Skip to main content

অ্যাদ্দিন বাঙালিদের নামে অনেক নিন্দামন্দ শুনেছি। ট্রেণ্ডে গা ভাসিয়ে আমিও কিছু লিখেছি, বলেছি। কিন্তু আজ এমন একটা উপলব্ধি হচ্ছে যে না উল্লেখ করে পারছি না। বাঙালি আবেগপ্রবণ জাত, হুজুগে জাত - এ সব আসলে মিথ্যা, ডাহা মিথ্যে কথা। আসলে বাঙালিকে বুঝতে গেলে আপনার গভীর আত্মবোধ থাকা দরকার। একটু বুঝিয়ে বলি। ধৈর্য থাকলে পড়বেন, নইলে স্ক্রোল করে পরের পোস্টে বা ছবিতে বা ভিডিওতে চলে যান, আমার কিস্যু মনে হবে না, আজ আমার তৃতীয় নয়ন খুলে গেছে।

      আলোচনায় আসা যাক। দেখুন বাঙালির ঈশ্বরচেতনা জন্মগত, ইতিহাসগত তো বটেই। বেশি প্রাচীনে যেতে পারব না, আমার স্পণ্ডাইলোসিস আছে, মাথা না তো বেশি উঁচু করতে পারি, না বেশি নীচু করতে পারি। তো মোদ্দা কথা হল বেশি পুরোনো ফাইল ঘেঁটে লাভ নেই, হালের মহাপ্রভুকে ধরুন। তিনি কি বলছেন? দেহাত্মবুদ্ধি থাকলে সাচ্চা ভক্তি আসা দুর্লভ। এর মানে কি? এর মানে হল দেহতে 'আমি' বোধ ত্যাগ করতে হবে। দেহের উপর 'আমি' বোধ আনাকে বলে অধ্যাস। মায়া। মিথ্যা। কুহক। হীনবুদ্ধি। অন্ধবুদ্ধি। নিজেকে ভাবতে হবে মহাচেতনার ক্ষুদ্র চেতনা, অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব। সে অনেক বড় আলোচনা, কিন্তু এই হাইপারলিঙ্কে ক্লিক করলাম না, আমি একটা ছোট্টো পপ-আপ তুলে এইটুকু বলি যে সেই মহাচেতনার একটা ক্ষুদ্র চেতনা আমি-আপনি-আপনার বউ-শাশড়ি-মেনি-টমি-চেতক ইত্যাদি সবাই। কিভাবে? সে আপনি ভেবে পাবেন না, ধরতে পারবেন না। অনুভবে জানতে হবে। তাই অচিন্ত্য। বুঝলেন? না বুঝে থাকলে না বুঝবেন, সে আপনার কর্মফল। তো এই চেতনা আপনার মনে এসে গেলেই কি হবে? অমনি আপনি দেহের থেকে মনটা টুক্ করে তুলে নিতে পারবেন।

      এই গেল মহাপ্রভুর তত্ত্ব। এরপর আসলেন আমাদের দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুর। রামকৃষ্ণদেব। দেখুন তিনিও বলছেন, দেহটা হল খাঁচা। আসল হল আমাদের সেই আত্মা। এই দেখুন, একজনের নাম করতে তো ভুলেই গেসলাম, আমাদের লালন ফকির গো! সুনীল, গৌতম আর কালিকাপ্রসাদের সৌজন্যে শিক্ষিত মানুষ, মানে ওই আর কি যারা সাপকে স্নেক, কুকুরকে ডগ, ভাতকে রাইস, ঝোলকে গ্রেভি বলে তারা অবধি সিডিতে, ইউটিউবে লালনের গান শুনছে আজকাল, চাট্টিখানি কথা, এ কি কম কথা! তো সেই লালন অবধি কি বলেনি, "খাঁচার ভিতর অচিনপাখি কমনে আসে যায়"? বলেছে তো। তারপর আরো আছে, "পাখি কখন উড়ে যায়, বদ হাওয়া লেগেছে গায়", আছে না? তো লালনেরও সেই এক তত্ত্ব, মানে দেহ খাঁচা, আত্মা পাখি।

      আর আমাদের ঠাকুর কি বলছেন? সাধন করতে করতে বোঝা যায় ঝুনো নারকেলের অবস্থা, ভিতরে নারকেল খড়খড় করছে। অর্থাৎ, ডাব আর নারকেলের আলাদা হওয়ার অবস্থা। নারকেল আত্মা, ডাব দেহ। আরো আছে - একজনের ছেলে মারা গেছে, মা কাঁদছে। ছেলের বাবা বাইরে থেকে আসতেই যখন বউ হাউমাউ করে কাঁদছে তখন স্বামী বলছে, "আমি দেখলাম আমি রাজা হয়েছি আর আমার সাত ছেলে হয়েছে। তারা সবাই মরে গেল। এখন আমি স্বপ্নের সাত ছেলেগুলোর জন্য কাঁদব, না এই এক ছেলের জন্য কাঁদব? দুই-ই তো স্বপ্ন গো।" জানি না তার বউ কোনো মনোবিদের অ্যাপো নিয়েছিল কিনা স্বামীর জন্য, কিন্তু তত্ত্বকথা কি দাঁড়ালো, যে এসব স্বপ্ন।

