Skip to main content

 

 

 

 

 

 

তবে আনন্দ কি? সুখ? শান্তি?

 

কোনোটাই নয়। আনন্দ একটা শক্তি। উদ্যম। যার বিপরীতের শব্দ বিষাদ। আনন্দলাভ করার উপায়? কিছু নেই। আবার আছেও। যেমন ধরা যাক আমি দিল্লী যেতে চাই। আমি আছি কলকাতায়। আমি কিভাবে যাব? আমায় কলকাতা থেকে একটা একটা স্টেশান ছেড়ে ছেড়ে দিল্লীতে পৌঁছাতে হবে।

আনন্দও তেমন। আনন্দকে পাওয়া যায় না। যা পাওয়া যায় তা সুখ। তার একটা ডিউরেশান পিরিয়ড আছে। আমার পানীয়ের সুখ, আমার চুম্বনের সুখ, আমার মিলনের সুখ, আমার ভ্রমণের সুখ, আমার নতুন আবাসনের সুখ, আমার নতুন যানের সুখ, নতুন পোশাকের সুখ, নতুন কাজের সুখ, নতুন সম্পর্কের সুখ ইত্যাদি সবের একটা ডিউরেশান আছে। অর্থা এ সবেরই সুখ হিসাবে থাকার একটা আয়ু আছে। পুরোনো হলেই আবার মন উসখুস, আবার উচাটন। আবার নতুনের খোঁজ।

আনন্দ নতুনও না, পুরোনোও না। আনন্দকে পাওয়া যায় না। আনন্দতে পৌঁছাতে হয়। যেমন যে গান গাইছে, সে সা, রে, গা কে তৈরি করতে পারে না, শব্দবিজ্ঞান অনুযায়ী সে তৈরি হয়েই আছে। তাকে শুধু সেই তরঙ্গ অবধি নিজের কণ্ঠস্বরকে পৌঁছাতে হবে। কিভাবে? বাকি তরঙ্গকে একে একে বর্জন করে করে। তবে গিয়ে সঠিক সুরটায় গিয়ে পৌঁছানো যাবে। এও তেমন। আনন্দ হয়েই আছে। তাকে পেতে হবে। আনন্দ কিভাবে হয়েই আছে তাকে দেখার জন্য কোনো গুহায় সেঁধিয়ে বসার দরকার নেই। ঘোর কলি চলছে, ওতে আরো বিকার বাড়বে। তার চাইতে একটা শিশুর সঙ্গলাভ অনেক অনেক পুণ্যের। তখনই বোঝা যায় আনন্দের বিচ্ছুরণ কি স্বাভাবিক, কি সতেজ, কি নিঃশর্ত।

তবে আমি পাব কিভাবে? আমায় খুঁজে বার করতে হবে আমার আনন্দের আবরণ কিসে কিসে হচ্ছে? আনন্দ আমার স্বাভাবিক অবস্থা। আমার সহজাবস্থা। আমি যখন গভীর ঘুমে যাই, আমার বাড়িগাড়ি, টাকাপয়সা, সম্পর্ক ইত্যাদি সব ঘুমিয়ে পড়ে। এবং অবশ্যই তাদের জড়িয়ে যাবতীয় সমস্যার ইতি ক্ষণিকের জন্যে হলেও। আমি ঘুমের মধ্যে আমার আনন্দময় অবস্থায় স্থিতু হই। উঠে বলি, আহা, কি ফ্রেশ লাগছে। যদি এ ঘুম স্বাভাবিকভাবে না আসে তবে ওষুধের সাহায্যে নিজেকে নিস্তেজ করে ফেলি খানিক। ক্রমে চিন্তারা আমার থেকে দূরে যায়, আমি ঘুমে ডুবি। কিন্তু এ তো অস্বাভাবিক অবস্থা। স্বাভাবিক ঘুম থেকে নিজেকে বঞ্চিত হতে হলে জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়ে। ঘুম চাই, ভালো থাকার এ প্রথম অত্যাবশ্যক শর্ত। ঘুমই হল নিত্য বরাদ্দ স্বাভাবিক আনন্দের প্রশান্তসাগর।

আমায় খুঁজে বার করতে হবে আমার নিরানন্দের কারণ কি কি? দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমার দৃষ্টিভঙ্গী। যে উপন্যাস আমার আনন্দের কারণ হতে পারে, সেই উপন্যাসই পরীক্ষার বিষয় হলে আমার পীড়নের কারণ হয়ে পড়ে। কারণ উপন্যাস তখন আর আমার কাছে উদ্দেশ্য নয়, উপায়। আমার ভালো মার্ক্স তোলার সিঁড়ি।

