Skip to main content
 
 
 
“আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন”? 
        উত্তর এলো “হ্যাঁ দেখেছি” শুধু না, “তোকেও দেখাতে পারি”। দেখালেন। তিনি ছুঁয়ে দিতেই নরেনের বিশ্বজড়বোধ লোপ পেয়ে যায়। বিশ্ব চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে তার চেতনা। সেকি ঈশ্বর দর্শন? এরপরেও তিনি শোনেন তাঁর গুরুই এই বিশ্বসংসারের বিশ্বপিতা, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সেই রামকৃষ্ণ”। সেই কি তবে ঈশ্বরদর্শন? না, তাতেও তো শান্তি হল না তাঁর! অথচ শাস্ত্র বলছেন একবার ঈশ্বরকে লাভ করলেই মানুষ চিরশান্তিতে ডুবে যায়, তার নাকি আর কিছুরই তৃষ্ণা, খোঁজ থাকে না? সে নাকি ‘তৃপ্ত ভবোতি... স্তব্ধ ভবোতি... অমৃত ভবোতি’ হয়ে যায়? হল না তো নরেনের বেলায়। 
        তারপর তিনি স্বামীজি, স্বামী বিবেকানন্দ। ছুটলেন গাজীপুরের পাওহারি বাবার কাছে। কিসের আশায়? সিদ্ধি? নাতো। ঠাকুর তো দিতে কবেই চেয়েছিলেন। নেননি তো? ঠাকুর এও বলেছিলেন, এই দিয়ে জগতের মঙ্গল করতে পারবি। তাও চাইলেন না। তবে? গাজীপুরে কিসের জন্য? দিনের পর দিন সে ফকিরের দরজায় পড়ে থাকছেন। বারবার তাঁকে অনুরোধ করছেন, কিন্তু সে ফকির তাঁকে ঘুরিয়েই যাচ্ছেন, ঘুরিয়েই যাচ্ছেন। স্বামীজি তার গুরুভাইদের, প্রমদাবাবুকে চিঠি লিখছেন, একবারটি এসে সে মহাপুরুষের, মানে পাওহারি বাবার সান্নিধ্য নেওয়ার জন্য। কিসের জন্যে? ঈশ্বর দর্শন তো হয়েই গিয়েছিল না? 
        গাজীপুর বাবার কাছ থেকে বিফল মনোরথ হয়ে ফিরলেন। তারপর নানা ঘটনাবলীর পরম্পরায় বিদেশ যাত্রা। সেখানে তাঁর একবার নির্বিকল্প সমাধিও হয়েছিল শোনা যায়। তবে? সেতো নাকি শ্রেষ্ঠ অবস্থান সাধনক্ষেত্রে। তাও স্বামীজির প্রাণে এত অস্থিরতা কেন? চিঠির পর চিঠিতে এত উদ্বেগ কেন? তিনি ঘুমোতে পারছেন না রাতের পর রাত। শরীর ভাঙছে। একবার নাগমশায়ের বাড়িতে গেলেন। সারারাত পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে উঠে বললেন, এতদিনে এই প্রথম শান্তিতে ঘুমোলাম। কেন? মা-ই তো বলছেন, সন্ন্যাসী হলে আর যা হোক নাহোক শান্তিতে ঘুমোতে পারবে, গৃহস্থের যা অশান্তি? তবে স্বামীজির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হল কেন? 
        তিনি ইচ্ছামৃত্যু বর পেলেন, জগজ্জনীর কণ্ঠস্বর শুনলেন, তবু প্রাণে শান্তি এলো না। কালীপুজো, দূর্গাপূজো করলেন। বিদেশী শিষ্যেরা কেউ কেউ ভুরু কুঁচকালেন, তুমি অদ্বৈতবাদী, তুমি কালীপুজো করো কেন? তিনি চিঠিতে সে জবাবদিহিও করছেন, ও আমার এক খেয়াল জানবেন, ওটা আমার ব্যক্তিগত। একটু অহংকার তো দেখানোই যেত না, “আমি ব্রহ্মজ্ঞানী, আমায় এ প্রশ্ন করা আপনার সাজে না” এরকম কিছু একটা? বললেন না। 
        তবে স্বামীজির ঈশ্বর কে ছিলেন? নিরাকার ব্রহ্ম... কালী... শিব... রামকৃষ্ণ... বুদ্ধ (নিজেকে যার দাসানুদাস বলতেন)... কে তবে? 
