বাঙালির মা কে? কালী-দূর্গা-সরস্বতী-লক্ষ্মী। তারপর মাঝে হয়েছিল – দেশ – বন্দে মাতরম। এখন? জানে না যেন, নেকু!
তবে কালীর সাথে বাঙালির একটা নাড়ির টান। রামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, প্রেমিক, রামকৃষ্ণ, বামাখ্যাপা ইত্যাদি একের পর সাধক কবির কল্পনায়, বিশ্বাসে বাঙালির মাটিতে একটা মা মা অনুরণন বেজেছে। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির। নাটমন্দিরে প্রতি শনিবার বিকাল থেকে সন্ধ্যারতি পর্যন্ত কীর্তন, ভক্তি সঙ্গীত গাওয়ার একটা চল আছে। দল বেঁধে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে বসে একটার পর একটা গান গেয়ে যান। চারদিক ঘিরে বসে থাকে ভক্তকূল। শুধুই কি ভক্তকূল? সে আলোচনা থাক। তখন কলেজে পড়ি। একদিনের ঘটনা আমার মনে পড়ে যায়। আপনারা যারা দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে সন্ধ্যেবেলার দিকে গেছেন, দেখবেন বহু মানুষ অফিস ফেরত সোজা মন্দিরে চলে আসেন। কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে যান। সেরকমই এক অফিস ফেরত মানুষ, বয়েস এই ধরুন পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। ফর্সা গায়ের রঙ, বেঁটে, মোটাসোটা। সারাদিনের ক্লান্তি চোখেমুখে। পাশেই একজন মহিলা বসা, খুব সম্ভবত ওনার স্ত্রী। নাটমন্দিরে গান হচ্ছে, ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে/ মাকে মনে পড়ে আমার মাকে মনে পড়ে।‘ ওখানে গান গাইবার একটা প্রথা হল একটা পদ বেশ কয়েকবার গাইবার পর পরের পদ ধরা হয়। আমি হঠাৎ ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি হাপুশ নয়নে কাঁদছেন। একটা থামে মাথা ঠেকিয়ে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। পাশে বসা ভদ্রমহিলা ওনার হাতের পাতার উপর নিজের হাতটা রেখে স্থির দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে। এতক্ষণ যা মন্দিরের চত্ত্বর ছিল মুহূর্তেই আমার কাছে একটা বাঙালি গৃহস্থের বাড়ির অন্দরমহল হয়ে উঠল। বুঝলাম আমার সামনে যে দেবীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি শাস্ত্রের, বিধি-বিধানের প্রণালী বহুদিন পেরিয়ে এসেছেন। তিনি শুধুই মা। এ এক যুগান্তব্যাপী সাধনা বাঙালি মননের। শুধু মা-কে ডেকে শান্তি পাওয়াতেই পূর্ণতার আস্বাদন। বাঙালির দূর্গাপূজো তাই আড়ম্বরের। কোথাও কোনো দূর্গামন্দির সেভাবে নেই। অল্পজ্ঞ চিত্রপরিচালক মাত্রই যেমন বাঙালি পরিবার মানেই একটা দূর্গা মন্দির দেখান। আসলে তা তো নয়। দূর্গা দেবী হলেও মা হয়ে উঠতে সেভাবে পারেননি, পেরেছেন কালী। দীর্ঘদিনের সাধনায়, বিশ্বাসে।
সেদিন থেকে দক্ষিণেশ্বরের উপর একটা দৃষ্টিভঙ্গী বদলালো। জানি সেখানে বলি হয় না, পাণ্ডার উৎপাত নেই। কিন্তু তার থেকেও বড় যে কথা সেদিন দেখলাম একটা প্রস্তরমূর্তির কেন্দ্রে নিজের মাকে দেখার, অনুভব করার কল্পনাশক্তির মাধুর্য। স্বার্থেন্বেষীরা তো আছেই। ধর্মস্থান আর স্বার্থান্বেষী তো একই পয়সার এপিঠ ওপিঠ। যেখানে মানুষ সেবাও করে একটা আত্মকেন্দ্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে। নিজের মুক্তি বা ভগবানের তুষ্টির মাধ্যমে স্বার্থলাভ। চিত্তশুদ্ধির জন্য কি আর প্রতিষ্ঠান লাগে। সে তো অন্ধকারে হাপুশ নয়নে কাঁদলেই মিলে যায়। নিজেকে কঠিন করে রাখা থেকে নরম আর নীচু হতে পারার সাধনা তো ধর্ম কোনোদিন শেখাতে পারেনি। পেরেছে ভালোবাসা। বহুশাস্ত্রীয় প্রবচন শুনিয়ে, ব্রত-উপবাস করে, দীক্ষা নিয়ে মালা-কর জপে মানুষের যা না হয়েছে, তা একটা আস্তগোটা মানুষের প্রেমে পড়ে হতে দেখেছি শিশিরপাতের মত। তাই প্রেমের আঁশটা নিয়ে চলে ধর্ম আর ধর্মব্যবসায়ীরা। প্রেমের শাঁসটা নিয়ে চলে সংসার।
