সৌরভ ভট্টাচার্য
27 April 2017
কোথা থেকে ফিরছিলাম মনে নেই, সন্ধ্যে সন্ধ্যে হবে, বড় রাস্তা পেরিয়ে বাঁকটা ঘুরতে যাব, হঠাৎ মনে হল, কিসে একটা খটকা লাগল যেন? কি যেন নেই?... মনে পড়ল, এখানে রোজ বিকাল থেকে প্রায় ন'টা অবধি একজন ফুচকাওয়ালা দাঁড়ায়। তাকে ঘিরে প্রায় সারা সন্ধ্যেই থাকে বাচ্চাকাচ্চা, তরুণ-তরুণীদের দল। আজ কেউ নেই। ফাঁকা। শুধু স্ট্রীট লাইটের আলোটা ওই ফাঁকা জায়গাটুকু বৃথাই ভরাট করার চেষ্টা করছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
তার মানে ওরা আমার মনের কিছুটা অংশ আমার অজান্তেই দখল করে নিয়েছিল। আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি।
আরেকদিন, খুব জোর কালবৈশাখী হয়ে গেল তার আগের দিন। আমি দু'দিন পর হেঁটে ফিরছি কোথাও থেকে একটা। মাঠ পেরিয়ে একটা বড় গাছ পড়ে গেছে ঝড়ে। দেখলাম সেটার গোড়া থেকে উপড়ে পড়ে আছে মাঠের ওপর। তার ডালপালা কাটাও শুরু হয়ে গেছে। মনের ভিতর একটা শূন্যতা তৈরি হল। কেন? আমি তো কোনোদিন গাছটাকে মন দিয়ে দেখিনি। কোনোদিন ভাবিনি। আমি না দেখলে, বা ভাবলে কি হবে? ও তো তার জায়গা করেই নিয়েছে আমার মনের কোনো একটা অংশে।
তাই ভাবি, প্রতিদিন এমন কত তুচ্ছ জিনিসে পরিপূর্ণ জীবনটা। ভালো করে দেখতে শিখলাম না বলে শুধু 'নেই নেই' করে কাটিয়ে দিলাম। কত অস্তিত্বের জোরে যে আমার এই ক্ষুদ্র 'আমি'টার অস্তিত্ব তার সীমা মেলা ভার। আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ শুনলাম আমার পাশের রাজ্যে চলে যাচ্ছে কাজের সূত্রে বদলি হয়ে। বাইরের দিক থেকে তাতে আমার কিছুই প্রভাব পড়ার কথা নয়, কারণ তার সাথে আমার দেখা হওয়ার তেমন কোনো সুযোগই ঘটে না। তবু জানতাম সে আমার শহরে আছে। আজ যখন সে থাকবে না শুনলাম, মনে একটা শূন্যস্থান তৈরি হল। তবে কি মনের রাজ্যে স্থান আর সময় সম্পূর্ণ তার নিজের অঙ্কে গড়া? বাইরের সব হিসাব ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তার কাছে?
আরো ছোটখাটো বস্তুর দিকে তাকিয়ে দেখি। আমার টয়লেটে যে ফ্লাশটা আছে, কোনদিন চোখে পড়ে সেটা চোখে পড়ার মত করে? যেদিন দেখি সেটায় জল জমেনি কোনো কারণে সেদিন মনটা তার সমস্ত আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকায়, অসুবিধাটা হল কিসে? প্রতিদিন যখন অন্যমনস্কভাবে চটিটা গলিয়ে রাস্তায় নামি, খেয়াল থাকে না তো চটিটাকে ভালো করে দেখার, ভাবি ওতে দেখার কি থাকতে পারে? পারে থাকতে, যেদিন ওর ফিতে আলগা হয়ে অল্প টানে ছিঁড়ে যায়।
আমার সমস্ত আগ্রহ আমাতে। আমার সুখে, ব্যক্তিগত আমাতে। তাই বরাদ্দের কিছু কম হলেই তাকিয়ে দেখি, খুঁজি, কিসে গোল হল? সেই ঘোরটা যেদিন কোনো কারণে হঠাৎ করে খসে যায়? অমনি দেখি শত সহস্র মানুষের ভিড়ে আমার অস্তিত্বের এক একটা অণু-পরমাণু জড়িয়ে। তাকে চিনি, না চিনি তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। শুধু সে আছে বলেই আমি আছি - এ বোধটা স্পষ্ট হয়ে মাথাটা নামিয়ে আনে আর বুকটাকে প্রসারিত করে তোলে। তাই বলা যায়, এ সমস্ত মিলিয়ে আমার একটা বড় শরীর আছে। আজ যশোর রোডে গাছ কাটা নিয়ে যে আমরা সরব হতে চাচ্ছি, কারণ সেটা আমার বড় শরীরে আঘাত করছে। জান্তে হোক, অজান্তে হোক - এই বড় শরীরটা সুস্থ থাকলেই আমার ক্ষুদ্র শরীরের যাত্রাটা নির্বিঘ্নে হতে পারে।
