বোকা হওয়া দোষের কিছু নয়। সমস্যার। যখনই বুঝতে পারবেন বোকা হয়ে গেছেন, নিজের কোনো খামতির জন্য বা অন্যের চালাকির জন্য, অনুতপ্ত হবেন না বা ক্ষুব্ধ হবেন না। স্বাভাবিক ঘটনায় ক্ষুব্ধ হওয়াটা অপ্রত্যাশিত বোকামি। যেই না বোঝা গেল, বোকা হলাম, তখনই দেখতে হবে বোকা হওয়ার জন্য যে ক্ষতিটা হল সেটাকে কি করে সামাল দেওয়া যায়।
এখন দেখুন, টাকাপয়সা বিষয় আশয় ইত্যাদি সংক্রান্ত বিষয়ে অবশ্যই আইনি রাস্তায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে হবে। এখন যেমন খুব করে সাইবার ক্রাইম নিয়ে সতর্কীকরণ চলছে। আসলে সেখানে সমস্যা হচ্ছে যে এক্ষেত্রে যারা বোকা বানায় তারা মানুষকে বোকা বানাবার জন্য রীতিমতো সাধ্যসাধনা করছে। প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। মানে তারা প্রফেশনাল আরকি। এখন প্রফেশনালদের সঙ্গে যুঝতে যাওয়া তো অবশ্যই বেশ কঠিন কাজ, তাই এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব সতর্ক থাকা যায় তার চেষ্টাটা করে যেতেই হবে।
এরপর আসে মানসিকভাবে বোকা হয়ে যাওয়ার পর করণীয়। থেকে থেকেই শুনি, অমুক আমাকে বোকা বানিয়ে গেল, আমার সঙ্গে ছল করে গেল, অভিনয় করে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি। এইক্ষেত্রে কি করবেন?
দেখুন, এই লেখাটা আপনি মোবাইলে পড়ছেন মানে ধরে নিতেই পারি যে মোবাইলের কিছু কিছু বেসিক জিনিস আপনার জানা। যেমন ধরুন ইনস্টল, আনইনস্টল করার ব্যাপারটা আপনি জানেন নিশ্চয়। সেটাকেই উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক।
যে কোনো মানুষের ছল, অভিনয়, চাতুরী বুঝে যাওয়ার পর, প্রথম করণীয় হল, নিজের ভেতর থেকে তার ফ্র্যাঞ্চাইজিটা তুলুন। মানে আরো সহজ করে বলি আপনার মানসিক জমিতে তার দেওয়া স্টলটা তুলে ফেলুন। তার পোঁতা বাঁশগুলো তুলতে আপনার একটু কষ্ট তো হবেই, কারণ তার ফ্র্যাঞ্চাইজি খোলার স্টল তৈরি করতে আপনিই সাহায্য করেছিলেন আপনার মানসিক জমিতে স্টল বসাতে দিয়ে। এবার তুলুন। কোয়ালিটি কন্ট্রোলে যখন ফেল করেছে তখন আর রাখার দরকার নেই। ঠিক যেমন ভাবে কোনো অ্যাপ আনইনস্টল করার পর তার কুকিজগুলো তুলে ফেলতে হয়। এও তেমন।
এখন দেখুন সম্পর্ক মানেই হল একজনের মানসিক জমিতে আরেকজনের ফ্র্যাঞ্চাইজি। এখন আমরা আপাতভাবে বিশ্বাস করে নিই ব্যাপারটা মিউচুয়াল। মানে তার জমিতে আমার ফ্র্যাঞ্চাইজি, আমার জমিতে তার। কিন্তু ক'দিন পর ক্রসচেকে ধরা পড়ে গেল যে তার জমিতে আসলে আপনার কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিই নেই, শুধু সামনে একটা প্ল্যাকার্ড ঝোলানো, ভিতরে সব ফক্কা। তখন? তখন সোজা ওই যা বললাম, বিনা দ্বিতীয় চিন্তায়, নির্দ্বিধায় তার ফ্র্যাঞ্চাইজি তুলে ফেলুন। নিজের মানসিক জমিতে আপনার পূর্ণ অধিকার। মায় পরমাত্মাকে সেখানে আসতে গেলেও আপনার অনুমতি লাগে, তো কোথাকার কোন কেষ্টবিষ্টু রে? বাদ দিন তো! এক্কেবারে ঝেড়ে ফেলুন।
