে সোজাসুজি ড্রেনে গিয়ে নালায় গিয়ে মিশছে। কেউ জানছে না কোন ছাদ কত জলে বর্ষায় ভিজছে। বর্ষার সময় নালার দিকে তাকিয়ে আর কে বসে থাকে? কিন্তু ওই দেওয়াল বেয়ে নামা কালো, ধূষর পাইপগুলোকে দেখো, ওরা জানতেই দিচ্ছে না কোন ছাদের সাথে বর্ষার কিরকম বোঝাপড়া চলছে।

      আসলে আমাদের সভ্যতার উন্নতির সাথে কোথাও একটা ঢাকাঢাকির সম্পর্ক আছে। মাঝে মাঝেই বাড়ির পাশ দিয়ে যখন ফেরিওয়ালা “টিভির কভার... আলমারির কভার... কম্পিউটারের কভার... গাড়ির কভার...” ইত্যাদি ইত্যাদি হাঁকতে হাঁকতে চলে যায়, ভাবি মানুষ কিছু বানাতে না বানাতেই কেমন তাকে ঢেকে মুড়ে ফেলার প্রবণতা আপনিই জন্মে যায়। আগে ‘টেলিফোনের কভার’ চীৎকার করতে করতেও যেত, আজকাল আর বলে না। ওরাও জেনে গেছে সেই ল্যাণ্ডফোনের যুগ আর নেই। বড্ড ধুলো চারদিকে। কারা বানায় এত ধুলো, কেউ জানে না।

      এই ঢাকাঢাকি অবশ্যই স্বাস্থ্যকর অভ্যাস। কিন্তু কতদূর অবধি? অনেকদিনের ঢাকা বস্তুর নীচে কত ময়লা, ছত্রাক জন্মে যায় এও তো দেখেছি। আমরা যত শিক্ষিত হচ্ছি, যত উন্নত সভ্যতার জীব হচ্ছি, তত ঢাকাঢাকি অভ্যাসটা মনের উপরেও চারিয়ে দিচ্ছি। সব সময় “ভালো আছি” মনের আগেই জিভ বলে দেয়। মনের উপর জিভের আস্তরণ। সে কি ভালো? মনের মধ্যে যা ওঠে তারই প্রকাশ ভালো নয় যদিও, সে হলে যে ‘তুর্কিনাচন’ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা সে কথা তো রবীন্দ্রনাথ বলেইছেন। কিন্তু তবে ‘বাক্য যেথা হৃদয়ের উৎসমুখ হতে’ এই কথাটার কি হবে? মনের উপর জিভের চাদর বিছিয়ে চলাটা কি খুব স্বাস্থ্যকর? এই যে যখন শুনি যে পাশের বাড়ির মানুষটা বা পাশের বাড়ির স্বামী-স্ত্রী ভীষণ হাসিখুশী ছিলেন, লকডাউনের পর থেকে ধীরে ধীরে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন, যদিও ঘটনাক্রমে দেখা হয়ে গেলে রাস্তায়, হেসে বলতেন “ভালো আছি”, তারপর একদিন গলায় দড়ি দিয়ে দিল – এ কি ভালো কথা? নয় তো। যদি দুঃখের, সমস্যার সত্যগুলো ভাষা না পেয়ে শুধুমুধু জিভের তলায়, হাসির তলায় চাপা পড়ে থাকে, তবে বিষাক্ত রস মনের মধ্যে চারিয়ে যায় না? আত্মহত্যা করতে কে চায় – শরীর না মন? অবশ্যই মন। শরীরের মৃত্যুর কথা ভাবলে সব সময়ই কষ্ট হয়, আতঙ্ক হয়। কিন্তু সে কি করবে, সে তো মনের অনুগামী। মন চায় আত্মহত্যা করতে। জিভের সাথে ভালোবাসার সম্পর্কটা কেড়ে নিয়েছে আমাদের ভদ্রসমাজ। সেই গালিবের কথা ভাবা যাক – “দিলে নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়/ আখির ইস দর্দ কা দাওয়া কেয়া হ্যায়... ম্যায় ভি মু মে জুবান রাখতা হুঁ/ কাশ পুছো কি মুদ্দা কেয়া হ্যায়”... সেই জিভের সাথে মনের কথার অভিমান। আসলে এত ভালো ভালো পজিটিভ ভাবের কথার মধ্যে সে কি করে নিজের সমস্যার কথা বা কষ্টের কথা বলে বসে। কষ্ট তো ব্যক্তিগত, সুখ নয়। সুখ সুগন্ধ। দুঃখ কোলাব্যাঙের মত। ঘরের কোণে, অন্ধকারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকে।

      তবে এই মনের ঢাকাঢাকি স্বভাবটা বেশিদূর অবধি ভালো নয় বলুন? সবাই অবিশ্যি এমন নয়। এই তো গেল বছর গরমকালে, এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গেছি। বেশ সাজানো গোছানো বাড়ি। চারদিকে একটুও ধুলোবালি নেই। বাথরুমের মেঝেতে জল নেই। চেয়ারে সোফায় ডাইনিং টেবিলে একটুও ধুলোবালি নেই। বেশ একটা পরিপাটি ব্যাপার। তা আমার সেই বন্ধু আবার ভীষণ সাহিত্যরসিক। আমরা বেশ কাব্য আলোচনা করছি। কাব্যে মেঘ আসছে। কারণ বাইরের আকাশে মেঘ জমেছে। বর্ষার কবিতার আলোচনা প্রায় মেঘদূত অবধি পৌঁছিয়েছে, হঠাৎ দেখি আমার সেই সাহিত্যরসিক বন্ধুটি কেমন উসখুস করতে করতে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎ বেশ প্রমাণ সাইজের একটা ঝাঁটা হাতে কিসের জন্য যেন তৈরি। ধপাধপ জানলা দরজা বন্ধ হয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না হঠাৎ কি হল? আমার পাশে বসা আরেক বন্ধু, যিনি সংসারজীবনে যথেষ্ট অভিজ্ঞ, আমায় শান্ত নিরুত্তাপ কন্ঠে বলল, “ঝড় আসছে, তাই ধুলো না ঢোকার প্রাক প্রস্তুতি চলছে।“ বুঝলাম। ভাবের চেয়ে ধুলো বাস্তব, একি আর বুঝি না!

      সত্যিই ওদিকে ততক্ষণে ঝড় শুরু হয়ে গেছে বাইরে। আমার আবার ঝড়বৃষ্টি বিদ্যুৎ ঝলক দেখতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু কি করি, কাঁচুমাচু মুখ করে বসে রইলাম। মনের মধ্যে কাব্যের আরশোলা ফড়ফড় করে কখনও এ কবি, সে কবির কবিতায় গিয়ে বসছে। বাইরে বেশ জোরে বৃষ্টি শুরু হল। আহা, মনের মধ্যে মল্লারের সুর যেন ধোপাবাড়ির পিটনির মত পাঁজরে আছড়ে আছড়ে পড়ছে। হয় তো আমার এই করুণ মুখচ্ছবি আমার ঝাঁটা হাতে বন্ধুটির প্রাণে কিছুটা দয়ার সঞ্চার করল, সে একটা দরজার পাল্লা খুলে দিয়ে বলল, শান্তি?

      শান্তি বলে শান্তি। কিন্তু ইহজাগতিক সুখ আর কাব্যের সুখ তো এক নয়। হুড়মুড় করে ধুলো সেই প্রস্তরীভূত মেঝের উপর ঝাঁপ দিয়ে রে রে করে পড়ল। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। না, ঝড় এলো না বটে বন্ধুপক্ষ থেকে, বুঝলাম তার বেজায় কাজ বাড়ালাম। সে নিশ্চয় মনে মনে ভাবছে, নিজের তো কামকাজ নেই, অকাব্যিক সংসারের নানা খুঁটিনাটি পরিপাটি করে সামলিয়ে যদি ওসব দার্শনিক তত্ত্ব নিয়ে লোফালুফি খেলতিস তো বুঝতাম, সে তো করবে না... মাঝখান থেকে আমার কাজ বাড়িয়ে...

      যা হোক, যে কারণে এই প্রসঙ্গের অবতারণা, সবাই যে মনের উপর জিভের ঢাকনা দেয় না সেইটা বোঝানোর জন্যেই। কিন্তু সেও কি দেয় না, দেয়। ক্ষেত্র বিশেষে আমরা সবাই মনের উপর বাজার থেকে বহুমূল্যে কেনা চলতি ফ্যাশানের জামা পরিয়েই বাইরে বার করি তাকে। সেই রীতি যে।

      সবার দৃঢ় বিশ্বাস, এটা না হলে আমাদের সমাজ টিকবে না। আমাদের মনকে আবৃত করতেই হবে। মনকে এমনভাবে আবৃত করতে শিখতে হবে যে মন যেন জামা পরতে বায়না না করে। আমার বলার আগেই যেন সে অবস্থা বুঝে মাথার মধ্যে রাখা আলমারি খুলে, পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, বা সামাজিক শিক্ষা অনুযায়ী, বা একটা আন্দাজ অনুযায়ী জামাটা গলিয়ে ফেলে। আমাকে যেন অপ্রস্তুত না করে। এর ফলে কি হল, যে প্রচণ্ড হিংসুটে সেও প্রচণ্ড ভালোবাসা, কি উদারতার জামা পরে ফেলল। যে ভীষণ দুর্বল সেও একটা প্রকাণ্ড গ্ল্যাডিয়েটারের জামা কিনে পরে ফেলল, যতই তার পোশাকের চাপে প্রাণ গলার কাছে এসে ত্রাণের রাস্তা খুঁজুক না কেন। এরকম উল্টোপাল্টা জামাপরা অভ্যাস আমাদের এমন হয়ে গেছে যে, মনে হয় যেন ঘুম থেকে উঠেই ‘গো অ্যাজ ইউ লাইক’ এ যাওয়ার তোরজোড় শুরু করে দিতে হচ্ছে। আমি আমাকেও বিশ্বাস করি না, আমি তোমাকেও বিশ্বাস করি না। আমার আমি, সে আমি থেকে তোমার পছন্দের আমি, তোমার পছন্দের আমি থেকে অমুকের পছন্দের আমি, অমুকের পছন্দের আমি থেকে তমুকের পছন্দের আমি... আবার কখনও কখনও আমার দুই হাতে দুই মানুষের পছন্দের আমি। মাঝে মাঝে এরকম নানা মানুষের পছন্দ অনুযায়ী আমিগুলোর ফেলে যাওয়া আবর্জনার মধ্যে থেকে জন্মায় খিটখিটে, বিরক্ত খেঁচুটে আমি একটা। কাউকে সামনে দুর্বল পেলেই তার গায়ে দুটো আঁচড় টেনে দিতে পারলে যেন তার গ্রীষ্মের দুপুরে গড়ের মাঠে বসে কোল্ডড্রিংক্স খাওয়ার সুখ।

      তারপর সারাদিন নানা মানুষের নানা পছন্দের ক্ষেত চষে এসে ক্লান্ত শরীরে যখন বিছানায় যাচ্ছি তখন আমার আসল আমি ঘুমিয়ে কাদা। হবে না? সারাদিক কেউ ডাকেনি যে তাকে! তার নামই বা মনে আছে আজ কজনের? আমারও আর তাকে ডাকতে ইচ্ছা করে না, ঘুমন্ত আমার আমির দিকে তাকিয়ে আমার এই চতুর বিষণ্ণ পরিণত আমি ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে দেখি সেখানেও কত রকম পোশাক নিয়ে কত লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি দরদাম করছি। ডিল করছি। সব স্বপ্নগুলোও বিক্রি হয়ে গেল কবে? জানতেই পারলাম না!

 

250
Fri, 09/25/2020 - 17:30

'সমাজ' অর্থে দুটো শব্দ হয়। এক, ইংরাজি মতে সোসাইটি শব্দটার উৎপত্তি ‘কম্প্যানিয়ন’ এই অর্থ থেকে; আরেক ভারতীয়, সহগমন অর্থে। কিন্তু উৎপত্তিগত পার্থক্য থাকলেও সমাজের নিজস্ব ভাবধারায় পার্থক্য বিস্তর। ভারতে হিন্দু সমাজ, মুসলিম সমাজ, শিখ সমাজ, অল্পবিস্তর বৌদ্ধ সমাজ, জৈন সমাজ ইত্যাদি নানা সমাজের একটা জটিল বৈচিত্রময় রূপ এই ভারতীয় সমাজ। তার প্রধান অংশ অবশ্যই হিন্দু সমাজ। ভারতের নবজাগরণ বলতে যখন রাজা রামমোহন রায়ের কথা আসে, তখন নিশ্চয় বুঝি যে, যে জাগরণের কথা বলা হচ্ছে তা মূলত হিন্দু সমাজের জাগরণের কথা। প্রাচীন উপনিষদের সূত্রের ভাষ্য যা সে সময়ে নতুন যুগের নতুন ভাবনায় এসেছিল রামমোহনের হাত ধরে। সতীদাহ প্রথার রদও অবশ্যই হিন্দু সমাজের একটা অন্ধকারময়, অমানবিক প্রথার রদের কথাই ছিল। এরপর যারা সেই জাগরণের শিখা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য আমাদের বঙ্গ থেকে বিদ্যাসাগর, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ।

      আমি কি তাদের অবদান নিয়ে স্কুলের রচনা লিখতে বসলাম? অবশ্যই নয়। আমি তাদের কাজ করার একটা সূত্রকে নিয়ে আলোচনা করার জন্য লিখতে বসলাম। কাল যে মহাপুরুষের জন্মদিন, তিনি শেষজীবনে যদিও তাঁর বাংলা তথা সমস্ত তথাকথিত সভ্য সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন – হ্যাঁ, আমি বিদ্যাসাগরের কথাই বলছি।

      সমাজকে দু'ভাবে সংস্কার করা যায়। এক, তাকে বুঝে, তার ভিতরে প্রবেশ করে; দুই, তার বাইরে গিয়ে বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে – এটা ঠিক নয়, ওটা ঠিক নয় ইত্যাদির মাধ্যমে। আমাদের সৌভাগ্য ছিল যে আমাদের সে সময়ের সংস্কারকেরা কেউ বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে – 'তোমাদের সব ভুল' বলে চীৎকার করে আমাদের শুধরাতে চাননি। যেটা হয়েছিল আফগানিস্থানে, যার খেসারত আজ সারা পৃথিবী দিচ্ছে পরোক্ষভাবে। সেইদিন কম্যুনিস্ট শাসকেরা ভেবেছিলেন আফগানিস্থান থেকে ইসলাম ধর্মকে মুছে ফেলে দিলেই আফগানিস্থান বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক সভ্যতার মত হয়ে উঠবে। মেয়েদের শিক্ষাব্যবস্থা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার তারা নিয়ে এল। কিন্তু হঠাৎ করে বড় তাড়াতাড়ি নিয়ে আসতে গেল। শুধু তাই নয়, মোল্লাদের উপর শুরু হল অত্যাচার। যে করেই হোক, ধর্মটাকে আফগানিস্থানের মাটি থেকে সরাতেই হবে, এরকম একটা উদ্দেশ্য পাগলের মত পেয়ে বসেছিল সেদিনের কম্যুনিস্ট শাসক দলের মগজে। নিজেদের শক্তি, নিজেদের ভাবনাচিন্তার বিরুদ্ধে যে কিছু থাকতে পারে সে তাদের ভাবনার বিরুদ্ধে ছিল। অবশ্য সে ছবি আজও চীন আর রাশিয়ার দিকে তাকালে বোঝা যায় সেদিনের কম্যুনিস্ট দল কি চেয়েছিল। কিন্তু যে ভুলটা একশো বছর আগে ব্রিটিশরা করেছিল, একজন আফগান রাজাও করেছিল, সেদিনের কম্যুনিস্ট দলও একই ভুল করল – আফগানিস্থানের মাটির ধর্মকে তারা বুঝল না, আফগানিস্থানের জাতীয় চরিত্রকে দুর্বল মনে করল। ফলে শুরু হল – জেহাদ।

      বলা হয় আমেরিকা নাকি এই জেহাদিদের তৈরি করেছিল। এ অর্ধসত্য। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় সেকেন্ডারি ইনফেকশান, বা গৌণ সংক্রমণ। বিষটা ঢেলেছিল কম্যুনিস্ট পার্টির ঔদ্ধত্য। হাজার হাজার মানুষ যে কারণে শরণার্থী হল পাকিস্তানে। সেই প্রবল প্রতিবাদ যখন মাথা চাড়া দিল তখন ঘোলা জলে মাছ ধরতে গিয়েছিল আমেরিকা। অবশ্যই সেই বিদ্বেষের হাত শক্ত করতে তার ভূমিকা ছিল, কিন্তু বিদ্বেষের আগুন জ্বালাতে নয়। যদি আমেরিকা সাহায্য না করত, তবে সব শায়েস্তা হয়ে যেত... এ ধারণা যারা পোষণ করেন হয় তারা আফগানিস্থানের ইতিহাস জানেন না, নয় তো এখনও মোহ ভাঙেনি বলতে হবে। তবে সে লড়াইটা ধীরে ধীরে আমেরিকা বনাম রাশিয়া হয়ে উঠছিল, মধ্যে আফগানিস্থান নিমিত্তমাত্র। কিন্তু তা হল না। ততদিনে আরেক বিধ্বংসী শক্তি জন্ম নিয়ে নিয়েছে, তারা ঘোষণা করছে তাদের না চাই আমেরিকা, না রাশিয়া, তারা আফগানিস্থানে প্রতিষ্ঠা করবে ইসলামিক রাষ্ট্র। তবে এখন যে শুধু আফগানিস্থান নয় সে আর বলাই বাহুল্য। সারা পৃথিবীতে শুরু হল এক তাণ্ডব, সে কবে শেষ হবে আমরা কেউ জানি না, তার সাথে সাথে মাথা চাড়া দিচ্ছে আরেক প্রতিক্রিয়া – মুসলিম বিদ্বেষ। আর আফগানিস্থান একটা আগ্রাসী প্রবল শক্তিকে প্রতিহত করতে গিয়ে আরেকটা প্রবল আগ্রাসী শক্তির হাতে এখন। তবু তাকে সে স্বীকার করে নিয়েছে – ঘরের লোক ভেবে। যদিও সে শক্তিও কালের নিয়মে দুর্বল হবে, যেদিন বন্দুকের শক্তির থেকে স্বাভাবিক নীতির শক্তিতে আস্থা জন্মাতে শুরু করবে, যেটা পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদীদের লোভে ধুলিসাৎ হয়ে পড়েছে। শুধু চোরাপথে আফিম বেচেই বা আর কতদিন একটা দেশের অর্থনীতি টিকে থাকতে পারে?

      সেদিনের ভারতের সংস্কারকগণ ভারতকে আধুনিক করতে কোনো পাশ্চাত্য তত্ত্বের আমদানি করার প্রয়োজনবোধ করলেন না। উদারনীতির সূত্রগুলো প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থ মন্থন করেই তারা আনলেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষার অদ্ভুত মিলন ছিল, কিন্তু কাজের বেলায় কোনো বিদেশী সাহেব অমুক বলেছেন বলে আমাদের তেমন হতে হবে, এ মূর্খামি তারা করেননি। তারা কাজ করেছিলেন। ভারতের মনীষার অতল তলে গিয়ে মণিমুক্তা কুড়িয়ে আনার ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। প্রদীপটা আবার ধুয়েমুছে জ্বালাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু বিদেশ থেকে ঝাড়লন্ঠন এনে বোঝাতে চাননি যে তোমাদের আসলে এককালে কিছু ছিল, কিন্তু বর্তমান যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে ও সব ফেলে এই পাশ্চাত্যের লণ্ঠন জ্বালো। বলেননি সেই কথা। তাই আমরা বেঁচে গেলাম। তাদের কাজের অনেক খুঁত আজকে বসে বসে বার করা কিছু অসম্ভব নয়, কিন্তু মনে রাখতে হবে তাঁরা কাজ করেছিলেন; শুধু ভাষণ দিয়ে, বা কয়েকটা বিদেশী আন্তর্জাতিক তত্ত্ব আউড়িয়ে ক্ষান্ত দেননি। সব চাইতে কঠিন যে কাজটা তাঁরা করেছিলেন – মানুষ গড়া। দল গড়া নয়। দ্বিতীয় কাজটা সোজা। তার ফল হাতেনাতে পাওয়াও যায়। কিন্তু প্রথম কাজটা ভীষণ পরিশ্রমের। অনেক আত্মত্যাগের। আর তার ফলও হাতেনাতে পাওয়া যায় না। হয় তো নিজের জীবনেও নয়। তারা আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মোহে কাজ করতেন না, ফলে কতজন হল দলে – এই প্রশ্ন অর্থহীন ছিল তাদের কাছে। কাজটা কতটা সত্য হল সেই ছিল তাদের পণ। তাদের বিশ্বাস ছিল কাজটা সত্য হলে তার ফল আজ না হয় কাল ফলবেই – সত্যমেব জয়তে, নানৃতং – সত্যেরই জয় হয়, মিথ্যার নয়; ট্রুথ প্রিভেলস।

      সে সংস্কারের মূলে একটা ভাব ছিল – দরদ। কৌশল নয়। দরদী মানুষ দেখে সত্যকে। কৌশলী মানুষ দেখে ফ্যাক্টস, বা তথ্যকে। তাই যুদ্ধে সৈন্যের হিসাব লেখা থাকে, ঘোড়া-অস্ত্রশস্ত্রের হিসাব লেখা থাকে, কিন্তু সেই সৈন্যের অসহায়তা বোধের হিসাব লেখা থাকে না, তার বাড়ির বিধবা মহিলাটার কান্নার হিসাব পাওয়া যায় না, কারণ সে অব্জেক্টিভ সত্য নয়, সে সাব্জেক্টিভ সত্য; তা কৌশলী মানুষের কোনো কাজে আসে না। কিন্তু সমাজ মানে শুধু হিসাব না, হৃদয়ও।

      তবে ভারতের সে জাগরণ কি সত্যিই রামমোহনের সময় থেকেই? এ কথা আমার মন মানতে চায় না। জাগরণ কথাটা চিত্তের সাথে সম্পৃক্ত। ভারতের চিত্তকে তুকারাম, কবীর, নানক, মীরা, চৈতন্য প্রমুখ সাধকেরা জাগায়নি? জাগিয়েছিল তো! নইলে “সবার উপরে মানুষ সত্য” এতবড় পদ কিসের জোরে বেরিয়েছিল চণ্ডীদাসের কলম থেকে? ভারতীয় সমাজের আত্মায় সেই জাগরণের বাণী বারবার এসেছে। জাগিয়েছে। তার অনেক দোষত্রুটি আছে, তার সমস্ত সমস্যার সমাধান অবশ্যই হয়ে যায়নি, কিন্তু তার সমাধানের পথ কোনোদিন তাকে তিরস্কার করে বাইরে থেকে বেরোবে না, তাকে গভীরে জেনে বেরোবে।

      আজকে আবার এক নতুন সময়ের উন্মেষ দেখছি। কেউ কেউ ভারতকে তার বাণীতে খুঁজছে, আর কিছু মানুষ ভারতকে পাশ্চাত্যের ধর্মের পরাকাষ্ঠা অন্যান্য ধর্মের আদলে বানাতে চাইছে। যেন একটা ভ্যাটিকান সিটি থাকবে, যেন একটা মক্কা থাকবে। কিন্তু হিন্দুধর্মে সেরকম কোনো একদেশি মতবাদ কবে ছিল? এক দেশ, এক নীতি – এই বিরোধ তো আদিকাল থেকেই, তার একটা সংগৃহীত রূপ হয় কুরুক্ষেত্রের আঙিনায়। সেখানে কৃষ্ণ বলছেন, নানা স্বভাব অনুযায়ী, নানা প্রবৃত্তি অনুযায়ী নানা মানুষের বৈচিত্রের কথা। প্রত্যেকে যে যার সীমার মধ্যে থাকবে, অন্যকে নিজের সীমানায় আনার চেষ্টা করবে না। গীতা ধমকানি দিচ্ছেন – কেউ কারোর বুদ্ধিভেদ জন্মাবে না, তুমি বলার কে যে তোমার মতই শ্রেষ্ঠ?

      শুধু তাই বলছেন না, বলছেন, তোমার আচরিত ধর্ম যদি অন্যের থেকে নিকৃষ্টও হয়, তবু তুমি অন্যের ধর্মে পারঙ্গম হওয়ার চাইতে নিজের ধর্ম আচরণে মৃত্যুবরণও করো, কারণ অন্যের পথ তোমার চলার পথ করতে গেলে তা হবে তোমার পক্ষে ভয়াবহ।

      যে ধর্মকে খানিক আগে বলা হল গীতায় যে তার স্বল্পমাত্র আচরণে মহাভয় থেকে তা ত্রাণ করে থাকে, সেই ধর্ম সম্বন্ধেই আবার সাবধানবাণী উচ্চারিত হল তা যেন তোমার স্বভাব অনুযায়ী হয়, নইলে তা ভয়াবহ।

      গীতায় ‘স্বভাব’ শব্দটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু সেই স্বভাবে কাম-ক্রোধ-লোভকে স্বীকার করা হয়নি। তাকে বলা হয়েছে বিকার, যা অজ্ঞানতাপ্রসূত। কিন্তু স্বভাব অনেক প্রকার তা বলা হয়েছে, এবং সে স্বভাব অনুযায়ী চলাকেই কর্তব্য --- এও স্থির করা হয়েছে। আজকে যাকে আমরা কেরিয়ার কাউন্সেলিং বলছি। রুচি অনুযায়ী কাজের জীবিকা নির্বাচনের কথা বলছি। স্বভাব অনুযায়ী তেমন কথাই বলা হয়েছে। যার কিছুটা মিল প্লেটোর রিপাবলিকেও কাজের বন্টনের সাথে মেলে। একই কথা, অধিকারের সীমা ছাড়িয়ে নিজের অহং-এর বিস্তারে না যাওয়া। নিজের রুচি অন্যের ঘাড়ে চাপানো কোনোদিন ভারতের সামাজিক আদর্শ ব্যবস্থা ছিল না। তা করতে যাওয়া আত্মহত্যারই সামিল।

      রামকৃষ্ণদেব সম্বন্ধে নিবেদিতা বলছেন – অতীত ভারত যা ছিল তার মানুষী রূপ। আর বিবেকানন্দ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছেন, ভবিষ্যৎ ভারত যা হবে তার রূপ। একই কথা প্রকারান্তরে রাধাকৃষ্ণান ও রাজাগোপালাচারীর কথাতেও আছে। সেখানে অবশ্য সারদাদেবীর উল্লেখ আছে। এদের কারোর জীবনেই অন্যের উপর নিজের রুচি চাপিয়ে দেওয়ার কথা নেই। আমার মঙ্গলের পথের সাথে তোমার মঙ্গলের পথ আলাদা হতেই পারে। “যার পেটে যা সয়। মা বাড়িতে মাছ এনেছেন। কাউকে কালিয়া, কাউকে ঝোল, কাউকে ভাজা করে দিলেন তাই”। এ রামকৃষ্ণের কথা। এ সম্পর্কে রামকৃষ্ণের বাণীর উল্লেখ করলে এই লেখার কলেবরই বাড়বে শুধু। বিবেকানন্দ বলেছেন, আমার পক্ষে যা অমৃত, তোমার পক্ষে তা বিষও হতে পারে। আসলে এই হল ভারতের আত্মার বাণী – এক সত্য, তার প্রকাশ নানা। গীতা বলেন, মানুষ নানা মতে, নানা ভাবে এক সত্যেরই অনুসরণ করে থাকে।

      ভারতের বাণীকে খুঁজতে গেলে তার আধ্যাত্মিক সত্যকে নানা বৈচিত্রের মধ্যে খুঁজতে হবে। ভারতের আধ্যাত্মিক সত্যকে যদি মঠে-মন্দিরে খুঁজতে হয়, সেও ব্যর্থ হবে। ভারতের আত্মার সত্য তার সামাজিক জীবনে। তার নিত্য জীবনযাত্রাকে খেয়াল করলে পাওয়া যাবে। তার বাউলের গানে, ফকিরের গানে পাওয়া যাবে। গ্রামে গ্রামে ঘুরলে সে সত্যের সহজ প্রকাশ পাওয়া যাবে। যাদের রাম-কৃষ্ণ-শিব ঘরের মানুষ হয়ে গেছে। তাদের আলাদা ঘর হয়, মন্দির না, যাকে বলে 'ঠাকুর ঘর'। তাদের অস্তিত্ব তাদের গানে, যাত্রায়, জন্ম-মৃত্যুর সমস্তটা জুড়ে। তার সমাজকে ভালো করে দেখলে দেখা যাবে কি এক সূত্রে আসমুদ্রহিমাচল বাঁধা। সে সূত্রের মুক্তো একটা নয়, নানা। তাকে একটা মুক্তোতে বেঁধে দিলে সে তার শ্রী হারায়। এ ভুল আশা করি আমরা যত তাড়াতাড়ি বুঝব, আমাদের তত তাড়াতাড়ি মঙ্গল।

      কেউ কেউ মনে করেন, বৈচিত্রতায় দেশের মধ্যে দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সব মিলে একটা জায়গায়, একটা নীতিতে বেঁধে দিলে দেশের ঐক্যকে মজবুত করা যায়। কথাটা শুনতে যুক্তিযুক্ত – কিন্তু তা আপাতভাবে। ভারতীয় সমাজে ভাবের একদর করাটা কোনোদিন টেকেনি। ইতিহাস শিক্ষা দেয়। একের ভাবকে বড় করে, অন্যের ভাবকে খাটো করলে ভবিষ্যতের অশান্তির বীজ পোঁতাটাই হয় কেবল। কারণ প্রকৃতিকে ভালো করলে খেয়াল করলে দেখা যায়, সে কোনোদিন একের আধিপত্য বেশিদিন মেনে নেয়নি। বৈচিত্রতায় দেশ দুর্বল হয় না, দেশ দুর্বল হয় সংহতি নষ্ট হলে। একে অন্যের প্রতিস্পর্ধী হলে। প্রতিস্পর্ধা লোভ জন্ম দেয়। আর সে লোভ যদি রাষ্ট্রশক্তির মদতপুষ্ট হয় তবে তা আরো দুর্ভাগ্যের। আমাদের কারোর সাথে কোনো অন্ধ প্রতিযোগিতায় আমাদের নামতে হবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রতিটা ধর্মের ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় আর প্রতিটা ধর্মের সাধারণ মৌলিক নীতিমালাগুলোকে যুক্ত করলে ছোটোবেলা থেকেই একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মায় ধর্ম ও তার স্থান নিয়ে। ধর্ম একটা শক্তি। সমাজকে যুক্ত রাখার একটা বাঁধন। প্রাচীন ধর্মের জায়গায় নতুন ধর্ম আসবে। কিন্তু ধর্ম প্রকারান্তরে থেকেই যাবে। তাই সে সম্বন্ধে সম্যক ধারণার বিকাশ ঘটানো আশু দরকার। অন্তত ভারতীয় সমাজকে বোঝার জন্য তা অত্যাবশ্যক। ছদ্ম সেক্যুলার খেলাটা বন্ধ না হলেই নয়। সেই ফাঁকে বেনোজল ঢুকছে। সত্যিকারের জ্ঞান-বোধ অপপ্রয়োগের হাত থেকে বাঁচায়। নিজের জায়গার, নিজের স্বভাবে, নিজের সত্যকারের ধর্মে স্থির থাকলেই যা আসুরি শক্তি তার বিরাম হবে। নিজের সুস্থতাকে নিজের স্বাস্থ্যেই রক্ষা করতে হবে, বাইরে থেকে কৃত্রিম অনুপানে নয়। সেইভাবে শরীরকে বাঁচানো যায়, আত্মাকে নয়।

 

251
Fri, 09/18/2020 - 18:07

 "আত্মনিন্দা পাপ, আত্মহত্যার চেয়ে বেশি।" ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

       আত্মঘৃণা বা আত্মনিন্দা – এক গভীর মানসিক ব্যাধি। ইংরাজিতে যাকে বলে 'Self-condemnation' বা 'Self-loathing'.

       ক্রমাগত মনের গভীরে নিজেকে দোষী ভাবা, নিজেকে ব্যর্থ ভাবা, নিজেকে অযোগ্য ভাবা – এ গভীর ব্যাধি একটা। “এ সব ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসো”, এ বলা যত সোজা, আদতে তত সোজা কাজটা নয়, কারণ রোগটার শিকড় অনেক গভীরে। এ ব্যাধির সূত্রপাত হয় তার শৈশবে, ক্রমে পূর্ণাঙ্গ আকার ধারণ করতে শুরু করে কৈশোরে ও যৌবনের প্রারম্ভে।

 

আত্মনিন্দা বনাম নম্রতা

=================

যদি মনে হয় এটা আমাদের স্বভাবের নম্রতার পরিচায়ক, বা আত্মসমালোচনার দিক, অর্থাৎ এটা আমাদের স্বভাবের একটা সদর্থক দিক, তবে খুব ভুল হবে। নম্রতা স্বভাবের একটা গুণ নিশ্চয়, কিন্তু আত্মনিন্দা নয়। “মিথ্যা নিন্দা রটাস নে নিজের, সে যে পাপ... তিনি বলে গেলেন আমায় নিজেরে নিন্দা কোরো না, সে যে পাপ”। রবীন্দ্রনাথের চণ্ডালিকা। নম্রতা নিজেকে নিয়ে ক্ষোভ নয়, নিজেকে স্বীকার করে নেওয়া সানন্দে, সহজে। তাই নম্রতা মানে সদর্থক বোধ। চেতনায় আলোর বোধ। কাজে আত্মবিশ্বাসের বোধ।

       আত্মসমালোচনাও কখনও আত্মনিন্দা নয়। সেখানেও নিজের ক্ষমতা, নিজের ভুল-ত্রুটির একটা সদর্থক, নৈর্ব্যক্তিক আলোচনা। এবং সব চাইতে বড় কথা, সে আলোচনাও সানন্দে ও সহজে মনের মধ্যে ঘটে। কোনো জটিলতা সৃষ্টি করে না। যে মানসিক জটিলতা সৃষ্টি হয় আত্মনিন্দা বা আত্মঘৃণা থেকে।

 

অভিভাবকত্ব

==========

অনেক কম বয়েস থেকে এই ব্যাধির সূত্রপাত আগেই বললাম। বাবা-মায়ের সাথে যদি সন্তানের অ্যাটাচমেন্ট খুব বেশি থাকে তবে এই রোগটা হওয়ার সম্ভাবনাও অনেক বেশি থাকে। কারণটা একটু তলিয়ে দেখতে হবে।

 

কেস ১

-----------

অ্যাটাচমেন্ট আর ভালোবাসার মধ্যে অনেক পার্থক্য। অ্যাটাচমেন্টে অনেক বেশি প্রশ্রয় থাকে যা ভালোবাসায় থাকে না। ভালোবাসায় একটা স্পেস দেওয়ার, একটু দূর থেকে সন্তানের বেড়ে ওঠাকে নজরে রাখার ব্যাপার থাকে। প্রবল অ্যাটাচমেন্টে তা থাকে না। সেখানে সেন্টিমেন্টালিজমের দাপট অনেক বেশি। মান-অভিমানের প্রাবল্য অনেক বেশি।

       একটা শিশু যখন এই অ্যাটাচমেন্টের মধ্যে বেড়ে ওঠে, যেখানে অনেক বেশি প্যাম্পারিং, অনেক বেশি যত্ন, অনেক বেশি পেয়ে যাওয়া, সেখানে শিশুর স্বভাবের মধ্যে একটা দুর্বলতা প্রবেশ করে। ক্রমে যত সে বড় হয় তত সে বোঝে বাবা-মায়ের এই ভালোবাসার আতিশয্য তার কাছে অনেকটা কামধেনুর মত। সে কিছুতেই এটা হারাতে চায় না। নিজের যোগ্যতা বোঝার, কোনো জিনিসের আর্থিক বা বিষয়গত মূল্য বোঝার ক্ষমতা তার মধ্যে তৈরি হয় না। সে জানে সে চাইলেই পায়। সে জানে সেই তার বাবা-মায়ের সব কিছুর কেন্দ্র।

       তবে আমি যে ব্যাধিটা নিয়ে কথা বলছি তার প্রত্যক্ষ কারণ এটা নয়। এটা চিকিৎসার ভাষায় সেকেণ্ডারি ইনফেকশান ঘটার সুযোগ করে দেয়। কেমনভাবে? সেইটা বলার। কোনো বাবা-মা'ই মুখে যাই বলুন সন্তানের কাছে সম্পূর্ণ প্রত্যাশাশূন্য হতে পারেন না। সেটা সম্ভব নয়। মুখে না বললেও আচার-আচরণে প্রত্যাশার দিকটা প্রকাশিত হয়েই পড়ে। কিন্তু যখন আমাদের আলোচ্য এই বিশেষ ক্ষেত্রের সন্তানটি বাবা-মায়ের প্রত্যাশানুরূপ না হতে পারে, তখন শুরু হয় তার মধ্যে একটা গভীর অপরাধবোধের সূত্রপাত। তার অজান্তেই নিজেকে ব্যর্থ, অযোগ্য, ঘৃণ্য মনে হতে শুরু হয়। কারণ বাবা-মা তার জন্য এত কিছু করলেও সে নিজে কিছু করতে পারল না। কি কর‍তে পারল না? সে বাবা-মায়ের ইচ্ছানুরূপ হতে পারল না।

       এইখানেই একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য ঘটে যায়। বাবা-মায়ের সঠিক তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা সন্তান নিজের যোগ্যতা, নিজের স্বপ্নকে চিনতে শেখে। বারবার অকৃতকার্য হলেও যেহেতু ইচ্ছাটা তার নিজের তাই সে আবার চেষ্টা করতে পিছিয়ে আসে না। সাময়িক ব্যর্থতা, সাময়িক অবসাদ তার হলেও তা 'আত্মনিন্দা' ব্যাধিতে পরিণত হয় না। কারণ তার বেড়ে ওঠায় সচেতন ভালোবাসা ছিল, শাসন ছিল, সঠিক গাইডেন্স ছিল। সেন্টিমেন্টালিজমের কুয়াশা ছিল না। প্রচণ্ড মাখামাখি ছিল না। নিজের যোগ্যতা, নিজের ইচ্ছা নিয়ে কোনো ধন্দ তৈরি হওয়ার অবস্থা হয়নি তার।

 

কেস ২

----------

অতিসমালোচনা, অতিনিন্দা। এটি আগেরটার থেকে একেবারে বিপরীত, কিন্তু বিষফল এইক্ষেত্রে আরো বেশি মারাত্মক। সারাদিন সন্তানকে বুঝিয়ে দেওয়া তার যোগ্যতা নেই। ক্লাস সেভেনের ছেলে মাঠে নামল ক্রিকেট খেলতে, বাবা তাকে সচীন বা সৌরভের সাথে তুলনা করে বললেন, কই ওদের মত যোগ্যতা কই? এই বলটা সচীন হলে খেলত জানিস তো? উফ্..., আমি ভাবতেই পারি না, কবে যে হবি? ক্লাস নাইনের ছেলে গান গাইতে বসল, বাবা অমনি লাফিয়ে উঠে বলল, আরে এ গান তো দেবব্রত বিশ্বাসের, আহা এরকম হয় না, দেবব্রত'র মত হচ্ছে না, মান্না দে'র মত হচ্ছে না, রফি'র মত হচ্ছে না... ইত্যাদি ইত্যাদি।

       এই অতি কঠোর অবাস্তব সমালোচনা সন্তানের মেরুদণ্ডটাকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দেয়। অনেক সময় মা সেই জায়গাটায় একটা সুব্যবস্থা আনেন, অথবা মা রূঢ় অতি-অবাস্তব সমালোচক হলে বাবা একটা সাম্যাবস্থা আনেন। কিন্তু যখন দু'জনেই একই কাজ করেন, বা একজনও প্রতিবাদ করেন না, তখন সন্তানের গভীরে ঢুকতে থাকে – সে আসলে কিছুই পারে না। আত্মনিন্দার বিষনদী।

       অতি-প্রশ্রয় আর অতি-সমালোচনা – এ দুটোই অবশেষে সন্তানের মনে একটা ধারণা তৈরি করে বসে, আমায় নিয়ে আমার বাবা খুশি নয়। অথচ যে অ্যাপ্রিশিয়েশানটা ছোটোবেলায় প্রথম বাবা-মায়ের কাছ থেকেই সন্তান আশা করে, যা ক্রমে তার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়, আত্মপরিচয় তৈরি করে। বারবার অন্যের সাথে তুলনা কিম্বা বারবার অতি-ভালোবাসার জালে আটকে সন্তানের দুর্বলতা তৈরি করে সেই দুর্বলতার গর্তে নিজের স্বপ্নের বীজ রোপণ করে দেওয়াটা একটা অপরাধ। কারণ সে বীজ শুকিয়ে মরলে সে দোষী, আর সে বীজে গাছ জন্মালেও সে গাছ তো তার নিজের স্বপ্নের নয়, তাই নিজের জীবনে সে পরবাসী। এ দুই-ই ভীষণ সাংঘাতিক অপরাধ। সামাজিক অপরাধ।

 

ধর্ম ও সমাজ

==========

“জানো আমি কিছুতেই আটকাতে পারি না, তোমার বৌদি পাশে শুলেই আমার মধ্যে কামের বোধ জেগে যায়, আমি সামলাতে পারি না আর। অথচ দেখো ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলছেন, দুটো সন্তানের পর ভাইবোনের মত থাকতে। আমার যদিও একটা, কিন্তু আর নেবো না তো দু'জনেই ঠিক করে ফেলেছি, তা হলেও কেন বলো তো বারবার এই ভুল হয়ে যাচ্ছে?”...।

 “আমার একটা ছেলেও সন্ন্যাসী হল না দেখো! ছোটোবেলা থেকে ওরা বেলুড় মঠে যাতায়াত করে, এত বড় বড় মহাপুরুষদের প্রণাম করে। সন্ন্যাসী মানেই তো ঈশ্বরের কাছে পৌঁছে গেছে বলো। রামকৃষ্ণদেব কি বলতেন? কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে সংসার। আমার ছেলে দুটোই তাতে ঢুকল, দু'জনেই বিয়ে করল। মঠে গেলে ওইসব মহারাজদের দেখলেই আমার মনে হয় যদি আমার সন্তানেরা অমন হত! আমার তো কিছুই হল না সারাজীবন, শুধুই সংসারের পাঁক ঠেলে গেলাম।“

 

       ধর্মের মধ্যে একটা মোহ আছে – শুদ্ধতার মোহ, জ্ঞানের মোহ, ঈশ্বর দর্শনের মোহ। বস্তুগত কারণে জন্মানো মোহ ভাঙার তাও একজন মানুষের সারা জীবনে কখনও কখনও সুযোগ আসে। কিন্তু শুদ্ধতা, জ্ঞান-ভক্তি, ঈশ্বর দর্শনের মোহ ভাঙতেই চায় না। যেহেতু ক্রাইটেরিয়া মাপা হয়ে গেছে যে "মানুষের জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরলাভ", এবং সে ঈশ্বরলাভ করতে যে পরিমাণ ধৈর্যরেতা, মানে বীর্যসঞ্চয়ী হতে হয়, তা আধুনিক ইন্টারনেট যুগে অত্যন্ত সুকঠিন বলে আরেক ধরণের আত্মনিন্দা জন্মায়। কাল্পনিক অশুদ্ধ জীবনযাপনজনিত আত্মনিন্দা, এ অনেকটা দার্শনিকের আত্মনিন্দা। আমি সংসার ত্যাগী সাধু হলাম না, আমার কাম জয় হল না, আমার ঈশ্বরদর্শন হল না ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে এদের সংখ্যা কম। আমার মনে হয় এরাই সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় ঠাকুর-দেবতার ছবি পোস্ট করে, নিজেদের প্রোফাইলে কোনো মহাপুরুষ বা দেব-দেবীর ছবি দিয়ে রাখে, এবং নানা মহাপুরুষের বাণীজীবী হয়ে সারাদিন বাণী পোস্টাতে থাকে। নইলে সত্যিকারের ভালোবাসায় বিজ্ঞাপন থাকে নাকি? যার মধ্যে কামজাত অপরাধবোধ যত বেশি তার মধ্যে শুদ্ধ জীবনের জন্য পাগলামিও তত বেশি। এ ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব। মানুষের শুদ্ধতা বলতে একটাই, কারোর ক্ষতি না করা, নিজেরও ক্ষতি না করা। এর বাইরে যা আছে তা সবই মনের বিকারজাত শুদ্ধতানুশীলন। কিন্তু এই সহজ বোধটা নানা ধর্মীয় গ্রন্থ ও নানা মহাপুরুষের কাঁড়ি কাঁড়ি মিথ্যাকথা, অবান্তর আজগুবি জীবনীগুলো শেষ করে দেয়।

       এরপর আসে নানা সামাজিক মানদণ্ড। আশার কথা এই যে তা ক্রমে শিথিল হচ্ছে। আগে যেমন পদে পদে মানুষ সামাজিক মানদণ্ডভ্রষ্ট হচ্ছে বলে নিজেকে দোষারোপ করে করে গ্লানিতে শেষ হত, ইদানীং তা হয় না। শুধুমাত্র বৈধব্য নিয়েই কত জলঘোলা হয়েছে সে কথা স্মরণ করালেই আমার বক্তব্য পরিষ্কার হবে আশা করি। কিন্তু এখনও নানা উদাহরণ আছে। যেমন কোনো দম্পতির বাচ্চা না হওয়া, কোনো মানুষের যৌনপছন্দে সংখ্যালঘু হওয়া, বেশি বয়সে জীবনসঙ্গী খুঁজতে যাওয়া ইত্যাদি নানা বিষয়ে সমাজ আজও কি খুব মুক্তমনা? নানা প্রশ্নে তাকে জর্জরিত করে তুলবে। ভিক্টিম যে, সে মরমে মরে গিয়ে বেঁচে থাকবে। তার মনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কৃত্রিম অপরাধবোধ। তাকে মনের মধ্যে একঘরে দেওয়া। তার আত্মনিন্দাকে উস্কে উস্কে তার স্বাভাবিক বাঁচাকে বিপন্ন করে তোলা।

 

সোশ্যাল মিডিয়া

=============

"কত মানুষ কত কিছু পারে, আমি কিচ্ছু পারি না। ও কত ভালো পারে! আমি একদম পারি না। ওর কত লাইক, কত কমেন্টস, কত শেয়ার – আমার কই? আমার আগের লেখায়/ছবিতে/ভিডিওতে কত লাইক, কত কমেন্টস, কত শেয়ার – এবারে কই?"

       এই সোশ্যাল মিডিয়া একটা মিথ্যা সহজলভ্য সেলেব্রিটিবোধ তৈরি করে দেয়। যেন আমি একটা বিশেষ কিছু। এ একটা নেশা। কিছু মানুষের বাহবা, প্রশংসা, ভালোবাসায় নিজেকে ক্রমে উপরে তুলতে তুলতে বাস্তবতার বোধ হারিয়ে ফেলা। এ ভয়ানক। কি মারাত্মক মাত্রায় ক্রমশ মানুষ ডিপ্রেশানে চলে যায় তার আশানুরূপ স্বীকৃতি না পেয়ে, আবার কি সাংঘাতিক একটা ইউফোরিয়ায় ভাসে কিছু ভাইরাল হলে, তা অহরহ দেখছি।

       নিজেকে নিয়ে নিজে তুষ্ট থাকা, নিজেকে নিয়ে নিজে ব্যস্ত থাকা ইত্যাদির অভ্যাস না গড়ে তুললে বিপদ। এইসব মিডিয়ায় যে সঠিক বন্ধু পাওয়া যায় না তা বলছি না, কিন্তু নিজের পরিমণ্ডলে, নিজের নন-ভার্চুয়াল জগতে যদি নিজেকে নিঃসঙ্গ, অযুক্ত রাখি, তবে ক্রমে আমার মধ্যেই একটা আমার ছায়াময় অস্তিত্ব তৈরি হয়, যে লাইক-শেয়ার-মন্তব্যের স্ট্যাটেস্টিক্সে বাঁচে-মরে। এ এক নতুন ধরণের অবসাদ, নতুন ধরণের আত্মহননের ধারা। আরেক ধরণের অসুস্থতার খাদ তৈরি করে নিজের মনের মধ্যে নিজের অজান্তেই।

 

লক্ষণ

=====

অবসাদ। সিদ্ধান্ত-হীনতা। রাগ। ক্ষোভ। অস্থিরতা। অমনোযোগী হয়ে পড়া। সম্পর্ক গড়তে বারবার ব্যর্থ হওয়া।

 

উপায়

=====

সক্রেটিস বলতেন মানুষের শ্রেষ্ঠজ্ঞান হল আত্মজ্ঞান। এ আমাদের প্রাচ্যের আত্মজ্ঞান নয়। বাস্তবিকভাবে আত্মজ্ঞান। নিজেকে ভালোভাবে বুঝতে চেষ্টা করা, জানতে চেষ্টা করা। নিজেকে যত স্পষ্টভাবে বোঝা যায় তত যে-কোনো ধোঁয়াশা কাটতে শুরু করে সহজেই।

       বুদ্ধ বলতেন, স্ব-অনুকম্পার অভ্যাস। নিজেকে ক্ষমা করার কথা। খুব কঠিন কাজ। কিন্তু ধীরে ধীরে করে ফেলতে হয়। নিজেকে গভীর থেকে ক্ষমা না করলে নিজের মুক্তি নেই নিজের কাছেই।

       রামকৃষ্ণদেব বলতেন, নিজেকে পাপী পাপী বলতে থাকলে শেষে পাপীই হয়ে যায়।

       যদি ঈশ্বরে সত্যিই খাঁটি বেমতলব বিশ্বাস থাকে, তবে সহজ উপায় হচ্ছে, নিজের বিচারের ভার নিজে না নিয়ে, তাঁর হাতেই ছেড়ে দেওয়া – “আমার বিচার তুমি করো তব আপন করে”। আর যদি না থাকে, তবে "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী 'পরে", এই কথাটা ভাবতে থাকা।

       এর বেশি হলে অবশ্যই মনোবিদের সাহায্য নেওয়া দরকার।

252
Wed, 09/16/2020 - 15:00

মানুষের প্রয়োজন যে শুধু ভাত-কাপড় আর আশ্রয় তা তো নয়, মানুষের আত্মসম্মানবোধ আছে। যে নীতি মানুষের আত্মসম্মানবোধের চারদিকে পাঁচিল তোলে, মানুষকে নিজের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়, সে নীতি মানুষের চিরকালের নীতি হতে পারে না। মানুষের লোভ আছে, স্বার্থপরতা আছে, ভয় আছে, ক্ষুদ্রতা আছে – এ সব আছে, কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস মানে শুধু এইক'টাই তো নয়। মানুষের পরার্থপরতা আছে, উদারতা আছে, আত্মত্যাগ আছে, সত্যান্বেষণ আছে। যে কারণে সেদিন উচ্চারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ – মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।

       সেই পাপ আজ আমাদের আবার ঘিরে ধরছে। 'মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ' অর্থে এই নয় যে মানুষের সমস্ত অবগুণকে অস্বীকার করা, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো অর্থে মানুষের মধ্যে মানুষের মহত্বের ওপর বিশ্বাস হারানো। মহাত্মা গান্ধী বলছেন, সমগ্র মনুষ্যত্ব একটা সাগরের তুল্য। তার ক্ষুদ্র একটা অংশ কখনও কখনও দূষিত হতে পারে বটে, সমগ্র সমুদ্রটা না, তাই মনুষ্যত্বের উপর বিশ্বাস হারানো যায় না।

       আজকে কথায় কথায় হার্ড ইম্যিউনিটির কথা শুনছি। গোষ্ঠী অনাক্রম্যতা। গোষ্ঠী অনাক্রম্যতাই মানুষকে রক্ষা করতে পারে, এমন কথা শোনা যাচ্ছে। এই গোষ্ঠী কথাটাকেই চিত্তের জগতে 'মনুষ্যত্ব' বলি আমরা। কোনো একজন মানুষ যখন বিশেষ কোনো ক্ষমতায় পারঙ্গম হয়, তখন তাকে আমরা প্রতিভা বলি। আর যখন কোনো একজন মানুষের মধ্যে এই গোষ্ঠীসত্তার অনুভব জাগ্রত হয় – তখন তাকে আমরা মনুষ্যত্ব বলি।

       আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি – সব কিছু যদি মানুষের এই মনুষ্যত্বের বোধকে খর্ব করে, তবে তা পাপ। কিভাবে খর্ব করে?

১) যখন মানুষ নিজের শ্রমের মর্যাদা ভুলে ‘পাইয়ে’ দেওয়ার নীতিতে অভ্যস্ত হতে চায়। রাজতন্ত্র আর গণতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য শুধু সিংহাসনের অধিকার নিয়ে নয়। অধিকারের তারতম্য নিয়েও হয়। রাজতন্ত্রে প্রজার ভালোমন্দের ভার সম্পূর্ণ রাজার উপর থাকে, গণতন্ত্রে জনগণের ভালোমন্দের ভার থাকে তার নিজের উপর। সে একজন নেতা ঠিক করে কোনো মানুষকে সামনে রেখে না, একটা আদর্শ নেতৃত্বকে সামনে রেখে। আদর্শ নেতৃত্ব তখনই সম্ভব যখন প্রতিক্ষণে সে নিজেও জাগ্রত থাকে, সচেতন থাকে নিজের বৃহত্তম স্বার্থের দিকে তাকিয়ে। মানুষের বৃহত্তম স্বার্থ তার মনুষ্যত্বের রক্ষা ব্যতীত আর কিছুই হতে পারে না। তার ভোগ, তার উচ্ছৃঙ্খলতা কোনোদিন তাকে দীর্ঘস্থায়ী মঙ্গলের দিকে নিয়ে যেতে পারে না, এ ইতিহাস সাক্ষী। কত সভ্যতা নিজের ধ্বংস নিজে ডেকে এনেছে শুধুমাত্র এই চিত্তের গোষ্ঠী অনাক্রম্যতাকে অস্বীকার করে। নিজেকে সর্বোত্তম ভেবে, নিজের ভোগকে একমাত্র পুরুষাকার ভেবে, নিজের ভবিষ্যতকে একমাত্র জীবনের লক্ষ্য করে। মানুষ একার মধ্যে একা কোনোদিন সার্থক হতে পারে না। মানুষ নিজের মধ্যে সমষ্টিকে না দেখতে পেলে সে আর যেই হোক, নেতৃত্বের আসনে বসার যোগ্য সে নয়। আজ সে বিভাজন স্পষ্ট।

২) বিভাজন - অতিমূল্যায়ন ও অবমূল্যায়নের দ্বারা---

সত্যের স্বভাবের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য থাকে। অতি ও অব – এ দুই থেকে সে নিজের অবস্থান পৃথক রাখে। সুনেতৃত্বের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল – সঠিক মূল্যায়ন। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। কোনো এক গোষ্ঠীর অতিমূল্যায়ন ও কোনো এক গোষ্ঠীর অবমূল্যায়ন যদি ক্রমাগত হতে থাকে তখন বুঝতে হবে শুধু নেতৃত্বই দোষদুষ্ট নয়, সমগ্র দেশের চেতনায় একটা অবসাদ এসেছে। জড়ত্বের অবসাদ। মানুষের ইতিহাসে এই জড়ত্বের অবসাদের গভীরতম বীজটি যা রোপণ করে তা হল 'ধর্ম'।

       ধর্ম তখন মানুষের অযৌক্তিক আকর্ষণ, অযৌক্তিক ভালোবাসা, অযৌক্তিক আস্থা, অযৌক্তিক বিবিক্ততা, অযৌক্তিক আত্মমর্যাদা, যখন ধর্ম মনুষ্যত্বের ধ্বজাধারী না হয়ে ধর্ম কোনো গোষ্ঠীর ধ্বজাধারী হয়ে ওঠে। সে তখন আত্মমোহে, আত্মমদে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে সে ভুলে যায় চিরকালের অবিনশ্বর অক্ষয় মনুষ্যত্বের সত্যধর্মেরই সে বাহক। নিজেকে ক্ষুদ্র করে, নিজেকে তীব্র উগ্র করে সে এমন তাণ্ডব ঘটাতে শুরু করে যাকে এক কথায় বলা যায় প্রলয়। তখন আসে চিত্তের অবসাদ। জড়ত্বর স্বভাব। সত্য যেখানে গ্রহণের দ্বারা আচ্ছন্ন সেখানে অবমূল্যায়ন আর অতিমূল্যায়নের খেলা চলতেই থাকে। ‘গ্ল্যাডিয়েটর’ সিনেমার কথাটা স্মরণ করাতে চাই। রাজা যখন দেখলেন সত্যধর্মে চলার ক্ষমতা তার নেই, তখন তিনি সমগ্র রাষ্ট্রে চিত্তের জাগরণের পথ রুদ্ধ করে প্রবৃত্তির লালসাকে চরিতার্থ করার দরজা খুলে দিলেন। মনুষ্য চরিত্রের দুর্বলতা সম্বন্ধে তিনি জ্ঞাত ছিলেন। মানুষ সেই প্রবৃত্তির উন্মাদনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিল। জাগ্রত চিত্ত যে প্রশ্ন করে, উন্মত্ত প্রবৃত্তি সে প্রশ্ন করে না। সেই থেকেই জন্ম নেয় মোহ ও ভ্রান্তির রাজত্ব।

৩) মোহ ও ভ্রান্তির রাজত্ব---

মোহ সত্যকে চায় না, তথ্যকে চায়। 'পোস্ট ট্রুথ' বলে যে শব্দটা শুনি, আসলে ওটা 'পোস্ট কাস্টমাইজড ফ্যাক্টস'। সত্যকে বিকৃত করা যায় না। তথ্যকে যায়। কারণ তথ্যের একটা সংগতি ও ধারাবাহিকতা থাকে। সেই সংগতি ও ধারাবাহিকতাকে নষ্ট করে দিয়ে, কিছুদিনের জন্য একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা যায়। আজকের দিনে আমাদের নানা মিডিয়া ও নানা নেতৃত্ব যে কাজটি করে চলেছে। সংবাদের গুরুত্ব, ভাবনার গুরুত্ব, আলোচনার গুরত্ব – সত্যের হাতে না, মোহের হাতে। আমাদের ঘোর তৈরি করে দিতে হবে। আমি আরেকটা সিনেমার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই – ইনসেপশান। কোনো ধারণাকে কারোর অবচেতনের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া, তার অজান্তেই। যাতে সে তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। তার মস্তিষ্কের মধ্যে একটা স্বচ্ছ অবাস্তব অলীক রূপ যদি এঁকে দেওয়া যায় তার নিজের সম্বন্ধে, যদি বৃহৎ মনুষ্যত্বের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথাটা ভুলিয়ে দেওয়া যায়, তবে তাকে দিয়ে যা খুশী করিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। তার মধ্যে যে সব উপাদানে এই ধারণা তৈরি করা যেতে পারে, তার উৎকৃষ্ট উপাদানগুলি হল – ধর্ম, সংস্কৃতি আর ভাষা। তাকে বলো, “এইগুলোতে তুমি অনন্য, বৃহৎ মনুষ্যত্ব থেকে এর মূল্য তোমার জন্য আলাদা। এই তোমার পরিচয়।“

       কিন্তু শুধু সীমা টেনে দিলে হবে না তো, চাই প্রতিপক্ষ। তাই কিছু প্রতিপক্ষ দাও দাঁড় করিয়ে। যারা হবে তার শত্রু। যারা তার মৌলিকত্ব, অস্তিত্বকে নাকি প্রতিমূহূর্তে বিপন্ন করতে চাইছে এমন গল্প শুনিয়ে দাও, বাকি কাজটা তারাই করে নেবে। এইবার সরে এসো। তোমার বারুদ ঠাসা হয়ে গেছে।

       মানুষের ব্যক্তিসত্তা আর সমষ্টিসত্তার বোধের মধ্যে যখন বিরোধ ঘটে তখন অনায়াসেই এই কাণ্ডটি ঘটানো যায়। সে যখন ভুলে যায় এই মহাসাগরের সে একটি বুদবুদ মাত্র, বুদবুদ হয়ে বা একটা দীঘি হয়ে সে আত্মগৌরবে কোনোদিন চিরপ্রতিষ্ঠ হতে পারবে না, তখন সে এমন নেতৃত্বের কথা বারবার শোনে, যে তাকে তার গুহার মুখে শিকার দিয়ে যায়। সমস্ত জঙ্গলের উপর যে তার স্বাভাবিক জন্মজাত অধিকার, তাকে ভুলিয়ে দেওয়া হয় সুচতুর কৌশলে। তার দুর্বলতাকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।

       একদিন আমাদের কল্পনায় দেব-দেবী ছিলেন তেত্রিশ কোটি। আমরা বুঝেছিলাম কোথাও একটা সত্যের কাছাকাছি নেই আমরা। অবশেষে আমাদের ধারণায় এলেন ব্রহ্ম। যিনি সমগ্র। যাকে নানা অলৌকিক ক্ষমতা থেকে মুক্ত করে বললাম, তিনি সত্য, চেতনা ও আনন্দ। আমরা চিত্তে মুক্তি পেলাম।

       আজ আবার চিত্তে মুক্তি পাওয়ার দিন এসেছে। ব্রহ্মকে জানার মাধ্যমে না, গণকে জানার মাধ্যমে। গীতায় বলা হয়েছে সমগ্রের দৃষ্টিই যার দৃষ্টি, সমগ্রের শ্রবণ যার শ্রবণ, সমগ্রের হস্ত-পদ যার হস্ত-পদ, তাকে জানার কথা। এ তো গণ অভ্যুত্থানের কথা। এ দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়ে কোন মধ্যযুগীয় ধর্মের দিকে আমরা চলেছি? সত্য দুই। এক লৌকিক; আর দুই, চিরন্তন। এই দুইয়ের সামঞ্জস্য যিনি ঘটান তিনি সার্থক কবি, সার্থক নেতা, সার্থক দার্শনিক। যিনি ভোলান, তিনি নন। সাধু সাবধান!

       মানুষ সত্য থেকে সত্যতর-তে যায়। ক্ষুদ্র সত্য থেকে বৃহৎ সত্যের দিকে যায়। অভিধানে তাই true, truer, truest --- এই তিনটি শব্দ পাওয়া যায়। কিন্তু false, falser, falsest --- বলে কোনো শব্দ হয় না। কারণ যা নেই আদতে, তার আর -তর/তম হয় কি করে? যা আছে তারই -তর/তম হওয়া সম্ভব। মিথ্যাকে নিয়ে ভয় নেই, ভয় হল ক্ষুদ্র সত্যকে চূড়ান্ত সত্য বলে সেখানেই বসে পড়ার সিদ্ধান্তকে। যত তাড়াতাড়ি এ ঘোর ভাঙে তত মঙ্গল।

253
Sat, 09/05/2020 - 10:55

 (আজ শিক্ষক দিবস। কিছু জিনিস শেখানো যায়, কিছু যায় না। জীবন যত্ন নিয়ে শিখিয়ে দেয় অনেক কিছু, যা মানুষের ভাষা শেখাতে পারে না। এ লেখাটা লিখে ফেললাম আমার খুব কাছের কিছু বন্ধুদের তাড়নায়। ভালোবাসা তো আতসকাঁচের মত, অতি ক্ষুদ্রকে অতি বৃহৎ করে দেখার ক্ষমতা তার আছে।

অতএব লিখেই ফেললাম। লিখবার ধারাটি সম্পূর্ণ আমার মত করে বানিয়ে নিয়েছি, যে ভাবে বলতে আমার সুবিধা হবে সেইভাবে।)

=================

জ্ঞান – ১। বস্তুগত বা প্রকাশিত (Explicit Knowledge); ২। আত্মগত বা অপ্রকাশিত (Tacit Knowledge)

       আমি যা জানি তা কি চাইলেই জানাতে পারি? যেমন কাউকে 'সাইকেল' চিনিয়ে দিতে পারি। কিন্তু কি করে সাইকেল চালাতে হবে সেই জ্ঞানটাকে কিভাবে একজনকে দিতে পারি? সেটা তাকে নিজে নিজে শিখে নিতে হবে।

       মানুষের প্রকৃতিতে তিনটে বড় দিক আছে বলা যায়--- ১। বুদ্ধি, ২। নীতি, ৩। অনুভূতি

 

  পর্ব – বুদ্ধি

 

=========

বুদ্ধিগত জ্ঞানকে আমি বলতে পারি বিনিময়যোগ্য। আজকাল একটা কথা শুনি, KT --- Knowledge Transfer, অর্থাৎ, যে জ্ঞান বিনিময়যোগ্য। যেমন শুনি কেউ একটা নির্দিষ্ট পদে কাজ করতেন, তিনি যখন সেই পদ ছেড়ে অন্যত্র যাচ্ছেন, তখন সেই পদে নতুন আসা মানুষটাকে তার জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন। এখানে একটা কথা একটু বলে নেওয়া যেতে পারে, এই যে জ্ঞানটা তিনি অন্য মানুষের সাথে বিনিময় করে নিচ্ছেন, সেকি শুধু তথ্য, না অভিজ্ঞতাও? যেমন কেউ যখন সাইকেল চালানো শিখছে, তখন যেমন তাকে দুই চাকায় ভারসাম্য রাখার কৌশলটা নিজেকেই শিখে নিতে হচ্ছে, কিন্তু আমি যখন তাকে বলছি মোড় এলেই আগে বেল দিবি, তখন আমি কি আমার অভিজ্ঞতা তার সাথে শেয়ার করছি, না তাকে কোনো তথ্য দিচ্ছি? বলা যেতে পারে আমার অভিজ্ঞতালব্ধ তথ্য দিচ্ছি। তবে এও একটা তথ্যই, যা আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছি। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতা আহরণের কৌশলটা শেখাতে পারছি না, সে তাকে নিজেকেই শিখে নিতে হবে।

       এই বুদ্ধিগত জ্ঞানের ক্ষেত্র অনেক আছে, অবশ্যই বিজ্ঞান তার মধ্যে একটা বড় রাজ্য। তারপর সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতিবিজ্ঞান, ব্যবসা ইত্যাদি সমস্তই এই বিশাল অংশের অন্তর্গত।

 

পর্ব – নীতি

==========

'নীতি' শব্দটা ঠিক যাচ্ছে না। কথাটা হবে নৈতিকতাবোধ। বিবেকবোধ। একজন মানুষের উচিত-অনুচিত বোধ। যার শাখায় ধর্ম, দর্শন বেড়ে উঠেছে। পুষ্ট ও অপুষ্ট দুই-ই করে এসেছে।

       এই বোধটাকে কি আমরা কাউকে শেখাতে পারি? এই প্রশ্নের মীমাংসা নিশ্চয় একবাক্যে হবে না। আমাদের সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা – এর কোনোটাই খুব সদর্থক কিছু বলে না। প্রথম কথা, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যে কিছুতেই একটা মানুষকে নৈতিকভাবে উন্নত করতে পারে না, তার প্রথম প্রমাণ প্রতিটা পরীক্ষাকেন্দ্রে প্রহরার নিখুঁত ব্যবস্থার প্রয়াস। যারা পরীক্ষা দিতে আসছেন, তারা যেন অসদ উপায়ে পরীক্ষা না দেন তার প্রয়াস। অর্থাৎ, শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বিবেকের উন্নতির গ্রাফটা সমান অনুপাতে বাড়ে না।

       তবে আমাদের সভ্যতার উন্নতি বলতে আমরা কি বুঝব? গুহা থেকে আজকের বহুতল নানা সুখ-সুবিধাযুক্ত আবাসন, চিকিৎসা ইত্যাদি নানা শাখায় উন্নতিকে আমরা কি বলব? অবশ্যই সভ্যতার উন্নতি। কিন্তু কোথাও একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, সে বিষয়ে গভীর আলোকপাত অবশ্যই করে গেছেন সত্যজিৎবাবু তার ‘আগন্তুক’ সিনেমায়। সভ্যতাকে প্রশ্ন করছেন জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। সভ্যতাকে নানা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন। আপাত মনোহর তত্ত্বগুলোকে নেড়ে ঘেঁটে তাদের অসারতায় দাঁড় করাচ্ছেন। শুধু ‘আগন্তুক’ নয় অবশ্যই, শাখা-প্রশাখা, গণশত্রু – শেষ এই তিনটি সিনেমাতেই মানুষের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্ন করেছেন সত্যজিৎ রায়।

       মানুষের সততার বোধ ও সহানুভূতির বোধ অতি প্রাচীন। এর কোনোটাই সে বাইরে থেকে শেখে না। এ বোধ সে নিয়ে জন্মায়। সততার বোধ আর অনুকম্পার বোধকে একত্রে আমরা নৈতিকতার মূল বলে থাকি। সেই সততার বোধ আর অনুকম্পার বোধকে কিভাবে কোন ক্ষেত্রে আমরা প্রয়োগ করতে পারি সেই নিয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক যুগে নীতিবিজ্ঞান বা এথিক্স। কিন্তু এর মূলে ওই দুটো শব্দই – সততার বোধ আর নৈতিকতার বোধ। সেই বোধের প্রতি কোনো ব্যক্তির আগ্রহ বা সহজ প্রবণতা থাকবে কি থাকবে না সে জটিল মনস্তত্বের ব্যপার, কিন্তু বোধটা থাকবেই।

       এতএব এই দুই বোধকে আমরা পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার প্রাচীন সাহিত্যে খুঁজে পাব, এবং আজকের দিনে দাঁড়িয়েও আমাদের এই উত্তর আধুনিক সভ্যতায় তার প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাব। সে সক্রেটিসের কথাই হোক, কি উপনিষদের গল্প।

 

পর্ব – অনুভূতি

===========

আমাদের অনুভূতির রাজ্য। ঠিক তা নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাইছি না। আমি বলতে চাইছি আসলে আমাদের আবেগের রাজ্যের কথা, বা আমাদের প্যাশনের কথা। প্যাশনের বাংলা কি বলি বলুন তো? অস্থির করে তোলা আবেগ? ঠিক হচ্ছে না। উত্তুঙ্গ আবেগ? কেমন একটা ভায়োলেন্ট শোনাচ্ছে না? ঠিক আছে, বরং 'প্যাশন'ই বলি, যার শাখায় সাহিত্য, শিল্প, সিনেমা ইত্যাদি সৃষ্টি হয়ে আসছে কালে কালে।

       এই প্যাশন কি আমরা কাউকে শেখাতে পারি? ক'দিন আগে আমাজনে একটা ওয়েব সিরিজ দেখলাম। আমার ভীষণ ভালো লাগল, বন্দিশ-ব্যাণ্ডিট। সেখানে নাসিরুদ্দিন তার নাতিকে গান শেখাতে গিয়ে বলছেন, তোমার গানে টেকনিক্যাল দিক ঠিক আছে, কিন্তু প্যাশন কম, বড্ড কেঠো। আমার মনে পড়ল 'বৈজু-বাওরা' সিনেমার কথাটা, “দর্দ লাও”। প্যাশন নিয়ে এসো।

       কিন্তু কিভাবে? কেউ তো কারোর প্যাশন কাউকে দিয়ে যেতে পারে না। পারে কি? না। আবার দেখুন এই প্যাশনও আমাদের সভ্যতার ইতিহাসের আগের থেকেই একই রয়ে গেছে। আমাদের হাসি-কান্না-সুখ-দুঃখ ইত্যাদি যা কিছু আছে, তা সে প্রাচীন কাল থেকেই আছে। হ্যাঁ, আমরা কালের সাথে সাথে কিছুটা সংযত হতে শিখেছি বটে, তাও তেমন একটা খুব গভীরে গিয়ে কি? তা নিশ্চয় নয়। আমাদের একটা প্যাশন আছে – ভয়। সেই ভয়ের দাপটে আমরা বেশ খানিকটা সংযত হতে বাধ্য হয়েছি বটে। পুলিশ, আইন-আদালত ইত্যাদি নানা উপকরণ আমাদের সমাজের চারদিকে প্রহরার মত জেগে আছে আমাদের সংযমকে টিকিয়ে রাখবে বলে।

       কিন্তু আমাদের হৃদয়বৃত্তির মূল ও মৌলিক উপাদানগুলো কি কিছু পরিবর্তন হয়েছে বলুন? আমি যখন প্রাচীন তামিল কবিতা 'কুরোন্তোকাই' পড়ছিলাম, নরনারীর প্রেমবিহ্বল সেই পদে কি আমি রস পাইনি? পেয়েছি তো। কিম্বা আরেক প্রাচীন তামিল সাহিত্য থিরুকুরালে প্রেমের যে বর্ণনা রয়েছে, সেকি আজকের নর-নারীর হৃদয়বৃত্তির চাইতে আলাদা? মোটেও নয়।

       কিন্তু এ ক্ষেত্রেও একই কথা – যে বোঝে, সে বোঝে।

 

উপসংহার

========

সিদ্ধান্ত

------------

দেখা যাচ্ছে, আমাদের বৌদ্ধিক সত্তা ছাড়া, বাকি যে দুই সত্তা – নীতি ও আবেগ – এই দুইকে আমরা প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি একই স্তরে দেখছি। অবশ্যই যেভাবে আমি সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছি সেই দৃষ্টিভঙ্গীতে।

       কিন্তু বৌদ্ধিক রাজ্যে আমরা ক্রমে অগ্রসর হয়েছি। আজকের বিজ্ঞানের সাথে অবশ্যই দুশো বছরের আগের বিজ্ঞানের প্রচুর পার্থক্য। কিন্তু আজকের কবিতা আর প্রাচীন কবিতায় ভাষার আর প্রকাশের পার্থক্য থাকলেও অনুভবের কোনো পার্থক্য অবশ্যই নেই। আর রইল নৈতিক বোধ, সেখানেও সত্যের প্রতি ও অনুকম্পার প্রতি আগ্রহকেই ধর্মের মূল কথা বলা হয়েছে। কোনো ধর্মই মানুষকে মিথ্যাবাদী ও নিষ্ঠুর হতে শেখায় না। তবে মানুষের সভ্যতার মূল কথা হল বিজ্ঞানের আর কিছুটা সংযমের প্রতিষ্ঠা। বাকি মূলগতভাবে সবটাই এক। আমরা আমাদের বাইরেটাকে আরো সুখ-সুবিধায় ঢেলে দিয়েছি বিজ্ঞানে, আর আমাদের প্যাশনকে বা এক্ষেত্রে অন্ধ-আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেছি নানা সামাজিক বিধিতে।

       বুদ্ধির উপজীব্য – সত্যের বা ফ্যাক্টের অন্বেষণ। নীতির উপজীব্য – নৈতিক সাধু জীবনের অন্বেষণ। আবেগের উপজীব্য – আনন্দ ও চিত্তসুখের অন্বেষণ।

 

পর্যবেক্ষণ ও প্রশ্ন

---------------------

আমাদের আজকের সমাজে প্যাশন ও বুদ্ধিগত চর্চা তুঙ্গে। কিন্তু নৈতিক জীবনের উপর আগ্রহ কম। ধর্ম তার অন্ধতায় প্যাশনের সাথে হাত মিলিয়েছে। সত্য ও অনুকম্পার চাইতে তার বিচরণ রাজনৈতিক রাজ্যেই বেশি। বাংলায় একটা কথা আছে – ভ্রষ্ট হওয়া। বুদ্ধি ও প্যাশন দু'জনেই যখন নীতিবুদ্ধি বা বিবেকবুদ্ধির হাত ছেড়ে যায় তখন সে নিজেই নিজের ক্ষতিসাধন করে বসে। দু'জনেই মাত্রা ঠিক রাখতে পারে না। অবশ্যই তা রাখার কথাও তাদের নয়।

       তবে প্রশ্নটা কি? আমি আগে বলেছি কাউকে নৈতিক জীবনে বাইরে থেকে চেষ্টা করে ফেরানো যায় না, এবং এও বলেছি, কাউকে প্যাশনও শেখানো যায় না। এই দুটোই হল অ-বিনিময়যোগ্য জ্ঞান বা বোধ।

       কিন্তু যায় তো, এমন উদাহরণও তো আছে। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, রামকৃষ্ণ, চৈতন্য প্রমুখ মানুষদের সংস্পর্শে এসে মানুষের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনের কথা তো আমরা জানি। ইতিহাস তার সাক্ষী। আজও এরকম ঘটনার সাক্ষী যে হই না, তা তো নয়। অনেককেই শুনেছি, অমুকের প্রভাবে তার জীবনের গতিপথ ভালোর দিকে ফিরে গেছে। তবে সে কিসের শক্তিতে? এর উত্তর হয় তো 'চরিত্রশক্তি'।

       মানুষ সুখী হয় কিসে? জ্ঞানে, প্রেমে, না বোধে? এর উত্তর হয় তো, বোধে। একজন বোধসম্পন্ন চরিত্রশক্তি হয় তো অপর একজনের বোধকে প্রভাবিত করতে পারে। বুদ্ধিগত তত্ত্বশিক্ষায় যে কিছু হয় না সে আমাদের চারদিকের বর্তমান পরিস্থিতিই সাক্ষী। কিন্তু একজন সঠিক চরিত্রের মানুষ অনেকগুলো চরিত্র গঠন করে দিতে পারে এর উদাহরণও আছে। তবে সেও নিশ্চয় এক শক্তি।

       আবার এমন মানুষ আছে যারা অন্যের আবেগকে দারুণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন যে কোনো পথের নেতা গোছের মানুষ। একজন মানুষ অনেক মানুষকে যখন প্রভাবিত করে, সে জনতার আবেগের উপর তা করে থাকে। সে মানুষ ভালো-মন্দ দুই হতে পারে। ইতিহাসে এমন দুই ধারার নেতার উদাহরণ প্রচুর।

       কিন্তু বোধকে প্রভাবিত করে এমন মানুষের সংখ্যা সবসময় মুষ্টিমেয়। কিন্তু সেই পারে একটা যুগের গতি ফিরিয়ে দিতে। আমরা যাকে বলি সংস্কারক।

       প্রশ্ন হল, সে সংস্কারক তৈরি হয় কিসে? এর উত্তর এক মহাকাল ছাড়া কেউ দিতে পারে কি?

254
Fri, 08/28/2020 - 09:57

 

আমার চিন্তা কতখানি আমার চিন্তা? আমার চিন্তা কতখানি আমার বাসনা, ভয়, ঈর্ষা ইত্যাদি দ্বারা প্রভাবিত? আমার আবেগের বাতাসে উড়িয়ে নেওয়া চিন্তা আর আমার যুক্তির লাগামে বাঁধা চিন্তা কি এক?

       বলা হয় আমি যা তা হলাম আমার চিন্তার সমষ্টি। আমার চিন্তার কতখানি আমি? আমার চিন্তা কতবার আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে গেল আমার বাসনা? আমি কোনো কিছুর বশবর্তী মানে হল আমার চিন্তাশক্তি আমার হাতে নেই। আমার আবেগের হাতে চলে গেছে রিমোট কন্ট্রোল। সে যা ভাবাচ্ছে আমি তাই ভাবছি। ভালো চিন্তা, খারাপ চিন্তা বলে কিছু হয় না, সে চিন্তা করার ক্ষমতা কতটা আমার হাতে সেটাই সব চাইতে বড় কথা।

       চিন্তা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমার বাসনা, ঈর্ষা, রাগ, ভয় সবাই এসে চিন্তার দরজায় দাঁড়ায়। বলে দাদা আমার এদিকে আসুন, আপনি আমার হয়ে একটু কিছু সৃষ্টি করে দিন। চিন্তা আমার দিকে একবার তাকিয়ে আমার অনুমতি বা প্রশ্রয় চেয়ে নেয়। ব্যস, এইটুকু ভুলই আমার দ্বারা হয়। আমি তাকে বলি যা, কিন্তু ততক্ষণই যতক্ষণ আমার সুখ লাগে, আরাম লাগে। কিন্তু তা কি হয়? বাসনা, ঈর্ষা, ভয়, রাগ সবাই এই বলে আমার কাছ থেকে চিন্তাকে নিয়ে যায় যে আমার হাতে কিছুক্ষণের জন্য দাও, দেখবে কি দারুণ সুখে রাখব তোমায়, আমাদের শক্তিতে এমন এমন সব সৃষ্টি করব যে তুমি তাজ্জব হয়ে যাবে। ব্যস, আমি লোভে পা দিয়ে দিলাম। চিন্তা আমার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এর ওর হাতে পড়ে খাবি খেতে শুরু করল। শুরুটা আমিই যে আমার লোভের বশে শুরু করলাম তা ভুলে গেলাম। তারপর ওদের হাতে চিন্তার পাকে নিজেই জড়িয়ে জড়িয়ে নিজের মধ্যে বিধ্বস্ত হতে শুরু করলাম। সুখ? কোথায় সুখ? কোত্থাও বিন্দুমাত্র সুখ নেই। আমিই আমার চারদিকে বিষাক্ত পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছি শুধু আমার অন্ধ আবেগগুলোর হাতে চিন্তাকে তুলে দিয়ে। আমি যে চেতনার আলোতে বাঁচি, সেই চেতনার আলো ক্রমশ ঢাকা পড়তে শুরু করল আমার চিন্তার মেঘের আড়ালে। আমি অন্ধকারে এসে পড়লাম। আমার চেতনা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমার কিছু করার নেই যেন, কাউকে দায়ী করার নেই, এ খেলা তো আমিই শুরু করেছিলাম।

       এই সময়ে ধৈর্য চেতনার ত্রাতা হয়ে আসে। সে বলে তুমি নিজেকে ওই চিন্তার মেঘের জাল থেকে বিচ্ছিন্ন ভাব। ওগুলো চিন্তাই শুধু। তোমার নানা অন্ধ আবেগের জ্বালানীতে জ্বলে উঠছে। তুমি তোমার অন্ধ আবেগের হাত থেকে বাঁচতে পারো, শুধু নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবো। চিন্তার সব সুতোটা কখনওই ওদের হাতে যায় না। একটা খেই সব সময় চেতনার হাতে ধরা থাকে। সে সেই খেই খুঁজে পায় না এই মেঘের আড়ালে গিয়ে। ধৈর্য সেই খেই খুঁজে দেয়। চেতনা ধীরে ধীরে আবার নিজের চিন্তাকে অন্ধ আবেগের থেকে মুক্ত করতে শুরু করে। চিন্তাকে সরিয়ে আনলে অন্ধ আবেগের শক্তিক্ষয় হতে শুরু করে। কারণ চিন্তার শরীরে না ঢুকলে ওরা কর্ম ক্ষমতাহীন। চিন্তা যত চেতনার আলোতে এসে দাঁড়াতে শুরু করে আবেগের শক্তি হ্রাস হতে শুরু করে, সে আবার তার অন্ধকার গুহায় ঢুকতে শুরু করে, চিত্তে আবার শান্তি আসতে শুরু করে।

       এর মধ্যে সব চাইতে কঠিন সময় হল যখন চিন্তা অন্ধ আবেগের সম্পূর্ণ বশে চলে এসেছে তখন। যেন বালিঝড় উঠেছে। যেন ধুলোঝড় উঠেছে। চারদিকে কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। এই সময়টা সব চাইতে কঠিন সময়। নিজের মধ্যে এইটুকু বিশ্বাসও যেতে শুরু করে যে আমার একটা স্বাধীন সত্তা আছে। আমি আমার অন্ধ আবেগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অসহায় একটা সত্তা নই। আমার চেতনা আছে। আমার বোধশক্তি আছে। আমারই প্রশ্রয়ে, আমারই দুর্মতিতে আমার আজ এই হাল। তখন কেউ প্রার্থনা করে, কেউ শান্ত হতে চেষ্টা করে ধৈর্য ধরতে চেষ্টা করে। তার একটাই কারণ আমাদের এইটুকু বোধ থেকেই যায় আমাদের চেতনার হাতে আমার চিন্তার একটা খেই আছেই আছে। তাকে খুঁজে পেলেই সমাধানের সূত্র বেরোয়। কিন্তু তাকে যে আমি পেতেই পারি, এ বিশ্বাস হারিয়ে গেলে সবটুকু হারিয়ে গেল। তখন আমার বাইরে থেকে সাহায্য লাগে। যে আবার আমার সেই সূত্রটুকু খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। সে আমার মধ্যে আবার সেই বিশ্বাসটা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে যে আমার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণের খেইটা আমি কখনও সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলতে পারি না। আমি শান্তিতে থাকতে পারি – এই বিশ্বাসটাই একমাত্র আমায় শান্তিতে রাখতে পারে। কোনো কৌশলে নিজেকে শান্ত করতে গেলে মনের গভীরে উদ্বিগ্নতার ঢেউয়ের উথাল-পাথাল চলতেই থাকে। সে বরং আরো খারাপ।

       এ এক যেন জীবনব্যাপী অভ্যাস। নিজের চিন্তার কারখানায় অন্ধ আবেগের জীবাণু না ঢুকতে দেওয়া। দিলেই সব গোলমাল করে যাবে। সংসারে আমার বলতে যদি সত্যিই কিছু থাকে, সে আমার এই চিন্তা করার ক্ষমতাটুকু। বাকি এ শরীর থেকে শুরু করে এই গোটা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে আমার ইচ্ছার কোনো মূল্য নেই। সেখানে শুধুই সমঝোতা, মেনে নেওয়া। তো এই চিন্তার স্বাধীনতাটুকুও যদি আমার অন্ধ আবেগের হাতে চলে যায়, তবে আমার বলে আর কি থাকল? আলো আর অন্ধকার, চেতনাশক্তি ও অন্ধ-আবেগের শক্তি দুই আমাদের মধ্যে আছে। মহান দার্শনিক কান্টের মতে এই আলোর দিকে ফিরে চিন্তার সুতো বাড়িয়ে দেওয়াকেই বলে আলোকিত হওয়া, যাকে ইংরাজিতে বলে enlightenment. তাকে কোথাও বাইরে খুঁজতে যেতে হয় না, চিন্তাধারার মুখটাকে ফিরিয়ে দিতে হয় কেবল। নইলে এই এক চিন্তাকেই তুলসীদাস বলছেন চিতার সমান, আবার এই এক চিন্তাকেই গীতা বলছেন, না চিন্তা করলে সুখ কোথায়? এমন স্ববিরোধী কথা হয় কি করে? হয়, চিন্তার প্রভুত্ব কার হাতে, তার উপরে নির্ভর করেই সবটা। সেই গানটা আছে না,

 

আর রেখো না আঁধারে, আমায় দেখতে দাও।

তোমার মাঝে আমার আপনারে দেখতে দাও।।

কাঁদাও যদি কাঁদাও এবার, সুখের গ্লানি সয় না যে আর, হায় রে,

নয়ন আমার যাক-না ধুয়ে অশ্রুধারে-

আমায় দেখতে দাও।।

জানি না তো কোন্ কালো এই ছায়া,

আপন ব'লে ভূলায় যখন ঘনায় বিষম মায়া।

স্বপ্নভারে জমল বোঝা, চিরজীবন শূন্য খোঁজা- হায় রে,

যে মোর আলো লুকিয়ে আছে রাতের পারে

আমায় দেখতে দাও।।

 

255
Thu, 08/13/2020 - 13:30

পথ নিয়ে দুটো কথা বলেছেন, এক, মত পথ বই আর কিছু নয়। দুই, শালাগুলো সারাদিন পথের কথা নিয়েই কাটায়, ডুব কেউ দেয় না।

       কথা দুটো রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব মহাশয়ের। যিনি একটি মহৎ ভুল করেছিলেন, মতকে পথ বলে। যত মত তত পথ – বলে যে স্লোগানটা ওনার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হল।

       রামকৃষ্ণদেব ভুল করেছেন? হ্যাঁ করেছেন। তিনি জানতেন মত মানে পথ। পথ কার লাগে? উনি নিশ্চয় ভেবেছিলেন পথ লাগে পথিকের বা যে চলতে চায় তার জন্যেই লাগে পথ। কিন্তু পথের দুই ধারে যে ব্যবসা করা যায় সেকি উনি জানতেন? না জানতেন না। কারণ? কারণ উনি বলে না, যে কোনো অমন ধরণের মানুষ জন্মেছেন, তাঁরা কেউই ধারণা করতে পারতেন না মানুষ এতটা ত্যাঁদড় প্রকৃতিরও হতে পারে।

       আদতে সত্যিই কি আমরা পথ চাই? মনে হয় কেউ চাই না। আমরা সেই পথের ধারে দোকান ঘর কিনতে চাই। বড় বড় ব্যবসায়ীরা বড় বড় দোকান ফেঁদে সেইখানে বড় বড় হোটেল খুলে ফেলেছেন। সেখানে কি নেই? সমস্ত রকম স্পিরিচুয়াল বিনোদনের ব্যবস্থা আছে। সেখানে সেলামি দিলে আপনিও ছোটো দোকান খুলতে পারেন আশেপাশে। কিম্বা তাদের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়ে আপনি অন্যত্রও ব্যবসা খুলে বসতে পারেন। কিন্তু পথ দিয়ে এগোতে চাইবেন না, ওইতেই যত গোল। একটা ক্ষুদ্র নাটিকা ভাবা যাক--

       ধরুন কেউ অমনধারা পুরুষ সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, যেই না তার নামের হোটেলটা সে পার হচ্ছে অমনি কেউ এসে রাস্তা আটকে বলল, কি মশায়, কই চললেন? আরে এদিকে আসুন, আপনার পাথরের ইয়াব্বড় মূর্তি বানিয়েছি তবে কিসের জন্য? তাকে গৃহবন্দীই করেছি কি শুধু? সাজাইনি কি নানা ফুলে? আসুন দেখে যান। অকারণে চলে ফিরে বেড়াবেন যদি তবে এত দামী মার্বেল দিয়ে এতবড় হোটেল বানাতে গেলুম কেন?

       সে মানুষ যদি বলে, উঁহু, বসার কথা তো আমি বলিনি! আমি বলেছি চরৈবেতি, চরৈবেতি। মানে এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো। অমনি হোটেলের প্রধান এসে বললেন, আহা সে ব্যবস্থাও আছে, দেখবেন চলুন।

       উনি আবার বিশ্বাস করে হোটেলে ঢুকলেন। গিয়ে দেখেন, ওমা! একটা বড় গোল করা, তাতে নানা মানুষ সেই গোলের পরিধি বরাবর ঘুরেই যাচ্ছে, ঘুরেই যাচ্ছে। উনি থমকে বললেন, একি চলা? এতো ঘুরেই যাচ্ছে, একটা জায়গায় পাক খাচ্ছে!

       হোটেলের মালিক বলল, সেই তো চাই, চলা নিয়ে কথা, ওরাও জানে ওরা একটা খেলা চাইছে, একটা কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাইছে, যাতে এই কঠিন, নিষ্ঠুর, দয়ামায়াহীন সংসারে কিছু একটা নিয়ে ভুলে থাকতে পারে। তবে বলুন, ঠিক করিনি? এতে অন্তত ওরা কিছু একটা নিয়ে তো থাকছে, হ্যাঁ কি না?

       কিন্তু এতো অন্ধকূপ? আলো কই? এত ঘুরে তো অবশেষে যেই মানুষ সেই মানুষই থাকবে, এতে কি হবে?

       ভুল বললেন। মোটেও একই মানুষ থাকবে না। ওরা গোঁড়া হবে আরো। যত গোঁড়া হবে তত কথায় জোর আসবে, তত আত্মবিশ্বাস বাড়বে, তত অন্যকে ভুল জেনে নিজেকেই একমাত্র ঠিক বলে জানবে, যুক্তির কথা শুনবে না, শুধুমাত্র ওই বইটার কথা শুনবে।

       কোন বই?

       কেন আপনার কথা নিয়ে যে বইটা লেখা হয়েছিল, সেই বই। ওদের বলে দিয়েছি উনি যা বলে গেছেন তাইতেই সব সত্যি আছে...

       মানে আমার মৃত্যুর পর থেকে সত্যের প্রকাশ হওয়া বন্ধ হয়ে গেছে, এই বুঝিয়েছ ওদের? হা কপাল! কিন্তু এতে তো ওদের বোধবুদ্ধি লোপ পাবে!

       পাক, তাতেই ওরা শান্তি পায়, ওরা বলে আমাদের এমন কিছু একটা দিন যাতে আমরা সংসারের সব জ্বালা ভুলতে পারি। আর কিছু না। আমাদের আর কিচ্ছু চাই না....... আমরা ওদের এই ধর্ম ধর্ম আধ্যাত্মিক খেলা দিয়ে দিই, একটা বই, একটা মূর্তি আর কয়েকটা শব্দমালা... ব্যস, ওরা ঘুরে ঘুরে খেলে, খেলে খেলে ঘোরে। ওরাও শান্তি পায় আর আমরাও ট্যাক্স পাই।

       কিসের ট্যাক্স?

       কেন? এই খেলাটা শেখানোর ট্যাক্স!

       কিন্তু তোমরা ওদের বলো না যে সত্যতে থাকলে, কাউকে হিংসা না করলেই মানুষের চূড়ান্ত মঙ্গল...

       হো হো... এসব কথা বললে মশায় আপনার মত হাল হত আমাদের... মাত্র বছরে দু'সেট জামা, গাড়ি বাড়ি নেই, কোনো আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, কোনো সুখ-বিলাস নেই। ওই চৌকিতে শুয়ে কুঁজোয় গড়িয়ে জল খেয়ে সারাদিন ঈশ্বর চিন্তা করে, এর তার সাথে বকে বকে জীবনটা ব্যর্থ হত আমাদের!

       কিন্তু তোমাদের ওরা বিশ্বাস করে কেন?

       করবে নাই বা কেন? প্রথমত আপনাকে আমরা সামনে রাখি.....

       আমাকে না, আমার মূর্তিকে...

       ওই হল, ওদের কাছে আপনার চাইতে ওই মূর্তি-ছবিই ভালো, নইলে আবার কাকে চড় মারবেন, কাকে চুলের মুঠি ধরে বার করবেন, কাকে বাঁশ নিয়ে তাড়া করবেন, কার দোকানপত্র ভাঙবেন... তার চাইতে ছবিতে মূর্তিতে চুপ করে বসে থাকেন, আমরা যা ইচ্ছা করে যাই। এই ভালো নয় কি?

       আমার মাথা ঘুরছে...

       সে ঘুরবেই... যা বলছিলাম... ওদের আমরা বুঝিয়েছি... আমরা যা করি তা মনের মধ্যে অনাসক্তভাব থেকেই করি, বাইরের এই সবই মায়া... এতে আমাদের কিছু মন নেই...

       আমাদের নাটিকাটি এখানেই শেষ হল। এইবার ভাবুন, কেন রামকৃষ্ণদেব আসার পরেও এত ধর্মে ধর্মে দলাদলি, বা এই এত বাহ্যিক আড়ম্বরের বাড়বাড়ন্ত। কারণ উনি একটা মস্ত ভুল করেছিলেন। পথ বলেছিলেন। কেউ পথ চায় না। কারণ কারোর কোথাতেও যাওয়ার নেই। সবাই একটু জিরোতে চায়। বিশ্রাম চায়। সারাদিন খাটাখাটনির পর এসে ভালো কয়েকটা কথা শুনে ঘুমিয়ে পড়তে চায়। তাই কয়েকটা ভালো কথা বলতে পারা লোকের কাছে এত মানুষের ভিড়। কিন্তু যেই কঠিন কথা, বা কাজের কথা বলবে, অমনি বন্ধু বিগড়ে যাবে। পথ চাই না আমাদের, আমাদের হোটেল দাও। এই হল গিয়ে কথা।

       এখন আপনি যদি পথকে সরিয়ে হোটেল রাখেন। দেখবেন হিসাব সোজা। কম্পিটিশানের ভাবটা চলে এলো। লাভ-ক্ষতি ভাবটা চলে এলো। মাঝে মাঝে ফিল্যানথ্রপিক কাজ করার ভাবটা চলে এলো। দলাদলি, কপটতা, বিজ্ঞাপন, আত্মজ্ঞাপন - ইত্যাদি কোনো শব্দতেই আর আপনার অসুবিধা হচ্ছে না (মানে যদি আপনি যুক্তিবুদ্ধির মানুষ হন), সব শব্দ চেনা এখন। জানা। কারণ মূল কথাটা বদলে নিয়েছেন, পথ না, পথের ধারে হোটেল।

256
Mon, 08/10/2020 - 12:00

দর্শন আর ধর্মের উদ্দেশ্যের মধ্যে একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। দর্শন জ্ঞান ও সত্যের খোঁজ। ধর্ম শান্তির অন্বেষণ। সত্য, জ্ঞান আর শান্তির একত্র অবস্থানও যে হয়নি তা নয়। পাশ্চাত্যে স্টোয়িক দর্শন মনে হয় এর একমাত্র উদাহরণ। স্টোয়িক দর্শনের সূত্র সক্রেটিসের ভাবনা, দর্শন ও জীবনবোধের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলেও, এর সম্পূর্ণ রূপ তৈরি হয় জেনোর মাধ্যমে। তারপর এপিকটেটাস, অরেলিয়াস ও সেনেকার মাধ্যমে মহীরূহ আকার ধারণ করে। স্টোয়িক দর্শনের মূল কথাটা হল আত্মনিয়ন্ত্রণ। অনেকটা গীতার স্থিতপ্রজ্ঞের মত, যে সুখে-দুখে-সম্পদে-বিপদে স্থিরচিত্ত হবে, নির্বিকার হবে। সেনেকার চিঠিপত্র, অরেলিয়াসের মেডিটেশান, এপিকটেটাসের নানা লেখার সংকলন – বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। এদের মধ্যে এপিকটেটাস কোনো এক ধনীর দাস ছিলেন। তার আত্মতন্ময়তা এমন হয়ে পড়ত মাঝে মাঝে যে তার কাজের ক্ষেত্রে তা বিঘ্ন ঘটাত। তার মালিক তাকে শারীরিক নিগ্রহ এমন পর্যায়ে করত যে তিনি নাকি প্রায় পঙ্গুই হয়ে পড়েছিলেন। অবশেষে মালিক হাল ছেড়ে এপিকটেটাসকে মুক্তি দেন, তিনি একটা স্কুল খোলেন, দর্শন শিক্ষা দেওয়ার জন্য। অরেলিয়াস ছিলেন সম্রাট। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের মনকে শান্ত রাখার জন্য নিজের জীবনবোধের যে গভীরে অবগাহন করেছিলেন, সেই জীবনবোধের সাক্ষ্য বহন করছে তার অসামান্য গ্রন্থ, ‘মেডিটেশান’। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নাইপালের বিখ্যাত বই, ‘দ্য হাউস ফর মিস্টার বিশ্বাস’ এ বারবার উল্লিখিত হয়েছে এই বইটার নাম। সেনেকা ছিলেন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, গভীরভাবে স্টোয়িক দর্শনে বিশ্বাসী। এমনকি তার মৃত্যুও হয় রাজরোষে। শিরাগুলো কেটে জলপূর্ণ বাথটবে শুয়ে প্রাণত্যাগের হুকুম হয়। তিনি সেইভাবেই মারা যান, শান্তভাবেই।

       এই হল মোটামুটি স্টোয়িক দর্শনের কথা পাশ্চাত্যে। এরপরের বাকি সব পাশ্চাত্য দর্শন মূলত বুদ্ধিগত, জীবনে কোনো অনুশীলনের দাবি রাখে না। কিন্তু প্রাচ্যে ভাবনাটা অন্যরকম। “শান্তম শিবম অদ্বৈতম” কথাটার মধ্যেই যেন মূলসুরটা। প্রথমে শান্ত হও, তারপর মঙ্গলে নিজেকে নিয়োজিত করো ও ভেদহীন মানসলোকে এ বিশ্বসংসারকে অবলোকন করো একের মধ্যে। এ হল দর্শন ও শান্তির একত্রে অন্বেষণ। ভারতীয় ষড়দর্শনের কথা যদি সরিয়েও রাখি আপাতত, তবু প্রাচ্যের যে তাও-দর্শন ও জেন-দর্শনের কথা আছে, সেখানেও মূল উপপাদ্য হল শান্তি। তাও আর জেন গভীর জীবন দর্শন, বহু প্রাচীন। জেন যদিও বৌদ্ধদর্শনেরই একটা শাখা। আমাদের এখানে যেমন দক্ষিণ ভারতের কবি-দার্শনিক থিরুভাল্লাভুরের লেখা ‘থিরুকুরাল’, খুব অল্প আলোচিত হয় উত্তরভারতে, বা বাংলায় তো প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যায়। যদিও থিরুকুরাল তাও-দর্শনের এর মত অতটা প্রাচীন নয়, কিন্তু এর গভীর চিন্তা অবশ্যই বিশ্ব সাহিত্যে এক মূল্যবান সম্পদ।

       ভারতীয় অন্যান্য দর্শনের মধ্যে প্রধান যে উপনিষদ, সেখানেও প্রতিটা উপনিষদের শুরুতে শান্তিপাঠ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমাদের মূল লক্ষ্য সেই জ্ঞান, যা আমাদের শান্ত করে। জ্ঞানের পরমগতি চিত্তের শান্তি। বুদ্ধের মতে যার চূড়ান্ত নির্বাণ, গীতার মতেও তাই, দৃঢ়-প্রতিষ্ঠ শান্তি। ইসলাম অর্থেও শান্তি। শিখধর্মের কথাতেও তাই।

       অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠা হল ধর্মের মূল উদ্দেশ্য। নিজের মধ্যে, নিজের বাইরে। বাইবেল বলছে, তুমি যদি শান্তিস্থাপক হও, তবেই তুমি ঈশ্বরের সন্তান। এই হল মূল কথা। যে ধর্মের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না, বুঝতে হবে আদতে তা ধর্ম নয়। তা হয় কোনো কাল্ট, বা মত, বা কোনো গোষ্ঠীর প্রথাগত বিশ্বাস মাত্র। যা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাই ধর্ম। কথাটাকে ঘুরিয়ে বললে তাই দাঁড়ায়, এবং আমাদের বোধের পক্ষেও সহজ হয়। বুদ্ধ বলছেন যদি একটা গাথা পড়ে তোমার হৃদয় শান্ত হয়ে যায় তবে জানবে সেই গাথাই তোমার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ। রামকৃষ্ণ বলছেন, যত গঙ্গার দিকে যাবে তত দেহ শীতল হবে। কোরান বলছেন, সমস্ত মনুষ্যজাতি এক ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ, নিজেদের মধ্যে শান্তিকে প্রতিষ্ঠিত রাখো। খুশবন্ত সিং নাস্তিক বিদগ্ধ পণ্ডিত মানুষ, একটা বই সংকলন করেছিলেন, ‘দ্য ফ্রি থিংকারস প্রেয়ার বুক’, দুর্দান্ত পুস্তিকা একটা, বিশ্বের নানা মূল্যবান ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে বিশেষ করে শান্তি-মৈত্রীর বার্তাবহ উদ্ধৃতিমালা।

       আজ আমাদের নতুন দর্শনের কতটা প্রয়োজন জানি না। কিন্তু শান্তি প্রতিষ্ঠা একান্তভাবে কাম্য। ধর্ম মানে শান্তি। ধর্ম মানে কোনো বিশ্বাসের গোলামি নয়, নিজের বিবেকবুদ্ধি কারোর পায়ে জলাঞ্জলি দেওয়া নয়, কোনো প্রথা প্রাচীন বলে, বহুমানুষ দ্বারা পালিত বলেই তার অন্ধ অনুকরণ নয়, কোনো ঈশ্বরে বাধ্যতামূলক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গল্প নয়। মহাত্মা বারবার বলতেন, শান্তি শুধু লক্ষ্য নয়, শান্তি পথও।

       কেউ যেন আমাদের কোনো লোভে, মোহতে ধর্মের নাম নিয়ে না ভোলায়। পৃথিবী ধর্মশূন্য হবে না। না হোক, সে মঙ্গলজনকও হবে না। কারণ তবে বহু উচ্চ-উদার হৃদয় নরনারী ইতিহাস থেকে হারিয়ে যাবে, বহু উচ্চমানের চিন্তা-ভাবনাও হারিয়ে যাবে। ধর্ম বলতে যেন আমরা শুধুই শান্তিকেই বুঝি। যা করলে, যা বললে, যা শুনলে, যা ভাবলে, আমার শান্তি, আমার পারিপার্শ্বিকের শান্তি, তাই ধর্ম। যা কিছু শান্তি পরিপন্থী তা কিছুতেই ধর্ম হতে পারে না। কবীর বলতেন, এমন কথা বলো যাতে তোমার নিজের মন তো শান্ত হয়ই, অন্যের শ্রবণও শান্ত হয়। সারদাদেবী বলতেন, যদি শান্তি চাও তবে অন্যের দোষ দেখা বন্ধ করো, জগতকে আপন করো।

প্রাণের প্রদীপে বোধের শিখা। প্রদীপের শিখাকে নিভিয়ে যে অন্ধকার সৃষ্টি হয়, সে শান্তি নয়, সে নির্জীব জড়ত্ব। শিখার চঞ্চলতাকে নানা রিপুর আঘাত থেকে রক্ষা করে, স্থির রাখার প্রয়াসই হল শান্তি।

শান্তিই পথ, শান্তিই লক্ষ্য, শান্তিই ভালোবাসা, শান্তিই ভ্রাতৃত্ব, শান্তিই মোক্ষ, শান্তিই ভক্তি, শান্তিই জ্ঞান, শান্তিই রাষ্ট্র, শান্তিই নীতি, শান্তিই সমস্ত জীবনের অমৃত।

257
Sat, 08/08/2020 - 11:37

নেতাজী অন্তর্ধান রহস্যের পর দেশ হয় তো এই প্রথম এতবড় রহস্যের সন্ধান পেল, সুশান্তের মৃত্যু রহস্য। যে রহস্যের সন্ধান কোর্টে, প্রিন্ট-ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়েই চলেছে, হয়েই চলেছে। সে হোক, প্রতিদিন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরোক, লকডাউনে বাঁচার একটা রসদ পাওয়া যাক, সব ঠিক আছে। কিন্তু বর্তমানে আরেকটি যে পালক যুক্ত হল, সাদা পালক না অবশ্যই, কালো পালক, রিয়া চক্রবর্তী। কে দোষী, কে নির্দোষ সে বিচার না হয় কোর্ট করুক, কিন্তু বাকিটা? যার মোদ্দা কথায় ‘আসুন রিয়ার ব্যক্তিগত গোপনীয় জীবনের দিকে উঁকি দিই’ ধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ হেডলাইন? অসহ্য।

       আসলে একজন মহিলার ব্যক্তিগত জীবন পুরুষের সম্পত্তি। তার অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সেই ব্যাসদেবের গপ্পোটা ভাবুন, দুর্যোধনের কি ইচ্ছা হল? দ্রৌপদীকে তার ব্যক্তিগত কক্ষ থেকে তুলে নিয়ে এসে তাকে ভরা সভায় উলঙ্গ করে সে দেখবে। ভীষণ একটা যেন স্বাভাবিক ইচ্ছা। শ্যাওলার মত কিছু অবান্তর সামাজিক রীতিরেওয়াজে পুরুষের এইসব ইচ্ছাগুলোকে ফেন্সিং করা থাকে। সেই ফেন্সিং ডিঙিয়ে যেতে পারাটা পৌরুষ না আইনভঙ্গ? পাঠকমাত্রেই এর উত্তর জানেন। তাই সাইনি আহুজার কেরিয়ারটা মাঠে মারা গেল নিয়ে দীর্ঘশ্বাসযুক্ত পোস্ট, পেজ থ্রি কভারেজ দেখি।

       দুটো শব্দ – ব্যক্তিগত আর গোপনীয়, পারসোনাল আর প্রাইভেসি। একটা কথা কি জানেন, প্রাইভেসির কোনো বাংলা ঠিকঠাক হয় না। আমরা প্রাইভেসির বাংলা করেছি গোপনীয়তা। তবে সিক্রেসির বাংলা কি হবে? অর্থাৎ প্রাইভেসি বলে কোনো শব্দের প্রয়োজন যেন আমরা অনুভব করিনি। ওই যে আছে না, “তুমি জন্ম হইতেই বলিপ্রদত্ত”, এর অর্থ আমরা এইরকম করে নিয়েছি, তুমি সমাজের জন্য জন্মেছ, তোমার জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটি সমাজ ঠিক করে দেবে, তোমার নিজের বিবেক-বিচার-শখ-আহ্লাদ-ইচ্ছা-বাসনা সব ঠিক করে দেবে সমাজ। তুমি তো সব কিছুর নিমিত্তমাত্র। তোমার নিজের অস্তিত্ব কোথায়? তুমি তো এই মহাকালের সমুদ্রে একটা বুদবুদ মাত্র। প্রাইভেসি বলে কোন শব্দ আমরা তাই আমাদের অভিধানে ঠাঁই দিইনি। হুম, ‘অন্দরমহল’, ‘অন্তঃপুর’ বলে কিছু কিছু শব্দ বানিয়ে দিয়েছি, যে শব্দের সুরটা গোপনীয়তার ইঙ্গিতে বাজে। সেই গোপনীয়তা রক্ষা করাকে জেনো আমার মার্জিত পৌরুষ আর সেই গোপনীয়তা ভেঙে ঢুকে পড়া আমার অমার্জিত পৌরুষ। মোদ্দা কথাটা এই দাঁড়ালো যে তোমার গোপনীয়তা রক্ষা করার সব ভার আমার। তাই মাঝে মাঝে সমাজ যদি ভুল করে সেই গোপনীয়তা ভেঙে ঢুকে পড়ে তবে আশ্চর্য কিছু হোয়ো না, অমনটা মাঝে মাঝে হতেই পারে। তোমার পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক হলেও, অস্বাভাবিক নয়।

 

       একজন মহিলার পার্সোনাল ব্যাগ ভীষণ একটা চাপা কৌতুহলের বিষয়। ফিসফিসানির বিষয়। আসলে কি আছে ওর মধ্যে? স্যানিটারি ন্যাপকিন তো থাকবেই, যখন তখন পিরিয়ড শুরু হয়ে যায় না!? আহা রে চুক... চুক... চুক...। কণ্ডোম? থাকতেই পারে, হাঁটাচলা চোখের যা চাওনি, ওসব থাকলে বিচিত্র কিছু নয়।... আরে না না ওনার ব্যাগে কণ্ডোম থাকতে পারে না, কি শুদ্ধ, কি পবিত্র দৃষ্টিটা না? যেন তাকালেই মা মা একটা ভাব, ওনার ব্যাগে তুলসীপাতা, মধু, কথামৃত, জপের মালা এইসবই থাকবে, তাই না রে? আর ওই মহিলার দেখ কালো ব্রা-টার স্ট্র্যাপটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, লাল ব্লাউজের ফাঁক দিয়ে, কিভাবে ঘেমেছে দেখ, আরে বগলের পাশ থেকে দেখ, ক্লিভেজ ভিজে একাকার নিশ্চয়।...        এই গোপনীয়তাকে ভেঙে ফেলার ইচ্ছা আসলে আমাদের অভিযানের লালসা। কারণ ওই যে বললাম, মহিলার ব্যক্তিগত জীবন হয় না, গোপনীয় জীবন হয়। আর সেই গোপনীয়তাটাও আমারই জন্য সুরক্ষিত করে সে রাখে, কবে আমি তার সেই গোপন দুনিয়ার একছত্র অধিপতি হব। সব মহিলাই এই চায়, এই জন্যেই তারা অপেক্ষা করে। কিন্তু তারা এমনি এমনি তার সেই গোপনীয়তা আমায় দিয়ে দেবে বুঝি? আমাকে তা লড়ে নিতে হবে, সে চায় তা, আমরা জানি। তাই তো জোর খাটালে সে কপট রাগ দেখায়, কিন্তু আসলে সে চায় আমি তার গোপনীয়তা ছিনিয়ে নিই। কারণ একজন মেয়ের পক্ষে সম্ভব একটা এতবড় ভার একা বহন করার? কক্ষনোও না। তার গোপনীয়তা তো তার নিজের নয়! তাই মাঝে মাঝে আমার জোরটা এত বেশি হয়ে যায়, বেহিসাবী হয়ে যায়, সমাজ তখন তাকে বলাৎকার, ধর্ষণ ইত্যাদি নামে ডেকে কি একটা পলিটিক্যাল কারেক্টনেস দেখায়। আসলে তো সবাই জানে, ব্যাপারটা আমি ঠিকই করেছিলাম, কারণ ওই যে, মহিলার ব্যক্তিগত বলে কিছু হয় না, সবটাই গোপনীয়, যা তার নিজের নয়, আমার ভোগের সামগ্রী, আমার পৌরুষের জোরেই একমাত্র যা সুরক্ষিত। আর হবে নাই বা কেন? তার বাড়িঘর পরিবার সব কিছু থেকে যখন আমি তাকে আমার পরিবারে আনছি, তার মানেই তো তাকে আমি ছিন্নমূল করে দিচ্ছি, তাই না? তবে তার আর ব্যক্তিগত কি থাকল? সবটাই তো আমার।

 

       এই হল আমাদের বিবেকের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া অন্ধকার, অনালোকিত মানসিকতা। ‘টাইট্যানিক’ সিনেমার শুরুতে একটা কথা ছিল, আমার স্পষ্ট মনে নেই, তবে অল্প অল্প মনে আছে, বৃদ্ধা রোজ বলছে, ‘মহিলার হৃদয় সমুদ্রের মত গভীর রহস্যে ভরা।‘ কথাটা আমার সেই বয়সে শুনে খটকা লেগেছিল, আজ বিরক্ত লাগে। কেন পুরুষের হৃদয় কি মরুভূমির মত স্পষ্ট? সব কিছু দেখা যায়? একদম চারদিকে ধু ধু করছে শুধু বালি আর বালি?

       এইখানেই গোলমাল। রহস্য, গোপনীয়তা। এর সাথে অবশ্যম্ভাবী জুড়ে যে শব্দটা, তা হল অ্যাডভেঞ্চার। সংসারের সমস্ত রহস্য, গোপনীয়তা ভেদ করে জানাকে আমরা তো সেইভাবেই দেখি।

       যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, রিয়া দোষী না নির্দোষ, তা আইন-আদালত জানাক। আমরা আমাদের এই নোংরা, কলুষ, বিকারযুক্ত কৌতুহল থেকে যেন মুক্তি দিই নিজেদেরকে। যেন ব্যক্তিগত আর গোপনীয় – এই দুটো শব্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে –প্রাইভেসি শব্দটার মানে শিখতে শুরু করি। আমাদের অভিধানে না থাক, আচরণে আসুক, ক্রমে অভিধানে এসে যাবে।

 

258
Tue, 08/04/2020 - 21:15

স্বামীজী যে ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন, মহাত্মা গান্ধী যে ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথ যে ভারতবর্ষ চেয়েছিলেন, তার কোনোটাই হয়নি। তাদের চাওয়াতে ভুল ছিল। তারা মানুষের দিকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছেন, সম্পদের দিকে ততটা নয়। মানুষ আগে, সম্পদ পরে। তিনজনেই শিক্ষা বলতে বুঝেছিলেন, চরিত্র। অবশ্যই ভুল বুঝেছিলেন। শিক্ষা মানে স্বনির্ভর হতে পারা। স্বনির্ভর হতে পারা মানে উপার্জনক্ষম হতে পারা। উপার্জনক্ষম হতে পারা মানে নিজের ইচ্ছা শখ বাসনা স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষাপূরণে সক্ষম হতে পারা।


       মানুষকে কে চালায়? শিক্ষা। ভুল। মানুষকে চালায় তার সংস্কার। তার অভ্যাস। ব্যক্তি অভ্যাসকে চালায় পারিবারিক পারিপার্শ্বিক অভ্যাস। পারিবারিক পারিপার্শ্বিক অভ্যাসকে চালায় সামাজিক অভ্যাস। সামাজিক অভ্যাসকে চালায় ঐতিহাসিক অভ্যাস। শিক্ষা মানে ভারতের ব্যর্থ রথীমহারথীরা ভেবেছিলেন সংস্কারকে বদলে দেওয়ার পদ্ধতি। হল না। তাই উপায় একটাই সংস্কারের কোয়ালিটি না বদলিয়ে, তার ইউটিলিটি বদলিয়ে তাকে ব্যবহার উপযোগী করে তোলার ব্যবস্থা করা। তার জৈবিক, মানসিক, বৌদ্ধিক সংস্কারকে ঘাঁটিও না। তথ্য দাও। সে তার সংস্কার অনুযায়ী সে তথ্যকে ব্যবহার করে নিতে পারবে। পশুকে যেমন খাদ্য দিয়ে বশ করো, মানুষকে তেমন তথ্য ও কৌশল শিখিয়ে বশ করো, কাজে লাগাও।

       সংস্কার মানে কি? আত্মকেন্দ্রিক অভ্যাস। নিঃস্বার্থপরতার কোনো সংস্কার হয় না। নিঃস্বার্থপরতা চেতনার জ্যোতি। চেতনার আদি-অন্ত-ভবিষ্যৎ হয় না। চেতনার শুধুই বর্তমান। সংস্কারের আদি হয়, মোটিভ থাকে। চেতনার কোনো মোটিভ থাকে না, চেতনা নিজেই নিজেতে পূর্ণ। চেতনা নিজেই নিজের উপায়। সংস্কার তা নয়, সংস্কার একটা মোটিভ না হলে কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে পারে না। অন্ধকারে গোল গোল ঘোরে। তাই তাকে কাজে লাগাতে একটা নিয়ম বার করা হয়। তুমি আমার কাজ করে দাও, আমি তোমার স্বার্থটা দেখে দেব। আধুনিক শিক্ষাপদ্ধতি এই গিভ এণ্ড টেক পলিসিকে আরো সুক্ষ্ম, আরো ব্যাপক পদ্ধতিতে ব্যবহারের পথ দেখায়। কারণ সে জানে তার চালিকাশক্তি চেতনা নয়, সংস্কারের বুনোশক্তি। তার আলো না, ভোগের সামগ্রী চাই। পথ না, খুঁটি চাই; যাতে বেঁধে দিলে সে গোল গোল ঘোরে, নিজেকে সুরক্ষিত ভাবে।

       চারদিকে তাকিয়ে দেখলে স্পষ্ট বোঝা যায় আমাদের শিল্পসত্তা থেকে শুরু করে যাবতীয় সৃষ্টিশীল কাজের মূল লক্ষ্যই এই আমাদের আদিম সংস্কারকে তৃপ্ত করা। আমাদের গান, আমাদের সিরিয়াল, আমাদের সিনেমা, আমাদের গল্প ইত্যাদি যাবতীয় যা কিছু। খুব মোটা দাগের হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সূত্র একটাই, কনফ্লিক্ট ফ্রি হতে হবে। কিভাবে হবে? জোয়ারে বা ভাটায় ভাসিয়ে দাও নিজেকে। সময়ের সাথে সে নিজের জায়গা খুঁজেই নেবে। শুধু কনফ্লিক্ট তৈরি করো না। মানুষ কনফ্লিক্ট ভালোবাসে না। মানুষ অন্ধ আবেগ ভালোবাসে। রাগ, হিংসা, আকর্ষণকেন্দ্রিক ভালোবাসা ইত্যাদি। মানুষ গিলে খাবে। তার আদিম যত আবেগকে জাগিয়ে তোলো। মানুষকে ঘর দাও। মাঠ দিও না, আকাশ দিও না। মানুষ মরে যাবে।

       কেন কনফ্লিক্ট ভালোবাসে না মানুষ? কারণ কনফ্লিক্ট হল চেতনা আর সংস্কারের সংঘাত। মানুষ ঈশ্বরের গল্প ভালোবাসে, শয়তানের গল্প ভালোবাসে, যুদ্ধের গল্প ভালোবাসে, কেউ একজন হারল, কেউ একজন জিতলে সে খুশী হয়। কিন্তু কনফ্লিক্টের চক্করে সে ক্লান্ত। কারণ চেতনাটা মানুষের সহজাত নয়, সংস্কারটা সহজাত।

       মানুষের ধর্মের দুটো স্পষ্ট দিক আছে। একটা চেতনার, একটা সংস্কারের। যে কোনো ধর্মের চেতনার দিকটা সব সময় প্রাসঙ্গিক, বাকিটা না। কিন্তু সংস্কারের দিকটাকে মজবুত না করলে কোনো ধর্মকে একটা বাস্তবিক সামাজিক রূপও দেওয়া যায় না। শুধু ইন্টেলেক্টে ধর্ম হয় না। তার অনেকগুলো বাহ্যিক অভ্যাসগত আনুষ্ঠানিক দিক তৈরি করতে হয়। তবে সেগুলো মানুষের মজ্জাগত হয়। সেইসব অনুষ্ঠান যুগের পর যুগ থেকে যেতে পারে। তার একটা মোটিভ তৈরি করতে হয়। ওই যে একটু আগেই বললাম, সংস্কারের মোটিভ থাকে, চেতনার কোনো মোটিভ থাকে না। সেই মোটিভ যতই অবাস্তব হোক না, তবু সে একটা নিজের তৈরি খেলা খেলেও একটা ধাতব ট্রফির দিকে ছুটে যাবে। হাতে ধরে বলবে, আমি জিতেছি।

       অন্যদিকে কর্তব্যবোধ। কর্তব্যবোধ মানুষের চেতনাজাত। তাই সেই কর্তব্য সমাধা হতেই মানুষের সার্থকতা। কর্তব্যের কোনো মোটিভ হয় না। সে নিজেকে সম্পূর্ণ করতে পারলেই নিজের মধ্যেই সুখ পায়। কিন্তু মোটিভের দাসত্ব করে যে সংস্কার সে কাজের শেষে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে, তার পুরষ্কার চাই। কারণ যে কাজটা সে করল তার সাথে তার আত্মার কোনো যোগ নেই, আছে তার সংস্কারের। তার লোভের, তার নানা বাসনার। সে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তার মনের মধ্যে জমে থাকা আদিম চালিকাশক্তি সে। তাই দেখা যায় যে মানুষের চেতনার বিকাশ যত অল্প তার সুখ তত বেশি। কারণ সুখ কনফ্লিক্টের বিপরীত। পূর্ণ চেতনার বিকাশ হয়েছে এমন মানুষ বাস্তবে সম্ভব না। তাই আমরা আমাদের থেকে চেতনায় অধিক বিকশিত মানুষের সংস্কারবশত সাধারণ দোষযুক্ত দিকের আলোচনা বেশি করি, সুখ পাই। বারবার করে বলি, ওই তো উনিও তো এরকম করেছিলেন...বা করেন। আবার যার মধ্যে অল্প হলেও চেতনার ডানার ঝাপট জেগেছে, সে বলে, আমি ওর কাছে যে আলো পেয়েছি, সে আমার অনেক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়েছে, আমি কৃতজ্ঞ, সে মহৎ, অন্তত আমার থেকে মহৎ এ আমি বুঝেছি। সে তার দিকে ছুটে যেতে চায়। তার মনে হয় সেই মহতের আলোর মধ্যে তার বুকের মধ্যে আটকা ছটপট করা ডানাদুটোকে সে স্বাধীনতা দেবে। সে যত এগোয় সেই আলোকপ্রাপ্ত মানুষ তার থেকে আরো দূরে সরে সরে যায়, তার ডানার ব্যথা আরো বাড়ে। হঠাৎ শুনতে পায় কেউ যেন বলছে, যে আলোকে খুঁজছ সে আলোর সমুদ্র তোমার ভিতরে। যা জানছ, যাকে জানছ, সে তোমার উদ্দেশ্য নয়, যার মাধ্যমে জানছ, সেই তোমার উদ্দেশ্য। তোমার সংশয়কে যে জানে তাকে প্রশ্ন করো, কে তুমি যে আমার সংশয়কে জানো? যতদিন উত্তর পাবে, ততদিন জেনো সব মিথ্যা। যেদিন কোনো উত্তর পাবে না, সেদিন জেনো আসল উত্তর পেলে।

       কিন্তু এতো হেঁয়ালি।

       আসলেই তাই। কারণ তুমি নিজের কাছে নিজেও এক হেঁয়ালি নও কি? বিশ্বজনীন সূত্রকে পাওয়া বাস্তব। আর বিশ্বজনীন সত্যকে পাওয়ার তাগিদ হল ধর্ম। নানা মতের সংস্কারগত অভ্যাস না। সে কুয়াশা।

       শুরুতেই এই কথাটাই বলেছিলাম, এই আলোর দিকে যে তীর্থযাত্রার কথা তারা ভারতের মাটিতে চেয়েছিলেন, তা হল না। কারণ জীবনটা তীর্থ না, আমোদ। চেতনাপরতা না, আত্মপরতা। আলোর থেকে ছায়ায় সুখ অনেক বেশি। জাগার থেকে যেমন ঘুমে। তাই ভুল ভিত স্থাপনের উৎসবই হোক, আসল ভিত খুঁড়তে কে যাবে?

259
Sat, 08/01/2020 - 18:11


“Goethe মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, Light! More light!... আমি বিশ্বাস করব, অন্যে যা করে করুক; আমি এই দেবদুর্লভ বিশ্বাস কেন ছাড়ব? বিচার থাক। জ্ঞান চচ্চড়ি করে কি একটি Faust (গেটের সৃষ্ট একটা চরিত্র) হতে হবে? গভীর রজনীমধ্যে বাতায়নপথে চন্দ্রকিরণ আসিতেছে, আর Faust নাকি একাকী ঘরের মধ্যে ‘হায় কিছু জানিতে পারিলাম না, সায়েন্স, ফিলসফি বৃথা অধ্যয়ন করিলাম, এই জীবন ধিক্!’ এই বলিয়া বিষের শিশি লইয়া আত্মহত্যা করিতে বসিলেন!... না, আমার এ সব ভয়ানক পণ্ডিতদের মতো একছটাক জ্ঞানের দ্বারা রহস্য ভেদ করতে যাবার প্রয়োজন নাই। আর একসের বাটিতে চারসের দুধ ধরলো না বলে মরিতে যাবারও দরকার নাই! বেশ কথা – গুরুবাক্যে বিশ্বাস। হে ভগবান, আমায় ওই বিশ্বাস দাও; আর মিছামিছি ঘুরাইও না। যা হবার নয়, তা খুঁজতে যাওয়াইও না। আর ঠাকুর যা শিখিয়েছেন, ‘যেন তোমার পাদপদ্মে শুদ্ধাভক্তি হয় – অমলা অহৈতুকী ভক্তি; আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই!’ কৃপা করে এই আশীর্বাদ কর।”


       কথামৃতকার মাষ্টার মহাশয়ের এগুলি স্বগতোক্তি, কথামৃতে লিপিবদ্ধ আছে, ১৮৮৫ সালের ১১ই মার্চ।

       তার ৯ বছর পর, রবীন্দ্রনাথ ছিন্নপত্রে লিখছেন---

“আমি আলো ও বাতাস এত ভালোবাসি! গেটে মরবার সময় বলেছিলেনঃ More light! আমার যদি সে সময়ে যদি কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করবার থাকে তো আমি বলিঃ More light and more space! অনেকে বাংলাদেশকে সমতল ভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরুদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে, যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না – চেয়ে চেয়ে দেখবার এবং দেখে দেখে মনটা ভরে নেবার এমন জায়গা আর কোথায় আছে!”

       কথামৃত ও ছিন্নপত্র দুই-ই শিক্ষিত বাঙালির খুব প্রাণের গ্রন্থ। কথামৃতের প্রভাব ও প্রসার স্বাভাবিক কারণেই বেশি, কিন্তু ছিন্নপত্রের প্রভাবও কম নয়। মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কথামৃতকার, রবীন্দ্রনাথের থেকে মোটামুটি বছর সাতেকের বড়। তিনি যখন এই কথাগুলো লিখছেন তখন ওনার বয়েস একত্রিশ। রবীন্দ্রনাথ যখন এই কথাগুলো লিখছেন তখন তাঁর বয়েস তেত্রিশ।

       বাংলায় দুটো ভাবনার দিক যেন তৈরি হচ্ছে। একজন সনাতন, বিনা বিচারে গুরুবাক্য শিরোধার্য করে চলবার রাস্তায় চলতে চাইছেন। দুই, একজন তাঁর মনের ভাবের সাথে, মনের মাধুরী মিশিয়ে জগতটাকে নিজের ভাবের মাধ্যমে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

       এই কথা বলতে বলতে আমার ত্রিপিটকের একটা গল্প মনে পড়ল। উপাখ্যানটি 'চঙ্কী সূত্র' নামে লেখা, ত্রিপিটকের 'মধ্যম নিকায়'তে---

       একজন ব্রাহ্মণ বুদ্ধের সাথে দেখা করতে এসেছেন। এসে জিজ্ঞাসা করছেন, কেন ব্রাহ্মণেরা বেদের নানা সূত্রকে মেনে চলবে না? সেসব তো মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিদের দ্বারা রচিত। তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় তো অবশ্যই সেসব মেনে চলা উচিৎ।

বুদ্ধ বললেন, আপনি সেইসব মন্ত্রের সত্য প্রত্যক্ষ করেছেন?

ব্রাহ্মণ বললেন, না।

তখন বুদ্ধ বললেন, আপনার গুরু, বা তার গুরু, বা তার গুরু...

ব্রাহ্মণ বললেন, না।

বুদ্ধ বললেন, এ তো অন্ধ প্রবেণীর মত হল। একজন ধূর্ত মানুষ, কিছু অন্ধকে খাওয়ার লোভ দেখিয়ে বাইরে নিয়ে আসে। একজন অন্ধের হাতে লাঠি ছিল, বাকিরা সেই অন্ধের কোমর জড়িয়ে একে অন্যকে অনুসরণ করে চলছিল। এইভাবে কিছুটা নিয়ে এসে সেই ধূর্ত একটা বড় গাছের গুঁড়িকে ঘিরে তাদের গোল করে দাঁড় করিয়ে, প্রথম অন্ধের হাত থেকে লাঠিটা কেড়ে নেয়, আর তাকে শেষ অন্ধের কোমর ধরিয়ে দেয়, বলে হাঁটো তোমরা। এইভাবে তারা সেই গাছটা ঘিরে ঘুরেই যায়, ঘুরেই যায়..., অবশেষে বিনষ্ট হয়ে যায়।

এই হল গল্প। বিশ্বাস বড় বিষম বস্তু। সে মিলায়। তর্ক বড় পাজি, সে নাকি দূরেই রাখে। এ-ও সেই গপ্পো। হার কে পাবে? গণেশ মা-কে ঘুরে গলায় হার পরে বসে পড়ল, কার্তিক সারা বিশ্ব ঘুরে এসে দেখল মায়ের হার তার আগেই গণেশ পেয়েছে। কারণ বিশ্বাস। মা-ই জগত। এরপরে আরো যোগ হল, পাপের থেকে মুক্তির উপায় নির্দিষ্ট তিথিতে নির্দিষ্ট নদীতে স্নান। পুণ্যও নানারকমের হল --- গোমূত্র থেকে উপবাস। অর্থাৎ, বিবেক রইল বিবেকের স্থানে, বিশ্বাস এল শর্টকাট নিয়ে। বিচারের পথ সেদিন থেকেই হল বিমাতা। বিশ্বাসই হল মূল। ক'দিন আগে আমাজনে ‘জাস্ট মার্সি’ বলে একটা সিনেমা দেখলাম। সেখানে আমেরিকার অ্যালাবামাতে কোনো সাদা চামড়ার লোক আঙুল তুলে, মাত্র কয়েক দশক আগেই, যদি কোনো নিগ্রোকে বলত, একে দেখেই মনে হচ্ছে খুনি, তবে সাথে সাথেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। এও বিশ্বাস। গায়ের রঙের উপর বিশ্বাস।

       এক ভারত জানে যুক্তি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না। এক ভারত জানে বিশ্বাসে মাথা নীচু করে নিলে প্রশ্নের মুখে জোঁকের মত নুন পড়ে। যে বিশ্বাসকে স্বীকার করার জন্য প্রমাণ লাগে না, সেই বিশ্বাসকে অস্বীকার করার জন্যও যে প্রমাণ লাগে না, সে তারা মানতে নারাজ। অন্ধ প্রবেণী বয়েই চলে, বয়েই চলে। আমরা অন্ধ জুগিয়েই চলি, জুগিয়েই চলি, জুগিয়েই চলি। জিজ্ঞাসা করি না, আপনি যে আমায় দীক্ষা দিচ্ছেন, আপনি কি আমায় ভালোভাবে চেনেন? আপনি কি নিজে সত্যলাভ করেছেন? আপনি কি আমায় কোনো কাল্টের ভোক্তা বানাচ্ছেন? না সত্যের আলোর দিকে এনে দিচ্ছেন? সত্য কি প্রতিষ্ঠান? অমনি সবাই হাঁ হাঁ করে উঠে বলবে, করো কি? করো কি? ধরো ধরো। কোমর ধরো, আনো গুরুবাক্যে বিশ্বাস।

260
Tue, 07/28/2020 - 10:54

আপনি যদি এখন ঘন ঘন হাত ধুতে যান, হাত স্যানিটাইজ করে দাঁত দিয়ে নখ কাটেন, হাত সাবানে রগড়ে রগড়ে চোখের পিচুটি পরিষ্কার করে, নাক পরিষ্কার করেন, কান খোঁচান - আপনাকে কেউ অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসর্ডার (OCD) আক্রান্ত বলবে না। বলবে আপনি সচেতন নাগরিক। এইভাবেই সময় মানুষের ধর্ম দর্শনের সংজ্ঞা বারবার বদলে দিয়ে এসেছে। পরিস্থিতিই ঠিক করেছে কি ন্যায় আর কি অন্যায়।

       কিন্তু আরেকখান OCD আছে, Obsessive Compulsive Devotion. এদের নিয়েই আজ যত গোল। কিন্তু এই নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। মানে বিচার আছে।

       যদ্দূর শুনিচি মানুষটা অযোধ্যায় সুখী ছিল না গো। ছোটোবেলায় মেলা পড়াশোনার চাপ, অস্ত্রশিক্ষার ঝক্কি। তারপর বনে জঙ্গলে ঘুরে রাক্ষস মেরে মুনিঋষিদের যজ্ঞের সুরাহা করা। যাও বা তার মধ্যে বিয়ে থা করে দেশে ফিরল তো পারিবারিক ক্যাঁচাল। যাও আবার বনে।

       দাঁড়ান জঙ্গল শুনেই আহাউহু করবেন না তো! ওই বনেই কয়েকটা দিন মানুষটা সুখী ছিল গো। চিত্রকূটে। আহা, ছোটো কুটির। চারদিকে পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা। কুলকুল করে নদী বয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের আদিবাসীরা এসে গল্পগাছা করে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। জানকীর সাথে তো দারুণ ভালোবাসা হয়ে গেল সেই সরল সহজ আদিবাসী স্ত্রীলোকেদের। দরশরথনন্দন দুজনেও পরম শান্তিতে নানা তত্ত্বকথা আলোচনা করছেন। জানকীও টেক পার্ট করছেন। রান্নাকরা, স্টারজলসা দেখার হ্যাপা নেই। প্রথমটার কারণ জঙ্গলে অরন্ধন, ফলমূল খেয়ে থাকারই বিধান। আর দ্বিতীয়টার কারণ অত জঙ্গলে ইলেকট্রিসিটিও নেই, আর মোবাইলের টাওয়ারও নেই। তাই ন্যাচেরালি অখণ্ড শান্তি, বিরামহীন অবসর। অনেকটা সময় দুজনে কাছাকাছি, যা মিথিলা, অযোধ্যা কোত্থাও হয়নি।

       তারপর তো সেই শূর্পনখার অধ্যায়। কিডন্যাপ কেস। হনুমান, বিভীষণ ইত্যাদি নিয়ে একটা কম্যিউনিটি স্থাপন। যুদ্ধ। জিতে যাওয়া। স্ত্রী উদ্ধার। বাড়ি ফেরা। ফিরতে না ফিরতেই সোশ্যাল অ্যাজিটেশান। আনরেস্ট। ফলে স্ত্রীর সাথে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং আশ্রমে পাঠিয়ে, এদিকে তিনি গর্ভবতী। বাবা হলেন জানতেও পারলেন না। ছেলেদের সাথেই যুদ্ধ। বউ ছেলে ফিরিয়ে আনলে আবার মাস মুভমেন্ট। ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল.... তোমার বিবাহ আপনার সুখের জন্য নহে, জন্ম হইতেই বলিপ্রদত্ত সমাজের কাছে.... সেই ডায়লগ.... সে যুগেও ছিল... আকাশে বাতাসে.... অর্থাৎ আবার নো কনফিডেন্স মোশন.... পাতাল প্রবেশ... মানে 'আই কুইট', ফার্স্ট ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট।

       এবারে বলেন, ওই চিত্রকূট ছাড়া মানুষটা সুখে আর কোথায় ছিল? তা ওইখানেই একটা কুটির বানিয়ে দিলে হত না? বাইরে লেখা থাকত, নো এন্ট্রি, প্রবেশ নিষেধ।

       সত্যিই তো মানুষটাকে তো কর্তব্যের যাঁতাকলে ন্যায্য অন্যায্য কত কাজ করিয়ে নিলি বাপ তোরা। পিতৃবাক্য, মাতৃসাধ, ভক্তবাঞ্ছা, ভ্রাতৃদায়, গণদাবী, ঋষিদাবী... বলি সত্যরক্ষা করতে করতে ব্যক্তিগত জীবন বলে তো কিছু রাখতেই দিলি না তোরা। এখন একটা ঢ্যাপকা মন্দির বানিয়ে দিলেই বুঝি খুশী হবে মানুষটা?

       তাই বলছিলুম কি ওই চিত্রকূটেই না হয় শান্তিতে থাকার একটা ব্যবস্থা থাকত। কেউ যেত না। কেন তোরাই তো হইহই করে, গোল করে মানুষটাকে অমন ডিপ্রেশানের দিকে ঠেলে দিলি। তুলসীদাস সাচ্চা ভক্ত, সেই এইসব কথা লিখেছে। তাই দেখিসনি অযোধ্যায় ফেরার পর আর কিছু ওইসব আগডুম বাগডুম ঘটনা লেখেনিকো। সোজা তত্ত্বকথায় চলে গেছে; ভক্ত কাকে বলে, মানসিক ব্যাধি কি, সাধু কাকে বলে.... এইসব আর কি। কি করে ওই দুঃখের কথাগুলো লিখবে বল বাপ আমার, যে মানুষটা 'ঠুমক চলত রামচন্দ্র' লিখছে, অর্থাৎ কিনা তার প্রভুর শৈশবের নুপুরের ধ্বনি পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছে, আহা কি বর্ণনা... কিলক কিলক উঠত ঘাই... গিরত ভূমি লটপটাই... ধায় মাতু কোল লেতু দশরথ কি রাণীয়া.... ডি ভি পালুস্করের গলা আসছে না কানে... আহা কি মধুর গলা গো ছিল মানুষটার... উস্তাদ আমির খাঁ বলত প্রসাদি কণ্ঠস্বর.... মধু মধু মধু....

       কথা ঘেঁটে গেল। যা বলছিলাম। তা তুলসীদাস কি লিখছেন তার রামচরিতমানসে? যার মুখারবিন্দ রাজসিংহাসনে প্রফুল্লিত হয়নি, কিম্বা জঙ্গলেও মুষড়ে যায়নি, সেই মুখারবিন্দই আমার প্রভুর। আহা, একে ইংরাজিতে বলে equanimity, মানে সাম্য অবস্থা চিত্তের। গীতায় বলা হল না, চিত্তের সমতাই হল গিয়া আসল যোগ... ওসব লোকদেখানি ধম্মকম্ম ছাড়ো বাপু, ওতে চিঁড়ে গলবেনি, চিত্তখানা ফ্লেক্সিবল করে মার্কেটে ছাড়ো তো বাপু... দেখবে কেমন হাওয়ায় দোলা খাচ্ছে... পড়ে যাচ্ছে না.... সেই গল্প মনে পড়ল। মাধবানন্দজী, রোজ জানলা দিয়ে তাকিয়ে কি দেখেন। ও মহারাজ, কি দেখেন? কোলের উপর কথামৃত খোলা, আপনি কি দেখেন রোজ? মাধবানন্দজী হেসে বললেন, আমি নারকেল গাছের দোল খাওয়া দেখি.... হাওয়ায় কেমন দুলে দুলে হাওয়ার সাথে একটা বোঝাপড়া করে নিচ্ছে দেখ.... তবেই তো টিকে আছে.....

       বুঝেছি... ভালোমন্দ যাহাই ঘটুক.. সত্যেরে লও সহজে....

       তো এই তুলসীদাসজী থোড়ি ওইসব লব-কুশ, পাতাল প্রবেশ লিখতে গেছেন... না, মোটেও না। বাল্মিকীকে বলেছেন, দেখো দাদা ওইসব আমার মোটেও ভালো লাগেনি, আমি ওইসব লিখতে পারব না। আমি সার কথাটা নিয়ে নেব, মাধুর্য। মাধুর্য দারিদ্রতেও থাকে, দৈন্যে থাকে না। এই কথা ক্রাইম অ্যাণ্ড পানিশমেন্ট উপন্যাসে দস্তয়েভস্কিও বলেছে। আমি বাপু চিত্রকূটের ওই স্বল্প আয়োজনের মধ্যেই সবটুকু মাধুর্য বার করে আনব, বাকিটা তো ঘটনা আর তত্ত্বকথা। বুঝেছ? তা না বুঝবেই বা কেন? যিনি বলছেন তার প্রভুর জঙ্গলের কাঠিন্যে বা রাজার সম্মানে কোনো মনের ভাবের হেলদোল হয়নি, সেই মানুষকি সত্যিই লিখতে পারত স্ত্রীর অমন করুণ পরিণতির পর ওনার মুখারবিন্দ শুকিয়ে যাওয়ার কথা? তা শুকিয়ে গিয়েছিল তো, আলবাত শুকিয়েছিল। বিলাপ করেন রাম লক্ষণের আগে... পড়িসনি বুঝি তোরা.... তাই যেখানে মানুষটা সুখী ছিলই না, সেইখানে ওইসব মহলে কি সুখী হবে বাপ আমার। তার চাইতে চ না বাপু চিত্রকূটে যাই, obsessive compulsive devotee না হয়ে intelligent sensible devotee হলে হয় না?

261
Sat, 07/25/2020 - 10:29
  অতি-যুক্তি আর অতি-আবেগ - দুটোই জীবনের পক্ষে বড় ক্ষতিকর। কারণ জীবনটা শুধু যুক্তিও না, শুধু আবেগও না, জীবনটা জীবনই। ধারাবাহিক অভিজ্ঞতা। অজানা, অচেনার মুখোমুখি হওয়া। আবার চেনা, জানার মধ্যে ঘোরাঘুরি করা। যে মানুষটা আমার কাছে সান্ত্বনা চাইতে এলো, তার দুঃখ, তার শোক, তার ভয় থেকে যে ত্রাণ পেতে এল আমার কাছে, তাকে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম যুক্তির ধারে ক্ষতবিক্ষত না করে যদি আবেগ দিয়ে শোনা যায় তার কথা, সেটা অনেক বেশি কার্যকরী হয়। কারণ আমাদের জানার সাথে ব্যবহারের কোনো সম্পর্ক সে অর্থে পাকাপাকি নেই। আমি যা জানি তা আমি জানি। আমি যা ব্যবহার করি তা আমি আমার জানা থেকে, যুক্তি করি না। তা করি আমার ইচ্ছা, আমার আবেগ, আমার ভয়, আমার আতঙ্ক, আমার লোভ, আমার ঈর্ষা, আমার স্বার্থ, আমার কাম, আমার চালাকি, আমার ক্ষুদ্রতা, আমার স্নেহ, আমার ভালোবাসা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা প্রবৃত্তি থেকে আমার ব্যবহার আমি করি। সেকি আমার জানার বিজ্ঞাপন না আমার বাধ্যতা? বা আমার স্বভাবের কাছে আমার অসহায়তা? আমার যা কিছু হোক না কেন, সে অন্তত আমার জানা বা যুক্তিজাত নয় সব সময়। তবে কি আমি কখনওই জ্ঞানের দ্বারা, যুক্তিদ্বারা পরিচালিত হই না? হই। তবে এই জ্ঞানও আমার আছে যে আমি সব সময় জ্ঞানের দ্বারা, যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হই না। আমার অনেক ব্যবহারের সাথেই যুক্তির কোনো সম্পর্ক নেই। এই জ্ঞান আমার আছে, আমি যুক্তিহীন সেই সময়ে। কিন্তু তা মিথ্যা নয়। সেই যুক্তিহীনতাই সত্য তখন। যদিও আমরা আমাদের প্রবৃত্তির অনুকূল আচরণ করে তারপর হাজার একটা যুক্তি সাজাই তার পক্ষ নিয়ে। এও আরেকটা চতুর প্রবৃত্তি। কে শিখিয়েছে? আমাদের অতিরিক্ত যুক্তিপ্রবণতার প্রতি লোভ। আমায় রাগী করেছে, অসহিষ্ণু করেছে, উন্নাসিক করেছে, দাম্ভিক করেছে - আমার এই অতিযুক্তি পরায়ণতার সাজ। যেখানেই আমি হেরেছি সেইখানেই আমি আহত পশুর মত ক্ষুব্ধ হয়ে থেকেছি। আমার সেই ক্ষুব্ধতায় সংসারের জীবন স্রোতের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। একপেশে, একঘরে হয়ে পড়ে থাকি আমি কেবল। আমার অতি যুক্তিপুষ্ট অহমিকার মিথ্যা অবাস্তব গোঙানি সহ্য কর‍তে করতে।        এ অভিজ্ঞতা আমাদের সবার। আমাদের সবার এই জ্ঞানটুকু আছেই যে আমাদের আচরণ বেশিরভাগ সময়েই যুক্তি নিয়ন্ত্রিত নয়। যদিও বারবার আমরা বিশ্বাস করতে চাই যুক্তিই মানুষের ব্যবহারের চূড়ান্ত নির্ণায়ক হওয়া উচিৎ। হয় না, এটা যুক্তি না, এটা অভিজ্ঞতা।        তাই যে মানসিকভাবে বিপন্ন মানুষটার পাশে আমি দাঁড়াচ্ছি, আমি যেন এইটা মনে রাখি, তার আমার যুক্তির পাঁচালির শোনার কোনো দরকার নেই। সে যুক্তিপিডিয়া তার মাথাতেও গিজগিজ করছে। তবু সে উঁচুতে উঠলে ভয় পায়, তবু সে নিজেকে অসুন্দর ভেবে কষ্ট পায়, তবু সে নিজেকে ব্যর্থ ভেবে যন্ত্রণা পায়, তবু সে নিজেকে হীন জেনে লজ্জা পায়...এরকম বহু তবু আছে। সব যুক্তির বিরুদ্ধে, যুক্তির বাইরে। কিন্তু সবটাই বাস্তব। মাকড়সা থেকে আমার জীবনহানির আশঙ্কা নেই জেনেও আমি ভয় পাই। আমার যে পরম বন্ধু সে আমাকে যুক্তির পাঁচালি শোনায় না তখন, সে হয় তাকে তাড়ায় নয় মেরে দেয়। কারণ সে জানে আমার ভয়টা অযৌক্তিক হলেও বাস্তব। আমাদের মধ্যে এমন বহু কিছু অযৌক্তিক হলেও বাস্তব আছে। তাকে যুক্তির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে তুলে, তাকে অপদস্থ, অপ্রস্তুত করে তুলে হয় তো আমার যুক্তির লেজ মোটা হয়, কিন্তু আমার বিবেক স্বস্তি পায় না। আমার মানবিক সহমর্মিতা লজ্জা পায়। ভালোবাসায় অতি-যুক্তি এমনই বেমানান, ক্ষতিকর, ঘাতক। নিজের ধারালো যুক্তির সামনে কাউকে দাঁড়াতে না দেওয়াতে, বিশেষ করে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত কোনো মানুষকে, বিপন্ন কোনো মানুষকে হেনস্থা করে কোনো বাহাদুরি, কোনো পদক পাওয়া যায় না। শুধু সম্পর্কটাকেই ব্যর্থতায় নিয়ে যাওয়া হয়।        আমি দেখেছি, নিজের অনেক ভুল শুধরাতে গিয়ে দেখেছি, ভালোবাসা আর ধৈর্যতেই একজন মানুষকে সাহায্য করা যায়। সযৌক্তিক তিরস্কার, ভর্ৎসনা আসলে কোনো কাজেই আসে না। সে আমায় এড়িয়ে যেতে শেখে, লুকিয়ে যেতে শেখে। লাভের লাভ কিছু হয় না। আজও শিখতে চেষ্টা করছি। নিজের হাজার সীমাবদ্ধতায় লজ্জা পাচ্ছি। তবু চেষ্টা করে যাচ্ছি অতি-যুক্তি আর অতি-আবেগের দুই ভিন্নধারার ফাঁদ থেকে জীবনের স্রোতটাকে বাঁচিয়ে জীবনটাকে শুধু জীবনই করে রাখতে। মানুষ তো অবশেষে মানুষই না?    
262
Tue, 07/21/2020 - 19:41
নিত্য নতুন তথ্য, তত্ত্ব আমাদের রোজ শুনতে হচ্ছে, জানতে হচ্ছে কোভিড নিয়ে। যেটা মাঝে মাঝে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। মনে হচ্ছে আসল কথাটা কি তবে?
       এই 'আসল কথাটা' মানে ঠিক কি জানতে চাইছি? ওষুধ, চিকিৎসার নানা খুঁটিনাটি, নানা বিধিনিষেধ ইত্যাদি সমস্ত নিয়ে এত ধোঁয়াশা রোজ তৈরি হচ্ছে কেন? এই একটু আলোর মুখ দেখলেই আবার কোথা থেকে সংশয়ের কালো মেঘ সব কিছুকে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে?        একটা কথা আমাকে বুঝতে হবে। একটা হল তথ্য, আর আরেকটা হল জ্ঞান। একটি অভিধান হল তথ্যভাণ্ডারের একটি আদর্শ উদাহরণ, আর জ্ঞান হল সেই শব্দভাণ্ডারকে ব্যবহার করতে পারা, অনুভব করতে পারা, বোধগম্য করে তোলা।        জ্ঞান অনেক তথ্যের উপর নির্ভর করে। তথ্য কি? সে পরিসংখ্যান হতে পারে, নানা পরীক্ষানিরীক্ষার ফলাফল হতে পারে, পূর্বতন কোনো ঘটনার ফলাফল হতে পারে। কোভিডের ক্ষেত্রে এর কোনোটার ভাণ্ডারই আমাদের কাছে পর্যাপ্ত নয়। ফলে নানা তথ্যের চমক দেওয়া সংবাদমাধ্যমের ব্যবসার দিকে তাকিয়ে নানা তিলকে তাল আর তালকে তিল করার খেলা, তার উপর নানা রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাবের চাবি ডানদিক কিম্বা বাঁদিক ঘোরানোর খেলা – মোটকথা আমরা সত্য হতে বহুদূর।        এখন প্রশ্ন হতে পারে, এই 'সত্য' কথাটা তথ্য না জ্ঞান? দুই সত্য। একটা ফ্যাক্ট, আরেকটা নলেজ। নলেজ একটা থিওরি। যে থিওরিটা ভুলও হতে পারে, তাকে আবার শুধরে নেওয়াও যেতে পারে। আমরা নানা ঘটনায় মনে মনে নানা থিওরি দাঁড় করাতে থাকি, আবার বাস্তবতার সাপেক্ষে তাকে বদলে নিতেও পারি। যেমন সত্যজিৎ রায়ের 'মহাপুরুষ' সিনেমার সেই দৃশ্যটা ভাবুন, যেখানে ট্রেনের জানলা দিয়ে তাকিয়ে গুরু হুঙ্কার দিচ্ছেন, ওঠ... ওঠ...। অমনি খানিকবাদে সূর্য উঠে গেল। ভক্তের মনে অমনি একটা বিশ্বাস জন্মে গেল, অর্থাৎ একটা থিওরি জন্মে গেল যে যেই না গুরুদেব হুঙ্কার দেবেন অমনি সূর্য উঠবে। এবার ধরুন ঘটনাচক্রে একদিন গুরুদেব সকালে উঠলেন না, তাও সূর্য উঠে গেল। তখন বুদ্ধিমান ভক্ত হলে বুঝে যেত তার আগের তত্ত্বটা ভুল, অর্থাৎ কিনা সূর্যটা ওঠার সাথে গুরুদেবের হুঙ্কারের কোনো যোগাযোগ নেই। কিম্বা আরেকটা উদাহরণ নেওয়া যাক, একটা বাচ্চা হয় তো ভাবে তাদের বাড়ীর উঠানের থেকে মোরগটা ডাকলেই সূর্যটা ওঠে। একদিন মোরগটা ডাকল না অথচ সূর্যটা উঠে গেল, তখন অবশ্যই সে ভেবে নেবে যে তার আগের তত্ত্বটা ভুল ছিল। সে তখন নতুন তত্ত্বে বিশ্বাস করবে যে সূর্য ওঠার সাথে মোরগের ডাকের কোনো সম্পর্ক নেই।        কিন্তু ভারতীয় মানসিকতায় আমাদের জ্ঞান আর বিশ্বাসের মধ্যে – 'জাস্টিফায়েড' কথাটার খুব একটা গুরুত্ব নেই। শ্রদ্ধা সেই জায়গাটা খেয়ে নিয়ে বসে আছে। শ্রদ্ধার অনেক ভালো গুণ আছে মানি, কিন্তু তার অবগুণটুকুও কম নয় সংসারে। সত্যের একটা তত্ত্ব আছে, JTB --- Justified True Belief, অর্থাৎ সঙ্গত বিশ্বাসযুক্ত জ্ঞানই সত্য। ভারতীয় মাটিতে এ তত্ত্বটার বড় অভাব। তার তত্ত্বদাতার প্রতি অন্ধ শ্রদ্ধার ঝোঁক যতটা বেশি, ততটা তাকে বাজিয়ে নেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করা হয় না। হয় তো রামকৃষ্ণদেবই প্রথম যিনি বাজিয়ে নেওয়াতে বিশ্বাস করতেন। যদিও সে প্রথা আর রইল না। সেদিন দেখলাম সূর্যগ্রহণের ক্ষতিকারক কুসংস্কারকে তাঁর আদর্শ অনুগামী প্রতিষ্ঠান সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন। সে কথা থাক। প্রতিষ্ঠান তো অধিষ্ঠানে দৃঢ়সংকল্প হবেই, চলার কথায় তো ভিত নড়বেই।        কথাটা হচ্ছে সঙ্গত বিশ্বাসযুক্ত জ্ঞানের প্রতি আমাদের কোনোদিনই তেমন ঝোঁক ছিল না, এখনও নেই। আমাদের সেই ঝোঁক না থাকাকে ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ নামে দেগে প্রশংসার তকমা এঁটে, গৌরবের ভূষণ পরিয়ে সমাজে চলমান রেখে দিয়েছি। তাই আমাদের এই দুর্যোগের দিনে, প্রবল সংকটের দিনে কোনো একটি বিশেষ মন্দিরের লক্ষকোটি টাকা ব্যয় করে শিলান্যাস করাকে অসঙ্গত বোধ হয় না। আমরা এখন একটা চটজলদি তত্ত্ব খুঁজছি। একটা শর্টকাট। একটা ম্যাজিক। নানা তথ্যাবলী, পরীক্ষানিরীক্ষামূলক পথের দিকে তাকিয়ে থাকার অভ্যাস আমাদের কোনোকালেই নেই। তাই এই যুগেও ভূয়ো বিজ্ঞান-মিস্টিক-দর্শন -এর ককটেল গুরুর অভাব হয় না। যিনি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্যে সাপের বিষ খেয়ে হজম করে দেন, সাথে মানবসেবা, পরাজ্ঞানের বহুমূল্য কোর্সের একটা ধোঁয়াশায় পাবলিক ডিলিং করে চলেন। অন্ধকার আর আলো – এই দুইতেই মানুষ নিজের অবস্থান নিয়ে স্পষ্ট। কিন্তু তাতে তো মুশকিল, তাই কুয়াশা তৈরি করো। কুয়াশায় মানুষ বিভ্রান্ত হয়। একের লজিক অন্যের ঘাড়ে চাপায়। “ওরা কি লোকসেবা করে না”? “উনি কি এত এত মানুষের বিনামূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেননি”? “উনি কি মশা ফাউণ্ডেশান নিয়ে গুগুল টকে বক্তৃতা রাখেননি?” --- এই সব কথাগুলো সত্য, কিন্তু খণ্ডিত ঘটনা হিসাবে সত্য, যুক্তি হিসাবে ফ্যালাসি। চিন্তার স্বচ্ছতার চাইতে কপট ম্যাজিক মহত্বের ধোঁয়াশা অনেক পাব্লিককে কাছে এনে দেয়। সক্রেটিস বলতেন, আমায় লোকে পছন্দ করে না আমার ফ্র্যাঙ্কনেসের জন্য। কবীর বলতেন, আশ্চর্য সব মানুষ, সরল সত্য কথা বলো তো তারা মারতে আসে, আর মিষ্টি মিথ্যা কথা বলো তো তোমায় মাথায় চড়িয়ে রাখে। ঘটনাচক্রে এই দুই জনেরই প্রাণ গিয়েছিল একই কারণে – সত্যকথা সহজ করে বলার অপরাধে। তাই এই আধুনিক যুগের মিস্টিক গুরুরা, যারা পরকালের সাথে ইহকালের সব তত্ত্ব জানেন বলে দাবি করে বেড়ান, তারাই বিশ্বসৃষ্টির আদিকালে উৎপন্ন এই জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী ভাইরাসের নাশের কৌশল জানতে বিদেশি গবেষণাগারের দিকে সশিষ্য তাকিয়ে থাকেন। ভক্ত নিজেকে ভাবায় উনি চাইলেই জানতে পারেন, জানতে চান না এ ওনার লীলা। জানলে পাছে অহংকার হয়, তাই লোকশিক্ষার জন্য এমন বিনয়। আসলে আলো নিভাতে তো কষ্ট নেই। কষ্ট আলো জ্বালতেই। চোখ বন্ধ করতে তো অসুবিধা নেই। চোখ বন্ধ করলেই নিজের মধ্যে নিজের রাজত্ব। চোখ খুললেই তো নানা বিরোধময় জগৎ। তার মধ্যে সমন্বয় করার দায় কে নেবে? তার চাইতে চোখ বন্ধ থাক।        যে দেশে এখনও কন্যাভ্রূণ হত্যা ঠেকাতে টাটকা কালি দিয়ে লেখা নানা বিজ্ঞাপন দেওয়ালে দেওয়ালে, সেই দেশে হঠাৎ করে সব্বাই মিলে ভয়ংকর যুক্তিপরায়ণ হয়ে, মানবিক হয়ে এই দুর্যোগ ঠেকাবে সে আশা করা সোনার পাথরবাটি আশা করার মত। তবে আইন, জরিমানা, ত্রাস – আমরা ভালো বুঝি, সেই পথেই আমাদের শিক্ষাও হয়, পূর্ণমাত্রায় না হলেও আংশিক। যেমন সদ্য করোনা ত্রাসে বিডিওকে ঢুকতে না দেওয়ার অপরাধে বেশ কয়েকদিন হাজতবাসে রাজ্যবাসীকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, নিজের সীমার মধ্যে থাকো। এ পথ খুব উন্নত সভ্যতার উদাহরণ না হলেও, এই পথটা ঠিক অন্তত আজকের পরিস্থিতিতে।        শুরুর কথায় আবার ফেরা যাক। আশু কোনো রাজপথ আমাদের বিদ্যার নাগালে নেই এইটা আপাতত মেনে নিতে হবে। নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হবে, শুধু গবেষণাগারেই নয়, নানা সামাজিক বিধিনিষেধেও, সেটাও বুঝে নিতে হবে। নিজের চোখকান খোলা রাখতে হবে, মিষ্টি মিথ্যা আশ্বাসের দিকে কান পেতে নয় অবশ্যই, যেটা সঙ্গত বিশ্বাসযুক্ত জ্ঞান তার দিকে তাকিয়েই। নানা যুক্তি বা অপযুক্তি অবশেষে সবটাই কল্পনা এখন। মনে রাখতে হবে যুক্তি কিন্তু প্রমাণ নয়। এত এত দার্শনিক, এত এত মিস্টিক মহাশয়েরা যুগ যুগ ধরে হাজার গণ্ডা বিচার করেও একমত হতে পারলেন না মানুষের আত্মা আছে কি নেই। অগত্যা তারা কোভিডের সত্যাসত্য জানিয়ে দেবেন এমন আশা করা বৃথা। ওনাদের ওইসব কাল্পনিক অনুমানগত লজিকের ভুলভুলাইয়া থেকে বেরিয়ে আসাই মঙ্গল। একটা ছোটো উদাহরণ দিই। যদি বলো স্বচ্ছ কাঁচ কি? বলা হয় যার ভিতর দিয়ে আলো আসে। আবার যদি বলো কার ভিতর দিয়ে আলো আসে, তবে কথা হল স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে। এই সব গোলানো কথা থাক। কাঁচের ভিতর দিয়ে আলো কি করে আসে বুঝতে একজন পদার্থ বিজ্ঞানীর কাছে যাও, বুঝিয়ে দেবেন। অর্থাৎ জ্ঞান আসুক, অনুমান আর নানা মনোরম ধাঁধারা বিশ্রাম করুক। জল্পনারা বিদেয় হোক। মনটা আলোকিত হোক। একটু দেশি, আঞ্চলিক ইত্যাদি চটকদার খবরের পাতা ছেড়ে বাইরের নানা পত্রপত্রিকায় চোখ রাখি। যদি না বুঝি, তবে না বোঝাই ভালো। যদি বুঝি তবে সে উত্তম কথা। আর যদি উল্টো বুঝি বা ভুল বুঝি তবে চরম বিপত্তি।        এখানেও একটা কথা আছে যদিও, আমি ভেবে পাই না স্বাধীনতার এতগুলো দিন পরেও জাতীয়স্তরে এখনও কোনো খবরের কাগজ ভারতের পূর্বদিক থেকে উঠে এলো না কেন? যদি বলো আমরা ইংরাজি জানি না, তা মিথ্যা, আমরা বড় বড় ইংরাজি জাননেওয়ালা সাংবাদিক জন্ম দিয়েছি এই বাংলা থেকেই, কিন্তু আজ অবধি একটাও জাতীয়স্তরের পত্রিকা কেন বার হল না কে জানে? যদি বলো 'দ্য টেলিগ্রাফ', সে আমাদের এই পাশাপাশি কয়েকটা রাজ্য বাদ দিলে অন্যত্র পাওয়া ভার। অবিশ্যি আর যে কয়েকটা জাতীয়স্তরের কাগজ আছে তাও যে খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে তো মনে হয় না, এক 'দ্য হিন্দু' আর 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' ছাড়া, তাও এরা মন্দের ভালো।        তবে সত্য জানার উপায়? রিড বিট্যুইন ট্যু লাইনস্ পড়ার অভাস মশায়। আর সাধারণ বুদ্ধিটাকে ডিফল্ট মোডে রাখা। ওইতেই যতটা হয়।
263
Tue, 06/30/2020 - 20:30
      জন্ম থেকেই বলা হল, মাথা নীচু করো। কোথায়? ওই ছবির ফ্রেমের সামনে। ওই পাথরের মূর্তির সামনে। ওই মাটির মূর্তির সামনে। উনি গুরুদেব, ওনার সামনে। উনি বয়োজ্যেষ্ঠ, ওনার সামনে। উনি শিক্ষক, ওনার সামনে।        ‘মাথা নীচু’ পর্ব চলছেই। একটা বাচ্চা বুঝতে পারছে না কি তাদের মহত্ব, কেন সে মাথা নীচু করবে? সে শুধু জানে তাকে মাথাটা নীচু করে যেতে হবে, কারণ বড়রা বলছেন। বড়দের কথাটা শুনতেই হয়। সমস্যা হচ্ছে, এই বিনা মহত্বের অনুভবে মাথা নীচু করাটা ক্রমে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। গাছকে দেখলে মাথা নীচু করে, পাথর দেখলে মাথা নীচু করে, নদী দেখলে মাথা নীচু করে, আগুন দেখলে মাথা নীচু করে, বিশেষ কোনো সাজ দেখলে মাথা নীচু করে, পোশাকের রঙ দেখে মাথা নীচু করে -- এই লিস্টের কোনো শেষ নেই। কিন্তু মোদ্দা কথাটা অনভ্যাসই রয়ে যায় – মহতের কাছে মাথা নীচু করার আনন্দ, তৃপ্তি, স্নিগ্ধতা। সে জানে মাথা নীচু করলেই সে রক্ষা পেয়ে যাবে, মাথা নীচু করলেই তার সব অমঙ্গল চলে যাবে, মাথা নীচু করলেই কোনো অদৃশ্য শক্তির অনির্দিষ্ট কারণে ক্রোধের হাত থেকে সে রেহাই পেয়ে যাবে। মেরুদণ্ড নীচু হওয়ার অভ্যাসটুকু রপ্ত করে ফেলে বটে, কিন্তু নীচু হওয়ার মাধুর্যটুকু থেকে বঞ্চিত রয়ে যায়।        মহৎকে অনুভব করতে পারার শিক্ষা আমাদের ছোটবেলা থেকে দেওয়া হয় না। নানা চাতুরী, নানা প্রতিযোগিতায় জেতার ন্যায্য-অন্যায্য কৌশল নানাভাবে শেখানো হতে থাকে। কোথায় কখন কতটা নীচু হতে পারলে আখেরে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা –- তার একটা রাফ হিসাবও হয়ে যায়, কিন্তু আদতে লাভের লাভ কিছু হয়ে ওঠে না।        পাশ্চাত্য দর্শনে অমন ঈশ্বরমগ্ন দার্শনিক স্পিনোজা, যিনি বার্ট্রান্ড রাসেলের মত অজ্ঞেয়বাদী দার্শনিকের ও আইনস্টাইনের মত বিজ্ঞানীর সবচাইতে শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার মানুষ ছিলেন, তিনি কোনোদিন এই নীচু হওয়ার অভ্যাসকে ভালো চোখে দেখেননি। তিনি একে বোধের অপূর্ণতাই বলেছেন। তবে এর উল্টো কথাটাও কোনো প্রাজ্ঞের সিদ্ধান্ত নয়, যে ঔদ্ধত্যই তবে সঠিক; কথাটা তাও নয়। “অতিবাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি নীচু হোয়ো না ছাগলে মুড়ে খাবে”, অনেকটা এই প্রবাদের কাছাকাছি হয় তো।        কিন্তু আমাদের এই বিনা মহতের কাছে নীচু হওয়ার তবে প্রেরণাটা কি? ক্ষমতার অন্ধ অতিবোধ। মানে ক্ষমতাকে নীতিহীন বিশ্বাস করা। কেন? যুগান্তরের অন্ধকারের ভয়। অন্যায্য ভয়। অযৌক্তিক ভয়। ভয় যত অমূলক, নীতিহীন ক্ষমতার প্রতি মোহও তত প্রবল। আমার তখন প্রায় সব কিছুকেই প্রবল অতীন্দ্রিয় ক্ষমতাশালী বলে মনে হয়। এক নিজের প্রতি বিশ্বাস ছাড়া। নিজের যুক্তি-বুদ্ধি-সাধারণ জ্ঞান সমস্তকে আচ্ছন্ন করে বসে আছে নীচু হয়ে থাকার অভ্যাস। এ নম্রতা না, এ বিকার। সাংঘাতিক বিকার। যুগান্তরের বিকার। এর অন্যথা হলেই তা ঔদ্ধত্য। যেমন অত্যন্ত দুর্বল ব্যক্তির পক্ষে যে মানুষ সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলায় ওঠে তাকেই তার তেনজিং নোরগের মত বোধ হয়, এও তেমন। অকারণে মাথা নীচু করার অভ্যাস তৈরি হয়নি এমন মানুষ এরকম ভীরু সমাজের কাছে অবশ্যই দাম্ভিক, উদ্ধত বলে গণ্য হবে এতে আর আশ্চর্য কি আছে? আর এই বিকার সমাজের এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকেছে যে যদি কোনো চিকিৎসক, কোনো শিক্ষক, কোনো উকিল তার যথার্থ প্রাপ্যটুকু নিয়ে, যোগ্য কাজটি সুচারুরূপে করার জন্য তৎপর হন, তবে তিনি ঈশ্বর হয়ে ওঠেন সাধারণের চোখে। কারণ সাধারণ মানুষ জেনে গেছে যে সে অকারণে নিজেকে নীচু না করলে তার ন্যায্য প্রাপ্তিটুকুও পাবে না। এ বিশ্বাস, এ অভ্যাস, এ অসুস্থতা। তবু এটাই স্বাভাবিক হয়ে আছে। তাই ঈশ্বর বলে পায়ে পড়তেও বাধে না, তাকে শয়তান বলে শারীরিক নিগ্রহ করতে কিম্বা কুৎসা রটাতেও বাধে না – দুটোই একই অসুস্থ মানসিকতার দুটো দিক।        তবে কি শ্রদ্ধা-বিশ্বাস থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। কিন্তু তা যথার্থ মহতের দিকে আপনি স্বতঃ উৎসারিত হোক। বিনা মতলবে। মহৎকে চেনা কঠিন, আমি অনেকের মুখে শুনেছি। কথাটা পুরো সত্য নয়। আংশিক সত্য। যার সুরের বোধ নেই, বা সুরের রসিক যে নয়, সে পণ্ডিত রবিশঙ্করের মাহাত্ম্য অনুভব করবে না। যে দর্শনের প্রতি আগ্রহ রাখে না, সে কান্ট কিম্বা স্পিনোজার মাহাত্ম্য বুঝবে না। সেইটাই স্বাভাবিক। তাই সে সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, এও কাম্য। কিন্তু যে যে বিষয়ে আগ্রহী সে সেই বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ মানুষের পরিচয় পাবেই পাবে। একজন মানুষকে সব ক্ষেত্রে সব মহাজনদের যথার্থ পরিচয় পেতেই হবে এমন বালাই কেউ দেয়নি। কিন্তু তা বলে শুধুমাত্র জোর করে গুণীকে গুণী না জেনেই, মহৎকে মহৎ না বুঝেই যদি সে বলে, এই তো আমি মাথা নীচু করে নিলাম, এইবার আমায় ছুটি দাও, পুরষ্কার দাও -– সে আখেরে এসে তীরে তরী ডুবিয়েই ছাড়ে। সমস্তটাই যে ফাঁকিতে ভরে গিয়েছে তার।        কবীর একটা দোঁহায় লিখেছিলেন, তোমরা পাথরের কাছে মাথা নীচু করে করে পাথর হয়ে গেছ। কথাটার মর্মার্থে একটা খোঁচ আছে। আমাদের ঈশ্বর একদিন ছিলেন সত্য, চেতনা ও আনন্দস্বরূপ। সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্র, তথা এ বিশ্বের কেন্দ্র তিনি। এ খুব একটা বড় কথা ছিল। ধীরে ধীরে মানুষ হল তার প্রতিভূ। অবতার হল, গুরু হল। অর্থাৎ অসীম, নৈর্ব্যক্তিক সত্তা হল সসীম, ব্যক্তি। দল হল। নানা কপট অবতার, গুরু, সিদ্ধপুরুষের ভিড় শুরু হল। যারা সত্যিকারের উদার তারা এই দাবীকে অস্বীকার করলেন। বললেন, এই কথা পুরো খাঁটি না, সমুদ্রের ঢেউ হয়, ঢেউয়ের কোনো সমুদ্র হয় না। তারা বললেন, গুরু একমাত্র সচ্চিদানন্দ। আবার অনেকে এদিকের কথা ওদিকের কথা মিলিয়ে একটা রফা করতে চাইলেন। এই ইন্দ্রিয় নশ্বর জগত আর সেই অতীন্দ্রিয় অবিনশ্বর জগতের মধ্যে রফা হল। দল হল। ব্যবসা জমল। ক্রমে গড মাফিয়াদের জন্ম হল। মানুষ তত্ত্ব ছেড়ে ব্যক্তি নিয়ে মজে গেল। ফাঁকি যত নির্লজ্জতার সীমা পেরোতে লাগল তার গোঁড়ামি আর নির্বোধ আচরণ তত দল বেঁধে গোষ্ঠীবেষ্টিত হয়ে দানা বাঁধতে শুরু করল। ভালোবাসা, চেতনা, জ্ঞান, সহনশীলতা – তার অসীমত্বের সংজ্ঞা হারিয়ে ব্যক্তি আর দলের সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হতে লাগল। মানুষ নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মুক্তি মুক্তি খেলতে লাগল। এক খামখেয়ালী, পক্ষপাতদুষ্ট, দাদাগিরি স্বভাবযুক্ত ব্যক্তিরূপ ঈশ্বরের আবির্ভাব হল। “আমি চোখ বুজে পথ পাইনে বলে কেঁদে ভাসাই পাড়া” -- এই হল গিয়ে অবস্থা।        এর মধ্যে কেউ কেউ সাবধান করে গেল। কেউ কেউ চীৎকার করে বলে গেল, বারবার বলে গেল, যে মিথ্যার রাস্তায় মিথ্যা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। কিন্তু আমাদের মাথা ততদিনে নীচু হতে হতে এমন নীচু হয়ে গেছে যে উদার আকাশ, উদার আলো আমাদের কাছে কপট বলে বিশ্বাস হতে শুরু করেছে। আমরা ‘সিনিক’ হয়ে পড়লাম, যেখানে আমাদের ‘স্কেপটিক’ হলে আশার আলো ছিল। একদিন যদি কেউ থেমে ভাবত যে কেন আমি নকুলদানা নিয়ে অসীমের সামনে দাঁড়াব? কেন আমি যাকে তাকে আমার গুরু মেনে তার পায়ে মাথা খুঁড়ে মরব? যে আমায় চেনে না, যে একটা দলের দলপতির বেশি কিছু না তাকে কেন আমি আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার অর্ঘ্যটি দেব? যা চিরকালের চেতনা সেকি ইতিহাসের কোনো একটা কালে, কোনো এক মহান ব্যক্তির জীবনে আবিষ্কৃত হয়ে লুপ্ত হয়ে গেছে? সেকি আজ নেই? উপনিষদ যখন বলে, ‘সে আজও আছে, কালও থাকবে,’ কার কথা বলে? আমার হৃদয়ের দিকে যে ইঙ্গিত করে, সে কার দিকে? সেকি কোনো অতীতকালের কোনো এক মানুষের জীবনের দিকে ইঙ্গিত করে নিজেকে নিঃশেষ করে ফেলেছে? বাকি সত্য বলতে যা বোঝায় তা হল তার ছবি আর পাথরের মূর্তি? বা অতীতের ভাবালাপ? আজকের জন্য কিচ্ছু সত্য নেই? মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটি যদি শুধুমাত্র নিউটনের মুখের দিকে তাকিয়ে আজ বেঁচে থাকত, তবে বিজ্ঞানও আজ জমে যাওয়া মজা পুকুরের মত দলে পরিণত হত, শ্রেণী হত না। বিদ্যালয়ে শ্রেণীর ভাগ আছে, দলের ভাগ নেই। শ্রেণী ক্রমবিবর্তমান, দল ক্রমবর্ধমান হতে পারে, কিম্বা ক্ষীয়মাণ, কিন্তু বিবর্তমান নয়।        আমরা কোনোদিন হয়তো মানতে চাইব না অজ্ঞতার সুখের চাইতে, মূর্খের নিরাপত্তার চাইতে সত্যের মুখোমুখি হয়ে নিজের দায়ভার নিজে নেওয়াতেই মঙ্গল। সত্যের উপর চোখ রাখতে গেলে সত্যদৃষ্টি থাকতে হয়। তখন মেরুদণ্ডের ক্ষণে ক্ষণে যেখানে সেখানে নীচু হওয়ার অভ্যাসটি ত্যাগ হয়, নম্রতায় ঈর্ষা আর বিকারের চাষ না হয়ে মাধুর্যের বোধ হয়, কারণ নম্রতা মানে তখন সত্যের সীমারেখার উপলব্ধি। কল্পনার পাগলা ঘোড়া না।    
264
Mon, 06/22/2020 - 21:30
        আজ অবধি যতপ্রকার ত্রুটি নিয়েই মানুষ জন্মাক না কেন, মন ছাড়া জন্মেছে, এমন উদাহরণ নেই। রবি ঠাকুর গাইছেন, মন রে ওরে মন/ তুমি কোন্ সাধনার ধন / পাই নে তোমায় পাই নে/ শুধু খুঁজি সারাক্ষণ।।        ভালো কথা, এ খোঁজারই বস্তু। কিন্তু খুঁজলেই আর মেলে কই? তবু একেবারেই কি আর মেলে না? তা বললে হবে কেন? তো সেই মনের খোঁজের পাড়ায় অনেক রথী-মহারথীর ভিড়। মাঝে মাঝে একাজে সেকাজে আমায় সে পাড়ায় ঢুঁ মারতে যেতে হয়। যেতে যেতে কিছু কথা আমার কানে এসেছে। সেই কথাগুলোই আমি আপনাদের সাথে একটু ভাগ করে নিতে চাই। শুনবেন? তবে আসুন।        তবে তার আগে একটা কথা বলি। আপনারা যদি সেই রথী-মহারথীদের মধ্যে হয়ে থাকেন, কিম্বা গভীর জিজ্ঞাসু হয়ে থাকেন, তবে আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমি জ্ঞানের জগতে নিতান্তই ভারবাহী গর্দভ বলতে পারেন। ভার বইতে বইতে কিছু উপাদান গায়ে মাথায় লেগে আছে, সেই সব নিয়েই বসা। কেমনভাবে বসা? এই যেমন ধরুন না কেন বাংলার একটা গ্রাম। সেই গ্রামের একটা মেঠোপথ। সেই মেঠোপথের বাঁকে, গ্রামের বাইরের দিকে একটা বড় বটগাছ। যার নীচটা গোল করে বাঁধানো। সেখানে আমি আপনি বসে আছি, দূরে সূর্য অস্ত যাবে যাবে করছে। গরুর গাড়িগুলো ধুলো উড়িয়ে গ্রামে ফিরছে। সেই ধুলোয় সূর্যের সোনা রঙ টলটল করছে। কেমন? এই হল আমাদের প্রেক্ষাপট। তবে শুরু করা যাক?        তো সেই পাড়ার এক মহারথী বলে কি জানেন? আমাদের মনের চিন্তা করার নাকি দুটো দিক আছে। ও হ্যাঁ, সেই মহারথী আবার নোবেলও পেয়েছিল, অর্থনীতিতে। আমি পড়েছি। কি নাম তার? আমি টুকে এনেছি, একদম শেষে নাম বলে দেব। এখন নাম মনে করতে গেলে কথার খেই হারিয়ে ফেলব। তো সেই মহারথী বলে কি জানেন? বলে আমাদের মনের নাকি দুটো দিক। মানে চিন্তা করার দুটো দিক। এক, যে চিন্তা আপনা আপনিই হয়ে যায়, অনেক সময় আমি বুঝতেই পারি না, কখন করে ফেললাম এরকম চিন্তা, সে এক রকম। যেমন ধরেন, আপনি একটা মোটর গাড়ি চালাতে চালাতে পাশে শিবেনবাবুর সাথে এ মাসে কত বীজ তুলবেন সেই গল্প করছেন। কিম্বা সাঁতার কাটতে কাটতে আপনার ছেলেকে নামতা শেখাচ্ছেন – এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই... আপনি ডুবেও যাচ্ছেন না, আবার নামতাও ভুলে যাচ্ছেন না। এই ধরণের চিন্তাকে বলে কিনা 'আপনা আপনি চিন্তা'। দাঁড়ান, এর একটা ইংরাজি নামও আমি জানি -- ইনট্যুইশান। এ চিন্তা আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাসের ফলে তৈরি হয়েছে। একে আমরা চাইলেই থামাতে পারি না।        তবে এই 'আপনা আপনি চিন্তা'র একটা গোল আছে জানো তো? এই যা, তুমি বলে ফেলেছি, কিছু মনে করবেন না... কি তুমি চলবে? আচ্ছা। তাই বলি। তো কথা হচ্ছে, এই 'আপনা আপনি চিন্তা'র একটা গোল আছে। কেউ কেউ নাকি এক অদ্ভুত ব্যামোয় ভোগে, তার নাম আমি বাংলায় করেছি 'বাগড়া চিন্তা'। ইংরাজি নামটায় ওরা বলে, অটোমেটিক নেগেটিভ থট। মানে ধরো তুমি একটা পরীক্ষা দিতে যাচ্ছ, অমনি তোমার মন বলবে, ওরে আমার কেষ্টবিষ্টু এলো রে, পরীক্ষা দিয়ে যেন উল্টে দেবে, ওরে ফেল করে মরবি... যা যা...        এরকম আনখাই চিন্তা। সারাক্ষণ ওদের মনের মধ্যে চলে। তা দাদা মিথ্যা বলব না, এ রোগ আমারও একটু আধটু নেই যে তা নয় কো। এই যেমন ধরো ট্রেন ধরব, ট্রেন সাতটা বারো-তে, আমি একটু দেরি করে বেরিয়েছি, অমনি ওই 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা' বলতে শুরু করল, ওহো বাবু এখন বেরোলেন, আজ তুমি আর ট্রেন পেয়েছ... ওকি তোমার শ্বশুরের ট্রেন যে তোমার জন্য হাত-পা ছড়িয়ে ড্রাইভার, গার্ড বসে থাকবে? হল তোমার, কিস্যু হবে না... যাও যাও...        যেই না ওসব চিন্তা মনের মধ্যে আসা, অমনি আমি ধাঁই ধাঁই করে দৌড়াতে শুরু করি। টেনশানে বুক ধড়ফড়, এত্ত এত্ত কিলো কিলো ঘাম। কি যন্ত্রণা বলো দেখি দাদা! কিন্তু একে তুমি থামাবে কি করে? তবে একটা কথা বলি, একে থামানোর উপায় আছে। সেই মহারথীরা একটা এয়সান ব্রহ্মাস্ত্র বার করেছে না? শুনেছি নাকি তার নাম সিবিটি -- কগনিটিভ বিহেভেরিয়াল থেরাপি, মানে 'বোধগম্যি আচরণের চিকিৎসা' বলতে পারো।        এখানে একটা গপ্পো আছে, এ বি সি থিয়োরি, মানে 'ক খ গ তত্ত্ব'। মানে হল, এই ধরো কোনো একটা ঘটনা ঘটল। সেটা হল 'ক'। সেই ঘটনায় তুমি যা চিন্তা করলে সেটা হল 'খ'। সেই চিন্তায় তোমার যে অনুভব হল সেটা হল 'গ'। যেমন ধরো তুমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছ, হঠাৎ তোমার উল্টোদিক দিয়ে বলাইদা যাচ্ছে, তুমি ডাকলে, সে তাকালোও না, সাড়াও দিল না। এই ঘটনাটা হল 'ক'।        এইবার তুমি ভাবলে, কেন ও সাড়া দিল না, আমি কি কিছু খারাপ কথা বলেছি কাল আড্ডা মারার সময়? এই ভাবনাটা হল 'খ'। অমনি তোমার মনে দুঃখু হল, সেটা হল গিয়ে 'গ'। আবার ভাবলে, শালা আমায় এড়িয়ে গেল? অমনি তোমার রাগ হল। কিম্বা ভাবলে, হয় তো আমায় দেখেনি, কিছু একটা চিন্তা করছে, যাকগে রাতে আড্ডার সময় জেনে নেব। অমনি তোমার মনটা শান্ত হয়ে গেল।        দেখলে তো, 'বোধগম্মি ব্যবহার চিকিৎসা'য় কেমন করে 'ক খ গ তত্ত্ব' এলো। আরো আছে। এ-ও ওদের কাছে শুনেছি। ধরো একদিন রাতে বেশ কয়েকটা লুচি আর মাংস খেয়ে শুতে গেলে আর তোমার খুব অ্যাসিড হয়ে বুকে ব্যথা করছে। এটা 'ক'। অমনি তুমি ভাবলে, এই কেলো, হার্ট অ্যাটাক হবে নাকি? এই চিন্তা হল 'খ'। অমনি তুমি ভয়ে বিছানায় চিমসে গেলে, এই হল 'গ'। এখন যেই না ভয়ে ঘাবড়ে একশা হলে অমনি বুকের ভিতর জোরসে ধুক ধুকানি গেল বেড়ে। তোমার ঘাবড়ানি প্রায় বিকার ওঠার মত হল, তুমি 'ও পিসি! ও শিবুদা', বলে কেঁদেকেটে পাড়ার লোক জড়ো করলে। তবে দেখেছ, 'ক খ গ তত্ত্ব'তে কেমন করে 'গ' আবার 'ক'-কে উস্কে দিয়ে আবার একটা চরকি তৈরি করে?        তো 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা'কে থামাতে হলে আগে আমাদের এই ধরণের চিন্তা মনে উঠলেই তাকে চেপে ধরতে হবে। আমরা করি না? দুর্গাপুজোর আগে যখন গ্রামে চোরের উৎপাত বেড়ে যায়, তখন আমরা রাত্রে পাহারা দিই না? কেউ গ্রামের রাস্তায় সন্দেহজনক এলেই বলি না, ওই তুই কে রে? কেন মুখে গামছা ঢেকেছিস, খোল...        এও সেরকম দাদা, যেই না 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা' আমার অজান্তে আমার মধ্যে আসতে শুরু করল, অমনি টুক্ করে তাকে ল্যাং মেরে ফেলে বলতে হবে, কে? তাই বটে? এইসব বলছিস? কথা কি সত্যি? মিথ্যা মিথ্যা যুক্তি সাজাচ্ছিস? আমি ট্রেন মিস করব? বলি আমার হাতে ঘড়ি নেই? তুই যা বলবি তাই শুনব? কক্ষনো না। এই শুরু হল 'আপনা আপনি বাগড়া চিন্তা'র বিষদাঁত ভেঙে ফেলার প্রথম ধাপ দাদা। বাকিটা যেটা ঘটনা, যেটা বাস্তব সেটা নিজেকে বলতে হবে। জোর করে, না শুনতে চাইলেও শক্ত করে বোঝাতে হবে।        আবার শুরুর কথায় আসি দাদা। তো বলা হচ্ছিল যে আমাদের দু'রকম চিন্তা। এক, 'আপনা আপনি চিন্তা', যা কিনা ইনট্যুশান; আর একটা হল গিয়ে 'সচেতন চিন্তা'। যেমন ধরো, তোমায় যদি বলি, পাঁচ দু'গুনে কত হয়? তুমি না ভেবেই বলে দেবে। ধর্মতলায় অফিস টাইমে ট্রাক চালাতে চালাতেও বলে দেবে। কিন্তু যদি বলি, বলো তো সাতশো পঁচানব্বইয়ের সাথে দুশো আশি গুণ করলে কত হয়? তুমি ট্রাক থামিয়ে খাতায়-পেনে করে বলবে, যদি না তুমি শকুন্তলা দেবী হও। একে বলে 'সচেতন চিন্তা' দাদা। কিন্তু জানো তো দাদা মানুষ চট জলদি সব বিষয়ে ওই 'আপনা আপনি চিন্তা'র থেকেই একটা ধাঁ করে সিদ্ধান্ত টেনে বসে। একটুও ভাবে না। এই যেমন ধরো একটা বাঁশ যখন আমাদের পুকুরে ডুবে থাকে, দেখলে মনে হয় না বাঁশটা জলের তলায় বেঁকে গেছে? প্রাথমিকভাবে আপনা আপনি তাই মনে হয় তো? কিন্তু আমি ভেবে জানি, আমার স্মৃতি থেকে জানি যে ওটা আসলে জলের খেলা, তাই অমন ভুল দেখাচ্ছে। তবু মানুষ কেন বলো তো 'আপনা আপনি চিন্তা'কেই এত গুরুত্ব দেয়? এক, শ্রম করতে হয় না; দুই, সহজ হয়ে যায়। আরে ভাই যে কোন কাজ করতে করতেই তা অভ্যাস হয়ে গেলে না ভেবেই সেরে ফেলা যায়। এই যেমন ধরো আমরা ঢেঁকিতে ধান পিষতে পিষতে কত গল্প করি, আগে আগে পারতাম? কিন্তু সেটা কাজের বেলায় ঠিক আছে। যদি তা সবক্ষেত্রেই ধাঁ করে মনে চলে আসা চিন্তাকেই ধরে চলি তবে আজীবন ঠকতে ঠকতে আর ঠকার শেষ থাকে না, তাই না?        মেলা কথা বলে ফেললাম দাদা। কিছু মনে কোরো না। বইটা হল গিয়ে (নামঃ Thinking, Fast and Slow) একজন ইজরায়েলের মনোবিদ অধ্যাপকের লেখা, নাম ড্যানিয়েল কানামান। আসলে দাদা এখন এই 'বোধগম্মি বিজ্ঞান' বা 'কগনিটিভ সায়েন্স' বেশ কিছু আশার কথা বলছে। আর দাদা কি বলব, এরা দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, স্নায়ুবিজ্ঞান, নৃবিদ্যা আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি – এই ষড়দিক নিয়ে এমন একটা কাণ্ড ঘটাচ্ছে না? যেন আবার সেই প্রজ্ঞার অন্বেষণ শুরু হচ্ছে দাদা নতুন করে। বুদ্ধ থেকে স্পিনোজা, দেকার্ত, কান্ট ইত্যাদি কার না ডাক পড়ছে গো দাদা ওদের কর্মশালায়!        যাই উঠি, মনটা ভারি হয়ে যায় দাদা, এমন একটা কাণ্ডতে আমার মূর্খামি দেখে লজ্জায় মরে যাই। কিছুই হল না গো দাদা জীবনে। এখান ওখান থেকে কিছু এঁটোকাঁটা নিয়ে জীবনটা চলে গেল। আসি গো দাদা, অন্ধকার হয়ে গেল। শুকতারাও উঠে গেল।    
265
Thu, 06/18/2020 - 16:00

 

দীর্ঘদিন শিক্ষকতার জন্য কিনা জানি না, আমি দেখেছি আমি অকারণ কারোর মেজাজ নিতে পারি না। সে যেই হোক, যিনিই হোন। এই স্বভাবটা যত বয়েস বাড়ছে বেড়েই চলেছে। চিরটাকালই একা থাকতে বেশি পছন্দ করি। সাথে বন্ধুবান্ধবও পছন্দ করি। কিন্তু একটা গণ্ডী অবধি। তারপর নিজের সাথে নিজের যে সম্পর্ক, সেখানে কাউকেই পছন্দ করি না। অনেকে নিষ্ঠুর মনে করে, রূঢ় মনে করে, ‘ডিসগাস্টিংলি কুল’ বলে থাকত আমার এক বন্ধু আমায় ছোটোবেলায়।
       একটা নিরিবিলি আমাদের সবার জন্য খুব দরকার। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, নির্জনবাস। সেই নির্জনবাসের জন্য আবাস ত্যাগ করার মানে হয় না, নিজের ভিতরেই নিজের জন্য একটু নির্জনতা খুঁজে না নিলে আমি দেখেছি আমি অন্তত থাকতে পারি না। সেখানে কিছু যে আমায় করতেই হবে তার কোনো মানে নেই, সব কিছু থেকে কিছুক্ষণের জন্য সরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সেখানে থাকতে হবে কিছুক্ষণের জন্য, এইতেই আমার মস্ত বড় একটা সুখ। তার কারণ হয় তো আমার স্বভাব।
       নির্জনবাস ঈশ্বর চিন্তার জন্য রামকৃষ্ণদেব বলতেন। সে কথা তাঁকে মানাতো। রামকৃষ্ণের ঈশ্বর আর আমাদের ঈশ্বরের মধ্যে অনেক বড় পার্থক্য। দু’জনে দু’পাড়ার। আমাদের ঈশ্বর চাঁদা চায়, পুজো চায়, সিংহাসন চায়, তোয়াজ চায়, রথ চায়, মন্দির চায়, ষোড়োশ উপাচার চায়, রক্ত চায়, দল চায়, নিয়ম চায় – চায় না শুধু হৃদয় আর অন্তর্যামীত্ব। আমাদের ঈশ্বর অভিশাপ দেয়, প্রতিশোধ নেয়, লোভ করে, বায়না করে, হিসাব রাখে, বাঁশ দেয়, দেয় না শুধু চৈতন্য। সুতরাং আমাদের ঈশ্বরের সাথে রামকৃষ্ণ তথা যে কোনো মরমীয়ার ঈশ্বরের পার্থক্য অনেক। সেখানে নির্জনবাসের দরকার আছে। আমাদের হাতে স্যানিটাইজার আর মুখে মাস্ক বেঁধেও মন্দিরে যাওয়ার দরকার আছে। আসলে ওই পাথরের সাজানো মূর্তি, ধুপ-ধুনো-ফুলের গন্ধ, মন্ত্র, আরতি, ঢাক, ঢোল, কাঁসর, ঘন্টা – এই সব মিলে একটা রেডিমেড ধর্মের বোধ জাগিয়ে তোলে। সেটা নিত্য সংসারের মধ্যে নিজের মধ্যে মেলে কি করে? সে অভ্যাসই যে গড়ে ওঠেনি। শুনেছি শুধু, বিশ্বাস হয়নি তো যে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে একটা ঘর আছে। সেই ঘরের মধ্যে আরেকটা ঘর আছে। তার মধ্যে আরেকটা ঘর। এইভাবে ঘরের পর ঘর পেরিয়ে যেতে যেতে নেশা লাগে। নিজের মধ্যে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার পথ পাওয়া যায়। ঈশ্বর সেখানে থাকুন চাই না থাকুন, নিজের কেজো-কেঠো আমি থেকে একটা মুক্তি মেলে। যে রাস্তার কথা ফকির অমলকে বলেছিল না? সেই ক্রৌঞ্চদ্বীপের কথা। যেখানে গেলে সব হালকা হয়ে যায়। যে দ্বীপে যাওয়ার পথ ভিতরের দিকে?
       রবীন্দ্রনাথ বলতেন, শান্তিনিকেতন। তোমার অন্তরকে বাইরে থেকে রক্ষা করো। এত গেলো উপদেশ। কিন্তু সেটি কি করে করতে হয় তার উদাহরণ দেখতে গেলে নয় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বা প্রশান্তকুমার পালের শরণাপন্ন হতে হয় – দুই রবীন্দ্রজীবনী – সম্পূর্ণ আর অসম্পূর্ণ। সেই কথা আলোচনা করতে ইচ্ছা করে না। অনেকবার মনে হয়েছে উনি যে সব অপমানের ভিতর দিয়ে গিয়ে শান্ত থেকেছেন লিখি তা নিয়ে। কিন্তু হাত সরেনি। শিক্ষালয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি যে এখনও, তাই শিক্ষালয় নিয়ে লেখার ধৃষ্টতা আমি করতে পারিনে। তার বলা কথাগুলো আউড়ে যাই, যাতে আবার করে নিজেকেও শোনানো যায়, কিন্তু সে কৃতকৃত্য জীবনের দিকে তাকালে যে আমি নুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে যাওয়া, ডুবে যাই যে, কে লিখবে?
       কিন্তু আমার সেই নির্জনতায় ভাবের চারা রোপণ করি তো এদের নার্সারি থেকে চারা নিয়ে গিয়েই। সব গাছ বাড়ে না। অনেক গাছই মরে যায়। সেও তো আছে না? “কত প্রদীপ এই থালাতে সাজিয়েছিলে আপন হাতে/ কত যে তার নিভল হাওয়ায় পৌঁছল না চরণছায়ে”। সেই নির্জনতায় ভাবের কুসুম ফুটুক চাই না ফুটুক, সেই নির্জনতায় মাটি রুক্ষ হোক, বাতাস উষ্ণ হোক – তবু সে আমার। সেইটুকু ঘর কাউকে ছেড়ে দিলে সংসারে ভিখারির মত বাঁচতে হয়। এর ওর দরজায় ভালোবাসা, সুখ, মান ভিক্ষা করে করে বেড়াতে হয়। ভিক্ষায় কারোর দরকার হয় তো মেটে, কিন্তু আনন্দ আর তৃপ্তি মেলে কই?

       পরুষবাক্য, অপমান, মেজাজ – সহ্য করি না। তার অর্থ এই নয় যে কোমর বেঁধে মাঠে নামি। ও বোকামি। সময় নষ্ট। মানুষের এক অসামান্য ক্ষমতা আছে উপেক্ষা করার। সময় লাগে, কিন্তু এই একমাত্র ঔষধ। একবার ফোঁস করে, বিষ না ঢেলে, ত্যাগ। ত্যাগ মনে হওয়াই ভালো। এও রামকৃষ্ণদেবেরই কথা। এও ভালো কথা। গীতবিতানেরও কথা –
‘যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক/ তারা তো পারে না জানিতে/ সকলের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে।“

       ডুব দিলে আনন্দ। ডুব দিলে আলো। ডুব দিলে শান্তি। ডুব দিলে ছুটি।

266
Sun, 06/07/2020 - 11:00
      জ্ঞান কি আনন্দের বিষয় হতে পারে? হতে পারে। একমাত্র দর্শনে হতে পারে। নইলে জ্ঞান কেবল ব্যবহারের বিষয়। তা তো নয়। জ্ঞান মুক্তি। জ্ঞান সুখ। জ্ঞান আনন্দ। জ্ঞানের পাতায় ভক্তির জলের বিন্দু।
       জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই। জীবনানন্দ। জ্ঞান আর প্রেম কি আলাদা? লাভ ইজ ওয়াইজ। রাসেল সাহেব। প্রেমই জ্ঞান, জ্ঞানই প্রেম। জ্ঞানাগ্নি। প্রেমাগ্নি। জ্ঞানোন্মাদ। প্রেমোন্মাদ।
       তবে ভাষায় কি বলি? কিছু না। সব মিথ্যা। জ্ঞানহীন সব মিথ্যা। জ্ঞানহীন সব অসুখ। কার জ্ঞান হয়? সরল হলে হয়। রামকৃষ্ণ। কি সরলতা? বৃক্ষের সরলতা। মাটির সরলতা। আকাশের সরলতা। জলের সরলতা। শিশুর সরলতা। যেখানেই ঈশ্বরের প্রকাশ সেখানেই সরলতা। রামকৃষ্ণ। ঈশ্বর মানে জ্ঞান। সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম। উপনিষদ। সত্য জ্ঞান অনন্ত – এক কথা।
       তুমি নিজেকে নিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আছো। কিচ্ছু খুলছে না। সব জটিল। সব যেন ধাঁধা। কোনো ধাঁধার সমাধান হচ্ছে না। একটা দড়ি। অসংখ্য গিঁট। খোলা যাচ্ছে না। জাদুকর এলো। এক টানে সব গিঁট খুলে গেল। রামকৃষ্ণ। জাদুকর মানে জ্ঞান। জ্ঞানের উল্টোদিক প্রেম। একই কথা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা। কাম হল। অর্থ হল। ধর্ম হল। মোক্ষ চাই। কি মোক্ষ? জ্ঞান। আলগা দড়ি। ছুটির ঘন্টা। মুক্তি। কিসের থেকে? অবুঝ বেগ থেকে। অসহ্য অতৃপ্ত বাসনা জ্বালা থেকে। যা পায়নি, তার জ্বালা। যা পেয়েছি, তা ফাঁস। প্রাণ বড়বাজারে মাল ওঠাচ্ছে, নামাচ্ছে। মালিক পয়সা দিচ্ছে। গাঁজা টানছে। মনে হচ্ছে যেন সুখ। সুখ, তবে ঘোরের মধ্যের সুখ। ঘোর বাঁচাতে আরো নেশা। নেশা বাঁচাতে মালিকের আরো আরো গোলামি। আনন্দ নেই। সব শূন্য। নিহিলিজম। জগত মানে প্রহেলিকা। জগত মানে বিষাদ। জীবন মানে গোলামি।
       এ মিথ্যা কথা। ঋজুতা হীন। ঋজুতা মানে জ্ঞান। জ্ঞানের ঋজুতা মানে ধর্ম। প্রেমের ঋজুতা মানে ঈশ্বর। ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান পঙ্গু। বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। আইনস্টাইন। ব্যক্তি ঈশ্বর নয়। সে কল্পনা। বোধের ঈশ্বর। সে সত্য। সে জ্ঞান। সে মঙ্গল। সে চেতনা। সে আনন্দ।
       জীবন মানে কি? কিছু না। জীবন ধাত্র। বোধ মধু। বোধ আনন্দ। বোধের মধ্যে বোধের ঋজু সুখ। গভীর সুখ। আনন্দ। শত্রু কে? বিক্ষেপ। সুখ মিলনে। বিচ্ছেদ মানে বিক্ষেপ। জ্ঞান মিলনে। প্রেম মিলনে। বিক্ষেপকে হানো। বিক্ষেপ অশান্তি। বিক্ষেপ অসুখ। বিক্ষের অ-সুর। কিসে যাবে?
       কাঁদতে পারো? রামকৃষ্ণ। কার জন্য? ঈশ্বরের জন্য। কোন ঈশ্বর? না গো, মন্দিরের নয়। প্রতিষ্ঠানের নয়। ধর্মের নয়। তোমার মর্মের। তোমার মর্মে সুখ নেই। তোমার মর্মে তুমি একা। নিঃসঙ্গ। বিষয় সুখ মর্মে প্রবেশ পায় না। মর্মের মধ্যে কাঁদো। মরমী হও। মানুষের সব সুখের প্রকাশ নেই। কিছু সুখ অবর্ণনীয়। অনির্বচনীয়। যেই ভকত সেই জানে, তুমি জানাও যারে সেই জানে। রবীন্দ্রনাথ। মরমে সুখী হও। মরমী হও। শুধু জাগতিক হয়ে মানুষ বাঁচে না। শুধু তর্কে বুদ্ধি জেতে। মর্ম না। কাঁদলে মানুষ নরম হয়। লোকে মাগছেলের জন্য ঘটি ঘটি কাঁদে, ঈশ্বরের জন্য কে কাঁদে? রামকৃষ্ণ। নিজের মর্মের জন্য কাঁদো। ও মোর দরদিয়া। আসন হয়নি পাতা, মালা হয়নি গাঁথা, আমার লজ্জাতে হেঁট মাথা, ও মোর দরদিয়া। রবীন্দ্রনাথ। এই দুয়ার দেওয়া ঘরে, কভু আঁধার নাহি সরে, তবু আছ তারি পরে, ও মোর দরদিয়া। রবীন্দ্রনাথ। মরমে মরমী আসুক। দরদী আসুক। কাঁদলে আসে। ভাবলে আসে না। ভাবায় ভাবায় ভাবান্ত। অবশেষে সব ফক্কা। ফাঁকি।
       পাশ্চাত্য দ্বিধা বিভক্ত। কেউ বলল, জ্ঞান মানে অভিজ্ঞতা। কেউ বলল, জ্ঞান মানে মননের মধু। কান্ট বলল, দুই সত্য। ক্ষেত্র বিশেষে। বেদান্ত বলল, অভিজ্ঞতা মানে প্রকৃতির রাজ্য। অভিজ্ঞতাপূর্ব জ্ঞান, কান্টের ভাষায় যা প্রায়োরি, অর্থাৎ বিশুদ্ধ জ্ঞান, মানে পুরুষ। দুই সত্য। মানুষের দুই জগতই সত্য। তবে তার মধ্যে এক তৃতীয় জগত আছে, পরা জগত। সব ছাপিয়ে নয়। সব নিয়ে। স্পিনোজা বুঝেছিল। তাই বলেছিল জীবন মানে বোধ। ঈশ্বর আবেগহীন নৈর্ব্যক্তিক। শঙ্করাচার্য বলেছিল ঠিক বুঝেছিস। চৈতন্য দিয়ে চৈতন্যকে জানা। ওগো সার্জেন আলোটা এবার তোমার মুখের ওপর ফেলো। রামকৃষ্ণ। প্রেমটি যেদিন জ্বালি হৃদয় গগনে কি উৎসবের লগনে, সব আলো তার কেমন করে পড়ে তোমার মুখের পরে, আমি আপনি পড়ি আলোর পিছনে। রবীন্দ্রনাথ।
       জগত ঘুর্ণীয়মান নয়। তোমার ঘুরে ঘুরে মাথা ঘুরছে। তুমি স্থির হও, জগত স্থির হবে। রুমি। কামুক দেখে জগতময় কাম। লোভী দেখে অর্থ। আমি দেখি যেন রাম। তুলসীদাস। কে রাম? সিয়ারামময় সব জগ জানি। সমস্ত জগৎ যা ময়, সেই আমার রাম। বুকের মধ্যে আনন্দ ঘট। জ্ঞানের। প্রেমের। তুমি যদি সোজা তাকিয়ে দু কিলোমিটার স্পষ্ট দেখো, সেটা তোমার চোখের রেটিনা আর লেন্সের সমীকরণ। তার বাইরে ঝাপসা দেখলে সেও সেই সমীকরণের সীমাবদ্ধতা। তার মানে কি তার বাইরে কিছু নেই? আমি যদি পাঁচশো মিটার দেখি সেও আমার রেটিনা আর লেন্সের সমীকরণ। তার বাইরে কি কিছু নেই?
       অন্ধকারে হাত বাড়ালেম কাহারো তরে। রবীন্দ্রনাথ। হাত বাড়ানোই আসল কথা। সেই বিশ্বাস। অন্ধকারকে অস্বীকার করা নয়। আলোর সন্ধান, অন্ধকারের মধ্যে থেকে। বিশ্বাস। একদিন ঝড় থেমে যাবে। বিশ্বাস। শান্তং শিবং অদ্বৈতম ব্রহ্ম। সূত্র। উপনিষদ। দোগ্ধা রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে শান্ত হও। তারপর শুভকে আহ্বান করো। যা ভালো। যা মঙ্গল। তাই আসুক। শুভ বলেই আসুক। মঙ্গল বলেই আসুক। আর কোনো কারণ না। সেই শুভর শক্তিতে আড়াল দূর করো। তোমার নিজের সাথে নিজের। তোমার সাথে আমার। সেই শুভর শক্তিতে বাধা দূর হোক। রাস্তা বানানো হোক। সেতু গড়ে উঠুক। সব সত্য হবে। হতেই হবে। নইলে মহতী বিনষ্টি। সত্যং জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম।   [ছবি: Debasish Bose]
267
Sat, 06/06/2020 - 11:30
        কারণ বাবার বেঠিক হওয়ার ক্ষমতা নেই। বাবার পছন্দ, বাবার বিচার, বাবার সিদ্ধান্ত – সব সময় নির্ভুল। ঈশ্বর বাবাকে এ ক্ষমতা দিয়েছেন। সবার ভুলের উপর বাবার নিষ্ঠুর নির্ভুল কটাক্ষ। বাবার চোখ কোনো ভুল এড়িয়ে যায় না। বাবার উপস্থিতি ভয় আর নিশ্চিন্ততার একটা মিশ্র উপস্থিতি। বাবার সাথে ঈশ্বরের মতের অনৈক্য হয় না। হতে পারে না। ঈশ্বর বাবাকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। বাবার শারীরিক অসুস্থতা ছল। বাবা কখনও অসুস্থ হন না। ঈশ্বর বাবাকে অসুস্থ করেন না। বাবা ভ্রান্তিহীন।        মা ভুল। মা কখনও কখনও ঠিক। সে উদাহরণ খুব অল্প। মায়ের সব ঠিক বাবার সাথে ঠিক। মায়ের কয়েকটা ভুল বাবার ঠিকের বিপরীতে। বাবার মেনে নেওয়াতে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা। নইলে কবে মড়া পাখির মত খাঁচার ভিতর থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়ে যেত।        বাবার ভালোবাসা পাহাড়ে ওঠার রাস্তার মত বাঁকা বাঁকা। উঠে যেতে হয়। তবে পাহাড়ের শীর্ষে পৌঁছিয়ে নিজেকে সার্থক মনে করা যায়। বাবার ভালোবাসায় প্রতিটা মোড়ে বাঁকে পরীক্ষা দিয়ে দিয়ে এগোতে হয়। বাবার ভালোবাসাও বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল। ঈশ্বরের ভালোবাসার মত জেদি। বাবার ভালোবাসা বর্শার ফলার মত একমুখী। বুকে বিঁধে থাকলে উপড়ে ফেলতে নেই। সহ্য করতে হয়। বাবার উদাসীনতাও ভালোবাসা। ঈশ্বরের মত। বাবার তিরস্কারেও শিক্ষা। বাবার সাথে অমত হওয়া মানে খাদের ধারে চলে আসা। তারপর বাবার ক্ষমা। সমস্ত আত্মবিশ্বাস পুড়িয়ে ফেলা ক্ষমা। সমস্ত আত্মসম্মানকে অঞ্জলি দিলে ক্ষমা। ঈশ্বরের মত বাবা একমুখী, সহমতী ভালোবাসা চান।        মায়ের ভালোবাসা পুকুরের মত সবুজ। ওতে শরীর খারাপ হয়। বৃদ্ধি-বিকাশ আটকে থাকে। মায়ের মতামত চিত্তাকর্ষী বহুমূল্য গোলাপের পাশে গজিয়ে ওঠা ঘাসের মত। মাড়িয়ে যেতে সুখ। মাড়িতে গেলে মায়েরও সুখ – এমনভাবেই মাকে ভাবতে হয়। মা মানেই ভুল। সারিবদ্ধ ভুল। বাবার উষ্ণ আড়ালে বাঁচা ভুল। মায়ের ভালোবাসা বাড়তি। বিছানায় চাদরের নীচে থাকা নরম তোশক। মায়ের ভালোবাসা অলিতে গলিতে জমে থাকা ছাওয়ার মত। সিঁড়ির নীচে ঠাণ্ডার মত। আসল অঙ্ক করার জন্য রাফ খাতার মত। আসলে মা মানেই রাফখাতা। হিজিবিজি। অর্থহীন। দিনে দিনে অন্ধকারে ডোবা। অবহেলাতেও মাথা তোলা ভালোবাসা। তারপর ইচ্ছামত মাড়িয়ে গেলেও ঈশ্বরের চোখে না পড়া অস্তিত্ব।        বাবার মেরুদণ্ডের হাড়ে বানানো ছেলের মেরুদণ্ড। পরিণত। বাধ্য। মা’কে তাড়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। মা’কে প্রশ্রয় দিতে নেই। মা মানে ভুল। মা মানে জড়পদার্থের প্রাণের অভিনয়। অভিনয়কে আসল বলতে নেই। আখেরে তাতে মায়েরই ক্ষতি। আসলে তাহলে সংসার যাবে আটকে। আসলে তাহলে কঠিন হলেই মায়ের মুক্তি। আসলে তাহলে মা’কে ছাড়িয়ে বাড়তে পারাতেই যুক্তি।        বাবা মায়ের মুক্তির আয়োজন করছে। মানুষটার ত্যাগে ঈশ্বর নাওয়াখাওয়া ছেড়েছেন। একজন পুরুষ একজন অসুস্থ নারীর জন্য নিজের জীবনের কয়েকটা রাত কাটিয়ে দিল ঘুমহীন। সূর্য পরেরদিন দেরিতে উঠল লজ্জায়। রোদের মধ্যেও সে কয়েকটা দিন কেমন একটা কিন্তু কিন্তু ভাব। একজন পুরুষ ক্রমশ মহাপুরুষ হয়ে উঠছে। আয়োজন হচ্ছে সম্বর্ধনার দেবলোকে। দেবতার মধ্যে ঈর্ষা। একজন পুরুষ ক্রমশ দেবতা হয়ে উঠছে। মহানগরের প্রতিটা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে ‘লাইভ বুলেটিন’। একজন নারীকে মুক্তির দিকে এগিয়ে দিয়ে একজন পুরুষ নির্বাপিত হচ্ছে – একে বলে নির্বাণ।        বাবার মেরুদণ্ডে বানানো সন্তানের মেরুদণ্ড। উপেক্ষা করতে শিখেছে ধার্মিকের মত নারীকে। নারীর যন্ত্রণার প্রকাশ আছে, অস্তিত্ব নেই। পুরুষের যন্ত্রণার অস্তিত্ব আছে, প্রকাশ নেই। এ তত্ত্ব শিখেছে সে। যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠের সামনে চলে রাজনীতি, ক্রীড়ানীতি, সংগীত সাহিত্যের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার। নির্ভুল বিচার। একজন মৃত্যুপথযাত্রী মোহ কবলিত নারী শূন্য দৃষ্টে তাকিয়ে দেখে নিজের বানানো সংসার। দুর্বলতাকে যে বুঝেছে সত্য। অনিত্যকে যে জেনেছে নিত্য। এক একটা নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মাকে যে জেনেছে পুত্র-কন্যা-স্বামী। হায় রে মূঢ়! আত্মাকে কি তোমার স্নেহের আশায় এ মায়াময় নশ্বর জীবনলীলায় প্রবেশ করে? প্রতিবাদ কি ছিল না তবে কোনোদিন সে নারীর? ছিল। তবে মূল চলচ্চিত্রে সে অংশটুকু বাদ গেছে সম্পাদকের কাঁচিতে। ঈশ্বরের সম্পাদক।        প্রদীপ নিভে গেল। নিভুক, মশাল নয়। সূর্য নয়। ঘরের কোণে জ্বলে থাকা প্রতিভাহীন এক ক্ষুদ্র দীপ নিভে গেল। যে দীপের সলতে থেকে তেলের ভার বহন করেছে একজন পুরুষ। একজন জ্ঞানী, নির্মোহ, নির্ভুল, আত্মগত, সমাজ-জীব উদ্ধারক পুরুষ। দেবতারা পুষ্পবৃষ্টি করলেন। ঈশ্বর সংসারে কয়েক মাস যাবৎ ছুটি ঘোষণা করলেন। আনন্দলহরী বেজে উঠল। শোকের এত রূপ! শোকের এমন আমেজি চেহারা! হয় হয়। কর্তব্য সুচারু রূপে সমাধা হলে পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে ওঠে। পুরুষের জীবন আত্মত্যাগের কর্তব্যের ধারাপাত। ত্রুটিহীন। আত্মক্ষমাহীন। পুরুষকে ক্ষমা করে ঈশ্বর। নারীকে ক্ষমা করে পুরুষ।        এ সব তত্ত্ব সন্তান শিখে গেল। প্রথম থেকে শেষ অবধি সে পুরুষ। তার মেরুদণ্ডে বাবার মেরুদণ্ডের বীজ। সমস্ত অন্তর দিয়ে বাবাকে বিদ্বেষ করতে করতে সে নিজে বাবা হল। কেন বিদ্বেষ জানতে ইচ্ছা করে না। কেন বাবাকে অসহ্য লাগে, নিজের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়েও বুঝতে পারে না। বুঝতে চায় না। অনেক রাতে ছায়ার মত মায়ের শরীরটা সমস্ত আচ্ছন্ন চেতনা জুড়ে জেগে থাকে। ঘুমাতে চায় না। ঘুমাতে দেয় না। নিজের সন্তানকে বুকে টেনে নিয়ে শোয়। বাবার নির্ভুল অকরুণ চোখদুটো অসহ্য লাগে। এখন সে পুরুষ বৃদ্ধ। অশক্ত। ছেলে বাবার সেবা করে। তার স্নায়ুতে স্নায়ুতে বিদ্বেষ। বৃদ্ধ চোখ এখনও আনুগত্য দাবী করে। তার নিজের তরুণ চোখ সদ্যজাত নিজের সন্তানকে বশ্যতায় অবশ করতে চায়। তার সমস্ত বিদ্বেষ ঘিরে জেদ। জেদের বিপরীতে আরেক অবুঝ নির্বোধ, কে সে? যেন মায়ের মত ব্যর্থ হতে চায়। আবার পরক্ষণেই মোহ কেটে যায়। নাকি মোহ এসে জোড়ে?        ঈশ্বর দু’জন। মোহ দু’রকম। আকাশ অনেকগুলো। হৃদয় বহুরূপী। বাতাসে শ্বাসবায়ু আর বিষ। মাথাতে অবোধ ছুটির লালসা। জিভ হরবোলা।        মাঝে মাঝে বাবার মেরুদণ্ড খুলে বিছানায় রাখে। একা একা পর্যবেক্ষণ করে। নিষ্ঠুরতা মানে কি বিবেক? বিবেক কি কর্কশ? জানলা দিয়ে দক্ষিণের বাতাস ঘরে ঢোকে। ভিক্ষাপাত্র নিয়ে কে যেন সামনে এসে দাঁড়ায়? সে কি পুরুষ না নারী? সে বুদ্ধ না মা? সন্তানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জলে ভরে আসে। ঘুমন্ত ক্ষুদ্রপ্রাণের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করে – আমায় সহনশীল করো, আমায় সহনশীল করো। প্রার্থনা করতে করতে মনের মধ্যে সংশয়, যেন ঈশ্বর বাবার ঘরে বাবার সাথে বসে দাবার গুটি সাজাতে সাজাতে তাকেও নিজের দলে আনার চক্রান্ত করছে। তবে কার কাছে প্রার্থনা? প্রার্থনা বন্ধ। তারাভরা আকাশের নীচে দাঁড়ায়। স্ট্রীট লাইটের আলোর থেকে নিজের দৃষ্টিকে আপ্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করে, দেখতে চায় ধ্রুবতারা। নিজের চেষ্টায়। ভোর হয়ে যায়। শুকতারা বলে, আবার কাল এসো। শিখিয়ে দেব।
268
Sat, 05/30/2020 - 11:23
একজন শ্বেতাঙ্গ একজন কৃষ্ণাঙ্গ'র গলায় হাঁটু দিয়ে পাড়া দিয়ে আছে। কৃষ্ণাঙ্গ মারা যাচ্ছে কাতরাতে কাতরাতে। তারপর মারা গেল। ভিডিওটা, ছবিগুলো সারা সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে দেখলাম গতকাল। কয়েকদিন আগেই ম্যান্ডেলা'র জীবনী পড়লাম। তবে এই ঘটনাটায় কি বিস্মিত হয়েছি? না। বিস্মিত হইনি, যন্ত্রণা হয়েছে। মানুষ তো এরকমও। একজন শিশু শ্রমিকদের ট্রেনে চব্বিশ ঘন্টা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে। একজন মানুষ রাস্তায় পড়ে মারা যাচ্ছে। কাউকে সন্দেহ করে পিটিয়ে মেরে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে একঘরে করে তার বেঁচে থাকার যাবতীয় মূল উপাদান থেকে বঞ্চিত করে মরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে।
       মানুষ তো এরকমও। হিংসা, আক্রোশ, নিষ্ঠুরতা – এগুলো অচেনা শব্দ নয় তো। যতগুলো সিনেমা বানানো হয় দেশে আর বিশেষ করে বিদেশে, তার সাথে আজকাল যত ওয়েব সিরিজ বানানো হয়, তার মূল একটা বিষয়ই তো হিংসা। কেমন জীবন্ত খুনের দৃশ্য, কেমন বাস্তবের মত কপটাচার, ধূর্তামি, নিষিদ্ধাচার – সব অন্ধকারের গল্প। ভালো লাগে তো আমাদের। নইলে এত তাদের চাহিদা কেন? এত আলোচনা, এত আলোড়ন কেন? “পুরো রিয়েল লাইফের মত না?” আসলেই তো তাই। আমাদের রিয়েল লাইফ আর রিল লাইফ এত মিশে যাচ্ছে একে অপরের সাথে যে আমরা এখন আমাদের রিয়েল লাইফটাও রিল লাইফের মত করে চাইছি।        আমাদের থ্রিলার চাই। আমাদের ভায়োলেন্স চাই-ই চাই। আমরা কি বুড়িয়ে গেছি? আমাদের রক্তে কি জোশ নেই? আমাদের কি শত্রু নেই? আমাদের কি লড়াই করে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার নেই? এ সব আছে। তাই আমরাও আছি। আমাদের ছোটো ছোটো বৃত্ত আছে। তার পরিধি আছে। সেই পরিধি বরাবর আমার পাহারা আছে। আমার সেই পরিধি অনেক কিছু হতে পারে। আমার চামড়ার রঙ হতে পারে, আমার ধর্ম হতে পারে, আমার অর্থনৈতিক অবস্থান হতে পারে, আমার প্রতিভা হতে পারে, আমার রাজনীতি হতে পারে, আমার পেশা হতে পারে, আমার রূপ হতে পারে। সেই পরিধির পাহারাদার আমি। আমার ইগো। আমার অস্তিত্বের ধ্বজা। পতপত করে উড়ছে আমার আকাশচুম্বী আমিত্বে।        এর বাইরে যে সভ্যতা – সে রাস্তাঘাটের সভ্যতা, আইন-কানুনের সভ্যতা, ব্যবসা-বাণিজ্যের সভ্যতা, প্রযুক্তিকরণের সভ্যতা। সেই সভ্যতার গঠনমূলক আর কার্যমূলক একক – মানুষ। এক-একটা পরিধি আঁকা মানুষ।        শিক্ষাকে যদি মস্তিষ্কের তথ্যীকরণ না বলি শুধু, শিক্ষাকে যদি প্রবৃত্তির কুশলীকরণ না বলি শুধু, তবে শিক্ষার বড় একটা কাজ চিন্তা আর আবেগশক্তির আলোকিতকরণ। চিন্তা সুংসবদ্ধ, সংগত হয়ে উঠলে তা হয়ে দাঁড়ায় মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতা। তখন কোনো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ বা অবলোকন করার ক্ষমতা সামান্যীকরণের (generalization) মাধ্যমে বাস্তবানুগ হয়। সে নিজেকে একজন কেউকেটা ভাবে না। সে জানে সংসারে সব কিছুর একটা প্রথা আছে, ধারা আছে, নিয়ম আছে। সেটাকে উল্লঙ্ঘন করে চললে আদতে বেশিদিন টিকে থাকা যায় না। এই গেল চিন্তার দিক। আর আবেগের শক্তিকে শিক্ষিত করে তুললে ‘চরিত্র’ নামে একটা বড় কবচ তৈরি হয়। সেখানেও মানুষ নিজেকে সৃষ্টিশীলতা ও সংযমের পথে নিয়োজিত করতে পারে। আর দুইয়ের নিয়ন্ত্রণপ্রাপ্তিতে এমন একটা জীবনবোধ তৈরি হয় যেটা তার নিজের মধ্যে নিজেকে নিয়ে অক্ষুব্ধ থাকার, সন্তুষ্ট বাঁচার রাস্তা দেখায়। সে নিজেকে নিয়ে অনেক নিরাপদ তখন। বুদ্ধ বলেন, বিষে হাত দিলে তখনই সংক্রমণের ভয়, যদি হাতে কোথাও কাটা থাকে। সঠিক শিক্ষা সেই কাটাদাগটা মিলিয়ে দিতে পারে।        কিন্তু সব চাইতে গভীর সমস্যা হল, আমাদের এই সময়ে উচ্চপদস্থ, ক্ষমতায় আসীন, প্রভাবশালী ইত্যাদি বহু সভ্যবৃন্দের আচরণ। সাধারণ মানুষ ঠিক-ভুল যাই বুঝুক, সিদ্ধান্ত নিতে পারার ক্ষমতা তো তার নেই। সে তাই একজন সভ্য নির্বাচন করে তার হয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে। বাস্তবে সে তার চোখ না হয়ে তার চোখে বাঁধা কাপড় হয়ে দাঁড়ায়, সে তার মুখ না হয়ে তার মুখের মধ্যে গোঁজা কাপড় হয়ে দাঁড়ায়। সে আন্দোলন করে, চীৎকার করে, প্রতিবাদ করে – কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস করে আসলে ক্ষমতায় এলে ওরকমই হয়। তাই একজনকে সরিয়ে আরেকজনকে আনলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই – 'যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ' হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, যে সেই ক্ষমতায় এসেছে, সেও সেই সাধারণের থেকে উঠে আসা মানুষ, যে কুশলী, যে তথ্যীকৃত মস্তিষ্কের বাহক, কিন্তু যে আদতে জানে না কি করে নিজের চিন্তার আর আবেগের দিক নির্ণয় করতে হয়। সে দিক নির্ণয় করার ধ্রুবতারাটি কি? সে শিক্ষা সে পায়নি। সে ধ্রুবতারাটি চিরটাকাল একটাই – বোধের সামান্যীকরণ। যখন কাউকে আমরা মহাত্মা বলি, তখন বলতে চাই অনেক ক্ষুদ্রাত্মা তার মধ্যে এসে আশ্রয় পেয়েছে বলে সে মহাত্মা। একজন উদারচিত্ত মানুষ বলতে তাই বুঝি। এই উদারতাই সামান্যীকরণের বেগ, প্রাণশক্তি।        তবে কি বিশেষ বলে, উৎকর্ষতা বলে কিছু থাকবে না? অবশ্যই থাকবে, সেটা ব্যক্তিবিশেষের প্রতিভা, ক্ষমতার বিশেষত্ব। কিন্তু চিত্তবৃত্তি তো আর ক্ষমতা নয়। সেখান থেকে একটাই শক্তি আসে, তাকে অনুকম্পা, সহানুভূতি ইত্যাদি যে নামেই অভিহিত করি না কেন।        একটা ঘটনা মনে পড়ল। উদাহরণ হিসাবে বলি। দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত গায়িকা এম এস শুভলক্ষ্মী একটা অনুষ্ঠান করে বাড়ি ফিরেছেন বেশ রাতে। এমন সময় এক গরীব পরিবার তার দরজায় এসে উপস্থিত হন। একজন পুরুষ তার বৃদ্ধা মা আর ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক দূর থেকে আসছিলেন গান শুনতে। কিন্তু রাস্তায় নানা কারণে পৌঁছাতে দেরি হয়। অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়। সেই পুরুষমানুষটার মা ভেঙে পড়েন। তাই অনুরোধ জানাতে এসেছেন যদি একটা গান অন্তত শোনানো যায়। এম এস শুভলক্ষ্মী তাঁর বাড়ির উঠানে বসে তাদের কয়েকটা গান শোনান।        একবার আমার মা কিশোরী আমোনকরের একটা গান টিভিতে শুনে মুগ্ধ হয়ে যান। তখন মা খুব অসুস্থ। আমি অনেক খোঁজ করে জানতে পারি উনি এই গানটা এখনও রেকর্ড করেননি। আমি নেট ঘেঁটে ওনাকে ফোন করি মুম্বাইতে। উনি সবটা শুনে বলেন ওনার এক ছাত্রী চন্দননগর থেকে আসে, তিনি তার হাতে আমার জন্য ওটা রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন। গানটা ছিল, "মন শিব শিব কি শরণ হো, যব প্রাণ তন সে নিকলে", ভৈরবীতে বাঁধা অসামান্য একটা ভজন।        এইটাই বলতে চাইছিলাম, প্রতিভা যাই থাকুক না কেন, চিত্তের ঔদার্যতায় যদি তার স্বাধিষ্ঠান না হয়, তবে আদিম প্রবৃত্তির হাত থেকে নিস্তার পায় কি করে মানুষ? উপনিষদে একটা কথা আছে – নির্বিশেষ। কথাটা আমার খুব ভালো লাগে। প্রথাগত শিক্ষার সবটুকু যেমন আমাকে অমুকের মত হতে হবে'র দিকে, তাকে প্রতিস্থাপিত করে কবে যে ‘আমাকে বিকশিত হতে হবে বা evolved হতে হবে’র দিকে যাবে জানি না। আগন্তুক সিনেমার শেষ কথাটা দিয়েই শেষ করি – কে দেবে আলো? কে দেবে প্রাণ?    
269
Tue, 05/26/2020 - 21:00
  যেন আমার দোষ। যেন আমার অপরাধী না হলেই নয়। যেন আমায় বলতেই হবে, হ্যাঁ আমার ভুল ছিল।        দোষ খোঁজার দরকার নেই। রামকৃষ্ণদেব সংসারীকে পাঁকাল মাছের মত সংসারে থাকতে বলেছেন, যাতে গায়ে পাঁক না লাগে। ভালো কথা, কিন্তু পাঁক ছোঁড়াছুড়ি করতে তো বলেননি? আমি নিজেকে পাঁক থেকে বাঁচানোর জন্য অন্যের গায়ে পাঁক ছুঁড়ে দেব, এটা কি খুব ন্যায়ের কথা হল?        ইংরাজিতে একটা কথা প্রচলিত আছে - Toxic Person. এই টক্সিক মানুষ মানে কি? মানে হল যে আরেকজনকে কোনো না কোনো আছিলায় দোষী, অপরাধী সাব্যস্ত করে ছাড়ে। ছাড়ে? না ছাড়ে না, ঘ্যানঘ্যান করেই চলে, করেই চলে। কোনোভাবে কাউকে নীচু, ভুল ইত্যাদি প্রমাণিত না করে সে নিজের মতামত ব্যক্ত করতেই পারবে না। একে বলে টক্সিক মানুষ। এখন এই টক্সিক মানুষের সাথে যে মানুষগুলোর নানাবিধ সম্পর্ক, বোঝাই যাচ্ছে তাদের গতি কিরূপ হবে। আমায় একবার একজন কথায় কথায় বলেছিল, "এই জন্যে তোমার কিছু হল না।" গোত্তা খাওয়া কথা। তার সাথে আমার বেশ দীর্ঘদিনের পরিচয়। আমায় ভালোভাবেই চেনে। তাই কথাটা বেশ ভেবে দেখার মত। একটু ভাবতেই ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হল। সে বেশ উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারী। কিন্তু আমি নই। আমি নেহাতই মাস্টার। তার উপর আমি যদি আমার মতামত স্পষ্ট করে জানাই, এবং সেই মতামত যদি আমার আত্মমর্যাদাবোধ ও উক্ত ব্যক্তির অহমিকাবোধ একে অন্যের বিপরীতে দাঁড়ায়, তবে টক্সিসিটি বাড়বে বই কি! তাই সে বলে বসল, কি জানো, আমার যার সাথেই পরিচয় হয় আগেভাগে তার দুর্বল জায়গাগুলো জেনে নিই, তারপর ব্যাগড়বাই করলেই সেখানে মারি খোঁচা। এই যেমন আমার অফিসে, উনি ফেসবুকে কবিতা লেখেন, তা আমার চাইতে তার লাইকের সংখ্যা ঢের কম, আমি সেদিন অফিসে দেরি করে গেছি বলে যেই না কথা শোনাতে এসেছে, দিয়েছি মোক্ষম - "বলি আপনার লেখায় ক'টা লাইক পড়ে? আমার দেখেছেন?....."        অগত্যা সে এইসব বলে ক্ষান্ত হল। আমিও মানে মানে তাকে বকিয়ে ক্ষান্ত দিলাম সেই যাত্রায়। যদিও সে অনেককাল আগের কথা, আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল। একজন এসে সারাটা দিন হাপিত্যেশ করে জানালো, সে যাকে ভালোবাসে, সে নাকি তাকে ভালোবাসে না, তা না, অস্পষ্টতায় ভালোবাসে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, সে কেমন ভালোবাসাবাসি? সে যা বলল, ঘটনাটা এই...        সে যখন কলেজে পড়াত তখন একখেন ছাত্রীকে তার মনে ধরে। ভালো কথা। মন যখন আছে তখন ধরবেই। হয় ব্রহ্মজ্ঞান, নইলে সংসারজ্ঞান - একদিকে গতি তো হতেই হবে। তা সে মেয়েও নাকি তাকে মেসেঞ্জারে 'হামিটামি' দেওয়া ইমোজি পাঠাত।        এই অবধি যেই না বলেছে অমনি আমার জ্যাঠা মন আমার কাঁচা মনের দিকে ভুরুটুরু কুঁচকিয়ে তাকালো - মানে হচ্ছে, ইয়ে তুমি কাউকে এরকম 'হামিটামি' মার্কা ইমোজি পাঠিয়েছ কি? আজ্ঞে বিস্তর পাঠিয়েছি। আমার কাঁচামন মাথা নীচু করল। না না লজ্জায় নয়, চোখাচোখি এড়াতে।        আবার গল্পে ফেরা যাক। সে বলে চলল, কিন্তু যেই না তার কলেজ শেষ হল অমনি সে কেমন পাল্টে গেল।        আমি মনে মনে ভাবলুম, গেল তো গেল আপদ গেল। আমি বলে এদিকে ঝড়জল, করোনা, ছাত্রছাত্রী নিয়ে সামাল দিতে জেরবার হচ্ছি, ইনি এলেন বৃন্দাবনলীলা নিয়ে। উফ! যেই না ভাবা অমনি কল্পনায় দেখলুম রাস চলছে, সব্বার মুখে মাস্ক বাঁধা.... মায় রাধা অবধি, রাধার মাস্কে একটি শিখীপাখা আঁকা যাতে কৃষ্ণ চিনতে পারেন। কিন্তু দেখা গেল সব গোপীরাই শিখীপাখা মাস্ক পরে ফিল্ডে নেমেছে। ব্যস, এবার কৃষ্ণ যায় কোথায়? হলেন না হয় তিনি অন্তর্যামী, কিন্তু অন্তরে তো সবারই এক আত্মা শুনেছি, ফলে সেখানেও তিনি যুত কর‍তে পারলেন না। তার মনে পড়ে গেল বালী-সুগ্রীবের মারামারি আগের অবতারের সময়ে, মানে রামের কেসে যা হয়েছিল। কিন্তু এই বার?        উফ্... কি কথায় এসেছি দেখলেন, কথা হচ্ছিল প্রেম রাস নিয়ে আমি চলে এলাম বানর নিয়ে, করোনা-উম্পুন-পঙ্গপালে মাথা কি আর ঠিক থাকে বলুন? যা হোক। তা গল্প হল প্রেমিকা আবার ফিরে এল.. আর শুরু হল বাইপোলার প্রেম।        না না, এই নামটা তার দেওয়া নয়। আমার দেওয়া। বাইপোলার প্রেম কেমন? অনেকটা গেছোদাদার মত। যখন মনে করবে সে তোমায় ভালোবাসছে তখন আসলে সে তোমায় ভালোবাসছে না। আবার যখন মনে করবে সে তোমায় ছেড়ে গেল, হঠাৎ তার ঘামের কি ডিও-র গন্ধ তোমার নাকে, অর্থাৎ সে এসে পড়েছে আবার!        আমি বললুম, তা কয়েকটা হামির ইমোজিতে তুমিও বা এমন টসকে যাচ্ছ কেন চাঁদু?        সে লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলল, ইয়ে মানে শুধুই কি ইমোজি?        আমি ধাঁ করে জানলার দিকে তাকালাম। বাইরে মেঘ করেছে আকাশে, হে বাবা শঙ্করাচার্য, আমায় অদ্বৈতজ্ঞানে অন্তত এই মুহূর্তের জন্য কানেকশান দাও বাবা... আমায় আরো কি শুনে ফেলতে হয়... আমার লজ্জা রাখো বাবা... মোহমুদগরটি দাও বাবা, হয় এর মাথায় মারি নয় নিজের মাথায় মেরে অজ্ঞান হই।        সে আরো বলছে। আমার জানলার পর্দা সজল হাওয়ায় চঞ্চল হয়ে উঠেছে। সে বলছে....            কিন্তু সে আমায় বড় অপমান করে...        আমি বললুম, ভালোবেসে? না, না ভালোবেসে?        সে একটু ভেবে বলল, দুটোই।        বললুম, কি বলে?        সে বলল, সে তার মুডের উপর চলে। আমায় না ধরে না ছাড়ে....        আমি বললুম, তা তুমি ধরা খেতে চাও না ছাড়া পেতে...        সে বলল, আমি জানি না।        তাকিয়ে দেখি তার ছলছল চোখ। মানে মনে ব্যথা। সাথে ভালোবাসা। তার সাথে অপমান। তার সাথে সম্পর্কের ভবিষ্যতের কুজ্ঝটিকা।        বললাম, বেরিয়ে এসো।        সে অনেকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে বলল, হুম।            সে চলে গেল। তখন বাইরে রীতিমতো ঝোড়ো হাওয়া। আমি ভাবলাম তাকে ডেকে বসতে বলি। বললাম না। যা ঝড় তার ভিতরে। ওকে শান্ত করি আমার এমন ক্ষমতা নেই। একবার ভাবলাম বলি, নিজের মর্যাদা থাকে না যেখানে সেখানে যাকে ভালোবাসা বলছ, সেকি মোহ নয়? মানুষ নিজেকে অপমানিত একমাত্র মোহের বশে করে। সেটুকু না করলেই নয়? সারাদিন কত মানুষকে দেখি অন্যকে সুখী করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি কাউকে কিছুক্ষণের জন্য আনন্দ হয় তো দেওয়া যায়, কিন্তু কাউকে সুখী বা দুঃখী করা কি সত্যিই আমাদের হাতে? সে যে হয় আপনিই হয়, যে না হয় তাকে স্বর্গে রাখলেও বলবে, হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে...        কিন্তু মোহতে বুঝতে দেয় না, মর্যাদা বস্তুটা খাঁটি, ভালোবাসাটি নয়। ও বস্তু নিয়ে বেশি মাতামাতি করলে ভালোর চাইতে মন্দই ঘটে বেশি।        সে বাড়ি ফিরে ফোন করল, আজ ভালোভাবে কথা বলেছে বলে নাকি সে সুখী.... কি আনন্দ...        হায় রে হায়.... বাইরে বেশ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আমি বরং বৃষ্টি দেখি। কারেন্ট নেই। ঝড়ের জন্য। কে কোথায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মরে... কিন্তু তবু তো কেউ কেউ ঝুঁকি নেয়... বেশিই ঝুঁকি নেয়...        যাক গে এসব তত্ত্বকথা, আমি বরং কৃষ্ণ তার রাধাকে খুঁজে পেল কিনা দেখি....
270
Sat, 05/23/2020 - 22:00
    প্রশ্নটা হল, মানুষের স্বভাবের কি রূপান্তর ঘটানো সম্ভব?          মানুষের স্বভাবকে দুইভাগে ভাগ করা যায় – এক, জন্মগত – যা ইনস্টিংক্ট; আর দুই, শিক্ষার দ্বারা অর্জিত বা অভ্যাসের দ্বারা অর্জিত। জিজ্ঞাসা হল, জন্মগত যে স্বভাব তার রূপান্তর ঘটানো যায়?        মানুষের জন্মগত স্বভাব দীর্ঘকালের অভিব্যক্তির সমষ্টিগত রূপ। তা আদিম, অকৃত্রিম, অমার্জিত, বর্বর। যদিও সবটা বর্বর নয়, মানুষের খিদে, তেষ্টা, ঘুম, কামাবেগ, আত্মরক্ষার তাগিদ – ইত্যাদি অবশ্যই নিষ্পাপ। এ সব প্রবৃত্তি মনুষ্যেতর জীব থেকে চলে আসছে। পশুদের মধ্যেও তাগিদ আছে নিজের প্রভুত্ব নিয়ে লড়াইয়ের। গোষ্ঠী সৃষ্টি করে সেই গোষ্ঠীর নেতা হওয়ার প্রবৃত্তি শিম্পাঞ্জি, হনুমান ইত্যাদি পশুজগতেও আছে। তাদের জগতেও ভাণ করার উদাহরণ আছে। তাদের জগতেও হিংসা, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি আছে। কখনও আত্মরক্ষার তাগিদে, কখনও বা নিজের প্রভুত্ব জাহির করতে – কোনো না কোনো তাগিদে পশুদের মধ্যে যে বর্বরতা তা মানুষের মধ্যেও আছে। কারণ মানুষও পশু – সামাজিক, বুদ্ধিযুক্ত পশু।        মানুষের স্বভাবের যে দিকগুলোকে রিপু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, অর্থাৎ কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ(অহমিকা)-মাৎসর্য(ঈর্ষা) – এই ষড়রিপু কি মানুষের জন্মগত স্বভাবের মধ্যে পড়ছে না? বিশেষ করে প্রথম তিনটে – কাম-ক্রোধ-লোভ। এগুলো মানুষকে কেউ শেখায় না। এগুলো সে নিয়েই জন্মায়। অর্থাৎ, তার জন্মগত প্রবৃত্তি। বাকি রিপুগুলোও তাই। শুধু রিপুই বা বলি কেন? আমাদের সুরক্ষিত থাকার চাহিদা, যার বিপরীত ভয়, এও আমাদের সেই আদিম স্বভাবের আরেক দিক।        ধর্ম মানুষকে প্রথম বলল, তাকে এই সবের বাইরে যেতে হবে। মূল উচ্ছেদ করতে হবে। পৃথিবীর সবক’টা প্রতিষ্ঠিত, প্রধান, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর মূল কথাই হল – ভালো হতে হবে। স্বভাবের জন্মগত ত্রুটিগুলো থেকে নিজেকে মুক্ত করতে হবে। একজন ভালো মানুষ হতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিটা ধর্মের মূল কথা এক। কেউ বলল, ভালো হলে স্বর্গে যাবে; কেউ বলল, ভালো হতে পারলে নির্বাণ পাবে; কেউ বলল, ভালো হতে পারলে মোক্ষ পাবে; কিন্তু মূল কথা সবার এক – ভালো হতে হবে। ‘ভালো হওয়া’ মানে জন্মগত স্বভাব থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শিক্ষাগত, অর্থাৎ অর্জিত স্বভাবের হাতে নিজেকে ন্যস্ত করতে শিখতে হবে। কয়েকটা মূল কথা যেমন – হিংসা ত্যাগ করতে হবে, মিথ্যা ত্যাগ করতে হবে, করুণা রাখতে হবে।        এগুলো কি করে হবে? কোনো ধর্ম ধ্যানের উপর জোর দিল, কোনো ধর্ম প্রার্থনা, কোনো ধর্ম সেবা, কোনো ধর্ম নাম-গান, কোনো ধর্ম ভ্রাতৃত্ববোধ ইত্যাদি। এগুলো সবই আমার আদিম স্বভাব থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য নানা অভ্যাস।        আর ভয়ের কি হবে? আমার আত্মরক্ষার তাগিদ? আমার নিজের অস্তিত্বের নিরাপত্তার তাগিদ? আমার দৈহিক নিরাপত্তাবোধের ভার নানা দেবদেবী থেকে বিজ্ঞানের আওতায় পড়ে গেল। আমার মানসিক নিরাপত্তার বোধ? না, সেটা বিজ্ঞান দিতে পারল না। তাই সেখানে নানা গুরু, মত, ইজম, প্রতিষ্ঠান, দেশভক্তি ইত্যাদি নানাবিধ বড় কিছুর সাথে যুক্ত হওয়ার প্রবণতা থেকে গেল। সেদিকে টালমাটাল হলে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। প্রয়োজনে হিংস্র হয়েও উঠি।        কিন্তু ওদিকে ধর্মের কি হল? দিন যত গেল, তত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিকৃতি এলো, মুখ্য গৌণ হল, আর গৌণ মুখ্য। যে কোনো প্রতিষ্ঠান যেমন অবশেষে প্রতিলিপি বা রেপ্লিকা বানাতেই শেষে অভ্যস্ত হয়ে যায়, কিম্বা বলা যায় মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে শুধুই আড়ম্বরযুক্ত আনুষ্ঠানিক হয়ে যায়, ধর্মের পরিণতিও তাই হল। অনেকে এসে মাঝে মাঝে মেরামতির চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু কাজ তেমন কিছু হল না।        কিন্তু কথা হল, এত ধর্ম, এত মতামত, এত বিশ্বাস, এত তত্ত্ব, এত ব্যাখ্যা – এর পরিণাম কি? জগৎ কি হিংসাশূন্য হল? জগৎ কি মিথ্যাশূন্য হল? জগৎ কি নিষ্ঠুরতামুক্ত হল? হল না।        এরপর এল নানা রাজনৈতিক মতাদর্শ। তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য – সাম্যবাদ। কিন্তু এই সাম্যবাদে প্রতিষ্ঠিত দেশগুলোর ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে কি মনে হয় তারা তাদের জনসাধারণের মধ্যে থেকে লোভ-ঈর্ষা-ক্রোধ ইত্যাদি দূর করতে পেরেছে? তারা সবাইকে এমনভাবে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে মানুষ নিজে থেকেই নিজের সম্পদ সবার সাথে ভাগ করে নিয়ে একসাথে মিলেমিশে এক নীতিতে, এক অবস্থানে থাকতে চাইছে? বলাই বাহুল্য, তা হয়নি।        অর্থাৎ, এত হাজার বছর ধরে আমাদের ধর্মনীতি আর রাজনৈতিক আদর্শ যা শিখিয়েছে তা মোটের উপর ব্যর্থ, কয়েকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা বা ব্যক্তিত্ব বাদ দিলে। আদিম রিপু রয়েই গেছে, শুধু তার সুক্ষ্মতা বেড়েছে, প্রকাশের ভঙ্গী বদলেছে, ক্ষেত্র বদলেছে। বাকি যা তা-ই রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে ধর্মক্ষেত্র সিসিটিভি-র তত্ত্বাবধানে। আমরা জানি ঈশ্বর বা শিক্ষা দুই-ই বেশিরভাগ মানুষের চামড়ার খুব গভীরে যায়নি, যেখানে রিপুর রাজত্ব সেখানে রাবণই রাজা। রাম বড়জোর বৈঠকখানা অবধি পৌঁছাতে পেরেছে। আচরণ অনুকরণ অবধি ঠিক আছে যতক্ষণ সে অভিনয় পরিবেশের অনুকূল। যেই পরিবেশ প্রতিকূল হল, অমনি আচরণ আর অনুকরণ নয়, আচরণ তখন অন্তরের রিপুনিকেতন হেড অফিসের দখলে। চেনা সাধুমানুষ, ভালো মানুষ তখন অচেনা।        তবে ধর্মে হল না, শিক্ষায় হল না, রাজনৈতিক আদর্শেও হল না। তবে হল কিসে? হল না তো! মানুষের স্বভাবের রূপান্তর তো হল না, তবে কি হল? হল পরিবর্তন। মানুষ আরো বেশি চালাক হল, ধূর্ত হল। সেই চালাকি, ধূর্তামির কিছুটা অংশ সভ্য ব্যবহার, আদবকায়দা, নানা ব্যবহারিক কৌশলাদিতে ঠাঁই পেয়ে গেল। অর্থাৎ এটাও অভিনয়, এটাও চালাকি, এটাও ধূর্তামি – কিন্তু সমাজের জন্য ভালো, তাই স্বীকৃত। মিষ্টি কথা, মিষ্টি হাসি, মিষ্টি ব্যবহার – এ সবই সমাজে স্বীকৃত, অভ্যাসে রপ্ত করে সামাজিক হয়ে ওঠার জিনিস। এ কি আমাদের ধর্ম শেখালো? না। বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদি শেখালো? না। আমাদের এতদিনের অভ্যাস শেখালো। আমাদের সামাজিক অভিব্যক্তি শেখালো কোন ব্যবহার আমার পক্ষে আর সমাজে টিকে থাকার পক্ষে মঙ্গল। তাই পুলিশ বাড়ল, আইন কঠিন থেকে কঠিনতর হল, শাস্তির প্রকার বদলালো। মানুষের আদিম স্বভাবের সাথে তার অর্জিত অভ্যাসরপ্ত স্বভাব একটা সমঝোতায় এলো। তার হিংসা রয়ে গেল। তার ঈর্ষা রয়ে গেল। তার প্রভুত্বের চাহিদা রয়ে গেল। তার তীব্র কামলালসা রয়ে গেল। সবই রয়ে গেল। সমাজে এ সব চরিতার্থ করার জন্য ক্ষেত্রও নির্মিত হল। বিজ্ঞান এসে বলল, এ সবই জীবজগতে পশু থেকে মানুষ হওয়া অবধি অভিব্যক্তির পথের শর্তাবলী, এ অপরিবর্তনীয়, একে কিছুটা বাহ্যিকভাবে উপরসা উপরসা অন্যরকম চেহারা দেওয়া যেতে পারে বড়জোর, কিন্তু একে একেবারে নিঃশেষ করা অসম্ভব। এইভাবে সুর আর অসুরে মিলে তৈরি হল আধুনিক সমাজের ভিত। যা মূলে আদতে সেই আদিম। বাইরে থেকে নানা আভরণে যুগে যুগে সজ্জারূপী খোলসত্যাগী। আবার নতুন সজ্জার পরিধান করে আবার নতুন সাজে।        এই সমঝোতার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ধর্মও থাকল। সে থাকল অধুনা আমফানে উৎপাটিত বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছটির মত। তার মূল প্রধান কাণ্ডটি যেমন অদৃশ্য। তেমনই তার যে মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ‘ভালো হও আর ভালো করো’ কথাটা, তা সে আজ আর জোর গলায় বলতে পারে না। সে দল গড়ে, ভেদ টানে, ক্ষণে ক্ষণে এর তার উপর চড়াও হতে প্রেরণা যোগায় – মোট কথা সে যাকে উৎখাত করতে সৃষ্ট হয়েছিল, সেই আদিম রিপুরই দাস সে এখন। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকটা ব্যতিক্রমী উদাহরণ ছাড়া।        তবে প্রথম প্রশ্নটা আবার শেষে এসে দাঁড়ালো। মানুষের আদিম রিপুর সেই স্বভাবের কি সম্পূর্ণ রূপান্তর সম্ভব? উত্তরে বলতে হয়, না। তবে যে প্রাচীন সভ্যতার থেকে আধুনিক সভ্যতা অনেক উন্নত, উন্মুক্ত, উদার, তা কি অস্বীকার করি? হ্যাঁ করি। যেটুকু খোলনলচে বদলেছে তা শুধু বাইরের থেকেই, আপাতদৃষ্টিতেই বদলেছে। ভিতরে ভিতরে সেই একই ঘটনা ঘটে চলেছে। আজ হয় তো সতীদাহ প্রথা নেই, কিন্তু আজও নির্ভয়ার মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেই চলেছে। কিছু প্রকাশিত, অধিকাংশই অপ্রকাশিত। এরকম উদাহরণ দিতে শুরু করলে শেষ হবে না। তার চাইতে সত্যজিৎবাবুর ‘আগন্তুক’ সিনেমাটাই যথেষ্ট হয় তো।        তবে উপায়? উপায় একমাত্র মনোবিজ্ঞান। নিজের আচার আচরণ মনোভাব নিয়ে সচেতনতা। নিজেকে নিজের পর্যবেক্ষণে রাখা। এর বাইরে যে শিক্ষাই থাকুক, তা শুধুমাত্রই বাইরের। আমার ষড়রিপু আছে – এ বিশ্বাসের মূলে আঘাত হানা। আমি নিজেই ষড়রিপু। আমিই রাগ, আমিই লোভ, আমিই ঈর্ষা। তবে নিজেকে স্পষ্ট চেনা যায়। নিজেকে বোঝা যায়। নিজেকে মিথ্যা বলার অভ্যাসটা যায়। নিজেকে মিথ্যা বোঝানোর খেলাটা শেষ হয়। ঈশ্বরের ঘাড়ে, দৈবের ঘাড়ে, সময়ের ঘাড়ে, পরিস্থিতির ঘাড়ে, বংশগত প্রাপ্ত জিনের ঘাড়ে - ইত্যাদি নানা দৃশ্য, অদৃশ্য, কল্পিত কিছুর ঘাড়ে দায় না চাপিয়ে নিজের উপর নেওয়ার অভ্যাস হয়। তখনই কিছু আশার আলো দেখা যায়। ফাঁকি দেওয়ার জায়গা আর অবশিষ্ট থাকে না বলেই হয় তো।    
271
Sun, 05/10/2020 - 11:30
  যখন স্কুলে যেতাম রাস্তার ধারে এক বিরাট গাছ পড়ত। কি সে গাছ আমার নাম জানা নেই। একটা নাম হয়ত বানিয়ে লিখে দেওয়া যেত, কিন্তু কি দরকার, গাছের ছায়ার তো কোনো নাম হয় না। এই গাছটাও ছিল তেমন। সে গাছে কোনোদিন ফুল, ফল দেখেছি বলে মনে পড়ে না। কিন্তু ছায়াটা মস্ত করে পড়ত, কিছুটা রাস্তায় আর কিছুটা ঘাসে। গরমের দিনে স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখতাম কোনো ফেরিওয়ালা, কোনো রিকশাওয়ালা, কোনো ভিখারি, কোনো দিনমজুর সে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছে। কেউ গামছাটাকে পাকিয়ে মোটা করে মাথার তলায় দিয়ে ঘুমাচ্ছে, কেউ রিকশাতেই সিটে বসে পা’টা সামনে টানটান ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে, কেউ গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে বিড়ি খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে আছে – এক একদিন এক এক রকম দৃশ্য।        মানুষের জীবনে অনেক না-মানুষী আত্মীয়তা থাকে। সে আত্মীয়তাগুলো এমন দাবিহীন নিস্তব্ধ যে তাদের আলাদা করে চোখে পড়ার জো নেই। কিন্তু তারা আছে। পশুপাখি-বারান্দা-দালান-মাঠ-পথ-গাছ-রাস্তার আলো-বাথরুমের কল-ছাদের ফাটা দাগ-কার্ণিশের ভাঙা ইট এরকম এত অজস্র অলক্ষ্য আত্মীয়তায় জড়িয়ে আমরা যে প্রত্যেককে আলাদা করে উল্লেখ করা সম্ভব হয় কই? আমার মন খারাপ হলে তাদেরও মুখ ম্লান হয়, মন ভালো থাকলে তারাও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।        এ গাছটার সাথেও দীর্ঘদিন যাতায়াতে আমার একটা আত্মীয়তা গড়ে উঠেছিল। যেদিন কেউ নেই তার ছায়ায়, ফাঁকা রাস্তা আলস্যে শুয়ে আমার সামনে, আমি রাস্তা থেকে নেমে সে গাছটার নীচে এসে দাঁড়াতাম, তার গায়ের ফাটা ফাটা ছালের ভিতর দিয়ে যাওয়া পিঁপড়ের সার দেখতাম, কি তাদের যাওয়ার তাড়া। গাছের উপরে বসে থাকা কাকের ক্লান্ত ডাক শুনতাম, কাকে ডাকছে এই খাঁ খাঁ দুপুরে ঠাহর করতে পারতাম না, মাথা তুলে এদিক ওদিক অন্য কোনো কাককে খুঁজে দেখতাম। কোনো কাককে না দেখতে পেলে মনে হত হয়ত আমার উপস্থিতি তার নিশ্চিন্ত বিশ্রামে ব্যাঘাত আনছে, তাই সে জানাচ্ছে, কিম্বা আনন্দ পাচ্ছে। খানিক দাঁড়িয়ে আবার বাড়ির পথে রওনা দিতাম।        একবার স্কুল থেকে ফিরছি, ঘন কালো করে মেঘ এলো। যদিও ছাতা সাথে কিন্তু এমন জোর বৃষ্টি এলো যে সে গাছের তলায় না দাঁড়িয়ে যাই কোথায়। গাছের তলায় দাঁড়িয়ে, তাও এমন জোরে ছাঁট বৃষ্টির যে ভিজেই যাচ্ছি। তখন হাফপ্যান্টের বয়েস, পিঠের ব্যাগ গাছের সাথে ঠেসিয়ে প্রাণপণে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছি। গাছের গায়ে পিঁপড়ের সেই সারি নেই। গাছের মাথায় কোনো কাক নেই। রাস্তা, মাঠ বৃষ্টির প্রবল ধারায় ঝাপসা। হঠাৎ কি খেয়াল হল পিঠের ব্যাগটা গাছের একটা নীচু ডালে ঝুলিয়ে মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হল সমস্ত আকাশ যেন আমাকে ভেজাবে বলেই এমন বৃষ্টির আয়োজন করেছে, যেন এতক্ষণ আমায় খেলায় ডাকবে বলেই অপেক্ষা করছিল। মাঠে চিৎ হয়ে শুয়ে চোখটা বন্ধ করে দিলাম। কান ভাসিয়ে সেকি প্রবল শব্দ। মনে হচ্ছে কোথায় যেন ভেসে চলে যাচ্ছি। একবার চোখ মেলে দেখলাম আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ভীষণ হাওয়ায় আর প্রবল জলের ধারায় গাছটা হেলে দুলে কি আনন্দে স্নান করছে। আমি শুয়ে, সে দাঁড়িয়ে এই যা তফাৎ। আমি চাইলেই ছুটে তার কাছে চলে যেতে পারি, কিন্তু সে আমার কাছে আসতে পারে না। কিন্তু এই মুহূর্তের আনন্দ আমাদের দুজনেরই। হঠাৎ করে দেখি একটা কাক কোত্থেকে ভিজে স্নান করে মগডালে বসে ভীষণ কোলাহল বাধিয়ে দিল। এ সেই আমার পরিচিত কাক কিনা কে বলবে। কিন্তু তার অমন কর্কশ ডাক শুনেই মনে হল, তাই তো, এইবার তো বাড়িতে ফিরতে হবে। পিঠে ব্যাগটা নিয়ে ছুটলাম বাড়ির দিকে, ছাতা খোলার আর দরকার হল না।        সেদিন রাতে ভীষণ ঝড় শুরু হল। সারারাত কারেন্ট এল না। কেউ কেউ বলল অনেক জায়গায় তার ছিঁড়ে গেছে, কারেন্ট আসতে নাকি দুদিন লেগে যেতে পারে। সারাটা রাত ধরে সেকি বাজ, সেকি ঝড়ের আওয়াজ। আগে ভাবতাম ঝড়ের সোঁ সোঁ আওয়াজ বুঝি লেখকেরা এমনি এমনি বানিয়েছে। সেইদিন রাতে প্রথম জেনেছিলাম তা তো নয়, ঝড় নিজেই এ আওয়াজ বানিয়ে লেখকদের কলমে পৌঁছিয়েছে।        পরেরদিন স্কুলে যাওয়ার সময় দেখলাম সে গাছটা মাটি থেকে উপড়ে মাঠের উপর শুয়ে। মাটির মধ্যে বিশাল গর্ত। মোটা মোটা শিকড়গুলো তারের মত জড়াজড়ি করে। কত লোক ভিড় করে গর্তটার দিকে দেখছে। আমিও গিয়ে মাথা নীচু করে তাকালাম, গর্তটার মধ্যে জল। জলের মধ্যে কিছু পিঁপড়ে ভাসছে। আকাশের আর অনেক মানুষের মাথার ছায়া টলটল করছে নোংরা কাদাগোলা জলে। আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল, কান্না পেল। আমি বললাম এ গাছটাকে আবার সোজা করে বসিয়ে দেওয়া যায় না?        কেউ শুনল না, সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। স্কুলের দিকে এগোতে লাগলাম। ইচ্ছাই করছে না। মনে হচ্ছে মাঠে বসে গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি। লোকগুলো সব চলে যাক। তবু যেতেই হল স্কুলে। ফেরার পথে দেখলাম লোকজন নেই, গাছটা উপুড় হয়ে শুয়ে। যে ডালটা সব চাইতে উপরে ছিল গাছটার সেই ডালটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাঠের উপর কেমন শুয়ে। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। একটানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে। কত ডাল মুচড়ে ভেঙে রয়েছে। পাতা ছড়িয়ে চারদিকে। কয়েকটা ছাগল অন্যদিকে কচ কচ করে পাতা চিবিয়ে যাচ্ছে। আকাশটা তখন আবার মেঘলা হচ্ছে। বাড়ি ফিরে গেলাম।        এরপর ধীরে ধীরে গাছটা কাটা হল। ক্রমে নিঃশেষ হয়ে গেল গাছটা। মাঠে কয়েকটা শুকনো ভাঙা ডাল আর আকাশের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা গর্তটা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট রইল না গাছটার।          সংসারে অনেকটা রাস্তা হাঁটা হল। অনেক গাছ উপড়াতে দেখলাম। অনেক ছায়া হারিয়ে ফেললাম। অনেককে ছায়াহীন হতে দেখলাম। নিজেই নিজের ছায়া হয়েছি, এমন বড় মিথ্যা কথাটা নিজেকে কোনোদিন বলিনি, আজও বলি না। সেই উপড়ানো গাছগুলোর ক্ষতগুলোর সামনে এসে দাঁড়াই। আকাশের দিকে তাকাই। মাটিতে এত ক্ষত, আকাশে বিন্দুমাত্র তার চিহ্ন নেই। আকাশ আর মাটির সম্পর্কটা যেন ঈশ্বর আর মানুষের মত। সেই ক্ষতস্থানের মাটি কপালে ছোঁয়াই, সেই উপড়ে যাওয়া ছায়াদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। ছায়াহীন আবার হাঁটা শুরু হয়। সবার ছায়াদের জন্য প্রার্থনা করি। ঈশ্বরের জন্য একটা মা খুঁজি। ছায়া মানে তো মা। সে কি শুধু জন্মদাত্রী?        ঈশ্বরের মত মাতৃহীন হই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, সামনে নিশ্চয় একটা বড় গাছ পাব, তার হবে বিশাল ছায়া। কেউ বলে এ ভাবনা মরীচিকা, কেউ বলে আশ্বাস। আমি হাঁটি আর হাঁটি। আমার সাথে সাথে হাঁটেন মাতৃহীন ঈশ্বর। দুজনেই ছায়া খুঁজি, শূন্যে। শেষে যেন শূন্যতাই সেই ছায়া। কারণ শূন্যের পরিধি বানিয়ে দেয় ভালোবাসা।  
272
Thu, 05/07/2020 - 17:25
    একবার মা’কে নিয়ে কলকাতায় যাচ্ছি ডাক্তার দেখাতে। এমন রোগ যার চিকিৎসাশাস্ত্রে নিরাময়ের পথ নেই, চরম পরিণতিকে ঠেকিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে। তবু সেইটুকুই আশার আলো।        গাড়ি কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে ধরে ছুটছে। আমার একটা কথাই মনে হয়েছিল সেদিন, যে কথাটা আজও কোথাও খুঁটিটাকে শক্ত করে বেঁধে রাখে আমার, সে কথাটি হল – দুঃখ আছে।        দুঃখ আছে – এ তো শুধু একটা কথা না, মন্ত্র। সংসারে দিবারাত্র আমার একটাই প্রচেষ্টা আমার চলনে-বলনে-আশায়-আকাঙ্ক্ষায় – 'দুঃখ নেই' -- এই কথাটাকে সত্য করার। নিজেকে মিথ্যা বলে, নানা ছলনায় নিজেকে ভুলিয়ে এই কথাটাই রাতদিন যেন নিজেকে দিয়ে বলিয়ে নিতে চাই – জগতে দুঃখ থাকলেও আমার জীবনে দুঃখ নেই, থাকতে পারে না, যদি থাকে সে আমার ব্যর্থতা।        কিন্তু সে সব অলীক সুখের জাল ছিঁড়ে যে কথাটা চরম মুহূর্তে সত্য হয়ে ওঠে – তা এই কথাটাই – দুঃখ আছে।        কথাটা বুদ্ধের। কিন্তু কথাটার সুরকে চিনেছি রবীন্দ্রনাথে। প্রাণের সাথে মিশেছে তাঁর উচ্চারণে। নানা গান, নানা প্রবন্ধ, নানা কথোপকথনে দেখেছি দুঃখকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই – এই কথাটাই বারবার করে বলছেন। অগৌরব সে দুঃখকে এড়িয়ে গেলে। ক্রমে দুর্বল হয়ে গিয়ে, সেই দুর্বল সত্তার তত্ত্বাবধানে নিজেকে নিয়ে রাতদিন ব্যতিব্যস্ত হয়ে থাকার নির্লজ্জ আত্মকেন্দ্রিকতায়। এ সুখ নয়, এ হীন তামসিকতা।        বুদ্ধের ঈশ্বর ছিল না। রবীন্দ্রনাথের ছিল। বুদ্ধের নির্বাণ ছিল। রবীন্দ্রনাথের ছিল আনন্দ। দীপের শিখা নির্বাপিত হওয়া যদি নির্বাণ হয়ে থাকে, রবীন্দ্রনাথের ছিল সেই শিখায় আত্মদানের হোমাগ্নিতে নিজেকে নিঃশেষিত করার আনন্দ।        রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধকে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলছেন। রবীন্দ্রনাথ বসার ঘরে বুদ্ধের মূর্তি রাখছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধগয়ায় বুদ্ধমূর্তির সামনে বিহ্বল হয়ে পড়ছেন। রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধের দর্শনে উপনিষদের বাণীর সুর খুঁজে পাচ্ছেন, সেই বাণীতে লাগছে বৈষ্ণব পদাবলীর রস। এ কি করে হয়? যিনি শূন্যবাদী, সেই বুদ্ধের সুরে কি করে 'পূর্ণমিদং'-এর মাধুর্য লাগে?        ছিন্নপত্রের রবীন্দ্রনাথের কাছে বসলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় সে সুর কিভাবে লাগে। তার ব্যাখ্যা নেই। ‘সাধনা’ বলে যে একটি ইংরেজি পুস্তিকায় রবীন্দ্রনাথ নিজের অধ্যাত্মবোধের একটি ধারণা গড়ে দিতে গেছেন, তাতে যেন অনেক কিছু বলা হল না। কিন্তু সমস্ত গীতবিতান, সমস্ত ছিন্নপত্র, সমস্ত রবীন্দ্রনাথ জুড়ে যে সুরটা – যে সুরে বাদী-সমবাদী সুর হয়ে থাকল – সত্য ও মঙ্গলচেতনা। যা অনুভবে সুখ না, আনন্দ। সত্য ও মঙ্গলের বোধ যে আনন্দ অনুভবে তার কি কোনো নির্দিষ্ট দেশকাল বাঁধা দর্শন হতে পারে? সত্য ও মঙ্গল যখন আলোচনার বস্তু তখন তাতে তর্কের আর আত্মবিজ্ঞাপনের শেষ নেই। কিন্তু সেই সত্য ও মঙ্গলবোধ যখন অনুভবের সেখানে আমার কোনো তর্ক নেই। শূন্যতা ও পূর্ণতার দ্বন্দ্বই বা কোথায়?        আমার বন্ধুকে আমি যে জানি সে আমার অনুভবে, যেভাবে জানি তাকে বাইরে থেকে সেভাবে জানা সম্ভব নয়। শিশুকে মা যেভাবে জানে তেমন পাড়ার লোকে জানে না, এই কারণেই। তাই আমার বন্ধু অথবা সেই শিশুটিই হোক না কেন, তার কিসে মঙ্গল তার জন্য আমায় লাইব্রেরীতে গলদঘর্ম হয়ে উপদেশের ফর্দ বানাতে হয় না, তা আমি এমনিতেই বুঝি, সে আমার অনুভব। সে আমার আনন্দ। তার জন্যে হাজার দুঃখ সহ্য করেও সে আনন্দ।        কিন্তু এভাবে সত্যকে আর মঙ্গলকে জানতে যে অনুভব – সে কি ভালোবাসা নয়? এমন ভালোবাসা আমি পাই কই? ভালোবাসা কি অভ্যাসের দ্বারা প্রাপ্ত ধন?        শব্দটা এখানে একটু খটমট। আসলে কথাটা ভালোবাসা নয়, কথাটা সিমপ্যাথি বা সহমর্মিতা। যে শব্দের উপরে দাঁড়িয়ে সমস্ত নীতিমালা। আমি যদি সেই সবল অনুকম্পায় নিজেকে স্থির, দৃঢ়চিত্ত না করি, তবে অন্যের জন্য কেঁদে ভাসাতেও আমার যেমন সময় লাগে না, ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তাকে আঘাত করে বসতেও তেমন দেরি হয় না। সহমর্মিতা কোনো আবেগপ্রবণতা নয়, এ এক সহজাত প্রবৃত্তি। অ্যাডম স্মিথ তার কালজয়ী বই, 'দ্য থিওরি অব মর‍্যাল সেন্টিমেন্ট' -এ বলছেন, অতিবড় পাষণ্ডও অতি ক্ষীণতম সহমর্মিতাবোধহীন হওয়া সম্ভব নয়।        আমার গান গাইবার ক্ষমতা হয় তো প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পীর মত নয়, কিন্তু তবু আমি গান গাই না? গাই তো। তেমনি আমার সহানুভূতির বোধ নাই বা হল কোনো মহানুভবের তুল্য, তবু তা আমার জীবনের জন্য অর্থহীন নয়। আমার তরী আমার এই একমুঠো সহানুভূতিতেই তীরে এসে ঠেকবে। নাই বা হল আমার অনুকম্পাবোধের উদযাপন, আমার নিজের চিত্তে একান্তে একটা জানলা খোলে সে - ই বিরাট বিশ্বের দিকে। আমার এই চোখেই আমি কাঞ্চনজঙ্ঘার রাজকীয় শোভায় মুগ্ধ হই, আমার এইটুকু হৃদয়ের অনুভবকে সম্বল করেই। আমার বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজনকে ভালোবাসি এই আমার একরত্তি প্রাণের আকুতিকেই সম্বল করে। তবে আমার সহানুভূতির বোধই বা দুর্বল, অপাঙক্তেয় হয়ে পড়ে থাকবে কেন? ওইটুকুতেই আমার মুক্তি, আমার ক্ষুদ্র আমি-র থেকে বৃহৎ আমি-তে উত্তরণের সোপান। তাকে হারাতে চাই না বলেই আজকের বুদ্ধ পূর্ণিমায়, আগামীকালের পঁচিশে বৈশাখে ক্ষুদ্র ভিক্ষাপাত্র হাতে দাঁড়াই, বলি, তোমার অনেক আছে, তার থেকে আমায় একমুঠো দিলেই যায় চলে।
273
Sun, 04/19/2020 - 21:46
    মাঝে মাঝেই একটা কথা পড়ছি, তবে তো সেই বিজ্ঞানের দিকেই তাকিয়ে থাকতে হল। ধর্ম কি দিল? সব তো মিথ্যা, ফক্কা, ধাপ্পাবাজ বেরোলো।        এই দুটো কথাই অর্ধসত্য। আজ এত এত মানুষ, এত এত অসুবিধার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, অপেক্ষা করছে, আশা করে পথ চেয়ে আছে একটা কিছু সুরাহা বেরোবে। এইটাই ধর্ম। এইটাই মানুষের জীবন্ত ধর্ম। এইটাই সেই ধর্ম যাকে আমরা বলি, যা ধারণ করে থাকে তাই ধর্ম। এই তিতিক্ষা, এই সহনশীলতা - একদিনে, এক মুহূর্তে লাভ করা যায় না। একে যতটা সহজলভ্য মনে হয়, আদতে তা নয়। রামকৃষ্ণদেব বলতেন তুমি যতই পাখিকে রাম-কৃষ্ণ-হরি ইত্যাদি নাম বলার অভ্যাস করাও না কেন, শেষে গিয়ে যেই না বেড়াল ধরবে তখনই সে ট্যাঁ ট্যাঁ করবে। তুলসীদাস বলছেন ধর্মলাভের সত্য পরীক্ষা হয় দুঃসময়ে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে - রোগে, শোকে, দারিদ্রে। সেই সময়ে কতটা সহনশীল তুমি? কতটা তিতিক্ষাবান? সেই হল আদতে আসল ধর্মের পরীক্ষা।        গীতা বলেন, যিনি সহনশীল তিনি অমৃতের অধিকারী। এ কোন অমৃত? নিশ্চয় নশ্বর শরীরের কথা ভেবে যুদ্ধক্ষেত্রে বলেননি। বলেছেন নিজের চিত্তের স্থৈর্যশক্তির কথা ভেবে। কি করে বলছি? কারণ সমস্ত গীতা জুড়ে সমচিত্ততার জয়গান। চিত্তের সাম্য যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেই জয়গান।          শিরডির যিনি সাঁইবাবা, সারাটা জীবন একটা শিক্ষার কথাই বলে গেলেন, শ্রদ্ধা ও ধৈর্য। ওনার ভাষায় শ্রদ্ধা ও সবুরী। সেই সহনশীলতার কথা। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, যে সয় সেই রয়। বলতেন, দেখো না, বাংলা বর্ণমালার মধ্যে 'স' তিনটে - স, শ, ষ। ওনার অনুপম উপমার কৌশল। তাই বলছেন, দেখো তিনটে স মানে আসলে ওই সহ্যের উপরেই জোর। সহ্য করতে হবে। সহনশীল হতেই হবে।        সেকালের বুদ্ধ বলছেন, আর একালের মা সারদা বলছেন, সহ্যের সমান গুণ নেই।        এই সহনশীলতাটুকুই ধর্ম। বাকিটা শুধু তার বহিরাঙ্গ। যেটুকু ভালো কথা, যেটুকু ভালো শিক্ষা, যেটুকু ভালো নীতি - সব এই একটা অভ্যাসের উপরেই - সহনশীলতা। তবে আমাকে কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে? এও এক গোলমেলে প্রশ্ন। ঈশ্বরের বোধ চেতনার গতির সাথে সাথে বদলে যেতে থাকে। আবার রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, যদ্দিন অজ্ঞান, তদ্দিন ওই ওই, আর যেই জ্ঞান হল, তখন এই এই।        এ সব কি কঠিন কথা? না, যে পরিস্থিতি দিয়ে আমরা যাচ্ছি তার চাইতে কঠিন কথা না। যে লক্ষাধিক মানুষ আজ এই পরিস্থিতে প্রায় ভাঁড়ার শূন্য অবস্থায় দিন গুনছে, যে মানুষগুলো তাদের কাছে নিঃশব্দে সাহায্যের তাগিদ নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে, তারা সবাই জানে এটা খুব একটা কঠিন কথা না। এইটাই বাস্তব। নইলে এতদিনে গোটা পৃথিবীতে মানুষ নামক জীবটি এত অসাম্য, এত অবিচার, এত অন্যায়ের মধ্যে কবে নিজেরাই কাটাকাটি করে শেষ হয়ে যেত। হয়নি। হবেও না। এই ভাইরাসেও পৃথিবী জনশূন্য হবে না। কিন্তু ধর্মের এই পাঠটা সব্বাইকে একবার ঝালিয়ে নিতেই হল। ভ্যাকসিন আজ না হয় কাল বেরোবেই। সেই দিন অবধি, তার সাধারণের নাগালগম্য হওয়া অবধি এবং তারপরেও নানা অসাম্যের মধ্যে চিত্তের স্থিরতার কাজটা করে যেতে যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে যাবে, সেই হল ধর্ম। কাণ্টের ভাষায় ক্যাটাগোরিক্যাল ইম্পারেটিভ। থিওরি অব জাস্টিসের লেখকের ভাষায় ন্যায্যতার প্রতি ঝোঁক, সবের মূল ওই এক, দক্ষিণেশ্বরের প্রজ্ঞাবান মানুষটির ভাষায় - নাহং, নাহং, তুঁহু, তুঁহু।        আমি আমি নই, তুমি তুমি। এই সহনশীলতা জন্মায় যেদিকে তাকিয়ে সেই বৃহতের দিকে, সামনের দিকে, আশার দিকে, তাকাতেই হবে। এ ছাড়া সম্বল নেই। বাকি সব বহিরঙ্গ।  
274
Mon, 04/06/2020 - 00:00
    ওগো মানব,    তুমি তো পান্থশালা প্রতিদিন দ্বারে তব    অতিথি নিত্য নব   কখনও আনন্দ, কখনও বিষাদ, কখনও ক্ষুদ্রচিন্তাভার কখনও ক্ষণিক জাগরণ এ সবেই তো অতিথি তোমার   ডাকো, ডাকো সবে     আপ্যায়নে না রেখো ত্রুটি   যদি বা দুঃখ আসে রাশি রাশি সমস্ত ঘর তছনছ করি   ভাসায়ে নিয়ে যায় যাবতীয় আসবাব সব      শূন্য করি গৃহ তবু, ওগো তবু, সসম্মানে গ্রহণ করো সে সবে,    হয় তো সব শূন্য করি       পথ রচি গেল তারা           আগামী আনন্দের             জানি না তো!   অশুভ চিন্তা, লজ্জা, দ্বেষ না ফিরায়ো, এলে দ্বারে   তারাও অতিথি তোমার প্রসন্নমুখে জানাও আমন্ত্রণ       ভিতরে আসিবার   কৃতজ্ঞ থাকো যে কেহই আসুক, মনে রেখো    এ সবের আগমনের হেতু যিনি       তিনি তোমার বোধের অতীত          এ কথাগুলি রুমির। রুমির সাথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, এই কথাগুলো আমার চেনা। বহুকাল আগে পড়া, আরেক কবির। নৈবেদ্যের ৩২ নম্বর কবিতা,   নির্জন শয়ন-মাঝে কালি রাত্রিবেলা ভাবিতেছিলাম আমি বসিয়া একেলা গতজীবনের কত কথা; হেন ক্ষণে শুনিলাম তুমি কহিতেছ মোর মনে-- "ওরে মত্ত ওরে মুগ্ধ, ওরে আত্মভোলা, রেখেছিলি আপনার সব দ্বার খোলা; চঞ্চল এ সংসারের যত ছায়ালোক, যত ভুল, যত ধূলি, যত দুঃখশোক, যত ভালোমন্দ, যত গীতগন্ধ লয়ে বিশ্ব পশেছিল তোর অবাধ আলয়ে। সেই সাথে তোর মুক্ত বাতায়নে আমি অজ্ঞাতে অসংখ্য বার এসেছিনু নামি। দ্বার রুধি জপিতিস যদি মোর নাম কোন্ পথ দিয়ে তোর চিত্তে পশিতাম!'        চমকিয়ে উঠলাম। এমন মিল! মিল তো বটেই। রবীন্দ্রনাথ যখন রুমির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন, তখন আমার মন আরো পিছিয়ে গেল, আরেক মহাকবির কথা মনে পড়ল, ব্যাসদেব, গীতার চতুর্দশ অধ্যায়ের বাইশ ও তেইশ নম্বর শ্লোক মনে পড়ল,        রথের সারথী বলছেন অর্জুনকে, দেখো – প্রকাশ, প্রবৃত্তি ও মোহ চিত্তে আবির্ভূত হলে তিনি না তো তাদের দ্বেষ করেন, না তো নিবৃত্তি আকাঙ্ক্ষা করেন। তিনি উদাসীন। তিনি অবিচলিত। তিনি মনে মনে জানেন, এসবই ত্রিগুণের বশে চিত্তে এসেছে, আবার সময় হলে চলে যাবে। তিনি চঞ্চল হন না তাই। প্রভাবিতও হন না। তিনি সুখ-দুঃখ, প্রিয়-অপ্রিয়, নিন্দা-স্তুতি, মান-অপমান, শত্রু-মিত্র ইত্যাদি সবাইকে সমচিত্তে গ্রহণ করেন।        রুমি মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, এই কথা। রুমি, রবীন্দ্রনাথ, ব্যাসদেব তিনজনেই মাঠে পা ছড়িয়ে বসে। অমাবস্যার রাত। তারা উঠেছে আকাশে। রবীন্দ্রনাথ গুনগুন করে গাইছেন,   আজি যত তারা তব আকাশে         সবে মোর প্রাণ ভরি প্রকাশে॥ নিখিল তোমার এসেছে ছুটিয়া, মোর মাঝে আজি পড়েছে টুটিয়া হে,    তব নিকুঞ্জের মঞ্জরী যত আমারি অঙ্গে বিকাশে॥ দিকে দিগন্তে যত আনন্দ       লভিয়াছে, এক গভীর গন্ধ,    আমার চিত্তে মিলি একত্রে তোমার মন্দিরে উছাসে।        আজি কোনোখানে কারেও না জানি,        শুনিতে না পাই আজি কারো বাণী হে, নিখিল নিশ্বাস আজি এ বক্ষে বাঁশরির সুরে বিলাসে॥          আমি বলতে যাচ্ছিলাম, এ গান তো আমি জানি, দেবব্রত বিশ্বাসের গলায় শুনেছি, গাইতেও পারি। কিন্তু বললাম না। রুমি মাথা নেড়ে ইশারা করে বললেন, উঁহু কথা বোলো না।          আমি দূরে একটা ছাতিমগাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসলাম। আমার অতীত জীবনের একটা একটা ভুল, ব্যর্থতা, বিশ্বাসঘাতকতা --- সব মনে পড়তে লাগল। দূরে ওনারা তিনজন বসে, আবছা গান আমার কানে আসছে। আমি মনে মনে গাইছি। হ্যাঁ, সমস্ত কিছুকেই গ্রহণ করতে হয়। সমুদ্রে স্নান করতে গেলে বড় ঢেউকে মাথা পেতে নিতে হয়, তার সাথে সংঘাতে যেতে নেই, তাকিয়ে এড়িয়ে চলার জো নেই।        হঠাৎ শুনি এক মহিলাকণ্ঠে, আমার পাশেই যেন। তারার আলোয় ভালো করে মুখের দিকে তাকালাম। পিঠের উপর খোলা চুল, চশমাটা হাতের মুঠোয় ধরা, হাঁটুদুটো জোড়া করে তার উপরে রাখা মাথা... আমি চিনি তো... নবনীতা দেবসেন...        আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এ কথাগুলো আমি বারবার আমার ভ্রমণ কাহিনীগুলোতে বলেছি না? জীবনের সবটা নিতে হয়, সবটা নিয়েই জীবন। ভালোবাসার বারান্দায় যেমন ভোরের আলো পড়ে তেমনই তো চড়া রোদের আলোও পড়ে, আবার ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় যেমন সে ভাসে, তেমন শ্রাবণের অমাবস্যাতেও তো ভেসে যায় বল, দুই ভেসে যাওয়া কি একরকম?        ভোর হল। ঘরের জানলার পর্দা উড়ে উড়ে বাইরের ঝলমলে সকালটা দেখাচ্ছে। উঠতে হবে, পাশ ফিরতেই হাত লাগল কিসে – গীতবিতান। জানি না আজ দরজায় কোন অতিথি।    
275
Thu, 04/02/2020 - 12:30
  কথামৃতের গল্প – ছেলে মাকে শুতে যাওয়ার সময় বলছে, মা আমার যখন হাগা পাবে আমায় তখন ডেকে দিও। মা বলছেন, আমায় ডাকতে হবে না বাবা, ওই হাগাই তোমায় ডেকে তুলবে।        এখন সেই হাগাই আমায় ডেকে তুলেছে। এত বাণী, এত উপদেশ, এত শিক্ষা – এক কোভিড এসে ঘেঁটে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিতে দিতে বলছে, ওঠো, জাগো, নিজের ফাণ্ডামেন্টাল প্রয়োজনটা বোঝো, খোসা ছাড়াও, মূলের দিকে যাও, উৎসের দিকে হাঁটো।        এখন মৃত্যু মানে রুমালচোর খেলা। কার পিছনে কখন রুমাল রেখে কে যাবে বোঝা দায়। এই মৃত্যুচেতনাকে অধ্যাত্মিক জগতে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। সমস্তটা যে নশ্বর, সমস্তটাই যে সরে সরে যাচ্ছে, পুরো সংসারটা যে হাত থেকে অল্প অল্প করে পিছলে পিছলে যাচ্ছে, সেটা বোঝো। তোমার সংসারে দু’দিন ঝুল না ঝাড়লে এদিকে সেদিকে ধুলো, ঝুল, ময়লা, কালি। তুমি ঝাঁট দিচ্ছ, ঝুল ঝাড়ছ, ঘর মুচছো, ফিনাইল দিচ্ছ, সাবান দিচ্ছ, শ্যাম্পু করছ – চারদিক ঝাঁ চকচক করছ। ভালো, পরিষ্কার থাকা ভালো, বেশ ভালো। পরিষ্কার থাকতে থাকতে শুচিবায়ুগ্রস্থ হচ্ছ, প্রয়োজনীয় জিনিস জমাতে জমাতে লোভী হচ্ছ, ওষুধপত্র আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র নির্ভর করে অমরত্ব পাচ্ছ ভাবছ, মৃত্যু যেন তোমার আবাসনের ময়লা ফেলার লোক, সময় করে এসে ঠিক বাড়ির বোঝা বুড়ো মানুষটাকে টুক্ করে নিয়ে চলে যাবে। তুমি ঝাড়া হাত-পা হয়ে বগল বাজাতে বাজাতে বিশ্ব সংসার ভোগ করে বেড়াবে। হিংসুটে হবে, স্বার্থপর হবে, জ্ঞানী হবে, মানী হবে – সব তুমি হবে। তুমি কোনোদিন বুড়ো হবে না। ডেথ ইজ ফর আদার্স – এই ভেবে কোলবালিশ জাপটিয়ে ইন্টেলেকচ্যুয়াল সুখ পাবে, শপিং মলে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে কুতকুতে লোভী লকলকে চোখে ইতিউতি চাইবে, মাল্টিপ্লেক্সে সামাজিক উৎপীড়নের উপর বানানো, ভীষণ প্রশংসিত উচ্চমানের সিনেমা দেখতে দেখতে দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক সাজবে।          ২০২০ বলল, না, এবার একটু উল্টোদিকে চাকা ঘোরাতে হবে। চণ্ডীতে আছে “সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশানাং”। বাছাধন, ওই সৃষ্টি যিনি করেন, যিনি রাখেন, তিনিই আবার ধ্বংস করেন। মানে গুটিয়ে নেন। তুমি শরণ চাইলে নিতে পারো, তবে তোমার এই অস্থিচর্মসার শরীরটার রক্ষার দায় আমি নেব না, তোমার মধ্যে এক জ্ঞান-আনন্দময় সত্তা আছে, তুমি বিস্মৃত হয়েছ, তুমি সেই সত্তাকেই নানা জ্ঞানের অন্বেষণে আর নানাবিধ সুখে খুঁজে বেড়াচ্ছ। আদতে তুমি নিজেকেই খুঁজছ। আদতে তুমি নিজেকেই চাইছ। আদতে তুমি তোমাতেই শেষ হবে। সারাটা জীবন যে ‘ভগবান ভগবান’ করে দৌড়ে মরলে, চোখ বন্ধ করে দৌড়ালে। সব কিছু নশ্বর, পরিবর্তনশীল জেনেও ভাবলে তোমার বেলায় উল্টোপাল্টা হবে। তাই কি হয় বোকা? আমায় যদি চাও তবে ফুল-প্যাকেজে চাও। মানে আমার সৃষ্টি আর স্থিতি নিলে আমার ধ্বংসটাও নিতে হবে। নইলে চাকা থেমে যাবে। যা পূর্ণ তা-ই শূন্য। তুমি এক বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে আবার যখন সেই বিন্দুতে ফেরো তখন তাকে কি বলো? কেউ বলে পূর্ণ, কেউ বলে শূন্য। তুমি যা দেখেছ, যা শুনেছ, যা ভেবেছ – সব নিজেকেই দেখেছ, শুনেছ, ভেবেছ। নিজেকে রক্ষা করতে চাইছ এখন, কিসের থেকে? মৃত্যুর হাত থেকে। রক্ষা পাবে। কিছুদিনের জন্য। কেউ রক্ষা চিরকালের জন্য পায় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানই সেই কথা বলবে। যে কোষের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় না, সে আদতে কি কোষের স্বভাব বহন করছে জানো? ক্যানসার কোষের। সে কোষ নিয়ম মানতে চায় না, সে নিজের মত একটা স্বতন্ত্র সত্তা বানাতে চায় তোমার শরীরে থেকেই, সে সীমা মানে না, লক্ষ্য মানে না। তোমার শরীরকে ধ্বংস করে ফেলে। তুমি নিজে কি সেই ক্যানসার হতে চাও সমাজে? বেরিয়ে এসো, এই ভুল ধারণা থেকে। তুমি নিজেকে আবিষ্কার করো আবার। নিজেকে খোঁড়ো। নিজেকে প্রশ্ন করো – কে আমি? কিসের জন্য এ আয়োজন? আমি কি শুধুই একটা রাসায়নিক বিক্রিয়া? যদি তাই হই, তবে এই রাসায়নিক বিক্রিয়ার সমন্বায়ক কে? এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অণুতে পরমাণুতে যে বিচিত্র কর্মযজ্ঞ, যে আলো অত কোটি মাইল দূর থেকে এসে তোমার বাগানের সবুজ পাতাটার উপর এসে পড়ছে তাকে ধারণ করার রাসায়নিক কণা সে গাছের পাতায় কে এনে দিল? রক্তের মধ্যে কে প্রাণবায়ুকে মিলিয়ে নিল? এই মহাবিশ্বের নানা কর্মকাণ্ডের সমন্বায়ক কে? কে সমস্ত পৃথক পৃথক চেষ্টা – অপচেষ্টা – বিরোধী চেষ্টা – বিদ্রোহী চেষ্টাকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে? খোঁজো খোঁজো সে সূত্র। সেদিন আরেক মহামারী এসেছিল কলকাতার বুকে। বিবেকানন্দ নিবেদিতাকে নিয়ে সেবায় ব্রতী। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিবেদিতাকে দিলেন আর এক মহান ভার।   কলকাতাবাসীকে শোনাতে হবে এ মহামারীর আর এক ব্যাখ্যা, আরেক দৃষ্টিকোণ। ভয় না, অভয় আসবে মনে। ভয়ংকর সত্যকে সামনে রাখতে হবে। মৃত্যুরূপা মাতা - বক্তৃতা দিলেন, নিবেদিতা। কিছু সঙ্কীর্ণ বাঙালী নাক সিঁটকালো, ম্লেচ্ছ দেবে কালীর উপর বক্তৃতা? তবু দিলেন নিবেদিতা। সে ইতিহাস। আজ বিজ্ঞানের যুগ। যুক্তির যুগ। সেই বিজ্ঞান, সেই যুক্তি কিসের অন্বেষণে? সেই মহাসমান্বয়কের অন্বেষণ। সেই সূত্র যা সমস্তকে একটা ছন্দে বাঁধছে।         কার ছন্দে? এই মহাকালের সাথে খণ্ডকালের ছন্দ কার নৃত্যালয়ের তালে বাঁধা পড়ে আছে? “নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু, পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভাণু।”        কে সে? হয় তো কেউ নয়? তুমি তাকে চেতনা বলতে পারো, তুমি তাকে ঈশ্বর বলতে পারো, তুমি তাকে কেন্দ্র বলতে পারো। তুমি যা কিছু বলতে পারো। কিন্তু যতদিন বলতে পারো, ততদিন তুমি এ সংসারে পর্যটক মাত্র, ট্যুরিস্ট। একদিন বলতে পারবে না। একদিন স্থিরচিত্তে নিজেকে সে মহান সমন্বায়কের হাতে সঁপে দিয়ে বলবে, “দিও না আমারে ছড়ায়ে”। নিজেকে আর ফেলে ছড়িয়ে রাখতে পারবে না। সেদিন তোমার কোনো তর্ক নেই। সেদিন তোমার কোনো ধর্ম নেই। সেদিন তোমার কোনো ঈশ্বর নেই। সেদিন তোমার কিছুই নেই। কারণ সেদিন তোমার তুমিই নেই। সেদিন শুধু আনন্দ। সুখের আনন্দ না। নির্ভয়তার আনন্দ। নির্ভরতার আনন্দ। আইনস্টাইন যেমন নিজের প্রাণসংশয়কালে ম্যাক্স বর্নের স্ত্রী হেডিকে বলেছিলেন, 'প্রতিটা প্রাণীর সঙ্গেই আমি এমন একটা একাত্মতা অনুভব করি যে, ব্যক্তির শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায়, তাতে আমার কিছু আসে যায় না'।        একদিন এ মানবকূল এ ঘোর বিপদ কাটাবে। সেদিন কে থাকবে, কে থাকবে না – সে হিসাব আমরা জানি না। কিন্তু সেই মহাসমন্বায়কের সাথে আমাদের যে হাঁটার ছন্দপতন শুরু হয়েছিল, সে ছন্দকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের জঙ্গল, নদী, সমুদ্র, আকাশ, বাতাস, পশুপাখি, শিশু আবার সুস্থ হবে। বাসযোগ্য হবে। ততদিনে আমাদের প্রার্থনা, আকাঙ্খা, আশা এই কয়েকটা প্রাচীন শব্দবন্ধে উচ্চারিত হোক -     সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ওম শান্তি শান্তি শান্তি।          সবাই সুখী হোক, সকলে নিরাময় হোক, সকলের দৃষ্টি মঙ্গলময় হোক, সকলের ভাগ্য দুঃখাতীত হোক। শান্তি শান্তি শান্তি।  
276
Tue, 03/31/2020 - 12:10
    গল্পটা এই রকম। একজন তার সারা গায়ে ট্যাটু করাবে ঠিক করল। এখন মানুষের শখ তো কত রকমের হয়। আমার এক ভাই যেমন যেখানেই বেড়াতে যায় সেখানেই একটা করে ট্যাটু করিয়ে ফেলে। যখন ঋষিকেশে গেল তখন হাতের উপর করল বুদ্ধের ট্যাটু। তারপর যখন রাজস্থানে গেল সেখানে করল ঘাড়ের উপর শিবের ট্যাটু। এখন সে হাতে বুদ্ধ, ঘাড়ে মহাদেবকে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।        প্রথমবারের ট্যাটুর সময় আমি ছিলাম। ঋষিকেশের আরেকটু উপরে একটা শহর তপোবন। পাহাড়ি পথ। বেশ ঘিঞ্জি গলি। একটা দোতলা দোকান, উপরের তলায় ট্যাটু হয়, নীচের তলায় ব্যাগ বিক্রি হয়। ভাইকে নিয়ে গেলাম সেখানে। উপরে উঠে দেখি একটা বড় বসার ঘর। সেখানে বেশ কিছু ইংরাজি পত্রিকা রাখা। একটা বইয়ের তাক, সেখানে বেশ কিছু ইংরাজি বই রাখা। ট্যাটুবিদ আমাদের অভ্যর্থনা জানালো, ভাইকে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে গেল, ডিজাইন ঠিক করা হবে। আমি একটা সোফায় বসে দূর থেকে ডিজাইন দেখতে লাগলাম, সাথে ট্যাটুবিদকে, তার বয়েস হবে এই তিরিশের আশেপাশে, মোটাসোটা, কিছু ফিট বডি, শরীরের যতগুলো অংশ খোলা, সব জায়গায় ট্যাটু, অর্থাৎ ভ্রাম্যমান জলজ্যান্ত বিজ্ঞাপন বলা যায়। কেশহীন চকচকে মাথা। কব্জীতে ড্রাগন। ঘাড়ে সিংহের মুখ। আরেক কব্জীতে মহাদেব।        ইতিমধ্যে ইয়া লম্বা ঢ্যাঙ্গা এক সাহেব ঢুকল। একটা হাফপ্যান্ট আর সবুজ টিশার্ট পরে, ঢুকেই আমায় বলল, হ্যালো। আমিও বললুম, হ্যালো। আমার সামনে সোফাতে বসেই ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে পড়তে শুরু করল। মুখ ভর্তি খয়েরি রঙের দাড়ি, খয়েরি রঙের চুল, হলুদ হলুদ দাঁত। চোখদুটো ঢুলুঢুলু। পা নাচাতে নাচাতে সে বই পড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে হিমালয়ের উপর কোনো বই হবে। আমি আর কি করি, বইয়ের তাক থেকে একটা ওশোর বই নামিয়ে পড়তে শুরু করলাম, যৌন জীবনে আধ্যাত্মিকতা।        হুড়মুড় করে একজন সাহেবিনী ঢুকে পড়ল। ঢুকেই আমায় একটা ‘হাই’ ঠেলে দিয়ে সেই হলদেটে দাঁতের সাহেবের ঘাড় জড়িয়ে ঠোঁটের উপর ঝক্কাস করে চুমু দিয়ে সোফায় ডুবে গেল। ততক্ষণে আমার সেই ভাই আর ট্যাটুবিদ পিছনের কাঁচের দরজা আঁটা ঘরে ঢুকে গেছে। আমার সামনে ওশোর যৌনজীবনের সুক্ষ্ম ব্যাখ্যা, আড়চোখে সামনের সোফায় আর একবার দেখে নিলাম, চুমু আর বেশিদূর গড়াচ্ছে কিনা। না, মেয়েটি একটা ঢোলা টিশার্ট, লালরঙের, একটা থ্রিকোয়াটার্স প্যান্ট পরে সাহেবের গলা জড়িয়ে হামলে পড়ে বইয়ে কিছু দেখছে আর কথা বলছে। বুঝলাম এরা ইংরেজি বলছে না, খুব সম্ভবত ফরাসী ভাষা বলছে। আমার দিকে একবার শ্বেতাঙ্গিনী আড়চোখে দেখল দেখলাম, দেখারই কথা, ফুলহাতা পাঞ্জাবি আর একটা জিন্সের প্যান্ট পরে বসে আছি, ভাবছে নিশ্চয় এ ট্যাটু করলে কোথায় করবে, সব যে ঢাকা।        হঠাৎ ট্যাটুবিদ কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে এসে বলল, আপনি ভিতরে আসতে পারেন, আপনার ভাইয়ের কাজটা শুরু হবে এখন।        ঢুকলাম। মাগো! একি! দেখি একটা খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আরেক সাহেব, টিশার্টটা বুকের কাছে দলা পাকানো, পায়াজামা হাঁটুর কাছে গোটানো। মধ্যখানে কিচ্ছুটি নাই, তিনি ঘাড় কাত করে দরজার দিকে ফিরে শুয়ে, মাঝে মাঝে কাতরে উঠছে, তার দুই ধবধবে শুভ্রফেনিল নিতম্ব জুড়ে সাগরের ঢেউ আঁকা হচ্ছে, যার মাথায় একটা মানুষের মাথার মত কিছু, যেটা কোমরের কাছটায় শেষ হয়েছে।        বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে, সূঁচের আগায় বিন্দু বিন্দু রক্ত জমছে, নিতম্বের ঢাল বেয়ে সে রক্তবিন্দু চুঁইতেই কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে। বাবা রে বাবা, কি শখ গা তোমার সাহেব, বলি গাঁজা চরস খেয়ে সাধ্যসাধনার তো হিড়িক বাইরে লেগেই আছে, তার উপরে একি সাধনা। আমার চড়কের কথা মনে পড়ল। সেও কি কম গা!        যা হোক, ভাই চেয়ারে বসে। তার হাতটা ট্যাটুবিদের হাতে ধরা। সে একটা স্পিরিট বা ওই জাতীয় কিছু তরল দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করছে, আমায় হেসে বলা হল, আপনি বসতে পারেন।        বসলাম, জানি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। যেই সে সূঁচটা ভাইয়ের হাতে ছুঁইয়েছে অমনি আমি সটান উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, আমি বরং বাইরে বসি, তোর হয়ে গেলে আয়। আমার কলিজার জোর দেখে ট্যাটুবিদ মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা।        আরে ভাই এতেও কি রক্ষে, এইতে তো ভুলেই গেছিলাম বাইরে আরো দুই মূর্তিমান বসে। কাঁচের দরজা ঠেলে যেই না বাইরে এসেছি, অমনি দেখি দুজনের সেকি ঘাড়ের উপর উঠে, মুখের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে... বলি এসব সিনেমায় দেখা ভালো লাগে, তা ধর্মতলাতেও না হয় দেখে নিতে পারি, তা বলে এমন তপোবনে? কেন রে, এখন একটু ধ্যানট্যান করে মনটাকে শান্ত করে নে না রে বাপু। আর তো এমন শান্ত, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ পাবিটাবি না।        আমায় দেখেই অবিশ্যি জড়ামড়ি অবস্থাটা ছেড়ে, টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক হয়ে বসে পড়ল দুজন। আমি যেন হেডমাষ্টার, তারা যেন আমার স্কুলের ছাত্র, যত্তসব! আমি আমার পুরোনো জায়গায় বসে আবার যৌনজীবনে অধ্যাত্মিকতার খোলা পাতার দিকে তাকালাম। সেদিন এই লছমন ঝোলার সামনের ক্যাফেটাতে ঢুকতে দিল না, বলে কি না সাহেবসুবো ছাড়া অনুমতি নেই, স্পর্ধা!        যা হোক বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি, ভিতরে কৈলাস আর বাইরে বৃন্দাবন – এমন অবস্থায় কি কর্তব্য ঠাওরাচ্ছি, এমন সময় রুমির একটা গল্প মনে পড়ল। বলি হ্যাঁ, শুনুন।        এই কথাটা দিয়ে আমরা লেখাটাও শুরু করেছিলাম। তা একজনের শখ হল সে ট্যাটু করাবে। গেছে সে ট্যাটুবিদের কাছে। একটা সিংহের ছবি আঁকাবে সে, শরীরে ট্যাটুর স্থানও নির্দিষ্ট করা গেছে। সে চেয়ারে আরাম করে বসেছে, কিন্তু যেই না ট্যাটুবিদ তার হাতে সূঁচটা বিঁধিয়েছে, সে চীৎকার করে উঠেছে, উফ, উফ, তুমি আঁকছ ট্যাটুবিদ?        ট্যাটুবিদ বলল, কেন ভাই, সিংহ?        সে কাতর স্বরে বলল, সিংহের কি আঁকছ?        ট্যাটুবিদ বলল, লেজ।        সে আবার কাতর স্বরে বলল, থাক থাক, তুমি লেজ ছাড়াই আঁকো।        ট্যাটুবিদ বলল, বেশ, তাই আঁকছি।        আবার যেই সে সুঁচটা বিঁধিয়েছে, এ আবার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে বলছে, এবার কি আঁকছ?        সে বলল, সিংহের প্রথম পা’টা।        সে বলল, থাক থাক, তোমার পা এঁকে কাজ নেই, আমি পা ছাড়াই সিংহ নেব।        ট্যাটুবিদ বলল, আচ্ছা।        যেই না সে আবার সূঁচটা বিঁধিয়েছে, অমনি খদ্দের আবার চীৎকার করে বলে উঠেছে, কি, কি আঁকছ এখন?        সে বলল, সিংহের পেট।        খদ্দের বলল, থাক, তোমাকে ওর পেট আঁকতে হবে না...তুমি পেট ছাড়াই সিংহ আঁকো।        ট্যাটুবিদ সূঁচটা সরিয়ে রেখে বলল, ভাই আল্লহা স্বয়ং লেজ, পা, পেট ছাড়া সিংহ বানাতে পারেনি, আমি কি পারব? বলে সে কাজে ইস্তফা দিল।        তাই রুমি বলছে, দেখো দুঃখ তো তোমায় পেতেই হবে। কোন আছিলা থেকে সরে কোন আছিলায় যাবে? রবি ঠাকুর গাইতে শেখাচ্ছেন না? “দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?... এড়িয়ে তারে পালাস না রে, ধরা দিতে হোস না কাতর/ দীর্ঘপথে ছুটে ছুটে দীর্ঘ করিস পথটারে তোর।”        ভাইয়ের ট্যাটু হয়ে গেল। সেদিন রাতে এল তার জ্বর। কেউ বকল, কেউ শাসন করল, কেউ সাবধান করল। আমি কিছু বললাম না। ভাই না হয় বাইরে একটা ট্যাটুর শখে আজ জ্বর এনেছে, কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই কি জীবনের নানা বাঁকে, নানা অদৃশ্য ট্যাটু আঁকার শখে, নানা রকম মাশুল দিইনি? দিচ্ছি তো, ভবিষ্যতেও দেব। আমাদের ট্যাটুগুলো দেখা যায় না এই যা।              রুমি থেকে রামকৃষ্ণ যে ট্যাটুবিদের কাছে ট্যাটু করাতে যেতে বলেন, সে ট্যাটুবিদেরও কি কম বায়নাক্কা? “আঘাত দিয়ে কহো মোরে, এই তো আমার কর... আমার চোখ বেঁধে ভবের খেলায়... বলছ হরি আমায় ধর...” গাইছেন না অতুলপ্রসাদ?        এ ব্যথা সইতেই হবে। কথা হচ্ছে আমার ট্যাটুবিদ কে? ভালোবাসা, তুমি ছাড়া আর কে? পুড়িয়ে নাও... পুড়িয়ে নাও...  
277
Wed, 03/18/2020 - 20:00
      কোরোনা ভাইরাস অনেক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হয় তালা ঝুলিয়েছে, নয় বাঁধন এনেছে – এই নিয়ে নানা পোস্ট দেখছি – কেউ ব্যঙ্গ করছেন, কেউ মজা করছেন, কেউ প্রবল পরাক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়ে অমুক মঠ, তমুক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র হয়ে তাদের সমর্থনে যুক্তির পর যুক্তি সাজাচ্ছেন।        এখন কথা হল, এতে আশ্চর্য হওয়ার কি আছে? মানুষ যে কারণে একসাথে বসে খেলা দেখা, একসাথে বসে ভোজ খাওয়া, মজলিস বন্ধ রেখেছে, সেইভাবেই একসাথে বসে ধর্মীয় কাজ বন্ধ রেখেছে।        এখানে যুক্তি হল, তবে ঈশ্বরের রক্ষাকর্তা রূপটি কই?        এখানে প্রথম কথাই হল, ধর্মীয় সংগঠন আর ঈশ্বরকে এক করে দেখা। প্রথমেই বুঝতে হবে ঈশ্বর কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে থাকেন না। সেখানে কিছু উচ্চমার্গের মানুষ, সাধারণ মানুষের ছোঁয়া বাঁচিয়ে, সাধারণ মানুষের উদ্ধারের জন্য থাকেন। সাধারণ মানুষ তাদের অর্থ, ভক্তি, যুক্তিবোধ – নিজের নিরাপত্তার আশায়, পরকালের পথ সুগমের জন্য, অভ্যাসবশত ইত্যাদি ইত্যাদি কারণে দান করে থাকেন সেখানে স্বেচ্ছায়। সেখানে মানুষের শুদ্ধতার হায়ারার্কি থাকে, মানে স্তরবিন্যাস আর কি। দেখবেন যিনি সেই প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ উচ্চমার্গীয় মহাত্মা তিনি বাতানুকূল ঘরে সেবকবেষ্টিত হয়ে আছেন আপনার উদ্ধারের জন্য, জনতার সেবার জন্য আত্মনিয়োগ করেছেন। জনতা নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে সাষ্টাঙ্গে কি, পঞ্চাঙ্গে, কি চতুর্থাঙ্গে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রণাম জানাচ্ছেন। আপনি প্রশ্ন করবেন, দূর থেকে কেন? কারণ বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, মানুষ যখন প্রণাম করে কাউকে তখন তার দ্বারা কৃত পাপ যেই সে নীচু হয় অমনি সেই ঢাল বেয়ে প্রণাম গ্রহণ করা ব্যক্তিটির পায়ের ফ্যালেঞ্জেস, মেটাটারসাল, টারসাল, টিবিয়া-ফিবিউলা, ফিমার হয়ে তার আত্মাকে অধিগ্রহণ করে তাকে পাপিষ্ঠ করে তোলে। তার তখন নানা রোগ হয়, ও মৃত্যু হয়। এখন এইভাবে মহাত্মারা যদি জনতার পাপে পটাপট মরতে শুরু করেন তবে এই পাপের সাগরে নিমজ্জমান জনতার উদ্ধার কে করবে? তাই অমন দূর থেকে ভক্তকূলের ভক্তি প্রদর্শনের ব্যবস্থা। এবার আপনি যদি আবার জিজ্ঞাসা করেন, তা কোন বিজ্ঞানী এই তত্ত্ব প্রমাণ করেছেন? আমি বলব যারা গোমূত্রে কোরোনা বিদায়ের ব্যবস্থা করছেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন গিয়ে, আমায় না।        এবারে আপনি যদি প্রশ্ন করেন যে, ঈশ্বর কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে থাকেন না, এই কথা আমি বুঝলাম কি করে?        সে উত্তরও আছে। প্রমাণ সহিত দেব। দেখুন আমাদের শাস্ত্রে আছে যে যখন যখনই ধর্মের গ্লানি হবে তখন তখনই তিনি আসবেন, আছে কিনা? আছে। তারপর যারাই হিন্দুধর্ম নিয়ে নাড়াঘাঁটা করেছেন তারাই জানেন আমাদের অবতারদের আসার একটা ক্রোনোলজি পাওয়া যায়? যায়। অতএব এইবার দেখুন, আলোচনায় আসা যাক।        এক্কেবারে প্রথম অবতার, রামচন্দ্র, রাজার ছেলে। কোথায় জন্মালেন? রাজার বাড়ি। বাকিটা আর বলার কিছু নেই, ওনার সম্পূর্ণ লীলা আমরা জানি, সে সবই জঙ্গলে, যুদ্ধক্ষেত্রে, দুষ্টনিবারণে। একবার হাতজোড় করে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের উদ্দেশ্যে প্রণাম করুন। আমি পরেরটায় আসছি।        এইবার এলেন কৃষ্ণ। হিন্দুধর্মে সবচাইতে জনপ্রিয় অবতার, এখনও ওনার জনপ্রিয়তার ধারেকাছে কেউ নেই, মায় এখনও হিন্দী সিনেমার গানে ওনার উল্লেখ, যেখানেই প্রেম সেখানেই কৃষ্ণ। তা তিনি কোথায় জন্মালেন? না কারাগারে। ওনার জীবনের বাকিটাও আর উল্লেখ করার কিছু নেই, যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বৃন্দাবন --- সে এক অদ্ভুত লীলা। একবার সাশ্রুনয়নে সেই নীলপাদপদ্ম স্মরণ করুন মনে মনে, অঞ্জলি দিন, আমি আরো এগোচ্ছি।        এরপর যে দশাবতারের উপাখ্যান আছে তাতে ঈশ্বর অনেক মানুষী তনুর পাশাপাশি অনেক অমানুষী তনুতে লীলাখেলা করেছেন, সে কথায় আর গেলাম না। কিন্তু বুদ্ধকে নিলাম। সেই কথাতেই আসছি।        গৌতম বুদ্ধ রাজার ছেলে। তারপর সংসার ত্যাগ করে বাকি আশিটা বছর ভারতের নানা জায়গায় ঘুরলেন। ধর্মপ্রচার করলেন।        তারপর ধরুন শঙ্করাচার্য জন্মালেন। তিনি এক সাধারণ পরিবারে দক্ষিণ ভারতে জন্মালেন।        তারপর ধরুন আমাদের নিমাই, তিনিও এক সাধারণ পরিবারে জন্মালেন।        তারপর বেশ কিছু অবতার একসাথে এলেন বা মোটামুটি কাছাকাছি সময়ে এলেন। রামকৃষ্ণদেব, শিরডির সাঁইবাবা, ওমকারনাথ ঠাকুর, লোকনাথবাবা, অনুকূল ঠাকুর, রামঠাকুর, রমণ মহর্ষি, বালক ব্রহ্মচারী, আনন্দময়ী মা প্রমুখ।        আমি যদি কারোর নাম উল্লেখ করতে ভুলে গিয়ে থাকি আমায় ক্ষমা করবেন, কারোর প্রতি আমার বিদ্বেষ নেই। এদের মধ্যে এক একজনের লীলা এক একরকম। তবে দেখেছি এক একজনের ভক্ত অন্য অবতারকে হয় নিন্দা করেন, নয় ছোটো চোখে দেখেন। সে তর্কে আমি যাচ্ছি না। সে রুচি আমার নেই।        আমি সবাইকেই প্রণাম জানিয়ে একটা কথাই বলতে চাই, দেখুন এনারা কেউ কিন্তু তাদের জন্মানোর আগে প্রতিষ্ঠিত কোনো মঠে বা আশ্রমে যোগ দিতে যাননি। মঠে বা আশ্রমে যে জন্মানো যায় না সে না জানার মত নির্বোধ আমি নই। কিন্তু এরা যদি জানতেন মঠে-আশ্রমে ঈশ্বর স্বমহিমায় আছেন তবে কি এনারা সেখানে নিজেকে যুক্ত করতেন না? না, কেউ তার আগের প্রতিষ্ঠিত কোন আশ্রমে বা মঠে নিজেকে যুক্ত করেননি, প্রত্যেকেই পৃথক থেকেছেন, নিজের আশ্রম খুলেছেন, বা তার ভক্তেরা খুলে দিয়েছেন।        অগত্যা প্রমাণিত হল ঈশ্বর মঠে-আশ্রমে থাকেন না, তাদের লিগ্যাসি মঠে-আশ্রমে থাকে। লিগ্যাসির একটা বাংলা হল উত্তারাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত উইলসম্মত সম্পত্তি। এইক্ষেত্রে কথাটাকে অন্যভাবে নিতে হবে অর্থাৎ অধ্যাত্মিক একটা লিগ্যাসির দিকে তারা যান। এই অধ্যাত্মিক লিগ্যাসি কি ভগবান? কদাপি নয়। ভগবান গীতাতে বলেছেন না তিনি কি কি, কোথায় কোথায় অধিষ্ঠিত, পড়েননি নাকি? সেখানে কোথায় বলেছেন আমায় খুঁজতে মঠে-মিশনে ইত্যাদিতে যাও? বলেছেন নিজের আত্মায় খোঁজো। নিজের মধ্যে খোঁজো, সেখানেই আমি।        আপনি বলতে পারেন, তবে ওই যে বলা হয়েছে আমার ভক্তেরা যেখানে একসাথে গান করেন নাচেন সেখানে আমি?        আরে ভাই, সেখানে তো বলা নেই যে আপনাকে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে তা করতে হবে। কারণ প্রতিষ্ঠানে যা হয় তা রেগুলার কারিকুলাম, অনুষ্ঠান, প্রাত্যহিকী – আপনি ফস্ করে একটা নিয়মের বাইরে গান গেয়ে ওঠেন তো দেখি সেইখানে গিয়ে, হয় আপনাকে চুপ করাবে, নইলে অর্ধচন্দ্র দেবে ওই মহাত্মাগণ, নইলে আপনাকে অনুমতি নিয়ে আসতে হবে কোনো পদস্থ মহাত্মার।        তাই বলছিলাম, অবশেষে কথাটা এই ঈশ্বর যেমন বিশ্বচরারচরের অণুতে-পরমাণুতে অধিষ্ঠিত আছেন বলে শাস্ত্রে আছে, আজও তেমনই আছে কথাটা। আপনারাই খামোখা এদিক ওদিক লিগ্যাসিকে ঈশ্বর ভেবে দৌড়াদৌড়ি করে বেড়াচ্ছেন। সেখানে তালা ঝুললে ভাবছেন ঈশ্বর ভয় পেয়েছেন। উঁহু, মোটেও না, যিনি আত্মস্বরূপ, যার দেহ নেই তার শরীরে কোরোনা কি করবে গা? কোরোনার লাইপোপ্রোটিন না কি সব আছে না? তার শুধু শরীরেই আগ্রহ, আত্মায় নয় রে বুদ্ধুরাম।        তাই বলি কি মনটাকে শান্ত করে, যেক'টা দিন বেঁচেবর্তে আছো বাপু, চাদ্দিকে এট্টু ভালোবেসে, না ঘেন্নাপিত্তি করে তাকাও তো দেখি বাপ আমার, কথা দিচ্ছি তিনি মনের মধ্যে শান্তি ঢেলে দেবেন। তারপর কোথায় কি হল মনই যাবে না। কেমন একটা ফুর্তি ফুর্তি ভাব আসবে। তবে হ্যাঁ, ওইসব মানুষগুলো যারা এর মধ্যেও নানা সত্যকারের প্রতিষ্ঠানে তোমার আমার সুরক্ষার জন্য প্রাণ হাতে করে লড়ে যাচ্ছে তাদের কাছে শ্রদ্ধাবনত হওয়াতে পুণ্যি বাড়বে এ আমি হলফ করে বলতে পারি। তাদের কাজের মহত্ব বুঝতে চোখকান বন্ধ করে বসতে হয় না বাপ আমার, চোখকান যত খোলা থাকবে তত বোঝা যাবে যে যতই ভববন্ধন খন্ডন করার প্রার্থনা করো না কেন, আদতে ওই ভববন্ধনেই তেনার লীলা।    
278
Mon, 02/24/2020 - 23:41
    শ্রদ্ধা আর প্রয়োজন, দুটো শব্দ আছে। একজন মানুষ শাস্ত্র, মন্দির, পুজো-আচ্চাকে শ্রদ্ধা করে। একজন মানুষ সব মানু্ষের মধ্যে সমান সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারার আদর্শকে শ্রদ্ধা করেন। একজন মানুষ নানা ধরণের খেলাধুলাকে শ্রদ্ধা করেন। একজন মানুষ রাজাকে কি রাজতন্ত্রকে শ্রদ্ধা করেন।       এরকম নানা রকমের শ্রদ্ধার সমাবেশ এই বৈচিত্রময় সমাজ। সবাই ভাবছেন তার শ্রদ্ধাই সব চাইতে বাস্তবানুগ, বাস্তবমুখী, কেন সবাই সেই শ্রদ্ধায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন না? ক্রমে শ্রদ্ধা প্রগাঢ় ভক্তিতে রূপান্তরিত হয়। সেই ভক্তি ক্রমে অন্য ভক্তির সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। ভক্তি হয় আক্রোশে পরিণত। তখন সমনস্কের সাথে সে নিরাপদ, সুখী, খুশী। যেই ভিন্ন মতের মানুষ এল, অমনি সে ক্রুদ্ধ, নয় কপট নম্রতায় তাকে স্বমতে আনার কৌশলে লিপ্ত, নয় রুদ্রমূর্তি ধারণ করে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়ল।       এর অন্যদিকে আছে প্রয়োজনের রাজ্য। সেখানে শৌখিন লড়াইয়ের অবকাশ নেই। অন্ন, বস্ত্র, জল, বায়ু, বাসস্থান, শিক্ষা - নিয়ে কারোর কোনো মতবিরোধ হয় না। এইসব নিয়ে কোনো পৃথকভাবে উদযাপনের দিনও হয় না। কারণ এগুলোর উপরে আমরা বাঁচি, এগুলো নিয়ে আমরা বাঁচি না। একজন শিশু তার খেলাঘরে নানা কিছু উদযাপন করে, কিন্তু নিজের মা-বাবার অস্তিত্বকে নিয়ে কোনো উৎসবের আয়োজন করে না। কারণ সে মা-বাবার উপরে বাঁচে, আর খেলনাকে নিয়ে সে থাকে। সেই যখন বড় হয়, মা-বাবার উপর নির্ভরতার দিন শেষ হয়, সেদিন সে মা-বাবার অস্তিত্বের নানা উৎসব আয়োজন করে।       আমাদের ভাষার মধ্যেও সেই বিভাজন স্পষ্ট। আমরা ইংরাজি ও খানিক হিন্দীতে নির্ভর করে বাঁচি, কিন্তু বাংলা নিয়ে থাকি। এই 'নির্ভর' আর 'নিয়ে' র মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। আমার বাড়িতে যিনি কাজ করেন, যিনি বাংলা ভাষা ভিন্ন অন্যকোনো ভাষা বলতে জানেন না তার কাছে মাতৃভাষা উদযাপন নিতান্তই আদিখ্যেতা। আমাদের তা বললে চলে না, আমাদের এই দিনটা এলেই খুব জোরের সাথে মনে করতে হয় আমাদের অস্তিত্বের সাথে আমারা একটা ভাষা প্রাপ্ত হয়েছিলাম। যে ভাষাটা এই প্রযুক্তিপ্রাণ যুগে ক্রমশ নিজের প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। আমাদের শিক্ষার ভাষা আর কাজের ভাষা দুই এখন আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে গেছে। আমাদের ঘর নেই আজ, কিন্তু মাঠ আছে। আমাদের নিজেদের জল খাওয়ার পাত্র নেই আজ, নিজেদের পুকুর দীঘি নেই, আছে সমুদ্র। আমাদের কথায় কথায় আজ আন্তর্জাতিক হতে হচ্ছে। তবে নিজের ঘর হারিয়ে আন্তর্জাতিক হওয়ার মধ্যে অভিনবত্ব কিছু না থাকলেও বেশ উত্তেজক কিছু আছে বইকি, নইলে এত মানুষ পোশাকে, আচারে, চলনে, বলনে, ভালোবাসায়, স্বজাতি অভিমানে এত পাশ্চাত্যমুখো কেন? কারণ আমাদের ঘর চাইনে, মাঠ চাই, আন্তর্জাতিক মাঠ।       একটা মজার উদাহরণ বলি। যখন 'সেপারেশন' বলে ইরানি সিনেমাটা অস্কার পেল, এবার আবার যখন 'প্যারাসাইট' বলে কোরিয়ান সিনেমাটা অস্কার পেল, তখন দুই পরিচালকই সমস্ত আন্তর্জাতিক চ্যানেলের সাক্ষাৎকারগুলোতে নিজেদের ভাষাতেই প্রধাণত কথা বলেছেন, আর মাঝে মাঝে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে কখনও কখনও। আমরা সব্বাই কিন্তু বেদম হেসেছি, অবশ্যই মনে মনে, তাজ্জব হয়েছি, ওমা! এতবড় একটা পুরস্কার পেলি, ইংরাজি জানিস নে? কতবড় নেমকহারাম রে তোরা? কি অশ্লীল দাম্ভিকতা!       আমরা সে নেমকহারামি করিনি কিন্তু। আমরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে, মৃত্যু অবধি সব শিক্ষার ভার ইংরাজি ভাষাকে দিয়ে আন্তর্জাতিক হয়েছি। আমরা আমাদের ঘর পুড়িয়ে এসে বলেছি আমাদের মাঠ আছে, আকাশ ভর্তি তারা আছে, এক সমুদ্র জল আছে, জঙ্গল ভর্তি ফল পাকুড় পশু আছে। মোদ্দা কথা আমরা আন্তর্জাতিক। তাই আমাদের সব ভাষা অবশেষে সব নদীর যেমন সাগরে এসে পড়ে, তেমন ইংরাজিতে এসে পড়ে।       আজ হঠাৎ করে যেহেতু প্রতিবেশী দেশে অমন একটা ঘটনা ঘটে গেছে, যেটা আমাদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করে, আমরা কেঁদেকঁকিয়ে "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো" গাইতে গাইতে যখন বলি, "আমি কি ভুলিতে পারি?" তখন আসলে মনে মনে বলি, "বেশ ভুলিতে পারি বাইশে ফেব্রুয়ারী থেকে বিশে ফেব্রুয়ারী অবধি। শুধু প্রকাশ্যে বলিতে পারি নে"। কারণ কি? কারণ এসব আমাদের সেন্টিমেন্ট, তাগিদ নয়। সেন্টিমেন্ট বড় স্পর্শকাতর বিষয়, ওই রামমন্দিরের মত, রামের শিক্ষাটা যেমন বড় নয়, বড় রামের আইডিয়াটা তেমনই আমাদের ভাষার মাথা উঁচু করে ইংরাজি ভাষার পাশাপাশি রাজপথে কাজের ভাষা হয়ে হাঁটার মান নেই, কিন্তু আমাদের সমস্ত সেন্টিমেন্ট অধিকার করে সে বসে। কারণ সেন্টিমেন্ট কখনও আন্তর্জাতিক হয় না। সেন্টিমেন্ট সব সময় প্রাদেশিক। কারণ সেন্টিমেন্ট এর মধ্যে একটা আদেখলাপনা আর পরশ্রীকাতরতা শুরু থেকেই থাকে। তাই আমাদের ভাষাটা আমরা চাই হাসপাতালে আইসিইউতে খুব প্রিয় বয়স্ক আত্মীয়ের মত নাকেমুখে নল গুঁজে শুয়ে থাকবে, আমরা আমাদের তুঙ্গে চড়া সেন্টিমেন্ট নিয়ে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে দেখা কর‍তে যাব। কাঁদব, গাইব, হাসব, বলব আমরা কত ভালোবাসি। এও বলব এই আইসিইউ এর বাইরে তুমি এসো না, আমরা পুরোদস্তুর আন্তর্জাতিক আজকে, তুমি বুঝবে না। আমরাও রবীন্দ্রনাথ নই, আর তুমিও সে বাংলা নও আজকে, তাই চুপটি করে শুয়ে লক্ষ্মীটি।       আচ্ছা ঘর যে নেই, তবে ঝড়ের সময় কি হয়? কেন আমাদের আন্তর্জাতিকতা মানে কি তবে? সেকি ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ নাকি? সে তো আমেরিকা গো, আমেরিকা। মায় লন্ডন যাওয়াকেও এখন আমরা পুরোনো শখ বলি। তবে আমাদের দুর্দিনে আমেরিকাই তো হবে আমাদের ছাতা, আশ্রয়। আমাদের প্রাণের কথা, কাজের কথা সবই তো ওদের ভাষাতেই বলতে পারি আমরা। তবে আর এই ডোবায় থাকব কেন?       তবে যে বইমেলায় এত বাংলা বই বিক্রি হল? তা তো হল, মানুষের সাধ আর তাগিদ দুটো আলাদা কথা বললাম যে বাপু, আগে গ্রন্থাগার খুলুক আর বিদ্যালয়গুলোয় বাংলা মাধ্যম ফিরুক, তবে ও যুক্তি শুনব। তদ্দিন আদিখ্যেতাই বলব।  
279
Wed, 02/19/2020 - 21:30
    ভারতের হিন্দু সভ্যতার আজ সত্যিই বড় দুর্দিন। যে কোনো সভ্যতার এক, তপস্যার দিক থাকে, আর দুই, আবর্জনার স্তূপ থাকে। সেদিন যে জঙ্গলের মধ্যে নানা বিষফলের সাথে পারিজাত ফুটেছিল, আজ এমন মনে করা হচ্ছে যে সেদিনের সে জঙ্গলে বিষফল বা বুনোফল বলে যেন কিছুই ছিল না। অনেকে আরো এগিয়ে গিয়ে সেই বিষফলের ফুলকেই পারিজাত বলে বিশ্বাস করাতে চাইছে। সাধারণ মানুষের না আছে স্মৃতির দীর্ঘজীবন, না তো গভীর পাঠের ধৈর্য বা সময়। ফলে তারা ক্ষণে ক্ষণেই বিস্মিত হচ্ছে, আহত হচ্ছে, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করছে, নিন্দামন্দ শাপশাপান্ত করছে।        হিন্দুধর্ম বলতে আমরা যা বুঝি তার প্রধান দুটো ধারা হয়, এক দর্শনের দিক; দুই, দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে মিশে নানা লোকাচার, ধর্মাচার ইত্যাদি নানা আচারের দিক। আমরা কথার তোড়ে যাকে আচার-বিচার বলে থাকি, সে আচার-বিচারের মধ্যে এখানে আচারের কথাই বেশি গুরুত্ব পায়।        একটা অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে দেশের পত্রপত্রিকাগুলো নানা গোল পাকিয়েছে। হিন্দু মহাসভার একজন বরিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব যিনি বলেছেন মেয়েদের বেশি পড়াশোনাই হল বর্তমান সমাজের নানা বিরোধ-দ্বন্দ্বের কারণ। কথাটা কিছু নতুন বলেননি। বাঙালি ভক্তকূল যারা প্রতিদিন এই কথাটা নিয়ে শয়ে শয়ে আলোচনার সূত্রপাত করছেন, বা নিন্দা-তিরস্কার করছেন, তাদের একটু আমাদের আধুনিকতম অবতার বলে যাকে মেনে নিচ্ছি, সেই রামকৃষ্ণদেবের জীবনী, কি তাঁর সহধর্মিনী সারদাদেবীর জীবনীর কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে চাইছি, যেখানে রামকৃষ্ণদেবও একই কারণে সারদাদেবীর পড়াশোনায় বাধ সাধেন ও বলেন, রামায়ণ পড়ছ পড়ো, আর মহাভারত ইত্যাদি পাঠের দরকার নেই; কারণ, মেয়েদের বেশি পড়াশোনা ভালো না। কার জন্য ভালো না? অবশ্যই সমাজের জন্য ভালো না। আরো মনে করে দেওয়া যেতে পারে, হৃদে বলে যে ভাগ্নে ছিল রামকৃষ্ণদেবের তিনি সারদাদেবীর বই কেড়ে নিতেন। কিন্তু এ-ও পাশাপাশি মনে রাখতে হবে এই সারদাদেবীই নিবেদিতাকে মেয়েদের স্কুলের জন্য উৎসাহ জুগিয়েছিলেন শুধু না, বিয়ে করাটাকেই মেয়েদের একমাত্র ভবিতব্য, এমন কথাকেও অস্বীকার করে শুধু পঠন-পাঠনে জীবন কাটানোটাকেও স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।        আমি যারা বিদ্যাসাগরকে পড়েছেন, তাদের প্রত্যেককে বঙ্কিমবাবুর ‘সাম্য’ প্রবন্ধটা পড়ার অনুরোধ জানাব। তিনি সমাজের নানা অসাম্যের আলোচনা করতে করতে শেষে আসেন আমাদের সমাজে স্ত্রী-পুরুষের অসাম্যের ব্যাপারে, যে কয়েকটা দিক নিয়ে তিনি আলোচনা করেছেন তা হল –     "১ম। পুরুষকে বিদ্যাশিক্ষা অবশ্য করিতে হয়; কিন্তু স্ত্রীগণ অশিক্ষিতা থাকে। ২য়। পুরুষের স্ত্রীবিয়োগ হইলে, সে পুনর্বার দারপরিগ্রহ করিতে অধিকারী। কিন্তু স্ত্রীগণ বিধবা হইলে, আর বিবাহ করিতে অধিকারিণী নহে; বরং সর্বভোগসুখে জলাঞ্জলি দিয়া চিরকাল ব্রহ্মচর্যানুষ্ঠানে বাধ্য। ৩য়। পুরুষে যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাইতে পারে, কিন্তু স্ত্রীলোকে গৃহপ্রাচীর অতিক্রম করিতে পারে না। ৪র্থ। স্ত্রীগণ স্বামীর মৃত্যুর পরেও অন্য স্বামীগ্রহণে অধিকারী নহে, কিন্তু পুরুষগণ স্ত্রী বর্তমানেই, যথেচ্ছ বহুবিবাহ করিতে পারেন।"          এই আলোচনার এক জায়গায় বলছেন,     "প্রথম তত্ত্ব সম্বন্ধে, সাধারণ লোকেরও একটু মত ফিরিয়াছে। সকলেই এখন স্বীকার করেন, কন্যাগণকে একটু লেখাপড়া শিক্ষা করান ভাল। কিন্তু কেহই প্রায় এখনও মনে ভাবেন না যে, পুরুষের ন্যায় স্ত্রীগণও নানাবিধ সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, দর্শন প্রভৃতি কেন শিখিবে না? যাঁহারা, পুত্রটি এম-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হইলে বিষপান করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারাই কন্যাটি কথামালা সমাপ্ত করিলেই চরিতার্থ হন। কন্যাটিও কেন যে পুত্রের ন্যায় এম-এ পাশ করিবে না, এ প্রশ্ন বারেক মাত্রও মনে স্থান দেন না। যদি কেহ, তাঁহাদিগকে এ কথা জিজ্ঞাসা করে, তবে অনেকেই প্রশ্নকর্তাকে বাতুল মনে করিবেন। কেহ প্রতিপ্রশ্ন করিবেন, মেয়ে অত লেখাপড়া শিখিয়া কি করিবে? চাকরি করিবে না কি? যদি সাম্যবাদী প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে বলেন, “কেনই বা চাকরি করিবে না?” তাহাতে বোধ হয়, তাঁহারা হরিবোল দিয়া উঠিবেন। কোন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তি উত্তর করিতে পারেন, ছেলের চাকরিই জোটাইতে পারি না, আবার মেয়ের চাকরি কোথায় পাইব? যাঁহারা বুঝেন যে, বিদ্যোপার্জন কেবল চাকরির জন্য নহে, তাঁহারা বলিতে পারেন, “কন্যাদিগকে পুত্রের ন্যায় লেখাপড়া শিখাইবার উপায় কি? তেমন স্ত্রীবিদ্যালয় কই?”        বাস্তবিক, বঙ্গদেশে, ভারতবর্ষে বলিলেও হয়, স্ত্রীগণকে পুরুষের মত লেখাপড়া শিখাইবার উপায় নাই। এতদ্দেশীয় সমাজমধ্যে সাম্যতত্ত্বান্তর্গত এই নীতিটি যে অদ্যাপি পরিস্ফুট হয় নাই—লোকে যে স্ত্রীশিক্ষার কেবল মৌখিক সমর্থন করিয়া থাকে, ইহাই তাহার প্রচুর প্রমাণ। সমাজে কোন অভাব হইলেই তাহার পূরণ হয়—সমাজ কিছু চাহিলেই তাহা জন্মে। বঙ্গবাসিগণ যদি স্ত্রীশিক্ষায় যথার্থ অভিলাষী হইতেন, তাহা হইলে তাহার উপায়ও হইত।"          এটি গেল শিক্ষা বিষয়ে। পুনর্বিবাহ নিয়ে লিখছেন এক জায়গায়,     "আর একটি কথা আছে। অনেকে মনে করেন যে, চিরবৈধব্য বন্ধন, হিন্দু মহিলাদিগের পাতিব্রত্য এরূপ দৃঢ়বদ্ধ যে, তাহার অন্যথা কামনা করা বিধেয় নহে। হিন্দু স্ত্রীমাত্রেই জানেন যে, এই এক স্বামীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার সকল সুখ যাইবে, অতএব তিনি স্বামীর প্রতি অনন্ত ভক্তিমতী। এই সম্প্রদায়ের লোকের বিবেচনায় এই জন্যই হিন্দুগৃহে দাম্পত্যসুখের এত আধিক্য। কথাটি সত্য বলিয়াই না হয় স্বীকার করিলাম। যদি তাই হয়, তবে নিয়মটি একতরফা রাখ কেন? বিধবার চিরবৈধব্য যদি সমাজের মঙ্গলকর হয়, তবে মৃতভার্য পুরুষের চিরপত্নীহীনতা বিধান কর না কেন? তুমি মরিলে, তোমার স্ত্রীর আর গতি নাই, এজন্য তোমার স্ত্রী অধিকতর প্রেমশালিনী; সেইরূপ তোমার স্ত্রী মরিলে, তোমারও আর গতি হইবে না, যদি এমন নিয়ম হয়, তবে তুমিও অধিকতর প্রেমশালী হইবে। এবং দাম্পত্য সুখ, গার্হস্থ্য সুখ দ্বিগুণ বৃদ্ধি হইবে। কিন্তু তোমার বেলা সে নিয়ম খাটে না কেন? কেবল অবলা স্ত্রীর বেলা সে নিয়ম কেন?        তুমি বিধানকর্তা পুরুষ, তোমার সুতরাং পোয়া বারো। তোমার বাহুবল আছে, সুতরাং তুমি এ দৌরাত্ম্য করিতে পার। কিন্তু জানিয়া রাখ যে, এ অতিশয় অন্যায়, গুরুতর, এবং ধর্মবিরুদ্ধ বৈষম্য।"          অন্য জায়গায় মেয়েদের নানা নিষেধের শিকলে আটকে রাখার বিষয়ে লিখছেন,     "কিন্তু পুরষের যত প্রকার দৌরাত্ম্য আছে, স্ত্রীপুরুষে যত প্রকার বৈষম্য আছে, তন্মধ্যে আমাদিগের উল্লিখিত তৃতীয় প্রস্তাব, অর্থাৎ স্ত্রীগণকে গৃহমধ্যে বন্য পশুর ন্যায় বদ্ধ রাখার অপেক্ষা নিষ্ঠুর, জঘন্য অধর্মপ্রসূত বৈষম্য আর কিছুই নাই। আমরা চাতকের ন্যায় স্বর্গমর্ত্য বিচরণ করিব, কিন্তু ইহারা দেড় কাঠা ভূমির মধ্যে, পিঞ্জরে রক্ষিতার ন্যায় বদ্ধ থাকিবে। পৃথিবীর আনন্দ, ভোগ, শিক্ষা, কৌতুক, যাহা কিছু জগতে ভাল আছে, তাহার অধিকাংশে বঞ্চিত থাকিবে। কেন? হুকুম পুরুষের।        এই প্রথার ন্যায়বিরুদ্ধতা এবং অনিষ্টকারিতা অধিকাংশ সুশিক্ষিত ব্যক্তিই এক্ষণে স্বীকার করেন, কিন্তু স্বীকার করিয়াও তাহা লঙ্ঘন করিতে প্রবৃত্ত নন। ইহার কারণ, অমর্যাদা ভয়। আমার স্ত্রী, আমার কন্যাকে, অন্যে চর্মচক্ষে দেখিবে! কি অপমান! কি লজ্জা! আর তোমার স্ত্রী, তোমার কন্যাকে যে পশুর ন্যায় পশ্বালয়ে বদ্ধ রাখ, তাহাতে কিছু অপমান নাই? কিছু লজ্জা নাই? যদি না থাকে, তবে তোমার মানাপমান বোধ দেখিয়া, আমি লজ্জায় মরি!        জিজ্ঞাসা করি, তোমার অপমান, তোমার লজ্জার অনুরোধে, তাহাদিগের উপর পীড়ন করিবার তোমার কি অধিকার? তাহারা কি তোমারই মানরক্ষার জন্য, তোমারই তৈজসপত্রাদিমধ্যে গণ্য হইবার জন্য, দেহ ধারণ করিয়াছিল? তোমার মান অপমান সব, তাহাদের সুখ দুঃখ কিছুই নহে?        আমি জানি, তোমরা বঙ্গাঙ্গনাগণকে এরূপ তৈয়ার করিয়াছ যে, তাহারা এখন আর এই শাস্তিকে দুঃখ বলিয়া বোধ করে না। বিচিত্র কিছুই নহে। যাহাকে অর্ধভোজনে অভ্যস্ত করিবে, পরিশেষে সে সেই অর্ধভোজনেই সন্তুষ্ট থাকিবে, অন্নাভাবকে দু্খ মনে করিবে না। কিন্তু তাহাতে তোমার নিষ্ঠুরতা মার্জনীয় হইল না। তাহারা সম্মত হউক, অসম্মতই হউক, তুমি তাহাদিগের সুখ ও শিক্ষার লাঘব করিলে, এজন্য তুমি অনন্ত কাল মহাপাপী বলিয়া গণ্য হইবে।"          পরিশেষে লিখছেন,     "এই তিনটি বিঘ্ন নিরাকরণের একই উপায়—শিক্ষা। লোকে সুশিক্ষিত হইলে, বিশেষতঃ স্ত্রীগণ সুশিক্ষিতা হইলে, তাহারা অনায়াসেই গৃহমধ্যে গুপ্ত থাকার পদ্ধতি অতিক্রম করিতে পারিবে। শিক্ষা থাকিলেই, অর্থোপার্জনে নারীগণের ক্ষমতা জন্মিবে। এবং এ দেশী স্ত্রীপুরুষ সকল প্রকার বিদ্যায় সুশিক্ষিত হইলে, বিদেশী ব্যবসায়ী, বিদেশী শিল্পী বা বিদেশী বণিক্, তাহাদিগের অন্ন কাড়িয়া লইতে পারিবে না। শিক্ষাই সকল প্রকার সামাজিক অমঙ্গল নিবারণের উপায়।        আমরা যে সকল কথা এই প্রবন্ধে বলিয়াছি, তাহা যদি সত্য হয়, তবে আমাদিগের দেশীয় স্ত্রীগণের দশা বড়ই শোচনীয়া। ইহার প্রতিকার জন্য কে কি করিয়াছেন? পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ব্রাহ্মসম্প্রদায় অনেক যত্ন করিয়াছেন—তাঁহাদিগের যশঃ অক্ষয় হউক; কিন্তু এই কয় জন ভিন্ন সমাজ হইতে কিছুই হয় নাই। দেশে অনেক এসোসিয়েশন, লীগ, সোসাইটি, সভা, ক্লাব ইত্যাদি আছে—কাহারও উদ্দেশ্য রাজনীতি, কাহারও উদ্দেশ্য সমাজনীতি, কাহারও উদ্দেশ্য ধর্মনীতি, কাহারও উদ্দেশ্য দুর্নীতি, কিন্তু স্ত্রীজাতির উন্নতির জন্য কেহ নাই। পশুগণকে কেহ প্রহার না করে, এজন্যও একটি সভা আছে, কিন্তু বাঙ্গালার অর্ধেক অধিবাসী, স্ত্রীজাতি—তাহাদিগের উপকারার্থ কেহ নাই। আমরা কয় দিনের ভিতর অনেক পাঠশালা, চিকিৎসাশালা এবং পশুশালার জন্য বিস্তর অর্থব্যয় দেখিলাম, কিন্তু এই বঙ্গসংসাররূপ পশুশালার সংস্কারণার্থ কিছু করা যায় না কি?"          এতগুলো উদ্ধৃতি দেওয়ার কারণ কি? আমি এইটাই বলতে চাই যে আমাদের শুধু আবর্জনাই ছিল তা নয়, সেই আবর্জনা পরিষ্কারের চেষ্টাও ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘ধর্মতত্ত্ব’, ‘কৃষ্ণচরিত্র’ সেই সাক্ষ্য বহন করে যেখানে তিনি তাঁর সমস্ত ধীশক্তি, বিচারশক্তি, শিক্ষা ইত্যাদি দিয়ে লড়াইয়ে নামছেন। এককথায় যাকে আমরা ‘সমাজসংস্কারক’ ইত্যাদি বলে থাকি। যদিও আজকের বাঙালি ঘরের নানা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত রমণীকূলের আগ্রহে পুষ্ট অত্যাধুনিক তত্ত্বে নিপুণ ধারাবাহিকগুলোর ব্যাখ্যা কি করতেন সাহিত্যসম্রাট বলা শক্ত, কিন্তু সে অন্য কথা।        তবে শুধু কি বঙ্কিম? নিশ্চয় না, 'ভারতের নবজাগরণ' বলে একটা কথা কথা প্রচলিত আছে। আমার কথাটার সাথে খুব একটা সম্মতি নেই। পাশ্চাত্যে যা হয়েছিল তা অবশ্যই নবজাগরণ, কিন্তু ভারতে সেদিন রামমোহনের হাত ধরে যা হয়েছিল, তা কি নবজাগরণ, না পুনর্জাগরণ? রামমোহন তথা বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, রমণ মহর্ষি, গান্ধী, অরবিন্দ, দয়ানন্দ ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজে যে প্রাণের ঢেউ এসেছিল সেকি পাশ্চাত্যের কোনো তত্ত্বে? না তো। রামমোহনের মননে উপনিষদের তত্ত্ব, ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠায় নতুন রূপ ধারণ করেছিল। ক্রমে আমাদের সভ্যতায় পাশ্চাত্যের নানা আলোকিত দিক এসে নিজের জায়গা করে নেয়। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা যোগসূত্র হয় জ্ঞানের, বিদ্যার, দর্শনের।  ভাবজগতের আদান-প্রদানের পথ খোলে। সংস্কার শুরু হয়েছিল এ সবের পথ ধরে। রাধাকৃষ্ণান যেমন বলছেন যে, এই মেলবন্ধন ছাড়া কোনো সভ্যতা উন্নত হতে পারে না। আজ যদি সেই যুগের ঋষিরা এসে দেখে আমরা তাদের দাগের উপর দাগই বুলিয়ে চলেছি, সেকি খুব গর্বের কথা হবে? না তো। যে গীতা, যে উপনিষদ ঘোষণা করে যে সমস্ত পুস্তকস্থিত তত্ত্ব মৃত, সত্যের পথে বাধাস্বরূপ, সে ঋষিরা নিশ্চয় আমাদের বিচার-পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র শব্দের বেড়ি পরে জীবনযাপন করতে শেখাননি? যদিও সে পথে ভারত হাঁটেনি বেশিদিন, বারবার নানা ক্ষুদ্রতা, সংকীর্ণতা জনজীবনকে আটকে ধরেছে, আবার নতুন করে স্রোতকে জাগিয়ে তোলার কেউ না কেউ এসেছে।        এগুলো গেল অতীতের কথা। আজ যখন কেউ বলছে, ঋতুমতী স্ত্রী-র কুকুর হয়ে জন্মানো বিধান, তখন বুঝতে হবে তারা সেই আবর্জনার ধারক-বাহক যারা মাথা তুলে দেখতে শেখেনি। ভারত বলে নয়, সভ্যতার প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মের ক্ষেত্রে ঋতুমতী হওয়াকে সাদরে গ্রহণ করা হয়নি। হয় তো ভারতে নানক, সারদাদেবী ছাড়া তেমন বিশেষ কাউকে চোখেও পড়ে না যারা এটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে দেখেছেন। অনেক অল্পবয়েসি মেয়ে আজও শীতের মধ্যে এক কাপড়ে মেঝেতে শুয়ে নিজের এই অভিশপ্ত সময়কে কাটানোর জন্য প্রাণ অবধি বিসর্জন দিয়েছে, এ-ও আমরা জানি। এ লোকাচার।        এখানে উপায় কি? বাছতে শেখা। কে শেখাবে? আমাদের অতীত ও বর্তমানের পরিশ্রমী, সৎ মানুষেরাই। অরিন্দম চক্রবর্তী মহাশয় যখন সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের কথা লেখেন, বলেন, যিনি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন, বর্তমান যুগের অনুকূল করে ভারতের দর্শনকে বোঝাতে যান, তিনি সীতারামদাসের বর্ণাশ্রম নিয়ে মতামতকে সমর্থন করে তার ব্যাখ্যা খুঁজে কালপাত করেন না। বিবেকানন্দ যেমন বলেন, উপনিষদে অনেক অবান্তর শ্লোক আছে, সেগুলো বলি না, বেছে নিই। তাঁর গুরু যেমন বলতেন, বালিতে চিনিতে মেশানো আছে, বেছে নিতে। “ল্যাজা মুড়া বাদ দিয়ে নাও” – এই যে উদারতা, এর শিক্ষাটা আজ মাঠে মারা যাচ্ছে। এক পক্ষের কাছে সবটাই নিন্দনীয়, সবটাই দূষণীয়, আরেক পক্ষের কাছে সবটাই গ্রহণীয়, সবটাই পূজনীয়। এরা দু'জনেই ভয়ঙ্কর। আর আজ এরা দু'জনেই মুখোমুখি। কোনো ধর্মগুরুর ছবি নিয়ে, কয়েকটা বাছাবাছা উদ্ধৃতি নিয়ে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় অকথা, কুকথা লিখে কেউ নিজেকে আধুনিক প্রমাণ করছেন, অন্যদিকে কেউ একজন দেবতার ছবি না শেয়ার করলে কি কি বিপদ হবে সেই কথা শেয়ার করছেন। দু'জনেই একই দোষে দুষ্ট, গভীরভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা কম, সেই ক্ষমতাকে পাঠের মাধ্যমে পূরণ করে নেওয়ার সদিচ্ছাহীনতা। সস্তায় বাজিমাতের চেষ্টা সব দিকে। আরে ভাই পুরাকালে কোনো বইতে কি মানুষে পুরাকালের গন্ধ থাকবেই, সে বিষয়ে অবগত থাকা আবশ্যিক, কিন্তু শুধু সেইটুকুই আছে বলে তাকে হাটে এনে নিজের গায়ে সেই কাদা মেখে ঘুরে বেড়ানোটা যেমন মূর্খামি, তেমন তাকেই ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিয়ে প্রচারে নামাটাও পাগলামি।        মাঝের পথে হেঁটে আজকের আবর্জনা পরিষ্কারের বড় বেশি দরকার। অবশ্যই সেই পুরোনো সূত্রে, যা বিবেকানন্দের ভাষায়, অন্ধকার অন্ধকার বলে চীৎকার করলে কিছু হবে না, আলো আনলে অন্ধকার এমনিই যাবে।  
280
Fri, 02/14/2020 - 11:30
              ভালোবাসা নিয়ে লেখার একটা ছুতো পেলে এমনি এমনিই যেতে দেব নাকি? কক্ষণও না। সে লোকে যতই বলুক ক্লিশে, যতই ব্যঙ্গ করুক, জ্ঞান দিক – ভালোবাসা তো রোজকার দিনের, আমি তবু লিখব। যদি বলো সব কথা কি ভালোবাসা নিয়ে এখনও লেখা হয়ে যায়নি? আমি বলব, হয়ে গেলেও আমি লিখব। তাদের লেখার উপর দাগ বোলাবো, তবু লিখব। কেউ যদি বলে এ ভালোবাসা তো আসলে কাম, বিশুদ্ধ কাম। আমি বলব, যে মাটির প্রদীপে শিখা জ্বালাতে জানে না, সেই বলে এ কথা। আমি বলি না, যদিও আস্তাকুঁড়েতে অনেক শিখাহীন প্রদীপের লজ্জা দেখেছি। সে কথা থাক। শিখার কথাই বলার আজ।       ভালোবাসা যেন এলেবেলে। তা নিয়ে বিপ্লব হয় না। তা নিয়ে আন্দোলন হয় না। তা নিয়ে বাজেট পেশ হয় না। কিন্তু তাকে নিয়ে আগ্রহেরও শেষ নেই, আবার ছুঁৎমার্গীদের হাজার-একটা বায়নাক্কারও শেষ নেই। যত নিয়ম-নীতি-ভয় মানুষের যেন ওই একটা শব্দে। সমস্ত জগৎ যেন উচ্ছন্নে যাচ্ছে ওই একটা শব্দে। অথচ এই একটা শব্দের অভাবে যে কত প্রাণ শুকিয়ে মরছে, পচে মরছে শুধু এই বিধিনিষেধগুলোর শিকলটার ভার গায়ের থেকে নামাতে পারছে না বলে, তার খেয়াল আছে? শরীরটার জুজু এমন দেখিয়ে রাখা হয়েছে, যেন পান থেকে চুন খসলেই শরীর ভালোবাসার রাজ্যে ঢুকে একটা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধাবে, আর যত পবিত্র ভালোবাসার ফল টুপটুপ করে মাটিতে পড়ে নষ্ট হবে, পুরো সমাজ মুহূর্তে ধ্বংস হবে।       সত্যিই কি তাই? মানুষী ভালোবাসায় এমন অসুরের মত শরীরের খিদে? বাকি যে ভালোবাসাটুকুকে আমরা সমাজস্বীকৃত ভালোবাসা বলি, হয় সে অনুকম্পা, নয় বাৎসল্য, নয় ভক্তি, আর বাকিটুকু আইনের স্বাক্ষর নিয়ে শরীরী হওয়ার অনুমতি। এর বাইরে ভালোবাসা গেলেই যেন সুনামি। আজও মধ্যযুগের ভালোবাসার শাসন বাজারে বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মেয়েরা কামিনী, মেয়েরা লজ্জাভূষণাবৃতা, মেয়েরা সমস্ত সমাজের ঢাল, মেয়েরা দুই তীর – মধ্যে বয়ে যাচ্ছে উন্মত্ত পুরুষী কাম ইত্যাদি ইত্যাদি। সমস্ত শুচিতা শরীর নিয়ে, সমস্ত শাসন শরীর নিয়ে, সমস্ত ধর্ম শরীর নিয়ে, সমস্ত নীতিনিয়ম শরীর নিয়ে – এ সবের মিলিত ফল কি? একটা ভণ্ডামিতে ভরা, নিষ্প্রাণ, অনুকরণ পুনারবর্তনে বাঁচা সমাজ। শরীরকে এত ভয় কেন? কারণ একটাই, ভালোবাসা নেই বলে। একটা গাড়ি যদি দুর্গম পাহাড়ি পথে ওঠে, তবে ক্ষণে ক্ষণে খাদে পড়ার ভয় সেই পায় যার চালক দুর্বল, খাদের আকর্ষণ না, খাদের ভয় তাকে খাদের দিকে নিয়ে যায় বলে। আমি এখনও দেখেছি যে বাড়িতে যত নানা গুরুর আধিপত্য সে বাড়ির বাচ্চাগুলোর মনে তত বিকার, তত অপরিণত বিকৃত ভাবনা-চিন্তার বিষফল।       যখন স্কুলে পড়ি তখন আমার এক সহপাঠী ছিল যাদের পরিবার রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত। আমি তার মুখে শুনতাম কিভাবে নারী পুরুষকে তার উৎকর্ষতা থেকে বিপথগামী করে। তারপর কলেজে উঠে শুনলাম আমার এক বৈষ্ণব সহপাঠীর মুখে যে নারী নরকের দ্বার। ধীরে ধীরে বুঝলাম, নারী হয় মা, নয় মাগী। এর মাঝখানে ধর্মীয় বিশ্বাস শ্বাস নিতে পারে না। ধর্মের এত শরীরী ভয়। এত সঙ্কোচ। এতেই নাকি সমাজ টিকে থাকবে, এতেই নাকি মঙ্গল। আমার বলতে লজ্জা থাকলেও, দ্বিধা নেই, স্কুলে পড়াকালীন এ বিশ্বাস আমার মনেও দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। আমিও মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত উন্নাসিক পৌরুষের গর্ব অনুভব করতাম – নারী হয় ত্যাগের সিঁড়ি, নয় ভোগের রাজ্য, হয় ভক্তিমতী, হয় সেবিকা, নয় অবিদ্যা, নয় রাক্ষুসী, নয় কুলক্ষণা। এ-ও আমাদের মহান আদর্শের শিক্ষা, যতই বাইপাস করার চেষ্টা করা হোক না কেন, যতই নানা মোড়কে আজকে ঢাকার চেষ্টা করা হোক না কেন।       এ প্রথার সাথে লড়াইয়ে অবশ্যই সারদাদেবী আর নিবেদিতার অবদান অনস্বীকার্য। কোনো ধর্মীয় উন্মাদনা নয়, কোনো অবাস্তব তত্ত্বকথার মোড়ক নয়, শুধুমাত্র মানবিকতাই এদের যুক্তির সাক্ষ্য। একটা উদাহরণই যথেষ্ট মনে করি --- একজন মহিলা কাঁদছেন পাগলের মত, কারণ তার উপপতি তাকে ছেড়ে চলে গেছে। যার সাথে সে নিজের সংসার ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। আমি আগেও বলেছি বেশিরভাগ শরীরীশুচিবাই, সঙ্কীর্ণমনা, জীবনে সব উৎসাহ হারানো দুর্বল মানুষগুলো ধর্মের রাজ্যে ঢোকে, শ্রীঅরবিন্দ যেমন বলতেন, যখনই মানুষকে বলি ঈশ্বরের কাছে সব সমর্পণ করো, সে আগেই নিজের সাধারণ বুদ্ধিটাকে সমর্পণ করে রাখে। সে যা হোক, যখন সেই মহিলার গলাচেরা কান্না বাগবাজারে সারদাদেবীর ঘরে এসে পৌঁছালো তিনি উঠে গিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ান এবং জিজ্ঞাসা করেন, কি হয়েছে ওর? সবটা শোনেন। ওনার সাথে যে সব আরো তথাকথিত পূর্ববর্ণিত ভক্তিমতীরা ছিল, তারা বলল, বেশ হয়েছে, যেরকম নিজের স্বামীকে ছেড়ে আসা, সেরকম শাস্তিই হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই অবশ্য, কারণ আজও একই নিদান পেতেন মহিলা, আমি সিরিয়ালগুলোর উপকরণ সম্বন্ধে যতটা জ্ঞাত তার উপর ভিত্তি করে বলতে পারি। কিন্তু সারদাদেবীর মুখ থেকে সেদিন যা বেরিয়েছিল, তা কি করে এক গ্রামে বড় হওয়া, তথাকথিত অশিক্ষিতা মহিলা বলে ওঠেন ভাবলে আজও বিস্মিত হতে হয়। তিনি বলেছিলেন, তোমরা চুপ করো, নির্দয় হয়ো না, যে মানুষটা একজনকে নির্ভর করে সব ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে, তাকে ছেড়ে যাওয়াটা খুব অন্যায় হয়েছে তার।       এ একটা যুগান্তকারী সংলাপ। এর অর্থ এ নয় যে তিনি বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ককে উৎসাহ জানাচ্ছেন বা নৈতিক সমর্থন জানাচ্ছেন, তিনি এইখানে ভালোবাসার পক্ষ নিচ্ছেন, নীতির না। এইখানেই সূত্রপাত হয় মধ্যযুগীয় ভাব থেকে মানবিক বিশ্বাসে নিজের বিচারধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। হ্যাঁ, তথাকথিত এমন একটা অনৈতিক, অসামাজিক ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিতেও তাঁর বাধেনি তখন। বারবার বলতেন, “ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক'জন? নিন্দা-ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কি করে যে তাকে ভাল করতে হবে, তা বলতে পারে ক'জনে?”       আর কি করে সে ভালো হয়? “ভালোবাসাতেই সব কিছু হয়, জোর করে কায়দায় ফেলে কাউকে দিয়ে কিচ্ছু করানো যায় না”। আর শেষে সেই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অমোঘ বাণী, “যদি শান্তি চাও, কারও দোষ দেখো না। দোষ দেখবে নিজের। জগৎকে আপন করে নিতে শেখো। কেউ পর নয়, জগৎ তোমার”। এতদিন তো আমরা শুনেছি জগৎ আমাদের পর, “মন চলো নিজ নিকেতনে, সংসার বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রম কেন অকারণে”... বিবেকানন্দ গাইছেন, আরোও শুনেছি, “ভেবে দেখ মন কেউ কারো না, মিছে ভ্রম ভূমণ্ডলে”... রামকৃষ্ণ তথা আপামর সাধক গাইছেন। কিন্তু সারদাদেবী একি কথা বললেন? হুম, এই কথাই ভালোবাসার কথা।       মানুষের সমস্ত শুচিবাই তার শুষ্ক হৃদয়ের সাইড এফেক্ট। মা সারদা তা জানতেন। বুঝতেন। পুরো জাতটা হৃদয়টাকে দূরে ফেলে, একে অন্যের দোষ দেখে, নিন্দামন্দ করে, ধুঁকছে, তা-ও বুঝতেন। তাই ওনার এক সঙ্গী যখন শীতের রাতে শুচিবাইতার জন্য গঙ্গাস্নানে যাবেন বলেন, তিনি ধমক দিয়ে বলেন, “সারাদিন জড়ের মত বসে থেকে থেকে কি শুচিবাই মনটাই না তোদের হয়েছে, আমায় ছোঁ, আর স্নানে যেতে হবে না।“ এ অহমিকার কথা না, আত্মবিশ্বাসের কথা।       আর নিবেদিতার কথা? স্বামীজির দিকে তাকিয়ে আছেন মুগ্ধ হয়ে, স্বামীজিকে আসলেই সেদিন দুর্দান্ত দেখাচ্ছিল, স্বামীজি মুচকি হেসে বলেন, দেখো এসব (নিজের শরীরের দিকে আঙুল দেখিয়ে) যেন তোমায় বোকা করে না দেয়!       নিবেদিতা তো সত্যিই স্বামীজিকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু এই কথাটাকে সহজভাবে মেনে নিতে ভক্তকূল পারবে না বলেই "সেই সময়" এর অসামান্য লেখকের আর ভয়ে স্বামীজির জীবনী লিখতে চেয়েও লিখলেন না। কিন্তু যখন "স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি" বইটা, বা "স্বামীজির সহিত হিমালয়ে" পড়লেই বোঝা যায় মানুষটাকে কি অপরিসীম ভালোবেসেছিলেন মার্গারেট। শ্রীকান্ততে লেখক যখন ইন্দ্রজিতের মনোভাব বালক শ্রীকান্তর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন তখন নিজেই প্রশ্ন করছেন যে পাঠক হয় তো ভাববে যে বালক এমন মনোরাজ্যের গভীরের কথা জানে কি করে? উত্তরও শরৎচন্দ্রই দিচ্ছেন, একমাত্র ভালোবাসলেই হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশের অধিকার মেলে, সব রহস্য উন্মোচিত হয়। এ কথা স্বামীজির শিষ্যদের সাথে একান্ত কাটানো সময়েও "দেববানী" বইতে উল্লেখ আছে - "প্রেমিকের কাছেই সব রহস্যের দ্বার উন্মোচিত"।       ভালোবাসা মানে হলিউড না, ভালোবাসা মানে বলিউড না, পার্ক না, আউটিং না – আবার এগুলোর সবক'টা থাকলেও আপত্তি নেই, শুধু এগুলো হলেই আপত্তি। ভালোবাসা মানে নিজেকে প্রতিদিন সব জড়তা থেকে বাঁচিয়ে নতুন হয়ে ওঠা – "তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে-ক্ষণ, ও মোর ভালোবাসার ধন।" সে ভালোবাসায় শরীর খাদ হয়ে সারাদিন আতঙ্কে রাখে না। সেখানে শরীর থেকে হৃদয় --- কেউ তার সামঞ্জস্য হারায় না বলেই কোনো বিকার হয় না। ভালোবাসা সঞ্জীবনী হয়ে ওঠে। ভালোবাসাকে কোনো সংজ্ঞায় বাঁধতে চাও কেন দুর্বল? ভালোবাসা সাকার থেকে নিরাকারের দিকে যাত্রা। নীড় থেকে আকাশে ডানা মেলা। তুমি আকাশ কেড়ে নীড়ে শেকল পরে আর যাই হোক মরে বেঁচে থাকতে পারো, বেঁচে থেকে মরতে পারো না।  
281
Fri, 02/07/2020 - 21:00
    জীবনের উদ্দেশ্য কি?        টলস্টয় তাঁর 'কনফেশন'-এ বলতে চাইছেন বিশ্বাসের কথা, faith। আমাদের শব্দ 'শ্রদ্ধা' কথাটা কি কাছাকাছি? বিশ্বাস করতে হবে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে। কোন ঈশ্বর? সেকি প্রতিষ্ঠিত ধর্মের? উত্তর হ্যাঁ-ও বটে, না-ও বটে। সেখানে ঠিক-ভুলে মেশানো একটা অবস্থা। বেছে নিতে হবে। জীবনচর্যায় সরলতা আনতে হবে। আরো মাটির কাছাকাছি আসতে হবে। ঈশ্বরের অন্বেষণ হতে হবে বৌদ্ধিক, কৌতুহল মেটানোর জন্য নয়, প্রাণের গভীরের আকুতিতে, অনুভবে। তার জন্য জীবনে একটা বড় প্রশ্ন জাগতে হবে, এ জীবনের উদ্দেশ্য কি?        টলস্টয়ের 'কনফেশন' পড়তে পড়তে আমার বারবার কথামৃতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, একই কথা, জীবনের উদ্দেশ্য কি? ঠাকুরের উত্তর - ঈশ্বরলাভ, চৈতন্যলাভ, বিবেক-বৈরাগ্যলাভ।        সে সময় কলকাতায় পাশ্চাত্য চিন্তাধারা, জড়বাদের জয়-জয়কার শুরু হব হব করছে। সাথে খ্রীষ্টধর্ম, ব্রাহ্মধর্মও প্রচার ও প্রসার লাভ করছে। সেদিন নানাভাবে মানুষ উত্তর খুঁজছে, এই একই প্রশ্নের উত্তর, তবে জীবনের উদ্দেশ্য কি? কিন্তু এই প্রশ্ন কতজন মানুষের জীবনে আসে? টলস্টয়ের বলা একটা প্রাচ্যের গল্পেই আসা যাক।        একজনকে একটা বাঘে তাড়া করেছে। সে দৌড়াতে দৌড়াতে একটা কুয়োর মধ্যে লাফ দিয়েছে। কুয়োর নীচে পড়ে যাওয়ার আগেই কুয়োর দেওয়ালে ঝোপঝাড় ধরে ঝুলে পড়েছে, কারণ কুয়োর নীচে কুমীর। উপরে বাঘ, নীচে কুমীর। চারদিকে অন্ধকার, শোনা যাচ্ছে কুট্ কুট্ করে কিসের যেন আওয়াজ হচ্ছে। কিসের আওয়াজ? ভালো করে খেয়াল করে দেখা যাচ্ছে যে ইঁদুরের দল ঝোপঝাড়গুলো দাঁত দিয়ে কাটছে। অর্থাৎ, তার নীচে পড়ে কুমীরের পেটে যেতে আর বেশিক্ষণ নেই। এমন সময় সে খেয়াল করল তার সামনের ঝোপঝাড়ের পাতায় কিছু মধু পড়ে। সে তৎক্ষণাৎ সেই মধু জিভ দিয়ে চাটতে শুরু করে দিল।        এই হল জীবন। এখন সংসারে সিংহভাগ মানুষ নানা নেশায় ছুটে চলেছে। কেউ অর্থ, কেউ মান-সম্মান, কেউ সুখ, কেউ অ্যাডভেঞ্চার --- আরো নানারকমভাবে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার উপায়ে। এর মধ্যে জীবনের কি উদ্দেশ্য এ হেন প্রশ্ন নিতান্তই বিলাসিতা অনেকের কাছে, অনেকের কাছে আপাতত কোনো একটা উত্তর আছেও হয় তো বা। কিন্তু এ সমস্ত কিছুর একটা অন্ত আছে, একটা বৈরাগ্য জাগার সময় আছে। সবার অবশ্যই নয়, কারোর কারোর। সে হঠাৎ করে এই সুখের মেলায় নানা উপকরণে সাজানো সব কিছু ছেড়ে কেঁদে ওঠে। যেন নাগরদোলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করে তার তারায় ভরা আকাশটার দিকে চোখ গেছে। সে বলে উঠেছে, কে আমি? কেন এ বিশ্বচরাচর? কেন আমি এসবের মাঝখানে? মৃত্যু কি? কেন এ সব কিছুকে এমনই রেখে আমায় চলে যেতে হবে? কোথায় যাব? মৃত্যুর পর কি অবশিষ্ট থাকে কিছু? আত্মা বলে কি কিছু হয়?        সে নাগরদোলা থেকে নেমে আসে। সব কিছু ছেড়ে একা হতে চায়। মানুষ দুঃখ থেকে দূরে থাকে, এর ব্যাখ্যা খুঁজে পায়, কিন্তু সে যখন সুখের থেকে মুখ ফিরিয়ে বলে, "আমার চাই না", তখন সংসারী ভাবে এর মাথাটা গেছে, সুখকে চায় না কে?        এরপর আসে বুদ্ধিজাত নানা জ্ঞানের অন্বেষণ। সব কিছুর ব্যাখ্যা আছে সেখানে। বিজ্ঞান তাকে নানা বিষয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব তত্ত্বের আভাস দেয়, বিশ্লেষণের পর বিশ্লেষণ করে সে অণু-পরমাণু-DNA-RNA-গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি বিস্ময়ের পর বিস্ময়ের দরজা খুলে দেয়। নানা অসম্ভবকে সম্ভব করার কৌশল তার হাতে তুলে দেয়। সে সেদিনের নচিকেতার মত প্রশ্ন করে, কিন্তু এতো ব্যাখ্যা, এ তো শুধুই সুখের উপকরণ, এ কি অনন্ত? এ কি আমায় জীবনজিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারে? এ কি আমায় শান্তি দিতে পারে?        না পারে না, বিজ্ঞান ঘুম দিতে পারে, শান্তি দিতে পারে কই? সে বলে জীবনের উদ্দেশ্য বলে কিচ্ছু হয় না, সব অর্থহীন, শূন্য বিষাদময় অবশেষে।        টলস্টয় রামকৃষ্ণের কথা বলেননি, কিন্তু রামকৃষ্ণের পথে কিছুটা হেঁটে ফেলেছেন নিজের অজান্তেই যেন। বুদ্ধির অগম্য কী কোনো সত্য আছে এ সংসারে?        রামকৃষ্ণদেবের উত্তর, আছে।        সংশয়ী উত্তর দেবে, তবে কি সে বুজরুকি নয়?        রামকৃষ্ণদেবের উত্তর, তোমার অনুভবের, তোমার কান্নার উত্তর যে সত্য, সে কি যুক্তির সত্য, সে বুজরুকি? বাইরে থেকে আহরিত জ্ঞানের সত্য? তোমার স্ত্রী-পুত্র-পরিবারের প্রতি ভালোবাসা কি যুক্তির সত্য না অনুভবের সত্য? যাকে অনুভবে অনুভব করা যায়, যাকে বোধে বোধ করা যায়, তাকে যুক্তিতে ধরবে কি করে? একসের ঘটিতে কি চারসের দুধ ধরে? তাঁর জন্য কাঁদতে পারো?        রবীন্দ্রনাথ বলছেন, একটা ফুলের দুটো সত্য আছে। এক, সে জননাঙ্গ, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, অর্থাৎ বাইরে থেকে যে জ্ঞানের আহরণ, আমাদের যুক্তি আর পর্যবেক্ষণের বিশ্লেষণে। দুই, সুন্দর, আমাদের হৃদয়ের দৃষ্টিতে। দুই সত্য।        যে ফুলকে শুধুই জননাঙ্গ দেখে সে খুব বড় মাপের যুক্তিবান হতে পারে, কিন্তু তার দেখা একদেশী, সে মানুষ হিসাবে অসম্পূর্ণ, কারণ তার হৃদয় সত্যশূন্য।        এ তো গেল তত্ত্বের নানা দিক নিয়ে আলোচনা। এর বাইরে কি কিছু নেই?        আছে, সরলতা। বুদ্ধির সরলতাকে বলি বোকামি, অনুভবের সারল্যকে বলে চরিত্র। বুদ্ধি তীক্ষ্ম হোক, ক্ষুরধার হোক, কিন্তু চিত্ত সবল হোক, সরল হোক। এমনই একটা চরিত্রের কথা বলতে গিয়ে রামকৃষ্ণদেব বলছেন - ভক্ত হবি তো বোকা হবি কেন?        ধর্মের সার চিত্তশুদ্ধি - বিবেকানন্দ সমস্ত ধর্মের সার আলোচনা করতে গিয়ে বলছেন। সব ধর্মেই গোল আছে, বালিতে চিনিতে মেশানো আছে - রামকৃষ্ণদেবের উক্তি।            টলস্টয় যখন এই বই লিখছেন তখন তার 'অ্যানা কারেনিনা', 'ওয়ার অ্যান্ড পিস' -এর মত কালজয়ী উপন্যাস লেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মনের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা, সংশয়। কি হল এতে? কি হবে এই নাম, এই সুখ, এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবনে? কি হবে এতে?        আমার একটা গপ্পো মনে পড়ল। ব্যাসদেব ক্ষুণ্ণমনে বসে আছেন, ইতিমধ্যে তার 'মহাভারত' লেখা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু মন ভীষণ বিষণ্ণ, কি যেন হল না, কি যেন হয়নি, কোথায় যেন একটা ভুল হয়েই যাচ্ছে। এমন সময় নারদ এসে তার পাশে বসলেন, ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন কি কারণে এত বিমর্ষ তিনি? ব্যাসদেব সব বললেন। নারদ বললেন, "বুঝেছি, দেখুন আপনি মহাভারতে নানা কথা লিখলেও কৃষ্ণকথা বড় অল্প লিখেছেন। সসীমকে নিয়ে জীবের তৃপ্তি নেই। জীব অসীমকে অনুভব করে, অসীমের মধ্যে নিজের পরিণাম খোঁজে, আপনি সেই রসে জীবকে বঞ্চিত করেছেন, আপনি কৃষ্ণকথা লিখুন। কৃষ্ণই সেই অসীম। জীবকে সেই কথা শোনান, সে তৃপ্ত হবে, আপনিও তৃপ্ত হবেন।" এরপর ব্যাসদেব ভাগবত রচনা করেন, এমনই প্রচলিত কথা।        টলস্টয় শান্তি পেয়েছিলেন কিনা জানি না। কেউ কোনোদিন শান্তি পেয়েছে কিনা জানি না। মানুষ মৃত্যুকে যখন খুব স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে, সংসারে সমস্ত ক্ষতিতে, অভাবে, দুর্ভাগ্যে যখন অবিচলিত থাকতে পারে তখন মানুষের কাছে দাঁড়িয়ে দেখেছি তার মধ্যে এক গভীর জীবনবোধ, যা বিশ্বাসের উপর দাঁড়িয়ে। যে বিশ্বাস শান্তির কথা বলে, মৈত্রীর কথা বলে, ধৈর্যের কথা বলে, ত্যাগের কথা বলে। এর বিপরীতকে সে অজ্ঞানতা বলে, মোহ বলে। এমন মানুষ দেখেছি। বড় বড় ডিগ্রী নেই, কিন্তু তার পাশে বসলে প্রাণ জুড়োয়। সে এই বিশ্বের সব কিছুর মধ্যে একজনের স্পর্শ পেয়েছে যেন অনুভবে, সে ব্যাখ্যা করতে জানে না, ভালোবাসতে জানে, সহ্য করতে জানে, শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে জানে - নিজের ভিতর ও বাইরেতে।          এর বাইরে যারা দল বেঁধে ধর্মচর্চা করে, জোর করে বোঝাতে চায়, প্রচারই যাদের মূল উদ্দেশ্য, যারা রাতদিন "আমরা-ওরা" যুদ্ধে ব্যস্ত, যারা সব কিছুকেই তাদের মন গড়া গল্পের ছাঁদে দেখতে চায়, যাদের অনুভব বলতে হিংসা আর স্বার্থপরতা, ক্ষমতা বলতে বাকচাতুরী আর আত্মপ্রতিষ্ঠা - এরা পরজীবী, এদের থেকে শত হস্ত দূরে থাকলেই মঙ্গল। এরা জানে সবশেষে এরাই সব কিছুতে ঠিক, বাকিরা সব কিছুতেই ভুল। এ সব ধর্মধ্বজীদের থেকে দূরে সরে সেই শান্ত, তৃপ্ত, সহজ সরল, বুদ্ধিদীপ্ত মানুষগুলোর মধ্যে জীবনের গভীর রহস্য অনেক বেশি প্রকট। আমাদের কপাল, আমরা সারাজীবন হয় অবতার, নয় মঠ মিশন, নয় ব্র‍্যান্ডেড সাধু সন্ন্যাসী, নয় অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বাবাজীর কাছে ঘুরে বেড়াই জীবনের এই সার সত্যটাকে জানার জন্য, আসল সত্য চারিদিকে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের শান্ত, সংযত, তৃপ্ত, সর্বংসহা জীবনশৈলীকে উপেক্ষা করে। যেখানেই সত্যকারের জীবন, সেখানেই সত্যকারের জ্ঞান, সত্য, শান্তি।
282
Fri, 02/07/2020 - 13:00
    একজন গঞ্জিকা সেবন করেন। আবার গঞ্জিকা সেবনের বিপরীতে কিছু বলা হলে সেই নিয়েই সায় দিয়ে মাথা নাড়েন। তো আমার প্রশ্ন হল, ইনি কি জ্ঞানপাপী না মুক্তমনা?        এ কথা বলছি কেন? কারণ এই সামাজিক মাধ্যমে এমন সুচতুর কৌশলী মুক্তমনাদের ছড়াছড়ি দেখছি। তাদের কথা হচ্ছে, এ দোষের বটে, আমি এ করেও থাকি, যদিও জানি এ দোষের বটে। তবে এইটুকু তো মানবা যে আমি উদার? আমি সৎ?        তা মানি বটে। তবে রকমসকম দেখে চক্ষু চড়কগাছ না হয়েও যায় না। এ কিরকম সততা বুঝিও না। একটা গপ্পো শুনতাম, "বাবুর এমন দয়ার শরীর যে মারতি মারতি জুতাখান ছিঁইড়া ফ্যালাইল আমার পিঠে, কিন্তু দামটুক নিল না"।        এ যে যদি দয়ার উদাহরণ হয় তবে সেও উদারতার উদাহরণ, সততার উদাহরণ বলাই যায়। যা উচিৎ বলে বোধ করি না, সে কাজটা করেও তাকে দোষার কি মানে তা আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে ভালোই লাগে দেখে, কারণ এরাই যখন আবার নানা নীতিটিতি নিয়ে কিছু বলে ফেলেন তখন মনে রাখতে হয় এদের সততা ও উদারতা এ হেন প্রবল যে নিজের আলোচ্য নীতির বিপরীত আচরণকেও নানা উদারতা সততার যুক্তিতে সমর্থন করতে এরা পিছপা হবেন না।        লোভ বড় উপাদেয় জিনিস। অর্থের লোভের চাইতে খ্যাতি ও মানের লোভ আরো প্রবল, এও বড় দারুণ সত্য। তাই লোভকে যদি বাধ্যতা বলে ধরে নিই তবে খুব একটা যুক্তির অবকাশ থাকে না। তখন সোজা কথা, হ্যাঁ আমার লোভ আছে, তবে এও জানি সে লোভ আমার সব্বনাশ করতে পারে। তবু আমি ছাড়িতে অপারগ। এ সব যুক্তির কথা নয়, চালাকির কথা। আর চালাক মানুষ মানেই গিরগিটি।        লোভী মানুষ অবশ্যই দুর্বল হয়। তাই তাদের ক্ষণে ক্ষণেই লোভের হাত থেকে বাঁচতে নানা বাইরের উদ্দীপনার দরকার হয়, বেশিক্ষণের জন্য না অবশ্য, যতক্ষণ লাইমলাইটের মাথার কাছাকাছি থাকে ততক্ষণই শুধু। যেমন সদ্য গঞ্জিকা সেবনের ক্ষতির দিক নিয়ে একটা লেখায় অনেক গঞ্জিকাসেবী উপলব্ধি করলেন গঞ্জিকাসেবন অতি হেয় বস্তু একটা, অনেকে আবার মনে জোরও পেলেন তা পড়ে, সে কথা বললেনও খুব সানন্দে, অমনি তার বেষ্টিতবর্গ বলল, আহা কি উদারতা, কি উচ্চচেতনা, কি স্বচ্ছ নির্লোভ ভাব!        সবই তো বুঝলুম, শুধু এই কথাটাই বুঝলাম না, ওহে গঞ্জিকাদ্বেষী বক্তিমাকারী ও গঞ্জিকাসেবী আচরণকারী - এই দ্বিচারিতায় কাকে ঠকাচ্ছেন আপনারা? বলি উন্মুক্ত মন, নির্লোভ বলিষ্ঠ চিত্ত কি আর লোভের বস্তা খাটের তলায় লুকিয়ে রেখে মেলে? "অবশেষে সত্যেরই জয় হয়" - এই নীতিতেই সত্যানুরাগী তার লোভকে বলে বাবা এখনই না, এত তাড়া কিসের? এখনই দুহাত পেতে ছোটাছুটি কেন? এখনই নিজের অস্তিত্বকে অমন ঢ্যাঁড়া পিটে লোকের কান মাথা ঝালাপালা করা কেন রে বাপু? বলি সব সৃষ্টির সাথে সৃষ্টিকর্তারাও যদি ভিক্ষার ঝুলি সাথে করে ফেরেন তো কেমন হয়? সেই দূরপাল্লার ট্রেনে যাত্রা করলে আজকাল কেমন একটা ফর্ম লিখে দিতে হয় না আপনার কেমন লেগেছে পরিষেবা জানানোর জন্য, এও তেমন। যেমন ধরেন, আপনি ভীমনাগের সন্দেশ খাচ্ছেন, ভীমনাগ আপনার নাকের ডগায় আপনার হাততালি পেতে বসে, আপনি কেসি পালের ছাতা ব্যবহার করছেন, কেসি পাল আপনার পিছনে পিছনে হেঁটে চলেছেন পিঠ চাপড়ানো নেওয়ার অভিলাষ নিয়ে। তো এইসব করাটা তাদের শোভা পায়? পায় না। কিন্তু তারা যদি বলেন এসব যদিও শোভা পায় না আমাদের, তবু করি, নইলে কি যেন একটা নেই নেই বলে মনে হয়, আপনি তখন কি বলবেন? আপনার নিজের সৃষ্টির উপর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাটা নিতান্তই কম, তাই হাতের সৃষ্ট বস্তু থেকে হাতে চুমু দেওয়ার অবকাশ তৈরি করে দিয়েই সে খামতি পূরণ করতে চাইছেন। একি আপনাকে শোভা পায়?        শোভা পায় কি না পায় জানি না বাপু, তবে হাটে বিকোতে গেলে এসব যে না করলেই নয় সে আমরা বিলক্ষণ জানি। - কি বিকোবেন? - আপন সৃষ্টি - কিভাবে বিকোবেন? - কেন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে? - তারপর? তারা সে সৃষ্টিতে নিমগ্ন হয়ে পাবে কাকে? আপনাকে? না নিজেকে? মানুষ সেই সৃষ্টির মধ্যেই আনন্দ পায় যার মধ্যে সে নিজেকে পায় - নিজের কৌতুহল, সুখ দুখ, নানা দার্শনিক জীবনজিজ্ঞাসা ইত্যাদি ইত্যাদি। তা সে সব পাবে না, আপনাকে পাবে? - জানি না... তবে চাইব নিজেকে পেয়ে সে যেন আমাকেই খোঁজে, আমার জন্য অর্ঘ্য সাজিয়ে আনে, আমি অমরত্ব লাভ করি আমার সৃষ্টিতে। - বুঝলাম, ডারউইনের নাম শুনেছেন? জানেন তো অবশেষে সবটাই প্রাকৃতিক বা পাব্লিক নির্বাচন। তারা আপনার উপস্থিতি, অস্তিত্ব সবটুকু আপনার জীবদ্দশাতেই শূন্য করে দিতে পারে, আবার আপনার উপস্থিতিকে আপনার মৃত্যুর পরেও প্রকট রাখতে পারে, এমন উদাহরণ তো চোখটা অহং এর পাঁচিল টপকালেই দেখা যায়, তাই না? তবে আর অকারণ প্রেশার বাড়াচ্ছেন কেন, কাজ হলে নিশ্চিন্তে নির্বাসন নিন, কাজটা বড় হতে দিন, কর্তাকে আড়ালে রেখে, ঈশ্বরের মত। জানেন তো ঈশ্বরের আরেক নাম 'কবি', সে নিজেকে সৃষ্টির আড়ালে রেখেছেন বলেই না, থোড়ি নিজেকে ফেরিওয়ালা বানিয়েছেন?  
283
Tue, 02/04/2020 - 21:30
  ওরকম তো হয়েই থাকে। এত বড় একটা আন্দোলন। এতগুলো মানুষের ভবিষ্যৎ। তার উপর এত সুক্ষ্ম রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক, স্লোগান। আর এসব যদি ছেড়েও দাও, ধর্ম! হুম এই হল গিয়ে কথা, ধর্ম, আমাদের ইমান, পরিচয়, ভবিষ্যৎদ্রষ্টা অতীতের সেই অভ্রান্ত দিশা-পুস্তক, অলোকসামান্য মহামানবেরা। তারপর নানা শাখা-প্রশাখা, যেমন পুরোনো বটের ঝুরি, এই সব নিয়েই তো আমরা। তা এত বড় একটা কাণ্ড যেখানে, সেখানে একটা শিশুর সেই মঞ্চে ঠাণ্ডা লেগে মারা যাওয়া এমন কি একটা বড় কথা হে বাপু! তার বাবা মায়ের এই আত্মবলিদান মনে রাখবে না ইতিহাস? আরে নিশ্চয়ই রাখবে। এই তো গর্ব।        কিন্তু কোথায় যেন একটা খোঁচ। বাচ্চাটা মারাই গেল? শীতে দিনরাত মা বাবার সাথে বসে থাকতে থাকতে মারাই গেল? তার আর কোনো বিকল্পও কি ছিল, মারা না যাওয়া ছাড়া?        রাজনৈতিক সুক্ষ্ম উদ্দেশ্যর কথা থাক। ফাঁসি নিয়ে এমনভাবে একটা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা যায়, তাও কি আগে জানতাম? উকিল আবার নাকি ব্যঙ্গ করেছে যে দেখে নিও ফাঁসি হবে না। তা ফাঁসি হলেই কি আর না হলেই কি, ক্ষণিক ভ্রমতৃপ্তি বই তো কিছু নয়।        মজার কথা হচ্ছে, আমাদের কিচ্ছু করার নেই। যে বাচ্চাটা মারা গেল, তার জন্যে হাজার একটা তত্ত্ব এদিকের হয়ে, ওদিকের হয়ে বলে গেলেও, সব শেষে জানি বাচ্চাটার মৃতদেহ মৃতই থেকে যাবে।        বিষাদ নয়। অবসাদ নয়। একটা আবছায়া মূর্তি সাথে ঘুরে ফিরে বেড়ায় যেন। বিচার বলো, সহমর্মিতা বলো, সে আমাদের সিনেমার জগতে যতটা পর্দায় ছায়া ফেলে সেভাবে কি আর বাস্তবের মাটিতে ছায়া ফেলে? ফেলে না তো। জীবন যেমন চলছে চলেই যায়। রাজনৈতিক মানুষেরা চীৎকার চেঁচামেচি করে। অভিজ্ঞতা বলে, এই তো স্বাভাবিক, এই নিয়ে এত ভাবনা চিন্তার তো কিছু নেই বাপু। তুমি বরং শিল্পে মন দাও, তোমার সুকুমারবৃত্তিগুলোকে প্রস্ফুটিত করো, ঘর গোছাও, কেউকেটা হও - একটা কিছু করো।        মনের আরেকটা দিক বলতে থাকে, কিচ্ছু কোরো না। সেদিন এক অন্তঃসত্ত্বা মহিলার পেটে লাথি মারল কলকাতার একটা হাস্পাতালের রক্ষী, সবার সামনেই। এভাবে শাস্তি হয় তো দিতেই হয় বড় একটা প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে। কত কত এমন রাতদিন ঘটে চলেছে।        এরকম অনেক প্রাণ নিশ্চয়ই চলে যায় বড় একটা মাঠে কবাডি খেলতে গেলে, শ্বাস আটকে। এত বড় মাঠে এতটা শ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা কি চাট্টিখানি কথা!        মনের একটা দিক শুধু কোনো বড় খেলায় নাম লেখাতে চায় না। নিজের ছোট্টো ঘরের সামনের আকাশটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শাহীনবাগের বাচ্চাটার কথা ভাবে। যে বাচ্চাটা তুচ্ছ, যে মৃত্যুটা তুচ্ছ, সেই তুচ্ছতার কথা ভাবতে ভাবতে বুকটা ভার হয়ে আসে। আবছায়া মূর্তিটা যেন স্পষ্ট হয়ে আসে। সে আরেকটা সকালের দিকে তাকায়, যদিও জানে সব সকালই সেই এক সকালের মত। সব ঈশ্বরই হাতে টানা রিকশার মত; মাথায় হাতলটা গলিয়ে যেদিকে টানবে, ছুটবে; যা চাপিয়ে দেবে, বয়ে নিয়ে বেড়াবে। টাল সামলাতে না পারলে উল্টিয়ে বিপত্তি বাধাবে। সব মহাপুরুষেরাই অতীতে দাঁড়িয়ে থাকে তাই, সব ঈশ্বরেরাই থাকে ভবিষ্যতে। মাঝে দাঁড়িয়ে মার খায় শুধু মানুষগুলো, সাধারণ মানুষগুলো, তুচ্ছ জীবনমরণের, এলেবেলে কাজের বোকা আত্মম্ভরি মানুষগুলো।        একদিন শাহীননাগ উঠে যাবে। বাচ্চাটাকেও দুদিনেই ভুলে যাবে সবাই, ইতিমধ্যে অনেকেই ভুলে গেছে যেমন, শুধু সভ্যতার অবচেতন বলে যদি কিছু থাকে, সে সেই আবছায়া মূর্তির মত সমাজের সাথে সাথে হাঁটবে আর বলবে, হিসাব মিলাও… হিসাব মিলাও।  
284
Thu, 01/30/2020 - 12:00
          সেদিন থেকে তিনটে বুলেট উপড়ানোর কাজ শুরু হল। কেউ করল স্তব, কেউ করল সমালোচনা। কেউ মাথা নীচু করল কৃতজ্ঞতায়, কেউ করল অভিযোগের পর অভিযোগ। কিন্তু এরা কেউ বুলেট উপড়ানোর কাজ থামায়নি। দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে, হেঁটে বলতে লাগল, বুলেট তুলে ফেলো... বুলেট.... শান্তি প্রতিষ্ঠা করো.... সাম্য....        ক্রমে এই ডাক এই তিনকোণা মাটির দেশ ছেড়ে গেল পুরো গোল পৃথিবীটার সাথে মিশে, নানা দেশে দেশে। সবাই বলল, বুলেটটা তোলো, বুলেট। শুধুমাত্র বসে বসে নিন্দা-স্তবে কিচ্ছু আসবে যাবে না মানুষটার। শোনোনি সে বিশ্বাস করে, "তুল্যনিন্দাস্তুতির্মৌনি", গীতার কথা - স্তুতি-নিন্দা যার কাছে সমান, যে মৌন দুয়েতেই। গীতাকে সে মা বলে, বলে, গীতা মাথার কাছে রেখে শুই, বলে, যখনই কোনো সংশয়ে ভুগি গীতার কাছে দাঁড়াই, উত্তর পাই। সে মানুষটার কাছে কিসের স্তবস্তুতি। কিন্তু বলো, তবু সে হিন্দু হতে পারল না ওদের কাছে। তাদের মনে হল সে হিন্দু কই, সে তো মুসলমানেদের বেশি তোষামোদ করে। বোঝো! ভালোবাসা ছাড়া শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় বুঝি? আচ্ছা বলো, বুদ্ধ বলল, ঘৃণার দ্বারা ঘৃণার উপশম হয় না। এ কথা কি স্লোগান? এ তো বিশ্বাসের কথা। মানুষ যে কথা শুধুই শোনাতে চায়, শুধুই মানাতে চায়, সে কথাকে সে স্লোগান বলে। কিন্তু যে কথাকে সে প্রাণের সাথে বিশ্বাস করে, সে কি স্লোগান হয় গো? তাই মানুষটা স্লোগান দিতে পারত না। প্রার্থনা করতে পার‍ত। হাঁটতে পারত। বুক পেতে দিতে পারত। মানুষটা সেই বহুযুগ আগে জেরুজালেমে জন্মানো একটা বোকা মানুষকে বেবাক ভালোবেসেছিল। সে জেরুজালেমের লোকটার একটা ব্যামো ছিল, সে শত্রু মিত্র চিনতে পারত না। সে বলত, যে তোমায় ভালোবাসে শুধু যদি তাকেই ভালোবাসো তবে তো তুমি ব্যবসায়ী, সে তো শুধুই লাভের দিকে তাকায়, যে শুধুই যে তার ঋণ চুকিয়ে দেয় তাকেই ভালোবাসে। বরং যেখানে তোমার অপমান, যেখানে তোমার জীবন বিপন্ন হতে পারে, তেমনভাবে ভালোবাসো। কি বাজে, অকাজের কথা না? হুম তো, কিন্তু এই বোকা লোকটা এই কথাগুলো সেই ক্রুশে ওঠা অবধি বিশ্বাস করে ছাড়ল, আর এই মানুষটা গুলি খাওয়া অবধি।        আসলে ওই জেরুজালেমের লোকটা আর এই পোরবন্দরের মানুষটার সমস্যা হল, পৃথিবীতে মানুষকে দিয়ে নানা কাজ করিয়ে নেওয়ার যে হাজার একটা কৌশল আছে সে তারা বিশ্বাসই করত না। সেই কি একটা শব্দ, ভালোবাসা, হিংসা না করা, সেই কথাতেই খেত, শুতো, নাইত, বেড়াত। বলত, শান্তি প্রতিষ্ঠা করো, নিজের মধ্যে, দেশের মধ্যে। কি ভাবে? হিংসা না করে, নিজেকে বিপন্ন করে। এইখানে যত মুশকিল হল জানো, আমায় বিপন্ন করার জন্য ঘরে বাইরে মানুষের অভাব নেই, কিন্তু কেউ যখন আমার জন্য নিজেকে বিপন্ন করে ফেলে তাকে নিয়ে হাজার একটা সমস্যা। তাকে এড়িয়ে চলা যায় না। তাকে ভুল বোঝানো যায় না। তার উপর অভিমান হয়। আস্থা ছাড়া অভিমান হয় না আস্থা ছাড়া আক্রোশ হয়। কিন্তু এ মানুষটাকে শত্রু ভাবলেও আস্থা রাখা যায়, এ কিরকম সমীকরণ বলো? কিন্তু তাই, তাই, তাই হল যে বারবার।        কিন্তু আজ কিছু মানুষ যে আবার তাকে খুঁজছে গো। আবার লুকিয়ে বন্দুক এনেছে। বলছে আমাদের দেগে দেওয়া বুলেট ওই মানুষটার বুক থেকে কে তুলতে বলেছে? ওরা টের পেয়েছে আমাদের মধ্যে ওই পোরবন্দের মানুষটা এখনও কানে কানে বলে, কেন কোরাণ গীতা বাইবেল ধম্মপদ গুরুগ্রন্থ আলাদা করবে, কেন বলবে না, এক রাম তার হাজার নাম, কেন জানবে না ঈশ্বরের কোনো ধর্ম নেই, কেন জানবে না সত্যই ঈশ্বর?        এইসব কথায় কারা যেন শিউরে শিউরে উঠছে আজ। বলছে, ওরা শত্রু!        এই বলে তারা হিংসাকে রাজার আসনে বসাচ্ছে। হিংসার বদলে হিংসা - এই নীতি বলতে চাইছে। জেরুজালেমের লোকটা বলেছিল, চোখের বদলে চোখ হলে গোটা বিশ্ব একদিন অন্ধ হয়ে যাবে। পোরবন্দরে মানুষটা বলেছিল, তাই তো। এরা বলছে, হোক অন্ধ, আমরা তো আছি! বোঝো! অন্ধকে নাকি অন্ধরা পথ দেখাবে!        শত্রু বানানোর কারখানা বাঁধা হচ্ছে। খোঁজো কে শত্রু। বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত সব স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে। বলছে, কে শেখালো এ ধর্ম? আমরা কি বলিনি বসুধৈবকুটুম্বকম?        এরা গলা চড়িয়ে বলছে, তাতে কি আমরা বারবার আক্রান্ত হইনি?        পুরাণের ঋষি বলছেন, কিন্তু সে আঘাত তো শরীরের? আমরা কি বলিনি আত্মা অমর? আমরা কি বলিনি সহ্য মহতের ধর্ম? আমরা কি বলিনি উদারতা আত্মার স্বভাব?        তারা বলেছে, কিন্তু আমাদের কি আজ অস্তিত্ব-সংকট নয়?        না। শিকাগো থেকে ফিরে আসা সে ছেলেটা একবার হিমালয়ের এক বিধ্বস্ত মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল,"মন্দিরের একি অবস্থা মা? আমি ঠিক করে দেব।" জানিস কি শুনেছিল সে? সে শুনেছিল, মা যেন বলছেন, "তুই আমায় রক্ষা করিস না আমি তোকে রক্ষা করি?" ছেলেটা লজ্জা পেয়েছিল।        ঋষি বললেন, যদি রাজার আসনে বসেছিস, তবে লজ্জার কারণ হোস না, গর্বের কারণ হ।        আজ সে বুলেট তোলার দিন। যেখানে যতটা হয়। সেতু বাঁধতে তো কাঠবেড়ালিও এসেছিল। আজ সে কাজে হাত লাগাতেই হবে।      
285
Thu, 01/23/2020 - 17:30
    পার্ক সার্কাসে লাগাতার চলছে ধরনা। "আভি ঘর সে নিকলো ওরনা দেশ সে নিকলোগে"... এই ঘটনাটার বিশেষত্ব হচ্ছে, মহিলারা। দেশজুড়ে নানান জায়গায় মহিলারা সমবেত হচ্ছেন, স্লোগান তুলছেন, রাস্তায় হাঁটছেন, রাস্তায় থাকছেন। আমার স্মৃতিতে এমন ঘটনার সাক্ষী আমি হইনি জ্ঞানত। অন্যদিকে সদগুরু বলছেন সরকার বোঝাতে পারেনি বলেই আজ দেশজুড়ে এত ক্ষোভ। রাষ্ট্রের পরিচালকের হাবভাব, "যে করে হোক, করেই ছাড়ব"। অর্থাৎ ততটা তারা দেশের নন, যতটা তারা তাদের নিজস্ব ধারণার প্রতি বিশ্বস্ত। ততটা সেই রাস্তায় নামা অজস্র মহিলাদের প্রতি নন, যতটা সাভারকরের ভারতকে রূপ দেওয়ার জন্য। কিন্তু এমন কেন? এ দেশের ছাত্রছাত্রী, রাস্তায় নামা সেই সব ঘর সংসার ছেড়ে আসা মহিলাদেরও তো মন্ত্রী আপনারা। তাদের সাথে সরাসরি কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? মঞ্চের কথা তো একপক্ষের কথা, বিতর্ক সভা তো কথার পিঠে কথা, কিন্তু এই মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানোতে, তাদের কথা শুনতে অসুবিধা কোথায়? সদগুরু তার নিজের কম্ফোর্ট জোনের মধ্যে থেকে আইনকানুন না পড়েই অলৌকিকভাবে সমস্তটার ভাব জেনে নিয়ে বারবার বলে চলেছেন, সবটাই বিভ্রান্তির থেকে তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আপনি নিজে এসে দাঁড়াচ্ছেন না কেন? আপনি তো আগে আত্মপ্রচারে জে এন ইউ-তে গিয়েছেন। অনেক সুক্ষ্ম তত্ত্বে আপনার অসাধারণ কথা বলার ক্ষমতায় নিজের মত প্রকাশ করেছেন। আজ তবে এত দূরে কেন? ওদের ভ্রান্তি দূর করার দায় তো আপনারও। আপনি নিজেকে 'এনলাইটেন্ড' ঘোষণা করেন। যার ভারতীয় তর্জমা হল --- দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন পুরুষ। আপনার পূর্ববর্তীদের তো এরকম চালচলন ছিল না বাপু? তারা তো অনেক সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামলেছেন, এমন উদাহরণ জীবনীগুলোতে লেখা হয়। তা আপনার 'ইনার ইঞ্জিনিয়ারিং' কি বাইরের এই প্রতিকূলতায় এমনই অক্ষম যে সে বিরুদ্ধ মতের মুখোমুখি হতে পারছে না? ভারতীয় যে আদর্শের কথা বারবার বলতে চাওয়া হচ্ছে, সেখানে 'নারী' খুব বড় একটা অধ্যায়। খুব গুরুত্বপূর্ণ, সংবেদনশীল আইনকানুন নারীকে নিয়ে। এখন সেই দেশের এত নারী যেখানে স্বেচ্ছায় নিজেকে এমন একটা অবস্থায় নিয়ে এসে রাতদিন কাটাচ্ছেন সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, সেখানে প্রাথমিক কর্তব্য এটাই হয় না কি সেই নারীদের সামনে এসে একবার অন্তত দাঁড়ানো? সারা বিশ্বের সামনে মাথাটা হেঁট হয়ে যাচ্ছে যে আমাদের! আপনারা নিশ্চয় অপেক্ষা করছেন তাদের পরাজয়ের, তাদের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার। সে অপেক্ষা কি খুব পৌরুষের? খুব সম্মানকর? জানি না, রাজনীতি কি মানবিকতার চাইতে বড়? রাজনীতি ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য - ইত্যাদি সব কিছুকে ছুঁয়ে সত্তাহীন করে দিতে পারে সে ঘটনা তো উঠতে বসতে দেখছি। কিন্তু মানবিকতাও বিকিয়ে যায় বুঝি? আসলে এখানে একটা দুর্ভাগ্যজনক ইতিহাস ও সামাজিক সমস্যা আছে। সেটা জানি। সেটা হল হিন্দু ও মুসলমান ভৌগোলিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে পাশাপাশি থাকলেও, একত্র থাকলেও, এক হয়ে ওঠেনি। তারা কোনোদিন আত্মীয়তায় আসেনি। পঁচিশে ডিসেম্বরে যেভাবে পার্কস্ট্রিট, চার্চগুলো আপন হয়েছে, সেইভাবে ঈদ, মহরমে পার্ক সার্কাস, মসজিদ আপন হয়নি। নানা মহৎ চরিত্রের উল্লেখে যেভাবে বুদ্ধ-খ্রীষ্টের উল্লেখ হয়, সেভাবে মহম্মদের নাম উচ্চারিত হয়নি। বাংলার জাগরণের পর থেকে নানা ধর্মীয় বিপ্লব হয়েছে। সেখানে এক স্বামী বিবেকানন্দ ও অনুকূল ঠাকুর ছাড়া মহম্মদকে নিয়ে বিশেষভাবে আলোচনা অন্য কেউ করেছেন বলে আমি পড়িনি। সে ক্ষেত্রেও অনুকূল ঠাকুরের নানা আলোচনায় যে গভীরতা ও ব্যাপ্তি রয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের ধর্মের নানা দিক নিয়ে সমন্বয়ের আলোচনায় তা বিস্ময়ের, যা অনেক কিছু নতুনভাবে ভাবাতে সাহায্য করে। (এ ক্ষেত্রে আমি "প্রেরিত প্রসঙ্গ" বইটার উল্লেখ করব, বিদ্যুৎরঞ্জন চক্রবর্তী মহাশয়ের দ্বারা সংকলিত, চর্যাশ্রম প্রকাশনালয় থেকে প্রকাশিত)।        কিন্তু এরকম কয়েকটা বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ছাড়া এই দুই ধর্মের মানুষ পাশাপাশি হাঁটলেও হৃদয়ের ব্যবধান রয়েই গেছে। দেশভাগের পর মহাত্মা তার বাকি জীবনটার উদ্দেশ্য করেছিলেন এই বিরোধের একটা সমাধানের পথ খুঁজতে (যদিও বহু ভারতবাসী, প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহের মতে যারা ill-informed, তাদের ধারণা মহাত্মাই দেশভাগের জন্য দায়ী। সে পুরোনো তর্কে আমি যেতে চাই না)। মোট কথা, তিনি বুঝেছিলেন যে এই বিষফলই পরে শিকড় গজাবে। চারদিক বিষাক্ত করে তুলবে।        বর্তমান সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে এই বিষফল সার পায়নি। কিন্তু পরের অধ্যায়ে এই বিষফলটা হঠাৎ করে সামনে আনা হল। একটা বড় ভুল হল এইখানে। একটা কথা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হয় তো বুঝতে ভুল করলেন, ভারতবাসী আদতে একটা হিন্দুরাষ্ট্র চায় না। হ্যাঁ, সিংহভাগ হিন্দুরাই চায় না। যদি চাইত তবে RSS -এর শাখা সে প্রতিটা অলিতে-গলিতে তৈরি করত দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এতগুলো বছর ধরে। বারবার সেক্যুলার দলগুলোকে ক্ষমতায় আনত না। এর একটা কারণ আছে প্রধানমন্ত্রী মহাশয় আপনাকে বুঝতে হবে, হিন্দু ধর্ম একটা ব্যক্তিগত জীবনযাপনের ধর্ম, যার মূল বিবেকানন্দের ভাষায় --- আধ্যাত্মিকতা। হ্যাঁ, সেই বিবেকানন্দ, যিনি আপনার জীবনের আরাধ্য, আপনি বারবার বলেন। সেই বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মকে অনুভবের ধর্ম বলেছেন, আন্দোলনের ধর্ম নয়। এই ধর্মের মধ্যে নানা দর্শন, নানা মত, নানা বৈচিত্র। আপনি জানেন তো সব, হয় তো আপনার সঙ্গীর বুঝতে ভুল হয়েছিল। বা বুঝতে চাইছেন না। ধর্ম আমাদের ভজনের, ধ্যানের, আলোচনার, শান্তির, ত্যাগের, দিব্যসুখের - তার সাথে এই জড় সংসারের কোনো যোগ নেই, আপনি জানেন। গীতা, উপনিষদ এইগুলোকেই প্রধান শাস্ত্র আপনার আরাধ্য বিবেকানন্দ বলেছেন, যার চূড়ান্ত দর্শন - অদ্বৈতভাব, অর্থাৎ সমস্ত জগতকে 'এক'-এর মধ্যে দেখা। কপিল তার মা-কে ভাগবতপুরাণে শিক্ষা দিচ্ছেন যে 'দুই' বলে সংসারে কিচ্ছুটি নেই। সেই বোধ মিথ্যা বোধ। প্রহ্লাদজী বলছেন, সমস্ত জীবে নারায়ণের প্রতি সশ্রদ্ধ হওয়াই ধর্মের মূল কথা। তবে? তবে আজ এ কোন হিন্দুধর্মের কথা আপনারা বলছেন? যিনি গেরুয়া পরে রাজার আসন থেকে খাবার, কম্বল, তাঁবু কেড়ে নেওয়ার আদেশ দেন, সে গেরুয়া কোন দর্শনের? ব্যাঙ্গালোরে যেখানে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে এতগুলো মানুষের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হল, সে কোন রাজধর্ম রাজা? আমি স্তম্ভিত, আমি লজ্জিত।        ভারত তার জয়যাত্রা এগিয়েছিল প্রাচীনকে ধর্ম করে নয়, আগামীকে লক্ষ্য করে বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতিকে মানবনীতির উপর দাঁড় করাতে চেয়ে। তার প্রজাকে ভয়মুক্ত, উদার জীবনের দিকে নিয়ে যেতে। ঈশ্বর তো অমর, তাঁর নীতি প্রাচীন শাস্ত্র ঘেঁটে বার করতে হবে এমন তো উপনিষদ বলেনি রাজা? বরং উপনিষদ বলেন সমস্ত শাস্ত্র মিথ্যা যদি হৃদয় না জাগে, অন্যা বাচ বিমুঞ্চথ, অন্য বাক্য ত্যাগ করো, হৃদয়ে সেই এক যিনি তাকে অন্বেষণ করো, যিনি সমস্ত জগতের মধ্যেও এক। ভেদ কোথায় রাজা?        হ্যাঁ, তবু ভেদ আছে, মানু্ষের অজ্ঞতায়। সেই অজ্ঞতাকে কি পুঁজি করবে রাজা? টিকবে না। এ মাটি ভারতের মাটি। ভারত না তো ভৌগলিক প্রকৃতিতে একঘেয়ে, না তো আত্মিক স্বভাবে একদেশি রাজা। তুমি ব্যর্থ হবে। একটা গান দিয়ে শেষ করি---     রইল বলে রাখলে কারে, হুকুম তোমার ফলবে কবে? তোমার টানাটানি টিঁকবে না ভাই, রবার যেটা সেটাই রবে॥     যা-খুশি তাই করতে পারো গায়ের জোরে রাখো মারো--- যাঁর গায়ে সব ব্যথা বাজে তিনি যা সন সেটাই সবে।।   অনেক তোমার টাকাকড়ি, অনেক দড়া অনেক দড়ি, অনেক অশ্ব অনেক করী--- অনেক তোমার আছে ভবে।     ভাবছ হবে তুমিই যা চাও, জগৎটাকে তুমিই নাচাও--- দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয় না যেটা সেটাও হবে।।
286
Fri, 01/17/2020 - 15:00
শান্ত থাকা মানে কি নিষ্ক্রিয় থাকা? স্থির থাকা মানে কি উদাসীনতা? জড়তা কি শান্তি দিতে পারে? বিহ্বল হয়ে পড়া, অস্থির হয়ে পড়াই কি বিপ্লব? ধৈর্যচ্যুতি ঘটাই কি আন্দোলন? সহ্যের সীমারেখা ছাড়ালে যে চীৎকার, সেইটাই কি প্রতিবাদ? মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা, মানুষকে তাতিয়ে দেওয়া, মানুষকে উস্কে দেওয়া - এর মানে কি নেতৃত্ব দেওয়া? জড়ত্ব আর উত্তেজনার মাঝখানে একটা অবস্থান আছে - জাগ্রত অবস্থা। যে জাগ্রত সে সচেতন। সে উত্তেজিতও নয়, জড়ও নয়। বাংলার গ্রামে যে এককালে বাউল, কীর্তন, পল্লীগীতি ইত্যাদির চল ছিল, তা কি মানুষকে জড়ত্ব দিত, না শান্তি? সারাদিনের নানা কর্তব্য, সফলতা-ব্যর্থতা, সুখ-দুঃখের মধ্যে নিজেকে অক্ষুব্ধ রেখে চলার একটা ব্যবস্থাপত্র তা করে দিতে। নিজেকে শান্ত রাখার, নিয়মিত রাখার, তুষ্ট থাকার একটা ক্ষেত্র তৈরি করে দিত নিজের মধ্যে। যে মানুষ শান্ত না, স্থির না, সে মানুষ কি দিশা দেখাতে পারে? দিশা দেখানো তো দূরের কথা, সে মানুষ কি কোনো কাজেই নিপুণ হতে পারে? দক্ষ হতে পারে? পরিস্থিতি যতই ঘোরালো হোক, জটিল হোক - তাকে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় বুঝতে হবে। শুধুই আক্রোশ, আস্ফালনকে যদি বেশ কিছু একটা হচ্ছে বলে বোধ করে বসে থাকি তবে নিজেকে ঠকাচ্ছি বুঝতে হবে। আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শান্ত থাকার অভ্যাস বা পরিচর্যাটা হারাচ্ছি। আমরা দুটো ধাপে বাঁচি - এক) ভীষণ অ্যাক্টিভ মোড, ভীষণ সক্রিয়, দৌড়াদৌড়ি, এ কাজ সে কাজ, এ মস্তি সে মস্তি, ফেসবুক টুইটার হোয়াটস অ্যাপ ইনস্টাগ্রাম সুপার অ্যাক্টিভ, সিনেমা ঘুরতে যাওয়া, আউটিং, বাইরে খাওয়া, পার্টি কিম্বা কর্পোরেট পুকুরে নাইতে যাওয়া, এরপর আঁতেল গ্যাদারিং, রাজনীতি গ্যাদারিং, কাব্যিক গ্যাদারিং, গ্যাদারিং এর গ্যাদারিং ইত্যাদি ইত্যাদি। দুই) ল্যাদ খাওয়া, অফ মোড, লো ফিল, ফাস্ট্রু খাওয়া, রিল্যাক্স করা। এর একটু অফ বিট মোড হচ্ছে ইয়োগা করা, মেডিটেট করা, কর্পোরেট গুরুর অত্যন্ত বাকচাতুরী, বাকমাধুরীপূর্ণ বিশ্রম্ভালাপ শোনা। এগুলো একটু সফিস্টেকেটেড মোড। তবে শান্ত থাকার পরিচর্যা কোথায়? রিল্যাক্স করতে, কি উদ্বাহু তাণ্ডব করে বেড়াতে বাইরের উপকরণ লাগে। নিজের মধ্যে শান্ত থাকার মাধুর্য জমিয়ে তুলতে শুধু নিজেকেই লাগে - 'গোটা-আমি'টাকে লাগে। এখন এই 'গোটা-আমি'টাকে পাই কোথায়? সে তো বাজারে, ইন্টারনেটে, অতীতে, ভবিষ্যতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে। তবে? রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন 'আড়াইশোটা' গীত গান ছাড়া অনেক কিছু লিখেছেন, তার মধ্যে একটা বই আছে "শান্তিনিকেতন"। সেখানে প্রবন্ধের পর প্রবন্ধ নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে সেখানে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার কথা বলা। এখন যদি বলা হয় রবীন্দ্রনাথ বিপ্লব বুঝতেন না, প্রতিবাদ বুঝতেন না, সে আলাদা কথা। তেমন তর্কবাগীশ আমি হয়ে উঠিনি এখনও। সে ক্ষমতাও নেই। কিন্তু এইটা বেশ বুঝি গোলমালটা ততটা বাইরে নয়, যতটা ভিতরে। তাই বাইরে আজ আসুরিক শক্তির এত আস্ফালন। কথাগুলো ক্রমে স্লোগান। স্লোগানগুলো ক্রমে অভ্যাস, ক্লিশে। অভ্যাসগুলো ক্রমে দিশাহীন। তখন চাই একটা উত্তেজনা। হইহই রইরই। শেষে সব শূন্য। শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। তবু এরই মধ্যে কিছু মানুষ স্থির থেকে, দৃঢ়তার সাথে নিজের অবস্থানে অনড়, সেই আশার আলো। বাইরে কোনো কিছুকে গোছাবার আগে, বাইরেটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার আগে, নিজের ভিতর সে শান্ত থাকার অভ্যাসটাকে রপ্ত না করতে পারলে একেবারেই কিছু হওয়ার নয়। অসুরকে অসুর হয়ে পাল্লা দেওয়া যায় না, অসুরকে নাশ করতে হলে নিজের ভিতরের শান্ত সমাহিত মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী সত্তাটাকে বলশালী করে তুলতে হয়। এ সূত্র পরিবারেও যেমন সত্য, পাড়াতেও যেমন সত্য, দেশের ক্ষেত্রেও সত্য। নইলে অসুরের জয় সেখানেই হবে প্রত্যেককে অসুর করে তোলা। অসুরের তো জোরের অভাব নেই, অভাব বিবেকের। ক্ষুব্ধ, চঞ্চল হৃদয়ে বিবেকের বার্তা এসে পৌঁছায় না, এই তার ধ্বংসের কারণ হয়। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটা কথাকে দিয়েই শেষ করি - "প্রতিদিন এসো, অন্তরে এসো। সেখানে সব কোলাহল নিরস্ত হোক, কোনো আঘাত না পৌঁছোক, কোনো মলিনতা না স্পর্শ করুক। সেখানে ক্রোধকে পালন করো না, ক্ষোভকে প্রশ্রয় দিয়ো না, বাসনাগুলিকে হাওয়া দিয়ে জ্বালিয়ে রেখো না, কেননা সেইখানেই তোমার তীর্থ, তোমার দেবমন্দির। সেখানে যদি একটু নিরালা না থাকে তবে জগতে কোথাও নিরালা পাবে না, সেখানে যদি কলুষ পোষণ কর তবে জগতে তোমার সমস্ত পুণ্যস্থানের ফটক বন্ধ। এসো সেই অক্ষুব্ধ নির্মল অন্তরের মধ্যে এসো, সেই অনন্তের সিন্ধুতীরে এসো, সেই অত্যুচ্চের গিরিশিখরে এসো। সেখানে করজোড়ে দাঁড়াও, সেখানে নত হয়ে নমস্কার করো। সেই সিন্ধুর উদার জলরাশি থেকে, সেই গিরিশৃঙ্গের নিত্যবহমান নির্ঝরধারা থেকে, পুণ্যসলিল প্রতিদিন উপাসনান্তে বহন করে নিয়ে তোমার বাহিরের সংসারের উপর ছিটিয়ে দাও; সব পাপ যাবে, সব দাহ দূর হবে।" ~ রবীন্দ্রনাথ (শান্তিনিকেতন)
287
Sun, 01/12/2020 - 00:21
  বিগ্রেড মঞ্চ, থুড়ি, বেলুড় মঠের মঞ্চ থেকে স্বামীজির স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণের ভাষণ শুনলাম। ডিজিটাল ইন্ডিয়া, CAA বিষয়ে সমস্ত 'যুবা ভাই' সমস্বরে হাত তুলে প্রধান নেতৃত্বের সহযোগিতায় আছে জানিয়ে দিল। পাশে বসে দুই পূজ্যপাদ ( পাদ মানে পা, অবশ্য পা যদি পূজ্য হয় অপর অর্থটিই বা হবে না কেন?), পূজ্য নিতম্ব ঠেকিয়ে আসনে, স্থিতপ্রজ্ঞ। স্থিতপ্রজ্ঞ মানে কি? আহা, যারা সুখে দুখে, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীতে ভেদ করেন না, যারা স্বামীজির সেই অমোঘ বাণী - বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর, মন্ত্রীকূল সেবে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর, পালন করেন তারা হলেন স্থিতপ্রজ্ঞ।        যা হোক, প্রতিষ্ঠান আর প্রটোকলের নানা বাধ্যতা আছে নাকি। আমাদের তেমনই বুঝানো হয়। আমাদের না বুঝে উপায়ও নেই। সব দিক রেখে সবাই চলছে। আবার তেনারাই আশাও রাখছেন কেউ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের আর কেউ সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে।        তবে আজ স্বামীজির জন্মদিন কিছু লিখব না? নিশ্চয়। আসলে কি জানেন, আমি যেমন পঁচিশে ডিসেম্বর, সেই মহাপ্রাণের জন্মদিন পোপের ভাষণ শুনি না, কোনো চার্চে যাই না, তেমনই কোনো আদর্শকে কোনো প্রতিষ্ঠানের জোরে বাঁচিয়ে রাখা যায় বিশ্বাস করি না। কোনো আদর্শ যদি একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বাইরে না বেঁচে থাকে তবে সে প্রতিষ্ঠান আসলে একটি মিউজিয়াম। সে মিউজিয়ামের সামগ্রী মূল্যবান নিশ্চয়, কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক।        গোটা স্বামীজিকেই দশখণ্ড রচনাবলীতে ধরা আছে। কোত্থাও যাওয়ার দরকার নেই। কারোর সাথে আলোচনার দরকার নেই। স্বামীজির অনুভবে সমস্ত ধর্মের সার চিত্তশুদ্ধ হওয়া। মনের মধ্যে চালাকি, স্বার্থপরতা, সঙ্কীর্ণতা, মতলব ইত্যাদি থাকলে বুঝি চিত্তশুদ্ধ হয়? কোনোদিন না। বারবার বলছেন নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর। তা এই ঈশ্বরের বিশ্বাসে আস্তিক নাস্তিক হওয়ার জন্য আগের দিনের সংজ্ঞাগুলো ত্যাগ করলেই হয়।        স্বামীজির যুক্তি, বিচার-বুদ্ধি, প্রখর স্মৃতিশক্তি ইত্যাদি ছাপিয়ে একটা কারণেই স্বামীজি স্বামীজি - একজন প্রাণখোলা প্রেমিক মানুষ, তাঁর তীব্র আবেগ, মানবিকতা, অনুকম্পা। এগুলো এমনই সাংঘাতিক ছিল যে সময়ে সময়ে তিনি নিজের সুক্ষ্মতম বিচারকেও ভাসিয়ে দিতেন। মনে নেই সেই ঘটনাগুলো?   ১) ছোটোবেলায় ঘরে দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছিল বলে ঘরের জামাকাপড় সব জানলা দিয়ে সাহায্যপ্রার্থীকে দিয়ে দেওয়া। ২) যে বেলুড়মঠ এত সাধ্যসাধনা করে তৈরি করা, সে মঠ বিক্রি করে দিতে চাইছেন ত্রাণের অর্থের জোগাড়ের জন্য। ৩) তখন তিনি বিশ্ববিখ্যাত। একদিন মঠে বসে ব্রহ্মচারী গুরুভাইদের সাথে শাস্ত্র আলোচনা করছেন, গিরিশ ঘোষ এসে ঢুকলেন। কিছুটা ব্যঙ্গ করে স্বামীজিকে এক অভাবগ্রস্থ, দারিদ্রপীড়িত, অসহায় রমণী ও তার সন্তানদের অবস্থা বর্ণনা করে বলছেন, আছে তোমার ওই বেদ বেদান্তে এর কি কিছু সমাধান?        স্বামীজির মুখের ভাব বদলে গেল। তিনি উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন। গিরিশ একজনকে বললেন যা গিয়ে দেখে আয় নরেন কি করছে?        বিবেকানন্দ ঘরে দরজা দিয়ে কাঁদছেন। জানলা দিয়ে সে দৃশ্য দেখে এসে যখন বলা হল তখন গিরিশ ঘোষ বলছেন, এই জন্য নরেন নরেন, তাকে ভালোবাসি তার এই মহানুভবতা, অনুকম্পাময় এত বড় হৃদয়টার জন্য, তোদের এই শাস্ত্রজ্ঞানের জন্য না।          এরকম উদাহরণ কত কত কত ছড়িয়ে। এক রমণী তাঁকে অন্য রকম কিছু ইঙ্গিত করায় তিনি তার বস্ত্র চুম্বন করে সজল চোখে বলেন, মা এ বেশে কেন?        উদাহরণ থাক, এই হৃদয়টার জন্য সমস্ত বুদ্ধি, বোধ, ইচ্ছা, বাসনা সেই মানুষটার পদপ্রান্তে বসতে চায়। সুক্ষ্ম বিচার কে চায়? তার ছড়াছড়ি। কিন্তু এই প্রেম, এই উদারতা, এই ভালোবাসা... এগুলোর তো ছড়াছড়ি হয় না? সংসারে বেশিরভাগ ভালোবাসার নীচেই ছোটো করে লেখা - শর্তাবলী প্রযোজ্য। স্বামীজি বলতেন প্রেম ত্রিকোণ যুক্ত। এক কোণ নিঃস্বার্থপরতা, এক কোণ, বাসনামুক্ত, এক কোণ, সে নিজেই নিজের লক্ষ্য। তবে? এর মধ্যে হিসাব কই? এর মধ্যে স্বার্থের ছায়া কই?        গতকাল এক হলিউডের নায়কের রবীন্দ্রনাথের "চিত্ত যেথা ভয় শূন্য" কবিতা আবৃত্তি শুনলাম বিদেশের মাটিতে। সে কবিতায় এক লাইন আছে, "যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে", এই কথাটা বড় একটা কথা। সে বাক্য কৌশলের ধার ধারে না। সে এক প্রাণ থেকে উচ্চারিত হয়ে আরেক প্রাণে অনুভূত হয়। তাকে বোঝাতে সুক্ষ্ম তত্ত্ব লাগে না।        আগে অনুভব, পরে বাকি কিছু। কথামৃতে এক গপ্পো আছে। পোদো বলে একজন এক পরিত্যাক্ত মন্দিরে ঢুকেই শাঁখ বাজাতে লেগেছে। সবাই ভেবেছে মন্দির বুঝি আবার খুলেছে। সবাই পুজোর উপকরণ নিয়ে এসে দেখে পোদো নোংরা মন্দিরের এক কোণে দাঁড়িয়ে শাঁখ বাজাচ্ছে। সে মন্দিরে দেবতা অবধি নাই। তখন সবাই বলে, " মন্দিরে তোর নাইকো মাধব, পোদো, শাঁখ ফুঁকে তুই করলি গোল"।        আমাদের পোদো চাই না, স্বামীজিকে চাই। স্বামীজি কোনো তত্ত্ব নয়, রোমা রোলার ভাষায় গসপেল অব ম্যানকাইণ্ড, মানবিকতার ভাষ্য। সে অনুভবের কাছে নতিস্বীকার করি। আমাদের ছোটো ছোটো অনুভব সে মহাসমুদ্রের দিকে এগোক, যে অনুভবে নিজেকে মনে হয়, "দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল"।        সে সম্বল তো তুমি স্বামীজি, হ্যাপি বার্থ ডে।
288
Wed, 01/08/2020 - 22:00
    এই লেখাটা কোনোদিন লিখব ভাবিনি। এগুলো যেন আমার পূর্বজন্মের কথা। কিন্তু আজ চারদিকে যা ঘটে চলেছে আমার মন সেই পূর্বজন্মেই ফিরছে বারবার। মনে হচ্ছে, কেন? কেন এরকম হচ্ছে? এরকমই কিছু কি হওয়ার কথা ছিল? এমন গ্রহণ লাগার কথা ছিল?        জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখেছি বাবা-মা অত্যন্ত রামকৃষ্ণ অনুরাগী। বসার ঘরে, শোয়ার ঘরে বড় বড় ছবি। বাবা মাঝেমাঝেই দক্ষিণেশ্বর যান। সাথে আমিও যাই সেই ছোটোবেলা থেকে, প্রথম প্রথম হনুমান দেখতাম (তখন প্রচুর হনুমান ছিল দক্ষিণেশ্বরে), কাঠের গাড়ি কিনতাম। পরে রামকৃষ্ণদেবের ঘর চিনলাম, সারদাদেবীর ঘর দেখলাম। বাবার ভবতারিণীর প্রতি অকৃত্রিম আবেগমথিত ভক্তি দেখলাম। আস্থা দেখলাম। মায়েরও তাই।        উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম, বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। মন ক্রমে নানা সংশয়ে আকুল হচ্ছে ধীরে ধীরে। ইতিমধ্যে ক্লাস নাইনে থাকতে পৈতে হয়ে গেছে। এক বছর একাদশী ইত্যাদি করেছি। রীতিমতো নিয়মমাফিক গায়ত্রী জপ চলছে। কিন্তু মনের ভিতর সংশয়। সত্যিই কি কিছু আছে? সব কি ফাঁকি?        এমন সময় হাতে এসে পড়ল রোমা রোঁলা রচিত রামকৃষ্ণের জীবন। পড়লাম। এতদিন পড়া হয়নি তেমন কিছু। বিবেকানন্দ পড়তে শুরু করলাম গোগ্রাসেই বলা চলে। তারপর কথামৃত। একটা কথায় মনে একটু শান্তির জল পড়ল - সত্যতে থাকলে ঈশ্বর লাভ হয়।        মন বলল, তাই, এতো বেশ কথা! কিন্তু তবু মনের মধ্যে সংশয়। শুরু হল বেলুড়মঠ যাওয়া। এত প্রশ্নের ভিড়, জবাব দেবে কে? ওদিকে মাতুলালয়ের প্রভাবে অরবিন্দ ঘোষের থেকে বেশি করে ঋষি অরবিন্দকে পড়ার দরকার হল। দিদা অরবিন্দের ভক্ত। লাইফ ডিভাইন, সিন্থসিস অব যোগা পড়ে বেশ লাগল। দারুণ যুক্তি তো! অনেকে বললেন দীক্ষা না নিলে মনের প্রশ্নের জবাব মিটবে না। অতএব দীক্ষার প্রস্তুতি। কিন্তু কার কাছ থেকে নেব? আমার এক বন্ধুর পরিবার ছিল ভীষণ রামকৃষ্ণ মিশনের অনুরাগী। তাদের বাড়ির সবাই দীক্ষিত। তারা বললেন মঠের প্রেসিডেন্টের কাছে নিলে সব চাইতে ভালো। স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী প্রেসিডেন্ট। ও, ইতিমধ্যে ভীষণ পণ্ডিত মানুষ শ্রদ্ধেয় হোসেনুর রহমনের সাথে পরিচয় হয়েছে, ওনার বাড়িতেও গেছি পার্ক সার্কাসের কাছে। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ সাহিত্যে বিদগ্ধ মানুষ। ওনার মুখে স্বামী রঙ্গনাথানন্দের কথা শুনে আরো শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। উনি ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীকে। অবশ্যই শ্রদ্ধা করার মত মানুষ। সে কথায় পরে আসছি।        মঠে গিয়ে জানলাম প্রেসিডেন্ট মহারাজের কাছে, মানে স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীর কাছে দীক্ষা নিতে গেলে দেরি হবে, অনেক লম্বা দীক্ষাপ্রার্থীর তালিকা। মুষড়ে গেলাম। আমার তো দেরি করলে হবে না। আমার তো ভীষণ তাড়া। যাকেই পাই জিজ্ঞাসা করি, আচ্ছা যদি ভাইস প্রেসিডেন্ট মহারাজের কাছে দীক্ষা নিই তবে কি কোনো পার্থক্য হবে? কেউ বলে হ্যাঁ, কেউ বলে না। আমি ঠিক করলাম ভাইস প্রেসিডেন্টের কাছেই নেব, যা থাকে কপালে, হবে। ঈশ্বর তো শুনেছি অন্তর্যামী। তিনি এমন পার্থক্য করবেন?        তখন স্বামী আত্মস্থানন্দজী সদ্য ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ওনার সেবক তাপস মহারাজের কাছে গেলাম। ওনার কাছে ইন্টারভিউ দিতে হবে, পাস করলে ফর্ম দেবেন, তবে দীক্ষা।        আমি আর আমার এক বন্ধু গেলাম। তাপস মহারাজ জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এসেছিস?        বললাম, দীক্ষা নেব।        বললেন, কেন?        বললাম, বই পড়েও ঠিক হচ্ছে না বলে।        উনি মুচকি হেসে বললেন, তা এই বয়সে মেয়েদের পিছনে না ঘুরে ঠাকুরের পিছনেই বা ঘুরছিস কেন?        ভাবলাম, একি প্রশ্ন রে বাবা! ওনার মুখে তখন দুষ্টুমির হাসি। আমার কোনো উত্তর নেই। বললেন, তা কি কি বই পড়েছিস?        আমি লিস্ট আওড়িয়ে গেলাম। উনি শুনে বড় বড় চোখ করে বললেন, বাপ রে, এতো মেলা বই পড়ে ফেলেছিস...        আমি বললাম, তবেই বুঝুন, এত পড়েও কিছুই ঠাহর কর‍তে পারছি না....        উনি ফর্ম দিলেন। দীক্ষার দিন স্থির হল ১৩ই মে, ১৯৯৬. কাশীপুর উদ্যানবাটীতে।        কাশীপুর উদ্যানবাটী, যেখানে রামকৃষ্ণদেবের জীবনের শেষ কয়েকমাস কেটেছিল। আমরা আনুমানিক তিরিশজন যুবক যুবতী কাশীপুরের সেই ঘরে বসে যে ঘরে রামকৃষ্ণদেবের জীবনাবসান হয়েছিল। সামনে মেঝেতে লাগোয়া খাট। জানলাগুলো খোলা। দরজা বন্ধ। আমরা মহারাজকে ঘিরে বসে। ওনার চোখ বন্ধ। সামনে রামকৃষ্ণদেব, সারদাদেবী, স্বামীজির ছবি রাখা।        এই ঘরের কথাগুলো বাইরে বলতে নেই বলা হয়। কিন্তু আজ আমায় বলতেই হবে। যদি তাতে কোনো পাপ হয় তবে হোক। কিন্তু আজ না বললে যে অপরাধবোধে ভুগব, যে বিবেকযন্ত্রনায় ভুগব, তা আমার কাছে অসহ্য। এই কথাগুলো বলব বলেই আজ লিখতে বসা।        উনি আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু কথা বললেন মন্ত্র দেওয়ার আগে। সেই কথাগুলোই আজ আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। সেই ঘরে কোনো মিডিয়া ছিল না, কোনো লিপিকার ছিল না। একজন প্রায় আশি ছুঁইছুঁই মানুষ শিরদাঁড়া সোজা রেখে কয়েকটা কথা বলেছিলেন, যা আজ এই দুর্দিনে বারবার মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন,        "মনে রেখো, ঈশ্বর এক। তিনিই আল্লাহ, গড ইত্যাদি নামে পরিচিত। তোমরা ঠাকুরের নামে দীক্ষা নিচ্ছ মানে মন্দির, মসজিদ, চার্চ ইত্যাদির মধ্যে আজ থেকে কোনো ভেদ করবে না। জানবে একই ঈশ্বর সর্বত্র। মানুষ রুচিভেদে নানা নামে, নানা প্রথায় তাঁকে ডাকে। দীক্ষা নিয়ে তোমার মধ্যে যদি এই উদারতা না আসে জানবে তোমার সব সাধনা ব্যর্থ। মানুষকে ভালোবাসা, তাকে কোনো অর্থে শোষণ, পীড়ন না করা তোমাদের ব্রত হোক। আর জানবে ঠাকুর অহংকার আর মিথ্যা সহ্য করতে পারতেন না। এই দুটো থাকলে তোমার জীবন ব্যর্থ।"        আজ মনে হয়, আচ্ছা, যদি ওই বন্ধ ঘরে উনি বলতেন, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব ছাড়া অন্য কাউকে মানার দরকার নেই। উনিই সব চাইতে আপডেটেড অবতার। বাকি সব ধর্ম থেকে আমাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ...ইত্যাদি ইত্যাদি...তবে কার কি বলার ছিল? ওনার সামনে তো প্রত্যেকেই তরুণ, তাদের মাথা মোড়ানো, ব্রেণ ওয়াশ করা তো এমন কিছুই কঠিন কাজ না। তবে কেন এমন উদারতার কথা বলা? কারণ এটাই তাঁর বিশ্বাস। রামকৃষ্ণদেবের সাধনের মূল কথা।        এরপর বছর গেছে। ওনার সাথে নানা বিষয়ে কথা হয়েছে। আলোচনা হয়েছে। একদিনও পলকের জন্যেও কোনো সঙ্কীর্ণ বিশ্বাস, কোনো সঙ্কীর্ণ মতামতের প্রশ্রয় দেখিনি। কি সাংঘাতিক উদারতা, কি অসামান্য মানবদরদী মন। এমনই স্বামী আত্মস্থানন্দজীকে আমি চিনেছিলাম।        দুটী ঘটনা স্বামী রঙ্গনাথানন্দজীকে নিয়ে বলি। একবার একটা অল্পজনের আলোচনা সভায় উনি ইংরাজিতে বলছেন। বলতে বলতে হঠাৎ করে উনি ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে ওনার বক্তব্য বলতে শুরু করলেন। সবাই অবাক, হঠাৎ হিন্দীতে কেন? উনি দক্ষিণভারতের মানুষ, অত ভালো হিন্দী বলতে পারেন না। দেখা গেল, যে মানুষটা সবাইকে চা দিতে এসেছিল, সে চা দেওয়ার পর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তার কথা বোঝার চেষ্টা করছে। তাই সে যাতে বুঝতে পারে, তাই হিন্দী।        আরেকটা ঘটনা। উনি ফ্লাইটে করে হায়দ্রাবাদ যাচ্ছেন। বিমানসেবিকারা যা খাবার দিচ্ছেন তাই উনি নিয়ে ওনার ঝোলায় ভরছেন। পাশে বসে থাকা আরেকজন মহারাজের অবাক লাগছে, উনি এমন ব্যবহার কেন করছেন? বুঝলেন এয়ারপোর্টে নেমে। রঙ্গনাথানন্দজী নেমেই দৌড়ে এয়ারপোর্টের বাইরে বসে থাকা একজন পঙ্গু ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। তার হাতের ঝুলি থেকে বার করে সব খাবারগুলো দিয়ে দিলেন। আরেকজন মহারাজ বুঝলেন কেন নিয়েছিলেন সব কিছু বিমানসেবিকার কাছ থেকে।        যখন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাথে স্বামী আত্মস্থানন্দজীর সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্কের কথা শুনেছিলাম, মনে একটা অন্য রকম আশার সঞ্চার হয়েছিল। যখন উনি স্বামী আত্মস্থানন্দজীর দেওয়া আশীর্বাদী ফুল পকেটে নিয়ে প্রথমবারের শপথবাক্য পড়তে উঠেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী অতিথি, মনে অন্যরকম আশা জেগেছিল।        আজ আমি খুব কনফিউজড। আজ যদি আত্মস্থানন্দজী থাকতেন, কি বলতেন উনি? জানি না। উনিই নাকি ওনাকে রাজনীতিতে আসতে বলেন সন্ন্যাসী হওয়ার বাসনাকে নিরস্ত করে। তবে কোনদিকে যাবে ভারত? রামকৃষ্ণের সর্বধর্ম সমন্বয় না মনুর পথে?        চাকরি সূত্রে লক্ষ্ণৌতে আছি। আমার এক সহকর্মীর সাথে কথা হচ্ছে, যিনি জন্মসূত্রে মুসলমান। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন বিকালে আমি কি করছি। আমি বললাম, আমার আজ একটু রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়ার আছে। সে বলল, আমি যেতে পারি? আমি বললাম, অবশ্যই। সে বলল, কেউ কিছু বলবে না? আমি বললাম, গিয়েই তো দেখো।        সে আমার সাথে আরাত্রিকে আমার পাশে বসে শুনে, মহারাজের কোয়াটার্সে মহারাজের সাথে চা পান করে গল্প করে যখন গাড়িতে উঠল, বিস্ময়ের অবধি নেই ওর। বলল, আমার কাপটাও আলাদা করে রাখা হল না তো!        সে যখন আমাদের বাড়ি এসেছিল কাঁচরাপাড়া কোয়াটার্সে, মা তাকে যখন আমাদেরই থালায় খেতে দিল, আমরা একসাথে খেলাম, সে খাওয়ার টেবিলেই বলল, হিন্দীতে বলল, যখন মঠেই তোমরা আলাদা করো না, তখন বাড়িতেও যে করবে না এই স্বাভাবিক। আমি আপ্লুত।        এইরকম একটা বিশ্বাসেই বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ এর ভারত দাঁড়িয়েছে। এর অন্যথা হয় না। আজ যারা রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষিত তাদের উপর আমার মনে হয় যেন বিরাট দায়। সারা ফেসবুক জুড়ে "জয় ঠাকুর, জয় মা" শুধু লিখবেন না। স্বামী ভুতেশানন্দজী বলতেন, তোমাদের ঠাকুরঘর না, তোমাদের আচরণ দেখে যেন বোঝা যায় তোমরা ঠাকুরের শিষ্য। তিনি যেন তোমাদের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত হন। রামকৃষ্ণদেব ও তার শিষ্যদের মধ্যে এই সমন্বয়ের উদাহরণের অভাব নেই। প্রতিজনের জীবনীতেই আছে ভুরি ভুরি উদাহরণ। কিন্তু সেকি শুধু বইতেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না তো। আপনারা সোচ্চার হন। যেন ধর্মে ধর্মে বিভেদ না জন্মাতে পারে কেউ এই মাটিতে।        আমার অনেক অভিযোগ, অনেক ক্ষোভ থাকতই পারে মিশন নিয়ে। কিন্তু সে মহান আদর্শকে নিয়ে তো নেই। আমার নাস্তিকতা, আস্তিকতা দুই নিয়েই আমি সেই মহান আদর্শের সামনে দাঁড়াতে পারি। মানুষ শেষ কথা হোক। রামকৃষ্ণদেবের কথা, "অন্যায় অসত্য দেখলে চুপ করে থাকতে নেই"। আর যা সত্য বলে অনুভব করেছি তাকে গোপনও কর‍তে নেই, "মন মুখ এক করাই প্রকৃত সাধন"। এই কথাটা খুব বড় কথা। আমার মনে হয় ওনার শ্রেষ্ঠ উপদেশ, বাণী। আজ অনেক বড় কর্তব্য যারা সেই আদর্শে বিশ্বাসী, দীক্ষিত, অনুরাগী সবার উপর। নইলে আর কেউ ক্ষমা করবেন কিনা জানি না, যদি রামকৃষ্ণদেবকে ইষ্ট বলে মানেন তবে জানবেন উনিই ক্ষমা করবেন না। আজ সত্যি অর্থে দীক্ষা নেওয়ার দিন, মন্ত্রে না, আচরণে, সমন্বয়ের প্রচারে, বিশ্বাসে। আপনার আশপাশকে সেই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করে তুলুন। রামকৃষ্ণদেবের এই উদার শিক্ষাটুকু যেন প্রাণিত হয়ে ওঠে আবার। এই অন্ধকারে আর গতি নেই।  
289
Mon, 01/06/2020 - 21:00
  অমর্ত্য সেনের পর এবার অভিজিতবাবুকে নিয়ে - দেশে থাকুন, তবে মতামত দিন।        বাছারা আমার কয়েকটা কথা মনে করিয়ে দিই -        রামকৃষ্ণ বিখ্যাত হলেন, স্বামীজির মত শিষ্য ছিলেন বলে। স্বামীজি বিখ্যাত হলেন শিকাগো (বিদেশ) নামে একটা জায়গায় সাদা চামড়ার বাহবা পেয়েছিলেন বলে। আমি হলফ করে বলতে পারি আপনারা দশখণ্ড স্বামীজি রচনাবলী এখনও পুরোটা পড়েননি, পড়লে ওনার ছবি, আর বাছাবাছা উদ্ধৃতিগুলোর অপব্যবহার করতে ভয় লাগত।        রবীন্দ্রনাথ = নোবেল= বিদেশ = সাদা চামড়ার বাহবা। সেই বিখ্যাত ভাষণ ওনার মনে আছে? যখন এক ট্রেন লোক মিলে ওনাকে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল। অগত্যা....        সত্যজিৎবাবু = অস্কার = বিদেশ = সাদা চামড়ার বাহবা।            ওহে দেশপ্রেমীগণ, বিদেশ হইতে কল্কে না পাইলে যে দেশের সন্তানেরা দেশজ প্রতিভা চিনিতে, বুঝিতে অক্ষম হয়, সেই দেশের মানুষের আর যা হোক 'বিদেশ বিদেশ' বলিয়া গাল পাড়া খুব একটা সমীচীন কিছু কি?        সত্যার্থী মহাশয়কে নোবেল পাওয়ার পূর্বে ক’জন চিনিতেন দেশপ্রেমীগণ?        আসলে 'দেশ' আর গ্রাম বা পাড়া শব্দটার মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা এক বিশেষ শ্রেণীর দেশপ্রেমীগণ ভুলতে বসেছেন। দেশ বলতে তারা গ্রামের ছেলে বা পাড়ার ছেলের অধিক কিছু বুঝে না। তাই তাদের অভিযোগের সুর খানিকটা এমন - "পাড়ায় থাকো না, পুজোয় চাঁদা দাও না, অমুকের ঠাকুমা মারা গেল যখন শ্মশানে গেলে না, আমাদের সাথে ক্লাবে আড্ডা মারতে আসো না, নাচো না, গুলিডাণ্ডা খেল না, ওপাড়ার মানুষদের উচিৎ শিক্ষা দিতে ডাণ্ডাবাজি করো না....ধুস, তুমি কোন কামের?"        এদের ধারণা রাশিয়া, আমেরিকায় চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ে ভারতীয়ের হৃৎপিণ্ড, যকৃত, পাকস্থলী, বৃক্ক ইত্যাদি সম্বন্ধে সম্যক ধারণা হয় না। এদের ধারণা সংস্কৃতে যাই বলা হয় তাই শাস্ত্র। এদের ধারণা ভারতের মাটি সূর্যের থেকে ছিটকে আসা পৃথিবীনামক গ্রহের নয়, সে অসীম অনন্তকাল থেকে এক বিশেষ পূর্ণ, নিখুঁত, সম্পূর্ণ অবস্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। এরা ব্যাখ্যা করে, খোঁজ করে না। এরা নিন্দা করে, সমালোচনা করে, কুৎসা করে কিন্তু নিজেকে নিয়ে কোনো সংশয় তথা আলোচনায় যায় না। এরা নির্দিষ্ট শত্রুপক্ষের অস্তিত্ব, পরিচয়ের চালচিত্রে নিজের ক্ষমতার বহর খোঁজে। এরা সৃষ্টি করে না, গ্রহণ করে না, শ্রবণ করে না। এদের জ্ঞান মিউজিয়ামের। এদের স্বপ্ন অতীতকালের। এদের ভালোবাসা বুড়ো বটগাছের ঝুরিতে লটকে। এদের অর্থনীতি জবরদখলের। এদের রঙ, ধর্ম, ঈশ্বর, মতামতের একটাই গর্ব-আস্থা-বিশ্বাস; প্রাচীনত্বে।        থেমে যাবে সব। তবে পুরোনো পাথর আচমকা কালের বেগে গড়িয়ে নামছে তো, কিছু ক্ষয়ক্ষতি তো হবেই। মেনে নিতেই হবে। মনে রাখতে হবে পাথর যখন গড়ায় তখন তার প্রবল বেগ থাকে, দিশা থাকে না। তবে আবার কালের নিয়মেই কোথাও গিয়ে জগদ্দলত্বপ্রাপ্ত হবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেইদিনের।    
290
Wed, 01/01/2020 - 01:00
  একজন পরিচিত মানুষ আমার, হঠাৎ বললেন, "আচ্ছা দাদা যদি শোনো আমি আর নেই, কি হবে? ভাববে আমার কথা? কষ্ট পাবে?" বলেই সে হো হো করে হেসে উঠল। তার সাথে আমার মাত্র কয়েক বছরের পরিচয়। যদিও তা এখন আত্মীয়তায় পরিণত হয়েছে, তবু কানে বাজল কথাটা। হাতের কাজ থামিয়ে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে হেসেই চলেছে, তার হাসি মুখের ওপর দুটো নিঃসঙ্গ চোখ; বুঝলাম কথাটার মানে কি।        ভাবনাটা মাথার মধ্যে ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল, "আচ্ছা দাদা, হঠাৎ যদি শোনো কাল আমি নেই"...        আমিও মৃত্যুর কথা, নিজের না থাকার কথা বলেছি। কার কাছে বলেছি? প্রিয়জনদের কাছে বলেছি। যে মানুষের আমার থাকা, না থাকায় কিছু যায় আসে, তার সামনে বলেছি। এটা মানবিক দুর্বলতা। এ আছেই। একমাত্র মানুষই হয়ত এমন জীব যে বৌদ্ধিক স্তরে জানে সে মৃত্যুঘেরা দ্বীপে বাস করছে। যে দ্বীপের মাটি ক্রমে ক্রমে ডুবে যাচ্ছে সাগরে। সে হারিয়ে যাবে। এ নিশ্চিত। তার সেই না থাকাকে সে হয় তো একটু আস্বাদান করে নিতে চায় কারোর ব্যথায়, কারোর শূন্যতা বোধে! সেই ব্যথা, শূন্যতাই তো সে তখন, না থাকা সে। তাই সে এ কথা বলে কোথাও একটা স্বস্তি পায়, সুখ পায়। তাই সে নিজের মৃত্যুর কথা ভাবে, প্রিয়জনের কাছে বলে। একেবারে দেখাশোনার আড়াল হয়ে যাওয়ার অবশ্যম্ভাবী দুঃখটাকে সে মাঝে মাঝেই সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেখে সে কতখানি সত্য, খাঁটি, কতটা মূল্যবান বাস্তবিক।        তবে এ কথা সেই বেশি বলে, যে বঞ্চিত, যে উপেক্ষিত। যে মানুষটার কথা বললাম সেই মানুষটার কথাও তাই। সংসারে তার কর্তব্যের শেষ নেই, তার সন্তানের কাছে, স্বামীর কাছে, পরিবারের কাছে, সমাজের নানা অযৌক্তিক, অমানবিক, নিষ্ঠুর একপেশে প্রথা-রীতির কাছে; সব শেষে এক শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা। অবশেষে সেই নিঃসঙ্গতাকে সরিয়ে প্রতিদিনের সকালকে নতুন করে আটপৌরে সংসারে আহ্বান জানানোর কর্তব্য, নিজেকে টিকিয়ে রাখার দায়। সহানুভূতি নেই, সুক্ষ্ম বিচার আছে, প্রতিদিন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে হাজিরা দেওয়ার আছে। সেখানে কত বিচারক, কত আইন, কত নালিশ তার বিরুদ্ধে - সে একা। সে একা সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা সে নিঃসঙ্গ।        আমি এমন মেয়েমানুষ সংসারে অহরহ চলতে ফিরতে দেখি। 'মেয়েমানুষ' কথাটায় প্রগতিশীলেদের যদি আপত্তি থাকে মার্জনা করবেন, আমি এই শব্দতেই ওদের দেখতে জানি। কি অকৃতজ্ঞ, একপেশে, পক্ষপাতদুষ্ট একটা পুরুষশাসিত সমাজ প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে তার রাজস্ব আদায় করে চলেছে দেখলে একটা অসহায় অসহ্য রাগ জন্মায়। সমাজের যে সিঁড়ি অবধি আলোবাতাস এসে পৌঁছায় না, হাজার একটা উন্নয়নমূলক আলোচনা এসে পৌঁছায় না, সেখানে তারা কতটা মুক্ত? তাদের আবেগ, তাদের ভালোবাসা, তাদের সেবা, তাদের ত্যাগ, এমনকি তাদের মহানুভবতাকে জলের দরে বিকোতে দেখি। যেন মেলায় পাঁপড়ভাজার দোকান; খুচরো পয়সায় কিনলেও হয়, না কিনলেও হয়। বাকি আর যা কিছু মেলায় তা দ্রষ্টব্য, বাহবা পাওয়ার, শুধু ওই পাঁপড়ভাজাটুকু ছাড়া, ওটা তো হয়েই থাকে। কি অসম্ভব থ্যাংকসলেস জীবন। যে মানুষটা সেলাই শিখল দাদাদের স্কুলের খরচ বাঁচাতে স্কুলে না গিয়ে, গরীব বাবার পয়সা বাঁচিয়ে, সেই বিধবা হয়ে দাদার গলগ্রহ হয়ে অন্ধকারের রাস্তায় বাঁচার পথ নিয়েছে। অধিক উপার্জনশীল ভাসুরের নানান সুখের ফরমায়েশ মাথা নীচু করে মেনে নিতে হয়েছে কম উপার্জনশীল স্বামীর লজ্জার মাশুল দিতে। এ সব গল্প শরৎচন্দ্রের নয়, আমার দেখা। এরকম ঘটনায় ভরে গেছে দুই চোখের পাতা, মাথা, বুক।        এমনই একজন মানুষ আমার সামনে দাঁড়িয়ে তার সাধের, স্বপ্নের মৃত্যুর কথাটা টেনে নিয়ে এসে পরোক্ষভাবে বলে গেল, সে যেদিন থাকবে না, আমি যেন সেদিন তার অনুপস্থিতিজনিত অসুবিধার কথা না ভেবে, শুধু তার অভাবটাকেই যেন সম্মান দিই, কষ্ট পাই। সে তাতেই শান্তি পাবে। তার আপনজনেদের উপেক্ষা, উদাসীনতায়, শুধুই প্রয়োজনীয়তার তকমায় বেঁচে থাকার অভিমানটুকু তাতেই যেন বিরাট সান্ত্বনা পাবে। সে ধন্য হবে।        নতুন বছর নিয়ে আমার কোনো আবেগ নেই। তবু এইটুকু কথা বলি, যদি কোনো মানুষ, সে যেই হোক, যে অর্থনীতির, যে লিঙ্গের, যে ভাষার, যে ধর্মের হোক না কেন, সে যদি তা খুব আবেগ নিয়ে নিজের না থাকার গল্প বলে, তবে জানবেন সে তার দুরতিক্রম্য নিঃসঙ্গতার হাত থেকে বাঁচার এর চাইতে সম্মানজনক আর কোনো পথ পায়নি বলেই বলছে। একটু ভালোবাসা, একটু গুরুত্ব চাইছে মানুষ হিসাবে। খুব বেশি কিছু নয়, এইটুকুই। আপনার কাছে সে একটা প্রশ্রয় চাইছে, জীবনে যে পূর্ণতা পায়নি, মরণে সে যেন আপনার আন্তরিক স্মরণে তা পূর্ণ হয়, এই তার সাধ। এ নিঃসঙ্গতা, উপেক্ষা মেয়েদের মত আমাদের সমাজে হয় তো রাস্তার কুকুরগুলোও নয়। খুব রূঢ় শোনালেও, এক এক সময় তাই মনে হয়। রীতিনীতিরগুলোতে অভ্যাস হয়ে গেছে বলে যেমন পশুদের নগ্নতা চোখে বাধে না, তেমনই সমাজের এই নিষ্ঠুরতা চোখে পড়ে না।        মানু্ষের নিঃসঙ্গতাকে তার আশেপাশের মানুষের আদমশুমারীতে মাপবেন না অনুগ্রহ করে। মনে রাখা যাক, মেলাতেই মানুষ নিঃসঙ্গ হয় বেশি, জঙ্গলের চাইতে। তাকে অনুভব করবেন তার সংবেদনশীলতার উপরে। তবেই তার এই অযৌক্তিক আবদারের একটা খেই মিলবে। "তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে" আসলে "তবু মনে রেখো" র উল্টোদিক, একই কথা, অন্যভাবে বলা। এইটুকুই আমার নতুন বছরের আবদার। ভালো থাকবেন সবাই। অনেক শুভেচ্ছা রইল।
291
Wed, 11/13/2019 - 22:30
             আমি হুমায়ূন আহমেদ প্রথম পড়ি কলেজে উঠে। ওনার সম্বন্ধে জেনেছিলাম তার আগেই অবশ্য, সুনীলবাবুর একটা প্রবন্ধে, দেশে বেরিয়েছিল। বিস্মিত হয়েছিলাম, এমন জনপ্রিয় একজন লেখক? কিন্তু বই পড়ব কি করে? এক তো তখন ইন্টারনেট বলে কিছু হাতের মুঠোয় নেই, ভরসা কলেজ স্ট্রীট, সেখানেও তেমন কিছু নেই। তবে?
       হাতের মুঠোয় চাঁদ পাওয়ার মত পেলাম, 'দেশ' পুজাবার্ষিকীতে ওনার একটা উপন্যাস। আমার নাম মনে নেই। একটা বাক্য পড়ে হতবাক হয়েছিলাম, ‘যখন কেউ আত্মহত্যা করে তখন তার ইয়েটা নাকি বড় হয়ে যায়।‘ বাক্যটা যে হুবহু এরকম ছিল তা হয়তো নয়, তবে ভাবটা এমন ছিল, একজন গাছে ঝোলা মৃত মানুষের বর্ণনা। এভাবেও লেখা যায়?
       এরপর নানাভাবে কিছু বই পড়ার সুযোগ এলো। একে একে ওনার সৃষ্ট নানা চরিত্রের সাথে পরিচয় হল। আমার বন্ধুমহল, ছাত্রমহলে ওনার বই সাজেস্ট করতে শুরু করলাম।
       এখানে একটা মজার কথা আছে। আমি খেয়াল করতে লাগলাম, আমি কিন্তু প্রচুর বই পড়ুয়া, বা অর্থোডক্স, বা প্রথাগত চিন্তার বাইরে চিন্তা করতে চান না --- এমন মানুষকে সন্তর্পণে সাজেস্ট করা থেকে এড়িয়ে যেতে শুরু করলাম। এর কারণ এক, নিজের ইনটুইশান, আর দুই, কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা। “ওনার লেখা ভীষণ হালকা”... ”ভাষাগুলো কেমন যেন”... ”গল্পের ধারা অবাস্তব”... ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর তো তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, মানিক, সমরেশ ইত্যাদি নানা লেখকের সাথে তুলনা আছেই। কিন্তু যারা অন্যরকমভাবে চিন্তা করতে চায়, বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের মধ্যে ওনাকে ভালো লাগাটা খুব উৎসাহ আর বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করেছি।
       আমাকে যেটা প্রথম আকর্ষণ করল ওনার লেখার তা হল অদ্ভুত অন্যরকম ভাষার ধরণ, বাক্যের গঠন। চরিত্রদের কথাবার্তার ধরণ, ঘটনার বিন্যাস। কিন্তু সে হল বাহ্য। যত বয়েস বাড়ল, তখন আকর্ষণের মাত্রা অন্যরকম হয়ে গেল। ও, এখানে একটা কথা অবশ্যই যোগ করতে হয়, তা হল প্রথম লাইনের পরে আর নিজেকে কষ্ট করে পড়তে হয় না, পড়িয়েই নেন উনি। কিন্তু সে কথাটাও নয়। আমি যেটা বলতে চাই সে অন্যকথা।
       হুমায়ূন আহমেদ – এক অসামান্য মনস্তত্ত্ববিদ। না, পুরোটা বলা হল না, এক দরদী মনস্তত্ত্ববিদ। একজন মানুষ আর একটা সমাজ – এই দুইয়েরই মন থাকে। একটা সমষ্টিগত মন, একটা ব্যষ্টি মন। যেমন এই মন থাকে, তেমন মনের দুটো স্তরও থাকে – এক, চেতন মন; দুই, অচেতন মন। আমি ইচ্ছা করেই ‘অবচেতন’ শব্দটা এড়িয়ে যাচ্ছি, বা 'মগ্নচৈতন্য' শব্দটাকেও ছুঁচ্ছি না। কারণ মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায়, বিশেষ করে কার্ল ইয়ুং -এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই 'অচেতন মন' শব্দটা বড় গুরুত্বপূর্ণ। হুমায়ূন আহমেদের লেখাতেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
       সমাজ আর মানুষ --- এই দুইয়ের অচেতন স্তরেই ওনার নিবিড় অবগাহন। একটা উপমা নেওয়া যাক। ধরুন, একজন মানুষ, যার ভীষণ অ্যান্টিক জিনিসের শখ, তিনি একটা শহরে বেড়াতে গেছেন, রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, হঠাৎ একটা বিশাল দোকান চোখে পড়ল, যে দোকানে প্রচুর অ্যান্টিক জিনিস সাজানো। উনি ঢুকলেন, দেখলেন দোকানে কেউ নেই। উনি দোকানে পা দিয়ে বুঝলেন মেঝেতে ধুলোর স্তর। তিনি ধুলোটা খুব আদরের সাথে সরিয়ে দেখলেন মেঝের অভূতপূর্ব কারুকার্য। মুগ্ধ হলেন। এইবার একটা একটা করে জিনিস নামালেন তাক থেকে আর ধুলো সরিয়ে সরিয়ে তাদের কারুকার্য দেখে মুগ্ধ হতে লাগলেন। সব কারুকার্য কি ললিত, কোমল? না তো। তাতে বীভৎস রস আছে, নিষ্ঠুরতা আছে, উদাসীনতা আছে, আরো এমন এমন কারুকার্য আছে, যা মোটেও সুখকর না। এইখানেই হুমায়ূন আহমেদ যাদুকর। তার চোখের দৃষ্টিতে একটা ভালোবাসা আছে। সে ভালোবাসা মানুষের বানানো সমাজের প্রচলিত প্রথার, নিয়মের এত বাইরে যে তাকে সাধারণে বুঝবে তা তিনি আশাও করেন না। তাই তিনি সবাইকে খুব নিখুঁত দৃষ্টিতে দেখেন। পড়ে ফেলেন সেইসব ভাষা, যে ভাষাগুলো তার একান্ত গোপন কক্ষে কালো প্রজাপতির মত ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছিল। তাকে তিনি যত্ন করে হাতের চেটোতে নেন, মুগ্ধ হয়ে দেখেন, মারেন না, আবার রেখে দেন তার জায়গায়, ভালোবাসার আলতো ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত না করে।
       হুমায়ূন আহমেদের মিশির আলি, শুভ্র, হিমু --- আমরা সবাই। ওনার সব চরিত্রের ভাষাই আমাদের ভাষা। কিন্তু সব ভাষা আমরা যা বলতে পারি না, অজান্তে ভেবে ফেলি, সমাজের নানা অভিভাবকের ভয়ে মুঠোর মধ্যে রেখে যন্ত্রণা পাই, নিজেকে নিয়ে নিজে লজ্জায় মরি, আমাদের বাঁচিয়ে দেন হুমায়ূন আহমেদ, তার নানা বাক্যের গঠনে; মনে হয়, আরে এই তো আমার চিন্তা, তবে আমি এতটা খারাপ নই, এতটা অস্বাভাবিক নই!
       এক এক সময় ভাবি, মানুষটাকে কতটা পুড়তে হয়েছিল। কারণ ওই অ্যাণ্টিকের ঘরে তো আর কেউ ঢুকবে না। হ্যাঁ, ওটা ঘর এখন। যেখানে হুমায়ূন আহমেদ থেকেছেন। অনেকেই সে ঘরের রাস্তা এড়িয়ে গেছেন, কারণ নিজেকে অতটা উলঙ্গ দেখা হয়ত সবার পক্ষে সম্ভব না। ভাষার মাধুর্যে রূঢ় সত্যকে ঢেকে রাখা যদি সাহিত্য হয়, তবে সেই কপটতা হুমায়ূন আহমেদ করেননি। একটা বুকে, একটা মাথায়, একটা জীবনে হিমুকে, শুভ্রকে আর মিশির আলিকে বয়ে নিয়ে বেড়ানো হয়ত এতটা সহজ কাজ নয়।
       আরেকটা কথা। মানুষের সামনে যে স্বপ্ন হুমায়ূন আহমেদ বুনেছেন, সে স্বপ্নের সম্পদ কল্পনা না, প্রকৃতি। সে প্রকৃতিতে গাছপালা, পশুপাখি --- সবাই পরিবার। সবার মন আছে, অনুভব আছে। অনুভব মানে তো অবশেষে ব্যথা। সে সুখই হোক, কি দুঃখই, অবশেষে তা যদি অবসাদ না হয় তবে তা স্বর্গীয় ব্যথা; না, স্বর্গীয় নয়, ভোরের শিশিরের মাধুর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে যে ব্যথা হয়, কারণ তা শুকিয়ে যাবে প্রখর তাপে; সমাজ, নিয়ম, এতটা প্রবল হয়ে যাবে যে আমাকে ওই দোকানে ঢোকার রাস্তা আবার খুঁজতে হবে, যেখানে হুমায়ূন আহমেদ আমার জন্যেই বসে আছেন, একটা গাছের পাতা হাতে নিয়ে, যে মাটিতে হেলায় পড়েছিল। হুমায়ূন আহমেদ আমাকে মানুষের কথা শোনাবে। শুনতে শুনতে আমি বাঙালি হয়ে একটা আস্ত গোটা জগতের মানুষ হয়ে উঠব। হুমায়ূন আহমেদ বলবেন, এবার এসো, আবার এসো। আমি এখানেই থাকি।  
292
Sun, 11/10/2019 - 11:30

