Skip to main content
ইচ্ছে ! –ইচ্ছে !সেই তো ভাঙছে, সেই তো গড়ছে,সেই তো দিচ্ছে নিচ্ছে।।
সেই তো আঘাত করছে তলায়, সেই তো বাঁধন ছিঁড়ে পালায়–
বাঁধন পরতে সেই তো আবার ফিরছে।।
~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (তাসের দেশ)
 

---মানুষটা তবে কোথায়? মানুষটা একমাত্র তার ইচ্ছাতে। কারোর বাড়িতে যখন যাই, তখন সেই বাড়ির ভিত, দেওয়ালের পুরুত্ব, কি ধরণের ইঁট ব্যবহৃত হয়েছে সে সবের খোঁজ করি কি? না তো। দেখি ঘরটা কেমনভাবে সাজানো। দেওয়ালে কেমন রঙ। কারণ সেইখানেই সেই বাড়ির মানুষটার ইচ্ছার প্রকাশ।
কেউ যখন কোনো পোশাক কিনতে যায়, সে যে কারণে পোশাক কিনছে সে কারণটা আদিম – লজ্জা নিবারণের জন্য। সেখানে সে মানুষটাকে পুরোপুরি পেলাম না। যেখানে সে পোশাকের রঙ দেখছে, তার উপরের অলঙ্করণ দেখছে, সেখানেই সে আসল মানুষটা। মানুষ তাই একটা ইচ্ছা। তার শোক, দুঃখ, উচ্ছ্বাস সব থাকতে পারে। তবে সেগুলো নিতান্তই প্রতিক্রিয়ামাত্র। সে নয়। সে একটা ইচ্ছা। নির্মল, স্বাধীন, অকারণ ইচ্ছা।
তবে এই ‘ইচ্ছা’ শব্দ নিয়ে অনেক গোলমাল। ”আমার ইচ্ছা ছিল অমুক হব... আমার অমুক হবে... তমুক হবে...” এগুলো তবে কি? এগুলো ইচ্ছার শাখা-প্রশাখা হতে পারে। তবে ইচ্ছা নয়। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক একটা ঝর্ণা। স্বচ্ছ, উচ্ছ্বল, স্রোতস্বিনী ঝর্ণা। সেই হল আমার আলোচিত ইচ্ছা। তার গতিকে কোনো বিশেষ খাতে বইয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে বিশেষ উপযোগী করে তোলাকে আমি ইচ্ছা বলি নে। কারণ ইচ্ছার কোনো উপযোগীতা নেই। সে শুধুই ইচ্ছা। অবিরাম স্রোতের নির্মল প্রস্রবণ – ইচ্ছা।
আমার ইচ্ছাকে আমি উপযোগী বা ফলপ্রদ করে তোলার কাজে ব্যবহৃত করাকে নাম দিতে পারি – বাসনা, চাহিদা। ইচ্ছার কোনো চাহিদা নেই। ইচ্ছার কোনো বাসনা নেই। কারণ এই দুটোই তাকে বাঁধে। এই দুটোই শৃঙ্খল। ইচ্ছার কোনো বাঁধন নেই। তাই যদি কোনো চাহিদা ব্যর্থও হয়, ইচ্ছা জীবিত থাকলে সে তার মধ্যেও নিজের গতিপথ খুঁজে নিয়ে প্রাণের স্রোতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইচ্ছা জীবিত না থাকলে আসে হতাশা। ইচ্ছার অনুপস্থিতিকেই আমরা বলি অবসাদ।
ইচ্ছার ঝর্ণাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। কি করে? তার সহজ উপায় নিজেকে শর্তমুক্ত করে। সে কেমন? যেমন আমি যদি নিজেকে বিশ্বাস করাই যে আমার অমুকটা না হলে বা আমি তমুকের মত না হতে পারলে কিছুতেই সুখী হতে পারব না, সাথে সাথেই আমি আমাকে শর্তাধীন করে ফেললাম। নিজেই ইচ্ছাকে একটা কঠিন খাতে বইতে বাধ্য করালাম। ভাবলাম এই খাতেই আমার ইচ্ছাকে যদি পরিচালিত করি তবেই আমার সর্বাঙ্গীন লাভ। তা হয় না। মাঝখান থেকে আমার ইচ্ছাটার স্রোত অবহেলায় শুকিয়ে মরতে থাকে।
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ শিশুরা। তাদের বাসনা নেই, ইচ্ছা আছে। তাই সারাদিন খুশি থাকার উপাদান খুঁজে নিতে তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। সারাদিন তাদের দৌরাত্ম্যের সাথে পাল্লা দেওয়া ভার। তবু তাদের সাথে থাকতেই আমার ভাল লাগে, হাল্কা লাগে। কেন? কারণ নিজের মধ্যের শুকিয়ে যাওয়া ইচ্ছা-প্রস্রবণকে তাদের মধ্যে খুঁজে পাই।
আজ অবধি তাই যা কিছু শুদ্ধ মহৎ সৃষ্টি হয়েছে, তা এই ইচ্ছার আঙিনায় হয়েছে। যে মানুষ হাজার অসুবিধা স্বীকার করেও নিজের গবেষণাগারে পড়ে থেকেছে, যে শিল্পী তার সমস্ত পার্থিব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে তার শিল্পের মধ্যে সমস্ত সত্তাকে ডুবিয়ে রেখেছে, কিসের শক্তিতে? তা ইচ্ছার শক্তিতে। কি পাবে সেটা বড় কথা নয়, সে যে নিজের ইচ্ছাকে রূপ দিতে পারছে তিল তিল করে, এতেই তার সার্থকতা।
আমাদের দুর্ভাগ্য, আজ ইচ্ছার স্বাভাবিক গতি রোধ করে মানুষকে ভীষণ ব্যবহারযোগ্য করে তোলার কল চারদিকে। মানুষের আত্ম-প্রবঞ্চনার ক্ষমতা আর অলসতার প্রতি আকর্ষণ তাকে কি ভীষণ কুয়াশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সে বুঝেও বুঝতে পারছে না। তার কারণ যে শক্তির উৎস সে জন্মলগ্ন থেকে পেয়ে এসেছিল তার তো অকালনিধন সে নিজেই করে বসে আছে নিজের লোভের তাগিদে। সে আর কিছু না তার ইচ্ছাশক্তি। এখন তো তাকে সবার মত হতে হবে। হতেই হবে।


