আমাদের ধর্মের সাথে উৎসবের খুব একটা মূলগত যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। ধর্মের কোনো একটা দিক একে অনুপ্রাণিত করে, এতটাই সত্যি। এরপর বাকিটা আমরা আমাদের মত বানিয়ে নিই।
দেবতা যেদিন দেবালয় ছেড়ে প্যাণ্ডেলে এসে উঠলেন, সেদিন ধর্মের চেয়ে, উৎসবের চেয়ে আবেগটাই বড় হয়ে উঠল। উৎসব আর উৎসব রইল না। হল উন্মাদনা। আবেগ যখন সারথি তখন বুদ্ধি - বিবেচনা নিতান্তই বাহুল্য। সর্বজনীনতার অসর্বজনীনতা পাড়ায় পাড়ায়। আমার পূজো তোমার পূজো। দুটোই সর্বজনীন। কোন 'সর্ব' সে বিধাতাই জানেন। সে সর্বজনীনতা কতদূর সে অভিজ্ঞতাও সবারই কম বেশি আছে।
রাস্তায় গর্ত, নদীর জল বিষাক্ত, দূষিত, কলুষিত। আওয়াজে, আলোতে, উচ্ছ্বাসে চারদিক হা রে রে রব। ত্রাহি ত্রাহি রব বুদ্ধি বিবেকের। কিন্তু কেউ শুনলে তো! আমাদের আমোদ চাই। পরিবেশের কথা পরিবেশবিদ ভাবুন। আমি পাড়ায় থাকি, ফ্ল্যাটে থাকি, ট্রেনে-বাসে-ট্যাক্সিতে চড়ি, অফিসে যাই - এর মধ্যে পরিবেশ কোথা থেকে আসে? গঙ্গার জল, অসুস্থ লোকের অসুবিধা, দীনের দুঃখ - এসব বইতে লেখো, আলোচনা করো, ফেসবুকে লেখো। বাস্তবে এসব ভাবতে গেলে সব মস্তির বারোটা বাজবে। পূজোতে কত মানুষের কত রুজিরোজগার বাড়ে সেটা একবার ভাবুন!
হক কথা। সুতরাং চলুক যেমন চলছে।
আমাদের সমাজনীতির একটা দিক আছে। এখানে পাঁচিল তোলা যত সোজা, পাঁচিল ভাঙা তত না। সেই আদি কাল থেকে চলে আসছে। অচ্ছুৎ প্রথা। কত প্রকার বিভেদ। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র তো ছিল তার সাথে তার কত সুক্ষ্ম প্রভেদ। সেই জাত ভেদটা খানিক উঠলেও, ভেদাভেদ করার অভ্যাসটা এত সহজে কি আর যায়! এত দলাদলি, এত 'আমরা -ওরা'র মাঝে 'সর্বজনীনতা' কথাটা কতটা আন্তরিক সে সন্দেহের। নাকি ওই শব্দটার বোধ নেই বলেই উচ্চারণটা এত বেশি তাই বা কে বলবে? আর এত ভাগাভাগির মধ্যে কোনো গঠনমূলক চিন্তা হয় কি? দলাদলি সস্তা প্রতিযোগিতার পথ তৈরী করে, সার্বিক উন্নয়নের পথ না। সবাই মিলে ভাবব যে, সে 'সবাইটা' কই? আর যেখানে 'সবাই' বোধের অভাব সেখানে সমাজ সচেতনতাটা জন্মাবে কি করে?
ক্ষুদ্র উদাহরণ। সপ্তমী অষ্টমী নবমীতে যে জলুস, যে আবেগ - বিজয়ার পর তা কোথায়? শুধু মেসেজই যথেষ্ট। আমার কাজ আছে না? ওসব সেকেলে প্রথা নিয়ে চললে হবে? ছাড়ো।
আর সর্বজনীন প্যাণ্ডেল? সে বস্তাবন্দী। পূজো কমিটি পরেরবার কাকে বাদ দেওয়া যায় আর কাকে রাখা যায় - এ মহাচিন্তায় ব্যস্ত। অগত্যা বাকি সচেতনতার সময় কই?