 

ঝড় থেমে গেছে। বাতাসে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসংগীতের সুর। দূরে মাইকে বাজছে কোথাও। রবিবারের সকাল। এলোমেলো বাতাসে গাছগুলোর নড়েচড়ে ওঠার আওয়াজ।
       সুরে একটা যন্ত্রণা থাকে। দূরের যন্ত্রণা। মনের মধ্যে দূর একটা থাকেই। স্মৃতি যাকে আগলে রেখেছে, সে যে বাস্তবে কোথাও নেই, কিন্তু সে যেন দূরে কোথাও আছে, এ বিশ্বাসে একটা যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমন একটা সুখও আছে। যে ছেড়ে গেল, সে যেন শুধু আমার নৈকট্যই ছেড়ে গেল, সে যেন শূন্য হয়ে গেল না। কারণ আমি তাকে ভালোবেসেছিলাম। আমি যাকে ভালোবেসেছিলাম সে শূন্য হয়ে যায় কি করে? সে দূরের হয়ে যায়। দূরের ওপর এমন বিশ্বাস আমাদের, এমনই আবদার। সে দূরত্বে আমরা কোনোদিন পৌঁছাব না, পৃথিবীর কোনো যানবাহন সেখানে যায় না, তবু সেই দূরত্বেই আমার ভালোবাসার স্মৃতির নিত্য অবগাহন।
       ছেড়ে আসা দিনগুলোতে যে ভালোবাসার মুহূর্তরা, মানুষেরা ছিল, তারা আজ কই? কিন্তু সেদিন যে গান বেজেছিল, আজও সেই গান বাজছে। সেদিন আমার ভালোবাসার মানুষটা যে মাটিতে, যে আকাশটার নীচে দাঁড়িয়েছিল, সেই আকাশ, সেই মাটি এই তো আমায় ঘিরে আজও রয়ে গেছে। শুধু সে নেই, সে গেল কোথায়? সে দূরে আছে। এই যে গানটা বাজছে, গানটা রবীন্দ্রনাথের। যে নির্জনে তিনি গানটা লিখেছিলেন, সুর দিয়েছিলেন, আমায় ঘিরে আজ সে নির্জনতা। নির্জনতা কি শুধুই জনশূন্যতা? তা তো নয়, নির্জনতা মানে অন্যের উপস্থিতির বোধশূন্যতা। আজ এই মুহূর্তে আমার চারপাশে যারা, তাদের দিকে আমার বোধের মুখ ফিরে নয়। আজ আমি উদাসীন। আমার সমস্ত কাজ-কর্তব্য-দায় ভারশূন্য। কারণ আজ দূরের মানুষেরা এই ঝোড়ো হাওয়ায়, ওই গানের সুরে আমার মনে ভিড় করে এসেছে। খানিকবাদেই সব মিলিয়ে যাবে জানি, তখন বর্তমান জগতের নানা কর্তব্য, হাসি-রাগ-অভিমান-ঈর্ষা-ক্ষোভ আবার আমার মনের অববাহিকায় প্রবাহিত হবে, কিন্তু এখন না। এখন আমি স্মৃতির গভীরে। সেই দূরের পথে যে দূরে কোনোদিন পৌঁছাতে পারব না, কিন্তু যেতে চাইব প্রতিদিন।
       তারপর হঠাৎ সুর কেটে যাবে। পথের দিশা হারাব। দূরের মানুষেরা বিস্মৃতির আড়ালে আবার ফিরে যাবে। আমায় ঘিরে এক বিষণ্ণতা। বিচ্ছিন্ন ভালোবাসার বিষণ্ণতা। বিচ্ছেদের যন্ত্রণার কোনো সংলাপ নেই। মানুষ বলে মানুষ নাকি সবলা? সত্যিই কি তাই? সব কিছুর ভাষা আছে? নেই তো। মানুষ সবলা ততটুকুই যতটুকু সে পাড়ের দিকে থাকে। যত সে তার ভেলা নিয়ে মাঝসমুদ্রের দিকে যায় তার ভাষা যায় বুঝি সাথে? যায় না তো। তাই পাড়ের থেকে যত মানুষ তারা একসাথে পাড়ি দেয় মাঝসমুদ্রে তত মানুষ তার সাথে যায় কি? যায় না। তারা ফিরে আসে পাড়ের দিকে। ভাষার ভার ছেড়ে যাওয়া বুকে তখন নিঃশব্দ ঢেউ ওঠা পড়ার শব্দ। দূরের আকাশে চিলের পাখা ঝাপটানোর শব্দ। সে শব্দের ভাষা নেই, সুর আছে। সে সুরে মিশে বেদনা। অসীমের বেদনা আমার এই সসীম সত্তায় আত্মপ্রকাশের। ওই দিগন্তের রেখা আরো দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। মন তখন আকাশের অতিথি, অসীমের দোসর। তাকে ভাষা ছোঁয় কি করে? যতো বাচা নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ – যেখান থেকে মন ফিরে আসে বাক্যের সাথে তাকে না পেয়ে। কাকে না পেয়ে? তার কোনো সংজ্ঞা নেই। তার কোনো রূপ নেই। তার অনস্তিত্বও নেই, তার অস্তিত্বও নেই। সে ক্ষুদ্র নয়, সে হিংসা নয়, সে ক্ষোভ নয়, সে অপ্রেম নয়, সে অপ্রকাশ নয়। যেন তার প্রকাশের মধ্যেই সব কিছুর প্রকাশ। তার অস্তিত্বের মধ্যেই যেন সবের অস্তিত্ব। এমন অস্তিত্বকে বলা হল ভূমা – অর্থাৎ সব। এই ‘সব’ কথাটা আমার লোভের নয়, আমার হাত পাতার নয়। আমার দেওয়ার, আমার নিজেকে শূন্য করার, আমার হাত উপুড় করে দেওয়ার। সবকে দেওয়ার আমার ক্ষুদ্র যা কিছু সঞ্চয়। তাকি ভাষায় হয়? হয় না তো। তাই ভাষা আগেই ছেড়ে গেছে সে তীরে আমায়, আমার সেখানে নীরবে যাওয়ার। সেখানে দূরত্বের যন্ত্রণা নেই, আবার নৈকট্যের আবদ্ধীকরণও নেই, সেখানে মুক্তি, সেখানে ছুটি, সেখানে আনন্দ, সেখানে পূর্ণতা।
       সেখানে কি পৌঁছায় তবে? সেখান পৌঁছায় একমাত্র সুর। সে সুরকে ভুলে থাকা যায় নিত্য জীবনে, সরিয়ে রাখা যায়, শূন্য করা যায় না। কারণ খাদ না মিশলে গয়না হয় না। কিন্তু সোনার যখন গয়না হতে ইচ্ছা করে না? কারোর শরীরের সাথে লিপ্ত হয়ে থাকতে ইচ্ছা করে না? সে যখন কিচ্ছু হতে চায় না? তখনই সে নিজে যা তাই হয়ে যায়। সে সুর তার আঙিনায় তখন, গৃহস্থের আঙিনায় বাউল যেন। সে সুরকে ফিরে শোনে শোনে, আনমনা হয়। যেন তার মানে সে বোঝে।
       আমাদের সব কিছু নিয়ে দৌড়-ঝাঁপ, হয়ে ওঠা, হতে চাওয়া – ইত্যাদির ভীষণ ছোটাছুটি যখন, তখন আমাদের জোয়ারের সময়। সাগর থেকে জল ঢুকছে নদীতে। কিন্তু সে তো আধখানা সত্য। সে জলকে ফিরিয়েও দিতে হবে যে ভাঁটায়, সাগরে, তবেই পুরো সত্যটা হবে। এই জোয়ার ভাঁটার মাঝখানে যে সুরটা বেজে চলে তাকে ভাষা ধরতে পারে না, আভাস দিয়েই ফুরিয়ে যায়। আমরাও ভাষা হারিয়ে ভাসি। যা কিছু মলিনতা তার জন্যে কাঁদি। সাগরের দিকে হাত বাড়াই। হাত বাড়াতে বাড়াতে বুঝি হাতটা মিলিয়ে গেল, কারণ আমরা চিরকালই সেই সাগরে, সেই অনাদিকালের থেকে ভেসে অস্তিত্ব আর অনস্তিত্বের মধ্যেখানের সুরের সাগরে। যাকে কেউ বাঁধতে পারেনি আজ অবধি। নিজেকে নানা তত্ত্বে বেঁধে নিজেকে ঠকিয়েছে মানুষ, যতদিন না সুর এসে মুক্তি দিয়ে বলেছে – চলো এবার। সেদিন তার নিজের এতদিনের সঞ্চয় অর্থহীন লাগে, সে বলে শুধু আমায় নিয়ে, আমায় মিলিয়ে আমার থেকে আমায় মুক্তি দাও, আমায় তোমার মধ্যে লীন করো, যে ‘তোমার’ শব্দটার সংজ্ঞাও সে জানে না। সে অজানাই সেদিন তার পরম জানা, পরম মুক্তি। কারণ সে তাকে জানে না, কিন্তু সুরের মাধ্যমে আত্মীয় বলে বোধ করে। বোধ কি জানা না সংজ্ঞা?

293
Fri, 11/08/2019 - 13:27
     

এ লেখাটা আমি লিখতে চাইছি না, কিন্তু এও জানি, এ লেখাটা না লেখা অবধি আমার শান্তি নেই। কেন লিখতে চাইছি না? কারণ নবনীতা দেবসেন নামটা আমার পরিচিত, জ্ঞাত নাম শুধু না, আমার আবেগের, অনুভবের যে ঘরদোর, তার বাসিন্দা। সে বাড়ির দরজা খুলতে নেই যখন তখন, কিন্তু আজ না খুলেও আমার নিস্তার নেই। কারণ আজ “এলে নয়ন মাঝে”-এর দিন। আজ না খুললে নিজেকে অকৃতজ্ঞ লাগবে। তাই লিখতে বসা। প্রণাম জানিয়ে...
       নবনীতা দেবসেনের সাথে আমার পাঠকগত পরিচয়। কোনো বাড়িতে ঢুকতে গেলে যেমন বাড়ির দরজায় গৃহকর্তা বা কর্ত্রীর নাম লেখা থাকে, তেমনই প্রতিটা বই, কি লেখার উপরে একটা নাম। যে বাড়িতে ঢুকছি সে বাড়ির পরিবেশের উপর যেমন আমাদের সংকোচ, শ্রদ্ধা, দ্বিধা, ভালোবাসা ইত্যাদি নানা অনুভব হয়, কোনো লেখার মধ্যে ঢোকার সময়েও তাই। 'নবনীতা দেবসেন' লেখা নামের ফলক দেখলেই আমার যুক্তিসত্তা ঢোকার আগে আমার আবেগের 'আমি' ঢুকে পড়ে। আমার অনুভবের 'আমি' হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। সে কবিতা হোক, কি গল্প হোক, কি প্রবন্ধ, কি ভ্রমণকাহিনী।
       কেউ একজন কোথাও লিখেছিলেন ক'দিন আগে, একজন ঔপন্যাসিকই জানেন একটা উপন্যাস লেখা কি কঠিন। কথাটা আমার মনে ধরেনি। একজন মালী, একজন রাঁধুনী, একজন গাড়ির চালক, একজন শিক্ষক, একজন চিকিৎসক, একজন গায়ক – যারাই তার কাজটা নিখুঁতভাবে, সততার সাথে করতে চান তারা সবাই জানেন প্রতিটা কাজ কত শক্ত! এ তত্ত্ব নিয়ে তপন সিনহা মহাশয়ের ‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার কথা মনে পড়ে। যিনি যে কাজটা নিখুঁতভাবে করতে চান সে কাজটা তার সমস্ত সত্তাকে নিংড়েই করতে হয়। এক কলম কবিতা লিখতেও তাই, একটা তুলির টান দিতেও তাই, একটা জটিল যানজটের ছাড়িয়ে একটা যাত্রীবোঝাই গাড়ি বার করে নিয়ে যেতেও তাই। তবে কি প্রতিভা বলে কিছু নেই? আছে, কিন্তু সে প্রতিভাও এই পরিচর্যার অনুশীলন ছাড়া ব্যর্থ।
       মার্কেজ একটা সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, যুক্তির ঘোরের আড়ালে বাস্তবটাকে না দেখতে পারার কথা। কথাটা মনে ধরেছিল। দর্শনে কোথাও একটা তীক্ষ্ণ যুক্তির দিক থাকে, কোথাও একটা ভাবের গভীরতা থাকে। নবনীতা দেবসেনের লেখায় এই আটপৌরে জীবনের খাঁজে খাঁজে ভাবের গভীরতা মুগ্ধ করেছে। টাইগার হিলে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয়ের বর্ণনার মধ্যে যতটা না কৃতিত্ব, ঘিঞ্জি শহরের ছাদে দাঁড়িয়ে নীচে রান্নাঘরের কুকারের সিটি গুনতে গুনতে সূর্যোদয়ের মাধুর্যকে বর্ণনার কৃতিত্ব অনেক বেশি। এই মাধুর্যকে দৈনন্দিন জীবনের প্রবাহ থেকে আঁজলা ভরে তুলে আনতেন নবনীতা। আমরা বিস্ময়ে তা আমাদের হাতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতাম, ধরে রাখতে পারতাম না বেশিক্ষণ, তবে সেই মাধুর্যকে নিজের সত্তার সাথে মিশিয়ে নিতে নিতে অনুভব করতাম তিনি “আমাদেরই লোক”।
       আইনস্টাইনকে তার মৃত্যুশয্যায় যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তিনি আদৌ ভীত কিনা জীবনের আসন্ন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে তাকিয়ে। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে, এই অসীম প্রাণপ্রবাহের দিকে তাকিয়ে তিনি নিজের ব্যষ্টিসত্তার বিনাশ নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন। নবনীতা দেবসেন তাঁর শেষ লেখায় তাই বলে গেলেন, কৌতুকের সাথে, সুকুমার রায়কে স্মরণ করে, “জানিস আমি স্যান্ডো করি”। কেন সুকুমার রায়কে স্মরণ? কেন গীতা বা উপনিষদের আত্মার অমরতাব্যঞ্জক কোনো শ্লোক নয়? কেন 'জীব যে একটা রাসায়নিক পদার্থের সমষ্টি তার বিনাশ আছে' – ইত্যাদি কোনো বস্তুবাদী দর্শনের উদ্ধৃতি নয়? কারণ নবনীতা জীবনের উৎসবকে দেখেছেন নিজের প্রাণের স্বচ্ছ-চিরতরুণ স্রোতে। কোনো তত্ত্ব নয়। আর যে মানুষকে স্মরণ করছেন সেই সুকুমার রায় কি লিখছেন তার অন্তিম লগ্নে 'আবোল তাবোল' কবিতায়? "ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর / গানের পালা সাঙ্গ মোর।" একই সুর।
       একি শোকের সুর? হতাশার সুর? নয় তো। এ বলতে চাওয়া --- আমি চললুম, কিন্তু এ উৎসব যেন না থামে। আলো জ্বেলে রাখো, থেমো না। সেনেকা যখন রাজার হুকুমে নিজের মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে এলেন নিজেই, তখন ক্রন্দনরত পরিবারের দিকে তাকিয়ে বলতে চেয়েছিলেন, কান্না কি শুধু এই এক লহমার বিচ্ছেদের জন্য? কান্না কি আজীবনের তপস্যা নয়?
       নবনীতা দেবসেন সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের পথের পথিক – কে যায় অমৃতধাম যাত্রী। সে অমৃত আমাদের ইন্দ্রিয় জগতের বাইরে হলেও আমাদের অনুভবের বাইরে নয়। নবনীতা দেবসেন কোনোদিনই আমাদের অনুভবের বাইরে যেতে পারবেন না। আর যা অনুভবের মধ্যে সে কোনোদিন নিঃস্ব হয়ে যায় না, অনুভবই তার মধ্যে প্রাণসঞ্চার করে উজ্জীবিত রাখে।

       নবনীতা দেবসেনের নানা লেখার মধ্যে আমার সব চাইতে প্রিয় কবিতা আর ভ্রমণকাহিনীগুলো। তার ভ্রমণকাহিনীগুলো যত না ভৌগলিক মানচিত্রের দিশা দেয় তার থেকে অনেক বেশি মানব চরিত্রের নানা বিচিত্রতার মানচিত্র আঁকে। তিনি সবচাইতে বেশি মজা করেন নিজেকে নিয়ে। তিনি সবচাইতে বেশি গোত্রহীন করে তোলেন নিজের অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যাগুলোকে। তিনি কোনো একটা নির্দিষ্ট দর্শনে বা বিশ্বাসে প্রতিদিন সব কিছুকে একই ধাঁচে দেখতে চান না। তার অভিজ্ঞতার সাথে সাথে উপলব্ধির মেরু পরিবর্তন, দিক পরিবর্তন আমাদের আরো কাছের মানুষ করে তোলে তাকে। কারণ আমরা নিজেরাও তাই। আমাদের গোত্রভুক্ত করতে চায় ধর্ম-রাজনীতি আর নানা ‘বাদ’। কিন্তু সে তো আমাদের মুখোশ। আসলে যে আমরা অবশেষে সবাই নানা ভুলভ্রান্তিতে ভরা মানুষ, নবনীতা দেবসেনের কলম তা জানে, তাই নিয়ে মজা হয়, ব্যঙ্গ হয়। যে কথাটাকে সযত্নে লুকিয়ে রাখি, সেই কথাটাকেই সবাই নিয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ার সাহস পাই তার তৈরি শব্দবন্ধে। কারণ নবনীতা দেখিয়েছেন মানুষ এসবের পরেও অনেক বড় --- সে মানুষ।
       আর কবিতার কথা? থাক। কবিতারা নিঃশব্দে আজ কবিতার স্বজন যারা তাদের মধ্যে মন্ত্রের মত বেজে চলুক, সে নিয়ে কথা না হোক। কবিতারা তো শব্দের ঊর্দ্ধে। সে নিয়ে আলোচনা না হোক, উচ্চারিত হোক শুধু, শ্বাসের সাথে, বুক নিংড়ে।
       সমাজের নানা উদ্বেগজনক ঘটনায় বারবার সামনে এসেছেন। অভিভাবকের মত কথা বলেছেন। শুভবুদ্ধির কথা বলেছেন। বকাঝকা করেছেন। বারবার উঠে দাঁড়াবার সাহস জুগিয়েছেন। সেও এক মানুষ।
       শেষে একটা কথা বলে শেষ করি। এ আবেগের কথা নয়, এ দায়িত্বের কথা। তিনি বারবার যে কথাটা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সে আমাদের বাংলাভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে। চারদিকে ইংরাজিতে লেখার হিড়িককে খুব একটা প্রশংসা করেননি। বলেছেন, ওতে নিশ্চয় বড় একটা পাঠককূলের দিকে তাকানো যায়, কিন্তু মানুষ কি শুধু পরিণতি আর লাভের কথা ভেবেই কাজ করবে? তার কর্তব্যবোধ থাকবে না? তার দায়িত্ববোধ থাকবে না? নিজের ভাষার প্রতি ভালোবাসা, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলতে বলতে কোথাও তার মধ্যে একটা হতাশার ভাবও লক্ষ্য করেছি শেষের দিকে লেখায়। বাংলাভাষা যতদিন বাঁচবে নবনীতা দেবসেনও থাকবেন, কিন্তু ভয় যেটা সেটা হল ভাষাটাই যদি না থাকে! যেভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে ভাষাটা নিজের জন্মস্থলেই নিজের গুরুত্ব হারাচ্ছে, জমি ছেড়ে দিচ্ছে, তার ভবিষ্যৎ কি তবে? কিন্তু গায়ের জোরে, কৌশল খাটিয়ে এই ভাঙন থামানোর নয়, এর পথ একমাত্র ভালোবাসায়। নিজের ভাষাকে ভালোবেসে তাকে বাঁচিয়ে রেখে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদের মধ্যেই আশা। সেইটাই নবনীতা দেবসেনের প্রতি আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধার্ঘ্য হবে। প্রকাশকের মত করে না, পাঠকের মত করে না, এ দায় নিতে হবে শুধুমাত্র নিজের রক্ত আর স্নায়ুর ছন্দের দিকে তাকিয়ে, ছন্দপতন যেন না ঘটে।

 
294
Mon, 10/28/2019 - 18:30

তুমি বলো, তুমি মিথ্যা প্রশংসা শুনতে চাও না তাই শুনতে যাও যা তোমায় উন্নত করবে?
       ধরো, তুমি একজন নাবিক। খুব খারাপ নাবিক। যদিও তুমি শুনতে চাও না তুমি খারাপ নাবিক। তাই আমি তোমায় বললাম, তুমি ভীষণ ভালো নাবিক।
       তুমি জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিলে। ভাবতে পারছ কি হতে চলেছে? হয় তো তুমি গন্তব্যে পোঁছালেই না, কিম্বা ফিরে আসতেই পারলে না। তুমি আর জাহাজ দুটোই চরম ক্ষতির সম্মুখীন হলে। হতেই তো পারে, না?
       এ কথাগুলো সক্রেটিসের কথা। মুশকিল হল আমাদের যারা "বিরাট শিশু", মানে আর কি যারা দেশ নিয়ে খেলছে, কি বিশ্ব নিয়ে খেলছে, তারা সবাই শুনতে চায় তারা দুরন্ত নাবিক। যে জাহাজ তার ভাসিয়েছে, আরো বড় মুশকিলের কথা যে সে জাহাজে আমরাও আছি। আয়রনি হল, আমরাই নাবিকের আসনের ভাগ্যনির্মাতা, তাই পরোক্ষভাবের নিজের ও দেশের ভাগ্যের দায়ও আমাদেরই।
       আপনি বলবেন, এ গল্প তো "রাজা তোর কাপড় কোথায়" এর মতই। ঠিক তা নয়। সেখানে সেই শিশুটি সরলতা থেকে বলেছিল। সেই শিশুগুলো এখন বড় হয়ে গেছে যে। সরলতা আর কই? আর বাকি শিশুরা এখন মোবাইলের কৃত্রিম আলোতে, কৃত্রিম খেলায় মগ্ন, সেখানে অঢেল আমোদ যোগানের ব্যবস্থা করা আছে রাজার নির্দেশে। তবে উপায়?
       গুরুদেবের ফকির বা ঠাকুর্দারা? এ কথাটা মনে আসেনি তা নয় বুঝলেন। কিন্তু দেদার ইন্দ্রিয়সুখের বিপণনের যুগে সে বিশু পাগল কি আর তার সে পাগল মাথাটাকেও ঠিক রাখতে পেরেছে? সেখানে কথা হয়েছিল প্রকৃতির বরাদ্দ মদের খোঁজ যারা না পায় বা রসিক নয় তারাই শুঁড়িখানায় ঢোকে। নরকেও সৌন্দর্য আছে, সে নরকবাসীর চোখে পড়ে না, এই নাকি তাদের সব চাইতে বড় অভিশাপ।
       এখন কথা হচ্ছে, প্রকৃতিবরাদ্দ সেই সুষমাময় মদের যোগান কি আর আছে? নেই যে সে তো বাচ্চাটার সেই হাপুস নয়নে কান্নাই প্রমাণ - ফিরিয়ে দাও আমার সে সুস্থ পরিবেশ, তার অঙ্গীকার... তোমরা বেইমান.. মিথ্যুক!
       তবে কে বলবে? কে বুঝবে? মহাভারতের সেই "ম্যায় মহাকাল হুঁ"? কিন্তু কাউকে তো একটা বলতেই হবে, নাবিক তুমি ভালো নাবিক নও। জাহাজ যে ডুবছে। কিন্তু রাজার সে ডেরায় বিরোধী কেন, সবাই ঢোকে। বেরিয়েই রাজার ভাষায় কথা বলে। আপনারা বলবেন, মগজধোলাই। আমি বলি, না না, মগজসুরা। কয়েক বিন্দু পান করলেই বলবেন, "আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...আমার চোখে তো সকলই নবীন সকলই বিমল।" কি জ্বালা বলুন তো।
       আর রঞ্জন? সে নন্দিনীকে খুঁজতে বেরিয়েছে। তার হাতে শুকনো রঙ্গনের মালা। কেউ বলে সে নাকি রাজার ডেরায়, কেউ বলে সে নাকি আর নেই, কেউ বলে সে আকাশের তারা হয়েছে, কেউ বলে ব্রহ্মজ্ঞানী হয়েছে। রঞ্জন বিশ্বাস করে না জানেন। আমার কেন জানি খালি মনে হয় গলিঘুঁজিগুলো খুঁজে দেখা দরকার একটু। সে থাকলে সেখানেই থাকবে। রাজপথে বড় বড় উৎসবেয় আয়োজন। সেখানে কি সে যাবে?
       একটা কথা বলে শেষ করি। সেদিন এসি ঘরে, নানা শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে এক বসে এক সন্ন্যাসী কি বলল জানেন? ব্রহ্মজ্ঞান হওয়ার আগে সংসারের এই দুর্দশা দেখে মানুষ নাকি বলে - "হোয়াট!!!!😟"
       তারপর যেই না ব্রেহ্মজ্ঞান হয়, অমনি হাসি মুখে হাত উলটে, বলে, "সো হোয়াট😊😊"
       এখন হিমালয়ের গুহায়, মানে নাকি যেখানে গুহাভাড়া করে ধ্যানধুন করা যায়, সেই হিমেল বাতাসের সব্বনেশে ঘুমের ছোঁয়ায় সব্বার মগজ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে নাকি গো.. গেলে চলবেনি... নন্দিনীকে আমাদের চাই.... রঞ্জনকে চেনাবে তো সেই.... সে শিশু না, ঠাকুর্দা-ফকির না, চাই তাকেই..

295
Fri, 10/18/2019 - 20:30

 

      চিঠি লেখা হয় না আজকাল ইত্যাদি কথা না। যে কথাটা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্রগুলো পড়তে পড়তে বারবার মনের কোণায় এসে দাঁড়ায়, প্রশ্ন করে, তা হল এই কথাগুলো চিঠিগুলো না লেখা হলে কলমের মুখ অবধি আদৌ কি আসত? ধরুন ছিন্নপত্র না, এমনিই অতি সাধারণ চিঠিপত্রগুলোর কথা, নানা জানা-অজানা মানুষকে চিঠি লিখেছেন তো অনেক। উনি নিজেও অবশ্য কোনো কোনো চিঠিপত্রে লিখছেন যে হয়ত তোমায় না লেখার হলে এই কথাগুলো আমি লিখতুমই না, তুমি তোমার যোগ্যতায় কথাগুলো আমায় দিয়ে লিখিয়ে নিলে...... এমন কথা অনেকবার লিখেছেন। তাই বলছি, এই কথাটা তো সত্যিই না, চিঠিতে যে কথা লেখার অবকাশ থাকে, সত্যিই কি আর কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থায় মনের এইরকম ধরণের কথাগুলোকে ছোঁয়া যায়?
      ‘এইরকম কথা’ বলতে আমি ঠিক কিরকম কথা বলছি? মনের অনেক চিন্তা আছে, ভাবনা আছে, অনুভব আছে, দুঃখ আছে যে কথাগুলো হাটের মধ্যে বলার নয়। কারণ তারা ঠিক কাজের কথা নয়। আমাদের হিসাবী মন আর নীতিবাগীশ মন যে কথাগুলোকে ঠিক আমল দেয় না, সেরকম কথাগুলোকে আমরা বলি কোথায়? বলা যেতে পারে - কেন গল্পচ্ছলে? হয় না তো। সামনাসামনি থেকে অনেক কথা বলা যায় না, যা একান্তে নিজের সামনে দাঁড়িয়ে লেখা যায়। যে কথাগুলো উচ্চারিত হয়ে হারিয়ে যাওয়ার নয়, যে কথাগুলোকে নিয়ে অবসরে নাড়াচাড়া করা যায়, সেই শব্দমালা থেকে আরো হয়ত নতুন মালা গাঁথা যায়। হোক সে বিনিসুতোর মালা। সে গান নয়, কবিতা নয়, ঘন ভাবাবেগ নয়, প্রবন্ধ নয়, উপদেশ নয়, হিসাব নয়, পরিকল্পনা নয়, পরনিন্দা নয়...সে শুধুই চিঠি। তার কোনো সমালোচক নেই, ব্যাকরণবিদ নেই, নিন্দুক নেই। আছে শুধু প্রাপকের আগ্রহজাগা দুটো হাত আর একটা সংবেদনশীল মন, যার দরজার ফাঁক দিয়ে গলে সে চিঠি তার কাছে পৌঁছালো।
      মা দিদাকে খুব চিঠি লিখতেন। যে সময়টা লিখতেন সে সময় আমাদের উপর নির্দেশ থাকত মাকে না ডাকার বা ঘরে কোনো শব্দ না করার। আমার সেই সময়ের মায়ের মুখটা দেখলে একটা অদ্ভুত আনন্দ বিস্ময় আর কষ্ট একসাথেই হত। আনন্দ, কারণ মাকে অতটা আত্মমগ্ন দেখা তো আর অন্য সময় যায় না, আর কষ্ট কারণ আমার থেকে যেন বড্ড দূরে, অচেনা মা। চিঠির শেষ কিছুটা জায়গা ছেড়ে রাখতেন আমার লেখার জন্য। নীল ইনল্যান্ড লেটারে মায়ের নীলকালিতে লেখা শব্দগুলো পড়ার চেষ্টা করতাম, অবশ্যই লুকিয়ে, বুঝতাম না, কষ্ট হত। আমার বরাদ্দ জায়গায় আমার কথা দিদাকে লিখতে বসতাম।
      আজ যদি মা ওই চিঠিগুলো না লিখতেন তবে কি সেই সব চিন্তাগুলো উনি আজ ফোনে জানাতেন? না হয়ত। কারণ আমাদের কথাবার্তার অভ্যাসটা মনের উপরের তলার বাসিন্দা। প্রয়োজনের দাসত্ব করতে করতে অনাবশ্যক কথা যদি সে বলে তবে সে কিছু ঠাট্টাতামাশা ইত্যাদি লঘুবাক্যবৃত্তি বই আর কি? চিঠি মনের গভীরের কথা লিখিয়ে নিতে পারে, চিঠির উদ্দিষ্ট মানুষটাও চিঠির গভীরতা বুঝে নিজেকে প্রস্তুত করেই সে চিঠি নিয়ে পড়তে বসে। তাতে অমর্যাদা হয় না।
      আজ একজন মানুষের চরিত্রহনন নিয়ে অনেক লেখা হচ্ছে। আমার ব্যক্তিগতভাবে বারবার মনে হয়েছে, খুব অস্বাভাবিক কিছু হচ্ছে? অমর্ত্য সেন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর তো দূরের কথা, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও কি এমন চর্চার বই সাধু ভাষায়, ভালো মলাটে, দামী প্রকাশনী থেকে, নামী লেখকের গবেষণায় বেরোচ্ছে না? আমাদের সংস্কৃতির আধুনিকতম রূপ কি প্রতিদিনের ধারাবাহিকগুলোতে আমাদের উচ্চমার্গের রুচির পরিচয় দিচ্ছে না? আমরা কি কথায় কথায় বলছি না, যা চাপ পড়ার সময় নেই ভাই... রাতদিন তাই ফেসবুক পড়ি-করি, আর ওসব ক্লাসিক বই পড়তে গেলে মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়... ইত্যাদি ইত্যাদি... বাঙালি তো তাত্ত্বিক আলোচনা ভুলেই গেছে। তার সব আলোচনাই চাতুরীর, বৈষয়িক, রাজনৈতিক, কূটকাচালির, এবং অবশ্যই যেগুলোর মানও অত্যন্ত নিম্নমানের। বাঙালির মননের চর্চায় আজ দর্শন কই, মৌলিক ভাবনা? তথ্যের গবেষণা আর চিন্তার মন্থনে পার্থক্য থাকেই। সে আলোচনা থাক।
      আমাদের সব কিছু বড় তাৎক্ষণিকতার রোগে আক্রান্ত। তাৎক্ষণিকতার একটা নেশা আছে। হোয়াটস অ্যাপে নীলদাগ মানেই কাউণ্ট ডাউন, উত্তর...উত্তর...যে লিখছে আর যে পড়ছে দুজনেই চাপে। রিয়্যাক্ট করার। আমরা প্রতিক্রিয়া দিই, প্রতিক্রিয়াশীল হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামি, ভাবি না। উত্তর খোঁজার চাইতে, উত্তর দেওয়ার তাগিদ অনেক বেশি আমাদের। কিন্তু এইটুকুই কি সম্বল আমাদের? না তো।
      আমি আজ অবধি কোনো মানুষের গভীরতম চিন্তার স্রোতে আবর্জনা দেখলাম না। চিন্তা যত কূল ছাপিয়ে মাঝনদীতে, তত সে স্বচ্ছ হতে শুরু করে। যত গভীরে সে যায়, তত পরিস্রুত সে। সে চিন্তায় হয়ত নির্বুদ্ধিতা আছে, ভুল বোঝাবুঝি আছে, অভিমানের চর পড়া শুকিয়ে আসা প্রবাহ আছে, কিন্তু মলিনতা নেই। বাইরে এর বিপরীত, সেখানে সে ভীষণ অগোছালো। সমস্ত তাড়াকে বাইরের দিকে রেখে মনের মধ্যে শুধু একটা অস্থিরতা আর উন্মাদনা বই যেন কিছুই নেই। যার বিপরীতে হতাশা, বিষাদ আর অবসন্নতা। প্রচণ্ড দৌড়াতে থাকলে মনের মধ্যে একটা ‘ফাইনাল ডে’ এর মোহ জন্মায়। আমরা যেন এমন একটা দিনের প্রত্যাশায় বাঁচতে থাকি যে দিনটা আমাদের সব স্বপ্ন সার্থক হবে, জ্ঞানে-অজ্ঞানে যা কিছু চাই, যা কিছু প্রত্যাশা, লোভ ইত্যাদি সেদিন যেন বাস্তব হবে। সব শত্রুনাশ হবে। আমার সেদিনের পর থেকে আর যেন কিচ্ছু চাওয়ার থাকবে না। প্রতিটা ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগীর কল্পনায় এমন একটা দিনের স্বপ্ন আছে। যাকে নিয়ে তার উৎকন্ঠাও আছে। কোথাও তো সে জানে, সে মিথ্যা। পূর্ণতাকে অনুভব করার সম্ভাবনা আসলে প্রতিদিনের মধ্যে আছে, কিন্তু আমাদের প্রতিটা দিন পূর্ণ করে বাঁচার শিক্ষা হয়নি, অভ্যাস তৈরি করেনি। তাই সবার দৌড় প্রতিযোগীর কল্পনায় একটা লাল ফিতে আছে। কিছু উপহার আছে। এই তার দৌড়ের অনুপ্রেরণা।
      এই দৌড়ের জগতে তো চিঠি অবশ্যই বেমানান। তার ভাষা শ্লথ। তার উপরে কোনো সাবজেক্ট লেখার দায় নেই। তার ভাবনা শুধু ভাবনাই। তার দুঃখ শুধু দুঃখই। তার সে শুধু সে-ই। চিঠির বক্তব্য কিছু থাকে না, চিঠি শুধু বলে যায়। বলার জন্য বলে। তর্ক হতে পারে, ভাব বিনিময় হতে পারে। কিন্তু সে কোনো কিছুর তাড়ায় নেই। স্পিনোজা তার বন্ধুর চিঠি পেলেন, যা একটা তাত্ত্বিক প্রশ্ন নিয়ে। স্পিনোজার সেদিন এক শহর থেকে অন্য শহরে যাওয়ার দিন, সব তৈরি, উনি বেরোবেন। কিন্তু চিঠিটা পড়ে বুঝলেন, এখন বেরোলে এই চিঠির উত্তর দেওয়া হবে না, সে শহরে গেলে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন। তাই তিনি দুদিন পিছিয়ে চিঠির উত্তর লিখতে বসলেন। আজ স্পিনোজার রচনাবলীর অংশ সেরকম নানা পত্রাবলী, আবার নির্বাচিত স্পিনোজার বইতেও, নির্বাচিত কয়েকটা চিঠির মধ্যে সে উক্ত চিঠি।
      পত্রসাহিত্য নেই, সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা মনের সে আগলগুলো খোলার আজ আর কোনো তাগিদ নেই। কারোর জন্যে কোনো ডাক আসে না। কারোর কিচ্ছু বলার নেই নির্জনে একটা সাদা কাগজকে। কোনো ডাকবাক্স এখন অপেক্ষা করে না কোনো উদ্বিগ্ন কাঁপাকাঁপা হাতে ফেলা কোনো চিঠির। সব বড্ড কাজের কথা চারদিকে। একটা গল্প বলে শেষ করি।
      আমার স্কুলে যাওয়ার পথে একটা ডাকবাক্স পড়ত। বেশ বড়, গম্ভীর মুখে যেন আমায় বলত, যা লিখেছ তা আমার আমার পেটের মধ্যে দিয়ে চলে যাও আমি সময় করে নিয়ে যাব। আমি প্রচুর চিঠি লিখতাম, বিশেষ করে আমার দিদাকে, কারণ তিনি তখন আমার ফ্রেণ্ড-ফিলোজফার-গাইড। একদিন হঠাৎ দেখি পোস্টবক্সটা নেই। বুকটা ধড়াস করে উঠল, তবে? কি করব এখন আমি? কোথায় চিঠি দিতে যাব? সেই তো লাইনের ওপার, মেলা দূর। দুরুদুরু বুকে পাশের চায়ের দোকানে জিজ্ঞাসা করলাম, হ্যাঁ কাকা, এই পোস্টবাক্সটা কই? কাকা উত্তর দিল না। পিসি বাসন মাজতে মাজতে বলল, উইড়ে গেছে।
      বোঝো, একটা কথা হল, উড়ে গেছে? তখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। উড়ে যাওয়ার গল্পে বিশ্বাস করার প্রশ্নই নেই, কিন্তু আমার না লেখা চিঠিগুলোর কি হবে? বেশ কয়েকদিন হতাশ হয়ে, উদ্বিগ্ন চিত্তে স্কুল যাতায়াত করতে করতে হঠাৎ একদিন দেখলাম একই জায়গায় লাগানো ছোট্টো একটা পোস্টবক্স। সে যেন গম্ভীর নয়। তার কথা হল, বেশ আমি পড়ব না কি লিখেছ, তুমি দিয়ে যাও আমি অবশ্যই পৌঁছে দেব।
      কি করে, কি করে একদিন পোস্টবক্স খোঁজা বন্ধ হয়ে গেল মনে পড়ে না। কিন্তু না লেখা চিঠি যে জমেই যাচ্ছে, সে বুঝি। সে সব কথা কেউ বলে না আজকাল। সে কথারা ব্যস্ত দিনে সে অকাল বৃষ্টির মত। শুধুই আপদ, শুধুই বালাই।

 

296
Wed, 10/02/2019 - 11:04
     

"Gandhi was inevitable. If humanity is to progress, Gandhi is inescapable... We may ignore him at our own risk."
~ Dr. Martin Luther King, Jr.


      ভারতের মানুষ একজন সম্পূর্ণ নিখুঁত মানুষ চায়। চিরকাল চায়। কারণ ভারতের মানুষ স্তবস্তুতি করতে ভালোবাসে। তাই সে এমন একজন মানুষ চায় – যে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত, যার উদ্দেশ্যে সে একটা নিষ্কন্টক স্তব রচনা করতে পারে, আবেগমথিত হৃদয়ে গাইতে পারে। তাই সব পুরাণের মধ্যে স্তবের এত আতিশয্য। ভক্ত স্তব গাইছেন, ভগবান তুষ্ট হয়ে তাদের মনস্কামনা পূরণ করছেন এ উদাহরণ ছড়াছড়ি। এ অত্যন্ত সরল, নিষ্পাপ একটি চাওয়া – আপত্তি নেই। কিন্তু অপরিণত মানুষের চাওয়া।

      এই জন্যেই ভারতে এত অবতারের আগমন বারবার ঘটেছে, ভবিষ্যতেও ঘটবে হয়ত বা। পৌরাণিক যুগের অবতার থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগেও নানা অবতারে পুষ্ট আমাদের সমাজ। তারা আমাদের জন্য সম্পূর্ণ, নির্ভুল, নিষ্কলঙ্ক। মঠে-মিশনে-আশ্রমে ভিড়ে ঘাটতি পড়েনি। আজও নানা স্তব রচনা হয়ে চলেছে, ভক্তগণ দলে দলে সেই জোয়ারে গা ভাসিয়ে নিজেদের মোক্ষের দিকে নিয়ে চলেছে।

      এখানে মূলে আরেকটা কথা আছে। গীতায় আছে, যখনই ধর্মের গ্লানি হবে, অধর্মের উত্থান হবে, তখনই ভগবান আসবেন, সব ঠিক করে দেবেন। অর্থাৎ, আমাদের কোনো ভূমিকা নেই কিছুতেই। আমরা চোখ বন্ধ করে, হাত জোড় করে তপস্যাটুকু করে গেলেই আমাদের দিক থেকে দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে।

      মহাত্মা এই পরীক্ষায় উতরলেন না। কারণ, সম্পূর্ণ জীবনটা শুধু না, সমস্ত চিন্তাগুলোও সবার সমক্ষে রাখতে চাইতেন। রেখেছেনও। 'ব্যক্তিগত' বলে কোনো শব্দে তাঁর ঘোর আপত্তি। “He exposed even the innermost personal thoughts which individuals usually regard as private. In nearly a half-century of profile writing, speaking, and subjecting his ideas to the test of actions, he painted a detailed self-portrait of his mind, heart, and soul.” – Louis Fischer

      আড়াল না থাকলে মহাপুরুষ হওয়া যায়, ঈশ্বর হওয়া যায় না। আর মহাপুরুষকে চিনতে হলে নিজের মধ্যে “মহান” শব্দের উপর আস্থা থাকতে হয়, ঈশ্বরকে চিনতে হলে কিছু অলৌকিকত্বের উপাদানই যথেষ্ট। তাই আমাদের সব অবতারদের ঘিরে কোনো না কোনো অলৌকিক উপাখ্যান আছেই, সে যতই সূক্ষ্ম ইন্টেলেকচ্যুয়াল হোক না কেন। গান্ধী সেই তকমাটা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন, কোনো আড়াল রাখতে চাননি। এইবারের ‘দেশ’ পত্রিকায় শ্রদ্ধেয় হোসেনুর রহমানের একটা প্রবন্ধ আছে – মহাত্মাকে নিয়ে। রহমান মহাশয়ের পায়ের কাছে আমি আমার কলেজ জীবনে গিয়ে বসে থেকেছি, ওনার নানা বিষয়ে প্রজ্ঞাপূত কথায় প্রাণে আরাম পেয়েছি। বহুদিন পরে ওনার লেখা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে যেন সেই কণ্ঠস্বরটা আবার কানে বাজছে। উনি লিখছেন, “গাঁধী হয়তো আমাদের কাছে বড় বেশি করে চেয়ে ফেলেছিলেন”।

      হ্যাঁ চেয়েছিলেন। স্তবকার চাননি, সাথী চেয়েছিলেন। সহযাত্রী চেয়েছিলেন। একটা সিনেমা দেখছিলাম, Article 15, সেখানে একটা সংলাপ আছে, “আমি সেই মানুষটার অপেক্ষায় আছি যে হিরোর অপেক্ষায় বসে থাকে না।“ কথাটা প্রাণে বেজেছে। আমাদের সমাজে অনেক ব্যধি। সে ব্যধি থেকে সরাবার জন্য পথে নামতে হবে আমাদেরই। উপকরণ জোগাড় নেই তা নয়, হাতগুলো দ্বিধাগ্রস্থ – পাছে ভুল হয়। “শিব গড়তে বাঁদর গড়ব নাকি”? তাই শিবও গড়া হয় না, বাঁদরও না। তাল তাল মাটি হাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে অবতারের অবতরণের অপেক্ষায় দিন কাটায়।

      মহাত্মা তা চাননি। তাঁকে যখন কেউ কেউ কৃষ্ণের অবতার হিসাবে দেখতে চাইছেন তখন কঠিন ভাষায় তাকে নিরস্ত করছেন। আমরা কিন্তু তা চাই না, আমরা হয় ঈশ্বর বানাব, নয় দানব। মহাত্মার সামনে বারবার তাই সুভাষ, আম্বেদকর, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি মানুষের ফেস্টুন টাঙিয়ে তুল্যমূল্য বিচার করতে হয় আমাদের। আমার করুণা হয় সেই মানুষগুলোর জন্য যারা একটা নিখুঁত মানুষ খুঁজতে বেরোয়। এমন নিখুঁত যা তারা নাকি কল্পনাও করতে পারে না। অথবা তাদের নিজেদের মত নিখুঁত নির্ভুল। ও না, তা হবে কি করে? তারা তো সব সাধারণ মানুষ। এই “সাধারণ মানুষ” পদটায় মানুষ নিজেদের যে কত শয়তানি, দুষ্টুমি ঢাকে তার ইয়ত্তা নেই। তাকে সর্বক্ষণ নিজের মধ্যে এই বোধটা জাগিয়ে রাখতে হয় যে তার কপটতা, নীচতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, স্বার্থপরতা, কর্তব্যভীরূতা, ইত্যাদি সব এই “সাধারণ মানুষ” শব্দটার নীচে চাপা পড়ে ক্ষমাযোগ্য, চলনসই হয়ে উঠল। “His (Mahatma) greatness lay in doing what everybody could do but doesn’t” এই কথাটা লুইস ফিশার মহাত্মার সাথে এক সপ্তাহ তাঁর আশ্রমে কাটিয়ে লিখছেন।

      মহাত্মা সম্বন্ধে আইনস্টাইন, রোমা রোঁলা, মার্টিন লুথার কিং ইত্যাদি নানা অগ্রগামী মানুষ বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে কি কি বলেছেন সে বারবার শুনেছি। তাতে নতুন করে কিছু মনে হয়নি। কিন্তু আজ এই মানুষ বিশ্বপ্রকৃতি আর তার নিজের মানবিক প্রকৃতিকে নিয়ে যে ঘোর সংকটে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে এ স্পষ্ট যে মহাত্মার প্রদর্শিত দর্শন ছাড়া আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন। “অহিংসা” একটা বাণী কেবল নয়, মহাত্মার কাছে সত্য উপলব্ধির পথ। আমাদের একসাথে বাঁচতে গেলে আজ – একটা সত্যাগ্রহ দরকার। আর কোনো দর্শন না। সব দর্শন বড় অমানবিক, শুষ্ক যুক্তি-নির্ভর, বৌদ্ধিক উত্তেজনা ছাড়া আর কিছু নয়। সব আছে, কিন্তু জীবন নেই। আমাদের আজ দর্শনের থেকে বেশি কিছু চাই, রাজনীতি থেকে বেশি কিছু চাই। আমাদের আজ এক সম্পূর্ণ মানবাত্মাকে আহ্বান জানানোর উপায় চাই। আমাদের বড় দুর্দিন। আমরা “উচিত”কে কবে “স্ব-ইচ্ছা” করে গড়ে তুলতে পারব? কবে আমরা বলতে পারব, আমাদের মনুষ্যত্ব আমাদের সব চাইতে বড় সম্পদ। আমাদের স্বাধীনতাবোধের সাথে দায়-দায়িত্ববোধ কবে যোগ হবে? কবে বুঝব বিশ্ব-বিধানের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিয়ে চলাই স্বাধীনতা। যা মিলতে সাহায্য না করে, যা নিজেকে কিম্ভূত-বিচ্ছিন্ন করে রাখে, সে খণ্ড পরিচয়ে আমার অহং বাঁচে কুয়াশার মত, আমি না।

      বুদ্ধিকে নির্মোহ, নিরপেক্ষ আর চিত্তকে অনুকম্পাযুক্ত রাখতে পারলে আমাদের আর কোন কৌশলের প্রয়োজন হয়? মহাত্মা ধর্মকে অস্বীকার করেননি। ধর্মকে সত্য আর অহিংসায় অনুবাদ করেছেন। বিশ্বের কেন্দ্রে এক উদার অনুকম্পাময় প্রেরণাশক্তিকে বলেছেন – রাম। তিনি রামের জন্মভূমিকে ইঞ্চিতে মাপেননি, চিত্তের কোমলতায় পেয়েছেন। রাম নামকে শান্তির দূত করেছেন, বহুর মধ্যে একের আনন্দে – “এক রাম, হাজারো নাম।“

      আমার মত অতি তুচ্ছ একজন মানুষের পক্ষে মহাত্মাকে নিয়ে বলার ক্ষমতা রাখা সম্ভব নয়। তবু তিনি মহাত্মা বলেই এ স্পর্ধা আমার, মার্জনা করে নেবেন। একদিন জীবনে এক প্রচণ্ড অন্ধকার ঘনিয়েছিল। ভীষণ দুর্দিন সেদিন। সদ্য আঠারোর দোরগোড়ায় জীবন, নানা সংশয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন মস্তিষ্কের সবকটি কোষ যেন। সব কিছু ভীষণ মেকি, অর্থহীন লাগছিল। সেই সময়ে হাতে এসে পড়েছিল মহাত্মার আত্মজীবনী। মোড় ঘুরেছিল জীবনের। উপরে ওঠার নয়, নীচে নামার, নিজেকে শূন্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তারপর থেকে আজ অবধি ঝড়ঝাপটা আসেনি তা তো নয়, বিচলিত করেছে, বিভ্রান্ত করতে পারেনি। সেদিন থেকে আজ অবধি মহাত্মাকে আরো জানতে বুঝতে যা যা পেয়েছি পড়েছি, তবু আমার মহাত্মা জিজ্ঞাসা থামেনি। নানা দর্শন, ধর্ম, মত, নীতি ইত্যাদি জানছি, কিন্তু বেঁচে থাকার মত এর থেকে উৎকৃষ্ট পথ আমার মত একজন মানুষের জন্য আর কি হতে পারে আমি পাইনি। আমাদের আজ দর্শন, রাজনীতি ইত্যাদি সব কিছুর বেশি কিছু চাই। মানুষের কথা চাই। আমার চারপাশের সাথে নিজেকে মিলিয়ে নিতে আর যুক্তি ও ভাবের মধ্যে সংহতি স্থাপন করতে আমাদের আর কোনো অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, অলৌকিক প্রত্যাশার প্রয়োজন যেন হয় না। মন-বাক্য-শরীরের ঐকতানে আপনিই নিজের মধ্যে শান্তি আসে। শান্তি থেকে জন্মায় আনন্দ। সে ঐকতানকে পূর্ণতা দিতে জানি এ জীবনে সক্ষম হব না। তবু যতটা চেষ্টা করা যায়। সহিষ্ণুতা শব্দটা মহাত্মা পছন্দ করতেন না, তবু এর বাইরে কোনো শব্দ নেই বলেই বারবার মনে করাতেন, এই সহিষ্ণুতার শক্তিতেই আমাদের উদারতা। আমাদের জাতীয়তাবোধই হোক, কি আত্মবোধই হোক, সে যেন হিংসামুক্ত হয়। বলতেন শান্তি কোনো গন্তব্য না, শান্তিই হল পথ, সত্যই হল ঈশ্বর।

      আমার বারবার মনে হয়েছে, তাঁকে সব মিলিয়ে আমাদের জানা উচিৎ, ওনার জন্য না, আমাদের নিজেদের জন্য। সুস্থ একটা পরিবেশ আর মনের ব্যবস্থা আনার জন্য। খুব সুক্ষ্ম বিচারের দরকার নেই। তিনি একজন ভুলভ্রান্তিমুক্ত নয় এমন একজন মানুষ, যিনি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলেন, মৃদুস্বরে বলতে চেয়েছিলেন ভালোবাসার থেকে বড় শক্তি আমি জানি না। আমি ত্রুটিমুক্ত নই, কিন্তু আমার উপলব্ধি নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, আমি নাও পারতে পারি, তুমি খানিক চেষ্টা করে দেখো, বলো, চোখের বদলে চোখ হলে এ পৃথিবী অন্ধ হয়ে যাবে একদিন। সত্য ও অহিংসা আমার আবিষ্কার নয়, এ তত্ত্ব হিমালয়ের চেয়ে প্রাচীন, আমি প্রয়াস করেছি মাত্র এ সত্যকে নিজের জীবনে প্রতিফলিত করার। আমি বলিনি তো আমি মহাত্মা, আমি নিখুঁত, আমি চড় খেতে গাল বাড়িয়েছি, বোকা বলে নয়, আমি মানুষকে ভয় পেতে ভুলেছি বলে, মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে বুঝেছি, নম্রতা দুর্বলের সজ্জা না, বীরের সাম্য বেশ।

      শেষ করি রাণা চট্টোপাধ্যায়ের 'মহাত্মা গান্ধী' কবিতাটি দিয়ে,

মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে আমি কখোনো
                  তেমন ক'রে ভাবিনি
একটিও কবিতা লিখিনি কোনোদিন
মনে হয়েচে নেতাজীকে যিনি হারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন
যার ভূমিকা বাঙালি বিপ্লবীদের বিষয়ে
খুব একটা সমর্থনযোগ্য ছিল না
তিনি যত বড়ই মহামানব হোন
আমার কিছু এসে যায় না।

তবু তাঁর আত্মজীবনী পড়েছি মন দিয়ে
পড়েছি দক্ষিণ আফ্রিকায় তিনি
কিভাবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রায় একাই
                        সংগ্রাম করেছেন
কি মমতায় অন্ত্যজ ও নিম্নকোটিদের
বুকে টেনে নিয়ে বলেছেন 'হরি-জন'।
শুনিয়েছেন 'ঈশ্বর-আল্লা তেরে নাম
                  সব কো সম্মতি দে ভগবান'।

তাঁর সত্যাগ্রহ, ডাণ্ডি অভিযান, 'ভারত ছাড়ো-
                      ইংরেজ' আন্দোলনগুলি
সারা ভারতকে তোলপাড় করেছিল,
এমনকি দাঙ্গার সময় নোয়াখালি
বা ভারত ভাঙ্গার মুহূর্তে বেলেঘাটায় থাকা
আমার জানা ছিল
তবু তাঁকে নিয়ে কখনো কবিতা লিখিনি।

অথচ জানি তাঁকে নাথুরাম নিষ্ঠুরভাবে
                       হত্যা করেছিল।
তাঁকে নিয়ে নেহেরু-জিন্নার কাজিয়াই
শেষ পর্যন্ত উপমহাদেশকে দুই টুকরো করে,
আর লক্ষ লক্ষ ভিটেমাটি হারানো মানুষ
                   চরম দুর্দিনে তাঁকেই শুধু
অভিশম্পাত করেছে। (যেমন আমরা ঈশ্বরকে করি বিনা দোষে)

আজ যতদিন যাচ্ছে বুঝতে পারছি
তিনি যিশু বা বুদ্ধের মতোন একজন
                       মহান মানব ছিলেন
তাঁর অহিংসা নীতির কোন বিকল্প নেই।
সাধারণ মানুষের প্রতি ভালোবাসার তুলনা
হয়তো একমাত্র চৈতন্যদেবের সঙ্গেই করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁকে মহাত্মা বলেছিলেন;
আজ খুব শান্তভাবে একটি সত্য মেনে নিয়েছি।
বিংশ শতাব্দীর শেষে লেনিন, নেতাজী,
হোচিমিন কিংবা মাও-এর
আগে যদি একটি নামও পৃথিবীর মানুষ
                     খুঁজে পায়
সে নাম অবশ্যই হবে মহাত্মা গান্ধীর।

297
Thu, 09/26/2019 - 11:35
    বাঙালি ভ্রমণ পিপাসু জাত। কালকূটের লেখায় আসে মানস ভ্রমণের কথা। আমাদের অনেকেরই অভিজ্ঞতায় আছে মানস ভ্রমণের স্বাদ। ও দাঁড়ান, মানস ভ্রমণ বলতে আবার মানস সরোবর ভাববেন না কিন্তু। ভাগ্যে আপনারা হিন্দী ভাষা সাহিত্যে তেমন দড় নন, নইলে কেউ কেউ আবার হয়ত রামচরিতমানসের ভাবজগতে ভ্রমণ ধরে বসতেন। না না, আমাদের কথা হল, মানসভ্রমণ নিয়ে। বাঙালি ইংরাজি-আমুদে জাত, তাই বলি মেন্টাল ট্যুরিজম।       বাঙালির অনেকগুলো মেন্টাল ট্যুরিস্ট স্পট আছে। বিশেষ বিশেষ দিনে বাস ছাড়ে, অবশ্যই মানসলোকের বাস, বাঙালি কাতারে কাতারে ওঠে, সেই সব মানসলোক পরিভ্রমণ করতে করতে আবেগাপ্লুত হয়, পুলকিত হয়, গর্বিত হয়, তারপর দিন ফুরালে আবার নিজের লোকে ফিরে আসে, আবার চিরপরিচিত ঈর্ষা-কলহ শৃঙ্খলিত জীবনচর্যার আবর্তে দিনযাপন।       আজকের ট্যুরিস্ট স্পট – বিদ্যাসাগর। মানস ভ্রমণের জন্য বাঙালিকূল রেডি। আবেগ গলার কাছে দলা পাকিয়ে। বাণীর বাণ 'সাঁ সাঁ' করে সোশ্যাল মিডিয়া ধাওয়া করছে। অবশ্যি বাঙালির সোশ্যাল মিডিয়া মানেই ফেসবুক, টুইটারে ঠিক বাঙালি নিজেকে জমাতে পারেনি। কেন পারেনি সে অন্যকথা, অন্য আলোচনা। পাখিটাকে পছন্দ হয়নি? মাত্র ওইক'টা শব্দে লিখতে আপত্তি? টু দ্য পয়েন্টে বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে থেকে নিজের মতটুকু তুলে আনতে ব্যর্থতা বা অসমর্থ হওয়া? জানি না, তবে আমাদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সেলিব্রিটিকূলও সেখানে তেমন প্যালা জমাতে পারেননি দেখেছি। কষ্ট পেয়েছি। কারণ ভারতের অন্যান্য জায়গার রথীমহারথী সব দেদার টুইট করছে আর হাজার হাজার ফলোয়ার হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে ইত্যাদি দেখছি তো। অবশ্য রাজনীতি মহলে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বেশ জনপ্রিয়, সে অন্য কথা।       তা আজকের এই 'বিদ্যাসাগর ট্যুরিস্ট স্পট'-এর মূল আকর্ষণ কি? দু'শো বছর। তাঁর শিক্ষা-আচরণ-দর্শন-ভাবনার সাথে একটা বড় সংখ্যার যোগ? নাকি শুধুই ঐতিহাসিক সেলিব্রিটির গর্ব করার মত একজনের একটা রাউণ্ড ফিগার অ্যাচিভমেন্টের সেলিব্রেশান? জটিল প্রশ্ন।       প্রথমে দেখতে হবে, কেন ভ্রমণ? কারণ হল, সেখানে আমরা যেতে পারি, থাকতে পারি না। কেন থাকতে পারি না? সোজা কথা, আমাদের হাঁফ ধরে, পা টনটন করে, বসার জায়গা খুঁজে পাই না, আর যদিও বা পাই, শোয়ার জায়গা তো পাই-ই না। ফলে ঘোরা হয়ে গেলেই অনেকগুলো বেলুন গর্বের উষ্ণ হাওয়ায় বাতাসে ভাসিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কল্পনা করি সে বাতাসে উড়ে উড়ে বিশ্বের সব দেশের আকাশে ছেয়ে যাচ্ছে, ক্রমে সবাই বাঙালিদের জয়গান করছে, বিস্মিত হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে আসে, ঘুম এসে যায়, ঘুমিয়ে পড়ি। পরেরদিন যখন জাগি আবার সেই কঠোর অনাড়ম্বর নিষ্ঠুর একঘেয়ে বাস্তব, বিরক্তিকর জীবিকা-যাপন, প্রেমহীন হৃদয়ে প্রেমের সরঞ্জামের পসরা সাজানো, অনুকম্পাহীন চেতনায় “আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে”, ক্লান্তি লাগে। বিষন্নতার টিয়া আয়ুর খাঁচায় শেখানো বুলি বলে চলে, কর্মক্লান্ত বাঙালি আরেকটা হুজুগ খোঁজে, একটু ইন্টেলেকচ্যুয়াল টাচ থাকলে ভালো হয়।       মুশকিল একটা আছে, বাঙালি বোঝে না যে জগতে সব উৎকর্ষতাই অভৌগলিক, ক্ষুদ্র কালের খণ্ডের বাইরে। যেমন মহাত্মা হয়ে যান ভারতীয়, গ্লোবাল, গুজরাটি নন, সুভাষ থেকে রবীন্দ্রনাথ হয়ে থাকেন বাঙালি, কেবল বাঙালিই। আমি কি হওয়া উচিত বলছি না, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী বলছি, কারণ রবীন্দ্রনাথকে হাজার চেষ্টা করলেও শুধু বাঙালি করে রাখা বেশ কঠিন। এই কথাটাই বেশ করে রবীন্দ্রনাথ ওনার বিদ্যাসাগর মহাশয়ের উপর লেখা প্রবন্ধগুলিতে উল্লেখ করেছেন। সে আর পুনরাবৃত্তি করছি না। আরো কি কি বলেছেন সে তো আমরা জানিই, না জানা থাকলে একবার পড়ে নিলে হয়, আর ভুলে গিয়ে থাকলে একবার ঝালিয়ে নিলে হয়। মোদ্দা কথা যে কথাগুলো বলেছেন তা সুখকর অবশ্যই নয়।       এখন এই ট্যুরিজমের লাভ কি? এ প্রশ্ন নির্বোধের প্রশ্ন। একটা কথা বলি, একটা বই আছে – দ্য লাস্ট গার্ল। নাদিয়া মুরাদের লেখা। কে এই নাদিয়া মুরাদ? যাকে তালিবানেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল আরো হাজার হাজার মেয়ের মত। তাকে বিক্রী করে। উপর্যুপরি ধর্ষণের পর ধর্ষণ করে, তাকে যৌনদাসী বানানো হয়। সে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়, নিজের ভাগ্যের আর সাহসিকতার জোরেই তা ঘটে। বর্তমানে বাকি মেয়েদের মুক্তির জন্য নানা জায়গায় ক্যাম্পেন করে বেড়াচ্ছে সে, আলকায়দা'র নির্মম অত্যাচারের কথা জানাচ্ছে। সে নোবেল পায়। অবশ্যই একটা স্বীকৃতি, তার কাজ এখনও অব্যাহত। (ও একটা কথা, এখানে বলে রাখি, যারা বইটা অর্ডার করবেন বা পিডিএফ খুঁজবেন টানটান কিছু নিখুঁত ধর্ষণের বর্ণনার জন্য, তাদের বলি, বইটা আপনাদের জন্য না, এ কথা এই জন্যেই বলে রাখলাম, লেখাটা ফেসবুকে পোস্টিত হবে যেহেতু, আর এখানে বেশ কিছু এমন সব মানুষ আছেন যাদের অকুন্ঠ উদার প্রেমের অত্যাচারে মেসেঞ্জারে অনেক মহিলার কি যে করুণ অভিজ্ঞতা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের উদ্দেশ্যেই বলা।)       বইটা পড়তে ভীষণ যন্ত্রণা হবে। আপনি কাঁদবেন, গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করবে, বালিশে মুখ গুঁজে নিজের গোঙানির আওয়াজ হয়ত বা চেপে রাখতে চেষ্টা করবেন, তবু পড়বেন, শেষ অবধি পড়বেন, মেয়েটা পালাতে পেরেছিল এই আশ্বাসটুকু আগে থাকতে জানা বলেই পড়বেন। ধর্মের অপব্যাখ্যা শুনে শিউরে উঠবেন। তবু বিশ্বাস করতে চাইবেন মনুষ্যত্ব ছাপা অক্ষরের দায়ে বাঁচে না, বাঁচে নিজের জোরে প্রাণের আকুতিতে, বিশ্বজনীন বিধানের আলোতে।       আজ যদি এই বইটা বিদ্যাসাগর পড়তেন, মানে মুরাদের বইটা। আজ যদি প্রতিদিনের কাগজে মেয়েদের উপর অত্যাচারের কথা পড়তেন। কি হত? না, আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। আমরা কেউই কল্পনা করতে পারব না। কারণ আমাদের যে ওরকম একটা হৃদয় নেই। মানুষ তাই-ই চিন্তা করতে পারে যা সে অনুভবে সত্য বলে জানে। একজন অত্যন্ত ক্ষুদ্র অনুভবী মানুষ বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা ইত্যাদি নিয়ে বড় বড় কথা বুনতে পারে, জীবনে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না তার। যেমন একজন ফেসবুক মাদার টেরিজাসম মানুষ কথায় কথায় আমায় বলেছিলেন, “কতজন কাজের লোক পুষব”? এই পোষার অনুভবটা সত্যি, তাই ভাষাটা অমন আড়ম্বরহীন তার গলা থেকে উচ্চারিত হয়েছিল। তার নানা পোস্টের মত অত নরম কোমল কৃত্রিম ভাষার ব্যবহার করতে হয়নি তাকে। আমি থমকেছিলাম। নিরুত্তর ছিলাম কিছুক্ষণ।       ভারতে একটা কথার মাহাত্ম্য খুব – সৎসঙ্গ। শঙ্করাচার্যের লেখায় সেই সৎসঙ্গ আমাদের মুক্তি পর্যন্ত নাকি দিয়ে দিতে পারে। অনেকে বিশ্বাস করেন মহাপুরুষদের এই জীবনীচর্চায় আমাদের সেইরকম একটা কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদিও আমার বিশ্বাস হয় না, কারণ যে পরিমাণ মহাপুরুষ আমাদের দেশে এযাবৎকাল জন্মেছেন, তাদের সঙ্গগুণে খুব একটা পরিবর্তন কি বাঙালির ঘরের দেওয়াল ছাড়া বাঙালির জীবনে কিছু এসেছে? সেখানে নানা ছবির সম্ভার বেড়েছে এ সত্য বটে। “বাঙালি মণীষীদের জীবনী” বইগুলোর বপুও বেশ তৃপ্তিকর, সে নিয়েও কোনো ক্ষোভ রাখার জায়গা বিধাতা দেননি। কিন্তু তারপর?       আর রইল বাঙলা ভাষার কথা। সে তো ক্রমে অস্তাচলের দিকে এগুচ্ছে। সে নিয়ে মেলা আলোচনা হয়েছে, আর কিছু বলার নেই। তবে মানুষটার কাছে বেড়াতে গিয়ে কি নিয়ে আসবেন বলুনদিকি?       একটাই কথা বলব – সহানুভূতি। সহানুভূতির দু'শো বছর হয় না। এই একটাই শব্দটিকে নিয়েই নীতি-বিদ্যা যাই বলুন। আপনার বিশ্ববিদ্যালয় যত বড়ই হোক না কেন, আপনি যতই বিস্ময়কর ব্যতিক্রমী চিন্তা করে জগতে তাক লাগাতে সক্ষম হোন না কেন, আপনি যতই প্রগ্রেসিভ হয়ে ২০১৯ -এর এই এঁদো ভারতে বাস করে ৩০১৯ -এর মত চিন্তা করতে, বিধান দিতে সক্ষম হোন না কেন? কিস্যু হয় না ওতে, জাস্ট কিস্যু হয় না। কাগজের বানানো প্লেন কব্জীর জোরে উড়ে এই মাটিতেই গোঁত্তা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। আপনি দেখেও দেখেন না, আপনি তখন আরেকটা প্লেন ওড়াতে ব্যস্ত, কাগজের প্লেন।       মানুষের সব নীতি, সব ভালো কথা, সব উন্নতি এই একটা কথাতেই আটকে যায়, সহানুভূতি। যদি সেটিই না রইল তবে তো শুধুই বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ ট্যুরিস্ট স্পটই রইল, তাই না? আর এই ট্যুরিস্ট স্পটের সাথে ওই ট্যুরিস্ট স্পটের তুলনা করে ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধানো। ওতে কিস্যুটি হয় না। মনে রাখবেন মানুষটি বেঁচে থাকতেই আমাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে কার্মাটারে স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছিলেন সাঁওতাল গ্রামে গিয়ে। আজ দুশো বছর পর তিনি যে আবার বাবু হয়ে বসে আমাদের আদিখ্যেতার রকমসকম দেখবেন এমনটা আশা করাই যায় না। তাঁর স্বপ্নের শিক্ষিত বঙ্গ ললনাদের সারা সন্ধ্যে অসামান্য ঘটনা ও সংলাপ সজ্জিত সিরিয়াল ঘনঘটামুখী হয়ে থাকা, বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ের আহামরি শিক্ষানুকূল পরিবেশ ইত্যাদি ইত্যাদি দেখে, বলি মুষ্টিমেয় ব্যাতিক্রমী উদাহরণে কি প্রাণ জুড়াবে মানুষটার আজ এই দুশো বছর পরে তার বঙ্গ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে তাকিয়ে? জানি না।       তবু যদি নাগাল পাই, তবে কি চাইব বলুনদিকি? শুধু ওই উষ্ণ হৃদয়টার হাতমুঠো করে আনা পরশ। যেমন আরতির পর আঁচলে নেওয়া হয়। তারপর জাগিয়ে রাখতে চেষ্টা করা সেই তাপটা, যদ্দিন জাগিয়ে রাখা যায়।       "হে মহাজীবন, হে মহামরণ, লইনু শরণ, লইনু শরণ..."    
298
Mon, 09/16/2019 - 22:00

শুধুমাত্র নিজের জন্য যে ভাষার ব্যবহার করে, হয় সে পাগল, নইলে পরমহংস। পাগলের বাক্যের উদ্দেশ্য-বিধেয়, বক্তাশ্রোতা ভেদবুদ্ধি থাকে না, আর পরমহংস কথা বলেন অদৃশ্য, অশ্রুত, অস্পর্শিত, অঘ্রাণিত(?) অস্তিত্বের সাথে, মোটকথা আমাদের ধরাছোঁয়া তো দূরের কথা ভাবনাচিন্তারও বাইরে।
      বাকি মানুষ কথা বলে কেন? গর্ব করবে বলে? পরিচয় তৈরি করবে বলে? ধুর মশায়, এগুলো পরে এসেছে, গৌণ কথা। যেমন এককালে জামাকাপড় পরত লজ্জা নিবারণের জন্য, এখন স্টেটাস বড় কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাক, সে মেলা বড় আলোচনা। আমি হয়ত বিন্দুটা দাঁড় করিয়েছি... ঘাবড়ে গেলেন তো, মানে আরকি পয়েন্টটা রেজ করতে পেরেছি।
      তো ভাষা হল যোগাযোগ স্থাপনের মাধ্যম। তার বাইরে সবই শৌখিন। যেমন আপনি যখন পেটব্যাথায় কাতর তখন আপনার সামনের চিকিৎসক যে ভাষা বোঝেন আপনাকে সেই ভাষাতেই কথা বলতে হবে। আপনি সাহিত্যচর্চায় না থাকলেও আপনার জীবনে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না, কিন্তু দিনযাপনের জন্য ভাষার ব্যবহারটিই আসল --- এইটে মনে রাখতে হবে। যে কারণে আমার তাবড় তাবড় ভাবনাবিদদের চাইতে এডওয়ার্ড জেনার যে টীকা আবিষ্কার করেছিল তাকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়; জ্বরের ঘোরে সব বই ফেলে প্যারাসিটামল ৬৫০ সব চাইতে মূল্যবান আবিষ্কার বলে মনে হয়। তারপর যেই সুস্থ হই অমনি গৌণকে মূখ্য বলে চালিয়ে তর্কে নেমে পড়ি।
      মানুষ সেই ভাষাতেই কথা বলবে তার সামনের মানুষ যে ভাষাটা বোঝে, এবং সে নিজে বুঝিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে। ভাষা কারোর কথায় বাড়ে কমে বাঁচে না। তবে তাবড় তাবড় বিখ্যাত হলিউড সিনেমা হিন্দিতে দেখতে বঙ্গসন্তানেরা ছুটত না, যদিও তামিলেও ডাব হয় সেটা আমরা বুঝি না। দেখতে ছোটে, কারণ বাংলায় হয় না। বাণিজ্যিক কারণে শুধু? মনে হয় না। এরকম আরো মেলা উদাহরণ আছে। সে নিয়ে ভারি করে লাভ নেই মাথা।
      মোদ্দা কথা যেটা বুঝি, যে ভাষা তাগিদে বেরোয় তাই ভাষা। আর যা সচেতন হয়ে আত্মপরিচয়ের ঝাণ্ডা তুলে ব্যবহার করতে হয় তা শখ। মুশকিল হল সংসারে শখের চাইতে দায়ের জোর বেশি। প্রত্যক্ষ উদাহরণের চাইতে আইডিয়া-কল্পনা-ইচ্ছা- বাসনার তেজ বেশিদিন টেকে না। গলা চড়ালেই যদি সত্য টাল খেত তবে তো হয়েই যেত।
      মানুষ যা বলে তাই ভাষা। যা ছাপে তাই না। তবে তো সংস্কৃত বইও লক্ষ লক্ষ ছাপা হচ্ছে। তো? ভাষা মুখে হাঁটে। সেই পরে ছাপায় আসে। তাই ইংরাজি হরফে সহজপাঠ ছাপা হচ্ছে। কারণ কথায় ওই ভাষা দুটো এগিয়ে যে। ভাষা বাঁচে শ্বাসে, ছাপাখানার কালিতে নয়। এটা বুঝলে দুটো লাভ। ভাষা নিয়ে কৌলিন্যবোধটা যাবে, আর এর-তার চোখ রাঙানিতে হাসি পাবে। "রইল বলে রাখলে কারে...."

299
Sun, 09/08/2019 - 23:00

           বিনয়ী মানুষেরা হয় দুষ্টু মানুষ, নয় মহাপুরুষ হয়। আজ যেমন চারদিকে বিনয়ী মানুষ দেখা যাচ্ছে তাতে বোধ হচ্ছে বিনয় এখন সারভাইভাল স্ট্র্যাটেজি। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন না, এ বলা চলে সামাজিক নির্বাচন – ইয়েস ম্যান (এখানে 'ম্যান' অর্থে সব লিঙ্গ'র কথা হচ্ছে কিন্তু, আমাকে কেউ আবার লিঙ্গবৈষম্যকারী ঠাওরিয়েন না।)। চালাক মানুষ, শয়তান মানুষ, দুষ্টু মানুষ – সবাই বিনয়ী। আগেকার ভিলেনদের মত কেউ জগত কাঁপিয়ে 'হা হা হা' করে হাসেন না। তারা মিষ্টি হাসেন। মিষ্টি করে কথা বলেন। কারণ বিনয় এখন বেস্ট স্ট্র্যাটেজি। কারণ এটা সেলসের যুগ। আপনাকে বিকোতে হবে। বিকোতে গেলে অবশ্যই আপনাকে বিনয়ী হতে হবে। গালাগাল খেয়ে হাত কচলাতে হবে। সত্য-মিথ্যা বলে কোনো শব্দ এই নতুন শতাব্দীতে আমরা বিশ্বাস করি না, তাই এখন তাকে সরিয়ে নতুন শব্দমালা – ইউজফুল গার্বেজ। মিথ্যা যদি 'ইউজফুল' হবে তবে আমায় তাই-ই সত্য হিসাবে মেনে নিতে হবে, পরম সত্যও যদি অকাজের হয় তবে নির্মম হয়ে তাকে তাড়াতে হবে।
      বিনয় তিন প্রকার – সুগন্ধী বিনয়, কেঠো বিনয়, ভ্যাদভেদে বিনয়।


১)সুগন্ধী বিনয়
----------------------
      মহাপুরুষোচিত। কেমন ব্যাখ্যা করা যাক। সাচ্চা বিনয়ের সাথে যেটা আসে সেটা হল 'অক্ষুব্ধতা'। জানিনা এমন বাংলা হয় কিনা। ‘চৈতন্যচরিতামৃত’তে একটা চমৎকার কথা আছে, “কৃষ্ণভক্ত সদা শান্ত”, কেন? না “প্রাকৃত ক্ষোভে তার ক্ষোভ নাহি হয়”। অর্থাৎ এ বিনয় অত্যন্ত দুর্লভ। মহাপুরুষদের জীবনীতে পড়েছি। এখানে 'মহাপুরুষ' শব্দটা একটু বলে নিই। 'মহাপুরুষ' শব্দটা আমার কাছে হল, যে একক সত্তার মধ্যে অনেক ক্ষুদ্রসত্তা দিশা পায়। এরা তাড়িয়ে নিয়েও বেড়ায় না, চালিয়ে নিয়েও বেড়ায় না, এরা জাগিয়ে নিয়ে সাথে ফেরে। এদের মধ্যে জন্ম থেকেই এক স্বর্গীয় আনন্দ। যে আনন্দে মশগুল থেকেই বিজ্ঞান, দর্শন, সমাজ, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি নানা সাধনায় আত্মমগ্ন হওয়া যায়। কারণ সংসারে একে অন্যকে মগ্ন করে মানে অন্যকে চুবিয়ে নিজেকে উঁচিয়ে রাখতে চায়। সব চাইতে কঠিন কাজ যে নিজেকে ডোবানো, সেই কঠিন 'আমি'টাকে নিয়ে মানুষ নাজেহাল। একবার গুরুর পায়ে দেয়, একবার নেতার পায়ে দেয়, একবার শুঁড়িখানার পায়ে দেয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এই 'আমি'টা অনেকটা সেই পিঠের নির্দিষ্ট জায়গার মত যেখানে নিজে গিয়ে চুলকানো যায় না। কারোর সাহায্য ছাড়া সে স্থানে গিয়ে অহমিকাকুণ্ডয়ন তৃপ্তি অসম্ভব।
কিন্তু মহাপুরুষগোছের মানুষদের কথা আলাদা। এ ধরণের মানুষদের অক্ষুব্ধ চেতনা মনকে প্রসন্নতা দেয়। ভাগবত বলেন যাকে দেখলে মন প্রসন্ন হয়, পবিত্র হয় সেই সাধু। বুঝলেন তো, এ সেই গেরুয়া কেস নয় কিন্তু। নিতান্ত পরীক্ষামূলক কথা। এমন অক্ষুব্ধ, আত্মমগ্ন মানুষ ছাড়া সত্যি বলতে বিনয় আর কোনো স্থলে নেই। কারণ এনারা জানেনই না এনারা কি।
      নীৎজেকে নিয়ে লিখতে গিয়ে রাসেল তার অমর গ্রন্থ 'পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস'-এ রীতিমত বকাঝকা করেছেন নীৎজেকে। এত তোমার কিসের সিনিকের কথা বাপু? যেন দুনিয়ায় একটা বিন-মতলবী ভালো মানুষ নেই, প্রেম নেই, শুধুমাত্র কিছু অত্যন্ত লোভী, ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের গপ্পো দিয়েই যেন জগৎ ভরা!
বাপরে, এই সব কথা বলে, শেষে কি বলছেন শুনবেন? টুকে দিই দাঁড়ান। বুদ্ধকে নীৎজের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কথা বলা হচ্ছে। অ্যাঁ! বুদ্ধ কেন? আরে বুদ্ধও শূন্যবাদ, অনীশ্বরবাদের কথা বলেছিলেন কিনা, তাই। তো কথাটা হচ্ছে, তিনি লিখছেন, মানে বার্ট্রান্ড রাসেল লিখছেন,
      “Buddha replies, ’because you love pain and your love of life is a sham. But those who really love life would be happy as no one can be happy in the world as it is’.
      For my part, I agree with Buddha as I have imagined him. But I do not know to prove that he is right by any arguments such as can be used in a mathematical or a scientific question. I dislike Nietzsche becasue he likes the contempaltions of pain, because he erects conceit into a duty, because the men whom he most admires are conquerors, whose glory is cleverness in causing men to die. But I think the ultimate argument against his philosophy, as against any unpleasent but internally self-consistent ethic, lies not in an appeal to facts, but in an appeal to the emotions. Nietzsche despises universal love; I feel it the motive power to all that I desire as regards the world. His followers have had their innings, but we may hope that it is coming rapidly to an end.”
      তেমন তেমন মহৎমানুষ আমি দেখেছি। কোনো কারণ নেই সুখী হওয়ার, তবু তার মনে বিন্দুমাত্র ক্ষোভ নেইকো। সত্যি বলতে হিংসা হয়েছে। এমন সচেতন সৃষ্টিশীল জীবন আর কি হতে পারে? সৃষ্টি কি শুধু লেখা, মূর্তিগড়া, লেকচার দেওয়া, আরো ইয়ে ইয়ে সব? না তো। সব চাইতে মধুর সৃষ্টি এমন একটা জীবনচর্যা। সেকি আর চাইলেই হয় গা, অনেক জন্মের পুন্যি লাগে, লোকে বলে। সেই হল গিয়ে সুগন্ধী বিনয়ী মানুষ।


২) কেঠো বিনয়
-----------------------
      এ খুব কঠিন বিনয়। এরা সত্যের প্রতি বিনীত। প্রচণ্ড বিনীত। কথা বললেই বোঝা যায়, বিনয় তপ্ত, ফুটছে। হুলের মত বিনয়। “আমি সত্য ছাড়া বলি নে”, ঔদ্ধত্যের মত বিনয়। ভাবটা এই, সত্যের প্রতি আমার আনুগত্যে অপারগ হয়েই বলছি, আর কোনো কারণ নেই। এই আনুগত্যের মূলেও একটা অতৃপ্তি, ক্ষোভ। কোথাও ঈর্ষা।
      সত্য – শব্দটা অনেক সময় রূঢ় কিন্তু নিষ্ঠুর নয়। এই রূঢ়তা আর নিষ্ঠুরতার মধ্যে যে পার্থক্য সে মনের প্রসন্নতার। শিক্ষক যখন অত্যন্ত অবাধ্য ছাত্রকে শাস্তি দেওয়ার জন্য রূঢ় হন, সে রূঢ়তা তার নিজের চিত্তের সাম্য ও প্রসন্নতা বিঘ্নের কারণ হয় না। কষ্টের কারণ হয় বইকি। তাই "দণ্ডিতের সাথে / দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে / সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার"। কিন্তু সে সত্য উচ্চারিত হতে গেলে চিত্তের যে মৈত্রীবোধ জন্মাতে হয় সে যদি না থাকে? তবে শুধুই আক্রোশ।
      আক্রোশ, ঘৃণা, অপছন্দ – এই শব্দগুলো আবেগের। বড্ড একপেশে। আমাদের রাজনীতির আলোচনায় দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই "যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা" গোছের মানসিকতাজাত মন্তব্যে ছয়লাপ।
      বিনয় বুদ্ধিজাত। বুদ্ধি যখন বোধের সীমাকে পরিমাপ করতে পারে না, কিন্তু তার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়, তখন তার মধ্যে যে বিস্ময়জনিত রূপ সৃষ্টি হয়, তাই বিনয়। বিনয় আর বিস্ময় একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারে না। যেমন কপট বিনয়ের সাথে ক্ষুব্ধতা বা ঈর্ষা বা মতলব না এসে পারে না।


৩) ভ্যাদভেদে বিনয়
---------------------------
      এর দুই ভাগ আবার। এক, মতলবীর ভ্যাদভেদে বিনয়, আর দুই, ঈর্ষাপীড়িত ক্ষুব্ধাত্মার ভ্যাদভেদে বিনয়। একজন মতলবী, অর্থাৎ তেলু, দ্বিতীয়জন ক্ষুব্ধ, অর্থাৎ ঘ্যানঘেনে।
      “তোমাদের কতবড় ক্ষেত গো, তোমাদের গাছে কত সীম হয়েছে গো, আমাদের কথা ছাড়ো, আমরা কি আর সেই ভাগ্য করেছি”... কিম্বা... ”এই গরীবের বাড়িতে আপনার পা পড়েছে... আমি আর কি, আপনিই সব।
      এ ধূর্তামি আর চালাকি। শ্রদ্ধা নেই, বিস্ময় নেই, প্রসন্নতা নেই। ঔদ্ধত্য আছে, উন্নাসিকতা আছে, চূড়ান্ত আত্মতৃপ্তির সুর আছে। সাথে বিনয়ের মোড়ক। এই বিনয় বিষ। এই নিয়ে আর কি লেখার, আজ রাজনীতি থেকে ধর্মনীতি, স্কুল-কলেজ, বাড়ি-ক্লাব এই বিনয়ের গুঁতোয় অস্থির। একেই ভদ্রতা বলে আজকাল। যেন এই সাধনা, কতটা রপ্ত করতে পারলাম তার উপর আমার চলনশীল হয়ে ওঠা সমাজে।

      স্পিনোজা 'বিনয়' শব্দটাকে খুব একটা পছন্দ করতেন না। ওনার মতে বিনয় হল গিয়ে 'pain accompanied by the idea of our weaknesses, is called humility.' সেই ভালো। অন্তত বিনয়ের অভিনয়ের চাইতে চুপ থাকা ভালো। দুর্বিনীত হওয়াটাই যে কাজের কথা তাও নয়। মাঝে একটা জায়গা আছে নাক না গলানো, মানে চুপ করে থাকা সেই নিয়ে যদিও আমার তেমন কোনো বক্তব্য নেই। কিন্তু মনের মধ্যে যতক্ষণ ক্ষোভজাত অশান্তি, ততক্ষণ আমার যে এই মধ্যস্থানে দাঁড়ানো অসম্ভব, আমায় যে একটা ঘোঁট পাকাতেই হবে। যে মানুষ কোনো একজায়গায় স্থির, সৎ, স্বচ্ছ সে-ই অমন করে কাঁদতে পারে, যা সারা পৃথিবী ISRO-তে প্রত্যক্ষ করল। এ কান্না সত্য কান্না। প্রাণের কান্না, চেতনার কান্না। কোনো মিথ্যা প্রবোধে নিজেকে ভোলানো নয়।
      মিথ্যা সেইটাই যখন দেখছিলাম একই চন্দ্রযানের ঘটনায় সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে প্রধানমন্ত্রীর স্বপক্ষে আর বিপক্ষে পোস্টের ঢেউ। অর্থাৎ আমরা মিথ্যার বেসাতিকেই আমাদের ক্ষুরধার বুদ্ধির উপজীব্য বানিয়ে নিয়েছি। আমার পরিচয় হয় আমার বিরোধীতায় নয় চাটুকারিতায়। লাগাতার বিরোধিতা আর লাগাতার চাটুকারিতা ঔদ্ধত্য আর কপট বিনয়ের নামান্তর। সে আমি সমর্পিত প্রাণ কম্যুনিস্ট হই কি ভগবানিস্ট, সমস্যা একই, "গাড়ি চলে না, চলে না, চলে না রে... গাড়ি চলে না।"

300
Wed, 09/04/2019 - 21:00

অস্তিত্ববাদের দুই পুরোধা – সার্ত্রে আর কাম্যু। ধরা যাক ওদিকে সার্ত্রের 'নসিয়া', 'বিইং অ্যাণ্ড নাথিংনেস'; আর এদিকে কাম্যুর 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস', 'স্ট্রেঞ্জার' ও 'রিবেল'।

      যখন এই অস্তিত্ববাদকে খুব কাছ থেকে দেখছি, তখন আদতে শেষে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছি কি? সার্ত্রের শেষে কোথাও একটা ভাগ্যের কাছে নতিস্বীকার, চূড়ান্তভাবে মেনে নেওয়া। কাম্যুর 'দ্য মিথ অফ সিসিফাস'-এ লড়াই করার কথা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে, সমস্ত প্যাশন দিয়ে।
      আমি জানি না এই দুইজন মানুষ জে কৃষ্ণমূর্তি পড়েছেন বা শুনেছেন কি না। জে কৃষ্ণমূর্তিকে পড়া বা শোনা বিচিত্র কিছু নয় কারণ এনারা প্রায় সমসাময়িক। কিন্তু মনে হয় না, কারণ এনাদের লেখায় তার সেরকম কোনো প্রতিফলন নেই।
      তবু কাম্যু ও সার্ত্রের মধ্যে একটা ইউটোপিয়া আছে। সব দর্শনের শেষেই হয়ত তাই আছে। মানুষ তত্ত্বে যা বোঝে জীবনে তা অনুদিত করতে পারে কই? নইলে এ যাবৎ যত তত্ত্ব আলোচনা হয়েছে মানুষের গভীরে তার প্রভাব কতটুকু? গীতাতে যখন বলা হচ্ছে যে 'যখন যখনই ধর্মের গ্লানি উপস্থিত হয় তখন তখনই আমি আসি', তখন এই কথাটাও বুঝতে পারি যে, আমরা যত মহান তত্ত্বের দর্শনই পাই না কেন, আদতে তা হারিয়ে যাবে, আবার বর্বরতা নিষ্ঠুরতা পাশবিকতা আমাদের গ্রাস করবেই করবে।
      কোনো মানুষের পক্ষে চূড়ান্ত ভালো, চূড়ান্ত সত্যকে জানা সম্ভব নয়। তবু সে জানতে চাইবে এ-ও সত্য কথা। জীবনের একটা মানে সে খুঁজতে চাইবে। সমাজের নানা নিয়ম, ধর্মের নানা তত্ত্ব সে একটা সময় ছেড়ে দাঁড়াবে, একটা মানে খুঁজতে চাইবে। কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে বলবে, এই সব পুরোনো খেলা আমি আর খেলব না, বড্ড অন্তঃসারশূন্য যেন, আমায় সত্যি সত্যি জীবনের একটা মানে খুঁজে বার করতে হবে। সত্যটাকে জানতে হবে।


      একদম গোড়ার কথা দিয়ে শুরু করা যাক। প্রথম কথা, ঈশ্বর আছে? এর সোজা সহজ উত্তর হল, হ্যাঁ আছে। ঈশ্বরের সংজ্ঞা বদলাবে, ঈশ্বরের নীতি নিয়ে জল্পনা-কল্পনা বদলাবে, কিন্তু ঈশ্বর বদলাবে না। কারণ ঈশ্বরের কতগুলো সমার্থক শব্দ আছে – রহস্যময়তা, উদারতা, শুভময়তা, আনন্দময়তা, সৃষ্টিময়তা, তন্ময়তা। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এই প্রতিটা শব্দের পিছনে “কেন” শব্দটা অর্থহীন। প্রতিটা শব্দ স্বয়ংসম্পূর্ণ। কেন রহস্যময়তা? উত্তর নেই, রহস্য আছে। কেন উদারতা? উত্তর নেই, উদারতা আছে। এইভাবে সবক'টা শব্দের কোনো “কেন” হয় না। মানুষ যেখানে এই ‘কেন’ শব্দ থেকে ত্রাণ পায় সেইখানে সে মুক্ত হয়। সে তখন যা আছে তাতেই মগ্ন হয়। আমার আশ্চর্য লাগে যখন দেখি সত্যান্বেষী দু'জন সাধক ভূখণ্ডের দুই প্রান্তে দুই সময়ে থেকে একই সত্যে এসে উপনীত হচ্ছেন।

      বিবেকানন্দ যখন জিজ্ঞাসা করছেন পাওহারি বাবাকে যে, জীবনযাপনের মূলসূত্র কি? পাওহারী বাবা বলছেন, 'যন সাধন তন সিদ্ধি', অর্থাৎ যাই সাধন তাই সিদ্ধি। আর বহু আগে কান্ট তাঁর নৈতিক দর্শন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, End theory, অর্থাৎ প্রতিটি কাজের উদ্দেশ্য আর উপায় যেন এক হয়। কোনো মানুষ যেন কিছুর উপায় না হয় তোমার, সে নিজেই যেন উদ্দেশ্য হয়। শুধু মানুষ নয়, তিনি বলছেন এই হল বিশ্বের বিধান যে উদ্দেশ্য ও উপায়কে এক হতে হবে। আমি যদি গান গাইছি, সে গান গাওয়ার উদ্দেশ্য যখন শুধুমাত্র আমার গান গাওয়াই হবে তখন সেই গানের মাধ্যমে আমি মুক্ত। কিন্ত যদি হাততালি হয় তবে আমি ব্যর্থ। প্রতিটা কাজকেই যেন তাতেই সম্পূর্ণ দেখি। মহাত্মা বলছেন যে উদ্দেশ্যের চাইতে উপায় আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কোনো সৎ উদ্দেশ্যে যেন অসৎ উপায় না নিই। এ মত রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে অনেকেরই, যা উদ্দেশ্য তাই যেন উপায় হয়।
      জে কৃষ্ণমূর্তির শিক্ষায় যখন 'Observer' আর 'Observed' এক হয়ে যায় তখন সত্য নিজেকে প্রকাশ করে। তার প্রধান কথা হচ্ছে সমগ্র মনের এক কেন্দ্রে আসা, যা একাগ্রতা বললে ভুল হয়, যা হল বুদ্ধের ভাষায় Mindfulness, সাধারণ কথায় ঐকান্তিক মনযোগের অবস্থা। আমি যখন খুব attentive কোনো বিষয়ে তখন সেই মুহূর্তে আমার সমগ্র সত্তার মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমি চূড়ান্ত সুখের, আনন্দের অনুভব তখন আপনিই পাই।
      তবে কোন ঈশ্বর বাদ যাচ্ছে? ব্যক্তি ঈশ্বর। যে ঈশ্বর আবেগপ্রবণ। যে ঈশ্বর নানা ইন্দ্রিয়াভাসে আমাদের সামনে নানা রূপে বারবার উদ্ভাসিত। সে ঈশ্বর বাদ যাচ্ছে। থেকে যাচ্ছে নৈর্ব্যক্তিক সত্তা – যা আনন্দ, যা রহস্য, যা শুভ, যা উদার। এই অনুভবগুলোকেই নাস্তিক ও আস্তিক নানা মতে নানা আচ্ছাদনে সমাজে কায়েম করতে চাইছে যুগযুগ ধরে। সবাই চাইছে মানুষ তথা সমাজ উদার হোক, সুখী হোক, নীরোগ হোক, শুভময় হোক। বিষাদকে নিয়ে নাড়াঘাঁটা এক বিলাস। সে নিয়ে বহু সাহিত্য দর্শন কাব্য হয়েছে, কিন্তু ধোপে টেকেনি।
      তার কারণ মানুষের জীবনের মূল কথা নিজের মধ্যে সংহতি স্থাপন। যে নিজের মধ্যে রাসেলের ভাষায় বিলিয়ার্ড বোর্ডের মত এ গুলি সে গুলি'র ধাক্কায় জর্জরিত হয়ে আছে সে কি করে বিষাদমুক্ত হবে? সে তো থেকে থেকে, দিনে দিনে, মাসে মাসে নিজেকে নিয়ে নাজেহাল হয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রধান ও প্রথম কথা হল নিজের মধ্যে সেই সংহতি স্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে। যদি জিজ্ঞাসা করি কি করে? তবে সপাটে উত্তর আসবে অ্যারিস্টটল থেকে জে কৃষ্ণমূর্তির – সংহতি স্থাপনের মধ্যে দিয়েই। যেমন বাড়ি বানাতে বানাতে মানুষ স্থপতিকার হয়, যেমন রেওয়াজ করতে করতে মানুষ গাইয়ে হয়, এও তেমন।
      আসলে প্রাচ্যের পক্ষে নাস্তিক হওয়ার জো নেই। কারণ বুদ্ধ সে পথ অনেক আগেই হেঁটেছেন। সাংখ্য অনেক আগে সে ব্যাখ্যা করেছে। আত্মা, জন্মান্তর ইত্যাদি না মানলেও বাকি যা পড়ে থাকে সেই আসল। সে কোনো মেটাফিজিক্সের কথা নয়, সে আদতে নিজের মধ্যে এই সামঞ্জস্য গড়ে তোলার কথা। পাশ্চাত্যে ধর্মের বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হয়েছে সে প্রধানত খ্রীষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠিত ভাব-আচার-শিক্ষাকে কেন্দ্র করে। আমাদের তো সে দায় নেই। এত বিচিত্র দর্শন, এত উদার ঈশ্বরের চর্চা তো আর কোনো ভূখণ্ডে হয়নি। তাই আমাদের নাস্তিকতা যখন ওদের অনুকরণে কোনো বিশেষ একটা মতের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া হয় তখন আমার হাসি পায়। মনে হয় এখানে অনুকরণের ঝাঁঝটা যত তীব্র সত্যকে আলিঙ্গন করার আন্তরিকতাটা তত খাঁটি নয়।
      ক'দিন আগে কথা হচ্ছিল আমাদের বন্ধু মহলে, সেই কথাটা দিয়েই শেষ করি। আস্তিকবাদের সমস্ত দর্শন শুরু হচ্ছে একটা কথা দিয়ে – ঈশ্বর আছে। আর বুদ্ধের সমস্ত দর্শন শুরু হচ্ছে একটাই কথা দিয়ে – দুঃখ আছে।
      জীবন বলল, দুই সত্য। ঈশ্বর আর দুঃখ একই কথা। কি করে? আমি যে দার্শনিককে হয়ত প্রাণের শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছি, সেই স্পিনোজার কথা দিয়েই শেষ করি। তিনি বলছেন, ঈশ্বর অনন্ত সত্তারই আরেক নাম। তোমার সান্ত সত্তা যখন সেই অনন্ত সত্তার দিকে তাকাচ্ছে, সে অনন্তকে অনুভব করতে চাইছে জ্ঞানে, প্রেমে, সে তখন দুঃখ বৈকি। তবে সে দুঃখ দুর্বলের জন্য নয়। উপনিষদ বলছেন, 'নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য।' অনন্তকে অনুভব দুর্বলের সাধ্য নয়। তবে উপায়? সেই সংহতি স্থাপন নিজের মধ্যে। তবেই সেই পরম উদারতা, পরম শুভময়তা, পরম শান্তি আমায় ঘিরে নেবে, আমায় সার্থক করবে।


    যে ধ্রুবপদ দিয়েছ বাঁধি বিশ্বতানে

        মিলাব তাই জীবনগানে ॥
গগনে তব বিমল নীল-- হৃদয়ে লব তাহারি মিল,
        শান্তিময়ী গভীর বাণী নীরব প্রাণে ॥
        বাজায় উষা নিশীথকুলে যে গীতভাষা
        সে ধ্বনি নিয়ে জাগিবে মোর নবীন আশা।
ফুলের মতো সহজ সুরে প্রভাতে মম উঠিবে পূরে,
        সন্ধ্যা মম সে সুরে যেন মরিতে জানে ॥

301
Tue, 09/03/2019 - 19:00

শব্দের দায়িত্ব কি? শব্দ থেকে বাক্য। বাক্য জুড়ে চিন্তার ভাষা। চিন্তা-ভাবনা-কল্পনা কেন? আত্মতোষণ, রাজশক্তি তোষণ, জনপ্রিয় মতামত তোষণ, প্রচলিত ধারণা-বিশ্বাস তোষণ?
      যুক্তি কার উপর দাঁড়িয়ে? কান্টের মতে যুক্তি শুধু অভিজ্ঞতা নির্ভর নয়, মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বজনীন উদার যুক্তির সপক্ষে ‘হাঁ’ থাকে। ক্যাটাগরিকাল ইম্পারেটিভ। কিন্তু আমি কি একটা কঠিন তত্ত্ব আওড়াতে লিখতে বসলাম? না তো।
      আমি লিখতে বসলাম শব্দের ধারভার বোঝার জন্য। আমি লিখতে বসলাম, আমি কিভাবে লিখব সেটা খোঁজার জন্য। আমাদের অস্তিত্বের একটা জৈবিক দিক আছে আরেকটা বৌদ্ধিক দিক আছে। আবেগকে আমি বৌদ্ধিক স্তরের প্রজা হিসাবেই দেখি, তার শক্তি আছে কিন্তু দিশা নেই। বুদ্ধি বলতে আমি প্রজ্ঞা-স্বজ্ঞা মিলিত মানুষের যুক্তি আলোকিত অস্তিত্বটির কথা বলছি।


      যুক্তির এক ধরণের কাজের ধারায় আসে কার্য-কারণ সূত্র ধরে সত্যের অন্বেষণ। অবশ্যই ডেভিড হিউমের হতাশার কারণ আছে, কারণ সেই পথে আমরা বেশি দূর এগোতে পারি না। কিছুদূর এগিয়ে সব ঝাপসা। তবে কার্যকারণ পথের বাইরে আরেক ধারার অন্বেষণে মানুষ শুধু নিজের যুক্তিকে মন্থন করে সত্যের আলোর উৎসের খোঁজ পেয়েছে, সেও আছে। বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত সূত্রের একটা বড় অংশ আমাদের যুক্তির মন্থনে। বাহ্যিক ঘটনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্দীপক মাত্র। বিজ্ঞানের গতিপথ যত সূক্ষ্ম, যত গভীর, তার বাহ্যিক নির্ভরশীলতা তত কম, সে তত বেশি সফিস্টেকেটেড।
      মানুষের অস্তিত্বের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে যুক্তি আর জৈবিক স্তরের মধ্যে সুখের অন্বেষণ। অন্য অর্থে মানুষ সেখানে স্বেচ্ছাবন্দী। তার জৈবিক প্রয়োজন অর্থাৎ ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আচ্ছাদন, আবাস, কাম ইত্যাদির প্রয়োজন মিটে গেলে সে তখন নানা আবেগজাত সুখে ব্যস্ত। সে জগতে স্বল্প বৌদ্ধিক, যুক্তির আনাগোনা থাকে, কিন্তু সেখানে সুখটাই প্রধান কথা। আমি যখন দাবার ছক সাজিয়ে বসছি, বা একটা উপন্যাস কি গল্প লিখছি, বা পড়ছি, বা একটা ছবি আঁকছি, দেখছি বা তর্কযুদ্ধে নেমেছি, সে সবই মনের আবেগের রাজ্যে সুখের বোধ আমায় চালিত করছে। বুদ্ধি সেখানে আজ্ঞাবাহকের ভূমিকায়। সুখ কর্তা। সুখের কোনো কর্তব্যবোধ নেই। তাই তর্কে আত্মপ্রতিষ্ঠার সুখ, সাহিত্যে নানা চরিত্রের মধ্যে, নানা ঘটনাপঞ্জীর মধ্যে, নানা ভাবে সত্যকে বিকৃত, পীড়িত করে সেই সুখের আমোদে সে ঘুরে ফিরছে। এ সুখ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, বাজারি বৌদ্ধিক-তর্জা ইত্যাদিতে আমাদের নানাভাবে মোহিত করে রেখে যাচ্ছে, কিন্তু নির্মোহ নির্মম সত্যের আলোর কাছাকাছি আনার কোনো দায় তার নেই।
      আমরা সেই সময় দিয়ে এগোচ্ছি যখন বুদ্ধি, তার স্বজ্ঞা-প্রজ্ঞা সমস্ত জলাঞ্জলি দিয়ে তার সৃষ্টির মূলে যে স্বার্থহীন কর্তব্যের তাড়না তা ভুলে আবেগের যাদুকাঠিতে, বা তার নিজের নিম্মস্তরের অস্তিত্বের স্ব-সম্মোহনে দিশাহীন ছুটে চলেছে।
যে কর্তব্যের কথা বললাম, সে কার প্রতি কর্তব্য? এর উত্তর সোজা, কিন্তু কঠিন, কর্তব্যের প্রতিই কর্তব্য। বারবার আলোচনায় আসছে সারা পৃথিবী জুড়ে আজ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি তথা, মৌলবাদী শক্তির আবির্ভাব। আমাদের বারবার বিস্ময় জাগছে কেন হচ্ছে? কিন্তু হবে না-ই বা কেন? মানুষের নানা বিভ্রমের হাত থেকে মানুষকে যারা বৌদ্ধিক স্তরে, চেতনার স্তরে জাগতে বলেছেন, তারা বারবার রাজরোষে পড়েছেন, সেদিনের সক্রেটিস, ব্রুনো হোক কি আমাদের এখনকার গৌরী লঙ্কেশ থেকে রোমিলা থাপার। রাজনীতি আর ধর্মনীতির সব চাইতে বড় শক্তি হল তার জনগণের উপর প্রভাব। তবে কি জনগণ বোকা? বোকা না বিভ্রান্ত, সংখ্যাগরিষ্ঠতাক্রান্ত। তাই আজও সামান্য সিনেমা দেখতে যাওয়ার আগে IMDB, Rotten Tomato-র rating-এর উপর নির্ভর করতে হয়। জনগণের রায়কে ধ্রুব জেনে শাসক সত্যের ঘোড়ায় লাগাম পরান।
      মিথ্যাকে চেনা সোজা, ভ্রান্তিকে চিনতে গেলে প্রজ্ঞা লাগে। প্রজ্ঞার দিকে মানুষ তখনই তাকায় যখন সে নিজের বুদ্ধি-বিবেকের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, দায়বদ্ধ। কিন্তু জনসাধারণের সে দায় নেই। কোনোদিনই ছিল না। তারা যখন বিপ্লব করে, তখন বুঝতে হবে কোন মানুষ তাদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
      সেই প্রভাবকের আবার প্রকার আছে। কেউ মানুষকে মানুষ দেখেন, কেউ প্রজা। কেউ সবার ঘরে আলোর ব্যবস্থা করতে চান, কেউ একটা বড় মশালের আলোর নীচে সবাইকে চান জড়ো করতে। মাঝে মাঝেই ভয় দেখান মশাল নিভিয়ে দেওয়ার। অগত্যা সবাই মশালের অনুগত হয়ে যায়। কেউ ঘরে আলো জ্বালতে গেলেই তখন জনতাই 'রে রে' করে তেড়ে যান, পাছে মশালটা নিভিয়ে দেয় রাজা। সংবাদপত্র, সিনেমা, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য --- সবাই সেই মশালের অনুগত তখন। মশালের উষ্ণতা, মশালের আলো, মশালের গর্ব, মশালের স্নেহ এমন মায়াময় একটা সোনার শৃঙ্খল তৈরি করে ফেলে যে তাকে ছিঁড়ে ফেলতে চাওয়া অনৈতিক বলে বোধ হয়, বেইমানি বলে বোধ হয়। আর বোধটাকে সার্থকভাবে জাগিয়ে দেওয়াই রাজার সফলতা। তখন প্রজাদের এক স্তর তৈরি হয় যারা রাজার অনুচর, উপরাজা। তাদের শাসন আরো তীক্ষ্ম, আরো স্থূল, আরো শক্তির প্রদর্শন।
      আর যে মানুষ প্রতি ঘরে আলো জ্বালবার কথা বলে? সে সার্বজনীন বিধানে বিশ্বাসী। সে বিধানের শক্তিতে একজন ভিখারিকে স্টেশানে বসে নিজের খাবারের অংশ কুকুরদের সাথে ভাগ করে নিতে দেখা যায়, নিজেকে অভুক্ত রেখেও নিজের শিশুকে খাবার জুগিয়ে যায়। এর ব্যতিক্রমও আছে, ব্যতিক্রম হিসাবেই আছে। তাই থাকবেও।

      এমন মানুষ কেউ কেউ আসেন যারা মানুষকে সেই সার্বজনীন বিশ্বাসের মধ্যে নিয়ে আসার ব্রত নেন, তারা যুগে যুগে ব্যর্থ হন। সেই ব্যর্থতা সাময়িক নিরিখে। কিন্তু চিরকালের স্রোতে তাদের কাজ নিঃশব্দে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ একটা চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে লিখছেন যে মননের জগতে তিনি মহাত্মার সাথে অনেক ক্ষেত্রে ভিন্নমত পোষণ করেন, তিনি স্বয়ং কাজের জগতে এলে হয়ত অন্যভাবে কাজ করতেন, কিন্তু তিনি বলেছেন যে তার সে প্রভাব নেই জনমানসে, যা মহাত্মা ও সুভাষের আছে। সেই চিঠিতে তিনি তাই সুভাষ ও মহাত্মার উপর আস্থা রাখার কথা বলছেন, পাশাপাশি এও বলছেন, সামনে আরো অনেক অনেক ঘাট আছে, আরো নতুন নতুন মাঝির আবির্ভাবও হবে। কিন্তু আমরা যেন অন্ধভক্তের মত "এই শেষ ঘাট" বলে বসে না পড়ি। রবীন্দ্রনাথ এইখানেই আমাদের মুক্ত করেন তথ্যের শিকল খুলে বোধের স্রোত এগিয়ে দিতে।
      আসলে সত্য তো ব্যক্তির উপর নির্ভর করে না, সে স্বয়ংবেদ্য, স্বয়ংম্ভূ। ব্যক্তিবিশেষের সীমাবদ্ধতায় সে সত্য বিকৃত হয়নি তা নয়, কিন্তু সেই মানুষের সাধারণের প্রতি কর্তব্যপরায়ণতার গতির সামনে বারবার ইতিহাস মাথা নীচু করেছে। সেই সময়ের সীমাবদ্ধতা, সেই মানুষের চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলেছে হয়ত, কিন্তু তবু সে কোথাও সত্যের কিছুটা অংশকে নিজের চেতনায় প্রতিফলিত করতে তো পেরেছেন! বিজ্ঞান ও দর্শন এই পথেই ধাপে ধাপে এগিয়ে এসেছে। চূড়ান্ত সে কাউকেই বলেনি। কিন্তু সার্বজনীন সূত্রকে মেনে নিয়েছে।

      যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, বুদ্ধির আহরণের পথ। বুদ্ধির প্রতি নিঃশর্ত কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্কল্প। সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গেলে মতের সৃষ্টি হয়, পরে নিজেই যা একটা কারাগার হয়ে পড়ে। ভ্রান্তির কুয়াশার প্রতি নির্মোহ নির্মম হতে পারাই সত্যের শ্রেষ্ঠ উপাসনা। বর্ণাশ্রম, ওঝা, জ্যোতিষী, ধর্মীয় মৌলবাদ ইত্যাদি রোগের কারণ নয়, উপসর্গ। এ রোগাদির কারণ মোহ। ভ্রান্তিকে সত্য বলে জানা। ভ্রান্তির কপট নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিতে সত্যের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকার মাশুল। আধুনিক সমাজ চাঁদের কক্ষপথে অবরোহনে নয়, ঝাঁ-চকচকে পথঘাটে নয়, আত্মমোহের সুখের মাদকতাতে নয়, অর্থনৈতিক অগ্রতিতেও নয়, সে সমাজ শুধুমাত্র শুভবুদ্ধির পাখাকে আকাশে মেলতে দেওয়াতে। বাকি যা কিছু শুভ আপনিই আসে।

302
Sun, 08/04/2019 - 20:30
          একদিন বন্ধুত্বকে নিয়ে অনেক দর্শন, অনেক বৌদ্ধিক আলোচনা করেছি। এখন সে সব পুরোনো কথা। বন্ধুত্ব দিবসটা ঠিক কিরকমভাবে উদযাপন করতে হয় তাও জানি না। আসলে কোনো দিবসই ঠিক কিভাবে উদযাপন করতে হয় তা জানি না। অ্যারিস্টটলের মতে তিন ধরণের বন্ধুত্ব হয় --- প্রয়োজনের, আমোদের আর প্রাণের। শেষেরটির অস্তিত্ব স্থায়ী হয় বলাই বাহুল্য। আমাদের তুলসীদাসজীও বন্ধুত্বের অনেক গুণগান গেয়েছেন। কিন্তু উদযাপন হয় কি করে? এ বলা আমার পক্ষে খুব শক্ত।         প্রথম কথা বইকে আমার কোনোদিন বন্ধু বলে ঠিক মনে হয়নি। যদিও এ নিয়ে স্কুলে প্রবন্ধ লিখেছি। বন্ধু বলতে মানুষকেই চেয়েছি চিরকাল, তাই চেয়ে আসছি। হয়ত যদি বেশি বয়েস অবধি টিকি, আশেপাশের মানুষ সব সরে যায়, তখনও কি বলতে পারব বই আমার একমাত্র বন্ধু? না, বলতে পারব না। হয়ত অশক্ত শরীরে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকব, রাস্তায় হাঁটা মানুষ দেখব, জোর করে কথা বলতে চেষ্টা করব। তবু মানুষকেই চাইব।       একটা গান আছে, 'জয় শঙ্খ গদাধর' তার একটা জায়গায় আছে 'অন্তিম বান্ধব দেহি পদম্'। এই গানটা নিয়ে আমার একটা অভিজ্ঞতা আছে। কালের নিয়মে এক প্রখ্যাত মানুষের সাথে আলাপ, তিনি নানা দর্শনে পণ্ডিত, দেশে বিদেশে তাঁকে যেতে হয় নানা বিষয়ে আলোচনা করতে। একবার তাঁর একটা স্কুলের উদবোধনে তিনি আমায় ডেকেছেন, অবশ্যই স্নেহের বশেই ডেকেছেন, কারণ ওনার আশেপাশে হাঁটার কোনো যোগ্যতাই আমার সেদিনও ছিল না, আজও নেই। আমি ওনার বাড়ি দুপুরের দিকে গেছি। বিকালে অনুষ্ঠান। হঠাৎ করে শ্রাবণের আকাশ ঝেঁপে এল বৃষ্টি। আমি আর উনি একটা মন্দিরের চাতালে। শিব মন্দির। বৃষ্টিতে মানুষ অনেক না বলা কথা বলতে পারে। বৃষ্টি মানুষকে সাহসী করে। কৃত্রিম নৈতিক আড়াল সরিয়ে আসল মানুষটা হুস্ করে বেরিয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় চিরকালের নীরব প্রকৃতি মুখরা হয়ে ওঠে।       আমায় বললেন, "জয় শঙ্খ গদাধর গানটা জানিস?"       "জানি। মায়ের কাছে, দিদিমার কাছে অনেকবার শুনেছি।"       "গাইতে পারিস?"       "আপনার সামনে?"       ভয়ে ভয়ে গাইতে শুরু করলাম। সামনের দৃশ্যপট বদলে যেতে লাগল আমার চোখের সামনে। সাদা-কালো সিনেমায় দেখা মহাপ্রভু এসে দাঁড়ালেন আমার মানসলোকে। শ্রীবাসের আঙিনা ফুল দিয়ে সাজানো। চারপাশে মহাপ্রভু'র পার্ষদেরা। খোল করতাল বাজছে। আর যেন কোথাও নেপথ্যে মল্লারের সুরে বেজে চলেছে বৃষ্টির ধারাপাতধ্বনি। লোকে লোকারণ্য শ্রীবাসের আঙিনা। নবদ্বীপের সমস্ত একা মানুষ, তৃষিত মানুষ, অসহায় মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে; এক মুহূর্তের জন্য দেখে নিতে চায়, এক ঝলক দেখে নিতে চায় সেই স্বর্গীয় মুহূর্তের ক্ষণিক চিত্র। আঙিনায় আর লোক ধরে না। বাইরে রাস্তায় সার দিয়ে মানুষ সাষ্টাঙ্গ প্রণামে শুয়ে, ধুলোতে শুয়ে। শোবে না? এই ধুলোতে হেঁটে গেছেন যে তিনি। কে তিনি? 'অন্তিম বান্ধব দেহি পদম্'।       চোখ মেললাম। বৃষ্টি পড়ে চলেছে অঝোরে। আর তিনি? তিনি বাচ্চাদের মত মন্দিরের চাতালে লুটিয়ে কাঁদছেন। আমি একবার ভাবলাম থামি। পরক্ষণেই মনে হল, না থাক, থামলে ওনার কান্নার যেন সুর কেটে যাবে। কিন্তু এমন কান্না কেন? ওনার তো কোনো অভাব নেই। অর্থ, খ্যাতি, নাম, যশ --- কি নেই ওনার? তবু এমন বুক ফাটা কান্না কিসের জন্য!       ওই যে, অন্তিম বান্ধব দেহি পদম্। বাবা-মা, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-পুত্রী --- সব ছাপিয়ে এই কান্না। এক পরম বন্ধুর জন্য কান্না। যে দরদী। যে আমার জন্যই আমাকে বোঝে। আমার জন্যেই আমাকে চায়। তার ভালোবাসায় আমি অমরত্ব পাব। আমার মধ্যে অমর হয়ে থাকার কোনো সম্পদ নেই, আমার এই কান্নাসিক্ত ভালোবাসাটা ছাড়া।       সারাদিন চলতে ফিরতে অনেক মানুষ দেখি --- জানলায়, দরজায়, রাস্তায়, প্ল্যাটফর্মে --- “no one to anyone”. আমার কান্না পায় দেখলে। কি সাংঘাতিক একাকীত্ব। কি যন্ত্রণা। কাকে বলবে? কে শুনবে? আমাদের যে অনেক তাড়া! শুনেছি কোনো কোনো দেশে মানুষ নিজের দেহটা দান করে যায় আজকাল এইটুকু ভরসায় যে মারা গেলে কেউ নিতে আসবে! এই একাকীত্বের ভয় আমাদের সবার ভিতর। একাকীত্ব নিয়ে অহংকারী মানুষ দেখেছি আমি। সে ভীষণ রকম অভিমান একটা। তারা সবার দ্বারা পরিবৃত হয়ে একটা একাকীত্ব নিয়ে বাঁচতে চান।       মানুষ এই একাকীত্ব থেকে বাঁচার জন্য একজনকেই খোঁজে, মানুষকে। কোনো সংজ্ঞাহীন যে সম্পর্কে মানুষের নিজেকে উজাড় করা সুখ, সেই সুখ বন্ধুত্বের পরম সুখ। সেখানে নিয়ম নেই, রাখঢাক নেই, শর্ত নেই, শুধু প্রাণের তাগিদ আছে। সে তাগিদ বয়েসের সাথে কমে না, বাড়ে। বয়েসের সাথে সাথে অভিমানগুলো বেড়ে যায় শুধু তাই তাদের এমন একটা কঠিন আচ্ছাদন বাইরে। যখন সে ভাগ্যের দোষেই হোক, কি কালের নিয়মেই হোক, কোনোমতেই কাউকেই নিজের আঙিনায় পায় না, তখন সে চায় ঈশ্বরকেই সেই পরমবান্ধব রূপে। কিন্তু শর্ত একটাই, সে যেন মানুষের রূপ ধরে আসে, মানুষের আবেগ নিয়ে আসে। তাই সব দর্শন শেষ হলে কবিতার শুরু হয়, কারণ সব তত্ত্বের শেষে একজন তৃষিত একলা মানুষ কাঙালের মত দাঁড়িয়ে থাকে, বন্ধুর জন্যই কেবল – অন্তিম বান্ধব।  
303
Mon, 07/29/2019 - 20:00
        সব আমার হাতে নেই। আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। আমার ইচ্ছানুযায়ী ঘটে না। আমার ভালো লাগাটা পাত্তাই দেয় না। এ সব ঠেলা সামলানো আমি শিখছি। প্রতিদিন শিখছি। একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া অভ্যাস করছি। মানে পাতা হাত গুটিয়ে নেওয়ার কথা বলছি। কিছু পাওয়া যায় না তা বলছি না, যেটুকু পাওয়ার ছিল তার বেশি পাওয়া যায় না। কিন্তু আগে থেকে কি করে বুঝব কতটুকু পাওয়ার ছিল? এতো পাঁচশো মুড়ির প্যাকেট নয় যে দোকান থেকে কিনে বাড়ির কৌটোর বপু দেখে বলে দেব কতটা আঁটবে, আর কতটা আঁটবে না। কেউ সে হিসাব আমার হয়ে করে দেবে তারও তো জো নেই। তেত্রিশ কোটি দেবতাই খাবি খাচ্ছে দাবিদাওয়া পুরোতে, তায় লক্ষকোটি দেশি-বিদেশি জ্যোতিষী, বাস্তুকার, গুরু ইত্যাদি সব ফেল। তাই কতটুকু সত্যিই আমার পাওয়ার ছিল আগে থাকতে বুঝি কি করে? হবে না। বরং কতগুলো মতবাদ আলোচনা করা যাক।   প্রস্তাব - ১) দাও, আর ফিরে নাহি চাও     ভেবে দেখলাম কথাটা। কারোর কাছ থেকে কোনো প্রত্যাশা না রেখে চলার চেষ্টা করলাম। প্রথম প্রথম মনে হল বেশ এগোচ্ছি। খানিক পরে দেখলাম আসলে আমি পারছি না। প্রত্যাশা না রাখার জন্য মনটা বেশ উঁচু গদিতে চড়ে বসতে চাইছে। তার কথা হল, আমি যদি কিছুই চাইব না, তবে নিজের সেই ঘ্যামটাই বা না দেখাই কেন? তাকে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিই না কেন, দ্যাখ, তোর কাছ থেকে আমি কিচ্ছু চাই না, তবু আমি তোকে ভালোবাসছি, তোর ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছি, এ নিতান্তই আমার মহানুভবতা। যদিও প্রকাশ্যে তা স্বীকার করায় আমার সামাজিক শিক্ষায় লাগে – অহংকার করতে নেই।       বুঝলাম কথাটা হজম হয়নি। নিষ্কাম কর্ম করা যায় না সে কথা অবশ্য দক্ষিণেশ্বরের খুড়ো আগেই পঁই পঁই করে বলে থুয়েছে। বলেছে, যতই তুমি ভাবো নিষ্কাম কর্ম করছ, কিন্তু কোথা থেকে অহং-এর ফেকড়ি বেরিয়েই পড়ে। খাঁটি কথা। একদম পার্ফেক্ট অবজারভারের কথা। এই তো হয়। আরে কাগজে কলমে তো কত কিছুই লেখা থাকে, সে সব সত্যি হলে বইয়ের পোকার দাম নিলামে চড়ত। ওদের জেনেটিকে অক্ষরগুলো আত্মসাক্ষর রেখে যেত, পোকারাই রাজত্ব করে বেড়াত।  অর্থাৎ এ পথ সে পথ নয়।   প্রস্তাব – ২) ঝোপ বুঝে কোপ মারো।     আগেরটার ঠিক উলটো অবস্থান। আগেরটা খানিক অবাস্তব হলেও নীতিগত বা আদর্শগত দিক থেকে বেশ উঁচু ধরণের। কিন্তু এ মতের কথা হল, বুঝেশুনে ইনভেস্ট করো নিজেকে। এক একটা সম্পর্ক এক একটা ইনভেস্টমেন্ট। মানসিক, শারীরিক, নিরাপত্তা, ভালো থাকা, তোষামুদে রাখা, শত্রুকে চমকে দেওয়ার জন্য রাখা, নিজের কথা শোনানোর জন্যে রাখা, বেড়াতে যাওয়ার জন্য রাখা, আদিরসের জন্য রাখা ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষের প্রয়োজনের শেষ নেই যেমন, মানুষকে ব্যবহার করার ফিকিরেরও শেষ নেই তেমন।       মনে ধরল না। যে পথে হাঁটতে গেলে আগে নিজেকে পাট পাট করে, ভাঁজ করে করে ছোটো করে নিতে হয়, তারপর ট্যাঁকে গুঁজে হিসাব কষে কষে খরচ করতে হয়, সেও খুব একটা যুক্তির কথা নয়। এক্ষেত্রে যেহেতু মানুষ চিত্তের সামগ্রী কিছুই পায় না সবাইকে ব্যবহার করতে করতে, তাই ভাবে সে বেশ জিতে গেছে আর কি। আসলে যে শুরু থেকেই হেরে বসে আছে, কারোর কাছে কিচ্ছুটি পায়নি, সে বুঝবে কি করে নিজে? বাইরের পাওনাগুলো গুনতে গুনতে ভিতরে যে কত দরিদ্র হয়ে পড়েছে সে আর বলতে? আমার একটা খুব দুষ্টু উপমা মনে এলো। মজার কথা যদিও। গ্রামে নাকি মহিলারা যখন বাহ্যে বসেন মাঠে, গুরুজন কেউ সামনে এসে পড়লেই, মাথার কাপড়টা লজ্জায় মাথায় ঢেকে নেন, যাতে সেই সেই গুরুজন চিনতে না পারেন, তার ফলে তার মুখটা চেনার জো থাকে না সত্যি, কিন্তু পশ্চাতদেশ উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। এই জাতীয় আত্মরক্ষকদের দেখলেই আমার খানিক তাদের গল্প মনে পড়ে। অর্থাৎ এ পথেও হাঁটা হল না।   প্রস্তাব – ৩) জগৎ তো এমনিই/ কেউ কথা রাখেনি     এ এক ধরণের ছিঁচকাঁদুনে দার্শনিকের দল। এদের মতে তারা ছাড়া সংসারে মনুষ্যপদবাচ্য কেউ নেই। অবশ্য যতক্ষণ আপনি সামনে থাকবেন আপনাকেও তাদের দলে রাখবে। তাদের শ্রেণীগত বৈষম্যবোধ একবারেই নেই। একটু মন দিয়ে নিন্দামন্দ শোনার অভ্যাস রপ্ত করতে পারলেই হল। এই সব বাড়ির কাজের মানুষদের পোয়াবারো দেখেছি। তারা গালে হাত দিয়ে পাত পেড়ে নিন্দামন্দ শুনবে, সায় দেবে, সময় বিশেষে কাঁদবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। ফলে সেই অসম্ভব রকমের বঞ্চিত মানুষগুলোকে তারা একটা ভেন্ট দেবে, নিজেও পার্থিব জগতে লাভবান হবে। আমি অনেক সময়েই দেখেছি প্রাক বৈবাহিক প্রেমে ছেলেটি মেয়েটির বাড়িতে মেয়েটিকে নির্যাতনের কথা শুনে এমন শোকে ডুবেছে যে স্বয়ং অর্জুনও সামনে নিজের জ্ঞাতিগুষ্ঠী দেখে অতটা শোকে নিমজ্জিত হয়েছিল কিনা সন্দেহ। তারপর বিবাহ পশ্চাৎ নিজের পরিবারের মানুষদের অবিবেচনা এমন পষ্ট করে দেখতে শুরু করল যে প্রায় মহাভারত শুরু হয় আর কি। ক্রমে মহাভারতের দিক বদলালো। একপক্ষ রাতারাতি নির্দোষ প্রমাণিত হল, আরেক পক্ষ রাতারাতিই কাঠগোড়ায় বাসা বাঁধল।        এই ছিঁচকাঁদুনে দর্শন বড় ভয়ংকর দর্শন। এ চিরকাল ঘেন্নার বস্তু, আজও তা। পাত পেড়ে নিন্দা শোনার চাইতে, পিছন উল্টে ঘুমানো অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর বলে আমি অন্তত মনে করি।   প্রস্তাব – ৪) কর্মফল ও ঈশ্বরের ইচ্ছা   এ আরেক ঘোড়েল প্রস্তাব। সবই কপালের লেখন বাবা। যেন ঈশ্বর বাঁশবাগানের মালিক। সারাদিন সে ভদ্রলোকের বাঁশ কেটে কেটে লোকের বাড়ি ডেলিভারি দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এ সূত্রের উৎসই যখন এত গোলমেলে তখন একে না ঘাঁটানোই ভালো। শুধু নিজের অভিজ্ঞতাটুকু বলে নিই, যে এক্কেরে খাঁটি অদৃষ্টবাদী দেখার সৌভাগ্য আমার আজ অবধি হয়নি। স্বার্থের কোর রিজিয়নে ঝড় এসে পড়লে 'রে রে' করে তেড়ে যান, অন্যের কোর অঞ্চল উপড়ে গেলেও বিন্দুমাত্র বিচলিত হন না। নিশ্চিন্তে বলেন, ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হয়েছে। এরকম নিষ্ঠুর ধর্মীয় প্রজাতির মানুষ দেখে দেখে চোখে শ্যাওলা জমে গেল। এদের কথা এখানেই ইতি।   প্রস্তাব – ৫) সত্যেরে লও সহজে     এই একটা কথাতে মন দাঁড়াল। ‘সত্য’ একটা অমোঘ শব্দ। সত্য কাকে বলে এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই তেমন। যেমন চোখের গঠন না জানলেও যা দেখছি তা নিয়ে সংশয় হয় না। তেমনই সত্যের সংজ্ঞা না জানলেও সত্যের বোধে সত্যকে চিনে নিতে তো অসুবিধা হয় না। সত্য বোধে সত্যকে নিয়ে চলার কথাটাকে দর্শনে বলে নরম্যাটিভ এথিক্স। বাকি সত্য কাকে বলে ইত্যাদি মেটা-এথিক্স নিয়ে মাথা ঘামিয়েও লাভ নেই, আবার বর্ণনাত্মক ও বস্তুনির্দিষ্ট এথিক্স নিয়েও খুব একটা ঘাঁটাঘাঁটি নিত্য জীবনে কাজে লাগে না, যদি না কলেজে ওই সব পড়িয়ে মান আর পেট চালাতে হয়। কারণ দুই চালাতেই অর্থের দরকার আগে, শীলবন্ত না হলেও চলে।        শুরুটা যা দিয়ে করেছিলাম, নিজের হাতে কতটুকুই আর আছে? এখন কথা হচ্ছে যে কাজটা কি খুব সোজা? না মোটেও না। তা বলে কি কাউকে নকশা কেটে হত্যা করে ফেলা, নিজের জীবনটা শেষ করে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া, সারাদিন হাপিত্যেশ করে বুক চাপড়ে মরাটা খুব সোজা কাজ বা কাজের কথা?          মানলাম ক্ষোভ-রাগ-অভিমান ইত্যাদি আবেগের শক্তি অত্যন্ত বেশি। তার যন্ত্রণাও অত্যন্ত বেশি। কিন্তু ধৈর্য্য বলেও তো একটা মানবিক গুণ মানুষের অনুশীলনের মধ্যেই পড়ে। ক্ষতিকর তীব্র আবেগকে কোন দর্শন, কোন যুক্তি আটকিয়েছে? না সেই সময় কোনো যুক্তি মাথায় কাজ করে? যা কাজ করে তা নিটোল ধৈর্য্য। সে ধৈর্য্যের শক্তি আসে সেই আঘাতের সত্য থেকেই, যে সত্যকে সহজে মেনে নেওয়ার কথা বলে যাওয়া হচ্ছে সেই কবে থেকে। একজন বলেছিলেন, ভাগ্য আমায় লেবু ছুঁড়ে মারলে সে লেবু দিয়ে আমি লেমোনেড বানিয়ে নেব। কথাটা মনে ধরেছিল। সত্যিই সে লেমোনেডের স্বাদ জীবনে যদি না-ই পাওয়া গেল, তবে আর হইলো ডা কি। তবে আর মহাভারত লিখে ব্যসদেব মহাকবি মহাজ্ঞানী মহামুনি কেন হতে গেলেন? অবশেষে যুধিষ্ঠিরের সাথে কুকুরটাকে পাঠাবার কথা ভাবতে পেরেছিলেন বলেই না?
304
Sat, 07/27/2019 - 13:00
          কাঁকিনাড়া কিম্বা ভাটপাড়ায় কেউ ‘মার্কিং সেফ’ অপশান পাচ্ছে না। মানে ফেসবুকের কথা বলছি। ভূমিকম্প, বন্যা, অ্যাক্সিডেন্ট ইত্যাদি এক সমস্যা। বোমাবাজি, হানাহানি, হিংসা ইত্যাদি আরেক সমস্যা। নানা মুনির নানা মত। ব্যালট থেকে ইভিএম, মোদি থেকে মমতা, রাহুল ইত্যাদি ইত্যাদি চলছেই। একদল বিজ্ঞজন চিঠি দিলেন --- দেশ খুব খারাপ অবস্থায়। আরেকদল চিঠি দিয়ে বললেন, বটে? একদল ভাবল, তাই তো, এরা প্রতিবাদী, ওরা সুবিধাবাদী। অন্যদল ভাবল, একদল হিংসুটে, আরেকদল স্বচ্ছদর্শী। মোট কথা যেরকম গড়ায় সময় সেরকম গড়াচ্ছে। প্রত্যক্ষ আঘাতে প্রতিঘাত, পরোক্ষ আঘাতে চিন্তায় আলোড়ন, লেখায় সুনামি, আর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কোনোরকম ঝুটঝামেলায় না থাকা মানুষেরা উদাসীন, নীরব খবরদর্শী বা খবরপাঠক।        কথা হচ্ছে, আমি আগেও চটতুম। এখন চটি না। আমি জানি যাই ঘটুক না কেন, মানুষের আগ্রহ, মানে আত্মপ্রেমের আগ্রহে সে নিজেকে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত রাখতেই পারে সব কিছু থেকে। এর অভিজ্ঞতা কি আমাদের নেই? ভাবলেই আছে, না ভাবলেই নেই। ভাবুন মানিক স্যার, থুড়ি মানে সত্যজিত মহাশয় জন্মালেন ১৯২১ সালে, মানে যখন বিয়াল্লিশের আন্দোলন হচ্ছে, কিম্বা স্বাধীনতা আন্দোলন হচ্ছে তখন তিনি কি নিজেকে তার সাথে জড়িয়ে মাথা খারাপ করছেন? করছেন না তো? যদি করতেন তবে কি হত? আঠারো বছর তো হয়েই গিয়েছিল না? "আঠারো বছর বয়স কি দুঃসহ”... আরে ধুর, ওসব কাব্যের কথা। সবার যদি দুঃসহ হত তবে আর দেখতেই হত না। পৃথিবীতে শান্তি বলে কিছু থাকতই না। সবাই সারাদিন বিপ্লব করে মরত। আচ্ছা কোনো মানে হয় বলুন? তিনি এইসবে জড়ালে হয়ত বেঘোরে জেলে থাকতেন, নয়ত শহীদ হতেন। আমরা এমন আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের চলচ্চিত্রকে দেখতে পেতুম? অমন একটা ইন্টেলেকচুয়ালাইজেশান অফ ইণ্ডিয়ান কালচার দেখতে পারতুম? না পেতুম না।       তাই কথা হচ্ছে নিজেকে ইনস্যুলেশানে রাখাটা অভ্যাস করতে হবে। ক্ষণকালে কি হচ্ছে আমাদের কি দরকার তাতে? আমাদের চিরকালের দিকে তাকিয়ে মনের নানা নান্দনিক, কোমলভাবগুলো নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা দরকার বইকি। যেমন মানিক স্যার বলেছিলেন না? 'আমার বয়েসী ছেলেরা যখন কবিতা লিখে খাতা ভরাচ্ছে, আমি তখন বিঠোভেন বাক শুনছি।' কি অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী কথা না? শুনলেই রোমাঞ্চ হয়। আমার তো ভীষণ হয়। কোথায় কি হল তা নিয়ে এত প্রতিক্রিয়া দেওয়ার তো কিছু হয়নি রে বাবা। যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সংসারে একটা পাতাও নাকি ঈশ্বরের ইচ্ছা ছাড়া নড়ে না, তা এতগুলো বোমা তাঁর ইচ্ছা বিনা পড়ে গেল, তাই হয়? জয়গুরু। আচ্ছা আপনি নাস্তিক? নাস্তিক না মাকু ঝেড়ে কাশুন। মাকু হলে নাস্তিকতার প্রদর্শন আপনার অঙ্গ, সে যতই আপনার নেতা তারাপীঠে পুজো দিন, আর স্বভাবে নাস্তিক হলে সে অন্য কথা। প্রদর্শনের থেকে অন্বেষণ সেখানে বড় কথা। কিন্তু আপনাদের কি যুক্তি দেব? আছে, সে ব্যবস্থাও আছে। সে হল, কার্য-কারণ সম্পর্ক। কারণ বিনা কার্য হয় না, আবার কার্য হয় কারণের খোঁচাতেই। কি, কেমন বললাম? হুঁ হুঁ বাবা, এমনিই কি আর মাথার চুলগুলো সাদা হয়ে গেল?       তো ঈশ্বর তো মহাজাগতিক ব্যপার নিয়ে থাকেন। তারা পূজ্য। তারা নমস্য। তাদের আমাদের মত ছোটোখাটো কথায় মন ভুলবে না, যদি না একটা ইয়া মাপের আদর্শ আনতে পারো সামনে। যেমন আমাদের এখানে এককালে কত কিছু হয়েছিল, না? একটা বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য কত কত মানুষ একজোট হয়েছিলেন। একটা বিদেশী আদর্শ গো। কত গান হল, সিনেমা হল, পুঁজিবাদের হাত গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা হল। কারা পুঁজিবাদ? উফ, ধুত্তোর এতো কিছু বোঝে না গো, আরে যারা অস্কার-টস্কার পুরস্কারগুলো দেয় গো। হুম তারাই। কিন্তু কিচ্ছু গুঁড়োলো না জানেন। হাতগুলোই কালের চাকায় ঢেকে গেল। সময়ের স্রোত বুঝবে কে বলো? কার্য-কারণ বলে যতই লাফাও চাঁদ আমার, কোন কারণের যে কি কার্য হবে তা কার্যটি না হওয়া অবধি বোঝে কার সাধ্যি গো! নিজের মন নিয়েই এত গোলমাল তা জগতের মনের কি খবর রাখি!? দাঁড়াও একটা গান মনে আসছে, "আপন মন যদি বুঝিতে নারি, / পরের মন বুঝে কে কবে॥" ... আহা কি গান! জয় মা।        তো কথা হচ্ছিল ইনস্যুলেশানের। দাঁড়ান, গানটা কার লেখা? আরে শান্তিনিকেতনের মানুষটার গো। ভাবুন দেখি সুভাষ, গান্ধী সবাই বলছে, আপনি বলুন, আপনি বলুন। কি ঠিক বলুন। কি ভাবছেন বলুন। মানুষটার অতবড় জোব্বাখানা ইনস্যুলেশানের কাজ করল না। দেখলেন? আচ্ছা ওনার রাজনৈতিক আদর্শ কে ছিলেন? মহাত্মার কে ছিলেন? কেউ না। কেন বলেন দেখি? আপনাদের একটা তত্ত্বকথা বলে লেখাটার বিরাম টানি। কারণ কি জানেন? আচ্ছা ধরুন একজনের বাচ্চা হল। আপনি গিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করেন, আচ্ছা আপনি কোন আদর্শ অনুযায়ী বাচ্চাটাকে মানুষ করছেন? কার মতন করে স্তনে মুখ দেওয়াচ্ছেন? কার আদর্শ অনুযায়ী ওর খাদ্য গলাধঃকরণের আদর্শ সময় নির্ধারিত করেছেন? ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্ন যদি করেন, উনি সেই ‘হাস্যকৌতুক’ নাটকের মত করে বলবেন, ‘মিনসেটা কি বকছে ভাই?’       আসল কথাটা হল ভালোবাসা জাগলে আর আদর্শ'র ক্যাটাগরি লাগে না। যেমন দক্ষিণেশ্বরের সেই ক্ষ্যাপা মানুষটা বলত না, এমনি বাতাস দিলে আর হাতপাখা লাগে না। বাকি সব আদর্শের গল্পই হল সেই না ভালোবেসে ভালো করতে যাওয়ারই ফল। মানুষকে সব চাইতে বড় অপমান করার উপায় শান্তিনিকেতন ঠাকুর বলছেন, "তাহার হিত করা অথচ তাহাকে প্রীতি না- করা।"       কি কথা মাইরি না? তার চাইতে ইনস্যুলেটেড থাকাটা ভালো নয়কি? কে জানে? নাকি একটা প্রদর্শনী প্রতিবাদ, প্রদর্শনী সহমর্মিতা, কাল্পনিক যথার্থতার জন্য 'রে রে' করে ঝাঁপিয়ে পড়াটা ঠিক। কোনটা কাজের কথা বলুন তো? ভারি শক্ত কথা। সলোমনকে ডাকতে হবে। কোনটা আসল ফুল আর কোনটা নকল বেছে দেবে। কিন্তু যদি নকল মৌমাছি ঢোকে, ড্রোনের মত? জয়গুরু।  
305
Thu, 07/25/2019 - 20:00
          সমস্ত মঙ্গলের উৎস কি? ধর্ম বলবে ঈশ্বর। সমস্ত অমঙ্গলের উৎস কি? স্পষ্ট উত্তর নেই। কেউ বলবে শয়তান, কেউ বলবে অজ্ঞানতা, কেউ বলবে ঈশ্বরের লীলা।       দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরগুলোর মধ্যে প্রথম আর দ্বিতীয় কারণটার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু শেষেরটার কোনো যুক্তি নেই। ওটা চালাকি। 'লীলা' শব্দটার অন্য অর্থ - এর কোনো কারণ খুঁজতে যেও না। অনেকে 'লীলা' শব্দের অর্থ করেছে ইংরাজিতে 'প্লে'। এখানে শব্দের খেলা হচ্ছে একটা। আমি যখন বলছি 'লীলা' আর 'প্লে' একই কথা তখন বোঝাতে চাইছি এর মধ্যে তেমন কোনো যৌক্তিক গুরুত্ব নেই। কিন্তু যখনই বলা হবে যে, সে না হয় বুঝলাম লীলা মানে 'প্লে'। কিন্তু ভায়া, প্লে-র তো একটা নিয়ম থাকে, তোমার 'লীলা'র নিয়ম কি?        নেই। উত্তর নেই। তবে অমঙ্গলের উৎস কি? কেউ বলছে স্বার্থপরতা, কেউ বলছে এটাই স্বভাব মানুষের, কেউ বলছে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। তবে উৎস কি? জানা নেই। অমঙ্গল যে আছে সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই যদিও। কিন্তু কেন আছে তার কোনো কারণ আমরা জানতে পারি না।        অবশ্যই এই অমঙ্গলের কারণ মনুষ্যঘটিত। আরো অনেক অনেক কারণ আছে যার কোনো অর্থ নেই। দুর্ভাগ্য বলে দেগে বসে থাকি। ভক্তের সান্ত্বনা - ঈশ্বরের ইচ্ছা। অভক্তের? নেই। কোনো সান্ত্বনা নেই। সে অবশ্য একদিকে ভালো। মিথ্যা সান্ত্বনার উৎস খোঁজার চাইতে মনকে এই বলিয়ে নেওয়া ভালো, কোনো সান্ত্বনা নেই।         সত্যিই কি নেই? আছে। মানু্ষের অন্তরে একটা মানস সরোবর আছে। তীর্থক্ষেত্র আছে। শান্তির দিকে যাওয়ার স্বাভাবিক ঝোঁক আছে। যদি রাশ ছেড়ে দেওয়া যায় তবে দেখা যায় মন কি করে করে নিজেকে ধীরে ধীরে শান্ত করে নিয়েছে। তার শোক আর ক্ষুব্ধ নয়। তার ক্ষতির ক্ষত আর জ্বালাময়ী নয়। তার অভিমান আর তপ্ত নয়। যদিও সবগুলোই আকারে ইঙ্গিতে তার মধ্যে রয়ে গেছে, কিন্তু সে সামঞ্জস্যে এসে পৌঁছিয়েছে। একে তাকে ডেকে গাল পাড়ছে না, অভিশাপ দিচ্ছে না, পাথরে মাথা ঠুকছে না। আবার সবার সাথে হাঁটার জন্য পা বাড়িয়েছে।        এইখানেই অমঙ্গলের পরাজয়। সে মঙ্গলের আবিষ্কারেই যে সব সময় হয়েছে তা তো নয়! নিজেকে শূন্য করেই হয়েছে বেশি। মানুষ আজ আর স্বর্গের গল্প, নরকের গল্প বিশ্বাস করে না, কিন্তু নিজের মধ্যে সেই সরোবরের খোঁজে বাইরে এর-তার কাছে দৌড়ের তার আর শেষ নেই। একদিন আগুন, বাতাস ইত্যাদিকে ঈশ্বর মেনেছিল। আজ মানুষকে ঈশ্বর বানিয়ে নানা গুরু, সম্প্রদায়, ধর্ম তৈরি করে দেওয়াল তুলে তুলে বসে আছে। গোড়ার কথাটা আবার ভুলে যাচ্ছি, আমার সমস্ত শোকের, ক্ষতির, অমঙ্গলের সান্ত্বনা আমার নিজেরই অন্তঃস্থলে। যদি জেদ ছেড়ে দিই। যদি বিশ্বাস করি আমার অস্তিত্ব অগুনতি মানুষের অস্তিত্বের থেকে কোথাও বিশেষ কিছু নয়। তবে সান্ত্বনা আপনিই মেলে। চারদিকে চেয়ে দেখি আমার এ বিপত্তি নতুন কিছু নয়, "মান্ধাতারই আমল থেকে চলে আসছে এমনি রকম— / তোমারি কি এমন ভাগ্য বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম!"       আমি সমতলে দাঁড়ালে, আমার হৃদয়ও সমতলে দাঁড়ায়। আমি সবার মাঝে দাঁড়ালে আমার হৃদয়ও সবার মাঝে দাঁড়ায়। তখন বাইরে থেকে কাউকে আমদানি করতে হয় না, "ওগো আমায় শান্তি দাও" বলে, নিজের মধ্যেই মনের নড়াচড়ার শব্দ পাওয়া যায়। বেশ বোঝা যায় সে গড়িয়ে গিয়ে কোথাও একটা দাঁড়াবার জায়গা খুঁজছে যেটা সেই সময়ের জন্য তার সব চাইতে নিশ্চিতস্থল। সেখানে সুখ নেই হয়ত, কিন্তু সান্ত্বনা আছে। শোকের অবসান আছে। সে অংশটুকুকে বাদ দিয়ে আমি হইনি, আমি আমিই আছি, আমার সান্ত্বনায়, আমার নিজেকে শান্ত করার জন্মপ্রাপ্ত ক্ষমতায়। শুধু তাড়া না দিলেই হল জেদের বশে।    
306
Fri, 07/19/2019 - 20:00
          বৈষ্ণব সাহিত্য মানুষকে সৌন্দর্যের বাঁধন থেকে মুক্তি দিল। জীবনে আনন্দের অভাব তখনই যখন সে আনন্দকে আমার বৈষয়িক সুখের নিমিত্তে খাঁচায় পুরে প্রতিদিন ছোলা খাওয়ানোর স্বপ্ন দেখি। আমাদের রেল কোয়াটার্সের জানলার থেকে কিছুটা দূরে দুটো খুব বড় বড় কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ ছিল। যখন সেই গাছদুটোর মাথায় ভোরের শুকতারা জ্বলজ্বল করত, কিম্বা আষাঢ়ের মেঘ রাজবেশে ঘনিয়ে আসত, মনের মধ্যে একটা প্রসন্ন আনন্দ অনুভব করতাম। সে সৌন্দর্য বা আনন্দ আমার ব্যক্তিগত কোনো কাজে আসার প্রতিশ্রুতি দিত না। কিন্তু যা অনুভব করতাম তাতে আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধ 'আমি'কে ছাপিয়ে যাওয়ার শক্তি পেতাম। সে আনন্দ মহার্ঘ্য আনন্দ, আমার কাছে ছিল তাই। 
      মানুষের নানাবিধ সুখের ফরমায়েশ। শরীরের সুখ, নিরাপত্তার সুখ বা সম্পদের, খ্যাতির সুখ। এর মধ্যে সম্পদের সুখ দুই সুখের যোগান দেয়, এক, খ্যাতি; দুই নিরাপত্তা। অপরদিকে এই সুখগুলোই মানুষকে বেঁধে ফেলে। সে গর্বের সাথে নিজের কাজের, ব্যস্ততার, যোগ্যতার, নাম-যশের মোহে নিজেকে চারদিক থেকে বেঁধে ফেলে, নিজেকে একজন বিশেষ কেউ অনুভব করে। কিন্তু এইখানেই শেষ নয়। যদি শেষ হত তবে মানুষের গৌরব বলে কিছু থাকত না। এই সুখের সাথে সাথে তার মধ্যে একটা কান্না জেগে ওঠে। মুক্তির কান্না। দুঃখের থেকে মানুষ নিষ্কৃতি পেতে চায়, কিন্তু সুখের থেকে সে পেতে চায় মুক্তি। তাই মুক্তির আকুতি এত তীব্র তার কাছে। কিন্তু এই মুক্তির শর্ত কি? কিম্বা মুক্তির সুখই বা কি? 
      দুইয়েরই প্রবল কথাটা হল – অধীনতা। মানুষ নিজেকে অধীন করে মুক্ত হয়। প্যারাডক্স? সে তো বটেই। কিসের অধীন হতে চায়? নিজের বিবেকের শাসনের, সার্বজনীন ভালোবাসার। আরো সহজ করে বলতে চাইলে – সে সার্বজনীন হয়ে উঠতে চায়, নির্বিশেষ হয়ে উঠতে চায়। আর ‘বিশেষ’ হয়ে থাকার সুখ সে চায় না। “কেন আমায় মান দিয়ে আর দূরে রাখ?... অসম্মানে আনো টেনে পায়ে তব। / তোমার চরণ-ধুলায় ধুলায় ধুসর হব।।"
      অত্যন্ত দুষ্ট, সমাজবিরোধী যেমন দেশের আইনের কাছে নতিস্বীকার করে সমাজে মুক্ত হয়, তেমন অত্যন্ত প্রবল আত্মাভিমানী যে সে-ও বিশ্বের সার্বজনীন যে নীতি তার কাছে নতিস্বীকার করে নিজেকে মুক্ত করে। বিশ্বে মুক্ত হয়। ছুটি পায়। 
অজ্ঞানতার মধ্যে একটা সন্তুষ্টি আছে। সে সন্তুষ্টি – অবোধ আত্মতুষ্টি। সেকি চিরটাকাল থাকে? থাকে না তো। একদিন হঠাৎ তার চোখ খুলে যায়, সে দেখে তার জ্ঞান, তার বুদ্ধি, তার নীতিবোধ, তার ঠিক-বেঠিকের হিসাব বড় দীন, বড় অকিঞ্চিৎকর। তার আত্মতুষ্টি দূর হয়। সেটা অত্যন্ত যন্ত্রণার অবশ্যই, কিন্তু সাথে সাথে অনির্বচনীয় জ্ঞানের সামনে দাঁড়িয়ে এই যে আত্মবোধ লাভ হয়, তার কাছে সে মাথা না নীচু করেও পারে না। সে বলে, ভাগ্যে তুমি এলে বলেই আমার এই জেগে ঘুমানোর পালা চুকল। সে নত হয়, তার মধ্যে অসীমের তৃষ্ণা জাগে, তার সুখ যায়, সে আনন্দ পায়। এই যেন চলার আনন্দ।
      কিন্তু এ কি চাইলেই হয়? হয় না। ওই ত্রিবিধ সুখের অর্থাৎ শারীরিক, নিরাপত্তার আর খ্যাতি-মানের সুখের মোহ না কাটলে হয় না। সুখের জন্য সে সঙ সাজে, রঙ মাখে, মহত্বের ভান করে, মহানুভবের ভান করে, অনুকম্পার অভিনয় করে, কিন্তু অবশেষে ক্ষুণ্ণ অথবা প্রবল অবোধ আত্মতুষ্টি ব্যতীত কিছুই নিয়ে ঘরে ফেরে না। সব অভিনেতাই যা চায়, সে-ও শেষে তাই-ই চায় – একটু হাততালি, একটু তোষামোদ, একটু পুষ্পবৃষ্টি।
      বৈষ্ণব সাহিত্য এক নতুন দর্শন এনে দিল। ভারতের অন্যান্য দর্শনে জ্ঞানের কথা বলা হয়েছে, কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে। জ্ঞানে বলা হয়েছে নিজের মধ্যে বিশ্বসত্তার অনুভবে নিজের বোধকে প্রসারিত করার কথা। কর্তব্যের বোধে বলা হয়েছে, নিজেকে সম্পূর্ণ স্বার্থমুক্ত করে সমাজের কল্যাণে আত্মযুক্ত হওয়া। বৈষ্ণব সাহিত্য বলল, ভালোবাসার মাধুর্যকে নিজের সুখের প্রতিকূলে নিয়োজিত করার কথা। সে পরম সুখকে তার বৈষয়িক জ্ঞান আর বৈষয়িক সুখ – দুইয়ের পারে নিয়ে গেল শুধু না, সামাজিক বিধিনিষেধের বাইরে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দেখালো। বলল, যে ভালোবাসায় কোনো স্বার্থসুখ নেই, সেই ভালোবাসার কোনো নীতিনিয়ম নেই। এই ভালোবাসার রূপ আর মাধুর্যের আস্বাদনেই তোমার মুক্তি। অবশ্য সে 'মুক্তি' শব্দটাকেও এড়িয়ে গেল। কারণ 'মুক্তি' শব্দটা অনেকটাই নিষ্কৃতি পদবাচ্য সেখানে। তাই এ যেন দুর্বলের কথা। সবলের কথাটা কি তবে? সে বলে, “তোমার অভিসারে যাব অগম-পারে / চলিতে পথে পথে বাজুক ব্যথা পায়ে।।”... সে বলে, “আমি শুচি-আসন টেনে টেনে বেড়াব না বিধান মেনে, / যে পঙ্কে ওই চরণ পড়ে তাহারই ছাপ বক্ষে মাগি।।... আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।”... সে বলে, “আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়। / আমি তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথে যে জন ভাসায়।।" 
      এ-ও আনন্দের পথ। নিজের সুখের কারাগারে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে সেই আনন্দের দিকে এগিয়ে চলা, যে আনন্দে আমি নিঃস্ব হয়ে পূর্ণ হব। যে সুখের কোনো শরীর নেই, উপাধি নেই, আছে মগ্নতা। 
      সেদিনের সেই বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারাকেই একালের রবীন্দ্রনাথে পেয়েছি। ভানুসিংহ'র স্লেটের পাশে বসেছি, যে বালক লিখছে, “গহনকুসুমকুঞ্জ-মাঝে”, যে জ্ঞানী লিখছেন, “যে আছে মাটির কাছাকাছি, / সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।"
      এ দর্শনের একই সূত্র আরেকজন আত্মমগ্ন পাশ্চাত্যবাসী মহাত্মা তার সারা জীবনে যুক্তির সাথে যুক্তি মিলিয়ে পাকা রাস্তায় হাঁটার আলো দেখিয়ে গেলেন – তিনি ইম্যানুয়েল কান্ট। এরা ছিলেন বলেই বলে বাঁচা। বাঁচতে শিখতে চেষ্টা করা। উড়ে আকাশ শেষ করব এমন ধৃষ্টতায় নয়, উড়ে পাখায় আরাম পাব, সেই সুখে। সেই কাঠবেড়ালির মত, যে সম্পূর্ণ সেতুটা একা বেঁধে দেবে এমন স্পর্ধা নিয়ে আসেনি, মহত্ত্বের মধ্যে নিজেকে স্বার্থরহিত নিয়োজিত করবে এমন একটা শুদ্ধ-ইচ্ছায় নম্র সুখে এসেছিল। সেই শুদ্ধ ইচ্ছাটাই চাবিকাঠি।
307
Tue, 07/16/2019 - 11:29
          জিজ্ঞাসা করলাম, গলায় কণ্ঠিমালাটা আগে দেখেছি?       চুল কাটতে কাটতে হেসে বলল, না। এই নিলাম। গুরুদেব বললেন, গলাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে রে, একটা কন্ঠি নে। তা নিলাম। আজ বাদে কাল তো নিতেই হত, বয়েস হচ্ছে।       শাঁখ বাজল এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে। সন্ধ্যে নেমে এসেছে। গুমোট গরম। আষাঢ় মাস। সদ্য উলটোরথ হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, মাছ-মাংস খাওয়া নিষেধ করেছেন?       নাপিত বলল, না না। বলেছেন মন যদ্দিন চাইবে খাবি।       পাখা ঘুরছে ফুলস্পিডে। সেলুনের বেঞ্চির উপর রাখা খবরের কাগজের পাতা পতপত করে উড়ছে। সদ্য হার্টের একটা বড়সড় অপারেশান হয়েছে মানুষটার। দক্ষিণের সাঁইবাবার আশ্রম থেকে একরকম নিখরচায়। শরীর ভেঙেছে। সেলুনের আশেপাশে অনেক বাড়ি। বড় বাড়ি। ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক ইত্যাদি ইত্যাদি। উপার্জনের বৈষম্য। ভীষণ বৈষম্য। নীতি আছে, ভাবনা আছে, চিন্তা আছে, তবু কি যেন নেই।       ঝাঁট দিচ্ছে কাজের দিদি। জিজ্ঞাসা করলাম, দেশের বাড়ি কেমন ঘুরলে? বলল, আর বোলো না দাদা, অটোর ভাড়া বাড়িয়ে তিরিশ টাকা করেছে। আমি তোমার দাদা আর আমার ভাই ভাইয়ের বউ। বললাম, কমাও, এতগুলো লোক যাচ্ছি..কে কার কথা শোনে। আর কমাবেও বা কেন, ওরও তো পেট চলার আছে।         মন আবার সেলুনে ফিরল। উপার্জনের বৈষম্য। এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। এ স্বাভাবিক। অনেক জটিল অর্থনীতি। বললাম, গুরুদেব কোথায় থাকেন? সংসারী? নবদ্বীপ। হ্যাঁ।       মানুষে মানু্ষে আলাপ কিসে হয়? শ্রেণীতে হয়, গোষ্ঠীতে হয়, আবার কখনও কখনো শ্রেণী ছাপিয়ে উন্মুক্ত খোলা হাওয়াতেও হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানু্ষের নামের সাথে মানুষের কর্মক্ষেত্রের, শিক্ষাগত যোগ্যতার উল্লেখ থাকে। বোঝা যায় সে কি যোগ্যতার মানুষ। কখনও মান বাড়ে, কখনও তাচ্ছিল্য জমে, কখনও উদাসীনতা আসে। কথার ওজন বাড়ে কমে। বিচার সুক্ষ্ম হয়। মনে মনে হিসাব হয় "ব্যাতন কত"? ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অহংজ্ঞাপন, অহংপীড়ন ইত্যাদির সুক্ষ্ম জোয়ারভাটা এদিক ওদিক ঘোরে বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে, চোখে পড়ে। "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে"..সত্যিই কবি? বিশ্বাস করতে? কাঁসর বাজছে কারোর বাড়িতে। জিজ্ঞাসা করলাম, আবার কবে চেক-আপ?       বলল, ছ মাস পর।       টাকা মিটিয়ে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরলাম। বাজার বসে গেছে। মানুষের প্রয়োজনের চাইতে আয়োজন বেশি লাগে। প্রয়োজনের চাইতে আরো প্রয়োজনের ডাক। বিলাস। স্বাচ্ছন্দ্য। শখ। নেশা। জ্বলজ্বলে আলোয় দোকান সাজানো। ফেল কড়ি মাখো তেল। বৈষম্যের কথা ভেবো না। ওসব ভাবতে নেই। চায়ের দোকানে থিকথিকে ভিড়।       জিন্স পরা। খালি গা। সারামুখ দাড়ি। চোখগুলো পেণ্ডুলামের মত অস্থির। দোকানিকে বিস্কুট চাইল। দোকানি দিল। তাচ্ছিল্যের সাথেই দিল। "শ্রদ্ধেয়া দেয়ম, অশ্রদ্ধেয়া অদেয়ম - শ্রদ্ধার সাথে দাও, অশ্রদ্ধার সাথে দিও না।" সাথে এক ভাঁড় চা। পাগল বসল হাত পা ছড়িয়ে, ট্রেন লাইনের থেকে নিরাপদ দূরত্ব রেখে। চায়ে চুমুক দিল। বিস্কুটে একটা কামড় দিয়ে ঢোকালো জিন্সের পকেটে। নিশ্চয় ভেঙে চুরমার হবে। কাঁধ অবধি ঝাকড়া ঝাকড়া চুল। যৌবন পেরোচ্ছে শরীর, নির্বিকার। জিজ্ঞাসা করলাম, কে? কেউ চেনে না।       খালি পা বাচ্চা মেয়েটা এসে দাঁড়াল। হাতে খালি গ্লাস। চা ভরে নিয়ে যাবে, বাড়িতে অসুস্থ মা। আশেপাশে রেল কারখানার নানা পদে চাকরি করা মানুষ। উদাসীন মানুষ। আত্মগত মানুষ। বৈষম্যের কথা বলতে নেই। করুণার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ার ভাবোদ্দীপক পোস্ট। দিতে হয়। করুণা জাগে। অচেতন মনের বৈষম্যের পাপবোধে আরাম লাগে। চোখ গড়িয়ে জল নামে। লাইক দিতে দিতে, শেয়ার করতে করতে, পাপবোধ কেন্নোর মত গুটিয়ে যায়। কিছুক্ষণ তো গুটিয়ে থাক। আরাম লাগবে। সংসার মানে পদ। সংসার মানে উপার্জনের মই। সংসার মানে অ্যাচিভমেন্ট। নামের পাশে ডিগ্রী। ডিগ্রীর পাশে টিকটিকির মত অহং। বাড়ির দেওয়ালে, সোশ্যাল মিডিয়ায়, আত্মপরিচয়ের খোদাই। আমার মেধার অর্জিত অধিকার। সাম্য? কিসের সাম্য? উদয় অস্ত খেটে আধপেটা খাওয়া নগরীর মধ্যে বজরা চলেছে উচ্চমেধার। উচ্চমেধা - অধিক উপার্জন। সরল হিসাব। জটিল নীতি। মেধার পাশে ওকে? চাতুরী। অন্যদিকে তাকাও।       গুরুদেব বসে। এসি অন। চারটে এসি। ভক্তের দল পদ্ম হাতে। কাঙাল গুরু, দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের জন্য প্রাণকাঁদা করুণামূর্তিগুরু এখন ধনীভক্তের পুঁজি। গুরুমূর্তি পাথর হয়ে কাঁচের মধ্যে। ভক্ত আসছে দলে দলে। আজ গুরুপূর্ণিমা। ধনী মঠ। ধনী ভক্ত। উচ্চমেধা। উচ্চবিত্ত। পাগল প্রেমিক স্তব্ধবাক। সেই পাগলটা? যার পকেট ভর্তি বিস্কুটগুঁড়ো। কই সে, কই সে? লাইনে দাঁড়িয়ে ভক্তের দল। "ঈশ্বর দর্শন জীবনের উদ্দেশ্য... কামকাঞ্চন ত্যাগ না হলে হবে না"... গুরুর কথা পাতায় পাতায়। ঠাণ্ডা ঘরে ঘুমন্ত পাতা। নানা মতের ভক্তের দল। নানা মত নানা গুরু। মতের বৈষম্য। কিন্তু একখেনে মানু্ষ এক। কোথায় এক?       মানুষ কি চায়? সুখ। মানুষ কি চায় না, দুঃখ। কে দেবে সুখ? গুরু অর্থ মেধা শ্রম চতুরতা উদাসীনতা স্বার্থপরতা।       মানুষ চায় দেহের সুখ, নিরাপত্তার সুখ, মানের সুখ, নামের সুখ। মানুষ চায় না দুঃখ। দেহের দুঃখ, অপমানের আশঙ্কার দুঃখ, নিজের নামের অনাবিষ্কৃত থেকে যাওয়ার ক্ষোভ। ঈর্ষা জমছে কেঁচোর মত। ভিজে ভিজে গা। "সচ্চিদানন্দ বই গুরু কই? মানুষ কখনোও গুরু হতে পারে না" বললেন দক্ষিণেশ্বরের পাগল বামুন। তবু গুরু হলেন নিজে, কারণ "সবাই কি অনন্তকে ধরতে পারে?" বললেন।       মানুষ অনন্তকে সান্তে পেল। সান্তে সান্তে বিরোধ বাধল। সীমায় সীমানায় স্পর্ধা! জটিল অঙ্ক। সত্য অনন্ত। জ্ঞান অনন্ত। তবু হিসাবী জ্ঞান হল পাথর। ভাবনা আটকালো। স্রোত স্তব্ধ হল। উড়ন্ত সাদা চিল সেদিন থেকে গুরু না, কবিকে খুঁজে ফিরল। কবি বলবে সত্য কথা। পাথর গলবে। স্রোত বইবে। আজ হোক গুরুপূর্ণিমা। আমি খুঁজছি কবিতা। আমি খুঁজছি মানুষ। গলিত মেধা মানুষ। বাউলের একতারা। স্রোতে গড়ানো পাথর। বৃষ্টিধরা মেঘ। লোভহীন অর্থহীন হাসি। একটা আরামদায়ক চিত্তজাত মৃত্যু। বাঁচার জন্য।
308
Sat, 07/13/2019 - 18:00
            শুভবুদ্ধি কি? পাঠ নির্ভর? না। শুভবুদ্ধির উৎস কি তবে? বইপড়া জ্ঞান মানুষকে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন করে না, এ বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে প্রতিটা পরীক্ষায় আর এতগুলো নিয়ম বানাতে হত না টুকলি থেকে বাঁচার জন্য। এত সিসিটিভি, এত চেকিং। যত উঁচুদরের পরীক্ষা তত নিয়মের আধিক্য, প্রায় অন্তর্বাসটুকু খুলে হলে ঢুকতে হয় এমন নিয়মকানুনের বহর সেখানে। অর্থাৎ প্রমাণিত হচ্ছে যে মানুষের দুষ্টবুদ্ধি বইয়ের অক্ষর চাপা পড়ে মরেনি, মরে না। সেখানে ‘কাজের মানুষ’ বানানো হয়, মানুষ বানানো হয় না।        অনেকবার শুনেছি – মানুষ গড়ার কারিগর। কথাটা ধোঁয়াশা লাগে। মানুষ বলতে আমরা শুভবুদ্ধি সম্পন্ন জীবই বুঝি। এখন গোড়ার কথা হল, বললেই যদি বুঝবে তবে গীতাটা কৃষ্ণ মহাশয় দুর্যোধনকে বলতেন, অর্জুনকে নয়। এই ইঙ্গিতটা খুব একটা বড় ইঙ্গিত শুভবুদ্ধির খেই খোঁজার জন্য। কেমন একটু বিশদে বলি।        আমায় একটা কথা অনেকবার শুনতে হয়েছে – আপনি/ তুমি যা বলছ তা তত্ত্বগতভাবে ঠিক, কিন্তু আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা তা না। আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক বেশি তোমার/ আপনার থেকে, আমি যা জেনেছি জীবন থেকেই জেনেছি, অর্থাৎ আমি অব্যর্থ ঠিক, তুমি শৌখিনগতভাবে ঠিক, আদতে ভুল।        আগে এই জটিলতাটা কাটিয়ে নিই। একজন মানুষকে বহুযুগ আগে প্রায় সবাই বলেছিল, সূর্য স্থির আর পৃথিবী যে ঘুরছে, সে কথাটা তুমি তত্ত্বগত বৌদ্ধিক অহংকারে বললেও, আদতে কিন্তু ঠিক নয়। আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, পৃথিবী স্থির, সূর্য ঘুরছে।  গল্পটা আমাদের জানা। মানুষটাকে কি লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছিল, সেও আমাদের জানা। শুভবুদ্ধির কথাটাও তেমন। তুলসীদাসজী বলছেন, সারাজীবন অমৃতের কথা শুনেই গেলাম, আর চোখে দেখলাম শুধু বিষ। এই শ্লেষাত্মক কথাটার মধ্যে সত্যের দ্যোতনায় বেজেছে। অর্থাৎ যা কিছু শুভ তা আমার অন্তঃস্থলে প্রজ্ঞার মধ্যে সুপ্তাবস্থা থেকে ক্রম বিকশিত। মানুষের সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়েছিল বর্বতার মধ্যে দিয়ে। ক্রমে তা মার্জিত হয়ে একটা সুসংহত সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলল। একটা পরিপূর্ণ, আদর্শ সমাজের ছবি যেন মানুষের প্রজ্ঞার গভীরে আছেই। সেই ছবিকে সে পূর্ণতার রূপ দিতে চাইছে। সব ক্ষেত্রে। সে যেন ভিতর থেকে বাইরে নিজেকে প্রকাশিত করে চলেছে লক্ষ ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে। তবু সে দমে যাচ্ছে না। যেন সেই পূর্ণতার উপর তার আজন্ম অধিকার। সে যদি সেই আদিম বর্বরতার অভিজ্ঞতাকেই চরম জেনে থেমে যেত তবে অসম্ভব ছিল এতটা রাস্তা এগিয়ে আসা। সামঞ্জস্য, সহাবস্থান, সভ্যতাস্থাপন – এর ছবি তার মনের মধ্যেই ছিল। পশুর হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষ একত্রে বাঁচতে শুরু করেছিল, ইতিহাসের এই কথাটা আমার কেমন সম্পূর্ণ সত্যি কোনোদিন লাগেনি। এখন যত বয়েস হচ্ছে তত আরো মিথ্যা মনে হচ্ছে।        বর্তমানের দর্শন বলে, আমাদের বোধের এ বিশ্ব না তো সম্পূর্ণ চেতনা না সম্পূর্ণ জড়। দুইকে নিয়ে একটা সৃষ্টি। কেনো উপনিষদ বলে, যদি তুমি অবিদ্যার আরাধনা করো তবে তুমি অন্ধকারে পতিত হবে, আর যদি তুমি শুধু বিদ্যার আরাধনা করো তবে আরো অন্ধকারে পতিত হবে। এও কি সেই জড়-চেতনের যুগ্ম অবস্থানের কথা বলতে চাইছে? বর্তমান যুগের একজন মহান স্নায়ুবিজ্ঞানী অ্যান্টোনিও দামাসিও দুটো বিখ্যাত বই লিখেছেন, এক, দার্শনিক দেকার্তের দৃষ্টিভঙ্গীর সীমাবদ্ধতা নিয়ে (Descartes’ Error), আর দুই, স্পিনোজার দর্শনের সারবত্তা নিয়ে (Looking For Spinoza)। স্নায়ুর গতিপথ, স্নায়বিক কার্যাবলীর সূত্র নির্ধারণের মাধ্যেম আত্মসত্তার খোঁজ এক অসামান্য প্রয়াস যা দামাসিওর গবেষণার মধ্যে বারবার আসছে। তার আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ – অনুভব ও আবেগ নিয়ে। অন্য অর্থে অনুভব ও আবেগের বিজ্ঞান নিয়ে।        পূর্ণতার বোধ মানুষের মননের, অভিজ্ঞতার না। আমরা যত অভিজ্ঞতা নির্ভর, আমরা তত সীমাবদ্ধ। আমরা যত মনন নির্ভর আমরা তত কল্পনাবদ্ধ। এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটায় যে, সেই আমাদের শুভবুদ্ধি। তবে কি তা ফ্রয়েডের ইদ-ইগো-সুপারইগো? না। শুভবুদ্ধি সেই ইগোর একটা ক্ষীণ আভাস। কিন্তু শুভবুদ্ধির শিকড় আরো গভীরে, প্রকৃতির আরো নিবিড় রহস্যালয়ে।        শুভবুদ্ধির উৎস খুঁজতে আমাদের স্নায়ুবিজ্ঞানের সাথে হাঁটার সময় এসেছে। আমাদের দর্শন, আমাদের এথিকস, আমাদের সমাজচেতনা, ব্যক্তিচেতনাকে বুঝতে আমাদের স্নায়ুবিজ্ঞান আরো সাহায্য করবে। মস্তিষ্ক একটা জটিল গ্যালাক্সি। তার মধ্যে যেন একটা ব্ল্যাকহোল কোথাও, হয়ত যা মানুষের ধ্যানের পরম সত্য – ঈশ্বর। রামকৃষ্ণের উপমার সেই বাড়ির গিন্নীর সবকিছু জমিয়ে রাখা কৌট। মস্তিষ্কের রহস্য উন্মোচনের সাথে সাথে মানুষের চেতনার নানা দিক উন্মোচিত হবে। আমাদের সমস্ত চিন্তা, চেতনা, আবেগ, অনুভব – কোন মাটি থেকে নানা রূপ হয়ে আমাদের ব্যক্তিসত্তায় বিচ্ছুরিত হয়ে চলেছে রাতদিন? মস্তিষ্কের কোন প্রদেশের কোন জটিলতায়, কোন অনুরণনে মানুষের আত্মচেতনা জাগ্রত হচ্ছে? আত্মপরিচয় লোপই বা পাচ্ছে কোন প্রদেশের ল্যাণ্ডস্লাইডে? খোঁজো, খোঁজো। আজ বিজ্ঞান-দর্শন-ধর্ম একসাথে একটা পরিচয় খুঁজতে চেষ্টা করছে। মহান মনোবিজ্ঞানী কার্ল ইয়ুং তার শেষ গ্রন্থে ( Man And His Symbols) ধর্মের নানা প্রতীক ও তার ব্যবহার নিয়ে একটা অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপ আলোচনা করেছেন। আর সবার ছুঁৎমার্গ থাকতে পারে, কিন্তু বিজ্ঞানের ছুঁৎমার্গে হাঁটলে চলে না। তাকে যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই তত্ত্ব মেনে চলতেই হয়। তাই ঘটছেও।        তবে শুভবুদ্ধির উৎস কি? জানি না। আমরা এতটা সে জানি আছে, আমার অস্তিত্বের আদিমলগ্ন থেকেই আছে। তার ব্যতিক্রম হওয়াটাকেই আমরা বলছি – অসভ্য, বর্বর, আদিম। নানা ‘প্যাথ’ যোগ করছি নানা শব্দের পিছনে, সাইকোপ্যাথ, সোসিওপ্যাথ ইত্যাদি। মূল কথাটা হল যে আমাদের শুভবুদ্ধির দিকের পথ, যা আবুল ফজলকে আকবর বলেছিলেন, ‘রাহ আকল’ – এই হবে সভ্যতা গঠনের পথ।        শেষ প্রশ্ন। বুদ্ধি কি অশুভ হতে পারে? আমি এই কথাটাই বলে আমার বকবকানি শেষ করব। আমার নিজের বোধ বলে হতে পারে না। একজন মানুষ খুন করছে, ধর্ষণ করছে, বোমা বাঁধছে, এ সব কি কোনো বুদ্ধির প্ররোচনায়? তাই কি? আমার মনে হয় এর জন্য দায়ী, বিকৃত বিশ্বাস। বিশ্বাস বলতে আমি সচরাচর যা বোঝায়, ধর্মে বিশ্বাস, অমুকে বিশ্বাস ইত্যাদি বলতে চাইছি না। আমি যা বলতে চাইছি তার যোগ্য কোনো শব্দ আমি জানি না। তাই এই ‘বিশ্বাস’ শব্দটাকেই আমি ব্যবহার করতে চাইছি। বিশ্বাস বলতে আমি তাই বলতে চাইছি যা - আবেগের ‘হ্যাঁ’। সে ‘হ্যাঁ’ না-এর দিকেও হতে পারে। সে ‘হ্যাঁ’ ধ্বংসের দিকেও হতে পারে। এমনকি আত্মধ্বংসের দিকেও হতে পারে। এই বিশ্বাস শব্দটা অনেকটা আকরিকের মত। তাকে মার্জিত করতে যে আলো প্রতিফলিত হয় তার উপর তাকেই কি আমরা বুদ্ধি বলি না? যে বুদ্ধি তার গভীরে গিয়ে যেটুকু ভালো তাকেই স্বীকার করে নেয়, বাকিটাকে হয় ফেলে দেয়, নয় নিষ্ক্রিয় করে রাখতে চায়। আজ কাউকে গারদে ভরে রেখে যে কাজটা আমরা করি, তার সে প্রবৃত্তিকে নিষ্ক্রিয় রাখার চেষ্টা করার জন্যেই তো। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, মানুষের মধ্যের একটা বিকৃত শক্তিশালী বিশ্বাস তাকে অসামাজিক, অন্যায়াকারী, দুর্বৃত্ত গড়ে তুলছে। বুদ্ধি কখনও মন্দ হয় না। হতে পারে না। এই আমাদের একমাত্র সম্বল। তাকে গড়ে তুলতে হবে যদি বলি, সে অগভীর কথা, তাকে আবিষ্কার করতে হবে। এই আবিষ্কারের নামই জীবন – সাধন। তাই এত অহং নাশের কথা। কেন? বলছি।        মানুষের দুটো আমি সত্তা – এক, তার ব্যক্তিসত্তা, দুই সামাজিক সমষ্টিগত ‘আমিসত্তা’। এই দ্বিতীয় ‘আমিসত্তা’-র মানুষ পাওয়া সব যুগেই বিরল। যারা সেই স্তরে পৌঁছিয়েছেন তারাই বুঝেছেন ব্যক্তি মানুষের মধ্যে যে সমষ্টিমানুষের বোধ আছে, সেই বোধকে জুড়ে যে আমি তৈরি হয় সে আমাদের বুদ্ধি-যুক্তির অতীত, কিন্ত সেই আমাদের পরম ধারক বাহক। তাকে যে নামেই চিহ্নিত করি না কেন, অবশেষে স্পিনোজার সেই অনন্ত-অসীমের বোধই আমাদের এগোবার দরজা। যা স্পিনোজার ঈশ্বর। মানুষের সাথে সাথে ঈশ্বর শব্দটারও যেন শুদ্ধিকরণ হল স্পিনোজার দর্শনে। আজ স্নায়ুবিজ্ঞানের সূত্রও বলতে চাইছে, “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া”...কিম্বা, “অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান”। সেই অনন্তের ডানার শব্দই আমার বুদ্ধি, তা কোনোদিন মলিন হতে পারে না। হবেও না। মেঘে ঢাকতে পারে। তাও বা কতদিন?  
309
Fri, 07/12/2019 - 10:46
    প্রমাণপত্র নিয়েছেন? টিটি দেখবে... এয়ারপোর্টে ঢোকার আগে দেখবে... পুলিশ দেখবে... হোটেলে চেক-ইন-এ চাইবে। আরো কত কত জায়গায় দেখবে। আপনার আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদি সাথে রাখুন। বয়েস হলে প্রতিবছর ব্যাঙ্কে জানিয়ে আসুন আপনি জীবিত – প্রমাণ দিন। আপনারা ভালোবেসে বিয়ে করুন, কি পরিবারের চাপে, কি যে কারণেই হোক – প্রমাণ কই? মরেছেনই যে তারই বা প্রমাণ কই? না না, অমুকে দেখেছে, তমুকে শ্রাদ্ধে খেয়ে গেছে বললেও হবে না, প্রমাণ কই?        এ সব তো হল সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রমাণ। গায়ে লাগে না। স্মৃতিতে লাগে। সব মনে রেখে রেখে গুছিয়ে রাখতে হয়। এরপর আপনি যদি মামলা-মোকদ্দমা ইত্যাদি করেন, সেখানে আরো প্রমাণ।        আপনি যোগ্য স্ত্রী তার প্রমাণ কি? আপনি যোগ্য প্রেমিক তার প্রমাণ কি? আপনি যোগ্য বন্ধু তার কি প্রমাণ? ব্যস, এইবার? কোত্থেকে কাগজে সই করিয়ে এনে চোখের সামনে মেলে ধরে বলবেন, ‘এই দেখো, প্রশাসনিক ভবন থেকে আমায় কাগজ দিয়েছে – আমি স্বামী / স্ত্রী / পুত্র / কন্যা / পুত্রবধূ হিসাবে এক্কেবারে যোগ্য, অর্থাৎ উত্তীর্ণ।’ না, সে পথ নেই। সে পরীক্ষার প্রশ্নাবলী আম্বেদকর কেন, কেউ ঠিক করে যায়নি। দেখলে না, অমন বউটারে রাজ্যবাসীর চূড়ান্ত দাবিতে আবার বার্নিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়েছিল। সে তিনি পটাং করে মাটির নীচে সেঁইধে গেলেন আলাদা কথা, কিন্তু প্রমাণের কথা উঠেছিল তো? কেমন রাজনীতি একটা পরিবারনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ল দেখলেন? কখন যে রাজনীতি পরিবারনীতিতে ঢোকে, আবার পরিবারনীতি রাজনীতিতে ঢোকে বলা ভারি শক্ত।        এখন কথা হচ্ছে, প্রশ্নাবলী কে ঠিক করবে? আপনার পরীক্ষক। সংরক্ষণশীল পরিবার, না আধা-সংরক্ষণশীল, না সম্পূর্ণ উন্মুক্তমনা? তারা ঠিক করবেন। কখনও সব ঢেকে, কখনও প্রায় সব খুলে আপনাকে প্রমাণ করতে হবে আপনি বংশের উপযুক্ত কঞ্চি। অর্থাৎ, আপনাকে নানাভাবে প্রমাণ করতে হবে আপনি যোগ্য। যেমন কখনও জিন্সের জায়গায় খদ্দর পরে, এক পোচের জায়গায় চার পোচ সিঁদুর লাগিয়ে, বাড়ি থেকে টাকা এনে, আধপেটা খেয়ে, না খেয়ে, পরে খেয়ে, পা টিপে, ঝাঁট দিয়ে, কাপড় কেচে, চোব্যচোষ্যে গেলার ব্যবস্থা করে, পুত্র জন্ম দিয়ে ঠিক সময় মত ইত্যাদি ইত্যাদি। এর উপরে আপনার যোগ্যতা নির্বাচন হবে। যদি এক্কেবারে ফেল করেন তবে ঝুলে যেতে পারেন কিম্বা মাটির নীচে সেঁধোবার সুযোগ না পেয়ে অগ্নিদগ্ধ হবেন। পরেরদিন কাগজে ছবি বেরোবে। উঁহু, সবাই আপনার ব্যথায় সমব্যথী হবে না। অনেক শাশুড়ি বউমাকে ছবি দেখিয়ে সাবধান করবেন, অনেকে বুঝিয়ে দেবেন, “তাও তো আমরা এ সব করি না।” অনেক বউমা নিজে থেকেই সাবধান হয়ে যাবেন। তবে এ তো সাধারণ স্থূল গল্প। এর চাইতে সূক্ষ্ম প্রমাণ তাগাদা জগৎ কি নেই? আছে।        তুমি আগের মত কথা বলো না... আগের মত তোমার শরীর সাড়া দেয় না... আগের মত তাকাও না... আগের মত রঙের জামাকাপড় পরো না... অর্থাৎ কিনা এসব করে প্রমাণ দাও, “তুমি তো সেই আগের মতই আছো”। তুমি ফেসবুকে, হোয়াটস অ্যাপে, রাস্তাঘাটে, শপিংমলে, সিনেমা হলে, বসার ঘরে, শোয়ার খাটে প্রমাণ দাও – তুমি একনিষ্ঠ, নইলে আমার সন্দিগ্ধ ভালোবাসা বাঁচবে কি করে?        তুমি সময় মত ফোন ধরে, সঠিক সুরে উত্তর দিয়ে, সঠিক সময় দেখা করে, সঠিক বস্ত্রে, সঠিক পোজে দাঁড়িয়ে থেকে প্রমাণ দাও – তুমি ভালোবাসো। আরো আছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কে আমার বা আমার গুষ্ঠির ছবিতে, লেখাতে, ইভেন্টেসে লাইক দাও, কমেন্টস দাও, প্রমাণ করো। অন্যের কীর্তিকলাপে না, আমার কীর্তিকলাপের দিকে হাঁ করে চেয়ে বসে থাকো রাতদিন। না, একদিনও ব্যতিক্রম হবে না। যদি ব্যতিক্রম হয়, তোমার মেলে, মেসেজবক্সে, হোয়াটস অ্যাপে – অভিমান, কোমল থ্রেট, ব্ল্যাকমেল – কি হল আমায় এড়িয়ে যাচ্ছ? নতুন পেলে? আমায় মন ভরছে না? প্রমাণ দাও... প্রমাণ দাও... প্রমাণ দাও।        ঘুম থেকে উঠে গুড মর্নিং থেকে শুরু করে রাতে গুড নাইট অবধি প্রমাণ করে যাও তুমি সম্পর্কে অন আছো, তোমার অ্যাভেলিভিলিটি লাইটটা যেন সবুজ থাকে হরদম জীবনে, তুমি প্রমাণ দাও, দিয়েই চলো; না, থেমো না, থামলেই আক্রান্ত হবে। ক্রমে তুমিও সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠবে। কিরকম? তখন তুমি ভাববে, আচ্ছা অনেকক্ষণ হল প্রমাণ চাইছে না তো? তবে কি অন্য কাউকে... তবে কি আমাতে সাফোকেটেড... ইত্যাদি ইত্যাদি, অর্থাৎ সাবধান, তোমাকেও ধরেছে সে রোগে।         কিন্তু কিসের এত প্রমাণ চাওয়া? কিসের এত সন্দেহ? কেন এত নিরাপত্তাহীনতা? বাইরে ব্যক্তিত্বের প্রবল প্রতাপ, কিন্তু নৈতিক দুর্বলতায় অন্তঃস্থল ক্ষয়িষ্ণু রোগে জর্জরিত।        এই তো হল তত্ত্বকথা, নীতির কথা। ব্যক্তিত্ব আর চরিত্রের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। প্রথমটার ভান চলে, দ্বিতীয়টার নয়। প্রথমটার বাঁধ বাইরে থেকে, দ্বিতীয়টার ভিত নিজের ভিতর। শক্ত হলে দাঁড়ানো যায়, নইলে বারবার নুইয়ে পড়ে। চারদিকে এত বাঁধ দেওয়ার তোড়জোড় যে ভিত গড়ার আর খেয়াল নেই কারোর। শক্ত বাঁধে ঠোকাঠুকি, কিন্তু নিজের ভিতে দাঁড়িয়ে শক্তহাতে নিজেকে সামলানো হাতের বড় অভাব। প্রমাণ দিয়ে দিয়ে, প্রমাণ চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত শরীরে ঘুম। ঘুম না, ঘুম না, ওটা অবসন্নতা। প্যাকেটে করে ঘুম বিকোচ্ছে ওষুধালয়ে।       আচ্ছা প্রমাণ যদি নাই মেলে? যদি দূরত্ব বাড়ে অযুত নিযুত, ভালোবাসা কি মরেই তবে? ভালোবাসা কি নৈকট্যে বাঁচে না হৃদয়ে বাঁচে? ভালোবাসা কি ঘেঁষাঘেঁষি না চটকাচটকি না ফোনাফুনি না গল্পাগল্পি? এগুলো সব ভালোবাসা হলেও... বাকি কি তবে কিছুই নেই? বোঝাবুঝি? বিশ্বাস রেখে নিশ্চিত জীবন? সে কি নেই, সে কি নেই? নাকি সেও গেল নির্বাসনে? হায় রে হায়, ভালোবাসা তবে শুধুই শরীরী... হরমোন বোঝা চাপের তরী... সম্পর্ক তবে আদালতে বাঁচা মন উকিলের জারিজুরি।
310
Wed, 07/03/2019 - 13:00
           অভ্যাসের সম্পর্কের দায় বড় বালাই। ছাড়তে গেলে মনে হয়, অ্যাদ্দিনের সম্পর্ক, নষ্ট হবে? আবার রাখতে গেলে বিগত দিনের যত বিশ্বাসঘাতকতা, মিথ্যাচার, চালাকি, অসম্মান ইত্যাদি স্মৃতিতে ভিড় করে এসে বলে, এখনও তাড়াওনি?           না তাড়ানো হয়নি। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে শান্তি লেগেছে। ঘরে এলে অস্বস্তি লেগেছে – তবু তাড়িয়ে দেওয়া হয়ে ওঠেনি। বলা হয়ে ওঠেনি – আর না। কিন্তু কেন?        এই কেন-র উত্তর না কোনো নীতিমালায় আছে, না কোনো মহাপুরুষের বাণীতে আছে। এ নিতান্তই দুর্বলতা। কিসের দুর্বলতা?        এ ভালো প্রশ্ন। দুর্বলতা আবার কিসের? যদি বলো ভালোবাসার দুর্বলতা, তবে বলব, ভালোবাসা যদি দুর্বলই হল তবে সেকি আর ভালোবাসা রইল? না তো। যা কিছু তার সত্তা হারায় সেকি আর সে থাকে? থাকে না তো। মৃত শরীরের বোঝাটা থাকে বোঝা হয়ে। তবু সে থাকে। দুর্বল প্রাণের প্রশ্রয় আঁকড়ে থাকে। তখন ক্ষণে ক্ষণে তার অভিমান, তার রাগ, একে অন্যকে দোষারোপ, একে অন্যের নামে সুযোগ পেলেই নিন্দা – এগুলো নিতান্তই রোগের লক্ষণ। আসল রোগ হল, মানুষটা আছে, কিন্তু সে সম্পর্কটা আর নেই।         এ অভ্যাসের অভিশাপ। যখন দূরত্বই ভালো, তখন নৈকট্য শুধু অস্বাস্থ্যকরই নয়, বিপদযুক্তও বটে। ক্ষমার অভিনয় তপ্ত, ক্ষুন্ন, ক্ষুব্ধ হৃদয়ে ভাড়া না দেওয়া ভাড়াটের মত। গেলে ঘর ফাঁকা, থাকলে ঘরে উৎপাত। এ জ্বালার মধ্যে এসে জোটে কিছু মায়ের ঘরের মাসি আর বাবার ঘরের পিসী। তারা এদিকেও যেমন ওদিকেও তেমন। এমন পরাশ্রয়ী মানুষরা মিথ্যাচারণ আর মিথ্যাকথাকে রীতিমত একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে চলে যায়। তার চাইতে মজার কথা, সে মিথ্যা ধরা পড়ে গেলে ন্যূনতম লজ্জার কোনো আভাসও চোখেমুখে ফুটে ওঠে না, খানিক বিব্রত হয়, এই আরকি। ভাবটা এমন, “তুমি তো জানোই আমি এমন চরিত্রের সেই নিয়ে আবার জলঘোলা করার কি আছে।“ সত্যিই আশ্চয্যি হতে হয় মানুষের রকমসকম দেখে। তবে এদের নিয়ে কথা বাড়ানো বৃথা, এরা বাঁচে শুধু আবর্জনায়। যদিও বাইরে কাপড়চোপড়ে একদম ধোপদুরস্ত, “ইয়ে পরী চ্যাহেরা, লোগ ক্যায়সে ক্যায়সে হ্যায়”...গালিব।        এসবের মূল ওই একটাই – দুর্বলতা। মৃত শরীরকে নিয়ে বেড়ানো। মৃত আস্থা, মৃত ভালোবাসা, মৃত বিশ্বাস, মৃত অপেক্ষা, তবু যেন সৎকার করে হয়ে ওঠা হচ্ছে না। এ যেন সেই মৃত শরীর আগলিয়ে রেখে বাঁচার মতই বিকৃত আসক্তি। মনের মধ্যে তিক্ততা বেড়েই চলেছে অথচ বাইরে ভদ্রতা, সামাজিকতা, লৌকিকতার মুখোশ আর টান মেরে খুলে ফেলা যাচ্ছে না। এর পরিণতি ভালো নয়। নিজের চোখে দেখেছি মানুষ কেমন ভাবে এই চাপের মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে মানসিক ভারসাম্য হারায়। দুশ্চরিত্র, মিথ্যুক, কপট মানুষের সাথে বসবাসের মত অভিশাপ নেই জেনেও, বেরিয়ে আসার সাহসটুকু সঞ্চয় যেন কিছুতেই করা যায় না। ভয় চেপে বসে।  অনিশ্চয়তার আশঙ্কা চলবার শক্তিকে বিবশ করে দেয়। প্রতিটা দিন নিজের মৃত্যুর প্রতীক্ষা করবে সে, তবু দরজা খুলবে না। আরো খুলতে দেবে না ওই পরাশ্রয়ী মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলো। কিন্তু যে মানুষটা একমাত্র দৈব আর মৃত্যুর দিকে তাকিয়ে জীবন কাটাচ্ছে, সে যদি একবার জানত ওর চাইতে ঢের সোজা দরজাটা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসা, অনিশ্চয়তা বিশ্বাসঘাতক হয় না, বিশ্বাসঘাতক হয় বিশ্বস্ততা, শুধু এই কথাটা বুঝলেই হল।        এ সব মানুষেরা আশেপাশেই। সংসারে আমার নিন্দুকের অভাব নেই। আজ যদি আমি সক্রেটিসের যুগে জন্মাতাম হয়ত বা বিষ খাইয়ে প্রাণে মারা হত আমায় যুবকবৃন্দের মাথায় ভুল চিন্তা ঢোকানোর দায়ে। সাজানো আরামদায়ক মিথ্যায় কোনোদিন সুখ পাইনি, আজও পাই না। তাকে বরাবর অস্বীকার করেছি। অতি নিকটের বন্ধু বা বন্ধুদের বিশ্বাসঘাতকতাতেও হার স্বীকার করে আপোষ করে বাঁচিনি। আজও বাঁচব না। আমার কথাটা আমি বলেই যাব। যে সত্যকে বিশ্বাস করেছি, মঙ্গলজনক জেনেছি তাকে বলেই যাব। ঝড় উঠুক, বন্যা আসুক, ফাঁসি দিক – যাই হোক। কারণ জানি এগুলোর পরেও মানুষ বাঁচে, কিন্তু একবার মিথ্যার সাথে গলা মেলালে আর কোনোদিন আলো দেখা যায় না। সে যেন আলোর মধ্যে থেকেই অন্ধকারে বাস করতে চাওয়া, তাকেই আমি সব চাইতে ন্যাক্কারজনক জীবন্মৃত বলি। তাই আমার সাথে বন্ধুত্ব বড় সোজা রাস্তায় হাঁটা নয় গো, হুম। সাবধান!  
311
Mon, 07/01/2019 - 12:00
         এ জগত তোমার প্রয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত, তোমার লোভের জন্য নয় - মহাত্মা গান্ধী   ধর্মহীন, দর্শনহীন, আদর্শহীন একটা সময়। বুদ্ধি তীক্ষ্ম। কিন্তু বুদ্ধির উপর ভরসা নেই। যে যত বুদ্ধিমান তাকে তত ভয়, তাকে তত সন্দেহ, তাকে তত নজরে রাখা – মতলবটা কি? বুদ্ধি এভারেস্টের চূড়ায় পতাকা পুঁতছে, বিশ্বাস এগোচ্ছে না। বিশ্বাস গলে গলে সংশয় নদী। বিষাক্ত জল। দুর্গন্ধ। বুদ্ধি নিষ্ঠুর। বুদ্ধি স্বার্থপর। বুদ্ধি একমেবদ্বিতীয়ম হবে - বাসনা। বুদ্ধি চরকার মত। নিজেকে পুড়িয়ে সব পুড়িয়ে ছারখার করে নিজে নিঃস্ব। বুদ্ধি ফ্রাঙ্কেস্টাইন।         বুদ্ধি – জলশূন্য পৃথিবী। বুদ্ধি – পারমাণবিক বোমা সমৃদ্ধ পৃথিবী। বুদ্ধি – বিশ্ব উষ্ণায়ণের পৃথিবী। বুদ্ধি – মানবিকতা শূন্য পৃথিবী। বুদ্ধি – মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা শূন্য দর্শন। বুদ্ধি – প্রজ্ঞাহীন আস্ফালন। বুদ্ধি – অনুকম্পাহীন লোভের সহোদর। বুদ্ধি – সন্দেহের সিল্করুটে খাদের আশ্বাস। বুদ্ধি – অশান্ত, এখনই...। বুদ্ধি – আমি আমি আমি...         প্রজ্ঞা – শান্তি। প্রজ্ঞা – আহরিত না, অর্জিত। প্রজ্ঞা – চর্চিত না, উপলব্ধিগত। প্রজ্ঞা – স্মৃতিগত না, অনুকম্পাসিক্ত। প্রজ্ঞা – ব্যক্তিপুষ্ট সত্তা না, সমষ্টিপুষ্ট সত্তা। প্রজ্ঞা – জন্মলব্ধ, স্বভাবসিদ্ধ, আবিষ্কারমুখাপেক্ষ।         প্রজ্ঞা ভালোবাসা। প্রজ্ঞা অনুকম্পা। প্রজ্ঞা নির্বৈরিতা। প্রজ্ঞা ধৈর্যশীলা। প্রজ্ঞা আলোকস্বরূপা।          পৃথিবী জলশূন্য হতে চলেছে – এ বড়কথা না। এ ফলাফল। পৃথিবী প্রজ্ঞাশূন্য হয়ে পড়ছে, বহুকাল। অনেকে বলেছে – শুনিনি। একটা গল্প - ভাগবতে আছে, ধর্ম আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে গাভীর বেশে শুয়ে, তার চারটে পা। কি কি চারটে পা – তপস্যা, শৌচ, সত্য ও করুণা। এ সকলের মধ্যে বলা হচ্ছে করুণাই একমাত্র যা পালনীয় কলিযুগে। কলিযুগ কি? জানি না। তবে হয়ত বলা হচ্ছে অন্ধাকারের যুগ, সংশয়ের যুগ। করুণা কি? প্রজ্ঞার জননী। “জ্ঞানের বিহনে প্রেম নাই”, আমার সময়ের কবি বললেন – এ কোন প্রেমের কথা? এ কোন জ্ঞানের কথা? কোথায় জ্ঞান মানে প্রেম আর প্রেম মানে জ্ঞান। যেখানে যেখানে মানবিকতা বিকাশের প্রতিষ্ঠান। প্রথম, বিদ্যালয়। শিক্ষা জ্ঞান ও ভালোবাসার ভিত্তিতে হওয়ার কথা ছিল। দ্বিতীয়, বিচারালয় – বিচার জ্ঞান ও অনুকম্পার সমীকরণে দাঁড়াবার কথা ছিল। চিকিৎসালয় – জ্ঞান ও সহানুভূতির সাহায্যে দাঁড়ানোর কথা ছিল। হল না।         কেন? কারণ, লোভের সাথে সিঁধ কাটল বুদ্ধি। জ্ঞান ও প্রেমের স্বরূপ – প্রজ্ঞাকে সরিয়ে বুদ্ধি আর লোভ এল বিচক্ষণতা, তাৎক্ষণিক লাভের ছদ্মবেশে। ঊর্দ্ধে ওঠা হল, উদ্ধার হওয়া হল না। সত্য নেই, শুদ্ধতা নেই, তপস্যা নেই, করুণা নেই। আছে তত্ত্বের পর তত্ত্ব। ছুরি ধার করার প্রতিযোগিতা। ধার যত তীক্ষ্ণ, তত নেশা। যত নেশা তত ঘোর। তত বেগ। যত বেগ তত অন্ধতা। যত অন্ধতা তত উল্লাস। ক্রমে সেই তীক্ষ্ম ধারে নিজের হাত ক্ষত বিক্ষত। প্রথমে আঘাত। তারপরে সয়ে যাওয়া। তারপরে কড়া পড়ে যাওয়া। তারপর আরো তীক্ষ্ণ ধার। সেই কড়া চিরে রক্ত। আবার আঘাত, আবার কড়া পড়ে যাওয়া। সভ্যতা এগোচ্ছে। কড়ার পর কড়া পুরু হচ্ছে। মাঝে মাঝে রক্তপাত। চীৎকার। আবার সয়ে যাওয়া। আবার কড়া পড়া। আবার ধার করার প্রতিযোগিতা। এখন নেশা।         এমনভাবে কড়া পড়তে পড়তে, ধার তীক্ষ্ণ হতে হতে...আমাদের সম্বল - তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধি, যা অযুত নিযুত আলোকবর্ষ দূরে থাকা নক্ষত্রের আলোয় চকমকিয়ে উঠছে, সাথে কড়াপড়া মানুষ।         প্রজ্ঞা, বুদ্ধির চর্চায় না, বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণে। প্রজ্ঞা সহজাত স্বভাবগত বুদ্ধি না, যা প্রতিটি প্রাণীর আছে, যা instinct। প্রজ্ঞা – সহজাত করুণাগত বিবেক – অনুশাসন। উদারচেতনার ঈশ্বরের সংজ্ঞা। উদারচেতনার নাস্তিকের শুভবুদ্ধি – “love is wise” – Bertrand Russell. “শুভ বুদ্ধিই ঈশ্বর” – রামকৃষ্ণ। “whoever is granted wisdom has indeed been granted abundant wealth” Quran. (2.269)        এমন বাণীর উদাহরণ অজস্র। এমন কাজের উদাহরণ – নগণ্য। তাও পৃথিবীটা এতদিন চলছে – এই আশ্চর্য! ভালো করে ভেবে দেখুন – শুধুই জলশূন্যতার সমস্যা? আর সব পূর্ণ?
312
Thu, 06/27/2019 - 08:00
        যখন চারদিকে অত্যন্ত নীচ স্বার্থপরতা, কুটিলতা, ধূর্তামি, সঙ্কীর্ণ পঙ্কিলতা ঘরের দেওয়াল হয়ে উঠতে শুরু করল, মনে হল পালাই। কিন্তু পালাই বললেই কি পালানো যায়, সমাজ তো শুধু বাইরে নেই, নিজের ভিতরেও তার গভীর শিকড়। আর কর্তব্য? সে তো শুধু সমাজের থেকে জন্মায় না, নিজের বিবেকের রসদও তো আছে তাতে। তাই পালানো হল না। কিন্তু পালানোর তাগিদটা নিয়ে দেওয়ালের সাথে মোকাবিলা শুরু হল।       দেওয়াল শুধু যে এরাই গড়ল তা তো নয়! মানুষের অতি-শ্রদ্ধা, অতি-প্রত্যাশাও গড়ল তিলে তিলে। সে প্রতিদিন হিসাব চায়, তার পাওনা মিটিয়ে নিতে চায়। মন নিজেকে নিয়ে নিজের মধ্য একটা আবর্ত তৈরি করে - মিথ্যা মহত্বের আবর্ত। লোভ জন্মায়। তার সাথে জন্মায় হাজার একটা সোনার শিকল। তার প্রতিও নির্মোহ হয় মন একদিন।       মন তখন ছুটি চায়। এতদিন ভাবতাম ছুটি বুঝি পাহাড়ের কোলে, সমুদ্রের সংসার ভোলানো অহর্নিশি গর্জনে, জঙ্গলের গভীরে নিঃসঙ্গতায়। ক্রমে বুঝলাম তা নয়, আমার ছুটি কেবল তোমার কাছে - যে তুমি আমায় দেখেছ আমার সব দোষত্রুটি মিলিয়ে আমার আপন সত্তায়। সেখানে আমি আমিই। কারোর সাপেক্ষে কিছু নই, কারোর তুলনায় কিছু নই। না মহৎ, না নীচ। আমার সত্য স্বরূপটাকে আমি তোমার মধ্যে দেখলাম। তুমিই সেই, যে দাঁড়ালে বিনা আভরণে আমার সামনে, আভরণহীন আমায় গ্রহণ করতে। স্বস্তি পেলাম, ভয়ও পেলাম। কুণ্ঠিত হলাম।       স্বস্তি পেলাম কারণ যা বললাম এতক্ষণ। ভয় পেলাম কারণ, নীড় ভাঙা ঝড় আমি দেখেছি। কুণ্ঠিত হলাম কারণ, নিজেকে এমন আভরণহীন সাদামাটা দেখার অভ্যাসটা চলে গিয়েছিল।       তবু পা বাড়ালাম। নিজেকে বন্ধন মুক্ত করলাম। বললাম, দাঁড়ালাম সামনে তোমার। আমি এমনই। আমি আমিই। সংসারে সহজ সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার সাধনই দুর্লভ, সে সাহস তোমার আছে। এখানে চারদিকে হতে চাওয়ার তুমুল তাগিদ। সঙ্কোচহীন, দ্বিধাহীন, সরল সহজভাবে বাঁচার জন্য যে রসদ প্রাণের গভীরে আছে - তা কেবল মেলে নিজেকে নিয়ে নিজের সমস্ত লোভ বিসর্জন দিলে। জেদ যখন বাইরে ছোটায় তখন তা লোভ। জেদ যখন সমস্ত প্রতিকূলতায় মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে শেখায়, তখন তা সাধন। শিকড়ের যেমন মাটি লাগে আমার তেমনই তোমার কাছে আসা। তুমিই সেই মাটি।       পাঠক এতদূর এসে ভাববেন, কার কথা লিখে চলেছি? কার উদ্দেশ্যেই বা লিখে চলেছি।       এই দুইয়ের উত্তরই ততটা স্পষ্ট নয়, যতটা কৈফিয়তহীন অনুভবের আকাশটা। সেই আকাশে যে ক্ষণিক রঙের আভা এই মুহূর্তটায় স্পষ্ট হয়ে উঠল, সেই মুহূর্তটুকুই হোক সত্য।       এখানে আজ কাল্পনিক ব্যর্থতার আশঙ্কায় তরুণ প্রাণের আত্মহত্যার মিছিল চারদিকে। বিদ্যালয় আজ আত্মহননের যূপকাষ্ঠ। শিক্ষা আজ বিভীষিকা। এ মিথ্যার কুয়াশাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিই - এতটা শ্বাস আমার বুকে ধরে না। আজ যে ঘটনা, যে মৃত্যুর মাত্র কয়েকটা বিদ্যালয়গুলোতে দেখলাম তা বিশালাকায় ডুবো পাহাড়ের চুড়ো মাত্র। তাদের উদ্দেশ্যে আমার কোনো উপদেশ নেই। কারণ উপদেশের কোলাহলে তারা বধির আজ, প্রতিক্রিয়াহীন। আপনাদের ব্যর্থতার গল্প শোনান তাদের, অসহায়তার গল্প শোনান, আর বারবার বলুন কেমনভাবে বন্ধুত্বের হাত ধরে সে ঝঞ্ঝা কাটিয়ে উঠেছেন। সে বন্ধু যেই হোক না কেন। বয়েস, লিঙ্গ, দেশ, কাল - কিছুই শর্ত নয় সেখানে। একটাই শর্ত - "যে আমারে দেখিবারে পায় অসীম ক্ষমায়।"       আমি বারবার বিশ্বাস করেছি, আজও করি - সংসারে সব চাইতে কঠিন, সব চাইতে আবশ্যক সাধন - সহজ হয়ে ওঠার সাধন। নিজের সাথে, পরিবেশের সাথে, সমাজের সাথে। আর তা তখনই সম্ভব - যখন মানুষ সত্য অর্থে বন্ধুত্বের মানে খুঁজে পায় নিজের জীবনে। বন্ধু হয়ে ওঠে নিজের। তার সাথে বন্ধু হয় কোনো বিশেষ একজনের, বা কয়েক জনের। ব্যর্থ হওয়াটা লজ্জার নয়, লজ্জার ভালোবাসতে না পারাটা, নিজেকে, বন্ধুত্বকে, সর্বোপরি জীবনকে। আর কেউ তাকে ক্ষমা করুক চাই না করুক, সে নিজে যেন ক্ষমা করে নিজেকে। নিজের বন্ধু হয়ে ওঠে। সাথে অন্যকেও ক্ষমা করার শক্তি পাবে তখন সে। বন্ধুত্ব ন্যায়-নীতির পরাকাষ্ঠায় গড়ে ওঠে না - ওঠে সহজ সরল শর্তহীন ক্ষমায়। বেঁচে থাকাটা সফল হওয়ার জন্য না, আনন্দে বেঁচে থাকাটাই সার্থকতা।       একজন ধনী মানুষ কয়েকদিন আগে আমায় বললেন, তিনি সপরিবারে প্রতিটা পুজো এখন অনাথ আশ্রমে কাটান। কারণ নিজের সন্তানকে দেখাতে চান, মানুষ কতটা কষ্ট করে বাঁচে। তবেই তো তারা মাটির সাথে নিজের যোগাযোগটা পাবে।   আমি জিজ্ঞাসা করলাম একান্তে, তোর কেমন লাগে পুজোয় কাটাতে সেখানে?          বাচ্চাটা বলল, আগে খারাপ লাগত। এখন ভালো লাগে। ওদের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে যে। এখন না গেলেই খারাপ লাগে।
313
Mon, 06/17/2019 - 12:00
          এখন চলতে ফিরতে মাঝে মাঝেই ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনি। ‘রাম’ নামটা শুনলেই বাল্মীকি মহাশয়, তুলসীদাসজী, কৃত্তিবাস মহাশয় স্মৃতিতে আসে। অবশ্যই মহাত্মার শান্তস্নিগ্ধ মুখাবয়বটাও। এদের মধ্যে তুলসীদাসজীর ‘রাম’ আমার অত্যন্ত প্রিয়। তার একটা কারণ অবশ্যই অসামান্য কাব্য, মনোমুগ্ধকর ভাষা। এত সরল সহজ গ্রাম্য ভাষায় যে এত গভীর দর্শন লেখা যায় তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সে কথা ছাড়াও ‘উত্তরকাণ্ড’ অধ্যায়ে মানুষের চরিত্রের উপমাসহ বিশ্লেষণও অত্যন্ত উপভোগ্য শুধু না কখনও কখনও মনে হয় মনোবিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রীরাও একবার চোখ বুলিয়ে দেখতে পারেন। খুব হতাশ হওয়ার মত নয়।          কিন্তু সে তাত্ত্বিক আলোচনার জন্য এ লেখাটা লিখতে বসিনি। এই যে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি আজ বাংলায় বাজছে, যে রাম সত্যিই বাংলায় সেই অর্থে কোনোদিন তেমন প্রধান দেবতা হিসাবে পূজিত হতেন না, সেই রামের নিজের বক্তব্য কি নিজের পছন্দ অপছন্দ বিষয়ে? আসলে দুই ধরণের পুজো আছে। এক আবেগের, এক অনুসরণের। যখন কেউ কোনো দেব-দেবী যেমন কালী, গণেশ, বিশ্বকর্মা, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদিকে পুজো করছেন, তখন তিনি বিশেষ কোনো কামনায় পুজো করছেন বলা যায়। কারণ সেই দেবদেবীরা কখনও সেই অর্থে মানব চরিত্রে গাঁথা হননি। সেখানে 'কোড অব কন্ডকাক্ট' -এর চাইতে স্তবের প্রাধান্য বেশি। কিন্তু ভারতে রাম ও কৃষ্ণ – দুই নারায়ণ অবতারের উপদেশে কোড অব কণ্ডাক্টের কথা আছে। সেখানে একটা মোদ্দা কথা হল – কেউ বিশ্বাস করে, বা পুজো করে, বা কোথাও মাথা নীচু করেও কোনো বিশেষ ধর্মের হয়ে উঠতে পারেন না। তাকে ‘হয়ে উঠতে’ হবে। যেমন 'শৈল-উপদেশ' দেওয়ার পরেই খ্রীষ্ট সাবধান করে দিয়েছিলেন যে এই কোড অব কণ্ডাক্ট অনুসরণ না করে শুধুমুধু আমার নাম নিয়ে চিল্লামেল্লি করলে খুব একটা লাভ হবে না, আমি সাড়া দেব না, এও তেমন। গীতাতেও দ্বাদশ অধ্যায়ে ভক্তের কোড অব কণ্ডাক্ট বলে শেষে সাবধান করে দিয়েছেন যে, এই সব হলে তবেই তুমি আমার ভক্ত। নচেৎ রাস্তা দেখো। সেখানে কোথাও চন্দন, তিলক, কণ্ঠী ইত্যাদির কথা বলা হয়নি, বলা হয়েছে পুরোদস্তুর মানুষ হয়ে ওঠার কিছু ব্যবস্থাপনা। “অদ্বেষ্টা সর্বাভুতানাং” দিয়ে যে শ্লোকগুচ্ছের শুরু। অর্থাৎ, বলাই হচ্ছে সর্বভূতে হিংসারহিত হওয়া দিয়ে প্রথম পাঠ। সব শ্লোক পাঠের পর যদি কেউ প্রশ্ন করেন যে কিন্তু এইসব তো আমার স্বভাবে নেই, তবে? তখন বলা হচ্ছে, অভ্যাস করো শ্রদ্ধার সাথে, তাতেও তুমি আমার প্রিয় হবে।       অর্থাৎ কিনা রাম বা কৃষ্ণের ভক্ত হতে গেলে জিভের চাইতে চরিত্রের অনুশীলন চাই বেশি, অন্তত এমনটাই এই দুই মহারথী দাবি করেন। এখন গীতা মোটামুটি সব না হলেও বেশিরভাগ বাঙালী বাড়িতে থাকবেই ধরে নিয়ে যারা না পড়েছেন তাদের দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তের লক্ষণ পড়ে নেওয়ার ভার দিয়ে আমি আমার আলোচনার দিকে এগোই, রামের কি মত? তুলসীদাসজী কি বলেন শুনি।     কহহু ভগতি পথ কবন প্রয়াসা। জোগ ন মখ জপ তপ উপবাসা।।   সরল সুভাব ন মন কুটিলাঈ। জথা লাভ সন্তোষ সদাই।।        “ভক্তিপথে কি এমন পরিশ্রম করতে হয় বলুন,” রাম তার রাজ্যবাসীকে উপদেশ দিচ্ছেন; আরো বলছেন, “যা দরকার তা হল, সরল স্বভাব, কপটতাহীন মন আর যা পাওয়া যায় তাতেই সন্তুষ্ট চিত্তে থাকা।“     মোর দাস কহাই নর আসা। করই তৌ কহহু কহা বিস্বাসা।।   বহুত কহউঁ কা কথা বঢ়াঈ। এহি আচরন বস্য মৈঁ ভাঈ।।        “আমার সেবক বলে যদি নিজেকে মনে করেন তবে কেন অন্য মানুষের মুখাপেক্ষী থাকবেন? তবে আর খাঁটি বিশ্বাস কি করে হল বলুন? যা হোক অনেক বলেছি আর কি বলি, শুধু বলি এই আচরণের আমি বশীভূত।”           এই আচরণের কথা ‘চৈতন্য চরিতামৃত’-তেও আছে, “কৃষ্ণেরে ভক্তি করে, করে লোকাপেক্ষা / কৃষ্ণ না করেন কৃপা তারে করেন উপেক্ষা”। (স্মৃতি থেকে লিখলাম, শব্দ একটু এদিক ওদিক হতে পারে।)         কি আচরণের? বলছি।     “বৈর না বিগ্রহ আস ন ত্রাসা। সুখময় তাহি সদা সব আসা।।   অনারম্ভ অনিকেত অমানী। অনঘ অরোষ দচ্ছ বিগ্যানী।।“        “না শত্রুতা যার, না তো বিবাদ-কলহ, না প্রবল আশা, না ভীত যে মানুষ তার তো চারদিক এমনই সুখময়। সে কোনো কিছুই না বুঝেশুনে আরম্ভ করে দেয় না, নির্দিষ্ট বাসস্থানহীন, ‘আমিত্ব’হীন, পাপহীন, ক্রোধহীন, তৎপর ও অনুভবী – এই হল তার পরিচয়।“        আবার কৃষ্ণদাস কবিরাজজী রচিত ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ স্মরণ করি। তিনি বলছেন, কে কৃষ্ণ নাম নেওয়ার যোগ্য?      “তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা।   অমানিন মানদেন কীর্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।“     “উত্তম হঞা আপনাকে মানে তৃণাধম।   দুই প্রকারে সহিষ্ণুতা করে বৃক্ষসম।। বৃক্ষে যেমন কাটিলেও কিছু না বোলয়।  শুকাইয়া মৈলে কারে পানী না মাগয়।। সেই যে মাগয়ে তারে দেয় আপন ধন। ঘর্ম্ম বৃষ্টি সহে আনের করয়ে রক্ষণ।। উত্তম হঞা বৈষ্ণব হবে নিরাভিমান। জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ-অধিষ্ঠান।। এইমত হঞা যেই কৃষ্ণ নাম লয়। শ্রীকৃষ্ণচরণে তার প্রেম উপজয়।।“         অর্থাৎ কিনা, হাতে ঝুলি গলে কণ্ঠি, কিম্বা উল্লাস চীৎকারে সে পথে হাঁটা হয় না। তার জন্যে রীতিমত কোড অব কণ্ডাক্ট বলা হচ্ছে। সেসব মেনে চললেই গতি, নইলে দুর্গতি।          এবার শেষ করি শেষ দুটো শ্লোক শুনি 'রামচরিতমানস' থেকে বলে এই ধারাতে।     প্রীতি সদা সজ্জন সংসর্গা। তৃন সম বিষয় স্বর্গ অপবর্গা।।   ভগতি পচ্ছ হঠ নহিঁ সঠতাঈ। দুষ্ট তর্ক সব দূরি বহাঈ।। মম গুন গ্রাম নাম রত গত মমতা মদ মোহ। তা কর সুখ সোই জানই পরানন্দ সন্দোহ।।         “সজ্জন মানুষের সাথে সঙ্গ করার যার সদা অভিলাষ, যিনি স্বর্গসুখ, মুক্তিসুখ দুইই খড়কুটোর ন্যায় ত্যাগ করেছেন, যিনি ভক্তিপথে আমোদিত থাকেন, কিন্তু জেদ ধরে থাকেন কোনো কিছুতেই বা দুষ্ট তর্ক বাধিয়ে মনের শান্তি নষ্ট করেন না।   আমার নাম গুণগান করেন নিজের মনের থেকে মোহ, অহংকার, আমিত্ববোধ দূরে সরিয়ে, তিনিই পরমানন্দ সুখে আত্মমগ্ন থাকেন জেনো।“       এই হল কথা। রাম নাম উচ্চারণের যোগ্যতা। রামের পদানুসরণের যোগ্যতা। এখন কথা হচ্ছে এসব লিখে বা বলে কি হবে? আমার কথা হচ্ছে না লিখে না বলেই বা কি হবে? যদি শুনেই সব শুধরে যেত তবে তো কৃষ্ণ গীতাটা দুর্যোধনকেই শোনাতেন, তাই না? কিন্তু তা তো শোনান নি। সে-ই শুনতেই বা চাইবে কেন? সজ্জনের উপর তো তার ভারি বিদ্বেষ? সে সাধু সহ্য করে নেবে কিন্তু মহাত্মা নয়। তবু এই কথাগুলো লিখে রাখলাম। নতুন রামপ্লাবন তো, আমার নিজেরও যেন ভুল না হয় কোনটা আত্মহারা সাগর আর কোনটা অ্যাকুয়াটিকা চিনতে, তাই।
314
Thu, 06/06/2019 - 23:49
         দুরকম সাধনার কথা বলা হল। বাঁদরের ছানা আর বিড়ালের ছানার মত। বলে রামকৃষ্ণ ঠাকুর বললেন, তবে সংসারীদের জন্য বিড়াল ছানার ভাব। কিরকম? না, যে অবস্থাতেই আছি যেন সন্তুষ্ট থাকি। আর বাঁদরের ছানার ভাব? নিজের চেষ্টায় নিজের মনের কেন্দ্র ঠিক করে দাঁড়ানো। ডাইনে বাঁয়ে যেদিক থেকে বাতাস আসুক, নড়লে চড়লে হবে না। স্থির থাকার সাধন। বড্ড কঠিন। হাওয়া কি শুধু শরতের হাওয়া? কোন সময়ে হুস করে কালবোশেখি এসে পড়ে। তখন কলিজার অত জোর কোথায় যে নিজেকে স্থির করে রাখা যায়? একবিন্দুতে অটল-অচল-সুমেরুবৎ দাঁড়ানোর জো নেই তখন।          তাই বললেন দক্ষিণেশ্বরের প্রদীপ জ্বালা ঘরে ছোট্টো ঘরটায় বসে, বেড়ালের ছানার ভাব। সংসারের যে মত অবস্থাতেই শান্ত থাকার সাধন। এখানে নিজেকে স্থির একবিন্দুতে রাখার জেদ নেই, এখানে মনের অপ্রসন্নতাকে ঠেকিয়ে রাখার সাধন। মনকে বলা, বাপু সব ছাড়লেও তুমি ছেড়ো না। প্রসন্ন থেকো। প্রসন্ন রেখো আমায়।            কি করে? মাধবানন্দজী, বেলুড়মঠের প্রেসিডেন্ট। সেই যুগের মানুষ। বিশাল পণ্ডিত সজ্জন মানুষ। কিন্তু প্রচণ্ড রাশভারি মানুষ। স্নেহ আছে, কিন্তু শাসনহীন, বল্গাহীন নয়। তা তিনি প্রতিদিন দুপুরে আহারের পর একাগ্র চিত্তে বাইরের জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। কোলের উপর ডান হাতের তর্জনী চিহ্নিত কথামৃতর খানিক আগে পড়া পাতা। সেবক প্রতিদিন দেখেন আর ভাবেন জিজ্ঞাসা করবেন, কি দেখেন আপনি অমন রোজ জানলার দিকে তাকিয়ে? কিন্তু সাহসে কুলায় না। একবার থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, মহারাজ, কি দেখেন?         মাধবানন্দজীর মুখে স্মিত হাসি। বললেন, জানলার বাইরে ওটা কি গাছ?        সেবক বলল, নারকেল গাছ।         মাধবানন্দজী বললেন, দেখ, ওই নারকেল গাছের পাতাগুলোর দিকে তাকা, যেমন যেমন হাওয়া আসছে তেমন তেমন নিজেরা দুলে দুলে সে হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। তাই না এত খুশীতে আছে। জীবনেও এমন করে যদি চলা যায়, যেমন যেমন সময় তেমন তেমন হয়ে চলা যায়, তবে এত গোল হয় না।            একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার এক সভায় ওনার বক্তৃতা অথবা দীক্ষা কিছু একটা আছে। উনি স্নানে যাবেন। ওনার হাইপাওয়ারের চশমা ছিল। সেবকের হাতের ধাক্কায় সেটা মাটিতে পড়ে গেল ভেঙে। সেবক ভয়ে কাঁটা, কি হবে এবার? এখনিই তো চশমা পাওয়াও যাবে না।         উনি শব্দটা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল রে?          সেবক কম্পিত কণ্ঠে যা ঘটেছে বলল। উনি হেসে বললেন, ও এই ব্যাপার? আরে স্বামীজি কি বলতেন শুনিস নি? এগুলো তো এইভাবেই যাবে, ওদের কি আর ম্যালেরিয়া টাইফায়েড হবে?          বিড়াল ছানার সাধন কোনো বড় একটা ঘটনায় হঠাৎ শুরু হয় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসন্তোষ জয়েই হয়। কিন্তু এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসন্তোষে কাবু হতে হতে এমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় যে হয় সুখী নয় অসন্তুষ্ট মন। ভাবে বুঝি অসন্তোষের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু একটা লাভ হবে, বা কিছুটা সুখ মিলবে। তা হয় না। সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করাটা একটা সাধন। আজ বিজ্ঞাপন আর সামাজিক মাধ্যমের দাপানির যুগে তো আরো বড় সাধন। নইলে অসন্তোষ স্বভাব হয়। রাগ, ক্ষোভ, ভয়, উদ্বিগ্নতায় অন্তঃকরণ জেরবার। দাঁড়াবার শোবার জো নেই। ছোট ছোট সারাদিন। কেন ছুটছি সেও যেন জানা নেই।            আজ বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী ছিল। বাবা বললেন মন্দিরে পুজো দিয়ে এসো। বিকালে তার ঘরে গিয়ে দেখলাম, তিনি জানলার বাইরে তাকিয়ে বসে। বললাম, কি ভাবছ? বললেন, ভবিতব্যকে মেনে নিলেই শান্তি বাবু, কতটুকু আমাদের হাতে? তখনই উপরের কথাগুলো মনে পড়ল।         বাবা উঠলেন, রামকৃষ্ণদেবের ছবির সামনে মাথা নত করলেন। মায়ের জন্য প্রার্থনা করলেন না নিজের জন্য জানি না। একটা প্রসন্নতা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের উপর বৈশাখের ভোরের শীতল বাতাসের মত বয়ে গেল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।            জীবনের কোনো ব্যাখ্যা শান্তি দেয় না। বিশ্বাস যখন নিভৃত, আত্মগত, তখন সে কত প্রসন্ন, কত শান্ত। সেই যখন দলগত, মঞ্চগত, সেই কত উগ্র। বিশ্বাস আমার পরিচয় কি? নয় তো, বিশ্বাস আমার পথ।          আবার ঠাকুরের কথা, শালাগুলো পথের কথা নিয়েই গোল করে, যেতে আর কেউ চায় না।         গেলেই পথ শেষ হয়। গোল মেটে।  
315
Wed, 06/05/2019 - 13:00
           আমাদের একটা দিবাস্বপ্ন আছে। যে স্বপ্নটার বিশেষ নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। কিন্তু আছে। আমাদের সিনেমা, মানে মূলস্রোতের সিনেমা, অন্যশব্দে যাকে বাণিজ্যিক সিনেমা বলে থাকি, তেমন সিনেমা, তেমন সিরিয়াল, তেমন গল্প – আছে। বাস্তব আর দিবাস্বপ্নের মধ্যে কল্পনা একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকে। কল্পনা ভবিষ্যতকে আংশিক দেখাতে, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে সাহায্য করে। কিন্তু দিবাস্বপ্নের সে দায় নেই। সে উইশফুল থিংকিং। তার সুখ-দুঃখ কাল্পনিক জগতে ঘুরে বেড়ায়। তার বাস্তব হয়ে ওঠার দায় নেই। ‘ভাবের সাথে ভবের মিলন’ হল কি হল না সেটা যেন খুব একটা বড় ব্যাপার নয়, বড় ব্যাপার আমার সুখ-দুঃখের কম্ফোর্ট জোনটা। আমার দিবাস্বপ্ন।        দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রী যখন বলেন কাল থেকে সমস্ত মহিলা বিনা পয়সায় যাতায়াত করবেন, সেটি তিনি মহিলাদের অপমান করছেন বুঝতে পারেন না। দুর্ভাগ্য অনেক মহিলাও বুঝতে পারেন না। অযাচিত ছাড় দেওয়া মানেই ধরে নেওয়া হয় মহিলাদের কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই। তারা সব সময় নানা সুবিধাকাঙ্ক্ষী। যেমন মহিলা আসন, মহিলা কামরা, মহিলা লাইন, মহিলা ব্যাঙ্ক, মহিলা থানার মত মহিলা ছাড়। কিন্তু ছাড়ের অর্থ কি? কারণ কি? যদিও তাদের মত কিছু যুক্তি আছে। সে যুক্তিতে তথ্য আছে কিন্তু সম্মানবোধটি নেই। মানুষ শুধু পরিসংখ্যান বা বাজেট নয়, মানুষের সব চাইতে বড় কথা তার সন্মানবোধ, যা অর্থের উপর নির্ভর করে না, নিজের বোধের উপর নির্ভর করে। ধরেই নেওয়া হচ্ছে যে ছাড় পেলেই তা নেওয়া হবে। নিশ্চই নেওয়া হবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি অনেক মহিলা এতে কোনো অসুবিধা দেখবেন না, বেশি ভাবছেন বলে হয়ত গালও পাড়তে পারেন। তবু শারীরিক ক্ষমতার পার্থক্য আছে বলেই আত্মসম্মানের পার্থক্য থাকবেই এমন কোনো যুক্তি হয় কি? তাই অনেক জায়গায় সে পার্থক্য অনুযায়ী বিধিব্যবস্থা থাকলেও এক্ষেত্রে তা গ্রহণযোগ্য কি?        কিন্তু তবু আমরা বিশ্বাস করি আমরা এতে জনতার সায় পাব। মুখ্যমন্ত্রীর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন অতিবড় নির্বোধও তুলবে না। তবু তিনি এভাবে ভারতের মহিলাদের ভাবতে দ্বিধা করেন না। যদি বলা হয় আমরা এমনই, তাই তিনি তার সিদ্ধান্তে বাস্তববোধ দেখিয়েছেন, তবে বলতে হয় যে মানবিকবোধটা বাস্তববোধের চাইতে বড় বলেই মানুষ মানুষ। সুবিধাবাদী হওয়াকে সে নীচু চোখে দেখে। কিন্তু অবশেষে জয় হবে জনরঞ্জন করা লঘু সিদ্ধান্তের, বিবেচনাগত কঠিন সিদ্ধান্তের নয় – এমনই ধারণা সমস্ত অল্পদর্শী মানুষের। আদর্শহীন রাজনীতির।         এ গেল এক। যে কথা বলছিলাম। আমাদের এক দিবাস্বপ্ন আছে। আমরা আমাদের বিবেকের ভার পুলিশের হাতে দিয়ে, চেকারের হাতে দিয়ে, প্রতিবেশীর সতর্কতার হাতে দিয়ে আপন চাতুরীর মাধুরীতে মগ্ন হয়ে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। কারণ আমাদের বিবেকবোধ নেই। আমরা জানি যে কারণে চাকরি তথা পরীক্ষায় সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে, সেই কারণে বা সেই অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া শ্রেণী না হলেও আমার সেই সুবিধায় চাকরি নিতে বিবেকে বাধে না। আমার নীতির ভারত, আমার সংহতিপূর্ণ ভারত আমার দিবাস্বপ্নের দেশ। আমার সেখানে কর্তব্য কিছু নেই, অধিকারবোধ আছে। আমি দু'কিলোমিটারের পথ সাইকেলে বা হেঁটে যাই না, বাইক লাগে, তাতে তেলের অপচয়, পরিবেশ দূষণ আমাদের দায়ের মধ্যে পড়ে না। আমি যত্রতত্র হর্ণ দিই, যত্রতত্র পানের পিক ফেলি, প্লাস্টিক ব্যবহার করি হাজারবার বারণ সত্ত্বেও, সিগারেটে সুখ টান দিই – কারণ আমার একটা দিবাস্বপ্নের দেশ আছে। সেখানে সব কিছু পার্ফেক্ট, সেখানে বিনা কর্তব্য সম্পাদনে সুখের প্রতিশ্রুতি, সেখানে দুর্যোগ নেই, সেখানে দুর্ঘটনা নেই।         আমাদের আরেকটি দিবাস্বপ্ন আছে। আতঙ্কের দিবাস্বপ্ন। আমাদের মাইনরিটি সম্প্রদায়, আমাদের ভাষার আত্মমর্যাদা, আমাদের সংস্কৃতির শুদ্ধতা, আমাদের যৌনজীবনের উপাখ্যান – সবই সেই নেগেটিভ দিবাস্বপ্নের ক্ষেত্র। আমরা পদে পদে শঙ্কিত - ‘সদাই মরে ত্রাসে- ঐ বুঝি কেউ হাসে!’-র মতন। আমাদের সে ত্রাসও দিবাস্বপ্নের ত্রাস। যা বাস্তবে নেই, তা ভয়ংকরভাবে কল্পনায় থাকে। এ যেন ‘জলসাঘর’-এর জমিদারের বিপন্ন আত্মম্ভরিতার মত। তার সমস্তটা তার মাথায়। যেখানে শুকনো কাঠ যত বেশি সেখানে আগুন লাগার ভয়ও তত বেশি। আমরা সেটা জানি। কিন্তু যদি বলি শুকনো কাঠের একটা পরিসংখ্যান কর দেখি? কেউ এগোবে না। কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে না। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে প্রমাণ করানোর চেষ্টা হবে সমগ্রচিত্র হিসাবে। এর জ্বলন্ত উদাহরণ সদ্য টাইমস ম্যাগাজিনে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে দুই মেরুতে রাতারাতি অবস্থান পরিবর্তন। তারাও জানে ভারতীয়দের একটা দিবাস্বপ্নের দেশ আছে। সেখানে আগুন লাগানো বা পুষ্পবৃষ্টি যাই করা যায় – তারা তা গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু সত্যিই এতটাই ভয়, এতটাই আতঙ্ক, এতটাই বিপন্নতা আমার চারপাশে? নয়তো। আমার দিবাস্বপ্নের অনুকূল খবর, প্রচার, রঙীন উপস্থাপনা আমাকে যে অবাস্তব জগতে ঠেলে দেয়, আমাকে যেভাবে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে, যে পোস্ট ট্রুথের জন্ম দেয় – সেকি সত্যি সত্যি আমার মঙ্গলের জন্য?         আমার মঙ্গল সেদিন হবে যেদিন আমি আমার এই দিবাস্বপ্ন থেকে বেরিয়ে এসে আমার দায়িত্ব বুঝে নেব। আমি কোনো বর্ডারে হয়ত যুদ্ধে যাব না। কিন্তু আমি টিটি-কে লুকিয়ে সিগারেট খাব না, আমি বিনা টিকিটে যাত্রা করব না, আমি মিথ্যা রটনা না তো রটাবো, না রটাতে দেব, আমার কাছে আমার মাথা নীচু হয় এমন কোনো কাজ করব না। সেই হবে আমার স্বপ্নের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা।        ভারত ধর্মের দেশ – মিথ্যা কথা। ভারত দর্শনের দেশ। ভারতে নানা দর্শন আছে। সেই দর্শনের নানা অপব্যাখ্যায় ছেয়ে গেছে আমাদের মাথাগুলো। আমাদের আবার সেই মূল দর্শনগুলোর কাছে ফিরতে হবে। কারুর ব্যাখ্যা, কারুর উপলব্ধির উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের সাধারণ বুদ্ধিতে বিচার করে দেখতে হবে কতটুকু আজকের দিনে আমায় মঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। কতটুকু সবার সাথে বাঁচতে, বেড়ে উঠতে সাহায্য করে, সেটুকু গ্রহণ করে বাকিটা নির্মোহের সাথে বর্জন করতে হবে। কারণ ওই যে বললাম, ভারত নানা দর্শনের দেশ। দর্শন মানেই সত্যকে আলিঙ্গন, মিথ্যাকে বর্জন। সত্যতে আস্পৃষ্ট মিথ্যাকে চেনাই বিবেচনা। আমাদের পোস্ট ট্রুথ থেকে বাঁচার উপায়। আমাদের দিবাস্বপ্ন থেকে জাগার মন্ত্র।  
316
Wed, 05/29/2019 - 16:00
           বাংলা ভাষায় যে ক'টা ইংরেজি ভাবগত শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে, আমার মনে হয় তার মধ্যে একটা প্রধান শব্দ হল – 'সিরিয়াস'। 'সিরিয়াসলি বলছি', 'সিরিয়াসলি কর' ইত্যাদি। যে ক'টা আমাদের পরিভাষা সিরিয়াস শব্দের আছে – 'গম্ভীর', 'রাশভারি', 'গুরুতর', 'সংকটজনক', 'আন্তরিক' ইত্যাদি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা যেভাবে বলি ‘সিরিয়াসলি’ বলছি, সেখানে আসলে আমরা বলতে চাইছি, হালকাভাবে না নেওয়ার জন্য, বা আমি যে মজা করছি না সেটা বোঝানোর জন্য। অথবা কোনো কিছুর গাম্ভীর্যতা বোঝানোর জন্য। কিন্তু আমি বাংলায় কিভাবে বলতে পারি?- 'তুই আরো মন দিয়ে পড়', 'তুই আরেকটু মন দিয়ে খোঁজ', 'তুই আরেকটু গুরুত্ব দে ব্যাপারটায়' ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কোথায় যেন হল না। অর্থাৎ ঠিক সেই অর্থে আমাদের কাছে 'সিরিয়াস' শব্দটার তেমন কোনো উপযুক্ত পরিভাষা নেই।        আমাদের বাড়িতে যিনি কাজ করেন তিনি সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষ। নিরক্ষর। তাকে আমি যে সকল ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি, তার মধ্যে এই শব্দটা বহুবার শুনেছি, “সিরিয়াসলি বলছি দাদা...", "ওর রোগটা খুব সিরিয়াস” ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে মনে হতেই পারে যে সে কেন একটা ইংরাজি শব্দকে নিজের ভাবের কাছাকাছি বোধ করল কোনো বাংলা শব্দ ছাড়া? অবশ্যই শুনে শুনে। তার মানে কি এই দাঁড়াল যে, এই 'সিরিয়াস' শব্দটাকে আমাদের মেজাজের সাথে বা ভাবের সাথে সেভাবে কোনোদিন পাইনি বলেই হয়ত সেই শব্দটা নেই। সেটা আলোচনার বিষয়টা না হয় সমাজবিদ ও মনোবিদদের জন্যে থাকুক।        'সিরিয়াস' শব্দটাকে আমাদের একটা প্রতিশব্দের খুব কাছাকাছি ব্যবহার করি আমি দেখেছি, সেটা হল 'আন্তরিক'। যার ইংরাজি অর্থ 'সিনসিয়ার'। 'ঐকান্তিক'ও কিছুটা সেই একই গোত্রীয় শব্দ। কিন্তু 'আন্তরিক' বলতে যা বোঝায় 'সিরিয়াস' বলতে তা বোঝায় কি? আমাদের দৈনন্দিন জীবনের দিকে দেখি।        আমি দেখেছি আমাদের বাড়ির মা-জেঠিমারা যে আন্তরিকতার সাথে প্রতিদিন লক্ষ্মীপূজো করেন সেই দিকে। নকুলদানা অথবা বাতাসা যা হোক হল, একটা নির্দিষ্ট পাঁচালী পাঠ হল ইত্যাদি। বছরের পর বছর করে চলেছেন কিন্তু মনে কোনো সময়ে কোনো প্রশ্ন আসছে না যে এটা আমি কি করছি? যে কোনো ধর্মের আনুষ্ঠানিক দিকই তাই হয়। প্রবল আন্তরিকতার সাথে কাজগুলো করা হয়ে থাকে। এইবার প্রশ্ন হল, তারা কি সিরিয়াসলি কাজগুলো করেন? না। কারণ সিরিয়াস হলেই মনের মধ্যে নানা সংশয়, নানা প্রশ্ন-জিজ্ঞাসা মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে। তাই ধর্মে আন্তরিক হওয়ার, অনুগত হওয়ার, প্রশ্নহীন সরল হওয়ার যে প্রশংসা আছে, এর বিপরীতগুলো হওয়ায় নেই। এমনকি সিরিয়াস হতে গেলেই বলা হবে, তুমি অত কিছু জানবে কি করে? এত ভেবো না। তুমি এই মন্ত্র সকাল থেকে রাত অবধি জপে যাও, তোমার কিছু না কিছু হবে। শিষ্য তাই করতে শুরু করল। বছরের পর বছর সে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সেই কাজ করে চলেছে। এবং নিজের মনের মধ্যে যে প্রশ্ন, সংশয় ইত্যাদি না এসে একটা শান্তভাব আসছে তাতে সে নিজেকে ধন্যও মনে করছে। সেই নির্দিষ্ট সময়ে সেই নির্দিষ্ট কাজটা না করতে পারলে তার যে মনঃপীড়া হচ্ছে তার জন্যেও সে নিজেকে ধন্য মনে করছে কারণ সে একটা পথে নিজেকে সম্পূর্ণ বশীভূত করতে পেরেছে। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝবে না যে সে আসলে নিজেকে মেরে ফেলছে শান্তির শীতল কারাগারে। অত সোজা পথে শান্তি মেলে না। যেমন গাড়ির চাকা না থাকলে গাড়ি কোনোদিন চলে না, অতএব কোনো দুর্ঘটনাও ঘটে না। এও সেই স্থবিরতার নিরাপত্তা। অবোধের শান্তি।         কিন্তু সে যদি সিরিয়াস হয়ে পড়ে, সে প্রশ্ন করবে। সে অস্থির হবে। কারণ আমি দেখেছি সেই অতিভক্ত মানুষই যখন ব্যাঙ্কে যাচ্ছে তখন আন্তরিক হয়ে সবার কথা না শুনে প্রতি পদক্ষেপে অত্যন্ত সিরিয়াস হয়ে প্রতিটা জিনিস বুঝে বুঝে কাজ করছে। প্রশ্ন করছে। বরং অন্যের থেকে বেশিই প্রশ্ন করছে। অবাক লাগে একই মানুষ এমনভাবে নিজেকে বদলে নেয় কি করে? একই মানুষ নিজের প্রত্যক্ষ স্বার্থের বেলায় যেমন সিরিয়াস, তেমনই পরকালের বা দৈবের কৃপা পাওয়ার জন্য নির্বোধের মত আচরণ করে কি করে? সে জানে ব্যাঙ্কের টাকার হিসাবে গরমিল হলে কোনো আষাঢ়ে গল্পেই মনকে প্রবোধ দেওয়া সম্ভব নয়। তাই সে এক্ষেত্রে সিরিয়াস হওয়াকে, সিনসিয়ার হওয়ার থেকে সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে।         আদতে যা কিছু সিরিয়াস তার থেকে আমাদের বাঙালী সমাজের একটা বৌদ্ধিক বিচ্ছেদ ঘটছে। এ রোগের কথা বিবেকানন্দ ও নেতাজী বলেছেন, তাদের লেখায় পড়েছি। দু'জনেই বলছেন, আমাদের রক্তে গুরুগম্ভীর জিনিস “হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া” একটা রোগ হয়েছে। এই কথাটা আমাদের ভাববার। অবশ্যই বাঙালীর সমালোচনায় সাধারণ বাঙালীর কাছে চন্দ্রিল যেভাবে আবেদন রাখবেন সেভাবে নীরদচন্দ্র চৌধুরী বা অম্লান দত্ত আবেদন রাখবেন না। কারণ আমরা সিরিয়াস আলোচনার চাইতেও রসালো আলোচনায় বেশি আগ্রহী। আগ্রহী অন্য ভাষায় 'আন্তরিক'। সমস্ত রসটা চেটেপুটে নেওয়ার জন্য প্রবল তাগিদ আমাদের। বাকি যে দু'জনের কথা বললাম তা পড়তে গেলে ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াস হয়ে পড়তে হয়, ভাবতে হয়। কারণ 'সিরিয়াস' শব্দটার সাথে ভাবনা-চিন্তার একটা যোগাযোগ তো আছেই। কেন ভাবব। আমার অন্তর তো সুখ চায়, শান্তি চায়, নিশ্চয়তা চায়, আমোদ চায়, তাই সেইতেই আমি আন্তরিক। রবি ঠাকুরের গান বলো পড়ছি, প্রবন্ধ কেন পড়ব রে বাবা?         এখানে আরো একটা দিক আলোচনায় এনে আমি ইতি টানি। সাহিত্যের ক্ষেত্রে, ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে। আর যে কোনো কাজে মানুষকে ভদ্রসভ্য হওয়াটা বাঞ্ছনীয় হলেও, লেখা আর অভিনয় এমন দুটো কাজের ক্ষেত্র যেখানে জীবনকে সিরিয়াসলি নিতে হয়, নীতি বা অন্য কোন কিছুকে নয়। তাই তাকে বাইরের জীবনে দুষ্টুলোক না হলেও মনের মধ্যে দুষ্টুলোককে দুষ্টু বলে তাড়িয়ে দিলে চলে না, তার প্রধান দায় সত্যের কাছে। সে সত্য ভাবগত ও বস্তুগত --- উভয়ক্ষেত্রেই। তবু ভাবগত সত্যের আবেদন তার কাছে বেশি। তাই মার্কেজের গ্রামের ভৌগলিক অস্তিত্ব না পেলেও ভাবের জগতে তার ম্যাপ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। এখানেও আমরা কিছু কিছু জায়গায় পিছিয়ে। একটা কাহিনী মানুষের ব্যবহার আর তার চিন্তা অনুভবের বিবরণ – এই দুইয়ের একটি ধারা প্রধানত। প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু থাকলেও তা নেপথ্যেই। কিছু কাহিনীতে প্রথম ধারাটি বেশি; কিছুতে কাহিনীতে দ্বিতীয়টির পরিমাণ বেশি। মানুষ জটিলতম জীব। ভাষা একটি দুর্বল উপায় মানুষের সে রহস্য উন্মোচনের চেষ্টায়। ধর্ম একটা বিশেষ দিকে মানুষকে টানে। রুচি, শালীনতা, সংস্কৃতি আরেকদিকে। এ সবের মধ্যে থেকে আসল মানুষটির নাগাল মেলা শক্ত। রুচি, শালীনতা, সংস্কৃতির বিপরীতে কিছু একটাকে লিখে ফেললেই যেমন মানুষের নগ্নরূপ ধরা হয় না, সেটা ভীষণ বস্তুগত নগ্নতার কথা হয়ে যায়, তেমন কোনো মানুষের পোশাকহীন স্ক্যান রিপোর্ট অথবা তার গোপন জীবনের খুঁটিনাটি, অথবা তার বিকারগ্রস্থ মানসিকতার বিবরণও কিন্তু সাহসী লেখা বা অকপট লেখা হয়ে যায় না। সব চাইতে কঠিন জায়গা হল মানুষের id-ego-superego-র টানাপোড়েনে দাঁড়ানো মানুষটাকে ভাষা কতটা উন্মোচিত করতে পারল তার উপর। বাকি ঘটনার পর ঘটনার বিবৃতি, ফেনার পর ফেনা জমিয়ে যা গড়ে ওঠে তার হয়ত একটাই আবেদন – সুখপাঠ্যতা। সেই সুখপাঠ্য সাহিত্যের চাহিদাও যেমন বেশি, পাঠক যেমন বেশি, তার মূল্যও কম কিছু নয়। কিন্তু এর বিপরীতে আরেক জাতের সাহিত্য আছে। একটা খোঁজের সাহিত্য। সে সাহিত্য সেই টানাপোড়েনের রঙটা যতটা স্পষ্ট পারে আঁকতে চায়। তার পাঠক কম। তার চাহিদা কম। যা অবশ্যই যে কোনো ভাষাতেই দুর্লভ ‘কঠিন বই’-এর আখ্যা পেয়ে যায়। আলোচনা কম হয়। কারণ তাতে রস অত্যন্ত গহীন। তার পাঠকেরা সিরিয়াস পাঠকের তকমা পান। চলতি কথায় আঁতেল। কথাটা সত্যিই। যা কিছু সিরিয়াস – তা খানিক রসহীন, খানিক অনিশ্চিত সংশয়াপন্ন, খানিক বিষাদময়। রবীন্দ্রনাথ যে শেষ জীবনে – ‘সত্য যে কঠিন’ বলেছিলেন, সে সত্যের এই স্বভাবের জন্যেই বোধ করি। সত্য সিরিয়াস, আন্তরিক নয়, আন্তরিক তো গল্প। কিন্তু সেই যেন শেষ আশ্রয়।  
317
Tue, 05/21/2019 - 17:00
           যখন স্কুলে পড়ি তখন সুনীলবাবু'র 'কেউ কথা রাখেনি' প্রথম শুনলাম। মনে হয়েছিল, তাই, এমন হয়? আমার সাথেও এমন হবে? তারপর যখন বেশ কিছুটা বড় হলাম, তখন মনে হল, না, সবাই হয়ত এমন হবে না। কেউ কেউ হবে। হল কেউ কেউ, আবার হলও না। এখন মনে হয় হলেই বা কি। প্রতিশ্রুতির কোনো প্রতিশ্রুতি হয় নাকি? হয় না। প্রতিশ্রুতি শরতের আকাশের মত। কখনও কখনও মেঘ কালোও হয়ে আসে। ঝড় হয়। জানি হওয়ার কথা ছিল না। তবু হয়। প্রতিশ্রুতিও তেমনই।        দু'রকম প্রতিশ্রুতি হয় – উচ্চারিত, অনুচ্চারিত। আঘাত লাগে বেশি অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি ভাঙায়। যেন কারোর কাছে স্পষ্ট করে কোনো নালিশ জানানোর নেই। সবাই বলবে, “কেন সবই তো ঠিকই চলছে। তোমার এত কিসের নালিশ? এত কিসের অভিমান?”        সত্যিই তো। যে প্রতিশ্রুতির বাক্যের শরীর নেই, যে প্রতিশ্রুতি শুধুই অনুভবের, তার কি কোনো মূল্য আছে? যেমন আমার বাড়ির পিছনের বাঁশঝাড়ে একটা দোয়েল পাখি প্রতিদিন বিকালে সূর্যাস্তের আগে আগে এসে বসে থাকত একদম উঁচু বাঁশটার মাথায়। হাওয়ার দুলুনিতে দুলত, কিন্তু উড়ে যেত না। ক্রমে অন্ধকার নামত। চারদিক থেকে শাঁখের আওয়াজ বেজে উঠত। আমি আর দোয়েল পাখিটা আকাশের বিরাট পট পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে নিজেদের মধ্যে একটা যেন আত্মীয়তার সূত্র তৈরি করে ফেলেছিলাম নিজের অজান্তেই। শুকতারা, দোয়েল আর আমি। এমন হত কোনো কোনোদিন পাখিটা আসত না। আমার প্রথমে অস্বস্তি হত। তারপর রাগ হত। কেন আসবে না? বুঝলাম, আমি প্রতিশ্রুতির জালে জড়িয়ে। অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতির। অভ্যাসের প্রতিশ্রুতির। এ অভিমান অর্থহীন, কিন্তু অস্তিত্বহীন নয়। কিন্তু মুশকিল হল কাজের জগতে অস্তিত্বের চাইতে অর্থের মূল্য অনেক বেশি। সে অন্য প্রসঙ্গ যদিও। সংসারে কত কিছুর অস্তিত্ব নেই, কিন্তু তার মস্ত অর্থ মানুষের কাছে। যেমন বড়লোক হওয়া, ক্ষমতাশালী হওয়া। কেমন নিজেদের মধ্যে গল্প বানিয়ে মানুষ তাতে বাস করছে সে হারারি ছাড়া আর কে জানে? কিন্তু তার জন্যে 'সেপিয়েন্স' পড়া লাগবে। এখন সে কথা থাক।         তো কথা হচ্ছিল অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি নিয়ে। যে প্রতিশ্রুতির শব্দের শরীর নেই। বাক্যের মানচিত্র নেই। প্রযোজ্য শর্তাবলী নেই। কিন্তু যা ভাঙলে তীব্র যন্ত্রণা। নিঃশব্দ যন্ত্রণা। জীবন মানেই এমন কত লক্ষ অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি, না? যাদের আমরা ধরেই নিয়েছি হবে। যেমন আমি একটা নির্দিষ্ট বয়েস অবধি বাঁচবই, আমার যেগুলো যেগুলো পাওয়া উচিত বলে মনে করি জীবন যেন সে সব আমাদের একে একে হাতের কাছে, শ্রমের কাছে এনে ধরা দেবে। আমরা সফল হব। প্রতিষ্ঠিত হব। (যে প্রতিষ্ঠা শব্দটাও তেমনই অস্তিত্বহীন অর্থপূর্ণ মানুষের বানানো গল্প। কারণ পৃথিবীর ইতিহাসে ওরকম নানা অপ্রতিষ্ঠিত মানুষের অবদানে সমাজ ঋণী; বিজ্ঞান, দর্শন, খেলা, সাহিত্য ইত্যাদি সব পথেই এমন উদাহরণ অজস্র।)        হয় না। সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করে না জীবন। “ওগো ভোলা ভালো তবে, কাঁদিয়া কি হবে”... এ একটা যেমন পথ, তেমন, “নেই যদি বা জমল পাড়ি, ঘাট আছে তো বসতে পারি / আমার আশার তরী ডুবল যদি দেখব তোদের তরী বাওয়া” – এও একটা পথ। যার মূল সূত্র পাওয়া রবীন্দ্রনাথের ‘উদাসীন’ কবিতায়।        কারণটা গভীর। আমার প্রাণের গভীরে আছে একটা প্রতিশ্রুতির প্রত্যাশা। আমি সংসারে ঢুকেইছি যেন অনেকগুলো কুপোন হাতে করে। প্রতিটা কুপোনে কি কি আমার পাওনাগণ্ডা আছে জীবনের কাছে সে সবের লিস্টি দেওয়া আছে। আমি একটা একটা করে কুপোনের গোপন সাংকেতিক অক্ষরমালা আবরণমুক্ত করব আর থলে ভরে ভরে জীবন দু'হাতে আমায় উজাড় করে সব গুছিয়ে হাতের কাছে দেবে। না দিলেই ফুঁসব। অভিমান করব। প্রচণ্ড রাগে নিজের ক্ষতি করব। নিজের শরীরের না পারি, নিজের বিবেক-বিবেচনার গলা টিপে আত্মিক আত্মহত্যা করব। তারপর আমার সমস্ত অনিয়ন্ত্রিত, অমার্জিত, অশাসিত প্রবৃত্তিরাজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ব সংসারে, যা পাই, যেটুকু পাই লক্ষ্যে নয়, সবটুকু চাই, এটাও চাই, ওটাও চাই --- লোভে।        প্রত্যাশা আর প্রতিশ্রুতি ক্রমে কুয়াশার মত মিলিয়ে যেতে শুরু করে। যা পূরণ হয় না সেও যেমন জ্বালা ধরায়, যা পূরণ হয়, সেও ক্রমে ফিকে হয়ে আসে। মনে মনে বলি, পূরণ হোক চেয়েছিলাম, কিন্তু ঠিক এভাবে নয়। কিন্তু ঠিক কিভাবে যে সেও স্পষ্ট নয়। তারপর একটা সময়ের পর বুঝতে শিখি আসলে প্রতিশ্রুতি বলে কিছু পাকাপোক্ত হয় না। কারণ কিছুই পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেনি মানুষের সংসারে আজ অবধি। এমনকি তার অচ্যুত ঈশ্বরের ধারণাও হাজারবার রঙ পরিবর্তন করে এত বেশি অন্য রকম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে নতুন করে সেখানেও কোনো প্রত্যাশা নেই।        তবে প্রতিশ্রুতি আসক্তির কি কোনো ঔষধ নাই? আছে। বাস্তব বোধ। যুক্তির চাইতে বড় কথা যুক্তির বাস্তবতার মান যাচাই করা। যাকে আমরা কাণ্ডজ্ঞান বলে থাকি। আমার জীবনটা যে একটা কাণ্ড, কোনো কাণ্ডের স্থির ফলাফল নয়, এটা বুঝলেই অনেকটা শান্তি। তাই কাণ্ডের সাথে কাণ্ডের প্রবাহে কোনো ধ্রুবতারা না রাখাই ভালো। যেটুকু আসে, যেটুকু থাকে, যতক্ষণ থাকে – সেইতেই নিজেকে সন্তুষ্ট করে নিতে না পারলে শুধু কাণ্ডটাই ঘটে যাবে। আমি স্থিরতার লোভে ভুলেই যাব, আমায় স্থির থাকতে বলা হয়নি, সাম্যে থাকতে বলা হয়েছিল। চলার মূল কথাটা শুধু এগোনো নয়, নিজের সাম্য বজায় রাখতে পারাটাই গোড়ার কথা। যেমন পায়ের উপর দাঁড়ানোটা গোড়ার কথা, চলাটা পরের।         তাই বলছিলাম শুরুতেই, এখন মনে হয় প্রতিশ্রুতি ভাঙুক। ক্ষতি নেই, প্রতিশ্রুতিকে বাইরের দরজার বাইরে না রেখে, আবার শোয়ার ঘরে খাটে না তুলে, বসার ঘরে বসিয়ে চা-সরবত খাইয়ে সৎকার করাটাই শ্রেয়। তারপর যখন যেতে চায় গেল।  
318
Sat, 05/18/2019 - 10:00
    "আমি যাকে অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তার জন্মোৎসবে আমার প্রণাম নিবেদন করতে এসেছি।" ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর            স্বর্গ আছে, ঈশ্বর আছে, দেবতা আছে, আত্মা আছে, ঈশ্বরকোটি-জীবকোটি আছে... এরকম কথা আমাদের অনেকেই বলেছেন। আমরা বিশ্বাস করতে চেয়েছি। করে পারিনি। কোথাও সে বিশ্বাসের সাথে আমাদের যুক্তি-বুদ্ধি-অভিজ্ঞতা মুখোমুখি রণংদেহি মূর্তি ধারণ করেছে। বিশ্বাস পাকাপোক্ত হয়নি, কারণ অবশেষে কিছু প্রত্যক্ষ হয়নি।        বুদ্ধ সে কথা শোনালেন না। বললেন, দুঃখ আছে। এই কথাটা ক্লাস নাইনের ইতিহাস বইতে পড়ে খুব অবাক লেগেছিল। এ কি এমন কথা যে একে মূল সত্য না আর্যসত্য ইত্যাদি বলতে হবে? জীবন গড়াতে লাগল। ছোটো ছোটো সুখের রেশমী রোঁয়াগুলো খুলে খুলে যেতে লাগল। কিছু পুড়ে গেল, কিছু হারিয়েও গেল। বারবার একটাই কথা সত্য হয়ে কানের কাছে বাজতে লাগল, দুঃখ আছে। বুঝলাম, এ ফাঁকির কথা নয়, ভাবের কথা নয়, বিশ্বাসের কথা নয় – অভিজ্ঞতার কথা। স্বীকার করার কথা – দুঃখ আছে। যত পোড় খেতে লাগলাম, তত মর্মে মর্মে অনুভব হতে লাগল, দুঃখ আছে। সুখ পেলাম না, মনের মধ্যে একটা প্রবোধ পেতে শুরু করলাম। কারণ একটা আছে। দুঃখের ত্রাতা সুখ হয় না, হলেও সে স্থায়ী হয় না। দুঃখের আসল ত্রাতা – সান্ত্বনা। যার আরেক অর্থ – প্রসন্নতা। শান্তি। 'সান্ত্ব' শব্দটার অর্থ হল 'শান্তি'। যার ইংরাজি 'কনসোল' শব্দটার উৎস ফ্রেঞ্চ 'কনসোলার', ল্যাটিন 'কনসোল্যারিও' শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ, শান্তি বা আরাম দান করা।         দুঃখ আছে। অর্থাৎ “আমার সাথেই কেন”... ”আমিই কেন”... ”দুঃখ কেন”... ”এত দুর্ভোগ কেন”... ইত্যাদি কথাগুলো খুব জোরের সাথে মাথা তুলতে পারল না। দুঃখের নিজের ভারের চাইতে তাকে অস্বীকার করা আর তার বিরুদ্ধে ছায়ার সাথে লড়ার মত একটা নির্বোধ লড়াইয়ের হাত থেকে যেন রেহাই দিলাম নিজেকে। সুখ এল না, শান্তির প্রলেপ পড়তে শুরু করল।         এর পর বলা হল, এই দুঃখের কারণ আছে। সে কারণ হল তৃষ্ণা। সেই তৃষ্ণার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পথও আছে। এই হল মূল চারটে সত্য। কিন্তু প্রথম কয়েকটা সত্য যেন নিউ জলপাইগুড়ি নেমে, দার্জিলিং বা কালিপঙ বা গ্যাংটক যেতে পাহাড়ি ঘুরপথে যাওয়ার ধকলের মত। নেওয়াই যায়। কিন্তু শেষ কথাটা? তৃষ্ণা বা বাসনা ছাড়া আমার অস্তিত্ব কই? আমি তো সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হতে আসিনি রে বাবা! অনেকে যেমন উদাহরণ দিয়েছেন, এ যেন মাথাব্যথা বলেছি বলে পুরো মাথাটাই কেটে বাদ দিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব।        তৃষ্ণা বা বাসনাত্যাগের তৃষ্ণা বা বাসনা কাউকে টেনেছে বলে আমার আজ অবধি বিশ্বাস হয় না। মানুষকে যা চিরটাকাল টানে – সে হল আনন্দ। সুখ আর আনন্দের মধ্যে মূল পার্থক্যই হল, সুখ পরিপূর্ণতার আশ্বাসে বাঁচে না, ক্ষণিকের জন্য বাঁচে; তাই তার এত তীব্রতা, ভয়, আশঙ্কা। সে গদিরই হোক, কি ক্ষমতারই হোক, কি ভোগেরই হোক, কি মতবাদের মত্ততারই হোক, কি অলীক স্বপ্নেরই হোক... কিছুতেই কিছু আসে যায় না। আনন্দ বাঁচে পরিপূর্ণতায়। তাই সে অসামঞ্জস্যকে ছেড়ে দিতেও রাজী হয় নির্মমভাবে। যেমন ‘গান্ধারীর আবেদন’-এ বারবার বলেছেন দুর্যোধনকে ত্যাগ করার জন্য। সেই ছেড়ে দেওয়াকে বাইরের অসম্পূর্ণ দৃষ্টিতে বলে ত্যাগ। যেন খুব নীরস একটা কথা। নবজাত অঙ্কুর কি বীজকে ত্যাগ করার জন্যেই ত্যাগ করে? না তো! তাকে আকাশের আনন্দ, আলোর আনন্দ, বাতাসের আনন্দ অনবরত আঘাত করে করে উদ্বেল করে তোলে না? সেই জন্যেই সে বাইরে আসার জো খুঁজতে বীজকে ত্যাগ করে। তেনজীং নোরগে-ই হোক, কি আইনস্টাইন-ই হোক, কি দ্য ভিঞ্চি-ই হোক --- তারা যে কঠিন তপস্যাকে বরণ করে নিয়েছিলেন সেকি কঠিন বলেই? না কিছু এক অদম্য আনন্দের প্রেরণায়? এনারা না হয় মহাপুরুষ। আমাদের দৈনন্দিন জীবনেও কি এর উদাহরণ যত্রতত্র ছড়িয়ে নেই? সুখ যখন বিবশ করছে, আমার আত্মসম্মানের দিকে কালো হাত বাড়িয়ে আনছে, আমার দুর্বলতাকে ব্যবহার করতে চাইছে, পিষে মেরে ফেলতে চাইছে আমার ব্যক্তিত্বকে, স্বাধীনতাকে... আমি কি প্রতিবাদ করিনি? প্রাণের বস্তুকেও ছেড়ে দিইনি স্বস্তির দিকে তাকিয়ে? সেই স্বস্তিই আমার প্রসন্নতা, আমার আনন্দ, আমার নির্জন একাকীত্বের নির্বাণ। নিজেকে বারবার মেরে ফেলে নিজেকে বারবার জন্ম দিয়েছি তো আমিই। কি যন্ত্রণায় অসহ্য রাতগুলো কাটিয়ে কোনো একদিন ভোরবেলায় বলে উঠেছি – ‘আর না। যা হবার হবে’... কিসের জোরে বলেছি সে কথা? আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে একটা বড় ‘হ্যাঁ’ শুনতে পেয়েছি শান্তির দিকে, আনন্দের দিকে, অনাড়ম্বরের দিকে। সেই আমায় জোর দিয়েছে। সেই আমার বোধ। আমার শুদ্ধতা। আমার চৈতন্য। আমার মধ্যে যাই শুদ্ধ তাই চৈতন্য। কারণ আলো কোনোদিন মিথ্যা হয় না। তেমন চেতনা কখনও অশুদ্ধ হয় না। মানুষকে তাই আজ অবধি যা পরম শক্তি দিয়ে এসেছে, তা সুখ না, দুঃখ স্বীকারের আনন্দ।        আর্নেস্ট হেমিংওয়ে'র কথায় "Man can be destroyed but not defeated." এ সত্যিটা 'Old Man and The Sea'-তে যে প্রেক্ষাপটে উঠে এসেছে তা দুঃখকে জয় করার তাগিদেই। দুঃখ চেতনারও হয়, দুঃখ লোভেরও হয়। বিশ্বের যতগুলো ক্লাসিক সাহিত্য দেখা যায়, সেখানে মানুষ তার লোভের দুঃখকে জয় করে মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণতার আকাঙ্ক্ষার দুঃখকে বরণ করে নিচ্ছে এমনটাই সত্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যখন বলছেন মৈত্রেয়ী দেবীকে 'মহৎ দুঃখের' যোগ্য হয়ে উঠতে তখন সে আশীর্বাদ। দুঃখকে এড়িয়ে যদি মানুষের গৌরব থাকত তবে বিশ্ব সংসারে মানুষের রচিত সমস্ত মহাকাব্যগুলো ব্যর্থ হত। 'সুখই মানুষের সবটুকু জুড়ে আছে' - এতবড় মিথ্যাকথা বলতে সমস্ত মহাকাব্য ঘৃণা করেছে বলেই মানুষকে সে দুঃখের মধ্যে বড় দেখতে চেয়েছে। বিলাসিতায় নয় - দহন দানে সে মহৎ। যে দহনদানের শিখাটি নির্বাপিত হলে, সমস্ত তাপটুকু নিঃশেষিত হলে যা থাকে তাকে বুদ্ধ বললেন - নির্বাণ। সে দানের শূন্যতা নয়, পূর্ণতা। আমার সবচাইতে বড় সম্পদ - বোধের সন্তোষ।     "দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে? বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে।। জ্বলতে দে তোর আগুনটারে, ভয় কিছু না করিস তারে, ছাই হয়ে সে নিভবে যখন জ্বলবে না আর কভু তবে।। এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে ধরা দিতে হোস না কাতর। দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর। মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবারে, তার পরে সেই জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে।।"  ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর     (ছবি: সুমন)      
319
Wed, 05/15/2019 - 14:00
           জন্মসূত্রে সবাই নিজেদের অ্যাকাউন্টে বেশ খানিকটা সময় পেয়েছি। কেউ কম, কেউ বেশি। জানা নেই। জানার উপায়ও নেই। চেক ভাঙিয়ে সময় নিয়েছি। ইচ্ছামত নিজের ব্যক্তিগত কাজে খরচা করেছি। তাতে জমেনি কিছু। ক্ষয়েইছে শুধু।         সময় কি তবে বাড়ানো যায়? ব্যক্তিগত খাতে বাড়ানো যায় না। সমাজের খাতে বাড়ানো যায়। নিজের অ্যাকাউন্টের সময় সমাজের অ্যাকাউন্টে কিছুটা করে করে জমা রাখলে তা অক্ষয় হয়।         পৃথিবীর সব দেশে সব সময় এমন কিছু মানুষ জন্মেছেন যারা ব্যক্তিগত সময়ের পুরোটাই সমাজের খাতে দিয়ে অমর হয়েছেন - লাভে না, বস্তুর বৈভবে না, চিত্তের প্রাচুর্যে।  আমাদের মুশকিল হল আমাদের সমাজের খাতটা বহুদিন হল শূন্য যাচ্ছে। সবাই নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অস্তিত্বকে সমাজ জানছে। অর্থাৎ আমার বাড়ির বাইরের দরজায় যে দাঁড়িয়ে, ওই সমাজ। আমি আলাদা, পৃথক একটা সত্তা। আদতে তো তা নয়। আমার ঘরের অন্দরমহল থেকে শুরু করে শোবার ঘর, ঠাকুরঘর মায় শৌচালয় অবধি সমাজ। কারণ আমি নিজেই সমাজ। আমার মধ্যে হাজার একটা বিরোধ, দ্বন্দ্ব। সেই স্বাভাবিক। আমি মানু্ষটাকে আলাদা করে দাঁড় করাতে গেলেই বিস্তর ফাঁকি। তা কি করে হয়?         হয় কারণ আমার মধ্যে দুটো আমি আছে - এক, ছোটো আমি। দুই, বড় আমি। সমাজ ওই বড় আমিটার প্রতিনিধিত্ব করছে আমার মধ্যে আর ছোটো আমিটা একটা উন্নতমানের বায়োলজিকালি অস্তিত্ব বই কিছু না। যা কিছু সংঘাত এই দুইয়ের মধ্যে। বাইরেটা তার প্রতিফলন। আজ যে শক্তিতে এত ধুন্ধুমার কাণ্ড, তারা কারা? তারা সবাই আমি আপনি রাম শ্যাম যদু মধু। কেউ আকাশ থেকে পড়েনি। রাজনীতির ক্ষেত্র ক্ষমতার ক্ষেত্র। কিন্তু বাকি ক্ষেত্রগুলোতে? আমরা কি অত্যন্ত সংযত, সত্যনিষ্ঠ, স্বচ্ছ, দুর্বলের প্রতি সদয় সমাজ? ক্ষমতার ক্ষেত্রে যা হয় তা প্রবলভাবে হয় বলে তা বড্ড বেশি চোখে পড়ে। আর বাকি জায়গাগুলোতে সুক্ষ্মভাবে একই কাণ্ড ঘটে চললেও চোখ এড়িয়ে যায়, কারণ তার প্রাবল্য কম। কোনো রাজনীতিবিদ আমাদের সমাজের বাইরে থেকে আসেননি। এই সমাজটাই জন্ম দিয়েছে, লালিতপালিত করেছে তাদের। তবে কার দিকে আঙুল তুলবে? একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে চারটে দেওয়ালের পৃথক অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, কিন্তু বাইরে এসে দাঁড়ালে সে সব মিলিয়ে একটা বাড়ি। আমাদের মধ্যেও তাই হাজার একটা দল। সে দলে হাজার একটা গোষ্ঠী বানিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে দলাভিমানে মত্ত হয়ে কাজের কাজ কিছু হয় কি? কিচ্ছু হয় না।          বড় হওয়ার দায়টা, বড় কাজের দায়টা শুধু অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে, ট্যাক্স দিয়ে আর ভোট দিয়ে যদি গণতন্ত্র চলত তবে আর কথাই ছিল না। চালাতে গেলে সবার মিলিত শক্তি লাগে। সে শক্তি ঘরের মধ্যের সমাজ থেকে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরের সমাজে গিয়ে মেশে। সে শক্তির উৎস বড় চিন্তা হবে শুভ উদ্দেশ্য হবে - শুরুতে এমন কথাই ছিল। মনুষ্যত্বের অঙ্গীকার। হঠাৎ কেমন সব গুলিয়ে গেল। কিছু মানুষ বুদ্ধির বলে, কৌশলের বলে সব এলোমেলো করে দিয়ে ভাবল, এরকমটা চললেই তো বেশ হয়...চলুক এইভাবেই। কিন্তু তা হয় না। মানুষের সব চাইতে বড় শক্তি তার সহনশীলতা। তার শান্তিতে থাকার, সামঞ্জস্যে বাঁচার তাগিদ। সে ক্ষমতা নিজের ক্ষুদ্রতাকে জয় না করলে জন্মায় কি? তখন মনে হয় ওসব খুব কাপুরুষের কথা। কিন্তু ওই যে আছে না..."ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ - কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ...."        সে মৃদু শুধু আস্ফালন করে না বলে। আদতে সেই চিরকালের পরম আশ্রয় মানুষের - বড় আমি। আমাদের মিলিত সামাজিক অ্যাকাউন্ট।    
320
Mon, 05/13/2019 - 10:00
           ব্যক্তিত্ব – একটা অস্তিত্ব। মানবিক অস্তিত্ব। অর্জিত, আত্মগত সত্তা। কিন্তু ঝিনুক মানেই যেমন মুক্তো নয়, মানুষ মানেই তেমন মনুষ্যত্ব নয়। ব্যক্তি মানেই ব্যক্তিত্ব নয়। পশুপাখির নিজের মধ্যে সামঞ্জস্য ঘটানোর কোনো দায় নেই। তার জৈবিকস্তরের সমস্ত ক্রিয়াপদ্ধতির একটা মাপ আছে সময় আছে, সর্বোপরি তার মনোজগত বলে কিছু নেই। তাই বিরোধ দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। মানুষের মধ্যে সে দিকটার ভার প্রকৃতি নিজের হাতে নেয়নি বলেই মানুষের ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যের প্রয়োজন এসে পড়ে। তার বাইরের জগত আর মনোজগত। সেখানে তার সামঞ্জস্য রক্ষার অবশ্যমম্ভাবী দায়। সে সামঞ্জস্য ফাঁকিতে গোঁজামিলে ভণ্ডামিতেও হয়, আবার খাঁটি সমাধানেও হয়। দ্বিতীয় পথেই ব্যক্তিত্বের রঙ ধরে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সে রঙের পরীক্ষাও হয়। আর প্রথম পক্ষের উদাহরণ চারপাশ ছড়িয়ে। তার সংখ্যাই বেশি। আমাদের ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষানীতি ইত্যাদি যাবতীয় কিছু সেই গোঁজামিলটাকে মজবুত করার জন্য সমাজস্বীকৃত পন্থা। সেখানে প্রথম কথা মানুষের স্বাধীনতা কেড়ে নাও। গুরু, শিক্ষক ও নেতার ভূমিকায় এসো। মানুষকে অনুসরণ করাও। মানুষ অনুসরণ করতে ভালোবাসে। তাকে ঈশ্বরের গল্প শোনাও, নানা তত্ত্বের গল্প শোনাও, সাম্য-স্বপ্নপূরণ ইত্যাদির আফিম খাওয়াও – কিন্তু দোহাই, চিন্তা করতে দিও না। যে চিন্তা করে তাকে - ধর্মে বলো নাস্তিক, শিক্ষায় বলো অবাধ্য, রাজনীতিতে বলো দ্রোহী। তবে নিশ্চিন্তে থাকো, এদের সংখ্যা কম। আদতে সিংহভাগ মানুষ চাইবে তুমি যেন তাদের শাসন করো, পথ দেখানোর ছলে পথ রোধ করে নিজে পথ হয়ে বোসো, মাথায় নিত্যনতুন উত্তেজনা দাও। মানুষ তোমার বশ হয়ে থাকবে। যেখানে মাথা নীচু করতে বলবে, করবে। যাকে পুজো করতে বলবে, করবে। যাকে হত্যা করতে বলবে, করবে। এমনকি আত্মহত্যা করতে বললেও করবে। কিন্তু একটা বিশ্বাস তোমাকে তাদের দিতে হবে – সে সুরক্ষিত, নিরাপদে আছে, সামনে সে বিপদবাধাহীন। ব্যস। মানুষ ধর্মে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে আর কিচ্ছুটি চায় না গো, একটু নিরাপত্তা, একটু আশ্বাস, একটু প্রবোধ চায়। সব চাইতে বেশি করে চায় তুমি তার স্বাধীনসত্তাটার একটা জামা দাও। একটা আবরণ দাও। কেমন বেমানান সংজ্ঞাহীন বিশ্রীরকমের বেয়াড়া হয়ে পিঠের কুঁজের মত সাথে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তুমি এর থেকে আমায় রেহাই দাও। আমায় একটা নাম দাও, পরিচয় দাও, মুখোশ দাও, দল দাও, গোষ্ঠী দাও। এরপর আমরা হইহই করব, শত্রুপক্ষ মিত্রপক্ষ বানিয়ে নেব, বেশ একটা লণ্ডভণ্ড করে নেব। তুমি শুধু একটা পদ্ধতি দাও। একটা মেথড। ধর্ম শিক্ষা রাজনীতি – সেই মেথডের বা কৃষ্টি-পদ্ধতির রূপ। তাই যে কজন স্বাধীন মৌলিকসত্তা এসেছেন মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে তাদের দেখেছি এই প্রথাগুলোকেই আগে উপেক্ষা করেছেন বা নমো নমো করে সেরে নিয়েছেন। কারোর বাধ্য হতে চায়নি। অথবা ঔদ্ধত্যে মত্ত হওয়ার মতও নির্বুদ্ধিতা দেখাননি, কারণ তার বোধে বিশ্বপ্রকৃতির আদিগুরু আসন পেতে বসেছেন। তিনি শিক্ষা দেন ভুলের স্বাধীনতায়, নম্রতার অনুবীক্ষণে সত্যের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণে, বিশ্বপ্রকৃতির শাশ্বত নিয়মের আশ্বাসে। সে মুক্ত হওয়ার সাধনা। যুক্ত থাকার অনুকম্পা।         কিন্তু এই সাধারণ মানুষ, মুক্তপুরুষ বাদ দিয়ে আরেক শ্রেণীর মানুষ থেকে যায়, যারা কাপুরুষ। আর যারা আসুরিক? তারাও আছে। কিন্তু তারা আছে শুধু ধ্বংস হওয়ার জন্য, অপঘাতে। আক্রোশ, লোভ, হিংসা, অহংকার – এইসবের দাসত্ব থেকে মুক্তি যার নেই, সে না পারে সাধারণ হতে না পারে মুক্ত হতে। সুতরাং তার কথা থাক।         যে কাপুরুষ, সে কে? আসলে সে কিছুই না। সে ভীতু? না। সে কূট? না। সে ছল? না। সে ভালো? না। সে মন্দ? না। আসলে সে কিছুই না, আবার সব কিছু, সে গিরিগিটির মত। তাই সংসারে আর সবাইকে নিয়ে চলার বিধান আছে, পথ আছে, উপায় আছে – কিন্তু কাপুরুষের সঙ্গের মত দুঃসহ জ্বালা আর কিছুতেই নেই। সেকি সুবিধাবাদী তবে? সেও না। কারণ সুবিধাবাদী অন্তত নিজের সুবিধাটা বোঝে। কাপুরুষ নিজের সুবিধাটুকুও ঠিকঠাক ঠাহর করে উঠতে পারে না। কখনও কখনও নিজের ক্ষতিকেও পরম মঙ্গল ভেবে এমন নিশ্চিত হয়ে বসে থাকে যে তার অতিবড় শত্রুও (যদিও সেও সম্ভব নয়, কারণ শত্রু জোটানোর মত যোগ্যতাও তার নেই) করুণা করে। রামকৃষ্ণদেব এই চরিত্রকে চিঁড়ের ফলারের সাথে তুলনা করেছেন, কিছুতেই আঁট হয় না। কি অসামান্য উপমা! একটা কথাতেই সার কথাটা বলে দিলেন, আঁট হয় না। একটা মানুষ যে সম্পূর্ণ ধৃতিশূন্য। তাকে নিয়ে কোনো ছোটো কাজে হাত দেওয়া যায় না, বড় কাজ তো প্রশ্নই ওঠে না। সে খালি ছেড়ে ছেড়ে যায়, হারিয়ে হারিয়ে যায়, সরে সরে যায়। আবার থেকে থেকে গায়ের সাথে জড়িয়ে যায়, চলার সাথে হোঁচট খায়, ভাবনার সাথে ঘোর তৈরি করে। এমন মানুষকে নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায় না। তাই এই সিদ্ধান্তেই স্থির থাকা শ্রেয় যে এ মানুষটা অবিকশিত নয়, মানুষটা অসম্পূর্ণ – কাপুরুষ। ব্যক্তিত্বহীন তামসিক সত্তা। সে গুহায় গর্জন করে, লোকালয়ে মহাপ্রভু, যীশুতুল্য স্থির নম্র আচরণ করে, একা নীরব থাকলে স্বপ্নীল হয়ে ওঠে, কথা বললে হাঁ-না এর মধ্যবর্তী নো-ম্যান্‌স ল্যাণ্ড এর শব্দ খোঁজে। তার প্রতিশ্রুতি নেই, তৎপরতা নেই, উৎসাহ নেই, ভুল নেই, ঠিক নেই, আনন্দ নেই, বিষাদ নেই, সে এক প্রবল শূন্যতা। কিন্তু সেই মানুষটাকে যদি কেউ আছে বলে তার সাথে চলবে স্থির করে, তবে সে একটা অসম্ভব পণ করতে চলেছে। কারণ মনে রাখতে হবে, আমাদের আচরণ ব্যক্তির সাথে না, ব্যক্তিত্বের সাথে হয়। আর কাপুরুষ মানে ব্যক্তিত্বহীন, শূন্যতা। শূন্যের উপর প্রাসাদ বানানো যায়? খড়কুটোই দাঁড়ায় না...প্রাসাদ...?!!     (এই লেখাটা পড়েই অবধারিত আমার মেসেঞ্জার, ফোন ইত্যাদিতে প্রশ্ন আসবে – কে? কাকে বলছ? ফেসবুকের এই এক সমস্যা। আসলে ফেসবুক একটা মঞ্চ তো। কেউ সেই মঞ্চে শুয়ে পড়ে হাত-পা ছুড়ে কাঁদুনি গেয়ে বলে, ও পিসি ও শিবুদা আমায় তোল্লা দাও... কেউ তার দুইঘটিসম বিশাল পাণ্ডিত্যে রাম-শ্যাম-নণ্টেফন্টে-বেদব্যাস-শেক্সপীয়ার-রবীন্দ্রনাথ এক আসনে বসিয়ে, মুড়ি মিছরি এক করে চিত্রহার বানিয়ে বাঁদর নাচ নাচে....হাততালি পেতে অসুবিধা হয় না...কারণ সবার নিজের মঞ্চ আছে...সবাই দর্শক খোঁজে...তাছাড়া ফেসবুকের মঞ্চের বাইরেও অনেক দরকার আছে...তাই কারোর মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়লে যদি আদতে বাস্তবিক জীবনে কিছু সুবিধা মেলে সেই অর্থে কিছু মানুষ লেজ নাড়ার গতি ক্রমাগত বাড়িয়েই রাখে.. আরো আরো কত কি...আবার আমাদের মত যারা শব্দ ভাব চিন্তার সমগোত্রীয় মানুষ খোঁজে তারা সেই মঞ্চে উঠে নিজের সাংকেতিক ভাষায় কথা বলে মনের মত মানুষগুলোকে খুঁজে বার করার চেষ্টা করে...  কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ করার জন্য এ লেখা নয়, সে ক্ষেত্রে আমার সেই ব্যক্তিটিকে সামনে পেলেই যথেষ্ট...ফেসবুকের মঞ্চে উঠে গাল পাড়ুম ক্যান...জয়গুরু)    
321
Thu, 05/09/2019 - 11:34
           সাজিয়ে কিছু মিথ্যা কথা আনিনি। সাদা পাতাটা সামনে থাকে যখন, তার পাশে তুমি, মনে হয় কিছু ভালো কথা লিখি। বিশ্বাসের কথা, আশ্বাসের কথা। আজ ইচ্ছা করছে না। আমার ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া আমার পুঁজি বলতে কিছু নেই। বড় ভাব, বড় আশা, বড় স্বপ্ন, বড় চিন্তা – নেই। ফুরিয়ে গেছে। টিকতে পারেনি। কোনো মহামানব আসবে না, আমরা বুঝে গেছি। ভান করাটা থামাইনি যদিও। তুমি কবি ছিলে। আজ কবিতা নেই, কবি আছে। আজ শুধু গদ্য। তুমি যে বিশ্লেষণ পছন্দ করতে না, মানুষের চরিত্র ঘেঁটে তার থেকে গভীর সত্যের অন্বেষণ যে তোমার বিশ্রী লাগত, আমরা সেই করি রাতদিন আজ। কারণ আমাদের কল্পনাশক্তি মৃত আজ। তার জায়গায় বিভীষিকা, আতঙ্ক, ভয়।         আমার নিজের লেখা অক্ষরগুলো দেখে ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে, কেন লিখছি এসব? অনেকেই তো নিন্দামন্দ করবে। বলবে “তবুও কি শুভ নেই? তুমি কেন শুধু শুধু অমঙ্গল দেখে কষ্ট পাচ্ছ?” আমি জানি যারা এ কথা বলে, তারা নিজেরাও তা বিশ্বাস করে না। দ্বিধায় তাদের বলার ভঙ্গীতে আর শব্দের উচ্চারণে পার্থক্য টানে। আমি চুপ করে থাকি। আসলে তুমি এখন নেই। এখন তুমি একটা অভ্যাস। এই মহান বিশ্বে আমরা আমাদের ক্ষুদ্রপ্রাণের জন্য বিস্মিত হই না, তবুও গাই... 'আকাশ ভরা সূর্য তারা'... অভ্যাস। আমাদের কারোর একলা চলার জো নেই আজ, দলে নাম না লেখালেও হাজিরা দিতেই হয়, তবুও গাই... 'যদি তোর ডাক শুনে'... অভ্যাস। আমাদের সবটাই অভ্যাস এখন। ভাব নেই। রক্তে জোর নেই, সুগার-কোলেস্টরল আছে। মাথায় সংশয়, সন্দেহ, ভড়ং-এর অভ্যাস।        আসলে আমরা ভালো নেই। তোমার ভারত পরাধীন ছিল। তুমি জন্মেছিলে, মারাও গিয়েছিলে একটা পরাধীন দেশে। যদিও তোমায় পরাধীন করবে কার সাধ্যি। তুমি সে স্বাধীনতা খুঁজেছিলে চিত্তের নানা ভাবে, শিক্ষাদানের নানা চিন্তায়, নানা সৃষ্টিতে। আমরা জন্মেছি মরছি - স্বাধীন দেশে। আমাদের নতুন কোনো স্বপ্ন দেখার সাহস নেই আর। কারণ আমাদের হাত-পা বাঁধা আমাদেরই মোহভঙ্গের অভিজ্ঞতায়। আমরা স্বাধীন দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি তা আমরা প্রতিদিন দেখছি। একটু একটু করে বুঝতে শিখছি, আসলে আমরা সৎ হতে শিখিনি। আমরা নকল করতে জানি, ভান করতে জানি, হয়ে উঠতে জানি না। আমাদের সমস্ত কিছুর সার্থকতার সীলমোহর আসে পাশ্চাত্য থেকে এখনও। আমরা যদ্দিন না পুরোপুরি পাশ্চাত্য হয়ে উঠছি তদ্দিন আমাদের মুক্তি নেই – এ আমাদের সার্বজনীন বিশ্বাস। তোমার আশ্রম ক্রমে টুরিস্ট স্পট হয়ে উঠছে। তোমার ভাবকে প্রতিস্থাপিত করছে আমাদের মধ্যমেধার গৌরব - যার মূল কথাটা হল – আমরা অত্যন্ত বাস্তববাদী হয়ে উঠেছি।         তুমি ভাব। আমরা বাস্তব। তুমি আকাশ। আমরা মাটি। তুমি কল্পনা। আমরা বস্তু।         অর্থাৎ আমাদের কোথাও মিল নেই। হতে পারে না। হবে না। আমাদের আবেগ আছে, সত্যানুভবের প্রতিশ্রুতি নেই তোমার মহিমাগানে। আসলে তুমি কোনোদিন আমাদের কাছের ছিলে না। তোমার গায়ের যে জ্যোতি, সেই জ্যোতিতে আমাদের স্বার্থসিদ্ধি হয়েছে খানিক। সেদিন তোমার নিন্দা ছিল প্রকাশ্যে। আজ তোমার কপট বন্দনায় তোমায় অস্বীকার করার কৌশল। কিছু মানুষের ব্যক্তিগত জীবনে যদি তুমি সত্য হয়ে থাকো, সেটুকুই সত্য। বাকিটা সম্পূর্ণ মিথ্যা।         এই মিথ্যার মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা কথাই জোর করে বলা যায় – সব মিথ্যা। মিথ্যাকে যদি মিথ্যা বলে না স্বীকার করি তবে তোমার সাথে বেইমানি করা হবে। আমাদের মিথ্যা শব্দের মালা গাঁথা, আমাদের আড়ম্বর – এইসবের মধ্যে একটাই কথা চাপা পড়ে থাকে, আমরা হয়ে উঠিনি। আমাদের শিক্ষা, ব্যবসা, রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য – সব কিছুই বড় মধ্যমেধার। যেন বাস্তব হয়ে ওঠাই লক্ষ্য – সত্য হয়ে ওঠা না। যা কিছু লাভের, যা কিছু গণনার, যা কিছু আয়তনের – তাই যেন সত্য। যা কিছু হয়ে ওঠার, যা কিছু সৃষ্টিশীলতার, যা কিছু মরমী – তা ব্রাত্য আজ। তুমি যে দরদিয়ার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলে, বলেছিলে “আসন হয়নি পাতা, মালা হয়নি গাঁথা... লজ্জাতে হেঁট মাথা... ও মোর দরদিয়া...” সেই দরদিয়াকে নির্বাসন দিয়েছি আজ। আজ আমাদের সমাজে পঞ্চক, মহাপঞ্চক সব আছে, শুধু ঠাকুর্দা নেই, সেই ফকির নেই। কারণ তারা লাভের হিসাব দেখাতে পারেনি কবি। আমি জানি, যেখানে ফকির নেই, যেখানে ঠাকুর্দা নেই – সেখানে তুমি কোনোদিন থাকতে পারো না। সেখানে যে থাকে সে তোমার ভাষায় – স্যার রবীন্দ্রনাথ, যে নোবেল পেয়েছে, যে বক্তৃতা দিয়েছে, যে হাজার একটা নির্বোধ স্বদেশবাসীর ফরমায়েশ খেটেছে, কিন্তু সে তুমি নও, যে তুমি কালান্তরের দ্রষ্টা, যে তুমি বাউল, যে তুমি মহামানবের আসার আশায় তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে।        আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ। আমাদের পেটের মধ্যে গজগজ করা কাগজের টুকরোগুলোতে তোমার রচনাবলীর পাতাও আছে। লজ্জা পেও না। আমরা কবি নই। আমরা ডানা ছাঁটা, ডানা কাটা বাস্তববাদী। আকাশটাকে আমরা নিতান্ত অপচয় বলেই জানি। সে তোমারই থাক। আমাদের থাক লোভ। আরো লোভ। আরো ভয়। আরো শঙ্কা। বাস্তব আমাদের কারাগার, সম্ভাবনা নয়, তাই বাস্তববাদিতার গর্ব নিয়েই বাঁচা। তোমার থাক বৈরাগ্যের মাধুর্য। স্বপূর্ণতার আনন্দ। আকাশের অবকাশ। সৃষ্টির যন্ত্রণা। আমরা প্রণাম করি। দূর থেকে।  
322
Sun, 04/28/2019 - 11:07