        আসলে এরা কেউ নন আবার সবাই। তিনি যত না ঈশ্বরকে চেয়েছিলেন, তার থেকে কোটিগুন যন্ত্রণায় মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন। মুক্তি যন্ত্রণা থেকে, দারিদ্র্য থেকে, পরাধীনতা থেকে, সর্বোপরি অজ্ঞানতা থেকে। স্বামীজি একটা যন্ত্রণা। বিবেকানন্দ নয়, বিবেকযন্ত্রণা। একটা অভুক্ত মানুষ সামনে এলে যার ব্রহ্মজ্ঞানে ভরসা টলে যায়, যে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠে বলে, যে ঈশ্বর এখানে আমায় একবেলা রুটি দিতে পারেন না, তিনি স্বর্গে আমায় ভালো রাখবেন তা বিশ্বাস করি না। রুটি তো আসলে নিজের জন্য চাননি। এ কোন স্বামীজি? এই কি যিনি ঠাকুরের কাছে নির্বিকল্প সমাধিতে বুঁদ হয়ে থাকার জন্য জেদ ধরেছিলেন? আসলে ঠাকুর জানতেন, এ নরেনের অভিমানের কথা। দরিদ্র রমণী যেমন তার অভুক্ত সন্তানদের ক্ষুধার জোগাড় করতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন, এও সে অভিমানে কথা। ঈশ্বরের মধ্যে আত্মহননের ইচ্ছা। জগতজুড়ে এত যন্ত্রণা অমন সুক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের সহ্য হয়? “লৌহপিণ্ড সহে যে আঘাত, মর্মর মূরতি তাকি সয়”? সয় না। তাই ঈশ্বরের আড়াল টেনেছেন বারবার। বারবার মানুষের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজতে দিনরাত অনাহারী থেকে, রক্তাক্ত পায়ে ঈশ্বরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, ঈশ্বরের মহত্বে মুগ্ধ হবেন বলে না, ঈশ্বরকে তাঁর নিজের মহত্ব স্মরণ করিয়ে দেবেন বলে। এত যন্ত্রণা, এত অমঙ্গলের মধ্যে তাঁর রথের চাকা ডুবে যাচ্ছে দিনদিন, সে রথের চাকা তুলে দিতে সাহায্য করবেন বলে তিনি গিয়ে দাঁড়াতেন ঈশ্বরের সামনে। আসলে কোথাও তিনি ঈশ্বরের বিবশতাকেও অনুভব করতেন, করুণা করতেন করুণাময়কে। ঈশ্বরের উপর এটুকু বিশ্বাস না থাকলে গরীব মানুষগুলো বাঁচবে কার মুখের দিকে তাকিয়ে? সে বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে তাই এত তাঁর ছটফটানি। 
        এ যন্ত্রণা খ্রীষ্টে ছিল, এই ভগবত প্রেমের কান্না মহাপ্রভুতে ছিল, এই সর্বগ্রাসী করুণা বুদ্ধে ছিল, এই প্রজ্ঞার ছটা শঙ্করাচার্‍্যে ছিল। এসব ঘনীভূত হয়ে দাঁড়ালো আজকের দিনটায়। যে ধ্যানে বসলে সামনে সাপ এলে খেয়াল থাকে না। যাকে ঘরে আটকে রাখলে জানলা দিয়ে কাপড়চোপড় বের করে গরীবদের দিয়ে দেয়, বিশ্ববিজয়ী যে প্রাণ, গিরিশ এক অভুক্ত পরিবারের বর্ণনায় ঘরে দরজা দিয়ে পাগলের মত আছাড়িপিছাড়ি কাঁদে, তাঁকে আর যা হোক ঈশ্বরের মোয়া দিয়ে ভোলানো যায় না। গান্ধী বলতেন, বিবেকানন্দ পড়ার পর তাঁর মনে হয় ভারতের প্রতিটা ধূলিকণা তাঁর কাছে পবিত্র, কথাটা আরো এগিয়ে বলা যায় মানুষটার কাছে প্রতিটা ভারতবাসীর প্রতিটা শ্বাস ঋণী।
        তিনি তাঁর সারাজীবনের উপলব্ধি তাঁর ‘সখার প্রতি’ কবিতাটাতে উজাড় করে বলে গেছেন। নামটাও বেছেছেন ‘সখার প্রতি’। গীতার কথা স্মরণ করতে বলি, কৃষ্ণ বলছেন “গীতা মে হৃদয়ং পার্থ”। হৃদয়ের কথা কার কাছে উজাড় করে বলা যায়? সখার কাছে। অর্জুন কৃষ্ণকে চিনতে পেরেও শুধুমাত্র সখ্যের ভূমিতেই দাঁড়াতে চেয়ে বলছেন, বন্ধু যেমন বন্ধুর সব অপরাধ ক্ষমা করে তুমিও আমার সব অপরাধ ক্ষমা করো কৃষ্ণ। 
        স্বামীজিও সেই বন্ধুত্বের আহ্বানে ডেকেছেন ওই কবিতাটায় তাঁর ভাবীকালের বন্ধুদের। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, যদি এই কবিতাটা কণ্ঠস্থ রাখা যায় তবে পৃথিবীর কোনো শাস্ত্র, কোনো মহাপুরুষের জীবনী অজানা থাকলেও সব শাস্ত্র, সব মহাপুরুষের জীবনী জানা হয়ে যায়। আমার সব ঝগড়া, সব কান্না, সব হতাশা, সব আশা এই মানুষটার সাথে জড়িয়ে। আমাদের দাঁড়াবার, আমাদের এগোবার, আমাদের নতুন করে ভাবার সব উপকরণ সাজিয়ে রেখে গেছেন। এমনকি ওর বিরুদ্ধে বলার ইচ্ছা থাকলেও, উনি শুনবেন আমি আশ্বস্ত করতে পারি। তবে ওর প্রাণটা যদি বোঝা যায় তবেই, নচেৎ নয়, কদাপি নয়। একবার ওর বন্ধু ওনাকে বলেন আপনি যে দক্ষিনের পণ্ডিতদের পারিয়া বলে গাল পেড়েছিলেন, তা কি ঠিক করেছিলেন? উনি হেসে বলেন, বলেছি নাকি ঠিক করেছি? বন্ধু ওনাকে উঠে জড়িয়ে ধরে বলেন, তাই তুমি এত বড়। 
        সত্যিই তাই এত বড়। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম, আলিঙ্গন মানুষটাকে জানাই তাঁর শুভ জন্মদিনে। হ্যাপি বার্থ ডে স্বামীজি।