সৌরভ ভট্টাচার্য
23 March 2017
সন্মিলিতভাবে অপমানিত বোধ করার মধ্যে একটা উত্তেজনা আছে। তাতেও 'একটা কিছু' করছি ভেবে ভীষণ আত্মপ্রসাদ লাভ করা যায়। কখনও কখনও তো আবার নিজের উপর বেশ খানিক বল প্রয়োগ করে অপমানবোধটাকে জাগিয়ে তুলতে হয়। সে তো হবেই, যেটা স্বাভাবিকভাবে না জাগে তাকে উন্মত্ত হয়েই তো জাগিয়ে তুলতে হয়। নিজের একটা প্রবল প্রতিপক্ষ না থাকলে কি আর খেলা যায়? তা সে যে রকম খেলাই হোক না কেন? আমি যে ইস্টবেঙ্গল সে কথাটা সামনে মোহনবাগান না থাকলে কি আর জমে? পুরো বাংলায় যদি শুধু ইস্টবেঙ্গল হত, তবে সে দলটার অস্তিত্ব থাকত না। দলের অস্তিত্ব থাকে প্রতিপক্ষ থাকলেই। সব ক্ষেত্রেই তাই। আমি বৈষ্ণব হিসাবে নিজেকে স্বতন্ত্রবোধ করি আমার সামনে শৈব কি শাক্ত থাকলেই। নইলে নিজেকে নিয়ে আর কবে নিজে নিজে ঘোঁট পাকানো যায়, থুড়ি দল পাকানো যায়। একদিন ভারতে এমন নানান মতের বিরোধ হয়েছে আবার সহাবস্থানও হয়েছে। দুই-ই সত্যি। দল থাকবে অথচ গোল হবে না তাকি হয়? এই এখন যেমন আমাদের বাংলায় সরকারি বনাম বেসরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার দুই দল তৈরি হয়ে গোল বেধেছে। দল আর গোল একে অপরের সাথেই চলে। চলবেও।
আচ্ছা কথাটা কি পুরো ঠিক বললাম? দল আর গোল সমার্থক? এটা অর্ধসত্য। কিরকম একটু ভেবে দেখা যাক। একটা কথা আছে - team-work. এখানে এই work কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো মিলিত জনসমষ্টি যদি কোনো সাংগঠনিকমূলক কাজে ব্যস্ত থাকে তবে তাদের একত্রিত হওয়ার জন্য কোনো কৃত্রিম কারণের আবশ্যক হয় না। তাদের ক্ষণে ক্ষণে অপমান বোধ উথলে ওঠে না। কারণ সোজা কথা - সময় নেই। তাই সে ধরণের উত্তেজনা ক্ষণিকের জন্য জন্মালেও নিজেই নিজেকে স্তিমিত করার একটা পথ খুঁজে নেওয়ার তার একটা তাগিদ থাকে। ঠিক যেমন আমাদের সরকারি আর বেসরকারি ডাক্তারবাবুদের, তাদের তর্ক করে সময় নষ্ট করার মত সময় নেই। তাই সে বিরোধ ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে (যদিও কিছু মিডিয়া আপনস্বার্থে সে ক্ষততে মলমের পরিবর্তে অম্লের ছিটা দিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় আছে)।
কিন্তু যে দলের একত্রিত হওয়ার কোনো স্বাভাবিক, গঠনমূলক আদর্শ নেই? তারা কি করবে? তাদের হাতে দুটো পথ। এক দলের সমর্থনে সদস্যদের সংখ্যা বাড়ানো আর দুই ক্ষণে ক্ষণে অপমানিত বোধ করে প্যাসিভ ভাবে নিজের অস্তিত্বকে প্রচার করা তথা উত্তেজিতভাবে নিজের দলগত অলীক কায়াকে অনুভব করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। এতে জনমানসের সমর্থন পাওয়া যায় হয়ত হুজুগে কিছুদিন, পরে আবার আপনা আপনি সব স্তিমিত হয়ে আসে, কারণ সারা পৃথিবীর আপামর সাধারণ মানুষের গায়ে চিরকালের জন্য কোনো লেবেল সেঁটে দেওয়া কারোর পক্ষে কোনোদিন সম্ভব হয়নি, হবেও না। তাই মহামানবের ডাক যখন আসে তখন সভা-সমাবেশের ব্যবস্থা করতে হয় না, হাওয়ায় হাওয়ায় সে ডাক এসে ঘরের দরজার আগল আলগা করে দিয়ে চলে যায়। মানুষ জাগে। নিজের পরিচয়ে জাগে, দলের পরিচয়ে না।
আজ আমাদের সে দুর্দিন। সাগরের বুকে কার কলমের একবিন্দু কালি পড়েছে বলে আজ যারা আস্ফালন করছে পুরো সাগর দূষিত হয়ে গেল বলে, তাদের দেখলে একটা কথাই মনে হয়, হয় তারা সাগরকে চেনেনি নয় তারা কালির পরিমাণ বোঝেনি। সাগর লজ্জা পাবে তারও একদিন রক্ষক লেগেছিল বলে। মনুষ্যত্বের অপমান যার গায়ে বাজে তিনি নিজে তার বিধান করেন, ইতিহাস সাক্ষী। কারণ সব ধর্মের শাঁসটা সেই মনুষ্যত্ব। কিন্তু শাঁসটা ফেলে যখন খোলটাকে সিংহাসনে বসাই তখন তার হয়ে বিধানের ব্যবস্থাও নিজেই করি। সে ব্যবস্থা চিরকালই আমার মত ক্ষুদ্রই হয়। কারণ অতটুকুই আমার ক্ষমতা যে। কিন্তু যেদিন তিনি এসে রাজাসনে বসেন সেদিন তাঁর আদেশ হয় মহৎ। একদিন সে আসনে বসেছিলেন বুদ্ধ, চৈতন্য, কবীর, নানকের মত মানুষের ভগবান, কোনো দলের অধিপতি নয়!
আজ সে রাজা নেই। তাই সিংহাসনে যাকে বসিয়েছি তার পায়ে মাথা নীচু করে রাখার মত শ্রদ্ধা বুকে জন্মায়নি, সে তো নিষ্প্রাণ আবরণ, রাজাকে তো নির্বাসনে পাঠিয়েছি। আর তাই আজ এতটা নির্লজ্জ হওয়া সহজ হয়ে উঠেছে আমাদের।