       সত্য তবে কি আনন্দ? না, সত্য বিষাদ? এর কোনো স্থির উত্তর নেই। রবীন্দ্রনাথের চেতনায় অধিক স্থান জুড়ে আছে আনন্দ। সত্য সেখানে আনন্দের মধ্যে প্রতিভাত। সে আনন্দের মধ্যেই তিনি দেখছেন মঙ্গল। রবীন্দ্র দর্শনে এ খুব বড় একটা কথা। রবীন্দ্রনাথ সত্যকে দেখেছেন আনন্দে। যে আনন্দে দুঃখের স্থান আছে, যন্ত্রণার স্থান আছে। যার মিলিত রূপ রুদ্র। তিনি ভীষণকে স্বীকার করেছেন, কিন্তু বিষাদকে নয়। বিষাদের কাছে আত্মসমর্পণের কথা কোনো মুহূর্তেই যেন নেই। এলেও তা ক্ষণিকের জন্য। কিন্তু শেষ কথা – সত্য যে কঠিন, সে কখনও করেনা বঞ্চনা। অর্থাৎ সে কঠিন, কিন্তু বিষাদের অন্ধকার নয়।
       কিন্তু পাশ্চাত্য দর্শনে ক্রমে সত্যকে দেখা গেল বিষাদে। যত ঈশ্বর অস্তিত্বহীন হল তত মানুষের খণ্ড চেতনায় সত্য ধরা দিল বিষাদে। দস্তয়েভস্কি, কাফকা, কাম্যু, নীৎজে ইত্যাদি সকলের চেতনায় সত্য বেজেছে বিষাদের সুরে। অবশেষে যেন সব কিছু ভীষণ অর্থহীন। কিন্তু সেই অর্থহীনতার চেতনা কখনই আত্মহত্যার পথে প্ররোচিত করার জন্যে নয়, মিথ্যা স্বপ্নের কুয়াশা ভেদ করে নির্মম বাস্তবের অকরুণ ত্যাগের মধ্যে বাস করার আহ্বান যেন। যে চেতনাকে বলা হচ্ছে 'আনন্দ' রবীন্দ্রনাথের দর্শনে, বা ঔপনিষদিক দর্শনে। দস্তয়েভস্কির কথায় তা 'ব্যাধি', 'নোটস ফ্রম দ্য আণ্ডারগ্রাউণ্ড'-এ লিখছেন। কাম্যু সব শেষে সব কিছুকেই 'অ্যাবসার্ড' বলছেন। কিন্তু কেউ 'আনন্দ' বলছেন না।
       সত্যকে সত্যের মধ্যে দেখা যায় না। কারণ সত্যের নিজের কোনো অবয়ব হয় না। যেমন হয় না সময়ের। সত্যকে কোনো যুক্তি, কোনো উপলব্ধি বা কোনো বিশ্বাসের অবয়বে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন, একটা ফুল হৃদয়ের দৃষ্টিতে সৌন্দর্যবোধে সত্য হলেও, বুদ্ধির দিক থেকে যুক্তির রাজ্যে সে একটা জীবের জননাঙ্গ বই কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ এই দুইকেই সত্য বলেন। একটা অনুভবের সত্য, অপরটা যুক্তির।
       তবে সত্য কি?
       কে জানতে চাইছে? আমি। এবার সেই প্রাচীনতম প্রশ্ন উঠে এলো – যা ডেলফির মন্দিরে সক্রেটিস পেয়েছিলেন, উপনিষদের ঋষি ধ্যানে পেয়েছিলেন – 'আত্মানাং বিদ্ধি' – নিজেকে জানো। যে 'আমি' সত্যকে জানতে চাইছে, যে 'আমি' সুখের সমুদ্রে নাইতে চাইছে, যে 'আমি' লড়াই করে নিজের অস্তিত্ব এই মরণশীল জগতে টিকিয়ে রাখতে চাইছে – এ সবই কি এক? সবই তো দেখি একটি আধারেই জড়াজড়ি করে। তবে এর উত্তর পাই কি করে? এক পথ, মিথ্যাকে জানা। উপনিষদ বললেন, 'নেতি নেতি' করে যাওয়া। অর্থাৎ এটি মিথ্যা, এটি মিথ্যা - এই সূত্র ধরে এগোনো।
       কি মিথ্যা? সবটাই মিথ্যা। এই নিয়ে প্রাচ্য–পাশ্চাত্য'র দার্শনিকদের কোনো গোল নেই দেখলাম। আখেরে সবটাই যে মিথ্যা, একটা মুখোশের আড়ালে – এই উৎপেতে ভয়ংকর সত্যটাকে নিষ্ঠুরভাবে উন্মোচন যেভাবে পাশ্চাত্য সাহিত্যে হয়েছে, তা আমাদের এদিকে হয়নি। আমাদের যা হয়েছে তা আধ্যাত্মিক প্রেক্ষাপটে, এমনিতে আমরা সামাজিক সাহিত্যে ওই মাত্রায় নির্মমতার পরিচয় দিইনি। কোথাও একটা পেলব, করুণ, আদি অথবা বাৎসল্য ইত্যাদি রসে সাহিত্যের ইতি ঘটেছে। মানব চরিত্রের মারাত্মক মাত্রায় বিশ্লেষণ ঘটিয়ে তার ব্যবচ্ছেদ করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু অবশেষে বলা হচ্ছে – সবটাই মিথ্যা।
       এই মিথ্যাকে সরস করে তুলতে আমাদের কেউ কেউ বলে উঠল – এ সব লীলা। 'লীলা' শব্দের মধ্যে আমরা বলতে চাই যদিও এ সব মিথ্যা তবে উদ্দেশ্যগতভাবে ও বস্তুগতভাবে সেটা নির্দোষ, কারণ এর পশ্চাতে একজন সত্যময় সত্তা আছেন যে! আরেক পক্ষ অবিশ্যি এই তত্ত্বটার ধার ধারেন না, তারা বলে ওঠেন – সব মায়া, শূন্য। বুদ্ধের দর্শন যে পথে এগোতে এগোতে নাগার্জুনের শূন্যবাদে এসে দাঁড়িয়েছিল। মোটকথা, আমাদের মধ্যে এই মিথ্যাকে নিয়ে একটা সংজ্ঞাগত সমস্যা থাকলেও অস্তিত্বগত সংশয় ঘটেনি। কিন্তু আস্তিক্যবাদের দর্শনগুলো এই মিথ্যার পিছনে ধ্রুব সত্যের কথা জানানোর চেষ্টা করেছেন, যিনি আদতে ব্রহ্ম। কিন্তু বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক সে পথে হাঁটেনি। তারা তাদের মত করে একটা পথ তৈরি করেছেন। যেমন বৌদ্ধধর্মের প্রধান একটা কথা 'করুণা'। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, এই 'করুণা' কথাটা যদি বৌদ্ধধর্মে না থাকত তবে একটা ‘বিশুদ্ধ আত্মহত্যার’ কথা ছাড়া বৌদ্ধধর্মের আর বিশেষ কিছু বলার থাকত না।
       তবে আবার আগের কথাটা বলি, সত্যকে জানার উপায় মিথ্যাকে 'মিথ্যা' বলে চিহ্নিত করা। এখন কথা হল এখানেও প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের একটা পার্থক্য। প্রাচ্য বলতে শুরু করল, আমি শরীর নই, কারণ শরীরের বাড়-বৃদ্ধি-ক্ষয়-ক্ষতিতে আমার চিত্তের 'আমি' বোধটির কিছুমাত্র হ্রাসবৃদ্ধি হয় না। সেইভাবেই আমার সুখ-দুঃখ আর উৎসাহ-অবসাদ। আমি বলি আমার সুখ-দুঃখ অনুভব হচ্ছে; আমার উৎসাহ-অবসাদ অনুভব হচ্ছে। অর্থাৎ, 'আমার হচ্ছে', কিন্তু তা 'আমি' নই, অর্থাৎ এগুলো মিথ্যা। এইভাবে সে একটা আত্মতত্ত্বের উপর দাঁড়াতে চায়।
       সক্রেটিসের কথা কিন্তু অন্য। তার কথা অনুযায়ী, তোমার জ্ঞান, বিশ্বাস, তথ্য কতটা সত্য বিচার করে দেখো। যার বেশিরভাগটাই মানসিক ও বৌদ্ধিক স্তর নিয়েই, সাথে সামাজিক ও বহির্বিশ্বের কথাও আছে। কিন্তু এই বিচারের মাধ্যমে মিথ্যাকে আর অধ্রুব অনুভবগুলোকে চিহ্নিত করার সাথে সাথে যে একটা চিত্তের স্থিরতা আসে সে কথাটাও যেন সেই সময়ের দর্শনে এসেছিল। যার থেকে স্টোয়িক দর্শনের উৎপত্তি। জেনো, অউরেলিয়াস, সেনেকা যে পথের পথিক, পরে কিছুটা শোপেনহাওয়ার। কিন্তু পাশ্চাত্যের এই দর্শনের সাথে আমাদের আত্মদর্শনের কোনো মিল নেই। কোনো অবিনাশী, ধ্রুব, অমর শুদ্ধ-বুদ্ধ-মুক্ত আত্মার কথা কিন্তু কেউ বলেননি। আর বললেও সেটা ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে বলা, যে বিশ্বাসটারও তেমন কোনো গুরুত্ব নেই যে অর্থে যুক্তি-বিচারের মাধ্যমে নিজের মনুষ্যত্বকে জানার আগ্রহ আছে।
       মনুষ্যত্ব আর আত্মতত্ত্বের প্রধান পার্থক্য হল, একটা ইন্দ্রিয়জগতের মধ্যে আর অপরটা অতীন্দ্রিয় জগতের। পাশ্চাত্য প্রথমটার দিকে ঝুঁকেছিল, প্রাচ্য দ্বিতীয়টা। প্রথমটা দাঁড়িয়ে মানুষের সহজাত উপলব্ধি, শুভবুদ্ধি, মনন ইত্যাদির উপরে। কিন্তু পরেরটা দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বাসের উপরে। সমস্যা হল আজকের এই ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন বৌদ্ধিক ও বিজ্ঞানপ্রাণতার যুগে সেই বিশ্বাস পাই কোথায়? সেই পরম মঙ্গলময় সত্তার উপর ভার দিয়ে বাঁচার দিনই বা কোথায় সিসিটিভি আর সন্ত্রাসবাদের যুগে? সেই পরমমঙ্গলময় সত্তাই আজ সর্বাধিক বিপন্ন যেন। মানুষ আশ্রয় পায় কোথায় তবে আজ? একদিকে এই ভয়ংকর বিধ্বংসী আসুরিক মানবসত্তা, অন্যদিকে মানুষের একসাথে একত্রে সহমর্মিতায় থাকার আকুতি। কিভাবে এই যুযুধান দুই শক্তির লড়াইয়ের পরিণতি আঁকা থাকবে এই মহাবিশ্বের ইতিহাসে একদিন যদি পৃথিবী সত্যি শূন্য হয়ে যায় অস্তিত্বে? সে উপসংহার টানবে কে? মানুষের করুণা, ত্যাগ, পরার্থপরতা? না, হিংস্র, বর্বর, আত্মপরতা? জানি না আমরা। আমরা শুধু একটা পক্ষ নিয়ে দাঁড়াতে পারি কেবল। সেই পক্ষটা যতটা তাড়াতাড়ি নিই ততটা পথ হাঁটতে পারি, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারি। তারপর বোঝা যাবে যে জগতে যে দুটো পথ সত্যের দেখা হয়েছিল – আনন্দে আর বিষাদে – তার মধ্যেa কে ছিল সত্যের কাছে বেশি? পূর্ণ আনন্দময় সত্তা না অন্ধকারময় শূন্যতা।

323
Mon, 04/22/2019 - 14:22
    মাননীয় ধর্মাবতার,             আমার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করুন। আগামী প্রজন্মের মানুষদের কানেও যেন এই জবানবন্দি পৌঁছায় তার ব্যবস্থা আপনি করুন। কারণ আপনার ন্যায়বিচারের শেষে আপনি যে শাস্তি আমার জন্য বরাদ্দ করবেন তাতে আমি জীবিত থাকার যোগ্যতা হারালেও হারাতে পারি। ধর্মাবতার, আমার একান্ত অনুরোধ আমার এ জবানবন্দি যেন পৌঁছায় আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে।        আমি বলছি। কিন্তু বলতে গিয়ে বুঝতে পারছি বলাটা ততটা সহজ নয় যতটা ভেবেছিলাম। এক কথায় বলা যায় না। একটা শব্দ, ‘ক্ষোভ’ - বললে মনে হয় যেন সবটা বলে ফেললাম, কিন্তু আসলে কি বললাম? কিচ্ছু বললাম না। আমার মত অনেক নির্বোধ নরনারীতে পূর্ণ এ সমাজ, যারা জানে না কি সাংঘাতিক এক মানসিক বিকারে আক্রান্ত তারা। প্রতিদিন তিলে তিলে নিজের আত্মাকে ক্ষয় করে চলেছে, তবু হায়, তারা বুঝতে পারছে না তারা কি নরকের মধ্যে নিজেকে ধাক্কা মেরে ফেলে, ওঠার সিঁড়ি পুড়িয়ে ফেলে কি যন্ত্রণায়, অসহায়তায় দিন কাটাচ্ছে। এ অসহায়তা কল্পিত, স্ব-আরোপিত ধর্মাবতার। তবু মানুষ এর থেকে বেরোতে পারে না, এমন মূঢ় আমাদের 'মন' নামক অদ্ভুত জন্তুটা ধর্মাবতার। আমার বলতে বলতে কান্না ঠেলে আসছে, গলা বুজে আসছে, আমার বিগত দিনগুলোর কথা মনে করে নিজেকে নিয়ে জঙ্গলে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু এর কোনোটাই আমি করিনি ধর্মাবতার।        ক্ষোভের একটা সহধর্মিণী আছে ধর্মাবতার – ঈর্ষা। ওর যা আছে, আমার কেন তা নেই – এ এক অদ্ভুত রোগ। আমি যেন শতাব্দীর পর শতাব্দী এই রোগে আক্রান্ত ছিলাম। আমার যা আছে তাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই কোনোদিন করিনি, শুধু বিষের তুণে বিষাক্ত বাণ ভরেছি – ওদের কেন আছে ভেবে ভেবে। আমার রাত-দিন একটুও শান্তি ছিল না ধর্মাবতার। আমার ক্ষমতার পরিমাপ, যোগ্যতার পরিমাপ, শ্রমের পরিমাপ কোনোদিন করিনি। ওদের ধরেই নিয়েছি অসীম। ঈশ্বরের মত। মনে হয়েছে ঈশ্বরের করুণা যদি অসীম হয়ে থাকে, আর তাঁর সেই অসীম ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস যদি খাঁটি হয়ে থাকে তবে কেন আমার ক্ষমতা, যোগ্যতা ইত্যাদি সসীম হবে আমার শরীরটার মত, আমার রূপের মত। আমি নিজেকে বারবার বিচারের দোরগোড়ায় আনার থেকে রুখে দাঁড়িয়েছি। ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলেছি, আমি তাঁর সন্তান, আমি অসীম কিছু প্রাপ্তির সম্ভাবনা রাখি, কেন তবে এ অবিচার আমার প্রতি?        হ্যাঁ ধর্মাবতার, আপনি ঠিকই অনুভব করছেন। আমি ক্রমশ মানুষ থেকে ঈশ্বরের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে শুরু করলাম। আমার মনে হতে লাগল তিনি বড্ড একপেশে। তাঁর বিচার বলে কিছু নেই, তিনি নপুংসক। হ্যাঁ ধর্মাবতার, আমার ঠিক এই কথাগুলোই মনে হয়েছিল। আমি যদি আজ থেকে পাঁচশো বছর আগে জন্মাতাম হয়তো এই কথাটার জন্য এখনি আপনি আমায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমি জানি আজ আপনি তা দেবেন না। এ যুগ আলোকিত যুক্তির যুগ। আপনি ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনবেন। জুরিদের সাথে আলোচনা করে আমার শাস্তির বিধান দেবেন। যদি আপনার হৃদয়ে ঈশ্বরের প্রতি প্রেম থাকে, তবে আপনার হৃদয়ে নিশ্চয় এখন ক্রোধের আর ঘৃণার আগুন জ্বলছে আমার প্রতি। কিন্তু আমি জানি তবু আপনি চুপ থাকবেন, কারণ আপনার পদের সম্মানের প্রতি আপনি দায়বদ্ধ। আমি করতালি দিচ্ছি আপনার এই মহানুভবতায় ধর্মাবতার।        আমি ক্রমে নাস্তিক হয়ে উঠলাম। আমি বুঝলাম, ঈশ্বর একটা বুজরুকি। ওতে আমল দিয়ে জীবন নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমি যেই ঈশ্বরকে কবর দিলাম বা সৎকার করলাম, ধর্মাবতার, অমনি আমার হৃদয়ের মধ্যে থেকে ধর্মের শেখানো সমস্ত শুভ চিন্তাগুলো উধাও হয়ে গেল। আমি বুঝলাম, আমি ভালো হয়েছিলাম ভয়ে। ধর্মের সুক্ষ্ম ভয়ে, নিজের অবমাননার ভয়ে, ঈশ্বরের দৃষ্টির সামনে অবমাননার ভয়ে। আসলে মানুষের আজন্ম একটা বাধ্য হয়ে চলার অভ্যাস গড়ে দেওয়া হয় ছোটো থেকে। এখন সেই অভ্যাসটা এমনই পাকাপোক্ত যে তাকে নিয়ে আর দ্বিধা হয় না মানুষের। ছোটোবেলায় বাবা-মা, পরে শিক্ষক, হাস্পাতাল-অফিস-কাছারি ইত্যাদির হাজার নিয়মকানুন, তারপর দেশের সংবিধান। এত কিছুর কাছে বাধ্য হয়ে চলতে চলতে তার বিশ্বাস হয়ে যায় যে, যে বাধ্য হয়ে চলে সেই ভালো। সেই সৎ। সে পুরস্কার পাবে। কিসের পুরস্কার সে ধারণাটা তার কাছে স্পষ্ট নয়, কিন্তু সে জানে একটা পুরস্কার সে পাবে। যত দিন যায় তার লোভটা তত বাড়ে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারটা তার কপালে এসে জোটে না। ইতিমধ্যে যে ক'টা কিছু পেয়েছে তাকে পুরস্কার হিসাবে ভুল করেছে বুঝতে পেরেছে, কারণ যা পেয়েছে তার সাথে তার যতটা মাথা নীচু হয়েছে বাধ্যতায় সে হিসাব মেলেনি। আমি এখানে একটা কথা বলে নেব ধর্মাবতার। মানুষ স্বভাবতই লোভী। তাই তার হিসাবে সে কোনোদিন সন্তুষ্ট হবে না। যা পাবে তাই তার কাছে তুচ্ছ হবে। এ অবধারিত। এবার তার মধ্যে জন্মাবে ক্ষোভ। ও! একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি। এই বাধ্য হয়ে চলার শ্রেণীকক্ষে কখন যে ঈশ্বর এসে অলক্ষ্যে দাঁড়ায় সে জানতেও পারেনা। সে কেবল বুঝতে পারে যে তাকে ঈশ্বরের বাধ্য হয়েও চলতে হবে। এবার তার সামনে একটা অলৌকিক, অযৌক্তিক পুরস্কারের লোভ এসে দাঁড়ায়। কারণ, ঈশ্বর স্বয়ং অলৌকিক, অযৌক্তিক। তার ক্ষোভের মাত্রা আরো বাড়তে থাকে, সাথে ঈর্ষা। কিন্তু এর থেকে বেরোবার কোনো পথ সে জানে না, কারণ নীরবে নিজের ঈর্ষা আর ক্ষোভ নিয়ে চলাই তার ভবিতব্য সে বুঝে নিয়েছে। কারণ মাত্র কয়েক প্রজন্মের মানুষের জীবনে বিপ্লব দেখার সুযোগ হয়ে থাকে। বাকি শতাব্দীর পর শতাব্দী সে মুখ গুঁজেই বাঁচা-মরা অভ্যাস করে ধর্মাবতার।        আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। আপনি ভাবছেন আমি কেন ঈর্ষা জারিত ক্ষোভকে বিপ্লবের তুষের সাথে তুলনা করছি, তাই তো? তুলনা করছি না, একটা আরেকটার থেকে বাঁচার উপায়। যেমন বসন্তের ঝরাপাতা কালবৈশাখীর ঝাপটে উড়ে চলে যায়, এ সেরকম একটা কিছু ভাবতে পারেন ধর্মাবতার। তেমন মানুষের ক্ষুব্ধ চিত্ত বিপ্লবের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে শুদ্ধ হয়েছে, মানুষ আত্মত্যাগী হয়ে নিজের প্রাপ্য অধিকার বুঝে নিয়েছে এমন কাল তো এসেছে মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে ধর্মাবতার। আসেনি?         কিন্তু হায়! আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন বিষাক্ত ক্ষুব্ধ জীবন। আমি কোনো কালবৈশাখী দেখিনি ধর্মাবতার আমার জীবনে। কয়েকটা মিথ্যা বসন্ত এসেছে। আমি চিরটাকাল ঈর্ষাসিক্ত ক্ষোভেই কাটিয়ে দিয়েছি। সারারাত জেগে ছুরিতে ধার দিয়েছি অথচ প্রতিবেশীর কানে যেন না পৌঁছায় তাই কোনো মধুর সংগীতকে ভাড়া দিয়েছি জিভে। চোখের মণির মধ্যে ঈর্ষাকে ঢেকে কপট তৃপ্তির পর্দা টাঙিয়েছি। কিন্তু প্রতিদিন রাত জেগে জেগে অপেক্ষা করেছি প্রতিবেশীর মৃত্যুর খবরের, বন্ধুর আত্মহত্যার খবরের, কোনো সোনা ভর্তি জাহাজডুবির যে সোনার আমার বাড়িতে আসার কথা ছিল না। আমি অপেক্ষা করেছি আনন্দে বুক চাপড়ে কাঁদার শোক দেখানোর জন্য, যাতে করে আমি সবাইকে দেখাতে পারি যে আমি ভীষণ মানবদরদী, সন্তুষ্ট, প্রফুল্ল একজন মানুষ। আদর্শ মানুষ। কিন্তু সেও হয় না। আমি একটা মিথ্যা কথা বলেছি ধর্মাবতার। আমি ছুরিতে শুধু রাতে না দিনেও ধার দিতাম, আমার ঘরের গোপন কক্ষে, যে ঘরটাকে আমার পাড়া-প্রতিবেশীরা ঠাকুরঘর বলে জানত। আমার পূজোর মন্ত্রোচ্চারণে, ঘন্টার আওয়াজে, আমার শুদ্ধ পোশাকের আড়ালে আমি যে একটা আস্ত শয়তান হয়ে উঠছিলাম কেউ জানতেও পারত না ধর্মাবতার। আমি ক্রমশ ক্রমশ একজন নরখাদক হয়ে উঠছিলাম। সবাই আমার শত্রু। কার অমঙ্গলের আকাঙ্ক্ষা আমি না করতাম ধর্মাবতার! ক্ষোভ, হ্যাঁ হ্যাঁ শুধুমাত্র এই একটা শব্দ আমার মাথার প্রতিটা কোষকে নষ্ট করে দিচ্ছিল ধর্মাবতার! সেই নষ্ট কোষের মধ্যে রক্ত শুষে খাচ্ছিল ঈর্ষা। তাতে ছত্রাকের মত জন্মালো হিংসা। আমি একজনকেও হত্যা না করে লক্ষ মানুষের হত্যার ভার নীরবে মাথা নীচু করে বয়ে নিয়ে চলতে শুরু করলাম ধর্মাবতার! আর কেউ না জানুক, আমি তো জানতাম প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে চলেছি আমি নিঃশব্দে; কেউ না জানুক, আমি, ধর্মাবতার, আমি তো জানতাম!        একদিন এক ধর্মসভায়, প্রার্থনারত অবস্থায় আমি বোমের একটা কুঁচিতে কয়েকশো মানুষের সাথে মারা গেলাম। আমার শরীরের রক্ত গিয়ে মিশল আমার আরাধ্য দেবতার শরীরে। সেই প্রথম আমি ঈশ্বরের মুখোমুখি হলাম। আমি আর্তনাদ করার সময়টুকুও পাইনি ধর্মাবতার। কিন্তু দেখলাম আমার ভিতর থেকে একটা সাদা পাপড়ির মত আলো মিলিয়ে গেল। সে পাপড়িটা কি উজ্জ্বল, কি শুভ্রতা তার! আমি বুঝলাম, সেই ছিল আমার সত্যকারের সুখ যা একান্ত আমার হতে পারত যদি না আমি ক্ষোভের বিষে পড়তাম। দেখতে দেখতে আমার ভিতর থেকে কোটি কোটি পোকা বেরিয়ে পড়তে লাগল। আমার ক্ষোভের বিষ, সারা আকাশ ছেয়ে ফেলল কালো মেঘে। আমি অন্ধকারে চোখ বন্ধ করলাম। তারপর চোখ খুলে দেখি আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে ধর্মাবতার। কিন্তু এই প্রথম আমার প্রাণে কোনো অশান্তি নেই। আমি বুঝেছি যে সাদা পালক আমি দেখেছিলাম সেও মিথ্যা, আমার সুখের কল্পনা মাত্র। কেবল আপনিই সত্য ধর্মাবতার – মহাকাল, আমার বিচার করুন।
324
Fri, 04/19/2019 - 10:30
          বিধাতা উপদেশের ব্যবস্থা করেননি, অভিজ্ঞতার দরজা খুলে রেখেছেন। ভেবেছিলাম যত বয়েস বাড়বে মনের মধ্যে তত একজন স্পষ্ট গুরুমশায়ের আসন দেখতে পাব। যে প্রতি পদক্ষেপে আমায় সদুপদেশ দেবে, আমার হতে যাওয়া ভুল আটকাবে আমার হাত ধরে। কিন্তু হল কই? মনের মধ্যে না দেখি গুরুমশায়কে, না মোড়লকে।       দায়িত্ববোধ বিবেকবোধের চাইতে অনেক বেশি দরকার। যেদিন একজন জলজ্যান্ত মানুষকে চিতায় তুলেছি ঢাকঢোল বাজিয়ে, কিম্বা আজও ছেলের গলায় ক'গাছা সুতো ঝোলানোর উৎসবে লোক খাইয়ে নিজের কাল্পনিক 'উচ্চবর্ণ'-এর উল্লাসে মাতছি --- দুই-ই ভয়ানক। এতে আমাদের বিবেকে লাগে না, কারণ বিবেক গড়তে সমাজ, শাস্ত্র ইত্যাদি অনেক মালমশলা আছে। কিন্তু মানবিকতার দায়িত্ববোধ জন্মালে বোঝা যায়, যা করছি তা নিতান্ত অন্ধ অমানবিক একটা প্রথাকে অনুসরণ। এতে সমাজের কিছু মঙ্গল নেই, খানিক উত্তেজনা, আমোদপ্রমোদ ছাড়া। এই দায়িত্ববোধ মুক্তচিন্তার অভ্যাস থেকে জন্মায়, যে চিন্তার দায়ভার নিজেকেই নিতে হয়।       আমি যেদিন পৈতে ছেড়েছিলুম সেদিন আমি মনের মধ্যে একটা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলুম। যেদিন প্রথাগত ধর্মের অভ্যাস ছেড়েছি সেদিনও তাই। ঈশ্বর আছেন কি নেই, এ প্রশ্ন অমূলক। আমাদের কল্পিত ঈশ্বর থেকেও যে এদ্দিন গোটা বিশ্বের খুব একটা উপকার হয়নি সে চোখ মেললেই বোঝা যায়। তবু যদি তিনি থেকে থাকেন, তিনি এতটা দুর্বল নন নিশ্চয়ই যে মানুষের বানানো চিত্রনাট্যে অভিনয় করতে চাইবেন। আমি 'মিস্টিক' কি জিনিস জানি না। কারণ চোখে দেখিনি। ভক্ত দেখেছি মেলা। যত দেখেছি ভক্তির উপর ভক্তি কমেছে তত, তাদের দ্বিচারণে। মুষ্টিমেয় ভক্ত যাদের নীরব ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে নিজের বিশ্বাসের বিজ্ঞাপন নেই, এমন মানুষ নিয়ে কিছু বলার নেই, তারা শ্রদ্ধেয়। কিন্তু দলতান্ত্রিক ভক্তমণ্ডলীর এমন সব দ্বিচারণ দেখেছি যে অবাক হয়েছি। তাদের ভাষার সাথে ভাব মেলে না, ভাবের সাথে কর্ম মেলে না। শেষ কথা হয়ে দাঁড়ায়, "আমরা বনাম তোমরা"। এই নিয়ে অবশ্যই তর্ক হতে পারে, কিন্তু তর্কে অপযুক্তি আর ছদ্মযুক্তির আতিশয্যে আসল কথাটা মাঠে মারা যায় যে আদতে আমরা আমাদের ছাড়া কিছু বুঝি না, বা তা বোঝা সম্ভবও নয়। ঈশ্বর ইত্যাদি ইন্দ্রিয়-অতীত বস্তু নিয়ে ইন্দ্রিয়জগতে মারামারি করা যায় না। যা বুঝি না, যা জানি না, তাকে কেবল মানি বলে দাঁড় করিয়ে রাখলে নিজেকেও দাঁড়িয়ে পড়তে হয়। স্থবির হতে হয়। সেই স্থবিরতাকে সিদ্ধি বলে বিশ্বাস করাতে গেলে হয় চোখ রাঙাতে হয়, নইলে ভান করতে হয়। অগত্যা সত্যভ্রষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছুই হয় না।       যে কথাটা শুরুতে বলতে চাইলাম। অর্থাৎ মনের মধ্যে কোনো গুরুকে পেলাম না। পেলাম সত্যকে নিজের বোধের আলোয় অনুভব করার সাহস। মাঝে মাঝে মন দুর্বল হয়েছে। দলের মধ্যে আশ্রয় চাইতেও গেছি, যাতে কোনো রেডিমেড সত্যের সাথে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। ঠকেছি। নিজে সত্য না হলে সত্যের সন্ধান মেলে না, এ হাড়ে হাড়ে অনুভব করে ফিরে এসেছি। কিন্তু নিজে সত্য হব বললেই তো হওয়া যায় না। এত ভেজাল মিশে যে কোনটা আসল আমি খুঁজে পাওয়াই দায়। তবে উপায়? উপায় একটাই, তবু চলতে থাকা। কোন GPS নেই, ম্যাপ নেই। সম্বল বলতে একটাই, আমি যতটা খাঁটি, আমার প্রাপ্য আলোও সামনে ততটাই। নিজের খিদে অনুযায়ী ভাত নিজেকেই বেড়ে নিতে হবে, অন্যের খাওয়া অনুকরণ করলে আখেরে হয় আধপেটা, নয় আইঢাই।       তবে কি কেউ পথ দেখাতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। তবে পথ নেই যেখানে সেখানে পথ দেখাবে কি? প্রতিদিন আমার হয়ে ওঠাটাকে যদি মিথ্যা মিথ্যা 'চলা' নাম দিই, তবেই পথের কথা আসে। আর পথের কথা এলেই অমনি পথপ্রদর্শকের প্রসঙ্গ, আর সে প্রসঙ্গ এলেই ফাঁকি আর ভণ্ডামির আয়োজন। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন হয়ে ওঠার কথা, সেখানে আমায় কেউ হইয়ে দিতে পারে কি করে? আমায় অনুপ্রাণিত করতে পারে কেউ অবশ্যই, কিন্তু সে তো বাইরে থেকে তাড়া দেওয়া নয়, সে তো ভিতরের তাগিদ। আর আমার তার প্রতি শ্রদ্ধাও সেই অনুপ্রেণায় সাড়া দিয়ে ক্রমে ভিতরের দিকে হয়ে ওঠায়। অনুভবের এত বিজ্ঞাপন কেন তবে? নিজেকে নিয়ে এত মার্কেটিং-ই বা কেন তবে? আমার শরীরের প্রতিটি কোষ থেকে শুরু করে আমার ব্যক্তিত্বটি পর্যন্ত পরিবর্তনশীল একটা সত্তা। তার ছন্দ বাঁধতে গেলেই তাকে বিনষ্ট করা। শুধু দেখতে হবে তার গতিটা যেন থেমে না যায়। মনে রাখতে হবে আমি চলছি না, আমি হচ্ছি। কি হচ্ছি? আরো স্পষ্ট, আরো স্বচ্ছ। কার কাছে? জগতের বানানো ঈশ্বরের কাছে নয়, কোনো নীতির কাছে নয়, শুধুমাত্র নিজের ভিতর যে প্রাণের স্পন্দন চলছে তার কাছে। এইতেই আনন্দ। সর্বোচ্চ আনন্দ। এর বাইরে যা কিছু শুধুই পোশাকি, তার আবর্জনা কালের স্রোতে অনেক জমেছে, এবার একান্তভাবেই ত্যাগ না করলেই নয়।
325
Sun, 04/14/2019 - 13:44
        আমাদের ক্ষুদ্র আশা, ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। যা কিছু বড়, মহৎ তাকে আমরা সন্দেহের চোখে দেখে এসেছি। আমাদের খুচরো চালাকি, খুচরো ত্যাগ, খুচরো কর্তব্যবোধ। আর এইসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা বিশাল পর্বত প্রমাণ – আমি আর আমার অভিমান।          আমি না-অভিমানী বাঙালি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সকালে কলে জল না এলে অভিমান, মাছের বাজারে মনের মত মাছ না পেলে অভিমান, নিজের প্রিয় নেতার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কটূক্তি করলে অভিমান, প্রিয় নায়কের সিনেমা মনের মত না হলে অভিমান। এ তো গেল বাহ্যিক। নিজেকে নিয়ে অভিমানের তো শেষ নেই আমাদের। আমার রূপ, আমার চাকরি, আমার বাড়ি, আমার গাড়ি, আমার ভবিষ্যৎ, আমার বর্তমান সামাজিক অবস্থান – কিছু আমাদের মনের মত নয়। আজকাল আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক না পড়লে অভিমান। এখন তারও বাড়া, লাইক কেন? লাভ সাইন নয় কেন? আমি তো ওর ওখানে কমেন্টস করেছি, ও কেন করে না, তার অভিমান। ইত্যাদি ইত্যাদি।        আসলে আমরা বরাবরই অল্পে তুষ্ট। ছেলেমেয়ের একটা যা হোক সরকারি চাকরি, একটা বাড়ি, সুগার – প্রেসার – ল্যারেঞ্জাইটিস – গ্যাস – অম্বল - স্পন্ডাইলোসিস সম্বলিত দেহটার একটু আরাম, মোটামুটি একটা ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, একজন গুরুর কাছে দীক্ষা, কয়েকটা নির্দিষ্ট গান, সিনেমার পরিমণ্ডল, আর প্রাণ খুলে সুক্ষ্মতর্কে পাড়া প্রতিবেশী থেকে পার্লামেন্ট হয়ে মায় মার্কিন দেশের অবস্থা নিয়ে একটু পরনিন্দা-পরচর্চা করার মত একটা শুদ্ধ বিবেক – ব্যস, আর কি চাই?  আর কিছু চাই না। আমরা দুর্বল জাত। আমাদের সন্দেহ, চাতুরী আর কপটতাও বড় একটা উচ্চমানের নয়। সারাদিনের জীবনযাত্রায় কাউকে একটু ভাড়াটা কম দিলে, দরদামে অন্তত একটা টাকা কমালে, কাউকে নিজের বাক প্রতিভায় একটু নিরস্ত বা মুগ্ধ করতে পারলেই আমার সারাটাদিন মেঘলা আকাশ...থুড়ি সারাটা দিন আনন্দে কেটে যায়। আমি কোলবালিশটা জড়িয়ে একটা ‘রুচিকর’ গান চালিয়ে বেশ আবেশে চোখবুজে কত কি ভেবে নিতে পারি। নিজেকে যে জায়গায় দেখতে চেয়েছিলাম, হল কই? ভাগ্যের প্রতি অভিমান, রামকৃষ্ণ-কালী-মহাদেব-লোকনাথ-রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি কোনো ভগবানের ওপর অভিমানে ঠোঁট ফুলে আসে, গলাটা বুজে আসে... তখন একমাত্র সম্বল আমাদের চিনি ছাড়া লিকার চা। আমাদের সব অভিমান ধুয়ে যায়। আমরা নতুন কোনো জায়গায় বা আগে ঘোরা কোনো বেড়াতে যাওয়ার জায়গার হদিস খুঁজি, ছুটির তালিকা দেখি, ট্রেনের সিট অ্যাভেলেবেলিটি দেখি... উত্তেজিত হই, সুখী হই।        মিথ্যা আমাদের মাথার মুকুট। আমার বুদ্ধিমত্তার সব চাইতে সুক্ষ্ম জ্যোতি। তাকে নিন্দা কোরো না। মন মুখ এক সন্ন্যাসীই করেনি তা আমরা! আমাদের খবরের কাগজ সত্যি কথা ছাপে না, শিক্ষক সত্যি কথা বলে না, চিকিৎসক মারের ভয়ে গা বাঁচিয়ে চলে সত্যিটা বলতে পারে না, পাড়া প্রতিবেশী সত্যি কথা বলে না, বন্ধু বান্ধব সত্যি কথা বলে না, আমি নিজেও নিজের কাছে সত্যি কথা বলি না। তবে আমাদের দু’রকমের মিথ্যা আছে। এক সত্যি সত্যি মিথ্যা। আর মিথ্যা মিথ্যা সত্যি। সত্যি সত্যি মিথ্যা মানে যেগুলোকে আমরা ঢপ, গুল, ডাহা মিথ্যা কথা বলে থাকি। আর মিথ্যা মিথ্যা সত্যি মানে, আমরা যেগুলোকে বাস্তব প্রমাণের বিরুদ্ধে গিয়েও প্রাণপণ লড়ে সত্যি বলে বিশ্বাস করি। যেমন বাঙালির চাইতে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য, সঙ্গীত, বুদ্ধি প্রতিভা উড়ে – বিহারী – তামিল - তেলেগু ইত্যাদির হয় না। আমাদের সাথে একাসনে বসতে যদি কেউ পারে সে একমাত্র ফরাসী, জার্মান আর কিছুটা ইংরেজরা ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম আরো নানা মিথ্যা মিথ্যা সত্য আমাদের ভাঁড়ার ঘরে শিকড়বাকড় বিছিয়ে বসে আছে। একটাকে টান দিলেই হুড়হুড় করে বাকিগুলো বেরিয়ে আসবে। আর নিজেকে নিয়ে মিথ্যা? বাঙ্গালী আজন্ম মহাপুরুষ, কালের ঘোরে, পরিস্থিতির চাপে দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থায় থাকে।        তবে এখন, এই মরশুমে বাঙালি খুব সজাগ। এখন আমাদের নিন্দা-লক্ষ্য বাছার সময়। অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছর কাদের নিশ্চিন্তে বুক বাজিয়ে নিন্দা করতে পারব তাকে বাছার সময়। আর এ নিন্দা করতে তো শুদ্ধ বিবেক আমাদের আছেই। কারণ যা কিছু ভালো তা হয় অতীতে ঘটে গেছে অথবা তা আমাদের মাটিতে আসতে দেরি আছে – তাই যা কিছুই হচ্ছে খারাপ হচ্ছে এ নিয়ে তো সন্দেহই নেই। আর তারাও হয়েছে তেমন। তারাও জানে এরা আমাদের সব কিছুতেই নিন্দা করবে, অগত্যা আমরাও চালিয়ে যাই, তোমরাও চালিয়ে যাও। মিথ্যার একটা মস্ত সুবিধাই তো হল যেমন খুশী সাজিয়ে নেওয়া যায়। আর আমরা যখন বস্তুর গুণের থেকে সাজের দিকে বেশী টান অনুভব করি তখন আমাদের ঠকাতে তো কারোর কোনো অসুবিধা নেই। আর আমরাও তো একে তাকে ঠকিয়ে, মানে খুচরো ঠকিয়ে, কর্তব্যে ফাঁকি দিয়ে জীবন ধারণের চেষ্টায় আছি, নাকি? তবে? একটা কথা তো সবাই জানি, আমরা সবাই নিজেকে বঞ্চিত ভাবি। এতে আমাদের একটা মস্ত সুখ। পরনিন্দাতে আমাদের মস্ত সুখ, যদিও আমরা ওগুলোকে বাধ্যতামূলক সমালোচনা বলেই মানি। নিন্দুকে যা রটায় সে অন্য কথা। আমরা সবাই বিশ্বাস করি আমরা কেউ ভালো নেই। কিন্তু এই ভালো না থাকার মধ্যে আমরা বেশ একটা সুখে আছি। কারণ আমাদের সব ভালো না থাকার কারণগুলো সব ওদের বানানো। ওদের মানে কাদের? সে তুমি শূন্যস্থান পূরণ করে নাও, আমি ব্ল্যাংক চেক দিলুম।  
326
Thu, 04/11/2019 - 13:00
  এত আলো জ্বালা কেন?
   আমি হয়রান হয়ে যাচ্ছি একটু অন্ধকারের জন্য
আমার বিশ্বাস আর আমার ধর্মের জন্য
     কিছুটা জায়গা তো দাও!            দুটো কথা আছে। এক, কে বলেছেন আর দুই, কি বলছেন। আমরা প্রথমটা দ্বারা বেশি প্রভাবিত হই। আমাদের গুরু, আমাদের ধর্মগ্রন্থ, আমাদের অবতারের হায়ারার্কি, আমাদের দেশীয় আচার, লোকাচার এরা একদিকে। অন্যদিকে আমাদের ভালোবাসার পছন্দের নেতারা। কি বলছেন সেটা বড় কথা নয়, কে বলছেন সেটা তো দেখো!         কারণটা প্রাচীন, আমরা অথোরিটিতে বিশ্বাসী। কেউ একজন অথোরিটি হবে আমাদের দ্বন্দ্বের, সংশয়ের, বিবেকের, ভবিষ্যতের, এমনকি ভালোবাসার পর্যন্ত। আমাদের শেখানো হয়েছে ছোটোবেলা থেকে চিন্তা করতে নয়, ওরকমভাবে চিন্তা করতে। এই ‘ওরকম’ কথাটা অথোরিটির। অথোরিটি মানে জীবনের প্রতি অনুরাগহীনতা। অথোরিটি মানে লোভ, ভয়, ঈর্ষা। কারোর মধ্যে যদি অনুরাগ থাকে তবে তার সাথে তার দায়বদ্ধতাও থাকে। যেহেতু আমাদের সে অনুরাগ নেই, তাই আমাদের নিয়ম আছে। রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’ এর ভাষায় কৃষ্টি। কে বলছেন – এর বাইরে ভাবাটা আমাদের অশ্রদ্ধা। এটা খুব একটা কঠিন সমস্যা। চিন্তার ঘূর্ণী ভেদ করে নৌকা বের করা যে কঠিন, আর তাও যদি এত শতাব্দী পুরোনো হয়।        দুটো কথা আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অভ্যাস করাতে শুরু করতে হবে গোড়া থেকে। এক, কোনো কিছু বলা হয়েছে, ঘটে আসছে, কয়েকটা সুফল পাওয়া গেছে ইত্যাদি মানেই সেটা সত্যি নয়। আর দুই, আমি যেটা অনুভব করছি মানেই সেটা সত্যি নয়।        যা কিছু আছে, যা কিছু মহৎ বলে স্বীকৃত, যা কিছু প্রথা-বিশ্বাস-ঐতিহ্য ইত্যাদির নামে চলে আসছে তাকে প্রশ্ন করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। প্রশ্ন করার অভ্যাস দুই রকমে হয়। এক জন্মগত অনেকে এই স্বভাবটা নিয়ে জন্মায়। দুই, পড়ার অভ্যাস যদি বেশি হয় তবে হয়। আমি দ্বিতীয়টাতে জোর দেব বেশি। কারণ জন্মগত, বাড়ির পরিবেশগত ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু পড়ার উপর আছে। একজন যখন অনেক পড়ে তখন অনেক বিরুদ্ধ মতামত, প্রমাণ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদির মুখোমুখি হয়। তার মধ্যে সংশয়ের বীজ জন্মায়। এই সংশয়ই তাকে বাঁচার রাস্তা করে দেয়। মোহ কাটে। ভ্রম মেটে। কারণ বিরুদ্ধের মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করতে তাকে চিন্তা করতে হয়, কাউকে অথোরিটি মানলে অন্য অথোরিটি তার মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে, সে আবার নিশ্চিত সুরক্ষিত অবস্থান থেকে অজানাকে সামনে রেখে ভাসতে আরম্ভ করে, নতুন দ্বীপের সন্ধান পায়। এ কলম্বাসের দেশ আবিষ্কারের থেকে কম উত্তেজক নয়। অন্যের আবিষ্কৃত দেশের চাইতে নিজের খুঁজে পাওয়া মাটিতে সে বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়। এ সবই সম্ভব হয় যদি মননশীল পাঠের অভ্যাস তৈরি করা যায়। সিরিয়াস প্রশ্নের আঘাতে সুখ-শান্তির আপাত মধুর বিষাক্ত জীবনযাত্রার অবসান ঘটে। নিজেকে ‘সাধারণ’ দেগে কঠিন কর্তব্যকে এড়িয়ে গা এলিয়ে ঈর্ষাবাণে আর ‘আঙুরফল টক’ অভিঘাতে জর্জরিত হতে হয় না। হিপোক্রেসির আঁতুড়ঘর করে ফেলতে হয় না নিজের মস্তিষ্ক আর বিবেককে। এ গেল এক জ্বালা।        দ্বিতীয় কথাটা আরো কঠিন। আমার অনুভব সত্যের প্রমাণ নয়। সে আমার অনুভব যতই অকৃত্রিম হোক না কেন। যতই তীব্র হোক না কেন। যতই মধুর সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্ভাবনাশীল মনে হোক না কেন। আখেরে ওতে তরী ডুববেই। যখনই আমি কোন বাক্য শুরু করি যে “আমার মনে হয়” বা “আমি অনুভব করি” তখনই মনে করাতে হবে নিজেকে, অনুভব মানে সত্য নয়। সে যতবারই তা সত্য প্রমাণিত হোক না কেন। তখন আমি জানব যে সেটা কাকতালীয়, তার উপর নির্ভর করে জীবন চালানো মানে লটারি কেটে জীবিকা নির্বাহের সামিল। সে কারোর যদি সারা জীবনে সব লটারি অব্যর্থ ভাবে লেগে গিয়ে থাকে তবু সে নিতান্তই চান্স। সত্য নয়। সত্যের একমাত্র কষ্টিপাথর – যুক্তি। যুক্তি আবেগ নয়, অনুভব নয়। তা প্রমাণসাপেক্ষ, পরিমাপসাপেক্ষ, বিচারসাপেক্ষ।          আজ সব কিছুই ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’। আমাদের সব কিছু ভীষণ আবেগ আর অনুভব নির্ভর। আমাদের সিনেমা, সাহিত্য মায় বিজ্ঞানের অবধি সমালোচনা করতে, মতামত দিতে কোনো প্রাকশিক্ষার প্রয়োজন আমরা দেখিনা। ‘আমার মনে হয়’... ব্যস...” আমার গাট ফিলিংস”... ব্যস... ইত্যাদিতে জগত ঝালাপালা। এ এক ভয়ানক নার্সিস্টিক বা ঘন অযৌক্তিক স্ব-আসক্তির বিকার। সব কিছু এখনই বুঝে নিতে চাই, সব অনুভব এখনই করে নিতে চাই, সব সত্যি এখনই জেনে নিতে চাই। তা হয় না। ফলে আমাদের চিরদিনের যে চিত্তবৃত্তি সে থাকছে উপবাসী। আমাদের যে সত্যের সাধনা, আমাদের আরো বেশি পরিচ্ছন্নতার, আরো বেশি মানবিক হয়ে ওঠার, আরো বেশি যুক্তি-নির্ভর হয়ে ওঠার সাধনা, সেও থাকছে অবহেলায়। ভাঁড়ার ভরছে ক্ষণিকের ঘরের, মিলিয়েও যাচ্ছে মুহূর্তেই। আবার শূন্যতার হাহাকার, আবার নতুন উন্মাদনার খোঁজ।         নতুন যারা জীবনের দোরগোড়ায় তাদের এ দুটোর অভ্যাস করতে শেখাতে হবে। নইলে হাতের মুঠোয় যে যন্ত্রটা এখন প্রায় প্রত্যেকের, সেই স্মার্টফোনে তারা ভুলেই যাবে যে সেটা জীবনের একটা অসম্পূর্ণ বিকৃত ছায়ামাত্র। সেটা জীবন নয়। জীবনের মানে চিরকালই একটা - সংগ্রাম, অ্যাচিভমেন্ট নয়, ওটা একটা ডাঁহা মিথ্যা কথা।
327
Mon, 04/08/2019 - 12:00
           রূঢ় সত্য আছে। কঠিন সত্য আছে। সত্যের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে। ভিতরের বাইরের জগতের মধ্যে সামঞ্জস্য আছে।         জীবনের সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা। জীবনকে নিয়ে চিন্তা। এ দুটো তো একই কথা নয়। আমার অনুভবের সাথে যথাযথ শব্দ খোঁজা যেমন একটা শক্ত কাজ। এও তো তেমনই। জীবনকে নিয়ে চিন্তা করতে গেলে অনেকগুলো ধারা জন্মায়। তার একটা বিজ্ঞান – অর্থাৎ যা ধরা ছোঁয়া প্রমাণ পরিমাপের মধ্যে। আরেকটা দিক অস্পষ্ট, অজ্ঞাত, অনুভবের। আমার মধ্যে যেন এক অনুভবী। রবীন্দ্রনাথের গানে যাকে দরদিয়া, স্বামী, প্রভু, জীবনদেবতা, সখা, বন্ধু – ইত্যাদি নানা নামে জেনেছি।         সে অনুভবীর অনুভবেই আমার যা কিছু অনুভব। অনুভবের কোনো ভবিষ্যৎ কাল বা অতীতকাল হয় না। যা হয় ‘এখন’ ই অর্থাৎ বর্তমানে। কোনো অনুভবের স্মৃতি কখনওই অনুভব নিজে তো নয়। তাই অনুভবী সব সময় – এখন। সে স্বাবলম্বী, নির্ভয়। আমার ভয়, আমার দুশ্চিন্তা, আমার লোভ – এই আমায় ‘এখন’ থেকে বারবার পিছনে বা সামনে টেনে নিয়ে যায়। আশঙ্কা, উদ্‌বেগ, উৎকণ্ঠা ইত্যাদিতে পীড়িত তখন আমার মন।         আমার চিন্তাকে যখন আমি স্পষ্ট করে বুঝি তখন যে অনুভব জন্মায় – সে অনুভবে আমি স্থির শান্ত। আমি মানে চিন্তা। সে চিন্তা যত অগভীর, যত জট পাকানো, যত প্রভাবিত – তত অস্থির আমি। তাই নানা কিছু জানার চাইতে সব চাইতে গভীরে যে জানাটা স্পষ্ট করে জানার চেষ্টায় কাল কাটালে মন অনেকটা শান্ত থাকে, সুস্থ থাকে তা হল নিজের চিন্তাকে স্পষ্ট করে জানার চেষ্টা।         এর মধ্যে কয়েকটা জিনিসকে সারা জীবন জানা যাবে না সে কথা নিজেকে বলেই এ চেষ্টা শুরু করা উচিৎ বলে আমার মনে হয়।         প্রথমত, মৃত্যু। এ চিরকালের রহস্য থেকে যাবে মানুষের কাছে। তার নানা ব্যাখ্যা নিশ্চয় থাকবে। ব্যাখ্যার পর ব্যাখ্যা জমতেই থাকবে, কিন্তু মৃত্যু তার পরম রহস্যময়তার থেকেই যাবে।         দ্বিতীয়ত, ঈশ্বরের অস্তিত্ব ও অনিস্তত্ব। এ নিয়ে তর্কে কাল কাটানো নিরর্থক। ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাথে মানুষের সরাসরি কোনো সম্পর্ক আছে বলে আজ অবধি মানব সভ্যতার ইতিহাসে কিছু প্রমাণিত হয়নি। ঈশ্বরকে স্বীকার করেও মানুষ চূড়ান্ত বর্বর, হিংস্র, লোভী, উন্মাদ হয়েছে, আবার ঈশ্বরকে অস্বীকার করেও অনেক সৎচরিত্র মানুষ সমাজে এসেছেন তারও উদাহরণ আছে। কথাটা ঈশ্বর নয়। কথাটা মানুষের সদ আর অসদ গুণাবলী। দুই-ই। এখন দেখতে হয় কোনো একটা সমাজ, কোনো একটা সময় কোন গুণাবলীকে উৎসাহিত করছে চর্চা আর বৃদ্ধির জন্য আর কোন অবগুণগুলোকে দমনের চেষ্টা করছে তার উপর। বিপরীতটা চর্চাটাও যে হয় তার উদাহরণও আমরা ইতিহাসে দেখেছি।         তৃতীয়ত, ভাগ্য নিয়ে। ভাগ্য অনেকগুলো বস্তু আর শর্তের সমাপতন। যে মানুষটা দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে, বা বিশ্বাসঘাতকার শিকার হচ্ছে, কিম্বা কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে – সেই কঠিন সময়ের সমাপতনে তার নিজের কোনো ভূমিকা নেই, কিন্তু তাকে স্বীকার করে নিয়ে নিজের মধ্যের সাম্যাবস্থা বজায় রাখার দায় তাকে নিতেই হবে। নইলে বাইরে শূন্য হওয়ার আগে নিজের মধ্যেই শূন্য হয়ে যাবে। নিজেকে ধ্বংস করে কি লাভ? আমার সমস্ত কিছুকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার ভার যখন আমারই উপর, তখন সে ভার মাথা উঁচু করে বয়ে নিয়ে যাওয়াই ভালো। ভাগ্যের হাত ধরে যে যন্ত্রণা দুর্ভোগ আসে তার থেকে বেরোবার পথ যদি বিজ্ঞানের বা মানুষের অন্য কোনো ক্ষমতাই আবিষ্কার করে না থাকতে পারে তবে তো সে ভার বহন করে নিয়ে চলাতেই গৌরব।          মৃত্যু, ঈশ্বর-অনীশ্বরবাদ, ভাগ্য – এই তিনজনকে প্রণাম জানিয়ে সরে আসাই ভালো। এদের কারোর উপরে আমার শান্তিতে থাকার ভার নেই যে। আমার শান্তির ভার আমারই হাতে। নিজেকে যতটা বুঝেছি তারই উপরে। নিজেকে অর্থাৎ নিজের চিন্তাকে। নিজের উদ্দেশ্যকে। সেই উদ্দেশ্যও অবশ্যই আরেকটা চিন্তা। আমরা বলি না, “কি চিন্তা করে কাজটা করেছিলি / ছিলে / ছিলেন?” নিজের চিন্তাকে বোঝার জন্য নিশ্চয় চেষ্টা করব, ওই তিনটে পাড়ার লড়াইয়ে নিজেকে না যেতে দিয়ে। কারণ ওতে সময়, আর ক্ষমতা নষ্ট। ভারতের এটা বুঝতে অনেক সময় লেগেছিল। বুদ্ধ সাবধান করার পরেও। ফলে পুরো জাতটা জেগে ঘুমালো। অদ্ভুত উদ্ভট সব তত্ত্ব আবিষ্কার করল। সে পথের নেশায় আর না যাওয়াই ভালো। যদিও সে পথের নেশা নানা বাবাজী, মঠ মিশন ইত্যাদি তথাকথিত সরল দর্শনের ছদ্মবেশে আজও আমাদের লক্ষ লক্ষ ভারতীয় অতিবিশ্বাসপ্রবণ জাতটার প্রাণশক্তি শুষে খাচ্ছে, তবুও আশা করব, এ পথের বিরাম আসুক। সদগুণের চর্চা বাড়ুক বিজ্ঞানের আবিষ্কারের সাথে সাথে, কিন্তু একজন সমস্ত সদগুণসম্পন্ন আকাশস্থ কিম্বা হৃদয়স্থ পুরুষের গল্পের নোটে গাছটা মুড়াক। তিনি হৃদয়ে বা আকাশে যেখানেই থাকুন, অতি ঘৃণ্য বর্বর দুর্ঘটনাকে যে আটকাতে পারছেন না, সে তো প্রতিদিনের খবরের কাগজই যথেষ্ট।         আমরা আমাদের চিন্তার জগতটাকে বুঝতে চেষ্টা করি। সব কাজের মধ্যে মধ্যে। যে বাড়িতে সারা বছর কাটাই, যে গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াই, যে বিছানায় শুই, যে পোশাকে থাকি – সে সবের যেমন ধোয়ামোছা, কাচাকাচি, সার্ভিসিং ইত্যাদি চলে, তেমনই যে চিন্তার মধ্যে, যে চিন্তা সারাপথের পাথেয়, তাকেও মাঝে মাঝে স্বচ্ছ করে নিতে হবে। অনুভবে শান্তি আসবে তখন। অনুভবীর কথা যে বললাম, সেও আমিই। আমার নিস্ক্রিয় সত্তা। সেও আমিই। আমার সক্রিয় সত্তার দিকে স্থির নজরে তাকিয়ে। রবিবাবু যাকে বলেছেন, “যে আমি ওই ভেসে চলে” গানটায়। সেই নিষ্ক্রিয় আমি যখন চোখ কুঁচকে তাকাচ্ছে, বুঝতে হবে যে আমার চিন্তাকে সার্ভিসিং এ পাঠানোর সময় এসে গেছে। না পাঠালে অন্তঃকরণের উষ্ণতা বাড়বে। চারদিক তপ্ত হয়ে উঠবে। শান্তি হারাব।  
328
Sat, 04/06/2019 - 20:00
           ধীশক্তি। মানে কি চিন্তাশক্তি? বড্ড কঠিন কথা দাদা। এই মনে হয় বুঝলাম। খানিক বাদেই ফক্কা। মাথার মধ্যে জাবর কাটছে চাঁদের বুড়ি। এই মুণ্ডু কি ভাবছিস? মেলে না উত্তর... হ্যালো ব্রেন... কি ভাবো?... নো রিপ্লাই... ইস লাইনকে সভি রুট ব্যাস্ত্ হ্যায়, কৃপয়া থোড়ি দের বাদ কোশিশ করে.... জাত গেল জাত গেল বলে এ কি আজব কারখানা... ব্রেন কি ভাবো?... কিসের ব্যস্ততা?... মানুষের জাত হয়... জাতের মানুষ হয়... শোননি? জাত শিল্পী... এ জাত সে জাত নয়? কে বললে? হবেও বা, আমি মুখ্যু ঢেকি... ব্রেনে নিউরনের জায়গায় নেফ্রন আটকে... চিন্তা করব কি গা? ছেঁকেই চলেছি... ছেঁকেই চলেছি...        কি ছেঁকেছি জানি না। যা গেল তাই দামী ছিল না যা রইল তাই দামী, আজও বুঝলাম না। তা বুঝবই বা কি করে বলো, বোঝার জন্যে তো ব্রেন চাই। আমার যে ব্রেনের মধ্যে নেফ্রন। নেফ্রন বোঝো না? আরে যা বৃক্কে থাকে, মূত্র বানায়। সেই হল কথা। আমি ওসব ভাবি কি করে বলো? আচ্ছা শুরুর কথাটা কি ছিল যেন? ধীশক্তি। ঠিক। কথা হচ্ছিল ধীশক্তি কি। জানি না। শব্দটা শুনেছি যদিও। একবার পৈতে হল আমার। যেমন সব মানুষের হয়। প্রচূর উপহার পেলাম। আমি 'প্রচুর' শব্দটাতে 'ঊ'কার দিয়েছি দেখো, মানে অনেক উপহার বোঝাতে। পৈতেতে গায়ত্রী মন্ত্রও শিখেছিলাম৷ উপহারগুলোর মেয়াদ ফুরোলো, মন্ত্রটা রয়ে গেল৷ পায়খানায় মাকড়সা দেখলে, ফাঁকা রাস্তায় একা হাঁটলে রাত্তিরে, কুকুরের হাঁ-মুখ পেরিয়ে চলে যেতে, পরীক্ষা হলে প্রশ্নপত্র পাওয়ার আগে, পড়ার ব্যাচে আমার ক্রাশের পাশের জায়গাটা ফাঁকা পাওয়ার তালে... ইত্যাদি ইত্যাদি কত কারণে যে গায়ত্রী মন্ত্রটা বলেছি। ভাবলাম যদি কাজে দেয়। দিল না। তারপর দীক্ষামন্ত্র নিলাম ফর্ম ফিল-আপ করে, রেশানের চালের মত এক ঘরে আশিজন বসে মন্ত্রও নিলাম। কাজ হল না৷ আসলেই কপালটা খারাপ। মুখ্যু মানুষ কি আর ঈশ্বর বোঝে? এদিকে মাথার লাইন সবসময় বিজি। পরের চিন্তায় সারাদিন ব্যস্ত, নয় ভবিষ্যতের চিন্তায়। কার গাড়ি হল, বাড়ি হল, সুন্দরী বউ হল, নতুন ফোন হল এইসব, নয় কাল কি হবে? সামনের সপ্তাহটা কেমন যাবে, বিকালে কি খাব, সামনের বছর কোথায় ঘুরতে যাব... নানারকম ভবিষ্যৎ চিন্তায় জেরবার।        একটু ব্রেক কষলাম... ঘ্যাঁচ... মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে থামলাম। ব্রেনে শর্টসার্কিট হয়েছে৷ নইলে এত ধোঁয়া উঠছে কেন? এত গরম কেন? শুনেছি যারা বহুদ্দিন ধরে মদ খায়, তারা নাকি হঠাৎ করে ছাড়তে পারে না। ছাড়লেই কি সব ব্যামো হয়। আমার ব্রেনের সেই দশাই হয়েছে আর কি। ব্রেন চিন্তার নেশায় মশগুল। পরের চিন্তা আর ভবিষ্যতের ভাবনা। বললেই বলবে, সবই তো তোমার জন্যে করছি বাপধন আমার। তোমার মত একটা সেন্টিমেন্টাল ফুল আজকের দিনে কি অচল তা যদি জানতে, কিস্যু হবে না তোমার দ্বারা। ওই ত্যাগীদের দেখে শেখো, কি সুন্দর কামিনীকাঞ্চন ত্যাগের আর জীবে প্রেমের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে বাড়ি-গাড়ি-এসি করে ফেলল। ওসব তুমি বুঝবে না... সেন্টিমেন্টাল মিডিওকার স্টুপিড উজবুক একটা।          অগত্যা চুপ মেরে যাই। কি বলি, নিজের ব্রেনের কাছে ঝাড় খেতে কার ভালো লাগে বলো? চারতলা বাড়ি। একদম নীচে একটা দুষ্টুলোক। তার উপরে পেটুক লোক। তার উপরে আবেগী লোক। মাথার উপর তিনি, আমার ব্রেনি মানুষ। তার কথাতেই তো আমাদের সংসার চলে। আমি কোথায় থাকি? আমি ঘামাচির মত। এই এখানে তো সেই সেখানে। আমায় কেউ ডাকে না, আমিও কাউকে ডাকি না। কিন্তু চাই আমি সবাইকে। না ডাকলেও।        আরে আসল কথাটাই তো হচ্ছে না। 'ধী' মানে কি যেন? আসলে পৈতের পর থেকে ওই কথাটাই আমার মাথায় নড়েছে। আমার মাথার উপর যে আকাশটা, আমি ব্রেন সরিয়ে ওটা দেখি। আমার খুব ভালো লাগে। আনন্দ পাই। মনে হয় কাজে লাগুক না লাগুক একটা আকাশ তো আছে। মাথার উপরেই আছে। এমনকি বিশ্বাস করুন, যে আমি চশমা ছাড়া টিভি কি সিনেমা দেখতে পাই না, সেই আমি কিনা চশমা ছাড়া আকাশ দেখে ফেলি? মানে কত বড় ব্যাপার‍টা বলুন একবার!        আমার মনে হয় আমাদের ধী-টা এই আকাশের মতই একটা বড় অকাজের কিছু একটা বস্তু। শুনেছি পাতা নাকি সূর্যালোকের নামমাত্র নিয়ে বাকিটা ফিরিয়ে দেয়, ওতেই সালোকসংশ্লেষ হয়ে যাবে বলে। আমরাও কি তাই? অতটুকু ধী-তেই সংসারের গ্রাসাচ্ছাদন আমোদ-আহ্লাদ হয়ে যায় বলে বাকিটা ফিরিয়ে দিই? এই যেমন ধরেন রবীন্দ্রনাথের কথা। মানুষটার মাত্র আড়াইশোটা গান গেয়ে বাকিটা ধুলোচাপা দিয়ে রাখলুম, মাত্র গান আর কয়েকটা কবিতা নিয়ে অমন সব প্রবন্ধগুলো সিলেবাসের বাইরে বলে রেখে ফানুস উড়াতে লাগলুম। কি মুশকিল। এদিকে মাথার ব্যামোতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ ওরে দেখতে পারে না। ও তারে৷ লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ। এর ডানার সাথে ওর ডানার ঠোকাঠুকি। হবে না? আকাশটাকে কেটে ছোটো করে বাকিটা মহাকাশে ফিরিয়ে দিয়েছি যে, বলেছি, এতেই হবে। তাই বাকি ধী-টা আমাদের ডেকে ডেকে বলছে, "ওরে এদিকে আয় অনেক জায়গা, ওরে আগল খোল, এদিকে আয়।" আমরা ভাবছি ওসব নিশিডাক। তাই কয়েকটা মন্তর আওড়ে, মিছিমিছি মহান লোকের কাঠের মূর্তি বানিয়ে এইটুকু ধী-এর স্লেটে এত্তবড় জীবনের আঁক কষতে চাইছি। তাই কি হয় রে পাগলা?
329
Sat, 03/30/2019 - 15:30
           তিনটে নামেই প্রথমে চমক লাগবে। নীৎজে আর কামু না হয় বুঝলাম। কিন্তু বাপু, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঢুকলেন কি করে? না তো এদের দু’জনের সঙ্গে দর্শনে মিল, না তো জীবনচর্যায়। তবে কোন যুক্তিতে এই তিনটে নাম একসাথে উচ্চারিত হয়? 
       খাঁটি কথা। কামু'র মধ্যে নীৎজের প্রভাব আছে সর্বজনবিদিত। তা বলে রবীন্দ্রনাথ? সময়কালটা একটু দেখে নেওয়া যাক। নীৎজের জন্মসাল ১৮৪৪, রবীন্দ্রনাথ ১৮৬১, অ্যালবার্ট কামু ১৯১৩ (অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাওয়ার বছর) – প্রথমজন জার্মানে, দ্বিতীয়জন অবিভক্ত ভারতে, তৃতীয়জন ফরাসী দেশে। তবু কোন এক ক্ষণে এদের তিনজনের কক্ষপথ কোন এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছিল। অবশ্যই চিন্তার কক্ষপথ। 
       প্রথমে আলোচনায় আসা যাক নীৎজে ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। অবশ্য এখানে বলে রাখা ভাল আমি যে রবীন্দ্রনাথের কথা বলছি সে রবীন্দ্রনাথ শুধুই দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ। নীৎজে তার জীবনের অনেকটা সময়, বিশেষত শেষের দিকে ও প্রথম দিকে কাটান চুড়ান্ত মানসিক বিপর্যয়ে। তবে বিপর্যয় শব্দটা ১৮৮৮ থেকে শুরু করে ওনার মৃত্যু (১৯০০ খ্রীষ্টাব্দ) অবধি চুড়ান্ত চলে। মধ্যবয়সে মনের মধ্যে চুড়ান্ত সংঘর্ষ ও সংঘাত দেখা দিয়েছিল ওনার, তার থেকে তিনি এক দার্শনিক তত্ত্বে উপনীত হন, যা কিছুদিনের জন্য তার মনকে প্রবোধ দিয়েছিল। সে দার্শনিক তত্ত্ব ওনার জীবনে উপলব্ধ হয় যখন ওনার বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি। কী সেই দার্শনিক তত্ত্ব? তার নাম উনি দিলেন --- AMOR FATI, বাংলায় কি বলব? ভাগ্যের সাথে সখ্যতা? ওনার অর্থানুরূপ বলতে গেলে --- দুর্ভাগ্যের সঙ্গে সমঝোতা। ওনার লেখা বিখ্যাত বই The Gay (Gay শব্দটির অর্থ এখানে হর্ষ বা প্রফুল্লতা) Science–এ উনি লিখছেন, যার মোটামুটি বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় --- যা কিছু অসুন্দর, যা কিছু যন্ত্রণা, যা কিছু দুঃখ আমি তার বিরুদ্ধে আর লড়াই করব না। তাকে স্বীকার করে নেব। বাধ্য হয়ে না, ভালবেসে। এমন একটা দিন আমার জীবনে আসুক যেদিন ভাগ্যের দিকে, ভাগ্যের যেকোন বিড়ম্বনা, যেকোন পরিহাসের দিকে তাকিয়ে আমি বলতে পারব --- আমি রাজি (YES SAYER)। 
       আমি থমকে গেলাম। সেই চল্লিশ বছরের কাছাকাছি এসেই জীবনের নানা সংঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে যে কবিতাটা জন্মাচ্ছে সে কবিতার প্রথম লাইন, “মনেরে আজ কহ যে / ভাল মন্দ যাহাই আসুক / সত্যেরে লও সহজে।” আশ্চর্য হলাম, কি সাংঘাতিক মিল! কবিতাটা যদি পুরো পড়া যায়, দেখা যাবে এ তো নীৎজেরই AMOR FATI! নীৎজে, যিনি সোচ্চারে ঘোষণা করছেন, GOD is dead; রবীন্দ্রনাথ, যিনি পরম বিশ্বাসে, আশ্বাসে মৈত্রেয়ী দেবীকে চিঠিতে লিখছেন ‘স্বর্গের কাছাকাছি’তে, তিনি আছেন, তিনি আছেন, তিনি আছেন। দু’জনেই বিশ্বাসের দুই প্রান্ত থেকে, অস্তি ও নাস্তি থেকে দুটো পৃথক কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে একটা বিন্দুতে ক্ষণিকের জন্য মিলে গেলেন, ছুঁয়ে গেলেন। 
       পাশ্চাত্যের Stoic এবং প্রাচ্যে সাংখ্য ও বেদান্তে এই দর্শনের ইঙ্গিত আছে। অরেলিয়াসের ‘Meditation’, সেনেকা'র ‘পত্রগুচ্ছ’, এপিকটেটাসের ‘উদ্ধৃতাবলী’তে এই দর্শনের ইঙ্গিত বহন করে। সাংখ্য-বেদান্তকে যদি এক জায়গায় গীতার দর্শনের আলোতে দেখি সেখানেও বলা হচ্ছে, ‘সমত্বং যোগা উচ্যতে’ – অর্থাৎ সাম্যের কথা, চিত্তের সমতার কথা। নীৎজে ও রবীন্দ্রনাথ জীবনের চরম সংকটময় মুহুর্ত তাদের উপলব্ধিতে এই দর্শনকে নতুন করে উপলব্ধি করলেন --- একজন দার্শনিকের যুক্তিতে, আর একজন কবিতার ছন্দে।        কামু অবশ্যই এদের কিছুটা পরে। তিনি যখন The Outsider প্রকাশ করতে চলেছেন, প্রকাশককে বলছেন, অপেক্ষা করো। এই Outsider–কে বোঝাতে আমার একটি দার্শনিক প্রবন্ধও আসছে – The myth of Sisyphus. যেখানে তিনি ব্যাখ্যা করতে চলেছেন, Absurdity. সেই গ্রন্থে তিনি বলছেন, “অস্তিত্ব ছলনাময়ী এবং তা শাশ্বত।” 
       রবীন্দ্রনাথে আসি। রবীন্দ্রনাথের অন্তিম শয্যায় লেখা কিছু কবিতা যেন ওনার জীবনের সমস্ত উপলব্ধিগুলিকে কোথাও একটা উপসংহারে টানার প্রয়াস। আমি সঞ্চয়িতা’র চারটি কবিতার নাম বলব --- ‘রূপনারানের কূলে’, ‘প্রথম দিনের সূর্য’, ‘দুঃখের আঁধার রাত্রি’ এবং ‘তোমার সৃষ্টির পথ’। শেষ কবিতাটায় আসা যাক ---   তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তা'রে
যে-পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তা'রে চিরসমুজ্জল।
বাহিরে কুটিল হোক অন্তরে সে ঋজু,
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তা'রে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়
আপন আলোকে ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তা'রে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভান্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।          কবিতাটা কি সেই একই অনুভূতির দ্যোতনায় বাজছে না? অস্তিত্ব ছলনাময়ী। এ যেন ভূখন্ডের দুই মহান স্রষ্টার দুই মেরুর চিন্তা এক সমসত্ত্ব সিদ্ধান্তে এসে দাড়াল। এখানেও আস্তিকের দর্শন ও নাস্তিকের দর্শন মিলেমিশে একাকার। 
       লেখার এবারে একটা উপসংহার টানতে হয়। কিন্তু নীৎজে, রবীন্দ্রনাথ ও কামুর চিন্তার উপসংহার টানার ধৃষ্টতা দেখাব সে হেন মানসিক ভারসাম্যহীন আমি হইনি। আমি শুধু একথাটাই বলে শেষ করতে চাইব, আসলে দর্শনে ‘মিথ্যা’ বলে কিছু হয় না। প্রতিটি মানুষের, সে যত সামান্যই হোক কিম্বা মহীরুহ --- তার নির্দিষ্ট একটি দর্শন থাকবেই, হোক না যতই অস্পষ্ট। আমার মধ্যে হয়তো সত্যের ক্ষীণতম প্রকাশ, আরেকজনের দর্শন হয়তো সত্যতর, কেউ হয়তো সত্যতমে। কিন্তু দর্শনের কোন Superlative Degree হয় না। ‘চুড়ান্ত সত্য’ বলে আদৌ কি কিছু হয়? হয় না। আমাদের উপলব্ধ খন্ডিত সত্যগুলো যে অসীম সত্যের প্রকাশ তা আমাদের বোধের, চিন্তার ও অনুভবের অতীত। তাতেই আমাদের বিস্ময়, সেই বিস্ময়ই আমাদের জীবনের এক-একটা বদ্ধ দরজা খোলার শব্দ।
330
Sat, 03/23/2019 - 22:30
           চিন্তাকে পড়তে জানতে হয়। পড়ি। সব সময় বুঝি না। আবার কে চিন্তার সুতো পাকাচ্ছে তাও বুঝি না।        চিন্তা অনেকটা বইয়ের মত। মাথার মধ্যে থরে থরে সাজানো। কোনোটা নতুন বই, কোনোটা পুরানো। কোনোটা প্রিয় বই, কোনোটা তেমন একটা প্রিয় না, মাঝারি। কোনোটা এক্কেবারেই প্রিয় বই না। তবু আছে। পোকায় কাটে না। বিস্মৃতিতে কাটে। কোনো একটা বেশ বড় সাজানো চিন্তার টুকরো স্মৃতি এসে মনটায় আনমনা দমক লাগিয়ে যায়। খোঁজ খোঁজ তখন বাকি চিন্তাটা। সে চিন্তায় কার মুখ, কার হাসি, কার চাহনি, কার কণ্ঠস্বর, কার স্পর্শ, কার চুম্বন, কার সজল আঁখি - মন হারালে কাজের গোড়া।        চিন্তা অনেকটা ফলের মত। অনুভবটা তার রস। টোকো চিন্তার টোকো অনুভব। মিষ্টি চিন্তার মিষ্টি অনুভব। আবার শাঁখ আলু কিম্বা ইডলির মত স্বাদহীন চিন্তাও আছে। ঝুরো ঝুরো চিন্তার ঝুরো ঝুরো অনুভব, সেও আছে।        আসলে মানুষের একটা কুঁজ আছে। অন্তরজগতের কুঁজ। বাকি সব প্রাণীর আছে বাইরের জগত। আমাদেরই আছে একটা অন্তর্জগতের কুঁজ। তাকে বয়ে নিয়ে বেড়ানোর যন্ত্রণা। সবার অন্তর্জগতে নিজের নিজের বিশ্ব। সেখানে গ্রহণ আছে, ধুমকেতু আছে, উল্কাপাত আছে। আলো আঁধারির খেলা আছে।        কথা হচ্ছে সেই অন্তর্জগতেই সব কি আমার মনের মত? ধুর। তাও কি হয়? একটুও মনের মত নয়। নিজের মনের গতি নিজের মনের ধার ধারে না। "মন রে ওরে মন তুমি কোন সাধনার ধন, পাইনে তোমায় পাই নে, শুধু খুঁজি সারাক্ষণ"।          এখন এই হল অবস্থা। যার বাইরের প্রচুর কাজ, সে ভাবে যার কাজ নেই তার যেন মস্ত ছুটি। আহা তাই যদি হত। চিন্তার নাগরদোলায় একবার চাপলে আর দেখতে হচ্ছে না। যতই বলো, ওরে আমায় নামিয়ে দে না... ওরে কে কোথায় আছিস বাছা নামিয়ে দে না... কেউ কোত্থাও নেই। নাগরদোলা এই উঠছে, ওই নামছে। এই নামছে, ওই উঠছে। তাকিয়ে দেখো কেউ কোত্থাও নেই। ওদিকে সুয্যি পাটে যাবে যাবে কচ্চে। দেখতে দেখতে চলেও গেল। একটা একটা তারা ফুটে উঠল সারা আকাশ। মানুষ ঘুরতে ঘুরতে বলছে, ওই সপ্তর্ষি..নামিয়ে দে না... চুমু খাব... ঊই দূরে কালপুরুষ উঠল... নামিয়ে দে না... ঘর বেঁধেছি, তাতে চাল ছাইব, বর্ষা এলো বলে... ঊই ধ্রুবতারা উঠল... নামিয়ে দে না... আমি পূজো কোব্বো, উপোস কোব্বো, যজ্ঞ কোব্বো, জগতের কল্যাণে পেরান দেব... নামিয়ে দে না... ও পিসি.. ও শিবুদা.. নামিয়ে দে না...        কেউ নামে না। চরকি ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে। তারপর একদিন...কি জানি কি হয়.. কেউ বলে দেহ ছেড়ে সে নাকি তাও নাগরদোলা আঁকড়ে বলতে থাকে, এঁই দ্যাঁক এখুঁনো নাঁমিনি...        কেউ বলে না গো না, দেহ পুড়লেই বা মাটিতে মিশলেই সব শ্যাষ...               আমি ওসব কিচ্ছু জানি না। মাইরি বলছি। কেউ কেউ আবার দেখি, হাঁকিয়ে কলম কষিয়ে বলে, এই হল আমার শ্যাষ লেখা.. তারাই বা বোঝে কি করে কইখানে কি শেষ..   আমি ওসব কিচ্ছু জানি না। ও মন কোথায় শুরু কোথায় যে শেষ কে জানে...        একতারাটা কে বাজায় জানেন দাদা? আর জেনেই বা কি হবে? আমি কি ছাই একতারা? আমি যে সিন্থেসাইজার... কখন যে কি সুরে বাজে.. যাই হোক, এই তো জীবন দাদারা... নামিয়ে দে না বললেই আর নামাচ্ছে কে...  
331
Mon, 03/18/2019 - 13:00
         ধর্ম অনুভবের বিষয়। সেই আদিকাল থেকে নানা অনুভবী মানুষ এসেওছেন ধর্মের জগতে, অনুভবে তাঁদের তারতম্য থাকলেও কেউ তেমন ধারার হিংস্র নন। ঈশ্বর বোধে, আত্মা বোধে তাঁদের অনুভব আলাদা। কারোর কাছে কালী, কারোর কাছে কৃষ্ণ, কারোর কাছে স্বর্গস্থ পিতা ইত্যাদি। ভারতীয় দর্শনে আত্মা অনেকটা অংশ জুড়ে থাকলেও, বুদ্ধের অনুভবে আবার আত্মা বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। এঁদের প্রত্যেকের অনুভবের কাছে এনারা প্রত্যেকে খাঁটি থেকেছেন। আবার নীৎজে, রাসেল ইত্যাদি নাস্তিক মানুষেরাও তাঁদের অনুভবের বোধের কাছে নিজেরা খাঁটি থেকেছেন।
       সত্যটি তবে কি? আসলে 'ফ্যাক্ট' যে অর্থে সত্য, 'সত্য' সে অর্থে সত্য নয়। নীতিগত সত্যে মানুষে মানুষে ভেদ আছে। মিল আছে শুধু বস্তুগত সত্যে। আজ আঠারোই মার্চ, দু'হাজার উনিশ, এই কথাটা পৃথিবীর একটা বড় গোলার্ধের মানুষ স্বীকার করে নেবেন। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জ স্তরে আমাদের তেমন ভেদ নেই। কিন্তু যেই সেটা চিন্তার জগতে, নীতির জগতে এলো অমনি এক এক জনের অনুভূত সত্যের মধ্যে ফারাক তৈরি হল। 
       গোলমাল এতেও হয় না। গোলমাল হয় যখন অনেকজন মানুষ মিলে কোন একটা অননুভূত সত্যকে স্থির ধ্রুব জেনে মানতে শুরু করেন। অর্থাৎ সত্য তখন অনুভবের না হয়ে মানার বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। এই হল গোল। মানুষ যাকে অনুভব করে তা নিয়ে তার কোনো সমস্যা হয় না, কারণ তাকে সে এত ভিতরে পায় যে কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেও সে তার বিরোধিতাকে হয় মূঢ়তা নয় তার বোধের বাইরে কিছু একটা মেনে নিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে। সমস্যা হয় তার মানার বিরুদ্ধে কথা বললে। যাকে সে মানে তাকে অনুভব করতে পারে না বলেই মানে। মানুষে মানুষে যা কিছু বিরোধের মূল এই মানা। আর সব মানার মূল কোনো ভয়, যে ভয় তার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার বাইরে। 
       এখন গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চলতে গেলে কিছু কিছু জিনিস তাকে মেনেই নিতে হয়, কারণ মেনে না চললে সে আলাদা, সে পৃথক। সেই আলাদা হয়ে বাঁচার সাহস বেশিদিন মানুষের থাকে না। তার একটা গোষ্ঠী আশ্রয় দরকার হয়। এই গোষ্ঠী আশ্রয়ের চাহিদা তার সেই সভ্যতার সূচনা থেকে। দল বাঁধার তাগিদ। দল ছাড়া মানুষ বাঁচে না। যদি মানার গোষ্ঠী দল বেঁধে বাঁচে, তবে না-মানার মানুষেরও দল তৈরি হয়। আবার না মানা আর মানার মধ্যে সংঘর্ষ। কোথাও সম্মুখ সমর, কোথাও ঠাণ্ডা লড়াই।        তবে চিন্তার মূলে এসে একটা কথাই দাঁড়ালো। আমার কথা হচ্ছে যে, এই যে সত্য সত্য করে দুনিয়া কাবার হয়ে গেল, সেই সত্য কি তবে মানুষের বোধনির্ভর অবশেষে? সত্য বলে যা কিছু তা সবই আমার বোধের উপর? সেই 'আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ'? বেশ, তবে সেই বোধ কি? সেও কি একান্ত নির্ভরযোগ্য? 
       এইখানে খুব গোলমাল। বোধশক্তি এক একজনের এক এক রকম। মানুষ নিজের বোধের তুল্য আরেকটা মানুষের দেখা না পেলে পাগলাতে শুরু করে। সে ভাবে আমি কি তবে এতটাই ভুল? হ্যাঁ, এইটাই ভাবে। কারণ সত্যের আরেকটা শব্দ – ঠিক। আমি কি ঠিক অনুভব করছি? আমি কি ঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছি? আমি কি ঠিকটাই ভাবছি? 
       সে তার নিজের ঠিকের সাথে অন্যের ঠিক মেলাতে যায়। মেলে কিছুটা, আবার মেলেও না অনেকটা। মানুষ কপটও তো হয়। সে তার অনুভবের ঠিকের বাইরে কোনো গূঢ় মতলবে অভিনয় করেও তো কাজ হাসিল করার পন্থা জানে। সেই নিয়েও আরেক সমস্যা। তাই এই অনুভবের ঠিক আর লোকের মানার ঠিকের গোলমালে সেই মানুষটার জেরবার অবস্থা যে অভিনয় করতে চাইছে না। যে নাম লেখাতে চাইছে না কোনো দলেই। সে কি করে তখন? সে একা হয়। সে খ্যাপা হয়। সে আলোচনার বস্তু হয়। নিন্দা আর স্তুতি দুই-ই তার ভাগ্যে জুটবে কিন্তু অন্তরের আরাম সে পায় কই? কারণ তার বোধের সত্যকে সে কারোর সাথে মিলিয়ে নিতে পারছে না। কেউ কেউ হয়ত মানতে চাইছে, বুঝতে চাইছে না।
       তবু এটাই রাস্তা। কেউ কারোর হয়ে বোধ করে দিতে পারে না। কেউ কারোর হয়ে এক পা-ও হেঁটে দিতে পারে না। কেউ কারোর হয়ে একটা প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজে দিতে পারে না। এই ভীষণ লড়াইয়ে সে একা। তার ত্রাণ নেই। একটা মাত্র ফাঁকির পথ ছিল অন্যের জুতোতে পা গলানো, কিন্তু সে তো গলাতে চাইছে না।
       আসলে তার বাইরের সমস্যার চাইতে ভেতরের সমস্যা প্রাণান্তকর। সে বুঝছে না তার বোধশক্তি নিজেও কতটা ত্রুটিমুক্ত। কতটা সে সত্যের কাছাকাছি আসতে ব্যগ্র? কতটা সে আত্মনির্ভরশীল। কতটা সে আত্মমোহে আচ্ছন্ন? কে উত্তর দেবে? কোন বই তাকে এর সমাধান দেবে? কেউ না। তাকে নিজেকেই খুঁজতে হবে। একাই খুঁজতে হবে। বারবার ভুল হবে। সাথে একজনই সাথি --- তার ধৈর্য। তার একান্ত সত্যানুগত্য। আর কি? আর কিচ্ছু না... সেই তার প্রেম, সেই তার জীবন, 'মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর / এরা পরকে আপন করে আপনারে পর...'          কে আপন কে পর?...  
332
Tue, 03/05/2019 - 20:30
           কতটা ভাগ্য আর কতটা যোগ্যতা? কার কাছে বেশি ঋণী থাকব? কার কাছে বেশি কৃতজ্ঞ আমি? অনেকবার ভেবেছি, যতবার ভেবেছি, ততবার ভাগ্যই জিতেছে। তবে কি আমি অদৃষ্টবাদিতার কথা বলছি? না না। আমি বলছি আমার অনুভবের কথা, আমার সোজা তাকিয়ে দেখা অতীতের ছবিটার কথা।         রাস্তায় চলতে ফিরতে যখন আমার চাইতে তথাকথিত অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিম্বা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের মুখোমুখি হই, তখন মনে হয় শুধুই কি আমাদের মধ্যে যোগ্যতার পার্থক্য? যে সুযোগ সুবিধাগুলোর মধ্যে আমি বড় হয়েছি, সেগুলো যদি সামনের তথা কথিত পিছিয়ে পড়া মানুষটা পেত, সে কি আমার চাইতে অনেক অনেক ভালো কিছু করত না? কতজন মানুষ সব সুযোগ সুবিধা পায়? কতজন জীবনের উজ্জ্বল দিকটায় পিঠ পেতে শুয়ে থাকতে থাকতে আয়ুক্ষয় করে? শুধুই কি যোগ্যতার মানদণ্ড পার্থক্যের মূলে?        যে মানুষ সাঁতার কাটতে পারে, সে যদি তার জীবন চক্রে একটা সমুদ্রও না পায়? কিম্বা নদী? যে দুর্দান্ত পাহাড়ে চড়তে পারে, সে যদি সারা জীবনে একটা টিলার মুখোমুখিও না হয়?         যোগ্যতার কোনো মূল্য নেই বলছি না। কিন্তু সে পরের কথা। আগে ভাগ্য তাকে তার ক্ষেত্রে নিয়ে আসুক।         অবশ্য ভাগ্যের একটা বিকল্প হয়। মানুষের সহযোগিতা। সহৃদয়তা। যে মানুষটা মরুভূমির বালিতে হাত পা ছুঁড়ে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে সাঁতারের চেষ্টা করছে, সেই মানুষকে একজন সমুদ্র দেখা মানুষ যদি হাত বাড়িয়ে দেয়? ভাগ্য হেরে যায়। ভাগ্য আর যোগ্যতার মধ্যে যখন কিছুতেই মেলবন্ধন হয় না, সেই ফাঁকটা পূরণ করতে পারে কিছু সহৃদয় মানুষ। যেমন শিক্ষক, যেমন প্রতিবেশী, যেমন আত্মীয়। হয় না?        আমার ক্ষমতা স্বল্পের চেয়ে স্বল্প। কিন্তু স্বপ্ন পাগলের মত বড়। যারা সিমেন্ট, ইট নিয়ে দৌড়াচ্ছি তাদের বলি পাঁচিল না, সেতু বানিয়ে যাও। যারা অনেক উঁচুতে উড়ছে, বলি শকুনের মত শুধু ভাগাড় না খুঁজে দূরের সমুদ্রের, জঙ্গলের খবরও দাও। আজ এই ইন্টারনেটের যুগে যোগাযোগের সুযোগ কি সাংঘাতিক। শুধু কুয়াশা বানিয়ে, কোলাহল না তুলে, স্বচ্ছ, সহজ রাস্তা বানানো যাক। ভাগ্যের মুখ না ফিরলেও, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া যাক।    
333
Mon, 03/04/2019 - 23:30
           যিনি পশুকে শাসন করেন তিনি পশুপতি। শিব। তিনি মঙ্গল। সে মঙ্গলের সাধন নেই। যে পশুর কথা শুনলাম সে পশু প্রাণিবিদ্যার কোনো শাখায় নেই। কিন্তু সে পশুর ডাক শোনা যায়। ভীষণ তার আচরণের সাক্ষীও হওয়া যায়।         ভূত প্রেত সব শোনা যায় সে পাড়ায় বশীভূত। সেই ভূত-প্রেতরূপী নানা বিকার, পশুরূপী নানা অতি-ইচ্ছার যিনি হালধারক, তিনি শিব, মঙ্গলস্বরূপ। মঙ্গল তবে কি? মঙ্গল হল সংঘর্ষ, দ্বন্দ্বপরায়ণ নানা বিরুদ্ধ ইচ্ছার সিদ্ধান্ত। সচেতন সিদ্ধান্ত। কল্যাণকে আবাহন জানানো। যে কল্যাণ বাইরে কোথাও নেই। ওই দ্বন্দ্বের মধ্যেই স্থিত। এই গ্রহ-তারা-নক্ষত্র, অণু-পরমাণু যে প্রবল শক্তির ধারক বাহক হয়েও যে সংহতি সৃষ্টি করেছে সেই সংহতি, তিনিই শিব। "নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু, / পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে সাজিল চন্দ্র ভানু"। ব্যক্তিজীবনে সেই সামঞ্জস্যই শিব। সমাজ জীবনে বৈচিত্রের সাম্যাবস্থানই শিব।         "সকল দ্বন্দ্ববিরোধ -- মাঝে জাগ্রত যে ভালো / সেই তো তোমার ভালো"।         তবে আমার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে যে বিরোধ? আজ চতুর্দিকে যে এত বিরোধ, এত হিংসা, এত হানাহানি, এর মধ্যে মঙ্গল কোথায়? ক্ষীণ আশাও তো দেখছি না। এই চরম অন্ধকারের মধ্যেই তাই হয়ত আহ্বান শিবের। অসুন্দর, বিষ, পশু, ভূতপ্রেত - মধ্যে শিব। কল্যাণ। মঙ্গল। মঙ্গলকে খুঁজতে ওই বিষ, ওই পাশবিকতা, ওই অসুন্দর - ওরই মধ্যে খুঁজে বার করতে হবে। তবে মুক্তি। তবে কল্যাণ। তবে শান্তি।          প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশে মানুষ যায় পর্যটক হয়ে। কিন্তু তার সেই বাইরের নৈসর্গলোকের নেশা কাটতে কতক্ষণ? তার পর্যটকের বেশ আর কদ্দিনের? ফিরে এসে তার সঞ্চিত মধু মুহূর্তেই যায় শুকিয়ে। সে আবার রুক্ষ হতে শুরু করে। রূঢ় হয়ে ওঠে। তার মধ্যের মাধুর্যের গভীর আকুতি চারদিকের বদ্ধ দেওয়ালে মাথা কুটে মরে। তখনই তার মনে করার সময়, বাইরে নয়, স্বর্গীয় নৈসর্গিক মাধুর্যে নয়, প্রতিদিনের এই আটপৌরে সংসারেই মঙ্গলকে জাগাতে হবে।        রবীন্দ্রনাথ উপনিষদের কথা বলে বলেন, শান্তং শিবম অদ্বৈতম। আমি যখন শান্ত হই তখনই পাই শিবকে, মঙ্গলকে। সেই মঙ্গলের মধ্যেই আমার বিরোধ ঘুচতে থাকে। আমার অশান্তি মরতে থাকে। আমি আমার চিত্তের মাধুর্যে ডুবি। বলি, আহা বাঁচলাম। যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে কিসের থেকে বাঁচলে, কার থেকে বাঁচলে? কি বলি? বলি নিজের ভিতরে নিজের হাত থেকে বাঁচলাম।         এই শান্তির সুখটা পাব বলে কোথায় কোথায় না দৌড়াই, নিজেকে মিথ্যা আর নানারকম প্রবোধে ভুলিয়ে ভুলিয়ে দু'কিলোমিটারের রাস্তা দুশো কিলোমিটার ছুটিয়ে মারি। কিছুতেই হার স্বীকার করি না। মাথা নীচু করি না। অন্তরের সেই শান্তিময় সত্তা আমার রকম সকম দেখে হাসে। আমি আরো রেগে যাই। ভাবি সে মিথ্যা। বাইরে এত আয়োজন, এত সুখের প্রতিশ্রুতি, তুমি কে? চির বৈরাগী তুমি, কাঙাল তুমি। তোমার সাথে আমার কি মিল? তুমি যাও, তুমি যাও, তুমি যাও।        তারপর কি হয়? তাই হয়, সবার সাথে যা হয়, কারোর আগে, কারোর পরে। বাইরের আলো একটা একটা করে নেভে, বাইরের সুখের প্রতিশ্রুতিগুলো একটা একটা করে অর্থহীন হয়ে পড়ে। বাইরের জৌলুস যত কমে, ভিতরের সে চিরকালের বৈরাগীর রঙ তত উজ্জ্বল হতে শুরু করে। তার মুখের উদাসীন জ্ঞানতৃপ্ত হাসিতে মন জুড়াতে শুরু করে। ক্রমে শান্ত হতে শুরু করি। বুঝতে শুরু করি, আমিই এই বিশ্বাসংসারের খেলায় একমাত্র খেলোয়াড় নই, আমার আগে অগুনতি খেলোয়াড় এসেছে, আমার পরেও বহু'র আসার প্রতীক্ষা। খেলা চলবেই। নানা দ্বন্দ্বে বিরোধের মধ্যে সেই কল্যাণময়কে মানুষ খুঁজে বার করবেই। এর অন্যথা কোনো যুগে হবে না। হতে পারে না। আমার অহং-এর উৎপীড়ন জ্বালা জুড়াতে শুরু করে। এই বিপুল বিশ্বে তখন আমার একটা ছেঁড়া চট জুটলেই নিজেকে ধন্য মনে করি। সেই চটের উপর প্রাণের অফুরান আনন্দকে সাথে নিয়ে বসি। সবার খেলা দেখি। আনন্দে মন মত্ত হয়ে বলে, এত কাছেই ছিল এতবড় আনন্দের খনি? দেখিনি কেন? কে চাপা দিয়ে রেখেছিল? নিজেই বুঝি, সে আমি আমি আমি, সেই ছেঁড়া চটের থেকে দূরে ছোটা আমি।   শান্তি শান্তি শান্তি।    
334
Sat, 01/26/2019 - 11:30
            প্রজাতন্ত্রদিবস। অবশ্যই ভারতের। যদিও ‘দেশ’ শব্দটা পরিসর হারাচ্ছে ‘বিশ্ব’ শব্দের কাছে। হারারির মতে আমরা যদি একটা বিশ্বনীতিতে না দাঁড়াই তবে ক্রমে আমাদের এ বিশ্ব বাসযোগ্য রাখা কঠিন হবে। তোমার দেশের বাতাস দূষিত হলে তার ফল আমিও ভুগি, তোমার আবহাওয়া উত্তপ্ত হয়ে উঠেল সেই তাপে আমিও পুড়ি, তোমার অসংযমের দায়ে আমার দেশেও অকাল বন্যা, খরা। এসো একটা নীতি বানাই, বিশ্বনীতি। এখন ই-কমার্সেও বিশ্বনীতির ডাক এসেছে। বিতর্ক হচ্ছে। হবে, সে আলাদা কথা। কিন্তু আমার কথা আজ নিজের দেশ নিয়েই। প্রজাতন্ত্র দিবস।          দেশে নানা প্রজা। গরীব আর ধনী, ইংরাজিতে ‘আছে’ আর ‘নেই’ প্রজা। উপেক্ষিত আর তোষিত প্রজা। সেই নিয়েই কথা। একটা ঘটনা, গত জুলাইতে থাইল্যাণ্ডে ঘটেছিল। বারোটা বাচ্চা একটা গুহায় আটকে পড়েছিল। সারা বিশ্বে হইচই পড়ে গেল। নানা দেশ থেকে নানা কুশলীরা এলেন, গুহার জল নিষ্কাশিত হল, বাচ্চাগুলো উদ্ধার পেল। আমাদের দেশেও সে সংবাদে বৈদ্যুতিক আর ছাপা মাধ্যম দুই-ই লাভের মুখ দেখেছিল। একটা থ্রিলারের মত গপ্পোটা বানানো হয়েছিল। আর ফেসবুকে... ”আহারে বাচ্চাগুলো... বেরোলো কি?... ঘুমাতে পাচ্ছি না..” ইংরাজিতে, বাংলায়, হিন্দীতে... নানা পোস্ট... ছবি... ইত্যাদি। স্বাভাবিক, খুব স্বাভাবিক। সহমর্মিতা খুব ভালো গুণ।          এবার ঘটনা, মেঘালয়। পনেরোজন শ্রমিক। মালিকের লোভে গর্তে গেল, অভাবের অসহায়তায়। তাদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ছিল কিনা জানি না, টুইট করত কিনা জানি না। সেই থাইল্যাণ্ডের গুহার বাচ্চাগুলোর কথা জানত কিনা জানি না। কিন্তু তাদের পরিবার ছিল, খিদে ছিল, সাধ ছিল, বাঁচার ইচ্ছা তো নিশ্চয় ছিল। এগুলো থাকতেই হয়। কিন্তু মানবাধিকারের জ্ঞান ছিল না। জন্ম থেকেই মানুষ হয়ে জন্মানোর যে সম্মানটুকু পাওয়া উচিৎ, তা জানত না, উচ্চ উপার্জনক্ষমতারহিত হওয়ায় সে আশাটুকু বাতুলতা যদিও। আমাদের পাণ্ডিয়ার টিপ্পনী আছে, ভোটের কাজিয়া আছে, কত রকম ‘বাদ’ এর আনুগত্যরক্ষা আছে, নিজেকে সোশ্যাল মিডিয়া তথা জগত সংসারে টিকিয়ে রাখার দায়ের চেয়ে অধিক সোচ্চারে জাঁকিয়ে রাখার দায় আছে। ইত্যাদি নানা নানা সমস্যা তো আছেই। যা নেই তা হল একটা স্বাবলম্বী মানবিকতাবোধ। যার একটা বড় দিক হল সবল সহমর্মিতা। ফেসবুকীয় হাওয়াগামী সহমর্মিতা নয়, স্ব-বিশ্লেষণ ক্ষমতাযুক্ত সহমর্মিতা। তার দায় কে নেবে? সে সময় কোথায়?          উদ্ধারকাজ চলছে। কি উদ্ধার হচ্ছে? দেহের পচা-গলা বিচ্ছিন্ন অংশরা টুকরো টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসছে। যন্ত্র দিয়ে ধড়টা টানতে গেলে মাথাটা আলাদা হয়ে ভেসে চলে যাচ্ছে। বাড়ির লোকেরা তাই নেওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। অভিযোগ জানাচ্ছে না যে তা নয়। তবে খুবই ক্ষীণ সে অভিযোগের কণ্ঠস্বর। তারা বলছে আপনারা ওই দেহের অংশগুলোই একটু পরীক্ষা করে জানিয়ে দিন কার, আমরা তারই সৎকার করে নেব। আপনারা কাপড়ে জড়িয়ে দিলেই হবে।          কি ছোট্টো চাহিদা না? কি অল্প। মারা গেল তো কি হল। গরীব তো ওভাবেই মরবে বলে জন্মেছে। তবে এ ঘটনা আজ বিশ্বের আকর্ষণ আসবে কি করে? নিজের দেশের মানুষের উদাসীনতা পেরিয়ে বাইরের সহমর্মিতা এসে পৌঁছাবেই বা কি করে? কেমন দৃষ্টিকটু লাগে না আমাদের? আমরা যতই যা হই, একটা উচ্চ-সংস্কৃতিসম্পন্ন জাত। দেশের মানুষের চাইতে আমাদের ভাবাবেগ অনেক অনেক বেশি দামী।  বিবেকানন্দ বলেছেন না, ভারত মরে গেলে পৃথিবীর সব উচ্চভাব নাকি এক্কেবারে মরে যাবে। তবে? সেগুলো রাখতে ব্যস্ত থাকব, না কে গুহায় ঢুকে মরল তা নিয়ে ভাবব। ও তো ওদের কর্মফল, নাকি?          আমি জানি না নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য উন্মোচিত হলে দেশের কি ক্ষতিবৃদ্ধি হবে, জানি না পাণ্ডিয়ার উক্তিতে দেশ ক ইঞ্চি মাটির তলায় ঢুকল, আমি জানি না কোন নেতা দেশের সর্বোচ্চ আসনে বসলে এমন একটা নির্দয়, কূপমণ্ডুক, আত্মকেন্দ্রিক জাতের ঘুম ভেঙে তরতর করে একটা সঠিক অর্থে সভ্য দেশ হয়ে উঠবে, আমি জানি না কোনো নারীর কুমারীত্ব আয়াপ্পাকে বিচলিত করলে কি কাণ্ড ঘটে যাবে, আমি জানি আজ যে পতাকাগুলো পত পত করে উড়ছে সেখানে পনেরোটা পচাগলা শরীরের মাংস, রক্তের দাগ লেগে। দুর্ঘটনাটা দুর্ঘটনাই। কিন্তু উদাসীনতাটা লজ্জার। তাই আজকের দিনটা সেই পরিবারের দিকে তাকিয়ে লজ্জার, যে পরিবারগুলো এখনও গর্তটার সামনে বসে। যাদের পাশে যন্ত্র আছে, কর্মী আছে, সহমর্মিতা নেই।    
335
Sat, 01/12/2019 - 11:30
              বিবেকানন্দের একটা প্রিয় উপমা ছিল। একটা বীজ, সে জল-মাটি-বাতাস-আলো নিয়ে অঙ্কুরিত হয়, কিন্তু সে নিজে জল, মাটি, বাতাস কিম্বা আলো হয়ে যায় না, সে একটা গাছই হয়।          কিন্তু হঠাৎ করে কিছু মানুষ যেন ক্ষেপে উঠে বলতে চাইছে, তা নয় নয়..এই যে বীজ, এ অঙ্কুরিত হল সম্পূর্ণ মাটির গুণে, কেউ বলছে, না এই আলোর গুণে, কেউ বলছে বাতাসের তো কেউ বলছে জলের। কিন্তু কেউই বলছে না বীজটার নিজের মধ্যে একটা প্রাণশক্তি ছিল, তার জোরেই সে বাইরের সব উপকরণকে গ্রহণ করতে পেরেছে, আত্মভূত করতে পেরেছে।         মানুষের মধ্যে সেই সংশ্লেষ আর বিশ্লেষণের ক্ষমতা আছে বলেই সে আলাদা অন্যান্য প্রাণীকূলের থেকে। সেই তার কেন্দ্রস্থ চেতনা। বিবেকানন্দের আরেকটা উপমা - একটা বিশালাকায়, প্রভূত ক্ষমতাসম্পন্ন রেলইঞ্জিন লাইন বেয়ে ধেয়ে আসছে, আর ঠিক সেই সময়েই সেই লাইন বেয়ে একটা ছোট্ট পিঁপড়ে এগিয়ে চলেছে। ইঞ্জিনটা আসছে দেখে সেই পিঁপড়েটা রেললাইন থেকে নেমে গেল। কিন্তু ইঞ্জিনটা কোনোদিন লাইন থেকে নামতে পারবে না, যতই ক্ষমতাসম্পন্ন হোক না কেন সে। কারণ সে জড়, শুধুই নিয়মাধীন। পিঁপড়ে হল চেতনা। চেতনার ক্রিয়াশীল দিকটা হল ইচ্ছা।         সব মানুষের জীবনেরই দুটো দিক আছে। এক তার দৈনন্দিন জীবন, দুই তার মধ্যে স্থির শান্ত একটা আন্তরিক স্থায়ী জীবন। সাধারণ মানুষের প্রথমটাই হয় মুখ্য, মহানুভবের দ্বিতীয়টা হয় মুখ্য। কিন্তু দুজনের মধ্যেই এই দুইদিক থাকে বলে একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে বৌদ্ধিক, আত্মিক সাহচর্যে।         আজ সমস্যা হচ্ছে, মহানুভবের নিত্য ব্যবহার্য লোটাও শাশ্বত জীবনের ইঙ্গিতবহ বলে প্রচার হচ্ছে। এতে সুবিধা দুই। এক মহানুভবের কপট মহতী সঙ্গও হল, আবার তার বড় পরিসরের কথাটাকে বাদ দিয়ে তার ছোট পরিসরের কথাটাকেই বড় কথা বলে চালিয়ে দেওয়া গেল। এতে মঙ্গলের চাইতে লাভের দিকে ঝোঁক হল বেশি।         আজ এক দুর্দিন। যে আলোতে মশাল জ্বালা যায়, সেই আলোকেই বাড়ির উনুন ধরানোর কাজে লাগিয়ে নিজের তুখোড় বিষয়বুদ্ধির গর্বে ফেটে পড়ছি, মাঝে মাঝে অন্যের চালে আগুন লাগাবার কাজেও প্রয়াস পাচ্ছি সে আগুনে। প্রতিদিন একটু একটু করে ভুলে যাচ্ছি, আমরা কেউ জিততে আসিনি, আমরা বাঁচতে এসেছিলাম - শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে, ঐক্যের মঙ্গলে, বৈচিত্রের মাধুর্যে। যেটাই মহানুভবের আকাঙ্খা। নামের মোহ নয়, প্রাণের জয়। পথ মহান হয় পথিকের দিশার মহানতায়, পায়ের জোরের উন্মাদনায় নয়।  
336
Sat, 01/05/2019 - 11:00
          শবরীমালা মন্দিরে মহিলারা ঢোকার পর মন্দির ধোয়া হল। মন্দির অশুচি হয়েছে। পড়লাম। ক্যালেণ্ডারের দিকে তাকালাম, ২০১৯, জানুয়ারি।         এ লড়াইটা চলবে। এ লড়াইটা আরো আগে শুরু হওয়ার কথা ছিল। ভণ্ডামি আমাদের রক্তে। ভণ্ডামি শব্দটায় অসুবিধা হলে বলি দ্বিচারিতা। যে রজস্বলা নারীদের স্পর্শে মন্দির তথা দেবতা অশুচি আজ, সে দেবতা কি জানেন না, যে পুরুষভক্তরা শুধু তার মন্দিরে প্রবেশাধিকার পাচ্ছে, সেবার অধিকার পাচ্ছে, সেই পুরুষেরা আসত কোথা থেকে যদি সেই তথাকথিত অশুচিতাকে বিধাতা সংসারে স্থান না দিতেন? পুরুষকে জন্ম দিত কোন রজ অতীত নারী? শুনেছি তিনি নাকি দুই পুরুষের বীর্যে জন্মেছেন। নারীর প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু সেই পদ্ধতিতে যতক্ষণ না তিনি তার সেবককূলকে জন্ম দিতে পারছেন ততক্ষণ তো মেনে নিতেই হবে না সেই শুদ্ধ-নিষ্পাপ পুরুষজাতের জন্মদাত্রী অশুচি রজস্বলা নারীদের? মূলকে উপেক্ষা করে ফলের গুণগান করাকে আমরা মনুষ্যসমাজেই নিন্দনীয় বলি, আর তিনি তো দেবতা!         এ গেলো দেবতার কথা। আর আমাদের ধর্মের আখড়ায়? একজন নারী, আসনে বসে তার স্বামীর পূজো নিচ্ছেন। আরেকজন নারী গায়ে আগুন নিচ্ছেন, স্বামীর ঢালা কেরোসিন গায়ে নিয়ে। এ দুই-ই কি অস্বাভাবিক নয়? দেবী বনাম নরকের দ্বার, শক্তি, মুক্তির সহায় ইত্যাদি কত সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত সে বলে শেষ করা যাবে না। অথচ দিনের পর দিন এগুলো আমাদের চোখে, ব্যবহারে এত সহজ হয়ে পড়েছে যে অস্বাভাবিকত্বের আঁচটুকু গায়ে লাগে না। এটাই তো কাম্য, এই তো হওয়া উচিত।         বৃদ্ধ বাবা, মাকে বাড়িতে একা ফেলে ছেলে, বউ নিয়ে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে বাসা গেড়েছে।, কারণ বাচ্চার কেরিয়ার গড়তে হবে, সেই আবার দীক্ষা নিয়ে মঠে-মিশনে ঘুরে বেড়িয়ে জগজ্জননী, জগৎপিতার জন্মোৎসবে যোগদান করে, বাড়িতে দারুণ ঠাকুরঘর করে কি খেলায় মেতে আছে। এগুলো সব গা সওয়া আমাদের।           ধর্ম অন্ধ হতে শেখায় না, ধর্ম অমানবিকতা, অন্ধত্বকে জাস্টিফাই করে, এ আগেও লিখেছিলাম, এ বড় ভয়ংকর। কিন্তু আমাদের মজা হচ্ছে যতক্ষণ জীবাণু সংক্রামিত না হচ্ছে ততক্ষণ চোখ ফিরিয়ে নিজের স্বার্থ-প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়ে মত্ত থাকি। তখন সমাজের ফাঁকি, আপাত মধুর নির্দোষ প্রথা-দর্শনগুলোর দিকে আঙুল তোলা - ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর সামিল। কিন্তু যে ধিকিধিকি আগুনটা জ্বলছে সে-ই যে সারা শহরে ত্রাসের কারণ হয়ে উঠতে পারে, সে বোধ কই?    "ধর্ম নিয়ে লিখবেন? অমুকের ভাবাবেগে লাগবে যে?"         লাগুক। সেই ভাবাবেগের ঘেরাটোপে কি বিষাক্ত জিনিস সংসারে প্রতিদিন নানা অবতারের শিক্ষায় সংসারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে সেগুলোর দিকে তাকানোর দরকার নেই? ধিক সেই শিক্ষা, সেই মনন, সেই সাহিত্য যা শুধু নির্মল নিকেতনে সুউচ্চ ভাব মন্দিরের বাইরে বেরোবার প্রাণশক্তি পায় না। যা বলার তা প্রতিদিন বলতে হবে, আঙুল তুলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন না, আগুন লাগলে ঘটি মাটিতে ঠুকলেই ভেবেছিলাম জল উঠবে, জল যখন উঠল না শুধু ধুলোই উড়ল তখন আমাদের বিস্ময়ের সীমাপরিসীমা রইল না।         আমাদের সত্যিই সেই ঘটি কপালে ঠুকে ঠুকেই দিন যাচ্ছে, সময়ে কূপখননের কথা ভুলে গিয়ে।    
337
Mon, 12/31/2018 - 11:00


        অনুভূতির ইচ্ছা জন্মায়। ভালোবাসার অনুভূতির এক ইচ্ছা, ঈর্ষার অনুভূতির আরেক ইচ্ছা। যখন "হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি, ছুটি নে কাহারো পিছুতে... মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই কিছুতে" - সে আরেক ইচ্ছা। 

        বুদ্ধি বলতে যাকে বুঝি, তার যত জ্বালা, অনুভূতিকে অস্বীকার করবে, সে সম্ভব নয়। কিন্তু অনুভূতিজাত ইচ্ছাগুলো সব তো আর সুবিধার নয়, তখন? তার মহা বিপদ তখন, 'শ্যাম রাখি কি কূল রাখি' অবস্থা। সব ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটালে সভ্য সমাজে থাকা দায়, এদিকে ইচ্ছার গতিরোধ করলে মনের মুখভার। বেশি চাপাচাপি করলে আবার ভবিষ্যতে বিষফোঁড়া হওয়ার ভয়। 
        এখন এই হাজার হাজার অনুভূতি আর সে হাজার হাজার ইচ্ছার ভবিতব্য কি তবে? গালিব সাহেব তো বলেই বসলেন, এর এক একটা সাধ সাধতেই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। তা মানুষটার বুকের পাটা ছিল তিনি অমন কথা বললে বলতেও পারেন। কিন্তু আমরা ছাপোষা মানুষ, আমাদের সভ্য হয়ে না চললে যে সব যায়। তবে? এই যেমন ধরেন গিরিশ ঘোষ। যেই না ওর বাড়ির সামনে দুর্গা ফেলল, তিনি কুড়াল দিয়ে দিলেন ফালাফালা করে। নাকি কান্নার ধুয়ো তুললেন না, "এই আমার বাড়ির সামনে দুর্গা ফেলে গেছে... অসভ্য... ইতর" ইত্যাদি। 
        তো কথা হচ্ছে, যাকে ডিপ্লোম্যাটিকভাবে ঠিক থাকা বলে, এমন মসৃণ মানুষের সংসারে অভাব নেই। তারা চলতে ফিরতে, নাইতে খেতে, কথাতে কান্নায় হাসিতে এক্কেরে একশোতে একশো। অবশ্যি না হয়েই বা উপায় কি? এত ভালোমানুষ যে নই সেটা জানান দিলে তোরা সংসারে টিকতে দিবি? আমার গুষ্ঠীর ষষ্ঠী পুজো করে ছাড়বি না রাতদিন! আর তোরাও যে কি সে আমার জানতে বাকি নেই যদিও, তবু তোরা যেহেতু বেড়াল ঝুলিস্থ রেখেছিস অগত্যা আমিও অসহায়। 
        উফ, কোথাকার কথা কোথায় এনে ফেললাম। কথা হচ্ছিল ইচ্ছা নিয়ে। ভালো অনুভূতির ভালো ইচ্ছা আর মন্দ অনুভূতির মন্দ ইচ্ছা। আচ্ছা এই ভালো মন্দ কেসটা কি? এর কি নির্দিষ্ট কিছু মাত্রা আছে? উত্তর, নেই। তবে? বলছি।
        যদি তুমি পাহাড়ে চড়বে ঠিক করেছ, তবে আঁকা বাঁকা পথটাই তোমার ভালো। আর যদি খাদে গড়াবে ঠিক করেছ, তবে রাস্তার ধারের ওই ঢালটাই তোমার ভালো। মোট কথা যদি বাঁচতে চাও, একরকম ভালো, আর যদি মরতে চাও, আরেকরকম। তুমি বলবে, এইটা কি কথা হল, কেউ মরতেই বা চাইবে কেন? আহা, চাইবে নাই বা কেন? ইচ্ছার গতি অত যদি হিসেবী হবে তবে সে ইচ্ছা কেন হবে, হেডমাস্টার হবে। সেই হল কথা। 
        তবে ইচ্ছার গতি ইচ্ছার প্রকৃতির উপর নির্ভরালো। এখন এই দুষ্টু ইচ্ছাগুলোর গতি কি হবে তবে? ভালো ইচ্ছাগুলো তো বেশ সেজেগুজে পার্কে, নদীতে, পাহাড়ে, সমুদ্রে বেড়িয়ে আসবে। মন্দ ইচ্ছাগুলোর কি হবে? ওদের কি কবর দেব না চিতায় তুলব? বন্দী করে রাখব না নাইয়ে খাইয়ে পাতালঘরে পুষে রাখব? মানুষ সবটাই করে। নইলে দেখনি শকুনি যেভাবে দুষ্টু লোক, রাবণ সেভাবে কি? কিম্বা মন্থরা যেভাবে দুষ্টু কংস সেভাবে কি? নয় তো বলো!
        এখন তবে কথা দাঁড়াল এই, যার যেমন অনুভূতি তার তেমন ইচ্ছা। আচ্ছা অনুভূতি বদলানো যায়? বুদ্ধি, কি বলেন? পারেন? বুদ্ধি হাই তুলে বলল, না না। সে আমি পারি না। তবে শুভবুদ্ধি বলে কি কিছুই নেই? শুভবুদ্ধি তো শুভ অনুভূতির সাথেই আসবে নাকি? একজন লোক ঈর্ষায় জ্বলছে, তার কি আর শুভবুদ্ধি জন্মাবে? কখনও না। তবে উপায়? আছে। বুদ্ধি পারে না, পরিবেশ পারে। চারপাশের পরিবেশটা যদি খানিক বেশি সুস্থ, বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ, বেশি সহযোগিতাপূর্ণ হয় তবে আখেরে সে দুষ্টু ইচ্ছাগুলো কিছুটা হলেও কাহিল হয়। কেমন? যেমন শীতে ডেঙ্গুর মশা কাহিল হয়। ডেঙ্গুর মশার যে ইচ্ছা হয় না তা তো নয়, কিন্তু শীতে পেরে ওঠে না। এই হল কথা। বুদ্ধি বলল, হুম, কিছুটা ঠিক। আমি বললাম, আরে ভাই, আমি তো কিছুটার কথাই বললাম। পুরোটা কে আর জানে? তাই না!

338
Tue, 12/25/2018 - 11:00

        খ্রীষ্টের উৎস যতই প্রাচ্য হোক, খ্রীষ্ট আমাদের মানসে পাশ্চাত্যের সাদা চামড়ার ভগবান। ধনীর ভগবান। উন্নতশ্রেণীর মানুষের ভগবান। এক কালের শাসকের ভগবান। তাই খ্রীষ্টের প্রতি আনুগত্য, ঠিক "এক গালে চড় মারলে আরেক গাল বাড়িয়ে দাও" এর প্রতি আনুগত্য নয়। এ আনুগত্য পাশ্চাত্যের প্রথম বিশ্বের প্রতি আনুগত্য। কেক খাওয়া তার একটা প্রধান সাংকেতিক উদযাপন। কাল বেশ গ্রামের ভিতরের দিকে গিয়েছিলাম, সেখানেও দেখি কেকের দোকানের পর দোকান সাজানো। শহরে তো বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। ছুটির ঘন্টা চারদিকে।
        খ্রীষ্ট আমাদের মনীষীদের মানসলোকে গভীর আবেদন রেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা, বিবেকানন্দ ইত্যাদি মহামানবদের লেখায় বারবার এসেছেন। কিন্তু সে খ্রীষ্টকে ভারত নেয়নি, ভারত নিয়েছে কেকের খ্রীষ্ট, সারারাতব্যাপী মোচ্ছবের খ্রীষ্ট, যাতে নাকি ওয়াইন খেলে আরো জাতে ওঠা যায়, গলার লকেটের খ্রীষ্ট, দেওয়ালের ক্রুশের খ্রীষ্ট। আর জগত নিয়েছে পোপের খ্রীষ্ট।
        তবে খ্রীষ্ট আজ কোথায়? সব মহামানব চিরটাকাল যেথায় - সবল সতেজ অনুকম্পায়, ভালোবাসায়। ভালোবাসার কোনো নির্দিষ্ট ব্যাকরণ নেই, পুঁথি নেই, চারদেওয়ালের ঘেরাটোপ নেই, সে মন্দির মসজিদ চার্চ যাই বলো না কেন। ভালোবাসা নিজেই শাসন, নিজেই অভয়, সদা আত্মতৃপ্ত। তাকে ডাকা যায় না, সাড়া দেওয়া যায়। দল পাকিয়ে নয়। নিভৃতে একান্তে কিম্বা সতীর্থের ভাতৃত্বে।

339
Sun, 12/16/2018 - 14:01

        ছোটোবেলায় আমি সান্টার গল্প শুনেছি। কিন্তু সে গল্প বলেই শুনেছি। যেমন প্রাণভোমরা রাক্ষসীর বুকে থাকে তেমন। যেমন লালকমল, নীলকমলের জন্য কোনোদিন অপেক্ষায় থাকিনি, তেমনই সান্টার জন্য কোনোদিন অপেক্ষায় থাকিনি। আজ অনেক বাচ্চাকে দেখি তারা রাতের ঘুমে, নির্দিষ্ট দিনে সান্টার উপহারের অপেক্ষা করে। বাড়ির লোক কিছু একটা কিনে মাথার কাছে রেখে দেয়। সে বাচ্চারা ভাবে সেটা সান্টার উপহার। 
        এর মধ্যে কতটা ভাণ, কতটা নির্দোষ সরলতা, কতটা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মোহপরায়ণ আনুগত্য - বলতে পারি না। শুধু জানি এরকম কিছু আমার ছোটোবেলায় দেখিনি। হতে পারে আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িনি বলে বা মায়ের অত্যন্ত বাস্তবমুখী স্বপ্নমেদ বর্জিত শাসন প্রণালীর জন্য, বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে, কেবল টিভি, ইন্টারনেট ইত্যাদির অনুপস্থিতির দরুণ নিবিড়ভাবে পরিচিত হতে না পারার জন্য। কারণ কিছু একটা হবে। 
        ক্রমে বড় হওয়ার সাথে সাথে সান্টার মত নানা দেবদেবীর গল্প জানলাম। লক্ষ্মী অর্থ দেন, সরস্বতী বিদ্যা দেন, মা কালী বিপদ থেকে বাঁচান, বিশ্বকর্মা যন্ত্রপাতিতে কুশলতা দেন, ইত্যাদি। এখন জানি সারা পৃথিবী জুড়ে সান্টারা আছে। সান্টার সাথে জুড়ে সেন্টিমেন্ট। সেই সেন্টিমেন্টে আঘাত করতে নেই, এই কথাটা সত্য অনুভবের চাইতেও অনেক বড় কথা। তাই সত্য যাক সেন্টিমেন্ট থাক। সান্টার সাথে সান্টার বিরোধ। কখনও সুপ্ত আগ্নেয়গিরি, কখনও উত্তপ্ত লাভা উদগারি। ধর্ম, সান্টাদের গল্প মানেই সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। সেই আগ্নেয়গিরির গায়ে গোলাপের চাষ হতেই পারে, জনবসতিও শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকতেই পারে, কিন্তু তবু তা সুপ্ত আগ্নেয়গিরিতুল্যই৷ জাগলে টের পাওয়া যায়। 
        সান্টার গল্প যারা বিশ্বাস করে না, সান্টার গল্প যারা বলতে পারে না, তারা জনপ্রিয় হয় না। গণশত্রু হয়। সেন্টিমেন্টের ক্ষেতে মাজরা পোকা তারা। বিদ্বেষের আগুনে পুড়ে মরতে হয় তাদের। আমার যেমন মেলা বন্ধু বিচ্ছেদ হল ফেসবুকে এসে। এমন সব হাবজিগাবজি অবতার, ভগবান, মঠ মিশন নিয়ে লিখলুম বলে তারা চটে পালালো। যারা মিষ্টি মিষ্টি গল্প লেখে তাদের ওখানে আসর জমালো। দুঃখ পেলুম। চলে গেল বলে ততটা নয়। এত দুর্বল ছিল জানতে পেরে।
        দুর্বল বড় হিংসুটে ভক্ত হয়। তাদের জোরটা প্রেমের জোরে না হয়ে দলের জোরে হয়। তাই যেহেতু সত্যের ভিত নাই, সেন্টিমেন্টের কম্বলে হাত দিলেই কামড়াতে আসে। আঁচড়ে দেয়। দিয়েছেও অনেকে। সে যাক। তবু স্বভাব যায় কি মলে? 
        তবে সান্টা কি একেবারেই নেই আমার জীবনে? এসেছে তো। সে বড়দিনের মধ্য রাত্রে নয়। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছি। হাফ প্যান্টের বয়েস তখন। হঠাৎ কালো করে আকাশ ছেয়ে মেঘ। গাছগুলোর তলায় আরো নিবিড় ছাওয়া। ঘাসের উপর মেঘ ঢাকা চাদরে নিবিড় আদর। হাওয়া দিচ্ছে ভিজে বাতাস। দুপুরবেলা, অথচ চারদিকে কেমন শ্রাবণের মেঘে অল্প আলো, মায়াবী আলো। চারদিকের সব সবুজ মিলে কি আনন্দে অধীর হয়ে উঠেছে, মেঘ এসেছে বলে। 
        ঝড় শুরু হল। সাথে বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি। সারা প্রকৃতিজুড়ে কি সমারোহ, ঘরেতে মায়ের অপেক্ষা আমার জন্য। দৌড় দৌড় দৌড়। পিঠের মধ্যে অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, ইংরাজি, বাংলা - সবাই লাফাচ্ছে। খাতা ভিজছে, পেন ভিজছে, টিফিনের টাকা ভিজছে। ওদের ভিজলে প্রাণ যায়। আমার যায় না। আমার আশেপাশে লক্ষহাতে আমায় ধরে ছুটছে জোব্বা পরা সেই মানুষটা, সেদিন থেকে আজও, আমার রবীন্দ্রনাথ, আমার সান্টা। মায়ের অপেক্ষা আমার জন্য রান্নাঘরে না, অনেক দূরে। ছুটছি তো ছুটছিই। দল নেই। শিষ্য নেই। গুরু নেই। বিদ্যা নেই। পাণ্ডিত্য নেই। উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। আছে গুটিকয়েক বন্ধু আর বিস্ময়ের উপর বিস্ময়, ব্যস!

340
Fri, 12/14/2018 - 12:30


        একটা সময় মন পাকতে শুরু করে সংসারে। পাকা রঙ যা ধরে সে শুধু যে তার নিজের ব্যক্তিত্ব মিশে, তা ঠিক নয়, চারিপাশের মানুষের অবদানই বেশি। 
        মানুষের উপর প্রভাব ফেলে মানুষ। প্রকৃতি ইত্যাদি যা বলি, তার প্রভাব আর কতটুকু? যেটুকু পড়ে সেও সাময়িক। মানুষের উপর মানুষের প্রভাবই দীর্ঘস্থায়ী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী। মানুষের প্রভাব মানুষ এড়িয়ে চলে, এমন হওয়ার যো নেই। সব ত্যাগ করে যে সন্ন্যাসী হতে চাইছে আদতে সেও পরোক্ষ ভাবে জনমানস দ্বারা প্রভাবিত বলেই সব ত্যাগ করে নিজেকে নিয়ে সরে থাকতে চাইছে, সে নিজের কাছে নিজে আগেই হেরে বসে আছে। যদিও এ পথে ব্যতিক্রমও যে নেই তা নয়, তারা নিজের মধ্যে কিছু একটা উপলব্ধি করে সংসারের সাথে মিশতে চেয়েছে। কিছু একটা জানাতে চেয়েছে। সে অন্য প্রসঙ্গ। 
        তবে এ কি পরাধীনতা? হ্যাঁও বটে, নাও বটে। আমি কতটা প্রভাবিত হব তা তো আর আগে থাকতে স্থির করে রাখতে পারি না। প্রভাবকে কাটিয়ে ওঠা যায় না, কিন্তু প্রভাবকে বিচারের আওতায় আনা তো যায়। তার মোড় ফেরানো যায়, তাতে নিঃস্পৃহ হওয়া যায় কিছুটা দূর অন্তত। ধীরে ধীরে এক রঙ থেকে অন্য রঙে এসে দাঁড়ানো যায়। সে শুধুমাত্র সম্ভব বিচার আর ধৈর্যর উপর নির্ভর করে।
        একের প্রভাব কাটাতে না কাটাতে আরেকের প্রভাব এসে পড়ে। গোলটা বাধে তখন, যখন প্রভাবিত হই অথচ তা বোধের মধ্যে ধরা দেয় না। মনে হয় যেন সেইটাই আমি। একটু শান্ত হলে বোঝা যায়, সারাদিনের মাত্র কতটুকু আমি, আর কতটা বাইরের নানা রঙের তুলির টান, যা অবশ্যই আমার আমির ক্যানভাসেই পড়েছে। সেটা অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু সেই তুলির টানের রেখাকে নির্বিচারে মেখে বসে থাকা স্বাধীন চিত্তের স্বভাব নয়। সে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে দেখার চেষ্টা করবেই। যেমন বীজ রোদ-জল- বাতাস নিয়ে নিজেকে অঙ্কুরের মধ্যেই দেখে। সবকে সে স্বীকার করে, কিন্তু সে সবিচার, সচেতন স্বীকার। জড়ের মত আত্মসমর্পণ নয়। 
        মানুষের সব চাইতে কঠিন পরীক্ষা অপমানের পরীক্ষা। অপমান পরুষ বাক্যে কিম্বা উপেক্ষায়, যাই হোক। সে অপমানের বোধ বড় সাংঘাতিক রঙ চড়ায়। কিন্তু মজার কথা হল, আমায় ততটাই অপমান করা সম্ভব যতটার মান নিয়ে আমি নিজে নিশ্চিতরূপে জ্ঞাত নই। আমার যে মান, সে এমন একটা অদৃশ্য বায়বীয় বস্তু যে তার সুনির্দিষ্ট পরিখা নির্ধারণ করা কঠিন। পা যখন স্বাভাবিক থাকে তখন সে আমার কাছে সমস্যা নয়, কোথায় কাঁটা বিঁধল, কোথায় ঠাণ্ডা-গরম অনুভব হল ইত্যাদি বেশ বোঝা যায়। কিন্তু যখন সেই পায়েই ঝিঁঝিঁ ধরে, কিম্বা আহত থাকে - তখন সে হয় নিজেই সে নিজের বোঝা নয় আতঙ্ক - এই বুঝি বিপদ হল। 
        মানুষ হিসাবে আমার যে মান সে সুনির্দিষ্ট, তা সংবিধান স্থির করে দিয়েছে, তাকে নিয়ে গোল নেই আমার, কিন্তু এই "সৌরভ ভট্টাচার্য্য" নামক জীবটার জন্য যে মানের ব্যবস্থা "সৌরভ" নিজেই করেছে, তার হিসাব? সে বস্তুটা যে কোথাও নেই! তাই অল্প কথাতেই সে অস্তিত্বসংকটে ভোগে, গুমরে মরে, শাপশাপান্ত করে মরে। 'সৌরভ' মরে 'সৌরভ' এর তৈরি জালে। 
        উপায়? সেই সব কুয়াশা কাটানোর চিরকালীন উপায়, ধৈর্য আর বিচার। পালাবার পথ নাই, কিন্তু আনন্দে থাকার আলো আছে প্রচুর, বাইরে না, ভিতরে।

341
Fri, 11/23/2018 - 10:27

        নানক দেখেছিলেন একটা অখণ্ড মানবজীবনের ছবি। শান্তিপূর্ণ ভারতের, তথা বিশ্বের ছবি। কবীর তার পথের অগ্রজ। তার দৃষ্টিতেও ছিল একটা অখণ্ড মানবজীবনের ছবি। অখণ্ড মানবজীবন - যে জীবন শ্রদ্ধা, অনুকম্পাস্নাত আর বিকাররহিত হবে। নানকের বাণীতে ঈশ্বরের তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা নেই, ঈশ্বরের স্বভাবের কথা আছে। আসলে তাঁর বাণী নেই, সঙ্গীত আছে। কিন্তু সেই স্বভাবের কথার মধ্যে ফাঁকির কথার অবকাশ নানক রাখেননি। কিরকম, আজকের তাঁর শুভজন্মদিনের অবকাশে একবার আলোচনা করা যাক। 
        গুরুগ্রন্থসাহেব, যা শিখধর্মের মূল গ্রন্থ, তা বহু সাধকের বাণী আর গান সম্বলিত। যেমন 'গীতগোবিন্দ' রচয়িতা জয়দেবের পদও সেখানে আছে। যেহেতু 'গুরুগ্রন্থসাহেব' গুরু, তাই তিনি হলেন 'গুরুগ্রন্থসাহেবজী'। শিখ কথাটা এক মতে হল - যে জীবনের দর্শন দাঁড়িয়ে আছে শিখ অর্থাৎ, শিক্ষা কথাটার উপর। মানুষের জীবন অর্থাৎ শিক্ষা। কি শিক্ষা? বাঁচতে শেখা, মাথার মধ্যে নানা তথ্যের ভাণ্ডার জমানো নয়, বরং বিকাররহিত বাঁচতে শেখা। সেই 'গুরুগ্রন্থসাহেব' শুরু হচ্ছে 'জপজী' সাহেব দিয়ে। সেই 'জপজী' নানকের বাণী সংকলন। যার প্রথম বাণী শিখধর্মের মূলমন্ত্র - 
        'তিনি এক। তাঁর নাম, এক সত্যনাম। তিনি কর্তা। তিনি নির্ভয়। তিনি নির্বৈর। তিনি নিরাকার। তিনি স্বপ্রকাশ, অজন্মা। তিনি গুরু কৃপায় প্রাপ্ত। তিনি ছিলেন, আছেন, যুগ যুগ ধরে থাকবেন, এই নানকের সত্যনুভব।'
        নাম হোক, সত্য নাম। নানকের শিক্ষার তিনটি স্তম্ভ। প্রথম এই সত্যনাম স্মরণ। কারণ? কেননা চিন্তা মিথ্যাকে সৃষ্টি করতে পারে, তাই সত্যকে স্মরণ করা। নানকের ঈশ্বর খুব স্বচ্ছ সাদামাটা। জটিল তত্ত্বের ধারণা ধারে না। তাই তার নামের নানা ফলাফলের গুণগান অলৌকিক না, চিত্তশুদ্ধির। যত সত্যনাম স্মরণে থাকবে তত নিজের চিত্তের মধ্যে সত্যের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়বে। চিন্তাজাল মিথ্যার কুহক থেকে বেরিয়ে আসবে। তোমার বিভ্রান্তি কমবে। নানকের অনুভব এমনটাই মনের অনুশীলন। 
        ভারতের অন্যান্য মতে যেমন ঈশ্বরের নাম করলেই মুক্তির পথ, নানক জানতেন সেই পথে অনেক ফাঁকি এসে জমবে, তাই তাঁর মতে ঈশ্বরের প্রসাদ নিজের চিত্তে অনুভবের পথ হল, তাঁর হুকুম মানা। এই 'হুকুম' শব্দ পুরো 'জপজী' জুড়ে। কি হুকুম? দুটো প্রধান হুকুম। এক, কিরত করনি, অর্থাৎ সদুপায়ে জীবিকা নির্বাহ। জীবিকা দিয়ে জীবন শুরু, তাই জীবনের প্রথম শর্তই হল তা শুদ্ধ করা, দোষরহিত করা। এই হল প্রথম হুকুম। দ্বিতীয় হুকুম হল, বন্দ চাকনা, অর্থাৎ সেবা, মানবসেবা। ঈশ্বর তোমার সেবার দিকে তাকিয়ে বসে নেই। মানুষ আছে। তোমার উপার্জিত অর্থে সংসারের সব দুর্বলের অধিকার। কারণ নানকের দর্শনে দাতা একজনই, যিনি যুগাদিযুগ ধরে সত্যস্বরূপ। তুমি অনুভব করো তোমার সৎ শ্রম জাত অর্থ সেই দাতারই দান, তাকে একা নিজের মধ্যে নিঃশেষ কোরো না, তবে তা ভোগ, তোমায় বিকারগ্রস্থ করবে। কারণ যে কোনো বিকারের মূল কথা হল, লোভ। বাঁচো তার হাত থেকে, সেবায়, দানে। অহঙ্কার আপনিই নীচে নেমে আসবে, তুমি ত্রাণ পাবে। বিকাররহিত জীবনই আনন্দের মূল। নানকের এই শিক্ষাই আজও কিছুটা লঙ্গরখানা, করসেবা হয়ে শিখ ধর্মের অনুশীলনের মধ্যে বেঁচে আছে। 
        একটা গল্প আমি আগেও কোথাও লিখেছি। একবার উনি মর্দানার সাথে, (মর্দানা, যিনি ওনার সারা জীবনের পথের সঙ্গী। নানকের পায়ে হাঁটা পথটা সুদীর্ঘ, সম্ভবত ভারতের অন্যান্য মনীষিদের মধ্যে সব চাইতে বড়। যিনি পাঞ্জাব থেকে বাংলা হয়ে দক্ষিণ ভারত হয়ে মক্কা হয়ে আবার পাঞ্জাবে ফিরেছিলেন পায়ে হেঁটে।) বেণারসে এসে দেখেন, সবাই গঙ্গায় নেমে মাথার পিছন দিক থেকে জল পিছনে ছুঁড়ছে। উনি জিজ্ঞাসা করেন, এর কারণ কি? তারা বলে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জল দিচ্ছে, যাকে আমরা তর্পণ বলি। তিনিও তাড়াতাড়ি জল নিয়ে পশ্চিমদিকে ছুঁড়তে লাগলেন। সবাই তাকে এরকম করার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেন, তিনি পাঞ্জাবে তার চাষের ক্ষেতে জল দিচ্ছেন। লোকে বলে তোমার কি মাথা খারাপ? এখান থেকে জল সেখানে যায়? নানক বলেন কেন যাবে না? এখান থেকে জল যদি পরলোকে যেতে পারে তবে সেখানেই বা যাবে না কেন? 
        নানকের কথা মনে করা আজ বড় দরকার। সেই সব মনীষার কথাই স্মরণ করা এই ক্ষণে দরকার যারা একটা অখণ্ড মানবধর্ম অনুভব করেছিলেন, সাথে সাথে নানা ভাষাভাষির মত নানা ধর্মের প্রকাশকেও স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করেছিলেন। নানকের ভাষায় মনের ধারা হয় দুইমুখী - গুরুমুখী মন আর হয় মনমুখী মন। অর্থাৎ এক মন, কখনও চেতনাযুক্ত কখনও অন্ধপ্রবৃত্তিমার্গী। দ্বিতীয়টা ভয়ের, কি ব্যক্তিজীবনে কি রাষ্ট্রজীবনে। যে 'বহু'তে শঙ্কা প্রকাশ করে, এ জগতে সে বেশিদিন টেকেনি, বহুর মধ্যে যে নিজের স্থান খুঁজে নেয়, সেই থেকেছে। এটা ভোলাতে চাইলেই ভুলব কেন?
342
Thu, 11/22/2018 - 10:24

১) “বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, কায়িক, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস – এই সকল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত ধর্ম” - গীতা

২) ক -“লোকবৃদ্ধির জন্য স্রষ্টা মুখ, বাহু, ঊরু ও পদ থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সৃষ্টি করলেন” – মনু
খ – “ব্রাহ্মণদের জন্য, অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ” – মনু
গ – “ব্রাহ্মণ এই সমগ্র সৃষ্টির প্রভু”- মনু। ঘ – “মানুষের মধ্যে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ” – মনু। 
ঙ – “ব্রাহ্মণদের দেহই সনাতন মূর্তি। তিনি ধর্মের জন্য জাত এবং মোক্ষলাভের যোগ্যপাত্র” মনু। চ –“পৃথিবীতে যা কিছু আছে, সেই সব ব্রাহ্মণের সম্পত্তি। শ্রেষ্ঠত্ব ও আভিজাত্য হেতু ব্রাহ্মণ এই সবই পাওয়ার যোগ্য”...”অন্য লোকেরা যা ভোগ করে, তা ব্রাহ্মণের দয়া হেতু করে” ইত্যাদি ইত্যাদি.........আর এগোলাম না। শেষ করা দায় হবে। 
৩) “যার ভক্তি নেই সে ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণ নয়” – রামকৃষ্ণ। কিন্তু মনে রাখতে হবে সেই রামকৃষ্ণ মিশনেই ব্রাহ্মণ শরীরের কুমারী না হলে পূজ্য নয় অষ্টমীতে।


        অর্থাৎ এই হল বেদান্তের ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণতন্ত্রের ব্রাহ্মণের পার্থক্য। প্রথমটা হল এক ধরণের মানুষের কথা, দ্বিতীয়টা হল একটা হায়ারার্কি প্রতিষ্ঠার ভিত স্থাপন। প্রখ্যাত অধ্যাপক অশীন দাশগুপ্ত তাঁর প্রবন্ধ ‘সহিষ্ণুতার ইতিহাস’ প্রবন্ধে বলছেন অল বিরুনীর কিতাব-উল-হিন্দ এ ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে উল্লেখ করছেন, এগারো শতকের ব্রাহ্মণেরা অহংকারী এবং বিশ্বজগৎ সম্পর্কে অজ্ঞ ও অন্ধ। এই নিয়ে অবশ্য পরে অনেক জল ঘোলা হয়। কিন্তু কথাটা যে পুরো মিথ্যা নয় ক্রমশ একটা সমাজের অধঃপতনে সে কথা স্পষ্ট। 
        আজ এই কথাগুলো কেন? আমার আশ্চর্য লাগল, টুইটারের কর্তার ‘ব্রাহ্মণ পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থা নিপাত যাক’, কথাতে আপত্তি আজও ওঠে তবে জেনে। মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থা, রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কারের পথে নানা প্রতিবন্ধকতার গল্প এতদিন শুনে এসেছি। আজ প্রত্যক্ষ করছি, একটা জাতের বুদ্ধিজীবী মহল তথা সাধারণ মানুষের বৃহৎ অংশ কি অসামান্য গভীর ঘুমে থাকা এতদিন ধরে অভ্যাস করে নিয়েছে। “যাই হোক, ওতে আমার কিছু এসে যায় না, যতক্ষণ না সরাসরি আমার ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য-সুরক্ষায় তা শঙ্কা আনে।“ রোগের লক্ষণ নিয়ে যত আলোচনা দেখি, তার কারণ নিয়ে গভীরে ভাবার সময় কোথায়? আর ভাববই বা কেন? আমার তো জনপ্রিয় হতে হবে, ভাবার দায় নিয়ে মাথা গরম করে, না ঘুমিয়ে ভেবে, বিপি বাড়িয়ে, বনের মোষ তাড়িয়ে আমার কাজ কি? তাই আমাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক যে সোশ্যাইটির ছবি আনে, তা দেখলে হতাশই হই। যা হোক, এ তো পড়েইছি আমরা, নতুন কিছু আশাই বা করার কি আছে? 
        কিন্তু তবু। এই নিকৃষ্ট একটা তন্ত্রের বিরোধের জন্য একজন মানুষকে ক্ষমা চাইতে হল, কেন? না তিনি একটা অত্যন্ত অপ্রিয় সত্য অকপটে বলে ফেলেছিলেন, এবং আশা রেখেছিলেন যে ভারতীয়রা, প্রথম বিশ্বে পদার্পণে ইচ্ছুক ভারতীয়েরা তার কথার সমর্থন করবে, আর বাকিরা যারা মধ্যযুগীয়, তারা হেরে যাবে, লজ্জায় মুখ লুকাবে। কিন্তু তা হল না। বক্তার জন্য মুখ লুকাবার কাপড়ের ব্যবস্থা করল ভারতের প্রগতিশীল সমাজই। কেন চাইতে হল? না, কোনো যুক্তি নেই। সেন্টিমেন্ট আছে। আমাদের যেখানে যুক্তি থাকে না, সেখানে আমাদের সেন্টিমেন্টটা সাংঘাতিক। একটু এদিক ওদিক হলেই আমাদের সেন্টিমেণ্টে লেগে একাকার কাণ্ড হয়ে যায়। ভারতীয় সেন্টিমেন্ট।
        আজ ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেসে ইলাইয়া লিখছেন, পুরুষের শুক্রাণু পবিত্র আর মহিলার রজ কেন অপবিত্র? এ প্রশ্ন তিনি কাকে করছেন? যুক্তিকে না ভারতীয় সেন্টিমেণ্টকে? দক্ষিণের অনেক মন্দিরের আগে একটা কি দুটো হাতি বাঁধা থাকে, হয় সেগুলো জ্যান্ত না হয় মূর্তি। তার কিছু ধর্মীয় ব্যাখ্যা অবশ্যই আছে। কিন্তু আমার মনে হয় ভারতীয় সমাজকে ধাক্কা দিতে গেলে আগে ওই হাতির মত সেন্টিমেণ্টের পাহাড়টাকে ডিঙিয়ে সেই কাজটা করতে হবে। আর যদি যুক্তি আসে যে উনি বিদেশী হয়ে কেন নাক গলিয়েছেন? আমি মনে করিয়ে দিতে চাই, আমাদের রামমোহন, বিদ্যাসাগরও এই বিদেশীদের সাহায্য না পেলে কতটা নিজেদের লক্ষ্যে পৌঁছাতেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। 
        আসলে আমাদের এখানে পেরিয়ার আর আম্বদেকর ছাড়া এই বর্ণাশ্রম থেকে চিরকালের মত বেরোবার রাস্তা নিয়ে কেউ কথা বলেনি। কেউই না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তবে তা ঘনিষ্ঠ মহলেই। গান্ধী অস্পৃশ্যতা নিয়ে ভেবেছেন, কিন্তু এই প্রথার বিরুদ্ধে বলেননি। সর্বধর্ম সমন্বয়কারী রামকৃষ্ণও এক জায়গায় বলে বসছেন যে, শান্ডিল্য আর ভরদ্বাজ গোত্রের ব্রাহ্মণের হাজার দোষ থাকলেও পূজ্য। এরকম নানা ঘাঁটা কথা আমাদের মহাপুরুষেরা এত করে বলেছেন যে বলার নয়। স্বামীজিও এর খুব একটা বিপরীতে ছিলেন না, যদিও তার মধ্যে লক্ষ স্ববিরোধ। বাকি আর যারা অন্তত বাঙলার গুরুগণ কেউই এর বিপক্ষে ছিলেন বলে আমি পড়িনি। তাই বেদান্তের ‘সব সমান’ দর্শন আর মনুর বর্ণাশ্রম একসাথেই চলেছে। আমাদের দর্শনের এই কপটাচারকে আমরা ‘জটিল উদারতা’, ‘পরমার্থিক আর লৌকিক ব্যবহারের পার্থক্য’ ইত্যাদি নানা নাম দিয়ে এড়িয়ে গেছি। কিন্তু জীবাণুর যতই গালভরা নাম দিই না কেন, আদতে সে তো ক্ষতিকর জীবাণুই, তাই তাকে তথাকথিত সৎ কাজে, গোষ্ঠীস্বার্থের উদ্দেশ্যে যেভাবে লাগানো হয়েছে, তাকে একটা স্থায়ী আসন জনমানসে দেওয়া হয়েছে, সর্বপোরি তার যে একটা মোহ তৈরি হয়েছে, অভ্যাসের দাসত্ব তৈরি হয়েছে, তাকে উৎখাত করতে জানি না কতদিন আরো লাগবে।

343
Wed, 11/21/2018 - 11:08

        যে কোন ism বা -বাদ এর সুবিধা হল, সে একটা করিডোর ভিসন বা টানেল ভিসন দেয়। যেমন নারীবাদীর দৃষ্টিভঙ্গীর মজা হল সংসারে আশেপাশে যাই ঘটুক না কেন, তাকে অন্যান্য যে কোনো দৃষ্টিভঙ্গীতেই দেখা যাক না কেন, তার ব্যাখ্যা একটা নির্দিষ্ট দিকেই গড়াবে, একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গীতেই হবে। যা কিছু সামগ্রিকতাকে বাদ দিয়ে হয়, সে যতই মনোগ্রাহী, সুযুক্তিসম্পন্ন হোক না, তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না, কারণ তা একপেশে, অর্ধসত্য। তাই যে কোনো ইজম তথা বাদ-ই অর্ধসত্য। সে এক বিশেষ গোষ্ঠীর। তা যতটা না বিরোধের বিষয় হয়, তার তুলনায় খুব সামান্যই সে কোনো সামগ্রিক সুদূরপ্রসারী সমাধানের আলো দেখাতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুশকিল হল, সেই সামগ্রিক চেতনার বিকাশের কথাটা এতবার বলা হয়ে গেছে, তার পরিভাষাগুলো এত ক্লিশে হয়ে পড়েছে যে তার আবেদন আর মস্তিষ্কের কোষে পৌঁছায় না, যতক্ষণ আমরা শুধুমাত্র বুদ্ধিবিলাসী হয়ে থাকি। অর্থনীতিবিদ অশোক মিত্র একটা প্রবন্ধে এককালে কিছু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যুবকের গণ-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কথা বলতে গিয়ে একদম শেষে বলছেন, "বর্তমান প্রজন্ম বড়জোর বিস্ময় প্রকাশ করবে, এই সম্পন্ন ঘরের ছেলেগুলির কি মাথা খারাপ হয়েছিল যে মার্কিন এইচ-ওয়ান, এমনকি খোদ ও-ওয়ান ভিসার জন্য চেষ্টা না করে বাউন্ডুলে ভ্যাগাবন্ডদের দিকে নাম লেখাল"। 
        এই বুদ্ধিবিলাসীতার সাথে যে শব্দটার খুব ঘনিষ্ঠতা তা হল বৌদ্ধিক-অসততা, ইন্টেলেকচ্যুয়াল ডিজনেস্টি। তাকে নানা যুক্তি খাঁড়া করতে হয়, কারণ নিজেকে বোঝানোর চাইতে পাড়াকে বোঝানোর দায় অনেক। ইংরাজীতে যাকে স্মাগনেস বা চূড়ান্ত আত্মতুষ্টির অনুভব বলে কোনো কিছুর প্রাপ্তিতে বা সফলতায়, তা বেশিদিন থাকে না, তারপর নিজের অবস্থান বোঝানোর একটা দায় এসেই পড়ে, সেই দায় থেকেই তৈরি হয় এমন একটা বৌদ্ধিক অসততার দর্শন, নানা গালভরা প্রতিশব্দ, নানা পোস্টট্রুথের আমদানী ইত্যাদি ইত্যাদি। "যদিও আমি মাকু, তবু কেন আমার সন্তান মার্কিনী? আসুন বোঝাই"..."যদিও আমার মাতৃভাষা অন্তঃপ্রাণ, তবু কেন আমার সন্তান পরভাষায় শিক্ষাজগতে তার কচি পা রাখল? আসুন বোঝাই"... বোঝায় যত বোঝা বেড়েই চলে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়। একে বৌদ্ধিক অসততা বলছি। যার মূলেও সেই একটা ইজম এর প্রতি ছদ্ম-আনুগত্যের ভাব। 
        আচ্ছা, যদি এই ইজম সরিয়ে দেওয়া যায়, তবে কি আমাদের মুখোশগুলো খানিক আলগা হতে সুবিধা হয়? আমরা একটু বেশি করে নিজেদের অবস্থান নিয়ে জটিলতা মুক্ত হই? কেউ কেউ বলবেন তবে তো দেশে আদর্শ বলে কিছুই থাকবে না! মানলাম থাকবে না, কিন্তু কথাটা কি আরেকটু গভীরে ভেবে দেখা যায় না? আদর্শ বলে কিছু থাকবে না, না আদর্শের গরিমা বলে কিছু থাকবে না? দুটো এতই কাছাকাছি যে তাদের আলাদা করা শক্ত। 
        যে আদর্শের প্রতি আন্তরিক টানে আদর্শের কাছে আসে তাকে ভানের সাহায্য নিতে হয় না, কিন্তু যে আদর্শের গরিমার টানে আসে, সে গরিমা নিজের কাছে নিজের হোক কি পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে, তাকে নিয়েই যত গোল। সেই নিজেকে নিয়ে ধন্দে পড়ে। এদের এককালে আমাদের দর্শন বলতে চেয়েছিল - সংকর। অর্থাৎ মনে ভাব এক, কিন্তু চেষ্টাটা আরেক পথে। এদের সংখ্যাটাই সংসারে বেশি, তাই গোলোযোগের আওয়াজটায় আমরা এত অভ্যস্ত হয়ে পড়ি যে, যে মানুষটা নিঃশব্দে কাজ করছে, পরতে পরতে ব্যাখ্যা করছে না, তার মুখের দিকে তাকিয়ে সংশয় প্রকাশ করি, বলতে চাই, "ওহে তুমি খাঁটি তো? তুমি চেঁচাচ্ছ না কেন? তোমার কি আত্মবিশ্বাসের অভাব?” সে যখন সেই কথাগুলোতেও কোনো প্রতিবাদ জানায় না, তখন একপক্ষ তাকে বলে, দাম্ভিক, আরেকপক্ষ বলে, মূর্খ। 
        তাই বলছিলাম যে, যদি সব আদর্শগুলো সরিয়ে রাখা যায়, সব ইজমগুলো ভুলে থাকা যায়, তবে কিসের উপর মানুষ দাঁড়াতে পারে আবার? এইবার আমি আবার একটা বাজে প্রশ্ন করব। আমাদের চিন্তা মানুষকে দাঁড় করাতে না আমাদের চিন্তা মানুষকে নিয়ে জোট বাঁধতে? দল পাকাতে? শেষেরটাই অবধারিতভাবে বেশি সত্যি। মা চান ছেলেটা বাঁচুক, বাবা চান ছেলেটা দাঁড়াক। প্রথমটা জীবজ দাবি, প্রকৃতি এর সহায়। পরেরটা বুদ্ধিজ, মানুষের তৈরি সংজ্ঞা, তাই এক্ষেত্রে হতাশা, অবসাদ, ব্যর্থতা। কারণ দলভুক্ত করা গেল না। কিসের দলভুক্তি? না সফলদের তালিকায়। কাকে সফল বলে? কানে আঙুল দিন, এখনই একটা বোমা ফাটবে, আর সেই বোমা থেকে টুকরো টুকরো সফলতার সংজ্ঞা আপনাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলবে। 
        আমাদের শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি - এর একটা বড় উদ্দেশ্য দলগঠন, শ্রেণীগঠন। তার বাইপাস, মানুষ গঠন। যতক্ষণ না এই অভিমুখ বদলাচ্ছে, যতক্ষণ না একটা মানুষ স্বাধীন বৌদ্ধিক প্রাণনায় নিজেকে চিনছে, ততদিন এ স্বচ্ছতা আসা অসম্ভব। যেদিন সে সেই বিকাশের মাটিতে এসে দাঁড়াবে, সেদিন সে বুঝবে তাকে সহানুভূতিসমন্ন হতে হবে না, কারণ সহানুভূতি শব্দটা অহংকারি ড্রয়িংরুমজাত, সে আপনি সহমর্মি হয়ে উঠবে, কারণ সহমর্মিতা মায়ের হেঁসেলের শব্দ, যেখানে মেনু কার্ড পৌঁছানোর আগে সন্তানের খিদের বার্তা পৌঁছায়। সেদিন সে দলের সদস্য না, গোটা একটা মানুষ।

344
Mon, 11/19/2018 - 14:00

        মানুষের কতগুলো মৌলিক প্রবণতা আছে ব্যক্তিত্বের। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ, ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ, সত্য বা জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ, শুদ্ধতার প্রতি আকর্ষণ। খিদে, তেষ্টা, নিরাপত্তা, কাম, অহং-এর তৃপ্তি - এগুলোকে ধরছি না। এ সবার মধ্যেই থাকে, মাত্রার তারতম্যে। এরা প্রবণতা না, এরা চাহিদা।
        এদের মধ্যে আমার আলোচনার কেন্দ্র আজ – শুদ্ধতার প্রবণতা যাদের। শুদ্ধতার দুটো দিক আছে - কাল্পনিক আর বৈজ্ঞানিক। যে গঙ্গাজল বিনা শোধনে পানযোগ্য নয়, সেই গঙ্গাজল পবিত্র বলে পূজোর যোগ্য, এইখানে একটা কপটতা আছে। কারণ এই শুদ্ধতাটা কাল্পনিক। ধর্মীয় মানুষের ভাষায় - বিশ্বাসের। 'গণশত্রু'র চরণামৃত। সমস্যা হল এই শুদ্ধতার ভাবটা পরীক্ষণীয় নয় বলেই, একের সাথে অন্যের বিরোধ ঘটাতে এর জুড়ি নেই। আমার বাড়িতে যখন কেউ শুদ্ধ পানীয় চান, তখন আমার পানীয়জল শোধনকারী যে কোম্পানীর হোক সেই নিয়ে তিনি বিরোধ করেন না, কারণ তিনি জানেন যে সে জলের শুদ্ধতা পরীক্ষিত বলেই বাজারে সেই কোম্পানিটি ছাড়পত্র পেয়েছে। কিন্তু তার পূজ্য দেবতা বিনা শোধিত গঙ্গাজল পেতে আপত্তি করেন না - এ তার বিশ্বাস।
        সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ, ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ, সত্য বা জ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ যে শ্রেণির মানুষদের তাদের বাইরের প্রামান্যের উপর নির্ভর করতে হয় না। সে তার অন্তরের উপলব্ধি, নয়তো যুক্তি-বিচার-অভিজ্ঞতা সম্বলিত জ্ঞান। কিন্তু কাল্পনিক শুদ্ধতা সমাজ-প্রথা-শাস্ত্র-মহাপুরুষ বাণীনির্ভর। আমার পক্ষে শনিবারে আমিষাহার অশুদ্ধ - প্রমাণ শাস্ত্র। তোমার পক্ষে শনিবারে নিরামিষ আহার অপরাধ - প্রমাণ শাস্ত্র। কিন্তু কোন মানুষ এই প্রমাণগুলোর মুখাপেক্ষী? আমার মনে হয়, যে সব মানুষ বুদ্ধিগতভাবে স্বনির্ভর ও পরিণত হয়ে উঠতে পারে না, তারাই শুদ্ধতার দিকে ঝোঁকে বেশি। শরীরের মধ্যে ও মনের মধ্যে যে প্রবৃত্তিগুলোকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, নিজের স্বাভাবিক বুদ্ধি-বিবেক-বিচারের মাধ্যমে, বারবার নিজের কাছে নিজের হেরে যাওয়া তাদের মানসিক সত্তাকে যেভাবে দুর্বল করে তোলে তার থেকে বাঁচার জন্য সে একটা সমাজনির্মিত সমাজস্বীকৃত শুদ্ধতার সমর্থন চায়। সম্পূর্ণরূপে নির্ভুল নিখুঁত, অবশ্যই সেই কারণেই কৃত্রিম, অবাস্তব একটা জগতে নিজের অমরত্বের আস্পৃহা রাখে। গভীরের এই আত্মপ্রবঞ্চনা সে যে সজ্ঞানে করে তা নয়, আবার বিষয়টি যে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত তার কাছে তা-ও নয়।
        সেদিন একটা বাণী পড়লুম, রামকৃষ্ণদেবের, 'যিনি শুকরের মাংস খেয়ে ঈশ্বরের পাদপদ্মে মন রাখেন, তিনি ধন্য, কিন্তু যিনি হবিষ্যি খেয়ে কামিনী-কাঞ্চনে মন রাখেন তিনি ধিক্কৃত'। আমার মনে দুটো প্রশ্ন জাগল, প্রথম, এই ঈশ্বরটি কে? আজ শবরীমালায় যারা ঈশ্বরের কৌমার্য রাখতে নারীকে ব্রাত্য করছেন কিম্বা ঈশ্বরের রাজ্যে প্রবেশের জন্যে বোমা বাঁধছেন, কিম্বা ঈশ্বরের রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিযোগী ঈশ্বর খাড়া করছেন এরাও কি নয়? এর উত্তর কোনদিনও পাওয়া সম্ভব নয়, কারণ ঈশ্বর হয় রাজনীতির নয় অতীন্দ্রিয়, দুই-ই সাধারণের বোধের বাইরে। দ্বিতীয়ত, ঈশ্বরের পাদপদ্ম ও কামিনী-কাঞ্চন এই দুই-ই কি মানুষের মন রাখার একমাত্র স্বাভাবিক পরিসর? অভিজ্ঞতা তো তা বলে না। সংসারে মানুষের নানা প্রয়োজন, নানা কর্তব্য, লড়াই ইত্যাদিতে এই দুইটিরই অবকাশ কতটুকু? কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের ঈশ্বরমত্ত সমাজ মানবিক স্বাভাবিক গতিপথটিকে উপেক্ষা করে এই দুটোকেই চুড়ান্ত জ্ঞান করে সমাজটাকে বাধার নিয়ম বানিয়েছিল। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে চিতায় পুড়িয়ে শুদ্ধতার আদর্শে মোহগ্রস্থ করতে তাদের বাধেনি। একজন বিধবাকে একটি পশুর থেকেও অধম জীবন যাপন করাতে সেই শুদ্ধতার পরিভাষার ছলনায় তাদের বাধে নি। শুদ্ধতা নৈতিক জীবন যাপনে নয়, শুদ্ধতা অনুকম্পায় নয়, শুদ্ধতা এক এবং একমাত্র শাস্ত্রীয় অনুশাসনে। আজ যার চুড়ান্ত নিদর্শন শবরীমালা থেকে অযোধ্যা। 
        শুদ্ধতার প্রতি আকর্ষণের এই মোহ ভারতের মাটিতে বহু প্রাচীন। ব্রহ্মচর্য, বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ভারতের মূল আদর্শের একটি। যৌনতা এবং শুদ্ধতা - এদের মধ্যে সম্পর্কটা ভীষণ জটিল। যেন প্রবল আকর্ষণই প্রবল বিকর্ষণের ছদ্মবেশে। তাই এদের সহাবস্থান আজ যখন বিভিন্ন ধর্মের ক্ষেত্রে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে তাতে আর বিস্মিত হই না। যারা কথামৃত পড়েছেন, তারা জানেন, 'ঈশ্বর' শব্দটির পাশে পাশে যে শব্দটি মাত্রাতিরিক্ত উচ্চারিত হয়েছে তা 'কামিনী-কাঞ্চন'। রামকৃষ্ণের উপলব্ধি জনসাধারণ নেয় নি। কিন্তু বারবার উচ্চারণে তার বিকৃতিটি জনমানসে স্পষ্ট। কারণ যা ত্যাগ করতে হবে তা তার বোধের মধ্যে। কিন্তু যা পেতে হবে তা তার বোধের বাইরে। যা আছে তা পাপ, যা নেই তা শুদ্ধ --- এই দ্বন্দ্বে তার প্রতি মুহুর্তের বেঁচে থাকাটা দুর্বিষহ। কিন্তু কোন দুর্বিষহ অবস্থাকেই মানুষ চিরদিন সহ্য করে না। তাই কপটতায় অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। নিজের অভিজ্ঞতা, রুচি, অবস্থাকে আড়াল করে একটা মুখোশ, ভান, আচরণবিধি, যা সমাজস্বীকৃত আঁকড়ে ধরে নেয় --- 'সবাই সবাইকে আড়চোখে দেখে'। বেড়ালটা ঝুলি থেকে না বেরোলেই হল। ঝুলির মধ্যে 'মিউমিউ' ডাক গেরুয়ার রঙে কিম্বা কীর্তনের কোলাহলে চাপা দিলেই হল। এই কি শুদ্ধতা?
        ফ্রয়েড বলছেন, পাপের বোধ গভীর থাকলে শুদ্ধতার প্রতি আকর্ষণ গভীর হয়। রামকৃষ্ণ ও যীশু বলছেন, ঈশ্বরকে পেতে গেলে পাঁচ বছরের বালকের মত স্বভাব হতে হয়। কি সব্বোনেশে কথা! যে শরীরে সক্রিয় পিটুইটারী, সে শরীর পঞ্চম বর্ষীয় বালকের স্বভাব! তখন কাম কি খেলা? সংসার কি বিনোদন? দায়িত্ব কি বন্ধন? হতাশা কি বৈরাগ্য? নিজের চোখে কাপড় বাঁধা কি সরলতা? বুঝি না। এতবড় বিশ্ব এক বালকস্বভাব ঈশ্বর চালাচ্ছে বললে যুক্তির সঙ্গে যুক্তি মেলানোর দায় থেকে বাঁচা যায়। কিন্তু সে কি এস্‌কেপিজম নয়? জানি না। 
        সবশেষে একটাই কথা বলি, তাত্ত্বিক আলোচনা নয়, এই কাল্পনিক শুদ্ধতার মোহ থেকে বেরিয়ে আসার সময় বহুদিন হল হয়েছে। শান্তি, সাম্য ও সামঞ্জস্য একটি ব্যক্তি মানুষের, কি একটি সমাজের প্রধান লক্ষ্য আমরা বহুদিন বুঝেছি। এমনকি ওই ধর্মগ্রন্থগুলোতেও এর ইঙ্গিত আছে। কিন্তু এই শান্তি, সাম্য ও সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠার জন্য কি কোন কৌশলের প্রয়োজন? না। সচেতন, পরীক্ষাশীল, সপ্রশ্ন জীবনশৈলী ব্যতীত এর কোন পথ নেই। যে সত্যের অস্তিত্ব আছে, অথচ প্রয়োগ নেই সে ভয়ঙ্কর - শুদ্ধ গঙ্গাজলের মত।

345
Fri, 11/16/2018 - 21:30

        আজ দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে বিবেক দেবরায় মহাশয় খুব আক্ষেপ করে লিখেছেন যে কলকাতার প্রধান গ্রন্থাগারেও আধুনিক বইয়ের সংযোজনের হার খুব কম। এবং কি কি আইনে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধের মধ্যে পড়ে, তাও লিখেছেন। তা অতবড় মানুষটা যখন বলছেন, তখন অমন একটা আইন নিশ্চয় থাকবে। কিন্তু যে দেশে লাইব্রেরিতে সেই কালিদাসের পর আর কোনো বই সংযোজন হয়নি, সেই দেশের আইনি ব্যবস্থা কোন ধারায় হবে? 
        আমার ছোটোবেলাটা কাটে রেলকলোনীতে, কাঁচরাপাড়ায়। আমার অত্যন্ত সৌভাগ্য আমাদের কোয়াটার্সের থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে রেলের একটা দুর্দান্ত লাইব্রেরি ছিল। যিনি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন, বাবার বন্ধু, বাবার থেকে বয়সে বড়, আমি জেঠু বলে ডাকতাম, 'লাইব্রেরি জেঠু'। বেশ লম্বা চওড়া মানুষ। মাথায় টাক। লাইব্রেরিতে ঢুকলেই দেখতাম একটা টেবল ল্যাম্পের আলোয় কোনো একটা বই মনযোগ দিয়ে পড়ছেন, আমায় একবার আড়চোখে দেখে ক্যাটালগটগুলো বাড়িয়ে দিতেন। উফ্‌, সে কি উত্তেজনা। অপূর্ব হাতের লেখায়, লেখকের নাম, লাল কালিতে, তার নীচে সার দিয়ে বইয়ের নাম নীলকালিতে, পাশে বইয়ের সংখ্যা। সব গোটা গোটা অক্ষরে। কোনোটাই কাটাকুটি নেই, দুবার বুলানো নেই। এক একটা বইয়ের নাম পড়ি আর বুকটা ধড়াস ধড়াস করে, এক একটা না পড়া বই মানেই এক একটা দেশ আবিষ্কার করা। আমি ক্লাস এইট থেকে এই লাইব্রেরিতে যাতায়াত করছি নিয়মিত। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সৈয়দ মুস্তাফা, সমরেশ মজুমদার ইত্যাদির কিশোর গল্প, উপন্যাস থেকে বড়দের লেখায় আসতে শুরু করছি, সমরেশ বসু, নীহারবাবু, নরেন মিত্র, আশাপূর্ণা ইত্যাদিরা আসছেন। একটু একটু ইংরাজি পড়াও শুরু করেছি। অবশ্য তার জন্যে দায়ী বাবার আরেক বন্ধু শ্রদ্ধেয় অলোক স্যার। অসামান্য মানুষ। আমায় ইংরাজি পড়াতেন। একটু ওনার কথা বলে নিই।
        অলোক স্যার অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন, মেডিকাল কলেজ পড়ার সুযোগও পেলেন, কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার জন্য পড়া আর হল না। বাড়িতে অনেকগুলো ভাই। তিনি রেলে চাকরিতে ঢুকলেন। নিজের সেই অপূর্ণতা ভুলতে ডুবলেন সাহিত্যে। বিশেষ করে ইংরাজি সাহিত্যে। আমার ক্লাস এইট অবধি ইংরাজিতে দারুণ ভয়। কিন্তু কি করে কি করে সব ভয় কাটিয়ে দিলেন কাকু। বাজারে দোকানে, রাস্তায় যেখানে দেখা হত সেখানেই ভয়েস চেঞ্জ, ট্রান্সলেশান, সমার্থক শব্দ খোঁজা খেলা চলতে শুরু করল। আমাকেও পাগলের মত অনুবাদের নেশা পেয়ে বসল, যা পাই ভুলভাল অনুবাদ করে খাতা দিয়ে আসি। আজ ভাবি কি অত্যাচার সহ্য করতেন আমার জন্য। কিন্তু কোনোদিন বিরক্ত হতে দেখিনি। মানুষটার নিজের স্বপ্ন না পূরণ হতে পারার ক্ষোভ মিলিয়ে গেল ওনার সন্তানদের মধ্যে দিয়ে। প্রত্যেকে অন্যন্ত কৃতি নিজেদের পড়াশোনার জগতে ছিল। আজ জানি না তিনি কোথায় আছেন, তবে এটুকু জানি, আজ যে ভাষাটার জন্য বিশ্ব-সাহিত্যে পাঠকের আসনে বসতে পারি, সে সম্পূর্ণ ওনার জন্য। এ ঋণ শোধ হওয়ার নয়। 
        তো যেটা বলছিলাম, একটু একটু ইংরাজি পড়া শুরু হয়েছে, প্রথম ধাক্কা খেলাম মনে আছে ডেভিড কপারফিল্ড পড়ে। কেঁদেকেটে একশা। একবারের কথা মনে আছে, টুয়েলভে পড়ি, পেপার থেকে লোলিটার কথা শুনে পড়ার খুব ইচ্ছা। লাইব্রেরিতে গিয়ে যেই না বইটা হাতে নিয়েছি, পিছন থেকে গুরুগম্ভীর স্বর - উঁহু, এখন নয়। গম্ভীর মুখে তাকিয়ে আমার দিকে লাইব্রেরি জেঠু। উনি আমায় রাধাকৃষ্ণাণ হাতে দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। কল্পনা করুন, কোথায় লোলিতা পড়ার নিষিদ্ধ বাসনা, আর কোথায় শিক্ষার উপরে রাধাকৃষ্ণাণের ইংরাজিতে সংকলিত প্রবন্ধ সমগ্র। তাই পড়লাম। মূল কথা বুঝলাম, রাধাকৃষ্ণানের মতে চরিত্র গঠনই মূল কথা শিক্ষার। বুঝলাম, আমার মধ্যে দুশ্চরিত্র হওয়ার আশু সম্ভবনা দেখেই গোড়ায় কোপ মারতে চেয়েছিলেন। 
        ক্রমে স্কুল শেষে কলেজ, লাইব্রেরি যাওয়ার সময় কমছে। তবে ইতিমধ্যে উনি ওনার সেন্সর তুলে নিয়েছেন। আমারও স্বাদ ক্রমে ফিকশান থেকে কবিতা আর নন ফিকশানের দিকে যাচ্ছে। লাইব্রেরিটাও যেন আমার সাথে সাথে বড় হচ্ছে। আমার পরম আশ্রয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই গত বছর যখন মুরাকামির 'কাফকা অন দ্য শোর' পড়ছি, যেখানে মূল চরিত্র একটা লাইব্রেরিতে বসবাস করছে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে, আমার কল্পনায় শুধু আমার সেই কাঁচরাপাড়ার রেলের লাইব্রেরি বারবার এসেছে। মন খারাপ হয়েছে। কেন হয়েছে? সে কিন্তু শুধু নস্টালজিক হয়ে পড়া নয়। কারণটা বলি। 
        আমাদের কাঁচরাপাড়ার পাট চুকল। আমরা হালিশহরে বাড়ি করে এলাম। আমার মনে আছে, আমি যেদিন সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে এসে হালিশহরের নতুন বাড়িতে ঢুকলাম, আগেই সব ফেলে বিকালেই সাইকেল নিয়ে লাইব্রেরির কার্ড করাতে গেলাম। কিন্তু লাইব্রেরি দেখে মাথায় হাত। মনে হল যেন কালিদাসের পর বইয়ের সংযোজন হয়েছে কি? তবু কয়েক মাস পড়লাম। একজন বয়স্ক মানুষ থাকতেন লাইব্রেরিতে। তার সাথে সুন্দর বন্ধুত্ব হল। আজ সেই লাইব্রেরির সাথে আর সম্পর্ক নেই, কিন্তু সেই লাইব্রেরির নতুন জেঠুর সাথে আজও বন্ধুত্বটা অটুট। তারপর সরকারি লাইব্রেরিতে গেলাম, আগের লাইব্রেরি থেকে কিছুটা ভালো, তবু খুব আপডেটেড বলতে যা বোঝায় তা বিন্দুমাত্র নয়। সেখানে চাকরির জন্য পড়া চলে, খবরের কাগজ পড়া চলে।
        তবে বই পাই কই? শুরু হল মাঝে মাঝে কলেজস্ট্রীট যাওয়া। কিন্তু তাও বা সময় হয়ে ওঠে কই? তারপর সে অভাব পূরণ করল যখন অনলাইন শপিং শুরু হল। ক্রমে বইয়ের জন্য হাহাকার ঘুচল। তারপর শুরু হল মোবাইলে, কম্পিউটারে, ট্যাবে, কিণ্ডলে বই পড়ার চল। কিন্তু তবু সেই নিঃশব্দ অক্ষরগুলো, একছাদের তলায় সার দিয়ে কালের প্রবাহ পেরিয়ে আমার হাতের স্পর্শের অপেক্ষায়...আমি যাব...খুঁজে বার করব...সময়ের মধ্যে সময়কে হারিয়ে, নিজের ব্যক্তি আমির পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্যের আঙিনায় ঢুকে বসব, সে সুখ আর নেই। আজ সব কিছু বড় আমি-তুমির মধ্যে। লাইব্রেরি - যেমন সমুদ্রের তীরে এসে দাঁড়ানো, সেরকম অনুভূতি কই?

346
Thu, 11/15/2018 - 12:47

        ভারত একদিন বুঝেছিল, শাস্ত্র আর হোলিবুকের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। শাস্ত্র যা শাসন করে, যাকে শুধু শুদ্ধ, পবিত্র বলে মেনে চললেই হয় না, প্রয়োজনে তাকে প্রশ্ন করাও যেতে পারে। এই প্রশ্ন করা, ক্রিটিকালি দেখার প্রচেষ্টা নিয়ে ভারতের দর্শন এগিয়েছে বলেই, ভারতে ধর্মগ্রন্থ আর দর্শন গ্রন্থ কাছাকাছি এসে পড়েছে। যদিও পাশ্চাত্য মতে যা দর্শন তা ভারতে সে অর্থে নেই, এখানে অতীয়ন্দ্রিয়বাদ নির্ভরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নয় দর্শন। তবু একটা প্রশ্নের জায়গা প্রাচীন ভারতে ছিল। 
        এ কথাটা এই জন্যে বলা, বেশ কিছুদিন আর বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ, বহুবিবাহ সংক্রান্ত যুক্তিগুলো পড়তে পড়তে দেখছিলাম কিরকম ভাবে তিনি একটার পর একটা শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। কোনো পাশ্চাত্য দর্শনের উল্লেখ নেই সেখানে। ইদানীং দুদিন ধরে পড়লাম রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা কলমের ভাষ্য। ভাবতে অবাক লাগছে, "আপনি এরকম একটা বহু বছর ধরে চলে আসা প্রথার বিরুদ্ধে বলছেন কেন?” - এমন একটা বাক্যবন্ধ দিয়ে শুরু হচ্ছে সেই তর্ক। অর্থাৎ একটা মানুষকে জলজ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে, তার প্রতিবাদের অভিসন্ধি খুঁজতেও মানুষের বেগ পেতে হচ্ছে না। মানুষের অন্ধত্ব কোথাও পৌঁছালে এমনটা সম্ভব ভাবতে বাকরোধ অবস্থা হয়। 
        কলকাতায় এসে কেউ যদি মিউজিয়ামকেই গোটা কলকাতা জেনে বসে থাকে, কেউ যদি এস্প্ল্যানেডকেই শুধু কলকাতা জেনে বসে থাকে, তবে তাতে তার নিষ্ঠা, তার একাগ্রতা, তার ভক্তির প্রশংসা করার উপযুক্ত ক্ষেত্র মেলে বটে, কিন্তু তার সংকীর্ণতার কথাটা উহ্য থেকে যায়। তারপর একদিন মনুমেন্টের ভক্তের সাথে মিউজিয়ামের ভক্তের, এস্প্ল্যানেডের ভক্তের সাথে চিড়িয়াখানার ভক্তের বিরোধ বেধে যায়। কারণ সবাই জানে তাদের পূজ্য বস্তুটিই হল পুরো কলকাতা। এই পুরো কথাটা থেকেই যত গোল। এক মতে হোলি শব্দটা হোল অর্থাৎ সম্পূর্ণ শব্দটা থেকে জন্মেছে। আজ অবধি আদর্শগত যা কিছু বিরোধ, এই শব্দটা থেকেই তার সূত্রপাত। এ বলে এ সম্পূর্ণ, সে বলে সে। 
        জিবরান বলেন, কখনও বোলো না তুমি সত্যকে জেনেছ, বলো, তুমি একটা সত্যকে জেনেছ। জিবরান বলেন, তোমার খোলা জানলার আকাশের চাইতে আকাশ অনেক বড়ো, মনে রেখো। আমাদের এখানেও সে গোল শুরু হল তখন যখন শাস্ত্রের উল্লিখিত সত্যের চাইতে শাস্ত্রের অক্ষরমালা বড় হয়ে উঠল, চরিত্রের চাইতে মানুষটা বড় হয়ে উঠল। তখন পূজোতে শুধু অন্ধতার দাপট, অনুকরণের দাপট। অনুসন্ধিৎসা অন্তর্হিত। হৃদয়ের একটা বৌদ্ধিক অনুসন্ধিৎসা আছে। যার মিলিত ফল, বোধ। সে বোধের আলোয় জ্বলে বিবেক। মানুষের জাগ্রত চিত্ত কোনোদিন তৃপ্ত হতে পারে না। যদি সে তৃপ্ত হয়, সে মৃত। তুলসীদাসের কথায় আছে, ভরউ নিরন্তর হোয়ে না পুরে, সে কোনোদিন পরিপূর্ণ হয় না। সে তৃষ্ণার জোরেই মানুষের সমাজ, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন, রাজনীতি।
        বেদান্ত দর্শনে এই কথাগুলোর আভাস আছে। সেখানে একটা বড় সত্যের দিকে এগোবার কথা বলা আছে। সোশ্যালিস্টের সমাজ আর বেদান্তের ব্রহ্ম অবস্থান খুব একটা দূরত্বে নেই। আত্মা বলতে যে অতীয়ন্দ্রিয়তার দিকে ঝোঁক বোঝায় তাকেও নস্যাৎ করে বেদান্ত বলে অল্পে সুখ নেই, সমগ্রতে সুখ। অর্থাৎ তুমি কাউকে সমগ্র বলে থেমে থেকো না, নিজের মধ্যে সমগ্রের আসার জায়গা করে দাও, তুমি নিজে বড় হও। যীশুর ভাষায়, পিতার মত উদার হও। রামমোহনের খ্রীষ্টকে আবিষ্কার আর বেদান্তকে চেনা এই বড় ক্ষেত্রের উপর দাঁড়িয়ে। রবীন্দ্রনাথের উদার শিক্ষানীতি এই বেদান্তের উপর দাঁড়িয়ে। মানুষের মধ্যে যে একটা বড় আসন পাতা আছে, তার মধ্যে যে একজন বড় মানুষ আসার কথা আছে সে কথা লালনের মনের মানুষেও আভাস পেয়েছিল ভারত, রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন বাউলের গানে। কিন্তু মোদ্দা কথাটা সেই সঙ্কীর্ণতার ঊর্দ্ধে ওঠার চেষ্টা। যে তাগিদটা তার মধ্যে আছেই। 
        আজ আবার সে কথা ভোলার চেষ্টা হয়েছে। আধুনিক যুগের সবচাইতে বড় বেদান্তের ভাষ্যকার বিবেকান্দের উদার বেদান্ত দর্শন রামকৃষ্ণের অবতারবরিষ্ঠায় মন্ত্রে আবার নতুন করে সঙ্কীর্ণতা তৈরি করে দলাদলির সূত্রপাত করে বসেছে। ভারতে একের পর এক গুরু, একের পর এক সম্প্রদায় আবার সেই 'আলোকে ভরা উদার ত্রিভুবন' এর উপর ঢাকনা দিচ্ছে। কথাটা আস্তিকতা বা নাস্তিকতা না, কথাটা সঙ্কীর্ণতার। কোনো মানুষই তার বিশ্বাসের গুণে বড় হয়নি, হয়েছে সেই বিশ্বাসের উদার প্রয়োগের মাহাত্ম্যে। সে ইডা স্কাডারের ভেলোর হাস্পাতাল প্রতিষ্ঠাই হোক, গান্ধীর রামই হোক, আর রবীন্দ্রনাথের ঔপনিষদক ব্রহ্মই হোন, - এরা কেউ সংকীর্ণ নয়, এই হল মূল কথা। আজ শবরীমালা থেকে প্রস্তরমূর্তি, নামকরণ সবই বিশ্বাস করাতে চাইছে ছোটো, স্পষ্ট কথাটাই শেষ কথা, কিন্তু তা নয়। এ যুগের এক প্রধান দার্শনিক রামকৃষ্ণের অনুভবে, গেড়িগুগলি ডোবাতেই বাসা বাধে। 'সাগরে যার বিছানা মা, শিশিরে তার কি করিবে'। ঢাকনাটা সরাতেই হবে।

347
Mon, 11/12/2018 - 21:30

        মানুষ বাণীতে বাঁচে। অতীতে বাঁচে। আক্ষেপে বাঁচে। ক্ষোভে বাঁচে। ঈর্ষায় বাঁচে। প্রতিযোগিতায় বাঁচে। ছলনায় বাঁচে। ক্রোধে বাঁচে। বিষণ্ণতায় বাঁচে। অপমানে বাঁচে। অহঙ্কারে বাঁচে। হীনমন্যতায় বাঁচে। রোগে বাঁচে। অভাবে বাঁচে। প্রাচুর্যে বাঁচে। মধ্যবিত্ততায় বাঁচে। অলসতায় বাঁচে। উদ্যমে বাঁচে। ভয়ে বাঁচে। সাহসে বাঁচে। দুশ্চিন্তায় বাঁচে। উদাসীনতায় বাঁচে। আনন্দে বাঁচে। যৌনতায় বাঁচে। ঈশ্বরকে জড়িয়ে বাঁচে। ঈশ্বরকে হারিয়ে বাঁচে। হাসতে হাসতে বাঁচে। কাঁদতে কাঁদতে বাঁচে। আশায় বাঁচে। আকাঙ্ক্ষায় বাঁচে। কথায় বাঁচে। জেগে বাঁচে। ঘুমিয়ে বাঁচে। 
        ক্ষণে বাঁচে? মানে বিস্মৃতিতে বাঁচা, স্মৃতিতে বাঁচা - সে কথা না। এই ক্ষণে বাঁচে? এই মূহুর্তে বাঁচে? কোনো ধ্যান না। কোনো আশা না। কোনো ভয় না। অতীত না। ভবিষ্যত না। রাগ না, অভিমান না, আনন্দ না, উচ্ছ্বাস না। প্রদীপের শিখার মত এই ক্ষণটিতে মনের মধ্য থেকে যে আলো আসছে, সে যতটুকু আলোই হোক না, সেই আলোতে শুধু এইক্ষণটুকুতে বাঁচে? অতীতের জানলা আর ভবিষ্যতের দরজাটা খানিক ভুলে এই সময়টুকুতে উপচে পড়ে বাঁচে? বাঁচা যায় কি?
        মন তা হতে দেয় না। হয় অতীতে না হয় ভবিষ্যতের কল্পনায় ঠেলে নিয়ে যায়। তার একটা কারণ কি মন নিজের অস্তিত্ব সংকটে ভোগে? অতীত আর ভবিষ্যতের ধারক, রক্ষক, জন্মদাত্রী তো সে নিজেই, তাই এই দুইকে উপেক্ষা করলে কি সে মুষড়ে পড়ে? বলে, আমি তবে কি করব? আমি তবে কোথায় যাই? এসো তোমায় স্মৃতির সেঁক দিই, নইলে ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন পালকে সুড়সুড়ি দিই। আর মেজাজ যদি বিগড়ে থাকে তবে অতীতের কয়েকটা কাঁটা তুলে দিই, নইলে ভবিষ্যতের কিছু স্বার্থসিদ্ধির পরিকল্পনা ছকে দিই - কি বলো? রাজি? মনের বাতাসে চিত্তশিখা টলমল। তবে ক্ষণে বাঁচা কি যায় না? 
        যায়। কিন্তু আমি যে তুলনা প্রিয়। আমার মধ্যে কি সব সময় তুলনাখেলা চলে না? আমার বন্ধুর পোশাক থেকে ফেসবুক লাইক সংখ্যা, ট্রাম্পের গাড়ি থেকে হাঁদুদাদুর অ্যাম্বাসাডার - সবই কি আমার তুলনার বস্তু না? সব তুলনাতেই মানুষ অসুখী। তবু তুলনা করতেই হয়, কারণ তুলনার মধ্য একটা লটারির আনন্দ। অ্যাড্রেনালিন সুখ। তোমার পাওয়া, না পাওয়ার সাথে আমার পাওয়া না পাওয়ার। এই তুলনা দুই ধরণের হতে পারে, কি ধরণের হবে তা নির্ভর করে মানুষটার ধাত কেমন। 
যদি একটু দুঃখ বিলাসী হয়, তবে সে নিজের না পাওয়ার তালিকা বানিয়ে ফুটপাথ থেকে রাজগৃহ সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে কার সাথে কোথায় সে কতটা পিছিয়ে। যত সে পিছানোর দূরত্ব বাড়বে তত সে দুঃখ, হতাশায় ডুববে আর তত একটা মোহগ্রস্থ হওয়া আনন্দ তাকে চেপে ধরবে। কেন? কারণ মানুষের গভীরে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার একটা আদিম তাগিদ। কিছু একটা তো চাই, তাই আর কিছু না পেলে নিজের অপূর্ণতার লিস্টি বানিয়ে নেকু কান্না কেঁদে, ফেসবুক থেকে বন্ধুদের কানের পোকা অবধি সানাই বাজিয়েই চলবে, বাজিয়েই চলবে। 
        যদি অহং বিলাসী হয়, তবে সে নিজের পাওয়াগুলোকে অতি পাওয়া করে নিজের মধ্যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করবে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভয়ও পাবে, কোনদিন যায় খসে। আবার পাশাপাশি ঈর্ষা আর অভিমানের গুঁতোও চলবে। তুল্যমূল্য বিচারের দাঁড়া কোনদিকে কতটা ঘোরে তার উপর সে মনের গতি নির্ভর করছে। মন বুঝে কথা না বললে, সায় না দিয়ে চললে শ্রোতার কপালে অশেষ দুঃখ। সে যা বলবে তার উল্টো মানে বুঝে নিতে হবে। শ্লাঘা সোজাসুজি কথা বলতে চায় না। যদি বলে লাল, তবে বুঝো নীল। 
        তবে কি মানুষ ক্ষণে বাঁচা অভ্যেস করতে পারে? না, পারে না। এ মেলা শক্ত ব্যাপার। তুলনাহীন মন যদি হতে পারে সে ক্ষণে বাঁচে। তুলনাহীন মন সুরের পিয়াসী। তার কথার চাইতে সুর আসে বেশি। সুরের কোনো তুলনা নেই। সুরের কোনো বক্তব্য নেই। সুরের কোনো অবয়ব নেই। সুরের কোনো চাহিদা নেই। তাই যে সুরের তৃষ্ণায় মজেছে, তারই তুলনার পেণ্ডুলাম থেমেছে, সেই ক্ষণে বেঁচেছে, সুরে বেঁচেছে। যতটা বাঁচা যায় ততটায় মঙ্গল। "সুরহারা প্রাণ বিষম বাধা, সেই তো আঁধি, সেই তো ধাঁধা/ গান-ভোলা তুই গান ফিরে নে, যাক সে আপদ ছুটে।"

348
Wed, 10/24/2018 - 11:00

        এই তো শ্রদ্ধা ছিল। গেল কোথায়? এই তো ভক্তি ছিল। গেল কোথায়? একটা পাখি সকাল থেকে ডাকছে, তোর নাম কি? থাক, নাম জেনেই বা কি হবে! কটা নামই আর মনে থাকল সারা জীবন? এখন শান্ত মনটা। জোয়ার-ভাটা পেরিয়ে গেছে। বড় বড় বজরা বুকের উপর ঢেউ তুলে হারিয়ে গেছে। এখন সব শান্ত। শ্রদ্ধা নেই। ভক্তি নেই। বিশ্বাস নেই। শুধু একটা শান্তি আছে। 
        লক্ষ্মী মানে শ্রী। জানতে? ভুলে গিয়েছিলে? হুম। জানি, কিছু কিছু শব্দের মানে বদলে যায়। সব কিছু বদলে যায়। আজ কাগজে দেখলুম সাদা পায়াজাম পাঞ্জাবী পরা সেই বিখ্যাত কবি ভাসানের উৎসবে রাজাসনের পাশে বসে। তিনি রাজসভা কবি। সেদিন পড়লাম একজন বিখ্যাত লেখিকা বলছেন, দিনে যে কুড়ি হাজার শব্দ লিখতে পারে না, সেকি লেখক? - দৌড়াতে গেলে লম্বা পথে, জিভ বেরিয়ে যাবে হটে। 
        এই কথাগুলো শ্রী নয়, এই দৃশ্যগুলোও নয়। এদের ব্যাখ্যা আছে, সত্য নেই। তবু এই কথাগুলো, এই দৃশ্যগুলোর মধ্যে একটা ইঙ্গিত আছে। সে ইঙ্গিত বলে, আমাদের লক্ষ্মী নেই, পদ্ম নেই, ধান নেই, আলপনা নেই। এদের অবয়বগুলো আছে, আত্মাটা আর নেই। 
        পাখিটা ডাকছে এখনও। কাকে ডাকছে? নাকি কাঁদছে? নাকি প্রতিবাদ জানাচ্ছে? জানি না। আমার বইয়ের আলমারির সাদা পাঞ্জাবীর ‘কবিতাসংগ্রহ’- রা হাই তুলছে, আমি রাজাসন কোথায় পাই? জানলার বাইরে একখণ্ড নীল আকাশ, ওটা প্রতিশ্রুতি, জানলা আর আকাশের সংসার। জানলায় জাল পড়ে, কপাট পড়ে, আকাশে সাদামেঘ, কালোমেঘ, সূর্য, তারা যাতায়াত করে, তবু অবশেষে একটা প্রতিশ্রুতি থেকে যায়। সে প্রতিশ্রুতি বদলায় না। প্রতিশ্রুতি মনে রাখা মানুষটা বদলে যায়। হাই তুলতে তুলতে পাশ ফিরে শোয়, আকাশটাকে, জানলাটাকে পিছনে রেখে। সে বলে, ভক্তি শ্রদ্ধাকে স্বতন্ত্র হতে দিতে নেই। আগুন জ্বলে। ধোঁয়া হয়। লোকসান হয়। লোকসান হলে কবিতার শব্দরা বিচ্ছিন্ন হয়ে সুষমা হারায়। স্বরযন্ত্রে গানই না, চীৎকারও ওঠে। দাবিয়ে রাখতে হয়, স্লোগান তুলতে সেই জোরকে কাজে লাগাতে হয়। 
        তুমি বলবে তোমার লেখা আমি বুঝলাম না। আমি বলি, আমি তোমার জন্য লিখি না, নিজেকে সুস্থ রাখতে লিখি। আমি সারা পৃথিবী পেরিয়ে যাব বলে হাঁটি না, সুস্থ থাকতে হাঁটি। কোনো মানুষকে আদ্যপ্রান্ত শুষে খাব বলে ভালোবাসি না, সুস্থ থাকব বলে সঙ্গ প্রত্যাশা করি। তুমি সরে দাঁড়াও সাদা পাঞ্জাবি, আমার লাগছে। আমার ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাস নেই। আমার শান্তি আছে। 
        এখন আমি দাঁড়িয়ে গঙ্গাতীরে। লক্ষ্মী মাটির মূর্তি হতে শুরু করেছে যখন থেকে তখন থেকে একটা জাহাজের প্রত্যাশা নিয়ে এই গঙ্গাতীরে এসে দাঁড়াই। একটার পর একটা প্রমোদতরী ভেসে ভেসে যায়। ডাকে, কিন্তু সাড়া দিই না। বলি আমার ভক্তি নেই, শ্রদ্ধা নেই, বিশ্বাস নেই, শান্তি আছে, তোমরা চলে যাও। 
        আমি সমুদ্রের ধারে যেতেই পারি। হেঁটে হেঁটে খালি পায়ে পৌঁছিয়ে যেতেই পারি সমুদ্রের ধারে। কিন্তু এখনই পায়ে বালি মাখতে চাই না, কিছুক্ষণ আরও মাটি লাগুক। তারপর বালিতে মিশে গেলেই হবে। বালির কোনো ধর্ম নেই, প্রত্যাশা নেই, নিজস্বতা নেই। সূর্য তাতালে তাতে, আবার রাত শীতল করলে শীতল হয়। এমন নির্লজ্জ না হলে এতবড় সমুদ্রের ধারে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখে কি করে? মিশে যেত না সেই কবে? আমি এখনই যাব না সেখানে।

349
Sat, 10/06/2018 - 23:39


        বোষ্টুমি (এ বানান অভিধানে নেই, জিভেতে আছে) এসে দাঁড়ালো দরজায়, নামগান শুনতে পাচ্ছি। বোষ্টুমির গায়ে গেরুয়া শাড়ি। কপালে চন্দন। কালো মুখের মধ্যে খোদা দুটো পোড় খাওয়া চোখ। 

        বাগানে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইবে। রাধা-কৃষ্ণের নামে ভিক্ষা চাইবে। তাকে টাকা দিতে বিরক্ত হব, মনে হবে অপচয়, মনে হবে এমন সুস্থ সবল শরীর, ঠকাও কেন? তবু দেব, কারণ বচসা করতে ভালো লাগবে না। পূজোর মাস, হাতে দুটাকা নিয়ে ভাবছি, বোষ্টুমি চাইবে শাড়ি, দেব না। কেন ঠকাবে? দিলাম পয়সা হাতে, সে মাথায় ঠেকিয়ে বলল, "আসি ভাই!” কি সুরে বললে এ কথা! 
        সুরের মধ্যে ব্যথা। উদাস ব্যথা। খোঁচ লাগল, ফিরে তাকালাম চোখের দিকে। সজল চোখ, যেন সদ্য একটানা বৃষ্টির পর পাতায় পাতায় বিন্দু বিন্দু জল। জিজ্ঞাসা করলাম না, কি হয়েছে তোমার? জিজ্ঞাসা করতেই পারতাম, কিন্তু সংসারে কিছু ব্যথা আছে, যাকে ভাষা দিতে গেলে মনটা বিষিয়ে ওঠে। সে ব্যথাকে ধীরে ধীরে সইয়ে নিতে হয়, মানিয়ে নিতে হয়, মিশিয়ে নিতে হয়। বোষ্টুমির চোখে সেই ব্যথা। বোষ্টুমি বুঝল, আমি বুঝলাম। মানুষের চোখে উপর পর্দা, সে পর্দা আরেক চোখের চাহনিতে উড়ে যায়, বোষ্টুমি আবার বলল, আসি ভাই। 
        বোষ্টুমি ফিরে গেল। সাথে গেল আমার দু’টাকা। ভিক্ষা বলি যাকে। কিন্তু বোষ্টুমি আমাকেও একমুঠো ভিক্ষা দিয়ে গেল। আমার কিছু ব্যথার নীরব ভাষা। ওর চাহনিতে। সে চাহনি আর সে কন্ঠস্বর আমার ঘরের কোনায় কোনায় আমার সাথে লেগে রইল খানিক। মানুষ ভাষায় বলে না, সুরে বলে। মানুষ সুরে বাঁচে, সেই রবি বাউল বলে গেল না, কথাটা মানুষের প্রয়োজনের, আর সুরটা অপ্রয়োজনের। নিজের মধ্যে যে আমিটাকে কারোর প্রয়োজন নেই, অথচ যাকে হেলা করলে নিজের কাছেও নিজের প্রয়োজনটা ফুরাতে শুরু করে সে এসে আমার সামনে বসল। এমন আগেও হয়েছে। 
        চলন্ত ট্রেন। গিজগিজ করছে মানুষের দরকারি কথাবার্তা, ঠাট্টা-ইয়ার্কি। হঠাৎ কোনো বাউলের একতারায়, অমধুর কন্ঠস্বরে বাজল এমন একটা সুর যা সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে গেল, সব কোলাহল ছাপিয়ে বাইরের সরে সরে যাওয়া গাছ, মাটি, বাড়িঘরগুলো এমন স্পষ্ট হয়ে উঠল, মনে হল এই তো আমি আছি, মাটির টানেই আছি। সে ভিখারি আমায় ভিক্ষা দিয়ে গেল। সে বলে গেল, ফেরো... ফেরো... ফেরো...
        কোথায় ফিরব? জানি না। কোনো দর্শন না। কোনো উদ্দেশ্য না। কোনো উচ্চ আদর্শ না। কারোর কাছেও না। সে ফেরার খবর আছে বাউলের কাছে। সে ফেরার খবর আছে ভিক্ষার ঝুলির কাছে। সে ফেরার খবর আছে আগুনের কাছে, জলের কাছে, আকাশের কাছে, মাটির কাছে। সব অপ্রয়োজনের কাছে। 
        কাজ, দায়িত্ব, চালাকি, ফাঁকি এরা সব একের সাথে একে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে। কাউকে ছেড়ে কারোর থাকার যো নেই, যদি না সে মানুষটা মাঝে মাঝে ফিরতে পারে। সব কাজের ভাষা ভুলে, সুরের ভাষায় ডুবতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেন - যে নোবেল পেয়েছে, যার বিশ্বজোড়া খ্যাতি, যে ইংরাজিতে কথা বলতে পারে, সে স্যার রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু যে লেখে সে নিতান্তই রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির একটা বড় ফেরা তার রবীন্দ্রনাথের কাছে ফেরা। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র সে, যে তাকে না বুঝিয়েও বোঝাতে পারে। যে তাকে তার ফেরার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। 
        তাই ভিক্ষা চাই। একমাত্র ভিক্ষাতেই সে ফেরার টান। উপার্জনে না। উপার্জন খুব বড় জিনিস, কিন্তু পরম জিনিস নয়। কাজের মানুষ, আত্মাভিমানী মানুষ আমায় বকা দেবে, বলবে, কি অলুক্ষুণে কথা বাপু তোমার! তাকে প্রণাম জানিয়েই বলি, দাদা আমি সে অকর্মণ্যের ভিক্ষার কথা বলছি নে, আমি বলছি সে ভিক্ষার কথা, যে ভিক্ষা সব কাজ হারালে আসে না, যে কাজি হারালে আসে। যে কাজ করবে সেই আর নাই, তার আর কাজ কই বলো। তুমি বলবে একি হেঁয়ালি কথা বাপু তোমার। আমি বলব, দাদা আজ বরং থাক, যেদিন তোমার পোশাকে লাগবে আশ্বিনের ঝড় সেদিন না হয় তুমি বুঝো। আজ সে তর্ক থাক। 
        আমার পরম বিপদ তাই সেইদিন যেদিন আমার ভিক্ষাপাত্র যায় চুরি। চুরি করে আমার অভিমান, আমার উপার্জনের অভিমান। সেদিন নিজেকে একটা মস্ত মানুষ বলে বোধ হতে শুরু করে, মনে হয় আমায় ছাড়া এই জগত সংসার চলবে কি করে? আমায় একটা মস্ত কাজ করতে হবে, আমি যে ধরাধামে এসেছি সে কথাটা যো সো করে সবাইকে বোঝাতেই হবে। যত বেশি এ চিন্তা চাপে, তত অহং মদ ওঠে গেঁজিয়ে, বুদ্ধি হয়ে ওঠে বল্গাহীন। উপনিষদের ঋষি বলে ওঠেন, "তোমার রথ চলেছে ঊর্দ্দ্বশ্বাসে, সে রথের সারথি কই? তোমার বিবেক কই?” কিন্তু সে কথা শোনার আমার সময় কই তখন? রথের ঘড়ঘড় আওয়াজ যত ওঠে, আমার অহং তত ওঠে নেচে, রথের চাকার ধুলো যত ওড়ে আমার অহং তত বলে ওঠে এই... এই... এই তো চাই...
        এমন সময় বোষ্টুমি এসে দাঁড়ায় দরজায়, হাতে তার ভিক্ষাপাত্র। মনের ভিতর প্রাচীন ভিখারি ওঠে কেঁদে। অপুষ্ট, চীরবাস নিয়ে সে আমার সামনে এসে দাঁড়ায়, বলে আমায় মুক্তি দাও... আমি ভিক্ষায় যাই.... তোমার চিত্ত গিয়েছে অভিমানের বিষাক্তবাষ্পে ভরে... তুমি ভুলেছ তোমার ভিক্ষাপাত্রের কথা... তুমি ভুলেছ এ সংসারে আমরা সবাই ভিখারি... পরম যা কিছু পাই তা ভিক্ষা হিসাবেই পাই... এ ভুললে পরম বিপদ......

350
Wed, 10/03/2018 - 11:30

        দর্শন শুষ্ক, অনেকে বলেন। যদিও আমার কাছে আজ অবধি তা মনে হয়নি কখনও। নিজেকে জানার, নিজের বাইরে ভিতরে আসা যাওয়া করার এর থেকে ভালো পথ আর দেখি না। প্রতিটা অনুভবের একটা ছায়া থাকে। সে ছায়ার থেকে সরে দাঁড়িয়ে যদি কিছুক্ষণ নিবিষ্ট চিত্তে সেই ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকা যায়, তবে মনে হয় সেই ছায়াটার মধ্যে নিজের একটা আলগা পরিচয় পাওয়া যায়। পরিচয়টা আলগাই অবশ্য। এরকম কোনো একটা ছায়া নিয়ে একটা কবিতা জন্মায়। কখনও সেই ছায়ারা একটা বিরাট সাম্রাজ্য তৈরি করে একটা উপন্যাস বানায়। কয়েকটা ছায়া জুড়ে জুড়ে গল্প বানায়। যাই বানাক, আদতে সে সেই ছায়া। সেই ছায়ার পর্যবেক্ষণকারী যে, তারও একটা ছায়া সেই পর্যবেক্ষণের মুহূর্তে তৈরি হয়, কিন্তু সেটা সেই সময়ের জন্য থেকে যায় তার অগোচরে। সেটাকে বাস্তবে আনা সেই মুহূর্তে তার কোনোদিনই সম্ভব নয়। সেইখানেই তার নিজের অস্তিত্বের রহস্য। 
        মানুষ যেন দুটো প্রকাণ্ড পাঁচিলের মধ্যে একটা সরু পথ দিয়ে চলেছে, তার আগুপিছু অন্ধকার। সে একটু ডানদিক বাঁদিক সরতে গেলেই তার পাঁচিলের সাথে ধাক্কা, সামনের দিকে তাকে এগোতেই হচ্ছে, কিন্তু সেই এগোনোর কোনো দিশা সে যেন পাচ্ছে না, কারণ ঘুটঘুটে অন্ধকার। তখন তার মধ্যে একটাই উপায় - বিশ্বাস। যার উপচ্ছায়া তার কল্পনা। 
        মানুষ বিশ্বাস ছাড়া কল্পনা করতে পারে না। প্রতিটা কল্পনাই জন্মায় কোনো না কোনো বিশ্বাস থেকেই। এই বিশ্বাস আর কল্পনা না থাকলে, মানুষের এই সরু অন্ধকার গলিটায় চলাফেরা করাটা কিছুতেই হয়ে উঠতে পারে না। সেই কল্পনাকেই সে নিজের প্রেরণা বলে, পরিচয় বলে। যদিও কোনো বিশ্বাসই তার কাছে চিরস্থায়ী নয়, তবু একটা না একটা বিশ্বাস সে বানিয়েই চলতে থাকে। 'আমি কোনো কিছুতেই বিশ্বাস করি না' যখন কেউ বলে - সেও এক ধরণের বিশ্বাস থেকেই বলে। তার নাম সিনিজিম, নিহিলিজম ইত্যাদি যাই দিই না কেন, সবই আদতে বিশ্বাস। 
        বিশ্বাস আর জানা - এদের মধ্যে একটা প্রকৃতিগত মিল থাকেই। যে মানুষটা যে ধরণের বিশ্বাসী সে সেই ধরণের কিছুই জানতে চায়। জানা আর বিশ্বাসের মধ্যে যখন বিরোধীতা হয়ে থাকে, তখন সে বিশ্বাসটাকে বদলে নেয় তার সেই জানার অনুরূপ করে। যেমন আমি দিল্লী যাওয়ার আগে একটা বিশ্বাস নিয়ে পৌঁছালাম, তারপর সেখানে গিয়ে আমার জানাটা যেই আমার বিশ্বাসের সাথে বিরোধীতায় গেলো, আমি অমনি তখন আমার বিশ্বাসের ধারাটা বদলে নিলাম। আবার আমার কল্পনার ধারা বদলে গেল। তা যে সব সময় সুখকর হয়ে উঠবে তা তো নয়, সে খুব একটা উৎকণ্ঠাজনকও হয়ে উঠতে পারে। আর যারা সে বিশ্বাসটাকে বদলাতে চাইল না তারা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়ে নিজেকে আরো বেশি অস্পষ্ট করে নিজের সুস্থ থাকার ক্ষমতাটাকে দুর্বল করে তুলল। 
        এইখানেই আমাদের আজকের দিনের সমস্যা। আমাদের পূর্বপুরুষদের একটা বিশ্বাস ছিল, একটা জীবনশৈলী ছিল, যা অনেকটা একটা ঐতিহ্য আর বিশ্বাসের প্রতি তার আনুগত্য রেখে চলত। কিন্তু আমাদের জানাটার বেগ এখন এতবেশি যে আমাদের বিশ্বাস ঠিক তার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে বদলে নিতে পেরে উঠছে না। আমরা একটা তত্ত্ব পড়ি উদ্ভিদবিদ্যায়। কোনো কোনো গাছের উপরিতলে একটা মোমের আস্তরণ থাকে, যা জড়। এখন হয় কি, উদ্ভিদের উপরিতলের সজীব কোষগুচ্ছেরা এত তাড়াতাড়ি বেড়ে ওঠে যে সেই মোমের আবরণ তার সাথে তাল রাখতে না পেরে যায় ফেটে ফেটে। আমাদের বিশ্বাসের হয়েছে আজ সেই দৈন্যদশা। সে কি করবে, কোন দিকে ফিরবে, কোন দিকে তার নিশ্চিন্ততা সে যেন কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না। তাই যা পাচ্ছে তাকেই বলে উঠছে, আরে এটাই আমাদের দেশের আদর্শ ছিল, এটাই ভারতীয় সংস্কৃতি, এটাই আমাদের ঐতিহ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব বলতে বলতে যত তার নিজের মধ্যে নিজের দুর্বলতাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে সে তত জোরে চীৎকার করে সেই দুর্বলতার মাথায় বাড়ি মেরে বলতে চাইছে, আমি এটাই... আমি এটাই... আমি এটাই... 
        এই সমস্যা একটা কালের কালের সমস্যা। একজন মানুষ যেমন ব্যক্তিগত, তেমনই সে একটা সময়গতও। একটা সভ্যতাও তাই। এখন এই অস্পষ্টতার মধ্যে সে নিজের বিশ্বাসের পিঁড়িটা খুঁজে বেড়াচ্ছে যে একটু হাত পা ছড়িয়ে বসবে। কিন্তু সে পিঁড়ি আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে রেগেমেগে একবার মাটিতে বসছে, একবার গাছের ডালে বসছে, একবার নদীর ঢেউয়ে চড়ে বসতে চাইছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু একটা হয়ে উঠছে না। 
        তবু বিশ্বাসটাকে খুঁজে পাওয়া দরকার। এ বিশ্বাস কেউ কাউকে খুঁজে দেয় না, নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়, কিন্তু এই বিশ্বাসটাকে খুঁজে নিতেই হয়। কিন্তু এর একটা কিন্তুও আছে। যা জানি সেই কি পরম?
        না। যা প্রাথমিকভাবে জানি, তা আপাত। তাকে আরো গভীরে গিয়ে জানতে হলে আমাকে সেই ছায়াদের সামনে দাঁড়াতে হবে, যতটা নিরপেক্ষ হয়ে দাঁড়ানো যায়। সেই ছায়াদের পর্যবেক্ষণ করতে করতে একটা বোধ জন্মায়। সেই বোধটাকে দিনের আলোয় নিয়ে এসে, অনেকের সামনে রেখে পরীক্ষা করে দেখতে হয় সেই বোধের বাস্তবতা কতটা। সেই থেকে শুরু হয় একটা নতুন কৃষ্টির। সে কৃষ্টি সচল, জীবন্ত। সে জানার পাশে এসে বসে। জানার অপূর্ণতা পূরণ করে নতুন সজাগ কল্পনায়। তাতে ঘোর তৈরি হয় না, তাতে সময়ের সাথে আবার একটা নতুন সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাকেই আমরা বলি নবজাগরণ। নতুন বিশ্বাস।

351
Tue, 10/02/2018 - 10:16

        “Gandhi was inevitable. If humanity is to progress, Gandhi is inescapable... we may ignore him at our own risk” ~ Dr Martin Luther King Jr.
        কোন বই আমার জীবনের ধারা সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে যদি ভাবি, সেটা অবশ্যই মহাত্মাজীর 'আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ'।
        তখন আমি ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। অনেক কিছুই পড়া হয়ে গেছে। কিন্তু কোথাও একটা ফাঁক থেকে যাচ্ছে। যে জীবনটা খুঁজছি, তার আভাস তো পাচ্ছি, কিন্তু তাকে ধরতে পাচ্ছি না। এমন সময় একটা দূর্গাপূজোর আগে, আমার এক বন্ধুর বাড়ি গেছি। তার বাড়িতে তাদের বইয়ের আলমারিতে পেলাম বইটা। কিরকম একটা কৌতুহল জাগল। আবার একটা কুন্ঠাও। কারণ বেশিরভাগ বাঙালির মত আমিও ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি, নেতাজী ভালো লোক আর গান্ধীজী দুষ্টুলোক। নেতাজী'র জন্মদিনে পতাকা তুলে ভাষণ দিতে হয়, গান্ধীজী'র জন্মদিনে বেলা করে ঘুম থেকে উঠে একটা ছুটির দিন কাটাতে হয়। একটা সিনেমা দেখানো হয় হলিউডের বানানো, ওটাতে নাকি মিছিমিছি গান্ধী আছে, দু'তিনবার তো দেখেছিস, আর কত দেখবি?
        তবু বইটা নিলাম। আমার মনে আছে আমি সেই পূজোটায় একদিনও বাইরে বেরোইনি। গোগ্রাসে গিলেছি বইটা। বইটা ক্রমে আমায় গিলেছে।
        আজ অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে। বহু ছাত্রছাত্রীকে বইটা উপহার দিয়েছি। আজও দিই। কেন? তার আগে দুটো ছোট্টো গল্প বলি।

এক
-------
        তখন গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকায়। একটা আন্দোলন শুরু হচ্ছে। একটা নতুন ধরণের আন্দোলন। জেনারেল স্মার্ট বলছেন, এই গান্ধী নামক ব্যক্তিটির প্রতি মাসে কিরকম একটা মানসিক অসুস্থতা শুরু হয়, এবারও হয়েছে। এর আবার একটা নবীদের মত পাগলামি। সেই সময় গোখলে ওনার আন্দোলনের জন্য ভারত থেকে টাকা পাঠাচ্ছেন। চাঁদা তোলা হচ্ছে সারা ভারত জুড়ে। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে প্রভাব ভীষণ বেশি। ইতিমধ্যে গান্ধীকে নিয়ে একটা নাটক পরিবেশিত হয়ে গেছে। ১৯১৩ সাল। রবীন্দ্রনাথ সদ্য নোবেল পেয়েছেন। তিনিই হলেন প্রথম সারির অনুদান দাতা, ১০০ টাকা পাঠালেন, বললেন, আমাদের দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতীয় ভাইবোনেদের সংগ্রামের জন্য আমার ক্ষুদ্র অনুদান। এরপর আবার একটা চেক গেল কয়েক মাস পরেই। রবীন্দ্রনাথ গোখলের কাছে ক্ষমা চাইছেন সমস্ত বাঙালিদের হয়ে, কারণ সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীজীর কাণ্ডকারখানায় সারা ভারতে সাড়া জাগলেও, বঙ্গবাসী নিরুত্তাপ ছিল।

দুই
------
        দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকাকালীন একটা ঘটনা। খাওয়া নিয়ে একদিন গান্ধীজী নিজের ছেলেদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে বসেন উত্তেজনার বসে। কারণ ট্রেন ধরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে, একটা আন্দোলনে যোগ দিতে যাওয়ার কথা তার। ট্রেনে যেতে যেতে একটা চিঠি লেখেন নিজের ছেলেকে, ক্ষমা চাওয়া চিঠি, নিজের দুর্ব্যবহারের জন্য। তিনি লেখেন, আমি ভুলে ভরা, অসম্পূর্ণ একজন মানুষ, আমার ভুলগুলো দেখে শিক্ষা নিও, আর আগামী দিনে এমন ব্যবহার করলে আমায় সাবধান করে দিও।
        দু'জন মানুষ ক্ষমা চাইছেন। একজন সদ্য নোবেল পেয়েছেন, যিনি নিজের ক্ষুদ্র অনুদানের জন্য আর বাংলাদেশের উদাসীনতার জন্য। আরেকজন যিনি ক্রমে বিদেশের মাটিতে ইতিমধ্যে জনপ্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন, তার নিজের ছেলের কাছে।
        আমাকে এগুলোই বিস্মিত করেছে। এমনভাবে ক্ষমা চাওয়া যায়? হ্যাঁ যায়। ভারতে আর সব মহাপুরুষেরা আজন্ম মহাপুরুষ। আমি একমাত্র এনাকেই পড়েছি যেখানে আমি তাঁকে প্রতি পদে পদে নিজের ভুলগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে জানিয়ে যেতে দেখেছি। তিনি যখন মহাত্মা তখনও নিজের তীব্র কামুকতা নিয়ে লিখতে তাঁর অসুবিধা হচ্ছে না। সেগুলো তিনি না লিখলে আমরা কেউ জানতেও পারতাম না। তবু সত্যের কাছে তাঁর চূড়ান্ত দায়। কারণ সত্যই ঈশ্বর তাঁর সংজ্ঞায়। তাই সব লিখে যেতে হবে। কি করে তিনি রিপুর হাত থেকে লড়াই করে নিজেকে বাঁচাচ্ছেন, সেও লিখে যেতে হবে। কারণ তাঁর ওই আত্মজীবনীটা লেখার মূল উদ্দেশ্যই হল, আমি যখন পেরেছি, সবাই পারতে পারে। তাকে নির্ভীক, নম্র আর সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। এই অহিংসা।
        সাধারণ অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যে মানুষ নম্র, সে হয় ভীতু, নয় কোনো স্বার্থের মতলবে আছে, অথবা কোনো হীনমন্যতা - সে অর্থনৈতিক হোক কি সামাজিক অবস্থানগত। আত্মজীবনীটা আমার সামনে স্পষ্ট রাখল একটা জীবন, যে জীবনটা মতলবহীন নির্ভীক নম্র। এমন হয়? হয়। লুইশ ফিশার, যিনি ওনার সব চাইতে বিখ্যাত জীবনীকার, তিনি ওনার সাথে কাটিয়ে লিখছেন, একে আমি কার সাথে তুলনা করব? বর্তমানে বা বর্তমানের কাছাকাছি যত বিখ্যাত, ক্ষমতাশীল ব্যক্তিত্ব আছে কারোর সাথে কি এর মিল আছে? বলে ফিশার কিছু নাম করেছেন - চার্চিল, বিসমার্ক ইত্যাদি। এরকম নাম করতে করতে বলছেন, না, আমি যে মানুষটাকে দেখছি, তার সাথে মিল পেতে গেলে আমায় কয়েক হাজার বছর পিছনে যেতে হবে জেরুজেলামে। হ্যাঁ, এই কথাটাই লিখছেন লুইশ ফিশার যিনি গান্ধীজীর সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন বেশ কিছু কাল। আর বলছেন, আসলে গান্ধী যে কাজগুলো করে চলেছেন, যে নীতি নিয়ে চলেছেন, সেগুলো অত্যন্ত সরল, আমরা প্রত্যেকেই তা নিজেদের জীবনে পালন করতে পারি, কিন্তু করি না।
        আসলে আমরা তর্কে জিততে ভালোবাসি, জীবনে না। তাই আমি আজও তর্কই শুনে আসছি। যেন সত্য প্রতিষ্ঠা ছাড়া সামনের মানুষটার জীবনের আর কোনো উদ্দেশ্যই নেই। তার জীবনে কোনো ত্রুটি, কোনো ভুল নেই বলেই গান্ধীজীর কোনো ত্রুটি সে মানুষটা যেন ক্ষমা করতে পারছে না। পরে বুঝেছি, অহংকারের চাইতে বড় সত্যের সন্ধান পাওয়া জীবনে একটা পরম আশীর্বাদ। সবাই পায় না। তাই পূজো বা নিন্দা - এর কোন একটা পথ নিয়ে নেয়, তাতে আর যা হোক, নিজের জীবন দিয়ে কোনো সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করার দায় থাকে না। বাক্য আর ভঙ্গীমাতেই সব সারা হয়ে যায়।
        জীবনে চরম সংকট এলে রবীন্দ্রনাথ বলছেন বড় বড় মানুষের জীবনগুলোর দিকে তাকাও। তখন কোনো কিছু আর শক্তি দিতে পারে না। মনে রেখো, এই মানুষগুলো সারাটা পথ অনেক কাঁটা, অনেক যন্ত্রণা, অনেক অপমান, অনেক দুঃখ একা পেরিয়ে এসেছেন, তবু হেরে যাননি।
        আমি যতবার এই মানুষটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, একটাই কথা প্রাণের মধ্যে বেজেছে, থেমে থাকলে চলবে না। বিশ্বাস রাখতেই হবে। বারবার মনে করিয়েছেন, মনুষ্যত্ব একটা মহান সমুদ্র, তার খানিক ক্ষুদ্র অংশ বিষাক্ত হয়েছে বলে সম্পূর্ণ সমুদ্রটার উপর আস্থা হারাতে নেই। আর ওদিকে শুনেছি, সেই মানুষটা তার জীবনের শেষ প্রবন্ধে লিখছেন, 'তবু মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ'।
        আজ জীবনগুলো ব্রতহীন, আদর্শহীন। আমাদের জ্ঞান, আমাদের সম্পদ আজ মনুষ্যত্বের প্রয়োজনের চাইতে মানুষ নামক জীবটার দরজায় পসরা সাজিয়ে বসেছে। কারণ সেখানে নগদে সব মেলে হাতেনাতে তৎক্ষণাৎ। মনুষ্যত্ব দিন দিন হেলায়, দীনতায় তার শ্রী হারাচ্ছে। ধর্ম আর অধ্যাত্মিকতার নামে একটা উচ্চমানের শৌখিন চিত্ত-বিলাসিতায় পেয়ে বসেছে আমাদের। এতে সব আসছে, জীবনের গৌরবটা ছাড়া। মানুষ বলছে, অমন গৌরবে আমার কাজ নেই, মনুষ্যত্ব হাসছে। সে জানে এ জীবজ আস্ফালনের শেষে চূড়ান্ত হতাশা, ব্যর্থতা যখন গ্রাস করবে, তখন সে হাত বাড়িয়ে আবার বলবে, আমার অমৃত পান করার ছিল। কারণ ব্যর্থতা কোনো বাহ্যিক ঘটনা নয়, ব্যর্থতা একটা বোধ, একটা অনুভব। সেই দিন এই মানুষটার সামনে এসে আবার দাঁড়াতে হবে, যে বলবে, আমার জীবনটাই আমার বাণী। নিজের জীবনকে সুন্দর করে তোলাই সব চাইতে বড় শিল্প। গ্রামের বাড়িগুলোতে যাও, সেখানেই ভারতের প্রাণধারার উৎস। অকৃত্রিম আনন্দধারায় স্নান করো, নিজেকে আহুতি দিয়ে, আনন্দে, পূর্ণতায়। নির্ভীক হও।
 

352
Sat, 09/29/2018 - 12:30

        শবরীমালাতে রজঃস্বলা নারীদের প্রবেশাধিকার নিয়ে যিনি একমাত্র বিরোধীতা করলেন সুপ্রিম কোর্টে রায়দানের সময়, তিনি একজন মহিলা বিচারপতি। তার বক্তব্য - ধর্ম আর প্রথার সাথে যুক্তির কোনো সম্পর্ক থাকা উচিৎ নয়। 

        কথাটা দু’ভাবে দেখা যেতে পারে। এক, মহিলা হলেই যে তার মহিলাদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকতে হবে সেটা কোনো কাজের কথা নয়। তিনি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গী রাখতেই পারেন। দুই, একটা চিন্তার কথা হল এই যে, একজন মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন, একটা প্রথা আর বিশ্বাসের বিরোধীতা করা যুক্তির সাজে না, যে যুক্তি নারীদের পক্ষে বলে নয়, যে যুক্তি মানুষের সমান অধিকারের পক্ষে কথা বলছে।


প্রথা বনাম যুক্তি

============== 
        প্রথা, বিশ্বাস এগুলোকে ধ্রুব মনে করা হয়, কারণ এগুলোতে দীর্ঘদিন কোনো পরিবর্তন আসে না। মজা হচ্ছে, যে কোনো ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিজ্ঞানের অগ্রগতির সব সুবিধা নেওয়া হয়। বিদ্যুৎ নির্ভর আলো-পাখা-কম্পিউটার-এসি আরো নানা সামগ্রীতে ভরপুর। যান-বাহন সব কিছুই আধুনিক। এমনকি সেই ধর্মের প্রতিনিধির অনেকেই এরোপ্লেন ছাড়া যাতায়াত করেন না এমনও জানি। কিন্তু চিন্তার জগতে সেই বিজ্ঞানের গতি নৈব নৈব চ। তখন সেই আমরা পুরাতনপন্থী, প্রাচীনপন্থী। ঐতিহ্যের নামে যা কিছু অবৈজ্ঞানিক, অসত্য প্রতিষ্ঠ তার অনুসারী। কেন? কারণ মানুষ সব চাইতে অপছন্দ করে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে। সেই ক্ষেত্রে ভারত তো অগ্রগণ্য, সাথে আমাদের সহোদর দেশগুলোও। কারণ আমাদের যা কিছু চরম সত্য সব জানা হয়ে গেছে। এখন শুধু দাগের উপর দাগ বুলিয়ে যাও। তাতে কি হবে, নতুন চিন্তার দায়ভার নিতে হবে না। নিজের নিশ্চিত জীবনযাপনে কোনো সংশয়ের ভ্রুকুটি দেখা যাবে না। অগত্যা বোলাও দাগ।


আয়াপ্পা ও ব্রহ্মচর্য্য

================= 
        আয়াপ্পা হলেন বিষ্ণু আর মহাদেবের মিলিত সন্তান। এখন কথা হচ্ছে তিনি ব্রহ্মচারী কেন থাকতে চান? কারণ সকলের অভীষ্ট পূরণ করার জন্য আয়াপ্পার হাতে ওই একমাত্র পথ। এখন এই ব্রহ্মচর্যটা খুব পুরুষ ডমিনেটিং ব্যাপার। পৃথিবীর সব ধর্মের প্রধান মানুষটি যেমন পুরুষ, এও তেমন। মহিলার অবতার হয়ে পৃথিবী উদ্ধারের কথা শোনা যায় না। কারণ পৃথিবীর ঈশ্বরও পুরুষ। সেই আয়াপ্পার মন্দিরের বাইরে অপেক্ষা করছেন চিরকাল এক নারী যিনি এককালে রাক্ষসী ছিলেন, তার ইচ্ছা আয়াপ্পাকে বিয়ে করে। তো সেই নারীর প্রেমের প্রতি মর্যাদা রক্ষায় কোনো ঋতুবতী মহিলা সেখানে ঢোকেন না। তারা নাকি স্বেচ্ছায় যান না। যেমন পুরুষেরাই নাকি মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ক্লান্তি লাঘবের জন্য সব ধর্মীয় কাজ থেকে সরিয়ে রাখতে নানা নিয়ম করেছিল। অর্থাৎ যা কিছু নিয়ম তা দয়াবান পুরুষের হৃদয়জাত। আধুনিক মহিলারা তাতে লিঙ্গবৈষম্যের আঁচ পাচ্ছেন। 
        আসলে আমরা তথ্যের থেকে গল্প ভালোবাসি। সত্যের থেকে মনের মত রূপকথা। তাই হল কি সেই গল্পে কেউ অন্য রকম ধারা জন্মালে ক্ষেপে যাই। মনে হয় তা কেন হবে? আমরা কি তবে এতদিন ভুল ছিলাম? এখন কথা হচ্ছে যে, চিরটাকাল যে কেউই ঠিক থাকতে পারে না। 'ঠিক'টা যে পরিস্থিতির সাথে সাথে বদলে যায় তা কে কাকে বোঝাবে? আর বোঝাতে গেলেই তারা বুঝবেই বা কেন? আর যারা কথায় কথায় প্রশ্ন করে তারা তো আরো মুশকিলে ফেলে। কেন যে এত জানার ইচ্ছা, বিচারের ইচ্ছা? আরে আমরা তো সব বিশ্বাসকেই জায়গা দিয়েছি। সেই উদারতা তো আমাদের আছে। কিন্তু যুক্তির কথা আবার কেন? 
        এই ব্রহ্মচর্য্য এমনই একটা অদ্ভুত ধারণা, যা পৃথিবীর সব ধর্মেই আছে। তার প্রধান ধারণ এই পদ্ধতিতে মানুষ শুদ্ধ থাকে। কি শুদ্ধ থাকে? তার শরীর, মন ইত্যাদি। কেন শুদ্ধ থাকে? কারণ যৌনতা অশুদ্ধ। তুমি জন্মালে কি করে? যৌনতায়। একমাত্র যীশু আর রামকৃষ্ণদেব নাকি বিনা যৌন মিলনে জন্মেছিলেন বলে দাবী করেন ভক্তরা। বাকি বুদ্ধ, নানক, কবীর, রামপ্রসাদ এদের যে বাচ্চাকাচ্চা ছিল? সে অন্য কথা। অর্থাৎ আবার গোলমাল। শুদ্ধতাটা তবে কি? কান্ট মহাশয় বলেন যা কিছু সদিচ্ছায় করা হয় তাই শুদ্ধ। নইলে কোনো কিছুই সেই অর্থে শুদ্ধ হয় না। বোঝো কার কথা কোথায় পাড়ছি। তো কথা হল শুদ্ধতা রক্ষা করতে হলে নির্যৌন থাকতে হবে। এ নিয়ে মহাত্মারও অনেক কথা ছিল। সে যাক। আমার ভয় খালি শরীর আর মনের এমন বিচ্ছেদে যদি কোনো মঙ্গল আশা করি, সে কি স্বাভাবিক? নাকি বুদ্ধির মধ্যস্থতায় শরীর আর মনের একটা মিল ঘটিয়ে চলাটাই স্বাভাবিক?


ভয় বনাম যুক্তি

============== 
        ঈশ্বর আর ধর্মের মূল উৎস ভয়। আমি প্রেমিকের কথা বলছি না। কবিতার ঈশ্বর অনেক উদার, বুঝদার। ধর্মের ঈশ্বর রাজনীতি বোঝেন মানবনীতির চাইতে বেশি। তো কথা হল যে এই ভয়ের দরজা ঠেলে কোনো নারী কি সত্যিই যাবেন মন্দিরে? কজন যাবেন? কাটবে এতকালের লালিত ভয়? যুক্তির কোনো ঐতিহ্য নেই। ভয়ের ঐতিহ্য হয়, ধর্ম হয়, সংস্কার হয়। কিন্তু যুক্তি চিরকাল একা। তার না অতীত, না ভবিষ্যত। তবে? সেই এত কালের লালিত ভয়ের শিকল ভেঙে কে যাবে সেই হল কথা। তবে আশার কথা কি, মানুষ বিশ্বাস না করলেও বুঝছে যে অন্ধতার ভিতটা নড়ছে। তাকে আর কালের দোহাই দিয়ে ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। প্রাচীনত্বটা যে কোনো যুক্তি নয় সামনে নিয়ে চলার এটা স্পষ্ট হচ্ছে। 
        একটা বিশ্বব্যাপী চিরকালীন নীতি আছে - সাম্য। একের শাসনে জগত চলে - এই বিশ্বাস মানুষের যেদিন ভাঙল, সেদিন সে বলেছিল আমার ঈশ্বর সর্বভূতে, প্রতিটা অস্তিত্বের কণায় কণায়। এই ঈশ্বরের পূজো চলে না, এই ঈশ্বরের সাধনা চলে। সে সাধনা নিজের ক্ষুদ্রতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সাধনা। তাতে আমরা যত শীঘ্র সফল হই তত মঙ্গল। সেই সাধনার ডাক রবীন্দ্রনাথের প্রাণে এসেছিল। তাই তিনি এত যন্ত্রণা বাইরে ভেতরে সহ্য করেছিলেন। সসীমে অসীমের ডানার ঝাপট। রবীন্দ্রনাথের কথা কেন বললাম? সবার বক্তব্য তো যুক্তি নির্ভর হয় না। এর হয়েছিল। কবি কল্পলোকে থাকবেন, সেই স্বাভাবিক, কিন্তু দেখা যায় ইনিই সেই সময় সব চাইতে বেশি মাটির কাছাকাছি থাকতে পেরেছিলেন। কোন দল না গড়েই। সে অন্য কথা।

353
Fri, 09/28/2018 - 20:30

        তো সুপ্রীম কোর্ট বলল মেয়েরাও মন্দিরে ঢুকতে পারবে। আহা, আমাদের কালীঘাট, দক্ষিণেশ্বর, তারকেশ্বরের কথা হচ্ছে না, সে দক্ষিণভারতের কি এক সবরীমালা মন্দিরের কথা। আমাদের বাপু অমন ধারা শক্ত নিয়ম কোনো বড় মন্দিরে দেখি নাই। বাঙালী মাত্রেই মা অন্তঃপ্রাণ জাত। এই শুরু হচ্ছে দেবীপক্ষ, দেখুন না সপরিবার দূর্গা, তাতে দুইজন মা, লক্ষী-সরস্বতী, আবার লক্ষ্মী, তারপর কালী, জগদ্ধাত্রী ইত্যাদি মায়ের পর মা। তার সাথে মঙ্গলচণ্ডী, বিপত্তারীণি ইত্যাদি তো আছেই। তার সাথে এখন আনন্দময়ী মা, মা সারদা, গৌরী মা এরকম অনেক মানবী মায়েরাও আছেন। সুতরাং মোদ্দা কথা আমরা মাতৃগত জাত। আমাদের উঠতে বসতে চলতে ফিরতে 'মা মা' ডাক। পাড়ায় পাড়ায় কালীমন্দির। এমনকি বাংলার বাইরেও কালীবাড়ি মানেই বাঙালিপাড়া। তাই আমাদের ওসব নিয়ে মাথা ঘামানো নেই। মন্দিরে মেয়েরা ঢুকতে পারবে না, এ আবার কি বেয়াড়া কথা বাপু, তার জন্য মোকদ্দমা করা লাগে? 
        আমি হালিশহরে থাকি। রামপ্রসাদের মায়ের মন্দির তো আছেই, সাথে আবার পাশেই রাসমণির ভিটে। তার সাথে সিদ্ধেশরী কালী মন্দিরও খুবই প্রসিদ্ধ। অর্থাৎ কিনা মায়ের জায়গা। এবার কথা হল এই মাতৃসাধনা বাঙালীকে কি দিয়েছে। গান দিয়েছে, মন্দির দিয়েছে, কয়েকজন খ্যাতনামা মাতৃসাধক দিয়েছে, তার সাথে সতীদাহ, বিধবা নির্যাতন, বধূনির্যাতন, নারীশিক্ষায় বিরোধীপক্ষ হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদিকে উপেক্ষা করে যাওয়ার ক্ষমতাও দিয়েছে। মজার কথা হচ্ছে বাঙালি মেয়েদের কথা যারা ভাবলেন, তাদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার হলেন, তারা কিন্তু কেউ মাতৃসাধক নয়। না রামমোহন, না বিদ্যাসাগর। একমাত্র ভাবলেন কে? নিবেদিতা। তিনি সাধিকা হিসাবে ততটা ভাবেননি, যতটা সমাজসংস্কারক হিসাবে ভেবেছেন। তাতে যদি মনে করা হয় যে সময় বিবেকানন্দের পর রামকৃষ্ণ মিশনের ব্রহ্মাজ্ঞানী, মাতৃসাধক রামকৃষ্ণের শিষ্যরা নিবেদিতাকে খুব একটা সাহায্য করেছিলেন, তাও নয়। তখন মা সারদা ইতিমধ্যে দেবী হিসাবে পূজিতা, প্রতিষ্ঠিতা, সন্ন্যাসীবৃন্দ সেই নিয়ে ব্যস্ত। বড় করে দূর্গাপূজা হচ্ছে, আরো নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান হচ্ছে, মাঝে মাঝে সেবা হচ্ছে, বড় বড় ভাষ্য লেখা হচ্ছে, বক্তৃতা দেওয়া হচ্ছে, মেয়েদের মঠ প্রতিষ্ঠা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আদতে সমাজে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে নড়ে চড়ে বসার কথা আসছে ঠাকুরবাড়ি থেকে। শান্তিনিকেতন থেকে। আজ সেই প্রতিষ্ঠান থেকে যতগুলো কৃতী মানুষ আমরা পেয়েছি নানা দিকে সেই সন্ন্যাসী মহল থেকে কোথায়? কারণ ধর্ম আমাদের তাকিয়ে অন্ধ থাকতে শেখায়, শিক্ষা নয়। আজও মিশনের যতগুলো বড় বড় নামকরা স্কুল কলেজ সে সব পুরুষের জন্য, মহিলাদের জন্য নয় কিন্তু। 
        এইখানেই সবরীমালার কথা। মেয়েরা মন্দিরে ঢুকতে পারবে না, এতবড় একটা অপমানজনক কথা মানুষ ভাবতে পেরেছিল আর এত বছর ধরে সেই প্রথা টিকিয়ে রাখা হয়েছিল, এ একটা খুব বড় আশ্চর্য কথা। কতটা অন্ধকার মনে জমে থাকলে বাইরের এতবড় অন্ধকারটা মানুষের চোখে সয়ে যায় ভাবতে অবাক লাগে। মনুষ্যত্ব আর ধর্মের সম্পর্ক অনেকটা বৃষ্টি আর বন্যার মত। ধর্মে মনুষ্যত্বের কথা বারবার আসে, বৃষ্টির কপট আশ্বাসেই যেমন বন্যা আসে তার মত, কিন্তু অবশেষে সে যা আনে তা দুর্যোগ। আসলে আমি যা বলতে চাই তা হলে অনেক জায়গাতেই আমরা এখনও বিশ্বাস করি মেয়েদের অনেক জায়গায় ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই বলতে হয়। নরেন্দ্রপুর, রহড়া, শিল্পমন্দির ইত্যাদি নানা অত্যন্ত উন্নত মানের পঠন-পাঠনের খ্যাতি যেখানে সেখানে মেয়েরা ঢুকতে পারে না, পড়তে পারে না। এটা কি সবরীমালার থেকে আরো বেশি ভয়ংকর নয়? সেখানে তো না হয় ধর্মের কথা, কিন্তু এখানে যে বিদ্যার কথা। এতো বিশ্বাসের কথা নয়, কিন্তু একটা অন্ধতার কথা। যেহেতু সন্ন্যাসী পরিচালিত তাই মেয়েরা ব্রাত্য। আর কদ্দিন আমরা এই মধ্যযুগীয় বিশ্বাস নিয়ে চুপ থাকব বলতে পারেন? এও কি অপমানজনক নয়? বলা যেতে পারে অক্সিলিয়াম, ডনবস্কো, সেন্ট জেভিয়ার্সেও তো তাই। কিন্তু আমাদের নরেন্দ্রপুর, রহড়ার মত নামকরা কয়েকটা মেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা বলুন তো সন্ন্যাসী বা সন্ন্যাসীনিদের দ্বারা পরিচালিত? নেই। বাস্তব কথাটা কি বলুন দেখি, অতীতে পুরুষেরা মেয়েদের ব্রাত্য করেছে হেলায়, অবজ্ঞায়। আর মেয়েরা একত্রিত হতে চেয়েছে কিছুটা নিরাপত্তার জন্য, আমাদের তথাকথিত দাপটে পৌরুষের আঁচ থেকে কিছুটা দূরত্ব রাখার জন্য। প্রথমটা দূর করার সময় বহুদিন হল এসে গেছে, দ্বিতীয়টাকে আনতে না পারলে আর সভ্য হলুম কই? 
        সেটাও যুক্তি নয়। আসলে মানুষের দুটো অপযুক্তি হয় - একটা অযুক্তি আরেকটা ধর্ম। প্রথমটা নিয়ে বিদ্রুপাত্মক লেখা লেখা যায়, কিন্তু পরেরটা নিয়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙাতে হয়। জাগো বাবু জাগো। মধ্যযুগ পেরিয়ে গেছি আমরা, আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি, এবার জামা পাল্টাও, নতুন পোশাক পরো, নতুন আলোতে ভাবো।

354
Thu, 09/27/2018 - 15:16


আত্মবিশ্বাস ও ভাষা
================
        আত্মবিশ্বাস হারাতে শুরু করলে মানুষ নিজের সাথে সাথে নিজের বলতে যা কিছু তার উপর জোরও হারাতে থাকে। আমাদের ভাষার জোর যে কাজের ক্ষেত্রে অনেক কমে এসেছে তার কারণ এই নয় যে আমাদের পরিভাষা নেই, কারণ এই যে আমাদের পরিভাষা বানানোর তাগিদ নেই। তার ব্যবহারের দরকার নেই। আমাদের এ আত্মবিশ্বাসহীনতার জেরেই হয়ত আমরা বহু বছর হল মৌলিক চিন্তার জগতেও বিশেষ কোনো স্থান করে নিতে পারিনি। অমর্ত্য সেনের মত মানুষেরা বিশ্বজনীন চিন্তার কাজগুলো ইংরাজিতেই করেন আর ইংরাজিতেই লেখেন, তারপর সেগুলো খুব খারাপ, প্রায় অপাঠ্য অনুবাদ বাজারে চলতে থাকে।
        মহাত্মাজি তার আত্মজীবনীটা পর্যন্ত গুজরাটিতে লিখেছিলেন। আরো অনেক লেখা ওনার গুজরাটিতে আছে। হিন্দীতে আছে। যখনই ইংরাজিতে বলার দরকার হত, এক প্রকার ক্ষমা চেয়ে কাজটা শুরু করতেন। ওনার ইচ্ছা ছিল ভারতের প্রতিটা আঞ্চলিক ভাষা আরো সবল হয়ে উঠুক, মৌলিক কাজগুলো আরো বেশি করে নিজের নিজের ভাষায় হোক। ভায়োলেন্স শব্দটার যথার্থ বাংলা করা শক্ত। একটা সুক্ষ্ম ভায়োলেন্স অবশ্যই ভাষার সংঘাত।

ভাষা ও ভায়োলেন্স
================
একটা দেশে অনেক ভাষা। উন্নত ভাষা, ধনীর ভাষা। রঙ্গনাথানন্দজী একটা ঘরোয়া মিটিং-এ ইংরাজিতে কথা বলছেন। হঠাৎ ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলতে শুরু করলেন। কেন? কারণ যে জল দিতে এসেছিল সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একজন মানুষের বহুভাষী হওয়াটা গুণের। কিন্তু সেই ভাষার প্রধান যে সুর সেটা মাতৃভাষা না হলে সেটা নিজের সাথে নিজের ভায়োলেন্স। 'আমি' মানে শুধু একটা শরীর তো নই, একটা স্রোতের একটা ক্ষণিক বুদবুদ, এটা কাব্য না, এটা সত্য। আমার বাড়িতে প্রতিটা কথায় যদি ইংরাজি শব্দের ব্যবহার হয় সেটা আমার কাজের লোকের সাথে ভায়োলেন্স। তাকে না বুঝতে দেওয়ার কৌশল, তাকে অপমান করা। রাশিয়ার সাহিত্যে পড়েছি, একটা সময় তারা উন্নত আলোচনা ফরাসী ছাড়া করতেন না, কাজের লোকের সামনেও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ফরাসীতে করতেন। এটা ভায়োলেন্স। বরং তার বেরিয়ে যাওয়া অবধি অপেক্ষা করা অনেক সম্মানের। অন্যের মান রাখলে নিজের মান থাকে - এটা আদিম নীতি।

ভাষা ও শ্রেণী
===========
        তুমি অশিক্ষিত। কারণ তুমি বাংলা ছাড়া বোঝো না। এ মানসিকতা সারা ভারতে নিজের নিজের ভাষা নিয়ে। এটাও ভায়োলেন্স। একটা ভাষার জন্য নিজেকে উচ্চমার্গীয় মনে করার যে ইগো, সেও ভায়োলেন্স। এক সময় আমাদের দেশের মুনিঋষিরা যখন তারা এত বড়লোক হয়ে উঠতে পারেননি, তখন সাধারণের থেকে সাধারণ জীবনযাত্রার মানের মধ্যে আদর্শের সার্থকতা খুঁজে পেতেন। তারা গ্রাম্য সরল ভাষায় কথা বলতেন। এখন তারা নেই। এখন ভারতের ভাষার সাথে সাথে শ্রেণীর পার্থক্য যেমন বেড়েছে তেমন আধ্যাত্মবাদের সংজ্ঞাও বদলেছে। আগে ছিল আদর্শ, নীতির আলোচনা। এখন সব গুরুরা স্ট্রেস রিলিজ ম্যানেজমেন্টে ঈশ্বরের সাথে পরলৌকিক চুক্তিতে নেমেছেন। তাই ভাষা এখন ইংরাজি। আরাম এখন কম্ফোর্ট। সাধনা এখন রিল্যাক্সিং এলিমেন্ট। হঠাৎ গুরুদের কথা বললাম কেন? কারণ গুরুরাই ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ। আমাদের সমাজ সংস্কার থেকে শুরু করে রাজনীতি --- সব কিছুই ধর্মনীতির মাধ্যমে দেখার চল ছিল। সেইখানে শ্রেণী বিভাজন হয়ে পড়া মানে সেটা একটা বড় লক্ষণ আমাদের পরিবর্তনটা অনেক গভীরের।

ভাষা ও পরিভাষা
===============
        অ্যান্টিবডি কাকে বলে? না, শরীরে অ্যান্টিজেন ঢুকলে শরীর তার থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যা উৎপন্ন করে তাকে অ্যান্টিবডি বলে। পরিভাষা আমাদের সেই অ্যান্টিবডি। সে প্রতিক্রিয়া। তাই তার মানে আছে, মান নেই। শরীরের সেই প্রবিষ্ট বস্তুটি যদি শরীরের পক্ষে আপাত হানিকারক মনে না হয় তবে কোনো অ্যান্টিবডির দরকার নেই।
        ইংরাজি আর হিন্দী আমাদের প্রতিপক্ষ না, আমাদের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন, হৃদয়ে বলিউড আর মাথায় হলিউড। এই আমাদের মোটামুটি সামাজিক অবস্থান। সুনীলবাবু যখন তার বেকার জীবনে বছরখানেকের জন্য বিদেশ গিয়েছিলেন, তখন সেখানকার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানি ছেড়ে বারবার দেশে ফেরার তাগিদ অনুভব করছেন, কারণ আর কিছুই না, নিজের দেশ, ব্যস। সেখানে চাকরি নেই, কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যত নেই ইত্যাদি তো আছেই। তাও সুনীলবাবু ভাবছেন, আজ যদি আমি বিদেশে থেকে যাই, তবে কয়েক বছর পর দুটো গাড়ি হবে, নিজের বাড়ি হবে, মেম কি ভারতীয় বউ হবে, বাংলা না জানা দুটো ছেলেমেয়ে হবে। তারপর পূজোর সময় কয়েকটা সস্তা টেপ রেকর্ডার, ক্যামেরা, রেডিও ইত্যাদি নিয়ে দেশে ফিরে আত্মীয়দের মধ্যে বিলি করবেন আর বলবেন, তোদের এখানকার রাস্তাগুলো কি নোংরা রে, এখনও জল জমে থাকে, ডোমেস্টিক ফ্লাইটে কি গন্ধ... ইত্যাদি ইত্যাদি...
        সুনীলবাবু ফিরেছিলেন পরিভাষা বানানোর টানে না, স্বভাষাকে আরো সাবলীল করার তাগিদে নিজের প্রাণের শক্তিতে। এটাই আত্মবিশ্বাস। হুমায়ুন আহমেদের লেখায় গুচ্ছের পরিভাষা নেই, আছে মৌলিকভাবে বিশ্বটাকে দেখার আত্মবিশ্বাস, ভাষা আপনি জন্মেছে। কালকূটকে, সৈয়দ মুজতবা আলীকে পরিভাষা খুঁজতে হয়নি, নিজের আত্মবিশ্বাসেই পেয়েছেন ভাষার সন্ধান। কারণ ভাষা মস্তিষ্কজাত নয়, ভাষা প্রাণজাত।

উপসংহার
=========
        একটাই কথা, আরো আরো লেখা। কেউ না ছাপুক, ফেসবুকে লেখা। নানা বিষয়ে লেখা। যে যে বিষয়ে কাজে আছেন, অকাজে আছেন, যা দেখছেন, অনুভব করছেন, পারছেন, বুঝছেন, সব সব লিখে ফেলা। নিন্দুকেরা বলবে, এত লেখা? কে পড়বে? কেউ পড়বে না। তবু লিখতে হবে। ভাষার জন্য লিখতে হবে। বিসমিল্লা বলে শুরু করুন, কি রামজী বলে শুরু করুন, কি লেনিন-মার্ক্স যাই বলে শুরু করুন। লিখুন। ভাষার জন্যে লিখুন। আরো লিখুন, আরো ভাবুন, আরো দেখুন, আরো শুনুন, আরো পড়ুন। তবে অবশেষে সব কিছুই যেন বাংলায় অনুবাদ হয় আবেগে, যুক্তিতে। ব্যস, দেখতে দেখতে ভাষাটা ছুটবে। শুধু ভাষার জন্য লিখুন। আর কিচ্ছু না। ভালোবেসে যে সত্যই লেখা হয় তাই সাহিত্য। আরো আরো নতুন লেখা তৈরি হোক তাই। সে লেখা রান্নাঘর থেকে গবেষণাগার, ব্রিগেড থেকে নির্জন গঙ্গাতীর --- সবকিছুই ছেয়ে ফেলুক। আমি আশাবাদী।
 

355
Mon, 09/24/2018 - 11:00


        (যে বক্তা, তার ভাষায় কখনও এদেশের টান, কখনও ওদেশের, আসলে তার ওদেশের শিকড়ে এদেশের মাটি। সে কি করে? যদি বলি সে জেলে তবে যেন তার ধুতির কোম্পানীর নাম বলা হয়, ধরণ বলা হয় না, তার ধরণ তার কথায়। ভালো লাগলে শোনেন, নইলে আসেন, ভালো থাকবেন।)

        অনুভব, আবেগ প্রকাশ করা যাবে না। বললে তা নিয়ে লোকে হয়ত হাসাহাসি করবে। অনুভব, আবেগ অনেক কোমল জিনিস, আপনি ওকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারেন না, হয় শোনেন নইলে আমারে যেতে দেন, আমার নিজের কথা, নিজের অনুভবের ভাষা আপনি বুদ্ধি দিয়ে বুঝবেন কি করে? বুদ্ধি হৃদয়ের কথা বোঝে? সে তো বোঝে মতলবের কথা। হ্যাঁ, আমার নিজের মতলবের কথাই সে বলে। কিন্তু আমি যে রাতদিন নিজের মতলবের জন্যে ঘুরে বেড়াই এই কথাটা আপনাকে কে বলল? আমার দিল নাই? আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা নাই? তবে? আমার জন্য আপনাকে আর ভাবতে হবে না, আমারে ছেড়ে দেন।

        তবে কি জানেন, মনের মধ্যে নদীর যে ওঠা-পড়া, তার কোনো ভাষা নাই। তার বুকের উপর যে রোদের আলোর মতির বিন্দু, তারও কোনো ভাষা নাই। দেখেন না, অতবড় আকাশটা কেমন হাঁ কইরে ঐ নদীর মুখের দিকে ঠায়ে তাকায়ে থাকে! কি খোঁজে বলেন দেখি, আপনি তো এত পড়ালেখা জানা মানুষ, কি খোঁজে বলেন দেখি? পারবেন না। আপনাদের বুকের ভিতর বইয়ের পাতার শ্যাওলা জমে জমে এত পুরু হয়েছে যে আপনি ওই রাস্তায় আর হাঁটনের সাহস পান না, না? আমি বুঝি।  আপনাদের মত মানুষ দেখলি আমার মায়া হয়। মনে হয় এত্ত বড় একখান মাথা লইয়া ডাঁইয়ে-বাঁইয়ে কোনো দিকে রেখেই আর শান্তি পাচ্ছেন না, তাই না? আপনারা নিজের কথা কইতে পারেন না, না? সব সময় হিসাব করি দেখতে হয়, কথাটার কত ওজন হল, না? আরে হাল্কা কথা বলবেন পাখির মত আকাশে উড়ে যাবে, আর ভারি কথা বলবেন বুকের ভিতর নোঙর গেড়ি থাকবে, কথা বলতি এত ভাবেন কেন?
        মনের ওই ঢেউ, ওই হল ভাব। ওকে বাঁধা যায় না। নদীর ওই বাঁদিকটায় তাকান, দেখেন কেমন খাঁড়ি কেটে নদীর জল ভরে রেখেছে, ওতে ঢেউ দেখসেন, নেই। কখনও কখনও আসে, যখন আসে তাকে এখানকার লোকে কয় দুর্যোগ। নদীর জোয়ার ভাঁটাকে কেউ দুর্যোগ বলে শুনেছেন? শোনেননি, শুনবেনও না। তো ওই ঢেউরে কেউ বাঁধতি পারে না। আপনি নৌকা চড়েছেন? চড়েননি, শুধু ওই ভোঁ দেওয়া বড় বড় স্টীমার চড়েছেন, জানি তো। যদি চড়তেন, যদি একটা রাত থাকতেন আমাদের নৌকায় তবে জানতেন, নদীর সাথে মনের কথা কেমন মিশে মিশে যায়। অতলের কথা কেমন নদী ঠিক টেনে বার করে নেয়। নদী চায় না কিছু, দেয়। আপনার কথা আপনাকেই ফিরিয়ে দেয়। তাই বলি মনের কথা বলার ভাষা না পেলে নদীর কাছে আসেন। বন্ধু না পেলে নদীর ধারে আসেন, কাউরে না কাউরে পাবেনই, নদীর ধারে অনেক মানুষ কথা শুনতেই আসে। যেমন এখন আমায় পেলেন।
        আজ আমি আসি, যাবার আগে আবার বলে যাই, ভালোবাসা আর না বাসা, এই নিয়ে সংসার। হয় আপনি এদিকে, নয় ওদিকে। সব মানুষকেই জীবনে এদিক ওদিক করতে হয়, ওই নিয়ে অত মাথা ঘামাবেন না, নদী দেখেন, জীবন নদী, দুই পাড়ই আছে, ভালোবাসার ঘাট, না ভালোবাসার ঘাট, পালে হাওয়া যেদিকে লাগল গেলেন, অযথা দাঁড় টেনে মরেন কেন রাতদিন?
(ছবি, সুমনের)

356
Thu, 09/20/2018 - 19:30

        ভয় আমার আত্মীয় না। ভয় আমার প্রতিবেশী না। ভয় আমার পরিচিতও না। ভয় আমার কে? জানি না। ভয় একা হাঁটে না। ভয় একটা মৃতগাছের ডালের উপর শকুনের মত তাকিয়ে থাকে। আমি ঝিমিয়ে পড়লে চীৎকার করে ওঠে আকাশ মাটি কাঁপিয়ে। ভয়ের জন্য আমার সাথে তোমার দূরত্ব। ভয় আমায় ব্যঙ্গ করে। ভয় তোমায় অবিশ্বাস করতে বলে। আমি অবশেষে ভয়ের সাথে বনিবনা করতে চাই, ভয় চায় না। ভয়ের কোনো আত্মবিশ্বাস নেই। আমারও নেই। ভয় আমায় দূরের কথা বলে। ভয় আমায় বলে আর কিছুটা দূর হাঁটলেই সন্ধ্যে নামবে। আমি কিচ্ছু দেখতে পাব না। আমি কারোর কথা শুনতে পাবো না। আমার সামনে থাকবে উত্তাল সমুদ্র, তার ঢেউয়ে পাল তোলা কোনো নৌকা থাকবে না। যদি থাকে সেই নৌকায় থাকবে ফুটো, ডুবিয়ে দেবে মাঝসমুদ্রে নিয়ে গিয়ে। আমি শ্বাস নিতে পারব না। আমার নাক-মুখ দিয়ে জল ঢুকবে। আমার হৃৎপিণ্ডটা জলে ভরতি হয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।
        আমি ভয়ের কথা বিশ্বাস করি না। তবু ভয়ের কথা শুনি। ভয় আমায় জানলা-দরজা আটকে রাখতে বলে। আমি ছিটকিনি না দিয়েও তা বন্ধ করে রাখি, যেন বলতে চাই আসলে আমি জানলাটা খোলা রাখতেই চেয়েছিলাম। আসলে আমি দরজাটা দিয়ে বাইরে যেতেই চেয়েছিলাম। ভয় আমার অক্ষরগুলো মুছে মুছে দেয়। দিয়ে নিজের অক্ষর বসায়। ভয় যেন আমার শুক্রাচার্য। কোন হিরণ্যকশিপুর শিক্ষালয়ে এসেছি শিক্ষা নিতে কে জানে। আমার চারদিকে শুধু বাধা। শুধু অন্ধকারের পায়ের শব্দ। শুধু মৃত্যুর ফিসফিস গল্প। আমার সাথে সাথে যারা বসেছে আসন পেতে, তারাও কাঁপে, তটস্থ হয়ে থাকে হিরণ্যকশিপুর ভয়ে। সেদিন যেমন ছিল। প্রতিটা দৈত্যের সন্তান ভয়ে ছিল। ভয়কে মাথায় করে রেখেছিল বলেই সারা সংসারকে ভয়ের চোখে দেখেছিল, ভয়ের চোখেই দেখতে শিখেছিল। এমন সময় এসেছিল প্রহ্লাদ। হিরণ্যকশিপুর বলে ত্রাস, সে ত্রাসের সন্তান। সে ত্রাস হয়ে এলো না, এলো মুক্তি হয়ে। ভয়ের থেকে মুক্তি নিয়ে। তার উপর শাসন যত বাড়ে তার বিক্রম ওঠে তত বেড়ে। সে কাউকে ভয় পায় না। তার সহপাঠীদের কাছে এ এক আশ্চর্য কথা হল, তুমি ভয় পাও না কেন? প্রহ্লাদ বলেছিল, সে সারা বিশ্বসংসারে এক অভয় আশ্রয়কে দেখেছে, সে নারায়ণ, সে নাকি সর্বত্র, সংসারে প্রতিটা জীবকে যদি শ্রদ্ধার চোখে দেখা যায়, তবেই সেই পরম অভয়দাতাকে তুষ্ট করা যায়। এর বাইরে নাকি জীবনে কোনো সাধনই নেই। কথাটা তো তাই, যা বিশাল সেই বিশালত্বকে ধরবার মত হৃদয় তো চাই। একবার জাহাজ ঝড়ে তুমুল বিপজ্জনক অবস্থায়। জাহাজের ক্যাপ্টেন অবধি ভাবছেন যে জাহাজ বুঝি আর বাঁচানোই গেল না, যাত্রীরা প্রমাদ গুনছেন, এমন সময় জাহাজের ডেকে রবীন্দ্রনাথ গান বাঁধছেন, "ভুবন জোড়া আসনখানি, আমার হৃদয়-মাঝে বিছাও আনি..."
        আমার রাজা নাটকের কথা মনে পড়ল। সেই বলা হয়েছিল না, তিনি কোনোখানেই বিশেষ করে নেই বলে সবখানে সবসময় আছেন, এও যেন তেমন একটা কথা। বড় কথা। বড় কথা না হলে ভয়ের শকুনটা উড়তেই চায় না। আসলে ও আমায় মৃত দেখতে চায়, যাতে সে আমায় খেতে পারে। আমার মৃত আত্মার উপর সে তার ভোজ চালাতে পারে।
        কিন্তু সে প্রহ্লাদই বা কই, আর সে রাজা নাটকের সুরঙ্গমাই বা কই, যে এই ঘোর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমায় বলবে, ভয় নেই।
        আমি যে এই কথাটাই মনেপ্রাণে শুনতে চাই, অহরহ শুনতে চাই, ভয় নেই, ভয় নেই, ভয় নেই। কে বলবে সেই কথাটা?
        হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সেই শকুনের চোখে চোখ রাখলাম, সে তীক্ষ্ম আওয়াজে আমার কান মাথা ফাটিয়ে চীৎকার করে উঠল। বললাম, আমি তো কিছু চাইছি না তোমার কাছে, তুমি উড়ে যাও, আমায় মৃত পাবে না। তোমার দরকার আমার মৃত আত্মা, তাকে পাবে না। আমার অক্ষরগুলোকে আমি দেব না তোমায় ছুঁতে। আমার চিন্তার নদীতে তোমায় দেব না পা ডোবাতে, তুমি উড়ে যাও... তুমি উড়ে যাও... তুমি যাও... যাও... যাও...
        বলতে বলতে আমার গলায় যেন সাত সমুদ্রের ঢেউ এসে লাগল... আমার চারিদিকে আলো হয়ে উঠতে লাগল... দেখলাম শকুনটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আসলে ও ছিল আমারই উল্টোদিকের ছায়া। আমি বুঝতেই ও মিলাতে শুরু করল।

357
Wed, 09/19/2018 - 19:28

        হাতটা ঠাণ্ডা বস্তুতে লাগলে ঠাণ্ডা অনুভব হয়, গরম বস্তুতে লাগলে অবশ্যই গরম অনুভব হয়। আবার দুঃখ অনুভব হয়, আনন্দ অনুভব হয়, ফ্রেশ অনুভব হয়, কুল অনুভব হয়। কথা হচ্ছে, এই অনুভবটা কি তবে? অনুভব কি অভিজ্ঞতা, না কোনো অভিজ্ঞতার দরজা? সুখ একটা অনুভব, কিন্তু সেটা অভিজ্ঞতা কি? নাকি সুখের সাথে ঘর করার পর যা জমে যা হারায় - সেই স্মৃতিটা অভিজ্ঞতা? অনুভব স্থায়ী হয় না, অভিজ্ঞতাও চিরস্থায়ী হয় না, তবে অনুভবের থেকে স্থায়ী বেশি। অনুভবের স্মৃতি থাকে? থাকে তো, সেটা শুধুই স্মৃতি, তার কোনো দিশা নেই, তার কোনো বক্তব্য নেই, তার খিদে থাকতে পারে। যেমন আমি কোনো মুখরোচক খাবার খেলাম, সেই খাবারটা আবার খেতে চাওয়ার ইচ্ছাটা আমার সেই সুখের অনুভবের স্মৃতি থেকে জন্মায় কিন্তু সেই খাবারটা খাওয়ার পর যদি আমার কোনো অসুস্থতা হয়ে থাকে, তবে সে আমার অভিজ্ঞতা। বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতা। 
        অনুভবের বিচার ক্ষমতা থাকে না। তার থাকে সুখ আর দুঃখের স্মৃতি বা অনুভব। সে সেই সুখের আর দুঃখের স্মৃতিকে যথাক্রমে আবার ফিরে পেতে বা দূরে রাখার চেষ্টা ক্রমাগত করেই যায়, করেই যায়। নিজের অজান্তেই করে যায় অনেক সময়। নিজের অজান্তে মানে কি? অনুভবকে জানে কে? যে বিচার করে সে না যে বিচারের সাক্ষী সে? আমি। এর আর কোনো উত্তর হয় না। আমি যদি বলি, চেতনা, তবে সে চালাকি হয়, চেতনা আর আমার মধ্যে পার্থক্য কোথায়? কোত্থাও নেই। আমিই চেতনা, আমিই জেগে থাকা। ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্ন দেখে সে আমি নই, সে আমার উপচ্ছায়া। আমি না হয়েও আমার ঘুমন্ত অংশ। 
        আমার আবগে তবে কি? আমাদের দেশে অনেক রসের কথা বলা হয়েছে। বীর রস, বাৎসল্য রস, শৃঙ্গার রস ইত্যাদি। এরা এক একটা আবেগ। এই আবেগেরও কোনো হিতাহিত জ্ঞান নেই। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে সংসারে ভালো-মন্দ বলে যে দুটো কথা আছে, সে না আবগে জানে, না অনুভবে। তারা জানে আমার ভালো লাগা আর মন্দ লাগা। কিন্তু এই ভালোলাগা-মন্দলাগা আর ভালো-মন্দের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা বিশদে বুঝাবার দরকার নেই। সুগারের রুগীর যতই মিষ্টি ভালো লাগুক, সে বিচারের মাধ্যমে জানে যে তা তার পক্ষে খারাপ। কিন্তু এই ভালোলাগা আর মন্দলাগা'র সাথে আমাদের ভালো-মন্দ বোধের যে বিরোধ, তাকে কি খুব সহজ বিরোধ? না তো। কারণ দুটোই যে আমি, বরং আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে অনুভবটা যেন বেশি 'আমি', আমার বেশি কাছের। এই দ্বন্দ্ব মানুষের আদি দ্বন্দ্ব। সে কোনদিকে যাবে তবে? তার ভালোলাগার অনুভব না বোধ-বিচারে জাগা ভালোর দিকে? বহু বছর আগে, ভারতীয় দর্শনে একটা উপায় বলা হল - শ্রেয় ও প্রেয়র কথা এলো। অর্থাৎ যা করা উচিৎ আর যা করতে ভালোলাগে। অবশ্যই বলা হল, শ্রেয়টাই বেশি কাম্য। কিন্তু সে কথা আবেগ বুঝল না, তাই আজও কথায় কথায় আমরা বলি - "বেশি জ্ঞান দিস না তো!” অর্থাৎ যে জ্ঞান আমার ভালোলাগার বিরোধিতা করে, আমায় নিরস্ত হতে বলে আমার প্রিয় কোনো অনুভবের থেকে আমরা তাকে বলি অযাচিত জ্ঞান, শুষ্ক জ্ঞান ইত্যাদি। সিগারেটের প্যাকেটের উপরের সতর্কীকরণ ছবির থেকে আমার সিগারেটের ধোঁয়ার সুখানুভূতি অনেক বেশি কাছের, অনেক বেশি আকর্ষণের। এই বিরোধ, সেই আদিম বিরোধ। 
        তবে এ কথা স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে যে মানুষের আবগ তার পক্ষে অনেক সময়েই যায়নি, ভুল প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে অনেকটা দূর তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার পর। তবে কি আবেগে শূন্যতাকে নিয়েই বাঁচতে হবে? তখন দুটো কথা এলো, এক, মাত্রাজ্ঞান আর দুই শান্তরস। 
        মাত্রাজ্ঞান মানুষকে শান্ত রাখে। কিরকম? কথাটা হল এক এক মানুষের সহনশীলতা আর ব্যক্তিত্বের ধরণ এক এক রকম। তাই মাত্রাজ্ঞানের তারতম্য হয়েই থাকে। যদি শারীরিক দিক থেকে দেখা যায় তবে আমরা অনেকটা একই রকম সেখানে, কিন্তু মানসিক দিক থেকে আমরা একই রকম তো নই। পাশ্চাত্য দর্শনে এপিক্টেটাস, অরিলিয়াস, সেনেকা অনেকেই এই শান্তরসের কথা বলেছেন, যাকে বলা হয় স্টোইসিজম। জেনো এর প্রতিষ্ঠাতা। আমাদের গীতাতেও যখন অর্জুনকে বারবার বলা হচ্ছে সুখ-দুঃখ-জয়-পরাজয়-লাভ-অলাভ-এ শান্ত থাকার কথা, তখন সেই দর্শনের কথাই বলা হচ্ছে। একটা প্র্যাক্টিসের কথা বলা হচ্ছে। একটা মানসিক অনুশীলনের কথা বলা হচ্ছে। এও বলা হচ্ছে যে এ একদিনে হবে না, তোমায় লাগাতার প্র্যাক্টিস করে যেতে হবে, একটা বৌদ্ধিক অনুশীলনের অঙ্গীকার করিয়ে নিতে চাইছেন বুদ্ধ পঞ্চশীলের মাধ্যমে। আবেগের উপর বুদ্ধির জয়, অনুভবের উপর বোধের জয় - এই কাম্য বলা হচ্ছে। তার উপায় কি? বলা হচ্ছে সেই এক কথা - শান্ত থাকতে অভ্যাস করো। বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করো। বুঝতে গেলেই বুদ্ধির ডাক পড়বে। বুদ্ধি কোনোদিন কোলাহলে কাজ করে না। বুদ্ধির কাজের প্রথম শর্তই হল - শান্ত। তাই কোনো পরীক্ষা হলে বা বাজারের মধ্যে করা হয় না, কোনো বিদ্যালয় শোরগোলের মধ্যে গড়ে ওঠে না, কোনো আলোচনা উত্তেজনার মধ্যে সফল হয় না। সব মন্দির-মসজিদ-গীর্জা-প্যাগোডা ইত্যাদিতে মতের, আচারের, বিচারের লক্ষকোটি পার্থক্য থাকলেও একটা জায়গায় সবাই এক - "শান্তি রাখুন"। কারণ মানুষের বুদ্ধির প্রথম শর্তই হল - শান্তি। শান্তি মানে নীরবতা সব সময় নয়, শান্তি মানে সাম্যাবস্থা।


        শান্ত রাখার কয়েকটা অনুশীলন, যা আমার ভালো লাগে, পাশ করিনি, এখনো চেষ্টায় আছি - 
১) কম কথা বলার অভ্যাস
২) বেশি কথা না বলার অভ্যাস
৩) অপ্রয়োজনীয় কথা না বলার অভ্যাস
৪) মিথ্যা যতটা না বলা যায় তার অভ্যাস 
৫) সব না শোনার অভ্যাস
৬) বেশি না শোনার অভ্যাস 
৭) নিন্দা না শোনার অভ্যাস
৮) নিজের প্রশংসা না শোনার অভ্যাস 
এই গেল অষ্টাঙ্গিক মার্গ। আর কয়েকটা সত্য মনে রাখার অভ্যাস। 
১) আমি আছি
২) আমি আগে ছিলাম না
৩) আমি পরেও থাকব না
৪) আমি 'মানুষ' হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও, 'আমি' বলে কিছু হয় না।
 

358
Fri, 09/14/2018 - 10:00

"আসিবে ফাল্গুন পুন,   তখন আবার শুনো
     নব পথিকেরই গানে নূতনের বাণী।।"

        আমার বসতি কলকাতা নয়, শহরতলী। রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখলাম দারুণ আলোকসজ্জা। মনে মনে ভাবলাম, কি পূজো সামনে? প্যাণ্ডেল যে? ভাবলাম বিশ্বকর্মা হবে বুঝি, না, গণেশ পূজো। ইদানীং গণেশ পূজোর চল বাংলায় বাড়ছে সে নতুন একটা কোনো কথা না। সাথে গণপতিবাবার মারাঠী গানও বাজছে। আবার "লক্ষ্মীটি দোহাই তোমায় আঁচল টেনে ধোরো না"-ও বাজছে। আমি মানশ্চক্ষে দেখলাম, ভবিষ্যৎ বাঙালীর সংস্কৃতি হিন্দী ও হিন্দীর কাছাকাছি ভাষাগুলোর ঘরে দাসীবৃত্তি করছে। বিশেষ করে বাংলার গান।
        আমাদের আগে নানা রকম গান ছিল। কীর্তন, বাউল, কবিগান ইত্যাদি তো ছিলই, তারপর এলেন নিধুবাবু, রবিবাবু, অতুল-দ্বিজেন-কান্ত, নজরুল, হেমেন, সলিল, পুলক, গৌরীপ্রসন্ন ইত্যাদি। বাঙালীর মধ্যবিত্তের মনের কথা এরা বলতে পেরেছিলেন। এখন বাঙালীর মূলধারার গানের খাত নিতান্তই মন্দা। কেন?
        গানের দুটো দিক থাকে। এক প্রাণের দিক, আর দুই মনের দিক। প্রাণ সাড়া দেয় সুর আর তালের মেলবন্ধনে, আর মন সাড়া দেয় ভাষার দ্যোতনায়। আমরা জীবনমুখী গানের যে ঢল দেখেছিলাম, তাতে স্বাদ বদলিয়েছে, খানিক প্রতিবাদ জন্মিয়েছে, বুদ্ধি আর মনের ঘরে কিঞ্চিৎ দোলাও লেগেছে, কিন্তু সে গান প্রাণের গান হয়ে উঠতে পারেনি। সে গান নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সে গান শুনে জাতে ওঠা গেছে, সে গান একটা শ্রেণী তৈরি করেছে, কিন্তু এ সবই বৌদ্ধিক আর মানসিক স্তরের, এর কোনোটাই তার প্রাণের সম্পদ হয়ে উঠতে পারেনি। অনুপম কিছুটা সে অর্থে সফল হলেও সেও সেই একটা বৌদ্ধিক স্তর আর কিছুটা মানসিক স্তরের বেশি ভেতরে ঢুকতে পারেনি। যা পারছে হিন্দী সিনেমার গান, বাংলা সিনেমার গান নয় কিন্তু। তার কারণ সে গানে তার মন-বুদ্ধি সাড়া দেওয়ার আগে প্রাণ সাড়া দিচ্ছে। প্রাণের গতি চিরকালই এক। তার প্রেম আছে, তার যন্ত্রণা আছে, তার কিছু অস্পষ্ট কথা আছে, যা সুর বোঝে। প্রাণ, বুদ্ধি বা মনের মত অতটা obvious নয়, তাই তার আকুতি সুরের কাছে। যে সুর একদিন তাকে বাংলার নানা সুরস্রষ্টাই দিয়েছে, কিন্তু আজ অনেকটা মাথা খাটিয়ে সে সুরের নদীর এক আঁজলা জল হয়ত পাওয়া যায়।
        আরেকটা কারণ, ভাষার জড়তা। আমাদের ভাষার আড়ষ্ঠতা অনেক বেশি। জীবনের গতির সাথে আমরা ঠিক যুত করে উঠতে পারিনি আমাদের ভাষা নিয়ে। একটা খবরে পড়লাম, আমাজন তাদের ওয়েবসাইটটাকে এবার হিন্দীতেও আনবে, কারণ এত বেশি সংখ্যক মানুষ হিন্দীতে লিখে সার্চ করছে বলে। যে কোনো জনপ্রিয় হলিউডের সিনেমা তামিল, তেলেগু আর হিন্দীতে ডাব হয়ে আমাদের দেশে চলে। বাংলায় চলে না। তার কারণ, আমাদের ভাষার আড়ষ্ঠতা আর ছুঁৎমার্গীতা। 'বিড়ি জালাইলে জিগার সে পিয়া', বাংলায় অনুবাদ করা যায় না। জোর করে করলে হয় রসহানি হয়, নয় কানে লাগে।
        আমাদের জাতের একটা প্রাণের বিচ্ছেদ ঘটছে। আমাদের বুদ্ধি আছে, বিচার আছে, রুচিবোধ আছে, কিন্তু কিছুতেই প্রাণের আদিম টানের কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। আমাদের কবিতা, সাহিত্য, সিনেমা কোনোটাই যেন সে অর্থে সে প্রাণের কথাটা অকপটে বলে উঠতে পারছে না। কেন? আমরা কি আমাদের বুদ্ধিকে এতটা কৃত্রিম অনুশাসনে বেঁধে ফেলেছি যে নিজের কাছে নিজে সহজ হয়ে উঠতে পারছি না? বাঙালিরা যেমন বরাবরই নাচতে আড়ষ্ঠ। আমি বিসর্জনের নাচ বলছি না, বা রবীন্দ্র-কত্থক ইত্যাদিও বলছি না। আমি বলছি যে কোনো উৎসবে অবাঙালি আর বাঙালির নাচের মধ্যে একটা পার্থক্য থাকে, আমরা প্রাণোচ্ছ্বল হয়ে উঠতে পারি না। আমাদের সামনে যেন সব সময় একটা অদৃশ্য সেনসার বোর্ড। এতটা না, এর বেশি না, এরকম না - ইত্যাদি নানা ঘেরাটোপে আমাদের প্রাণের শক্তিটা যেন কোথায় হারাতে বসেছে। আমাদের আড্ডা আছে, আমাদের সুক্ষ্ম-অতিসুক্ষ্ম যুক্তি-তক্কো বাদানুবাদ আছে, কিন্তু আমাদের যেন প্রাণের ডাকটা নেই। 
        অথচ বাঙালির আগের রূপ এমনটা ছিল না। বাঙালি প্রাণের উৎসবের অভাব ছিল না। গানের অভাব ছিল না। কিন্তু আজকের মত এমন একটা মেরুকরণ গানে ছিল না। আজ সারা ভারতজুড়ে যে প্রাণশক্তির জোয়ার এসেছে, গানে-সিনেমায়-নাচে, আমরা তার সাথে পেরে উঠছি না। তাই সে অভাব তাদের থেকে আমদানি করেই পুরণ করে নিচ্ছি। প্রাণের স্রোতে জাতবিচার থাকে না। তার বেগটা একটা ছন্দে চলে, কিছু সরল আবেগকে খুব স্পর্শকাতরভাবে ছুঁয়ে যেতে চায়। কোনটা সেন্টিমেন্টালিজম, কোনটা ইমোশনাল লুজ মোশান, কোনটা ততটা ইন্টেলেকচ্যুয়াল নয় - এসবের সুক্ষ্ম তর্কে সে জড়ায় না।
        জীবনের প্রথম কথাই প্রাণ, তার সাথে যোগাযোগ ছিন্ন হলে যতই সুক্ষ্মতা থাকুক, আদতে মূল স্বাস্থ্যটা ভেঙেই পড়ে। আমাদের ছুঁৎমার্গতা কাটানোর সময় এসেছে, আমাদের সুক্ষ্মবিচার ভুলে গতিটাকে বলবান করে নেওয়ার সময় এসেছে, মনে রাখতে হবে সব কিছুর মূলেই মানুষ। তার ভাষা, তার কবিতা, তার গান, তার আঁকা, তার সিনেমা ইত্যাদি যাই সে করুক, মূলে সে মানুষের হৃদয়ে জায়গা না করে নিলে শেষে সব ফাঁকি। কি কবিতা হল আর কি কবিতা হল না, কি গান হল আর কি গান হল না, এ সব বিচার অনেক হল। কি মানুষকে ছুঁলো আর কি ছুঁলো না, এই শেষ কথা না হলেও প্রধান একটা কথা তো অবশ্যই। আর যা কিছু সাধারণ মানুষকে ছোঁয় অবশেষে সে-ই কালজয়ী হয়ে থাকে। তবে সে কালজয়ী হোক চাই না হোক, কোথাও সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করার মধ্যে যে উন্নাসিকতা আমরা দেখিয়েছি, তার খেসারত আজ আমরা এক প্রকার পঙ্গু হয়ে দিচ্ছি। বৌদ্ধিক সুক্ষ্ম সাধনার মোহে, মূলস্রোতকে অপুষ্ট রেখে আজ শূন্যতায় গর্বের তোরণ তুলে নিজেদের পিঠ চুলকাচুলকি করে যে অস্বাস্থ্যকর, রুগ্ন পরিবেশ সৃষ্টি করেছি, তাতে অন্য ভাষা এসে স্থান দখল করবে এই স্বাভাবিক, খিদে যখন আছে খাদ্যের জোগান তো দিতেই হবে, সে চাষ যদি না হয়, তবে আমদানিই সই।

359
Fri, 09/07/2018 - 11:09

        আয়না কথা বলে না। সময় কথা বলে না। সকালের আলো, রাতের অন্ধকার কথা বলে না। আশেপাশের পশুপাখিরা শব্দ করে, কিন্তু কথা বলে না। মানুষের সব কথা মানুষকে নিয়ে। কত কথা। নিজেকে নিয়ে কথা, প্রতিবেশীকে নিয়ে কথা। মানুষের আত্মীয় - প্রতিবেশী থেকে ঈশ্বর সবাই, এমনকি মাঝে মাঝে সে নিজেও নিজের প্রতিবেশী, সে নিজেই দূরের আত্মীয়। কথা অনুভবের নদীতে, আবগের ঢেউয়ে ডোবে, ভাসে। কথার ফলা যুক্তির ধারে তীক্ষ্ম হয় - নিজেকে কাটে, পরকে কাটে। কথা আর ফুরায় না। নিজের কথার রসে নিজে ডুবে থাকে মানুষ। মাঝে মাঝে সে রস যখন ওঠে গেঁজিয়ে, ফেলে দেয়। আবার নতুন কথার সাজা আনে, পাতে, ডোবে। মানুষ চায় তার কথার রসে শুধু সে না, অন্যেও ডুবুক। কথা আত্মীয়তা বোনে। মানুষের খোঁজ শুধু শরীরের না, অন্যের মধ্যে নিজেকে খোঁজ, এ এক আজব খোঁজ। নিজের মধ্যে সে অন্যকে খুঁজবে, আবার অন্যের মধ্যে নিজেকে খুঁজবে। কথায় খুঁজবে। যেখানে কথারা অনুভব হয়ে যায় সেখানে খুঁজবে। এ লেখা যখন তুমি পড়ছ, তখন জেনো আসলে আমি আমার কথা দিয়ে তোমার মধ্যে ঢুকতে চাইছি, তোমার মধ্যে নিজেকে দেখতে চাইছি, নিজের মধ্যে তোমায় দেখতে চাইছি। কথা নদী। কথা সুতো। কথা সাঁকো। কথা আকাশ। কথা সমুদ্র। কথা গরল। কথা অমৃত। 
        আমি অমৃত চাই শুধু কে বলল, আমি গরলও চাই। আমার প্রেম আমার গরলামৃত। আমার সারা শরীর মন পুড়িয়ে, ঝাঁঝরা করে যে চলে গেল সে প্রেম। আমার শরীরে সে কেন্নোর মত হাঁটে না, বাজের মত পড়ে, সে কুসুমের মত আদর করে। আমি প্রেমের দোলনা চাই না শুধু, আমি প্রেমের গুহা চাই, প্রেমের জঙ্গল চাই, প্রেমের এভারেস্টের চূড়া চাই, প্রেমের নায়েগ্রা চাই, প্রেমের ভিস্যুভিয়াস চাই। প্রেম আমায় শুদ্ধ করে না, প্রেম আমায় অশুদ্ধ করে না, প্রেম আমায় যাযাবর করে। আমার গায়ে ঘাস হয়ে ওঠে, আমার ছোটো ছোটো পতঙ্গের মত ইচ্ছাকে লালন করে নিজের গর্তে প্রেম। আমার কথা প্রেমে জন্মায়, প্রেমের আঘাতে জন্মায়, প্রেমহীনতায় জন্মায়। কথা আমার হতাশার প্রলেপ, কথা আমার উপবন, কথা আমার বার্ধক্যের যষ্টি। কথা মহাকাল চুঁইয়ে চুঁইয়ে বিন্দু বিন্দু নামে ক্ষণকালের পাত্রে। সরের মত ভাসে। রামধনুর মত ওঠে। ঝরা ফুলের মত ঘাসে শুয়ে থাকে। 
        কিছু কথা বাঁধের ওদিকে থাকে। শক্তি সঞ্চয় করে। তারা বর্ষার অপেক্ষা করে। কিছু কথা মেঘভাঙা বৃষ্টির মত ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে যায়। যুদ্ধ বেধে যায়। কথার আঘাতে কথারা শুয়ে, আহতের আর্তনাদে দেওয়ালের টিকটিকিকে চমকে দেয়। কিছু কথা নিহত হয়ে কবরে যায়। যুদ্ধ থামে। নতুন কথা অহিংস হয়। ক্ষমা হয়। বট গাছের মত দাঁড়ায়। শান্তি আসে। আবার কিছু কথা কপট নটিনীর মত হয়। রঙচঙ মেখে আড়লে অল্প আলোয় মোহিনী হয়ে দাঁড়ায়, রাস্তা আটকে দেয়। ভুলভুলাইয়ার পর্ব শুরু হয়। তারা আবর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়। 
        কিছু কথা বীজের মত নিঃশব্দ হয়। মৌমাছির চাকের মত সঞ্চয়ী হয়। ঝিনুকের বুকের মত মুক্তোস্নেহী হয়। শূন্য কলসীর অন্ধকার মুখের মত রহস্যপূর্ণ হয়। চিলের ডাকের মত অলীক হয়। সপ্তর্ষিমণ্ডলের মত অতিপরিচিত দূরের হয়। সে কথার বুকে রাখা থাকে আগামী প্রজন্মের কথার ভার। সে কথা বলা যায় না। সে কথা অজন্মা। সে কথার দিকে ধীর পায়ে এগোতে এগোতে মৃত্যু কোলে তুলে নেয়। তারপর আর কথা থাকে? জানি না। নাকি সব কথা সেদিন সেই আদিম ধ্বনিতে লীন হয়, যে ধ্বনির আরেক নাম, ইচ্ছা-অমৃত।

360
Wed, 09/05/2018 - 15:14

   “There is nothing wrong in absorbing the culture of other peoples; only we must enhance, raise and purify the elements we take over, fuse them with the best in our own"
        কথাটা ছিল আগামী দিনের ভারতবর্ষের। রাধাকৃষ্ণান যা ভাবতে চেয়েছিলেন তা হল আগামী ভারতের চিন্তাধারা কেমন হবে তা নিয়ে। তিনি দুই ধরণের ভারতীয়দের কথা বলেছিলেন। এক, যারা গোঁড়া, যারা মনে করেন ভারতীয় ষড়দর্শনে যা লেখা হয়ে গেছে সেগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করলেই ভারতীয় সংস্কৃতি বেঁচে যাবে; আর দুই, সেই ধরণের ভারতীয়েরা যারা মনে করেন ভারতীয় সব চিন্তাধারাই ভিত্তিহীন, সেগুলো থেকে সরে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ পাশ্চাত্যপন্থী হয়ে বাঁচাটাই পথ।
        এই দুই শ্রেণী আমি আজও দেখছি। আমি যদি বেদান্ত'র সমর্থনে কোনো কথা বলেছি, তখন ধরে নেওয়া হচ্ছে আমি সতীদাহ প্রথাও সমর্থন করছি; আবার আমি যখন বেদান্ত'র বিরোধিতা করছি তখন ধরে নেওয়া হচ্ছে ভারতীয় সংস্কৃতিটাই আমার কাছে একটা প্রহসন। এই দুই চিন্তাধারার মধ্যে যে কোনো একটা যোগসূত্র থাকতে পারে সে চিন্তাই অনেক ক্ষেত্রে নেই। আমি একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে আলোচনাটা শুরু করি।
        তখন আমার বয়েস অল্প। রামকৃষ্ণ নামাঙ্কিত একটা প্রতিষ্ঠানে যেতাম। গানের প্রতি বরাবরই ভীষণ ঝোঁক, তো সেখানে কয়েকটা ভক্তিগীতি গেয়ে বেশ সুনাম হচ্ছে, গানের মহড়া দিচ্ছি বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে, মাঝে মাঝে মহারাজ তোষণেও ভাগ নিচ্ছি ইত্যাদি। কিন্তু কোনো একটা জায়গায় খুব খটকা লাগছে। এরা কথামৃত, বিবেকানন্দ রচনাবলী ইত্যাদি পড়ছেন, আলোচনা করছেন --- অথচ যেই না আলোচনাটা শেষ হল অমনি যাবতীয় সঙ্কীর্ণ কূটকচালি, ইত্যাদি আলোচনা এসে পড়ছে মুহূর্ত যেতে না যেতেই, তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে উদারতার ছদ্মবেশে একধরণের গোঁড়ামিও বাসা বাঁধছে যেন কোথাও। কয়েকজন সংসারে ঘা খাওয়া মানুষ একটা অলীক বিশ্বাস নিয়ে বাঁচতে চাইছেন - আত্মা, পরমাত্মা, ব্রহ্ম, সাকার, নিরাকার, মায়া ইত্যাদি কিছু অসম্ভব কথাকে জীবনের পাথেয় করে, কি চূড়ান্ত অবাস্তব জীবনদর্শনের আলোচনা! তার সাথে 'আমরা-ওরা' গল্প তো আছেই। আমার মনে হত তবে কি আমরা একটা গোঁড়ামি ছাড়তে গিয়ে আরেকটা গোঁড়ামির মধ্যে ঢুকতে চাইছি? রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ আবার সেই অথোরিটি হয়ে দাঁড়াচ্ছেন? তাঁদের চিন্তার সাথে না মিললেই তুমি ম্লেচ্ছ? অন্য দলের? একবার একটা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের 'বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি' গাইলাম। একজন বরিষ্ঠ সদস্য উঠে এসে আমায় বললেন, “এ সব গান অনেক হয়েছে, এবার একটা ভক্তিগীতি গাও"। মনে মনে বললাম, তবে কি এতক্ষণ খেমটা গাইলাম কত্তা? আরেকটা অনুষ্ঠানে, একজন বললেন, 'হরি' নাম তো অনেক হল, এবার রামকৃষ্ণের নাম গাও দেখি।" বললাম, "হরি আর রামকৃষ্ণ কি আলাদা?" বললেন, "হ্যাঁ তো, হরি মানে তো কৃষ্ণ, ও তো বৈষ্ণবদের ঠাকুর।" ক্রমে বুঝলাম আমি একটা অদ্ভুত গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ছি। এখানে উদারতার নামে আস্তে আস্তে সেই বস্তাপচা শৌখিন মৌলবাদ ঢুকছে। আরো গভীরে গিয়ে জানলাম স্টেজের বক্তৃতা দেওয়া মানুষ আর আশ্রমের নিভৃতে বসা গেরুয়াধারী মানুষটা অনেক ক্ষেত্রেই এক নন। একটা মুখোশ, আরেকটা মুখ। যে মুখটা ততটা সুবিধের নয়। পালিয়ে এলাম সব ছেড়ে। নিজের স্বাধীন চিন্তাধারা জলাঞ্জলি দিয়ে অন্যের মুখের ঝাল খাওয়া যদি একমাত্র পথ হয়ে থাকে তবে নিতান্ত মুখ্যু থেকেই মরা ভালো। অতঃপর ফেসবুকে বিস্তর গাল খেলাম, আগের সৌরভের সাথে পরের সৌরভের মিল পাওয়া ভার হল, বন্ধু-বিচ্ছেদ হল, বলা হল আমি 'চিপ' পাবলিসিটির জন্য এসব করছি। "নইলে হাঁড়ির খবর যা জেনেছ তা জেনেছ, সেই নিয়ে বাজারে বলার কি দরকার বাপু!, আমরা তো একটা পরিবার, পরিবারের কথা বাইরে কেন?” বোঝো! দলতন্ত্রের বিষ চাপা দিতে চাওয়া হচ্ছে 'পরিবার' নামের বিশুদ্ধ শব্দের আড়ালে। কিন্তু আমার যে স্বভাব খারাপ দাদা, যা সত্য বলে বুঝি তাই ঢাক পিটিয়ে বলি, লুকিয়ে করা এক শৌচাদি ছাড়া আর কিছুই হল না জীবনে।
        এবার এই গোঁড়াদের কথা রাধাকৃষ্ণানের কলমে শুনি। উনি বলছেন, “now reverence for authority has become the imprisonment of human spirit. To question the belief of the scriptures is to question the authority of the great dead. Inquiry and doubt are silenced by the citation of ancient texts, scientific truths are slighted, if they cannot be fitted into the procrustean bed of established belief. Passivity, docility and acquiescene become the primary intellectual virtues.”
        কিন্তু এটাই তো ভারতের অতীত ছিল না। সেখানে তর্ক ছিল, প্রশ্নের অবকাশ ছিল। রামকৃষ্ণ স্বয়ং নিজের কথায় বলেছেন, ল্যাজামুড়ো বাদ দিয়ে নিবি। এখন পাল্টা অপযুক্তি হচ্ছে, তবে কি তুমি রামকৃষ্ণ'র থেকেও জ্ঞানী? আরে তা কেন, একজন বিজ্ঞানী যদি বলে থাকেন যে পৃথিবী ঘুরছে, সূর্য স্থির, তবে আমার বেলায় কি বলা হবে তুমি কিন্তু জেনো উল্টোটাই সত্য, ওসব কথা বিজ্ঞানীর জন্য। যা সত্য তা সবার জন্যেই সত্য, তাই সে সত্য। প্রাচীন ভারতের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলছেন, “The ancient seers desired not to copy but to create. They were ever anxious to win the fresh fields for truth and answer the riddles of experience, which is ever changing and therefore new. The richness of inheritance never served to enslave their mind. We cannot simply copy the solutions of the past, for history never repeats itself. What they did in their generation need not to be done over again.”
        রাধাকৃষ্ণান বলছেন, আমাদের স্কলার বেড়ে গেছে কিন্তু চিন্তাবিদ পাওয়া যাচ্ছে না, সব সেই চর্বিতচর্বণ। কারণ যে ধর্মের কথা আমরা বলছি সেও তো নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে। তাকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে এইটাই তার চরম রূপ বলে যেই মনে করেছি, অমনি চিন্তা স্রোত হারিয়ে শিকল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজেকে তাতে বেঁধে ভাবছি, যাক আমার একটা হিল্লে হয়ে গেল; আর যারা সেই শিকলে বাঁধা পড়ল না, তাদের সেই শিকলে আনার জন্য দরদ আর অভিশাপ একসাথে উথলে দিচ্ছি। দুটোই সব্বোনেশে। রাধাকৃষ্ণান ঠাট্টা করে বলছেন, যদি সেই আড়াই হাজার বছর আগের কোনো ঋষি এসে তোমাদের কাণ্ড-কারখানা আজকের দিনে দেখেন, তিনি তো তাঁর যোগ্য উত্তরসূরীই পাবেন না, সবাই অনুকরণে ব্যস্ত। অতীতের সমস্যায় অতীত বেঁচেছিল। বর্তমানের সমস্যায় সেই প্রাচীন পুঁথি কতটা কাজে আসছে ভালো করে খুঁটিয়ে পড়ে নিজে ভেবে দেখো দিকি কত্তা। তারপর যতটা থাকল নিলে, বাকিটা না হয় ফেলেই দিলে। আজ এই শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে কার মাথা খারাপ হচ্ছে বলো ব্রহ্ম সাকার কি নিরাকার ভেবে? কে ভাবতে যাচ্ছে তুমি ব্রাহ্মণ কি শূদ্র? কে ভাবতে যাচ্ছে আত্মার দর্শন হল না ঈশ্বরের সাক্ষাৎকার হল? আজ আমাদের অন্যান্য নানান সমস্যা। সেগুলোর হাল কি লেখে তোমার বইতে কও দেখি? আছে আছে, ভালো করে পড়ে দেখো, প্রচুর এমন কথা আছে যা কাজে লাগে। শুধু অথোরিটি থেকে বাঁচো। নিজেকে বাঁচাও অন্যকেও রেহাই দাও। গীতা তো তোমার বেদকেও 'যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং' বলে ঝেড়ে কাপড় পরিয়েছে; বলেছে, ওসব স্বর্গ-নরক যাওয়ার মতলব ছাড়ো দিকিনি বাপু, মনটাকে স্থির করে এখানেই একটা কিছু করে দেখাও, হুম... স্বামীজি ঠাট্টা করে বলছেন না, বউ-বাচ্চার মুখের ভাত জোগাড় করতে পারো না, তুমি দৌড়াচ্ছ মোক্ষ নিতে।
        এরপর এর বিপরীত পক্ষের কথা হল, ভারতের যা কিছু সব বুজরুকি। এদের কথা হল, “more English than the English themselvs... if India is to thirve and flourish, England (আজকের দিনে আমেরিকা পড়ুন, কারণ বইটা প্রথম ছাপা হয়েছিল ১৯২৩ সালে) must be her ‘spiritual mother’ and Greece her ‘spiritual grandmother’."
        রাধাকৃষ্ণান শেষ করছেন আশার বাণী দিয়ে। বলছেন, এই রক্ষণশীল আর আমূল সংস্কারক --- দু'জনকেই মুখোমুখি হতে হবে, নিজেদেরকে বুঝতে হবে। রাধাকৃষ্ণান নাম উল্লেখ করে বলছেন, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা, অরবিন্দ'র লেখা পড়লে একটা ক্ষীণ আভা মিলতে পারে ভারতকে কোন পথে যেতে হবে। বিজ্ঞানের সাথে প্রাচীন প্রজ্ঞাকে মেলাতে হবে।
        আইনস্টাইন তথা আমাদের আবদুল কালাম মহাশয়ের নানা লেখাতেও এর আভাস আছে। কিন্তু প্রজ্ঞার সাথে বিজ্ঞানের মিলনে কেউ অথোরিটির ভূমিকা নেবে না। স্বাধীন চিন্তা আর সদিচ্ছাই থাকবে মূল চালিকাশক্তিতে, তবেই নতুন দিশা পাবে মানুষ।
        আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ এখনও অনেক অনেক বছর আমাদের সামনে আলো ধরে দাঁড়াতে পারে, অমন নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী খুব কম দেশই নিজের ভাষায় এতগুলো দিকে পাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছে; আর আমাদের মত খুব কম দেশই তা অগ্রাহ্য করে কয়েকটা গানে-কবিতায় অবহেলার চূড়ান্ত জায়গায় রেখে নিজেকে অন্ধকারের দিকে সগর্বে নিয়ে যাওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পেরেছে।
 

361
Sat, 09/01/2018 - 11:30


“I would very much wish for him (Amartya Sen) to find a suitable biographer, this would have to be an enonomist familiar with philosophy, but who was not Sen’s student, and who is not a Bengali” ~ Ramchandra Guha


        আজকের 'দ্য টেলিগ্রাফ'র এডিটোরিয়ালে একটা প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবী রামচন্দ্র গুহার মন্তব্য। শেষ কথাটায় ঠেক খেলাম, কেন একজন বাঙালি অমর্ত্য সেনের জীবনীকার হতে পারবেন না? পক্ষপাত, আবেগ আর স্বজনজনিত দুর্বলতা দুষ্ট হয়ে যাবে বলে? কথাটা কোথাও একটা খারাপ লাগা আনল। আমরা ভাবাবেগ তাড়িত জাত নিঃসন্দেহে, ভক্তিমার্গ আমাদের স্বচ্ছচিন্তাকে বারবার কুয়াশায় ঢাকে এও সত্য। কিন্তু সেকি শুধু বাঙালি বলেই? ভারতের কজন সঠিক নিরপেক্ষ জীবনী-লেখকের নাম আমরা করতে পারব? আমি কিছু ইংরাজিতে জানি, বেশ কিছু বাঙলায় জানি। কিন্তু সেই পক্ষপাতদুষ্ট কলম কি শুধু ভারতের মাটিতেই, পৃথিবীর অন্য ভাষায় নেই? মনুষ্যপ্রকৃতির দুর্বলতা কোনোদিন ভূগোলে সীমাবদ্ধ হয় না। সে দুর্বল দিক হয়ত কোনো দেশের চিন্তার, মননের জলবায়ুতে বেড়ে উঠতে পারে না সে আলাদা কথা। অর্থাৎ নিরপেক্ষ দিকটা হয়ত বেশি চর্চিত। 
        আমি যে ক’টা বাঙালী লেখকরচিত জীবনী পড়েছি, তার একটাও সে অর্থে নিরপেক্ষ হয়ত নয়। প্রশান্তকুমার পাল, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় -রবীন্দ্রনাথ। ইন্দ্র মিত্র- বিদ্যাসাগর। স্বামী সারদানন্দ - রামকৃষ্ণ। স্বামী গম্ভীরানন্দ - স্বামীজী। এর মধ্যে সব চাইতে দাগ কেটেছে ইন্দ্র মিত্রের বিদ্যাসাগর। যেমন জীবনী বলতে বুঝি অনেকটা যেন তেমন। কোথাও বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মিথগুলো দাঁড়াতে দেননি, অসম্ভব পরিশ্রমের ফসল অবশ্যই। বাকি জীবনীগুলো অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ, কিন্তু সেই অর্থে একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নির্ভর হয় তো নয়, প্রশান্তকুমার পাল অবশ্য কিছুটা লেগেছে। 
        একটা ঘটনা বলি, আমার অনেকের জীবনী বাংলায় পড়ে পড়ে রামচন্দ্রগুহের মত অনেকটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল, যে বাঙালী হয়ত সত্য অর্থে জীবনীকার হতে পারে না। বেশ কয়েক বছর আগে বইমেলায় বিদ্যাসাগরের জীবনী খুঁজছি ইংরাজিতে, বাস্তবসম্মত জীবনী পড়ব বলে। একটা ইংরাজি বই হাতে নিয়ে দেখছিও, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমায় বকা দিলেন, "কি করছেন এটা"? আমি চমকে গিয়ে বললাম, আজ্ঞে বিদ্যাসাগরের জীবনী খুঁজছি... উনি ফের দাবড়ানি দিয়ে বললেন, "যান আনন্দ থেকে ইন্দ্র মিত্রের বইটা কিনুন"। ওনার বলার মধ্যে এমন কিছু একটা নিশ্চয় ছিল যে আমি দৌড়ে গিয়ে বইটা কিনে ফেললাম। আর বাকিটা না বলাই ভালো, একটা রিভিউ লিখেছিলাম ফেসবুকে তো অবশ্যই, অনেককে কিনতেও অনুরোধ করেছিলাম। 
        আমি নিরপেক্ষ জীবনী বলতে কি বোঝাতে চাইছি। আমি বলতে চাইছি না যে একটা নিরপেক্ষ জীবনী মানে সেখানে তার অন্ধকার দিকটার শুধু উল্লেখ থাকবে আলোকিত দিকের পাশাপাশি। আমি সার্থক জীবনী বলতে বোঝাতে চাইছি তাতে অতিকথন যেন না থাকে। নিন্দা-প্রশংসা-স্তুতি কোনোটাই যেন না থাকে। যত প্রতিভাশালী মানুষই হোন না কেন, তিনি অবশেষে মানুষ, এই কথাটার মধ্যে একটা গর্ব আছে, সেই গর্বটাকে ছোটো করে তাকে অকারণ দেবত্বে, বা মহত্বে বড় যেন না করতে যাই। বিবেকানন্দের একটা কথা আমার অসম্ভব ভালো লাগে, একজন মানুষের যা গুণ সে তার নিজের চেষ্টার্জিত, কিন্তু তার যে দোষ তা আপামর মানবজাতির দোষ। এই কথাটা বড় দামী কথা। কারোর দোষের আলোচনা করাটাই একজনের স্বরূপ উদঘাটনের সত্য দায়ভার বহন করা নয়, তার ভালোমন্দ দুটোকেই পাশাপাশি রেখে, তার স্ববিরোধকেও স্বীকার করে যে মানুষটার চরিত্র দাঁড় করানো হয়ে থাকে, সেই সার্থক সৃষ্টি। মিথ্যা কিছুক্ষণের জন্য কুহক সৃষ্টি করতে পারে, কালের আকাশে সত্য সূর্য যদ্দিন না ওঠে। তা দিয়ে ক্ষণিকের কাজ চালানো যায়, ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর রাখা যায় না। সেই সার্থক জীবনী লেখার কাজে বাঙালী অপারগ, এ আমি বিশ্বাস করি না। সেদিনের চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত আজকের দিনে শুধুই ভক্তিগ্রন্থ। ঐতিহাসিক উপাদান তাতে অল্পই। রোঁমা রোঁলাও সেদিন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দর জীবনী লিখতে গিয়ে এই একই জায়গার মধ্য যেন একটা সংশয়ে ভুগেছেন, কোথায় সমালোচনার কলম আবার ভক্তিতে ডুবিয়ে নরম করে নিয়েছেন, আর রামকৃষ্ণ মিশন সেই বইয়ের ফুটনোট দিয়ে দিয়ে ক্রমাগত সাফাই গেয়ে গিয়েছে। ফলে কোনোটাই ইতিহাস হয়ে ওঠেনি। তাতে রস আছে, কিন্তু সত্য কতটা আছে তা সংশয়ের। একজন পুরুষকে অবতার সৃষ্টি করতে গিয়ে যখন বলা হয়, তাঁর সাধনকালে মাসিকচক্র হত কিম্বা লেজ বেড়ে গিয়েছিলে হনুমান সাধনকালে - তখন সেটা আর জীবনী থাকে না, তখন তা সাধারণ যুক্তিবুদ্ধির বাইরে এমন কিছু একটা হয়ে দাঁড়ায়, হয় তাকে অন্ধ বিশ্বাসে স্বীকার করে নিতে হয়, অথবা বলতে হয়ে - অনৃত। তার সত্যকারের মহত্বও যেন কোথাও এই কুহকে চাপা পড়ে লজ্জায় মুখ লুকায়। 
        আমার পড়া অসামান্য কয়েকটা বায়োগ্রাফির একটা লুইজ ফিশারের 'গান্ধী'। দুই, ডেভিড হার্বার্ট ডোনাল্ডের 'লিঙ্কন'। দ্বিতীয় বইটা আমার মনের অনেক গভীরে ছুঁয়ে গেছে, কারণ ইতিহাসকে অবিকৃত রেখে এমন সরস একটা উপাখ্যান লেখা চাট্টিখানি কথা না। তাছাড়া আর্ভিং স্টোন তো রইলেনই। তাছাড়াও মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাণ্ডেলা, মার্কেজ ইত্যাদি অনেকেরই পড়েছি। রামচন্দ্র গুহার যে গান্ধীর উপর বায়োগ্রাফিটা বেরোচ্ছে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। প্রথম ভাগ পড়া হয়েছে, পরেরভাগ এগারোই সেপ্টেম্বর বেরোচ্ছে, তার অগ্রিম বুকিং করে রেখেছি, শুনেছি অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন বইটার জন্য। সেটা বিশ্বাস্য, কারণ প্রথম ভাগ 'গান্ধী বিফোর ইণ্ডিয়া' সেই সাক্ষ্য বহন করে। 
        অবশেষে বলি, রামচন্দ্র গুহা আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক, থেকেও যাবেন। তবে আজকের কথাটা কোথাও একটা খোঁচা আর খোঁজ একসাথে দিয়ে গেল। সত্যিই কি আমরা নিরেপক্ষভাবে একটা মানুষের জীবন বলে যেতে পারি না, তাকে দেবতা বা অসুর কোনোটাই না বানিয়ে?

 
362
Fri, 08/24/2018 - 11:30


        ফেসবুকে একটা ছবি নিয়ে খুব আলোড়ন হচ্ছে। বিয়ের টোপর মাথায় একজন সম্পূর্ণ নগ্ন নারী। এ দৃশ্য নতুন কিছু না, নানা ফটোগ্রাফির পেজে এরকম চিত্র ভুরিভুরি। বলা যেতে পারে পুরুষের নগ্নচিত্র তোলা হয় না কেন? কারণ অনেকের মতে পুরুষের শরীরে নাকি সেই সৌন্দর্য বিধাতা দেননি, যেই সৌন্দর্যে নারীকে ভরিয়ে তুলেছেন। কোনোদিনই এ যুক্তি আমার খুব একটা সৎ বলে মনে হয়নি, আজও হয় না।
        আসল কারণ হল পুরুষের উর্বশী বাসনা। চিরকাল আছে, খুব সুক্ষ্ম বাসনা। ঠিক কামজ বলা যাবে না, আবার কামরহিত বলাও যাবে না। স্থূল কামাবেগ অনেকটা মার্জিত হয়ে বৌদ্ধিক স্তরে একটা শৈল্পিক ব্যঞ্জনা নিয়ে দাঁড়ায়। শিল্প, ললিত কলা, সুক্ষ্ম রসবোধ ইত্যাদি নিয়ে নারী সেখানে একজন খুব উঁচুদরের, উঁচুস্তরের মনোরঞ্জনের বস্তু। এখানে কয়েকটা শব্দে আমি মনযোগ আকর্ষণ করতে চাইছি --- এক, দর আর স্তর - দুটোই উঁচু হতে হবে, মানে সুক্ষ্ম আরকি। দুই, 'বস্তু' হতে হবে, মানে মানবিক সম্পর্কিত না। যেমন সেই বিশ্বসুন্দরীতে বুদ্ধিবৃত্তির মাপও নেওয়া হয় না? খানিক সেরকম। অর্থাৎ আমরা বলতে চাই, ওহে নারী, আমরা তোমার কটিদেশ, স্তনযুগল, উচ্চতা, তীক্ষ্মতা ইত্যাদি বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুর বিচারেই ক্ষান্ত দেব, এমন স্থূল রসজ্ঞ ভেবো না আমাদের, আমরা পুরুষ, আমরা জানি কি করে বস্তুর কদর করতে হয়, আমরা তোমার বোধ-বুদ্ধিরও পরিমাপ করব, হুম, এতই সুক্ষ্ম বিচারশক্তিসম্পন্ন আমরা।
        রাজশেখর বসুর 'দ্বান্দ্বিক কবিতা' গল্পটা স্মরণ করাই। স্বামী বড় কবি, তার মানসলোক জুড়ে এক পরমাসুন্দরী যার উদ্দেশ্যে কবিতা লেখেন (আগে সেই স্থানে স্ত্রী ছিলেন, কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের স্থূলতায় স্ত্রী সেই স্থান অধিকারের সুক্ষ্মতা হারান)। বন্ধুরা বলে কবিদের কল্পনায় একজন নারী থাকতে হয়, এ নাকি 'একরকম তান্ত্রিক নায়িকাসাধনা'। তো গল্পের ঘটনাপ্রবাহে স্ত্রীও একজন পুরুষকে কল্পনা করে কবিতা লিখতে শুরু করেন, সে কবিতাও খুব জনপ্রিয় হয়ে যায়। গৃহে অশান্তি বাধে। অবশেষে দু'জনেই কবিতা লেখা থেকে নিজেদের নিরস্ত করেন। অর্থাৎ কবিতাতেও সেই এক ধরণের উর্বশী কামনা রয়েই গেছে পুরুষদের, যা মহিলাদের ক্ষেত্রে হলে সামাজিক ন্যায়নীতির ভিত নড়ে যাবে, কারণ সতীত্ব শব্দটা নারীত্বের দায়।
        উর্বশী ঘরের লোকও নয়, তথাকথিত বারবনিতাও নয়। উর্বশী স্বতন্ত্র। তার রূপ থাকবে, কাম থাকবে, আকর্ষণ করার ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু বাঁধন থাকবে না। তাকে মানুষ হলে চলবে না। তাকে কল্পনা আর কামের মধ্যবর্তী স্থানে দাঁড়াতে হবে যে জায়গাটা ভরিয়ে রাখবে শিল্পের আচ্ছাদন। কেউ নাক সিঁটকালেই বলব, বর্বর, এর মধ্যেও নোংরামি খোঁজে, আরে বাবা আর কবে নিজেদের আধুনিক করবি রে বাপ! বিদেশে এমন মানুষ রাস্তায় হেঁটে গেলেও কেউ তাকায় না। আমাদের কল্পনার সেই 'বিদেশ' আর স্বর্গসুখবাসনার খুব একটা পার্থক্য নেই।
        তাই নারী তুমি উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াও। ভয় নেই, তাতে আমার পুরুষাঙ্গ উত্তেজিত হবে না, উত্থিত হবে না, আমার মধ্যের শিল্পের তৃষ্ণা দাবানলের মত বেড়ে উঠবে। আমি মুগ্ধ হব। আমি তারিয়ে তারিয়ে তোমায় দৃষ্টিসুখে ভোগ করব। আমি বলব, ব্যাপারটা আসলে ভীষণ নান্দনিক বুঝলেন, এ রস সবার জন্য না। আমার অমনি সেই সুরসভার কথা মনে পড়বে। সেখানেও নানা উর্বশীর গল্প। তারা নৃত্যগীতে পারদর্শী। তারা নানা অঙ্গ-বিভঙ্গ, ছলা-কলায় পারদর্শী। তারা নান্দনিক, কেবল নান্দনিক, শুধুই নান্দনিক।
        রবীন্দ্রনাথে উপসংহার টানি -

নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ, সুন্দরী রূপসী,

          হে নন্দনবাসিনী উর্বশী!
গোষ্ঠে যবে সন্ধ্যা নামে শ্রান্ত দেহে স্বর্ণাঞ্চল টানি
তুমি কোনো গৃহপ্রান্তে নাহি জ্বাল সন্ধ্যাদীপখানি,
দ্বিধায় জড়িত পদে কম্প্রবক্ষে নম্রনেত্রপাতে
স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে
               স্তব্ধ অর্ধরাতে।
        উষার উদয়-সম অনবগুণ্ঠিতা
               তুমি অকুণ্ঠিতা।

সুরসভাতলে যবে নৃত্য কর পুলকে উল্লসি

          হে বিলোলহিল্লোল উর্বশী,
ছন্দে ছন্দে নাচি উঠে সিন্ধুমাঝে তরঙ্গের দল,
শস্যশীর্ষে শিহরিয়া কাঁপি উঠে ধরার অঞ্চল,

তোমার মদির গন্ধ অন্ধবায়ু বহে চারি ভিতে,

মধুমত্তভৃঙ্গসম মুগ্ধ কবি ফিরে লুব্ধচিতে
               উদ্দাম সংগীতে।
         নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা
               বিদ্যুৎ-চঞ্চলা।

363
Fri, 08/17/2018 - 11:27

        রুচির বৈষম্যতা আর রুচির মান এক কথা কি? খাদ্যে রুচির পার্থক্য হয়েই থাকে। টক, ঝাল, মিষ্টি, অম্ল ইত্যাদি নানা স্বাদের বৈষম্য থাকে। তাতে কারো কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে কোনো তথ্য কোথাও লিপিবদ্ধও নেই। কিন্তু খাদ্য-অখাদ্যের বিচার যখন আসে তখন যদি কেউ সেই বিচারের ক্ষেত্রকে রুচির বিচারের ক্ষেত্রর মধ্যে নিয়ে আসে? অখাদ্যকে রুচির তারতম্য বলে চালাতে চায়? তখন বুঝতে হবে এই ক্ষেত্রে তার নিশ্চয় কোনো স্বার্থ আছে অথবা নিতান্তই নির্বোধ সে। 
        সদ্য যে দু’জন রাজনীতিবিদ প্রয়াত হলেন, শ্রদ্ধেয় বাজপেয়ীজি ও সোমনাথবাবু, তাঁরা ভারতবর্ষকে যে রাজনীতির সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন তা হল রুচির রাজনীতি। ভাষায়, সিদ্ধান্তে, আচরণে, বিরোধিতায়, কটাক্ষে, উপেক্ষায়, সাহসিকতায় - মার্জিত রুচির উদাহরণ বুঝিয়েছিলেন। আমাদের লোকসভা, বিধানসভার মত ভাষা, কালচার, অর্থনৈতিক অবস্থান, ধর্ম ইত্যাদির বৈচিত্রময়তা সারা বিশ্বে আরেকটা পাওয়া ভার। সেখানে গ্রাম্য ভাষা, ভায়োলেন্স থেকে শুরু করে অশোভন চুটকি সবই চলে এসেছে, আনপার্লিয়ামেন্টারি হয়েও থেকে গেছে। এসবের মধ্যে নিজের রুচির মর্যাদা রক্ষা করে কাদার ছিটা গায়ে মেখেও কাদা না ছিটিয়ে তারা জলের ব্যবস্থা করেছিলেন। যাতে করে শুধু নিজের গায়ের কাদা না, তাদের সতীর্থদের কাদাও ধুয়ে যায়। যা বাস্তবিক যায়নি। 
        রুচির কথায় প্রথম যে কথাটা আসে তা হল ভাষা। একজনের হিন্দী ও অন্যজনের ইংরাজি ভাষার শব্দ চয়ন কখনও শালীনতার মাত্রা ছাড়াত না। অথচ রসবোধ যে কম হত তাও নয়। নানা ভাষণে বিশ্বের নানা কবির উদ্ধৃতি বহুবার শুনেছি প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ধীর, সৌম্য উচ্চারণে। সমৃদ্ধ হয়েছি। 
        আজ ছবিটা শুধু ভারত বলে না সারা বিশ্বে সাংঘাতিকভাবে বদলে যাচ্ছে। আমরা চাইছি রামরাজ্য, আমেরিকা চাইছে রাহাজানির গুণ্ডামি, সাথে কোরিয়া চাইছে হিটলারের মত শাসন, পুটিন চাইছে সারা বিশ্বের লেনিনের ধারার অন্ধ অনুসরণ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে প্রবল জাতীয়তাবোধের একটা ঢেউ উঠেছে। যে জাতীয়তাবোধ আত্মসম্মানের না, আত্মপক্ষ সমর্থনের, যা অন্ধ আবেগ তাড়িত। তার একটাই উদ্দেশ্য নিজেকে পৃথক রাখা, অন্য অর্থে বিচ্ছিন্নতাবাদ। সব মিলিয়ে সারা বিশ্বজুড়ে একটা 'পিছনে এগিয়ে চলোর' মত দশা। 
        আমাদের শরীরে অটো ইম্যুউন বলে একটা রোগ হয়, যাতে আমাদের নিজেদের ইম্যুউন সিস্টেম নিজের শরীরের বিরুদ্ধেই কাজ করে নিজের শরীরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। আজ আমাদের সারা বিশ্ব সেই অটো ইম্যুউন রোগে আক্রান্ত। 
        আমরা উন্নতি বলতে বুঝেছিলাম উদার উন্মুক্ত সুস্থরুচির মানবিক সহাবস্থান। যার মূলে থাকবে বিদ্বেষ রহিত চিন্তাধারার প্রসার জীবনের অববাহিকায়। কিন্তু সেই বিদ্বেষরাহিত্য আজ কোথায়? জগতে দুটো সত্য ধ্রুব, এক অনিশ্চয়তা আর দুই পরিবর্তনশীলতা। এর মধ্যে মানুষ যে আলোক নিজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জেনেছিল তাকে বলেছিল - প্রজ্ঞা বা উইজডম। যার মূল ভিত বিদ্বেষরহিত মনোভাব ও সহিষ্ণুতা। তার চর্চা আজ কোথায়? 
        বিজ্ঞান আমাদের জ্ঞান দিতে পারে কিন্তু প্রজ্ঞা দিতে পারে না। আজ বিজ্ঞান প্রযুক্তির দাস। সেদিন রোমে তথা গ্রীসে যে বিজ্ঞান মানুষের চেতনায় জন্ম নিচ্ছিল সেদিন সে ছিল মানুষের জ্ঞানতৃষ্ণার সেবক। আজ সে দাস মানুষের লোভের। কারণ মানুষ জানে বিজ্ঞানের চাইতে বিজ্ঞানজাত প্রযুক্তির কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। প্রযুক্তি তার লোভ তার হিংসাকে আরো নিপুণ আর বিস্তারিতভাবে প্রয়োগের জন্য অনেক বেশি কাম্য, তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের চাইতে। তাই বিজ্ঞান আজ দাস। দাসত্বের নীতিবোধ আর রুচির শালীনতা থাকে না। যা থাকে তা হল ঈর্ষা আর দ্বেষ। যা আজকের বিশ্বের মূল চালিকা শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 
        তত্ত্বের থেকে বেশি শক্তিশালী চরিত্র। সমস্ত মানবিক শক্তির মূল শক্তি তার চরিত্র শক্তি। ঘন অন্ধকারেও যে আলোর দিকে তাকায় সে মানুষের মঙ্গলের প্রতি বিশ্বাস। তারপর সেই আলোর দিকে পথ রচনা করে যুক্তি। প্লেটোর সেই বিখ্যাত উপমা গুহার কথা স্মরণ করাই, তার অমর গ্রন্থ 'রিপাব্লিকে'। 
        ক্রমশ অন্ধকারে প্রবেশ করতে করতে আবার সেই বিশ্বাসের দিকে পথ চেয়ে থাকা, সেই বিশ্বাসীর দিকে পথ চেয়ে থাকা, যে আলোর দিকে তাকিয়ে তার শুভ যুক্তিগুলো সোপানের মত মানব সমাজের সামনে রেখে দেবে যাতে আবার বর্বর, অসংস্কৃত অতীত থেকে আমরা সামনের দিকে, আলোর দিকে হাঁটার বল পাই।

364
Tue, 08/14/2018 - 17:45

        ডারউইন মহাশয়ের মতে সংগ্রামই হল টিকে থাকার মোদ্দা কথা। কিসের জন্য সংগ্রাম? না অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। আমাদের কিসের জন্য সংগ্রাম? না সুবিধার জন্য। সবার থেকে বেশি সুবিধার মধ্যে আমি বাঁচতে চাই। যে 'বেশি সুবিধা'র কোনো নির্দিষ্ট পরিমাপ নেই, থামার জায়গা নেই। 
        একটি ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে শুরু করি। আমায় চক্ষু চিকিৎসক বললেন, আমার বাই-ফোকাল চশমা লাগবে এখন থেকে, কারণ আমি প্রেসবায়োপিয়ায় এসে পড়েছি, চল্লিশ উত্তরণের সাথে সাথেই। অর্থাৎ, আমার চশমার জমি দ্বিধাবিভক্ত হবে, উপরের অংশ দূরের আর নীচের অংশ কাছের। আরো শোনা গেল যে আরেক ধরণের চশমা হতে পারে, তার দাম বেশি; তাতে দূরের, মধ্যের আর নিকটের --- তিনটে পাওয়ার অ্যাড করা থাকবে, তার নাম 'প্রগ্রেসিভ'। ভালো কথা। পরীক্ষার জন্য দুই পক্ষই বানানো গেল। একটা স্বল্পমূল্যর আরেকটা অতিমূল্যর। বেশ বুঝলাম, প্রগ্রেসিভের একটা মজা হল মাঝে কোনো বিভেদক রেখা না থাকায় লোকে বুঝবে না আমার বয়েস হচ্ছে। অর্থাৎ কিনা, 'বুড়োদের মত' চোখের নীচে অর্ধচন্দ্রাকার গোল্লা দেখা দিয়েছে - এমন কথা ভাবানোর সম্ভাবনা নেই। কিন্তু এছাড়াও অনেকেই বললেন প্রগ্রেসিভ বেশ সুবিধার চশমা। অবশ্যই তাই। 
        কিন্তু মুশকিল হল সুবিধা আর সাধের দ্বন্দ্ব। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি। প্রগ্রেসিভে লেন্সের সমস্যা হল তার বাইরের পরিধির দিকের দুইপাশে দুটো ব্লার জোন অর্থাৎ অস্পষ্ট অঞ্চল থাকে। মাঝের করিডোর দিয়ে নিজের দৃষ্টি অ্যাডজাস্ট করার অভ্যাস করতে হয়। যত বেশি টাকা দেওয়া যাবে তত সেই করিডোরের অঞ্চল বাড়বে, কিন্তু অস্পষ্ট অঞ্চল শূন্য হবে না, সে থাকবেই। খানিক ঠুলির মত। কাউকে কটাক্ষে দেখা যাবে না স্পষ্ট, সম্পূর্ণ মুণ্ডু তার দিকে ঘুরিয়ে দেখতে হবে।
        তো যেটা বলছিলাম, দ্বন্দ্ব শুরু হল সুবিধা বনাম সাধের। আমি দেখতে চাই গোটা আকাশ, গোটা মাঠ, দিগন্তরেখা। কিন্তু প্রগ্রেসিভ আমায় বলল, দেখো আমি তোমায় কাজের সুবিধা করে দিতে পারি, কিন্তু দেখার সুখটা তো দিতে পারি না। দেখে সুখ আর দেখার সুখ --- দুটো আলাদা কথা। কাজের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে তা হল দেখে সুখ, আর আমি চাইছি দেখার সুখ। আমি আদিগন্ত চেয়ে থাকব, আমার দৃষ্টির সমস্তটা দিয়ে প্রকৃতির মাধুর্যে অবগাহন করব তবেই যে না বেঁচে থাকার সুখ! আমি যে নিতান্তই একটা কাজের মানুষ নই এটা কাকে বোঝাই। তাই অনেকের যা ধর্তব্যের মধ্যেই না, আমার কাছে তা-ই পরম মূল্যবান। আমি যে একবিন্দু দেখা থেকেও নিজেকে বঞ্চিত করতে চাই না, এমনকি তা চোখের কোনার দেখাটুকুও না। আমি যে সারাদিন কম্পিউটার আর চার দেওয়ালের মধ্যে কাটিয়ে দিনযাপন করি - তা তো নয়!
        অগত্যা আমি সব ত্যাগ করে আমার সাধের বাই-ফোকাল চশমায় ফিরে এলাম। জীবনে সুখ বলতে যে দুটো, এক পড়া আর দুই দেখা - সে হতে নিজেকে আর বঞ্চিত হতে হল না। পড়ার চশমা আর দেখার চশমা আলাদা হল। আমি শান্তি পেলাম। হিসেবী বলল, কিন্তু এতগুলো টাকার চশমা?! আমি মনে মনে বললুম, আর আমার গোটাটা দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণা? হিসেবী বলল, ঢং! আমি বললুম, হ্যাঁ তো, আমার বেঁচে থাকার ঢং।
        সেই নিয়েই কথা। সুবিধা বনাম সাধ। জীবনে যদি সুবিধাটাকে বড় করে দেখি, তবে সরকারি মতে ডেথ সার্টিফিকেট না বেরোনো অবধি বেঁচে রইলাম সন্দেহ নেই, কিন্তু মনের মধ্যে যে মরে রইলাম, সে খবর কে রাখবে? আমার সাথে আমার বিধাতার যে অংশে একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক সে আমার সাধের সম্পর্ক। সেইখানে আমার বিধাতা আমায় একান্ত মৌলিক করে গড়েছেন। রস নিয়ে তর্ক চলে না। 'তুমি কেন উস্তাদ আমির খাঁ'র বাগেশ্রীতে কঁকিয়ে ওঠো না' বলে তর্ক জোড়া যায় না। সে আনন্দ চিত্তগত। সে উপলব্ধি আত্মগত। জীবনের যে সাধকে সুবিধার উপরে রেখে মানুষ পায়, তাতেই সে নিজেকে পায়। তাই তেনজিং নোরগের পাহাড়ে চড়া আর আমার বাইশ তলায় লিফটে ওঠার মধ্যে একটা পার্থক্য রচনা হয়। আর যারা সাধের গলা টিপে সুবিধার দিকে ঝোঁকে, এমন মানুষের তর্কের রাজ্যে জিততে অসুবিধা হয় না বটে, কিন্তু নিজের অন্তঃকরণের দৈন্যের পীড়া থেকে মুক্তি মেলে কি? তার অন্তরের দৈন্য প্রতি মুহূর্তে বাইরের প্রাচুর্যের মধ্যে সান্ত্বনা খুঁজে ফেরে। বাইরে মেলা বস্তু জমিয়ে সবাইকে দেখার জন্য ডাকে। সহজ সুখের সুক্ষ্মতা যত কমে, উত্তেজনার দরকার হয় তত বেশি। শুরু হয় অন্যের ঈর্ষায় নিজের ঈর্ষার সার্থকতা খোঁজা। বৈভব পাঁচিল তৈরি হয়। তার তোষামুদে, সুবিধাবাদীদের সংখ্যা যত বাড়ে, নিজের ভিতরের একাকীত্ব তার তত ভারি হয়ে ওঠে। সাধের ছায়া প্রেতাত্মার মত ঘুমের মধ্যে এসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তখন ব্যস্ততার মাত্রা বাড়িয়ে পালাবার পথ খুঁজে বার করা ছাড়া আর অন্য কোন পথ থাকে না।
        তবে সাধের উপর আরেকটা শব্দ থাকে, কর্তব্য। একমাত্র এই কারণে যে মানুষ তার সাধকে ত্যাগ করে সে দৈন্যের শিকার হয় না। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি, কর্তব্যের নামে যাকে সাজানো হয়েছে, আসলে তা সুবিধার প্রতি আনুগত্য। তাই কর্তব্যের নামে যেটা থাকে, তা সমাপনের পর আত্মতৃপ্তির ঔজ্জ্বল্যতাটা চরিত্রে জ্বলে কই? সে কপট কর্তব্যের মূলটা টানলেই সুবিধাবাদীর চেহারা বেরিয়ে পড়ে। আত্মপ্রবঞ্চকের চেহারা হয়ে আসে। যে নিজের সাধকে হত্যা করতে পারে সুবিধার জন্য, সে সব ধরণের অমানবিক কাজ করতে পারে। তার ভালোবাসাও সুবিধার নামান্তর। সাধের না। সাধ ঐশ্বরিক। সুবিধা আসুরিক। তাই প্রথমটায় সাধনা, পরেরটায় চেষ্টা। 
        সাধ মানুষকে পরিপূর্ণতা বোধের দিকে নিয়ে যায়। থামতে শেখায়। সাধ বলে, লোভ না, আমায় পূর্ণ করার দায় তোমায় নিতেই হবে, নইলে তুমি ব্যর্থ হবে যে! 
        সুবিধা বলে, বোকার হদ্দ হোয়ো না, ওসব আবেগ-টাবেগ সমূলে উৎপাটন করে একটা কাজের মানুষ হও দিকিনি, তখন বুঝবে বেঁচে কি সুখ!
        সাধ বলে, তুমি ভিখারি, চিরকালের ভিখারি হয়েই থেকো। তোমার দুর্ভাগ্য তুমি থামতে জানো না, বাধ্য হয়ে থামো, তৃষ্ণা নিয়ে থামো। তাই তোমার থামাটা যন্ত্রণা, সুখ না। আমার সে পথ নেই, আমার চলার প্রথম ধাপ থেকেই আমি পূর্ণতার আশ্বাস, আনন্দ।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার - এই লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে একজন মানুষের নাম যদি না করি। আমাদের টুবলুদা ওরফে সন্দীপ ভট্টাচার্য। বাইরের দিক থেকে তার একটা চশমার দোকান (দূর্গা অপটিক্যাল), কিন্তু আদতে মানুষটা আদ্যন্ত একজন গবেষক। লেন্স নিয়ে এমন অগাধ ভালোবাসা আর জ্ঞান আমি এযাবৎ আর কারোর মধ্যে দেখিনি। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি সব সময়ে প্রস্তত। আমার উপরোক্ত কাণ্ড-কারখানায় এ মানুষটাকে পাশে না পেলে মুশকিল হত। আমার পাগলামিকে ইনি বেশ গুরুত্ব দিয়ে শোনেন, যে সমস্যার কথা কাজের বাইরের কথা, সেই সমস্যাকেও গুরুত্ব দেন। ফলে এমন বৈজ্ঞানিক রসজ্ঞ মানুষের তত্ত্বাবধানে আমি এ যাত্রায় তরেই গেলুম।]

365
Tue, 07/31/2018 - 12:00

        সবার শেষ কথা কি বাজারে কাটতি? বক্স অফিস হিট? এমন একটা ধারণার বিপরীত মানে কি আঁতলামি? বলা হয় আঁতেল শব্দটা নাকি ইন্টেলেকচ্যুয়ালের ফরাসী উচ্চারণের অপভ্রংশ। হবে হয় তো। তবে কথাটা ব্যঙ্গাত্মক এই নিয়ে সন্দেহ নেই। 
        তবে যে কোনো সৃষ্টির অনুপ্রেরণার উৎস কি হবে? বাজারের চাহিদা না নিজের বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্কুশাঘাত? বলা শক্ত। কারণ এই দুইয়ের মধ্যে যে বিচরণ করে সে চরিত্র। আমি কোন দিকে ঝুঁকব, কতটা ঝুঁকব আর কেনই বা ঝুঁকব - তার মাত্রা, বিচারের ভার আমার চরিত্রর। মূল মানসিক গঠন। 
        সমস্যা হল যখন ছদ্ম আঁতলামি আর শুদ্ধ আঁতলামির মধ্যে ফারাক করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমি আঁতলামি শব্দটাই বেছে নিলাম, শব্দটা ব্যঙ্গের হলেও খোঁচাটা আরামদায়ক। খোঁচায় কোথাও একটা মান আছে। ছদ্ম আঁতলামির আত্মপ্রসাদের দোকানে যে মাছি ওড়ে আর শুদ্ধ আঁতলামির রুক্ষতায় যে মরীচিকা - এই দুইকে চিনতে শিখলেই সমস্যার সমাধান হয়। কিন্তু মরীচিকার ভয়ে অনেকেই পথ বদলায়, যেন সেই চিটেগুড়ের আত্মপ্রসাদে পচন ধরবে না কোনোদিন, এমন ভাব। মরীচিকা একদিন মিলিয়ে গিয়ে ধাঁধাঁ কাটায়, কিন্তু সম্পৃক্ত আত্মপ্রসাদ বিকারের বেশি আর কিছু অবশেষে দিয়ে উঠতে পারে না। 
        যে কারণে লিখতে বসলাম। আমাদের লেখায় মৌলিক প্রবন্ধের অভাব। প্রবন্ধ রাজনীতি, ধর্ম, সমাজ, খেলাধুলা, সঙ্গীত সাহিত্য যে কোনো বিষয়ভিত্তিক হতেই পারে। কিন্তু সে ছাড়াও আরেক বিশেষ ধরণের প্রবন্ধ হয়, যা শুধুমাত্র চিন্তার উৎকর্ষতার তাগিদেই সৃষ্টি। দর্শন তার উচ্চতম শিখর নিঃসন্দেহে। সেখানে চিন্তার জন্যেই চিন্তা, কোনো কিছু প্রমাণ বা প্রতিষ্ঠার জন্য না। সত্যান্বেষণের তাগিদেই দুরূহ পথে এগোবার দুঃসাহস রাখা সে পথে। মানুষ ভ্রান্তির আঁশ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে বোধের অন্তঃকরণে প্রবেশ করে, পথ খোঁজে, আলো দেখার প্রয়াস পায়। সত্যতে প্রবেশ করে সত্য হয়। সৎ সাহিত্যের জন্ম হয়। 
        এই কথাটাই মূল - সত্য। সত্য অর্থে আমি ইংরাজিতে যাকে ফ্যাক্ট বা বাস্তব বলতে বোঝায় তা বলছি না, সত্য বলতে আমি বোঝাতে চাইছি একটা সৎ দৃষ্টিভঙ্গী। মানুষ নিজে একটা জটিল বহুমাত্রিক ধারাবাহিক সত্তা। এই ধারাবাহিক সত্তার মধ্যে মূলসুর খোঁজার একটা তাগিদ থেকে জন্মায় সত্যের অন্বেষণ, শুধু বিচার দিয়ে নয়, নিজের সমস্ত অন্তঃকরণটা দিয়ে। হয়ত আমি এই অন্তঃকরণ শব্দটা দিয়ে স্বজ্ঞা বা ইনট্যুইশান ইঙ্গিত করতে চাইছি যা অভিজ্ঞতা সঞ্জাত। 
        রাশিয়ায় দস্তোইয়েভস্কির 'ব্রাদার্স কারামাজোভ' এর মতন আরেকটা সৃষ্টি বিশ্বের সারা লেখনীর ইতিহাসে বিরল। আমি বহুবার বইটার উল্লেখ করেছি, কারণ যা কিছু পড়ার পর এই বইটার সমতুল্য কোনো ক্ষুরধার দুঃসাহসী মানবিক বিশ্লেষণের উদাহরণ আমি আর কোনো লেখনীতে পড়ে উঠিনি আজ অবধি, পেলে অবশ্যই স্বীকার করব। 
        মানুষ আর তার মন একটা অসীম রহস্য। তার শরীরও কম কিছু নয়। সে শরীরের রহস্য উন্মোচনের দায়ভার নিয়েছে বিজ্ঞান। মানুষের অন্তঃস্থলের সত্য উন্মোচনের দায় সাহিত্যের, ওরফে ভাষার। ভাষা যেন দড়ি-বালতি। সেই দড়ি-বালতি কুয়োতে নামানো হবে কুয়োর কতটা গভীরে সে যেতে পারবে সেই তাগিদ নিয়ে। সে নিয়ে আসবে শুদ্ধ জল। কিন্তু শুধু দড়ি-বালতি নামানোর নানা কৌশল রপ্ত করে, রঙীন দড়ি আর অলঙ্কৃত বালতির মোহে কুয়োর গভীরে যাওয়ার তাগিদকে এড়িয়ে যাওয়াটা নিতান্তই জোচ্চুরি। তাতে প্রচুর কোলাহল হয়, প্রচুর হাততালি মেলে, প্রচুর খ্যাতি হয়, কিন্তু কাদের সামনে? যারা একটা ঝিনুক নিয়ে এসেছে সমুদ্রের সামনে। তাদের ঝিনুক ভরার খ্যাতিতে দিন কাটালে দিনের শেষে যা জমে তা শুধুই ফাঁকি। অবশেষে সে ঝিনুক যায় ভেঙে, অথবা সেই স্বল্প জল কালের মার্তণ্ডে কখন যায় শুকিয়ে। যা পড়ে থাকে তা কেবল ফাঁকি - মুখব্যাদান করে, মহাকালের দরবারে ভিখারির বেশে। এতে মানুষের গৌরব নেই। এতে শুধু আড়ম্বর আর সজ্জা-কৌশল আছে। যদি বলো সেও কি কম মূল্যবান, তবে আমার কিছু বলার নেই। সে মূল্যের মূল্য দেওয়ার মত সময় বা রুচি, বিধাতা আমাদের বোধহয় দেননি। তাই বিশ্ব দরবারে নিজেদের মহিমা নিয়ে দাঁড়াতে গেলে এত ম্লান হয়ে আসে আত্মপ্রসাদের দুর্বল শিখার তেজ আমাদের। 
        সত্য খোঁজার তাগিদ জীবন থেকে আসে। কারণ জীবনটা সত্য-মিথ্যা উভয়ের নিটোল বুনন। "তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী"... কবির অন্তিম উচ্চারণ প্রায়। সন্ন্যাসী গুহার গভীর অন্ধকারে নিজের মনের মধ্যে ডুবে যে সত্য আবিষ্কার করে আর শেয়ার মার্কেটে দীর্ঘদিন কাটানোর পর একজন সুচতুর বিজ্ঞ বাজারের যে সত্য আবিষ্কার করে, এই দুটোই জীবনের পক্ষে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। কারণ জীবনটা অবিনশ্বরও নয় ঈশ্বরের মত আবার লাভ-লোকসানের তরল হিসাবও নয় বাজারের মত। তবে? তাকে এককথায় বলতে চাওয়ার মত মূর্খামি যার যেই করুক সৎ সাহিত্য কোনোদিন করেনি। সে দুই অতিবাদকে অর্থাৎ ত্যাগ-ভোগ এই দুইয়ের তত্ত্বকেই দূরে রেখে নিজের চলার পথ খুঁজতে চেয়েছে, আবিলতা সরিয়ে, প্রেয়ের ঊর্দ্ধে শ্রেয়কে স্থান দিয়ে। সব সময় পারেনি, এও সত্য। তবে চেষ্টা করেছে। প্রেয় আকাঙ্ক্ষীর দল ব্যঙ্গ করেছে, বিদ্রুপ করেছে, তবু সে তার অন্তরের ঋজুতা থেকে সরে আসতে চায়নি। কারণ সে জানে বাজারের হাওয়ার খেয়া ভাসালে হয়ত কুবের হতে পারবে ধনে-মানে কিন্তু ধ্রুবতারার সাথে বিচ্ছেদ ঘটবে চিরকালের। মানব সভ্যতার যে যাত্রাপথে সে চলতে চাইছে, অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার সে স্রোত কোলাহল থেকে অনেক দুরে। নিঃশব্দ নীরব সে চলায় বিরাম টেনে নিজেকে ব্যর্থ করার কোনো অর্থই হয় না বাজারি লাভের লোভে। অধ্যাত্ম সাধনায় মুক্তি আর বাজারে লাভ - দুই ব্যক্তিগত। সাহিত্য সে ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থসিদ্ধির জন্য না। এ সিদ্ধি সবার। তার মূল্য সত্যকারের তৃষ্ণায়। সে তৃষ্ণা জাগলে পরে তবে সে সেই তৃষ্ণা নিবারণের আনন্দ উপলব্ধি করে। সার্থক হয় লেখক আর পাঠকের নিভৃত একান্ত আলাপন। সে যাত্রাপথের আনন্দগান পৃথিবীর কোনো না কোনো ভাষার লেখনীতে ফুটে ওঠেই, আর সে বাজার ছাপিয়ে, কালের স্রোতে ভেসে পথিকের হাতে আসবেই, বণিকের কাছে মূল্যহীন হয়ে। বণিকের কাছে সে নিছক আঁতলামিই।

366
Sun, 07/29/2018 - 14:03

        বঞ্চিত হওয়া আর ত্যাগ করা একই কথা তো নয়। দৃষ্টির সামনে যে অসীম জগত তার একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্বে নিজেকে স্বীকার করে বাঁচতে চাওয়ার অভ্যাস - এই তো কথা? একি সামান্য কথা? আমার এই 'আমি' জাগতের কাছে অতিতুচ্ছ একটা অস্তিত্ব হলেও, আমার নিজের কাছে তো সে আছে বলেই জগত সংসার! আমি না থাকলে জগতের তিলমাত্র অভাব হবে না, কিন্তু আমি না থাকলে আমার দেখা-শোনার এই জগতটাও যে সাথে সাথে হারিয়ে যায়। 
        এই ব্যক্তিগত আমির উপরে দাঁড়িয়ে যে সমষ্টিগত জগত - এ এক আজব রহস্য। পিলসুজের উপর রাখা প্রদীপ, তার শিখাতে অধিকার সমস্ত জগতের, কিন্তু পিলসুজের ভার একার আমার। কাউকে বলা যাবে না, "ভাই একটু আমার হয়ে প্রদীপটা ধরবে, আমি যে আর এ প্রদীপের ভার বইতে পারি না"। হয়ত সে ধরবে, তবে সে তার অনুকম্পা, আর যদি সে না শোনে তবে সে তার অধিকার, তার ইচ্ছা। দুই বাস্তব, দ্বিতীয়টার উদাহরণই প্রবল। 
        এই একার 'আমি' র উপর দাঁড়িয়ে যে 'দশের আমি' তাকে রক্ষা করে চলার দায় সম্পূর্ণ নিজের। 'দশের আমি' মানে নানা আমি, সে আমি দাদা, ভাই, শিক্ষক, বন্ধু, প্রতিবেশী ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সবের মূলে যে আমার 'একা আমি' সেই সে পিলসুজ। আমার অক্ষয় আনন্দ, আমার অক্ষয় সত্তা, আমার অক্ষয় অস্তিত্ব। অক্ষয় বললাম যে? হ্যাঁ অক্ষয় তো, কারণ সেই মূল ক্ষয় হলে যা থাকবে তাকে জানবে কে? তাই আমার সেই 'একা আমি' র বোধের সম্মুখে যে ঘটনাপ্রবাহ সেই আমার ক্ষয়শীল, আমি নই। এ আমি সেই বেদান্ত মতের অমর আত্মা নই। আমার এ আমি নিতান্ত আমার দেহ নির্ভর চেতনার স্রোত। জগতের কাছে যা লক্ষকোটি স্রোতের একটি, কিন্তু আমার নিজের কাছে যা একান্ত অবলম্বন, সম্বল। 
        কেন তবে আনন্দ বললুম? অবশ্যই আনন্দ। আমি যেখানে কেউ নই, যেখান আমার কোনো সমাজগত পরিচয় নেই, কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই, সেই যে মৌলিক একা আমি সেখানে যদি আনন্দের স্রোতের সন্ধান না পাই, তবে সমাজে আমার ভিখারির দশা থেকে মুক্তি দিতে স্বয়ং ঈশ্বরও অপারগ হবেন। আমার সেই মূল আমি, পিলসুজ আমিতে আমার আনন্দের বোধ - কিছু পেয়ে নয়, কিছু হারিয়ে নয়, সে আনন্দ আমার অস্তিত্বের গভীরতম আনন্দ। তাকে ভোগ করা যায় না। যে আনন্দ ভোগ্য, তা সুখ। সে আনন্দে আমি আনন্দময় হয়ে উঠি, আর বাইরে সে কিছু নয়। এর বাইরে সংসারে যা কিছু তাই হরণ যোগ্য, কেবল আমার এই হয়ে ওঠাটা বাদ দিয়ে। তাই সে আনন্দ আমার পিলসুজের আনন্দ। সে আনন্দের প্রস্রবণ আমার সমস্ত কাজে, চিন্তায়, একাকীত্বে, সঙ্গসুখে। সেই আমার পরম আশ্রয়, আমার নির্বিষাদ ঘন আমার মধ্যে আমার নিবিড় মুহূর্ত। 
        আমার অস্তিত্ব আমার সত্তা। সময়ে অসময়ে তাকে ডাকার মত সাহস যেন আমার থাকে। সব কিছু হারালেও যেন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারি, আসলে যা হারিয়েছি, তা এককালে পেয়েছিলুম বলেই হারিয়েছি, তারা আমার ছিল না। যা হারালো তা 'দশের আমি' থেকে কোনো এক 'আমি' র খসে পড়া। মন যেন একবার পিলসুজের দিকে তাকিয়ে দেখে, আসল যে আমি, তাকে হারানো যায় না, এ বিশ্বাস যেন সে রাখে। এ সত্তা যেন আমার চোখ। চোখ বন্ধ করলেই যেমন আমার পরিদৃশ্যমান জগত একটা অন্ধকার পর্দার আড়ালে বিলীন হয়ে যায়, এও সেরকম। আমার চোখের অস্তিত্বের মতই আমার সেই 'একা আমি'র দৃষ্টির সামনেই তারা সব দাঁড়িয়ে। সংসারের নানা ঘটনা থেকে দুঃখ, সুখ, আনন্দ, বেদনা যে ভোগ করছে সেও আমার সেই 'একা আমি' র একজন মিথ্যা প্রতিবিম্ব। সে মিথ্যা বলেই এত অল্পতে ভেঙে পড়ার অভিনয় করে, নানা ছদ্মবেশে সব কটা আমির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে রাখে, তাকে আমরা বলি অহং - সে মিথ্যা, সে তোলা আদায়কারীর মতই মিথ্যা। তার আড়ম্বর, তার রাগ, অভিমান, ভয়, শোক সব মিথ্যা। সে সেজে থাকা রাজা। আসল রাজা আমার অভ্যন্তরের নীরব সাক্ষী। আমার 'একার আমি', পিলসুজের আমি। সে কি তবে নির্বিকার? তা নয়, সে শুধু নানা অভিজ্ঞতার জ্ঞাতা, তাতেই তার আনন্দ। আমার মিথ্যা অহং যখন মাথাকুটে মরছে, কারণ তার দীর্ঘদিনের প্রেমের স্বপ্ন বিশ্বাসঘাতকতার এক ধাক্কায়, এক লহমায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তখন সেই 'একার আমি' তাকে বলে ওঠে - স্বপ্ন ভেঙেছে, কিন্তু সেই ভাঙার মধ্যে দিয়ে তুমি একটা সত্যকেও কি জানলে না? সেই সত্য কি এতই মূল্যহীন? মোহভঙ্গের দুঃখ ক্ষণিকের কিন্তু মোহভঙ্গের সুখ চিরকালের। একি সত্য নয়? 
        হ্যাঁ তাই সত্য। সেই সত্য যা আমার এই 'একা আমি' পিলসুজের মত ধারণ করে সংসারে নানা ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে। এর বাইরে যা, তাকে মিথ্যা বলি না, তবে তা আমার বলে সত্য বলি না, তা আমার ক্ষণিক প্রতিবেশীর মত সত্য। ক্ষণকালটাই সত্য, চিরকালটা শুধু আমার একার ঘরে আমি হয়েই সত্য। এই দুইয়ের ব্যবধানটা ঠিক ভাবে মেনে নিয়ে চলতে পারলেই দিশাহারা হই না। সুখী হতে হবে এমন দিব্যি দিয়ে তো কেউ পাঠায়নি, মূর্খ না হলেই হল। জীবনে তৃপ্তি থাকুক, পূর্ণতা থাকুক, আনন্দ থাকুক। এরা কেউ কিছুতে নির্ভরশীল নয়, এতেই বিশ্ব-সংসারের বাকি সুখগুলো নির্ভরশীল, এটা বুঝলেই আর এর দরজায় ওর দরজায় সুখের জন্য হাত পেতে ঘুরে বেড়াতে হয় না, নিজের দরজাটা হাট করে খুলে রাখলেই হল। আসা যাওয়া দুয়েতেই আনন্দ তখন। অভিজ্ঞতার আনন্দ, সুখের না। পিলসুজের আনন্দ। শিখা নিভলেও যে থাকে, অন্ধকারে একা।

367
Fri, 07/27/2018 - 14:30

        গুরু যেদিন ব্যক্তিত্ব থেকে ব্যক্তি হল সেদিনই বিপদ হল। বিদ্যা আর দক্ষতার বলে চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, উকিল, রাঁধুনি, মুচি, জমাদার। কিন্তু গুরু হন ব্যক্তিত্বের বলে, ততটা বিদ্যা আর দক্ষতার জন্য না। 

        গুরু আর শিক্ষকের পার্থক্য হল, গুরুকে ব্রহ্ম-বিষ্ণু-মহেশ্বর স্তবের যোগ্য হওয়ার দায় নিতে হয়, কিন্তু শিক্ষকের সে বালাই নেই। এইখানেই শুরু হল গুরুবাদের ফাঁকির গল্প। যেন বই হয়ে দাঁড়ালো পদার্থবিজ্ঞান, কাঁচি হয়ে দাঁড়ালো শল্যচিকিৎসক, ঝাড়ু হয়ে দাঁড়ালো জমাদার। তাদের পিছনের সত্তাটা হল গৌণ।
        শ্রমের মান কমে এলো কৃপার নীচে। ফলে আলস্য হল সাধন, আর শ্রম হল শূদ্র। বাক্য যত সুক্ষ্ম হল পেশী হল তত দুর্বল, বুদ্ধি হল চতুরতার সমার্থক শব্দ। সমস্ত সদগুণ, ক্ষমতা, প্রেম, করুণা, সত্যপরায়ণতা হল এক ব্যক্তি - সদগুরু। 
        আলো শব্দটা লিখলে আলো জ্বলে ওঠে না, তার জন্য সাধন লাগে। সৎ আচরণ লাগে। অনুকম্পা লাগে। আত্মত্যাগ লাগে, যার গেরুয়া ব্র‍্যাণ্ডে স্বঘোষিত না হলেও চলে। কিন্তু অলৌকিক গল্প আর রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে গুরুবাদ দাঁড়ালো, তাতে গোষ্ঠী হল, দুর্বলতা এলো, ত্যাগের ছদ্মবেশে ভোগ এলো। আলো জ্বলল না।
        সংঘর্ষ হল না। দ্বন্দ্ব তৈরি হল না। তাই ব্যক্তিত্বও তৈরি হল না। যা তৈরি হল তা ছাঁচ। অনুকরণ এলো, ঝুলনের মত সাজানো রূপকথা হল, সত্য পড়ে রইল দূরে অবহেলায়। গুরু রইলেন নির্বাসিত। ছাঁচ বসল আসন পেতে। ব্যক্তিত্ব না, শিষ্য 'ব্যক্তি' চেয়ে বসেছে। দাগ বোলানো সোজা, দাগের উপর আসক্তি আনা আরো সোজা, মুশকিল হল নিজের থেকে নিখুঁত দাগ টানতে শেখা। তাই ভোগ, আরতি, উৎসব, উপঢৌকন, পাথরের মূর্তি সব হল কিন্তু একটা প্রাণের সলতেও পুড়তে রাজি হল না। ব্যক্তিত্ব অনুপ্রাণিত করে, ব্যক্তি দল বাঁধতে বলে। তাই দল হল, আলোকিত প্রাণ এলো না।

368
Wed, 07/25/2018 - 11:00

        ন্যায় আমাদের নীতিগত না ধর্মগত। ধর্ম আমাদের বিবেকগত না, আচারগত। আচার আমাদের বিজ্ঞানগত না, অতীত ঐতিহ্যগত। তাই মারতে বা মারের হয়ে সাফাই গাইতে আমাদের অসুবিধা হয় না। আমাদের অবচেতন জুড়ে হাজার বছরের আচারের ভরবেগ, আমি থামাতে চাইলেও থামবে কেন? 
        আমি জন্মাবধি দেখে আসছি বিজ্ঞান আর আচার-অনুষ্ঠান একসাথেই চলতে পারে। কেন? না ওটা মানতেই হয়, কেন? না ওটা হয়ে আসছে, করলে ক্ষতি তো কিছু হচ্ছে না... অগত্যা যুক্তিবাদী মানুষের ছেলের পৈতের কার্ড পেয়েছি, নাস্তিকতার আলোচনা শুনেছি বক্তার হাতে বিপত্তারিণীর লালসুতো বাঁধা দেখতে দেখতে। এভাবেই বড় হয়েছি। অনেক আচারে হয়ত নিজের অজ্ঞাতেও মাথা নুইয়েছি। পরে ভুল বুঝে সরে এসেছি। আসলে একটা মানুষের গড় আয়ু যদি ধরি সত্তর, সেইটুকু সময়কালের মধ্যে যুগ যুগ সঞ্চিত প্রথার বিরুদ্ধে যুক্তি পেলেও রুখে দাঁড়ানোর সাহস পায় কোথায়? অনেক সময় যুক্তি না পেলেও সাধারণ বুদ্ধিতে হয়ত কোনো প্রথা মেনে চলার কোনো যুক্তি পায় না, তবু তাকে মানতেই হয়। কারণ আগেই বললাম, এক, প্রথা, দুই, মানলে ক্ষতি কি? 
        সংশয় জন্মানো আমাদের বিশ্বাসে পাপ। যে কোনো বিশ্বাসের বিপরীতপক্ষ থাকবেই – যারা অবিশ্বাসী এবং অন্য তত্ত্বে বিশ্বাসী। তাই একপক্ষ গরুর দোহাইয়ে পিটিয়ে মারে, আরেকপক্ষ ঈশ্বরের দোহাইয়ে WTC উড়িয়ে দিতে পারে। অনেকে তা সমর্থনও করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, এটাও বড় সাংঘাতিক কথা। যখন বাংলাদেশে একজন একজন করে মুক্তচিন্তাবিদকে হত্যা করা হচ্ছে, তখন আমার কিছু পোস্টের প্রতিবাদে এমন সব মেসেজ মেসেঞ্জারে ঢোকে, আমি বাধ্য হই বহু বাংলাদেশী বন্ধুকে ব্লক করতে। অথচ তার কয়েকটা পোস্ট আগেই তারা কোনো কবিতায় বা গল্পে অত্যন্ত সুন্দর কমেন্টস করেছেন। কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু নিরুপায় হয়ে সরে এসেছি তাদের থেকে। 
        আমরা একটা অদ্ভুত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এটা মানব সভ্যতার আয়রনি কিনা জানি না, ঠিক যে সময়টা আমরা কোথাও একটা গর্ব করতে শুরু করেছিলাম যে আমরা অনেকটা কুসংস্কারমুক্ত হয়ে এসেছি, ঠিক তখনই সারা পৃথিবীজুড়ে শুরু হল একটা বিচ্ছিন্নতাবাদী, অসহিষ্ণুতার আবহাওয়া। আজ যদি আবার শুনি পোলিও, স্মলপক্স ইত্যাদি হচ্ছে, তখন আমাদের বৈজ্ঞানিক মহলে যেমন দুশ্চিন্তা, সাময়িক হতাশার ছায়া আসবে, আজ সারা বিশ্বজুড়ে সেই হতাশা আর দুশ্চিন্তার ছায়া বুদ্ধি-বোধ সম্পন্ন নাগরিক মননে। কোথায় ভুল হল? আমরা জানি না। তবে কি এই অসহিষ্ণুতার বীজ তলে তলে তার শিকড় বিস্তার করে চলেইছিল? এখানে একটা কথা মনে হয়। 
        শিক্ষার যে টেকনিক্যাল দিক সেটা আমরা হয়ত অনেকটা প্রাথমিক স্তর অবধি আনতে পেরেছি, কিন্তু শিক্ষার যে আলোকিত দিক সেটা আনতে আমরা সেই স্তরে ব্যর্থ হয়েইছি। সেই ব্যর্থতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে তারা যাদের তাতে লাভ। একটা সুস্পষ্ট বিভাজন রেখা টেনে গোষ্ঠী বিভক্ত করে দিলে অল্পজ্ঞ, আত্মবিশ্বাসহীন শাসকের সুবিধা হয়। শিক্ষার অর্থ যদি সাক্ষরতা হয় তবে তাতে আমরা এগিয়েছি। কিন্তু সেই অক্ষরজ্ঞান তাকে কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটাও যখন আমরা স্থির করে দিই, তখন সে শিক্ষার নামে প্রহসন হয়ে ওঠে। 
        আসলে আমাদের শাসকের একটা ভাবমূর্তি ছিল। আমাদের আশা ছিল সেই সঙ্কীর্ণ ভাবমূর্তি থেকে তারা বেরিয়ে এসে একটা বৈচিত্রপূর্ণ ভূখণ্ডের সার্থক শাসক হয়ে উঠবে। কারণ তার আগে আমরা একটার পর একটা দুর্নীতি আর তার প্রশ্রয়ে ক্লান্ত। কিন্তু তা হতে হতেও হল না। আমাদের চেতনার গভীরে একটা দাগ স্পষ্ট টানা হতে শুরু করেছে, আমরা বুঝছি আমরা একটা বিশেষ কোডের মাধ্যমে শাসিত হচ্ছি, উন্মুক্ত বিচার বিবেচনায় নয়। আলোচনা হচ্ছে না যে তা না, আলোচনার যুক্তিরা আগেই সেজে বসে আছে, আমাদের সামনে শুধু MCQ, হয় এটা নয় ওটা, বেরোবার উপায় নেই। একটা সাদা পাতা দেওয়ার সাহস আর কোনো পক্ষ আমাদের দিচ্ছে না। এমত অবস্থায় যে যা বলছেন আমরা শুনছি, আমাদের উপায় নেই। কারণ আমাদের একটা পুরোনো রোগ আছে, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি দুর্বলতা। তার কতটা ত্যাজ্য আর কতটা গ্রাহ্য এখনও তা নিয়ে সম্যক ধারণা তৈরি হয়নি আমাদের। আমরা বেদান্তে পদার্থবিদ্যার জটিল সূত্রের আভাস পাই, আবার শনিবারে নিরামিষ খাওয়ার পক্ষে যুক্তিয় শাস্ত্রীয় আর অতিবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও খুঁজে পাই। দুজনেই জানে তারা প্রাচীন নির্ভুল অতিজাগতিক অনুশাসনের শাসন কর্তার বিধান অনুসারে কাজ করে চলেছে। সব ধর্মেই তাই, এক একভাবে। রাজনৈতিক মহল আমাদের এই আদিব্যাধির ব্যবহারের কৌশল জানেন। কেউ বলছে এরা তোষিত হচ্ছে, কেউ বলছে ওরা তোষিত হচ্ছে। কিন্তু একটা দেশের সামগ্রিকতায় যে কোথাও এরা-তোরা-আমরা-ওরা নেই, এই কথাটা হঠাৎ করে খুব কম গুরুত্ব পাচ্ছে। 
        একটা সুড়ঙ্গপথ ক্রমে সরু হতে হতে কোন দিকে এগোচ্ছে বুঝছি না। কথা ছিল রাজপথ হবে, হচ্ছে সুড়ঙ্গ। অক্ষরের রঙ বদলাচ্ছে, কথার সুর পাল্টাচ্ছে, কোনো একটা বিশেষ ব্যবসায়ীর কব্জায় প্রায় গোটা ভারতের চলমান দূরভাষ মহল, এটা কোন দিকে এগোনোর সঙ্কেত? ভারত তুমি সাবধানে রেখো ব্যালট তোমার!