----ইচ্ছাকে একটু প্রাচীন কলেবরে দেখা যাক। আমাদের শাস্ত্র বলছেন – যিনি এক তিনি বহু হলেন কেন? উত্তর এল – তাঁর ইচ্ছা।
হ্যাঁ ঠিকই তো। মানুষ তার গভীরতম অংশে যদি কিছুর শুদ্ধ আভাস পেয়ে থাকে তো সে কি? তার আত্মা। আত্মা কি? শুভ ইচ্ছা বই আর কি?! সে বলেছে বিশ্বসংসারকে সে নিজের আত্মার মধ্যেই দেখেছে। সে কি করে সম্ভব যদি সে নিজের মধ্যে শুভকে না খুঁজে পায়? তবেই তো এতবড় শক্তি পেয়েছে যে সে রাজসিংহাসন ত্যাগ করেছে। ক্রুশে বিদ্ধ হয়েছে। প্রফুল্ল মুখে বিষ পান করতেও দ্বিধা করেনি। কারণ সে নিজের মধ্যে তথা সারা বিশ্বের কেন্দ্রে এক শুভ ইচ্ছার অস্তিত্বকে অনুভব করেছে। বুদ্ধি দিয়ে নয়! চিন্তা করে নয়! নিজের সারাটা জীবন দিয়ে। বুদ্ধি দিয়ে জানলে তবু তার স্কুল-কলেজে ধর্ম-দর্শন পড়িয়ে, কিম্বা ভাষণ দেওয়ার পর ছুটি আছে। কিন্তু জীবন দিয়ে জানলে তার আমরণ ছুটি নেই। তাকে সেই শুভ ইচ্ছার দাসত্ব করতেই হবে।
তবে চারদিকে এত অমঙ্গল কেন? এর কোনো সোজা এককথায় উত্তর নেই। কারণ সংসারে শুভ ইচ্ছার একটা শত্রু আছে – লোভ। কেন আছে? জানি না। কেউ জানে না। তার হাতে বারবার হত্যা হয়েছে শুভ ইচ্ছার ধ্বজাবাহীদের। ভবিষ্যতেও হবে। মানুষ যাকে হত্যা করেছে, কাল তাকে সম্রাট বানিয়ে নিজের শ্বেতশুভ্র অঙ্কে ধারণ করেছে। তাই হত্যাকারীরা, চক্রান্তকারীরা ইতিহাসে হারিয়ে গেছে। তারা হারায়নি। হারাবেও না।


---তবে শিক্ষা কি হওয়া উচিৎ? এই শুভ ইচ্ছাকে বস্তু জগতে প্রকাশ করার সহায়ক। শিক্ষা তাকে তুলি দেবে, রঙ দেবে, সাদা কাগজ দেবে, অতীতের মহৎ সৃষ্টির নমুনা দেখাবে-- ব্যস এত অবধি। তারপর বলবে না, তুমিও এগুলিরই পুনারাবৃত্তি করো। বলবে, তুমি দায়িত্বশীল হও। এ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে চলো। শুভ ইচ্ছা যখন দায়িত্বশীল হয় তখন তা হয় সভ্যতা। আর শুভ ইচ্ছা যখন অনুকম্পার হাতে হাত ধরে তাকে বলি ধর্ম।
আমাদের পরম সৌভাগ্য এইদুটোই আমাদের কৃত্রিম উপায়ে রপ্ত করতে হয় না। আমাদের শুধু অলসতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে হয়। একটা রাশিয়ান প্রবাদ আছে – যে হাত ঘামে সে হাত মুঠো হয় না, যে হাত শুকনো সেই হাতই মুঠো হয়। আমাদের ঘর্মাক্ত কলেবরে জোয়ালটায় হাত দিতে হবে। আর কাউকে দিয়ে জোয়াল টানিয়ে, তাকে শোষণ করে নিজের আরামকে যখনই আমি কায়েম করতে চাইব, তখনই নিজের জীবনীশক্তিকে হত্যা করে নিজের আর তার, দুজনেরই বিনাশের খাল কাটব। সে মরবে বঞ্চনায়, আমি মরব স্থবিরতায়।
তাই বাঁচার সঠিক স্থান, আমার তৈরি প্রাসাদে না। ইচ্ছা-ঝর্ণার ধারে। সেখানেই আমি মুক্ত, সজীব, প্রাণোচ্ছ্বল। সেখানেই আমি সার্থক। মনে রাখতে হবে, ইচ্ছা ভবিষ্যৎ বা অতীতের গর্ভে জন্মায় না, ইচ্ছা শুধু বর্তমানের। অন্য ভাষায় ইচ্ছা মানে বর্তমান, এখন, এই মুহুর্তটা।