যে মানুষটাকে আমি প্রচণ্ড ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করি, তাকে নিয়ে আমার মনে ভীষণ অশান্তি, নিরাপত্তাহীনতা। কারণ আমার তার উপর দখল চাই। সে সব সময় আমায় সময় দিক, আমার কথা ভাবুক, আমার ফোনের উত্তর দিক, অর্থা সর্বক্ষণ সে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বাঁচুক ইত্যাদি ইত্যাদি। আনন্দ গেল। কারণ আমি প্রেম চাইছি না, খাঁচা চাইছি। তাকে দখল করে আমার ভালোবাসার খাঁচায় ভরে রাখতে চাইছি। এতে হয় তো সিউডো নিরাপত্তার বোধের সুখ কিছুদিনের জন্য পাওয়া যায়। কিন্তু আনন্দ? কদাপি নয়।

এরকমভাবে ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যাবে আমার আনন্দকে আমি নিজেই মাটি করছি নিজের ক্ষুদ্র সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীতে। আনন্দ মুক্ত উদার চিত্ত না হলে ধরা দেয় না। আমরা অন্তরের অন্তঃস্থলে সে কথা জানি। তাই আমরা ছুটি কাটাতে কেউ কেষ্টপুরের খাল দেখতে বা পানায় ভরা হাঁটুজলে নাইতে যাই না। আমরা পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল মরুভূমি খুঁজি। তাই খুঁজি যে আমায় আমার বানানো হাজার শর্ত থেকে মুক্তি দেবে। আমি আমার আনন্দকে আবার ফিরে পাব। সে বিশাল হবে, উদার হবে, গভীর হবে - তবেই আমার বেড়িয়ে আনন্দ। সে আনন্দ জন্মায় কি জঙ্গলে, জলে না পাহাড়ে? মনে। আমার সত্তার গভীরে। কারণ আমি কিছু দিনের জন্য সব ভুলব বলে গেছি। আমার এই চেষ্টাটাই আমার মধ্যের চিরকালীন আনন্দের প্রস্রবণটা খুলে দিয়েছি। আমি দু হাত ছড়িয়ে বলছি, "আহা, শান্তি, বাঁচা গেল।" কি আশ্চর্য না? যা যা জমিয়ে পাহাড় করে তুলে বাঁচার অর্থ খুঁজেছি, নিজের অহংকে নাইয়ে খাইয়ে বড় করেছি, এক এক সময় তার হাত থেকেই নিজেকে বাঁচিয়ে শান্তির রাস্তা খুঁজছি। সুখ আর শান্তির পার্থক্য বুঝতে পারছি।

অনেকে আনন্দের লোভে ঈশ্বরের থানে বাসা বেঁধে বসে। নিজের আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে অন্যের আনন্দেরও দফারফা করে বসে। যে আনন্দকে অনুভব করতে উদার, মুক্ত, নির্ভীক সতেজ চিত্ত দরকার হয়। সেই আনন্দের জন্যেই তারা ঠিক এর বিপরীতের অভ্যাস করে। সঙ্কীর্ণ, নানা কুসংস্কারবদ্ধ, ভীরু, দুর্বল চিত্তে মিনমিন করে বাঁচে। ভাবে খুব ভক্ত হচ্ছে। আর তা নইলে কি এক নেশায় হুঙ্কার দিয়ে পাড়া কাঁপায়, একে তাকে ভয় দেখিয়ে ফেরে। যার মনে যত বিকার তার তত বাঁধন, তত নিয়ম, তত কৌশল। সে যত ভয় পায় দেখায় তার দ্বিগুণ। এ নিয়ম।

এ সবের থেকে দূরে যদি থাকতে চাই, নিজেকে বাঁচাতে চাই, তবে নিজের ভালো থাকার ব্যবস্থা নিজেকেই করে নিতে হবে। যেমন কি কি খাবারে আমার শরীর বিগড়ায় সে সে খাবারকে বর্জন করে স্বাস্থ্যের আনন্দকে কায়েম করি, তেমনই যা যা আমার নিরানন্দের কারণ সেই সেইকে একেবারে বর্জন করে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। নইলে বিষাদের ছোবল একবার যদি নেশা ধরায় তবে ভালোভাবে বাঁচা সত্যিই দায়। এ দায় আমার হয়ে কোনো গুরু, কোনো ভগবান, কোনো দাদাদিদি নেবে না গো, এ দায় নিজেকেই নিতে হবে।

"আপনারে দিয়ে রচিলি রে কি এ আপনারই আবরণ!

খুলে দেখ দ্বার অন্তরে তার আনন্দনিকেতন।।"

 

(ছবি Debasish Bose)