369
Sat, 07/14/2018 - 10:00

        এক, আমি নিজে; দুই, আমার সমাজ; আর রইল বিশ্বচরাচর। এই তিনকে ঘিরে একটা জীবন। এই তিনটেকে গেঁথে একটা সূত্র আছে - দর্শন। একজন মানুষ জেনে হোক, না জেনে হোক, কোনো না কোনো একটা দর্শনে বিশ্বাস করে। তার সেই বিশ্বাসের সাথে তার আচরণ যত খাঁটি সে তত স্বচ্ছ। তার সে দর্শন যত উচ্চ, সে তত মুক্ত। জ্ঞান না সুখ? জ্ঞানের মধ্যে সুখের খোঁজ যার, তাকে আমরা দার্শনিক বলি। আর সুখ খুঁজতে গিয়ে যে নানা ভাবে অভিজ্ঞ, তাকে সংসারে খুব একটা কেজো লোক বলি। অবশ্যই সক্রেটিসের কাছে যে সুখের অন্বেষণ আর কোন খাতে কত টাকা কিভাবে জমা রাখলে ভবিষ্যতে কি কি সুবিধা - এর খোঁজ দেওয়া মানুষ এক হতে পারে না। এদের মধ্যে একজন চাইলেই অন্য হতে পারে না। তাই এখানে দ্বন্দ্বযুদ্ধের অবকাশ নেই। নিজের স্থান, রুচি অনুযায়ী মানুষ নিজের গন্তব্য স্থির করে এসেছে যুগযুগ ধরে।
        জ্ঞানান্বেষণ অপর অর্থে সত্যের খোঁজ, তত্ত্বগতভাবে। এ এক অনন্ত খোঁজ। কেউ এর প্রান্তে পৌঁছায় না। এ পথের পথিক হতে পারাতেই নিজেকে সার্থক মনে করে সে। ঘর থেকে সমুদ্রে যাওয়ার পথ পাওয়া যায়, সমুদ্রকে ঘরে আনার পথ কি মেলে? সে ভ্রম। মানুষ যেখানে নিঃসংশয়ত্ব বোধ করে, সেখানেই যখন সে প্রশ্ন করার স্পর্ধা দেখায়, সেই হয় তার সত্য অর্থে সত্যের খোঁজ। কারণ সব ক'টা থামার একটা সুখ আছে, সেই সুখের উৎখাতেই গতির সূচনা। এই কারণেই জ্ঞানের পথিকরা সুখের বিরোধিতা করে এসেছেন, কিছু কিছু অর্থে সেই বিরোধিতা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে বিকারের জায়গায় পৌঁছিয়ে যায়নি যে তাও বলা যায় না। অনেকে এমন ধারণাও পোষণ করেছেন যে নিজেকে যত উৎপীড়ন করা যায় তত বেশি জ্ঞানালোকের কাছে থাকা যায়, এও ভ্রম, মোহ। যে স্থান থেকে ফেরার তাগিদ বুদ্ধ অনুভব করে মধ্যপথের কথা বলেন।
        তবে সুখের মোহ একটা আছে। সে সত্যের ভান করে বিভ্রান্তির মধ্যে বসিয়ে রাখে। যে সুখে জগন্নাথকে হিন্দুনাথ করে নিশ্চিন্তে ভক্তের দল দিন যাপন করছিলেন, হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলে বসল, দাদা একটু উঠবেন, বলি কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?
        তবে কোথায় থামব? থামার মধ্যে যে একটা সুখ আছে। কেন সে সুখ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করব? এমন একটা সিদ্ধান্তে আমায় স্থির করে দাও যাতে ঈশ্বর থেকে সংসার সব কিছুর সুখ আমার করায়ত্ত হয়ে থাকে, আমি তোমায় গুরু মেনে ঈশ্বরের ঊর্দ্ধে স্থান দেব, দেখো! এরকম শিষ্যের অভাব নেই বলেই আমাদের দেশে সেরকম গুরুরও অভাব হয়নি কোনো কালে, যার নির্দেশের একশো আটটা পুঁথির মালায় বিশ্বের যাবতীয় সুখের তথা জ্ঞানের সূত্রের ধাঁধা মিলে গেছে।
        আমাদের দর্শনে থামার দিকে যত ঝোঁক ততটা পাশ্চাত্য দর্শনে নেই। তাদের ঝোঁক চলার দিকে। আমরা যখন দরজায় শেষ ছিটকিনিটা চিরকালের জন্য মারার ফিকির খুঁজি, পাশ্চাত্য তখন আরো কয়েকটা খোলা দরজা রাখে আগামী প্রজন্মের জন্য। তাই আমাদেরটা হয়ে রইল অতীন্দ্রিয়ের আবর্তে ভুলভুলাইয়া, ওদেরটা হয়ে রইল পথ। আমরা বসার ফিকির খুঁজি - যাঁকে জানলে সব জানা হয়ে যায় তিনি ব্রহ্ম। ব্রহ্ম কি? যাঁকে মুখে বলা যায় না, ব্যাখ্যাতীত। একটা অন্ধকার ঘরে একজন অন্ধ মানুষ। এ এক প্রবল সম্ভাবনাময় অবস্থান। সে যা খুশী মনে করতে পারে। জগতটা মিথ্যা, জগতটা লীলা, জগতটা অর্ধেক মিথ্যা অর্ধেক লীলা, জগতটা চেতনা, জগতটা জড় ইত্যাদি ইত্যাদি। তার তো নিশ্চয়তা মানে তার নিঃসংশয়তার নিশ্চয়তা। যে নিঃসংশয়তা তার আলোহীনতার শান্তি আশ্রম।
        তাই আজ এত বছর পর, সারা বিশ্বের গতিময়তা থেকে মুখ ফিরিয়ে আমাদের প্রবল মল্লযুদ্ধ এখনও ধর্মের মল্লভূমে। একজন মানুষ তার যৌন সম্পর্ক সমলিঙ্গে না বিষমলিঙ্গে হবে সেই নিয়ে আলোচনা, বাদ-বিতণ্ডা বছরের পর বছর ধরে। বিজ্ঞান বলো, পরিবেশ বলো, শিক্ষা বলো, স্বাস্থ্য বলো - এসবের আলোচনায় সময় নেই আমাদের। ওসবে পাশ্চাত্যের অনুকরণ কাম্য, যদিও তাদের গালমন্দ করতে করতেই, কারণ প্রাচীন ভারতে সব নাকি ছিল, ওরা চুরি করে এগিয়ে গেল, আমরা ভাগ্যের পরিহাসে পিছিয়ে রইলাম।
        সামগ্রিক জীবনে রুদ্ধগতি থাকলে ব্যক্তিগত জীবন বিষাদ আর ক্ষণিক আমোদের ধারাবাহিকতা ছাড়া কিছুই হয় না। ভারতীয় অন্দরমহলের জীবন সেই ছন্দে এখনও। আজও তার পদে পদে দীর্ঘশ্বাস - দাও ফিরে সে বেদান্ত, লও এ বিজ্ঞান। রথ বহুকাল হল আটকে। লক্ষকোটি জনসাধারণ নিজের চলার পথই খুঁজে পায় না, তো সে পরমাত্মার চলার পথ খুঁজবে, তাই তাঁকেও নিয়ে গিয়ে মাসির বাড়ির দোরগোড়াতেই থেমেছে। ওর বেশি এগোনোর দুঃসাহস দেখায়নি। যিনি বিশ্বচরাচরের প্রভু তাঁরও নাকি নিজের পরিবার আছে, মানে মাসি পিসি আছে। এ সেই থামার কথা। এই থামাতে একটা রোম্যান্টিক ভাব আছে, দেখো আমরা বৃহৎকে কেমন ক্ষুদ্র করে পেয়েছি। সেটা অবশ্যই গর্বের কথা হত, যদি সেই বৃহৎ তার ক্ষুদ্রত্বে স্বধর্ম না হারাতো। একটা মিছরির টুকরো যত ক্ষুদ্রই করা হোক না কেন, সে তার মিষ্টত্ব ছাড়ে না, যদি ছাড়ে তবে সে বালির কণা ছিল। তাই মহৎকে নিজের ক্ষুদ্রত্বের সীমানায় আনার সাধনা বড় সুখের নয়। কিন্তু আমরা যে সুখ চাই, তার কি হবে? তাই ফাঁকি এসে জমল। সত্যের ভানে নানা তত্ত্ব এসে বসল। তা নিয়ে এমন কোন্দল বাধল যে আজও সমাধান হল না। রথের চাকা সুখের গর্তে আটকে। জ্ঞানের পথে, সুখকে জলাঞ্জলি দিয়ে এগোনোর কথা, সেখানে কোনো প্রান্তিক স্টেশান নেই, এটা মনে না রাখলে মননের জগতে আমাদের থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড় হতেই থাকবে।

370
Thu, 07/12/2018 - 17:17

        মনের উপর বোধের নিয়ন্ত্রণ থাকবে - এমন কথা ছিল সভ্যতার মূলে। কিন্তু সভ্যতা বলতে কি বোঝানো গেল? বলা হল যা মার্জিত, যা ভদ্র। ভদ্র অর্থাৎ মার্জিত। যা দোষমুক্ত। দোষ কি? এই কথাটার মীমাংসা হয়ে ওঠেনি এখনও। যদি একমাত্রিক আলোচনায় আসা যায় তবে একটা দোষের সংজ্ঞা দাঁড় করানো যায়। যার চূড়ান্ত নিদর্শন - ধর্ম। ধর্মের মধ্যে সব কিছুর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আছে, যে সিদ্ধান্তগুলো মেনে চললে এই জীবনে ও পরজীবনে পুরষ্কারের আশা আছে। বেশিরভাগ মানুষ এই চূড়ান্ত নির্দেশের দাস হয়ে বাঁচতে চায়, প্রাচীনযুগেও চেয়েছে, আজও চেয়ে চলেছে। মানুষের গুরু, দেবতা, নেতা, শাসক ইত্যাদি কোনো না কোনো রূপে একজন চূড়ান্ত কাউকে চাই। যার উপরে কিছু থাকবে না আর। আসলে বেশিরভাগ মানুষই ধার্মিক হয়েই জন্মায়। ধার্মিক মানে আমি নীতিবান বা নৈতিকরূপে উৎকৃষ্ট মানুষকে বোঝাচ্ছি না। আমি বলতে চাইছি চরমবাদী মানুষ, যে সবকিছুর একটা একমাত্রিক ব্যাখ্যা চায়। সমস্ত সমস্যার একটাই সমাধান সূত্র খোঁজে। ঈশ্বরকে বা ঈশ্বরপ্রেরিতকে তুষ্ট করা। কারণ মানুষের মধ্যে ধর্মবিশ্বাসের মূল নিহিত। ধর্মবিশ্বাস মানে বিনা চিন্তায় কাউকে একজন অথোরিটি মেনে আত্ম-স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে, একটা কাল্পনিক নিশ্চিন্ততায় দিন কাটানো। ঈশ্বরের তুষ্টি আর ক্রোধের উপর তার জীবনের সব সুখ দুঃখের ব্যাখ্যা তখন। কিন্তু কাজটা যেহেতু অতটা সোজা নয়, তাই ঈশ্বরের তুষ্ট-রুষ্ট হওয়ার গতিবিধিকে রহস্যময়, বোধের অতীত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে।
        হয় মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নয়ত কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে ভালোবাসে। দ্বিতীয়পক্ষের মানুষ নিয়েই সংসার। তার নিজের সব চাইতে বড় দায় হল তার আবেগ। সংসারকে বায়ুশূন্য কল্পনার চেষ্টা করা আর মানুষকে আবেগশূন্য ভাবার চেষ্টা করা একই কথা। আবেগ তার দায় কেন? কারণ আবেগ যতটা শক্তিশালী ততটা প্রজ্ঞাবান নয়। আবেগের মন্ত্রণায় বহু ক্ষতির সাক্ষী মানুষের ইতিহাস। কাম-ক্রোধ-লোভ ইত্যাদি যে ষড়রিপুর কথা যে আছে, সে আবেগেরই এক একটা তীব্ররূপ। তার হাত থেকে বাঁচার জন্য আস্তিক জানে ঈশ্বর কিছু আবেগ পছন্দ করে আর কিছু আবেগ পছন্দ করে না। সেই অনুযায়ী সে নিজের আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। বলা বাহুল্য তা পেরে ওঠে না। বিবেকযন্ত্রণায় ভোগে। বিভিন্ন ধর্মীয় পুরুষেরা সেই বিবেক যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য নানা বিধান দেন। সুক্ষ্ম শোষণপদ্ধতির উদ্ভাবন হয়। অলক্ষ্য শাসকের, ধর্মীয় পুস্তকে লিখিত বিধানের খেসারত দিতে হয় তাকে, তাও একটা নির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাসের পরিমণ্ডলে জন্মানোর দরুন।
        এতো গেল ধর্ম আর সভ্যতার বোঝাপড়া। না চাইলেও ধর্ম আর রাজনীতি থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবমুক্ত থাকা কারোর পক্ষেই অসম্ভব। তবে যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম - সভ্যতা। ভদ্র হওয়া। মার্জিত হওয়া, দোষমুক্ত হওয়া। কেউ কেউ বলেন সদগুণের আচরণে ক্রমে উৎকর্ষতার দিকে এগোনোর কথা। একই কথা। উৎকর্ষ মানেই হল অপকর্ষ মুক্ত, অর্থাৎ সেই দোষমুক্তি'র কথাই প্রকারান্তরে। তবে দোষ কি? এই থেকেই ধর্মের আলোচনায় ঢুকেছিলাম। বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গীতে দোষ কি? যা বহু পর্যবেক্ষণে ক্ষতির দিকে নিয়ে যায়, প্রমাণিত - তাই দোষ। খুব সাধারণ উদাহরণ নেওয়া যাক, সূর্যগ্রহণে খাদ্যগ্রহণ নিষিদ্ধ - ধর্মীয় শাসন বলল। বিজ্ঞান তার পর্যবেক্ষণে বলল - হয় না। পর্যবেক্ষণ, মনন আর জিজ্ঞাসা - এই বিজ্ঞানের মূল। বিশ্বাস, আনুগত্য আর একদেশিতা - এই ধর্মের মূল। একটা জিজ্ঞাসা দ্বারা চালিত, আরেকটা ভয় দ্বারা। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, কেউ যদি বলেন, তবে কি প্রেমের ধর্ম বলে কিছু হয় না? না হয় না। কেউ কেউ অপার্থিব মানবপ্রেম দ্বারা উদ্বুদ্ধ হতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে তার অনুসারীরা যে সেই একই অনুপ্রেরণায় আন্তরিকভাবে সিক্ত হবে এমনটা ইতিহাসে কোথাও দেখা যায় না। খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, মহাপ্রভু'র অনুসারীরা যে যে ধর্মের গোষ্ঠী বানালেন সেই সেই ধর্মের কারণেই বহু মানুষের প্রাণ গিয়েছে শুধু না, বহু মানুষ উৎপীড়িত হয়ে আসছে তাদের সেই মহামানবপ্রেমের গোষ্ঠীবৃন্দের আন্তঃঘৃণার জন্য।
        তবে ধর্ম টিকে রইল কেন? প্রতিটা ধর্মের গঠনগত তিনটে দিক আছে। এক, অলৌকিক গল্প; দুই, নীতির অনুশাসন; তিন, একটা মানবগোষ্ঠী বানানোর ক্ষমতা। এই তিনটে ধর্মের গঠনগত স্তম্ভ। এই স্তম্ভগুলো এক এক ধর্মে আলাদা হলেও, দ্বিতীয়টার ক্ষেত্রে অনেকটা এক। প্রেম, করুণা, সহমর্মিতা, সত্যপরায়ণতা ইত্যাদি সদগুণের প্রতি আনুগত্য দেখানোর কথা সব ধর্মেই আছে। সেই থেকে বহু উচ্চগুণসম্পন্ন মানুষ জন্মিয়েছেনও সব ধর্মে। তাই ধর্মকে সম্পূর্ণ উৎখাত করে কোনো সভ্যতাই কোনোদিন গঠন করা সম্ভবপর নয়। মনে রাখতে হবে দেশের কয়েকজন মনীষীকে নিয়ে একটা দেশ নয়। সেই দেশের সাধারণ মানুষ নিয়েই সেই দেশের চরিত্র। ঈশ্বরে বিশ্বাস কমবে হয়ত, কিন্তু তার জায়গায় অন্য আরেকজন শাসক এসে বসবে, কারণ সাধারণ মানুষ কোনোদিনই চিন্তায় স্বতন্ত্র হতে চাইবে না। তার একটা না একটা মাথা নীচু করার জায়গা লাগবেই। মানুষের কাছে তার পরিখাহীন স্বাধীনতা বিষম বালাই যে। তাই ধর্মান্ধতার জায়গায় রাজনীতি, বিশেষ কোনো মত বা দর্শন ইত্যাদি নিয়ে মানুষ দল বানাবেই, গোষ্ঠী বানাবেই। কিছু না কিছুর প্রতি তার অন্ধ আনুগত্য থাকবেই। কারণ ওই যে শুরুতে বললাম, মানুষ ধার্মিক হয়েই জন্মায়। এদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন নানা জিজ্ঞাসায় সংসারের এই অভ্যস্ত অচলায়তনে মাথা কুটে মরবে, উত্তর খুঁজতে চাইবে, পর্যবেক্ষণ আর মননকে আত্মশক্তি বানাতে চাইবে। যুগান্তরের ভিতে দাঁড়ানো এই পাঁচিলটার গায়ে একটা ছিদ্র করতে চাইবে। প্রথম প্রথম চাইবে পুরো সংসারটাকে সেই ছিদ্র দিয়ে বাইরে নিয়ে আসতে। খানিক পরে বুঝবে সে ভুল ছিল, তার মৃত্যুর পরেই সেই ছিদ্র বন্ধ করার জন্য বহু মানুষ সিমেন্ট-বালি নিয়ে অপেক্ষায় আছে। এতো আলোয় তাদের ভয়। সংসার জাগতে চায় না। কারণ সংসার জানে জাগলে সুখ নেই। খুব কম মানুষই বোঝে, সুখটা জেগে ওঠাতেই, জেগে উঠে পাওয়া না পাওয়ার হিসাবে নয়।

371
Wed, 07/04/2018 - 11:30

        মহাকাব্যের একটা সুর থাকে। হঠাৎ মনে এলো সেই ক্ষণটার কথা --- গভীর রাত; একজন নারী একজন পুরুষের সাথে গোপনে দেখা করতে যাচ্ছেন, নিজেকে রক্ষার বিনতি জানানোর জন্য। কারণ কীচক তাকে বিরক্ত করছে। কীচক তার মর্যাদায় হাত দিতে চাইছে। কার মর্যাদায়? যাকে জনসমক্ষে চূড়ান্তভাবে লাঞ্ছিতা হতে হয়েছে রাজনৈতিক কূটনীতির জন্য, তার মর্যাদায়। যার কাঙ্ক্ষিত পুরুষ, চারজন আরো পুরুষের সাথে সমকক্ষ হয়ে গেল, পারিবারিক নীতির জন্য, তার মর্যাদায়। যাকে কামুক, লোভী, নীতিবান, অসুর, ঋষি, পরিবারের গুরুজন ইত্যাদি সবার কাছে বারবার লাঞ্ছিতা হতে হয়েছে, এমনকি নানা নীতির ছদ্মবেশেও লাঞ্ছিতা হতে হয়েছে যা আগে বললাম, তার মর্যাদায়। সেই মানুষটা নিজেকে গোপন করে নিয়ে চলেছে একজন পুরুষের কাছে, আত্মরক্ষার বিনতি জানানোর জন্য।
        মহাভারত তার চরিত্রের সংখ্যা গরিষ্ঠতায়, ঘটনার জটিল বুননে, সময়ের বিশাল মানচিত্রে দাঁড়িয়েছিল বলে মহাকাব্য হয়নি। এত জটিল ঘটনা, সময়ের ঘূর্ণাবর্তেও মানুষের যে সুক্ষ্ম বলিষ্ঠ আত্মমর্যাদা বোধে সে মানুষ – সেই কথাটা প্রথম থেকে শেষ অবধি সার্থকভাবে বলতে পরেছে বলে তা মহাকাব্য। মনুষ্যত্বের মহিমাটুকু অক্ষুণ্ন থেকে গিয়েছে। 
        কাব্য কেন? কারণ মানুষ গদ্য শরীরে, কাব্য আত্মায়। মহাকাব্য কেন? কারণ সেই শরীরের সবটুকু অস্তিত্ব ক্ষুদ্রতা, জটিলতা, স্থূলতা স্বীকার করেও সে আত্মা অবধি পৌঁছাতে পেরেছিল বলে। একটা ডিঙি নিয়ে নদী পার হওয়া আর একটা প্রকাণ্ড জটিল কলকব্জা সমন্বিত জাহাজ নিয়ে সমুদ্র পার হওয়া তো সমান কথা নয়। মহাভারত তা পেরেছিল।
        যে ক্ষুদ্র মুহূর্তটার কথা বলছিলাম তা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না ঘটনা প্রবাহের মধ্যে, তবু সেই ক্ষণটায় যে মাধুর্য কবি এঁকেছেন তা অদ্ভুত। দ্রৌপদী তখন সৈরিন্ধ্রী। পঞ্চপাণ্ডব অজ্ঞাতবাসে বিরাট রাজার কাছে। কীচক, বিরাট রাজার শালার কুদৃষ্টিতে দ্রৌপদী তখন। সে রাজা বিরাট ও তার স্ত্রী সুদেষ্ণাকে গিয়ে বলেছে কীচককে সাবধান করার জন্য, এও বলেছিল তার পাঁচ গন্ধর্ব স্বামীর হাতে সে অবশ্যই মারা যাবে, কিন্তু কেউ শোনেনি সে কথা। আচ্ছা, যখন স্বৈরিন্ধ্রী সেই পাঁচ স্বামীর কথা ভেবেছিল তখন সে কি সত্যিই পাঁচজনের কথাই ভেবেছিল, নাকি তার মাথায় শুধু একটাই মুখ ভেসে এসেছিল – বল্লভ, ভীমের ছদ্মবেশ। হয়ত তাই।
        সেই মুহুর্তটার কথা একবার ভাবুন, যে কোনো মুহুর্তেই তারা ধরা পড়ে যেতে পারে, এমন আশঙ্কা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না, আবার বনবাস হবে তবে, তার মধ্যে কীচকের উৎপাত। এমন একটা প্রেক্ষাপটে কবি শুধু বাইরের ছবি আঁকলেন না। তিনি দুটো হৃদয়ের ছবি আঁকলেন। কবি এমন একটা দৃশ্যপট আঁকলেন যা মহাকালের প্রবাহে চিরকালের সুর। যুদ্ধ, হিংসা কোনোদিন মহাকালের সম্পদ নয়। সেই প্রেমের বর্ণনায় চাঁদ ছিল না, নানা ফুলের সৌরভ ছিল না, ছিল না কোনো স্বর্গীয় সঙ্গীত। যা ছিল তা হল কঠোর বাস্তব, বিপদ, দুর্যোগ। তার মধ্যে জাগল প্রেম। আঁকা হল একান্ত নিবিড় একটা মানবিক প্রেমের অধ্যায়। 
        সেদিন রাত্রে লুকিয়ে এলেন সৈরিন্ধ্রী রন্ধনশালায়। যেখানে মেঝেতে শুয়ে ভীম। এই প্রথম দ্রৌপদী যেন নিজের ভাষা খুঁজে পেলেন। যা নীতির কথা না, অভিমানের কথা। কি লিখছেন কাশীদাস মহাশয়,


বিরাট রন্ধনগৃহে ভীমের শয়ন।
নিদ্রা যায় বৃকোদর হয়ে অচেতন।।
সঙ্কেতে বলেন দেবী চাপি দুই পায়।
উঠ উঠ, কত নিদ্রা যাও মৃতপ্রায়।।
হীনজন সাধ্যমত আপন ভার্য্যারে।
প্রাণপণে করি রক্ষা সঙ্কটেতে তারে।।
সভামধ্যে যত মম অপমান কৈল।
সিংহের রমণী লৈতে শৃগাল ইচ্ছিল।।
চরণ চাপিতে ভীম হন জাগরিত।
দ্রৌপদী কাতর দেখি উঠেন ত্বরিত।।
কহ ভদ্রে, এত রাত্রে কেন আগমন।
দুঃখিতের প্রায় দেখি মলিন বদন।।
যে কথা কহিতে আছে, শীঘ্র কহ মোরে।
কেহ পাছে দেখে শুনে, যাহ নিজ ঘরে।।
ভীমবাক্য শুনি আরো বৃদ্ধি পায় দুঃখ।
নয়নে সলিল পড়ে, কৃষ্ণা অধোমুখ।।
ভীম বলে, কহ প্রিয়ে কি হেতু শোচন।
কি দুঃখ তোমার কহ করিব মোচন।।
এত শুনি সকরুণে বলেন পার্ষতী।
কি দুঃখ শোচন, যার যুধিষ্ঠির পতি।।
জানিয়া শুনিয়া কেন জিজ্ঞাসিছ মোরে।
আপনার দুঃখ কিবা বলিব তোমারে।।
হস্তিনায় দুঃশাসন যতেক করিল।
কুরুসভা মধ্যে সবে বসিয়া দেখিল।।
একবস্ত্রা পরিধানা আমি রজঃস্বলা।
কেশে ধরি আনিবেক করিয়া বিহুলা।।
তদন্তরে অরণ্যেতে দুষ্ট জয়দ্রথ।
বলে ধরি লয়ে গেল পাপিষ্ঠ উন্মত্ত।।
দ্বাদশ বৎসর বনে দুঃখে বঞ্চি শেষে।
মৎস্যদেশে সুদেষ্ণার দাসী হৈনু এসে।।
গোরোচনা চন্দনাদি ঘষি নিরন্তর।
দেখ দেখ কলঙ্কিত হৈল দুই কর।।
সে সব দুঃখের কথা নাহি করি মনে।
তোমা সবা দুঃখ দেখি ভুলি ক্ষণে ক্ষণে।।
বিনা অপরাধে মোরে কীচক দুর্ম্মতি।
সবার সাক্ষাতে মোরে মারিলেক লাথি।।
এ ছার জীবনে মোর নাহি প্রয়োজন।
এত লঘু হয়ে জীব কিসের কারণ।।
রাজকন্যা হয়ে মোর সমান দুঃখিনী।
স্বামীর জীয়ন্তে কেহ, না দেখি, না শুনি।।
আজি যদি কীচকেরে তুমি না মারিবে।
নিশ্চয় আমার বধ তোমারে লাগিবে।।
গরল খাইব কিংবা প্রবেশিয়া জলে।
প্রভাতে মরিব আমি কীচকে দেখিলে।।
নিত্য আসে দুরাচার আমার নিলয়।
মোর ভার্য্যা হও বলি অনুক্ষণ কয়।।
সৈরন্ধ্রী বলিয়া মোরে করে উপহাস।
ধিক্ মোর ছার প্রাণে, আর কিবা আশ।।

        ভীম কাঁদলেন। অনুতাপে, আক্রোশে, যন্ত্রণায়। যে কাজ তিনি রাজসভায় নিমেষে করতে পারতেন সেই কাজ তিনি পারেননি যুধিষ্ঠিরের মর্যাদা রক্ষায়। আজ সে কথা বলেই ফেললেন।ভীমের সে অনুতাপ পৌরুষের বললে বড় একপেশে কথা হয়ে যায়, এটা আত্মমর্যাদার কথা। ওই যে শুরুতেই বলছিলাম, মহাকাব্য মানুষকে বিশাল প্রেক্ষাপটে মনুষ্যত্বেই দেখে, তার মানবতার সম্পদেই তাকে গরীয়ান করে তোলে। তাই ভীম কাঁদলেন,


এত বলি কান্দে দেবী মুখে দিয়া কর।
তিতিল নয়নে নীরে ভীম কলেবর।।
কৃষ্ণার ক্রন্দন দেখি কান্দে বৃকোদর।
করপদ কাঁপে ঘন, কাঁপে ওষ্ঠাধর।।
ধিক্ মোর বাহুবল, ধিক্ ধনঞ্জয়।
তোমার এতেক কষ্ট দেখি প্রাণ রয়।।
আমারে কি বল কৃষ্ণা, আমি কি করিব।
আত্মবশ হৈলে কেন এত দুঃখ পাব।।
যেখানে তোমারে দুষ্ট মারিলেক লাথি।
সেইখানে পাঠাতাম যমের বসতি।।
সভাসহ মারিতাম নৃপতি সহিতে।
কাহারে না রাখিতাম অন্যেরে কহিতে।।
বিদিত হইলে পুনঃ যাইতাম বন।
এত অপমান অঙ্গে হয় কি সহন।।
কটাক্ষে চাহিয়া মোরে রাজা মানা কৈল।
সে কারণে দুরাচার কীচক বাঁচিল।।
যুধিষ্ঠির বাখ্য আমি লঙ্ঘিতে না পারি।
নহিলে এ গতি কেন হইবে সুন্দরী।।
ইন্দ্রের অধিক সুখ শত্রুগণে দিয়ে।
এত দুঃখ হৈল শুধু তাঁর বাক্যে রয়ে।।
সভামধ্যে করিলেক যত দুঃশাসন।
মৃত্যু ইচ্ছা হয় তাহা করিলে স্মরণ।।
সে সকল অপমান বসি দেখিলাম।
যুধিষ্ঠির আজ্ঞা লাগি সব সহিলাম।।
ক্রন্দন সম্বর দেবি, দুঃখ হৈল ক্লেশ।
অল্পদিন হেতু আর কেন ভাব ক্লেশ।।


        ভীম এবার সৈরিন্ধ্রীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে পুরাণ কথা শোনান (না পুরানো কথা শোনান?)। কাকে কাকে অতীতে কোন কোন যাতনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সে কথা শোনান। দ্রৌপদী শান্ত হয়ে সবটা শোনেন। ভীমের বলা শেষ হলে বলেন, তুমি যা বললে ভীম সবটাই আমি জানি। কিন্তু আমি যে বলেছি আমার পাঁচ গন্ধর্ব স্বামী আছে, তার কি হবে ভীম? আমার কথা নিয়ে সে দুষ্ট কীচক আমায় কিনা পরিহাস করে, বলে সে তাদেরও হত্যা করবে। আমার কথা তবে মিথ্যা হবে ভীম? আমি মিথ্যাবাদী হব? কাল সকাল হলেই সে আবার আসবে আমার ঘরে, আমায় উৎপীড়ন করবে। এ সব সহ্য করতে হবে? কেন ভীম? কেন আমায় দেবী হতে বলছ? হব না, বরং - "আজি রক্ষা পেলে পিছে হব ঠাকুরাণী।" 
        ভীম ক্রুদ্ধ হলেন, দ্রৌপদীর উপর না, নিজের অসহায়তার উপর। আগে বলছিলাম না, যখন দ্রৌপদী তাঁর পাঁচ স্বামীর উল্লেখ করছিলেন তখন তাঁর মনের মধ্যে কি সত্যিই পাঁচ স্বামীর মুখ ভেসেছিল? ভাসেনি তো, তাই যদি হত তবে আজ রাত্রে তিনি ভীমের কাছেই বা কেন। আর তাও স্পষ্ট করে বলছেন কাশীরাম দাস, দ্রৌপদী বলছেন, "তোমা বিনা রাখে ইথে, নাহি দেখি আন।।" 
        তবে তো সৈরিন্ধ্রী পাঁচজনের কথা ভাবেনি, সে ভীমকে এও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে তাকে জয়দ্রথ, জটাসুরের হাত থেকে সেই ভীমই তো বাঁচিয়েছিল, তাই ভীমই দ্রৌপদীর একমাত্র অবলম্বন এই ঘোর বিপদে। তবে কি শুধুই সেই কারণেই তার ভীমের কথা মনে হয়েছিল। তাই যদি হত তবে অভিমানের কথা আসত না। সে জানত ভীমই পারবে, একমাত্র সে-ই অমানবিক একপেশে পুরুষের বানানো নীতির শৃঙ্খলে নিজেকে কারারুদ্ধ করেনি। তার মধ্যে জেগে আছে চিরকালের মানবনীতি। 
কীচক বধ হয়। ভীম তাকে বধ করে দ্রৌপদীর প্রতি তার অকৃত্রিম মানবিক প্রেমের তাগিদেই, নিজের পৌরুষের আস্ফালনে না, তাই সে আত্মগর্বের উল্লাসে দ্রৌপদীকে ডেকে বলে, 


...হাসিয়া কৃষ্ণারে ডাকে পবন কুমার...
অগ্নি জ্বালি দেখ এবে যাজ্ঞসেনী সতি।
তোমা হিংসি কীচকের এতেক দুর্গতি।।
অপরাধমত দণ্ড পাইল দুর্মতি।
যে তোমার অপরাধী তার এই গতি।।

এই কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, "যে তোমার অপরাধী তার এই গতি।"

        আজ ভারতের বড় দুর্দিন। কত লাঞ্ছিতা সৈরিন্ধ্রী যে আজ ঘরে ঘরে, সেদিনের সে কবি কল্পনাও করতে পারতেন কিনা জানি না। থাকলে তিনি আজ কৃষ্ণ না ভীমকে আহ্বান জানাতেন তাও জানি না। তবু এই কথাগুলোর মধ্যে একটা আশা থাকে। একটা ভরসা থাকে। একটা জাতের আদর্শ থাকে। সে আদর্শে যতই ধুলো জমুক, কাঁচে চিড় ধরে না। ধুলো সরালেই স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব ধরা দেয়, মনুষ্যত্বের। সব প্রেমের চূড়ান্ত পরিণতি তাই সেই মানবিক প্রেম। তাই ঈশ্বরের গোপাল রূপকে বলা হয় সাধনার শেষ পরিণাম (কথামৃত অনুযায়ী)। সব ধর্মের, সব নীতির শেষ কথা মানবনীতি। তাই মহাকাব্য, যা শুধু পাতায় না, যা জীবনপযাপনের ধ্রুবতারা হয়ে চির উজ্জ্বল।

372
Fri, 06/29/2018 - 16:00

        জানার একটা সীমা আছে। জানার একটা দৃষ্টিকোণ আছে। যাকে যা জানছি তাকে অনুভবে জানছি না তথ্যে জানছি সেও আছে। জানার পরিসরের বাইরে আরো অনেক এমন কিছু আছে যা আমার জানা উচিৎ ছিল, আবার জানার মধ্যেও এমন অনেক জিনিস আছে যা আমার না জানলেও চলত। এই জানা আর অজানার মধ্যে যে মেঘ ও রৌদ্রের খেলা তা নিয়ে বেশ একটা মজা আছে। অহংকারটা আছে এর মধ্যে কোথাও একটা। বনের মধ্যে যেমন বাঘ লুকিয়ে থাকে তেমন। ব্যাটা ঘাপটি মেরে বসে থাকে শিকারের জন্য। যখন শিকার নেই, তখন সে-ও নেই।
        আমাদের অতীতে অনেক জ্ঞানীগুণী মানুষ ছিলেন, বর্তমানেও আছেন। মজা হল, অতীতে যাঁরা ছিলেন তাঁরা সময় আর প্রাপ্ত তথ্যের সীমারেখায় বন্দী। তাদের কারোর উপর আমার প্রেম বা দ্বেষ থাকলে আমরা সেই তথ্যের উপর আমার কল্পনার রং চড়িয়ে যা বানাই তা গল্প। সে গল্প পুরো মিথ্যাও নয়, পুরো বাস্তবও নয়। বাস্তব আর মিথ্যার মধ্যে একটা সুক্ষ্ম স্থান আছে – সেই সত্য। কারণ মিথ্যাকে মিথ্যা জানতেও একটা সত্যবোধ লাগে। নইলে ভিত্তিহীন কল্পনাকে আমরা বলি মায়া – ইলিউশান। সেই অন্তর্বর্তী সত্যের এক রত্তি এদিক ওদিক হলেই তার শুদ্ধতা নষ্ট। সেই সত্যই ভাবগত সত্য – ঋত। 
        এখন কল্পনার সমস্যা হল সে অব্জেক্টিভ নয় অর্থাৎ সে বস্তুগত নয়, সে বিষয়গত – সাব্জেক্টিভ। আমার ব্যক্তিত্বের ধাঁচ (স্কিমা) অনুসৃত কল্পনা এমন একটা বিশেষ প্রকার যা আমার ব্যক্তিত্বের সীমাবদ্ধতা দুষ্ট, সন্দেহ নেই। তাই আমার জানা আর কল্পনার দ্বারা সৃষ্ট কোনো অতীত মানুষের তথা ঘটনার রূপচিত্রে আমার নিজস্বতার অংশ অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে একি শুধু অতীতের ক্ষেত্রে, তা তো নয়। তবে জেনোফন যে দৃষ্টিতে সক্রেটিসের ছবি এঁকেছিলেন, প্লেটো তার থেকে এত উন্নত ছবি আঁকলেন কি করে? কারণ ওই যে, ফাঁকা অংশটায় যে কল্পনার রাজত্ব, সে তো স্রষ্টার নিজের মনের মাধুরী। কিন্তু সব সময় যে সে মাধুরীই থাকবে তার কি নিশ্চয়তা আছে, গরলও তো থাকতে পারে! 
        তবে এই দাঁড়ালো যে, যা জানি তা খানিক তথ্যনির্ভর আর বাকিটা আমার কল্পনানির্ভর। আমার জানতে যে তথ্যাবলী লাগে, সেই তথ্যাবলীর ফাঁকটুকু পূরণ করে আমার কল্পনা। যে কল্পনা আমার ব্যক্তিত্বের রঙে রাঙা। তাই অতীতের ধারণা আমাদের যত সুস্পষ্ট বর্তমানের নয়। বর্তমানকে জানা কঠিন শুধু নয়, অনেকাংশেই অসম্ভব। বর্তমান - যা থেকে অতীতের জন্ম হচ্ছে এবং যে নিজে ভবিষ্যতের বুকে হামা দিচ্ছে। বর্তমান কোনোদিন দাঁড়ায় না, হামা দেয়। কারণ এক, বর্তমান সর্বদাই সদ্যজাত। তার মধ্যে খানিকটা পক্কতার রঙ যেই ধরে সে অতীতের হতে শুরু করে। যদিও এই সন্ধিক্ষণটা ধরা খুব শক্ত। তখন প্রায়শই কোনটা বর্তমান আর কোনটা অতীত গুলিয়ে যেতে থাকে। আমাদের অহং শিকারি বেশিরভাগ সময়েই সেই সদ্য অতীতকে বর্তমান বলে প্রমাণ করে, নিজের মূঢ় নিশ্চয়তার নখ দাঁত নিয়ে সদ্যজাত কোমল বর্তমানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বর্তমানকে নিজের বিষাক্ত বা সুমিষ্ট কল্পনা দিয়ে বিকৃত করার সুক্ষ্ম কৌশল রপ্ত করে। অন্যকে বিভ্রান্ত করে, ক্রমে নিজেও বিভ্রান্ত হয়, এইভাবেই অহং ধ্বংসের দিকে যায়।
        বর্তমান সদা সদ্যজাত, নিষ্পাপ, প্রাণপ্রাচুর্য আর সম্ভাবনায় ভরপুর। তবে আমরা বর্তমানকে জানি কি করে? প্রথম কথা স্বীকার করতেই হয়, আমরা কেউ কোনোদিন সম্পূর্ণ অর্থে বর্তমানকে জানতে পারি না, পারবও না স্পষ্ট করে। যেমন চোখের খুব কাছে কোনো বস্তু এনে ধরলে আমরা তার স্পষ্ট রূপ দেখতে পাই না।তাকে খানিক চোখের থেকে দূরে না সরালে সে স্পষ্ট নয়। তবে উপায়? উপায় দুটো, এক, অতীতভূত বর্তমান আর স্বজ্ঞা নির্ভর বোধ। অতীত নির্ভরতার কথা খানিক আগেই বললাম। যার থেকে জন্মায় যত মৌলবাদ, সঙ্কীর্ণ মতবাদ, ক্ষণিক আত্মতুষ্টির বোধ। 
        স্বজ্ঞার ক্ষেত্রে এর বিপরীত। আমি যা কিছু জানি তা অনির্দিষ্ট কোনো এক চিরন্তন চেতনার মধ্যে দিয়েই জানি। সেই চিরন্তন চেতনার কোনো রূপ বা সংজ্ঞা হয় না। তাকে আমাদের শ্রদ্ধেয় কান্ট মহাশয় পিওর রিজিন বলে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন বলা হয়েছে, নিউটন আপেল পড়তে দেখলেন বটে কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটা তো আর পড়তে দেখেননি আপেলের সাথে ট্যাগ করা অবস্থায়? সে তো তিনি মননের মাধ্যমেই জেনেছেন, এও তেমন। তবু এত কিছুর পরও মনে রাখতে হবে যে সে কিন্তু অধরাই থেকে যাবে, আর সেখানেই আমাদের নিজেদের হাত থেকে মুক্তি। আমা হতে জাত অতিঠিক আর অতিভুল --- দুইয়ের হাত থেকেই আমার মুক্তি। 
        কবিতার আনন্দ সেখানেই। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ের হয়েই থাকে। কবিতাই একমাত্র যা চিরকালীন। তাই পৃথিবীতে গভীরতম কথাগুলোর বাহক তথা প্রকাশক কবিতাই। বাস্তব আর মিথ্যার মধ্যে সত্যের সেই সুক্ষ্ম অবস্থানটায় একমাত্র কবিতাই খুব নিশ্চিন্তে দাঁড়াতে পারে। সে বোঝায় না, উপলব্ধি করায়। সে ব্যাখ্যা করে না, দর্শন করায়। তাই প্রয়োজনের মুক্তি যদি ভাষায় হয়, তবে ভাবের মুক্তি অবশ্যই কবিতায়।

373
Fri, 06/15/2018 - 12:30


        একটা রঙের জোয়ার এসেছে আমাদের দেশে। এতদিনের বিচ্ছিন্নতা আর পোষাচ্ছে না। একটা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবার নির্দেশ আসছে। যারা দাঁড়াতে পারছে না তাদের ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার নির্দেশও আছে সার্কুলারে। ধর্ম প্রাচীন না। ধর্মের একটা শক্তি আছে। ধর্মের ভূগোলে বিশ্বাস করা কিছু মানুষ বলছে এই সীমার মধ্যে নিজেকে বেঁধে ফেলো। তারপর ধর্মের সেই আদিম শক্তিটাকে ভাপিয়ে তোলো। পাতলা, মিহি দর্শন যা ধরতে গেলে পিছলে যায় সেই ধর্ম না। একটা মোটা কাতা দড়ির মত শক্ত কিছুর গায়ে দর্শনের প্রলেপ দাও। বোঝাও প্রাচীন ধ্রুব সত্যের মহিমা।


        একটা বলিষ্ঠ গণতন্ত্র একটা সুক্ষ্ম রাজতন্ত্রের উপরেই দাঁড়ায়, এটা স্পষ্ট বুঝতে হবে। ভারত রাজনীতি বোঝে রাজার মহিমায়। আলোচনা, চর্চার থেকে শক্তিশালী শব্দ এখানে নির্দেশ দেওয়ার বলিষ্ঠ হাতের উপর আস্থা। আলোচনা বুঝতে আমরা দুর্বলতা বুঝি। সেন্টিমেন্টালিজ্ম আর প্যাট্রিয়াটিজ্মের সখ্যতা গভীর আমাদের মাটিতে। মহাপ্রভুর চৈতন্যদেবের ‘হা কৃষ্ণ’ কান্না আর দেশের মাতৃবন্দনায় কান্নার একই সুর আমাদের – প্যাট্রিওয়টিজ্মের সাথে ভক্তির রসায়ন আমরা ভালো খাই। রামপ্রসাদী সুরে দেশাত্মবোধ। দেশে আত্মবোধ না মানবতায় আত্মবোধ? না, প্রাচ্যে মানবতায় আত্মবোধ জন্মায়নি বাস্তব জীবনে কোনোদিন, শাস্ত্রে যাই থাক। আমাদের সব স্বীকৃতি পাশ্চাত্য অভিমুখী। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, অর্থনীতি ইত্যাদির চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাশ্চাত্যে। আমরা তাদের মানদণ্ডে উতরে গেলেই সার্থক। বুকার, অস্কার, নোবেল, গ্র্যামি, পুলিৎজার ইত্যাদি যাই বলো। যদিও আমরা অনন্তের পুত্র-পুত্রী। ব্যস অত অবধিই। ওর বেশি আর এগোতে দিইনি আমরা নিজেদের। ওর পরে বিরাট খাই। নিজেকে বাস্তবের আঙিনায় বাজিয়ে নিতে আমরা বরাবর অপারগ। অন্যের দ্বারা সাধিত বাস্তবের আঙিনায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যে নির্যাসটুকু পড়ে থাকে তাকে হাতের চেটোয় তুলে নিয়ে যতটা সম্ভব ঘরে এনে জড়ো করতে আমাদের জুড়ি নেই।


        আজ যে কন্ঠস্বরগুলো চেপে দেওয়া হচ্ছে এক এক করে সে কণ্ঠস্বরগুলোর প্রতিধ্বনি অন্যান্য কণ্ঠস্বরে এত দুর্বল যে তাতে লজ্জা জাগে। আমাদের ওতে কিছু আসে যায় না। আমরা জানি আমাদের কোনো দায় নেই। আমাদের কোনোদিনই কিছুর দায় ছিল কি? ছিল না। আমরা অন্যের দায়ের সুচারু সম্পন্নতার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পেরেছি, কিন্তু নিজের দায়কে ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে নিশ্চিন্তে বসে আছি। যে কোনো উচ্চ-আদর্শ বিলাসী জাতিই কপট হয়। আর সেই কপটতার ছিদ্র দিয়েই তাদের প্রাণশক্তি, আয়ু স্খলিত হতে থাকে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে বেরিয়ে যেতে থাকে। আমরা সেই নিষ্ক্রিয় দুর্বল অবস্থাকে উন্নত চরিত্রের পরাকাষ্ঠা বানিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগি আর চারদিকের যত আধিব্যাধিতে ঘিরে থাকি।


        একজন শাসকের সবচাইতে বড় ভয় সত্যে না, সত্যের প্রকাশে, যে সত্য তার দুর্বলতার বার্তা বহন করে। আর দুর্বলতার বার্তা বহনকারী মাধ্যমকে আমরা বলি সাংবাদিকতা। বিরোধীপক্ষ থাকে, তাকে নিয়েও ভয় নেই আমাদের। কারণ আমরা জানি, আমাদের দেশে যারা বিরোধীপক্ষ তারা আসলে পরাজিতপক্ষ। পরাজিতপক্ষ আর বিরোধীপক্ষের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যার পরিচয় শুধু পরাজয়ে তার সামনে একটাই লক্ষ্য জয়ী হওয়ার। আর বিরোধীপক্ষের একটা বড় দায় শাসককূলের স্বেচ্ছাচারিতার, অপসিদ্ধান্তের যুক্তিযুক্ত বিরোধিতা করা। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা বিজেতা আর পরাজিতর সংঘর্ষ দেখে আসছি কেবল, কোঁদল যত দেখি তর্ক তত দেখি না। আমাদের জঙ্গলে যেন সিংহ নেই, সিংহের ছাল আছে শুধু, যা বিদেশ থেকে আমদানি করা।


        এরও একটা কারণ আছে যা আরো গভীরে। আমরা বিরোধিতা বলতে স্বার্থ আর আবেগের ঊর্দ্ধে উঠতে পারি না বলে আমাদের বিরোধী দলের সংখ্যা এত বেশি। বিরোধিতা করারও একটা নীতি আছে। তা হাত-পা ছুঁড়ে কান্না নয়, কাদা ছেটানো নয়, ষড়যন্ত্র নয়। তা প্রকাশ্য যুক্তির আলোয় রুখে দাঁড়ানো আর বাস্তবের নিরিখে তার প্রয়োগের সম্ভাব্যতা বিচারে তাকে ফলীয়মান করে তোলার সৎপ্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করা। তা তো আমাদের মাটিতে হওয়ার জো নেই। না পোষায় দল খুলুন। মঙ্গলের নীতি একটা হয় না, একত্বে হয়। সেই একত্ব জন্মায় একটা দেশের উন্নতির স্বার্থে একমুখী চর্চায়। একের স্বার্থ বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো হয়, দশের স্বার্থ একটা নীতিতে চলে। আমার বাড়ির নর্দমা, রাম-শ্যাম-যদু-মধু'র বাড়ির নর্দমা যে বড় নর্দমায় এসে মেশে তাকে কি করে পরিবেশের ক্ষতি সাধন না করে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায় তার জন্য একজোট হয়ে একটা ব্যবস্থা নিতে হয়। আমাদেরই নিতে হয়। কারোর উপর সে দায়িত্বটা দিয়ে তার ভাবনা অনুযায়ী একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হয়। আমাদের কপালে সে ‘কারোর’ খোঁজটা পাওয়া বড় দুষ্কর। কারণ আমরা আত্মস্বার্থে বিচ্ছিন্ন। নারীবাদী ভাবছে তার মত অনুযায়ী সমাজটা চললেই উন্নতি, সংরক্ষণবাদী ভাবছে তার, প্রাচীনবাদী, পুঁজিবাদী, সাম্যবাদী, ধর্মবাদী ইত্যাদি নানা বাদীতে বাদীতে ছয়লাপ, সেই স্বাভাবিক, কিন্তু এদের মিলিত কোনো কন্ঠ নেই। কারণ টুকরো টুকরো বিরোধিতাকে একটা বড় আকারে, সুনির্দিষ্ট নীতিতে দেখতে আমরা অক্ষম। ফলে যত স্বার্থ তত দল। ভাবের মিলনও হয় না, আর কাজের বেগও মঙ্গলমুখী হয় না। কারণ মিলনের ভাবমূর্তিটা আমাদের চিন্তায় কোনোদিনই ছিল না। তার মধ্যে এত ফাঁক-ফোঁকর বলেই যে না এতদিন ধরে এতগুলো বিদেশী শাসনের, শোষণের সাক্ষী আমাদের মাটি। নীতির বিরোধ হলে দুটো দলেই লড়াই চলে, স্বার্থের রূপ যেমন অজস্র তেমন আমাদের দেশে দলের সংখ্যাও অজস্র।
        আজ ভাবনার দিন। দুশ্চিন্তার দিন। যে রঙে মাতামাতি হচ্ছে তা আদতে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। একের মধ্যে বহুত্বের নির্বাসনে না বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যে?
 

374
Tue, 06/05/2018 - 14:00

        'চর্চা' শব্দটার আগে বানান ছিল 'চর্চ্চা'। চর্চ্চ শব্দটার অর্থ আলোচনা, আন্দোলন, উচ্চারণ। সেই থেকে চর্চ্চা, তার থেকে চর্চা। চর্চা মননের শব্দ। মুক্তো কি করে হয়? ঝিনুকের অভ্যন্তরে একটা গ্রন্থি থাকে, ন্যকর গ্রন্থি। সেই গ্রন্থি থেকে কঙ্কিওলিন নামক রাসায়নিক পদার্থ সিঞ্চিত হয়ে মুক্তো তৈরি হয়। কিন্তু সিঞ্চিত হবে কাকে কেন্দ্র করে? বাইরে থেকে একটা ধুলিকণা কি বালুকণা সেই উদ্দীপকের কাজ করে। সেই ধুলিকণা বা বালুকণা নিউক্লিয়াস হিসাবে ধরা হয় স্থূল অর্থে।

        আমাদের চর্চা সেই মননের মুক্তো। শুধু একা একা তা হয় কি? হয় না। প্রচুর বই পড়ে তা হয় কি? না তাও হয় না। সেনেকার চিঠিপত্রগুলো তার অসামান্য বিশ্লেষণ। শ্রীরামকৃষ্ণের পুঁথিগত বিদ্যা কতটুকুই বা ছিল, কিন্তু তার চর্চা, তার স্বজ্ঞার তাড়না ছিল এমন গভীর যে মনন-সাগরের তলদেশ মন্থন করে অমূল্য রতনের সন্ধান আমাদের এনে দিয়েছে। সক্রেটিস, খ্রীষ্ট, বুদ্ধ, কনফ্যুসিয়াস, নানক, কবীর এদের প্রত্যেকেরই একই ইতিহাস। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মৌলিক পথে নিজেদের মননের গভীরতা স্পর্শ করেছেন শুধু না, বিশ্বমানবতার সাথে তাকে যুক্ত করেছেন নিরহং প্রচেষ্টায়।
        তবে কি পাঠের কোনো মূল্য নেই? আছে। তার মূল্য যতটা না অন্দরমহলে তার চাইতে অধিক বাহ্যিক প্রকাশের অনুশীলনে। সেইজন্যে দেখা যায় অনেক পঠিত একজন মানুষ, অনেক বড় বড় কথা বলছেন, উদ্ধৃতিও দিচ্ছেন, কিন্তু কোথায় যেন একটা মিশছে না। কি মিশছে না? আচরণ, উদ্দেশ্যের সাথে বক্তব্যের। শ্রীরামকৃষ্ণ একে বলতেন এক গোয়াল ঘোড়া। অর্থাৎ কিনা গরু তো নেই-ই সাথে ঘোড়াও নেই। অথবা বলতেন শকুন। অনেক উঁচুতে উড়েও দৃষ্টি ভাগাড়ে। রান্নার পর অনেকে বলেন, তরকারিটা যেন 'হাঁ' করে তাকিয়ে আছে, অর্থাৎ কিনা মিশ খায়নি। এই মিশ খাওয়ার রসায়নটা বড় জটিল, গভীর। তা অক্ষর পাঠে জন্মায় না, তা জন্মায় আত্মপাঠে। ভাবের অঙ্কুরে জন্মায় ভাষা। কিন্তু ভাবই যদি না জন্মায় তবে অঙ্কুর আসবে কোথা থেকে, যা বাইরে থেকে অঙ্কুরের মত দেখায় আসলে তা কলমের কৃত্রিম গাছ। তাতে ফলন হয় বাজারি মতে কিন্তু প্রকৃতির যে ধারাবাহিক অভিব্যক্তির পথ তাতে তার অবদান শূন্য। বিজ্ঞানেও তাই। তাই আজ unlearn কথার প্রবর্তন হচ্ছে। অর্থাৎ মনকে 'জানা'র ভারমুক্ত করো। তবে মননের বেগ স্বাভাবিক হবে। স্বমত স্ব - আলোতে এসে পথ পাবে, পুনরাবৃত্তির হাত থেকে বাঁচা যাবে। পাঠ মনোরঞ্জনের জন্য হলে অবশ্যই আলাদা কথা যদিও। 
        তবে কোনো পাঠ কি সেই বালুকণার কাজ করতে পারে না? নিশ্চয় পারে। পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় পারে। আমরা অক্ষরজ্ঞানী ভারতীয় মাত্রেই বহুভাষী। আমাদের এক ভাষায় না জীবিকা মেটে, না তো হৃদয়। এ প্রথা আজ বলে না, ভারতের নবজাগরণে এ ভাব স্পষ্ট। সেই সময় বিশ্বসাহিত্য নানা মনীষীর কলমে ভারতের মাটিতে প্রবেশের পথ পেল, তাও খাইবার পাসের মাধ্যমে না, রীতিমত রাজপথে। চিত্ত মুক্ত হল নানা'তে, সীমাবদ্ধ অহং-এর আস্ফালনে না। যেখানে যে যুক্তিতেই সীমাবদ্ধতা জন্মেছে সেখানেই মনন বাধা পেয়েছে। সীমাবদ্ধতা শব্দটা ধর্ম আর অন্ধবিশ্বাসের সাথে যায়, চর্চা আর মননের সাথে যদি যেত তবে আজ বিজ্ঞান প্রাদেশিক হয়ে থাকত, মানবতা শতধা। আজ যদি কোনো পদার্থ বিজ্ঞানী কিম্বা জীববিজ্ঞানী বলে বসেন আমি আমার নিজের ভাষা ছাড়া বিজ্ঞান চর্চা করব না, তবে তা নিতান্তই হাস্যকর কথা হয়ে ওঠে। বরং আমাদের বিজ্ঞানের পথেই সার্বজনীনতার চর্চার বেগ বহুগুন বেড়ে উঠেছে। আমরা জানি সালোকসংশ্লেষের তত্ত্ব রাশিয়া, কলম্বো, আমেরিকা, আফ্রিকায় পৃথক হয় না, না তো পৃথক হয় মাধ্যাকর্ষণের সুত্র। যদি কোনো ব্যতিক্রম বা তারতম্য থাকে তারও একটা যুক্তিনির্ভর কারণ দর্শানো যায় বিজ্ঞানে। একেই চর্চা বলে।
        চর্চার মূল রসদ বাইরে থাকে না। মূল রসদ থাকে ব্যক্তিত্বে। তাই কোনো মহাপুরুষ পাঠাগারে জন্মায়নি। জন্মিয়েছে মাঠেঘাটে, দারিদ্র্যে, বোধহয় কিঞ্চিৎ অনাদরে, অবহেলায়। বাইরের পাঠ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যা জীবনপাঠ, তাকে উদ্দীপ্ত করেছে, ক্ষেপিয়ে তুলেছে, সে প্রাণের গভীরে ঢুকে তত্ত্বের আলো খুঁজেছে। কৃত্রিম কোনো পাঠের বিশালতায় সে চাপা পড়েনি, 'বই পড়ে সে বই হয়ে যায়নি', যদি হত তবে সে বড়জোর স্কলার বা পণ্ডিত হত শুধু, মননের আধার যে জ্ঞানী সে হয়ে ওঠা সম্ভব হত কি?
        আজ আমাদের সমস্যা হল - এই চর্চার অভাব। আমাদের চর্চা, তথ্য আর উদ্ধৃতির জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে। অতিরিক্ত পদ পাত্রে থাকলে যে তা আমাদের সুষম আহার হয়ে ওঠে না, বরং স্বাস্থ্যের পক্ষে তা হানিকর সে কথা আমরা ভুলতে বসেছি। 'গীতাঞ্জলি'র প্রকাশের সাল, কবিতা বা গানের সংখ্যা, পাতার সংখ্যা, কয় কপি ছাপা হয়েছিল, কোন কালিতে, কোন ফরম্যাটে, কোন প্রেসে, কার তত্ত্বাবধানে ইত্যাদি জানলেই যদি 'গীতাঞ্জলি' জানা যেত তবে আজকের দিনের প্রযুক্তিবিদ্যা, তার চেয়ে সহায়ক কিছুই নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ জানা শুধু আসন পাতা, আসনের উপর উপবিষ্ট হবেন যিনি তাকে আর আমন্ত্রণ জানানোর সময় কারোর নেই। পাখি আর গান গায় না, নড়ে না, শুধু শুকনো পুঁথির পাতাগুলোর আওয়াজ খসখস করে যত আমরা তত উৎফুল্ল হয়ে উঠি - এই তো সফলতা। কিন্তু তা তো সত্য নয়। যে বোধ, প্রজ্ঞা চালকের আসনে আসার কথা ছিল তাকে তো বাইরে থেকে পাওয়া যায়নি? বই তো মানুষ আবিষ্কার করেনি, মানুষ বই আবিষ্কার করেছে। সেই তার সীমাবদ্ধতা জানবে। কিন্তু সে নিজেই যখন 'রক্তকরবী'র অলক্ষ্যে থাকা রাজার মত নিজের সীমানায় নিজেকে আটকে রাখতে চায় তবে তা নিতান্তই লজ্জার, শঙ্কার তো বটেই।
        চর্চা ফিরে আসুক। আসবেই। চর্চার প্রধান চালিকা শক্তি তৃষ্ণা। সে তৃষ্ণা পাঠে মেটে না, সে তৃষ্ণা ভাবের গভীরে নীরবতায় মেলে, যখন সে একটা সুত্র আবিষ্কার করে। হতে পারে সে অতি সামান্য, তাই হোক, তবু সে তার মননসঞ্জাত। তাতেই তার পূর্ণাধিকার। তবেই সে নানা পাঠে নিজের সেই অনুভূতির একটা মিল পায়। নিজেকে বিশ্বমানবতার সাথে মিলিয়ে একটা সাজুয্যতায় আসতে পারে। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে না সে। সে অনুভব করে তার আগেও বহুকাল তারই মতন কেউ এই অভিজ্ঞানের পথে হেঁটেছে, এবং একটা স্মৃতিচিহ্নও রেখে এসেছে অক্ষরের মালায়। কিন্তু সেই মিল পাওয়ার আগে তাকে নিজেকে তো সেই পথে হাঁটার অভ্যাস করতে হবে আত্মশক্তিতে ভর করে, একা। তবে গিয়ে মিলবে সে আনন্দনিকেতন। নইলে অন্যের অনুভূতি আর অক্ষরে দাগ বুলিয়ে আর যা হোক পণ্ডিত হওয়া যায়, প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া যায় না। কারণ মনন ও প্রজ্ঞা পাঠনির্ভর নয়, প্রেম আর জ্ঞানের তৃষ্ণানির্ভর। তার ফল্গুধারার মত বেগকেই বলা হয় চর্চা। যা স্বধর্মীর আশ্রয়ে বাড়ে, তীক্ষ্ণ হয়। কিন্তু স্বধর্মীর অভাবে মারা যায় না। স্বাবলম্বী হয়।

375
Thu, 05/31/2018 - 17:00
            কথায় বলে – বাদ-বিতণ্ডা। কথা দুটো একসাথেই উচ্চারিত হলেও তাদের অর্থের ফারাক বিস্তর। বাদ – তত্ত্ব নিরূপণের জন্য তর্ক। বিতণ্ডা – স্বমত প্রতিষ্ঠিত হোক চাই নাই হোক, পরমত খণ্ডনের জন্যেই তক্ক। তবে এইভাবে বলি, এক হল গিয়ে তর্ক আর এক হল গিয়ে তক্ক।         ইদানীং পশ্চিম দেশে একটা তর্ক ও তক্ক'র দারুণ রব উঠেছে – The Intellectual Dark Web (IDW)। হয়েছে কি, বিভিন্ন ক্ষেত্রের মানুষজন নির্ভীকভাবে, এমনকি জনমতের, রাজমতের বিরুদ্ধে গিয়েও নিজেদের বিচার-বিবেচনা স্বাধীনভাবে উপস্থাপনার জন্য একটা platform বানিয়েছেন। কোনো মূলধারার পত্রিকায় কোনো আলোচনা ছাপা হবে না, বা দেখানো হবে না। YouTube, Podcast, Twitter ইত্যাদি গণমাধ্যমে আর নানা সভাগৃহে আলোচনা হতে পারে। শর্ত হল Politicaly corrtectness, Pseudo Intellectualism ইত্যাদি থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে হবে। এই IDW কথাটার সূত্রপাত করেন Eric Weinstain নামক এক আমেরিকান অর্থনীতিবিদ তথা লেখক। ঘটনার সূত্রপাত ঘটে Evergreen State College -এ Day of Absence বলে একটা অনুষ্ঠানে যখন সব শ্বেতাঙ্গদের কলেজ থেকে সরে থাকতে বলা হয়। এর প্রতিবাদেই এরিক সাহেব চটেন, আর এই IDW সূচনা ঘটান। ইতিমধ্যেই এটা তীব্র সাড়া ফেলেছে জনমানসে সেখানে। লোকে সাজানো সত্যি শুনতে শুনতে ক্লান্ত আসলে, তাই এই তৃষ্ণা একটা সঠিক অর্থে তর্কের - এমনটাই বক্তব্য এই তার্কিকমহলের সদস্যদের।         আমরাও ক্লান্ত। এক পয়সা পেট্রোলের দাম কমার মত রসিকতা সহ্য করার মত অবস্থায় আমরা হয়ত আর নেই। আমরা ‘সারা পথের ক্লান্তি’ আর ‘সারা দিনের তৃষা’ বয়ে বয়ে সত্যিই ক্লান্ত। ‘কেমন করে মেটাব যে’ সত্যিই ‘খুঁজে না পাই দিশা’। তখনই মনে এল শব্দটা – বাদ – তত্ত্ব নিরূপণার্থে কৃত তর্ক। সে তর্ক জাল বিস্তার করে না, সে তর্ক দিশা বার করে। কারণ এক একটা যুক্তি সেখানে গুহার দেওয়ালে আঘাত, আলোর তৃষ্ণায়। সে অন্ধকারের যন্ত্রণা না থাকলে এই তর্কে তো আমার অধিকার নেই। আমি তো বিবিক্তসেবী সন্ন্যাসী নই, না তো নির্বোধ – তবে? তবে এ দায় আমারও। সাবধান অন্ধকার থেকে না, সাবধান আলোর মত প্রহেলিকা থেকে, যা আলো নয়, কিন্তু আলো – ‘আচ্ছে দিন।‘         ঠুলি পরতে চাইলে ঠুলির অভাব নেই। কিন্তু ঠুলির অন্ধকার আর অন্ধত্বের অন্ধকারের মধ্যে একটা পার্থক্য তো থেকেই যায় না? দ্বিতীয়টায় আমি চাইলে কোনোদিন চক্ষুষ্মান হতেও পারি। আমার আলোর তৃষ্ণা মরেনি সেখানে, কিন্তু প্রথমটায় তো আলোই শত্রু। তাই ঠুলি যত মজবুত হয়, নির্বোধের স্বর্গের চারণক্ষেত্রও তত পরিব্যপ্ত হয়। চারণক্ষেত্র যত পরিব্যপ্ত হয় সদস্য সংখ্যাও তত বেড়ে ওঠে। আর সদস্য সংখ্যা যত বেড়ে ওঠে গণ-সম্মোহনের উল্লাসও তত তীব্র হয়। উল্লাস যত তীব্র হয় বিবেক-বিচার ততই নিষ্ক্রিয় অঙ্গ হয়ে পড়ে। ক্রমে ডাল ভেঙে পড়ার সময় হয়। একটা ডাল যখন মূল গাছ থেকে পৃথক হয়ে যায় নিজের বিশালত্বের অহংকারে আত্মতুষ্টিতে, বোঝা যায় তার শোকাবার সময় এলো। তাই শত শত সংখ্যা ছাড়িয়ে গেলেও ভেড়ার পালের গতিবিধি সংসারে একটা রূপকের স্থান নিয়েছে। তা খুব একটা গর্বের কি?         মুশকিল হল এই বিতণ্ডাপ্রেমীদের নিয়ে। আজকাল টিভিতে যে তর্কাতর্কি হয় সন্ধ্যেবেলা গোছ করে, তার অধিকাংশই ওই আমাদের আগের কথা অনুযায়ী তক্কা-তক্কি। ওতে কারেন্ট পোড়ে, মাথা গরম হয়, হাই ওঠে, সময় নষ্ট হয় – কাজের কাজ কিচ্ছু নয়। ওরা পরের দিনের বিষয় খোঁজে আর বিষজ্বালা ধরাতে পারে এমন লঙ্কামুখো, আচারমুখো লোক খোঁজে। মাঝে মধ্যে খানিক দামী কিছু হয় বটে, তবে কি আর করা, রাজরোষে সেধে তখনই পড়া যায় যখন সম্রাট তুষ্ট থাকে, তাই না? Pseudo intellectual -এর বাংলা কি হতে পারে - মেকি-বুদ্ধিজীবী? তা তাদের লক্ষণ কি? প্রথম লক্ষণ অবশ্যই বিতণ্ডা। দ্বিতীয়ত তারা নির্দিষ্ট ক্ষেত্রের বাইরে কথা বলবে না, কারণ তার ওই জমিটুকুই চাই। সত্যের জমি থাকে না, আকাশ থাকে। ক্ষুদ্র মতের একটা দুর্বল, স্বার্থান্বেষী, লোভী বুদ্ধিজীবী লাগে। যাদের দল থাকে, মত থাকে, পোশাক থাকে, বিশ্বাস থাকে – এগুলো সব ক'টাই থাকা ভালো, কিন্তু এগুলো সবই তাদের লাভের নিরিখে চূড়ান্তভাবে থাকে। তাই শব্দের যাদু, চাটনি থাকলেও সত্যের বোধের যে মর্যাদা তা থাকে না। সাময়িকভাবে জয়ী হয় কিন্তু বিশ্বাসযোগ্যতায় দাঁড় করানো দায় হয়। ক্রিটিকাল থিংকিং তো আর কোটেশান পড়ে জন্মায় না, না তো শুধু নিজের অভিজ্ঞতা বা স্বার্থের ঘরে ঘুঁটি তুলে। সে জন্মায় সৎ, নির্ভীক মননের গর্ভে। সে গর্ভ-যন্ত্রণা তারা সইবে কেন? এই মেকি-বুদ্ধিজীবী শ্রেণীতে ভর্তি চারদিক আজ। লোকে খাচ্ছে, তাই এরা আগাছার মত বাড়ছে। কথার পর কথা জমছে। ডেসিবেল চড়ছে, ম্যানিফেস্টোর নতুন সংস্করণ হচ্ছে কিন্তু “রাজা তোর কাপড় কোথায়” বলা শিশুটাকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। সে ব্যস্ত গুগুল প্লে স্টোরে, জিও!         তবে কি এ সব কথা সেই কবি বহুকাল আগে বলে গেছেন, কেউ তেমন আমল দেয়নি তা আর কি করা... এখনও তিনি আমাদের সাথে একই কালের বাতাসে শ্বাস নিচ্ছেন... কিন্তু বহকাল কোনো কণ্ঠস্বর শুনতে পাই না বলে বড় কষ্ট লাগে। কি বলেছিলেন তিনি –   “বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না। কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, তারা আর কিছুই করে না, তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার করে।”  - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী  
376
Sun, 05/27/2018 - 11:00
            আমার ছোটোবেলায় যখন ক্যাসেটের দোকানে যেতাম তখন ক্যাসেটের সারিতে কয়েকটা নজরুলগীতির ক্যাসেট থাকত – পূরবী দত্ত, ফিরোজা বেগম, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ইন্দ্রাণী সেন, ড: অঞ্জলি মুখোপাধ্যায় ইত্যাদি। কিন্তু আজ যখন সিডির দোকানে যাই সেই অর্থে নজরুলগীতির সিডি প্রায় চোখেই পড়ে না। আর আজকের দিনের কয়েকজন নজরুলগীতির গায়ক গায়িকার নাম বলতে বললেও ক'জন বলতে পারবেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। অবশ্যই এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কথাগুলো বলা। বাংলাদেশের ছবিটা অনেকটা অন্যরকম। সেখানে নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠান আছে, স্বরলিপির শুদ্ধতা নিয়ে সিরিয়াস কাজ হয়, সঠিক অর্থে নজরুলের গান বিশেষ করে শিক্ষা-প্রচার-প্রসারের ব্যবস্থা আছে। কারণ অবশ্যই নজরুল সেখানে জাতীয় কবি তাদের। আমাদের সে বালাই বা দায় কোনোটাই নেই।         ধর্ম কি কোনো কারণ? ভারতের জলবায়ুতে ধর্মের গতায়াত অনেক গভীরে। তবে কি সেই কারণেই কিছুটা আত্মীয়করণের অভাব? তাই বা কিভাবে বলি? তবে গালিবের প্রতি ভারতের তথা বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহলের এমন একটা টান কিভাবে আসে? অবশ্যই সে টান আসাটা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। সারা ভারতের গালিব এখনও নানা লেখায়, নানা প্রসঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছেন। গাওয়া হচ্ছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে। কিন্তু নজরুল নয় কেন? নজরুল সে অর্থে বাঙলার গালিব হয়ে উঠলেন না কেন? আসলে বাঙালীর বুদ্ধিজীবী মহলে বা মননে নজরুলের সেই জায়গাটা কোনোদিন ছিল না, আর আজ তো নেই। তবে ওনার লেখার সঠিক অর্থে মূল্যায়ন হয়নি? নাকি নজরুলের জীবন দর্শন একটা বিশেষ সময়ের পরে তার প্রাসঙ্গিকতা হারালো? সেই অর্থে অবশ্যই সেই সময়ের আরো তিন কবির কথা আসে --- রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রনাথ। এদের মধ্যে অতুলপ্রসাদ আর রজনীকান্তের গানের চাহিদা বরাবরই একইরকম খানিক দেখে আসছি। খুব যে একটা বেড়েছে বা কমেছে আমার মনে হয় না। সেদিনও দেখেছি কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়ের বাইরে এদের গানের ধারক-বাহক কেউ ছিলেন না, আজও তেমন কেউ নেই। মাঝে নূপুরছন্দা ঘোষের কিছু মৌলিক চেষ্টা অবশ্য দেখেছিলাম। এ প্রসঙ্গে আরেকজনের কথা মনে পড়ল --- শ্রদ্ধেয় বিমান মুখোপাধ্যায়। একপ্রকার নজরুলের গানের এনসাইক্লোপিডিয়া। জানি না, তার প্রয়াণের পর তার শিষ্য-শিষ্যারা কতটা তার রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টায় আছেন। তবু মোট কথা এই তিন কবিও আজ বিস্মৃতির পর্যায়ে। কিছু কিছু রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মাঝে মাঝে অতুলবাবুর কিছু গান বার করে থাকেন এই যা। তাও অবশ্য ওদেশেই এখন বন্যা, অদিতি মহসীন ইত্যাদি। আগে কণিকা, সুচিত্রা কয়েকটা রেকর্ড করেছিলেন অতুলপ্রসাদের। কণিকার একটা নজরুলগীতিও শুনেছিলাম – 'চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়', আর 'কেউ ভোলে না কেউ ভোলে'। সে অন্যপ্রসঙ্গ।         আমাদের ছোটোবেলায় রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা পাড়ায় পাড়ায় হতে দেখতাম। আরেকটাও মজার কথা ছিল। আমি দেখেছি তখন দুটো দলও ছিল, একপক্ষের নজরুল, আরেকপক্ষের রবীন্দ্রনাথ। একটা বেশ রেষারেষির ভাবও ছিল। এমনকি তখনকার দিনের মোটামুটি এক খ্যাতনামা নজরুলগীতি শিল্পীকে এমনও বলতে শুনেছি, “রবীন্দ্রনাথ চাইলে নজরুলের নোবেল পাওয়াও হয়ে যেত। ওনার অনেক কানেকশান ছিল বিদেশে, আসলে জমিদার ছিলেন তো, তায় ব্যবসায়ী পরিবার, ওইতেই তো নোবেলটা উনি বাগিয়েছিলেন। আমাদের নজরুলের তো সে ভাগ্য ছিল না।“ এখন সে সব আর দেখি না। আধুনিক প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের দেখেছি তাও কয়েকটা রবীন্দ্রনাথের গান বলতে পারে, কিন্তু নজরুলের গান একটাও না। এক যদি না গান শেখে কিম্বা বাড়িতে চর্চা থাকে কারোর।         আমি সেই কারণটাই খুঁজতে চাইছি। কেন এরকম হল? চর্চাটা এত কমে গেল কেন? আমি সাধারণের কথা বলছি না। কারণ নজরুলের কয়েকটা নির্দিষ্ট কবিতা আর গান ছাড়া তার কি অবদান আছে বাঙলা সাহিত্যে তা অধিকাংশ বাঙালীর কাছেই ধোঁয়াশা।         বাঙ্গালী টেম্পারামেন্টের সাথে কি তবে নজরুলের মিলল না? বহুকাল পরে নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকের কথায় আন্তর্জাতিক মহলে নজরুলের নামটা শুনেছিলাম। তিনি নাকি ওনার লেখায় বেশ প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিভাবে হয়েছিলেন সে নিয়ে বিস্তারিত কিছু জানার সৌভাগ্য অবশ্য আমার হয়নি। ওনার লেখা পড়েও কিছু আঁচ করে উঠতে পারিনি। তবে উনি বলেছিলেন এ কথা সত্য।         আমার কথাটা অন্য জায়গায়। বিদ্রোহী কবি কথাটা শুনলেই আমার কেমন যেন একটা লাগে। কবি মানেই তো কোথাও একটা বিদ্রোহী সে। সে বিদ্রোহ যার প্রতিই হোক না কেন। তবে কি বলতে চাইছি নজরুলের বিদ্রোহটা খুব চড়া দাগের ছিল অন্যান্য সমসাময়িক কবির থেকে? আর তাতেই ওনার কাব্যপ্রতিভার চূড়ান্ত মূল্যায়ন আমরা করে ফেললাম? আমাদের দেশে তাই কি গালিব থেকে রবীন্দ্রনাথ জাতীয় স্তরের কবি হলেও নজরুলের স্থানটা হারিয়ে ফেললাম আমরা? কাউকে খুঁজে নিতে হয় আমাদের আর কেউ আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান --- এই হয়ে আসে। প্রথমটায় লাগে সাধারণের তৃষ্ণা আর দ্বিতীয়টায় লাগে সেই ব্যক্তির প্রতিভার ক্ষমতা। নজরুলের দুর্ভাগ্য আমরা দু'দিকেই হারাচ্ছি তাঁকে। না তো তৃষ্ণা আছে তাঁকে নিয়ে আরো গভীরে চর্চার, আর না তো তার লেখা আমাদের নিত্যজীবনের তথা মননের সামগ্রী হতে পেরেছে বৌদ্ধিক স্তরে। এ আমাদের ক্ষতি তো বটেই। সাথে এমন অনেক সম্পদ হারাচ্ছি তা আমাদের ভাষার এককালের গৌরব ছিল।         প্রাসঙ্গিকতার বাইরে আরেকটা কথা আছে – ঐতিহ্য। সে সম্পদের সঠিক মূল্যে রক্ষণাবেক্ষণের দায় আমাদের। হারিয়ে যেতে দিলেই হারিয়ে যায়। তাতে আর এমন বড় কথা কি। কিন্তু কথা হচ্ছে আমাদের ভাঁড়ার ঘরের পরিসর কি এতোই ছোটো যে প্রাসঙ্গিকতার বাইরে কোনো কিছুই আমরা রাখতে পারি না। শুনেছি জাহাজ টলোমলো হলে কিম্বা উড়োজাহাজ বিপজ্জনক সীমানায় এলে তার ভার লাঘবের জন্য শুধুমাত্র অতি প্রয়োজনীয় বস্তু বাদ দিয়ে বাকি সব ফেলে দেওয়াটাই প্রথা। আমরা কি তবে সেই চূড়ান্ত সংকটকালীন পরিস্থিতি দিয়ে যাচ্ছি যেখানে “ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো এ তরী” রব উঠেছে সেই কোন কাল থেকে? আজও ভারতের গ্রামে, শহরে তুলসীদাস পড়া হচ্ছে; দক্ষিণে ত্যাগরাজের গানে আজও জনসমাগম হচ্ছে শুধু না, আধুনিক প্রজন্মের শিল্পীরাও কি আনন্দে তার গান গাইছেন। আমাদের কাশীরাম দাস, কৃত্তিবাস, রায়গুণাকর, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি হারাতে বসেছে। গতকাল এক গ্রামে গিয়েছিলাম। সেখানে আমবাগানে বসে থাকা এক বয়স্ক মানুষের সাথে পরিচয় হল। খুব স্বচ্ছল তার অর্থনৈতিক অবস্থা নয়। কিন্তু তাতে তার চিত্তের আর স্মৃতির গতি কিছুতেই হার মানেনি। কয়েকটা পল্লীগীতি শোনালেন যার মূল অর্থ হল কিভাবে চাষবাস করবে, পরিবার প্রতিপালন করবে, সুপথে চলবে ইত্যাদি। তাতে ইউরিয়া, ফসফেট চাষে দেওয়ার কথাও বলা হচ্ছে আবার মেয়েদের স্বাধীনতার কথাও গাওয়া হচ্ছে। বিজয় সরকারের গান শোনাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন পরেরদিন। আমি শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, রবীন্দ্রনাথ ‘কালান্তর’-এ একেই লোকশিক্ষা বলেছিলেন গলিপথে। এগুলো কি তবে হারিয়ে যাবে? তাও সিনেমার কল্যাণে লালনের গান আবার প্রাণ ফিরে পেয়েছে, কালিকাপ্রসাদের দৌলতে কিছুটা কীর্তন, পল্লিগীতির মরা নদীতে বাণ ডেকেছে। নয়ত লালন আর কীর্তন তো এসোটেরিক হয়ে পড়ছিল ক্রমে। কিন্তু কবীর হননি ভারতের মানসলোকে।         আমাদের এ বোধ কি কোনো কালে হবে যে প্রয়োজন আর প্রাসঙ্গকিতার বাইরেও একটা দুনিয়া আছে, আর সেখানেই মানুষ সার্থক। আমাদের পরিচয় আমাদের ঐতিহ্য আর উদারতা দুইয়ের সামঞ্জস্যতায়। এক-কে সরিয়ে অন্যকে বড় করলেই এমন অনেক অঘটন ঘটে যাবে। আমার মাটিতে, আমার ইতিহাসে, আমার মননে যা মূল্যবান তা আমার নিরিখেই মূল্যবান। তার অন্যান্য দেশের নানা প্রতিভার সাথে মিলুক চাই না মিলুক। আমার বাউল, আমার কীর্তন, আমার কথাগান, আমার পটের গান, আমার ভাদু গান, আমার বৈতালিক --- সব জীবাশ্মের পথে আজ। কারণ অপ্রাসঙ্গিক ওরা আজকের দ্রুততার পাশ্চাত্য পোশাকি সভ্যতায়। আজকাল আবার আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির কথা বললে ভাবা হয় আমি সতীদাহ প্রথা থেকে পর্দাপ্রথা, বাল্যবিবাহ সব সমর্থন করছি, না হয় পদ্মফুলের কৃপাকাঙ্ক্ষী হয়েছি। আমরা আধুনিকতার ভাণ করছি কোনো উচ্চ-উদার দর্শনের জন্য না। আমরা আধুনিকতার ভাণ করছি স্রেফ আমাদের ওতেই সুবিধা বলে। আমাদের প্রয়োজন চরিতার্থ হচ্ছে সেই সব অনুকরণের ফলে। তার কতটা বিবেকের জাগরণ আর কতটা অনুকরণের, কম্ফোর্ট জোন খোঁজার তাগিদ তা একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়।          আমাদের মিউজিয়াম বানাতে হবে না। আমাদের প্রসারিত হতে হবে। শুধু সামনে না, অতীতেই ভাঁড়ারেও অমূল্য সব সম্পদ আছে তার দিকেও হাত বাড়াতে হবে। বিশ্বনাথ রায়ের লেখা ‘রবীন্দ্রনাথ: প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের নতুন পাঠ’ বইতে পড়েছিলাম কি জ্বলন্ত তাগিদে তিনি সেই পুরাকালের সাহিত্য নিমগ্ন হয়েছিলেন শুধু না, সে রসের ভাঁড়ার সকলের জন্য উন্মুক্তও করেছিলেন গ্রন্থাগারে তাদের আবার নিয়ে এসেও। এ আমাদের শিখতেই হবে। কারণ আত্মপরিচয় সঠিক অর্থে না ঘটলে আত্মবিশ্বাস জন্মায় না। আর আত্মপরিচয় শুধু প্রাসঙ্গকিতা আর পরিচয় নির্ভর হলে গিরগিটিও হার মানে।    
377
Sun, 05/13/2018 - 11:30

        বাঙালির মা কে? কালী-দূর্গা-সরস্বতী-লক্ষ্মী। তারপর মাঝে হয়েছিল – দেশ – বন্দে মাতরম। এখন? জানে না যেন, নেকু! 
        তবে কালীর সাথে বাঙালির একটা নাড়ির টান। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, প্রেমিক, রামকৃষ্ণ, বামাখ্যাপা ইত্যাদি একের পর সাধক কবির কল্পনায়, বিশ্বাসে বাঙালির মাটিতে একটা মা মা অনুরণন বেজেছে। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। নাটমন্দিরে প্রতি শনিবার বিকাল থেকে সন্ধ্যারতি পর্যন্ত কীর্তন, ভক্তি সঙ্গীত গাওয়ার একটা চল আছে। দল বেঁধে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে বসে একটার পর একটা গান গেয়ে যান। চারদিক ঘিরে বসে থাকে ভক্তকূল। শুধুই কি ভক্তকূল? সে আলোচনা থাক। তখন কলেজে পড়ি। একদিনের ঘটনা আমার মনে পড়ে যায়। আপনারা যারা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সন্ধ্যেবেলার দিকে গেছেন, দেখবেন বহু মানুষ অফিস ফেরত সোজা মন্দিরে চলে আসেন। কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে যান। সেরকমই এক অফিস ফেরত মানুষ, বয়েস এই ধরুন পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। ফর্সা গায়ের রঙ, বেঁটে, মোটাসোটা। সারাদিনের ক্লান্তি চোখেমুখে। পাশেই একজন মহিলা বসা, খুব সম্ভবত ওনার স্ত্রী। নাটমন্দিরে গান হচ্ছে, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে/ মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।‘ ওখানে গান গাইবার একটা প্রথা হল একটা পদ বেশ কয়েকবার গাইবার পর পরের পদ ধরা হয়। আমি হঠাৎ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি হাপুশ নয়নে কাঁদছেন। একটা থামে মাথা ঠেকিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। পাশে বসা ভদ্রমহিলা ওনার হাতের পাতার উপর নিজের হাতটা রেখে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে। এতক্ষণ যা মন্দিরের চত্ত্বর ছিল মুহূর্তেই আমার কাছে একটা বাঙালি গৃহস্থের বাড়ির অন্দরমহল হয়ে উঠল। বুঝলাম আমার সামনে যে দেবীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি শাস্ত্রের, বিধি-বিধানের প্রণালী বহুদিন পেরিয়ে এসেছেন। তিনি শুধুই মা। এ এক যুগান্তব্যাপী সাধনা বাঙালি মননের। শুধু মা-কে ডেকে শান্তি পাওয়াতেই পূর্ণতার আস্বাদন। বাঙালির দূর্গাপূজো তাই আড়ম্বরের। কোথাও কোনো দূর্গামন্দির সেভাবে নেই। অল্পজ্ঞ চিত্রপরিচালক মাত্রই যেমন বাঙালি পরিবার মানেই একটা দূর্গা মন্দির দেখান। আসলে তা তো নয়। দূর্গা দেবী হলেও মা হয়ে উঠতে সেভাবে পারেননি, পেরেছেন কালী। দীর্ঘদিনের সাধনায়, বিশ্বাসে। 
        সেদিন থেকে দক্ষিণেশ্বরের উপর একটা দৃষ্টিভঙ্গী বদলালো। জানি সেখানে বলি হয় না, পাণ্ডার উৎপাত নেই। কিন্তু তার থেকেও বড় যে কথা সেদিন দেখলাম একটা প্রস্তরমূর্তির কেন্দ্রে নিজের মাকে দেখার, অনুভব করার কল্পনাশক্তির মাধুর্য। স্বার্থেন্বেষীরা তো আছেই। ধর্মস্থান আর স্বার্থান্বেষী তো একই পয়সার এপিঠ ওপিঠ। যেখানে মানুষ সেবাও করে একটা আত্মকেন্দ্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে। নিজের মুক্তি বা ভগবানের তুষ্টির মাধ্যমে স্বার্থলাভ। চিত্তশুদ্ধির জন্য কি আর প্রতিষ্ঠান লাগে। সে তো অন্ধকারে হাপুশ নয়নে কাঁদলেই মিলে যায়। নিজেকে কঠিন করে রাখা থেকে নরম আর নীচু হতে পারার সাধনা তো ধর্ম কোনোদিন শেখাতে পারেনি। পেরেছে ভালোবাসা। বহুশাস্ত্রীয় প্রবচন শুনিয়ে, ব্রত-উপবাস করে, দীক্ষা নিয়ে মালা-কর জপে মানুষের যা না হয়েছে, তা একটা আস্তগোটা মানুষের প্রেমে পড়ে হতে দেখেছি শিশিরপাতের মত। তাই প্রেমের আঁশটা নিয়ে চলে ধর্ম আর ধর্মব্যবসায়ীরা। প্রেমের শাঁসটা নিয়ে চলে সংসার। 
        বাঙালির এই মাতৃসাধনার চূড়ান্ত রূপ হয়ে হয়ে এলেন আমার মনে হয় কয়েকজন রমণী। সারদাদেবী, ভগবতীদেবীর নাম তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কারণ এরা যে শক্তিতে এতবড় পুরুষতান্ত্রিক মধ্যযুগীয় সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন তা তাঁদের অসম্ভব ধৈর্য্য, আত্মত্যাগ আর মাতৃত্বের গভীর অনুকম্পায়। তাদের মধ্যে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির বিলাস ছিল না। ছিল আপামর সাধারণ আর উপস্থিত বুদ্ধির তীক্ষ্মতা।

১) একটা দাতব্য চিকিৎসালয়ে বহু বড়লোক এসে বিনা পয়সায় ওষুধ নিয়ে যায়। মহারাজেরা বুঝতে পারেন না কি করা উচিৎ। মায়ের কাছে পরামর্শ নিতে গেলেন। মা বললেন, যে হাত পাতে বাবা, সেই গরীব জানবে।
২) বস্তিতে উপপতি ছেড়ে গেছে এক মহিলাকে, বাগবাজারে। সবাই বলছে বেশ হয়েছে, আরো নিজের পরিবার ছেড়ে এসে থাকো। মা বললেন, তা কেন, ওর পাপের সাজা ভগবান দেবেন, কিন্তু ওই মহিলা তো ওই পুরুষটার মুখ চেয়েই ঘর ছেড়েছিল, লোকটা ঠিক করেনি।
৩) কথায় কথায় বলেছিলেন, যে ভালো হতে চায়, তাঁর (ঈশ্বরের) উপর নির্ভর করে চলতে চায়, সে যদি বিপথে যায় তো সে মহাপাপের দায় তো তাঁর!। 
আমি শুনিনি এমন করে কেউ ঈশ্বরকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করার ক্ষমতা রেখেছেন ধর্মের জগতে। 
৩) বিদ্যাসাগর জানতে চেয়েছেন গ্রামে দূর্গাপূজোর কিরকম বড় করে আয়োজন করা যাবে? ভগবতীদেবী বলেন, গ্রামের বাচ্চাগুলো স্কুলে পড়তে যায়, না খেয়ে, বাবা, তুমি যদি ওদের একটা প্রতিদিন খেয়ে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারো তো গ্রামে সারা বছর দূর্গাপূজো লেগে থাকে। 
        এরকম অজস্র ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, আত্মশক্তি জাগাতে সিলেবাস লাগে না, একটা সুস্থ স্বাভাবিক সাহসী বিবেক লাগে। 
        দক্ষিণেশ্বরের মাটিতে রাসমণি-সারদা-মা কালী মিলে নারীশক্তি তথা একটা মাতৃশক্তির ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ তো সে মহাযজ্ঞের আহ্বায়ক মাত্র। কিন্তু পূর্ণতা তো সেই মা-তেই।
        আমি সে অর্থে আস্তিক নই। কিন্তু মাতৃত্বের বোধ ছাড়া যে জগৎ অন্ধকার, সেটুকু বুঝবার ক্ষমতা তো রাখি। তাই বোধহয় সারদাদেবীর বিশ্বমাতৃত্বের বোধে চিত্তে একটা আরাম জাগে। এমন জীবনও হয়! মাথা আপনিই নীচু হয়। যেখানে মানুষ কোনো ঐশ্বরিক মোহ ছেড়ে একটা প্রাণের নিঃস্বার্থ আকুতি নিয়ে মা ডেকেছে, প্রাণে এসে বেজেইছে। বিদ্যাসাগর ভিখারির কণ্ঠে মাতৃনাম শুনে কেঁদে ভাসিয়েছেন, সে মা শুম্ভ-নিশুম্ভ-রক্তবীজ দলনী না। সে মা আমার দাওয়ার বসে বড়ি দেওয়া, আমার পথ চেয়ে না খেয়ে বসে থাকা, আমার আশা-ভরসা-ব্যর্থতা-আনন্দ-বিষাদের আবরণী – মা।

378
Sat, 05/12/2018 - 11:00

        অনুপ্রেরণার একটা গতি থাকে। সে গতির দিক থাকে, অর্থ থাকে, বৈশিষ্ট্য থাকে। আমাকে কেউ যদি অনুপ্রাণিত করে থাকেন তবে সে অনুপ্রেরণা তাতেই গিয়ে শেষ হবে এ কেমন কথা? আমার যাত্রা যদি রবীন্দ্রনাথে শুরু হয়ে থাকে আর সে যাত্রা যদি রবীন্দ্রনাথেই শেষ হয়, তবে নিজেকে ব্যর্থ তো করবই সাথে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শটাকেও ব্যর্থ করব। তেমনই সঙ্গীতেও। আমি যদি অনুপ্রাণিত হয়ে থাকি উস্তাদ আমির খাঁ-এর স্বর্গীয় মাধুর্যে তবে সে অনুপ্রেরণা আমায় চলতে ফিরতে কত কিছুর মধ্যে যে সঙ্গীতের আস্বাদন করাবে তার ইয়ত্তা নেই। নাকি আমি কূপমণ্ডূক হয়ে বসে থাকব? এই ভাবেই তৈরি হয় গোঁড়ামির ভিত পতন। সেও এক অনুপ্রেরণা, তবে জড় অনুপ্রেরণা। সে এমন একটা বাড়ি বানায় যার দরজা জানলা সব একমুখী। সে ভিতরে আসতে দেয়, কিন্তু বাইরে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। তার বাড়ির মধ্যে থাকে একটা মন্দিরের মত কিছু, তার পূজো চলে, কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণ চলে না। তার বাড়ির প্রতিটি আনাচে-কানাচে সেই অনুপ্রেরণার উপস্থিতি। সে বাড়ি যেন একটা নির্দিষ্ট সময়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাসটাকে অনেকে নিষ্ঠা ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করে। পায়ে যত ঝিঁঝিঁ ধরে সে তত লোককে ডেকে তার জড়তার গুণগান করে। বলে, সংসারে মূল্যবান বলে যদি কিছু থাকে তবে অমুক বস্তুটি।
        এবার বাইরে থেকে যদি ঘটনাটা দেখি। মানুষ জানে পৃথিবীতে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। কিন্তু বৈচিত্র্যকে বৈচিত্র্য হিসাবে দেখতে গেলে চিত্তবৃত্তির যে স্বাস্থ্য ও চর্চা লাগে, তা অনেকের ক্ষেত্রেই অবহেলিত থেকে যায় আজীবন। বৈচিত্র্যকে সে তখন দেখে নিষ্ঠাহীনতা হিসাবে। ভয় পায়। তার দুর্বল চিত্ত যত বৈচিত্র্যের বিচিত্রতায় কেঁপে কেঁপে ওঠে, নিরাপত্তাহীনতায় আর নিশ্চয়তাহীনতায় ভোগে, সে তত হিংস্র হয়ে ওঠে, আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। অথবা সুকৌশলী হয়ে ওঠে। মোট কথা তাকে এই বৈচিত্র্যপূর্ণ জগতের বিচিত্র কোলাহলের বাইরে গিয়ে একটা নির্দ্বন্দ্ব বিশ্রামাগার না খুঁজে পেলেই নয়। এ হেন মানুষের পক্ষে ওই গোঁড়া অনুপ্রেরণামুগ্ধ দল একটা মরুদ্যানের কাজ করে। তারা বলে, দাদা আপনিই যা হোক একটা কিছুকে অন্তত ধ্রুব পেয়েছেন এই হুসমান জগতে। এখানে তো চোখের পলক পড়তে না পড়তেই হুস করে সব বদলিয়ে যায় গো দাদা।
        এই হল দুর্বলের বাসা। দুর্বলের বিশ্বাস। দুর্বলের গতি। সত্য অর্থে অনুপ্রেরণার গতিতে ছুটি নেই। সেই ‘ছুটদাদু’র মত সে দশদিক ঘুরিয়েই ছাড়বে। আমার খেদের সীমা নেই যে আমি পৃথিবীর সব ক’টা ভাষা পড়তে পারি না। বুঝতে পারি না। তাই ইংরাজি ভাষার দিকে তাকিয়ে থাকি। পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা ভাষায় নানা মানুষের একই মানবিকতার গল্প শুনতে শুনতে কেমন ঘোর লেগে যায়। মনে হয় আপেল কেন মাটিতে পড়ল তা না জানতে পারলেও আমার চলবে, কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের কথা যদি অধরা থেকে গেল, মানুষের মাধুর্য যদি না পেলাম, তবে সব ব্যর্থ। শুনতে শুনতে মনে হয়, মানুষের কথাতেই সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের সুর দেখছি। এ এক নিরবিচ্ছিন্ন কালের স্রোত। আমিও একটা বুদবুদ তার। মনে হয় অনন্তকাল ধরেই এই সংসারে আছি। জানি না এরকম কোনো একটা অনুভব থেকেই জন্মান্তরের ধারণা মানুষের মনে জন্মেছিল কিনা। হাজার বছরের পুরোনো কোনো লেখায় যখন নিজের মনের কোনো একটা রঙের আভাস দেখি, মনে হয় যেন যে মন নিয়ে জন্মালুম সে যেন আমার আগের থেকেই জন্মে আছে। নইলে আমার জন্মের আগেই তার এই অনুভূতির কথা লিপিবদ্ধ হল কি করে? আবার এই সাদৃশ্যতাতেই মানবিকতার বীজ। আমরা যে একইরকম। আমাদের মধ্যে যে একই সূত্র। এই আদিম অনুপ্রেরণা। 
        বয়েস যত বাড়ছে তত মানুষের চলে যাওয়ার সাক্ষীও তো হচ্ছি। যার সাথে কথা হল দু’দণ্ড সারা জীবনে যেদিন শুনি সে মানুষটা আর নেই, সেদিন ক্ষণিক হলেও এক শূন্যতা বুকে খামচে ধরে। সে শূন্যতায় আবার ভালোবাসাকে নতুন করে স্নান করিয়ে বসাই। বলি, আমায় পূর্ণ করো। এই সাম্যহীন সংসারে সাম্যতার সংগ্রাম যদি কেউ করে থাকে সে ভালোবাসাই। ওই যে বললাম মানবিকতা। সেই মানবিকতার শাঁস তো এই ভালোবাসা। অনুপ্রেরণা। মানুষ ছবিতে, গানে, শব্দে এই একটাই কথা বলবার চেষ্টা করছে তো। যেখানে সে সফল হচ্ছে সেখানে সে বিশ্বের আসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাকি তো সব গয়ংগচ্ছ – সেও আছে। 
        তো যে কথাটা দিয়ে শুরু করেছিলাম। গতি আর অনুপ্রেরণা। আমাকে যে-ই সঠিক অনুপ্রাণিত করে সে আমায় একটা গতি দান করে। সে গতির পথ বিচিত্র। একটা তৃষ্ণা। “ফিরি আমি উদাস প্রাণে/ তাকাই সবার মুখের পানে/ তোমার মত এমন টানে কেউ তো টানে না”। আমাদের শাস্ত্রে পড়েছি পরীক্ষিতের কথা। তিনি নাকি মাতৃগর্ভে একবার ঈশ্বরের মাধুর্যের আস্বাদ পেয়েছিলেন। তারপর জন্মাবধি সেই আস্বাদনের জন্য পরীক্ষা করে বেড়িয়েছেন সক্কলকে, তাই তার নাম হয়েছিল পরীক্ষিত। যিনি শুকদেবের কাছে একটা বড় কথা শুনেছিলেন – ভাগবত। মৃত্যুর অপেক্ষা করতে করতে। কবি সেখানে শুকদেবের মুখ দিয়ে একটা বড় কথা বলিয়ে নিয়েছেন – ঈশ্বরকে যদি ভালোবাসতেই হয় তবে অকারণেই বেসো, হাত পেতো না, হাত উপুড় করো। এ কথাতে অবিশ্বাসীর প্রাণেও দোলা লাগে যে! “অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান/ দাও, আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল”।
        একেই বলি অনুপ্রেরণা। “আমার যা ছিল তা গেল ঘুচে যা নেই তার ঝোঁকে/ আমার ফুরোয় পুঁজি, ভাবিস বুঝি মরি যে তার শোকে/ আমি আছি সুখে হাস্যমুখে দুঃখ আমার নাই”। এই গতি পালে লাগুক। বাইরের জল আসুক। নাহয় কিছু নোনাজলও আসুক। আমরা বেছে নেব। সুস্থ শরীর যাই খায় তার থেকে সু-কে নিয়ে কু-কে বর্জন করে। সুস্থ মনও তাই। অসুস্থ শরীরেরই হাজার একটা শাসন, বিধি। কারণ সে ফারাক করতে জানে না। আমরা কি থোড়ি অসুস্থ? লাগুক পালে হাওয়া। আসুক না হয় বেনোজল। আমরা বুঝে নেব। খালি অনুপ্রেরণার নামে ভিটামিন আর খাবো না, খোলা মাঠে যাব। “ওগো আমি তুফান পেলে বাঁচি”।
379
Thu, 05/10/2018 - 11:33

        জানো কিনা জানি না। আমি অনেক বাড়ি দেখেছি, যারা কেউ হাসে না। তারা যে দুঃখী তা নয়। তারা হাসার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। চোখের উপর তাদের কোনো পর্দা নেই আর। ধুলো-বালি-খড়কুটো সব গিয়ে চোখে পড়ছে, কিন্তু তবু তাদের চোখ জ্বালা করছে না, আমি এমন দেখেছি। তাদের চোখের সামনে টিভিতে কতলোক হাসছে-কাঁদছে-গল্প করছে-নাচছে-গাইছে। তারা স্থির হয়ে টিভির সামনে বসে। কত দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মানবিক বিপর্যয় দেখাচ্ছে - তাদের মুখের পেশীগুলো স্টেশানের নামের অক্ষরের মত নিশ্চুপ। ট্রেনের যাতায়াতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। ট্রেনের দরজা দিয়ে নেমে কেউ বলছে, এই তো সেই স্টেশান, এখানেই তো আসার ছিল। স্টেশানের নামের হলুদ পাটাতনে লেখা, কালো অক্ষরেরা চুপ। কেউ বলছে, এটা তো নয় আমার স্টেশান। তবু অক্ষরেরা চুপ। বৃষ্টি-ঝড়-অসহ্য তাপ- কনকনে ঠাণ্ডা - প্ল্যাটফর্মের স্থান পরিচায়ক শব্দ চুপ। সে যেন ভুলেই গেছে তার অস্তিত্ব মুছে যায়নি এখনও। সে যেন ভুলেই গেছে তাকে দেখে গন্তব্য নির্ধারণ করে এখনও অনেকে। সে যেন ভুলেই গেছে পৃথিবীটা ঘুরছে এখনও, বাতাসে এখনও তার শ্বাস নেওয়ার মত অনেক অক্সিজেন আছে। অফুরান খাদ্যও আছে। তার মলমুত্র ধারণ করার ভাগাড়ে স্থানাভাব লক্ষকোটি বছরেও হবে না, তার একার মত। 
        আসলে এরা পরিত্যক্ত। এদের ভালোবাসা ছেড়ে গেছে। এরাও আর ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না তেমন আগের মত। তবু পায়ে সুড়সুড়ি দিলে যেমন শরীরের ভিতরটা রি-রি করে ওঠে, এদের তেমনই অন্যের ভালোবাসা দেখলে মনের ভিতরটা ওরকম করে ওঠে। ওরা সামলে নেয়। মৃত্যু ছাড়া ওদের প্রতীক্ষায় তেমন আগ্রহ নিয়ে কেউ বসে নেই আর। ওরাও মৃত্যুর সাথে, এই আলোকময় জগতের সাথে পাষাণ প্রাচীর তোলার সাজসরঞ্জাম জোগাড় করে নিয়েই বসে আছে। ওরা হাসে না। ওদের বয়সের ভারের চেয়ে মনের ভার অনেক বেশি। ওরা আমাদের নগর-দুরন্ত-গতিমান সভ্যতার গারবেজ। লিক টায়ার। পুরোনো ফুলে ওঠা ব্যাটারি। পুরোনো এডিশানের ওএস। নরদমার মুখে জমে থাকা নোংরা, বেরোলেই স্রোত ফিরবে। 
        ওদের চোখের উপর চোখ রেখে আমার হৃদয় স্তিমিত হয়ে আসে। আগাম স্টেশানের ঘোষণা শুনতে পাই। শুধু প্ল্যাটফর্ম কোন দিকে পড়বে বুঝতে পারি না।

380
Wed, 05/09/2018 - 17:00

        আমি আজকের দিনে বুঝেছিলাম আমার ঘরের ভিতর যে আলো আসে, সে আলো এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আলোরই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র একটা আলো, সে বিশ্বজনীন। আমি আজকের দিনে বুঝেছিলাম, আমার বাগানে যে ফুলটা প্রতিদিন সকালে ফোটে সে বিশ্বজনীন, আন্তর্জাতিক নয়। আমি আজকের দিনে বুঝেছিলাম, আমার উঠোনে যে বাউল আসে, তার গলায় যে গান বাজে, তার একতারায় যে সুর ওঠে, তার আবেদন বিশ্বজনীন, আন্তর্জাতিক নয়। আমি আজকের দিনেই বুঝেছিলাম মানুষের মধ্যে আরেক মানুষ থাকে, সে বাউলের ভাষায় সোনার মানুষ, মনের মানুষ। সেই তাঁর লেখায় মহামানব, যে ‘মানব-অভ্যুদয়’ এর জয়ধ্বনির দিকে পথ চেয়ে বসে থাকে। সে আন্তর্জাতিক হওয়ার জন্য লোভাতুর নয়, তার শিরায় উপশিরায় মানবতার বাণী। মানবতার ডাক। সে ‘মানুষের ধর্ম’ এ আত্মপ্রকাশ ঘটায়। মানবতা – বিশ্বের কেন্দ্রে এক। 
        আমরা বিশ্বের একটা প্রাচীনতম সভ্যতা। তার ইতিহাসের বিচিত্র ধারা। সে ধারা শুধু রাজা-মহারাজের গল্প নয়। সে বিচিত্র দর্শন, বিশ্বাস, জীবনশৈলীর ইতিহাস। সেও আজকের দিনে জেনেছিলাম। জেনেছিলাম তিনি স্বর্গস্থ কোনো ঈশ্বরের খোঁজে ভারতের প্রাচীন ঋষি-মুনিদের কুটিরে যাননি। তিনি গিয়েছিলেন, মানুষের অন্তরে সেই গভীরতম মনুষ্যত্বের খোঁজে। যিনি অন্তর্যামী। যিনি আমায় ছেড়ে নন। যিনি আমার প্রেম-মঙ্গল-সত্য। তিনি একই সাথে সমগ্র মানবজাতির প্রেম-মঙ্গল-সত্য। তাঁকেই তিনি চেয়েছিলেন। কঠিনে, ত্যাগে, আত্মনিবেদনে। সে তপস্যাকে জীবনের তপস্যা বলেছিলেন। বৃহৎ সত্যকে গ্রহণ করার যোগ্য হতে বলেছিলেন, বৃহৎ ত্যাগে আর বৃহৎ দুঃখকে বরণ করে। জীবন যে ‘দহন-দান’ হতে পারে, সেও আজকের দিনেই জেনেছিলাম। 
        আজকের দিনেই জেনেছিলাম, মনুষ্যত্বর ভিত আত্মনিয়ন্ত্রণের জোরে। আত্ম-সংযম ব্যতীত মনুষ্যত্ব শুধুই কথার কথা। মিথ্যা অলঙ্কার। ভারতের দীর্ঘ পথে নানা বর্বরতা, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, ক্ষুদ্রতা এসে পথকে পঙ্কিল করে তুলেছে। তবু সে নিজেকে তার থেকে বার করে এনেছে মানবতার জোরে। বুদ্ধ, চৈতন্য, দাদু, কবীর, নানক, তুলসীদাস প্রমুখ আলোকোজ্জ্বল মানুষদের কথাও ওনার কাছেই জেনেছি। এমনকি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মহাত্মার কথাও ওনার কাছে বসেই জেনেছি যারা ওর প্রায় কাছাকাছি কালেই বিচরণ করেছেন। তাঁরা কেউ কোনো অনুকরণের অজুহাতে, সস্তা বাইরের সাজ-সজ্জার পরিবর্তনে আমাদের আন্তর্জাতিক করে তোলার চেষ্টা করেননি। তাঁরা চেয়েছিলেন আমাদের মধ্যে মনুষ্যত্ব জাগুক। মনুষ্যত্ব জাগুক আত্ম-নিয়ন্ত্রণে। আত্ম-নিয়ন্ত্রণে সত্য দৃষ্টি জন্মায়। সত্য দৃষ্টি জন্মালে মানুষ মঙ্গলের পথ খুঁজে পায়। “শান্তং শিবম অদ্বৈতম” – তাঁর সারা জীবনের চিন্তা-বাক্য-কর্মের মূল ভিত্তি ছিল। যিনি নিজেকে আত্ম-নিয়ন্ত্রণে শান্ত করতে পেরেছেন, তিনিই সত্য দৃষ্টিতে মঙ্গলকে জেনেছেন। আর মঙ্গলেই সবের মধ্যে একের যোগসূত্র। তখনই সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা পায়, শ্রী এসে বসে। আজ চারদিকে যে কোলাহল, যে তাড়া দেখলে হাসি পায়। জানি অবশেষে সব ব্যর্থ হবে। কারণ সত্যের কোনো তাড়া থাকে না। সে বলে না, আমার এখনই চাই। যে বলে আমার এখনই চাই, সে লোভ। তার তাড়া, আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার। নইলে তার মান থাকে না। সে মোহগ্রস্থ। এমন মোহগ্রস্থের দল সব যুগেই ছিল। তবে এদের কোলাহলটাই সম্বল। ধৈর্য, স্থৈর্য্য, আত্মত্যাগ – এই সবের মূল্য ফাঁকি আর শৌখিন অপুষ্ট উদারতায় ভোলাতে চায়। তাতে দুর্বল হৃদয়ে খানিক হুজুগের ঢেউ ওঠে বটে, কিন্তু শেষে সব অন্তঃসার শূন্যতায় পর্যবসিত হয়। সত্য বলে, তুমি সময় নাও, আমি অপেক্ষা করছি। তুমি নিজেকে পাও, অনুকরণে না, মনুষ্যত্বের দাবীতে। মনুষ্যত্বের একটাই আদেশ – প্রকাশিত হও। আত্মপ্রচার থেকে সরে এসো। বিশ্বের আঙিনায় নিজের মনুষ্যত্বের আনন্দে স্থির হয়ে দাঁড়াও। নিজের পোশাক, আচার, বিশ্বাস নিয়ে লজ্জিত হোয়ো না, সবল হও। মানুষের চিরকালের সাধন তার সংযম। তার মিথ্যাকে ত্যাগ করে আরো বেশি সত্যের নিকটাপন্ন হয়ে ওঠা। তুমি বাইরের চোখ ধাঁধানো ছলনা, বাগাড়াম্বরে ভুলো না। শান্ত হও, মঙ্গল-প্রেম আর সত্যে নিজেকে অভিষিক্ত করো। এই মানব-অভ্যুদয়। একে ফাঁকিতে চেও না। সে নিজেকে অপমান করা। 
        এসব আজকের দিনেই জেনেছিলাম।

381
Fri, 04/27/2018 - 10:39
          “Asaram believed that sexual exploitation of girls is not a sin for 'Brahmgyani' or a highly enlightened person”           আসারাম নিজেকে বিশ্বাস করত যেহেতু তার 'ব্রহ্মজ্ঞান' হয়েছে তাই একটা কিশোরী বা যে কোনো কাউকে ধর্ষণের অপরাধ তাকে স্পর্শ করতে পারে না। আমার কথাটা শুনে খটকা লাগল। আলোচনা এগোনোর আগে, আসুন দেখে নেওয়া যাক দুটো ব্রহ্মজ্ঞানের উক্তি। গীতা আর কথামৃত থেকে। ১) “আমি কর্তা এই অভিমান যাহার নাই এবং যাহার বুদ্ধি কর্মফলে লিপ্ত হয় না, তিনি জগতের সমস্ত প্রাণী হত্যা করিলেও হত্যাকারী হন না, বা হত্যাক্রিয়ার ফলে বধ্য হন না” – গীতা ১৮ অধ্যায়, শ্লোক ১৭ ২) গোপীরা যমুনা পার হতে পারছেন না। এমন সময় ব্যাসদেব সে পথে এলেন। গোপীরা তাকে ধরলেন যমুনা পার করিয়ে দিতে। তিনি বললেন, আগে তোমাদের সাথে কি আছে আমায় খাওয়াও। গোপীরা ননী খাওয়ালো। তিনি খেয়েদেয়ে যমুনাকে বললেন, হে যমুনা যদি আমি কিছু না খেয়ে থাকি তবে তুমি দু'ফাঁক হও। যমুনা দু'ফাঁক হল। গোপীরা হেঁটে চলে গেলেন। কিন্তু উনি যে অত ননী খেলেন? উনি খাননি তো, উনি তো ব্রহ্মজ্ঞানী। তাই উনি শুদ্ধাত্মা। পাপ-পুণ্যের পার। - এটা কথামৃতের তত্ত্ব।           এই হল মোটামুটি ব্রহ্মজ্ঞান হলে কি কি বেনিফিট পাওয়া যায় তার আউটলাইন। কথা হচ্ছে, আমার এই ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে কি না কে নির্ধারণ করবে? কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো পরীক্ষা পদ্ধতি তো নেই। আমি আসারামের বহু প্রবচন শুনেছি সংস্কার টিভিতে। লোকটার বলার একটা আকর্ষণী ক্ষমতা ছিল। নইলে অতগুলো মানুষ তার বাকচাতুর্যে বিমোহিত হবেই বা কেন? আর তারা যে সব অশিক্ষিত আকাট মুখ্য তাও তো নয়। তারা যথেষ্ট পড়াশোনা জানা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সব। আর সাধারণ মধ্যবিত্ত অগুনতি মানুষ তো আছেই। কথামৃতে আছে, ‘যাকে অনেক লোক মানে গণে তার মধ্যে নিশ্চই কিছু ঈশ্বরের ক্ষমতা আছে।‘ সেই অর্থে আসারামের মধ্যে ঈশ্বরীয় গুণ আছে সন্দেহ নেই।          তো কথা হচ্ছিল ব্রহ্মজ্ঞান নিয়ে। কেউ কি করে বুঝবে তার ব্রহ্মজ্ঞান হয়েছে? এ বলা খুব কঠিন। তবে বেদান্ত দর্শনে এই হল সাধনার চূড়ান্ত অ্যাচিভমেন্ট। এরপরে শুধু ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়ে ঘোরা। আমি যখন প্রচণ্ড শাস্ত্রচর্চা করছি, প্রায়ই মঠে যাচ্ছি কিশোর তথা যৌবনের প্রথম বেলায়, আমারও প্রায়শই ধারণা হত আমারও বুঝি ব্রহ্মজ্ঞানের মত কিছু একটা হচ্ছে। কারণ বেদান্ত, স্বামীজি, কথামৃত ইত্যাদি গোগ্রাসে গিলছি। ভাবছি ব্যাপারটা হেবি ইজি। ব্রহ্মজ্ঞান বেশ একটা ‘কুল’ থাকার অবস্থা। নো টেনশান ডু ফুর্তি। কারণ তখন নাকি চারদিক আনন্দই আনন্দ। কারোর উপর কোনো আসক্তি রাখা চলবে না, ইজি লাইফ হতে হবে, কোনো ঝুটঝামেলায় থাকা চলবে না, সবসময় মনে করতে হবে জগতে যা হচ্ছে সব মায়া – ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। সব মায়া, মিথ্যা। একমাত্র সত্য ঈশ্বর। তাতে মন লাগিয়ে রাখতে হবে সবসময়। মনকে তীর করো, ওঁকারকে ধনুক করে এক্কেবারে সটান ব্রহ্মে গিয়ে মিশে যাও। তবে এই কাম-ক্রোধের বিকার? এসব তো মায়া, সংস্কার। আসবে যাবে। এ সব নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন? ওগুলো সংস্কার বশে আসবে, চলে যাবে। এই দেশ-কাল ইত্যাদি মানুষগুলো আদতে মুক্ত আত্মা। শরীরটা শুধুই পোশাক। ও নিয়ে অত ভাবাভাবির কি আছে?         ফলে একটা নির্মম আত্মকেন্দ্রিক জীবন-দর্শনের সূত্র গেঁথে দেয় এই ব্রহ্মজ্ঞানের লক্ষণের বর্ণনাগুলো। আমি এমন পরিবারও দেখেছি তারা সবাই দীক্ষিত, বাড়ির কেউ কারোর সাথে ভালো করে কথা বলে না, পাড়ায় মেশে না, কারণ ওতে মন ব্রহ্মের স্থিরতা থেকে চ্যুত হবে। ঠাকুর বলেছেন, যে মন ঈশ্বরে দিবি সে মন একে তাকে দিয়ে নষ্ট করা কেন? দই পেতে সংসারে আসতে হবে, হাতে তেল মেখে কাঁঠাল ভাঙতে হবে। অর্থাৎ যাই হোক না কেন, নিজেকে সংসারের মধ্যে জড়ালে চলবে না, নিজেকে ঈশ্বরের চিন্তায় ডুবিয়ে রাখতে হবে।         এই দর্শন যে মানুষকে কতটা আত্মকেন্দ্রিক করে তুলতে পারে তা নিজের চোখে দেখেছি বলেই জানি। এই ব্রহ্মজ্ঞানের দোহাইয়ে আজ একটা আসারামে ভারত কেঁপে উঠছে, ভালো করে তাকিয়ে দেখলে এই ব্রহ্মচিন্তার উদাসীনতা যে আমাদের কতটা ক্ষতি করে আসছে যুগ যুগ ধরে ভাবতে গেলে ভিরমি খেতে হয়। একটা জাতের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে বসে আছে এই দর্শন। নির্লিপ্ত থাকো, উদাসীন থাকো। সাধারণ অনুকম্পা, সাধারণ ভালোবাসার গলা টিপে একটা কৃত্রিম জগতের প্রতিশ্রুতির মোহে আটকে রেখেছে যেভাবে যুগ যুগ ধরে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। আমি আগেও বলেছি, আজও বলছি, একটা মানুষকে ঈশ্বর জেনে সেবা করার মত বাণীটা আমি বুঝিনি। যে ঈশ্বরকেই মানুষ চোখে দেখল না, জানল না, তাকে নাকি ভালোবাসতে হবে একটা মানুষের যাবতীয় মনুষ্যোচিত বৈশিষ্টকে সরিয়ে। কারণ আমার প্রায়োরিটি ঈশ্বর, মানুষ না। আমাকে প্রত্যেকটা জীবকে অবিনশ্বর, কামনা-বাসনারহিত ঈশ্বর সত্তা ভাবতে হবে। কিন্তু ঈশ্বরের কি খিদে-তেষ্টা-কাম-দুঃখবোধ থাকে? তবে কি ঈশ্বররূপী মানুষ অভিনয় করছে? একই সাথে বলছি জীবই শিব আবার বলছি জীবের দুঃখ দারিদ্রতার কথা – কিরকম সোনার পাথরবাটি টাইপের কথা হয়ে যাচ্ছে না? তাই সেবাও হল না, মানবিক স্বাভাবিক প্রেমও হল না। একটা দরকাঁচা টাইপের কিছু হল। আমায় গালাগাল করার আগে নিজের কমোন সেন্সকে একবার প্রশ্ন করে নেবেন, এই হেঁয়ালি আপনি বুঝেছেন কি? যদি বুঝেছেন তো আপনাকে অজস্র অভিনন্দন, আমি বুঝিনি। বরঞ্চ সবাই ঈশ্বরের সন্তান, তাদের সেবায় ঈশ্বর তুষ্ট হন, এটা বুঝি। বা ঈশ্বর প্রেমে জীবের সাথে এসে লীলা করছেন, এটাও বুঝি। খ্রীষ্টান আর বৈষ্ণবদের খানিক এই মত। এটা তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে বোঝা গেল। কিন্তু এর সাথে তো ব্রহ্মজ্ঞান যায় না। তাই বলা হল যে প্রতিটা জীবই আসলে শিব, বাকিটা মিথ্যা মায়া। মানে এই শরীরবোধ আরকি। তবে? শরীরটাই যদি মায়া হয়, তবে ধর্ষণটা কি করে সত্য হতে পারে? অপযুক্তি মানছি। কিন্তু এ যুক্তির সম্ভাবনা তো উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।          ঠিক এইরকম ব্রহ্মজ্ঞানেরই কথা বলে যেত আসারাম। কেঁদে ভাসাতো ঈশ্বরের নামে। নিজে অনেকবার দেখেছি। কথামৃতে আছে, ‘যার ঈশ্বরের নাম করতেই চোখে জল আসে সে ঈশ্বরলাভ করেছে।‘ এবার কি বলবেন? আরো আছে, ঈশ্বরকোটি আর জীবকোটি। অর্থাৎ ঈশ্বরের নিজের ব্র্যান্ডের আর সাধারণ ব্র্যাণ্ডের। রামকৃষ্ণ নিজেকে ঈশ্বরকোটি বলে বিশ্বাস করতেন। একবার একজন তাকে কর্মফলের তত্ত্ব শোনাতে চাওয়ায় রামকৃষ্ণ বিরক্ত হয়ে মাষ্টার মশায়কে বলেন, ‘ওকে বোঝাও যে ঈশ্বরকোটির অপরাধ হয় না।‘ আরেকটা গোলমেলে তত্ত্ব। 'বায়ুতে সুগন্ধ দুর্গন্ধ দুই থাকে, কিন্তু বায়ু নির্লিপ্ত থাকে।' এটাও ব্রহ্মজ্ঞানের তত্ত্ব। তবে আর দৈবদৃষ্টিতে ভুল কোথায়? ধর্ষণের পাপই বা তাকে স্পর্শ করবে কেন?         আসারাম রামকৃষ্ণ নয়। কিন্তু কথায় কথায় রামকৃষ্ণ তথা নানা মহাপুরুষদের বাণী টেনে আনত। রামকৃষ্ণ প্রসঙ্গ বেশিই আসত। নিজেকে আসারাম ব্রহ্মজ্ঞানীই মানত। প্রায় যেন রামকৃষ্ণ সমকক্ষ। কিন্তু রামকৃষ্ণের কপট-ব্রহ্মজ্ঞান সংক্রান্ত গল্পগুলো বোধহয় এড়িয়ে যেত অথবা ভাবত যে ওগুলোর উর্ধে সে। হতেই তো পারে। কারণ বাকি ব্রহ্মজ্ঞানীর ক্রাইটেরিয়াগুলো তো মিলে যাচ্ছে।         আমি কয়েকদিন আগে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। বিদ্যাসাগর আমাদের বেদান্ত দর্শনকে পাগলের প্রলাপের মত কিছু একটা ঠাওরাতেন। আসলে শুদ্ধতা খুব কঠিন একটা মাপকাঠি। আবার খুব সরলও। আমি এটা বলতে চাইছি না যে বেদান্ত বা কথামৃত বা ওই ধরণের অতীন্দ্রিয় দর্শন ধর্ষক তৈরি করে। কিন্তু এটা বলছি, তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। আমি কালকূটের ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’ থেকে শুরু করে নানা ধর্মকেন্দ্রিক স্থানে যে অনাচারগুলোর সাক্ষী হয়েছিলেন তার কথা স্মরণে রাখতে বলি। আর রইল অবশেষে নারীর কথা। সে প্রাচীন ভারতই হোক আর আধুনিক ভারতের গুরু অবতারেরাই হোক – খুব একটা ভালো কথা তো বলতে শুনিনি কাউকেই প্রায়। নারী একটা এক্সপেরিমেন্টের বস্তু ধর্মজগতে। সে কখনও দেবী, কখনও কামিনী, কখনও নিজের সংযমের পরীক্ষাপাত্র, তার নগ্ন কোলে বসে নিজের পুরুষাঙ্গের আত্মনিয়ন্ত্রণের শৌর্য্য পরীক্ষা করে নিতে হয়।           ব্যাপারটা একটু সামারাইজ করে নেওয়া যাক। আসারাম, একে ব্রহ্মজ্ঞানী, দুই ঈশ্বরের নামে চোখে জল আসে, মহাপ্রভুর মত নেচেকুঁদে একশা হয়, তায় অত মানুষের আলোকবর্তিকা, তায় কয়েকটা অবলা নারীর সাথে যৌন সম্পর্ক, থুড়ি লীলা রে বোকা ওটা লীলা। মহাপুরুষদের সব চেষ্টাই লীলা। আমি পড়িচি, ভুলভাল বোঝালেই হবে? তোমাদের ও জাগতিক শাস্তি, জাগতিক আইনব্যবস্থা ওপারে কি হবে? তখন আসারাম দেখে নেবে, কত ধানে কত চাল। নারী, তায় আবার শিশু, কিশোরী। অমন একটা ব্রহ্মজ্ঞানীর পুরুষাঙ্গের স্পর্শ পেয়েছিস, কোথায় ধন্য হবি, তা না কোর্ট কাছারি করতে লেগেছে। ধন্যি কলি বটে।             এরকম ধরণের ব্রক্ষ্মজ্ঞানের কথা শুনলে রামকৃষ্ণ বলতেন, অমন ব্রহ্মজ্ঞানে মুতে দিই।         “নিজের কষ্টের বেলায় সংসারী সাজো, অন্যের বেলায় ব্রহ্মজ্ঞানী সেজো না” – সত্যানুসরণ।  
382
Wed, 04/25/2018 - 17:04
    “Ceasing to believe caused a permanent scar in the place where one’s faith had been, making it impossible to forget.”   ~ Gabriel Garcia Marquez           সিদ্ধান্ত নেওয়া কয়েকটা শর্তের ওপর নির্ভর করে --- ১। তার জানা; ২। তার প্রবণতা; ৩। কোন বাহ্যিক প্রভাব।     ১। জানা -------------         যখন আমরা কিছু জানি তা বৌদ্ধিক স্তরে দুটো পথে আসতে পারে --- ১। অভিজ্ঞতা এবং ২। পাঠনির্ভর। বৌদ্ধিক স্তরে কল্পনাশক্তি মানুষকে পাঠনির্ভর বিচার-বিশ্লেষণ করতে সক্ষম করে। যখন কোন উপন্যাস পড়া হচ্ছে, যার প্রেক্ষাপট আমার অভিজ্ঞতার বাইরে কোন সময় ও দেশকে নিয়ে, আমার কল্পনাশক্তি সে প্রেক্ষাপটকে আমার গ্রহণক্ষমতার কাছে বাস্তব করে তোলে। পঠিত চরিত্র, স্থান আমার আশেপাশের ইন্দ্রিয়লব্ধ দুনিয়ার সাথে এক হতে শুরু করে।           আরো সুক্ষ্মদিক থেকে দেখলে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতার তাত্ত্বিক প্রতিফলনও পরিবর্তিত হয় আমার পঠিত কোন তাত্ত্বিক বিচারের মাধ্যমে। এরা যুগপৎ আমার সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে। যেমন একটা উদাহরণ দেওয়া যাকঃ আমি আমার অভিজ্ঞতায় জানি, কোনো প্রতিকুল পরিবেশে হিংসাত্মক, আক্রমণাত্মক হয়ে উঠলে কিছু ক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়। অথচ আমি পাঠের মাধ্যমে জানলাম, ক্ষমা ও সহনশীলতা অনেক ক্ষেত্রে তার থেকে অধিক ফলপ্রসূ এবং সদর্থে ফলপ্রসূ। পরেরবার যখন কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লাম তখন আমার পূর্ব অভিজ্ঞতালব্ধ সিদ্ধান্ত হিংসাত্মক হয়ে ওঠা ও পাঠজনিত বিচারশীল সিদ্ধান্ত, ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা - এদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়, যার ফলস্বরূপ আমার হিংস্রতার প্রাবল্য কিছুটা কমে খানিক বেশি সভ্য হয়ে উঠি, যেভাবে সভ্যতার বিকাশ হয়। তা যতটা না সহজাত প্রবৃত্তিজনিত জান্তব আবেগের তাগিদে, তার থেকে অধিক বলবৎ সভ্যতার ইতিহাসের ক্রমান্বয়ে আসা নানা শুভবিচারসম্পন্ন মানুষের সৎচরিত্র ও সৎ-শুভ বিচারলব্ধ নির্দেশনার পঠনের প্রভাব। দমন, সংযম, অনুশীলন ইত্যাদি শব্দগুলোর মাহাত্ম্য ক্ষণিক জান্তব আবেগের কাছে অর্থহীন হলেও একটা স্থায়ী সভ্যতার দিকে তাকিয়ে এগুলিই সম্বল, যাকে শীল তথা Discipline নামে অভিহিত করা হয়।     ২। প্রবণতা ----------------         কোন সিদ্ধান্ত নিতে প্রবণতার প্রভাব ততটাই, যতটা কোনো যানে তার গতিক্রিয়তা। প্রবণতাকে সুসংহত ও সুশীল করার প্রাচীন পদ্ধতিকে আমরা একসময় শিক্ষা বলেছিলাম। যদিও আজ শিক্ষার অর্থ কুশলী হওয়া --- তথ্যে অথবা কৌশলে। সে অন্য প্রসঙ্গ। প্রবণতাকে সুসংহত করার কথা ধর্মীয় অনুশাসনের বাইরে যাদের মাধ্যমে এসেছে তা হল শিল্প, সঙ্গীত, সাহিত্য। ধর্মের যেদিকে সঙ্গীত ও শিল্প এসেছে তা নম্র ও কোমল। এর বিপরীতটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। সেখানে ডাইনী হত্যা থেকে সতীদাহ --- সবই এক ছাতার তলায় ঠাঁই পেয়ে যায়, এমনকি কখনও কখনও কুসংস্কার এত তীব্র হয়ে ওঠে যে, সে সঙ্গীত শিল্প সাহিত্যকেও ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ বলতে পিছপা হয় না। সভ্যতা বর্বরতার প্রাচীরে ধাক্কা খেয়ে কিছুকালের জন্য পশ্চাদ্‌গমনে উন্মুখ হয়। তবু অবশেষে শিল্প সাহিত্য ও সঙ্গীতই মানবাত্মার আত্মপ্রকাশের ভগীরথ হয়, কারণ এই তিনটির কেন্দ্রই মানবিকতা তথা সহমর্মিতা। একটা ভোরের ফুলের মাধুর্য্যমণ্ডিত কোমলতা যে হৃদয় উদ্‌ভাসিত হয় সেই হৃদয়ই শিল্পী নামের যোগ্য। দুর্বলতম মানুষটার সবলতম মানুষটার হাতে নির্মম অত্যাচার যে হৃদয়ে বিনিদ্র কশাঘাত করে সে হৃদয়ই সাহিত্যিক হওয়ার যোগ্য। আর সীমায়িত জীবনের অসীম প্রেমের আত্মপ্রকাশের যে আকুতি সে-ই যখন মহাকাশ ব্যেপে সুরে কোনো হৃদয়ে প্রতিদ্ধনিত হয় সে হৃদয়ই সঙ্গীতের।           মানুষের সমস্ত জান্তব প্রবণতা শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীত দ্বারা যদিও নিয়ন্ত্রিত হয় না, তার জন্য লাগে যৌক্তিক অনুশাসন, যাকে অন্য অর্থে আমরা বলিCivic Code, যা অবশ্যই মানুষের হৃদয়ে শুভবুদ্ধির সমর্থন ও করুণাসঞ্জাত। তাই সেদিনের কারাগার আজকের সংশোধনাগার হয়ে ওঠে। আমরা সংশোধনে বিশ্বাসী হই। তবুও বর্বরতার কাছে আজও মানুষের শুভবুদ্ধি সম্পূর্ণ জয়ী হয়ে উঠতে পারেনি। শুভেচ্ছা এখোনো বহুরাত নির্মম নিদারুন নিষ্ঠুরতায় অসহায়ের মতন মাথাকুটে মরে। মানবসভ্যতার গ্লানি আজও সম্পূর্ণ নিরাময় হয়নি।     ৩। বাহ্যিক প্রভাব -------------------         সিদ্ধান্ত নেওয়ার সবচাইতে বিপজ্জনক প্রভাবক এটি, যার মুখ্যস্থানে রাজনীতি ও ধর্ম ক্ষুদ্র নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থান্ধতাদুষ্ট। যা কিছু সুন্দর, যা কিছু সত্য সে সবই সীমায়িত ও পরিশীলিত অনুভব ও বোধের ক্ষেত্রে। যার সার্থকতার সর্বশ্রেষ্ঠ রূপ হল শ্রী তথা সামঞ্জস্য। মানবসভ্যতার প্রাচীন ইতিহাস থেকে আজ অবধি যা তার উদারতাকে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তা হল উদারতার ছদ্মবেশে আসা ধর্ম। সভ্যতার এর থেকে বড় পরিহাস আর কি হতে পারে? মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তি-উদারতা-আত্মবিকাশের প্রতিশ্রুতি দেয় যে ঈশ্বর এবং স্বঘোষিত প্রেরিত পুরুষকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানেরা, দুর্ভাগ্য, সময়ের আয়নায় দেখলে মানুষের মুক্তি, উদারতা ও আত্মবিকাশের সবচাইতে নিষ্ঠুর এবং বলশালী অন্ধকার ইতিহাসে রচয়িতা হয়েছে তারাই। শত্রু যখন মিত্রের ছদ্মবেশে আসে তখন তা ভয়ঙ্কর। তাই রাবণের চেয়ে ভয়ঙ্কর শকুনি। কুরুক্ষেত্রের চেয়ে ভয়ঙ্কর ধৃতরাষ্ট্র ও নানা শূরবীর সাক্ষী দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। এটা চিরকালই হয়েছে, আজও হয়ে চলেছে। কারণ, যতদিন মানুষ মুক্তিকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টার মাধ্যমে না চাইবে, উদারতাকে উদারতা লাভের প্রচেষ্টার মাধ্যমে না চাইবে তথা আত্মবিকাশকে বিপদসংকুল নানা জান্তব প্রবণতার মধ্য দিয়ে আত্মবিশ্বাসে নির্ভর করে সামনের দিকে এগোতে না চাইবে ততদিন আমাদের ঈশ্বর তথা ধর্ম নামক রূপক মুক্তি-উদারতা-আত্মবিকাশের মোহে আত্মপ্রবঞ্চনায় স্থবির হয়ে থাকতে হবে। সেদিনের মায়ের দয়া আজ বসন্ত রোগ। Small Pox, Polio প্রায় নির্মূল জগত থেকে। সেদিনে কুকুরে কামড়ালে খ্রীষ্টান যাজকরা শয়তানের ভর মনে করে কত শিশুকে হত্যা করেছে, চিকিৎসার অভাবে বিষপান করিয়ে মেরেছে, মানসিক ভারসাম্যহীন বহু চরিত্র ডাইনী আখ্যা পেয়ে পুড়ে মরেছে। এ সবই ছিল ধর্মের সুপরিকল্পিত, সুচিন্তিত, সর্বোপরি সমাজের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় কৃত ঈশ্বরেচ্ছার বাস্তবিকরন। সেদিনও ঈশ্বর নীরব ছিলেন, তিনি আজও নীরব থাকেন। মানুষ যেখানে পাশের মানুষটার ইচ্ছে সম্পূর্ণ অর্থে বুঝে উঠতে পারে না, সেখানে কিছু মানুষ দাবী করেন তারা না কি জগতকেন্দ্রের শাসক পুরুষের ইচ্ছার শারীরিক স্বরযন্ত্রস্বরূপ।           নির্বোধ মানুষ সে ফাঁদে পা দেয়। কারণ, তার জানা, তার অভিজ্ঞতা, তার পাঠ ইত্যাদি সমস্তকে একত্র করলেও তার মধ্যে যে অন্ধকারটা বেঁচে থাকে তা অসীম। সে সবকিছু না জানলেও এটুকু জানে সে সবটুকু জানে না। সেখানে সে দুর্বল হয়, সে আতঙ্কিত হয়। সে যদিও জানে তা তার Small Pox ইত্যাদি বহু মারণরোগ কোনো ঐশ্বরিক, আকস্মিক, অলৌকিক হস্তক্ষেপে পৃথিবী থেকে নির্মূল হয় নি। নির্মূল হয়েছে কোন এক সত্যান্বেষী সাধকের বিনিদ্র গবেষণায়। প্রতিভার ব্যাখ্যা থাকে, কিন্তু অলৌকিকত্বের না তো থাকে ব্যাখ্যা, না পরিচয়। সে অলৌকিকত্বের অন্ধকার মানুষের পূর্বোল্লিখিত অজ্ঞানতার অন্ধকারের দোসর হয়ে ওঠে। নির্বোধ, অসহায় মানুষ আরেকজন কোন মানুষকে ঈশ্বর বানানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। আরেকটা অন্ধ অনুসরণের জন্য আকুল হয়ে ওঠে। পেয়েও যায়। একটা অন্ধকার যুগের পরে আরেকটা অন্ধকার যুগ শুরু হয়। আশা এই তবু মানুষ আলোতেই বিশ্বাস রাখে। আলোতেই নির্ভয় হয়। সত্যি আলোটা এলে আলোর মত নকল আলোকে চিনতে তার সময় লাগে না। সভ্যতায় নতুন জোয়ার আসে।
383
Mon, 04/23/2018 - 21:00
            বাচ্চাটার এক পায়ে জুতো, আরেক পা খালি। মন্দিরের চাতাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মা উদাস চোখে বসে। সিঁথিতে সিঁদুর নেই। হাতে শাখাপলাও নেই। সিঁথিতে যেন কোনোকালের মোছা সিঁদুরের আবছা দাগ। শুকনো অববাহিকায় পড়ে থাকা নুড়ির মত কয়েকটা শ্রীহীন চুল হালকা বাতাসে উড়ছে। দৃষ্টি দূরে। মানুষ খুব গভীরে তাকালে দৃষ্টির দূরত্ব বাড়ে। হঠাৎ কি খেয়াল হল, বাচ্চাটার দিকে চমকে তাকালেন, বললেন, নেমে এসো, জুতো খুলিয়ে দিই, এটা ভগবানের জায়গা না? বাচ্চাটা বিগ্রহের দিকে একবার তাকালো। অপ্রসন্ন দৃষ্টি। তার এক পাটি জুতোর ধুলোও সইতে পারেন না যিনি তিনিই ভগবান, সে বুঝল। বলল, কেন মা? ঠাকুরের হাঁপানি হবে দাদুর যেমন ধুলো লাগলে হয়?          ভদ্রমহিলা অপ্রতিভ হয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমি বুঝেও অন্যমনস্কতার ভাণ করে বাচ্চাটার দিকেই তাকিয়ে থাকলাম। বাচ্চাটা আমার মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে গুটিগুটি পায়ে নেমে জুতোটা খুলে, আগের খোলা জুতোর পাশে রেখে ফের মন্দিরের চাতালে উঠল। গোল গোল ঘুরতে লাগল। এখন আর তার দেবতায় ভয় নেই। পায়ে ধুলো জুতো নেই যে!          আমি পরপর রাখা দুটো জুতোর পাটির দিকে তাকালাম। নিরপরাধ দুটো পাটিজুতো। রাস্তার ধুলো লেগে অপবিত্র হল। দেবতার রোষের কারণের সম্ভাবনা রাখে তারা।         বাচ্চাটার ঘুরন্ত ফ্রকের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা খামচে ধরা একটা ব্যথা হল। আমার চোখের সামনে কাশ্মীরের দেবস্থান ভেসে এল।          আজ নোয়াম চোমস্কি ও আরো নানান বিদ্বজ্জনদের লেখা প্রধানমন্ত্রীকে লেখা চিঠিটা পড়লাম। শেষ লাইনটায় ধাক্কা খেলাম, guilty of silence থেকে নিজেদের বিবেককে বাঁচানোর জন্যে এ চিঠি লেখা। শব্দটায় চমক খেলাম। ঠিক এই শব্দটাই খুঁজছিলাম, নীরবতার অপরাধ। বহু মানুষকে দেখছি এই প্রতিবাদ নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক রোষের লেখনী লিখতে। তাদের এক পক্ষের যুক্তি, কিছুতেই কিছু হয় না। আর আরেক পক্ষের যুক্তি আরো নিকৃষ্ট, যদি আপনার বাড়িতে হত আপনি কি এইভাবে ফেসবুকে সোচ্চার হওয়ার সময় পেতেন?          'কিছুতেই কিছু হবে না' মতাবলম্বীদের জন্য আমার চিরকালীন শ্মশান সান্ত্বনা। সে আগেও জানিয়েছি। সে কথা থাক। কিন্তু দ্বিতীয়দের বলি, যে যুক্তিতে আপনি সব প্রতিবাদকে প্রহসন ইত্যাদি আখ্যা দিচ্ছেন, সেই যুক্তিতেই বলি, সেরকম হলে আপনিই কি, কে কি প্রতিবাদ করছে এ সব সুক্ষ্ম বিচারের সময় পেতেন? কার সমবেদনায় কতটুকু ভণ্ডামী বিচারের এমন অখণ্ড অবসর পাচ্ছেন বলেই না এত সুন্দর করে বিধান দিতে পারছেন!          আসলে বেঁচে থাকার একটা লড়াই আছে। আমাদের বাড়ি যিনি বাসন মাজেন তিনি IMF -এর প্রধানের গুরুত্বের চাইতে পাড়ার মাতব্বর বিশুদার (কাল্পনিক নাম) গুরুত্ব বেশি বোঝেন। সেটা তার অপরাধ নয়। সেটা তার সীমাবদ্ধতা। তথ্যে অনেক কিছু জানলেও অনুভবে অনেক কিছু আবেদন জানায় না। আর তখনই অত্যন্ত সুচারুভাবে নিজের অবস্থানকে জাস্টিফাই করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সাথে অন্যেরও। কারণ অনুভবের, সমবেদনার অনুভব যেখানে নেই সেখানে শুষ্ক বিচার-প্রবণতার প্রবণতা বাড়বেই।          আমার একটাই অনুরোধ, আপনি আপনার কক্ষপথে নিশ্চিন্তে ঘুরুন যতক্ষণ না কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা লাগছে বা ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা জাগছে, কিন্তু সবাইকে এইটা বোঝাতে আসবেন না, কার প্রতিবাদের ধরণ কি ধারার হওয়া উচিৎ। আমি সহমত হতে না পারি, তাই বলে অশ্রদ্ধা রাখার মত ঔদ্ধত্য দেখানোটা নিতান্তই মূর্খামি।         বাচ্চাটা মায়ের সাথে ফিরে গেল। দেবালয়ের শুদ্ধতা ছেড়ে পাদুটো তার সাধের জুতো জোড়ায় গলিয়ে এই ধুলো রাস্তাতেই হাঁটতে হাঁটতে গেল। ভাগ্যে বিশ্বজোড়া দেবালয় নয়, তবে তার জুতোর সাথে আরো কত কি যে ভগবৎপ্রীত্যর্থে ছাড়তে হত কে বলবে? মানুষ সুরক্ষিত একমাত্র মনুষ্যত্বে, এটা বুঝতে আরো কতজন কবীরের দরকার বুঝি না। যিনি বলতে পেরেছিলেন -         নিজের ঘর নিজেই জ্বালিয়ে          দাঁড়িয়ে মশাল হাতে       আসতে চাও তো আসো বন্ধু          শুধু ঘরটা জ্বালাও আগে  
384
Mon, 04/23/2018 - 16:49
            আমার কিছু অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে ইচ্ছা করে। তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু কথাগুলো ভীষণ সত্যি। অনুভবে সত্যি। অভিজ্ঞতায় সত্যি। শাস্ত্রকারের মতে যাই হোক না কেন। তারা কোনো বাণী নয় যদিও, তবু তারা সত্যি। রেললাইনের ধারে জন্মানো ছোট্টো গাছটার মত সত্যি। তারা খেদও নয়, অতৃপ্ত বাসনাও নয়। তারা উপপত্রের মত একটু জায়গা করে নেওয়া নিতান্তই এলেবেলে। তবু অস্তিত্বের মত শরীরী। অদৃশ্য হলেও বাতাসের মত, ব্যস্ত মনে চাপা পড়ে থাকা কান্নার মত। তাদের কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই। বাইরের কোনোকিছুর সাথে তাদের কোনো লেনাদেনা নেই। তারা নিজেরাও জানে না তারা কেন আছে। কিন্তু তবু তারা আছে।         আমার মামু (দিদির মেয়ে) কাশ্মীর থেকে বেড়িয়ে এলো। খুব ছোটো তখন সে। এসেই বড় বড় চোখ করে বলল, "জানো মামু একদিন বেড়িয়ে এসে হোটেলে ঢুকে দেখি এত্ত এত্ত হনুমান আমাদের হোটেলের ঘরজুড়ে। সারা ঘর এক্কেবারে লণ্ডভণ্ড করে রেখেছে।" আমি বললাম, তারপর? তাদের তাড়ালি কি করে? সে খানিক ভাবল। তারপর বলল, "ওরা নিজেরাই চলে গেল যে!"         আমি জানি তার এই হনুমানঘটিত কাণ্ডের একটি সাক্ষীও সে পাবে না এই কঠিন বাস্তব আবদ্ধজীবীদের মধ্যে। কিন্তু সে যে চোখে হনুমানগুলোকে দেখেছিল, তাদের যে দুরন্তপনা আর বাধ্যতার ছবি মনের মধ্যে এঁকেছিল, সে কি শুধুই মিথ্যা? দলিল দস্তাবেজ বলবে মিথ্যা। কাজের জগতে, নীতিশিক্ষায় সে বড় অপরাধী নিশ্চই। কিন্তু মানুষের কল্পনাটা এতটাই শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে? কল্পনার কি কোনো হৃদয় নেই, সাধ নেই, আশা-হতাশা নেই। সব আছে। শুধু তার বাস্তব জগতে হাজিরা দেওয়ার মত সামর্থ্য নেই। তবু কল্পনার কাছে কল্পনা বাস্তব। বাস্তবের চোখে সে যতই অনস্তিত্ববান হোক না কেন। আমি সেই অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই। কারা শুনবে? কেউ শুনতে চায় না। বলে, এইখানে কেমন গরমিল হল যে? জানি তো হল। তুমিও জানো আমি জানি। তবু তুমি বলবে, কারণ তোমার অহংকারে বেজেছে। তোমার জানা জগতের বাইরে আমার কল্পলোক, তুমি তা মানবে না। না মানো, তোমার বাগানের টগরফুল আমার চোখে যদি আমার প্রেমিকার কানের ঝুমকোর মত দেখায়, তবে সে দায় তোমায় আর তোমার বাগানের টগর - দুজনের কাউকেই নিতে হবে না। সে দায় আমারই। তুমি বলবে মিথ্যা। আমি বলব, অন্ধ তুমি। সংসারে এমন অনেক সত্যি আছে যা সত্যের চোখে পড়ে না, মিথ্যার চোখেই পড়ে। সেই সত্যগুলোকে নিয়েই মানুষ খেলাঘর সাজায়। সব মানুষের খেলাঘর থাকে। তুমিও একদিন বুঝবে।          একদিন হল কি আকাশ জুড়ে কালো মেঘ করে এলো। আমি তখন অনেক ছোটো। জানলা দিয়ে দেখছি মাঠের সীমানা বেয়ে একটা বিরাট ঢেউয়ের মত কালো মেঘ রাজকীয় ভঙ্গিতে এক পা এক পা করে আকাশের মাঝখানে এগিয়ে আসছে। আর তার সেই কালো রঙের বুকে মাথাটা রেখে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটা। তার লালফুলগুলো যে কি অপরূপ হয়ে উঠেছে কালোর রঙের পটে, আমি হাঁ করে চেয়ে রইলাম। আমার সামনে খোলা অঙ্কের খাতাটা আসন্ন ঝড়ের হাওয়ার পতপত করে উড়ে গেল। দেখতে দেখতে ঝড় উঠল। এতক্ষণের শান্ত, নিরীহ প্রকৃতি কি ভীষণ হয়ে উঠল। জানলার পাল্লা পড়তে লাগল ধমাস ধমাস করে। মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মায়ের সাথে ছুটলাম খোলা বারান্দায়। শাড়ি, জামাগুলো দড়ি ছিঁড়ে উড়ে যাওয়ার জন্য যেন ছটফট করছে। বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা বিঁধতে লাগল আমার পিঠে, মাথায়। আমি আনন্দে আত্মহারা হই আরকি। এরা কারা যারা আমায় ছুঁচ্ছে? ওই আকাশ থেকে নামছে? বাহ্ রে, লাগুক পিঠে। মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঘরে আনলেন। যতটা ভেজার কথা ছিল, ভিজলাম তার চেয়ে অনেক। কারেন্ট গেছে। ঘরের মধ্যে ভর দুপুরে সন্ধ্যের অন্ধকার। বাইরে আওয়াজ বৃষ্টির আর বাজের। এদের আওয়াজ তো রোজ শুনি না। এরা তো রোজ রোজ এমন সরব হয়ে আমার চারপাশটা এমন স্বপ্নের মত অন্য জগত বানিয়ে দেয় না। ব্যাঙের ডাক শুরু হল। কৃষ্ণচূড়া গাছটাকে দেখছি মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে পাগলের মত নাচছে। তাকে বলতে গেলাম, ওরে তোর সব ফুল মাটিতে পড়ল যে রে! কে শোনে কার কথা। সে তো পাগল তখন। ঝড়ের সাথে যেন তার কত কথা! বৃষ্টির সাথে যেন তার কত জন্মান্তরের মিতালি। বৃষ্টি যেন তার সখী।         আমি ছুটে এসে মায়ের কাছে দাঁড়ালাম। মায়ের মুখটা দেখলাম। আমার যে কোনো অনুভূতি হলেই আমি মাকে ছুটে দেখতে আসতাম। প্রতিবার মুগ্ধ হয়ে যেতাম। মনে হত আকাশ, বাতাস, মাটি, জল, সূর্য, চাঁদের মত আমার একটা মা আছে। সে শুধুই আমার। সংসারে তার অন্য কোনো কাজ নেই। থাকতেই পারে না। আর আমারও সংসারে আপন বলতে যেন ওই একজনই - আমার মা। একটা গন্ধ, একটা মুখ, একটা হাসি, একটা দৃষ্টি, একটা স্পর্শ। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি। আমি মায়ের পাশেপাশে ঘুরঘুর করছি। আমি জানি বৃষ্টি থামবে। মেঘ তার সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে আবার চলে যাবে। আবার কারেন্ট আসবে। আমায় আবার পড়তে বসতে হবে। কিন্তু আমার একটা আনন্দ থাকবেই - মাকে দেখার। ঘুরতে ফিরতে একটু ছুঁয়ে নেওয়ার। মনে হত যেন ঈশ্বরী।         আমি কত সহজেই আস্তিক হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের চোখ বন্ধ করে ঠাকুরঘরে বসা। মায়ের তুলসীতলায় গলায় আঁচল দিয়ে প্রদীপ জ্বালা। শাঁখে ফুঁ দিত গালদুটো ফুলে ওঠা, উপোস করে থাকলে ফর্সা মুখটায় কালি পড়ে যাওয়া - এরাই আমার ঈশ্বরের অস্তিত্বের সব চাইতে বড় প্রমাণ ছিল।         আজ মা ছাড়া সব কিছু আছে। সেই শাঁখ, সেই আসন, সেই শাঁখা-পলা, সেই ঘট, সেই দেবদেবীরা সিংহাসন জুড়ে, সেই প্রদীপ, ধুপদানি, সেই মেঘ, সেই কৃষ্ণচূড়া, সেই বৃষ্টি, এমনকি আমার সেই কাঙালপনা মায়ের মুখটার জন্য, - কিন্তু এরা সব অপ্রাসঙ্গিক আজ। এত ব্যস্ত জীবনে এরা মালার সুতো ছিঁড়ে যাওয়া পুঁথির মত আজ। আদরযত্ন পায় না। এমনকি ন্যূনতম সম্মানটুকুও পায় না। তবু থেকে যায়। এরকম অজস্র অপ্রাসঙ্গিকতা লক্ষ লক্ষ প্রাসঙ্গিতার সাথে পাশাপাশি হেঁটে যায় সারাটা জীবন। না তারা ছেড়ে যায়, না আমি তাদের ছাড়তে পারি। যদিও ভাণ করি এমন, যেন সেসব আমি ভুলেও ভাবি না। তাদের যে আমি সম্পূর্ণ ভুলে গেছি এই কথাটাই রাতদিন মনে রাখি।         শিশুদের মধ্যে যতটা না প্রাসঙ্গিকতা তার বহুলাংশে বেশি তাদের অপ্রাসঙ্গিকতা। আমরা রাতদিন তাদের বাধ্য করছি আমাদের ভাষা শেখার। প্রাসঙ্গিক করার। কিন্তু তারাও একটা প্রকৃতিদত্ত ভাষা নিয়েই জন্মায়। আমাদেরও কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে সে ভাষা শেখার চেষ্টা করার। তাদের ইচ্ছা-বায়নাগুলোকে অপ্রাসঙ্গিক আখ্যা না দিয়ে তাদের সেই অপ্রাসঙ্গিক জীবনটাতেই একটু না হয় নিজের ছুটি খুঁজে নেওয়া যাক। আমি কথা দিচ্ছি, বিফলকাম হওয়ার অভিজ্ঞতা হবে না। অনেক কিছু তাদের দৃষ্টিতে দেখার সুযোগ হবে। নতুন করে এই বোকাসোকা পৃথিবীটাকে আবার ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে। আর এতগুলো আজগুবি ধর্মীয় গল্প যদি হজম করে ফেলছি, যাদের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করলেও জীবনসংশয়, তখন এই কতকগুলো নিরীহ অপ্রাসঙ্গিক উপাখ্যান মেনে নিই নাহয়। বাঁচাটা আরেকটু সহজ হবে। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়।    
385
Mon, 04/16/2018 - 14:00
            'চক্ষুলজ্জা'র ইংরাজি অভিধানে মনের মত পেলাম না। সংসদের অভিধানে তো একটা রচনাই লিখে বসেছে দেখলাম। কেন বলুন তো? তবে কি ওদের ওদিকে লোকে এমনধারা লজ্জা পেতে লজ্জাবোধ করে? জানি না। তবে আমাদের বাঙালিজাতটার আর কিছু লজ্জা থাকুক চাই না থাকুক এই চক্ষুলজ্জাটা কিন্তু বেশ দগদগে। শুধু চক্ষুলজ্জা কেন হবে, কর্ণলজ্জাও আছে তার সাথে।         'লজ্জা' জিনিসটা সমাজের খাতিরে না বিবেকের খাতিরে – এটা আগে স্থির করতে হবে। সমাজের লজ্জাটা অভ্যেসের। স্থূল। প্রাণশক্তিহীন। নিজের তৈরি করা নিজের ভাবমূর্তির প্রতি চূড়ান্ত একটা আনুগত্য নিয়ে বাঁচতে চাওয়া। তবে কি অভদ্রের মত আচরণ করাটাই চক্ষুলজ্জার বিপরীত শব্দ? তবে কি আমরা যে ভদ্র আচরণ করি তা শুধু অভদ্র আচরণ করলে চোখে লাগবে বলে? নাকি সেইভাবে আচরণ করাটাকে আমার ঠিক বলে মনে হয় বলে? সেই গোল্ডেন রুলের কথা চলে এলো – ‘তুমি অন্যের সাথে সেইভাবেই ব্যবহার করো যেরূপ ব্যবহার তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো’। একটু অন্য কথা হলেও বলে নিই- এই গোল্ডেন রুলটা পৃথিবীর সব ধর্মে কোথাও না কোথাও উল্লিখিত আছে। সেটা এবার কলেজ স্কোয়ারের বইমেলায় বিরাট করে টাঙানো আছে দেখলাম। কারণটা যদিও বুঝলাম না। যাক গে সৎ চিন্তার প্রসারের জন্য হয়ত বা।         তো যেটা বলছিলাম, তবে কি আমরা যে ভদ্র ব্যবহার করি তা সামনের মানুষটার মানসিক আঘাত যাতে না লাগে সেই ভেবে না আমি অন্যরকম ব্যবহার করলে আমার ভাবমূর্তিটা নষ্ট হবে সেই ভেবে? এই দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকেরা খুব গোলমেলে হয়। এরাই মনে হয় সেই 'সাপের গালেও চুমু আর ব্যাঙের গালেও চুমু' গোত্রের হয়। এরা অন্যের মনের আঘাতের থেকে নিজের ভাবমূর্তির রঙচটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত। তো হল কি আমাদের ভদ্রতাবোধ, সৌজন্যবোধ প্রাণের সেই সাড়াটা পায় না বলে বোধহয় কিরকম একটা কৃত্রিমতার আড়ষ্ঠতার ভাবটা কাটিয়ে উঠতে পারে না। এই বোধটা আমার বোধগয়ায় হয়েছিল। কিছু একটা কারণে আমায় একজন সাহেব মানুষ সুন্দর হেসে thank you বলেন। কথাটা আর সুরটা আমার কানে বাজে। এর আগে যে এ শব্দবন্ধটা শুনিনি তা তো নয়। তবে এরকম আরাম লাগল কেন প্রাণে? তারপর বুঝলাম, আসলে কথাটা প্রাণের গভীরের ধন্যবোধ থেকে জন্মেছে। তাই সেটা সত্য হয়ে উঠেছে। সুরে মিথ্যা আসে না। কারণ সত্যটা তো কোনো কথা না, একটা সুর। প্রাণে বাজলে তবেই চোখে-মুখে ফুটে বেরোয়। নইলে এত ভাণ, এত বাক্যবিস্তার, এত চাকচিক্য – কবে আমরা সত্যযুগে পৌঁছিয়ে যেতুম, যদি এর সিকির সিকি ভাগও সত্য হত। আমাদের 'thank you' -টা হল, ‘এই আমি আমার তরফ থেকে দিয়ে রাখলুম কিন্তু’ – এই ধরণের। ওতে প্রাণের সুর নেই, দায়সারা গোছের কিছু একটা আছে। তাই মাঝেমধ্যে আমাদের sorry -টাও ‘বেশ করেছি’ টাইপের শোনায়। শুধু বলতে হয় তাই বলা। সেই মনে আছে ‘আগন্তুক’-র শেষ দৃশ্যে ছুটদাদু কেমন thank you -টা নিতে চাইলেন না। বাচ্চাটার একমুখ হাসি নিয়েই নিরুদ্দেশে পাড়ি দিলেন আবার।         দেখলেন কোথাকার কথা কোথায় এসে পড়ল? শুরুতেই যা নিয়ে বলছিলাম, চক্ষুলজ্জা। তবে কি চক্ষুলজ্জার জন্য আমরা কোথাও বড় হয়ে উঠতে পারছি না। অথবা বড় হয়ে ওঠার নামে এমন ছড়াচ্ছি যে হাঁটা যাচ্ছে না? কিরকম একটু ভেঙে বলি। আমি দেখেছি অনেকেই যৌনতা বিষয়ে কোনো কথা হলেই বলেন – বড়দের কথা-বড়দের সিনেমা-বড়দের গল্প-বড়দের ছবি ইত্যাদি। যেন আমরা সব অতি ভোলাভালা শিশুর মত যৌনবোধরহিত শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ আত্মা। বাকি সব যা তা! আমাদের যৌনতা নিয়ে বাড়াবড়ির অন্ত নেই। পর্ণোগ্রাফি আর রামায়ণের মাঝে যে একটা রাস্তা আছে সেটা বোঝার মত বোধ তৈরি হতে আমাদের সময় লাগবে কি আরো? জানি না। তবে এই চক্ষুলজ্জার চক্করে পড়ে আমাদের সাহিত্য তথা শিল্পের যে প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে সেটা মাঝে মাঝে মনে হয়। আমরা ‘ওসব’ কথা ইংরাজিতে বলি, পড়ি, কিন্তু বাংলায় উচ্চারণ করতে গেলেই আমাদের চক্ষু-কর্ণ লজ্জা এসে উপস্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথের 'চোখের বালি' আর 'যোগাযোগ' উপন্যাস লিখবার সময় যে নিন্দা, কটুকথা সহ্য করতে হয়েছিল তা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শিবনারায়ণ রায় বলছেন, একটা সমাজিক পরিবেশ যে কিভাবে একটা উৎকৃষ্ট সাহিত্য সৃষ্টিতে বাধা হতে পারে, পূর্ণ না হলেও আংশিক দায়ভার তো বটেই, তা রবীন্দ্রনাথের এই দুটি উপন্যাস দেখলে বোঝা যায়। এতে আমাদের ক্ষতি।         এতো গেলো যৌনতা সাহিত্যে। আমাদের শিক্ষাতেও বহু শিক্ষক শিক্ষিকারা যৌনতা নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সাথে আলোচনায় কুন্ঠিত হন – তাদের একটা চক্ষুলজ্জা আছে না? একটা মান-সম্মান আছে না? অর্থাৎ সেই ভাবমূর্তির প্রশ্ন।         আমার অনেক বয়স্য কি তার চাইতেও বড় মানুষ এসব কথা বললে লজ্জা পান দেখেছি। লুকিয়ে আলোচনা করেন। গোপনে পর্ণোগ্রাফি দেখে ব্রাউজিং হিস্ট্রি ডিলিট করে এমন সাধু সেজে বসেন, যে মুখ দেখে মনে হয় সদ্য মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হলেন। আবার এর বিপরীতও আছে, যা আগেই বলেছি। কলম দিয়ে না যৌনাঙ্গ দিয়ে লিখছে বোঝার উপায় নেই। আসলে তাই তো হয়, যে স্বাভাবিক সুস্থ আলোচনা-শিক্ষা আমাদের দেশে চক্ষুলজ্জার ফিকিরে আটকিয়ে সেখানে বিকার থাকাটাই স্বাভাবিক। আরো ভয়ংকর অবস্থা হল এই চক্ষুলজ্জা যখন অবচেতনেও ছাপ ফেলতে শুরু করে। অমানুষ জড়বস্তুতে পরিণত করে। বিধবা বলে এটাসেটা করতে চক্ষুলজ্জার দোহাই, অথচ সেই বিধবার সাথে রাতে ছেনালি করতে সমাজের বাধেনি - এমন উদাহরণ একালেও বিলুপ্ত নয়।         আলোচনা অতি দীর্ঘ হল। এবার ইতি টানি। শেষ করার আগে একটা ইঙ্গিত দিয়ে যাই খালি। আমাদের দেশের প্রাচীন লালিত আদর্শ – ব্রহ্মচর্য্য। আমাদের শুদ্ধতার প্রতিশব্দই যৌনতারহিত। আদিম পাপ। সেই আপেল কেস। কিন্তু ওরা ওসব ছাড়িয়ে বহুকাল আগে পরিণত হয়ে উঠেছে আর আমরা এখনও প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে – নারী নরকের দ্বার... মেয়েমানুষের সাথে থাকলে ভগবানলাভ হয় না... ইত্যাদি আউড়িয়ে যাচ্ছি। যে ছেলেটা স্কুলে গিয়ে যৌনতাকে সুস্থ, স্বাভাবিক পড়ল, সেই যখন তার বাড়ির লোকের কাছে শোনে বা পড়ে আমাদের ধর্মগুরুরা বলে গেছেন মেয়েমানুষদের কাছ থেকে দূরে না থাকলে জীবন সফল হবে না... কিম্বা বীর্য্যধারণ না করতে শিখলে তুমি পাপী-অশুদ্ধ, ভগবান রোজ তোমার কোমরের নীচ থেকে হাঁটু অবধি শুদ্ধতা মেপে যান – তখন গোলমাল হয় বই কি। তখন চক্ষুলজ্জার উৎপন্ন হয়। কারণ যা বিবেকে, জ্ঞানে বাধে না, তা বাইরে বাধে তো। তাই সংযম, সৌজন্যতাবোধ না বুঝে আমরা বুঝি শিকল, আড়ষ্ঠতা, প্রাণহীন শুষ্ক অভিনয়ের ধারাবাহিকতা।    
386
Fri, 04/13/2018 - 16:30
            আমাদের চেতনায় একটা মধ্যযুগীয় শেওলা বরাবরই আছে। আজ বলে নয়। মধ্যযুগীয় নানা ধ্যান-ধারণারা এখনও আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যথেষ্ট প্রভাব রাখে। আমাদের চেতনায় একটা পচন ধরেছে। যে পচনটার আশু সমাধান না খুঁজলে সত্যিই বিপদ। প্রগতিশীল, মুক্তমনা ইত্যাদি কথার অর্থ আমি ততটা বুঝি না, যতটা বিজ্ঞান নির্ভরতা বুঝি।           মধ্যযুগীয় শেওলা বলতে কি বুঝি সেটা আগে স্পষ্ট করে নিই। আমাদের ধর্ম আর সমাজব্যবস্থা একে অপরের সাথে খুব ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িয়ে। তাদের মূল ব্যাখ্যা প্রাচীন অথবা মধ্যযুগীয় নানা বিধানের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। তার মধ্যে মিশ্রণ ঘটেছে বহু পরের দিকে। মূলত আমাদের ধর্মের যেদিকটা দর্শন, যেদিকটা অতীন্দ্রিয় সেদিকটা ততটা হানিকারক নয় যতটা আমাদের আচার-বিচার সম্পর্কিত বিধানগুলো। কিন্তু আমরা প্রত্যেকটাকে একে অপরের সাথে জড়িয়ে দেখি। কারণ সুক্ষ্ম বিশ্লেষণের মাধ্যমে একে অপরটার থেকে পৃথক করে দেখা সাধারণের পক্ষে সম্ভব না। আর পচনের সূত্রপাত সেখান থেকেই। আচার-বিচার আর পরলৌকিক জীবনের প্রতি অগাধ আস্থা আমাদের জনজীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন মুক্তচিন্তকের কাজ নয় এর স্রোত অন্যদিকে ঘোরানো। মজার কথা হচ্ছে আমাদের জনজীবনের এই স্রোতের মুখ যারা ঘুরিয়েছিলেন তারাও আরেকটা কোনো ধর্ম্মমতের সূচনা করেই আগেরটা থেকে আমাদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন। ফলে আমাদের যে ক'টা সামাজিক বিপ্লব হয়েছে সেগুলো প্রকারান্তরে ধর্মবিপ্লব। ফলে যে কোনো আন্দোলনের পুরোধা হয়ে থেকেছে আমাদের ধর্মানুগত্য। রামমোহন, গান্ধীজী, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি সমাজসংস্কারকেরা তো বটেই, স্বামীজি-দয়ানন্দ সরস্বতী ইত্যাদিরা তো আছেনই। এই ধারার একমাত্র ব্যতিক্রমী ছিলেন বিদ্যাসাগর মহাশয় উত্তর ভারতে আর দক্ষিণে ই ভি রামস্বামী পারিয়ার। যদিও রামস্বামীর মধ্যে একটা পাশ্চাত্যের কম্যুনিজমের প্রভাব ছিল। কম্যুনিজম আরেক প্রকার ধর্মানুগত্যের কথা বলে।         আধুনিক পথের ভারতের প্রথম পুরুষ আমার মনে হয়ে বিদ্যাসাগর যিনি সম্পূর্ণ নিজের বিবেকজাত শক্তিতে দাঁড়াতে পেরেছিলেন। স্বীয় বুদ্ধি-বিবেকের বাস্তবায়িত রূপ আনার জন্য কোনো ঈশ্বর তথা গুরু তথা অবতার তথা শাস্ত্রানুগত্য দেখাননি। মনে রাখতে হবে যে সেই সময় অমন রামকৃষ্ণের আন্দোলনের থেকেও নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। রামকৃষ্ণ নিজে ওনার সাথে দেখা করতে যান, দু'জনের কথাও হয়, রামকৃষ্ণ চেয়েছিলেন বিদ্যাসাগর তার সাথে যোগাযোগ রাখুন, কারণ তিনি রামকৃষ্ণের দৃষ্টিভঙ্গীতে 'নিজের ভিতরের সম্পদের খপর পাননি, তাই ওই সব লোকশিক্ষা, জনসেবা ইত্যাদি নিয়ে আছেন'। রামকৃষ্ণ বিদ্যাসাগরের এই তাকে এড়িয়ে চলাটাও পরবর্তীকালে ভালো চোখে দেখেননি, বলেছেন, বিদ্যাসাগরের এত গুণ কিন্তু মিছে কথা কয়, কারণ আসব বলেও এলোনি।         এই কথাটা ভাববার। যে মানুষটা নিজেকে এমন একজন শক্তিশালী ধর্মগুরুর কাছ থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে সমাজসংস্কারের কাজে ব্রতী থাকলেন তার কি মূল্যায়ণ ভারতবর্ষ করল? না ভুল ভাবছেন, আজ ওনার জন্মদিন কি মৃত্যুদিন কিছুই নয়। যদিও আমাদের প্রথা ওই দুটো দিনেই অগভীর স্মরণ করে বাকিদিন ভুলে থাকা। আমাকে আজকের দিনে ওনাকে স্মরণ করালো আজকের ভারতের পরিস্থিতি। আজ ভারতের প্রধান সমাজ সংস্কারকের ভূমিকায় বিবেকানন্দের জায়গায় যদি বিদ্যাসাগরের রোল মডেল থাকত আমার বিশ্বাস ভারত আরো এগোতো। বিবেকানন্দের পাশ্চাত্যাভিযান ছিল। সন্ন্যাসের আকর্ষণ ছিল। আধ্যাত্মবাদের আকর্ষণ ছিল। বিদ্যাসাগরের এর কোনোটাই ছিল না। তাঁর প্রধান সম্বল ছিল একটা সংস্কারমুক্ত মন আর অগাধ পড়াশোনা। এর কোনোটাই ভারতের চিত্তে আলোড়ন তোলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। আমাদের ওতে কিছু যায় আসে না। আমাদের প্রয়োজন পরলৌকিক জীবনের একটা গতি। যদিও বিবেকানন্দ এই পথে আমাদের কয়েকবার নিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু গায়ে গেরুয়া আর মঠের প্রতিষ্ঠাতার মুখে সে কথার আবেদন আর কতটা থাকে? আর রইল সেবা, বুঝতে অসুবিধা হল না যে ওটা খ্রীষ্টধর্মের সেবারই একটা পরিবর্তিত রূপ, ফলে সেও খুব একটা ধোপে টিকল না।         বিদ্যাসাগরের সে দায় ছিল না। তার ফলে শেষ জীবনটায় যন্ত্রণারও শেষ রইল না। তাকে এই শিক্ষিত-ভদ্র সমাজ ছেড়ে দূরে কার্মাটারে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে হল আদিবাসী, অশিক্ষিত মানুষগুলোর সাথে। সেখানেই ভালো ছিলেন আমাদের এই মুখোশধারী সভ্য সমাজের থেকে।         স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে যে শেওলার কথা বলছিলাম তা দূর হওয়ার পরিবর্তে আরো স্থায়ী হয়ে বসল। এটা ভারতের একটা বৈশিষ্ট্য, কিম্বা অভিশাপ। আমরা আমাদের কোনোদিন দৈবমুক্ত ভাবতে পারি না। কেন পারি না জানি না, বোধ করি কেউ জানেন না। আর এখন তো বাতাসে একটা চল আছে যে আমাদের ধর্মে যা আছে তা পৃথিবীর কোনো ধর্মে নেই, এমনকি বিজ্ঞানের সব কথাগুলোও নাকি আমাদের বেদ-উপনিষদের সাথে মিলে যায়। কোন কথা কতটা টানলে কোন খাতে বয় সে বলা মুশকিল। কিন্তু যেটা হল তা হল একটা মোহ আমাদের কিছুতেই যাচ্ছে না যে আমাদের ধর্মের গল্পগুলোর বয়েস হয়েছে, তাকে আর ছোটানো যায় না। মানুষের যেমন ভীমরতি ধরে আমাদের ধর্মীয় সিদ্ধান্তগুলোরও তেমন ভীমরতি'র অবস্থা। আমাদের জ্ঞানের প্রয়োজন, প্রজ্ঞার প্রয়োজন কিন্তু কোনোমতেই আর যাগযজ্ঞ, জাতি-বর্ণের প্রয়োজন নেই। যিনি চূড়ান্ত বর্ণাশ্রম মানেন তিনিও ব্লাডব্যাঙ্কে গিয়ে তার মুমূর্ষু প্রিয়জনের জন্য আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের বিধানই মেনে নেন।         এ আলোচনা দীর্ঘ করার প্রয়োজন দেখি না। ভারতে যদি সত্যিই কোনো মানুষ বৃহৎ অর্থে ধর্মহীন বিপ্লব ঘটিয়ে থাকেন সে বিদ্যাসাগর মহাশয় একা। আজ সে জীবনের শিক্ষা, বিশ্বাসের আলো প্রায় নিভু নিভু ভারতের চেতনা থেকে। যদি সত্যিই এ দেশটাকে জাগাতে হয়, যদি সত্যিই এ দেশের বিবেকের সামনে একটা বলিষ্ঠ আয়না তুলে ধরতে হয় তা অবশ্যই বিদ্যাসাগরের জীবন। সে তিনি আমাদের পরলৌকিক জীবনের ভার নিতে পারুন চাই না পারুন; বেদান্তের সুক্ষ্ম যুগোপযোগী ব্যাখ্যা করতে পারুন চাই না পারুন; তিনি আমাদের আত্মাকে সবল, সুস্থ করে তুলতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আমাদের আজ গুরুর দরকার নেই, বিজ্ঞান আছে দর্শন আছে সে জায়গায়; আমাদের আজ সেবার জন্য কিছু আত্মার মুক্তলোভী গেরুয়াধারীর দরকার নেই, তার জন্য সেনা-তথা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা আছে; আমাদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোও যতদূর সম্ভব ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হোক তার জন্য বিচার-বিশ্লেষণ নির্ভর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। আর সর্বোপরি আমাদের সামনে যদি সত্যিই কোনো রোল মডেল দরকার তো তিনি বিদ্যাসাগর হোন। আমার মনে হয় আসিফা, নির্ভয়া, কামুদিনি ইত্যাদি কমবে। হাঁটার রাস্তায় কুয়াশা থাকলে বড় বিপদ। আবারও বলছি, ভারতে যে ধর্মবিশ্বাসমুক্ত একটা বড় নিঃশব্দ বিপ্লব তিনি সে যুগে ঘটিয়েছিলেন সেই আমাদের আদর্শ হোক। মানুষটাকে আমরা কার্মাটার থেকে আবার ফিরিয়ে আনি। নিজেদের দুর্ভাগ্যমুক্ত করি। ঈশ্বর বলে যদি কেউ থাকেন, তিনি আমাদের সেই সৎকাজেই প্রতিষ্ঠিত হবেন। সত্য কর্মে, ভেদাভেদি ধর্মে না।    
387
Tue, 04/10/2018 - 16:01
            বিশ্বব্রহ্মাণ্ড আলোকিত করেও আমার দোরগোড়ায় আলো করার মত আলো কম হয় না। প্রতিটা প্রাণী-উদ্ভিদ এই কথাটাকে তার প্রাপ্য হিসাবে এমন করে জানে যে সে নিয়ে তাদের সংশয় হয় না। একবার পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় দেখেছিলাম, কি উতলা হয়ে, ভীত হয়ে, ডানা ঝাপটিয়ে, চীৎকার করে পাখিগুলো পাগলের মত করছিল। ওই যে আছে না, "না চাহিতে মোরে যা করেছ দান-- / আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ", এ কথাটা ভুলে যাওয়াটাই সত্য অর্থে মূঢ় হয়ে বাঁচা। একটা হোটেলে গেলে, কি বিমানে উঠলে, কি ট্রেনে উঠলে - কত কি মনে রেখে চলতে হয়। এই কার্ড, সেই প্রমাণপত্র ইত্যাদি ইত্যাদি। তার যেন কোনো ভুল না হয় কত সতর্কতা রেখে চলতে হয়। সেরকম এতবড় একটা ঘটনার মধ্যে জন্মে গেলেও তার কিছু দায় থেকেই যায়। পেয়াদা নেই ঠিক, কিন্তু আত্মপ্রসাদ বলে একটা কথা আছে, তার মাধুর্য কমতে শুরু করে, ফিকে হয়ে যায়। সারাদিন ব্যাঙ্ক, অফিস, পাড়ার মিটিং, বিয়ের কেনাকাটা, স্কুলের মাইনে... লক্ষকোটি উপলক্ষ্য, আবার তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের প্যাঁচের দুর্ভাবনায় জড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে অবশেষে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির ম্যাচুরিটি প্রত্যাশী, অমুক অফিসের চেয়ারকর্তা বই যে কিছু মনে হবে না। এর বাইরে বেরোতেই হবে। অকাজের শ্বাস নিতে হবে।           একটা নীরব নির্জনতা নিজের চারদিকে না গড়ে নিতে পারলে ভিতরে ভিতরে কোথাও একটা সুতো খসে যাবে। তার জন্যে কোত্থাও যাবার লাগে না। নিজের মধ্যে এক ছিলিম কৃতজ্ঞতা আর আধ-ডজন নির্জনতা হলেই হয়। আমাদের মা-ঠাকুমা'র প্রজন্মকে দেখেছি অনেক সকালে উঠে পড়তেন। সকাল আটটার মধ্যে কত কাজ তাদের সারা হয়ে যেত। তার মধ্যে কিছু অসাংসারিক কাজও তো থাকত। পূজোর ফুল তোলা, তুলসীমঞ্চে জল দেওয়া, উঠোনটা পরিষ্কার করা, কিম্বা কিছু না করেও বাগানে অথবা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা। এ মানুষগুলোর উপরে তো কম চাপ থাকত না। আমরা এক একজন, এক এক সময়ে যে যার কর্মক্ষেত্রে যাব তার রুচি অনুযায়ী খাবার বানানো, টিফিনের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ওই অল্প সময়ের মধ্যে কি নিপুণভাবে সব হয়ে যেত। কিন্তু এর মধ্যেও দেখেছি নিজের রুচি-ইচ্ছা অনুযায়ী দিনের এক খণ্ডে নিজের সাথে কি সুন্দর কাটাতেন। ওই সময়টায় আমিও কাছে যেতে অস্বস্তিবোধ করতাম। যেন আমার খুব কাছের জন হয়েও তারা সে সময়টায় অনেকটা দূরের। আজ বুঝি সেই নির্জনতাতেই তারা এমন আশ্রয় হয়ে ওঠার সাধনাটা করতেন। আমাদের সাধ্য ছিল না তাদের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলে নিজের মনের অজান্তেও কোনো কটুশব্দ উচ্চারিত করতে। সেই ব্যক্তিত্ব, সেই মহত্বটার জন্য তারা কোনো হেঁটমুণ্ড তপস্যা করেননি। নিজেকে শুদ্ধ, পরিশীলিত আর স্বচ্ছ রাখার মত ভারসাম্য নিজের মধ্যে তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন। যা তাদের দিত তাদের সেই আত্মগত ক্ষণগুলো।           আজ ছবিটা বড্ড এলোমেলো। তার একটা প্রধান কারণ আমাদের নির্জনতা আছে কিন্তু নীরবতা নেই। কিছুটা সময় নিজের মধ্যে সে নীরবতা গড়ে তোলার কথা বললাম সেটা মোবাইলের নেটদুনিয়া সংক্রামিত। আমরা একা হয়েও নিজের চারদিকে একটা অশ্রুত কোলাহলের মধ্যে। কই নির্জনতা? আমায় ঘিরে যে মহা মহিমাময়, বিচিত্র শোভার, রহস্যময়, প্রাণবন্ত প্রকৃতিটা সে যে চিরকাল নীরব। আমার নীরবতায় তার নীরব প্রতিচ্ছবি না পড়লে আমার সবটুকু কোলাহলে শেষ হয়ে যাবে। আমার ছাত্রছাত্রীদের মাঝেমাঝে বলি, দেখ তোরা এই মুহূর্তে আমার বাড়িতে, মানে হালিশহরের একটা বাড়ির ছাদের তলায় যেমন বসে আছিস, ঠিক তেমনই উত্তর চব্বিশ পরগণাতেও আছিস, পশ্চিমবঙ্গেও আছিস, ভারতেও আছিস, এশিয়াতেও আছিস, আবার বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যেও আছিস। তোর শরীরের একটা ভৌগলিক অবস্থান আছে। কিন্তু তোর মনের ভৌগলিক অবস্থানটাকে যদি না বাড়াতে পারিস তবে কোনোদিন পালে সমুদ্রের হাওয়া লাগবে না। ডিঙি চড়েই জীবন শেষ হবে। অথচ দেখ, একটু ভাবনাটাকে বড় করে নিলেই আমার এই বারান্দায় বসেই তুই ব্রহ্মাণ্ডের আশ্বাস পাচ্ছিস। খোলা চোখে দেখে মানুষ কিচ্ছু হয়নি কোনোদিন, মানুষ আসল যা দেখেছে তা চোখ বন্ধ করেই, জ্ঞানের আলোতে। নইলে আগাথা দিদির চোখে যা পড়ে আমার চোখে পড়ে না কেন? কিম্বা নিউটন বা মেণ্ডেল? আসলে তারা দেখার বাইরে কিছু একটা দেখার অভ্যাস করেছে যে।           তো যে নীরবতার কথা বলছিলাম, আমাদের সে নীরবতা নেট সংক্রামিত। অশ্রুত কোলাহল বেষ্টিত। যে মানুষের নীরবতা নেই, তার মানসিক সাম্যতাও নেই। নৈতিক জীবন তো দূরের কথা। নিজের মধ্যে এত কোলাহল যে নীতির সুক্ষ্ম স্বচ্ছতা চাপা পড়ে যায়। মেয়ে মায়ের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলছে, কটাক্ষ করছে --- এ বড় দুর্ভাগ্যের। সে নিজেও একটা নৈতিক জীবনের কাঠিন্য থেকে মুক্তি চাইছে, “তুমিও তো করো”–র অজুহাতে। এ আশঙ্কার। এ কথা বলা বাহুল্য মায়ের ছাপ যতটা গভীরে গিয়ে প্রভাবিত করে বাবার ছাপ ততটা নয়। বাবার দুশ্চরিত্র হওয়াটা সন্তানের পক্ষে দুর্ভাগ্যপজনক। তার বেশি কিছু নয়, সে বেঁচে গেলেও যেতে পারে। কিন্তু মায়ের চরিত্রের কালিমাটা তার ভবিষ্যৎ জীবনের পক্ষে শুধু দুর্ভাগ্যজনক নয়, বিষবৎ। কোনো কিছুর উপর বিশ্বাস রাখা, শুদ্ধতায় আস্থা রাখা, নিজের জীবনের গতির হাল ঠিক রাখা ক্রমে দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে তার পক্ষে। এ কোনো সমাজবিজ্ঞানের পরিসংখ্যান মেপে বলছি না, এত বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমি দুটো ধরণের ঘটনারই বহুবার সাক্ষী হয়েছি। প্রথম ক্ষেত্রে সফল হয়েছি ছেলে বা মেয়েকে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসার চেষ্টায়। যাদের বাবার সমস্যা। পালিয়ে গেছে, বা অন্য কারোর সাথে থাকে, কিম্বা পাড়ার সবাই জানে তার বাবার সাথে আর কারোর কোনো অবৈধ সম্পর্ক আছে। কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে কিছু করতে পারিনি। যাদের মাকে নিয়ে একই ধরণের সমস্যা, তাদের সন্তানদের মধ্যে একটা সন্দেহপ্রবণতার বিষ এমনভাবে ঢুকে থাকে যে পরক্ষণেই কি করবে সে নিজেও জানে না। যা নিজে বলছে তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না যেন। যা বলছে অত্যন্ত বিশ্বাসের সাথে কার্যক্ষেত্রে তার বিপরীত ঘটিয়ে বসছে। অথবা বাইরে অত্যন্ত নিপুণ কার্যক্ষম হলেও ভিতরে ভিতরে অত্যন্ত নিষ্ঠুর আত্মকেন্দ্রিক একটা জীবনশৈলিতে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। বহুবার দেখলাম।           আমার কথার স্রোত অন্যদিকে ঘুরে গেছে, বুঝছি। তবু বলেই ফেললাম। যাই হোক, যেটা বলছিলাম, নীরবতার কথা। আমার মধ্যে নীরবতা তৈরি করতে পারলে বিশ্বের নীরব যে ছন্দ তার সাথে একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখা যায়, নিজের মধ্যে নীরব হতে পারলে, ভয়-আতঙ্ক-দুশ্চিন্তা ইত্যাদির মাত্রাও উল্লেখযোগ্য হারে কমতে শুরু করে। ভালো বই, ভালো গান, ভালো আলোচনা ইত্যাদি এই নীরবতা তৈরির প্রথম ধাপটা অবধি হয়ত নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু ওরা কেউ অন্দরমহল অবধি যেতে পারে না। সেখানে নিজেকে নিয়ে একাই যেতে হয়। জীবনের গভীরতম কবিতাটা, সংগীতটা শোনার সৌভাগ্য হয়। শূন্যের মধ্যে যে বিশ্রাম মেলে সে বিশ্রাম আমি কোনো পর্বত, সাগরে, জঙ্গলে পাইনি, নিজের মধ্যে সেই নীরব শূন্যতাটা যা দিতে পারে। ক্রমে সে আমাদের মধ্যে এমন একটা দরজা খুলে দেয় যে আমি নিজেকে পাই এ মহাসংসারের প্রাচীনতম নাড়ির টানে। একটা পাখির উড়ে যাওয়া, একটা পাতা খসে পড়া, এক টুকরো মেঘ ভেসে যাওয়া, একটা মানুষের নীরবে হেঁটে যাওয়া ইত্যাদির নতুন একটা ভাষার সাথে পরিচিতি মেলে। শান্তি আসে। যে শান্তি কোনো ওষুধে মেলে না। কোনো বাহ্যিক শুশ্রুষায় মেলে না। মেলে নীরবতার আত্ম-শুশ্রুষায়। তবে গিয়ে সেই পূর্বোল্লিখিত গানটার পরের দুটো লাইনে আমাদের প্রবেশ মেলে –           “দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য ক’রে / অতি-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে।।”  
388
Thu, 04/05/2018 - 15:58
            এ আলোচনাটা কিছুটা আত্মগত। নিজের মধ্যে উত্তর খোঁজা। তার প্রধাণ কারণ এই আলোচনা করার বৈধ যোগ্যতা আমার কোনো অর্থেই নেই। তবু মন থাকলে গতি থাকবে। আর মনের গতি তো চিন্তা। চিন্তা আর কবে সরলরেখায় হল? চিন্তা কখনও আবর্ত, কখনও খাদের কিনারায়, কখনও মাঝসমুদ্রে। কখনও সখনও সবুজ মাঠের মধ্যে হাত পা ছড়িয়ে টানটান আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে থাকে না যে তাও নয় অবিশ্যি। সেই চিন্তার কিছু কথা।           কিছুদিন আগে দক্ষিণ ভারতের একজন খ্যাতনামা সংবাদ পাঠিকা বহুতল আবাসন থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। নিজেকে শেষ করার আগে তার স্যুইসাইড নোটে লিখে যান, “আমার মস্তিষ্কই আমার সবচাইতে বড় শত্রু”। কি কারণে লিখেছিলেন আমি জানি না। ইচ্ছা হয়নি। কিন্তু কথাটা খুব খাঁটি। আমার অনেক লেখায় (বিশেষ করে ধর্মপ্রসঙ্গে) অনেকে প্রতিবাদ করে আমায় মেসেঞ্জারে অথবা সাক্ষাতে বলেন যে, “আমি আপনার সাথে যুক্তিতে পারব না, কিন্তু আপনি ভুল”। আমার উত্তরটা খুব ঘোরালো লাগে। যুক্তিতে পারা না পারার কি আছে, যদি না অপযুক্তি থাকে? যুক্তি তো পেশীশক্তি নয় যে সে অন্ধ, সে তো সত্যের তীর ধরে ধরে হাঁটতে পছন্দ করে। কিন্তু না, তারা সে কথা মানতে নারাজ। তখন বুঝি আসলে কোথাও একটা তাদের সুলালিত প্রাচীন ধারণায় আঘাত করছে। এবং সেটা যে অন্ধ তারা নিজেরাও জানেন, কিন্তু সে কথা প্রকাশ্যে আলোচনা পছন্দ করেন না।         যেটা বলছিলাম, “মস্তিষ্কই আমার সবচাইতে বড় শত্রু”। ঠিক। দস্তয়েভস্কি তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Notes From The Underground’ এ লিখছেন - Consciousness is a disease. অস্তিত্বের গভীরে একটা যন্ত্রণা। অব্যক্ত যন্ত্রণা। প্রশ্নের যন্ত্রণা। রহস্যময়তার অন্ধকার। পথ নেই। আলো নেই। শুধু অনুমান। অনুমানের কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে? এই অনিশ্চয়তাতেই জীবন। জীবন শুধু পদ্মপাত্রের আগায় জল টলটল জলবিন্দু নয়, জলকণাগুলোর মধ্যে নিবিড় ঘন অবিরাম সংঘর্ষ।         প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দু'ভাবে এ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। প্রাচ্যের আত্মদর্শন প্রধান। আত্মার দর্শন। অতিজাগতিক বিশ্বাসের দর্শন। তার প্রমাণ নেই। অনুমান আছে। অতীন্দ্রিয় অনুভবের উপাখ্যান আছে। কিন্তু তা সার্বজনীন নয়। কিন্তু বহুচর্চিত হওয়ার জন্য তা লোকপ্রিয়। আমরা জন্ম থেকেই আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী। এ নিয়ে আমাদের কোনো সংশয় নেই। এর বিরুদ্ধে চিন্তা করতেই বরং আমাদের সচেতন অভ্যাস করতে হয়। এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে এ ধারণা আমাদের অবচেতনে। আসলে একটা সমষ্টিগত অবচেতন তো থাকেই প্রত্যেকটা সমাজে। যা আমাদের চাল-চলন-বিবেক-বিচার নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের অলক্ষ্যে।         পাশ্চাত্য এর কোনো সহজ মীমাংসা দেয়নি। বৌদ্ধদর্শনে খানিক অনাত্মবাদের কথা এলেও পুনর্জন্মবাদের চক্করে সে তত্ত্ব খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠেনি। যদিও বৌদ্ধ দার্শনিকেরা অতি সুক্ষ্ম বিচারে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন যে বেদান্তের আত্মার সাথে জড়িত পুনর্জন্মবাদ আর তাদের পুনর্জন্মবাদ আলাদা। তবু কোথাও একই গোত্রের হয়ে দাঁড়ায় – কারণ মৃত্যুর পর কিছু একটা অস্তিত্বে তারা বিশ্বাস করেন যা আবার জন্মলাভ করবে। পাশ্চাত্যে সুবিধা হল ওদের ধর্ম আর দর্শন কিছুটা কাছাকাছি কোনো একটা সময়ে এলেও গুলিয়ে যায়নি একটার সাথে আরেকটা। তার ফলে দর্শনটা স্বাবলম্বী হয়ে নিজের শাখা-প্রশাখাকে বিচিত্র চিন্তা আর ভাবের শক্তিতে বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছে। আমরা যেটা পাইনি। আমাদের ধর্ম আর দর্শন একে অন্যের সাথে মিথোজীবিতায় বেড়ে উঠেছে। তার ফলে দর্শনটা ঠিক স্বাবলম্বী কোনোদিনই হয়ে ওঠেনি। তাকে আত্মার অমরত্ব এবং বিশ্বের এক পরম সত্য ব্রহ্মের কাছে বরাবর নিজের নজরানা দিয়ে আসতে হয়েছে। চার্বাক ইত্যাদি ছিল যদিও তবে ততটা গভীরতায় তারা পৌঁছিয়েছে বলে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় না।         পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের ধারা বিচিত্র আগেই বললাম। এখানে একটা কথা শুধরে নিই, সরাসরি প্রাচ্য দর্শন বলা হয়ত আমার উচিৎ হচ্ছে না। কারণ প্রাচ্যে আরো অনেক দর্শন উঠে এসেছে চীনে, জাপানে যা অত্যন্ত গভীর, এবং অবশ্যই অনেকটা অতীন্দ্রিয়ের রহস্যময়তা মুক্ত। আমার আলোচনায় আমি বিশেষ করে ভারতের দর্শনের কথা বলতে চাইছি। পাশ্চাত্যের যতগুলো দর্শন আছে আমি বিশেষ করে তার অত্যাধুনিক দর্শন ‘অস্তিত্ববাদ’-এর কথা বলছি।         অস্তিত্ববাদের মূল কথা প্রথমে আমার অস্তিত্ব তার পরে যা কিছু সারবত্তার প্রশ্ন। নিজের অস্তিত্বের নিরিখে সব কিছুকে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া। সব কিছুর অর্থ খুঁজতে যাওয়া। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় পৃথিবীর কোনো দর্শনই এই মূল জায়গাটা থেকে সরতে পারে না। নিজের অস্তিত্বের সাথে তাকে একটা বোঝাপড়ায় আসতেই হয়। যে ভাবেই হোক। ‘জীব নিত্য কৃষ্ণদাস’ থেকে শুরু করে ‘মানবতাবাদ’ তথা ‘মানবতন্ত্রের’ মূল কথাটাই এই বোঝাপড়া করতে চাওয়া। সমষ্টির সাথে নিজের ব্যষ্টিসত্তার যোগসূত্রটা খুঁজতেই হবে। সমষ্টিকে কখনও ঈশ্বরের নামে কখনও নানা –‘ইজম্’-এর নামে মানুষ ব্যাখ্যা করতে চেয়েছে। সেই ব্যাখ্যাগুলো বদলে বদলে গেছে কিন্তু ব্যষ্টি বদলায়নি। সারা বিশ্বের ধর্মের সাথে ধর্মের না মিললেও তাই পৃথিবীর যে কোনো মানবসাহিত্যের সাথে মানুষের একাত্ম হতে অসুবিধা হয়নি। রাশিয়ার কোনো গ্রাম্য নারীর উপাখ্যানেও আমার চোখে জল এসেছে, আবার দূর্গার মৃত্যুর বর্ণনাত্মক দৃশ্য সে দেশের মানুষের চোখের কোল ভিজিয়েছে। মূল কারণ আমাদের অস্তিত্বের অনুভূতিটা যে এক। আর কিছুকে নিয়ে আমাদের সংশয় এলেও নিজের অস্তিত্বকে নিয়ে তো কোনো সংশয় আসেনি। যদিও নীৎজের তত্ত্বতে সে খানিক ঝলক দিয়েছিল কিন্তু সার্ত্রের দর্শনে সে আত্মধ্বংসের পথ থেকে রক্ষা পায়। সার্ত্রে মানুষের অস্তিত্বের গভীরে একটা প্রতিশ্রুতি দেখেছিলেন। ‘Bad Faith’ নামক মলিন, অসত্য আত্ম-অবমাননাকর মোহময়তা থেকে নিজেকে রক্ষা করার তাগিদ খুঁজে নিতে বলেছিলেন। যদিও অস্তিত্বের গভীরে অর্থহীনতার যন্ত্রণা অস্বীকার করেননি, কিন্তু তার কাছে হেরে যাওয়াকেই মানুষের চরম পরিণতি বলে মানতেও চাননি।         তবে ব্যষ্টির সাথে সমষ্টির যোগসূত্র না, ব্যষ্টির মধ্যেই ব্যষ্টিকে তীক্ষ্ম নজরে দেখার প্রথম প্রয়াসটা খুব সার্থকভাবে বোধহয় দস্তয়েভস্কি করেন। অবশ্যই তার ‘Notes From The Underground’ গ্রন্থে। সেই বিশ্লেষণ তার ‘Brothers Karamazov’-এও গভীর। তবে তাকে পরবর্তী সময়ে একটি স্বাবলম্বী মৌলিক দর্শনরূপে দাঁড় করান কাম্যু (বিশেষ করে The Stranger উপন্যাসে), সার্ত্রে (বিশেষ উল্লেখ্য ‘Being and Nothingness’ এবং ‘Nausea')। মূল কথা হল কোন প্রচলিত বিশ্বাস, ধ্যানধারণার স্রোতে গা ভাসানো নয়। নিজের অস্তিত্ত্বকে পর্যবেক্ষণ, অনুভব, বিশ্লেষণ। এর কোনোটাই অতীন্দ্রিয় রহস্যময়তায় নয়, বরং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সংবেদনে এবং যুক্তিগ্রাহ্যতায়। কোন আনন্দের প্রতিশ্রুতি নেই, কোন পূর্বপরিকল্পিত বিশ্বাসের কাছে দায়বদ্ধতা নেই। দায়বদ্ধতা সত্যের কাছে এবং নিজের মোহমুক্ত পক্ষপাতরহিত ধীশক্তির কাছে। যা লালন করার ক্ষমতা রাখে স্থায়ীত্বকে সত্তার বিবর্ধনে। যদিও মানুষের অসীম ক্ষমতা আত্মধ্বংসের, কিন্তু তা কোন অর্থেই যুক্তি ও সুবিবেচনা অনুমোদিত হতে পারে না। নিজের অস্তিত্বকে রক্ষা করে চলার মধ্যেই নিহিত আছে অন্যের অস্তিত্বকে রক্ষা করার দায়বদ্ধতা। শুধু যে সমষ্টি দ্বারাই ব্যষ্টি প্রভাবিত হয় তা তো নয়, ব্যষ্টিরও দায় থাকে সমষ্টির দিকে।         এতক্ষণ যা বললাম, তা হয়তো একটা ভূমিকা বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তার বিশ্বাসের গভীরে রেখেছিলেন উপনিষদের বিশ্বাসকে --- 'আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে' --- আনন্দ থেকে এ জগতের সৃষ্টি। মানুষের কেন্দ্রে এক আনন্দময় সত্তার অস্তিত্বে তিনি বিশ্বাস করতেন। উপনিষদের ভাষায় যা সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ, যা অমর। এই ক্ষুদ্র আত্মার সাথে ইন্দ্রিয়াতীত এক পরম মঙ্গলময় কারুণিক ব্রহ্ম তথা ঈশ্বরের অস্তিত্বেও বিশ্বাসী ছিলেন। যিনি তার প্রেমে কখনো কখনো যেন অত্যন্ত মানবিক।         কিন্তু আমার খটকা লাগে রবীন্দ্রনাথ তার শেষ কয়েকটা কবিতায় তিনি যেন ক্রমশ বেদান্ত’র ব্রহ্ম থেকে ভবিষ্যতকালের দর্শন অস্তিত্ববাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। প্রথম দিনের সূর্য এবং দিবসের শেষ সূর্য সত্তার নতুন আবির্ভাবে অথবা বৎসরান্তের শেষে উত্তর না পেয়ে ফিরে যায় --- 'পেল না উত্তর'। শুধু কি এখানেই ক্ষান্ত হলেন? বললেন --- 'আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন / সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে'; অথবা 'সত্যেরে সে পায় / আপন আলোক ধৌত অন্তরে অন্তরে'... কিম্বা... ‘সত্য যে কঠিন, / কঠিনেরে ভালবাসিলাম / সে কখনো করে না বঞ্চনা’। এ সত্য কোন সত্য? এ তো আনন্দময় সত্তা নয়। এ তো আত্মার অমরত্বের বিজয় তোরণ নয়! এ তো পরম কারুণিক পরমেশ্বরের আশ্বাসের শান্ত তৃপ্ত মুগ্ধ চিত্ত নয়! এ কোন রবীন্দ্রনাথ? যিনি বলেন ‘অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে / সে পায় তোমার হাতে / শান্তির অক্ষয় অধিকার’। কোন ছলনা? ব্রহ্ম'র? আত্মার অমরত্বের? উপনিষদের প্রতিশ্রুত গভীর আনন্দের? তাই কি অবশেষে অস্তিত্ব'র সত্য যে গভীর দুঃখ তাকে স্বীকার করে নেওয়া? নির্মোহ সত্যকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে যে শান্তি, অবশেষে সেই কি হল তার শেষ আশ্রয়? তেমন কথাও যে বলেননি তা তো নয়! বলেছেন, ‘এই বাহ্য আবরণ, জানি না তো, শেষে / নানা রূপে রূপান্তরে কালস্রোতে বেড়াবে কি ভেসে। / আপন স্বাতন্ত্র‍্য হতে নিঃসক্ত দেখিব তারে আমি / বাহিরে বহুর সাথে জড়িত অজানা তীর্থগামী’।           এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সোজা নয়, কিন্তু তবু নিজের জন্য এই উত্তর যে পেতেই হবে। বিজ্ঞান তো শুধু জড়ের রাজত্বে বিরাজ করে না, সে এমন গভীর সত্যের সন্মুখে দাড় করায় বারবার যা বিশ্বাসের অন্দরমহলে বহু লালিত পালিত অচলায়তনের ভিত নাড়িয়ে দেয়। নতুন দর্শনের জন্ম হয়, যে দর্শন শুধু বিশ্লেষণের কথা বলে না, নতুন আলোতে নতুন করে সংশ্লেষের কথা বলে।
389
Tue, 04/03/2018 - 19:30
          আমার একটা ঘর আছে। তার চারদিকে চারটে দেওয়াল আছে। তার মাথার উপর ছাদ আছে। ছাদে একটা পাখা ঝোলে। কখনও ঘোরে, কখনও হাঁ করে নীচের দিকে তাকিয়ে ঝুলে থাকে। ঘরে চেয়ার টেবিল খাট বিছানা তোষক বালিশ চাদর ইত্যাদি আছে। এখন কথা হল এগুলো তো সবার বাড়িতেই আছে। এ বলার কি আছে?         বলার আছে। আমি এদের যে রাতদিন দেখি, কখনও খেয়ালে রাখি, কখনও রাখি না এরা তা জানে না। জানার কথাও না। কারণ এরা জড়। আমার কিছুটা জড় হলেও পুরোটা ঠিক জড় নয়। জড়ের বোধ থাকলে আর নিজেকে জড় বলি কি করে? আমার জন্য আমার মন কেমন করে। আমার জন্য আমার ভাবনা হয়। আমার উপর আমি উদাসীনও হই। আমাকে নিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা। এও নতুন কথা কিছু নয়। সবারই সবাইকে নিয়ে নানা অভিজ্ঞতা থাকে। কথাটা হল আমি আমার থেকে পালাতে চাই। অন্য আমি হতে চাই। আপনার আমিকে আমি ভালো করে খেয়াল করি রাতদিন। আপনি জানে না। আমি আপনার সাথে আমার তুলনা করি রাতদিন, আপনি জানে না। কারণ আপনি নিজেও তাই করেন। আমরা একটা জালের মধ্যে আটকে রাতদিন লুকোচুরি খেলছি। এটা রূপক। জাল আবার কি? ও একটা তুলনা।         আমার আমার থেকে পালাতে ইচ্ছা করে। সমুদ্র, নদী, পাহাড়, বই, সিনেমা – কিছুক্ষণের জন্যে এ কাজে সাহায্য করলেও সবটা এদের দিয়ে হয় না। আমাদের মধ্যে তাই একটা মৃত্যু বিলাসিতা থাকে। যৌবনে বেশি থাকে। বয়েসের সাথে সাথে সত্য অর্থে মৃত্যু, মানে মেডিকাল ডেথ, যত কাছে আসতে থাকে তত সব গুলিয়ে যেতে থাকে। তখন ওসব রোম্যান্স আর ভাল্লাগে না। তবু পালাতে ইচ্ছা করে। অন্য আমি হতে ইচ্ছা করে। আপনি বলবেন যৌনতার কথা।         বাংলা ভাষায় যৌনতার কথা বলা যায় না। সংকোচ লাগে। বাংলা ভাষাটার আশেপাশে যেন মা-মাসি-পিসী দাঁড়িয়ে। কিন্তু তবু সে যৌনতাও একঘেঁয়ে। শরীরের একটা ভোগের সীমা আছে। মানে স্নায়ুর। একটা স্নায়ু একই অনুভূতি অনেকক্ষণ নিতে পারে না। স্নায়ুর মধ্যে একটা আমি লেগে আছি – চিকিৎসাশাস্ত্র বলে। আমি আপনি বুঝি না। আমি আপনি বুঝি আমি আছি। আমায় নিয়ে লোপালুপি খেলছে সময় আমার পরিবেশ। আমায় ভারসাম্য রাখতে হচ্ছে। হাত বাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। নইলে যে কোনো মুহূর্তে পড়ে যেতে হবে। যদিও একবার পড়ে যেতে হবেই। হঠাৎ একদিন আলো নিভে ভোকাট্টা হবে। সময় আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, বলো তো এরপর কি? আমি আমার দিকে তাকাই। হাতড়াই। কখগঘ থেকে সক্রেটিস ব্যাসদেব সার্ত্রে ডকিন্স হকিং সব আওড়াই। কিচ্ছু বুঝি না। যেই বুঝি মনে হয় অমনি আবার নতুন ধাক্কা। চেনা দেওয়াল, চেনা পাখা, চেনা মুখ, চেনা ভাষা অচেনা। আবার নতুন ডাটা। লোড করো। অপেক্ষা করো নেক্সট আপডেটের জন্য।         আমি তবু পালাতে চাই। নতুন হতে না। পালাতে চাই। নতুন হওয়া মানেই পুরোনোকে মনে রাখার একটা ব্যাপার থাকে কোথাও। আমি সম্পূর্ণ পালটে যেতে চাই। তারপর আবার বদলাতে চাই। আমি মৃত্যুকে না বলতে চাই।         চিন্তার প্রসব যন্ত্রণা এরা। আমি আমাকে ছাড়া কাউকে চিনি না। আমি আমাকে ছাড়া কারোর উপর জোর করতে পারি না। তাও এ শরীরটা না। আমি বলতে যা বুঝি তা এ শরীরটা না। যদিও বেদান্তের ভাষায় আত্মা পরমাত্মার গল্পে যাচ্ছি না। কারণ আমি অমরত্বে বিশ্বাস রাখি না। ঠিক বিশ্বাস না, আমি অমরত্বে ইচ্ছা রাখি না। কারণ আমি নতুন হতে চাই না। আমি অন্য হতে চাই। অমরত্ব মানে বোরিং কিছু। আমার শেষ অবলম্বন কারোর স্মৃতিতে বেঁচে থাকতে চেষ্টা করা। তবু এসব মিথ্যা কথা।         রামকৃষ্ণদেব বলছেন আমাদের ‘দাস আমি’ হয়ে থাকতে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বড় আমি’ তে বাস করা। আমি জানি না, আমাদের সে ‘বড় আমি’, ‘দাস আমি’ কে পাব কোথায়? তাদের আমার মধ্যে কালচার করে তৈরি করতে হবে। কিন্তু কার দাস হব? কোন ঈশ্বরের? মাইল বদলালে ঈশ্বরের দাবী বদলে বদলে যায়। রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ‘মা ছেলের পেট অনুযায়ী ঝোল, অম্বল, ঝাল রাঁধেন।‘ আমার পেটে কি সহ্য হয় বুঝি কি করে? কেউ জানে না। আমিও জানি না। আপনিও না। জানে যারা দল বেঁধে নাম লেখায়। তারা চুষি কাঠি চোষে। চুষুক। আমি চুষব না। চুষি কাঠির লড়াইয়ে যাব না। এর চুষি কাঠির সাথে ওর চুষি কাঠির লড়াই। জানে না বলেই এত ঠোক্কর। এত গোলমাল। ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’। সেই আমিকে খোঁজা।         আমি আমাকে খোঁজা ছেড়ে দিয়েছি। আমি দেখছি আমায়। আমায় দেখা। আমায় বোঝা। আমায় ছেড়ে পালাতে চাওয়া। অন্য আমি হতে চাওয়া। “কি সুর বাজে আমার প্রাণে, আমি জানি মনই জানে”...         আমি কোকুন। আপনি কোকুন। গুটিয়েই যাচ্ছি, গুটিয়েই যাচ্ছি। এরপর প্রজাপতি হতে হবে। প্রজাপতি হয়ে যাবে। এ মানুষে সে মানুষ আছে। কই আছে? আছে আছে আছে...পালাতে চাইলেই আছে...  
390
Mon, 04/02/2018 - 11:50
          তোমাদের জন্য আমার শান্তি নেই। আমার ব্যক্তিগত জীবনে শান্তি ছিল। যখন ধর্ম আমার একান্ত ব্যক্তিগত ছিল। আমার ধর্মে সেদিন আমি ছিলাম, আমার ঈশ্বর ছিলেন। সংগীত ছিল। নৃত্য ছিল। আকুতি ছিল। আনন্দাশ্রু ছিল। আমার ধর্মের মধ্যে আমি সারা বিশ্বের ছবি দেখতাম। আমার স্তব ছিল, ভজন ছিল, ফুলের সাজ ছিল। আমার উৎসব ছিল আবীরে, প্রসাদে, আনন্দে, আবেগে, কীর্তনে, নাচে। আমার প্রাণের সে আনন্দ প্রতিবেশীকে ভাই করে নিয়েছে। আমার প্রাণের সে গভীর শান্তি অন্যের ধর্ম বিশ্বাসের সাথে নিজের ধর্ম বিশ্বাস মিলিয়ে নিয়েছে। আমি তুলেছি জবা, সে তুলেছে গোলাপ, আমি তুলেছি আকন্দ, সে তুলেছে কুন্দ। আমার বাগানে যে ফুল ফোটে, আমার পাশের বাড়ির বাগানে সে ফুল ফোটে না। আবার আমার বাগানে যে ফুল ফোটে না আমার পাশের বাড়িতে সে ফুল ফোটে। আমাদের দুজনের তা মেনে নিতে অসুবিধা হয়নি তো। কারণ আমরা আমাদের ধর্মকে আমাদের প্রাণের গভীরে প্রেমের আসনে পেতে ছিলাম। আমার দারিদ্র্য ছিল, অভাব ছিল। কিন্তু ক্ষোভ ছিল না, অভিযোগ ছিল না। বাইরের অভাব, বাইরের পার্থক্য অন্তরের সাধনায়, ভক্তিতে, আশ্বাসে, ভালোবাসায় পূর্ণ করে তুলেছিল আমায়। সেদিন আমার ঈশ্বর আমার ব্যক্তিগত ছিল। আমার ডাকে সাড়া দিত। আমার কান্না শুনত। আমার বিপদে আপদে আমি আকুল হয়ে তার পায়ের কাছে নিজেকে উজাড় করে দিতাম। আমার সে ভিন্ন বিশ্বাসী প্রতিবেশী আমার বিপদে তার ঈশ্বরের কাছে আমার হয়ে প্রার্থনা করত। যদি বলি দোয়া করত তবে কি আবেগের পরিবর্তন হয় গো? একই থাকে। কান্নার আওয়াজ যার গলায় যেমন হোক, যে ভাষায় হোক, যন্ত্রণা কি আলাদা হয়? আমাদের দুজনেরই তাতে অসুবিধা হয়নি তো কোনোদিন। অসুবিধা হতে শুরু করল যেদিন তোমরা এলে।         আসলে যে মানুষ তার ধর্ম বিশ্বাসে, ঐকান্তিক সাধনায় নিজের অন্তরে পরিপূর্ণতা পায়নি সেই বাইরে অমন অশান্ত, একচোখো, বিদ্বেষকামী হয়ে থাকে। তোমার যাতে রুচি, তোমার যাতে তৃপ্তি তুমি সেখানেই শান্ত হও। আমার তৃপ্তি আমার রুচিতে আমি শান্ত, তৃপ্ত। তোমার এতে অসুবিধা কোথায়?         আসলে তোমাদের মতলব স্বার্থ। আমাদের কোনো মতলব ছিল না। আমাদের জীবনের থেকে একটু শান্তি আর সুখের বেশি কিছু চাহিদা ছিল না। তাই কোথায় কতখানি ফারাক দেখে দেখে বেড়ানো আমাদের কাজ ছিল না। তোমাদের উদ্দেশ্য ক্ষমতা। আমাদের উদ্দেশ্য শান্তি। তোমরা তাই ব্যবহার করতে চাও আমাদের। তোমরা তাই আমাদের দারিদ্র্যের গর্তে গরম তুষ ভরে ভরে দাও। আগুন জ্বালাও। সে আগুনে নিজের অহংকে সেঁকে নিতে চাও। এতেই তোমার ক্ষমতালোভী ক্ষুধার ক্ষণিক আরাম। আমার ঈশ্বর আজ আমার ঘরের কোণা ছেড়ে বারোয়ারি হয়েছে তোমাদের জন্য। আমার প্রার্থনা আজ স্লোগান হয়েছে তোমাদের জন্য। আমার কান্নার পবিত্র জল হারিয়ে গিয়ে তপ্ত লাভা হয়েছে তোমাদের জন্য। আমার মনের কোণের শান্ত, স্থির বিশ্বাস, ভক্তি আজ উন্মাদনা হয়েছে তোমাদের জন্য। আমি কিছুতেই স্থির হতে পারছি না। আমার ঘরের ছেলে আজ তার হৃদয়মন্দিরের সিংহাসন শূন্য রেখে তোমাদের বানানো অপদেবতার ঘোরে পড়েছে। সে শান্তির কথা বলে না। সে কি ভাষায় কথা বলে আমি বুঝি না। আমি শুধু তার চোখের দিকে দেখি। সে চোখে শান্তি নেই, তৃপ্তি নেই। আমি মূর্খ হলেও এটুকু জানি যে, যে চোখে শান্তি নেই সে বুকে ঈশ্বর নেই। কোনো বিশ্বাসের ঈশ্বরই নেই, ক্ষুব্ধ হৃদয়ে থাকে না সে। আমায় ভুল বোঝতে পারবে না। আমি শান্তির সংজ্ঞা না দিতে পারি, ঈশ্বরকে চোখে না দেখে থাকতে পারি, কিন্তু সে অদেখা ঈশ্বরকে আন্তরিক ডাকার যে ফল, অসীম শান্তি, সে আমি জানি। তুমি ভণ্ড। তোমাদের হুঙ্কারে আমার বুক কাঁপে। সাথে আমার বুকের ভিতর যে শান্তিময় মন্দির, সে মন্দিরে যে দেবতা সেও কেঁপে ওঠে।         তোমরা কারা আমি জানি না। আমি স্লোগান বুঝি না, আমি উন্মত্ততা বুঝি না, আমি আমার ঘরের কোণের শান্তি বুঝি। আমি আমার প্রাণের গভীরের সেই হারিয়ে যাওয়া আনন্দ খুঁজি। আমার একলা মুহূর্তে জাগা আমার নীরব শান্ত ঈশ্বরের চোখদুটো খুঁজি। দেখো সংসারে আমার অভাব, অপূর্ণতা, বঞ্চনা সব আছে। সে কার নেই বলো? জীবনে কে সব কিছু পায়? কিন্তু আমার প্রাণের আসন থেকে আমার আনন্দময় বিভুকে কেড়ে নিও না। তোমার চোখের মণিতে মতলবের কাজল, তাই তুমি সব কিছু এত ভেদাভেদের দৃষ্টিতে দেখো। একবার সে মতলব সরিয়ে ফেলো যদি দেখবে সব তার যথাস্থানেই আছে।         মনের মধ্যে কালি থাকে। থাকে বলেই আত্মশুদ্ধির পথে হাঁটে মানুষ। কিন্তু তুমি তো সে কালি নিয়ে বাজারে ব্যবসা ফাঁদছ নিজের মতলব সিদ্ধ করতে। এতে বড় অমঙ্গল। বুঝছ না? এতে যে সার্বিক ক্ষতি, সারা সংসারে আগুন লাগালে যে তোমার ঘরটাও একদিন পুড়ে ছাই হবে। এটা কবে বুঝবে?
391
Sun, 04/01/2018 - 11:31
    (কেউ যেন ব্যক্তিগত ভাবে নিয়েন না, লেখকের কিঞ্চিৎ বায়ুরোগ আছে, মাথায় চড়লে প্রলাপ বকে। এ সেই প্রলাপ)             বাঙালী ভক্তের জাত। বাঙালী হুজুগের ভক্ত। কালী, দূর্গা তো অনেক হল। এরকম পুরুষতান্ত্রিক সমাজে  অমন মেনীমুখো হয়ে থাকলে চলবে না বাপু! বাঙালি অ্যাদ্দিনে বুঝেছে। পুরুষাকার জাগছে। রক্তে অ্যাড্রিনালিনের পরিমাণ বাড়ছে। ওই বোলপুর আর জোড়াসাঁকো করে করে শুকুতে বসেছিল গা! তো কথা হল, নতুন একটা হুজুগ বাঙালি বহুদিন পর পেলো। ফুটবল, ক্রিকেট বড্ড গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। ঘ্যানঘ্যানে, ম্যাড়মেড়ে। ধুর! আমরা পুরুষ না? অমন রাদ্দিন "ম্যা, ম্যা" করে ডাগলে চলবে? আর ক'দ্দিন জাতটা নাবালক থাকবে, অ্যাঁ!           আর তাই এই নতুন খেলা। তা দেখোনি পুরোনো শুকিয়ে যাওয়া নদীতে হঠাৎ করে বান ডাকলে কেমন নোংরা, পাঁক, মড়া, শুকনো গাছের ডাল ইত্যাদি হুড়মুড় করে ভেসে আসে? এও তেমনি। অ্যাদ্দিনের শুকনো শিরা-ধমনী-স্নায়ুতে একটু ঢেউ খেলছে গো। আর কদ্দিন সেই রোবিন্দনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, জীবনানন্দ নিয়ে হেদিয়ে মরবি বাপ! ও সব তো শুঁটকিমাছের থেকেও শুকিয়ে ছিবড়ে হয়ে গেছে। আর যা গুটিকতক ফুলের ঘায়ে মূচ্ছো যাওয়া কবি লেখক আছে তাদের দিয়ে কয়েক কিলোমিটার দৌড় করানো যায় না, জোরে কথা বললে হেঁপিয়ে মরে, বইমেলায় হালখাতা খুলে বসে, তাদের দিয়ে কি হবে বাপ! তারা বরং বর্ষা, বসন্ত, পেরেম-টেরেম নিয়ে থাকুক, আর কিছু সেই বস্তাপচা মেয়েদের দাবীটাবি নিয়ে শখের লড়াই করুক। আমরা নামি আসল লড়াইতে।           আরে ভাই নরম মেরুদণ্ড যেদিকে বাঁকাবি সেদিকেই বেঁকবে। আমরা বলি 'ফ্লেক্সিবিলিটি'। নিন্দুকেরা বলে 'নীতিহীনতা'। তা মোদ্দা কথাটা তো বাপ এক, নরম সরম থাকা, যাতে যেদিকে খুশী ঝুঁকে পড়তে অসুবিধা না হয়। জলের মত রং। যে রঙ ঢালবে, তাতেই মজবে।               আসলে দীর্ঘদিন বাঙালী মাটির স্পর্শ হারিয়েছে। তার শিরায়-উপশিরায়, চলনে বলনে - শুচিতা, কৃত্রিমতা, অনুকরণ, দায়হীন গড্ডালিকা প্রবাহের ঢল চলছে। বাইরে চকচকালে হবে কি, ভিতরে ভিতরে যে শাঁস হারিয়ে বাজারি পুরে কাজ চলছে মেলা দিন ধরে। তার সাথে অতীত গৌরবের জন্য উন্নাসিকতার খেসারৎ তো দিতেই হবে। দিতে হচ্ছেও। মেড়ো, বিহারী, উড়ে - অসংস্কৃত, অমার্জিত ইত্যাদি মনোভাব কি কম দিন পোষণ করেছি? তাচ্ছিল্যই বা কি কম করেছি? মনে করেছিলাম, অতীতের সেই প্রস্রবণে বাকি ভবিষ্যত কালটা অমনই কেটে যাবে। তাই যায়? টিকে থাকার সংগ্রামে নিত্য নিজেকে নতুন করে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয়, এগিয়ে আসতে হয়। আসিনি তো। না পেরেছি অতীতের মান রাখতে, না পেরেছি দ্রুত পরিবর্তনশীল জড়বিশ্বটার সাথে তাল রাখতে। অগত্যা যা ঘটার তাই ঘটছে। সত্যের মূল্যে যা অর্জন করতে হয়, তাকে সস্তা ভাণে পাব মনে করেছিলাম। আজ চড়া সুদে সে ঋণ শোধ করতে হচ্ছে। লজ্জায় মরে যাচ্ছি, কিন্তু কাউকেই দায়ী করতে পারছি না। কেউ কেউ হাস্যকরভাবে "ওরা আমাদের সংস্কৃতি কেড়ে নিল" বলে কান্নার ধুয়ো তুলছি। তাতে পরোক্ষে নিজের গালেই নিজে চুণকালি মাখাচ্ছি।           জানি না কোনদিকে চলেছি। তবে এর আশু কোনো সমাধান আমাদের হাতে আছে বলে মনে হয় না। বাঙালীর প্রাণের গতি এই অপমানে, এই লাঞ্ছনায় আবার জেগে উঠুক। সত্যের মূল্যে নিজের আত্মসম্মান ফিরে পাক - ফাঁকি দিয়ে নয়, সত্যের মূল্যে - এই প্রার্থনা।    
392
Wed, 03/21/2018 - 09:00
    (এ লেখার উদ্দেশ্য 'কথামৃত' এর সমালোচনা নয়, আমাদের যোগ্যতার বিচার।)   কৃষ্ণ কেনে দরশনে দিবেন কলিকালে।  নিজ ভ্রমে মূর্খলোক করে কোলাহলে।।  ~ মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য (চৈতন্যচরিতামৃত - মধ্যলীলা)   ঈশ্বর দর্শনই মানব জীবনের উদ্দেশ্য  ~ শ্রীরামকৃষ্ণ             'কথামৃত' নেই এমন পড়ুয়া, ভক্তিচর্চাকারী বাঙালির ঘর খুঁজে পাওয়া শক্ত। বাঙালি সাহিত্যভিত্তিক ইতিহাস ভালোবাসে, না তথ্যভিত্তিক ইতিহাস ভালোবাসে - ও বড় কঠিন প্রশ্ন। তবে সাধারণ মানব প্রবৃত্তির কথা মাথায় রেখে বলা যায়, প্রথমটিই বেশি জনপ্রিয়। এখানে একটা গোলমাল আছে। রোমা রোলাঁর লেখা রামকৃষ্ণের জীবনী এবং রিচার্ড শিফম্যানের লেখা The Prophet Of New Age --- এরা কট্টর তথ্যভিত্তিক ঐতিহাসিক সাহিত্য না সাহিত্যরস ভিত্তিক জীবনী, এ বলা খুব শক্ত কিছু নয় বই দুটো পড়লে। রামকৃষ্ণ মিশনের মতে এই দুটি প্রায় প্রামাণ্য গ্রন্থ। কিন্তু শ্রদ্ধেয় অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের লেখা 'পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ' ব্রাত্য, তা নাকি শুধুই সাহিত্য। অথচ তাতে কি প্রমাণগত ভুল আছে সে বিষয়ে কোনো আত্মপক্ষ সমর্থনকারী বই মিশন থেকে লেখার প্রয়াস করা হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। অথচ বইটার গালমন্দ আমি শুনেছি আর কিছু পত্রপত্রিকাতে পড়েওছি, অবশ্যই সেগুলো মঠ মিশন কর্তৃক প্রকাশিত।          এক হতে পারে আমাদের অচিন্ত্যবাবুর আন্তর্জাতিক কোনো পরিচয় উল্লেখ্য দুই পাশ্চাত্য পন্ডিতদের মত তো অবশ্যই নেই, তাও তার মধ্যে একজন আবার নোবেলজয়ী। কিন্তু না, তাও তো নয়। 'Kali's Child' বলে একটা বই লেখা হয় বেশ কিছু বছর আগে, তাতে রামকৃষ্ণদেবের যৌনতা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা ফ্রয়েডীয় মতে লেখক নাকি করেছেন। সমকামিতা ইত্যাদি প্রসঙ্গ এসেছে। বইটা অবশ্য আমি পড়িনি তবে সে লেখা নিয়ে লোকসভাতেও প্রচুর হইচই করা হয়েছিল। কারণ আমাদের শুদ্ধ সংস্কৃতিতে অবতার যৌনগন্ধহীন হওয়া একান্ত কাম্য, এবং আমরা এও জানি তাদের জন্ম নরনারীর শারীরিক মিলনেও হয় না। সে হয় দিব্যসত্তার মধ্যস্থতায়। সুতরাং এর উপর যদি কারো সমকামিত্বের কথা বলা হয় তো কেলেঙ্কারি! এমন কি আমাদের গায়ত্রী স্পিভাক দিদিও ক্ষেপে উঠে অনেক কথা বলেছিলেন যে এটা বাংলার একটা বিশেষ সাধন কৌশল যাতে পুরুষ নারীরূপে নিজেকে কল্পনা করে, এবং "প্রকৃতিভাবে পুরুষকে আলিঙ্গন, চুম্বন করতে ইচ্ছা হয়" (কথামৃত, ২৭শে অক্টোবর, শ্যামপুকুর বাটি। শ্রীম যদিও পুরুষ শব্দটা লিখে ব্র্যাকেটে 'ঈশ্বর' কথাটা লিখেছেন, যাতে কোনো ভুল মেসেজ না যায়)। রামকৃষ্ণ মিশন থেকে কিন্তু এর যোগ্য জবাব দেওয়া হয়েছে একজন মহারাজের মারফত, খুব সম্ভবত লেখাটা ত্যাগরূপানন্দ মহারাজের লেখা। কিন্তু আমাদের বাঙালি লেখক মহাশয়ের বইটা আপামর বাঙালিকুল দ্বারা সমাদৃত হলেও প্রাতিষ্ঠানিক ভুল হিসাবেই থেকে গেল এতগুলো বছর।          আমার যে আলোচনায় আসা। বাঙালির কাছে 'কথামৃত' কি? বাঙালি যে মাত্রাতে কথামৃত পড়ে সেই মাত্রাতে বিবেকানন্দ পড়ে না এ বলা বাহুল্য। বিবেকানন্দের কয়েকটা বাঁধাধরা উক্তি ছাড়া বিশেষ কিছু সাধারণ বাঙালি আজকাল তেমনভাবে পড়ে না। অবশ্যই সবার কথা বলছি না। কেন? কারণ সোজা, কথামৃতে রস আছে। বিবেকানন্দের দর্শনের কাঠিন্য আছে। কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া উদ্দীপনাময় জ্বালাময়ী বাণীর কি খেল আজ রাজনৈতিক মহলে আর তার ফল আমরা হাড়েহাড়ে টেরও পাচ্ছি আজ। আর সম্যক জ্ঞান না থাকার মাশুলও দিচ্ছি।          কথামৃত কি তবে? একটা সান্ত্বনা, একটা আশা, একটা ভেন্ট। প্রতিটা ছোট বড় বইমেলায়, বহু নামীদামী প্রকাশনার সাথে বহু অখ্যাত প্রকাশনা যে হারে কথামৃত ছাপায়, আমার প্রশ্ন জাগে, তবে কি বাঙালি সত্যিই দ্বিচারী? কেন বলছি? কথামৃতের কয়েকটা মূল প্রতিপাদ্য বিষয় আছে।   ১) ঈশ্বর দর্শনই মানব জীবনের উদ্দেশ্য           এই কথাটার অর্থ কি আমি আজও বুঝলাম না। আমি এই প্রবন্ধের শুরুতেই একটা দ্বন্দ্ব দেখিয়েছি। মহাপ্রভুর উক্তি আর শ্রীরামকৃষ্ণের উক্তি। দুটো স্ববিরোধী। যদিও এর বহু জটিল ব্যাখ্যা করে এটাকে সেটা প্রমাণ করতে আমাদের শাস্ত্রকারদের জুড়ি পাওয়া ভার। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গী পৃথক।          যদি বলি ঈশ্বরলাভ, তাও অর্থটা খুব জটিল। আমি সাধারণ মানুষদের কথা বলছি। বুঝব কি করে তার ঈশ্বরলাভ হয়েছে? সমাধিতে? ভর হতে দেখেছি অবশ্য অনেককেই। সেটা কি ঈশ্বরলাভ? কিন্তু তাদের চরিত্রের তো এমন কিছু উন্নত বৈশিষ্ট্য দেখি না। যদি বলি অত্যন্ত উদারতা আসে, সেখানেও গোল। আমি এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যাদের সারাদিনে ঈশ্বরের সাধনার নামগন্ধ নেই কিন্তু অত্যন্ত উদার চরিত্রের মানুষ। অন্তত বহু ব্র্যান্ডেড ভক্তদের থেকে তো বটেই। তারা স্বচ্ছ, মুক্ত, সাবলীল চিন্তার অধিকারী শুধু না, নম্রতাতেও অনেক এগিয়ে। তাদের মধ্যে ধর্মীয় প্রতিযোগিতার চিহ্নও দেখি না। আমাকে একজন মহারাজ একবার অরবিন্দ প্রসঙ্গ তোলাতে বলেছিলেন, 'ওরকম অরবিন্দ আমাদের মাঠে ফ্যা ফ্যা করে বহু ঘুরে বেড়াচ্ছে।' আমি তর্কে যাইনি। কি হবে গিয়ে? আমি যে মাপকাঠিতে মাপব সে মাপকাঠিই তো নেই হাতের কাছে।          তবে সমস্যা কি? সমস্যা হল, আমার এই এত বয়সেও একজনও সেরকম মানুষ দেখলুম না, যে কিনা ওই ঈশ্বরলাভের তকমা পেয়েছে। কিন্তু হেদিয়ে মরছে আর 'সারাজীবন সংসার করে মরলুম, আমাদের জীবনের আর কিছু হল না' - এমন সব কথা মেলা শুনলাম। শুনছিও। আচ্ছা সব মানুষের জীবনের এক উদ্দেশ্য হয়?   ২) কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগ           কি বলি? আর বলার কি কোনো প্রয়োজন আছে? সোনার পাথরবাটি বলে একটা কথা আছে যদিও। কিন্তু একটা মানুষ যদি রাতদিন ভাবে তাকে তার যৌন জীবন আর টাকাকড়ি ছেড়ে বাঁচতে অভ্যাস করতে হবে, কিরকম হবে তার মানসিক গঠন? টাকাকড়ি না হয় ছাড়তে পারবে না, মনকে বোঝাবে, আর না হোক ডোনেশন দিতে তো লাগেই। সে বেলায় তো কেউ 'না' করে না। কিন্তু যৌন তৃষ্ণা? সে কি খারাপ?  যদিও, 'স্বদারায় মাঝে মাঝে গমনে দোষ নেই ', 'স্ত্রী আধখানা ছানার মন্ডা, কখনও খেলে ইচ্ছা হলে' ইত্যাদি বিধান কয়েকটা আছে কথামৃতে। কিন্তু প্রধান কথাই হল ত্যাগের কথা। কাম-কাঞ্চন ত্যাগ।         আসলে ভারতে এই ত্যাগের প্রতি একটা প্রবল ঝোঁক আছে। মহাপ্রভুও বলছেন, 'আমি যতক্ষণ না ত্যাগ করব ততক্ষণ লোকে আমার কথা নেবে না। বলবে, এ তো বিষয় ভোগের মধ্যে থেকে লোকশিক্ষা দেওয়া!' অতএব ত্যাগ। আমার মনে হয় মহাত্মা গান্ধীর প্রায় অর্ধসন্ন্যাস সাজের পিছনে এই মনোভাবই বলবতী থাকবে। নইলে ভারতীয় সমাজকে প্রভাবিত করা যায় না। আপামর জনসাধারনের সামনে পথপ্রদর্শক হয়ে দাঁড়ানো যায় না।          রোমিলা থাপারের মতে এই যে 'সিন্ডিকেট হিন্দুইজ্ম' চালু হল গত শতাব্দী থেকে তারাও একটা নতুন ত্যাগীর ট্রেন্ড আবিষ্কার করল। সমাজের যাবতীয় সুখ-সুবিধা, বিজ্ঞানের আধুনিকতম আরাম বিলাস সব থাকবে, কিন্তু গেরুয়া থাকবে আর বীর্যধারণের অঙ্গীকার থাকবে। আর তার সাথে কয়েকটা সামাজিক কাজ করলে তো কেয়া বাত! ভক্তগণ চোখে ঠুলি বেঁধে আপনার দাস হয়ে যাবে। "ওরা কত সামাজিক কাজ করে জানেন?" ভাবটা এমন যেন ওই কয়েকজন গেরুয়াধারী না হলে এই এত এত সামরিক, আধা সামরিক, সরকারি, বেসরকারি, বৈজ্ঞানিক কাজ নগণ্যই এতদিনের সমাজে।         তো নিজেদের যৌন জীবনের থেকে অব্যাহতি না মিলুক, কিছু আত্মঘোষণাকারী নির্যৌনজীবেদের দেখে আমাদের ভক্তেরা ভক্তিপ্রাণ হয়ে বেঁচেবর্তে থাকেন আর নিজের 'অস্বাভাবিক' যৌন জীবনের জন্য আদর্শচ্যুত হতে হতে আত্মগ্লানিতে ভোগেন।  প্রশ্ন, কতটা বীর্য্য ধারণ করলে ঈশ্বরের আসন টলানো যায়?   ৩) নির্জন বাস - ঈশ্বরই বস্তু, বাকি সব অবস্তু           মোদ্দা কথা মনের অর্ধেক ঈশ্বরে দিয়ে, বাকিটা সংসারে দিয়ে কাজ করতে হবে। কিন্তু কথা হল, যে ঈশ্বরের সম্বন্ধেই কোনো ধারণা নেই, যাকে পাওয়াই নাকি জীবনের উদ্দেশ্য তাতে মন রাখব কি করে? আগে পেয়ে পরে মন রাখতে হবে তো? কারণ না পেলে মন কি হাওয়ায় রাখব? এখানে আসে সাধন ভজনের কথা। নাম সংকীর্তন, জপধ্যান, প্রার্থনা - সবই সেই না পাওয়া, না দেখা, না ছোঁয়া, না অনুভব করা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে। এখানে বলা হচ্ছে এইভাবেই ধীরে ধীরে হবে। আর মনে রেখো সংসারে কেউ তোমার নয়, তুমি কারোর নয়। মুখে বলবে "ভালোবাসি" কিন্তু মনে জানবে কেউ তোমার নয়। হল? সাধন শুরু তবে?         সে হোক। ক্ষতি নাই। দেশে আরো কয়েকটা মহাপুরুষ মিলবে না হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, ওই সংসারটাকে এক্কেবারে অবস্তু বলে বসলে চলে কি? বলি পোলাপান নিয়ে সংসার। এই কথায় মনের জোর মিলবে কি করে? আর বাকি সব যদি অবস্তুই হল তবে নীতিবান, সৎ হওয়ারও তো কোনো প্রেরণা দেখি না। তাই কি আমরা 'অতিভক্তি চোরের লক্ষণ' ইত্যাদি কথা শিখেছি? যেমন কেউ টাকা ধার নিয়ে যদি বলে, সবই অবস্তু দাদা কেন মাথা ঘামান, কিম্বা কয়েক মুঠি মাটির জন্যে এত ভাবনা কিসের? তখন?           প্রবন্ধ আর দীর্ঘ করতে চাই না। কিন্তু এরকম আরো নানা 'পরকাল' কেন্দ্রিক কথা পাতায় পাতায় আছে। যদিও স্বামীজীর চিন্তা পুরো বিপরীত। সে আগে অন্য লেখায় বলেছি। কথা হচ্ছে হঠাৎ এ লেখার উদ্দেশ্য কি?          আমার এক ভাই, বয়েস সাতাশের গোড়ায়, চোখ দেখাতে চুঁচুড়ার একটি বিখ্যাত অত্যন্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিবেষ্টিত চোখের হাসপাতালে যায়। স্বনামধন্য চিকিৎসক বলেন, আমার মনে হচ্ছে তোমার চোখে গ্লকোমা আছে, তুমি পরীক্ষা করে এসো। তারই হাসপাতালে পরীক্ষা হয়। গ্লকোমা নির্ধারিত হয়। চিকিৎসা শুরু হয়। সদ্য মাতৃহারা ভাইটি সংসারে দৃষ্টিহারা হওয়ার জন্য দিন গুনতে থাকে। বছর যায়। ক্রমে ভয়টা তার মজ্জায় পৌঁছাতে থাকে। আমরা জোর করে ঠেলে ওকে শঙ্কর নেত্রালয়ে পাঠাই। তারা বলে সে পুরোপুরি সুস্থ, কোনোদিনই অমনধারা রোগ তার চোখে হয়ই নি। আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াতে লাগল, তবে এই যে ছেলেটার এক বছরের মানসিক যন্ত্রণার দায় কে নেবে? মামলা মোকদ্দমা করার না তার সময় আছে না সামর্থ্য। অনেক কাজ তার সামনে।          তবে উপায় কি? আমাদের বাইরে ভিতরে এত অসাম্য, এত মুখোশ কেন? উক্ত ডাক্তারের চেম্বারে রামকৃষ্ণের ছবি মনে পড়ল। সাথে সাথে এরকম আরো কিছু মানুষের মুখ মনে পড়ল যারা ভুল চিকিৎসায় নয়, একটা অবাস্তব আদর্শের যাঁতাকলে পিষে মরছে দিনরাত। একটা দুর্গম, সুউচ্চ পাহাড়ের চুড়োয় হেঁটে ওঠার প্রয়াস পাচ্ছে। পারছে না। তবু তাকে কেউ বলছে না তুমি একটা স্বাভাবিক সাধারণ জীবনযাত্রাতেই সার্থক। কোনো অধরা, অদৃশ্য ঈশ্বরকে, কিম্বা গত কোনো মহাপুরুষের ছবিকে আদর্শ করে চলতে হবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াও। নিজে বিচারশীল হও। জীবনের উদ্দেশ্য ভোগ-ত্যাগ কিছুই নয়। সৎ জীবন, একটা সহানুভূতিশীল মন আর সুস্থ পরিবেশ গড়ার মত বৈজ্ঞানিক উপায় - আর কি দরকার? নাস্তিক মানে কি অহংকারী? সব ঈশ্বরপ্রাণ মানুষেরা যদি মানুষ হত ভক্ত না হলেও তবে পৃথিবীতে বহু রক্ত রাস্তায় গড়াত না।         কিন্তু এই কথাগুলো তো নতুন না? তবে আমরা কি সত্যিই দ্বিরাচারী? অসুস্থ হয়ে মারা গেলে বলি 'শালার ডাক্তার', তাকে মারধোর করি, গু-মুত খাওয়াই, আবার বেঁচে গেলে বলি ঈশ্বরের দয়ায় বেঁচে গেল! আরে ভাই ভুল লোক কোন পেশায় নেই, কিন্তু সে পেশার কৃতিত্ব পাবে ঈশ্বর আর ব্যর্থতার দায় নেবে মানুষ ডাক্তার --- এ কেমন কথা? নাকি যেহেতু 'কথামৃত' তে আছে ডাক্তার আর উকিলের পয়সা ঠাকুর নেন না, তারা মানুষের কষ্টের উপর টাকা রোজগার করে বলে? তাই কি বিদ্বেষের সমর্থন?         তবে কি সত্যিই আমরা দ্বিরাচারী? তাই এত কপি কথামৃত বিক্রি? তাই এত ছবি দোকানে, বাড়িতে, ট্রেনে, বাসে? অথচ বাস্তবে আমরা যেই তিমিরে কি সেই তিমিরে? আমরা কি তবে একটা পালাবার, মুখ আড়াল করার ভেন্ট খুঁজি অবশেষে? আর যেখানের জল সেখানেই আবদ্ধ হয়ে পোকায় ধরে? কেন সরাবো, জগৎটা মিথ্যা যে!    
393
Fri, 03/16/2018 - 14:00
            মানুষ বাঁচে তিনটে রহস্যময়তায় --- অসীম আকাশ, অনন্ত সময় আর তার রহস্যময় অন্তঃকরণে। এই তিনটেকেই সে অল্পবিস্তর জানে।           যা জানে না তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। তার মধ্যে রাতদিন একটা অমীমাংসীত রহস্যের টানাপোড়েন। অথচ এই টানাপোড়েনের আয়ু অনন্ত নয়। তার চারপাশে অহর্নিশি যবনিকা পতনের আওয়াজ --- মৃত্যু। মৃত্যু মানে কি সময়? মৃত্যু মানে কি পরিবর্তন? মৃত্যু মানে কি শূন্যতা? বাইরের দিকে তাকিয়ে সে বলে, হয়তো তাই, শূন্যতা। নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে মনে হয় সত্যিই কি শূন্যতা?          তার সারাজীবন এই তিনটে অনাদি স্রোতের তীরেই কাটে। এর বিপরীতে তার ক্ষিধে, তেষ্টা, ভয়, লোভ, যৌনতা --- সে-ও আছে। তারা প্রশ্ন করে না। তারা আদিম দাবী নিয়ে ফেরে। মিটলেই শান্তি। নইলে উৎপীড়ন। পৃথিবীর ইতিহাসে সক্রেটিস, বুদ্ধ, রামানুজ... গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, নিউটন, আইনস্টাইন, হকিন্স –এর পাশাপাশি হিটলার, মুসোলিনী, স্তালিন, চেঙিজ খাঁ --- এরাও আছে। একদল প্রশ্ন করে, উত্তর খোঁজে; আরেকদল নিজের প্রবৃত্তির নৈতিক অনৈতিক যাবতীয় তৃপ্তিসাধনে মত্ত।          দিনের শেষে দু’জনেই অতৃপ্ত। না তো মেলে সব প্রশ্নের উত্তর; না তো হয় সব লোভের, সব বাসনার উপশম। মাঝামাঝি যারা তারা সমাজ বানিয়েছে, হাজার নীতি বানিয়েছে, প্রথা বানিয়েছে; তাতে নিজেকে শৃঙ্খলায়িত করে জীবনের একটা অর্থ দাঁড় করিয়েছে, সে অর্থ তার দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। সে তারার গতি নিয়ে ভাবে না, সে সময়ের সংজ্ঞা খোঁজে না। নিজেকে পারিবারিক তথা সামাজিক দায় দায়িত্বের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিন্তা করে না। তারা সুখী। কারণ, প্রশ্ন আর প্রবল প্রবৃত্তি - দুটোই তাদের মধ্যে তেমন প্রবল না। তাই তাদের উপশমেরও কোন ব্যস্ততা তাদের নেই। তার জীবন মানে - আত্মরক্ষা, পরিবার রক্ষা, কিছু সমাজস্বীকৃত বাসনা পূরণ আর বাকিটা দায়িত্ব কর্তব্যের ঘরে টিক মার্ক দিতে দিতে চলা প্রাণপণ চেষ্টায়, কোনটায় যাতে ক্রশ না পড়ে। যদি পড়ে তবে সামাজিক মানসন্মানের অধঃপতন। যদি বা কখনও কোন প্রশ্ন মাথা তোলে তার জন্য রেডিমেড প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-দর্শন-গুরু-আশ্রম-পূজো-যজ্ঞ রইলই। চিন্তা করার ক্ষমতা একটা জীবাণুর মত, যখন সারা মাথা ছড়িয়ে পড়ে, যাকে ‘মেটাস্টেসিস’ বলা যায়, তখন তার থেকে পাগল অথবা প্রতিভাসম্পন্ন স্বীকৃতি না পেয়ে বেরিয়ে আসার জো নেই। যদি সে প্রশ্নের সামাজিক স্বীকৃতি মেলে তবে তুমি প্রতিভাসম্পন্ন; যদি না মেলে তবে পাগল। ইতিহাসে বহু পাগলের শতাব্দীশেষে প্রতিভাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি পাওয়ার উদাহরণ ভুরি ভুরি। আবার বহু পাগলের ব্যর্থ জীবনের উপর কালের পলিস্তর।         প্রশ্ন একটা জীবাণু। একটা সংক্রমণ। পৃথিবীর ইতিহাস বলতে কিছু প্রশ্নের আর কিছু প্রবৃত্তির আলোড়ন আর উৎপীড়নেরই ইতিহাস। বাকিটা তো গয়ংগচ্ছ। লোভীদের ইতিহাস, মানে যাকে প্রবৃত্তি বললুম, তাদের কীর্তিকলাপ সারা পৃথিবী জুড়ে মোটামুটি একই রকম। চুড়ান্ত ধ্বংসলীলা, আত্মস্থাপন - “স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে”, এই মোটামুটি। কিন্তু প্রশ্নের ইতিহাস বৈচিত্র্যময়। সক্রেটিস যখন প্রশ্ন করছেন ‘আমি কে?’; নিউটন যখন প্রশ্ন করছেন, ‘আপেল কেন মাটিতে পড়ল?’ --- সে একরূপ। আবার কখোনো কখোনো প্রশ্ন একটা সুনির্দিষ্ট রূপ না নিয়ে একটা বাধা হয়ে বারবার চিন্তার সামনে এসে দাঁড়াতে থাকে। সে বাধাটাকে ঠেলতে ঠেলতে আপেক্ষিকতাবাদ, ব্ল্যাক হোল থিওরী ইত্যাদির মতন তত্ত্বরা সামনে এসে দাঁড়ায়। তবু রহস্য ঘোচে না। যদি কেউ বলে, রহস্য বলে সংসারে কিছু নেই, তবে তার বোধের ক্ষমতার উপর সন্দেহ জাগে। রহস্যকে রহস্য বলে জানা, জ্ঞানপিপাসু’র অনুভব; রহস্যকে দুর্ভেদ্য অনড় প্রাচীর বলে জানা আত্মসুখীর আত্মপ্রবঞ্চক দর্শন। প্রশ্নের প্রতি দায়বদ্ধতা, সুখের প্রতি দায়বদ্ধতা আর লোভের কাছে বশ্যতা --- তিনটে শ্রেণী পুরাকাল থেকে চলে আসছে। মানুষ, দেবতা, অসুর। সংসারে যা কিছু প্রশ্নের উৎস ছিল মানুষ, দেবতা নয়। জগৎ সংসারকে দু’হাতে চিরে তার রহস্য ভেদ করতে চেয়েছে মানুষ। দু’হাতে নিংড়ে ভোগ করতে চেয়েছে পশু। আর আরামের খোঁজ করেছে দেবতা। ঈশ্বর থেকেছেন চিরকাল রহস্যাবৃত, অসীমের দ্যোতনা হয়ে।          প্রশ্ন তবে জীবাণু। প্রশ্নকর্তা তবে সংক্রামিত। সংক্রমণ যত গভীর তার উন্মত্ততা তত তীব্র। প্রশ্নের সাথে সুখের সহাবস্থান হয় না। প্রশ্নের কোন আয়ুস্কাল হয় না। প্রশ্নরা রক্তবীজের মতন। একটা পড়ে অসংখ্যকে জন্ম দেয়। একের সংক্রমণ আরেকে ছড়ায়। প্রশ্নরা ঘুমায় না। ঘুমাতে দেয় না। প্রশ্নকর্তা ঘুমিয়ে পড়লে প্রশ্নেরা অপেক্ষা করে মাথার কাছে। প্রশ্নরা সুখী নয়। প্রশ্নরা সুখী হতে দেয় না। কারণ, প্রশ্নই সুখ, প্রশ্নই আনন্দ, কিন্তু কার কাছে?          রাস্তা তো অনেক রকম। একদিকে খাদ, আরেকদিকে পাহাড়ের ঢাল; একদিকে সবুজ মাঠ, আরেকদিকে নদী; দু’ধারে জঙ্গল, দু’ধারে মরুভূমি, কিম্বা সরু আল, দু’দিকে চাষের ক্ষেত --- রাস্তা কখোনো কখোনো সাঁকোর সামনে দাঁড় করায়; আবার কখোনো কখোনো সাঁকো বানিয়েও নিতে হয়, কারণ, চলাটা অব্যহত রাখতে হয়। এই সমস্ত পথের অভিমুখ আপাত দৃষ্টিতে বিকেন্দ্রিত মনে হলেও, চলতে চলতে এক পথের সাথে আরেক পথের দেখা হয়। পথে পথে জাল বোনা হয়। সমস্ত জাল জুড়ে একটা বৃত্ত রচনা হয়। সেই বৃত্তের উপলব্ধিতে পথিকের চলার অবসান হয়। পথের প্রান্তে কোন গন্তব্যে পৌঁছে নয়, পথকেই উপলব্ধি করে। বলা হয়, একটা সরলরেখাকে ক্রমাগত টানলে তা না কি একটা বৃত্ত হয়। কেউ তো টেনে দেখে নি, উপলব্ধি করেছিল। সমস্ত উপলব্ধি মানে বৃত্ত সম্পূর্ণ করা। বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া মানে সব শেষ হওয়া না, কেন্দ্রে বসবাস করা। কেন্দ্র একটা স্থিতাবস্থা নয়, কেন্দ্রটা সাম্যাবস্থা। যুগে যুগে কেন্দ্র প্রতিস্থাপিত হয়, সবকিছু নতুনভাবে শুরু হয়। পুরোনোগুলো অপেক্ষা করে আবার তারা নতুন হবে বলে। কারণ, যুগের গতিপথও একটা আবর্তন। নাগরদোলা যেখান থেকে উঠিয়েছিল যেমন সেখানেই নামিয়ে দেয়; ওঠা আর নামার মধ্যে পার্থক্য থাকে একটা বৃত্তের অভিজ্ঞতার – এও তেমন।         কথা হচ্ছিল প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্নরা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হতে হতে একটা বৃত্ত তৈরী করে। সে বৃত্তেরও একটা কেন্দ্র থাকে। সে প্রশ্নও নয়, সে উত্তরও নয়। সে কেন্দ্রে পৌছানোর অধিকার একমাত্র দর্শনের। প্রশ্নের পিছনে শুধু কৌতুহল থাকলে তা স্বার্থ, প্রশ্নের পিছনে বিস্ময় থাকলে তা দর্শন। বিস্ময়ের উত্তর যদি বিস্ময়কেই স্তিমিত করে তবে তা উত্তর নয়, তা মতামত। বিস্ময়ের উত্তর যদি আরোও গভীর বিস্ময়ে এনে দাঁড় করায় তবে তা দর্শন। যার শেষ কথা, কিম্বা শুরুর কথা, ‘আমি জানি, আমি কিছুই জানি না।’ শেষের কথা শুরুর কথা হয় কি করে? ঐ যে বললাম, বৃত্ত। দু’জনে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে, একজন পুবের দিকে তাকিয়ে, আর একজন পশ্চিমে। পুবের পথিক রিক্তহাতে যাত্রা শুরু করে, যাত্রাপথে হাতে ভরে ওঠে নানা সম্পদ, অর্ঘ্য। যাত্রাশেষে পশ্চিমে আসে আবার রিক্ত হয়ে। রিক্ত না হলে পশ্চিমমুখী দুয়ারে আসা যায় না। পশ্চিমমুখী দুয়ারে প্রবেশ করে দেখে, তার পাশেই পুবমুখী দুয়ার। বৃত্ত সম্পুর্ণ হয়। একটা সক্রেটিসের জন্ম হয় - 'আমি জানি আমি কিছুই জানি না'।    
394
Wed, 03/14/2018 - 21:30
  দুই সত্তা   -------------         মানুষের দুটো রূপ আছে। তার ভালোর দিক, আর তার খারাপের দিক। দুটোই অস্তিত্ববান তার চেতনায়। মানুষ যত তার ভিতরের রূপটা চিনতে শিখল তত সে বিচ্ছিন্নভাবে, বিশ্লিষ্ট করে নিজের নানা গুণ আর অবগুণগুলোকে অনুধাবন করতে পারল। তারা পৃথক পৃথকভাবে স্বনির্ভরশীল অস্তিত্ত্বে যেন তার মধ্যে সদা বিবাদমান। তার বাইরের ভয় কমল। বাইরেটাকে সে একটা নিয়মের মধ্যে দেখতে শিখল, আর নিজের ভিতরকে সে রহস্যাবৃত দেখল। সে রহস্য যেন জটিল থেকে জটিলতর হতে শুরু করল। তার মধ্যে একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ভালোর দিকে। কাকে সে ভালো বলল? যে গুণ বা বৃত্তিগুলো তাকে স্থিতি, বৃদ্ধি, নানা মানুষের সাথে সহাবস্থান করতে শেখালো। সে বুঝল, তার পক্ষে একা একা বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। তাকে সমাজ গঠন করতে হবে। যে সমাজের মূল নীতিই হল সহাবস্থান আর পারস্পরিক সহায়তা। এই শক্তিতেই সে সমাজ গড়তে চাইল। এই বৃত্তির অনুকূল যা, তাকেই সে ভালো বলে গ্রহণ করল, আর যা কিছু প্রতিকূল তাকে সে প্রত্যাখ্যান করতে চাইল। যদিও পারল না। কেন সে কথায় পরে আসছি।     দুই সত্তার ভিত্তি ----------------------         সহমর্মিতা, ভালোবাসা, সত্যপরায়ণতা, সংযম, জ্ঞান, নির্ভীকতা, ন্যায়পরায়ণতা – মোটামুটি এইগুলোকে সে ভালোর পর্যায়ে ফেলল। কারণ এগুলো সামাজিক সহাবস্থানে সহযোগী। এর বিপরীতগুলো কিন্তু সহযোগী নয়। যেমন হিংসা, মিথ্যাচার, চুরি, উচ্ছৃঙ্ক্ষলতা, অজ্ঞতা, দুর্বলতা, শঠতা – ইত্যাদি মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহাবস্থানের বৃত্তির বিপরীত, তাই সেগুলোকে সে বলল খারাপ। এরকম একটা বিশ্বাস নিয়ে মোটামুাটি তার সভ্যতার যাত্রা শুরু হল। কিন্তু সে বুঝল না তার ভিতর এই ভালো আর মন্দ বৃত্তিগুলোর প্রেরক কে? সে অপরাধীর শাস্তি আর ভালোর অভ্যর্থনার ব্যবস্থা তো করল, কিন্তু এই দুই প্রবৃত্তির উৎসটা তার কাছে একটা ধোঁয়াশাই রয়ে গেল। একদিন সে প্রকৃতির নানা ঘটনাকে দেবতার নানা খেলা রূপে দেখেছে। সূর্য, চাঁদ, তারা, মাটি, জল, বাতাস, আলো, ঝড়, ভূমিকম্প, দাবানল, স্বাস্থ্য, রোগ ইত্যাদি সব কিছুর আলাদা আলাদা ব্যক্তিরূপ বিশ্বাস করেছে। পূজো করেছে। কেন সে ব্যক্তিরূপ বিশ্বাস করেছে? কারণ সে নিজেকে ব্যক্তিরূপে অনুভব করেছে। মানুষ নিজেকে একটা পৃথক সত্তারূপে অনুভব করে। শরীর আর মন দিয়ে গড়া একটা সত্তা, সব কিছুর মধ্যে থেকেও সব কিছু থেকে আলাদা। কারণ সে যা কিছু চিনছে সব নিজের ব্যক্তিত্ত্বের মধ্যেই চিনছে। সে যেন স্বতন্ত্র। এই বোধটাই সে যা কিছু তার অনুকূল কিম্বা যা কিছু তার প্রতিকূল সবার উপর আরোপ করেছে। সবার আলাদা আলাদা দেব-দেবী হয়েছে। বাইরের প্রকৃতির সাথে তার ভিতরের প্রকৃতিরও। যেমন বুদ্ধি, স্বাস্থ্য, রূপ, ঐশ্বর্য ইত্যাদি।     পাপ পূণ্য --------------         কিন্তু এরপর যখন সে ভালো-মন্দের মধ্যখানে এসে দাঁড়ালো, বাইরের আর ভিতরের প্রকৃতির খেলাটাকে একটা নিয়মে চিনল তখন তার দেব-দেবীর আধিপত্য আর আগের মত আর অনুভব করল না। কিন্তু তার অস্তিত্বের কেন্দ্রে এই সৎ আর অসৎ প্রবৃত্তির উৎসটাকে সে কিছুতেই চিনে উঠতে পারল না। কিন্তু সেটাকে স্থির করতে না পারলে সমাজকে সুষ্ঠ শৃঙ্ক্ষলায় পরিচালনা করা মুশকিল। সে নিজের গভীরে গিয়ে একটা বিশ্বাসের সন্ধান পেল। সে বুঝল তার সব কিছু সৎ গুণাবলী একত্রিত হয়ে যে মানুষী রূপটা দাঁড়ায় সে হল ভগবান; আর সব অসৎ প্রবৃত্তি একত্রিত হয়ে যে মানুষী রূপটা দাঁড়ায় সে হল শয়তান। এই বিশ্বাসের শক্তিতে সে ভালো আর মন্দের ভিত তৈরি করে সমাজটাকে দাঁড় করাতে চাইল। আর বিশ্বাস যখন আসবে তখন ভালো-মন্দের একটা বিশ্বাসগত নামকরণও লাগবে – পাপ আর পুণ্য। যা কিছু খারাপ, স্থিতি-সহাবস্থানের বিপরীত তাই পাপ; যা কিছু স্থিতি আর সহাবস্থানের অনুকূল তাই পুণ্য। তার একদিকের প্রণেতা ভগবান আর আরেকদিকের প্রণেতা শয়তান। ভারতের দর্শনে এই দুইয়ের উৎসকে আবার একই দেখানোর চেষ্টা আছে। কারণ আরো গভীরে সে বুঝেছে যে দুই-এর উৎসই তার মন, তার অন্তঃকরণ। কিন্তু কোথায় গিয়ে তারা এক তার হদিশ তারা বুঝতে পারেনি।     সাম্যতা -----------         সবের মূল একটা কথা ধ্রুব যে মানুষের আদিম প্রবৃত্তির একটা কেন্দ্র হচ্ছে তার সামাজিক হয়ে ওঠার তাগিদ। তাহলে যে কথাটা ছেড়ে এসেছিলাম, তবে মন্দের উৎস কোথায়? মন্দ বলতে তাই ধরে নেওয়া হচ্ছে যা কিছু এই সামাজিক সহাবস্থানগত স্থিতির পক্ষে হানিকর। তার একটা প্রধান কারণ আমাদের মধ্যে পশুত্ব। 'পশুত্ব' বলতে যা কিছু শুধুমাত্র আমাদের সহজাত প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তার কথা বলতে চাইছি। যার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। আমাদের সত্তার মধ্যে আমাদের সমষ্টিগত আর ব্যক্তিগত অবস্থান পাশাপাশি। একটা আরেকটাকে ছেড়ে দাঁড়াতে পারে না। তাই কোনোভাবেই সোশ্যালিস্ট (রাজনৈতিক অর্থে না) বা ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট পৃথকভাবে একছত্র অধিপতি মানবসত্তার ক্ষেত্রে হতে পারবে না। কোনো একটা বাড়লেই মানুষ তার ভারসাম্যতা হারাবে। ইতিহাসে জোর করে একত্রীকরণ আর সমমাত্রীকরণের কি পরিণাম আমাদের ভালোভাবেই জানা। এই দুইয়ের কোনো একটাকে প্রধান করতে গেলেই শয়তানের আবির্ভাব ইতিহাসে হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। এই দুই-এর ভারসাম্যতেই মানুষের প্রকৃতির সাম্যতা। আমার শরীর, অথবা আমার বাড়ির পাঁচিল, অথবা আমার দেশের সীমারেখাই আমার ব্যক্তিগত আর সমাজগতরূপের ব্যবধায়ক নয়। আমার মধ্যে আমিই ব্যক্তি আবার আমিই আমার মধ্যে সমাজ। আমার মধ্যে আমি নিজেকে সমাজরূপে, মানবতারূপে দেখেছি বলেই যে না বাইরে তার রূপটাকে গড়তে পেরেছি?     আপোষ ------------         তবে যে দুই মেরুর কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, ভগবান আর শয়তান – এই দুইয়ের অধীশ্বরও তো আমি-ই। ভারতের দর্শনের একটা শাখা সেই অবধিও পৌঁছিয়েছিল তো বটেই। সে দর্শনকে সে "অদ্বৈতবাদ" বলেছে। সে নিজের সাথে তার সৃষ্ট সব কিছু'র একাত্মতা তৈরি করতে করতে নিজেকেই ঈশ্বর বলে অনুভব করেছে। অর্থাৎ যা কিছু ভালো তার সব কিছুর উৎস সে নিজে, আবার যা কিছু অমঙ্গল তার সব কিছুর মূলও সে নিজে। এমন একটা সত্যে সে উপনীত হয়েছে, যদিও সামাজিকভাবে সে তত্ত্ব ভয়ে হোক আর যে কোনো কারণেই হোক জনপ্রিয়তা পায়নি। হতে পারে মানুষ অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে যে, মানুষ ভয়ে যতটা সংযত, স্বাধীনতায় ততটা নয়। তাই মানুষ অতটা স্বাধীনতাকে ভয় পেয়েছে। সে দায় অধিকাংশ মানুষ নিতে না পেরে ব্যভিচারী হয়ে উঠবে এমন একটা আশঙ্কা হয়ত করেছে। আর সে আশঙ্কাও অমূলক নয় সে আজকের দিনেও স্পষ্ট। আজও আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখেছি, ফাইন না বসালে, আইন-জেল, পুলিশের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে সৎ থাকা মুষ্টিমেয় কয়েকজন ক্ষণজন্মা ছাড়া বোধহয় হয় না। মানুষের দৈব শাস্তির ভয় যত কমছে তার অপরাধপ্রবণতা কি ততটা বাড়ছে? জানি না। সমাজবিদরা বলতে পারবেন।     তোর ভিতর জাগিছে কে রে --------------------------------------         পৃথিবীতে সবক'টা প্রধান ধর্মে ঈশ্বরের আবাসস্থল হিসাবে তার অন্তঃকরণকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও তার অনেক শাখা-প্রাশাখা সে মূল সত্যটাকে চাপা দিয়ে আগাছার মত অন্ধকার করেছে মানুষের চেতনা অনেক বেশি যুগযুগ ধরে। তবে এই কথাটা আমার বেশ লাগে, যা কিছু ভালোর চূড়ান্তরূপ আমার ঈশ্বরের আবাসস্থল আমার হৃদয়ে। এটা পুরোনো মানুষের উপলব্ধ সত্য। আজ সে সত্যকে চাপা দিয়ে একটা প্রশ্ন, তবে প্রবলতম নিষ্ঠুর মানুষটার হৃদয়ে তিনি কি নিদ্রাগত? তবে অমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ঈশ্বরের সাথে আমাদের কিসের সম্পর্ক?          মনে রাখতে হবে যখন এইসব ধর্মগুলোর উৎপত্তি তখন মনোবিজ্ঞান বলে কিছু ছিল না। আজ আছে। তাও আমরা সাইকোপ্যাথ ইত্যাদি নাম দিয়ে, সংজ্ঞা দিয়ে তাকে ক্যাটাগোরাইজ করতে সক্ষম হলেও তার উৎসটা বুঝে উঠতে পারিনি। ঠাণ্ডা মাথায় একজন কি করে একটার পর একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে তার মানসিকতার ব্যাখ্যাও আমাদের কাছে অজানা আর তার চিকিৎসা পদ্ধতিও। আমরা তাই এখনও ঈশ্বর আর শয়তানের সংজ্ঞা থেকে সম্পূর্ণ নিজেকে মুক্ত করে উঠতে পারছি না। যুক্তি আমাদের ভালো আর মন্দের উৎসকে চেনাতে পারছে না যে।         এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের কত কত নিগূঢ় রহস্য আমরা ভেদ করে ফেলেছি, অণু-পরমাণু, নক্ষত্রদের গতিপথ আকার আয়তন --- সব জেনে ফেলছি এক এক করে। প্রাণের কেন্দ্রে গিয়ে তার জিনগত গঠন, পরিবর্তনের ইতিহাস সব জেনে ফেলছি। শুধু জানতে পারছি না কোন মানুষটা কখন কোন মুহূর্তে আমায় ঠকাবে, কে কোনদিন কখন ধীর মস্তিষ্কে গিয়ে একটা বোমা বাজারের মধ্যে রেখে আসবে, এক লহমায় সহস্র প্রাণ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। যদি বলি মানুষ দুর্ভাগ্যে ভয় পায়, রোগে শোকে ভয় পায়, তবে স্বল্প সত্য বলা হয়। মানুষ সব চাইতে বেশি ভয় পায় নিজেকে আর তার চারপাশের মানুষের দুর্জ্ঞেয়তাকে। তাদের আর তার নিজের মধ্যের অগম্য রহস্যের অন্ধকারকে। তাই যখন কোনো আলোকিত মানুষ তাকে তার মধ্যের শুভের সন্ধান দিতে চেয়েছে, সে তার সর্বস্ব ত্যাগ করে সে দুর্গম পথে, ত্যাগের পথে হেঁটেছে। রোগ, শোক, মৃত্যু, শারীরিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা সব জলাঞ্জলি দিয়েছে। কারণ সে শুভের সন্ধান পেয়েছে। শান্তি পেয়েছে। শান্তি অমঙ্গলে পাওয়া যায় না। শান্তি মেলে মঙ্গলে। আর মঙ্গল কখনও এক'কে নিয়ে নয়, সে সবাই'কে নিয়ে। আবার কালচক্রে সেই মঙ্গলঘটেই বিষ ভরা হয়েছে, কিন্তু সে তো অন্য কথা।     বিপ্লব ---------         তাই মানুষের ইতিহাসে বারবার ঈশ্বরের রূপের প্রতিস্থাপন হয়েছে। একজন আলোকিত পুরুষ তার পূর্বের বিষাক্ত ঘটকে ফেলে নতুন মঙ্গলের পথের দিশা দিয়েছেন। প্রাচীন চীৎকার করেছে, 'তুমি নাস্তিক' বলে। নতুন তাকে অনুসরণ করেছে। নতুন ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে। মূল কিন্তু ওই একটাই কথা, শুভের উৎস কি? অশুভের উৎসই বা কি? কিভাবে অশুভের বিনাশে শুভ আসবে? কিভাবে একটা মানুষের অন্তর্জগতে পরিবর্তন আসবে? সে তো বাইরের অঙ্ক কষে, জিনের দৈর্ঘ্য জেনে, তারা'র গতিবেগ জেনে নয়? তবে? কিসের মাধ্যমে মানুষের চিত্তের শুদ্ধি হবে?         জগৎ স্রষ্টা ঈশ্বর – বেঁচে নেই আজ। ঈশ্বরের নানা নামের আতঙ্ক চারদিকে ধুলো উড়িয়ে বেড়াচ্ছে। শুধু কোনো এক পাগল হয়ত একলা মরুভূমিতে, সমুদ্রের ধারে, গভীর জঙ্গলে, পাহাড়ের নির্জনে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমাদের সব শুভের উৎস কোথায়? সব অশুভের উৎসই বা কি? এত ছদ্মবেশ কেন? কোনো পরীক্ষাগারে সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। কোনো ধর্মগ্রন্থে না। পাওয়া যাবে নিজের চিত্তকে মন্থন করলে হয়ত। আর সেই নিজের চিত্তকে মন্থন করার আবেগই ঈশ্বর। সে অনন্তের দিকে তাকিয়ে মানুষের চিত্তের ব্যকুল কান্না। সে তো ব্যক্তি না। সে ইন্ট্রোস্পেকশান না। সে তো স্বার্থপ্রণোদিত। এ আরো গভীর। এই নিজেকে ডুবিয়ে, নিজেকে হারিয়ে খোঁজা। উপায় কি আছে?         “আঁধার রাতে একলা পাগল... যায় কেঁদে... বলে শুধু... বুঝিয়ে দে... বুঝিয়ে দে... বুঝিয়ে দে...”
395
Mon, 03/12/2018 - 14:00
    অসীমের কি সহানুভূতি আছে? অসীম একটা অস্তিত্ব, নাকি মানবিক চেতনার একটা আভাস। রামকৃষ্ণ বলছেন, “মানুষ কি কম গা? মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে।“ অনন্ত মানে কি মহাকাশ? অসীম কি মানবিক চেতনার অবসর? রবীন্দ্রনাথ নিজের ছোটোবেলায় গায়ত্রী মন্ত্রের অনুভূতি বলতে গিয়ে বলেছেন, সে মন্ত্র তাকে অসীমের মধ্যে বিচরণের জন্য যেন অবসর দিত। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্রতা, সীমা ছাড়িয়ে তিনি অসীমের মধ্যে নিজের চিত্তকে উন্মুক্ত করতেন, তার চোখের কোল জলে ভরে উঠত।         এর অর্থ কি তবে? তবে কি সত্যিই অসীম অনুকম্পাশীল? পৃথিবীর ইতিহাস দেখলে তো তা মনে হয় না। সেখানে এত হানাহানি, এত রক্তপাত, এত নিদারুণ অসহায়তা, বর্বরতা, নিষ্ঠুরতা – এসব কি অনুকম্পার নিদর্শন? তা তো নয়। তবে? তবে কি শূন্যতার পাশে হতাশা – এই আমাদের ভবিতব্য?         মরমী সাধকের জীবন বলে, না, তুমি অসীমের অনুকম্পায় আস্থা রাখো। আমি জানি পৃথিবীতে বহু অন্যায়, বহু অবিচার, বহু নিষ্ঠুরতা – তবু বলি আস্থা রাখো। অসীমের মানবিক অস্তিত্বে ভরসা হারিও না। অন্যদিকে বিজ্ঞানী বলে, এ সংসার অণু-পরমাণু'র সংঘাতে সৃষ্ট পরিকল্পনাহীন ঘটনাপ্রবাহ। এর মধ্যে কার্য-কারণ সূত্র আছে, কিন্তু তার মধ্যে কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ নেই। তোমার বানানো অর্থের দায় তোমাকেই বহন করতে হবে। অসীমকে তুমি যতই মানবিক ব্যক্তিরূপে দেখতে অভিনিবিষ্ট হও না কেন, অবশেষে সব শূন্য।         তবে কি সত্যিই এ জগত অনুকম্পাহীন, পরিকল্পনাহীন এক ঘটনাপ্রবাহের মালা? কার কাছে প্রশ্ন করছি? প্রশ্ন করছি আমার অন্তঃকরণের কাছে। আমার অন্তঃকরণ কি? আমার আবেগ, বুদ্ধি, স্মৃতি। আমার এই ত্রয়ীর কাছে আমার এ প্রশ্ন খুব বড় জটিল প্রশ্ন হয়ে গেল নাকি? তবে? আমার মধ্যে আরেক সত্তা আছে – স্বজ্ঞা – Intuition। সে কি অব্যর্থ? কে উত্তর দেবে? আমার মধ্যের স্থিত ত্রয়ী? তারা কি সত্যিই স্থিত? তাও নয়ত। এরা তো নিত্য পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তনের আভাসও কি আমার চেতনায় আছে?         এখানে একটা কথা আছে। কথা থেকে তত্ত্ব বলাই ভালো। তবে তত্ত্ব মানে ইংরাজিতে যাকে 'থিওরী' বলে তা নয়। তত্ত্ব মানে মূল সত্য। যেমন একটা পাখা ঘুরছে তার মূল সত্য বিদ্যুতের নির্দিষ্ট প্রবাহের ব্যবহার প্রণালী -- সেই হল তত্ত্ব। তো এই ক্ষেত্রে একটা তত্ত্ব আছে যা আমাদের বৈদান্তিক দার্শনিকেরা দিয়ে থাকেন, সে হল তোমার এই ত্রয়ীর পরিবর্তনশীলতার পিছনে কে ধ্রুব আছে, যে সেই পরিবর্তনগুলোকে উপলব্ধি করতে পারছে? --- এই হল আত্মতত্ত্বের ভিত্তিভূমি। অর্থাৎ, আমার এই ত্রয়ীর পিছনে 'আত্মা' নামক অপরিবর্তনীয় চেতন সত্তা আছে, যে আমার সব পরিবর্তনের দ্রষ্টা। এই 'দ্রষ্টা' শব্দটা বেদান্ত দর্শনে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। অনেকে এই তত্ত্বের উদাহরণ দিতে গিয়ে সিনেমার পর্দা'র উল্লেখ করেন, যেমন সাদা পর্দায় নানা ছবি প্রতিফলিত হয়ে ওঠে কিন্তু অবশেষে সেই পর্দা অবিকৃত থাকে ইত্যাদি। তবে কি তাই? মনোবিজ্ঞান কি বলে? আচ্ছা মনোবিজ্ঞানে পরে আসব। আগে শুনি বেদান্ত দর্শনের ঘোরতর বিরোধী বুদ্ধ কি বলেন। বুদ্ধ বলেন, এই ত্রয়ী একটা দীপশিখার ন্যায় কিম্বা একটা স্রোতস্বিনী নদীর ন্যায়। অর্থাৎ যেমন দীপশিখার প্রতি মুহূর্তের শিখাটা প্রতিক্ষণের জ্বলনে উৎপন্ন একটা ধারাবাহিক ঘটনা, অথচ যেন একটাই স্থির শিখারূপে ভ্রান্তভাবে প্রতীয়মান, এও তাই। আবার যেমন নদীর প্রতিক্ষণের জলধারা নতুন, অথচ দেখে মনে হয় একই নদী – এও সেরকম। অর্থাৎ কিনা আমাদের এই ত্রয়ী সত্তা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল একটা তত্ত্ব। এর কি কোনো দ্রষ্টা আছে? বুদ্ধ বলেন, নেই। তবে আমি কে? বুদ্ধ বলেন, তুমি নিয়ত পরিবর্তনশীল একটা সত্তা। তুমি স্থির নও। তুমি নিজেকে যে স্থির ভাবো এও এক ভ্রান্তি। এই হল মোটামুটি বুদ্ধের 'অনাত্মবাদ তত্ত্ব'।         তবে কি দাঁড়ালো? আপাতত ঘেঁটে গেল। তবে পরিবর্তনটাই ধ্রুব। এবার আসা যাক আমাদের মনোবিদেরা কি বলেন। সে কথায় আসার আগে বলি, আমি যা বলছি আমার স্বল্পজ্ঞান থেকে বলছি। এর বাইরে যাদের আরো জ্ঞানের গভীরতা তারা আরো বিশদে বলবেন নিশ্চই। তবু যেটুকু পুঁজি তাই থেকেই বলি। আমাদের মনের দুটো স্তর আছে। একটা 'চেতন' আরেকটা 'অচেতন'। ‘অবচেতন’ স্তর নিয়ে নানা মত আছে। অনেকে মানেন, অনেকে মানেন না। আমি না মানার দলেই রইলাম আপাতত। তবে কথা হচ্ছে আমাদের মনের গভীরে আরেকটা স্তর আছে। সেই সব কিছুকে দেখছে, স্মৃতিতে রাখছে, ভিতর থেকে কলকাঠি নাড়ছে, আমার চরিত্র গঠন করছে। আমার চরিত্র বলতে আমি যে কোনো ধরণের চরিত্রই বলতে চাইছি। তবে কি সেই-ই দ্রষ্টা? কোনো কোনো বৈদান্তিকের মতে আমাদের তিনটে স্তর আছে। জাগরণ, সুপ্তি আর সুষুপ্তি। বলা হচ্ছে আমাদের গভীর ঘুমের মধ্যে যে অবস্থায় আমাদের চেতনার একটা ক্ষীণ ধারা জাগ্রত থাকে, সেই-ই আত্মা। যার ফলে আমরা আবার আমাদের জাগ্রত অবস্থায় আমাদের পূর্ণ চেতন স্তরকে ফিরে পাই।         তবে কি সেই গভীরতম মনের স্তরকেই আমাদের বৈদান্তিক দার্শনিকেরা আত্মা বলে ধারণা করেছিলেন। এর উত্তর স্পষ্ট দেওয়ার মত কেউ নেই। তবে বুদ্ধের কথা শুনে খানিক তাই ধারণা হয় বটে। কিন্তু বুদ্ধ কেন বললেন, আমাদের এই পরিবর্তনের ক্রমময়তা আমাদের দেহনাশের পরও অব্যহত থাকে এবং আরেকটা দেহ ধারণ করে সেই পরিবর্তনের ধারা চলতেই থাকে যতক্ষণ না আমরা বাসনামুক্ত হই। অর্থাৎ সবরকম তৃষ্ণামুক্ত হই। সে কি তবে আরেকভাবে আত্মতত্ত্বের আভাস? যে আত্মতত্ত্ব সেমি-অমরত্বের অধিকারী? থাক, এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে সক্ষম নয়। কেন নয়?         আমাদের আহরিত জ্ঞান দুই প্রকার। এক, প্রামাণ্য; দুই, শুধু আত্মগত। একটা স্থূল উদাহরণ দেওয়া যাক। আমার প্রচণ্ড দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় চেপেছে, সে জ্ঞান আমার মনের মধ্যে যদিও আছে, কিন্তু তা কি আর প্রমাণ করা সম্ভব? কিন্তু আমার ফোঁড়া পেকে পুঁজ জমেছে, কিম্বা আমার চোখের নার্ভ শুকিয়ে আসছে, এ প্রমাণ করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে উপায় কি? এক্ষেত্রে উপায় হয় রাশিতত্ত্ব'র সাহায্য নেওয়া, অথবা কোনো একটা প্রকল্পিত তত্ত্বকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করা। রাশিতত্ত্ব অনুযায়ী সব সাধকদের অনুভূতি নিয়ে যদি একটা পরিসংখ্যান করা যায় তাদের মধ্যে মিল ও অমিল কতটা, তবে এক তত্ত্বের আভাস মেলে। সেই অর্থে একটা কথা বলা যায়, এরা প্রত্যেকেই ক্ষমাপরায়ণতা, করুণা, সত্যপরায়ণতা আর সহনশীলতার কথা বলেছেন। নিজেদের মধ্যে মূল তত্ত্বের পার্থক্য থাকলেও। তবে এই উপলব্ধির উৎস কি তাঁদের?         এর উত্তরও আমাদের অজানা। তবে একটা বিপরীত তত্ত্ব আমরা এর থেকে টানতে পারি। যারা এই কয়েকটা মূল সত্যের কাছাকাছি আসতে পারেননি তারা সত্যপ্রতিষ্ঠ নন। এ সিদ্ধান্তে আসার কারণ কি? শুধুই কি এগুলো নীতি হিসাবে খুব সার্বজনীন বলে? একদম তাই। বিজ্ঞান আমাদের একটা বড় সত্যে মুক্তি দিয়েছে – সার্বজনীনতা। বিজ্ঞানের কোনো সত্য দেশ-কাল-পাত্র বিশেষে সীমাবদ্ধ নয়। ফলিত নানাভাবে হলেও। মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব পাত্র-পরিবেশ বিশেষে পৃথক প্রাবল্যে হলেও আদতে তত্ত্বগতভাবে তা ধ্রুব। এই সার্বজনীনতাই ধ্রুব। পাই-এর মান যেমন ধ্রুব। শূন্য যেমন ধ্রুব। এই ধ্রুব সত্যের আভ্যন্তরীণ রূপ – ক্ষমা-সত্য-করুণা-সহনশীলতা।         যে প্রশ্নে শুরু করেছিলাম, তবে কি অসীম অনুকম্পাশীল? জগতে নানা ধ্বংসলীলার দিকে তাকালে মনে হয়, না। কিন্তু এত সহস্র সহস্র যুগের এত ধ্বংসলীলার পরেও যখন এত জীবের ধারক-পোষক প্রকৃতির দিকে তাকাই, মনে হয় হ্যাঁ-ও বটে।         আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের মৃত্যুর পরওয়ানা হাতে করে ঘুরতে ঘুরতে এ হিসাবে মন টেকানো শক্ত যদিও। ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ, অভাব, অবিচার, ক্ষোভ ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনই ব্যক্তিগত জীবনের লাভ-সুখ-আনন্দ-তৃপ্তিও তো আছে। কোনো একটাকে বড় করে দেখলে কোথাও একটা সামঞ্জস্যতা নষ্ট হয়, আর সেই নষ্ট সামঞ্জস্যতাকেই যদি একমাত্র সত্যি বলে ধরে নিই তবে জীবনের অনেকগুলো মুহূর্তের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করা হবে।         আমাদের সেই হৃত সামঞ্জস্যতাকে ফিরে পেতে হবে। ব্যক্তি জীবনে আর সমষ্টিগত জীবনে। কাউকে অনুসরণ করে সে পথে যাওয়া মুর্খামি। কাউকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাকে যদি অনুসরণ বলো আমার আপত্তি নেই। কিন্তু কাউকে ধ্রুব বানিয়ে সামঞ্জস্যতা না ব্যক্তিজীবনে আসে, না সমষ্টিজীবনে। গভীর পর্যবেক্ষণ, অনুধ্যান, আত্ম-সমালোচনাই সে পথে হাঁটার নিশ্চিততম উপায়। তাতে ভুল হবে না তা তো নয়। কিন্তু সে ভুলের একটা ব্যাখ্যাও থাকবে, যার উপরে পরের ঠিকটা দাঁড়াবে। কিন্তু অন্ধ অনুসরণে ভুলের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধু আনুগত্যের পরিমাপ আছে। তাতে সমূলে বিনষ্টি।    
396
Fri, 03/09/2018 - 23:00
            অবশেষে আমরা পুতুলপূজায় বিশ্বাসী - যেভাবেই হোক। সে লেনিন হোক আর শ্যামাপ্রসাদ। মূল কথা হল আমাদের পুতুল আর আমাদের আদর্শ সমার্থক। একটি নড়লে আরেকটা নড়ে যায়। আমাদের বাদবাকি দিকগুলো মানে একটা শিক্ষিত সভ্য সমাজে যেগুলো নিতান্তই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, সেগুলোতে আমরা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে গেছি। নিন্দুকে যাই বলুক না কেন। যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ, পানীয়জল, শৌচালয় ইত্যাদিতে। কর্মসংস্থানের কথা আর নাই বা বললাম।          ফলে আমাদের হাতে এখন অঢেল সময়। ক'দিন আগে অবধি আমরা ট্রাম্প আর কিমের টেনিস খেলা দেখছিলাম। একবার এদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আরেকবার ওদিকে। বেশ একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব মনের মধ্যে এসে গিয়েছিল। সে শো আপাতত বন্ধ। এখন আমাদের নতুন খেলা নব্য ভারত বনাম প্রাচীন ভারত। এ খেলাও বহু পুরোনো। মেলা বড় বড় খেলোয়াড় খেলে গেছে এই ফিল্ডেও। অদ্বৈত দর্শনের পদার্থ বিজ্ঞানের আলোয় বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা, বর্ণাশ্রমের জিনগত ব্যাখ্যা, ব্রহ্মের আণবিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা ইত্যাদি। খেলাগুলো পুরোনো হয়েছে। কিন্তু মুশকিল হল আমাদের নব্য ভারত আর প্রাচীন ভারত উভয়েই এই কোর্টের বাইরে গিয়ে খেলতে ভয় পায়। একপক্ষের দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য ধর্ম - ঈশ্বরকে নেই প্রমাণ করা; আর আরেক পক্ষের দর্শনের মূল প্রতিপাদ্য গোটা ভারতকেই আধ্যাত্মিক আলোর ফোকাসে মেলে ধরা। মাঝখানে মানুষের কথা - লবডঙ্কা। অবশ্য ভারতের দর্শনে মানুষ কোনোদিনই মূলধারার দর্শনের বিষয় ছিল না। এক বুদ্ধের আগে তেমন করে কেউ ঈশ্বর হটিয়ে মানুষকে জায়গা দেওয়ার কথা বলেনি। কিন্তু বললে কি হবে, তার দর্শন যে আবার বড় বেশি নঞর্থক। ত্যাগ, নির্বাণ - এসব কথায় মৈত্রী ইত্যাদি রসাতলে গেল। আর এখন যেটিকে 'বৌদ্ধধর্ম' বলে দেখছি সে তো জলের সাথে এমন জল মেশানো যে স্বয়ং বুদ্ধবাবাজীও চিনতে পারবেন কি না সন্দেহ।          তো মানুষের কথা কেন্দ্রে রেখে এক গ্রীসের দার্শনিক ছাড়া প্রাচীন যুগে কে বলল বলো? আমাদের তো রূপক, আচার, নিষ্ঠা, সংস্কার ইত্যাদিতে মানুষের কন্ঠস্বর মেলা দিন হল চাপা। দেখোনি আমাদের মানুষের সেবা করতে তাকে শিবের খোলস পরে দেখতে হয়, আমাদের দেশের সেবা করতে তাকে 'মা' বলে জানতে হয়। আমাদের সবই বড্ড রূপকধর্মী। যেটা যে বস্তু আসলে, সেটাকে সেই অবস্থায় দেখতে আমাদের প্রেস্টিজে না কিসে লাগে ভগাই জানে।          বাস্তববুদ্ধি জাগায়, বাস্তব নীতিবোধ শক্তপোক্ত করে এমন কথা ছোটবেলা থেকে এ জাতটা কোথায় শুনলো বলো? হাজার একটা ধর্মগুরু, হাজার একটা আচার-বিচার, হাজার একটা অতীন্দ্রিয় জীবনদর্শন। কোটি টাকার প্যান্ডেল, ঠাটবাটে থাকা সন্ন্যাসী, লক্ষ টাকার মন্দির, দুর্নীতিগ্রস্থ আপাদমস্তক সামাজিক ক্রিয়াকান্ড, হাজার একটা যুক্তিহীন শ্রেণীবিন্যাস - সংরক্ষণ, একটা দেশে নানা শিক্ষাব্যবস্থা --- এত বৈষম্যের মধ্যে তার পক্ষে সহজ লড়াইয়ের পথ কি হতে পারে? পুরোনো শত্রুকে ধরে মারো।  এখন পুরোনো শত্রু কে? খুব সোজা তো। হয় পাশ্চাত্য-ধার্মিক হও, নয় প্রাচ্য-ধার্মিক হও। পাশ্চাত্য ধার্মিক মানে কি? মানে হল যা কিছু ভারতজাত না, তাই মহান, বিজ্ঞানপ্রসূত; এতে কোনো দ্বিধা না রাখা। একজনের authority ছেড়ে আরেকজনের authority স্বীকার করে নেওয়া। ধর্ম মানে ঈশ্বর না, অলৌকিকত্বে বিশ্বাস করা না। ধর্ম মানে যে কোনো কিছুকে অথোরিটিত্বের মর্যাদা দিয়ে তার পায়ের কাছে বসে পড়া। কোনো প্রশ্ন না করা। চূড়ান্ত আনুগত্যে সারাটা জীবন দিয়ে দেওয়া।          এই নিয়ে একটা মজার কথা মনে পড়ল। একজন আমায় বলল, গুরু হিসাবে কাউকে একবার স্বীকার করে নিলে নাকি তাকে আর ত্যাগ করতে নেই। আমি বললাম, আমি মানি না। সে বলল, মানো না মানে কি? স্বয়ং রামকৃষ্ণ বলেছেন, যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়িবাড়ি যায়, তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়। আমি বললাম, আমি রামকৃষ্ণ বললেও মানি না একথা। সে রীতিমতো আঁতকে উঠলো আমার স্পর্ধা দেখে। কারণ দুটো - এক, আমি রামকৃষ্ণের অথোরিটিত্বে অবিশ্বাস করছি; দুই, গুরুর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যে বিদ্রোহ করছি।         এইখানেই আমাদের জাতীয় স্তরের গোলমাল - প্রশ্নহীন আনুগত্য। কারন সে নিজেকে শুধু মানুষ হিসাবে কোনোদিন মূল্যবান, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ভাবতেই শেখেনি। আমাদের শিখতেই দেওয়া হয়নি। মানুষ হিসাবে আমার একটা গুরুত্ব আছে শুধু না, আমার মানবিকতার বাইরে কোনো ধর্ম, কোনো ঈশ্বর নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না আজকাল - এই কথাটা এখনও আমাদের বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। তাই আমাদের অনেক সমস্যাই মধ্যযুগীয়, তারাই আমাদের খবরের কাগজ, তর্ক-বিতর্ক জুড়ে থাকে।          কতগুলো কথা স্পষ্ট বুঝতে হবে:         ১) বিবেক, চেতনা, নীতিবোধ - কোনো ধর্মপ্রসূত নয়, সে আমাদের মন্দির, বহু বাবাজীদের দেখলেই বোঝা যাবে। নৈতিকতা একটা দীর্ঘকালীন অভিব্যক্তিজনিত মানবিক বিকাশ। তা থাকবেই।          ২) মানুষের সমস্যা মানবিক স্তরেই মেটাতে হবে। কোনো আদর্শ, নীতি'র থেকে বড় কথা বাস্তববাদী, যুক্তিবাদী, তথ্য নির্ভরশীল হওয়া।         ৩) ধর্ম আর রাজনীতির অবস্থান এক নয়। একটা ব্যক্তিগত, আরেকটা সমাজগত। যদিও কতটা ব্যক্তিগত তা WTC-র শূন্যস্থানটা দেখলে আতঙ্কিত হতে হয়। তাছাড়া আরো আরো আতঙ্কবাদ তো আছেই। তর্ক উঠবে ওটা আসল ধর্ম নয়। বুঝলাম সেটা। কিন্তু ওই সর্বস্বান্ত মানুষগুলোকে বোঝানো যাবে? আসলে যে জিনিসেরই দুটো-তিনটে ব্যাখ্যা হয় সেটা নিয়েই গোল পাকে। আপনার ব্যাখ্যা আর আমার ব্যাখ্যায় ঘোরতর দ্বন্দ্ব তৈরী হয়। সেটা কবিতার সংজ্ঞা, অর্থনৈতিক সংজ্ঞায় চার রকম কেন, লক্ষরকম হলেও গোল বাধে না। কারন প্রতিটার পিছনে যুক্তি আছে। অথোরিটি নেই। তাই তার একরকম সমাধানের পথও মেলে।          ৪) মানুষকে কেন্দ্রে না রাখলে সত্যিই বিপদ। মানুষকে বিজ্ঞানের আলোতে না দেখলে কোনো ভেদাভেদ কোনোদিন ঘুচবে না। মানুষের বিজ্ঞানগত রূপটা আবেগহীন নয়, সংবেদনশীল। সংবেদনা থেকেই যতকিছুর সৃষ্টি। এমনকি যদি ঈশ্বরের অস্তিত্বকেও স্বীকার করে নিই তর্কের খাতিরে, সেও আমার সেই সংবেদনের উপরেই দাঁড়িয়ে। শুধু বিশ্বাস ভয়ঙ্কর।         রাজনীতি নয়, ধর্মনীতি নয়, একটা সুস্থ সমাজ গড়ে ওঠে একটা সুস্থ শিক্ষাপ্রণালীর মাধ্যমে। সুস্থ শিক্ষাপ্রণালী মানে শুধু ঠিকটা বলার চেষ্টা করেই ক্ষান্ত দেওয়া নয়; যারা ভুলটা বলছে, প্রচার করছে, সে পাশ্চাত্যধার্মিক হোক কি প্রাচ্যধার্মিক - তার নিরসনে প্রয়াস পাওয়া। মনে রাখতে হবে, আমরা এমন একটা দেশের নাগরিক যেখান একজন মানুষকে জলজ্যান্ত চিতায় তুলে পুড়িয়ে মারতে নেই বলতেও একটা মহাপুরুষ লাগে। অগত্যা তোমরা অমন মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি খেলো না বলতেও চিল্লাতে হবে। কারণ অথোরিটি'র সর্বোচ্চ অভিশাপ হল সে সংবেদনশীলতাকে নষ্ট করে ফেলে।    
397
Thu, 03/08/2018 - 22:30
            বিশ্বাসঘাতকতা পাপ না অপরাধ – জানি না। তবে বিশ্বাসঘাতকতায় বহু মানুষকে মানসিক ভারসাম্য হারাতে নিজের চোখে দেখেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি। আমার মনে হয়, একটা মানুষকে এর থেকে গভীরে আহত করার বোধহয় আর কোনো উপায় নেই। বিশ্বাস যত গভীর আঘাত তত গুরুতর। যে মাটিতে ভুমিকম্প ঘনঘন হয়, সে মাটিতে নাকি মানুষ কাঠের বাড়ি বানায়। কেন? যাতে কম আঘাত লাগে? যাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়? হয়ত বা। যে সম্পর্কে একবার বিশ্বাসঘাতকতা ঢুকেছে সে সম্পর্কের পাটাতনে এমন কাঠের বাড়ি, বালির বাড়ি, ক্রমে তাসের ঘর গড়ে তোলা ছাড়া উপায় থাকে না।          আমাদের জীবনের দর্শন এমন কি আর বড় তত্ত্বকথার উপর দাঁড়িয়ে থাকে? কয়েকটা ছোটোখাটো বিশ্বাস, আস্থা আর আশ্বাসেই জীবন কেটে যায়। সেই ছোটোখাটো আশা-আকাঙ্ক্ষার তাগিদেই জীবন চলে যায়। তারপর সময়ে অসময়ে, যেখানে সেখানে মৃত্যুর পরিহাস তো আছেই।         “হায় বুদ্ধিহীন মানবহৃদয়! ভ্রান্তি কিছুতেই ঘোচে না, যুক্তিশাস্ত্রের বিধান বহুবিলম্বে মাথায় প্রবেশ করে, প্রবল প্রমাণকেও অবিশ্বাস করিয়া মিথ্যা আশাকে দুই বাহুপাশে বাঁধিয়া বুকের ভিতরে প্রাণপণে জড়াইয়া ধরা যায়, অবশেষে একদিন সমস্ত নাড়ী কাটিয়া হৃদয়ের রক্ত শুষিয়া সে পলায়ন করে, তখন চেতনা হয় এবং দ্বিতীয় ভ্রান্তিপাশে পড়িবার জন্য চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠে।“           আমি নিজের চোখে যে জীবনটাকে শেষ হয়ে যেতে দেখি উপেক্ষায়, জেদে, তাকে নিয়ে গল্প লেখার কোনো সাহস আমার হল না। যাকে বিয়ে করেছিল সে কালের কবলে গেল বড় তাড়াতাড়ি। বেঁচে থাকার সঞ্চয় বলতে যা কিছু ছিল তাও নিল জ্ঞাতিগুষ্ঠী। সমাজ বলো, নিয়ম-নীতি বলো নিরপেক্ষ তো কেউ হয় না বলো? হয় কি? অতটা ন্যাকা সাজা আর যা হোক একজন গরীবের তো হয় না। কবে কার ভাগ্যে কোন শিঁকে ছিঁড়েছিল তার উপাখ্যানে মন আশা বাঁধবে কতদিন? বাঁধে না। বিধবা, দরিদ্র আর সুশ্রী হলে একটা সমাজে যা যা অনায়াসে ঘটে তা তা সব ঘটেছিল তার সাথে। সে মেনে নিয়েছিল। কিছুটা জৈবিক কারণে আর কিছুটা পরিস্থিতির চাপে। জৈবিক কারণ বলতে নিশ্চই কামের কথা বলছি না, একটা খিদেও তো আছে।         মজার কথা হল, তার একটা ঘরের ভাঙা টালির ফাঁক দিয়ে আসা জ্যোৎস্নার ফাঁদে সেও পা দিয়েছিল। কোনো খিদে মেটাতে আসা পুরুষের প্রেমের কামড়কে মধুর লেগেছিল হয়ত কোনো একটা বসন্তের রাতে। নির্মম একাকীত্বের নিষ্ঠুর চাহনি থেকে বাঁচার জন্য। হতেও তো পারে। ভুল জেনেও ভুলের জন্যই বাঁচতে ইচ্ছা করে? সবসময় ঠিকটা করার অবকাশ আমাদের বাংলার মেয়েদের ভাগ্যে বিধাতা আর কতটুকু অবসর দেয়? আর তার মুল্যই বা কত? একদিকের ভুলের পলেস্তারা খসে পড়তে পড়তে আরেকদিকের ভুল কেঁপে ওঠে। তাকে সামাল তো দিতেই হয় না? দিতে হয়। এতবড় সমাজ যে তার প্রতিটা অঙ্গুলিহেলনের হিসাব রাখে গো। পুরুষ হয়ে পুরুষের শাসন ভোলা যায়, মেয়ে হয়ে যায় না। সেখানে ঈশ্বর থেকে বাড়ির পাঁচিল --- সবাই বিধান দেয়। তাকেও দিয়েছিল। সে মাথা পেতে নিয়েওছিল, শুধু সবার অলক্ষে নিজের কুলুঙ্গিতে জমিয়েছিল একটুকরো অবৈধ ভালোবাসা। একপক্ষেরই সে কি জানত না? জানত তো। আমি জানি সে জানত। সে যে লিখে রেখেছিল। অবাক হচ্ছেন না? লিখে রেখেছিল? হ্যাঁ, সে দরিদ্র ছিল, সার্টিফিকেটহীন ছিল, কিন্তু নিরক্ষর তো ছিল না। তাই নিজের কথা নিজের ভাষায় লিখে রেখেছিল।          পাঠক বলবেন সে কথা আমি কি করে জানলাম? জানা যায়। 'দরদ' বলে একটা শব্দ আছে। সে বাতাসের থেকেও সুক্ষ্ম। এক হাতের গন্ধ মেখে আরেক হাতে এসে পড়ে। তেমনভাবেই এসে পড়েছিল। ভুল বানানে, ভুল ব্যাকরণে একটা আদ্যন্ত মানুষের কথা পড়েছিলাম, লুকিয়ে। সে জানতে পারেনি। জানলে লজ্জায় মারা যেত। বাহ রে, যেত না? একে পুরুষ, তায় বয়সে ছোটো। তবু হাতে এসে পড়েছিল আমার। একজন বলেছিল, তুমি তো লেখ, এ লেখার মর্ম তুমি বুঝবে।          স্পর্ধা! মর্ম বুঝব আমি? সারা গা দগদগে একটা জীবনের মর্ম বুঝব আমি? বুঝিনি। দূর থেকে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনের আঙুল দিয়ে তার জীবনের গা’টায় হাত বুলিয়ে দেখার চেষ্টা করে দেখেছি কতটা টাটায়।          ও, আরেকটা কথা তো বলাই হয়নি। তার একটা ছেলেও ছিল। মানে এখনও আছে। তার মৃত স্বামীর সন্তান। সে যখন বুঝল তার প্রেমের শরীরে পোকা লেগেছে, সে পোকা তার রক্ত চুষে তার ছেলের গায়ে হাত বাড়াচ্ছে, সে নির্মম হল। এই প্রথম সে নির্মম হল। বুকের মধ্যে নিজের ধারালো নখ দিয়ে উপড়ে বাইরে নিয়ে এসে মাটি চাপা দিয়ে রাখল তার পোকায় ধরা প্রেমের হৃৎপিণ্ডকে। নিজের উঠোনেই পুঁতল। কতদূর যাবে? কোন শিকারি কুকুর কোথা থেকে খুঁড়ে বার করে পুরোনো রক্তের দাগ বরাবর হাজির হবে, কে বলতে পারে?          ছেলেটা বড় হল। দরদী হল না। দারিদ্র্যের সব দায় দিল মা’কে। ও হ্যাঁ, এখন সে তো মা। কখন যে এই ‘মা’ হওয়াটা হয়ে যায় সে নিজেও টের পায়নি আর পাঁচটা মেয়ের মত। কিন্তু তার মধ্যে তবু একটা স্বতন্ত্রতা ছিল। যতবার সে মেরুদণ্ডটাকে সমঝোতার খাতিরে একটু বেঁকাতে গেছে, ততবার সেটা এমন বিচ্ছিরি আওয়াজ করে সোজা দাঁড়িয়েছে, পাড়ার লোকে কি, তার নিজেরই বড্ড কানে বেজেছে। সমাজে বাজার আগেই যেহেতু কানে বেজেছে তাই সে আরো শক্ত হয়েছে আগে থেকেই। সমাজ বিধান দিতে এসে অমন শক্ত, প্রেমে গলে না মেয়েমানুষ সহ্য করবে কি করে? দিয়েছে তাকে একঘরে করে। পুরুষগুলো তাকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। যেন ফ্রীজে পচানো সুস্বাদু খাবারের অপচয় মেনে নিচ্ছে উদারতায়, এমন তাদের দেমাক। সে শক্ত চোখে তাকিয়েছে। কড়া জবাব মিষ্টি সুরে দিয়েছে। আসলে সে অক্ষর চিনেছে যে। নিজের মনকে নিজের সামনে সাদা পাতায় অক্ষরে বাঁধা দেখতে শিখেছে যে। তাকে বাঁধবে কি করে বলো?          তার বউমাও পারল না। বউমা স্বাধীনতা বলতে স্বেচ্ছাচারিতা, আর আত্মসুখ বোঝে। অমন বুড়ি, তাও নাকি বেশ্যামাগী, হোক শাশুড়ি, কিসের দায়? সে বলেছে বেশ্যা না হলে অমন সোজা চোখে চোখ রাখে পাড়ার অত শিক্ষিত পুরুষের চোখে। কি যাদুতে বশ করেছে সেই জানে। দু’কলম কি লিখতে জানে, ধরাকে সরা জ্ঞান করে। নিজের কেচ্ছা নিজেই লিখেছে এমন মেয়েমানুষকে যমে নেয় না? হ্যাঁ গো তোমার মা-টা কি গো? ছেলের চোখ লজ্জায় নেমে এসেছে। সত্যিই তো আলাদারকম মেয়েমানুষ তার মা। নইলে বৃহস্পতিবারে লক্ষ্মীপূজো দেয় না! বড়লোকের বাড়ির থেকে চেয়ে এনে নভেল পড়ে? অলক্ষী... বাবাকে খেয়েছে... এবার আমাদেরও...             আচ্ছা বলো, একটা মানুষ কতটা সইবে? ওই যে বললাম, বিশ্বাসঘাতকতা। তার উপরে বালির বাড়ি। চোরাবালিতে ঘূর্ণী লাগল। তার মনের পিছে শরীর ভাঙল। ক্রমে কুঁজো হল। এক পা চলতে দু’মিনিট দাঁড়ায়। হাঁফ ধরে এলে এর বাড়ির দরজায়... ওর বাড়ির দরজায় বসে জিরোয়। তবু কারো সাহায্য নেবে না। একটা মজার কথা কি জানেন, ওকে কেউ অমুকের মা, তমুকের বউ বলে ডাকত না। এইখানেই ওর জিত। ওকে সবাই ওর নাম ধরে, কিম্বা ওর নামের শেষে ‘দি’ যোগ করে ডাকত। এতটা জেদ কোন ছেলে-বউ মানবে বলো? দিল ভাত বন্ধ করে। সে নালিশ জানালো না। শুধু মারা গেল। চুপ করে। একা একা মারা গেল।          এখন বলো আমি একে নিয়ে কিসের গল্প লিখব? সে খাতাগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে ছেলের বউ। জেনেছি অনেকদিন আগে। আমার এই ক’টা কথা তার স্মৃতির তর্পণে লেখা থাকল। কেন লিখলাম জানো? আজ যখন হেঁটে ফিরছি একজন কুঁজো হয়ে আসা বুড়ি, উশকোখুশকো চুল, ছেঁড়া শাড়ি, একটা স্টোভ নিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে যেতে যেতে বলল, “আমার কাছ থেকে নিয়ে যাস বাবারা এটা, আমার থাকা এখন তখন। কখন যাই।”          আমার বুকে বিঁধল। আমি আছি – এই কথাটা ভুলতে তো কিছুতেই পারা যায় না। আমার এতবড় গুরুত্ব সংসারে যে সে হিসাব করে করে তো আশই মেটে না। সেখানে সে এত সহজে এমন শূন্য নিজেকে করে ফেললে কি করে? কিসের যন্ত্রণায় এতবড় নির্বাণ পেল? কোন গাছের তলায় সে সারাটা জীবন কাটালো এ বোধিলাভের জন্য? কতটা পোড়ালো সংসার তাকে?          জানি এ শোকের হিসাব হয়ত বিধাতার খাতাতেও লেখা নেই। বাংলার গ্রামেগঞ্জে এমন মেয়েমানুষদের মত মূল্যহীন, অর্থহীন, বাড়তি জীবনের হিসাবে সমাজ আর বিধাতা দুই-ই উদাসীন। ভাগ্যে মৃত্যু নয়।          ও! শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলে নিই। আমি কিন্তু নাম জানাবো না। কোনোভাবেই না। সে আপনি / তুমি যত পরিচিত বা কাছেরই হোন না। যে জীবনটা অমন অলক্ষ্যে গেল, সে জীবনটার কথাই বলার দায় আমার, তার পরিচয়ে কি এসে যায়?    
398
Wed, 02/28/2018 - 10:21
      মনের মধ্যে একটা নিরিবিলি ছাদ থাকে। একটা চিলেকোঠা থাকে। একটা বই সেখানে যতটা জীবন্ত একটা মানুষ ততটা নাও হতে পারে। সে চিলেকোঠা ততটা নির্জনতা, নিঃশব্দতা নয়, যতটা নিরিবিলি বা অবকাশ যাপনের তাগিদ। লেখক আর পাঠক মুখোমুখি বসে সেখানে। দু'জনেই একা। দু'জনের মত করে একা। একজন তার চেতনার সবটুকু নেওয়ার ক্ষমতা দিয়ে কিছুটা জীবন সংগ্রহ করেছেন নিজের মধ্যে। তারপর ধীরে ধীরে তাকে আপন মনের মাধুরী, ধী, পর্যবেক্ষণশৈলী সহযোগে একটার পর একটা শব্দ সাজিয়ে রচনা করেছেন --- যা তার নিজের সত্তা। 'ওয়ার এণ্ড পিস' যতটা নেপোলিয়ানের গল্প, ইতিহাসের একটা সময়ের গল্প, ততটা টলস্টয়ের মনোজগতেরও অংশ। ঐতিহাসিকের নেপোলিয়ান আর টলস্টয়ের নেপোলিয়ানে কোথাও তাই পার্থক্য থেকেই যায়। কোথাও হয়ত বা টলস্টয়ের অন্তর্দৃষ্টি ইতিহাসের দেশ-কালের সীমারেখা ছাপিয়ে এমন কোনো সত্যের নিকট পৌঁছে যায়, যা তথ্যে ধরা না গেলেও অনুভবে ধরা যায়? হতেও তো পারে? মানুষ তো শুধু একটা জীবনপঞ্জী না, তার থেকেও বেশি কিছু। তার আয়ুষ্কাল না হয় দেশ-কালের গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ, কিন্তু তার চিত্তটা তো নয়! যদি তাই হত তাহলে কালিদাসের কাব্য, সুপ্রাচীন তামিল প্রেমের কবিতাগুচ্ছের কথা আমার কথা হয়ে ওঠে কি করে? কারণ চিত্ত অমর। চিত্তের ঢেউগুলোর আন্দোলন বাতাসে বাতাসে ভেসে ফেরে আরেকটা সংবেদনশীল চিত্তের খোঁজে। তাই কোনো এক ঐতিহাসিক চরিত্রের কান্না শরদিন্দুর মননলোকে আলোকিত হয়ে আমার চোখের কোল ভিজিয়ে যায়। সে দায় ঐতিহাসিকের তো নয়। ঐতিহাসিকের দায় তথ্যের কাছে নিজের জবাবদিহিতে নির্ভুল থাকায়। সেখানে সে সফল হলে তার পারিশ্রমিক হাতে ফুল্ল মনে বিদায় নেয়। কিন্তু সাহিত্যিকের দায় তো তার হৃদয়ের কাছে, সে সেই দায়ের কাছে নতিস্বীকার করে কালের গভীরে ডুব দেয়। তার নিজের চিত্তে চিরকালীন মানবচিত্তের হাসি-কান্না, আশা-হতাশা, উচ্ছ্বাস-বেদনার স্পর্শ পায়। তা তুলে নিয়ে আসে বর্তমানের পাঠকের কাছে। নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে অন্যের তৃষ্ণার জল সঞ্চয় করে রাখে।         চিত্তের এই গভীর গহনে ডুব দিতে গেলে পাঠক আর লেখক উভয়েরই একটা নিরবিচ্ছিন্ন নিরিবিলির দরকার। নইলে ফাঁকি এসে জমে বিস্তর। কেবলই বাইরের কথার ধারাবিবরণে, স্নায়বিক উত্তেজনায় উজিয়ে পাঠককে বিহ্বল করে তোলা কোনো সৎ সাহিত্যিকের কাজ কি? সে তো খানিক চটুল সাংবাদিকতা আর ছদ্ম-সাহিত্যের সংমিশ্রণ। সে ফাঁকিতে কোনো লেখা যত না ঋদ্ধ করে তার থেকে চঞ্চল করে তোলে অনেক বেশি। চমৎকৃত করে ভাষার চপল ব্যবহারে। নিজের বোধের, অনুভবের নিঃস্বতা ঢাকতে বাইরের আবরণ আর আভরণের গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে প্রবল করে। শ্রদ্ধেয় নীরদবাবু বলতেন ভালো বইয়ের মলাটের কোনো চাকচিক্য হয় না। সে সরল সহজ। এই কথাটা শুনে আমার বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র রচনাবলীর কথা মনে আসত।          আসলে সুলেখকের হদিশ দেন সুপাঠকই। ইদানীং সেখানেও একটা বড় গোলমাল হচ্ছে। কোনো নতুন বইয়ের কেউ প্রশংসা করলে, বিশেষ করে যিনি পাঠক হিসাবে উচ্চমানের বলে আমার বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসে সে বই কিনেছি। পড়ে কেমন খটকা লেগেছে। সাথে সাথেই মনে হয়েছে এই প্রশংসা কোনো অনুরোধ বা উপরোধ বা give & take policy দুষ্ট নয় তো? অথবা মনে করেছি নিজের সাহিত্যমূল্য বোঝার ক্ষুদ্রসীমারেখায় হয়ত সে লেখা ধরা পড়েনি। মুষড়ে গেছি। আবার কালের চক্রে এমন কোনো বই হাতে এসে পড়েছে যা বিশ্ব-সাহিত্যে বেশ সম্মানের, তার রস বেশ আস্বাদন করতে পারছি, তখন মনে হয়েছে এই বই তবে তো বেশ বুঝতে পারছি, ওইটে কেন পারলুম না? কোনো বই পড়ে তার যথার্থ মূল্যায়নের জন্য প্রচুর জ্ঞান না থাকলেও, ‘আমার ভালো লেগেছে’ – এই কথাটা যদি নির্মোহ হয়ে, নিজের বিবেকের কাছে খাঁটি থেকে বলা যায়, তবে সাহিত্যের মাথায় রাজতিলক দেওয়ার সম্মান না পেলেও, তার পায়ে নিজের ভক্তি অর্ঘ্যটুকু শুদ্ধ থাকে। সেও বা কম কি?         সাহিত্যের বাইরের দিকটায় দেশ-কাল-ভাষার একটা ঐতিহাসিক রূপরেখা থাকলেও, গভীরে যত যাওয়া যায় সে রূপরেখার মূল্য তত ক্ষীণ হয়ে আসে। কারণ ওই যে বললাম মানুষের চিত্ত একটা অমর সাগর। তার জল পুরোনো হয় না। ভাষা বদলায়, ভঙ্গী বদলায়, চরিত্রেরা বদলায় – কিন্তু সব সেই চিত্ত-সাগরের ক্ষণিক ঢেউ। সাগরেই মিশবে। পাঠক চিত্তের গভীরতম তল স্পর্শ করে আবার সঞ্জীবিত হয়ে উঠবে। হাজার হাজার বছর আগে কোনো লেখকের চিত্তে জাগা এক ঢেউ আজকের পাঠকের চিত্তে জেগে ওঠে – এই সাহিত্যের ধর্ম। জীবাশ্ম যেমন তার বিগত প্রাণের একটা ক্ষয়িষ্ণু চিহ্ন কালের চাকায় পিষে যেতে যেতেও টিকিয়ে রাখে, কিন্তু প্রাণ পায় না, সাহিত্য সে জীবাশ্ম নয়। প্রাচীনত্বে তার ভাষা দুর্বোধ্য হতে পারে। কিন্তু সেই দুর্বোধ্য ভাষার পথ যদি একবার সুগম হয়ে ওঠে পাঠক সেই সাহিত্যে ডুব দিয়েও আবার নিজেকে সেই চিরকালীন চিত্তসাগরে পায়। অনুভব করে। তৃপ্ত হয়।         তাই রবীন্দ্রনাথের কথায় অলসতায় সাহিত্য জন্মায় না, সাহিত্য জন্মায় অবকাশে। সেই অবকাশে আমার চিত্ত যেন আবিলতায় না ভরে ওঠে। আমি যেন সাহিত্যের রসদ খুঁজতে ভাগাড়ে না ঘুরে মরি। আমার আবেদন যেন প্রথমত আমার নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ হয়। বিবেক ছাড়া সংসারে আর যা কিছু চললেও চলতে পারে, সাহিত্য এক মুহূর্তও বাঁচে না। এমনকি ধর্মও যে বিবেক ছাড়া জীবিত থাকতে পারে তার উদাহরণ চতুর্দিকে। কিন্তু সৎসাহিত্য বিবেক আর অবকাশের যৌথ মিলনে গড়ে ওঠে। তার তাড়া নেই। তার লোভ নেই। তার আত্মাভিমান আছে, কিন্তু ক্ষুদ্র অহং-এর আবিলতা নেই। পৃথিবীতে সেদিন সত্য অর্থে দুর্দিন না, যেদিন ধর্ম বলে কিছু থাকবে না; পৃথিবীতে সেদিন সত্য অর্থে দুর্দিন যেদিন সৎ সাহিত্যের অভাব হবে। কারণ বিবেকের দায় একা সেই-ই নিঃস্বার্থভাবে বহন করে এসেছে। পাঠকের ইতিহাস সাক্ষী।    
399
Sun, 02/25/2018 - 21:00
    একটা ছবি বেশ কয়েকবার দেখছি ফেসবুকে। ছবিটা শেয়ার করলাম না। একটা শিশু বন্দুকের নলের সামনে, ট্রিগার চেপার অপেক্ষায়। তারপর নাকি ট্রিগার দাবানো হয়েছিল।         ভীষণ দুর্বলচিত্ত মানুষ তো, এরকম কিছু হলে, দেখলেই একজন সর্বমঙ্গলময়, করুণাময় ঈশ্বরকে খুঁজি। যে সব কিছু ঠিক করে দেবে। দুষ্টুলোকগুলোকে ভ্যানিশ করে দেবে।         রাস্তায় চায়ের দোকানে চা নিতে এসেছে মাঝবয়েসী সুঠাম দেহ একজন লোক। বারবার বলছে, "মা রে চীনারা ঢুকে গেছে। আমি পুলিশ নিয়ে আসছি। মা গো তোর যে গয়না চুরি করেছে তাকে ধরেছি রে মা... কাঁদিস না"... বলতে বলতে তার চোখ ভিজছে। কে তার মা, জানি না। কি তার চুরি গেছে তাও জানি না। শুধু জানি মানুষটা পাগল হয়ে গেছে।         একজন ঈশ্বরকে ভীষণ খুঁজি এই সময়। ভীষণ। একা ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে। সমুদ্রের অনন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে। ভোরের সূর্যোদয়ে লাল আকাশের দিকে তাকিয়ে। বিছানায় একা শুয়ে নিজের মাথা-বুক খুঁড়ে। পাই না।         চারদিকে সমাজের পরিশ্রমী মানুষের অর্থপুষ্ট ঈশ্বরবিলাসীর দল। কেউ প্রকাশ্যে বিভেদের কথা বলছে, কেউ কৌশলে গোপনে ভেদের পাঁচিলে ইঙ্গিত করছে। ওরা-আমরা। ওদের ঈশ্বর-আমাদের ঈশ্বর/গড/আল্লাহ্‌ ইত্যাদি।         তবে আশা কি এক্কেবারে নেই? শুধু যে ধর্মের বিভেদ সেই তো নয়। রঙের বিভেদ। জাতির বিভেদ। দেশের বিভেদ। আরো কত কত...         দুর্বল হই। সব যুক্তি, শিক্ষা খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। সর্বশক্তিমান, পরমকরুণাময়ের হদিস কই? নেই... নেই... নেই.... বুদ্ধিপ্রমাণ হাতড়িয়ে বলে। ইতিহাসের দলিল মুখের উপর ছুঁড়ে মেরে বলে, ওই নামে কেউ বেঁচে নেই। হৃদয়? সে কখনও বিষণ্ণতার অতল গহ্বরে তলিয়ে, কখনও উদ্দীপনায় ভরপুর। পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। সে যেন এইমাত্র গভীরের গভীরতম প্রদেশে কিছু পেয়েছে, লাফিয়ে উঠেছে। পরক্ষণেই হারিয়ে বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে থেকেছে।         সংসারে সমুদ্রই যেন শেষ কথা তবে। নোনতা জলের অসীম সাগর। যত গভীরেই যাই নোনতা নোনতা আর নোনতা। আমার রক্ত আর অশ্রুর স্বাদের মত। ঈশ্বর যেন নোনতা সাগরের ঢেউ। নুনের ঢিপি। ঈশ্বর যেন নোনতা সাগরের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সাদা একখণ্ড মেঘ। ঈশ্বর যেন নোনতা সাগরের বুকে দোলা অসীম নীল আকাশের প্রতিচ্ছবি। এই ক্ষণে মূর্ত, পরক্ষণেই লয়প্রাপ্ত।         বুদ্ধ জন্মেছিলেন। মারা গেছেন। বুদ্ধত্ব জন্মায় না। মারা যায় না। কিন্তু সে বুদ্ধত্ব অনুকম্পায়, না নির্বাণে? প্রথমটাকে শূন্য করে পরেরটার কি মূল্য?         অহিংসা - প্রভাতের সূর্য, না ধ্রুবতারা, না ধূমকেতু?         উত্তর দিতে আসবে আমার নোনতা ঈশ্বর    
400
Wed, 02/21/2018 - 10:27
  আজ ভাষা দিবস। সাহিত্য দিবস না। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমার মাতৃভাষা দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলা। তাই আমার এই দিনটাতে কোনো গর্ব নেই। যে ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়ার কথা ভাবতে পারা যায় না, যে ভাষায় কথা বলার মধ্যে সম্মানবোধ সাধারণ বাঙালী জনচেতনার নেই, আর যা হোক সেই ভাষা নিয়ে আদিখ্যেতা করার মত মানসিক গঠন আমার নেই।         একটা বাঙালী সন্তান জন্মেই জানতে পারে যে পা দুটো নিয়ে সে এ সংসারে এসেছে তা অচল। তার সে পা-দুটো কেটে রনপা বসিয়ে দেওয়া হয়। অনেক উঁচু থেকে সে কিছুটা তাচ্ছিল্যে, কিছুটা করুণায় নিজের পা-দুটোকে দেখতে শুরু করে। আর যারা সে রনপা লাগানোর সামর্থ্য রাখে না তারা কিছুটা হীনমন্যতায়, আর কিছুটা ভাগ্যের বশ্যতায় মাথা নীচু করে সবটা হজম করে যাওয়ার চেষ্টা করে। রক্তমাংসের যে পায়ে সে স্বাভাবিকভাবে তার জন্মলব্ধ মাটিতে ঘুরে বেড়াতে পারত তার বদলে সে পরবাসী হয়ে ঘোরে। তাতে লজ্জা নেই, কারণ পরবাসীর সংখ্যা কিছু কম নয়, আর তার চাইতেও বেশি পরবাসী না হতে পারার আক্ষেপযুক্ত মানুষ। অগত্যা অসুবিধা হয় না।        কিছু নতুন কথা বললাম কি? আদতেই নয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে  ইদানীংকালেরও বহু চিন্তাবিদেরা এ কথা বলেছেন, বুঝিয়েছেন, করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কিচ্ছু হয়নি। পাড়ায় পাড়ায় ইংরাজী প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলছে রোজ একটা করে। তবে কি দাঁড়ালো -     বাঙালীর প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত মাধ্যম কি?           ইংরাজী। বাঙালী সন্তানের এক পরম লক্ষ্য কি?         ইংরাজীতে তুখোড় কথা বলা। বাঙালীর শ্রদ্ধার ভাষা কি?         ইংরাজী।             তবে আজ কিসের উৎসব? দ্বিচারিতার। ছেলেকে মেয়েকে ইংরাজি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বাঙলা ভাষার ভবিষ্যত নিয়ে কবিকূল, সাহিত্যিককূল সভা করবেন। ছেলেমেয়ে বিদেশে প্রতিষ্ঠিত হলে আহ্লাদে আটখানা হবেন। ছেলেমেয়ে গ্রামে গিয়ে একটা বাংলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি নিলে জাত যাবে। “ওসব তোমার জন্য না, তার জন্য লোক আছে।” বিদেশে বসে আজকাল আবার অনেকে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখছেন শুধু না, রীতিমতো বাংলা ভাষার কিসে কিসে উন্নতি হবে সে নিয়েও বেজায় চিন্তিত এমন একটা ভাবও তাদের মধ্যে আছে। আসলে এদের দোষ নেই। এদের ধারণা বাঙলা ভাষাটা লাইব্রেরী, সাহিত্যসভা, লিটল ম্যাগাজিন, কাব্যি, প্রবন্ধ, গপ্পো ইত্যাদির বাইরে আর বাঁচে না। এরা আয়েস করে বাংলা বলেন, কঠিন কঠিন বিষয়ে আলোকপাতের ভাণ করেন। অসম্ভব স্বাধীন চিন্তার অভিনয় করেন ইংরাজি ভাষার গায়ে ঠেসান দিয়ে। আদতে পুরোটাই ওই শখের বাজারের ক্ষীরের পুতুল।           এদের জন্যে ভাষাটা বেঁচে নেই। ভাষাটা এখনও জ্যান্ত আছে কেমন দেখতে হলে গ্রামে আসুন। যেখানে এখনও মানুষ বাংলা ভাষা শুধু না, বাংলা সন তারিখে জীবন যাপন করেন। আসলে একটা ভাষা বাঁচে সেই দেশের মাটির সাথে ওতপ্রোত হয়ে। এদের দেখলে আমার লজ্জা করে। নিজের দৈন্য বুক চিরে অট্টহাস্য করে। তবুও আমরা এদেরও দূষিত করে তুলব ধীরে ধীরে। সংসারে অর্থের চাইতে বলবান আর দারিদ্র্যের চাইতে যন্ত্রণা কি আর আছে? একটা কালিকাপ্রসাদ পেতে বাঙালীকে কত জন্ম অপেক্ষা করতে হয় সে বাঙালীর বিধাতাও বোধ করি জানেন না।         আমরা কি তবে সত্যিই বাই-লিঙ্গুয়াল? দ্বিভাষী?          না। আমরা ইংরাজী অবলম্বী জাত। আমরা হিন্দী অবলম্বী জাত। আমরা কাজের জগতে মার খাই ইংরাজী ভাষার কাছে আর আবেগের জগতে মার খাই হিন্দী ভাষার কাছে। আমাদের আধুনিক প্রজন্মের বৃহৎ অংশের প্রাণের ভাষা জোগায় হিন্দী গান। বাংলা নয়। ইদানীং হিন্দী ভাষার প্রতিও একটা শ্রদ্ধার ভাব চেতনায় আসছে দেখছি ইংরাজীর পাশাপাশি। আমরা যখন ছোটো ছিলাম, হিন্দী কিছুটা অস্পৃশ্য অসংস্কৃত ভাষার মধ্যে পড়ত। ছবিটা কিন্তু বদলাচ্ছে। আধুনিক বাঙালী প্রজন্ম হিন্দীকেও সাদরে গ্রহণ করতে শিখছে। বাঙলা আরেক ধাপ পিছোচ্ছে। হিন্দীর কাছে হারছে। আমরা যতই চীৎকার করি না কেন, নিজের দুর্বলতার প্রতিষেধক না খুঁজে যদি সবলের ওপর আক্রোশ জমাই তাতে কিছু লাভ আছে কি? করুণার পাত্র হওয়া ছাড়া? যতই আমাদের ভাষায় নোবেল থাকুক, আমাদের বিশাল সাহিত্য সম্ভারের দোহাই দিই না কেন, ওতে ভাষার একদিকের কথা বলা হয়। যেটা একটা ক্ষুদ্র দিক। সাহিত্যের দিক। ভারতের যে ক'টা ধ্রুপদী ভাষা আছে (সংস্কৃত, তামিল, তেলেগু, কানাড়া, মালায়লম, ওড়িয়া) আর আন্তর্জাতিক মহলেও যে ক'টা ধ্রুপদী ভাষা আছে (তার মধ্যে তেলেগু পড়ে না যদিও) তার মধ্যে বাংলা নেই। আমরা সে অর্থে নবীন। কিন্তু তাতে কি? প্রাচীনত্বের চাইতে প্রাণবন্ততার প্রয়োজন অনেক বেশি। কিন্তু ওই যে রনপা লাগানো পায়ে আর কতটা প্রাণশক্তি আশা করা যায়? সে বড়জোর অসম্ভব ভালোরকম একটা অনুকরণ উপযোগী হয়ে উঠতে পারে, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছু হয় না। মৌলিক কিছু হয় না।         তাই আজ আমার কোনো উৎসব নেই। কোনো আবেগ নেই। কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস, জয়দেব, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, বৃন্দাবন দাস, রূপ-সনাতন, নিধুবাবু, রামপ্রসাদ, লালন, কৃষ্ণদাস কবিরাজ, আজু গোঁসাই, কাঙ্গাল হরিনাথ --- এরকম অনেক জানা, আরো অনেক নাম না জানা ভাষার ভগীরথ জন্মালে তবে একটা রবীন্দ্রনাথ আসার পথ তৈরি হয়। রবীন্দ্রনাথ শুধু কবি হলে আজ তার নামটা নিতুম না। তিনি একটা নেড়ি কুকুরের ট্র্যাজেডি না লিখতে পারার অক্ষমতার যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন বলে তার নামটা নিতে হয়... হয় নাই সর্বত্রগামী... তার লাগি কান পেতে আছি...          সেই সর্বত্রের বোধ যে ভাষায় সেখানে আমরা খণ্ডিত, দ্বিধান্বিত। হয় আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসী সম্পূর্ণ বাঙলা ভুলে ইংরাজ হই, অথবা দ্বিধা কাটিয়ে, ঘাটেবাটে নামি, তবে ভাষা সঞ্জীবনী পাবে আবার নতুন করে। ভাষা ধুলোবালি মেখে জন্মায়। সে ধুলো প্রেসে বা বইমেলায় বা সাহিত্যসভায় পাওয়া যায় না। সে ধুলো অজস্র সহস্র পায়ের ধুলো ওঠা জীবনযাত্রায় পাওয়া যায়। যেখানে মানুষ নামের লোভে ফেরে না, প্রাণের টানে ফেরে।
401
Sun, 02/18/2018 - 11:30
 
তোমার ভালো থাকার প্রধান অন্তরায় তোমার ভাবনা। অথবা তোমার ভাবনারা। সেরকম কিছু ভাবনার কথা বলি। (প্রথমে সমস্যারা, শেষে সমাধানেরা)     ১) দ্বন্দ্ব    ----------         তোমার জীবন জুড়ে নানা দ্বন্দ্ব। প্রথম আর প্রধান দ্বন্দ্ব তোমার নিজেকে নিয়ে। তুমি যা আর তুমি মনে করো যা হওয়া উচিত ছিল - তার দ্বন্দ্ব। তুমি নিজের দিকে সরাসরি তাকাও না। তোমার লক্ষ চোখে লক্ষ জন। তুমি তুলনা টেনে চলছ। তোমার চলতে ফিরতে নানা গুরু, নানা নেতা, নানা শিক্ষক। তাদের নানা উপদেশ। সবার নিজস্ব মত তোমাকে নিয়ে - তোমার কি হওয়া উচিত ছিল। ছোটবেলা থেকে তুমি শুনে আসছো তোমায় কি কি হতে হবে; কেমন করে হাঁটতে হবে, খেতে হবে, শুতে হবে, কথা বলতে হবে, প্রেম করতে হবে, আদর করতে হবে, ঝগড়া করতে হবে ইত্যাদি। তোমার চারদিকে কত মত, কত ভগবান, কত আদর্শ। সবারই একটা কথা - 'উচিৎ'। এটা হতেই হবে। ধার্মিক ভাবছে ঈশ্বরের প্রেমে জগৎ না ভাসলে ত্রাণ নেই, কম্যুনিস্ট ভাবছে সবার সমান ধনসম্পদ না হলে সংসারে চূড়ান্ত মঙ্গল নেই, পুঁজিবাদী ভাবছে বেশি মুনাফা যদি না মালিকের ডেরায় ঢোকে তবে মালিক অবসাদে ভুগবে, উৎপাদনের হার কমবে। তোমায় একটা পথ স্থির করতে হবে। জগতের মঙ্গলের একটা স্কিমে গা ভাসাতেই হবে যেন। তারপর শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সায়েন্স ভালো কি আর্টস, কমার্স ভালো কি টেকনোলজি। দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দ্ব। কোথায় যাবে?     ২) ভয়    -----------         তুমি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগো। অহর্নিশি। তোমার মধ্যে নিজেকে প্রমাণ করার অসম্ভব তাগিদ। রাতদিন নিজেকে প্রমাণ করতে চাইছ। নিজের কাছে, সবার কাছে। চাপ নিয়ে ফেলছ না? তোমার মধ্যে রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে প্রতিযোগিতার বিষ। তুমি নিজেও নিজের প্রতিযোগী। তোমার ঘুম নেই। তুমি বিশ্রাম জানো না। তুমি ছুটছ। নিজের ছায়ার সাথে ছুটছ।         তোমার নিজের মধ্যে একটা অপরিবর্তনশীল ভবিষৎ পরিকল্পনা। তার এক চুল এদিক ওদিক হওয়ার সুযোগ নেই। হলেই তুমি গলায় দড়ি দেবে, শুঁড়িখানায় যাবে, না তো অবসাদে ঘরে দোর দেবে। তোমার নিজেকে নিয়ে মেলা অশান্তি। তুমিই তোমার পোষা কুকুর। তুমি বল ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছ, সে মুখে করে করে আনছে। তুমি খুশি হয়ে নিজেকে বিস্কুট দিচ্ছ। পিঠ চাপড়ে দিচ্ছ। জগতের কাছে ভাবের, মানে ইমেজের সেল্ফি পাঠাচ্ছ। (এই সেল্ফি তোলার ব্যামো কি মানুষের আজকের গা? সেই কবে থেকে।) মনে মনে ভয় পাচ্ছ, যদি কাল কুকুরটা বলটা না নিয়ে আসে? আমার কি হবে? তুমি মাঝরাতে উঠে উঠে কুকুরটার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছ। নিজেকে ভুল বোঝাচ্ছ, ভাবছ এ তোমার ভালোবাসা। ভালোবাসায় এত ভয়? এত সূক্ষ্ম হিসাব নিকেশ?         অথচ কুকুরটাকে ছেড়ে দিয়ে একটু নিজেকে মানুষের মত মানুষ হিসাবে দেখবে না। তোমার ঈশ্বর তোমায় ভয় দেখায়, তোমার পুরোহিত তোমায় ভয় দেখায়, তোমার নেতা তোমায় ভয় দেখায়, তোমার ইন্সুয়রেন্সের কোম্পানি তোমায় ভয় দেখায়। তুমি ভয়ের বশ্যতা স্বীকার করেই বাঁচো। কারণ ওর বাইরে গেলে তুমি অস্তিত্বহীনতায় ভোগো। ভয় তোমার অস্তিত্ব, তোমার অভ্যেস। ভয়ে তুমি নিজেকে জীবন্ত অনুভব করো। কারণ সব ভয়ের চূড়ান্ত ভয় তোমার কাছে - স্বাধীনতা। যদিও তুমি মুখে বলো তুমি তাই চাও। কিন্তু চাও না। তাই তোমার এত গুরু, এত নেতার দরকার। আচ্ছা বলোতো, কাউকে শ্রদ্ধা করা আর তাকে অথরিটি মানা এক? শ্রদ্ধা করতে স্বাধীন মনের অধিকারী হতে হয়। আর অথরিটি মানলে সব স্বাধীনতার সব্বনাশ। তুমি দ্বিতীয়টাই চাও। কারণ তুমি নিজের থেকে চিন্তা করতে ভয় পাও। নিজের সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নিতে ভয় পাও।     ৩) পালিয়ে বাঁচা    -----------------------         তুমি রাতদিন পালাচ্ছ। কিসের থেকে? বাস্তব থেকে। যা আছে তার থেকে। তোমার ধর্ম, তোমার রাজনীতি, তোমার শিক্ষা ইত্যাদিও সব পালানোর কৌশল। তাই এত কম বৈচিত্র‍্য। তুমি শুধু চাও একটা কল। যে কলের ধাঁচে সবাইকে ফেলে একটা বিশাল কলেবর বানাও। কেউ যাতে আলাদা করে কিছু ভাবতে না পারে। ওদের শিখিয়ে দাও কি উচিত কি অনুচিত। চোখটা এমনভাবে কাপড়ের রঙে বেঁধে দাও যাতে ওরা কাপড় খুলতে গেলে মনে করে চোখটাই বুঝি উপড়ে গেল। পিছন থেকে চাবুক মারো। মিষ্টি চাবুক। উচ্চাকাঙ্ক্ষার চাবুক। আরো আরো পাইয়ে দেওয়ার গল্প শোনাও। লোভ আর ভয় - পুঁজি তোমার। কাজে লাগাও।         তবে কি আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী? না তো। প্রতিষ্ঠান বলতে যদি পোস্ট অফিস, হাসপাতাল, বিদ্যালয়, স্টেশন ইত্যাদি হয়, আমি তার বিরোধী নই তো। কিন্তু প্রতিষ্ঠান বলতে যদি 'আমরা বনাম ওরা' হয়ে দাঁড়ায় তবে তবে তো সমূহ বিপদ। ধর্ম, রাজনীতি, নানা ইজ্‌ম - এরা তাই তো করে।         আরো সমস্যা আছে। তুমি তোমার স্মৃতিতে বাঁচতে চাও। সেও পালানো। বাইরের জগতে তোমার জীবিকা ইত্যাদির জন্য তোমার স্মৃতিশক্তি ভীষণ জরুরী। কিন্তু তুমি নিজেকে সে স্মৃতির খাঁচায় দেখো। সারা বিশ্বের হাজার তত্ত্বকথা, হাজার নীতিকথায় স্মৃতির কোটর ভর্তি। তুমি পালাচ্ছ। তুমি নিজে বাস্তবে যা অনুভব করছ তার থেকে তুমি বাইরে যেতে চাইছ তোমার অতীতের রূপরেখায় অবগাহন করে।       উপায়    --------- ১) তুমি নিজে একটা অপঠিত বই। প্রথমে তাই দিয়েই শুরু করো। নিজেকে পড়া অভ্যাস করো। সে বইয়ের পাতা উল্টাবে কি করে? নানা সম্পর্কে। সম্পর্করাই তোমায় চেনাবে তুমি কে? সব সম্পর্কে সচেতন থাকো। একটা গাছের পাতা ঝরে যাচ্ছে তোমার সামনে, তুমি কি খেয়াল করছ? দেখো। তোমার সাথে সব কিছু সম্পর্কের সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হও। নিজেকে চেনার এ সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কিভাবে? ২) Passive Awareness অভ্যেস করো। নিষ্ক্রিয়ভাবে সচেতন থাকো। Judge কোরো না, তুলনা কোরো না। সব কিছুকেই বিচার করার, মতামত দেওয়ার অভ্যেসটা ছাড়ো। ওতে তোমার মানসিক স্থিতি নষ্ট হয়। জ্ঞাত থাকো, কিন্তু ঘেঁটে থেকো না। কিভাবে? ৩) ভালোবাসো। ভালোবাসা বিচার করে না। ভালোবাসা দ্রষ্টা আর দ্রষ্টব্যের মধ্যে বিভেদ ঘুচিয়ে দেয়। মা সন্তানকে দেখতে দেখতে নিজেও সন্তানবৎ নিজেকে অনুভব করেন বলেই তার কোন কান্না কিসের তা টের পান। শিল্পী একটা ফুলের মাধুর্যে মগ্ন হয়ে নিজে সেই ফুলের সত্তায় জাগরিত হন, ফুলের মাধুর্য তার চোখে ধরা দেয়। তুমি পরিপূর্ণ হৃদয়ে জীবনটার দিকে তাকাও, জীবনও তার সব মাধুর্য উজাড় করে তোমার সামনে মেলে ধরবে। তুমি নিজেই এই বিশাল মনুষ্যত্ব। কিছুই তোমায় ছেড়ে নেই। হতে পারে না। এই অসীম আকাশ হোক তোমার সীমারেখা। ছোটো হয়ো না, কাউকে ছোটো কোরোও না।
402
Sat, 02/17/2018 - 11:13
  চারটে কৌশল। ভালো থাকার। মনকে ভালো রাখার। বুদ্ধধর্মে একে বলে 'ব্রহ্মবিহার'। কথাটা শক্ত। ব্রহ্ম অর্থে আনন্দ বুঝে নিলে হ্যাপা নেই। গুরুদেব বলেন, সত্যকে পাই নিয়মের মধ্যে আর আনন্দকে পাই সৌন্দর্যের মধ্যে। চিন্তার জলে ভাবের স্রোত। অববাহিকা আমার হৃদয়, মানে আমি। ডুবছি আর ভাসছি। বিরাম নেই। কখনও আবার নিজের তৈরী ঘূর্ণিতে ফাঁসছি। ত্রাহি ত্রাহি রব। নানা মানুষের সম্ভার নিয়ে সংসার। এত বিচিত্র গতিতে হাল ঠিক রাখি কি করে? সেই নিয়েই কথা। এর মধ্যেই ভালো থাকার একটা প্রাচীন কৌশল নিয়ে খানিক কথা বলার ইচ্ছা।     ১) মৈত্রী  ------------         সোজা কথায় বন্ধুত্ব করার ইচ্ছা। যেমন শুনেছিলাম না, অভিসার মানে ততটা যাওয়া নয়, যতটা যেতে চাওয়া - এও খানিক সেই ধারায়। ততটা বন্ধুর সংখ্যা না যতটা আমার মধ্যে বন্ধুত্বের ইচ্ছা। বন্ধুত্বটা কার সাথে? সারা পৃথিবীর সব মানুষের সাথে? না। দস্তয়েভস্কি বলছেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ 'The Idiot'-এ, 'একজন মানুষের চাইতে মনুষ্যত্বকে ভালোবাসা ঢের সোজা', তাই তো, সেখানে তো আর প্রতিপদে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। নিজের ভাবে মনুষ্যত্বের রূপ বানিয়ে মনে মনে ভাববিলাসে থাকলেই হল। তারপর ভীড় ট্রেনে, টিকিটের লাইনে, প্রতিবেশীর সাথে জমি ভাগাভাগিতে স্বরূপ বেরিয়ে পড়বে ক'দ্দুর মানবপ্রেম হয়েছিল।         তবে বন্ধুত্বটা কার সাথে? সজ্জনের সাথে। যার কাজে কথায় অনুকম্পায় সুহৃদ হয়ে বাঁচার ইচ্ছা আছে। তার সাথে। বন্ধুত্ব কি দেবে? বন্ধুত্বই দেবে। এখানে বুদ্ধ একটা ফেঁকড়ির কথা বলে রেখেছেন অবশ্যি। বন্ধুত্ব আর মৈত্রী'র মধ্যে একটা ফারাক আছে। মনে রাখতে হবে যে আলোচনাটা হচ্ছে তার মূল উদ্দেশ্য মনের শান্তি, স্থিরতা। তাই ফেঁকড়ির কথাটাও বলে রাখা। বন্ধুত্বের মধ্যে যে আসক্তির ভাব আছে মৈত্রী'র সে দায় নেই। তাই আমাদের মধ্যে যে চিপকে-চিপকি বন্ধুত্ব আছে, যেখানে মান অভিমানের গল্প আছে সেখানে এ তত্ত্বের কথা হচ্ছে না। সে তো থাকবেই। কিন্তু তাদের সংখ্যা আর কত? আর তাদের জন্য কোনো টিপস কারোর থেকে জানতে হয় না। হিংসা-অহিংসা, মারধোর , গালাগাল সব চলে সেখানে। আহা, সে যে মথুরা, বৃন্দাবনের কেস। সেখানে বুদ্ধ বাবাজির কি কাম? আমাদের কথা হচ্ছে, আমাদের সেই অন্দরমহলের বৃত্ত ছাড়ালে যে মহৎ জগৎ, সেখানে মনের সাথে বোঝাপড়ার গল্প। তো সেইখানে দরকার মৈত্রী - সজ্জনের সাথে। ভাবটা বড় কথা, ঘটনাটা নয়, বুদ্ধের মতে।         কিন্তু সজ্জনের সাথে তো এমনিই মনের স্থিতাবস্থা থাকে। তার জন্য এই ভাব অভ্যাসের কারণ কি?         আছে। 'আমিও কি কম ভালো মানুষ? বরং সদগুণে হয়ত ওর থেকে বেশিই হবে' - এই হল ক্যাঁচাল। ইগো ঘটিত চাটনি। ঝাল চাটনি। তারে ভাগানোর কথা বুদ্ধ বলছেন। যাও, গিয়ে বন্ধুত্ব করো, এবং মনে মনে বন্ধুত্বের ভাব পোষণ করো।     ২) করুণা  ---------------         চারপাশে বহু অসুস্থ, দরিদ্র, উৎপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্থ মানুষ আছে। তাদের প্রতি ভাব থাকবে করুণার। বুদ্ধের মত এমন। কথা হল, এরকম মানুষ আমার চিত্তবিকলের কারণ হবে কেন? আমি তো যথেষ্টই দয়ালু এদের প্রতি! তবে?         বুদ্ধ বলছেন, সমস্যা আছে। তুমি এরকম অবস্থায় কোনো মানুষকে দেখলেই ভাবো, আমার এরকম হবে না তো? হে ঠাকুর এরকম যেন আমার না হয়!         ব্যস, চটকে গেল তোমার মানসিক স্থিতি। মনের মধ্যে ভয়, আতঙ্ক, আগাম অশুভের আশঙ্কা। বুদ্ধ বলছেন, এ ভাব প্রশ্রয় দিও না। তোমায় দুর্বল করবে। তুমি মনের মধ্যে করুণার ভাব রাখো। চিন্তারা সুষ্ঠ হবে। ভয়রহিত হবে। ওই যে বললাম, চিন্তার জলে ভাবের স্রোত। স্রোতের অভিমুখ বদলাও।     ৩) মুদিতা  --------------         এ হল ঈর্ষার প্রতিষেধক। অন্যের প্রাপ্তিতে, উন্নয়নে আন্তরিক তৃপ্তিলাভের অভ্যাস করা। নইলে জীবন পুড়ে খাক হয়ে যাবে। রাসেল মহাশয় ওনার 'Conquest Of Happiness' বইতে গোটা একখান চ্যাপ্টার রেখেছেন Envy -র উপরে। এ বড় আজিব মনোভাব; মানে এই ঈর্ষা, বা অসূয়া, বা পরশ্রীকাতরতা। কোনো পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না। অমুকের এটা হয়েছে শুনলেই রাতের ঘুম গেল। সে কি করে পেল? আমি কেন পেলুম না? আমার ভাগ্য কেন এত রূঢ়, নির্দয় আমার প্রতি? হে ঈশ্বর তুমি কেন এমন পক্ষপাতিত্ব করো? ইত্যাদি ইত্যাদি...         বুদ্ধ বললেন, কারোর সৌভাগ্যে খুশি হও। অভ্যাস করো। ভাব বদলাও। অভিনন্দন জানানোর আগে নিজের চিত্তকে বড় করো, তাকে অভিনন্দিত করার আগে নিজে অভিনন্দিত হও। আনন্দিত হও। দেখো প্রফুল্ল হবে মন। চলতে ফিরতে হাল্কা লাগবে। যে কোনো কারোর সৌভাগ্যে আর মুষড়ে পড়তে হবে না মনে মনে। ভিতরে ভিতরে গুমরে মরার চাইতে ঢের গুন ভালো নয় কি যে ভাবের স্রোত বদলে ফেলা? আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এই একটি ভাব যদি মন থেকে উপড়ে ফেলা যায় মনের প্রায় ৯০ শতাংশ শক্তির অপব্যয় বন্ধ হয়ে যায়। বহু অযৌক্তিক তুলনার কাঁটাঝোপ থেকে বেরিয়ে খোলা মাঠে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। তাই বুদ্ধ বলছেন, প্রসন্ন হও। যদি তুমি অন্যের আনন্দে সামিল হওয়ার কৌশল শিখে গেলে, তবে তোমার জীবনে আনন্দের, উৎসবের আর অভাব হবে না। কুচুটেমি ছাড়ো। ঝাঁপ দাও আনন্দ সাগরে।     ৪) উপেক্ষা  ----------------         সংসারে গোলমেলে মানুষের অভাব নেই। দুর্বিপাক, দুর্ভাগ্য তো পায়ে পায়ে। সবসময় কি তার থেকে বের হওয়ার পথ থাকে? থাকে না। সেক্ষেত্রে মহৌষধি হল - উপেক্ষা।         আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এটি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আজকের দিনে। মানে এই বাজারি সভ্যতায়। রাতদিন প্ররোচনা আর কৃত্রিম অভাবের হাহুতাশের আবহাওয়ায় সুস্থ বাঁচতে গেলে। কথাটা হল কতটা উপেক্ষা করা যায়?          উপেক্ষা মানে কি উদাসীন কিম্বা নির্লিপ্ত থাকা? না। অমন নেগেটিভ কথা না। ভাবটা পজিটিভ। উপেক্ষার অ্যান্টিবায়োটিক। নির্লিপ্তি বা উদাসীন হয়ে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে থাকা নয় কো।         তা বলে কি সব অন্যায় সহ্য করব?.... সব মেনে নিতে হবে?.... অমুক আমাকে ঠকিয়ে তমুক করে নিল, আমি হাত পা গুটিয়ে বসে থাকব?....         হ্যাঁ তাই। আমার খুব কাছের এক বন্ধু একবার বলেছিলেন, সারাক্ষণ সজারুর মত কাঁটা ফুলিয়ে বেঁচে থাকা যায় না... আগাছায় জল না দিলে সে উপেক্ষাতেই মরে। কথাটা মনে খুব ধরেছিল। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়, অনেক ঝুটঝামেলা একটু উপেক্ষা করলেই এড়ানো যায়। গায়ে পড়ে অশান্তি আসবে না তা বলছি না, কিন্তু গায়ে মাখব কি মাখব না - সেটুকু স্বাধীনতা নিজের মধ্যে অর্জন না করলে তো বিপদ। মনের খাতায় FIR জমতেই থাকবে, মনের বোঝা বেড়েই চলবে, আর আমি আমার সদবুদ্ধির নাকে তেল দিয়ে 'জ্বলে গেলাম, পুড়ে গেলাম, মরে গেলাম' করে দাপিয়ে বেড়াব... বলি কত কষ্ট করে যে মহিলা আমায় দশ মাস পেটে ধরে, নিয়ে, খাইয়ে, পড়িয়ে বড় করেছেন, সেকি এই জন্যে?         উপেক্ষা সাধতেই হবে। 'চারদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারি / ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি'               এর পুরো প্যাকেজের বিস্তারিত রূপ জানতে হলে গীতবিতান তো রইলই। পাতা উল্টিয়ে, মনকে দু' ঝিনুক সে অমৃত পান করালেই হল। মন তো কত্তা আমার, তাকে যেমন মানুষ করব তেমনই হবে। লাভ-ক্ষতির চাইতে বড় কথা স্বস্তিতে বাঁচতে দেবে না গা! এমন ট্যুরে এসেছি, চারদিকে কত কিছু! কিছুই দেখা হবে না! অমন বেয়াদপ ছেলে নিয়ে ঘোরা যায়? তাই শুদ্বোধনের ছেলেটার কথা কিছু বলে রাখলাম। বড় ভালো মানুষটা ছিলেন তো। তা তিনি কি আর আপনার আমার খারাপ চাইবেন? সেই আর কি...
403
Thu, 02/15/2018 - 19:30
  তখন আমার অশৌচ। মা চলে গেছেন। সবাই বলল, মন্দিরে যেও না, শুভ অনুষ্ঠানে যেও না, তোমার অশৌচ। এক বছর। প্রথম কয়েকমাস কিছু বুঝলাম না। পরে ধীরে ধীরে বুঝলাম কথাটা কত গভীরে কাজ করে গেছে।          একদিন বাজারে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম। খুব অস্বস্তি হতে শুরু করল। প্রথমটায় বুঝলাম না কেন। তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরে এলাম। ছাদে অনেক রাত অবধি একা পায়চারি করলাম। বুঝলাম আমার অস্বস্তির কারণ কি। আমার বোধ হয়েছে, আমি অশুচি, আমি অপবিত্র। আমার উপস্থিতিতে সব কিছু অমঙ্গল হবে। আমি মূর্তিমতী আপদ একটা। আরো গভীরে হাতড়ালাম। মন বলল, তুমি অমঙ্গল, তাই তোমার মাকে হারালে।          পাড়ায় একজন আত্মীয়তুল্য চিকিৎসকের মেয়ের বিয়ে। খুব করে বলেছিলেন যেন যাই। গেলাম। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই বুঝলাম আমার শরীর খারাপ লাগছে। মাথা ঘুরছে। ঘাম হচ্ছে। আমি অশুচি। আমার অশৌচ চলছে। আমার উপস্থিতিতে সব নষ্ট হবে। এখন না হলেও পরে হবে। হবেই হবে। আমি এক ছুটে অভদ্রের মত বেরিয়ে এলাম। আমার মন বলতে লাগল, পালা.. পালা!         মজার কথা হল, এগুলো কোনোটাই আমি সচেতনভাবে ভাবতাম না। অবচেতনের স্তর থেকে কথাগুলো উঠত। যেখানে আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। না শোনা যেত হয়ত, কিন্তু তখন আমি শোকে বিহ্বল, দিশাহারা।          আমি লোকজন, মেলামেশা, বাইরে হাঁটতে যাওয়া সব বন্ধ করে দিলাম ধীরে ধীরে। শুধু কয়েকজন বন্ধু ছাড়া কারোর সাথেই কথা বলতাম না। যদিও পড়ানোতে কোনো ছাপ ফেলত না এই পরিবর্তনগুলো। এক কথায় গৃহবন্দি করে ফেললাম নিজেকে।           কদিন এভাবে চলত জানি না। তবে আমায় বাঁচালো কবিতা। লেখার নেশা আর কবিতা পড়ার মধ্যে ডুবে যেতে লাগলাম। আমায় সুস্থ করল রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ-বিষ্ণু দে-সুনীল-শঙ্খ-শক্তি-নীরেনবাবু-অরুণ সরকার- গালিব- জাভেদ-গুলজার-ফৈজ। ইংরাজিতে poemhunter বলে একটা সাইটে প্রচুর কবিতা পেলাম বিশ্বের নানা ভাষার বিখ্যাত কবিদের। একটা নতুন ধর্ম আবিষ্কার করলাম। কবিতার ধর্ম। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম না। কোনো ঈশ্বরের স্তবস্তূতি না। আমি তুমি বা আমরা তোমরা না। স্রেফ, এক এবং একমাত্র কবিতা। বাইরে বন্ধুরা ছিল না তা নয়। কিন্তু যেখানে নিজেকেই নিজে সহ্য করতে পারছিলাম না, সেখানে বাইরে থেকে কারোর সাহায্য কি করতে পারে? তবু বর্ণনাতীত সাহায্য পেয়েছিলাম বন্ধুদের কাছে থেকে অনস্বীকার্য।  ক্রমে সুস্থ হতে শুরু করলাম। এরই মধ্যে Suman এর অতর্কিতে আমার লেখা ফেসবুকে দিয়ে ফেলা। ফেসবুকে বসবাসকারী নানা অসামান্য মানুষদের সাথে পরিচয়। যেন নতুন পাড়ায় বাসা পেলাম। জীবনের আরেকটা অধ্যায় শুরু হল।           এই কথাগুলো হঠাৎ কেন বললাম? আজ একই ঘটনা আবার দেখলাম। একজন মহিলা, সদ্য বিধবা হয়েছেন। কর্মরতা, কিন্তু উচ্চ- শিক্ষিতা নন। তিনি তার বোনের মেয়ের পাত্র দেখতে যেতে পারবেন না, শুভকাজে যাবেন না, কারণ....         জানাই তো। আর নাই বা বললাম। কিন্তু এ প্রথাগুলো মাথা পেতে নেওয়ার মধ্যে যে কোনো গর্ব নেই তা তাকে বোঝাতে পারলাম না। এটা নাকি আমাদের ঐতিহ্য। "মেয়ে মানুষের এরকম কিছু উপোষ-কাপাস, নিয়ম-টিয়ম না মানলে সমাজ টিকবে?" এক সমাজে কত সমাজ! উপরের স্তরে হয়ত আলো পড়ছে, কিছু ভাঙছে। কিন্তু নীচের স্তরগুলো সেই অন্ধকারেই ডুবে। শিক্ষার অভাব না সাহসের? অন্যায়কে অন্যায় বলতে বিশাল কিছু বিদ্যাবুদ্ধি লাগতে দেখিনি। লাগে একটা সতেজ কমোন সেন্স।আর সব চাইতে ভয়ংকর সেই যে বিশ্ব-বিদ্যালয়ের পথ বন্ধ করে না (কারণ সেখান থেকেও প্রচুর অমেরুদণ্ডী জন্মাতে দেখেছি), যে কমোনসেন্সকে আড়াল করে দাঁড়ায় সেই প্রথা/ধর্ম/আচার যাই হোক না কেন।          তখনই মনে হল, সেই ভাষায় কবিতা লেখা যায় না যেই ভাষায় একজন অল্পশিক্ষিত মানুষও কবিতার মর্মে ঢুকবে? কারণ কবিতার মত এমন নিঃশব্দে, মাথার মধ্যে তথাকথিত যুক্তিবাজীর সিনক্রিয়েট না করে কে হাড়েমজ্জায় ঢুকতে পারে?          সে "লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ" হোক, কিম্বা "আজ আমাদের ন্যাড়াপোড়া কাল আমাদের দোল".... এরকম সুরে। শুধু কথাগুলো অন্য হবে। নতুন শব্দের নেহাই পড়বে এই অচলায়তনের ভিতে? হয় না? কবিতার মত বিশল্যকরণী আছে নাকি? Top of Form  
404
Sun, 02/04/2018 - 13:23
    আদতে একটা মানুষ নিজে ভালো না হলে কি কারোর ভালো বন্ধু হতে পারে? ‘বন্ধুর মত’ হতে পারে, কিন্তু বন্ধু হয়ে ওঠা কি এত সোজা? তাকে দিয়ে আমার কিছু প্রয়োজন মেটে আর আমাকে দিয়ে তার, এটা একটি চলতি বন্ধুত্বের মতন কিছু একটা হলেও বন্ধুত্ব তো নয়। যার সঙ্গে স্বস্তি আর তোষণ তবে কি সেই বন্ধু? কিছুটা সত্যিই হলেও পুরোটা কি? নয়। কারোর সঙ্গই সদা-সর্বদা সুখের কারণ হতে পারে কি? পারে না। তাই স্পেস বলে একটা কথা আছে। স্পেস তো শুধু স্থানের না, সময়েরও। আর তোষণের বিকার তো আছেই। যে ভুল পথে যাচ্ছে তাকে তুষ্ট করতে চাওয়ার জন্য তার সাথে বিপথে যাওয়া কি বন্ধুত্ব? তবে বন্ধুত্বর বীজটা কোথায়?          মানুষ প্রথম যে জায়গায় নিজেকে অনুভব করে, সে তার একাকীত্বে। একাকীত্ব সসঙ্গ আর নিঃসঙ্গ দুই-ই হতে পারে। যদিও প্রথমটা দ্বিতীয়টার থেকে পীড়াদায়ক বেশি। সেই একাকীত্বের সাথে বন্ধুত্ব একটা মানুষের প্রথম কাজ। সেখানে ফাঁকি থাকলে তার জীবনে একটার পর একটা ফাঁকিই জমতে থাকে শুধু। তার সব কিছুই তখন সেই একাকীত্ব বা শূন্যতা বোধের পরিপূরক। সে আদতে কাউকে চায় না, সে নিজের সেই একাকীত্ব থেকে বাঁচতে চাওয়ার একটা বিকল্প খোঁজে। সে সহজেই আসক্ত হয়ে পড়ে, তার বন্ধুত্বের ফাঁস কিছুতেই গলার নীচে নামতে চায় না, অতন্দ্র প্রহরীর মত সর্বক্ষণ সন্দেহে জেগে থাকে আর প্রতিক্ষণে কৈফিয়েৎ দাবী করে – এ সুস্থ বন্ধুত্ব নয়। প্রথম প্রথম মনে হতে পারে, ‘আহা রে আমি কি গুরুত্বপূর্ণ মানুষটার কাছে’ কিন্তু সেই আরামই ক্রমে হাসফাঁসের কারণ হয়ে উঠবে, রুদ্ধ লাগতে শুরু করবে চারদিক। কারণ যে নিজের একাকীত্বকে সম্মান করে না, সে অন্যের একাকীত্বকেও সম্মান করে না, তার মর্যাদা রাখে না। সে তার সেই একাকীত্বকেও ঈর্ষা করে বলে, “কেন তুমি আমায় ছাড়া ভালো আছো? হতেই পারে না। আমায় ছাড়া তুমি একা থাকতেই পারো না (কারণ আমি পারি না, আমার তোমায় খুব প্রয়োজন, তোমার জন্য না, আমার জন্যে)।“          কিন্তু এই একাকীত্বের সাথে বাস করাটা যখন রপ্ত হয়ে আসে সুস্থ ভঙ্গীতে তখন নিজেকে নিজের মধ্যে স্বাবলম্বী হিসাবে পাওয়া যায়। সে তখন বন্ধুত্বের প্রয়োজনে ফেরে না, বন্ধুর প্রয়োজনে ফেরে। বন্ধুত্ব একটা একাকীত্ব, একঘেঁয়ে বেঁচে থাকার বিকল্প। যা বলছিলাম আগেই। তবে এ একাকীত্বকে কি করে বশে আনা যায়? কথাটা ভুল হল, একাকীত্ব বোধের যন্ত্রণা থেকে কি করে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রথম শর্তই হল, এটা বুঝতে হবে, আমার সাথে সব সময় যে থাকে সে হলাম আমি। ‘আমি’ একটা অস্তিত্ব। আবার সেই ‘আমি’ কে সব সময় পর্যবেক্ষণে আর তুলনা বিচারের মধ্যে যে রেখেছে সে একজন পর্যবেক্ষক, সেও আমার অংশ, তবে সে অনেকটা বাইরের মশলায় তৈরি, মানে বাজারী মশলায় আরকি। সে সব কিছুর সাথে সব কিছু তুলনা করে, বিচার করে। বলে,”তুমি ওর মত কেন হলে না”। এই ‘পর্যবেক্ষক আমি’ আর ‘অস্তিত্ববান আমি’ র মধ্যে যে সমঝোতা করায় সে হল আমার স্বাভাবিক বুদ্ধি। তার পরিমিতি বোধ আছে, সংযম আছে, রুচি আছে। কিন্তু তার তাড়া নেই, মাতব্বরি করার সাধ নেই। ফলে তার কথা শোনার দায়ও নেই। কিন্তু দায় না থাক, মঙ্গল অবশ্যই আছে। সেই বুদ্ধির অনুগামী হয়ে চলাতেই একাকীত্বের সাথে সহবাস সম্ভব। এ হল মোদ্দা কথা। ছবি এঁকে, গান গেয়ে, নেচেকুঁদে, কবিতা লিখে সে থেকে পরিত্রাণ নেই, সে সবের ক্লান্তি আছে। যদি না তারা সেই শুভ সাধারণ বুদ্ধি দ্বারা অভীদীপ্ত হয়ে থাকে।          এই বোঝাপড়াটা হয়ে গেলে তো তার আর কারোর প্রয়োজনই থাকবে না? তখন সে বন্ধু নিয়ে কি করবে?          ভুল কথা। বন্ধু কোনো খাদ্য না যে খিদে পেলেই কাজে লাগে। কোনো অভাবের পরিপূরক হয়ে সে আসে না। বন্ধু পরিপূর্ণ হৃদয়ের গভীর আলিঙ্গন। সেই বন্ধুত্ব স্থায়ী, সেই বন্ধুত্ব সুস্থ। কারণ সে দুই পূর্ণের মিলনের ফলে জাগে। সেখানে দৈন্য নেই, সেখানে অভিযোগ নেই। তবে সে দীঘির মত নিস্তরঙ্গ নয়, সে সমুদ্রের মত গভীর, প্রাণোচ্ছ্বল, আনন্দে টইটুম্বুর। সব প্রতিকূলতার মুখে সে দাঁড়াতে পারে, কারণ তার মধ্যে কোনো গোপন শর্ত বা মতলব নেই। এই বন্ধুত্ব অর্জন করতে হয়, পালন করতে হয়, চর্চা করতে হয়। আর দায়বদ্ধতার থেকে গভীর বন্ধন হৃদি-বদ্ধতা। দায়বদ্ধতার বিকল্প, ফাঁকিবাজির পথ থাকে, কিন্তু হৃদি-বদ্ধতাতে সেই ফাঁকির ইচ্ছাটা জন্মানোর অবকাশই মেলে না, তো ফাঁকির প্রশ্নই ওঠে না। এ জীবনে সে এক পরম সম্পদ। বন্ধুত্ব বন্ধুর সাথেই হয়, ‘বন্ধুর মত’ র সাথে হয় না। সে কোনো প্রশ্নের উত্তর নয়, তার কোনো বিকল্প নেই, সে পরিপূর্ণ হৃদয়ের তৃষ্ণা, তাই তার কোনো উপমাও নেই।
405
Fri, 02/02/2018 - 10:58
  তুমি তোমার মূর্খামিতে খাঁটি এ নিয়ে নাই সন্দেহ   কিন্তু তোমার মূর্খামির সাথে কি করে হাঁটি?             আপনি শপিং মলে কেন যান? আগে গুচ্ছের টাকা বাণ্ডিল করে বাইরে যেতেন, এখন ডেবিট, ক্রেডিট কত কার্ড। আবার ডেবিট কার্ডেরও কত প্রকার। এত কার্ডের বহর কেন? আগে গান শুনতে একরকম ক্যাসেট, সিনেমা দেখতে আরেক রকম ক্যাসেট ছিল, এখন নেই; সব সিডি, পেনড্রাইভে কেন?         মোদ্দা কথাটা হল মানুষ একটা প্যাকেজ চায়। আগে ঘুরে ঘুরে বাজার করা হত, এখন একটা বড় বিল্ডিং-এ ঢুকে যাও, সব আছে। এত টাকা নিয়ে ঘুরব কেন? এক টুকরো প্লাস্টিক যন্ত্রে ঘষলেই টাকা বেরোবে – প্যাকেজ। একটু ভালো করে ভাবলেই দেখা যাবে, আমরা সব কিছুকে সহজ করা বলতে একটা ছন্দে বা একটা সিস্টেমে আনতে চেষ্টা করে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছি।         ধর্ম – প্রাচীনতম প্যাকেজ। কি করে? আসছি, তার আগে আরো খানিক গৌরচন্দ্রিকা করা বাকি। মানুষ আবেগ আর বুদ্ধির একটা সমন্বয়। কোনো প্রাণীর ‘কারণ’ লাগে না বাঁচতে। মানুষের লাগে। কোনো প্রাণীর ব্যাখ্যা লাগে না কোনো কিছুর। মানুষের লাগে। এত প্রশ্ন, এত জিজ্ঞাসা, এত অনিশ্চয়তা, এত দ্রুত পরিবর্তনশীল জগতের এত বৈচিত্র‍্যময়তা – মানুষ ভয় পেয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী। সে জল, আকাশ, আগুন, বাতাস ইত্যাদিকে পারসোনিফায়েড করে একটা ব্যাখ্যা খুঁজেছিল। তাও হল না। তার আরো বড় কোনো ব্যাখ্যা দরকার হয়ে পড়ল। যাতে এই নানা বিরুদ্ধ ব্যাখ্যারা একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারে। একটা পরম ব্যাখ্যা – তার একেশ্বরবাদ।         কিন্তু মুশকিল হল মুসলিমের সেই 'এক'র সাথে, হিন্দুর 'এক' মিলল না। হিন্দুর 'এক'র সাথে খ্রীষ্টানের 'এক' মিলল না। সে অন্য কথা। এক অনন্তে নানা অনন্ত। কি করে হয়? হয় না তো! তবু হয়। আর তার থেকে বড় ট্রাজেডিটা হচ্ছে ধর্মের মহৎপ্রাণ মানুষের সংখ্যার চাইতে ধর্মের অন্ধ অনুসারীর সংখ্যা এত বেশি যে প্রথম জনেরা দৈনন্দিন সামাজিক জীবনে প্রায় ঠাঁই-ই পান না। আমির খুসরু'র ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব আর লাদেনের ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব তুলনা টানলেই বোঝা যাবে। এ তো গেল অনেক বড় ক্ষেত্রে উদাহরণ। প্রতিদিনের জীবনে কত মানুষের প্রাণ সংশয় হচ্ছে, বেঁচে থাকা অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে এই প্রবল ধর্মবিশ্বাসের ফলে সে কি চোখে আঙুল দিয়ে আর দেখানোর প্রয়োজন আছে?         আমাদের সামনে সত্যিকারের দুটি বড় চ্যালেঞ্জ – এক ধর্ম নিজে। আর দুই নানা ছদ্ম বিজ্ঞানবেশী ধর্ম। দ্বিতীয়টা বেশি ভয়ংকর। কারণ সে ছদ্মবেশে মারে। ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান’ – নামক যে ক'টা বই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে তার একটু গভীরে আলোচনা করতে গেলেই বিপদ। বক্তাও চান না, শ্রোতাও চান না। কেন চান না? আর সেটাই আমার আলোচ্য বিষয়।             এইটা লিখব কেন মাথায় এলো? কাল একটা ভূমিকম্প হল দিল্লীতে। কাল সুপারমুনের ওপর নানা শো ছিল। আমার অত্যন্ত পরিচিত দু'জন শিক্ষিত মানুষের আলোচনার বিষয় ছিল, এই দুটির মধ্যে সাদৃশ্যতা। সে আলোচনার বিশদ বিবরণে যাওয়ার মত রুচি আমার নেই। কিন্তু কেন তারা যেতে চাইছেন না এই প্রাচীন বিশ্বাসগুলোর বাইরে?         কারণ একটাই – প্যাকেজ কেন ছাড়ব? প্যাকেজের নিশ্চিন্ততা কেন ছাড়ব? বিজ্ঞান আমায় ‘কি করে’ বলতে পারবে। ‘কেন’ ব্যাখ্যা দিতে পারবে? পারবে না। তাই আমি শুনবও না। কি করে বাঁচতে হবে, কি করে জীবন ধারণ করলে আমার কোনো বিপদ হবে না, আমার কোনো ক্ষতি হবে না। আমার মৃত্যুর অন্ধকারে সবটুকু আশা-ভরসা শেষ হয়ে যাবে না, সে খবর বিজ্ঞান দিতে পারবে? পারবে না। তাই আমিও শুনব না। ধর্ম আমাকে সব কিছুর ব্যাখ্যা দিতে পারে। সব কিছুর একটা উদ্দেশ্য দিতে পারে। আমায় ভালো হতে, আমায় স্বজনের জন্য স্বার্থত্যাগ করতে, আমায় কারা পাপী, কারা শত্রু, তাদের মারতে, তাদের ঘৃণা করতে, ঘৃণা না হলেও করুণা করতে, একজন রাজার মত, মায়ের মত, বাবার মত, বন্ধুর মত, স্বার্থগন্ধহীন সুহৃদের মত অদৃশ্য শক্তিকে হাতের নাগালে দিতে... ইত্যাদি ইত্যাদি কত শিক্ষা দিয়েছে, দিয়ে আসছে। আমি কেন ছেড়ে দেব? আমি কেন এ কম্ফোর্ট জোন ছেড়ে বাইরে আসব? বিজ্ঞান আমার দাস। বিজ্ঞান আমার ভীতি নিবারক। কিন্তু বিজ্ঞান আমার দোসর হতে পারে না! কারণ বিজ্ঞানকে পার্সোনিফায়েড করা যায় না! যদি মাধ্যাকর্ষণ বল নিউটনের পূজায় আমার সখ্যতা স্বীকার করে, তবে নিশ্চয় বিজ্ঞানকে আমি আমার অন্দরমহলে ঠাঁই দেব, নইলে কেন? সে থাকুক আপন নৈর্ব্যক্তিক সত্তা নিয়ে বাইরের দরজায়। ডাক পড়লেই যেন হাজির হয় – তাহলেই হবে। এই হল আমাদের মোটের উপর ধর্ম আর বিজ্ঞানের সহাবস্থান। তা হলে কেন বের হব? কে বার করতে চাইবে? চলছে তো দুটোই পাশাপাশি।         কথাটা কি তবে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা নিয়ে? আদৌ তা নয়। আস্তিক তো সবাই। যখন সে একা, নিজের সাথে এই বিশ্ব চরাচরের যে একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে, সেই সম্পর্কের মাধুর্যে বুঁদ হওয়াই তো আস্তিকতা। আমার বোধের গভীরে একটা গভীর বোধ আছে যার আলোতে আমি জ্ঞাত হই আমার জ্ঞানের অস্তিত্বকে। সেই তো আমার অন্তর্যামী। সে কি পারসোনিফায়েড? হ্যাঁ, আবার না। 'হ্যাঁ', কারণ আমি পার্সোনিফায়েড। আমার সেই পার্সোনিফায়েড হওয়ার প্রবৃত্তির বাইরে যাওয়ার চেষ্টা আমি যতই করি না কেন, তা কিছুতেই খাঁটি হওয়ার নয়। তাই সব সত্যই কোথাও শেষে গিয়ে –মানবসত্য। আবার পাশাপাশি ‘না’, কারণ আমার ভিতরেই একটা নৈর্ব্যক্তিক সত্তা আমায় রাতদিন আমার সীমার বাইরে যেতে আমায় ডাকছে। তবে দাঁড়াব কোথায়? কোনো একটা তত্ত্বে বা মতে দাঁড়াবার নেই। একটা নৌকা হলে চলমান স্রোতের মধ্যে বেয়ে চলা যায়, সেই নৌকাটা আমার বোধ। সে ব্যক্তিও বটে আবার নৈর্ব্যক্তিকও বটে।         সমস্যাটা এত অবধি জন্মায় না। সমস্যাটা জন্মায় যখন আমি সে মরমী সম্পর্কের জায়গায় দল পাকিয়ে নিজের জগৎ তৈরিতে মাতি আমার নিজের ব্যাখ্যায়, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থবুদ্ধির অনুকরণে। তাতে আরাম মেলে, সুরক্ষা মেলে, স্বস্তি মেলে – সত্য মেলে না। ফলে ধর্মের সামগ্রী শুধু বাণী হয় না, বোমও হয়। যে শেখায় সে যখন অনুকরণকেই সমস্ত সত্যের মূল ভিত্তি মনে করে, তখন ভয় আর আশঙ্কা তাকে আরো বর্বর করে অনায়াসে তুলতে পারে। যে বর্বরতাকে সে নিষ্ঠা আর ব্রতের আড়ালে ঢেকে রাখে।         এ তো গেল ধর্মের ভয়। এর থেকেও ভয়ংকর আমাদের ছদ্ম-বিজ্ঞান। যেখানে নাকি আত্মার অস্তিত্ব আর পদার্থ বিজ্ঞানের অস্তিত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠছে। এটা বিষাক্ত চর্চা। এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে আগামী প্রজন্মের অবস্থা হয়ত বা আমাদের থেকেও সঙ্গীন হবে। কারণ ঠাকুমার চন্দ্রগ্রহণে খাবার বর্জনের থেকে ভয়ংকর, বেদান্তের প্রমাণের সাপেক্ষে পদার্থবিদ্যার ব্যবহার। সাবধান হতে হবে, আরেকটা অন্ধকার যুগের সূচনার আগেই।
   
