মানুষে মানুষে বিভেদ ঘটায় না কে? গায়ের রঙ, বিত্তের পরিমাণ, ভৌগলিক সীমারেখা, রাজনৈতিক অবস্থান, মেধার সুক্ষ্মতা, স্মৃতির আয়ুষ্কাল, আরো আরো কত কি... এত হিসাব কে রাখছে? তবে আর ধর্মের নামে একা দোষ চাপানো কেন? ধর্ম মানি না, কারণ তা মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে - এ যুক্তি তাই খুব একটা মজবুত মনে হয় না।
একটু অন্যভাবে ভাবা যাক। ধর্মের দুটো প্রধান দিক আছে, এক, নীতির দিক। দুই, ঈশ্বরের অস্তিত্বে 'হাঁ' বলার দিক। দুটোই এক ধরণের অথোরিটি বা কর্তৃত্বতা দাবি করে ব্যক্তিজীবনে। যেটা মেনে নেওয়া খুব দুষ্কর, অন্তত কম বয়সে ও মাঝ বয়সে। ঘুষের টাকা না নিলে 'সতীত্ব দেখানো বা মারানো' ট্যাগ করে দেওয়া খুব পুরোনো প্রথা, সারা বিশ্বে কি হয় তো বলতে পারব না, অন্তত আমাদের চারপাশে এ বহুবার হতে দেখেছি। কোনো প্রতিষ্ঠানে সৎ থেকে কাজ করে যাওয়ার যে দুঃসহ অভিজ্ঞতা তা কম-বেশি অনেকেরই আছে, তাই সে আলোচনা থাক। একটা ঘটনা বড়মামার মুখে শুনেছিলাম। তিনি একজন বন্ধুর সাথে বসে গল্প করছেন, সেই বন্ধুর অধীনে বহু শ্রমিক 'দিন আনি দিন খাই' ভিত্তিতে কাজ করেন, তারা সব লাইন করে দাঁড়িয়ে হপ্তার টাকা নিচ্ছেন। হঠাৎ একজন মহিলা, কোলে একটা বাচ্চা, অত্যন্ত গরীব, এসে সেই বন্ধুটার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, "কিরে তুই আমায় এত টাকা বেশি দিচ্ছিস কেন? আমি তো গত সপ্তাহে দু'দিন কাজে আসিনি!” সে তার অতিরিক্ত টাকাটা দিয়ে ফিরে গেল। খানিক পর একজন পুলিশের বড়বাবু এলেন, বন্ধুর কাছে মাসের তোলা আদায় করে চলে গেলেন।
এই দুটোই তো সংসারের রূপ। প্রথমটা ধর্ম। দ্বিতীয়টা অধর্ম। আরেকটা ঘটনা বলি। স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজীর কাছে শুনেছিলাম। কোনো এক গ্রামে ধর্মসভায় উনি যোগ দিতে যাচ্ছেন। ট্রেন, বাসের শেষে গরুর গাড়িতে। গল্প জুড়লেন গাড়োয়ানের সাথে। জিজ্ঞাসা করলেন, এ গাড়ি তোমার? সে বলল, না মহারাজ, এ গাড়ি আমার মালিকের। মহারাজ বললেন, তা কিরকম হিসাবে টাকা-পয়সা পাও? সে বলল, সারাদিন যত ভাড়া পাই, তার একটা নির্দিষ্ট অংশ তিনি দেন। মহারাজ বললেন, আমার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল... বললুম, আচ্ছা যদি তুমি সব ক'টা ভাড়ার কথা না বলো, উনি তো আর দেখতে আসছেন না?
লোকটা তড়াক করে গাড়ির থেকে নেমে বললেন, ছিঃ ছিঃ! সাধু হয়ে এ কথা আপনি মুখে আনলেন কি করে? আমি যদি তাই করি তবে তা ধম্মে সইবে?