বাঙালির এই মাতৃসাধনার চূড়ান্ত রূপ হয়ে হয়ে এলেন আমার মনে হয় কয়েকজন রমণী। সারদাদেবী, ভগবতীদেবীর নাম তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। কারণ এরা যে শক্তিতে এতবড় পুরুষতান্ত্রিক মধ্যযুগীয় সভ্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন তা তাঁদের অসম্ভব ধৈর্য্য, আত্মত্যাগ আর মাতৃত্বের গভীর অনুকম্পায়। তাদের মধ্যে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির বিলাস ছিল না। ছিল আপামর সাধারণ আর উপস্থিত বুদ্ধির তীক্ষ্মতা।
১) একটা দাতব্য চিকিৎসালয়ে বহু বড়লোক এসে বিনা পয়সায় ওষুধ নিয়ে যায়। মহারাজেরা বুঝতে পারেন না কি করা উচিৎ। মায়ের কাছে পরামর্শ নিতে গেলেন। মা বললেন, যে হাত পাতে বাবা, সেই গরীব জানবে।
২) বস্তিতে উপপতি ছেড়ে গেছে এক মহিলাকে, বাগবাজারে। সবাই বলছে বেশ হয়েছে, আরো নিজের পরিবার ছেড়ে এসে থাকো। মা বললেন, তা কেন, ওর পাপের সাজা ভগবান দেবেন, কিন্তু ওই মহিলা তো ওই পুরুষটার মুখ চেয়েই ঘর ছেড়েছিল, লোকটা ঠিক করেনি।
৩) কথায় কথায় বলেছিলেন, যে ভালো হতে চায়, তাঁর (ঈশ্বরের) উপর নির্ভর করে চলতে চায়, সে যদি বিপথে যায় তো সে মহাপাপের দায় তো তাঁর!।
আমি শুনিনি এমন করে কেউ ঈশ্বরকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করার ক্ষমতা রেখেছেন ধর্মের জগতে।
৩) বিদ্যাসাগর জানতে চেয়েছেন গ্রামে দূর্গাপূজোর কিরকম বড় করে আয়োজন করা যাবে? ভগবতীদেবী বলেন, গ্রামের বাচ্চাগুলো স্কুলে পড়তে যায়, না খেয়ে, বাবা, তুমি যদি ওদের একটা প্রতিদিন খেয়ে স্কুলে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারো তো গ্রামে সারা বছর দূর্গাপূজো লেগে থাকে।
এরকম অজস্র ঘটনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, আত্মশক্তি জাগাতে সিলেবাস লাগে না, একটা সুস্থ স্বাভাবিক সাহসী বিবেক লাগে।
দক্ষিণেশ্বরের মাটিতে রাসমণি-সারদা-মা কালী মিলে নারীশক্তি তথা একটা মাতৃশক্তির ধুন্ধুমার কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলেন। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ তো সে মহাযজ্ঞের আহ্বায়ক মাত্র। কিন্তু পূর্ণতা তো সেই মা-তেই।
আমি সে অর্থে আস্তিক নই। কিন্তু মাতৃত্বের বোধ ছাড়া যে জগৎ অন্ধকার, সেটুকু বুঝবার ক্ষমতা তো রাখি। তাই বোধহয় সারদাদেবীর বিশ্বমাতৃত্বের বোধে চিত্তে একটা আরাম জাগে। এমন জীবনও হয়! মাথা আপনিই নীচু হয়। যেখানে মানুষ কোনো ঐশ্বরিক মোহ ছেড়ে একটা প্রাণের নিঃস্বার্থ আকুতি নিয়ে মা ডেকেছে, প্রাণে এসে বেজেইছে। বিদ্যাসাগর ভিখারির কণ্ঠে মাতৃনাম শুনে কেঁদে ভাসিয়েছেন, সে মা শুম্ভ-নিশুম্ভ-রক্তবীজ দলনী না। সে মা আমার দাওয়ার বসে বড়ি দেওয়া, আমার পথ চেয়ে না খেয়ে বসে থাকা, আমার আশা-ভরসা-ব্যর্থতা-আনন্দ-বিষাদের আবরণী – মা।