Skip to main content

"কি হবে না দাদুভাই? কূপমণ্ডূক"

সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' এর প্রায় শেষ দৃশ্য। সত্যজিৎ রায়ের চেতাবনি। মজার কথা হল এ চেতাবনি কথামৃতে, স্বামীজির ভাষণেও বারবার এসেছে। একই উদাহরণ।

কূপ তো অনেক ধরণের হয়। কুসংস্কারের কূপের থেকে বড় কূপ ভ্রান্ত ধারণার কূপ। আগেভাগেই মতামত, সিদ্ধান্ত টানার কূপ।

চিন্তাতত্ত্ব জগতে একটা তত্ত্ব নিয়ে খুব আলোচনা হয়। সিস্টেম ১ পদ্ধতি। সিস্টেম ২ পদ্ধতি। আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, বাঙালির সব চাইতে বড় উৎসব কি... দুই দু’গুণে কত হয়.... রবীন্দ্রনাথের কোন লেখা নোবেল পেয়েছিল.... ইত্যাদি ইত্যাদি.... আমরা চট্‌ করে না ভেবেই বলে দেব। একে বলে সিস্টেম ১ চিন্তাপদ্ধতি। আর যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ১৯ কে ১৭ দিয়ে গুণ করলে কত হয়? আমাকে ভাবতে হবে। এ হল সিস্টেম ২ চিন্তাপদ্ধতি।

আমাদের কূপমন্ডুকতায় এই প্রথম ধারার চিন্তাপদ্ধতির বিশাল প্রভাব। যেখানে কোনো ক্রিটিকাল থিংকিং নেই, যেখানে খতিয়ে দেখা নেই, যেখানে সরজমিনে নেমে দেখা নেই। সেখানে সবটাই চলছে আমার ভাসা ভাসা খেয়ালে, ভাসা ভাসা ভ্রান্তধারণায়।

বাস্তব এক জিনিস, আর বাস্তবের আমার চেতনায় প্রতিভাসিত হওয়া আরেক জিনিস। বাস্তব আমার চেতনায় কি রঙে জন্মায় সে ঠিক হয় আমার মনের গঠন অনুযায়ী। আমার যাবতীয় সুখ-দু:খ - এই বাস্তব আর আমার মনের গঠনের মিশ্রণের ফল। অর্থাৎ বাস্তব আমার চেতনায় যে রঙ ধরালো তা তার উপর নির্ভর করে। আমার সুখ-দু:খের জন্য তাই অনেকাংশে আমি নিজেই দায়ী। অবশ্যই এ সুখদুঃখ মানসিক সুখদুঃখর কথাই হচ্ছে। বাস্তব আমায় সুখী বা দুখী করে না। করে আমার চেতনায় তার প্রতিভাস। যা আমার পূর্বাভ্যাস, আমার শিক্ষা, আমার সংস্কার, আমার আশেপাশের সামাজিক গঠন ইত্যাদি অনেকটা স্থির করে দেয়।

কিন্তু এই বিবশতাই তো মানুষের ভাগ্যের শেষ কথা নয়। তবে আর অ্যামিবা থেকে বুদ্ধ অবধি এতটা রাস্তা আসা কি সম্ভব ছিল? মানুষেরই একমাত্র ক্ষমতা আছে নিজের বোধের ব্যপারে বোধযুক্ত হওয়ার। আমার বোধকে দেখারও আরেকটা বোধ আমার আছে। তাকে যাই নাম দেওয়া যাক না কেন, আত্মসমীক্ষা, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সংযম ইত্যাদি। আসলে তা নিজের চোখে নিজেকে দেখার ক্ষমতা। নিজের বাহ্যিক আচরণ শুধু না, ওই যে প্রতিভাসের কথা হল, সে প্রতিভাসকেও দূর থেকে দেখার ক্ষমতা মানুষের আছে। আর আছে বলেই আমার মধ্যে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় বোধও আছে।

সব কিছুর গভীরে থাকে এক সর্ব ধারক ভালোবাসা। যাকে চিত্ত নামে ডাকা যায়। যাই আদতে আমি। চিত্ত। পুরোনো নাম। গভীর ভাব। ভালোবাসায় চুবিয়ে নিলে অনেক কিছু আবর্জনা মুক্ত হয়। এখানে ভালোবাসা মানে আবেগসর্বস্ব সুখের অন্বেষণ নয়। এখানে ভালোবাসা মানে আন্তরিকতা। সুখ না, গঠনমূলক সমীকরণের অন্বেষণ। সাম্যের খোঁজ। ধৈর্যের খোঁজ। স্থিতির খোঁজ, ধ্বংসের না। সে কাজ করে চিত্ত। মর্ম।

ওই যে চিন্তাপদ্ধতি, সিস্টেম ১ আর সিস্টেম ২ বললাম, আর যে প্রথমের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম, তার থেকে রেহাইয়ের উপায়ও এই, আন্তরিক চেষ্টা। আর এর থেকে রেহাই পাওয়া মানেই নিজেকে উদ্ধার করা নানা পাঁকের থেকে।

তবে এর মানে এ নয় যে সব কিছু ভ্রান্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। শেষে সেই গান গাইতেই হবে, "মাগো আমার সকলই ভ্রান্তি"। কিন্তু সে তো দার্শনিক অতৃপ্তির কথা। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলতেন, এক নৌকা পাকা ধান ডুবে যাওয়া আর বুদ্ধের আর্য সত্যের দু:খ তো আর এক নয়। এও তেমন, নিজের চারপাশকে, বাস্তব সমাজকে নিজের চেতনার উদার প্রতিভাসে দেখা আর নানা জটিল আবেগের ক্ষুদ্র সংকীর্ণ প্রতিভাসে দেখার মধ্যে তো পার্থক্য আছেই। নিজের সুখদুখের জন্য কদ্দিন আর একে-তাকে, ঈশ্বর, ভাগ্যকে দায়ী করা চলে। নিজেকে নিজের ভার তো নিতেই হবে।

সেই জন্য এর থেকে মোক্ষম চেতাবনি আর কি হতে পারে-

কি হবে না দাদুভাই?

কূপমণ্ডূক।