একটা সুর বেজে চলেছে দূরে কোথাও। কান পেতে শুনলে মনে হচ্ছে, দূরে কই, এই তো কাছে আমারই বুকের মধ্যে বেজে চলেছে সে। সুরটা যেন প্রথম কানে এলো, কিন্তু অচেনা নয়। নিজের ভিতর নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে শুনছি, বেজেই চলেছে, বেজেই চলেছে সে সুর। এখনই যেন বর্ষা নামবে, ভিজে চুপচুপ হবে আমার সমস্ত আমি। ভিজতে ভিজতে আমি শুনব, ভাবব - কে বাজালো এই সুর?
দিনের নানান কাজের তাড়াদের দরজার কাছ থেকে ফিরিয়ে দেব, বলব, আজ আমার ভীষণ জ্বর যে, কাজে যাই কি করে? তোমরা যাও। তরপর অনেক অর্থহীন কথার মধ্যে থেকে একটা দরকারি কথা খোঁজার খেলায় মাতব। অর্থহীন কথা, অর্থহীন চেষ্টা, অর্থহীন অবকাশযাপন আমার সারাদিন জুড়ে বেড়ালের মত এ ঘর ও ঘর করতে থাকবে। আমি তাদের পিছনে পিছনে তো যাব না, তবু তাদের দূর থেকে দেখব, আর সেই সুরের মধ্যে ডুববো। কেজো মানুষদের চোখ এড়াব, তারা কাছে এলেই বলব, দূরে যাও, আমার শরীরে ভীষণ বিশ্রী একধরনের ছোঁয়াচে রোগ হয়েছে যে! তারা ভয়ে লেজ তুলে হুড়মুড় করে দৌড় লাগাবে, আমি নিজের মনে মনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ব, কিন্তু বাইরের একটা ঘাসের আগাও জানবে না সে কথা। তারা জানবে আমার ভীষণ অসুখ।
আমার এতদিনের সাধের যা কিছু সঞ্চয়, সব আজ যেন অকিঞ্চিৎকর, অর্থহীন মনে হবে। আমার কেজো আমি অভিমানে ফুঁসবে, বলবে - আচ্ছা..বটে...তবে। আমি তার অভিমানকে তোয়াক্কা করব না, বলব আজকের দিনের জন্যে তো আমিই রাজা, আমার সব কিছু অর্থহীন আজ, আমার কাছে এসো না। দেখছো না আজ রোদ ওঠেনি, আজ কেমন অস্পষ্ট সব কুয়াশায়, তুমিও যাও। মনে রেখো তুমি আসলে দাস, আমিই প্রভু, অর্থহীন আমি আসল, তুমি নকল. তুমি শুধুমাত্রই প্রয়োজনের। প্রয়োজনের বাইরেও যে আমার অস্তিত্ব তুমি ভয় করো তাকে, কারন সে অর্থহীন। সে পাগল। সে বেহিসাবি। তোমার অস্তিত্বের একদম বিপরীত প্রান্তে সে বসে। কি ভীষণ সংকট তোমার তাকে নিয়ে। সে শোনে সুর, সে খোঁজে খেলা, তুমি খোঁজো যন্ত্র, তুমি খোঁজো কাজ। তোমার কানে সুর পৌঁছায় না। তুমি সুরের নাগাল পাও না, ওদিকে গর্ব করে বলো, ওসব মিথ্যা, কুহক। হয় রে হায়, যদি তুমি কোনোদিন টের পেতে কত বড় কুহক তুমি নিজে। কিন্তু সে টের তুমি কোনোদিন পাবে না, কারণ অন্ধকার নিজেকে অনুভব করে আলোর অনুপস্থিতিতেই, তুমিও তাই ওগো আমার কেজো অহং, তুমি যে আমার সুরের আলোর অনুপস্থিতি মাত্র শুধু।
কিন্তু আজ তুমি যাও। আজ সব তর্ক থাক। আজ বিশ্বসংসারের কোন কোণায় কি ঘটল, আমি কিছুই জানতে চাই না, আজ আমার কোনো দায় নেই। আজ আমার জন্যে যে অপেক্ষায় আছে সে আমার অদেখা বন্ধু, আমার চিরকালের সাথী। সে অর্থহীন। সে অসীম। অসীমের কোনো অর্থ হয় না। তাই শূন্য হয়ে সে এত ছদ্ম-অর্থপূর্ণ জগতের মধ্যে নিশ্চিন্তে বাস করে, আমারই প্রতিবেশী হয়ে। যেদিন সবকিছু ভেঙে পড়ে, সব সঞ্চয় এক লহমায় ভীষণ ঝড়ে হারিয়ে যায়, নিজেকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে ফেলি, যেদিন সত্য অর্থে আমার নিতান্তই দুর্দিন, সেদিন সে আসে। বুকের মধ্যে পরম আদরে কাছে ডেকে নেয়, বলে, এই তো আমি এসেছি, তোমার চিরকালের সাথী মহাশূন্য, তুমি জানো আমায়, কিন্তু কোনোদিন ভয়ে স্বীকার করোনি। তাই হয় জানো, মানুষ ততদিন আমায় স্বীকার করে না, যতদিন সে আমায় স্বীকার না করে অনায়াসে চলতে পারে, যতদিন না তার অহং এর পথ ফুরিয়ে আসে।
অবশেষে আমি বিশ্রাম পাই সেই অসীম শূন্যের বুকে এসে। সে আমার আনন্দ, আমার পরম গন্তব্য, আমার পরম প্রিয় সখা। সে আমার শূন্য। কিন্তু সে ফাঁকি নয়। সে সব অর্থ থেকে, সর্বোপরি আমার নিজের থেকে আমায় মুক্তি দেয়। বীজের আবরণ যেমন সব চাইতে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় অঙ্কুরের জাগরনের, এও তেমনিই। অঙ্কুর যেমন একটা অবকাশ পেলে নিজেকে মেলে ধরে চারদিকে, তেমনি আমিও একটা অবকাশ পাই নিজেকে মেলে ধরার, নিজেকে প্রকাশ করার এই শূন্যের কোলে। আজ আমার সেই অর্থহীন দিন। সব অর্থ থেকে মুক্তির দিন।
সৌরভ ভট্টাচার্য
19 December 2017