406
Tue, 01/30/2018 - 12:00
    মানুষ যা যা কিছুকে অত্যন্ত করে চায়, তার প্রধানতম হল সমাজ। সে নিজেকে দেখতে চায় সমাজের আয়নাতেই। সমাজ তার অস্তিত্ব। তার পায়ের তলার মাটি। ব্যক্তি আর সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্বটা আমরা দেখি, সেটার মূলে আসলে গঠিত, জীবিত সমাজ বনাম আমার কল্পিত, ধী-দৃষ্ট সমাজ। ব্যক্তি বলে যা আমরা বুঝি, তা একটা মৌলিক অস্তিত্ব তো কিছুতেই নয়। না হলে অভিব্যক্তি কথাটা অর্থহীন হত। দীর্ঘকালের ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়ার ক্ষণিক বুদবুদ এই ব্যক্তিসত্তা। এমনকি জীবনবিজ্ঞানের কথা অনুযায়ী গর্ভস্থ একটা ভ্রূণকেও তার প্রাচীন গতিপথের ধাপগুলিকে একবার করে স্মরণ করতে করতে আসতে হয় – ব্যক্তিজনি জাতিজনিকে স্মরণ করে – বিজ্ঞানী হেকেল মহাশয়ের অসামান্য পর্যবেক্ষণ। তাই 'সমাজ' শব্দটা শুধু ভৌগলিক অথবা কোনো নির্দিষ্ট কালের গণ্ডীতে আবদ্ধ একটা কথা না। যা স্থবির তা প্রথা, বিশ্বাস, আচার ইত্যাদি হতে পারে। সেগুলো বদলে বদলে যায়, কিন্তু সমাজবোধটা না। কখনওই সমাজের বাইরে মানুষ যেতে পারে না। যায় যদি সে নিজের একটা সমাজ গড়ে নিতে চায়। যার উদাহরণে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী গঠিত হয়; তারা রাজনৈতিক কি ধার্মিক কোনো বিশ্বাসের তাগিদে স্বতন্ত্র হওয়ার চেষ্টা করে, আর বৃহৎ সমাজকে প্রভাবিত ও অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করে নিজের মধ্যে।             আমাদের সামনে ইদানীং দুটো ঘটনা ঘটে গেল। করনি সেনা বনাম পদ্মাবতী, আর সমকামী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের নতুন অবস্থান। দ্বিতীয় ঘটনাটার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বিজ্ঞানের নতুন নতুন গবেষণা, আবিষ্কার সেই জনগোষ্ঠীর আন্দোলনের পথ সুগম করে দিলেও সারা বিশ্বে মূলখণ্ডের সামাজিক মানসিকতার প্রেক্ষিতে তার লড়াইয়ের পথ দীর্ঘ।         এবার আসি প্রথম ঘটনাটায়। পদ্মাবতী আদৌ ছিলেন কিনা, নাকি তিনি কবি কল্পনা সে অন্বেষণের ভার নেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে যে কথাটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তা হল, রাজপুতের ভাবজগতের সমাজের সাথে বনশালী মহাশয়ের ভাবজগতের সমাজের একটা বিরাট বিরোধ এসে উপস্থিত হয়েছে। সমাজটা বাইরে থাকলেও সমাজের মূলটা থাকে মানুষের অন্তরের ভাবমুখের কেন্দ্রে। তাই ভিতরের বিরোধ বাইরে এসে পড়বে এ বুঝতে খুব কঠিন হয় না। রাজপুত কখনওই সমকামী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ক্ষিপ্ত হবে না। কারণ সেটা তার সামাজিকবোধের সীমারেখার বাইরে, কিন্তু পদ্মাবতী তাদের। তাই বনশালী যেন তাদের সেই সামাজিক পরিসীমার মধ্যে ঢুকে নিজের রাজত্ব বিস্তার করতে চাইছেন, আর তাতেই রাজপুতেরা নিজেদের রাজ্যের স্থিতিশীলতা নিয়ে চরম সংকটে পড়ে যাচ্ছেন। ফল হিংসাত্মক। যে কোনো ভয়ের বাহ্যিক আকার হিংসাই হয়ে থাকে। একটা সুস্থ কুকুরও কখনও সাধ করে কাউকে কামড়াতে যায় না, যদি না কোনো কারণে তার থেকে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা আশঙ্কা করে কিম্বা বিপন্ন বোধ করে। মানুষের সাথে পশুর পার্থক্যটা হল মানুষের একটা সামাজিক দেহ আর সামাজিক ভূমি আছে। কিছু উন্নত পশু সমাজেরও আছে যদিও তবে ততটা সুক্ষ্ম অভিব্যক্তি সে পথে হয়ে উঠতে পারেনি।         একটা সমাজের বহুরূপ হতে পারে। নানা মান্যতাও হতে পারে। কিন্তু বৈপরীত্যের সহাবস্থান ততক্ষণই হতে পারে যতক্ষণ কেউ কারোর থেকে বিপন্ন বোধ না করেন। এ এক চিরকালীন সংগ্রাম। বাড়ির বয়স্কা মানুষটার সাথে নব্যযুগের নাতনির সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধ, বাবা-ছেলের বিরোধ, ধর্মে-ধর্মে বিরোধ, রাজনৈতিক মতাদর্শে বিরোধ ইত্যাদি সবই দুটো সামাজিক ধারণার বিরোধ। শুভ-অশুভে বিরোধের মূল কথাটাতেও একই সুর। তবে ঈশ্বরের কৃপা কিম্বা প্রকৃতির খেলা – যাই বলি, যা অশুভ, যা স্থিতি আর বিকাশের বিরোধী তার মাত্রাটা চিরকাল কম। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। জীবের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর নির্ধারকের (জিন) একটা প্রকটগুণ হয়, আরেকটা প্রচ্ছন্ন। প্রচ্ছন্ন যে সে প্রকটের উপস্থিতিতে অপ্রকাশিত থাকে। বেশিরভাগ বংশগত রোগের জন্য দায়ী এই নির্ধারকগুলি প্রচ্ছন্নগোষ্ঠীভুক্ত। তা যদি না হত তবে সুস্থ থাকাটাই ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়াত।         সমাজের ধারাকে শুধু যে আমরা বহন করে চলি তাই তো নয়, তাকে আমরা পরবর্তী প্রজন্মতে স্থানান্তরিত করতেও চাই। খুব আগ্রহের সাথে চাই। দেখা যায় অল্প বয়সে একটা মানুষ যতটা বিদ্রোহী, অবাধ্য, একগুঁয়ে থাকে, বয়েস বাড়ার সাথে সাথে সে নম্র, বাধ্য, আজ্ঞাবহ হয়ে উঠতে চায়। তার কারণটাও খুব জটিল কিছু না। অল্প বয়সে সে তার নিজের সামাজিক ভাবালোকে অন্যের হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। ক্রমে যত সে বড় হতে থাকে তার সেই পৃথক, স্বতন্ত্র সামাজিক ভাবধারার সাথে প্রবাহিত মূলস্রোতের ভাবধারার লড়াইয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে আপোষ করতে শুরু করে। আপোষ ক্রমে অভ্যাস হতে শুরু করে। যে যতটা আপোষ করে সে পরবর্তী নব প্রজন্মের প্রতি ততটা রূঢ় হয়। সে জানে কতটা মূল্য তাকে চোকাতে হয়েছে তার স্বতন্ত্র সামাজিক স্বপ্নকে লালন করার জন্য।         এরই মধ্যে কেউ কেউ আসেন যারা নিজেদের ভাবের সমাজের মাধ্যমে অন্যের ভাব সমাজকে প্রভাবিত করতে পারেন। বিরোধ সেখানেও হয়। কিন্তু সংঘর্ষ অমঙ্গলের পথে না হেঁটে ক্রমে মঙ্গলের পথে ফেরে। সেই বিখ্যাত লাইন ‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে’ – এর একটা উদাহরণ হতে পারে। যে কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তিই এর উদাহরণ যারা মঙ্গলের মধ্যে পথ খোঁজেন। আমাদের দেশে এককালে ধর্ম আর দর্শনের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য ছিল না। সেখানে অনেক আলোচনায় দেখেছি মানুষের মঙ্গল কিসে, এই আলোচনার সূত্রে আধ্যাত্মিক আলোচনা শুরু হয়েছে, কোনো বিশেষ মত প্রচারের জন্য নয়।         সমাজের গভীর কেন্দ্রে এই মঙ্গলবোধটা লোপ পেলে সমাজ আর টেকে না। এই মঙ্গল কিসে? এই মঙ্গল তার চিত্তের বিকাশে তার অহং -এর স্বার্থ চরিতার্থতায় নয়। এই কথাটা ইতিহাসে বারবার ভোলার প্রমাণ আছে। বহু বিরোধ আগেও হয়েছে ভবিষ্যতেও হবে; আর এরই মধ্যে অতি ধীর পদক্ষেপে বিকাশের সম্বেগে, প্রেমে অভীদীপ্ত হয়ে মানুষের আত্মা মঙ্গলের সমাজে সার্থক হবে।
   
407
Tue, 01/23/2018 - 11:30
    সবই তো আছে। নেতা আছে, নীতি আছে, ধর্ম আছে, ধর্মস্থান আছে, গুরু আছে, শিষ্য আছে। তবু কি যেন নেই। কার যেন একটা অভাব। কত পাণ্ডিত্য আছে। কত গবেষণা আছে। কত বড় বড় প্রতিষ্ঠান, কত চিন্তাবিদ আছেনই তো। তবু কি যেন নেই, কি যেন নেই।            সুভাষচন্দ্রের ভাষণ দিতে গিয়ে কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে। মোহনদাস গান্ধী নুন বানাতে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সাড়া দিয়েছে – ইতিহাস সাক্ষী। সুভাষ বা গান্ধী কেউই তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করলে চাকরি দেবেন এমন কথা দেননি। তবু মানুষ গেছে। মেরেছে। মরেছে। কিসের জোর ছিল? তবে এখন মানুষ কি এতটাই স্বার্থান্ধ যে বড়োর ডাক সে শুনতেই পায় না? ইতিহাস তো সে কথা বলে না। বরং বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, মহাপ্রভু থেকে শুরু করে যাঁদের কথা বললাম, এদের অনুসরণকারীর তো অভাব হয়নি কখনও। এবং যারা অনুসরণ করেছেন তাদের জীবন যে খুব মধুর ছিল না তাও তো আমরা জানি। বরং কি ভয়ংকর বিপদসঙ্কুল ছিল আমরা শুনেছি তো।          সব মানুষ কি সাড়া দিয়েছিল? তাই দেয় কখনও? কিছু মানুষ তো ক্ষুদ্রস্বার্থ মগ্ন থাকবেই। আত্ম-করুণায় নিমজ্জিত। আগের দিন শরৎবাবুর একটা লেখা ওনার জন্মভিটেতে পড়ছিলাম, শখের সাহিত্যিক আর সত্যিকারের মানুষের জীবনীকারের কথা বলেছেন। যে মানুষ নিজের জীবনের চাইতে, নিজের বুদ্ধি-অনুভবের চাইতে বড় কিছুকে অনুভব করে উঠতে পারেননি সারা জীবন তার কাছে থেকে আর যা হোক বড় কিছু আশা করা যায় কি করে? তাদের কথা থাক। কথা হচ্ছে মানব সমাজের বড় একটা অংশ চিরটাকাল সাড়া দিয়ে এসেছে, আর তাদের নিয়েই মানব সভ্যতার অগ্রগ্রতির ইতিহাস।          কিসের ডাকে সাড়া দিয়েছে তবে? কি ছিল তাদের কণ্ঠে যা এখন অনুভবে পাচ্ছি না? একটা শব্দ – দরদ। আজ যে মানুষটার জন্মদিন তাকে নিয়ে কয়েকটি চর্চাই আজন্ম শুনে গেলাম, এক - কি ভাবে তিনি হারিয়ে গেলেন অথবা মারা গেলেন। দুই - গান্ধীর সাথে তাঁর জাতশত্রুতা। যে কথাটা উহ্য থেকে যায় সব ক্ষেত্রে সে দরদের কথা। অবশ্যই তার কারণ আছে। যিনি নীল রঙ চোখে দেখেন না, তার সামনে একটা নানা রঙের বস্তু থাকলে তিনি বাকি সব রঙের তারিফ বা আলোচনা করলেও নীলরঙটা তো এড়িয়েই যাবেন এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও তাই। অথচ মূল কথাটা হল আমাদের যত নীতি, নিয়ম, আইন থাকুক না কেন অবশেষে তা নির্ভর করে একটা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টের উপরেই। একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার দেশবন্ধু অনুকূলচন্দ্র মহাশয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন। কথাবার্তার পর দেশবন্ধুকে বারবার তিনি অনুরোধ করেন থেকে যাওয়ার জন্য কয়েকদিন আরো। দেশবন্ধু জানান তিনি অপারগ, কারণ কংগ্রেসের ভার অন্য কাউকে দিয়ে ক'দিন সময় কাটানোর মত উপায় তার নেই। শুনে অনুকূলচন্দ্র মহাশয় হেসে ওঠেন আর বলেন, এক কংগ্রেসের দায়িত্ব দিয়ে আসার মত মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না, তবে এতবড় দেশটা স্বাধীন করছেন কাদের জন্য? (এখানে উল্লেখ্য, সুভাষবাবুও দু থেকে তিনবার অনুকুলচন্দ্রের সাথে দেখা করতে যান যেহেতু ওনার বাবা-মা ওনার কাছে দীক্ষিত ছিলেন। ওনার সাথে কথোপকথন লিপিবদ্ধ আছে, সেখানেও একই কথার উপর জোর দেওয়া হয়েছে দেখা যায়, আগে মানুষ তৈরি। সুভাষবাবু সে কথা শুনে বলেন, ঠিক, আগে একটা মানুষের সংস্কার ঠিক না হলে শুধু বাহ্যিক শিক্ষা কি করতে পারে? পরে আরো একবার দেখা করতে যান, কিন্তু এত ভিড় হয়ে যায় ওনাকে দেখেই যে শুধু প্রণাম করে চলে আসেন কথা হয় না।          আমি এ তথ্য খুঁজে বার করি ‘ফরগটেন হিরো’ সিনেমাটা দেখার পর। যখন দেখি শ্যাম বেনেগল মহাশয় দেখাচ্ছেন সুভাষ রামকৃষ্ণ-স্বামীজি-অনুকূলচন্দ্র - এই তিনজনের সামনে ধ্যান করছেন আর পরবর্তীকালে ওর এলগিন রোডের বাসভবনেও ছবিটা দেখি তখন কৌতুহল জাগে। তারপর নানা বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই তথ্যাবলী আবিষ্কার করি)         কথাটা সেই দরদ। দরদ কথাটার দুটো অর্থ হয়, এক – ব্যথা, দুই – সহানুভব। “দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না”, বৈষ্ণব সাহিত্যে আছে। মানুষ নিজের জন্য রুখে দাঁড়ায় যখন তখন সেটা তার জান্তব আত্মস্বার্থ কায়েম রাখার প্রাগৈতিহাসিক জৈবিক তাগিদ। আবার যখন সে নিজের কথা ফেনিয়ে ফেনিয়ে সোচ্চারে বলে বেড়ায় ‘আহা আমি বেচারা’ মত, সেও তার দুর্বল অহং-এর কপট আত্মশ্লাঘা। তারও কিছু ধামাধরা শ্রোতা পাওয়া যায় অবশ্য। তবে সে শোনা ভুলতে সময় লাগে না। আরেক বিকার দেখা যায়, প্ররোচিত করা। সব চাইতে সস্তা পথ এটাই বোধহয় – provoke করা। সে সেকালেও ব্যবহার করা হয়েছে, এ কালেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। এতে দরদের মত মুখোশ থাকে। কিন্তু ভিতরে স্বার্থসন্ধানী চোখের সতর্ক নজরদারিও থাকে। তাই যতটা ধুলো ওড়ে, ধোঁয়া হয়, গনগনে তেজ হয় – তা নিভে যেতে বা থিতিয়ে পড়তেও বেশি সময় নেয় না।          কারণ মূল কথাটা থাকে না যে। যে কথাটা হল – দরদ। দরদ নির্বোধ আবেগ না। দরদ প্ররোচনা না। দরদ স্বল্পায়ু না। দরদ হঠকারী না। দরদ অনুশাসনহীন না। দরদ একটা ভাষা। একটা চেতনা। একটা বোধ। প্রাণীকূলও সাড়া দেয়, মানুষের কি কথা। মানুষকে সভ্যতায় সাবালক করে দরদ। সে শব্দে কথা বলে না। শব্দ উচ্চারণ হয় যে চেতন ঊষ্মায়, সেই উত্তাপে সে আরেকটা প্রাণকে উদ্দীপ্ত করে। তখন অনেকগুলো প্রাণ একটা বৃহৎ স্বার্থে একত্রিত হয় মঙ্গলে, লোভে নয়। যদি লোভে হয় তবে তা ‘সারদা কাণ্ড’ হয়, কিন্তু প্রাণ উৎসর্গী আবেগে চুর হতে পারে না। প্রাণত্যাগের থেকে অনেক বড় কথা স্বার্থত্যাগ। দরদ তা করতে প্রাণিত করে। নিজেকে সার্থক অনুভব করে। পরিপূর্ণ অনুভব করে। এই দুটোই মানুষী অনুভব। এর কোনো বিকল্প হয় না। আর তখনই কোনো স্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা হয়। সে অবশ্যই একদিনের কাজ নয়।
408
Mon, 01/22/2018 - 10:00
    সেদিন বেসিনে মুখ ধুচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম বেসিনের সাদা রঙের উপর আরেকটা উজ্জ্বল সাদা আলো। বুঝলাম বেসিনের উপর যে ছোট্ট জানলা সেই দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়েছে। এ যেন হঠাৎ করে বাড়তি একটা পাওয়া। মন চমৎকৃত হল। খুব দূরের অধরা কিছু আজ যে তার নাগালের মধ্যে, সে যে কি পুলকিত হল, তা বলার নয়।         নাগালের মধ্যে। এই কথাটা খুব একটা বড় কথা। সংসারে আর যেখানে যত মণিমাণিক্যই ছড়িয়ে থাক, সে যদি আমার নাগালের মধ্যে না এলো তবে যে সবই বৃথা। আমার তাতে কোনো সুখ নেই, কোনো তৃপ্তি নেই। তার উপর যদি অন্যের নাগালের মধ্যে সে সুখকে দেখলাম তো বুকের ভিতর এক লক্ষ বাদুড়ের ঝটপটানি। ওরা ঈর্ষা, ওরা আমারই বুকের রক্ত চুষে আমাকেই ক্ষীণ দুর্বল করছে। তবু ওরা আছে। কারণ দুটো। এক, ওরা বড্ড obvious, নীতিমালার মত রামধনু নয়; আর দুই, ওরা আমার নাগালের মধ্যে।         "কেবল তুমিই কি গো এমনি ভাবে রাঙিয়ে মোরে পালিয়ে যাবে?... তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো---'          কি গাইলাম? নাগালের মধ্যে পাওয়ার গান। নাগালের মধ্যে ডাকার কথা। তুমি যদি নাগালের মধ্যে আসো, তবে, 'আমার হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়'। এসো সুখ, আমার নাগালের মধ্যে বসো। এসো নাম-যশ-খ্যাতি-সম্পদ, আমার নাগালের মধ্যে বসো। দেবী ইহ তিষ্ঠ, ইহ তিষ্ঠ, ইহ তিষ্ঠ। তুমি আমায় ভোগ করো, আমিও করি তোমায় ভোগ। তুমি অন্যের হয়ো না দেবী, বড়ো বাজে গো বুকে। তুমি অধরা থেকো না দেবী, আমার মানবজনমের সব আয়োজন হবে ব্যর্থ। রহো রহো দেবী রহো।         তবু হাত ছাড়িয়ে চলে গেল কত। হাতের মধ্যে যা এলো না সে তো অসীম। মন জানে সে হিসাবে সে থই পাবে না। এক আঁজলা জল নিয়ে সারা সমুদ্রটাকে যে আহবান জানানো যায় না, সে কথা সে কি আর জানে না? খুব জানে। তবু তার নাগালের মধ্যে চাই সব।         মন সে অসীমকে বলল, তুমি ঈশ্বর। বলল, তুমি তো সব পারো, এনে দিতে পারো না এই সারা সমুদ্রটাকে আমার হাতের মুঠোয় ভরে? তুমি যে কৃপাসিন্ধু!         ঈশ্বর বললেন, পারি তো। তুমি হাতের মুঠোটা বড় করো দেখি আরেকটু? ভক্ত বলল, আরো একটু? এই এতটা? বলে সে হাতের মুঠো খানিক বড় করল। ঈশ্বর বললেন, হল বটে, তবে আরো খানিক বড়ো করো, তুমি পারবে। ভক্ত আরো খানিকটা বড়ো করে বলল, হল এবার? ঈশ্বর একই কথা বললেন আবার, হল তো, তবে আরো খানিকটা, এই বলে তিনি সাগরের বুক থেকে আরেক আঁজলা জল দিলেন ভক্তের হাতে। ভক্তের আনন্দঘটে লাগল অমৃতের স্বাদ। সে আরো বড় করতে চেষ্টা করল তার মুঠি। তার কষ্ট হল, কান্না পেলো, তবু সে চেষ্টাটা থামালো না। একদিন দেখল তার মুঠোর বাঁধন আলগা হয়ে পড়ছে, তাতে আকাশ এসে বসল। তার মুঠোর রঙ হল নীল। ভক্ত কাঁদল। যন্ত্রনায় না, আনন্দে। সে মুঠো ক্রমে জল হল, মাটি হল, বাতাস হল। তারপর এক অলীক আলোয় মিলিয়ে গেল। সে কেঁদে বলল, ঈশ্বর তুমি কই? ঈশ্বর বলল, আদিতে যা ছিলাম, অসীম, তাই আছি তো গো। যাকে তুমি নাম দিয়েছিলে ঈশ্বর। আজ তুমিই তাই - অসীম।         ভক্ত বলল, আমি বুঝছি না যে? অসীম বলল, অসীম হয়ে অসীমকে বুঝবে কি করে? ভক্ত বলল, তবে আমার আনন্দের কি হবে? আমার নাগালের কি হবে? অসীম বলল, আমায় দাও। তোমার সসীম নাগালকে আমাতে দেবে বলেই না এত আয়োজন! ভক্ত বলল, আমায় পেয়ে তোমার লাভ? অসীম বলল, আমায় না পেলে তোমার যে ক্ষতি, তার থেকে তোমায় বাঁচানোতেই আমার লাভ, আমার আনন্দ। আলোর আনন্দ অন্ধকারের উপর জোর খাটিয়ে না, অন্ধকারকে আলিঙ্গন করে। অন্ধকার তাতে আলো হয়ে ওঠে, তাতেই আলোর সার্থকতা।         আজ সেই দিন। তুমি তোমার নাগাল নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াও, আমাকেই চাও, আমার থেকে কিছু চেয়ো না। বলো - সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। সত্য জ্ঞান অনন্তই শাশ্বত। তুমি তাই। হয়ে দেখো।             গল্পটা আমাদের এখানেই শেষ হলে পারত। হল না। কারন এ গল্প অসম্পূর্ণ। অর্ধসত্য। অসীমকেও যে সসীমের দরজায় দাঁড়াতে হয়েছে সময়ে সময়ে।         "তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিও"         দেবী সরস্বতী কি কোনোদিন রাধা হতে চেয়েছেন? তবু হয়েছিলেন। নবদ্বীপে। সরস্বতী নেমেছিলেন রাধাকুণ্ডে। আর ওঠেননি। ভারত মাধুর্যে ভেসেছিল। জ্ঞান মধুর হয়ে ছিল। ভীষণ হয়নি।
   
409
Fri, 01/12/2018 - 11:30
      “আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন”?          উত্তর এলো “হ্যাঁ দেখেছি” শুধু না, “তোকেও দেখাতে পারি”। দেখালেন। তিনি ছুঁয়ে দিতেই নরেনের বিশ্বজড়বোধ লোপ পেয়ে যায়। বিশ্ব চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার চেতনা। সেকি ঈশ্বর দর্শন? এরপরেও তিনি শোনেন তাঁর গুরুই এই বিশ্বসংসারের বিশ্বপিতা, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই রামকৃষ্ণ”। সেই কি তবে ঈশ্বরদর্শন? না, তাতেও তো শান্তি হল না তাঁর! অথচ শাস্ত্র বলছেন একবার ঈশ্বরকে লাভ করলেই মানুষ চিরশান্তিতে ডুবে যায়, তার নাকি আর কিছুরই তৃষ্ণা, খোঁজ থাকে না? সে নাকি ‘তৃপ্ত ভবোতি... স্তব্ধ ভবোতি... অমৃত ভবোতি’ হয়ে যায়? হল না তো নরেনের বেলায়।          তারপর তিনি স্বামীজি, স্বামী বিবেকানন্দ। ছুটলেন গাজীপুরের পাওহারি বাবার কাছে। কিসের আশায়? সিদ্ধি? নাতো। ঠাকুর তো দিতে কবেই চেয়েছিলেন। নেননি তো? ঠাকুর এও বলেছিলেন, এই দিয়ে জগতের মঙ্গল করতে পারবি। তাও চাইলেন না। তবে? গাজীপুরে কিসের জন্য? দিনের পর দিন সে ফকিরের দরজায় পড়ে থাকছেন। বারবার তাঁকে অনুরোধ করছেন, কিন্তু সে ফকির তাঁকে ঘুরিয়েই যাচ্ছেন, ঘুরিয়েই যাচ্ছেন। স্বামীজি তার গুরুভাইদের, প্রমদাবাবুকে চিঠি লিখছেন, একবারটি এসে সে মহাপুরুষের, মানে পাওহারি বাবার সান্নিধ্য নেওয়ার জন্য। কিসের জন্যে? ঈশ্বর দর্শন তো হয়েই গিয়েছিল না?          গাজীপুর বাবার কাছ থেকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরলেন। তারপর নানা ঘটনাবলীর পরম্পরায় বিদেশ যাত্রা। সেখানে তাঁর একবার নির্বিকল্প সমাধিও হয়েছিল শোনা যায়। তবে? সেতো নাকি শ্রেষ্ঠ অবস্থান সাধনক্ষেত্রে। তাও স্বামীজির প্রাণে এত অস্থিরতা কেন? চিঠির পর চিঠিতে এত উদ্বেগ কেন? তিনি ঘুমোতে পারছেন না রাতের পর রাত। শরীর ভাঙছে। একবার নাগমশায়ের বাড়িতে গেলেন। সারারাত পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে উঠে বললেন, এতদিনে এই প্রথম শান্তিতে ঘুমোলাম। কেন? মা-ই তো বলছেন, সন্ন্যাসী হলে আর যা হোক নাহোক শান্তিতে ঘুমোতে পারবে, গৃহস্থের যা অশান্তি? তবে স্বামীজির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল কেন?          তিনি ইচ্ছামৃত্যু বর পেলেন, জগজ্জনীর কণ্ঠস্বর শুনলেন, তবু প্রাণে শান্তি এলো না। কালীপুজো, দূর্গাপূজো করলেন। বিদেশী শিষ্যেরা কেউ কেউ ভুরু কুঁচকালেন, তুমি অদ্বৈতবাদী, তুমি কালীপুজো করো কেন? তিনি চিঠিতে সে জবাবদিহিও করছেন, ও আমার এক খেয়াল জানবেন, ওটা আমার ব্যক্তিগত। একটু অহংকার তো দেখানোই যেত না, “আমি ব্রহ্মজ্ঞানী, আমায় এ প্রশ্ন করা আপনার সাজে না” এরকম কিছু একটা? বললেন না।          তবে স্বামীজির ঈশ্বর কে ছিলেন? নিরাকার ব্রহ্ম... কালী... শিব... রামকৃষ্ণ... বুদ্ধ (নিজেকে যার দাসানুদাস বলতেন)... কে তবে?          আসলে এরা কেউ নন আবার সবাই। তিনি যত না ঈশ্বরকে চেয়েছিলেন, তার থেকে কোটিগুন যন্ত্রণায় মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন। মুক্তি যন্ত্রণা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, পরাধীনতা থেকে, সর্বোপরি অজ্ঞানতা থেকে। স্বামীজি একটা যন্ত্রণা। বিবেকানন্দ নয়, বিবেকযন্ত্রণা। একটা অভুক্ত মানুষ সামনে এলে যার ব্রহ্মজ্ঞানে ভরসা টলে যায়, যে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠে বলে, যে ঈশ্বর এখানে আমায় একবেলা রুটি দিতে পারেন না, তিনি স্বর্গে আমায় ভালো রাখবেন তা বিশ্বাস করি না। রুটি তো আসলে নিজের জন্য চাননি। এ কোন স্বামীজি? এই কি যিনি ঠাকুরের কাছে নির্বিকল্প সমাধিতে বুঁদ হয়ে থাকার জন্য জেদ ধরেছিলেন? আসলে ঠাকুর জানতেন, এ নরেনের অভিমানের কথা। দরিদ্র রমণী যেমন তার অভুক্ত সন্তানদের ক্ষুধার জোগাড় করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন, এও সে অভিমানে কথা। ঈশ্বরের মধ্যে আত্মহননের ইচ্ছা। জগতজুড়ে এত যন্ত্রণা অমন সুক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের সহ্য হয়? “লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর মূরতি তাকি সয়”? সয় না। তাই ঈশ্বরের আড়াল টেনেছেন বারবার। বারবার মানুষের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে দিনরাত অনাহারী থেকে, রক্তাক্ত পায়ে ঈশ্বরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ঈশ্বরের মহত্বে মুগ্ধ হবেন বলে না, ঈশ্বরকে তাঁর নিজের মহত্ব স্মরণ করিয়ে দেবেন বলে। এত যন্ত্রণা, এত অমঙ্গলের মধ্যে তাঁর রথের চাকা ডুবে যাচ্ছে দিনদিন, সে রথের চাকা তুলে দিতে সাহায্য করবেন বলে তিনি গিয়ে দাঁড়াতেন ঈশ্বরের সামনে। আসলে কোথাও তিনি ঈশ্বরের বিবশতাকেও অনুভব করতেন, করুণা করতেন করুণাময়কে। ঈশ্বরের উপর এটুকু বিশ্বাস না থাকলে গরীব মানুষগুলো বাঁচবে কার মুখের দিকে তাকিয়ে? সে বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই এত তাঁর ছটফটানি।          এ যন্ত্রণা খ্রীষ্টে ছিল, এই ভগবত প্রেমের কান্না মহাপ্রভুতে ছিল, এই সর্বগ্রাসী করুণা বুদ্ধে ছিল, এই প্রজ্ঞার ছটা শঙ্করাচার্‍্যে ছিল। এসব ঘনীভূত হয়ে দাঁড়ালো আজকের দিনটায়। যে ধ্যানে বসলে সামনে সাপ এলে খেয়াল থাকে না। যাকে ঘরে আটকে রাখলে জানলা দিয়ে কাপড়চোপড় বের করে গরীবদের দিয়ে দেয়, বিশ্ববিজয়ী যে প্রাণ, গিরিশ এক অভুক্ত পরিবারের বর্ণনায় ঘরে দরজা দিয়ে পাগলের মত আছাড়িপিছাড়ি কাঁদে, তাঁকে আর যা হোক ঈশ্বরের মোয়া দিয়ে ভোলানো যায় না। গান্ধী বলতেন, বিবেকানন্দ পড়ার পর তাঁর মনে হয় ভারতের প্রতিটা ধূলিকণা তাঁর কাছে পবিত্র, কথাটা আরো এগিয়ে বলা যায় মানুষটার কাছে প্রতিটা ভারতবাসীর প্রতিটা শ্বাস ঋণী।         তিনি তাঁর সারাজীবনের উপলব্ধি তাঁর ‘সখার প্রতি’ কবিতাটাতে উজাড় করে বলে গেছেন। নামটাও বেছেছেন ‘সখার প্রতি’। গীতার কথা স্মরণ করতে বলি, কৃষ্ণ বলছেন “গীতা মে হৃদয়ং পার্থ”। হৃদয়ের কথা কার কাছে উজাড় করে বলা যায়? সখার কাছে। অর্জুন কৃষ্ণকে চিনতে পেরেও শুধুমাত্র সখ্যের ভূমিতেই দাঁড়াতে চেয়ে বলছেন, বন্ধু যেমন বন্ধুর সব অপরাধ ক্ষমা করে তুমিও আমার সব অপরাধ ক্ষমা করো কৃষ্ণ।          স্বামীজিও সেই বন্ধুত্বের আহ্বানে ডেকেছেন ওই কবিতাটায় তাঁর ভাবীকালের বন্ধুদের। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, যদি এই কবিতাটা কণ্ঠস্থ রাখা যায় তবে পৃথিবীর কোনো শাস্ত্র, কোনো মহাপুরুষের জীবনী অজানা থাকলেও সব শাস্ত্র, সব মহাপুরুষের জীবনী জানা হয়ে যায়। আমার সব ঝগড়া, সব কান্না, সব হতাশা, সব আশা এই মানুষটার সাথে জড়িয়ে। আমাদের দাঁড়াবার, আমাদের এগোবার, আমাদের নতুন করে ভাবার সব উপকরণ সাজিয়ে রেখে গেছেন। এমনকি ওর বিরুদ্ধে বলার ইচ্ছা থাকলেও, উনি শুনবেন আমি আশ্বস্ত করতে পারি। তবে ওর প্রাণটা যদি বোঝা যায় তবেই, নচেৎ নয়, কদাপি নয়। একবার ওর বন্ধু ওনাকে বলেন আপনি যে দক্ষিনের পণ্ডিতদের পারিয়া বলে গাল পেড়েছিলেন, তা কি ঠিক করেছিলেন? উনি হেসে বলেন, বলেছি নাকি ঠিক করেছি? বন্ধু ওনাকে উঠে জড়িয়ে ধরে বলেন, তাই তুমি এত বড়।          সত্যিই তাই এত বড়। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম, আলিঙ্গন মানুষটাকে জানাই তাঁর শুভ জন্মদিনে। হ্যাপি বার্থ ডে স্বামীজি।
 
410
Sat, 01/06/2018 - 23:27
  আজ রামকৃষ্ণ জিতে গেলেন। বলেছিলেন না, “চালকলা বাঁধা বিদ্যা আমার চাই না”। কি স্পর্ধা না এক মূর্খ বামুনের? এতবড় এডুকেশান সিস্টেম, এত কোটি কোটি টাকা খরচ করে শিক্ষিত মানুষ তৈরির উপায়। এত গবেষণা, এত গবেষক, এত শিক্ষক, এত অধ্যাপক, এত স্কলার... সব শেখালো, শুধু অসুস্থ মাকে কি করে বাঁচিয়ে রাখতে হয়, সেবা করতে হয়... না ‘সেবা’ কথাটা আবার সেকেলে, কি করে take care করতে হয় আর শেখাল না।            তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। যখন ছেলেটা হাত ধরে তাকে ছাদে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কি বিশ্বাসে তার হাতদুটো ধরে ছাদের দিকে হাঁটছিলেন না? সেই হাতদুটো, যেই হাতদুটো ছিল একদিন খুদে খুদে, তাকে আঁকড়ে থাকত, বাঁচত। রবীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন, মানুষের বাচ্চা পৃথিবীতে সবচাইতে অসহায় হয়ে জন্মায়। তার মা তাকে কোলে তুলে স্তন না দিলে সে বাঁচে না। সত্যিই তো তাই না? সেই ছোট্টো হাতদুটো দিয়ে মাকে আঁকড়ে ছাদের কার্ণিশের পাশ দিয়ে হাঁটা মাকে জড়িয়েও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা। ধুর, এসব সেন্টিমেন্টাল কথার কি দাম আছে? ওটা তো বাড়তি। আমাদের পারফেক্ট হতে হবে যে?          তিনি অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অধ্যাপক ছিলেন। তিনি অধ্যাপক ছিলেন। ভুল টাইপ করছি না। ইচ্ছা করেই লিখছি। কারণ শিক্ষার আলো... বাতি... জ্যোতি... ইত্যাদি কত কত কথা মনে আসছে যে। একি কথা? আপনি খামোখা মাত্র একজন অধ্যাপকের অপরাধে অধ্যাপনাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন কেন?          কারণ এতবড় সিস্টেমে, একটা একটা ধাপ পেরিয়ে মানুষটা যখন এত উঁচু ধাপে এসে দাঁড়ায়, সে তো একদিনে নয়। কত পরীক্ষা। কত যোগ্যতার মাপকাঠির মানদণ্ড পেরিয়ে সে আজ এই জায়গায়। এতগুলো যোগ্যতা বিচারের মানদণ্ড তবে কি মাপল? আজ অপরাধীর তালিকায় শিক্ষাজগতের সাথে জড়িত ব্যক্তির সংখ্যা তো কম নয়। ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির চেষ্টায় তো শিক্ষক মহলের নাম বেশ এগিয়ে।          আমার মনে পড়ছে একটা ঘটনা। আমার মা তখন বেশ অসুস্থ। আমার এক ছাত্রীর বাবা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। তিনি অধ্যাপক পেশায়। আমার ঘরে আমার মুখোমুখি বসলেন। বললেন, আপনি নাকি অমুক জায়গায় একটা অফার পেয়েছেন চাকরীর? বললাম, হ্যাঁ। বললেন, যাচ্ছেন না কেন? বললাম, মাকে এই সময়ে ছেড়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না। উনি ব্যাঙ্গাত্মক হেসে আমায় বললেন, একদিন এই দিনটার জন্য আপনি পস্তাবেন। মা কারোর সাথে চিরটাকাল থাকেন না। আপনার বাবার দায়িত্ব তাকে দেখা। আপনার নয়। আপনি টাকা পাঠিয়ে দেবেন... ইত্যাদি।          আমি শুনছি না, এবং বিরক্ত হচ্ছি সেটা ওনাকে হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলাম। ওনার ইগোতে লাগলো। আমায় বললেন, দেখুন সত্যিটা আমিও জানি আপনি কেন যাচ্ছেন না। বলেই চেয়ারটা আমার আরো কাছাকাছি এনে ফিসফিস করে বললেন, এই সব ডাগর ডাগর মেয়েদের এত কাছ থেকে পাওয়া... আমরা যারা শিক্ষকতা করি আর কারা পায় বলুন?          না, নাটকীয়ভাবে আমি ওনাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিইনি। আমি হেসেছিলাম। আর মনে মনে আমাদের শিক্ষিত হওয়ার অভিমানটার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিলাম। আমার সত্যিই বলতে করুণাই হয়েছিল।          আমি আবারও বলছি, কোনো পেশাকে ছোটো করার জন্য লিখছি না কথাগুলো, আমিও এক অর্থে এই পেশার সাথেই যুক্ত। আমি শুধু বলতে চাই, আমাদের যেন মনে থাকে আমরা পাখিটার গান বন্ধ করে একটা সোনার খাঁচাই বানাতে পেরেছি শুধু এতদিনে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা মানুষকে একটা যন্ত্রের দৃষ্টিতে দেখে, তার কর্মক্ষমতা, কুশলতা বাড়াতে পারে মাত্র, তার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে একমাত্র জ্বলন্ত জীবন্ত আত্মাই। আবার রবীন্দ্রনাথে ফিরি, তিনি বলছেন, তাই বলে সেই গুরুদের কোথায় পাই? আমাদের যে মাষ্টার দিয়ে কাজ চালাতে হয়।  রামকৃষ্ণ বলছেন, “যে পণ্ডিতের বিবেক-বৈরাগ্য নাই, তাকে খড়কুটো বোধহয়।” এটাই কথা, খুড়কুটো। কোন খড় কতটা ছাঁটলে কি কাজে কতটা ব্যয় হবে, তার হিসাব সোজা, কিন্তু সে খড়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা অত সোজা কাজ কি? প্লেটো তার কালজয়ী গ্রন্থ – ‘দ্য রিপ্লাবিক’-এ বলছেন চারটে প্রাথমিক সত্যের কথা – সাহস, প্রজ্ঞা, সংযম আর ন্যায়পরায়ণতা। এইগুলিই একটা মানুষকে মানুষ করার, একটা দেশকে মাটি-জল-পাথরের হিসাবের বাইরে গিয়ে একটা সভ্যতা গড়ার ভিত গঠন করে দেয়। সে কথা না শুনেছে তারা, না শুনেছি আমরা।          আজ শিক্ষার অন্ধকার চারদিকে। বড্ড অন্ধকার। যতটা হয়ত মানুষের না জানলেও হত তার চাইতে কোটিগুন বেশি জেনে ফেলেছি, যতটা অনুভবের দরকার ছিল, যতটা প্রজ্ঞার দরকার ছিল তার চর্চার ভাঁড়ার থেকেছে শূন্য। চূড়ান্ত অসামঞ্জস্য চারদিকে। কিন্তু একটা মানুষের শেষ ধাপ তো একটা অনুভব। মানুষ মানে একটা অনুভব। একটা শিশু যখন জন্মায়, সে এই জগতটাকে চেনে অনুভবেই, চিন্তায় নয় তো! চিন্তা তো অনুভবের অনুগামী। চিন্তা থেকে যা জন্মায় তা আবেগ, অনুভব না। যদিও দেখতে একই রকম। তাই আবেগ ভুল করতে পারে, কিন্তু অনুভব নয়। কারণ সেটা চিন্তার পূর্ববর্তী। চিন্তার জননী। অনুভব passive, আবেগ active.          এই অনুভবের শোধন পরিমার্জন হবে কি করে? সেকি একার কর্ম? সেকি ব্যক্তিগত প্রয়াস? আমার মনে হয় না। অনুভব একটা ঋতুর মত। মানুষের সমাজে এক একটা ঋতু আসে অনুভবের জগতে। বর্ষা, বসন্ত, শীত ইতাদির মত। তখন আমরা সবাই সেই ঋতুর দ্বারা প্রভাবিত হই নিজের নিজের মানসিক গঠন অনুযায়ী। আজ আমাদের বড্ড সংকীর্ণ অনুভবের ঋতু। সব কিছুকেই বড্ড ছোটো দৃষ্টিতে দেখছি। অথচ হাতের আর পায়ের নখগুলোকে এত তীক্ষ্ম করে ফেলেছি যে চলতে ফিরতে নয় অন্যের শরীর কাটছে, নয় নিজের। প্রচণ্ড শিক্ষিত যে আমরা। থেমে যাওয়া হৃৎপিণ্ডকে আবার যন্ত্র লাগিয়ে স্বাভাবিক ছন্দে আনতে পারি, পারছি না শুধু একটা শুকিয়ে যাওয়া হৃদয়ে আবার বিশ্বাসের আলো জোগাতে। ঈশ্বরে বিশ্বাস নয়, মানুষের মধ্যে যে সুতোটা থাকে, যাতে একেকটা মানুষ গাঁথা থাকে সেই সুতোটার খেই ধরে রাখতে। পারব কি করে, এটা যে খুব খারাপ ঋতু চলছে। রবীন্দ্রনাথের শেষের দিকের গান না, ওই মহামানব আসে...         আসবে, আসতেই হবে। এতগুলো মানুষের রক্ত মাড়িয়েই আসবে। ওই মায়ের রক্ত রাস্তা থেকে তো ধুয়েই যাবে... মহাকালের পাতা থেকে ধোবে কি? মনে হয় না। কারণ মহাকাল একটা সংখ্যা না। সব সংখ্যার গর্ভ। মহাকাল একটা চিন্তা না, অনুভব।
411
Thu, 12/21/2017 - 11:00


রাগ হতেই পারে। সে রাগের ন্যায্য কারণ থাকুক চাই না থাকুক। যদিও সব রাগেরই ন্যায্য কারণ নাকি সব সময় থাকে। রাগ মানে কি অসন্তোষ? তা তো নয়। আবার 'তা তো হয়' বললেই বা আপত্তি কি? রাগ মানে কি ক্ষোভ? রাগ মানে কি হতাশা? রাগ মানে কি অভিমান? রাগ মানে তবে ক্রোধ? রাগ মানে তবে অভিযোগ?
        সবই যদি বলি? সেই ভালো। রাগের সাথে রাগারাগী করে আর লাভ কি? "ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে"... আহা কি সত্য কথা... কি কঠিন কথা! মাথার মধ্যে রাগের শব্দ আর ভালোবাসার শব্দরা পাশাপাশি বাস করে। এ পাড়া ও পাড়া মতন। যেন কত ভাব! ভাব তো আমাদের সাথে দুই পাড়ারই, যখন যাকে কাজে লাগে। বুকের মধ্যে এই তো ছিল উপবন। মৌমাছি গান গাহিতেছিল। পরীরা কলসি ভরে ভরে অমৃত সাপ্লাই করিতেছিল। মন্দমধু পবন সনসন করে বহিতেছিল। ব্রহ্মের সদ্য লন্ড্রী ফেরত ধুতির গন্ধে প্রাণটা মধুমধু হয়ে উঠতেছিল। সবই ঠিক চলিতেছিল, সহসা কি হইল?
        এইটা বড় কঠিন কথা দাদা গো.. সহসা কি হইল... লোকে বলে নারী চরিত্র নাকি দেবতাও জানে না তো কি ছার্ মনুষ্য! কিন্তু ভাইরে মনের চরিত্রটিই বুঝি দুই দুগুণে চার? বুকের মধ্যে ছিল উপবন, হয়ে গেল ভিসুভিয়াস পলকেই। কিছু বোঝার আগেই উত্তপ্ত লাভা গরগর করে বেরোতে শুরু করল। প্রথম প্রথম চেপে রাখার চেষ্টা..... তারপর জিভের মধু বুকের তপ্ত লাভার তাপে শুকোতে শুরু করল... জিভের উত্তাপ বাড়তে আরম্ভ করল... তারপর? তারপর আর কি, রে রে রে রে! তবে রে হতচ্ছড়া ইস্টুপিট ঠেঙিয়ে তোরে করব টিট...
        ভিসুভিয়াস জাগছে। চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া হচ্ছে। বুদ্ধিটা কেমন গোল পাকায়ে পাকায়ে শূন্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। লাটাই ক্রমশ পাইপই করে ঘুরছে। বুঝছি এইবার থামতে না পারলে মহাবিপদ,পরে এর মেলা খেসারত দিতে হবে.. কিন্তু হলে কি হবে... অমন তপ্ত বুকেরও যে একটা সুখ আছে গো.. তারে ছাড়ি ক্যামনে। ভসভস... দুমদাম.. বোমা ফাটছে জিভে মাথায় বুকে। গলার পারা চড়তে চড়তে আকাশ ছুঁয়েছে, পাড়াপ্রতিবেশী বলছে নাকি কাকপক্ষী বসা দায় হয়েছে।.. আসলে যদিও এসব মিথ্যা কথা... আসলে তো আমার রাগ হয়েছে।
        তো মাথার মধ্যে রাগের শব্দ আর ভালোবাসার শব্দরা মারামারি বাধিয়েছে। কিন্তু তাই কি? মাঝে মাঝে ভালোবাসার শব্দরাও রাগের পাড়ার শব্দ চুরি করে আনে। সে কথার সুর মিষ্টি। কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তার বুকে কুলের কাঁটা। বিছুটির জ্বালাপোড়া। প্রেমের শব্দরা অন্যপাড়া ঘুরে জিভের নাগালে এসেছে। চেনা কথা। চেনা শব্দ। চেনা মুখ। চেনা উচ্চারণ। চেনা চাহনি। তবু সব অচেনা। যেন মেন্ লাইনের গাড়ি ঘুরে কর্ড লাইনে। গন্তব্য এক। কিন্তু পথ ভিন্ন।
        এতো গেল মিষ্টি রাগের কত। মুশকিল হল বিষাক্ত রাগের কথায়। যখন প্রেম নেই। মুশকিল কি জানেন, সংসারে মাছওয়ালার সাথে সব্জীওয়ালার প্রেম না থাকুক ক্ষতি নেই গো। উত্তর কলকাতার সাথে দক্ষিণ কলকাতার বিবাদ থাকুক, ক্ষতি নেই গা। কিন্তু বাপে মেয়ে বিষ ঢুকলে মুশকিল। ভাবছেন এ আবার কি কথার সাথে কি কথা পাড়লাম। বলছি ভেঙে।
        সেই গুরগাঁও এর স্কুলটার কথা মনে আছে? আর মনে থাকবেই বা কি করে? সংসারে এতবড় সব ঘটনার মধ্যেখানে কে মনে রাখে কোন স্কুলে কোন বাচ্চাকে কোন ইলেভেনের দাদা বাথরুমে হত্যা করেছিল। কোন ক্রিকেটারের বিয়ে হানিমুন, গুজরাটে করা যেন এগিয়ে কারা যেন পিছিয়ে, দেশের এসব চিন্তা ছেড়ে এসব খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবলে চলবে?
        তবু বলি। কি তাজ্জব কথা দাদারা, সে ছেলেকে নিয়ে, মানে সেই ইলেভেনের ছেলেকে নিয়ে শিক্ষক শিক্ষিকা মহলে মেলা অভিযোগ গো! সে নাকি একবার স্কুলের জলের ট্যাংকে বিষ মেশানোর পরিকল্পনাও করেছিল। ওমা কি কান্ড হত বলুন? সারাদিন টিভিতে লাইভ ফুটেজ.. বাচ্চাদের সারিসারি মৃতদেহ.. মায়েদের আছাড়ি-পাছাড়ি কান্না.. আপনি চোখ মুছতে মুছতে টিভির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন, ও মাগো বলে আর্তনাদ করছেন, মাঝে মাঝে চ্যানেল পাল্টিয়ে সিরিয়ালটা কদ্দুর এগোলো দেখে নিচ্ছেন, কিংবা খেলার স্কোরটা, আর নিউজ চ্যানেলের লোকেদের তো ছেড়েই দিন, তারা বাড়িতে ফোন করে বলে দিয়েছেন, আমায় কয়েকদিন কোনো ফোনটোন কোরো না বুঝলে, বিশাল TRP উঠবে এখন, অমুক চ্যানেলটা গতবার আমাদের থেকে বেশি ফুটেজ দিয়েছিল, এবারে ওদের আর চান্স দেওয়া যাবে না, আমাদের এডিটর বলেছেন, ভালো TRP এনে দিলে সপরিবার মরিশাসে এক হপ্তা, হুররে, বুঝলে?
        তো সে ছেলের এ হেন পরিকল্পনার কথা শুনে আমার মটকাটা যা গরম হয়েছিল কি বলি, মনে হচ্ছিল দিক শালাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। কিন্তু একটা কথা সব ওলট পালট করে দিলে। সে নাকি সারাদিন বাপ্-মায়ের তুমুল ঝগড়াঝাটির মধ্যে বেঁচে থাকে, সে নাকি তার বাবা মা কারোর হৃদয়ের উষ্ণতা পাইনি, কারোর সাথে তার নৈকট্যের সম্পর্ক না গো। ভালোবাসা না পেলে একটা রাস্তার কুকুরই শুকিয়ে যায়, খেকুটে হয়ে যায়, আর এতো মানুষের বাচ্চা। ভাবছেন কি আদিখ্যেতা আমার না? একটা খুনিকে নিয়ে? আসলে তা নয় জানেন। আমি এই ছেলেটার কথা ভাবছি না। আমি ভাবছি আগামী যে খুনীগুলো আমাদের অহং এর তপ্ত তাওয়ায় সেঁকে এই সমাজে ছেড়ে দেব, তাদের কথা।
        প্রেম না থাকুক। ভালোবাসা না থাকুক। বিষটাকে কি কিছুতেই এড়ানো যায় না? একটা understanding বলেও তো প্রক্রিয়া আছে সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখার। তাতেও যদি না মেতে কাউন্সেলিং করা যায় না? সব সমাধানের পথ যে আমাকেই জানতে হবে তার কে মাথার দিব্যি দিয়েছে বলুন? কত প্রফেশনালসরা তো আছেন আপনার কথা শুনবেন বলে, আপনার আমার মনের অশান্তির ফিকিরগুলো খুঁজে খুঁজে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবেন, এগুলোকে আর বাড়তে দেবেন না। যেমন করে মানুষ শখের বাগানে আগাছাকে দূরে রাখে। সেকি আগাছার প্রতি ঘেন্নার জন্য না গোলাপের স্বাস্থ্যের জন্য? এটা ভাবার দায় যে নিজেদেরই নিতে হবে। নিজেদের জন্য না, গোলাপটার জন্য।
        ছেলেটার কি শাস্তি হবে জানি না। কিছু একটা অবশ্যই হবে। আমি ভাবি ওই বাবা মায়ের কোনো সাজা কোনোদিন হবে না। কেউ তাদের কোনো প্রশ্ন করবে না। এই সমাজটার চারদিকে এত অসহিষ্ণুতা, এত বিষাক্ত জমাজলা, সে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না। ঘরে নারায়ণ পুজোর আয়োজন হবে, জ্যোতিষীর কাছে ছেলের মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পাথর, মাদুলি কেনা হবে। কার্পেটের নীচে ধুলো জমতেই থাকবে, জমতেই থাকবে, তবু পরীক্ষিত, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাধানের পথে হাঁটার চেষ্টাটা হবে না, আরো আরো বেশি বেশি আলোচনা হবে না। এরকম আর কদ্দিন চলবে?

412
Wed, 12/20/2017 - 17:54


অনেকদিন আগের ঘটনা। স্কুলে পড়ি। দূরদর্শনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছে। মনোযোগ দিয়ে শুনছি। গান শেষ হল, আমার পাশে বসা একজন কাকু বললেন, বল তো উনি যে শাড়িটা পরেছিলেন তার দাম কত হবে? আর ওনার পায়ের কাছে যে কার্পেটটা রাখা ছিল তার দাম কত আন্দাজ কর তো?
        আমার খুবই করুণ দশা হল। শিল্পী যে শাড়ি পরেছিলেন সেই নিয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, কিন্তু তাঁর সামনে যে কার্পেট রাখা ছিল সেটা তো খেয়াল করা হয়নি।


        এই কথাটাই বলবার জন্য বসা। আমরা যা কিছু পর্যবেক্ষণ করি, তা কি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ? মনোবিদরা বলেন, না। আমাদের মনোরাজ্যের একটা নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্র আছে, যাকে তারা স্কিমা (Schema) নামে অভিহিত করেন। অর্থাৎ, আমি তাই মনে রাখি যা আমি মনে রাখতে চাই। তবে একটা কথা আসতে পারে, তাহলে আমরা দুঃখজনক ঘটনা, পীড়াদায়ক স্মৃতি ধরে রাখি কেন? প্রথমত, এই ধরে রাখা / না রাখাটা আমাদের ইচ্ছা/অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে না। আমাদের স্কিমাই সেটা নির্ধারণ করে দেয়। তাই নেগেটিভ ইমোশান বা নেগেটিভ স্মৃতিগুলোর পোষণের ক্ষেত্রে মরবিড, বেদনাবিলাসী ইত্যাদি স্বভাবের কথাও আমরা জানি। যে স্বভাবটাও তার হাতে নেই। সব স্বভাবই যদি বদলানো যেত তবে আর জেলখানার প্রয়োজন হত না। চূড়ান্ত অপরাধপ্রবণ ব্যক্তি আর অত্যন্ত সৎ ব্যক্তি – দু'জনেই তাদের স্বভাবের শৃঙ্ক্ষলে আবদ্ধ। এ কথাটা আমার না, স্বামীজির। তিনি বলছেন, এই যে আমি ভালো ভালো কথা বলছি তোমাদের সামনে, আর কেউ হয়ত চুরি করছে --- আমরা দু'জনেই আমাদের স্বভাবের দাস। আমি ভালো না বলে থাকতে পারি না, আর সে না চুরি করে থাকতে পারে না।
        তাই আমাদের সমাজ অপরাধীর বিচারের সোজা পথটাই বেছেছে। অপরাধের চিকিৎসা করার দায় নেয়নি। সে অত্যন্ত কঠিন, সময়সাধ্য, বিপদসঙ্কুল পথ। ‘সংশোধনাগার’ -এর বাস্তবায়িত রূপ যদি সত্যিই আকাঙ্ক্ষানুরূপ হত! গুগুল-এ কোনো ইংরাজি শব্দের অর্থ খুঁজতে গেলে, সেই অর্থের সময়ের সাথে ব্যবহারের গ্রাফ দেখায়। দেখছিলাম, insecurity শব্দটা ১৮০০ সালে যে পরিমাণ ব্যবহৃত হত, ২০১০ -এ তার ব্যবহারের মান প্রচুর বেড়ে গিয়েছে।
        একটা পরীক্ষার কথা শুনেছিলাম। একটা ঘরকে অফিসরুমের মত সাজানো হল। তাতে অফিসে যা যা থাকে, চেয়ার টেবিল কম্প্যুটার ইত্যাদি সবই রাখা হল, কিন্তু তার সাথে একটা খুলি আর একটা সাঁড়াশিও রাখা হল। ঘরে তিরিশজনকে কিছুক্ষণ রেখেই বাইরে নিয়ে আসা হল। তারপর তাদের প্রত্যেককে যখন আলাদা আলাদা করে ঘরের সামগ্রীর তালিকা বলতে বলা হল, আশ্চর্যজনকভাবে দেখা গেল, মাত্র ৮ জন খুলি আর সাঁড়াশির কথাটা বলতে পারলেন, বাকিরা পারেলনই না। তার কারণ মনোবিদদের ব্যাখ্যায়, আমাদের অফিস বলতেই একটা স্থির ধারণা মাথার মধ্যে আছেই, তার বিপরীতে কিছু গেলেই সে আর তা গ্রহণ করবে না। তাই খুলি আর সাঁড়াশিটা অতজনের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল।


        তবে আমাদের পর্যবেক্ষণের নির্ভরযোগ্যতা কতটুকু? অথচ আজ আমাদের যা কিছু অগ্রগতি তার মূল উদ্দীপক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই পর্যবেক্ষণ। যদি সব পর্যবেক্ষণই পক্ষপাতদুষ্ট তবে দাঁড়ানোর জায়গা কোথায়? এইখান থেকেই আমি মনোবিদদের থেকে বিচ্ছিন্ন হলাম। পর্যবেক্ষণের অর্থ কি? তার মূল উপাদান কি?
প্রথমেতেই দ্বিতীয়ের উত্তর আছে – মন। তার গভীর সংযোগই পর্যবেক্ষণ ও নিরীক্ষণ। ধরি স্টেশানে বসে আছি। ট্রেন আসতে ঢের দেরি। আমার হাতে বেশ কিছুটা বাড়তি সময়। আমি চেয়ারের পাশে হেঁটে চলা একটা পিঁপড়েতে মনোসংযোগ করেছি। একটা পিঁপড়ে আছে, আমার একটা মন আছে আর আমি – দ্রষ্টা হিসাবে আছি। আমি পিঁপড়েটার বাসস্থান, চলার গতি, গায়ের রঙ ইত্যাদি বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলাম, তাতে নিজের মধ্যে একটা আমোদ অনুভব করলাম। এটা একধরণের পর্যবেক্ষণ।
        অন্যভাবে ভাবা যাক। প্রেক্ষাপট একই। আমি পিঁপড়েতে মনোযোগ না দিয়ে, মনের আগাম কোনো সমস্যার ভাবনায় ডুব দিলাম। সেটা ব্যক্তিগত, পরিবারগত, জীবিকাগত, রাজনীতিগত, খেলাগত ইত্যাদি যা খুশীই হতে পারে। সেখানে সমস্যাটা পিঁপড়ের জায়গায়, মন আছে, দ্রষ্টা হিসাবে আমিও আছি। কিন্তু একটু পার্থক্য আছে। পিঁপড়ের সাথে দ্রষ্টার কোনো সম্পর্ক ছিল না, এখানে সমস্যার সাথে দ্রষ্টার সম্পর্ক আছে। তাই এইক্ষেত্রে পর্যবেক্ষণ শব্দটা আগের উদাহরণের সাথে প্রয়োগগত অনুরূপ হলেও ফলাফলত অনুরূপ নয়। আগের পর্যবেক্ষণের সাথে আবেগজনিত সমস্যা ছিল না। এইক্ষেত্রে আছে। পর্যবেক্ষণকে পথভ্রষ্ট করে দুশ্চিন্তার জটাজাল তৈরি করতে থাকবে আমারই আবেগময় সত্তা। যেন দ্রষ্টার আসন ধরে কে নাড়াচ্ছে কিম্বা যেন কেউ দ্রষ্টার সামনে কয়লার উনুনে আঁচ ধরিয়ে চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া করে তুলছে --- আমার আবেগ। আবেগেরও একটা ইতিহাস আছে। তারও একটা ফাইল আছে। সে কি পরিবেশে বড় হয়েছে, তার শিক্ষার মান কিরূপ (অবশ্যই আমি কাগজে ছাপা সংখ্যারাজির কথা বলছি না, যা নাকি মেধার মান নির্ণয় করে, আমি বিশ্বাস করি না)। আরো কিছু গভীর রহস্য নিশ্চই আছে যা আবেগের উৎসকে ঢেকে রেখেছে আজও আমাদের কাছে। ধর্ম বলেছে ‘পাপের’ কথা। বিজ্ঞান বলছে অপরাধের কথা। ধর্ম পাপের সংজ্ঞা নিয়ে নিশ্চিত, বিজ্ঞান অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে সংশয়ে। যত দিন যাচ্ছে, মনস্তত্ত্বের যত জটিল তন্ত্রী চোখে পড়ছে তত অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে আমরা বদলে বদলে যাচ্ছি, অবশ্যই যা কাম্যও।
        দুটো উদাহরণ দেওয়া গেল। এবার তৃতীয় উদাহরণে আসা যাক। ঘটনা আর প্রক্রিয়া – এই দুটোই একে অন্যের সাথে জড়ামড়ি করে থাকলেও, প্রক্রিয়া বহুক্ষেত্রে ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। বৃষ্টি পড়ছে – এটা ঘটনা। কি করে পড়ছে? এর উত্তর বাইরে নেই, ভিতরে এসো। আপেল পড়ার ঘটনাটা যেমন বাইরের কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের ব্যাখ্যাটা তো বাইরের নয়। যদি বলি তা শুধু নিউটনবাবাজীর নিউরোনের মধ্যে ঘুমাতেছিল, আপেল পড়ার অভিঘাতে জেগে উঠে একটা প্রবচন দিল – যা কিনা বিশ্বশুদ্ধ লোক মাথায় করে নিল... ব্যাপারটা তাই কি? নয় ত। নিউটনের মাথার মধ্যে যে সত্যটা ধরা দিল, তা তো বিশ্বজনীন, চিরকালীন সত্য। তবে সে সত্যের মধ্যে নিউটন ছিলেন, না নিউটনের মধ্যে সে সত্য ছিল বলো তো?
        আমাদের মধ্যে কোনো সত্য থাকে না। যদি থাকত তবে তা ব্যক্তিগত হত। সার্বজনীন হত কি? খুব অহংকারী ব্যক্তি যেমন ভাবে – এ বিশ্বে যা কিছু ঘটছে, তা তাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। সে মনে-প্রাণে সে কথা বিশ্বাস করে বলেই যে না হাতে–কোমরে তাবিজ জড়িয়ে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি পাল্টে ফেলতে চায়! কি স্পর্ধা তার না? তাই তো একদেশের জ্যোতিষীদের সাথে অন্যদেশের জ্যোতিষীদের না মিলল গ্রহ-নক্ষত্রের সংখ্যায়, আর না মিলল বৃষ্টি-ঝড়-ভূমিকম্পের হিসাবের। কিন্তু দেখো, এক দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীর সাথে সব দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীর কেমন মিল। কারণ তারা যে সত্যের মধ্যে বাস করছে সে সত্যকে আবিষ্কার করছে, না তো নিজের মধ্যে নিজের মত করে সত্যকে সৃষ্টি করেছে। বাড়ির দশটা লোকের চোখে কাপড় পরিয়ে নিজেকে কন্দর্পকান্তি বিশ্বাস করানো যায়। কিন্তু সারা বিশ্বের লোকের তো চোখে কাপড় দেওয়া যায় না। ঠিক সেরকম নিজের বুদ্ধি-বোধের চোখে কাপড় বেঁধে নিজেকে নিয়ে মূর্খের স্বর্গে দিন কাটানো যায় কিছুকাল, সবার চোখকে তো ফাঁকি দেওয়া যুগ যুগ ধরে সম্ভব নয়!
        ঘটনা ছাড়াও আমরা যে শৃঙ্খলে প্রকৃতির মধ্যে আবদ্ধ, তা হল সত্যি অর্থে ধর্ম। যে অর্থে আমরা বলি, জলের ধর্ম, মানে জলের 'রিলিজয়ন' না কিন্তু। রিলিজিয়ন না, ধর্ম। একটা নিয়ম। প্রক্রিয়ার নিয়ম। মেন্ডেল নামে যে বিজ্ঞানীর কথা আমরা স্কুলে পড়েছি, সেই ধর্মযাজক মহাশয় মটরগাছের এত বর্ণ, এত প্রকার নিয়ে কি ধাঁধাতেই না পড়েছিলেন। কাটিয়ে বেরোলেনও তো। বংশগতিবিদ্যার জনক হলেন। যদিও সেদিন তার কথা কেউ আমল দেয়নি, মাথা খারাপ, উন্মাদ ভেবেছিল। তিনি গভীর বিষাদেই হয়ত বা জীবনটা শেষ করলেন। কিন্তু সেই সত্যটা কি অস্বীকৃত রইল আজ? না তো। সেদিন যদি তিনি তার ভিতরের সেই তৃষ্ণাকে, কৌতুহলকে দমিত করে, যাজক-পরম্পরার রীতি-রেওয়াজে জীবন কাটাতেন, কি সমূহ ক্ষতি হত! আবিষ্কার হত না, তা বলছি না, আরো কয়েক শতক দেরি হয়ে যেত না?
        এই শেষ ধারার পর্যবেক্ষণকেই ভারত তার প্রাচীন দর্শনে নাম দিয়েছিল, তত্ত্বালোচনা। খুব সুন্দর একটা কথা প্রচলিত ছিল – তত্ত্বদর্শী। অর্থাৎ যা দেখার অগম্য বলে জানি, তাকেও দেখার একটা উপায় আছে। যে মানুষটা স্টেশানে পিঁপড়ে দেখছিল, যে সমস্যার গভীরে ডুবছিল, তাদের ছাড়িয়েও এমন একজন তো থাকতেই পারে, যে সংসারের ঘটনাগুলো ছাপিয়ে তার মধ্যের কোনো একটা প্রক্রিয়ার সূত্র বুঝতে চেষ্টা করছে। কিছু একটা মিলিয়ে নিতে চাইছে।
        এই শব্দটাতেই থামতে চাইছি। ‘মিলিয়ে নেওয়া’। ইংরাজিতে invention আর discovery বলে দুটো পৃথক শব্দ আছে (আমাদের পৃথক শব্দ থাকলেও, যেমন ‘উদ্ভাবন’, আমরা দুটোকেই ‘আবিষ্কার’ বলে চালাই। প্রথম স্টীম ইঞ্জিন ‘আবিষ্কার’ করেন কে? আর নিউটন কি সূত্র ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন?)। যে কোনো discovery হল কোনো একটা প্রতিবেশী সত্যকে চেনা, যে সত্যের সাথে আমার অস্তিত্বের সত্য প্রত্যক্ষ কিম্বা পরোক্ষভাবে জড়িত। তাকে নিজের বোধের সাথে মিলিয়ে নেওয়া। সে পূর্বস্থিত, অনাদি বোধ স্কিমাও নয়, অভিজ্ঞতাও নয়। সে যে কি, সে ইম্যানুয়েল মহাশয় যতদূর যুক্তি যেতে পারে, ততদূর তার অন্বেষণ করে দেখিয়েছেন – সে অগম্য, কিন্তু অনস্তিত্ব নয়। মানুষের পরম সার্থকতা সেই বোধের তীরে তীরে হাঁটা। এর অন্যথা যখনই এসেছে মানুষ যে হিংস্রতার উদাহরণ দেখিয়েছে তা শিউরে ওঠার মত। আমরা এই সময়ে, প্রায় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষপটের মধ্যে হেঁটেও যে যুদ্ধকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি না, তার কারণ প্রাক্তন দুটো বিশ্বযুদ্ধ। আমাদের স্মৃতিপথে তারা এখনও ম্লান হয়ে যায়নি যে!
        সেই বোধের গভীরে যাওয়াকেই ভারত বলেছিল – অন্তর্মুখ হও, নিজেকে জানো। এই ‘নিজে’ অর্থে একটা ব্যক্তিসত্ত্বাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন মাত্র, এতটা স্বল্পদর্শী তারা ছিলেন বলে বিশ্বাস হয় না। তবে প্রকৃতির সাথে অমন মিলেমিশে থাকার কথার সাক্ষ্য আমাদের প্রাচীন সাহিত্য বহন করত না। তাও-সম্প্রদায়ের মতে, জীবনে চলার মূলসূত্রই হল, প্রকৃতির মত সহনশীল হও। নমনীয় হও জলের মত। যা কিছু মৃত তাই কঠিন, তাওবিদ বলছেন, দেখোনি মৃত উদ্ভিদের দেহ, মৃত প্রাণীর দেহ? কেমন কঠিন, কেমন অনমনীয়? প্রকৃতির সাথে চলার ছন্দটা আবার খুঁজে নাও। গভীরে পর্যবেক্ষণ করো। কোনো ঘটনা না। কোনো দুঃখ-সুখ না। প্রশ্ন করো, কোন সূত্রে এত বৈচিত্র একছন্দে গাঁথা পড়ে আছে–

“নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু,
পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্র ভানু।
     তব নৃত্যের প্রাণবেদনায়     বিবশ বিশ্ব জাগে চেতনায়
     যুগে যুগে কালে কালে     সুরে সুরে তালে তালে,...”

তোমার গভীর দেখাই তোমার খোঁজা। তোমার খোঁজাই তোমার সাধনা। তোমার সাধনাই তোমার করুণার গঙ্গোত্রী।

“হেথায় কারো ঠাঁই হবে না    মনে ছিল এই ভাবনা,
          দুয়ার ভেঙে সবাই জুটেছে।
যতন করে আপনাকে যে     রেখেছিলেম ধুয়ে মেজে,
          আনন্দে সে ধুলায় লুটেছে ॥”

 

 

413
Tue, 12/19/2017 - 11:00

একটা সুর বেজে চলেছে দূরে কোথাও। কান পেতে শুনলে মনে হচ্ছে, দূরে কই, এই তো কাছে আমারই বুকের মধ্যে বেজে চলেছে সে। সুরটা যেন প্রথম কানে এলো, কিন্তু অচেনা নয়। নিজের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুনছি, বেজেই চলেছে, বেজেই চলেছে সে সুর। এখনই যেন বর্ষা নামবে, ভিজে চুপচুপ হবে আমার সমস্ত আমি। ভিজতে ভিজতে আমি শুনব, ভাবব - কে বাজালো এই সুর?
        দিনের নানান কাজের তাড়াদের দরজার কাছ থেকে ফিরিয়ে দেব, বলব, আজ আমার ভীষণ জ্বর যে, কাজে যাই কি করে? তোমরা যাও। তরপর অনেক অর্থহীন কথার মধ্যে থেকে একটা দরকারি কথা খোঁজার খেলায় মাতব। অর্থহীন কথা, অর্থহীন চেষ্টা, অর্থহীন অবকাশযাপন আমার সারাদিন জুড়ে বেড়ালের মত এ ঘর ও ঘর করতে থাকবে। আমি তাদের পিছনে পিছনে তো যাব না, তবু তাদের দূর থেকে দেখব, আর সেই সুরের মধ্যে ডুববো। কেজো মানুষদের চোখ এড়াব, তারা কাছে এলেই বলব, দূরে যাও, আমার শরীরে ভীষণ বিশ্রী একধরনের ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে যে! তারা ভয়ে লেজ তুলে হুড়মুড় করে দৌড় লাগাবে, আমি নিজের মনে মনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ব, কিন্তু বাইরের একটা ঘাসের আগাও জানবে না সে কথা। তারা জানবে আমার ভীষণ অসুখ।
        আমার এতদিনের সাধের যা কিছু সঞ্চয়, সব আজ যেন অকিঞ্চিৎকর, অর্থহীন মনে হবে। আমার কেজো আমি অভিমানে ফুঁসবে, বলবে - আচ্ছা..বটে...তবে। আমি তার অভিমানকে তোয়াক্কা করব না, বলব আজকের দিনের জন্যে তো আমিই রাজা, আমার সব কিছু অর্থহীন আজ, আমার কাছে এসো না। দেখছো না আজ রোদ ওঠেনি, আজ কেমন অস্পষ্ট সব কুয়াশায়, তুমিও যাও। মনে রেখো তুমি আসলে দাস, আমিই প্রভু, অর্থহীন আমি আসল, তুমি নকল. তুমি শুধুমাত্রই প্রয়োজনের। প্রয়োজনের বাইরেও যে আমার অস্তিত্ব তুমি ভয় করো তাকে, কারন সে অর্থহীন। সে পাগল। সে বেহিসাবি। তোমার অস্তিত্বের একদম বিপরীত প্রান্তে সে বসে। কি ভীষণ সংকট তোমার তাকে নিয়ে। সে শোনে সুর, সে খোঁজে খেলা, তুমি খোঁজো যন্ত্র, তুমি খোঁজো কাজ। তোমার কানে সুর পৌঁছায় না। তুমি সুরের নাগাল পাও না, ওদিকে গর্ব করে বলো, ওসব মিথ্যা, কুহক। হয় রে হায়, যদি তুমি কোনোদিন টের পেতে কত বড় কুহক তুমি নিজে। কিন্তু সে টের তুমি কোনোদিন পাবে না, কারণ অন্ধকার নিজেকে অনুভব করে আলোর অনুপস্থিতিতেই, তুমিও তাই ওগো আমার কেজো অহং, তুমি যে আমার সুরের আলোর অনুপস্থিতি মাত্র শুধু।
        কিন্তু আজ তুমি যাও। আজ সব তর্ক থাক। আজ বিশ্বসংসারের কোন কোণায় কি ঘটল, আমি কিছুই জানতে চাই না, আজ আমার কোনো দায় নেই। আজ আমার জন্যে যে অপেক্ষায় আছে সে আমার অদেখা বন্ধু, আমার চিরকালের সাথী। সে অর্থহীন। সে অসীম। অসীমের কোনো অর্থ হয় না। তাই শূন্য হয়ে সে এত ছদ্ম-অর্থপূর্ণ জগতের মধ্যে নিশ্চিন্তে বাস করে, আমারই প্রতিবেশী হয়ে। যেদিন সবকিছু ভেঙে পড়ে, সব সঞ্চয় এক লহমায় ভীষণ ঝড়ে হারিয়ে যায়, নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে ফেলি, যেদিন সত্য অর্থে আমার নিতান্তই দুর্দিন, সেদিন সে আসে। বুকের মধ্যে পরম আদরে কাছে ডেকে নেয়, বলে, এই তো আমি এসেছি, তোমার চিরকালের সাথী মহাশূন্য, তুমি জানো আমায়, কিন্তু কোনোদিন ভয়ে স্বীকার করোনি। তাই হয় জানো, মানুষ ততদিন আমায় স্বীকার করে না, যতদিন সে আমায় স্বীকার না করে অনায়াসে চলতে পারে, যতদিন না তার অহং এর পথ ফুরিয়ে আসে।
        অবশেষে আমি বিশ্রাম পাই সেই অসীম শূন্যের বুকে এসে। সে আমার আনন্দ, আমার পরম গন্তব্য, আমার পরম প্রিয় সখা। সে আমার শূন্য। কিন্তু সে ফাঁকি নয়। সে সব অর্থ থেকে, সর্বোপরি আমার নিজের থেকে আমায় মুক্তি দেয়। বীজের আবরণ যেমন সব চাইতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় অঙ্কুরের জাগরনের, এও তেমনিই। অঙ্কুর যেমন একটা অবকাশ পেলে নিজেকে মেলে ধরে চারদিকে, তেমনি আমিও একটা অবকাশ পাই নিজেকে মেলে ধরার, নিজেকে প্রকাশ করার এই শূন্যের কোলে। আজ আমার সেই অর্থহীন দিন। সব অর্থ থেকে মুক্তির দিন।

414
Fri, 12/15/2017 - 18:00

ভূত বলে কিছু আছে নাকি? আছে তো, খুব আছে। আমি নিজের চোখেই কতবার দেখেছি। প্রত্যেকটা অসময়ের মৃত্যুর একটা অসম্পূর্ণ গল্প রেখে যায়। যায় না? সেই অসম্পূর্ণ গল্পটাই তো ভূত। তাকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায়, কোলে তুলে গল্প করা যায়। হয় না? শুধু যে মৃত্যুতেই এরকম ঘটে তাও তো নয়। ধরুন রাস্তা দিয়ে হাঁটছেন, একজন অপূর্ব একটা গন্ধ মেখে তার সুবাস ছড়িয়ে চলে গেল আপনার পাশ দিয়েই, হয়ত আপনার ভীষণ তাড়া তখন, কিন্তু তবু মনের অলস ঘরে একটা গল্প ওই সুবাস তৈরি করে দিয়ে যাবেই যাবে। আপনি অন্যমনস্ক হতে হতে টাল সামলিয়ে আবার বস্তু জগতে ফিরবেন। সারাদিন এরকম কত ছেঁড়া ছেঁড়া গল্প মনের আনাচেকানাচে জমা হতে থাকে, তাই দিয়ে কি আর সংসার চলে? না, সংসার চলে না বটে, কিন্তু মানুষ চলে। মানুষের ভিতরে ভিতরে যে অকারণে, অকাজে, বয়েস নিরপেক্ষ চলা, সেটা এইগুলোকেই পাথেয় করেই তো? নইলে রবি ঠাকুর কেন ঘরের লোক হল বলুন? সেকি অমন কঠিন দর্শনের কথা ‘শান্তিনিকেতন’ - কি ,‘মানুষের ধর্ম’-এ বলেছেন বলে? না তো। তার চোখে ‘ছেলেটা’, ‘সাধারণ মেয়ে’, ‘নিস্কৃতি’ চোখে পড়েছিল বলে? আমার তো মনে হয় দ্বিতীয়টাই কারণ। আমার রবীন্দ্রনাথ তো কঠিন হতে শুরু করল যখন সিলেবাসের মধ্যে ক্লাসরুমে স্যারের হাতে পড়লেন, তখন যেনা জানলুম, ভদ্রলোক এতবড় মাপের মানুষ ছিলেন, এত জ্ঞানীগুণীদের তত্ত্বালোচনায় তাঁর আসন!
কিন্তু সে ছবি মুছতে বেশি সময় লাগল কই? ‘গীতবিতান’ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, তোমার ওসব গুরুত্বপূর্ণ অকাজ সারা হয়ে থাকলে একটু আসব? বললাম, এসো, কি বলবে?
        সে বলল, শ্রাবণ এসেছে, আকাশের দিকে তাকিয়েছ? রাতের বৃষ্টিতে পাতার উপর জলের ধারাপাত শুনেছো? শরৎ এলো, আকাশের রঙটা খেয়াল করেছ? বসন্ত এলো, হাওয়াটায় তোমার মনের মধ্যে কোনো অকাজের কথা জাগছে না? এত শোক কেন তোমার? এত সারাদিন কিসের হিসাব? এত ভয় পাও কেন?


        দেখোদিকিনি, কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে এসে দাঁড় করালাম। তো যেটা বলছিলাম, মনের মধ্যে ছেঁড়া টুকরো গল্পগুলোর কথা। সেই গল্পের সুখের কথা কাউকে বোঝানো যায়? যায় না। ওসব গল্পরা অসম্পূর্ণই থাকে সব সময়, পরিচ্ছেদের পর পরিচ্ছেদ বাড়তে থাকে মনের অতল গহ্বরে। “ হ্যাঁ রে, কি ভাবছিলি?” – যেই কেউ জিজ্ঞাসা করল, অমনি ফাঁপরে পড়ে গেলাম, সত্যিই তো কি ভাবছিলাম? থাক, সে ছাই নিজেই কি জানি? একটু অপ্রস্তুত হেসে বলতে হয়, কই সেরকম কিছু না তো। কিছু মানুষ আবার নিজেকে প্রচণ্ড কাজের মানুষ, ব্যস্ত মানুষ সাজিয়ে এমন চরকির বেগে নিজেকে ঘোরায় আর সকলের দিকে একটা তিরষ্কার, অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকায়, যেন সে ছাড়া সংসারে বাকি সব মানুষেরা বিধাতার শক্তির অপচয় মাত্র। এই সব অত্যন্ত কেজো লোকেদের নিতান্ত করুণার পাত্র বলেই বোধহয়, সে তাদের অহংকারের জন্য না, তাদের আশেপাশে যে সব মানুষে পরিবৃত হয়ে থাকে সেই জন্য। তারাও সব কাজের মানুষ। নানা ফিকিরে সেই ব্যস্তমস্ত ইগোধারীর কাছ থেকে স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলেই তারা চম্পট দেবে। টিকিটিও আর খুঁজে পাওয়া দায়।
        এর প্রধান একটা কারণ বোধহয় মানুষে মানুষে যে সত্যিকারের সম্পর্কের বুনট, তা অপ্রয়োজনের। তাই বোধহয় সব সম্পর্কের চূড়ান্ত সার্থক পরিণাম – বন্ধুত্ব, ফেসবুকেও আমরা যে পরিচয়ে একে অন্যের দিকে হাত বাড়াই। এমনকি এখানে আত্মীয়স্বজন, শিক্ষক-শিক্ষিকা সবারই একখানাই ফেসবুকীয় পরিচয় – বন্ধু। তবে ওসব তাত্ত্বিক আলোচনা থাক। মনের গল্প হচ্ছিল, তাতেই ফেরা যাক বরং। মনের অলস ঘরের গল্প। তবে আসলে তা তো অলস ঘরের গল্প না, সে তো অবকাশের গল্প। ক্ষণিক বিরতির গল্প।
        যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তবে সেই অসম্পূর্ণ গল্পের বক্তা কে? শ্রোতাই বা কে? বক্তা হল আশা, আর শ্রোতা আমার সুপ্ত, অবিকশিত ইচ্ছা। তারা জন্মায় কোথা থেকে? জানি না। কেউ জানে না। তবু তা দিয়েই আমাদের সকাল থেকে রাত, জীবন চাকা গড়িয়ে চলে, এমনকি ঘুমের মধ্যেও ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলে চলে, যা আভাসে স্বপ্ন হয়ে ধরা দিয়েও ধরা দেয় না। কেউ কেউ বলেন, আমি যা স্বপ্ন দেখি তার প্রায় সবটাই মনে করতে পারি। যেন এটা খুব একটা বড় কথা। কিন্তু আদতে কি তাই? তা নয়ত। স্বপ্নের ঘটনাবলী আর স্বপ্ন কি এক? না তো। স্বপ্নের মধ্যে এমন কিছু একটা তো অবশ্যই থাকে যেটা তাকে সম্পূর্ণ বাস্তব করে আমাদের সামনে ঘটিয়ে যায়, তখন কি মনে হয় সেটা স্বপ্ন দেখছি? হয় না তো? আর যখন স্বপ্নটা স্মৃতিপথে এসে জাগা অবস্থায় রোমন্থন করি, তখন তো জানি সেটা অবাস্তব তখন আমার কাছে, তার সেই বিশ্বস্ততাটা কোথায়? তাই আদতে অর্থহীন ওটা। তবে মনোবিদের কাছে হয়ত তার গুরুত্ব অনেক। হতে পারে। কিন্তু মনোবিদের কাছে আমার মন আর আমার কাছে আমার মন কি এক? নয়ত।
        খেয়াল করলে দেখা যাবে, মানুষের প্রতিটা অসম্পূর্ণ গল্পের একটা যন্ত্রণা থাকে। সেটাই যেন তার মূলসুর। বলা হয় পশুপাখির কোনো ভূত হয় না কেন? আরে হবে কি করে। তাদের জীবনের পুরোটাই তো শরীরের গল্প। শরীরের কোনো গল্প হয় নাকি? সে বড়জোর একটা স্থূল দাগ টানে মনের গল্পের দুটো প্যারাগ্রাফের মধ্যে। আর পশুর যেটুকু মন, সেতো আমাদেরই দেওয়া, তাকে পোষ্য করে। আমি অবশ্য প্রাণীবিদের দৃষ্টিভঙ্গীতে বলছি না, সেই দৃষ্টিতে তো আমি নিজেও একটা প্রাণী বই আর কিছু নয়। তাই সত্যজিতের সাইমন ভুত হতে পারে, মহেশের মোষটা নয়। কারণ মহেশের গল্প সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, সাইমনের নয়।
        যেটা বলছিলাম, অসম্পূর্ণতার যন্ত্রণার কথা, কান্নাই যেন মূলসুর সেই সব গল্পগুলোর। কান্না তো আসলে আশা হত হলে জন্মায় না, আশা অবরুদ্ধ হলে জন্মায়। যে কাঁদে, বুঝতে হবে তার মধ্যে কিছুটা আশার অনুভূতি এখনও টিকে আছে বলেই সে কাঁদছে, নইলে সে স্থবির হয়ে যেত। তাই কান্নাটা আস্তিকের, স্থবিরতাটা নাস্তিকের। আমি ঈশ্বর বিশ্বাসের আস্তিক্যের কথা বলছি না। সে তো খুব ছোটো কথা। যারা বইমেলায় যান না ইচ্ছা করে, তাদের ধারণা পৃথিবীতে সব বইয়েই মোটামুটি কি লেখা আছে না জানলেও, এইটুকু জানেন যে ওতে কাজের কথা কিছু লেখা থাকতে পারে না, তাই তারা যান না। ঈশ্বর বিশ্বাসের আস্তিকতা মোটামুটি এরকম। তিনি প্রতি বৃহস্পতিবার নকুলদানা চান, এই নিয়ে যাদের কোনো সংশয় নেই, সেই আস্তিকতা তো খুব ছোটো কথা। কিন্তু যে আস্তিকতা মানুষকে কাঁদায় সে খুব বড় আস্তিকতার কথা। রামকৃষ্ণ মহাশয় তাই বলতেন, কাঁদতে পারো? অর্থাৎ কেঁদে কেঁদে তোমার ঈশ্বরকে তুমি বানিয়ে নাও, খুঁজে নাও। বেলের চারা লাগাবার পিছনেও কোথাও একটা নান্দনিক স্বার্থবোধ থাকে, কিন্তু কেউ যদি বটের চারা কিম্বা অশ্বত্থ্বের চারা পোঁতে, নিজের বাড়ির দেওয়ালে ফাটল ধরতে পারে জেনেও, সেই আস্তিকতা, যে ঘরের দোর ভেঙে পরের কান্নায় সামিল হয়ে যায়। অশ্বত্থকে বলে, তুমি বড়ো হও, আমি দেখে যাব না, কিন্তু আমার আগামী প্রজন্মকে আশ্রয় দিও, ছায়া দিও। সেকি বেল, রজনীগন্ধা, গোলাপের কাজ গা?
        আশা অবরুদ্ধ হয়ে যে সুর জাগায় তাই কান্না, এইটাই বলছিলাম, হত আশা শুধুই দীর্ঘশ্বাস, জীবনবিমুখ। আবদ্ধ আশাকে তাই চালাকির আশ্রয় নিতে হয় না, তার কান্নাই পথ বানিয়ে ফেলে, কারণ সে জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় না যে। আর পথও যদি একান্তই নাও বানাতে পারে, তবে পথ বানাবার সামগ্রীর আয়োজন করে রেখে যায় পরের প্রজন্মের জন্য।
        সেই কান্নাগুলোর গল্পই ভূত। আস্তিক অসম্পূর্ণতাই ভূত। এই ভূত শুধু মৃত মানুষের আশেপাশে না, বহু জীবিত মানুষের আশেপাশেও ঘোরাফেরা করে। তাদের কথা মানুষের কথার মত নয়। তারা বাক্য দিয়ে কথা বলে না, কথা বলে দুটো বাক্যের মধ্যখানে যে শূন্যস্থানটা তৈরি হয় তা দিয়ে। কেউ কেউ শুনে ফেলে। শুনে ফেলে তার নিজের ভূতেদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। এইভাবে বেঁচে থাকা মানুষের পাশাপাশিই ভূতেরাও বাসস্থান গড়ে। তারা কল্পনা না, বাস্তব। বস্তজগতের বাস্তব না, মনের অবকাশের ঘরের, অকাজের মানুষটার দোসর। পৃথিবীকে ভালো রাখতে গেলে, মানুষকে ভালো রাখতে গেলে, তাই ভূতেদের ভালো রাখতে হবে আরো। কারণ ভূত ছাড়া যেটুকু মানুষ পড়ে থাকে সে নিতান্তই জীববিজ্ঞানের যন্ত্র, যার পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে যাওয়ার বড় কিছু একটা নেই, কিছু দূষণ আর হত্যার গল্প ছাড়া। আসল গল্প বলে আস্তিক ভূতেরা। ভালোবাসার অসম্পূর্ণ গল্প। যে গল্প ভেজা দুড়দুড়ানি বুকে খুঁজতে হয়।

 

 

415
Mon, 12/11/2017 - 14:00

আপনাদের বলছি, সেই সব বাবা-মায়েরা, শিক্ষক-শিক্ষিকা-পাড়া প্রতিবেশীরা...

আপনারা বিন্দুমাত্র আঁচ পান না, একটা ছেলে ক্রমশ আচার ব্যবহারে চেনা ছকের গণ্ডী পেরোচ্ছে? কোথাও যেন তার ব্যবহারটা ঠিক নয়। তার মধ্যে ক্রমে বাসা বাধছে অপরাধকামী সত্তা..ছোটো ছোটো অপরাধ কি অবহেলায় হারিয়ে যেতে থাকে প্রশ্রয়ে...আমি আমার পরিবারে..আশেপাশের অনেক পরিবারে দেখে আসছি...'এই বয়সে ছেলেদের এরকম একটু-আধটু কৌতুহল থাকেই...ও বয়েসের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে'...
        ঠিক কিন্তু হয় না। সে ধর্ষক না হলেও, আরো অনেক কিছু হয় যা আলো নিভলে মশারির মধ্যে কেউ কেউ হয়ত টের পায়। যা আমাদের মহামান্য আদালতের চোখে নিরপরাধ ঘটনা হলেও। একটা বয়েসে এগুলো আটকানো যেতে পারত কিন্তু। অনেক রকম পদ্ধতি আছে এখন একটা সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার। কাউন্সেলিং তার মধ্যে একটা বড় পথ।
        দায়িত্বটা আসলে কিন্তু সবার। শুধু বাবা মায়ের নয়। কারণ বিষবৃক্ষের ফল শুধু নিজের গাছটার ক্ষতি করে কি? নয় তো। আমাদের আশপাশ সম্বন্ধে আমদের আরেকটু সচেতন হতেই হবে। স্কুলগুলোতে সিলেবাসের দায়ভার ছাত্র-ছাত্রীদের ঘাড়ে চাপিয়ে সচল মানুষ বানাবার পাশাপাশি, একটা আত্ম-নিয়ন্ত্রণক্ষম মানুষ বানাবার দায়ভার শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিতে হবে। প্রয়োজনে এই বিষয়ের সাথে যুক্ত পেশাদার ব্যক্তিবর্গের সাহায্য চাইতে হবে।
        কথা বলুন, নিজের ছেলে হোক, আত্মীয়ের ছেলে হোক, পাড়ার ছেলে হোক, ছাত্র হোক..তার সাথে কথা বলতে অভ্যাস করতে হবে। যৌনতা নিয়ে তার কি চিন্তা-ভাবনা জিজ্ঞাসা করুন। শিশু হোক, কিশোর হোক, পশু তো নয়! কথা তো বলতে পারে! কথা বলুন, সরাসরি যৌনতা নিয়ে তার কি ধ্যান-ধারণা শুনুন। পর্ণ থেকে কণ্ডোম, যা বিজ্ঞাপনের হাত ধরে ওই বয়সের কাছে আগাম পৌঁছাচ্ছে, সে বিষয়ে তার মতামত শুনুন। আগ্রহ নিয়ে শুনুন। অযথা জ্ঞান দেবেন না, মনে রাখতে হবে যৌনতা কোনো অর্জিত বা ন্যস্ত চাহিদা নয়, এটা instinct, সহজাত প্রবৃত্তি।
        আমি দীর্ঘদিন আমার ছাত্রদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলে আসছি সরাসরি, তার একটা কারণ অবশ্যই আমাকে 'জীবন বিজ্ঞান' পড়াতে হয় তাই নিয়ম মাফিক সামনে চলেই আসে। তবু না এলেও আমি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেও তার মনোভাব জানতে চাইতাম। কারণ সহজাত প্রবৃত্তিগুলোকে বোধের আলোতে সুনিয়ন্ত্রিত করেই সভ্যতা তৈরি হয়েছে। এই তো মূলসূত্র, আজই বা সব ঘেঁটে যাবে কেন? তারা অনেক কথা বলতে চায়, মনে রাখতে হবে, আবারও বলছি, 'বলতে চায়'। আগে মন দিয়ে শুনুন, তারপর নিজের কথাগুলো তাদের ধারণার পাশাপাশি রাখুন, তাদের নস্যাৎ করে দিয়ে নয়। সে ধীরে ধীরে ঠিক ভুল বুঝতে শিখবে। সাহায্য করুন, একটু দূর থেকে, ট্রেইন করতে যাবেন না, ওরা শিশু বা কিশোর, পশু নয় কিন্তু। মানুষের মত ব্যবহার করুন। যদি কোনো রকম দুর্বোধ্য অবস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন, আবারও বলছি প্রফেশনালদের সাথে কথা বলুন। দেখেছি প্রচুর লাভ হয়। মোট কথা উচ্চাসন ছেড়ে নামার সময় হয়েছে। অন্তত বেশিরভাগ মানুষ যদি আমরা এভাবে সচেতন হতে পারি আশাপাশের ছেলেগুলোর বেড়ে ওঠার সময় তবে হয়ত এই ধরণের ঘটনার কিছুটা সংখ্যা কিছুটা হলেও কমবে।
        আর কিছুতেই কিছু না হলে, হোমে পাঠানোর ব্যবস্থা হোক, অপরাধ ঘটার অপেক্ষায় না থেকে। প্রয়োজন হলে মায়েদের অনুরোধ, তারাই এ কাজটা করুন। কারণ আমি এখনও বিশ্বাস করি 'মায়ের চোখ এড়ানো কঠিন'।

416
Thu, 12/07/2017 - 10:13

“বুঝিলাম, শচীশ এমন-একটা জগতে আছে আমি যেখানে একেবারেই নাই। মিলনমাত্র যে আমাকে শচীশ বুকে জড়াইয়া ধরিয়াছিল, সে-আমি শ্রীবিলাস নয়, সে-আমি 'সর্বভূত'; সে-আমি একটা আইডিয়া।
এই ধরনের আইডিয়া জিনিসটা মদের মতো; নেশার বিহ্বলতায় মাতাল যাকে-তাকে বুকে জড়াইয়া অশ্রুবর্ষণ করিতে পারে, তখন আমিই কী আর অন্যই কী। কিন্তু এই বুকে-জড়ানোতে মাতালের যতই আনন্দ থাক্‌, আমার তো নাই; আমি তো ভেদজ্ঞানবিলুপ্ত একাকারতা-বন্যার একটা ঢেউমাত্র হইতে চাই না--আমি যে আমি।“


        ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসটার মত এত গভীরে নাড়া আমায় খুব কম উপন্যাস দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের। ‘গোরা’ ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু মনস্তত্ববিদ্যা আর ধর্মবৃত্তির এমন মুখোশ খসানো লেখা, স্তম্ভিত করে দেয়। আমি ছোটবেলা থেকে যতবার ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ কথাটা শুনতাম কিম্বা ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর’, আমার কেমন সংশয় হত। মনে হত আমায় যে ভালোবাসে, হঠাৎ করে কোনো একদিন যদি জানতে পারি যে, সে আসলে আমায় ভালোবাসেনি, বেসেছে আমায় ব্রহ্ম জেনে, সেদিন কি আমার অপমান লাগবে না? লাগবে। আমি একটা মানুষ, আমি যা দাবীই করি না কেন, সে ভালোবাসাই হোক, কি করুণাই হোক, সে মানুষ হিসাবেই করি, কখনও তো নিজেকে ব্রহ্মের প্রতিভূ হিসাবে নয়!
        তাই বারবার এই আইডিয়াটা থেকে নিজেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেছি। কারণ এর মধ্যে একটা নেশা আছে। একবার এক ভক্তমণ্ডলী কম্বল বিতরণের অনুষ্ঠান করে গরীব মানুষদের জন্য। তারা কম্বল দেওয়ার আগে তাদের একটা চেয়ারে বসিয়ে কপালে চন্দনের টিপ পরিয়ে, হাতে ফুলের স্তবক দিয়ে, প্রণাম করে কম্বল হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। আমার ওই হতদরিদ্র চেয়ারে বসা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে কোথাও খুব যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছিল। কেমন যেন আমাদের একটা খেলার নেশায় পেয়েছে। 'ভগবান' 'ভগবান' খেলা। ওরা আমাদের খেলনা। আজ কিছুক্ষণের জন্য ওরা ভগবান। ওদের অপ্রস্তত, সঙ্কুচিত আচরণ আমাদের ইগোকে কোথায় যেন একটা আরাম দিয়ে যাচ্ছে, ‘আমরাও কিছু একটা করছি’। আমার মনে হচ্ছিল, আচ্ছা এভাবে যদি আমরা না দিতাম, আমাদের মনের ভাব মনেই রেখে, মানুষের স্বাভাবিক যে মর্যাদা সেই মর্যাদাটুকু দিয়েই যদি তাদের হাতে এই সামগ্রীগুলো তুলে দিতাম? তাতে কি খুব অসুবিধা হত? হত। আমাদের সুক্ষ্ম ভক্তের ইমেজটার যে ইগো সে আরাম পেত কি? যে মানুষগুলো সাধারণ মানুষ হওয়ার সম্মানটুকু থেকে বঞ্চিত, সে যদি হঠাৎ ব্রহ্মের সম্মানে ভূষিত হওয়ার যাঁতাকলে পড়ে, তবে সে নিতান্তই বিড়ম্বনা তার কাছে।
        তবে আজ যে কথাটা এত সহজে লিখছি, সেদিন কিন্তু এতটা সহজে অনুভব করিনি একথাগুলো। বরং আমার মাথায় এমন বিপরীত চিন্তা আসার কারণে নিজেকে ভর্ৎসনাও করেছি। তবু যা সত্য বলে অনুভব করেছি, তা একদিন না একদিন তো বলিষ্ঠ হবেই নিজের সত্তায়। তাই-ই হয়েছে।


        ‘চতুরঙ্গ’ উপন্যাসে আরেকটা কথা মারাত্মক লাগে। 'ননী' নামক মেয়েটিকে বাড়ির বড়ছেলে ধর্ষণ করে যখন গর্ভবতী করেছে ও বাড়ি থেকে বিতাড়িত করেছে, সে তখন নানা ঘটনার পর আশ্রয় পেয়েছে সেই বাড়িরই আরেক প্রান্তে জগমোহনের বাৎসল্যে। যে জগমোহন 'নাস্তিক' বলে সর্বজনবিদিত। সে খবর পেয়ে তাদের বাড়িরই একজন মহিলা এসে বলছেন, তুমি একি অনাচার করছ বাবা? ওকে বিদায় করো! তখন জগমোহন বলছেন, "তোমরা ধার্মিক, তোমরা এমন কথা বলিতে পার।"
        এই লাইনটা চড়ের মত লেগেছিল। আজও লাগে। ক'দিন আগে টাইমসের এডিটোরিয়ালে পড়ছিলাম, বলা হচ্ছে, ‘ভারতের সময় এসেছে এবার ধর্মের কোন্দল ছেড়ে সামাজিক নানান সমস্যার হাল খোঁজার।‘ পড়ে হাসিই পেল। সময় এসেছে না, বহুদিন হল এসে বসে আছে। কিন্তু আমাদের সময় হলে তো!
        ধর্মের আর ভালোবাসার মধ্যে একটা চুক্তি আছে। যেন ভালোবাসার চূড়ান্ত অভাব যাদের তারাই এই ধর্মের আশ্রয়ে নিজের একটা গতি খোঁজেন। কারণ ধর্মগ্রন্থে কিম্বা ধর্মসভায় যে পরিমাণ ভালোবাসার কথা লেখা আছে বা আলোচনা হয় আর কোথাও হয় বলে দেখি না। এইক্ষেত্রে ধর্মের দোসর অবশ্য রাজনীতি কিছুটা। সেখানেও প্রচুর সহমর্মিতা তথা ভাইচারা জাগাবার কথা আসে। কিন্তু মুশকিল হল এই দুই ভালোবাসাই বড্ড শর্তসাপেক্ষ। ধর্মের ভালোবাসার সীমা আছে। আর রাজনীতির ভ্রাতৃত্ববোধের একটা মরশুম আছে। রাজনীতি থাক। তবে সেখানে প্রায়শই দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াবার এমন উতলা আবেগ দেখি, ভয় হয় যে, সত্যিই যদি পৃথিবী একদিন দারিদ্র্যমুক্ত হয় তবে এনারা না স্ব-অস্তিত্বসংকটে ভোগেন।
সে যাক, তবে ধর্মের এই ভালোবাসার অনুশীলনটা বড় ভয়াবহ লাগে। কারণ ভালোবাসাটা স্বাভাবিকভাবে না এলে তার গতি এত বিচিত্রপথে বইতে থাকে যে তার দায় সামলানো রীতিমত কঠিন। অবশ্যই তাতে মানুষের অনেক সেবা হয়। দুর্গতরা একটা আশ্রয় পায়। কিন্তু ক'জন? সমাজটা তো দয়ায় চলে না, দায়ে চলে – রবীন্দ্রনাথের কথা। সেই দায়বোধটা ধর্ম দিতে পারে না, দেয় নাগরিকত্বের বোধ। একটা বিশাল তন্ত্রের আমি একটা অংশ, আর পাঁচটা মানুষের থেকে কোথাও কোনো অংশে আমি ছোটো বা বড় কোনোটাই নই। সেই তন্ত্রে আমার যোগ্যতা অনুযায়ী আমার একটা ভূমিকা আছে। সেটা সুচারুরূপে করে যাওয়াটাই আমার মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচাইতে বড় কাজ, কিম্বা একমাত্র কাজ।
        ধর্মের সমস্যা হল সে প্রেমের বাণী দেয়, প্রেম দেয় না। করুণার শিক্ষা দেয়, কিন্তু তার সাথে করুণার পাত্রকে সমান করে নিতে শেখায় না। যারা আমাদের আলোকিত পুরুষ তাদের নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। কারণ তারা কোনো ধর্মে জন্মান না। মুশকিল হল তাদের থেকে ধর্ম জন্মায়। যীশু খ্রীষ্টান ছিলেন না, বুদ্ধ বৌদ্ধ ছিলেন না, নানক শিখ ছিলেন না। তারা তখনকার প্রতিষ্ঠিত ধর্মস্থান থেকে বরং দূরেই থাকতেন। ভালোবাসাটা তাদের বাণী ছিল না, শ্বাস-প্রশ্বাসের মত স্বাভাবিক ছিল। তারা বাণী দিয়ে মানুষকে জাগাতেন না, জীবনের ঊষ্মা দিয়ে জাগাতেন। কিন্তু পরবর্তীকালে শুধু বাণী আর জীবনটার মুকাভিনয়টুকুই থাকে, ঊষ্মাটা আর মেলে না। তাই যেটা পথ ছিল, সেটা গোল হয়ে ঘুরে পাঁচিল হয়ে দাঁড়ায়। যেখানেই স্বাভাবিক জীবনের তাগিদের অভাব সেখানেই ধর্মের আয়োজন সবচাইতে বেশি। ভালোবাসা তখন ম্যানিফেস্টো। একদলের প্রতি প্রাণঢালা ভালোবাসা, কিন্ত দল বদলালেই ভালোবাসার গভীরতা আর দিক বদলে গেল। তখন সে শুধু করুণার পাত্র। তার প্রতি শুধু তখন ধার্মিকের কর্তব্যটুকু টিকে থাকে। বাইরের প্রাকৃতিক আলো নিভলেই ঘরের কৃত্রিম আলোগুলোর খোঁজ পড়ে, এও সেরকমই একটা কিছু বলা যেতে পারে।
        তবে কি ধর্মের প্রয়োজনীয়তা নেই? কথাটাই অবান্তর। যেন সংসারে যা কিছু প্রয়োজন তাই শুধু আছে। তা তো নয়, প্রয়োজনের অতিরিক্ততেই সংসার উপচে পড়ছে। ধর্ম আছে আর থাকবেও, তবে সে প্রয়োজনের জন্য না, আমাদের ভয়ের আর অমরত্বের প্রতি আসক্তির জন্য টিকে থাকবেই। যেমন রূপকথা, যেমন ভুতের গল্প, যেমন সবাই সমান সম্পদের অধিকারী – ইত্যাদি ধারণারা এখনও টিকে আছে তার কোনো বাস্তব প্রমাণসূত্র ছাড়াই।
        মানুষের সবচাইতে বড় মোহ বোধহয় নিজেকে বুদ্ধিমান জীব ভাবা। মানুষ আদতে যুক্তিপূর্ণ একটা সত্তা না তো শুধু। তাই সে শুধু প্রয়োজনের হতে পারে না। জামা যদি শুধু লজ্জা নিবারণের হত, তবে এত কুশলী কারিগরের দরকার হত না। কোনোমতে কাজ চললেই হত। পৃথিবীতে দুটো বিশ্বযুদ্ধ হয়ে যেত না যদি সে শুধুই যুক্তিনির্ভর সত্তা হত। আসলে সে মনোনির্ভর একটা সত্তা। যা শরীরের থেকে নিজেকে পৃথক ভেবে একটা অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারে। যা তার মানসিক অস্তিত্ব। সেইটাই আসল তার কাছে। তার নিজের তৈরি ‘আমি’। তার সব পরিচয়টুকুই এই মানসিক বলয়ের মধ্যে। বাকিটা তো শুধু প্রয়োজনের ক্ষেত্র, যেমন পশুদের। তাই বলছিলাম আমরা বুদ্ধিমান সত্তা নই, মনোময় সত্তা। যে মন ভুলের আর ঠিকের একটা আজব সংমিশ্রণ। যতই আলো জ্বালো, অন্ধকারটাই অসীম হয়ে থাকবে। এরই মধ্যে রাস্তা খুঁজে চলা, আদৌ যদি তা রাস্তা হয় তো।
        এর মধ্যে সুখ বলতে এই এক চিলতে শীতের রোদের মত কামে-আবেগে-স্নেহেতে-কান্নায়-আবদারে জড়িত ভালোবাসা। ধর্ম যার মুখোশ বেচে, আর প্রতিদিনের সংসার যা চালের মত বুকে ফুটিয়ে ভাত রাঁধে। সে ভাতের ফ্যানেও কোনো কোনো জীবন চলে যায়। কারণ সে ফ্যানটুকুও খাঁটি। মুখোশ অন্তত নয়।

417
Tue, 12/05/2017 - 15:00
এ লেখাটা লেখার কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা অথবা সার্টিফিকেটের ছাড়পত্র আমার নেই। তাই অনেকের কাছে এ লেখা বাতুলতার তুল্য হতেই পারে। তবু যেটুকু কথা দানা বাঁধছে, তাকে সামনে রাখতে চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই নয়। রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়, আমরা ভাবব বললেই ভাবতে পারি না, যতক্ষণ না ভাবনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।         জিডি বিড়লা স্কুলে যে ঘটনাটা ঘটল, তাকে বিচ্ছিন্ন একটা ঘটনা হিসাবে দেখতে হবে কি? একজন আমার অভিভাবকতুল্য মানুষ বললেন, ধর্ষণের এই বারমাস্যা আর সহ্য হয় না। কথাটা তো তাই, এ তো নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা এখন। ভাবনাটা মনের মধ্যে ঘুরিয়েই চলে – কেন? কেন? কেন? আমি প্রতিবাদ করতে পারি, লেখায়, মোমবাতির মিছিলে, ধর্না ধরে, কিন্তু তারপর? সেই তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এমন তো নয় যে এরা সব যোগসাজশ করে এসব ঘটনা কোনো নির্দিষ্ট একটা দল ঘটিয়ে চলেছে। কিম্বা সবাই একই পরিবারের লোকজন যারা এরকম ধরণের এক একটা জঘন্য ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু একটা জায়গায় সবাই এক, আমরা একটা নির্দিষ্ট সমাজের, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর দিয়ে সবাই যাচ্ছি।         একজন মানুষ যখন বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন আমরা বলি না, রোগজীবাণুগুলো অত্যন্ত বলশালী হয়ে উঠছে, কিম্বা জীবাণুগুলো উক্ত ব্যক্তির উপর পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। আমরা বলি, ব্যক্তিটির অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি শক্তি দুর্বল হয়েছে। তবে কি আমাদের সমাজের তথা সময়েরও একটা সমষ্টিগত দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে কোথাও?         ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য চুরি করে খাওয়া, কিম্বা খাদ্যের জন্য হত্যালীলা চালানোর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু যে বঞ্চিত নয় খাদ্য থেকে, তার যখন ক্ষুধার চাহিদা মাত্রা ছাড়ায় তখন আমরা তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় 'অসুস্থ' বলি, আর চলতি ভাষায় 'বিকারগ্রস্থ' বলি। কাম শরীরের একটা চাহিদা। তাকে সুষ্ঠু পথে নিবারণ করার জন্য সমাজের নানা ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারাই এই ধরণের অপরাধের সাথে জড়িত হয়ে যাচ্ছে যারা বঞ্চিত নয়, তবে কি তারা বিকারগ্রস্থ? না, এত তাড়াতাড়ি সমাধান টানলে তা অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট হবে। কারণ 'বিকার' শব্দটার ব্যাপ্তি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। তাই শব্দের আড়ালে পাশ কাটালে চলবে না।         মানুষের সত্তায় বুদ্ধির পাশাপাশি আরেকটা অস্তিত্ব আছে - impulse. এই শব্দটার আভিধানিক অর্থ নানা। প্রবৃত্তি আর ক্ষণিক আবেগ – এই দুটো শব্দের একটা মিলিত রূপ আমার বোধে impulse, 'প্রবৃত্তি' শব্দটাকেই বেছে নিলাম। যদিও প্রবৃত্তির আরো অন্য মাত্রাতেও অর্থ হয়। impulsive মানে আবেগতাড়িত। কিন্তু এই শব্দটার অর্থের সাথে অপরাধ জগতের মিল কতটা? এই বিষয়ে যখন আলোচনা করছিলাম আমার এক বন্ধুর সাথে, সে আমায় দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ ও শাস্তি’ বইয়ের খুনের দৃশ্যটার কথা মনে করালো। সে খুনটা করেছিল একটা আবেগে না একটা অন্ধ প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে?         একটা অন্ধপ্রবৃত্তি তাকে পেয়ে বসেছিল। তার চিন্তাভাবনা সব সেই নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছিল। চিন্তাভাবনারা ক্রমে পরিকল্পনা এবং ধীরে ধীরে কাজে বাস্তবায়িত হল। মূল ছিল তার অন্ধপ্রবৃত্তি। তার দারিদ্র কি তাকে এই রাস্তায় আসতে বাধ্য করেনি? তাই যদি হবে তবে দারিদ্র আর অপরাধ একটা সরল সমীকরণে এসে দাঁড়াবে। কিন্তু তা কি সত্য? চরিত্র শব্দটা দাঁড়ায় কোথায় তবে?          'চরিত্র' শব্দটা এখন আর আগের অর্থে শোনা যায় না। চরিত্রগঠন রাধাকৃষ্ণানের মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। চরিত্রের একটা অর্থে সদগুণাবলী হলেও, ব্যপক অর্থে তার মূল সত্তার বহমানতার ধারা। সে ধারা সে নিয়ে জন্মায়। কিন্তু সবটাই কি সে নিয়ে জন্মায়? একই বাড়ির দু'ভাই দু'রকম – এ উদাহরণ কি খুব অপ্রতুল? সেই অর্থে অবশ্যই কিছুটা মানসিকতা সে নিয়েই জন্মায়। কিন্তু এই যদি শেষ কথা হত তবে 'শিক্ষা' কথাটা প্রহসন হত, 'সভ্যতা' শব্দটা অলীক হত। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল। পড়েছিলাম ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ বইতে। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বলা গল্প। একজন ছেলেকে তার মাসি অত্যন্ত প্রশ্রয় দিতেন ছোটোবেলা থেকে। সব অপরাধ নির্বিচারে মেনে নিতেন। অনেকে বারণ করত, তিনি শুনতেন না। ছেলেটা বড় হল। একটা বড়সড় চুরি করে ধরা পড়ল। পুলিশ এলো ধরতে। যখন তাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে পুলিশকে বলল, একটু দাঁড়ান, মাসির সাথে আমার একটা কথা আছে, সেরেই আসছি। তাকে মসির কাছে আনা হল। সে মাসিকে বলল, মাসি, একটা কথা শোনো কানে কানে। মাসি যেই না কানটা তার মুখের কাছে বাড়িয়েছে, সে প্রচণ্ড জোরে কানটা কামড়ে ধরল আর বলল, যদি তুমি ছোটোবেলা থেকে আমায় ঠিকঠাক শাসন করতে তবে আজ এই দিনটা আমায় দেখতে হত না।         এই তো গেল গল্প। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? ন্যাশেনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে গত বছর একটা ছয় এপিসোডের তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল – দ্য স্টোরি অব গড। অসামান্য তথ্যচিত্র। তাতে একটা এপিসোড ছিল, অমঙ্গলের উৎস কি? সেই তথ্যচিত্রের দুটো ঘটনা এখানে উল্লেখ্যঃ

এক) একজন মনোবিদ কয়েকজন শিশুকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা খেলা শেখান। তারপর বলেন তোমরা একা একা এই ঘরটায় আসবে আর এই খেলাটা খেলবে। তাই হয়। সেই মনোবিদ একটা গোপন ক্যামেরা সেই ঘরের এক কোনে লাগিয়ে দেন। আমরা দর্শকেরা দেখলাম বেশির ভাগ বাচ্চাই অসৎ উপায়ে খেলাটা খেলল, যাকে বলা যায়, চিটিং করল।         এরপর তিনি আরেকটা গ্রুপকে নিয়ে একই নির্দেশ দেন আর সেই ঘরে একটা চেয়ার দেখিয়ে বলেন যে এই চেয়ারটায় একজন অদৃশ্য রাজকুমারী বসে আছেন, যিনি তোমাদের খেয়াল রাখবেন। তারপর দেখা যায়, একটা একটা বাচ্চা ঢুকছে আর খেলাটা সৎভাবে খেলার চেষ্টা করছে। কারণ চেয়ারে অদৃশ্য প্রিন্সেস।         এইবার মনোবিদ একটা সিদ্ধান্ত টানেন যে, মানুষ একজনের নজরদারির সামনে থাকলে বেশি সৎ হয়। এটা দেখতে দেখতেই আমার মনে পড়ল, নানা জায়গায় লেখা থাকে, আপনি কিন্তু ক্যামেরার নজরদারির আওতার মধ্যে আছেন। সেদিনের ঈশ্বর আজকের সিসিটিভি ক্যামেরা!
দুই) একজন দাগী আসামী। সে অপহরণ, ধর্ষণ ও খুন - সবই করেছে, তার সাথে আরো রক্তহিম করা অপরাধ। তাকে প্রশ্ন করা হল, তোমার কোনো অনুশোচনা আছে? সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, না। সে বহু বছর জেলবন্দী। তাকে জিজ্ঞাসা করা হল, তুমি কি বাইরের জগতে আসতে চাও? সে তেমনি ঠাণ্ডা গলায় বলল, কি লাভ? আমার মধ্যে তো কোনো অনুশোচনাই নেই। আমি হয়ত একই কাজ করব আবার। প্রশ্ন করা হল, কেন করবে? সে বলল, কারণ আমি আপনাদের মত নই। আমি আমার impulse চাপতে পারি না। কারণ আমি যতগুলো কাজ করেছি সে আমার অদম্য প্রবৃত্তির তাড়নাতেই করেছি। আপনাদের মত সুস্থ মানুষদের সাথে আমাদের পার্থক্যই হল এই যে আমরা আমাদের প্রবৃত্তির বেগ আটকাতে পারি না, আপনারা পারেন। আমার নির্ভয়ার উপর বানানো তথ্যচিত্রটা মনে পড়ল। তার ধর্ষণকারীদের যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তাদের মধ্যেও কিন্তু কোনো অনুতাপের লক্ষণ দেখা যায়নি। বরং তারা ঘটনাটাকে জাস্টিফাই-ই করছিল একরকম।

        প্রশ্নটা হল এইখানে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে, কি সমাজগত জীবনে আগে একটা ধর্মের কিম্বা ঈশ্বরের ভয় ছিল। যে ভয়টা নিজের ভিতর থেকে জন্মাতো। কারণ ঈশ্বর অন্তর্যামী, তিনি সর্বত্র অবস্থিত, অর্থাৎ আমি যাই করি না কেন, তার দৃষ্টিগোচর তা হবেই, তাই আমায় ভালো হতে হবে।         আমাদের আইন-কানুন যাই থাকুক না কেন, পুলিশ তো আর অন্তর্যামী হতে পারে না; কিম্বা সর্বত্র অবস্থিত হতে পারে না। নির্ভয়ার ঘটনার পর অনেকেই দাবি করেছিলেন, দিল্লীর এত রাস্তা অন্ধকার কেন? রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা হোক আরো বেশি করে, কারণ আলোতে অপরাধ কম হয়। কথাটা আসলে আলো না, কথাটা কারোর নজরদারির। পুলিশ না থাকলে কতজন মানুষ ভদ্র সেই নিয়ে সংশয় খোদ বিবেকানন্দও প্রকাশ করেছিলেন, যার দর্শনের মূল কথাই নাকি –‘সর্বভূতে সেই প্রেমময়’।
        তবে উপায় কি? আমাদের ঈশ্বরবোধ আর ধর্মবোধ বিজ্ঞান কেড়েছে না বিজ্ঞানজাত ভোগবাদ কেড়েছে তা আমার কাছে স্পষ্ট নয় এখনও। অনেকের কাছেই নয় বলে আমরা আধুনিকোত্তর যুগে অজ্ঞেয়বাদের দিকে ঝুঁকছি বেশি। সে না হয় দার্শনিক আর দর্শনের সমস্যা। আমাদের এই প্রবৃত্তিমুখী জীবনস্রোতের হাল ধরবে কে? ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ বইতে বারবার পড়েছিলাম, প্রবৃত্তিমুখী জীবনের সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে ঝুঁকির কথা। তার উপায় হিসাবে বলা হয়েছিল, একটা ideal নির্দিষ্ট না হলে কোনোদিনই একটা সমাজ তথা ব্যক্তি নিজের অন্ধপ্রবৃত্তির উপর কাবু পেতে পারে না। তার একটা আদর্শকে নিজের সামনে রাখতেই হবে নিজের জীবনের মূল্যবোধ স্থির করার জন্য। নইলে সে নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে নিজেকে নিজেই ধ্বংস করে ফেলবে। একজন সমাজবিদ ওনাকে প্রশ্ন করছেন, তবে সে আদর্শ কি হওয়া উচিৎ? উনি বলছেন, এক, ধর্মের সঠিক উপস্থাপনা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে। যেখানে ধর্ম অর্থে হল সমস্ত প্রকার দুর্বলতা ত্যাগ করে, অকৃত্রিম হৃদয়ে নিজের ও নিজের চারপাশের বৃদ্ধি ও বাঁচাকে কায়েম করার পথে চলা। দুই, সমস্ত আলোকিত মহাপুরুষদের শিক্ষার মধ্যে যে একতা ও সমভাবাপন্ন করুণা আর আদর্শপ্রাণতার কথা আছে তাকে সামনে রাখা।          মহানামব্রত ব্রহ্মচারী থেকে রাসেল অবধি সবার কথার মূলসুর একটাই – সবার সাথে মিলে চলার শিক্ষা না পেলে আদতে সব শিক্ষাই আমাদের পক্ষে বিষতুল্য। "love is wise and hatred is foolish" - রাসেল বলছেন।         সবই জানছি, কিন্তু করাটা আর হয়ে উঠছে কই? আত্ম-প্রশ্রয়, অদৃষ্টবাদ আর আলস্য – আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে। প্রেসক্রিপশান আছে কিন্তু ওষুধের দোকানগুলো খুলতে বাধা। যদি বা ওষুধের দোকান খুলল তো তেঁতো ওষুধ গিলতে রুগীর অনীহা, আর পরিজনের অপ্রিয় হওয়ার ভয়ে রুগীকে ওষুধ গেলাতে পিছপা হওয়া। এ রোগ তবে সারবে কবে?         শাস্তি কঠোর তো হতেই হবে, তার সাথে ঘোগ দিয়ে জল বেরোনো যদি না আটকানো যায়, তবে?


418
Tue, 11/28/2017 - 23:55

চশমা ছাড়া ফেসবুকে একটা পোস্টে চোখ পড়ল, একটা শব্দ - sex. প্রোফাইলের ছবিটা খালি চোখে অস্পষ্ট বুঝছিলাম, প্রথমে মনে হল একজন মহিলা, সাথে সাথেই মনের মধ্যে উঠল, বাপ রে! সাহস আছে। তারপর দেখলাম পুরুষ, সাথে সাথেই সে লেখা হয়ে গেল fact আমার কাছে।
        তবে fact বলতে যা বুঝি, তাই শেষ কথা না, fact এরও লিঙ্গবৈষম্য আছে বুঝলাম। যা আমার পুরুষ হিসাবে বলতে ভাবতে শালীনতা বোধ ছাড়াই না, একজন মহিলার ক্ষেত্রে তা fact হতে পারে ভাবা যায় না। যদি fact হয় তবে তা অশ্লীল। সত্য বলার সাহসিকতার চেয়ে, নোংরামি করার দায় তাকে বেশি নিতে হয়। কারণ এটাই বুঝে আসছি আমরা। এটাই বোঝানো হয়েছে।
        ছোটোবেলা থেকে প্রচুর দেবীমূর্তির সাথে বড় হয়েছি। লক্ষী, সরস্বতী, দূর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী, শীতলা, সালকিয়ায় বড়মা, মেজোমা, ছোটোমা - বিশ্বাস, এই সব দেবীদের হাতে সংসারের ভার। এরা দেবী। মা, বড়মা, ঠাকুমা, দিদা, মাসিরা - সবাই ঘিরে একটা নিরাপদ স্থান। দেবীর মত। দিদিরা, বোনেরা আমার জন্য নিজেদের প্রায়োরিটি ছাড়বে এটাই কাম্য। কারণ আমি পুরুষ, তারা নারী, দেবী। তারা ছাড়বে। আমরা নেব, এমনটাই সমাজের ব্যবস্থা। "সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে", এর বিপরীত কথাটাও কিন্তু একই সাথে তৈরি হয়, "সংসার বিষের হয় রমণীর দোষে"। পুরুষ নিষ্ক্রিয়। অটল অচল সুমেরুবৎ। তার জন্যে সব কিছুই পূর্ব হইতে প্রদত্ত। এমনকি রমণীও। যাকে শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার পর দেবী-মা হওয়ার সাধনায় ব্রতী হতে হয়। বীর্যের আবেগের উপর তাকে স্থান পরিবর্তন করে নিতে হয়। সেটা যত সুচারুরূপে করা যায় তত - "মহাভারতের কথা অমৃতসমান"
        কি উচিৎ, কি অনুচিত সে মনুর সাথে এলিজাবেথ টেলার লড়ে বুঝে নিক, আমি ওর মধ্যে ঢুকছি না। কিন্তু আমি কি দেবীর রঙ চটতে দেখছি? আমি কি মন্দিরের গায়ের পলেস্তারা খসতে দেখছি? নারীকে হয় মাতৃরূপে দেখতে হয়, নয় কামের দ্বারা তুষ্ট করে হয় - আমি বলিনি, শাস্ত্রে বলেছে, সমাজ বলেছে। রাতের অন্ধকারে তুমি নিজেকে তার সামনে দাঁড় করিয়ে দেখো কি চাইছ - মা না নারী? তুমি যা চাইবে সে তাই হবে। হতে বাধ্য সে। সে রমণী তুমি রমণ। সে শক্তি, তুমি শক্তিমান। তুমি আসল, সে আসলের মত। তুমি পুরুষ, তুমি জন্মসূত্রেই ধী, বুদ্ধি, প্রতিভার স্বাভাবিক ধারক। পুরুষ জন্মলগ্ন থেকেই বুদ্ধির জনক, স্ত্রী তুমি নও, তোমায় প্রমাণ করতে হবে। তুমি বহু মহাপুরুষের পতনের কারণ। তুমি নরকের দ্বারস্বরূপ। তবু আমি, এ তর্কেও যাব না, ব্যাসের সাথে নাইটেঙ্গল বুঝে নিক।
        তবে কি পরিবর্তন চাইছি? বালাইষাট! এমন আর্যসভ্যতার পরিবর্তন চাইব? কটা মাথা আমার ঘাড়ে? আমি fact খুঁজছি। তবে কি fact এর চেয়ে শক্তিশালী শ্লীলতা?

 
হো...হো...হো....

        কথাটা শ্লীলতা না। কথাটা ভয়, নিরাপত্তাহীনতা। শ্লীল অশ্লীল তো গৌরবের বিষয়। রুচির বিষয়। ভয় কি রুচির বিষয় না গৌরবের? হ্যাঁ ভয়। যে ভোগ্য সে দেবী বা নারী হলে কাজ চলে যায়, মানুষের মর্যাদায় দেখতে হলে অস্বস্তি হয়। কারণ সে দায়ভার নিয়ে আর যা হোক সমাজ চলে না। নারী পথে বিবর্জিতা, স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ঙ্করী - আমি বলিনি শাস্ত্রে বলেছে। কেন বলেছে? প্রমাণ নিশ্চই অজস্র আছে। সেদিনও আছে আজও আছে। কিন্তু পুরুষবুদ্ধিতে প্রলয় দেখাও তো? নেই। পাবে না। যতই বিশ্বযুদ্ধের উদাহরণ দাও, সে শক্তির ক্ষেত্র। মায়ের ইচ্ছা। মা কালী কিসের মূর্তি রে? ধ্বংসের।
        সত্যি বলতে প্রতিযোগিতা মেধার ক্ষেত্রে তাও মেনে নিতে হচ্ছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা বন্ধঘরে অসহ্য। আর প্রতিযোগিতাই বা হবে কেন? সহাবস্থান হবে না কেন? কি করে হবে? স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয় এ সবাই জানে, সবাই না বুঝলেও। কিন্তু মত প্রকাশের জায়গায় fact আসুক। শ্লীল অশ্লীল পরে কিছু একটা দাঁড়িয়েই যাবে। যে শ্লীলতা শিখিয়ে আনতে হয় সে বেশিদিন স্থায়ী হয় কই? দাঁড়ায় তো সেই fact. তবে fact এর কি লিঙ্গবৈষম্য থাকা উচিৎ? আমি অন্য কাউকে না, নিজেকেই প্রশ্ন করছি। শুধু এই কথাটা সরিয়ে নিই না কেন - তোমাদের এটা বলতে নেই। শোনা অভ্যেস করি। অত ভয় পাওয়ার কি আছে? তাতে দুনিয়া যদি উল্টেই যায় তো উল্টাক। উল্টোপিঠটাও দেখা যাবে না হয় তাহলে।

419
Fri, 11/24/2017 - 15:30
আজ এক নতুন তথ্য জানলাম, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুণ বুঝতেন না। সুবিনয় রায় আর গীতা ঘটকের কথাও আছে, তাঁরাও বুঝতেন না। অনাবশ্যক, আনুনাসিক, সুরের ‘মায়ায়’ নাকি শ্রোতাকূলকে বিভ্রান্ত করে গেলেন। বুঝলেন কে? সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত ইত্যাদিরা। 
        কে বলছেন? একজন রবীন্দ্রসংগীত ‘গবেষক’ তার ফেসবুক পেজে। "আমার কণিকার গান পছন্দ না" - এত অবধি বুঝতে অসুবিধা হয় না, কিন্তু তার থেকে ভালো গাইতেন অমুক অমুক শিল্পী, এটা শুনেই থতমত খেলাম। কারণ যে শিল্পীদের নাম করলেন, তারা নিজেরা যদি শুনতেন এই কথাটা, ভবলীলাসাঙ্গ করতেন হয়ত বা (তাদের নামগুলো আমি ইচ্ছা করেই আর উল্লেখ করলাম না, কলম সরল না, অন্তত তাদের তো একটা সম্মান আছে নিজের জায়গায়)।          আমি তকমাধারী গবেষক নই। তবে বুঝি, ‘আজ কিছুতেই যায় না মনের ভার’, কিম্বা ‘আমার যেদিন ভেসে গেছে’, কিম্বা ‘আকাশভরা’ শুনতে দেবব্রত চালাই; কিন্তু কখনওই দেবব্রত'র গলায় ‘বাজে করুণ সুরে’, ‘আনন্দধারা', ‘বেদনা কি ভাষায় রে’ ইত্যাদি শুনব না, কণিকারই শুনব। ‘প্রচণ্ড গর্জনে আসিল’ সুচিত্রাই শুনব, সুবিনয় না; কিম্বা ‘এ কি সুগন্ধহিল্লোল’ সুবিনয়েরই শুনব।         তালিকা আর দীর্ঘ করলাম না, কিন্তু নাটকীয় উপস্থাপন হলেই তাতে কাব্যের মূল্য রাখা গেল, বাকিরা রাখলেন না, কারণ তাদের গায়কীতে সুরের গভীর চিন্তন আছে, গায়নে সে নাটকীয়তা নেই বলে – এ নিতান্তই বালখিল্য কথা। ভীমসেন যোশী আর আমির খাঁ - মেজাজ আলাদা, কিন্তু দুই-ই অনুভবের প্রকাশের দুই ধারা। বলা হবে রবীন্দ্রনাথের গান তো কাব্যপ্রধান। ব্যস, হয়ে গেল আর কি, সুর তো গৌণ। ঠিক এই ভয়টাই সত্যজিৎ রায় করেছিলেন, বলেছিলেন, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে যথাবিহিত তালিম নিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথের গানে আসা হয়। নাটকটা সহজেই চোখে পড়ে, মনের উপর একটা রেখাপাত করে, কিন্তু সুরের গভীর আবেদনে ডোবার জন্য শ্রোতারও একটা চর্চা থাকা জরুরী। সুচিত্রা মিত্র এক জায়গায় বলছেন তথ্যচিত্রে,“গানে মোহর (কণিকা) আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে”।
        তবে আলোচনাটা শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নয়। আশঙ্কা, এই ধরণের গবেষণার পাত্ররাও ছাড়পত্র পাচ্ছেন। এবং এদের লেখা গবেষণাপত্র ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে স্বীকৃত তথ্য হিসাবে পৌঁছাবে। তবে কি আমাদের সাধারণ মেধার মান এমন তলানীতে এসে পৌঁছালো?         ফেসবুক খুললেই, একটা লিঙ্ক আসছে, কিছু একটা বৌদি নিয়ে গান। অর্থাৎ বৌদিবাজি কালচার। এই নামাঙ্করণ বেশ পুরোনো। “ভয় যদি পাও আরশোলায়, সব্বাই তার সুযোগ চায়”। সব্বাই? মানে, আমি আপনি প্রত্যেকেই? হ্যাঁ, গীতিকারের(?) মতে তাই। ক'দিন আগে ফেসবুকে আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়া সুপ্রিয়া মাসি, একটা পোস্ট করেছিলেন, ‘বাঙালী কেন কবি নয়’, রবীন্দ্রনাথের। সেখানে রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর কল্পনার দৈন্য নিয়ে বলছেন। কল্পনা অবশ্যই আকাশকুসুম না, কল্পনা যা বড় কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করে। “I have a dream” বলতে লুথার যে কল্পনা বলেছিলেন, এ সে কল্পনা।         কল্পনার দৈন্যর সাথে যদি অসংযমী হয়ে ওঠা সাহসিকতার পরিচায়ক হয়, তবে রোগ আরো গুরুতর হয়ে ওঠে। শিল্প–সাহিত্যচর্চার একটা প্রধান অঙ্গ ‘সংযম’, মাত্রাজ্ঞান। এ মাত্রাজ্ঞান একদিনে হয় না। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, বৈদ্য'র সাথে থাকতে থাকতে কোনটা কফের নাড়ি, কোনটা পিত্তের নাড়ি মানুষ চিনতে পারে। এ নিয়ে অল্পজ্ঞরা তর্ক জুড়তে পারে, কিন্তু বিশ্বের দরবারে তারা মুখচুন করেই ফিরে আসে। সারা বিশ্বে সাহিত্য-শিল্প-চলচ্চিত্র যে জায়গা ছুঁতে চাইছে, যে প্রয়াস চলছে, আমাদের তা কই? একটু সিনেমার জগতটা দেখা যাক। আমরা যখন ছোটো ছিলাম (আমার জন্ম ১৯৭৬), তখন ‘হিন্দী সিনেমা’ একটা অচ্ছুৎ শব্দের মত ছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালী নাক সিঁটকাতো, ওমা! হিন্দী সিনেমা দেখে, ম্যাগো! কি সব অখাদ্য গান, বদরুচি, ছেলেমেয়ে মানুষ হবে?         গত কয়েক দশক ধরে হিন্দী সিনেমার পরিবর্তন দেখুন। সামাজিক যে সমস্যাগুলো নিয়ে তথাকথিত ‘বুদ্ধিজীবি’ হওয়ার আত্মতুষ্টিতে ভোগা বাঙালী মাথাই ঘামায়নি, তারা সে সে বিষয়ে সিনেমা করে দেখাচ্ছে। বহু সিনেমার নাম করা যায়, সে থাক। আজই রিলিজ হয়েছে ‘কড়ভি হাওয়া’। পরিবেশের, আবহাওয়ার পরিবর্তন, বৃষ্টির আকাল ইত্যাদিতে মানুষের জীবনে তার প্রভাব। এই নিয়ে একটা সিনেমা করার কথা আমরা ভাবতে পারছি কই এখন বাংলায়? হিন্দী সিনেমার জগতে চিত্রনাট্য, অভিনয়, সঙ্গীত নিয়ে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে বাঙ্গলায় তা কই?         আমি লেখক নই। পাঠক তো বটেই। প্রচুর বই পড়তে ভালোবাসি। নানা বিষয়ে। অগত্যা মাতৃভাষায় কুলায় না, ইংরাজির শরণাপন্ন হয়েই থাকতে হয়। যেটা মজার কথা হল, ফেসবুকের দৌলতে বহু নামী লেখকদের সাথে সাক্ষাতে কথা হয়েছে, তাদের অনেকের কি অসম্ভব কম পড়াশোনা দেখে মর্মাহত, বিস্মিত হয়েছি। যদিও ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু খুব কমই সংখ্যায় তাঁরা। জানি না জয়পুর আজ যে মাত্রার সাহিত্য উৎসবের প্রথা শুরু করে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরা ক্রমশঃ পিছিয়ে যাচ্ছি কেন? সেও কি এরমকই কিছু কারণে? আজ আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে একটু মাথাটা উঁচু করে দেখলেই চোখে পড়ে। নিজের দেশ, ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ কি কমছে আমাদের? আন্তর্জাতিক হওয়া মানে কিন্তু বিশ্বের নানা তথ্য জেনে তার খিচুড়ি করে কিছু একটা লেখা নয়। নিজের দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, সমাজের মধ্যে দিয়ে বিশ্বমনের সত্তার কাছাকাছি পৌঁছানোর প্রয়াসকে আন্তর্জাতিকস্তরে পৌঁছানো বলে। বিভূতিবাবুর ‘হরিহর-সর্বজয়া’, মানিকবাবুর ‘শশী’, তারাশঙ্করের ‘বানোয়ারি’ – কেউ সে অর্থে গ্লোবাল নয়, কিন্তু লেখকের কলমে তারা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষের আত্মীয়তা অর্জন করতে পারে। যেমন পেরেছে টনি মরিসনের 'সেথে-ডেনভার’, নাইপালের ‘মিস্টার বিশ্বাস’, দস্তয়েভস্কির ‘কারামাজোভেরা’ কিম্বা টলস্টয়ের ‘লেভিন’।         প্রসঙ্গান্তরে যাই। রম্যরচনা। কই? সেই বিশুদ্ধ, বুদ্ধিদীপ্ত, তীক্ষ্ণ, কখনও কখনও শ্লেষাত্মক হাসির উপাদান কই এখন? আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, একজন সাহিত্যিকের লেখার সবচাইতে ধারালো দিক তার এই ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা। মীরাক্কেলে যে সব জোক্সে বাঙালী রাতের পর রাত হেসেছে, শিউরে উঠেছি। যৌন সুড়সড়ি, অশ্লীলতার দ্ব্যর্থ উপস্থাপন, অত্যন্ত নিম্নমাত্রার ভাঁড়ামি – এই কি অবশিষ্ট পড়ে রইল হাসির উপাদান হিসাবে?         প্রবন্ধের প্রসঙ্গ থাক। হীরেন দত্ত, অশোক মিত্র, শিবনারায়াণ রায়, অম্লান দত্ত'র স্বাদ তো আর পাচ্ছি না। বড্ড অগভীর। বড্ড একপেশে। বড্ড মেরুকৃত বেশিরভাগই এখন। প্রতিবারের বইমেলার দিকে মুখিয়ে থাকা, 'বইয়ের দেশে' খুঁজে ঝুঁকি নিয়ে কলেজস্ট্রীট চষে বই কেনা (ঝুঁকি, কারণ অত ট্যাহা কই?), মৃতপ্রায় লাইব্রেরীর চরকি কাটা, ফেসবুকে নতুন স্বাদের, সৎ লেখা খোঁজা (অনেকেই অসামান্য ভালো লিখছেন, বিশেষ করে জীবনের নানান ক্ষেত্রের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা), অবশেষে ইংরাজি ভাষায় বিদেশি বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড করে তৃষ্ণা মেটানো।         তাই বলছিলাম, আমরা কি মধ্যমেধার রুচির থেকেও নামছি? অবশেষে কি বঙ্গসন্তানদের পৌরুষ বৌদিবাজি, ‘তবে হয়ে যাক’ই? বিশ্বের দরবার কি আঙুরফল টক?



(সমস্ত মত অবশ্যই ব্যক্তিগত) 
420
Mon, 11/20/2017 - 13:00

Isolation - বিচ্ছিন্ন রাখা না থাকা?
         মনের ধর্ম কি? বিচ্ছিন্ন থাকতে চাওয়া? কিছু কারণে কখনও কখনও হয়ত চাইলেও মূলত তা মনের ধর্ম কি? আসলে কথাটা 'isolation' বললে মনের যে বোধের সাথে যায়, 'বিচ্ছিন্ন' বললে তা যায় না। ছিন্নমন বা ছিন্নসত্তা বলি যদি? হ্যাঁ কতকটা আমার মনের ভাবের রস পেল। তবে এই কথাটাই থাক – ছিন্নমন বা ছিন্নসত্তা।
        আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এই ছিন্নমনের বাস। কিছুটা অংশ জুড়ে। যার যত বেশি তাকে তত অন্তর্মুখ, লাজুক বলা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অহংকারী বা ঘ্যাম বা অ্যাটিচিউড দেখানোও বলা হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত আলোচনায় পরে আসছি। আগে আমাদের দেশের অতীতে এই মনোভাবের কিছুটা তাকিয়ে দেখি।

ভারতীয় সমাজের গল্প
--------------------------------
“মানুষের পরশেরে প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে,
ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে।”
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

        ভারতের সাধনা অন্তর্মুখের সাধনা। তার শাস্ত্র বেশিরভাগই মুক্তির কথা বলে। যার মূল সাধন এই ছিন্ন হওয়ার চেষ্টায় রত হওয়া। গীতা বললেন এক জায়গায় --- ‘বিবিক্তদেশসেবিত্বমরতির্জনসংসদি’, অর্থাৎ কিনা অধুনা রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় ‘নির্জনবাস’, বা সেই শ্যামাসঙ্গীতের মত – ‘ভেবে দেখ মন কেউ কারো নয়’, কিম্বা স্বামীজির প্রিয়গান, ‘মন চল নিজ নিকেতনে’। মোদ্দা কথা ‘ভেন্ন হও’, ‘একলা হও’, মনের মধ্যে টুলটুল করে চেয়ে থেকে থেকে আত্মার জ্যোতিখান খোঁজো। ভারত দীর্ঘদিন ধরে সে আত্মার জ্যোতি খুঁজল। কি পেল তা আজও বুঝলাম না। তবে স্বামীজি ইত্যাদির মত প্রাচ্যদূতেরা যখন পাশ্চাত্যে জয়জয়কার তুলে এলেন, আমাদের যেন বোধ হল, ‘যাক এতদিনের প্রাচ্যের সাধনার একটা মুখরক্ষা হল’। কথাটা হল আত্মার মাহাত্ম্যে বিশ্বাস না থাকুক, পাশ্চাত্যের মাহাত্ম্যে তো আর চোখ বন্ধ করে শূন্য খোঁজার বালাই নেই, চোখ চাইলেই জলের মত স্পষ্ট। তখন আর ‘মায়ের দেওয়া মোটা’ কাপড়ের দেশপ্রেম মোহ কদ্দিন টেকে রে ভাই?
        টেকেও নি। না ওদের, না আমাদের। যতই আমাদের মহাপুরুষগণ আমাদের দর্শনের বড়বড় কথা বলে আসুন না কেন, আদতে তো আমাদের ২০১৭ -তেও 'মাঠে হেগো না রে বাপু’ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানাতে হয়, স্বচ্ছ অভিযান চালাতে হয়, সে আমাদের চিত্তশুদ্ধির যতই কারনামা থাকুক না কেন। ফলে ওরা যখন আমাদের দেশে ঘনঘন যাতায়াত শুরু করল, নিজেদের বোধশক্তি অনুযায়ী ভারতকে বুঝতে শুরু করল, তখন সে ‘আত্মারামের’ মাহাত্ম্যর ভুতও ঘাড় থেকে নামল। তবে ওরা গুণীর কদর সে কালেও করেছে, আজও করে আসছে। সেটা ওদের উদারতার জন্যে তো অবশ্যই।
        তো যেটা কথা হচ্ছিল, আমাদের মূলকথা হল বিচ্ছিন্ন হও মূলধারা থেকে, আত্মপোলব্ধি করো ইত্যাদি। এই ভাবটা আজও আমাদের রক্তে প্রচ্ছন্ন বয়ে চলেছে। তিন দিকে সমুদ্র আর এক মাথা হিমালয় নিয়ে সেদিন যে কাজটার সুবিধা হয়েছিল, আজ আর হচ্ছে না, তাই পারা চড়ছে। কারণ দীর্ঘদিন ছিন্নসত্তায় থাকলে তো বিকার আসা স্বাভাবিক, তাই দীপিকার মুণ্ডুর দাম একলক্ষ হয়ে দাঁড়ায় ‘পদ্মাবতী’র জন্য। যারা করছে তারা তো নিজেদের 'আপামর জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন বিশেষ প্রজাতির মানবকূল' বলে দীর্ঘদিন ধরে ভেবে এসেছেন, অভ্যাস হয়ে গেছে যে!
        ভাবেন আজ যদি আম্বেদকরের হাতে না পড়ে, বর্ণাশ্রমে পূর্ণ আস্থাবান কোনো মহাত্মার হাতে গিয়ে আমাদের সংবিধান বানানোর ভার পড়ত। কি হত? আমাদের আবার হয়ত কয়েকশ বছর অপেক্ষা করতে হত এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। কারণ মনে রাখবেন আমাদের সে যুগের গুরুদের থেকে আজকের কর্পোরেট গুরুরাও কিন্তু প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই বর্ণাশ্রমের ধামাধারী। সেই বর্ণাশ্রম, যা আমাদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবাদের সুচারু, সুপরিকল্পিত, নিষ্ঠুর, বর্বর প্রকল্প। আসলে তো আমরা সেইদিনই আত্মধ্বংসের শেষ সীমানায় গিয়ে পৌঁছিয়েছি যেদিন একজন মানুষকে তার মজ্জায় মজ্জায় বিশ্বাস এনে দিতে পেরেছি – সে নীচ, সে অস্পৃশ্য।
        একটা দেশের মধ্যে কোনোদিন একতা তৈরি হয়নি। তা হবেটা কি করে? বুদ্ধি-যুক্তির অগম্য কোনো কারণের উপর নির্ভর করে যদি মানুষে মানুষে ভেদ তোলার স্থায়ী বন্দোবস্তকে একটা সমাজ মাথায় তুলে রাখে সে সমাজে বিষবৃক্ষের বীজ অঙ্কুরিত হবে না? যার প্রথম বিদ্রোহী সন্তান ছিলেন বুদ্ধ, যার আশ্রয় নিয়েই অবশেষে আম্বেদকরজীকেও এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল উৎপাটনে ব্রতী হতে হল। ইদানীং কেরলের একটা মন্দির অসামান্য একটা কাজ করলেন, তারা দশজন তথাকথিত অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষকে পূজারীপদে আভূষিত করলেন। তবু এ কিছুই না, এত হাজার হাজার বছরের ‘পবিত্র’ ‘দেশের হিতোকারক’ অভ্যাস, একদিনে তো আর যাবে না। তাই খবরের কাগজের পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনের পাতাটা খুললেই বোঝা যায়, যিনি যত উচ্চশিক্ষিত, আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত হোন না কেন, সমগোত্রীয় না হলে বিপদ। আমি এমন বহু দীক্ষিত বাড়ির মানুষকে দেখেছি যারা অন্যের হাতের খাবার খান না, তাতে নাকি তাদের সত্তাহানী হবে। এমন নিষ্ঠুর বর্বরোচিত ব্যবহারকে 'ধর্ম' বলে চালাতে আমাদের দেশের গণ্যমান্যেরাই পারেন। এবং স্বমহিমায় চালিয়েও যাচ্ছেন। “তুমি কি বেশি বোঝো বাবা! অমন ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের বচন মিথ্যা হয়?” কতদিন স্বপাকে খেলে আর কতটা বীর্য্য জমালে যে পরমাত্মা খুশী হয়ে সেলফি পাঠাতে রাজী হন তা জানলে না হয় একবার চেষ্টা করে দেখতুম।
        এরকম নানান অভূতপূর্ব প্রণালীতে এই বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা আমাদের সমাজে হয়েছে, হয়েও চলেছে।

ব্যক্তিগত ছিন্নমন তথা ছিন্নসত্তা
---------------------------------------------
“Loneliness and the feeling of being unwanted is the most terrible poverty… no one to anyone” ~ Mother Teresa.
        ছিন্নমন ছিন্নসত্তা থেকে একাকীত্ব জন্মায়। কিন্তু কেন এই বিচ্ছিন্নতা? নানা কারণ হতে পারে। একটা প্রধান কারণ অবশ্যই বয়েস ও শারীরিক অসুস্থতা। দ্বিতীয়টার মারাত্মক বর্ণনা কামুর বিখ্যাত উপন্যাস ‘প্লেগ’ আর দস্তয়েভস্কির ‘Notes from the underground’. হাস্পাতালের সম্পর্ক তাই কখনও বেশিদূর গড়ায় না। সে চূড়ান্ত একাকীত্ব, সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একার মধ্যে একা শারীরিক যন্ত্রণার সাথে লড়া। ক্রমে আশেপাশের মানুষের সহানুভূতিতে ভাঁটা পড়তে থাকা, নির্মম একাকীত্বের গ্রাসে ধীরে ধীরে লয়প্রাপ্ত হতে হতে মৃত্যুর মধ্যে মুক্তি খোঁজা। হাস্পাতালে চিকিৎসাধীন মানুষটার সকাল-বিকাল জানলার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখের মত করুন, শূন্যদৃষ্টির মত অসহায় যন্ত্রণা খুব কমই দেখিনি কি?
        আরেকটা কারণ দূরত্ব। দূরত্বটা কিলোমিটারের উপর নির্ভর করে না, করে যানবাহনের সুযোগ-সুবিধার উপর। বাড়ি থেকে বারো কিলোমিটার দূরের চরসরাটি যাওয়ার থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে কলকাতায় যাওয়া অনেক সোজা আমার কাছে। কারণ চরসরাটি যাওয়ার কোনো সহজলভ্য উপায় নেই। বহু ছিন্নমনের জনক এই অসুবিধা। চাইলেই কোথাও যাওয়া যায় না। বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলগুলোতে এ অসুবিধা আরো প্রকট। অনেক যুবক যুবতীর পক্ষে এটা হানিকারক দেখেছি। সুযোগের অভাব। এইসব অঞ্চলে এটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা যায়। বড় শহর থেকে যত দূরত্ব, এই ধরণের বিচ্ছিন্নতাজনিত সমস্যার শিকার যুবক যুবতীর সংখ্যা তত বেশি। কারণ বৈদ্যুতিক বিজ্ঞাপন ও ইন্টারনেটের দৌলতে বড় শহরে প্রাপ্য সব সুযোগ-সুবিধা, আমোদপ্রমোদের খবরাখবর জানা যাচ্ছে, কিন্তু তাতে অংশ নেওয়া যাচ্ছে না, এ এক চূড়ান্ত বিকার উৎপাদক অবস্থা।

        আরো নানা কারণ তো আছেই। তার মধ্যে আরেকটা বড় কারণ প্রিয়জনের মৃত্যু বা বিচ্ছেদ। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলি। মা চলে যাওয়ার পর আমার অশৌচ পালনের পালা এলো। আমি না মানলেও 'সমাজের যারা মানে তাদের মানসিক অসুবিধার কথা ভাবতে হবে' --- এমনি বলা হল। শুভ উৎসবে যাওয়া যাবে না, মন্দির এড়িয়ে যেতে হবে ইত্যাদি। বেশ কয়েকমাস পর থেকেই আমার নিজেকে নিয়ে কেমন একটা অস্বস্তি হতে শুরু করল। বাজার ঘাট, লোকারণ্য অঞ্চল এড়িয়ে যেতে থাকলাম। মনে হত আমায় দেখলেই কারোর কোনো ক্ষতি হবে, ফলে বন্ধুবান্ধবদের এড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করতাম। ক্রমশঃ যেন একটা বিকার আমায় পেয়ে বসতে লাগল। একবার মনে হল বাইরে কোথাও কাটিয়ে আসি, আমার কিছু পরিচিত মানুষ জয়রামবাটী যাচ্ছিলেন, ভাবলাম ওদের সাথে যাই, মনের যে তীব্রশূন্যতাবোধ তার কিছুটা হয়ত মিটবে। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ সারদার পথে তো আর সংকীর্ণতার কথা নেই। কিন্তু সেখান থেকে উত্তর এলো আমি এই অবস্থায় সেখানে থাকতে পারব না। বুঝলাম দশখণ্ড বিবেকানন্দ রচনাবলী, কথামৃত, লীলাপ্রসঙ্গ, শতরূপে সারদা – এসব সাহিত্য মাত্র। পরিবর্তন না সমাজে, না সাধকের হৃদয়ে।
        নিজেকে একা করে নিতে নিতে ক্রমশঃ অসুস্থতায় এসে পড়তে লাগলাম। আমাকে বাঁচালো দুজন – এক, কবিতা, আর দুই, কাঞ্চনজঙ্ঘা। কাঞ্চনজঙ্ঘার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল কি তুচ্ছ বিকারের কবলে আমার মস্তিষ্ক, আমার হৃদয়! পথ খুলল কবিতা। বুঝলাম ভুল বোঝানো হচ্ছিল আমাকে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, যারা দূরে রাখছে আমার অশৌচের ভয়ে আমায় তাদেরই চোখের উপর চোখ রেখে দেখি। নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঁচার কথা আর মনেও আনব না। তাদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে বুঝলাম ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ ছাড়া তাদের ঝুলিতে সম্বল বলতে তেমন কিছু নেই। তারা সব চাইতে বেশি ভয় পায় ভুল করতে আর ব্যর্থ হতে। তাদের উপর মায়াই হল, এর থেকে বড় ব্যর্থতা মানুষের জীবনের আর কি হতে পারে, নিজের বুদ্ধি-বিচার বন্ধক দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ানো আর লোককে সে মোড়কে ভরার চেষ্টা করার মত?

        বাহ্যিক কোনো কারণে যদি নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়, তার জন্যে উপায় হয়ত অনেক সময় নাও মিলতে পারে। সে অবস্থাটার সাথে মানিয়ে নিয়ে অথবা লড়াই করে অপেক্ষা করা ছাড়া সমাধানের পথ নেই হয়ত বা। কিন্তু বাকি সব বিচ্ছিন্নতার মূল কারণ অজ্ঞানতা। এটা এক্কেবারে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। সে অজ্ঞানতা সমাজের যুগসঞ্চিত শাস্ত্রের অচলায়তন হোক, কিম্বা বিকারের দুর্ভেদ্য প্রাচীরই হোক। এ বিকার দু'প্রকার হয় – হীনমন্যতা আর অতিমান্যতা। দুটোই সাংঘাতিক ক্ষতিকারক। হীনমন্যতা বাড়ির সামনে শ্যাওলার চাষ করে, আর অতিমান্যতা পাঁচিল তুলে তুলে আলো বাতাস রোধ করে।
        বাকি ধনী দরিদ্র, মানী অমানী ইত্যাদির পার্থক্য আর বিচ্ছিন্নতাটা সমাজ যত ভদ্র হয় তত লোপ পেয়ে যায়। পাশ্চাত্যে ওদের এই বিচ্ছিন্ন অধিবাসীর সংখ্যার একটা মাপ আছে, যার বাড়ন্ত লেখচিত্র সমাজবিদদের ভ্রূকুটি তুলছে। আমরা আত্মতুষ্টিতে এখনও ভুগে চলেছি? একাকীত্ব? ফুঃ। ওসব নিয়ে আমরা ভাবি না। একা এসেছিস, একাই যাবি... বুঝলিরে পাগল!

421
Thu, 11/16/2017 - 14:00

হিন্দু মহাসভা নাথুরাম গড্‌সের মন্দির প্রতিষ্ঠা করল। নাথুরাম গড্‌সে তাদের আদর্শ, পুজ্য। তার কারণ তিনি হিন্দুধর্মের মহত্ব প্রচার করেছিলেন বলে নয়, গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন বলে। গান্ধীকে ও তার আদর্শকে কারোর অপছন্দ হতেই পারে, সভ্যতার ইতিহাসে গড্‌সে ও মহাত্মার অবদানের ফারাক বোঝার মত মানসিকতা বা ইচ্ছা অনেকের না-ই থাকতে পারে। কিন্তু পৌরাণিক পুরুষ রাম তথা কৃষ্ণ পূজ্য কি শুধু রাবণ তথা কংস নিধনের জন্য, না ধর্মসংস্থাপনের জন্য? ধর্ম অর্থে আমি একটা সামাজিক ব্যবস্থাপনার কথা বলছি। পূজ্য হতে গেলে কি কারোর হত্যাকারী হওয়াই যথেষ্ট?
        স্বভাবতই এ প্রশ্ন আমি হিন্দু মহাসভার কাছে রাখছি না। কারণ, ধর্মের যে দিকটা প্রাতিষ্ঠানিক তথা ঐতিহাসিক তা কোন না কোনভাবে অচলায়তন হয়েই দাঁড়ায়। আর পশ্চাৎগমনের মধ্যেই সমস্ত গৌরব, প্রাচীনত্বই ঐতিহ্য, যা কিছু পুরোনো তাই পবিত্র, নির্ভুল, ধ্রুব --- এমন বিশ্বাস পোষণকারীর দল পৃথিবীর সব ধর্মেই আছে। পাশ্চাত্য সভ্যতা তার উন্নয়নের পথে এগিয়েছে ধর্মকে উন্নত করে নয়, নিজেকে ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে। একাজ বহু আগে কান্ট, স্পিনোজা, সর্বোপরি ভোল্টায়ার দিয়ে শুরু হয়েছিল, যদিও গ্রীসে এ মুক্তচিন্তার আরোও প্রাচীন উদাহরণ পাওয়া যায়।
        একটা সদ্যঘটিত উদাহরণ নেওয়া যাক। একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ধর্মগুরুর, যিনি জীবনে বেঁচে থাকার শিল্পকলা শেখান (Art Of Living), তিনি সমকামিতাকে একটি ব্যাধির আখ্যা দিয়েছেন। তার কয়েকদিনের মধ্যেই আজ অস্ট্রেলিয়ায় সমকামিতার স্বীকৃতির মহোৎসব পালিত হচ্ছে। তবে কি সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিলেই মুক্তমনা হওয়া যায়? অবশ্যই না। এটি একটি উদাহরণমাত্র, যা প্রাচীন সংস্কারকে ভেঙে নতুন পথের দিকে নির্দ্বিধায় পা বাড়াতে পারে। একসময় কন্ডোমের ব্যবহার এবং গর্ভপাত নিয়ে খ্রীষ্টিয় মিশনারীদের সাথে প্রগতিশীল সমাজের বিরোধ ঘটেছিল। স্বভাবতই কেউ কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারেননি কোনটা কেন বেশি জরুরী এবং কেন নয়। অবশেষে সমাজ অর্থাৎ প্রগতিশীল সমাজ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে সভ্যতার এগিয়ে চলার পথ পরিস্কার করে। আজ ভারতের সে দিন এসেছে। ভয় গেরুয়ায় নয়, ভয় প্রাচীনত্বের মোহে।
        বার্ট্রান্ড রাসেল একবার বলেছিলেন, বেথোভেন, বাক্‌ যদি নিশ্চুপ থাকতেন, কিম্বা শেক্সপীয়র, বায়রন যদি কলম না ধরতেন, তবুও সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে কোন প্রভাব পড়ত কি? পড়ত না। কিন্তু বিজ্ঞানের অগ্রগতি থেমে থাকলে আজ সাধারণ মানুষের জীবন অনেকটা পিছিয়ে আটকে থাকত, অথবা শ্লথগতিতে এগোত --- এ বলার অপেক্ষা রাখে না। একবার আমার প্রবল জ্বরে আমার সমীপবর্তী বন্ধুকে ঠাট্টা করে বলেছিলাম, “প্যারাসিটামলের থেকে প্রয়োজনীয় বস্তু সংসারে এই মুহূর্তে আর দেখছি না কিছু। ঋষিবাক্য মাথায় থাকুন, আত্মা যতই অবিনশ্বর হোন, আমায় একখানি প্যারাসিটামল ৬৫০ দে বাবা।”
        তবে কি বিজ্ঞানের অগ্রগতি সবক্ষেত্রে খুব আশাব্যঞ্জক? অবশ্যই না। সত্যজিৎবাবুর ‘আগন্তুক’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘সভ্যতার সংকট’ যেন দুই প্রবল চিন্তাবিদের দুটি উপসংহার, যা একই সূত্রে প্রতিষ্ঠিত। ভবিষ্যৎটা তবে কার হাতে?
        আত্মার অবিনশ্বরতা না মানলেও সমাজের অবিনশ্বরতা স্বীকার করি। সমাজ একটা প্রবহমান নদী, যার কিছু জল বাস্পীভূত, শোষিত, অপসারিত হলেও নদীর আকার আকৃতি একই থাকে। সমাজও তেমনি। কোথাও কোথাও কেউ কেউ নদীর অববাহিকায় গর্ত কেটে, কিম্বা নদীর পাশে অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ তৈরী করে, সেই আপন কীর্তির মোহে তাকেই নদী আখ্যা দেবে এ বিচিত্র কিছু না। তাদের সাথে বিবাদ করতে যাওয়া বৃথা। ঈশ্বরও শুদ্ধহৃদয়ের অভাবে শয়তানে পরিণত হন এ উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং অগণিত রক্তপ্লাবিত ধর্মযুদ্ধ। আর শুদ্ধতাটা অনুভবের বিষয়, তর্কের নয়। কিন্তু অভিশপ্ত প্রাচ্যের এই ইতিহাসের পুণরাবৃত্তি যেন শেষই হতে চায় না। বুদ্ধিতে স্বীকার করলেও প্রাণে তাকে সঠিকভাবে অনুভব করার অভাবে, ‘প্রগতি’ শব্দটা মুখেই উচ্চারিত হয়ে থাকে, অন্যদিকে আচরণে সেই সংস্কারলব্ধ পথকেই মূল জেনে আত্মতুষ্টিতে ভোগা ছাড়া কোন বিকল্প থাকে না।
        অবশেষে বলি, এ কোন হিন্দু ধর্মসভা? কারণ হিন্দু না তো দলবদ্ধ, না তো সংঘবদ্ধ, না তো তন্ত্রবদ্ধ কোন বিশেষ দল --- একথা বহু আলোচিত। সে আত্মায় বিশ্বাস করে, বেদান্তে বিশ্বাস করে, গুরুতে বিশ্বাস করে, পুনর্জন্মে বিশ্বাস করে। বাকি অন্য কোনো আদর্শ তার পক্ষে মেনে চলা বাধ্যতামূলক নয়। সে ঈশ্বরকেও অস্বীকার করতে পারে।
        আজ মানুষের জীবন ততটা অন্তর্মুখ নয় যতটা আগে ছিল, বা সম্ভব ছিল। অন্তর্মুখ ধর্ম যে আত্মবিশ্লেষণ তথা চিত্তের ঔদার্যের বৃদ্ধির অনুশীলন শেখায়, বহির্মুখ ধর্ম ততটাই ভয়ঙ্কর হয়ে দল পাকিয়ে ‘Holier Than Thou’ হতে শেখায়। তাই যে ভারতবর্ষ আদি শঙ্করাচার্যের ‘বিবেকচূড়ামণি’তে জাতপাত, উচুনীচু, ধর্ম-অধর্ম ত্যাগ করার উচ্চদর্শনের কথা বলে, সেই-ই ‘মনুসংহিতা’তে এসে মানুষে মানুষে বিভেদ টানার কথা শেখায়, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। ঐ যে বললুম ধর্ম অন্তর্মুখ হলে যে উদারতা শেখায় বহির্মুখ হলে ততটাই গন্ডী কেটে নিজের স্বকল্পিত মহত্বে অন্ধ হয়।
        সব গৌরবময় অধ্যায়ের একটা শেষ থাকে। আমাদেরও ছিল। কিন্তু সেই ‘ছিল’টাকেই যদি আজ মুখ্য করে তুলি, তবে চলা দায় হয়। মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্বল তার মনুষ্যত্ব। যার মূলমন্ত্র ‘তুমি’ আর ‘আমি’ প্রতিভায়, ক্ষমতায় ভিন্ন হলেও বেচে থাকার অধিকারে ও সন্মানে এক। একাধিপত্যের জন্য এ সংসার নয়, ইতিহাস সাক্ষী। সংসার ‘এক’-এর বলে চলে না, একত্বের বলে চলে, তাকেই প্রগতি বলে।

 

 

 

422
Tue, 11/14/2017 - 10:30
সত্যি বলতে আমি জানতাম না। আমার কোনো ধারণাই ছিল না। জিজ্ঞাসা করলাম, সকালে কি করো? বলল, সকালে বাড়ি গিয়ে রান্না চাপাই, ঘরের কাজ করি। তারপর সেন্টারের দিদিরা অন্য কোথাও পাঠালে যাই। 
- কিসের কাজে?  - কেন? আয়ার কাজে। খুব বয়স্ক পেশেন্ট হলে দুপুরের স্নান-খাওয়ানোর জন্যে যাই।  - ঘুম?  - এই যে এখানে যতটুকু হয়।

        এ তো গেল একরকম। কারোর কারোর রাত আটটা থেকে সকাল আটটা করে আবার পরের দিন অন্য কোথাও সকাল আটটা থেকে রাত আটটা। 
- ঘরে যাও না? - না। - কেন? - কি হবে? ছেলে তো বাইরে কাজ করে। মানুষ বলতে তো আমি আর ওই ছেলে। কার জন্য ফেরা?

        বিধবা, সংসারের কোনো পিছুটান নেই, বা সে অর্থে তেমন কোনো ঘরের দায়িত্ব নেই, তারা চব্বিশ ঘন্টাই আয়া।
        বাইশ বছরের মেয়ে থেকে পঞ্চাশ বছরের বয়স্কা। কেউ বিধবা, কেউ স্বামী পরিত্যক্তা, কারোর স্বামী অমানুষ, কারোর ঘাড়ে সংসারের জোয়াল, কেউ বা স্বামীর উপার্জনে সংসার চালাতে পারে না।

        বাবা অসুস্থ না হলে, সমাজের এইদিকটা আমার চোখে কোনোদিন পড়ত না হয়ত। খুব নিষ্ঠুর হলেও কথাটা তো সত্যি, আয়ার কাজ মানে একটা সম্মানহীন যেমন তেমন কাজ। যদিও তাদেরই সেবায় বাবা অনেকটা সুস্থের দিকে, এও সত্যি। আয়া কোনো বিশেষ কলে গড়া যন্ত্র নয় যে সকলের ব্যবহার, নিষ্ঠা সমান হবে। তারতম্য তো আছেই। থাকতেই হবে। কিন্তু হরেদরে খারাপ মানুষ আর ক'টা দেখলাম। দেখিনি তো। চুরি হয়েছে। নিজে সজাগ হয়েছি। কিছু বলতে বেধেছে। চুরি বন্ধ হয়েছে। সারাদিন না ঘুমিয়ে দিনরাত পরিশ্রম করেও যাদের সংসারের চাকার কর্কশ আওয়াজ থামতে চায় না, তখন তাদের চুলচেরা নীতির বিচার করতে বিবেকে বেধেছে। আমায় তো কোনদিন ওই পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। বিচার করব কোন বিধানে? চুরিকে সমর্থন করছি না, নিজের অপারগতার কথা বলছি মাত্র।
        এ সমাজ নাকি পুরুষতান্ত্রিক। নাকি কেন? নিশ্চয় পুরুষতান্ত্রিক। পুরুষ অনেক সংসারে কেন, বেশিরভাগ সংসারেই শেষ কথা বলে। তবে এরা কারা? কোন সংসারের? যাদের সকাল বিকাল না বেরোলে বাড়িতে হাঁড়ি চড়ে না, তারা কোন তন্ত্র চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? মানবতন্ত্র কি পুরুষতন্ত্রের চাইতে বড় শব্দ? মধ্যবিত্ত, শিক্ষিতা কর্মরতাদের কথা বলছি না। তাদের তবু খানিক খোলা আকাশ আছে। লড়াইয়ের মানে সেখানে স্পষ্ট না হলেও তার একটা অস্তিত্ব আছে। কিন্তু এরা? হাস্পাতালে, নার্সিংহোমে, বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা এই অশিক্ষিতা, বা নামমাত্র শিক্ষিতা মেয়েরা, বউরা? এরা কোন তন্ত্রের অধিকারী?
        বাবা হয়ত আয়াকে দু-তিন বার ডেকে রাতে সাড়া পাচ্ছেন না, আমি শুনতে পেয়ে যখন আয়াকে বকাবকি করার জন্য দোতলায় উঠেছি, দেখেছি দুটো শুকনো রুটী নামমাত্র তরকারি কিম্বা ডালে ডুবিয়ে কোণের ঘরে সেঁধিয়ে বসে, অত্যন্ত সংকোচের সাথে, ডান হাতে সবেমাত্র একটা গ্রাস নিয়েছে, মুখেরটা চিবোচ্ছে, উদাস শূন্যদৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে। সামনে দেওয়াল। বড়লোকেদের বাড়ির দেওয়াল। দেওয়ালে চোখ আটকে কিসের হিসাব মেলাচ্ছে সেই জানে। কোন হিসাবটাই বা মিলেছে তার? খাওয়া হল কি হল না খোঁজ নেওয়ার মানুষ সংসারে কই তার? এই খাওয়ার সময়টাও তো তার বাড়তি। কাজের জন্যে আসা, সে পয়সা পাচ্ছে তার জন্যেই তো, না হাত-পা ছড়িয়ে খাওয়ার জন্য? তবে চোরের মত লুকিয়ে খেয়ে নিতে হবে না? যাতে বাড়ির লোকজন টের না পায় সেও মানুষ, তারও খিদেতেষ্টা আছে। আয়াদের কেন, আমাদের সমাজের অনেক মানুষের নিজের মানুষ হওয়ার মত বালাই খুব কম আছে।         বকাবকি হল না। তার ওই ফ্যালফ্যালে শূন্য চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারিনি। তার অপরাধীর মত মুখ আমার বিবেক পুড়িয়েছে। তার ঘুম ধরে আসা চোখে, তার ঝিমুনি লাগা অবাধ্য শরীরের দাবীকে, অনাবশ্যক উৎপাত মনে করে ফাঁসির আসামীর মত মুখে বলা, “একটু চোখটা লেগে গিয়েছিল দাদা” – কথাটা তীরের ফলার মত বিঁধেছে।         রাতে ছাদের দরজায় শিকল পড়েছে কিনা যখন দেখতে উঠেছি, কারোর কারোর আশঙ্কার চোখও দেখেছি। পরে জেনেছি, প্রয়োজন হলে অনেকের খাদক হতেও তাদের হয়। “পেটের জন্যে কত যে কি করতে হয় দাদা! এসব কাকে বলবেন? সেন্টারের দিদিরা বলবে অত সতীপনা নিয়ে এসব কাজ হয় না। সব মানুষ তো আর সমান হয় না। কারোর কারোর খিদে বেশি। তো? বাজারে তো তার থেকে বাঁচারও উপায় বেরিয়েছে, বেরোয়নি? কি বলবেন দাদা?”          কিচ্ছু বলব না। বলার কথা তো আমার নয়। বলার কথা তো নয়। এ পাপের ভাগীদার হওয়া শুধু। প্রত্যেকের। সমাজটা তো আমাকে বাদ দিয়ে নয়। ক'দিন আগে যখন মেঘালয় বেড়াতে বেরোলাম, বাবাকে প্রণাম করে, টাটা করে বেরোচ্ছি; সেই অবাঙালী আয়া বলল, দাঁড়ান দাদা। দাঁড়ালাম। সে হাঁটুগেড়ে বসে দুটো হাত আমার পায়ের পাতায় রেখে, নিজের কপালে ছুঁইয়ে বলল, সাবধানে ঘুরে আসুন দাদা।         আমার চোখ জ্বালা করল। কোনোরকমে তাকে হাসিমুখে 'আচ্ছা' বলে, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে ভাবছিলাম, ও কিসের জোরে এমনভাবে প্রণাম করল - কৃতজ্ঞতায়, নাকি শ্রদ্ধায়? উত্তর পেলাম ফিরে আসার পর। সে বলল, রাখীতে আমি যেখানেই থাকি দাদা, আমি আপনাকে রাখী পরাতে আসবই দেখো। বুঝলাম সে আত্মীয়তার যোগসূত্রটা খুঁজে পেয়েছে।আমার সামনে এরা এক একজন নতুন মানুষ। মানুষ শাসনটা সানন্দে নেয় সে অধিকার অর্জন করলে, কিন্তু অপমানটা নয়।

- কি পাশ?
- উচ্চমাধ্যমিকটা দেওয়া হয়নি। ইলেভেন অবধি পড়েছি।  - কেন? - বিয়ে করে নিলাম। - সে কি করে? - অ্যামাজনের কুরিয়ার।         তাকে বোঝালাম বেশ করে, তুই উচ্চমাধ্যমিকটা দে, এই তো বাইশ বছর বয়েস। কেন জীবনটা নষ্ট করছিস?         বুঝল। কত খরচ শুনল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা গ্র্যাজুয়েশান করতে কত পড়ে?         বললাম। 'আচ্ছা' বলে সে প্রসঙ্গে ইতি টানল।         পরের দিন বাড়িতে এসেই আমার ঘরের দরজার কাছে দাঁড়াল। একটা কথা বলব? - বল।  - বলছিলাম, আমি ওকে বলে ওর গ্র্যাজুয়েশনটা করানোর ব্যবস্থা করি বুঝলে। টাকার অভাবে ও লাস্ট ইয়ারটা পড়তে পারেনি। তুমি ব্যবস্থা করবে? আমি আমার থেকে টাকা দিয়ে ওকে করিয়ে নেব। ওর খুব ইচ্ছা জানো তো, কিন্তু ওই যে বললাম, অভাবে.. গলা বুজে আসাটা সামলে নিয়ে উপরে উঠে গেল ছুটে। আমার বাস্তবজ্ঞান একটা মরুঝড়ে উড়ে গেল। এটা কি তন্ত্র? পুরুষ?

        এক দরিদ্রা রমণী। এক মঠের পরিচারিকার কাজ করেন, দু'বছরে যার দুটোর বেশি শাড়ি দেখিনি, যা শতচ্ছিন্ন। বয়েস ষাটের উপর। একদিন সন্ধ্যায় আমার পথ আগলে দাঁড়ালেন। 
- একটা কথা বলব আপনাকে? অত্যন্ত সংকোচ চোখেমুখে। তবু মুখের কোণায় একটা প্রাণভোলানো হাসি।  - বলুন। - এবার আপনি মনটা স্থির করেন। একটা বিয়ে করেন। আপনার জন্য আমার বড্ড চিন্তা হয়। কে দেখবে আপনাকে? মঙ্গলময়ের কাছে প্রার্থনা করেন, তিনি ঠিক জোগাড় করে দেবেন।          আমার উত্তর নেই। একজন মানুষ, যার হারানোর মত সম্বলটুকু তার মঙ্গলময় বিধাতা তার জন্য জোগাড় করতে পারেননি, সেই রমণী আমার ভবিষ্যতের জন্য চিন্তিতা!

        পুরুষতন্ত্রটা কি আসলে তবে? একটা ঢাল? শান্ত প্রকৃতির অঙ্কে লালিত একটা স্বপ্ন, যা মুহূর্তে চুরমার হয়ে যেতে পারে প্রকৃতি তার ধৈর্য, স্থৈর্য হারালে? হ্যাঁ তাই। ধারকের অস্তিত্ব অহংকারে নয়, ধারকত্বেই। এটা যত শীঘ্র বোঝা যায় ততই মঙ্গল। নইলে এ অপমানের ভার চোকাতে একেকটা সভ্যতাকে কম মূল্য দিতে হয়নি, না জানি আরো কত মূল্য দিতে হবে ভবিষ্যতই জানে।

423
Sun, 11/12/2017 - 01:38

ডিসেম্বরের 9 তারিখ, 1946, বি আর আম্বেদকরজী একটা বক্তব্য রাখেন আসন্ন গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক সূচনার উপর। তা পড়তে পড়তে বেশ কিছু জায়গায় চমকে উঠতে হল। মনে হল প্রতিটা কথা কি সাংঘাতিক রকম প্রাসঙ্গিক আজও। অতবড় ভাষণটা তো আর দেওয়া যায় না, তার কিছু কিছু অংশ, যা আমাকে ভাবালো, তা তুলে দিলাম আম্বেদকরজীর ভাষাতেই।

সংবিধান সংবিধানের উপর নির্ভরশীল নয়, নির্ভরশীল তার প্রয়োগবিধি আর প্রয়োগকর্তার উপরঃ   "The working of a Constitution does not depend wholly upon the nature of the Constitution. The Constitution can provide only the organs of State such as the Legislature, the Executive and the Judiciary. The factors on which the working of those organs of the State depends are the people and the political parties they will set up as their instruments to carry out their wishes and their politics. Who can say how the people of India and their purposes or will they prefer revolutionary methods of achieving them? If they adopt the revolutionary methods, however good the Constitution may be, it requires no prophet to say that it will fail. It is, therefore, futile to pass any judgement upon the Constitution without reference to the part which the people and their parties are likely to play." ভারতের বারবার পরাধীন হওয়ার জন্য বাইরের শত্রু শুধু তো নয়, ঘরের শত্রুও কি কম ছিল? ভবিষ্যতে কি তবে দেশের নানান জাতপাত, উঁচুনীচু শ্রেণী বিভাজনই ঘরের শত্রু হয়ে দাঁড়াবে?  "What perturbs me greatly is the fact -that not only India has once before lost her independence, but -she lost it by the infidelity and treachery of some of her own people. In the invasion of Sind by Mahommed-Bin-Kasim, the military commanders of King Dahar accepted bribes from the agents of Mahommed-Bin-Kasim and refused to fight on the side of their King. It was Jaichand who invited Mahommed Gohri to invade 'India and fight against Prithvi Raj and promised him the help of himself and the Solanki Kings. When Shivaji was fighting for the liberation of Hindus, the other Maratha noblemen and the Rajput Kings were fighting the battle on the side of Moghul Emperors. When the British were trying to destroy the Sikh Rulers, Gulab Singh, their principal commander sat silent and did not help to save the Sikh Kingdom. In 1857, when a large part of India had declared a war of independence against the British, the Sikhs stood and watched the event as silent spectators. Will history repeat itself? It is this thought which fills me with anxiety. This anxiety is deepened by the realization of the fact that in addition to our old enemies in the form of castes and creeds .we are going to have many political parties with diverse and opposing political creeds. Will Indian place the country above their creed or will they place creed above country? I do not know. But this much is certain that if the parties place creed above country, our independence will be put in jeopardy a second time and probably be lost for ever. This eventuality we must all resolutely guard against. We must be determined to defend our independence with the last drop of our blood." আর অসাংবিধানিক আন্দোলন নয়, কারণ সংবিধান এখন আমাদের হাতে। "If we wish to maintain democracy not merely in form, but also in fact, what must we do? The first thing in my judgement we must do is to hold fast to constitutional methods of achieving our social and economic objectives. It means we must abandon the bloody methods of revolution. It means that we must abandon the method of civil disobedience, non- cooperation and satyagraha. When there was no way left for constitutional methods for achieving economic and social objectives, there was a great deal of justification for unconstitutional methods. But where constitutional methods are open, there can be no justification for these unconstitutional methods. These methods are nothing but the Grammar of Anarchy and the sooner they are abandoned, the better for us."  ভারতের ব্যক্তিপূজার প্রতি ঝোঁক কি ভবিষ্যতে প্রচ্ছন্ন একনায়কতন্ত্র তৈরি করবে? "For in India, Bhakti or what may be called the path of devotion or hero-worship, plays a part in its politics unequalled in magnitude by the part it plays in the politics of any other country in the world. Bhakti in religion may be a road to the salvation of the soul. But in politics, Bhakti or hero- worship is a sure road to degradation and to eventual dictatorship." ভারতের সব চাইতে বড় শত্রু তার সামাজিক জাতপাতের বিচার, অস্পৃশ্যতা। গণতন্ত্রের মূল তিনটি পরিকাঠামো - স্বাধীনতা, সাম্য আর ভাতৃত্ব। এর মধ্যে শেষ দুটি, অর্থাৎ সাম্য আর ভাতৃত্ববোধের বড় বাধা এই সামাজিক শতাব্দীপালিত বিভাজন। তা কি দূরীভূত হবে? "What does social democracy mean? It means a way of life which recognizes liberty, equality and fraternity as the principles of life. These principles of liberty, equality and fraternity as the principles of life. These principles of liberty, equality and fraternity are not to be treated as separate items in a trinity. They form a union of trinity in the sense that to divorce one from the other is to defeat the very purpose of democracy. Liberty cannot be divorced from equality, equality cannot be divorced from liberty. Nor can liberty and equality be divorced from fraternity. Without equality, liberty would produce the supremacy of the few over the many. Without fraternity, liberty would produce the supremacy of the few over the many. Equality without liberty would kill individual initiative. Without fraternity, liberty and equality could not become a natural course of things."

 

424
Fri, 10/27/2017 - 13:30

কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজে যখন রুগীকে নিয়ে যাওয়া হল, তখন তিনি অচৈতন্য। সেরিব্রাল অ্যাটাক। বয়েস ৪৬। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষার পর চিকিৎসক বললেন, “এখানে কোনো নিউরোর ডাক্তার নেই, আপনারা কলকাতায় নিয়ে যান, নইলে ওনার যা অবস্থা উনি বাঁচবেন না।" বাঁচলেনও না। কলকাতায় যাওয়ার যাত্রা শুরু হতে না হতেই জীবনযাত্রার অন্তিম অধ্যায় অ্যাম্বুলেন্সেই সমাধা হল।
        ক্ষোভ, শোক, যন্ত্রণা যাই থাক, মফঃস্বলে এ খুব ব্যতিক্রমী ঘটনা না। কাঁচরাপাড়ায় রেলের যে হাস্পাতাল তারও একই অবস্থা। ব্যবস্থা আছে, বাইরে সুপারস্পেশালিটি লেখাও আছে, কিন্তু বিন্দুমাত্র জটিলতা আসলেই বি আর সিং ছুটতে হবেই। আমার এক কনিষ্ঠ বন্ধু, সে একটা জেলার মেডিক্যাল কলেজে দীর্ঘদিন কাজ করার কি সব অভিজ্ঞতার ইস্তাহার শুনিয়েছে। একজন মানুষের কাছে অতিমানবিক দাবীর নামান্তর এক কথায়। সব দায় কি তবে সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকা যায়? পরিবর্তন হয় তাতে?
        হয় না। যে কোনো তন্ত্রের মূলে যে কথাটা থাকে তা হল - মানুষ আর তার পরের শব্দ - মানসিকতা। যে মানসিকতা যুগের সাথে সাথে চরিত্র অভিধা পায়। জাতীয় চরিত্র। তার স্থবিরতার দিক আছে আবার গতিময়তার দিকও আছে। প্রথমটায় নিজের চেষ্টা আর পরেরটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে রাখলে যা হয় - আমাদের ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষ্য। আমরা আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে আর্যরক্তের শুদ্ধতা বজায় রাখার প্রাণপণে চেষ্টা করব, কারণ মহাপুরুষ বলিয়াছেন - 'যেদিন ভারতবর্ষ ধ্বংস হইবে, সেদিন সারা পৃথিবীর শুদ্ধভাবগুলি ধ্বংস হইয়া যাইবে'। অগত্যা জগতের এতবড় স্থবিরতার সাধনের ডাককে আমরা উপেক্ষা কেমন করে করব? আমরা নিজেরা নড়ব না, ভাগ্যের কল আমাদের যেদিকে নিয়ে যায় সেদিকেই যাব। দায় তবে ভাগ্যের হবে। তাই হয়েও আসছে। অর্জন করার চাইতে ভিক্ষার উপর টানটা আমাদের বেশি। উদাহরণ?
        বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতা আর শহরতলী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে বছরের এই নির্দিষ্ট সময়টাতে। সবাই জানি এ রোগের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা প্রাণঘাতীও বটে। আমরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছি, ভয় পাচ্ছি, ভয় দেখাচ্ছি, তবু নিজে থেকে কোনো বছরই নড়েচড়ে বসছি না, নিজের বাড়ির আশপাশ পরিস্কার রাখার দায়িত্ব নিজে নিচ্ছি না। মশা তাড়াবার কয়েল, ক্রিম - সব কিনছি, কিন্তু মশা জন্মাবার পথটা বাঁধবার ব্যবস্থা করছি না। কারণ প্রথমটার প্রেরণা আসে ভয় থেকে, আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে, পরেরটার ডাক আসে বিবেক থেকে জনস্বার্থে, যে জনের মধ্যে 'আমিও' পড়ি। সেখানে আমি সরকারের মুখাপেক্ষী। পঞ্চায়েত থেকে, কি মিউনিস্যাপলিটি থেকে লোক এসে কবে ব্লিচিং ছড়াবে, ততদিন মশারা ধৈর্যসহকারে সংযম পালন করবে, তারপর দয়াপরবশিত হয়ে সেই সরকারি ব্লিচিং-এ প্রাণত্যাগ করবে, আর আমি বিপদমুক্ত হব। অন্যথা হলে ভাঙচুর করার নাগরিক অধিকার তো আমার আছেই।
        আত্মতুষ্টি আর আত্মক্ষোভ - এই দুটোই বড় সাংঘাতিক মারণ আবেগ। আশ্চর্যের কথা আমাদের দুটোই আছে। নিজেদের দায়িত্বে আমরা সন্তুষ্ট। নিজেদের অধিকারে আমরা ক্ষুব্ধ। যতটা পাওয়ার ছিল পেলাম কই? আর যতটা করার বা দেওয়ার ছিল? সপাটে উত্তর, করেছি তো!
        কথাটা হল, আমাদের সভ্যতা আসলে তো পাশ্চাত্য সভ্যতার আদলে তৈরি হতে চাওয়া একটা অনুকরণ সভ্যতা। তাদের মত হাস্পাতাল, পথঘাট, আইন আদালত, ভোটাভুটি সবই চাই। এর কোনোটার উৎসই আমাদের প্রাচীন ভারত তো নয়। তার অপরিণত আভাস যদিও দেশপ্রেমীদের দ্বারা আবিস্কৃত এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে, তবু আমাদের বেশির ভাগ শব্দই 'প্রতিশব্দ' আধুনিক সভ্যতায়। এমনকি এই 'সংস্কৃতি' শব্দটাও, যা culture-কে অনুদিত করে। অনুকরণের সমস্যা হচ্ছে, তার তাগিদটা বাইরে হওয়ার মত হয়েই ফুরিয়ে যায়। ভিতর থেকে হয়ে ওঠার মত শক্তি তাতে থাকে না। তাই যেখানে সেখানে এত অসামঞ্জস্য। বাইরের চাকচিক্যে যদি সব কিছুর শেষ পরিমাপক হয় তবে মুশকিল।
        এ কথাটা আমাদের দেশের বেশ কিছু মনীষী অনুভব করেছিলেন। আচার-অনুষ্ঠান আর অতীন্দ্রীয় জীবনদর্শন - এই দুই খাদ এড়িয়ে শুধু মানবিক নৈতিকতার উপর ভারতকে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ। রামমোহন - বিদ্যাসাগর - রবীন্দ্রনাথ, ই ভি রামস্বামী (যাকে এশিয়ার সক্রেটিসও অনেকে বলেন), গান্ধী ইত্যাদিরা।
        স্বাধীনতার পর নানান আদর্শের সংঘর্ষ, বিশেষত নানান রাজনৈতিক মতাদর্শ থেকে ক্রমশঃ আদর্শহীন ক্ষমতাসর্বস্ব আস্ফালন ভারতীয় আত্মমগ্ন, শান্তরূপটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলল। দীর্ঘদিন পরের শাসনে থেকে, সব অনিষ্টের দায়ভার পরের ঘাড়ে ফেলে নিজেদের ঋষির সন্তান ভেবে আত্মতুষ্টিতে বাঁচতে কোনো অসুবিধা হয়নি। যারা সে তুষ্টিতে সুড়সুড়ি দিয়েছেন, কিম্বা সে আত্মমদের যজ্ঞে আহুতি দিয়ে এসেছেন, তাদের ছবি দেওয়ালে, মন্দিরের বেদীতে রেখে পূজোতেও দ্বিধা হয়নি। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলেছেন তাদের দেশদ্রোহী, অভারতীয়, বিদেশী পা-চাটা বলে তিরস্কার করতে বাধেনি। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পর, পঞ্চাশটা বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যখন 'অমৃতের পুত্রদের' স্বরূপ উদঘাটিত হতে শুরু হল, যখন আমরা বুঝতে শুরু করলাম আমরাও পৃথিবীর আর সকল দেশের মতই বেশির ভাগ স্বার্থদুষ্ট আর কিছু স্বার্থহীন আদর্শপ্রাণ মানুষের মিলিত সভ্যতা, আমরাও আদতে মানুষ। আমাদের প্রাচীন দর্শন মানবাত্মার যতই মহিমাজ্ঞাপন করে থাকুক অবশেষে - 'অন্নগত প্রাণ', তখন বড় একটা ঝটকা খেলাম। যদিও এ মোহভঙ্গ স্বাধীনতার প্রাক্কালেই শুরু হয়েছিল। বামধারার রাজনীতিতে বিশ্বাসী একদল তরুণ-তরুণী গড়ে উঠছিল, যার পূর্ণবিকাশ ও অধঃপতনের সাক্ষী আমাদের নিজেদের রাজ্যই। অবশেষে বেদও টিকল না, দাস-ক্যাপিটালও ব্যর্থ হল। উপায়?
        ভারতের মনসায় এখন তুমুল দ্বন্দ্ব - প্রাচীন ভারত বনাম আধুনিক নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জড়িত বিশ্ব সংসার। যেখানে কেউ কারোর চূড়ান্ত ঊর্ধে নয়। কেউ কোনো কোনো অংশে খানিক এগিয়ে, খানিক অংশে পিছিয়ে। মিলিয়ে সে সবার মাঝে সবার মত। তবে সে গর্ব করবে কি নিয়ে? ঠিক। আমরা শেষ কিছু দশক ধরে একটা গর্বের উপর দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। ধর্মে দর্শনে আমাদের একাধিপত্যের গর্ব। আজ বিশেষ একটা রাজনীতির আদর্শ আমাদের আশ্বাস দিচ্ছে সে হৃতগৌরব আমাদের ফিরিয়ে দেবে। সেই গৌরবের ধ্বজাধারী মহাপুরুষদের ছবিও তাদের দলের রঙের সাথে মিশে যাচ্ছে। ভারতের চিত্ত সংশায়কুল। কারণ, যুক্তি, আস্ফালন তখনই বাড়ে যখন বিশ্বাস তলানীতে এসে ঠেকে। আমাদের নিজেদের সে প্রাচীন সংস্কারে কি সে বিশ্বাস আর ফেরা সম্ভব? কখনও না। তাই এত ভয়। আর ভয় থেকে এত নিরাপত্তাবোধের অভাব। এত বিচ্ছিন্নতাবাদী হিংসার সূত্রপাত। এও যাবে।
        এ যুগ সিদ্ধান্তের যুগ না। এ যুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার যুগ। ক্রিটিকাল থিংকিং-এর যুগ। সার্বিক আলোচনার যুগ। আদর্শ-বিশ্বাসের থেকে বড় কথা বিশ্লেষণ আর সংশ্লেষণ। সেই পরীক্ষার থেকে জন্মাবে দিশা। যার হাল ধরবে মানুষের জন্মলব্ধ দায়িত্ববোধ। ভারতকে এটা বুঝতে হবে। যা গেছে তা চিরকালের জন্যই গেছে। তার মমি পূজো করে আর বেঁচে থাকার দিন নেই। ভারতচেতনা থেকে বিশ্বচেতনায় যত শীঘ্র জাগি ততই মঙ্গল। তবেই বিশ্ব সংসারে নিজের দায়িত্ব মিলবে। নইলে সারা বিশ্বে ঐতিহাসিক পর্যটক স্থান হিসাবেই বাঁচতে হবে।

 

 

 

 

 

 

 

 

425
Fri, 10/06/2017 - 14:00

রোম্যান্টিসিজম এ যদি একটা ক্ষতির আশঙ্কা না থাকত তবে শব্দটা মাহাত্ম্য হারাতো। ভয়কে জয় করে নিজের আবেগ, ভালোবাসাতে প্রতিষ্ঠিত হতে চাওয়ার প্রয়াস অথবা সাধনার ভিত্তিই এই রোম্যান্টিসিজম। নতুনকে নতুন ভাবে দেখতে শুধু রুচি লাগে না, সাহস লাগে, আত্মবিশ্বাস লাগে। প্রথা ভেঙে নতুন পথের ভগীরথ হতে শুধু বিচক্ষণতা লাগে না, ধৈর্য্য, অধ্যবসায় আর প্রাণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা লাগে। প্রাথমিকভাবে চারপাশের চূড়ান্ত বিরোধিতা আর অসহযোগিতার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়াবার জন্য যা লাগে তা ঔদ্ধত্য না, বীজের অঙ্কুরের মত ঐকান্তিক ইচ্ছা।
        রোম্যান্টিসিজম শব্দটা যত নতুন, অনুভবটা তত নয়। তাকে আলাদা করে চিনেছে মানুষের বোধ হয়ত অনেক পরে, কিন্তু তলে তলে তারই প্রেরণায় সে এতটা পথ হেঁটে এসেছে, ঝুঁকি নিয়ে, অস্তিত্ব-সংশয় নিয়ে। সবাই যে সফল হয়েছে তা অবশ্যই নয়। তবু বিফল হয়েও তারা ব্যর্থ হয়নি।
        মানুষের ধর্মের উৎপত্তি আর প্রগতির ইতিহাসটাও এই ধারার ব্যতিক্রম নয়। ভয় আর প্রেম এই দুই মেরুর মধ্যে মানসিক অবস্থান আমাদের। দুটোর যে কোনো একটার চূড়ান্ত স্থানে থাকতে গেলেই বিকারগ্রস্থ অথবা মহাপুরুষতুল্য হতে হবে। তবে পুরাণের মহাপুরুষদের বাদ দিলে ঐতিহাসিক মহাপুরুষদের চিত্ত সম্পূর্ণ ভয়মুক্ত এমন প্রমাণ কোথাও মেলেনি। অকুতোভয় - শব্দটা যতটা আভিধানিক, ততটা বাস্তবিক নয়। কারোর অবস্থান ভয়ের দিকে বেশি, তো কারোর প্রেমের দিকে। সেই অনুযায়ী তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ। আমাদের সভ্যতার অগ্রগতিতেও একই সূত্রের পদাচিহ্ন। জঙ্গল কিম্বা গুহা সভ্যতার থেকে শুরু করে আধুনিক নগরসভ্যতার গতিপথটাও সেই রেখচিত্রেই। ভয়ের থেকে প্রেমের দিকে এগোনো। জ্ঞান ভয়কে সরিয়ে প্রেমের পথ খুলেছে। জ্ঞানের বিহনে তাই প্রেম নাই, কবির ভাষায়।
        দেবতারা ভয়াল ছিলেন। কৃপাটা তাদের প্রেমজ ছিল না, খেয়ালজাত ছিল। সে সব দেবতারা ক্রমে ধর্মীয় অভিব্যক্তির টানে এক পরমাত্মায় লীন হতে থাকলেন। তখনও প্রেম শব্দটা পরিপক্ক হল না। ভয় আর প্রেমের মাঝে একটা শব্দ এলো - শ্রদ্ধা। উপনিষদে যে শব্দটা আমরা পড়ি বারবার। শ্রদ্ধাকে আহ্বান করার মন্ত্রও আছে। অর্থাৎ শ্রদ্ধা পারসনিফায়েড। দেবতারা ক্রমে বিবেকযুক্ত হচ্ছেন যেন। কিন্তু তখনও প্রেম শব্দটা আসেনি। ভক্তি কিছুটা আসব আসব করেও পুরো অর্থে জন্মাতে পারছে না। শ্বেতাশ্বর উপনিষদে যা অনেকটা আধুনিক কালের রচনা সেখানে তার আভাস দেখা গেল।
        ভক্তি পূর্ণমাত্রায় এলো পৌরাণিকযুগে। বুদ্ধ কর্ড লাইন ধরে নীতি আর অনুকম্পার উপর ধর্মের ভিত্তি গড়ে দিলেন। যদিও ভক্তি আক্রমণ করল বুদ্ধকে তীব্র বেগে তাঁর প্রয়াণের বেশ কয়েক শতক পরে। স্তব, স্তোত্র তাঁর নামে রচনা হয়ে তাঁকে পুরোদস্তুর ভগবান বানিয়ে তুলল। তবু ভক্তি যেন এখানেও ভয়ের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।
        ভক্তি আরো এগিয়ে এসে দুটো ভাগে বিভক্ত হল। এক, বৈধীভক্তি। দুই, রাগ-অনুরাগ ভক্তি। এর বীজ গাঁথা হল যদিও ভাগবতে ভারতীয় ধর্মে, কিন্তু বিশ্বের নানান ধর্মে ততক্ষণে সুফী, খৃষ্টীয় মরমীসাধনার পথ তৈরি হতে শুরু হয়ে গেছে।
        আমার আলোচ্য এই দ্বিতীয়টা, অর্থাৎ রাগানুরাগ ভক্তি। ভগবানকে ভালোবাসার কথা। নিঃস্বার্থ, ঝুঁকিপূর্ণ, আত্ম-বিস্মরণের মাধ্যমে সেই ঐশী শক্তির সাথে মিলিত হতে অথবা তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করার সাধনা। ভুল বলা হল একটু, ঐশী শক্তি না, ঐশী অস্তিত্ব। অতীন্দ্রিয় অনুভবের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সেই হল জীবনের মূল লক্ষ্য। নইলে মহতী বিনষ্টি - তোমার জীবন ব্যর্থ।
        রামকৃষ্ণদেব বিখ্যাত হলেন কিম্বা অনন্য হলেন, তাঁর বহু চর্চিত কালীদর্শনের ঘটনার জন্য কখনও না। কারণ বহু সাধক বলে থাকেন তারা ঈশ্বরের দর্শন, বাণীর শ্রবণ করে থাকেন। রামকৃষ্ণদেব বিখ্যাত হলেন তাঁর সে ঐকান্তিক, জীবনসংশয়ী ব্যকুলতার জন্য। তারপর মুহুর্মুহু সমাধি অতীন্দ্রিয় সত্তার উপর আস্থা মানুষের মনে আরো বাড়িয়ে তুলল। কারণ ভারতীয় মননে অতীন্দ্রিয় অনুভবের প্রতি ক্ষুধা তীব্র। একজন তো তাঁকে সরাসরি সমাধিটা শিখিয়েই দিতে বলল। কিন্তু এই অতীন্দ্রিয়বাদটা কি?
        মানুষের সত্তার সাথে রোম্যান্টিক অনুভবের ক্ষুধা চিরকাল। সারা পৃথিবীতে তা নানাভাবে মূর্ত হয়েছে। শিল্পে, সাহিত্যে, দর্শনে, সঙ্গীতে, রাজনীতিতে সর্বত্রই সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে এই রোম্যান্টিসিজম এর বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। ধর্মে তার রূপ এলো মিস্টিসিজম হয়ে। মরমীবাদ। ঈশ্বরকে অনুভব করার কথা। তাঁর সাথে একাত্মতা অনুভব করার কথা। মহাপ্রভুর কৃষ্ণ, রামকৃষ্ণের কালী, কবীরের রাম, তুলসীর রাম (উল্লেখ্য, কবীরের রাম পুরাণপুরুষ না, সে নির্গুণ তথা সগুণ সত্তা, নিরাকার, কারণ কবীর অবতার স্বীকার করতেন না। তুলসীর রাম অযোধ্যার। তিনি পুরাণপুরুষ।), রামপ্রসাদের কালী, মীরার কৃষ্ণ - এই মরমীবাদের সৃষ্টি। কেন এই মরমীবাদের সৃষ্টি? কারণ সে তার একার উপভোগ্য। সবার নয়। সে তাঁদের নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি। রামকৃষ্ণদেবের জীবনে একটা গল্প আছে, তিনি মুড়ি খেতে খেতে আলপথ দিয়ে হাঁটছেন, এমন সময় দেখেন সারা আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে যায়, আর সেই মেঘের উপর দিয়ে একসারি বক উড়ে যায়। কালো মেঘের বুকে অমন সাদাবকের কন্ট্রাস্টে যে অসামান্য মাধুর্য তৈরি হয়, রামকৃষদেব তাতে মূর্ছিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনাটাই সাক্ষ্য দেয় একজন মানুষের মন কি অসম্ভব তীব্র অনুভূতিপ্রবণ হলে এটা সম্ভব। যে অনুভূতির মূল হল রোম্যান্টিসিজম। তাই এই দক্ষিণেশ্বরের কালী আর রামকৃষ্ণের কালীর মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। যেমন শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস ফুল গাছপালা নদী ঋতুমালার সাথে রবীন্দ্রনাথের আকাশ বাতাস ইত্যাদির ফারাক।
        একি মিথ্যা তবে? হ্যাঁও বটে, নাও বটে। মানুষের সব চাইতে বড় সীমারেখা হচ্ছে সে কোনোদিন মানুষকে ছাড়িয়ে বেশি কিছু হতে পারবে না। হতে চাইলেই তাকে মিথ্যা হতে হবে। মাকড়সা যেমন নিজের সৃষ্টি জালের মধ্যে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকে। ঠিক তেমন মানুষ নিজের মনের মাধুর্যের মধ্যে নিজেকে নিয়ে মত্ত থাকে। তার বেশি যাওয়ার তার জো নেই। তাই মহাপ্রভুর কৃষ্ণ কোনোদিন নিত্যানন্দের কৃষ্ণ নয়, কিম্বা শ্রীজীব গোঁসাইয়ের নয়, যদিও সেই কৃষ্ণের আভাসে তবু সে কৃষ্ণ নয়। তাই রামকৃষ্ণের কালীও বিবেকানন্দের নয়। বিবেকানন্দ আপ্রাণ চাইছেন আমাদের সেই মরমী অনুভবের মোহ থেকে বাস্তবমুখী করতে। সারাটা জীবন যেন উনি স্থির করতে পারলেন না, রামকৃষ্ণ না বুদ্ধ? নাকি এদের মিলিত রূপে কোনো আদর্শ। দুর্ভাগ্য সেটা স্থির করার আগেই তাঁর জীবনবসান হয়। তবে এখানে একটা কথা উল্লেখ্য, অনূকূলচন্দ্রের অনেক কথা আমি মেনে নিতে না পারলেও এটা অনস্বীকার্য যে উনি এই মোহ থেকে বার করে ধর্মকে একটা সামাজিক সচলরূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন আজীবন। তাঁর ধর্মের সংজ্ঞা হল - পারিপার্শ্বিকের সাথে তোমার নিজের বাঁচা ও বাড়ার প্রয়াসকে ধর্ম বলে। এ দর্শনে উনি সারা জীবন স্থির থেকেছেন এটা বাস্তব। কোনো মানুষই ঈশ্বর ঈশ্বর করে ক্ষেপে উঠলে তাকে দাবিয়ে দিয়ে সমাজমুখী করতে সচেষ্ট হয়েছেন।
        ধর্ম যখনই মরমী তখনই ব্যক্তিকেন্দ্রিক। সমাজ বিমুখ। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ 'কথামৃত'। একজন হাস্পাতাল বানাতে চেয়েছিল তার সঞ্চিত অর্থ দিয়ে। রামকৃষ্ণ তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, জীবনের উদ্দেশ্য ওসব না, ভক্তি লাভ করা। ঈশ্বরের কাছে ভক্তি চাও। ওসব ছাড়ো। এ পথ থেকে ধর্মের সংজ্ঞা বদলাতে চেষ্টা করেও সফল হননি বিবেকানন্দ তার স্ববিরোধী বক্তব্যমালার জন্য। অগভীর হয়ে পড়েছে দর্শনের ভিত। অপরপক্ষে বিবেকানন্দের দর্শনকে কিছুটা কাস্টমাইজ করে মহাত্মা, রবীন্দ্রনাথ, আরো অনেক বিপ্লবী তাদের দেশপ্রেমের জ্যোতি জ্বালতে পেরেছিলেন। কিন্তু সে রামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ নয়। সে স্বাধীন বিবেকানন্দ।
        অবশেষে এই কথাটাই বলা, আজও বহু মানুষ প্রাণান্ত সাধনা করছেন, ছলের আশ্রয়ে সমাজবিমুখ হয়ে বসে আছেন এই ঈশ্বর অনুভবের ঠেলায়। বাউল বলো, সাধক বলো, শিল্পী বলো, সাহিত্যিক বলো সবই আপন মনের মাধুরীতে মত্ত। সে পথের অনুকরণ হয় না। শিল্প সাহিত্যে বাঁচোয়া হল তা শিষ্য বানায় না। কিছু পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় না। যা ফল তা হাতেহাতে। ছবি দেখে তোমার ভালো লাগল, বই পড়ে তোমার ভালো লাগল - ব্যস ওতেই পূর্ণতা। কিন্তু এই যে তুমি অমুক দিকে মুখ করে অমুক শব্দমালা (মন্ত্র) প্রতিদিন ১০৮বার আবৃতি করলে তোমার অমুক অনুভূতি হবে - এতেই গোল পাকলো। কোনো মরমী মানুষের অনুসরণ করে জীবন কাটালে আখেরে জবুথবু হয়ে বাঁচা ছাড়া কোনো পরিণাম দেখি না। সে অনুকরণে সে হয়ত অসম্ভব শান্ত হয়েছে, কিন্তু সে তো তোতাকাহিনীর পাখি হয়ে উঠেছে।
        মন মুক্ত হোক। খোলা হাওয়া লাগুক। এসোটেরিক বা মরমী কোনো পথেই যাওয়ার দরকার কি? রোম্যান্টিসিজম থাকুক স্ব-ভাব অনুযায়ী। না থাকলেও ক্ষতি কি? সংসারে কাজের অভাব নেই। মুখোশের বাড়বাড়ন্ততেই ক্ষতি। মানব সম্পদের ক্ষতি।

426
Tue, 09/26/2017 - 10:00

অপু দিদির সাথে কাশের বনে ছুটেছিল। শরতের সেই দৃশ্যই হয়ত বা বাঙালীর মনে শেষ ডক্যুমেন্টেড শরতের দৃশ্য তার আগে পরে আরো ছিল আর হবেও বা। কিন্তু সেই দৃশ্যটাই আমাদের শরতের সিগনেচার টিউন।
        তারপর বাঙালী শরৎ ছেড়ে হল শারদীয়ার। শারদীয়া শব্দের উৎস যদিও শরৎ, তবু শারদীয়া আর শরতের রইল না। বাঙালীর শরৎ মানে সেপ্টেম্বর আর অক্টোবর। শরৎ কাশ নীলাকাশের মাধুরী ছেড়ে এলো প্যাণ্ডেলের আর আলোকসজ্জার প্রতিযোগিতায়। শারদীয়ার উৎসব ক্রমে ঐতিহ্য থেকে হল ব্যবসায়ীদের তুরূপের তাস। মিডিয়ার হটকেক তুল্য স্টোরি। অনলাইন কেনাকাটার 'বাম্পার অফার'। উৎসব হল উচ্ছ্বাস। হৃদয়বৃত্তি ম্লান হল আবরণ আর আভরণের ঐশ্বর্যবৃত্তির চাকচিক্যে।
        রবীন্দ্রনাথের উৎসবের সংজ্ঞায় - মানুষ মিলিত হয় যে নিমিত্তে। কিন্তু উচ্ছ্বাসের জোয়ারে মানুষ শুধু একত্রিতই হয়, মিলিত আর হয় কই? লাইনে দাঁড়ানো হাজার হাজার মানুষ, এ ওর আগে যেতে চাইছে, এ ওকে ঠেকে গুঁতিয়ে ফেলে মাড়িয়ে পারলে সবার প্রথম প্রতিমার সামনে দাঁড়াতে চাইছে। তারপর? প্যান্ডেলের আভ্যন্তরীণ কারুকার্য, দেবদেবীর অঙ্গসজ্জা, আভরণ, গঠনের কায়দা ইত্যাদিতে চোখ ধাঁধানো বিস্ময় - “হ্যাঁরে কত খরচ করে থাকবে সব মিলিয়ে? কয়েক কোটি তো হবেই, না?” ক্ষুদ্র, সামর্থহীন, লোভ-সমাকুল বাঙালী চিত্তে গর্ব-ঈর্ষা-ক্ষোভের মিলিত আন্দোলন। কিন্তু দাঁড়াবার সময় নেই, আরো প্যাণ্ডেল 'হপিং'-এ যেতে হবে, ফেসবুকের টাইমলাইন ক্ষুধার্ত চোখে তাকিয়ে, বন্ধু-বান্ধব-পরিচিত-অপরিচিতের সাথে ঠাণ্ডা লড়াইয়ের ব্ল্যু হোয়েলে নাম লেখানো - 'আমার দূর্গাপূজা'...'ফিলিং ফেস্টিভ'...ইয়া...হুউউউউ!
        ভোগ পরকে তাড়ায় নিজেকে বাড়ায় - এটা গুরুবাণী। উৎসবের যে মাধুর্য, যে আত্মত্যাগ, যে বন্ধুত্বপূর্ণ উষ্ণ অভ্যর্থনা - বাঙালী তা ভুলেছে। বাঙালী খুব সহজে ভোলে। শুধু কোথায় কতটুকু গর্ব করতে হবে সেটুকু বাদ দিয়ে সে চর্চা থেকে গসিপে অনায়াসে ঢল নামাতে পারে। তার রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-বিবেকানন্দ-সত্যজিৎ ইত্যাদি ইত্যাদি শুধুই ভারতীয় অবাঙালীদের থেকে উঁচু সিটে বসার জন্য, নিজের চর্চার জন্য না। আর বিদেশীদের সামনে তো তারাও খড়কুটো, ওদের দেশের প্রতিভার কাছে আমাদের প্রতিভা! ছোঃ!
        লোভ তাই মূলমন্ত্র এ তথাকথিত উৎসবের। আর লোভের স্বভাবই হল - অসামঞ্জস্য। তারই প্রতিফলন চতুর্দিকে এই ঐতিহ্যমণ্ডিত উৎসবের বুকের রক্তপান করে। সে গান, সে সাহিত্য, সে পাড়ার কাকিমা-জেঠিমা-কাকু-জেঠু-দাদু-দিদারা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে? এত হৃদয়হীন আত্মপ্রচারের ভিড়ে কোথায় নিজের ঠাঁই খুঁজে পাওয়া যায়? দূর থেকে জনসমাবেশ চোখে পড়ল, কাছে গিয়ে দেখি এরা একে অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে খুব কাছাকাছি, যেন বন্ধুত্বের থেকেও কাছাকাছি। তাই ঈর্ষায়, পরশ্রীকাতরতায়, শত্রুতায় যত সহজে আজ বাঙালী মনের বিশ্বাস, ততটা সহজে বন্ধুত্বে, মানবিক স্বভাবজাত সহমর্মিতায় নয়। উদাহরণ - মহম্মদ আলি পার্কের ঘটনা। এত নিষ্ঠুর, আত্মকেন্দ্রিক, স্ব-অবমাননার আড়ম্বর বিশ্বের আর কোথায় কোথায় হয় জানা নেই আমার।
        সব শেষ হলে আসে ট্রেনে ঝোলা, বাসে ঝোলা, নাকে-মুখে দুটো গ্রাস পুরে জীবনযুদ্ধে ঝাঁপানো বিষন্ন, অবসাদগ্রস্থ বাঙালীর দল। যেন খুব শীগগির একটা মধ্যরাতের প্রমোদাগার থেকে জেগে উঠেছে সব। অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর স্নায়বিক উন্মাদনার ভারে দুর্বল বাঙ্গালী শরীর আর ক্লান্তির ভার বহন করতে পারছে না। কিন্তু বাঙালীর অফিসজুড়ে এখন লক্ষ লক্ষ বিদেশী ক্লায়েন্ট। বাঙালী ক্লান্তির হাই তুলতে তুলতে কম্পিউটার অন করতে করতে বলছে, ওয়াটস অ্যাপ করছে - হ্যাপি বিজয়া!
বিজয়ায় কার বাড়ি যাব? কেন যাব? কেন মরতে মরতে নাড়ু বানাবো, মিষ্টি বানাবো? ওদের কাজ ছিল না, বোকা ছিল বলে সারাদিনরাত পাগলের মত খেটে ওসব ছাইভস্ম বানাতো আর বারোভূতে গেলাতো। কেন রে বাবা, মিষ্টির দোকানগুলোতে আছে। স্ন্যাক্স-এর ভ্যারাইটির তো বাজারে অভাব নেই! অগত্যা কিছু সিদ্ধি, কিছু ভাং এখনও কোথাও কোথাও টিকে থাকলেও স্ব-মহিমায়, বিজয়ার আপন করার দিন গেছে। সেদিক থেকে আমরা অনেকটা অকপট হয়েছিই বলা চলে। হৃদয়ে যে সৌহার্দ্য আর নেই, অকারণ বাইরে তার প্রদর্শন করে লাভ কি? একান্তই যদি না তাতে আমার বৈষয়িক কিম্বা মর্যাদার কোনো উন্নতির সম্ভাবনা থাকে? যদি থাকে, তখন মেরুদণ্ডের নমনীয়তা প্রদর্শন আমাদের কাছে শিখে যেও, তখন আমার বারোমাস বিজয়া। তা বলে অমন হাড়-হাবাতে মাসিমা জেঠিমার বাড়ি যাব কেন? কি এমন করে ওর ছেলেরা? যত্তসব!
        ক্লাব থাকুক, পার্টি থাকুক, চাঁদার জুলুম থাকুক (জুলুম না, আবদার যদিও ওটা সাংবিধানিক পরিভাষায়), ভুরিভোজ থাকুক সব থাকুক। শুধু এতকিছুর মধ্যে আমার ভিতরের 'আমি'টা কিছুতেই আর 'আমরা' হওয়ার সুযোগ পেল না, এই ক্ষোভটাও থাকুক। নইলে ভবিষ্যতে আলো জ্বালবার জন্য শেষ সলতেটাও তো হারাবো!

 

 

 

 

427
Sat, 09/23/2017 - 11:34


"Reformation of society in line with 'BARANASHRAMIC (বর্ণাশ্রমিক)' tradition, creation of a state and then a world's state without the so called Democratic system"
'অর্থাৎ আমরা আমাদের বর্ণভেদ ব্যবস্থার আস্থায় তোমাদের তথাকথিত গণতন্ত্রের বিশ্বাসকে হটিয়ে নতুন পৃথিবী গড়ার শপথ নিচ্ছি। এটাই আমাদের লক্ষ্য।'

        উপরোক্ত বাক্যগুলো কোনো প্রাচীন পুঁথি থেকে নেওয়া নয়। বর্তমানের একটা অত্যন্ত প্রসিদ্ধ ধর্মীয় সংগঠনের ওয়েবসাইটের প্রথম পাতায় সুসজ্জিত করে লেখা। যে সম্প্রদায়ের সাথে জড়িত আছেন অত্যন্ত প্রথিতযশা সাহিত্যিক 'মানবজমিন' এর শ্রদ্ধেয় লেখক মহাশয়।

        অর্থাৎ গণতন্ত্রের যে মূল বিশ্বাস, প্রতিটা মানুষ সমান আর তার সমান অধিকার - এক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। প্রতিটা মানুষ সমান নয়, মেধার যোগ্যতায় সে বিজ্ঞানও মানে। কিন্তু প্রতিটা মানুষ সমান নয় বংশের প্রেক্ষাপটে? না মশায়, বুঝলাম না।
মজার কথা হচ্ছে, এই কথাটা প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ তার অনুগামীও হচ্ছেন।



কাল জানলাম যে চিকিৎসককে অসুর সাজিয়ে দেখানো হয়েছে কোনো পূজামণ্ডপে। খারাপ লাগত না, যদি পাশাপাশি বাকি সব পেশার অসুরদের পুতুল রাখা থাকত। কারণ অসুরহীন এমনকি সাধকমহলও যে নয় তার প্রমাণ বহুজন শ্রদ্ধেয় জেলনিবাসী বাবাজীরা তো আছেনই। তবে শুধু চিকিৎসক কেন? পাব্লিক সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়িটা বেশি লাগবে বলে? মানুষের অজ্ঞতা আর স্বল্পদর্শীতার মত পুঁজি বড্ড কম। তাতে ঢেউ তোলা যায় আর খুব সহজেই। অগত্যা খোঁচাও..খোঁচাও..যে যত কম বোঝে, সেই বেশি ক্ষেপে ওঠে, তাকে ক্ষ্যাপাও ক্ষ্যাপাও। সমস্যা আমাদের রাজ্যে চিকিৎসা সংক্রান্ত কিছু একটা নিশ্চই আছে। নইলে এত ক্ষোভ, এত আলোচনা, এত লেখালেখি, ভিনরাজ্যে কাতারে কাতারে চিকিৎসা শরণার্থী হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি সব ঘটে না, মানছি। কিন্তু একটা পেশাকে এভাবে কলঙ্কিত করে দেখানো তা বলে? কেন বাকি ক্ষেত্রগুলোতে আমরা বুঝি ভারতের এক নম্বর রাজ্য বলে ভূষিত হয়েছি?

        উপরের দুটো ঘটনার মিল কোথায়? মিল তো আছেই। রবি ঠাকুর একবার মেয়েদের শিক্ষায় যখন সমাজ বাগড়া দিচ্ছিল, বলেছিলেন, আমরা এমন একটা পাখি বানাতে চাইছি যার ডানাদুটো সামনে ওড়াবে আর পা'দুটো পিছনের দিকে টানবে।
বিজ্ঞান বলতে জীবনবিজ্ঞান, ভৌতবিজ্ঞান ইত্যাদি বোঝানোর আগে যেটা বোঝায় - বিশেষ রূপে জানা। সে চর্চাটা হচ্ছে কোথায়?
        তুমি তোমার বিশ্বাসে, মতে অনড়, অটল, অচল থাকতেই পারো। চোখ বন্ধ করে মূর্খের স্বর্গে বাঁচতে তোমায় কেউ কোনোদিন আটকাবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, তোমার সামনে যেদিন পরের প্রজন্ম প্রমাণ চাইবে যাতে সে নিজেও সে বিশ্বাসের বৌদ্ধিক সমর্থন খুঁজে পায়, সেদিন তুমি কি বোঝাবে? বলবে পশ্চিমবঙ্গের সব চিকিৎসক কসাই ছিল? আরেক পক্ষ বোঝাবে দেশটা বর্ণাশ্রম না মেনে রসাতলে গেল? বুঝবে সবাই?
        ব্যক্তিগত আক্রমণ করে ফেললাম? হয়ত বা। কিন্তু কি করব বলো, তোমাদের বাড়ির ভিতরে এটুকু অন্ধকার মেনে নিতে পারতাম, তোমার সে অন্ধকারের মহোৎসবকে তুচ্ছ করেও দেখতাম হয়ত বা, কিন্তু তুমি যখন মানুষের অজ্ঞতা আর স্বল্পদর্শীতাকে পুঁজি করে ব্যবসা ফাঁদতে চাও, স্বার্থসিদ্ধি চাও, তখন তা কি আর ব্যক্তিগত থাকে বাছা? তোমার বাগানের টক আম তুমি খাওগে, বাজারে জনগণে বিলাবে আর বলবে ওছুধ, ওছুধ...অমনি আমিও চিল্লাবো..ওরে খাইসে নে রে.. খাইস নে!

 

428
Fri, 09/15/2017 - 13:30

আদৌ কোনটা সমস্যা আর কোনটা সমস্যা না, সেটা বোঝাই একটা জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনটা তৈরি করা হয়েছে আর কোনটা নিজে থেকেই একটা সমস্যার রূপ নিয়েছে সেটা বড্ড গোলমেলে ব্যাপার। যেমন রোহিঙ্গা সমস্যাটা কিছুটা তৈরি করা আর বাকিটা ঐতিহাসিক জটিলতা। জল ঘোলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মহল যতটা উদ্বিগ্ন হওয়া দরকার তা হয়ে উঠছে না। এ ওকে, সে তাকে দোষারোপ, চাপসৃষ্টি ইত্যাদিতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। এমনকি যথেষ্ট পরিমাণ ত্রাণের আয়োজনও হয়ে উঠছে না। ওদিকে এর সাথে যোগ দিয়েছে জঙ্গি সংগঠনের হুমকি। সারা পৃথিবীতে একটা বড় মহলে মুসলিম বিদ্বেষপরায়ণতার বাতাবরণ চলছে। যার মূল কারণ অবশ্যই মুসলমান ধর্ম আর সন্ত্রাসবাদকে এক করে দেখা। যে অভিযোগ রোহিঙ্গাদের উপরেও ন্যাস্ত করা হচ্ছে। কিন্তু মোট কথা একটা জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ চূড়ান্ত মানবিক বিপন্নতার মুখোমুখি যার জবাবদিহি নোবেলজয়ীকে ইতিহাসের কাছে করতে হবে। কারণ এত মানুষকে বিপন্ন করে, বঞ্চিত করে উন্নতির পথে যাওয়া যায় না, ইতিহাস সাক্ষী। তাদের বড় যুক্তি, তাদের এই নতুন স্বাধীনতায়, সদ্যজাত অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বিষম বাধা এই রোহিঙ্গারা। বৌদ্ধরা নয়। তবে এ বৌদ্ধ সেই অহিংস বৌদ্ধ নয়।
        আমাদের দেশে তৈরি হচ্ছে একটা অস্পষ্টতা। সমস্যাটা ঠিক কোথায় আমরা যেন বুঝেও বুঝতে চাইছি না। আমাদের অবস্থা অনেকটা সেই প্রভু আর তার সাধের পোষা সারমেয়টার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভু বিকালবেলা মাঠে গেলেন, সাথে সারমেয়টাও গেল। প্রভু একটা বল পুব দিকে ছুঁড়লেন, সারমেয়টা দৌড়ে গিয়ে সে বল নিয়ে এলো। প্রভু একে একে পশ্চিমে, দক্ষিণে, উত্তরে ছুঁড়ে গেলেন আর সারমেয় তার ল্যাজ নাড়তে নাড়তে সেদিক থেকে বল এনে দিতে লাগল। এমনকি মাঠের যে সমস্ত স্বাধীনচেতা সারমেয়ের দল ছিল তারাও এই বল আনা নেওয়া দেখতে দেখতে মূল সমস্যাগুলোর কথা ভুলে, বলের সমালোচনা, ছোঁড়ার কৌশলের সমালোচনা, সারমেয়ের প্রভুভক্তির সমালোচনাতে এমন মেতে গেল যে বাকি কথা কেই বা শোনে, কেই বা বোঝে আর কেই বা বলে।
        আমাদের হঠাৎ করে বোঝানো হচ্ছে - তোমরা হিন্দু। তোমাদের একটা জাত্যাভিমান আছে। মানে থাকা দরকার। তোমাদের বিবেকানন্দ বলে একজন ছিলেন, যিনি না থাকলে আজ হিন্দু বলে যে অস্তিত্ব আছে তা ধুলিস্যাৎ হয়ে যেত। তোমাদের মনে রাখতে হবে যে তুমি যখন নিজেকে হিন্দু বলে ভাবতে শুরু করবে অবশ্যই তোমার কিছু প্রতিদ্বন্দী থাকবে যারা হিন্দু নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো তৈরি করা সমস্যা। ভাবগত সমস্যা। এখন মুশকিল হল ভাবগত কৃত্রিম সমস্যার কোনো সীমারেখা হয় না। 'রাজার অসুখ' যে কারণে কোনো বৈদ্যের হাতে সারে না। সত্যকারের সমস্যার একটা সমাধান আছে তার সীমারেখাও আছে। তার বিধান বেরোবার সাথে সাথে তা অন্তর্হিত হয় শুধু না তা সমাজকে একটা নতুন পথে আর খাতে পরিচালিত করার ক্ষমতা রাখে। সতীদাহ প্রথা রদ হতে শুধু বিধবারাই বেঁচেছেন তা নয়, মেয়েদেরও যে একটা নিজস্ব অধিকার আছে বেঁচে থাকার, সেটাও তারা অনুভব করেছে। তারা জেনেছে, তাদের এ দুঃখটা তাদের একার ব্যক্তিগত দুঃখ নয়। এতে বিশ্ববাসীর প্রাণ কেঁদেছে। তার একার কান্না, একার অসহায়তা দেশের, বিশ্বের মানবিক আত্মাকে নাড়া দিয়েছে। এও নবজাগরণের একটা বড় ধাপ হয়ে দেখা দিয়েছে সেদিন। কোনো সত্যকারের সমস্যার সমাধান বের হলে, তাই বলছিলাম, সে একটা নতুন আলো নিয়েই আসে।
        আমাদের অনেক সমস্যা আছে। তার পরিমার্জনের পথ না দেখিয়ে বর্তমানে তা আবরণের আড়ালে পড়ছে। বিশ্বের প্রথম দেশগুলোর সাথে আমরা হঠাৎ করে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছি। কিন্তু সে প্রস্তুতি কোথায়? আমাদের হঠাৎ যেন সেই 'অসময়ে ডাক পড়েছে, কেন যে তা কেই বা জানে' মতন দশা। অধুনা ভারতীয় অর্থনৈতিক সংস্কারের সাথে আমার একটা ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা মনে পড়ছে। সংসারে যে কয়টা বস্তুর উপর আমার আকর্ষণ আছে, তার মধ্যে বইয়ের পরেই আসে হাতঘড়ি। তা দামী হতে হবে এমন কোনো কথা নেই, কিন্তু হাতে না থাকলে অস্বস্তি অনুভব করি (সাথে বই না থাকলেও করি। তাই পড়ি না পড়ি একটা বই সাথে থাকলে নিজেকে সনাথ লাগে)। তো আমার এক ভাই তথা বন্ধু এই প্রেমবশতঃ আমাকে একটা বেশ দামি ঘড়ি উপহার দিল। মুশকিলটা হল তার ডায়ালটা এতটাই বড় যে সে আমার থেকে বেশি দ্রষ্টব্য হয়ে উঠল। আমার চলতে ফিরতে মনে হতে লাগল আমার সমস্ত সত্তাজুড়ে একটা বিশাল ঘড়ি। কারণ সেটা আমার হাতের স্বাস্থ্যের সাথে বেমানান।
আজ আমাদের এই ডিজিটালায়ণ থেকে বুলেট ট্রেনায়ণ সবই কেমন রোগা হাতে প্রবল ঘড়ি সদৃশ্য ঠেকছে আমার কাছে। এত ভার নিতে পারবে তো? মোড়কে হয়ত আমরা বিশ্বের প্রথম দেশের মতন দেখতে হলাম, কিন্তু কেউ যদি প্যাকেট খুলে বসে? তাও নয় প্যাকেটের বাইরের স্তরে দামি দামি বস্তুতে সাজিয়ে রাখলাম, তাতেও যদি কারো মন না ভরে? সে যদি আরো গভীরে হাত দিতে চায়? আরো অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে। দেশের লোকদের না হয় বলব “ছুঃ... ওদিকে... ওই যে ধর্ম বাঁচাও... ধর্মে এসো... শোনো কি বলেছেন বিবেকানন্দ...”। কিন্তু সব লোক তো শুনবে না। কিছু লোক তো লঙ্কেশেদের স্মরণসভায় যাবেই তাদের কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ বা উদ্দেশ্য না থাকলেও। আর এ জাতটা তো চুপ করে থাকার নয়। এরা ধর্ম নির্বিশেষে রাস্তায় হেঁটেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চীৎকার করে গলা ফাটিয়েছে। ইদানীং কলকাতায় যে একটি বিশেষ ধর্মের জন সমাবেশ দেখা গেল রোহিঙ্গাদের অত্যাচারের জন্য তাদের কিন্তু বিগত সব এত নৃশংস জঙ্গি হামলায় জড়ো হতে দেখিনি আমি এমন প্রবলভাবে।
        ভারতীয় হিন্দুদের একটা অংশ গোঁড়া হলেও সামগ্রিকভাবে তা নয়। তাই যে কোনো জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রতিবাদের সাক্ষী ভারতের পথ মাঠ ঘাট হয়েছে। "বিশ্বের সকল হিন্দুভাইয়েরা শান্তিতে থাক"... এরকম একটা প্রার্থনা আমাদের কানে লাগে, অন্য অনেক ধর্মের কানে না বাজলেও।
        অনেকে ভাবেন এটা আমাদের দুর্বলতা, নিজের ধর্মের প্রতি অনানুগত্য, অনাস্থা, ঔদাসীন্য ইত্যাদি। কিন্তু আমার মনে হয়, হিন্দুধর্মই হিন্দুর ধর্মকে ছড়িয়ে এগিয়ে যেতে বেশি উৎসাহিত করেছে। কারণ হিন্দু ধর্মকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়নি, হিন্দু ধর্মকে নিত্যনতুন আবিষ্কার করতে চেয়েছে। তাই হিন্দুধর্মে অসংখ্য অবতারের বিশ্বাস আছে। তারা আবিষ্কার করবেন, মেনে নিতে বলবেন না। সে ধর্মে ঈশ্বরও শেষ কথা নয়, সে ধর্মে শেষ কথা 'মঙ্গল'। একের মঙ্গল না, 'বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়'।
এইখান থেকেই আমি মোড় ফেরাতে চাইছি আমার আলোচনার। বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজনীতিকে আজ এই ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠা না করলে বিপদ – 'বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়'। সত্যি আমাদের আজ প্রচুর সমস্যা। বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তগুলোই সর্বত্র পোঁছে উঠতে পারিনি এখনও। তাদের অসীম সহ্যক্ষমতা, অভিযোগহীনতা, আত্ম-অধিকার সম্বন্ধে অজ্ঞতার উপর যদি এই মোড়ক সংস্কার দাঁড় করাতে চাই তবে যে একদিন সমূলে ধ্বসে পড়বে সব। সে ভার কে বইবে? সেদিন হয়ত মসনদে আরেক রাজা, কিন্তু সে ক্ষতিপূরণের ভার তো বইতে হবে লক্ষকোটি শান্তিপ্রিয় এ সাধারণ মানুষের প্রবাহকে। আমাদের বর্তমানে মহাপুরুষদের ভুললে ক্ষতি নেই। তাদের কথাগুলো ভুললেও ক্ষতি নেই। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তারা জীবনধারণ করেছিলেন সেই জীবনীটা ভুললে বিপদ। কোনো মানুষের বিক্ষিপ্ত বাণী ভুল ধারণা তৈরি করতেই পারে, কিন্তু পুরো জীবনটা জানা থাকলে জীবনের মূল সুরটা বোঝা যায়। আর তখনই কোন কথাটা মুখ্য আর কোন কথাটা গৌণ সেটা বোঝা সহজ হয়ে পড়ে।
        সেগুলোকে উপজীব্য করেই প্রধান সমস্যাগুলোর দিকে চোখ ফেরানো যাক। শিক্ষার মানের একটা যথার্থ সাম্যতা আসুক সারাদেশে, স্বাস্থ্যের ন্যূনতম সুবিধাগুলোর আওতায় আসুক দরিদ্রতম মানুষটা, বেকারত্বর সমাধানের কথা আরো সিরিয়াসলি ভাবা হোক, পানীয় জল, পায়খানা বাথরুম, আবাস প্রকল্প আরো ঠিকভাবে মনিটরিং করা হোক। দেশের বড় বড় অর্থনীতিবিদদের গায়ে রাজনৈতিক রঙ না বুলিয়ে, অতীতের গৌরবের মোহ ছেড়ে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান আরো কিসে মসৃণ করা যায় সেগুলো ভাবা হোক। স্বাস্থ্য মজবুত হলে যেমন অনাক্রম্যতাও বেড়ে যায়, তেমনি তখনই আমরা ওই সব মোড়ে মোড়ে, ফটোতে ফটোতে অস্তিত্বসংকটে ভোগা মহাপুরুষদের সাচ্চা উত্তরসূরী হব। ব্যাসদেবের উত্তরসূরী নিশ্চই রামরহিম বা আশারাম বেরোবে না সেদিন।

 

429
Sun, 09/10/2017 - 13:30

বর্তমানে কর্পোরেট গুরুমহলে সদগুরুর নামটা বহুল পরিচিত। জাগ্‌গি বাসুদেব। তার দাবী তিনি আলোকপ্রাপ্ত পুরুষ। তিনি মানবকল্যাণে নিয়োজিত। সে কল্যাণে বহুল অর্থ-বিত্ত-নেতা ইত্যাদির যোগ। একজন বরিষ্ঠ সাংবাদিক তাকে রামরহিম, আশারাম ইত্যাদি ধর্মগুরুদের বিষয়ে মতামত জিজ্ঞাসা করেন। তিনি উত্তর করেন, তাদের আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, মিডিয়ায় আমার বিশ্বাস নেই, আমি নিজের অনুভবের বাইরে কিছু বলি না, আর দেশের আইনের পথে তারা শাস্তি পাবেন।
        খাসা যুক্তি। কিন্তু কথা হচ্ছে 'ব্যক্তিগত অনুভব' -এর ক্ষেত্রটা কতটা? সে কি অলৌকিক মার্গের? যে কে কোথায় কি 'সু' অথবা 'কু' কীর্তি করছে তা সেই অলৌকিক যোগবলে না জানা অবধি নীরব থাকতে হবে? আর মিডিয়াকে বিশ্বাস না করলে তার নিজের এত মিডিয়া নির্ভর কাজকর্ম কেন? অবশ্য ওনার মতে মিডিয়া ওনার পিছে ধায়, উনি নন। সে কথা থাক, তবে কি ইঙ্গিতটা এরকম যে আশারাম, রামরহিমে মিডিয়া রঙ চড়িয়েছে?
        আমাদের সমস্যাটা এখানে। সদগুরুকে নিয়ে চর্চা করার জন্য এ লিখতে বসিনি। আজ অর্থাৎ রোববার ১০ই সেপ্টেম্বরের আনন্দবাজারে আরেকটা খবর আছে যে বিবেকানন্দকে এতদিন বস্তুবাদের আবরণে ঢেকে তার ভাবমূর্তির সর্বনাশ করা হয়েছে, অগত্যা তার 'হিন্দুনেতা' ইমেজটাকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। তার প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গেছে। এরকম যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে বেশ কিছুদিন আগে স্পষ্ট লিখেছিলাম বিবেকানন্দ সম্পর্কিত একটা পোস্টে। আজ পূর্ণাবয়বে সে মূর্তিটা ধরা দিল। আজ আর ইঙ্গিত না, ঘোষণা।
        বিবেকানন্দ কি হিন্দুনেতা ছিলেন? ছিলেন। স্পষ্ট উত্তর। তবে সেটি তার একমাত্র পরিচয় যে নয় তা বলা বাহুল্য। তার মধ্যে স্ববিরোধ কি নেই? প্রচুর আছে। তাতে তার প্রতিভার কিছুমাত্র মান ক্ষুন্ন হয় না। কারণ সেদিনের বাতাবরণটার দিকে চোখ রাখলে, সেদিন ভারতের পক্ষে জাগবার একটা মূল অস্ত্রই ছিল হিন্দুধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে জাতটাকে আবার জাগিয়ে তোলা। রামমোহনের বেদান্ত নির্ভর জাগরণ, এক ঈশ্বরের উপাসনার প্রচলন থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান, প্রবন্ধ, কবিতা অবধি সে ঢেউ বর্তমান। গান্ধীর ক্ষেত্রেও তাই। অরবিন্দও সেই পথেরই পথিক। তবে গান্ধী-অরবিন্দ-রবীন্দ্রনাথের হিন্দুধর্মের থেকে বিবেকানন্দের হিন্দুধর্ম কিছুটা আলাদা। রবীন্দ্রনাথের হিন্দুধর্ম ধীরে ধীরে 'মানুষের ধর্ম' হিসাবে পরিণতি লাভ করে। বোধহয় ভারতের প্রথম প্রতিভা যিনি 'আন্তর্জাতিক মানসে' আমাদের চিত্তকে ডেকেছিলেন। আধুনিক চিন্তা বলতে তা পাশ্চাত্যের অনুকরণ নয় কিম্বা আমাদের ধর্মের যুগসঞ্চিত কুসংস্কারের আধুনিক ব্যাখ্যাও নয়। তা আমাদের ভিতরের দেশ-কাল অতীত যে মনুষ্যত্ব তার নিরিখে জগতে কর্মযজ্ঞে নামার আহ্বান। অমর্ত্য, সত্যজিৎ, নন্দলাল, জগদীশ, সত্যেন বোস ইত্যাদি নানা আধুনিক ভারতের রূপকারের জীবন মননের সাথে যুক্ত সে পরীক্ষাগার - শান্তিনিকেতন। কোনো মঠ-মিশন থেকে তারা জন্মাননি, কিম্বা প্রগতিশীল চিন্তায় খুব প্রভাব সেই ধর্মীয় সংগঠনগুলো ফেলেছিল বলেও আমার অন্তত জানা নেই।
        তবে বিবেকানন্দ যে যুক্তিশীল হওয়ার জন্য, সেবামূলক কাজে ব্রতী হওয়ার মাধ্যমে ধর্ম অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছিলেন শুধু না, হিন্দুধর্মের একটা সার্বভৌম দর্শন আছে - এই সত্যটা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে আমাদের দেশের সেই সময়ের আত্মবিশ্বাসে যে প্রবল একটা অনুপ্রেরণার জোয়ার এনেছিলেন সে কথা অনস্বীকার্য। সে আত্মবিশ্বাস ক্রমশঃ ধর্মের ক্ষেত্র ছেড়ে দেশপ্রেম তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে সাংঘাতিক ঢেউ তুলেছিল। সি রাজাগোপালাচারীর অনেক লেখায় এর বিবরণ আছে। তাছাড়া গান্ধী, নেতাজী, রবীন্দ্রনাথ সকলেই এ কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন দেশের ভিতর এই জেগে ওঠার কেন্দ্রবিন্দুটাকে জাগিয়েছিলেন বিবেকানন্দ তার ধর্মের ধ্বজা উড়িয়ে। আসলে সেদিন আমাদের একজোট হওয়ার জন্য এছাড়া কোনো পথ ছিল না। তবে সে কথা সম্পূর্ণ সত্যিও নয়। আমাদের দেশে নানা জীবন দর্শন, আদর্শ, নানা পরীক্ষার মাধ্যমে যে একটা বিশাল বৈচিত্র্যময় সমাবেশ তৈরি করেছিল, যাকে আমরা 'হিন্দুধর্ম' নামে একত্রে চিহ্নিত করতে চেয়ে আসছি, তা কেবল বর্বরতা, আর সতীদাহ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে অবিচার হবে। এই মাটিতে 'ভূমা' থেকে শুরু করে 'সর্বে সুখী ভবন্তু' ইত্যাদি নানা প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছিল, যা একদেশী নয়। উপনিষদ তথা নানান ধর্মীয় সাহিত্যে মানবতার এমন উচ্চ-উদার আদর্শের কথা শোনানো হয়েছিল যা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। সে কথাই ধ্বনিত হয়েছিল বিবেকানন্দের কণ্ঠে শিকাগো ধর্ম মহাসভায়।
        তবে মাটির যেমন উর্বরতা হ্রাস পায়। তাকে পুনরুজ্জীবিত করতে নানা প্রকল্প লাগে, বিশেষ চরিত্রের গাছ বুনতে হয়, তেমন ধর্মের ক্ষেত্রেও। ধর্মের উদারতা, জীবনীশক্তিও হ্রাস পায় কালের গতিতে। কোনো মহাপুরুষের জীবনে তা আবার পুনর্জন্ম লাভ করে, আবার মানুষকে বেঁচে থাকার সদর্থ শেখায়। হিংসা, ক্ষুদ্রতা, লোভ থেকে মুখ ফিরিয়ে বৈচিত্র‍্যের মধ্যে সহাবস্থানের পথ দেয়। নানক, কবীর, দাদু, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, শিরডির সাঁই - এনারা সেই গাছগুলো যারা ধর্মকে আবার নিজের জীবনে ধারণ করে দেখিয়েছেন, ধর্মগ্রন্থের পাতার সাথে মিলিয়ে নয়, বিবেকের সাথে সদ বিবেচনার আলোকে। মানুষ প্রাণ পেয়েছে, জেগে উঠেছে। পোলিটিকালি কারেক্ট হয়ে উদারতার ঘোষণা আর প্রাণের কেন্দ্রে বিশ্বনিখিলের সাথে যুক্ত হওয়ার আনন্দে সবাইকে নিজের জানার মধ্যে যে বিপুল পার্থক্য বলতে দ্বিধা নেই সে ধর্মের মাধ্যমে চিরটাকাল মানুষ পেয়েছে। যেখানেই পায়নি সে ধর্মের সাথে নিজেকে ব্যর্থ করেছে।
         আজ সে ধর্মের স্থান নিয়েছে বিজ্ঞান। যাই অন্ধকার দূর করে তাই ধর্ম। গুরুর অর্থ যিনি অন্ধকার দূর করেন। তবে কোন বিজ্ঞানীকে আমাদের গুরুর সংজ্ঞার বাইরে রাখতে পারি? কোন বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য লেখক যারা মানব হৃদয়ের গভীর রহস্যের কিনারা দেখিয়েছেন তাদের এই সংজ্ঞার বাইরে রাখতে পারি? কাউকে পারি না। আর ভয়টাও সেখানেই।
        ভারতের একটা স্বভাব আছে - আত্মমোহে বাস। যে কারণে সে বারবার বিদেশী শত্রুর হাতে পরাজিত নিগৃহীত হয়েছে। আজ সে আবরণে ঢাকার পুনঃপ্রচেষ্টা দেখতে পাচ্ছি। বিচ্ছিন্নতার মধ্যে নিজের সত্তা খোঁজার চেষ্টা ভারতে আগেও হয়েছে। জাতের কঠিন নিয়ম, আচারের অমানবিক বাড়াবাড়ি সে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার কৃপণ কৌশল। এতে চিত্তের ক্ষুদ্রতা, বিকারই বাড়ে। মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আবার জড়ত্ব আসে। নিজেকে কিম্ভূত জগতের অধিবাসী করে সারা জগতকে ম্লেচ্ছ তকমায় ভূষিত করে আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। কিন্তু অবশেষে আমরা একটা বিচ্ছিন্ন প্রাণীগোষ্ঠী হয়ে বিশ্বে দরবারে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারাই। সেটাই ভয়ের। যে অস্ত্র এককালে কাজে লেগেছিল তাকে মিউজিয়ামে শোভা পায়। কিন্তু আজ যদি তাকে বাইরে এনে আবার একটা কৃত্রিম যুদ্ধ ঘোষণা করে, কৃত্রিম দেশপ্রেমের বন্যা জাগিয়ে একটা মোহ তৈরি করে ঘোলা জলে মাছ ধরার কৌশল ফাঁদি তবে আখেরে তা দেশের দশের পক্ষে অমঙ্গলই ডেকে আনে। শ্রদ্ধার বস্তু আর কাজের বস্তু এক সবসময় হয় না। প্রথম যে মাইক্রোস্কোপে কোষের আকার অনুধাবন করা হয়েছিল, তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা রেখেই আমরা ইলেকট্রণ মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করি। কিন্তু আজ যদি কেউ সব ইলেকট্রণ মাইক্রোস্কোপ সরিয়ে সেই প্রাচীন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে আসার প্রয়াস পাই? তবে যে সমূহ ক্ষতি? আর যেখানে সেই বীজটা আমাদের রক্ত থেকে নির্বাসিত হয়নি এখনও। এখনও আমরা ধর্ষক গুরুর হাত ধরে পরকালে যাওয়ার পথ খুঁজি। বাস্তবকে অস্বীকার করে নিজের তৈরি এই আত্মসম্মোহনসৃষ্টিকারী সংস্কৃতিতে যে ভীষণ ভয় পাই।
        একটা ঘটনা বলে শেষ করি। বাবাকে যেদিন হাস্পাতালে ভর্তি করে মধ্যরাতে ফিরছি কলকাতা থেকে, সেদিন একটা বেলুড় মঠ সংক্রান্ত পোস্ট করে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলাম। মেসেঞ্জারে, কমেন্টস বক্সে অনেক আক্রমনাত্মক, আমার ভ্রমনিবারক মেসেজ পাই। যার মোদ্দা কথা ওনারা অত ভালো ভালো কাজ করেন, আপনি তার উল্লেখ না করে এইসব লিখছেন কেন? মনটা সেদিন দুর্বল আমার। মনের কোনায় একটা অল্প ভয় এলো ক্ষণিকের জন্য, বাবার এমন সংকটজনক অবস্থা, এমত অবস্থায় আমার কি উচিৎ হচ্ছে এমন ধর্মীয় স্থানের প্রতি কটাক্ষ করা? দুর্বল মনের বিকার যা করে তাই হল। মাকে হারানোর জন্য একজন ধর্মগুরুর শিষ্য আমায় বলেছিলেন, আমি অমুক মতে দীক্ষা না নেওয়ার জন্যই এই পরিণতি ইত্যাদি। আমার আরো ভয় করল।
        রাত আড়াইটে নাগাদ আমার বাড়ির সামনের মাঠে গাড়ি আমায় নামিয়ে চলে গেল। আমি মাঠে বসলুম। মাথার উপর চাঁদ উঠেছে। চারদিক ঘুমন্ত নিস্তব্ধ। আমার হঠাৎ মনে হল জীবনে কাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এসেছি - ভয়কে না সত্যকে? মন বলল, সত্যকে। তবে যা নিজে দেখেছি, অনুভব করেছি, সাক্ষী থেকেছি, অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত হয়েছি, তাকে অস্বীকার করে কোনো 'বিশাল' কাজের মোহে কেন সত্যভ্রষ্ট হব? হলাম না। মনে হল যা হয় হোক, যদি সত্যি কোনো মহান শক্তি আমার ক্ষতি করেন, করুন; জানব তিনি আর যে হন সত্য নন। যা ক্ষতি হয় হোক, সত্যভ্রষ্ট হলে সব হারাব। সেই আমায় শক্তি দিল। সারাটা বিশ্বের সাথে নিজের যোগসূত্র পেলাম। সেই-ই মঙ্গল যা সত্যে প্রতিষ্ঠিত। তাই ধর্ম। তার কোনো গ্রন্থ হয় না। তা মানুষ তার চেতনার জন্মলগ্ন থেকেই পায়। সেই ভরসা। সেই আশা। ভয়ে না, মানুষ এগোয় সত্যের আলোকে, বোধের আলোকে।

430
Fri, 09/08/2017 - 17:00

মানুষের চাহিদার শেষ নেই। ধন,মান,যশ ইত্যাদি ইত্যাদি। কত কত মহাপুরুষেরা সাবধান করে গেলেন যুগ যুগ ধরে, 'ওরে অত চাস নে, চাস নে', তা কে শোনে কার কথা! আমিও শুনিনা, তুমিও শোনো না, রাম শ্যাম যদু মধু কেহই শোনে না।
        কথা হচ্ছে মাটি চাই, না ধূমকেতু চাই। এ কেমন কথা হল, ধূমকেতু কি একটা চাওয়ার জিনিস? তা বটে। কিন্তু তবু চাই যে। তা এই ধূমকেতু বস্তুটি কি? খ্যাতির ইচ্ছা গো। একটু কাব্য করে বললুম আর কি। এখন খ্যাতির ইচ্ছা কার না করে? ভালো রাঁধলে, লিখলে, গাইলে, নাচলে, অ্যাক্টো করলে, ফটো তুললে, ছবি আঁকলে, খেললে ইত্যাদি রে ইত্যাদি...বাপ রে হাঁপ ধরে গেল! তা এইসব কিছু করলে লোকে 'ভালো হয়েছে...ভালো হয়েছে' বললে মনের মধ্যে কেমন একটা গোলাপী রঙের ধোঁয়া ধোঁয়া নেশা ধরে না? বেশ ধরে। ওটিই তো হল অহং এর গায়ের রঙ গা। যখন ও খুব খুশী হয়, তখন অমন গোলাপী রঙের হয়ে যায়। আর কোনো কারণে যদি রেগে গেল, বা অসন্তুষ্ট হল, মাগো মা, এমন ধারা ফুঁসবে না। গা পুরো লালে লাল! হুম! সে যাকে পারে তাকে আঁচড়ায় তখন, এমনকি বাগে কাউকে না পেলে নিজেকেও। আরে হ্যাঁ, নইলে বলছি কি। উফ্‌, রাতের ঘুম কাবার, খাবার হজম হয় না, বাহ্য দুব্বল হয়ে তরল, কানের ভিতর গরম হাওয়া, গালের উপর তপ্ত তাওয়া, আর মাথার মধ্যে পার্লামেন্ট। এ বসে তো ও ওঠে, ও ওঠে তো সে বসে। বাপ রে বাপ! আর বাপ, সেও কি এসব ঝ্যালেনি গা, খুব ঝেলেছে।
        তো এই হল যশের চাহিদা। যশ মানে শুধু নোবেল, ভারতরত্ন, অমুক তমুক পুরষ্কার কইতাসি না, যশ মানে হইল গিয়া, আমি যে আছি সে বেশ করে লোকের মাঝে জানান দেওয়ার উশখুশেপনা। তা, ইহা কি মন্দ? আর মন্দ বললেই বা নোকে শুনবে কেন? গীতায় কেষ্ট ঠাকুরের একটা কতা আমার হেব্বি মনে ধরে। অজ্জুন তো বেটা ভেবেছিল, বেশ সেন্টু খাইয়ে যুদ্ধুটুদ্ধু থেকে সরে যাওয়া যাবে। যা ভয় পেয়েছিল। আহা আমাদের মত পাড়ার দাদাতুতো ভয় না। এ ভয় হল পারিবারিক ভয়, স্নেহের দুব্বলতা, যা কোনো ভিটামিনেই যেত না, যদি না কেষ্টবাবাজী অমন মোক্ষম দাওয়াইটি দিতেন। কি ভাবছেন? এই ফাঁকে গীতা বোঝাব? সে গুড়েবালি কত্তা, বলার কথাডা বইলে কেটে পড়ব। তা অজ্জুনের ভয় সেঁটকে পড়া দেখে কিজনো ঠাকুর বললেন, এত ভয় কিসের বাওয়া...এমন লাট খেলে তো আর মোক্ষোটোক্ষ মিলবেনি চাঁদু...উঠে পড়ো...ঝাড়ো উন শালে কো এক এক করকে...। অজ্জুন ফের কাঁদে, ফের সেন্টু দেয়। তখন আমাদের কিজনো ঠাকুর ভাবলেন, এ তো মাল ভালো কেঁচিয়েছে। এডারে থার্ড ডিগ্রী না দিলে তো আর চলতিসে না। তো তখন তিনি এটাসেটা বলে বললেন, দ্যাখো বাওয়া...জন্মে থেকে ওই এক যুদ্ধু করতি তো শিখেসো...বলি মাষ্টার হবে, টোল খুলবে, ব্যাবসা বাণিজ্য করবে...এসব তো হবেনি তোমার দ্বারা। এমনকি দশটা পাঁচটা রিকশা চালালেও তো পেস্টিজে লাগবে। তার চাইতে যা করতে এয়েচো তাই করো বাওয়া...বলেই সে মোক্ষম কথাটা বললেন, নিগ্রহ কিং করিষ্যতি...মানে আর বারণ করলি কে আর কথা শুনচে বলো...যে যার প্রকৃতি দ্বারা চালিত। বেসিক নেচারটা যাবে কোতায় বাপু...তুমি এখানে যুদ্ধু না করলে, বাড়ি গিয়ে হুক্কলের সাথে যুদ্ধু বাধাইবা, ও যে তোমার তোমার রক্তে বাবা!
        তো কথাটা হল, বারণ করলেই বা লোকে শুনবে কেন? আর বারণই বা করবে কেন? যশের ইচ্ছা বলো, কি খ্যাতির ইচ্ছাই বলো, সে তো আমাগো বেসিক ইনস্টিংক্ট, নাকি? কিন্তু কথাডা তবে শুরুতে কি বললাম, যে মাটি চাই না ধূমকেত?
        ঠাট্টা থাক। আজ ব্লু হয়েলই বলো, আর ইজ্জত রাখতে 'হনার কিলিং' ই বলো। একই জিনিস কিনা? মানুষ কি অনায়াসে নিজের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাজারে ঝুলিয়ে রাখতে পারে বলো, শুধু একটু বিখ্যাত হবে বলে। কি সব্বোনেশে নেশা। নিজের স্বাভাবিকতা, সুস্থতা, ক্ষমতার বাইরে কিছু ভোগ করতে গেলে তা নেশাই তো হয়ে দাঁড়ায় না? আজ সেই নেশার নানান পোশাকি নাম। বিকোচ্ছে দেদার। লক্ষ লাশের উপর তৈরি হচ্ছে ভোগায়তন। কে পড়ল, কে মরল কেউ তাকাচ্ছে না। সময় নেই। তার জায়গাটা ফাঁকা হলে আমি চড়ব যে! এ সবই তো আমরা জানি। কিন্তু দম না ফুরোলে যে থামা যাচ্ছে না। সামনে খাদ দেখতে পেলেও না। মনে মনে বলছি ওতেই তো সবাই ঝাঁপিয়েছে, আমিও ঝাঁপাই...মেজরিটির সাথে চলো।
        অন্যভাবে যদি দেখি। কেউ অটোগ্রাফ নিল, কেউ সেলফি তুলল, মোদ্দা কথা একজন সেলিব্রিটি হওয়া গেল। তাতে কি ভিতরের পাত্রটা পূর্ণ হল? শান্তি এলো? স্থিরতা এলো? ভাগ্যবলে বেশ কিছু সেলিব্রিটি মানুষের কাছে আসার সুযোগ হয়েছে। পাশে থেকে দেখেছি, খ্যাতির টানাপোড়েনে সে সত্যকারের ভিতরের মানুষটা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। একটা ঘটনা মনে পড়ল। চার্লি চ্যাপলিনের অটোবায়োগ্রাফিতে পড়েছিলাম। তিনি তখন ট্রেনের টয়লেটে। অর্ধেক সেভ হয়েছে সবে। ট্রেন দাঁড়িয়েছে। টিটি এসে বললেন, আপনাকে দেখার জন্যে মানুষ ভিড় করে আছে বাইরে। আপনি যদি একবার বাইরে আসেন। তিনি বাইরে এসে লোকের সেই উচ্ছ্বাস উন্মাদনা ইত্যাদিতে ক্ষণিকের জন্য বিহ্বল হয়ে যান। তারপর নিজের কোচে এসে একটা বিষাদের মধ্যে তলিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর মনে হয়, বিখ্যাত হওয়াটা এত সস্তা, এত অন্তঃসারশূন্য!
        আরেকটা ঘটনা বিখ্যাত লেখক উইল ডুরান্টের জীবন থেকে। তিনি সমুদ্রের ধারে বসে আছেন। ততদিনে তিনি বেশ বিখ্যাত। তাঁর পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের গল্প তখন অত্যন্ত জনপ্রিয় বই। তবু নিজের ভিতরে কোথাও একটা শূন্যতা অনুভব করছেন যেন। হঠাৎ দেখলেন দূরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়ালো। তার পাশে বসা একজন মহিলা তার বাচ্চাটাকে নিয়ে দৌড়ে সে গাড়িটার দিকে এগোলেন। ভদ্রলোক বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে শুরু করলেন, আর বাচ্চাটা 'বাবা বাবা' বলে সে ভদ্রলোকের গালে চুমু খেতে লাগল। ডুরাণ্টের চোখ জল এলো। তিনি অনুভব করলেন, একজন মানুষের আসল শান্তির জায়গা তার পরিবারের, তার কাছের মানুষগুলোর সাথে।
        এই মানুষটাকেই বলছিলাম, মাটি। এই সম্পর্কের উষ্ণতাই মাটি। এখানে একটা জীবনের সাথে আরেকটা জীবন কালের কাঁটায় উলের মত বোনা হয়ে যায়। একটা ছিঁড়তে গেলে আরেকটা ছিঁড়ে যায়। এর মূলতত্ত্ব মাধুর্য। আমার ক্ষমতা, ঐশ্বর্য না। আমার মনুষ্যত্বের মাধুর্য। সেই সার। সেই দিয়েই আমি একটা পরিবার গড়ি। তারা আমার অটোগ্রাফ নেয় না, আমার প্রশংসা করার সময়ও তাদের নেই। তারা রোগে-শোকে-সুখে-দুঃখে আমার শরীর মনের সাথে ছায়ার মত লেগে থাকে তাদের শরীর মন দিয়ে, তারাই আমার পরিবার। আমার মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার প্রেরণা। সময় সেখানে হিসাবের বাইরে। সেখানেই আমি বাঁচি। আমি শ্বাস নিই। আমি হাত-পা ছড়িয়ে টানটান করে বলি, আহা, শান্তি! তাই কথা হল, ধূমকেতু পাই বা না পাই, এই মাটিটা না পেলে দাঁড়াই কোথা?

(শেষে একটা কথা না বললে হয় না। এই যে আমার এত লেখার শখ সেও কি বিখ্যাত হব বলে? এর বিচার কালের হাতেই থাক। আমি নিজে নাই বা করলাম।)

431
Sat, 09/02/2017 - 12:30

"All happy families are alike; each unhappy family is unhappy in its own way"

        'Anna Karenina' র বিখ্যাত প্রথম লাইন। আমার কথাটা মাথায় এলো 'নীল তিমি' খেলার প্রসঙ্গে। তবে কি নিঃসঙ্গতাই এর কারণ? নিঃসঙ্গতার কারণ অনেক হতে পারে।

বাবা-মায়ের কাছ থেকে সময় কম পাওয়া। আর যদি সময় পায়ও বা 'quality time' বলতে যা বোঝায় সেটা না পাওয়া। পড়াশোনার সাথে নিজেকে relate করতে না পারা। স্কুলের বা প্রাইভেট শিক্ষক / শিক্ষিকার কাছে নিজের প্রয়োজন অথবা অসুবিধাকে বোঝাতে না পারা। ঠিকঠাক বন্ধু না পাওয়া। স্বভাবজাত communication skill এর সমস্যা। বাড়িতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। বেশিরভাগই বাবা মায়ের মধ্যে সমস্যা। কিশোর / কিশোরী বয়সে প্রেমঘটিত ব্যর্থতা। মেধার সাথে বিষয়ের অসামঞ্জস্যতা, ফলস্বরূপ হীনমন্যতা। এই হীনমন্যতা নিজেই একটা বিরাট সমস্যা।

নিঃসঙ্গতা ছাড়া আরো কিছু কারণ হতে পারে।

কৌতুহল অ্যাডভেঞ্চারের ইচ্ছা বন্ধু বান্ধবদের emotional force কিছু একটা achievement -এর উচ্চাকাঙ্ক্ষা।

        নিঃসঙ্গতা বাদে বাকি কারণগুলোর ক্ষেত্রে কাউনসেলিং কাজে দিতে পারে, কিন্তু নিঃসঙ্গতার ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো গভীর। আমার কথাটা বলতে খুব খারাপ লাগলেও তবু বলতে হচ্ছে, ছেলেমেয়েকে বড় করা আর পোষ্যকে(pet) কে লালন করার মধ্যে একটা বিস্তর পার্থক্য আছে। বহু পরিবারে সে পার্থক্যটা যেন কোথাও লোপ পেতে চলেছে দেখছি। আদর, স্নেহ, শাসন - সবই যেন মাত্রাছাড়া। বিবেচনাহীন।

        মানুষের একটা ক্ষমতা আছে, সহানুভূতিসহ পর্যবেক্ষণ বা নিরীক্ষণ। এ দায়িত্ব শুধু যে বাবা-মা তে বর্তায় তা নয় তো, এ দায়িত্ব প্রতিটা শিক্ষক শিক্ষিকার। যে ছেলেটা বা মেয়েটা আমার সামনে পড়তে বসছে, সে একটা সম্পূর্ণ মানুষ, আগামী সমাজের একটা স্তম্ভ। তাকে সূর্যের আলো কিভাবে ক্লোরোফিলকে উত্তেজিত করে সেটা বোঝাবার আগে প্রাথমিক দায়িত্ব সে বোঝার মত অবস্থায় আছে কি না বুঝতে চেষ্টা করা। সমস্যা বুঝলে, ক্লাসে না হোক, পরে তাকে ডেকে তার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করা। কারণ ওই যে বললাম, সে একটা সম্পূর্ণ মানুষ। আমি তার বেশ খানিকটা বাদ দিয়ে শুধু তার মনোযোগটা ক্লাসে চাইব, আর না দিলেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করব বা উদাসীন থাকব- এতে আর যা হোক, শিক্ষাটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়, শিক্ষক আর ছাত্র দুজনেরই। দায়টা সহানুভূতির সাথে নিলে বিরক্তির পর্যায়ে পৌঁছায় না। আমার বিশ্বাস, এই মানসিকতার শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা খুব একটা কম হয়ে যায়নি এখনও। যদিও বিপরীত উদাহরণও আছে।
        আসল কথাটাই হল - সহানুভূতিশীল হওয়া। প্রশ্রয় আর সহানুভূতির মধ্যে পার্থক্য করতে অসুবিধা হয় অনেকের দেখেছি। তার কোনো বিধিবদ্ধ নিয়মও নেই। মাঝে মাঝে ভুল করতে দেওয়ার অথবা ভুলটাকে খাটো করে দেখায় আদতে লাভ প্রচুর হয়, যদি না সেটা দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ হয়। প্রশ্রয়ের সাথে প্রশ্রয়দাতার একটা দুর্বলতার যোগ থাকে, কিন্তু সহানুভূতির সাথে সেটা থাকে না। সে প্রয়োজনে বাইরে নির্মমতার কঠোর অভিনয়ও করতে পারে, কিন্তু নিজেকে লক্ষ্যভ্রষ্ট হতে দেয় না।
         কিন্তু এসবই তো তাত্ত্বিক কথা। তবু এর অনুশীলন ব্যতীত কোনো পথও তো চোখে পড়ছে না। এর সাথে আরেকটা ভয় হচ্ছে মাঝেমধ্যে। এই গেমটার এত প্রচার আবার backfire না করে বসে। যে সব ছাত্রছাত্রীরা এই গেমের দৌলতে খবরের কাগজের পাতায় উঠে আসছে সেই ঘটনাটাকে সেই বয়েসী ছেলেমেয়েরা কি চোখে দেখছে? এই বয়সে ভেবেচিন্তে কাজ করতে তো শেখায় না। আবেগ, উত্তেজনা, উন্মত্ততা অনেক হঠকারি পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে দিতে পারে তাদের। এটাও ভাবা দরকার। সতর্ক থাকার দরকার বলে আমার মনে হয়। কি ভাবে নিচ্ছে তারা এই খবরগুলো। 'কাল আমারও নাম উঠবে'... এই নেশা বা আকর্ষণ তৈরি হচ্ছে না তো!

432
Mon, 08/28/2017 - 13:00

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার কিছুতেই অবতার মানবেন না। তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করছেন, কিন্তু কদাপি মানুষ ভগবান হতে পারে তা স্বীকার করবেন না। ডাক্তারের মত, শ্রীরামকৃষ্ণ - As man I have the greatest regard for him.
        মহেন্দ্রলালবাবু ভক্ত হয়ে আসেননি। তবু শ্রীরামকৃষ্ণের সাথে কথা বলতে গিয়ে সময়ের হিসাব থাকে না। তর্ক করেন। রাত্তিরে শুতে গিয়ে ঝড় হলে চিন্তা করেন, "মানুষটা জানলাগুলো লাগিয়েছে তো?" তবু তর্ক চলে নানান খাতে। দুর্বোধ্য ইংরাজি ভাষা শ্রীরামকৃষ্ণকে বাংলায় তর্জমা করে বুঝিয়ে দেন আশেপাশের কেউ। ডাক্তারের কথা শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ কখনও হাসেন, কখনও উত্তর করেন। উত্তর শুনে মহেন্দ্রলাল সরকার তাজ্জব হন। এ মুখ্যু মানুষ এসব কথা জানলে কি করে? শেষে বলে বসেন, "শুধু বই পড়লে তোমার এত জ্ঞান হত না"। ফের তর্ক শুরু হয়। রামকৃষ্ণকে বলেন, "তুমি অহংকারী, অমন লোকেদের পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে দাও কেন?"
        শ্রীরামকৃষ্ণ হাসেন। কখনও উত্তর করেন। তবু কেউ কাউকে ছাড়ার কথা ভাবতে পারেন না। কথাটা কি তবে?
        কথাটা একটাই, একটা অমোঘ ভালোবাসা। মানুষের যুক্তি-বিচার-বুদ্ধি সব আছে। তার পাশাপাশি আছে তার অন্তরে গভীর ভালোবাসার তৃষ্ণা। শুধু পাওয়ার না, ভালোবাসা দেওয়ারও। শ্রীরামকৃষ্ণের একটি তত্ত্বে তাই তার মন মজল - "মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ।"
        তিনি বুঝলেন, এই কথাটি নতুন না। কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিটি খুব নতুন। যে মানুষ যত শুদ্ধ তার ভিতরে নিঃস্বার্থতা তত মূর্ত। আর নিঃস্বার্থ, নির্ভীক হয়ে বাঁচার যে তৃপ্তি তা মহেন্দ্রলাল সরকার জানেন। মাষ্টারমশায়, মানে কথামৃতকার বলছেন, জলে কিম্বা কাঁচে যেমন সূর্যের আলোর বেশি প্রকাশ তেমনই মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ।
মহেন্দ্রলাল সরকার শুধু না, এ তত্ত্বে স্তম্ভিত হয়েছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর পর্যন্ত। বিদ্যাসাগর বলছেন, "তবে কি তিনি কাউকে বেশি শক্তি, কাউকে কম শক্তি দিয়েছেন?" শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন, "তোমার কি শিং বেরিয়েছে দুটো? তোমার দয়া, তোমার বিদ্যা আছে - অন্যের চেয়ে, তাই তোমাকে লোকে মানে, দেখতে আসে।"
বিদ্যাসাগর চমকালেন। তাই তো, বিদ্যালয়েও দেখেছেন, সব ছাত্র সমান নয়, সব শিক্ষক সমান নয়, সব কর্মী সমান নয়। সমাজেও আজীবন তাই দেখে আসছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ আরো বলছেন, সব জলই জল, কিন্তু কোনো জল খাওয়া যায়, কোনো জল পূজা পার্বণে লাগে, কোনো জলে শুধুই শৌচকার্য চলে।
        "মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ" মানে কি তবে? মানে আস্তিকতা নাস্তিকতার পারের কথা। যে মানুষ নিঃস্বার্থভাবে মানুষের সেবায় আত্মনিবেদন করল সারাটা জীবন, আমরা তাকে বলছি, মানুষ নয়, যেন ভগবান!
        যদি বিদ্যাসাগর শুধু পণ্ডিত হতেন তবে কি শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে দেখতে যেতেন? নিশ্চই নয়। সেরকম পণ্ডিতের তো অভাব ছিল না তখন, আবার এও নয় যে বিদ্যাসাগর প্রবল ঈশ্বরভক্ত হিসাবে খ্যাত। তাও নয় মোটেই। কিন্তু তিনি তো শুধু বিদ্যাসাগর নন, দয়ার সাগরও। সেই আকর্ষণ রামকৃষ্ণের। 'বজ্জাৎ আমি, ছোটো আমি, কাঁচা আমি' যেই ত্যাগ করেছে, শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে সেই সাচ্চা মানুষ। সাচ্চা মানুষে তাঁর প্রকাশ। বেশি প্রকাশ। যেন বাড়ির মধ্যে তাজমহল। যেতেই হবে তার কাছে। সে আসবে কেন? তিনি নিজে কি এমন? "তোমার শরীরের লোমগাছির সমানও তো নই, এমনকি ছোটো লোমের সমানটাও নই"। এই ওর নিজের সম্বন্ধে নিজের উক্তি। তবে তিনি যে এর বাড়ি, ওর বাড়ি অনাহূত হয়েও যাবেন তাতে আর আশ্চর্যকথা কি?

        কিন্তু কথা হল, আমি হঠাৎ এ প্রসঙ্গ নিয়ে পড়লাম কেন? কারণ ইদানীং চারদিকের গুরুদের দেখে। ঐশ্বর্য আর আধ্যাত্মিক বোধ কোনোদিনই পাশাপাশি আসেনি আমাদের সংস্কৃতিতে। একজন পরম আত্মনিবেদিত বিজ্ঞানী, শিল্পী যেই হোন না কেন, বিলাসিতার সাথে আপোষহীন সব দেশে সব কালেই তারা। গ্ল্যামার বলতে যা বোঝায় তার থেকে শতহস্ত দূরেই থেকেছেন। ভারতবর্ষ বলেছিল বহুকাল আগে - সত্যম জ্ঞানম অনন্তম ব্রহ্ম। অর্থাৎ তার গভীরতম উপলব্ধিকে সে - সত্য-জ্ঞান-অনন্তের মধ্যে দেখেছিল। এক একজন মহাত্মার চরিত্রেও এই দিকটাই প্রধান ছিল। নিঃস্বার্থ লোককল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। সমাজের তাদের কাছে ঋণের শেষ নেই।
        কিন্তু আজ এটা কি হচ্ছে? এক একজন ভোগ বিলাসের শিখরে থেকে নিজেকে ঈশ্বরের পথ প্রদর্শক বলে দাবী করছেন, আর হাজার হাজার লোক তাকে অনুসরণ করছে? স্বার্থহীনতা, বৃহৎ কল্যাণে উৎসর্গীকৃত প্রাণের বিন্দুমাত্র আভাস নেই যেখানে, শুধু বাকচাতুরী, গ্ল্যামারের চোখ ধাঁধানো আলো, অলৌকিক গল্প সর্বস্বতাতেই সব মিলিয়ে গেল? কোনো আদর্শের খোঁজ নেই? সে আদর্শ যথাযথ প্রতিপালিত হচ্ছে কিনা প্রবর্তকের চরিত্রে দেখার খোঁজ নেই। যে বোধকে, জ্ঞানকে, নিঃস্বার্থতাকে জীবনের চরম পরিণতি প্রচার করছে তার এত বস্তুনির্ভর জীবন কেন হবে? এত প্রাইভেসির কি দরকার? যীশু থেকে রামকৃষ্ণ অবধি কারোরই তো আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগত না, VIP খাতির তো কেউ পেতেন না তাদের দরবারে? মহাপ্রভুর রাজদর্শন এড়িয়ে চলার গল্প তো অতি প্রাচীন নয়? তবে আজ এ কি মোহের পথে চলেছি। অন্ধকে অন্ধ পথ দেখানোর চেষ্টার কথা উপনিষদ বলেছেন, সাবধান করেছেন। কিন্তু সে সাবধান বাণী উপেক্ষিতই থেকে গেল। মানছি রামকৃষ্ণ, মহাপ্রভু, রমণ মহর্ষির মত মানুষ মুড়িমুড়কির মত আসে না। তা বলে যদি রবিশঙ্করের সেতারের ছড়ের সাথে পাড়ার হাবুদার সেতার গুলিয়ে ফেলি সে অপমান তো আমার বোধের! তারা না থাকুন, সে আদর্শটুকু তো মারা যায়নি। না হয় শূন্যই থাক সে আসন। তা বলে যাকে তাকে বসিয়ে মনের দুর্বলতার তোষণ করব? তাদের দেখানো রাজপথের মত উজ্ব্বল রাস্তায় হাঁটব না? বোধ-জ্ঞান-শান্তির রাস্তার চেয়ে গ্ল্যামার-শক্তি-প্রতিপত্তির দাসত্ব করব? কিছুতেই হতে পারে না। কারণ রামকৃষ্ণের সে অমোঘ দর্শন - "মানুষে তাঁর বেশি প্রকাশ।" কার বেশি প্রকাশ? মানুষের মহত্বের। তার অভাব চিকিৎসক, শিক্ষক, বিজ্ঞানী, রাজনীতি, শিল্পী কোনো মহলেই চিরকালের অভাব ঘটবে না। ওইটুকুই তো আমাদের চলার গর্ব, পাথেয়!

 

433
Sat, 08/26/2017 - 19:30

"Fibonacci সিরিজ শিখলাম" - আমার একজন কনিষ্ঠ বন্ধু কম্পিউটার ক্লাস করে আসার পর বলল। কি বস্তু সেটা? ১,১,২,৩,৫,৮... অর্থাৎ সিরিজ শুরু হয় প্রথম দুটি সংখ্যার যোগফল দিয়ে। তার প্রথম সংখ্যা ০ হতে পারে, ১ হতে পারে। সিরিজের এর পরের সংখ্যাগুলোর প্রতিটি তার আগের দুটি সংখ্যার যোগফল। এইরকমভাবে সিরিজ চলতে থাকে। মনে পড়ল আমাদের বোটানি ক্লাসে এই সিরিজের উল্লেখ পেয়েছিলাম পত্রবিন্যাস বুঝতে। অর্থাৎ প্রতিটা গাছের পাতার নির্দিষ্ট বিন্যাস পদ্ধতি।
        তবে কি অঙ্ক বোঝানোর জন্য খামোখা কলম কামড়ে পড়লুম? তা নয়। হল কি, এই সিরিজের ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে যেটা চোখে পড়ল তাতেই সমস্ত মনপ্রাণ আটকে গেল। এই সিরিজের প্রথম প্রামাণ্য লিখিত প্রমাণ নাকি মেলে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে, ছন্দ উপাখ্যানে। যে প্রয়োজনেই এসে থাকুক, ভারতে এ চিন্তা করা হয়েছিল তবে। আরো খুঁজতে গিয়ে জানলাম, কেরালার প্রাচীন গণিতের উপর উইকিতে ইতিমধ্যে একখানা পেজও বর্তমান।
        খটকাটা লাগল অন্য জায়গায়। এত অবৈজ্ঞানিক ভাবধারায় বয়ে চললাম কেন আমরা তবে? যদি আমাদের পূর্বপুরুষদের এ হেন মেধার বিন্যাস বিজ্ঞান গবেষণায় ছিল, তবে সে এগোলো না কেন?
        এর দুটো উত্তর হতে পারে। এক, আমাদের প্রাচীনেরা বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক দিকে যে আগ্রহ অনুভব করেছিলেন তা প্রয়োগের দিকে অনুভব করেননি হয়ত।
দুই, পরলোক, আত্মতত্ত্ব ইত্যাদিতে এত গভীর চর্চা শুরু হল যে এইসব জাগতিক, পার্থিবজ্ঞান তুচ্ছাতিতুচ্ছ বলে বোধ হতে লাগল।
        আমার ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয়টাই বেশি কারণ মনে হয়। আমরা প্রধানত বিশ্বাসপ্রবণ জাত। আমাদের জীবনের মূলকেন্দ্রে গুরু বা ঈশ্বর বা কোনো অতীন্দ্রিয় দর্শন না থাকলে আমরা নিজেদের জীবনটা অর্থহীন মনে করি। আসল না পাই নকল দিয়েও কাজ সারতে রাজী আমরা। তবু কেন্দ্রে চাই-ই কাউকে।
        একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। শিয়ালদাতে ট্রেনে বসে আছি। ২.০৫ ট্রেনের ছাড়ার সময়। বোর্ডে বড়বড় করে লাল অক্ষরে লেখা। তবু আশেপাশের কোনো ট্রেন হর্ণ দিলেই এই প্ল্যাটফর্মের লোক ছুটতে শুরু করছে। তারা প্রত্যেকেই কম বেশি জানেন ট্রেনটার ছাড়ার সময়, কিন্তু তবু যদি ছেড়ে যায়!
        এইটাই ভয়ংকর মানসিকতার লক্ষণ। নিয়মের ঊর্দ্ধে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। যাকে স্বেচ্ছাচারিতা বলা যায়। জগতে সব চাইতে স্বেচ্ছাচারী তোষামোদখেকো অস্তিত্ব তাই আমাদের দেব-দেবীরা। জগতে একটা নিয়ম আছে, সব কিছুই একটা কার্য-কারণ সূত্রে গাঁথা, এটা আমরা কিছুতেই মানতে পারি না। এত নিয়মের তথ্যে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। ভক্তি খুঁজি। এমন কাউকে ভক্তির পাত্র খুঁজি যিনি আমার হয়ে সব ভেবে দেবেন, কিম্বা যিনি তাঁর ইচ্ছার দাস করে আমার স্বাধীনতাহরণ করবেন। আমি নিজের স্বাধীনতার দায় নিজে আর বইতে পারছি না যে!
        সংসারে যারা প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটা কাজে, পদক্ষেপে ঈশ্বরের মঙ্গলহস্ত দেখে, ঈশ্বরের অভিশাপের নিদর্শন দেখতেও তাদের চক্ষুর অভাব ঘটে না। ক্রমে একজটাদেবী, হাজার একটা আইনকানুন, শাসনে অনুশাসনে জীবন একটার পর একটা শৃঙ্খলায় শৃঙ্খলিত হতে থাকে, আর আমরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় থাকি যখন লোকটা নড়েচড়ে না, আমরা বুঝি 'শিক্ষা সম্পূর্ণ হইয়াছে'।
        নিয়মকে না মানলেই অপমান। নিজের অপমান, নিজের চারপাশের অপমান। কর্তায় ইচ্ছায় কর্মের দিন চলে গেছে এখন। এখন সবে মিলি করি কাজ।
        কিন্তু এই কাজটা ততক্ষণ সম্ভব নয় যতক্ষণ পারস্পরিক যোগাযোগের পথটা নির্মোহ, সংস্কারমুক্ত হয়। আমাদের সংসারে নিয়মনীতির অভাব নেই। অভাব মনুষ্যত্ব আর বিবেকযুক্ত নিয়মনীতির। কোনবারে কি খায় না, কিম্বা কোন ধরণের পাত্রের সাথে কোন ধরণের পাত্রীর বিবাহে কি কি অশুভ ও অমঙ্গলের সম্ভাবনা, তাই নিয়ে আমাদের চিন্তার অন্ত নেই। একবারও মনে প্রশ্ন হয় না, তবে পৃথিবীর এত দেশে, এত সামাজিক বৈচিত্র‍্যে আর সব জাতিগুলো উচ্ছন্নে গেল না কেন? আমাদের নীতি-দর্শন-আস্থা সার্বজনীন কিনা ভাবার অবকাশ নেই আমাদের, অথচ সেই সব আজগুবি আচার অনুশীলনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার অভাব হয় না আমাদের।
        'পথের পাঁচালি'-র দূর্গার মৃত্যুর সে ভয়ানক রাতটার কথা ভাবুন। তাদের ঘরে কি ছিল না, দেব-দেবী, ধর্মগ্রন্থ, আচার-বিচার সব ছিল। ছিল না কেবল প্যারাসিটামল। ওষুধটা আবিষ্কার হল ১৮৭৭. মার্কিনমুলুকে এল ১৯৫০. বিশ্বে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে করতে ৬০/৭০ দশক। এই জ্বর নামানোর পদ্ধতি সার্বজনীন। আমেরিকানদের নামে আর চীনাদের নামে না বাতুলেও বলে না। বিজ্ঞানের সবচাইতে বড় কথা তার এই সার্বজনীনতা। তাকে এর ওর খিদমৎ খেটে মরতে হয় না। সে নিজেই নিজেতে সম্পূর্ণ সার্বজনীনতার জোরে।
        পাশ্চাত্য দর্শনও সেই খোঁজটা করেছিল। তাই তাদের দর্শনের একটা সারিবদ্ধ ইতিহাস লেখা যায়। তার সমালোচনা করা যায়। ফলঃস্বরূপ তাকে এগিয়েও নিয়ে যাওয়া যায়।
        আমাদের দর্শন নোঙর গাড়ল অতীন্দ্রিয়বাদে। আর অতীন্দ্রিয়বাদের কোনো সার্বজনীনতা সম্ভব নয়। তার অমোঘ আকর্ষণ আছে। কিন্তু সহজ সার্বজনীনতা নেই। এক চার্বাক ছাড়া প্রত্যেকেই আত্মা পরমাত্মার চক্করে পড়ে (চার্বাক ব্যক্তিগতভাবে আমার অসম্পূর্ণ, প্রতিক্রিয়ামূলক দর্শন বোধ হয়) গিয়েছিল।
        আধুনিক যুগের প্রাক্কালে যে নিও বেদান্তইজ্মের ঢেউ এলো, ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে সেটা খ্রীষ্টের সেবাদর্শের একটা বৈদান্তিক মোড়ক। বিবেকানন্দ, মহাত্মা, রবীন্দ্রনাথ প্রত্যেকেই ছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত শুধু না, প্রবলভাবে পাশ্চাত্যের ভাব ধারায় প্রভাবিত। তাই সেই সময়ে দাঁড়িয়ে নিও বেদান্তইজ্ম ছাড়া বিশেষ কোনো উপায়ও ছিল না। "জীবে প্রেম করে যেই জন" ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেকপক্ষও উঠে দাঁড়ালো প্রার্থনা সমাজ ইত্যাদির মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় কৃষ্টিকে অবলম্বন করে। চলল সে ঢেউ, ভারতের দর্শনে বহু মানুষ প্রভাবিত হলেন সেদিন। একঘেয়ে খ্রীষ্টধর্মের পাশাপাশি বৌদ্ধ আর বেদান্তদর্শনের মধ্যে একটা নতুনত্বের স্বাদ পাওয়া গেল। রোমা রোল্যাঁ, টলস্টয়, ম্যাক্সমুলার, শোপেনহাওয়ার ইত্যাদি বহু মনীষী মুগ্ধ হলেন। আলোচনার স্রোত বইল। ভারত যেন সার্বজনীন হতে হতেও কোথায় ঠেক খেল। ঠেক খেল তার অতীন্দ্রিয়বাদে। এগিয়ে গেল বুদ্ধইজ্ম। আজ সারা বিশ্বে বুদ্ধচর্চার প্রবণতা দিন দিন ক্রমবর্ধমান, কারণ বুদ্ধ মানুষকে কোনো বিশেষ আত্মতত্ত্বে মুক্তির কথা শোনাননি, শুনিয়েছেন সার্বজনীন নীতির শক্তিতে - অষ্টাঙ্গিক মার্গে। জগৎকে প্রভুর লীলাক্ষেত্র বললেন না, বললেন, দুঃখ আছে - এই মোদ্দা কথা - আর্যসত্য।
        কিন্তু সে অন্য গল্প। কথা হচ্ছে এই সার্বজনীনতাটুকুর। যা শুরুতেই বলছিলাম fibonacci সিরিজের গল্পে। এই সর্বগ্রাহক পটভূমিকায় যদি দাঁড়াতে না পারি, holier than thou করে সব কিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে কোনো খামখেয়ালি ঈশ্বরের তোষামোদিতে জীবনের পরম সার্থকতা খুঁজি, তবে সবশেষে সেই old wine in new bottle হতে বাধ্য।

434
Tue, 08/15/2017 - 23:49

আমাদের ছোটোবেলায় Turning Point বলে একটা অনুষ্ঠান দূরদর্শনে হত। Yash Paul সৌম্যকান্তি চেহারা, খুব কাছের একজন দরদী শিক্ষকের মতন বিজ্ঞানের নানা অজানা বিষয়ে আলোপাত করতেন।
        চব্বিশে জুলাই মারা গেলেন। বিশেষ কেউ জানতে পারল না। কারণ, ১) তিনি কোন ধর্মগুরু নন, ২) তিনি রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তিত্ব নন এবং ৩) অবশ্যই বিনোদন জগতের জনপ্রিয় কেউ নন।
        বিজ্ঞান পড়ার প্রতি যত আগ্রহ, বিজ্ঞানচর্চার প্রতি সে আগ্রহ কি স্বাধীনতার এত বছর পরেও জেগেছে আমাদের জনমানস স্তরে? বিজ্ঞান নিয়ে পড়লে ডাক্তার-ইঞ্জিনীয়ার হওয়া যায়, তাছাড়া পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে মাথা উঁচু করে হাঁটা যায় - এই এত অবধিই বিজ্ঞানের চর্চা। তবে জনমানসে নেই কেন? কারণ সব আমাদের 'ব্যাদে আসে' (বেদে আছে)।
        বিজ্ঞানের প্রতি অনীহার মোড় আজ অথবা কাল হলেও ফিরতে পারে, ভয়ংকর হল ছদ্ম-বিজ্ঞানের আড়ালে আসল বিজ্ঞানের ধামাচাপা পড়ে যাওয়াটা। রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন বারবার বলেছি, অত্যন্ত প্রিয় লাইন আমার - "আমার আঁধার ভালো, আলো কে যে লোপ করে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে"।
        আমাদের সেই স্বাধীনতাটার দিকে এগোবার চাই। স্কুল কলেজের বিজ্ঞানের সিলেবাসের কথা বলছি না। বলছি দৈনন্দিন জীবনে তাকে মান্যতা দেওয়ার কথা। বলা হয়, Cleanliness is next to Godliness. সে পরিচ্ছন্নতা কি কেবল বাইরের? কক্ষনো না। সে পরিচ্ছন্নতা চিন্তার জগতে না এলে বিপদ। বিজ্ঞান ভবিষ্যতবাণী সে অর্থে করতে পারে না, মৃত্যুকে ঠেকাতে পারে না, অমরত্বের প্রতিশ্রুতি দিতে পারে না - কিন্তু ভয়মুক্ত করতে পারে তার যুক্তিতে, তথ্যে, স্বচ্ছতায়।
        কিন্তু ইদানীং বেশ কিছু সাহিত্য রচনা হচ্ছে বিজ্ঞান আর ধর্মকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে তার মধ্যে একটা মিল খুঁজে। একে সিউডোসায়েন্স বলা যেতে পারে। এটা ভয়ানক। এতে দুর্বল মন কিছু প্রশস্তি পেতে পারে, সুস্থ সবল মন না। মানুষকে কতরকম ভয় যে ধর্ম দেখাতে পারে, এবং আজও দেখিয়ে চলেছে নানা ধর্মগুরুরা, প্রাণ শঙ্কিত হয় দেখলে-পড়লে-শুনলে।
        আরেকদিক, টিভি চালান, দেখুন জ্যোতিষীর পর জ্যোতিষী। আপনার ভবিষ্যতের জ্যান্ত ছবি তেনাদের নখদর্পণে। ভয় আর লোভ - এই দুটোর মত পুঁজি সংসারে খুব কম। মারো খোঁচা, চালাও ব্যবসা। ধর্ম-ব্যবসা, ভাগ্য-ব্যবসা তখনই কমতে পারে যখন এই সার্বজনীন বিজ্ঞানমনস্কতা বাড়বে।
        তবে ঈশ্বরের কি হবে? বিজ্ঞানমনস্কতা মানে নাস্তিকতা নয়। তিনি যদি সত্যিই সত্যস্বরূপ হবেন, তবে কি তিনি চাইবেন আমরা সারাটা জীবন মায়ের আঁচল ধরে ধরে ভীরু হয়ে ঘুরি? কখনই না। চিত্তে সংশয় যদি জাগে তবে সে সত্যকে জানার জন্য, মিথ্যাকে দূর করার জন্য। কখন ওই মিথ্যার পায়ে আত্মসমর্পণের জন্য নয়। সত্য কোনো খেলনা নয় যে একজন আমায় হাতে ধরে বলল, খেলো, চারদিক ভুলে মেতে যাও খেলায়, আর আমি অমনি মেতে গেলুম। কিন্তু তাই হচ্ছে। সত্যান্বেষণ সর্বদাই নাস্তিকতার ছদ্মবেশে আসে। তাতে হাত-পা পোড়ে। পুড়ুক। কিন্তু ফাঁকি থাকে না। দুর্বলতা থাকে না। দুর্বলতাকে শ্রদ্ধা-বিশ্বাসের, অতিভক্তির আড়ালে রেখে বেশিদিন চলা খুব শক্ত। বেকন একবার বলেছিলেন, দুই আর দুই যোগ হলে পাঁচ হয় বললে আমি রাগব না, হাসব। বড়জোর করুণা হবে। কিন্তু বিশ্বাসের বিরুদ্ধে বললে? তেলেবেগুনে চটে লাল।
        মির‍্যাকেল মানে কি ধর্ম? না। সে নিজেও যদি সত্যান্বেষণ না হয়ে চর্বিতচর্বণ হয়ে ওঠে, তবে বিপদ। মৃত্যুর সামনে, বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে বুক কাঁপে নি, কোনো ঐশীশক্তির সাহায্যের কাছে করুণ প্রার্থনা করেনি এমন মানুষ হাতে গোনা হয়ত। কিন্তু সে তো চরম বিকল অবস্থা মনের, সেই কি তার স্বাভাবিক অবস্থা? শরীরের রোগগ্রস্থ অবস্থাকে স্বাভাবিক অবস্থা মেনে নিলে তো বিপদ। মনের মধ্যে গভীরতম কেন্দ্রকে জাগিয়ে তোলে যে শক্তি, ক্ষুদ্র স্বার্থের থেকে বেরিয়ে কায়-মনে-বাক্যে গতিময় করে তোলে যে মহৎস্বার্থ - সেই ধর্ম। তাই কোনো মন্দিরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকাকে উত্তম ভক্ত ছোটো চোখে দেখে। সে বলে তাঁর ইচ্ছার কাছে মাথা নোয়াও। নিজের ক্ষুদ্র ইচ্ছাকে বৃহৎ ইচ্ছার মধ্যে লীন করে দাও। এই উত্তম ভক্তি। সেখানে ভয় নেই। প্রেম আছে। সহিষ্ণুতা আছে।
        আজ এই স্বাধীনতাই কাম্য। চিত্ত মুক্ত হোক নির্ভীক সত্য ধর্মে আর মনন-মেধা মুক্ত হোক সৎ বিজ্ঞানে।

435
Thu, 08/10/2017 - 12:30

তবে কি আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী? কিন্তু তা তো মোটেও নয়। জন্মালাম একটা হাসপাতালে, পড়াশোনা করলাম স্কুল-কলেজে, টাকা রাখতে ব্যাঙ্কে গেলাম, চিঠি পোস্ট করতে পোস্ট-অফিসে... এ সবই তো প্রতিষ্ঠান। সমাজের পক্ষে অপরিহার্য। এছাড়াও বিধানসভা লোকসভা থেকে শুরু করে আরো নানান প্রতিষ্ঠানের সাথে জীবনযাত্রা তো প্রতিপদে জড়িয়ে। তবে? ক'দিন ধরে একটাই কথা মাথায় ঘুরছে, তবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ কি, প্রয়োজন কি?
        ধর্মের সংজ্ঞা নানান। তার একটা নীতির দিক আছে আরেকটা বিশ্বাসের দিক আছে। আর এই দুই মিলিয়ে একটা 'আদর্শ' তৈরি করে তাতে বাঁচার দিক আছে। তাই বলা হয় কোনো আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখতে একটা প্রতিষ্ঠান তথা সঙ্ঘের দরকার আছে - সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি। কিন্তু বাঁচিয়ে রাখা মানে কি? কোনো কিছুর পুনরাবৃত্তি করে যাওয়া? কোনো অনুষ্ঠানের, কোনো তত্ত্বের কথা বারবার আওড়িয়ে যাওয়া? প্রতিটা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের একজন প্রতিষ্ঠাতা বা কেন্দ্রপুরুষ থাকেন। তিনি তার সময়ে কোনো এক বিশেষভাবে সত্যকে উপলব্ধি করেছিলেন, তারপর সেই 'বিশেষ ভাবটি'কে প্রথা করে পরবর্তী অনুগামীগণ তার পুনরাবৃত্তি করে যেতে থাকে। সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা হয়। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে সাম্প্রদায়িকতা। ক্রমশঃ প্রাণহীন শুষ্ক আবর্তনে জীবনযাত্রা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। একটা জড়ত্বের শান্তি মনকে আচ্ছন্ন করে রাখতে চায়। সেই বিরোধী কোনো কথা হলেই মনের ভিতর তীব্র প্রতিবাদ ওঠে। বিরোধীপক্ষ যদি দুর্বল হয় - 'রণং দেহি' দল পাকিয়ে, আর যদি সবল বিরোধীপক্ষ হয় তবে পালিয়ে গিয়ে নিন্দা, তাও সদলবলে।
        তো যে কথাটা বলছিলাম, তবে কি পুনরাবৃত্তিই আদর্শকে ধরে রাখার একমাত্র কৌশল? পুনরাবৃত্তিতে কি সত্যলাভ হয়? পুনরাবৃত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে কি আশা করা যায় যে সব যুগে সে তার প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারবে? পারবে না। আর তাই বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। সময় একটা গতি, আর পরিবর্তন একটা অপরিবর্তনীয় নিয়ম। তার চাইতেও বড় কথা মানুষ তার জীবনের গভীরতম সত্যের খোঁজ কি সম্প্রদায়ের মধ্যে পায়? নাকি কোনো সম্প্রদায়কেই সেই সত্য বলে নিজেকে আশ্বস্ত করার আত্মপ্রবঞ্চনামূলক প্রয়াস পায়? বলা হয়, every religion starts with a blasphemy... প্রতিটা নতুন ধর্মই পুরোনো ধর্মের সমালোচনা দিয়ে শুরু হয়। আসলে পুরোনো ধর্মের না, ওই প্রাণহীন শুষ্ক পুনরাবৃত্তির ভূতকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য সে হাঁক দেয়। ওঠে ঝড়। রক্ষণশীলের দল চিরটাকাল থাকে, তারা তুমুল চীৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেয়। দেখে মনে হয় আদর্শের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্য থেকে তারা বুঝি এমন অধীর হয়ে উঠেছে, কিন্তু আদতে তা না। তারা ওই পুনরাবৃত্তির ধারার সাথে নিজেদের অস্তিত্বকে এমন আঁকড়ে ফেলেছে যে সেই ধারার মৃত্যুতে তারা নিজেদের অস্তিত্ব সংকট অনুভব করছে। সেদিন শুনলাম কোনো এক নব্বই পেরোনো সন্ন্যাসী অসুস্থ শরীরে, রোগের আচ্ছন্ন ঘোরের মধ্যেও তার জপের মালাটা হাতড়িয়ে খুঁজে জপে বসার চেষ্টা করছিলেন। তার শিষ্যরা অত্যন্ত গর্বের সাথে সে উপাখ্যান বর্ণনা করছিলেন, ভক্তিতে গদগদ হয়ে। কথাটা শুনেই আমার মনটা এমন বিকল হয়ে গেল, এই নাকি সিদ্ধাবস্থা? একটা অভ্যাসের কাছে নিজের সমস্ত প্রাণশক্তির জলাঞ্জলি দিয়ে তাকে একটা স্থবির পুনরাবৃত্তির যন্ত্র বানিয়ে ফেলাটাই জীবনের চূড়ান্ত প্রাপ্তি? কিন্তু তাই তো হবে। কারণ আবর্তনের ধারা বজায় রাখাই যে প্রতিষ্ঠানের মূল, সে প্রতিষ্ঠানে ইনি তো সর্বোচ্চ স্থানের অধিকারী হবেনই।
        মাঝে কলেজ জীবনে বেশ কিছু ধর্ম ও বিজ্ঞানের একতাদর্শী কিছু বই পড়েছিলাম এক বিখ্যাত সন্ন্যাসী প্রবরের। মুগ্ধ হয়েছিলাম। আজ আর সে মুগ্ধতা নেই। কারণ আজ তার অন্তঃসারশূন্যতাটা চোখের সামনে স্পষ্ট। আমি যখনই ধর্মের যথার্থতা প্রমাণের জন্য অমুক বিজ্ঞানী তার অমুক লেখায় অমুক কথাটি বলেছেন বলতে শুরু করব, তখনই বুঝতে হবে যে আমার ধর্মবিশ্বাসের অন্তরালে কোথাও বেনোজল ঢুকছে। তখন আপাতদৃষ্টিতে অকাট্য সব যুক্তির সামনে শ্রদ্ধায় মন এমন অবশ হয়ে ওঠে যে তার মুগ্ধতা কাটানো ভার। কিন্তু আরো গভীরে যেতে যেতে বুঝতে পারা যায় সে নিতান্তই ভুল ছিল। উন্নতমানের তঞ্চকতা ছাড়া সে আর কিছুই নয়। আজ মিঞা মল্লারের যথার্থতা বোঝাতে যদি আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের বৃষ্টির রেকর্ডের খাতা বের করতে হয় তবে তা আবহাওয়া দপ্তরের লজ্জা নয়, সে লজ্জা মিঞা মল্লারের। মিঞা মল্লারের আবেদন রসিকের কাছে। অরসিকের কাছে তার মাহাত্ম্য বোঝাতে গেলেই অমন ফাঁকির আয়োজন করতে হয়। ফল হয় এই, একদিন সে ফাঁকি ধরা পড়েই, তখন সে অরসিকের সে রসধারায় আসার পথটা চিরকালের জন্য বন্ধ হয়। কারণ সে ভেবে বসে এর পুরোটাই হয়ত বুজরুকি।
        তাই মানুষের হৃদয়ে করুণা, প্রেম আর সত্যের আহ্বান জানাতে বড় বড় সন্ত মাহাত্মার কোনোদিন সংখ্যাতত্ত্বের দ্বারস্থ হতে হয়নি। বরং সংখ্যাতত্ত্ব তাদের বিরুদ্ধেই সাক্ষ্য দিয়েছে চিরটাকাল। সে বড় গলা করে বলতে চেয়েছে ওই সব দুর্বলতা, ছাড়ো! স্বার্থই একমাত্র নীতি এ জগতে বাঁচতে।
        তবু সে মহাত্মারা তাঁদের অনুভূত সত্যে অটল থেকেছেন, সে প্রমাণের জোরে না। সে তাঁদের চরিত্রের জোরে, যে চরিত্র আগুনের মত উজ্জ্বল আর জলের মত কোমল। তবে গিয়ে মানুষ নীরবে তার পাশে দাঁড়িয়েছে। নিশ্চিন্তে ঘুমুবে বলে নয়, সে আগুনে পুড়ে নিজেকেও সার্থক করবে বলে। সে মহাত্মারা অত্যন্ত বড় কথা অত্যন্ত বড় করেই বলেছেন, মানুষকে ফাঁকি দিয়ে তার কাছে সহজলভ্য করে ব্যবসা করার জন্য নয়! তাঁরা যুগে যুগে এসে বলেছেন, তোমার নিজের মধ্যে এক পরম সত্য আছে। যাকে প্রেমে চেনো, বোধে চেনো। মুক্ত হও, আনন্দিত হও। তুমি যত স্বার্থত্যাগ করবে তত সে তোমার মধ্যে শক্তিশালী হবে। "বীজটা মরলেই গাছটা হবে"। তাই এই কথাটাই চিরটাকালের সত্য কথা হয়ে রইল - স্বার্থত্যাগ করো। কাঁচা আমি ত্যাগ করো; ছোটো আমি ত্যাগ করো; ভালোবেসে ত্যাগ করো; বোধের আলো জ্বেলে ত্যাগ করো; সেবায় ত্যাগ করো। অল্প অল্প করে শুরু তো করো, দেখবে ভয় কমছে, বিকার কমছে। তুমি নিজেই বুঝবে তুমি ঠিক পথে কি বেঠিক পথে। বাঁচতে গিয়ে মরার রাস্তায় হেঁটো না। স্বার্থপরতার রাস্তা মরার রাস্তা।
        হ্যাঁ গো, এই কথাটা বুঝতে প্রতিষ্ঠান লাগে? নিয়মনীতি লাগে? মানুষ নিজেকে ফাঁকি দেওয়ার অজস্র কৌশল বার করে। আমাদের অজস্র দুর্বলতা। ভয়, অনিশ্চয়তা। সবই সত্য। তবে সেগুলোর কাছে আত্মসমর্পণ কোনোদিন সেগুলোর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পন্থা হতে পারে না। যতই তাকে সোনার শিকলে বাঁধি না কেন। অবশেষে সবটাই ফাঁকি।
        "যে করেই হোক” - কথাটাতে আমার খুব অসুবিধা লাগে। “end justifies the means” বা "সব ভালো যার শেষ ভালো” কথাটা আর কোথায় খাটে আমি জানি না, কিন্তু এই আত্মোপলব্ধির পথে খাটে না। সঠিক উপায় ছাড়া সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না। আর এক্ষেত্রে তো পথই নেই। truth is a pathless land -- এ এককালে কবীরজি বলেছিলেন, হাল আমলে জে কৃষ্ণমূর্তি বললেন।
        এটা অভ্যাসের কথা না, পুনরাবৃত্তির কথা না। তাগিদের কথা। প্রাণের তাগিদের কথা।

 

 

 

 

 

 

 

 

436
Fri, 07/28/2017 - 13:00
সক্রেটিস নেতা ছিলেন, না গুরু ছিলেন, না শিক্ষক ছিলেন? সক্রেটিসের কোনো ধ্যানের মন্ত্র আছে? পূজাপদ্ধতি? নেই। তিনি শিক্ষক ছিলেন। সব শিক্ষকই সঠিক অর্থে শিক্ষক হলে দার্শনিক। যিনি জ্ঞানের অন্বেষণ করেন। আর সেই অন্বেষণের পার্শ্বধারায় স্বতঃউৎসারিত স্রোত হিসাবে জন্মায় শিক্ষকতার তাগিদ। তাই সক্রেটিস-প্লেটো-অ্যারিস্টটল দার্শনিক তথা শিক্ষক। 
        দেখুন এই ধারায় একটা শিক্ষক ছাত্রের সম্বন্ধ থাকলেও কেউ কারোর স্তব রচনা করেননি, অতিলৌকিক গুণাবলীতে ভারাক্রান্ত করেননি। যীশুর ক্ষেত্রে হল। কারণ তাঁকে বলা হল গুরু। এই 'গুরু' শব্দটার সাথে আমরা ভারতীয়েরা বোধহয় ভ্রূণাবস্থা থেকে পরিচিত। গুরু - যিনি অন্ধকার দূর করেন ইত্যাদি স্তোত্র আজ থেকে কয়েক দশক পিছোলে বোধহয় কোনো ভারতীয়ের ধড়বিহীন মাথাও আবৃত্তি করতে পারত। অন্ধকার দূর হয়েছিল কি? সে বড় কঠিন প্রশ্ন। সমাজের দিকে পক্ষপাত-নির্মম দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়, যতজন অন্ধকারের দূরকর্তা এসেছিলেন সে অর্থে প্রায় কিছুই হয়নি। বিবেকহীনতার অন্ধকার আর বুদ্ধিভ্রষ্টতার অন্ধকার দুটোই গ্রাস করে রেখেছিল, বহুলাংশে এখনও আছে। 'অমানবিক' হওয়ার স্বপক্ষে ভারতীয় শাস্ত্র তথা দর্শনের মত শক্তিশালী উপকরণ খুব কম দেশেই মজুত হয়েছে। 
        একপেশে কথা বলছি? আপনি গ্রন্থের উদ্ধৃতি না দিয়ে চারপাশটা তাকান, স্পষ্ট হবে। অতীতে বহুদেশই অমানবিক আচার-প্রথা দুষ্ট ছিল। কিন্তু যুক্তিনির্ভর শিক্ষার আলোক বিস্তারের সাথে সাথে সে ধারা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। আর এই কথাটা বলব বলেই এ প্রসঙ্গের অবতারণা। তাদের শিক্ষক ছিল, আমাদের ছিল গুরু। শিক্ষককে প্রশ্ন করা যায়, সংশয় প্রকাশ করা যায়। গুরুকে করা যায় না। এমনকি তিনি বুড়ো আঙুলটা চাইলেও দিয়ে দিতে হয়। এই দ্রোণাচার্য্য-একলব্য প্রসঙ্গ আমার কাছে গর্বের না, লজ্জার। সে যদি সেদিন বুড়ো আঙুলটা দিতে অস্বীকার করত তবে সেদিন থেকে ভারতের চিন্তা-বোধের ধারা অন্যখাতে বইত হয়তো। এরকম অজস্র উদাহরণ ভারতীয় গল্প-পৌরাণিক কাহিনীতে ছড়িয়ে আছে, আদতে যা দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে চলেছে আমাদের। মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে গেছে এই অসঙ্কোচ, প্রশ্ন দ্বিধাহীন বুদ্ধিবৃত্তের আত্মসমর্পণ। কোনো প্রশ্ন নয়, শুধু আজ্ঞা প্রতিপালন। কিন্তু শিক্ষকের সাথে সে নিঃশর্ত, প্রশ্নহীন সম্বন্ধ নয়। সেখানে শিক্ষকের বোধ-অভিজ্ঞতার সাথে নিজের বোধ-অভিজ্ঞতার যুক্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তা যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ সংঘর্ষ। তাতেই গতি, তাতেই উভয়পক্ষের মঙ্গল। ভারতীয় প্রথায় এ ধারা রুদ্ধ। কোথাও কিঞ্চিৎ প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও তা এতটাই ভক্তিপূর্ণ ভয় মিশ্রিত যে বুদ্ধির তীক্ষ্ণ আক্রমণের স্পর্ধা সেখানে নেই। শ্রদ্ধা, নম্রতা ইত্যাদি যুগ যুগ লালিত অতিপ্রিয় শব্দ তথা গুণাবলীর আড়ালে বুদ্ধির ক্ষুরধার গতি নির্জীব মৃতপ্রায়। তাই সেই অর্থে নানান অতীন্দ্রিয় মতবাদের বৈচিত্র‍্যময় সম্ভারে আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো ভরে থাকলেও, সঠিক অর্থে বিজ্ঞানের পথ কোনোদিন পাইনি। সেদিকে উৎসাহিত করবে কে? কে নীতিকে বাস্তবমুখী, প্রয়োগমুখী করে তুলবার প্রয়াস পাবে? সে তো ঔদ্ধত্য। আমাদের অমুক শাস্ত্রে, অমুক যুগে যাই হয়ে থাক, সমাজের যে ইতিহাস ধারা নিয়ে আসছিলাম, তাতে মাঝখানে বিদেশী শাসন পর্ব না এলে যে কি গতি হত আজ ভাবতে শিউরে উঠতে হয়।
        যা কিছু শরীর নিজের সাথে মিলিয়ে নিতে পারে না, তাই ক্রমশঃ শরীরের পক্ষে বিষ হয়ে ওঠে। আমাদের অপ্রশ্নক আনুগত্য তাই করেছে। দ্রৌপদীর নিজস্ব প্রতিবাদের ভাষা থাকতে নেই। সীতার নেই। কোনো নারী চরিত্রের নেই সে অর্থে। হলে সে ব্যতিক্রম। কর্ণের নিজস্ব কণ্ঠ থাকতে নেই। সবাই নাকি নিজের নিজের ধর্মের প্রতি চরম দায়বদ্ধ। এই অসীম দায়বদ্ধতাই ধর্ম, গুণের লক্ষণ। এ তো গেল পৌরাণিক, কাল্পনিক উপাখ্যান। বর্তমানেও কি এর থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত আমরা? না তো। এখনও জ্ঞানে-অজ্ঞানে মাথা বিকোবার জায়গা খুঁজছি না আমরা? গুরু না হোক নেতা?
এইটা আরেকটা বড় ভয়ের দিক। গুরু আর নেতার একটা সংমিশ্রণ ইদানীং সমাজে বেড়ে উঠেছে। অর্থাৎ তারা যে শুধু আপনার নিঃশর্ত হৃদয়পদ্মে পূজিত হতে চাইছেন তা নয়। রীতিমতো দল পাকিয়ে, গোষ্ঠী বানিয়ে একজন পুরোদস্তুর নেতাও হয়ে উঠছেন। মানে আরকি আপনার মস্তিষ্কের চলার রাজাও তিনি হবেন। আপনার আবেগ, বিবেকবোধের উদগাতা আর যুক্তি-বুদ্ধির নিয়ামক একজনই হলে আপনাকে আর পায় কে? সব বিষয়ে তিনিই শেষ কথা। আর আপনার 'yes man' সেজে থাকা। আপনার পরকালে কি হবে, সেখানে ঘর বুকিং পাবেন কিনা, আপনার মেয়ের ঠিক কোন বর্ণের ছেলের সাথে বিয়ে দিলে সব দিক থেকে মঙ্গল... আপনার আগাম দিনে কোনো কঠিন ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, ইত্যাদি সব কিছুর উত্তর তারা জানেন। নেতা-গুরু প্যাকেজ। যদি কিছু অমঙ্গল হয়, সে আপনার অশ্রদ্ধা, সঠিক মাত্রায় ঠিক না করার ভুল। আর যা কিছু ভালো সে তাদের উদ্ভুত বা প্রাচীন ঋষির দেওয়া অমোঘ বিধানের অনুসরণের ফল।
        এ উৎপাত যে আধুনিক আমদানী তা অবশ্য বলা ভুল। এ চিরটাকালই ছিল আমাদের দেশে। ইদানীং বাড়ছে। আসলে আমরা ভীষণ কনফিউজড। এত প্রশ্ন মাথায় আসা কি ঠিক, সব কিছুকেই এত objectively বা বস্তুগত করে দেখাতে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে না? জীবনে কিছু একটা রহস্য রহস্য, ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা, অধরা অধরা না থাকলে কি ভালো লাগে? হাজার হোক আমাদের একটা সংস্কার আছে না? আমরা কোনো দিনই অমনধারা উদ্ধত নই। যা কিছু প্রতিবাদহীন নম্র আমরা তারই জয়গান গেয়েছি। কিন্তু কথা হচ্ছে খাবার হজম হল না, এদিকে তা মুখ দিয়ে কিম্বা পায়ুদ্বার দিয়ে বেরোনোর অবকাশও পেলো না, তখন তার কি হবে? সে শরীরের মধ্যে আরেকটা শরীর তৈরি করবে। আমার মধ্যে আরেকটা দুর্বোধ্য প্রতিকূল সত্তা। তাকে নম্রতা দিয়ে, শ্রদ্ধা দিয়ে না চেপে রাখলে চলবে কেন? তার যতই ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতা, অবসাদের কোমল নেশা, পরাক্রমহীনতা থাকুক না কেন, আদতে তো আমরা ভালো মানুষ? নাকি? হ্যাঁ তো।
        তাই আমাদের যুক্তিতে আর বিবেকে কেমন অতটা খোলাখুলি সূর্যের আলো সহ্য হয় না। নিজেকে পুরোটা মেলে ধরতে কত সংশয়, কেমন একটা লজ্জা লজ্জা লাগে। কুণ্ঠিত হই। ফিসফিস করে বলি, আরে ওসব ওদের দেশে সাজে, আমাদের না। আমাদের একটা ঐতিহ্য আছে না, আঙুল কেটে ফেলার। তাই আমাদের গুরু চাই। এই আপনি কোনো গুরু চেনেন? আর কিচ্ছু না, শুধু একটু শান্তি চাই ব্যস। আর কিচ্ছু না। যার উত্তরের কোনো প্রশ্ন করা যায় না সেই গুরু। আহা দিন না দাদা খুঁজে। মাথাটা ভীষণ অভারতীয় হয়ে উঠছে দিনদিন। কোন নাক, কোন ইড়াপিঙ্গলা, কোন সাকার নিরাকার, কোন ক্রিয়াযোগ করতে হবে বলুন... জাস্ট শান্তি চাই। শিক্ষক চাই না, গুরু চাই।
        এ হেন শান্তি অন্বেষকদের তাই শ্মশানের গৃধ্রের দল খুঁজেই যাচ্ছে, খুঁজেই যাচ্ছে, খুঁজেই যাচ্ছে। স্লোগান বলি? গুরু যদি বিবেকবোঝা তবে - "ভাগাও গুরু ভণ্ড বেশ, আনো শিক্ষক বাঁচাও দেশ"।
437
Fri, 07/21/2017 - 12:30

১৮৯৫ সালে তারিখহীন একটি চিঠিতে বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণানন্দকে লিখছেন, "এক্ষণে দেখিতেছি যে, ওই ঘন্টাপত্র লইয়া রামকৃষ্ণ অবতারের দল বাঁধিবে এবং তাহার শিক্ষায় ধূলিনিক্ষেপ হইবে... আমি যে রামকৃষ্ণ পরমহংসের শিষ্য এবং তোমরাও যে তাই, এইটি বই লিখে ছাপাতে যত্ন তো যথেষ্ট হয়েছে; কিন্তু আমি যে আজ ছ'বৎসর ঘন্টাপত্র ত্যাগ করার জন্য বলছি, তাতে কারো কানপাত নাই। আমি একমাত্র কর্ম বুঝি পরোপকার, বাকি সমস্ত কুকর্ম।”
        স্বামীজীর আরেকটা চিঠি ১৮ই নভেম্বর ১৮৯৪ সালে লেখা রাজা প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায়কে, "আমার দৃঢ় ধারণা কোন ব্যক্তি বা জাতি অপর জাতি হইতে নিজেকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়া বাঁচিতে পারে না। আর যেখানেই শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা বা নীতি সম্বন্ধীয় ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া এইরূপ চেষ্টা করা হইয়াছে, যেখানেই কোন জাতি আপনাকে পৃথক রাখিয়াছে, সেখানেই তাহার পক্ষে ফল অতিশয় শোচনীয় হইয়াছে।
আমার মনে হয়, ভারতের পতন ও অবনতির এক প্রধান কারণ - জাতির চারিদিকে এইরূপ আচারের বেড়া দেওয়া। প্রাচীনকালে এই আচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল - হিন্দুরা যেন চতুষ্পার্শবর্তী বৌদ্ধদের সংস্পর্শে না আসে। ইহার ভিত্তি অপরের প্রতি ঘৃণা। 
        প্রাচীন বা আধুনিক তার্কিকগণ মিথ্যা যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া যতই ইহা ঢাকিবার চেষ্টা করুন না কেন অপরকে ঘৃণা করিতে থাকিলে কেহই নিজে অবনত না হইয়া থাকিতে পারে না।”
        ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ শ্রীযুক্ত কালিদাস নাগকে লিখছেন, "হিন্দুধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচারমূলক হওয়াতে তার বেড়া আরও কঠিন। ... আহারে ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখ্যান করে না, হিন্দু সেখানেও সতর্ক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষ্যে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারে নি। আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু। সেইখানে পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে ... অন্য আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই … ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল।”
        ১৯৩১ সালে রবীন্দ্রনাথ 'প্রবাসী' পত্রিকায় লিখছেন, “হিন্দুসমাজে আচার নিয়েছে ধর্মের নাম। এই কারণে আচারের পার্থক্যে পরস্পরের মধ্যে কঠিন বিচ্ছেদ ঘটায়। মৎস্যাশী বাঙালীকে নিরামিষ প্রদেশের প্রতিবেশী আপন বলে মনে করতে কঠিন বাধা পায় ... যে চিত্তবৃত্তি বাহ্য আচারকে অত্যন্ত বড় মূল্য দিয়ে থাকে তার মমত্ববোধ সংকীর্ণ হতে বাধ্য।”
        রবীন্দ্রনাথ ১৮৯২ সালে 'সাধনা' পত্রিকার পৌষ সংখ্যায় লিখছেন, 'আচারের অত্যাচার' নামক প্রবন্ধ। লিখছেন, "ইহাকে স্পর্শ করিব না, তাহার ছায়া মাড়াইব না, অমুকের অন্ন খাইব না, অমুকের কন্যা গ্রহণ করিব না, এমন করিয়া উঠিব, অমন করিয়া বসিব, তেমন করিয়া চলিব, তিথি নক্ষত্র দিন ক্ষণ লগ্ন বিচার করিয়া হাত পা নাড়িব, এমন করিয়া কর্মহীন ক্ষুদ্র জীবনটাকে টুকরো টুকরো করিয়া কাহনকে কড়াকড়িতে ভাঙিয়া স্তুপাকার করিয়া তুলিব এই কি আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। হিন্দুর দেবতা, এই কি তোমার বিধান যে, আমরা কেবলমাত্র 'হিঁদু' হইব, মানুষ হইব না।”


        উপরের উদ্ধৃতিগুলোর সংখ্যা কিছু বেশি হল, কিন্তু না দিয়ে উপায় ছিল না। বিবেকানন্দের প্রথম পত্রের আশঙ্কা যে বহুলাংশে সত্যি হয়েছে সে কথা অতি অন্ধও বুঝতে পারে। যে মাটিতে 'যত মত তত পথ' মন্ত্রের উদগাতার জন্ম, সে মাটি আজ দাঙ্গার ভয়ে আশঙ্কায় আতঙ্কে দিনযাপন করছে। এর থেকে বড় ব্যর্থতা আর কি হতে পারে? বিবেকানন্দ বহু চিঠিতে তার গুরুভাইদের সাবধান করছেন, চিরটাকাল চেলারা তার গুরুর নাম বড় করতে গিয়ে শিক্ষাকে ডুবিয়েছে। অনুরোধ করেছিলেন এক্ষেত্রে যেন তা না হয়। বাস্তব কি আমরা সবাই জানি। দল বাঁধা হল, সম্প্রদায় হল শুধু না, কয়েক দশক আগে রামকৃষ্ণ অনুগামীদের একটি পৃথক সম্প্রদায়ভুক্ত করার জন্য রামকৃষ্ণ মিশন কোর্ট কাছারি পর্যন্ত করল।
        কারণ একটাই, আমাদের কাছে দর্শন সত্য উপলব্ধির চাইতে আচার প্রধান। যা কিছু প্রাচীন তাই পবিত্র। তাই যখন বাসন-কোসন আবিস্কার হয় নি, পাতায় খাওয়ার রেওয়াজ ছিল, সেই পাতায় খাওয়া আজ পবিত্র আচার। যিনি যত উচ্চ, যত গভীর, যত বিশ্বজনীন শিক্ষাই দিন না কেন, তা যদি আমরা আমাদের সংকীর্ণ আচারের মধ্যে না নিয়ে আসতে পারি তা যেন প্রতিষ্ঠা লাভ করল না। আমরা মুখে বলি “হাঁ বটে, কিন্তু... কৃষ্টিটা তো থাকে না।” তাই অবশেষে কৃষ্টিটাই রয়ে গেল, বাকি সব হয় শিকেয় তোলা থাকল, নয় অনভ্যাসে অচর্চায় দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে দৈনন্দিন জীবনে তার গুরুত্ব হারালো। আমরা প্রাচীন আর্যসমাজের গৌরবচ্ছটায় নিজেদের অজ্ঞতায় আত্মপ্রসাদ লাভ করে আত্মতুষ্ট থাকলাম, বাকি বিশ্বকে উপেক্ষা করলাম, করুণা করলাম।
        আশ্চর্য লাগে আমার আশেপাশে এখনও বহু মানুষ একে অন্যের ছোঁয়া বাঁচিয়ে খাওয়াটাকে চলাটাকে পরম পূণ্যের কাজ বলে মনে করেন। তার পিছনে তাদের উর্বর মস্তিষ্কপ্রসূত যুক্তিরও অভাব নেই। যে গঙ্গাজল নিশ্চিন্তে একগ্লাস পান করতে মনে ভয় সেই গঙ্গাজলে ঠোঁট ডুবিয়ে 'ওম্‌ বিষ্ণু ওম্‌ বিষ্ণু' বলে পবিত্র হতে মনে সংশয় জাগে না। সে আত্মায় বা বিষ্ণুতে জীবাণুর সংক্রমণ হয় না বলেই হয়তো। তবুও ওটা মানতেই হবে, কারণটা আচার। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, সমাজে গরু হত্যা করে কিম্বা অষ্টাদশ বর্ষীয়া কন্যার বিবাহ না দিয়ে একঘরে হতে হয়, অথচ মানুষ খুন করে সমাজে অনায়াসে ঠাঁই পাওয়া যায়। আচার এমনই বিষম বস্তু।
        যার অস্তিত্ত্ব আছে, যার অনুভব আছে, যার যুক্তি আছে, তাকে নিয়ে সামনের দিকে এগোনো যায়। কিন্তু যার উৎস শুধুমাত্র কাল্পনিক ভয় তাকে নিয়ে এগোনোও যায় না, নিজেদের মধ্যে শান্তিতে বসবাস করাও যায় না। তাই দেশের আচার, রাজ্যের আচার, পাড়ার আচার, গোত্রের আচার, পরিবারের আচার, বিভিন্ন গুরুদের আচার ... কোথায় যাবা? কোন একটা থেকে বাঁচবে যদি, একশোটা এসে ঘাড়ে পড়বে। অবশেষে কোন একটা তথাকথিত আধুনিক আচারের পায়ে স্বাধীন চিন্তাবোধ বিসর্জন দিয়ে 'হিঁদু' হয়ে উঠতে হয়, উঠতেই হয়।
        গুরু উচ্চাসনে বসে বললেন, ওরে মাছ মাংস পিঁয়াজ রসুন ছাড়। শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন, কেন গুরুদেব? গুরুদেব প্রসন্ন হেসে গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ওতে মানুষের আয়ুক্ষয় হয়। শিষ্য গদগদচিত্তে গুরুকে প্রণাম করে সব সংশয় মিটিয়ে ফিরে গেল। গুরু আদেশ করলেন, ওরে তামাকটা আন। এত অবধি পড়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন এল, তামাকে কি আয়ু বাড়ে? যদি প্রশ্ন করা হয়, তবে আমার মেসেঞ্জার ভর্তি অকল্পনীয় আর্যবিজ্ঞানীদের বহু আয়াসসাধ্য বিজ্ঞানপর্যবেক্ষনসম্ভুত ফল ও তার ব্যবহার ইত্যাদির তথ্যে ভরে উঠবে। রবীন্দ্রনাথ বলতেন, কুয়াশার চাইতে অন্ধকার ভাল। সত্যিই তাই। ঘরে যখন লো ভোল্টেজ হয় তখন বিরক্ত হয়ে ভাবি, এর চাইতে কারেন্ট যাক, অন্তত মোমবাতিটুকু জ্বেলে পুরো আলোটুকু পাই। লো ভোল্টেজের মুশকিল হল আবছা আলোয় সব কিছু স্পষ্ট দেখাও যায় না, ওদিকে কাজ চলে যাচ্ছে বলে মোমবাতি জ্বালতেও হাত সরে না। মোটামুটি কাজের এই নমুনা আমাদের মন্দির থেকে বাড়ী, বিদ্যালয় থেকে শ্মশানঘাট - উদাহরণে উদাহরণে ভরপুর।
        তাই যে মানুষটার রক্তমাংসের শরীর রসিক মেথর থেকে আরম্ভ করে গিরীশ ঘোষ অবধি সকলের স্পর্শযোগ্য ছিল এবং যার থেকে প্রেমাশীষ পাওয়ার যোগ্য ছিল, আজ সেই মানুষটার মর্মরমূর্তি কাঁচের আড়ালে বোধহয় হাঁপিয়েই উঠছে। যে মানুষটা নবদ্বীপ থেকে সারা ভারত পাগলের মত ছুটে বেরিয়েছিল, আজ তুলসীমালা চন্দন তিলক, নিরামিষ ভোজন ইত্যাদি তত্ত্বের জনক হিসাবেই বোধহয় মাটিতে পাথরে মাথা ঠুকছেন। বুদ্ধ দেশছাড়া, কবীর লুপ্তপ্রায়। কারণ, এদের আচারে বাঁধতে বোধহয় ততটা সুবিধে করা যায় না। ভয় হয় আজ থেকে দুশো বছর পরে রবীন্দ্রনাথের নামেও না "ওম্‌ রবীন্দ্রনাথায় নমঃ” মন্ত্রে দীক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়, এবং পঁচিশে বৈশাখ খিচুড়ি অন্নের ব্যবস্থা করা হয়। কি কি পোশাকে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে হবে এবং কি কি ফুল ব্যবহৃত হবে সে সব তো ইতিমধ্যে আচারের মধ্যে এনে ফেলেছি, বাকিটাও বোধহয় এসে পড়ল বলে।

438
Fri, 07/14/2017 - 15:30

একবার আমার এক পরিচিত মানুষের সাথে গল্প করছি, খুব অসুস্থ উনি তখন, দুটো কিডনীই খারাপ। উনি মজা করে বলছেন, “জানো তো সাউথে গিয়েছিলাম চোখের চিকিৎসা করাতে শঙ্কর নেত্রালয়ে। কিন্তু হোল বডি চেক আপ করাতে গিয়ে যখন জানলাম যে আমার কিডনী দুটোই খারাপ এবং তাড়াতাড়ি বদলাবার ব্যবস্থা না করলে মৃত্যু আসন্ন তখন কি আর চোখের কথা ভাবি?” বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন।
        এয়ারটেলের বিজ্ঞাপনের বাংলাটা পড়ে হাসি পেয়েছিল। একটা বাক্য ঠিকঠাক গঠিত হয়নি বলে। কিন্তু 'সম্পর্কতা' শব্দটা নিয়ে কিছু সেরকম মনে হয়নি। ওটা অনেকে হাইলাইট করছেন। ওটা নিয়ে অনেক মজাও হচ্ছে। সে সব পড়েও বেশ মজা পাচ্ছি। আসলে আমি দেখেছি অনেকেই, আমি নিজে তো বটেই, 'সৌজন্যতা', 'দারিদ্র্যতা' এরকম আরো কিছু শব্দ বলে বা লিখে ফেলি। তারপর কেউ কেউ বলেন, অমনি ঠিক করে ফেলি। কিসের একটা ফ্লো-তে বলে ফেলি তা জানি না। তবে আমার মত অনেকেই বলেন দেখেছি, অবশ্যই যারা আমার মত বাংলা ব্যাকরণে নিতান্ত দুর্বল তারাই করেন। ইংরাজিতে যেমন disbalance শব্দটা। আমি লিখতেই তলায় লালদাগ দেখাল, অর্থাৎ কিনা অভিধান বহির্ভূত শব্দ। কথাটা যে imbalance তা অন্যকে ঠিক করে দেওয়ার মধ্যে আমি বেশ একটা আত্মপ্রসাদও লাভ করি মনে মনে। যদিও জানি বক্তা কি বলতে চেয়েছে এবং সে নিজেও সেটা বুঝেছে যে আমি বক্তব্যটা বুঝেও ওকে ঠিক করে দিচ্ছি। কারণ যদিও ভাষার প্রথম প্রয়োজন মনের ভাব প্রকাশ, তা হলে কি হবে, একটা শৈলী তথা নিয়ম আছে না? যতই সেটা গৌণ হোক না এখন সেটাই মুখ্য। যেমন এককালে পোশাক পরিধান করত মানুষ লজ্জা নিবারণের জন্য। এখন লজ্জা নিবারণ গৌণ হয়ে গেছে, এখন তার অলঙ্কার, তার রকমই প্রধান। তা এরকম তো কত কি-ই পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে, যাবেও।
        তো যে কথাটা বলছিলাম, এয়ারটেলের বিজ্ঞাপনটা। আচ্ছা একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখবেন, গুগুল ট্রান্সলেটে হিন্দীটা যত ভালো অনুবাদ হয় ইংরাজী থেকে বাংলাটা তত ভালো হয় না। এমনকি গুগুল সার্চে কোনো একটা শব্দ লিখলে প্রথম সার্চেই যে অপশানটা আসে সেটাতে একটা অনুবাদের জায়গা থাকে, তাতে হিন্দীটা প্রায় সব শব্দের সাথে আসে, কিন্তু বাংলাটা আসে না। এটাই বলতে চাইছি। 
        আমরা আমাদের ভাষা নিয়ে যতই রক্ষণশীলতা রাখি না কেন, প্রয়োগশীল না হলে বাঁচব কি? বলে রাখি এই 'প্রয়োগশীল' শব্দটা কিন্তু অভিধানে পেলাম না। তবু যা বলতে চাইছি তা বোধহয় বোঝাতে পারছি। দৈনন্দিন জীবনে কতটা জায়গা আমার ভাষাটার? কর্মক্ষেত্রের কথা থাক। সেখানে সর্বভারতীয় স্তরের কথা আলাদা। কিন্তু কতজন মানুষ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে শুদ্ধ বাংলায় নিজেকে রাখা সম্ভব বলে ভাবতে পারেন? অসম্ভব। কারণ আমাদের ভাষার প্রয়োগের দিকটা ক্রমশঃ সঙ্কীর্ণ হতে শুরু করেছে এই টেকনোলজীর যুগে। কতজন নিজের মোবাইলটা বা ফেসবুকটাতে বাংলা মাধ্যম করে রাখেন। এক যদি না তার আদর্শগত কোনো দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু সেটা তো আলাদা কথা। যেমন ধরুন আমি বায়োলজী পড়াতে গিয়ে যে সমস্যার মুখোমুখি হই। এক একটা বইতে এক একটা বাংলা টার্ম। spermathica কোথাও হচ্ছে শুক্রধানী তো কোথাও শুক্রাধার তো কোথাও শুক্রথলি। মানে এক, কিন্তু পরিভাষা আলাদা। আমাদের সে সদিচ্ছা নেই যে একটা বোর্ড গঠন করে পরিভাষাগুলোকে এক রকম করতে। আরো দেখুন, আপনি একটা ইংরাজী ভুল লিখুন, কি ভুল বানান লিখুন, অমনি তলায় লালদাগ চলে এসে সতর্ক করে দেবে আপনাকে। কিন্তু বাংলায় খুঁজতে যান, পাবেন না। আমরা অত খাটব কেন? আমাদের রবীন্দ্রনাথ আছে... বিবেকানন্দ আছে...
        আমি ভুল লেখা বা বলাকে সমর্থন করছি না। কিন্তু কথা হচ্ছে আমার উপরের ওই গল্পটার মত, যে ভাষাটা মরতে বসেছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্তর থেকে জীবনের, প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে, সেখানে একটা কোম্পানীর বিজ্ঞাপন আর কি করবে? ভাষাটাকে আরো প্রযুক্তির সাথে যোগ না করতে পারলে, আরো সহনীয়, নমনীয় না করতে পারলে টিকে থাকব কি করে? প্রযুক্তির সাথে যারা যুক্ত তাদের মধ্যে আরো 'অভ্র'-র সৃষ্টিকর্তার মত মানুষ না আসলে সমস্যা। আরো পরিভাষা চাই। আরো বাংলার ব্যবহার চাই। নতুন শব্দ চাই-ই চাই। ভাবের তাগিদে ভাষা তৈরি হয়। কিন্তু হাতের কাছে সেই বাইরের কোম্পানীর বস্ত্র পেলে কে আর খাদি পরতে চাইবে? তখন রক্ষণশীলতা ছাড়া আর তো কোনো গর্বের জায়গা বেঁচে থাকে না। যে গাড়ি চলার গৌরব হারিয়েছে তাকে মিউজিয়ামে না রাখলে, ক্ষণে ক্ষণে তার হৃত গৌরব স্মরণ না করলে যে তার মান রাখা দায়। তাই কি ভবিতব্য হতে চলেছে তবে? নিশ্চই না। ভেঙে গড়তে হবে। গড়তে গেলে ভাঙতে হবেই। কিন্তু শুরুতেই ভাঙার মধ্যে গড়ার তাগিদটা গড়ে নিতে হবে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেই হবে। সেই সাচ্চা তাগিদটাই নতুন চলার শক্তিতে ঝাঁপাবে। আর চলমান বস্তুর শুদ্ধতা নিয়ে কেউ ভাবে না। বেডসোরের কথা ভাবব কেন যদি ভাষাটা হেঁটে চলে বেড়ায়? বালাই ষাট!

439
Tue, 07/11/2017 - 23:00

(এই লেখাটি পড়ার পর যারা আমায় আনফ্রেণ্ড করতে চান, সানন্দে করুন। প্লিজ বোকা বোকা তর্ক জুড়বেন না। আমার অভিজ্ঞতায় সত্য যে বেশে প্রতিভাত আমি তাতে দায়বদ্ধ। কাল যদি এর বিপরীতটা সত্যি বলে মনে হয়, তাও বলব, দ্বিধা করব না।)

বিশ্বাস জন্মানো আর বিশ্বাসে জন্মানো - দুটো আলাদা কথা। ইংরাজীতে illusion, delusion বলে দুটো আলাদা শব্দ আছে। Illusion অর্থে দাঁড়ায় মায়া, যা ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। আর Delusion অর্থে দাঁড়ালো ভ্রান্তি - মিথ্যা বিশ্বাসকে আঁকড়ে বাঁচার প্রবণতা, বাস্তব সে বিশ্বাসের নানা বিপরীত উদাহরণ দেখলেও।
আরেকটা ইংরাজী শব্দ ব্যবহার করতে চাই – violence. এর কোনো সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই আমার। এবার আসি মূল কথাটায়। বিশ্বাস।
        বিশ্বাস মানুষের চিত্তে একলা জন্মায়। মানুষের যতগুলো চিত্তবৃত্তি আছে তার মধ্যে একমাত্র বিশ্বাসই একলা দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে। বুদ্ধির প্রমাণ-যুক্তি লাগে। অনুভবের একটা উৎস তথা উদ্দীপক লাগে। বিশ্বাসের কিছু লাগে না। এইখানেই তার জোর আর এইখানেই সে ভয়ংকর হতে পারে। অন্যদিকে এই নির্ভরতাই বুদ্ধি আর অনুভবের সীমাবদ্ধতা আবার তাদের প্রয়োগশীলতা।
        কোনো কাজের প্রারম্ভের বাঁশিটা বাজে বিশ্বাসের হাত ধরে। তারপর তাকে এগিয়ে নিয়ে চলে যুক্তি আর অনুভবের স্বচ্ছতা। সে কলম্বাসের দেশ আবিষ্কারই হোক, কিম্বা নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার। এক নতুন দেশ থাকবেই - এই বিশ্বাস কলম্বাসকে ঘর ছাড়া করেছিল, অন্যদিকে নিশ্চই এর কোনো কারণ থাকবেই এবং যা অনুধাবনযোগ্য - এই বিশ্বাসই নিউটনকে ভাবতে প্রবৃত্ত করেছিল। মূল বিশ্বাস। 
সেরকমই একটা বিশ্বাস - জগতের একজন স্রষ্টার উপর বিশ্বাস। একজন নিয়ন্তার উপর বিশ্বাস। জগৎনীতির কোনো একজন প্রেরক-রক্ষকের উপর বিশ্বাস। ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র জয়-পরাজয়, পাওয়া-না পাওয়া, ত্যাগ-ভোগ ইত্যাদির জটিলতায় কোনো এক দায়িত্বপরায়ণ অতি-মানুষী অস্তিত্বের উপর বিশ্বাস। 
        এই বিশ্বাসগুলো একা জন্মায়। কিন্তু বোধ হওয়ার পর সে বুঝতে পারে তার সেই বিশ্বাসের একটা প্রতিষ্ঠিত রূপ আছে। যাকে সবাই ধর্ম বলে। প্রথমত সে মেনে নেয়। এই মেনে নেওয়াটা সহজ হয় কারণ এই বিশ্বাসের বোধটা সে নিয়ে জন্মিয়েছে। যেমন সংখ্যা, আকার, রঙ, সুর ইত্যাদিকে মনের মধ্যে ধারণ করার বৃত্তি সে নিয়ে জন্মেছে, এও তেমনি। 
        অভিজ্ঞতা বাড়ে, তার মনের ভিতর তার চিন্তার পটভূমিটা পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। সে এক বিশ্বাস থেকে আরেক বিশ্বাসের দিকে যায়। এক -ism থেকে আরেক -ism বলা যায়, কিন্তু কোনো ism ছাড়া সে বাঁচতে পারে না, কারণ ওটা তার মূল প্রবৃত্তিগুলোর প্রথম প্রবৃত্তি।
        আমার এই আলোচনার কেন্দ্র তাও নয়। এগুলো তো প্রাককথন মাত্র। আমার কথাটা হল - বিশ্বাস না, বিশ্বাসকে ব্যবহার করা। আজ যে সমস্যাটা সভ্যতার সব থেকে বড় সমস্যার আকার ধারণ করছে তা হল – আতঙ্কবাদ। সমস্যাটার মূল কারণ ধর্মবিশ্বাস না, ধর্মবিশ্বাসের ব্যবহার। আমি ইচ্ছাকৃতেই 'অপব্যবহার' শব্দটা বলছি না, কারণ যে কোনো বিশ্বাসের যে কোনো ব্যবহারই অপব্যবহার। আমি যদি আপনার সেই আদিম বিশ্বাসে আঘাত এনে প্রমাণ করতে পারি যে অমুক নদীতে অমুক তিথিতে ডুব দিলে আপনার উপর সেই সর্বশক্তিমান প্রচণ্ড খুশী হবে, তবে আপনাকে এও বোঝাতে পারি অমুক ধর্মের উপাসকদের হত্যালীলায় মাতলে সর্বশক্তিমান তোমার উপর অত্যন্ত প্রসন্ন হবেন। আপনি বলবেন, প্রথমটা নিরীহ, কিন্তু পরেরটা ভয়াবহ। আমি বলব দুটোই ভয়াবহ, একটার ক্ষতির মাত্রা কম, আরেকটার ক্ষতির মাত্রা তীব্র। কারণ দুটোতেই ব্যবহার কথাটা আসছে, বিশ্বাসকে ব্যবহার, অন্য অর্থে violence. 
মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিকে ব্যবহার করলে তার ক্ষতির পরিমাণ ওই মাত্রায় পৌঁছায় না, যা তার বিশ্বাসকে ব্যবহার করলে হয়। কারণ বিশ্বাসে সে আদিম কিন্তু বুদ্ধিতে সে আধুনিক। আমি বহু ধর্ম্মমত, বহু গুরু-অবতার-আচার্য্য পড়ে এটুকু বুঝেছি তার মধ্যে ফাঁকির অংশটা অনেক বড়। তার মোদ্দা একটা কথাই হল বিশ্বাসের উপর manipulation. 'আমি জানি, তুমি জানো না' - এ কথা বস্তুজ্ঞানের ক্ষেত্রের মানা যায়। অঙ্ক, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান ইত্যাদি সবের ক্ষেত্রে মানা যায়, কিন্তু এই যখন বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আসে? অর্থাৎ 'আমার বিশ্বাস ঠিক, তোমারটা বিশ্বাসটা এসো ঠিক করে দিই' তখনই এলো প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা। 
        একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। কোনো একজন মানুষ, যিনি গুরু, তিনি আপনাকে আমাকে সে অর্থে চেনেন না, জানেন না অথচ তিনি একটা ঘরে আপনাকে আর আপনার মত আরো বহু মানুষকে নিয়ে গিয়ে একটা সংস্কৃত শব্দ উচ্চারণ করলেন, ব্যস, সব হয়ে গেল। এবার আপনি বছরের পর পর বছরের ওটি পুনরাবৃত করে যান, কেউ খোঁজ নিতে আসবে না আপনার উন্নতি না অবনতি হচ্ছে, কেউ জানতে চাইবে না ওই শব্দবন্ধটাতেই আপনার যাবতীয় তৃষ্ণা মিটল কিনা? ওটিই আপনার প্রকৃতির সাথে সঠিক অনুপানে গেল কিনা?... কেউ জানতে চাইবেন না। আপনি শুধু পুনরাবৃত্তি করতে থাকবেন, তাতে ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে একটা অবশেসান তৈরি হবে, অন্য অর্থে আপনি চাইবেন যেন আপনার মধ্যে সেই অবশেসানটা তৈরি হয় যাতে করে আপনি কঠোর বাস্তবটা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও পালাতে পারেন, তারপর দল তৈরি করবেন, আপনার বিরোধীদের মনে মনে করুণা করবেন, যদিও বাইরে বাইরে একটা সর্বধর্মসমন্বয়ের মুখোস রাখবেন, কারণ ওটা মার্কেটে চলছে সবচাইতে বেশি এখন। কিন্তু কোনোদিনই সমজ্ঞান করতে পারবেন না। কারণ আপনার অর্জিত বস্তুটাই যখন আপনার কাছে ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা তখন অন্যের পথ হয় আপনার কাছে ঈর্ষার কারণ নয়ত করুণার। 
        এটা ভায়োলেন্স। আপনি মেনে নিচ্ছেন কারণ আপনার হাতে অপশান নেই। ঠিক এরই চূড়ান্ত ভয়ংকর রূপ হল ওই জঙ্গীগোষ্ঠীগুলো। তাদের বিশ্বাসগুলোও ওরকম ভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। হতেই থাকবে, কারণ প্রতিবাদ করার মত শুদ্ধ বিশ্বাসী সত্তা কই? আপনি এক রকম অবসেশান চান, সে আরেক রকম, অবশেষে সবটাই সেই অবসেশানের উপর দাঁড়িয়ে। ওদের বাঁচিয়ে রাখার, মদত দেওয়ার বিত্তশালী মানুষের অভাব নেই। কারণ কুরুক্ষেত্রটা হয়েছিল কৌরবদের জন্য না, যুধিষ্ঠির, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্রের মত ক্ষমতাধর, শক্তিশালী মানুষগুলো চুপ করেছিল বলে। আমরা চুপ থাকব। কারণ আমরা ঘুম থেকে জাগতে চাই না। আমাদের দুর্বলতায় সুড়সুড়ি দেওয়া লোক আমরা ঠিক খুঁজে বার করে নেব, যারাই জাগার কথা বেশি বলবে তাদের নামে পূজোর ব্যবস্থা চালু করে আচ্ছা সে প্রতিশোধ নেব। সন্ন্যাসীর গান সেলুট দেখব, তিনি কোনদিন কি মোজা পরতেন, কি অসম্ভব ভালো কথা বলতেন, কবে কোথায় জন্মেছিলেন, হেঁটে ছিলেন, চুল কামিয়ে ছিলেন সে ফর্দ মুখস্থ করব। ওগুলো আমার জীবনচর্চা। যারা ওসব করবে না তাদের ভীষণ ক্ষতি হবে ভয় দেখাব। যেমন ইদানীং শুনলাম, অত্যন্ত শিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ, ঈষ্টনিষ্ঠ একজন মানুষের কাছে, অমুক সময়ে অমুক মন্ত্রে দীক্ষা নিইনি বলেই আমার মা মারা গেছেন, আমার পরিবারে একটার পর একটা দুর্যোগ এসেছে। এটাও ভায়োলেন্স। 
        একজন অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ লেখিকা আমায় ফ্রেণ্ড রিক্যোয়েস্ট পাঠালেন। আমি বিনা সন্দেহে আপ্লুত হয়ে তাকে গ্রহণ করলাম। সাথে সাথেই তিনি আমার একটা লেখার কমেন্টস বক্সে গিয়ে লিখলেন, রামকৃষ্ণ মিশনে জাতপাত মানা হয় না। আমি বললুম, তবে কুমারী শুধু বামুনের মেয়ে হয় ক্যান? উনি এড়িয়ে গেলেন। তারপর দেখি আমার কোনো লেখাতেই ওনার কোনো সাড়াশব্দ নেই, তখন বুঝলাম, ও আচ্ছা, আমায় শুধু ওই জ্ঞানটুকু দেওয়ার জন্যেই কপট বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো। অর্থাৎ সত্যের উপরে দল অবস্থিত। এটাই ভয়ংকর। এটাই delusion. এটাই ভিতরে ভিতরে মারে। বাইরে মারার সুযোগ করে দেয়। এটাই নিজের বিশ্বাসের ব্যবহার হতে দেওয়া। তবু বলব না - আত্মোদীপো ভব। যে বলেছিল আন ব্যাটাকে পূজো করে বলি দিই। জয় মা!