      এখন এই তত্ত্বটা প্রথম মার্কেটে সাধারণের জন্য লঞ্চ কে করে বলুন তো? কেষ্ট ঠাকুর গো। গীতায়। মনে নেই? কেন মৈত্রেয়ী দেবীর লেখা 'ন হন্যতে' পড়েননি বুঝি? তার মানে কি? আত্মা সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, 'ন হন্যতে, হন্যমানে শরীরে' - অর্থাৎ কিনা এই মরণশীল দেহে আত্মা অমর। আত্মা পাখি অমর। সত্যজিতের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা' সিনেমার সেই দাম্ভিক ছবিদাদু যদি কৃষ্ণকে এই সময় জিজ্ঞাসা করতেন, "এ পাখিতে রোস্ট হয়?", যেমন সিনেমায় তেনার শালাবাবু পাহাড়িদাদুকে, অমন ভালোমানুষটাকে, কি অপদস্থ করল ভাবুন...! সে যাক, তো কৃষ্ণকে এ কথা বললে তিনি কি বলতেন? বলতেন, উঁহু ছবি, একে অগ্নি দহন করে না, জল সিক্ত করে না, বায়ু শুষ্ক করে না।

      এখন শাস্ত্রজ্ঞেরা আমার এ কথার খুঁত ধরতে পারেন, তারা বলবেন, কিন্তু এ তত্ত্ব তো উপনিষদে আগে থেকেই ছিল! কৃষ্ণ বলেছেন তো পরে।

      ঠিক কথা। উপনিষদে ছিল বটে, তবে তা প্রাইম কাস্টমারদের জন্য। কৃষ্ণ এক্কেরে বিগডিল ধামাকায় খোলা ময়দানে সে সব কথা বলে ফেললেন। তাই না?

      এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ সব কথা কেন? মোদ্দা কথাটা হল, এইবার বোঝা যাচ্ছে বাঙালির রক্তে রক্তে গোপনে ছিল আত্মতত্ত্ব - সে জানে আসলে সে অমর শুদ্ধ মুক্ত আত্মা। অ্যাদ্দিন সে নিজেকে গোপনে রেখেছিল। আজ তার আত্মপ্রকাশের দিন। আসন্ন দুর্গাপুজোয় সবাই যখন ভয় দেখাচ্ছে, হো হো হো, তুচ্ছ মৃত্যুভয় দেখাচ্ছে; হো হো হো, অর্থাৎ, কিনা এই নশ্বর, কাঁচা বাঁশে বাঁধা তুচ্ছ দেহের ভয় দেখাচ্ছে, তখন বাঙালি "হা রে রে রে" করে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। করোনা, কোভিড দেহকে পীড়া দেয় রে পাগলা, আত্মাকে নয়। মৃত্যু দেহের হয় রে গবেট, আত্মার নয়। নাস্তিকের দল যত! মায় মেডিক্যাল কলেজেও শুনলাম পুজো হচ্ছে। হোক। কারণ তারাও বুঝেছে এক অধ্যাত্মতত্ত্ব ছাড়া বাঙালির চিকিৎসাতত্ত্বে তেমন শ্রদ্ধা নেই। চিকিৎসা নিতে হয় তাই নেওয়া। যখন পুজোর শেষে লাখে কোটিতে আসবে, সব এসে জড়ো হবে, তখন বেড কোথায়? অত চিকিৎসক কোথায়? নার্স কোথায় অত? তখন সব্বাইকে ওই প্যাণ্ডেলের নীচে শুইয়ে দেওয়া হবে। এরকম আরো কত কত প্যাণ্ডেল যে করতে হবে সে কেউ জানে না। বাঙালি প্যাণ্ডেলকে সত্য বলে জানে, হাস্পাতালকে নয়।

      এই হল গিয়ে আমার উপলব্ধ তত্ত্ব। যদিও আমার আত্মতত্ত্ববোধ এখনও ততটা পাকা হয়নি। ঈশ্বর না জগত - কোনটা যে মায়া এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। চারবার হাগু হলেই বিছানায় লটকে 'চিঁহি চিঁহি' করে ডাকি। তবু অন্যের বিশ্বাসে আঘাত দিতে নেই। বাঙালি বীরতনয়গণ, এগিয়ে যাও। আমি সাথে নেই। বাঙালি বীর তনয়, তনয়া, মধ্যম, মধ্যমাগণ আপনার প্রমাণ করুন, কোটি কোটি বাঙালিরে মা রেখেছ তত্ত্বজ্ঞানী করি, মানুষ করোনি।