হুম বুঝলাম, এই ঝেড়ে ফেলায় প্রধান সমস্যা সে নয়, আপনি নিজে। তার ফ্র্যাঞ্চাইজিতে লাগানো স্টলের বাঁশগুলো। কারণ সেগুলো আপনারই জমিতে হওয়া। আপনারই মাটিতে গাঁথা। কিন্তু দেখুন আখেরে অন্যকে নিজের মনের জমি লিজ দিয়ে লাভটা কি যদি সে তার অপব্যবহার করে? আপনার স্বপ্ন মরুক ক্ষতি নেই, আপনি সুস্থ থাকুন। আর সুস্থ থাকা মানে শুধু শরীরের হেঁটেচলে বেড়ানো নয়, মনেরও হেঁটেচলে বেড়ানো, মনেরও নানা কিছু হজম করে নেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি ইত্যাদি আরকি। শরীর আর মন একই বস্তু, প্রশ্রয় দিলে কুঁড়ে, খাটালে চনমনে। নিয়ম এক।
প্রশ্ন করতে পারেন, লাভক্ষতির হিসাব কি ভালোবাসায় আসে? এ প্রশ্ন ন্যায্য, কিন্তু বাস্তব না। আমরা কেউ-ই মহৎ প্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে ধরাধামে আসিনি। সুতরাং নিজের এই প্রেম-প্রেম, ভালোবাসা-ভালোবাসা, স্নেহ-স্নেহ ইমেজটাকে এত প্রায়োরিটি দেওয়ার কোনো দরকার নেই। নিজের একটা কাণ্ডজ্ঞানওয়ালা সত্তা আছে। তাকে প্রায়োরিটি দিন। তাতে হয় তো আপনার কাছে আপনার ওই হৃদয়ওয়ালা ইমেজটা একটু টাল খাবে। খাক। কিন্তু অমন ভাঙা মেলা বুকে বয়ে নিয়ে বেঁচে থাকার চাইতে ওসব আবর্জনা সরিয়ে খোলা বাতাসে চারটি ভালো গাছ লাগানোর অভ্যাস অনেক ভালো।
এইটা বলেই শেষ করি। মনের জমিতে একে তাকে ফ্র্যাঞ্চাইজি দিতেই হবে এমন কোনো মানে নেই জানেন। ভালো গাছ লাগান। ভালো বই, ভালো গান, ভালো সিনেমা, ভালো ওটিটি, ভালো রিল, ভালো স্বপ্ন (যে স্বপ্ন নিজেকে নিয়েই অবশ্যই), ভালো খাবার, ভালো ছাদ, ভালো সাবানের গন্ধ, ভালো চা, ভালো রাস্তা... এরকম অনেক ভালোগুলো বেছে নিন। জীবন যেখানে যেখানে আমাদের বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় সেখানে ঘাওড়ামি করার তো কোনো কারণ দেখি না। ঘাওড়ামি মানে হল অযৌক্তিক জেদ। বেশ নরম আর সজাগ মনে একটা ভালো কিছু বেছে নিলেই হয়। অনেকে বলেন ভালো কাজ করতে। আমি এই ভালো কাজ মানে কি আজও বুঝি না। সব কাজই ভালো যদি মন ভালো থাকে। মন ভালো রাখতে মনে বাগান করতেই হয়। সার দিতে হয়। মাঝে মাঝে একা একা কেঁদে সে বাগানে বর্ষাকাল আনতে হয়। বাহ রে, মীরার গানে শোনেননি, আঁশুয়ন জল সিঁচ সিঁচ প্রেম বেল বোয়ে…. এ প্রেম আত্মপ্রেম। স্বার্থপ্রেম না। সে তো নিজেকে নিয়ে ভুল হিসাব। নিজেকে নিয়ে ঠিক হিসাবে জন্মায় আত্মপ্রেম। তবেই হল কথা।
আর একটা ক্ল্যারিফিকেশন দিয়ে নিই, কেউ বলতে পারেন, ভালোবাসায় আবার ফ্র্যাঞ্চাইজির কথা কেন... সে তো ব্যবসার কথা।
আমি রবি ঠাকুরের গানের দোহাই দিয়ে সে কথার উত্তর দিই,
"ব্যবসা মোর তোমার সাথে চলবে বেড়ে দিনে রাতে... আপনা নিয়ে করব যতই বেচাকেনা…"