এই হল ধম্ম বা ধর্ম। বেশ কিছুকাল আগে দুই মুচির কথা লিখেছিলাম। একজন আমার জুতোতে একটা পেরেক ঠুকে দেওয়ার পর যখন পয়সা দিতে গেলাম, বললেন, একটা সামান্য পেরেক ঠুকে পয়সা নেব? সে টাকা রাখার জায়গা আমায় আমার ভগবান দেননি। আরেকজন মুচি আমার ছোটোবেলায় দেখা, যে দিনে তিরিশ টাকা না কত একটা টাকা হয়ে গেলে আর বসত না। এ ধর্ম।
আমার বাবা রেলে কাজ করতেন। আর আমি সেদিন থেকে আজও অসম্ভব ট্রেনের ভক্ত। তো ছোটোবেলায় বাবার কাছে সারাদিন ট্রেনের গল্প শুনতাম। বাবা একবার আমায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বলো তো ট্রেন চলার ব্যাপারে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কোনটা? আমি ইঞ্জিন, লাইন, বগি, ড্রাইভার কিছু বলেই বাবাকে তুষ্ট করতে পারলাম না। অবশেষে বাবা বললেন, সিগন্যাল। আমার খেয়াল হল, তাই তো? আমি এত ট্রেন দেখি, কিন্তু সিগন্যালটাকে আলাদা করে তো কোনোদিন গুরুত্ব দিইনি। সে যে আছে, যেন বাড়তি হয়ে। অকারণ পথ আটকে, না তো স্পিড কমিয়ে যাত্রাতে বিঘ্ন তৈরি করতে। সেদিনের সে উত্তর মনে ধরেনি। আজ বুঝেছি। সেই সিগন্যালটাই ধর্ম।
তবে কি নীতির কোনো বিকল্প নেই? না নেই। একটা কোষের মধ্যেও প্রতি মুহূর্তে যা ঘটে চলেছে তা একটা নিয়ম নীতি মেনেই ঘটে চলেছে। মজাটা হচ্ছে, নিয়মটা চোখে দেখা যায়, নীতিটা দেখা যায় না। নীতি বলতে আমি সূত্র বলতে চাইছি এখানে। প্রেসার কুকারে রাঁধার নিয়মটা আমার জানলেই চলে যায়, কিন্তু যে নীতিতে বা সূত্র মেনে প্রেসার কুকারটা কাজ করে, তা আমার না জানলেও চলে।
তবে কি নীতি মেনে চলতে গেলে একজনকে ঈশ্বর বিশ্বাসী হতেই হবে। আমার ব্যক্তিগত অনুভব হল, না। তবে তার নিজের থেকে বড় কিছু একটা জীবনে অনুভব না করলে সে নীতির উদয় হবে না জীবনে। সব চাইতে বড় শত্রু আমার স্বার্থবুদ্ধি। স্বার্থবুদ্ধি মাত্রেই ক্ষণিক বুদ্ধি। একটা চিঠির একটা অংশ, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন,
"আমাদের দেশে কিছুকে বাঁচিয়ে তোলা এবং বাঁচিয়ে রাখা প্রাণান্তিক ব্যাপার, অহোরাত্র মৃত্যুর সঙ্গে হাতাহাতি লড়াই করতে হয় – কেননা জীবনগত শ্রদ্ধা সেখানে বড় দুর্বল, সেই জিনিসকে জাগিয়ে তুলতে পারিনে - সেই জন্য ছোটোখাটো বাধা এবং আত্মাভিমানে আমাদের সমস্ত তপস্যা শতছিদ্র ও জীর্ণ হয়ে পড়ে। ... আমাদের দেশের যে দৈন্য সে কেবলমাত্র চরিত্রের দৈন্য - আমাদের সম্পদকে আমরা দৃঢ়শক্তিতে ধারণ করে রাখব এবং স্থায়িভাবে পোষণ করতে থাকব এমন প্রশস্ত আধার আমাদের নেই... জীবনের অভাব কি কোনোদিন টাকা দিয়ে পূরণ কর যায়?... ভাবনার কথা কেবল আত্মশ্রদ্ধার অভাব - সেই দৈন্য সকল দৈন্যের মূল এই জন্য যে সেই দৈন্য পূরণ করতে পারে কুবেরের ভাণ্ডারেও এমন ঐশ্বর্য্য নেই।"
