Skip to main content

কয়েকদিন ধরে দেখছি বাঙালিরা বাঙালিদের কাছেই দেশে-বিদেশে বড় অপমানিত হচ্ছেন। প্রতিবাদ, মান-অভিমান এই সবও হচ্ছে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।

বিদেশে গিয়ে বাঙালি শিল্পীরা বাঙালি শিল্পরসিকদের কাছে অপমানিত হচ্ছেন। এদিকে নিজের মাটিতে নিজের ভাষার সঙ্গে দুষ্টু সৎমায়ের মত ব্যবহার করছে এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কি গেরো! ফলে অভিমান, ক্ষোভ, অপমান মিলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

এখন বাঙালি প্রতিবাদটা করবে কার কাছে? কেউ কেউ কথায় কথায় বলেন, বয়কট করো। এখন অমন ফস্ ফস্ করে বয়কট করলে তো আর কাজ চলে না। তাই একজন নামী সঙ্গীতশিল্পীর চোখ অভিযোগ অভিমান ভরা লাইভে আরেকজন নামী অভিনেত্রী কমেন্টেসে লিখলেন, ওহে তুমি ভাই নিজের কথাই শুধু বলো, কারণ তুমি যখন অন্যের অপমানের ফিরিস্তি গাইছ, তখন সে হয় তো আবার ভিসার লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে, সব অপমান ভুলে।

কথা বাস্তব। সব দিকেই বাস্তব।

এদিকে সেদিনও বেশি দেরি নেই যেদিন বাংলা মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালি সন্তান পেতে বিদেশী আতসকাঁচ আমদানী করতে হবে। জীববিদ্যায় যোজক প্রাণী বলে একটা ব্যাপার আছে। মানে যে প্রাণীতে দু'জাতের প্রাণীর বৈশিষ্ট্য আছে। এই যেমন আর্কিওপটেরিক্স বলে একটা পাখি ছিল তার মধ্যে সরীসৃপ আর পক্ষীর উভয়েরই বৈশিষ্ট্য ছিল। এখন আমাদের বাংলা মাধ্যমের বেশ কিছু স্কুল ছাত্র টানার জন্য আর্কিওপটেরিক্স হচ্ছে। মানে দুই ভাষাতেই পঠন পাঠন চালাতে চাইছে। ফলে হচ্ছে কি যারা ইংরাজি স্কুলের অতি-খরচের বোঝা বইতে পারছেন না, এদিকে ভাবছেন বাংলা ভাষায় শিক্ষা পেলে সন্তানের ভবিষ্যৎ শুকনো চরে গিয়ে ঠেকবে, তারা সন্তানদের এইসব স্কুলে, কম বেতনে ইংরাজিতে পড়িয়ে, উপযুক্ত ইংরাজি জানা ভবিষ্যতের চাকুরীজীবী বানাবার স্বপ্নকে সাকার করবার সম্ভাবনা দেখছেন। আজকাল তো অনেকেই সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজও বাংলাকে সরিয়ে হিন্দি করে নিচ্ছেন সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য।

কিন্তু এ হল তলাকার কথা। যা দেখা যায়। বলা যায় না। তবে কি বাংলা ভাষার কোনো ভবিষ্যৎ নেই? তা কেন? বইমেলায় রাশি রাশি বাংলা বই বিক্রি হচ্ছে। যারা ইংরাজি মাধ্যমে পড়েছে তারা বুঝি সবাই বাংলা ভুলে যাচ্ছে? বালাইষাট! তা কেন হবে? দস্তুর মত গড়গড় করে ভাষাটা বলে যাচ্ছে। পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু দিনে দিনে এদের সংখ্যা কি কমবে? মোটেও না! থাকবে। কিন্তু গৌরবটা থাকবে না। যেমন এখন নেই। এখন কর্পোরেটের দুনিয়ায় হিন্দী আর ইংরেজি এসে বাংলা ভাষাকে অপশনাল করে ফেলেছে। বাংলা ভাষার শিকড় সরু হয়ে গিয়েছে। সে শিকড় দিয়ে কর্মজগতের জন্য পুষ্টিরসের আমদানি বন্ধ। কারণ কর্মজগতে তার আর ডাক পড়ে না। শুধু বিনোদন আর আটপৌরে ব্যবহারের জন্য ক্ষীণধারা আসে। তাহলে কি গেছে? এক কথায় 'সিরিয়াসনেস'টা গেছে। কমিটমেন্টটা দুর্বল। মায় বৃহৎ পরিসরে ঠিকঠাক মানের খবর, আলোচনা, বিশ্লেষণের জন্যেও ইংরাজি কাগজই ভরসা। সেখানে যে সিরিয়াসনেসটা আছে, এখানে তা যেন কোথাও একটু পানসে।

