'অখণ্ডতা' আর 'সততা'র মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি? রামকৃষ্ণদেব যখন বলছেন, টেলিগ্রাফের তারে ফুটো থাকলে খবর যায় না, তখন বলতে চাইছেন তো এই অখণ্ড অনুভবের কথাই?
নিজের মধ্যে এই অখণ্ড অনুভব আমাদের কতক্ষণ স্থায়ী হয়? আমরা যাই করি না কেন, যে কাজের সঙ্গেই যুক্ত থাকি না কেন, সুখ মানে আদতে তো এই অখণ্ড অনুভব।
প্রশ্নটা কি অধ্যাত্মিক, না দার্শনিক? আসলে কোনোটাই নয়। প্রশ্নটা আত্মিক। আমরা এমন একটা মুহূর্ত বাঁচতে সবাই চাই যে মুহুর্তটাতে আমার এই ছড়ানো-ছেটানো 'আমি'টা এক হয়ে একটা অখণ্ড সত্তা হবে। আমি ডুবে যাব। আমি পূর্ণ হব। সেই ক্ষণটায় পৌঁছাতে চাই বলে সারাদিন কত না কত আঘাত, যন্ত্রণা, কষ্টকে মেনে নিই। প্রাণের গভীরে বিশ্বাস তো অবশ্যই করি এত বড় জীবনটা ফাঁকি কিছুতেই নয়। যা চাইছি নিশ্চয়ই তা পাব। কিন্তু কিভাবে?
শুরুতেই স্পষ্ট করে বোঝা যায় না আসলে কি চাইছি? কি পেলে নিজেকে সার্থক মনে হবে? জীবনে সফল তো ছোটো-বড় অনেক কিছুতেই হয়েছি, সেই নিয়ে সেলিব্রেশানও হয়েছে। তবু কি প্রাণের গভীরে সে আশটা মিটেছে? না মেটেনি। প্রাণের গভীরে নিজেকে পূর্ণ করে পাওয়ার সাধ সে তো অধরাই থেকে গেছে। নিজেকে অখণ্ডভাবে অনুভবের তাগিদ, সে বারবার ডেকে যাচ্ছে। সে ডাকের অনুভবকে কি নামে চিনি? ভালোবাসা।
মানুষ ভালোবাসা পেতে পেতে সেই অখণ্ড অনুভবে গিয়ে পৌঁছায়? না, ভালোবাসতে বাসতে?
উত্তরটা সবাই জানি। কিন্তু ঝড়ের গতিতে ছুটি বলে স্বীকার করি না। ভাবি গতির ঘোরে সত্যের দাবীটা চাপা পড়ে যাবে। যায় না। গতি কমে আসে। ক্লান্তি লাগে। অবিশ্বাস জন্মায়। সিনিক হই। ঈর্ষায় দগ্ধ হই। আরো নানা বিকারে মনটা বিষাক্ত হয়ে ওঠে এমন যে যেন নিজের হাত থেকেই নিজে পরিত্রাণের পথ খুঁজি। বাইরে ঈশ্বর বানাই, ক্লাব বানাই, হাজার একটা আয়োজন করে নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি। হয় না। সেও ব্যর্থ হয় অবশেষে। প্রাণে অখণ্ডতা জন্মায় না, জন্মায় শূন্যতা।
উপায় ভালোবাসা পাওয়া না, ভালোবাসার ক্ষমতা। ভালোবাসা মানে শুধু সুখ না। এও জানি আমরা। সুখ, দুঃখ, আঘাত --- সব ভালোবাসার দরজা দিয়ে আসে। সব আসবে না? সব না এলে জীবনকে পরিপূর্ণভাবে অনুভব করব কিভাবে? অখণ্ড অনুভবে জন্মাব কিভাবে? সব চাই তাই। মনীষীরা তাই আমাদের দুঃখকে অসম্মানের বলেননি, অবাঞ্ছিত বলেননি, বলেছেন ক্ষুদ্রতাকে। ভালোবাসতে না পারার ভয়কে। আঘাতকে সহ্য করতে না পারার মানসিকতাকে। বলেছেন, এভাবে নিজেকে ব্যর্থ কোরো না। বুক চিতিয়ে ভালোবাসো। শুধু ভালোবাসার জন্যেই ভালোবাসো। আঘাত পাও। যন্ত্রণা পাও। সুখ পাও। কিন্তু কোনো পাওয়াটাকেই বিশেষ পাওয়া বলে আঁকড়ে ধরে বোসো না। স্রোত রুদ্ধ হবে। অখণ্ডের সাধনায় পড়বে ছেদ। গোঁজামিল জায়গা করে নেবে। মাঝরাস্তায় ছেদ পড়বে যে!
আমার গভীরে যে পূর্ণ হওয়ার তাগিদ, তাকে এই রাস্তাতেই সার্থক করে নিতে হয়। আর অন্য কোনো রাস্তা নেই, শর্টকাট নেই। একি আদৌ সহজ? কে বলল জীবন সহজ? জীবন কঠিন। ভীষণ কঠিন। তাই এত খাঁটি। এত সত্য। এত প্রাণবন্ত। সহজ বলে যদি কিছু থাকে, গতির ছন্দ, পথ নয়!