যদি কোনোদিন বড় কিছু চেয়ে থাকি, তা ঘোরের বশে চেয়েছি। ছোটোবেলায় মনে হত যখন খুব বড় হব তখন আর যা হোক ফুচকা খেতে কেউ বাধা দেবে না, ট্রেনের জানলার পাশের সিটটায় যতক্ষণ খুশী বসে থাকা যাবে, কেউ বলবে না ঠাণ্ডা লেগে যাবে এবার এদিকে এসো... আরো দামী দামী খেলনা কিনে আনা যাবে, কেউ বাধা দেবে না।
আজ সে সব আছে - খেলনা, জানলার ধারে সিট, ফুচকা... শুধু আমার আর সে আমিতে ফিরে যাওয়া হল না। এখন সে বারণগুলোর জন্যেই প্রাণ কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝে। তবে সে তো অন্যকথা। সেই 'তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও' বলে ধুলোতে নেমে আসতে ইচ্ছা করে। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই যে এত কিছুর মধ্যে ক্ষণিক থাকা আমারও হয়েছিল, সাক্ষী হওয়া হয়েছিল, ভোগ করার জন্য নয়। ভোরের শান্ত শীতল হাওয়া, সারাদিনের কাজের মধ্যে নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা, সন্ধ্যের আকাশের রঙ, পাখিদের ঘরে ফেরা, রাতের আকাশের নিঃসঙ্গ উদাসীনতা যেমন দেখেছি... তেমন দেখেছি ক্ষুধার্ত শিশুর করুণ অন্তর্ভেদী কান্নার সামনে অসহায় মায়ের দুটো চোখ... সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় উন্মাদপ্রায় বাবা-মায়ের অবস্থা... আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় হাসপাতালের ফ্রি বেডে শুয়ে থাকা বৃদ্ধা রমণীর বিকালের এক কাপ চায়ের প্রতীক্ষা...
কেঁদেছি প্রচুর... ভেবেছি ভাবনার সীমান্ত রেখা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে নিজের ক্ষুদ্র ক্ষমতা অনুসারে... কোনো কিছুর উত্তর মেলেনি। শুধু বুঝেছি প্রশ্ন নয়... উত্তর নয়... জীবন এক একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তে গাঁথা বুদবুদের মালা... এ অসীম সাগরে এই সৃষ্টি হচ্ছে... পরক্ষণেই হচ্ছে বিলীন। যদি সব সরিয়ে সে সাগরের তলদেশে ডুব দেওয়া যায়... তবে এই জগতের পাশাপাশি আরেক জগতের হদিস মেলে যে জগতের কথা ফকির দিতে চেয়েছিল অমলকে... সে পথে ভিতরে দিয়ে যেতে হয়... প্রকৃতির অপেক্ষায় না থেকে নিজেকেই নিজে শূন্য করে ফেলতে হয়... তবে কারো চোখে চোখ তো পড়ে... সেই তো ভরসা...
তার মানে ওরা আমার মনের কিছুটা অংশ আমার অজান্তেই দখল করে নিয়েছিল। আমি বিন্দুমাত্র টের পাইনি।
আরেকদিন, খুব জোর কালবৈশাখী হয়ে গেল তার আগের দিন। আমি দু'দিন পর হেঁটে ফিরছি কোথাও থেকে একটা। মাঠ পেরিয়ে একটা বড় গাছ পড়ে গেছে ঝড়ে। দেখলাম সেটার গোড়া থেকে উপড়ে পড়ে আছে মাঠের ওপর। তার ডালপালা কাটাও শুরু হয়ে গেছে। মনের ভিতর একটা শূন্যতা তৈরি হল। কেন? আমি তো কোনোদিন গাছটাকে মন দিয়ে দেখিনি। কোনোদিন ভাবিনি। আমি না দেখলে, বা ভাবলে কি হবে? ও তো তার জায়গা করেই নিয়েছে আমার মনের কোনো একটা অংশে।
তাই ভাবি, প্রতিদিন এমন কত তুচ্ছ জিনিসে পরিপূর্ণ জীবনটা। ভালো করে দেখতে শিখলাম না বলে শুধু 'নেই নেই' করে কাটিয়ে দিলাম। কত অস্তিত্বের জোরে যে আমার এই ক্ষুদ্র 'আমি'টার অস্তিত্ব তার সীমা মেলা ভার। আমার অতি প্রিয় একজন মানুষ শুনলাম আমার পাশের রাজ্যে চলে যাচ্ছে কাজের সূত্রে বদলি হয়ে। বাইরের দিক থেকে তাতে আমার কিছুই প্রভাব পড়ার কথা নয়, কারণ তার সাথে আমার দেখা হওয়ার তেমন কোনো সুযোগই ঘটে না। তবু জানতাম সে আমার শহরে আছে। আজ যখন সে থাকবে না শুনলাম, মনে একটা শূন্যস্থান তৈরি হল। তবে কি মনের রাজ্যে স্থান আর সময় সম্পূর্ণ তার নিজের অঙ্কে গড়া? বাইরের সব হিসাব ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে তার কাছে?