খুব শিক্ষিত স্কলার হতে হয় কি এই বোধটাকে জাগাবার জন্যে? কেউ একজন ট্রেন থেকে নেমে বলল, "বেকার টিকিট কাটলাম, কেউ তো চেকই করল না।" এটা ভয়ংকর কথা! আত্মশ্রদ্ধাহীনতার কথা। যা নেই, তা নেই-ই। তা থাকলে কি পার্থক্য হয়, তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানো যাবে না। এই ভাবটা অনেকটা পরিবেশের উপরও নির্ভর করে। যে অফিসের পরিবেশ অনেক স্বচ্ছ, সেখানে একজন মানুষ অসৎ পথে যেতে গেলে দু'বার ভাববে। আবার উল্টোটাও সত্য, যে অফিসে ঘুষ খাওয়াটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে সেখানে যে সৎ থাকতে চাইবে তার অবস্থা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে জীবনসংশয়ও অস্বাভাবিক নয়।
বলা হল, একটা মোক্ষমার্গ আরেকটা ধর্মমার্গ। বিবেকানন্দ এই নিয়ে বড় সুন্দর করে হাতে ধরে বোঝাবার মত বুঝিয়েছেন। হরিনাম, সাধন-ভজন, সঙ্কীর্তন ইত্যাদি মোক্ষপ্রার্থীদের জন্য। আর সৎ পথে থেকে জীবন যাপনের উৎসাহ সাধারণ মানুষদের জন্য।
কথা হচ্ছে, রীতির সৎ-অসৎ বলে কিছু হয় না। নীতির হয়। ধর্ম শব্দটা তাই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একটা মানুষকে ক্রমোন্নোতির দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ। যদি বিশ্বাস করি আমরা বিবেক-বিবেচনাসম্পন্ন জীব, তবে ধর্ম একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর যদি ভাবি শুধুমাত্র একটা কথা বলা জন্তু তবে এ আলোচনা বাতুলতা।
বুদ্ধ সেই মানুষের কথা বলেছিলেন, যা মানুষ বলতে আমরা বুঝি। আমি বুদ্ধধর্ম বলতে যা এখন বুঝি তার কথা বলছি না, বলছি বুদ্ধ যখন কোনো মানুষ না, মানুষের একটা স্তরের কথা। তিনি ঈশ্বরকে সরিয়ে মানুষের কথা বলেছিলেন। বলা যায় প্রথম ধর্মীয় গণতন্ত্রের কথা বলেছিলেন। নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে, কোনো অদেখা অস্তিত্বে ভার দিয়ে ফাঁকি দিলে চলবে না। বড্ড সোজা কথা, বড্ড কঠিন কথা। নিজের ভালোমন্দের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার কথা।
আমাদের প্রজন্ম কোনো বিশ্বযুদ্ধ দেখিনি, আমরা খুব বড় কোনো ক্রাইসিসের সেভাবে সম্মুখীন হইনি। তৈরি করা ক্রাইসিস আর সত্যিকারের ক্রাইসিসের মধ্যে কি পার্থক্য তাও বুঝি না। তাই সৎ হওয়ার, নীতিবান হওয়ার সে অর্থে কোনো তাগিদ আমাদের নেই। বলতে চাইছি না যে একমাত্র সংকটকালই সৎ মানুষ বানায়, বলতে চাইছি জীবনবোধের গভীরতা তখনই জাগে যখন জীবনটা ভোগের থেকে মূল্যবান লাগে। একটা চূড়ান্ত বিলাসবহুল জাহাজের এক পরমভোগী যাত্রীকে যদি বলা যায় যে জাহাজটায় একটা ছিদ্র দেখা গেছে, আর তাতে বিন্দু বিন্দু জল এই বিলাসযানে ঢুকছে, তবে পুরো ডুবতে আরো মাসখানেক লাগবে। সে কি আর নিশ্চিন্তে ভোগে মন দেবে? না।
আমাদের ক্ষেত্রেও তাই। অভ্যাসে বা রীতিতে যদি সততা না থাকে, তবে তাকে আহরণ করা ছাড়া কোনো গতি আছে বলে তো মনে হয় না। আর সততা ছাড়া কোনো জাতের কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কল্পনা পাগলেও করতে দ্বিধা করবে।
(Samiran দার তোলা ছবিটা অনেক কথা মাথায় নিয়ে এলো। তাই...)