আফসোস মাঝে মধ্যে এটা সেটা নিয়ে হবে। এ স্বাভাবিক। কিন্তু আফসোস যখন স্বভাবে দাঁড়িয়ে যায় তখন সে এক বালাই।
অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায় অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যা হয় তো না নিলেই ভালো হত। কিন্তু সেই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কি সম্পূর্ণ আমার নিজের হাতে ছিল? কোনো সিদ্ধান্তই সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে হয় কি? পারিপার্শ্বিকতা, সেই সময়ে আমার ম্যাচিউরিটি লেভেল, আমার মানসিক পরিস্থিতি এরকম অনেক কিছু কোনো একটা সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। সেটাই স্বাভাবিক। আমরা যত পরিণত হই তত আমাদের অতীতের ভুল, ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা সম্বন্ধে বোধ জম্মায়। কিন্তু সেই বোধও চরম নয়। যত এগোব, যত অভিজ্ঞ হব, তত বোঝা যাবে কোন সিদ্ধান্ত কতটা ঠিক ছিল আর কতটা ভুল।
সমস্যা হচ্ছে বোধের ম্যাচিউরিটি লেভেল বাড়লেও যে সিদ্ধান্ত একবার নিয়ে ফেলেছি তাকে কি আর বদলানো যায়? না। সে সিদ্ধান্তে একটা নির্দিষ্ট সময়ের শিলমোহর লেগে গেছে যে! সেই সিদ্ধান্তের ফল আমি প্রতিদিন পাচ্ছি, তার থেকে নিস্তারের পথ নেই। তবে সেই ফলকে আমি কিভাবে নেব সে আমার নিজের উপর। আফসোস করে করে, না সহজভাবে মেনে নেওয়ার সাধনায়।
সহজ হওয়াকে আমরা সিদ্ধিলাভ বলি। যে প্রথম সাইকেল চালাতে শিখতে শুরু করছে তার নিজেকে নিয়ে আর সাইকেলকে নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই। সাইকেলের প্যাডেল, হ্যাণ্ডেল, বেল সব তাকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়ে। যেদিকে গেলে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা, না চাইতেও হ্যাণ্ডেল সেদিকেই যায় ঘুরে। ক্রমে সহজ হয়। এমন সহজ হয়ে আসে যে ভিড় রাস্তা, দুর্গম রাস্তা কিছুতেই তার সাইকেলকে আটকাতে পারে না। সাইকেলে সে সিদ্ধিলাভ করেছে, মানে সহজ হয়েছে।
গান শেখাতেও তাই। যখন প্রথম প্রথম রেওয়াজে বসল তখন নিজের কণ্ঠের সঙ্গে সুরের মিল ঘটানো কি কঠিন এক কাজ। হয় তো প্রতিবেশীরা ঘরের জানলা বন্ধ করে দিল। সেই মানুষটাই যখন সুরে সিদ্ধিলাভ করল, প্রতিটা পর্দায় অনায়াসে বিচরণ তার কণ্ঠের, তখন সেই প্রতিবেশীই জানলা খুলে দিল। অর্থাৎ সুর তার কাছে সহজ হয়েছে।
জীবন বোধকে সহজ করে নেওয়াও এক সাধনা। সব চাইতে বড় সাধনা। হতে পারে আমি ভীষণ পণ্ডিত মানুষ, হতে পারে পৃথিবীর সব জ্ঞান আমার নখদর্পনে, কিন্তু জীবন বোধ কি সহজ হয়েছে? নাকি বিদ্যাবোঝাই বাবুমশায়ের মত ঝড়ের সামনে সব বিদ্যাশক্তি শূন্য হয়ে পড়েছে?
যদি জীবন বোধ সহজ না হল, তবে আসল কাজটাই রইল অসম্পূর্ণ। আফসোস করে করে, ক্ষুব্ধ থেকে থেকে জীবনের সব রসটুকুকে যদি বিষাক্ত করে তুলি, তবে আমার চারপাশটাও বিষাক্ত হয়ে ওঠে। সব কিছুর উপর আমার ক্ষোভ, রাগ উগরে ওঠে। ভাবি সবাই বুঝি আমার শত্রু, সব কিছুই আমাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যেই ঘটে চলেছে। কি যন্ত্রণাময় জীবন আমি নিজের হাতে নিজের জন্য গড়ে তুলি তখন।
কিন্তু যদি সহজভাবে মেনে নিই নিজের ভুল ত্রুটি সবকিছু। যদি নিজেকে ক্ষমা করে, নিজের ফেলে আসা রাস্তার যাবতীয় যা কিছু অসম্পূর্ণতাকে মার্জনা করি নিজের প্রতি সত্যিকারের করুণায়? তবে নিজের ভিতরের কর্কশ শব্দ কমে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে সহজ হয়ে আসতে শুরু করে মন। আজকাল ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি নিয়ে প্রভূত চর্চা হচ্ছে। এই ইমোশনাল ম্যাচিউরিটি নিয়ে চর্চা একদিন ভারতে আর গ্রীসে অধ্যাত্মবিদ্যা তথা দর্শনের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল সেই প্রাচীন কালে, যা নানা সাহিত্যে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে আজও। তাঁরা বুঝেছিলেন, মানুষের আসল কাজ জানা নয়, বাঁচা। সেই বাঁচাটাকে কি করে সহজ করা যায় সেই রাস্তা খুঁজতেই নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়েছিলেন। পথ পেয়েছিলেন। শান্তির পথ, আনন্দের পথ, সংহতির পথ।
লালন গাইলেন,
সহজ মানুষ ভজে
দেখনারে মন দিব্যজ্ঞানে
পাবিরে অমূল্য নিধি বর্তমানে।।
ভজ মানুষের চরণ দু’টি
নিত্য বস্তু হবে খাঁটি।
মরিলে সব হবে মাটি
ত্বরায় এই ভেদ লও জেনে।।
রবীন্দ্রনাথ গাইলেন,
সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি--
কাছের জিনিস দূরে রাখে তার থেকে তুই দূরে র'বি ॥
কেন রে তোর দু হাত পাতা-- দান তো না চাই, চাই যে দাতা--
সহজে তুই দিবি যখন সহজে তুই সকল লবি সহজ হবি, সহজ হবি, ওরে মন, সহজ হবি
আপন বচন-রচন হতে বাহির হয়ে আয় রে কবি।
সকল কথার বাহিরেতে ভুবন আছে হৃদয় পেতে,
নীরব ফুলের নয়ন-পানে চেয়ে আছে প্রভাত-রবি॥