বেলুড়মঠ, শান্তিনিকেতন - এগুলো পার্কসদৃশ, কিছুটা উচ্চমার্গের বিনোদনস্থল আজ। কোনো রসালো মিষ্টি বানানোতে বিফল হলে, মা-কাকিমাদের মুখে একটা কথা শোনা যায় - ইস্, রসটা ভিতরে যায় নি রে!
এই প্রকার অর্ধ-পাচিত মানুষের ভিড় দিনদিন বেড়েই চলেছে। এটা দুশ্চিন্তার। কারণ, না জানার চাইতে, ভুল জানা আরো ভয়ংকর। সে সব ক্ষেত্রেই। আমি যতজন বামপন্থী দেখেছি, তার মধ্যে কতজন ‘দাস ক্যাপিটাল’ পুরো খণ্ড পড়েছেন, তা হাতে গুনে বলে দেওয়া যায়। সবাই শর্টকাট খুঁজে চলেছে। বলার মত যুক্তি, খোঁচাবার মত সুক্ষ্ম পিন জমিয়ে চলেছে। ভাবার মত, উদ্বুদ্ধ হওয়ার মত ধৈর্য বা আন্তরিকতা কই? ফলে অল্পজ্ঞতা আজ ভীষণ আকার ধারণ করছে। এটা ভয়ের।
আজ স্বামীজির জন্মদিন। তাই তাঁর কথাই বিশেষ করে বলি। আজ বিশেষ রাজনীতি দলের তিনি মূল পুঁজি, আরেক রাজনৈতিক দল হঠাৎ ঘুম ভেঙে টের পেয়েছেন, মানুষটা মোটের উপর ভাল ছিল। দুটোই ভয়ানক।
আমাদের ছোটবেলা থেকে সিলেবাসে স্বামীজির আদর্শ বুঝবার উপযোগী কোনো পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা হল না। কি করে হবে? গায়ে গেরুয়া যে! রোমা রোঁলা নামক নোবেলজয়ী সাহিত্যিক তাঁর জীবনী লিখতে গিয়ে, নামকরণ করলেন, ‘The Gospel of Mankind’। আমাদের বোধগম্য হল না। কারণ ওই এক। আমাদের আদর্শকে নকল করে চলতে হয়, অনুকরণ করে হাঁটতে হয়, তাই অনুসরণের দায় নেই। ওরা যেমন অঙ্গভঙ্গি করছে, করে যাও।
স্বামীজি প্রথম, যিনি চূড়ান্ত সমন্বয়ের পথে হাঁটলেন। হিন্দুধর্মের এতবড় সমালোচক অহিন্দুদের মধ্যেও মেলা দায়। নাস্তিকতার সপক্ষে তাঁর যুক্তি এত ক্ষুরধার, তা দার্শনিক নিৎজেকেও হার মানায়। তবে কি তিনি নাস্তিক ছিলেন? হ্যাঁ-ও বটে, না-ও বটে। আমাদের আস্তিকতা ও নাস্তিকতা দুটোই অপরিপক্ব। কেউ বিশ্বাস করেন আছেন, কেউ বিশ্বাস করেন নেই। শেষমেশ দুটোই বিশ্বাস। স্বামীজি চাইলেন উপলব্ধি - Religion is realisation। আমাদের কাছে নাস্তিকতার আর এক অর্থ ঈশ্বরবিদ্বেষীতা। যা মানি না, তাই শুনলেই গায়ে জ্বালা ধরে কেন বুঝি না। বলা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না, শান্তিনিকেতনও এরকম একদল মানুষের ভিড় দেখেছি। রবীন্দ্রনাথ বলতে প্রায় মূর্ছা যান, কিন্তু সেই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত চিন্তা, যে ঔপনিষদিক সুধা সঞ্জীবনীতে সিক্ত, সেই গ্রন্থটি তাদের কাছে ব্রাত্য। এদের রবীন্দ্র বিশ্লেষণ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও বুঝতেন কিনা জানি না। এদের আমি ভীষণ ভয় পাই। কারণ এরা অর্ধসত্যে ভর দিয়ে হাঁটেন। অর্ধসত্য, মিথ্যার চাইতেও ভয়ংকর। রবীন্দ্রনাথ বলছেন - আমার আঁধার ভালো... আলোরে যে লোপ ক’রে খায় সেই কুয়াশা সর্বনেশে।
স্বামীজির চর্চার মধ্যে তাই গভীরে গেলেই কয়েকটা সমন্বয়ের চূড়ান্ত চেষ্টা দেখি।
১) ধর্ম-বিজ্ঞানঃ
ধর্মঃ যা মানুষকে মানুষ হতে শেখাবে। বিশ্বাসে না, অনুভূতিতে। প্রতিটা ধর্ম থেকেই মহান মানুষের জন্ম হয়েছে। যা প্রমাণিত করে সেই ধর্মের সত্যতা। নিঃস্বার্থতা, করুণা, সত্যপরায়ণতা কোনো বিশেষ ধর্মের কুক্ষিগত সম্পত্তি না। তা সার্বজনীন ধর্মের অঙ্গ। “To be good and do good - that is the whole of religion”. উল্লেখ্য, ‘whole of religion’ বললেন, ‘part of’ না। এটাই সব।