তবু কিছু মানুষ এ ডুবন্ত তরীকে বাঁচাতে প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের প্রেরণা একটাই, বাংলা ভাষার প্রতি, সংস্কৃতির প্রতি, ইতিহাসের প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। তারা মিছিলে গলা ফাটান না, উত্তেজক স্লোগান লেখেন না, "আপনি বাংলায় থেকে বাংলায় কথা বলুন" বলে কলার ধরে ঝাঁকি দেন না, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাবিধ ফ্যান্সি তর্কেও গা ভাসিয়ে দেন না।

তারা শুধু নিরলসভাবে নিজের জীবিকা সামলে যতটুকু সময় বাঁচে, কি নিষ্ঠার সঙ্গে ভাষাটার জন্য কাজ করে চলেছেন দেখি। এটা একটা আশার কথা। আমার ভরসা জাগে এনাদের দেখলেই। এইসব মানুষদের হারানো খুব শক্ত। কারণ এনাদের তাগিদটা না তো রক্ষণশীলের মত, না তো ছুঁৎমার্গীর মত, না তো অবাস্তব আকাশ কুসুমের। এনাদের কাছে নিজের ভাষাকে শ্রদ্ধা করা মানে অন্য ভাষা, বা সংস্কৃতিকে অশ্রদ্ধা করা না, বা তাদের প্রতি উদাসীন থাকাও না। এনারা ভীষণ ইনক্লিউসিভ। এরকম খাঁটি উৎসাহ, খাঁটি ভালোবাসা, খাঁটি তাগিদের জয় অবশ্যম্ভাবী।

হয় তো কয়েক প্রজন্ম খুব কনফিউশানের ভিতর দিয়ে যাবে। কিন্তু তারপর এনাদের বোনা বীজেই আবার নতুন করে এ ভাষার, এ সংস্কৃতির নতুন অঙ্কুর বেরোবে। যে ভাষার ইতিহাসে এত বড় বড় গুঁড়ি, এত গভীরে যে ভাষার মননের শিকড়, সে ভাষা আজ ভীষণ প্রতিকূলতার সামনে দাঁড়িয়ে তার বাইরের পল্লব-শাখা-ফুল-ফলে ম্লান হয়েছে নিশ্চয়ই, সে কি শুধু বাইরেই? মাটির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। যারা সেটা টের পান তারা জানেন কোনো ভাষাই কেবল ছাপাখানার উপর নির্ভর করে চলে না, চলে হৃদয় আর কণ্ঠের যুগপৎ আলিঙ্গনে। যাকে প্রাণবায়ু জীবিত রাখে। ছাপাখানার কালিই শুধু নয়। সেখান থেকেই আবার জন্মাবে ভবিষ্যতের বাংলা ভাষা। যার জোর হবে অকৃত্রিম, স্বপ্ন থাকবে দশদিক ছাওয়া, মাটিতে পা রেখেই। তাকে অপমান করবে কে? তার চোখের দিকে তাকালেই তো সে দেখবে আত্মনির্ভর, খাঁটি উজ্জ্বল আলো। যে প্রাণের আনন্দে বলে, আমি আছি। এই তো। ছুঁয়ে দেখো। হাত পাতো, এনেছি নতুন প্রাণের উপহার, নকল নেই, সবটাই আসল, অধ্যবসায়ে পাওয়া, সাধনার ধন, আমার অ আ ক খ…. আমার প্রাণে প্রবেশের পথ, তোমার হাতে হাত রাখার আমার আত্মবিশ্বাস।