Skip to main content


জীবনের প্রতিটা কোণ যুক্তিতে আলোকিত থাকবে মানুষ এতটা অভিযোজিত হয়ে উঠতে পারেনি। যদি বলি সে শুধু যুক্তির দ্বারা পরিচালিত হবে এবং সে চেষ্টাই সে সারাজীবন করে যাবে, তবে তাকে ভয়ংকর অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। কারণ যুক্তির আলোর এত জোর নেই যে, সে জীবনের সব বাঁক, খানা-খন্দগুলোতে তার হাত ধরে চলবে, তাকে সঠিক পথ দেখাবে। এ যেন দু-ব্যাটারির টর্চ হাতে অ্যামাজনের জঙ্গলে প্রবেশ।
     যুক্তির প্রতি এই অতিশ্রদ্ধা পরবর্তীকালে নানান মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে শুরু করে, যা স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ব্যাঘাত আনতে দেখা যায়।
      প্রথমতঃ সে যখন বুঝতে পারে তার যুক্তির সীমা অথচ তাকে মানতে পারে না, তখন তার মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, যা তার আত্মবিশ্বাসের পক্ষে ক্ষতিকর। সে যুক্তি ছেড়ে অপযুক্তির আশ্রয় খোঁজে। সহজভাবে যেখানে ‘বুঝছি না’ বলা যায়, তাকে ‘বুঝেছি’ বলতে অজস্র মিথ্যা যুক্তির আশ্রয় খুঁজে বেড়াতে হয়। ফলস্বরুপ, তৈরি হয় একটি সংকর চরিত্র। তার কথায় ও কাজে সামঞ্জস্যতা পাওয়া ভার। কারণ বাইরে সে যতই বোঝাক ক্ষুরধার অপযুক্তিতে, ভিতরে সে সেগুলোর অন্তঃসারশূন্যতা জানে।
      এভাবে আরো এগোতে এগোতে ক্রমশঃ তার মধ্যে শুষ্কতা, সন্দেহপ্রবণতা, অতৃপ্ততা বাড়তে থাকে।

      কিন্তু এর বিপরীতটা যদি হয়? যদি তাকে ছোটবেলা থেকেই শেখানো যায় যুক্তির সীমারেখা সম্বন্ধে, তা হলে ‘বুঝিনি’ বলতে লজ্জাবোধ করে না। জ্ঞানের আলো না থাকুক, সংশয়ের কুয়াশা থাকে না। সে সত্যের আশ্রয় লাভ করে। ‘বুঝিনি’ বলবার সৎসাহস সে লাভ করে।
      এই ‘বুঝিনি’ বলার মধ্যে যে গৌরব, তা তাকে আরো বৃহৎ সত্যের মধ্যে প্রবেশের অধিকার দেয়। সে বুঝতে পারে ‘হাঁ’ এর মধ্যে যেমন একটা সত্য আছে, ‘না’ এর মধ্যেও ততখানি বা তার থেকে অধিক সত্য আছে। তার মধ্যে জন্ম নেয় একটা গভীর জীবনবোধ। যা ‘না’ থেকে শুরু হয়। আপাতভাবে এটা নঞর্থক শোনালেও, এর থেকেই তৈরি হয় সত্যিকারের সদর্থক মানসিকতা।
     তাকে মানতে হয়, রোগ-শোক-মৃত্যু-পরাজয় সব সত্য। তাকে তার নিজের দর্শন/বিশ্বাস খুঁজে নিতে হয়, যা তার একান্ত ব্যক্তিগত। যেখানে সে জীবনের ‘হাঁ’ আর ‘না’কে নিজের মত করে মেলায়। সেই বিশ্বাসে সে দাঁড়ায় নিজের মুখোমুখি। প্রশ্নের মীমাংসা করতে না পারুক, তাকে শ্রদ্ধা করতে শেখে। ‘জানি না’ বলে সে যুক্তির অহংকার বিসর্জন দেয়। সে আশ্রয় পায় তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস/দর্শন-এ। সেটি নিয়ে তর্ক চলে না, তাকে বুঝতে হবে। কারণ তর্ক নামক বস্তুটা একান্ত যুক্তির রাজ্যের। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক-
     আমি তুমি দু'জনেই জামা কিনতে যেতে পারি একসাথে, কারণ জামাটা প্রয়োজন সে নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তুমি লাল জামা কিনলে বলে আমায়ও লাল জামা কিনতে হবে, আর তা না হলে আমারটা জামা-ই নয় এটা কোনো পরিণত মানসিকতার লক্ষণ না।
     আমরা দু'জনেই দুটো ভিন্ন রঙের জামা কিনে পাশাপাশি যেমন ফিরতে পারি, তেমন দু'রকম বিশ্বাস নিয়েও পাশাপাশি চলতেই পারি শুধু না, চলতে হবেই।
   সেই বিশ্বাসকে নিজের জীবনে জাগিয়ে তুলতে হবে। আনতে হবে বলব না। কারণ জন্মগতভাবে আমরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ মানসিকতা উপযোগী বিশ্বাস নিয়েই জন্মাই। তাকে যদি সঠিকভাবে লালন করার, চর্চা করার সুযোগ দেওয়া যায় তবে তা জীবনকে অনেক বেশি সামঞ্জস্যতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে পারে। তাতে ছদ্ম-জ্ঞানী মানুষের সংখ্যা কমে, স্বচ্ছ মানুষের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করি। মানুষের বিভ্রান্তি কমবে। অনেক রকম মানসিক ব্যাধিও কমবে বলে আমার বিশ্বাস। সেই চিরপূরাতন কথাটা দিয়েই ইতি টানি-
                                 'বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর'