সৌরভ ভট্টাচার্য
23 January 2018
সবই তো আছে। নেতা আছে, নীতি আছে, ধর্ম আছে, ধর্মস্থান আছে, গুরু আছে, শিষ্য আছে। তবু কি যেন নেই। কার যেন একটা অভাব। কত পাণ্ডিত্য আছে। কত গবেষণা আছে। কত বড় বড় প্রতিষ্ঠান, কত চিন্তাবিদ আছেনই তো। তবু কি যেন নেই, কি যেন নেই।
সুভাষচন্দ্রের ভাষণ দিতে গিয়ে কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়েছে এমন ঘটনা ঘটেছে। মোহনদাস গান্ধী নুন বানাতে যাওয়ার ডাক দিয়েছেন তাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ সাড়া দিয়েছে – ইতিহাস সাক্ষী। সুভাষ বা গান্ধী কেউই তাদের মতাদর্শ অনুসরণ করলে চাকরি দেবেন এমন কথা দেননি। তবু মানুষ গেছে। মেরেছে। মরেছে। কিসের জোর ছিল? তবে এখন মানুষ কি এতটাই স্বার্থান্ধ যে বড়োর ডাক সে শুনতেই পায় না? ইতিহাস তো সে কথা বলে না। বরং বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, মহাপ্রভু থেকে শুরু করে যাঁদের কথা বললাম, এদের অনুসরণকারীর তো অভাব হয়নি কখনও। এবং যারা অনুসরণ করেছেন তাদের জীবন যে খুব মধুর ছিল না তাও তো আমরা জানি। বরং কি ভয়ংকর বিপদসঙ্কুল ছিল আমরা শুনেছি তো।
সব মানুষ কি সাড়া দিয়েছিল? তাই দেয় কখনও? কিছু মানুষ তো ক্ষুদ্রস্বার্থ মগ্ন থাকবেই। আত্ম-করুণায় নিমজ্জিত। আগের দিন শরৎবাবুর একটা লেখা ওনার জন্মভিটেতে পড়ছিলাম, শখের সাহিত্যিক আর সত্যিকারের মানুষের জীবনীকারের কথা বলেছেন। যে মানুষ নিজের জীবনের চাইতে, নিজের বুদ্ধি-অনুভবের চাইতে বড় কিছুকে অনুভব করে উঠতে পারেননি সারা জীবন তার কাছে থেকে আর যা হোক বড় কিছু আশা করা যায় কি করে? তাদের কথা থাক। কথা হচ্ছে মানব সমাজের বড় একটা অংশ চিরটাকাল সাড়া দিয়ে এসেছে, আর তাদের নিয়েই মানব সভ্যতার অগ্রগ্রতির ইতিহাস।
কিসের ডাকে সাড়া দিয়েছে তবে? কি ছিল তাদের কণ্ঠে যা এখন অনুভবে পাচ্ছি না? একটা শব্দ – দরদ। আজ যে মানুষটার জন্মদিন তাকে নিয়ে কয়েকটি চর্চাই আজন্ম শুনে গেলাম, এক - কি ভাবে তিনি হারিয়ে গেলেন অথবা মারা গেলেন। দুই - গান্ধীর সাথে তাঁর জাতশত্রুতা। যে কথাটা উহ্য থেকে যায় সব ক্ষেত্রে সে দরদের কথা। অবশ্যই তার কারণ আছে। যিনি নীল রঙ চোখে দেখেন না, তার সামনে একটা নানা রঙের বস্তু থাকলে তিনি বাকি সব রঙের তারিফ বা আলোচনা করলেও নীলরঙটা তো এড়িয়েই যাবেন এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও তাই। অথচ মূল কথাটা হল আমাদের যত নীতি, নিয়ম, আইন থাকুক না কেন অবশেষে তা নির্ভর করে একটা মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্টের উপরেই। একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার দেশবন্ধু অনুকূলচন্দ্র মহাশয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছেন। কথাবার্তার পর দেশবন্ধুকে বারবার তিনি অনুরোধ করেন থেকে যাওয়ার জন্য কয়েকদিন আরো। দেশবন্ধু জানান তিনি অপারগ, কারণ কংগ্রেসের ভার অন্য কাউকে দিয়ে