 

440
Sun, 07/09/2017 - 10:00

(আজ গুরুপূর্ণিমা। প্রজ্ঞা, জ্ঞান, বোধ, শুভবুদ্ধির দীপশিখা বহনকারী সেই পুরাকাল থেকে অধুনা সমস্ত আলোকিত আত্মার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।)

বিবেকানন্দের একটি বিখ্যাত উপমা - নিউটন আপেল মাটিতে পড়া দেখে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটি আবিষ্কার করলেন। তা বলে কি মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটিও গাছের সাথে ঝুলছিল? না। সেটা নিউটনের নিজস্ব ভাবনাপ্রসূত। ভাবনার উৎস অবশ্যই ওই আপেল, যা নিউটনের মনকে আন্দোলিত করেছিল।
        অভিজ্ঞতা আর বোধের মধ্যে তবে সম্পর্কটা ঠিক কোন গোত্রের? বোধ কি তবে অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞার মিলিত সত্তা একটা? যার বহিঃপ্রকাশ হল চরিত্র? কিরকম একটু ভাবা যাক। 
        আমাদের জীবন অর্থে একটা নিরবচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতার ধারা। ঘুমের গভীরতাও আরেক ধরণের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতাগুলোর একটা নির্যাস কেউ গ্রহণ করে আমার অন্তরের মধ্যে, ধীরে ধীরে একটা রূপ গড়ে ওঠে আমার। বাইরের আমি ততটা 'আমি' নই যতটা আমি ভিতরের 'আমি'। মানে আমার সাথে আমি। বাইরের 'আমি'টার প্রধান অংশ জুড়ে একটা অভিনয়। তাতে অনেক গোঁজামিল, অনেক ফাঁকি। সে আমিও জানি। কিন্তু ভিতরের ওটা কি বলা হল? আমার সাথে আমি? “তোমার ভিতর বসত করে কয় জনা মন, কয় জনা?”
        আমার চেতনায় যে সত্য উদ্ভাসিত হয়, তাকে অনুধাবন করে কোন চেতনা? তার কি সংজ্ঞা হয়? রূপ হয়? হয় না তো। কিন্তু কথা হচ্ছে অত ভিতর মহলে কোনো ধুলোবালি ঢোকে না, যতটা থাকে বাইরের মহলগুলোতে। আর আমাদের চিন্তা-বলা-চলা সবই ওই বাইরের মহলের থেকেই। অত গভীরে ঢুকলে ছাই কাজ হয় নাকি? তবে? সেই বাইরের মহল নিয়েই কথা। 
        এও তো সত্যি যে, ভ্রান্তিও এক ধরণের অভিজ্ঞতা? ভ্রমের অবসানও আরেক ধরণের অভিজ্ঞতা? কিন্তু যে সময় আমি ভ্রান্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সে সময়টাতে তো আমার ভ্রম ভাঙার অভিজ্ঞতা হচ্ছে না। যেমন স্বপ্নের অভিজ্ঞতা যখন হচ্ছে তখন তো আমি সেটাকে স্বপ্ন বলে জানছি না, তাকে তো সত্যি বলেই বোধ হচ্ছে। কারণ সব মিথ্যার বিশ্বাস উৎপাদনের হাতিয়ার তো ওই সত্যের মুখোস, সেকি আর জানতে বাকি আছে! এও তেমন। যখন আমার ভ্রান্তির অভিজ্ঞতা হচ্ছে, অর্থাৎ ভ্রান্তিকেই সত্য বলে বিশ্বাস করছি, অনুভব করছি, চিন্তা-বলা-চলাকে চালিত করছি সেই অনুযায়ী, যে যাই বলুক নিজের গোঁ'তে টিকে থাকার আত্মাভিমান পোষণ করছি মনে মনে, তখন কি বিন্দুমাত্রও আভাস পাচ্ছি যে, এ প্রাসাদ বালির উপর দাঁড়িয়ে? কিছু মুহূর্ত পরেই ধুলোয় চুরমার হয়ে ভেঙে পড়বে? না তো, জানছি না। তাই "না জানিয়া পথ ভ্রমিতেছি পথে, আপন গরবে, অসীম জগতে"। 
        এই তো হল অভিজ্ঞতার অবস্থা। সে ভ্রান্তি থেকে পরিত্রাণের কোনো আশা নেই। কোনো মানুষ কোনোদিন জোর দিয়ে বলতে পারবে না তার সমস্ত অভিজ্ঞতা সত্যসঞ্জাত। মূলেই যে সে কথা স্বীকার করা - 'যা দেবী সর্বভূতেষু ভ্রান্তিরূপেণসংস্থিতা / নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমোঃ'। তবে উপায়? নাস্তিক বলবে 'সময়', আস্তিক বলবে 'ঈশ্বরের কৃপা' - 'অসতো মা সদগময়... তমসো মা জ্যোতির্গময়... আবীরাবীর্ম এধিঃ'.. হে স্বপ্রকাশ তুমি আপনাকে প্রকাশ করো আপনি। এ আদিম প্রার্থনা। মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এই প্রার্থনা উদগত হয়েছিল সেই প্রাচীন যুগে, ক্ষুদ্র 'আমি'র স্বার্থে নয়, বৃহৎ 'আমি'র স্বার্থে। যে আমিটা বাইবেলের মতে শুধু রুটিতে বাঁচে না। সে সত্যজ্ঞানপুষ্ট হতে চায়। তার জন্য সে নানান ত্যাগ স্বীকার করে, কৃচ্ছসাধন করে, এমনকি আত্মাহুতি পর্যন্ত দিতে প্রস্তত থাকে। শুনেছি  'হেলিকোব্যাকটর পাইলোরী' নামক জীবাণুর অস্তিত্বের আবিষ্কর্তা দুই বিজ্ঞানী, উক্ত জীবাণুতে যে সত্যিই পেটে ক্ষত সৃষ্টি হয় প্রমাণ করার জন্য নিজেরা সেই রোগে ইচ্ছাকৃতভাবে সংক্রামিত হয়ে প্রায় জীবন বিপন্ন করে প্রমাণ করেছিলেন। এ উদাহরণ বিজ্ঞানের জগতে বিরল নয় অবশ্য। 
        কিন্তু সে তো গেল জাগতিক জ্ঞানের জগতের কথা। মানুষের তো দুটো রাজ্যে বিচরণ, এক বাইরের আর এক ভিতরের। বাইরের রাজ্যে তো যুক্তি-প্রমাণ ইত্যাদির মাধ্যমে সুরাহা মেলে। ভিতরের জগতে? সেখানে যুক্তি কিছুদূর গিয়ে পথ হারায় আর প্রমাণ কার কাছে কে করবে? সব ঘেঁটে ঘ। সেখানেও ভ্রান্তির পর ভ্রান্তি। যে শরীর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, সেটা গেলে কি আর চিন্তার অবকাশ থাকে? আর চিন্তা না করতে পারলে কি নিজের অস্তিত্বের কোনো পরিমাপক জ্ঞান সম্ভব? ঘুমের মধ্যে কি 'আমার আমি'কে টের পাই? পাই না তো। তবে? তবে সংজ্ঞা না থাকুক, বোধ থাকে একটা। মাপ না পাই, অস্তিত্বের আভাসটুকু ছেড়ে যায় না কখনও। যার উপর নির্ভর করে আবার জেগে উঠি। জাগরণের প্রাক্কালে আবার ক্ষণমাত্র শূন্যতার পরই বহির্বিশ্বে নিজের পরিমাপযুক্ত আমি জেগে ওঠে - অমুক আমি... তমুক পাড়ায়... অমুক দেশে... তমুক পরিবারে... তমুক দায়িত্ব... রাগ... বাসনা... পরিকল্পনা... ভয়... সব এসে এসে একটা গোটা 'কেজো আমি'কে আমার ভিতরের আমি'র উপর দাঁড় করায়। 
        কিন্তু যে প্রজ্ঞার কথা হচ্ছিল সে কে তবে? Intuition না Kant-এর pure reason সে? কে বলবে? একটা খুব পুরোনো উদাহরণ ভারতীয় কাব্যে দর্শনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। শুদ্ধ বারিধারা যেমন করে মাটিতে মিশে লিপ্ত হয়, তেমন আমাদের বাসনামণ্ডিত ক্ষুদ্র 'আমি'তে জড়িয়ে চেতনা আস্পিষ্ট হয়। 'পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে'। উপায়?
        যিনি এই অবস্থার মধ্যে আমার চেতনার আলোকে অহং-এর ছায়ামুক্ত করে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেন তাঁকেই বলা হল - গুরু, অর্থাৎ যিনি অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে যান। আমায় ভ্রম থেকে মুক্ত করেন। তিনি কোনো মানুষের সংজ্ঞা নন। তিনি একটা অবস্থার কথা। বুদ্ধ যেমন বলেছিলেন, 'বুদ্ধত্ব' একটা নির্মোহ, ভ্রান্তিহীন অবস্থা। 'গুরু' যিনি বিকারমুক্ত। বিকার অর্থে complex নয়, distortion। যা পরিবর্তিত মূল অবস্থা থেকে। তাই বলা হয়, তেমন আকুলতা থাকলে শেষে মনই গুরু হয়। ঠিক তাই তো। আমি আমার ছাত্রকে যাই বোঝাই না কেন, তার ভিতরের শিক্ষক তাকে ভিতরে বসে না বোঝালে সে শুধু তথ্যমাত্র যা আত্মকৃত হয়নি। কি লাভ তাতে? রমণ মহর্ষি বলছেন, বাইরের গুরুর কাজ শুধু ভিতরের গুরুর কাছ অবধি পৌঁছে দেওয়া। সত্যিই তাই। যদি বলা হয়, সেরকম গুরু পাই কই? ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব বলছেন, সচ্চিদানন্দই গুরু। অর্থাৎ তোমার মধ্যের চেতনা-আনন্দ'র যে অস্তিত্ব তাকেই আরো গভীরভাবে চাও, ডাকো, আত্মসমর্পণ করো, সব মিলবে। "আপনাতে আপনি থেকো মন, যেও নাকো কারো ঘরে / যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজো নিজ অন্তঃপুরে"... জয়গুরু।

441
Thu, 07/06/2017 - 21:30

সরস্বতী পূজো-জন্মাষ্টমী-দোল-কালীপূজো ইত্যাদি স্কুল ছুটি; ঈদ মহরম স্কুল ছুটি; পঁচিশে ডিসেম্বর স্কুল ছুটি; বুদ্ধ পূর্ণিমা স্কুল ছুটি। 

        প্রতিটা কারণ ধর্মীয়। তালিকা আরো দীর্ঘ করা যায়, করলাম না। কারণ পয়েন্টটা ধরা গেছে নিশ্চই। 
        আচ্ছা যদি বলি, নিউটন অমুক সালে 'গন উইথ দ্যা উইন্ড' লিখে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছিলেন; কিম্বা বলি আইনস্টাইন প্রথম হিমালয় অভিযানে যান; কিম্বা বলি অশোক গ্রীনিচ মিন টাইম ঠিক করতে মেসোপটেমিয়া গিয়েছিলেন; কিম্বা যদি বলি কলম্বাস আর পীথাগোরাস বঙ্কিমবাবুর সাথে গলফ খেলতেন ইডেনে ইত্যাদি ইত্যাদি... যে কোনো মাধ্যমিক কি এইট পাশ করা মানুষ আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহহীন হবেন। কারণ? ওগুলো আমরা পড়েছি। স্কুলে পড়ানো হয়েছে। 
        কিন্তু আপনার যদি ব্যক্তিগত আগ্রহ না থাকে আপনি বলতে পারবেন না গীতার মোদ্দা কথাটা কি... কোরাণের মূল চরিত্রগঠনের নীতিগুলো কি কি... বুদ্ধধর্মে কোন কোন অনুশীলনটা প্রধান... গুরুগ্রন্থসাহেবের মধ্যে সারা ভারতের কত সন্ত-মহাত্মার বাণী লিপিবদ্ধ করা আছে...
        কারণ? কারণ আপনাকে আমাকে পড়ানো হয়নি। আচ্ছা আপনাকে আমাকে যখন কবিতা পড়ানো হচ্ছে ক্লাস টুয়েলভ অবধি, কেউ কি মনে করছেন... 'আমরা তো কবি নই?'... 'আমাদের তো ভবিষ্যতে কবি হওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই'... না, বলছেন না। কারণ সুস্থ বেঁচে থাকার জন্য ইতিহাস, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যাদির প্রাথমিক জ্ঞানটা থাকা বাঞ্ছনীয়। চলতে কাজে লাগে। 
        ধর্মটা? আপনাকে ধর্মের বই পড়তে গেলে কি আধ্যাত্মিক জ্ঞানপিপাসু হতেই হবে? ঈশ্বরে বিশ্বাসী হতেই হবে? না। কোনো দরকার নেই। ঠিক যেমন কবিতা, বিজ্ঞান ইত্যাদি পড়বার সময় সেই সেই বিষয়ের সর্বজ্ঞ হওয়ার কোনো দায় নেই আমার। সেটা আমার জীবনশৈলী সমৃদ্ধ করতে তথা আশপাশটা বুঝতে সাহায্য করে মাত্র। ধর্মের ক্ষেত্রেও ঠিক সেই কাজটা করা আশু প্রয়োজন বলে মনে হয়। মহাত্মা বারবার বলেছিলেন, বিদ্যালয়ে সব ধর্মের বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞানটা হোক সবার। মানুষ বুঝুক শৈশব থেকেই যে মোদ্দা কথাটা সব ক্ষেত্রেই এক। ভালো হও। উন্নত হও। স্বার্থহীন হও। সে যে ভাবেই তা উপস্থাপন করুক না কেন, সেটা তার বাহ্যিক দিক। গৌণ দিক। 
        পদার্থবিদ্যা, জীবনবিজ্ঞান, রসায়ন, ভূগোল, ইতিহাস, সাহিত্য সীমাহীন সাগরের মত গভীর আর প্রসারিত। তবু তার মধ্যে থেকেই বিজ্ঞজনেরা কিঞ্চিৎমাত্র সংগ্রহ করে প্রাথমিক ধারণাটা করিয়ে দেন আমাদের বোধের সাথে। আমাদের বোধের রাজ্যে তাদের একটা পরিচয় ঘটে। সেই পরিচয় পরবর্তীকালে আমার রুচির সাথে বৃদ্ধি পেয়ে আরো গভীরতা আর প্রসারতা লাভ করে। আমার চেতনায় জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে। 
        ধর্মে এই কাজটা হল না কেন? কেউ কারোর ধর্ম সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা না নিয়েই বড় হচ্ছি, তাও ভারতের মত দেশে, যেখানে ধর্মের বিষয়ে মানুষ এত সচেতন, স্পর্শকাতর, এত সিরিয়াস। যে যা খুশী প্রচার করছে, আমরা বিশ্বাস করছি। গৌণটা মুখ্য হয়ে যাচ্ছে। কোনো কথা তার প্রেক্ষাপট ছাড়া তুলে ধরলে বিভীষিকা সৃষ্টি করতে পারে। আজ হচ্ছে। কারণ মূলটা আমরা জানি না। 
        কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, ঠিক এই জিনিসটা আমাদের যৌন বিজ্ঞান নিয়েও ছিল। এখন পুরো অন্ধকারটা না কাটলেও কিছুটা কেটেছে। আমি বায়োলজি পড়াই। মেয়েরা তাদের মায়ের কাছ থেকে মোটামুটি যৌন জীবন সম্বন্ধে একটা প্রাথমিক ধারণা তবু পায় দেখেছি, যদিও তাও অনেক ভুলভ্রান্তিতে ভরা, কিন্তু ছেলেদের অবস্থা শোচনীয়। না বলতে পারে বাবাকে, আর মাকে তো প্রশ্নই উঠছে না। সম্বল সবজান্তা বন্ধুরা, আর অধুনা নেট। 'হস্তমৈথুন করলে কি অন্ধ হয়ে যায়?... বাচ্চা হয় না পরে?... লিঙ্গ খসে পড়ে যায়?... ক্ষয়ে যায়?'... আজব সব প্রশ্ন। কারণ স্কুলে পড়ানো হয় না। ও তো basic instinct, ঠিক শিখে যাবে।
        ধর্মও তো ব্যক্তিগত basic instinct, অগত্যা ওসব পড়িয়ো না। সেক্যুলার হও। এদিকে সব পার্বণে ছুটি। মোচ্ছব। কারণ ওটা social matter. আরে ভাই সমাজের বাইরে মানুষের কি অবশিষ্ট থাকে? ধর্ম আর সমাজ আলাদা করা অনেকটা শিখা থেকে আলো পৃথক করার ন্যায় অসম্ভব কথা। অভিধানে দুটো আলাদা শব্দ হলেও যে একই সাথে বেড়ে ওঠে দুটো, একি অস্বীকার করা যায়? আমি চূড়ান্ত নাস্তিক হই না, তাতে কি এসে গেল, সব ধর্মের প্রাথমিক ধারণাটা থাকবে না আমার? বাধ্যতামূলকভাবে এই সমাজের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে থাকা চিন্তার প্রকাশের ভিন্নতাগুলো বুঝব না? মূল কথাটা যে একই সেটা জ্ঞানী-বিদগ্ধজনেরা একত্রিত হয়ে একটা সিলেবাসের মধ্যে আনতে পারবেন না? শুভবুদ্ধিযুক্ত মানুষের কি এতই অভাব, আকাল পড়েছে দেশে? সমালোচনা নয়, উৎখাত নয়, অস্বীকার নয়, সমস্যার উপর উপর সমাধানের কপট চেষ্টা নয় - গভীরে গিয়ে এর জড়টা ধরে টান মারতে হবে। আর তা হবে জ্ঞানের মাধ্যমে। একে অন্যকে সঠিকভাবে জানার মাধ্যমে। এ যত শীঘ্র হয় তত মঙ্গল। নইলে সত্যিই সামনে বড় দুর্দিন।

442
Fri, 06/16/2017 - 21:00

অপমানিত হওয়ার অভিজ্ঞতা সংসারে নেই এক পাগল আর শিশু বই কে আছে? এমনকি দেবতারাও অপমানের বদলা নিতে কি ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন তারও অজস্র উদাহরণ শাস্ত্র ঘেঁটে বার করাটা বিচিত্র কিছু নয়। আর এই ফেসবুকের যুগে সে অপমানের প্রথা, মাত্রা, কৌশলের তো নিত্য নতুন আবির্ভাব। এমনকি তা আত্মহত্যা অবধিও গড়াচ্ছে এমনই তার প্রভাব। আজ যে কথাটা বলব বলে লিখতে বসলাম তা হল সে যুগের অপমানের এক উদাহরণ।
        অপমানের জ্বালা অসহ্য। আর তা যদি অকারণে হয়। বুদ্ধদেব বলছেন, তুমি যদি পরুষ বচনের ধার বিনা প্রতিকারে সহ্য করে নিতে পারো, তবে তুমি নির্বাণপ্রাপ্ত হয়েছ, তুমি নিজেও জানো না। এবার ঘটনায় আসি। 
        'অবতার' নামক এক পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের সম্বন্ধে একটা কুৎসিত মন্তব্য প্রকাশ করা হয়। যাতে বলা হয়, রবীন্দ্রনাথ যৌবনে কুৎসিত যৌনব্যাধিতে ভুগছিলেন। আরো নিশ্চয় এই ধরণের কিছু লেখা হয়, যার দরুন রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়েন, আর কয়েকটা পত্রে এই উক্তিগুলোর তীব্রভাষায় প্রতিবাদ জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। কথাটা এত অবধি হলে এ প্রসঙ্গে লিখতে বসতুম না, কথাটা হল যে ভাবে তিনি নিজেকে এই ঘূর্ণী থেকে রক্ষা করেন ও চিত্তের ক্ষুব্ধতার থেকে শান্তির পথে এগোন।
        প্রথমে প্রতিবাদের চিঠিগুলোর নির্বাচিত অংশে আসি, ২রা অক্টোবর ১৯২৮ সালে রাণী মহলানবিশকে লেখেন - “'অবতারে' আমার নামে অদ্ভুত কলঙ্কারোপের কথা প্রথম শুনবামাত্র হিংস্র প্রবৃত্তি জেগে উঠল - সেটা আদিম যুগের পশু, বড় রকমের ঘা খেলেই ঝোপের ভিতর থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসে। মনে হল এতবড় মিথ্যুককে শাস্তি দেওয়াই চাই। সেদিন রাত্রি দুটো থেকে সকাল পর্য্যন্ত ক্রোধের উত্তেজনায় ঘুমই হল না।”
        অপর একটি পত্র প্রশান্তচন্দ্র মহালনবীশকে লেখেন, 
"'অবতার' নামক পত্রে আমার নামে অভাব্য অকথ্য অশ্লীল কুৎসা রটনা করা হইয়াছে। আমার পক্ষে পরম বেদনার কারণ এই যে, আমি ছাড়া আমার দেশের দ্বিতীয় কোনো খ্যাতিনামা ব্যক্তির সম্বন্ধে এরূপ বীভৎস মিথ্যা প্রচার করিতে কোনো নির্লজ্জ নিন্দাব্যবসায়ী সাহস করিতেই পারিত না। যে দেশে আমার বিরুদ্ধে এমন অকল্পনীয় নীচতা কুত্রাপিও সম্ভবপর হইয়াছে সে দেশে নিঃসন্দেহে অনেক লোকে এরূপ মিথ্যোক্তি বিশ্বাস না করিলেও ইহা লইয়া আনন্দবোধ করিবে এবং আমার প্রতি বিদ্বেষবুদ্ধির প্রবলতায় একথা ভুলিতেও দ্বিধা করিবে না যে, আমার নামে এতবড় কলঙ্কে সমস্ত পৃথিবীর সম্মুখে ভারতবর্ষকেই পঙ্কলিপ্ত করা হইতেছে। যে মাটিতে জন্মিয়াছি সে মাটির দুঃখদুর্ভাগ্য ও গ্লানি অগত্যা আমাকে বহন করিতেই হইবে এবং যে নিন্দার উদ্ভব অসম্ভব ও প্রতিবাদ অনাবশ্যক হওয়া উচিত ছিল তারও প্রতিবাদ করার অপমান আজ আমাকে স্বীকার করিতে হইল।” 
        এ ছাড়াও আরো তিনটে চিঠি আছে। মোটামুটি ভাব একরম বলে আর আলাদা করে উদ্ধৃতি দিলুম না। তবে স্মরণ করতে অনুরোধ করি ইদানীং বাজারে প্রচলিত অত্যন্ত জনপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের উপর এরকমই কেচ্ছাকাহিনীমূলক বইয়ের কথাগুলো। উপরের চিঠিটার কথাগুলো খুব করে মনে হচ্ছে, - 'সে দেশে নিঃসন্দেহে অনেক লোকে এরূপ মিথ্যোক্তি বিশ্বাস না করিলেও ইহা লইয়া আনন্দবোধ করিবে'। ওনার অনুমান মিথ্যা হয় নি, আধুনিক কালের বইমেলাগুলোতে ঘুরলেই স্পষ্ট হয়। কি ধরণের বই সেখানে লোকে উৎসাহ সহকারে কিনছে আর রবীন্দ্রনাথকে আরো 'গভীরে' জানার প্রয়াস পাচ্ছে। অর্থাৎ, অন্তর্বাস না খুলে দেখলে আমরা শুধু তার সৃষ্টির উপর নির্ভর করে তার মননের গভীরতায় প্রবেশের শিক্ষা সেকালেও পাইনি, আজও পাইনি যে!
সে যাক, যে কারণে এই লেখার অবতারণা। মাত্র দুদিনের মধ্যেই ওনার আরেকটা চিঠি রাণী মহলানবিশের কাছে পৌঁছায়, সেটা পড়া যাক, ৪ঠা অক্টোবর, ১৯২৮ লিখছেন, "পর্শু তোমাদের কাছে 'অবতার' সম্পর্কীয় যে চিঠি পাঠিয়েছি সেটাও আমার পছন্দ হচ্চে না। সেটাতে যতটা ক্ষোভ আছে তাকে স্থায়ী আকারে রাখতে চাই নে। কেননা, সে অত্যন্ত ক্ষণিক। আজ ভোরে উঠে পূর্বদিকে তাকিয়ে দেখলুম পৃথিবীর প্রাত্যহিক খেয়া নৌকটি অন্ধকারের পাড় থেকে আলোর পাড়ে আর একবার এসে লাগল। 
        এমনি করেই দিন রাত্রির পারাপার হতে হতে আমিও পৌঁছবো আমার শেষঘাটে - সেও যে খুব বেশি দেরি আছে তা নয়। এমনি সুন্দর করেই শেষ করতে হবে - যেতে হবে আলোর ঘাটে - প্রতিদিনের ময়লা হাতের দাগগুলো সর্ব্বাঙ্গে নিয়ে কি সেখানে যাওয়া যায়?”
        চিঠির শেষ অংশে এও যোগ করছেন যে, প্রতিবাদ মাত্রই যদি না ছাপতে চাও তাতেও আমি আপত্তি করব না।


        রবীন্দ্রনাথের এ অসম্ভব অপমান থেকে নিজের চিত্তের উত্তরণ ঘটাতে কয়েকদিন লেগেছিল। আমাদের না হয় কয়েক মাস লাগুক, তবু ওই শেষের কথাগুলোর তো কোনো বিকল্প দেখিনে সংসারে। ফার্স্টবয় না হয় নাই হতে পারলাম, তা বলে কি ফেলুবয় হতে হবে? পাশ যে করতেই হবে, নইলে ভগবানকে না হোক, রবীন্দ্রনাথকে মুখ দেখাব কি করে? ঋণের তো শেষ নেই, সবই তো ধারে চেয়ে নিয়ে কাজ চালাচ্ছি। কিনব যে সে সামর্থ্য কোথায়?


 

443
Fri, 06/16/2017 - 13:28

তবু চলতে ফিরতে কেন জানি ক্যালেণ্ডারে চোখ। বাংলা দিনপঞ্জিকা তো নেই, ইংরাজী ক্যালেণ্ডারেই চোখ। ইংরাজি সংখ্যার নীচে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে লেখা - ১ আষাঢ়। 
        কি আদিখ্যেতা! নাগরিক জীবনে এর কি গুরুত্ব বাপু? তুমি কি চাষবাস করবে? না কবতে লিখবে? যদি ভাব কবতে লিখবে, সে তো সেকেলে বস্তু বাছাধন আমার! 
        তবু মাঝে মাঝে আকাশে চোখ। কারণ মেঘের সাথে আমার গোপন মনের কোথাও না কোথাও, কিছু না কিছু একটা যোগসূত্র তো আছেই। মেঘের চিরকালের আমন্ত্রণ আমার অবচেতন মনের গহনে। যার নাগাল যখন-তখন পাই কই? মেঘ মনের গভীরের কথাগুলোর, অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলোর সই। আর বর্ষার মেঘ মানে দুই সইয়ের চতুর্মাস্য কাল যাপন। যখন তখন মনের ঝাঁপি খুলে কখনও কদম্বের গন্ধ, তো কখনও ভিজে মাটির গন্ধে পাগল করা। বৃষ্টিজলের ধারার মাটির বুকে ভাসা ছোটো ছোটো বুদবুদের, ক্ষণকালের অস্তিত্বের সুখে ভরপুর। তাই মেঘলা দিনে আমি আনমনা। 
        কিন্তু বাছা, এতো কাজের কথা নয়? 
        সেইখানেই তো শান্তি খুড়ো। কাজের কথা না বলতে পারার মত অজুহাত বর্ষা ছাড়া আর কে দেয় বলো। "বেরোতে পারছি না, হাঁটুজল"... "কাকা ট্রেন বন্ধ, লাইনে জল"... "কাল ভিজে আজ জ্বর"... আহা! কত্ত অজুহাত খুড়ো। এমন বিবেকের দংশনহীন মাঠঘাট ভাসানো সুখ বর্ষা ছাড়া কে দেয় কাকা? বাড়ির লোকের সাথে খিচুড়ি থেকে পুরোনো দিনের গল্পের ঝাঁপি, দুই-ই আনে বর্ষা। আমরা যখন মেঘলা অন্ধকারে তুমুল প্রেমে চটকাচটকি, মাখামাখি, কান্নাকান্না - বাইরে তখন ঝরঝর... ঝরঝর... ঝরে চলেছে প্রকৃতির আদিম কান্না... আদিম স্নেহ... আদিম সোহাগ... বর্ষা। তুমি বুঝবে না কাকা, মানুষ কাজের থেকে অনেক বড়। সে কথা ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারা যায় কই? তোমার জগতে ইন্দ্রিয়সুখের অঢেল আয়োজন, তোমার জগতে কান্না ক্ষোভের, অভাবের, তাই বিশ্রী সে। মানুষের মধ্যে যে সুখের কান্না সে কই তোমার? তুমি ভুলে যাও মানুষ কাঁদতেও ভালোবাসে। সে তোমার ওই মাল্টিপ্লেক্সে অন্ধকার ঘরের কৃত্রিম কান্না নয়। দুটো চোখের উপর চোখ রেখে হৃদয় মুচড়ানো কান্না, কোলবালিশে মুখগুঁজে বুকের ভিতর উত্তাল সাগরের ঢেউ আছড়ানো কান্না, উদাস চোখে বর্তমানের বেড়াজাল ছিঁড়ে অনশ্রু কান্না। তুমি বুঝবে না কাকা। তুমি কান্না মানে জানো শূন্যতা। কান্না মানে পূর্ণ হৃদয়ের অসহায় অসীম ভালোবাসাও, তুমি জানো না।
        তাই তোমার মতে আজ 16th June হলেও সে শুধু আমার কেজো পোশাকে, তোমায় ভোলাতে। আমার ঘরের জামায় আজ ১লা আষাঢ়। তুমি চোখ-কান বন্ধ করো। আমি ভিজতে নামি মনে মনে, তোমার আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরকে কাঁচকলা দেখিয়ে। আমার বর্ষার খবর সে জানে না, পায় না। আমায় এ বর্ষামন্ত্র কে শেখালো? রবীন্দ্রনাথ গো! সেও কি বলে দিতে হয়?

444
Mon, 05/29/2017 - 13:08

শান্ত থাকা যায় কি করে? এ প্রশ্নটা বড় ঘোরেল। 'কিছু করা' আর 'শান্ত থাকা' কি এক বস্তু? অনেকে জপ-ধ্যান করে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন দেখেছি। আমিও করে দেখেছি। ওতে কি কাজের কাজ কিছু হয়? আমার মনে হয় না। এ অনেকটা সিনেমা দেখার মত। যতক্ষণ দেখছি, মনটা একাগ্র, স্থির। যেই হল থেকে বেরোলাম, যেই কে সেই। কিছুক্ষণের জন্য মনের বিরাম কি তবে শান্ত হওয়ার লক্ষণ?
        গোলমালটা হল, একাগ্র হওয়ার চেষ্টা করা আর ধ্যানস্থ হওয়ার চেষ্টা করা এক বস্তু তো না। একাগ্র হওয়ার চেষ্টাটা একটা যান্ত্রিক প্রচেষ্টা। তাতে কিছু লাভ নেই, তা নয়; তবে তাতে আখেরে কিছু লাভ বিশেষ একটা হতে দেখিনি। বাস্তব থেকে সরে আসার জন্য যা কিছু করি, তা অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গিয়ে মনঃপীড়া, উদ্বেগকে আরো প্রবলতর করে তোলে। তখন নিজের মুক্তি, নিজের পূণ্য, নিজের ভবিষ্যতের সুখ-নিরাপত্তা ইত্যাদির ভাবনারা একটা ভুলভুলাইয়া তৈরি করে চরকির মত ঘোরায়। সেই যে গানে আছে না, "আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে"। অর্থাৎ টকের জ্বালায় ঘর ছেড়ে তেঁতুল তলায় বাস। সংসারের স্বার্থচিন্তা তখন পোশাক বদলে ধর্মীয় স্বার্থচিন্তায় পর্যবসিত। এ আরো সুক্ষ্ম, ফলে শিকল আরো মজবুত, ছলনা আরো গভীর। শান্তি আসবে কোথা থেকে?
        আরেকটা জটিল কথা - ঈশ্বরলাভ। কথামৃত পড়ে, 'ঈশ্বর লাভ' আর 'ঈশ্বর দর্শন' কথাদুটো ইদানীং খুব চলতি। দার্শনিক বইয়ের মধ্যে ভুরিভুরি সেইসব কথা। ধোঁয়া, ধোঁয়া... ছায়া ছায়া সেই শব্দের মোহে মানুষ ছুটে বেড়াচ্ছে, আজব আজব খেয়ালে নিজেকে ভুলিয়ে রাখছে। আজ সমাজের কাজ, কাল জপযজ্ঞ, পরশু নাম-সংকীর্তন ইত্যাদি সব খেয়ালের তাড়না। ভিতরে কোনো বোধ জন্মেছে তার জন্যে যে করা হচ্ছে তা না, করা হচ্ছে একটা অনুকরণ, কিছুটা আত্মশ্লাঘা, কিছুটা 'কিছু একটা করতে হবে' ইত্যাদির জন্য। 'বড় কাজ' করার মোহ অন্যান্য যে কোনো মোহের চাইতে সাংঘাতিক মোহ। কিন্তু এ সব করেও সারাটা দিনের শেষে শূন্যতা।
        সত্যি কথাটা হল নিজেকে ফাঁকি দিয়ে লাভ নেই। ভাবের ঘরে চুরি থাকলে সব সঞ্চয় ব্যর্থ। নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে - আমার এত আটুপাটু কিসের? এ চঞ্চলতা না ব্যাকুলতা? দেখা যাবে প্রায় সবটাই চঞ্চলতা। একঘেয়ে জীবনের হাত থেকে বাঁচবার জন্য একটু অন্যরকম কিছু দিয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার কৌশল। এতে প্রচণ্ড ক্ষতি। মানুষের সবচাইতে বড় অসহায়তা হল সে নিজেকে বেশিদিন ভুলিয়ে রাখতে পারে না। কঠোর বাস্তবটার মুখোমুখি হতে সে যতটা দৌড়ায় তত পথটাই বেড়ে যায়... "এড়িয়ে তাঁরে পালাস না রে, ধরা দিতে হোস না কাতর / দীর্ঘ পথে ছুটে কেবল দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর"। নিজেকে মিথ্যা বলার হাজারো কৌশল ধীরে ধীরে রপ্ত হয়। আমার সাজানো বানানো ভগবান, যিনি নাকি তার সারা বিশ্বের সব কিছু ছেড়ে আমারই খিদমদগিরি করার জন্য আছেন, তার ঠেলায় জীবনের যে গভীরতম সত্য আর তার উপলব্ধি, যাকে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না, সে আসার আর পথ পায় না। সত্যের পথ আগলে বসে আমারই তৈরি আমার সত্য। যা না দেয় বল, না দেয় জীবনের নির্মম সত্যগুলোর মুখোমুখি হওয়ার সাহস, আর না তো সে আমায় করে মুক্ত আমার আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা-ভাবনার আবর্ত থেকে। চরম ক্ষতি আরো আছে - সে হল দু'হাত ছেড়ে ভালোবাসার ক্ষমতা সে কেড়ে নেয়। কারণ সঠিক অর্থে ভালোবাসা কোনো স্বার্থকেন্দ্রিক হৃদয়ে জন্মাতে পারে না। সেখানে ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতার পাঁকে কি করে জন্মাবে সেই সংসারে একমাত্র সঞ্জীবনী - ভালোবাসা? সেখানে গুরু, মন্ত্র, কৌশল, রীতিনীতি, আমার ভগবান - ইত্যাদির পাঁচিলের পর পাঁচিল গাঁথা। সেখানে সারাদিন আমার আগলানোর চেষ্টা - আমার সংসার, আমার সঞ্চয়, আমার পূণ্য, আমার ইহকাল-পরকাল। নিজেকে ছেড়ে দিলাম কই? তাই ছোটো সংসারে জমল অনেক, বড় সংসারে রইলাম ভিখারি হয়ে। শান্তি আসবে কোথা থেকে?
        তবে শান্তি আসে কি করে? কিছু করে নয়। নিজের মধ্যে যতক্ষণ না ঠিক ঠিক সমন্বয় হচ্ছে, ততক্ষণ শান্তির কোনো সম্ভবনা নেই। শান্তি কোনো ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ ফল নয়। শান্তি পরোক্ষ ফল। শান্তি নিজের মধ্যে নিজের একটা গতিময় অবস্থা - আমার সমস্ত শক্তির সম্যক অবস্থান, অব্যবস্থাহীন অবস্থান। আমার মধ্যে শূন্যতা আছে, নিঃসঙ্গতা আছে, তার থেকে পালিয়ে কোনো ফল নেই। তার মুখোমুখি হতেই হবে। সে শূন্যতা, নিঃসঙ্গতা হাজার মানুষের ভিড়ে থাকলেও আমার মধ্যে থাকবে। তার ভিতর দিয়েই যেতে হবে। তবে গিয়ে যে সত্য আমাকে ধরে রেখে আমাকে নিয়ে চলছে, তার সাথে সাক্ষাৎ হবে। তবে গিয়ে শান্তি আসবে। কারণ সে সত্য আমার নিজের বানানো নয়, সে আমার 'আমি'-র ধারক-বাহক। তখনই আমি মহাপুরুষদের বাণীর মর্মার্থে প্রবেশ করতে পারব। তাকে মুখস্থ রেখে চলতে হবে না। আমি আলোকিত হব। অশান্তির মধ্যে শান্ত হব। চেষ্টা করে না। বরং আত্ম-সম্মোহনের চেষ্টাগুলোকে দূরে রেখে। নিজেকে বইপড়া আত্মা জেনে না, নিজেকে জানতে পেরে যে, আমি আর সবার আমির সাথে যুক্ত একটা সত্তা। নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবাটাই ছিল অজ্ঞতা। ভগবান তখন আমার হয়েও সবার, আমিও তখন আমার হয়েও তাঁর, তথা সবার।
        তখন আর ভালোবাসা অভ্যেস করতে হবে না। তখন মন আপনি শান্ত। প্রার্থনা তখন দিগন্তব্যাপী - সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া - সকলে সুখী হোক... সকলে আরোগ্য লাভ করুক।

445
Mon, 05/22/2017 - 14:00
মাঝেই মাঝেই ফেসবুকে বন্ধু-আত্মীয়-পরিচিতদের বেড়াতে যাওয়ার ছবি দেখি। যাওয়ার আগের মুহূর্তের ছবিতে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু বেড়াবার ফাঁকে ফাঁকে যে ছবিগুলো পোস্টিত হয় তাতে তারা অন্যরকম হতে শুরু করে। 
        মনে হয় মানুষের মনের সাথে চামড়ার একটা যোগাযোগ আছে। ছবিগুলোতে দেখি পুরো মানুষটা হাসছে। সে মানুষটা ঘরে যখন হাসে, অতটা গভীর থেকে হাসে না। ঠোঁট যুগলকে ঊর্দ্ধমুখী অর্ধবৃত্ত করলেই তো আর হাসি হয় না রে বাবা! চোখের কোণে একরাশ ক্লান্তি, মুখের বলিরেখায় বিষণ্ণতার কালো ছোপ, এই নিয়ে কি আর অমন হাসা যায়! সেই কেমন এক ধারা হাসি আছে না, যেখানে ঠোঁটদুটোর কোণা একটুও উপরের দিকে বাঁক নেয়নি, তবু তার মুখের দিকে তাকালে মনে হয়, 'বাহ্‌, মানুষটা বেশ খুশী আছে।' খুব ভালো বাংলায় বললে যাকে বলে 'প্রসন্নতা'। 
        আমাদের জগৎখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ব্যাস মহাশয় তাঁর প্রথম কাউন্সেলিং-এর বইতে, মানে গীতাতে বলছেন, প্রসন্নতাতেই যত দুঃখের অবসান হয়। কথাটা শুনে দিলীপ রায়ের একটা উক্তি মনে হত। উনি একবার কিছুটা অভিমানে শ্রীঅরবিন্দকে বলছিলেন, “আপনার কথা শুনে মনে পড়ছে একটা প্রবাদ - যদি সোয়ালো পাখি ধরতে চাও, তবে সোয়ালো পাখির পাছায় একটু নুন মাখিয়ে দাও"। কথাটা হল সোয়ালো পাখির পাছাই যদি আমার হাতে আসে তবে কি সোয়ালো পাখিটা অধরাই থেকে যাবে? আমার আবার এই কথাটা লিখতে গিয়ে সেই কথাটা মনে পড়ে গেল, কার মামা না কাকাকে যেন আধখানা কুমীরে খেয়েছিল বলে বাকি আধখানা মরে গেল! তো সে যাক, এসব আলাং তালাং না বকে যেটা বলছিলাম, প্রসন্নতার কথা। 
        বুড়ো হচ্ছি যত, বুঝছি, ব্যাস বাবাজী ঠিক অত কাঁচা কথাটা বলেননি বুঝলেন। বোঝার গোল হয়েছিল। আসলে আমাদের শব্দগুলো ক্রমশঃ ইংরাজী শব্দের পরিভাষা হতে গিয়ে নিজের অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। এই যেমন ধরেন কিনা, 'সাধু' শব্দটা। সাধু মানে তো 'monk' না, সাধু মানে যে 'সচ্চরিত্র'। এখন এই 'সচ্চরিত্র' অর্থটাতেও চচ্চড়ি পাকানো হয়েছে। যে সারাজীবন জননাঙ্গের সিল খোলেনি সে-ই সচ্চরিত্র এমনটা ভাবলে তো সেই স্বামীজির কথাটা মনে পড়ে - 'কাপুরুষের আর কি ইন্দ্রিয়সংযম!' হে হে কি কতা মাইরি! 
        তো 'প্রসন্নতা'টা মনে হয় ঠিক happy... gay(পুরোনো অর্থে)... jolly... ইত্যাদি শব্দগুলো যায় না। কি যে ছাই যায়, জানি না। মেলা ইংরাজী অভিধান ঘেঁটেও না। সে যাক। কথাটা হল প্রসন্নতা। একটা অবাধ্য ভালো রাখার চেষ্টা নিজেকে। যাই হোক, আমি আমার মনের স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত হতে কিছুতেই দিতে চাই না। কিছুতেই না। তার জন্যে একটা বিশ্বাস লাগে। একটা সহজ সরল বিশ্বাস, বোকার মত গোঁয়ারের মত স্থবিরতা না। একটা বাচ্চা যেমন বিশ্বাস করে আনন্দে থাকাটাই তার স্বাভাবিক অবস্থা, সেই বিশ্বাসটাকে আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া। আনন্দে থাকার জন্য বস্তু লাগে না, শর্ত লাগে না। একটা বয়ে চলার বেগ লাগে।
        এই বয়ে চলার বাইরের কথাটাই বেড়াতে যাওয়া। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, ঠাঁইনাড়া। একটু ঠাঁইনাড়া হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কথা হল টাকার যোগান হয়ত সময়ে কুলায় না; সময় হল, তো সাথী মিলল না; সব মিলল তো সুযোগটা ঘটে উঠল না কোনো কারণে। একঘেয়ে চরকি কাটা তবু কাটাতেই হবে। যে করে হোক। মনের খোলসত্যাগ দরকার। সরীসৃপ যেমন জীবনযাত্রায় চলতে চলতে বহু আবর্জনা জমিয়ে ফেলে তার খোলসে, ঠিক তেমন আমাদের চলতে চলতেও বহু আবর্জনা জমতে শুরু করে মনের চামড়ায়। যতই সতর্ক হও না কেন জমবেই জমবে। আরো জটিল কথা হল, সেই আবর্জনাগুলো যে জমছে সে হুঁশও থাকে না। মনে হয় এই তো বেশ আছি। চলার বেগ কমছে, ভাবার ঘোঁট পাকছে, সহজ আনন্দের স্রোত ঘোলা হতে শুরু করছে, আচার-আচরণে উষ্ণতা বাড়ছে - অর্থাৎ খোলস ত্যাগের সময় এসেছে। মনের খোলস ত্যাগ। অভ্যাসের জড়তার থেকে বেরোনোর জন্যে এটা করতেই হবে। তার জন্যে পাহাড়, নদী, সমুদ্রতেই যেতে হবে তার কি মানে আছে? একটা ঘটনা বলি, আমাদের বাড়িতে একজন মানুষ আসেন মাঝে মাঝে যার সংসারে সেই অর্থে সন্তষ্ট থাকার কোনো কিছুই নেই। কিছুই সেই অর্থে পায়নি সে জীবনে। কিন্তু কি কারণে যেন তার অভিযোগ বড্ড কম। আমি যখন এর-ওর-তার অভিযোগে পর্যুদস্ত হতে থাকি, তখন তার দিকে তাকালে বিস্মিত হই। তার কাছেই একদিন শুনেছিলাম, তার ভাষাতেই বলি -“জানো ভাই, আমার যখন খুব মন খারাপ লাগে তখন শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠে আরো দূরে চলে যাই, হালিসহরে নামি না”। 
        তারপর শুনি কোন স্টেশানের থেকে কিছুটা দূরে বড় একটা মাঠ, আরো দূরে গেলে বড় দীঘি যার উপরে শরৎকালে কাশের ঝালর ঝুলে পড়ে; বড় একটা বটতলা আছে কোনো একটা স্টেশানের থেকে পনেরো মিনিট দূরত্বে মাত্র। সেখানে একটা চায়ের দোকান আছে, সেই চায়ের দোকানের দোকানি একজন গোঁসাই। সে চায়ের মধ্যে মিষ্টি গোলে আর মনের মধ্যে গোলে কৃষ্ণরসের মধু...
        এরকম কত বেড়াতে যাওয়া আছে। অনেক বঞ্চনা, ক্ষোভ, অতৃপ্তি যখন মনের মধ্যে ক্ষতের পর ক্ষত সৃষ্টি করতেই থাকে তখন সহজতম উপায় হচ্ছে তাদের থেকে দূরে সরে যাওয়া। আর প্রকৃতির থেকে বড় তীর্থক্ষেত্র আছে নাকি? সেখানে ঝরাপাতা, ঝরাফুলের হিসাব কষে কষে বিবর্ণ হয়ে বসে থাকে না কেউ। সেখানেই তো যেতে হবে। খোলস ত্যাগ করতে হবে। উষ্ণতা কমাতে হবে। বিশ্রাম নিতে হবে। প্রসন্ন হয়ে, ল্যাদ খেয়ে নয়।
446
Fri, 05/19/2017 - 20:30

মূল তত্ত্বটা কি তবে? এই যে এত ছোটাছুটি, এত ধর্ম, এত মত, এত দর্শন। কোথাও কি বাস্তবটা থেকে বিমুখ হওয়ার চেষ্টা। ব্যক্তিগত জীবনে যখন অত্যন্ত সংকটকালীন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছি বারবার, মনে হচ্ছে, তবে কি প্রস্তুত ছিলাম না? নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য এত তোড়জোড় ছিল? সব বানানো গল্প? রূপকথা?
        প্রথম কথা কে দেখাবে আলো? ধর্মের সম্প্রদায়ের অন্ত নেই। সেখানে শয়ে শয়ে লোক যাচ্ছে, দীক্ষিত হচ্ছে। কে দীক্ষা দিচ্ছেন? তিনি কি নিজে আলোকিত? না তিনি কোনো একটা বিশেষ অভ্যাস তথা বিশ্বাসের বাহকমাত্র। তিনি সেই অভ্যাসের পথে, সেই বিশ্বাসের পথে আপনাকে নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু আলোকিত করতে পারেন কি? না পারেন না। কারণ আলোকিত করতে গেলে নিজেকে আলোকিত হতে হয় প্রথম। তবে? আমি কি কোম্পানীর দেশলাই কাঠি কিনছি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা আলো জ্বললে তো সব দেশলাইয়ের রঙই সমান। কিন্তু আলো জ্বলে কই? এ তো কাঠিতে কাঠিতে ঠোকাঠুকি। এ তো প্রতিদিন কাঠিগুলো বার করে রোদে শুকিয়ে ঝেড়েমুছে আবার খাপের মধ্যে ভরে ফেলার অভ্যাস।
        তবে কি ধর্ম-দর্শন বাস্তবের থেকে মুখ ফিরিয়ে চলার কথা শেখায়? গোড়ায় যাই আগে।
       যে কথাটা সংসারে খুব বড় কথা সে হল - অর্থ। খুব বড় একটা শক্তি। সংসারে একে খুব বড়ো জায়গা দেওয়া হয়েছে। না দিয়ে উপায় ছিল না, কারণ মূলত আমরা স্বার্থকেন্দ্রিক সত্তা। অর্থের খুব বড় একটা ক্ষমতা হল, তার অসামান্য প্রভাব বিস্তারের শক্তি। দারিদ্র্যতা কাম্য নয়। তুলসীদাসও স্বীকার করছেন, দারিদ্র্যের চেয়ে বড় দুঃখ সংসারে নেই। কিন্তু অর্থের কি কোনো ধর্ম হয় না? নীতি হয় না? সে কি ভয়ংকর একটা বিধ্বংসী শক্তি? তা নয়। রামকৃষ্ণে আসি, বলছেন, যে মানুষ টাকার বশ নয় সে-ই মানুষ।
        এই হল মূলসুর। যে মানুষ টাকার বশ নয়। তবে সে কিসের বশ? ধর্মের? ঈশ্বরের? গুরুর? এর উত্তর হাঁ-ও বটে আবার না-ও বটে।
        যদি ধর্ম-গুরু-ঈশ্বর ইত্যাদির অর্থ সচেতনতা হয়, জড় অভ্যাস বা গোষ্ঠীকৃত বিশ্বাস নয়, তবে উত্তর হাঁ। যদি বিপরীতটা হয়, তবে উত্তর - না। তাই বলছেন, টাকার বশ হয়ো না, তবে মানুষ থাকবে না। তবে, টাকায় কি হয়? বলছেন - খাবার, থাকার ব্যবস্থা, কোনো মানুষ অসুবিধায় পড়লে তার সেবা। অর্থাৎ শরীরকেন্দ্রিক যত কিছু। কিন্তু সে আমার সিক্যুরিটি নয়। সে আমার প্রয়োজন। খুব কি পার্থক্য হল? হল। খুব বড় পার্থক্য হল। ভূমিকম্প হলে যেমন বাড়ির দেওয়াল আর ছাদ-ই আমার আতঙ্কের কারণ হয়, অথচ যারা কিনা অন্য সময়ে আমার সিক্যুরিটির ভূমিকা পালন করে, সেই ছাদ-দেওয়ালের হাত থেকে বাঁচার জন্যেই তখন বাইরে খোলা আকাশের নীচে দাঁড়াতে হয়, এও তেমন। যে জিনিস মানুষের প্রয়োজনের জন্য এসেছিল, সেই যখন মানুষের পরিচয় হয়ে দাঁড়াতে চায়, তখন বুঝতে হয়, আমরা কোথাও একটা বড় গোল পাকাচ্ছি। নিজের তৈরি ফাঁসে নিজেকে জড়াচ্ছি। আর জড়াতে জড়াতে শেষে এমন একটা পরিস্থিতি এসে দাঁড়ায় যে, আমার যে একটা খোলা আকাশ পাওয়া জন্মগত অধিকার, সেটাও ভুলতে বসি।
        তবে সিক্যুরিটি কি? আবার রামকৃষ্ণে আসি, বলছেন, সঠিক বুদ্ধি। শুধু সূত্র না, উদাহরণ দিচ্ছেন। বলছেন, দেখো, পঞ্চপান্ডবদের ওপর দিয়ে অত ঝড় গেল, বনবাস হল, অথচ তাদের বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়নি। কারণ তাদের ঈশ্বরে মতি ছিল। আর ওদিকে দেখো রাজপ্রাসাদে থেকে, অত ঐশ্বর্য্য, প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেও কৌরবদের কেমন বুদ্ধিভ্রষ্ট হল। কারণ ঈশ্বরে মতি ছিল না (রামকৃষ্ণের ঈশ্বরের পরিভাষা চেতনা। কথামৃতে বহু জায়গায় ঈশ্বর কথাটার পরিবর্তে চেতনা শব্দ ব্যবহার করেছেন)।
        কি অকাট্য উদাহরণ। প্রাচুর্য্যই যে শেষকথা বলে না, আজ নোকিয়া, অ্যাম্বাসাডার ইত্যাদি রথী-মহারথীদের অবস্থা দেখলেই অনুমেয়। তাদের কোম্পানীতে তো মেধা-পরিকল্পনার অভাব ছিল না। শুনেছি, যে ছেলেটা নাকি বচ্চনের সাথে খেলে কোটিপতি হয়েছিল, আজ সে দেউলিয়া প্রায়। অর্থাৎ টাকার পরিমাণই শেষ কথা বলে না তো! আমরা অবশ্য আদা নিয়েই ভাবি, জাহাজের কথা থাক। কথা হল, আমার সিক্যুরিটি অর্থ না, সদবুদ্ধি।
        ঈর্ষা, শোক, ক্ষোভ - সদবুদ্ধির পরিপন্থী। নিজের অবস্থানটা, যোগ্যতাটা সঠিক মাত্রায় অনুধাবন করতে দেয় না। অকারণ ফাঁদে পা দি-ই। তার একটা বড় কারণ আমাদের ওভাবেই শেখানো হয়েছে। আজ চিটফাণ্ডের যে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কথায় রাঘব বোয়ালদের ধরা হচ্ছে, আপামর সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, লোভ ছাড়া সে ধূর্ত কৌশল তাদের সফল হতে পারত? যে অঙ্কের টাকা তারা ফেরত দেবে বলেছিল, বা যে অঙ্কের মুনাফার কথা তারা বলে মায়াজাল সৃষ্টি করেছিল, তাতে পা দিল কে? কেন, আমাদের সাধারণ বুদ্ধি তখন কোথায় চরতে গিয়েছিল? যে টাকা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক দিতে পারে না, তারা দেয় কি করে? ভাবিনি তো। ওই যে - "আমি আপন মনের মারেই মরি, শেষে দশজনারে দোষী করি / আমি চোখ বুজে পথ পাইনে বলে কেঁদে ভাসাই পাড়া"। বুদ্ধি তো তখন - 'লোভ-উপহৃত চেতসা'! চেতনা লোভ চুরি করেছে যে।
        তাই বলছেন, যে টাকার বশ নয়, বরং টাকা যার বশ, সেই মানুষ। রোজগার হবে, উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকবে, কিন্তু জেনো, সব শেষে মায়ের ইচ্ছা।
        সুকঠিন নাস্তিকও এ যুক্তি স্বীকার করবে, অনেক সময় সব চেষ্টার শেষেও নৌকা তীরে ভেড়ে না, এমন উদাহরণও সংসারে অপ্রতুল নয়। মায়ের ইচ্ছা না বুঝি, কালের গতির মুখাপেক্ষী যে হতেই হয়, সে কথাটা না মেনে যো আছে? তবে বিশ্বাস করলে আমার শান্তি, না করলে ক্ষোভে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয়। সফল হওয়া আর সফল সাজার ভাণ করার মধ্যে যে কি সুতীব্র যন্ত্রণা তা আজ এই দেখনদারির যুগে বোঝা খুবই কঠিন। মানুষের সব চাইতে বড় সিক্যুরিটি অবশেষে তাই মানুষই। সদবুদ্ধিযুক্ত মানুষ। অর্থের অধীন না, বিবেকের অধীন মানুষ। শেষ নিরাপত্তা।
        সবশেষে বলি, রামকৃষ্ণ ঈশ্বরের অবতার ছিলেন কিনা বলতে পারি না, তবে অমন একটা পরিখাহীন চেতনার ধারা সংসার খুব কমই দেখেছে। তাই নানান দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা দার্শনিকদের পাশে এই পক্ষপাতশূন্য চেতনার অক্ষয় জ্যোতিটা এ সংসারে, এ অন্ধকার সময়ে একটা বড় আশ্বাস।

447
Sat, 05/13/2017 - 10:21

বেশ কিছুদিন ফেসবুকে অনুপস্থিত ছিলাম, তার একটা কারণ অবশ্যই ব্যক্তিগত পড়াশোনা তো নিশ্চই ছিল, কিন্তু তার সাথে আরেকটাও কারণ ছিল, ছিলই বা বলছি কেন? আছে, তা হল একটা অনীহা। ফেসবুকে চোখ রাখার অনীহা। বড্ড উগ্র লাগছে ধীরে ধীরে অনেক কিছু। ধর্ম, রাজনীতি, নারীবাদ, যৌনতা ইত্যাদি বিষয়গুলো বড্ড black & white standpoint নিয়ে একটা তুমুল ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়েই চলেছে। বয়েস হচ্ছে? অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছি? হবেও বা। 

        আজ সকালে ফেসবুক খুলতেই জানলাম আমার বন্ধু তালিকাভুক্ত এক নারী রজঃস্বলা হয়েছেন গতকাল রাত থেকে। তিনি বিশেষ একটি ব্র্যাণ্ডের স্যানিটারি ন্যাপকিনের ছবিসহ সে কথা পোস্ট করেছেন। উনি যখন রজঃস্রাবে সিক্ত হচ্ছেন, পেটে ব্যাথা হচ্ছে তখন পৃথিবীর এক গোলার্ধের মানুষ নিদ্রাগত। স্বাভাবিক ভাবেই জানতে পারেনি। আমিও জানতে পারিনি। কিন্তু এমন অসামান্য একটা ঘটনা উনি গোপন করতে চাননি। এর পিছনে নিশ্চই কোনো সাংঘাতিক রকমের কোনো একটা ইজম প্রসূত প্রতিবাদ নিশ্চই আছে। আমার মফঃস্বলের, স্বল্পজ্ঞান, পুরুষোচিত বুদ্ধিতে তা কুলায়নি। তবে ওনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে উনি সে রজঃস্রাবের ছবি তুলে পোস্ট করেননি। সত্যি বলতে আমার গা গুলাতো। আমি সত্যিই অতটা আধুনিক, উন্নতমনা, স্রাবসচেতন, রজঃ সহানুভূতিসম্পন্ন হতে পারিনি হয়ত। তবে যতটা আমার ক্ষুদ্রজ্ঞান, মানুষের শরীরে যদ্দিন FSH, LH, ইস্ট্রোজেন, প্রোজেস্টেরন ইত্যাদি হরমোন থাকবে স্বাভাবিকমাত্রায়, এবং প্রাইমর্ডিয়াল ফলিকল হয়ে গ্র্যাফিয়ান ফলিকল তৈরি হবে আর তা ওভিলিউশানের পর অনিষিক্ত থেকে যাবে ফ্যালোপিয়ান টিউবের কোনো একটা স্থানে, সে নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষার পর জরায়ুর এণ্ডোমেট্রিয়াম কলাসহ বাইরে বেরোবেই। এ ঘটনা শিক্ষতা-অশিক্ষিতা, গ্রাম্য-শহুরে, প্রাচ্য-পাশ্চাত্য, আস্তিক-নাস্তিক, কম্যুনিস্ট-ফ্যাসিস্ট, হিন্দু-মুসলিম-খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন ইত্যাদি সকল মনুষ্যের হয়ে এসেছে যারা সেই ধরণের জননতন্ত্রবাহী। 
        তবু বলব আমি অন্তত আপনার রজঃস্রাবের সাক্ষী বা জ্ঞাতা হতে চাই না। ফেসবুক নিশ্চই আপনাদের মত উত্তোরতর আধুনিকাদের জন্য MY PERIODS বলে কোনো অপশান অদূর ভবিষ্যতে চালু করার কথা ভাববেন, যেখানে সবাই জানতে পারবে আপনার কবে শুরু হল, কবে শেষ হল। আপনাকে হয় অভিনন্দন জানাবেন নয় সমবেদনা, কোনটা আমি এখনই সঠিক বলতে পারছি না, তবে কিছু একটা তো নিশ্চই জানাবেন আপনার ফেসবুক তালিকাভুক্ত বন্ধুরা। 
        আসলে আমি অনেক উদারমনা, উন্নতচিন্তাশীল নারীদের পড়েছি, জেনেছি, কথা বলেছি তাদের রজঃস্রাবের তিথি না জেনেই। তাদের সম্পূর্ণ জানা হয়ত আপনাদের মতে আমার কম হয়ে গেল, তবু বলব যতটা জেনেছি তাই পর্যাপ্ত মনে হয়েছে জানেন, কি পুরুষোচিত অহংকার না? সে যাক, আমার একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনারা যারা ভবিষ্যতে এমন কিছু অসামান্য দুঃসাহসী কাজের পরিকল্পনায় আছেন সত্বর অনুগ্রহপূর্বক আমায় আনফ্রেন্ড করুন। আবারও বলছি, আমি আপনাদের রজঃস্রাবের সাক্ষী বা জ্ঞাতা হওয়ার কোনো বাসনা পোষণ করিনা মনের কোনো কোনায়। 
        আরেকটা কথা, সেই পোস্টে কোনো আরেক রমণী আগামী পশুপুরুষদের জন্য করুণা কামনা করেছেন যাদের উক্ত পোস্টটা দেখে পাশবিক প্রবৃত্তি জেগে ওঠার সম্ভাবনা উনি আশা করছেন। অবশ্যই ওনার আশা দুরাশা নয়। কারণ তসলিমা নাসরিনের টুইটার যখন ফলো করতাম তখন ঠিক এরকম একটা পোস্ট উনিও করেছিলেন। তাতে যে সব কমেন্টস এসেছিল তাতে সেরকম কমেন্টস এসেছিল তো। তাতে অবশ্য আশ্চর্য কিছু হই না খারাপ লাগলেও। মানুষের পাশবিক প্রবৃত্তি কি আর কোনোদিন নাশ হওয়ার? আমি কোনোদিন বিদেশ যাইনি। দেশেরই কিছু শহর গ্রাম ঘুরেছি। আমি কোত্থাও দেখিনি পাবলিক টয়লেটের মুখ রাস্তার দিকে করা, যাতে আপনার শ্রীঅঙ্গটি সবার চোখে পড়ে। যুক্তি অবশ্যই এক - কেন তোমার কি নাই?... তোমার কি অন্যরকম?... একে গোপন করার ইচ্ছাও অনাধুনিক, মধ্যযুগীয় বর্বরতা, অশিক্ষার পরিণাম নয়?... আসুন সবাই সবারটা দেখি... আধুনিক, উন্নতমনা হয়ে উঠি। আর কতদিন ওই বস্তাপচা শ্রীঅঙ্গঢাকা মধ্যযুগীয় সভ্যতায় পড়ে থাকব? 
       বাস্তবটা হল, সংযমে অসংযমে মিশ্রিত মানবসভ্যতা। যতই উন্নতমনা হই - বাইরে যাওয়ার আগে কি শুতে যাওয়ার আগে বাড়ির দরজায় খিল, বিয়ের সাথে সাথে উকিল ডেকে প্রেমকে আইনস্থ, এটিমের পিন থেকে ফেসবুকের পাসওয়ার্ডকে গোপন রাখার তাগিদ ইত্যাদি কিসের জন্য? অমার্জিত মানবকুলের হাত থেকে মান আর সম্পদ রক্ষার জন্যেই তো! অর্থাৎ সে তো আছেই, আর থাকবেও। না হলে আইনি জটিলতা আর পুলিশের সংখ্যা কমত এ বলা বাহুল্য। তো জেনেশুনে ন্যাকা সাজা কেন হে বাপু! সর্বোপরি মানুষ হই না কেন? নারী বলেই সব চিন্তা নারীতেই শুরু আর নারীতেই শেষ করে শেষে সব সেই কুমীর রচনাই করা কেন হে বাপু!
        হে হে, দেখছেন কেমন পুরুষোচিত দেমাক বেরিয়ে পড়ল? টেস্টোস্টেরণ না কিসের প্রভাব জানি না, তবে সব ক্ষেত্রেই অগ্রণী ভূমিকায় পুরুষের সংখ্যা অধিক হওয়ার কারণ কি শুধুই পুরুষশাসিত সমাজ, না তলে তলে সমস্যাটা আরো গভীর তা ভেবে দেখার... তবেই তো বদল আসবে।

448
Wed, 05/10/2017 - 12:03

পথ পাচ্ছিল না মানুষটা। তার জাগতিক সুখ কিছু অপ্রাপ্ত হওয়ার কথা নয়। রাজার ছেলে সে। তবু কেমন গোলমাল হয়ে গেল সব কিছু। বার্ধক্য রোগ শোক মৃত্যু - এসবের কোনো একটা অর্থ তো থাকবে? সবই এমনি এমনি? মিছিমিছি। এতবড় সৃষ্টি শুধুই কিছু অন্তঃসারশূন্য অভিনয়ের জন্য? এ হতে পারে? কিছুতেই হতে পারে না।
লোকটার মাথার মধ্যে শিরা-উপশিরাগুলো ছিঁড়ে ফেটে পড়বে মনে হতে লাগল। যেন শত সহস্র হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে মাথার ভিতরের দেওয়ালে। সে পাগলের মত অস্থির হয়ে উঠছে। রাজপ্রাসাদের কোনায় কোনায় উত্তর খুঁজল, পেলো না। ভোগে উত্তর খুঁজল, পেলো না। সংসারের কোনো কোনায় তার জন্য উত্তর অপেক্ষা করছে সে জানে, কিন্তু কোথায়? 
        একে একে এক-একজন বিখ্যাত সব ধর্মপুরুষের কাছে উপস্থিত হল। সবাই কৌশল নিয়ে ব্যস্ত। কেউ উত্তর দিচ্ছে না। মূল প্রশ্নটা এড়িয়ে যাচ্ছে সবাই - এসবের অর্থ কি? এত আয়োজন সব বৃথা? শুধু ছলনা? মিথ্যার আশ্বাস সব? কই ভগবান? এত এত প্রাণ অঙ্কুরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অভুক্ত, পীড়িত, রোগগ্রস্থ, কাতর, অসহায় এই লক্ষকোটি প্রাণকে রুদ্ধ কারাগারে নিক্ষেপ করে যে ঘুমাচ্ছে অঘোরে সে দয়াময়? সে ভগবান? সে সৃষ্টিকর্তা? বিদ্রোহ করে উঠল মানুষটার হৃদয়, মিথ্যা সব! সব কৌশল, আচার, বিধি-নিষেধকে তুচ্ছ করে গিয়ে বসল বৃক্ষের তলদেশে।


        এর পরেরটা তো ইতিহাস। আজ আমাদের ভগবানের চেয়ে বেশি প্রয়োজন বুদ্ধকে। ঐশী শক্তিতে নয়। করুণার বাণীতে। আত্মশক্তি জাগাতে অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাসী হতে হয় না, নিজের সাথে বিশ্বস্ত থাকতে হয়, বুদ্ধ শেখাল। বুদ্ধের বাণীর মর্মস্থলে একটা যন্ত্রণা আছে। নিজের ক্ষুদ্রতা থেকে, সঙ্কীর্ণতা থেকে উত্তরণের জাগরণস্পৃহা। সেটা যন্ত্রণা। বুদ্ধের বাণীর মর্মস্পর্শ করতে তাই সেই যন্ত্রণার অংশীদার হতে হবে। সেই যন্ত্রণাকে নানান আজগুবি বিশ্বাসে ধামাচাপা দিতে যতই চেষ্টা করব, নিজের অন্তরের অন্তঃস্থলে ততই দুর্বল থেকে দুর্বল হতে থাকব। পুরোহিত, জ্যোতিষী, তাবিজ, গ্রহ-নক্ষত্র, তিথি, পঞ্জিকা আর তেত্রিশ কোটি তো রইলেনই - কেউ রেয়াত করবে না। সবার দরজায় ভিখারির বেশে দাঁড়াব গিয়ে, তবু ভিক্ষার ঝুলি কোনোদিন ভরবে না। জন্মভিখারির অবস্থা তখন আমার। 
        বুদ্ধ বললেন, কি চাও? যন্ত্রণার সাময়িক কপট উপশম, না যন্ত্রণার মূল উৎপাটন? যদি দ্বিতীয়টা চাও তো আমার কাছে এসো। আমি পথ পেয়েছি। সে পথে শুধু আমি না, তুমিও হাঁটতে পারো যদি চাও। বুদ্ধ কোনো মানুষ না, বুদ্ধ একটা অবস্থা। তাই তোমার জীবনের বুদ্ধপূর্ণিমার আয়োজনের পথ তোমায় করতে হবে। তুমি বুদ্ধ হও। নিজেকে উদ্ধার করো।
        সবার আগে তোমার দেখাটাকে বদলাও। ভুল দেখছ বলছি না। দূর থেকে দেখছ। কাছ থেকে দেখো। দেখো, প্রতিটা অণু-পরমাণু প্রতিটা ক্ষণের সাথে পরিবর্তনশীল। এটা মনে রেখো। তুমি নিজেও নানা পরিবর্তনের একটা মালা। সে মালার যে সূতো সে তোমার স্মৃতি। সেও মিথ্যা। তোমার অস্তিত্ব একটা শিখার মত। যে শিখা প্রতি মুহূর্তের দহনের ক্রমাগত রূপ একটা। তোমার অস্তিত্ব একটা বহমান নদীর মত, যে নদীর স্রোত প্রতি মুহূর্তের বয়ে যাওয়া জলধারার নিরবচ্ছিন্ন গতিধারা একটা। তুমি আছো, আবার নেইও। এটা বুঝতে চেষ্টা করো। যেমন তুমি, তেমন তোমার চারপাশ - বহতা ধারা। আটকাতে যেও না, আঘাত পাবে। তোমার জীবনের প্রথম তৃষ্ণাকে মারো - সব সুখ স্থায়ী করার ইচ্ছা। হবে না, বোঝো, কারণ জগতে দুঃখ আছে। তুমি চাইলেও এড়াতে পারো না। তুমি চাইলে তার মূল বিনাশ করতে পারো।
        এরপর তোমার ভালোবাসার দিকে তাকাও। ওকে আরো বড় করো। ভালোবাসা বড় হলে প্রেম হয়। আর প্রেম বড় হলে হয় করুণা। করুণা অসীমের প্রতিশব্দ। ওর সীমা হয় না। তার একদিকে ক্ষমা আরেক দিকে তিতিক্ষা। ভার লাগবে না দেখো। তুমি জাগো। অসীমে ডানা মেলো। অসীমকে পাও অসীমকে আঁকড়িয়ে নয়, অসীমে মিশে গিয়ে। অনস্তিত্ব হও। নিজেকে বুদবুদের মত মিশে যেতে দাও। ভয় পেও না। ভয় বুদবুদের, সাগরের নয়। সাগর হও। করুণায়। 
        যে ভালোবাসা আর জ্ঞান বোধের অঙ্কুরকে সিক্ত রাখে সেই সাধনা। সেই সাধনার সিদ্ধাবস্থাকে বলে - বুদ্ধ। আমার হাত-পা-নাক-চোখ-মুখ-গা-হৃৎপিণ্ড-ফুসফুস-মস্তিষ্ক এরা কেউ বুদ্ধ নয়। অকারণ আমায় পূজো কোরো না। আমার বোধের মধ্যে যে বোধের শিখা সে-ই বুদ্ধত্ব। সেই শিখাকে আলিঙ্গন করো। তোমার ভক্তিতে যদি যন্ত্রণা না থাকে তবে তা আমার সামনে এনো না। সে দিবাস্বপ্ন ভেঙে ফেলে এসো আমার কাছে। আমি চিরকালের। কারণ এ আমি সে আমি নই যে মাতৃগর্ভে জন্ম নিয়েছিল। এ আমি সে আমি, যে বোধের জ্যোতিতে জন্মেছে নিজেকে নিজের তৈরি অজ্ঞান আবরণের থেকে মুক্ত করে। মানুষকে অজ্ঞান রাখে কোনো ঈশ্বর নয়, তার নিজের তৈরি করা নিজের হাতে বোনা অজ্ঞানতার মসলিন চাদর। সরিয়ে দাও, নিজেকে জানো। সেই নিজের মধ্যে সব'কে জানো। বুদ্ধ হও।

(ছবিঃ ইন্টারনেট)

449
Tue, 05/02/2017 - 23:41

শব্দগুলো যে সবসময় ভাব বা চিন্তা প্রকাশের সহায়ক হয় তা তো নয়, অনেক সময় যথেষ্ট প্রতিকূল অবস্থাও সৃষ্টি করতে পারে। বাধাও হয়ে দাঁড়ায়। 
        আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো বেশিরভাগই বাঙ্ময় নয়। সেখানে ছড়ানো ছেটানো প্রথম স্পর্শের অনুভূতি, প্রথম দেখার অনুভূতি, প্রথম স্বাদের অনুভূতি। সেদিন কি করে করে হঠাৎ নিজের ছোটোবেলায় কাটানো শহরে পৌঁছে গিয়েছিলাম। দেখলাম সব স্মৃতিরা তাদের অস্তিত্ব গাছে, রাস্তায়, আকাশে, বাতাসের স্পর্শে, ফুলের ঘ্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে। সম্পূর্ণ ছোটোবেলাটা যেন আমার থেকে আলাদা হয়ে আবার আমার সাথে সম্পৃক্ত হয়েও আমার সামনে এসে দাঁড়াল। কথা বলল না। কিন্তু তার সেই নির্বাক বিশুদ্ধতায় নিজের পূর্ণরূপটা দেখলুম মনে হল। সেখানে সংজ্ঞা নেই, কোনো ধারণার অচল সীমারেখা নেই, সবকিছুই ভীষণ পেলব অথচ পূর্ণভাবে অকৃত্রিম। মনটা স্নিগ্ধ হল। যেন সেই সময়টার মধ্যেই ধরা থাকে জীবনের সম্পূর্ণ অর্থটার বীজ। তাই সারাটা জীবন নানান অভিজ্ঞতার শেষে মনে হয় সেই আপাত অর্থহীন, গতিময়, নিষ্পাপ সময়টাতে ফিরে যাওয়ার জন্যই যেন এতটা পথ হাঁটা।


ফুল যা ছিল পূজার তরে 
 যেতে পথে ডালি হতে অনেক যে তার গেছে পড়ে। 
কত প্রদীপ এই থালাতে সাজিয়েছিলে আপন হাতে
কত যে তার নিবল হাওয়ায়, পৌঁছল না চরণছায়ে।।


        তাই তো। সব প্রদীপ তো জ্বালা থাকল না, সব ফুলও তো নিয়ে আসা গেল না পূজার বেদী অবধি। কিছু কাড়ল অন্যমনস্কতা, কিছু কাড়ল লোভ, কিছু কাড়ল ভাগ্য। তবু সবটুকু যে নিঃশেষ হয়নি এই পরম ভাগ্য। তাতে লজ্জা পেতাম আমি তো অবশ্যই, বোধকরি সেও পেত। 
        এক বৃদ্ধ পূজারী আসতেন বাড়ির বিশেষ কোনো পূজো থাকলে। একদিনের স্মৃতি মনে এলো, পূজো শেষে উনি চা খাচ্ছেন, সামনে আমি বসে। আমায় বললেন, “দেখো, এই যে আমরা এত মূর্তি গড়ে পূজো করি, শেষে কি করি? ভাসিয়ে দিই। বাইরের জলে না হলেও মনে মনে তো বিসর্জনের মন্ত্র পড়তেই হয়। যেমন করে আমরা ঈশ্বরকে এই মূর্তির মধ্যে আবাহন করি, তেমন তাকে বিদায়ও তো দিই। তবেই বোঝো অবশেষে সব আকারহীন, আকৃতিহীন, অবয়বহীন... কিন্তু অস্তিত্বহীন নয়। অথচ এই সহজ কথাটা না বুঝে দেখো, আজ ধর্মের নামে, ঈশ্বরের নামে কি মারামারি।” 
        বলার শেষে একটু হাসির রেখা দেখা দিল ওনার ঠোঁটের কোণে। ওনার মলিন ধুতি, গায়ে নামাবলী, বয়সের লক্ষণ ফুটে ওঠা অশক্ত শরীরে যে কথাগুলো উচ্চারণ করলেন, তা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি শেখেননি, শিখেছেন নিজের সহজ জীবনবোধ থেকে। শৈশবের কাছে প্রকৃতি যে সুষমায় ধরা দেয়, বয়সের সাথে সাথে মোহমদের আবরণে সে ঢাকা পড়তে শুরু করে। তাই সহজ অনুভূতিগুলো জটিল হতে শুরু করে। পাপ জন্মায়। পাপ শাস্ত্রের নিয়মে জন্মালে তার হাজার একটা প্রায়শ্চিত্তের পথ আছে, যেমন অমুক নক্ষত্রে স্নান, দক্ষিণা ইত্যাদি। কিন্তু পাপ প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরণে জন্মালে প্রায়শ্চিত্তের একটাই পথ - ফলভোগ আর তার থেকে উত্তরণের পথ খোঁজা। মানুষই একমাত্র জাত, যে নিজেকে মানুষ বলে অনুভব করে। সে অনুভব কেবল শরীরের সত্তায় নয়, তবে মানুষের শরীর আর মনুষ্যত্ব দুটো পৃথক শব্দ হত না যেমন আর সব প্রাণীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। মানুষের প্রকৃত শিক্ষা তাই ওই শৈশবেই - প্রকৃতির নীরবতায়, প্রকৃতির মুখরতায়, প্রকৃতির বৈচিত্রতায়, প্রকৃতির সামঞ্জস্যে, প্রকৃতির গতিময়তায়, প্রকৃতির স্থবিরতায়, প্রকৃতির রূপে, রঙে, শান্তস্নিগ্ধরূপে, আবার প্রবল দুর্যোগে। 
        মুশকিল হচ্ছে শিক্ষাটা ব্যবসা হয়ে যাচ্ছে সেই চোখ ফোটা বয়েস থেকেই। অত্যন্ত স্মার্ট, কেতাদুরস্ত, চলন-বলনশীল তো হচ্ছেই, কিন্তু সামঞ্জস্য রাখার শিক্ষাটা অধরা থেকে যাচ্ছে। কারণ সামঞ্জস্য শিক্ষা, মাত্রাজ্ঞান, রুচিবোধ কোনো প্রত্যক্ষ শিক্ষার ফল তো নয়, সেটা সব সুশিক্ষার মন্থনজাত সুধা। যে সুধায় সে নিজে তৃপ্ত হয়, সমাজ তৃপ্ত হয়। 
        যেটা শুরুতে বলছিলাম, শব্দের বাধা। এই বিপণনসর্বস্ব যুগে খোলা হাওয়া একটা অস্তিস্ব সংকটের সংকেত। এক সময় ছিল রাজা-উজিরদের বানানো have & have not -দের বিভাজন, আজ সেই দাগটা টানছে কপট উদার অর্থনীতি। ষড়রিপুর তৃতীয় রিপুটি সম্বন্ধে ভাগবত বলছেন দুষ্পুরণীয়। অর্থাৎ বাকিগুলো কোনো না কোনো ভাবে নিজেদের তৃষ্ণা নিবারণের পর থামতে জানে, কিন্তু লোভের কোনো ইতি নেই। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলে, সাধারণ কোষ আর কর্কট কোষের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, প্রথমজন থামতে জানে, তার মাত্রজ্ঞান আছে, সামঞ্জস্যবোধ আছে, কিন্তু দ্বিতীয়জনের তা নেই। সে কেবল বেড়েই চলে, বেড়েই চলে। অবশেষে একদিন দেহের পূর্ণ সামঞ্জস্যকে নষ্ট করে তাকে মৃত্যুর মুখে ছুঁড়ে ফেলে। কিন্তু এ তো শরীরের কথা।
          প্রকৃতির একটা আত্মগতগুণ তার সামঞ্জস্যবোধজাত সন্তোষের অনুভব। সন্তোষ আর বাসনা পূরণহেতু সুখের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রথমটা একটা সক্রিয় অবস্থা, আর দ্বিতীয়টা দুটো চঞ্চল অবস্থার মধ্যের নিষ্ক্রিয় অবস্থা। দ্বিতীয়টার ঘোর কাটানোর জন্য বিজ্ঞাপন জগতের রথী-মহারথীরা আছেন। সংসারে কারা সফল আর কারা বিফল অর্থাৎ প্রচলিত ভাষায় লুজার তার সংজ্ঞাও সেই বিপণন জগতের অদৃশ্য রাজার অঙ্গুলি নির্দেশে হয়। তবে আর যাই কোথায়?
        শেষ করি শিক্ষা দিয়েই। শিশুর কাছ থেকে প্রকৃতিকে কেড়ে নেওয়ার মত অপরাধ কমই আছে সংসারে। প্রকৃতির একটা নিজস্ব ভাষা আছে শিশুর সাথে নিজের যোগাযোগ স্থাপন করার। তার মধ্যে এমন কিছু বোধ প্রতিষ্ঠিত করার যা তার সারা জীবনের পাথেয়। উপায়? প্রকৃতি বলতে শুধু নদী-পাহাড়-সমুদ্র তো বোঝায় না, প্রকৃতির আরেকটা অর্থ অকৃত্রিম যা। ভাষার সাথে বোধের যোগাযোগকে বলি শুদ্ধতা। ভাষা যদি আবেগ আর মতের ব্যাখ্যানের অস্ত্র হয় শুধু, তবে মানসিক ভারসাম্যহীন একজন ব্যক্তির চেয়ে অকপট ব্যক্তি সংসারে আর নেই, কারণ সে প্রতিনিয়ত তার আবেগ আর মতের প্রকাশই ঘটিয়ে চলেছে। শুধু বোধের অভাব বলেই তাকে ব্রাত্য বলছি সংসারে।
        এই বোধের শিক্ষাই প্রকৃতির শিক্ষা। প্রকৃতির নৈকট্যজাত শিক্ষা। এ অন্ধকার ঘরে হয় না, ব্ল্যাকবোর্ডে হয় না, পরীক্ষাগারে হয় না, বইখাতাতে হয় না। সেগুলো রথের সাজসজ্জা... রথীর কথা কি ভাবব না? রথের মূল্য রাখতে যে রথীর অস্তিত্ব সংকট হয়ে আসছে... সে ভাবার কি সময় হয় নি? 
        ভাষা হোক বোধজাত। শব্দ কারাগার না হোক, বোধনিঃসৃত জ্যোতির ধারক আর বাহক হোক।

450
Mon, 05/01/2017 - 09:30

দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাইরের প্রাঙ্গণ। সকাল আটটা। উল্লেখযোগ্য ভিড় নেই। রামকৃষ্ণদেবের ঘরে ঢুকতে বাঁশ। ডাঁয়ে, বাঁয়ে, পিছনের দিকে বাঁশ আটকানো - প্রবেশ নিষেধ - এখানে জুতা রাখবেন না। ঘরে ঢুকতে গেলে মন্দিরের ভিতরের প্রাঙ্গণে ঢুকে তবে যাও। এখন যাব না। লাইনে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না। চারদিকে ছোটো ছোট ঘুরন্ত ক্যামেরা, পুরুষ-নারী পুলিশ। সারা গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে পরীক্ষা চলছে - কেন এসেছ মন্দিরে, মরতে না মারতে? ভক্তিতে, না হিংসাতে? 

        যাব না ভিতরে। রামকৃষ্ণদেবের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসলাম। সামনে রাসমণি দেবীর পূর্ণাবয়ব মূর্তি। বাঁ পাশে গঙ্গার আওয়াজ। থেকে থেকেই ঝমঝম করে বালি ব্রীজ দিয়ে রেলগাড়ি যাওয়ার আওয়াজ।
          “স্নান করলাম বুঝলেন”
        বয়েস আন্দাজ ষাটের উপর। সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরে, মোটা চশমা চোখে এক ব্যক্তি আমারই উদ্দেশ্যে বললেন। আমার পাশেই বসে। পায়ের কাছে ওনারটা ছাড়া দু'জোড়া লেডিস চটি। পাশে রাখা দুটো মেয়েদের ব্যাগ। বেশ সচ্ছল অবস্থা মনে হল।
        "ও আচ্ছা", সোনামুখ করে বললাম। ওনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সেটা একটা সাদা রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, "প্রায়ই আসি। সোদপুর বাড়ি তো। টুক করে সকাল হলেই গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কতক্ষণ আর লাগে, ওই ধরুন আধঘন্টা।”
        আমি মুখের হাসিটা এখনও ধরে রেখেছি।
        "ওরা সব, মানে আমার বউ আর মেয়ে মন্দিরে দর্শনে গেল বুঝলেন, আমি যাই না। আমার ওসব ভালো লাগে না... ওই গুঁতোগুঁতি... ঠেলাঠেলি... কে যাবে বলুন... তার চেয়ে বাড়ির ঠাকুরঘরে চোখ বুজে বসে থাকব... শান্তি... কি বলেন?... আরে ভগবান কি আলাদা? এই ধরেন না, বিবেকানন্দ কি বলেছিলেন, সর্বভূতে তিনিই আছেন, তাই সবার সেবা করলেই হল...” বলেই ওনার দ্বারা সংরক্ষিত বস্তুগুলোর দিকে তাকালেন। বুঝলাম পুরোদস্তুর সেবায় নিয়োজিত প্রাণ।
        "এই যে বিবেকানন্দ বললেন সর্বভূতে তিনি আছেন, আপনার কি মনে হয় না এ বিশ্বাস মানুষের ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে?"... বলতে বলতেই সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা, ঠিক দাঁড়িয়ে না, কিছু কারণে বেশ উদ্‌বিগ্ন এক মধ্যবয়েসী মানুষের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের তখন বিবেকানন্দের অদ্বৈতবাদ অপেক্ষা গুরুতর কিছু সমস্যা জীবনে দেখা দিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। এদিকে খোদ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ, মুখ ফিরিয়েই বা নেন কি করে? কাঁচুমাচু মুখ করে হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
        আমার পাশের ভদ্রলোক ফের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "বিজ্ঞান এসে গেছে মশায়... বিবেকানন্দ এখন আর কেউ মানবে না... বিশেষ করে ওই সর্বভূতে ঈশ্বর তত্ত্বটা আর তো চলবেই না।”
        তাই তো, বিবেকানন্দর যুগে তো আর স্ক্যান, MRI ছিল না, তা হলেই বুঝতেন ওসব কথা ঘোরের কথা। আজ আমরা মানুষের সবটুকুন পরীক্ষা করে বুঝেছি, ওসব গোঁজামিলের কথা। 
        সামনের উদ্‌বিগ্ন মানুষটা তখন আরো উদ্‌বিগ্ন, কারণ বোঝা যাচ্ছে না। তার সাথে আমার পাশের ভদ্রলোকের এমন গুরুতর দার্শনিক নৈরাশ্যবাদের কথায় আরো ঘেঁটে যাচ্ছেন। 
        “মানুষ বর্বর হয়ে যাচ্ছে মশায়, বর্বর। না হলে শালা কেউ নিজের মাংস নিজে খায়... মশায় এখন একটা কুত্তাকে যে ভরসা করা যায় মানুষকে নয়, তবে বিবেকানন্দের কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন?"
        একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দমকা দিয়ে ঘর্মাক্ত গায়ের উপর দিয়ে বয়ে গেল। মনে মনে বললাম, আঃ! গাছের পাতাগুলো ঝরঝর করে শব্দ করে উঠল। দূরে কোথাও কেউ শাঁখ কিনছে, বিভিন্ন রকম আওয়াজ ভেসে আসছে। 
        কথাটা তো মিথ্যা নয়... মানুষে মানুষে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান... সামনে গুচ্ছ গুচ্ছ সিসিটিভি... সতর্ক পুলিশ... সন্দিগ্ধ পাশের মানুষের উদ্দেশ্য... ঈশ্বর কই? সেতো ওই মূর্তিতে আর ফটোতে... আটকে গেছে...
        চারদিক থেকে মালার গন্ধ, ধূপের গন্ধ, আরো নানা রকম মনের শুদ্ধতাবোধ আনয়নকারি আয়োজন... অবশেষে সব ব্যর্থ?
        ইতিমধ্যে ভদ্রলোকের স্ত্রী আর মেয়ে চলে এসেছেন। তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কচুরী খাওয়া ঠিক হবে কিনা, নাকি বরানগরের আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাবেন সোজা, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হল। স্ত্রী ও মেয়ে দুজনেই বেশ ভারিক্কি চেহারার মানুষ। মেয়েও বিবাহিতা। কপালে পূজো দেওয়ার স্মৃতিচিহ্ন - বড় লাল সিঁদুরের ফোঁটা। 
এরা পরিবার। সামনের গাছগুলোতে হনুমানের পরিবারের দাপাদাপি। হনুমান সন্দেহ করে? না, কোনো পশুই সন্দেহ করে না। করে মানুষ। সব চাইতে বেশি নিজেকে আর নিজেদের। 
        ওরা চলে গেলেন। বরানগরই যাবেন। মহিলা দু'জনের সাদা লাল পেড়ে শাড়ি, আরো একই রকম শাড়ির ভিড়ে মিলিয়ে যেতে লাগল। পাশে সেই ভদ্রলোকও মিলিয়ে গেলেন মানুষের ভিড়ে, যে মানুষদের মধ্যে আর বিবেকানন্দের দেখা ঈশ্বরকে দেখতে পাচ্ছেন না আর।


        সারাটা দিন গড়ালো। সন্ধ্যে হব হব। কাশীপুরের রতনবাবুর ঘাট। সামনে গঙ্গা। ঘাটের আলোগুলো জ্বলেছে। বেশ কিছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। ওপারে দেখা যাচ্ছে বেলুড় মঠ। মঠের পাড় ধরে বসা সার দিয়ে অজস্র মানুষ। তাদের উপরে লাল রঙের ফুলের গাছ। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা।

        তার নীচে বসা মানুষের অতশত পোশাকের রঙ - যেন ফুলগুলো ঝরে ঝরে পড়েছে মনে হচ্ছে। তবু ওরা ফুল নয়, মানুষ। 
        একটা কান্নায় ঘোর ভাঙল। পাশেই কাশীপুর মহাশ্মশান। সেদিক থেকে আসছে। শ্মশানের কান্নাটা শুধুই কান্না। একজন অল্পবয়েসী মেয়ে কাঁদছে। কেন কাঁদছে? থাক, আর এগোলাম না। শ্মশানের কান্নায় কোনো ক্ষোভ থাকে না, হিসাব থাকে না, লজ্জা থাকে না, অহংকার থাকে না। মৃত্যু যে কাওকেই রেহাই দেয় না। মৃত্যুর মত এমন অমোঘ, অবুঝ, সমদৃষ্টির বালাই সংসারে আর কি আছে! শ্মশানের কান্না তাই পবিত্রতম কান্না। আত্মা নগ্ন হয়। সাজানো মানুষটা মৃত্যুর সামনে দাঁড়াতে পারে না। তাই মানুষটা পুরো মানুষ তখন। 
        আবার তাকালাম ওপারে। সার দেওয়া মানুষের সারি। পাশাপাশি বসে। মানুষ দূরেও থাকে পাশে থাকার জোরে। বাইরে না হোক অন্তরে, ভিতরে। মানুষ একা থাকতে পারে না। একা থাকতেও এক বুক অভিমান লাগে, মানুষেরই ওপর। স্বেচ্ছা একাকীত্ব? সে তো নিজেকে ছাড়িয়ে দ্বিগুণ জোরে সবার মাঝে আসার কৌশল... বর্ষার জল যেভাবে দূরে গিয়ে সজোরে সবেগে কাছে ফেরে... নইলে তো মহাশূন্যে হবে ব্যর্থ সব আয়োজন!
        সন্ধ্যে হয়ে গেল। শাঁখ বেজে উঠল এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আমার আশেপাশে মানুষের ঢল। এ শুধুই অবিশ্বাস? কোথাও ভুল হচ্ছে কিছু।
এত দূর থেকে দেখি বলেই বুঝি মহাকাশের প্রতিটা গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। মালাকে একসাথে দেখলেই তবে তার মাধুর্য, প্রতিটা ফুলকে আলাদা করে দেখলে তো নয়। প্রতিটা শব্দের থেকে সরে এসে না দাঁড়ালে যেমন একটা পরিপূর্ণ বাক্যের অর্থ বোঝা যায় না, এও তেমন। তাই একটু সরে এসে, একটু দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায়, বিশ্বাসটাই আছে। বিশ্বাসহীনতাটা দুর্যোগমাত্র। ইতিহাসে দুর্যোগগুলোই লেখে। নিত্য ঘটনাটা লেখা বাহুল্য। চিরটাকাল স্বাভাবিক আর নিত্যের জোরেই বাঁচে ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রমের জোরে নিত্য তো নয়! তাই অনন্তকাল ধরেই মানুষ পাশেপাশেই থাকবে, হাঁটবে, বাঁচবে। এই একটু দূর থেকে সংসারটাকে দেখার অভ্যাসকেই বলা হয়েছিল - বৈরাগ্য। বৈরাগ্য চশমার কাঁচটার উপর জমা ধুলোগুলো সরানোর চেষ্টা। চশমাটাকেই বদলের কথা নয়। আর নিজের মধ্যে অন্যের অস্তিত্বের প্রয়োজনকে উপলব্ধি করার মত আস্তিকতা আছে নাকি মনুষ্যজন্মে আর কিছু? তখনই প্রতিদিনের তুচ্ছতার ক্লেদ ঘোচে মহাকালের অসীম ধৈর্য্যে, আশ্বাসে, বিশ্বাসে। 
        কান্নাটা শুনতে পাচ্ছি না আর, বহুদূর হেঁটে চলে এসেছি। তবু কান্নাটা এখনও বুকে বাজছে। ওই কান্নাটাই মোহ-মুদগর... নইলে নিজের হাত থেকে রেহাই নেই যে!

451
Thu, 04/27/2017 - 10:16
কোথা থেকে ফিরছিলাম মনে নেই, সন্ধ্যে সন্ধ্যে হবে, বড় রাস্তা পেরিয়ে বাঁকটা ঘুরতে যাব, হঠাৎ মনে হল, কিসে একটা খটকা লাগল যেন? কি যেন নেই?... মনে পড়ল, এখানে রোজ বিকাল থেকে প্রায় ন'টা অবধি একজন ফুচকাওয়ালা দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে প্রায় সারা সন্ধ্যেই থাকে বাচ্চাকাচ্চা, তরুণ-তরুণীদের দল। আজ কেউ নেই। ফাঁকা। শুধু স্ট্রীট লাইটের আলোটা ওই ফাঁকা জায়গাটুকু বৃথাই ভরাট করার চেষ্টা করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
        তার মানে ওরা আমার মনের কিছুটা অংশ আমার অজান্তেই দখল করে নিয়েছিল। আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি।
        আরেকদিন, খুব জোর কালবৈশাখী হয়ে গেল তার আগের দিন। আমি দু'দিন পর হেঁটে ফিরছি কোথাও থেকে একটা। মাঠ পেরিয়ে একটা বড় গাছ পড়ে গেছে ঝড়ে। দেখলাম সেটার গোড়া থেকে উপড়ে পড়ে আছে মাঠের ওপর। তার ডালপালা কাটাও শুরু হয়ে গেছে। মনের ভিতর একটা শূন্যতা তৈরি হল। কেন? আমি তো কোনোদিন গাছটাকে মন দিয়ে দেখিনি। কোনোদিন ভাবিনি। আমি না দেখলে, বা ভাবলে কি হবে? ও তো তার জায়গা করেই নিয়েছে আমার মনের কোনো একটা অংশে। 
        তাই ভাবি, প্রতিদিন এমন কত তুচ্ছ জিনিসে পরিপূর্ণ জীবনটা। ভালো করে দেখতে শিখলাম না বলে শুধু 'নেই নেই' করে কাটিয়ে দিলাম। কত অস্তিত্বের জোরে যে আমার এই ক্ষুদ্র 'আমি'টার অস্তিত্ব তার সীমা মেলা ভার। আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ শুনলাম আমার পাশের রাজ্যে চলে যাচ্ছে কাজের সূত্রে বদলি হয়ে। বাইরের দিক থেকে তাতে আমার কিছুই প্রভাব পড়ার কথা নয়, কারণ তার সাথে আমার দেখা হওয়ার তেমন কোনো সুযোগই ঘটে না। তবু জানতাম সে আমার শহরে আছে। আজ যখন সে থাকবে না শুনলাম, মনে একটা শূন্যস্থান তৈরি হল। তবে কি মনের রাজ্যে স্থান আর সময় সম্পূর্ণ তার নিজের অঙ্কে গড়া? বাইরের সব হিসাব ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তার কাছে? 
        আরো ছোটখাটো বস্তুর দিকে তাকিয়ে দেখি। আমার টয়লেটে যে ফ্লাশটা আছে, কোনদিন চোখে পড়ে সেটা চোখে পড়ার মত করে? যেদিন দেখি সেটায় জল জমেনি কোনো কারণে সেদিন মনটা তার সমস্ত আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকায়, অসুবিধাটা হল কিসে? প্রতিদিন যখন অন্যমনস্কভাবে চটিটা গলিয়ে রাস্তায় নামি, খেয়াল থাকে না তো চটিটাকে ভালো করে দেখার, ভাবি ওতে দেখার কি থাকতে পারে? পারে থাকতে, যেদিন ওর ফিতে আলগা হয়ে অল্প টানে ছিঁড়ে যায়। 
        আমার সমস্ত আগ্রহ আমাতে। আমার সুখে, ব্যক্তিগত আমাতে। তাই বরাদ্দের কিছু কম হলেই তাকিয়ে দেখি, খুঁজি, কিসে গোল হল? সেই ঘোরটা যেদিন কোনো কারণে হঠাৎ করে খসে যায়? অমনি দেখি শত সহস্র মানুষের ভিড়ে আমার অস্তিত্বের এক একটা অণু-পরমাণু জড়িয়ে। তাকে চিনি, না চিনি তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। শুধু সে আছে বলেই আমি আছি - এ বোধটা স্পষ্ট হয়ে মাথাটা নামিয়ে আনে আর বুকটাকে প্রসারিত করে তোলে। তাই বলা যায়, এ সমস্ত মিলিয়ে আমার একটা বড় শরীর আছে। আজ যশোর রোডে গাছ কাটা নিয়ে যে আমরা সরব হতে চাচ্ছি, কারণ সেটা আমার বড় শরীরে আঘাত করছে। জান্তে হোক, অজান্তে হোক - এই বড় শরীরটা সুস্থ থাকলেই আমার ক্ষুদ্র শরীরের যাত্রাটা নির্বিঘ্নে হতে পারে। 
        যদি কোনোদিন বড় কিছু চেয়ে থাকি, তা ঘোরের বশে চেয়েছি। ছোটোবেলায় মনে হত যখন খুব বড় হব তখন আর যা হোক ফুচকা খেতে কেউ বাধা দেবে না, ট্রেনের জানলার পাশের সিটটায় যতক্ষণ খুশী বসে থাকা যাবে, কেউ বলবে না ঠাণ্ডা লেগে যাবে এবার এদিকে এসো... আরো দামী দামী খেলনা কিনে আনা যাবে, কেউ বাধা দেবে না। 
        আজ সে সব আছে - খেলনা, জানলার ধারে সিট, ফুচকা... শুধু আমার আর সে আমিতে ফিরে যাওয়া হল না। এখন সে বারণগুলোর জন্যেই প্রাণ কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝে। তবে সে তো অন্যকথা। সেই 'তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও' বলে ধুলোতে নেমে আসতে ইচ্ছা করে। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই যে এত কিছুর মধ্যে ক্ষণিক থাকা আমারও হয়েছিল, সাক্ষী হওয়া হয়েছিল, ভোগ করার জন্য নয়। ভোরের শান্ত শীতল হাওয়া, সারাদিনের কাজের মধ্যে নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা, সন্ধ্যের আকাশের রঙ, পাখিদের ঘরে ফেরা, রাতের আকাশের নিঃসঙ্গ উদাসীনতা যেমন দেখেছি... তেমন দেখেছি ক্ষুধার্ত শিশুর করুণ অন্তর্ভেদী কান্নার সামনে অসহায় মায়ের দুটো চোখ... সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় উন্মাদপ্রায় বাবা-মায়ের অবস্থা... আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় হাসপাতালের ফ্রি বেডে শুয়ে থাকা বৃদ্ধা রমণীর বিকালের এক কাপ চায়ের প্রতীক্ষা...
        কেঁদেছি প্রচুর... ভেবেছি ভাবনার সীমান্ত রেখা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে নিজের ক্ষুদ্র ক্ষমতা অনুসারে... কোনো কিছুর উত্তর মেলেনি। শুধু বুঝেছি প্রশ্ন নয়... উত্তর নয়... জীবন এক একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তে গাঁথা বুদবুদের মালা... এ অসীম সাগরে এই সৃষ্টি হচ্ছে... পরক্ষণেই হচ্ছে বিলীন। যদি সব সরিয়ে সে সাগরের তলদেশে ডুব দেওয়া যায়... তবে এই জগতের পাশাপাশি আরেক জগতের হদিস মেলে যে জগতের কথা ফকির দিতে চেয়েছিল অমলকে... সে পথে ভিতরে দিয়ে যেতে হয়... প্রকৃতির অপেক্ষায় না থেকে নিজেকেই নিজে শূন্য করে ফেলতে হয়... তবে কারো চোখে চোখ তো পড়ে... সেই তো ভরসা...
452
Tue, 04/25/2017 - 10:30

যে সমাজ সুখ আর নিরাপত্তার বাইরে হাঁটার মনুষ্যত্বের পুঁজিটুকু হারিয়ে ফেলেছে, সে সমাজে একটা ছ বছরের নাবালিকাকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে মারার ঘটনা, নিতান্তই চাঁদে জল পাওয়া যায় কিনা ধরণের ঘটনা। তার ওপরে যখন সে মেয়েটা দিনমজুরের মেয়ে। আমার চারপাশ ভীষণ শান্ত। সব ব্যাপারে অত প্রতিক্রিয়াশীল হও কেন? এরকম ঘটনা এতবড় পৃথিবীতে ঘটতেই পারে। এত বিষাদের কথা কেন? এত নেগেটিভ ভাবার কি আছে? তেলের দাম কি বাড়ল? আইপিএল এর খবর বলো। 

নাটকীয় উপস্থাপনা দরকার। খবরের কাগজ, টিভির নিউজে বেশ দৃশ্যমান বর্ণনা প্রয়োজন। তবে গিয়ে আমরা হুজুগে মাতব। বেশ কিছুদিন সমস্ত আবেগকে কেন্দ্রীভূত করে ঝাঁপিয়ে পড়ব, পাড়ে গামছা তোয়ালে সাবান রেখেই ঝাঁপাব, যাতে সবাই যখন উঠবে তখন আমিও উঠে গা হাত পা মুছে আবার সেঁধিয়ে যেতে পারি ডেরায়। 
এত সভা সমতি, এত স্লোগান, এত লেখালেখি, এত চীৎকার...সব কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। তার কারণ সবই ভীষণ সুপারফিসিয়াল স্তরের। একদম নীচের তলা অবধি গিয়ে কাজের, সচেতন করার মানুষ কই? শিক্ষা কই? হাত বাড়ানোর হাত কই? যে সমাজ দুর্বল, পিছিয়ে পড়া স্তরকে অনুগ্রহ করে সাহায্য করে, সে ক্ষীণধারার নদীর মত কিছুদুর প্রবাহিত হয়েই শুকিয়ে যায়। মানুষের অনুকম্পার স্বাস্থ্য অতটা উন্নত হয়নি এখনও। অনুগ্রহ না, কর্তব্য, দায়িত্ব। যে সুবিধাটা আমি শুধুমাত্র জন্মসূত্রে পাচ্ছি, তা আরো নীচের স্তর অবধি নিয়ে যাওয়টা আমার কর্তব্য, দায়িত্ব। কিন্তু সে গুড়েবালি। সমাজের উন্নতির জন্য আমাদের করণীয় ভোট দেওয়া আর প্রতিদিন নিন্দা-সমালোচনা করা। আর নৈতিক পথে চলার ভার সাধু-সন্ন্যাসী নামক ব্যাচেলার ব্র্যান্ডের। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য - সুখ ও নিরাপত্তার গোড়াকে শক্ত করার প্রচেষ্টা পাওয়া। তার জন্য আস্তিক, নাস্তিক, নীচু হতে, যুক্তির ধোঁয়া সৃষ্টি করতে, যা বলো তাই করব। শুধু দেখো আমার গাড়ির দরজা যেন চলতে চলতে খুলে না যায়, মাঝপথে টায়ার না ফেটে যায়।
এটা ঠিক যে সমাজ সতীদাহ থেকে বাল্যবিবাহ সব কিছুর সমর্থন যোগ্য শাস্ত্র বানাতে পেরেছে, যে সমাজ জন্মসূত্রে মানুষে মানুষে প্রভেদ সৃষ্টির জাত নামক অভিনব বৈজ্ঞানিক কৌশল আবিষ্কার করতে পেরেছে, সে সমাজকে স্বাভাবিক মনুষ্যত্বে সাড়া দিতে অনেকটা গভীর আলোড়ন, চীৎকারের প্রয়োজন। আমাদের বর্তমান দ্বন্দ্বের বিষয় ধর্ম। আমরা ভীষণ ব্যস্ত রাম-রহিমের মধ্যে একটা বোঝাপড়া সেরে নিতে। নিজের স্বভাবে স্বাভাবিক উদারতার অনুভব না থাকলে বাইরে তা প্রদর্শনের একটা উত্তেজনা চেপে ধরে। আর যে সমাজে স্বর্গপ্রাপ্তির চেয়ে বড় পুণ্য আবিষ্কৃত হয়নি, সে সমাজে ইহকালটা রাবণের বংশধরদের হাতেই চলতে থাকে আর থাকবেও। ইহলোকের সুখের গোড়াপত্তন হলে চাই দিব্যলোকে অর্থাৎ পরলোকে সুখের গোড়া মজবুত করার তাগিদ। যা কিছু অদৃশ্য, তাই অদৃষ্ট। সেটা যখন যুক্তির দ্বারা, শুভবুদ্ধির দ্বারা নিয়ন্ত্রণে আনা গেল না, তখন দেবতা আর জ্যোতিষীরাই ভরসা। 
এ হেন সমাজে মনুষ্যত্বের আশা? যেখানে আধুনিক হওয়া যায় পোশাক বদলালেই, নিজের ভাষা ছাড়তে পারলেই, সেখানে আধুনিক হওয়ার অর্থই তো ওদের মত হওয়া। ভিসা পাসপোর্টএর হ্যাপা ছাড়াই যারা নিজের দেশেই যারা বিদেশকে অনুভব করতে চান, তাদের সংখ্যাও মা ষষ্ঠীর কৃপায় কম নয়। তারা বেশি চীৎকার করে, স্বদেশের উপর রাগ যে কোনো ইস্যুতে উগরে উগরে বার করে, ওদের মত (পাশ্চাত্যদের) লেখে, ওদের মত জন্মগতভাব এমন ধারা বিশ্বাস করে, অন্যকে বিশ্বাস করাতে চায় ফলে কোনো জলই আর নিম্নগামী হওয়ার মত বলিষ্ঠ ধারায় বয় না, নীচুস্তরে যারা তারা সে অন্ধকারকেই আঁকড়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে। 
অনুকরণশীল আর সংরক্ষনশীল সমাজের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব বাড়ছে, সেখানে স্বাস্থ্যবান মনুষ্যত্বের বিকাশ, মননের বিকাশ স্বাভাবিক গতিতে হবে, এমন আশা করাটাই বাড়বাড়ি। এর মধ্যে যারা আপন চরিত্রবলে বলীয়ান হয়ে সোজা দাঁড়াবার জোর দেখাতে পেরেছেন, বা পারছেন তারাই আগামী ভবিষ্যতের ভরসা। সত্যার্থী মহাশয়দের মত মানুষদের কাজ নিয়ে তেমন উৎসাহ আমাদের ভারতীয়দের তেমন একটা নেই। নোবেল না পেলে তার নাম তথা কাজের সম্বন্ধে না জেনেই ধরাধাম থেকে বিদায় নিতে হত, আর তাতেও আমাদের কোনো ক্ষোভ হত না, কারণ ওসব অকাজের কাজ। আমাদের মিডিয়া ধনঞ্জয়ের দিনপঞ্জিকা ছাপে, সত্যার্থীদের মত মানুষদের খোঁজে গেলে ব্যবসায় ঘাটতি হবে। আসলে আজগুবি দর্শন আর বিশ্বাস আর অনুশীলনের ফলে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছিয়েছি যে কোনো কিছুই একটা বাড়াবাড়ি মাত্রায় না পৌঁছালে নড়ে উঠিনা। তাই দেশকে 'মা' বলে না ভাবলে স্বাভাবিক দেশপ্রেম জাগে না, প্রতিটা জীবকে নাকি শিব হিসাবে না দেখলে তাকে ভালোবাসার বা সেবা করার তাগিদটুকুও মনে স্থির জন্মায় না। 
অর্থাৎ মানুষের যখন নিতান্ত শুধু মানুষ হয়ে থাকার মানটুকুও সমাজ দিতে পারে না, তখন ছ বছরের মেয়ে ধর্ষণের পর পুড়ে মরল আর না মরল...আত্মার তো কিছু হল না...আর স্বদেশী বিদেশিরা দেখল আলোড়নকারী নিউজ বানানোর তেমন কোনো রসদ নেই যখন …
ইতিহাস যতই জাগাতে চাক আমাদের...সে তথ্যের থেকে অমোঘ অস্ত্র আমাদের আছে, 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু...'...ঘুমিয়ে পড়ুন...কোত্থাও কিচ্ছুটি হয়নি...স্বর্ণযুগ এলো বলে...

453
Sat, 04/22/2017 - 11:24

মহাত্মা না সেলিব্রিটি? নাকি দুই-ই? একবার বাণী বসুর একটা সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, লেখালেখির জগতে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলে, এ দুয়ের সাযুজ্য খুব কমক্ষেত্রেই দেখা যায়। এ প্রসঙ্গ বিতর্কের। কিন্তু যা বলতে চাইছি সেটা তর্কের জন্য না মোটেই। 
আমাদের সারাদিন ঘিরে নানান বিখ্যাত মানুষ। যিনি যে পরিমণ্ডলে বিচরণ করেন, তাঁর সেই পরিমণ্ডলের বিখ্যাত মানুষেরা তাঁকে ঘিরে। মহাপুরুষ বা গুরু, লেখক, রাজনীতিবিদ, অভিনেতা ইত্যাদি যে কোনো পথেরই হোন না কেন। তবে মহাত্মা কি? মহাত্মা মানে কি মহাপুরুষ? হ্যাঁ-ও, আবার না-ও। আজ যাঁদের মহাপুরুষ বলছি, তাঁদের সময়ে তাঁরা হয়তো সাধারণের থেকে কিঞ্চিৎ বেশি পরিচিত ছিলেন, অথবা একদমই সেরকম অর্থে পরিচিত ছিলেন না। খ্রীষ্টকে চিনতেন কিছু মানুষ, মানতেন মুষ্টিমেয় ক'জন। রামকৃষ্ণদেব, সক্রেটিস, কবীর ইত্যাদির ক্ষেত্রেও তাই। তবে বুদ্ধ, মহাপ্রভুর পরিচিতি তাঁদের জীবিত অবস্থাতেই কিঞ্চিৎ বেশি ছিল, অনুগামীর চেয়ে শত্রুসংখ্যাও তাই কম ছিল না। তবে তাঁরা কেউই অগম্য ছিলেন না। অর্থাৎ ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিলেন না। মহাপ্রভু তথা বুদ্ধের সাথে দেখা করতে গেলে অগ্রীম অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা ছিল না। সে সময়ের রাজারাজড়াদের ক্ষেত্রে অবশ্যই ছিল। কারণ প্রথম পক্ষেরা মহাত্মা ছিলেন, সেলিব্রিটি ঠিক নন। দ্বিতীয় পক্ষেরা হলেন সেলিব্রিটি। 
প্রতিটা যুগের মানুষের একটা প্রশ্ন থাকে, তৃষ্ণা থাকে। আমাদের এই যুগে সেই প্রশ্ন আর তৃষ্ণা বড় বস্তুগত। চোখের জলের রাসায়নিক গঠন, প্রকার, সে বস্তুটির অভাবে কি কি করণীয় - সব প্রশ্নের উত্তর মেলা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু সেটা কেন বেরোয়, তা বস্তগত জ্ঞানের দ্বারা মিটবে না। আমাদের দুটো শব্দ খুব গোলায় দেখেছি, 'বস্তুবাদী' আর 'বাস্তববাদী'। খ্রীষ্ট, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ বস্তুবাদী ছিলেন না, বাস্তববাদী অবশ্যই ছিলেন। আমাদের মুশকিল হচ্ছে স্থূলকে যত সহজে স্বীকার করছি, সুক্ষ্মকে ততটা সহজে নয়। তাই মনের গভীরের কথাগুলোকে, ভাবগুলোকে স্থূল সংজ্ঞায়িত করে 'মার দিয়া কেল্লা' গোছের একটা ভান করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর কার্পেটের তলাকে ধুলোয় ধুলোয় ভরিয়ে তুলছি। প্রশ্ন নেই, গভীরে তৃষ্ণা নেই; আছে ক্ষুধা, আছে লোভ, আছে প্রয়োগ প্রবণতা। মানুষ কি অবশেষে একটা প্রয়োগ? একজন পার্ফরমার? একজন প্রয়োজন? না তো! মানুষ অবশেষে একজন মানুষ। মানুষের অতিরিক্ত সে যা কিছু হতে গেছে, ব্যর্থ হয়েছে। একদিন দেবতা হতে গিয়ে বিকারগ্রস্থ হয়েছে (উদাঃ বৌদ্ধযুগের স্বর্ণময় সময়টার পরবর্তীকাল), আর আজ যন্ত্র সাজতে গিয়ে আরো গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে। 
মানুষ এককালে যেমন প্রশ্ন করেছিল আগুন কি করে জ্বলে? বৃষ্টি কি করে হয়? তার উত্তরে সে পেয়েছিল যা, তাকে বললাম আমরা বিজ্ঞান। সে প্রশ্ন ছিল কৌতুহলের, বুদ্ধির, বহির্বিশ্বের সমস্যাজাত। যুক্তি সেখানে অগ্রগামী। মানুষের অন্তুরের অন্তঃস্থল থেকে আরেকটা প্রশ্ন জেগেছিল - আমাদের অত্যান্তিক মঙ্গল কিসে? উত্তর এসেছিল সংযম আর মৈত্রীর। তাকে আমরা বললাম ধর্ম। যাত্রা শুরু হল। দুই পথেই তৈরি হল নানান বিকার। যুগে যুগে এমন এক একজন মানুষ জন্মালেন যাঁরা সে বিকারগুলো পরিষ্কার করে আমাদের চলবার পথটাকে আবার যোগ্য করে তোলার প্রয়াস পেলেন। আমরা এগোলাম খানিকটা। আবার বিকার ঢাকল। 
সমস্যাটা বিকারে না। সমস্যাটা বিকারগুলোর প্রতি নির্বিকার থাকায়। শুরুতেই বলছিলাম না যে মহাত্মা বলতে মহাপুরুষ বা সেলিব্রিটি বোঝায় না, মহানকে অনুভব করার ক্ষমতাকে বোঝায়। সে ক্ষমতার স্থূল প্রকাশ দেখি যখন সমুদ্র কিম্বা পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়ে বলি - “আঃ... ছাড়া পেলুম!” কিসের থেকে ছাড়া পেলাম? আমার ক্ষুদ্র পরিসর থেকে। বাড়ির মধ্যেও যদি ঠাকুরঘর করি, সেই স্থানটাকে আমরা দৈনন্দিন সংসারের কোলাহল, মলিনতা থেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করি। সেখানে আমরা পবিত্র চিন্তার, পবিত্র ভাব আনার চেষ্টা করি। কেন? সেটাকেই আমরা বলেছি সাধন, তাই। নিজের ক্ষুদ্রতার কাছ থেকে মুক্ত হয়ে নিজের মধ্যে যে বড় তার কাছে যাওয়ার প্রয়াসকে বলছি ধর্ম। অবশ্য ফাঁকিবাজ সব পথেই আছে। এ ক্ষেত্রেও আমরা কোনো ছবি, মূর্তি অথবা গুরুকে বড়র প্রতীক জেনে নিজে বড় হওয়ার সাধনটাকে পাশ কাটাতে গেছি। তাতে নিজেকে ও তার সাথে নিজের পূজ্য উভয়কেই চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ করেছি। যত ক্ষুদ্র উদ্দেশ্য, আয়োজন তত বড়। তাই গীতায় যেখানে শুধুমাত্র জল, ফুল, ফল আর পাতাকেই সর্বাধিক বাহ্যিক পূজা বলছে আমরা সেখানে ষোড়শোপচারের আয়োজন করেছি। ফলও হাতেনাতে পাচ্ছি, যে এক জায়গায় মাথা নীচু করে রাখলে বিশ্বসংসারে আর কোথাও মাথা নীচু করতে হয় না, সেইখানে ফাঁকি দিয়ে সর্বত্র, যখন-তখন মাথা নীচু করছি। আর নিজেদের অত্যন্ত চালাক জীব ভেবে আত্মতুষ্টি লাভ করছি। 
জীবনের উদ্দেশ্যটা সেলিব্রিটি হওয়া তো নয়, নিজের ভিতরের অনুভবকে শুদ্ধ করার প্রয়াস। মাদার টেরেসা একটা চমৎকার কথা বলতেন, 'ঈশ্বর আমায় সফল হওয়ার জন্য পাঠাননি, বিশ্বস্ত থাকার জন্য পাঠিয়েছেন।' কি অসামান্য কথা! বলা হয় নিজের ক্ষুদ্রতার থেকে বাঁচার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হল, মহৎ অনুভবের সঙ্গে থাকা। মহৎ বাণীই হোক, জীবনীই হোক, সারাটা দিন যদি সেই সুধা থেকে নিজেকে বঞ্চিত না রাখি, তবে আমার অনুভবও একদিন সেই পবিত্র আত্মাদের অনুভবের কিঞ্চিৎ ছোঁয়া পাবে। চুম্বকের সাথে থাকতে থাকতে যেমন লোহাও চুম্বক হয়, খানিক তেমন আর কি! 
তাই খোঁজ সেলিব্রিটির না হোক, তৃষ্ণা সেলিব্রেশানের না হোক, যা বাহ্যিক আড়ম্বর শুধু। তৃষ্ণা হোক নিজেকে আরো মার্জিত, পরিশীলিত করার। শান্ত, প্রসন্ন আর সংযত করার। তবেই আমিও বাঁচি, আমার আশপাশটাও সুস্থ হয়।
454
Fri, 04/14/2017 - 23:29

"Cultivation of mind should be the ultimate aim of human existence."


মননে অমৃত শুধু ওঠে না, বিষও ওঠে। কিন্তু কথাটা গরলেরও না, অমৃতেরও না। কথাটা মন্থনের। আম্বেদকরের জন্মদিন আজ। সকাল থেকে বাঙলা ভাষায় যেক'টা পোস্ট দেখলাম, তার বেশিরভাগই বিদ্রুপাত্মক আর ব্যঙ্গাত্মক। হাসিই পেল, করূণাও হল। স্বামীজি আর নেতাজী (যাদের বেশিরভাগ বাঙালী, বাঙালী হিসাবে দেখতেই পছন্দ করে, ভারতীয় হিসাবে নয়) দুই মহাপুরুষই বলেছেন, আমাদের সাবধান করেছেন - তোমাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত রোগ ঢুকেছে, যে রোগের আশু চিকিৎসার ব্যবস্থা না হলে সমূলে বিনষ্ট হবার আশঙ্কা। রোগটা কি? - সব কিছু হেসে উড়িয়ে দেওয়া। যে কোনো ভারী ভাবকে অন্তঃস্থ করার অনিচ্ছা। ক্রমশ সে অনিচ্ছা অভ্যেসে পরিণত হয়। 

আজ সে অনিচ্ছার বহুলাংশে আমাদের সামনে। আমাদের বেশিরভাগেরই এখন অনেক কিছুই 'মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যায়'। মাথাটা নীচু করতে করতে এমন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, কোনো উঁচু কথা বলতে, আলোচনা করতে আমাদের স্বজাতীয়দের সাথে দ্বিধা হয়, 'খিল্লি' করবে না তো! অহো আত্মশ্রদ্ধার মান আমাদের! তাই বাঙালীর কিছু সহজ হিসাব - মহাত্মা গান্ধী দেশভাগ করে, নেহেরুকে রাজা করে সব্বোনাশ করলে; নেতাজী বন্দুক নিয়ে এসে ঢাঁই ঢাঁই করে গুলি চালিয়ে সব সাহেব তাড়িয়ে দিলেন - সেকি ভীষণ যুদ্ধু! বাবা রে বাবা!... আম্বেদকর সারা জীবনে শুধু কাস্ট রিজারভেশান করে দেশের ভবিষ্যতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিলেন...
আমরা simplification-এ বিশ্বাসী। জৈন দর্শনে দুটো কথা আছে - একান্তবাদী ও অনেকান্তবাদী। প্রথমটার অর্থ হল কোনো কিছুকে একটা সিদ্ধান্তে এনে দেখা। পরেরটার অর্থ হল কোনো কিছুকে অনেকগুলো দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেখা। বলা বাহুল্য, আমরা অতশত ভাবাভাবিতে নেই, পড়াশোনাতে তো নেই-ই... কেন করব? আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা বলে গেছেন, বিশ্বাস করে গেছেন, তাতে আস্থা নেই বুঝি? বই পড়ে দেখার কি দরকার? 
তাই কিছু কথা বলার ইচ্ছা হল। বেশ কিছু বছর আগে একটা প্রাইভেট নিউজ চ্যানেল বিভিন্ন ভারতীয় ব্যক্তিত্বের উপর একটা আলোচনা করেন, আর একটা ভোটের আয়োজন করা হয়, গান্ধী উত্তর ভারতবর্ষে কে সর্বোচ্চ প্রাসঙ্গিক ও প্রভাবশীল ভারতীয় হতে পারে। ফলাফল এসেছিল - আম্বেদকর। কেন? তার অনেক কারণ আছে। সে সবের দীর্ঘতালিকা ফেসবুক দেওয়াল সহ্য করতে পারবে না, বেজায় দীর্ঘ হবে। তাই মাত্র কয়েকটা দিক বলবার চেষ্টা করছি যা আমায় ভাবায়।


১) প্রতিবাদী ও প্রতিষেধক চিন্তক
-------------------------------- 
আম্বেদকর বৌদ্ধধর্ম নিয়েছিলেন। ঠিক যে কারণে গৌতম একদিন বুদ্ধত্বের দিকে এগিয়েছিলেন ঠিক সেই কারণে। বিদ্রোহ করেছিলেন - যত ক্ষুদ্রতা, অমানবিকতা, শোষণ, পীড়ন হিন্দুধর্মের নামে হয়ে আসছে, বলা যায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের (কারণ শুধু দর্শন দিয়ে ধর্ম হয় না। গীতা, বেদ-উপনিষদের ধর্ম আর অনুশীলিত হিন্দুধর্মের মধ্যে বিস্তর ফারাক) নামে হয়ে আসছে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন। ভারতবর্ষের মানুষ বিচারশীল, যুক্তিবাদী, আরো বেশি মানবিক হোক চেয়েছিলেন। 
বার্ট্রাণ্ড রাসেলের 'Principles of social reconstruction' বইয়ের প্রস্তাবিত মতের বিরোধিতা করতে গিয়ে বলছেন, বলের আবশ্যকতা আছে। কিন্তু যদি তা গঠনমূলক কাজের জন্য হয় তবে তা শক্তি কিন্তু যদি তা ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য হয় তবে সেই বল-ই ভায়োলেন্স। 
আরেক জায়গায় বলছেন, Buckle এর মতে ইতিহাস হল ভূগোল আর পদার্থবিদ্যার সমন্বয় - এ যেমন অর্ধসত্য, তেমনই মার্ক্সের মতে - ইতিহাস অর্থবলের গতিপথের সাক্ষ্য, এও অর্ধসত্য। এরা দু'জনেই যে ভুলটা করলেন, তা হল মানুষকে কোনো স্থান না দেওয়া। তার মতে অকৃত্রিমতা আর মেধা - চরিত্রের এ দুটো মহৎগুণ তো নিশ্চই, কিন্তু যথেষ্ট নয়। এর সাথে তার থাকতে হবে সামাজিক দায়বদ্ধতা, সচেতনতা, তাকে সমাজের 'scavenger' বা ঝাড়ুদার হতেই হবে। 
বলছেন, শুধুমাত্র অসন্তোষ থেকে কোনো বিপ্লব জন্মাতে পারে না। শুধু সেটুকু হলে তা নঞর্থক। দরকার সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারবোধ, ন্যায়ের উপর আস্থা, বিশ্বাস। নইলে শুধুই কোলাহল, শুধুই বিতণ্ডা। 
জীবনের শেষদিনগুলোতে বুদ্ধ আর তার শিক্ষাকে একটা বই (যা উনি দেখে যেতে পারেননি) আকারে লেখেন। যা পয়েন্ট করে করে লেখেন, অসামান্য বিশ্লেষণে বুদ্ধ ও তাঁর শিক্ষার সামাজিক ও রীতিনীতির বিচারে।


২) জাতিভেদ ও সংরক্ষণ
------------------------- 
প্রথম কথা উনিই বোধহয় প্রথম যিনি এই জাতিভেদ প্রথার সমূল বিনাশ চেয়েছিলেন। পারেননি সে আর আলাদা করে বলতে হবে না যদি বৃহৎ ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে দেখি। উনি বলেছিলেন, তোমরা উঁচুজাতেরা শিক্ষা পাচ্ছ, আলো পাচ্ছ, কিন্তু আপামর বঞ্চিত শ্রেণীরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছে। বড়জোর বিধবা-বিবাহ, বাল্যবিবাহ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, সংস্কারের চেষ্টা চলছে, কিন্তু কখনওই মূল যে জাতিভেদ প্রথা তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলছেন না। তার প্রধান কারণ হিসাবে উনি বলেন, এক, সাধু-সন্ত-মহাত্মাদের জাতিভেদপ্রথাকে স্বীকার করা (এখনও রামকৃষ্ণ মিশন, অনুকূল ঠাকুর ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে এই প্রথা চলে আসছে); দ্বিতীয়, আমাদের শাস্ত্র'র সমর্থন ও শিক্ষা। তিনি বলেন, এই নিষ্ঠুর পদ্ধতি শ্রমের ভেদ করছে না, করছে শ্রমকারীর ভেদ, এ লজ্জা!, এ অন্যায়!, এ অমানবিক! একে উচ্ছেদ করো। আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে এর সমূল বিনাশ হোক, মানুষ শাস্ত্রের ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তি দিয়ে ভাবুক, চিন্তা করুক।
বলা বাহুল্য, সে হয়ে পারেনি। কিঞ্চিৎ কোথাও কোথাও হয়েছে। তার একটা বড় কারণ, বহু আধুনিক ধর্মগুরুদের এর সমর্থন আশ্চর্য সব যুক্তিতে। তার সব চাইতে বড় যুক্তি হল - এত দিনের প্রাচীন পদ্ধতি সব ভুল?! 
চিন্তা যেখানে প্রাচীনত্বের ভারে এগোয়, সেখানে 'অ্যান্থ্রোপলজি' কি করে বোঝাবে endogamy (অন্তর্জাত বিবাহ) আর exogamy (আন্তর্জাত বিবাহ) -এর পরিণাম কি কি? অন্তর্জাত বিবাহের পরিণামই সতী ইত্যাদি? ক'টা মানবিক কথা শোনাতে রামমোহন আর বিদ্যাসাগরকে জীবনপাত করতে হয়েছিল... এ কি খুব সোজা কাজ?
বারবার বলতেন, কোনো ধর্মের আর তার অনুগামীর মূল্যায়ন শুধুমাত্র তার সামাজিক মূল্যবোধ আর নৈতিক মূল্যবোধের উপর হওয়া উচিৎ। বাকি সব অর্থহীন।
আর সংরক্ষণের ব্যাপারে উনি যা বলেছিলেন তার সাথে আমাদের কোটা সিস্টেমের বিস্তর ফারাক। উনি চেয়েছিলেন দশ বছর এই প্রথাটা থাকুক (নেটে এর বহু প্রমাণ পাওয়া যায়, আর সর্বোপরি ১৭ খণ্ড আম্বেদকর রচনাবলী আর প্রধান লেখাগুলোর সংকলনও বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়), তারপর তা দীর্ঘায়িত করা হবে কি হবে না বিবেচনা করা যাবে। ভাল করে ওনার লেখাগুলো পড়লে সে যুক্তিগুলো স্পষ্ট বোঝা যায়, কিন্তু ওই যে বললেন উনি, শুধু অসন্তোষে কোনো পরিবর্তন হয় না, অধ্যবসায় আর বিশ্বাস তো লাগবেই না?

৩) হিন্দী ভাষা আর ভারতের একতা
----------------------------------- 
বেশ কিছুদিন আগে হিন্দীভাষাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বিস্তর গাল খেয়েছিলাম (যদিও আশাও তাই ছিল)। সে নিয়ে নতুন করে কিছু বলব না আর। শুধু কয়েকটা কথা বলে ওনার উদ্ধৃতি দেব, অনুগ্রহ করে যদি পড়েন। সারাটা দেশ বাঁধা আছে একটা কালচারের সূত্রে। খুব ঠিক। কিন্তু United India-র যে স্বপ্ন উনি দেখেছিলেন, তাতে বলেছিলেন সারাটা দেশে একটা প্রধান ভাষা হওয়া দরকার ছিল। যাকে ঘিরে একটা দেশ দাঁড়াত। ইংরাজীতে যতক্ষণ না প্রতিটা মানুষকে যোগ্য করা যায় ততক্ষণ হিন্দীই সঠিক নির্বাচন। এটা মেনে নিলে ভারত একটা সম্মিলিত রাষ্ট্র, না হলে সদাবিবাদমান রাজ্যের একটা সমষ্টি।


"This danger is of course inherent in the creation of linguistic States. 

There is equal danger in not having linguistic States. The former danger a 
wise and firm statesman can avert. But the dangers of a mixed State are 
greater and beyond the control of a statesman however eminent.
How can this danger be met ? The only way I can think of meeting the 
danger is to provide in the Constitution that the regional language shall not be the official language of the State. The official language of the State shall be Hindi and until India becomes fit for this purpose English. Will Indians accept this ? If they do not, linguistic States may easily become a peril.
One language can unite people. Two languages are sure to divide people. This is an inexorable law. Culture is conserved by language. Since Indians wish to unite and develop a common culture it is the bounden duty of all Indians to own up Hindi as their language.
Any Indian who does not accept this proposal as part and parcel of a linguistic State has no right to be an Indian. He may be a hundred per cent Maharashtrian, a hundred per cent Tamil or a hundred per cent Gujarathi,
but he cannot be an Indian in the real sense of the word except in a 
geographical sense. 
If my suggestion is not accepted India will then cease to be India. It will be a collection of different nationalities engaged in rivalries and wars against one another.
God seems to have laid a heavy curse on India and Indians, saying ‘Ye 
Indians shall always remain divided and yet shall always be slaves!’....."


 

455
Wed, 04/12/2017 - 23:19


(এটা প্রবন্ধ হয়ত না। গল্প তো নয়ই। চারদিকে ব্যক্তিগতজীবনগুলো যখন ক্ষতবিক্ষত  হচ্ছে দেখি, খুব কষ্ট পাই। কিছু করার তো ক্ষমতা নেই, জীবিকা সামলে, যেটুকু পারি লিখতে চেষ্টা করি সারাদিন। অনেকে কথা বলতে চান, আমার ইচ্ছা থাকলেও শরীর আর সময়ে কুলায় না। খারাপ লাগে বুঝি। আমারও লাগে। উপায় নেই যে। 
আমি ভীষণ মুষড়ে পড়ি কারোর আত্মহত্যার কথা শুনলে। তাকে না চিনলেও মনে হয় হয়ত আমারও কিছু করার ছিল তার জন্য। অপরাধী লাগে। একটা মানুষ তার জীবন শেষ করে দেবে? মানতে পারি না। 
        বেশ কিছুটা রাস্তা হাঁটলাম। কিছু অভিজ্ঞতা তো হল। কিছু ঝড়, কিছু মরুভূমি পেরোলাম। সে সবের কিছু কথা লেখার চেষ্টা করলাম। যে ভাবে উতরিয়েছি নিজেকে। জ্ঞান মনে হলে পড়বেন না। উপলব্ধি মনে হলে দেখতে পারেন, যদি কিছু কাজে লাগে।)


আজ ভোরে জানতে পারলাম এক অল্পবয়েসী মহিলা আত্মহত্যা করেছেন, আমাদের পাশের পাড়ায়। একটা বাচ্চা মেয়ে আর স্বামী - এই নিয়ে সংসার। আমি চিনতাম না। আশেপাশে অনেকেই আমায় চেনাবার চেষ্টা করলেন। পারলাম না। আসলে এরকম একটা মৃত্যুর পর আর পরিচয় পেতে ভালো লাগে না। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা হয়, তার থেকে তার উপর একটা উপেক্ষা করার ইচ্ছা জন্মায় - 'কেন হেরে গেল... কেন পালিয়ে গেল...' তবু কষ্টটা থেকেই যায়। 
        অনেকের অনেক সাংঘাতিক রকম লড়াইয়ের কথা ফেসবুক জানায় আমায়, চারপাশের ঘটনারা তো আছেই। যে বিষয় নিয়ে বলব বলে বসা তাতে আসি। আমি দেখেছি, সংসারে সব চাইতে ভীষণ যন্ত্রণা বোধহয় সব চাইতে কাছের মানুষগুলোর উদাসীনতা, অমানবিকতা, স্বার্থপরতা। কথাটা নতুন অবশ্যই নয়। যন্ত্রণাটা তবু পুরোনো হতে চায় না। যে দুর্ব্যবহারটা সে করে চলেছে, তার দুর্ব্যবহারের কথাটা বলব কাকে? কোন আদালতে তার বিচার চাইব? বলতে গেলে নিজের লজ্জা, না বলতে পারলে হৃৎযন্ত্রের চাপ। নানান অসুস্থতা। চাপতে চাপতে সেগুলো মনের মধ্যে নানান রোগের শিকড় তৈরি করতে থাকে অলক্ষ্যে। 
        আমার ব্যক্তিগত জীবনেও দেখেছি, এমনটা হয়। এ পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম প্রথম টাল খেয়েও এখন সামলে নিয়েছি। কিভাবে সামলেছি সেই ক'টা কথা একটু বলার চেষ্টা করি। যদি কারোর কোনো উপকারে আসে।


১) আরো আঘাত সইবে আমার
----------------------------------------
প্রথম শর্ত, মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। যে যতটা সেটা অতিক্রম করতে পেরেছে সে ততটা উন্নত শ্রেণীর মানুষ। একটা ফোনের দোকানে ক'টা আইফোন থাকে? একটা হাওড়ায় ক'টা রাজধানী ছাড়ে? আপনার বাগানে যত ঘাস তত বনস্পতি কি থাকা সম্ভব? 
অর্থাৎ এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। মৌখিক মিষ্টতার অভাব নেই... "হও জড়প্রায়, অতি নীচ, মুখে মধু, অন্তরে গরল"... স্বামীজির কথা... "তবে পাবে এ সংসারে স্থান"। অতএব, অমন ব্রহ্মজ্ঞানী মানুষটাই যখন তার আশেপাশের মানুষগুলোর জ্বালাতে জ্বলেপুড়ে মরতেন সেখানে আপনি আমি তো কোন ছার! আপনি ভাববেন ওনারা তো অত উঁচুস্তরের মানুষ, ওনাদের কি আর এসব হত?... দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, খুব ভুল ধারণা... আমাদের থেকে লক্ষগুণ বেশিই হত। প্রমাণ? ওদের ব্যক্তিগত চিঠিপত্রগুলো পড়ে দেখুন। কি যন্ত্রণা... কি যন্ত্রণা... কি যন্ত্রণা... মাগো মা...। স্বামীজির মতন অসংসারী মানুষ চিঠিতে লিখে বসছেন, 'জীবনটা আর কি... শুধুমাত্র একটার পর একটা মোহভঙ্গ বই ত নয়!' কথাটা কিন্তু তত্ত্বকথা হিসাবে বলা না, বলা যন্ত্রণার উপলব্ধি থেকে। 
        তবে পেরোলেন কি করে? হ্যাঁ এই হল মোদ্দা কথা। তবে পেরোলেন কি করে? দেখুন, তাদের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতি করেনি। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আপনি আর আমি দুজনেই ঠিক করলাম দিল্লী যাব। আপনি গেলেন প্লেনে, আমি গেলুম ট্রেনে। আপনি যে পথ মাত্র কয়েক ঘন্টায় পাড়ি দিলেন, আমি সে পথ পুরো একটা রাত কাবার করে পাড়ি দিলাম। এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। ওদের হিল আপটা তাড়াতাড়ি হয় কারণ ওদের মনের গতিবেগ খানিক দ্রুত করে নিয়েছেন ওনারা। এ যেমন সত্যি, পাশাপাশি এটাও সত্যি যে, যে তীব্রতায় ব্যথা আমাদের হয় ওদের ক্ষেত্রে সে ব্যথা একশোগুণ বেশি তীব্রতায় হয়। পার্থক্য শুধু সেটা অতিক্রমের গতিবেগে। সাক্ষী চিঠিপত্র।


২) সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে
----------------------------------------------
না, কখনও আপনাকে বুদ্ধের মত পোজ দিয়ে সবাইকে ক্ষমা করার কথা বলছি না। প্রচণ্ড রাগ হবে, তেলেবেগুনে জ্বলে যাবেন। আবার সাংঘাতিক অভিমান হবে, মরে যেতে ইচ্ছা করবে, পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করবে, বিবাগী হতে ইচ্ছা করবে। আবার এমন বিতৃষ্ণা আসবে যে খুন করে দিতে ইচ্ছা করবে, ফাঁসি দিতে ইচ্ছা করবে, ভস্ম করে দিতে ইচ্ছা করবে। এ সব অকাট্য সত্য। কিন্তু কোনো ফল নেই। কারণ এর একটাও হবে না। 
        সহজতম উপায় বলি। যা দেখেছি। ধরুন আপনি ইয়ে করতে বসেছেন। মানে বড়োটা। জোর করবেন না। ও নিজের চাপে ক্রমশ নিজেই বহির্দ্বারের দিকে এগোবে। আপনি শুধু অপেক্ষা করুন। বেরোবেই বেরোবে। এও তেমন। ভুলতেও যাবেন না, জোর করে মনে করে কষ্ট পাওয়ারও কোনো দরকার নেই। শুধু মনে রাখতে হবে ঘটনাটাকে ফ্লাশ করব, নিজেকে নয়। আমার দুঃখ, শোক, চূড়ান্ত অপমান এসব আমার, কিন্তু আমি নই। এটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। যাই হচ্ছে তা আমি ফিল করছি, কিন্তু আমি নিজে তা হতে যাব কেন? আমি ড্রেন, আমি নদী, আমি আকাশ, আমি সিনেমার পর্দা, আমি রাস্তা ইত্যাদি। আমার উপর দিয়ে যা কিছু যেতে পারে, কিন্তু সেগুলো আমি নই। আমি ড্রেনের জল নই, নদীর জল নই, মেঘ নই, সিনেমা নই, লোকজন-গাড়িঘোড়া নই। আমার উপর দিয়ে যা হয় হোক, আমি তা নই। আমাকে শেষ করার ক্ষমতা নেই কারোর, হ্যাঁ আমার সাজানো সব কিছু তছনছ করে দিতে পারবে, কিন্তু মাটিটা কেড়ে নিয়ে যাবে কে? এটা বারবার মনকে বোঝাতে বোঝাতে মনের মধ্যে একটা বসার জায়গা পাওয়া যায় একটু উঁচুতে। আর উঁচুতে উঠলে যা সহজেই করা যায় তা হল উপেক্ষা। 
        নিজের জন্য এই উঁচু ঢিবিটা আপনাকে বানাতেই হবে। 'একা যদি না পারিস মন, গীতবিতানকে সঙ্গে নে না'। সে-ই বানিয়ে দেবে। 
        এই উঁচু ঢিবিটাকেই কেউ ঈশ্বর বলে, বলে আমায় তুলে নাও... "আমারে আড়াল করিয়া দাঁড়াও হৃদয়পদ্মদলে"। কেউ বলে মনের জোর... ”বহিতে পারি এমনি যেন হয়"। তবে সে সিট পেতে হবেই। 
        এখানে আরেকটা গল্প আছে। রামকৃষ্ণদেবের গল্প। ঝড়ের এঁটো পাতার গল্প। হাওয়া যেদিকে নিয়ে যায় যাক সেদিকেই ভেসে যাওয়ার পথ। অহং-এর প্যানপ্যানানিতে কান না দিয়ে দুপুরবেলা গাছের কোটরে কাঠবেড়ালি দেখার অভ্যাস, রাস্তায় চলা লোকজনের পোশাক-আশাক, বাচ্চাদের হইহুল্লোড়, ইত্যাদি নানান দিকে মনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার অভ্যাস। একে বলে 'জ্যান্তে মরা' অবস্থা। বাইরে মৃতের ভান, ভিতরে আনন্দবাজার। কারণ অবশেষে এটা বুঝতেই হয়, বাইরে একচুল ঘটনা নিয়ন্ত্রণেও আমার হাত নেই, না তো মনের মধ্যে ওঠা নানা বিকারের ওপর, আমার হাত শুধু আমার গুরুত্ব দেওয়া না দেওয়ার উপর। এটাই আমার চয়েস। এমনকি পুরা গীতাখানের শেষেও কৃষ্ণ বলছেন, 'যথা ইচ্ছাসি তথা কুরু'... অর্থাৎ সব বলে থুইলাম, এবার তোমার যা ইচ্ছা করো।


৩) খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি
------------------------------------
এই দ্বিতীয় ধাপের মধ্যেই আছে তৃতীয় ধাপের বীজ। শুধু ঢিবিটার উপর বিপদকালে চড়ে বসলেই হবে না। তাকে ধোয়ামোছা করতে হবে। 'আমার এ ঘর বহু যতন ক'রে, ধুতে হবে মুছতে হবে মোরে'। একে ভালো বাংলায় বলে সাধনা বা অন্তর্মুখ হওয়া - বড় কঠিন শব্দ। সে থাক, বরং ভাবা যাক সম্পূর্ণ নিজের জন্যে একটা জগত বানানোর কথা। সেখানে কারোর প্রবেশ নিষেধ। সেখানে আমার মুখোমুখি আমি। চলছে অনন্তকালের বোঝাপড়া। বাইরের জগতের ধুলোবালি কিচ্ছু ঢুকতে দেবো না সেখানে। রাতদিন ঘেঁটে থাকার জন্য আমার জন্ম হয়নি, আর না তো এর-ওর মনের মধ্যে শিকড় ঢুকিয়ে রসপানের জন্য, যে তারা দূরে সরে গেলেই নিজের অস্তিত্ব সংকটের ভয়ে হাত-পা পেটের মধ্যে সিঁধাবো। কে কি বলল, কে কি সিদ্ধান্ত টানল - এসব কানে পৌঁছালেও প্রাণে পৌঁছাবার পথ বন্ধ হবে তখন। এ নাকউঁচু মদিরা পানের কথা না। সংসারে যা কিছু শূন্য তাই বিপজ্জনক। শুনেছি তো নাকি জমি কিনে বেশিদিন ফাঁকা রাখাও নিরাপদ নয় নাকি আজকাল। কারা যেন পার্টি অফিস খুলে দেয়। তবেই বুঝুন, পার্থিব জমির যদি এই গতি হয়, তবে এমন মানব-জমিন বিনা আবাদে পড়ে থাকলে কি হবে সে সহজেই অনুমেয়। যে পারবে ভাগাড় বানিয়ে ফেলবে। তবে কিনা হল নিজের মত করে নিজের জন্য বাঁচার কৌশল।


৪) বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
---------------------------------------------
বন্ধু। জীবনের একটা মূল্যবান সময় এই সম্পর্কটা তৈরি করতে দিতে হবে। দিতেই হবে। সব বীজে ভালো গাছ হবে না। কয়েকটা পচা, ধুরুন্ধর বেরোবেই। হয়ত অনেকগুলোই বেরোবে। কিন্তু কয়েকটা চারা একদম খাঁটি হবেই হবে। 'বন্ধু' শব্দটা মনের সেই গভীর থেকে বাইরে - সর্বত্র যাতায়াত করতে পারে। শাস্ত্র থেকে গালিগালাজ - সব অনায়াসে শুনতেও পারে, দিতেও পারে। যা কিছু মঙ্গল, যা কিছু গঠনমূলক, যা কিছু বলপ্রদ তা যদি এই বন্ধু শব্দজাত না হত, তবে স্বয়ং ঈশ্বর থেকে বিশ্বচরাচর একটা প্রকাণ্ড ধোঁকা বই কিছু হত না। কিন্তু তা তো নয়। এ বিশ্ব সংসার বন্ধুশূন্য হয়ে পড়েছে এমন আকাল হয়নি এখনও, যদি না আমি নিজেকে নিজের আগল থেকে বাইরে না আনি। বন্ধুত্বের সাধনায় অহং পালাবার পথ পায় না, মঙ্গল বেরোবার পথ পায় না। কারণ একদিকে গালিগালাজ অন্যদিকে আবদার - দুইয়ে মিলে সে একটা ওয়েসিস বানিয়ে ফেলে। সেই ওয়েসিসের জন্যই তো আরো কয়েকটা সকাল নতুন করে দেখার ইচ্ছা। দেখতেই হবে। সব বলতে হবে। কোনো ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের কথা বলছি না। একদম ঘামের গন্ধ পাওয়া বন্ধুত্বের কথা বলছি, যে আসছে গেট খোলার আওয়াজে, হাঁটার শব্দে, চোখ বন্ধ থাকলে ছোঁয়াতেই টের পাওয়া যায়। সেখানে শুধু কথা হোক। প্রয়োজন আর অপ্রয়োজন - দুইয়ের-ই কথা হোক। বুকের পাথর গলে যাক। ভারমুক্ত হই। আবার চলি। সেই ওয়েসিসে মাঝে মাঝে ঈশ্বরও স্নানে আসেন, যখন অভিমান গলে বন্যা আসে। এটাই বাঁচা। খামোখা মরতে যাবো কেন?
        এসবের পরেও অবসাদ আসবে। বিষাদ আসবে। শুধু মনে রাখতে হবে, ওগুলো জীবনের এক একটা প্যারাগ্রাফ, পুরো বইটা নয়। আর একটা এত মোটা বইয়ের কয়েকটা পাতা না হয় ভুলভাল ছাপা হলই, তা বলে পুরো বইটা ফেলে দেব?!

456
Tue, 04/11/2017 - 22:00

মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটায় না কে? গায়ের রঙ, বিত্তের পরিমাণ, ভৌগলিক সীমারেখা, রাজনৈতিক অবস্থান, মেধার সুক্ষ্মতা, স্মৃতির আয়ুষ্কাল, আরো আরো কত কি... এত হিসাব কে রাখছে? তবে আর ধর্মের নামে একা দোষ চাপানো কেন? ধর্ম মানি না, কারণ তা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে - এ যুক্তি তাই খুব একটা মজবুত মনে হয় না। 
        একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। ধর্মের দুটো প্রধান দিক আছে, এক, নীতির দিক। দুই, ঈশ্বরের অস্তিত্বে 'হাঁ' বলার দিক। দুটোই এক ধরণের অথোরিটি বা কর্তৃত্বতা দাবি করে ব্যক্তিজীবনে। যেটা মেনে নেওয়া খুব দুষ্কর, অন্তত কম বয়সে ও মাঝ বয়সে। ঘুষের টাকা না নিলে 'সতীত্ব দেখানো বা মারানো' ট্যাগ করে দেওয়া খুব পুরোনো প্রথা, সারা বিশ্বে কি হয় তো বলতে পারব না, অন্তত আমাদের চারপাশে এ বহুবার হতে দেখেছি। কোনো প্রতিষ্ঠানে সৎ থেকে কাজ করে যাওয়ার যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা তা কম-বেশি অনেকেরই আছে, তাই সে আলোচনা থাক। একটা ঘটনা বড়মামার মুখে শুনেছিলাম। তিনি একজন বন্ধুর সাথে বসে গল্প করছেন, সেই বন্ধুর অধীনে বহু শ্রমিক 'দিন আনি দিন খাই' ভিত্তিতে কাজ করেন, তারা সব লাইন করে দাঁড়িয়ে হপ্তার টাকা নিচ্ছেন। হঠাৎ একজন মহিলা, কোলে একটা বাচ্চা, অত্যন্ত গরীব, এসে সেই বন্ধুটার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, "কিরে তুই আমায় এত টাকা বেশি দিচ্ছিস কেন? আমি তো গত সপ্তাহে দু'দিন কাজে আসিনি!” সে তার অতিরিক্ত টাকাটা দিয়ে ফিরে গেল। খানিক পর একজন পুলিশের বড়বাবু এলেন, বন্ধুর কাছে মাসের তোলা আদায় করে চলে গেলেন। 
        এই দুটোই তো সংসারের রূপ। প্রথমটা ধর্ম। দ্বিতীয়টা অধর্ম। আরেকটা ঘটনা বলি। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজীর কাছে শুনেছিলাম। কোনো এক গ্রামে ধর্মসভায় উনি যোগ দিতে যাচ্ছেন। ট্রেন, বাসের শেষে গরুর গাড়িতে। গল্প জুড়লেন গাড়োয়ানের সাথে। জিজ্ঞাসা করলেন, এ গাড়ি তোমার? সে বলল, না মহারাজ, এ গাড়ি আমার মালিকের। মহারাজ বললেন, তা কিরকম হিসাবে টাকা-পয়সা পাও? সে বলল, সারাদিন যত ভাড়া পাই, তার একটা নির্দিষ্ট অংশ তিনি দেন। মহারাজ বললেন, আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল... বললুম, আচ্ছা যদি তুমি সব ক'টা ভাড়ার কথা না বলো, উনি তো আর দেখতে আসছেন না?
        লোকটা তড়াক করে গাড়ির থেকে নেমে বললেন, ছিঃ ছিঃ! সাধু হয়ে এ কথা আপনি মুখে আনলেন কি করে? আমি যদি তাই করি তবে তা ধম্মে সইবে? 
এই হল ধম্ম বা ধর্ম। বেশ কিছুকাল আগে দুই মুচির কথা লিখেছিলাম। একজন আমার জুতোতে একটা পেরেক ঠুকে দেওয়ার পর যখন পয়সা দিতে গেলাম, বললেন, একটা সামান্য পেরেক ঠুকে পয়সা নেব? সে টাকা রাখার জায়গা আমায় আমার ভগবান দেননি। আরেকজন মুচি আমার ছোটোবেলায় দেখা, যে দিনে তিরিশ টাকা না কত একটা টাকা হয়ে গেলে আর বসত না। এ ধর্ম।
        আমার বাবা রেলে কাজ করতেন। আর আমি সেদিন থেকে আজও অসম্ভব ট্রেনের ভক্ত। তো ছোটোবেলায় বাবার কাছে সারাদিন ট্রেনের গল্প শুনতাম। বাবা একবার আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বলো তো ট্রেন চলার ব্যাপারে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কোনটা? আমি ইঞ্জিন, লাইন, বগি, ড্রাইভার কিছু বলেই বাবাকে তুষ্ট করতে পারলাম না। অবশেষে বাবা বললেন, সিগন্যাল। আমার খেয়াল হল, তাই তো? আমি এত ট্রেন দেখি, কিন্তু সিগন্যালটাকে আলাদা করে তো কোনোদিন গুরুত্ব দিইনি। সে যে আছে, যেন বাড়তি হয়ে। অকারণ পথ আটকে, না তো স্পিড কমিয়ে যাত্রাতে বিঘ্ন তৈরি করতে। সেদিনের সে উত্তর মনে ধরেনি। আজ বুঝেছি। সেই সিগন্যালটাই ধর্ম। 
তবে কি নীতির কোনো বিকল্প নেই? না নেই। একটা কোষের মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে যা ঘটে চলেছে তা একটা নিয়ম নীতি মেনেই ঘটে চলেছে। মজাটা হচ্ছে, নিয়মটা চোখে দেখা যায়, নীতিটা দেখা যায় না। নীতি বলতে আমি সূত্র বলতে চাইছি এখানে। প্রেসার কুকারে রাঁধার নিয়মটা আমার জানলেই চলে যায়, কিন্তু যে নীতিতে বা সূত্র মেনে প্রেসার কুকারটা কাজ করে, তা আমার না জানলেও চলে। 
        তবে কি নীতি মেনে চলতে গেলে একজনকে ঈশ্বর বিশ্বাসী হতেই হবে। আমার ব্যক্তিগত অনুভব হল, না। তবে তার নিজের থেকে বড় কিছু একটা জীবনে অনুভব না করলে সে নীতির উদয় হবে না জীবনে। সব চাইতে বড় শত্রু আমার স্বার্থবুদ্ধি। স্বার্থবুদ্ধি মাত্রেই ক্ষণিক বুদ্ধি। একটা চিঠির একটা অংশ, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
"আমাদের দেশে কিছুকে বাঁচিয়ে তোলা এবং বাঁচিয়ে রাখা প্রাণান্তিক ব্যাপার, অহোরাত্র মৃত্যুর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করতে হয় – কেননা জীবনগত শ্রদ্ধা সেখানে বড় দুর্বল, সেই জিনিসকে জাগিয়ে তুলতে পারিনে - সেই জন্য ছোটোখাটো বাধা এবং আত্মাভিমানে আমাদের সমস্ত তপস্যা শতছিদ্র ও জীর্ণ হয়ে পড়ে। ... আমাদের দেশের যে দৈন্য সে কেবলমাত্র চরিত্রের দৈন্য - আমাদের সম্পদকে আমরা দৃঢ়শক্তিতে ধারণ করে রাখব এবং স্থায়িভাবে পোষণ করতে থাকব এমন প্রশস্ত আধার আমাদের নেই... জীবনের অভাব কি কোনোদিন টাকা দিয়ে পূরণ কর যায়?... ভাবনার কথা কেবল আত্মশ্রদ্ধার অভাব - সেই দৈন্য সকল দৈন্যের মূল এই জন্য যে সেই দৈন্য পূরণ করতে পারে কুবেরের ভাণ্ডারেও এমন ঐশ্বর্য্য নেই।" 
        খুব শিক্ষিত স্কলার হতে হয় কি এই বোধটাকে জাগাবার জন্যে? কেউ একজন ট্রেন থেকে নেমে বলল, "বেকার টিকিট কাটলাম, কেউ তো চেকই করল না।" এটা ভয়ংকর কথা! আত্মশ্রদ্ধাহীনতার কথা। যা নেই, তা নেই-ই। তা থাকলে কি পার্থক্য হয়, তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না। এই ভাবটা অনেকটা পরিবেশের উপরও নির্ভর করে। যে অফিসের পরিবেশ অনেক স্বচ্ছ, সেখানে একজন মানুষ অসৎ পথে যেতে গেলে দু'বার ভাববে। আবার উল্টোটাও সত্য, যে অফিসে ঘুষ খাওয়াটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে যে সৎ থাকতে চাইবে তার অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জীবনসংশয়ও অস্বাভাবিক নয়।
        বলা হল, একটা মোক্ষমার্গ আরেকটা ধর্মমার্গ। বিবেকানন্দ এই নিয়ে বড় সুন্দর করে হাতে ধরে বোঝাবার মত বুঝিয়েছেন। হরিনাম, সাধন-ভজন, সঙ্কীর্তন ইত্যাদি মোক্ষপ্রার্থীদের জন্য। আর সৎ পথে থেকে জীবন যাপনের উৎসাহ সাধারণ মানুষদের জন্য।
        কথা হচ্ছে, রীতির সৎ-অসৎ বলে কিছু হয় না। নীতির হয়। ধর্ম শব্দটা তাই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একটা মানুষকে ক্রমোন্নোতির দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ। যদি বিশ্বাস করি আমরা বিবেক-বিবেচনাসম্পন্ন জীব, তবে ধর্ম একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর যদি ভাবি শুধুমাত্র একটা কথা বলা জন্তু তবে এ আলোচনা বাতুলতা।
        বুদ্ধ সেই মানুষের কথা বলেছিলেন, যা মানুষ বলতে আমরা বুঝি। আমি বুদ্ধধর্ম বলতে যা এখন বুঝি তার কথা বলছি না, বলছি বুদ্ধ যখন কোনো মানুষ না, মানুষের একটা স্তরের কথা। তিনি ঈশ্বরকে সরিয়ে মানুষের কথা বলেছিলেন। বলা যায় প্রথম ধর্মীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে, কোনো অদেখা অস্তিত্বে ভার দিয়ে ফাঁকি দিলে চলবে না। বড্ড সোজা কথা, বড্ড কঠিন কথা। নিজের ভালোমন্দের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার কথা।
        আমাদের প্রজন্ম কোনো বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, আমরা খুব বড় কোনো ক্রাইসিসের সেভাবে সম্মুখীন হইনি। তৈরি করা ক্রাইসিস আর সত্যিকারের ক্রাইসিসের মধ্যে কি পার্থক্য তাও বুঝি না। তাই সৎ হওয়ার, নীতিবান হওয়ার সে অর্থে কোনো তাগিদ আমাদের নেই। বলতে চাইছি না যে একমাত্র সংকটকালই সৎ মানুষ বানায়, বলতে চাইছি জীবনবোধের গভীরতা তখনই জাগে যখন জীবনটা ভোগের থেকে মূল্যবান লাগে। একটা চূড়ান্ত বিলাসবহুল জাহাজের এক পরমভোগী যাত্রীকে যদি বলা যায় যে জাহাজটায় একটা ছিদ্র দেখা গেছে, আর তাতে বিন্দু বিন্দু জল এই বিলাসযানে ঢুকছে, তবে পুরো ডুবতে আরো মাসখানেক লাগবে। সে কি আর নিশ্চিন্তে ভোগে মন দেবে? না। 
        আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। অভ্যাসে বা রীতিতে যদি সততা না থাকে, তবে তাকে আহরণ করা ছাড়া কোনো গতি আছে বলে তো মনে হয় না। আর সততা ছাড়া কোনো জাতের কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কল্পনা পাগলেও করতে দ্বিধা করবে।


(Samiran দার তোলা ছবিটা অনেক কথা মাথায় নিয়ে এলো। তাই...)

457
Wed, 04/05/2017 - 12:04

তুলসীদাসের রাম যে অযোধ্যায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেখানে ট্রেনে স্থূল শরীরে পৌঁছানো যায় না। কবীরের রাম দশরথের পুত্র রাম না। মহাত্মার রাম এ বিশ্বসংসারের প্রাণকেন্দ্রে থাকা সচ্চিদানন্দ। তুলসীদাস তাই দুই হাতজোড় করে সমগ্র জগতকে প্রণাম জানিয়ে বলেন - 'সিয়া রামময় সব জগ জানি'। রবীন্দ্রনাথের লেখায় বারবার রামের তথা রামায়ণের উপমা এসেছে। সে মাধুর্যের রসে সিক্ত। একটা ফুল দেখে তিনি বলছেন, এ যেন প্রভুর কাছ থেকে আসা অঙ্গুরীয়, যেমন সীতার কাছে অশোকবনে হনুমান নিয়ে গিয়েছিলেন, এই কথা বলতে যে প্রভু আপনাকে ভোলেননি, তিনি শীঘ্র আসছেন আপনাকে উদ্ধার করতে। এ তেমন। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রামায়ণ ভাবগত সত্য, বস্তুগত না। যে রামকে ভারতবর্ষ চিরটাকাল আদর্শের প্রতিমূর্তি দেখে এসেছে। বন্ধু, পিতা, স্বামী, রাজা ইত্যাদি। তুলসীদাসজী রাম চরিত্রকে এঁকেছেন নিজের মানসমাধুর্যে। কোনো কূট তর্ক-বিতর্কে যেতে চাননি। যেমন সংগীত রসিক আওয়াজের মধ্যে সুর খুঁজে পায়, বিমূর্ত রাগের রূপ দেখে তেমন। অরসিকের কাছে কি ভৈরব আর কি পূর্বী। দুই শব্দ। তাই তার সম্বল তর্ক। রামায়ণ তর্কের জায়গা না। মাধুর্যের জায়গা। বিশ্বাসের জায়গা। আস্থার জায়গা। 
আজ রামনাম আতঙ্কের। অথচ যে মহাপুরুষের কন্ঠে এ নাম রাতদিন গীত হত সে মহাত্মার কণ্ঠে এ নাম ছিল অহিংসার মন্ত্র। তাঁর একমাত্র সম্বল। লক্ষ মানুষের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারিত হত, আশা সঞ্চারিত হত এই নামের মাধ্যমে তাঁর আত্মায়। তার কারণ তিনি পরমাত্মাকে আত্মায় পেয়েছিলেন, বাইরে দলতন্ত্রের মধ্যে, বা সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে না। জলকে তত্ত্বত উপলব্ধি করেছিলেন বলে ঠাকুরের ভাষায় 'পানি', 'অ্যাকুয়া', 'ওয়াটার' সব সমার্থক করতে পেরেছিলেন। এক রাম তার হাজার নাম।
মুশকিলটা সেদিন হল, যেদিন রামকে পুরাণ পুরুষ থেকে ঐতিহাসিক পুরুষরূপে দেখা আমাদের বেশি জরুরী হয়ে উঠল। সেদিন বিরোধ বাধল, রক্তারক্তি হল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, প্রয়োজনটা কম হলে আয়োজনটা বেশি হয়। বাল্মীকি থেকে রামকৃষ্ণদেবের চৌকাঠওয়ালা, মণিমানিক্যখচিত মন্দিরের প্রয়োজন হল না, কোথাও তার দরকার আছে বলেও গেলেন না, আজ হঠাৎ রামের আবাসস্থলের একান্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এর অর্থ আমাদের বাল্মীকি, তুলসীদাস, চৈতন্য, রামকৃষ্ণের রামের থেকে অন্য রামের প্রয়োজন বেশি। বিবেকানন্দ বলছেন, মন্দিরের অচল শিবের চাইতে সচল শিবের পূজা শুরু হোক। বলছেন দেশটাকে আদর্শে জাগাও, মানুষ তৈরি করে জাগাও। যার মূল কথা উদারতা, চৈতন্যের বিকাশ। অন্তরের রামের পথে চললে যা মেলে। তুলসীদাস বলছেন, 'পরহিত সম ধরম নাহি ভাই, পরপীড়ন সম নাহি অধমাই'।
অন্ধকার দূর করার উপায় 'অন্ধকার অন্ধকার' বলে চেঁচানো নয়, শুনেছি বহুবার কথাটা। অন্ধকার দূর হতে পারে তাই আবার যদি গভীর আন্তরিকতার সাথে এই মূলগ্রন্থের পাঠে ফিরে যাই মহাত্মাদের বাণী অনুসরণ করে। তুলসীদাসজী বলছেন, শাস্ত্র তো দুর্গম পাহাড়, সেখানে বহুরত্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এও সত্য। তবে সে রত্নের খোঁজে বিবেক-বৈরাগ্যকে ঢাল না করে যদি এগোতে যাও তো ভুলভ্রান্তিতে পথ হারাবে। কি খাঁটি কথা! বিবেক অর্থে সত্য-অসত্যের মধ্যে পার্থক্যজ্ঞান। আর বৈরাগ্য বলতে বলছেন, দর্শিত-কল্পিত-শ্রুত-শ্রুতব্য যাবতীয় বিষয়ের উপর নিরাসক্তি। অগত্যা বোঝা গেল তো "জয় শ্রীরাম” বলে ঝাঁপিয়ে পড়াকেই রামভক্তের লক্ষণ বলা হয় না, তুলসীদাসজী আরো বলেছেন, কপটতা হচ্ছে সবচাইতে বড় শত্রু এ পথের, মুখে রামনাম আর আচরণে রাবণের মত হলে বিপদ ভাই। রামজীকে তুষ্ট করার সহজতম পথ কি তবে? 
“সরল সুভাব, না মন কুটিলাই
যথালাভ সন্তোষ সদাই।” 
বলে তুলসীদাসজী বলছেন রামের মুখে, বলতো যে আমার ভক্তরূপে নিজেকে জগতে প্রচার করে অথচ অন্যের সাথে শত্রুতায় লিপ্ত হয় সে কি আমার ভক্ত?
বলছেন, শত্রুতা, পরমুখাপেক্ষিতা, ভীতি যদি ছাড়তে পারো তবেই তুমি আমার ভক্ত হওয়ার যোগ্য। তবেই হল, আচরণে ভক্ত হওয়ার কথা হল, আবরণের না, চীৎকারে না, দলতন্ত্রে না। বিশ্বাসে, স্থৈর্য্যে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়। তবেই রাবণকেও আর বাইরে দেখতে হবে না, ভিতরেই সোনার লঙ্কায় শুভবুদ্ধি সীতার অপহৃত রূপকে দেখতে পাব। কেঁদে উঠব, শুভ উদ্যমরূপী হনুমানজী আমার মতিতে বসবেন, আর ধীরে ধীরে পরমালোকরূপী রামচন্দ্র আমার অন্তঃস্থলকে অযোধ্যা গড়ে তুলবেন। মনে মনে সেদিনই সঠিক সুরে, সঠিক মাত্রায় উচ্চারণ হবে - জয় শ্রীরাম। গাইব -
ঈশ্বর-আল্লাহ্ তেরো নাম
সবকো সম্মতি দে ভগবান 
রঘুপতি রাঘব রাজারাম
পতিতপাবন সীতারাম
(আজ রামনবমী)

458
Sat, 04/01/2017 - 10:52


মানুষ কবে সভ্যতার প্রথম সোপানে পা রাখল ইতিহাসবিদরা বলতে পারেন। কিন্তু প্রথম কবে একে অন্যকে বোকা বানাতে শুরু করল কেউ বলতে পারেন? কেউ জানেন না। ইতিহাসবিদদের কথা না হয় থাক। আমাদের মহাভারতে দেখুন, এক কুরুক্ষেত্র হয়ে গেল কি না সেই একবার দ্রৌপদী হেসেছিল বলে। মনে নেই? কেউ কেউ বলেন না? সেই যে গো, পাণ্ডবদের গৃহপ্রবেশের দিন। সে নাকি যেখানে মনে করো দরজা সেখানে স্ফটিক নির্মিত দেওয়াল। ফলে দুর্যোধন কি নাস্তানাবুদ হয়েছিল। তা যেই না দুর্যোধন মুখ থুবড়ে ধাক্কা খেয়ে পড়েছে, অমনি দ্রৌপদী আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না, 'হো হো' করে হেসে উঠল, বলে 'কানার ছেলে কানা'। না, অতবড় ঠাট্টাটা আর নেওয়া গেল না, ব্যস... লেগে গেল কাঁটা দুর্যোধনের বুকে। তারপর তো সে পাশাখেলা, বস্ত্রহরণ মায় কুরুক্ষেত্র অবধি গড়িয়ে তবে শেষ হল। উফ্‌, বোকা বানাবার কি মূল্যই না চোকাতে হল গা। পুরো বংশটা প্রায় নির্বংশ হওয়ার জোগাড়! 
        একটা গল্প মনে পড়ল। ওই বোকা বানানো নিয়েই আর কি। এক গ্রামে এক বড়লোক মোলো। তার দুই ছেলে। ধামড়া ছেলে কিন্তু কিছু করে নাকো। বাপের পয়সায় বসে বসে খায়। এদিকে শখ ষোলো আনা, বিয়েটিয়ে সব সারা। সে বড় গরীব গ্রাম ছিল। কেউ মারাটারা গেলে মন্দিরে পূজো দিয়ে দিত দশদিন পর, ব্যস ওইতেই তাদের স্বর্গবাস হয়ে যেত। তা গরীবদের স্বর্গ আর কি। কিন্তু এরা তো বড়লোক, এরা কেন ওরকম করে শ্রাদ্ধ সারবে? তারা সারা গ্রাম নেমন্তন্ন করল। গয়া থেকে পুরুত ডাকা হল। আর ধনী মানে ওদের কাজের লোককে বলা হল সারাটা উঠোন গোবর দিয়ে নিকিয়ে দিতে। 
        সব ব্যবস্থা হল। শ্রাদ্ধ শুরু হল। গ্রামের লোক গিজগিজ করছে। শ্রাদ্ধ কাকে বলে দেখবে। এর মধ্যে হল কি, শ্রাদ্ধ চলতে চলতেই দুই ভায়ের মধ্যে বচসা বেধে গেল, বাপের সম্পত্তি নিয়ে। প্রথমটায় মুখে মুখে, তারপর হাতাহাতি। এ ওর গলা টিপে ধরে, ও এর গলা টিপে ধরে। লোকজনের মধ্যে বেশ একটা উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল, তারা ভাবলে এই বুঝি শ্রাদ্ধের একটা রীতি। ওদিকে দুইভাই মারামারি করতে করতে গড়াগড়ি দিতে দিতে এক্কেবারে নিকানো উঠান ছাড়িয়ে গ্রামের রাস্তায়। লোকজন তাদের পিছুপিছু, বড়লোকদের শ্রাদ্ধ বলে কথা। কিন্ত ওদিকে সে ধনী কাজের মাসি ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছে, সে বুক চাপড়াচ্ছে আর বলছে, "হায় হায় রে, শ্রাদ্ধ এতদূর গড়াবে আগে জানলে আমি পুরো গ্রাম গোবর দিয়ে নিকিয়ে দিতুম গো!”

        তা এই হল গল্প। আসলে আমাদের বোকা হওয়াটা ভাগ্যের গোড়া থেকেই লেখা আছে। আর কেউ আমায় বোকা বানাক না বানাক নিজেকে বোকা বানাবার কোনো সুযোগ কি ছাড়ি? বার্ট্রাণ্ড রাসেল এক জায়গায় বলেছিলেন, 'বদ্ধোন্মাদ হওয়ার পূর্বলক্ষণ হচ্ছে, নিজেকে আর নিজের কাজকে জগতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা।' আহা, কি খাঁটি কথাখানা! নিজেকে বোকা বানাবার বিস্তর কায়দা আমরা জানি। প্রথমটাই হল, নিজেকে অত্যন্ত চালাক মনে করা। উফ্‌ এ যে কি রোগ! যে যাই বলে সন্দেহ। "উঁহু তা কি করে হয়! আমার তো এরকম মনে হয় না"... ইত্যাদি। এমনকি বোকা বনে গেলেও স্বীকার করব না, এমন গুমোর। এ আরেক ঝঞ্ঝাট। ফলে আরো বোকা হওয়ার রাস্তা খোলা। এ ছাড়া বিস্তর ভুল বিশ্বাস তো আছেই। সেই রামপ্রসাদের গান, “ওমা নিম খাওয়ালে চিনি বলে"... অর্থাৎ কি না বোকা বানাতে দেব-দেবীরাও ছাড়ে না। তবে যাই কোথা? আহা, ওই যাওয়ার লগে বাসনাটাও তো আরেক বোকামি। যেতেই বা হবে কেন? বোকা হওয়ার তো একটা সীমা আছে, না কি? সেটা না দেখে, যাবোই বা কেন? 
        ভালোবেসে বোকা বনে পাগল হয়েছে এমন মানুষের সংখ্যা কিছু কম নয়। একে ভালোবাসা অন্ধ, তায় বোকা বনিয়ে নিলে সুদটুকু তো পাওয়া যায়ই আসলটাও গাপ করা যায়। সে সুযোগ আর ছাড়া কেন? এ সব আদিম গল্প। আসল কথাটা হচ্ছে অন্যের হাতে বোকা হওয়া নয়, নিজের হাতে বোকা হওয়া। অলসতা আর লোভ - এই দুইখান যত নষ্টের গোড়া। লটারির টিকিট কাটা কোন গোত্রের ধম্ম জানি না, তবে অনেককে দেখেছি সারাটা জীবন লটারির দর্শনে বিশ্বাস করেন। এদের অদৃষ্টবাদী বলে বোধহয়। এদের দেবতা থেকে মানুষ কেউই বাদ দেয় না বোকা বানাতে। এ তো গেলো ব্যবহারিক জীবনের বোকা হওয়ার গল্প। আর জ্ঞানের জগতে?
        মজার কথা হচ্ছে, এইখানে আবার উল্টা নিয়ম। সেই 'stay hungry, stay foolish' -এর গল্প এখানে। এখানেও যেই তুমি নিজেকে চালাক ঠাওরেছ অমনি মুখ থুবড়ে মাটিতে। এই জগতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ তাই সক্রেটিস মহাশয়। তিনি বারবার বলতেন, 'আমি সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হিসাবে নিজেকে দাবি করতে পারি, কারণ আমিই একমাত্র জানি যে আমি কিছু জানি না।' কি চমৎকার কথা! অর্থাৎ বোকা থাকো, জেগে থাকো। নিজের বোকামিকে যদি চিনতে পারা যায় সেই তো সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান। তবেই তো জ্যোতিষী থেকে আমাদের তৈরি দেবতারা আমাদের সমঝিয়ে চলবে। কারণ তারা তো জেনে গেছে যে আমি আমার বোকামির সীমারেখা জেনে গেছি।
        আর ভগবান? আমার সব বোকামিকে যিনি আমার অন্তরে বসে, মাষ্টারের মত লালদাগ দিয়ে চিহ্নিত করে যাচ্ছেন, তাকেই মানি। আমাদের বানানো মন্দির মসজিদ চার্চের ছাদের তলায় থাকা দেবতাদের বুঝি না। কারণ তাদের যে হারে বোকা বানাই আমরা! মা গো মা! একটা বিশ্বের কতগুলো বিশ্বস্রষ্টা হয় কে জানে বাপু! তার মধ্যে কেউ শুনি গরু খেলে গোঁসা করে আবার কেউ শুয়োর খেলে। এতবড় ব্রহ্মাণ্ডে কে কি খাচ্ছে এই খবর নিয়ে যদি ঘর চালাতে হয় সে ভদ্রলোককে তবেই হয়েছে! কি বোকাই বানিয়েছি ব্যাটাকে! তাই তারে ছেড়ে ওই বুকের মধ্যে নড়াচড়া করে যে, তারেই চিনতে চাচ্ছি, যাকে হাজার চেষ্টাতেও বোকা বানানো যায় না গো!
        সংসারে চালকের আসনে তাই রেখেছি হৃদয়কেই। বুদ্ধিকে ঘরদোর মোছার কাজ দিয়েছি, ওকে আলমারির চাবি দিলে মাথা খারাপ করে দেবে। ঠকে যাব? হে হে, সে ভয় বুদ্ধিরই কেবল, হৃদয়ের নেই। সে বোকা হওয়া আর বোকা করার ঊর্দ্ধে বলেই এমন বোকা সেজে থাকে। ওইতেই বুদ্ধির এত ভয় ওকে নিয়ে। তাই সে চোখাচোখি হতে পিছিয়ে যায়। হৃদয় চোখে না তাকিয়েও চোখের মণিতেই তাকায়। তবে আর ভয় কি?

459
Fri, 03/24/2017 - 11:30

বুদ্ধি বলিয়া বস্তুটি যতটা সহজপাচ্য ভাবিয়াছিলাম, কার্যক্ষেত্রে দেখিলাম ততটা নহে। মস্তিষ্কে উহার কিঞ্চিৎ উপস্থিত টের পাইয়াছিলাম সে বহুদিন হইল। পর্যাপ্ত যে নাই তাহা শিক্ষককূল নানাবিধ সংখ্যা দ্বারা বুঝাইবার প্রয়াস পাইয়াছেন বিদ্যালয় হইতেই। কিছুতেই অধিক সংখ্যা ফলাফল পত্রে রহিত চাহিত না, অন্য ছাত্রদের ফলাফলপত্রে শোভিত হইত। মনে অবশ্য ঈর্ষা কোনোদিন জাগে নাই, মনে হইয়াছিল যেটুকু রহিয়াছে তাহাতেই কার্য মিটিবে। 
বাস্তবে অন্যরূপ ঘটিল। বুদ্ধি নিজে বুদ্ধিমান এ নিয়ে সন্দেহ নাই, কিন্তু যাহার মস্তিষ্কের কোষগুচ্ছ আবাস করিয়া উহা রহিয়াছে তাহার প্রতি বিন্দুমাত্র করুণা তাহার আছে বলিয়া বোধ হয় না। কারণ বলিতেছি। যাহা বুঝিতে চাই, তাহা উহা বুঝাইতে চাহে না। যাহা উহা বুঝাইতে চাহে, আমি আবার তাহা বুঝিতে চাহি না। কি গোল! তাহার উপর উহার গুমোর প্রবল। কিঞ্চিৎ বাহিরের বাতাস লাগিলে কাহিল হইয়া পড়ে। আপন ঘরে দরজা জানলা দিয়া, দাবার ঘুটি সাজাইয়া প্রবল পরাক্রমে কখনও নিজেকে, কখনও নিজের ছায়াকে, কখনও আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী করিয়া কোমর কষিয়া যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যখন বলি, বাহিরে বসন্ত আসিয়াছে, ভ্রুকুটি করিয়া আমার দিকে তাকায়। যদি কাহারো নয়নে নয়ন মিলিল, অমনি মস্তিষ্ক হইতে চিরকুট পাঠায় - মূর্খ! ফলে বোঝাই যাইতেছে বুদ্ধির সহিত সহজ বনিবনায় ঘর করা এ জীবনে আর হইল না। 
যদি ঘটনাটি এতদূর হইত, তাও সামলানো যাইত। কিন্তু সমস্যা আরো গভীর। বুদ্ধি যেদিন মস্তিষ্কে পাকাপাকি থাকিতে আসিল, সেদিন উহার দিকে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন হইয়া মুখ ভার করিয়া রহিল হৃদয়। এই হৃদয় শব্দটি বড় অপর্যাপ্ত। বলা যাইতে পারে উৎপেতে কক্ষ। বুদ্ধির সহিত বনিবনা না হউক, তবু উহার গতিবিধি ঠাহর করিতে পারি। কতটা উঁচুতে উঠিল চড়িতে না পাই, দূর হইতে দেখিতে পাই, ও নামিয়া আসার অপেক্ষায় থাকি। কিন্তু এই উৎপেতে কক্ষটির অভ্যন্তরে যিনি থাকেন তাহার গতিবিধি ঠাহর করা এক প্রকার অসাধ্য বুঝিয়া রণে ভঙ্গ দিয়াছি। কোনো নীতি, ধর্ম, নিষেধ উহার কর্ণগোচর হয় না। সব কিছু আপনি গড়িয়া লইতে চায়। যত বলি এইরূপ ব্যবহার করিলে সমাজ মানিয়া লয় না। সে বলে, “সমাজের দোহাই বুদ্ধির কাছে পাড়িও, আমার কাছে নহে”। বুদ্ধি শুনিয়া বলে- “আজন্ম আকাট মুর্খ!” হৃদয় বলে, “শুষ্কজীর্ণ বৃদ্ধ!” ব্যস, লাগিয়া গেল। কার পক্ষ লই? অগত্যা 'আমার কাজ আছে' বলিয়া সেই কুরুক্ষেত্র হইতে পলাইয়া আসি। দূর হইতে শুনি চলিতেছে বাদ-বিতণ্ডা, বাহিরের লোক জিজ্ঞাসা করে, "অন্যমনস্ক দেখি যে?” মনে মনে বলি, আর দাদা অন্যমনস্ক, অন্যের মন লইয়া ঘর করিবার যে জ্বালা। বাহিরে কৃত্রিম হাসিয়া বলি, 'ও কিছু নহে'। ঘরের কথা পাঁচকান করিয়া কি লাভ! 
তবে এইটুকু বুঝিয়াছি, আপনাকে বুদ্ধিমান অথবা ইন্টেলেকচ্যুয়াল বলিয়া দাবি করিবার কোনো অভিপ্রায় মনের কোনো কোটোরে না রাখাই ভালো। যদ্দিন এই উন্মাদাশ্রম ফেরৎ হৃদয়খানিকে বশে না আনা যাইতেছে ততদিন বুদ্ধির সহিত পূর্ণ বনিবনা সম্ভব নহে। উহা যাহারা পারিয়াছেন তাহাদের শ্রীমস্তিষ্ককে জোড়করে প্রণাম জানাই। আমি আপাতত ফিরি গঙ্গাতীরে, সংসার একঘরে করিয়াছে, বাউল বলিয়াছে তুমি বড্ড শিক্ষিত, অগত্যা ঘর ও ঘাটের কোনো ঠিকানাই যখন পাকাপাকি হইল না তখন গঙ্গাতীরই শ্রেষ্ঠ স্থান। কোনো একটি তরণী যদি ভুল করিয়া এই দিকে আইসে, যাহার মাঝির সহিত পূর্ব জনমের পরিচিত এমন বোধ হয় নয়নে নয়ন মিলিবা মাত্র, তাহার নৌকায় কিঞ্চিৎ স্থান ভিক্ষা চাহিয়া লব। তাহার পর সে যেদিকে লইয়া যায় যাইব। বুদ্ধিকে বলিব, এইবার তুমি আইস, আমার প্রয়োজন মিটিয়াছে, ওপারে তোমার না হইলেও চলিবে, আর হৃদয়কে বলিব সম্মুখে মাঝির দিকে চাহিয়া থাক, হাল ধরিবার প্রয়োজন নাই তোমার, গান ধরিবার সব প্রয়োজন ফুরাইবার পর যে প্রয়োজন থাকে, তাহা রহিয়াছে। নাও খানি বাও মাঝি, জুড়াই গঙ্গার শীতল স্পর্শে!
460
Thu, 03/23/2017 - 14:00

সন্মিলিতভাবে অপমানিত বোধ করার মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে। তাতেও 'একটা কিছু' করছি ভেবে ভীষণ আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। কখনও কখনও তো আবার নিজের উপর বেশ খানিক বল প্রয়োগ করে অপমানবোধটাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। সে তো হবেই, যেটা স্বাভাবিকভাবে না জাগে তাকে উন্মত্ত হয়েই তো জাগিয়ে তুলতে হয়। নিজের একটা প্রবল প্রতিপক্ষ না থাকলে কি আর খেলা যায়? তা সে যে রকম খেলাই হোক না কেন? আমি যে ইস্টবেঙ্গল সে কথাটা সামনে মোহনবাগান না থাকলে কি আর জমে? পুরো বাংলায় যদি শুধু ইস্টবেঙ্গল হত, তবে সে দলটার অস্তিত্ব থাকত না। দলের অস্তিত্ব থাকে প্রতিপক্ষ থাকলেই। সব ক্ষেত্রেই তাই। আমি বৈষ্ণব হিসাবে নিজেকে স্বতন্ত্রবোধ করি আমার সামনে শৈব কি শাক্ত থাকলেই। নইলে নিজেকে নিয়ে আর কবে নিজে নিজে ঘোঁট পাকানো যায়, থুড়ি দল পাকানো যায়। একদিন ভারতে এমন নানান মতের বিরোধ হয়েছে আবার সহাবস্থানও হয়েছে। দুই-ই সত্যি। দল থাকবে অথচ গোল হবে না তাকি হয়? এই এখন যেমন আমাদের বাংলায় সরকারি বনাম বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুই দল তৈরি হয়ে গোল বেধেছে। দল আর গোল একে অপরের সাথেই চলে। চলবেও। 
আচ্ছা কথাটা কি পুরো ঠিক বললাম? দল আর গোল সমার্থক? এটা অর্ধসত্য। কিরকম একটু ভেবে দেখা যাক। একটা কথা আছে - team-work. এখানে এই work কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো মিলিত জনসমষ্টি যদি কোনো সাংগঠনিকমূলক কাজে ব্যস্ত থাকে তবে তাদের একত্রিত হওয়ার জন্য কোনো কৃত্রিম কারণের আবশ্যক হয় না। তাদের ক্ষণে ক্ষণে অপমান বোধ উথলে ওঠে না। কারণ সোজা কথা - সময় নেই। তাই সে ধরণের উত্তেজনা ক্ষণিকের জন্য জন্মালেও নিজেই নিজেকে স্তিমিত করার একটা পথ খুঁজে নেওয়ার তার একটা তাগিদ থাকে। ঠিক যেমন আমাদের সরকারি আর বেসরকারি ডাক্তারবাবুদের, তাদের তর্ক করে সময় নষ্ট করার মত সময় নেই। তাই সে বিরোধ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে (যদিও কিছু মিডিয়া আপনস্বার্থে সে ক্ষততে মলমের পরিবর্তে অম্লের ছিটা দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় আছে)। 
কিন্তু যে দলের একত্রিত হওয়ার কোনো স্বাভাবিক, গঠনমূলক আদর্শ নেই? তারা কি করবে? তাদের হাতে দুটো পথ। এক দলের সমর্থনে সদস্যদের সংখ্যা বাড়ানো আর দুই ক্ষণে ক্ষণে অপমানিত বোধ করে প্যাসিভ ভাবে নিজের অস্তিত্বকে প্রচার করা তথা উত্তেজিতভাবে নিজের দলগত অলীক কায়াকে অনুভব করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এতে জনমানসের সমর্থন পাওয়া যায় হয়ত হুজুগে কিছুদিন, পরে আবার আপনা আপনি সব স্তিমিত হয়ে আসে, কারণ সারা পৃথিবীর আপামর সাধারণ মানুষের গায়ে চিরকালের জন্য কোনো লেবেল সেঁটে দেওয়া কারোর পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হয়নি, হবেও না। তাই মহামানবের ডাক যখন আসে তখন সভা-সমাবেশের ব্যবস্থা করতে হয় না, হাওয়ায় হাওয়ায় সে ডাক এসে ঘরের দরজার আগল আলগা করে দিয়ে চলে যায়। মানুষ জাগে। নিজের পরিচয়ে জাগে, দলের পরিচয়ে না। 
আজ আমাদের সে দুর্দিন। সাগরের বুকে কার কলমের একবিন্দু কালি পড়েছে বলে আজ যারা আস্ফালন করছে পুরো সাগর দূষিত হয়ে গেল বলে, তাদের দেখলে একটা কথাই মনে হয়, হয় তারা সাগরকে চেনেনি নয় তারা কালির পরিমাণ বোঝেনি। সাগর লজ্জা পাবে তারও একদিন রক্ষক লেগেছিল বলে। মনুষ্যত্বের অপমান যার গায়ে বাজে তিনি নিজে তার বিধান করেন, ইতিহাস সাক্ষী। কারণ সব ধর্মের শাঁসটা সেই মনুষ্যত্ব। কিন্তু শাঁসটা ফেলে যখন খোলটাকে সিংহাসনে বসাই তখন তার হয়ে বিধানের ব্যবস্থাও নিজেই করি। সে ব্যবস্থা চিরকালই আমার মত ক্ষুদ্রই হয়। কারণ অতটুকুই আমার ক্ষমতা যে। কিন্তু যেদিন তিনি এসে রাজাসনে বসেন সেদিন তাঁর আদেশ হয় মহৎ। একদিন সে আসনে বসেছিলেন বুদ্ধ, চৈতন্য, কবীর, নানকের মত মানুষের ভগবান, কোনো দলের অধিপতি নয়! 
আজ সে রাজা নেই। তাই সিংহাসনে যাকে বসিয়েছি তার পায়ে মাথা নীচু করে রাখার মত শ্রদ্ধা বুকে জন্মায়নি, সে তো নিষ্প্রাণ আবরণ, রাজাকে তো নির্বাসনে পাঠিয়েছি। আর তাই আজ এতটা নির্লজ্জ হওয়া সহজ হয়ে উঠেছে আমাদের।
461
Wed, 03/22/2017 - 13:45

ক্রমশ এই বোধটা স্পষ্ট হচ্ছে, যে ভাবে মানব সভ্যতার গতিপথটা ভাবা গিয়েছিল ঠিক সেইভাবে এগোলো না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাবাদ, মৌলবাদ মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠছে। 'ধর্ম' শব্দটা একটা আতঙ্কের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে কোনো জটিল পরিস্থিতিতে নিজের একটা অবস্থান নিজের কাছে বুঝে নিতে হয়। সেটা যতটা গভীর, মননসিদ্ধ হয় ততটা সার্বজনীন ও সত্যের কাছাকাছি অবস্থান করে। আজ নিজেকে নিজের মধ্যে সংহত করে, নিজের বিবেক-বিবেচনা-শিক্ষা-রুচির মিলিত অন্তঃসত্তার কাছে এই প্রশ্ন - তবে উপায় কি? 
প্রথম কথা, আমি 'সেক্যুলার' শব্দটার ব্যবহার জানলেও তার মর্মার্থ আর প্রয়োগ নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান। আমি এই লেখাটা লিখতে বসলাম তার একমাত্র কারণ নিজের চিন্তা আর অনুভবগুলোকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই বলে এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে। 'সেক্যুলার' শব্দটার সততা নিয়ে আমার একটা প্রশ্ন জাগে। মানুষের অভিব্যক্তির সাথে সাথে ধর্মের অভিব্যক্তি ঘটে চলেছে যুগ যুগান্ত ধরে। মানুষের মধ্যে একটা ধ্রুবের খোঁজ আছে। সে এমন একটা কিছুকে চায় যা শাশ্বত, যা নির্দিষ্ট, যা ধ্রুব। সব ক্ষেত্রেই সে তা চায়। বিজ্ঞানে একদিন অণুকে ধ্রুব জেনেছিল। তারপর এল পরমাণু। আজ তাকে ছাড়িয়ে আরো অন্য কিছু। বিজ্ঞান একটা সূত্রকে আবিষ্কার করার প্রয়াস পেয়েছে সব ক্ষেত্রে। তাকে ধ্রুব মেনে অন্যান্য সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ খুঁজেছে। এক কথায়, সে এই বিশ্বচরাচরের মধ্যে একটা নিয়মকে খুঁজেছে, যাকে সে বলতে পারে অচল, ধ্রুব, শাশ্বত। তেমনি সমাজেও সে একটা নিয়ম বানাতে চেয়েছে, সে আইনব্যব্যস্থা এনেছে, যাকে সে বলছে ধ্রুব। অবশ্যই এই ধ্রুবও অন্যান্য ধ্রুবগুলোর ন্যায় সময়ের সাথে, অভিজ্ঞতার সাথে পরিবর্তনশীল। 
ঠিক তেমনই একটা মানবিক বোধ হল - ধর্ম। তার অভিব্যক্তি ঘটেছে বারবার। জড়ের উপাসনা থেকে ক্রমশ চেতনার জাগরণকে বলা হল ধর্ম। সারা বিশ্বে ভারতের মত আর কোথাও এত পরীক্ষা-নিরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ ধর্ম নিয়ে বোধহয় আর কোনো ভূখণ্ডে হয় নি। ফলস্বরূপ সারা বিশ্ব পেয়েছে অত্যন্ত গভীর ও অত্যন্ত উন্নত একটা দর্শন। সারা বিশ্বে তা স্বীকৃত, আদৃত হয়েছে নানা গুণী-জ্ঞানী মানুষের দ্বারা, এ বলা বাহুল্য আজ। 'হিন্দু' নামটা সে দর্শনের একটা অত্যন্ত দুর্বল পরিভাষা। কারণ তাতে পাড়ার শেতলা পূজো থেকে রামমোহন-রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দ-গান্ধী-অরবিন্দ সব একধারায় নির্দিষ্ট হয়। এদের মধ্যে সবচাইতে করুণ অবস্থা বোধ করি আজ বিবেকানন্দের। তাঁকে সম্পূর্ণ না পড়ে বিচ্ছিন্ন কয়েকটা উদ্ধৃতিতে যে কি ভীষণ দূষণ চলছে রাজনৈতিক মহলে তা কহতব্য নয়। কষ্টই হয়। কোনোদিনই আমরা আকর গ্রন্থে না গিয়ে, সব কিছুকেই ভাসাভাসা জেনে, দল পাকিয়ে, অজ্ঞানতার গর্ব করে কূপের মধ্যে জীবন কাটানোকে গৌরবের বলে জেনেছি। আজও সে ধারা অব্যহত। শিকার হচ্ছে আমাদের দেশের গৌরবের সম্পদগুলো। এ নিতান্তই দুর্ভাগ্য। 
মত আর ধর্ম – এ দুটোকে এক করে দেখা মানে গঙ্গা আর নদীকে সমার্থক বলে জানা। দ্বন্দ্বটা ধর্মের সাথে ধর্মের না, মতের সাথে মতের। এটা স্পষ্ট বুঝতে হবে। আমরা যখন উঁচু ক্লাসে পড়ছি তখন স্কুল থেকে নির্দিষ্ট বইয়ের নাম বলে দেওয়া হত না। যে যার পছন্দমত লেখক বেছে নিত, কিন্তু বিষয়টা একই থাকত। পদার্থবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, অঙ্ক, রসায়ন ইত্যাদিতে সবক্ষেত্রেই তাই করেছি। বন্ধুদের সাথে মতান্তর হয়েছে, আমার মতে এটা শ্রেষ্ঠ বই তো ওর মতে অমুকটা। সৌভাগ্য হাতাহাতি হয়নি। কারণ ইন্ধন জোগানোর পর্যাপ্ত লোক ছিল না। ধর্মের ক্ষেত্রে তা আছে। আরো দুর্ভাগ্য যখন সমাজের স্বীকৃত বুদ্ধিজীবিরাও সেই শব্দের ফারাকটুকু না বুঝে সস্তা প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতিত্বের খেলায় নেমে পড়েন। পদের সাথে যে দায় বর্তায় তাকে অস্বীকার করার মধ্যে একটা অপরিণত, উদ্ধত মানসিকতার পরিচয়ই আসে, তার বেশি কিছু নয়। কিছু জলঘোলা হয়, রক্তারক্তি হয়, আবার সব শান্ত হয়। সেই মানুষগুলোর ভিতরকার পরিচয়টাও উন্মোচিত হয় আর ইতিহাসের কালো পাতায় তারা মুখ গুঁজে স্থবির হয়। 
তবে ধর্মটা কি? সে চিরকালীন - সত্য প্রেম করুণা। পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থ মানুষকে অসৎ, নিষ্ঠুর হতে শেখায় না। প্রতিটা সম্প্রদায় থেকে কোনো না কোনো মহাত্মা ইতিহাসের পাতা উজ্বল করে আছেন। আর তাতেই প্রমাণ হয় প্রতিটা মতের মধ্যে কিছু না কিছু সারবস্তু আছে যা সেই মহাত্মাদের জন্ম দিয়েছে। এ বোধ আমার অন্তত জন্মেছে বিবেকানন্দ পড়ে। একবার ভেলোর হাসপাতালে খ্রীষ্টকে নিয়ে একটা আলোচনায় যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল; সেখানে ফাদার জিজ্ঞাসা করেছিলেন, খ্রীষ্টকে নিয়ে এমন গভীর আগ্রহ আর বোধ জন্মালো কিভাবে? গর্বের সাথে বলেছিলাম, বিবেকানন্দ-মহাত্মা-রবীন্দ্রনাথ পড়ে। এঁরা তো গ্রহন করতেই শিখিয়েছিলেন। এমনকি 'পরধর্মসহিষ্ণুতা' শব্দটাতেও স্বামীজির ঘোরতর আপত্তি ছিল, যেন ওর মধ্যেও 'আমি তোমার থেকে উন্নত' এমন একটা ভাব আছে। বলেছিলেন সবার কাছ থেকে শেখার কথা, নেওয়ার কথা। তবে আজ এ বিচ্ছিন্নতার কথা অন্তত আমাদের কে শেখাচ্ছে? তারা কারা? কোন ধর্মগ্রন্থের দোহাই তারা দিচ্ছে? কোন ধর্মে লেখা আছে যে একটা বইয়ের কিছু শব্দই ধ্রুব? কোত্থাও লেখা নেই। ওগুলো সূত্র। মানবহৃদয় তার পরীক্ষাগার। শুধু সূত্র মুখস্থ করে গেলাম আর কোনোদিন ল্যাবে ঢুকলাম না, কেমন করে শিক্ষা সম্পূর্ণ হবে? হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন মেশালে জল হয় - এটা ধর্ম। কিন্তু সেই মেশানোর পদ্ধতিটা তো নানান হতেই পারে! সেই তো মত। তুমি তোমার মত বানাও, আমি আমার মত বানাই। শেষে যখন দেখব দুজনেরই সেই শীতল জল উৎপন্ন হয়েছে তখন হাসতে হাসতে ল্যাব থেকে গলা জড়াজড়ি করে বেরিয়ে আসব। কিন্তু শুধু সূত্র মুখস্থ করে গেলে তাতে মাথা ফাটিয়ে বেরিয়ে আসতে হবে। ল্যাবে ঢুকতেই হবে। আর ল্যাবে ঢুকলে নতুন সূত্রও আবিষ্কার করা যেতে পারে, "এমন মানব জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা"। 
এবার উপসংহার টানি। এতক্ষণ যা বললাম তা তত্ত্ব। অনেকে বলবেন, তুমি এতক্ষণ যা বকে গেলে সে সব কথা আমরা আগে বহুবার পড়েছি। কিন্তু দাদা, চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনি। বেশ, তত্ত্বকথা থাক। কথামৃত, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ইত্যাদি সব বিশ্ববিজয়ী মহাপুরুষেরাও থাক। এদের পড়ে বোঝা শক্ত শুধু না, এদের জীবনের দিকে তাকিয়ে অনেকাংশেই শুধু ‘হিন্দু’ বলে তকমা আঁটাটাও মুশকিল না। কারণ রামকৃষ্ণের কথাতে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়ের’ কথা থাকলেও বাস্তব জীবনে হিন্দুমতের অনুশীলনই প্রধান।
সব তত্ত্ব, ভাবের কথা থাক। 'সেক্যুলারিজ্‌ম' তো আরো না। তার দাপটও অন্যান্য গোঁড়া ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে বহু ক্ষেত্রে কম কিছু না। সে নিজেই একটা তথাকথিত আধুনিক ধর্ম বলা যায়। সেও থাক। 
আজ কাগজে দেখলাম আসন্ন 'উরুস' পর্বের জন্যে বিশেষ ট্রেন চলার বিজ্ঞাপন। মনটা ঠেক খেল। পশ্চিমের দিকে একটা একদা অখ্যাত গ্রামের কথা মনে পড়ল। এক কপর্দকশূন্য ফকির সেই গ্রামে যুবা বয়সে আচমকা এসে পড়ে। তার অসামান্য ব্যক্তিত্ত্বে মুগ্ধ হয়ে সেই গ্রামের সরল বেশিরভাগ অশিক্ষিত মানুষজন তাকে আপন করে নেয়। ক্রমশ তার কথা দূর দূরান্তের গ্রামের লোকজন জানতে পারে। ভিড় বাড়ে। নির্ভরতা বাড়ে, ভক্তি বাড়ে, উৎপাতও বাড়ে। ফকির কাউকেই বিমুখ করে না। একটা ছেঁড়া আলখাল্লা পরে, মাথায় একটা ফেট্টি বেঁধে সারা গ্রাম ভিক্ষা চেয়ে বেড়ায়। সে ভিক্ষা চাওয়ারও কি কৌশল, একটা টিনের পাত্রে ঝোল আর ঝোলার মধ্যে রুটি নিয়ে তার ডেরায় ফিরত। সে রুটি থেকে কিছু গরীব মানুষেরা নিয়ে যেত, কিছু কুকুর খেয়ে যেত, অবশিষ্ট সে নিজে খেত। একবার গ্রামে উরুস আর রামনবমী একসাথে পড়ল। দু’পক্ষই মিছিল বার করবে। করলও। রাস্তায় প্রায় মারামারি বাধে আর কি! সে ফকির ক্রুদ্ধ হল। বলল, "ওরে মূর্খের দল, রাম-রহিমের মধ্যে পার্থক্য কে করল! নিজের মঙ্গলের পথ চিন্তা করো।" না উপদেশের কথা না, সে অনেক আছে, জীবনের কথা। তার জন্য বানানো রুটি যদি কুকুরের প্রতি মায়াবশত কেউ খাইয়ে দিয়েছে এমন হত, তবে সে ফকির খুশি হয়ে যেত। নিজেকে অন্যের বিষ্ঠার একটা কীটের সাথেও তুলনা করতে সংকোচ বোধ করত। থাকত মসজিদে, তাকে বলত দ্বারকামাঈ। সামনে তুলসীগাছ লাগিয়ে জল দিত দু’বেলা। হজ করা হাজিকে বলত অহংকার না করতে, আবার নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণকেও ভর্ৎসনা করত ব্রাহ্মণত্বের অহংকার দেখালে। একবার এক গরীব কুষ্ঠ রুগী কিছু ফল নিয়ে আসে সে মসজিদে। সে ফকির সেটা উপস্থিত ভক্তের মধ্যে ভাগ করে দেয়। একজন একটু উন্নাসিক মহিলা সেটা লুকিয়ে ফেলে দেয়, ঘৃণায়। ফকিরের নজর এড়ায় না। সে আবার সেই কুষ্ঠাক্রান্ত মানুষটাকে ডাকে, ওর হাতে ফল দিতে বলে, আর বলে আমার সামনেই খাও। রোগকে ঘৃণা করো, রুগীকে না। আরেকবার এক বোর্খাবৃত সুন্দরী মহিলার দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে তাকাচ্ছিল ফকিরের পাশে বসা এক ব্যক্তি। সে মহিলা চলে গেলে ফকির তাকে বলে, “সামনের দরজা খোলা থাকতে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকতে চেষ্টা করো কেন? সুন্দরকে দেখো, মনের মধ্যে পাপ এনো না।”
সে ফকিরের গল্প বলতে শুরু করলে শেষ হওয়ার নয়। থাক। তার প্রধান শিক্ষা দুটোই। এক) সবার মালিক একজনই, দুই) মানব জীবনের সাধনা দুটোই - শ্রদ্ধা আর ধৈর্য্য। এইভাবে সারাটা জীবন একই সাথে দুটো ধর্মের মধ্যে সহাবস্থানের উদাহরণ অত্যন্ত বাস্তব কঠোর জীবনে ভারতে আরো আছে কি না আমার অন্তত জানা নেই। লালন ইত্যাদি বাউলেরা যে পথ ভাবের মধ্যে, গানের মধ্যে খুঁজেছিলেন এই ফকির সে পথ তীক্ষ্ণ বোধ, বিশ্লেষণ আর বাস্তব মাটিতে জীবনের চর্যায় দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কবীরের সাথে তাঁর কোথাও একটা মিল আছে বলেই হয় তো বলতেন, “কবীর আমার বাপ!” 
এই জীবনটা আজ আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে। যখন আমি কর্মক্ষেত্রে ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে কাজে নামি, আমার ছাত্রছাত্রীদের নানান প্রশ্নের সামনে এসে দাঁড়াই, তখন মাথায় ফেট্টি বাঁধা সেই সরল সহজ মুখটা মনে পড়ে। 
হ্যাঁ আমি সাঁইয়ের কথাই বলছি। গ্রামটার নাম শিরডী। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, সেখানে অনেক টাকার মন্দির ইত্যাদি। আমি বলি, আমি বহিরঙ্গের তর্কে যাব না। জীবনটার কথা বললাম, পরেরটা তো আমরা করেছি, সে কথা থাক। 
আজ এই ভীষণ দুর্দিনে সেই ফকিরকে ভীষণ প্রয়োজন। যাকে ভাবতে কোনো দেব-দেবী, মন্দির-মসজিদ ভাবতে হয় না। সরল প্রাণে ভাবতে হয়, জগতে ‘এক’ বই দুই নেই। পাওয়ার পথ শ্রদ্ধা আর ধৈর্য্যের সাধন। এ দুটো চিরকালীন মানবসম্পদ, কোনো সম্প্রদায়ের না।
462
Wed, 03/15/2017 - 11:30


দ্বন্দ্ব তো আছেই। ঘুম থেকে উঠে থেকে রাতে শুতে যাওয়া ইস্তক দ্বন্দ্বের বিরাম নেই। আমি চাই একটা তো মন চায় আরেকটা। আমি যেটা ঠিক বলে মানি, মন সেটার বিপরীত রাস্তায় পা বাড়িয়ে বসে। যা বুঝে গেছি হওয়ার নয়, মন সেটাকেই হইয়ে ছাড়ানোর জন্য সর্বস্ব নিলেমে তুলে দিতে প্রস্তুত। ভাবলাম হব ভালো। বাস্তবে সেরকম ভালো হয়ে ওঠা আর হল না। হতে চাইলাম পাইলট, হয়ে গেলাম অফিসবাবু। 
মুশকিল হল বাইরের সমস্যাগুলোকে ভাগ্যের কি এর-ওর দোহাই দিয়ে পার পাওয়া যায়, কিন্তু ভিতরের গণ্ডগোলগুলোর কি হাল হবে? পাইলটের জায়গায় অফিসবাবু - মেনে নিলাম। গ্রেটা গার্বোর জায়গায় নিস্তারিণী - চলে যাবে। আয়নায় দেখতে চাইলাম সৌমিত্রবাবুকে, দেখলাম নৃপতি - তাও সই। কিন্তু মনের মধ্যে রাত-দিন যেসব উচিত-অনুচিত, ঠিক-বেঠিক, কর্তব্য-অকর্তব্য, বিশ্বাস-সংশয়, সত্য-মিথ্যার ঘ্যাঁচোরঘ্যাঁচ, তাকে থামায় কোন বদ্যি? মাথার মধ্যে কুটুর-কুটুর করে কেটেই চলেছে ঘিলুর পাঁপড়। উপায় কি? বলি উপায় কি কিছু আছে? না গোটা জীবনই এই কেত্তন শুনতে শুনতে জান কয়লা হবে? পাড়াশুদ্ধো বউ মানুষের বেস্পতিবার নকুল দানা দিয়ে, পাঁচালী পড়ে পূজো সেরে চাট্টি খেয়েদেয়ে সংসার গড়াতে কোনো অসুবিধা নেই, তোর ব্যাটা হতচ্ছাড়া মুখপোড়া মন অ্যাতো প্রশ্ন কিসের? - মা লক্ষী কি নকুলদানা চেয়েছিলেন? বলি পাঁচালীর ওই এডিশানটা কি পুরোনো সিলেবাসের মনে হচ্ছে না?... এ সব কি নষ্টামি কথা ভাবো? সব চাইতে বড় প্যাঁচাল হল - কোনটা করা উচিত কোনটা না। বাবা রে বাবা! রাম-শ্যাম-যদু-মধু যাকেই শুধাও, সব্বার নিজের নিজের আইনশাস্ত্র আছে (আমিও অবিশ্যি কম যাই না কিছু)। মাথা পুরো আউলা-ঝাউলা। 
এখন যে কোনো এই ধরণের ট্যাঁড়া প্রকৃতির দ্বন্দ্বের দুটো সমাধানের পথ আছে। এক, মেজরিটিতে দ্বন্দ্বকে চাপা দাও। উদাঃ ধরা যাক পানকেষ্ট বামুনের ছাওয়াল, পেরেম হল খালেদার সাথে। বিয়ের কথা কিম্বা নিকার কথা যখন উঠল, তখন সে পানকেষ্ট আমাদের পড়ল একগলা জলে। বাড়িতে রাজি নয়। ত্যাজ্যপুত্র করবে। কি করা যায়? গো উইথ দ্য মেজরিটি ম্যান! ধরো বামুনের মেয়ে, আনো ছাদনাতলায়!... দ্বন্দ্ব? নিকুচি করেছে দ্বন্দ্বের ইয়ের। সব লোকে সব কালে যা ঠিক মেনে করে এয়েচে তাই তো করলুম না কি? বলি ছামাজিক ছিক্যুরিটিটা ভেবে দেখতে হবেনি? বলি, যাই ব্রিগেড তাই কি শোয়ার ঘর? যাই গীতা-বাইবেল, তাই কি চণ্ডীমণ্ডপ? 
এমন কত দেখলাম আপনাদের আর কি বলি? কত কথা দেওয়া, কত সিকনি গড়ানো ভালোবাসা, কত শপথের মায়ের ক্যাঁতায় আগুন করে দিলে গা এই মেজরিটির যাদুকাঠি! যাহাই মেজরিটি তাহাই সত্য। শালা বিবেক মারিও না। ওসব মিনমিনে-পিনপিনেরা দুই ধরণের হয় - এক, যারা ফটোর মধ্যে থাকে, যাদের নামে রচনা লিখতে হয়, আর দুই, শালা খালি পকেট, না তো লোকবলহীন ন্যাজ নামানো লেড়িকুত্তার মত লোকগুলো। এদের যত বায়ানাক্কা মাইরি। সততা, বিবেচনা... আরো কত * জানো!

বলা বাহুল্য, এই পথের পথিক প্রচুর। উঁচুদরের থেকে নিম্নমানের অভিনেতাতে ভরতি চাদ্দিক। নিম্নমানের অভিনেতারা চেল্লায় বেশি। উঁচুদরেরা মিষ্টি কথায় কাজ সারে। মানে আর কি পাষাণ হৃদয়টা মসলিনের চাদরে মোড়া। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তো থেকেই যায় না? যারা ঠিক মহাপুরুষও হতে চান না, আবার গড্ডালিকায় গা-ও ভাসাতে চান না! তারা সম্পূর্ণভাবে তারা, মানে 'নিজে যা তাই হতে চায়'?! কি স্পর্ধা না? বিনা মেক-আপে স্টেজে? শালারা ভাবে কি নিজেদের? নিন্দুকদের কেউ এদের ভাবে আরো বড় খেলোয়াড় তো কেউ ভাবে শালা বোকা পাঁঠার অণ্ডকোষজাত। এরা তবু নিজে নিজে হাঁটতে চায়। নিজে নিজে সব প্রশ্নের মানে খুঁজতে যায়, বুঝতে যায়। কি রোয়াব না? হুঁ, তবু সেটুকুও যদি বুঝত তারা। এদের অসম্ভব আত্ম-সম্মান টিকিয়ে রাখার ঝোঁক সেটাও বুঝতে দেয় না যে! এদের দ্বন্দ্ব মেটে কি করে? 
রাত জেগে। অর্থাৎ দ্বিতীয় প্রকার পথ। দ্বন্দ্বকে থামাতে চাইলে দ্বন্দ্ব মেটে না। দ্বন্দ্বের উত্তর চাইলে দ্বন্দ্ব যায় আরো বেড়ে। দিন-রাতের দ্বন্দ্বের অবসান যেমন হয় আহ্নিকগতিকে বুঝে নিলে, ঠিক তেমন সব দ্বন্দ্বের অবসান হয়, দ্বন্দ্বের অবসানে না, মূলের অবসানে, দ্বন্দ্বের কারণটাকে খুঁজে বার করতে পারলে। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দ্বন্দ্বের অবসান বলতে বুঝি কোলাহলটার অবসান। তা তো নয়। কোলাহলটাকে থামালেও বিরোধটাকে কি থামানো যায়? না যায় না। তাতে চাপ বাড়ে বরং আরো বেশি। তাই উপায় হল - বোধের ক্ষমতাটা বাড়ানো। যাতে সে যুযুধান দুইপক্ষকেই বুঝতে পারে। তাদের লড়াইয়ের কারণটাকে খুঁজে বার করতে পারে। চিন্তার দ্বারা না, চিন্তার বাইরে গিয়ে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তখন সে দেখে, যারা সামনের দিকে লড়াই করছে, তারা পিছনের দিকে একে অপরের পরিপূরক হয়ে অবস্থান করছে। ভুলটা ছিল তার দেখার। তাকে প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে হবে, সব দ্বন্দ্বের মূল তার মন। তার মনের বাইরে কোথাও কোনো দ্বন্দ্ব নেই। "নেই যে রে ভয় ত্রিভুবনে, ভয় শুধু তোর নিজের মনে"। 'আমি প্রকৃত অর্থে কি' - এটা না বুঝে, 'আমার কি হওয়া উচিৎ' এটার পিছনে ছুটলে আত্ম-প্রবঞ্চনা ছাড়া কোনো পথ দেখি না। "তুমি আমার অন্তঃস্থলের খবর জানো, ভাবতে প্রভু আমি লাজে মরি", কান্তকবির ঢঙে গাইতে হয়। সব দ্বন্দ্বের মূল এই 'যা চাই' আর 'যা প্রকৃত' তার মধ্যে। অনেকে বলবেন, “আমার মধ্যে অনেক গোলমাল, তার কি হবে?” উত্তরে বলি, তার উপর কার্পেট চাপা দিলে তো সমাধান হয় না কিছু। কার্পেট চাপা দেওয়া সামাজিক সমাধানের পথ, আত্মগত সমাধান ওতে হয় না। নিজের মুখোমুখি না হওয়ার সাহস থাকলে, নিজে যা, তা বিনা অভিযোগে অন্তত নিজের কাছে স্বীকার করে না নিলে, সারাটা জীবন মুখস্থ পাঠ বলেই কাটবে। একটা কস্টিউম ছাড়তে না ছাড়তেই আরেকটা কস্টিউম পড়ার ডাক আসবে। কি লাভ ওভাবে বেঁচে? বরং কিছু ভুলই না হয় হোলো, সে হোক। তবু তা আমার নিজের হোক, অন্যের ভূমিকায় নির্ভুল অভিনয় না হোক। সে যথাযথ অভিনয়ও আমার লজ্জার। তাই রাস্তা একটাই - নিজের মুখোমুখি হয়ে নিজেকে নিজের আকরিক থেকে চিনতে শেখা। সেই অনাদি প্রার্থনা - 
অসতো মা সদ্‌গময় / তমসো মা জ্যোতির্গময়


 

463
Sun, 03/12/2017 - 11:22


সেদিন কি ছিল না তবে? পণ্ডিত ছিলেন, তত্ত্ব ছিল, টোল ছিল, জ্ঞানী-গুণী সব ছিলেন, কি ছিল না? ছিল না অনুভব। সব কিছু ছিল শুষ্ক। প্রাণে শান্তি নেই, বোধে নিশ্চয়তা নেই। মানুষ দিশাহীন। রাস্তা আছে, কিন্তু গন্তব্য নেই। জীবনে সব কিছু যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে, মালা করে গেঁথে নেওয়ার সুতো নেই। মানুষ ব্যর্থতা মেনে নিতে পারে, কিন্তু অগৌরব মানতে পারে না। এক একটা যুগ আসে যদিও, যখন মানুষ কোনোদিকেই নিজের গৌরবের পথ খুঁজে পায় না। সব দিকে সে নিজেকে দীন, হীন করে তোলে লোভে, ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে। এক বিষাক্ত পরিবেশ তিল তিল করে অন্ধকার করে দেয় চেতনা, শুভবুদ্ধি আসার পথ। শোষণ-পীড়ন সহস্র ফণা দিয়ে গ্রাস করে মনুষ্যত্ত্বের সবটুকু রস, মানুষকে বিশ্বাস করাতে বাধ্য করে, সে আসলে নীচ, স্বার্থপর একটা জীব। শুধুই আহার-নিদ্রা-মৈথুনেই তার জীবনের পরমার্থতা। ভোগই একমাত্র পুরুষার্থ। যা কিছু মহান, যা কিছু নিঃস্বার্থ, যা কিছু দিব্য - তাই মিথ্যা, অলীক। খুব অন্ধকারে যখন হাতড়ে হাতড়ে কোনো জিনিস খুঁজি, তখন যাই হাতে বাধে তাকেই ভয়ংকর অথবা মনমুগ্ধকর কিছু একটা কল্পনা করে হয় ত্রস্ত্র হই, নয়তো মোহগ্রস্থ হই। দুই-ই বিনাশক।
সেই সময় জন্মালেন বাংলার ঘরে নিমাই পণ্ডিত। নিমাই পণ্ডিত দাম্ভিক, জ্ঞানচূড়ামণি। কিন্তু তাতে তো যুগপ্রয়োজন সমাধা হবে না। আগেই বললাম, সেই রকম পণ্ডিত, জ্ঞানী, নৈয়ায়িকের তো অভাব ছিল না দেশে। তারাই তো ছিলেন সমাজের মাথা। নিমাই পণ্ডিত গয়া থেকে ফিরলেন শ্রীচৈতন্য হয়ে। অন্ধকার ঘরে যেমন 'অন্ধকার অন্ধকার' বলে চেঁচালে কিছু হয় না, আলো আনতে হয়, ঠিক তেমনই শ্রীচৈতন্য হলেন সেই আলো। তিনি নিজে কি জানলেন তা? বোধহয় না। তাঁর বুকে তখন অসীম যন্ত্রণা। পরমসত্যের আভাস পাচ্ছেন, কিন্তু ধরা যাচ্ছে না। চৈতন্যভাগবতে চমৎকার বর্ণনা আছে সে সবের। তিনি টোলে পড়াতে এসেছেন, কিন্তু কিছুতেই পড়ানো আর হয়ে উঠছে না। তিনি আত্মমগ্ন হয়ে ছাত্রদের কৃষ্ণোপদেশ করছেন। মানব জীবনকে সার্থক করার আহ্বান করছেন। কোথায় ব্যকরণ, কোথায় নীতিমালা। সব ভেসে যাচ্ছে। তারপর যখন হুঁশ হচ্ছে, লজ্জিত হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, কি বললাম আমি! ততক্ষণে ছাত্ররাও প্রেমে বিহ্বল, আবেশিত। তারা বললেন, আপনি এতক্ষণ আমাদের কৃষ্ণোপদেশ করছিলেন। বলছিলেন জীবনের কোনো স্থায়িত্ব নেই, নিশ্চয়তা নেই, তাই আমরা যেন যত সত্ত্বর কৃষ্ণে মন আনয়ন করি।

"আজি আমি কেমত সে সূত্র বাখানিলু?”
 
পড়ুয়া সকলে বলে, - "কিছু না বুঝিলু।।
যত কিছু শব্দে বাখানহ 'কৃষ্ণ' মাত্র
বুঝিতে তোমার ব্যাখ্যা কে বা আছে পাত্র?”

তিনি তো শুধু শ্রীচৈতন্য নন। চেতনা থাকলেই তো হবে না। চেতনার গতিশক্তি হলেন গুরু - প্রভু। এইক্ষেত্রে - মহাপ্রভু। তিনি মাকে বলছেন, -
 
"চণ্ডাল 'চণ্ডাল' নহে, - যদি 'কৃষ্ণ' বলে।
বিপ্র 'বিপ্র' নহে, - যদি অসৎ পথে চলে।। 
আরো বলছেন, -
ভক্তিহীন-কর্মে কোনো ফল নাহি পায়
সেই কর্ম ভক্তিহীন, - পরহিংসা যা'য়।।
(চৈতন্যভাগবত)


এই জন্ম হল মহাপ্রভুর। ক্রমশঃ টোল গেল। বিশ্বসংসারের গুরুকে কি আর ওই ছোট্ট টোলে ধরে? নদীয়া ক্রমশঃ উত্তাল হয়ে উঠল প্রেমে। রাজশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াল। মানব প্রেমের পথ রুখে দাঁড়াবে কোন শক্তি। মহাপ্রভু বেরোলেন নগর সংকীর্তনে। বর্ণনা আছে, সেদিন নাকি সারা গ্রাম সুসজ্জিত হয়েছিল দীপে, মালায়, আলপনায়। সন্ধ্যায় শুরু হল নগর সংকীর্তন। কঠিন পথ কিছু নয়। ডাকার পথ। কোনো মহাপুরুষের প্রাণে পরমসত্য সংজ্ঞায়িত না, তা প্রেমায়িত। তাই যখন মহাপ্রভুর ডাকে কৃষ্ণনাম আসে, সে ভেদসূচক নয়, তা প্রেমসূচক। সেখানে বাক্য অথবা শব্দবন্ধ কথা বলে না, কথা বলে প্রাণের গভীর আবেগ, যা শুদ্ধ, নির্মল, অসূয়াশূন্য, পরম করুণ, স্বার্থগন্ধশূন্য। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায় না। সাড়া দিতেই হয়। বলা হয়, নগরের যারা চোর ছিল, তারা সেই সন্ধ্যের সুযোগকে কাজে লাগাবে বলে নাকি ষড়যন্ত্র করেছিল। একজন তাদের মধ্যে বলে, "এরা তো সারাটা রাত এই করবে, চল না প্রথম প্রহরটা মজা দেখে নিই, পরের প্রহর থেকে কাজে লাগলে হবে।" 
 
তাই কি হয়! তাদের সমস্ত কুপ্রবৃত্তি সে পরমকরুণ মুখারবিন্দে পড়ার সাথে সাথে লুপ্ত হয়ে গেল। কখন ভোর হল তারা টের পেলে না। শুধু দেখল, সারা রাত সেই অপরূপ সুন্দর মানুষটার পিছনে পিছনে কৃষ্ণনাম গেয়ে গেয়ে ভোর হয়ে গেল; তাদের গণ্ডদেশ, বুক ভেসে গেছে তাদেরই চোখের জলে। এত জল কোথায় ছিল? ছিল ছিল, মানুষের গভীরে কত কান্না থাকে! কত অনুশোচনা, কত পাপের অসহনীয় জ্বালা, বলবে কোথায়? কার কাছে? হয় ব্যঙ্গ করবে, নয় তো ধিক্কার দিয়ে সমাজের বাইরে নিক্ষেপ করবে, অচ্ছুত করে রাখবে। মানুষ কাঁদবে কার পায়ে? কার করুণায় শুদ্ধ হয়ে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে? এত পাপের গ্লানি থেকে মুক্ত করবে কে? তাকে কাঁদিয়ে শুদ্ধ করবে কে? যীশু বলছেন, 'আমি যদি তোমাদের দোষী করার জন্য আসতাম, তবে কেউই আমার পিতার রাজ্যে প্রবেশের অধিকার পেতে না। আমি সে জন্য আসিনি। পিতা আমায় পাঠিয়েছেন তোমাদের দোষ ক্ষমা করার জন্য। বিশ্বাস করো। আমিই সেই ভাল রাখাল যে তার ভেড়াগুলোকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। আমিই সেই খোঁয়াড়ের দরজা।" 
মানুষকে এমন সুন্দর সাজিয়েছে কেউ আগে? তার কপালে চন্দন, গলায় মালা, তার সারা অঙ্গ সুবাসিত চন্দনে। সে যে ডাকতে এসেছে। সে যে ভালোবাসতে এসেছে। কি ভাবে ডাকবে? ওই দেখো, ঊর্দ্ধবাহু, গৌরবর্ণ, দু'চোখে করুণাকাতর অশ্রু, তিনি নীলাচলের তীর বেয়ে ছুটে চলেছেন, নিনাদিত কণ্ঠস্বরে বাজছে -
কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহি মাম পাহি মাম
রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষ মাম রক্ষ মাম

ওই শোনো তিনি গাইছেন, -
 
হরের্নাম হরের্নাম হরের্নামৈব কেবলম
কলৌ নাস্তেব্য নাস্তেব্য নাস্তেব্য গতির্ন্যথা

শুনেছো মহামন্ত্র? 
 
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে

মন আর কবে রাজী হবে? পেলে তো ভিক্ষা। পাত্র নেই? সে পাত্রও দিচ্ছেন মহাপ্রভু, শোনো- 
 
তৃণাদপি সুনীচেন, তরোরিব সহিষ্ণুনা
অমানিন মানদেন কীর্তনীয় সদা হরি


উত্তম হঞা আপনাকে মানে তৃণাধম।
 
দুই প্রকারে সহিষ্ণুতা করে বৃক্ষসম।।
বৃক্ষে যেমন কাটিলেও কিছু না বোলয়।
শুকাইয়া মৈলে কারে পানী না মাগয়।।
সেই যে মাগয়ে তারে দেয় আপন ধন।
ঘর্ম বৃষ্টি সহে করে আনের রক্ষণ।।
উত্তম হইয়া বৈষ্ণব হবে নিরভিমান।
জীব সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।
এই মত হঞা যেই কৃষ্ণ নাম লয়।
শ্রীকৃষ্ণ চরণে তার প্রেম উপজয়।।
(চৈতন্যচরিতামৃত)


[আজ শ্রীশ্রীমহাপ্রভুর পূণ্য জন্মতিথি]

464
Mon, 03/06/2017 - 18:30

আচ্ছা নারীবাদ বলতে কি, এক বিশেষ প্রকার যৌনতন্ত্র বিশিষ্ট, ইস্ট্রোজেন-প্রোজেস্টরণ কবলিত এক প্রকার প্রাণীকূলের কথা বোঝায় না মানবতার একটা বড় অংশকে বোঝায়? মানবসত্তার যে দিকটা এক গোলার্ধে তার মতন করে বিকশিত হতে চাইছে অথচ হতে দেওয়া হচ্ছে না, তার বিরুদ্ধে বলার কথাকেই আমি বলতে চাইছি। সমস্যা হল পৌরুষ বলতে যা বোঝায় তাতে মনে হয়, মানবিকতা থেকে বাদ দিলে যে প্রকাণ্ড অনিয়ন্ত্রিত শক্তির দাপট থাকে তার কথা বলা হচ্ছে। তার কারণ আমার মনে হয়, এই ছেলে হয়ে ওঠার ধারণাটা অনেকটা আরোপিত। একদিকে যেমন সমস্ত কোমল অনুভূতি, ভাবাবেগকে দমনের কৌশল যাকে বলি পুরুষ করে তোলা, অন্যদিকে তেমন সমস্ত কোমলগুণ, পরনির্ভরশীলতা ইত্যাদিতে প্রচণ্ড জোর দিয়ে মেয়ে করে তোলার প্রয়াস, তাও ততটাই যতটা ওই অসামঞ্জস্য পূর্ণ পুরুষত্বের ভোগ্য হয়ে ওঠা যায়। এর মাঝখানে মানবধর্মটিকেও যতটা কৌশলে (সে ধর্মের হোক কি রাষ্ট্রের) দমন করে নিজের মত গড়েপিটে নেওয়া যায় তার প্রবণতা। পুরো ইতিহাসটা এমন না হলেও, একটা বড় অংশ ইতিহাসের এমনই মানবসভ্যতার। 
কিছু কি পাল্টাচ্ছে? না old wine in new bottle হয়ে যাচ্ছে সবকিছু। মনে তো হয় বদলাচ্ছে। যদি সে বদলায়ও তবে তা কি স্লোগানে, সেমিনারে বদলাবে? বারবার আমার মনে হয়, না। সেরকম ভাবে বদলাবে না। ভাবনা বদলাতে হবে। ভাবনা বদলায় ভাবাতে শুরু করলে। ভাবাতে শুরু করে চরিত্র, তত্ত্ব না। অস্তিত্বের শক্তিতে যা দাঁড়ায় তাই চরিত্র। চরিত্র অক্ষরে কথা বলে না, চরিত্র কথা বলে সময় আর সমাজের মাত্রার মধ্যে নিজেকে খাপ খাইয়ে, প্রকাশ ক'রে নিজের অস্তিত্বের নীরব স্ব-অভিমানের বলে। সে ভাঙে আর গড়ে একই সাথে, একই হাতে। একটু সেকেলে কথাই না হয় বলি। সীতা চরিত্র আমায় বরাবর ভীষণ বিস্মিত করে এই কারণেই। তিনি লঙ্কায়, কি মুনির আশ্রমে, কি অযোধ্যায় নিজের সম্মানের সাথে একবিন্দু আপোস করলেন না। সারাটা জীবন কতটা সুখ পেলেন কি কতটা দুঃখ পেলেন সেটা মানব ইতিহাসে বড় কথা নয়। সুখই যদি পরম সফলতার পরাকাষ্ঠা হত তবে প্রথম যে মানুষটা শত সমস্যা সহ্য করে, প্রাণ হাতে করে এভারেস্টে উঠেছিল তার নাম না করে, যে শ্যামবাজারের বাড়িতে ঘুমিয়ে, দাওয়ায় আড্ডা মেরে পুরো জীবন কাটালো তাকে বাহবা দিতুম। তাই যখন চরম মুহুর্তটা এলো সীতার জীবনে তখন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে করলেন। এটাই প্রতিবাদ। প্রতিবাদের মাত্রাটা ঠিক করে সমাজ আর সময়ের পরিস্থিতি। তাতে সত্যিকারের কাজটা হয়। না হলে আওয়াজ যত হয়, ধুলো যত ওড়ে, কাজ তত হয় না। অবিশ্যি রবি ঠাকুরের মতে - অনেকে জলে নেমে হাত-পা কে কতটা ছুঁড়তে পারে তার উপরেই তার সাঁতারের দক্ষতা ঠাওরায়, কতটা দক্ষতায় জলটা পার হল সেটা বড় কথা না। 
তাই লোকচক্ষুর আড়ালে, বিনা হাততালিতে আত্ম-সম্মানকে মরতে না দেওয়ার যে লড়াই, তাকেই আমার বড় কঠিন আর খাঁটি লড়াই বলে মনে হয়। মনে হয় শিশিরপাতের মত তাদের সংগ্রামেই ধুয়ে যাবে মানব চেতনভূমির ওপর যে জড় আস্তরণ তার। তাদের কথাই বলতে হবে। আরো আরো বেশি করে বলতে হবে, লিখতে হবে। সেই অর্থে আমি একশোবার কেন লক্ষকোটিবার নারীবাদী। আমার মাকে বাবার ভূমিকায় দেখতে চাইনি কোনোদিন, মাকে মায়ের ভূমিকায় স্পষ্ট দেখেছি। সেখানেই মা সার্থক। আজ মাকে একজন নারী হিসাবেও দেখি, তিনি আর তাঁর মা, মানে আমার দিদা(কেউই নেই যদিও আজ) নিজেদের চিন্তায়, নীতিতে, সংযমে অত্যন্ত স্পষ্ট, স্বচ্ছ ছিলেন। সংযম কথাটা আত্ম-সম্মান রাখার ক্ষেত্রে সব চাইতে জরুরী দেখেছি। কোথায় থামলে নিজের ক্ষতি হবে না, এইটা না বুঝলে হয় দুর্ঘটনায় থামতে হয়, না তো অন্যে এসে থামায়, আর সেই সুযোগে সে আমার উপর নিয়ন্ত্রণের অধিকারটুকুও পেয়ে যায়। সেটাই দুর্বলতা। কিন্তু সেটাই শেষ কথা না। হতে পারে না। কোনো মোহ না - না তো অতিশক্তির, না তো অক্ষমতার – সংসারে উস্কানো আর দাবানো দুই দলের লোকই উপস্থিত, পায়ের মাপ না জানলে ভুল চটি পরে রাস্তায় হোঁচট খাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ওই যে কে একজন বলেছিলেন না - স্বাধীনতা মানে যা খুশী তাই করাকে বলে না, যেটা করা উচিৎ সেটাই করার পরিবেশটাকে বোঝায়। 
তাই আমি সে সমস্ত লড়াইগুলোর কথা লিখবই, কেউ না পড়লেও লিখব। অন্ততঃ নিজের কাছে নিজের মুখ দেখানোর ব্যবস্থাটা তো করা থাক! আমার কাছে গর্ভঋণ আর দুগ্ধঋণ তথা স্নেহ-প্রশ্রয়-আদরগুলোর ঋণ, বীর্যঋণের চেয়ে অনেকাংশে দামী। ছোট করছি না কাউকেই, শুধু মাপটা বলছি আমার চোখে। এক সীতা দিয়ে আমি পুরো জগৎ কল্পনা করতে পারি, শতকোটি রাম দিয়েও পারি না, এক সীতা কম পড়ে ( এ তত্ত্ব বুঝতে ঋণস্বীকার - বিবেকানন্দ)।
আরেকটা কথা। বর্বরতা, ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, পৈশুন্য ইত্যাদি কোনোদিন পৃথিবী ছেড়ে যাবে না, এ অকাট্য সত্য। লড়াইটায় নামার আগে তাই এটা মেনে নিই, না হলে তাড়াতাড়ি হতাশা আসবে। মানতে হবে, অন্ধকারকে নিশ্চিহ্ন করতে পারব না, ঠেকিয়ে তো রাখতে পারব!
 
465
Tue, 02/28/2017 - 10:28


বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ স্তোত্র লিখতে গিয়ে লিখছেন - সংশয়রাক্ষসনাশনাশমহাস্ত্রম - সংশয়রূপী রাক্ষসকে মারবার মরণাস্ত্রস্বরূপ। 
কথা হচ্ছে, কোন সংশয়? আর তা নাশই বা হবে কি করে? 
সংশয় - আত্মসংশয়। নিজেকে নিয়ে সংশয়। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয়। এতদিন যত পড়াশোনা, চিন্তাভাবনা সব কিছুই বৌদ্ধিক স্তর অবধি। তার গভীরে যেতে গেলে আটকে যাচ্ছে কোথায় একটা। সব কিছু করা যাচ্ছে, পাশ্চাত্য-প্রাচ্য জ্ঞানীগুণীর কত তত্ত্ব, কত ইতিহাস, কতরকম ন্যায়-নীতি ইত্যাদি পড়া হয়ে যাচ্ছে - তবু কোথায় একটা ভীষণ শূন্যতা। কিসের একটা হাহাকার... কিছুকে একটা আঁকড়ে ধরতে চাইছি... সব কিছু সরে সরে যেতে পারে না... কিন্তু কি ধরব? কাকে ধরব? কোনদিকে হাত বাড়াব? একটা সিদ্ধান্ত সকালবেলায় হলে বিকালবেলায় তাকে সরিয়ে আরেকটা সিদ্ধান্ত, যাই কোথায়? ধর্মীয় বিশ্বাস? তাও তো পুঁথি-পুরাণ-বেদ-বেদান্ত... ওদিকে বিদেশী-দেশি সব দেখা হল... হচ্ছে না যে কিছু! সব যেন রূপকথার মত মিলিয়ে যাচ্ছে... মরুভূমিতে স্লেজগাড়ি চড়ে ঘোরার স্বপ্ন দেখাতে চাইছে যেন সব। তবু... তবু... তবু... কিছু তো একটা চাই! সংসারের এত শক্তি নেই যে সে আমায় পরিপূর্ণ করে আটকে রাখতে পারে, এত ভালোবাসা বেসেও অনেকটা জায়গা শূন্যই পড়ে থাকে... নিজেকে নিয়ে এতো মহাজ্বালা হল... উপায়? 
এসেছে এক নতুন মানুষ দেখবি যদি আয় চলে...
এমন একজন মানুষকে আমাদের প্রয়োজন হয়েছিল যে ইতিহাসের আগের যুগ থেকে উঠে আসবে। যে পড়া কথা বলবে না, শোনা কথা বলবে না, শেখানো কথা বলবে না... যে দেখা কথা বলবে... অনুভূত কথা বলবে... বিনা উদ্দেশ্যে কথা বলবে... কোনো পক্ষ নিয়ে কথা বলবে না, সত্যের পক্ষ নেবে শুধু। 
আর তার জীবন কেমন হবে? স্ফটিকের মত স্বচ্ছ, অথচ স্তরের পরে স্তর। আড়াল থাকবে না, রহস্য থাকবে। যে রহস্য সমাধান করতে করতে আমরা আমাদের জীবনের জটিল থেকে জটিল সমস্যাগুলোর সমাধান অজান্তেই পেয়ে যাব। তাই মাষ্টারমশায় বলবেন - "আপনাকে যে যত বুঝবে সে তত উন্নত হবে"। 
তার ভালোবাসা কেমন হবে? অসহ্য! শান্তিদায়ক না। না গিয়েও থাকা যাবে না, আবার গেলেও জ্বলেপুড়ে দক্ষিণা দিয়ে আসতে হবে। আত্মদানের দক্ষিণা। পথ অন্যদিকে ঘোরাতে চাইলেও, পথ ঘুরে সে অক্ষরজ্ঞানমাত্রজ্ঞাত, অর্ধনগ্ন, ভাবোন্মাদের দরজায় এনে দাঁড় করাবে। সে হেসে হেসে বলবে... 'কি ফিরে এলে যে আবার? বড় যে পালাবার তাল করেছিলে', .....আমি অসহায়... নিজের মনের কাছে... তার প্রেমের কাছে। 
আর তার মরণ কেমন হবে? হবে যেন মশালের মত। নিজেকে পুড়িয়ে ছাই করতে করতে, নিজেকে নিঃশেষ করার আগে আরেকটা মশালে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে। 
তার শিক্ষা কেমন হবে? তার কথা ছাড়ো। তার দেশ-বিদেশখ্যাত-পূজ্য শিষ্য এমন কথা ঘোষণা করতেও দ্বিধান্বিত হবে না - "তাঁর নাম বরং ডুবে যাক - তাঁর উপদেশ ফলবতী হোক। তিনি কি নামের দাস?' ... যে শিষ্য তার সারাটা জীবন মুখ থেকে রক্ত ওঠা শ্রমের বিনিময়ে তৈরি মঠ প্রাঙ্গণ তথা বাড়ি এক নিমেষে বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন শুধুমাত্র দুর্ভিক্ষের সেবার টাকা না ওঠার জন্য। যে শিষ্য বলতে পারেন, “নিজে নরকে যাও, পরের মুক্তি হোক - আমার মুক্তির বাপ নির্বংশ"... যে শিষ্য বলতে পারেন, “সব ত্যাগ করেছো, এখন শান্তির ইচ্ছা, মুক্তি ইচ্ছাটাকেও ত্যাগ করে দাও।”
তাই দরকার ছিল তো, খুব দরকার ছিল এমন একজন মানুষের আসার, তার নাম যে না হয় রামকৃষ্ণই হল। কথাটা নামে নেই, কথাটা একটা পথের, একটা আশ্বাসের, কথাটা একটা বিশ্ব-পাঠশালার ভিত গড়ার। বিশ্ব-বিদ্যালয় অবধি পৌঁছাতে সবাই পারে না, আমার মত মূর্খ মানুষ হলে তো কথাই নেই; দরকার ছিল একটা বিশ্ব-পাঠশালার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করার। যেখানে সবাই চাটাই নিয়ে বসবে, মাটিতে বসবে। যেখানে গুরু সব ধর্মের গুরুর বেশে আসবেন, সব ধর্মের মূল কথাটা শিখিয়ে বলবেন - এই হল মূল, এখান থেকে এক একটা স্রোত বেয়ে এক একদিকে গেছে। তোমার যে পথটায় সোজা লাগে সে পথ ধরে হাঁটতে শুরু করো। শুধু এটুকু জেনো, উৎসটা যেমন এক ছিল, মোহনাটাও একই থাকবে। সেখানে আবার দেখা হবে, যেভাবে দেখতে চাও সেভাবেই দেখতে পাবে।
আমরা যত উন্নত হচ্ছি, তত কম মানুষ হচ্ছি, তত একা হচ্ছি। যত একা হচ্ছি ততই প্রমাণ করছি যে আমি মানুষ হতে পারছি না, কারণ মানুষ একা থাকতে পারে না। মানুষ একা থাকতে পারে না বলেই সমাজ গড়েছিল। আজ সমাজের ভিত কাটতে শুরু করেছে আবার একা করে নিজেকে, বিচ্ছিন্ন করে নিজেকে। মানুষ একা হয় এটা-ওটা কারণের জন্য - এ খুব ভুল কথা। মানুষ একা হয় নিজের মধ্যে অন্যকে আপন করার শক্তিটা কমে যায় যখন সেই রোগে। যেমন অজীর্ণ রুগী ঘর ভরতি খাবার থাকলেও অপুষ্টিতে মরে তেমন। সে আপন করার পথ দেখাবে কে? দার্শনিক? সন্ন্যাসী? না... না... না। সে পথ দেখাবেন 'মা'। তাই আরেকটা স্তম্ভ আরেকদিকে তৈরি হল। "জগতকে আপন করে নিতে শেখো, কেউ তোমার পর নয়"... মৃত্যুর আগে ঘোষণা করছেন মা সারদা। সারাটা জীবনে মা যা করে দেখালেন তা না করলে আর কোনো মহাপুরুষের মহাপুরুষোচিত ঘটনাগুলোকে নিছক গল্প বলেই হয় তো মনে করতাম। তবে মায়ের কথা থাক। সে কথা বাপের কথার থেকে জোরে ছোটে। আগল দেওয়া মুশকিল। 
তো যেটা বলছিলাম, আজ এই 'একা' হওয়া আর 'একা' করার যুগে গেরুয়াই যে একমাত্র পথ হতে পারে না সেটা সে রামকৃষ্ণ নামধারী মানুষটা বুঝেছিলেন, তাই অমন শক্তিস্বরূপাকে আমাদের সামনে বসিয়ে রেখে গেলেন শুধু না, নিজের থেকে তাকে যে আরো বেশি কাজ করতে হবে এমন ঘোষণাটুকুও করে গেলেন। তাই অবশেষে রামকৃষ্ণের শিক্ষার চূড়ান্ত কথাটা মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত হল, যাতে আধুনিক যুগের ধর্ম তথা ঈশ্বর ও জীবনের অনাদি সূত্রের নতুন ব্যাখ্যা যোগ হল - "ঈশ্বর দর্শন হলে কি হয় বাবা, মাথায় দুটো শিং গজায়? না হৃদয়টা মাঠ হয়ে যায়!” 
তবেই বোঝো, মাঠেই মেলা হয়... বোঝে প্রাণ বোঝে যার! শিং নিয়ে ঘুরে লাভ নেই মন। ওতে গোঁতানোই যায় শুধু, মাঠ বানাও বানাও, মাঠ হও মন মাঠ হও.... একা যদি না পারিস মন... সে রামকৃষ্ণ-মা-স্বামীজিকে সঙ্গে নে না।


(আজ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণের পূণ্য জন্মতিথি)
 

466
Fri, 02/24/2017 - 10:05


কালকের Times of India'র প্রথমপাতায় চোখ পড়তেই 'রাজা' নাটকটা মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের। সেখানে বলা হচ্ছে, 'তিনি সবখানেই আছেন বলে কোনোখানে বিশেষ করে নেই'। রবীন্দ্রনাথ আজকের কাগজটা দেখলে লাইনটা সংশোধন করতেন কিনা বলতে পারি না। হয় তো আজকের গুরুরা বলতে চান - 'তিনি কোনোখানেই নেই বলে একজায়গায় বিশেষ করে আছেন'। 

আজ শিবরাত্রি। গতকালই ভারতের জনপ্রিয় খবরের কাগজের প্রথমপাতায় মহাদেবের উচ্চতম মর্মর মূর্তির উন্মোচনের বিজ্ঞাপন। তাও দু'পাতা জুড়ে। এই বিজ্ঞাপনের দরুণ কি বিপুল খরচ হয়ে থাকবে সে অনুমেয়, আরো সহজেই অনুমেয় ওই প্রকাণ্ড মূর্তিটি বানাতে কি পরিমাণ খরচ হয়ে থাকবে। এত টাকা আসে কোত্থেকে? ভক্তদের থেকে। কি ধরণের ভক্ত? দুঃস্থ ভক্ত। উঁহু, দুঃস্থ বলতেই ছেঁড়াজামাকাপড়, লো ব্যালেন্স বোঝায় না। যারা প্রতিদিনের স্ট্রেস সামলাতে না পেরে আধ্যাত্মিক নিরাময়ের পথ খোঁজেন, তাদের কথা বলা হচ্ছে। সেই প্রয়োজন মেটাতেই জন্ম হয়েছে নতুন এক প্রকার সম্প্রদায় - কর্পোরেট গুরু। 
মানুষের নানান জিজ্ঞাসা। মোটামুটি দুই প্রকার যদি ভাবি - জাগতিক আর পরাজাগতিক। জাগতিক প্রশ্নের মীমাংসার পর আসে পরাজাগতিক নানান প্রশ্ন (সকলের না অবশ্য)। সে মীমাংসা করার প্রাচীন পদ্ধতি ছিল অলৌকিক, কাল্পনিক ব্যাখ্যা। যার অনেকটা অংশ রিলিজিয়নের অংশীভূত (আমি ইচ্ছা করেই 'ধর্ম' শব্দটা ব্যবহার করলাম না, তার অর্থ অনেক গভীর), নানান পৌরাণিক কাহিনী। তারপর সে জায়গা নিল দর্শন, যুক্তি। মানুষ খুব গর্বের সাথে স্বীকার করতে শিখল - সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। আর সীমারেখাটা মানার মধ্যে কোনো লজ্জাও নেই। তবু শ্রদ্ধা নির্ভর আরেকটা পথের অস্তিত্ব থেকেই গেল, যাকে বলি ভাববাদ বা মরমীবাদ। সে পথে যুক্তি চলে না। তার কারণ এ নয় যে সে যুক্তির বিরুদ্ধে, কারণ সে যুক্তির অগম্য। সে পথের প্রধান বাহক প্রেম। প্রেমকে বাদ দিলে যা থাকে শুধুই রহস্য, অন্ধকার রহস্য। 
মানুষের দুটো সমস্যা। জাগতিক আর তাত্ত্বিক। জাগতিক সমস্যাবলীর সমাধানের তার নানান পথ- বিজ্ঞান, নানান নীতি ইত্যাদি। আর তাত্ত্বিক সমস্যা? সেরকম মানুষ আমি অন্তত এতবড় জীবনে দেখলুম না, যিনি কোনো তাত্ত্বিক সমস্যায় জর্জরিত হয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলছেন। বইতে অবিশ্যি পড়েছি এমন মানুষ কালেভদ্রে জন্মেছে এই ধরাধামেই। তাঁরা মাথায় থাকুন। তবে কি ছদ্ম তাত্ত্বিক সমস্যাও হয়, কিছু জাগতিক সমস্যার মত। ছদ্ম জাগতিক সমস্যাকে যেমন শৌখিন সমস্যা বলা যায়, তেমনই ছদ্ম তাত্ত্বিক সমস্যাকে নিছক কৌতুহলের গোত্রে ফেলা যায়। সে যাই হোক, সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্য - শান্তি পাওয়া। আমার শান্তি চাই, সলিড শান্তি। সে অ্যাল্প্রাজোলামই দিক, কি গুরুই দিক – I need relaxation. মনে রাখতে আমরা শান্তি অর্থে peace বলতে চাইছি না, কারণ কোনো বুদ্ধিমানই ওটা বাইরে থেকে চান না, ওটা উৎপন্ন করেন নিজের মধ্যে। আর সে পথটা চিরকাল ত্যাগের মাধ্যমেই আসে, সে পেটের মল হোক বা অতিরিক্ত চাহিদা বা লোভ হোক। না ছাড়লে গতি নেই। কিন্তু রিল্যাক্সেশানে তো সে শর্ত নেই। জন্ম হল কর্পোরেট গুরুর। 
ভেবে দেখুন সেই বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, সক্রেটিস, নানক, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ ইত্যাদি বোকা লোকগুলোর কথা। ঠাকুরের ভাষায় 'পোঁদের কাপড় ঠিক না থাকা' লোকগুলোর কথা। কি বোকামিই না করেছেন তেনারা। মানুষকে বলেছেন বড় হওয়ার কথা, ত্যাগের কথা। কোথায় একটু রিল্যাক্স করবে মানুষ, সে শিক্ষা দেবে...না কি সব কঠিন কঠিন কথা বলে সাধের প্রাণটা খোয়ালে। আজ কেমন তাদের শিষ্যেরা সে ভুলটা ধরতে পেরেছে দেখুন। এসি ছাড়া কথাই বলে না, সর্বভুতে ব্রহ্ম না দেখুক লক্ষীকে তো অবশ্যই দেখছেন। এই নিয়ে বেশ কিছুকাল আগে দস্তোয়েভেস্কির 'ব্রাদার্স কারামাজোভ' এর একটা অভিনীত অংশ ইউটিউব থেকে তুলে দিয়েছিলাম - দ্য গ্রেট ইনকুইজিটার। সেখানে দেখানো হয়েছিল, আজ যদি যীশু এসে কোনো মতে রোমে পোপের প্রাসাদে গিয়ে পৌঁছাতেন তবে কি দশা তারা মানুষটার করত। সব প্রতিষ্ঠিত ধর্মেরই এক অবস্থা কম বেশি। 
কথা হল তাদের শিষ্যেদের নিয়ে নয়। তাদের অত ক্ষ্যামতা নেই। কিন্তু এই কর্পোরেট গুরুদের কার্যকলাপে নজরদারি করবে কে? মুশকিল হচ্ছে যে বোকা বনতেই সুখ পায়, বিশেষ করে বিজ্ঞজনের কাছে বোকা বনার মধ্যে যে আত্মপ্রসাদ লাভ করে, সে আত্মতুষ্টির জগতে 'রাজা তোর কাপড় কোথায়' বলার লোক কই? কদিন আগে খুব ভক্ত দুজন মানুষের কাছে শুনলাম জয়রামবাটিতে মা সারদার মূর্তিটা নাকি ক্রমশঃ মুখ ফিরিয়ে নাট মন্দির থেকে মাঠের দিকে তাকাচ্ছে, সেখানে বেশি লোক ধরবে বলে। যারা বললেন, তারা সংসার ত্যাগ করে ফুল টাইম ভক্ত। চমকে উঠলাম, যে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সারাটা জীবন সব রকম অলৌকিক, বুজরুকি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বলে গেলেন তাদের শিক্ষার ধীরে ধীরে এ কি পরিণতি হচ্ছে? বললুম, সেখানে যে গুরু আমায় চেনেন না তিনিই নাকি আমায় দীক্ষা দিয়ে ইহকাল-পরকালের সুব্যবস্থা করে দেবেন এমন কথা আছে। তারা বললেন, তারা নাকি এত উচ্চে থাকেন তাদের ব্যক্তিগতভাবে কাউকে জানার প্রয়োজন হয় না। মনে মনে ভাবলুম তবে রামকৃষ্ণদেব বা সারদাদেবী অথবা তাদের সরাসরি পার্ষদরা বোধ হয় অতটা উঁচুতে উঠে পারেননি। তারা তো শুনেছি আগে ভাব জেনে তবে দীক্ষা দিতেন। যেই না সে কথা বলা, অমনি তারা ক্ষেপে উঠলেন। যুক্তি পাল্টে গেল, বললেন - অত গভীরের কথা জানার ক্ষমতা তাদের নেই। বললুম, নেই যখন তখন সে পথটাই বন্ধ করে দিলে হয়। উপযুক্ত চিকিৎসক না থাকলে শুনেছি কম্পাউন্ডারে সে কাজ কিছুটা চালিয়ে নেন, সে তত্ত্ব ভাবজগতেও হানা দিয়েছে শুধু না, ভালো রকম গোড়াপত্তন করে বসেছে দেখে আতঙ্কিত হলাম। কারণ ওই যে - যে ঠকছে, সে যদি চোখ-কান বন্ধ রাখাকেই উৎকৃষ্ট ভক্তি বলে মনে করেন, তবে তো আর কথাই নেই। আরেক সম্প্রদায়ে দেখেছি - 'সবার মধ্যেই এক নারায়ণ' এমন সুন্দর ভাবোদ্দীপক কথাকেও বলা হচ্ছে, আবার 'অন্যের হাতে খাওয়ায় শুদ্ধতা নষ্ট হবে' এমন অপমানজনক কথাও একই সাথে উচ্চারিত হচ্ছে। অসুবিধা নেই, বিবেক ঘুমাচ্ছে যে। 
যত দিন যাচ্ছে, যত মানুষ যোগ্য কনজিউমার হয়ে উঠছে, তত তার সাধারণ বুদ্ধিগুলোর ধার কমছে কি? না হলে অত কোটি কোটি টাকা ডোনেশান দিয়ে শান্তি কিনতে যায় কোন মূর্খামিতে? যে পথে ত্যাগ নেই, সেবা নেই, সরলতা নেই, সমদর্শিতা নেই, আত্ম-সমালোচনা নেই - সে কোন ধর্মের পথ? সে গুরুরা কোন ধর্মের গুরু? সে পথের পথিকেরা কোন জগতের অন্বেষণে? অন্তর্যামীর বাজার দর কমেছে বলেই না আজ এতবড় মূর্তির আয়োজন! ঘুমন্ত বিবেককে ঘুমাতে দাও। সে জেগে গেলে শান্তি বিঘ্নিত হবে। জাগ্রত অহং এর গোড়ায় ঢালো জল। যত বড় আয়োজন, তত তার আস্ফালন। তত সে বিত্তশালী। ভিতরের কতটা দীনতা চাপা দিতে এতটা ঐশ্বর্যের মোড়কে ঈশ্বরকে ঢাকতে হয় সে বিচার করবে কে? 
একটা গান মনে পড়ছে। মহাপ্রভু সম্বন্ধে - 
                 "একি অপরূপ কথা, কহনে না যায় 
                        গোলোকেরই নাথ হইয়া ধুলায় লুটায় 
                              হায় হায় চন্দনে লেপিত অঙ্গ ধুলায় লুটায়” 

সে ধুলা গায়ে মাখব বলেই বসে থাকা। যে আমায় ভরে দেবে তার জন্যে পথ চাওয়া নয়, যে আমার সর্বনাশ করবে তার জন্য পথ চাওয়া। 

“যে করে আমার আশ, তার করি সর্বনাশ 
তাও যদি করে আশ, হই তার দাসানুদাস”

467
Tue, 02/21/2017 - 23:30

"আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা যেমন মাতৃক্রোড়ে জন্মেছি তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম, এই উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য।” ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"যে ভাষায় প্রথম 'মা' বলিতে শিখিয়াছি, সে ভাষা দিয়া প্রথম 'এটা ওটা সেটা' চিনিয়াছি, যে ভাষায় প্রথমে "কেন' প্রশ্ন করিতে শিখিয়াছি, সেই ভাষার সাহায্য ভিন্ন ভাবুক, চিন্তাশীল কর্মী হইবার আশা করা আর পাগলামী করা এক। ...পরভাষায় যতবড় দখলই থাক, তাহাতে ওই চলা-বলা-খাওয়া, নিমন্ত্রণ রক্ষা, টাকা রোজগার পর্যন্ত্যই হয়, এর বেশি হয় না, হইতে পারে না।” ~ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
"মনে হচ্ছে আমরা এমন এক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, যদি কেউ ইংরাজী না জানে তবে সে আশা করতে পারে না যে সে একজন বোসের (আচার্য জগদীশ্চন্দ্র বোস) মত হবে। আমিও এর চেয়ে বড় কুসংস্কারের কথা ভাবতেই পারি না। কোনো জাপানী আমাদের মত অসহায় বোধ করে না।” ~ মহাত্মা গান্ধী


মানুষ যখন জন্মায় আলো বাতাসের মধ্যে যেমন জন্মায় তেমন একটা ভাষার মধ্যেও জন্মায়। প্রথম যে কান্নাটা সে কাঁদে, যে যে শব্দগুলো করে তা শুধু তার মা বুঝতে পারেন, কোনটা খিদের, কোনটা পেট ব্যাথার, কোনটা দুষ্টুমির। সে সম্পর্কটা একান্তই প্রাকৃতিক, জৈবিক। এরপর ধীরে ধীরে সে বলে, 'খিদে পেয়েছে'... 'তেষ্টা পেয়েছে'... 'মায়ের কাছে যাব'... কেউ বলতে পারে না, ঠিক কোন মুহুর্তটাতে সে নিজেকে প্রকাশ করার জন্য এই সঠিক শব্দগুলো নির্বাচন করতে শিখল, আর ধীরে ধীরে তাদের পাশাপাশি বসাতে শিখল। কোনো ব্যাকরণ না, কোনো পণ্ডিতমশায় না, কোনো কার্যক্রম না... তবু সে শিখতে শুরু করল। বিশাল শব্দসমুদ্র থেকে নিজের প্রয়োজনীয় শব্দগুলো চিনে নিতে শুরু করল। ধীরে ধীরে তার সম্পূর্ণ সত্তাটা সেই ভাষার সাথে একাত্ম হতে শুরু করল। একটা মানুষ মানে একটা ভাষা। একটা ভাষা মানে তার অন্তঃকরণ, তার ভাব। 
এ গেল একদিক। যত বড় হতে লাগল তত তার জৈবিক প্রয়োজন ছেড়ে বৌদ্ধিক প্রয়োজনের দিকে এগোতে শুরু করল। ভাষা শুধু প্রকাশের না, প্রয়োজনের হয়ে উঠতে লাগল। যে ভাষা দিয়ে সে বিশ্বসংসারের দিকে হাত বাড়িয়েছিল, সেই ভাষার স্রোত বেয়েই বিশ্বসংসার তার মধ্যে প্রবেশ করতে শুরু করল। সাহিত্য, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদির মাধ্যমে সে নিজেকে একটা ধারাবাহিক স্রোতের অংশস্বরূপ বলে বোধ করতে লাগল। সে বুঝল সে আসার আগে নানান ক্ষেত্রে মানুষ তার অপরিসীম অধ্যবসায়ে নানান আবিষ্কার, উৎকর্ষতা, বাধা-বিঘ্ন নাশ করে এগিয়ে চলেছে। তার নিজেকেও এক বিন্দু জল সেই সাগরে যোগ করতে হবে। করতেই হবে। তিলমাত্র হলেও সে পথের সামনের দিকে তাকে হাঁটতে হবে, হাঁটতে না পারলেও তার পরে যারা হাঁটবে তাদের পথ পরিষ্কার করতে হবে। 
তার ভিতরের এ বোধ যে তৈরি করে দিল, সে তার মাতৃভাষা। আমাদের ক্ষেত্রে যা বাংলা। একটা ভাষা - একটা সংস্কৃতি, জীবনশৈলী, মেধা-চিন্তন-মননের ধারক-বাহক-প্রেরক। যত ভাষার গভীরে পৌঁছাই তত আমার অস্তিত্বের মূলটা গভীর থেকে গভীরতর মজ্জায় ঢুকতে শুরু করে। বহু মননের অংশীদার হই, বহু ঐতিহ্যের স্বাদ পাই। নিজেকে আবিষ্কার করি, সমাজকে আবিষ্কার করি, সময়কে আবিষ্কার করি। আমার বাংলা ভাষা বেয়েই প্রাণে বাউল আসে, কীর্তন আসে, পদাবলী আসে, ক্রমে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে বিশ্বের আঙিনায় আসা হয়। 
একটা মানুষ তথা একটা সমাজের উৎকর্ষতা তার বৈচিত্রতার মধ্যে। একদেশিতা প্রাণের স্বভাব নয়। তা যদি হত পৃথিবী জুড়ে এত বিচিত্র জীবের, এত বিচিত্র মৌলের অবস্থান হত না। মানুষের আর সমাজের প্রকৃতিতেও সেই বৈচিত্রের প্রতি সহজাকর্ষণ আছে বলেই মৌলবাদদের স্ব-অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য এত ভয়ের, আতঙ্কের, লোভের সৃষ্টি করতে হয়। এক বিকারকে কায়েম করতে হাজার বিকারের শরণাপন্ন হতে হয়। তবু শেষরক্ষা হয় না বলেই অগ্রগতিটা অব্যহত রয়েছে, মাঝে মাঝে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘূর্ণাবর্ত মাথা চাঁড়া দিলেও। ঝড়টা স্বাভাবিক অবস্থা না। মৃদুমন্দ বাতাসটাই স্বাভাবিক অবস্থার লক্ষণ। ভাষার ক্ষেত্রেও তাই। মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরাজী ভাষা শেখাটা আমাদের অত্যাবশ্যক। সে ভাষাটা আজ কাজের জন্য হলেও, সারা পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ রাখতেও মোটামুটি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরাজী ভাষাটা আমাদের মাতৃভাষার বিকল্প হতে পারে না, পরিপূরক হতে পারে। যে কোনো ভাষাই মাতৃভাষার পরিপূরক হতে পারে, মাতৃভাষাকে সমৃদ্ধ করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে তা পরিপূরক মাত্র, বিকল্প না। কোনো কিছুর মূলটা থাকলেই ডালপালার বিকাশ ঘটে। নয় তো 'না ঘরকা, না ঘাটকা' হয়ে সংকর জীবের সৃষ্টি হতে বাধ্য, যার নিদর্শন খুব একটা দুর্লভ নয়। নিত্য-নৈমিত্তিক খাদ্য তালিকায় কিছু অভাব থাকলে বাইরে থেকে ভিটামিন খেয়ে সে অভাবটুকু পূরণ করা যায়, কিন্তু কেউ যদি নিত্য খাদ্যকে ভিটামিন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে চায়, তবে তা হাস্যস্পদ শোনায়।
জলপানের একটা উদ্দেশ্য অবশ্যই তৃষ্ণা নিবারণ, কিন্তু তার সাথে সাথে সে একটা তৃপ্তিও অনুভব করে। সে তৃপ্তিটা একমাত্র মাতৃভাষাতেই সম্ভব। যদি কেউ তা অস্বীকার করেন, তবে মূলে কিছু গলদ ঘটেছে অনুমান করে নেওয়া যেতেই পারে। আমার অঞ্চলের প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত নন এমন মানুষের সাথে যে ভাষায় আত্মীয়তা গড়ে তুলতে পারি, সে নিশ্চই আমার মাতৃভাষা। আজ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যা হিন্দীভাষায় গড়তে পারি (এ নিয়ে আগে একটা প্রবন্ধ লিখেছি, তাই বিস্তারিত আলোচনা বাহুল্য। ক'দিন আগে এক সৈনিক তাদের দুর্দশা নিপীড়নের যে চিত্র সবার সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল, তা হিন্দী ব্যতীত অন্য কোনো ভাষায় বললে কতটা আলোড়ন তুলত আমার সন্দেহ।)। 'গান্ধী' নামক হলিউডের সিনেমাটা যারা দেখেছেন, তাদের সেই বিখ্যাত দৃশ্যটা নিশ্চই মনে আছে, মহাত্মার প্রথম ভাষণ, তাঁর আগে যাঁরা বলেছেন বেশিরভাগই ইংরাজীতে, ইংরাজদের মতন করে। তাতে জনসাধারণের মস্তিষ্ক সাড়া দিলেও হৃদয় সাড়া দেয়নি। পৃথিবীর সব কালের সব জননেতারাই জনগণ অবধি পৌঁছাতে পেরেছিলেন, জাগাতে পেরেছিলেন মাতৃভাষাতেই। সক্রেটিস, বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, চৈতন্য, কবীর, নানক, তুলসীদাস, রামকৃষ্ণ প্রমুখ কিংবদন্তী মহাত্মা সকল এর উজ্জ্বল উদাহরণ। মহাত্মা গান্ধী সেটা পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সেটাই মহাত্মা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ভারত এঁকে নিজের আত্মীয় বলে বোধ করেছিল। হৃদয়ের সাড়া একমাত্র মাতৃভাষাতেই পাওয়া যায়। জীবনের মূলসুর যে 'ওরা কাজ করে' -দের নিত্যজীবনের সুরে বাঁধা, সে সুর একমাত্র মাতৃভাষাতেই অনুভব করা যায়। জীবনটাকে ওপর ওপর ঘেরাটোপে আলো-বাতাস না লাগিয়ে মরে বেঁচে থাকার চাইতে বড় কিছু চাইলে 'নান্যপন্থা বিদ্যতে' - অন্য পথ নাই। তাতেই আমাদের নিত্যকারের জীবনযাত্রা চলে। জীবন থেকে মৃত্যু অবধি সব অভিজ্ঞতা এই ভাষাতেই অনুদিত হয়ে সাহিত্যসম্পদ হয়ে কালজয় করে। 
মাতৃভাষা আমার কোনো পছন্দ না, যেমন আকাশ-বাতাস-সময় আমার কোনো পছন্দ না, আমার পরিচয়। সে আত্মপরিচয় স্বীকার করতে কুণ্ঠিত হলে সে পূর্ণ অর্থে মনুষ্যপদবাচ্য কিনা তাই যখন বিবেচ্য তখন বাকিটা আর কহতব্য না। যা সহজে পাওয়া যায় তার মূল্য বুঝতে যে বোধের প্রয়োজন শুধু নয়, আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষাও প্রবল থাকা বাঞ্ছনীয়, তবেই একটা দাদাঠাকুরের জন্ম হয়। একটা একুশে ফেব্রুয়ারী মাথা তোলে। অন্য ভাষার সাথে বৈরীতাতে গিয়ে না, স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে নিজের মাটিতে, নিজের পরিচয়ে। ভাষা একটা ইতিহাস না, ভাষা শ্বাসবায়ু, রক্ত, জ্যোতি। ভাষা একটা ঘটনা, একটা প্রবাহ। আর মাতৃভাষাটা 'আমার' না, মাতৃভাষাটাই 'আমি'।

(ফেসবুকে বহু মানুষ, কিছু গ্রুপ অসাধারণ কাজ করে আসছেন সারাটা বছর ধরে মাতৃভাষা নিয়ে। আজ এই বিশেষ দিনটাতে তাঁদের সক্কলকে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও প্রণাম জানাই। আমার এ সরব চিন্তামালা তাঁদেরই উদ্দেশ্যে রাখলাম।)

468
Fri, 02/17/2017 - 19:53


আজ সকালে আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল। নানা দুর্যোগের ভিতর দিয়ে তাকে যেতে হচ্ছে। অর্থনৈতিক, পারিবারিক ইত্যাদি সমস্যায় জর্জরিত। আমরা কথা বলছিলাম, সূত্র খুঁজছিলাম বেরিয়ে আসার। সমস্যাগুলো থেকে নয়। সমস্যাজাত উদ্বিগ্নতা থেকে। 
ও চলে যাওয়ার পর একটা শব্দ খুব গভীরভাবে চেপে বসল মাথায় - বিষাদ। ডিপ্রেশানের কাছাকাছি প্রতিশব্দ। বাংলাতে 'অবসাদ' আর 'বিষাদ' নিজেদের মধ্যে পরিবর্তনীয় শব্দ। মন খারাপ আর বিষাদ এক নয় যদিও। তবু বিষাদ যেন দীর্ঘস্থায়ী আত্ম-বিকল অবস্থা। এর কারণ যদি মস্তিস্কের গঠনগত ত্রুটি, জেনেটিক ইত্যাদি কারণ সংক্রান্ত হয়ে থাকে তবে তা আলাদা কথা। সেখানে কিছু বলার যোগ্যতা আমার নেই। আমার নিজের ক্ষেত্রে সেরকম কিছু বুঝলে অবশ্যই যেমন চিকিৎসার শরণাপন্ন হব, সবার ক্ষেত্রে তাই পরামর্শ দেব।
কিন্তু যদি মনে হয় এটা সেই জাতীয় কিছু নয়, অর্থাৎ ততটা গভীর নয়, তখন? আমার মনে আছে, জীবনের একটা খুব ঘন অন্ধকার সময়ে জ্যোতিষীর দরজাতে দাঁড়াতেও দ্বিধাবোধ করিনি। আজ সেই মূর্খামির কথা স্মরণ করতেও লজ্জা বোধ করছি না, অথবা বলতেও না। কারণ সেদিন যদি সমস্ত আশা-ভরসা নিয়ে জ্যোতিষীর দরজায় না দাঁড়াতাম তবে তার অন্তঃসারশূন্যতা সম্বন্ধে আজ এত নিঃসংশয়ও হতে পারতাম না। অবশেষে শেষ আশ্রয় - প্রজ্ঞা। 
আমার সেই সব চেনা-অচেনা বন্ধুদের সাথে কথা বলব বলে এ লেখা লিখতে বসলাম, যারা একটা দীর্ঘস্থায়ী মন খারাপের শিকার হয়ে রয়েছেন, অথচ কি ভাবে সে থেকে বেরোবেন বুঝে উঠে পারছেন না। আমার কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করলে যদি একজন মানুষেরও অন্তত আংশিক সুরাহা হয় তবে নিজেকে আর আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াসকে ধন্য মনে করব। 
আমাদের মন অভিব্যক্তির অনেকটা পথ হাঁটলেও, তার মূলগত কিছু দিক খুব একটা বদলায়নি। প্রথমতঃ, তার সুখান্বেষণের প্রবৃত্তি। সুখ আর ভয়ের খুব একটা নিবিড় সংযোগ আছে। যার সাথে জড়িয়ে শোক তথা মন খারাপের বীজ। 
সুখের ধারা বদলেছে, চরিত্র বদলেছে, কিন্তু সুখের প্রতি আকর্ষণের প্রাথমিক তাগিদ কি বদলিয়েছে? না। আর সে কখনো বদলাবার নয়ও। সুখ বলতে কি বুঝি? তাৎক্ষণিক আরাম থেকে বৌদ্ধিক নিশ্চয়তার বোধকে স্থায়ী করার একটা প্রবৃত্তি - এগুলো সব মিলিত হয়ে একটা জটিল প্রেরণা-শক্তি, যাকে অন্যভাবে বলতে পারি বেঁচে থাকার উৎসাহ। উৎসাহ, উদ্যম এরা জীবনের প্রথম সুখ। অথবা বলা যায় বাকি সব সুখের ভিত্তি। তাই এই আত্ম-নির্ভর সুখের অপর একটি নাম হল - আনন্দ। আমি কোনো একটা চেষ্টায় হয় তো ভীষণ রকম ব্যর্থ হলাম, কিন্তু যদি উদ্যম বা উৎসাহ হারিয়ে না ফেলি, তবে সে হারকে পায়ে পিষে আবার এগোতে পারব। সে হার বাধা হবে না, হবে সিঁড়ির একটা ধাপ মাত্র। 
আমরা যারা বিবেকানন্দ সাহিত্য পড়েছি, তারা পড়েছি, এক জায়গায় উনি বলছেন, গীতা পড়া হয়ে গেলে, ব্যাধগীতাটা একবার পড়ে দেখার জন্য। কলেজ জীবনে পড়েছিলাম ব্যাধগীতা। অসামান্য একটা গ্রন্থ। আজও এতদিন পর নানান দুর্যোগে সে প্রাচীন স্বচ্ছজ্ঞান প্রস্রবণের কাছে দাঁড়াই। কিছু না কিছু হাতে আসেই। তার কয়েকটা শ্লোকের বাংলা এখানে দিই আগে, পরে আলোচনায় আসছি।

১) প্রজ্ঞা দ্বারা মানসিক দুঃখ আর ওষুধ দ্বারা শারীরিক দুঃখকে নিবৃত্ত করবে।
২) শোক করতে থাকলে কিছুই হয় না, শুধুমাত্র পরিতাপ হয়... মূর্খেরা অসন্তুষ্ট থাকে, জ্ঞানী সর্বদা সন্তোষ লাভ করেন। (তুলনীয়, বিখ্যাত দার্শনিক জে কৃষ্ণমূর্তির কথা - you need enough intelligence to be simple) 
৩) অসন্তুষ্ট ব্যক্তির কখনো আত্মতুষ্টি ও পরমসুখ নাই। 
৪) বিষাদে মনোনিবেশ করা উচিৎ নয়। কারণ, বিষাদ উত্তম বিষ যা অজ্ঞানী স্বল্পবুদ্ধিকে ক্রদ্ধ সর্পের ন্যায় মেরে ফেলে। 
৫) আত্মবমাননা প্রাপ্ত হয়ে কোনও মঙ্গল লাভ হয় না।

একজন মাংস বিক্রেতা ব্যাধের কাছে এক সাধনার অহংকারে অহংমগ্ন যুবক সন্ন্যাসীর জ্ঞানপ্রাপ্তির উপাখ্যান নিয়ে এই ব্যাধগীতা। যে সন্ন্যাসীকে ব্যাধের কাছে আসার পথ দেখিয়েছিলেন এক গৃহবধূ যিনি একান্তভাবে তার অসুস্থ স্বামীর সেবাপরায়ণা ছিলেন। যে গৃহবধূর কাছে এই তরুণ দাম্ভিক সন্ন্যাসীর অহং প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয়। 
তবে মূল কথাটা হল বুকের মধ্যে শূন্যতাবোধের একটা কারণ নিশ্চই আছে। তাকে খুঁজে বার করতে হবে। এর প্রথম হাতটা পাওয়া যায় কোনো সহৃদয় বন্ধুর কাছ থেকে। অন্তত একজনের কাছে অভিনয় না করে নিজেকে পুরোপুরি খুলে ফেলতে হবে। প্রথম প্রথম খুব সংকোচ হবে। জড়তা আসবে। কোথা থেকে শুরু করব বুঝে ওঠা যাবে না। সে যদি কিছু মনে করে... সে যদি কাউকে বলে দেয়... সে যদি বিরক্ত হয়... ইত্যাদি ইত্যাদি নানান কুন্ঠা আসবে। আসুক, তবু বলতে হবে। আমি বিশ্বাস করি না আমাদের চারপাশটা এতটাও খারাপ হয়ে গেছে যে সেরকম আন্তরিকভাবে হাত বাড়ালে একটাও সাহায্যের হাত আসবে না। আসলে নেগেটিভ প্রচার, আলোচনা ইত্যাদি এত বেশি চারদিকে হয়ে আসছে যে বিশ্বাসটা টাল খেয়ে বসে আছে অনেক গভীরে। সেটাকে ছাড়তে হবে। নিজের চারপাশটাকে নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, শুধু নিজেকে নিয়েই এত ব্যস্ত ছিলাম যে চারপাশটাকে 'জানিই তো সব' এর লেবেলে ঢেকে পাশ কাটিয়ে গেছি। কোনোদিন নিজের হাতে নেড়েচেড়ে দেখিনি। 
সে যা হোক, নিজের কথা নিজেকে বলতে হবে, না আড়াল করে। বলতে হবে, আমার সকালে উঠতে ইচ্ছা করে না, মনটাকে শান্ত বা রিল্যাক্সড রাখতে ভুলে যাচ্ছি, নিজেকে কি এক অজানা অপরাধবোধে রাতদিন অঙ্কুশবিদ্ধ করে চলেছি। এদিকে ঈর্ষা, তো ওদিকে পরশ্রীকাতরতার ছোবলে ছোবলে জেরবার। সারাদিন সোশ্যাল নেটওয়ার্ক, বিজ্ঞাপন আর মিডিয়ার ভিড়ে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারছিনা। দিন দিন আমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি। এ আমি সে আমি নই, যাকে আয়নায় দেখি। অবশ্য আমার এই বিষাদও এখন বাজারি বস্তু। তাকে নিয়েও নানান ফাঁদ। সবাই নাকি আমার ভালো করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে, কিন্তু কি হচ্ছে, আমি নিজের মধ্যেই কোথায় একটা হারিয়েই যাচ্ছি, হারিয়েই যাচ্ছি... বুকের মধ্যে শূন্যতার অন্ধকার। সারাটা মন অবসন্ন, অসাড়। শরীর জড়ের মত অচেতন।
কথা বলতে শুরু করুন। জোর করে, নিজের বিষাদকে আড়াল রাখার কোনো প্রয়োজন নেই আবার মন খারাপকে প্রশ্রয় দিয়ে বাড়িয়ে তোলারও কোনো মানে হয় না। এই 'প্রশ্রয়' শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এই ক্ষেত্রে। প্রথম প্রথম কোনো একটা ন্যায্য কারণে মন খারাপ হওয়ার পর যখন মন দেখে যে সে অতিরিক্ত গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে, তখন সে একটা পেন হারানোর মন খারাপকেও স্বজন হারানোর মন খারাপের তুল্য আসন দিয়ে শোকের উৎসব তৈরি করে নেয় নিজের মধ্যে। প্রতি মুহুর্তে অন্যের কাছ থেকে আশ্বাস আর সান্ত্বনা চাওয়ার অভ্যাসটা একটা ব্যাধির মত হয়ে দাঁড়ায়। শেষে সত্যিকারেরই একদিন আসে যেদিন প্রশ্রয় দেওয়ার আর সীমা-পরিসীমা থাকে না, মানুষটা গভীর বিষাদ সাগরে নিমজ্জমান হয়। তলিয়ে যায়। 
এই আসল-নকলের ব্যালেন্সটা শিখিয়ে দেয় 'প্রজ্ঞা'। ঠিক কোনটা স্ব-আরোপিত আর কোনটা সত্যিকারের দুঃখ, তাকে চিনিয়ে দেয় প্রজ্ঞা - 'আপনি যে দুখ ডেকে আনি সে যে জ্বালায় বজ্রানলে-- / অঙ্গার ক'রে রেখে যায়, সেথা কোনো ফল নাহি ফলে। / বন্ধু কোনো ফল নাহি ফলে 
তুমি যাহা দাও সে-যে দুঃখের দান / শ্রাবণধারায় বেদনার রসে সার্থক করে প্রাণ || / বন্ধু সার্থক করে প্রাণ'

সে যাই হোক, নিজের ভিতর সেই উৎসাহ, উদ্যমের ভিত যে আনন্দ তাকে জাগিয়ে রাখতে হবে। খুঁজে পেতে হবে। পেতেই হবে। এমন একটা কাজ খুঁজে নিতে হবে যাতে সে পথ হতে পারে, কিছুটা হেঁটে আসার। কিছুটা সময় অবশ্যই শারীরিক ব্যায়ামে দিতে হবে, নিদেন পক্ষে হাঁটা আধঘন্টা প্রতিদিন, যখন সময় হোক। শুধুই হাঁটার জন্য হাঁটা, অন্য কারণে নয়। এমনকি 'যাই ফেরার পথে বাজারটা সেরে আসি' - এমন মানসিকতা থেকেও যত দূরে থাকা যায় তত মঙ্গল। হাঁটলে মন ভালো হয় - এ নিজের ক্ষেত্রে দেখেছি। আর জীবনে স্বল্প কিছু বন্ধু থাকুক, যাদের সাথে আহ্নিকগতি আর বার্ষিকগতি - উভয় গতিতেই সাথে থাকা যায়, বিনা অভিনয়ে। সেটা বাস্তব জীবনে হওয়াই বাঞ্ছনীয়, ভার্চুয়াল জগতে না। শ্রী অরবিন্দ বলতেন - depress the depression. 
আর একটা কথা বলে শেষ করি; কোনো কিছু, কোনো মুহুর্ত, কোনো মানুষই পার্ফেক্ট না, এমন কি আমিও না - এই নেগেটিভ সূত্রটা, আর সব কিছুই, সব মুহুর্তই আর সব মানুষই পরিবর্তনশীল, এমনকি আমিও - এই পজিটিভ সূত্রটা... এই দুই সূত্র শান্তিতে উড়তে সাহায্য করে, অন্তত আমাকে তো করে। সক্কলে ভালো থাকবেন, সুখী হওয়ার দরকার নেই, পথিক হতে পারলেই হল।


 

469
Wed, 02/01/2017 - 11:24


‘সংস্কৃতি’ শব্দের ইংরাজী পরিভাষা – culture. ঠিক কি কারণে জানি না, ‘জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস’ আর ‘চলন্তিকা’ দুটো অভিধানেই ‘সংস্কৃতি’ শব্দটার ব্যাখ্যা দেওয়ার পরপরই ‘culture’ শব্দটা লেখা আছে, যেন ওই শব্দটা না হলে আমরা ঠিক বুঝতে পারতাম না, কি বলতে চাওয়া হচ্ছে। তবে কি সংস্কৃতি শব্দটা খুব পুরোনো নয় বাংলা ভাষায়? অথবা ধারণাটা? সে তত্ত্ব ভাষাবিদদের দরবারে রেখে আপাতত আমি আমার আলোচ্য বিষয়ে আসি। তার আগে ছোটো ঘটনা বলে নিই। 
কদিন আগে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরছি এক বন্ধুর বাইকে, হঠাৎ কানে আসল ভীষণ সুন্দর সুরে কোথাও রামচরিতমানস গাইছেন কেউ। এগোলাম সেদিকে শব্দভেদী বাণের মত। পৌঁছিয়ে দেখি বিরাট একটা মাঠে বিশাল প্যাণ্ডেল, হাজার হাজার লোক, বাইরে বাইক, সাইকেল, টোটো থিকথিক করছে। মঞ্চে একজন রামচরিতমানস গাইছেন, ব্যাখ্যা করছেন। নীচে গুণমুগ্ধ শ্রোতাগণ। বলা-বাহুল্য নিরানব্বই ভাগ তাদের অবাঙালী। এর খানিক আগেই ছাব্বিশে জানুয়ারী উপলক্ষে নানান জায়গায় মোচ্ছবের আয়োজন দেখতে দেখতে ফিরছিলাম। তুলসীদাসজীর রামচরিতমানস নিয়ে আর কি বলার। সে তো নিজেই ভারতবর্ষের একটা অধ্যায়। এটা সংস্কৃতি। আমাদের সাধনলব্ধ, যুগসঞ্চিত সম্পদ। আর ওই মোচ্ছবটা বিনোদন।


Culture – the arts and other manifestations of human intellectual achievement regarded collectively. (Oxford dictionary) 
সংস্কৃতি – অনুশীলন-বদ্ধ দেহ-মন-হৃদয় ও আত্মার উৎকর্ষ (সাহিত্য সংসদ)


ছোটোবেলায় একটা শব্দ খুব শুনতাম, ইদানীং কম শুনছি বা শুনছিই না বলা যায় – অপসংস্কৃতি। আদৌ এরকম একটা শব্দ হয় কি না অভিধানে জানি না। হওয়াটা খুব একটা বাঞ্ছনীয়ও নয়। কারণ সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় অভিধান অনুযায়ী, তার বিপরীতার্থ হওয়া খুব একটা যুক্তিসঙ্গত নয়, অন্তত আমার মতে। 
সে যা হোক, শব্দটার ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না। তবে আজ শব্দটার প্রয়োগে এত অনীহা কেন? কারণ অনেকটা যেন মাছের বাজারে আঁশটে গন্ধের অভিযোগ জানানোর তুল্য ঘটনা সেটা আজ। আমার চারপাশে সে অর্থে সংস্কৃতি চর্চার অবকাশ কি খুব পর্যাপ্ত? সংস্কৃতির নামে প্রাণহীন পুনরাবৃত্তির অভাব হয় তো সে অর্থে নেই, কিন্তু সে পথে সজীবতার অভাব একান্ত সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে বলে আমার মনে হয়। কারণ সেই জায়গাটা নিচ্ছে ক্রমশঃ বিনোদন, ইংরাজীতে enterntainment. এ সবের মধ্যেও কাজ হচ্ছে না বলছি না, তবে বিপদটা হচ্ছে, বিনোদন আর সংস্কৃতির মধ্যে কোনো ফারাক নেই, এমন একটা মানসিকতা কোথাও যেন তৈরি হচ্ছে। যেন সংস্কৃতির ছদ্মবেশে আসুক বিনোদন। 
সংস্কৃতির সাথে একটা শব্দ খুব অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে – চর্চা তথা অনুশীলন। অনেকে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে এক করে একটা মিউজিয়ামস্থিত মানসিকতায় সংস্কৃতিকে দেখতে চান, তাদের কথা বলছি না। সেখানে চর্চা শব্দটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না, সেখানে পুনরাবৃত্তি তথা একটা অচলায়তনের ধারণা চলে আসে। তা না, সময়ের, সমাজের যেমন একটা ধারা আছে, তেমন বুদ্ধিবৃত্তিরও একটা নিজস্ব ধারা আছে, প্রবাহ আছে, অববাহিকা আছে। সেই অববাহিকার পলি জমে তৈরি হয় সংস্কৃতি। তাতে কিছু কাঁকড় জমে, তা কালের স্রোতে ধুয়েও যায়। এর প্রধান চালিকাশক্তি হল বোধ। বোধের উন্মেষ, মার্জনা যেখানে নেই, সেখানে সেই শূন্যতা স্থুল বিনোদন দ্বারা পরিপূর্ণ থাকবে, এতে আশ্চর্য হওয়ারও কিছু নেই অবশ্য। আবার এ স্থুল বিনোদন বস্তুটা কি?
যদি বিনোদনকে খুব কাছ থেকে দেখি, তবে তার মধ্যে দুটো দিক আছে - এক আনন্দ, দুই আমোদ। আনন্দ, বোধের আলোয় জন্মায়। আমোদ জন্মায় ইন্দ্রিয়ের অথবা স্থূল মনের বৃহৎ আন্দোলনে। সেই অর্থে কিছু বিনোদন সুক্ষ্ম, কিছু স্থূল হতে পারে। কিন্তু কথা হচ্ছে, এর পরিমাপ করবে কে? সংসারের সিংহভাগ রমণী যদি সারাটা সন্ধ্যে অসামান্য চিত্রনাট্য সম্বলিত ধারাবাহিক দেখতে থাকেন আর পুং কুল নানান চাপে চাপান্বিত হয়ে মুক্তির পথ খোঁজেন, তবে সেখানে বিনোদনই হবে সুয়োরানী। এর জন্যে গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের আবশ্যকতা নেই। সংস্কৃতির চর্চা যে করব সে সময় কোথা বাপু?
কথাটা মিথ্যা নয় পুরোপুরি। জীবন যাত্রার দ্রুতময়তা বেড়েছে। বুদ্ধি আর বোধের সাথে লাগাম আর ঘোড়ার একটা সম্পর্ক আছে। বোধ যেখানে ঘুমন্ত বা আগ্রাসী উচ্চকাঙ্ক্ষায় মোহমুগ্ধ সেখানে গতির সাথে ছন্দ আশা করা দুরূহ ব্যাপার।
সেই বুদ্ধির চর্চা আবার বিজ্ঞানের দ্বারে এমন নাড়া বেঁধেছে, আর সুখের এমন সব কায়দাকানুন রপ্ত করেছে, তাকে বোধের মন্দিরে ফেরানো সত্যিই আজ দায়। অর্থাৎ বিজ্ঞানকেও এখন তত্ত্ব ছেড়ে প্রয়োগোন্মুখ হতে হচ্ছে। হতেই হবে। জ্ঞানের দায় ততক্ষণই মানবো যতক্ষণ দিনান্তে সে আমার পাতে রাজভোগ আনতে পারে, নতুবা তাকে পেন্নাম করে শিকেতে তুলে রাখো। এ হল আরেক বিনোদন। উচ্চাঙ্গের বিনোদন। বিজ্ঞান মানে এখন ডোরেমন। সেখানে তবু খানিক বোধের দায় দেখানো হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের ঝোঁক বিনোদনের দিকে এমন ধারার যে তাকে অস্বীকার করার কথা ভাবা অর্থে সন্ন্যাস নেওয়ায় সামিল। অগত্যা মঙ্গলশঙ্খ ধুলায় পড়ে থাকে। কে দেবে ফুঁ? অকারণে ঘুম কে ভাঙাবে? গাল খেতে হবে যে? ওর চাইতে রবি ঠাকুরের বৌদির সাথে সম্পক্ক, গান্ধী কোন নারীর কোন স্তনেতে হাত রাখতেন, বিবেকানন্দর কি কি রোগ ছিল ইত্যাদি মহান সব চর্চায় মাতি। স্থূল হলে দু’হাতে জাপটিয়ে যে সুখ, সুক্ষ্ম হল সে সুখ কোথায়? ফসকে যায় যে?


তবে উপায় কি নেই? আছে। যাঁরা এরই মধ্যে খানিক সংস্কৃতি চর্চায় মগ্ন তাদের ছোটোবেলার দিকে তাকাই। দেখি বীজ রোপিত হয়েছে সেইকালেই, সেই নরম মাটিতে। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলছি নে। তবে সে চর্চার বীজ সেই বয়সে অভ্যেস না হলে বেলা গড়ালে সব দিকে তাল রেখে চলা সত্যিই খুব ঝঞ্ঝাটের। তখন একপক্ষ আরেকপক্ষকে বলেন আঁতেল, আরেকপক্ষ অন্যপক্ষকে বলেন ইতর। লেগে যা লেগে যা নারদ নারদ। অনেক কথা হল। এবার উপসংহার টানি, utopian ঢঙে। লোকে যা বলে বলুক। স্বপ্ন না দেখব তো এতগুলো স্নায়ুকোষ মাথায় পুষছি কি কত্তে? ধ্রুপদী ভাবে বলি - 
মাঝামাঝি অবস্থানটার জন্য বিদ্যালয়গুলোর ভাবনা-চিন্তা বদলানোর আশু প্রয়োজন। ভালো সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচিত্র, শিল্প ইত্যাদিকে মান্যতা দেওয়া, তার সমঝদার করে গড়ে তোলার দায়িত্ব যদি অল্প বয়েস থেকে দেওয়া যায়, তবে পরীক্ষা পাসের থেকেও বড় একটা লক্ষ্য পাওয়া যায়। প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে কাজ মানুষ করে সে নিতান্ত প্রাণের টানে করে, আনন্দ থেকে করে। যে আনন্দ আরেক আনন্দের উৎস খুলে দেয় সে সৃষ্টির আনন্দ। উৎপাদন আর সৃষ্টির মূল প্রভেদটাই সেইখানে। একটার পরিণামে আনন্দ, আর আরেকটার সূচনা থেকেই আনন্দ। সেই আনন্দ থেকে জন্মায় শুদ্ধ জ্ঞান। যাতে সে নিজেকে নিজের মধ্যে আবিষ্কার করে। বেঁচে থাকার একটা কারণ পায়। দুর্ভাগ্য আমরা যে অসামান্য সম্পদ থেকে আমাদের ছাত্রছাত্রীদের বঞ্চিত করে রেখেছি বহুকাল। সেই কর্ষণের দিন এসে গেছে। তবে আবার মঙ্গলশঙ্খ আর আর মঙ্গলঘটের খোঁজ হবে। আর খুঁজতে বেরোবে আমাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম আগের প্রজন্মের হাত ধরে।


 

470
Thu, 01/26/2017 - 08:30

সন্ধ্যাবেলা, ২৫ শে জানুয়ারী। একজন বয়স্ক ভদ্রলোক দু’হাতে দুটো ভারী ব্যাগ, নিজের সমস্ত জীবনীশক্তিটুকুকে এক করে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছেন। মুখে শ্রমের চিহ্ন আছে, বিষণ্ণতা নেই। গুণগুণ করে গাইছেন, “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে”। তাকে পাশ কাটিয়ে সাইকেলে আরেক মধ্যবয়সী অবাঙালী একজন “ম্যায় চরণ কি দাসী” গাইতে গাইতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন। আরেকটু এগোলাম। মাইকে বাজছে ‘বন্দে মাতরম’, এ আর রহমানের সুর।
প্রতিটা টুকরো ছবি আমার ভারতবর্ষ। কোন বৌদ্ধিক ধারণা নয়, কোন ঐতিহাসিক স্মৃতির দলিল নয়, জীবন্ত প্রাণবন্ত ভারতবর্ষ। আরো প্রাচীনকালে উপনিষদ ঘোষণা করেছিলেন, সম্বোধন করেছিলেন, “শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”... শোন জগৎবাসী, হে অমৃতের পুত্রগণ, তোমার অন্তরে শায়িত সেই পরমপুরুষকে না জানলে সবটাই ব্যর্থ। ভারতবর্ষ জগৎবাসীকে যে কথাটা শুনিয়েছিল, বা যুগে যুগে শুনিয়েছে সেটা এইভাবে মানবজীবনকে সার্থক করার সাধনার ডাক দিয়ে। আরো সঞ্চয়, আরোও সঞ্চয় – এ পথ কোনদিনই ভারতবর্ষে অন্তরাত্মার ভাষা হতে পারেনি। সে নিজের আত্মার মধ্যে জগতাত্মাকে অনুভব করবার প্রয়াস পেয়েছে, দেশের সাধনাকে জগৎ সাধনা করে দেখেছে। তাই মহাত্মা গান্ধীর মধ্যে যে আদর্শ সারা জগৎ দেখল, মহাত্মা তাকে নিজে বললেন, “এ আদর্শ হিমালয়ের মত প্রাচীন।” তা ঠিক এ আদর্শ নিজের ভিতরে সবার সাথে যুক্ত হওয়ার সূত্রটাকে আবিস্কার করার আদর্শ তথা সাধনা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, মানুষ এক কোথায়? সেন্সাস রিপোর্টে? না, মৈত্রীতে।
প্রতিদিনের জীবন যাপনে মলিনতা দীনতা নেই একথা বলা হয়নি কখোনো। আছে। আকরিক থেকে সোনাকে পৃথক করাকে জ্ঞান বলা হয়েছে। আকরিককে শুধুমাত্র শিলা হিসাবে জানাকে অজ্ঞানতা বলা হয়েছে। আকরিকের থেকে সোনা বার করার পদ্ধতিকে বলা হয়েছে সাধনা। যদি বলি এটি কোন বিশেষ ধর্মমত তবে ভয়ঙ্কর মিথ্যে কথা বলা হয়। মানুষের বাইরে যেমন একটা বিজ্ঞান আছে, অর্থাৎ কিছু সূত্র আছে, তেমনই মানুষের নিজের সত্তার একটা সূত্র আছে, একটা বিশ্বজনীন নিয়ম আছে। সে নিয়ম হল – প্রকাশের তাগিদ, সব তুচ্ছতা দীনতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার একটা প্রচেষ্টা। যা সে জন্মসূত্রে মানুষ পায়। যদি না পেত তবে অগ্রগতি, অভিব্যক্তি, উন্নতি শব্দগুলো নিতান্তই প্রহসন হত। মহত্ত্ব বস্তুটা সঠিক যে কি মানুষ জানে না। তার নানা রূপ কল্পনা করেছে যুগে যুগে। কখনো ঈশ্বর, কখোনো ধর্ম, কখোনো নীতি, কখনো বা মত (-ism) ইত্যাদি নানারূপে সে মহত্বর দিকে ইঙ্গিত করেছে। সে বারবার বলেছে আমি যা আমি তাতে সন্তুষ্ট নই। আমাকে এগোতে হবে। আরো বড় হতে হবে। আরো অর্থপূর্ণ হতে হবে। সার্থক শব্দটা অর্থকে স্বীকার করেই তৈরী হয়েছে। যার বিপরীত শব্দ নিরর্থক। 
তবে এ কোন অর্থ? মানুষের জীবনের কি তবে কোন নির্দিষ্ট অর্থ আছে? ‘নির্দিষ্ট’ শব্দটার সংকীর্ণ অর্থে নেই। কিন্তু ‘নির্দিষ্ট’ শব্দকে নির্দেশসূচক শব্দ বললে আছে। সে ক্রমশ আরো এগোতে চায়, উন্নত হতে চায়। মহত্বকে লাভ করা যায় না। দীনতার বিরুদ্ধে, ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করাকেই মহত্ত্ব বলে। তাই এক অর্থে খ্রীষ্ট থেকে মহাত্মা আপাত দৃষ্টিতে ব্যর্থ হলেও চিরকালীন দৃষ্টিতে ব্যর্থ নয়। তাই মহাত্মার দেশমুক্তির পথ আজ বিশ্বের বহু অগ্রণী মানুষের আদর্শ, অন্যতম অবলম্বন।
আজ প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রজা অর্থে যদি মানবতন্ত্রের দিকে তাকাই তবে বোঝা যায় এ গণশক্তির মূল উৎসটা কোথায়। সেই বিশ্বব্যাপী সঙ্গীত লহরীতে যোগ দেওয়ার জন্য তার চিত্ত আকুল। আমি মানি কি না মানি, আত্মত্যাগের যে আনন্দ, স্বার্থত্যাগের যে সার্থকতা, যে আনন্দ সে আনন্দই মানুষকে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও মহৎ কাজে সাহস জুগিয়েছে, এবং ভবিষ্যতেও যোগাবে। মহৎ কাজ বলতে শুধু বড় কাজ বলতে চাইছি না। সংসারে যে মানুষটা উদয়-অস্ত পরিশ্রম করে একটা পরিবার প্রতিপালন করছেন। নীরবে নিজের দায়িত্বটুকু সমাধা করে, নিঃশব্দে বিদায় নিচ্ছেন, সেও কম বড় কাজ নয়। নানা শোকে-দুঃখে নিজের কর্তব্যে এমন অবিচল থাকার ক্ষমতা মানুষ কোথায় পেত, যদি না নিজের ভিতর সে সর্বসহা অস্তিত্বে বিশ্রাম পেত? 
চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য হয় না – একথাটা সম্পূর্ণ অর্থেই বাণী। যা শুধু পথই দেখায় না, বিপদসঙ্কুল ঘূর্ণাবর্ত থেকে দেহকে না আত্মাকে রক্ষা করে। অতীন্দ্রিয় আত্মা নয়, আত্মসন্মানকে রক্ষা করে। একমাত্র যে সন্মান মানুষ নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে করতে পারে, যা তার জীবনে পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ দান, আশীর্বাদ।
471
Sat, 01/21/2017 - 10:00

"অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা"
আমি 'শয়তান' শব্দটায় আস্থা রাখি না। তবে আবর্জনা আর বিপথ বা কুপথের অভিজ্ঞতা রাখি। সাথে বিভ্রান্তিকর পথেরও। আগে ভাবতাম, 'কর্মহীনতা' আর 'অলসতা' হয়তো সমার্থক দুটো শব্দ। তা তো নয় দেখছি। মনের অলসতা আর বাইরের কাজের ধারাবাহিকতা অনায়াসে একসাথে সহাবস্থান করতেই পারে। বিশেষ করে কাজটা যখন ধারাবাহিকভাবে একই ধারার হয়ে ওঠে। কয়েকদিন আগে একটা বিদেশী সংবাদপত্রে পড়ছিলাম, অতিব্যস্ততা মানুষকে ক্রমশঃ মানসিক অনুর্বরতার দিকে নিয়ে যায়। ক্রমশঃ তা তার সৃষ্টিশীলতা তথা তার উদ্যমকে কমাতে থাকে। ফলঃস্বরূপ কোনো আকস্মিক পরিবর্তনকে নিতে না পেরে মুখ থুবড়ে পড়ে। 
এই কথাগুলো কিছু নতুন না অবশ্য। সক্রেটিসের বহু পুরোনো উক্তি, 'অতিব্যস্ত জীবনের অনুর্বরতা সম্বন্ধে নিজেকে সচেতন রেখো।' 
যে কথাটা বলতে চাই, অলস চিন্তায় কি সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মহৎ কাজের জন্য অবসর প্রয়োজন, আলস্য না।' অবসর অর্থে কখনোই অতিরিক্ত সময় নয়। অবসর অর্থে 'তাড়া নেই' এমন সময়, অথবা একান্ত আমার নিজের জন্য সময়। সেই অবসরকে হয় আলস্যে কিম্বা মহতের সৃষ্টিতে ব্যয় করা যেতে পারে। এখানে মহৎ অর্থে আমি ভালো বোঝাতে চাইছি। তবে ভালো শব্দটার অর্থ অনেকটা ন্যাকা বা ডিপ্লোম্যাটিক হয়ে দাঁড়ায় বলে বিপদ। আর মহৎ শব্দে মহাপুরুষোচিত হয়ে দাঁড়ালে তো আরো বিপদ। মহৎ অর্থে যে সাহিত্যে মানুষের কথা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ অস্বাস্থ্যকর দৃষ্টিভঙ্গীতে বলেই ইতি টানা হয়নি। ঋত্বিকবাবু বলতেন, 'একটা বদ্ধ ঘরে, অন্ধকারে মানুষ কয়েক ঘন্টা ধরে তোমার কাজ দেখবে। শেষে যেন তারা একটা নঞর্থক মানসিকতা নিয়ে ফিরে না যায়।' তাই 'মেঘে ঢাকা তারা' সিনেমার শেষ দৃশ্যে আবার আরেক নীতার চটি ছিঁড়ে যায়। এমনকি 'যুক্তি তক্কো আর গপ্পো'র শেষ দৃশ্যে মৃত্যুর প্রাক মুহুর্তে ঋত্বিক বলে ওঠেন, 'কিছু একটা করতে হবে তো!'
অলস চিন্তার এ বিশ্বাস কোথায়? সে তো সর্বত্র নঞর্থক, ইন্দ্রিয়পরতার গন্ধে লুব্ধ। সে সাহিত্যে উত্তরণের পথ নেই, আছে ক্রমশঃ নিমজ্জমান হওয়ার চোরাবালি। ওই একটা কথা আছে না, 'যদি বা রুগী ছিল বসে, বদ্যি তারে শোয়ালে এসে' - এ খানিকটা সেরকম। লেখার ক্ষেত্রে 'Tone' আর 'Mood' বলে দুটো কথা আছে। প্রথমটা লেখক যে দৃষ্টিভঙ্গী বা শৈলী বা অনুভূতি নিয়ে লিখছেন। আর Mood -এর ক্ষেত্রে যে অনুভূতিটা পাঠকের মনে জাগছে। অবশ্যই প্রথমটার উপর দ্বিতীয়টা অনেকাংশে নির্ভর করছে। 
এই Tone যদি খুব সঙ্কীর্ণ হয়, তবে দেখাটা আর দেখানোটা অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। ছোট জায়গায় আলোড়ন তোলা অনেক সুবিধা যদিও, তবে তাতে সামগ্রিকতার সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা মুশকিল হয়ে পড়ে। আর ক্ষুদ্রতার লজ্জাটা এখানেই সর্বাধিক যে, সে বড়কে শুধু অস্বীকার করেই ক্ষান্ত হয় তাই নয়, বড়োকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে তাকে ভয়ংকর রকম অপদস্থ করতে পেরেছে এমন একটা আত্মপ্রসাদও লাভ করে। তাতে দল তৈরী হয়, দলের দলপতি তিনিই নির্বাচিত হন যিনি তার নিজের দলের কাউকে কড়া সমালোচনা কখনোই করেন না। কারণ এক, ছোটো শরীরে অত সহ্য হয় না। যার আপন মহত্ব ক্ষুদ্র পরিসরেই, সে যে কোনো সমালোচনায় অস্তিত্ব সংকটে ভোগে। হিংস্র হয়ে ওঠে, ক্ষিপ্র হয়ে ওঠে। সমালোচক তথা নিজেকেও রাগের বশে আঁচড়ে খিমচে একাকার শুধু করে না, অসম্ভব রকমের অভিমানে নিজের সমস্ত কিছুকেই অনর্থক বোধ করতে শুরু করে মনে মনে। যেন তার সমস্ত সৃষ্টির দায় ছিল পাঠকের মনোরঞ্জনের, তার নিজের প্রকাশিত হওয়ার কোনো সুখ বা আনন্দ ছিল না। এক নিমেষেই সব ব্যর্থ। 
তাই মহত্বের উপর, উদারতার উপর আস্থাহীনতায় কিছুদিনের জন্য কিছু দুর্বলচিত্ত মানুষের হাততালি পাওয়া গেলেও দিনের শেষে নিজের কাছে নিজেকে চূড়ান্ত দীন হয়েই ফিরতে হয়। মনে হয় ভিতরে যেন সে কোথাও একটা হেরে গেল। এটাই আমাদের মানুষ হওয়ার অদ্ভুত Irony যে সে বিশ্বের সকলের কাছে দীনবেশে থাকলেও নিজের কাছে সে কিছুতেই নিজেকে হীন দেখতে পারে না। তাই বৈষ্ণবের আত্মদীনতা কোনোদিনই হীনতার অনুভব নয়। তা হলে আর যা হোক, অমন অমর বৈষ্ণবসাহিত্য সৃষ্টি হত না। হীনতা মৃত্যুতুল্য, তা আপনাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখে কই?
এমনকি যিনি অত্যন্ত নঞর্থক কোনো লেখাও লেখেন, তখনও তার আত্মকেন্দ্রে কোথাও একটা বিশ্বাস জন্মায় তিনি একটা মহৎ কাজ করছেন। অর্থাৎ নিজের কাছে হীনতার প্রশ্নই আসছে না। তবে তিনি স্বার্থপরের মত তার এই গর্বিত অনুভূতিটাকে ব্যক্তিগত মনে করেন। অত্যন্ত Cynic ব্যক্তিও নিজের Cynicism নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। কিন্তু এটা ভাবার প্রয়োজন বোধ করেন না যে কেন এই আত্ম-সার্থকতার অনুভূতিটার মধ্যে স্বপ্রতিষ্ঠিত হতে না পারলে নিজেকে ব্যর্থ অনুভূত হয়।
তাই বলি, স্বার্থপর নিজের মহত্বের অনুভবকে ব্যক্তিগত অনুভব করে রাখতে চান আর উদার মানুষটা প্রত্যেক মানুষকে সেই মহত্বের অনুভূতির স্বাদ পাওয়াতে চান। তিনি বোঝেন, শুধু ক্ষুদ্র সময়ের গণ্ডী আর কালের গণ্ডীতে সত্যকে পাওয়া যায় না। সত্যের ছায়া অথবা আভাস মাত্র পাওয়া যায়। ছায়ার সীমা আছে, তা বাধা আর ক্ষেত্রর উপর নির্ভর করে। আলোর সীমা নেই। তার প্রসারিত আর প্রকাশিত হওয়াতেই আনন্দ। 
তাই মহৎ সাহিত্যকে তথা যে কোনো সৃষ্টিকে শুধু নিজের সময়কাল বা নিজের দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হয় না। চিরকালের ধারার সাথে আর মানবতন্ত্রের ধারার সাথে একটা সামঞ্জস্য পেতেই হয়। না হলে যতক্ষণ আঁচ ততক্ষণ তাপ।
এই গেল অলসতার দিক। এর বিপরীত যে দিক, অর্থাৎ অতিক্রিয়াশীলতা তা শুধু অল্প পরিসরেই সম্ভব। ছোটঘরে আওয়াজ যত বেশি হয়, মাঠে কি আর হয়? সমুদ্রের ধারে তো আরো অসম্ভব! আর আমরা এই মহামানবের সাগরতীরের বিলাসবহুল নিবাসগুলোতে দিন কাটাতে কাটাতে তো ভুলেই যাই মাঝে মাঝে যে, ওই সমুদ্রতীরটায় অবশেষে দাঁড়াতেই হবে। হেসে-কেঁদে একটা রফা করতেই হবে। অসৎ যা কিছু সৃষ্টি তা একদিন মুখব্যদান করে এই সাগরের তীরে পড়ে থাকবে। সব রঙ, নক্সা ওর গা থেকে উঠে যাবে। আমি থাকব না সেদিন, কিন্তু আমার সৃষ্টির লজ্জাটা থেকে যাবে। ফাঁকিটা ধরা পড়ে যাবে, আর চারদিকে হাসির রোল উঠবে।
472
Fri, 01/13/2017 - 19:00


মৃত্যু আর প্রেম - সুতোর মত পার্থক্য দুটোর রহস্যময়তায়। ভীষণ আগ্রহ আমাদের - কেমন করে হল? কিভাবে হল? কি করে হয়? কিরকম লাগে সেই সময়টায়? মৃত্যুতে ভয় মিশ্রিত কৌতুহল, উত্তেজনা। আর প্রেমে উত্তেজনা মিশ্রিত উদ্বেগ। 
এই দুটো রহস্যই চিরকাল শান্ত জীবনযাত্রায় কালবৈশাখী এনেছে, ভবিষ্যতেও আনবে। কি অসীম রহস্য! ভুলে থাকবে, সে যো নেই। এড়িয়ে যাবে যে, সে পথ নেই। মুখোমুখি হবে যে, সে সাহস আছে কি? ইতিহাসের কত অধ্যায় ঘুরে দাঁড়াত অন্যখাতে এই দুই বালিঝড়ের অস্তিত্ব না থাকলে জীবনে।

    এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর
     বাহিরে বাঁশির রবে ছেড়ে যায় ঘর।।
       ভালোবাসে সুখেদুখে ব্যাথা সহে হাসিমুখে
          মরণেরে করে চিরজীবননির্ভর।।

কে বাজায় এমন বাঁশি কবি? যে মরণের উপর নির্ভর করেই জীবনযাপন করতে হয়? এত দুঃখ চেয়েছিল কেন মানুষ? এমন দাবানলের মত ভালোবাসা কেন কবি? যে সব পুড়িয়ে ছারখার করেও আশা মেটে না তার?

    তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন
   আমায় হৃদয় পাগল-হেন
তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?

   যদি প্রেম দিলে না প্রাণে

কি প্রেম চাইল কবি মানুষ? সংসার বাঁধার জন্য এ প্রেমের আকুতি তো না কবি! এ যে পুড়ে মরার জন্য আকুল তৃষ্ণা। এ প্রেম যে ঈশ্বরকেও রেহাই দিল না কবি

     তুমি রইবে না ওই রথে
       নামবে ধুলাপথে - 
  যুগ-যুগান্ত আমার সাথে চলবে হেঁটে হেঁটে

ঈশ্বর নেমেছেন রাস্তায়। এত অসহ্য যন্ত্রণা না হলে বয়ে চলেছি কিসের জোরে কবি?

তুমি সাধ করে, নাথ, ধরা দিয়ে আমারও রঙ বক্ষে নিয়ো
এই হৃৎকমলের রাঙা রেণু রাঙাবে ওই উত্তরীয়।।

রাস্তা শেষ হতে চায়, শ্বাস ফুরিয়ে আসতে চায়, তৃষ্ণা আর মিটতে চায় না। সন্ন্যাসী বারবার তিরস্কার করেন। নীতিবাগীশ কলঙ্কের ভয় দেখান। মন্দিরের ভগবান মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলেন, - তুই অশুচি, ফিরে যা! অন্তরের ভগবান দরজা খুলে বলেন, ভিতরে আয়। মৃত্যুকে বরণ কর। মরণ মানে শ্বাসের ফুরিয়ে যাওয়া না। মরণ মানে শ্বাসরহিত হয়েও বাঁচার অভ্যাস। বাউল বুঝল। বলল, জ্যান্তে মরো... মরো... মরো... মরে গিয়ে বাঁচো। 
সব লাজলজ্জা ত্যাগ করে দাঁড়াই এসে জয়দেবের সামনে। বলি, গাও জয়দেব। সংসার আজ বড় আলুনি আমার কাছে। ওরা বাঁশি শোনেনি জয়দেব। ওদের ঘুমাতে দাও। আমার ঘুম যে ছুটেছে জয়দেব। তুমি বলেছো প্রেম কি? প্রেম গরলামৃত। অমৃতে গরল মিশেছে আজ আমার জয়দেব। পৃথিবীর কোনো ধর্ম, কোনো নীতি আজ আমায় শান্তি দেবে না জয়দেব! ওরা ভয়ও দেখাতে পারে না আজ আমায়! তুমি এসো। আলিঙ্গন করো আমায়। সম্পূর্ণ উলঙ্গ না হলে তো তুমি আলিঙ্গন করো না বন্ধু। আজ আমি সম্পূর্ণ উলঙ্গ জয়দেব। 
তুমি গেয়েছো গীতগোবিন্দে যেন অরসিকের সামনে তোমায় গাইতে না হয়। সে সব চাইতে বড় অভিশাপ কবি জীবনে। কবি আমিও চাই না অরসিকের মধ্যে জীবনধারণ আর। আমায় আজ নিয়ে চলো নিভৃতে। সেখানে শুধু তুমি আর আমি থাকি। পাশে বসুক মরণ আর প্রেম, দুই সখীর মত।
সে কি এলো জয়দেব? তার পায়ের নূপুর কি পেলে শুনতে? তার মাথার শিখীপাখায় কি চাঁদের কিরণ লুটিয়ে পড়ে তার সারা মুখ শীতল চুম্বনে ভরিয়ে তুলছে? তার গলার মালার ফুলের থেকে ভ্রমরের গুঞ্জন কি কানে এসে পৌঁছেছে তোমার? কে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে? তুমি জয়দেব না রবীন্দ্রনাথ? কি গাইছ তুমি?

  রতিসুখসারে গতমভিসারে মদনমনোহরবেশম্‌ ?!

 না গাইলে?

  মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে?

কে তুমি? রবীন্দ্রনাথ না জয়দেব? যেই হও, এসো, আমায় বন্ধু বলো, হাতদুটো দাও... আহা... চন্দনের গন্ধে ভরে যাচ্ছে আমার মনপ্রাণ বন্ধু... কি অসহ্য যন্ত্রণা সখা!... কি আনন্দ!... এ সংসারকে চুপ করতে বলো দু'দণ্ড... বলো না গো... সে কি এলো... এলো... এলো?

[আজ কেঁদুলিতে চলছে জয়দেবের মেলা]

(ছবি - আন্তরজালতন্ত্র থেকে)
 

473
Thu, 01/12/2017 - 10:25


বিবেকানন্দের ভারতবর্ষের সাথে আমার ভারতবর্ষের মিল কোথায়? তাঁর আত্মজ্ঞান, নিঃস্বার্থপরতা, ধ্যানপরায়ণতা, সৎ-সাহসিকতা, ধর্মে যুক্তিপরায়ণ হওয়ার চেষ্টা, সর্বোপরি দেশের প্রতি সর্বগ্রাসী ভালোবাসা - এ সব তো মিউজিয়ামে দেখতে যাওয়ার বস্তু আজ। আর বাকি যতটুকু বিবেকানন্দ পড়ে থাকে সে তো ‘ব্র্যাণ্ড বিবেকানন্দ’ - রাজনীতির, ক্লাবনীতির, মঠ-মিশন নীতির ইত্যাদি। প্রাণ কই? রামকৃষ্ণ মিশন থেকে যে পত্রিকাগুলো বেরোয়, তাতে গত বারো বছরের মধ্যে নতুন চিন্তাধারা কই? গত দশ বছর আগের ‘উদ্‌বোধন’ পত্রিকার সাথে আজকের পত্রিকার কোনো পার্থক্যই করতে পারি না, কেবল মলাট আর নামগুলো পরিবর্তন ছাড়া। নতুন ধরণের কালোপযোগী চিন্তা-ভাবনা কই, যা যুব সমাজকে আকর্ষণ করবে? বিবেকানন্দ, তাঁর গুরু ও গুরু মা যে খুব ভালো মানুষ ছিলেন সে নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কিন্তু তাঁরা যে অসম্ভব সাহসী ছিলেন, এই কথাটা যেন আমরা মনে রাখতে চাইছি না। নতুন ধরণের চিন্তা, সমালোচনার ধার দিয়ে হাঁটার শক্তি বা সাহস যেন তাঁদের উত্তরসূরী বলে দাবিদারদের লুপ্ত আজ। সব অবশেষে সেই – Holier than thou কৌটোতে ঢুকে পড়েছে। 
বিবেকানন্দ তথা শ্রীঅরবিন্দের উচ্চারণে 'শ্রদ্ধা' শব্দটা বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। ওই শব্দটাই যেন তাঁদের দর্শনের, বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর। এমনকি দু’জনেই এই শব্দটাকে ইংরাজীতে অনুবাদ করার মত কোনো শব্দও স্বীকার করেননি। বরং ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চেয়েছেন 'শ্রদ্ধা' বলতে আমরা কি বুঝি। উপনিষদে শ্রদ্ধাকে আহ্বান করার প্রার্থনা আছে। সেখানে ঋষি শ্রদ্ধাকে প্রভাতে, দ্বিপ্রহরে, সন্ধ্যায় নিজ জীবনে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানাচ্ছেন। এই ‘শ্রদ্ধা’ কি ফাঁকিতে পাওয়ার বস্তু? কয়েকটা ভাষণ, কয়েকটা প্রস্তরমূর্তি (রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতেন পাথরের পিণ্ডিদান) ইত্যাদি দিয়ে সে রিক্ততাকে ঢাকা সম্ভব? বিবেকানন্দ এক জায়গায় বলছেন, 'আমি ভারতকে যুক্তিবাদী করতে চাই'। কিন্তু তিনি চাইলে কি হবে, আমরা কি চাই? ‘যুক্তি’ আর ‘শ্রদ্ধা’ কি দুটো স্ববিরোধী শব্দ? না। ঠিক সেই কারণে একজন চিকিৎসককে একটা শপথ বাক্য উচ্চারণ করে চিকিৎসার জগতে পদার্পণ করতে হয়। দেশনেতাকে একটা শপথ বাক্য উচ্চারণ করে দেশসেবার ভার নিজের হাতে তুলে নিতে হয়। এই শপথটাই হল শ্রদ্ধা। আমাদের জীবনের হাল। আমাদের শাস্ত্র বলেন, তিনি তেমনই হবেন যেমন তাঁর শ্রদ্ধা। 
বিবেকানন্দ ও তাঁর ভাবশিষ্য নেতাজী বারবার উল্লেখ করেছেন, তোমাদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ কমছে, একটা সবকিছুকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভাব এসে পড়েছে... এটা বিপজ্জনক। 
এটা যে বিপজ্জনক সেইটাই যে আমাদের বোধে নেই, সেটা যে আরো কতবড় বিপজ্জনক তা বোধ করবে কে? শ্রদ্ধা কোনো অতীন্দ্রিয় জগতের জন্যে রক্ষিত বিশেষ এক প্রকার বর্ম না। শ্রদ্ধা আমার মানুষ হিসাবে নিজেকে দেখার মূল্যায়ণ। একজন অতিশিক্ষিত মানুষ যে কারণে অনায়াসে অসৎ হয়ে যায়, আর একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষ সততার মাটি আঁকড়ে থাকেন - তার কারণ এই শ্রদ্ধার তারতম্যতা। কোনো স্বর্গবাসী দেবতার প্রতি না। নিজের প্রতি। আত্মশ্রদ্ধা যার আছে তার হাত, তার পা, তার চোখ, সর্বোপরি তার মন কোনোদিন অবিবেকের রাস্তা মাড়ায় না। সে মহাপুরুষ হবে বলে না, সে নিজেকে অত ছোটো দেখতে পারে না বলে। রবীন্দ্রনাথ তাই যখন বলেন, 'সে পথে মানুষ অনেক সঞ্চয় করেছে, জমিয়েছে... তবু বলি সে পথ তোমার না হউক...' তখন এ আর্তি আমার আত্মশ্রদ্ধার কাছে তাঁর; আমার ভিতরের স্বার্থলোভী হিসেবী ছোটো মানুষটার কাছে না, যে শ্রদ্ধাবোধটাকে কুকুরের মত শুঁকে দেখে ও দিয়ে টাকা হয় কিনা? 
বিবেকানন্দের তাই কোনো ঈশ্বর ছিল না মানুষ ছাড়া। দেশকে খুঁজতে গিয়ে পেয়েছিলেন ভারতাত্মাকে। ভারতাত্মার মধ্যে পেয়েছিলেন অখিল মানবাত্মাকে। মহামানবের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন আমাদের মত অজস্র লক্ষকোটি সাধারণ মানুষের মধ্যে। বারবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন আমার ভিতরের আমার মহত্ত্বকে আমার পূর্ণতার অনুভবকে। তাকে জাগাবার উপায় স্বরূপ বলে গেলেন - ধর্ম আর শিক্ষাকে। যে ধর্মের প্রথম আর শেষ কথা মানবাত্মার মহত্ত্ব। আর যে শিক্ষার মূল সুর চিত্তের প্রসার। বারবার বুঝিয়ে গেলেন, মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে বসে ঈশ্বরকে অস্বীকার করে না, নিজেকে অস্বীকার করে। তাই বলে গেলেন, এ যুগে যে নিজেকে বিশ্বাস করে না সেই নাস্তিক। নিজেকে বিশ্বাস অর্থে নিজের মহত্ত্বে বিশ্বাস। “তিনি বলে গেলেন আমায়, নিজেরে নিন্দা কোরো না... সে যে পাপ!” রবীন্দ্রনাথ গাইলেন চণ্ডালিকায়। 
আজ তাই মনে হয় সেই প্রাচীন যুগের চিরকালীন প্রার্থনাকে নিজের চিত্তে নিভৃতে জাগিয়ে তুলি -
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে প্রভাতে এসো
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে দ্বিপ্রহরে এসো
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে সন্ধ্যায় এসো
হে শ্রদ্ধা, তুমি আমার চিত্তে নিশীথে এসো


(ছবিঃ ইন্টারনেট)

474
Sun, 12/25/2016 - 13:56
      আজ যে মহাপুরুষের জন্মদিন তিনি একটা খুব বড় কথা বলেছেন, নিজের ভিতর ঈশ্বরের রাজ্য অন্বেষণ করো, বাকি সব কিছু তোমায় আপনা থেকেই আসবে। আবার বলছেন সে পথের দ্বার অত্যন্ত শীর্ণ। আবার বলছেন এক শুঁড়িখানায় দাঁড়িয়ে, একটা শিশুকে টেবিলের উপর দাঁড় করিয়ে, যতক্ষণ না এই শিশুটার মত সরল হতে পারছ সে রাজ্য থেকে তুমি অনেক দূরে।  এডওয়ার্ড সাহেব বুদ্ধের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলছেন, আপনারা যদি মনের করেন যীশু আপনাদের নিজস্ব ধর্ম আর বুদ্ধ নন কারণ তিনি পূর্বের, তবে ভুল করছেন, আপনাদের ধর্মের সূত্রপাতও সেই পূর্ব দিক থেকেই শুরু হয়েছিল।  পাশ্চাত্য দর্শনে একদিন নীতি, সমাজ, কর্তব্য ইত্যাদি নিয়ে প্রবল আলোচনা হয়েছিল। বেশ বড় একটা যুগ ছিল সেটা। ক্রমশঃ আরেকটা মতবাদ বা দৃষ্টিভঙ্গী দেখা দিল পাশ্চাত্য সাহিত্য তথা দর্শনে – নঞর্থক বাদ। সে জটিল দর্শনের মূলে কোথাও একটা বিষাদের সুর আসে। দস্তইয়েভেস্কি (যদিও রাশিয়ান), কাফকা, জিদে, সাঁত্রে, নিৎজে ইত্যাদিদের লেখায় কোথাও একটা বিষাদের সুর। সবই আছে তবে আমরা যেভাবে সবকিছুকে নিজেদের মত অর্থযুক্ত ভাবি ঠিক সেভাবে তারা অর্থযুক্ত নয় – এই বোধটা চূড়ান্ত হতে শুরু করে লেখায়। কঠোর বাস্তববাদ, অস্তিত্ত্ববাদ, ইহলোকবাদ ইত্যাদি নানান দর্শনে একটা ‘নেই নেই’ ভাব, একটা শূন্যতার দিকে ইঙ্গিত। সব শূন্য জেনে কোথাও একটা বিশ্রাম নেওয়ার কথা। যদিও এ আপামর পাশ্চাত্যবাসীর মনোদর্শন না। তাহলে তারা এত কর্মমুখী হয়ে উঠতে পারত না কখনোই। এ তাদের এক প্রকার চিন্তার রাজ্য। ভাবনার ক্ষেত্র। এই বিষাদ জীবনের গভীরে যে নেই তা নয়। আছে বলেই তাকে ঢাকতে এত উচ্ছ্বাস বাইরে। এত উত্তেজনা এত মাদকতা। আজ যা আমাদের সমাজের উপর ছেয়ে আসছে।  আমাদের দেশে কি তবে এই নঞর্থক দর্শন ছিল না? দর্শনের কথা থাক, জীবনের উপর এ রকম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল না? ছিল। আমরাও ভেবেছি শূন্যতার কথা, জগতলীলার অন্তঃসার শূন্যতার কথা, জীবনের ক্ষণিক অস্তিত্বের কথা। বিষাদ এসেছে। তবে বিষাদেই থেমে থাকতে চাইনি। তার জায়গায় এসেছে আরেকটা শব্দ – বৈরাগ্য। ‘অর্থহীন সব কিছু’ এই শেষ কথা না, এর পরের কথাটাও বুঝতে হবে। আরো এগোতে হবে। ঠাকুর রামকৃষ্ণ, রামপ্রাসাদ সেনের একটা গান উল্লেখ করে বলছেন, অনুভবের আগে এ সংসার ধোকার টাটি, অনুভবের পর এই সংসারই মজার কুটি। রামকৃষ্ণদেব আরো বলছেন, এগিয়ে পড়ো, এগিয়ে পড়ো, এগিয়ে পড়ো। বিশ্ব সংসারে ছলনার জাল নেই তা তো নয়, কিন্তু সে ছলনাকে বোঝার মত বোধও তোমার ভিতর আছে, ঠকাতে চাইলেই ঠকবে কেন? বোধের সেই ক্ষমতাই তোমায় দেবে তোমার বৈরাগ্য - ‘প্রবৃত্তি নিবৃত্তি জায়া, প্রবৃত্তিরে সঙ্গে লবি/ ওরে বিবেক নামে তারই বেটা তত্ত্বকথা তায় শুধাবি’। একটু রাশ টানো না গো, দেখো না একবার ভিতরের চোখদুটো মেলে, সব বুঝতে পারবে। কোথাও বনে বাঁদাড়ে ঘুরে মরতে হবে না, কোনো গুহায় গিয়ে গিয়ে ছাইভস্ম মেখে বসতে হবে না, শুধু অন্তঃকরণটা শুদ্ধ করো। কাঁদো, কাঁদো। অবিশ্বাসী কাঁদে না। জ্বলে মরে। সে জানে না কাঁদতে কাঁদতেই বিশ্বাস জন্মায়। কাঁদতে কাঁদতেই ছুঁচের উপরের কাদা ধুয়ে যায় আর তখনই চুম্বক তাকে টানে। ওগো শুধু এই কথাটা বলব বলেই আমার আসা, মা আমাকে পাঠিয়েছেন শুধু এই কথাটুকু তোমাদের জানাতে হবে বলে, তোমাদের একজন মা আছেন বোঝাতে, যেমন সেই লোকটা জেরুজেলামে এসেছিল তোমাদের একজন পিতা আছেন বোঝাতে। সেই পিতাই আমার এই মা, সেই মা-ই মহম্মদের আল্লাহ্‌। সেই মা-ই বুদ্ধের বোধস্বরূপ হয়ে পরম বোধ- নির্বাণ। তিনি আরো কত কত কি তিনিই জানেন। তোমার অত না জানলেও চলবে, হ্যাঁ গা এক সের দুধের ঘটিতে কি আর চার সের দুধ ধরে? আর তোমার যদি এক বোতল মদে নেশা হয়ে যায়, তবে শুঁড়িখানায় কত মদ আছে জানার কি দরকার?  এই হল আমাদের রামকৃষ্ণ ঠাকুরের কথা। পৃথিবীতে এতবড় মাপের দার্শনিক এর আগে এসেছিলেন কিনা আমার অন্তত জানা নেই। তিনি বলছেন, তবে মর্কট বৈরাগ্য না, শুষ্ক বৈরাগ্য না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, গাছ ফলের ভারে আপনি নুয়ে পড়ে সেই সত্যকারের নম্রতা। এই হল সত্যকারের বৈরাগ্য। ‘বাহিরের এই ভিক্ষা ভরা থালি এবার যেন নিঃশেষে হয় খালি/ অন্তর মোর গোপনে যায় ভরে প্রভু তোমার দানে তোমার দানে তোমার দানে’  এই হল কথা। এ নিজেকে ছাপিয়ে নিজেকে মেলে ধরার কথা। খুব কঠিন কথা? না কঠিন কথা না, খুব বড় কথা। আকাশের মত কথা। সমুদ্রের মত কথা। জীবনকে ভরিয়ে তোলার কথা। খানদানী চাষা হওয়ার কথা। ‘এমন মানবজমিন রইল পড়ে আবাদ করলে ফলত সোনা’ । বিষাদ না, বৈরাগ্য। পরীক্ষার আগে যেমন সব দিক থেকে মন তুলে নিয়ে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়, সেকি শূন্যতার জন্য? না না না। সে পরীক্ষার ফলের দিকে তাকিয়ে এই কঠোরতাকে স্বীকার করে নেয়, শিক্ষকের কথায় বিশ্বাস করে। ভিতরের জগতের পরীক্ষক আর ছাত্র দুই আমি। নিজেকে ফাঁকি দিলে নিজের ফাঁকি, নিজেকে ভরিয়ে তোলার সাধনায় দীক্ষা নিলে, নিজেই পূর্ণ। আজকে সেই দীক্ষা নেওয়ার দিন।   ছবি - ইন্টারনেট    
475
Fri, 12/23/2016 - 13:30
প্রেমের জ্বলন্ত বহিঃপ্রকাশ আমার যতদূর মনে পড়ে স্কুলের দেওয়ালেই প্রথম দেখি। আমাদের একদম ছোটবেলায় বাড়িতে বাড়িতে টিভির প্রচলন হয়নি। আর টিভিতে দূরদর্শন ছাড়া চ্যানেলও কিছু আসত না। রবিবারের বাংলা সিনেমা দেখার উৎসাহ দেওয়া হত, কিন্তু হিন্দী সিনেমা সেরকমভাবে বারণ না করা হলেও উৎসাহও দেওয়া হত না। অবশ্যই কিছু বিশেষ বিশেষ সিনেমা ছাড়া।  সুতরাং প্রেম শব্দটা অভিধানের বাইরে শুধু ছিল তাই-ই না, একরকম নিষিদ্ধই ছিল বলা চলে গুরুজনদের সামনে। তো স্কুলের অমুক নামের পাশে তমুকের নাম যোগচিহ্ন দিয়ে লেখা থাকত। ক্লাসরুমে, প্র্যাক্টিকাল রুমে, বাথরুমের দেওয়ালে; তার সাথে নানান আলোচনা তো আছেই। প্রেমের প্রতিশব্দ তখন শুনেছি বড়জোর ‘লাইন মারা’। ‘ঝাড়ি মারা’ ইত্যাদি শব্দ তখন শুনেছি বলে তো মনে হয় না। ঠিক যেমন 'পটি' শব্দটাও আমি অন্তত ছোটবেলায় কোনো বাঙালী পরিবারে শুনিনি, অন্তত মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে তো নয়ই। এই শব্দগুলো অভিধানে স্থান নিশ্চই পাবে, বা হয় তো ইতিমধ্যে পেয়েও গেছে। সে যাক, যেটা বলছিলাম, ‘প্রেম’ বস্তুটার সাথে পরিচয় সেই স্কুলের দেওয়াল থেকে।  সে সব আলোচনাতে যাচ্ছিও না। যেটা বলতে চাইছি সেটা হল, দিন দিন আমার একটা জিনিস গুলিয়ে যাচ্ছে, প্রেম কি ভদ্রতার বিরোধী শব্দ, না পরিপূরক, না অন্যকিছু?  যত চারদিক প্রেমের বহর দেখছি, মনে হয় কোনটা জীবনে বেশি প্রয়োজন - একজন প্রেমিক/প্রেমিকা না একজন ভদ্র বন্ধু? এখন কথা হল ‘ভদ্র’বলতে আমি কি বোঝাতে চাইছি? ‘ভদ্র’ মানে প্রচলিত অর্থে যে ‘ন্যাকা’, ‘ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না’, ‘ভিজে বেড়াল’, ‘মিনমিনে’ ইত্যাদি সমার্থক শব্দ আসে সে অর্থে ভদ্র বলতে চাইছি না। ‘ভদ্র’ অর্থে অভিধান অনুযায়ী যে শব্দগুলো আসে, যেমন ‘শিষ্টাচারসম্পন্ন’, ‘সাধু’ (গেরুয়াধারী না, বদ মতলবরহিত), ‘সজ্জন’ ইত্যাদি সেই কথা বলছি। যিনি, ইংরাজীতে ‘Gentle’ বলতে যা বোঝায় সেরকম, অর্থাৎ ‘Mild and kind in nature or character’.  তো সে অর্থে কাকে আমার বেশি প্রয়োজন জীবনে? বা কোনটা বেশি দরকার - প্রেম না ভদ্রতা? চারদিক দেখে মনে হয়, আগে ভদ্রতাটাই শিখি, তারপর না হয় প্রেমের দিকে এগোনো যাবে। তবে তো পুরো ব্যাপারটা খুব শুকনো রসকষহীন হয়ে পড়বে না? উত্তরে বলি - ঝগড়া, মারামারি, মান-অভিমান ইত্যাদি রোম্যান্টিকতা সম্পর্কে থাকবে না, তা বলছি না। কিন্তু তারও তো একটা মাত্রা থাকে, নাকি? মাত্রা অর্থে নিজের ভুলটা অনুভব করার ক্ষমতা। মুখ থেকে খারাপ কথা বেরোবে না, কি সব চাইতে কাছের মানুষটার সাথে সব সময় মেপে ব্যবহার করে চলতে হবে - এ কখনো সম্ভব না। কিন্তু ভুলটা হয়ে গেলে তাকে অনুভব করার মত মানসিকতা না থাকলে তো বিপদ! ভুল করবার স্বাধীনতা আর ভুলটা বুঝতে পেরে তাকে শুধরে নেওয়ার অথবা শুধরাতে দেওয়ার উদারতা যদি কোনো সম্পর্কে না থাকে তবে তো তা ধ্বংসের দোরগোড়ায়। হয় সে সম্পর্ক স্থবির হয়ে জীবাশ্ম হবে, নয় তো সংঘর্ষের তাপে পুড়ে নিঃশেষ হবে। এর প্রধান শর্তই হল ধৈর্য্য। আর সেই ধৈর্য্যটাও ততক্ষণই রাখা সম্ভব যতক্ষণ সেই মানুষটার ওপর আমার অনুভূতিটা গভীরভাবে জীবিত থাকে। তার মধ্যে একটা অপরিহার্য্যতার বোধ থাকে। প্রেমের মানুষটা optional হলে সে টান জন্মায় না, এটা compulsory হওয়ার ক্ষেত্র।  তবে ভদ্রতাকে আগে রাখতে চাই কেন? কারণ ঠিকভাবে কলম ধরতে না শিখলে যেমন অক্ষর প্রকাশ সঠিক হয় না, আর অক্ষরের প্রকাশ সঠিক না হলে যেমন ভাব প্রকাশ অস্পষ্ট হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা, ঠিক তেমন, যদি নিজেকে নিজে না সংযত রাখতে শিখি তবে সামান্য ঝড়েই তরী ডোবার সম্ভাবনা প্রবল। তাই বলি প্রেমিক অথবা প্রেমিক না পেলেও জীবনে বড়সড় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম, সজ্জন না পেলে প্রাণ যায়!   আলোচনার ধারা কিঞ্চিৎ অন্যদিকে ঘোরাই। আচ্ছা এমনও তো আছে, আসলে সে সজ্জন না কিন্তু বাইরে তার মত ভদ্র মানুষের জুড়ি মেলা ভার? নেই আবার? বিলক্ষণ আছে। আর তারাই তো আছে। ভদ্র অর্থে এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দুজনে এসে দাঁড়িয়েছে – এক, যে যাচক অর্থাৎ needy আর দুই, যে দুর্বল। এরা সাত চড়ে রা কাটে না, গালমন্দ করে না ইত্যাদি। কিন্তু চাকা ঘুরতে দাও এদের সাথে শয়তানিতে এঁটে ওঠার লোক পাওয়া ভার হবে। কারণ সে তখন ভাববে আমি যখন মাথা নীচু করেছি সেদিন (অর্থাৎ যাকে সেদিন ভদ্রতা বলা হয়েছিল) আজ সে করুক! তবে সে তো গেল এমনি সামাজিক আলোচনা। প্রেমের সম্পর্কে এর গতি কি তবে?  মুখোশধারী ভদ্রতা চিনব কি করে? খুব সোজা নয় যদিও। তবু চেনা যায়। মুখে গালাগাল করলেই সে অভদ্র, আর যে প্যাঁচের পর প্যাঁচ কষে মিষ্টি কথা বলে, বা বাক্যের ফেরে তিলকে তাল করে ভালোবাসার ট্যাক্স চেয়ে ভদ্রতার সাথে চিমটি কাটে…সে হল গিয়ে ভদ্র, এমন হিসাব হলে বিপদ। যে সত্যিকারের ভালোবাসে তার উদ্দেশ্য কোনোদিন অসাধু হতে পারে না। এই তার সব চাইতে বড় পরীক্ষা- তার নিজের কাছে, তার ভালোবাসার মানুষটার কাছেও। সেই ভদ্রতাটুকু, সৌজন্য বোধটুকু হারিয়ে গেলে শুধু রোম্যান্টিকতায় বেশিদিন সম্পর্কের জোড় টেকে না। তাই বলছিলাম, ভদ্রতাটা বা সজ্জন মানুষের সঙ্গ বোধহয় প্রেমের চাইতে বেশি প্রয়োজন বাঁচতে। আমাদের পরিবারগুলোয় আগে তাই বোধহয় এমন জ্বর জ্বর প্রেমের বাতিক ছিল না । অথবা থাকলেও তার উপদ্রব এত বেশি ছিল না। মানুষ বুঝত ওই আঁচে চড়ানো প্রেমের চাইতে সজ্জন ব্যক্তির সাথে জীবনটা অনেক নিশ্চিত। কারণ ওদিকে আঁচ কমে গেলেই সব ঠাণ্ডা হতে শুরু করবে যে!  নতুন শব্দ দিয়ে শুরু করেছিলাম, আবার নতুন শব্দ দিয়েই শেষ করি। শুধু ভদ্র জীবনসঙ্গী নাকি আজকাল ম্যাড়ম্যাড়ে... জলভাত... পান্তাভাত... পানসে... ইত্যাদি লাগছে। চাটনির মত ভালোবাসা চাই, টকঝালমিষ্টির সম্পর্কের দিকে কি ছুটোছুটি... খোঁজাখুঁজি... ওয়াটস অ্যাপ... ফেসবুক... “অনলাইন আছি... কই তুমি এসো...” “ও তো শুয়ে পড়েছে...” “ওর কথা ছাড়োতো...” “বাচ্চাটা যেন জানতে না পারে...” “ডিলিট করে দিও... বা পাসওয়ার্ড দিয়ে রেখো... বুঝলে... হাঁদারাম!!!!!!!!”
   
476
Wed, 12/21/2016 - 13:11
        অবশেষে কি হল? তোমার সেই খেলাটা মনে আছে? দাঁড়াও বোঝাই আগে কোন খেলাটার কথা বলছি। সেই যে গো, অনেকগুলো দাগ অথবা রেখা, তারা কোনো এক বস্তুকে কেন্দ্র করে আঁকা, কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ওর মধ্যে একটাই মাত্র দাগ ওই বস্তুটার সাথে লেগে আছে, বাকিগুলো মাঝপথে হারিয়ে গেছে বা শেষ হয়ে গেছে। মনে পড়ল? বা খেলাটা এমনও থাকে, অনেকগুলো গলিপথ আঁকা একটা মাঠের দিকে, দেখে মনে হবে সব গলিগুলোই ওই কেন্দ্রের মাঠে পৌঁছাবে, কিন্তু পৌঁছাতে গিয়ে দেখবে একটা বাদে সব রাস্তাই হারিয়ে গেল মাঝপথে (যেমন ছবিটায়)। আমাদেরও সেই হাল গো। তোমারও, আমারও। মনে হয় একটা সমস্যা সমাধানের কত না পথই আছে, কিন্তু অবশেষে? একটাই পথ – 'আপন দুটো চরণ ঢাকো'। নিজেকে পাল্টে ফেলো, নিজেকে সরিয়ে নাও, নিজের দাবি-দাওয়াগুলোর মূল্য ছাঁটো। অত মূল্য কেউ দেবে না। সরে আসো ভায়া। বাইরে না, ভিতরে। এইটা একটা চালাকির খেলা। সবাই পারে না। যদি পারলে তো বেঁচে গেলে বলব না, একটু স্বস্তি পেতে পারো এই আর কি। কি রকম? ভিতরে ভিতরে নিজেকে সরিয়ে আনতে হবে, বাইরে যেমন ছিল তেমনই থাকবে। হাসি, গল্প, ঠাট্টা, মজা ইত্যাদি সব যেমন ছিল চলবে। কিন্তু নিজের ভিতরে সরে আসতে হবে সব দাবি-দাওয়া নিয়ে, বিনা শর্তে।  উঁহু... যদি যুক্তি খাটিয়ে করতে চাও, পারবে না। বাচ্চা পুতুলখেলা ছাড়ে যুক্তির দোহাই দিয়ে না, সে ছাড়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে ওগুলোর মূল্যহীনতা বুঝতে পেরে। এও তেমন, যতক্ষণ তোমার মনে হবে - 'না, আমি তো চেষ্টা করলেই পারি', ততদিন চেষ্টা চালিয়ে যেতেই হবে, নতুবা তা ভণ্ডামী হবে, কাপুরুষতা হবে। কিন্তু একটা সময় এসে ওই খেলাটার মত নিজের ঘোর ভাঙে, বুঝতে পারি কত স্বল্প ক্ষমতা আমার। কত দিক থাকে এক একটা ঘটনার আর তারা কত রকম শর্তসাপেক্ষ। তার একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ফ্যাক্টর হলুম গিয়ে এই নাম-রূপধারী আমার সত্তাটি। তখন মনে হয়, 'উফ্..., কি অসম্ভব বোঝাই না নিজের ঘাড়ে, নিজের অজ্ঞতাবশে তুলে নিয়েছিলুম। আরেকটু হলেই নিজের চাপে নিজেই মারা পড়েছিলুম আর কি!' তবে কি আমি খুব বড় একটা বিধান দিতে বসলুম? তা না। সব মানুষের তো আর প্রকৃতি এক না। কেউ শান্তিপ্রিয়, কেউ অহংপ্রিয়, কেউ অলসতাপ্রিয়। এদের এক একজন সমাধানের এক একরকম পথ খোঁজে। তবে বাপু এ তত্ত্ব আমার না, এ তত্ত্বের কপিরাইট আমাগো দ্যাশের দার্শনিকদের। ঠাট্টা নয়, যেটা বলছিলাম। তো যে যার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী সমাধানের পথ খুঁজবে। একটা গল্প আছে না কথামৃতে, সেই একটা চিল এক টুকরো মাংস মুখে করে বসেছিল। অমনি চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক তাকে ঘিরে হুজ্জুতি শুরু করতে লাগল। তো সে বেচারা আর কি করে, সেই মাংসের টুকরো নিয়ে একবার পুবে, একবার পশ্চিমে এরকম নানান দিকে ঘুরে শেষে 'ধুর শালা মাংসের টুকরো' বলে যেই না মাটিতে ফেলে দিয়েছে, অমনি সব কাক ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে ছেড়ে ওই মাংসের টুকরোর দিকে ধেয়ে গিয়েছে। তখন চিলটা নিশ্চিন্তে একটা গাছের ডালে গিয়ে বসল।  এখন কথামৃত থাক। সে গল্প যিনি বলছেন তিনি হলেন গিয়ে পরমহংস মশায়। আমাদের কি আর এরকম গল্প ভালো লাগবে? থুড়ি, এরকম সমাধান ভালো লাগবে? যারা শান্তিপ্রিয় প্রকৃতির তাদের বেশ ভালো লাগবে। যারা অহং প্রিয়? তাদের গল্পটার ভার্সান কেমন হবে? চিলটা মাংসের টুকরো মুখে করে নিয়ে তো বসেছে। এদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে কাক উড়ে এসে উৎপাত শুরু করে দিয়েছে। তখন সে কি করল? মাংসের টুকরোটা পায়ের নখে আটকে, 'হা রে রে...' বলে কাকের দলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। উফ, কি যুদ্ধুটাই না হল... কা কা... কোঁ কোঁ... কত রকম আওয়াজ চারদিকে। একদিকে একা চিল অন্যদিকে হাজার কাক (এই সংখ্যাটা কাস্টমাইজ করে নেওয়া যেতে পারে ইচ্ছা অনুযায়ী)। তিনদিন তিনরাত যুদ্ধ চলার পর একটা সমাধান হল। কিরকম সমাধান? যদি অহংপ্রিয় মানুষটি সাম্যবাদী হন তবে সমাধান হবে কাকের সাথে চিল তার মাংসের ভাগ তুল্যমূল্য বিচারে ভাগ করে নিল। আর যদি পুঁজিবাদী হন, তবে সমাধান হবে, চিলটা কাককূলকে সংহার করে মাংসটা একাই ভোগ করতে লাগল।  আর যদি সে ব্যক্তি অলসতাপ্রিয় হন তবে? তবে তো আরো সোজা! চিলটা মাংসের দোকানে ভিড় দেখে আর ও পথ না মাড়িয়ে সোজা বাড়ি এসে ঘুম লাগিয়েছে। ব্যস, সোজা সমাধানের পথ।  তো কথাটা দাঁড়ালো তাই, আগে মাংস মুখে না নিলে তো আঙুর ফল টকের গল্প হয়ে যাবে। তবে একদিন সত্য সত্যই আঙুর ফলের উপর বিরাগ জন্মায়। তখন মনের মধ্যে অশান্তি থাকে না, দুঃখ অবশ্য থাকে, সে তো থাকবেই। তবে জ্বালাটা থাকে না। অভিজ্ঞতা হিসাবে থাকে, জার্নির একটা পার্ট হিসাবে তাকে মেনে নিতেই হয়। মানুষকে ছাড়া যাব কোথায়? থাকতে তো হবে সবার সাথেই, শুধু একটা চাবি নিয়েই তখন সংসারে চলতে ইচ্ছা করে, যে চাবি দিয়ে শুধু নিজের বাড়ির তালাটাই খোলে। যদিও আগে মনে হত, অনেক তালা খুলতে পারি এই এতগুলো চাবি আমার কাছে আছে। চলতে চলতে একটা একটা করে চাবি খসে পড়তে থাকে হাত থেকে, বুঝতে পারি ওগুলো সব ভুল চাবি ছিল। শুধু একটা চাবিই যেন না হারিয়ে ফেলি, যা দিয়ে অন্তত নিজের বাড়ির দরজাটা খোলে। তাতেই শান্তি।     (ছবি - ইন্টারনেট থেকে ঝাঁপা)    
477
Fri, 12/16/2016 - 09:30
  "একবার সঞ্চয় করতে আরম্ভ করলে ক্রমে আমরা সঞ্চয়ের কল হয়ে উঠি, তখন আমাদের সঞ্চয় প্রয়োজনকেই বহুদূরে ছাড়িয়ে চলে যায়, এমনি কি, প্রয়োজনকেই বঞ্চিত ও পীড়িত করতে থাকে।"  ~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর       তখন কলেজ পাস করেছি। নানান পরামর্শ নানান দিক থেকে। এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে যাতে করে ভবিষ্যতটা নিরাপদ হয়। সেই থেকে শব্দটা কানের কাছে, মাথার অলিতে গলিতে পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল - 'সিক্যুরিটি' চাই, সিক্যিওর লাইফ চাই। শব্দটা আমায় ঘিরে ততক্ষণে একটা বড় ধরণের পাঁচিল তৈরি করে ফেলেছে। এমন সময় শনি দিলেন তাঁর করুণ দৃষ্টি আমার উপর। পরপর কয়েকটা ঝড়ে সব তছনছ হয়ে গেল। চারদিক ধুলোঝড়ের মত অন্ধকার। সম্পূর্ণ অন্ধকারে তাও বা হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে কাজ চলে যায়। কিন্তু আলো আঁধারির মিশ্রণে যে ধুলোঝড়, তাতে কিছু সঠিক ঠাহর করা দায়। পড়লাম মুখ থুবড়িয়ে। আজ সেই দিনটার জন্য অবশ্য কৃতজ্ঞতা জানাই সেই 'যে জন দেয় না দেখা' ...তাঁকে।  একটা গান মনে পড়ল।        পথিক সবাই পেরিয়ে গেল ঘাটের কিনারাতে  আমি সে কোন আকুল আলোয় দিশাহারা রাতে সেই পথ হারানোর অধীর টানে অকূলে পথ আপনি টানে     দিক ভোলাবার পাগল আমার হাসে অন্ধকারে।।   তাই হল। গভীর বিষাদ অন্তরাত্মার আসন কুরে কুরে খাচ্ছে। সবকিছু যেন শূন্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার উপক্রম। তবে একদিন এমন একটা কিছু হল...   উত্তরপাড়া স্টেশানে বসে আছি। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যের দিকে যাচ্ছে। পূজো ক'দিন পর। প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজ পুরোদমে চলছে সামনে। বাচ্চাগুলো কি হুটোপাটি করছে। কিন্তু আমার মন নির্বিকার। এসি কামরার ভিতরে থাকলে যেমন বাইরের জগতের শুধু চলাফেরাটাই চোখে পড়ে, কিন্তু তার উত্তাপ, কোলাহল কিছুই কানে আসে না, আমার সেরকমই হতে থাকল। মনে হল কি হবে এভাবে বেঁচে? যদি সব স্বপ্ন এক নিমিষেই যায় গুঁড়িয়ে এত নির্মম ভাগ্যচক্রে পিষে!  হঠাৎ আমার পাশে কি একটা নড়ে উঠল। একটু চমকে তাকিয়ে দেখি একটা বুড়ি। আমারই পাশে নানান তালগোল পাকানো অজস্র ছেঁড়া কাঁথার মধ্যে পাক খেয়ে শুয়েছিল, খেয়ালই করিনি। উঠে বসল। পরনে ময়লা একটা শাড়ি। তাও দশ-বারোটা ছেঁড়া জায়গা তাতে। সামনের দিকে পাদুটো ছড়িয়ে বসতে না বসতেই কোথা থেকে দুটো কুকুর ল্যাজ নাড়তে নাড়তে ওর পাশে এসে ওকে আদর করতে শুরু করল। বুড়ি বলল, "এসে গেছিস, দাঁড়া।" বলে এক ঝটকায় উঠে, অদূরেই একটা চায়ের দোকান থেকে একভাঁড় চা আর দুটো বিস্কুট কিনে আনল। একটা বিস্কুট দু'টুকরো করে কুকুর দুটোর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে, আরেকটা বিস্কুট নিজের চায়ের ভাঁড়ে ডুবিয়ে মুখে দিল। বসার ভঙ্গী একই রকম আবার। ওই কাঁথার বাণ্ডিলের মধ্যে পাদুটো সামনের দিকে ছড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চা খেতে লাগল। সামনের এত মানুষের চলাফেরা, এত সাজ-পোশাকের বৈভব, সব কিছুতেই সেই নির্বিকার। তার গভীরে চোখে কোন দূরের জগতের উদাসীনতা, হাতে যে চায়ের কাপ, সেই চা খাওয়ার মধ্যে না আছে আসক্তি, না তাচ্ছিল্য।  মনের মধ্যে বিদ্রোহ জাগল। সব চাইতে বড় মরণ শরীরের না, মানের। ভিখারীর সাথে কথা বলব? হ্যাঁ বলব। মান যাবে যে? কেউ দেখে ফেললে? পাক। ওই লাইনে শোয়ার থেকে তা কি কম ভয়ঙ্কর নয়? মন চমকে উঠল? হৃদয়ের কথা মস্তিষ্কে পৌঁছায় কি করে?  -তোমার কে আছে? -কেউ নেই -খাও কি? -ভিক্ষা করে -ভয় করে না? -কিসের, বদ মানুষের? না ভগবান আছেন -ভগবান? কে সে? আছেন? বিশ্বাস করো? -লেখাপড়া তো জানি না বাবু, তবে জানি তিনি আছেন, না হলে ওই কুকুরগুলো তো দেখলে, ওরাই বা আমায় চেনে কি করে আর আমিই বা ওদের বুঝি কি করে? ওরা তো মানুষ নয়! ওরা আমরা তুমি সব তাঁর ইচ্ছায়, সব তাঁর কেরামতি, এ মনে রাখলে শান্তি বাবু। তার ঘর ছিল। বর মরল। শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়ালো। লোকের বাড়ি কাজ করে ক'বছর কাটল। কিন্তু স্থায়ী কিছু হল না। অবশেষে এই হল তার স্থায়ী আবাস। পথ, ভিক্ষা আর ভগবানের উপর অগাধ আস্থা। কয়েকটা ট্রেন ছেড়ে বসে রইলাম। এ কি করে সম্ভব? তবে কি এই 'সিক্যুরিটি' শব্দটা এতটাই আপেক্ষিক? ওর তো দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। কেন? সঞ্চয় নেই বলে? মান নেই বলে? পরিবার নেই বলে? নাকি নিজের প্রতি ভালোবাসা... না তা কি করে হয়, নিজের ওপর তো তার কোনো অভিযোগ নেই! তবে আমার এত ভয়, হতাশা কেন? আমার মূল্য কি ওর থেকে অনেক বেশি? আরো লক্ষ লক্ষ মানুষ কি এইভাবেই দিনাতিপাত করছে না এই অসাম্যতাপূর্ণ, অসামঞ্জস্যতাপূর্ণ জগতে? তবে নিজেকে নিয়ে এতো উদ্বিগ্নতা কিসের? এ কি চূড়ান্ত স্বার্থপরতা, লজ্জার নয়? যেখানে এতগুলো মানুষ এইমাত্রার জীবন যাপন করছেন সেখানে আমি 'আমার যে কি হবে' ভেবে আকুল হচ্ছি। বিশ্বসংসারকে বাইরে ব্রাত্য করে রেখে নিজেকে বিশ্বের প্রাণকেন্দ্র ঠাওরে চোখের জলের বান ডাকছি! মনে হল যুগান্ত সঞ্চিত অন্ধকার এক নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। নিজের সাথে নিজের মুখোমুখি হতে ভালো লাগল। লজ্জা লাগল না, ক্ষোভ হল না। হাওড়া স্টেশানে নামলাম। লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে হাঁটতে হাঁটতে মনে হতে লাগল এই মানবসমুদ্রের আমিও তো একটা ঢেউ। আমি বিচ্ছিন্ন হলেই চূড়ান্ত ব্যর্থ। সংসারের নিজস্ব যে বিধান আছে, চলার বেগ আছে, ছন্দ আছে, তার থেকে নিজেকে ছিন্ন করে, নিজের জন্য একটা আলাদা বিধান, বেগ তথা ছন্দ তৈরি করে বাঁচার মধ্যে হয়তো একটা মদমত্ত সুখ আছে, তবে সার্থকতা নেই। সেদিন স্থির করলাম, আর নিজেকে আলাদা করে ভাবা নয়। যা হওয়ার হোক। যতটুকু চেষ্টা করার করে যাই, হলে ভালো, না হলে 'মরে যাব মরে যাব' করে বাঁচব না।     আজ যখন বহু বড়বড় সম্ভাবনা শুধু এই অলীক 'নিরাপত্তা' শব্দটার কুহক মোহে নষ্ট হয়ে যায় দেখি তখন বড় যন্ত্রণা হয়। যে অসাধারণ গাইত, সে গিয়ে সেঁধোলো ইঁদুর দৌড়ের দুর্বলতম প্রতিযোগী হয়ে। দৌড়ে দৌড়ে দৌড়টাকে অভ্যাস করল। হয়তো বা কাঙ্খিত উচ্চতা স্পর্শ করল। তারপর? তারপর গভীর বিষাদ। 'এ তো আমি চাইনি?' - কিন্তু তখন বড্ড দেরি হয়ে গেছে যে। তখন নিজেকে ভুল বোঝানো, নিজের পরের প্রজন্মকে ভুল বোঝানো, কৃত্রিম সুখে গা ভাসানো, সব রপ্ত করে ফেলতে চায়। করেও। মরে বেঁচে থাকার অভিনয় যে কি সাংঘাতিক! আসলে ওরা সফল নয় তো, সফল ব্যক্তিদের মত, এই 'মত' শব্দটা যাদের জীবনের মাপকাঠি, তাদেরই বানানো এই ইঁদুর দৌড় কনসেপ্টে পিষছে হাজার হাজার আরো দুর্বল, সুবিধাবাদীর দল। আর একটা কথা মনে রাখতে হবে, এরা চিরটাকাল তাদের শ্রেণীকেই বাঁচিয়ে রাখতে চায় যে করেই হোক, না হলে তাদের অস্তিত্বসংকট প্রবল হয়ে উঠবে। এরাও ট্রাপিজের খেলা দেখায়, বাঘের সাথে মজা করে, ইত্যাদি আরো অনেক কিছু করে, তবে সবই ওই জোকারের মত। আর জোকার চিরকাল জোকারই তৈরি করে। তবে কি নিরাপত্তার কথা ভাবব না? অবশ্যই ভাবব। সাথে এটাও মাথায় রাখব নিরাপত্তাটা ব্যাঙ্কে না, সোশ্যাল স্টেটাসে না, সার্টিফিকেটে না। আসল নিরাপত্তা আমার নিজের মধ্যে, হৃদয়ে। নিজের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততায়, সততায়, মানবিকতায়, সহনশীলতায়। তাই কেউ সব হারিয়েও দাঁড়াতে পারে, আবার কেউ সব থাকতেও ভয়ে আতঙ্কে আধমরা হয়ে বেঁচে মরে থাকে।
   
478
Mon, 12/12/2016 - 19:00
”কেউ যখন বুঝে যায় না স্যার, যে তার উপর আমার দুর্বলতা আছে, অমনি সে ঘ্যাম দেখাতে শুরু করে। ভালো করে কথা পর্যন্ত বলে না। কথায় কথায় অপমান করে, জানে তো উল্টে আমি কিছু বলব না তাকে..." বলতে বলতে তার সারা মুখে ছেয়ে এলো বাদল মেঘ, চোখের কোণায় পদ্মপাতার উপর পড়ে থাকা বৃষ্টিবিন্দুর মত বড় বড় দু'ফোঁটা জল। কত বয়েস হবে মেয়েটার? এখনো কুড়ির থেকেই কয়েক ঘর পিছিয়ে, এত গভীরের মনস্তত্ত্ব বুঝল কি করে? তাকে চিনি বলেই জানতাম। তার পরীক্ষার খাতা, নিয়মিত আসা-যাওয়া, দুষ্টুমি করা, বকা খেয়ে চুপ করে থাকা, পরক্ষণেই মিটিমিটি হাসা মাথা নীচু করে - এই তো ছিল ওর সম্পূর্ণ পরিচয় আমার কাছে। আজ মনে হল, শুধু ফুলটার পাঁপড়িগুলোর বিকাশের খবরটুকুই জানতাম, তার কেন্দ্রে যে তার মধ্যে পরিণত মকরন্দের আধার পূর্ণ হয়েছে, সে খবরটা আসেনি এতদিনে। 
তারপরের প্রশ্নটা আরো সাংঘাতিক - "আপনার হয়নি এরকম কখনো স্যার?”
বুঝুন স্যার। এ জটিল মাথা নয় যে কথার প্যাঁচে কথা ঘুরিয়ে পালানো যাবে। সামনে দু'জোড়া সরল চোখ উত্তরের অপেক্ষায়। সরল কিন্তু নির্বোধ নয়, মনে রেখো। সোজা রাস্তাতেই হাঁটতে হয়, এ বিশ্বাস মন থেকে মুছে যায়নি ওর এখনো, স্যার খুঁজছেন চতুর উত্তর। পেলেন না স্যার। 
একটু হেসে বললাম, "হয় তো..." ততক্ষণে তার মনের বাঁক ঘুরে কথা অন্যখাতে গিয়ে পড়েছে। বলল, "যাক গে, যা খুশী করুক, আমি তো ওকে কষ্ট দিইনি কখনো! আমি আসি। এসব কথা বলবেন না প্লিজ ওকে, আমার এখন তত কষ্ট হয় না আর।"
চলে গেল। স্যার বসে রইলেন একা, ফাঁকা ক্লাসঘরে। কে ছিল শিক্ষার্থী আর কে ছিল শিক্ষক? নিজের ভালোবাসার প্রত্যুত্তর না পেলেও নিজেকে সংযত রাখা যে কি দায় সে ইতিহাস দীর্ঘ। আমার এই হালিসহরেই ক’দিন আগে টিউশান ব্যাচে একজন দ্বাদশ ক্লাসের ছাত্র, এক ছাত্রীকে ছুরির আঘাত করে বসল শুধুমাত্র প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। এরকম ঘটনার নজির দুর্লভ নয়। বহু সাহিত্য, চলচিত্র এর ওপর সারা পৃথিবীব্যাপী আছে, ভবিষ্যতেও হবে।
ভালোবাসা না, আমি চাইছি আরেকজনের মনোযোগ, attention. তাই না কি? ভালোবাসা আর মনোযোগ ভিক্ষা করা কি এক বস্তু? আমি কাউকে ভালোবাসতেই পারি। এবং এটা বুঝতেও বেগ পেতে হয় না যে, সে মানুষটার আমার উপর সেরকম কোনো আকর্ষণ নেই। অর্থাৎ আমি যে ধরণের গুরুত্ব তার কাছ থেকে পেতে চাইছি তা পাব না। কারণ তার কাছে সেটা স্বাভাবিকভাবে আসছে না। 
সঠিক অর্থে ভালোবাসাটা কোনো শর্তনির্ভর না। সেখানে ধারাবাহিক কিস্তিতে মনোযোগ দাবী করাটা অস্বাস্থ্যের লক্ষণ। কোথাও যেন সে তার নিজের ও অপর মানুষটার ভালোবাসার উপর সন্দিহান বুঝতে হবে। তাই বারবার মনোযোগের পরীক্ষা দিতে আহ্বান জানায় তাকে। পরীক্ষা করে দেখে নিতে চায় তার কাছে সে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। এটা অস্বাভাবিক না, স্বাভাবিক, তবে অজ্ঞতাপূর্ণ। আর এটাও মনে রাখতে হবে অজ্ঞতা থাকাটাও স্বাভাবিক। তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করাটাই অস্বাভাবিক, ব্যতিক্রমী। তাই অশান্তি, কলহ, অভিযোগ, ঈর্ষা ইত্যাদি সবই নাকি প্রেমের অঙ্গ হয়ে পড়ে। তাই যাকে নাকি ভালোবাসি মন-প্রাণ দিয়ে, সে আমার দিকে তার ধ্যানজ্ঞান দিয়ে রাখেনি বলে তার গলাতে ছুরি চালাতেও আমার দ্বিধাবোধ নেই। সেটাও তো ভালোবাসাই। আমার ভালোবাসা চাই না, চাই অ্যাটেনশান। পুরোপুরি অ্যাটেনশান। আচ্ছা পুরো না হোক আংশিক, তার সিকিভাগ! তবু অ্যাটেনশানের হিসাব আসবেই আসবে। কারণ অজ্ঞতার একটা নিজস্ব সুখ আছে। ঘুমের মধ্যে যত স্বপ্ন আসে, জেগে থাকলে আসে কই? অজ্ঞতার মত গভীর ঘুম কই আর? সে যদ্দিন পরমায়ু থাকে তার।
এই নিরুত্তর একপক্ষ ভালোবাসাকে তবে বুকে করে বেড়ানো যায় কি করে? বারবার তার কাছে নিজের অসহায়তা বুঝিয়ে? তাকে বারবার নানান ভাবে উত্তক্ত করে, ঘ্যানঘ্যান করে আদায় করেই ছাড়ব ভেবে? অথবা অন্য কোনো কৌশলে বা চক্রান্তে? 
এর কোনোটাই নয়। বাচ্চা মেয়েটার উত্তরটা খুব আশ্চর্য লাগল – আমি তো তাকে কষ্ট দিইনি! তবে থাক, আপনি বলবেন না তাকে। 
এত শুদ্ধ ভাবটা সে পেল কি করে? অথচ এর বিপরীতটাই তো দেখছি নির্লজ্জের মত নানান ভাষায়, বিকারে আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। অপরজনকে বিব্রত করে, অপদস্থ করে, উৎপীড়ন করে, তার সৌজন্যবোধের যথার্থ সুবিধা নিয়ে, আত্মদাবির ফরমায়েশ চলেই যাচ্ছে চলেই যাচ্ছে। কি ঘৃণ্য পরিণতি ঘটছে। তবে তাও সই, তাও চলুক, তাও পাই। 
জেদ মানে ভালোবাসা না। মনোযোগ মানে ভালোবাসা না। আসলে কিছু মানেই ভালোবাসা না। কারণ ভালোবাসা মানে কিছু না। ওটা একটা দাবী না, ওটা একটা ব্রত। সে ব্রত উদযাপনের ভার আরেকজন না নিলে নিজেকেই নিতে হয়। আর যদি সেও সে ব্রত উদযাপনের ভার নেয় সে তো খুব ভালো কথা। কিন্তু না নিলেও সে ব্রত যেন অসম্পূর্ণ না থাকে। তাতে নিজের দীনতার প্রকাশ। অসম্পূর্ণ ব্রতের পাপের জন্ম দেয়। তাই ভালোবাসার সে ব্রতকে সার্থক করতেই হয়। নিজের জন্য। নিজেকে পরিপূর্ণ করার জন্য। আর সে সবই হোক গোপনে। একান্ত গোপনে। সে যেন জানতেও না পারে তাকে ভালোবেসেছিলাম। কারণ যে ভালোবাসা মনে করাতে হয়, সে আধসিদ্ধ চালের মত, না হয় পরিপাক, না হয় বমি। মাঝখান থেকে পেট ব্যাথায় প্রাণ যায়। তখন ভালোবাসা পিট্যুইটারীর কার্য ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। মস্তিষ্কের আরো গভীরের মননের আলো সেখানে পৌঁছায় না। যদিও অজ্ঞতার অন্ধকারে চলার স্বাধীনতা সবার আছে। চিরটাকাল থাকে। তবে সে একটা অন্ধকার থেকে আরেকটা অন্ধকারেই নিয়ে যায় মাত্র। এর বেশি কিছু সে পারে না। একটা কবিতা মনে পড়ছে... তাই দিয়েই শেষ করি –      সত্য যা দিয়েছিলে থাক্ মোর তাই,
       দিবে লাজ তার বেশি দিলে।
দুঃখ বাঁচাতে যদি কোনোমতে চাই
       দুঃখের মূল্য না মিলে।
দুর্বল ম্লান করে নিজ অধিকার
       বরমাল্যের অপমানে।
যে পারে সহজে নিতে যোগ্য সে তার,
       চেয়ে নিতে সে কভু না জানে।
প্রেমেরে বাড়াতে গিয়ে মিশাব না ফাঁকি,
সীমারে মানিয়া তার মর্যাদা রাখি,
যা পেয়েছি সেই মোর অক্ষয় ধন,
  যা পাই নি বড়ো সেই নয়। 
                  (দায়মোচন, রবীন্দ্রনাথ)    
479
Sun, 12/11/2016 - 19:30
           

সুব্বুলক্সমী না শুভলক্ষ্মী? এম এস শুভলক্ষ্মী, আমার বলতে সুবিধা হয়। প্রথম শুনেছিলাম টিভিতে। স্কুলে পড়তাম। অল্প অল্প হিন্দী বুঝতে শুরু করেছি। একটা হিন্দী ভজন গাইলেন, 'মেরে তো গিরিধর গোপাল'। মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে রইলাম শুনে। এমন গলা না হয় হল, এমন ভাব এমন অনায়াসে আসে? তাও মন্দির না, পাহাড় পর্বতের গুহা না, অ্যাতো লোহালক্কড়-আলো-ক্যামেরা ঘেরা শতচক্ষুর সামনে গাওয়া! এমন একাত্ম হওয়া যায়! অভিনয় নয় সে তো বুঝছি, কারণ অত্যন্ত ভালো অভিনয় মনের মধ্যে একটা আনন্দের রেশ রেখে যায়, কিন্তু এ তো তা না, এ তো সামনে থেকে পাশের জগতের উপর পর্দা সরিয়ে দেওয়া আচমকা। 

ক'দিন পরেই একটা লেখা বের হলো ওনার ব্যাপারে টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ঘটনাটা মনে বহুদিন দাগ কেটে রইল। এক দরিদ্র দম্পতি বহু দূর থেকে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে মাদুরাইতে এসে শুনলেন ওনার গান খানিক আগেই শেষ হয়ে গেছে। স্ত্রী কেঁদে ফেললেন। এতটা আশা নিয়ে এতটা পথ আসা তবে বিফলে গেল? মাটিতে বসে পড়লেন কাঁদতে কাঁদতে, শরীরে আর বল নেই যে! স্বামী বললেন, দেখি কি করা যায়। খোঁজ নিয়ে জানলেন উনি কোথায় কার বাড়ি উঠেছেন। গেলেন অত রাত্রেই স্ত্রীকে নিয়ে। কেউ একজন বলল, উনি সবে শুতে গেছেন, ভীষণ ক্লান্ত। স্বামী বললেন, একবার ডেকে দিন, অনেক দূর থেকে এসেছি, অনেক আশা নিয়ে।  ওনাকে ডাকা হল। উনি এসে সব শুনলেন। তারপর ওনার স্ত্রীকে বললেন, কেঁদো না, বোসো, আমি আসছি।  এলেন, কয়েকটা গান শোনালেন। রাত্রে সেখানেই থেকে যেতে বললেন। এই হলেন মানুষ শুভলক্ষ্মী।   কি আছে ওনার গানে? ওনার নিজের ভাষায়, সঙ্গীতের উদ্দেশ্য হল সঙ্গীতের অতীত যে সত্তা আছে তাকে প্রকাশ করা। কে সে? সে-ই ওনার ভগবান। ফ্রন্টলাইন পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন ভারতরত্ন পাওয়ার পরপরই। কিশোরী আমোনকর সেই জন্যেই বোধহয় ওনার কণ্ঠস্বরকে বলতেন অষ্টম সুর।    'মীরা' সিনেমাটা দুটো ভাষায় হল। উনি অভিনয় করলেন মীরার ভূমিকায়। হিন্দীটা দুর্ভাগ্যবশতঃ আর চোখে পড়ে না, ওই টিভিতেই যে ক'বার দেখা। মহাত্মা ওর কণ্ঠস্বরকে বলতেন, "মীরার কণ্ঠস্বর।" ওর খুব প্রিয় ভজন ছিল 'হরি তুম হরো' নামে ভজনটি। সত্যিই যেন তাই। উস্তাদ আমির খাঁ'কে শুনলে যেমন মনে হয় তানসেনের কণ্ঠস্বর আর গায়কী বোধহয় এরকমই কিছু হয়ে থাকবে।  আরেকটা দিনের কথা মনে পড়ছে। একদিন বিকাল বেলায় ন্যাশেনাল চ্যানেলে ওনার গান হবে, পেপারে লিখল। খুব উদগ্রীব হয়ে আছি। গান শুরু হল। চমকে উঠলাম ওনার গান শুনে, এ কি গাইছেন উনি? উনি গাইছেন, "আমার মল্লিকাবনে"। আমার অসাধারণ লাগল। (এই নিয়ে যদিও খুব মজার মজার কথা শুনেছি। একটু প্রসঙ্গান্তর হবে যদিও। এখন ইউটিউবের দৌলতে ওনার দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত আর 'ধনধান্যে পুষ্পে ভরা' গানটা পাওয়া যায়। কিছু মানুষের গলায় শুনেছি, 'এ হে এটা রবীন্দ্রসঙ্গীত হল নাকি!' আসলে হয়েছেটা কি, আজকাল সবাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারেন, তার সঙ্গীতের সঠিক অর্থে তালিম থাকুক চাই না থাকুক। তালিম অর্থে মার্গ সঙ্গীতের কথাই বলতে চাইছি। না হলে শুধু অভিনয় আর আবেগের রসবড়া হয়ে যাচ্ছে গানগুলো। 'বাজে করুণ সুরে', 'ঘোরা রজনী এ', 'অসীম কালসাগরে' ইত্যাদি গানগুলো যথাযথ গাইবার লোক কমে যাচ্ছে। যে জোঁড়াসাকোতে অত বড় বড় তাবড় তাবড় শিল্পী এসে গেয়েছেন, গতবার ২৫শে বৈশাখ শুনে এলুম সেখানে লাইন ও সুরের চ্যুতিতেও নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস চলছে। মাঝ অনুষ্ঠান থেকে উঠে আসতে বাধ্য হলুম। গানটাও যে শেখার জিনিস, চর্চার জিনিস, শুধুই নিজের ভালোলাগাটুকু দিয়ে মাপার জিনিস না, এটা না বুঝতে পারলে কোনো শ্রেষ্ঠ কীর্তিরই যথার্থ উত্তরসূরী হওয়া যায় না। এটা যত তাড়াতাড়ি বুঝি ততই মঙ্গল।  তার সাথে এই উন্নাসিক ভাব, "ও গাইবে কি? অবাঙালী, ও কি বোঝে?" এই উন্নাসিক ভাবটা ছাড়তে পারিনি বলেই আজও বাংলার বাইরে সে অর্থে রবীন্দ্রনাথের গানকে পৌঁছানো গেল না। যিনি রবীন্দ্রসংগীত গান না, তাঁর ধারা পৃথক হতেই পারে খানিক। তাতে 'গেল গেল' রব তুললে তো সবই গেল। একটা ক্ষুদ্র পরিসরেই আটকে থাকল। কয়েকটা বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো ধারাবাহিক কাজ হল না। 'গীতাঞ্জলী' বলে একটা অনুষ্ঠান হল, বড় বড় শিল্পীরা গাইলেন হিন্দীতে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তবু সবার মনে হল, সেই 'অতিভালো'টা যখন হল না, তখন আর কি হল!)  শুভলক্ষ্মীর কর্ণাটকি সঙ্গীতে অবদান নিয়ে কিছু বলার নেই। খোদ রাষ্ট্রসংঘের সভাঘরে ওকে দক্ষিনী সঙ্গীত গাইবার আমন্ত্রণ তো আছেই, সাথে সাথে বিদেশের বহু জায়গায় ওর সঙ্গীত পরিবেশন, ভালোবাসা, ওকে ঘিরে উৎসাহ দেখার মত। (অবশ্য ওনার সমসাময়িক আরেকজন দক্ষিণী কণ্ঠসঙ্গীত শিল্পীর নাম করতেই হয় - ডি কে পোট্টমল, অসামান্যা এই মহিলা শিল্পীর কণ্ঠস্বরের সাথে উত্তর ভারতের গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গল'র অদ্ভুত মিল আছে, কি অক্লান্ত লড়াই এনারা করেছিলেন সেই শুদ্ধ ধারাকে পৃথিবীর বিভিন্ন কোণায় ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য)। শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠে অসামান্যভাবে জেগে উঠেছে বিভিন্ন মরমী সাধকের পদাবলী। দক্ষিণের ত্যাগরাজের অসামান্য সব রচনা (যার মধ্যে 'ভাবয়ামী রঘুরামম্', আর 'বন্দমু রঘুনন্দনম্' আমার অত্যন্ত প্রিয়)। এ ছাড়া তুলসীদাস, মীরা, সুরদাস, কবীর তো আছেনই। আমার প্রিয় কয়েকটা পদাবলী বলি ওনার কণ্ঠে এদের। তুলসীদাস - 'তু দয়াল দীন হুঁ'; মীরা - 'মেরে তো গিরিধর গোপাল'; সুরদাস - 'হে গোবিন্দ রাখো শরণ' (এই গানটার শেষে একটা বিস্তার আছে, যা আকুতি ছাড়া আর কিছু না, গায়ে কাঁটা দেয় যতবার শুনি); কবীর - 'ভজ রে ভাইয়া রাম গোবিন্দ হরি'। একবার ওনার একটা ক্যাসেট কিনলাম, 'বিষ্ণু সহস্রনামম্'। এক পিঠে বিষ্ণুসহস্রনামম আর অন্য পিঠে শঙ্করাচার্যকৃত বিখ্যাত রচনা 'মোহ মুদগর' ভজ গোবিন্দম। আশ্চর্য হলাম, উনি শুরু করছেন শ্রীরামকৃষ্ণের প্রণাম মন্ত্র দিয়ে - 'ওঁ স্থাপকায় চ ধর্মস্য।' কারণ শ্রীরামকৃষ্ণদেব ওনার নারায়ণ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র দিলীপ রায়ের গানের সাথে ওনার গান মিশেও একটা আশ্চর্য মাধুর্য তৈরি করত। 'মোহে চাকর রাখো জী' গানটাতে তো শেষে কীর্তনের অংশটুকু সম্পূর্ণ দিলীপ রায়ের গায়কীকেই মনে পড়ায়।  ভজনের বর্তমান অবস্থা দেখুন। ডি ভি পালুস্কর যে অসাধারণ ধারা ভজনের প্রবর্তন করলেন, তা শুভলক্ষ্মী হয়ে যশরাজ হয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। সেই গানগুলোতে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের মারপ্যাঁচের থেকে দরদটা অনেক বেশি থাকত। আকুতিটাতে দেখনদারি ছিল না। তবে এ অভাব দক্ষিণে নেই। আজও জয়শ্রী, উন্নিকৃষ্ণাণের গলায় ত্যাগরাজ শুনলে অভিভূত হই। পরিবর্তন হয়েছে প্রকাশে, মূলে না। উত্তর ভারতে এই অভাব খানিক ঘটলেও, আমাদের এখানে অবস্থা খুব সঙ্গীন। সেইভাবে ভক্তিসঙ্গীত কই? গাইবার লোক কই? মরমী সঙ্গীত গাইতে হলে অথবা তার রস গ্রহন করতে হলে কি নিজেকে রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ হতেই হয়? তা তো নয়! নিজের মধ্যে একটা রসিক, ভাবগ্রাহী মন থাকতে হয়। তাতে আর কি হয় জানি না, মনের সুস্থতা অনেকখানি বাড়ে দেখেছি। আর আজ ভক্তিসঙ্গীতের নামে যে ধরণের গান তথা গাইবার প্রথা দেখছি, তা আমাদের ঐতিহ্যের পক্ষে খুব একটা অনুকূল নয়।  শুভলক্ষ্মীর কণ্ঠস্বর ভারতের অনাদি কণ্ঠস্বর। তার অনুভূতি, গভীর অন্তরাত্মার আত্মদানের অনুভূতি। তাঁর উপস্থিতি চিত্তশুদ্ধি ঘটায়। সেইখান থেকেই আবার আমাদের চলার উৎসাহ পাই, দিশা পাই, এই প্রার্থনা।   (আজ ওনার প্রয়াণ দিবস)          
480
Thu, 12/01/2016 - 13:53
গত ২৫শে নভেম্বর Al Jazeera নিউজ চ্যানেল বিখ্যাত দার্শনিক, ভাষাবিদ, সমাজবিদ, ঐতিহাসিক নোম চোমস্কি মহাশয়ের একটা সাক্ষাৎকার YouTube এ দেয়। বিষয়ঃ ট্রাম্প জেতার পর ওনার প্রতিক্রিয়া। তীক্ষ্ণ ও ধারালো, তথ্য ও যুক্তিপূর্ণ, মোহ ও পক্ষপাতমুক্ত মন্তব্য একের পর এক ওনার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে করতে করতে শেষ যে কথাটায় এসে দাঁড়ালেন, তার সারমর্ম হল, সমস্যা যত ঘনীভূতই হোক, ভবিষ্যত যতই সংকটময় হয়ে উঠুক না কেন, এ সব থেকে মুক্ত হওয়ার পথ – মানুষের সতর্ক বুদ্ধি।    থমকে গেলাম। কথাটা নতুন না। কিন্তু একেই চরম অস্ত্র বলে চিহ্নিত করার মধ্যে অবশ্যই অভিনবত্ব আছে, বিশেষ করে আজ যখন সব কিছু কৌশলে অথবা যেন-তেন-প্রকারেণ নামক নীতির(?) দিকে ঝোঁক বাড়ছে। গায়ের জোর, মৌলবাদের স্থূল বিধ্বংসী শক্তি স্বগর্বে মাথা তুলে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে অস্তিত্ব খুঁজতে চাইছে। মৈত্রী শুধু মাত্র মতলবের তলবদারি করে বেড়াচ্ছে।  আশ্চর্য হওয়ার আরও আছে। এই একই কথা রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ‘কালান্তর’ প্রবন্ধ গ্রন্থে সাংঘাতিক জোরের সাথে উচ্চারিত হয়েছে। আমি তার কিছু অংশ তুলে তুলে দিলাম। শুধু এটা বলার জন্য, পথটা চিরটাকাল একই – অবুদ্ধির সাথে লড়াই করা, শুভবুদ্ধির জোরে, সতর্ক বুদ্ধির জোরে। ১) এই উদ্ধৃতিটার প্রাসঙ্গিকতা আজও কোনো অংশে কমেনি। ভবিষ্যতেও যে কবে কমবে সেই আশায় চলা। ইংরাজরা আমাদের শত্রু ছিল না, শত্রু ছিল আমাদের অবুদ্ধি। দেখি ওনার ভাষায় – “আজকাল আমরা এই একটা বুলি ধরেছি, ঘরে যখন আগুন লেগেছে তখন শিক্ষা-দীক্ষা সব ফেলে রেখে সর্বাগ্রে আগুন নেবাতে কোমর বেঁধে দাঁড়ানো চাই; অতএব সকলকেই চরকায় সুতো কাটতে হবে। আগুন লাগলে আগুন নেবানো চাই এ কথাটা আমার মতো মানুষের কাছেও দুর্বোধ নয়। এর মধ্যে দুরূহ ব্যাপার হচ্ছে কোন্টা আগুন সেইটে স্থির করা, তারপরে স্থির করতে হবে কোন্টা জল। ছাইটাকেই আমরা যদি আগুন বলি তা হলে ত্রিশ কোটি ভাঙাকুলো লাগিয়েও সে আগুন নেবাতে পারব না। নিজের চরকার সুতো, নিজের তাঁতের কাপড় আমরা যে ব্যবহার করতে পারছি নে সেটা আগুন নয়, সেটা ছাইয়ের একটা অংশ অর্থাৎ আগুনের চরম ফল। নিজের তাঁত চালাতে থাকলেও এ আগুন জ্বলতে থাকবে। বিদেশী আমাদের রাজা, এটাও আগুন নয়, এটা ছাই; বিদেশীকে বিদায় করলেও আগুন জ্বলবে-- এমন কি স্বদেশী রাজা হলেও দুঃখদহনের নিবৃত্তি হবে না। এমন নয় যে, হঠাৎ আগুন লেগেছে, হঠাৎ নিবিয়ে ফেলব। হাজার বছরের ঊর্ধ্বকাল যে-আগুন দেশটাকে হাড়ে মাসে জ্বালাচ্ছে, আজ স্বহস্তে সুতো কেটে কাপড় বুনলেই সে আগুন দু দিনে বশ মানবে এ কথা মেনে নিতে পারি নে। আজ দুশো-বছর আগে চরকা চলেছিল, তাঁতও বন্ধ হয় নি, সেই সঙ্গে আগুনও দাউ-দাউ করে জ্বলছিল। সেই আগুনের জ্বালানি-কাঠটা হচ্ছে ধর্মে কর্মে অবুদ্ধির অন্ধতা।“ ২) ধর্ম আর কুসংস্কারের মধ্যে পার্থক্য করা, অনেকটা তরকারিতে বরবটি আর লঙ্কা আলাদা করার মত কঠিন ব্যপার হয়ে দাঁড়ায়। যতই সুক্ষ্মভাবে বিচার করি না কেন, ঠিক বরবটি ভেবে লঙ্কা চিবাবোই, আর ঝালের চোটে হাউমাউ করে খানিক পাড়া মাথায় করব। অনেকে অবশ্য লঙ্কার ভয়ে বরবটিও বাদ দিতে চান। আমি আবার বরবটির লোভ ছাড়তে পারি না। তাই সহজ হিসাব করে নিয়েছি- যে জ্ঞান যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে আসে তাকে বলে বিজ্ঞান, আর যে জ্ঞান বুকের মধ্যে প্রেমের মাধ্যমে আসে তাকে বলি ধর্ম। যেমন আমাদের পাড়ার একটা কুকুরের পা কেউ মেরে ভেঙে দিয়েছে, তার যন্ত্রণাটা যে আমায় কষ্ট দিয়ে কিছু একটা করতে বলছে, সে যুক্তি না, সে ধর্ম, আর তাকে সারাতে যে বিদ্যা লাগবে, তাকে বলি বিজ্ঞান। দুই-ই লাগে সুস্থ বাঁচতে। এও রবীন্দ্রনাথের কাছেই শিখতে চেষ্টা। ওর বকুনি তো আজ নতুন খাচ্ছি নে, সেই... যাক উদ্ধৃতিটা দিই –   “নিত্য ব্যবহারের জন্যে যে আগুন জ্বালাবার কাজটা তাদের নিজের বুদ্ধির হাতেই থাকা উচিত ছিল কোনো একদিন সেই কাজটা কোনো অগ্নিগিরির আকস্মিক উচ্ছ্বাসের সহায়তায় তারা সাধন ক'রে নিতে পারে। কিন্তু ক্বচিৎ-বিস্ফুরিত অগ্নিগিরির উপরেই যাদের ঘরের আলো জ্বালাবার ভার, নিজেদের বুদ্ধিশক্তির উপর নয়, মুক্তির নিত্যোৎসবে তাদের প্রদীপ জ্বলবে না এ বিষয়ে সন্দেহমাত্র নেই। অতএব যে-শিক্ষার চর্চায় তারা আগুন নিজে জ্বালাতে পারে, নিজে জ্বালানো অসাধ্য নয় এই ভরসা লাভ করতে পারে, সেই শিক্ষা পাওয়াই ঘরের অন্ধকার দূর হওয়ার একমাত্র সদুপায় আত্মশক্তির পথে চলতে যে-বুদ্ধি যে-অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, যে মানুষের তা নেই তাকে অলৌকিক-শক্তি-পথের আভাস দেবামাত্রই সে তার জড়শয্যা থেকে লাফ দিয়ে ওঠে। তা না হলে আমাদের দেশে এত তাগাতাবিজ বিক্রি হবে কেন। যারা রোগ তাপ বিপদ আপদ থেকে রক্ষা পাবার বুদ্ধিসংগত উপায়ের 'পরে মানসিক জড়ত্ব-বশত আস্থা রাখে না, তাগাতাবিজ স্বস্ত্যয়ন তন্ত্রমন্ত্র মানতে তারা প্রভূত ত্যাগ এবং অজস্র সময় ও চেষ্টা ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হয় না। এ কথা ভুলে যায় যে, এই তাগাতাবিজ-গ্রস্তদেরই রোগতাপ-বিপদ-আপদের অবসান দেবতা বা অপদেবতা কারো কৃপাতেই ঘটে না, এই তাগাতাবিজ-গ্রস্তদেরই ঘরে অকল্যাণের উৎস শতধারায় চিরদিন উৎসারিত। যে-দেশে বসন্তরোগের কারণটা লোকে বুদ্ধির দ্বারা জেনেছে এবং সে-কারণটা বুদ্ধির দ্বারা নিবারণ করেছে, সে-দেশে বসন্ত মারীরূপ ত্যাগ ক'রে দৌড় মেরেছে। আর যে-দেশের মানুষ মা-শীতলাকে বসন্তের কারণ ব'লে চোখ বুজে ঠিক ক'রে বসে থাকে সে-দেশে মা-শীতলাও থেকে যান, বসন্তও যাবার নাম করে না। সেখানে মা-শীতলা হচ্ছেন মানসিক পরবশতার একটি প্রতীক, বুদ্ধির স্বরাজচ্যুতির কদর্য লক্ষণ।“ ৩) শেষ কথাতে আসি। আমাদের খবরের কাগজগুলোতে বিয়ের বিজ্ঞাপনগুলো দেখেছেন তো? দেখবেন লেখা থাকে ছেলে অমুক অমুক পাশ, অমুক বিদেশি কম্প্যানীতে চাকরি করে, অথবা ডাক্তার, অথবা ইঞ্জিনীয়ার... অমুক গোত্রের, অমুক গণের, অমুক গুষ্ঠিরপিণ্ডীর পাত্রী চাই। কন্যাপক্ষ থেকেও সেই এক কেস। কন্যা যতই শিক্ষিতা হোন না কেন, অমুক গোত্রটি চাইইইই (অবশ্য এ সবের ব্যতিক্রমও আছে)। তা হলে কথাটা হচ্ছে এত বিদ্যা গেল কই? বাড়িতে পুরো বৈদ্যুতিক তারসজ্জা করলাম, অথচ বাড়িতে যেন বিদ্যুৎ সরবরাহের সংযোগই করা হয় নি... অমন বিদ্যার কাঁতায় আগুন। মানুষকে যদি এখনও এমন ভেদে ভাগ করতে পারিস, তো পড়াশোনা সব ৫০০/১০০০ নোটের মত বাতিল করলেই হয়। আর কথা না, শেষ উদ্ধৃতিটি দিই –   “নিজের সতর্ক বুদ্ধিকে সর্বদা জাগ্রত রাখতে সচেষ্ট শক্তির প্রয়োজন হয়। যে-সমাজ দৈব গুরু ও অপ্রাকৃত প্রভাবের 'পরে আস্থাবান নয়, যে-সমাজ বুদ্ধিকে বিশ্বাস করতে শিখেছে, সে-সমাজে পরস্পরের উৎসাহে ও সহায়তায় মানুষের মনের শক্তি সহজেই নিরলস থাকে। আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রণালীর দোষে একে তো শিক্ষা অগভীর হয়, তার উপরে সেই শিক্ষার ব্যাপ্তি নিরতিশয় সংকীর্ণ। এইজন্যে সর্বজনের সম্মিলিত মনের শক্তি আমাদের মনকে অগ্রসরতার দিকে, আত্মশক্তির দিকে উন্মুখ করে রাখতে পারে না। সে সহজেই অলস হয়ে পড়ে এবং প্রচলিত বিশ্বাস ও চিরাগত প্রথার হাতে গা ঢেলে দিয়ে ছুটি পায়। তার পরে অশিক্ষিতদের সঙ্গে আমাদের প্রভেদ ঘটে এই যে, তারা আপন অন্ধবিশ্বাসে বিনা দ্বিধায় সহজ ঘুম ঘুমোয়, আমরা নিজেকে ভুলিয়ে আফিঙের ঘুম ঘুমোই; আমরা কুতর্ক ক'রে লজ্জা নিবারণ করতে চেষ্টা করি, জড়তা বা ভীরুত্ব-বশত যে-কাজ করি তার একটা সুনিপুণ বা অনিপুণ ব্যাখ্যা বানিয়ে দিয়ে সেটাকে গর্বের বিষয় ক'রে দাঁড় করাতে চাই। কিন্তু ওকালতির জোরে দুর্গতিকে চাপা দেওয়া যায় না।  দেশকে মুক্তি দিতে গেলে দেশকে শিক্ষা দিতে হবে, এ কথাটা হঠাৎ এত অতিরিক্ত মস্ত ব'লে ঠেকে যে এ'কে আমাদের সমস্যার সমাধান ব'লে মেনে নিতে মন রাজি হয় না। দেশের মুক্তি কাজটা খুব বড়ো অথচ তার উপায়টা খুব ছোটো হবে, এ কথা প্রত্যাশা করার ভিতরেই একটা গলদ আছে। এই প্রত্যাশার মধ্যেই রয়ে গেছে ফাঁকির 'পরে বিশ্বাস; বাস্তবের 'পরে নয়, নিজের শক্তির 'পরে নয়।”   [উপরে উল্লিখিত নোম চোমস্কির সাক্ষাৎকারটির লিঙ্ক নীচে দিলাম]      
481
Thu, 11/24/2016 - 17:00

হিন্দীভাষা নিয়ে আমাদের একটা ছুঁচিবাই আছে। আমরা হিন্দী গান শুনব, হিন্দী সিনেমা দেখব। কিন্তু হিন্দী ভাষাটা লিখতে বা পড়তে শিখব না। দক্ষিণ ভারতে এ গোঁড়ামি আরো ভীষণ। হিন্দী আমাদের জাতীয় ভাষা – এ কথাটা ভুল। জাতীয় ভাষা আমাদের সবক’টাই। মানে বাইশটা ভারতীয় ভাষাই জাতীয় ভাষা। সেখানে হিন্দী আর ইংরাজী আমাদের কাজের ভাষা, বা official language.