আরো ছোটখাটো বস্তুর দিকে তাকিয়ে দেখি। আমার টয়লেটে যে ফ্লাশটা আছে, কোনদিন চোখে পড়ে সেটা চোখে পড়ার মত করে? যেদিন দেখি সেটায় জল জমেনি কোনো কারণে সেদিন মনটা তার সমস্ত আগ্রহ নিয়ে সেদিকে তাকায়, অসুবিধাটা হল কিসে? প্রতিদিন যখন অন্যমনস্কভাবে চটিটা গলিয়ে রাস্তায় নামি, খেয়াল থাকে না তো চটিটাকে ভালো করে দেখার, ভাবি ওতে দেখার কি থাকতে পারে? পারে থাকতে, যেদিন ওর ফিতে আলগা হয়ে অল্প টানে ছিঁড়ে যায়।
আমার সমস্ত আগ্রহ আমাতে। আমার সুখে, ব্যক্তিগত আমাতে। তাই বরাদ্দের কিছু কম হলেই তাকিয়ে দেখি, খুঁজি, কিসে গোল হল? সেই ঘোরটা যেদিন কোনো কারণে হঠাৎ করে খসে যায়? অমনি দেখি শত সহস্র মানুষের ভিড়ে আমার অস্তিত্বের এক একটা অণু-পরমাণু জড়িয়ে। তাকে চিনি, না চিনি তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। শুধু সে আছে বলেই আমি আছি - এ বোধটা স্পষ্ট হয়ে মাথাটা নামিয়ে আনে আর বুকটাকে প্রসারিত করে তোলে। তাই বলা যায়, এ সমস্ত মিলিয়ে আমার একটা বড় শরীর আছে। আজ যশোর রোডে গাছ কাটা নিয়ে যে আমরা সরব হতে চাচ্ছি, কারণ সেটা আমার বড় শরীরে আঘাত করছে। জান্তে হোক, অজান্তে হোক - এই বড় শরীরটা সুস্থ থাকলেই আমার ক্ষুদ্র শরীরের যাত্রাটা নির্বিঘ্নে হতে পারে।
যদি কোনোদিন বড় কিছু চেয়ে থাকি, তা ঘোরের বশে চেয়েছি। ছোটোবেলায় মনে হত যখন খুব বড় হব তখন আর যা হোক ফুচকা খেতে কেউ বাধা দেবে না, ট্রেনের জানলার পাশের সিটটায় যতক্ষণ খুশী বসে থাকা যাবে, কেউ বলবে না ঠাণ্ডা লেগে যাবে এবার এদিকে এসো... আরো দামী দামী খেলনা কিনে আনা যাবে, কেউ বাধা দেবে না।
আজ সে সব আছে - খেলনা, জানলার ধারে সিট, ফুচকা... শুধু আমার আর সে আমিতে ফিরে যাওয়া হল না। এখন সে বারণগুলোর জন্যেই প্রাণ কেঁদে ওঠে মাঝে মাঝে। তবে সে তো অন্যকথা। সেই 'তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও' বলে ধুলোতে নেমে আসতে ইচ্ছা করে। কৃতজ্ঞতার শেষ নেই যে এত কিছুর মধ্যে ক্ষণিক থাকা আমারও হয়েছিল, সাক্ষী হওয়া হয়েছিল, ভোগ করার জন্য নয়। ভোরের শান্ত শীতল হাওয়া, সারাদিনের কাজের মধ্যে নানা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা, সন্ধ্যের আকাশের রঙ, পাখিদের ঘরে ফেরা, রাতের আকাশের নিঃসঙ্গ উদাসীনতা যেমন দেখেছি... তেমন দেখেছি ক্ষুধার্ত শিশুর করুণ অন্তর্ভেদী কান্নার সামনে অসহায় মায়ের দুটো চোখ... সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় উন্মাদপ্রায় বাবা-মায়ের অবস্থা... আসন্ন মৃত্যুর প্রতীক্ষায় হাসপাতালের ফ্রি বেডে শুয়ে থাকা বৃদ্ধা রমণীর বিকালের এক কাপ চায়ের প্রতীক্ষা...
কেঁদেছি প্রচুর... ভেবেছি ভাবনার সীমান্ত রেখা বরাবর হাঁটতে হাঁটতে নিজের ক্ষুদ্র ক্ষমতা অনুসারে... কোনো কিছুর উত্তর মেলেনি। শুধু বুঝেছি প্রশ্ন নয়... উত্তর নয়... জীবন এক একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তে গাঁথা বুদবুদের মালা... এ অসীম সাগরে এই সৃষ্টি হচ্ছে... পরক্ষণেই হচ্ছে বিলীন। যদি সব সরিয়ে সে সাগরের তলদেশে ডুব দেওয়া যায়... তবে এই জগতের পাশাপাশি আরেক জগতের হদিস মেলে যে জগতের কথা ফকির দিতে চেয়েছিল অমলকে... সে পথে ভিতরে দিয়ে যেতে হয়... প্রকৃতির অপেক্ষায় না থেকে নিজেকেই নিজে শূন্য করে ফেলতে হয়... তবে কারো চোখে চোখ তো পড়ে... সেই তো ভরসা...