ক'দিন সময় কাটানোর মত উপায় তার নেই। শুনে অনুকূলচন্দ্র মহাশয় হেসে ওঠেন আর বলেন, এক কংগ্রেসের দায়িত্ব দিয়ে আসার মত মানুষ খুঁজে পাচ্ছেন না, তবে এতবড় দেশটা স্বাধীন করছেন কাদের জন্য? (এখানে উল্লেখ্য, সুভাষবাবুও দু থেকে তিনবার অনুকুলচন্দ্রের সাথে দেখা করতে যান যেহেতু ওনার বাবা-মা ওনার কাছে দীক্ষিত ছিলেন। ওনার সাথে কথোপকথন লিপিবদ্ধ আছে, সেখানেও একই কথার উপর জোর দেওয়া হয়েছে দেখা যায়, আগে মানুষ তৈরি। সুভাষবাবু সে কথা শুনে বলেন, ঠিক, আগে একটা মানুষের সংস্কার ঠিক না হলে শুধু বাহ্যিক শিক্ষা কি করতে পারে? পরে আরো একবার দেখা করতে যান, কিন্তু এত ভিড় হয়ে যায় ওনাকে দেখেই যে শুধু প্রণাম করে চলে আসেন কথা হয় না।
আমি এ তথ্য খুঁজে বার করি ‘ফরগটেন হিরো’ সিনেমাটা দেখার পর। যখন দেখি শ্যাম বেনেগল মহাশয় দেখাচ্ছেন সুভাষ রামকৃষ্ণ-স্বামীজি-অনুকূলচন্দ্র - এই তিনজনের সামনে ধ্যান করছেন আর পরবর্তীকালে ওর এলগিন রোডের বাসভবনেও ছবিটা দেখি তখন কৌতুহল জাগে। তারপর নানা বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে এই তথ্যাবলী আবিষ্কার করি)
কথাটা সেই দরদ। দরদ কথাটার দুটো অর্থ হয়, এক – ব্যথা, দুই – সহানুভব। “দরদী নইলে প্রাণ বাঁচে না”, বৈষ্ণব সাহিত্যে আছে। মানুষ নিজের জন্য রুখে দাঁড়ায় যখন তখন সেটা তার জান্তব আত্মস্বার্থ কায়েম রাখার প্রাগৈতিহাসিক জৈবিক তাগিদ। আবার যখন সে নিজের কথা ফেনিয়ে ফেনিয়ে সোচ্চারে বলে বেড়ায় ‘আহা আমি বেচারা’ মত, সেও তার দুর্বল অহং-এর কপট আত্মশ্লাঘা। তারও কিছু ধামাধরা শ্রোতা পাওয়া যায় অবশ্য। তবে সে শোনা ভুলতে সময় লাগে না। আরেক বিকার দেখা যায়, প্ররোচিত করা। সব চাইতে সস্তা পথ এটাই বোধহয় – provoke করা। সে সেকালেও ব্যবহার করা হয়েছে, এ কালেও হচ্ছে, ভবিষ্যতেও হবে। এতে দরদের মত মুখোশ থাকে। কিন্তু ভিতরে স্বার্থসন্ধানী চোখের সতর্ক নজরদারিও থাকে। তাই যতটা ধুলো ওড়ে, ধোঁয়া হয়, গনগনে তেজ হয় – তা নিভে যেতে বা থিতিয়ে পড়তেও বেশি সময় নেয় না।
কারণ মূল কথাটা থাকে না যে। যে কথাটা হল – দরদ। দরদ নির্বোধ আবেগ না। দরদ প্ররোচনা না। দরদ স্বল্পায়ু না। দরদ হঠকারী না। দরদ অনুশাসনহীন না। দরদ একটা ভাষা। একটা চেতনা। একটা বোধ। প্রাণীকূলও সাড়া দেয়, মানুষের কি কথা। মানুষকে সভ্যতায় সাবালক করে দরদ। সে শব্দে কথা বলে না। শব্দ উচ্চারণ হয় যে চেতন ঊষ্মায়, সেই উত্তাপে সে আরেকটা প্রাণকে উদ্দীপ্ত করে। তখন অনেকগুলো প্রাণ একটা বৃহৎ স্বার্থে একত্রিত হয় মঙ্গলে, লোভে নয়। যদি লোভে হয় তবে তা ‘সারদা কাণ্ড’ হয়, কিন্তু প্রাণ উৎসর্গী আবেগে চুর হতে পারে না। প্রাণত্যাগের থেকে অনেক বড় কথা স্বার্থত্যাগ। দরদ তা করতে প্রাণিত করে। নিজেকে সার্থক অনুভব করে। পরিপূর্ণ অনুভব করে। এই দুটোই মানুষী অনুভব। এর কোনো বিকল্প হয় না। আর তখনই কোনো স্থায়ী পরিবর্তনের সূচনা হয়। সে অবশ্যই একদিনের কাজ নয়।