কেন এই প্রসঙ্গের অবতারণা হল সেটা আগে বলি, না হলে বুঝতে অসুবিধা হবে। আমি জানি আমার এ লেখাটার কোনো মূল্য নেই। এতে কিছুই হবে না। আমার এই লেখাটাই সার হবে। আর আপনারা যাঁরা কষ্ট করে পড়বেন তাঁদের কিছুটা সময় অপচয় হবে মাত্র। আমি আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আর সাথে সাথে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখছি আমায় এই সময়টা দেওয়ার জন্য।


আমার আত্মীয়পরিজন সারা ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাছাড়া ছোটবেলা থেকে ভারতের বহু জায়গায় বেড়াবার দরুন স্বদেশের সাথে খুব নিবিড় একটা সম্পর্ক অনেকদিন ধরে রক্তে বয়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ এক জায়গায় বলছেন, “… দেশ কেবল মৃণ্ময় পদার্থ নয়, তা চিন্ময়ও বটে। তা যে কেবল বিশ্বপ্রকৃতিতে আছে তা নয়, তার চেয়ে সত্যরূপে আমাদের চিৎলোকে আছে। মনে রাখতে হবে যে অনেক পশুপক্ষীও বাংলার মাটিতে জন্মেছে। অথচ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হৃদয়ের মধ্যে বাঙালীর সঙ্গে একাত্মিকতার বোধ আত্মীয়তার রসযুক্ত নয় বলেই বাঙালীকে ভক্ষণ করতে তার যেমন আনন্দ…”। বাঙালী হতে গেলে তার মাটি-জল-আবহাওয়ার মত তার জীবনযাত্রা, জীবনদর্শন ইত্যাদিও তার রক্তের মধ্যে প্রবাহিত হওয়ার দরকার। এ কথা অবশ্যই মানি। সেই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে কথাটা বলা। সেই অর্থে ভারতবর্ষ বহুদিন রক্তে ঢুকে এসেছে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সাহিত্য হিন্দী আর ইংরাজী ভাষার মাধ্যমে মস্তিষ্কে বাসা তৈরি করেছে। এখানে বলে রাখি, এর অর্থে আমি গেরুয়াকরণের ভারতবর্ষ বোঝাতে চাইছি না কোনো অর্থেই। আবার খুব নম্র হয়ে এটাও উল্লেখ করতে চাই, সত্যজিত রায়ের সিনেমাও কেমন যেন একটা অন্য ভারতের গল্প মনে হয় আমার। সিনেমা হিসাবে তা অত্যন্ত উৎকৃষ্ট মানের সে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সব চরিত্ররাই যেন কিরকম অন্যভাবে কথা বলছেন, অন্যরকম চলাফেরা করছেন, আবেগগুলোও যেন অপরিচিত। ওনার শিল্পীসত্তার বিরুদ্ধে কিছু বলার ধৃষ্টতা আমি রাখি না। সে অত্যন্ত উন্নতমানের। কিন্তু আমার কাছে যেন ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা, তরুন মজুমদার, কি আরো পিছিয়ে গেলে দেবকী বসু ইত্যাদিদের সিনেমায় অনেক কাছাকাছি পরিচিত বাঙালী তথা ভারতীয়দের দেখেছি। এদের সিনেমার চরিত্রদের অভিব্যক্তিগুলো যেন আমার ঘরের লোকের মত। ওনার সিনেমায় আমি সেটা খুঁজে পাই না। হতে পারে আমার বোধের ধারা খুব স্থূল তাই। খারাপ লাগলে ক্ষমা করবেন। কারণ এ নিয়ে তর্ক হয় না। এটা নিতান্তই ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গীর প্রশ্ন।


হিন্দী ভাষা প্রসঙ্গে আসি। একটা হলঘরে কিছু গণ্যমান্য লোকেদের মাঝে বক্তব্য রাখছেন ভূতপূর্ব স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী মহাশয়। ইংরাজীতেই বলছেন। হঠাৎ বলতে বলতে থেমে গেলেন, তারপর ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে বলতে শুরু করলেন। সবাই অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতাকি করছেন। খানিক বাদে কারণটা সবার গোচরে এল। একজন পরিচারক, শ্রোতাদের চা দিতে এসেছিলেন, ফিরে যাওয়ার সময় তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মহারাজের দিকে তাকিয়ে ওনার বক্তব্য শুনতে চেষ্টা করছিলেন। এই মহাপ্রাণের চোখ তা এড়িয়ে যায়নি। তিনি তাড়াতাড়ি তাঁর বক্তব্য হিন্দীতে বলতে শুরু করেন, কারণ এই ভাষাটা বলতে না পারলেও আজ সিনেমা ইত্যাদির দৌলতে অনেকেই বুঝতে পারেন। আমি এটাই বলতে চাইছিলাম।


একটা দেশে শুধুমাত্র একটা বিদেশি ভাষাকে নিয়ে একটা বিভেদরেখা তৈরি হয়ে আছে এটা ভাবতে, দেখতে বড় লজ্জা লাগে। অর্থনৈতিক অসাম্যতা, উপার্জনের অসাম্যতা ইত্যাদি তো আছেই। সে পার্থক্যটার থেকে মর্মান্তিক লাগে যখন দেখি একজন মানুষ তার সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ইংরাজী আয়ত্ত করতে পারেননি বলে হীনমন্যতায় ভুগছেন। একজন মানুষের সামনে তার অবোধ্য ভাষায় কথা বলাটা অপমানজনক। শুনেছিলাম দক্ষিণ ভারতে এই প্রভেদ ভীষণ ছিল। এখন আর ততটা না। ভেলোরে ডাক্তারেরা, চেন্নাইয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দেখেছি হিন্দী বলতে সংকোচ করেন না। কথাটা সেখানেই। ইংরাজী শিখতেই হবে রুজিরোজগারের জন্য, আমাদের দৈনন্দিন কথাতেও ইংরাজী শব্দের ব্যবহার হতেই পারে, তাতে দোষের তো কিছু নেই। সেটাই স্বাভাবিক। ওভাবে একটা ভাষার গতিপথ স্থির করা যায় না। ভাষা একটা সজীব বস্তু। কিন্তু হিন্দী ভাষাটাকে যদি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ আরো ভালোবেসে কাছে টেনে নিতেন, আমার মনে হয় নিজের উপর আমাদের আস্থা আরো বাড়ত বই কমত না।


আমি বিজ্ঞান পড়াই। সব পরিভাষাগুলো (Term) সেখানে ইংরাজীতে ব্যবহার করতে আমার ছাত্রছাত্রীদের বাধ্য করি। কারণ উচ্চামাধ্যমিকের পরে আর তো মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ নেই। সে তো অথৈ জলে পড়বে তখন। সেই অথৈ জলে পড়ার অভিজ্ঞতাও বহু ছাত্রছাত্রীর হয়ে থাকে।
আচ্ছা যদি এমন হত, সব উচ্চশিক্ষা হিন্দীতে পড়ানোর পরিকাঠামো তৈরি হত। সে চিকিৎসাবিদ্যা হোক, কি প্রযুক্তিবিদ্যা। মনে হয় ভারতের সব শ্রেণীর মানুষের কাছে ব্যাপারটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হতে পারত। একবার ক্লাসে আমায় একজন ছাত্র বলল, অমুকের আপনার পড়ানো বুঝতে অসুবিধা হয়। জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? সে বলল, কারণ আপনি ইংরাজীতে বলেন বেশি বলে। আমার গালে একটা চড়ের মত লেগেছিল। কারণ যে ছাত্রটিকে নিয়ে আলোচনা তার বাবা রিক্সা চালান। স্বভাবতই সে খুব পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে আসছে। আমার অসহায় লেগেছিল একদিকে আমার উচ্চশিক্ষায় তাকে ইংরাজীতে সড়গড় করে তোলার দায়বদ্ধতা এবং অন্যদিকে তার সামাজিক, শিক্ষাগত অবস্থানের বাস্তব চিত্র। তখন আমার মনে হয়েছিল ২২টা ভাষায় হয়তো পৃথক পৃথকভাবে উচ্চশিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও কঠিন। কিন্তু যদি ইংরাজীর জায়গায় এটা হিন্দী হত, তবে তো সে আর আমি শুধুমাত্র ভাষার ব্যবধানে এতটা দূরত্বে দাড়াতাম না। তার নিজের দেশে নিজেকে এত প্রবাসী লাগত না। আমার বাড়িতে আসা যে বাউল, সে গর্বের সঙ্গে বলে, ‘আমি সারা দেশ ঘুরে বেড়াই জানো, তুমিও ঘুরতি পারো যদি হিন্দী কথা কইতে পারো। আমি পারি।’ তার সেই গর্ব আমাকেও স্পর্শ করেছিল। মনে হয়েছিল আসমুদ্র হিমাচলের একজন দেহাতী মানুষের সাথে তার হাসিকান্নার ভাষায় সামিল হতে আমার যেন কোন বাধা রইল নয়া। তাই বলছিলাম একটা দেশের ভিন্ন প্রদেশের মানুষ নিজেদের মধ্যে একটা ভাষাতেই কথা বলতে পারতেন। একটা ভাষাতেই গরীব ধনী নিজেদের মনের ভাষা লিখতে বলতে পারতেন। যোগাযোগটা আরো নিবিড় হত। কারণ তামিল, তেলেগু, মালায়ালম, কন্নড় ইত্যাদি ভাষার থেকে হিন্দী যতই আলাদা হোক না কেন, অন্তত ইংরাজীর চাইতে তো কাছাকাছি বটেই। সে একই মাটির গুণেই হোক, আর যেকোনো যোগসূত্রের জন্যই হোক। আবেগ এক, বৃহদাংশের ধর্মবিশ্বাস এক, ইতিহাস এক, তবে ভাষায় একটা একত্ব আসলে কি ক্ষতি ছিল? আজ সাহিত্য একাডেমীতে যখন ভারতের নানান ভাষার গল্পের অনুবাদ পড়তে পাই বেশির ভাগই হিন্দীতে, তখন মনে হয় ইংরাজীর চাইতে অনেক বেশি আমার কাছের। আমার বাড়িতে ঝাঁট দিতে দিতে যখন আমাদের কাজের মাসি টিভির দিকে তাকান, তখন যদি বাংলা বা হিন্দী কোনো অনুষ্ঠান হতে থাকে আমার লজ্জা লাগে না, কিন্তু যদি ইংরাজী কিছু হয় আমি চ্যানেল ঘুরিয়ে দিই।


সব শেষে আবার বলি, আমি ইংরাজী শিক্ষার বিরোধিতা করছি না, আমার আপত্তি ইংরাজী নির্ভরতার স্বদেশেই। সেই স্থলে হিন্দী অভিষিক্ত হোক। তবে যারা হিন্দী বলে তারা বেশি সুবিধা পাবে না? পাবে তো, কিন্তু সেই যুক্তিতে তো আমরা ইংরাজী পড়া থেকে বিরত হই না, কারণ পৃথিবীর বহুদেশ তো সেই ভাষাতেই কথা বলে থাকে। সেখানে আমরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছি না। তবে এখানেই বা পিছোবো কেন? বরং যে ভারতবর্ষটা ইণ্ডিয়ার বহু পিছনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে, হীনমন্যতায় ভুগছে, তার হাতটা ধরে তাকে তুলে নিয়ে আসি। এক আসনে বসি। ভাষাটা হৃদয়ের বাহ্য প্রকাশ। সেই প্রকাশে কথা প্রকাশিত হয়। স্টেশানে নেমে কুলির সাথে যে ভাষায় কথা বলছি, যেন সেই প্রদেশের উচ্চ আধিকারিকের সাথেও সেই ভাষাতেই কথা বলি। কেউ যেন হাঁ করে আমার বা আর কারোর মুখের দিকে তাকিয়ে না থাকে। কারণ একটা বিদেশী মাটিতে জন্মানো ভাষা তার স্বদেশের মানুষটা আর তার মধ্যে প্রাচীর তুলেছে বলে।


কোনোদিন হবে না জানি। তবু বলতে পেরে মনটা হাল্কা লাগছে। তর্ক চাই না। সহমত হলে খুশী হব, অমত হলে অবাক হব না।

482
Sun, 11/20/2016 - 09:30

ভিতরে যেন দু-মুখো আয়না বসানো। বাইরের দিকে মুখ করা যেদিক, তাতে পড়ছে বাইরের ছবি। আর ভিতরের দিকে মুখ করা যেদিক, সেদিকে পড়ছে ভিতরের ছবি।
     ভিতরের ছবিগুলো সাদাকালো। বাইরের ছবিগুলো রঙীন। ভিতরের ছবিগুলোতে যারা, তাদের জগতটায় আমি অকর্তা। বাইরের ছবিগুলোর জগতে আমিও একটা চরিত্র। আমি ইচ্ছা করলেই অন্য চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করলেও করতে পারি। বুঝতে অসুবিধা হল? দাঁড়াও একটু ভেঙে বলি।
     ধরো, তুমি আসতেই আমার মনে হল, আমি আজ তোমার সাথে খুব ঝগড়া করব... কিম্বা খুব উচ্চ-বিষয়ে আলোচনা করে তোমায় বিব্রত করব (অবশ্যই কোনো প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য)... অমনি আমি নিজেকে বাইরের দিকের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে সেরকমটাই সাজিয়ে নিলাম, যেরকমটা আমি চাই। আর তুমি আসতেই আমি সেইরকম করে অভিনয় করতে শুরু করলাম... আর অভিনয় করতে করতে খেয়াল রাখলাম ঐ বাইরের দিকে মুখ করা আয়নার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে... আমার অভিনয়টা খাঁটি হচ্ছে তো?
     মজার কথা দেখো... এই পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু ভিতরের আয়নায় ধরা পড়ছে... এমনকি, আমি যে মাঝে মাঝে নিজের অভিনয়টা যাচাই করে দেখছি, সেটাও ওই ভিতরের আয়নায় ধরা পড়ছে। ওই ভিতরের আয়নাটা সম্পূর্ণ আমার হাতের বাইরে। ওর কাঁচে ময়লা পড়ে না... ওর আয়নার দিক বদলানো যায় না...(ও এখানে একটা কথা বলে রাখি, বাইরের আয়নাটার কিন্তু মুখ কিছুটা হলেও ডাইনে-বাঁয়ে করা যায়। যখন যেমন ঘটনা দেখতে চাইবে, সে তখন সেই কোণ থেকেই ঘটনাটা দেখাবে। তোমাকে আজ আমি পরম মিত্রের কোণ থেকে দেখলেও, কালই চাইলে পরম বৈরির কোণেও আয়নাটা তাক করতে পারি)।
     ভিতরের আয়নায় যাদের ছায়া পড়ে, তাদের সবাইকে আমি নিজেও চিনি না। ওরা কখন আসে, কি রকম সাজে আসে, কি রকম অঙ্গভঙ্গি করে... তার কোনো দিশাই মানুষ সারাজীবন চোখ রেখেও বুঝে উঠতে পারে না। আমিও পারলাম না। পৃথিবীতে যত দর্শন বলো, ধর্ম বলো, সব ওই ভিতরের আয়নাটারই কথা। কিন্তু দেখো একের সাথে অন্যের কত অমিল। শুধু একটা জায়গাতেই সবার মিল, কি বলো তো? রহস্যের ব্যাখ্যা যে যেরকম ভাবেই করতে চেষ্টা করুক না কেন... রহস্যটাকে অস্বীকার কেউ করতে পারেনি। আস্তিক বলে, এই রহস্যের এক স্রষ্টা আছে, তাকে জানলেই সব রহস্যভেদ হবে। আর নাস্তিক বলে, এই রহস্য অনন্ত, অনাদি, স্বয়ম্ভূ। আর অজ্ঞেয়বাদী বলে, হবেও বা।
     যতই চেষ্টা করো, ওই ভিতরের আয়নার রহস্য বুঝতে পারবে না। তোমার আমার স্বপ্নের পর্দাও ওই ভিতরের আয়নাই। চলতে ফিরতে যখন কারোর ঐ ভিতরের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পারা যায়... তখনই আমরা তাকে বলি 'ভালোবাসা'। কি আশ্চর্য দেখো, সেও কেমন টের পায়, তার ভিতরের মুকুরে যেন কত জন্মের চেনা মুখের ছায়া। সে এগিয়ে এসে নিশ্চিন্তে তার হাত ধরে, বলে, তুমি যেখানে নিয়ে যাবে আমি যাব। তোমায় আমি চিনেছি, বাইরের পরিচয়ে না, ভিতরের পরিচয়ে।
     দেখো আরো কত কথা বলতে ইচ্ছা করছে। ধরো সেই মানুষটা বাইরের নানান ঘাত-প্রতিঘাতে পাল্টে গেল। তুমি দেখবে, একবার যাকে ওই ভিতরের আয়নায় দেখেছো, বাইরের হাজার পরিবর্তনেও তার সেই ছবি তোমার সেই অন্তরের আয়নায় বদলাবে না। তুমি তখন খুব গভীরে জানবে, মানুষটা এখন এরকম হয়ে গেলেও, কালের গতিকে আবার সে ফিরে আসবে। বাইরের আয়নায় তার মুখ যতই বদলাক, অন্তরের আয়নায় সেই স্থির দেখা মুখের সাথে আবার একদিন না একদিন মিলবেই। তুমি দেখবে, হয়ও তাই। হয় তো তার জন্য তোমার পুরো জীবনটাই কাটল, সে কাটলই না হয়; একটা মানুষকে সত্যি অর্থে পুরো পেতে এক কেন, লক্ষ জন্ম দেওয়া যায়... কি বলো যায় না? সেখানে কি আর আপোস চলে?
     আর যাকে বাইরের আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ভালোবাসতে চাও, সে নিতান্তই মোহ জেনো। সেও সত্যি, তবে মোহ হিসাবেই সত্যি। যেমন বর্ষার মেঘ শুধু বর্ষাকালেই সত্যি, তার পিছনের নীলাকাশের মত চিরকালের সত্যি সে কখনোই নয়।
     এই ভিতরের আয়নাটা মাঝে মাঝে বাইরের আয়নার আলোর বিচ্ছুরণে ধাঁধিয়ে যায় জানো! যেমন গ্রহণ লাগে, অনেকটা ওরকম। বুঝবে কি করে? দেখবে মনের মধ্যেটায় সব সময় কেমন একটা তৃষ্ণা। একটা ছটফটানি। তা হবে না? মানুষ নিজের বাড়ি তো আর নিজের তৈরি করা জমির উপর করে না, করে তো ধরিত্রীর উপর। তবেই যে না তার ভরসা থাকে। না হোক সত্তর তলা বাড়িই হল। তার ভূমির সাথে সম্পর্ক না থাকলে টিকবে? কি বলো? তেমনই এখানেও... বাইরের দিকের আয়না নিতান্তই চলমান অর্থহীন ছবি... ভিতরের আয়নাতেই তার অর্থপূর্ণ অবয়ব।
     তবে আমি কে? দুটো আয়নার ছবির মধ্যে যদি একটা গড় কষো... সেই আমি... আছি বটে... কিন্তু নেই...

483
Sun, 11/06/2016 - 10:00
  'প্রেম' অনুভূতিটা বিশ্বজনীন, কিন্তু 'ভ্যালেন্টাইনস ডে'টা আন্তর্জাতিক। এই দুটো শব্দ নিয়ে আজ কথা। যা কিছু বিশ্বজনীন তাই কি আন্তর্জাতিক? না। কিন্তু যতদিন যাচ্ছে কোথাও যেন আজকের এই অর্থশক্তি নিয়ন্ত্রিত বিশ্বে এইদুটো শব্দকে এক করে ফেলার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। যেন বোঝানো হচ্ছে কোথাও, দেখো যা কিছু আন্তর্জাতিক আসলে তাই বিশ্বজনীন। আবার এই আন্তর্জাতিক শব্দেরও অনেক জটিল অর্থ আছে। কোন কোন দেশে তা প্রভাব ফেলেছে দেখতে হবে। যেমন আমাদের দেশের কোনো শিল্প তথা উদ্ভাবিত বস্তু যদি শুনি কোরিয়া, শ্রীলঙ্কায় স্থান পেয়েছে; তখন আমরা তাকে ততটা আন্তর্জাতিক ভাবতে পারি না, যতটা আমেরিকাতে পেলে ভাবি। অর্থাৎ মার্কিন মুলুকের লোকেরাই সদর্থে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়ার আধিকারিক। তবে সে অন্য আলোচনা।    আমাদের লেখক কবিকুলের (বিশেষ করে আধুনিক কালের) বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে, তাদের পঠিত প্রিয় কবি লেখকদের যেসব নাম বলেন তাদের বহু মানুষকে উইকিপিডিয়া খুঁজে আমায় চিনতে হয়। মনে মনে আগে লজ্জা পেতাম, হায় রে এত কম জানি। আজ এই ফেসবুকের দৌলতে সে রহস্যের সমাধান হয়েছে। অনেককে ব্যক্তিগতভাবে যখন জিজ্ঞাসা করেছি, আপনি কবীর, দাদু, থিরুভাল্লাভুর, তুলসীদাস, মূল রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পড়েছেন? তখন দেখেছি রামায়ণ মহাভারত নিয়ে তাদের জ্ঞান অনেকেরই ওই টিভি সিরিয়াল অথবা ঠাকুমা ঠাকুর্দার মুখে শোনা গল্পগাথা অবধি। আর বাকিদের মূল লেখা পড়ার অবকাশ পাননি। তাই এখন আর লজ্জা পাই না।    যখন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়তে যাই, তখন দেখি তার ব্যবহৃত বেশিরভাগ উল্লেখ, উদ্ধৃতি আমাদের প্রাচীন অথবা মধ্যযুগীয় সাহিত্যকে আধার করে। বিদেশি নাম নেই যে তা নয়। কিন্তু দেশের গন্ধ অনেক বেশি। অথচ তারপর থেকে আশ্চর্যজনকভাবে আমাদের মানসলোক থেকে তাঁরা উধাও হয়ে গেলেন। কবে থেকে যেন মনে হল বিদেশি লেখকদের রেফারেন্স না দিলে যেন আমাদের জাতে ওঠা যাবে না। সে কি রবি ঠাকুরই আমাদের সব্বনাশটা করলেন? আন্তর্জাতিক হয়ে? কারণ এনারা তো দেখি, তামিল, তেলেগু, মারাঠী কোনো সাহিত্যিকের নামই করেন না। যেন ওসব দেশে সাহিত্য বলে কিছুর অস্তিত্বই নেই। আর থাকলেও যেন তা নিতান্তই পাতে দেওয়ায় মত না। এক বিখ্যাত কবি খালি খালি বিদেশী কবিদের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেলফি দিচ্ছিলেন। তা তাঁকে বললুম, “কত্তা আজ প্রেমচাঁদের জন্মদিন, এমনকি গুগুলও মনে রেখে তার ছবি দিয়েছে, আপনি যদি দুটো লাইন আপনার টাইমলাইনে ওর সম্বন্ধে লেখেন। তবে বাঙ্গালী আবার না হয় তার দিকে ক্ষণিক হলেও তাকায়।“ তা মেসেজ পড়া হল। কিন্তু উত্তর এলো না। টাইমলাইনে প্রেমচাঁদও এলেন না। তার মানে এই নয় যে আমি সঙ্কীর্ণ ন্যাশেনালিজমের পক্ষপাতিত্ব করছি।    আমার বক্তব্য হচ্ছে, বিশ্বজনীন হতে হলে কি আন্তর্জাতিক হতেই হয়? না তো। কবীর পড়তে গিয়ে, রামচরিতমানস পড়তে গিয়ে, উপনিষদ পড়তে গিয়ে এমন অনেক লাইন পেয়ে যাওয়া যায় যা বিশ্বমানবের কথা। আর তাই তা বিশ্বজনীন। বহু মানুষ তাদের কথায় নিজের কথা খুঁজে পেয়েছিলেন। কালের গতিকে তখন হয়তো তারা সে অর্থে আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারেননি। তো? খুব কি মান কমে গেল? নাকি বিশেষ কোনো পুরস্কারে ভূষিত না হলে তার মধ্যের বিশ্বমানবের অস্তিত্ব আমার কাছে অগম্য থেকে যায়?   আমার জানলার সামনে দেখতে পাচ্ছি অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। ঘরটা অন্ধকার হয়ে আসছে এই দিনের বেলাতেও। যদি এই বর্ষা, এই মেঘলা অন্ধকার, এই আমার একা ঘর আমায় কিছুক্ষণের জন্য মনের পর্দা সরিয়ে গভীর কোনো বিরহকে ছুঁয়ে ফেলতে পারে, সেই অনুভূতিকে কি শুধুই বঙ্গীয় বা ভারতীয় বলা ঠিক হবে? বিশ্বের অন্য কোন কোণায় আমারই মত মানসিক গঠন, এমন কোনো ব্যক্তিরও কি এক অনুভূতি হবে না? নিশ্চই হবে। কারণ এ সর্বজনীন অনুভূতি।   এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। ইদানীং যখন টলস্টয়ের বিভিন্ন কালজয়ী লেখায় ডুবে ছিলাম, তখন দেখেছি, যে অনুভূতিগুলোকে উনি ব্যক্ত করে চলেছেন তা সর্বজনীন অনুভূতি। আর তাই তিনি বিশ্বজনীন লেখক। সেই এক কথা রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, কে সচ্চিদানন্দ, প্রেমচাঁদ, ত্যাগরাজ, থিরুভাল্লাভুর, জ্ঞানেশ্বর ইত্যাদি সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমাদের খোঁজ হোক সর্বজনীন মানবিক উৎকর্ষতার, আন্তর্জাতিক বাজারি চাহিদার নয়। তা না হলে দিন দিন এক তথ্য-পরিসংখ্যান নির্মিত প্রাচীরে আটকে পড়ে প্রাণের সব রসটুকুকে জলাঞ্জলি দিয়ে চূড়ান্ত অবসাদের দিকে নিজেকে নিয়ে যাব। আমার ভয় হয় তাই যাচ্ছিও আমরা। বিদেশী সাহিত্য নিশ্চই পড়ব, তবে তা মানবিক উৎকর্ষতার গুণে পড়ব, আন্তর্জাতিক মহলে নিজের বিচরণ ক্ষমতা জানানোর জন্যে না। মনে রাখতে হবে, একজন মানুষ শুধুমাত্র নিজের ভাষাটুকু জানলেই তার মাধ্যমে বিশ্বমনের নাগাল পেতে পারে। অক্সফোর্ড অভিধানের অভাব তার বোধের খামতি ঘটাবে না, তথ্যের খামতি কিঞ্চিৎ ঘটালেও। উদাহরণ হিসাবে মনে করা যাক আজকের দিনের বিশ্ববরেণ্য ইরানি পরিচালক আসগার ফরিদিকে। তিনি ইংরাজী ভাষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ। তার 'Separation' সিনেমাটা যখন বিশ্ব দরবারে মনোনীত হল শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্র হিসাবে (সালঃ ২০১১) তখন তিনি অবাক হয়ে বলেছিলেন, 'এ সিনেমা তো আমি শুধুমাত্র ইরানের জন্য বানিয়েছিলাম। ভাবতেও পারিনি তা ইরানের বাইরেও সবাইকে স্পর্শ করবে।' অর্থাৎ তিনি অজান্তেই বিশ্বমনের কথা বলে ফেলেছেন। তাই হয়, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, 'বিভিন্ন ঘটনা ও চরিত্র তো সাহিত্যের উপলক্ষ্য মাত্র। লেখক বলতে তো চান তাদের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতার কথা।' যেমন নিজের মনকে জানলে বিশ্বমনের গতিবিধি টের পাওয়া যায়, তেমনই নিজের দেশ ও ভাষাকে জানলেই সর্বজনীন ভাষা ও দেশের গতিপথ অনুসরণ করতে সুবিধা হয়। তাই সবার খোঁজ শুরু হোক নিজের, তারপর বুঝে যাব স্বতঃই বিশ্বের আত্মীয়তার রহস্য। আন্তর্জাতিক না হলেও ক্ষতি নেই, বিশ্বমনের অধিকারি না হলে চূড়ান্ত ক্ষতি। তা না হোক এই প্রার্থনা।
484
Sat, 11/05/2016 - 12:32
p { margin-bottom: 0.25cm; line-height: 120%; }a:link { } ইচ্ছে ! –ইচ্ছে !সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।।
সেই তো আঘাত করছে তলায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়–
বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে।।
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (তাসের দেশ)   ১
---মানুষটা তবে কোথায়? মানুষটা একমাত্র তার ইচ্ছাতে। কারোর বাড়িতে যখন যাই, তখন সেই বাড়ির ভিত, দেওয়ালের পুরুত্ব, কি ধরণের ইঁট ব্যবহৃত হয়েছে সে সবের খোঁজ করি কি? না তো। দেখি ঘরটা কেমনভাবে সাজানো। দেওয়ালে কেমন রঙ। কারণ সেইখানেই সেই বাড়ির মানুষটার ইচ্ছার প্রকাশ।
কেউ যখন কোনো পোশাক কিনতে যায়, সে যে কারণে পোশাক কিনছে সে কারণটা আদিম – লজ্জা নিবারণের জন্য। সেখানে সে মানুষটাকে পুরোপুরি পেলাম না। যেখানে সে পোশাকের রঙ দেখছে, তার উপরের অলঙ্করণ দেখছে, সেখানেই সে আসল মানুষটা। মানুষ তাই একটা ইচ্ছা। তার শোক, দুঃখ, উচ্ছ্বাস সব থাকতে পারে। তবে সেগুলো নিতান্তই প্রতিক্রিয়ামাত্র। সে নয়। সে একটা ইচ্ছা। নির্মল, স্বাধীন, অকারণ ইচ্ছা।
তবে এই ‘ইচ্ছা’ শব্দ নিয়ে অনেক গোলমাল। ”আমার ইচ্ছা ছিল অমুক হব... আমার অমুক হবে... তমুক হবে...” এগুলো তবে কি? এগুলো ইচ্ছার শাখা-প্রশাখা হতে পারে। তবে ইচ্ছা নয়। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক একটা ঝর্ণা। স্বচ্ছ, উচ্ছ্বল, স্রোতস্বিনী ঝর্ণা। সেই হল আমার আলোচিত ইচ্ছা। তার গতিকে কোনো বিশেষ খাতে বইয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে বিশেষ উপযোগী করে তোলাকে আমি ইচ্ছা বলি নে। কারণ ইচ্ছার কোনো উপযোগীতা নেই। সে শুধুই ইচ্ছা। অবিরাম স্রোতের নির্মল প্রস্রবণ – ইচ্ছা।
আমার ইচ্ছাকে আমি উপযোগী বা ফলপ্রদ করে তোলার কাজে ব্যবহৃত করাকে নাম দিতে পারি – বাসনা, চাহিদা। ইচ্ছার কোনো চাহিদা নেই। ইচ্ছার কোনো বাসনা নেই। কারণ এই দুটোই তাকে বাঁধে। এই দুটোই শৃঙ্খল। ইচ্ছার কোনো বাঁধন নেই। তাই যদি কোনো চাহিদা ব্যর্থও হয়, ইচ্ছা জীবিত থাকলে সে তার মধ্যেও নিজের গতিপথ খুঁজে নিয়ে প্রাণের স্রোতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইচ্ছা জীবিত না থাকলে আসে হতাশা। ইচ্ছার অনুপস্থিতিকেই আমরা বলি অবসাদ।
ইচ্ছার ঝর্ণাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কি করে? তার সহজ উপায় নিজেকে শর্তমুক্ত করে। সে কেমন? যেমন আমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করাই যে আমার অমুকটা না হলে বা আমি তমুকের মত না হতে পারলে কিছুতেই সুখী হতে পারব না, সাথে সাথেই আমি আমাকে শর্তাধীন করে ফেললাম। নিজেই ইচ্ছাকে একটা কঠিন খাতে বইতে বাধ্য করালাম। ভাবলাম এই খাতেই আমার ইচ্ছাকে যদি পরিচালিত করি তবেই আমার সর্বাঙ্গীন লাভ। তা হয় না। মাঝখান থেকে আমার ইচ্ছাটার স্রোত অবহেলায় শুকিয়ে মরতে থাকে।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ শিশুরা। তাদের বাসনা নেই, ইচ্ছা আছে। তাই সারাদিন খুশি থাকার উপাদান খুঁজে নিতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। সারাদিন তাদের দৌরাত্ম্যের সাথে পাল্লা দেওয়া ভার। তবু তাদের সাথে থাকতেই আমার ভাল লাগে, হাল্কা লাগে। কেন? কারণ নিজের মধ্যের শুকিয়ে যাওয়া ইচ্ছা-প্রস্রবণকে তাদের মধ্যে খুঁজে পাই।
আজ অবধি তাই যা কিছু শুদ্ধ মহৎ সৃষ্টি হয়েছে, তা এই ইচ্ছার আঙিনায় হয়েছে। যে মানুষ হাজার অসুবিধা স্বীকার করেও নিজের গবেষণাগারে পড়ে থেকেছে, যে শিল্পী তার সমস্ত পার্থিব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে তার শিল্পের মধ্যে সমস্ত সত্তাকে ডুবিয়ে রেখেছে, কিসের শক্তিতে? তা ইচ্ছার শক্তিতে। কি পাবে সেটা বড় কথা নয়, সে যে নিজের ইচ্ছাকে রূপ দিতে পারছে তিল তিল করে, এতেই তার সার্থকতা।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আজ ইচ্ছার স্বাভাবিক গতি রোধ করে মানুষকে ভীষণ ব্যবহারযোগ্য করে তোলার কল চারদিকে। মানুষের আত্ম-প্রবঞ্চনার ক্ষমতা আর অলসতার প্রতি আকর্ষণ তাকে কি ভীষণ কুয়াশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সে বুঝেও বুঝতে পারছে না। তার কারণ যে শক্তির উৎস সে জন্মলগ্ন থেকে পেয়ে এসেছিল তার তো অকালনিধন সে নিজেই করে বসে আছে নিজের লোভের তাগিদে। সে আর কিছু না তার ইচ্ছাশক্তি। এখন তো তাকে সবার মত হতে হবে। হতেই হবে।


----ইচ্ছাকে একটু প্রাচীন কলেবরে দেখা যাক। আমাদের শাস্ত্র বলছেন – যিনি এক তিনি বহু হলেন কেন? উত্তর এল – তাঁর ইচ্ছা।
হ্যাঁ ঠিকই তো। মানুষ তার গভীরতম অংশে যদি কিছুর শুদ্ধ আভাস পেয়ে থাকে তো সে কি? তার আত্মা। আত্মা কি? শুভ ইচ্ছা বই আর কি?! সে বলেছে বিশ্বসংসারকে সে নিজের আত্মার মধ্যেই দেখেছে। সে কি করে সম্ভব যদি সে নিজের মধ্যে শুভকে না খুঁজে পায়? তবেই তো এতবড় শক্তি পেয়েছে যে সে রাজসিংহাসন ত্যাগ করেছে। ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছে। প্রফুল্ল মুখে বিষ পান করতেও দ্বিধা করেনি। কারণ সে নিজের মধ্যে তথা সারা বিশ্বের কেন্দ্রে এক শুভ ইচ্ছার অস্তিত্বকে অনুভব করেছে। বুদ্ধি দিয়ে নয়! চিন্তা করে নয়! নিজের সারাটা জীবন দিয়ে। বুদ্ধি দিয়ে জানলে তবু তার স্কুল-কলেজে ধর্ম-দর্শন পড়িয়ে, কিম্বা ভাষণ দেওয়ার পর ছুটি আছে। কিন্তু জীবন দিয়ে জানলে তার আমরণ ছুটি নেই। তাকে সেই শুভ ইচ্ছার দাসত্ব করতেই হবে।
তবে চারদিকে এত অমঙ্গল কেন? এর কোনো সোজা এককথায় উত্তর নেই। কারণ সংসারে শুভ ইচ্ছার একটা শত্রু আছে – লোভ। কেন আছে? জানি না। কেউ জানে না। তার হাতে বারবার হত্যা হয়েছে শুভ ইচ্ছার ধ্বজাবাহীদের। ভবিষ্যতেও হবে। মানুষ যাকে হত্যা করেছে, কাল তাকে সম্রাট বানিয়ে নিজের শ্বেতশুভ্র অঙ্কে ধারণ করেছে। তাই হত্যাকারীরা, চক্রান্তকারীরা ইতিহাসে হারিয়ে গেছে। তারা হারায়নি। হারাবেও না।


---তবে শিক্ষা কি হওয়া উচিৎ? এই শুভ ইচ্ছাকে বস্তু জগতে প্রকাশ করার সহায়ক। শিক্ষা তাকে তুলি দেবে, রঙ দেবে, সাদা কাগজ দেবে, অতীতের মহৎ সৃষ্টির নমুনা দেখাবে-- ব্যস এত অবধি। তারপর বলবে না, তুমিও এগুলিরই পুনারাবৃত্তি করো। বলবে, তুমি দায়িত্বশীল হও। এ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলো। শুভ ইচ্ছা যখন দায়িত্বশীল হয় তখন তা হয় সভ্যতা। আর শুভ ইচ্ছা যখন অনুকম্পার হাতে হাত ধরে তাকে বলি ধর্ম।
আমাদের পরম সৌভাগ্য এইদুটোই আমাদের কৃত্রিম উপায়ে রপ্ত করতে হয় না। আমাদের শুধু অলসতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে হয়। একটা রাশিয়ান প্রবাদ আছে – যে হাত ঘামে সে হাত মুঠো হয় না, যে হাত শুকনো সেই হাতই মুঠো হয়। আমাদের ঘর্মাক্ত কলেবরে জোয়ালটায় হাত দিতে হবে। আর কাউকে দিয়ে জোয়াল টানিয়ে, তাকে শোষণ করে নিজের আরামকে যখনই আমি কায়েম করতে চাইব, তখনই নিজের জীবনীশক্তিকে হত্যা করে নিজের আর তার, দুজনেরই বিনাশের খাল কাটব। সে মরবে বঞ্চনায়, আমি মরব স্থবিরতায়।
তাই বাঁচার সঠিক স্থান, আমার তৈরি প্রাসাদে না। ইচ্ছা-ঝর্ণার ধারে। সেখানেই আমি মুক্ত, সজীব, প্রাণোচ্ছ্বল। সেখানেই আমি সার্থক। মনে রাখতে হবে, ইচ্ছা ভবিষ্যৎ বা অতীতের গর্ভে জন্মায় না, ইচ্ছা শুধু বর্তমানের। অন্য ভাষায় ইচ্ছা মানে বর্তমান, এখন, এই মুহুর্তটা।  
485
Sat, 10/29/2016 - 19:33

চারদিকে আলোকসজ্জা। সন্ধ্যে হয়েছে বেশ খানিকক্ষণ হল। রাস্তায় হাঁটছি। কিছু একটা চিন্তা মাথার মধ্যে নিজের অজান্তেই চলছে। হঠাৎ কানে এলো একটা মহিলা কণ্ঠস্বর, অনুরাধা পাড়োয়াল, প্যাণ্ডেলে বাজছে, 'সময় তো থাকবে না গো মা'...
চিন্তায় ছেদ পড়ল। চিন্তার চাদর গা থেকে খুলে বাইরের জগতে চেতনা ফিরল। শুনলাম কোথাও বাজছে পান্নালালের কণ্ঠস্বর - 'আমি সব ছেড়ে মা ধরব তোমার রাঙা চরণ দুটি'। আরো এগোলাম। কোথাও শ্রীকান্ত আচার্য, কোথাও কুমার শানু, কোথাও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্য'র কণ্ঠস্বরে বেজে চলেছে শ্যামাসঙ্গীত। আজ হঠাৎ শ্যামাসঙ্গীতের মত করে আমার চেতনায় গানগুলো বাজল না। একটাই শব্দ মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করে উঠল মশালের মত - 'মা'।


মনের মধ্যে মন জাগল। আশেপাশের ভিড়ে সব মানুষকে হঠাৎ-ই মনে হল - কেউ একা, অসহায় নইতো। আমাদের সবার তো একজন মা আছেন! না, ঠিক বললাম না, আমাদের সবার মধ্যেই কোথাও একটা মায়ের জন্য আকুতি তো আছেই, না!


নেই? আছে। সারাদিনের নানান পরিশ্রম, আঘাত, উপেক্ষা, অপমান, বঞ্চনা, দুঃখ, লাঞ্ছনা সইতে সইতে যখন মনটা বিষণ্ণ হয়ে ওঠে, তখন একটা কোথাও সান্ত্বনা খুঁজি, একটু স্নেহ পাওয়ার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় এই ঘন অন্ধকারে, এই পাতালগামী হতাশার অন্ধকারে কেউ যদি আমার মাথায় একটু হাত রাখত, বলত এই তো আমি আছি। কোনো তুচ্ছ, হীন যাদুমন্ত্রে না, পবিত্র স্নেহের স্পর্শে আমার অবসাদগ্রস্থ আত্মাকে আবার পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারত- সে কে হত? সেই মা। পরম সান্ত্বনা, পরম বিশ্রাম, পরম আশ্বাস যেখানে - মা সেখানে।
পুরুষের বাহুবল আছে, বিপদ-ঝুঁকিপূর্ণ পথে ঝাঁপিয়ে পড়ার দুঃসাহস আছে। আরো নানান জায়গায় সে অগ্রগণ্য প্রকৃতির বরে। কিন্তু এসব উগ্রসুখের শেষে, প্রতিদিনের শান্ত পরিমিত নিত্য জীবনযাত্রায় সে নিতান্তই দুর্বল। নিজেকে সুষ্ঠুরূপে পরিচালিত করার ক্ষমতা প্রকৃতি তাকে দেয়নি। তার হাত ধরার প্রয়োজন হয় একজন নারীকে। যেরূপেই হোক। সে তার শারীরিক চাহিদা, মানসিক চাহিদার শেষে তার স্ত্রীর কাছে যেটা চায় সেটা আশ্রয়। তাকে ধারণ করবার আকুতি। নিজেকে সঁপে দেওয়ার ব্যকুলতা। সব পুরুষের গভীর অন্তরালে একটা মায়ের জন্য চাহিদা থাকে। কারণ এ ধারণক্ষমতা পুরুষের নেই যে, তাই পৃথিবীও হয়ে ওঠে Mother Earth. আর প্রকৃতি তো মা-ই। তবে পুরুষের অসুবিধাটা কোথায় এ শক্তিকে স্বীকার করতে? আছে তো। মহিষাসুরের বংশ কি শেষ হল নাকি? হয়নি। তাদের কথা আলাদা। আর যারা ভোলা মহেশ্বরের মত জগন্মাতার কাছে অহং বিসর্জন দিতে অপরাগ অথচ ঠিক মহিষাসুর গোত্রীয় নন (যাদের সংখ্যাই অধিক) তারা কি করবে? সে-ও মানবে। তবে নিজের পৌরুষের ঠুনকো গর্বকে বাঁচিয়ে রেখে। যেন সে তার হাতে হাত রাখা নারীটিকে বলতে চায় - “তুমি বুঝবে আমি কত অসম্পূর্ণ, দুর্বল তোমায় ছাড়া, কিন্তু কখনোই তা আমায় বুঝতে দেবে না যে তুমি বুঝেছো। আমার ইগোতে লাগবে। জানোই তো তোমার আছে পুরো সংসারটার ভিতর-বাইরে সত্যিকারের, আর আমার আছে শুধুই আমার পৌরুষের এই সাজানো বর্ম, জগতকে তাক লাগানো ছাড়া যার কোনো কাজ নেই; আর তাও সে করে নিজের ভিতর নিজেকে সম্পূর্ণ অসম্পূর্ণ জেনেই।”


খুব ক্লীশে শোনালেও, তাই যখন কোনো পুরুষ নারীজাতির অপমান করে তখন সে নিজের অস্তিত্বকেই বিপন্নতার মুখে ঠেলে দেয়। আর এদের কারোরই অন্তিম পরিণাম সুস্থ মর্যাদাযোগ্য থাকে না আর। এ কথা কোনো ব্যক্তি পুরুষের ক্ষেত্রেও যেমন সত্য ঠিক তেমন এক জাতির ক্ষেত্রেও সত্য। স্মরণে আসছে বিবেকানন্দের সেই পর্যবেক্ষণ, ভারতের অবনতির দুটো কারণ - এক, গরীবদের পদদলিত করা আর দুই, নারীজাতিকে অসম্মান করা।


খুব মধ্যযুগীয় কথা শোনাচ্ছে? এ মধ্যযুগীয় না, এ চিরন্তন সত্য। 'মা' - আমাদের সৃষ্টির প্রথম পরিচয়। 'মা'-ই আমাদের সারাটা জীবনের সুষ্ঠু পরিচালিকা শক্তি। দেখা যায়, যে পরিবারের মা সম্মান পান, যে পরিবারের মায়ের কথা যথাযোগ্য গুরুত্ব পায় সে পরিবারের শৃঙ্খলা তত সঠিক হয়, মাত্রানুগ হয়, মাধুর্যমণ্ডিত হয়। তবে কি সব নারীর মধ্যেই এই শক্তি, এই ক্ষমতা বর্তমান? আমার বিশ্বাস কম-বেশি অবশ্যই বর্তমান। তবে কোনো নারী যদি শুধু নিজের লাস্যতাকেই উপজীব্য করে বাঁচতে চান তার কথা আলাদা। তার পরিণাম সমষ্টির মূল ধারার পরিণাম নয়। কোথাও তো একটা অসম্পূর্ণতা থাকেই। সন্তান গর্ভে ধারণ করেই যে সে ধর্ম পালিত হয় তা তো নয়, সংসারে স্নেহের ক্ষুধা অপরিসীম। একজন মাদার টেরেসা, একজন মা সারদা, একজন নিবেদিতা না, বহু মাতৃত্ব সীমা ভাসিয়ে আজও বইছে বলেই সংসারটা এখনও টিকে আছে। সে স্পর্শ পাইনি এ কথা বলা পাপ, অকৃতজ্ঞতা হবে!


কথাটাকে আরো এগোনো যেতে পারে। 'মা' কি তবে শুধুই নারী জাতি? না। 'লাগে রহো মুন্নাভাই' এর একটি দৃশ্যের কথা মনে করাচ্ছি। যখন প্রধান চরিত্র মুন্নাভাই (সঞ্জয় দত্ত) তার বন্ধু সার্কিটের (আরশাদ ওয়ার্শি) প্রতি নিজের কৃতজ্ঞতা জানাতে, অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে কাঁদছে, আর বলছে, 'আমি যখন খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভরতি ছিলাম তুমি তখন গান গেয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে, ঠিক মায়ের মত!'
এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম - মায়ের মতো। একজন বন্ধু, প্রতিবেশি, সঙ্গী যে কেউ যখন আমার পাশে এসে তার স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেয় কোনো যৌন আকর্ষণ, স্বার্থগন্ধ ছাড়াই, তখনই তা মায়ের স্নেহের মত হতে বাধ্য (এখানে একটা কথা বারবার বলতে ইচ্ছে করে, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্কটা কোনো মতেই শুধু যৌন আকর্ষণ হতে পারে না। আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে 'সহধর্মিনী'। জীবনসঙ্গিনী ইত্যাদি শব্দ থেকে এই শব্দটার তাৎপর্য আরো গভীর বলে আমার অন্তত মনে হয়।)।


তাই মনে হয় এই 'মা' শব্দটার উপর যদি সত্যিই আমাদের শ্রদ্ধা জন্মায়, যেভাবে বিভিন্ন মাতৃসাধক তাদের নানান গীতাবলিতে, নানান পদে দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে এইভাবকে একাত্ম করে নেওয়ার পথ দেখিয়েছেন তবে আমরা আরেকটু বোধহয় বেশি অগ্রসর হতে পারতাম। তিনি কালী হন, দূর্গা হন, মেরী হন, গর্ভধারিনী হন, স্ত্রী হন, বন্ধু হন, যেই হন - অত্যন্ত শক্তিশালী ক্ষমতাকে স্বীকার করতেই হয়, নিজের মধ্যেও করতে হয়। না হলে বুদ্ধ কখনোই বলতে পারতেন না “মা তাঁর একটি মাত্র পুত্রকে যেরকম ভালোবাসেন, সেইরকম ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত জীবকে আগলে রাখবে।” কিম্বা চণ্ডী গাইতে পারেন - "যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা। / নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।।" মাতৃত্ব ইস্ট্রোজেন বা প্রজেস্টেরণ নির্ভর নয়, অথবা টেস্টোস্টেরণ বিরোধীও নয়।


আজকের রাতটা এই মাতৃত্বকে বিশ্বের নিরিখে দেখার রাত। একটা কুকুর বেড়ালের মা'ও যেমন তার সন্তানকে রক্ষা করে স্নেহের জোরে, একটা পাখি তার নীড়ে যেমন তার শাবকের জন্য মুখে করে খাবার নিয়ে আসে, একজন মানব মা তার দুর্বলতম সন্তানকে (প্রকৃতির কোলে দুর্বলতম হয়ে জন্মায় বোধহয় মানব সন্তান। মা তাকে কোলে না করলে তার স্তনপান করে বাঁচাটাও অসাধ্য তার পক্ষে, এমনই মাতৃস্নেহের উপর নির্ভরশীলতা তার) যেমন করে কোলে নিয়ে স্তন পান করান - এ সবের মধ্যে একটাই শব্দ আছে - মা। এই শক্তিকে অসম্মান করলে নিজের সর্বনাশ।
ছোটবেলা থেকে বড়বেলা অবধি নিজের মাকেই পরম আশ্রয় বলে জেনেছিলুম। পবিত্রতা কত হালকা করে মাকে জড়িয়েই বুঝেছি বড়বেলা পর্যন্তও। যত দিন গেছে, বুঝেছি মাতৃত্ব একটা এমন আলো সে যাতেই প্রতিফলিত হোক না কেন সে একই মাতৃত্বের প্রকাশ হবে। অনেক মা বলে কিছু হয় না, মা একজনই। সব দিকে শুধু তার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ মাত্র। তাই মাকে শেষ যাত্রায় এগিয়ে দিয়ে যখন ফিরছিলাম, দেখেছিলাম একটা বেড়াল তার বাচ্চাকে মুখে করে রাস্তা পার হচ্ছে। তৎক্ষণাৎ মনে হল মাকে হারালাম কই? এই তো মা। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে এক বৃদ্ধকে কাঁদতে দেখেছিলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে, তখন নাটমন্দিরে গান হচ্ছিল, “মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে... মাকে মনে পড়ে আমার”...পাশে তার স্ত্রী চুপ করে বসেছিলেন। তার মুখে অপরূপ গাম্ভীর্যতা। ভদ্রলোকের ডান হাতটা চেপে ধরে আছেন। মনে ভাবলাম, উনি কাঁদছেন কৃতজ্ঞতায় না যন্ত্রণায়? যন্ত্রণায় কাঁদলে মানুষের মুখে এমন সারল্য আসে কি? আসে না। বহু স্ত্রীকে বলতে শুনেছি, ‘ও যেন আমার আগেই যায়, ও নিজেকে সামলাতে পারবে না, চলতে পারবে না আমি আগে গেলে। বরং আমি পারব।‘


আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমাকে মধ্যযুগীয় বললেও বিশ্বাস করি, মেয়েদের জাত মায়ের জাত। তার অসম্মান করার অর্থ নিজের সব্বনাশকে ডেকে আনা। দক্ষিণেশ্বরের সেই পাগলা মানুষটাও আজ এই বাণীই শুনিয়ে সারা বিশ্বকে জয় করেছেন, তোমাদের একজন মা আছেন। অসহায়তা যত গভীর হবে, ডাক যত আকুল হবে, সে মায়ের অস্তিত্ব ততই প্রকট হবে তোমার কাছে। কাম না, অর্থ না - মানুষের পরম চালিকাশক্তি, পরম অন্বেষণ হল প্রেম। যার চূড়ান্ত প্রকাশ হলেন 'মা'।


(ছবিঃ সুমন)

486
Mon, 10/24/2016 - 17:30

---

তো হল কি, অনেকে বলছেন কাল কেমন বেড়ালুম সে বিষয়ে কিছু লিখতে। প্রথমে ভাবলাম লিখব না, কারণ গন্তব্য (কামারপুকুর-জয়রামবাটি) কিছু নতুন জায়গা নয়, আগেও গেছি, আর যাঁদের উদ্দেশ্যে যাওয়া তাঁরাও ঘরের মানুষ। তবে আর লেখার কি থাকতে পারে?

কিন্তু স্বভাবের দোষ বলে একটা কথা তো আছেই না! হাত যে নিশপিশ করতে থাকে। গল্প বলার ইচ্ছাটা ভিতরে ভুড়ভুড়ি কাটতে থাকে। অকম্মের ঢেঁকি হলে যা হয় আর কি! তাই ভাবলাম শুরু তো করি, না হয় কোনো গভীর তত্ত্বকথা নাই বা লিখলাম, ক’টা প্রাণের কথা লিখতে দোষ কি?
তো প্রায় রাতারাতি ঠিক হল - হৃদি কামারপুকুরে চলো মন। সাতসক্কালে পাড়ি দিলাম (সে খবর তো আপনাদিগের জানা, নইলে অত ভোরে কোবতে লিখে স্টেটাস দিতে কে যায়!)। ন’জন বন্ধু। নানান গল্প, লেগ পুলিং, সৎ প্রসঙ্গ, ইতর প্রসঙ্গ ইত্যাদি নিয়ে সাড়ে তিন ঘন্টার পথ। অবশ্যই উল্লেখ্য অসাধারণ রাস্তা! আমার পূর্বের অভিজ্ঞতায় রাস্তার অবস্থা খুব করুণ ছিল। এবারে দেখলাম পুরো ঝাঁ চকচকে, মসৃণ রাস্তা।
পৌঁছালাম কামারপুকুর হয়ে জয়রামবাটি। তখন দশটা। দুপুরে প্রসাদের জন্য কুপনের ব্যবস্থা থাকে। আগেই গেলাম সেই লাইনে। কুপন দেওয়া হচ্ছে। ছোট একটা ঘরে সন্ন্যাসী বসে, পাশে জনকয়েক টকটক করে লিখে ফেলছেন নানাবিধ ক্ষুধার্ত ভক্ত তথ্যাবলী। একজন ভদ্রলোক, কালো মোটা বেঁটেখাটো চেহারা, উদগ্রীব মুখে বললেন, “মহারাজ (সন্ন্যাসীদের এই নামে ডাকা হয়। নিশ্চয় কিছু গভীর আধ্যাত্মিক কারণ থাকবে। সে জানি না। তবে চেহারা ও মেজাজ- দুই মহারাজাজনিত হওয়ায় সে তত্ত্ব আর ঘেঁটে দেখার কারণ দেখি নে।), আমার পাঁচটা কুপন লাগবে।” মহারাজ গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, “তা তারা কই?” ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন, “এই আশেপাশে আছে আর কি।” মহারাজ সাতিশয় বিরক্ত হয়ে উঠলেন, সাথে তার পার্ষদরাও (পুরো রাজসভার মতই আর কি!), বললেন, “আনুন দেখি আগে।” (আমি ভাবলাম, হয়তো চেহারা বুঝে চালের মাপ নেবেন, অ মা! তা না গো। পরে শুনলুম, এনারা অদৃশ্য দ্যাবতাকূলে যে ভরসা রাখেন, দৃশ্য মনুষ্যকূলে সে ভরসা রাখতে পারেন না, মানুষ এতই দুষ্ট হয়েছে; তার কারণ অবশ্য নাকি কলি। কথাটা অস্বীকার করারও উপায় নেই। আমার সব পূর্বপুরুষেরাই এই কলিকালেই জন্মেছিলেন, তাই কলির আদিঅন্ত আজও ঠাহর করে উঠতে পারলাম না। আর দুষ্ট মানুষ যে আছে সে আর জানিনে! এত কষ্টে উপার্জিত অর্থ এঁদের, সেও যদি বারোভূতে লুটেপুটে খায়, তো দেশোদ্ধারটা কে করবে শুনি?) তো হল কি, একঘর গিজগিজ করছে ভক্তের দল, তায় আবার এতক্ষণ লাইনে দাঁড়াবার পর তিনি যখন শুনলেন মহারাজ সক্কলকে দেখতে চান, তার তো কাঁদোকাঁদো অবস্থা। তিনি কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন; উঁহু, এ বৈরাগ্যের প্রাণ বাছাধন, ওতে গলবেনি, অগত্যা তিনি সক্কলের উদ্দেশ্যে বাইরে এলেন।
আমি ইতিমধ্যেই আমাদের গ্রুপের সক্কলরে তলব দিয়ে বাইরের জানলায় দাঁড়াবার অনুরোধ জানালাম (অমনটাই রীতি আর কি, মহারাজ তার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে তাদের ক্ষুধার সততার মান বিচার করে কুপন দেবেন, অবশ্যই প্রণামীর বিনিময়ে হলেই ভালো)। তা কুপন নিয়ে বাইরে আসতেই দেখি সে ভদ্রলোক কোলে পিঠে দু’জনকে নিয়ে, পিছনে পিছনে তিনজন অবগুণ্ঠিতা রমণী সমভিব্যাহারে চলেছেন পরীক্ষালয়ের দিকে, থুড়ি মহারাজের ঘরের দিকে।
এবার মন্দিরে এলাম। সারদাদেবীর প্রস্তরমূর্তির সামনে সব চোখ বন্ধ করে বসে। ভাবলুম বসে কি হবে, চোখ বন্ধ করলেই তো সব সমান, সে আমার ঘরই হোক, কি এই মন্দির। বাইরে এলাম। উদ্দেশ্য আমোদর নদ। চড়া রোদ। একটা ভ্যান পেলাম। সাথে বেশ লম্বা খোঁচাখোঁচা দাড়িওয়ালা মাঝবয়েসী ভ্যানচালক। মুখটা দেখে বেশ লাগল। একটা নির্লিপ্ততা, উদাসীনতা আবার একটা কিছুর তৃষ্ণাও যেন। বললুম, “আমোদর নদ যাবে?” সে বলল, “ক’জন?” বললাম, “নয়জন, কত নেবে?” বলল, “নব্বই।” ওর বলার ধরণটা বেশ লাগল, যেন ওর ভাবতে পারা সবচাইতে বড়দরটা হেঁকেছে। বলেই সে আমার মুখের দিকে কুতকুত করে তাকাতে লাগল। আমারও মজা করার ইচ্ছা চাপল, বললাম, “দেব না নব্বই। একশো দেব।”
সে ক্ষণিক চুপ করে আমার মুখের দিকে তাকালো। তাকাবেই তো! আরে বাবা সংসারে তার আর আমার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক সেটা অর্থ ছাড়া আর কে বুঝিয়েছে অমন করে? তাই সে ভাবল - ইয়ার্কি। যেই তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “ডাকি সক্কলরে?” সে হেসে বলল, “তাইলে তো ভালোই হয়!” চড়লাম। সুমন ক’টা কলা কিনেছিল, বললুম, “খাও।” সে নিল। আমাদের ভ্যানের তলায় যন্ত্রের আওয়াজ- ভটভট... ভটভট... উপরে আমাদের হইহট্টগোল... সেও হাসছে... নিজের গ্রামের কথা বলছে... আমরা যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি, সেও বেশ মজছে। আমিও এতক্ষণে একজন অভক্ত পুরোদস্তুর মানুষ পেয়ে খুব স্বচ্ছন্দ অনুভব করছি। একটা গাছের গুঁড়িতে বসে তার সাথে গ্যাঁজাচ্ছি, একবন্ধু এসে বলল, “আপনার একটা ছবি নেব?” চালক প্রথমে ঘাবড়ে গেল, তারপর একগাল হেসে দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “দাড়িটা যে কাটা হয়নি।” আমি বললুম, “নাই বা হল, হোক ছবি।”
ছবি হল, ফিরে এলাম। প্রসাদের লম্বা লাইন। একজন সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরা মাঝবয়েসী ভদ্রলোকের পায়ে আমার এক বন্ধুর পা লাগতেই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, “আপনি মায়ের লোকের গায়ে পা দিলেন!” বন্ধুটি অবশ্য বলল যে সে ওই ‘মায়ের লোকের’ মাহাত্ম্য আগে জানত না, তাছাড়া ইচ্ছাকৃতও নয় ঘটনাটা।
যা হোক, লাইনে উৎকৃষ্ট সব আলোচনা চলছে। কোন মহারাজের সাথে কার ঘনিষ্ঠতা কত বেশি। কে কতবার মঠে যায়, কত জপ করে, কোন নক্ষত্রে কতবার জপে কি কি ফল... বলছেন, আর লাইনের মুখটা এগোচ্ছে কিনা খেয়াল রাখছেন। আমার সামনে একজন পঞ্চাশের কাছাকাছি উন্নাসিক ভক্ত দাঁড়িয়েছিলেন। তার সঙ্গীর সাথে হাইফাই গল্প করছেন, আর আড়চোখে আমাদের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন; বুঝছি উনি ইম্প্রেশান জমাতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু আমাদের ভক্তিহীন প্রসঙ্গে বারবার নিজের উচ্চ প্রসঙ্গ ব্যর্থ হওয়ায় চটেমটে নিজের সঙ্গীকেই বকাঝকা শুরু করলেন। আমার একটা ঘটনা মনে পড়ল। বেলুড় মঠে একটা বই কিনছি। দু’জন ভদ্রলোক আমার পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাসেট দেখছেন (তখনও সিডি আসেনি বাজারে), একজন বললেন, “এই বেদপাঠের ক্যাসেটটা নাও, আমি রোজ সকালে অফিস যাওয়ার আগে চালাই।” তার সঙ্গীটি বললেন, “আরে আমি তো সংস্কৃত কিছু বুঝি না।” তার সঙ্গীটি বললেন, “আহা, তুমি না বোঝো, তুমি চালালে পাশের বাড়ির লোক বুঝবে, হুঁ হুঁ কিছু একটা চলছে।” সঙ্গীটি ক্যাসেট কিনলেন। বুঝলাম পুরোদস্তুর ভক্ত হয়ে গেলেন।
মেয়েদের লাইনে অন্যকরম গল্প। ঘর গেরস্থলির নিত্যকার পরিচিত গল্প, আমার মনে হয় মেয়েরা বেশিক্ষণ ভান করতে পারে না, তাই যত উচ্চমার্গের আলোচনা দিয়েই শুরু করুন না কেন, একটু রান্নাঘরের গন্ধ কথাতে পেলেই ঢুকে পড়েন নির্দ্বিধায়, আর মনে মনে নিশ্চই বলেন, আঃ দিদি বাঁচালেন, ব্রহ্ম আলোচনা করতে করতে শুনতে শুনতে আরেকটু হলেই পা পিছলিয়ে সে ব্রহ্ম পোড়ারমুখোর ঘাড়ে পড়েছিলুম আর কি!

 

---

খাবার ঘরে ঢোকার সুযোগ হল। বিশাল হলঘর। মেঝেতে লম্বা মাদুর মতন কিছু একটা পাতা। সার দিয়ে বসানো হচ্ছে। পাশের লোকের থেকে আমার তিলমাত্র ফাঁক হলেই রে রে করে ভলেন্টিয়াররা তেড়ে আসছেন। আন্তরিক বকাঝকার সাথে সবটা ম্যানেজ করা হচ্ছে। সেই ভদ্রলোক আমার কয়েকজনের পরেই বসে। ইতিমধ্যে আমার উপর বেজায় চটেছেন, কারণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকাকালীন জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “এটা ছাড়া কুপনের আর লাইন হয় কি?” উনি ভর্ৎসনার ভঙ্গীতে বললেন, “কুপনের না, প্রসাদের লাইন বলুন।” বুঝলাম কুপনের ব্যাপারটা প্রসাদের মাহাত্ম্যে অযথা টাং অ্যাড়াক ওনার পছন্দ না।
যা হোক সক্কলে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে খাওয়া শুরু করলেন (আবার ইতর শব্দ, প্রসাদ গ্রহণ করতে শুরু করলেন)। সাথে আন্তরিক হম্বিতম্বি যারা শিবজ্ঞানে জীবসেবা করছেন তাদের। তারা খাইয়ে কৃতার্থ করছেন এমন ভাব, আর এরা খেয়ে ধন্য হয়ে যাচ্ছে এমন ভাব। মনে হচ্ছিল যেন কয়েদীদের খাওয়ানো হচ্ছে। মৃদু ব্যবহার নেই, ভালোবাসা নেই, সম্মান জানানো নেই। আসলে থাকবেই বা কি করে? সব তো ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে খরচ হয়ে গেছে, ভাঁড়ার তো শূন্য। আর সবই তো কর্মচারীরা করছেন, একজন সন্ন্যাসী শুধু দূরে দাঁড়িয়ে তদ্বির করে চলেছেন কর্তব্যজ্ঞানে।

এলাম কামারপুকুর। দরিদ্র মহিলারা আশেপাশে ঘুরতে লাগলেন, “দাদারা চলুন না ঘুরিয়ে নিয়ে আসি ঠাকুরের সব জায়গাগুলো, নিজেরা চিনতে পারবে না গো!” (‘গো’ - কথাটা একটা বিশেষ টানে উচ্চারণ করেন সব্বাই)। চেনা পথ, তাই নিলুম না কাউকে। হালদার পুকুরে সাপ দেখলাম, লাহাদের বাড়ির কিছুদূরে আকণ্ঠ মদ্যপানে দাঁড়াতে না পারা মাতাল দেখলাম, মাছের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকা পুচকে পুচকে ছেলের দল দেখলাম, ভাঙ্গা পরিত্যাক্ত দোতলা বাড়ি দেখলাম, ঠাকুরের পাঠশালায় সেলফি তোলা নরনারীর ভক্তিমহিমা দেখলাম। সব ঘুরে মন্দিরে যখন এলাম- সাড়ে তিনটে। দরজা খুলল। ঠাকুরের প্রস্তরমূর্তির সামনে দাঁড়ালাম।

মনটা টাটাতে লাগল। “কি চাই তোমার?” ঠাকুর না, আমি জিজ্ঞাসা করলাম। বললাম, “হ্যাঁ গো, তুমি কি তবে একটা পাথরের সাদা মূর্তি হবে বলে এত কিছু করলে? পুরো পৃথিবীটা যখন অর্থ আর বিকৃত কামনায় জর্জরিত হচ্ছে, তখন তুমি একটা সহজ রাস্তা বাতলে গেলে। ‘ভালোবাসো’ এই একটা প্রাচীন মন্ত্রকে নানান উপাচারে সাজিয়ে মানুষকে পূজা করে গেলে। জগতের মাকে নিজের মা বলে ভালোবাসতে বললে। সেই মায়ের একটা জলজ্যান্ত রূপও জয়রামবাটি থেকে আনালে। তারপর? কি হল? কি হচ্ছে? তোমায় ঘিরে এই মহারাজ কালচার শুরু হয়ে গেল কি করে গো? এত শাসন, এত নিয়ম, এত আড়ম্বর, এত ভেদাভেদ... তোমার পোষাতো এগুলো? প্রেমের বাণী তো বই খুললে আর ভাষণে, কিন্তু কাজে কই?”
“তবু তুমি থাকো। এই অসম্পূর্ণতার মধ্যেও থাকো। তুমি গেলে সব্বনাশ। ঘোর অন্ধকার।” অফিসঘরের বাইরে দেখলাম, এক প্রতিবন্ধী ভদ্রমহিলা, হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, সিঁড়িতে উঠতে চেষ্টা করছেন। এক পা তুলে আরেক পা তুলতে খুব যন্ত্রণা হচ্ছে, মুখের বিকৃতিকে হাসিতে ঢাকতে ঢাকতে নিজের থেকেই বলছেন, “ও কিছু নয়, ও কিছু নয়।”
রক্ষী একজন এসে বলল, “আপনি টাকাটা দিন, আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসছি”, উনি বললেন, “না। আমি নিজে যাব।” গেলেনও, আমার কেবল মনে হতে লাগল, ওই বিশালবপু গেরুয়াধারী এমন কি অর্জন করেছেন যে নেমে এসে ওনার হাত থেকে প্রণামীটা নিতে পারলেন না! উনি নিশ্চই সাশ্রুনয়নে সে উপকারটা মাথায় করে রাখতেন। না কি আমার বন্ধুর কথাটাই সত্যি, তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “হ্যাঁ রে মঠের চারদিকে এমন কাঁটাতারের বেড়া কেন রে?” সে বলল, “আরে অনেক দামী দামী মহারাজেরা থাকেন না! যদি কেউ উঠিয়ে নিয়ে চলে যায় তো!”
ফিরবার পথে পা বাড়ালাম। মনের কোণে একটাই কথা গুনগুন করতে লাগল, তবু তো এই সেই মাটি, যেখানে এমন দু’জন জন্মেছিলেন যাদের কিছু প্রয়োজন ছিল না নিজেদের জন্য - না অর্থ, না বিলাস, না নাম, না খ্যাতি। যারা মানুষের কাছে স্বর্গের না, মানুষের ঈশ্বরকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন, প্রতিদানে কিছুই না চেয়ে। বললেন, জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ। জিজ্ঞাসা করলাম, সেটা কি? বললেন, হৃদয়টাকে মাঠ করে দেওয়া, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া না। ওতে নিজে বেরোতেও খোঁচা, অন্যের আসতেও খোঁচা।

 

487
Wed, 10/12/2016 - 11:00


অত্যাচার দু'রকম হতে পারে। প্রমাণ সাপেক্ষ আর প্রমাণ সাপেক্ষ নয়। যা প্রমাণ সাপেক্ষ তার পরিমাপ নেওয়ার একটা পদ্ধতি আছে। আর যা প্রমাণ সাপেক্ষ নয়, তার স্বাভাবিকভাবেই পরিমাপ করবার কোনো উপায় নেই। প্রমাণ সাপেক্ষ আর প্রমাণ সাপেক্ষ নয়, দুর্নীতির ক্ষেত্রেও একই কথা।

কেউ যখন অপমানিত বোধ করেন অথবা দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন বুঝতে পারেন, তখন তা সবসময় কি তথ্যপ্রমাণ যোগাড় করে প্রমাণ করতে পারেন? না। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।
ধরুন আপনি ব্যাঙ্কে গেছেন। একটা কাগজের কাজ, যা ইচ্ছা করলেই ভারপ্রাপ্ত মানুষটি দুটো সই করে আপনার কাজ সেরে দিতে পারেন, তিনি আপনাকে দু'মাস ঘোরালেন। এটা আপনি কোন আইনে ফেলে সেই ভারপ্রাপ্ত মানুষটাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন? কোনো আইনেই নয়।
ধরুন আপনি ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের ঘরে ঢুকেছেন। আপনার বয়েস হয়েছে, হাঁটুতে ব্যাথা, দাঁড়াতে পারেন না বেশিক্ষণ। তিনি আপনাকে বসতে বলছেন না। এটাকে আপনি কোন ধারায় ফেলবেন? কোনো ধারাতেই না। এটা বারবার কেন হয়? একটু প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে ব্যাপারটাকে বোঝার চেষ্টা করি।
ক্ষমতার একটা নিজস্ব 'ভার' আছে। সাথে 'দায়' আছে। ভারের দিকটা অহংকারের। দায়ের দিকটা কর্তব্যের। আমি যখন সমাজে কোনো একটা শিক্ষায় (সেটা ওকালতি, শিক্ষকতা, চিকিৎসকতা - যা কিছুই হোক না কেন) একটা স্থান অধিকার করেছি, তখন এই দুটোই আমার উপর এসে বর্তায়। এখন কথা হল কোনটার ব্যাপারে আমি অধিক সচেতন, আমার পদমর্যাদা নিয়ে, না আমার কর্তব্য নিয়ে? এইখানে আসে একজন ব্যক্তির শিক্ষার, বিবেকের, বোধের প্রশ্ন। কেউ যখন বলেন, "আমি ভীষণ চেষ্টা করি...", তখন বুঝতে হবে তার চেষ্টায় যতখানি না আন্তরিকতা তার থেকে শতগুণ বেশি তার চেষ্টা করার দম্ভ। কারণ চেষ্টা কখনোই প্রচণ্ড হয় না, চেষ্টা একজন ঠিক মানুষের কাছে চিরটাকাল অতৃপ্তির অনুভূতি... ইস্... আরেকটু যদি পারতাম। অবশ্যই এটা তখনই সম্ভব যখন সে সেই কাজটাকে ভালোবেসেছে, সেই কাজের মধ্যে নিজের মানবিক উৎকর্ষতাগুলোর বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা দেখেছেন। নইলে একই কর্মক্ষেত্রে একজনের ভীষণ জনপ্রিয়, নির্ভরতার স্থান অন্যজনের থেকে হয়ে ওঠেন কি করে? মজার কথা তিনি নিজের এই ভাবমূর্তিটা সম্বন্ধেও অচেতন থাকেন। কারণ জনপ্রিয় হওয়ারও তো অনেক কৌশল থাকে, যা শুধু জনপ্রিয় হওয়ার উদ্দেশ্যেই পালিত। জনপ্রিয়তা সেখানে বাই-প্রোডাক্ট না। সেটাই মূল উদ্দেশ্য। সুতরাং ঘনীভূত প্রচ্ছন্ন অহং।
যে গাছ যতটা উঁচুতে ওঠে তার ছায়া ততটা দীর্ঘক্ষেত্র জুড়ে প্রসারিত হয় (তবে নারকেলগাছও সংসারে অনেক আছে, এও সত্য)। একটা উক্তি মনে পড়ল। জীবনে নিজের চোখে একজন মহাপুরুষকে দেখেছি – স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী। বেলুড় মঠের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি যুবক সন্ন্যাসীদের বলতেন, "দেখো তোমাকে যখন লোকে প্রণাম করেন, তখন তোমায় প্রণাম করেন না এটা মনে রেখো। তাঁরা নব্বই শতাংশ প্রণাম করেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব-মা সারদা-স্বামীজিকে, আর দশ শতাংশ প্রণাম করেন তোমার গেরুয়াটাকে। তবেই আর অহংকার আসবার জায়গা পাবে না।" এটা শুধু তো যুবক সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে না, সবক্ষেত্রেই সত্য। সবক্ষেত্রেই তো মানুষ মান দেন হয় আমার পদকে, নয়তো আমার অধীত বিদ্যাকে, অমুক নামধারী ব্যক্তি বিশেষকে তো নয়!
আমার ছোটমাসির কাছে একটা ঘটনা শুনলাম। আমার দাদু ডাক্তার ছিলেন। মাসি একদিন সকালে দাদুকে জলখাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে গিয়ে দেখেন, দাদু বারান্দায় পায়চারি করছেন। সকাল থেকে অনেক রুগী দেখেছেন দাদু। বেলা এগারোটা হয়ে গেছে। দাদুকে বারবার খেতে বলায়, দাদু কিছুটা রেগে গিয়ে বলেন, "আরে বেটা অমুকের আজ ইঞ্জেকশান নিতে আসার কথা, এখনো আসছে না, ও তো মারা পড়বে!”
আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে দাদু তাঁর লুনা নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যে রুগীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন, তিনি চাষী। তাঁকে মাঠে গিয়ে ধরেন। উত্তাল গালাগাল করেন, সেই মাঠেই ইঞ্জেকশান দেন, তার বাড়ির লোককে বুঝিয়ে আসেন রোগটা কতটা ভয়ংকর হতে পারে চিকিৎসায় গাফিলতি করলে... তারপর ফিরে এসে জলখাবার খান।
তবে কি এটা সার্বজনীন মনোভাব হতে পারে? কিছুটা তো হয়ই। প্রত্যেক জাতের একটা নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো থাকেই। না হলে একটা জাত আরেকটা জাতের থেকে এগিয়ে যায় কি করে? আমাদের দেশের উত্তর আর দক্ষিণ ভাগের মধ্যে এতটা আকাশ পাতাল ভেদ হয় কি করে? কোথাও ভালোর ভাগ বেশি খারাপের ভাগ কম, তো কোথাও উল্টোটা।
এ কি অপরিবর্তনীয় তবে? না। এরজন্য আত্মসমালোচনা প্রয়োজন। কি ব্যষ্টিতে, কি সমষ্টিতে আত্মসমালোচনা ব্যতীত উন্নতি অসম্ভব। আমরা যখন ছোট, তখন বাংলা সিনেমার হাল নিয়ে চূড়ান্ত অভিযোগ আসত। ধীরে ধীরে হাল বদলালো। আরেকটা মজার কথা, আমাদের ছোটবেলায় হিন্দী সিনেমা দেখলে তাদের কিছুটা বখাটেদের দলে ধরা হত। আজ সেই হিন্দী সিনেমার হাল দেখুন, 'পিঙ্ক' দেখতে দেখতে সেইটাই ভাবছিলাম, বাংলায় শেষ কবে এরকম একটা সিনেমা দেখেছি?
সন্ত কবীর বলতেন, নিন্দুককে মাথার কাছে নিয়ে শোও। কারণ সেই তোমার উন্নতির পথটা দেখতে সাহায্য করবে। তবে ব্যষ্টিতে যেমন আত্মসমালোচনা মানে শুধু নিজেকে বোঝায়, সমষ্টিতে একটা গোষ্ঠীকে বোঝায়। কোনো একটা বিশেষ রাজনৈতিক দল, অত্যন্ত স্বচ্ছতার দাবী/প্রতিশ্রুতি নিয়ে দল গড়ল। কিছুদিনের মধ্যেই আস্থা হারাতে বসল। তখন কেউ কেউ আত্মপক্ষ সমর্থনে বলল, আরে দেখুন ও ভালো কাজ করছে, সে ভালো কাজ করছে... কিন্তু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কিছু বলা-কওয়াতে ঢিলেমি আসতে লাগল। কেউ কিছু বললেই পাল্টা তীব্র আক্রমণ আসতে লাগল...জনক্ষোভ রাগে পরিণত হতে থাকল... ক্রমশ নেতা বনাম নাগরিক হতে শুরু করল। এই ‘বনাম’ শব্দটা খুব বিপজ্জনক। জনসাধারণ বনাম যখন কোনো প্রতিষ্ঠান হয়, বুঝতে হবে সেই প্রতিষ্ঠানে বহুদিন ধরেই আগাছা পরিষ্কার করা হয়নি।
সমাজটা ‘বনাম’-এর না, সহযোগিতার। তাই ‘বনাম’ এর উৎসটা যত ক্ষীণ হয়, যত স্বচ্ছ ও মানবিক হয় তত মঙ্গল। তত উন্নতির। কিছু বদলোক সবসময় থাকবে... খারাপ শিক্ষক, খারাপ ডাক্তার, খারাপ উকিল, খারাপ নেতা, খারাপ অফিসার, খারাপ সাধু... থাকবেই... দেখতে হবে তারা যেন পুষ্টি না পায়... আর সে দায় আমাতেই বর্তায়... যতক্ষণ না তাতে সফল হচ্ছি ততক্ষণ কাজলের ঘরে থাকলে কালি তো লাগবেই... যদি পরিবর্তন করতে না পারি, তবে মাথা নীচু করে স্বীকার করে নেব... নিজের বাড়ির ময়লা ফেলতে নিজে যাব, অন্যকে চ্যালেঞ্জ করার আগে... গলাবাজি করে তা ঢাকব না... কারণ একটা ভুল সব অহংকারী লোকই চিরটাকাল করে এসেছে... 'সাধারণ মানুষকে বোকা বানানো যায়।'
যায়, তবে বেশিদিন না। এটা মাথায় রাখতে হবে। আমার প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা রক্ষার দায় আমার, যদি আমি তার কর্মচারী হই। অন্যায়টা যখন হবে তখন চুপ করে বসে থাকব, নানান অজুহাত দেব, আর যখন তার জন-প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে তখন সোচ্চার হয়ে উঠব সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে, এ নিতান্তই ভণ্ডামী। এ দিয়ে সত্যকে ঢাকা সম্ভব না। যখন যুক্তিতে পারব না, তখন ব্যক্তিগত আক্রমণ করব, কিন্তু এ কদ্দিন? জল যে অনেক দূর গড়ালো..

488
Sun, 10/02/2016 - 11:35
    তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “শালা এবারের দোসরা অক্টোবরটা রবিবার পড়ে গেল। পুরো ছুটিটার পেছন মারা গেল।“  যিনি বললেন তিনি এইট পাশ বা মাধ্যমিক পাশ বা সাধারণভাবে স্নাতক নন। আরো দীর্ঘ তার শিক্ষা আমদানির তালিকা।  এটা অবশ্য নতুন কথা কিছু না। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি। তাছাড়া যার জন্য ছুটিটা, তিনিই বা কি এমন মানুষ? একজন অত্যন্ত কূট, পরশ্রীকাতর, দেশভঙ্গকারী, ঈর্ষাপরায়ণ, কামুক, স্বেচ্ছাচারী, গোঁয়ার, সুবিধাবাদী বিখ্যাত মানুষ। এর প্রতিটা বিশেষণের সাথে বহু ইতিহাসপ্রাপ্ত নিদর্শন তালিকা একটু পড়াশোনা জানা বাঙালীমাত্রই বলতে পারবেন (ব্যতিক্রমও আছেন অবশ্য, আমার মত ইতিহাসে কাঁচা)। টাকার নোটে কেন ওনার ছবি। নেতাজী বা ভগৎ সিং যাদের দেশপ্রেমের ক্যারিয়ারে উনি জল ঢেলেছিলেন তাদের ছবি থাকবে না কেন? আমাদের পাড়াতেই তো, ২৩শে জানুয়ারী পতাকা উত্তোলন হয়, আজকে হয় না। না হওয়ার জন্য উপরের কারণগুলোর থেকে আর বেশি কারণ নিশ্চই চাই না? আমি না সে আলোচনায় যেতে চাই না। এইসব উৎকৃষ্টমানের আলোচনা শুনতে শুনতে বয়েসটা গড়িয়ে অনেক হল। আর এসবে যেতে চাইছি না। তাই যদি সেরকম কোনো অভিসন্ধি নিয়ে পড়েন বা কমেন্টস করেন, আমার অনুরোধ প্লিজ করবেন না। কারণ সোজা কথা – আমি মানুষটার কাছে ব্যক্তিগতভাবে ঋণী। তাঁর অসামান্য আত্মজীবনীর জন্য বিশেষ করে।  বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর সুদীর্ঘ আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলছেন, আচ্ছা যদি গান্ধীকে নাৎজি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে হত, তবে কি অহিংসা কাজে আসত? বলেই বলছেন, তবে এর অর্থ এই নয় যে আমি অহিংসার পথকে অমান্য করছি। আমি সে পথকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি (প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, রাসেল জীবনের প্রান্তবেলায় কারাবরণ পর্যন্ত করেছিলেন কিছুটা যুদ্ধ বিরোধী কথা বলার জন্যেই, তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।)। এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। তবে বুদ্ধ, খ্রীষ্ট থেকে শুরু করে মহাপ্রভু অবধি এই পথের পথিক, কমজন না। সে সব জীবনেও আততায়ীর ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে। তবে মশালটা নেভেনি। কারণ তাঁরা কেউই একটা মানুষ নন, একটা চরিত্র, একটা ঘটনা, একটা দৃষ্টান্ত।  আসলে কোনো পন্থাকেই চূড়ান্ত পন্থা বলে ভাবার মধ্যেই ভুলটা হয়। আমি একটা পথে চলছি মানেই যে বাকি পথের বিরোধিতার কথা ভাবছি, তা কেন হবে? আজকের পরিস্থিতিতে দেখা যাক। আজ ভারত এক সংকটাপন্ন মুহুর্তে দাঁড়িয়ে। এখানে কি অহিংসা পথ চলবে? না। চলবে না। তবে কি মহাত্মা ভুল প্রমাণিত হলেন? কখনোই না। অহিংসার মূল কথাটা কাপুরুষতা না। তার মূল কথা হল – সত্যাগ্রহ।  এই সত্যাগ্রহ শব্দটার মধ্যে আক্ষরিক অর্থে না ঢুকে আরেকটু গভীরে গিয়ে তাকালে একটা বোধের আভাস পাওয়া যায়। সত্য'র শক্তিতে দাঁড়ানো। সত্যকে একমাত্র যুক্তি, আশ্রয়, উদ্দেশ্য আর উপায় ভাবা। অনবরত সত্য'র অনুসন্ধানে রত থাকা আর যেটুকু আলো পাওয়া যায় তাতেই নিজেকে সঁপে দেওয়ার জন্য প্রস্তত থাকা। তবে এখানে হিংসার কথা বা অহিংসার কথা কেমনভাবে আসে? আসে। হিংসায় সত্যকে দেখা যায় না। অহিংসায় দেখা যায়। অহিংসা মানে প্রেম বললে অনেক বড় শব্দ শোনায়। এতটা বলা যায় হিংসা না থাকা। প্রেম নাই বা থাকল। উরিতে যা ঘটানো হল – তা হিংসা। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বাইরের শত্রু আর লাগবে কেন? দেশের গভীরেও কত... এক ট্রেন নিরীহ মানুষকে ফিশপ্লেট খুলে দিতে তো কোনো পাক জঙ্গীসংগঠন আসেনি! সে কথা থাক। তবে ওটাই হিংসা। আর আমাদের এখন যা করা হচ্ছে, তা প্রতিক্রিয়া। আত্মরক্ষার্থে। তা কখনোই হিংসার পথ না। বাইরের আচরণই যদি আদর্শের পরিমাপ হবে, তবে আত্মঘাতী জঙ্গিরা মহাপুরুষের পর্যায়ে চলে যায়। ভুল হোক চাই ঠিক হোক, তারা একটা আদর্শের জন্যেই তো প্রাণ দিল! কিন্তু তারা তো আর সামাজিক জীব নয়। তাদের আদর্শ সত্যনির্ভর না। স্বার্থনির্ভর, হিংসানির্ভর। যদিও স্বার্থ আর হিংসা সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় একটু দূর এগোলেই। যে পথে দায়িত্ব নেওয়ার তাগিদ নেই, অধিকার আর দাবীর তাগিদে সব করা যায়... যে পথে কর্তব্যের কোনো দায়ভার নেই... সে পথে শুধুই উন্মাদনা। সবচেয়ে বড়ো কথা, সে পথ অমানবিক। এ কথাগুলো হয় তো বাহুল্যই হল। কিন্তু দেশে তাদের সমর্থন করার মতও এত ছদ্ম-উদারতার হিড়িক পড়েছিল ক'মাস আগে। তাই স্পষ্টভাবে বলে দেওয়াই সমীচীন মনে হল।  তা হলে সত্যটা কি? সেটাই সত্য যার উপরে পারস্পরিক সহাবস্থানের কথা ভাবা যায়। সে আমার পরিবারের বেলায় সত্য, পাড়ার বেলায় সত্য, দুটো দেশের মধ্যেও সত্য। মনে পড়ে সেই বিখ্যাত গান... “তোরা যুদ্ধ করে করবি কি তা বল... রাজ্যে রাজ্যে পরস্পরে দ্বন্দ্বে অমঙ্গল...” আর একথাটা আমরা বুঝি বলেই বর্তমান পরিস্থিতে সে দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছি না। আপ্রাণ চেষ্টা করছি যুদ্ধটার কোনো বিকল্প পথ খুঁজতে। কারণ আবেগে ভেসে, উত্তেজনায় একটা সিদ্ধান্তে লোকের চোখ ধাঁধানো যায় বটে, কিন্তু সে সিদ্ধান্তের দায়ভার বহন করার বেলায় ‘তু তু ম্যায় ম্যায়’ এসে পড়ে। অথবা নীরবে সরে দাঁড়াতে হয়, উদাহরণ – বুশ। এ তো গেল সমষ্টিগত জীবনের বিশাল ক্ষেত্রের কথা। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে এই সত্যাগ্রহের মূল্য কি? সে মূল্যও অপরিসীম। তার আগে বুঝতে হবে, সত্যের প্রধান শত্রু কে? সত্যের প্রধান শত্রু মিথ্যা না। প্রধান শত্রু হল অলসতা। আমি জানি সত্যিটা কি। তবু মানব না, কারণ আমার অলসতাকে আমি 'ডিফেণ্ড' করতে চাই। নানান যুক্তির মাধ্যমে বোঝাতে চাই... ”জাগায়ো না আমায় জাগায়ো না”... জাগলেই যে কাজে নামতে হবে। আর কাজ মানেই তো ঠিক বেঠিকের হিসাব করে সামনের দিকে এগোনো। কি দরকার, সবাই যা করছে, বলছে, ভাবছে তাতেই গা ভাসিয়ে দাও না। ঠিক হলে আমার লাভ, ভুল হলে সার্বজনীন দায়। কি মজা। ঘুম চলুক। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তর্ক বিতর্ক চলুক। ঘাম না ঝরুক, মাথা না ঘামুক। শুধু মুখ চলুক। মহাত্মার জীবনী লিখতে গিয়ে লুইশ ফিসার তার কালজয়ী বইতে বলছেন না, মহাত্মা কোনো বিশাল কাজ বা বড়ো কাজ করেননি, তিনি সেই সব কাজই করেছেন, যা চাইলে আমরাও করতে পারতাম, কিন্তু করিনি।   মহাত্মা এই সত্যের জায়গায় একটু সচেতন করে দিতে চাইছেন। সত্য'র উপর নিজের যা কিছু সব সমর্পিত রাখতে বলছেন। নিজের জীবনের যাবতীয় সঞ্চয় এমন একটা ব্যাঙ্কে রাখলাম, দিনের শেষে সে ব্যাঙ্ক ডুবে গেল, আমি দেউলিয়া হলুম। কারণ ব্যাঙ্কটা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মিথ্যার অঙ্কের মহিমায় আমায় ডুবিয়ে দিল। যে পরিমাণ লাভ সাধারণ ব্যাঙ্ক দিতে পারছিল না, সে ব্যাঙ্ক দিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। সত্য বলল, এ হয় না। শর্টকাট মানেই কোথাও একটা গোল আছে। লোভ বলল, তত্ত্বকথা রাখো। শেষে ভরাডুবি হল।  এই উদাহরণ রূপক জীবনাদর্শ হিসাবে যেমন সত্য, সারদা কাণ্ড হিসাবেও ততটাই সত্য। খুব কঠিন না এই অলসতা ত্যাগ করা; যেমন যতক্ষণ না বিষধর সাপ রাস্তায় দেখছি, ততক্ষণ লাফিয়ে পালানোর মর্ম বুঝেছি কি? না বুঝিনি। ততদিন পালানো উচিৎ, কি উচিৎ না এই তর্কে মজে আছি। ম্যাক্স মুলার বলতেন, সত্য যদ্দিন না অনুভূত হয়, তদ্দিন আউড়েই যায় মানুষ। তাতে কি আর পেট ভরে দাদা?  আমরা যে ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির উপর বসে আছি, সাধের সংসার পেতে দিবানিদ্রা দিচ্ছি, আর মাঝে মাঝে একটা আধটা ফুলকি দেখে ভাবছি, এ আর এমনকি... একটা বড় গামলা এনে সব লাভা সরিয়ে রেখেই আবার ঘুম দেব... সেই অজ্ঞতার উদ্দেশ্যে মার্টিন লুথার কিং -এর কথাটা বলে ইতি টানি... "We may ignore him at our own risk."
   
489
Tue, 09/27/2016 - 23:38

মনের মধ্যে দমচাপা ঘর কার না থাকে? সে ঘরে যেতে ভয়। সে ঘরে জুজুবুড়ির বাস। সে ঘরে একবার সেঁদোলে বেরোবার পথ পাওয়া দায়। সেখানে অনেক অপমান, অনেক ক্ষোভ, অনেক বিষজ্বালা। সে ঘরে অনেক অপূর্ণ সাধের দীর্ঘশ্বাস, অনেক স্বপ্নের জ্যান্ত কবর, অনেক অভিমান জমা জঙ্গলের একাকীত্ব।
সে ঘরে আমরা বড়ো একটা ঢুকি না। থাক বাবা। সে সাহস কে দেখাবে? খুঁচিয়ে ঘা করে কি লাভ বলো? কিন্তু যাব না বললেই তো হয় না, সে ঘরে না যাই, সে ঘরের অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করি এমন নির্বোধও তো নই। সে ঘরের তাপ আসে তো মাঝে মাঝেই আমার বসার ঘরে, শোয়ার ঘরে, স্নানের ঘরে।
সে ঘরে ঢোকে কে তবে? দু'জন। গভীর আনন্দ আর গভীর দুঃখ। এই দুটো অনুভূতিতে আমরা সে ঘরে ঢোকার সাহস পাই। তাই দুটোতেই চোখে জল।
গভীর সুখ জন্মালো বুকে। পাগল করা আনন্দ; বা আনন্দে পাগল, আত্মহারা। দড়াম করে ঢুকলাম সে ঘরে। চীৎকার করে বললাম, "আমি আছি, তবু আছি এই দেখো... আমি আনন্দেই আছি... কে বলল আমার সব হারিয়েছে? এই তো দেখো আমার বুকে ফুটন্ত সুখ..."
এতে কাজ হয়। কিছু বাষ্প সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছু দীর্ঘশ্বাস ওই আনন্দের সাথেই গলে জল হয়ে বেরিয়ে যায়, মিলিয়ে যায়।
কিছুটা তবু থেকেই যায়। ওরা তো থাকবেই। না হলে ভারসাম্য নষ্ট হবে যে মনের।
গভীর দুঃখেও সে ঘরে আসি। পা টিপে টিপে চোরের মত। যাতে ওরা জেগে না যায়। ঘরটার একটা কোণায় বসে দেখি। চুপ করে দেখি। অতীতের কত অপমান, কত ক্ষোভ, কত অব্যক্ত যন্ত্রণা স্তরে স্তরে সাজানো। আবার আমার কোলেও আজ একটা আরো নতুন অপমান, কিম্বা ক্ষোভ, কিম্বা সেই না বলতে পারা যন্ত্রণা, যাকে এই ঘরটার কোনো এক কোণায় স্থান দেব বলে নিয়ে এসেছি। কতক্ষণ একা বসে কাটে তার কোনো হিসাব থাকে না। বাইরের আকাশের রঙ পালটায়, ঘরের লোক কাজে যায়, কাজের থেকে ঘরে ফেরে – আমি নির্বিকার। আমি যে সেই দমচাপা ঘরে গো... ডাকলে বুঝি... ডেকো না এখন... এখন আমার সাড়া দেওয়ার মনটা নেই যে... সে মুখ ফিরিয়ে আমারই মুখের দিকে তাকিয়ে বসে... দমচাপা ঘরে...
তারপর কোনো এক ক্ষণে বেরোতেই হয় সে ঘর থেকে। তালা লাগিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। জমা কাজে হাত দিই। ভাগ্যিস সংসারে কাজটা বড়, মনটা না। না হলে চোখে পড়ত হয়তো... মনের গায়ে কালশিটে... জল জমেছে নাভির চারপাশে... মনের বুকের ভিতর ভীষণ শ্বাসকষ্ট...
কারোর চোখে পড়ে না ভাগ্যিস। সেখানে আমি যন্ত্র, মানুষের মত যন্ত্র। ভালোবাসাও যন্ত্রের আওয়াজের মত একটা বাই-প্রোডাক্ট। পেলে ভালো, না পেলেও ক্ষতি নেই। কাজটা হলেই হল। এই সময়গুলোতে এই যন্ত্র হতেই ভালো লাগে। সংসারে আমার দমচাপা ঘরের জিনিস তার নিজের দমচাপা ঘরে নেবে – এমন মানুষ কোথায়? সবারই যে ঠাসাঠাসি ঘর। তাই বুকের কথা সহসা কারো কাছে ফাঁস করে কি লাভ?
তবে সে ঘরে যে সহজেই ঢুকে যেতে পারে, তাকে আটকিয়ে রাখার জো কারোর নেই, এ আমাদের সকলের অভিজ্ঞতা। যেমন আমাদের পঁচিশে বৈশাখ... সে তো আমাদের সব ঘরে ঢুকে বসে। তাকে আসতে মানা করি এমন ক্ষমতা কার আছে? আমরা তাকে ডেকেই তো বলি... অনেকদিন চোখজোড়া শুকনো... আমায় কাঁদাও দেখি... “দেখি কেমনে কাঁদাতে পারো”...
আর যাদের এই পথ নেই, তারা নিতান্তই দুর্ভাগা। এর ওর কাছে কেঁদে-কঁকিয়ে তার সে দমচাপা ঘরে ঠেলে ঢোকাতে চায়... আর বলে, "আসুন না... দেখে যান... আপনি ছাড়া আমার এমন সুহৃদ আর কে আছে গো!" (এখানে একটা কথা বলে রাখি...যারা শুধু ওই ঘরের দিকে ঠেলার জন্যেই সুহৃদ খোঁজেন... তাদের কাছে প্রত্যেকেই যেন এক এবং অদ্বিতীয়ম এমনধারা ভাব করে থাকেন... খবরদার! সে ফাঁদে পা দিয়েছো কি মরেছো... তুমি ছাড়া সে ঘরে সেঁধুবার আর লোক নাই একথা মনেও স্থান দিও না। ঠকবে।)
সে ঘরের একটা রহস্য আছে। সে ঘরের তাপ কমাবার এক রহস্যময় উপায় জানি। বলি?
অন্য ঘরগুলোর পরিমাপ আর পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া। ওই ঘরটার বোঝা তখন অনেক কম। এবারের প্রশ্ন অন্য ঘরগুলোর মাপ আর সংখ্যা বাড়াবো কি করে?
খুব সোজাও না, আবার কঠিনও না। বই পড়ুন। নানান জীবনের বই পড়ুন। দেশ বিদেশের মানুষের কথা পড়ুন। বড় বড় চিন্তাবিদদের কথা পড়ুন আর ভাবুন।
আমরা ভাবি, আরে অত বড় বড় মানুষের কথা কি আর আমরা ছাই বুঝব? আচ্ছা বলুন দেখি, ওরা বড় হলেন কেন? কঠিন কথা বলেছিলেন বলে? না বহু মানুষের কথা একা নিজেই বলেছিলেন বলে। আপেল কেন মাটিতে পড়ে আমার না জানলেও জীবনটা ব্যর্থ হওয়ার কোনো কারণ দেখি নে, কিন্তু মনের কথা যারা বলে গেছেন, মানুষের কথা যারা বলে গেছেন তাদের কথায় না স্নান করলে প্রতিদিন, গায়ে গন্ধ হবে যে!

490
Sun, 09/18/2016 - 15:41

“সবাই যারে সব দিতেছে”...
"আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”...
“ওরা কাজ করে”...
"ওরা অকারণে চঞ্চল”...

‘সবাই’... 'ওরা’... এ দুটো শব্দের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে আর কি বলার। অহরহ ব্যবহৃত হওয়া অতি প্রয়োজনীয় দুটো শব্দ। আমি আপনি জগাদা পটাদা কাকা মামা পিসে ভাগ্নে ভাগ্নী বন্ধু... আমরা সবাই ব্যবহার করছি। আবার মন্ত্রী খেলোয়াড় জ্ঞানীগুণী মানুষ... ওরাও ব্যবহার করছেন।
  দেখুন, বলতে বলতেই, 'সবাই' আর 'ওরা' এই কথাদুটোর ব্যবহার করা হয়ে গেল। কে এই ‘সবাই’ আর ‘ওরা’?

সবাই
-----------
তা কে এই ‘সবাই’? সবাই মানে কি সম্পূর্ণ মানবজাতি? না একটা গোষ্ঠী বা দল বা সম্প্রদায়? কয়েকটা দিক থেকে ভাবা যাক। পৃথিবীর আদিমতম বিভাজনের মধ্যে অবশ্যই একটি বড় বিভজন কর্তা ধর্ম (religion অর্থে)। তাই দিয়েই শুরু করা যাক।
       কিছু ধর্মনীতিতে ‘সবাই’ মানে সবাই। সেখানে পশুপাখী থেকে জড়পদার্থ অবধি এক, যদি তা 'বেদান্ত দর্শন' হয় বা 'Pantheism' বা এই ধরণের কোনো দর্শনভিত্তিক ধর্ম হয়। আর যদি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম হয় তো তবে 'সবাই' মানে সেই বিশেষ ধর্মাবলম্বীরাই হবেন ‘সবাই’। অর্থাৎ ধর্মের ক্ষেত্রে ‘সবাই’ বললে, দেখতে হবে কোন সম্প্রদায়ের থেকে কথাগুলো উঠছে। যেমন বৈষ্ণব শাক্ত খ্রীষ্ট বৌদ্ধ মুসলমান ইত্যাদিরা যখন ‘আমরা সবাই’ বলেন তখন তা একটি বিশেষ বিশ্বাসের কথা মাথায় রেখেই বলেন। আর এই ‘সবাই’ এর সীমাটা যদি কেউ আত্মশক্তিতে বাড়িয়ে আরো বড় করে নেন, তখনই তৈরি হয় ইতিহাসের এক একটা অধ্যায়।
      এবার দেশপ্রেমের কথায় আসা যাক। ‘আমরা ভারতীয়’... 'আমরা আমেরিকান’... 'আমরা বাংলাদেশী’... অর্থাৎ, এ ‘সবাই’ও সারা মনুষ্যজাতি নয়। একে আমরা Nationalism বলি। এও এক ধরণের ‘সবাই’, কিন্তু সবাই না।
     এরপর আসে অর্থনীতি অনুযায়ী। ‘আমরা মধ্যবিত্তেরা’ – এক প্রকার 'সবাই'। ‘আমরা গরীব লোকেরা’ – আরেক প্রকার 'সবাই'। এরকম নানারকম 'সবাই'।
     তারপর রাজনীতির 'সবাই'। ‘আমরা লাল’... 'আমরা সবুজ’... 'আমরা গেরুয়া’... আবার 'সবাই'য়ের লিস্ট। কিন্তু সব সবাই 'সবাই' না। অথচ ভাষণে দেখুন বলা হচ্ছে, ‘ভাইসবগণ, আমরা...’ ইত্যাদি। কোন লোকেরা ভাইসব আর কোন লোকেরা নন, তা ভোটের রেজাল্টের পর বোঝা যাচ্ছে।
     তারপর শরীরের রঙ, উচ্চতা, সৌন্দর্য্য, যৌনতার নানান প্রকারের উপরে ‘আমরা সবাই’ আছে।এরপর খেলা, পেশা, শিক্ষা, রাজ্য, জেলা, পাড়া, বাঙাল-ঘটি, স্মার্টফোন-বেসিক ফোন, উত্তম-সৌমিত্র, দেব-জিৎ ইত্যাদির 'আমরা সবাই' দল তো আছেই। আরো কত উহ্য গেল।
     তা দাঁড়ালো এই, সব ‘সবাই’ কিন্তু সবাই না। তা হলে কার 'সবাই' কতটা সেটা কিসের ওপর নির্ভর করছে? এ বলা শক্ত। আমরা যখনই উচ্চারণ করছি ‘সবাই’, তখনই ভাবখানা এমন যেন বলতে চাইছি বিশ্বশুদ্ধ সব্বাই। তা তো নয়। ‘সবাই’ মানে একটা দল। এইটাই সঠিক ব্যবহারযোগ্য ধারণা।

ওরা
--------
     এখন এই ‘ওরা’টা তা হলে কারা? সহজ হিসাব। যারাই ‘সবাই’ এর মধ্যে পড়লেন না, তারাই হয়ে গেলেন ‘ওরা’।
     এই ‘ওরা’ শব্দটার উপর আমাদের একটা গভীর ঈর্ষা বিদ্বেষ, আবার মনের গভীরে কোথাও একটা লোভও। ‘ওরা’র কিছুকে যদি ‘সবাই’ করে নেওয়া যায়, কেমন হয়? বেশ হয়, না? মানুষ নিশ্চিন্ত হয় ‘সবাই’ শব্দের আশ্রয়ে। বড় সংখ্যার গর্বে। কিন্তু ধরা যাক যদি, ‘ওরা’র চক্করে ‘সবাই’ এর সীমা কমতে শুরু করেছে, তখন? তখন আমি মনে মনে প্রমাদ গণি।
     আমরা শ্রেষ্ঠ। আমরা আমরাই। ওরা ওরাই। আমরা আছি, ছিলাম আর থাকব। ওরা যে কেন আছে? বাড়তি লোকজন সব! আমাদের মতের বিরুদ্ধে যায়। আমরা আস্তিক, ওরা নাস্তিক। আমরা শাসক, ওরা বিরোধী। আমরা স্বাভাবিক, ওরা সমকামী, হিজড়া ইত্যাদি, মানে ভালো ভাষায় LGBT আর কি! আমরা সঠিক, ওরা সম্পূর্ণ ভুল না হলেও অতি ক্ষুদ্র অংশেই হয় তো বা ঠিক, যা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না আমাদের সাথে তুলনায়!
     এই উন্নাসিকতা মনের গোপনে সব ‘সবাই’ এর আড়ালে কিছুটা হলেও থাকে। এও দেখেছি, যারা কোনো ‘সবাই’ এর মধ্যে ঢুকতে পেলো না, তারাও নিজেরা একটা আলাদা ‘আমরা সবাই’ বানিয়ে নেয়।
     'সবাই' আর 'ওরা' – দুটো স্বতঃবিরোধী শব্দ। তবে কি এর মীমাংসা হয় না?

     হয়, একটা শব্দেই হয়। সেটা হল আধুনিক বিজ্ঞান। আমি বিজ্ঞান বলতে Technology বলছি না। আমি বিজ্ঞান অর্থে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলতে চাইছি। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান।
     আর সেই বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে যে ধর্ম, তাকে বলি – মানবধর্ম। আমার খিদে যেমন পায়, তোমারও তেমন পায়। আমার হাড় ভাঙলে যেমন যন্ত্রণা হয়, তোমারও হয়। হয়তো তোমার সহ্যক্ষমতা আমার থেকে বেশি, তাই প্রকাশটা আলাদা কিন্তু যন্ত্রণাটা সমান।
   এ যেন অনেকটা সেই গোল্ডেন রুলের মত কথা – অন্যের সাথে তেমন ব্যবহারই করো, যেমন ব্যবহার তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো।
    সেই বিজ্ঞানে এসে আমি তুমি রাম শ্যাম সব এক। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ‘ওরা’ শব্দের ঠাঁই নেই। যেখানে আছে সেখানেই সে ব্যর্থ। আর সঠিক দর্শনেও সেই ‘ওরা’ শব্দের অস্তিত্ব নেই। তাই যেখানেই এই মূল কথাটা থেকে ধর্ম সরে গেছে, সেখানে সে উগ্র হয়ে উঠেছে। আর বিজ্ঞানও যেখানে দল পাকাতে গেছে সেখানে সে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। তার ‘সবাই’-এর চারদিকে শক্ত বেড়া। ‘ওরা’ শব্দের অস্তিত্বটাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছে আর শিখিয়ে চলেছে তারা। তার সমাপ্তি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – অপঘাতে।
      তাই আমাদের সেই দর্শনের দিকে আরো জোর কদমে এগোতে হবে যে দর্শন আমাদের ‘সবাই’-এর পরিধি বাড়িয়ে ‘ওরা’কেও মিলিয়ে নেবে। তবেই শান্তিতে সহাবস্থান। খেয়াল করে দেখতে হবে, আমাদের ‘সবাই’-এর ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে কাউকে জোর করে না ঢুকিয়ে, ‘সবাই’টাকেই বাড়িয়ে নিলে হয়, যাতে ‘ওরা’ও আমাদের ‘সবাই’ এর আওতাতেই এসে পড়ে।
     শ্রী সারদা দেবীর মৃত্যুর প্রাক্কালে উচ্চারিত সেই অমোঘ নিদানটি মনে পড়ল – "জগতে কেউ তোমার পর নয়, জগতকে আপনার করে নিতে শেখো।"
     বিস্ময় জাগে এতবড় ক্ষমতা পেয়েছিলেন কি করে? আর শুধু তো বলেননি, করেও দেখিয়েছিলেন। এক তথাকথিত সমাজের অচ্ছুৎ মানুষের যখন তিনি এঁটো তুলছিলেন, একজন ভৎর্সনা করে বলেন, “কি ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়াচ্ছো? তুমি না বামুন?!”
     সারদা দেবী তাকে জবাব দেন, “ছত্রিশ কইরে? সবই তো দেখি আমার।”
     ইতিহাসে এমন অসামান্য চরিত্র আর ক'টি এসেছেন জানি না, আর আসবেন কিনা তাও জানি না। মহান কর্মক্ষেত্রে নয়, আটপৌরে জীবনযাত্রায়, প্রতিদিনের হাজার তুচ্ছতার মধ্যে এমন একটা জীবনী – খুব বড় একটা অনুপ্রেরণা তো অবশ্যই। এতবড় উদাহরণ ঘরের পাশে থাকতে আর এদিক ওদিক দৌড়িয়ে কি হবে? তবে সে অন্য আলোচনা।

491
Mon, 09/05/2016 - 11:59

"এখনকার ছেলেমেয়েরা স্যারেদের আগের দিনের মত সম্মান করে না। আগে হাজার মারধর করো মুখে 'টুঁ' শব্দ করত না। আগেকার দিনে পড়াশোনাও অনেক ভালো ছিল এখনকার থেকে। এখনকার মত এত নোটস মুখস্থ, টিউশান পড়ার ধুম ছিল না। স্যারেরাও স্কুলে খুব ভালো পড়াতেন। ওতেই সব হয়ে যেত।"


উপরের কথাগুলো শুনে বড় হননি এমন বাঙালী মেলা ভার। কথাগুলো আংশিক সত্য তো বটেই। একটা কথা বাজারে আছে, আধুনিক বাজারে, 'Knowledge Transfer'. এখন কথা হচ্ছে, এই তথ্য স্থানান্তরণের সাথে শিক্ষা দেওয়ার মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই আজকের শিক্ষা পদ্ধতিতে। আমি অনেক তথ্য জানি, তুমি এসো তোমার মাথায় ঢুকিয়ে দিই। আমার এই তথ্য ঢোকানোর কৌশল যত সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম হবে, আমার দক্ষিণাটাও ততটা ভারী থেকে ভারীতর হবে।


এই শিক্ষা স্থানান্তরণের পদ্ধতিটির ভাবটা আমাদের সমাজে এখনো খুব একটা সড়গড় নয়। যদিও খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই এখনো দেখেছি অনেক অভিভাবক তথা ছাত্রছাত্রী টাকাপয়সার কথা সরাসরি বলতে একটু সংকোচ বোধ করেন। বেশিদিন এ সঙ্কোচ থাকবে না অবশ্য। এর একটা বড় কারণ হল, আমাদের সেই প্রাচীন ‘জ্ঞানদান’ ধারণা। অর্থাৎ বিদ্যা দান করা যেতে পারে, কিন্তু কখনোই বিক্রি করা যাবে না। অস্বীকার করার উপায় নেই এটা সত্যিই অত্যন্ত উচ্চ আদর্শ। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এ ভাব বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই এখন জ্ঞান তথা তথ্য তথা কৌশল বিক্রির যুগ। আর সব কিছুর মত এটাও একটা বস্তু। এও ব্যবসার কাঁচামাল। পুঁজি। তাই এখন সেই জ্ঞান তথা তথ্য তথা কৌশল বিক্রেতা, কোনো অতিরিক্ত মান-সম্মান আশা করে বসলে সেটা নিতান্তই অতিরিক্ত চাওয়া। ক্রেতা বলে বসলেন বলে, 'কেন বাপু, ন্যায্যমূল্য কি ধরে দিইনি? আপনার কথা অনুযায়ী অগ্রিমও তো দিয়েছি (একটা কথা মনে থাকতে থাকতে এখানে সেরে রাখি, সেই পুরাতন যুগের ধ্যানধারণায় চলা শিক্ষকও যে নেই তা নয়, তাঁরা এখনও আছেন; আর ‘আমায় সম্মান করো’ বলে নাকীকান্না জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর দলে কোনোদিন নেই তাঁরা। তাঁদের সময় কোথায়? একদলকে তৈরি করে রণাঙ্গণে পাঠাতে পাঠাতেই যে আরেকদল এসে হাজির তাঁদের দোরগোড়ায়।)!'


এ তো গেল শিক্ষকের পদের স্থানান্তরণ। আরেকটা সমস্যা ক্রমশঃ জটিল হয়ে উঠছে – 'Burden Of Knowledge' - জ্ঞানের বোঝা। যতটা জানলে কাজ চলে যায় তার চাইতে বেশি জানাটা ক্ষতিকারক না লাভদায়ক? আপাতদৃষ্টিতে লাভদায়ক হলেও আগাম একটা বিপদের বার্তা সে নিয়ে আসছে। দেখা যাচ্ছে, বেশি জ্ঞানের বা তথ্যের ভারে তার স্বাভাবিক চিন্তা করার বা তার মধ্যের Intution বা স্বজ্ঞার তীক্ষ্ণতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। যখনই কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ছে, সে তার Ready-made Database হাতড়াচ্ছে। সেখানে কোনো সাহায্য না পেলে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে, কি করে এই আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে! ইন্টারনেটে বসছে, নানান জনের নানান অভিজ্ঞতার তথ্যের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকছে। দরকাঁচা কোনো উত্তর পাচ্ছে, তাকেই সে চরম সত্যি বলে মেনে নিয়ে বাস্তব জগতে কাজে লাগাতে যাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। আবার ইন্টারনেট ঘাঁটা। আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। লেগে গেল তো ভালো, না হলে সংকর অবস্থায় সঙ্কটাপন্ন থাকা।


এর প্রধান কারণ, তাকে যুক্তিপূর্ণ চিন্তা করতে শেখানো হয়নি ছোটোবেলা থেকে। তাকে ভুল করার খুব একটা অবকাশ দেওয়া হয়নি। যে সবসময় অন্যের জ্ঞানের ভাঁড়ারঘরে অনায়াস যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছে অর্থবলের বিনিময়ে, সে কেন খামোখা খেটে মরবে নিজের ভাঁড়ার ঘর তৈরি করার জন্য?


একেই বলা হচ্ছে 'জ্ঞানের বোঝা' বা 'জ্ঞানের বাধা'। কারণ আহৃত জ্ঞান মানেই অতীতের তথ্য সঙ্কলন। যে সবসময় সেই মৃত তথ্যের উপর চলাফেরা করতে অভ্যস্ত হবে তার ক্ষেত্রে জীবন মানেই একটা চূড়ান্ত নিরাপত্তায় ঘেরা আবাসন হবে। সব কিছুর মধ্যেই চরম নিশ্চিন্ততা খোঁজাটা দুর্বলতার অলসতার লক্ষণ। আর মানুষের সবচাইতে অলস যন্ত্রগুলোর মধ্যে একটা হল তার মস্তিষ্ক। সে যদি না খেটে, শুধু অন্যের ধনে ভাগ বসিয়ে চালিয়ে নিতে পারে তবে কেন আর লড়তে যাবে বেকার বেকার?


তার অন্তঃকরণের এই চূড়ান্ত পঙ্গুত্বকে, এই পরনির্ভরশীলতাকে সে স্বাধীনতা নাম দিয়ে বসছে। কারণ এখন স্বাধীনতার একটা সহজলভ্য সমার্থক শব্দ হচ্ছে, 'ক্রয়ক্ষমতার পরিমাপ'। একটু ভাবলেই এর অসারতা দৃশ্যমান, তাই এই নিয়ে আর কথা বাড়ানো নিষ্প্রয়োজন।
এর উল্টোটা যদি অভ্যেস করানো যেত? যদি তাকে লাইফবোটের জোগান না দিয়ে সাঁতার শেখানো হত ছোটোবেলা থেকে? তবে তো আর সে ‘বিদ্যাবোঝাই বাবুমশাই’ হত না? সে মননের গভীরতায় ডুব দিতে পারত। আরো বেশী আত্মবিশ্বাসী, আরো বেশি নিজের কাছে নিজে সৎ হতে শিখতে পারতো। আমার মনে হয়, জগতে আরো নানান কাজের দিক তৈরি হত। কারণ, যে যার রুচি অনুযায়ী জীবনধারণ করার স্বাধীনতাকে স্বাধীনতা বলত। দিনের শেষে সে আর টাকার অঙ্কে নিজের সফলতা বিচার করত না, করত নিজের আত্মপ্রসাদে, যেটা সে নিজের কাজের মাধ্যমে পেয়েছে।


আর ঠিক সেই দিন সে সঠিক অর্থে 'শিক্ষক দিবস' পালন করতে পারত। সে বুঝতে পারত, যে দামী লাইফবোট যুগিয়েছে সে তার সেদিনের সত্যিকারের সুহৃদ ছিল না, যে বারবার তাকে মাঝনদীতে ঠেলে দিয়েছে, সাঁতার কাটার উৎসাহ যুগিয়েছে, সেই-ই তার সত্যিকারের শিক্ষক ছিল, আছে, থাকবে।


ঠিক তাই 'তোতাকাহিনী'র লেখককে আজও এত বেশি করে দরকার হয়, সব কম্পিউটার Shut Down হয়ে যাওয়ার পর। সাঁতার শেখা বাকি আছে যে এখনো।

492
Thu, 08/25/2016 - 10:25

মানুষ মানুষের চাইতে অতিরিক্ত বেশি কিছু চায়। অতিমানবিক ক্ষমতা চায়, অতিমানবিক ঈশ্বর চায়, অতিমানবিক দর্শন চায়। কিন্তু সে সবই তার বিকারের চাওয়া। কথামৃতে একটা গল্প আছে, একজন বিকারের রুগী ঘরে শুয়ে শুয়ে বলছে, “ওরে আমি এক জালা জল খাব রে, ওরে আমি বিশমণ চালের ভাত খাব রে।“ বদ্যি বাইরে দাওয়ায় হুঁকো খেতে খেতে বলছেন, “ওরে খাবি খাবি, আগে জ্বরটা সারুক।“

এই বিকারটা যখন ঘোচে তখন বুঝি যে, যা চাইছিলুম তা অতিচাওয়া ছিল। তাতে শান্তি পেতুম না। জ্বালা আরো বাড়ত। তবে মানুষের গভীরতম চাওয়া কি? সে চিরকালই মানুষকে চাওয়া। শুধু একটা জীব হিসাবে মানুষ না। যা কিছু মানবিক তাকে চাওয়া। তার ধর্ম, তার দর্শন, তার বিজ্ঞান ইত্যাদি সব কিছুই যদি এই মানবিক ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়, তবে তা লোভের সামগ্রী হয়ে ওঠে কিম্বা আতঙ্কের। তাতে স্বস্তি নেই, তৃপ্তি নেই, স্থিরতা নেই। আছে উন্মাদনা, ধ্বংসাত্মক উগ্রতা আর নিষ্ঠুরতা।
ভারতীয় দর্শনে “আত্মতত্ত্ব” হঠাৎ একদিন খুব বড় আকার ধারণ করেছিল। মানুষ যেন মানুষের চাইতে অনেক বেশি বড় এইটা বোঝাবার জন্য এমন সব তত্ত্ব, ধর্মমত, ক্রিয়াকাণ্ড বড় হয়ে উঠেছিল যে মানুষের মানবিক ধর্ম পিছিয়ে পড়তে লাগল। চাপা পড়ে গেল। যাগযজ্ঞ, আকাশ ছোঁয়া অতিমানবিক দর্শন মানুষের চিত্তকে বিবশ করে তার সাধারণ চলার শক্তিটাকে পঙ্গু করে তুলল। বুদ্ধ'র আবির্ভাব হল সেই সময়ে। তিনি মানুষকে বোঝালেন, আত্মা বলে কিছু হয় না। তুমি সর্বাঙ্গীণ একটা মানুষ। কোনো দৈবী বা ঐশী ক্ষমতার মোহে নিজের মনুষ্যত্ত্বকে জলাঞ্জলি দিও না। নিজের মধ্যে অস্বাভাবিক, অতিজাগতিক, অতিমানবিক কিছু খুঁজো না। সে তোমায় চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ করে যাবে।
বুদ্ধ মুক্তি দিলেন আমাদের মনুষ্যত্ত্বকে ‘মৈত্রী’ মন্ত্রে। জন্মালো বৌদ্ধভারত। সে স্বর্ণযুগেরও অবসান হল। সেই বুদ্ধকে কেন্দ্র করেই মানুষের অন্তরের অতিজাগতিক তথা অতিমানবিক স্পৃহা প্রতিশোধ নিতে এল তন্ত্র ইত্যাদি নানান জটিল আবর্ত পথের ঘূর্ণাবর্ত তৈরি করে।
জন্মালো ভাগবত ধর্ম। এ এক অদ্ভুত পথ রচনা করল মানুষকে তার হৃত মনুষ্যত্ত্ববোধের গৌরব বোঝাতে। সে শুরুই করল অতিজাগতিক, অতিমানবিক গল্পগাথা দিয়ে। মৎস, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন ইত্যাদি ক্রমে বুদ্ধ ও কৃষ্ণ। যেন ক্রমশ মানুষের অভিব্যক্তি। এদের প্রত্যেকের চরিত্র বর্ণনায় প্রধান স্থান পেলো মনুষ্যত্ত্ব। বলা হল জ্ঞান, কর্ম ইত্যাদি সব ব্যর্থ যতক্ষণ না তোমার মধ্যে ভক্তি জন্মাচ্ছে। কিরকম ভক্তি? যে ভক্তি জীবপ্রেমকে ঘিরে তৈরি হয়। কপিলমুনি তাঁর মাকে বললেন, “মন্দিরের দেবতা পূজা করে যদি তুমি বাইরে এসে জীবকে কষ্ট দাও, তবে তোমার পূণ্যকুম্ভে ছিদ্র হয় মাতঃ”। প্রহ্লাদজী তাঁর বন্ধুদের ভাগবত ধর্ম বোঝাতে গিয়ে বলছেন, “ঈশ্বরকে তুষ্ট করা কোনো কঠিন কাজ নয় আমার বন্ধুরা। তিনি প্রতিটা জীবে অধিষ্ঠান করছেন। সংসারে প্রতিটা জীবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও প্রেমপূর্ণ হয়ে থাকাই তো শ্রেষ্ঠ ভগবতপূজা। আর এইপ্রকার আচরণে প্রভু যেরূপ সন্তুষ্ট হন, আর কোনো প্রকার সাধনে সেরূপ নন।“
শ্রীকৃষ্ণ ঠিক এই স্থানটাতে আমাদের আপনার চেয়ে আপন হয়ে উঠলেন। তাই মহাভারত ও তার মধ্যস্থ গীতা; ভাগবত ও তার মধ্যস্থ উদ্ধবগীতা থেকে শুরু করে নানান পদাবলী, কীর্ত্তন, ঠুমরী, নৃত্যের বিষয়াবলী- সবেতেই কৃষ্ণের উপস্থিতি। এমনকি গোপালভাবে একটি শিশুর মূর্তিতেও তাঁর পূজা সম্ভব। যেখানে ভগবান যেন ভক্তের চাইতে দুর্বল। এ কি করে সম্ভব – একই পুরুষের উক্তি দর্শনের গভীর তত্ত্বালোচনাতেও, আবার একই পুরুষের কীর্তি প্রেমের বৈধ-অবৈধ সীমারেখার ঊর্দ্ধে গিয়েও?!
সম্ভব। কারণ শ্রীকৃষ্ণের ধর্মে বাদ দেওয়া হয়নি কিছু। সংসার থেকে সরে আসার কথা বলা হল না। নিজেকে অতিমানবতার মোহে দেখার কথা বলা হল না। বলা হল, সবার মধ্যে নিজেকে খুঁজে নাও, নিজের মধ্যে সবাইকে খুঁজে নাও। সংসারে একটা স্বধর্ম আছে (যা অবশ্যই religion অর্থে না), তার একটা বাঁধন যেমন আছে, তার একটা মুক্তির পথও আছে। মুক্তি অর্থে পলায়ন না, মুক্তি অর্থে ভালোবাসায় সহজ করে নেওয়া। কিরকম ভালোবাসা? শর্তসাপেক্ষ না। নিঃশর্ত ভালোবাসা। এইখানে গীতা থামেন। ভাগবত শুরু হয়। গোপীপ্রেম আসে। যার মাধ্যমে আবার প্রাণে ভাবের বন্যা আনবেন মহাপ্রভু বহু শতাব্দী পরে। কেন্দ্রে থাকবেন সেই কৃষ্ণ। স্ব বিরোধী কৃষ্ণ। প্রেমিক কৃষ্ণ। দার্শনিক কৃষ্ণ।
সেই তত্ত্বে কেউ খুঁজতে বেরোলো মনের মানুষ, কেউ গভীরের ভূমাকে। কি এই ভূমা? ওই যে রবীন্দ্রনাথ যাঁর পায়ের ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন, লোকে লোকে, কালে কালে, যুগে যুগে – "ওই মহামানব আসে..."
এই হল আসল কথা। 'ক্ষুদ্র আমি'কে হারিয়ে 'বড় আমি'র পায়ে সর্বস্ব বিকানোর কথা। এতে বড় বাধা ভয়। এতে বড় সহায় প্রেম। এই কথাটাই গোড়াতে বলছিলাম, মানুষ অবশেষে মানুষকেই চায়। মানবিক ধর্মই চায়। তাই দার্শনিক থেকে বাউল সবই শেষে এসে নানানভাবে একই কথা বলেন বা গান – "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।" আমার ঈশ্বরকেও মানুষ হয়েই আসতে হয়। তাতেই আমরা দু'জন সার্থক।

তাই তোমার আনন্দ আমার 'পর

তুমি তাই এসেছ নীচে।
আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর,
তোমার প্রেম হত যে মিছে।
আমায় নিয়ে মেলেছ এই মেলা,
আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা,
মোর জীবনে বিচিত্ররূপ ধরে
তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে॥
তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে
তব আমার হৃদয় লাগি
ফিরছ কত মনোহরণ-বেশে
প্রভু, নিত্য আছ জাগি।
তাই তো, প্রভু, হেথায় এল নেমে,
তোমারি প্রেম ভক্তপ্রাণের প্রেমে,
মূর্তি তোমার যুগল-সম্মিলনে সেথায় পূর্ণ প্রকাশিছে॥


(এই ছবিটা পাঠিয়েছেন Saheli, আমার খুব প্রিয় বন্ধু। ছবিটার জন্য কৃতজ্ঞ আর প্রণত দুই হলাম তার কাছে।)

493
Mon, 08/22/2016 - 19:20

মন্দির থেকে ফিরে আসার পর মন্দিরের ধূপধুনোর গন্ধ কিছুটা গায়ের সাথে লেগে আসে। সময়ের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দিলেও তাই হয়। সময়ের কিছু অধঃক্ষেপ জমে মনে। সে কার গুণে বলতে পারি না, সময়ের - না মনের; নাকি দুজনেরই মিলিত কোনো রহস্যে।
'শম্ভু মিত্র' নামটাও সেরকমই সময়ের রেখে যাওয়া এক টুকরো খণ্ড মনের অবচেতনে। আমরা যে সময়ে বড় হচ্ছি, সে সময়ে শম্ভু মিত্র'র নাটক দেখার সৌভাগ্য আর নেই। বাবা-কাকাদের মুখে নাম শুনেছি। জ্ঞানীগুণী মানুষজন খুব শ্রদ্ধার সাথে ওনার নাম নেন দেখেছি। পেপারে মাঝে মাঝে ছবিও দেখেছি। আর শুনেছি তিনি অজ্ঞাতবাসে। তিনি আর কাজ করবেন না। কৌতুহল হয়েছে, ক্ষোভ হয়নি। কারণ যাঁর কাজ সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই তাঁর কাজ না দেখতে পারার কোনো আফসোস তৈরি হয়নি। তারও আগে থেকে শুনেছি সুচিত্রা সেনও অজ্ঞাতবাসে বা নির্বাসনে, তাই আর কৌতুহলেও বোধহয় কোনো নতুনত্ব ছিল না।শুধু মাঝে মাঝে মনে হত, কেন?
ওনাকে প্রথম দেখা দূরদর্শনের একটা নাটকে – ‘অমল ও দইওয়ালা’তে। তাতে তিনি তেমনভাবে দাগ কাটেননি, আর কাটবেনই বা কেন, সমস্ত মন জুড়ে তো অমল! আহা বেচারা অমল। আর সে ফকিরবেশি শম্ভু মিত্র'কে ভালো লাগার একটাই কারণ, অন্তত সে মানুষটা আর যা হোক অমলের সাথে ঠিক করে কথা বলেছিল। অমলের বন্ধু হতে পেরেছিল। তাই তাকে ভালো লেগেছিল। কিন্তু তখন সে শম্ভু মিত্র কেন হবে? সে তো ফকির! সে এমন দেশে যাওয়ার কথা বলে, যে দেশে গেলে নাকি সবই হাল্কা হয়ে যায়, কোনো কিছুরই আর ভার লাগে না। আর সে দেশে যাওয়ার পথ? সে একটা রাস্তা আছে, সে পথ নিজের ভিতর দিয়ে যেতে হয়।
হায় রে আমার নির্বোধ মন! এমন অনায়াসে, এমন বাচনভঙ্গীতে যে মানুষটা, এমনধারার কথাগুলো এত গভীরে গেঁথে দিতে পারে কিম্বা পৌঁছে দিতে পারে – সে কোন জগতের মনের অধিকারী?
বুঝিনি। বুঝেছিলুম অনেক পরে। হঠাৎ শুনলুম তিনি নির্বাসন থেকে বেরুবেন। তখন আমরা কলেজে পড়ি। বেরুলেন। দূরদর্শন একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিল। তিনটে রবিবার পর পর দেখানো হল। মনে কি একটা ঘোর তৈরি হল। এঁর গায়ে, পোশাকে, চলনে বলনে চিন্তনে কেমন যেন একটা চেনা লোকের গন্ধ না?! হ্যাঁ তো! কে সে? রবীন্দ্রনাথ! রবীন্দ্রনাথ, আমার চোরাবালি তখন, আমার আমাজনের জঙ্গল তখন, আমার স্কুল থেকে ফেরা বাড়ির পিছনে নির্জন পুকুরপাড় তখন। এ যে সেই ভাষায় কথা বলে!
সেই সাক্ষাৎকারের কিছু কথা মনে গেঁথে গেল চিরকালের জন্য। এমন নম্রভাবে জীবনের গভীর কিছু সত্য এমনভাবেও বলা যায়!
বললেন, 'দেখো জগতটা গোল। তুমি যখন সোজা দাঁড়িয়ে ভাবছ নিজেকে পৃথিবীর উপরে, ঠিক সেই সময় তুমি যদি পৃথিবীর বাইরে গিয়ে নিজেকে দেখতে পারো, দেখবে তুমি কিছুটা হেলে দাঁড়িয়ে আছো কারণ পৃথিবীটা তো গোল। তাই ওই সময়ে ওইটাই সাম্যাবস্থা। সাম্যাবস্থার কিছু absolute হয় না।'
বললেন, 'মানুষ সৎ হবে। হবে কারণ সেটা তার কর্তব্য। অথচ আমরা কেমন জানো তো? ওই যে প্রভুর কুকুর, প্রভু বলটা ছুঁড়ে দিলেন, অমনি কুকুর গিয়ে দৌড়ে নিয়ে এলো, আর এসেই প্রভুর মুখের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়তে লাগল – অর্থাৎ আমায় কিছু পুরস্কার দাও এবার! আমরাও ঠিক তেমন।'
মন আটকালো শম্ভু মিত্রে। রেডিওতে পনেরো দিন ধরে সকাল ন'টা কি দশটা নাগাদ বিভিন্ন স্বনামধন্য ব্যক্তিরা ওনার সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন তার পরপরই। প্রায় প্রতিটা গিলতে লাগলাম গোগ্রাসে। বেশ কিছু মজার ঘটনাও ঘটেছিল সেই সাক্ষাৎকারগুলোতে। একবার এক প্রখ্যাত বাচিক শিল্পী (মহিলা) তাঁকে আবৃতির যে একটা স্থির পন্থা আছে মানাবেনই মানাবেন, আর উনি কিছুতেই স্বীকার করবেন না। শম্ভু মিত্র'র বক্তব্য হল, 'কোনো একটা কবিতা পড়ে আমার ভালো লেগেছে, মনে দাগ কেটেছে, আমি আমার সেই ভালোলাগাটা সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই, এই তো? এই জন্যেই তো কবিতা বলা। তো তাতে নাটকীয়তা থাকবে, কি না থাকবে, অথবা তা কাটাকাটাভাবে বলতে হবে, সেটা নির্ভর করছে কবিতাটার উপর আর যিনি বলবেন তার মানসিক গঠন, কণ্ঠের প্রকার ইত্যাদির উপর। এর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম থাকবে কেন?'
কিন্তু সেই শিল্পী তো মানতে রাজীই নন, 'তা হলে তো কবিতা শেখানোই যাবে না' ইত্যাদি মতান্তর হওয়াতে সেই শিল্পী রেগেমেগে উঠে পড়েন। রেডিও'র ধার্য সময়ের আগেই অনুষ্ঠান শেষ হল, অগত্যা কর্মকর্তারা সুচিত্রা মিত্র'র গান চালিয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণে লেগে পড়েন।
পরবর্তীকালে যখন ওনাকে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংলাপের অসুবিধা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয় (অনেকের মতে রবীন্দ্রনাথের নাটকের সংলাপগুলো মঞ্চে উপস্থাপনার জন্য যথাযথ নয়।), উনি অদ্ভুত একটা কথা বলেন। বলেন, 'রবীন্দ্রনাথের সংলাপ বলতে গেলে গলাটাকে নগ্ন করতে হয়। না হলে সেগুলো বড্ড কৃত্রিম শোনায়।' এই কথাটা বুঝতে আজও চেষ্টা করছি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা প্রথম শুনলাম ওর কণ্ঠে – ‘উদাসীন’। আমার কাছে একটা ধ্রুবতারা হয়ে গেল। কি সাহিত্যবোধে, কি জীবনদর্শনে। তার আগে বহু মানুষের গলায় বহু কবিতা শুনেছি। মনে হয়েছে, বাঃ সুন্দর আবৃতি করলেন তো! কিন্তু উনি যখন বললেন, সেটা তো আর শুধু কবিতা বলা হল না, কবিতাটা কোনো অতিরিক্ত অলঙ্কার ছাড়াই সম্পূর্ণ আটপৌরে বেশে আমার মধ্যে প্রবেশ করল। ‘পৃথিবী’ কবিতাটা অনেকের গলায় শুনেছি। মুগ্ধ হয়েছি। শম্ভু মিত্র'র গলায় যখন শুনলাম, কবিতাটার শ্বাস-প্রশ্বাস আমার গায়ে লাগতে লাগল। এত জীবন্ত! তবে এও দেখেছি, অনেক বাচিক শিল্পী ওনার কবিতা বলাটাকে একটু তাচ্ছিল্য করে দেখেন। কারণটা আজ বুঝি, চেষ্টা করে গলা, ভঙ্গী আয়ত্ত কিছুটা করা গেলেও যেতে পারে, কিন্তু শত চেষ্টা করেও ওই বোধের গভীরতায় কি আসা যায়? যে বিশ্বাসে ওই স্বরক্ষেপণ হয়, তা কি শুধু অভ্যেস? অগত্যা চালাও নিন্দা!
একবার ওঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি ফিরে ফিরে রবীন্দ্রনাথের কাছে আসেন কেন? কি অসামান্য উত্তর দিলেন, 'যাঁর চিন্তা যে কোনো বিষয়ে আমার থেকে শতগুণ এগিয়ে তাঁর কাছে ফিরে যাব না?' আসলে সত্যিই তো, উনি তো রবীন্দ্রনাথকে চিন্তা করতেন না, রবীন্দ্রনাথে বাস করতেন।
বারবার বলতেন, মনে করাতেন, 'শিল্পীর প্রথম দায়িত্বই হল তাকে সৎ হতে হবে। নিজের সাথে, সমাজের সাথে। তবেই সে যা অভিনয় করবে তা সত্য হয়ে উঠবে। যা বলবে, তা বিশ্বাসের সাথে বলতে হবে। অভিনয়টাকেও সৎ করতে হয়।' বলতেন, 'একটা গান কেমন হবে তা যেমন আমি নেচে দেখাতে পারি না, ঠিক তেমনই একটা নাটক কেমন হবে তা আমি গেয়ে দেখাতে পারি না, নাটক করেই দেখাতে হয়।'
একবার কোনো এক নাটকে ডাক্তারের চেম্বার দেখাতে হবে। তা নানা মুনি নানা মত। উনি নাকি একটা কাপড়ে লাল ক্রস এঁকে একটা টেবিল আর চেয়ার করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, 'লোকে ডাক্তারের চেম্বার কেমন হয় সেটা দেখতে নাটকটা দেখতে আসবে না, আসবে একটা গল্প দেখতে।' কি আত্মবিশ্বাস! বলেছিলেন, 'আমি যদি অভিনয় করতে না পারি স্টেজে পর্দা টানব, তাও না পারি টর্চ দেখিয়ে লোককে আসন দেখাব, তা-ও না পারি তো টিকিট বিক্রি করব – তবু নাটক ছাড়ব না।'

তবু কেন নির্বাসনে গিয়েছিলেন? বলতেন, 'দেখো, মানুষ জীবনে যখন খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন শুধু একটা কারণে তো নেয় না, অনেকগুলো কারণ থাকে।'
কিছু কারণ আমরা আজ অনেকেই জানি। সে কথা থাক। বড় অভিমান ছিল বলেই না অমন নিঃশব্দে চলে গেলেন, পণ করিয়ে গেলেন কাছের মানুষদেরকে, তাঁর দেহ দহনের আগে কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। পায় নি। কোথাও তাঁর মরদেহ শুইয়ে সেই সরকারী-অসরকারী শোকজ্ঞাপন হয়নি।
আজ এই লেখাটা লিখতে বসে বুঝলাম মনের কত গভীরে সেই কণ্ঠ, সেই উপলব্ধ সত্যগুলো বাসা বেঁধে আছে, তাঁরই মত নিঃশব্দে। ‘উদাসীন’ কবিতাটার মতই-

"হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি,
     ছুটি নে কাহারো পিছুতে ।
মন নাহি মোর কিছুতেই, নাই
                কিছুতে..."

[ওনার জন্মদিন (২২অগাস্ট ১৯১৫) উপলক্ষ্যে আমার অতিক্ষুদ্র শ্রদ্ধাঞ্জলি]

[ছবিঃ ইন্টারনেট]

 

494
Sun, 08/07/2016 - 23:28

'বন্ধুত্ব' সবসময় একটা সরে সরে যাওয়া নাম। সম্পর্কের একটা নাম থাকে। তার একটা স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছা থাকে। কোথাও বা একটা দায়ও থাকে। কিন্তু বন্ধুত্ব একটা স্থবিরতার নাম না। একটা ঘটমান চলমান অস্তিত্ব। 'বন্ধু' একটা সম্পর্ক হতেই পারে। কিন্তু বন্ধু নামক সম্পর্কে যে বন্ধুত্বটা টিকেই আছে তা কে জোর দিয়ে বলতে পারে? হয়তো সেটা একটা অভ্যাস এখন। একটা পরিচিতি এখন। কারণ ওই যে বললাম, বন্ধুত্ব একটা গতির নাম। তবে বন্ধুত্বের যে শপথ বা চুক্তি হয় তা কিসের? তা একটা সম্পর্কের নাম, যদিও শব্দটা এক।

সব সম্পর্কের মধ্যেই এই বন্ধুত্বটা থাকতে পারে। আর যতক্ষণ তা থাকে ততক্ষণই তাকে একটা গতিশীল সম্পর্ক বলা যায়। সেখানে ভুল বোঝাবুঝি আছে, মনোমালিন্যতা আছে, অশান্তি আছে। আর এসব যতক্ষণ একটা স্বাভাবিক মাত্রা অবধি আছে, ততক্ষণ বোঝা যায় একটা চলমানতা আছে, সেখানে ভরকেন্দ্রটা খোঁজার প্রয়াস চলছে। এ দ্বন্দ্ব ভালো। এতে বিষ নেই, উত্তাপ আছে।
কিছু সম্পর্কে বন্ধুত্বটা নেই। বরং বিতৃষ্ণাটা কালো মেঘের মত বুকের তলায় জমছে। বিষ তৈরি হচ্ছে। এ হল বন্ধুত্বের ঠিক বিপরীত অবস্থান। এ সংঘর্ষ ভাঙনের। বেরোনোর পথ খোঁজার তাগিদে।
তবে বন্ধুত্বের প্রধান সূত্রটা গতিময়তা। দু'জনকেই সমান তালে এগোবার তৃষ্ণাটা জিইয়ে রাখতে হবে।বন্ধুত্বের ভালোবাসা সেটা পারে। সে এক পা এগোলে, যে পিছোলো তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এসো। সে যদি বলে দাঁড়াও, আমি প্রস্তুত নই এখনো। তবে বন্ধুত্ব বলে, আমি আছি অপেক্ষায়। সে নিজে এগোতে থাকলেও, পিছিয়ে আসা বন্ধুর এগিয়ে আসার পথটার দিকে চোখ রাখে, একটা হাত সবসময় তার দিকে এগিয়ে রাখে আন্তরিকতার সাথে।
আর যদি সে পিছিয়ে থাকা বন্ধু বলে, আমি আর যাব না, অথবা অন্যদিকে যাব? তবে সেই বন্ধুত্ব সাথে সাথে রূপান্তরিত হয় সম্পর্কে। তাতে যদি সহমর্মিতা থাকে, গ্রহনশীলতা থাকে, তবে তা স্বাস্থ্যকর। যদি বিতৃষ্ণা থাকে, ঈর্ষা থাকে, অভিমান থাকে, তবে তা দুর্ভাগ্যের। দুর্ভাগ্যজনকভাবে শেষেরটির উদাহরণই সংসারে বেশি।
বন্ধুত্ব এতই চঞ্চলা, এতই অমোঘ। তার শর্ত বড় কঠিন। সে একই সাথে অপরিহার্য, আবার নিষ্ঠুর। প্রেমের মধ্যে তাও একটা জৈবিক উপাদান থাকে (অবশ্যই আমি প্রচলিত অর্থে প্রেম বলেছি), কিন্তু বন্ধুত্বে সে সহজ আকর্ষণের পথও নেই।
দেখেছি, অত্যন্ত শিক্ষিত আর প্রথাগত বিদ্যায় একেবারে অশিক্ষিত মানুষের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের উদাহরণ। কাছে গিয়ে জেনেছি, তাদের মিলটা হয়েছে মনের গভীরে যে চিরকালীন চলাটা বাইরের সব ঐশ্বর্য্যকে তুচ্ছ করে স্বীয় পথে চলে, সেই চলার মিলে। সেখানে তথ্য লাগে না, তত্ত্ব লাগে না, একটা সংবেদনশীল মন লাগে।
চলতে চলতে সংবেদনশীলতাটা যোগায় শক্তি আর রুচিটা নির্দেশ করে দিক। আমি হয়তো ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একজন বিদগ্ধ শ্রোতা, আমার বন্ধু হয়তো পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের। তাতে বন্ধুত্বের কোনো অসুবিধা হবে না, পরস্পরকে বুঝতে বোঝাতে কোনো অসুবিধা হবে না। অসুবিধা হবে কোনো কারণে সে এই সংবেদনশীলতার চর্চাটা যদি ছেড়ে দেয়। কারণ চর্চাটা সবক্ষেত্রেই প্রথম শর্ত।
বন্ধুত্ব বন্ধ আবহাওয়ায় হয় না। রুদ্ধদ্বারে হয় না। শর্তের শৃঙ্খলে সম্পর্ককে বাঁধা গেলেও যেতে পারে, বন্ধুত্বকে নয়। কারণ বন্ধু বলে কোনো সম্পর্কই হয় না। যে কোনো সম্পর্কের মধ্যে বন্ধুত্ব থাকতে আসে, বসতে আসে, বাঁচতে আসে। তাকে জীবনের মত ধারণ করতে হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসের মত চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়, যত্ন করতে হয়।
যার প্রধান কথা হল - সাথে চলার অঙ্গীকার; কারোর কাছে না, নিজের কাছে।

দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে,

আপন জেনে আদর করি নে।
পিতা ব’লে প্রণাম করি পায়ে,
বন্ধু ব’লে দু হাত ধরি নে।।
আপনি তুমি অতি সহজ প্রেমে
আমার হয়ে যেথায় এলে নেমে
সেথায় সুখে বুকের মধ্যে ধ’রে সঙ্গী বলে তোমায় বরি নে।।
ভাই তুমি যে ভাইয়ের মাঝে, প্রভু ,
তাদের পানে তাকাই না যে তবু–
ভাইয়ের সাথে ভাগ ক’রে মোর ধন তোমার মুঠো কেন ভরি নে।।
ছুটে এসে সবার সুখে দুখে
দাঁড়াই নে তো তোমারি সম্মুখে,
সঁপিঁয়ে প্রাণ ক্লান্তিবিহীন কাজে প্রাণসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ি নে।।

 

495
Sun, 08/07/2016 - 14:44

রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘সাধনা’ গ্রন্থের ভূমিকায় বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে নিজের ধর্মবোধ বলতে গিয়ে একটি জায়গায় বলছেন – 'উপনিষদ ও বুদ্ধের বাণী, শাশ্বত আত্মার বাণী, যা অসীমের পথে বিকাশের প্রেরণা। আমি নিজ জীবনে তা অনুসরণ করেছি, ও সেই বাণীই প্রচার করে এসেছি সারা জীবন...'

এমন স্পষ্ট করে তিনি তাঁর ভাবের গঙ্গোত্রীর পথ খুলে দিলেন। ‘এসো স্পর্শ করে যাও’ বলে আহ্বানও জানালেন। যেন বলছেন, তারপর ভালো লাগলে নিও, না হলে ফেলে যেও।
আজ বাইশে শ্রাবণ। এই কথাটা ঘুরে ফিরে মনের মধ্যে বাজছে। তাই এ লেখা লিখতে বসা। একটা ব্যক্তিগত কথা এখানে বলে নিই, এই বলার পিছনে কোথাও আত্মজাহির করা, বা সমাজ উদ্ধার করা, বা গুরুগিরি করার মতলব আঁটছি এমন ধারণা যেন কেউ অনুগ্রহ করে না করেন। বন্ধুরা বাড়িতে এলে ভালো খাবারটা, ভালো বসার জায়গাটা, ভালো পোশাকটা দিতে যেমন ভালোবাসি, এক্ষেত্রেও তাই, নিজের ভালো চিন্তাটা যা আমায় ভালো রেখেছে তাকে এগিয়ে দিতেই ভালোবাসি। ব্যস আর কিছুর জন্য না। তার জন্যই লিখতে বসা।
রামকৃষ্ণদেব বলছেন, ‘শাস্ত্রের সার কথাটা গুরুমুখে শুনে নিতে হয়, তা হলে অসার ভাগটা আর চিন্তা করতে হয় না।‘ ঠিক তাই। উপনিষদ বা ত্রিপিটক সম্পূর্ণ পড়ে তার মর্মোদ্ধার করা বা রসবোধ করার মত ক্ষমতা আমাদের মত সাধারণ মানুষের কোথায়? তাই আমাদের গুরুদেবকে দরকার। খুব দরকার। যিনি সারভাগটা বলে দেবেন। আর এমন গুরুদেব ছাড়া কার মুখের দিকেই বা তাকাব? যিনি শুধু গান লেখেন না, গানগুলো পর্যায়ক্রমে সাজিয়ে একটা গীতবিতানও বানিয়ে দিয়ে যান আমাদের জন্য।যাতে মনের অবস্থার ভাব অনুযায়ী ঠিক গানটা খুঁজে পেতে বিলম্ব না হয়। নিজের ধর্মবোধ তথা জীবনবোধকে ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে (যা শান্তিনিকেতনে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে পাঠ করতেন), সেটিকেও অতি সংক্ষিপ্ত করে ‘সাধনা’ বইয়ের অন্তর্গত করে রেখে গেলেন বিশ্ববাসীর জন্য।তাঁর সারা জীবনের শ্রেষ্ঠতম উপলব্ধির সারাংশ।
উপনিষদে বিবেকানন্দ দেখলেন ‘অভীঃ’ মন্ত্র। ত্যাগের মাধ্যমে আহ্বান করলেন সে পথে। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন ‘আনন্দ’- মন্ত্র। সুখে-দুঃখে স্থির থেকে আনন্দকে অনুভব করার পথ। কি সে তপস্যার পথ? বললেন, শান্তম শিবমদ্বৈতম।এই মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে বললেন, সর্বপ্রথম শান্ত হও। কি করে হব? বললেন, শোনো উপনিষদের ঋষিদের বাণী – মা গৃধঃ – লোভ কোরো না।
শান্ত হলে পাবে শিবকে। শিব অর্থে মঙ্গল। পাবে মঙ্গলের পথকে। মহাত্মা রমণ মহর্ষির কথা মনে হল। তিনি বলতেন, 'পৃথিবীর সব ধর্ম, দর্শন শিক্ষার একটাই লক্ষ্য – শান্ত হও।'
তাই বলা হল মঙ্গলের পথকে পাবে। সেই মঙ্গলের মধ্যে সবাইকে দেখবে একসূত্রে - অদ্বৈতে। কারণ মঙ্গল 'এক'-এর মধ্যে। একজোট হওয়াতে নয়, একবোধ হওয়াতে। এই হল উপায়। এরমধ্যেই আছে সে আনন্দধামে যাওয়ার, নিজের আনন্দস্বরূপকে অনুভব করার পথ। বারবার তিনি মনে করাচ্ছেন উপনিষদের ইঙ্গিত - 'এ বিশ্বচরারচর আনন্দ হতে জাত।' যে আনন্দ শাশ্বত, চিরজাগ্রত, চিরগুহায়িত। গুহায়িত অর্থে হৃদিকন্দরগত। মৈত্রেয়ীদেবীকে এক জায়গায় বলছেন, যখনই মন উদ্বিগ্ন হবে, চঞ্চল হবে, মনে মনে আবৃত্তি কোরো – আনন্দম পরমানন্দম পরম সুখম পরমাতৃপ্তি!
কিন্তু এ তো গেলো ধ্যানের মন্ত্র। এই কর্মজীবনে? কি করে এ ভাবকে ধরে চলব? কিভাবে প্রকাশিত হবে এ ভাব কাজে? রবীন্দ্রনাথ দাঁড় করালেন বুদ্ধের সামনে। বুদ্ধের সব বাণী মন্থন করে কি মূলমন্ত্র দিলেন? বললেন, 'মৈত্রী ভাবনা'। দুঃখকে চরম বলে জানা বুদ্ধের চরম বাণী না। জীবনকে কেটেছেঁটে অতি সরল করে প্রাণসাগরে পাড়ি দেওয়ার পক্ষপাতিত্ব রবীন্দ্রনাথ করেননি কোনোদিন। তাতে মানুষের মহত্বের প্রতি অবমাননা করা হয়। বললেন, বুদ্ধের মর্মবাণী শুধুই যদি ত্যাগের কথা, জীবন থেকে সরে আসার কথা হত, তবে তো বলতে হয় বুদ্ধ একটা পবিত্র আত্মহত্যার পথ বলেছেন।'
তা তো না। তিনি অপরিমেয় মৈত্রীর কথা বলেছেন। (যার বর্তমান ইংলিশ হল – Loving kindness. জানি না সেটা কতটা ঠিক অনুবাদ, তবু আজ এই কথাটা সারা বিশ্বে নিনাদিত তো হচ্ছে! )। আরো বললেন, 'সংসারের প্রবল অন্ধকারের দিনগুলোতে দাঁড়াও মহৎ জীবনগুলোর সামনে। তাঁদের জীবন কি প্রতিমুহুর্তেই লোকসমাগমে পরিপূর্ণ? উৎসবমুখরিত? না তো।এই মহৎ জীবনগুলোর প্রতিটা দিন-রাত্রি কি কঠোর, কি অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। বারবার হতাশা, বিশ্বাসঘাতকতা এসে পথ অবরোধ করেছে। নীরবে সহ্য করেছেন। হেঁটে গেছেন অমৃতত্ত্বের দিকে, কারোর প্রতি বিদ্বেষ না রেখে। তুমি অনুপ্রাণিত হও। নিজেকে তৈরী করো। জীবনের পথের দুর্গমতার কাছে হেরে যেও না।'
এরকম কিছু কথাতেই মনটা ভরেও আজ, উদাসও আজ। যত দিন যাচ্ছে তত মনের উদাস ভাবটা কমছে। বাইশে শ্রাবণ শুধু চোখের জলের দিন না, এই দিনটাতেই নিজেকে দিয়ে বলিয়ে নিতে হবে - দুঃখের কাছে, ক্ষুদ্রতার কাছে, অসত্যের কাছে হেরে যাওয়ার জন্য এ জীবন না। গীতবিতানের থেকে বড় ধর্মগ্রন্থ কি আছে আমাদের জীবনে যাদের রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বেঁচে থাকার অর্থ নেই। তাই সে মুখের দিকে তাকিয়েই গাই –

আনন্দ তুমি স্বামী, মঙ্গল তুমি,
 
তুমি হে মহাসুন্দর, জীবননাথ ॥
শোকে দুখে তোমারি বাণী জাগরণ দিবে আনি,
নাশিবে দারুণ অবসাদ ॥
চিত মন অর্পিনু তব পদপ্রান্তে--
শুভ্র শান্তিশতদল-পুণ্যমধু-পানে
চাহি আছে সেবক, তব সুদৃষ্টিপাতে
কবে হবে এ দুখরাত প্রভাত ॥

 

(ছবিঃ সমীরণ নন্দী)
[বইয়ের লিঙ্কঃ SADHANA : The Realisation Of Life]
{গানের লিঙ্কঃ আনন্দ তুমি স্বামী, মঙ্গল তুমি - ঋতু গুহ}

496
Tue, 08/02/2016 - 11:06

'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর’ - আজন্ম শোনা কথা। যত বয়েস বাড়ছে তত হেঁয়ালির মত শোনাচ্ছে কথাটা।

মানুষ আজন্ম একা। একাকিত্বের গভীরতায় সে নিজেকে খুঁজে পায়। তাই যখনই মানুষ কিছু খুঁজতে চেয়েছে, সে একা হতে চেয়েছে। নিজেকে খুঁজে পেয়েছে সবার সাথে একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের সূত্রে। যাকে বলা যায় পারস্পরিক নির্ভরশীলতা। বাস্তুতন্ত্র এর সাক্ষ্য দেয় সর্বোচ্চ স্তরে। সে অনেক দূরের তত্ত্ব। সে নিয়ে আলোচনার জন্য লিখতে বসিনি। বসেছি একটা যন্ত্রণা নিয়ে।

আশেপাশের সম্পর্কগুলোতে বড় ভাঙন। বিষণ্ন লাগে। হতাশ লাগে এক একটা সময়। তবু কোনো শাশ্বত সত্যের উপর বিশ্বাস করে দাঁড়িয়ে আবার খুঁজতে শুরু করি পথটা কোন দিকে?
আচ্ছা মানুষের একাকিত্ব যায় কিসে? নাকি একাকিত্বটাই তার স্বাভাবিক অবস্থা? আসলে মানুষ দুটোই চায়। তাকে সুস্থ বাঁচতে গেলে একাকিত্ব আর সাহচর্যর একটা সামঞ্জস্যে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে। যেমন গায়ের জামা গায়ের সাথে এক্কেবারে সেঁটে থাকলেও অসুবিধা আবার এক্কেবারে ঢলঢলে হলেও চলে না। কিম্বা বাড়ির ছাদ। মাথায় ঠেকলেও চলে না, আবার আকাশে ঠেকলেও না। আমরা এই দূরত্ব রাখা আর না রাখার একটা সাম্যে আসতে চাইছি সব সময়। পাশের মানুষটার ঘাড়ের উপরও নিশ্বাস ফেলতে চাই না, অথচ তার গায়ের গন্ধটা না পেতে পারি এমন দূরত্বও সয় না।
তবে এত একাকিত্ব কেন আজ চারদিকে? যে একাকিত্ব বাহ্যিক কারণে গড়ে ওঠে তার একটা সান্ত্বনা থাকে কোথাও। কিন্তু যে একাকিত্ব মানসিক কারণে গড়ে ওঠে তা ক্রমশঃ ক্রমশঃ রোগের আকার ধারণ করে, ধীরে ধীরে প্রাণশক্তি অগোচরে শুষে নিতে নিতে, অসময়ে সব শেষ করে দেয় আচমকাই। বাইরে থেকে যতই আচমকা হোক, ভিতরে কি এতটাই আকস্মিক? না তো! এদিকে আত্মহত্যা, নানান জটিল ব্যাধির প্রকোপ বেড়েই চলেছে, বেড়েই চলেছে। যত বাইরের প্রগতি, তত ভিতরে দৈন্যর প্রেতনৃত্য। নিজেকে নিজে এতবড় করে তুলছি যে, সে বৃহৎ সত্তার নির্বান্ধব একাকিত্বের চাপ সহ্য করতে না পেরে, বাস্তব আর অবাস্তব জীবনের ফারাকটুকু মুছে যাচ্ছে বোধের থেকে। কৃত্রিম জগতে, কৃত্রিম সাহচর্যে কালপাত করে চলেছি। কাকে ঠকাচ্ছি?
মানুষ সাহচর্য পায় কিসে? কিসে তার একাকিত্ব দূর হয়?
এর একটাই উত্তর – বিশ্বাসে, আস্থায়। প্রথম আস্থা নিজের উপর। মানুষের নিজের উপর বিশ্বাস থাকলে নিজের কাজের জায়গাটা, এই বিচিত্র সংসারে নিজের ভূমিকাটা স্পষ্ট বুঝতে পারে। সে নিজেকে অবাঞ্ছিত, অপ্রয়োজনীয়, বোঝাস্বরূপ ভাবার অবকাশ পায় না। কিন্তু এতে তার দাঁড়াবার ক্ষমতা জন্মায়, হাঁটার না। তার বর্ণপরিচয় হয়, কিন্তু বাক্যগঠন হয় না।
এরপরের বিশ্বাস ভালোবাসার উপর। ভালোবাসা যদি আস্থার হাত ছেড়ে একা দাঁড়াতে যায় তবে তা বিকার হয়ে ওঠে। গেঁজিয়ে যায়। আজ যত সমস্যা এই ক্ষেত্রটায় এসে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের ভালোবাসার পাশের মানুষটাকে। সব খুব দ্রুত পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে। কারোর উপর ভরসা নেই, অথচ পাশে লোকের অভাব নেই। 'Cast Away' নামক একটা ইংরাজী সিনেমা দেখেছিলাম। অত্যন্ত উঁচুদরের সিনেমা। তার যে প্রধান চরিত্র সে একটা বিমান দুর্ঘটনায় একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপে একা বহুকাল কাটাতে বাধ্য হয়। বহুকাল তীব্র জীবন-সংগ্রামে জয়ী হয়ে সে নিজের দেশে দৈবাৎ ফেরার সুযোগ পায়। ফিরে এসে দেখে সব পাল্টে গেছে। একটা চতুষ্কোণ পথের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে সে স্বগতোক্তি করে, 'এই বহু মানুষের মধ্যের একাকিত্ব যেন সেই জঙ্গলের একাকিত্বের চাইতে বহুগুণ যন্ত্রণার!'
তাই হয়। কিন্তু এই বিশ্বাস ছাড়া বাঁচার পথই বা কোথায়? ‘আমার কেউ নেই’... ’আমাকে কেউ পছন্দ করে না’... ’আমি মরি কি বাঁচি তাতে কারোর কিছু এসে যায় না’... এর প্রতিটা কথা সত্য হলেও তা আংশিক সত্য। আমি খেয়াল রাখলে অন্যে খেয়াল রাখে, আমি খোঁজ রাখলে অন্যেও খোঁজ রাখে, আমি পাশে দাঁড়ালে অন্যেও পাশে দাঁড়ায়। হয় তো হিসাবে বরাবর হয় না সবসময়, তবু নিজের মধ্যে বিশ্বাসটুকু জাগিয়ে রাখার কাজটা নিজেকেই করতে হবে। নিশ্চই হতাশ হওয়ার মত বহু ঘটনা ঘটছে চারদিকে, নিশ্চই অনাস্থা বৃদ্ধির হারটা তীব্র হয়ে উঠছে দিন দিন, তবু...

হ্যাঁ এই ‘তবু’ ছাড়া গতি নেই। নিজের গদির থেকে নামতেই হবে। নিজের ধ্যানধারণা যা কিছু নঞর্থক তাকে পাশ কাটাতেই হবে, অস্বীকার না করতে পারলেও। সবার মাঝে গিয়ে মিলতে হবে। ফিল্মী কায়দার ‘আমি তোমার আর তুমি আমার’ ছাড়াও সংসারে অনেকরকম সম্পর্ক আছে, যেগুলোতে নিজের প্রাণশক্তির অপচয় হয় না নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিলে। মানুষ সবচাইতে বেশি খুশী হয় নিজেকে ভুলতে পারলে। আমি যাকে চাই তার হয় তো আমাকে প্রয়োজন নেই, নাই বা থাকল। চারপাশের সব ক'টা দরজা খুলে দেখি, কারোর নিশ্চই প্রয়োজন আছে আমাকে। এই খোঁজেই সমাজের শিরায়, ধমনীতে রক্ত ছোটে। আমার প্রয়োজন ভালোবাসার লোক, কারোর প্রয়োজন ভালোবাসার হাত। এই খোঁজই অনাথ আশ্রম থেকে শুরু করে নানান সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে অথবা সমাজের নানান আরো ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ পরিসরে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। মাদার টেরেসা বলতেন, 'কুষ্ঠ, টিবি ইত্যাদি ভয়ংকর রোগ না, ভয়ংকর রোগটা হল সবার কাছেই অবাঞ্ছিত হওয়ার অনুভব।'

এই বোধটা থেকে উত্তরণের পথই ধর্ম। ক্ষুদ্র সংসার থেকে উত্তরণের জন্য তীব্র যন্ত্রণা। সেই বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণায় হেরে না গিয়ে নিজেকে বিশ্বসংসারের ডাকে সাড়া দেওয়ার উপযুক্ত বোধ করা। আর এই বোধের জন্য গভীরে থাকা বিশ্বাস।
"আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া"

 

497
Fri, 07/29/2016 - 19:39

 

 

মানুষ যখন জন্মায় তখন সব মানুষই সাধারণ, যখন ইহলোক ত্যাগ করে যায় তখন সবাই সাধারণ না। তাই যিনি জন্মেছিলেন তিনি আর পাঁচটা সাধারণ শিশুর মতই - ঈশ্বরচন্দ্র, আর যিনি আজকের দিনে সংসার ত্যাগ করে গেলেন তিনি বিদ্যাসাগর, তথা করুণাসাগর। তিনি আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মত না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

তিনি যা করলেন, বললেন, ভাবলেন - পরকালের না। রহস্যময়তার না। পলায়ন প্রবৃত্তির না।
এই কথাটা বোঝা আমাদের সমাজে খুব শক্ত। কারণ আমাদের ধর্ম-দর্শনের বাস্তব রূপটা অনেকটা অন্যলোক বা পরলোক বা Other World সংক্রান্ত চিন্তাভাবনায় বেশি মগ্ন। যদিও দর্শনের গভীরে গেলে তা বলে না। সে অন্য কথা। সেই যুক্তির কাটাকাটিতে যাচ্ছি না। সে অন্য কোনো লেখার বিষয় হতে পারে। এখন না।
আমাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে একজন মানুষের মুখ খুব তীব্রভাবে ভেসে আসে – বিদ্যাসাগর। আমি দেখিনি, আমার বাবা দেখেননি, আমার ঠাকুর্দা দেখেননি তাঁকে। ইন্দ্র মিত্র দেখিয়েছেন। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি।
কথা হল, এই মানুষটা আমাদের পূজা-জপ-তপ-কীর্ত্তন কিচ্ছু শেখাননি। নিজেকে অবতার ঘোষণা করেননি। কোনোরকমের ঈশ্বরত্বের মোহ বা আবেশ তাঁকে ঘিরে সৃষ্টি হয়নি। পরকালের কিছু সুরাহা হয় এমন কোনো মতলবের পথ দেখিয়ে যাননি – অগত্যা, অতএব ওনাকে ভোলা আমাদের অনেক সহজ হয়ে গেল।
আমাদের এখানে স্মরণে মননে থাকতে গেলে কিছু গুণাবলী থাকা প্রয়োজন।

১) দেবময়তাঃ বেশি না, অন্তত জীবনে একবার সমাধি হলেই হবে। কিছু রহস্যময় কথা বলতে হবে। যেগুলো শুনতে মধুর, বুঝতে ধোঁয়াশা, আর করতে...? করতেই হয় না। আহা সমর্পণ করা হয়ে গেছে যে গুরুকে, এবার যা হবে ওনার কৃপায়।

বিদ্যাসাগর ফেল। এগুলোর কোনোটাই সারাজীবনে হয়নি। উল্টে বলা হয়েছে, বেদ উপনিষদ মাথা খারাপ লোকেদের রচনা। না হলে এত এত যন্ত্রণা মানুষের তার (ভগবানের) চোখে পড়ে না!
২) পরকালের আশ্বাসঃ কোনো অসুবিধা হবে না সেখানে। টুক করে চোখ বুজে একটু কষ্ট করে মরতে হবে, তারপর সেখানে হোটেল বুক করা থাকবে। গুরুর নাম নাও আর সেঁধিয়ে পড়ো। কেল্লা ফতে!
বিদ্যাসাগর মহাশয় এতেও ফেল।
৩) বিপদে আপদে রক্ষা করার পুরো গ্যারান্টিঃ যেখানেই হোক... ট্র্যাফিকে, আমাজনে, প্রশান্ত মহাসাগরে, নিউ ইয়র্কে, কি গোবিন্দপুরে ইত্যাদি। সব পাপ হরণ হয়ে যাবে। মালা কবচ, নাম, কিম্বা যাগযজ্ঞ ইত্যাদির যে কোনো একটাতে।
বলা বাহুল্য, এ সবেও আমাদের আলোচ্য মানুষটা ফেল।
আর অন্যদিক থেকে দেখতে গেলে নায়ক, বা গায়ক তো তিনি নন-ই। সুতরাং সেই সুবাদেও মনে পড়ার কথা না। একবার সুনীল গাঙ্গুলি মশায় বলেছিলেন, রবি ঠাকুর যদি কয়খানা গান লিখে না যেতেন, তবে ওকেও মনে রাখত কিনা সন্দেহ। রাখত হয় তো, নামের সাথে একটা ‘গুরুদেব’ কথাটার যোগ আছে না!

বিদ্যাসাগর কোনো মানুষের নাম তো ঠিক না, একটা বিশেষ ধরণের চরিত্রের নাম। যে চরিত্রটা আমাদের দেশের সাথে ঠিক যায় না। কথা হল কেন যায় না? কি এমন শেখাতে এসেছিলেন যাতে অসুবিধা হল?

সর্বপ্রথম হল, অতিরিক্ত ইহকালসর্বস্ব কর্ম ও দর্শন। যেটাতে আমরা স্বচ্ছন্দ্য বোধ করি না খুব একটা। কোনো metaphysical কথা নেই। দুঃস্থ, গরীব, অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। তার উদাহরণ লিখতে বসলে আর এ প্রবন্ধের সীমা পরিসীমা থাকবে না। একটা অতি ক্ষুদ্র উদাহরণ দিই।
এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে বসে আছেন। উচ্চদর্শন নিয়ে আলোচনা চলছে। নীচে রাস্তা থেকে একজন ভিখারি ডেকে যাচ্ছে। উনি শুনছেন। খেয়াল করছেন, গৃহস্বামীর কোনো হেলদোল নেই। সে ডেকেই যাচ্ছে কাতর স্বরে নীচের থেকে। এবার গৃহস্বামী বিরক্ত হচ্ছেন। ভিখারি চলে গেল।বিদ্যাসাগর উঠে দাঁড়ালেন, গৃহস্বামী কিছু বোঝার আগেই তিনি রাস্তায় এসে গিয়েছেন। দৌড়ে সেই ভিখারিকে ধরলেন। তাকে বললেন, তোকে একটা টাকা দিতে পারি, যদি তুই আমার একটা কথা রাখিস। সে বলল, কি? বিদ্যাসাগর সাশ্রুনয়নে বললেন, তুই এই পাষণ্ডের বাড়ি কোনোদিন ভিক্ষা চাইতে আসবি না, আমিও এই বাড়ি আর আসব না কোনোদিন। বলেই হাঁটা লাগালেন।
এরকম অজস্র ঘটনা আছে। তা কবিকল্পনা না। আমার হাত নিশপিশ করছে আরো কিছু লিখতে। না, আর না। প্রসঙ্গে ফিরি।
তারপর যুক্তিনির্ভরতার শিক্ষা। এটা আমাদের সাথে যাওয়া খুব কঠিন ব্যপার। অদৃষ্ট মানি, কৃপা মানি – যুক্তি আবার কি? তাতে কি এই ভবরহস্য ভেদ করা যায়?
না যায় না। উনি চানও নি তা। তবে এখানে আশ্চর্য লাগে ওনার মায়ের কথা ভেবে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্যাসাগর’ প্রবন্ধে তাই শুরুতে ওনার মায়ের কথা বলেছেন, অত্যন্ত সকরুণ মর্মস্পর্শী সে বর্ণনা। সে গল্পও আমরা অল্পবিস্তর জানি। সেই গ্রামের সবার কম্বল হলে ওনার নিজের কম্বল নেওয়া, গ্রামে একটা শিক্ষাসত্র খুলে দিলে দূর্গাপূজা না করলেও চলে – বলার মত সাহসী মহিলা ক'জন ছিলেন এ পোড়ার দেশে?
যেটা নিয়ে খুব বলা হয় বিধবা বিবাহ প্রচলন, সেটা অবশ্যই খুব গুরুত্বপুর্ণ ঘটনা তবে তা আমার কাছে শূধুমাত্রই ওর মহৎ চরিত্রের বহিরঙ্গের ঘটনা। আসল কথাটা হল, মেয়েদের অবস্থাটা বুঝতে পারা। অনুভব করতে পারা। মর্মে গিয়ে সে যন্ত্রণায় বিদ্ধ হওয়া।
প্রবল বর্ষা। সন্ধ্যে পার হয়ে গেছে। রাস্তা শুনশান। এক সমাজে পতিতা রমণী খদ্দেরের আশায় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছেন। একটা মানুষ আসছে দেখে সে পিছু নিল। মানুষটা তাকে প্রত্যাখ্যান করল। সে তবু পিছু নিল। বলল সে না সাড়া দিলে তার অসুস্থ বাচ্চাটার চিকিৎসার, খাবারের টাকা পাবে কোথায়?
লোকটা ঘুরে দাঁড়াল। সে রমণী বুঝল কি না জানি না, সেই মানুষটার চোখ থেকে দরদর করে যে জল পড়ছে, সেটা বৃষ্টির জল না। সে তাকে ক'টা টাকা দিয়ে বলল, আপনি ফিরে যান মা, আর দাঁড়াবেন না। তারপর যে যন্ত্রণা নিয়ে সে মানুষটা ফিরে গিয়েছিল, সে যন্ত্রণার জন্যই সে শুধু বিদ্যাসাগর না, করুণাসাগরও বটে। তার বাকি কাজগুলো তো সে যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ। মহৎ কাজ তো কত হয় চারদিকে দেখি, চাঁদা তুলে, মাইক নিয়ে, সেইরকম চোখের জল কই? বুকফাটা হাহাকার কই? তাই প্রকল্প হয়, উন্নতি হয় না। সেবা হয়, অগ্রসর হয় না।
পরবর্তী প্রজন্মের কত বড়মাপের লেখক, কত সাহিত্যিক, ছাত্র যে জলের তোড়ে ভেসে যেত সে সময় উনি পাশে না থাকলে সে ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।
একটু প্রসঙ্গান্তরে বলি, কৈলাশ সত্যার্থীর ফেসবুক পেজটা ঘুরে আসবেন। দেখবেন তার একটা পোস্টে কি আশ্চর্যজনক কম লাইক, কমেন্টস পড়ে। কারণ? ওই যে বললাম, আমাদের ওতে রুচি নাই। ভদ্রলোক নোবেল পাওয়ার আগে অবধি ক'টা কাগজ ওনার সম্বন্ধে আমাদের জানাবার প্রয়াস নিয়েছে? লজ্জা লেগেছিল যে নোবেল পাওয়ার আগের দিন অবধিও এই মানুষটাকে চিনতাম না। এটা লজ্জার।
বুদ্ধ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধীর যে সব কথা যুক্তির, স্ব-পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে, আমরা সেই সব উপদেশ আচ্ছা করে ঝেঁটিয়ে দূরে রাখতে পছন্দ করি। আর বিদ্যাসাগরের তো পুরোটাই সেই কথা। রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি, বাঙালী গড়তে গড়তে বিধাতা যে কি করে একটা বিদ্যাসাগর বানিয়ে ফেললেন আশ্চর্যের!
এই লেখার কোনো উপসংহার হয় না। বেশ কয়েক বছর আগে বিদ্যাসাগরের উপর একটা জীবনী বইমেলাতে কিনছিলাম। ইংরাজীতে। কারণ আমার ধারণা ছিল, বাংলায় লেখাগুলো বড্ড একপেশে। হয় অতিভক্তি, নয় বড্ড নীরস। ভাসা ভাসা। পাশে দাঁড়ানো মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক আমায় রীতিমতো ধমক দিলেন – ইন্দ্র মিত্র পড়েছেন? বললাম, না। আরো জোরে ধমক, যান এখনই ‘আনন্দে’, কিনুন।
কিনলাম। পড়লাম। সেদিন থেকে সেই অচেনা ভদ্রলোককে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই। এইভাবে এক জীবনী লেখা যায়!
আমি আমার ছোট বড় সকল বন্ধুদের করজোড়ে অনুরোধ জানাই, বইটা জীবনে একবার অন্তত পড়ে নেওয়ার জন্য। না হলে সত্যিই ক্ষতি।

 

(করুণাসাগর বিদ্যাসাগরঃ বইটির পিডিএফ লিঙ্ক)
(আজ এই মহাপ্রাণের মহাপ্রয়াণের দিন)

(ছবিঃ আন্তর্জালতন্ত্র)

498
Thu, 07/28/2016 - 11:51


আমার একজন পরিচিত, ভাইয়ের বয়সী, অফিস থেকে ফিরে আমায় ফোন করল। কুশল বিনিময়ের জন্য। নতুন অফিস তার। আমায় ফোন করল যখন তখন রাত পৌনে এগারটা। বলল, "অফিসের পরিবেশ খুব ভালো। আমায় ৯ ঘন্টা থাকতেই হবে, তারপর যদি কাজ বাকি থাকে তো সেটা পুরো করে আসতে হবে।"

কথাটা মাথায় গেঁথে গেল। উইকিপিডিয়া খুলে বসলাম। পড়লাম, সাপ্তাহিক কাজের সময়ের সাধারণ গড় হিসাব, ৪৪-৪৫ ঘন্টা/সপ্তাহ, তবে সেটা নাকি ৩৫ ঘন্টা/সপ্তাহ (France) থেকে ১১২ ঘন্টা/সপ্তাহ (North Korea) হতে পারে। থমকে গেলাম।
পরিসংখ্যানের জটিলতায় যেতে চাইছি না। যা বলতে চাইছি, তা আমার আশপাশের নিজের চোখে দেখা, মাথায় গুঁতো মারতে থাকা কিছু চিন্তার ব্যাপারে।
আমি দেখলাম, তারা ন'ঘন্টা কাজ করছে, আড়াই থেকে তিন ঘন্টা যাতায়াত করছে, সাত থেকে আট ঘন্টা ঘুমাচ্ছে। কত হল? ১৯ থেকে ২০ ঘন্টা! বাকি ৪ ঘন্টা কি ৫ ঘন্টা তার নিজের জন্য বরাদ্দ। যে সময়টায় সে দস্তুরমত ক্লান্ত। তার মধ্যে তার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, সন্তান, সামাজিক দায়বদ্ধতার দায়িত্ব। চার থেকে পাঁচ ঘন্টায় তা কি করে সম্ভব? সম্ভব করা হচ্ছে। যাদের স্নায়ুগুলো এই অতিরিক্ত চাপ নিতে পারছে না, তাদের? যাদের উচ্চাকাঙ্খা বা প্যাশন সাঙ্ঘাতিক কিছু অতিমানবিক নয়, তাদের বেলায়?
‘রক্তকরবী’ মনে পড়ে গেল -
‘আমাদের না আছে আকাশ, না আছে অবকাশ; তাই বারো ঘন্টার সমস্ত হাসি গান সূর্যের আলো কড়া করে চুঁইয়ে নিয়েছি একচুমুকের তরল আগুনে (মদ)। যেমন ঠাস দাসত্ব, তেমন নিবিড় ছুটি।'
আজ তাই আমোদ এত মোটা দাগের। যদি বা বিনা তরল গরল পানে কোথাও কাটিয়ে এলাম, হোটেলের কর্তৃপক্ষ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছেন, “আপনারা ড্রিংক করেন না! আশ্চর্য!” একবার নয়, বহুবার এই অভিজ্ঞতা বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে গিয়ে হল। আশ্চর্য যত না সেই কতৃপক্ষ হয়েছে আমি হয়েছি তার থেকে বেশি। এমন প্রশ্নও স্বাভাবিক? এটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?
এখন মনে হচ্ছে হ্যাঁ, গুরুত্বপূর্ণ বটে। যে স্নায়ুগুলো এই অতিমানবিক চাপ, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর নিয়ে চলেছে তাদের ক্ষেত্রে একে অন্যায় বলা যায় না বোধহয়, যদি না তাদের সুস্থ বাঁচার, সুস্থ recreation-এর সুযোগ থাকে। অথবা নিজের স্বাভাবিক সত্তাকে টিকিয়ে রাখার মত মনের জোর থাকে এর মধ্যেও। সে আলাদা কথা।
ক'দিন আগে ব্যাঙ্গালোর গেলাম এলাম ট্রেনে। তিরিশ ঘন্টার কাছাকাছির যাত্রা। ট্রেনে কমবয়সী ছেলে-মেয়ের অভাব নেই। বেশিরভাগই ছেলে। অবাক হলাম, কষ্ট পেলাম দেখে, তারা পুরোটা পথ হয় ঘুমিয়ে, না হয় মোবাইল বা ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিল। মনে হল যেন, এই আশেপাশের বাস্তব জগতটাকে এড়িয়ে চলাটা এমন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে, এই ফেসবুক, ওয়াটস অ্যাপের বাইরের দুনিয়ায় পা রাখতে হয় তো বা অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে, অথবা আরো গভীরভাবে হয়তো insecure অনুভব করছে। একবার জানলার বাইরে তাকালো না। এত মনোরম নৈসর্গিক দৃশ্যরা হয় ঘুমে, না হয় ভারচুয়াল জগতে লীন হয়ে যাচ্ছে। এটা কি খুব স্বাস্থ্যকর মানসিকতার লক্ষণ! এভাবে কতদিন? অবসাদ বাড়ছে, অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে, আত্মহত্যার পরিসংখ্যান বাড়ছে। সবার সহ্যশক্তি, লড়াইয়ের শক্তি সমান নয়। তাই প্রতিক্রিয়াও সমান না। তবে কম-বেশি যাই হোক না কেন এর কুপ্রভাবমুক্ত সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব কি?
আরেকটু গোড়ায় আসা যাক। আমি শিক্ষাজগতের সাথে যুক্ত। কি অসম্ভব ক্রমবর্ধমান লোভ শিক্ষাক্ষেত্রে অভিভাবকদের মধ্যে দেখতে পাচ্ছি রীতিমত ভয় লাগছে। লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে বড় বড় প্রতিষ্ঠানে এগারো-বারো ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করে দেওয়ায় হচ্ছে। যারা পারছেন না, অপরাধবোধে ভুগছেন। ছেলেকে বা মেয়েকে যে করে হোক ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার করতেই হবে। সে কি পড়তে চায় বড় কথা না। সে কি হতে চায় বড় কথা না। অবশ্য বাঙালি ছাত্রছাত্রীদের মত এত বাধ্য ছাত্রছাত্রীও কমই দেখা যায় বোধহয়। তারাও ভাল ছেলেমেয়ের মত যুপকাষ্ঠে গলা বাড়িয়ে প্রস্তুত। অবশ্য ক'জনেরই বা সে মনের জোর বা পরিণত চিন্তাভাবনা থাকতে পারে এই বয়সে। তবু অন্য রাজ্যের দিকে তাকালে একটু সংশয় হয় বই কি, আমাদের ছাত্রছাত্রীরা যতই স্মার্ট হোক না কেন, নিজেদের ভবিষ্যতের বেলায় কি খুব বেশি পরনির্ভরশীল নয়? একটু বেশিই অপরিণত নয়? বলার অপেক্ষা রাখে না এর ব্যতিক্রম আছে।
কথাটা হল, আমি যদি পড়ার মধ্যে নিজের আনন্দটা খুঁজে না পাই, শেখার মধ্যে দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে না শিখি, তবে ভবিষ্যতে নিজের মত করে বাঁচার মেরুদণ্ডটা তৈরি হয় কি? জানি এটা বলা যত সোজা, করাটা না। তবু বলি, আমি নিজে দেখেছি, যে এই পথে এগিয়েছে সে লড়াইটা শিখেছে। ন'ঘন্টা কেন, বারো ঘন্টা কাজ করেও সে উদ্যমহীন হয় না, কারণ তার সময়টা তার কাছে চুরি হচ্ছে না, অপহরণ হচ্ছে না, অপচয় হচ্ছে না। তা সৃষ্টিশীলতার কাজে লাগছে। সেই ছাত্রজীবন থেকেই সে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখে গেছে। নিজের কাজেই। সেই তার ছুটি, সেই তার সাধনা।

সব শেষে শুরুর সূত্র ধরে বলি, আবার একটা মে ডে হবে কিনা জানি না। তবে এই ট্র্যাফিক, অতিশ্রম এর দুনিয়ায় আটকে কতদিন সুস্থ সমাজ রাখা যাবে তা ভাববার। সংসারে নির্বোধের একটা জন্মগত সুখ আছে, অন্ধের দেশে আলোর প্রতি আস্পৃহা বা না দেখতে পাওয়ার ক্ষোভ নেই, তবু সেটা অমানবিক। সারাদিনে যদি বেঁচে থাকার জন্য চার-পাঁচ ঘন্টা আর বছরে ১৪ টা মুক্তদিনের অবকাশ থাকে তবে সে সমাজের গতি জড়ের গতি। তাতে পুনরাবৃত্তি আছে, গতি আছে, আড়ম্বর আছে - প্রাণ নেই।

আর যে শিক্ষায় শিক্ষার বস্তু শুধুই মই, আনন্দ নেই সে শিক্ষা দিয়ে আবিষ্কার হয় না, নতুনের খোঁজ হয় না, শুধুই শংসাপত্র তৈরি হয়।

 

499
Tue, 07/19/2016 - 10:12
  (আজ গুরুপূর্ণিমা। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অজ্ঞতার অন্ধকার থেকে আলোতে আনার প্রয়াসে বহু প্রাণ আত্মসুখ বিসর্জন দিয়ে আলোর পথ খুঁজেছেন। বাইরের বিশ্বে তা বিজ্ঞান, মননের গভীরে তাই অধ্যাত্মজ্ঞান। দুটো পথেরই প্রধান অন্তরায় – লোভ। কোথাও ধনের তো কোথাও মানের।    আজ যখন নীচের এই লেখাটি পোস্ট করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন এক অনুজের কাছ থেকে একটা মেসেজ পেলাম। সে লিখছে, ‘তিনি কাউকে নকুলদানা দেবেন, কাউকে সন্দেশ। যা দেবেন নিজের হাতেই দেবেন। আমার নকুলদানাই সই, অন্যের সন্দেশে লোভ করে তাঁর হাতের স্পর্শ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে রাজী নই।‘  মনটা দ্রবীভূত হল। যে সংকট থেকে নিজেকে সে উদ্ধার করার পথ নিজের মধ্যেই সে পেল, সেই সে আলোটুকুই সংসারে সার। সে আলোক শিখার ধারক ও বাহক সকল আত্মাকে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানাই আজকের এই পবিত্র তিথিতে।)     'যতো বাচা নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহা'   ‘যেখান থেকে মন ও বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে’       এই একটি পঙক্তিতে সমগ্র অন্তর্জগৎ আর বহির্জগতের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট দাগ টানা হল। আমার চিন্তা বাক্য নির্ভর। শব্দ নির্ভর। রূপ ও শব্দ ব্যতীত চিন্তা অসম্ভব। এ নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনে বহু সুন্দর সুন্দর গভীর আলোচনা হয়েছে। রাসেল ও উইটেঞ্জেস্টাইন এর নাম অগ্রগণ্য।  আলোচনা সেটুকু নিয়ে না। যা বলতে চাই তা হল, এই শ্লোকটাতেই আমার বাগানে বেরোবার পথের ইঙ্গিত আছে। অসীম সাগরে ভেলা ভাসাবার জন্য নোঙর তোলার শক্তি দেয় এই খণ্ড শ্লোকটি। সে পিঠে হাত রেখে বলে, ভাই রে, যাকে তুমি চাইছ, সে তোমার এ পোশাকে আসবে না। আমি বলি তবে? সে বলে, তোমায় তোমার মনের পোশাক, চিন্তার পোশাক খুলতে হবে। নগ্ন হতে হবে। পুরো সংসারটা যখন পার্থিব সুখ-দুঃখ, চাওয়া- পাওয়ার হিসাব নিকাশে আমায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে চাইছে, আমার অন্তরাত্মা বিদ্রোহ করে বলছে, "ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায়, তবু জেনো মন তোমারে চায়", তখন এই শ্লোকে আমি আশ্রয় পাই। নিভৃতে একান্তে, বাইরের সংসারকে বাইরে রেখে প্রবেশ করি অন্তর্লোকে। একা, আমার চির অপেক্ষমাণ প্রিয়তমের জন্য। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, তুমি যদি নিজের মধ্যে শান্তি খুঁজে না পাও, তবে পৃথিবীর কোনো গুহা, কোনো মন্দির, কোনো সাগরতীরে শান্তি খুঁজে পাবে না।  একদম ঠিক কথা। সেখানে বিশ্রাম মিলতে পারে, শান্তি না। আমার মাথার মধ্যে অহোরাত্র যে শব্দের স্রোত বয়ে চলেছে, যে চিন্তার ঘূর্ণিপাক তৈরি হয়ে চলেছে, তাকে যদি সময় মত থামাতে না পারি, তবে সে আবর্তের পর আবর্ত তৈরি করে আমায় গ্রাস করবে। সে চিন্তাস্রোতের প্রয়োজন আছে, তবে সে প্রয়োজনের বেড়া ডিঙিয়ে অপ্রয়োজনের রাজ্যে ঢুকলে আমার অন্তঃকরণকে ক্ষত বিক্ষত করে তোলে। তাকে থামাতেই হবে।  একটা প্রশ্ন এখানে উঁকি দিয়ে যায়। যদি মন ও বাক্য তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে, তবে আমি পাব কি করে? এর উত্তর সোজা কথায় দেওয়া শক্ত। কারণ, ‘কথা চিন্তা বাক্য’ - সব এক গোত্রীয়। শব্দমালা। তার তো সে পথে যাওয়ার অধিকার নেই। তবে? তবে এর উত্তর একটু অন্যরকম। কার চিন্তা, কার মন তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে? খুঁজতে হবে। এত চিন্তা, এত অনুভূতি - এসব কার? আমি যে রাত দিন, "আমার মনে হয়...আমার ভাললাগা মন্দলাগা, আমার অধিকার অনধিকার, আমার দুশ্চিন্তা হতাশা" ইত্যাদির ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, এর আসল ভোক্তা কে? আমি কি মন? আমি কি চিন্তার জাল? আমি কি বুদ্ধি? আমি কি প্রাণশক্তি? আমি কি আবেগের জটাজাল? আমি কি? আমার ঘুমের মধ্যে যে গভীর চেতনা জাগ্রত থাকে, যে স্বপ্নগুলোকে দেখে, যে আমার জেগে থাকাকে দেখে, যে আমার গভীর ঘুমন্ত দশা দেখে - সে কে? আমার গভীরতম ঘুমের থেকে যখন আমি উঠি, কে আমায় সাজিয়ে গুছিয়ে বাইরের সংসারে পাঠায়। কিছুই তো হারায় না। সেই গভীর ঘুমের মধ্যে তো আমার শোক, দুশ্চিন্তা, হতাশা কিছুই কাজ করে না। অথচ আমি তো মৃতও নই সে সময়টাতে। আমি ঘুমন্ত। তবু কোন সে গভীর চেতনায় জাগ্রত? যেখানে আমার তৈরি করা সংসারের তিলমাত্র আঁচও প্রবেশাধিকার পায় না?  সেই সময়টাতে যে জেগে থাকে, তাকে যদি বাইরের জেগে থাকার সময়েও অনুভবে আনতে পারি, তবে আমার অন্দরমহলে আর বাইরের সংসারের বিষ ঢোকে না। আমি অনাসক্ত থাকতে পারি। একটা সিঁড়ি ছাড়তে হলে, আরেকটা সিঁড়িতে পা দেওয়া চাই আগে। এই শ্লোকটি সেই সিঁড়ির ধাপ। সেই গানের কথা মাথায় আসল -   রূপসাগরে ডুব দিয়েছি   অরূপ রতন আশা করি; ঘাটে ঘাটে ঘুরব না আর ভাসিয়ে আমার জীর্ণ তরী।   সময় যেন হয় রে এবার   ঢেউ খাওয়া সব চুকিয়ে দেবার, সুধায় এবার তলিয়ে গিয়ে অমর হয়ে রব মরি।   যে গান কানে যায় না শোনা   সে গান সেথায় নিত্য বাজে, প্রাণের বীণা নিয়ে যাব সেই অতলের সভামাঝে।   চিরদিনের সুরটি বেঁধে   শেষ গানে তার কান্না কেঁদে, নীরব যিনি তাঁহার পায়ে নীরব বীণা দিব ধরি।
500
Thu, 07/07/2016 - 19:00


প্রেম 'লো ব্যাটারি' দেখাচ্ছে। হৃদয়ের সাথে লুজ কানেকশান। বিপদ সঙ্কেত মাঝে মাঝেই জ্বলে উঠছে। কবিতা, গান, গল্প – (মানে সবই রোম্যান্টিক আর কি) ট্রাই করা হয়ে গেছে। কিছুতেই কিছু কাজ দিচ্ছে না। পাড়ার জগাদা, অফিসের নেপুদা, কলেজের প্রাক্তন/প্রাক্তনী, অভিমানী বা অভিমানিনী – এসবের ডেটাবেসও ফেল করছে। বরং কথা বলতে গিয়ে কর্ডলাইনে কথা চলে গিয়ে ফের আরেক মুখোমুখি সংঘর্ষ হতে হতে রক্ষা পাওয়া গেছে। ‘তোমার তো স্বভাব বদলাবে না... কি করে বদলাবে... উফ্‌ কি বাঁচা যে আমি বেঁচেছি!... কেন একে ছেড়েই দাও না... আমায় ছাড়তে তো বেশিক্ষণ ভাবতে হয়নি!... একটা এস এম এস ... ”আমি আর পারছি না”... ব্যস!... এই কেসটায় হচ্ছে না কেন?... আসলে আমিই বোকা ছিলাম... গ্র্যান্টেড হয়ে গিয়েছিলাম না..’
অগত্যা এ পথ বন্ধ। খোঁজ খোঁজ। আরে কই যাই... পল্লীগীতি... বাউল... ফকির... ওল্ড মেলোডি... মডার্ন মেলোডি... বাংলা... হিন্দি... ওড়িয়া... ভোজপুরী... অসমীয়া... তামিল... তেলেগু... ইংরাজী.... মায় জাপান কোরিয়া অবধি শোনা হয়ে গেছে... আরে কথা বুঝি কে বলছে... সুর তো বুঝি। সারা বিশ্বেই প্রেমের সুর এক... এও বোঝো না! যত্তসব! রবি ঠাকুর? হুঃ! কি যে একখান কথা কইলেন? সে তো আর শুনতে হয় না, সে তো বেজেই চলেছে মাথার মধ্যে। সব অ্যাপ্স রেডি দাদা, শুধু বুকে ইনস্টল করা যাচ্ছে না। বুকটা হাহাকার করছে। পরিত্যক্ত ড্যামের মত। সিমেন্ট না হওয়া পিলারের রডের মত লাগছে নিজেকে। শূন্যে তাকিয়ে আছি।
ট্রেনে বাসে হাসিমুখ দেখলেই গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, শালারা যেন আমায় দেখিয়ে দেখিয়েই এই অভিনয়টা করছে। আজকাল শাপশাপান্তে তো কোনো কাজ হয় না। তাই গুয়েচ্ছা পাঠাই মনে মনে। যাক শালার সব নষ্ট হয়ে।
এক বন্ধু বলল, মানে বিজ্ঞ বন্ধু আর কি, স্পেস দিতে। বলল প্রেমে নাকি শুদ্ধতা কমে যাচ্ছে আমাদের। তাই নাকি এই সব শুষ্কতার কেস। বলেই হাইফাই সব কোটেশান ঝাড়ল। মালটা নিজে প্রেম করেনি বাপের জম্মে, আমায় এসেছে প্রেমের জ্ঞান দিতে। তা বললাম, 'শুদ্ধতার কেসটা কি?' বলল, 'শরীর বোধ কমা।' বললাম, 'হ্যাজাস না, শরীরবোধ মানে কি? সেক্স?' বলল, 'হ্যাঁ।' বোঝো, শালার প্রেম সম্বন্ধে কনসেপ্ট দ্যাখো, ওই জন্য শালার, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন’ এর বেশি প্রেম এগোলো না। শরীর ছাড়া প্রেম আসে? এতো শালা হোমস্ক্রিন ছাড়া মোবাইল অন্ করার কেস হয়ে গেল।
এদিকে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, ইয়েও হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝেই। কিন্তু বুকের ভিতরটা সেই ফাঁকা ডাবের মত উপুড় হয়ে পাঁজরের সাথে লটকে। প্রেম কই? হে ঈশ্বর প্রেম কই? গেরুয়া প্রেম না, মাদার টেরেসা মার্কা প্রেম না, বুক ধড়াস ধড়াস, লোম খাড়া করা, কানে ভোঁ ধরানো প্রেম কই? যদি প্রেম দিলে না প্রাণে, তবে শরীর কেন জ্বালিয়ে দিলে এমন অগ্নিবাণে...
নাহ্‌ তাও তো নয়। শুধু শরীরকে দুষে কি হবে? সে তো বায়োলজিকাল ফ্যাক্ট। কিন্তু এমন লাগে কেন? একা থাকলে মনে হয়, পাশে থাকলেই ভাল ছিল, আবার কাছে আসলেই মনে হয় – "হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে!" আসলে বুকটা নিয়েই যত ক্যাঁচাল।
মাথায় - অফিস, বাজেট, ব্যাঙ্ক, লোন, জামা-জুতো-বেল্ট, ইত্যাদি সব আছে। কাকে কখন কোথায় প্যাঁচে ফেলতে হবে, ঘোল খাওয়াতে হবে, কোথায় কি ঢপের চপ ভাজা আছে, তেল ছাড়ছে – এসব ডেটা নির্ভুল আছে। ঠিকঠাক আপডেটও নিচ্ছে। আর শরীরের কেসটাও তো ঠিক আছে। মাঝে এই বুকের ভিতরেই যত গারবেজ ফাইলের স্তুপ। তবে কি সময়?
হ্যাঁ এই কথাটাই আমি শুনতে পছন্দ করি না। সময় দিচ্ছি না নাকি নিজেকে? মানে গারবেজ ফাইল সাফ করার? সেও বা বললে কি করে হবে? এই তো, কদিন আগেই মন্দারমণি, তার আগে ডুয়ার্স, তারও আগে লাচুং ঘুরে এলাম। কি কত্তে গেসলাম? গারবেজ ক্লিয়ার করতেই তো! তা করিনি?
তা ঠিক, করিনিই বটে। আসলে যতবার ঢুকতে গেছি, এত ধূলো, এত অন্ধকার, এখানে ওখানে এত ভাঙা শিশি বোতলের কাঁচের টুকরো! তাই গরল পান করেছি। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে এই যে, বন্ধুবান্ধবরা সব আমার কেচ্ছা, ক্ষোভ, রাগ, অভিমানের ফিরিস্তি শুনেছে। কেঁদেছে, সান্ত্বনা দিয়েছে, আমিও তাই করেছি, অবশেষে যা হওয়ার তাই। নিজের ফিউজ নিজেই কেটে, ঘর অন্ধকার করে, বুকের ভিতরকে ‘নেই’ করে আবার লঙ্কায় ফিরে এসেছি। রাবণের মত দশ মাথায়, লক্ষ দিক সামলাচ্ছি, 'না-হৃদি' শরীরের ভাড়া দিচ্ছি নিজেকে বাজারে মত করে চলনসই করে নিয়ে। বুক তোলপাড় হলে তরলাশ্রয়। হরমোনের বান আনছি শরীরে শরীর জুড়ে। চাপা হৃদয়ের গোঙানি বেরোচ্ছে ঘামের সাথে। অর্গাজমের পূণ্য সঞ্চয় চলছে। সবই চলছে, হচ্ছে, গড়াচ্ছে, দৌড়াচ্ছে, উড়ছে, সাঁতার দিচ্ছে। কিন্তু কে যে এক অলক্ষে অদৃশ্য ইসিজি যন্ত্র ফিট করে গেছে, কে যেন বলেই চলেছে – রিপোর্ট ভা্লো নয়... ভালো নয়... ভালো নয়...

501
Wed, 07/06/2016 - 18:33

দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলের বহু মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রমে বাড়ির টিভির পর্দায় ভেসে আসছে পুরীর রথযাত্রার দৃশ্যাবলী। অজস্র মানুষের অসীম উৎসাহ, নৃত্য-গীত-কীর্তনে মুখরিত মন্দিরের সম্মুখস্থ বড়দাণ্ড বা মহৎপথ। ধারাবিবরণকারীদের বিভিন্ন ভাষায় ভক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যান।
     বারবার একটা শব্দ কানে এসে মনকে আপ্লুত করে যাচ্ছে – মহাপ্রভু। জগন্নাথজীর অপর নাম। প্রেমের ডাক। আস্থার ডাক। আশ্বাসের ডাক।
     বেলুড় মঠে একবার এক সাধুকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আপনারা মঠে স্নানযাত্রা পালন করেন কেন? সে তো জগন্নাথজীর উৎসব।'
     সাধু প্রসন্ন হেসে বললেন, 'শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকে আমরা জগন্নাথ হিসাবে দেখি, তাই।'
     আজ রথযাত্রা দেখতে দেখতে সেই কথাটা মনে আসল। সাথে সাথেই ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ল, ‘এখানকার ভাব একঘেয়ে নয়।’
     ঠিক তাই। ভক্ত বলছেন, ‘আমি নাস্তিক মত পড়ছি’। ঠাকুর হেসে বললেন, 'সেও এক বিশ্বাস, এক মত।'
     সত্যিই তাই। যাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে মানুষ আস্তিক, যাঁর অস্তিত্ব অস্বীকার করে মানুষ নাস্তিক, তাঁকে প্রণাম জানাই।
     সংসারের মূল সুরই হল বৈচিত্র। কতরকম মত, কতরকম বিশ্বাস, কতরকম জীবনশৈলী। সেই বৈচিত্রতাকে নাশ করে সব কিছুকে একঘেয়ে করে তোলার কি মানে আছে? আমি তুমি রাম শ্যাম যদু মধু সব একরকম, তাও কি কখনো হয়। সব্বাইকে একমতে আনার মত বিধ্বংসী ইচ্ছা আর সংসারে দুটি নাই। রামকৃষ্ণদেবের তাই সাবধান বাণী, 'কারো ভাব নষ্ট করবিনি'। সানাইয়ের শুধু পোঁ ধরে থাকা তাঁর পোষায় না, তাই তিনি 'সা রে মা তে' আছেন, অর্থাৎ কি না বৈচিত্রে আছেন। সে তো না হয় হল, তা বলে অমন জটিল লোক তোমার সাথে কেন? ঠাকুরের উত্তর, আরে জটিলে-কুটিলে না থাকলে যে মায়ের খেলা পোষ্টাই হয় না। অর্থাৎ কিনা জমে না! নাও, সেই বৈচিত্রের কথা। বহুরূপী গিরগিটির কথা, ধোপার রঙের গামলার কথা ...ইত্যাদি ইত্যাদি। মোদ্দা কথা তাঁর ওই একঘেয়ে ভাব সয় না।
     তুমি কে, কোথা থেকে আসছ বড় কথা নয়। একটাই কথা, তুমি অকপট তো? তোমার যা খামতি সে আমার দায়িত্ব পূর্ণ করে নেওয়ার। তুমি শুধু দেখো, তোমাতে আমাতে যেন কোনো আড়াল না থাকে। সংশয় আছে? থাকবেই তো। তোমার সংশয় যত গভীর, আমার খেলা তত মধুর। তুমি শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, মুসলমান যেই হও। তুমি মানুষ, তোমার অসীম ক্ষমতা। কেন জানো? ‘মানুষ কি কম গা? মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে’।
     হ্যাঁ তুমি অনন্তকে চিন্তা করতে পারো। তুমি ঈশ্বরের ধারণাকে অস্বীকার করতে পারো। তাঁকে ব্যক্তিসত্ত্বা হিসাবে ভাবতে তোমার নাও ইচ্ছা করতে পারে, বিশ্বাস নাও হতে পারে। কিন্তু তুমি অনন্তকে অস্বীকার করতে পারো? পারো না। এই বিশাল ব্রহ্মাণ্ডের সাপেক্ষে তোমার অস্তিত্বটাকে একবার খুঁজতে যাও... কি দেখলে? কিছু পেলে না। জানো সংসারে দেখেছি, ‘মা আর মেয়ে আলাদা করে জয়মঙ্গলবার করে, যেন মা আর মেয়ের মঙ্গল আলাদা।‘ মানুষের মঙ্গল আলাদা কিছুতে নয়। সে একে। মিলনে। দ্বেষহীনতায়। তাই বলেছি, ‘প্রার্থনা করো, পোকাটারও যেন নিন্দা না করি’।
      হীনবুদ্ধি হবে বলে কি জন্মেছ এত বড় বিশ্বে? না তো! বুদ্ধি - যাতে খাওয়া থাকার ব্যবস্থা হয়, তাই কি শুধু বুদ্ধি? এই যে সূর্য তারার কক্ষপথ মাপছ, জোয়ার ভাঁটার হিসব কষছ, এই কি তবে বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ? না গো। বুদ্ধির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ প্রেম সাগরে ডুবে। যে বুদ্ধি প্রেমের দিকে না নিয়ে যায় সে তো শুষ্কপথ, শুষ্কবুদ্ধি। শুষ্ক হয়ো না। ‘একভাঁড় জল পুকুরে চুবিয়ে রাখলে ভিজে থাকে, বাইরে এনে ফেলে রাখলে শুকিয়ে যায়’। চুবিয়ে রাখো। মানুষের সাথে থাকো। ঘরে দোর দিয়ে আটকিয়ে কাকে ডাকবে? যে তিনি তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে গলদঘর্ম হয়ে মোট বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার মধ্যে তাঁকে না দেখতে পেলে কিসের যাগযজ্ঞ? ফেলে দে ওসব!

     ঠাকুরের কাছে সবচাইতে বড় আশ্বাস এই, তাঁর বাড়ির সামনে যে পথ সে বড়দাণ্ড। মহৎপথ। সে পথে যাওয়ার শর্ত একটাই, অকপট হও। রীতিনীতি'র তিনি খুব একটা ধার কোনোদিন ধারতেন না। ভাবগ্রাহী জনার্দন। কথাটা হল তোমার মনটা কোথায়? স্বার্থে? না পরমার্থে? তাঁর ঈশ্বরের প্রতিশব্দ - গড, আল্লাহ্‌, কালী, দূর্গা নন। প্রতিশব্দ হল, ‘চেতনা’। আশীর্বাদ, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। কিসের চৈতন্য? নিজেকে অশ্রদ্ধা না করার। ‘যে শালা নিজেকে পাপী পাপী রাতদিন বলে, সে পাপীই হয়ে যায়।‘
     মানুষ ভুল করতেই পারে। করবেই। করেও। তাঁর তাতে আপত্তি নেই। ভুলকেই আঁকড়ে বাঁচাকে, ক্ষুদ্রতাকেই চরমার্থ বলে ধরলেই তিনি গর্জে উঠছেন ‘একি হীনবুদ্ধি গা!’
     হ্যাঁ তাই তাঁকে জগন্নাথের প্রতিভূ বলতেই পারি। কারণ তিনি তাঁর কাছে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান নি, অধিকারটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ‘ঈশ্বর কি তোমার পর?’
     তিনি অনন্তভাবময়। কথাও শেষ হওয়ার নয়, অগত্যা বিরাম নিই। জয় প্রভু।

 

502
Mon, 07/04/2016 - 13:44

নিবেদিতা তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ - 'স্বামীজিকে যেরূপ দেখিয়াছি' শেষ করছেন একটা প্রার্থনা দিয়ে, স্বামীজির এই জীবন্ত সত্তা যেন শুধু স্মরণীয় না হয়ে চেতনায় জ্বলন্ত জাগ্রত হয়ে অবস্থান করুক।

'কোনো একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মানো ভাল, কিন্তু তার গণ্ডীর মধ্যেই মৃত্যু হল অতি ভয়ঙ্কর।'...'চিত্তশুদ্ধি অর্থে নিঃস্বার্থপর হওয়া'...'নিঃস্বার্থপরতাই ঈশ্বর'...
এ কথাগুলো বলার আড়ালে যে মানুষটা, সে শুধু চিন্তাবিদ হলে আজ মন খারাপের প্রশ্ন থাকত না। সে মানুষটা রোগের চিকিৎসা করতে চাননি, চেয়েছেন রুগীর চিকিৎসা। সারা পৃথিবী জুড়ে ঝড়ের মত ঘুরে বেড়িয়ে শরীর যখন প্রায় ছিবড়ে হয়ে গেছে, ওঁর ভাষায় 'মুখ থেকে রক্ত ওঠা' পরিশ্রমে, তখন সে বেলুড় মঠে ফিরতে চাইছেন বিশ্রামের জন্য, আর কিসের জন্য? না বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা জলের ধারার সাথে বেয়ে বেয়ে চলে যাবে, তা দেখার জন্য। খুব নগন্য কথা, জানি। তবু আজকের দিনে ভারী কথাগুলো বেরোতে চায় না যে।
ভালোবাসার প্রকৃত রূপটা ওর লেখায় পড়ে জেনেছিলাম। বললেন প্রেম ত্রিকোণাত্মক। এক, নিঃস্বার্থপরতা। দুই, বাসনাহীনতা, কারণ প্রেম নিজেই নিজের লক্ষ্য, পরিপূর্ণতা। ভালোবাসা আনন্দময়। যদি তাতে যন্ত্রণা, শোক, বিষাদ আসে তবে জেনো, তা স্বার্থপরতা, ইন্দ্রিয়পরতা, প্রেম নয়। তিন, ভয়হীনতা। কেমন না, যে মহিলা রাস্তায় একটা কুকুর দেখলে পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়েন, তিনি তার সন্তানের জন্য সিংহের মুখোমুখি দাঁড়াতেও অকুতোভয়।
'সম্পদে-বিপদে, ঐশ্বর্যে-দারিদ্র্যে, রোগে-স্বাস্থ্যে - মৃত্যু পর্যন্ত যেন বিচ্ছেদ না হই' নিবেদিতার মুখে এই কথাগুলো শুনে সারদাদেবী আনন্দে আপ্লুত হয়ে ওঠেন, বারবার আবৃত্তি করতে থাকেন, 'আহা কি ধর্মের কথা গো!' স্বামীজি পরবর্তীকালে বিবাহের এই প্রতিশ্রুতির কথা বলতে গিয়ে বলেন, 'স্বাধীনতা শুধু কিছু করার অধিকার নয়, বরং কিছু করার ইচ্ছাকে দমন করার অধিকারকেও বোঝায়!' এক বৃদ্ধ দম্পতির কথা বলেন, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর একসাথে থাকার পর তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। বৃদ্ধ প্রথম রাতে একা শুতে যাওয়ার বলে ওঠেন, 'দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর আমি শুতে যাওয়ার আগে ওকে চুমু খেয়ে শুতে গেছি, হা ঈশ্বর আজ আমি শুতে যাব কি করে?' এ ঘটনা বলতে বলতে স্বামীজি উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকেন, এই হল নিষ্ঠা, এই হল ধর্ম, এই তো মুক্তি!
হ্যাঁ একজন সন্ন্যাসীই একথা বলছেন। যাকে আমরা 'হয় এটা' 'নয় ওটা' চিন্তাধারা বলি (black and white thinking) স্বামীজির চিন্তায় সে ধারা নেই। তিনি সব সময়ই যে কোনো আদর্শের দুটি বিপরীতপ্রান্তের তুল্যমূল্য বিচার করে তাদের মিলনস্থল চিহ্নিত করেই ক্ষান্ত হতেন। তাই বলতে পারেন, সব ধর্মের মূলেই একটা স্বার্থপরতার ভাব থাকে, তা না হলে কোনো ধর্মই তৈরি হত না।
এক এক সময় মনে হয়, ওনার গায়ে ওই গেরুয়া বস্ত্রটা না থাকলে কি ভালই না হত! যদিও জানি সেদিনের প্রয়োজনের তাগিদে তার দরকার ছিল। তবে আজ নেই। তাঁকে শুধু হিন্দু সন্ন্যাসী ভাবা মানে আইনস্টাইনকে, বিঠোভেনকে শুধুই জার্মান, অথবা শেক্সপীয়ার কিম্বা টলস্টয়কে শুধুই ইংরেজ বা রাশিয়ান ভাবার সামিল। ভাবলে, ঠকব আমরাই। ক্ষতি আমাদেরই। তিনি নিজেই বলছেন, তিনি A VOICE WITHOUT FORM, নৈর্ব্যক্তিক কণ্ঠস্বর। সে স্বর যতই কানের ভিতর ধরে মরমে পশে ততই মঙ্গল। ব্যক্তির মঙ্গল, দশের মঙ্গল, দেশের মঙ্গল, তথা বিশ্বের মঙ্গল। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রোমা রোঁলা তাই স্বামীজির জীবনীকে লিখতে গিয়ে বলছেন... GOSPEL OF MANKIND.....মানব আত্মার বাণী।


( আজ ৪ঠা জুলাই, ওঁর মহাপ্রয়াণ দিবস)

503
Thu, 06/30/2016 - 19:30
বেশ কিছুকাল আগে আমার এক অত্যন্ত প্রিয় আলোকচিত্রগ্রাহকের তোলা একটা পলাশের ছবিতে লিখেছিলাম - ঠোঁটটা অনেক কাছে আনার পর জানলাম, সামনে ওটা ঠোঁট ছিল না, ছায়া ছিল।  ফেরার পথে কিছু পলাশ কুড়িয়ে ফিরলাম খেয়াল করিনি কোনোদিন,  পলাশের বুক এত লাল ছিল।
একজন স্বনামধন্য কবির হাতে সে লেখা পড়ল। তিনি বললেন, ‘এ কি করেছ? পলাশকে ঠোঁটের সাথে না, যোনির সাথে তুলনা করো। ঠোঁটের সাথে তুলনা করাটা সেকেলে হয়ে গেছে যে, বুঝলে?’ চুপ করে থাকলাম। কি বুঝব? ওনার মনের গতি? না তথাকথিত আধুনিক সাহিত্যের রীতি? 'দেশ'-এ 'পার্থিব', 'প্রথম আলো' এইদুটো লেখা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি 'দেশ' নেওয়া বেশ কিছুকাল বন্ধ রেখেছিলাম খানিক এই কারণেই। অকারণে অযথাই বিছানা আসতে শুরু করল গল্পে। পুরো লেখাটা পড়ার পর মনের মধ্যে একটা শূন্যতা অনুভব করতাম। আধুনিকতা কি? পুরোনোকে সরিয়ে নতুনকে আনা। পুরোনো ধ্যান-ধারণার পরিবর্তে নতুন ধ্যান-ধারণা। পুরোনো মূল্যবোধের জায়গায় নতুন মূল্যবোধকে আনা। মানুষের পরিবর্তনে যা আসে সে তো মানুষই। আধুনিক মানুষ ও পুরোনো মানুষের মধ্যে 'মানুষ' শব্দটার তো পরিবর্তন সম্ভব না। তেমনই সম্ভব না মানুষের কিছু মৌলিক মূল্যবোধের পরিবর্তন। যা দেশ-কাল-নির্বিশেষে চিরন্তন। সত্য, প্রেম, নিঃস্বার্থপরতা, অনুকম্পা ইত্যাদি। সাহিত্য কি তবে সে জটিল পথ পরিবর্তনের ছবি আঁকবে না? তার মস্তিষ্কের গভীর তন্ত্রীতে উপতন্ত্রীতে যে আন্দোলন, যে সংশয়, যে উপলব্ধি তার কথা বলবে না? সে গুরুদায়িত্বকে এড়িয়ে শুধুমাত্র sensual হয়ে উঠলেই কি আধুনিক সাহিত্য হয়ে গেল? নিজের প্যান্টজামা খুলে সর্বসমক্ষে দাঁড়ানোতেই কি আধুনিক মানসিকতার পরিচয়? সেই দৃশ্যকে নির্লজ্জের মত উপভোগ করাকেই কি তবে maturity বলে? মানে পরিণত মনের পাঠক? মস্তিষ্ককে শরীর থেকে ছিঁড়ে নিজের নাভির নীচের সমস্ত খিদে, লাস্য অভিলাষকে জাহির করাই কি সত্যকারের সাহিত্যের অকপটতা বিচারের একমাত্র মানদণ্ড ভাবতে হবে? সমাজের যে নিয়ম-শৃঙ্খলা সমাজকে ধরে রাখতে, সুষ্ঠুভাবে চালিত হতে সাহায্য করছে, তার মূলে কুঠারাঘাত করে, তার সঠিক মূল্যায়নের পথ থেকে সরে এসে শুধুমাত্র অহংবশতঃ তাকে ভাবাবেগের জোয়ারে ভাসিয়ে দেওয়ার কথায়, বাহবা আশা করা কি খুব দায়িত্বজ্ঞানহীন, সস্তা উদ্দেশ্যে চরিতার্থতার কৌশল নয়? ইংরাজী ভাষার দৌলতে বিশ্বের বহু কালজয়ী সৃষ্টি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। দেখেছি মানুষের কথাই চিরটাকাল মানুষের প্রাণে গিয়ে স্থির আসন নিয়েছে। কথা হচ্ছে কোন মানুষ? মানুষের মধ্যে একটা পশু চিরটাকাল আছে। সে যে পশুর অভিব্যক্ত রূপ এ কথা তো আর ঘটা করে বলার প্রয়োজন নেই। সে জীব। তার আহার নিদ্রা মৈথুন - সব আছে। সব জীবের যেমন আছে। এখন ব্যাপারটা হল, সাহিত্যের কাজ কি সে সবের খতিয়ান দেওয়া? এ যেন রাজকবিকে হেঁশেলের দায়িত্বে পাঠানো। আরে সে সব যে আছে সে তো কেউ অস্বীকার করছে না। তবে তার বর্ণনাই কি উৎকৃষ্ট সাহিত্যের পরিচয়? একটা সুদর্শন প্রাসাদে এসে কি রসিক ইঁটের হিসাব কষে? অপূর্ব একটা তৈলচিত্র দেখতে দেখতে রসিক তেলের কোম্পানীর খোঁজ নেন? যদি নেন তবে আর যেই হোন, তিনি রসিক নন। একটা ঘটনা মনে পড়ল। রেজওয়ানা চৌধুরীর অনুষ্ঠান থেকে ফিরছি। অসাধারণ অনুষ্ঠান ছিল। তার ঘোর তখনো কাটেনি। কয়েকজন মহিলা সহযাত্রী হলেন, যাঁরাও উক্ত অনুষ্ঠানে ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন আরেকজনকে বললেন, ‘শাড়িটা দেখেছিস? গলার হারটা?’... তারপর বাংলাদেশ ও ভারতে শাড়ির গুণগত মান, গয়নায় খাদ মেশানোর ধারা ইত্যাদি উচ্চতত্ত্ব আলোচনায় রত হলেন। আবার এমনও হয়েছে, ট্রেন চিল্কার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। সকালের মনোরম পরিবেশে প্রাণ স্নিগ্ধ। এমন সময় একজন সহযাত্রী বললেন, ‘এই যে চিল্কায় কি কি মাছ পাওয়া যায় জানেন?’ তারপর কি কি মাছ কি কি রন্ধন পদ্ধতিতে কিরকম লোভনীয় হয়ে ওঠে তার বিশদ বিবরণের তালিকা শুরু হল। তাই বলছিলাম সাহিত্যকে স্থূল বাজারের কারবারি করে তুললে আখেরে আমাদের ক্ষতি। তবে কি সাহিত্যে সে জীবজ বর্ণনার কোনো প্রয়োজন নেই? নিশ্চই আছে। প্রয়োজন পড়লে তার বর্ণনার দায় নিতে হবে বইকি। তবে কি ভাবে? সেখানেই আসে পাঠক ও লেখকের রুচির শালীনতা ও সুক্ষ্ম রসবোধের পরিচয়। পুষ্টির প্রয়োজনে খাদ্য অম্ল, কটু, তিক্ত, ঝাল হোক, কিন্তু শুধুমাত্র রসনার তৃপ্তির জন্য তাকে সেই ধারায় আনতে হলে তো বিপদ! মননের অভাব sensuality দিয়ে পূরণের প্রথা বহু প্রাচীন। মননের অভাব ঘটলে বিশ্ব সাহিত্যের আঙিনায় আসি না কেন? লিখতে না পারি পড়তে তো পারি। মননে শাণ তো দিতে পারি। তারপর না হয় জামাকাপড় পরে ভদ্রস্থ হয়েই সাহিত্যের দুনিয়ায় আসি। খুব কি দেরি হয়ে যাবে?
504
Sun, 06/26/2016 - 21:00
'মত কিছু ঈশ্বর নয়' - ঠাকুর বলতেন। মত পথ। মতের প্রচার চলে, সত্যের নয়। তবে সত্যের সাথে মতের সম্পর্ক কি? মত হল সত্যের শরীর। ভাবটা রবীন্দ্রনাথের। শরীর জীর্ণ হয়, আত্মা অর্থাৎ সত্য নয়। এই সত্যের প্রকাশ কোনো মতকে আশ্রয় করেই হয়। আলো যেমন কোনো বস্তুতে প্রতিফলিত না হলে আমার চোখে ধরা দেয় না, তেমনই অন্তরজীবনের অনুভূত কোনো সত্য, কোনো দর্শন অথবা মতকে আশ্রয় না করলে দানা বাঁধে না। শরীরের যেমন একটা স্থূলত্ব আছে, মতের অথবা দর্শনেরও তেমন একটা স্থূল দিক আছে। যত দ্বন্দ্ব, যত বিরোধ, যত অসহিষ্ণুতা এই স্থূল দিকটাকে নিয়ে। একজন রসায়নশাস্ত্রে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিকে যদি রসায়নের পরীক্ষাগারে নিয়ে যাওয়া যায়, তবে সে সবকিছুকেই তার সীমিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখবে ও একের সাথে আরেক বস্তুর মধ্যে বিরোধ, অসামঞ্জস্যতা অনুভব করবে। কারণ দুটো আপাতবিরোধী বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র গঠন করতে লাগে গভীর জ্ঞান অথবা গভীর উপলব্ধি। প্রথমটা বাহ্যিক বস্তুজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োজ্য, দ্বিতীয়টা মনের জগতের জ্ঞানের বিষয়।  উপনিষদ বলেন, 'সত্য বস্তু এক, জ্ঞানী তাকে নানানভাবে প্রকাশ করেন।' ঠিক কথা। তবে কিসের মাধ্যমে প্রকাশ করেন? ভাষার মাধ্যমে, ভাবের মাধ্যমে। আবার একটা নতুন শব্দ এলো - ভাব। এটা ভাষার থেকে উৎকৃষ্ট প্রকাশমাধ্যম। কারণ এ আরো সুক্ষ্ম। তাই যত ভাবের গভীরে মরমী সাধক পৌঁছেছেন, তিনি তত অনুভব করেছেন সব বিরোধের অসারতা। অনুভব করেছেন, 'সব কা মালিক এক'- সাঁই, কিম্বা 'সবাই সেই এক'কেই চাচ্ছে'- ঠাকুর। এই ভাবের গভীরে ঢোকাকেই সাধন বলে। অনুভবের গভীরে। বুদ্ধ যখন বলছেন, 'বিদ্বেষ দ্বারা কখনো বিদ্বেষ নিবারিত হয় না, তা শুধুমাত্র বিদ্বেষহীনতা দ্বারাই প্রতিহতযোগ্য' - তখন তিনি বৌদ্ধিক যুক্তির কথা বলছেন না, বলছেন অন্তরের গভীরে যে আলোর স্পর্শ অনুভব করেছেন, সত্য বলে জেনেছেন, তার কথা। বার্ট্রান্ড রাসেলও যখন সহিষ্ণুতার কথা বলছেন, সাথে সতর্কও করছেন, যে এই সহিষ্ণুতার বাণী না প্রচারিত পালিত হলে মনুষ্যসমাজের তথা এই পৃথিবী আর বাসযোগ্য থাকবে না, তখন তিনি সাথে সাথে এও বলছেন, এ হল অনুভূতির কথা, মরমের কথা, ভাবের কথা। সারদাদেবী কি অদ্ভুত সরলতার সাথে দিকনির্দেশ করছেন - 'ঈশ্বর হল মনের ধন বাবা।' তাই তো। ঈশ্বরের অনুভব একটা অস্তিত্বের অনুভব, চেতনার অনুভব, আনন্দের অনুভব। তাই উপনিষদ বলছেন, তিনি সচ্চিদানন্দ। অর্থাৎ তিনি সত্য - অস্তিত্ব, তিনি চেতন - জ্ঞান, তিনি আনন্দ -প্রেম। কিন্তু কথা হল এগুলো সব আমার মধ্যেও বর্তমান! তবে কি আমিও ঈশ্বর? উত্তর 'হাঁ'ও বটে 'না'ও বটে। আমাতে আর তাঁতে গুণগত মিল আছে, নেই পরিমাণগত মিল। আমার অজ্ঞানতা আছে, নিরানন্দতা আছে। যদি না থাকত তবে আমাতে আর তাঁতে ভেদ থাকত না। যেমন নেই বুদ্ধ, খৃষ্ট, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ ইত্যাদি দেবমানবদের জীবনে। সেখানে সবসময় আলো, সেখানে সবসময় প্রেমের ঠাণ্ডা বাতাস। আবালবৃদ্ধবনিতা, ধনী-দরিদ্র, তাদের শরণাপন্ন হচ্ছেন শান্তির জন্য, আনন্দের জন্য। তাঁরা কি তবে মত? না, তাঁরা এক একটি আলোকস্তম্ভ। সে আলোকস্তম্ভের দৈর্ঘ্য, উচ্চতা ইত্যাদির পরিমাপে যেও না। ঠকবে। আলো'কে নাও দু'হাত ভরে। দেখো কোনো বিরোধ নেই। প্রত্যেকে সত্যের পূর্ণ প্রকাশ। অনুভবে, বিচারে নয়। তবে সত্যকে অনুভব করব কোন মতে? যে মতে আমার রুচি। ঠাকুরের সেই গল্প। ধোপাঘরের গামলা। যে যে রঙের কাপড় চায়, সেই রঙের কাপড় পায়। একজন এসে জিজ্ঞাসা করল ধোপাকে, 'তুমি নিজে কোন রঙে ছুপেছ?' ধোপা হেসে ফেলল। প্রশ্নকর্তা সেই রঙেই ছুপতে চায় যে! তাই মতকে অগ্রাহ্য করার যেমন উপায় নেই, তেমন তাকেই সত্য বলে আঁকড়ে ধরারও অর্থ নেই। সত্য স্বপ্রকাশ। মত শুধু সিঁড়ি। ব্যস, এটা বুঝলেই আর গোল নেই।
505
Sat, 06/25/2016 - 08:00


আস্থা। বিশ্বাস।

দুটো শব্দ ব্যাখ্যা করতে পারব না। অর্থটা বুঝি। অন্তত তাই ধারণা ছিল। আজ চারিদিকে যা দেখছি, সত্যি বলতে কি, আতঙ্কিত হচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আস্থাহীনতার অভিজ্ঞতা হয়নি এমন নয়। হয়েছে। ঝড় সামলে দাঁড়িয়েছি, এটা বেশি সত্যি আমার কাছে। "মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়ে ছিল তার, তাই নিয়ে কে বা করে হাহাকার/ সুর তবু লেগেছিল বারেবার মনে পড়ে তাই আজি"।
কিন্তু এ আস্থাহীনতা, অশ্রদ্ধা ধীরে ধীরে সম্পর্কগুলোর পাকে পাকে জড়িয়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। ফেসবুক, ওয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি আমাদের যত কাছে আনছে, এক এক সময় মনে হচ্ছে এতটা কাছাকাছি আসার যোগ্য কি আমরা করতে পেরেছি নিজেদের? জানি না। আমার পাশের মানুষটার সাথে চলাফেরা, ওঠাবসা, কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে যে জীবন যাপন, তা কি এই বৈদ্যুতিক সামাজিক মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে পাওয়া আংশিক অস্তিত্বের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া সম্ভব? কখনো না। আমার পাশের মানুষটার দোষগুণ সব মিলিয়ে তাকে নেওয়ার মধ্যে একটা সাধনা আছে। মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে সেই সম্পর্কে।
কিন্তু এই সহজলভ্য সামাজিক মাধ্যমে যে স্পর্শগুলো পাই, তা কতটা খাঁটি? কতটা বাস্তব? কতটা মূল্যবান? সে ভাবনার দরকার হয় না, কারণ তাৎক্ষণিক সুখটার মোহ অত্যন্ত বেশি।
তাই দেখছি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে ব্যভিচার। এটা নাকি আধুনিকতা। ব্যভিচার আগে ছিল না বলছি না। তবে এমন মহামারীর মত ছিল কি? বালিশের ওয়াড় বদলাবার মত বদলে বদলে যাচ্ছে প্রেম। শরীরের চাহিদা চিরটাকাল অপূরণীয়, অথবা দুষ্পূরণীয়। তা বিচিত্র যুক্তিজালে আষ্টেপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ছে এই সাংঘাতিক আন্তর্জালতন্ত্রের শিরা উপশিরা বেয়ে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাকে ফাঁকি দিয়ে গোপন পথে বিকারের রাস্তায় খুঁজছে আত্মতৃপ্তির পথ। কারণ দুর্বল সবসময়ই বিকল্পতা খোঁজে গোপনে, সরাসরি লড়াইয়ের পথ ছেড়ে।
নীতিবাগীশের মত শোনাচ্ছে হয়তো কথাগুলো। তা শোনাক। নীতি কি জানি না। আস্থা কি বুঝি। যে ছাদটার তলায়, যে খাটের উপর বসে, এই লেখাটা লিখছি, সেই ছাদ আর খাটের উপর আস্থা রয়েছে বলেই সে নিশ্চিন্ততা অনুভব করছি।
আমার বারবার মনে হচ্ছে, এই সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের যত কাছাকাছি এনে ফেলেছে, তত কাছাকাছি আসার যোগ্যতা আছে আমাদের? আমরা একে অন্যের প্রাইভেসি, শালীনতা, স্বাস্থ্যকর দূরত্ব বজায় রাখতে শিখেছি? আমরা কি অন্যের ইচ্ছা, বিশ্বাস, ইত্যাদিকে সম্মান জানিয়ে সম্পর্ক রাখাতে অভ্যস্ত হয়েছি? ভাবপ্রবণতার সাথে প্রেমকে গুলিয়ে তাৎক্ষণিক মদিরাপানে উদ্যত হওয়াকে কি চরম স্বাধীনতা বলে ভুল করছি না? চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছি না? হাতের একটা স্পর্শেই যখন যে কারোর কাছে আসতে পারছি যখন তখন, আর অসুবিধা কোথায়?
আমার মাথায় এই প্রশ্নগুলো হাতুড়ির বাড়ির মত মেরে ফিরছে। কবিতা, গল্প তো আছেই। তা সাহিত্যের বস্তু। তা জীবন থেকে জাত, জীবনের উদ্দেশেই। তাকে জীবনের থেকে বড়ো করে দেখতে হবে এমন কোনো দায় আমি অনুভব করি না। লিখতে ভাল লাগে, লিখে চলি। কিন্তু লিখতে এসে যা সব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাতে ভয় হচ্ছে, আমি কি এতটাই অনাধুনিক? এতটা পিছিয়ে আছি? তা হলে এ প্রশ্নগুলো এতটা ভাবাচ্ছে কেন?

কারণ একটাই, আস্থা হারাতে চাই না। আত্মসংযমকে আজও সভ্যতার কর্ণার স্টোন বা প্রাথমিক ভিত্তি বোধ হয়। তা বিপন্ন হলে সভ্যতা বিপন্ন। একটা একটা পরিবার মিলেই সভ্যতা। তাই চুপ করে উদাসীন হয়ে থাকা গেল না। ভাবের ঘরে চুরি করে আর যা হোক, কলম ধরা অসাধ্য।
লেখাটা যখন প্রায় শেষ, তখন ভোরের আলো ফুটছে পূবাকাশে। আমার বিনিদ্র রাত লক্ষবার ঈশ্বরের দরজায় ঘা দিয়ে ফিরল। উত্তর এল না। অবশেষে উত্তর এলো ভোরের দোরগোড়ায় এসে। রাস্তার বামদিক দিয়ে হাঁটার নিয়ম থাকলে, ডান দিক দিয়ে হাঁটবার ইচ্ছা হওয়াটাকেই বলে ব্যভিচারিতা। মানুষ বিশ্বাসে বাঁচে, তর্কে না। সে বিশ্বাসকে হনন করা আত্মহত্যারই সামিল।

506
Sun, 06/19/2016 - 20:00


রবীন্দ্রনাথের কথায়, ‘যদি বলি মানুষ মুক্তি পেতে চায়, তবে মিথ্যা কথা বলা হয়। মানুষ মুক্তির চেয়ে ঢের বেশি চায়, মানুষ অধীন হতেই চায়... সে বলছে, হে প্রেম, তুমি যে আমার অধীন, আমি কবে তোমার অধীন হব!’

এ কি সত্যিকারের আকুতি? নাকি নিছক বানানো কথা? মানুষের গভীরের অংশটা চাপা থাকে, উহ্য থাকে। তবে নিষ্ক্রিয় থাকে না। সেখান থেকে তার কলকাঠি নাড়ানোয় আমাদের মনে নানা আন্দোলন। মানুষের মন যদি একস্তরবিশিষ্ট একটা সত্তা হত তবে এতো জটিলতার প্রশ্ন ছিল না। কিন্তু তা তো নয়। তাতে স্তরের পর স্তর। এক স্তরের সাথে আরেক স্তরের সংঘর্ষ আচমকাই। বাইরের মনে ধাক্কা। আমরা অবুঝের মত বাইরে তার কারণ হাতড়ে বেড়াই। খুঁজে বেড়াই এর ওর কাছে তার সমাধান। একে ওকে সেধে মরি – 'ওগো আমার একি হল...', 'রাতে ঘুম নেই...', 'সারাদিন মনে অশান্তির ঘূর্ণি...', 'জ্বলেপুড়ে গেলাম...' ইত্যাদি। সে কি করে বুঝবে তার মনের তলদেশে তখন চলছে স্তরে স্তরে সংঘর্ষ। চলছে নবনির্মাণ। কে করছে? কেউ জানি না। আস্তিক বলবেন আত্মা বা ঈশ্বর। নাস্তিক বলবেন, ঘটনাপ্রবাহের এমনই ধারা – অনির্দেশ্য ও অনির্দিষ্ট।
যেমন একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। মানুষ একটা আশ্চর্যরকম আশা নিয়ে বাঁচে – কোনো একদিন তার মনের মানুষটাকে সে খুঁজে পাবে। ঈশ্বর যাকে তারই জন্য যেন এই সংসারে পাঠিয়েছেন। সে যাকে খুঁজছে তাকে সে পাবেই পাবে। পায় না। তাকে গল্পে খোঁজে, সিনেমায় খোঁজে, বিদেশে খোঁজে, স্বপ্নে খোঁজে। পায় না। যাকে পায় তার মধ্যে তার রূপটাকে আপ্রাণ মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিছুটা হয়, বেশিরভাগটাই বাদ পড়ে যায়।
ঠাকুমার মুখে শুনেছিলাম, পুরাণে নাকি আছে, দ্রৌপদী তার গতজন্মে এমন স্বামী প্রার্থনা করেছিলেন যার মধ্যে ধৈর্য্য, বীর্য, সুপ্রেমিকতা, ধর্ম, কোমলতা ইত্যাদি নাকি সব গুণ থাকবে। তা বাস্তবে তো সেটা সম্ভব না। তাই নাকি পাঁচজন স্বামী পেয়েছিলেন, যাদের মিলিত গুণাবলী তার কাঙ্খিত গুণাবলীর সমষ্টি। গল্পটা মনে ধরেছিল। তাই হয়। মনে মনে তাই মানুষের বাঁয়ে-ডানে দৃষ্টি চলেই যায়। চোখে ঠুলি পরে চরানোর যে চেষ্টাটা সমাজ করে আসছে, সে ধর্মেরই হোক, বা শাসনেরই হোক, মানে পিনাল কোডের শাসন আর কি, তবু চোখ তো যেতে চাইবেই। আবার এই সমাজটাও তো আমারই সৃষ্টি, আমার মধ্যে আমিই তো সমাজ, যতই উপেক্ষা করি, সেও তো জানি ডানা ব্যথা হলে নীড়েই ফিরতে হবে। মাসীমা-পিসীমার পাশে এসে বসতে হবে, শক্ত ডানাওয়ালাগুলোকে তেড়ে গালাগাল করতে হবে, শিষ্টাচার শেখাতে হবে। কারণ নিজেকে যতই স্বেচ্ছাচারিতার ছাড়পত্র দিই না কেন, নিজেদের সন্তানদের তো একটা সমাজই দিতে হবে না? সুস্থ, শিষ্ট, ভদ্রমানুষের সমাজ! কি অসম্ভব স্ববিরোধিতা। হতেই হবে। তবেই তো হলাম গিয়ে মানুষ। টলতে টলতে সামলানো অভ্যাস করাই তো জীবন।
সে যা হোক। কথা হচ্ছে সেই মনের মানুষটার পূর্ণরূপটা কোথাও যখন কোনোভাবেই আর মিলছে না, তখন ধর্মে, কল্পনায়, অন্তরে তাকে নানান রূপে আঁকার প্রয়াস পাওয়া গেল। এখানে একটা মজার ছাড় আছে। আমরা তাই বিশ্বাস করি বা বুঝি, যা আমরা আদতে মনের গভীরে বুঝতে বা বিশ্বাস করতে চাই। ফলে নিজের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এই মনের মানুষ খোঁজার খেলায় ইতি টানি। যদিও গভীরে সে চলতেই থাকে। তার আভাস পাই হঠাৎ উপচে পড়া খুশীর মুহুর্তে চোখের জলের আচমকা আবির্ভাবে। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড হাসির দমকের মধ্যেই অপরিচিত কোনো চিরাকাঙ্খিত মুখের বেদনার্ত উদ্ভাসে।
তবু এইখানটাতে এসে সে নিজেকে আর তার আশপাশের মানুষগুলোকে সম্পূর্ণরূপে পায়। কারণ এবার তার খোঁজের তৃষ্ণাটা নেই। আছে মিলবার তৃষ্ণা। সবার অপূর্ণতার সাথে নিজের অপূর্ণতার মিলনে পূর্ণরূপের আস্বাদন। তাই তার এত উৎসব। সেই সবকে যদি বলো ঈশ্বর, মেনে নিই। আর যদি কোনো এক খামখেয়ালি, আমার থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তাকে বলো ঈশ্বর – তো বলব অমন ঈশ্বরের ক্যাঁতায় আগুন। সে ব্যাটা, যাকে ভালোবাসি যদি তার চোখের মধ্যে ধরা দিতে না পারে, তবে অমন মুরোদহীন, ইনসিকিউরিটি কমপ্লেক্সে ভোগা ঈশ্বরকে চাই না। কিন্তু তাকে তো ভালোবেসেই পেয়েছি, তাই ঐশ্বর্য্যকে আমার এত ভয়, তার প্রথম হাত পড়ে আমার ভালোবাসায়। আমার ঈশ্বর দীনহীন হোক, চলবে; আমিও তাই থাকি, মরেও বাঁচব। বেঁচে মরে থাকার সে ঢেরগুণ ভালো।
তাই শুরুর কথাটা আবার শেষে বলি। অধীন হতেই চাই। প্রেমের। শুদ্ধ প্রেমের।

507
Sun, 06/12/2016 - 19:30


ঈশ্বরের বিরোধিতাও এক ধরণের আস্তিকতা। কারণ যার অস্তিত্বহীনতা নিয়ে আমার মনে কোনো সংশয় নেই, তার অনস্তিত্ব নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কি দরকার?
আমি যদি স্নান করতে না চাই, তবে স্নানাগারে ঢোকার কোনো কারণ দেখি না। আমি ভুতে বিশ্বাস করি না। তাই "ভুত নেই" বলে একটা প্রবন্ধ ফেঁদে বসারও প্রয়োজন দেখি না। কারণ আমি জানি সত্যের শক্তি আমার থেকে বহুগুণ বড়। তা আমার প্রকাশের অপেক্ষায় থাকে না। আর সত্য কার কাছে কিভাবে প্রকাশিত হবে তাও আমার নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। তাই অকারণ আমার অনুভূত সত্যকে অন্যের অনুভূত সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে কোনো সুখ আমি কোনোদিন উপভোগ করতে পারিনি।
ধর্ম নিয়ে বহু বাদানুবাদ আছে। ধর্মের ব্যাখ্যা কালে কালে বদলেছে। আরো বদলাবে। যেমন বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তগুলো। প্রাক্তন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যেমন আধুনিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে নস্যাৎ হয়ে গেছে, ঠিক তেমনই।
কথা হচ্ছে এক চামচ জলে সাগরের রূপ কল্পনা করার অভ্যেস। ধর্ম চিরটাকাল বিভেদ তৈরি করে এসেছে মানুষে মানুষে - এ যেমন অর্ধসত্য আবার ধর্ম না থাকলে মানুষ ব্যভিচারী, অনৈতিক হয়ে উঠত - এও তেমন অর্ধসত্য। অবশ্য এখানে আমি ধর্ম বলতে ইংরাজীতে 'রিলিজিয়ান' বলতে যা বোঝায় তাই বলছি। কারণ ভারতীয় দর্শনে ধর্ম হল যা 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়'- এরকম ব্যাখাও পাওয়া যায়। তাতে অতীন্দ্রিয় কোনো বিশাল অস্তিত্বের শরণ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে না। এমনকি গীতাতেও নিজের বুদ্ধির শরণ নেওয়ার কথা আছে, আর "বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি" অর্থাৎ বুদ্ধিনাশ হলেই নিজের ধ্বংস মানুষ নিজেই ডেকে আনে, এমন উদ্ধৃতিও আছে। এই বুদ্ধি অবশ্যই শুভবুদ্ধি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে সেখানে যে, মানুষ যত নিজেকে জ্ঞানের দর্পণে দেখে, তত সে নিজেকে অন্যের সাথে সমান দেখে। তার বিভেদবোধ দূর হয়। সেই গীতাতেই আবার ঈশ্বরের কথাও আছে, তাঁর শরণ নেওয়ার কথাও আছে।
তাই বলছিলাম এখানে আমি ধর্ম বলতে 'রিলিজিয়ান'ই বলতে চাইছি। আসলে আস্তিকের ঈশ্বর আর নাস্তিকের ঈশ্বর - দুটোরই মোদ্দা কথা হচ্ছে বিশ্বাস। একজনের 'হাঁ'-এ বিশ্বাস, আরেকজনের 'না'-এ। অগত্যা ঠোকাঠুকি। এর সহজ সমাধান হল, কেউ কারোকেই দলে টানতে না চাওয়া।
ধর্মের আর দর্শনের একটা বড় পার্থক্য হল হৃদয়ের কাছে আবেদন। এইটাই ধর্মের সবচাইতে বড় শক্তি আবার সবচাইতে বড় ভয়ের। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে দেখা যাক। দর্শনের আবেদনটা সিংহভাগ বৌদ্ধিক স্তরের। তার আনন্দ বিশুদ্ধ বৌদ্ধিক আনন্দ। সংসারে একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও একই সাথে অসৎ মানুষ মিউজিয়ামে গিয়ে দেখতে হবে এমন দুর্লভ নয় মোটেই।
ধর্মের শক্তির জায়গাটা হল তার হৃদয়ের কাছে আবেদন। একজন মানুষ ঈশ্বরকে ভালোবাসে বলে হত্যা করল না, চুরি করল না, মিথ্যা বলল না। কারণ সে ঈশ্বর বলে একজনের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে, যিনি আদতে শুভগুণের সমাহার ও শুভ মানুষের উপর সদয়। মূলত পৃথিবীর সব ধর্মগুলোর সার কথা- সত্য, প্রেম ও করূণা। এই তিনটেকে বিশেষ করে অনুসরণীয় বলা হচ্ছে 'সার্থক মানুষজীবন' অতিবাহিত করতে। সেই বিশ্বাস তাকে দুর্দিনে সাহস জুগিয়েছে, আশ্বাস দিয়েছে, ভরসা দিয়েছে। সবার সাথে যুক্ত থাকার একটা কারণ দেখিয়েছে। দুঃখকে, মৃত্যুকে বরণ করার একটা পথ দেখিয়েছে। তাই পৃথিবীর সব ধর্ম থেকে প্রচুর বড় বড় মনীষীদের নাম পাওয়া যাবে। অগুনতি সাধারণ মানুষের জীবন এই ধারায় বয়ে চলে যাচ্ছে, যারা নির্বিবাদে একটা শান্তিপূর্ণ জীবন কাটিয়ে যাচ্ছেন যুগ যুগ ধরে।
কিন্তু এই হৃদয়ের কাছে আবেদনই আবার বিপদের কারণ। সে সাম্প্রদায়িকতা শেখায়। নীচু হওয়ার জায়গায় ঔদ্ধত্য শেখায়। আসলে মানুষের মূলগত কিছু ত্রুটি আছে। হিংসা, ভেদাভেদ, স্বার্থপরতা ইত্যাদি কাউকে শেখাতে হয় না। এটা তার জন্মগত স্বভাব। তাই এই দোষগুলো ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষাক্ষেত্র, চিকিৎসাক্ষেত্র ইত্যাদি সর্বত্র নিজের গতিপথ তৈরি করে নিয়েছে। অসৎ ধার্মিক, অসৎ চিকিৎসক, অসৎ শিক্ষক, অসৎ ব্যবসায়ী ইত্যাদি সর্বত্র ভুরিভুরি উদাহরণে ভর্তি। কারণ অসৎ, স্বার্থপর ইত্যাদি হওয়াটা মানুষের জন্মগত প্রবৃত্তি, বিপরীতটাই শিক্ষণীয়। সেই শিশুবয়সের পাঠ - "সদা সত্য কথা বলিবে"।
তো কথা হচ্ছে, এই নিম্নবর্গীয় পিপাসাগুলো যখন ধর্মের শরীর আশ্রয় করে বসে তখন তা আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে। কারণ আর সব পথ মস্তিষ্ক অবধি গিয়ে ক্ষান্ত হয়, ধর্মের পথ হৃদয় অবধি পৌঁছায়। সে বিকারগুলোকেই সত্য বলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। কারণ প্রধানত প্রভুত্বের লোভ। সে ধর্মই হোক আর রাজনীতি হোক, কি শিক্ষানীতি - সবার উপরে তো উঠতেই হবে না!
যখনই মানুষ শুভবুদ্ধি আর অনুকম্পার পথ ছেড়ে অন্যপথে হেঁটেছে (যার উদাহরণই ইতিহাসে অধিক) তা সে সরাসরি হোক আর ছদ্মবেশেই হোক সে অন্ধকার তৈরি করেছে। এমনকি আলো জ্বালার নাম করে চারপাশটা অন্ধকারে রেখে নিজের উঠানটা আলোকিত করে রাখার ইচ্ছাটাও বর্বরতা। সে যতই উচ্চতত্ত্বের মোড়কে ঢাকো না কেন! বিভিন্ন তত্ত্বের, বিশ্বাসের মুখোশগুলো খুলে গেলে আমরা আসলে আদতে সেই বর্বর মানুষই। কয়েকজনকে বাদ দিলে। তারা ব্যতিক্রম। আমরা নই। আমরা যত উন্নত হচ্ছি তত বর্বরতাগুলোকে নিত্যনতুন কৌশলে
ব্যাখ্যা করতে আর ঢাকতে শিখছি - এইমাত্র পরিবর্তন।
"পাশের বাড়ির মানুষগুলো না খেয়ে মরে যাচ্ছে, আর নিজের মেয়ের বিয়েতে হাজার টাকা খরচ, এরা আবার জীবে দয়ার কথা বলে, শালা!" রামকৃষ্ণের নগ্ন হুঙ্কার।
তাই জেরুজেলামের যীশুর, দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে এলেম লাগে; আর ভ্যাটিকানের যীশু, বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণের শিষ্য সাজাটা এত সোজা হয়ে যায়। প্রথমটা যে শুদ্ধতা দাবী করে, পরেরটা করে না।

508
Sun, 06/05/2016 - 23:40

সাইকেলের চাকা। টোটোর চাকা। বাইকের চাকা। বাসের চাকা।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি বন্ধুর আসার অপেক্ষায়। সামনে হুসহুস করে চাকার দল ছুটে চলে যাচ্ছে। তার উপরে মানুষ। ব্যস্ত মানুষ, চিন্তিত মানুষ, খোশমেজাজি মানুষ, দুঃখী মানুষ। রোগা মানুষ, মোটা মানুষ। গরীব মানুষ, ধনী মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ।
সবাই চাকার উপর। কেউ যাচ্ছে। কেউ নিজেকে নিয়ে যাচ্ছে, কেউ কাউকে নিয়ে যাচ্ছে। চাকার পর চাকা ঘুরে চলেছে। চাকার পর চাকার সারি।
প্রাণীবিদরা বলেন, আমাদের দেহ জুড়েও এক মস্ত চাকা ঘুরে চলেছে। হৃৎপিণ্ড থেকে রক্ত বেরিয়ে বনবন করে সারা শরীর ঘুরে ফের ঢুকে পড়ছে হৃৎপিণ্ডে। কোষের মধ্যে কি এক সান্দ্র বস্তু আর সব কিছু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোষ ভাঙছে গড়ছে এও নাকি ভীষণ এক চক্র - কোষচক্র।
ওদিকে পরিবেশবিদরা বলছেন, সারা পরিবেশ জুড়েও চলছে এক বিশাল চক্র। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদিরাও আবদ্ধ হচ্ছে, আবার মুক্ত হচ্ছে, এমনধারা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে।
ওদিকে মহাকাশবিদরা বলেন সব গ্রহ-নক্ষত্র নাকি ঘুরে চলেছে অনন্তকাল ধরে। পরমাণুবিদরা বলেন, সব অণু-পরমাণুও নাকি ঘুরে চলেছে সাঁইসাঁই করে।
আবার ওদিকে ঋষিমুনিরা বলেন আমরাও নাকি জন্ম-মৃত্যু চাকায় ঘুরে চলেছি যুগযুগান্ত ধরে। প্রাণীবিদ হেকেল মশায় বলেন, প্রতিটা জীব যখন মাতৃগর্ভে আসে, সে পুরো অভিব্যক্তির পথটা নাকি ঝালিয়ে নেয় ওইটুকু সময়ের মধ্যেই। মানে আর কি এই যেমন আমরা। আমরা তো মানুষ (নীতিবাগীশরা কি বলেন তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই, মানে প্রাণীবিদদের কাছে তো আমরা মানুষই, সে চরিত্র আমার যাই হোক না কেন) তা সেই মানুষ হওয়ার আগে আমরা যা যা ছিলুম (মানে ওই বিজ্ঞানী দাদাভাইবোনেরা যা যা খুঁড়ে খুঁড়ে বার করেছেন আর কি), আমরা নাকি মায়ের গর্ভে ওই পুরোটা একবার রিভিশান দিয়ে তবে ধরাধামে ল্যান্ড করি। অর্থাৎ কিনা সেই চাকার গল্প।
এই সব ভাবতে ভাবতে মাথাটা আমার ভোঁ ধরে গেল। যেদিকে তাকাই চাদ্দিকেই চাকার খেলা, বাইরে ভিতরে চরকির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে চাকা।
তবে আমার এই অস্তিত্বটাও নিশ্চই কোনো এক বিশাল চাকার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র, তস্য ক্ষুদ্র, মানে এমনই ক্ষুদ্র যা ধারণাও করা যায় না, সেইরকম একটা ক্ষুদ্র আবর্তনের অংশ! এই যে আমি হঠাৎ করে এই মহাপ্রাণসাগরে ভেসে উঠেছি, এই যে আমাদের সবার সাথে দেখা হওয়া, পরিচয় হওয়া একি সবটাই আকস্মিক? সে মহাকালের আবর্তন আমায় চেনে? না চেনে না। সাগর কি তার সব ঢেউকে মনে রাখে? রাখে না তো। তাতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু যে অনন্ত চেতনার সাগরে এক লহমার আভাসে আমি ফুটে উঠছি, সেই ভাগ্যটুকু কি নিতান্তই একটা চান্স? না না না। হতে পারে না। তাহলে এমন করে এত সুখ, এত দুঃখ, এত চেষ্টাকে নিয়ে এমন নিবিড় আনন্দে ভরে উঠত না জীবন। সবকিছুই অর্থহীন হয়ে পড়ত তবে। আকাশের সব গ্রহনক্ষত্র'র এমন সামঞ্জস্য থাকত না, মহাকালের সব কিছুই হত অনর্থক, তার বিশ্বব্যাপী লীলার সাথে আমার চেতনার যোগসূত্র খুঁজে না পেলে।

তাই বিশ্বাস করি সে এমনি এমনি ডাকেনি আমায় তার সভায়। একটা সুর গাইতে ডেকেছে। একি কম সৌভাগ্য! হোক না সে নিতান্ত ছোট একটা সাদামাটা সুর। সেই গেয়ে বেড়াই নিজের সমস্ত শক্তিটুকুকে একত্র করে।
শুধু এইটুকু প্রার্থনা, সে সুর যেন চড়ায় না ধরি, আর সব সুরকে ছাপিয়ে এই কলতানকে বিঘ্নিত করার চেষ্টায়, ক্ষণিকের আত্মমোহের অহংকারে। সে কাজটুকু শেষ হলে যেন বিদায় নিই বিনা অভিযোগে, বিনা ক্ষোভে। সাশ্রুনয়নে তাঁর দ্বারে এসে, তাঁর বাঁশি তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে, নম্রচিত্তে যেন বলে যেতে পারি - আমি ধন্য, আমি কৃতজ্ঞ এই মহাসভায় ক্ষণিকের জন্য আসার আমন্ত্রণ পেয়ে। যা কিছু ভুলত্রুটি ক্ষমা কোরো।


(ছবিঃ সুমন)

509
Thu, 06/02/2016 - 09:30

যেখানেই স্বাধীনতা সেখানেই বৈচিত্র্য। মানুষ স্বাধীন হল চিন্তায়। হল বৈচিত্র্যময়। আদবকায়দা, পোশাক-আশাক, রীতিনীতি, বিশ্বাস, ধর্ম - সব হল বৈচিত্র্যময়।
বিজ্ঞান এল এগিয়ে। সবাই এলো কাছাকাছি। কিছুটা অতিরিক্ত কাছাকাছি। যেন দরজা খুললেই ভিনদেশ। টিভিতে, উড়োপথে হাতের কাছেই সারাবিশ্ব। ইন্টারনেট চিত্রগুপ্তের খাতাকেও নস্যি করে দিয়েছে।
মুশকিল হল এইবার। সব ক্রিয়ারই একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। হচ্ছেও। যতই আমরা কাছাকাছি আসছি, যতই কিনা নানানরকম প্রকার দেখছি, ততই নিজেকে জোর করে নিজে বানাবার চেষ্টায় উঠে পড়ে লেগে গেছি। ওই যেরকম অনেকেই আছে না, বাইরের লোক দেখলে ঘরের লোকের সাথে একটু বেশি বেশি প্রেম দেখায় - এও সেরকম আর কি। নিজস্বতা রক্ষার তাগিদে সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। আচমকাই নিজের ভাষার প্রতি, নিজের ধর্মের প্রতি, নিজেদের রীতিনীতির প্রতি ভালবাসা হুসহুস করে বাড়ছে। প্রেম করবে বলে না, প্রেমের মাধ্যমে আত্মজাহির হবে বলে সেজেগুজে বসাটা কি খুব কাজের কথা? না বোধহয়। সেটা খুব একটা স্বাস্থ্যকর না। তাতে অন্যের উপর চোখরাঙানীতে যতটা মন যায়, নিজের উন্নতিতে তার শতাংশের এক অংশও না। আমি যে আছি - এটা বেশ জোরের সাথে না বোঝালে অস্তিত্বসংকট অনুভব হয়। অস্বাস্থ্যের লক্ষণই হল - মাত্রাহীনতা। সেই মাত্রাহীনতা লাগামছাড়া হয়ে অন্যের ত্রাসের কারণ হয়ে উঠতেও সময় লাগে না। জন্ম হয় সন্ত্রাসবাদের। এক বিশেষ অস্তিত্ব জাহিরের কৌশল।
এর কোনোটাই প্রকৃতির নিয়মে চিরস্থায়ী নয়। প্রকৃতি কখনোই ঔদ্ধত্য বরদাস্ত করেনি। সহাবস্থানই তার মূল চলার ছন্দ। এর বিপরীতাচরণ মানেই নিজের ধ্বংসের পথ রচনা করা - অতি দর্পে হতালঙ্কা।

510
Sun, 05/29/2016 - 19:30

বলা হল যদি তুমি তারাখসা দেখতে দেখতে কিছু চাও, তুমি পাবে। আবার কেউ বলল, চোখের ঝরাপাতা হাতে যা চাইবে, পাবে।
    এগুলো কি সত্যি? সত্যিই। কারণ কোনো এক তাৎক্ষণিক ক্ষণিকের মুহুর্তে যে চাওয়াটা মনে পড়ে, সেই চাওয়াটাই তো আমার গভীরতম চাওয়া। সবারই কি থাকে? এর উত্তর 'হ্যাঁ'-ও আবার 'না'-ও। কিছু চাওয়া তো সবারই থাকে। তবে ঐকান্তিক চাওয়াটা কি সবার থাকে? থাকে। তবে দশের ইচ্ছায় সেটা এত তলিয়ে যায় যে তার টিকিটাও আর দেখা ভার। এই দশের ইচ্ছা বনাম আপন ইচ্ছার লড়াইয়ে, আপন ইচ্ছাকে টিকিয়ে রাখতে পারলে তবে কোনো কথা। না তো সেই বিখ্যাত লাইন রবীন্দ্রনাথের - নূপুরের মত বেজেছি চরণে চরণে.... সাধিয়া মরেছি ইঁহারে তাঁহারে উঁহারে...
    সেই ঐকান্তিক চাওয়ার একটি গভীরতম আদি চাওয়া, নিজেকে চাওয়া। নিজেকে বুঝতে চাওয়া। নিজেকে জানতে চাওয়া। সারাদিনের ঘাত-প্রতিঘাত, হাসি-কান্না, আনন্দ-উচ্ছ্বাসে তো নিজেকে জানছিই। তবে কোন অতল থেকে একটা গভীর বেদনা জেগে উঠে উদাস করে - এ নহে, এ নহে। মানুষ আত্মমগ্ন হয়। তবে কে সে?


    মানুষ বুঝতে পারে, সে নিজের মধ্যে যেন কোথাও পুরোপুরি এক না। তার মধ্যে নানান বৈপরীত্য। নানান অনুভূতি, নানান উপলব্ধি। কোথাও যেন তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। সে তখন এই চিত্তস্রোতের ভাবের প্রবাহতে ভাসতে ভাসতেই তল খুঁজতে শুরু করে। দেয় চিত্তস্রোতে ধ্যানের পাড়ি।
    নিজেকে লাগতে লাগল অজানা। এ কে? এ কে বাসা করে আমারই চিত্তগুহায়? কার মন্দ্রিত কণ্ঠস্বরে আমোদিত আমার চিত্ত। কে সে? কে?
    এমনভাবে সে হয়তো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সমাজের মূলস্রোত থেকে কিছুকাল। তার মাথায় জন্মালো জটা, সারাগায়ে হল মাটির ঢিবি। সংসার টের পেল না বাইরে থেকে কিছু। সবাই ভাবল, সে বুঝি হল পাগল। কিম্বা উদাসী। বয়স্কেরা বললে, না না, এ যে সন্ন্যাসী। নিন্দুক বলল, কঠোর বাস্তব থেকে পলায়নের মতলব, হুঁ, বেশ বুঝেছি।
    সে থাকল স্থির। অবিচল। তার মনে লেগেছে কোন অজানা সমুদ্রের ঢেউ। সে তলিয়ে যাচ্ছে জ্ঞান থেকে জ্ঞানান্তরে। এক উপলব্ধি থেকে আরেক উপলব্ধিতে। মন কেন্দ্রীভূত হয়ে আসছে। তার সাথে আসছে সারাটা বিশ্ব। সবাইকে সে নিজের মধ্যে অনুভব করছে। কেউ তো পর নয়। আবার কেউ আপনও তো নয়। প্রবহমান কালের স্রোত বয়ে চলেছে। সেই স্রোতে কেউ কাছে আসছে কেউ দূরে যাচ্ছে। সেই কালস্রোতে বুদবুদের মত অজস্র প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে। কাল বয়ে যাচ্ছে সব কিছুকে ক্ষয় করে, আপন গর্ভ থেকে জন্ম দিয়ে আপন গর্ভেই লয় করে।
    এসবের সাক্ষী যে চেতনা, সে নির্লিপ্ত, সে প্রসন্ন, সে করুণাময়। একা বসে নির্বিকার সব ঘটনার সাক্ষী। না আছে তার কান্না, না আছে তার হাসি। সে থামাচ্ছে না কিছুই, আবার ঘটাচ্ছেও না কিছুই। তাকেই চিনতে পারার কথা ছিল যেন এ সংসার সংসার খেলা শেষ হলে।
    কিসের সে করুণা? সে করুণা চিত্তপ্রসাদের। জ্ঞানের আত্মময়তার। সার্বিক আত্মীয়তায় যার পরিণাম। তখন সে বোঝে যা ছিল তা পূর্ণ, যা আছে তা পূর্ণ, যা থাকবে তা পূর্ণ। এই পূর্ণের স্বাদ, এই পূর্ণের প্রেম, এই পূর্ণের আশ্রয় তাকে আবার সবার কাছে ফিরিয়ে আনে। চেনা সংসারে অচেনা হয়ে, নিষ্ঠুর এ সংসারে চির আপন হয়ে।

511
Sun, 05/22/2016 - 21:00


"জীবের আত্যন্তিক মঙ্গল কিসে?".... "হ্যাঁ গো, কাল কি দুধে বেশি জল মিশিয়েছিলে নাকি ?"
দুটোই প্রশ্ন। প্রশ্ন কোথায় নেই? সেই গীতায় অর্জুনের প্রশ্ন... বাইবেলে যোহন, ম্যাথিউ ইত্যাদির প্রশ্ন... বুদ্ধকে আনন্দ, আম্রপালির প্রশ্ন... সক্রেটিসকে প্লেটোর প্রশ্ন... অধুনা কথামৃতে ঠাকুরকে স্বামীজি থেকে গিরিশের অবধি নানান প্রশ্ন।
এতো গেল দর্শনের কথা। এছাড়া ছাত্রের প্রশ্ন, পার্লামেন্টের প্রশ্ন, প্রতিবেশীর প্রশ্ন, প্রেমিকের/প্রেমিকার প্রশ্ন.... প্রশ্নে প্রশ্নে ছয়লাপ।
কথা হল, সব প্রশ্নই কি একই গোত্রের? অতি বড় গর্দভেও বলবে না সে কথা। আমি যে কথা বলতে এ প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি সেটা হল, প্রশ্নের দুই ধারা খোঁজার জন্য।
প্রশ্নের উদ্দেশ্য কি? জানার ইচ্ছা। সে জানার ইচ্ছার অবশ্যই তারতম্যতা আছে। শুরুর উদাহরণ দুটো তার চূড়ান্ত উদাহরণ ধরা যেতে পারে। তবে তা নির্দোষ প্রশ্ন।
তবে কি প্রশ্নও দোষদুষ্ট হয়? সে কথাতে পরে আসছি। আমার প্রশ্ন'র ব্যাপারে আলোচনার পরিসরটা খুব বড় না। যে প্রশ্ন তাত্ত্বিক, যে প্রশ্নের 'হাঁ' বা 'না' এ উত্তর হয় না, সেই নিয়ে কথা বলার ইচ্ছা। অর্থাৎ প্রথম জাতের প্রশ্ন যা শুরুতেই বলা হয়েছে।
গীতায় একটা কথা আছে, 'পরিপ্রশ্নেন'। এই একটা শব্দেই যা বলতে চাই তার ইতি টানা যায়। কি অসাধারণ উক্তি!
একদিন শিরডির সাঁই তাঁর এক শিষ্যকে এই শ্লোকটির অর্থ বোঝাচ্ছেন। যেই এই শব্দটি উচ্চারিত হল, অমনি সাঁই বললেন, "পরিপ্রশ্নেন মানে কি"? শিষ্য বললেন, "প্রশ্ন করা"। সাঁই হেসে বললেন, "তবে ব্যাসদেব মাঝখান থেকে 'পরি' শব্দটা জুড়লেন কেন?"
শিষ্য নিরুত্তর।
সাঁই বললেন, 'পরিপ্রশ্নেন' মানে - শুদ্ধ মনে প্রশ্ন করা। গুরুকে পরীক্ষা করা, বা প্রশ্নের প্যাঁচে ফেলে তাকে জব্দ করার চেষ্টা ইত্যাদির থেকে নিরত থেকে, নম্রভাবে প্রশ্ন করা।
ঠিক তাই। শঙ্কর থেকে অধুনা গীতা ভাষ্যকার স্বামী রামসুখদাসজীর ব্যাখাও তাই। প্রশ্ন হোক নির্দোষ, অকপট, জানার গভীর আকুলতা থেকে। যা অনায়াসেই নম্র করবে প্রশ্নকর্তাকে।
এই হল কথা। কিন্তু সে জানার তৃষ্ণা জাগাও তো এক পরম ভাগ্যের কথা। তার চাইতে চারটে চটুল প্রশ্ন করে, শব্দের মারপ্যাঁচ খেলে খানিক বিদ্যাজাহির করে অহং তুষ্টিতেই তো আমোদ বেশি। অগত্যা প্রশ্নের মানও সেই গোত্রের হয়। সে প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলে যে প্রশ্নকর্তারই অপমান, সে বোধটুকু তো প্রশ্নকর্তা অহংমদে বিস্মৃতপ্রায়। তার বুঝ হল - 'সব মানুষ সমান। অর্থাৎ আমি যতটা বুঝি তুমি ব্যাটা তার থেকে বেশি বোঝো কি করে? আমি যতটা অনুভব করি তুমি ভণ্ড তার থেকে বেশি অনুভব করো কি করে? আমার জানার, অনুভবের বাইরে যা কিছু সব মিথ্যা।' এমনটাই সে মদমত্ত প্রশ্নকর্তার ধারণা।
তবে কি সে খুব উদ্ধত? না মোটেই না। এখানে আরো চাতুরী। সে একদম বিনয়ের অবতার, না তো সত্যবাদী যুধিষ্ঠিরের অনুজ। হয় বলবে, "আমি ভাই নরাধম, কিছুই বুঝি না, তবু বলো এটা যদি এটা হয় তবে ওটা তবে সেটা নয় কেন? আর দ্বিতীয় পক্ষের বুলি হল, "আমি যা বলি স্পষ্ট বলি, ওসব ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলা আমার ধাতে সয় না, বলতে হলে বলো, না হলে বোলো না। এটা যদি ওটা হয়, তবে সেটা ওটা হবে না কেন?"
নাও বোঝাও। যদি উত্তর দাও, আবার প্রশ্ন। কারণ তার মূল উদ্দেশ্য তো প্রশ্ন করা না, প্রশ্নের ফাঁদ তৈরী করা। তাই তুমি তা কেটে বেরোলে যে তার সব চেষ্টায় জল পড়ে গেল। সক্রেটিস এহেন লোকেদের খুব এড়িয়ে চলতেন। বলতেন, সফিস্ট। ভাবুন, যে মানুষটা সারাদিন প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে লোককে জেরবার করতেন, তিনিই এড়িয়ে যেতেন। কারণ ওই এক। এ ধারার প্রশ্নের পিছনে তৃষ্ণা নেই, আছে অহং-এর ঈর্ষারূপী তপ্ত কুণ্ড।
তাই বলছিলাম, তত্ত্বগত প্রশ্ন করবার জন্য আগে একটা পূর্ব সাধন থাকা চাই। সে একটা জীবন মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়ান চাই। তবে তার সঠিক উত্তর আসে, ও সঠিক উত্তরদাতা প্রভুর ইচ্ছায় জোটে। না হলে সবই ফাঁকি। সম্বল শুধু বুলি!
প্রার্থনা করি সে প্রশ্ন চিত্তে জাগুক। সর্বগ্রাসী, আকুল সংশয় আসুক। মন অকপট তৃষ্ণার্ত হোক, নিছক কৌতূহলী না। তবে সে পরম মুহুর্ত আসবে জীবনে।
"দরজায় করাঘাত করো, দরজা খুলে দেওয়া হবে" - বাইবেল
"প্রার্থনা আন্তরিক হলে তিনি শুনবেনই শুনবেন" - শ্রী রামকৃষ্ণদেব

512
Sat, 05/21/2016 - 09:30

রামায়ণ থেকে যদি বারো বছরের বনবাসের অধ্যায়টি বাদ দেওয়া যায় তবে তাতে যত তত্ত্বকথাই থাকুক না কেন, সেটা মহাকাব্য হয়ে ওঠে না। মহাভারতের বেলাতেও তাই। পঞ্চপাণ্ডব যদি পায়ের উপর পা তুলে রাজত্ব করেই কাটিয়ে দিতেন, তবে যতই তাতে গীতার কালজয়ী উপদেশ থাকুক, তা-ও মহাকাব্য হত না। জীবনের স্বাভাবিক গতিপথের সাথে মিলত না। হত রূপকথা। এমনিই সমস্ত মহাপুরুষের জীবন।
বুদ্ধ এই কথাটাই বললেন, দুঃখ আছে। এটাই প্রথম সত্য। একে স্বীকার করো যদি তবেই বাকি কথাগুলো শোনার যোগ্যতা তোমার আছে। একে অস্বীকার করো যদি, তবে পরে এসো। আরো একটু পরিণত হয়ে এসো।
দুঃখকে বরণ তোমায় করতেই হবে। না হলে ভীরু হয়ে সংসারে থাকতে হবে আড়ালে আড়াল খুঁজে। নানান দেবতা উপদেবতার পায়ে ফুল দিতে দিতে নিজেকে জাগাবার সময়টুকু আর পাবে না। কখনোই নিজেকে চেনা হয়ে উঠবে না আর। তাই বলছি, তুমি এসো, আমার প্রথম সত্যিটা স্বীকার করো, দুঃখ আছে।
বুদ্ধ এই বলে আমাদের ফাঁকি দেওয়ার পথটা বন্ধ করলেন। "আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন" - রবীন্দ্রনাথের একদম জীবন সায়াহ্নে লেখা কবিতায়, সারা জীবনের উপলব্ধি। শুধু সায়াহ্নে না, সারাটা জীবন দুঃখকে স্বীকার করার, বরণ করার দর্শন ওঁর সারা জীবনের লেখায়। নিজের জীবন যাপনেও।
এ কি পেসিমিজম তবে? না। একদমই না। এ আত্মশক্তির উদ্বোধনের কথা। এ কান্নার কথা না। হতাশার কথা না। অন্ধকারের কথা না। এ চলার পথের জয়গান। আমি যে দুঃখের থেকে বড়, সেটা দুঃখকে স্বীকার করে জানাব। তার থেকে এড়িয়ে গিয়ে নয়।
বুদ্ধ যখন কপিলাবস্তুতে রাজপুত্র ছিলেন, সেই বৈভবে, কৃত্রিম সুখ বিলাসময় জীবন যাপনে সত্যকে পাননি।
তিনি পথে নামলেন। মুখোমুখি হলেন দুঃখের। আলোড়িত হল মনপ্রাণ।
উপলব্ধি করলেন, নিজেকে দুঃখের থেকে দূরে রেখে সত্যের সাধন হয় না। ত্যাগ করলেন, পারিবারিক সুখ, রাজ ঐশ্বর্যের সুখ, মানের সুখ, দেহের সুখ।
দুঃখকে বরণ করলেন। বসলেন তপস্যায়। আলো দেখতে পেলেন। তা দুঃখকে এড়িয়ে গিয়ে নয়, দুঃখকে বরণ করেই। মৈত্রীতে, কল্যাণে সে পথ। মৈত্রী, সুখে দুখে। কল্যাণ - সুখে দুখে। উপদেশ দিলেন, অষ্টাঙ্গিক মার্গের। আটটা সত্য নিবন্ধ। যার অনুশাসনে আত্ম-নিয়ন্ত্রণের কথা। যা দুঃখকে বরণ করেই, তাকে এড়িয়ে গিয়ে নয়।
আজ যে চূড়ান্ত সুখবাদী যুগে আমরা বাস করছি, তাই এটা এত ঠুনকো। এর দর্শন তাই এত ভীরু। তাই এত আস্ফালন তার। এত আত্মহত্যা, এত অবসাদ, এত মানসিক বিকার। যে স্নায়ু আমার সুখ নিয়ে যায়, সেই আমার দুঃখকেও বহন করে। একটার পথ খুলে রেখে আরেকটার পথ কি করে বন্ধ রাখা যায়? যায় না। এটা মানতেই হবে। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, শুধু ন্যায্য দুঃখ বলে কিছু হয় না। ঠিক যেমন বরাদ্দের চাইতে অনেক বেশি সুখ পেলে আমরা হিসাবের খাতা খুলে বসি না, ঠিক সেই রকম।
তাই তথাগত আমাদের একটা সহজ, সরল পথ দিয়ে বললেন, হয় চলো, না হয় স্বপ্নের জাল বুনে বসে থাকো। বললেন, একজন মানুষ সারাটা জীবনে মাত্র দুটো ভুলই করতে পারে - এক, চলা না শুরু করা, দুই, মাঝপথে থেমে যাওয়া।


(ছবিঃ সুমন)

513
Thu, 05/19/2016 - 08:30
তবে উপায় কি? উপায় হাজার লক্ষ কোটি। মত যদিও পথ, তবু সে মতের ঘোরে অন্ধকার চারদিক। মতের সাথে মতের লড়াই। বিশ্বাসের সাথে বিশ্বাসের লড়াই। বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাসের লড়াই। বিনাযুদ্ধে কেউ আর সূচ্যাগ্র মেদিনী দেবে না - এমনই হুংকার দশদিকে। এই লড়াইয়ে অংশীদারি আমি তুমি সে, রাম শ্যাম যদু মধু সব। রাস্তায় দু'জন মানুষের কথায় আড়ি পাতো, শুনবে মত ভাষা পাচ্ছে শ্বাসের জোরে - "আমার মতে তো অমুকের বাড়ি না যাওয়াই ভাল" ... "আর যাই বলুন, অমুকের মত জায়গা হয় না" .... "তবে কি অমুকটা করা তোমার/তার উচিৎ হয়নি".... সারাদিন চলছে, রাস্তায়, ঘরে, বাজারে, ট্রেনে, বাসে, জাহাজে, প্লেনে, অটোতে, রিকশায়..... এমনকি মনে মনেও... "আমার মতে......" পার্লামেন্ট বলো, বিদ্যালয় বলো, হাসপাতাল বলো, অফিস কাছারি বলো - সর্বত্র। মতের সাথে মতের অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। এটাই ভাল। এটাই হওয়া উচিৎ। তবেই যোগ্যতম মতের উদবর্তন সম্ভব। কোন মত টেকা উচিৎ আর কোন মত নয়, সেটা খণ্ডযুদ্ধ না বাধলে বোঝা যাবে কি করে? তাই এই মতের মতান্তর প্রয়োজন। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। কথা হচ্ছে এই যে - একজন মানুষের কি একটাই মত থাকা উচিৎ? তা না তো কি? অনেক মত থাকা উচিৎ? আমার মনে হয়, হ্যাঁ। সেগুলো আপাত স্ববিরোধী হলেও, তা আখেরে শুভ'র দিকে নিয়ে যায়। কেমন? একটু বলা যাক। জৈনধর্মে একান্তবাদী ও অনেকান্তবাদী বলে দুটো শব্দ আছে। একান্তবাদী, সেই অন্ধের হস্তীদর্শনের মত; হয় বলে হাতিটা থামের মত, না হয় বলে সরু সুতোর মত ইত্যাদি। হাতি সম্বন্ধে তাদের এইটাই চূড়ান্ত মত। আর অনেকান্তবাদী দেখেছেন পুরো হাতিটাকেই। তাই তাঁর মতে ওই সব মতগুলোই সত্য। মানে হাতি পায়ের কাছে থামের মত, লেজের কাছে সুতোর মত ইত্যাদি। তাহলে একজন মানুষের অনেকগুলো মত ক্ষেত্রবিশেষে থাকতেই পারে। আর সেই থাকার অভ্যাস করাটাকেই বর্তমানে নাম দেওয়া হল - ক্রিটিকাল থিংকিং। অর্থাৎ কিনা বিশ্লেষণাত্মক চিন্তন। ভাল কথা। তবে কি এরা সুবিধাবাদী? আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য তা মনে হলেও হতে পারে, কারণ সেখানে স্বার্থসিদ্ধির একটা মতলব থাকে। কিন্তু অনেকান্তবাদী যে, সে তার নিজের কাছে সৎ, সে জানে ক্ষেত্রবিশেষে মতের পরিবর্তন না করলে সত্যের অপলাপ হয়। তাই সে কোনো সোজা সরল সিদ্ধান্ত টেনে জীবনটাকে মূর্খের স্বর্গে কাটাতে নারাজ। এই অবস্থাটাকেই বার্ট্রান্ড রাসেল মহাশয় বলেছিলেন, - সমস্যাটা হল এই দুনিয়ায় বোকারা ভীষণ নিশ্চিত, আর বুদ্ধিমানেরা সংশয়ী।  সংশয়ী সন্দেহবাতিক অর্থে না, সংশয়ী কারণ সে একটা মতে নোঙর ফেলে বসে থাকতে চায় না। সে সবকিছুকেই নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে পরখ করতে চায়। ধর্মের জগতে এটা একটা বিরাট সমস্যা। এখানে মত শেষ কথা। এখানে মতকেই সত্য নামে চালিয়ে দেওয়ার একটা আদিম প্রবণতা। তুমি ভেবো না। আমি যেটা বলছি মেনে নাও, দেখবে সব ঠিক থাকবে। এ এক অদ্ভুত দাদাগিরি। অনুভূতি নেই, আস্ফালন আছে। সত্য নেই, সত্যের মুখোশ আছে। প্রাণ নেই, মুক্তি আছে। এ তো মহামুশকিল। সারা বিশ্বজুড়ে একটা ত্রাস হয়ে উঠছে এই মতের বোমা। যদি তুমি বাঁধতে পারো এ বোমা তবে তুমি বেঁচে গেলে, না বাঁধবে তো এই বোমা দিয়েই তোমার পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটিয়ে ছাড়ব। উফ্, কি সমস্যা। স্বামী রঙ্গনাথানন্দজী (রামকৃষ্ণ মিশনের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট) একটা দামী কথা বলতেন। একটা বড় বিজ্ঞানের সভা করো। দেখো সভা শেষে সবাই হাসিমুখে বেরিয়ে আসছে, যথেষ্ট তর্কাতর্কির পরও। কিন্তু একটা ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে একটা সভা বসাও, দেখবে সব হাত, পা, মাথা ভেঙে বেরোচ্ছে। এই হল বিপদ। এখানে উদারতা হল অস্তিত্বের সংকট। ঠিক যেমন রাজনীতিতেও। উদারতা দেখিও না বাপু, তবে প্রতিপক্ষ ভাববে তোমার আত্মবিশ্বাস কম, অথবা তোমার মতে কিছু একটা গোলমাল আছে। তবে উপায়? রাজনীতিতে বলতে পারি না। ধর্মনীতিতে স্বামীজির বিখ্যাত উক্তিই মনে আসে, যতগুলো মানুষ ততগুলো ধর্মমত হওয়া উচিৎ। বেশ কথা। তাঁর গুরুরও একই মত। এত দলাদলি কি দরকার বাপু? ধোপাঘরের গামলা। নানান রঙ। যে রঙে চাও ছোপো। একঘেয়ে কেন হবে? আহা কি কথা! কবে যে এর আরো বিস্তার হবে মহাকালই জানেন!
514
Sun, 05/15/2016 - 22:49
ঈশ্বর কে? আত্মা কি? শাস্ত্র কি? এ সবই কি ভয়ের বিকার? শুদ্ধ বিকার? ভবিষ্যতের চাইতে অন্ধকার তো আর কিছুই নেই। জানি না কি হবে। সেই অজানার আতঙ্ক, আশঙ্কাই কি ঈশ্বরের জন্মকারণ? প্রতি শনিবার বারের ঠাকুরের পূজা দেখি। সে পূজার পিছনে একটাই আকুতি - বাবা বাঁশ দিও না। এই রইল আমার ভক্তি। দাঁড়াও, ভক্তি কি? এখানে ভক্তি মানে স্বেচ্ছায় উদ্ধত মস্তিস্কের অবনমন। তাতে লাভ? কিঞ্চিৎ সামাজিক লাভ। চিরকোন্দলরতা দুই বিরুদ্ধাস্বভাবা রমনীকে পাশাপাশি আঁচল জড়িয়ে চোখ বুজে ঈশ্বরতুষ্টি যজ্ঞে বসতে দেখেছি। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় ভয়ের তাগিদে হলেও অহং-এর কিঞ্চিৎ বিলোপে সামাজিক সহবাস। এই কি ঈশ্বরের মহিমা? সামাজিক উৎসবগুলোর বেশিরভাগই ধর্মকেন্দ্রিক। সেই অর্থে ঈশ্বরকেন্দ্রিক। যেকোনোভাবেই হোক মানুষের সাথে মানুষের মিলনের আনন্দের পথ তৈরী করা। সে না হয় হল। বর্তমানে উৎসব করতে সেই বুড়ো ঈশ্বরের তেমন একটা দরকার নেই। যদিও একটা প্যাণ্ডেলে বসিয়ে রাখলে অসুবিধা নেই। নমো নমো করে তাকে চাট্টি শুদ্ধ তৈলমর্দন করলেই হল। তবে এই কি ঈশ্বর? এই কি ধর্ম। তবে এর আর কি দরকার? গেলেই হয়। অবশ্যি একরকম গিয়েই আছে। তবে যেটুকু ভয় বেঁচে আছে সেটুকুতেই রাজত্ব করে যাচ্ছে। সব চাইতে বড় ভয় তো মৃত্যু। তারপর এলো দারিদ্রতা। না বোধহয়, দারিদ্রতার ভয় মৃত্যুভয়ের থেকেও বড়ই হবে। তারপর রোগশোকের ভয় তো আছেই। অগত্যা আনো দেবদেবী। লাগাও পূজা। ভয় আর জ্ঞান, আলো আর অন্ধকারের মত। জ্ঞান হল তো ভয় কমল। কিন্তু ভবিষ্যতের অন্ধকারের বুক চিরবে কোন জ্ঞান? আমি ভারতীয়দের গড় আয়ুর হিসাব করতে পারি। রামবাবু কদ্দিন বাঁচবেন কি আর বলতে পারি? কাল জোয়ার ক'টায় বলতে পারি, বর্ষা আসতে কদ্দিন হিসাব কষতে পারি। কিন্তু কাল আমার কি হবে বলতে পারি? কাল আমার ছেলেটা, কি মেয়েটা স্কুল থেকে সুস্থ নিরাপদে বাড়ি ফিরবেই কিনা বলতে পারি? না পারি না। তাই ভবিষ্যতের ভয় আমার পিছু ছাড়ে না। অনেকে অবশ্য এর থেকে বেরোবার দুটো পথ দেন। কেউ রাখেন উদ্ধত অভিমানের উপেক্ষা। কেউ রাখেন উদাসীনতার বৈরাগ্য। তবে দুটোই কার্যক্ষেত্রে দুর্বল হতেই দেখেছি। অভিনয়ে খুব পারদর্শী না হলে অনেক সময়ই মহত্বের আসনে নিজেকে রাখা দায়। সেও না হয় হল। এই কি তবে শেষ কথা বলবে? এইরকম পাড়ার দাদা গোছের ঈশ্বরের তোলা দিতে দিতেই জীবন যাবে? এমনকি তোলা নিয়ে কাজ না করলেও তার বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া যাবে না? এ তো খুব গণ্ডগোলের ব্যাপার তা হলে! আসলে ধর্ম যতক্ষণ বাইরের ততক্ষণ এর বেশি সে এগোতে পারে না। এ যেকোনো জ্ঞানের ক্ষেত্রেই। আমি আপেলটা কেন মাটিতে পড়ল যখন জানতে চাইলাম, তখন নিজের ভিতরে তাকালাম। উত্তর পেলাম। তাকে বললাম, বিজ্ঞান। সে জানার ইচ্ছা ভিতর থেকেই এসে ভিতরকেই সমৃদ্ধ করল। কিন্তু যেদিন বাইরের সুখের জগতে বিজ্ঞানকে ডাকলাম। তার পরিণতি আসল গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে শুরু করে দূষণের লাগামছাড়া মাত্রায়। সে জ্ঞান সুখ দিল যেমন অনেক, তেমন বহুপ্রাণীকে, উদ্ভিদকে অবলুপ্তির পথে পাঠিয়ে আজ সে আমারই দিকে তার করাল মুখ নিয়ে এগিয়ে আসছে। স্বর্গীয় নানান দেবতাও তাই। হয়তো কিছু সুখের বরাদ্দ তাদের জিম্মায় আছে। তবে মানুষকে ভয় দেখিয়ে যেখানেই কিছু মানাতে হয়েছে, সেখানেই নানান নিষ্ঠুর বিধিনিষেধ থেকে শুরু করে উগ্রপন্থী অবধি তৈরীর পথ হয়েছে। মানুষ শোষিত হয়েছে। ঈশ্বরের কথা এখানেই শেষ হত যদি, তবে আমাদের চলা, বন্দীর শিকল পরে বধ্যভূমিতে চলার সেই বিখ্যাত উপমার চাইতে বেশি কিছু হত না। তবে তা তো নয়!  মরমী সাধক ইঙ্গিত করলেন, ভিতরে এসো। বললাম, কি ভাবে আসব? সে বলল, ভালোবাসো। মানুষ বাইরে থেকে ভালোবাসতে পারে না। যে ভালোবাসা বাইরে টানে, সেটা কাম। প্রেমের ছদ্মবেশেই আসে। সময় তার ছদ্মবেশ খুলে দেয়। সে তখন উত্যক্ত, ক্ষিপ্র, অতৃপ্ত যন্ত্রণা ছাড়া কিছুই নয়। যে টান ভিতরে একটার পর একটা দরজা খুলে নিয়ে আসে - সেই প্রেম। তার আসার পথ তৈরী করো। দুঃখকে মাথা পেতে স্বীকার করো, সে যাওয়ার আগে তোমায় সোনা করে যাবে। দুঃখ থেকে বাঁচতে গিয়ে যত গোল করেছ। পালাবার রাস্তাটাই বাড়িয়েছ, পালাতে পারোনি। সুখ ফাঁকি দিয়েছে যত, তুমি দুর্বল হয়েছ তত।  তবে ঈশ্বর? আরে বাবা খালি ঈশ্বর ঈশ্বর করো কেন? আগে চোখটা পরিস্কার হোক দেখবে, যাকে অ্যাদ্দিন খুঁজে বেড়িয়েছো, চিরটাকাল তারই বুকের ওপর বসে রয়েছো। শুধু নাড়ির যোগটা টের পাওনি। কারণ ভিতরে আসোনি।
515
Sun, 05/08/2016 - 09:00

আজ কি কিছু বলার দিন? আমি বুঝে উঠতে পারি না। একবার ভাবি না, আজ চুপ থাকার দিন। যা কিছু তিনি সারাটা জীবন জুড়ে বলে গেছেন, সেই মনন সাগরে স্নান করার দিন। সাঁতার কাটার দিন। রোজই আসি। তবে আজ সারাদিনই সেই সাগরের সাথে কাটানোর দিন। আজ অন্য কোনো কথা নয়। আজ শুধু তিনি।


কি বলব? তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ? কতটা প্রাসঙ্গিক তাঁর রচনা আজকের সময়ে? প্রিয় গান, কবিতার উদ্ধৃতি? না। এর কোনোটাই না। তবে?
তবে বলব, কিছু অনুভবের কথা। একটা সময় মনে হত, খুব মনে হত, আচ্ছা যদি ওনার জন্মের আগে জন্মাতুম কি হত? জীবনটা তো সম্পূর্ণ বসার ঘর থেকে ফিরে যেত! শাস্ত্রের শাসনে জীবনের পরম দয়িতকে চিনতুমই না। সে নিজে এসে আমার হৃদি আসনে বসতে চাইলেও তাকে বিশ্বাস করতুম না। বলতাম, তুমি কে হে? কই তোমার ঐশ্বর্য? কই তোমার অঘটনপটিয়সী মায়া? কই তোমার আয়ুধ? আমার মন্ত্র পড়া হল না আর এরই মধ্যে তুমি ঘরে সেঁধোলে যে? এমন আরো কত অর্বাচীনের মত তর্ক জুড়তুম।


কি করে জানতাম, সে অসীম নীল আকাশের সাথে তাকায়! কি করে জানতাম সে আমার ব্যাথায় ব্যাথায় পা ফেলে আমার সাথে সাথে ফেরে! কি করে জানতাম আমার সংসারে ঘোর তাণ্ডব, সংশয়ের দোলা এসবই তারই লীলার অংশ! আরো কত কত বলব? বলা যায় না। নিজের সাথে যে নিজের পরিচয় ঘটায়, তার পরিচয় ঘটাবে কোন আমি? চোখকে দেখব কোন চোখে? হৃদয়কে জানাব কোন হৃদয় দিয়ে? সাগর তার তিলমাত্র অংশ নদীর বুকে আনলেই জোয়ার, সাগরকে ধরবে কোন নদী? আর এখানে বলবার লোকটা তো ডোবার চাইতেও ছোট। তবু সে ডোবার জলে সাগরের জল এসে পড়েছে বৃষ্টির সাথে। সূর্যের আলো, চাঁদের আলো এসে পড়েছে করুণা করে। এই ঢের। এতেই তার গর্বের সীমা পরিসীমা নেই।


বাণীর একটা অসুবিধা হল, সে খণ্ডিতভাবে জাগায়। সে পুরো সত্তাকে জাগরিত করতে পারে না। সুর পারে। তাই পেরেছে। একজনের নাকে অক্সিজেন সিলিণ্ডার বেঁধে তাকে ঘোরালে সে সর্বদা সুস্থ অক্সিজেন পায় বই কি, তবে সেটা তার স্বাস্থ্যকর অবস্থা নয়, এ বলা বাহুল্য। যে অক্সিজেন সে বাতাস থেকে পায় তাই তাকে স্বাস্থ্য দেয়, সুস্থ করে। তেমনই সুর। সে ভিতরে গিয়ে চেনা-অচেনার রাজ্যে দোলা লাগায়। উদাস করে। গানের বাণী তখন শরীর ধারণ করে সম্পূর্ণ একজন আত্মনির্ভরশীল সত্তা। যেন এক ব্যক্তিসত্তা। সে কথা বলে। মনের অলিতে গলিতে চলে ফিরে বেড়ায়। সে জাগায়। সামঞ্জস্যহীন জাগরণ না। উত্তেজনার ক্ষণিক উন্মাদনা না। সে জাগায় পরিপূর্ণতায়। সে উদ্বোধিত করে।


বারবার তাই বলেছেন, লোভ না করার কথা। শান্ত থাকার কথা। শ্রীহীন না হওয়ার কথা। রুদ্রকে বরণ করার কথা। ভীষণকে না ফেরানোর কথা। দুর্বল, আত্মশক্তিহীনতায় কোনো গর্ব নেই। দীনতার অনুভব বড়র কাছে হোক, বলশালীর কাছে না। এ জোর, এ শক্তি - সাধনালব্ধ। কিসের সাধন? সহজ হওয়ার সাধন। সত্যে, মঙ্গলে, কল্যাণে।
কথার শেষ নেই। কিছু কথা হল। এই থাক। প্রার্থনা এই যেন প্রার্থনার মূল্য বুঝি। যেন শান্ত হই, শিবের মধ্যে সংসারকে দেখি, একের মধ্যে সবাইকে পাই।
(ছবিঃ সুমন)

516
Thu, 04/21/2016 - 08:00

কাল গভীর রাতে ছাদে এসে দাঁড়ালাম। সারাটা আকাশ জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। আশেপাশে গাছগুলোর মাথায় চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে দুধ সাদা রঙ। ঠান্ডা বাতাস দুরন্ত বাচ্চার মত শরীরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। দেহ শীতল হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'এই যে বাতাস দেহে করে অমৃতক্ষরণ'।

মনটা প্রসন্ন হল। কেন হল? কেন এ আচমকা আনন্দমগ্ন বিশ্ব চরাচরের মধ্যে নিজেকে অনুভব করলাম?
মন বলল, আমি মহৎকে অনুভব করছি। এই চিরচেনা সব কিছুর আড়ালে, আমি আমার পরমাত্মীয়র ছোঁয়া পাচ্ছি। যিনি মহৎ।
তাই হয়। মানুষ যখন মহতের সামনে এসে দাঁড়ায় সে তার ক্ষুদ্রতাকে অনায়াসে বিসর্জন দিতে পারে। কারণ সেটা তার স্বরূপ না। তাই সে বিশাল পর্বতের সামনে দাঁড়ায়, অসীম সমুদ্রের সামনে দাঁড়ায়। ছুটে ছুটে যায় অরণ্যের গভীরতায়। এতো গেল প্রকৃতির কথা।
সে উৎসব রচনা করে। সবার সাথে, সবার মাঝে নিজের মুক্তি খোঁজে। তার আরেক মহত্বের স্পর্শ - মহান চরিত্রের স্পর্শ। তার সামনে প্রতিদিন দাঁড়ানোকে সে পূজা বলে। সে পূজা আসলে নিজের অন্তরের অপ্রকাশিত মহত্বের। যাকে সে বাইরে খুঁজছে। প্রকাশিত হওয়ার একটা পন্থা খুঁজছে।
সেই মহত্বের স্পর্শই তাকে প্রসন্ন করে। আত্মস্থ করে। সুস্থ করে।
আর কিছু না পাই, দিনের শেষে এ তারা ভরা আকাশ তো রইলই। তার সামনেই দাঁড়াব। গুরুদেবের ভাষায়...


প্রতিদিন আমি হে জীবনস্বামী,

   দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।
করি জোড়কর, হে ভুবনেশ্বর,
     দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার অপার আকাশের তলে

      বিজনে বিরলে হে--
    নম্র হৃদয়ে নয়নের জলে
  দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার বিচিত্র এ ভবসংসারে

 কর্মপারাবারপারে হে,
নিখিলজগৎজনের মাঝারে
  দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

তোমার এ ভবে মোর কর্ম যবে

     সমাপন হবে হে,
ওগো রাজরাজ, একাকী নীরবে
     দাঁড়াব তোমারি সম্মুখে।

 

 

517
Sun, 04/17/2016 - 09:00


সূত্র কথাটার অর্থ সুতো। আমার লজ্জা নিবারণের জন্য যে বস্তুটি সর্বাগ্রে প্রয়োজন - পোশাক, সে এই সহস্র সুতায় নির্মিত। আমার জীবনে সুতার প্রথম প্রয়োজন - আমার পরিধেয় বস্ত্র।
 
শুরু হল শিক্ষারম্ভ। সূত্রের নতুন অর্থ পেলাম। গণিতের সূত্র, পদার্থবিদ্যার সূত্র, রসায়নের সূত্র। সেই সুতো। এ কিরকম সুতো? এ চিন্তাকে গেঁথে রাখবার সুতো? ঠিক তা না, আবার তাও। বিজ্ঞান অর্থে বিশেষ জ্ঞান। আপেলটা মাটিতে পড়ল। তাতে একটা সূত্র পাওয়া গেল। কি সূত্র? না মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। অর্থাৎ শুধু আপেলটা না, আম জাম কলা লিচু, আমি তুমি কাকি মেশো, ইঁট পাথর ঢিল পাটকেল - যাই পড়ুক না কেন তা এক কারণেই পড়বে। মাধ্যাকর্ষণ। তা হলে এই নানা ঘটনার মধ্যে এক নিয়মকে খুঁজে পাওয়াই হল সূত্র। বিজ্ঞানী বলেন, এই সব ঘটনাকে আমি এই একটা সুতোয় বেঁধে ফেলেছি, আর প্রকৃতি আমায় বোকা বানাতে পারবে না। এই হল বিজ্ঞানীর সূত্র।

শুরু করেছিলাম পোশাক দিয়ে। কিন্তু বাস্তবতঃ তার আগেই অজান্তেই আরেকটা সুতোর বাঁধনে আমি এসে পড়েছি। আমার বংশগত সুতো। এই সুতোর কথা প্রথম বলার চেষ্টা করেন এক ধর্ম যাজক, স্কুলে সবাই তাঁর নাম শুনেছি - মেন্ডেল সাহেব। তা তাঁর কথা কেউ গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি। ভাবল ব্যাটার মাথা বিগড়িয়েছে। সারাদিন চার্চের সামনে মটর গাছ লাগায় আর তাতে যে কি রহস্য পায় কে জানে! অগত্যা সে বুড়োকে নিতান্ত অবসাদগ্রস্ত হয়েই ভবলীলাসাঙ্গ করতে হয়। তার বহু বছর পর আমরা টের পাই - আরে হ্যাঁ, একখান সুতোর মত জিনিস আছে বটে তো! যা কিনা এক প্রাণ থেকে আর এক প্রাণে যায়। আর শুধু যায়! ঠিকুজিকোষ্ঠী নিয়ে যায়, যেমন আমরা মেমোরি কার্ডে ডেটা ট্রান্সফার করি, সেরকম আর কি! বোঝো। তা সেই সুতোর নাম কি গা? তার নাম হল - ক্রোমোজোম। তাতেই তোমার আমার ইহকাল পরকাল, ভূত ভবিষ্যতের সুপ্ত তথ্য। ভাবা যায় এক সূতো সেই যুগ যুগ ধরে কালে কালে তার রঙ পাল্টাচ্ছে আর বিশ্ব চরাচরের রূপান্তর ঘটিয়ে চলেছে।

আচ্ছা, এই সূত্রলীলা কি এখানেই শেষ? না গো। আরেকটা কথা না বললে যে সবটা বলা হয় না। সে হল দর্শনের সূত্র। চর্মচক্ষুর দর্শন না। অন্তঃশ্চক্ষুর দর্শন। ভগবান গীতায় বললেন, বন্ধু হে, সারাটা জগৎ এক সূত্রে গাঁথা, যেমন মালার পুঁথিরা সব এক সূত্রে গাঁথা, ঠিক তেমন।
এ হল প্রেমের সূত্র। সেই প্রেম সূত্রই হল সত্য। এক সত্য। সে সূতোতে পুঁথির মত এ জগতে সব গাঁথা। পালাবে কোথায়? তাই প্রেমে পড়ে তুমিও বাঁচো, আমিও বাঁচি। এ সুতো কাটতে পুরাকালে অসুরেরা চেষ্টা করেছিল, আজও করে আসছে। এ যে কালিদাসের বুদ্ধি ভায়া। এ বিশ্ব সংসারে যে সুতোর জোরে তার অস্তিত্ব, তাকে কেটে বাঁচা যায়? কেউ পারেনি কোনোদিন, ভবিষ্যতেও পারবে না। সেই সুতোকেই খোঁজো, আঁকড়ে ধরো। সেই আশ্রয়, আশা, আনন্দ, পরমানন্দ।

 

518
Wed, 03/23/2016 - 09:00

আয় দেখে যা নতুন ভাব এনেছে গোরা।


মুড়িয়ে মাথা গলে কাঁথা
কটিতে কৌপীন পরা।।

গোরা হাসে কাঁদে ভাবের অন্ত নাই
সদাই দীন দরদী বলে ছাড়ে হাই।
জিজ্ঞাসিলে কয় না কথা
হয়েছে কি ধন হারা।।

গোরা শাল ছেড়ে কৌপীন পরেছে
আপনি মেতে জগত মাতিয়েছে।
মরি হায় কী লীলে কলিকালে
বেধবিধি চমৎকারা।।

সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলি হয়
গোরা তার মাঝে এক দিব্য যুগ দেখায়।
লালন বলে ভাবুক হলে
সেই ভাব জানে তারা।।

লালন সাঁইয়ের বিখ্যাত একটি গান। সেই সময়ের একটা পূর্ণছবি এই গানটায়। কোন সময়ের? কোনো ঐতিহাসিক শতাব্দীর অঙ্ক না। একটা সময় যখন পাণ্ডিত্য ছিল, জ্ঞানচর্চা ছিল, অর্থ ছিল ইত্যাদি সব ছিল। তবে কি ছিল না? ছিল না ভাব।
এই 'ভাব' শব্দটার খুব সোজা কোনো অর্থ দাঁড় করানো সম্ভব না। চিত্তের একটা জড়ত্ব এসেছিল। অনুভব ছিল না। রস ছিল না। ছিল শুধু শুষ্ক পাণ্ডিত্য। সংকীর্ণ চরিত্রের শাসন। বিধিনিষেধের অমানবিক অত্যাচার।
ইতিহাসে এ ঘটনা নতুন না। যখনই চিত্তের জড়ত্ব সভ্যতাকে গ্রাস করেছে, শুকিয়ে ফেলেছে মানুষের নিজের তৈরি বেড়াজালে মানুষকেই- তখনই কোনো না কোনো মহাত্মার আবির্ভাব। তিনি আনেন ভাবের বন্যা আমাদের চিত্তে লাগে গতি। আমরা এক ধাক্কায় অনেকটা পথ দিই পাড়ি।
মহাপ্রভুর অবদান নিয়ে আলোচনা করার ধৃষ্টতা করব না। সে পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনাও আমার কাছে অসার লাগে। যা দরকার, তা হল চিত্তে সেই রঙ যতটা লাগে, ততটা ধারণ করার সাধনা। চেষ্টা না। চেষ্টা আর সাধনায় বিস্তর ফারাক। শ্রদ্ধার ফারাক। চেষ্টার সে জোর নেই, সেই সহনশীলতা, ধৈর্য্য, স্থৈর্য নেই; যা সাধনার আছে।
মহাপ্রভুর সাধনা - উদারতার সাধনা। প্রেমের সাধনা। বিশুদ্ধ প্রেমে। যে বিশুদ্ধ প্রেম, সহনশীলতার কথা বলে তরুর মত। যে বিশুদ্ধ প্রেম, মর্মকর্ষিত নম্রতার কথা বলে তৃণের মত। যে স্থির ভালোবাসা, নিজেকে সরিয়ে অন্যের পথ তৈরি করার কথা আগে ভাবায়।
এ সাধনায় সফল হলে, তবে চিত্ত দ্রবীভূত হবে সেই পরমের মাধুর্য রসে। কিরকম মাধুর্য? যেমন পলাশের রঙের মাধুর্য। তা ফুলে নেই। আছে চিত্তে। ফুল তো উদ্দীপক মাত্র। সে তত্ত্বকথা থাক।
কথা হল সেই মাধুর্যের সন্ধান কিসে মেলে? আগের কথাগুলো তো সাধনার কথা। কিন্তু সেই সাধনায় যে আমার মতি নেই। আমার ইচ্ছা থাকলেও শক্তি নেই। তবে? কোথায় পাব সেই মাধুর্যের পথ। আরো ভেঙে বললে, সহজ পথ?
আছে। যে মানুষ সে মাধুর্যে ডুবে মাধুর্যময় হয়ে আছে, পাব তার কাছে। শরীর পুষ্টি পায় মুখ থেকে গৃহীত বস্তুগত খাদ্যে। মন পুষ্টি পায়, শ্রবণেন্দ্রিয়ের কাছ থেকে। শ্রবণমঙ্গলম্!
তাই বলছেন, "সাধুসঙ্গ সাধুসঙ্গ সর্বশাস্ত্রে কয় / লবমাত্র সাধুসঙ্গে সর্বসিদ্ধি হয়"। সাধু মানে Monk না, Saint না, সাধু মানে যিনি সচ্চরিত্র। শুধু সচ্চরিত্র নয়, পরম কারুণিক। যিনি আমার মনের মল ধুইয়ে দেবেন নিজের হাতে, আমাকে তাঁর মাধুর্যে অবগাহন করিয়ে। যদি না শুনতে চাই? তবু আমার গায়ে সে চন্দন চন্দন গন্ধ মাখা হয়ে যাবেই যাবে। কথায় আছে না, চন্দনতরুকে যে কুঠার- আঘাত করে, ছিন্ন করে; সেই কুঠারের শরীরেও লাগে চন্দনের সৌরভ। ঠিক সেইরকম।
মহাপ্রভু সেই মাধুর্যের পূর্ণ ভাণ্ডার। পরম কারুণিক। অযাচিত প্রেম তাঁর প্রতি পদক্ষেপে ধুলায় লুটিয়ে পড়ে। সে জাত মানে না, ধনী দরিদ্র মানে না, ভালো মন্দ বোঝে না। বোঝে একটাই কথা, নম্র চিত্তের আকুল ডাক।
সারাটা ভারতে আজও গ্রামে গ্রামে ঘুরলে, তাঁর কণ্ঠ নিঃসৃত সেই মহামন্ত্রের ধ্বনি শোনা যায়। সে নাম চিত্তের দরজায় আঘাত করছে, ডাকছে আজও দীনদরিদ্র থেকে ধনী বিত্তবানকে। সে নামে সহায় খুঁজছে নিজের নিঃসঙ্গতার সাথী। পরপারে যাওয়ার সাহস খুঁজছে কেউ। কেউ খুঁজছে ভরসা, জটিল জীবনযাত্রার আবর্তে পড়ে, অসহায় হয়ে। কি পাচ্ছেন? "যেই ভকত সেই জানে, ওগো তুমি জানাও যারে সেই জানে"।
তবে সে কি শুধু পাওয়ার? না। যার মনের গভীরে ঢুকেছে নামের রস, সে ছাড়ছে খোলস। বাইরের যা কিছু তা অত্যন্ত ভারী হয়ে উঠছে তার কাছে। হয়েছে অবহ। সে মজছে ভিতরে। প্রেমের ডাক তার দরজায়। একান্তভাবে তারই জন্য। তারই হাতে সে আবীর, যে আবীরের রঙের স্বপ্ন তার ঘুমে অনেকবার তাকে ছুঁয়ে গেছে। রঙীন করে গেছে তাকে।
মহাপ্রভু সেই ডাক। ঊর্দ্ধবাহু এই উন্মাদ মানুষটির একটাই আবেদন - ডাকতে শেখো। যদি না পারো আমায় দেখো। আমি শুধু ডাকতে শেখাতেই তো এসেছি। সব সহায়, সব গর্ব, সব আড়ম্বর দূর করে শুধু ডাকো। একান্তে তাঁকে ডাকো। শুধু ডাকো ডাকো ডাকো। তিনি সাড়া দেবেনই দেবেন। চিত্তরথে লাগুক অনুরাগের টান। ছোটাও রথ। সার্থক করো জীবন। ধন্য করো তোমার চারপাশ সুগন্ধে। তোমার অস্তিত্বের সুগন্ধে, আনন্দে। শুরু করেছিলাম লালন দিয়ে, ইতি টানি গুরুদেবে -

"আনন্দময়ের আনন্দ আলয় নব নব তানে ছাও রে
পড়ে থাকো সদা বিভুর চরণে আপনারে ভুলে যাও রে"

 

(ছবি - নেট)

519
Sat, 03/12/2016 - 08:00

অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বসে। রাস্তাটা বেঁকে গিয়ে যে গ্রামটাতে গেছে, সে গ্রামের অনেককেই চিনি। তারাও চেনে আমায়। তবু এখন যেন সেই চেনাচিনি থেকে সরে আমি। সামনে অনেক দূর অবধি বিস্তৃত ধানক্ষেত। সবুজে সবুজ চারদিক। গরম তেমন নেই, আবার ঠান্ডার দাপটটাও নেই, বসে থাকতে ভালই লাগছে।

মন শান্ত না। খুব কাছের বেশ কয়েকজন মানুষ, খুবই দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও মারণ রোগের রক্তচক্ষু, কোথাও রাজনৈতিক দ্বেষাদ্বেষি, কোথাও সাম্পর্কিক জটিলতার আবর্ত।
সামনের ঈষৎ অন্ধকার হয়ে আসা আকাশে নীড়ে ফেরা পাখির দল। কিছু দূরে একটা বড় বটগাছে ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব। আমার পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছে একজন দুজন মানুষ। কেউ হেঁটে, কেউ রিকশায়, কেউ বাইকে। কেউ গল্প করতে করতে, কেউ গান শুনতে শুনতে, কেউ নীরবে। তারা চলে গেলে প্রকৃতি নিজের মত একা, পাশে আমি, একজন সাক্ষী। সাক্ষী তো সবাই, হয় তো সচেতন সাক্ষী।
মন ভাল নেই। নানান চিন্তা, দুশ্চিন্তা জট পাকাচ্ছে। কালো মেঘের মত মুখ ভার করে এমন স্নিগ্ধ, শান্ত পরিবেশেও মনকে ক্ষুব্ধ করে চলেছে। এত কিছু হচ্ছে চারপাশে। কত মত, কত ঘটনা, কত সৃষ্টি। আমি হঠাৎ করে যেন থেমে গিয়ে থমকে পড়েছি মাঝপথে। অনেকের ফোন এড়িয়ে যাচ্ছি, অনেকের রাগের কারণ হচ্ছি, অনেকের অভিমানের। জানি, তবু আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। এত মানুষের এত যন্ত্রণার অসহায় দর্শক হয়ে থাকাটা যে কি শাস্তি! অথচ কিচ্ছু করার নেই। হাত পা খুব স্বল্প পরিসরে ছোঁড়াছুড়ি করে শেষে ক্লান্ত হয়ে মেনে নেওয়ার পালা। জানি সব। বুঝি সব। তবু ওই, "বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।"
ঝোঁপের মধ্যে জোনাকি দেখা যাচ্ছে। আকাশে তারা উঠে গেছে বেশ কিছু। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, না, চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। এটা কি পক্ষ? মনে পড়ছে না। যাক গে। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বসলাম।
পরিচিত অসহায় মুখগুলো ভেসে উঠল ভিড় করে। আচ্ছা, এরকম, ঠিক এই জায়গায় বসে আমার মতই কি কেউ একজন তার প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কষ্ট পায়নি, বহু বহু যুগ আগে, কিম্বা কয়েক মাস আগেও, কিম্বা গতকালই? নিশ্চই পেয়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে তারও চোখের কোল ভরেছে, নিবিড় স্নেহে, আরক্ত ভালোবাসায়। তবে কোথায় আলাদা আমি? আমার কোন কষ্ট, কোন যন্ত্রণাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে আমারই জীবনে ঘটছে? আগে কারো কোনোদিন হয়নি? বা ভবিষ্যতেও হবে না?!
একটাও নেই। সব যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি হয়, শুধু মুখগুলো বদলে যায়। আমার ক্ষুদ্র, যন্ত্রণাক্লিষ্ট আমিকে সরিয়ে এ কোন আমি এসে দাঁড়াল? যে আমি আকাশ মর্ত্য পাতাল ব্যেপে দাঁড়িয়ে আছি, জেগে আছি অনন্তকাল ধরে। জেগে থাকবও। যেন ছোট আমিগুলো এই বড় আমিটার গায়ে বিন্দু বিন্দু লেগে। ফুলের রেণুর মত। যেন ঝরে পড়ে যাবে যে কোনো মুহুর্তেই। মিথ্যা হবে সে, শুধু এই বিশাল আমিটা ছাড়া। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অণুতে অণুতে যেন এই বিশাল আমি-র যোগাযোগ। সব ক্ষতি, সব দুঃখ, সব সুখ, সব উল্লাস - শুধু ওই বিন্দু বিন্দু আমিগুলোর। এ অন্তহীন আমি-র নয়। এ চিরকাল শান্ত, স্থির, আনন্দে পরিপূর্ণ।
মন শান্ত হল। মন এই বিশাল সংসারের আমি-র মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল তার সব তরঙ্গ নিয়ে। সমস্ত প্রকৃতির সাথে এ বিশাল অস্তিত্ব এক হয়ে দাঁড়াল। কোথাও যেন বিন্দুমাত্র নেই ফাঁক। আমার শান্ত বুকে জেগে সব আমি-র মিলিত আমি, সবার আমি। কোথায় আলাদা আমি কারোর থেকে? যারা গেছে, যারা ছেড়েছে তারা সব এই বিশাল একত্বে চিরকালের জন্যে বাঁধা। এ আমিটা যেন বিশাল প্রাচীন এক বটবৃক্ষ। ওই পাশের বটগাছটার মত। তাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনন্ত 'আমি' এসে চিরটাকাল বাসা বেঁধেছে। আবার কালের স্রোতে মিলিয়ে গেছে। প্রতিদিনের সুখ দুঃখ, আশা নিরাশা, হাসি কান্নায় গড়া সে ক্ষুদ্র আমি - মিথ্যা আমি। এই বৃহৎ আমিই সত্য। এই পারে এ দুঃসহ জীবনের ভার বইতে।

জানি প্রত্যহের সংসারে এ বড় আমিটাকে হারিয়ে ফেলব আবার। আবার ভয় পাব, আশঙ্কিত হব, কাঁদব। তবু, জানব এ মিথ্যা। এ শুধুই মিথ্যা।
আমার সব অশান্তিকে বুকে করে নিয়ে আছে যে পরম শান্তি, আমার সব শোককে বুকে করে নিয়ে আছে যে পরম আনন্দ তাকে আমি হারাতে পারি, সে পারে না। সে-ই সত্যি, আমার এই ভীতু, ক্ষুদ্র, দুর্বল আমিটা না। সে হতে পারে না। তা হলে এতবড় সৃষ্টিটা শুধুই মিথ্যা, ছলচাতুরী হত।
তাই যদি হত, তবে সংসার একটা বুদ্ধ, একটা খ্রীষ্ট কিম্বা একটা লালন জন্ম দিতে পারত না। সব খোঁজ, সব সাধন হত ব্যর্থ। সেই তো দিশা, সেই সে গানে -
"এ মানুষে সেই মানুষ আছে"

 

 

520
Thu, 03/10/2016 - 20:00

সংশয়রাক্ষস নাশমহাস্ত্রম - স্বামীজি বললেন ঠাকুরকে। যিনি সংশয়কে নাশ করার শুধু অস্ত্র না, মহাস্ত্রস্বরূপ।
কিসের সংশয়? ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে? 'হাঁ'ও বটে, 'না'ও বটে। 'হাঁ'- কারণ, ঠাকুরের ঈশ্বরের 'ইতি' করা যায় না।
সন্ধ্যেয় রাস্তায় দাঁড়ানো রঙমাখা মুখে গণিকারূপী 'মা', মন্দিরের প্রসাদে মুখ দিয়ে যাওয়া বেড়ালরূপী 'মা', তাঁর সমাধিস্থ দিব্যকান্তিপ্রজ্বলিত মুখে লাথি মেরে যাওয়া ঈর্ষাপরায়ণ কালীবাড়ির কর্মচারীরূপী 'মা', যার পায়খানা নিজের চুল দিয়ে গভীর রাত্রে পরিস্কার করেছিলেন সেই রসিক মেথররূপী 'মা', গোপালের মায়ের মত হতদরিদ্রা বিধবারমণীরূপী 'মা' প্রমুখ তাঁর 'মা'; সহধর্মিণীরূপী 'মা', সংসারে নিস্পৃহ দিব্যত্যাগের জীবনে ব্রতী হতে দৃঢ়সঙ্কল্পত্যাগী যুবকবৃন্দরূপী 'মা'।
মানুষের মধ্যে গভীর অনুসন্ধান তাঁর। "চোখ বুঝলেই তিনি আছেন, আর চোখ খুললেই তিনি নেই! তা না, সবই তিনি।" "শালগ্রাম শিলায় তাঁর পূজা হয়, আর মানুষে হয় না?" "মানুষগুলো যেন বালিশের ওয়াড়, ভিতরে শুধু তিনি।"
এরকম নানান উক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারা জীবনে। মানুষ কি এতই মূল্যবান? বললেন, "হ্যাঁ গো, মানুষ কি কম গা, মানুষ অনন্তকে চিন্তা করতে পারে।"
এরকম একটা কথা কেউ বলল না তো! আমার সবচাইতে বড় ক্ষমতা আমি সসীম হয়েও অসীমকে ধারণা করতে পারি। আমার মধ্যে সে অসীম, সে অনন্তে যাওয়ার করিডোর আছে। সেখানেই তো আমি অনন্য, যেখানে আমি আমার ক্ষুদ্রতাকে অতিক্রম করতে পারি। সে ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছিলাম আমরা। বস্তুজগৎ এক প্রতিযোগিতার জন্ম দিয়ে আরেক প্রতিযোগিতায় শেষ করে। শান্তি কই?
ভোগে শান্তি কই, সেখানে তো ভোগান্তি। শান্তি মুক্তিতে। মুক্তি মানে পালানো না। "সংসারের দুঃখকষ্ট দেখে যে সংসার ত্যাগ করে সে হীনথাকের লোক"। অর্থাৎ, তাতে তাঁর সম্মতি নেই। তবে মুক্তি কিসে? নিষ্কাম ভালোবাসায়। "তোমার কাছে কিছু চাই না, শুধু দেখতে ভালোবাসি।" "নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু।" 'আমি আমি' না, 'তুমি তুমি'। যতক্ষণ 'আমি' ততক্ষণ অজ্ঞান। "জল ফুটছে, তাতে আলু পটল বেগুন লাফাচ্ছে, মনে করছে আমি লাফাচ্ছি। জানে না, নীচে আগুন আছে।" তাই "আমি ম'লে ঘুচিবে জঞ্জাল।"
সংশয় আমায় নিয়ে আমার। আমার জীবন নিয়ে, আমার প্রেম নিয়ে, আমার কাজ নিয়ে, আমার সফলতা-বিফলতা নিয়ে, আমার লক্ষ্য নিয়ে। আমার সকাল থেকে রাত অবধি হাজারো সংশয়ের মেঘ। কোনোকিছুই যেন ঠিক করে উঠতে পারছি না। যাই ধরছি, স্থির করছি - সাবানের ফেনার মত পিছলে পিছলে যাচ্ছে। প্রতিমুহুর্তে হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। ঘেঁটে ঘেঁটে যাচ্ছে সব। এদিকে সব জানি বিদ্যেবোঝাই বাবুমশায়ের মত। শুধু সাঁতার জানি না। তাই সব থেকেও সব বৃথা হতে বসেছে।
ঠাকুর হেসে বললেন, ওরে, একের পিঠে যত শূন্য বসাস সংখ্যাটা তত বড় হয়। কিন্তু সামনের 'এক'-টাকে মুছে দিলে সব শূন্য শুধু শূন্যই। সেই এক'কে খোঁজো।
খুঁজে পাচ্ছ না? একটু তোমার অহংটাকে দূরে সরিয়ে আমার কাছে নিভৃতে একলাটি এসো না গো। তোমায় একের খেই ধরিয়ে দেব বলেই তো আমার আসা! অহং যাচ্ছে না? একটু কাছে এসো, ওকেও সরিয়ে দেব, কৌশলে না গো। প্রেমে। আমি ঢোঁড়াসাপ না, জাতসাপ। একবার ধরলে না মজিয়ে ছাড়ি না। এসেই দেখো না।

521
Thu, 03/03/2016 - 08:00

যে ভয়গুলোকে প্রাণপণে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি, মনে হয়েছে বারবার যে এই কাল্পনিক ভয়ংকর ঘটনাগুলোর একাংশও যদি বাস্তব জীবনে ঘটে তবে মরে যাব!

    তবু সে ঘটনাগুলো ঘটেছে। একাংশে না, শতাংশ ছাপিয়ে ঘটেছে। মনে হয়েছে, সব শেষ হবে আর খানিক পরেই, এই যে মাথা ঘুরে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ব, আর কোনোদিন উঠে দাঁড়াবার শক্তি পাব না।
    তবু রাস্তাটা ফুরিয়েছে। রাস্তা কিছু বিশ্বাস কেড়েছে, রক্তাক্ত পায়ের কিছু ছাপ নিয়েছে, চোখ গলা জল নিয়েছে, খানিক দীর্ঘশ্বাস নিয়েছে। আমায় নেয়নি। নিতে পারেনি। নিতে পারেও না।
    কে নেবে? ছেলে, মেয়েকে অকালে, অসুরের হাতে হারিয়েও বহু বাবা-মা আজও বেঁচে আছেন। বহু মানুষ যাদের বেঁচে থাকার আপাতদৃষ্টিতে সব হারিয়েছেন, তারা তবুও আছেন। সংসারটা তাদের মুখের দিকে তাকিয়েই সকালকে ঘরে ডাকে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস। কত কঠিন লড়াই মানুষকে লড়তে দেখেছি, কি ভীষণরকম হেরে যেতে দেখেছি মানুষকে ভাগ্যের কাছে, মিথ্যার কাছে, অশুভ শক্তির কাছে। তবু কি অদম্য আত্মবিশ্বাসে উঠে দাঁড়াতে দেখেছি। কোনো বিরাট দর্শনের জোরে না। শুধু বেঁচে থাকার মধ্যে যে গর্ববোধ আছে সেটাকে মরতে দিতে চায় না বলে। শুধু বাঁচবে বলে। বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য হয় কিনা জানি না, তবে অর্থ হয়। সেটা বেঁচে থাকাই। তবু প্রতিদিন সকালে মনে করা আমি আছি, তবু আছি।
    আপনার সামনে আশাপ্রদ কিছু নেই। নাই থাক। হতাশাও নেই। ওটা আপনার মনের সৃষ্টি। আমার সামনে সিঁড়ি না থাকলেই খাদ আছে, এ আমি বিশ্বাস করি না। মানুষ সত্যিকারের খাদের সামনে এসে দাঁড়ালে তবু কিছু না কিছু একটা খোঁজে উঠে দাঁড়াবার তাগিদে, কিন্তু আশঙ্কার খাদের থেকে ওঠার কোনো উপায় সে খুঁজে পায় না। পাবে কি করে? যে মন দিয়ে সে উপায় খুঁজবে, সেই মনই তো খাদের দুঃস্বপ্ন বুনতে ব্যস্ত। মনের মত এমন শক্তিশালী অস্ত্র সারা বিশ্বে নেই। মুশকিল হল সে গড়তেও যেমন পারে, ভাঙতেও তার জুড়ি নেই। তার মতন উপদেষ্টাও নেই, আবার তার মতন কুমন্ত্রকও নেই।
    তাই বাইরের সব ভাঙনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান যায়, সাথে যদি নিজের মনকে পাওয়া যায়। সে যেন খুঁতখুঁত না করে, ধৈর্য না হারায়। আমার ইচ্ছা আবেগ বুদ্ধি যদি এক সারিতে এসে দাঁড়ায় তবে যত ভাঙা কপাল হোক না কেন, রাজপথ না পেলেও সুড়ঙ্গ একটা পাওয়া যাবেই যাবে। যদি বিষাদ, হতাশা এসে সে সুড়ঙ্গের মুখ আটকে বসে? তবে রক্ষা করা বিধাতারও অসাধ্যি। সাপের মত বিষাদ বিষ ঢালে, চুঁইয়ে চুঁইয়ে তা হৃদয়ের সব শক্তি শুষে নির্জীব, অদৃষ্টবাদী করে মৃত্যুর অপেক্ষায় রেখে যায়।
    মনকে সব অবস্থায় এই রাজী করানোর সাধনাই চলবার সাধনা। নতুবা বাস্তবিক দুঃখ, আর কাল্পনিক দুঃখ মিলিয়ে যে অঙ্কটা দাঁড়ায় তা একটা জীবনে ধারণা করা সাধ্যাতীত। কারণ ওই দুঃখটাই সব চাইতে বড় সত্য। আর সুখ বলে যেটা পাওয়া যায়, সেটা নিতান্তই দুঃখটাকে সাময়িক ঠেকিয়ে রাখার কৌশল। তবে কি হতাশবাদীর পোঁ ধরলুম? না, তা না। মনকে রাজী করাবার কথা বলছি; সুখে, দুঃখে, সম্পদে, বিপদে তুমি পাশে থেকো মন। যে মন শুধু আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে মন না, যে মন আয়নার আশেপাশেও ঘোরাফেরা করে সেই মন এ ডাকে সাড়া দেবে। তাকে দিতেই হবে, সেখানেই তার গর্ব, সে শুধু হাঁটে না, চলেও। চলার পথে যা কিছুবাধা সৃষ্টি করে তাকে সে নির্মমভাবে ত্যাগ করে, শুধু চলাটা ত্যাগ করতে পারে না। এইখানেই সেই বড় মনটার শক্তি। চরৈবেতি চরৈবেতি ।

522
Sat, 02/27/2016 - 10:00

সাম্যবাদ কি পুঁজিবাদ না, অবশেষে প্রয়োজনবাদ। আদর্শ, নীতি ইত্যাদির যুগ কোথাও একটা শেষের দিকে। এখন দেখতে হয় আদর্শ বা নীতি কতটা উচ্চ বা মহান না, কতটা ফলপ্রসূ। কারণ, চাই সুখ। আমার প্রয়োজন সুখ। শীতকালে লেপ, রুম হিটার। গরমকালে এসি, কুলার। সকালের চা থেকে রাতের ঘুম – সব আমার প্রয়োজন, আমার সুখ। মাঝে যা আসে সবের মূল সূত্র – সুখের আস্বাদ অথবা ভবিষ্যতের সুখের প্রতিশ্রুতি। আমার স্বপ্ন, আমার ইনভেস্টমেন্ট। আমার রাজনৈতিক মতাদর্শ আমার সুরক্ষা। আমার স্বপ্নের সুরক্ষা। আমার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষা।

এ কিছু নতুন তত্ত্ব না। বহু আগে অ্যারিস্টটল, এপিকুরিয়াস হয়ে বেন্থামের লেখনীতে তা প্রায় পূর্ণ মাত্রা পেল। পরে আরো নাম করা দার্শনিক, লেখক, গায়ক ইত্যাদিরা সেই মতের ধারক বাহক হলেন।
সুখের প্রতি আকর্ষণ, আর দুঃখের প্রতি বিকর্ষণ সমস্ত জীবের প্রাথমিক চালিকাশক্তি। এখন এই সুখের প্রকারভেদ অবশ্যই হয়। শারীরিক সুখ, মানসিক সুখ। মানসিক সুখ আবেগজনিত ও বুদ্ধিজনিত ভাবা যেতে পারে। শারীরিক সুখের – আহার নিদ্রা মৈথুনের আস্বাদে আমরা পশুর সাথে এক গোত্রভুক্ত, অভিব্যক্তির পথের প্রমাণস্বরুপ ।
এর পরের ধাপ, বৌদ্ধিক ও আবেগজনিত। পেশার সুখ যদি এই দুটোকে নিয়ে হয় তবে কেয়াবাৎ! আমার বুদ্ধি ও আবেগ একই সাথে সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছে – তা উত্তম সাহিত্য, উত্তম সিনেমা, উত্তম শিল্পকলা।
এর পরের ধাপ আধ্যাত্মিক সুখ। খুব দুরূহ ভাষায় বোঝানো। যে বোঝে সে বোঝে। বাকিরা লড়ে মরে, তর্কের প্রাচীরে মাথা কুটে মরে। রামকৃষ্ণদেবের কথা অনুযায়ী – বিষয়ানন্দ, ভজনানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ।
ভজনানন্দ কি? সাধনার আনন্দ। সাধনা কি? আত্মজয়ের চেষ্টা। ক্ষুদ্র সুখের ত্যাগ বড় সুখের চরণে। এতে যদি সুখের ভাগটা বাদ দেওয়া যায় তবে তা আসুরীক চেষ্টা, গীতার মতে।
ব্রহ্মানন্দ এর পরের। ঠাকুরের কথা অনুযায়ী, পেনসান ভোগের আনন্দের মত। আরেক জায়গায় বলছেন, দাঁড় বেয়ে খালবিল পার হয়ে বড় নদীতে পড়ে, পাল তুলে, হুঁকো সেজে পায়ের উপর পা তুলে নৌকার পাটাতনে শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখা।
সে উচ্চকথা থাক, যার হয় হোক। কথা হচ্ছে বড় বড় উচ্চাদর্শ যে আজ জোট বেঁধে দেশ বাঁচাবার আছিলায় দেশোদ্ধারের কাজে নামতে চাইছেন, তাতে দোষের কিছু দেখি নে। এ যুগই হল প্রয়োজনের। হতে পারে সেই প্রয়োজনের চূড়ান্ত নিম্নধাপ শোষণ-উৎপীড়নে এসে দাঁড়িয়ে যায়, তবু তার থেকে অব্যাহতির কোনো রাস্তা বৃহতের দরবারে নেই। আসে ইউনিয়ান, বিভিন্ন প্রকার সংগঠন – আরেক প্রয়োজনবাদ। বড় শাসকের হাত থেকে রেহাই পেয়ে ক্ষুদ্র শাসকের হাতে। খামচা খামচি, খিমচা খিমচি। এর কি ভয়ংকর পরিণাম হতে পারে পশ্চিমবঙ্গবাসীর জানতে বুঝতে আর বেগ পেতে হয় না।
কথা হল এই প্রয়োজনের তবে কোনো নীতি, বিবেক নেই? আছে, আবার নেইও। আপেক্ষিক স্তরে আছে। চূড়ান্ত স্তরে নেই। শরীরে ঘা হলে পোকা হয়। শরীরের স্বার্থে ঘা সারানো প্রয়োজন, পোকার স্বার্থে ঘা'টাকে আরো দগদগে করে রাখা। কি করবেন? বুদ্ধিমান বুঝিয়া লও।
এই নিষ্ঠুর খেলাটাই কি শেষ কথা তবে? না। আসে প্রেমবাদ। তার নিরানব্বই ভাগ প্রয়োজনের রাহুতে ঢাকা হলেও, একাংশ সব যুগেই বাইরে থাকে। কিছু মানুষ নিজের প্রয়োজন ছাপিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়, ভালোবাসে। নিজের উদরান্ন তার পাতে দেয়। এও আছে। এরাই বাঁচেন, এরাই পথ কাটেন। এরাই আলো আনার তীর্থযাত্রায় প্রাণ দেন।
আর আছে উন্মাদবাদ। এরা ভালো মন্দ কিছু বোঝেন না, বোঝেন এক'টাই শব্দ – প্রতিশোধ, হিংসা, উত্তেজনা। এরা ধর্মের, রাজনীতির ছদ্মবেশে থাকে। চূড়ান্ত পবিত্র সমাজের কথা বলে, চূড়ান্ত উদারতার কথা বলে। এরা বলে মানুষ মানি না, ঈশ্বর মানি। এরা বলে দেশ মানি না, বিশ্ব মানি। মানে জল মানি না, সাগর মানি।
এর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা বাপু চাট্টিখানি কথা না। শুধু দেখে যাও। শুনে যাও। নিজের উপলব্ধি আর বিশ্বাসের সাথে সৎ থেকে যাও। যতটা ভালোবাসা যায়, যতটা ক্ষমা করা যায়, যতটা নির্লোভ থাকা যায় তাতে নিজেরই মঙ্গল। উপদেশের মত শোনাল? তা না, শান্তিদেশের কথা বললুম।

523
Fri, 02/19/2016 - 14:26


“তুমি ঠিক করে দেওয়ার কে?”

এই প্রশ্নটা আমার কাছে খুব বিভ্রান্তিকর লাগে।
একটা বাড়িতে একটা নির্দিষ্ট প্রথা থাকে। নৈশভোজের সময়, পোশাকের মান, উৎসবের প্রকার ইত্যাদির। আমার বাড়িতে ১০টায় খায় রাতে, তোমার বাড়িতে ১১টায়। আমার বাড়ির মেয়েরা সালোয়ার পরে, তোমার বাড়ির মেয়েরা শাড়ী। আমার বাড়িতে লক্ষীপূজোর চল আছে, তোমার বাড়িতে সরস্বতী।
এরকম পাড়া, রাজ্য, দেশ অনুযায়ী এক একটা প্রথা, রীতি, কৃষ্টি, সংস্কার ইত্যাদি চলে আসছে। তা পরিবর্তন হয়েছে, পরিমার্জন হয়েছে। পুরোনো নিয়মের জায়গায় নতুন নিয়ম এসেছে। এভাবেই এগিয়েছে। একদিকে সে বেঁধেছে, আরেকদিকে সে খুলেছে। এই বাঁধন আর খুলনের সামঞ্জস্যতাতেই একটা পরিবার তথা সমাজ এগিয়ে চলেছে। হাঁটতে গেলে যেমন একটা পা মাটিতে স্থির রেখেই আরেকটা পা তুলতে হয়, সিঁড়িতে উঠতে গেলে যেমন একটা পা এক সিঁড়িতে রেখেই আরেকটা পা অপর সিঁড়ির দিকে এগোতে হয়, তেমনই একটা নিয়মে স্থির থেকেই ততক্ষণ অপর নীতিতে যাওয়া যায় না, যতক্ষণ না তা পূর্ব নীতি অপেক্ষা উন্নত বলে বিবেচনার দ্বারা স্থির হয়।
প্রশ্ন হল এই বিবেচনা করবে কে? এখানে দুটো উত্তর আসে। এক, জনতা। দুই, সুবিবেচকেরা। গণতন্ত্রের মধ্যে যে ‘তন্ত্র’ শব্দটা আছে, তার একটা অর্থ শৃঙ্খলা, অথবা একটি সিদ্ধান্তনির্ভর পথ। একটা প্রতিষ্ঠিত বিধি বা নিয়ম, যা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা সৃষ্ট। কিসের জন্য সৃষ্ট? শাসনের জন্য। প্রশ্ন আসে সঠিক নেতৃত্বের।
প্লেটোর কথা অনুযায়ী – প্রজ্ঞা, সংযম, ন্যায়বোধ ও সাহস এই চারটির প্রকাশ যে ব্যক্তিত্বে সে-ই সঠিক নেতৃত্বের অধিকারী। জনগণ একটা শক্তি। কিন্তু তা অসীমের দৃষ্টিতে গতিময় হলেও ক্ষুদ্রকালের গণ্ডিতে তা দিশাহীন। মানুষকে সঠিক জ্ঞান কখনও জনসাধারণে দেয়নি, দিয়েছে আলোকপ্রাপ্ত অসাধারণেরাই। না হলে আজও পৃথিবী স্থির থাকত আর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে হত। আপনার আমার চারপাশে যা কিছু বুদ্ধিগত তত্ত্ব ও প্রযুক্তিগত বস্তু ব্যবহার করছি – সবই কোনো ব্যক্তির অবদান, আমজনতার নয়। একটা সেফটি পিন থেকে শুরু করে একটা অত্যাধুনিক মহাকাশযান অবধি কোনো ব্যক্তিগত মস্তিস্কপ্রসূত। যার প্রণালীবদ্ধ ধারাবাহিক লিপিবদ্ধ ব্যবস্থাকে আমরা সিলেবাস বলি। আমাদের বিদ্যালয়ে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় মানুষের বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শনের অগ্রগতির মাইলস্টোনগুলোর সাথে, যার প্রতিটি উদ্ভাবনের সাথে একটি করে ব্যক্তির নাম জড়িয়ে, যাঁরা সামান্য না, অসামান্য ছিলেন।
এইবার প্রশ্ন আসে ন্যায়ের ক্ষেত্রে কি নানা মুনি নানা মত হয় না? হয়। আর সেখানেই আসে জনতার ভূমিকা। সে কার কথা শুনবে। রামায়ণে আমরা দু’জন পরামর্শকের ভূমিকা দেখেছি। এক বিভীষণ, দুই মন্থরা। তা শোনা না শোনার পরিণামও সবার জানা। পুরাণে শুক্রাচার্য ও বৃহষ্পতি দুই গুরুর কথাই উল্লেখ আছে।
কিন্তু কথা হচ্ছে কিছু একটাকে স্থির করে নিয়েই সব চলে। আপনার স্কুলের একটি ছাত্র বা ছাত্রী শুধুমাত্র যদি অন্তর্বাস পরিধান করে বিদ্যালয়ে আসে, আপনি কি ব্যবস্থা নেবেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকা হয়ে? সে যদি বলে এ আমার নিজস্ব পোশাকের মত? আপনি বলবেন এ শালীন নয়। সে বলবে এই শালীনতা নির্ধারণ করবার আপনি কে? একজন বলল, আমি এই সিলেবাসে পড়ব না। আপনি কে সিলেবাস ঠিক করে দেওয়ার? আমি মার্চ মাসে পরীক্ষায় বসব না। আপনি কে পরীক্ষার রুটিন ঠিক করার? এ তর্কের অবসান নেই। কারণ এর একটা যুক্তি অন্য যুক্তিতে এসে কাটে। ফলে চলতেই থাকে চলতেই থাকে। থামব কোথায়? সংযমে। সংযম কিসে? আমার আপনার যাতে মঙ্গল তাতে। কিসে মঙ্গল? সেটা শুধু যুক্তি স্থির করতে পারে না। পারে সহানুভূতিসম্পন্ন অন্তর্দৃষ্টি বা প্রজ্ঞা। ফের সেই নেতৃত্বের প্রশ্ন। সাময়িক ক্ষিপ্র উন্মাদনার না। বিপ্লব মানে উন্মাদনার থেকে বেশি কিছু, তা গলার জোরে হয় না। ক্ষেপিয়ে দিয়ে হয় না। সে আপন দাবীর সত্যের জোরে জায়গা নিয়েই ছাড়ে, আজ না হয় কাল। তাকে কোনো প্রশাসন চিরটাকাল দাবিয়ে রাখতে পারে না। আর সত্যের পথিক কখনও আত্মহননের পথ বাছে না, প্রত্যাঘাত বা অসহযোগের পথ বাছে। দুয়ের পিছনেই থাকে তার উপলব্ধ সত্যের জোর। যে শক্তি অমর।
সেই সত্যকে উপলব্ধি করার স্থৈর্য্য, ধৈর্য্য আমাদের আসুক। উত্তেজনা না, উদ্দীপনা আসুক। প্রচারের, রাশি রাশি সমর্থনের ধাঁদালো আলোয় না, সত্য ও মঙ্গলের স্থির আলোয় গতিপথ নির্ধারিত হোক।
তাই উপনিষদের সেই প্রাচীন বাণীতেই ইতি টানি – “সত্যমেব জয়তে নানৃতং”। সত্যেরই জয় চিরটাকাল হয়ে থাকে, মিথ্যার না।

524
Fri, 02/19/2016 - 08:00

মন বিষণ্ণ। মন পেলো না পারের খবর। আসা যাওয়া দেখছে সে জনমভর। প্রাণ আর জড়ের মধ্যে কোন চৈতন্যের বাস? কে বাসা করে মানুষের বুকে? কার ইঙ্গিতে বর্ষা বসন্ত নিয়ম করে আসে যায়? মন বোঝে তার গভীরে পাতাল সিঁড়ি, নামলে পরে নামতেই থাকে, নামতেই থাকে, নামতেই থাকে। চোখ কিসের সুখে আপনিই ভরে ওঠে, বুকের ভিতর দুধ ওথলানো, পাওয়া না-পাওয়ায় মেশা কান্না সুখ। কার মুখের আভাস ওই নীলাকাশে আবছা ভেসে ওঠে? কার স্পর্শ সন্ধ্যের উদাস বাতাস নিয়ে ফেরে?