বিজ্ঞান আমাদের বাহ্যিক জীবনকে সহজ করবে। বহিঃপ্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে শেখাবে। এটা হল প্রয়োগশীল বিজ্ঞান। আর তাত্ত্বিক বিজ্ঞান আমাদের একের খোঁজ করাবে। যেমন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র। সেটা কি আপেলের সাথে পড়েছিল? না, তা নিউটনের মস্তিস্ক মন্থনজাত। সব সত্য আমাদের অন্তরে। বাইরে থেকে একটা উদ্দীপন লাগে। যেটা আপেল ছিল।
এখানে স্বামীজির আরেকটা অল্প আলোচিত দিকের আমি উল্লেখ করতে চাই মাত্র। তাঁর মনোবিজ্ঞানের উপর শ্রদ্ধা ও বিশ্লেষণের গভীরতা। পরবর্তীকালে ফ্রয়েড, কার্ল জুঙ পড়তে গিয়ে দেখেছি, ওঁর লেখায় এর আভাস স্পষ্ট। অবচেতন মন সম্পর্কে বলছেন, তুমি যা করো, যা ভাবো তাই একটা দাগ হিসাবে মনের তলানীতে থেকে যায়, চিরকালের হয়ে। তাই তোমার অবচেতন তৈরী করে। তোমার প্রবণতার দিক নির্দেশ করে। তাই আজকের অভ্যাসই কালকের স্বভাব তৈরী করে। অচেতন স্তরকে না পরিস্কার করে তুমি চেতনকে নিয়ন্ত্রিত করতে পারো না। এই তত্ত্বটাই ফ্রয়েডের মূল তত্ত্বগুলির একটি - repression. এ নিয়ে আলোচনা পরে করা যাবে যদি সম্ভব হয় কখনো।
২) প্রাচ্য-পাশ্চাত্যঃ
প্রাচ্য দেবে দর্শন। গভীর জীবনবোধ। পাশ্চাত্য দেবে বিজ্ঞান, প্রয়োগকৌশল।
আজ তাই সত্যি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, শ্রীঅরবিন্দ, রমণ মহর্ষি, দলাই লামা সেই বার্তাই পৌঁছেছেন। আইনস্টাইন থেকে শুরু করে আর্ণল্ড টয়েনবির মত পাশ্চাত্য মনীষীদের কণ্ঠেও বেজেছে একই সুর।
৩) ভারতের অতীত ও বর্তমানঃ
অতীতে সব ভাল ছিল - ভুল। অতীতে সব খারাপ ছিল - ভুল। অতীতের থেকে অনেক শিখবার আছে। সে মননের গভীরতা, সমাজের জন্য দায়বদ্ধতা, মহৎ জীবনের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থত্যাগ। এ সব শিক্ষা। সর্বোপরি অন্তর্দৃষ্টি সম্বলিত জীবনযাপন অভ্যাস।
বর্তমানের দিকে তাকিয়ে শিখতে হবে আরো বেশি যুক্তিপরায়ণতা। ধর্মের আড়ম্বর যাক। পুরুত যাক। আসুক সেবা। আসুক শৌখিনতা। বিলাসিতা। সব্বাইকে ‘ত্যাগীশ্বর’ হওয়ার দরকার নেই। বিলাসিতা আসলে জীবিকার প্রকার বাড়বে। কাজ বাড়বে। দারিদ্রতা কমবে।
শিক্ষাপদ্ধতি প্রয়োগমুখী হোক, তাত্ত্বিকতা শিক্ষার পাশাপাশি। মেয়েদের শিক্ষা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। তবে তা পুরুষের অঙ্গুলিহেলনে না, তা হোক তাদের নিজেদের স্বাধীনতায়।
৪) গৃহী-ত্যাগীঃ
একজন সামলাক ছোট সংসার। আরেকজন ধরুক বড় সংসারের হাল। তবে মনে রাখতে হবে, সমাজের মূল থাকে গৃহীর হাতে। সুস্থ, সৎ গৃহীজীবনই জন্ম দিতে পারে খাঁটি সন্ন্যাসীর।
৫) অন্তর্জগত-বহির্জগতঃ
তুমি জগতের পরিবর্তন করবে, এ মোহে থেকো না। জগতে সুখদুঃখের পরিমাণ সমান। একটা বাড়লে আরেকটাও বাড়বে। তবে কি জগতের হিতসাধন করবে না। করবে, তবে তা নিজের চিত্তবিকাশের জন্য। "আয় বেচারা তোর উপকার করি বলে না"। তুমি কৃতজ্ঞ থাকো, কেউ তোমায় তার সেবা করার সুযোগ দিচ্ছে বলে। সে তোমায় তোমার চিত্তের বিকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে।
আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে আমি কয়েকটা দিকের ইঙ্গিত করলাম মাত্র। স্বামীজি অনন্তের সন্তান। সেখানে সীমা টানা যায় না। শুধু বলি, সে মহাপ্রাণ আমাদের ঘুম ভাঙাক। আমাদের জন্ম-মৃত্যুকে অর্থবহ করে তুলুক - এই প্রার্থনা।