মন তার একলা আঁধার ঘরে একলা ফেরে। ডুকরে কাঁদে। কাকে যেন ডাকতে চায়। কে যেন তার গোপন আপন। তার নাম যেন তার সবার নামে মেশা। তার চলতে ফিরতে বুকের মধ্যে একতারারই ভাষা। সে আনমনা হয়। সে উদ্বেল হয়। তার সীমার সাথে অসীমের বিবাহের খবর এসে পৌঁছায়। কিন্তু যেন পরিচয় আছে অনন্তকাল দূরে তবু একরাত্রি পরে।
বাউল এসে দাঁড়াল তার দরজায়। বাউলের চোখে পড়ল চোখ। তার মনের দীঘিতে লাগল ঢেউ। সে যেন পেল ভববৈদ্য। এ যেন তার কবেকার চেনা চোখ। তার গতজন্মের হারিয়ে যাওয়া খেলার সাথী। তার পোশাকে যেন সেই বঁধুর স্পর্শমাধুরী লেগে। সে বাউলকে বলল, ভেতরে এসো।
বাউল আসল ঘরে। বেজে উঠল একতারা। বাউল গাইছে নামগান। ঘরের পাঁচিল গেল সরে। তার ভুবন উঠল দুলে। নামের মালার ফুলের গন্ধ, তার বুকের মধ্যে এসে, গোপন দরজায় দিল নাড়া।
সে বাউলকে বলল, তোমার জাত কি?
বাউল বলল, "মায়েনসের কোনো জাত হয় না রে। হিঁদু, খেষ্টান, মোচলমান সবের ভিতর সেই আমার গোবিন্দ। এই যে পাতাখান", এই বলে বাউল জানলা ছুঁয়ে থাকা শিউলির পাতা দেখিয়ে বলল, "এই যে পাতাখান এর মধ্যিও যে গোবিন্দ, তোমার মধ্যিও সেই। আমার গুরু কি কইল জানো? বললে, মায়েনসেরে কখনো হিংসা করবি না। হিংসা করলি সাধন ভজন হয় না রে!" বাউল থামল। বললে, "মায়েনসের দুইখেন জাত - বাবা আর মা"।
বাউলের চক্ষে গুরুপ্রেমের বিন্দুজল, গালে বইল প্রেমধারা হয়ে। তার একতারা আবার উঠল বেজে। লালন বসলেন গোঁসাইয়ের কণ্ঠে ভক্তিমাখা হয়ে।
বাউল নামল পথে। সংশয়ী বললে, ওরে ভণ্ড কাজ কর, ভিক্ষা মাগিস গৃহে?
বাউল উঠল হেসে, বলল, "তোমায় গোবিন্দ দেছেন ঝাঁটা (সে সংশয়ী তখন ঝাঁটা হাতে গৃহস্বামীর বাগান পরিচর্যায় ছিল রত) আমায় দেছেন একতারা। তোমার কাজের শক্তি আর আমার গানের শক্তি দুই গোবিন্দের লীলা। কেন লীলায় বাধা দাও ভাই!"
আবার একতারা উঠল বেজে। নামের অগুরু পড়ল ছড়িয়ে চারিধার। ঘরে ফিরে মন দেখল চাবি। সে বাউল গেছে রেখে তার বুকের ভিতর অন্তঃপুরের সিঁড়ির ঘরের চাবি। তার প্রাণ উঠল দুলে।


(ছবি - Suman)

525
Wed, 02/17/2016 - 09:55
অশান্তিতে থাকার একটা অন্যতম মূল কারণ – শান্তিতে থাকতে চাওয়া। চাইবেন না। ওটাও একটা বিলাসিতা। আপনার চারদিক আপনাকে অস্থির করে তুলতে চাইছে, উদ্বিগ্ন করে তুলতে চাইছে, আর আপনি প্রাণপণ শান্ত থাকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন – এতে হিতে বিপরীত। আপনার মধ্যেই একটা সংঘর্ষ তৈরী হচ্ছে। কারণ আপনি স্থিতাবস্থা চাইছেন। তা হবার নয়। স্থির আপনাকে থাকতেই হবে, তবে শান্তি? না, কিছুতেই না।
শান্তি কোনো প্রচেষ্টার প্রত্যক্ষ ফল না। বিভিন্ন প্রচেষ্টার সুসামঞ্জস্যতাপূর্ণ অবস্থানের পরোক্ষ পরিণাম। স্বামীজী তাঁর একটা চিঠিতে তাঁর গুরুভাইদের লিখছেন – ‘সব ত্যাগ করতে পারো আর শান্তির আশা ত্যাগ করতে পারো না?’ ভাবুন। একজন সন্ন্যাসী বাকি অন্য সন্ন্যাসীদের লিখছেন শান্তির আশাও ত্যাগ করার কথা। রবীন্দ্রনাথও তাঁর শান্তিনিকেতন প্রবন্ধে লিখছেন, কি চাই? শান্তি? উনি বলছেন, না। চাই প্রেম। সুখে দুঃখে অবিচল থাকার প্রেম। স্বামীজীর আরেক গুরুভাই, শ্রীরামকৃষ্ণদেবের মানসপুত্র ব্রহ্মানন্দজী বলছেন, "শান্তি পেতে গেলে আগে অশান্তিটাকে খুঁচিয়ে তোল।" কি অসম্ভব সুন্দর কথা। কার্পেটের তলায় ধুলো জমিয়ে কি লাভ? মনের গভীরে কুরে কুরে খাচ্ছে অশান্তি, বাইরে শান্ত থাকার ভাণ করে কি সুখ? চাই না সুখ, চাই না শান্তি। চাই না, চাই না, চাই না। সারাটা জীবন আমি এই শান্তির মায়ামৃগর পিছনে দৌড়াব না আর। সে শুধু দুর্বলই করে আমায়। কে শান্তিতে আছে? পাগল, শিশু আর পূর্ণ নির্বোধের কাছে ছাড়া, এ সংসারে সেই বস্তুটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। দরকার কি? তাই বলে কি সাধ করে গরম জলে পা দিতে হবে? কখনো না। তবে গরম জলে একান্ত পা পড়ে গেলেও ফোসকা পড়বে না এমন দুরাশা করব না। আর ফোসকা পড়লে তা যন্ত্রণা দেবে না – এমন ধারা কল্পনাকেও মনে ঠাঁই দেব না। অশান্তিকে গলবস্ত্র হয়ে ডাকব না, কিন্তু এসে পড়লে খাটের তলায় সেঁধিয়ে গিয়ে মূর্খের স্বর্গেও জুড়াতে চাইব না। আর অন্যদিকে শান্তিদেবীর পায়ে তৈলমর্দন করে শক্তি অপচয়ও করব না। রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনে অজস্র লেখা এই কথা বারবার শিখিয়ে গেছে আমাদের। সে উদাহরণে ভারাক্রান্ত না করে একটি গানের উল্লেখ করে প্রসঙ্গের ইতি টানি।

           তোমার কাছে শান্তি চাব না,
           থাক্-না আমার দুঃখ ভাবনা ॥
অশান্তির এই দোলার 'পরে        বোসো বোসো লীলার ভরে,
           দোলা দিব এ মোর কামনা ॥
           নেবে নিবুক প্রদীপ বাতাসে,
           ঝড়ের কেতন উড়ুক আকাশে—
বুকের কাছে ক্ষণে ক্ষণে            তোমার চরণ-পরশনে
           অন্ধকারে আমার সাধনা ॥

526
Sun, 02/14/2016 - 13:14

আজ প্রেমোৎসব উদযাপনের দিন। যে প্রেক্ষাপটেই হোক না কেন। এর বিরোধিতা করার কোনো কারণ আমার মনে আসে না। কেউ কেউ বলেন প্রেমের আবার উদযাপন দিবস হয় নাকি? সে তো সারা বছরের রোজদিনই। খুব ঠিক কথা। তা একদিন একটু বেশি করে উদযাপিত হলে ক্ষতি কি? রোজ খাই বলে কি আর নেমন্তন্ন বাড়ি যাই নে? নাকি রোজ বাড়ির ঠাকুরকে নকুলদানা দীপ ধূপ দিই বলে বড় দূর্গোৎসবে, কি অন্য ধর্মীয় উৎসবে যোগ দিই নে? খুব দিই। রোজ পোশাক পরলেও সেদিন বিশেষ ভাবে, বিশেষ রঙের, বিশেষ কায়দার পোশাক পরি। এও সেরকমই আর কি। বিশেষ ভাবে ভালবাসার কথা ভাবা।


প্রেম যদিও ভাবের বস্তু, তবু যা চারদিকে দেখি তাতে ব্যাপারটা পুরোপুরি বায়বীয় বলে মনে হয় না। প্রেমকে বাস্তবায়িত করতে অর্থের একটা বড় রকমের দায়িত্ব আসে। আমি কাউকে ভালোবেসে তার সাথে চিরটাকাল কাটাব, তাই সেই ভাবটাকে মজবুত করতে উকিল লাগে। যতই 'যদিদং হৃদয়ং অং বং ছং' আওড়াও, ম্যারেজ সার্টিফিকেট ছাড়া ভুলছিনে বাপু, হুঁ! লোকজন ডেকে খাওয়াও, অর্থাৎ কিনা ভালবাসাটার একটা সামাজিক দড়ি চাই, সব্বাইকে জানিয়ে, সাক্ষী রেখে এই প্রতিজ্ঞে করলুম আমরা একসাথে হলুম।


তবে কি কি আসল? টাকা, আইন, সমাজ (মানে পাড়াতুতো, আত্মীয়স্বজনতুতো সমাজ) – এই তিনের বাঁধন।
এরপর আসবে লৈঙ্গিক বিধান। অর্থাৎ পুরুষ হলে প্রেমের দায় এক রকম আর স্ত্রী হলে প্রেমের দায় আরেক রকম। প্রেমের অনুভূতি যতই এক প্রকার হোক - পুং-এর ঘর, স্ত্রী ঘরণী। আমি শুয়ে শুয়ে বার্ট্রাণ্ড রাসেল পড়ব, কি বিধানসভা লোকসভা সামলাব, তুমি চা করবে। তখনই অবসর নেবে যখন আমি পুং নামক জীবটির তাতে সামাজিক, কি কারুণিক, কি অসহায়িক সম্মতি আছে। কারণ তুমি দ্বিতীয় লিঙ্গ। আমি পুং প্রথম লিঙ্গ। (আর ওরা তৃতীয় লিঙ্গ- থাক থাক আমরা বড় সামাজিক জীব, যখন তখন ওদের নাম করতে নেই, রাম রাম)।


অর্থাৎ কি না প্রেম বস্তুটির বায়বীয় দিকটার এই শর্তগুলো পুরোপুরি বা বেশিরভাগের মত পূরণ হলে টিকতে পারে। দাবি-দাওয়া, লাভ লোকসানের হিসাব তো আছেই। আর আছেন অহং ও তার পরিবার। মানে তার বাচ্চারা- ঈর্ষা, অভিমান ইত্যাদি। তা স্বল্পে মিটল তো ভাল, না হলে রাগারাগি, হাতাহাতি, কোর্টাকুর্টি।
তাই বলি ভায়া প্রেম করতে রীতিমত এলেম লাগে। তার চাইতে সে সবের থেকে প্রেমকে বাঁচিয়ে অন্তত একদিনের জন্যই সই তার বিশুদ্ধ রূপটা আস্বাদন করলে ক্ষতি কি?

আজ না হয় উল্টোটাই হোক। আজ অকারণেই বলিই না হয় – আমি ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়। আজ ওর কিছু কাজ আমিই না হয় করি। অপটু হাতে না হয় ভুলই হল, রান্না হল নুনে পোড়া, চা হল কড়া তিতে, হোক। তবু হোক। কথা বেসামাল হোক, কতটা হতে পারে দেখাই যাক না। আমি দেখেছি, খাঁচায় বদ্ধ পাখি, বহুদিন পর উড়তে পেলে আকাশকে ভয় পায়। তার নিজের জন্মগত অধিকারের আকাশকে ভয় পায়! নিজের জন্মলব্ধ ডানাদুটোকে করে অবিশ্বাস। কয়েক পা এগিয়ে সে আবার খাঁচার আশ্রয়ই খোঁজে অনেক সময়। তবে সব পাখি না, কেউ কেউ তবু জোর করে উঠানের আমডালটায় গিয়ে বসে সাহস করে। দেখেছি তো।


দাও আজ খাঁচাটা খুলে। ভয় নেই সে এক উড়ানে আকাশটা পার হয়ে যাবে – এমন ভালবাসার শক্তি তাতে নেই, তুমিই দাওনি তাকে। তবে সম্ভাবনাও কি নেই? আছে আছে আছে। সেই সুযোগটাই আজকের। সেই পূজোর সময় যেমন খানিক ভুলভাল খাওয়াই যায়, কেউ কিচ্ছুটি মনে করে না, এমনকি চিরকেলে বাঙালী পেটও না – দেখোই না কিছুটা বেহিসাবী প্রেমে ভেসে আজ। খুব ক্ষতি হবে না। প্রমিস!

527
Sat, 02/13/2016 - 09:48

বিন্দু বিন্দু মনের গুঁড়ো ছড়াচ্ছে সারাটা দিন জুড়ে। জড়ো করতে গেলে খেলনার মত রূপ। যার মানে নেই। একটা গাছের শুকনো ডাল, দূর থেকে ভেসে আসা মানে না বোঝা কথা, বাতাসের হাল্কা গা ছুঁয়ে যাওয়া - এ সবারই কোনো ব্যাখা নেই।

বুদ্ধি বুদ্ধু এখন। অনুভব তার সমস্ত সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে টহল দিচ্ছে চারপাশ। প্রতিক্ষণে তার অস্তিত্বে জাগছে নতুন অনুরণন। শান্ত আকাশের মত তার সারা গায়ে কোমল থিরথির মেঘমালার মত সুখ। একে এক কথায় কি বলে? অবকাশ? হবেও বা।
যাই বলি না কেন, এ সময়ের মধ্যে কোথাও একটা করুণ রসের গোপন সঞ্চার থাকে। কি কথা যেন মনে এসেও মনে আসে না। ছুঁয়ে যেতে যেতে কি একটা যেন বলে যায়? সেটা কি - বিরহ? ক্ষোভ? প্রেমহীনতা? জানি না।
আচ্ছা কোনো অপূর্ণতাই বা হবে কেন? পূর্ণতার কোনো বেদনা নেই?
আছে। সে বেদনার সুর অন্যরকম। তার ভাব পূর্ণ বিকশিত ফুলের, তবু কিসের একটা বেদনা। পূর্ণতার বুকের মধ্যে একটা অপূর্ণতার ব্যাথা থাকে। সেটা কি?
সেটা আত্মসমর্পণের আকুতি। নিজেকে পূর্ণ করে পাওয়াই কি শেষ কথা? না। পূর্ণ করে পাওয়ার পর আসে পূর্ণভাবে লীন হতে চাওয়ার ব্যাকুলতা। কিন্তু সে ব্যাকুলতা কার প্রতি? কার কাছে সে চায় পূর্ণ বিলীনতা?
অসীমের প্রতি। যে অসীম অজ্ঞেয়। যে অসীম দুরূহ তার অসীমতায়। তাকে জানার দ্বারা সীমায়িত করা জানা যায় না। পাওয়ার দ্বারা সীমায়িত করা যায় না। অনুভবের দ্বারা রঞ্জিত করা যায় না। কাল যাকে খণ্ডিত করতে পারে না আপন নিগড়ে। সেই অসীমের প্রতি। তাতে সব পূর্ণতার চরম পরিণতি। সব সার্থকতা তার মধ্যে চরম আত্মবিসর্জনে। তা কি মৃত্যু?
না। মৃত্যু একটা যাত্রাপথের বাঁক মাত্র। তার চরম পরিণতি কিছুতেই নয়। তাই তাকে বারবার ফিরে ফিরে নিজেকে গড়তে হয়। আবার ভাঙতে হয়। ফের গড়তে হয়। এই ভাঙাগড়ার চক্রের মাধ্যমে সে পূর্ণতার দিকে এগোয়। পূর্ণতা শুধু ভাঙাও না, শুধু গড়াও না। এ দুই ধারাকে নিয়েই তার অস্তিত্ব।
সেই পূর্ণতার ব্যাথা যতক্ষণ না বুকে বাজছে, যতক্ষণ না দু'হাত উপুড় করার তাগিদ দিনরাতের স্থবির সুখকে পীড়িত করছে - ততক্ষণ নিস্তার নেই। কোনো পূর্ণতাই ততক্ষণ সেই চরমের সুখ পায়নি বুঝতে হবে, যতক্ষণ না সে নিজেকে নিঃস্ব করতে চাইবে স্বেচ্ছায়। বিলীন হতে চাইবে আনন্দে, সেই পরমানন্দে। যা অসীম। যা সব মাধুর্যের পরাকাষ্ঠা। যেখানে, সব শেষের শুরু আবার সব শুরুর শেষ।

উপনিষদ যাঁকে বলেন -

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।
ব্রক্ষ্ম অনন্ত। এই জগৎও অনন্ত। কিন্তু 'এই' জগৎ 'সেই' ব্রক্ষ্মের উপর আরোপিত সত্তা মাত্র। 'এই' জগৎকে যদি সরিয়ে দেওয়া যায় (তথাপি) 'সেই' ব্রক্ষ্ম অনন্তই থাকেন। ওঁ শান্তি, শান্তি, শান্তি।

 

528
Thu, 02/11/2016 - 10:36

যদি শান্তি চাও, দোষ দেখো না – বহুশ্রুত মা সারদার উক্তি বা উপদেশ। কিন্তু... - একটা 'কিন্তু' তবু খচখচ করে। সেটা কি করে সম্ভব? তবে কি উনি মৃত্যুশয্যায় একটা গোলমেলে কথা বলে গেলেন? তা কি করে হয়?


    এ কথাটা বহুবার ভেবেছি। ভুল না ধরলে শুধরাব কি করে? যার যেটা ভুল সেটা তাকে বলব না? সে তো আরো বিপথে যাবে? এরকম নানান তর্ক যুক্তি মাথার মধ্যে ঘোরে।


    আসলে কথাটার অন্য একটা জায়গায় বোঝবার সূত্র আর বলবার হেতুটা আছে। “যদি শান্তি চাও”। এর অর্থ এ নয় যে, অন্যায় অসত্য দেখলে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে হবে। তখন না বলার জন্য মনটা অশান্ত হয়ে উঠবে। সেক্ষেত্রে পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে সত্যটা বা ঠিকটা বলতেই হবে।


    কিন্তু আরেকটা দিকও আছে। অনেক সময় দোষ দেখাটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন মনটা অকারণে হয়তো না, তবে এড়ানোযোগ্য কারণেও নালিশপ্রবণ হয়ে ওঠে। নিজেকে নিজে ক্ষত-বিক্ষত করে তোলে অসন্তোষে, ক্ষোভে। এ তার মানসিক ও শারীরিক – দুই স্বাস্থ্যের পক্ষেই ক্ষতিকর। কারণ তখন সেটা স্বভাবপ্রসূত, বিবেচনাপ্রসূত নয়। বিবেচনাশক্তি সবদিক সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারে, কিন্তু যখন মনই অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল তখন তাকে শান্ত রাখা দায়। হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তি – যে কোনো একটাকেও অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলে সে আত্মসত্ত্বাকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। প্রথমটা দুর্বল, আবেগপ্রবণ করে তোলে আর দ্বিতীয়টা শুষ্ক তর্কপ্রবণ করে তোলে। দুইই অস্বাস্থ্যকর।


    জগৎটা সর্বাঙ্গসুন্দর নয়। গীতা বলেন, ‘অনিত্যম, অসুখম লোকা’ ... রামকৃষ্ণদেব বললেন, বালিতে চিনিতে মেশানো এ জগৎ, তোমায় চিনিটা বেছে নিতে হবে, গোলমালে ভরা চারদিক, তোমায় ‘গোল’ ছেড়ে ‘মাল’টি নিতে হবে। আর কথাতেই তো আছে, "যা আছে ভাণ্ডে, তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে"। অর্থাৎ, আমি রাম শ্যাম যদু মধু সক্কলেরই এক দশা – ভালো-মন্দ মেশানো প্যাকেজ। তা তিতেটা ছেড়ে মিঠেটা নিলেই হয়, তিতে নেই কে বলল? তবে আমার ও নিয়ে কোনো লাভ নেই, এই কথাটাই মা বললেন। ওতে অশান্তিই বাড়বে।


    একটা গল্প বলে শেষ করি। শিরডির সাঁইবাবার কাছে এক ভক্ত যেতেন। তিনি ভীষণ লোকের নিন্দা করে বেড়াতেন। একদিন সাঁই তার সাথে বিকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছেন, আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। ভক্তটি খেয়াল করলেন, সাঁই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা শূকরের নোংরা খাওয়া দেখছেন। তিনি ঘেন্নায় নাক কুঁচকে বললেন, ছি ছি একি দেখছেন সাঁই, চলুন এগিয়ে চলি।


    সাঁই একটু হেসে বললেন, দেখ কি সুন্দর নিজের জিভ দিয়ে চেটে নোংরা জায়গাটা পরিস্কার করে দিচ্ছে! ভক্ত বললেন, ছি ছি। সাঁই বললেন, ছি ছি কেন রে, তুইও তো নিজের জিভ দিয়ে লোকের নোংরা চেটে বেড়াস, করিস না এর ওর নিন্দা সারাদিন?
    স্বভাব কি একদিনে যাবে? না যাবে না। তাই ঠাকুর অভিনব প্রার্থনা শেখাচ্ছেন, "যখন ভক্তি প্রার্থনা করবি, সাথে এও প্রার্থনা করবি, মা আমি যেন কারো দোষ না দেখি, কারোর নিন্দা না করি, এমনকি পোকাটারও না।"


    মা সারদা দক্ষিণেশ্বরে প্রার্থনা করছেন কেঁদে কেঁদে, মা আমার দোষদৃষ্টি দূর করে দাও।
    তবেই যে না মা, নইলে যেতুম কোথায়!

529
Sat, 02/06/2016 - 09:00

শরীরটা আমার বাইরের জিনিস, আর চিন্তাটা আমার ভিতরের – এমন একটা ভাগ আমাদের বোধে স্বতঃই এসে থাকে। আমার হাঁটাচলা, কথাবলা ইত্যাদি নানান অঙ্গভঙ্গী আমার এই বাইরের জিনিসটার সাথে – আমার শরীর। ভিতরের আমি কখনো তার থেকে আলাদা আবার কখনো একযোগে। এই বাইরে ভিতরের মাঝে এমন একটা জায়গা আছে, যাকে বলা যেতে পারে NO MAN’S LAND. সেখানে আমরা বুঝে উঠতে পারি না, আমরা একটা রাসায়নিক উন্নতমানের যন্ত্র, না চেতনাযুক্ত অস্তিত্ব? যে আমার অংশ বাইরের জগতের সাথে লড়ছে সেই কি করে ভিতরে সব কিছুর সাথে একাত্বতা অনুভব করে? এই স্বাতন্ত্র্যতাবোধ ও একাত্বতাবোধ যুগপৎ থাকে কি করে? সেদিন ট্রেনে একজন তার অসুস্থ বাচ্চার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। অনেকেই দিলেন, অনেকেই দিলেন না। ভাবছিলাম, এই যে প্রার্থনা, তা কার কাছে? আমার মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য আমি আছে তার কাছে? না যে আমিটা একাত্ম হয়ে আছে তার কাছে? উত্তরটা বুঝতে অসুবিধা হল না।


    আমাদের এই শরীরটা যেহেতু বাইরের দিকে তাই এ আমাদের মধ্যে এই পৃথকত্বের বোধটাকে জাগিয়ে রাখে। তার স্থূল অস্তিত্বের কাছে সে নিজে যতবড় সত্য, আর কিছু তেমন না। সে কাড়াকাড়ি করে হোক, ছিনিয়ে হোক, অসৎ উপায়ে হোক – নিজেরটা চাই-ই চাই। এটাই শরীরের ধর্ম। তাই এটাকে আমরা পাশবিক বলে থাকি। কারণ পশুদের শুধু বাইরেটাই আছে। তাই তার কোনো ধর্মবোধ, নৈতিক বোধের সংজ্ঞা না জানলেও চলে। শরীর সবকিছুকে আলাদা করেই দেখে। সেটা দোষের না। সেটাই তার স্বভাব।


    অন্তর দেখে একের মধ্যে। সে একের নাম – সমাজ হতে পারে, -ism হতে পারে, দেশাত্মবোধ হতে পারে ইত্যাদি। মোটমাট সে একের রশি খোঁজে। বাইরের থেকে বাঁধবে, গোদা বাণ্ডিলের মত, না মালার মত গাঁথবে সূতোর মত- সেটা নির্ভর করছে বাঁধনটার উপর। প্রেম, সহানুভূতি – এগুলো মালার সূতো। শাসন, রীতিনীতি – এগুলো কাতা দড়ি, পাকিয়ে বাণ্ডিল বানাবার। প্রথমটা এক করে। দ্বিতীয়টা শুধুই একত্র, এক না।
এই কারণেই সার্কাসে পশুকে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, মানুষকে সেভাবে দেওয়া যায় না। পশু চাবুক বোঝে, মানুষ বোঝে লজ্জা। সে লজ্জাবোধ হারিয়ে ফেললে সে শুধুই ওই বাইরেরটাই, অর্থাৎ শুধুই একতাল মাংসের প্রাণী। তখন তার শাস্তির মান আরো কঠোর। কারণ যার হৃদয় অপরাধের পর অনুতপ্ত না, তার শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণই তখন একমাত্র পথ।


    ভিতরের এই অস্তিত্বের জন্যই আজ এমনধারা ছন্নছাড়া ভাব চারদিকে। হঠাৎ করে আমাদের সমাজ, সাহিত্য, শিল্প শরীরকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। তা কি করে, কেন, ইত্যাদি আলোচনা থাক। তা হয়ে উঠেছে এটা স্পষ্ট। শারীরিক সুখ কিনবার মাত্রা আকাশছোঁয়া। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিস্কার সে দিকেই বিদ্যুৎগতিতে এগোচ্ছে। শরীর শরীর আর শরীর। আমাদের চিত্তবৃত্তিটাও যে শুধুমাত্র কতকগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল – এ বলতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছেন না অনেকেই। এ চূড়ান্ত জড়বাদের উপর দাঁড় করাতে চাইছি নীতি-নিপুণ সমাজ – সোনার পাথরবাটি।


    তা হয় না। শুধু যুক্তি, শুধু জড়বাদ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না – আমি যদি তোমায় খুন করে ভালো থাকি, তবে ভুলটা কোথায়? কি বলবেন? এরকম করতে নেই? কেন করতে নেই? তোমার সাথেও এরকম কেউ করতে পারে, তাই তুমিও কোরো না – এই বলবেন তো? সে বলবে, আমার সাথে করবে? কার ঘাড়ে ক'টা মাথা? আমার প্রহরী আছে, রক্ষী আছে, আগলাবে। আমি বলশালী, আমি যা ইচ্ছা করব, তুমি দুর্বল, তোমার জন্য ওসব ধর্মের বাণী, ন্যায়ের বাণী- আমার জন্য না। কি বলবেন?


    এটাই হল পশুর সত্ত্বার ভাষা। আমার শরীরের ভাষা, আমার বাইরের দিকের ভাষা। এর কোনো দিশা নেই, ভিত্তি নেই। আছে যুক্তি, তার বিরুদ্ধ যুক্তি ইত্যাদি।


    উপনিষদ বললেন, ভিতরের দিকে তাকাও। কেন তাকাব? ভয় থেকে মুক্ত হবে বলে, শান্তি পাবে বলে, আনন্দ পাবে বলে। যা বাইরে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছ। কি দেখব ভিতরে – অবিচ্ছিন্ন নিজেকে। কারণ যত গোল এই বিচ্ছিন্ন দেখা থেকেই। শরীর বিচ্ছিন্ন দেখে, নিজেকে পৃথক দেখে – ভুল দেখে। তাই এত ভয়, এত অশান্তি, এত দুঃখ। নিজেকে অবিচ্ছিন্ন দেখো, আলোর মধ্যে। কিসের আলো? প্রেমের, প্রজ্ঞার। INTELLECT না, INTUITION.
    যুক্তি না, প্রজ্ঞা। অবসাদ না, ধৈর্য্য। ক্ষোভ না, সন্তোষ। ঈর্ষা না, অভিনন্দন। ক্রোধ না, উপেক্ষা।


    এই ভিতরের ধর্ম। শরীরের না। এই সূতো মালা গাঁথার, কাতা দড়ি না পাকিয়ে দেওয়ার।

530
Tue, 01/26/2016 - 08:00
২৫শে জানুয়ারী সন্ধ্যেবেলা। কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে ২৬শে জানুয়ারীর ছুটির উদযাপন করার প্ল্যান করছে কানে এলো। শীতের কুয়াশায় ঢাকা মাঠ। ছেলেগুলোকে স্পষ্ট দেখাও যাচ্ছে না। গলার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারছি অনেকেই কৈশোরের দোড়গোড়ায় হবে। আলোচনার মূলকথা যা বুঝলাম – মদের মোট টাকাটা উঠছে না। আমি অস্বস্তিতে পড়ছি, তবু জায়গাটা ছাড়তে পারছি না, কারণ একজন বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি। ভাষা অশালীন। তবে কান অভ্যস্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ হুল্লোড় শুনে বুঝলাম সমস্যা মিটে গেছে। হইহই করে সব আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মাফলারে, টুপিতে, পুলওভারে আদ্যোপান্ত ঢাকা। বড়জোর ক্লাস টুয়েলভ হবে ওদের বরিষ্ঠতম সদস্যের।
বন্ধু ফোনে জানাল সে আসছে না। হাঁটতে শুরু করলাম বাড়ির দিকে। মোড়ে মোড়ে প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনের জন্য বাঁশ পোঁতা। তাতে পতাকা উত্তোলন হবে। কয়েকটা জায়গায় মাঠে আগুন জ্বলছে। সারারাতব্যাপী পিকনিক। কাল প্রজাতন্ত্র দিবস – ছুটির দিন। আমোদের গন্ধ। এই জিনিসটা খাওয়ার চল কি আগের থেকে বেড়ে গেছে? মনে মনে নিজেকে কনজারভেটিভ বলে দুষলাম। তবু মনে হল, বেড়েছে কি? ছাত্রছাত্রী মহলে ইদানীং এত বেশি শুনি, ধন্দ লাগে। উড়িষ্যায় দেখেছি আদিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন উৎসবে কিশোর কিশোরী থেকে বুড়োবুড়ী অবধি প্রমত্ত হয়ে উঠেছে। খুব আধুনিক হয়েছি কি তবে? জানি না। মনটা কেমন লাগতে লাগল। কিশোর মুখগুলো রাস্তায় বেশি করে চোখে পড়তে লাগল। এরা কাকে ঠিক বলে জানে? কি জিনিসটা বড় এদের কাছে? কোনো স্বপ্ন দেখে কি? নাকি বড়দের মুখে, 'এ দেশের কিছু হবে না... সব উৎসন্নে গেছে' গোছের মনোভাব এদেরও শিকড়ে দানা বাঁধছে? এরা কি বিশ্বাস করে তারা ভাল কিছু করতে পারে... বড় কিছু করতে পারে? ওদের স্বপ্নকে আগলে রাখার মত শক্ত হাত আছে ওদের আশেপাশে? মোবাইল ভরতি পর্ণোগ্রাফি... শিক্ষকবেশী ব্যবসায়ী... অতি-উচ্চাকাঙ্খী উদভ্রান্ত বাবা মা... ঘোরাচ্ছন্ন বন্ধু-বান্ধব... লক্ষহীন অস্থির সংস্কৃতি... ইত্যাদির ঘূর্ণী কাটিয়ে কে ওদের স্বপ্নের মাঝি হবে? কে হাল ধরবে? এইসব মাথার মধ্যে জট পাকাচ্ছে। হাঁটছি। হঠাৎ কানে এলো, কে কাকে বলছে, “বাবা পড়াশোনাটা ঠিক করে কর। আমাদের মত গরীবের এই পড়াশোনা ছাড়া কি পুঁজি বল?” পিছন ফিরে তাকালাম। সেলুনে একজন মধ্যবয়সী মানুষ, যিনি নাপিত, তিনি তার কিশোর বয়সী এক খদ্দেরের মাথায় কিছু একটা পেশাগত কাজ করতে করতে খুব আবেগ আর আন্তরিকতা মিশিয়ে কথাগুলো বলছেন। আমি খানিক থামলাম। ভাল করে খেয়াল করলাম সে সেলুনের মালিককে। এরা নতুন ভারত গড়তে পারেন না? আমরা দেশ বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে অনেকদিন তো দেশ চালালাম। ওরা কি ভাবেন খোঁজ নিয়েছি? ওরা কিভাবে ভাবেন? জীবন কি শিখিয়েছে ওদের যে এত উতলা ছেলেমেয়েদেরকে পড়াশোনা শেখাবার জন্য – এ উদাহরণ তো ইনি একা নন! মহাত্মা গান্ধী বুদ্ধিজীবি মানুষদেরও মাঠে ঘাটে, কায়িক পরিশ্রমের কাজের কথা বলতেন (প্রবন্ধের শেষে দ্রষ্টব্য)। একজন সম্পূর্ণ মানুষের বিকাশে প্রাথমিক শারীরিক শ্রমের গুরুত্ব খুব দিতেন, যা তলস্তয় ফার্মে করেছিলেন। ওনার পায়খানা পরিস্কার করার উদ্যোগের কথাও ওর জীবনী পাঠক মাত্রেই জানেন।  এ সত্য। জীবনের সব শিক্ষা বই দিতে পারে না, সিলেবাস দিতে পারে না। আবার বিনা প্রথাগত শিক্ষাতেও সে আলো পূর্ণ মাত্রায় জ্বলবে না। এই দুই শিক্ষার মেলবন্ধন চাই। শুধু আই আই টি, এ আই এম এস ইত্যাদির হিসাবে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন হয় কি? না বোধহয়। যে গ্রামে, যে শহরের মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারায় শরীর ও মনের মেলবন্ধন যত স্বচ্ছ, সুস্থ, সেখানকার জীবনের মান তত উন্নত। সেখানে দুর্নীতি, ব্যাধির প্রকোপ তত কম। সুস্থ সবল মানসিকতার অধিকারী মানুষকে অসৎ করার চেয়ে দুর্বলচিত্ত, দুর্বল দেহ মানুষকে অসৎ করা অনেকগুণ সোজা। অন্তত অসৎ কাজে চুপ করিয়ে রাখার মতন মহান কাজে তারা সর্বদা সহজলভ্য। আর যার গলায় জোর আছে, শরীরে জোর আছে, সে চেঁচাবেই। সৎ হবে ভেবে না, প্রকৃতির নিয়মানুসারেই। অসুস্থতা নেই বলছিনে। কিন্তু কোনো জায়গার বেশিরভাগ মানুষ অসুস্থ হলে সেখানকার জলহাওয়া পরীক্ষা করা উচিৎ। আমাদের মুলস্রোতে সমাজের সবস্তরের মানুষকে হাত লাগাবার, মতামত দেবার অধিকার দিতে হবে। প্রথাগত শিক্ষাকে, হাতেকলমে শেখা মানুষদের সাথে যুক্ত হতে হবে। আবার বিপরীতটাও সম্ভব করতে হবে। শুধু প্রকল্প চালু করে না। উদ্যোগী হয়ে সেগুলোকে ফলপ্রসূ করে তুলতে। তার সাথে, মাথার সাথে শারীরিক শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন হই এমন শিক্ষাধারাও চালু করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ শুধু কলম না, হালও ধরেছিলেন। সে ছবিও দুষ্প্রাপ্য না।
দেখাই যাক না ভেবে। ====================== মহাত্মাজীর লেখা থেকে সংগৃহীতঃ
-------------------------------
ঐশ্বরিক নিয়ম
-------------- ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন যাতে সে উদরান্নের জন্য কাজ করে। বলেছিলেন, যারা কাজ না করে খায়, তারা তস্কর। আমরা যেন ঘাম ঝরিয়ে উদরান্নের সংস্থান করি। এই হল মহান প্রকৃতির অভিপ্রায়। এতএব, যে যতক্ষণ অলস হয়ে বসে থাকে, সে ততক্ষণই তার প্রতিবেশীদের কাছে বোঝা। ওরকম করার অর্থই হচ্ছে অহিংসার প্রথম পাঠটির বিরোধিতা করা। প্রতিবেশীর জন্য অন্যের সুসঙ্গত ও নির্দিষ্ট বিবেচনা না থাকলে অহিংসা অর্থহীন, এবং এই প্রাথমিক শর্তটি অলস ব্যক্তি পূরণ করতে পারে না।  রুটির জন্য শ্রম প্রসঙ্গে তলস্তয়ের রচনা পড়ে প্রথম আমি ঐ নিয়মটি উপলব্ধি করি যে, বাঁচতে হলে মানুষকে কাজ করতেই হবে। কিন্তু তার আগেও রাসকিনের 'আনটু দিস লাস্ট' পড়ে শ্রমের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জাগরুক হয়েছিল। ত. ম. বন্দারেভ নামক জনৈক রুশী লেখক প্রথমে এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেন যে, মানুষের উচিত স্বহস্তে পরিশ্রম করে নিজের রুটি জোগাড় করা। বিষয়টি তলস্তয় গ্রহণ করলেন এবং ব্যাপক প্রচার করলেন। আমার মতে, 'গীতা'র তৃতীয় অধ্যায়েও এই একই নীতি বিধৃত হয়েছে। যেখানে বলা আছে যে, উৎসর্গ না করে যে ব্যক্তি খাদ্য গ্রহণ করে সে চুরি করা খাদ্য খায়। এখানে উৎসর্গের একমাত্র অর্থ হতে পারে রুটির জন্য শ্রম।
যুক্তির নিয়ম
------------ যুক্তির সাহায্য নিলেও ওই একই সিদ্ধান্তে আসতে হয়। যে কায়িক পরিশ্রম করে না, খাওয়ার অধিকার তার আসবে কোথা থেকে? বাইবেলে আছে, 'নিজের কপালের ঘামের বিনিময়ে তুমি তোমার রুটি খাবে'। একজন লক্ষপতিও যদি সারাদিন বিছানায় গড়িয়ে কাটায় এবং এমনকি তাকে খাইয়েও দিতে হয়, তাহলে সে-ও বেশিদিন ওইভাবে কাটাতে পারবে না, অচিরাৎ নিজের জীবন নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠবে। সে, এতএব ব্যায়াম করে ক্ষিধে তৈরী করে, নিজের হাতে খায়। এখন, কী গরিব, কী ধনী সকলকেই যদি কোনও-না-কোনওভাবে ওই ব্যায়াম করতেই হয় তাহলে তা কেন উৎপাদনশীল বা রুটির জন্য শ্রমের রূপ নেবে না? কেউ চাষীকে প্রাণায়াম বা পেশীর ব্যায়াম করতে বলে না। আর মানবজাতির নয় দশমাংশ জমি চাষ ক'রেই প্রাণধারণ করে। পৃথিবী আরও কত আনন্দময়, স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ও আরোও শান্তিপূর্ণ হতো যদি ওই বাকি এক দশমাংশ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠের উদাহরণ অনুসরণ করত, অন্তত তাদের খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমটুকু করত।


531
Sun, 01/24/2016 - 18:00
কথা বলার একটা ছন্দ থাকে। হাঁটাচলার ছন্দ থাকে। গান-কবিতার ছন্দ থাকে।
তেমন আমার দেখার আর শোনারও একটা ছন্দ আছে। বাইরের দুনিয়ায়, কি আমার ব্যক্তিগত দুনিয়ায় যা কিছু ঘটে চলেছে, সবেতে কি আমার মন সাড়া দিচ্ছে? না, দিচ্ছে না। আমি যা সব চোখের সামনে দেখি না কেন, সে প্রত্যক্ষ হোক কিম্বা টেলিভিশানের পর্দায় হোক - আমার মন সেই সেই ঘটনাগুলোকেই নথিভুক্ত করবে যে ঘটনাগুলো তার অন্তঃকরণের ছন্দের সাথে মেলে।
শ্রবণের ক্ষেত্রেও তাই। যা শুনছি, সরাসরি হোক কিম্বা যন্ত্রের মাধ্যমে, সব কি নিচ্ছি? না, নিচ্ছি না। সেই শ্রবণের মাধ্যমেও যা কিছু পাই, তাকে অন্তঃকরণের ছন্দের সাথে মিলিয়েই আমার মত করে পাই।
এই ছন্দের স্রষ্টা কে? এর সঠিক উত্তর কারোর জানা নেই। কিছুটা সে নিয়ে জন্মায়, যা তার মূল রসদ। বাকিটা পরিবেশ তৈরী করে দেয়। ইমানুয়েল কাণ্টের মতে প্রাথমিক জ্ঞান আমরা নিয়েই জন্মাই। ভারতীয় দর্শনের সাথে এই দর্শন বেশ খানিকটা মেলে। গীতা বলেন, শ্রদ্ধার কথা। যা মানুষ নিয়ে জন্মায়। সেই শ্রদ্ধা অনুযায়ী তার অন্তঃকরণের ছন্দ গড়ে ওঠে। আমার হয়তো মার্ক্সের তত্ত্বের উপর খুব বিশ্বাস, আপনার হয়তো বুদ্ধের তত্ত্বের উপর, আবার কারোর হয়তো বা খ্রীষ্টের তত্ত্বের উপর। জেনেটিকালি একে ব্যাখ্যা করা খুব শক্ত। একই পরিবারে ভিন্ন রুচির ভাই-বোন হয় কি করে তা হলে? একই বাহ্যিক পরিবেশে বড় হয়ে একই পরিবারের দুই ভাই দু'রকম হয় কি করে? তার মানে তারা জন্মলব্ধ একটা default mode নিয়েই আসে।
মানুষের দুটো সত্য নিয়ে চলতে হয়। এক, তার দর্শিত, শ্রুত সত্য। আরেক তার বিশ্বাসোচিত সত্য। যেমন ক'দিন আগে লিখেছিলুম -
গোলাপ লাল হয়
    এ ধ্রুবসত্য, ইন্দ্রিয়লব্ধ সত্য
অস্বীকার করার যো নেই আমার কাছে গোলাপের চেয়েও সুন্দর
                     রজনীগন্ধা
  এ আমার বিশ্বাসের সত্য
        সারা সংসার অস্বীকার করলেও তাই আমি মন্দিরে না গিয়েও -
    প্রণত এ মাটির সব ধূলিকণার কাছে মন্দির সংসারের সত্য
ঈশ্বর সত্য আমার বিশ্বাসের
এই যে বিশ্বাসের সত্য, এর মাধ্যমেই বাইরের সম্পদ হয় আমার অন্তরের সম্পদ। বাইরের ছন্দের সাথে পা মেলায় আমার অন্তরের ছন্দ। আমি শীতের সকালে ছাদে দাঁড়িয়ে। নীলাকাশের বুকে টুকরো টুকরো কিছু সাদা মেঘ। সামনের বড় দীঘিটার সবুজ জল হিমেল হাওয়ায় শিহরিত হয়ে উঠছে। পাড় বরাবর নারকেল, সুপারি, আম ইত্যাদি গাছের সারিতে সবুজ উজ্বল চারপাশ। পাখিদের রোদ পোহানো। সব মিলিয়ে যে ছবিটা আমার সামনে তা মনোহর। কিন্ত এই মনোহর পরিবেশটা কি সম্পূর্ণ পরিবেশের উপকরণেই গড়া? আমার কি কিছুই অবদান নেই? যদি বলো নেই! তবে মিথ্যা কথা বলা হয়। আমার মনের অন্তঃছন্দ এই রূপের ছবিটাকে একটা নিবিড় অনুভূতি দিয়ে প্রাণের উৎসবে নিয়ে আসছে। আমি ভিতর থেকে বলে উঠছি - বাহ্, অপূর্ব! আমি মুগ্ধ। আমি ধন্য।
এ তো গেল সুন্দরের কথা। নান্দনিক দিকের প্রসঙ্গ। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনের সাথে এর কি সম্পর্ক? আছে। আমার কাগজে সই করতে গেলেও লেখা থাকে - This is true according to best my of knowledge and belief. তাই হল মোদ্দা কথা। অর্থাৎ, আমার বিশ্বাসের সত্যের দাবী শুধু শৌখিন মহলে না, নিতান্ত কেজো জগতেও।
আমরা বিশ্বাস করি আমাদের যোগ শুধুমাত্র ছোট সংসারের সাথে না, বড় সংসারের সাথেও। তাই যে কারণে যোগী ধ্যানে বসে বিশ্বাত্মাকে নিজের অন্তরে বসিয়ে সেই বৃহত্তর আস্বাদ পেতে চান, সেই কারণেই একজন ব্রিগেডের মাঠে লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে আপ্লুত হয়ে যান। পার্থক্য হল, একজন নিঃস্বার্থভাবে সেই বৃহতের সাথে যোগসূত্র খুঁজছে, আরেকজন স্বার্থের জন্য। তাই প্রকার আলাদা। ফল আলাদা। প্রয়োগ আলাদা। কিন্তু উদ্দেশ্য এক।
যখন কেউ বলেন আমাদের এই ছোট সংসারকে জানলেই সব হয়ে যায়, তখন তাই তা হাসির কথা হয়ে ওঠে। যিনি সকাল বিকাল সংসারের মাসকাবারির বাজার থেকে শুরু করে নানান খুঁটিনাটিতে ব্যতিব্যস্ত, তিনিই যখন স্কুলে ভুগোল ক্লাসে ঢুকে মহাকাশের তত্ত্বে ডুব দেন তখন অন্য মানুষ। এটি করতে পারলেই তিনি সার্থক শিক্ষক। আমাদের শিক্ষা সম্পূর্ণ করতে তাই বড়কেই ডাকতে হয়েছে। সারা বিশ্বের ইতিহাস, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ঠিকানা, মানবসভ্যতার উন্মেষের কথা ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ ছোটকে জানায় আমার জীবনের সার্থকতা নেই।
এই ভিতরের ছন্দটি ঠিক থাকে যদি নিজের বিশ্বাসের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা যায়। তবে সবকিছু অমনি অমনি আমাদের পেড়ে ফেলতে পারে না, সবকিছুই গায়ে এসে অসভ্যের মত লাগে না। যতই পরিবেশ পরিস্থিতি জটিল হোক না কেন, ভিতরের দৃষ্টিতেই আলো পাওয়া যায়।
সব সমস্যা সমাধানেরই দুটো পথ। এক, সমস্যাটাকে তুচ্ছ করে দেওয়া। দুই, নিজেকে এত বড় করে ফেলা যে সমস্যাটা আপনিই তুচ্ছ হয়ে যায়। বিশ্বাসের সত্য এই দ্বিতীয়টার পথ খুলে দেয়।

532
Sun, 01/17/2016 - 23:09
অনেক মানুষের জঙ্গলে একা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হয়, কোথায় যাচ্ছি? জীবনগুলোর কিছুটা সময় রাস্তার যানজটে, কিছুটা কর্মক্ষেত্রে, কিছুটা শপিং মলে, সিনেমা হলে, পার্টিতে আড্ডায় টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। উজ্বল আলো, ঝাঁ চক চক রাস্তাঘাট, কায়দাকানুনের ফিরিস্তি, এসবের মধ্যে মানুষটা কই? টাকা প্রয়োজনের আঙিনা ছাড়িয়ে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা আজ। কল্পনা বাস্তবের মাটি ছাড়িয়ে নিয়ন আলোতে পোকার মত আটকে। শিকড়ে জোর নেই বলে ঝুরিতে নির্ভর বেশি। সম্পর্ক টান হারিয়ে প্রয়োজনের হিসাব মেলাচ্ছে। প্রয়োজন বিলাসে সীমা হারিয়েছে। চোখে মুখে গভীর অবসাদের লক্ষণ তীক্ষ্ণ। অবসাদ যত তীক্ষ্ণ, আস্ফালন তত তীব্র। এ ভাঙবে। আজ না হয় কাল। এর মূলে মিথ্যা। মানুষ সবকিছুর শেষে মানুষই। মানুষ জন্মায় মানুষের মত, তাকে মারা যেতে হয় মানুষের মতই। মাঝে সে নিজেকে যাই সাজাক, যাই বানাক। অর্থ, উচ্চাশা কোনোদিন তাকে নিজের গুরুত্ত্ব বুঝতে দেয় না। সে সবসময় জানে ক্ষমতাই শেষ কথা বলে। অর্থ তাকে ক্ষমতাবান করে অনেক কিছুর। দামী কথা। কিন্তু যতক্ষণ তা প্রয়োজন মেটায় তা ভাল, কিন্তু যেদিন সে আমার যোগ্যতার বেশি ক্ষমতা যোগায় সেদিন আমি ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। মানুষকে অস্থির করবার সবচাইতে সহজ উপায় তাই, তাকে তার যোগ্যতার বেশি পাইয়ে দাও, স্বপ্ন দেখাও। সে তোমার গোলাম হয়ে যাবে। যোগ্যতা অর্থে আমি শিক্ষাগত, কর্মগত যোগ্যতার কথা বলছি না। বলছি ভোগ করার, সঞ্চয় করার যোগ্যতার কথা। আমার চারপাশ কি আমার এই জীবনযাত্রার যোগ্যতা দেয়? আমার পাশের বাড়ির মানুষটা যেদিন দুটো সিদ্ধভাত আধপেটা খেয়ে, দুটো অর্ধভুক্ত শিশুকে নিয়ে শুতে যায়, সেই রাতে কি আমার বিনোদাগারে বসে আমোদলীলায় ভাসার যোগ্যতা আসে? আমার সে আমোদাগারে ঢোকার সমস্ত সামাজিক ক্ষমতা থাকলেও, আমার মানবিক যোগ্যতা কি আছে? না নেই। আর এই মানবিক যোগ্যতা এমন একটা শব্দ আমার আজ উচ্চারণ করতেও লজ্জা করে। মনে হয় এই বলবে, এ কোনো রাজনৈতিক পার্টির ম্যানিফেস্টো, নাকি কোনো ধর্মের সেই বস্তাপচা বাণী! খুব কঠিন এই শব্দটার হয়ে লড়া। কারণ একে শেখানো যায় না। পড়ানো যায় না। এর মাপকাঠি হয় না। এর পরিসংখ্যান বার করা যায় না। ইদানীং Stanford University একটা বিশেষ বিভাগ খুলেছেন, যার মূল একটা শব্দ Compassion - অনুকম্পা। তাঁরা এই নিয়ে গবেষণা করছেন। বিশ্বের বড় বড় মানুষদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন যাঁরা এই পথে কাজ করে চলেছেন বহু বছর ধরে। সমাজে সব মানুষের ক্ষমতার মান সমান না। দুর্বলের সাথে, পিছিয়ে পড়া মানুষের সাথে সমাজের বেশি সক্ষম, সুবিধাভোগী মানুষের পার্থক্যের প্রাচীর ভাঙতে পারে এবং ভেঙে চলেছে এই একটাই শব্দ - অনুকম্পা। বিখ্যাত দার্শনিক আর্ণল্ড টয়েনবি এক বইতে বলছেন, যদি বলি মানুষকে ভালোবাসো (Love) তবে তার অর্থ স্পষ্ট হয় না, যদি বলি অনুকম্পা (compassion) রাখো, তবে তার অর্থ স্পষ্ট হয়। খুব দামী কথা। আমাদের চলতে ফিরতে সারাদিনের রুক্ষতার, শুষ্কতার মূলও এই, অনুকম্পাহীনতা। তা আমার বোধের সীমাকে ঘোরে আচ্ছন্ন করে। ওই যে বললাম, যোগ্যতার হিসাব থাকে না। লোভের সবচাইতে বিপজ্জনক দিকই হল সে তুচ্ছকে অপরিহার্য করে দেখাতে পারে। তখন খাদকেই উপবনসদৃশ মনে হয়। নির্বিচারে পা দিই। মুখ থুবড়ে পড়ি। এ পরিণতি স্বাভাবিক। কারণ বিচারের আগেও যা কাজ করে তা সংবেদনশীলতা। সংবেদনা তখনই জাগে যখন চেতনার প্রকাশে কোনো বাধা নেই। লোভের মত চেতনার বাধা আর কি আছে? গীতা বলেন, - লোভ উপহৃত চেতনা... লোভে অবলুপ্ত চেতনা। একটা গল্প শুনেছিলাম। একবার কেউ একজন ব্যাসদেবকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনার লেখা এত বই তো পড়া সম্ভব না আমার পক্ষে, দয়া করে বলবেন এই আঠারোটা পুরাণ, এত শাস্ত্রের সার কি? ব্যাসদেব বলেন, সর্বশাস্ত্র পুরাণেষু ব্যাসস্ব বচনদ্বয়ম / পূণ্যায় পরোপকারায়, পাপায় পরপীড়ানাম। (সমস্ত পুরাণ, শাস্ত্রের মূল হল, পরোপকার হল ধর্ম, পরের পীড়নই পাপ।) তুলসীদাস বলেছেন, দয়া ধরমকে মূল হ্যায়, পাপ মূল অভিমান / তুলসী দয়া না ছোড়িয়ে, যব তক ঘটমে প্রাণ (দয়া সব ধর্মের মূল, অহমিকা সব পাপের মূল। হে তুলসী তুমি দয়া ছেড়ো না যতক্ষণ শরীরে আছে প্রাণ।) সব ধর্ম, সব সাহিত্য, সব সৃষ্টির মূল এই একটা শব্দকে ভিত্তি করেই - অনুকম্পা। আমাদের সবচাইতে বড় ক্ষমতাই হল একে অপরকে অনুভব করার ক্ষমতা। তাতেই আমার চারপাশটা আমার চারপাশ হয়ে ওঠে, পাঁচিল হয়ে ওঠে না।
533
Tue, 01/12/2016 - 11:57

বেলুড়মঠ, শান্তিনিকেতন - এগুলো পার্কসদৃশ, কিছুটা উচ্চমার্গের বিনোদনস্থল আজ। কোনো রসালো মিষ্টি বানানোতে বিফল হলে, মা-কাকিমাদের মুখে একটা কথা শোনা যায় - ইস্, রসটা ভিতরে যায় নি রে!

এই প্রকার অর্ধ-পাচিত মানুষের ভিড় দিনদিন বেড়েই চলেছে। এটা দুশ্চিন্তার। কারণ, না জানার চাইতে, ভুল জানা আরো ভয়ংকর। সে সব ক্ষেত্রেই। আমি যতজন বামপন্থী দেখেছি, তার মধ্যে কতজন ‘দাস ক্যাপিটাল’ পুরো খণ্ড পড়েছেন, তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। সবাই শর্টকাট খুঁজে চলেছে। বলার মত যুক্তি, খোঁচাবার মত সুক্ষ্ম পিন জমিয়ে চলেছে। ভাবার মত, উদ্বুদ্ধ হওয়ার মত ধৈর্য বা আন্তরিকতা কই? ফলে অল্পজ্ঞতা আজ ভীষণ আকার ধারণ করছে। এটা ভয়ের।
আজ স্বামীজির জন্মদিন। তাই তাঁর কথাই বিশেষ করে বলি। আজ বিশেষ রাজনীতি দলের তিনি মূল পুঁজি, আরেক রাজনৈতিক দল হঠাৎ ঘুম ভেঙে টের পেয়েছেন, মানুষটা মোটের উপর ভাল ছিল। দুটোই ভয়ানক।
আমাদের ছোটবেলা থেকে সিলেবাসে স্বামীজির আদর্শ বুঝবার উপযোগী কোনো পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হল না। কি করে হবে? গায়ে গেরুয়া যে! রোমা রোঁলা নামক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে, নামকরণ করলেন, ‘The Gospel of Mankind’। আমাদের বোধগম্য হল না। কারণ ওই এক। আমাদের আদর্শকে নকল করে চলতে হয়, অনুকরণ করে হাঁটতে হয়, তাই অনুসরণের দায় নেই। ওরা যেমন অঙ্গভঙ্গি করছে, করে যাও।
স্বামীজি প্রথম, যিনি চূড়ান্ত সমন্বয়ের পথে হাঁটলেন। হিন্দুধর্মের এতবড় সমালোচক অহিন্দুদের মধ্যেও মেলা দায়। নাস্তিকতার সপক্ষে তাঁর যুক্তি এত ক্ষুরধার, তা দার্শনিক নিৎজেকেও হার মানায়। তবে কি তিনি নাস্তিক ছিলেন? হ্যাঁ-ও বটে, না-ও বটে। আমাদের আস্তিকতা ও নাস্তিকতা দুটোই অপরিপক্ব। কেউ বিশ্বাস করেন আছেন, কেউ বিশ্বাস করেন নেই। শেষমেশ দুটোই বিশ্বাস। স্বামীজি চাইলেন উপলব্ধি - Religion is realisation। আমাদের কাছে নাস্তিকতার আর এক অর্থ ঈশ্বরবিদ্বেষীতা। যা মানি না, তাই শুনলেই গায়ে জ্বালা ধরে কেন বুঝি না। বলা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না, শান্তিনিকেতনও এরকম একদল মানুষের ভিড় দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ বলতে প্রায় মূর্ছা যান, কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত চিন্তা, যে ঔপনিষদিক সুধা সঞ্জীবনীতে সিক্ত, সেই গ্রন্থটি তাদের কাছে ব্রাত্য। এদের রবীন্দ্র বিশ্লেষণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বুঝতেন কিনা জানি না। এদের আমি ভীষণ ভয় পাই। কারণ এরা অর্ধসত্যে ভর দিয়ে হাঁটেন। অর্ধসত্য, মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর। রবীন্দ্রনাথ বলছেন - আমার আঁধার ভালো... আলোরে যে লোপ ক’রে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।
স্বামীজির চর্চার মধ্যে তাই গভীরে গেলেই কয়েকটা সমন্বয়ের চূড়ান্ত চেষ্টা দেখি।


১) ধর্ম-বিজ্ঞানঃ

ধর্মঃ যা মানুষকে মানুষ হতে শেখাবে। বিশ্বাসে না, অনুভূতিতে। প্রতিটা ধর্ম থেকেই মহান মানুষের জন্ম হয়েছে। যা প্রমাণিত করে সেই ধর্মের সত্যতা। নিঃস্বার্থতা, করুণা, সত্যপরায়ণতা কোনো বিশেষ ধর্মের কুক্ষিগত সম্পত্তি না। তা সার্বজনীন ধর্মের অঙ্গ। “To be good and do good - that is the whole of religion”. উল্লেখ্য, ‘whole of religion’ বললেন, ‘part of’ না। এটাই সব।

বিজ্ঞান আমাদের বাহ্যিক জীবনকে সহজ করবে। বহিঃপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখাবে। এটা হল প্রয়োগশীল বিজ্ঞান। আর তাত্ত্বিক বিজ্ঞান আমাদের একের খোঁজ করাবে। যেমন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। সেটা কি আপেলের সাথে পড়েছিল? না, তা নিউটনের মস্তিস্ক মন্থনজাত। সব সত্য আমাদের অন্তরে। বাইরে থেকে একটা উদ্দীপন লাগে। যেটা আপেল ছিল।
এখানে স্বামীজির আরেকটা অল্প আলোচিত দিকের আমি উল্লেখ করতে চাই মাত্র। তাঁর মনোবিজ্ঞানের উপর শ্রদ্ধা ও বিশ্লেষণের গভীরতা। পরবর্তীকালে ফ্রয়েড, কার্ল জুঙ পড়তে গিয়ে দেখেছি, ওঁর লেখায় এর আভাস স্পষ্ট। অবচেতন মন সম্পর্কে বলছেন, তুমি যা করো, যা ভাবো তাই একটা দাগ হিসাবে মনের তলানীতে থেকে যায়, চিরকালের হয়ে। তাই তোমার অবচেতন তৈরী করে। তোমার প্রবণতার দিক নির্দেশ করে। তাই আজকের অভ্যাসই কালকের স্বভাব তৈরী করে। অচেতন স্তরকে না পরিস্কার করে তুমি চেতনকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারো না। এই তত্ত্বটাই ফ্রয়েডের মূল তত্ত্বগুলির একটি - repression. এ নিয়ে আলোচনা পরে করা যাবে যদি সম্ভব হয় কখনো।


২) প্রাচ্য-পাশ্চাত্যঃ

প্রাচ্য দেবে দর্শন। গভীর জীবনবোধ। পাশ্চাত্য দেবে বিজ্ঞান, প্রয়োগকৌশল।
আজ তাই সত্যি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, শ্রীঅরবিন্দ, রমণ মহর্ষি, দলাই লামা সেই বার্তাই পৌঁছেছেন। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে আর্ণল্ড টয়েনবির মত পাশ্চাত্য মনীষীদের কণ্ঠেও বেজেছে একই সুর।


৩) ভারতের অতীত ও বর্তমানঃ

অতীতে সব ভাল ছিল - ভুল। অতীতে সব খারাপ ছিল - ভুল। অতীতের থেকে অনেক শিখবার আছে। সে মননের গভীরতা, সমাজের জন্য দায়বদ্ধতা, মহৎ জীবনের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগ। এ সব শিক্ষা। সর্বোপরি অন্তর্দৃষ্টি সম্বলিত জীবনযাপন অভ্যাস।
বর্তমানের দিকে তাকিয়ে শিখতে হবে আরো বেশি যুক্তিপরায়ণতা। ধর্মের আড়ম্বর যাক। পুরুত যাক। আসুক সেবা। আসুক শৌখিনতা। বিলাসিতা। সব্বাইকে ‘ত্যাগীশ্বর’ হওয়ার দরকার নেই। বিলাসিতা আসলে জীবিকার প্রকার বাড়বে। কাজ বাড়বে। দারিদ্রতা কমবে।
শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগমুখী হোক, তাত্ত্বিকতা শিক্ষার পাশাপাশি। মেয়েদের শিক্ষা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তবে তা পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে না, তা হোক তাদের নিজেদের স্বাধীনতায়।


৪) গৃহী-ত্যাগীঃ

একজন সামলাক ছোট সংসার। আরেকজন ধরুক বড় সংসারের হাল। তবে মনে রাখতে হবে, সমাজের মূল থাকে গৃহীর হাতে। সুস্থ, সৎ গৃহীজীবনই জন্ম দিতে পারে খাঁটি সন্ন্যাসীর।


৫) অন্তর্জগত-বহির্জগতঃ

তুমি জগতের পরিবর্তন করবে, এ মোহে থেকো না। জগতে সুখদুঃখের পরিমাণ সমান। একটা বাড়লে আরেকটাও বাড়বে। তবে কি জগতের হিতসাধন করবে না। করবে, তবে তা নিজের চিত্তবিকাশের জন্য। "আয় বেচারা তোর উপকার করি বলে না"। তুমি কৃতজ্ঞ থাকো, কেউ তোমায় তার সেবা করার সুযোগ দিচ্ছে বলে। সে তোমায় তোমার চিত্তের বিকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে।


আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে আমি কয়েকটা দিকের ইঙ্গিত করলাম মাত্র। স্বামীজি অনন্তের সন্তান। সেখানে সীমা টানা যায় না। শুধু বলি, সে মহাপ্রাণ আমাদের ঘুম ভাঙাক। আমাদের জন্ম-মৃত্যুকে অর্থবহ করে তুলুক - এই প্রার্থনা।

534
Sun, 01/10/2016 - 20:00

চার্লস ডারউইন। তাঁর বিখ্যাত তত্ত্ব - অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। অন্তঃপ্রজাতি, আন্তঃপ্রজাতি এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে। শেষের দুটো নিয়ে কিছু ভাবছি না। বিজ্ঞান সে পথে প্রভুত শক্তিশালী, আমাদের সুরক্ষা-প্রাচীর। যদিও নিশ্ছিদ্র নয়। তবে সে আলোচনা থাক। আমার ভাবনার পরিধি অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম অবধি। ইতিহাসে পড়লাম মানুষ নিরাপদে বাঁচার জন্য একসাথে থাকা আরম্ভ করল। শুরু হল সভ্যতার প্রথম ধাপে পা দেওয়া। বেশ। মানুষ প্রথম কবে বুঝল সে নিজের প্রজাতির থেকেও নিরাপদ নয়? ক্ষতি আসতে পারে, আঘাত আসতে পারে সেখান থেকেও? অর্থাৎ, প্রথম কবে সে উপলব্ধি করল - অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম? সে বুঝল তার তীর-ধনুক, পাথর, লোহা ইত্যাদির লক্ষ্য শুধুমাত্র বন্য হিংস্র জীব না, মানুষও। কবে তার অভিধানে প্রথম 'অসভ্য' কথাটা যোগ হল? কোনো ঐতিহাসিক জানেন না। তবে সভ্যতার উন্মেষের সাথে সাথেই মানুষ বুঝল, এবার তাকে আরেকটা সংগ্রামের জন্য তৈরী হতে হবে। সে বুঝল প্রকৃতি তাকে শিং, বিষদাঁত, বিষনখ ইত্যাদি কিছুই দিয়ে পাঠায়নি, দিয়েছে বোধশক্তি। যার একদিকে যুক্তি আরেকদিকে অনুভূতি। সে বুঝল একসাথে থাকার বিরুদ্ধে যে প্রবৃত্তি, তার বিরুদ্ধে একটা শক্তিকে দলবদ্ধ করতে হবে। তৈরী হল সমাজনীতি। আসল সুর - অসুরের দ্বন্দ্ব। শুভ বুদ্ধি বনাম অশুভ বুদ্ধি। সমাজনীতি। ক্ষুধা, যৌনতা, নিরাপত্তা - এই তিন প্রধান প্রবৃত্তি এর মূলভিত্তি। এগুলোর তোষণকে সে নিশ্চিত করতে চাইল। কাজটা এত সরল নয়। মানুষের প্রবৃত্তি ধারাবাহিক পথে চলে না। তার অনেক স্তর। অনেক ব্যাপ্তি। অনেক চোরাগোপ্তা খুপরি। তৈরী হল ধর্মনীতি। কথা হল, সমাজনীতি বাঁধবে বাইরে থেকে, ধর্মনীতি বাঁধবে ভিতর থেকে। গতিপথ তৈরী হবে। মুলধারার সাথে জন্মাল শাখা-প্রশাখা। তৈরী হল আইন। জন্ম নিল আইন রক্ষাকর্তা। সে যুগে রাজা থেকে এ যুগে মন্ত্রী। প্রয়োজন এক, প্রকার আলাদা।

এ হল ইতিহাস। অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম ও নীতির উদ্ভবের ইতিহাস। সে ধর্মনীতি হোক চাই রাজনীতি। এই নীতি শব্দটার কেন্দ্রে আরেকটা শব্দ আছে, সদর্থে। তা হল কৌশল। তাই Honesty is the best Policy হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ কৌশল। আমাদের এই উত্তরাধুনিক যুগে, দেহের আঘাত থেকে কৌশলের আঘাত তীব্র। এখন নীতিতে নীতিতে টক্কর। এক কৌশলের কাছে আরেক কৌশলের হার মানা। নতুন শব্দ - কূটনীতি। অর্থাৎ চোরাস্রোতে এক কৌশলকে আরেক কৌশলের ছদ্মবেশে হত্যা করা। কূটনীতি হল কৌশলের ডুবোজাহাজ।  কপটতা, মিথ্যাচরণ - এই কৌশলেরই দুর্বল সংস্করণ। যে ব্যবহার করছে সেও সেই অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রামেই বাঁচতে চাইছে। কিন্তু পথটা সাময়িক বেছেছে। সে জানে তাকে এক্ষুণি কিছু একটা করে এ সংগ্রামে জিততে হবে, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু মুশকিল হল - "স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে"। তাই এ কৌশল টিকল না। তবে? মূলসুর যেখানে সাথ না দেয়, সেখানে বাকি কোনো সুর ধোপে টিকবে না। কোনটা সে মূলসুর? সমাজ - সভ্যতা। একসাথে থাকার আদিম প্রবৃত্তি। অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম তো মন্থনজাত বিষ। সে বাদীসুর হিসাবে নেই। সে সমবাদী। তাই যে সমাজই, যে সভ্যতাই সেই সুরটাকে মুল ভেবেছে, সেই মিথ্যা-কপটতা-লড়াইয়ে শেষ হয়ে গেছে। এতএব মূলসুর - "একসূত্রে বাঁধিয়াছি "

আবার ডারউইনে ফিরি। তিনি বলছেন, এই সংগ্রামের ফলে একটা পরিবর্তন আসে। তা যদি সাংগঠনিক হয় তবে টিকল, নয়তো অবলুপ্ত হল। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গর ক্ষেত্রে এ বলা খুব কঠিন কোন অঙ্গ থাকবে কোন অঙ্গ থাকবে না। প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ এলো। অর্থাৎ প্রকৃতি ঠিক করবে। আমাদের চিত্তবৃত্তির ক্ষেত্রে এটি নির্ধারণ করা কঠিন না, অনুসরণ করা কঠিন। তবু তারও একটা ক্রমগতির পথ তৈরী হয়েছে। সেই বর্বর আদিম যুগ থেকে আজ অবধি সে ক্ষেত্রে পরিবর্তনের একটা খসড়া দেখা যাক।

সামাজিক নীতি : ----------------------------- ১)সেই নীতিই গ্রাহ্য যা মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে হস্তক্ষেপ করবে না, যতক্ষণ তা নিজের বা অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়।  ২) সেই সমাজনীতিই সার্থক যা আরো বেশি সহিষ্ণুতার অনুশীলন শেখায়, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। তা ধর্মীয় হোক, কি আচার- বিচার- সংস্কৃতি বিষয়ক হোক। যে যে সমাজ এ নীতি থেকে যত যত দূরে, সেখানে ক্ষোভ, গৃহযুদ্ধ তত তত ব্যাপক, অনেক গভীর পর্যন্ত্য বিস্তৃত।

ধর্মনীতিঃ --------------- আগের ক্ষুদ্র বোধ থেকে সে পরিবর্তনের মাধ্যমে বিশ্ববোধে এসে পৌঁছিয়েছে। বাইরের নানান দেবতা এসে মিলেছেন অন্তর্যামীরূপী অনন্তের অনুভূতিতে।  যতক্ষণ না আমি বিশ্বব্যাপী একত্ব অনুভব করছি, মৈত্রী অনুভব করছি চিত্তে ততক্ষণ সব ধর্মমতই ভ্রান্ত। বুড়োদের ছেলেখেলা। যার বলিদান আজও ঘটে চলেছে।  যে ধর্মের সাথে মুক্ত দর্শন বোধ নেই, সে চিরটাকাল এ বিশ্বের জন্য সামাজিক বোধের জন্য ভয়াবহ। বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, সক্রেটিস এরা সেই পূর্ণাঙ্গভাবে বিকশিত মানুষের এক একটা নিদর্শন। অনুকরণে না, অনুসরণে এরাই ভবিষ্যতের কাণ্ডারী।

তবে অভিব্যক্তি শুধু অগ্রগামী না। মাঝেমধ্যে পশ্চাৎগামীও হয়ে ওঠে। একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করে - এ উদাহরণ ইতিহাসের পাতায় ভুরিভুরি।  তবে শেষ কথা, তাই সত্য, যা - বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়।

535
Sun, 01/03/2016 - 20:00

খুব আলোচিত বিষয় - ধর্ষকদের ফাঁসি হওয়া উচিৎ কি না। আমি ভণিতা না করে সরাসরি আমার নিজের চিন্তা-ভাবনার নির্যাস বলি - উচিৎ।

মনুষ্যসমাজে তিন ধরণের মানুষ দেখা যায় প্রধানত রুচির দিক দিয়ে।

নর। নরোত্তম। নরাধম।

নর - যে সাধারণ দোষ-গুণ মিলিয়ে মানুষ। তার কোনোটাই তীব্র না বা উৎকট না।
নরোত্তম - যে গুণাবলীতে নরের অনেক ঊর্দ্ধে। তাঁরা প্রাতঃস্মরণীয়।
নরাধম - যে দোষে নরের চাইতে নীচে বা অনেক নীচে।

প্রতিটা মানুষের দুটো জীবন - ব্যক্তিগত ও সমাজগত। অর্থাৎ দুটো মানুষ - ব্যক্তি আর সমষ্টি।

কথা হচ্ছে নরাধমদের নিয়ে। তাদের প্রাণহানিমূলক শাস্তির দরকার আছে কি নেই।
আছে। অপরাধ যখন এমন মাত্রায় এসে পৌঁছাচ্ছে যাকে স্মরণ করলে গা শিহরিত হয়ে উঠছে - সেক্ষেত্রে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া বাধ্যতামূলক।
ক্ষমা খুব বড় মাপের গুণ। তা ব্যক্তিসত্ত্বায় আসুক ক্ষতি নেই। পৃথিবীর যে কোনো মহৎগুণ ব্যক্তিগতই হয়ে থাকে, সমষ্টির না। সমষ্টির হাল ধরে আইন। যদি মৃত্যুদণ্ড না বিবেচ্য হয়, তবে যত মহাপুরুষদের নামে পূজাস্থল, মহিমাজ্ঞাপনের স্থল, শ্রদ্ধা জানাবার স্থান আছে - সব ভেঙে দেওয়া হোক।
যে সমাজে নরাধমকে চরম শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই, সেই সমাজে চরম শ্রদ্ধাজ্ঞাপনেরও অধিকার থাকা উচিৎ নয়। একদিকে এগোবো, আরেকদিকে চুপ করে হাত-পা গুটিয়ে থাকব, তা হতে পারে না। নির্ভয়া, দামিনী, কামুদিনীরা আমাদের বোন, সন্তান হতে কতক্ষণ? আপনি ব্যক্তিসত্ত্বায় যত মহৎ হোন হোন, নিশ্চই তা প্রশংসনীয়। কিন্তু সামাজিকভাবে তা হতে পারে না। সেখানে বিবেকের থেকে ভয়ের প্রভাব বেশি।
সমাজ মানুষের বিবেক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে - এ কোনোদিন সম্ভব না। কারণ এই তিন প্রকারের মানুষ সব সমাজে সবসময় থাকবে।
পূজা যদি হয় জিন্দাবাদ, জয়ের সূচক নরোত্তমের জন্য, তবে নরাধমের জন্য মুর্দাবাদ। একটা থাকলে আরেকটাকেও থাকতেই হবে।
অনেকে বলছেন, পুরুষত্বহীণকরণ। আমার মনে হয় না। তাতে তার অপরাধপ্রবণতা আরো বাড়বে। কারণ ক্ষুধার্তের হিংসার আক্রোশ আরো তীব্র, আরো ভয়াবহ।

অতএব আর এ বিষয়ে আমার কোনো সংশয় নেই, চরম শাস্তিই হোক। কয়েকটা বিক্ষিপ্ত না, এটাই হোক একমাত্র শাস্তি।

তাতে কি মেয়েটা ফিরে আসবে?
এ প্রশ্নটা আবার ব্যক্তিগতস্তরের। আমাদের প্রধান ও প্রথম দায়বদ্ধতা সমাজের প্রতি। যদি সমাজ সুস্থ থাকে তো আমি সুস্থ, আমার ভবিষ্যৎপ্রজন্ম সুস্থ। যদি ময়লা জমছে তবে নির্মমভাবে তা উৎখাত করতে হবে। করতেই হবে। যতদিন না হয়, সব মহাপুরুষদের পূজা, জন্মদিনে ছুটি দেওয়া বন্ধ হোক।


(ছবিঃ সুমন)

536
Sat, 12/19/2015 - 10:46


একটা কয়েন পড়ল মাটিতে। আমার কানে শব্দ আসল। মনে চমক দিল, আমি ফিরে তাকালাম।  

একটা গভীর শোক পেলাম। মন তার সাজানো, গোছানো ধ্যান-ধারণায় আঘাত পেল। আমার বোধ আরো গভীর হল। জলের উপরের স্তরের ঢেউ ছেড়ে আমি মাটির সন্ধানে ডুব দিলাম। আমার বিশ্বাস - এ সমস্ত চলমান, ঘটমান, পরিবর্তনশীল সব কিছুর পিছনে কিছু একটা আছে যা স্থির, যা অপরিবর্তনশীল। তা না হলে, এত পরিবর্তনের মূলসুরটুকু কে বেঁধে রাখছে, তাল তো কাটছে না। 

এই কয়েন, এই শোক, এরাই হলেন গুরু - যিনি অন্ধকার দূর করেন। অজ্ঞানতার অন্ধকার, জড়তার অন্ধকার। যা কিছু আমার চেতনাকে নাড়া দেয়, ধাক্কা দেয়, ভাবিয়ে তোলে - তাই আমার গুরু। গুরু শব্দটা পুরোনো হলেও তার অর্থটা পুরোনো হয় না কোনোদিন।

যদি খেয়াল করি, এই জাগিয়ে দেওয়ার ঘটনাটাকেই যদি মূল লাভ বলে মনে করি, তবে শোকের, ক্ষতিরও একট অর্থ পাই। আমার সাথে কেউ একজন বিশ্বাসঘাতকতা করল। আমি গভীর যন্ত্রণা পেলাম। খুব সত্যি কথা। কিন্তু একটু শান্ত হয়ে ভাবলে দেখি, আমি জাগলামও তো বটে। একটা গভীর নাড়া আমায় আরেকটা সত্যির সাথে পরিচয় তো করালো। আমি জেগে যা দেখি, তা সত্য। ঘুমিয়ে যা দেখি, তা স্বপ্ন। যা সত্য, তাকে স্বীকার করার চেয়ে, মনুষ্যত্বের মহত্ব তো আর কোথাও অনুভব করার জায়গা দেখি না।

সারাদিন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে বিনা মেঘে বাজ পড়ার মত চমক প্রতিদিনই পাই। তার থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, মুখ ফিরিয়ে থাকলে ঘুমটা দীর্ঘ হয় সত্য, কিন্তু জেগে ওঠার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করি। ঘুমের সুখের সাথে দুঃস্বপ্নের ভয় আছে, কিন্তু জেগে ওঠার আনন্দের সে ভয় নেই। কারণ আনন্দ আর ভয়ের সাপে নেউলে সম্পর্ক। ভয়কে জয় করেই আনন্দের প্রকাশ। তাকে এড়িয়ে গিয়ে নয়। তাই আমাদের শাস্ত্রে 'অভীঃ' বা ভয়হীনতার কথা ঘোষিত হয়েছে। তা দুঃসাহসে ভর করে না, কারণ দুঃসাহসিকতারও একটা গৌরব অর্জনের লোভ আছে, আনন্দের সে বালাই নাই।

প্রতিদিনের আমার চেতনাকে এভাবে জাগিয়ে তোলার মুহুর্মুহু আয়োজনে আমি মুগ্ধ। এ জগৎ থেকে কিছু নেওয়ার জন্য না, জাগবার জন্য এসেছিলাম। বীজ যেমন মাটি ফুঁড়ে নীলাকাশে মাথা তুলে দাঁড়ায়, সে কি পাওয়ার জন্য? না, নিজেকে প্রকাশ করার জন্য। আমার জীবনটাও তাই। তার একদিকে ভরে ওঠে, আরেকদিকে হারিয়ে যায়। কিন্তু এই ভরা - হারানোর খেলার মধ্যে সে 'হয়ে ওঠে'। নিজের মধ্যে নিজেকে আবিস্কার করে। সেই আবিস্কারের কিছু অভিজ্ঞতা গানে, কবিতায়, ছবিতে রেখে যাওয়ার চেষ্টা করে। তা যেন দীর্ঘ পথের ধারে ধারে অগ্রগতির পথচিহ্ন। আমার চেতনার অভিব্যক্তির সুর। এ আমার মানুষ হয়ে জন্মানোর দায় - গুরুকে স্বীকার করে, তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে নয়।

537
Sun, 12/06/2015 - 10:27

দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার - অতি প্রাচীন কথা। কর্মক্ষেত্রে, শাসককূলে, ধর্মে, সমাজে, জাতিভেদে ইত্যাদিতে এর উদাহরণ ভুরিভুরি। সেগুলোর একটা যথাযথ কারণ আছে। অত্যাচারটা সমর্থনযোগ্য তা বলছি না। কেউ হয়তো শারীরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি ভাবে পিছিয়ে আছে। তাই সে নরম মাটিতে বলশালী প্রতাপ ফলিয়ে শুরু করেছে অত্যাচার। তবু সেরকম হলে তার উঠে দাঁড়াবার এবং অত্যাচারের প্রতিবাদ করার সুযোগ আছে ভবিষ্যতে।

তবে সবচাইতে কাপুরুষোচিত অত্যাচার হল, যখন দেখি কেউ বুঝে গেছে, 'এ মানুষটা আমায় ভালোবেসে দুর্বল, এখন যেরকম খুশী ব্যবহার করো না কেন, সে তো আর ছেড়ে যাবে না!' 
সেই দুর্বল মানুষটাকে যদি বলি, তুমি যাও কেন মিথ্যা ওর কাছে?
সে অসহায়ের মত চেয়ে থাকে।
যদি বলি, তুমি দুটো কথা শোনাতে পারো না?
সে আমতা আমতা করে উল্টে তারই হয়তো অযৌক্তিক সাফাই গাইবার ব্যর্থ চেষ্টা করে।
যদি বলি, অমন ভালোবাসার দরকার নেই।
কথাটা নিজেরই কানে বাজে। দরকার বুঝে কে আর কবে ভালোবাসল!

তাই এর কোনো যথার্থ প্রতিকারের পথ আমি দেখতে পাই না। এক যতক্ষণ না সে বুঝতে পারে, তার নিজের ভালোবাসার সম্মান রক্ষার্থেই তাকে মানুষটার থেকে দূরত্ব রাখতে হবে। তাতেই উভয়পক্ষের মঙ্গল। তবে এ বোধকে বুঝলেও, বাস্তবায়িত করতে খুব কম মানুষকেই দেখেছি। কিছুটা পরিস্থিতি, কিছুটা তার আত্মবিশ্বাসের অভাব। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঈশ্বর, ভাগ্য ইত্যাদির দোহাই দিয়ে নিজের অসহায়কর অবস্থাকে আরো চোরাবালির দিকে ঠেলে দিয়ে, একটা নিশ্চিত, জড়প্রায় মরণের দিকে নিজেকে নিয়ে যায়।

তবু বলব সেটা কাঙ্খিত পরিণতি না। হতে পারে না। একজন এমন ভালোবাসা বাসল যার পরিণতি স্বরূপ নিজেকেই ভালবাসতে সংশয় জন্মালো - সেটা ভালবাসা না। হতে পারে না। সে মোহ। আর মোহকে ভালবাসলেও সে মোহই থেকে যায়। এটা বুঝতেই হবে। মোহকে মোহ বলেই জানতে হবে। আর প্রেমকে প্রেম বলে চাইতে হবে। প্রেম আমায় ছোটো করে না। আমার মানুষ হয়ে বাঁচার অনুভূতিকে মেরে আমার বুকে প্রেতনৃত্য করে না। সে আমায় বাঁচার গৌরব দেয়, মর্যাদা দেয়। সে মান রাখার দায়িত্ব আমার। পিতলের বাটিকে সোনা ভাবলে, সে দায় পিতলের বাটির না। আমার। এ ভুল যত তাড়াতাড়ি ভাঙে মঙ্গল। তাতে আকাশ ভাঙা দুঃখ থাকুক। পাতালে ডোবা অন্ধকারের চেয়ে। সয়ে নেব। তবু তাই চাই।

ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে ওরে পাখি,
   যা উড়ে যা উড়ে যা রে একাকী॥
বাজবে তোর পায়ে সেই বন্ধ, পাখাতে পাবি আনন্দ,
   দিশাহারা মেঘ যে গেল ডাকি॥
নির্মল দুঃখ যে সেই তো মুক্তি নির্মল শূন্যের প্রেমে—
আত্মবিড়ম্বনা দারুণ লজ্জা, নিঃশেষে যাক সে থেমে।
দুরাশায় যে মরাবাঁচায় এত দিন ছিলি তোর খাঁচায়,
             ধুলিতলে তারে যাবি রাখি॥

(এ গান গুরুদেবের ছাড়া আর কার হতে পারে! শুনে নেওয়ার অনুরোধ রাখি)

(ছবিঃ সুমন)

538
Fri, 11/27/2015 - 20:30

হাসিতে রঙ করা মুখগুলোর পিছনে ঘন জঙ্গলের অন্ধকার। 

অন্ধকারগুলোর গন্ধ খুব চেনা। ফিসফিস শব্দ আসে। স্পষ্ট না। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস। কোনো রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ। ফোঁপানো কান্না। চাপা আর্তনাদ। এদিক ওদিক থেকে উঁকি দেয় তীক্ষ্ম রক্তচক্ষু, তাতে খোদাই করা প্রতিহিংসার নেশা। 

এই ঘন জঙ্গল দাপিয়ে বেড়ায় এক রাজা। অন্ধকারের রাজা। সে নিয়ম মানে না, শাসন মানে না। সভ্যতার উপর তার তীব্র ঘৃণা। সংযম তার কাছে ভণ্ডামী। 

তার সাথে দেখা হয় চলতে ফিরতে। আক্রোশের সাথে সে রাজপথে নাবার তোরণ খুলে দিতে বলে। তার কি প্রচণ্ড অস্থিরতা! কি পাগলামী তার দুটো বিস্ফারিত চোখে!

উপেক্ষা করে, চাপা দিয়ে, শিকল পরিয়ে তাকে আড়াল করে 'সাদা আমি'কে আবার বাইরে টাঙিয়ে রাখতে হয়। হাসতে হয়। কখনো অট্টহাসি, কখনো মৃদু।

তবে মাঝেমাঝেই সে জঙ্গলের থেকে কোনো বন্যপশু আচমকা ঢুকে পড়ে সভ্য ব্যবহারের সীমানা ডিঙিয়ে। মাংসাশী পাখির আঁচড় লাগে সুন্দর করে কাটা নখে। শেখানো বিদ্যা উড়ে যায় বর্বরতার ধূলোঝড়ে।

সে আদিমকে শিকল পরানো যায়, ঝিমিয়ে রাখা যায়। মেরে ফেলা যায় না। তার অস্তিত্বের ভিতেই এ প্রকান্ড অর্ধসত্যের সাজ চারদিকে। অভ্যাস যে দূর্গ বানাতে পারে অভিনয় তা পারে কি? পারে না। তাই প্রকাশ্যে সে অন্ধকারের রাজার নামে ফতোয়া জারি করে, গোপনে তাকেই যদি 'আত্মরক্ষা' ইত্যাদির দোহাই দিয়ে লালন করি, সাজানো প্রাসাদে ভূমিকম্প তো আসবেই। মাটির তলায় পশুর বাস যে!

আর যার ভাঙার নেশা, সে শুধুই ভাঙে। অন্যের প্রাসাদ ভাঙা শেষ হলে আমার প্রাসাদে চড়ে বসবে। দোহাই তাকে নীতি বুঝিও না। সে বোঝে না। ইতিহাস সাক্ষী।


(ছবিঃ সুমন)

539
Tue, 11/10/2015 - 20:00


অন্ধকার। মহানিশা। কালীপূজোর রাত। শাস্ত্রর কথা থাক। পুরাণে, তন্ত্রে, বেদে কি লেখে সে কথা থাক। আজ মনকে অন্ধকারের সামনে দাঁড় করানোর কথা।

আমি অন্ধকারকে জানি না। তাই সে অন্ধকার? হয় তো বা। অন্ধকারকে না চিনলেও তাকে এড়িয়ে চলার যো নেই। সে অন্ধকার আমার খাটের নীচের হোক কি মহাকালের। সে আছেই। তার সাথে আমার সম্পর্ক ভয় আর কৌতুহলের। কতটা ভয় আর কতটা কৌতুহল জানি না। তবে একটা আরেকটাকে ছেড়ে থাকতে পারে না, এ বেশ বুঝি। কৌতুহলের সাথে ভয়ের মাত্রা যদি কিঞ্চিৎ অধিক করা যায় তবে তাকে আডভেঞ্চার গোত্রে ফেলা যেতে পারে। সে আলোচনা থাক।

কথা হচ্ছিল অন্ধকারকে নিয়ে। অন্ধকারের আকর্ষণ আছে? আছে। তবে সে ঘরসংসার পাতা সুখী গৃহস্থের না। সে আকর্ষণ অভিসারের আকর্ষণ। যেন অন্ধকারের পারে আছে আমার চিরকাঙ্খিত আলোর শিখা। আমাকে সেখানে যেতেই হবে। তবে আমার হাতের কাছে যে আলো? না তাকে চাই না। ঘরের কোণের প্রদীপকে নিভিয়ে ওই অন্ধকারের বুক চিরে আমার পথ। এ আলো ফাঁকি। এ আলো কুহকের মত। এতে না চেনা যায় নিজেকে, না পরকে। আমি সেই আলো চাই, যে আলোর কেন্দ্র আছে, পরিধি নেই।

সেই আলোকে পাওয়ার পথ কোথায়? ত্রিকালদর্শী আঙুল তুলে ইশারা করলেন অন্ধকারের দিকে। বুক ভর্তি অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। জন্মজন্মান্তরের অন্ধকার। বললাম, পেরোবো কি করে? ত্রিকালদর্শীর চোখ চকচক করে উঠল। দু'হাত তুলে বলে গেলেন, মাভৈঃ!

সে অন্ধকার জমল আরো গাঢ় হয়ে। ইশারায় ডাকল, আয়। বললাম, কে তুমি? সে অন্ধকার বললে, মা। আমি বললাম, মা কেন? সে অন্ধকার বললে, সৃষ্টির আদি রহস্যে ঘন অন্ধকার। কালের অন্ধকারে ঢাকা। আমি সেই অন্ধকার তাই। বললাম, যদি হারিয়ে যাই। সে অন্ধকার বলল, আরো অন্ধকারে যাবি। বললাম, তারপর? উত্তর আসল, অন্ধকার যত গাঢ় হবে, আলোর তৃষ্ণা তত গভীর হবে আরো। ক্রমে দেখবি, অরুণোদয়। বললাম, আলো ফুটবে? সেই আলোকে পাব? অন্ধকার বলল, হ্যাঁ। আমি বললাম, তুমি যাবে মিলিয়ে? অন্ধকার বললে, এ মহাকালের উষ্ণীশে ঢাকা যে আলো, সে আলো লালিত আমারই বক্ষে।

বললাম, সে আলোকে এখানে আনোনি কেন, সর্বজনসমক্ষে? উত্তর এলো, তবে সৃষ্টির মূল সুর হয় ব্যর্থ। সে আলোকে গ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জনের পন্থা এই আঁধারের পথ। এসো স্বীকার করো একে।

যদি না করি? তবে কালের গহনে যাবে পিষে। চুরমার হয়ে যাবে সব অস্তিত্ব। যেমন কালের গহনে গেছে বহু সভ্যতা, আলোকে করে অস্বীকার, মিথ্যা আলোর দর্পে। এ দেখো আমার কণ্ঠে, সে ছিন্নভিন্ন মস্তকের মালা।

আর এই যে স্তবস্তুতির আয়োজন? মিথ্যা খেলা। অন্ধকারকে সন্তুষ্ট করতে ভীরুর মিথ্যা আয়োজন।

ভক্তি মিথ্যা তবে? যে ভক্তি ভয়ের পায়ে অঞ্জলি দেয়, সে মিথ্যা। যে ভক্তি আগুনের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে বলে শীতল, সেই ভক্তি। সেই পায় অন্ধকারে আলোর পথ।

প্রণাম মিথ্যা তবে? মিথ্যা, যদি মিথ্যার পায় হয় প্রণত। কারণ, নতমস্তকে জাগে, সেই চরণের গুণ, যার পায়ে প্রণত সে।

কারণবারি? বলি? সংসারের মদিরা পানেও যদি পা না টলে, এসো।
বলির রক্ত যদি চিত্তের জড়ত্বের হয়, দাও।

মহানিশায় মহাকালের পথ দেখলাম। চিরকালের সুরে বাঁধা। বাণী একটাই, মাভৈঃ। ভয়কে করো জয়। অন্ধকারকে করো স্বীকার নির্ভয়ে। রাখো পা, মহাকালের আঙিনায়। চেনো নিজেকে, অনন্তে।

540
Wed, 10/28/2015 - 10:46

আমাদের ধর্মের সাথে উৎসবের খুব একটা মূলগত যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। ধর্মের কোনো একটা দিক একে অনুপ্রাণিত করে, এতটাই সত্যি। এরপর বাকিটা আমরা আমাদের মত বানিয়ে নিই। 

    দেবতা যেদিন দেবালয় ছেড়ে প্যাণ্ডেলে এসে উঠলেন, সেদিন ধর্মের চেয়ে, উৎসবের চেয়ে আবেগটাই বড় হয়ে উঠল। উৎসব আর উৎসব রইল না। হল উন্মাদনা। আবেগ যখন সারথি তখন বুদ্ধি - বিবেচনা নিতান্তই বাহুল্য। সর্বজনীনতার অসর্বজনীনতা পাড়ায় পাড়ায়। আমার পূজো তোমার পূজো। দুটোই সর্বজনীন। কোন 'সর্ব' সে বিধাতাই জানেন। সে সর্বজনীনতা কতদূর সে অভিজ্ঞতাও সবারই কম বেশি আছে।
 
     রাস্তায় গর্ত, নদীর জল বিষাক্ত, দূষিত, কলুষিত। আওয়াজে, আলোতে, উচ্ছ্বাসে চারদিক হা রে রে রব। ত্রাহি ত্রাহি রব বুদ্ধি বিবেকের। কিন্তু কেউ শুনলে তো! আমাদের আমোদ চাই। পরিবেশের কথা পরিবেশবিদ ভাবুন। আমি পাড়ায় থাকি, ফ্ল্যাটে থাকি, ট্রেনে-বাসে-ট্যাক্সিতে চড়ি, অফিসে যাই - এর মধ্যে পরিবেশ কোথা থেকে আসে? গঙ্গার জল, অসুস্থ লোকের অসুবিধা, দীনের দুঃখ - এসব বইতে লেখো, আলোচনা করো, ফেসবুকে লেখো। বাস্তবে এসব ভাবতে গেলে সব মস্তির বারোটা বাজবে। পূজোতে কত মানুষের কত রুজিরোজগার বাড়ে সেটা একবার ভাবুন! 
 
      হক কথা। সুতরাং চলুক যেমন চলছে। 
 
     আমাদের সমাজনীতির একটা দিক আছে। এখানে পাঁচিল তোলা যত সোজা, পাঁচিল ভাঙা তত না। সেই আদি কাল থেকে চলে আসছে। অচ্ছুৎ প্রথা। কত প্রকার বিভেদ। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র তো ছিল তার সাথে তার কত সুক্ষ্ম প্রভেদ। সেই জাত ভেদটা খানিক উঠলেও, ভেদাভেদ করার অভ্যাসটা এত সহজে কি আর যায়! এত দলাদলি, এত 'আমরা -ওরা'র মাঝে 'সর্বজনীনতা' কথাটা কতটা আন্তরিক সে সন্দেহের। নাকি ওই শব্দটার বোধ নেই বলেই উচ্চারণটা এত বেশি তাই বা কে বলবে? আর এত ভাগাভাগির মধ্যে কোনো গঠনমূলক চিন্তা হয় কি? দলাদলি সস্তা প্রতিযোগিতার পথ তৈরী করে, সার্বিক উন্নয়নের পথ না। সবাই মিলে ভাবব যে, সে 'সবাইটা' কই? আর যেখানে 'সবাই' বোধের অভাব সেখানে সমাজ সচেতনতাটা জন্মাবে কি করে? 
 
      ক্ষুদ্র উদাহরণ। সপ্তমী অষ্টমী নবমীতে যে জলুস, যে আবেগ - বিজয়ার পর তা কোথায়? শুধু মেসেজই যথেষ্ট। আমার কাজ আছে না? ওসব সেকেলে প্রথা নিয়ে চললে হবে? ছাড়ো।
আর সর্বজনীন প্যাণ্ডেল? সে বস্তাবন্দী। পূজো কমিটি পরেরবার কাকে বাদ দেওয়া যায় আর কাকে রাখা যায় - এ মহাচিন্তায় ব্যস্ত। অগত্যা বাকি সচেতনতার সময় কই?

541
Sat, 10/10/2015 - 18:26

মন আর শরীর। এ দুটোই অস্তিত্ব। ভাগাভাগি করে নেই, বেশ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে।

     কিন্তু এই দুটোতেই তো পরিচয় শেষ হয় না আমার। পরিচয় হয় সম্পর্কের সূত্রে। সম্পর্ক মনের সাথে, শরীরের সাথে। শুধু আমার না, আমার চারপাশের সাথেও। শুধু জীবন না, জড়ের সাথেও। বিভিন্ন সম্পর্কের সূত্রে পরতে পরতে গড়ে ওঠে আমার এই পরিচয়।


   তবে ঠিক সেটা নিয়ে লিখব বলে ভাবিনি। বলতে চাই সম্পর্কশূন্যতার কথা। এমন অনেক সময় দেখেছি কোনো কোনো মানুষ কোনো সম্পর্কেই নিজেকে খুঁজে পাচ্ছেন না। নিজের মধ্যে খুব একটা নিবিড় যোগাযোগ অনুভব করছেন না কারোর সাথেই। হতে পারে বিশ্বাসঘাতকতা, গভীরভাবে অপমানিত হওয়া ইত্যাদি কিছু ঘটেছে অতীতে তাঁর জীবনে, অথবা তাঁর মানসিক গঠনটাই সেই রকম।

   যখনই কোনো মানুষ মনের সাথে সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়, দেখেছি তার মধ্যে একটা বিকারের আশঙ্কা তৈরী হয়। শরীর সক্রিয় হয় মনের চেয়ে বেশি। ক্রমশ সে অভ্যাস ব্যাধির আকার ধারণ করে। যাকে আমরা ইংরাজীতে perverted ব্যক্তি বলে থাকি। কেন ব্যর্থ হয় তার নানান কারণ থাকতে পারে। সেটা আগেই বলেছি।

   মনের সাথে মনের যে সম্পর্ক তা স্বাভাবিকভাবে সমাজের সাথে ভাবে সুস্থ রাখতে, যুক্ত রাখতে সাহায্য করে। নিজের মধ্যে নিজেকে সঙ্কুচিত করে না রেখে, অন্যের মনের মধ্যে মুক্তি পায়। পরিণত হয় তার জীবনবোধ দায়িত্ববোধের সাথে। অফিস কাছারির দায়িত্ব আর সম্পর্কের দায়িত্বের মধ্যে একটা বিস্তর ফাঁক আছে। দায়ের দায়িত্ব সমাধা করে মানুষ ছুটি খোঁজে, আর সম্পর্কের দায়িত্বের মধ্যে সে নিজের সার্থকতা খোঁজে। দ্বিতীয়টার অভাব মানুষের জীবনে যে রিক্ততা আনে, তা পূরণ করার মত ক্ষমতা সব মানুষের জন্য না। সে ক্ষমতা সৃষ্টিশীলতার ক্ষমতা। বহু মানুষ কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কে না গিয়ে কোনো একটি সাধনায় নিজেকে নিমজ্জিত করেছেন আজীবন - এরকম উদাহরণের অভাব নেই। কিন্তু তা সার্বজনীন হতে পারে না। সে ক্ষমতা, সে অধ্যবসায় বিধাতা সবার জন্য নির্দিষ্ট করেননি।

   তাই অন্যভাবে বললে হৃদয়বৃত্তির শূন্যতাই মানুষকে বিকারগ্রস্থ শারীরবৃত্তির বন্ধ্যা নিগড়ে বেঁধে ফেলে। সে একই আবর্তে ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে। শরীরের কোনো নীতি নেই, শপথ নেই। সে আদিম কাল থেকে একটাই শব্দ চেনে - সুখ। আগুনে হাত দিয়েছে, হাত পুড়িয়ে সরে এসেছে, খাদে পড়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, খাদের ধার থেকে সরে এসেছে। এরকমই তার স্বভাব। আগুনে তার ভয়, খাদে তার ভয়, ঝড়ে তার আতঙ্ক, মৃত্যু তার কাছে বিনাশ। সুখই তার একমাত্র চালনাশক্তি। তার দিশা। তার ধর্ম শুধুই ভোগ।

   অন্যদিকে মনের একটা নীতি আছে। ধর্মবোধ আছে। প্রেয়র থেকে শ্রেয় তার কাছে বেশি গৌরবের। শরীরের মত সে সুখে নিজেকে সার্থক ভাবে না। সে সার্থক বীরত্বে। মর্যাদায়। ভালবাসায়। সে আগুনকে বশে আনতে চায়, খাদের ধার ঘেঁষে হাঁটতে চায়। কারণ সে ভয়কে জয় করতে চায়। ভয়ের ওপর তার একটা ঘৃণা আছে। তার কাছে হেরে যেতে সে লজ্জাবোধ করে। শরীরের লজ্জাবোধ নেই, তার আছে। কারণ সে বুঝেছে, সবার সাথে এক হলেও কোথাও সে স্বতন্ত্র। এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে সে পরম বলে জানে। এর নাম সে দিয়েছে - ইচ্ছা। বাসনা না। শরীরের আছে বাসনা। চির অতৃপ্ত, আগুনের মত বাসনা। মন তার ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তাকে দমন করেছে। সভ্য হয়েছে। বুঝেছে শরীর তার চালনা শক্তি না। সে অন্ধ ঘোড়ার মত। তার চালনা শক্তি হল তার মধ্যের শুভ বোধ।

   এমনকি সে এ অসীম ব্রহ্মাণ্ডের সাথেও নিজের সম্পর্ক তৈরী করেছে। নাম দিয়েছে ঈশ্বর। সে সমাজ গড়েছে। শিখেছে নতুন একটা শব্দ - ত্যাগ। ঠিক সন্ন্যাসীর ত্যাগ না। বড়র ছোটোর জন্যে ত্যাগ। মানিয়ে নেওয়া। ছেড়ে দেওয়া। দুর্বলকে রক্ষা করা। নিজের মহত্বকে অনুভব করা। রূপ নিয়েছে ধর্ম।

   এই গতির বিপরীত যে গতি? যেখানে প্রেমশূন্যতা মরুভূমির মত হৃদয়কে দখল করে পড়ে আছে। সেখানেই দেখেছি বিকারগ্রস্ত কামের প্রেতনৃত্য। তার বিকৃত সুখের নানান ওজর।

   উপায় কি? ধর্মের বুলি না। সৎ উপদেশ না। তাকে নিজেকে একটা সম্পর্কের বাঁধনে বাঁধতে হবে। মনের সাথে। কাউকে অথবা কিছুকে নিজের মনের সবটুকু দিতে হবে। আবেগে না, প্রতিশ্রুতিতে। সেই বাঁধন চিরাচরিতভাবে বৈবাহিক না হলেও, বিবাহের মূল সুরটি তাতে বাজবেই বাজবে। বরং তথাকথিত বহু বিবাহেই দেখেছি বাইরের সানাই কেঁদে ফিরছে কৃত্রিম সাজসজ্জা ছেয়ে। প্রাণের সুর বোবা সেখানে - অনিচ্ছায়, বাধ্যতায়।

   তা না। তা চাই না। ভালবাসা আসুক শুষ্ক হৃদয়ে। সম্পর্ক গড়ে উঠুক। ঝড়-ঝাপটা থেকে দু'জনে রক্ষা করুক নিজেদের সম্পর্ককে। সেখানে কোনো আড়াল না থাকুক। তা হলে কোনো বাধাই কোনো সম্পর্কের বিনাশ ঘটাতে পারবে না। কারণ বিষবৃক্ষের বীজ বোনা হয় আড়ালে। আড়াল না থাকলে বিষ জমবে কোথায়? অন্ধকারে মজে বিষ, আলোতে জমে অমৃত।

542
Sun, 10/04/2015 - 18:36


আজকাল 'যোগ্যতা' নিয়ে আলোচনা খুব একটা দেখি না। আপনি কি যোগ্য? এ প্রশ্ন আত্ম-সম্মানে লেগে যাচ্ছে সরাসরি।
     'ইচ্ছা থাকলে মানুষ কি না পারে?' ... 'চেষ্টা করলেই সব হয়' .... 'ও করতে করতে শিখে যাবে' ..... 'জলে না নামলে কেউই সাঁতার শিখতে পারে না' ..... ইত্যাদি সব যুক্তির দোহাই-এ 'কারে দিলে রাজার পাঠ' হয়ে যাচ্ছে যে চারদিকে! যেমন কয়েকটি ঘটনাঃ


১) কেউ কেউ দু'চারখান শাস্ত্র পড়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাচ্ছেন, জগৎ ঈশ্বরশূন্য। সাধনা করে যে বস্তু উপলব্ধি করার, তা যুক্তির প্যাঁচে নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে। কাঁড়ি কাঁড়ি বই লিখে ফেলা হয়ে যাচ্ছে।
     অন্যদিকে কেউ কেউ কয়েকটা আদ্যিকালের লেখা কিছু কথাকে এমন সত্য বলে ধারণা করে বসছেন যে, কিছু 'উপলব্ধি' করার কোনো প্রয়াস তার আচরণে ব্রাত্য হয়ে পড়েছে। তার সারাদিনের কাজ- কে কে, কোথায় কোথায়, কি কি, কখন কখন তার সেই ছাপা অক্ষরগুলোর ভিন্ন অন্য কিছু ছাপিয়েছে বা বলেছে। খোঁজো তাকে, মারো তাকে।
     আরে ভাই, ক্ষমতার লোভ, দল গড়ার লোভ ইত্যাদি থাকুক, আপত্তি নেই। সরাসরি রাজনীতি করলেই হয়। ধর্মের নামে দল বেঁধে প্রচ্ছন্ন রাজনীতির কি দরকার?

২) এ তো গেল প্রথাগত প্রেক্ষাপটের কথা। শিক্ষকতার অবস্থাও দেখুন। একজন পরীক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি বিষয়টির তথ্য সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ব্যস। শুরু হল শিক্ষকতা, যেন 'জানার ক্ষমতা' আর 'জানানোর ক্ষমতায়' বিশেষ কোনো ফাঁক নেই। ফাঁক আছে বৈকি। আর সেই ফাঁকে আটকে, হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যারা শিখবে, না মুখস্থ করবে.... বড়লোক হবে, না বড়মানুষ হবে.... জীবিকার জন্য বাঁচবে, না বাঁচার জন্য জীবিকা নেবে... ঠাওর করতে না পেরে অথৈ জলে। কি করে পারবে? যিনি প্রদীপ ধরে পথ দেখাচ্ছেন, তিনি যে দীপের আলোর চাইতে তেলের হিসাব কষতে ব্যস্ত বেশি। তাই আলো কোন দিকে পড়ল না দেখে কতটা পড়ল তার হিসাবেই ব্যস্ত।

৩) এবার ব্যক্তিগত জীবনগুলোর দিকে তাকাই। সবাই বিশ্বাস করছেন, তিনি সব পেতে পারেন, সব করতে পারেন, চাইলেই। অন্তত বিজ্ঞাপনের দর্শন তাই দাবি করে।
     সে বলে, 'যেখানে দেখানোর কিছু নেই, সেখানটাকেই দেখানোর মত করে তোলা তো আমার কাজ!' মানুষকে একটার পর একটা ধাঁদায় ফেলো। যে ধাঁদাটা আজ অবধি কেউ নাগাল পায় নি, সেই ধাঁদাটার গোলে ফেলো। কি সেই ধাঁদা? 'সত্যিকারের ভালো থাকতে, আমার ঠিক কি কি, কখন কখন, কতটা লাগে'- এ ধাঁদা যে সমাধান করে ফেলেছে, তাকে পেড়ে ফেলা যায় না।
   তাই যারা সেটি পেরে গেছে তাদের 'লুজার' আখ্যা দিয়ে দাও। কারণ সে তোমার মত দৌড়ায় না, আঁচড়ায় না, পাগলের মত চাহিদাকে জাগিয়ে রাখতে পারে না। অসভ্যের মত ভাল থাকে। দিও না তাকে ভালো থাকতে, খোঁচাও।
    এর ফলস্বরূপ কি চূড়ান্ত বিষাদ, অস্থিরতার আবহাওয়া চারদিকে। কারণ আমি ভুলে যাচ্ছি যোগ্যতার ওপর ইচ্ছাশক্তি কাজ করে। ইচ্ছাশক্তি দিয়ে যোগ্যতাকে বাড়ানো যেতে পারে, বদলানো যেতে পারে না।

543
Thu, 09/24/2015 - 20:00

মনের গলি ঘুরছিলাম। নিজের সাথে, নেটের এ পাড়া ও পাড়া। কত কথা ছড়ানো ছেটানো। কত তথ্য। কত বাদ বিবাদ। মানুষের পরতে কতটা পোশাক লাগে, তার হিসাব আছে। খেতে কতটা চাল লাগে তাও মাপা যায়। কিন্তু বাঁচতে কতটা জ্ঞান লাগে - এ হিসাব করে ওঠা দায়। যদি জ্ঞানকে কাজের বস্তু ভাবি তবেই অবশ্য। কেউ যদি বলেন জানার আনন্দে জানতে চাইছি, তবে তার ক্ষেত্রে হিসাব নিকাশের বালাই নেই। যেমন কেউ যখন খাওয়ার আনন্দে খায়, কিম্বা সাজার আনন্দে পোশাক কেনে তারও যেমন হিসাব রাখা দায়। কতটা খাবে, কতটা জমাবে - কে বলতে পারে?
 
      তা হলে কথা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জ্ঞান কতটা লাগে? কি করে খেতে হয়, হাঁটতে হয়, কথা কইতে হয়, ইয়ে করতে হয় সেগুলো না হয় প্রকৃতি দায়িত্ব নিয়ে শিখিয়ে দেয়। বাকিগুলান? সেই সহজ পাঠ থেকে শুরু করে কঠিনের পর কঠিনতর পাঠ? তার তো কোনো ইতি নেই দেখছি।
 
      শখের পড়া, সার্টিফিকেট জমানোর পড়া, অর্থকরী উন্নতির পড়া, আরো কত পড়া... বাপ রে বাপ!
 
     এগুলো কি আমায় খুশী করছে? সত্যিকারের খুশী। খাঁটি নির্ভেজাল আনন্দ দিচ্ছে? না তো। এতো গলা টিপছে। কেউ বলবেন তবে কি মুখ্যু ঢেকি হয়ে থাকব নাকি? এই পড়লাম গোলে। কোনটা বেশি ভালো - গেঁয়ো মুখ্যু না পণ্ডিত মুখ্যু? আমায় হিসাব কষে বলেন দেখি, চারদিকে যা অনাচার, ভ্রষ্টামো, দূর্নীতি, তা কটা গেঁয়ো মুখ্যু করছে আর কটা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত মুখ্যু করছে? মুখ্যু মানুষগুলোকে ক্ষেপিয়ে তাতিয়ে মারাপিটি করতে কারা ভড়কাচ্ছে?
 
     গোড়ায় কি একখেন গলদ থেকে যাচ্ছে। ঠিক ধরতে পারছি না। কি যেন একটা শেখানো হচ্ছে না ওই বড় বড় বাড়িগুলানে - যাকে শিক্ষাক্ষেত্র বলে আর কি। কি বলেন তো? রবি ঠাকুর কিছুটা বুঝেছিলেন, তবে ওই বোঝাই সার। বোঝাতে পারেননি। আর পারবেনই বা কি করে? আমরা বুঝতে চাইলে তো!
 
     কথাটা হল মনুষ্যত্ব বলে একটা বিরাট আউট অফ সিলেবাস কোর্স আছে। ওটারে কব্জা করতে না পারলে বাকিগুলান বাচ্চার হাতে অ্যাটোম বোম হয়ে যায়। তাই হচ্ছেও। ফাটছেও যেখানে সেখানে।
 
     কোথায় করানো হয় সেই কোর্স? জানি না। বই কোথায় পাওয়া যায়? জানি না। তবে এটা জানি পরীক্ষার সেন্টার যখন তখন, যেখানে সেখানে পড়ে। টুকে পাস করার যো নেই। ইনভিজিলেটর বড্ড কাছে বসে। বুকের ধানাই পানাই ঘরটা ঘেঁষে। বড্ড কানপাতলা।
 
     এও শুনেছি সেই কোর্সটা করা থাকলে নাকি, বাকি কোর্সে ফেল করলেও কোথাও একটা পাস করা যায়। কিন্তু এই কোর্সে ফেল করলে, শেষে সব ওই এক বাদ দিয়ে শূন্য বসানো। তাতে যতই সংখ্যা বাড়ুক, মান বাড়ে না।

544
Wed, 09/23/2015 - 20:00

বাংলা দিনপঞ্জী অনুযায়ী এটা আশ্বিন। কিন্তু প্রকৃতির কি সে খেয়াল আছে? প্রকৃতির ক্যালেন্ডারের সাথে আমাদের ক্যালেন্ডার আর কবে মিলল?
 
      তাকে যতই বোঝাও, দেখো বাপু, আমাদের পূজোর কেনাকাটা আছে, প্যাণ্ডেল বাঁধার কাজ আছে, তাছাড়া আমাদের মাটির ঠাকুর - কাঁচা মাটিকে শুকিয়ে পাকা করতে হবে, তাতে রঙ করে তাও শুকাতে হবে... মেলা কাজ। তা এই সময় এমনধারা রঙ্গ করলে চলে? তাছাড়া তোমারও বাপু কাশফুল ফোটানোর বহর কিছু কম নয়, তার বেলা? 
 
     এ কিরকম এক মুখে দুই কথা হয়ে গেল না? একদিকে কাশফুল ফোটাচ্ছ, আকাশকে এমন নীলে ছোপাচ্ছ যে চোখ ফেরানো দায়, বাতাসেও তো শরতের গন্ধ মাখিয়েছিলে মনে হচ্ছিল... তারপর হঠাৎ কি হল? শ্রাবণের সাথে কি শরতের মুখোমুখি মোকাবিলা দেখতে চাও? শরৎ বেচারী তোমার শান্ত স্নিগ্ধ, কোমল রসে টইটুম্বুর, কিন্তু তোমার শ্রাবণ? সে তো মত্ত দামাল! পারে এ বেচারী ওর সাথে! তাই দিয়েছে নিজের সাজানো খেলাঘর ওর হাতে ছেড়ে। শ্রাবণ দিচ্ছেও সব লণ্ডভণ্ড করে ইচ্ছামত। তুমি নিষ্ঠুর উদাসীনের মত দেখছ। জানোই তো কি হবে শেষে!
 
    আমাদের সংসারেও কি এরকম অনাহুত বিপত্তির উদাহরণ কম? দেখছো না, পৃথিবীর পশ্চিমপ্রান্তে কাতারে কাতারে মানুষ আজও নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে, প্রাণপণে দুগ্ধপোষ্য শিশুটাকেও কোলে করে এ দেশ ও দেশের দরজায় করাঘাত করে ফিরছে - শুধু বাঁচবে বলে? কেউ সাড়া দিচ্ছে, কেউ নিষ্ঠুর হাতে ফিরিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের পাড়ে ভাসছে শিশুর প্রাণহীন শরীর। সে হয়তো তার আগের মুহুর্তেও এটাকে খেলাই ভেবেছিল?
 
     হয় হয়, এরকম বারবার হয়। সাজানো গোছানো সংসারে আচমকাই এইভাবে রুদ্র এসে দাঁড়ায়। ঠেকাবে কি করে? এ যে মহাকালের খেলা; যাকে মহাপুরুষেরা বলেন লীলা - সে সৃষ্টিরই হোক, কি ধ্বংসেরই।

545
Mon, 09/07/2015 - 19:12

"এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যার ওপর রবীন্দ্রনাথের কোনো গান বা কবিতা পাওয়া যায় না।"

     এ কথা আমিও আগে বিশ্বাস করতাম। বিশেষ করে গানের ক্ষেত্রে এ উক্তিটিকে ধ্রুবসত্য বলে জানতাম।

     আজ মনে করি না। আজ সে কথা কেউ বললে ভাবি, হয় আপনি পুরো গীতবিতানের পথ হাঁটেননি, নতুবা মানুষটাকে বোঝেননি। অহংকারীর মত শোনালো?

     আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোঝা বলছি না। তবে তা অহংপ্রসূত হত। আমি বলছি, যে বোঝার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বোধের আকারে দিয়েছেন - সেই বোঝার কথা। তথ্যের বোঝা না।

      একটা গাছের যতটুকু প্রকাশিত, তার অনেকখানি মাটির নীচে অপ্রকাশিত থাকে। সেখানে সে নীরব, একা। আমি খানিকটা সেই রবীন্দ্রনাথের কথা বলছি। নীরব রবীন্দ্রনাথের কথা। মহাশূন্যে, মহাকালের নিরিখে ব্রহ্মচিন্তা মগ্ন রবীন্দ্রনাথ শুধু নন। মানুষের সংসারের আঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষুদ্রতা, নৃশংসতার - নীরব সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ। গীতবিতানের দুটো পরপর গানের মধ্যে যে ফাঁক, দুটো কবিতার মধ্যে যে শূন্যতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প - সবকিছুর মধ্যে এক নীরব রবীন্দ্রনাথ আছেন। তা অধরা। তবু অনুমেয়। 

       আমার খুব মনে হয় কোনো মানুষের নীরবতার কাছে না পৌঁছালে, সে মানুষটাকে সম্পূর্ণ স্পর্শ করা যায় না। সে পৌঁছানোর উপায় কি? উপায় তাঁর প্রকাশিত রূপের অভ্যন্তরে ডুব দেওয়া। যেমন কোনো কিছু লিখতে গেলে দুটো শব্দ, বা দুটো বাক্যের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ ফাঁক রাখতে হয়, তেমন কোনো মানুষকে প্রাণের আলোয় অনুভব করতে গেলে তার বলার মধ্যে, না-বলাকে বুঝতে হয়। তবে সেই পূর্ণতাকে অনুভব করা যায় বলে আমার বিশ্বাস।

      তবে কি সব পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ নেই? আছেন। আমার শোকস্তব্ধ নীরবতায় তিনি আমার পাশে আছেন নীরব হয়েই। চেতনার বৃত্তি শুধু প্রকাশেই না, অপ্রকাশে সমাহিত থেকেও। রবীন্দ্রনাথের এই দুই-এর প্রকাশ যদি না আসে আমার চেতনায়, তবে আমি নিজেকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলাম। সে বড় ক্ষতি। সে ক্ষতির ভার আমার মত দৈন্য প্রাণ বহন করবে কি করে?

546
Wed, 09/02/2015 - 11:26

আত্ম-প্রচার ও আত্ম-প্রকাশের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আছে।

প্রথমটা, আলো নিজের মুখে ফেলে বাজারে ঘুরে বেড়ায়। সে মুখে প্রয়োজনের থেকে বেশি সাজ, জিভে প্রয়োজনের থেকে বেশি ভাল কথা, চোখ স্বাভাবিকের থেকে বেশি চকচকে।
 
আত্ম-প্রকাশে আলো নিজের তাগিদেই বাইরে আসে। অন্যের চোখে তা আপনিই পড়ে। চোখে আঙুল দিয়ে বিজ্ঞাপিত করতে হয় না।
 
সমস্যাটা অন্য জায়গায়। আত্ম-প্রচারে সময় খুব বড় একটা বাধা। কারণ সেখানে ধৈর্য্য নেই, আছে উত্তেজনা। উত্তেজনার কাছে সময়ের ধীর গতি বড়ই বিরক্তিকর। সে হইচই বাধিয়ে, ধুন্ধুমার কাণ্ড বাধিয়ে পথে নেমে পড়ে। বহু মানুষ অনুগামীও হয়। বিশেষ করে যারা আরেকটি নতুন উত্তেজনা খুঁজছিল তারা। আগের উত্তেজনাগুলো পুরোনো হয়ে যাওয়াতে, চাই নতুন কিছু যে! মুশকিল হল সব উত্তেজনার শেষ এক পরিণামে- সময়ের ধীর স্থির গতির পায়ে খেলনাগুলো রেখে, কালের গহন গভীরে আত্ম-বিলীন হওয়া। তার ঝুলিতে সঞ্চয় বলতে, কিছু মৃত শুকনো নিন্দা-প্রশংসার কাঁকড়। আনন্দ নেই।
 
আত্ম-প্রকাশে সে অধৈর্য্যতা নেই। তার মূল শক্তি অধ্যবসায়। সময় তার দোসর, গতি নির্দেশক। তার কোনো তাড়াহুড়ো নেই। সে নিমগ্ন তার সাধনায়। কখন যে সে লোকচক্ষুর মাঝে এসে পড়েছে সে খেয়ালও তার থাকে না। তার মনে হয়, এ বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের এক ক্ষুদ্র অংশ তার মন-প্রাণ রূপ ধারণ করে, প্রকৃতির বিচিত্র খেলায় অংশ নিয়েছে, সৃষ্টির খেয়ালে। অন্যের প্রশংসা তার উপজীব্য না, অন্যের নিন্দা তার বাধাও না। অন্যের প্রশংসা-নিন্দাকে সে অন্যের বলেই দেখে। তার একমাত্র সাধ, অন্তরাত্মাকে তুষ্ট করা। অন্তরে প্রসন্ন হওয়া, আনন্দিত হওয়া।

547
Sun, 08/30/2015 - 11:42

"এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই!" - বাবা-মা, শিক্ষক, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, প্রায় সকলের মুখেই এই কথাটা, আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ্যে গোপনে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে।
      আমার মনে হয়, কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা বা আনুগত্য - এ'দুটো বোধকে, আলাদা করা যতটা সহজ ভাবি, ততটা না। যে আমার কাছে প্রয়োজনের তাগিদে এসেছে, তাকে আমি স্নেহের সাথে জড়িয়ে দেখি যদি তাতে আপত্তি কিছু নেই। কিন্তু সেই স্নেহের একটা প্রতিদাবী মনের অলক্ষ্যে তৈরী হয়। সাথে ভালোবাসার দাবী, ভালোবাসার কৃতজ্ঞতার দাবী। মুশকিল হয় সেখানেই।
      আমি যখন একটা সিঁড়ি ছেড়ে পরের সিঁড়িতে উঠি, আগের সিঁড়ির কথা মনে থাকে? না, থাকে না। সেরকম সব সম্পর্কই যে ভালোবাসার ভিতে তৈরী হবে, সে আশা করাটা অবাস্তব না? এটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল, সম্পর্কের একটা মূল ভিত - প্রয়োজনের। একটা শিশু যখন ভূমিষ্ঠ হল, সে নিতান্ত অসহায়। আপনার উপর তার পূর্ণ নির্ভরশীলতা। আপনিও আপনার স্নেহের দাবীর কাছে অসহায়। আপনার ক্ষুধার্ত স্নেহের প্রয়োজন তাকে, আর তার বাঁচার একান্ত নির্ভরতায় প্রয়োজন আপনাকে। সেই থেকে একটা নিবিড় নৈকট্য। তা কি ভালবাসা? কিছুটা সেরকম অবশ্যই, তবে নিখাদ না। প্রয়োজনের তাগিদ এক রকমের ভালবাসার জন্ম দেয়, এ সেই প্রকার ভালবাসা।
      কৃতজ্ঞতাবোধ (কিছু নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক ব্যতিক্রম ছাড়া, যা কৃতঘ্নতা অবধি পৌঁছাতেও দ্বিধা করে না) নিশ্চই আছে, সাথে যদি ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদি দাবী করে বসি? সেটা হয় না। মানুষের সাহায্যে মানুষকে চিরকাল এগোতেই হয়েছে, হবেও। আমি যেমন সাহায্য পেয়েছি, আমি তেমন সাহায্য করবও, এটা নীতি। যাকে ইংরাজীতে গোল্ডেন রুল বলে, 'অন্যের সাথে তেমনই ব্যবহার করো, যেমন ব্যবহার তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো'। এ কথাটা আবার একটা অন্য প্রশ্ন খুঁচিয়ে দিয়ে যায় - আচ্ছা আমি নিজেই কি সেরকমভাবে, মানে যেমনটা আমি চাই, সেরকমভাবে কৃতজ্ঞতা মিশ্রিত আনুগত্য, ভালোবাসা দিতে পেরেছি আমার পূর্বজদের? পারিনি। পরের প্রশ্ন, আচ্ছা সবই কি আমার ইচ্ছানির্ভর ছিল? পরিস্থিতি, পরিবেশ, সময়ও কি আমাকে বিবশ করেনি কখনো? এর উত্তরও আমার জানা।
      নিজের কাজটুকু করে বিরাম চাওয়ার মধ্যেই তাই অন্তিম শান্তি। কর্তব্যের ইতি কর্তব্যের সমাপনেই। তাকে অকারণ স্মৃতিপথে দীর্ঘ করে, কৃতজ্ঞতাকাঙ্খী ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে ঘুরে বেড়ালে হয়তো দু-একটা আধুলি মিললেও মিলতে পারে, তবে তাতে সুষ্ঠুভাবে কৃত কর্তব্যটার যে আত্মসুখ তা অনেক ম্লান হয়ে পড়ে। কি দরকার?
      আপনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করুন চাই না করুন। তবু বলি কোনো একটা মন্দিরে সারাদিন কাটান। দেখুন সকাল থেকে রাত্রি কত মানুষের ভিড়। কত প্রার্থনা, আবেগ, হাসি, কান্না, কথা, গল্প, আলাপ, প্রলাপ। রাত বাড়ল। মন্দিরের দরজা বন্ধ হল। দেবতার মুর্তি অন্ধকার মন্দিরের মাঝে একা। হয়তো একটা প্রদীপ কেউ জ্বালিয়ে গেল। সেই ক্ষুদ্র প্রদীপশিখা দেবমূর্তির বিরাটা ছায়া এঁকেছে মন্দিরের দেওয়ালে।
      আমি, আপনি, আমরা সবাই সেরকমই এ দেহ দেউলে দেবতার মত একা। স্মৃতির প্রদীপে যে ছায়া অতীত সময়ের দেওয়ালে পড়ে, সে ছায়ার দাবী যত ন্যায্যই হোক আপনার, আমার কাছে, সব শেষে সে ছায়াই।
     অবশেষে একটা কথা বলি, আমি বুঝতে চাই না কেন - অকারণে, অপ্রয়োজনে শুধু ভালোবাসার জন্যে ভালোবাসার সংখ্যা এ সংসারে কতটুকু? সে দুর্মূল্য বস্তু অমনি মুড়িমুড়কির মত ছড়িয়ে থাকবে বুঝি? সে দুর্লভ বস্তুটি প্রয়োজনের সীমা ছাড়িয়ে অপ্রয়োজনে উত্তীর্ণ হয়ে কালজয়ী হয়, এও সম্ভব। তবে তা কদাচিৎ। যে পায়, সে পায়। তবু যা পেয়েছি তাই বা কম কি? কারোর তো সংসারে কখনো আমায় প্রয়োজন পড়েছিল। আমি যদি তাকে সত্য অর্থে সাহায্য করে থাকতে পেরে থাকি, তবেই আমি সার্থক। আমার জীবন সার্থক। কি হবে কৃতজ্ঞতার ভারী মালা গলায় বয়ে বেড়িয়ে? বরং সেও ভুলুক, আমিও ভুলি। তাতেই শান্তি।

548
Sun, 08/23/2015 - 09:09

বহুদিন আগে কোনো এক নিকটাত্মীয়া আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তাঁর সন্তানকে তিনি কোন মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দেবেন? বাংলা না ইংরাজী। উত্তর দিয়েছিলাম, ইংরাজী। তখন আমার দৃঢ় ধারণা ছিল ইংরাজী ভাষায় ভিত্‌ খুব মজবুত না হলে পেশাগত জীবনে পিছিয়ে পড়তে হবে। কেরিয়ার ছাড়া যে জীবনের অনেকাংশ বাকি পড়ে থাকে, সে বোধ তখনও জন্মায়নি বোধহয়, বা গুরুত্ব পায়নি। ঈশ্বরকে অশেষ ধন্যবাদ, আত্মীয়া আমার সে পরামর্শ কোনো কারণবশতঃ বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হননি। যদি হতেন, তা হলে আজ আমার আত্মগ্লানির সীমা পরিসীমা থাকত না। 
 
আজ অনেকটা পথ হেঁটে বুঝেছি, জীবনটা তালগাছের মত একবগ্গা, একমুখী না। তার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা, অনেক ফুল-ফল-পাতা। অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না জানি, জেনেও বলছি, প্রাথমিক শিক্ষা মাতৃভাষায় না দেওয়া, শিশুটির সাথে অপরাধের সামিল। তাকে মাটি থেকে তুলে, টবের কৃত্রিম পরিবেশে, কৃত্রিম পরিচর্য্যায় রাখার মত ভাল করতে যাওয়া। তাতে হয় তো সে খুব চলনসই, কাজের বস্তু হয়ে ওঠে, কিন্তু তার অন্তর্জীবনে সে থেকে যায় নির্বাসিত, বিচ্ছিন্ন, অপূর্ণ।
 
মানুষ জন্মসূত্রে প্রাকৃতিক ভাবে যেমন মাটি, দেশ, জলবায়ু, সংস্কৃতি, মা- বাবা পায়, তেমন একটা ভাষাও পায়। সে ভাষা তার প্রাণের ভাষা, বিশ্ব সংসারের কাছে নিজেকে প্রকাশ করার তার নিবিড়তম যোগসূত্র। তাকে ছিন্ন করার অর্থ, মাতৃগর্ভে ভ্রূণকে ছিন্ন করে আরো উন্নত কৃত্রিম পুষ্টিতে বড় করার চেষ্টা। তাতে প্রয়োগক্ষম হয়ে ওঠলেও, স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে বসে। 
 
মানুষকে সবশেষে নিজের স্বভাবের কাছে ফিরে আসতে হয়। সে স্বভাব শুধু আভ্যন্তরীণ না। আমি যে দেশে, যে পরিবেশে, যে সময়ে, ভাষাতে জন্মেছি, সে সব মিলিয়ে তার স্ব-ভাব, তার স্ব-স্থান, তার স্ব-পরিচয়। তা গ্রহণ করার জন্য কোনো অতিরিক্ত চেষ্টা করতে হয় না। সে ইতিমধ্যেই আমার সত্তার সাথে অনুস্যূত। আমার সময়, ভাষা, পরিবেশ আমার আত্মবিকাশের সব চাইতে সহজ উপকরণ, কারণ সে আমার জন্মপ্রাপ্ত অধিকার। 
 
যখন দেখি, কোনো মানুষকে নিজের মাতৃভাষার সাথে বেশি বয়সে চেষ্টা করে যুক্ত হতে হচ্ছে, খুব করুণ যন্ত্রণা অনুভব করি তার ছিন্নমূল পরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে। কোন শুভাকাঙ্ক্ষী তার শিশু বয়সে তাকে তার মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি বিকাশ ব্যহত করে ব্যতিক্রমী বনসাই বানাতে গিয়েছিলেন কে জানে!
 
আজ সেরকম বনসাই চারদিকে। ইতঃনষ্ট ততঃভ্রষ্ট বলে একটা কথা আছে, তার উদাহরণে ভরে যাচ্ছে চারপাশ। একটা কথা ভুললে কিছুতেই চলবে না, আমি আমাকে একমাত্র আমার ভাষাতেই পেতে পারি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন। তাঁরা স্বতন্ত্র। মধুসূদন দত্ত সকলে না।
 
একদল বলবেন, "আমি তো বাংলাটা ছোটবেলা থেকে জানতামই না, পরে শিখে বেশ রবীন্দ্রনাথ থেকে সুনীল গাঙ্গুলী পড়ে ফেলছি"। এটা কোনো কাজের কথা না। কথা হচ্ছে একটা সংস্কৃতিতে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে যে আপনি কি হারাচ্ছেন, আপনাকে বোঝাই কি করে! 
 
পরিশেষে বলি বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার একটা বড় সমস্যা হচ্ছে মানগত ও গুণগত দিক। এটা আছে অস্বীকার করি না। কিছু বেসরকারি বিদ্যালয় ছাড়া, প্রাথমিক সরকারি বিদ্যালয়গুলোর মান নিয়ে ভাববার প্রয়োজন আছে। পাশাপাশি বেশ কিছু প্রাথমিক বেসরকারি বিদ্যালয় বাংলা ভাষায় যে ভাবে শিক্ষার পথ তৈরী করেছেন, তাও প্রশংসার দাবী রাখে। অনেক আগে দেশ পত্রিকায় একটা কথা পড়েছিলাম, 'বাংলা ভাষা মাতৃদুগ্ধ, ইংরাজী বেবিফুড'। 
 
কথাটা খাঁটি। সেই মায়ের কাছেই আলোর প্রথম পথ তৈরী হোক, বাকিটা হাঁটার পথ সেই আলোই দেবে।

549
Tue, 08/18/2015 - 22:00

'হিকিকোমরি' নামটা শোনা? কারোর কারোর শোনা শোনা লাগতে পারে। একটা বাংলা সংবাদপত্রে খবরটা বেরিয়েছিল।

স্থান জাপান। সেখানে এক প্রকার মানসিক অস্বাভাবিকতা (বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে) দেখা যাচ্ছে। তাঁরা নিজেদের গৃহবন্দী করে রাখছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সারাটা সকাল ঘুমাচ্ছেন। রাতে ইন্টারনেটে জাগ্রত থাকছেন। সমস্যা গভীর। চিকিৎসকেরা দিশাহীন। সেই স্বেচ্ছা নির্বাসনের সময় কাল কারোর কারোর ক্ষেত্রে নাকি তিরিশ বছরেরও বেশি!

ঘটনাটা ভাবালো। মানুষ সৃষ্টিশীল কর্মে, কি আত্ম-উপলব্ধি হেতু স্বেচ্ছা নির্বাসন নিয়েছেন - এমন উদাহরণ ইতিহাসে বহু আছে। শুনেছি ডারউইন সাহেব তাঁর 'প্রাকৃতিক নির্বাচনবাদ তত্ত্ব' লেখার সময় বহু বছর বাড়ির বাইরে পা রাখনেনি। এরকম বহু তথ্য সম্বলিত লেখা বার্ট্রান্ড রাসেলের, 'Conquest of Happiness' নামক অসামান্য বইতে, 'Boredom' অধ্যায়ে আছে। কিন্তু এ যে বাস্তব জগতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করার তাগিদে স্বেচ্ছা নির্বাসন, এটা খানিক চিন্তার বিষয় বইকি!
মনোবিজ্ঞানীরা যতদূর বিষয়টা নিয়ে ভেবেছেন, তাতে তাঁদের একটাই কথা বারবার মাথায় আসছে - অতিরিক্ত চাপ -স্কুলে, কলেজে, কর্মক্ষেত্রে।

কথাটা ঠিক। না হলে একজন শক্ত সামর্থ্য মানুষ, এমন সুন্দর পৃথিবী, জীবন ছেড়ে অন্ধকারের আশ্রয়ে বাঁচতে চাইবে কেন?

চাইবে নাই বা কেন? জীবন তাকে ছোটবেলা থেকে কি শিক্ষা দিচ্ছে? না, কিছুটা ভুল হল। জীবন না, তার চারপাশ। সে একজন আর সারা বিশ্ব আরেকজন। তোমার সাথে 'সবার' লড়াই। কি অসম ব্যবস্থা! সে শুধুই প্রতিদ্বন্দ্বী হতে এসেছে। ঘরে-বাইরে তার একটাই মন্ত্র, আমি! লড়ে যাও। ছুটে যাও। ছিনিয়ে নাও। যতটা পারো ওঠো। কে পড়ল, কে মরল তাকিয়ো না। যত জমাবে, তত সার্থক। যত কিনবার ক্ষমতা, তত ক্ষমতার অধিকারী তুমি। তোমার জীবন সার্থক।

অথচ সে চারিদিকে তাকিয়ে কি দেখছে? দেখছে চারদিকে শুধু এই সার্থকতার রূপকথা নেই। সেখানে ব্যর্থতা আছে, বিশ্বাসঘাতকতা আছে, হতাশা আছে, বিষাদ আছে, অকাল মৃত্যু আছে, দুরারোগ্য ব্যাধি আছে, আরো আরো কত বিরুদ্ধ শক্তি আছে!
তার নিজের মধ্যেও দ্বন্দ্ব আছে, হৃদয় আছে, আবেগ আছে, অনিচ্ছা আছে, ভয় আছে, আরো আরো কত বিরুদ্ধ শক্তি তার মধ্যেও তো আছে।

- আচ্ছা এগুলো কি সত্যিই বিরুদ্ধ শক্তি?

বিরুদ্ধ শক্তিই বটে। তবে তা জীবনের হিসাবে না। আমাদের তৈরী স্বপ্নময় জীবনের বিরুদ্ধে। কারণ আমাকে তো জীবনের অর্ধপাঠ দেওয়া হয়েছে। জীবন মানে ভোগ, সফলতা, স্বাস্থ্য, প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।

কিন্তু জীবন মানে তো শুধুই Positive Thinking না। তার সাথে অনেক কিছু Negative-ও তো আছে। হ্যাঁ আছে। সেগুলোকে জোর করে Positive বানানোর তো কোনো কারণ দেখি না। সে বড় অবাস্তব শিক্ষা। Negative কে Negative ভাবেই স্বীকার করতে হবে। মানতে হবে জীবনটা একটা অভিজ্ঞতার যাত্রা। তাতে জেতা-হারা, সুখ-দুঃখ, সুসময়-দুঃসময়, বন্ধু-শত্রু, উদ্যম-হতাশা ইত্যাদি জোড় বেঁধে বেঁধে আসবেই। যে স্নায়ু আমার সুখ নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে, সেই স্নায়ুই আমার দুঃখকে বহন করারও ক্ষমতা রাখে। আমার চলার সাথে থামা, চাওয়ার সাথে দেওয়া, ভোগের সাথে ত্যাগের যদি সামঞ্জস্য না থাকে তো তরী একদিকে কাত হয়ে নদীতে ডুববেই, এ আর কি এমন আশ্চর্য কথা?

অর্জুন যখন কুরুক্ষেত্র দেখে শোকে ভয়ে একেবারে যা তা অবস্থায়, তখন কৃষ্ণ তাকে কি মোক্ষম কথাটাই না শোনালেন। বললেন, ভাই রে, সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় - এ সবকে সমান বোধ করে যুদ্ধে নামো দেখি বাবা।

এই হল পূর্ণ জীবন পাঠ। দু'দিক সামলে যদি চলতে পারো তো চলো। না হলে 'বিদ্যে বোঝাই বাবু মশাই' হয়ে বাড়ি বসে থাকো। শখের বোটে আর চড়ে কাজ নেই। বাড়ির সুইমিং পুল রইল। তাতে ঢেউ নেই, ঝড় নেই, কুমীর নেই, হাঙর নেই। প্রাণ ভরে সাঁতার কাটো, জলকেলি করো, যা খুশী করো। শুধু মনে রেখো, ওতে জীবনও নেই।
জীবনের এক হাত মরণের হাতে গোঁজা। ছাড়াতে যেও না। খেলে যাও। তখন বুঝবে, এখানে কেউ জিততে আসে না, খেলতে আসে। হারা জেতাটা by product বলতে পারো। এই হল জীবনের পূর্ণ শিক্ষা।

"মরণকে তুই পর করেছিস ভাই, জীবন যে তোর তুচ্ছ হল তাই"

550
Sat, 08/15/2015 - 10:54

শব্দ ছাড়া আমরা চিন্তা করতে পারি না। হক কথা। খুব বড় দার্শনিক Wittgenstein এই নিয়ে বহু গবেষণা করে নানাবিধ তত্ত্বের আলোক দিয়েছেন।
 
কথা হল, এ খুব খাঁটি কথা, বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বামীজি জ্ঞানযোগ বইতে বলছেন, 'চিন্তা বাঙনির্ভর'। উপনিষদের ঋষিরা প্রার্থনা জানাচ্ছেন, তাঁদের মন ও বাক্য যেন একে অন্যের পরিপূরক হয়ে ওঠে। রবি ঠাকুরের বিখ্যাত উক্তি, 'বাক্য যেথা হৃদয়ের উৎসমুখ হতে'।
 
কথা হচ্ছে, আমার চিন্তা করার ভাষা আর বলার ভাষা কি আলাদা? হ্যাঁ বহুলাংশে আলাদা। এ দুটিকে এক করেছেন দু'জন মানুষ। এক - পাগল, দুই - মহাপুরুষ। আর আমরা? হে হে, সেও কি উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে?
 
একজন কলিংবেল টিপলেন, দরজার ফাঁক দিয়ে তার মুখ দেখেই, মনে মনে বলে উঠলাম, ..........., আসার আর সময় হল না! (শূন্যস্থানগুলো নিজ দায়িত্বে পূরণ করে নেওয়াই ভাল)। দরজা খুলেই হাস্যমুখে বললাম, ওমা! কতদিন পরে, আসুন আসুন আসুন...
 
অজস্র উদাহরণ। থাক। আমি মিথ্যাকথা বলা উচিৎ কি উচিৎ না, কখন কি অবস্থায় কতটা মিথ্যা বলা উচিৎ, সে তর্কেও যাচ্ছি না।
 
বিপদটা অন্য জায়গায়। ভাবার ভাষা আর বলার ভাষা আলাদা হতে শুরু করলে, আত্ম-বিশ্বাস আর আত্ম-মর্যাদার খুঁটি খুব নড়বড়ে হয়ে পড়ে দেখেছি। কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সে মানুষের বিভ্রান্তির একশেষ হয়। সে বুঝে উঠতেই পারে না, কোন ভাষাটা সত্যি, ভাবার না বলার? যা আছে, না যা বানিয়েছে? যা আছে, অর্থাৎ যা fact তাকে স্বীকার করতে লাগে নম্রতা। আর নম্রতা তখনই সম্ভব যখন বুদ্ধির আর বোধের পরিপক্কতা এসেছে। না তো দেখা যায়, প্রার্থীরাই যা একটু নম্র হন। সে ভোটই হোক আর ভিক্ষাই হোক। সেই নম্রতাটা ঠিক নম্রতা না, ওটা একটা ব্যবহারিক কৌশল বলা যেতে পারে।
 
তাই ভাষাকে যত বেশি ভাবের সাথে সম্পৃক্ত করা যায়, মনের ওপর চাপও ততটাই কম হয় বলে মনে হয়। না বলতে পারা, না বোঝাতে পারার যে কি যন্ত্রণা সে সব মানুষই অল্পবিস্তর ভুগে আসছেন, মায় কবিগুরু অবধি (হেথা যে গান গাইতে আসা আজও হয় নি সে গান গাওয়া... ইত্যাদি)।
 
ভাষার স্বচ্ছতা মনের স্বচ্ছতা আনে। যাকে গোদা বাংলায় বলতে শুনেছি, স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। বলতে কষ্ট নেই বইকি, কিন্তু বলার পর? না, সে আশঙ্কা অমূলক। আজ অবধি সত্যি লুকিয়ে শেষরক্ষা হয়েছে বলে তো কিছু দেখলাম না। জটিলতাই বেড়েছে। সত্যি বলার সে সাহসটুকু হাতের পেশির উপর নির্ভর করে না, করে সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতার উপর।
 
কথা হল, কি ভাষায় তা বলব? যে হৃদয়ে হিংসা, রাগ, ঈর্ষা সে হৃদয় সত্য বলে না। সত্যটার মূলনীতিই হল সহমর্মিতা। আমি আমাকে না বুঝলে যেমন নিজের প্রতি অবিচার করি, ভুল মতামতে নয় হীন, না হয় তো মহান বানিয়ে বসি; ঠিক তেমনই সহমর্মিতার অভাবে অন্যকেও হয় আমার থেকে নীচ না তো আমার থেকে উঁচু ভেবে, হয় হেলা, না হয় তোষামোদ করি। ফলতঃ কারো সাথেই আমার সত্য পরিচয় হওয়ার সেতুটা মেলা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কি করে হবে, ভাষার শুদ্ধতা নেই। অশুদ্ধ ভাষাতে মনকে জারিয়ে জারিয়ে মনটাকে বিষাক্ত করে বসে আছি যে!
 
শুদ্ধ ভাষা শুদ্ধ ভাবের দোসর না হলে তা উপায় নেই। না চিত্তের না সমাজের!

551
Fri, 08/07/2015 - 21:00

অনেককে দেখেছি, প্রেমটাকে বিয়েবাড়ির মেনু কার্ডের মত বানিয়ে ফেলেছে। এটার পর ওটা আসবে, সেটার ওটা হবে। এইসব ভেবে লালা চুকচুক জিভে পাত পেড়ে বসে থাকে। একটু এদিক ওদিক হল কি, অমনি গোঁসা। যা দিয়েছে তার হিসাব কষে মনে মনে অভিমানের লুচি ভাজবে- "ইস্, এত দামী গিফট আনাটা কি ঠিক হল! এতো সেরকম কিছুই আয়োজন নেই দেখছি!"
     অনেকের প্রেম আবার ইনস্যুরেন্সের কাগজের মত। কিছু বেচাল বলেছ বা করেছ কি, অমনি কবে কত প্রিমিয়াম ভরা হয়েছে, তার হিসাব নাকের ডগায় ঝুলিয়ে দেবেন। বুঝুন ঠেলা এবার!
     কিছু প্রেম ধার দেওয়ার মত। আপনাকে মাসে মাসে সুদের টাকা গুনে দিয়ে আসতে হবে। যদি পারেন তো সব ঠিকঠাক, আর না পারেন তো বাড়ির কাক-চিল শুধু না, টিকটিকি, মাকড়সা পর্যন্ত্য ঘেমে নেয়ে পালাবার পথ পাবে না, হুম!
     কিছু প্রেম BSNL কানেকশানের মত। কখন কোন সময়ে ঠিক কতক্ষণের জন্য পাবেন, তা ঠিক বলা যায় না। আসতেও যতক্ষণ, যেতেও ততক্ষণ, যা হোক এরই মধ্যে আপনি মানিয়ে গুছিয়ে চললে ভাল, না হলে...
     কিছু প্রেম, কালীপূজোর প্যাণ্ডেলে টুনি বাল্বের মত। দেখেছেন না কেমন জ্বলে- নেভে, আবার জ্বলে-নেভে। সেরকম আপনাকেও থেকে থেকেই I LOVE U বা 'ভীষণ ভালোবাসি' ইষ্টমন্ত্রের মত তাঁর কর্ণকুহরে শোনাতে হবে। না হলেই তাঁর মনে সন্দেহ.. দ্বন্দ্ব... ফের কাক চিল মাকড়সা টিকটিকি...
     এগুলো ঠিক কি জাতীয় প্রেম মনোবিদদের ভাবার বিষয়। সে নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে এর নিদর্শন চারিদিকে দেখে দেখে, 'প্রেম' শব্দটা শুনলেই পিলে চমকে যায়, কি জাতীয় হইবেক? এই আশঙ্কায়!
    তাই বলি, হৃদয়টাকে একটু সামলে সুমলে রাখাই ভাল। না হলে অনেকের কাছে সে বস্তুটি আজকাল 'কমোড সদৃশ হইয়াছে'। আপনার হৃদয়টাকে কমোড বানিয়ে অপকম্মটি করে চলে যাবেন, ফ্ল্যাশটুকু পর্য্যন্ত না করে। আপনি হাপুশ নয়নে ফ্ল্যাশ করবেন, কি স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে কিছুটা রেখে নিজের ভিতরটা দুর্গন্ধে ভরাবেন সে আপনার ব্যাপার। যাই করুন বুঝে করুন...

     ড্রাইভ স্লো!

552
Mon, 08/03/2015 - 20:30

ইতিহাসে পড়েছিলাম, সেই আদিম যুগে, মানুষ - বিদ্যুৎ, ঝড়, বন্যা এইসব ঘটনায় ভাবত দেবতারা রুষ্ট হয়েছেন। তাই নানা রকম আচার অনুষ্ঠান করে তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করত। সেই থেকে ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী দেব-দেবীদের নামকরণ ও দায়িত্ব নির্ধারণের একটা কল্প-গল্প মানুষের মনে তৈরী হয়েছিল। বলা বাহুল্য বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সে ধারণা পাল্টাল।
 
কিন্তু একদিকে এখনো সেই অন্ধকার থেকেই গেছে অনেকখানি। মনের বিকার ও তার কারণ সমূহ। মনের যে অস্বাভাবিক অবস্থাগুলো সমাজের সুস্থতার পক্ষে এক একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়, সে ঘরেই হোক - পাড়াতেই হোক - রাজ্যেই হোক - দেশেই হোক - কি বিশ্বেই হোক, তার কারণ অন্বেষণ ও গবেষণা সাধারণ মানুষের বোধগম্য করাটা খুব জরুরী মনে হয়। অন্যভাবে মানুষকে বৈজ্ঞানিক পন্থাতে আত্ম-বিশ্লেষণের পথে এগোবার শিক্ষায় শিক্ষিত করাও খুব আবশ্যক। সন্দেহ প্রবণতা, মিথ্যা বলার প্রবণতা, চুপ করে সয়ে যাওয়ার কপট মহত্ব, খুঁতখুঁতেমি, বদরাগী, হতাশা, অবসাদ - এরকম আরো গভীর মনোবিকারের তালিকার সাথে আরো অল্প বয়সে পরিচিত হওয়া, বর্তমান সমাজের পক্ষে ভীষণ জরুরি। কবীর দাস সুস্থতার লক্ষণ হিসাবে কত আগে তাঁর দোহাতে বলছেন,(WHO বলার বহু আগে) - যে মানুষ পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিকারমুক্ত, সেই সুস্থ।
 
আমাদের পাঠ্যে (উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরে) কিছুটা এইসব নিয়ে লেখা শুরু হয়েছে যদিও, তবু মনে হয় অনেক অভাব এখনো আছে। মন নিয়ে কাজ করার আগ্রহ, সুযোগ আরো বাড়াতে হবে। তার সাথে এও মনে হয়, প্রতিটা বিদ্যালয়ে কমপক্ষে মাসে একবার করে, অন্তত একজন করে মনোবিদদের আসা, ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগ তৈরী করা, এসব খুব আবশ্যিক। কারণ আমরা যদি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রাথমিক অবস্থাতেই সচেতন হতে পারি, তবে কোনো বিকার অভ্যাসে রূপ নেওয়ার আগেই তাকে সম্পূর্ণ বা অনেকাংশে নির্মূল করা যাবে।
 
দেখেছি বয়ঃসন্ধিতে কত রকমের সংশয়, কুণ্ঠা, অপরাধবোধ, হীনমন্যতা ইত্যাদি তাদের অচেতন মন ঘিরে থাকে। না পারে নিজেকে বুঝতে, না পারে বোঝাতে। কি অসহায় অবস্থা! এই সময় যদি তারা মনের কথা খুলে বলার মত কাউকে পায়, যিনি একাধারে বন্ধুর মত কথা বলবেন, আবার বিজ্ঞানসম্মত সুপরামর্শও দেবেন। কি সুন্দর হয়ে উঠতে পারে স্কুলের পরিবেশ। শুধু বাগান, ক্লাসরুম পরিস্কার না; ছাত্রছাত্রীদের অন্তঃকরণটাও শুদ্ধ হবে বিজ্ঞানের আলোতে। নিজেকে চেনা, বোঝাটা আরো সহজ হয়ে উঠবে তার কাছে। আরো ভালো নাগরিক হয়ে ওঠাটা আরো সহজ হবে না তার কাছে?
 
শুধু স্কুল না। কর্মক্ষেত্রেও মনোবিদদের উপস্থিতি দরকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুনেছি আছে। তবে অনেকাংশেই দেখি তা নাম মাত্র। প্রতীক স্বরুপ।
 
তবে শুধু রোগের না, রোগ না আসার পথও মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণার আরেক দিশা। যে অসুস্থ সেও যেমন, যে সুস্থ সেও তেমন গবেষণার বিষয় হওয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়। যে সুস্থ, সে কিভাবে সুস্থ আছে, সেও বুঝতে হবে ('Positive Psychology' যা নিয়ে কাজ করে)। আরো গভীরে যাও..... এ ছাড়া গতি নেই। কারণ ছাড়া কার্য্য হয় না, এবং মনের প্রতিটা পরিবর্তনের পিছনেই যে ন্যায্য কারণ আছে, সে তত্ত্ব গৌতম বুদ্ধ বহু আগে তাঁর কার্য্য-কারণ তত্ত্বে বলেছেন। তাঁর মত করে সমাধানের পথও বলেছেন।
 
আমাদের বর্তমানে দরকার আরো আরো বেশি করে কারণ খোঁজা, কারণের কারণ খোঁজা। সমাধান সে পথেই আসবে। আমাদের জানতে হবে, আমার মনের বিকারগুলো নিয়ে হতাশ হওয়ার কারণ নেই, তার নির্দিষ্ট কারণ আছে ও সাম্ভাব্য প্রতিকারও আছে। কোনোটাই অমূলক বা এমনি এমনি হয় না।

553
Sat, 08/01/2015 - 11:00

আজ বন্ধুত্ব দিবস। জানতাম না। অনেকে বললেন বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু লিখতে। ভাবলাম কি লিখব? বন্ধুত্ব নিয়ে কি লেখা যায়! এ তো বিশাল বড় কথা - বন্ধুত্ব।

একটা বই পড়ছিলাম ক'দিন আগে। প্রাচীন রোমান দার্শনিক সেনেকার লেখা কিছু চিঠিপত্র নিয়ে। তাতে একটা খুব মজার চিঠি আছে। একজন সেনেকাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন, নিজের কিছু ব্যক্তিগত সংশয়, সমস্যার কথা জানিয়ে, আর চিঠিটা পাঠিয়েছেন তাঁর এক বন্ধুর হাতে। তাতে আরো উল্লেখ করেছেন যে, সেনেকা যেন তাঁর পত্রবাহক বন্ধুটির সাথে চিঠির ব্যক্তিগত বিষয়গুলি আলোচনা না করেন।

সেনেকা চিঠির প্রশ্নাবলীর উত্তর দেওয়ার আগে লিখছেন, "তুমি কেমন মানুষ হে, যে চিঠি নিয়ে আসছে, তাকে বন্ধু বলছ, আবার তার সাথে তোমার ব্যক্তিগত কথা আলোচনা করতেও বারণ করছ। তুমি কি বন্ধুত্বের মানে বোঝো? যাকে নিজের মতই বিশ্বাস করা যায়, সেই বন্ধু। এ যদি না বোঝো, তা হলে সমূহ বিপদ!"
তাই তো! বন্ধুত্বের এ দাবী যে মেটাতে পারে না, তাকে সঙ্গী সাথী বলা যায়, বন্ধু বলা যায় কি!

আমাদের দেশেও বন্ধুত্ব নিয়ে বেশ সুন্দর সব লেখা আছে। যেমন তুলসীদাসজীর বিখ্যাত গ্রন্থ - 'রামচরিতমানস'-এ লিখছেন, যে সাচ্চা বন্ধু তার কতগুলি গুণাবলী থাকবে। সে নিজের সমস্যার থেকে বন্ধুর সমস্যা বড় করে দেখবে, সে বন্ধুকে কুপথে যেতে বাধা দেবে, আবার বন্ধুর দোষগুলোও সর্বসমক্ষে ঢেকে রাখবে। আর বিপদের দিনে তার পাশে থাকা, সহানুভূতি হবে চূড়ান্ত।

আর এর বিপরীত যদি হয়? অর্থাৎ মুখে মিষ্টি আর তুলসীদাসজীর বর্ণনাতে 'মনের চলন বাঁকা সাপের মত'? বলছেন তাকে তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করো। কারণ কপট বন্ধু 'শূল বেদনার' মত হয়! কি চমৎকার উপমা!

বন্ধুত্বের মহিমা সারা পৃথিবীর সাহিত্যে মণিমুক্তার মত ছড়িয়ে। আর আমাদের জীবনে? অ্যারিস্টটল মহাশয় তো বলেই বসলেন, 'ভায়া সব ছাড়া বাঁচা যায়, কিন্তু খাঁটি বন্ধু ছাড়া প্রাণধারণ যে কি যন্ত্রণার'! সত্যিই তো তাই। অস্বীকার করি কি করে!

"আজকাল আর ভালো বন্ধু পাওয়া যায় না" - এই কথাটা আমি জন্মাবধি শুনে আসছি। এই 'আজকাল' শব্দটা বড় গোলমেলে। আমি তো এই আজকালেই বেঁচে আছি। পুরাকাল তো শুধু শুনেছি, পড়েছি। দেখিও নি, বাঁচিও নি সেকালে। তাও একালেই চারদিকে বন্ধুত্বের এত অভাবও তো দেখিনে ভায়া!

বলি কি, ভালো বন্ধুত্ব চাওয়ার আগে, নিজে ভাল বন্ধু হও দিকিনি! কার? সবার আগে নিজের। হুঁ। এই কথাটা আমার মনে বড় ধরে। গীতা বলেন, তুমিই তোমার সবচেয়ে বড় বন্ধু আবার তুমিই তোমার সবচেয়ে বড় শত্রু। কি খাঁটি কথা। বুদ্ধদেবও বলেন, তুমি যদি নিজের মনকে বন্ধু বানাতে পারো, তা হলে কেল্লাফতে! ওই কাজটি সবার আগে সারো। নিজের ভিতর নিজেকে নিয়ে ক্ষোভ, অশান্তির পাহাড় আর তুলো না। বন্ধুত্ব করো। তুমি যেমন, নিজেকে সেভাবেই স্বীকার করো তো ভায়া। সব তোমার সহজ হয়ে আসবে। তখন তুমি বুঝবে কে তোমার আসল বন্ধু আর কে ভেজাল। সারাদিন খুঁতখুঁত না করে একটু চোখ মেলে চেয়েই দেখিনা। সে বন্ধু আমার পাশেই আছে, আমি একটু এগিয়ে আসলেই হবে। হবেই হবে।

আর সব শেষে বলি, অ্যামিবা থেকে মানুষ অবধি যে পরম বন্ধু হাত ধরে নিয়ে এসেছেন, তেমন ভাবে হাত বাড়ালে সে হাতের ছোঁয়া বেশ পাওয়া যায়! এ বিশ্বাস না, বিশ্বাসের উপলব্ধি!

554
Wed, 07/22/2015 - 13:14

পরিবর্তন আর জীবন, এ দুটো সমার্থক শব্দ। এ কথা বহুশ্রুত। খাঁটি কথা, সন্দেহ নেই।

দেখেছি শারীরিক, মানসিকভাবে যখন সুস্থ থাকি, তখন যে কোনো পরিবর্তন নিজের মধ্যে একটা উত্তেজনা আনে, একটা আলোড়ন আনে। সেটা দুঃখ বা সুখ যাই হোক না কেন, তাকে স্বীকার করে নেওয়ার একটা লড়াকু মনোভাব জন্মায়। প্রাণ কিছুতেই সে পরিবর্তনের কাছে হার স্বীকার করতে চায় না। না তো সুখের কাছে, না তো দুঃখের কাছে। সে বলে, আমি বড়ো, তোমরা আমার চেয়ে বড়ো না। সে বলে, আমি বেশি শক্তিমান, তোমরা না।
 
অথচ সেই আমি যখন লোভে, আসক্তিতে দুর্বল। তখন সামান্য প্রতিকূল পরিবর্তনেই কেঁদে উঠি, চমকে উঠি, কুঁকড়ে যাই। যত দেবতা ঈশ্বর, সবার পায়ের কাছে কেঁদে বলি, আমি কোনো পরিবর্তন চাই না প্রভু। আমায় আড়াল করো। আমায় রক্ষা করো।কত তোষামোদ, কত পীড়াপীড়ি। 
 
আর এর উল্টোটা হলে, অর্থাৎ সুখের কিছু পরিবর্তন হলে? তাকে অক্ষয় রাখার জন্য কত মানত, কত কৌশল, কত ছল, কত চাতুরী।
 
থাকে কি পরিবর্তন থেমে? না থাকে না। প্রতিদিনকে একই রকম করে বাঁচার অভ্যাস, সব কিছুকে একই গতানুগতিক দৃষ্টিতে দেখার অভ্যাস, ছাড়তে না পারলে, আমাদের ভয় যাওয়ার না। 
 
তাই আস্তিককে বলা হল, শরণাগত হও। এ পরিবর্তন তাঁর বিধান, তাঁর ইচ্ছা।
 
নাস্তিকও তার মত করে বুঝল, মেনে নেওয়াতেই মঙ্গল। 
 
তাই ভাবি, এ পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। না হলে, থেমে থাকার চেষ্টা করতে করতেই কালের স্রোতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পথ চলা। সেকি কাম্য? না গৌরবের?

555
Mon, 06/29/2015 - 21:02


জানলাম নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন রয়্যাল সোসাইটিরর কর্ণধার হয়েছেন। গর্বিত হলাম। অবশ্যই তা ভারতের সাথে নাড়ীর যোগ থাকার জন্য। কিন্তু পরক্ষণেই মনটা দমে গেল। আচ্ছা আমরা আমাদের দেশে থেকে পারি না কেন?


মানুষের একটা খুব গভীর, আত্মিক স্বভাব হল অন্বেষণ। সে প্রশ্ন করে। সে জানতে চায়। বুঝতে চায়। এতে সে নিজেকে সম্পূর্ণ অনুভব করে। এতে তার গৌরব। সারাটা বিশ্ব ওলট-পালট করে ফেলছে তার এই জানার শক্তিতে, আবিস্কৃত তথ্যতে। আমরা স্বীকার করছি, Knowledge is Power. তবু কোথাও যেন কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে।


বিজ্ঞানের এখন খুব স্থুল দৃষ্টিতে দুটো শাখা। বিশুদ্ধ বিজ্ঞান আর ফলিত বিজ্ঞান। আচ্ছা অন্যভাবে বলি, Science and Technology. যদিও পুরোপুরি এক না এ দুটো। তবু কোথাও ভাবগত মিল আছে।


প্রথমটাকে যদি মস্তিস্ক বলি, পরেরটাকে বলি হাত-পা-চোখ-নাক-মুখ ইত্যাদি। বিজ্ঞানের গবেষণা আমাদের শরীরের মস্তিস্কের মত। তাতে নতুন আলো আসে, দিশা আসে, উদ্ভাবন আসে। তার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া কখনো হাত পা অবধি ছড়ায় আবার কখনো তা শুধুমাত্র জ্ঞানের আলো। আমাদের দেশে এই মস্তিস্কের দিকে ঝোঁকটা বড় কম দেখেছি। আমরা কি শুধুই হাত পা হয়েই থাকব। আর ভাড়া করে অন্যের মস্তিস্ক দিয়ে কাজ চালাব? কতদিন আর এভাবে চলবে?


যদিও জানি বিশুদ্ধ বিজ্ঞান গবেষণায় আমাদের দেশে অনেক বাধা। দুর্নীতি থেকে শুরু করে অপর্যাপ্ত গবেষণাগার - অনেক সমস্যা। জানি আছে। কিন্তু উৎসাহ? সেও কি আশানুরূপ আছে? মনে হয় নেই। আমাদের এখানে প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এমন টেকনোলজিমুখী প্রবণতা যে, কেউ বিশুদ্ধ বিজ্ঞান গবেষণায় যেতে চাইলে তা প্রথম পাতার খবর হয়ে দাঁড়ায়! কেন?


তার একটা বড় কারণ আমাদের সেই মানসিকতাটার অভাব। সরকার থেকে উদ্যোগের অভাব। স্কুলগুলোতে সেই মানসিকতা গঠনকারী শিক্ষকের নিদর্শন ও অনুপ্রেরণা- দুইয়েরই অভাব। তার চেয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হলে ভবিষ্যৎ অনেক বেশি নিরাপদ। "দেশের গবেষণার হালের কথা ভেবে তো আর আমি জীবন সংশয় করতে পারি না!"


ঠিক কথা। অথচ দেখুন সেই গেরুয়াধারী সন্ন্যাসীকে, যিনি তাঁর গুরুভাইদের চিঠি লিখছেন, একটা গ্লোব, কয়েকটা রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি নিয়ে গ্রামে গ্রামে যাও। তাদের প্রাথমিক বিজ্ঞানটা শেখাও।


ভাবা যায়! তিনি বিবেকানন্দ। তিনি সন্ন্যাসী! বলছেন না গীতা-বেদান্ত পড়াও। বলছেন বিজ্ঞান পড়াও আগে। সাধে কি টাটা তাঁর বিজ্ঞানকেন্দ্রের ভার এই সন্ন্যাসীর হাতে সঁপে যেতে চেয়েছিলেন! তাছাড়া জগদীশ বাবু, সি ভি রমন, সত্যেন বোস ইত্যাদি মানুষদের কেন আমাদের আদর্শ বানানো গেল না স্কুল কলেজে, খুব আশ্চর্য লাগে। রবীন্দ্রনাথ, যিনি আজ গীতবিতান আর সঞ্চয়িতাতেই সীমাবদ্ধ - সে ভদ্রলোক জগদীশবাবুর বিজ্ঞান গবেষণায় কি ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তা ইতিহাস সাক্ষী। এ ছাড়াও বিজ্ঞানের প্রসারে ওঁর চিন্তাভাবনা পুরো একটা আলাদা প্রবন্ধের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।


সেদিন বিখ্যাত বিজ্ঞানী নার্লিকার মহাশয়ের (যাঁর মহাকাশ তত্ত্ব - The Hoyle–Narlikar theory of gravity, 'বিগ ব্যাং' তত্ত্বের বিপরীতে খুব শক্তিশালী তত্ত্ব হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃত আজ) একটা সাক্ষাৎকার শুনছিলাম। পুরো সাক্ষাৎকারটার শেষে, সেই বর্ষীয়ান বিজ্ঞানীর গলাতেও শুনলাম একই ক্ষোভ - বিজ্ঞানচর্চাটা সেই মত এগোচ্ছে না ভারতে।


আমার মনে হয় প্রাথমিকভাবে এ কাজ স্কুল থেকেই শুরু করতে হবে। কৌতুহলের আনন্দ, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের খোঁজ নিয়ে আরো প্রকল্প স্কুলগুলোতে আনতে হবে। শিক্ষা যে একটা ভয়ংকর প্রতিযোগিতার চেয়ে অনেক বড় কিছু, সে পরিবেশ গড়তে হবে। তাতে স্কুলের সাথে সাথে বাবা-মায়ের উপরও কিছুটা দায়িত্ব বর্তায়। আর কিছু না, বিজ্ঞান মানেই যে ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার না, তার যে নিজেরও একটা মহিমাময় অস্তিত্ব আছে - অন্তত এই ধারণাটা তাদের মধ্যে যেন গেঁথে দেওয়া যেতে পারে।


তারপর রইল, ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের কথা। তা আছে বৈকি। সব পথের পথপ্রদর্শকেরই সে ঝুঁকি থাকে। তা বলে কি ভেড়ার পালের নিশ্চিত জীবনই বাঁচতে হবে? আরে ভাই, মরতে মরতে বেঁচে থাকার চেয়ে, বাঁচতে বাঁচতে মরাই ভাল নাকি!

556
Sun, 06/21/2015 - 20:00

ঈশ্বর, কেমন আছেন? ভাল থাকার কথা নয় যদিও, জানি। শিশু আর পাগল ছাড়া ভাল থাকা খুব শক্ত প্রভু। 

আপনার এ সৃষ্টির কোনো ব্লুপ্রিন্ট করা ছিল আগে থেকে? অবশ্য অনেকে বলেন আপনি নাকি খেলতে খেলতেই বানিয়ে ফেলেছেন এতবড় কাণ্ডটা। তা খেলা যে এতদূর গড়াবে তা বোধহয় ধারণা করতে পারেননি আগে থেকে। দেখুন ঝড়, সুনামি, ভূমিকম্প এগুলো নিয়ে কিছু বলার নেই। ওগুলো এত বড় সিস্টেমে একটু আধটু হার্ডওয়্যার কি সফটওয়্যার প্রবলেম হতেই পারে। আসল ঝামেলাটা ওখানে না। 
আসল ঝামেলাটা মন নিয়ে। 

একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, এই মনটা আপনি পুরো বানাতে পেরেছিলেন? আমার কেন জানি মনে হয়, মনটা বানাবার সময়, বেটা আপনার হাত পিছলে সুড়ুৎ করে আমাদের শরীরে মাথায় বুকে ঢুকে পড়ে। ব্যাস আর তাকে পায় কে! বিশ্বজোড়া তাণ্ডব লাগিয়ে দিয়েছে।

একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছা করে, আপনার মন আছে? লোকে বলে আপনি নাকি বিশুদ্ধ চেতনা। তা হলে আর বুঝবেন কি করে। লোভ, ঈর্ষা এগুলোর সাথে বাস করার কি জ্বালা। এ দিল্লীর দিকে টানে তো সে চেন্নাই এর দিকে টানে। মাঝখানে আমার অবস্থা ফালা ফালা। 

বুদ্ধি? হ্যাঁ সে তো আছেই। কিন্তু তার বাস তো কৈলাসে, মানে মস্তিস্কে। আর এ কৈলাস আপনার কৈলাসের মত ঠাণ্ডা না। তার ওপর তিনি ওপর তলার , বুকের মধ্যে কি হচ্ছে সে তিনি টেরও পাননা। আর টের পেলেও শুনছে কে? মন বেটা এমন হতচ্ছাড়া যে একেও বশ করে ঘোল খাইয়ে দেয়। মুশকিলটা কি বলুন তো, মনটা যে পরিমাণ আপডেটেড ভারসান, বুদ্ধিটা সেই তুলনায় অনেক ব্যাকডেটেড। 

মন একজনের কথা শোনে অবিশ্যি। ভালোবাসা। আচ্ছা ঈশ্বর আপনি ভালোবেসেছেন? শুনেছি আপনি আবার নাকি অদ্বিতীয়। দুই না হলে প্রেম আসবে কি করে? কে থাকে আপনার সাথে? আপনার হরমোন সিস্টেম আছে? নেই, জানি। থাকলে বুঝতেন প্রেম শুধু শ্বেতশুভ্র না, গোলাপের মত লাল। আবার তেমন তেমন ক্ষেত্রে রক্তের মত লালও হয়ে যায়। কালো ঝড়ের মতও হয় কখনো কখনো। সে সব কথা থাক। আরেকটা কথা কি জানেন, আপনি তো অনন্ত তাই কিছু হারাবার ভয় নেই আপনার। আমাদের যা মেলে তা তো ছিঁটেফোঁটা সময়ের মধ্যে। তার উপর তাকে রোগ, মৃত্যু এসবের শাসনেও মাথা পেতে থাকতে হয়। আপনার তো সে সমস্যা নেই, অনন্তে আর কি হারাবে। আমরা অসীম, অনন্ত এসব কানেই শুনেছি। অনুভব করি নি। তাই যে লোকটা সারাজীবন ‘মরতে পারলেই বাঁচি’ বলল, সেও স্বর্গে যাওয়ার সময় এলে হাত পা ছুঁড়ে , যাব না গো বলে কাঁদতে বসে। এটা মায়া? হতে পারে। মায়ার সাথেই তো বাস গো। মায়া কাটাতে গেলে চোখে শূন্য দেখি। 

লোকে বলে আপনি মা বাপ। আচ্ছা আপনার দশমাস আমাদের পেটে ধরতে হয়েছিল? প্রসব যন্ত্রণা? নাড়ি ছেড়ে বেরোবার সুখ? জানি না। আমাদের এই সংসারের মায়ের ভালোবাসা দেখে আপনার ভালোবাসা বুঝতে চেয়েছি। মেলে না জানেন। লোকে যখন আপনার নামে কাটাকাটি করে মরে, আমার খুব অবাক লাগে। এরা কি দেখেছে আপনাকে? আমার আরেকটা ভয় করে। আপনার সম্বন্ধে যা সব আজগুবি গল্প ছড়িয়ে, আজ থেকে চার পাঁচ হাজার বছর পরে না - হ্যারি পটার, স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যানের পূজো শুরু হয়ে যায়। আর তখন যেই কেউ বলতে গেল, এরকম কিছু ছিল না, অমনি প্রকাশ্য রাস্তায় তাকে "রে রে" করে মেরে ফেলা হল। সবাই বিশ্বাস করবে আপনি ওইসবই - ম্যাজিসিয়ানের মত কিছু একটা। আর জে কে রাউলিংদের মত লেখকদের মনে করা হবে মশীহা। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হবে না?

যা হোক, ভাল থাকবেন। নিজের যত্ন নেবেন। আমরা আমাদের এই বিনাশশীল শরীর, মন, বুদ্ধি নিয়ে এই খণ্ড সময়ের মধ্যে যেটুকু পারি আপনাকে আর আপনার সৃষ্টি এই সংসারকে বুঝতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাবও। জানিনা ক্রস কানেকশান হল , না লাইনটা লাগল। ভাল থাকবেন, আজ আসি, টাটা।

557
Tue, 06/16/2015 - 19:30

পার্থ দে আর কঙ্কাল। আলাদা করে কিছু বলার নেই। রোমহর্ষক, ভয়ংকর, রহস্যজনক সন্দেহ নেই।

যে বিষয়ে কিছু কথা মাথার মধ্যে ঘোঁট পাকাচ্ছে সেই কথাগুলো বলে ফেলতে চাই।
 
পুরো ঘটনাটায় দুটো শব্দ খুব ঘুরে ফিরে আসছে- এক, আধ্যাত্মিকতা; দুই, যৌনতা, বা আরো স্পষ্ট করে বললে ভালো - বিকৃত যৌনতা।
 
ইতিহাস ও বর্তমান দুই-ই সাক্ষী, এই দুটো শব্দ, অর্থাৎ যৌনতা ও আধ্যাত্মিকতা খুব কাছাকাছি অবস্থান করে। আপাত দৃষ্টিতে যেন এ দুটো একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। যেখানে যৌনতা সেখানে আধ্যাত্মিকতা থাকবে না আর যেখানে আধ্যাত্মিকতা, সেখানে যৌনতা নিষিদ্ধ। এটা একটা লিখিত-অলিখিত প্রথা। তাই চিরকালই, সাধুর যৌন কেলেঙ্কারীর ঘটনা যতটা জনরোচক, গৃহীর ততটা না।
 
এই আধ্যাত্মবিদ্যায় দুটো স্পষ্ট ধারা দেখেছি। এক, যেখানে মানুষ নিজের মধ্যে একটা WHOLENESS বা সর্বময়তা বা সার্বজনীনতা খুঁজছে। যাকে আত্মোপলব্ধি বা মুক্তি বলা যাচ্ছে। আরেকটা বাস্তব জগৎ থেকে সরে গিয়ে কিছু অলৌকিক শক্তি, অতিপ্রাকৃতিক উপলব্ধির ইচ্ছায় (লোভে?) জীবনকে বিপন্ন করে তোলা।
 
ধরা যাক, প্রথমটার নাম দিলাম 'আত্মিক আধ্যাত্মিকতা'; দ্বিতীয়টার নাম দিলাম 'ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতা', এর আরেকটা নামও অবশ্য আছে, 'গুপ্তবিদ্যা' বা OCCULT SPIRITULALITY.
আত্মিক আধ্যাত্মবিদ্যায় কোনো গুপ্ততত্ত্বের স্থান নেই। সেখানে নির্জনতার গুরুত্ব আছে কিছু ক্ষেত্রে। সেখানে মানসিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব আছে। মানবিক সদ্-গুণগুলোর চর্চা সেখানে প্রধান। আদিকালের বুদ্ধ, সক্রেটিস, যীশু, কনফুসিয়াস থেকে মধ্যযুগের চৈতন্যদেব, মীরা, নানক হয়ে আধুনিক কালের বিবেকানন্দ, অরবিন্দ, টেরেসা, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ, জে কৃষ্ণমূর্তি - সব এই আলোকিত পথের যাত্রী। বাইবেল, অরেলিয়াসের মেডিটেশান, প্লেটোর ডায়ালগ, গীতা-উপনিষদ থেকে শুরু করে চৈতন্যচরিতামৃত, কথামৃত, শান্তিনিকেতন, গীতবিতান - সব এই আলোর দিশারী।
 
এ পথের মুল কথা হল, নিজেকে প্রেমে, জ্ঞানে, সত্যে বিস্তার করো। ভালো হও। নিজের মধ্যের পাশবিক প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ আনো। এখানে ঈশ্বর অলৌকিক নন, এখানে তিনি সমষ্টির প্রতীক। আমার মধ্যের বিবেকের চালক। আমার প্রাপ্ত আলোর, শুদ্ধতার প্রেরণা। এর একমাত্র উদ্দেশ্য - চিত্তশুদ্ধি।
 
অন্যদিকে আসে ছদ্ম-আধ্যাত্মিকতা। এখানে কিছু একটা 'পাওয়াটা'ই আসল কথা। অতি-প্রাকৃতিক অনুভুতি, অলৌকিক শক্তির মোহ - মানুষের সাধারণ বুদ্ধি, বিবেক, ইত্যাদি সব নাশ করতে থাকে। তার স্বভাবকে বিকৃত করে। আর যেখানে পুরো স্বভাবটাই বিকৃতির পথে চালিত, সেখানে আর যৌনতাটা সুস্থ থাকে কি করে? তার সাথে আমাদের মত সমাজে, যেখানে যৌন আলোচনাও কয়েক দশক আগে নিষিদ্ধ ছিল (আজও কতটা স্বাভাবিক সন্দেহ, শুনেছি এখনো স্কুলের শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে এহেন 'বড়দের কথা' বলতে ভীষণ সঙ্কুচিত হয়ে যান) সেখানে সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত কিশোরের মত আমাদের সমাজও অতি আগ্রহ, কখনো অশালীন আগ্রহও দেখিয়ে ফেলছে।
 
এই ছদ্ম-আধ্যত্মিকতা ও আত্ম-আধ্যাত্মিকতার মধ্যে বিভেদটি খুব স্থুল নয়। সাধারণ বুদ্ধিতে দুইয়ে মিশে একাকার - জগাখিচুড়ি আধ্যাত্মিকতা। সেখানে মঠ, মন্দির, জ্যোতিষী, মারণ-উচাটন সব মিলেমিশে একপাত্রে। এরমধ্যে থেকে বিশুদ্ধ আত্মোন্নতির পথটা খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। গুলিয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভবনা। আর তার উপর দুর্বল চিত্ত হলে তো সোনায় সোহাগা। কারণ দুর্বলের ক্ষেত্রে আকর্ষণের বেগটাই প্রধান, দিকটা না।
 
দেবযানী একটা মঠে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। সেখান থেকে ডাকযোগে যোগ সাধনার শিক্ষা নিতেন, যা সম্পূর্ণ গুপ্ত। কিন্তু তা কতটা বৈজ্ঞানিক, কতটা নিরাপদ কে তা বিচার করবে? আমার ভয় হয় এরকম কত দেবযানী এখনো এরকম বহু আশ্রমে যাচ্ছেন, ঈশ্বর দর্শনের কোর্স করছেন আর কল্পসাগরে ভেসে জীবন বিপন্ন করছেন। আরো কত পার্থ দে এ ধরণের মানসিক বিকারের পথে নিজের অজ্ঞাতসারে এগিয়ে চলেছেন কে জানে? অথচ এঁরা কেউই অশিক্ষিত বা সমাজের পিছিয়ে পড়া শ্রেণীর নন। তা হলে সমস্যাটা কোথায়?
 
খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের সমাজে মুখচোরা, অস্বাভাবিক শান্ত ইত্যাদি ছেলেমেয়েকে বেশ প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখা হয়। "আমার ছেলে একদম অন্যরকম, সাত চড়ে রা কাড়ে না, মেয়েদের দিকে তাকায় না মোটেই"। তিনি ভাবেন না, তাঁর ছেলে বা মেয়ে সমকামী কিনা, বা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা আছে কি না। এরকম অজস্র উদাহরণ আপনার আমার জানা আছে। "মানসিক চিকিৎসা তো পাগলের জন্য, যা ব্বাবা, আমি পাগল নাকি!" - এ সংলাপও চিরপরিচিত।
আজ ডায়াবেটিস, AIDS, পোলিও, ক্যানসারের মত মানসিক রোগ নিয়ে আলোচনাও যথেষ্ট জরুরী। বরং বেশি জরুরী। কারণ একটা রোগগ্রস্থ মন পুরো পরিবেশটাই রোগগ্রস্থ করে তোলে। 
যে নিজের কাছে নিজে নিরাপদ, সুস্থ না, সে সমাজের কাছে কোনোদিন নিরাপদ ও সুস্থ নাগরিকত্বের দায়িত্ব বহন করতে পারে না। আমাদের আরো সচেতন হওয়াটা খুব জরুরী তাই।
যাকেই দেখা যাচ্ছে সমাজের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন বা যার মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, দায়িত্ব নিয়ে তার পাশে দাঁড়ানো দরকার। আজ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি ও পরামর্শ স্কুল, কর্মক্ষেত্রে অত্যাবশ্যক হওয়া উচিৎ।
 
ভবিষ্যতে আরো এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনা থেকে সমাজকে মুক্ত রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

558
Sun, 05/31/2015 - 15:21

আমি

-------


ছোটবেলা থেকেই সমুদ্রের ধারে যাচ্ছি। চামচে, ভাঁড়ে, আধখানা ডাবের খোলায় জল ধরে ধরে রাখছি। যত বড় হচ্ছি পাত্রের পরিমাণও বাড়ছে। হাড়ি, কলসী, ড্রাম - যাতে পারছি জল জমিয়ে জমিয়ে রাখছি। বড় হওয়ার সাথে সাথে জল আনার কৌশলও বদলেছে। আগে ছিল সহজ সরল কৌশল, এখন হয়েছে জটিল থেকে জটিলতর। জমিয়েই যাচ্ছি, জমিয়েই যাচ্ছি। খেলা ভুলেছি, বেড়ানো ভুলেছি, দিগন্তের দিকে চাইতে ভুলেছি। সমুদ্রে আসা নতুন নতুন নদীর পরিচয় নিতে ভুলেছি। শুধু জল জমানোর নেশা এখন।

সব জমানো জল নেই অবশ্য এখন। কিছু পাত্র পড়ে গেল, কিছু জল শুকিয়ে গেল অলক্ষ্যে। ঝড়ে ভাঙল কিছু পাত্র, কিছু ভাঙল এর ওর হাতে লেগে।
জলভরা পাত্রর সারি আমার চতুর্দিকে। হাঁটতে চলতে পা বেধে যায়। সমুদ্রে স্নানে যাব কি করে?

চারিদিকে কাঁকড়াগুলো যখন বালির তীরে উঠে আসে দল বেঁধে, অন্যমনস্ক হই। মনে হয়, আমারও ওরকম দল বেঁধে একসাথে থাকার কথা ছিল তো। চোখ পড়ে আমার জমানো জলের নিজের তৈরী জলাশয়ের দিকে। মায়া লাগে। মোহ জন্মায়। এই ক্ষুদ্র জলাশয়, ওই অসীম সমুদ্রের থেকে অনেক বেশি সত্যি যে আমার কাছে!
বন্ধনে নিরাপদ লাগে, মুক্তিকে ভয় করি! এ বিশাল সমুদ্র যেন সারাদিন ষড়যন্ত্র করছে, ফুঁসছে আমার এই নিজের হাতে গড়া জলাশয়কে ভেঙে গুঁড়িয়ে তছনছ করবে বলে। প্রতিটা ঢেউ এর সড়সড়ানি আওয়াজে শুনতে পাই, সেই ষড়যন্ত্রের ফিসফিসানি।

মনে হয় সম্পূর্ণ সমুদ্রটাকে কোনো যাদুবলে যদি স্থির করে দিতে পারতাম, আহ! বাঁচতাম তা হলে। ঘুমাতাম নিশ্চিন্তে আমার সাম্রাজ্যে একা সর্বাধীশ্বর হয়ে। হচ্ছে না... হচ্ছে না... হচ্ছে না। ক্ষেপে উঠছি, ভীষণ ক্ষেপে উঠছি। 

জানি আমার তৈরী এ জলাশয়ের জল ও সব নেবে। সূর্য শুষে নেবে নিষ্ঠুরের মত, ঢালবে সমুদ্রের বুকে।


সমুদ্র

--------

সেদিন ভোরবেলা ভাবলাম আর না, দিই সব জল ওর বুকে ঢেলে। সব হারিয়েই না হয় শান্ত হই! 

গেলাম সমুদ্রের কাছে। সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, নাও আমার সব কিছু, ভয়ে ভয়ে আর তো বাঁচতে পারি নে!।

ফিরিয়ে দিল। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বিশাল অনন্ত সাগর আমায় ফিরিয়ে দিল। 

সে বলল, তোমার এখনো সময় হয় নি! জল না, আমার চাই তোমাকে। ও জল তো আমারই।

চমকে উঠে বললাম, আমায়! আমায় নিয়ে কি করবে?

সমুদ্র বলল, যেদিন তা বুঝবে সেদিন দেখবে তোমার গা আমারই মত নোনতা... আমিই তুমি... তুমিই আমি...

559
Sat, 05/09/2015 - 08:23

 

আজ পঁচিশে বৈশাখ। কলেজের ছাত্র ছিলাম যখন তখন ভোরবেলায় উঠে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ী দৌড়াতাম। সুচিত্রা মিত্র, অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, ঋতু গুহ, বনানী ঘোষ, পূর্বা দাম প্রমুখ দিকপাল সব শিল্পীর কণ্ঠে চিত্ত স্নাত হত (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বচক্ষে দেখতে পাইনি কোনোদিন, এ ক্ষোভ আমার মরে গেলেও যাবে না)। আচ্ছন্ন হয়ে বাড়ি ফিরতাম। ওঁনারা তো শুধু কণ্ঠ দিয়েই গাইতেন না, গাইতেন সারাটা জীবন দিয়ে। ফলে গানও কানের ভিতর দিয়া মরমে পশতে বাধ্যই হত। আজও হয়।
      তবে সেই স্মৃতিচারণের জন্য এ লেখা নয়। কিছু কথা মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তাই বলতে চাই। রবীন্দ্রনাথ মানে কি শুধুই গীতবিতান? শুধুই সঞ্চয়িতা? বয়স যত বাড়ছে ক্ষোভও তত জমছে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ তাঁর ‘WHY TAGORE’ প্রবন্ধে লিখছেন, এক আন্তর্জাতিক মানের ব্যক্তিত্বকে, মননকে, চিন্তনকে আমরা আঞ্চলিক 'হিরো' বানিয়ে রেখে দিলাম। সত্যিই এ বড় আফসোসের কথা। 
     ‘কালান্তর’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘শিক্ষা’, ‘স্বদেশ’, ‘আত্মশক্তি’ ইত্যাদি প্রবন্ধ, বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক প্রমুখ চিন্তাবিদদের সাথে আলাপ আলোচনার পত্রাবলীসমূহ, বিভিন্ন বিষয়ে দেশে বিদেশে দেওয়া ভাষণ – এর কোনোটাই কি আজ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে? না, হারায় নি। 
      তাঁর অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষি, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ক প্রবন্ধগুলো আজও জ্বলজ্বল করে জ্বলছে স্বমহিমায়, সপ্রাসঙ্গিকতায়। দুর্ভাগ্য তা দুই মলাটের মধ্যেই আটকে থাকছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ কেউ হয়তো উচ্চশিক্ষায় ডিগ্রী লাভ করতে তার একমাত্র উপযোগীতা বুঝছেন।
    আমার বরাবর মনে হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে বিশ্বের অন্য স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোর একটা বড় ফারাক আছে। আমরা শুধু বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য লড়াই করিনি, আমরা লড়াই করেছিলাম যুগ যুগ ধরে জমে থাকা অন্ধকার, কুসংস্কারগুলোর থেকে সমগ্র জাতটাকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। না হলে মহাত্মাজীর কি দায় পড়েছিল বিহারে কোন গ্রামে লোকে কি অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় শৌচকার্য্য করে তার সংস্কারের জন্য, চেতনা আনার জন্য উঠে পড়ে লাগা? এরকম উদাহরণ অজস্র আছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। মহাত্মাজীর সেই আত্মবিকাশের কাজেও গুরুদেব ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘গুরুদেব’ কথাটা ওনার সৌজন্যতামূলক পোশাকী সম্বোধন ছিল না। যদিও মতবিরোধও কম হত না। সেই দেশ গড়ার কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পূর্বে উল্লিখিত ঐতিহাসিকের বিখ্যাত গ্রন্থ, ‘THE MAKERS OF MODERN INDIA’-তে অনবদ্যভাবে লেখা আছে।
      এসব কি হারিয়ে যাবে? কটা গান, আর কবিতায় মানুষটাকে বেঁধে দেব? আরো বিপজ্জনক কাণ্ড দেখছি ইদানীং আমাদের বিদ্বদগণদের মধ্যে। তাঁরা ইদানীং অতিমানবিক গবেষণায় মেতে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। তাঁর সাথে তাঁর বৌদির ঠিক কি ধরণের সম্পর্ক ছিল, কার কার স্তনে পিঠে কিভাবে কখন ঠিক কোন সময়ে হাত রেখেছেন, এমনকি কাল্পনিক সুইসাইড নোটও লেখা হয়ে যাচ্ছে। হলঘর ভাড়া করে চিত্রনাট্য লিখে অনুষ্ঠান, চলচ্চিত্রও হয়ে যাচ্ছে। হায় রে পোকায় খাওয়া পঙ্গু মস্তিস্ক সব! গু-ঘাঁটা স্বভাব আর যাবে কোথায়! ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব এহেন পণ্ডিতদের শকুনের সাথে তুলনা করতেন। বলতেন, শকুন যতই উঁচুতে উড়ুক, দৃষ্টি থাকবে সেই ভাগাড়েই। দাদা, রবীন্দ্রনাথকে দেবতা বা অপদেবতা - কোনোটা বানাবারই খুব দরকার কি??
     ছোট মুখে বড় কথা বলে ফেললাম অনেক। মার্জনা করবেন। কি করব বলুন, সোনার খনি ছেড়ে আর কতদিন আস্তাকুড় ঘেঁটে দিন কাটাব বলতে পারেন?
    নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, না হয় শঙ্খ ঘোষ আমার সঠিক মনে নেই, একবার পঁচিশে বৈশাখ দূরদর্শনের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'রবীন্দ্রনাথ আমাদের কুয়ো থেকে তুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন, মানুষ করতে চেয়েছিলেন। আমরা প্রত্যেক পঁচিশে বৈশাখ সেই গর্তটা থেকে বেরোই, আবার সারাটা বছর সেই গর্তে এক পা এক পা করে এসে সেঁধোই।'
 
শেষে দু’হাত জোড় করে বলি...
  “অন্ধজনে দেহ আলো, মৃতজনে দেহ প্রাণ”


 
  

(ছবিঃ সুমন দাস)

[ অধিক বিবরণঃ 
Why Tagore - Ramchandra Guha
http://indiatogether.org/tagore-op-ed ]

560
Mon, 05/04/2015 - 18:45

কে আমার পরম বন্ধু? যিনি আমার সব সমস্যার সমাধান করে দেন? না। তা হলে তিনি আমার পরম বন্ধু নন, তিনি পঙ্গুর লাঠি।
      তবে? তিনিই আমার পরম বন্ধু যিনি সমস্যায়, বিপদে আমার বুদ্ধিটাকে স্থির পথে এনে দেন, চিন্তাটাকে আরো স্বচ্ছ করে দেন। সমস্যার সমাধান না, সমস্যাটাকেই আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে সাহায্য করেন। ফলস্বরূপ সমস্যার সমাধানের পথ আমি আপনিই পেয়ে যাই।
      সময়ে সময়ে আমরা যখন পথভ্রষ্ট হয়েছি। নিজেদের হননের পথ নিজেই তৈরী করছি, যখন কোনোমতেই বুঝতে পারছি না কি কর্তব্য - ঠিক তখনই এমন একজন মহাত্মাকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি, যিনি আমার সমস্যার সমাধান করেননি, সমস্যাটা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। শান্ত করেছেন। সমাধানের পথ আমি নিজের ভিতরেই খুঁজে পেয়েছি।
     মহাত্মা বলছি কারণ তিনি অনেক উঁচুতে বলে নন। আমার মত বহু ক্ষুদ্রাত্মা তাঁতে আশ্রয় পেয়েছে বলেই তিনি মহাত্মা।
     বুদ্ধ এঁদের মধ্যে একজন। তিনি আমার তৈরী ঈশ্বরকে আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিলেন। বললেন, নিজের পায়ে দাঁড়াও। আমার তৈরী আচার, ধর্ম, রীতিনীতি কেড়ে নিলেন। বললেন, অনেক খেলেছ, আর না।
     আমি অসহায়ের মত তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমিই ঈশ্বর তা হলে?
তিনি বললেন, না। ঈশ্বরকে তোমার কি দরকার?
     বললাম, আমায় রক্ষা করবে কে? আমায় ঠিক পথে চালনা করবেন কে?
     বললেন, তুমি নিজে।
     বিস্মিত হয়ে বললাম, তাও কি সম্ভব?
    বললেন, যাঁকে চেনো না, জানো না, দেখো নি তাঁর হাতে সব সঁপা কি আরো বেশি অসম্ভব নয়?
    বললাম, আমার বিশ্বাস?
    বললেন, সে বিশ্বাস নিজের উপরে রাখো।
    বললাম, আমার ধর্ম?
    বললেন, তোমার তৈরী কাল্পনিক ধর্মের পথ ছাড়ো। সে ধর্মের পথে চলো, যা আকাশ, আলো, মাটি, জলের মত সরল। সময়ের মত অনাদি। যা বুঝতে জটিল তত্ত্ব লাগে না, লাগে শুদ্ধ হৃদয়।
বললাম, কি সেই ধর্ম?
    বললেন, মঙ্গলের পথে চলো, পাপ কোরো না, হৃদয়কে রাখো শুদ্ধ।
    বললাম, এসব তো আমি জানি।
    বললেন, জানি। শুধুই জানো। এবার করো।
    বললাম, কি পাবো?
    বললেন, শান্তি।

(ছবিঃ সুমন দাস)

561
Sun, 04/26/2015 - 11:33

মন বাইরের দিকে ছুটেছে। সারাক্ষণ তার বাইরে বাইরে খোঁজ। সে ছুটে মহাকাশকে ছুঁতে চাইছে, সে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে গিয়ে নুড়ি কুড়িয়ে আনতে চাইছে। সে আলোর বেগে ছুটতে চাইছে, মাতাল হাওয়ায় নাচতে চাইছে। সেই ছোটবেলায় একরকমের খেলনা ছিল, একটা যন্ত্রকে পাঁই পাঁই করে ঘুরিয়ে যাওয়া, ওর সাথে একটা দড়ি লাগানো থাকত সেটাও পাঁই পাঁই করে চরকীর মত ঘুরত। আমাদের মনটাও সেরকম। সারাদিন পড়িমড়ি করে ছুটছে। কেন ছুটছে? কোথায় যে যাচ্ছে সে নিজেও স্পষ্ট নয়। সকালে যেটা না হলেই চলছিল না, বিকালে সেটার থেকে ফালতু জিনিস কিচ্ছু নেই যেন। পশুদের এভাবে চললে অসুবিধা হয় না, কারণ তাদের পুরো সিস্টেমটাই আউটসোর্সিং-এ লেগে যায়। তাদের পুরো সত্ত্বাটাই বহিঃপ্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সমস্যা হল আমাদের তো তা নয়। আমাদের যে পুরোদস্তুর একটা অন্দরমহল আছে। তার দায়িত্ব কে নেবে?
      আমার যত সুখ দুঃখ ব্যথা বেদনা আবেগ উচ্ছ্বাস ইত্যাদি সবই তো এই অন্দরমহলের ব্যাপার। সে পাড়ার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলে যে আমারই সমূহ ক্ষতি। ক্ষতি না? বাইরের আঘাত তো বাইরে লাগে না, সে তো আমার অন্দরমহলের সব ক'টা কাঁচের দরজা জানলা নাড়িয়ে দিয়ে, সেরকম আঘাত হলে কয়েকটা কাঁচ ভেঙে গুঁড়িয়েও যায় যে! আর অনভ্যস্ত আমি বেচারা, জানিই না কোন কাঁচটা ভাঙল, কোথায় কাঁচের টুকরোগুলো ছড়িয়ে। অনভ্যস্ত তো অন্দরমহলের রাস্তাঘাটে! ফলে সেই কাঁচে পা কেটে রক্তাক্ত হই। যে আঘাতকে দুদিনে ঝেড়ে পরিস্কার করে অন্দরমহলকে সামলে ফেলার কথা, সেটাতেই আমার কয়েক বছর লেগে গেল হয়তো। কখনো কখনো আবার তাঁদের দ্বারস্থ হতে হয় যাঁরা অন্দরমহলের খবর রাখতে পারেন। তিনি মনোবিদ হোন বা কোনো সাধু-মহাত্মাই হোন। শেষেরটি বড়ই দুর্লভ।
     নিজের অন্দরমহলের ভার নিজেকেই নিতে হবে। যাতায়াত বাড়াতে হবে। গলিঘুঁজিগুলো আবিস্কার করতে হবে যতটা পারা যায়। তখন হঠাৎ করে কিছু ভাঙলে চমকে উঠব না। মনে হবে, হ্যাঁ ওটা খুব আলগাভাবেই রাখা ছিল, আমি দেখেছিলাম। এই দেখে আসার জন্যই ভিতরের পাড়াটা ঘুরে আসা দরকার খুব মাঝেমধ্যেই। তখন বাইরের অতিবড় আঘাতও আমি ধীরে ধীরে সামলে নিতে সক্ষম হব। কারণ ব্যাথাটা কোথায় বাজছে, পুরোটা না হলেও কিছুটা বুঝেছি। অনেকে বলেন মন নিয়ন্ত্রণের কথা। আমার মনে হয় আগে পুরো সুইচবোর্ডের কোন সুইচের কি কাজ সেটা আগে বুঝি, তারপর না হয় নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবা যাবে। না তো খুব গরম লাগছে যখন তখন হয়তো পাথার সুইচ না চালিয়ে রুম হিটারের সুইচে হাত দিয়ে বসলাম। এরকম বহু তথাকথিত মন নিয়ন্ত্রণের বহর দেখেছি। সেখানে সমাধানের চাইতে চাপা দেওয়ায় আগ্রহ বেশি। ফলে ভবিষ্যতে সেটা মনের গভীরে এমন পচন ধরায় যে আর কহতব্য নয়। কেন রে বাবা, মুখোমুখি হয়ে বোঝাপড়াটা সেরে নিলেই হয়, না চাপা দিয়ে।
     এ তো গেল অন্দরমহলের যাতায়াতের কথা। এখানেই কি শেষ? না মশায়। আরো আছে। বেশ একটা মজার ব্যাপার আছে। আপনার বাড়ি সাজাতে যেমন ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার পাওয়া যায়, ঠিক তেমন আমাদের যে অন্দরমহল নিয়ে কথা হচ্ছে, তারও ইন্টেরিয়ার ডিজাইনার পাওয়া যায়। তাঁরা যুগে যুগে জন্মেছেন। মানুষের দ্বারে দ্বারে ফিরেছেন। খুব আকূলভাবে বলেছেন, স্যার আপনার অন্দরমহলটা একটু গুছিয়ে দিই। আমি কানে তুলিনি, এক তো এ অন্দরমহল বাইরে থেকে চোখে দেখা যায় না, না তো লোকের বাহবা পাবার কোনো সুযোগ আছে। তায় এ মাল পয়সাকড়ি চায় না। কে জানে কি মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে এঁদের ভাগাও! না পুরো ভাগাও না। দেওয়ালে এঁদের ছবি লাগিয়ে দাও। বোঝো! যিনি আসলেন মনের ভিতরটা সাজিয়ে দিতে, আমি তাঁকেই সাজিয়ে রাখলাম আমার ঠাকুরঘরে, শোয়ার ঘরে, বসার ঘরে।

"সে যে মনের মানুষ কেন তারে বসিয়ে রাখিস নয়ন দ্বারে
ডাক না রে তোর বুকের ভিতর, নয়ন ভাসুক নয়নধারে"

562
Sat, 04/18/2015 - 10:27

(লেখাটির সাথে আমার পরিচিত জীবিত/ মৃত/অনাগত কোনো মানুষের মিল নেই।)

কারো কারো 'মানে' তৈরী করার ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকে দেখেছি। যেমন ধরুন আপনি বললেন, ভাবছি এই শীতে একটা গীজার কিনব। অমনি তিনি বলবেন, আমাদের আর সে ক্ষমতা কোথায় বলুন। (অথচ আর্থিক দিক দিয়ে তিনি হয়তো আপনার থেকে বেশি সক্ষম।)
আপনি বললেন, পাহাড় আমার খুব প্রিয়। অমনি তিনি বলবেন, তা আমার হাঁটুর যা অবস্থা আমি কি করে আর উঠব বলুন।
      আপনি বললেন, একটু অমুকের বাড়ি যাচ্ছি। অমনি তিনি বলবেন, তা আমাদের বাড়ি আর কেন আসবেন বলুন।
     এ তো গেলো কথা বলার ক্ষেত্রে। এরকমভাবে আপনার প্রতিটা আচরণের পিছনে আপনার গূঢ় উদ্দেশ্যের অর্থ ওনাদের অভিধানে করা আছে। যা শুনলে আপনি আকাশ থেকে পড়বেন, না আকাশে উড়ে যেতে চাইবেন তাই গুলিয়ে ফেলবেন।
     এরকম অজস্র উদাহরণ প্রতিদিন ঘটছে। বক্তা যা বলছেন, সেটাই যে তিনি বলতে চাইছেন- এটা এনারা স্বপ্নেও বিশ্বাস করতে চান না। কেন তা আমি বলতে পারব না। বুঝতে পারেন না, না বুঝতে চান না তেনারাই জানেন।
     একটা জোকস শুনেছিলাম অনেকদিন আগে। আপনাদের অনেকেরই জানা। এক ঠাকুরদা মাস তিনেক ধরে নাতি-নাতনীকে মহাভারত পড়ে শোনালেন। তারপর তাদের নীতিশিক্ষা কি প্রকার পোক্ত হয়েছে বোঝার জন্য প্রথমে নাতনীকে জিজ্ঞাসা করলেন, দিদিভাই তুমি কি শিখলে তা হলে?
     নাতনী বলল, দাদু এই বুঝলাম যে, প্রয়োজনে পাঁচজন স্বামীও রাখা যেতে পারে।
     দাদুর চক্ষু ছানাবড়া। তিনি নাতির দিকে ফিরে বললেন, আর তুমি কি শিখলে দাদুভাই?
     নাতি উত্তর দিল, প্রয়োজনে এক সূচাগ্র জমির জন্যও ভাইয়ের সাথে লড়া যায়।
     এরপর দাদুটি নাকি কাশীবাসী হয়েছিলেন গল্পকারের মতে।
     তো এই হল কথা। বলা আপনার হাতে, কিন্তু তার যে কে কি অর্থ করবেন তা আপনার হাতে নেই। তবে যাঁরা সব বিষয়েই নিজেকে জড়িয়ে পেঁচিয়ে অর্থ করেন, তাঁদের থেকে বাঁচার দু'একটা টিপসঃ

১) অবজেক্টিভ কথা বলুন। পাহাড়ে যাচ্ছি বলুন। পাহাড় ভাল লাগে বলবেন না। তাও তিনি প্যাঁচাবেন, তবে প্যাঁচটা খোলতাই হবে না অত।
২) ওনাদের কথার প্যাঁচে পড়বেন না। যা বলছেন শুনে যান নির্বিকার মুখভঙ্গীতে। কারণ আপনার বিরক্তিতে উনি আনন্দ পাবেন, আরো কথা বাড়াবেন।
৩) যদি কথার উত্তর দিতে শুরু করেছেন তা হলে মিনিট পাঁচেকের মধ্যে গুলিয়ে ফেলবেন কি দিয়ে কথা শুরু হয়েছিল। এদের কথার গলি বেণারসের গলির চেয়েও জটিল। শুরু করেছিলেন হয়তো পাতের আগে শুক্ত খাওয়া ভাল, কি ভাল না দিয়ে, কিছুক্ষণ পরেই হয়তো দেখলেন আপনি ওনার বাড়ির কাজের লোকের মাসির গতবারের পূজোয় কেনা, কাটা কাপড়ের উপাখ্যানে চলে গেছেন, যে শাড়িটা হয়তো ঘটনাচক্রে আপনি কিনে দিয়েছিলেন, এবং তারই ইচ্ছামত।
৪) যতটা সম্ভব দূরত্ব রাখুন। কথাবার্তা মিনিট দুয়েকের বেশি কদাপি না।
এরপর আপনার কপাল। দেখুন চেষ্টা করে। আর এমন মানুষ যদি বাড়ির লোক হন, তো ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরেরও অসাধ্য আপনাকে শান্তিতে রাখা। যতক্ষণ না আপনার গন্ডারের চামড়া হয়।

563
Sat, 04/18/2015 - 00:05

দাঁড়ান। ও কি! অত জোরে জোরে পা ফেলছেন কেন? এত জোরে জোরে কেউ শ্বাস নেয়? আরে অত তড়বড় করে কি বলে ফেলছেন কিছু খেয়াল আছে?
      বুঝেছি আপনার অসুবিধাটা কোথায়। সকাল থেকে একটাও অ্যালপ্রাজোলাম পড়েনি বুঝি?
     কি বললেন? অ্যালপ্রাজোলাম খান না? মানে! এ কি মামাবাড়ির আবদার নাকি, হ্যাঁ! কে বলেছে আপনাকে অ্যালপ্রাজোলাম না খেয়ে ঘর থেকে বেরোতে? কি মনে করেন নিজেকে? আর ঘর থেকে বেরোনোর কথাই বা বলছি কেন, ঘরেই বা নয় কেন?  
     মশায় শুনুন, খেয়ে দেখুন। ভাল লাগবে। প্রথমে প্রথমে কিচ্ছুটি টের পাবেন না। একটু পর হাত পা ঝিমঝিম করবে, মাথাটা হাল্কা হাল্কা লাগবে। চারিদিকটা এক নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিতে ভরে আসবে। তবে না?
     এবারে আপনি খবরের কাগজটা খুলে বসুন, দেখুন কোনো অসুবিধা হচ্ছে? ওই ধর্ষণের খবরটা পড়ুন। কেমন লাগছে? আর রাগ লাগছে, গা চিড়বিড় করছে? করছে না তো। হু হু ভায়া সাধে কি আর বলছিলাম। আচ্ছা এবার খেলার পাতাটা খুলুন। একই রকম লাগছে না? ওই ধর্ষণের খবর, রাজনীতির খবর, সারদা, রোজ ভ্যালী, আলুচাষীর আত্মহত্যা, যাদবপুর সব এক রকম না? আর ওই রাস্তায় ধর্মান্ধদের মুক্তচিন্তাকারীদের হত্যার ঘটনাটা.. আরে ধুর ধর্মান্ধ আবার কি? সবাই ভালই দেখে মশায়। কে যে কি দেখে এটাই বলা শক্ত। তবে তাতে আপনার আমার কি? আমরা তো অ্যালপ্রাজোলামের ভক্ত, কি বলেন... হি হি... হা হা হা... কি রকম হাসি পাচ্ছে না?
আচ্ছা এবার টিভিটা চালান। হ্যাঁ হ্যাঁ খবরের চ্যানেলগুলোই চালান না! ওই শুনুন, আলুচাষীর বউটার কান্না। ওটা? ওটা একটা বাচ্চাকে ডুবিয়ে মেরেছিল, তার মায়ের কান্না। ছাড়ুন। আপনাকে আরেকটা জিনিস দেখাব। পেন ড্রাইভে এনেছি। সেই একটা ডক্যুমেন্ট্রি হয়েছিল মনে আছে? আরে ওই দিল্লীর ধর্ষণের ঘটনাটাকে নিয়ে, বিবিসির? হ্যাঁ হ্যাঁ ওটা চালিয়ে দিচ্ছি। আমি চুরি করে টরেন্ট থেকে নামিয়ে রেখেছি। তার সাথে আরো দুটো হেভি পানুও নামিয়েছি। আছে আছে, ওই পেনড্রাইভেই আছে। পর পর দেখে যান। আরে ওভাবে সোজা হয়ে বসলেন কেন? আপনি ভুলে যাচ্ছেন আপনার অ্যালপ্রাজোলাম খাওয়া হয়ে গেছে। হ্যাঁ হ্যাঁ, আর বলছি কি? কোলের কাছে পাশবালিশটা নিন। নিয়েছেন, বাঃ লক্ষী ছেলে। এবার কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন, আমি 'নির্ভয়া' তথ্যচিত্র চালিয়ে দিচ্ছি। তারপর দুটো হট পানু। দেখবেন আমার অ্যালপ্রাজোলামের খেল! আপনি দেখুন, আমি ঘুরে আসছি। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে চলে আসছি।


     একি দাদা! ঘুমিয়ে কাদা যে! চলুন চলুন বাইরে বেড়িয়ে আসবেন একটু। দেখলেন? শেষ পানুটা দেখতে দেখতে চোখ লেগে গিয়েছিল? সে তো লাগবেই! প্রথম প্রথম না। কিন্তু বলুন, কোনো অসুবিধা হয়েছিল দেখতে? না তো! বলেছিলাম না।
     এবারে ট্রেনে বাসে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করুন। কোনো অসুবিধা নেই। কে ইভ টিজিং করল, কোথায় বোম পড়ল, কার টাকা কে মেরে পালাল, কোথায় কে মস্তানী করল, এসবে আপনার আমার কি? আমরা শুধু দেখে যাব, শুনে যাব। মাঝে মাঝে 'আহা, আহা' বলব। তবে মজা দেখবেন, আহাগুলো আর বুকের ভিতর থেকে বেরোচ্ছে না। গলার কাছে তৈরী হচ্ছে। ওই বড় বড় মানুষেরা যেমন কোনো দুর্ঘটনায় 'গভীর শোক' প্রকাশ করেন বা 'তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ' জানান, এও সেরকম আর কি। আপনি আইসক্রিম চুষতে চুষতেও সমবেদনা জানাতে পারেন, কম্পিউটারে বা আপনার স্মার্টফোনে গেম খেলতে খেলতেও দেশের দুর্দশা, পাশের বাড়ির খুন, ডাকাতি নিয়ে টুইট করতে পারেন। শুধু তাই? আপনার বাড়িতেও তো শুনি হাজার ক্যাঁচাল। কোনো প্রবলেম নেই। ছেলে মাল খেয়ে এসে বউ পেটাক, মেয়ে পাড়ার ছেলেদের সাথে লাফড়া করুক, বউ পাশের পাড়ার টনির সাথে মাঝরাতে হোয়াটস অ্যাপ করুক। আপনার শালা কি ছেঁড়া গেল তাতে। যার যা খুশী করুক। সারা দুনিয়া লাফড়াতে ভরে গেল দাদা, আপনার পরিবার কি আর সত্যযুগের হবে... কি বলেন? আরেকটা সত্যি কথা কি জানেন, আমার মনে হয় ভীষ্ম, দ্রোণ, এসব মাল অ্যালপ্রাজোলাম খেত। নাহলে তোদের বাড়ির সমত্থ বউটারে পিরিওডের সময় শাড়ি খুলে নিচ্ছে, আর ওইরকমভাবে ল্যাদ খেয়ে বসে থাকা যায়! এ অ্যালপ্রাজোলাম ছাড়া সম্ভব না দাদা। আমি বেট্ লাগাতে পারি। শালা ওই ব্যাটা পাণ্ডবদের গলাতেও যদি একটু করে তরল অ্যালপ্রাজোলাম ঢেলে দিত না, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটাই আর বাধত না। সব শান্তি। হে হে। সব অ্যালপ্রাজোলামের দান দাদা। এক মুখে আর কত গুণ গাইব?
       উফ্, কি অদ্ভুত অনুভুতি না দাদা? একেই বলে বেঁচে থাকা। লাইফটাকে হেল না করে বেঁচে থাকা। ভাল ভাল গান শুনুন, নভেল পড়ুন, কবিতা লিখুন, রান্না শিখুন, ধর্মের চ্যানেল দেখুন, ফ্যাশন চ্যানেল দেখুন, রাতে রোজ একটা করে গরম বই পড়ুন বা দেখুন, সকালে খবরের কাগজ পড়ুন, গজল শুনুন, সমাজ সচেনতন সিনেমা দেখুন পপকর্ন হাতে নিয়ে। শুধু একটাই মূল মন্ত্র, নিজেকে কোনো ক্যাঁচালেই শালা জড়ানো নেই।

উপায়? অ্যালপ্রাজোলাম।

564
Wed, 04/01/2015 - 13:44

(আজ ধর্মান্ধতার বর্বরতা যখন আবার তার কালো ফণা তোলার উপক্রম করছে, তখন একটু ভয় ভয় করছে বৈকি। তবে কি আমরা...)

      ধর্মের দুটো দিক আছে। এক অধ্যাত্মিকতা, দুই সমাজের রজ্জু হিসাবে।

     ধর্ম যেখানে ব্যক্তিগত সেখানে সে হৃদয়ের কোমল বৃত্তিগুলোকে অনুসরণ করার, অনুশীলন করার অনুপ্রেরণা যোগায়। এটা সব ধর্মেরই মূল কথা। সত্য, করূণা, প্রেম, অনুকম্পা কোনো একটি ধর্মের নিজস্ব সম্পত্তি না। এগুলো সার্বজনীন সদ-গুণাবলী। সব ধর্মের ভিতর থেকেই উন্নত, উদারচেতা, শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উদাহরণ দেওয়া যায়। ইতিহাসে তাঁদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, পথপ্রদর্শকের তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আজও লক্ষ লক্ষ মানুষ নীরবে, নিশ্চিন্তে তাঁদের নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের সাথে সবার সাথে মিলে মিশে বাস করছেন।

     ধর্মের আরেকটা দিক হল বাইরের দিক। প্রচারের দিক। লোকসংখ্যা বাড়ানোর দিক। এখানে তার সাথে একটি রাজনৈতিক দলের কোনো পার্থক্য নেই। মানব সভ্যতার আদিকালে ধর্মই ছিল মানুষকে গোত্রীকরণের একমাত্র রজ্জু। তখন এত -ইজম(ism) তৈরী হয় নি। আজ কত ইজম রাজনীতিতে, সমাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, ইত্যাদি। সেদিন বাঁধবার দড়ি ছিল শুধু ধর্ম, মানে বহিরাঙ্গের ধর্ম। এক একটা ধর্মের আবার তিন চার রকমের উপবিভাগ। এর কোনোটার কারণ মানুষের কল্যাণ না। মানুষের একত্রীকরণ। যাতে করে দল তৈরী করা যায়। আর দল তৈরী করলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা সহজ হয়। এ আদিম প্রবৃত্তি।
 
     বাকি ইজমগুলোর সাথে ধর্মের একটা মূল পার্থক্য আছে। বাকি ইজমগুলো মেনে চলতে বুদ্ধির একটা স্থান আছে। বহিরাঙ্গের ধর্মে বুদ্ধি প্রধান বাধা। তবে বুদ্ধিকে মোহগ্রস্থ করার উপায়? পরকালের লোভ দেখাও। তাই ধর্ম তার পরকালের কল্যাণ করার আছিলায় বিনা বাধায় হৃদয়ে প্রবেশের অধিকার পায়। আমরা ভুলে যাই যে, ধর্ম কল্যাণ করতে পারে তখনই যখন সেটা ভিতরের জিনিস হয়, দলতন্ত্র না। কিন্তু ততক্ষণে সে হৃদয়ের মধ্যে পৌঁছে গেছে। সেই পথে বিষ দাও বিষ চলে যাবে, মধু দাও মধু যাবে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী বিষই গেছে বেশি। কারণ সংসারে দল গড়লে, দলের শত্রু তৈরী হয় অনায়াসেই। আর শত্রু নিধনে, মধু না, বিষ লাগে। সুতরাং ঢালো বিষ।
 
     একজন বিজ্ঞানী আর একজন স্কুলের বিজ্ঞান ছাত্রের যা পার্থক্য, একজন অধ্যাত্ম আলোকিত পুরুষ ও তথাকথিত ধার্মিকের সেই পার্থক্য। একজন বিজ্ঞানীকে গিয়ে যদি বলি ইলেকট্রন আসলে পজিটিভ, অমনি তিনি হো হো করে হেসে উঠবেন, নতুবা আমায় বোঝাবার চেষ্টা করবেন। আর আমার অযোগ্যতা দেখলে, বলবেন পরে বুঝবে।
 
    কিন্তু যদি একজন বিজ্ঞানের ছাত্রকে বলো ইলেকট্রন পজিটিভ সে রেগে যাবে। কারণ সে ইলেকট্রন যে নেগেটিভ, এ তার বিশ্বাস। অভিজ্ঞতা না।
 
    ঠিক সেইরকম যেই কোনো দলতন্ত্রের ধর্মে আঘাত দিল, অমনি সে 'হা রে রে' করে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ উদাহরণ কম বেশি সব ধর্মে আছে। তবে যে ধর্মে reformation যত বেশি হয়েছে, সে ধর্মে এর ঔদ্ধত্য তত কমেছে। কিন্তু যে ধর্ম কোনো reformation কে স্বাগত জানায়নি সে আরো বেশি ঔদ্ধত্য হয়েছে। কারণ সত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার ওই একটিই উপায়।
 
    কিন্তু শেষ কথা হল-
  ধেয়ে আসে ঝড়, বেধে যায় রণ
সব শেষে জয়ী হয়, মৃদু সমীরণ।

565
Tue, 03/17/2015 - 19:18


সন্ন্যাসীনী ধর্ষণ মর্মান্তিক না। বয়সটাও মর্মান্তিক না। মর্মান্তিক সমাজের অবক্ষয়টা। শরীরে ক্যান্সার হলে তার অনেক লক্ষণ ফুটে ওঠে। যেগুলো কদর্য, অসহনীয় হলেও মূল তো তারা নয়!
      আমরা যে রোগটার শিকার সেটা হল- একটা মূল্যবোধহীন, অন্তঃসারশূন্য, ভণ্ড ব্যবস্থায় পরিপূর্ণ একটা সমাজের পোষ্য আমরা। কোনো বড় অপরাধই হঠাৎ করে ঘটে যায় না। বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পৈশাচিক ঘটনা যখন 'তুচ্ছ' ঘটনার আড়ালে যেতে শুরু করে তখন ধীরে ধীরে তারাই বড় ঘটনার আকার ধারণ করে। অন্তত সাহসটা পায়। চোখে ঠুলি পরে, কানে তুলো গুঁজে সংসারে যে নিরবিচ্ছিন্ন শান্তি অনুভব করা যায়, তাতেই অভ্যস্ত আমরা। হঠাৎ করে যখন আগুনের তাপ গায়ে ঠেকে, তাকিয়ে দেখি দাউ দাউ করে জ্বলছে চারিদিক, তখন হায় হায় করে ওঠার কি অর্থ! আগুন তো এক মুহুর্তে লাগেনি! ধীরে ধীরে যখন আগুন লাগার দাহ্য পদার্থগুলো জমা হচ্ছিল তখন কি করছিলাম? আজ চীৎকার করে পাড়া মাতালেই সমাধান হয়ে যাবে? কক্ষণো না। আমি সচেতন না হলে যেমন আমার বাড়ির, আমার সংসারের ঠিক-বেঠিক খেয়াল রাখা যাবে না, ঠিক তেমনই আমরা সচেতন না হলে কোনো দোহাই দিয়ে, কোনো আস্ফালনেই এর আশু সমাধান নেই।
      আরেকটা কথা। আমার মনে হয় এই 'ধর্ষণ' সংজ্ঞাটাও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বানানো একটা  ভণ্ড তকমা বিশেষ। কেন 'ধর্ষণ' শব্দ? তার বীর্য গ্রহনের স্থান আছে বলে? তার শরীরে পেশির পরিমাণ কম বলে? সে সম্ভোগের সময় নীচে থাকে বলে? তার অর্থনৈতিক জোর নেই বলে? তাকে তোমার সংসারের পোষ্য ভোগ্য বানিয়ে রেখেছ বলে? সে অবলা, দেবী, শুদ্ধতার প্রতিমূর্তি, সহনশীলতার পরাকাষ্ঠা, আরো কত কি তকমা লাগিয়ে মেয়েদের যে স্থানে রাখা হয়েছে তা নিতান্তই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে নিজেদের সুবিধার জন্যই। এটা আজ স্পষ্ট হওয়া দরকার।
     'শারীরিক অত্যাচার' বলা যাক, 'ধর্ষণ' না। এই শব্দটার সাথে মিথ্যা কিছু একটা আছে। যা মানসিক। একটা কৃত্রিম লজ্জার বোধ তৈরী করে শারীরিক অত্যাচারকে, আত্মগ্লানিতে নিয়ে যাওয়ার কৌশল। ধর্ষনে একজনের কেন শুদ্ধতা নষ্ট হল, শ্লীলতাহানি হল? কেন শুদ্ধতা আর শ্লীলতা শুধু মেয়েদের বেলায় হবে? পুরুষের বেলায় প্রযোজ্য হয় না কেন? কারণ ওই যে বিয়ের আগে আমার অক্ষত যোনি মেয়ে খুঁজতে হবে। পুরুষ ভারজিন কি না- প্রশ্ন নয় কেন? এই মানসিকতা থেকেই এই 'ধর্ষণ' নামক নোংরা, ভণ্ড শব্দটার উৎপত্তি।
     মেয়েরা যতদিন না বুঝছেন, এই শুদ্ধতার মোহ যতদিন না কাটছে ততদিন এ জিনিস চলতেই থাকবে। ততদিন 'লজ্জা' শব্দটা তাকে তাড়া করে বেড়াবে। দাঁড়াবার শক্তি দেবে না।
     আরেকটা কথা শুনলে আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। "মেয়েদের সম্মান করতে শিখতে হবে"। কেন? শেখার কি আছে? এটা কি স্বাভাবিক না? পুরুষকে সম্মান করা শিখতে হবে বলে স্কুলে কিছু পড়ানো হয় বুঝি? তা হলে মেয়েদের সম্মান করাটা বিশেষ অনুশীলনের ব্যাপার কি করে হল? এটাও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আরেকটা ভণ্ডামি।
    সর্বোপরি একটা কথা বলে শেষ করি, সেদিন আমার এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম ওই পেরেক কারখানায় এত মেয়ে কেন? সে বলল, মেয়েদের পারিশ্রমিক কম দিতে হয়, তাই।
    আমি হতবাক হলাম। হায় রে! কি পোড়ার নিয়ম! যাকে একই সাথে কখনো দেবী আবার কখনো দাসী বানিয়ে নিজের সুবিধা মত যাকে রাখা যায়, তার ক্ষেত্রে, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি শব্দটা প্রযোজ্য তো হবেই!
    যতদিন না মেয়েরা এই বোধটাকে স্বাভাবিকভাবে অর্জন করছেন, ততদিন এদের বিরুদ্ধে লড়ার মানসিক জোর পাবেন কোথায়?
    এ বস্তাপচা, স্বার্থকেন্দ্রিক, মানসিকতা ছাড়তেই হবে। তবেই জোর করে কারোর শরীরের উপর চড়া ও হওয়াকে আর পুরুষত্ব দেখানোর ক্ষেত্র ভাবা যাবে না। একজন মেয়েকে 'নারীত্ব' শব্দটা ভুলে মনুষ্যত্বে উন্নীত হতে হবে। তবেই হবে।

Top of Form
566
Sun, 03/15/2015 - 08:35


বুকের মধ্যে একটা স্পন্দন অনুভব করি। না, হৃৎযন্ত্রের না। তার চেয়েও গভীরে একটা কিছু। বেঁচে থাকার তাগিদ হয়তো। সে স্পন্দন খুব স্বতন্ত্র। আমার নিত্যদিনের যা কিছু, তা তার চোখ এড়ায় না। আমার একটা চিন্তাও তার অগোচর হয় না। সে আছে। তার এই থাকাটুকুতেই আমার প্রতিদিনের হওয়া। একটু একটু করে গড়ে ওঠা। হয়ে ওঠা।
যখন দেখি মাথার মধ্যে হাজার তত্ত্ব নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, মাথাটাকে রীতিমত কুস্তির আখড়া বানিয়ে ফেলেছে, আমি এক ডুবে আমার এই প্রাণের গভীরের গোপন দরজার কড়া নাড়ি। দরজা খোলে। আমি ভিতরে এসে নিশ্চিন্ত হই।
আমার এই প্রাণের গভীরে যে প্রাণের স্পন্দন তাকে কোনো নামে অভিহিত করলাম না। নামে কি আসে যায়!
মাথার মধ্যে কত ধারণার বাসা। পড়ে, শুনে, ভেবে কতরকম ধারণা বয়ে বেড়াচ্ছি। তাই দিয়ে বিশ্বসংসারের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি। নাম্বার দিচ্ছি, কাটছি, স্তুতি গাইছি। আরো কত কি! একবারও জিজ্ঞাসা করছি না, আচ্ছা এই ধারণাগুলো কি সব সত্যি? কোনো ফাঁক নেই? নেই কোনো অতিরঞ্জন? এরা কি অপরিবর্তনশীল? অমরত্ব লাভ করেছে?
ধারণা মানেই মৃত। কোনো এক সময়ে, কোনো বিশেষ মানসিকতায় তৈরী হওয়া একটা ছাপ। সময় এগিয়েছে, ধারণার উৎস পাল্টেছে, কিন্তু আমার ধারণাগুলো আর পাল্টালো না। কি করে পাল্টাবে? ওগুলোর ওপর আমার যে ভয়ংকর আসক্তি! আমার বাইরের শরীরটা যেমন হাত-পা-নাক-চোখ-মুখ নিয়ে তৈরী হয়েছে, তেমন আমার মনের শরীরটা হাজার ধারণা দিয়ে তৈরী। এত সহজে ছাড়া যায়! সে যে মানসিক মৃত্যুতুল্য। অগত্যা চলুক।
এই ধারণার পাঁচিলে ঘিরে আমার প্রাণের সেই গভীর স্পন্দন। সে জীবিত, তাই সে আঘাত করে। যার প্রাণের শক্তি যত বেশি তার আঘাত তত বেশি। সে তখন শুধু নিজের মৃতপ্রায় ধারণাগুলোকে সমূলে উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হয় না, সমাজের অচলায়তনের ভিত ধরেও নাড়া দেয়। সে যুক্তির জোরে না, প্রাণের গভীরে যে স্পন্দনের কথা বলছিলুম, তার জোরে। সে আলোকিত না, সে নিজেই আলো। আলোর বুকের মধ্যে যেমন আলোকিত করার স্বাভাবিক শক্তি থাকে, প্রাণের গভীরের সে অস্তিত্বের বুকে তেমনই মানুষকে উদার পথে, আলোকিত পথে, জ্ঞানের পথে নিয়ে চলার, পথ দেখানোর তার স্বাভাবিক শক্তি থাকে। তা তাড়িয়ে নিয়ে যায় না, হাত ধরে বন্ধুর মত নিয়ে যায়। পাগলের মত তাকে কামড়ে, আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করলেও সে ছাড়ে না। তার সে শক্তি যুক্তির জোরে না, প্রেমের জোরে। যা সেই প্রাণের স্পন্দনের আরেক নাম, আরেক দিক।
সে শুধু বলে, নিজেকে মুক্ত করো। বুঝব কি করে নিজেকে মুক্ত করছি? সে বলে, ওই ফুলের দিকে তাকাও, দেখো সে কুঁড়ির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেকে প্রকাশিত করেছে। তুমিও নিজেকে প্রকাশ করো।
হতে পারে আজ হিংসা, ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, লোভ চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে কোনোদিন তারা শেষ কথা হতে পারে না। মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস সে কথা বলে না। যাতে সবার শুভ, যাতে সবাই আলোকিত, যাতে সবার মঙ্গল, তার পথ চিরকালের মত আটকে রাখা যায় না! যুদ্ধ বাধবেই।
প্রাণের সেই গভীরের স্পন্দনের কাছেই মাথা নীচু করি। মাথা নীচু করি তাঁদের সামনে যাঁরা এই স্পন্দনের মূর্ত রূপ। প্রতিদিন একটু একটু করে আমার বুদ্ধি, যুক্তি, ইচ্ছাকে এই স্পন্দনের অনুকূল করে তোলাই সাধনা। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলতেন, 'বড় আমি'কে 'ছোট আমি'-র পায়ে সঁপে দেওয়ার সাধনা। রামকৃষ্ণদেব বলতেন, 'কাঁচা আমি'কে 'পাকা আমি' করা। যীশু বলতেন, বীজকে নষ্ট করে গাছকে জন্ম দেওয়ার কথা। আর বাউল? বাউল বললেন, মনের মানুষের খোঁজ করা।


(ছবিঃ সুমন দাস)

567
Wed, 03/11/2015 - 17:39

সব খারাপ কথার উত্তর দেওয়ার দরকার নেই। যখন কেউ বলছে, তখন তার দিকে না তাকিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে চলে যাও। কান থাকুক কানে। মন থাকুক চোখের সাথে বাইরে- খেলুক, ঘুরুক, দেখুক, ছুটুক। তারপর ফিরে এসে দেখবে, যে বলছিল সে নেই। ব্যস হয়ে গেল।
     কঠিন একটু। বাইরে যাওয়াটা না, যেতে চাওয়াটা। মনে হয় আমিও বলি। যেই বললে, অমনি ফাঁদে পা দিয়ে দিলে। আর ওড়া হল না।
      ফাঁদে না পড়ে অথবা ফাঁদে পড়ে আবার কেটে বেরোনোর চেষ্টা না করে, আগে থেকেই উড়ে যাওয়া ভাল নয় কি? কান না থাক, চোখ তো আছে!
     কি করে কথাটা মাথায় এল বলি। আমি পড়ছি, এমন সময় আমার খুব একজন ঘনিষ্ঠ, পিতৃসমান মানুষ এসে বললেন, "এত যে বই কিনিস, মরে গেলে তো সব আবর্জনা হয়ে থাকবে।"
     আমি চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। একই সাথে খুব কষ্ট আর রাগ হল। কিন্তু ততক্ষণে আমার চোখ জানলা দিয়ে বাইরে গিয়ে, গাছের ডালে বসা মাছরাঙাটার রূপে আটকে। মনে হল, এর এত রূপ, এত শোভা! সব তো আবর্জনাই হয়ে যাবে ও মরে গেলে! কিন্তু প্রকৃতি নিশ্চই তার কোনো পথ করে রেখেছে। তবে আমার বইগুলো নিয়েই বা ভাবি কেন? আমার শরীরটার যখন একটা গতি হওয়ার আছে, ওদেরও হবে।
     এই সব ভাবতে ভাবতে খেয়ালই করিনি কখন তিনি আমার পাশ থেকে চলে গেছেন। আমিও ওনার পাশ থেকে চলে গেছি অনেক দূরে, শুধু দেখাকে সাথে নিয়েই।
    তাই বলছিলাম, কান না থাক, চোখ তো আছে। বসতে না পাই, উড়েই যাবো। সব কথার উত্তর না দেওয়াই ভালো।

568
Fri, 03/06/2015 - 23:53


শরীরটা যখন অসুস্থ থাকে, যখন বিছানা ছেড়ে দু-পা উঠে খাবার জলটা গড়িয়ে খেতে মাথা টলে, হাঁফ ধরে যায় - তখন বোঝা যায়, যে স্বাস্থ্যকে অনায়াসে লাভ করেছি তার সত্যিকারের মূল্য কতখানি। এত দৌড়-ঝাঁপ, বকবকানি, কীসের জোরে।অথচ সেই স্বাস্থ্যকে কত তুচ্ছ করে দেখি যখন ভাল থাকি তখন, মনেই থাকে না!
      সাথে সাথে এও মনে হয় চিরটাকাল ক্ষোভেই কাটালাম, 'এটা পেলাম কই? সেটা হল কই?' কত ক্ষোভ, দীর্ঘশ্বাস। একবারও ভেবে দেখেছি কি, যা পেয়েছি অনায়াসে তার যোগ্য ছিলাম কি?
     যখন এ সংসার ছেড়ে চিরদিনের মত যাওয়ার সময় হবে তখন হঠাৎ করে চিরকালের তুচ্ছ করা জিনিসগুলো কি আমার চোখে অমূল্য, অসাধারণ লাগবে না?
    আমার বাড়ির ছাদে পড়া জামগাছটার ছায়া, দেওয়ালে চলা পিঁপড়ের সারি, দুপুরবেলায় ফেরিওয়ালার ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরের হাঁক, একটা বাচ্চার অর্থহীন কথা, কোনো একজন তথাকথিত না-সুন্দরীর চোখের গভীর চাহনি - এরা আমার কাছে সীমাহীন সত্য, অকৃত্রিম বিস্ময় মনে হবে না? আমার খুব মনে হয়, হবে। এগুলোকে আবার করে দেখার জন্যই বাঁচতে ইচ্ছা করবে। অথচ তখন সময় থাকবে না আর হাতে। চিরকাল পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার সাধে, পাহাড়ের পাদদেশে, যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তার সৌন্দর্য্যকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনলাম না কোনোদিন!
     সর্বোপরি যে মানুষগুলোর অকুণ্ঠ ভালোবাসা ঘিরে রাখছে আমায়, যাদের অনেকটা, 'ওরা তো আছেই' বলে চোখ ফিরিয়ে রাখছি- তাদের দিকে হাতজোড় করে ফিরতেই হবে। বলতেই হবে তাঁকে যিনি ঘিরে রেখেছেন হাজার তুচ্ছতার আড়ালে নিজেকে - 'এই জীবনে ধন্য হলেম তোমায় ভালোবেসে।'
     না হলে নির্ভার হয়ে ফেরা যাবে না যে!

569
Sun, 03/01/2015 - 12:07


প্রতিদিনের মত সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছি। ফাঁকা একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটছি এমন সময় দুজন ভদ্রমহিলার কথোপকথনের খন্ডাংশ কানে এসে পৌঁছাল -
     "ভাই, যে কোনো পরিস্থিতিতেই মানুষ নিজের চলার রাস্তাটুকু করেই নেয়। তা সে যেমনই হোক। সংসারে কোনো অবস্থাতেই মানুষ নিজের চলাকে থামাতে পারে না।"
     আমি বিস্মিত হলাম। ফিরে তাকালাম যিনি বললেন কথাগুলো তাঁর মুখের দিকে। তাঁর বয়স আন্দাজ ষাটের কোঠায়, আর যাঁকে বললেন তাঁর আনুমানিক তিরিশ। রাস্তার দু'ধারে দু'জন দাঁড়িয়ে।
    আমার ভিতরে ভিতরে আলোড়ন তৈরী হল। এগিয়ে গেলাম। যে মানুষটা এই কথা কটা উচ্চারণ করলেন, এই নির্জন রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে, এ কি পরম সাহিত্য না? যা মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতা আর বোধ পরস্পর মিশে তাকে রসসিক্ত করে প্রকাশ করে? হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চই তাই। অন্তত আমার মত মানুষের কাছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ 'এই যে কালো মাটির বাসা' পৃথিবীর বুকে নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলোকে নিয়েই তো সেরা সাহিত্য রচনা করেছে। অবশ্যই নিজের বোধ অনুযায়ী।
     সাহিত্যের অনেক -ইজম আমি শুনি। বুঝি না। তা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট পাওয়ার বিষয় হতে পারে। আমার হৃদয়ের সামগ্রী না। যার দু'বেলা খাওয়ার চিন্তা নেই, তাকেই টেবিল ম্যানার্স, খাওয়ার সময় হাতের বুড়ো আঙুল তর্জনী ছোঁবে কি না, নাকি কনিষ্ঠ আঙুলটি মধ্যমাকে ছুঁয়ে থাকবে ইত্যাদি নিয়ে মাথা ঘামাতে হয়। যার খিদেতে পেট জ্বলে, সে হাতের কাছে ভাত পেলে হুমড়ি খেয়ে, পড়ি মরি করে ভাতগুলো গলাধঃকরণ করে প্রাণে বাঁচে।
    সে সাহিত্যই আমি বুঝি। আমার চোখ, কান ওই মানুষগুলোর সাথেই ফেরে যে দু'বেলা ভাতের সন্ধান করছে, যে মানুষটা অত্যন্ত ভালোবেসে ব্যর্থ হয়ে ওই যে গলায় দেওয়ার দড়ি খুঁজছে, যে রমণী সংসারে সব দিয়ে আজ নিঃস্ব হয়ে জীবনের প্রান্তদেশে এসে মরার উপায় খুঁজছে। কত বলব। এরাই চারদিকে। আমার হতভাগ্য দৃষ্টিতে ভালো কিছু পড়ে কই?
    মাকে দেখেছি অন্যের দুঃখে কেঁদেছেন। সাহায্য করেছেন সাধ্যাতীত। প্রতারিত হয়েছেন তার চেয়ে বেশি। সেদিন ক্ষোভ ছিল আমার। আজ নেই। আজ বুঝি মা প্রতারিত হয়েছেন মানুষের ক্ষুদ্রতার কাছে। মানুষের যে মহান মানবিকবোধ সেখানে তিনি প্রতারিত নন। সেখানে তিনি মনুষ্যত্বে উত্তীর্ণা, সার্থক তাঁর জীবন।
   জীবন নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে, ওই যে যারা অর্ধনগ্ন হয়ে বাঁচার রসদ খুঁজছে আমি ওদের ওখানে যেতে চাই। পারছি না। আমার পায়ে দামী জুতো। দামী জামা-প্যান্ট আমার গায়ে। এদের খুলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে ওদের কাছে আমায় যেতেই হবে। যাঁকে প্রণাম করি, তাঁর চরণ দুখানি ওই নদীর মাঝখানে। ওদের পাশে। আমার প্রতিটা প্রণাম ব্যর্থ হয়ে আমায় ব্যঙ্গ করছে। করবেও যতদিন না আমি ওদের কাছে পৌঁছাতে পারি।
   লোকে বলে উগ্রপন্থীরা শুধু এক প্রজাতিরই হয়। আরে ভাই নানক, কবীর, যীশু, চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী ইত্যাদি উগ্রপন্থীদের কথা কেন বলে না? এমন উগ্রভাবে ভালোবাসার কথা বলা কোনদেশী ভালো লোকের কাজ? যে-ই এঁদের পথে পা বাড়িয়েছে জীবন ছারখার হয়েছে। তবে বিষে না, প্রেমে। তবে সে প্রেমের ঝাঁঝ বিষের চেয়ে শতগুণ বেশি।
    তাই বলছিলাম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য আমার কাছে ওঁনারাই রচনা করেছেন যাঁরা মানবাত্মার বুকে মুখ রেখে তার দীর্ঘশ্বাস আর প্রেম দুটোকেই অনুভব করেছেন। মানুষের কাছে এনেছেন। আমরা কেঁদেছি, ভেবেছি, বাঁচতে শিখেছি। শিখছি। শিখবও।

570
Wed, 02/25/2015 - 16:11

যৌথ পরিবারে কোনো বড় মানুষ যখন কোনো অবিবেচক বা আলপটকা মন্তব্য করে ফেলেন, অমনি অন্যান্য বিবেচক মানুষেরা সেটা নিয়ে কথা না বাড়িয়ে বিষয়টাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। যাতে পরিবারে শান্তি বজায় থাকে। এ অভিজ্ঞতা কম বেশি সব মানুষেরই থাকবে যাঁরা যৌথ পরিবারে মানুষ।

আমাদের এই খবরের চ্যানেলগুলোকে এ শিক্ষা কে যে দেবে! একটা ভুলভাল মন্তব্য কেউ করল তো, অমনি শুরু হয়ে গেল ব্রেকিং নিউজ, ডিবেট, আলোচনা, পর্যালোচনা, আরো কত কি! কেন রে দেশে কি আর কোনো সমস্যা নেই? এত বড় দেশে কিছু মানুষ উস্কানি কথা বলবেই। তাকে নিয়ে তিলকে তাল করে, ঘেঁটে ঘা করে, চুলকাতে চুলকাতে চুলকানী না ধরালেই কি নয়? 
 
বাড়ির মহিলা সদস্যরা পারিবারিক নাটকে ব্যস্ত আর পুরুষেরা রাজনৈতিক নাটকে। যত নিউজ চ্যানেল তাদের টী-আর-পি বানানোর জন্য খবর খোঁজা ছেড়ে এখন খবর তৈরী করাতে মন দিয়েছে বেশি। যেন নারদগিরি করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই এদের।
 
অন্যদিকে দেশে কোনো ভালো কাজ কেউ করছেন কিনা তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে, কবে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে পুরস্কার পাবেন, তবে। তারপর তিনি দিনে কতবার ব্রাশ করতেন, লুঙ্গী পরতেন না প্যাণ্ট পরতেন, অন্তর্বাস কোন কম্প্যানীর ব্যবহার করেন ইত্যাদি। বাপ রে বাপ! 
কবে আমরা দায়িত্বশীল হব কে জানে?

571
Sat, 02/07/2015 - 22:14

শাসকদল আর বিরোধীদল। যা কিছু হোক, আলোচনাটা এর বেশি এগোতে শোনা আর আমাদের ভাগ্যে জুটছে না। টিভিতে, কাগজে, পত্রিকায়, রাস্তায় ঘাটে - একই বিষয়, শাসকদল আর বিরোধীদল। বার্ট্রান্ড রাসেলের একটা বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ে - আমরা ভোট দিয়ে কাউকে একটা মন্ত্রীত্বে বসাই কারণ সব কিছুর জন্য কাউকে তো একটা দায়ী করতে হবে। আমাদের আলোচনাকেও তাই ওর বেশি এগোতে দিতে ভয় পাই। কি জানি বাইরের অন্ধকার যদি ঘরের অন্ধকারের দিকে আঙুল তোলে?!
      একটা কথা। রাজনীতিতে মানুষ করে, না মানুষে রাজনীতি করে? যে সমাজে আমাদের জন্ম-কর্ম-মৃত্যু, আমাদের রাজনীতি কি সেই সমাজের বহির্ভূত কোনো বস্তু? তা তো নয়। তবে আমাদের জাতীয় সামাজিক মেরুদন্ডটা কি এতটাই মজবুত, ঋজু যে সেখান থেকে উঠে আসা রাজনীতির মানুষগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের হবে? তা হতে পারে না। তবে এত বিস্ময় কিসের? পদের? না সেই চিরকেলে নিয়ম, চালুনি বলে সূঁচ তোর ইয়েতে কেন ফুঁটো?
     আমার বারবার মনে হয়, কোনো জাতির চারিত্রিক রূপ বোঝার জন্য তার লাইনে দাঁড়াবার মানসিকতাটা একটা উন্নত নির্ধারক। গণতন্ত্রের একটা অভিনব পদ্ধতি লাইন করে দাঁড়ানো বা সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো।
     ব্যাঙ্কে, রেলে, গ্যাস অফিসে, হাসপাতালে ইত্যাদি সর্বত্রই এই ব্যবস্থা। গণতন্ত্রে সবার সমান অধিকার। তাই লাইনের আগে - মাঝে - পিছনের অবস্থানগত পার্থক্য থাকলেও, গুরুত্বগত পার্থক্য নেই। কিন্তু আমাদের লাইনে দাঁড়ানোর মানসিকতাটা অন্যরকম। কি করে আগে যাওয়া যায় আরেকজনকে টপকে। যে সেই অভিসন্ধিতে টাকার জোরে, বা বাহুর জোরে, বা চালাকীর জোরে সফল হল; সে তো আমার কাছে ঈর্ষা ও প্রশংসার তুল্য। যে সেটা করতে পারছে না সে মরমে মরছে নিজের দৈন্যতা দেখে। কজন মানুষকে দেখেছি শান্ত মনে নিজের অবস্থানটাকে মর্যাদা দিয়ে অপেক্ষা করতে? বিনা ক্ষোভে বা বিনা হীনমন্যতায়? খুব অল্প সংখ্যক, যাদের আমরা বোকা নীতিবান বলে ঠাট্টা করি।
     কথাটা লাইনে দাঁড়ানোর না। কথাটা Short cut খোঁজার এমন জাতীয় মানসিকতা। কোন্ দর্শন একে কি ভাবে ব্যাখা করে জানি না। তবে রেটিনা আর মস্তিস্কের ওপর যে দর্শন প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের তাতে মনে হয় না শাসকদল বা বিরোধীদল খন্ডযুদ্ধ আলোচনায় কোনোদিন কোনো সুরাহা বেরোবে।
    আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজন আমার বেঁচে থাকার মূল তাগিদ। এ সত্য। তবে আংশিক সত্য। আমার প্রয়োজনটাকে আমি যে কোনো উপায়ে মেটাতে চাই এবং তা নৈতিক হল কি না হল দেখার আমার দরকার নেই। এও আংশিক সত্য। কখন বুঝব এ আংশিক সত্য? যখন দেখব আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনগুলো মেটানোর জন্য আমায় সমাজের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে। খাদ্য, বস্ত্র, পথ, আলো, চিকিৎসা, শিক্ষা সব কিছুতেই আমি সমাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর সেই কাজটাকে যে পথে সুচারুভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সেটাই হল নীতি। আমি আজ থেকে রাস্তার ডানদিক ধরে হাঁটব ঠিক করলে শুধু আমার না অনেকের অসুবিধা, এর ব্যাখার প্রয়োজন হয় না। ব্যাঙ্ক, স্কুল, অফিস, আদালত যখন তখন যেমন খুশী খুলবে বললে সেটা হাসির কথা হয়ে পড়ে। কারণ তাতে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ক্ষেত্রেই একটা বিষম গোলোযোগ তৈরী হবে। তাই আসলো নিয়ামানুবর্তিতা, সময়ানুবর্তীতা। কিন্তু এই অনুবর্তনের কাছে যদি মনটা স্বাভাবিকভাবে বাধ্যতা স্বীকার না করে, সব সময় যদি নিজের সুবিধাকেই প্রাধান্য দিতে চায় তখন যে কি অরাজকতার সৃষ্টি হয় তার উদাহরণ চারিদিকে। "ওনাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি তাই কাজ বার করতে অসুবিধা হল না"..."আপনার কেউ পরিচিত আছে গো, বলুন না তা হলে আর বেগ পেতে হয় না"... এধরণের বাক্যের সাথে আমরা জন্মলগ্ন থেকেই পরিচিত।
     এর ফলস্বরূপ হল, আমরা সর্বত্রই ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরীতে বেশি আগ্রহী হই। ডাক্তার, উকিল, শিক্ষক, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার, পদস্থ অফিসার, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী ইত্যাদি সব আমাদের ব্যক্তিগত পরিচয়ের মধ্যে হলে নিজেকে নিরাপদ বোধ করি। কারণ নীতির থেকে পরিচিতির জোর বেশি।
    জানি না এ চরিত্র আদৌ কোনোদিন বদলাবে কি না। নাকি আমাদের দেশে আরো কাঁড়ি কাঁড়ি মহাপুরুষ জন্মে যাবেন। আর জন্মাবেনই বা না কেন? যে দেশে একজন মানুষকে জ্বলজ্যান্ত চিতায় পোড়ানো বন্ধ করতে বোঝানোর আবশ্যকতা হয়, সে দেশে মহাপুরুষ তো মুড়ি মুড়কির মত আসবেনই। তুমি যত অন্যায় করো, নির্দিষ্ট তিথিতে অমুক যায়গায় স্নান করলেই তুমি শুদ্ধ! ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছিলাম। কার্তিক আর গণেশের মধ্যে নাকি চ্যালেঞ্জ হয়েছিল। যে পুরো পৃথিবীটা আগে ঘুরে আসতে পারবে, সেই জগদম্বার কোলে বসবেন। কার্তিক সারা বিশ্ব ঘুরতে বেরিয়ে গেলেন ময়ূরে চড়ে। ফিরে এসে দেখেন গণেশ মায়ের কোলে বসে। কি করে? কারণ গণেশের কাছে মা-ই সারা বিশ্ব। বোঝো! কি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব। শ্রদ্ধা হল গিয়ে অন্তরের ব্যাপার, তাকে এরকমভাবে প্রতিযোগিতার কাজে লাগানো কোন দেশি ন্যায়পরতা? কিন্তু সেই গল্প শুনেই বড় হলাম।
    ঘুষ নিতে না পারা, সমাজের অতিরিক্ত সুবিধাগুলো কোনোভাবেই করায়ত্ত না করতে পারার হীনমন্যতায় ভোগা আমরা যতদিন না মান-হুঁশে ফিরছি, ততদিন চলুক এই তর্জা, শাসকদল বনাম বিরোধীদল, আমরা বনাম ওরা, বর্ত্তমান বনাম পুরাতন। কিন্তু খবরদার! কখনোই আঙুলটা নিজের দিকে ঘুরিও না!

572
Mon, 02/02/2015 - 20:15

পুরীর সমুদ্রে যখন প্রথমবার বাবার হাত ধরে নামি, আমার সে কি উত্তেজনা! ঢেউ আসলেই তার উপর দিয়ে লাফাবার চেষ্টা করছি। এমন সময় একটা বড় ঢেউ আসল। লাফাতে গিয়ে বালির তীরে পড়লাম ছিটকে। বাবা হাসলেন, বললেন, "বড় ঢেউ আসলে লাফায় না বোকা, মাথা নীচু করে দিতে হয়। মাথার উপর থেকে ঢেউটা চলে যায়, আর ছিটকে পড়তে হয় না।"

     অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এলাম। আজ দেখছি এ নিয়ম শুধু পুরীর সমুদ্রেই না, জীবন সমুদ্রের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে সত্যি। বড় ঢেউ-এর সাথে না যুঝে, মাথাটা নীচু করে দেওয়াই শ্রেয়। তাতে ক্ষতির পরিমাণ কমে। না হলে বাইরে যা কিছু তছনছ তো হয়ই, সাথে সাথে ভিতরটাও এমন বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে যে কাঁদার শক্তিও থাকে না। তার চেয়ে মাথাটাকে নীচু করে রাখলে, বড় ঢেউটাকে যিনি পাঠান, তিনি সহ্য করবার শক্তিটুকুও দিয়েই পাঠান।

573
Sun, 01/11/2015 - 12:32

মনে হয় মৃত্যু সবচেয়ে বেশী সার্বজনীন। সকাল বেলায় নিজের কাজে ধরাবাঁধা ছকে ব্যস্ত, এমন সময় একজন খবর দিল পাশের পাড়ার একজন মিস্ত্রী মই থেকে পড়ে মারা গেছেন। কয়েকদিন হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন নাকি। তার একটু পরেই খবর পেলাম কলকাতার খুব নামকরা একজন চিকিৎসকের বাচ্চা ছেলেটা ICU তে জীবন মরণের স্পর্শরেখায় লড়ছে।
      আমি দুজনকেই চিনি না। না তো সেই মিস্ত্রীকে না তো সেই বাচ্চাটাকে। তবু মনটা হঠাৎ করে পুঁথির মত ছড়িয়ে পড়ল। কোনটা কোনদিকে গেল তার হদিশ পেলাম না। শুধু দেখলাম আমি এই আটপৌরে সংসারটাকে সামনে রেখে দূরে এসে বসে পড়েছি। আমার সামনে গাছপালা, পরিচিত অপরিচিত মানুষজন, পশুপাখী কলরব করতে করতে এগিয়ে চলেছে। আমি দ্রষ্টা। অথচ খানিক আগেই আমিও একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় এই প্রবহমান সংসারের মধ্যে ছিলাম, আশপাশ ভুলে। নিজের মধ্যে চিরকালের আমিটাকে ভুলে।
      কি করে হয়? এই মুহুর্তে যে আমি সারাটা সংসারকে এক নিবিড় স্নেহে মমতায় উপলব্ধি করছি, অপরিচিতকেও কোনো এক অকৃত্রিম আবেগে পরিচিতের মতই লাগছে, এ মনটা কোথায় থাকে? কাজের যে মন সে তো এভাবে দেখে না! সে তো একে বন্ধু, ওকে শত্রু, এটা দরকারী, ওটা তুচ্ছ এরকম হাজার একটা বিভাগ টেনে, নিজে কর্তা হয়ে বসে থাকে। ক্ষণে ক্ষণে তার রাগ, তার ক্ষোভ, তার ভয়, তার অভিমান, তার সুখ। শুধু তাই না, তার সকাল বিকাল, এ মাস সে মাস, এ বছর সে বছরে কত পার্থক্য।
     অথচ এখন! এই মুহুর্তে, কোনো বিভাগ নেই, কোনো পার্থক্য নেই, কোনো ক্ষোভ দুঃখ অভিমান হতাশা নেই। সে উদাসীন কিন্তু দুঃখী না। সে কিছু চায় না কিন্তু পেলেও তার কোনো ক্ষোভ বা লোভ নেই তার প্রাপ্ত বস্তুর ওপর। সে আত্মমগ্ন হয়ে বিশ্বমগ্ন। সে নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে এক অনন্ত সাম্যতা অনুভব করছে। তা যেন যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্বকে ঘিরে অনন্তকাল ধরে পালন করে চলেছে। সেই সমত্বের অনুভুতিতে তার ভয় নেই এখন। কারণ ভয় তো অসমানে, বিরুদ্ধতায়।
      কেজো সংসারে যেন সে বৃত্যের একটা চাপে বাস করছিল। সেই ক্ষুদ্র অংশটাকেই সে সর্বস্ব জেনে তাকে আপ্রাণ সোজা করার চেষ্টায় ছিল। ব্যর্থ হয়েছে বারাবার। নিজেকে দূষেছে, নিজের ভাগ্যকে দূষেছে, আশেপাশের মানুষজনকে দূষেছে। এখন সে কেন্দ্রে। সে বুঝেছে তার বোঝার বাইরে একটা সামঞ্জস্যতা আছে, যাকে অতিক্রম করা যায় না।
     কিন্তু তার নিজের সাথে, সমগ্র বিশ্বের সাথে এ পরিচিয় ঘটালে কে? মৃত্যু। মৃত্যুকে তাই বলছিলাম সত্যিকারের সার্বজনীন। কারণ সে শূন্যের দিকের দ্বার খোলে। যা কিছু 'আছে' র দিকে, তা জীবনকে পুঁজি করেই। সুখ দুঃখ, বন্ধু শত্রু, আশা নিরাশা সব। আর মৃত্যুর সব 'নেই' এর দিকে। এই শূন্যতা মানুষকে দুর্বল করে? না করে না। সাময়িক ভাবে তা মনে হলেও কোনো সত্য মানুষকে কোনোদিন দুর্বল করে না, করতে পারে না। সেটাই সত্যের মহত্ব। তা তিক্ত হলেও বলপ্রদ।
      নিজেকে হারিয়ে নিজের এই স্বরুপটাকে যদি উপলব্ধি না করতে পারলাম তা একজন সফল মানুষ হয়েই হয় তো জীবনটা কাটাতে হত, সার্থক হত না। সবশেষে তাঁকেই স্মরণ করি যাঁর হাতধরে এতটা হেঁটে আসলাম, আশা রাখি বাকিটাও উতরেই যাব।

কেন রে এই দুয়ারটুকু পার হতে সংশয়?
জয় অজানার জয়।
এই দিকে তোর ভরসা যত, ওই দিকে তোর ভয়!
জয় অজানার জয় ॥

জানাশোনার বাসা বেঁধে কাটল তো দিন হেসে কেঁদে,
এই কোণেতেই আনাগোনা নয় কিছুতেই নয়।

574
Mon, 01/05/2015 - 23:06

PK দেখলাম। হতবুদ্ধি হলাম। একজন ভিনগ্রহবাসীর চোখে ভারতবর্ষের প্রচলিত ধারণাগুলিকে বোঝার চেষ্টা। ভেবেছিলাম সিনেমাটি গভীর তাৎপর্য ও চিন্তাপ্রসূত হবে। হল বিপরীত।
     প্রথমত, প্রায় পাঁচ হাজার বছরের নানা পরিবর্তন, সংমিশ্রণ ও উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আসা একটা সমাজের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়া একজন পাঁচ বছরের শিশুর পক্ষেও সম্ভব, বিবেকানন্দ বলতেন। নানান ধর্ম, নানান রীতিনীতির যে বৈচিত্র, যা পরষ্পরবিরোধী হলেও একই সাথে সময়ের হাত ধরে পাশাপাশি অবস্থান করছে, তার রহস্য না খুঁজে কয়েকটা বিক্ষিপ্ত অন্ধকার ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাকে ব্যঙ্গ করা খুব প্রশংসনীয় কাজ বলে মনে হয় না।
     দ্বিতীয়ত, সত্য সাঁই, মহেশ যোগী ইত্যাদি অবর্তমান বিতর্কিত ধর্মগুরুদের নকল করে চরিত্র সৃষ্টি না করে জীবিত ও বিতর্কিত চরিত্রের অবলম্বনটা আরো বেশি সাহসিকতার কাজ হত, যেটা 'Oh My GOD' করতে সক্ষম হয়েছিল।
    তৃতীয়ত, বহুরূপী প্রথা ভারতীয় সংষ্কৃতির বহু প্রাচীন একটা শিল্প। এই শিল্পকে আশ্রয় করে মহাদেবের যে দৃশ্যটি শৌচাগারে দেখানো হয়েছে তা আমার কাছে অত্যন্ত নিম্নরুচির, নিন্দনীয় এবং মহাদেবের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বহু মানুষের আবেগের অবমাননা বলে মনে হয়েছে।
    সবশেষে বলি ধর্মের নামে বুজরুকি, শিক্ষার নামে প্রহসন, চিকিৎসার নামে লুণ্ঠন, শাসনের নামে শোষণ চিরকাল হয়ে এসেছে। তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সাহসের কাজ। কর্তব্যও বটে। কিন্তু সে কাজটা করতে গেলে সে দেশের ইতিহাস, প্রথা রীতিনীতিকে সে দেশের বিচারেই বুঝতে হয়। বিদেশী ঐতিহাসিকেরা যখন ভারতের ইতিহাস বুঝতে না পেরে তাকে ব্যঙ্গ ও অবজ্ঞা করতেন, রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ঝড়ের দিনেও ঝড়টাই প্রধান না, প্রধান সে ঝড়ের মধ্যে বসবাসকারী মানুষের কথা, কিন্তু বিদেশী পথিকের চোখে ধুলিঝড়টাই প্রধান, কারণ সে বাইরের লোক।
    অবশেষে বলি, আইনস্টাইন বলতেন, সবকিছুকেই সহজ করা উচিৎ, তবে অতিসহজ নয়। পুরো সিনেমাটি সবকিছুর একটি অতিসরলীকরনের চেষ্টা এবং সবশেষে বলিউডের চিরাচরিত প্রেমিক প্রেমিকার মিলন মাধুর্যে অশ্রুজলে সমাপন এবং হলিউডের ন্যায় আগাম পর্বের ইঙ্গিতের নকল। হিন্দুধর্মের উদারতা অন্যান্য ধর্মের উদারতার চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশী। তাই, কয়েকদিন আগে দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির প্রাঙ্গনে যীশুখ্রীষ্টের জন্মোৎসব পালনে যখন আমান আলি বঙ্গেশ সরোদ বাজাচ্ছিলেন এবং যা বহু পত্রিকায় ছাপাও হয়ছিল, ভারতবর্ষের সেই দিকটাকে আরোও বেশি কতে তুলে ধরা, সে উদার প্রাণশক্তির উৎস খোঁজা আরোও বেশি প্রাসঙ্গিক নয় কি? না কি তাতে বক্স অফিস হিট হয়না?

575
Thu, 12/25/2014 - 10:07

     

আজ ২৫শে ডিসেম্বর। এক মহাত্মার জন্মদিন। যিনি ত্যাগের মাধ্যমে প্রেমকে শুদ্ধ করে নিতে বলেছিলেন। নিজের জীবন ক্রুশে দিয়ে সে শিক্ষার নজির হয়েছিলেন নিজেই।
আমার প্রায়শই মনে হয়, সমস্ত মহাত্মাদের জন্মদিনের পরিবর্তে তাঁদের প্রয়াণ দিবসের মাহাত্ম্যই যেন বেশি। খ্রীষ্ট যেদিন জন্মেছিলেন, আজকের সেই দিনটি ছিল নিতান্ত সাধারণ অন্য দিনের মতই। তাকে আলাদা করে আবিস্কার করা যায় নি। সকল মহাত্মার জন্মলগ্নই তাই। বুদ্ধ, মহাপ্রভু, কবীর, নানক, মহম্মদ, রামকৃষ্ণ যেদিন জন্মেছিলেন সেদিন তাঁরা আর পাঁচটা শিশুর মতই জন্মেছিলেন। কিন্তু যত দিন যেতে লাগল তত তাঁদের দিব্য চরিত্রের এক একটা পাঁপড়ি বিকশিত হতে থাকল। তার চূড়ান্ত সমাপন টানল তাঁদের প্রয়াণ দিবস। মানুষ সেদিন মাথা নীচু করে দাঁড়াল, চোখের জলে শ্রদ্ধা জানাল। তাঁকে বলল ভগবান, মসীহা, অবতার, আরো কত কি!
তাই বলছিলাম। যেদিন জন্মে ছিলেন না, যেদিন ছেড়ে গেলেন সেদিন মানুষ তাঁর জীবনটাকে পিছন ফিরে দেখেছিল। আবিস্কার করেছিল তাঁকে। তাই খ্রীষ্টের শেষদিনটাই আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে-

"আমার সারা শরীরকে নাও তোমরা খাদ্য করে
আমার রক্তে ভরো পেয়ালা।
আমি যাব, ফিরবার সময় হল বন্ধুরা।
যা কিছু ছিল আমি উজাড় করে দিয়েছি,
শেষ রক্তবিন্দু আর শেষ নিঃশ্বাসকে করে সম্বল, বলছি-
বিশ্বাস রাখো,
নিজের ভালবাসাকে শুদ্ধ করো ত্যাগে।
যেভাবে আমি তোমাদের ভালবেসেছি
ভালবাসো একে অন্যকে সেই ভাবে।
যে ভাবে পিতা আমাকে তোমাদের মধ্যে দিয়েছেন
সে ভাবে নিজেকে দাও সবার মধ্যে।

তোমাদের মধ্যেই একজন করবে বিশ্বাসঘাতকতা,
তার হাত ধরেই আসবে আমার মৃত্যু।
তবে জেনো, এ অনিবার্য।

কারণ মৃত্যুকে জয় করবে যে প্রেম তার পেয়ালা
নিদারূণ বিষে ভরা।
সে বিষের উপর আমি হব জয়ী
হব মৃত্যুঞ্জয়!
তোমার বিশ্বাসকে করতে জয়।"

(ছবিঃ সুমন দাস)

576
Sun, 12/14/2014 - 23:32


ব্যক্তি ও নীতি। এ দু'জনের সম্পর্ক কি? দু'জন ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পর্কে নীতির থেকে আবেগ, ব্যক্তিগত ভাল লাগা, মন্দ লাগা, সুবিধা অসুবিধার গুরুত্ব অনেক বেশি। অন্যদিকে ব্যক্তির সাথে যখন সমষ্টির সম্পর্কের কথা আসে তখনই নীতির প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গও এসে পড়ে। পারিবারিক নীতি, ক্লাবের নীতি থেকে শুরু করে ধর্মনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতি ইত্যাদি। নীতি অর্থে 'বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়' পরীক্ষিত নিয়মাবলী। নীতিই পারে বহুকে একটি নির্দিষ্ট দিকে, নির্দিষ্ট উদ্দ্যেশ্যে পরিচালিত করতে। এই নীতির প্রস্তর থেকেই সভ্যতার ভিত স্থাপন। সত্যপরায়ণতা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি কোনো ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের দৃষ্টিতে তৈরী হয়নি। এগুলো সার্বিক সভ্যতার বিকাশের মেরুদন্ড। প্লেটো তাঁর কালজয়ী 'রিপাবলিক' গ্রন্থে বলেন, মানুষ তথা সমাজের মূল চারটি ভিতের কথা- সাহস, প্রজ্ঞা, সংযত আচরণ ও ন্যায়পরায়নতা। অন্যদিকে লোকধর্মের মূল সূত্রের আলোচনা করতে গিয়ে ব্যাসদেব বলেন, 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়' তত্বের কথা। এই নীতিই ব্যক্তি মানুষের চিত্তে সমষ্টির সাথে যুক্ত হওয়ার আকুতির বাস্তবায়িত পথ।
 
      স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, আমরা কি নির্ভুল সমাজনীতি, ধর্মনীতি, রাজনীতি আবিস্কার করে ফেলেছি? তার উত্তর, না। জীবের দেহের, মনের ক্রমবিকাশের মত নীতিরও ক্রমবিকাশ হয়ে চলেছে যুগ যুগ ধরে। তাই কালের সাথে সাথে নীতিরও পরিমার্জন, পরিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমবিকাশ চলেছে। ইতিহাস সাক্ষী। তাই কোনো নীতিই সম্পূর্ণ ত্রুটি মুক্ত, ধ্রুব নয়। এমনকি আমাদের গণতন্ত্রও না। যখন কোনো ব্যক্তিতে বা জাতিতে কোনো নীতিকে ধ্রুব বলে মানার প্রবণতা দেখা গিয়েছে তখনই তার মধ্যে একটা স্থবিরতা এসেছে, জড়তা এসেছে। ইতিহাসে এর প্রমাণও বহু মিলবে।
 
     তবে উপায়? উপায় হল উন্নত'তম' না পাই 'তর' তো পাই। তাকে অনুসরণ করা যা আরো বেশি আলোকিত বিজ্ঞানের আলোকে অথবা উদারতার জ্যোতিতে।
নীতির প্রথম শর্তই হল, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রস্বার্থের ঊর্দ্ধে উঠতে হবে। আমি সমাজের যত উচ্চ ক্ষমতায় আসীন আমার ত্যাগকে তত মহৎ হতে হয়। কারণ নীতির ক্ষেত্র যত বৃহৎ, তার সাথে জড়িত সমষ্টির স্বার্থও তত বৃহৎ। আমি একটি পরিবারের প্রধান হলে যে আত্মত্যাগ করতে হয়, পাড়ার উন্নয়ন কমিটির প্রধান হলে আত্মত্যাগের পরিমাণ আরো বেশি হয়। আর রাজ্যের বা দেশের প্রধান হলে? সহজেই অনুমেয় কি সজাগ সতর্ক হওয়া উচিৎ তাঁর প্রতিটা আচরণকে। প্রধান মানেই নীতির রক্ষার ভার তাঁর উপরে ন্যাস্ত।
 
     কিন্তু দেশের যিনি প্রধান তিনি যদি ব্যক্তিগত সম্পর্ককে নীতির ঊর্ধে স্থান দেন, দলীয় নীতিকে জাতীয় নীতির ঊর্ধ্বে বসান, নীতির ঊর্ধ্বে নীতিধারক হয়ে ওঠেন তখন তা আর যাই হোক গণতন্ত্র থাকে না। সেই স্বৈরতন্ত্র বা ব্যক্তিতন্ত্রে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, লাভ-লোকসানই মূল নির্ধারক বা মাপকাঠি। কোনো ঘটনাকেই আর সমষ্টির স্বার্থে ভাবা সম্ভব না। কোনো বিশেষ ব্যক্তির, বিশেষ পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে বাধ্য করার প্রচেষ্টা চলে। স্তাবকের দল অগ্রগণ্য হন। নিরেপক্ষ দল অত্যাচারিত হন, বিরোধীদল নির্বাসত হন। এর উদাহরণও কালকের অধুনা প্রাপ্ত ইতিহাস থেকে সূদুর ইতিহাসের পাতায় পাতায় সাক্ষ্য বহন করে আসছে।
 
     এর পরিণাম? সে তো সকলেরই জানা। 'অতি দর্পে হর্তা লঙ্কা'। শুধু সময়ের অপেক্ষা। স্তাবক আর স্তাব্য কেউই কালের গতিতে চিরস্থায়ী হতে পারেন না। চিরস্থায়ী নীতিই হল- 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়'।

 

577
Sun, 12/07/2014 - 15:44
গ্রামের বাড়িতে ভোর হতেই কানে আসত গরুর গাড়ির ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ। চোখ বুজে শুয়ে থাকতে থাকতে ভাবতাম ওদের ভয় করে না এত অন্ধকারে যেতে? একটা রোমাঞ্চ হত ভাবতে। কল্পনা করতাম খুব ঘন জঙ্গলের রাস্তায় গরুর গাড়িগুলো যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তার উপরে কিছু মানুষ। তাদের স্কুলে যেতে হয় না, পড়াশোনা করতে হয় না। যে কোনো সময়ে বাঘ আসতে পারে, ভুত আসতে পারে, আরো কত কি আসতে পারে! অথচ তারা নির্ভীক। এগিয়েই যাচ্ছে, এগিয়েই যাচ্ছে।এসব ভাবতে ভাবতে ভোরের আলো ফুটত। ভয়, রোমাঞ্চ আলো ফোটার সাথে সাথেই মিলিয়ে যেতে শুরু করত। আবার নানান খেলায় মেতে উঠতাম সারাদিন। সন্ধ্যে নামলে গরুর গাড়িগুলো আবার ফিরতে শুরু করত। আমি হাঁ করে ওদের দেখতাম। আমার কাছে ওরা তখন হিরো। আমি শহরে বড় হয়েছি। সেখানে গরু বলতে খাটালই দেখেছি। খাটালের বাইরেও যে গরুদের এমন স্বাধীন জীবন থাকে দেখে অবাক হয়ে যেতাম। ভাবতাম কি মজা ওদের! আমাদের পাড়ার খাটালের গরুগুলোর মুখ মনে পড়ে খারাপ লাগত, আহা বেচারারা!  
      এখন গ্রামে গেলে গরুদের না, মানুষগুলোকে দেখে অবাক হই, বিস্মিত হই। মানুষের এত স্বাধীন, এত খোলামেলা, এত বেহিসাবী সময়!   
      মাথার মধ্যে একটা ঠান্ডা হাওয়া অনুভুত হয়। মনে হয় পুরোটা বাঁধা পড়িনি তো! তখনই বাসে ট্রেনে ঝুলন্ত মুখ, মিছিলের মুখ, টাইপরাইটারে, ফাইলের পাহাড়ে গোঁজা মুখ মনে পড়ে যাদের মধ্যে আমারও মুখ। ভাবি উন্নতির জন্য এ বলিদান তো দিতেই হবে। তবে কোথায় কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। কিন্তু দুদন্ড বসে যে ভাবব সে অবকাশ কোথায়? বল যে একটা একটা ড্রপ পড়েই যাচ্ছে, পড়েই যাচ্ছে। খাটালের গরুগুলোকে মনে পড়ছে - কারোর বাতানুকূল খাটাল তো কারোর দেহনুকূল, এই যা!
578
Sat, 11/29/2014 - 19:17

মনোযোগের অভাব- এটা নতুন কোনো সমস্যা না। কিন্তু একটা অন্য কথা বলতে চেষ্টা করছি। মনোযোগ ছাত্র অবস্থায় কি বড় অবস্থায় দুটো কারণে আসতে দেখেছি। এক শাস্তির ভয়ে, যেটার সংখ্যা বেশি, আর এক বোধের উদয়ে। যদি বলি সিগারেট খাওয়া উচিৎ না, তবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করবেন আমি খুব একটা ন্যায্য কথাই বলেছি। কিন্তু কাজে করতে কি পরেরদিনই শুরু করে দেবেন? কক্ষণো না!
     দু'প্রকার লোক তা করে থাকতে পারেন। এক, যিনি কাউকে দেখেছেন কোনো রোগে আক্রান্ত হতে বা নিজে অসুস্থ হয়েছেন। কিম্বা যিনি খানিকটা পড়াশোনা করেই হোক বা যে কোনো কারণেই হোক কিছু একটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন সিগারেট খাওয়ার হানিকর দিকটার ব্যাপারে।
      সৎ জীবন যাপনের বেলাতেও এর ব্যতিক্রম হয় কি? না হয় না। বেশীর ভাগই মানুষই সৎ জীবন যাপন করতে বাধ্য হন। তাই এত পুলিশ, কোর্ট, আইন লাগে লোকের মধ্যে সৎ ভাবটাকে স্থায়ীভাবে বজায় রাখার জন্য। শাস্তির ভয়, অপমানিত হওয়ার ভয়, আর্থিক ক্ষতির ভয় ইত্যাদি নানাবিধ ভয় যখন কোনো মানুষের তথা দেশের নৈতিক জীবন যাপনের মুল অনুপ্রেরণা হয় তখন ভয় বা আইন একটু শিথিল হলেই দুর্নীতির মহামারী শুরু হওয়ার উপক্রম হয়। 'অপরাধ করে যদি শাস্তি এড়ানো যায় তা হলে অপরাধ করব না কেন?' এই 'কেন'-র উত্তর কোনো যুক্তি দিতে পারে বলে আমার মনে হয় না। কারণ নৈতিক স্বচ্ছ থাকার তাগিদটা যদি ব্যক্তিগত না হয় তবে তাকে সার্বজনীন কি করে করা সম্ভব? আবার এর অন্যদিকটাও আছে। কিছু মানুষের ক্ষেত্রে নৈতিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য বাইরে থেকে অনুপ্রেরণা লাগে না, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা দুর্ভাগ্যজনকভাবে সব দেশে, সব কালেই কম। বেশির ভাগ মানুষেরই এর জন্য একটা উৎসাহ, অনুপ্রেরণা বাইরে থেকে প্রয়োজন হয়। যে সমাজ নৈতিকভাবে সুস্থ হওয়ার জন্য যতটা সুযোগ বা পরিবেশ তাকে দিতে পারে সে সমাজ তত বেশি স্বচ্ছ নরনারী জন্ম দেওয়ার অধিকারী হয়। সেই স্থান দেওয়ার প্রধান শর্তই হল তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। যে মানুষ সত্যটাকে প্রধান উপজীব্য করে চলবেন বা সহজ সত্যটাকে সর্বজনসম্মুখে আনতে চাইবেন, তাঁর ততোধিক শত্রুসংখ্যা বাড়বে এ বলা বাহুল্য। কিন্তু তবু সে লড়তে পারে যদি রাজশক্তি তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাতে শাসকদলের সাথে শাষিতের একটা স্বচ্ছ সম্পর্ক গড়ে ওঠার সূত্র তৈরী হয়। কারণ সত্যের একটি অসাধারণত্ব হল, সে স্বপ্রকাশ। সত্যটাকে একজন কৃষাণ মজুর যেভাবে সহজে গ্রহণ করতে পারেন একজন উচ্চ-শিক্ষিত মানুষও সেভাবেই পারেন। যেমনভাবে ভারতের গরীব অশিক্ষিত মানুষের সাথে উচ্চশিক্ষিত মানুষও মহাত্মাকে নিজের লোক বলে মনে করতে পেরেছিলেন। সেটা পেরেছিলেন কি মহাত্মার বাক্যের জোরে? যুক্তির জোরে? না কৌশলে মুগ্ধ হয়ে? না এর কোনোটাই না। মানুষ তাঁকে চিনেছিল, নিজের করে জেনেছিল তাঁর চরিত্রের স্বচ্ছতার জোরে, সত্যের জোরে।
      তাই বলছিলাম, যে রাজশক্তি সাধারণ মানুষের এই ন্যায়ের পথে থাকাটাকে সুরক্ষিত করতে না পারেন সে রাজশক্তি সেই দেশের পক্ষে কখনোই আত্যন্তিক মঙ্গলকর হতে পারে না। কোনো দেশের জনস্বার্থ রক্ষার প্রধান ভিতটাই হল তাকে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। শুধু বাক্যের আস্ফালন, ক্ষমতার প্রদর্শন কালের গতিতে ক্রমশ দুর্বল হতে হতে, দেশের মেরুদন্ডকে ক্ষয় করতে করতে একটা বড়রকম দুঃসময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। যত তাড়াতাড়ি আমরা এটাকে ব্যক্তিগত জীবনে কি সমাজ জীবনে উপলব্ধি করি ততই মঙ্গল।

 

579
Sat, 11/22/2014 - 20:04

সম্পর্কের একটা যত্ন হয়। তাতে 'ধরে রাখা' আর 'ছেড়ে রাখা'র হিসাবটা খুব সহজ হিসাব না। যখন কোনো একটা দিকে ঝোঁক বেশি হয় তখনই সম্পর্কটা ভারসাম্যহীন হতে শুরু করে।
যদি 'ধরে রাখা'র জোরটা খুব বেশি হয় তখন সে সম্পর্কটা ক্রমশ কারাগারের রুপ নেয়। "এত ফোন কেন?"... "এত কৌতুহলের কি আছে?"..."আরে আমার কি ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু থাকতে নেই!"....ইত্যাদি ক্ষোভ, অসন্তোষ বাড়তে শুরু করে, যদিও অনেক সময় তার হয়তো কোনো বাহ্যিক প্রকাশ নাও থাকতে পারে। সেটা আরো ক্ষতিকারক।
     তখন আরেকজনের মনে হয়, "আমি এত যত্ন করি, এত খেয়াল রাখি তবু তার এত মনক্ষুণ্ণতা কিসের? কেন সম্পর্কটা এরকম ছাড়াছাড়া হয়ে পড়ছে? কথায় কথায়, ছোটখাটো ব্যাপারেও এত বিরক্তি কেন?"
      ফলস্বরুপ, দু'জনের মধ্যে যে স্বাভাবিক মানসিক আদান প্রদানের পথ, যেটা বেঁচে থাকার আত্মিক অক্সিজেন, সেটা বন্ধ হতে শুরু করে।
      আর এর উল্টোটা যখন ঘটে। যখন 'ছেড়ে রাখা'র প্রবণতাটার মাত্রা বেশির দিকে হয়ে পড়ে। তখন একজন নিজেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বোধ করতে থাকে। হীনমান্যতায় ভোগা শুরু হয়। কারণ সংসারে নিজেকে নিজের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বানিয়ে রাখবে, বা সম্পূর্ণ আত্মমগ্ন থাকবে, এমন মানুষ প্রশংসনীয় হলেও সংখ্যায় যে কোনো সমাজেই তাঁরা বিরল। সাধারণ মানুষের কাছে আমার গুরুত্ব তোমার ভালবাসায়। আর সে ভালবাসার প্রকাশ হল আমার প্রতি তোমার মনোযোগে। এই সহজ চিরকালীন আটপৌরে হিসেব।
      তাই সে মনোযোগের যখন বাহ্যিক কোনো প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না, কোনো আবেগকেই যখন কথায়-কাজে রুপান্তরিত হতে দেখা যায় না, তখন সম্পর্কের মধ্যে একটা শীতল হিমবাহ তৈরী হতে থাকে। কোনো এক সময়ে দুজনেই আর সেটা অতিক্রম করে একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে না, প্রাণান্তকরভাবে চাইলেও। দীর্ঘদিনের মানসিক অপ্রকাশ তাদের নিজেদের মধ্যে নিজেদের নিয়ে একটা অস্বচ্ছ মাতাজাল তৈরী করে নেয়। একজনের আচরণের কারণ আরেকজন তার কল্পনা অনুযায়ী করতে শুরু করে। "হয়তো আমাকে নিয়ে ওর কোনো অসুবিধা হচ্ছে"...."হয়তো ওর আর কাউকে ভাল লাগতে শুরু করেছে"... "হয়তো ওর কোনো মানসিক সমস্যা আছে".....
      এধরণের হাজার জল্পনা-কল্পনা ক্রমশ সম্পর্কটাকে খাদের ধারে এনে দাঁড় করায়, সত্যিটাকে আড়াল করে। সত্যিটা সামনে এলেও তাকে স্বীকার করার মত মানসিক স্বচ্ছ দৃষ্টি ততদিনে তারা দুজনেই হারিয়ে ফেলেছে।
     তাই শুরুতে বলছিলাম কোনো সম্পর্কের ভারসাম্য রাখাটা খুব সহজ একটা কাজ না। একজনের মন আরেকজনের থেকে অসংবেদনশীল হতেই পারে শুধু না, হয়েই থাকে। একজনের ত্যাগ আরেকজনের থেকে বেশি হয়েই থাকে। তবে তারও একটা সীমা আছে। যে ভাগটা সব সময়েই আমাদের মত পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের ঘাড়েই চাপানোর চেষ্টা চালানো হয়েছে, মেয়েদের হাজার মহত্ত্ব বর্ণনা করে। সে অন্য আলোচনা।
      সজাগ দৃষ্টি, স্বচ্ছ কথাবার্তা আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা যে কোনো সম্পর্ককেই খাদের ধার থেকে বাঁচাতে পারে বলে বিশ্বাস করি। হয়তো সে সম্পর্ক আগের ধারায় বইবে না, তবে সে তার নতুন ধারা বানিয়ে নিতেই পারে। সম্পুর্ণ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার থেকে যা শতগুণে ভাল।

 

580
Mon, 11/17/2014 - 23:56

আমি সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে ছিলাম খানিক আগে। একজন ভদ্রলোক আরেকজনকে তাঁর মেয়ের প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন, "আমার মেয়ে ভীষণ ভাল। সাত চড়ে রা করে না। একদম চুপচাপ থাকে।"
এ কথাটা আমি মেয়েদের প্রশংসার মানদন্ড হিসাবে আগেও শুনেছি। "হাজার বকো একটাও কথা বলবে না "....." আমার মেয়ে ঘর থেকেই বেরোয় না, কারোর সাথে কথা বলে না"..."এমন ঠান্ডা মেয়ে যে খিদে পেলেও মুখ ফুটে বলবে না, আজকাল এরকম ধরণের মেয়ে তো দেখাই যায় না"
আচ্ছা, এগুলো কি সত্যিই খুব প্রশংসনীয় গুণাবলী, না পরিবার তথা সমাজের ব্যর্থতার পরিচায়ক? যে একটা মানুষকে তার স্বাধীনতা, ইচ্ছা, অনিচ্ছা কেড়ে নিয়ে তাকে প্রশংসনীয় বানানোর মহৎকার্য্যটা মধ্যযুগ থেকে করার চেষ্টা চালিয়ে চলেছে?
581
Sat, 11/15/2014 - 20:38


যে যায়, সে যায়।
যে থাকে, সে টেনেবুনে পাঁচ-দশ বছর আরও থাকে।
সেও যেত, কিন্তু তার রয়েছে বেজায়
পিছুটান, কেউ-কেউ রহস্য করে যাকে
বলে মিছুটান।
~ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (মিছুটান)

  "ধুর্, চাকরীটা ছেড়েই দেব ভাবছি, না হলে কিচ্ছু করা হচ্ছে না" - এই বাক্যটা বা এই ধরণের উক্তি আমি আমার বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে শুনেছি, তারপরের পরের থেকে শুরু করে এখনো অবধি শুনে আসছি। সবার কাছ থেকে নয় অবশ্যই, তবে বেশ বড় একটা অংশের থেকেই। ট্রেনে, বাসে চলতে ফিরতেও এই কথাটা প্রায়শই শুনি, "ধুর শালা, এবার ছেড়েই দেব"। আরেকটা মজার জিনিস খেয়াল করেছি, এই মানসিকতাটার উদাহরণ খুব একটা দক্ষিণ বা পশ্চিম ভারতের মধ্যে দেখতে পাই নি, বিশেষ করে দক্ষিণে ভারতে। অবশ্যই সেখানেও ব্যতিক্রম নিশ্চই আছে।
নিজের কাজের প্রতি এই অনীহা অশ্রদ্ধা অতৃপ্তি দেখলে অবাক হতে হয়- কেন? কোথাও যেন একটা মনোভাব - 'ঠিক এই কাজটা করার জন্য আমি জন্মাই নি, আমার অন্য কিছু করার ছিল'। ফলস্বরূপ, সারা জীবন- 'হেথা নয় হেথা নয়, অন্য কোথা অন্য কোনোখানে'।
কিন্তু এতে লাভ? যার সত্যিই কিছু করার আছে, তাকে দেখেছি সে সামনে ঝাঁপ দিয়েছে আগু পিছু না ভেবেই। সেই কথামৃতের গল্পটার মত, ঠাকুরের অনবদ্য ভাষায়। ছেলে মাকে বলছে, "মা, আমি শুলুম, তুমি আমার হাগা পেলে আমাকে তুলে দিও"। মা বলছেন, "বাবা, আমায় তুলতে হবে না, ওই হাগাই তোমায় ঠেলে তুলবে।"
কিন্তু কথা হল বেগ না আসতেও ঘরের কাজ অযত্নে সেরে দরজায় গাড়ু নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকারও তো কোনো কারণ দেখি না, "আহা আমার যদি বাহ্য পেত!" বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলারও কোনো যুক্তি নেই, তাতে ইতঃনষ্ট ততভ্রষ্টই হয় শেষমেশ।
ইতিহাসের দিকে তাকালে খেয়াল করা যায় কারোর কোনো সামাজিক অবস্থাই তার প্রতিভা বিকাশের চূড়ান্ত বাধা হতে পারেনি চিরটাকাল। বহু প্রতিকুলতার মধ্যেও ভ্যান গগের আঁকা থামে নি, খালিল গিবরাণের লেখনী থামে নি, এদেশে তো উদাহরণ দিতে শুরু করলে থামা দায় হবে। ভাগ্য এঁদের জেদের কাছে, নিজের সিদ্ধান্তের সততার কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। যেমন আমরা শুনে এসেছি, 'সূর্য্য উঠলে প্রদীপের প্রয়োজন হয় না তাকে দেখার জন্য'।
কিন্তু সে প্রতিভা যদি না থাকে? তাহলে সাধারণভাবে বাঁচা কি খুব লজ্জার! মাদার টেরেসা একটা সুন্দর কথা বলতেন, "ঈশ্বর আমাকে সফল হওয়ার জন্য পাঠান নি, বিশ্বস্ত হওয়ার জন্য পাঠিয়েছেন"। কি চমৎকার কথা!
কি দরকার সারাদিন ক্ষোভের পর ক্ষোভের পাহাড় জমিয়ে তোলার। যেন আমি বিরাট একটা কেষ্ট বিষ্টু, হতভাগা এই সাধারণ কাজটা আমার সমস্ত প্রতিভার পায়ে শিকল বেঁধে রেখেছে। ছাড়া পেলেই আমি দেখিয়ে দিতাম আমি কে!
স্বামীজির কথা মনে পড়ছে। বলছেন, ছোটবেলা থেকে আমরা সবাই ভাবি, আমরা কোনো বড় কাজ করার জন্য জন্মেছি। তারপর যত বড় হই, প্রকৃতি চড় থাপ্পড় মেরে আমাদের সঠিক জায়গাতে বসিয়ে দেয়। আমরা যদি উপস্থিত কাজটাতে মন প্রাণ লাগিয়ে দিতে পারি, তবেই ভবিষ্যতে আমাদের আরো বড় কাজের জায়গা দেওয়া হবে।
আব্রাহাম লিঙ্কণ-এর জীবনী বোধহয় এর একটা জ্বলন্ত ভাষ্য। আর মনে পড়ে তপন সিনহার বিখ্যাত সিনেমা, 'গল্প হলেও সত্যি'র কথা। এই কথাটারই সুর তাতেও।
আমার কিছু করার ইচ্ছা থাকতেই পারে। আপত্তি নেই। আপত্তি অকারণ আত্মপ্রবঞ্চনায়।
ক্ষতি তো নিজের আর আমাতে ন্যস্ত কাজের। সর্বক্ষণ যদি বিরক্তই থেকে গেলাম নিজের কাজের ওপর তবে সে কাজের মান উন্নত হবে কি করে? পরিষেবায় আন্তরিকতা আসবে কি করে? নিজের কাজের ওপর যদি শ্রদ্ধা না রাখি তবে নিজের ওপরেও স্বাভাবিক শ্রদ্ধা রাখা দায় হবে যে! ক্রমশ পিছনের সারিতে হটতে থাকব। কোনো সৃষ্টিশীলতা থাকবে না।
যেকাজই হোক না, তাকে আমার মত করে পরিপূর্ণতার রূপ দেব শত বাধা অতিক্রম করেও, তবেই যে না আমি সার্থক! তা সে দেশ বিদেশে আমায় চিনুক আর নাই চিনুক!
582
Sun, 11/09/2014 - 18:17
ছোটবেলায় আমার সাথে সাথে ফিরত আমার শৈশব। তার সাথে তার বায়না। সব কিছুই তার খেলার জিনিস। ইচ্ছা হলেই পাওয়ার জিনিস। যোগ্যতা শব্দটা তখন তার অভিধানের বাইরে। বড়দের শাসন, "উঁহু, এরকম করতে নেই", "চাইতে নেই" - গোছের বাক্যগুলোই তখন না-পেতে পাওয়ার একমাত্র বাধা। কেন পেতে নেই, এটা বোঝার, বা তলিয়ে ভাবার থেকে ওটা বড়দের না-দেওয়ার অজুহাত ভাবাটাই স্বাভাবিক তখন। কারণ ওই যে বললাম, যোগ্যতা বলে কিছু হতে পারে এতো তার বোধের বাইরে।        এই স্বভাবটা যখন শৈশব অবধি থাকে তখন সমস্যা নেই। সমস্যা হয় যখন বড় হওয়ার সাথে সাথেও এই 'চাইলেই পেতে পারি' অভ্যাসটা থেকেই যায়। ছোট বয়সে যাকে 'বায়না' বলি, বড় বয়সে সেটাই 'বাসনা'। কিন্তু বাসনা আর বায়নার মুল তফাৎ হল প্রথমটায় যোগ্যতার জ্ঞানটা থাকা যতটা জরুরী, দ্বিতীয়টায় তার প্রশ্নই ওঠেনা। কোনো শিশুর যোগ্যতা অনুযায়ী বায়নার কথা ভাবা, ভাবনারও অতীত। এমনকি মহাপুরুষদের শৈশবের আচরণেও এর ব্যতিক্রম নেই। কিন্তু উল্টোটা যদি হয়, অর্থাৎ বাসনাটা যদি বায়নার স্বভাব নেয়? সে যদি না ভাবে এটা পাওয়ার বা পেয়ে রাখতে পারার যোগ্যতা আমার আছে কি না?        তখন তার নিজের অশান্তি, তাকে ঘিরে থাকা মানুষদেরও অশান্তি। আর সমস্যা হচ্ছে সংসারে কিছু কিছু বোধ আছে যা নিজে থেকে তৈরী না হলে তাকে বাইরে থেকে আনা অসম্ভব। যেমন খেতে বসে কারোর স্বাভাবিকভাবে কতটা খেতে পারি, এ বোধ যদি না থাকে, তবে তা তার নিজের স্বাস্থ্যের পক্ষে কি প্রবল হানিকর সে বলা বাহুল্য।        অনেকের মধ্যে অতিরিক্ত পজিটিভিজম এই বিপত্তিটাকে আরো আস্কারা দিয়ে কোথায় পৌঁছে দেয় তাও দেখেছি। কোথাও যে থামতে হবে, বা থামাটা দরকার এ যেন সে বিশ্বাসই করে উঠতে পারে না। তার শুধু মনে হয় সেটা তার ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার পক্ষে নিদারুন হানিকর চিন্তা। ফলে সে ছুটতেই থাকে ছুটতেই থাকে। তার জুতো ছিঁড়ে যায়, জামা-কাপড় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়, পায়ে ফোস্কা পড়ে, ঘুম ছুটে যায়, তবু সে ছুটেই যায়, ছুটেই যায়। তার বন্ধু-বান্ধবদের হাত ছেড়ে যায়, পরিবারের নাগাল পেরিয়ে যায়, তবু তার ছোটা আর শেষ হয় না। আর পাশে কিছু লোক, কিছু মিডিয়া-প্রদীপের ভুত- "আরো জোরে... আরো জোরে..." বলে চীৎকার করতেই থাকে তার ঘিলুর পাশে, চোখের পাশে, কানের কাছে। সে দৌড়েই যায়, দৌড়েই যায়। অবশেষে প্রকৃতির নিয়মেই হঠাৎ পড়ে যায় মাঝ রাস্তায় মুখ থুবড়ে। মিডিয়ার ভুত আর অত্যুৎসাহীর দল আরেকজনকে খুঁজে নেয়।        সে ক্ষত-বিক্ষত শরীরে রাস্তার ধারে নিঃসঙ্গতায় সেই ছুটন্ত মানুষগুলোর দিকে লোভার্ত, ঈর্ষান্বিত, পীড়িত চোখে তাকিয়ে থাকে। তার নিঃসঙ্গতা আর কাটতেই চায় না। কারণ মানুষের সঙ্গে থাকার অভ্যাসটাই তার হারিয়ে গেছে। বা হয়তো কদাচিৎ তার মনে হয়, "এতটার কি সত্যিই দরকার ছিল!"        কিন্তু ততদিনে তার জীবনে অনেকগুলো বসন্ত পার হয়ে গেছে! তার ফেরার পথ আর এগোবার পথ দুই-ই সপাটে বন্ধ হয়েছে মুখের ওপর। তার মনে হয়, যদি পুরোটাই স্বপ্ন হত! কিন্তু দুঃস্বপ্ন না সুস্বপ্ন সেটাও সে ভাল করে বুঝে উঠতে পারে না। কি উন্নতি!
583
Thu, 10/23/2014 - 23:21
আজ দীপাবলি। চারিদিকে আলোয় আলোকিত। চোখ জুড়িয়ে যায়। মনে আলোর উৎসাহ। “আরো আলো আরো আলো প্রভু নয়নে মম ঢালো”। হ্যাঁ, আরো আলো চাই। শুধু বাইরের নয়নে না, মনের দুটি নয়নেও। কি সে আলো?
সে আলো হল চেতনা। যাকে আমাদের সাধকেরা “মা” বলে ডেকে এসেছেন যুগ যুগ ধরে।
-কোন মা?
-জগতের মা। স্বার্থপরতা, ভয়, লোভ ইত্যাদি সব অশুভ শক্তির যিনি বিনাশ করতে পারেন সেই মা। তাঁকে সাধকেরা বলেছেন কি জানো? শক্তি। যিনি শিবের শক্তি। যিনি মঙ্গলের শক্তি। সেই শক্তিই হলেন চৈতন্যশক্তি, তোমার ভিতর আমার ভিতর। যার জোরে তুমি আমায় চিনছো, জগৎ চিনছো, নিজেকে চিনছো সেই মা, সেই চেতনা।
একবার ভাবোতো সেই আদিকালের কথা। কিভাবে জীবের সৃষ্টি হল। শরীরে প্রাণ হল, প্রাণে মন হল, মন থেকে বুদ্ধি হল, অবশেষে বোধ তৈরী হল। কে সে কারিগর? যে জড়ের রাজ্যে ধীরে ধীরে চেতনার রাজ্য তৈরী করল? সেই মহাচেতনা। যিনি ধীরে ধীরে, যুগ যুগ ধরে এই পথের দিশা দিয়ে আসলেন। মাঝপথে হারিয়ে গেল না, লুপ্ত হয়ে গেল না, বিনাশ হল না।
-কিন্তু আমি তো সে মহাচেতনাকে উপলব্ধি করি না?
-কি করে করবে? ধরো তোমার ঘরে শুধুমাত্র একটা ঘুলঘুলি আছে। তা দিয়ে দিনের আলোর কিছুটা তোমার ঘরে প্রবেশ করে।
তুমি তাই দিয়েই তোমার যাবতীয় দৈনন্দিন কাজ সমাধা করো। কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছো এই আলো কোথা থেকে আসে? যেদিন তুমি ভাবতে শুরু করবে, সেদিন থেকে শুরু হবে তোমার ভিতরে চলার আরম্ভ। তুমি দেখবে ধীরে ধীরে তুমি আলোর ছোট বৃত্ত ছাড়িয়ে আরো বড়ো বৃত্তে পা রাখছো। অনেক সংশয় দূর হচ্ছে, অনেক ভয় ঝরে ঝরে পড়ে যাচ্ছে। তুমি যেন অন্য মানুষ হয়ে যাচ্ছ। তোমার জীবন একটা অব্যক্ত আনন্দে ভরে উঠছে। কারণ যিনি চৈতন্যময়ী, তিনি আনন্দময়ীও তো বটে।
গর্ভধারিণী মা যেমন একটি শিশুর সব দুর্বলতা বোঝেন, জগতের মাও বোঝেন। তুমি বিশ্বাস রাখো। তোমার নাস্তিকতার আবরণ শুধু অজ্ঞতার অভিমান মাত্র। শুধু জানো মা সব জানেন, সব বোঝেন। তুমি যতবার পড়ে যাবে, কাঁদবে “মা” বলে, তিনি ততবার তোমায় কোলে তুলে নেবেন। তুমি আবার ভুলে যাবে, আবার কোল থেকে নামার জন্য ছটফট করবে। মা আবার তোমায় নামিয়ে দেবেন। তুমি খেলতে খেলতে আবার মাকে ভুলবে। আবার পড়বে, আবার কষ্ট পাবে, আবার কাঁদবে। মা আবার আসবেন তোমায় তুলে নিতে কোলে। এ খেলা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। তুমি কে এর অন্যথা করবে?
আজ দীপাবলি। শুধু বাইরে না, ভিতরেও আলো জ্বালার দিন। প্রতিদিনের তুচ্ছতায়, মলিনতায় যে আলো ম্লান হয়ে নিভু নিভু হয়ে আসছে, তাকে আবার জাগিয়ে তোলার দিন আজ। বসো গিয়ে মায়ের মন্দিরে। যেখনেই মাকে মনে পড়ে সেই মায়ের মন্দির। চোখ বন্ধ করো। সমস্ত বুক দিয়ে বিশ্বাস করো, যে শক্তিতে তুমি শক্তিমান, জগৎ চলমান, সে শক্তি তোমার মা! শুধু তোমার না, চোর, বদমাশ, অতিবড় পাষণ্ডেরও মা! তুমি বিচার করতে যেও না। সাধক বলছেন, “শ্যামা মা মোর সর্বঘটে”। আরো আছে। কে খ্রীষ্টান, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ দেখতে যেও না। সাধক গাইছেন, “জেনেছি জেনেছি তারা, জেনেছি তোর ভোজের বাজী/ যে তোমায় যে নামে ডাকে, তাতে তুমি হও মা রাজী”।
শুনলে ভাই! সব মা! তুমি শুধু ভেদ-বুদ্ধি ছাড়ো।

প্রার্থনা করো, যা তোমার চাই। শুধু মনে রেখো তা যেন মঙ্গলের জন্য হয়। তুমি পাবে।
আর সবচেয়ে ভাল হয় যদি চৈতন্য প্রার্থনা করতে পারো। তুমি নিজেই বুঝবে সেদিন কিসে তোমার মঙ্গল।
যেমন সাধক গেয়েছিলেন----
“আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা আনন্দময়ী”

জয় মা! জয় মা! জয় মা!
584
Sat, 10/18/2014 - 19:03
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বললেন, বাপু তোমায় নিজেকে নিজের best friend হতে হবে।
      শুনেই খটকা লাগল। তবে কি আমি নিজে নিজের বন্ধু হতে পারিনি? না সত্যিই পারিনি। শরীরকে যে ভাবে ইচ্ছামত কাজে লাগানো যেতে পারে, মনকে সেভাবে পারে কি?
- না পারে না
- কেন পারে না?
- কারণ মনেরও একটা মন আছে, তাই পারে না।
- মনেরও মন?!
- হ্যাঁ, মনেরও মন। তোমার অতীতের সব চিন্তা, অনুভুতি, অভিজ্ঞতা, ভয়, বাসনা, ক্ষোভ ইত্যাদি সব মিলে একটা মনের মন তৈরি করেছে। তাই তুমি যা বলবে, তাই সে শুনবে কেন? তুমি হাসতে বললেই সে হাসবে, ভাবতে বললেই সে ভাববে, পড়তে বললেই পড়বে - সেটি হবে না। আর সে না করলেই তুমি মুখ হাঁড়ি করে ঘুরে বেড়াবে, আমার মনটা পাজি, হতচ্ছাড়া ইত্যাদি বলে দুষবে।
- হ্যাঁ, এ তো হামেশাই হয়। তবে উপায়?
- উপায়টাই তো ভগবান বললেন, মনের বন্ধু হও।
- সে কিরকম?
- ধরো তোমার ইচ্ছা হল কারোর সাথে বন্ধুত্ব করবে। তখন তুমি কি করো? তার কথা শোনো, তাকে বোঝার চেষ্টা করো, নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করো। সর্বোপরি তার সাথে সময় কাটানোর চেষ্টা করো, তাই তো?
- হ্যাঁ।
- ঠিক তেমনই মনের সাথে কথা বলো, তার কথা শোনো, নিজে বোঝো, তাকেও বোঝাও, অবশ্যই বন্ধুর মত। ধৈর্য্য ধরো। কারণ এ তো আর পাড়ার বা স্কুলের বন্ধু নয়, যে চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারো। এ তোমার ভিতরের বন্ধু। তোমার সাথে রাত-দিন তার ওঠা, বসা, শোয়া। সে তোমায় যতটা বোঝে, এ সংসারে কারোর সাধ্য নেই তোমায় ততখানি গভীরে গিয়ে বোঝে। তাই শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বললেন যে নিজের বন্ধু হও।
যদি না হতে পার?
    ইম্যানুয়েল কান্টের মতে আমাদের মনের মধ্যেই যথেষ্ট বোধশক্তি নিহিত। যাকে উনি self-enlightenment বলছেন। আমরা তার যথোপযুক্ত ব্যবহার না করে করে নিজেদের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করে ফেলছি। নিজে নিজের বন্ধু হতে না চাইলে সে শক্তির অপচয়ই হতে থাকবে যে সারা জীবন! কি ভীষণ ক্ষতি!
     কান্ট আরো বলছেন। বলেছেন মানে, রীতিমত ধমকেছেন! বলেছেন - তা বাপু হবে নাই বা কেন? তোমার ভাল-মন্দের বিচারের ভার তো তুমি বাইরের লোকের হাতে দিয়ে বসে আছো। তোমার পুরুত আছে, গুরু আছে, মহাপুরুষ আছে, বই আছে। তারা তোমার হয়ে সব ভেবে দিচ্ছে। তুমি শুধু অধীন, দীন হয়ে ভাবছ, “যা হোক আমায় তো আর কষ্ট করে ভাবতে হচ্ছে না।”
ফলে তোমার দুর্বলতারও অন্ত নেই আর তোমার অভিভাবকেরও অন্ত নেই। কান্ট একটা দুর্দান্ত উদাহরণ দিচ্ছেন। বলছেন, তুমি যেন পালিত পশু। আর তোমার সমাজের তথাকথিত অভিভাবকেরা তোমার মালিক। তারা তোমায় সারাদিন ভয় দেখাচ্ছেন, “ওদিকে যেও না জুজু আছে, এ দিকে ফিরো না অমুক হবে”। আর তুমি ভয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছো। নানারকম ভয়ের শিকল তোমার পায়ে। অথচ কেউ বলছেন না, “বাবা নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করো। প্রথমে কয়েকবার পড়ে যাবে যদিও, তাতে কিছু হবে না। কিন্তু সারাজীবন অন্যের ঘাড়ে চড়ে বেড়নো ভাল না।“
    কান্ট বলছেন, তা হলে আমরা নিজেরা নিজেদের বন্ধু হয়ে উঠতে পারি না কেন? কারণ সাহসের অভাব, পাছে ভুল হয়! আর তার সাথে আছে অলসতা - আবার ভাবতে হবে!
ভগবান তাই গীতার উক্ত শ্লোকের শেষার্ধে বলছেন, ওহে বন্ধু, নিজেই নিজে উদ্ধার করো।
আগে নিজে নিজের বন্ধু হও। তখন তুমি সবকিছুকেই অনুভব করতে পারবে নিজের সুস্থ উদার চিত্তের কেন্দ্রে। কোনো অন্ধকার মন্দিরের কোণে নয়, অনুষ্ঠানে নয়, অন্ধ অনুকরণেও নয়।
এতেই তোমার মুক্তি। দুর্বলতা, অলসতা থেকেই অজ্ঞানতা। আর অজ্ঞানতা মানেই বাঁধন। সাহস করে খুলেই দেখো না, কি হয়!
585
Sat, 10/11/2014 - 17:38


জীবনের প্রতিটা কোণ যুক্তিতে আলোকিত থাকবে মানুষ এতটা অভিযোজিত হয়ে উঠতে পারেনি। যদি বলি সে শুধু যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হবে এবং সে চেষ্টাই সে সারাজীবন করে যাবে, তবে তাকে ভয়ংকর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। কারণ যুক্তির আলোর এত জোর নেই যে, সে জীবনের সব বাঁক, খানা-খন্দগুলোতে তার হাত ধরে চলবে, তাকে সঠিক পথ দেখাবে। এ যেন দু-ব্যাটারির টর্চ হাতে অ্যামাজনের জঙ্গলে প্রবেশ।
     যুক্তির প্রতি এই অতিশ্রদ্ধা পরবর্তীকালে নানান মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে শুরু করে, যা স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ব্যাঘাত আনতে দেখা যায়।
      প্রথমতঃ সে যখন বুঝতে পারে তার যুক্তির সীমা অথচ তাকে মানতে পারে না, তখন তার মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যা তার আত্মবিশ্বাসের পক্ষে ক্ষতিকর। সে যুক্তি ছেড়ে অপযুক্তির আশ্রয় খোঁজে। সহজভাবে যেখানে ‘বুঝছি না’ বলা যায়, তাকে ‘বুঝেছি’ বলতে অজস্র মিথ্যা যুক্তির আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে হয়। ফলস্বরুপ, তৈরি হয় একটি সংকর চরিত্র। তার কথায় ও কাজে সামঞ্জস্যতা পাওয়া ভার। কারণ বাইরে সে যতই বোঝাক ক্ষুরধার অপযুক্তিতে, ভিতরে সে সেগুলোর অন্তঃসারশূন্যতা জানে।
      এভাবে আরো এগোতে এগোতে ক্রমশঃ তার মধ্যে শুষ্কতা, সন্দেহপ্রবণতা, অতৃপ্ততা বাড়তে থাকে।

      কিন্তু এর বিপরীতটা যদি হয়? যদি তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো যায় যুক্তির সীমারেখা সম্বন্ধে, তা হলে ‘বুঝিনি’ বলতে লজ্জাবোধ করে না। জ্ঞানের আলো না থাকুক, সংশয়ের কুয়াশা থাকে না। সে সত্যের আশ্রয় লাভ করে। ‘বুঝিনি’ বলবার সৎসাহস সে লাভ করে।
      এই ‘বুঝিনি’ বলার মধ্যে যে গৌরব, তা তাকে আরো বৃহৎ সত্যের মধ্যে প্রবেশের অধিকার দেয়। সে বুঝতে পারে ‘হাঁ’ এর মধ্যে যেমন একটা সত্য আছে, ‘না’ এর মধ্যেও ততখানি বা তার থেকে অধিক সত্য আছে। তার মধ্যে জন্ম নেয় একটা গভীর জীবনবোধ। যা ‘না’ থেকে শুরু হয়। আপাতভাবে এটা নঞর্থক শোনালেও, এর থেকেই তৈরি হয় সত্যিকারের সদর্থক মানসিকতা।
     তাকে মানতে হয়, রোগ-শোক-মৃত্যু-পরাজয় সব সত্য। তাকে তার নিজের দর্শন/বিশ্বাস খুঁজে নিতে হয়, যা তার একান্ত ব্যক্তিগত। যেখানে সে জীবনের ‘হাঁ’ আর ‘না’কে নিজের মত করে মেলায়। সেই বিশ্বাসে সে দাঁড়ায় নিজের মুখোমুখি। প্রশ্নের মীমাংসা করতে না পারুক, তাকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। ‘জানি না’ বলে সে যুক্তির অহংকার বিসর্জন দেয়। সে আশ্রয় পায় তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস/দর্শন-এ। সেটি নিয়ে তর্ক চলে না, তাকে বুঝতে হবে। কারণ তর্ক নামক বস্তুটা একান্ত যুক্তির রাজ্যের। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক-
     আমি তুমি দু'জনেই জামা কিনতে যেতে পারি একসাথে, কারণ জামাটা প্রয়োজন সে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তুমি লাল জামা কিনলে বলে আমায়ও লাল জামা কিনতে হবে, আর তা না হলে আমারটা জামা-ই নয় এটা কোনো পরিণত মানসিকতার লক্ষণ না।
     আমরা দু'জনেই দুটো ভিন্ন রঙের জামা কিনে পাশাপাশি যেমন ফিরতে পারি, তেমন দু'রকম বিশ্বাস নিয়েও পাশাপাশি চলতেই পারি শুধু না, চলতে হবেই।
   সেই বিশ্বাসকে নিজের জীবনে জাগিয়ে তুলতে হবে। আনতে হবে বলব না। কারণ জন্মগতভাবে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মানসিকতা উপযোগী বিশ্বাস নিয়েই জন্মাই। তাকে যদি সঠিকভাবে লালন করার, চর্চা করার সুযোগ দেওয়া যায় তবে তা জীবনকে অনেক বেশি সামঞ্জস্যতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাতে ছদ্ম-জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা কমে, স্বচ্ছ মানুষের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করি। মানুষের বিভ্রান্তি কমবে। অনেক রকম মানসিক ব্যাধিও কমবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই চিরপূরাতন কথাটা দিয়েই ইতি টানি-
                                 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর'

 

586
Sun, 09/07/2014 - 08:55


এক ঘটি জল পুকুর থেকে তুলে পাড়ে রাখলাম কি ঘরে আনলাম।

     কেউ বলল তাকে ঘটির জল আবার কেউ বলল পুকুরের জল। দু’জনেই সত্যি। তবে যে বলল পুকুরের জল সে আরেকটু বেশি সত্যি।
     আমার যে চেতনা, তা খণ্ড চেতনা। মূল যে অখণ্ড চেতনা তার অংশ। তাই কেউ বলল, "এ হলাম আমি", আবার কেউ বলল, "হে অখন্ড আমি তোমার অংশ। তুমি প্রভু, আমি দাস।"

     এই ক্ষেত্রেও দুজনেই সত্যি। তবে দ্বিতীয় জন বেশি সত্যি।
     পৃথিবীর সব কটি প্রধান ধর্মের মূল সুর হল আমাকে এই অখণ্ড সত্তাটিকে অনুভব করতেই হবে। না হলে আমার মানুষ হয়ে আসাটা পূর্ণতা পাবে না। ব্যর্থ হবে।
     সব ধর্মগুলির ফেরার পথের যে দিশা আছে প্রধানত তা দুই ধারার। এক, জ্ঞানের পথ। দুই, ভক্তির পথ।
     সে বিষয়ে যাওয়ার আগে একটু খণ্ড চেতনার দিকে তাকানো যাক।
     আমার আমি এই খণ্ড চেতনা। সে যা সত্যি বলে জানে তাও তাই খণ্ড সত্যিই। কারণ খণ্ড সত্যি দিয়ে অখণ্ড সত্যকে জানা সম্ভব না। ঠিক যেমন এক ফালি জানলা দিয়ে পুরো আকাশ দেখা সম্ভব না। তাই আমার আকাশে রামধনু দেখা গেলেও তোমার আকাশে শুধুই কালো মেঘ। কারণ আমরা একই সময়ে দুটো ভিন্ন জানলা দিয়ে দু’টুকরো আকাশ দেখছি।
     এই ঘটনাকেই অন্ধের হস্তি দর্শন ঠাকুর বলতেন। কয়েক জন অন্ধ হাতি দেখতে গেল। হাত দিয়ে ছুঁলো। কেউ বলল থামের মত, সে পা ধরেছিল। কেউ বলল সরু, সে লেজ ধরেছিল। এরকম কেউ শুঁড়, কেউ মাথা ইত্যাদি ধরে তার মতই বর্ণনা করতে লাগল।
     এই হল খণ্ড চেতনার উপলব্ধ খণ্ড সত্য। এতে দৈনন্দিন জীবন চলে যায়। এতে বিজ্ঞান, সাহিত্য, নীতি বোঝা যায়। সব বেশ চলেই যায়। কিন্তু গোল বাধে তখন যখন হঠাৎ কোন এক মুহুর্তে তার মনে প্রশ্ন আসে, "আমি কে?"
     ব্যস তার সব গুলিয়ে গেল। তার চারিদিকে সব অর্থহীন লাগতে লাগল। পাগল হল। একে শাস্ত্রে বলে বৈরাগ্য, তীব্র বৈরাগ্য।
     সে জনে জনে জিজ্ঞাসা করে ফেরে, "হ্যাঁ গো এ কোন পুকুরের জল তোমার ঘটে, আমার ঘটে।"
     লোকে বলে, "ও কি আহম্মকি কথা, পুকুরের জল কেন হতে যাবে, এতো আমারই ঘটের জল।"
     সে মনে মনে বলে, "না গো না, এ আমার না। তুমি ঘুমিয়ে আছো।", সে পথ খোঁজে। পুকুরে যাওয়ার পথ, মিলনের পথ।
     এবার দুই পথের কথায় আসা যাক। প্রথম জ্ঞান। এ পথকে অভাবের পথ বলা হয়। ভাব অর্থাৎ emotion. এই ক্ষেত্রে বিচারই হল আসল। মূল কথা হল- বাবা, ঘটখানি দু’দিনের জন্য। আজ বা কাল ভাঙবে। তুমি সেই অখণ্ড পুকুরের জল। নিজেকে ঘট ভাবা বন্ধ করো। অর্থাৎ দেহাত্মভাব কদাপি না। ভাবো আমি সেই অখণ্ড চেতনার অংশ।
     বেশ কঠিন পথ। গীতায় ভগবান বলছেন, বাবা দেহধারী হয়েও দেহকে অস্বীকার করা চাট্টিখানি কথা না। পথে কিছু ভুল নেই। তবে কঠিন, এই যা।
     রামকৃষ্ণ দেবেরও তাই মত- কলিতে অন্নগত প্রাণ, ভক্তিপথই ভাল।
     অতএব ভক্তিপথ। এখানে ঘট ভাঙা বা অস্বীকার করার কথা না। ঘটটিকে পুকুরের মধ্যেই স্থাপন করার কথা। বিশ্বাসের কথা, ভাবের কথা, ভক্তির কথা।
     আমি রইলাম ঘট নিয়েই তোমার মধ্যে। এ ঘট তোমার বানানো প্রভু। তোমার ইচ্ছা রাখো কি না রাখো। আমি শুধু জানি আমার ঘটের সব জল তোমার, আমি রইলাম তোমার মাঝে তোমার হয়ে।
     এ হল লীলার কথা। ভক্ত গান বাঁধল, স্তব রচনা করল, মালা গাঁথল। যুগে যুগে পৃথিবীর দিকে দিকে এঁরা এসেছেন, আছেন আর আসবেনও। সুফী থেকে বাউল, খৃষ্টীয় প্রেমিক সাধক থেকে ফকির সব প্রেমে পাগল। মরমী হয়ে মানুষকে অমৃতের স্বাদ মর্মে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর গান দিয়ে জীবন দিয়ে।
     তাঁদেরই শরণাগত হই। পুকুরে নামব তাঁদের হাত ধরে।
     শাস্ত্র বলেন, ভক্ত কৃপা হরি কৃপা থেকে শক্তিশালী। তাই তাদেরই পথ চেয়ে বসে। কার পায়ে সে পুকুরের পাড়ের মাটি লেগে খুঁজছি। যেতে তো হবেই।
     তাই দুয়ারে বসে গাই-
                       "আমারে কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই আপনারে"

 

     কেউ তো আসবেনই এ পথে, যাব তার সাথে পুকুরে।

587
Sun, 08/17/2014 - 08:45

বাঁচাটাকে easy করার চেষ্টায় আছি। তাই আইন কানুন তৈরি হল, বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দূরত্ব কমানো গেল, আয়ু বাড়ানো গেল, শ্রম কমানো গেল আরো কত কি, কত কি হল। এসব হয়ে চলেছে আর হবেও। সেটাই স্বাভাবিক। যদি জীবনটাতে আরেকটু স্বাচ্ছন্দ্য আনা যায়। আসছেও তো। তবু?
     হ্যাঁ ওই তবুটাকে আর কিছুতেই পাশ কাটানো যাচ্ছে না। কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকেই যাচ্ছে। প্রথম প্রথম ভাবতাম আমার বুদ্ধিশুদ্ধি কম বলে হয়তো ঠিক বাগে আনতে পারছিনা জীবনটাকে। ও বাবা! চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি না তো! মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেঝে খুঁড়লেই তো সেই ধুলো বালি পোকা। তাই মার্বেলে এখন আর বিশ্বাস নেই। সে বাইরেই ভাল।

     আমাদের আশ্রমিক (আশ্রমিক মানে গেরুয়াধারীদের আখড়া না। যে অর্থে চতুরাশ্রম সেই অর্থে) জীবনগুলোতে একটা সাধারণ ভাব চোখে পড়ত। সহজভাব। এই শব্দটার যে কি মাহাত্ম্য তা ভাবলে আশ্চর্য্য হতে হয়।

     ধরা যাক আমাদের অভিব্যক্তি। আমি সহজভাবে দেখব, চলব, কথা বলব, খাব বলে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে প্রকৃতি কি পরিশ্রমটাই না করল।
     এক একটা মডেল আনল, কিছুদিন চালাল। যদি সে মডেল সহজ সুরটা ধরতে পারল, তো পেল ছাড়পত্র। না তো বাতিল। তার ঠাঁই হল Hall of Fame-এ।
     এই শরীরটার দিকে তাকাই। সেখানে কোষে কোষে কি পরিশ্রমটাই চলেছে আমার বেঁচে থাকাটাকে সহজ রাখতে। তার উপর আছে বিদেশী জীবাণুর আক্রমণ। প্রতি মুহুর্ত্তে তাকে সজাগ থাকতে হয়, যেন তাল না কাটে।

     এবার মনের কথায় আসা যাক। সেখানেই যত গোল। তার ধর্মই গোল পাকানো। তার হাজার প্রশ্ন, কৌতুহল, চাহিদা। তার সাথে রাগ, অভিমান, ক্ষোভ। চূড়ান্ত পর্যায়ে অবসাদ, ভারসাম্যহীনতা, আত্মহনন।
     তার দুটো সমস্যা। এক, নিজেকে নিয়ে। দুই, তার চারপাশকে নিয়ে।
     বার্টান্ড রাসেল তাঁর বিখ্যাত বই 'CONQUEST OF HAPPINESS'-এ সুন্দর একটা উপসংহার টেনেছেন এই বিষয়টার। বলছেন - জীবনটাকে বিলিয়ার্ড বোর্ড করে তুলো না। এ যেন শুধু এই গুটির সাথে ওই গুটির সংঘর্ষ। না, সেরকম না। একটা সামঞ্জস্যতা আনো। কি রকম সামঞ্জস্যতা? তোমার নিজের সাথে নিজের আবার তোমার চারপাশের সাথে তোমার।
     কি চমৎকার কথা!

    এখন উপায়?

     একটু এথেন্সের দিকে যাওয়া যাক। তিন দিকপাল। সক্রেতিস- প্লেটো – অ্যারিস্টটল। বললেন একটা অদ্ভুত পথ - মধ্যপথ। সক্রেতিস এর আভাস দিলেন। প্লেটো তাঁর কালজয়ী 'The Republic' বইতে কিছুটা উল্লেখ করলেন। অ্যারিস্টটল তাঁর আরেক বিখ্যাত বই, 'The Nicomachean Ethics'-এ বিশদ ব্যাখ্যা করলেন। বললেন দেখো, মাঝামাঝি একটা রফা করো। অতিসাহস, নির্লজ্জতা, আবেগপ্রবণতা এইগুলো যেমন ক্ষতিকর; তেমনই ভীরুতা, অতিলজ্জা, আবেগহীনতা ততটাই ক্ষতিকর। তুমি মাঝামাঝি এসো। দু'দিকের চূড়ান্ত দিকটা ত্যাগ করো। একে পাশ্চাত্য পন্ডিতেরা বলেন 'Golden Mean তত্ত্ব।
     সুন্দর প্রস্তাব। আমাদের দেশেও গীতায় সামঞ্জস্যতা পূর্ণ আচরণের কথা এসেছে। বলছেন, না তো প্রচুর খাও বা অনাহারে থাকো, না তো খুব ঘুমাও বা খুব জেগে থাকো।
    এরকম আর কি। তাছাড়া যাকে আমরা সত্ত্বগুণ বলি তাও এই দুই চূড়ান্ত ভাবেরই মধ্যবস্থা। 'তমো' মানে ম্যাদাটে ভাব আর 'রজো' মানে হুজুগে ভাব, এই দু'টোই ছাড়ো বাবা, মধ্যপথে এসো দিকিনি।
     বুদ্ধদেবও তাই উপলব্ধি করলেন। ভাগ্যে সুজাতা পায়েস রেঁধে দু'চামচ খাইয়েছিলেন। না হলে বেঘোরে প্রাণটা যেত অমন ভাল মানুষটার। না খেয়ে না খেয়ে শরীরটার অবস্থা বেগতিক। দাঁড়াতে গেলেই মাথা ঘুরছে, পা টলছে - ভারী মুশকিল। সুজাতার দেওয়া পায়েস খেয়ে উনি অনুভব করলেন মধ্যপথের কথা। বললেন তাঁর মত করে - সত্য উপলব্ধি করতে শরীরকে কষ্ট দেওয়ারও মানে হয় না আবার তাকে আদরে বাঁদর করারও মানে হয় না। তারপর তো প্রচারিত হল ওনার জগৎ বিখ্যাত 'মধ্যপথ' বা 'Middle Path' তত্ত্ব।
     আর আমাদের ঠাকুমা দিদিমারা?
    তাঁরা একটা দারুন কথা বলতেন, "অতি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে / অতি ছোটো হোয়ো না, ছাগলে মুড়াবে"। ভাব একবার! কত সহজে এক প্যাঁটরায় মায় সক্রেতিস থেকে বুদ্ধ অবধি বলে ফেললেন!

     আর সব শেষে আসি আমাদের পাগলা ঠাকুরে। তিনি কি বলেন নি এই মধ্যপথের কথা? বলেছেনই তো। তাঁর অনবদ্য ভাষায়,
     "থাকো রসে বশে।"

588
Sun, 08/10/2014 - 08:53
  অহংকার কার না আছে। যে মানুষটা জানে তার অহংকার নেই তার সেই স্বঘোষিত নিরহংকারের দাবী যে কি মারাত্মক তা তার আশেপাশের মানুষই টের পান।      অহংকার সুক্ষ্ম-স্থূল অনেক প্রকারই হতে পারে, সেটা নিয়ে আলোচনা না। আজ বলতে ইচ্ছা করছে ছদ্ম অহংকারের কথা। তার কতকগুলো রুপ আছে। কয়েকটা নেড়ে ঘেঁটে দেখা যাক।    প্রথম - বিনয়:    না না, সত্যকারের বিনয় না। সে তো অনেক ভাগ্য করলে মানুষের চিত্তে উদয় হয়। আমি বলছি কপট বিনয়ের কথা। "হে হে, আমি আবার কেন?"..."আহা আমি হলাম গিয়ে সাধারণ মানুষ"......"আরে আমার জন্য এত ব্যস্ততা কেন!"....ইত্যাদি। এদের মধ্যে "আমি অতি সাধারণ মানুষ" উক্তিটি সবচেয়ে ভয়ংকর। যে মানুষ নিজেকে সাধারণ বলে ঘোষণা করে প্রতি মুহুর্তে, নিজেকে সে যে কি অসাধারণ আসনে বসিয়ে রেখেছে সে সেই জানে।       দু'টো কারণে এ ঘোষণা আসে। এক, নিজেকে বিধিসম্মতভাবে বিনয়ী দেখাবার জন্য। কারণ ইতিহাস সাক্ষী, জ্ঞানী-গুণী মানুষজন চিরকালই নম্র। কিন্তু সে বোঝে না যে সে নম্রতা তাঁদের উপলব্ধ জ্ঞানই তাঁদের দিয়েছে। অভ্যাসে রপ্ত করতে হয় নি। ইংরাজীতে কার একটা উক্তি শুনেছিলাম, "তুমি অতটা নম্রতা দেখিও না, কারণ তুমি ততটা মহৎ নও।"  আরেকটা কারণ - ঢাল হিসাবে। "আমি সাধারণ মানুষ" - এই হল ঢাল। সব পাপ, সব অন্যায় সমস্তটাই ওই 'সাধারণ মানুষের' তকমায় ঢেকে ফেলতে চায়। এপক্ষের ধারণা আমি সাধারণ মানুষ যখন, তখন সব কিছু দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অধিকার আমার আছে। আর সব যা কিছু শুভ, মঙ্গলদায়ক তার জন্য সর্বজনখ্যাত মহান ব্যক্তিরা তো রইলেনই। এর তীর্যক ফলস্বরূপ যা কিছু ভাল বা মার্জিত তার উপরই এর তীব্র আক্রোশ আর তার সাথে সন্দেহও - "সত্যিই কি? না ভন্ডামী!"    দ্বিতীয় - নীতি নিপুণতা:    এ আরেক মুখোশ। সত্যিকারের নীতিনিপুণ না। তার জন্য যথেষ্ট ত্যাগ আর ভালবাসা প্রয়োজন। সে নীতি 'সেফটি-পিন'এর মত এর তার গায়ে ফোটাবার কাজে লাগে না। সে নিজেই নিজেতে সম্পূর্ণ। "ন ব্রুয়াৎ সত্যম অপ্রিয়ম"- অপ্রিয় সত্য বোলো না।       এ তা না। এ হল স্বার্থে ঘা লাগার নীতি- নিপুণতা। "আমি বাবা সব সময় সত্যি কথা বলতেই ভালবাসি".... "আমি আবার অন্যায় সহ্য করতে পারি না"...."আমার কাছ স্পষ্ট কথা".....ইত্যাদি।       প্রথমদিকে মনে হবে সত্যিই কি ন্যায়বোধ। মিথ্যাটা বা তিলমাত্র অন্যায়টা সহ্য হয় না। ও বাবা, আরেকটু কাছ থেকে দেখো। হয়তো দেখলে নিজের ছেলে বউ পিটিয়ে আসল তাতে কিছু বললেন না। কিন্তু পেপার দিতে দেরি করছে পেপারওয়ালা, অমনি বলবেন, "আমি নীতিতে বিশ্বাসী, ৬টার কাগজ সাড়ে ৬টা হবে কেন?" বা "আমার ফাঁকি সহ্য হয় না" বা "দেখো এটা রাগের কথা না। নীতির কথা" - এরকমভাবে বাক্য শুরু হল। তারপর নীতিতত্বের আড়ালে অহংতত্ব ফোঁস ফোঁস করছে, কান পাতলেই শোনা যাবে।  এরকম অজস্র উদাহরণ আশে পাশে তাকালেই দেখা যাবে, নীতিহীনতা আর কপট নীতিপরায়ণতার ডুয়াল মোড নিয়ে কত কান্ড চারিদিকে।    তৃতীয় - উল্টো কেস:    শীর্ষেন্দু মুখার্জীর 'বিপিন বাবুর বিপদ' মনে আছে? সেই বিপিনবাবু শুয়ে শুয়ে নিজের দু:খের কথা ভাবতে বড় ভালবাসতেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর চোখে জল চলে আসত, আর তাঁর মনটা হালকা হয়ে যেত।       এ অদ্ভুত এক অহংকার। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে দু:খী, দুর্ভাগা, বঞ্চিত মানুষ। "যখনই আমি বেরোব তখনই বৃষ্টি হওয়া চাই/ ট্রেনে বাদুড়ঝোলা ভীড় হওয়া চাই/ অবরোধ হওয়া চাই" ইত্যাদি। "আমার বেলাতেই পরীক্ষার প্রশ্ন কঠিন আসে", "আমার দিকে ভগবানের মুখ তুলে তাকানোর সময় কোথায়?"       এরকম হাজার অভিযোগ। শ্রীঅরবিন্দ এই ধরণের অহংকারকে বলতেন, 'তামসিক অহংকার'। তিনি বলতেন, এইক্ষেত্রে এদের সবসময়েই মনে হয় পৃথিবীতে যা কিছু ঘটছে তাকে কেন্দ্র করেই ঘটছে। সব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। মানুষ-ভাগ্য-ভগবান সব তার বিরুদ্ধে। এমনকি সে নিজেও যেন নিজের বিরুদ্ধে। খুব জটিল। অনেকটা কপট বিনয়ের মত। কিন্তু সেখানে অভিযোগটা কম। এখানে অভিযোগটাই বাদী সুর।         এরকম ছদ্ম অহংকারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া খুবই শক্ত, কারণ তেনাদের ভীষণ সুক্ষ্ণগতি। তবে মনের আরো অনেক বিকারের মত এরও একই দুর্বলতা। এদের যত শক্তি ছদ্মবেশের আড়ালেই। একবার চিনে ফেললে এদের উৎপাতটা অনেক কমে যায় মনোরাজ্যে।    সেই পরমহংসদেবের গল্প-       একজন বাঘের ছাল পরে ভয় দেখাচ্ছিল। যাকে ভয় দেখাচ্ছিল সে চিনে নিল। বলল, তুমি আমাদের হরে না? অমনি যে ভয় দেখাচ্ছিল সে হাসতে হাসতে চলে গেল।    এই তো। আর কি!
589
Sun, 08/03/2014 - 08:16
  তাকালেই কি দেখা যায়? না বোধহয়।         তাই যদি হত তা হলে হয়তো বা দেখতাম একটা হনুমান কলার কাঁদি পাশে রেখে ফুলের শোভায় বিমোহিত হয়ে মালা গাঁথতে বসেছে, আর গুনগুন করে গাইছে, "পরাবো বলিয়া তোমার গলায় সাধের মালাটি গেঁথেছি।"       কিম্বা হয়তো দেখতাম গরুগুলো জাবর কাটা ছেড়ে শরতের নীলাকাশে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে, কারোর বা আবার আঁখি ছলছল, "চাহি তোমার পানে।"       না, এরকম কোন ঘটনা ঘটেনা। কারণ তাকালেই আমরা দেখি না। দেখার কতগুলো ধাপ ভাবা যেতে পারে।      ১) চর্ম চক্ষুঃ         এ নিয়ে জীব বিজ্ঞানীদের ভান্ডারে প্রভূত তথ্য। কি ভাবে চোখের উৎপত্তি, আর ক্রমবিকাশ। আমাদের চোখ অবশ্যই তার উৎকৃষ্ট নমুনার মধ্যেই পড়ে।  এই চর্মচক্ষে আমরা যা দেখি তা শুধুই ঘটনা। আমি পদার্থ বিজ্ঞানের ভ্রান্তি, প্রতিসরণ এসব জটিলতায় যাচ্ছি না। তাই শুধুই বলি 'ঘটনা'।    ২) মানস চক্ষুঃ         আমি জানলা দিয়ে সামনের বট গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই পারি। তবু আমার চোখে পড়বে না তাতে খুব সুন্দর একটা পাখি এসে বসেছে, যদি না আমার মন সেই সময় চোখের সাথে থাকে। মন চলমান ঘটনাগুলোর মধ্যে পারম্পর্য্য খুঁজে বার করে। তার অর্থ বার করে। তাৎপর্য্য বার করে, এসব অবশ্যই নির্ভর করে তার শিক্ষা ও মানসিক প্রবণতার উপর।  একে এক কথায় বলা যায় অভিজ্ঞতা।  এতটাই সাধারণ দেখার শ্রেষ্ঠ ধাপ।         এরপর আরেকটা ধাপের কথা আছে।    ৩) আত্ম চক্ষু বা জ্ঞান চক্ষুঃ         গীতায় একটা কথা বেশ কয়েকবার উচ্চারিত হয়েছে খুব রহস্যের সাথে, "য পশ্যতি স পশ্যতি" - যে দেখে সেই দেখে।       আমার বন্ধুরা যাঁরা বেশ ভাল ক্যামেরা ব্যবহার করেন সেখানে দেখেছি একটা বিশেষ ছবি তোলার পদ্ধতি আছে - 'Panaromic view'. তুমি এ মাথা থেকে ও মাথা নিরবিচ্ছিন্ন ক্যামেরা ঘুরিয়ে একটা ছবি ওঠালে। পুরোটাই একটা ছবি হয়ে একটা ফ্রেমে বাঁধা পড়ল। ব্যাপারটা এরকম।       গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জীবন-মৃত্যুকে একটা প্যানারমিক দৃষ্টিতে দেখালেন। খন্ডিত না করে। অর্জুনের মোহ অপসারিত হল। তিনি এমন কিছু উপলব্ধি করলেন যা তাঁকে তাঁর সংশয়গুলোর হাত থেকে মুক্তি দিল।      তিনি বুঝলেন সংশয় কোন উত্তরে মেটে না, সংশয়ের পারে গেলে সংশয়ের উৎসটা চোখে পড়ে, তখন সংশয়টা উধাও হয়ে যায়।         এরপর?       এরপর সাম্য দৃষ্টির কথা। সব করো, কিন্তু বুদ্ধিটাকে সজাগ রেখে। সাম্যতা মানেই জাগ্রতাবস্থা। কোন রকম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা মানসম্মানের তোয়াক্কা কোরো না। তাহলে এদের বিপরীতগুলোও তোমায় আর পেড়ে ফেলবে না। ফলস্বরূপ যতটা উদ্বিগ্নতা মন তৈরি করে কাজের বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে, ততটা হবে না।       করা শক্ত। অবশ্যই। তাই গীতা বলছেন, ধীরে ধীরে এগোও। কেউ তাড়া দিচ্ছে না। আর যতটাই এগোবে ততটাই তোমার লাভ। কারণ ততটাতেই তুমি স্ব-প্রতিষ্ঠিত, স্থির, নির্ভীক।       তাই আমাদের শাস্ত্রে গুরুর প্রণাম মন্ত্রে বলেছেন, "যিনি চক্ষু উন্মীলিত করেন তাঁকে প্রণাম করি।" অন্য অর্থে যিনি দেখতে শেখান তিনিই গুরু।       বুদ্ধদেবও তাঁর 'অষ্টাঙ্গিক মার্গে'-এ বলছেন, বাপু প্রথমে দেখাটা ঠিক করো। অর্থাৎ 'সত্য দৃষ্টি' আনো। বাকিটা এমনিই শুধরে যাবে।       স্বর্গে যাওয়ার মতলব ছাড়। ওখানেও pollution, politics, frustration আর সর্বোপরি corruption. যা হওয়ার এখানেই হবে। জগতে একটাই অপরিবর্তনীয়, স্থির সত্য - 'সব কিছুই পরিবর্তনশীল।' এইটাকে বুদ্ধিতে স্থির রাখো, শান্ত হও। ইহলোকেই ইসপার কি উসপার। দেখার ভঙ্গীটা শুধু বদলাও।       সাম্য দৃষ্টিটাকে রপ্ত করো। তাতে এমন কিছু হবে যা তোমার পুরো জীবনটাকেই অন্য স্রোতে বইয়ে দেবে।         তাই বলছিলাম কত রকম দেখার কথা। সব শেষে বলি, চন্দ্র সূর্য্য আকাশ বাতাস বন জঙ্গল বর্ষা বসন্ত নদী পাহাড় সমুদ্র সবই তো ছিল, কিন্তু রবি ঠাকুর না থাকলে দেখতে শেখাতো কে?
590
Sun, 07/27/2014 - 15:16

বলা হয় আমাদের ধর্মে, দর্শনে ব্যবহারিক দিকটা তেমন গুরুত্ব পায়নি যতটা পেয়েছে তার ভাবের দিকটা। কথাটা কিছুটা সত্য তো বটেই। সে নিয়ে অনেক লেখা, আলোচনা ভাষণ আছে। সে থাক। বরং দুটি মূল ব্যবহারিক দিক নিয়ে আলোচনা করা যাক।
     ব্যবহার প্রধানত দু প্রকার। এক, অন্যের সাথে আমার ব্যবহার। দুই, নিজের সাথে নিজের ব্যবহার। এবং অবশ্যই এরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্কিত, অর্থাৎ একের প্রভাব অন্যতে পড়ে।
অন্যের সাথে আমার ব্যবহারের রকম অজস্র। যেমন অফিসে, বস - কলিগ (শত্রুপক্ষ + মিত্রপক্ষ + সুবিধাবাদী পক্ষ + উদাসীন পক্ষ ইত্যাদি) - ক্লায়েন্ট - বয় ইত্যাদি। অন্যদিকে পরিবার তো মহাভারত। এরপর পাড়াতুতো, ক্লাবতুতো, ট্রেনতুতো হাজার রকম মানুষ আর হাজার রকম ব্যবহার।
     এসবের মধ্যে ব্যালেন্স করে চলতে গেলে আমাদের শাস্ত্রমতে দুটো ব্যবহার পদ্ধতি খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয় রোজকার জীবনে। এক, শ্রদ্ধা; দুই, সন্তুষ্টি।
     শ্রদ্ধা অর্থাৎ একটা পজিটিভ অ্যটিটিউড। ভাগবতে আছে, প্রহ্লাদজীকে হিরণ্যকশিপু পাঠিয়েছেন দৈত্যদের টিউটোরিয়ালে। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের সিলেবাস কিছুতেই পছন্দ না প্রহ্লাদজীর। সে নিয়ে তো রোজ অশান্তি।
      এদিকে প্রহ্লাদজীর ব্যবহারের এমন এক মাধুর্য্য যে তাঁর সহপাঠীরা ধীরে ধীরে তাঁর প্রতি অনুরক্ত হতে শুরু করেছেন। কিন্তু হলে হবে কি, গুরুর ভয়ে আর কিছু বলতেই পারেন না।
     একদিন হল কি, দৈত্যগুরু গেলেন কি কাজে শহরে। ব্যাস, ছাত্রদের আর পায় কে। সবাই ধরে বসল প্রহ্লাদজীকে। তারা জানতে চায়, কি তাঁর মনোভাব? কেন তিনি এত অত্যাচারিত হয়েও নিজের বিশ্বাসের ওপর এত অটল? আর সর্বোপরি কি এমন তিনি উপলব্ধি করেছেন যে তাঁর মুখে এমন স্বর্গীয় প্রসন্নতা!
     প্রহ্লাদজী তাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। শিক্ষা দিলেন সংসার, জগৎ, ঈশ্বর ইত্যাদি সম্বন্ধে। কিন্তু সব শেষে বললেন দারুন একটা কথা। তিনি বললেন- দেখো, পরমাত্মা সব খানে, সব সময়ে, সব অবস্থায় বিরাজমান। তাঁকে প্রসন্ন করতে তোমায় কোন যাগযজ্ঞ বা সুকঠিন তপস্যা করতে হবে না। তুমি শুধু সবার প্রতি শ্রদ্ধাটা রেখো তোমার আচরণে। ব্যস তা হলেই হবে। তিনি সন্তুষ্ট। আর যিনি সব, তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট থাকলে তোমার কিসের অভাব?
      কি আশ্চর্য কথা! অথচ এই দেশেই লক্ষ টাকার প্যান্ডেল, লক্ষ টাকার মন্দির, ধর্মের নামে শোষণ পীড়ন আরো কত কি! বাপ রে বাপ! কে শেখালো এসব? দৈত্যগুরু?
     সে যাক। এই হল শ্রদ্ধা। আচরণ ভিন্ন হোক, কিন্তু মূল সুরটা যেন একই থাকে, শ্রদ্ধা। পরমহংসদেব এই ব্যবহার পদ্ধতিকেই বলতেন 'বাঘ নারায়ণ', দুর থেকে প্রণাম করার কথা।
যেমন আমাদের কান শোনে শব্দ, মন সেই শব্দে পায় সংগীত। আমাদের চোখ দেখে আকার, মন সেই আকারে দেখে ছবি। এই সংগীত, ছবি যেমন বাইরে কোথাও নেই, তা আমারই মনের প্রতিফলন। তেমনই পরমাত্মাও বাইরে কোথায়? তা তো আমারই শ্রদ্ধার প্রতিফলন। যা আমার মনের কেন্দ্রেই আছে। একেই পরমহংসদেব বলতেন চোখে ন্যাবা লাগলে সব হলুদ দেখানোর কথা।

     এই শ্রদ্ধাবোধ কি দেবে আমাকে? দেবে সংসারের সব চাইতে মূল্যবান সম্পদ- সন্তোষ। মানে সমঝোতা না, মানে মেনে নেওয়া না। এর মানে নিজের জায়গাটা খুঁজে পাওয়া আর নিজেকে খুঁজে পাওয়া একই সাথে।
      যেমন ধরা যাক কোন সংগীত শিক্ষার্থীকে এমন একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হল যেখানে সব ধরণের বাদ্য রাখা। সে বিভ্রান্ত হবে, অশান্ত হবে - কোনটা তার নিজের যোগ্য যন্ত্র!
     এটা ওটা নাড়তে চাড়তে একদিন সে নিজের যন্ত্রটা আবিস্কার করবে। তখন সে হবে সন্তুষ্ট। আর শুরু হবে তার সাধনা। তাই আমাদের শাস্ত্রকারেরা বলেছেন যে দেখো, সন্তুষ্টি হল সাধনার গোড়ার কথা। বাইরের দেখাটা মিটবে যখন, ভিতরের দেখা শুরু হবে তখন।
     আচ্ছা সন্তুষ্টির প্রধান শত্রু কে? লোভ। আবার ভাগবতে আসা যাক। যুধিষ্ঠিরের সাথে নারদজী সংসারের বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে আলোচনা করছেন। বলছেন- দেখ বাবাজীবন, সংসারে কাম, ক্রোধ ইত্যাদির একটা না একটা প্রশমনের উপায় আছে। যেমন ধরো, কাম মেটে স্ত্রীসঙ্গে, ক্রোধে কিছুটা শান্ত হয় রাগী কথা (মানে গালাগাল আর কি) ইত্যাদির মাধ্যমে। কিন্তু লোভের কোন উপশম নেই। ত্রিভুবন পেয়েও লোভ থামতে চায় না। কি ন্যায্য কথা! সেকালেই কি, আর একালেই কি।
     আচ্ছা এই লোভ জন্মায় কি করে? সোজা উত্তর- তুলনা করে। ওর আছে আমার নেই। ব্যাস হয়ে গেল। ঘুম গেল, খাওয়া গেল। ভাল কথা গেল, সাদা হাসিটা গেল; সোজা না তাকিয়ে আড়চোখে তাকানো শুরু হল। প্রতিবেশী গাড়ি কিনল। আমি সরাসরি বললাম না, "কি দারূন!" আড়চোখে তাকালাম যাতে সে বুঝতে না পারে, পারলেই তো আমি ছোট হয়ে গেলাম। তার থেকে আড়চোখে দেখব আর মনে বলব, "আচ্ছা! খুব দু'নম্বরি পয়সা হয়েছে না!" সাথে বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে গরম দীর্ঘশ্বাস! হায় রে।
     তুলনা একটা ঘোর। অন্ধ করে দেয় বিবেচনা শক্তিকে। তার একমাত্র ঘোষণা- "আমারও চাই", ব্যস। যোগ্যতা আছে কি না বা প্রয়োজন আছে কি না- এসব প্রশ্ন সে জানতে চায় না। কি করে চাইবে! ওটা যে মিথ্যা প্রবৃত্তি। সীমাকে মর্যাদা দেওয়া তো সত্যের স্বভাব। 'তুলনা' তো একটি অর্থহীন, দিশাহীন মিথ্যা। তাই তার নিজের যোগ্যতা বা সীমা বোঝার আবশ্যকতাই নেই। ইংরাজীতে একটা কথা আছে, Comparisons are odious. খুব খাঁটি কথা।
     আমার সস্তা জুতোর সাথে খগেনের দামী জুতোর তুলনায় আমার যে কষ্ট, তোমার একতলা বাড়ির সাথে নরেনের পাঁচতলা বাড়ির তুলনায়ও তোমার সেই কষ্ট। পার্থক্যটা বস্তুতে, ভাবে একই। পুরোটাই সময়ের আর শক্তির অপচয়।
     তাই শেষে নারদজী বললেন, যে মানুষ সংসারে সন্তুষ্ট হতে পেরেছে, সে সংসারের কাঁটাবনে জুতো পায়ে হাঁটছে। সন্তুষ্টির জুতো, নির্লোভত্বের জুতো। তুলনা ত্যাগ করো, শ্রদ্ধাশীল হও।
এই হল আত্ম-ব্যবহার। নিজেকে প্রশ্রয় না দেওয়ার। নিজেকে মুক্ত করার অভ্যাস। প্রতিদিন অল্প অল্প করে। এতেই জন্মাবে সুখ, মিলবে শান্তি।

     এই ভাবটিকেই ঈশোপনিষদ তাঁর প্রথম শ্লোকে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করছেন,

ঈশাবস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ।
তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধ: কস্যস্বিদ্ধনং।।

বিশ্বসংসারকে ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত দেখিবে, কারোর সম্পদে লোভ করিবে না, ত্যাগের* দ্বারাই ভোগ করিবে।

*নিরাসক্তিই সবচেয়ে বড় আত্মত্যাগ (স্বামীজি)।

 

591
Sat, 07/12/2014 - 08:15

(আদিকাল থেকে আজ অবধি সকল আলোর পথ প্রদর্শকদের চরণে আজ গুরু পূর্ণিমার পূণ্য তিথিতে আমার সশ্রদ্ধ নিবেদন)

মা কে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে ফিরছি কল্যানী থেকে। সন্ধ্যে হব হব করছে। রাস্তার আলো গুলো জ্বালা হয়ে গেছে। আমি আর মা গাড়ির পিছনের সিটে বসে। তিনি খুবই অসুস্থ।
মা হঠাৎ বললেন, "দেখ বাবু, কাল হয় তো আমি থাকব না। এই আলো গুলো জ্বলবে, এরকমই রাস্তায় লোক হাঁটবে, গাড়ী চলবে - অথচ আমি থাকব না।"
চুপ করে শুনছিলাম। সাময়িক মন খারাপ লাগলেও মায়ের অনুভুতিটায় একটা চিরকালের আক্ষেপ প্রাণে বেজেছিল - "সব থাকবে, অথচ আমি থাকব না!"
কি আকুতি! যে মানুষকে সংসারে দেখেছি প্রতিদিনের নিত্য নৈমিত্তিক কাজে - সাবান থেকে গ্যাস সিলিন্ডার, কাজের লোক থেকে পেপারওলা, আত্মীয়ের বিয়ে থেকে পাড়ার দূর্গাপূজা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে সারাদিন, তার মধ্যে এমন একজন চিরকালের মানুষও থাকতে পারে?
অবাক লেগেছিল। আরো অবাক লেগেছিল, মায়ের গলায় আক্ষেপের থেকে বিস্ময়ের সুরটা বেশি ছিল বলে।
এ আকুতি তো সব কালের সব মানুষের। এর থেকে উত্তরণ ঘটাতেই তো কেউ নিজের মধ্যে ডুবে কেউ বাইরের হাজার নেশায়। একজন প্রশ্নটার চিরকালের উত্তর খুঁজতে, অন্যজন প্রশ্নটাকেই চিরকালের জন্য ঘুম পাড়াতে।
তবে এই প্রথম না। দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেকবার হয়েছে, চেনা আটপৌরে মানুষের গলায় শুনেছি চিরকালের সুর। একজন মুচিকে বলতে শুনেছি, "বাবু জুতোতে সামান্য একটা পেরেক ঠুকেও যদি পয়সা নেব, সে পয়সা আমি রাখব কোথায়?" তখন নিজের চোখে জল ধরে রাখা দায়! এত বড় কথাটা সে এত সহজ করে কি ভাবে উপলব্ধি করল। অথচ এর বিপরীত উদাহরণেই আমরা অভ্যস্ত।
এই অসীমের সুর যা সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকবার প্রত্যক্ষ করেছি, ভবিষ্যতেও করব জানি - তাই আমাদের চলার পথের পাথেয়, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা। তাই বিশ্বাস হয় মানুষকে যতটা চিনি বা বুঝি বলে মানি সে তা চাইতেও অনেকখানি বেশি।
সেই জন্যই হয়তো চিরকালের আলোকিত মানুষদের অনুভুতিকে সত্য বলেই মানি। তাঁদের ভিন্ন গ্রহের জীব বলে মনে হয় না। তাঁরা মানুষের এই দিকটার পরিচয় সারা জীবন সবার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন বলেই তাঁরা মহাপুরুষ। অনেক ক্ষুদ্র যাঁর মধ্যে আত্মীয়তা লাভ করে, তিনিই তো মহান আত্মা বা মহাত্মা। যেমন বিন্দু বিন্দু জল মিশে থাকে মহাসাগরে। তিনি নিজেকে মহান বলে জেনেছিলেন বলে তিনি মহাত্মা নন, আমাকে - আমাদের মত শত সহস্র মানুষকে মহান বলে জেনেছিলেন বলে তিনি মহাপুরূষ।
স্বামীজী যখন বলছেন, "তোমরা যাকে ভুল করে মানুষ বলো, আমি তাকেই ঈশ্বর বলে ডেকেছি।" এ কাব্য নয়। এ ওঁর কাছে জ্বলন্ত বাস্তব। যীশু যখন বলছেন, "এরা কি করছে জানে না, এদের ক্ষমা করো পিতা", তখন তিনি তাদের হত্যাকারী দেখছেন না, দেখছেন মহিমান্বিত মানুষ হিসাবে। হ্যাঁ তখনো। তাই বুদ্ধ নি:সংশয়ে বলতে পারেন, "আত্মদীপ ভবো", অর্থাৎ নিজেই নিজের আলো হও।কি বিশ্বাস তাঁর আমার ভালোত্বের প্রতি! আসলে এঁরা কেউই নিজের সাথে অন্যের ভেদ দেখতে পাননি বলেই সংসারকে সীমা টেনে খন্ড করে দেখা এঁদের দ্বারা সম্ভব হয় নি। সব কে দেখেছেন একের মধ্যে। তাই নিজেকেও পেয়েছেন সবের মধ্যেই।
আমরাও তাঁদের সামনে দাঁড়ালে সেই অনুভুতির কিছুটা কিরণ পাই, তাতেই ধন্য আমাদের জীবন।
জানি বা না জানি, আমার মধ্যেও একজন চিরকালের মানুষ আছেন। বিশ্বের নিকৃষ্টতম পাপও যাঁর জ্যোতিকে তিল মাত্র হ্রাস করতে পারে না। সুযোগ পেলেই হুহু করে জ্বলে ওঠে সে তেজ। সংসার পায় আরেকজন অঙ্গুরীমালকে, আরেকজন ধর্মাশোককে।
তাই বলছিলাম প্রতিদিনের জীবন থেকে নিজের প্রতি, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেললে কে আমায় রক্ষা করবে? মহতের পায়ে শরণ নেওয়ার অন্তিম যোগ্যতাটুকুও যে হারিয়ে ফেলব! জীবন যে বিষাক্ত হয়ে উঠবে!
গুরুদেবের এই প্রার্থনা প্রতিদিন একটু একটু করে আমার জীবনে সত্য হয়ে উঠুক,

"আমার পরান-বীণায়
ঘুমিয়ে আছে অমৃতগান--
তার নাইকো বাণী, নাইকো ছন্দ,
নাইকো তান।
তারে আনন্দের এই জাগরণী ছুঁই'য়ে দাও।"

 

 

592
Sun, 07/06/2014 - 15:24
বাঙালী জাত প্রতিবাদের ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই কি? খিস্তি-হুমকি, ভজন-ভাষণ, নীলছবি-আঁতেল ছবি, খুন-ধর্ষণ সব হজম হয়ে যাচ্ছে নির্বিকার। কি এমন হজম শক্তি আয়ত্ত করেছে বাঙালী? না, কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর কথা বলছি না। বলছি সামাজিক মানসিকতার দিক থেকে। প্রতিটা মানুষের যেমন একটা মনের গতি থাকে আর তা যেমন সময়ের সাথে সাথে বদলায়, তেমনি সমাজেরও এক-একটা সময়ে গতির মুখ বদলায়। তারই কিছু ভাবনা চিন্তা। কয়েকটা ভাগে ভাগ করে নেওয়া যাক।          প্রথমত: মেকি আদর্শবাদীতা। বাঙালী মানেই তাকে প্রচ্ছন্ন বিবেকানন্দ, রামকৃষ্ণ, রবি ঠাকুর, নেতাজী হতেই হবে, এ যেন অলিখিত শর্ত। স্বামীজির একটা উক্তি এই প্রসঙ্গে আমার বার বার মনে আসে। উনি বলতেন শুধু আদর্শহীনতাই কোনো জাতকে নষ্ট করে না, উচ্চ আদর্শও করে। হ্যাঁ করে। আমি এমন এক আদর্শে জীবন যাপন করতে চাইলাম যা বাস্তবে আমার দ্বারা কখনই হওয়ার না, তা আমাকে ভিতরে ভিতরে দুর্বল করতে থাকে। আমাকে মনের গভীরে বিষাদগ্রস্ত করে তুলতে থাকে।     জীবনে যে কাজ, যে সাধ খুব স্বাভাবিক তাকে আমরা সমাজে অপাঙতেও করে রাখলাম আদর্শের অজুহাতে। "ওটা বাঙালীদের সাজে না" - এর চূড়ান্ত পরিণতি, একটা ভণ্ড, দুর্বল, ঈর্ষাপরায়ণ সমাজ।          দ্বিতীয়ত: পরিবর্তনের প্রতি অনীহা। আমি আগেই বলেছি আমি কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এ আলোচনা করছি না। আমরা কিছুকে একবার চূড়ান্ত স্বীকৃতি দিতে পারলে সেখান থেকে আমাদের সরায় কার বাপের সাধ্যি। রবি ঠাকুর, সত্যজিৎ, উত্তম-সুচিত্রা - সব আমাদের অন্তিম পরাকাষ্ঠা। এঁরা মহৎ এতে সন্দেহ পাগলেও করবে না। কিন্তু যেই ইতি টানলাম অমনি আমার চলাটাও যে থেমে গেল? এই ক্ষতি পূরাবে কে?      "এর উপরে আর হয় না"- বসে গেল স্ট্যাম্প। হয়ে গেলাম ইতিহাস। গঙ্গা দিয়ে যত জল বয়ে যাক, বাগানে যত নতুন ফুল আসুক, আমার তাতে কি? আমি তো ইতিমধ্যে জেনেই গেছি এর চেয়ে ভাল হয় না। থাকো নাক কুঁচকে, ব্যাস।          তৃতীয়ত: পার্থিব উন্নতির প্রতি কপট উদাসীনতা। যে যত গরীব সে তত সৎ। এ এক কঠিন ব্যামো। মনের কত গভীরে ঢুকে আছে এ শিকড় তা ভগবানই জানেন। আমরা আওড়াই, টাকা মাটি, মাটি টাকা। সৎ প্রমাণ করার জন্য নিজের স্বাভাবিক ইচ্ছার দমন অনিবার্য। ফল, ভিতরে-বাইরে দুদিকেই কাঙালপনা। অন্য রাজ্যের লোক ব্যবসা করুক, বড়লোক হোক তোমার তাতে কি। তুমি হলে গিয়ে পরমহংস দেবের বংশধর। তুমি ওসব কোরো না। তাতে ইহকাল পরকাল সব ঝরঝরে।      ব্যস হয়ে গেল সিদ্ধান্ত। বড় হাসপাতাল, সিনেমার প্রযোজক, বড় ব্যবসা এসবে বাঙালী খোঁজ, আতস কাঁচ লাগবে। আমরা কেন ওসব করব! কোথাও যেও না। ওগুলো ওরা করুক। আমরা ওসব করলে, কে ওদের সমালোচনা করবে। বালাইষাট! ওসব লোভের পথে যেও না।          এই রকম অনেক অবাস্তব আদর্শ জগতে বাস করতে করতে বাঙালী বুঝলই না আশেপাশের রাজ্য কবে জেগে উঠেছে। কি প্রকান্ড কর্মযজ্ঞ শুরু হয়ে গেছে। যখন জানল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। এখন সে জানে তার স্বাস্থ্য, শিক্ষা সব কিছুর উৎকৃষ্টতার জন্য তাকে আজ দক্ষিণের, উত্তরের, পশ্চিমের দ্বারস্থ হতে হয়। সে মেনে নিয়েছে। কখন মেনে নেওয়া যায়, যখন আত্মসম্মানের দীনতা আত্মম্ভরিতার জাল ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।      সেই জাত কিসের জোরে একজোট হবে? কিসের জোরে প্রতিবাদী হবে? তাই বিচ্ছিন্ন কয়েকটা প্রতিবাদ ছাড়া আমরা বহুলাংশে নির্জীব আজ। আজ আশা নতুন প্রজন্মের কাছে। তারা এই আদর্শ বিলাসিতা থেকে আমাদের জাগিয়ে যদি আবার নতুন করে শুরু করাতে পারে। আমরা বেঁচে যাই।    
593
Wed, 04/23/2014 - 00:16

যা দেখি তা বিশ্বাস করি তার অনেকটা কারণ আমার নিজের দেখার ক্ষমতার ওপর আমার আস্থা আছে বলে। যখন তা দুর্বল হয়, তখন পাশের মানুষের সাহায্যে নিশ্চিত হতে হয় যা দেখলাম তা সত্যি কি না।


     সেই রকম মনের ক্ষেত্রেও। যখন কিছু সত্যি বলে অনুভব করি তখন নিজের অনুভুতি শক্তির ওপর ভরসা থাকলে সংশয় জাগে না। কিন্তু না থাকলে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে, সন্দেহ করে মনে ঘোরের পর ঘোর জমতে থাকে। নিজের অনুভুতি শক্তি, বিচার শক্তি যত সুস্থ স্বাভাবিক হয় আশে পাশে সব কিছুই সুস্থ স্বাভাবিক ঠেকে। তার দুঃখ যন্ত্রণা কম হয় বলছি না, তা থাকেই কিন্তু তার বিকারটা থাকে না।


     কিছু কিছু মানুষকে দেখা যায় নিজের মধ্যে কোনো কিছু স্থির না করতে পেরে জগতে যা কিছু স্থির, সুস্থ তার ওপর খড়গহস্ত হয় বা ভ্রূকুটি করে ফেরে তার প্রধান একটা কারণ বোধহয় এটা। যাকে ইংরাজিতে cynicism বলে।


     দেখি বিভিন্ন যুগে আবির্ভূত মহাপুরুষদের বাণীর মধ্যে একটা সাধারণ সুর থেকেই যায় - স্থির হও। খুব গোড়ার কথা কিন্তু প্রতিদিন এই অসাধারণ সত্যকথাটি হারিয়ে কি নাকানি চোবানি-ই খেতে হয়। আত্মনিয়ন্ত্রণ হারানোর বড় বিপদ হল দশের নিয়ন্ত্রণের শিকার হওয়া। আমার বিচার-বিবেচনা, আবেগ - কিছুর ওপরেই আমার স্বাতন্ত্র্যতা নেই তখন। এমন মানুষের ভাগ্য খাঁটি সুখ তো দুরের কথা, খাঁটি দুঃখ থেকেও বঞ্চিত থেকে যায় সারা জীবন, যে দুঃখ কে বরণ করে নিলে তার গৌরব।

 

     তাই সাধকেরা চিরকাল বলে এসেছেন, যে মন, বুদ্ধি নিয়ে তোমার জগৎ কারবার আগে সেই মন, বুদ্ধি কে সুস্থ কর বাপু। আগে স্থির হও।কেউ তোমার হয়ে এটা করে দিতে পারে না। তোমাকে নিজেকেই নিজে স্থির করতে হবে। তা তখনই সম্ভব যখন বাইরের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারবে,ঘটনা থেকে না, তা তো ঘটে চলবেই। যেমন ঝড় উঠলে মাঝি ঝড়কে শান্ত না করতে চেয়ে তার হাল কে স্থির রাখতে চেষ্টা করে। এই পথ। স্থির হয়ে নিজেকে বোঝ আর সেই বোঝার শক্তি তে অন্যকেও। যেমন চিকিৎসক একটা শরীর ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে সব মানব শরীর কে জানতে পারেন, ঠিক তেমন।

594
Sat, 03/22/2014 - 00:03

     যেটা মিথ্যা, তার সাজ বেশি আস্ফালন বেশি এ তো চিরকেলে কথা। তা যতক্ষণ বাইরে দাপায় ক্ষতি সেই প্রকার দেখি না। বিপদ হয় যখন সে মনের মধ্যে চেতনার অগোচরে বাসা বাঁধে। তখন তার এক-একটা প্রবল পাকে মন নিস্তেজ, মোহগ্রস্ত হতে শুরু করে। আরো একটু খোলসা করে বলা যাক। যেমন ধরা যাক কেউ আমাকে একটা খুব সস্তা দামের পেন বেশি দামে বিক্রি করে গেল। আমি ঠকলাম, কিন্তু বিভ্রান্ত হলাম না। লিখতে গিয়েই টের পাব আমি ঠকেছি। কিন্তু যারা ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, শিক্ষার নামে আরো কতভাবে মনের মধ্যে মিথ্যার বীজ বপন করে চলেছে! কি বীভৎস করুণ তার পরিণাম! হাতেনাতে ভুল উপলব্ধি করব সে সম্ভাবনাও নেই, আবার দৈবাৎ মনের গভীরে সন্দেহ জাগলেও তাকে যে বাইরে প্রকাশ করব সে সাহস ও নেই, কারণ বহু মানুষ তাই সত্য বলে মেনে চলেছে যে! তারা গর্জে উঠে বলবে, "তুমি কি সত্য জেনেছ, মানে যাকে পরম সত্য বলে?" বলতেই হবে, “না জানি নি। কিন্ত তুমি যা সত্য বলে মেনে চলেছ তা কি সত্য?" সে বলবে,"আলবাত সত্য।" আমি জানতে চাইব, “কি করে?” সে বলবে, "এতে যে পরম শান্তি!" হায় রে! সে যে শান্তির বেশে বহুকালের অভ্যাসের জড়ত্ব, সে বোঝাব কি করে! তার সৃষ্টি নেই, পুনরাবৃত্ত আছে; তার প্রশ্ন নেই, অথচ উত্তর আছে; তার আনন্দ নেই, উল্লাস আছে।

     তাই শুরুতে বলছিলাম, যে মিথ্যা মনের মধ্যে বাসা বাঁধে তার হাত থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে ওঠে। আর যে সমাজ যত পুরোনো তার এ সমস্যা তত গভীর। আজও এই আধুনিকোত্তরযুগে দাঁড়িয়েও মনের যে সব অন্ধ গতিবিধি নজরে আসে তাতে বিস্ময়ের সীমা-পরিসীমা থাকে না। বুঝি, বিজ্ঞান যত উন্নতিই করুক তা বাইরের জীবনকে যত মসৃণ করুক, মনোরাজ্যে সে বহিরাহতই থেকে গেছে।


     আলোকিত যুক্তি, উন্মুক্ত আলোচনা, ভিন্নমতের সহাবস্থান এক ঔদার্য মহানুভবতায় - এ আমাদের অধরাই থেকে গেল সভ্যতার এতটা পথ পেরিয়েও।

 

     তবে এও জানি কোনো মিথ্যাই বেশীদিন স্থায়ী হয় না স্বাভাবিক নিয়মে। তাই যত না ভয় মিথ্যাকে তার চেয়ে বেশি ভয় মিথ্যার পৃষ্ঠপোষক দের। তাদের সুচতুর ভঙ্গী এরকম কত মিথ্যাকে আজও লালিতপালিত করে চলেছে তার পরিণাম চারিদিকে চোখ রাখলেই দেখা যায়। আজও তাই ভরসা সুসাহিত্যের, যা ভাবাবে, মিথ্যা সান্ত্বনায় আমার আত্মশক্তিকে খর্ব করবে না। এমন শিক্ষকের যিনি তাঁর সংশয়কেও সম্মান করবেন ও প্রকাশ করবেন আগত প্রজন্মের কাছে। তাদের সংশয়কেও আশ্রয় দেবেন তাঁর মুক্তচিন্তার পরিসরে। তবে মিলবে সোজা পথ। চড়াই-উতরাই থাকবে তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু ঘুর্ণাবর্ত থাকবে না।

 

 

595
Fri, 01/03/2014 - 02:56

মেয়েরা আমাদের অতীত সমাজে যে খুব সন্মানের সাথে বাস করেছেন তা বলতে পারি না। সতীদাহপ্রথা, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ...উদাহরণ বেড়েই চলবে। তারপর অনেক সমাজসংস্কারক এলেন।আমরা ধীরে ধীরে সভ্য হতে শুরু করেছিলাম। সত্যিই কি? বিশ্বাস করতে অসুবিধা হচ্ছে।আদিম রিপুর বর্বরতা কে সংযত করলে যে পৌরুষ বলে কিছু থাকবে না! তাই চলুক! আমরা রাস্তায় প্রতিবাদ করি,চেঁচাই,কাঁদি,তাতে কার কি!

 

হে ঈশ্বর এদের শুভ বুদ্ধি যদি দিতে না পার, তবে নপুংসক করে রাখ অন্তত! আমরা বাঁচি!