দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের বাইরের প্রাঙ্গণ। সকাল আটটা। উল্লেখযোগ্য ভিড় নেই। রামকৃষ্ণদেবের ঘরে ঢুকতে বাঁশ। ডাঁয়ে, বাঁয়ে, পিছনের দিকে বাঁশ আটকানো - প্রবেশ নিষেধ - এখানে জুতা রাখবেন না। ঘরে ঢুকতে গেলে মন্দিরের ভিতরের প্রাঙ্গণে ঢুকে তবে যাও। এখন যাব না। লাইনে দাঁড়াতে ইচ্ছা করছে না। চারদিকে ছোটো ছোট ঘুরন্ত ক্যামেরা, পুরুষ-নারী পুলিশ। সারা গায়ে হাত দিয়ে দিয়ে পরীক্ষা চলছে - কেন এসেছ মন্দিরে, মরতে না মারতে? ভক্তিতে, না হিংসাতে?
যাব না ভিতরে। রামকৃষ্ণদেবের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় বসলাম। সামনে রাসমণি দেবীর পূর্ণাবয়ব মূর্তি। বাঁ পাশে গঙ্গার আওয়াজ। থেকে থেকেই ঝমঝম করে বালি ব্রীজ দিয়ে রেলগাড়ি যাওয়ার আওয়াজ।
“স্নান করলাম বুঝলেন”
বয়েস আন্দাজ ষাটের উপর। সাদা পাঞ্জাবী পায়জামা পরে, মোটা চশমা চোখে এক ব্যক্তি আমারই উদ্দেশ্যে বললেন। আমার পাশেই বসে। পায়ের কাছে ওনারটা ছাড়া দু'জোড়া লেডিস চটি। পাশে রাখা দুটো মেয়েদের ব্যাগ। বেশ সচ্ছল অবস্থা মনে হল।
"ও আচ্ছা", সোনামুখ করে বললাম। ওনার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সেটা একটা সাদা রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, "প্রায়ই আসি। সোদপুর বাড়ি তো। টুক করে সকাল হলেই গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। কতক্ষণ আর লাগে, ওই ধরুন আধঘন্টা।”
আমি মুখের হাসিটা এখনও ধরে রেখেছি।
"ওরা সব, মানে আমার বউ আর মেয়ে মন্দিরে দর্শনে গেল বুঝলেন, আমি যাই না। আমার ওসব ভালো লাগে না... ওই গুঁতোগুঁতি... ঠেলাঠেলি... কে যাবে বলুন... তার চেয়ে বাড়ির ঠাকুরঘরে চোখ বুজে বসে থাকব... শান্তি... কি বলেন?... আরে ভগবান কি আলাদা? এই ধরেন না, বিবেকানন্দ কি বলেছিলেন, সর্বভূতে তিনিই আছেন, তাই সবার সেবা করলেই হল...” বলেই ওনার দ্বারা সংরক্ষিত বস্তুগুলোর দিকে তাকালেন। বুঝলাম পুরোদস্তুর সেবায় নিয়োজিত প্রাণ।
"এই যে বিবেকানন্দ বললেন সর্বভূতে তিনি আছেন, আপনার কি মনে হয় না এ বিশ্বাস মানুষের ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে?"... বলতে বলতেই সামনের দিকে দাঁড়িয়ে থাকা, ঠিক দাঁড়িয়ে না, কিছু কারণে বেশ উদ্বিগ্ন এক মধ্যবয়েসী মানুষের দিকে তাকালেন। ভদ্রলোকের তখন বিবেকানন্দের অদ্বৈতবাদ অপেক্ষা গুরুতর কিছু সমস্যা জীবনে দেখা দিয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। এদিকে খোদ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ, মুখ ফিরিয়েই বা নেন কি করে? কাঁচুমাচু মুখ করে হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
আমার পাশের ভদ্রলোক ফের আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, "বিজ্ঞান এসে গেছে মশায়... বিবেকানন্দ এখন আর কেউ মানবে না... বিশেষ করে ওই সর্বভূতে ঈশ্বর তত্ত্বটা আর তো চলবেই না।”
তাই তো, বিবেকানন্দর যুগে তো আর স্ক্যান, MRI ছিল না, তা হলেই বুঝতেন ওসব কথা ঘোরের কথা। আজ আমরা মানুষের সবটুকুন পরীক্ষা করে বুঝেছি, ওসব গোঁজামিলের কথা।
সামনের উদ্বিগ্ন মানুষটা তখন আরো উদ্বিগ্ন, কারণ বোঝা যাচ্ছে না। তার সাথে আমার পাশের ভদ্রলোকের এমন গুরুতর দার্শনিক নৈরাশ্যবাদের কথায় আরো ঘেঁটে যাচ্ছেন।
“মানুষ বর্বর হয়ে যাচ্ছে মশায়, বর্বর। না হলে শালা কেউ নিজের মাংস নিজে খায়... মশায় এখন একটা কুত্তাকে যে ভরসা করা যায় মানুষকে নয়, তবে বিবেকানন্দের কথা কে বিশ্বাস করবে বলুন?"
একটা ঠাণ্ডা হাওয়া দমকা দিয়ে ঘর্মাক্ত গায়ের উপর দিয়ে বয়ে গেল। মনে মনে বললাম, আঃ! গাছের পাতাগুলো ঝরঝর করে শব্দ করে উঠল। দূরে কোথাও কেউ শাঁখ কিনছে, বিভিন্ন রকম আওয়াজ ভেসে আসছে।
কথাটা তো মিথ্যা নয়... মানুষে মানুষে ঈশ্বরের অধিষ্ঠান... সামনে গুচ্ছ গুচ্ছ সিসিটিভি... সতর্ক পুলিশ... সন্দিগ্ধ পাশের মানুষের উদ্দেশ্য... ঈশ্বর কই? সেতো ওই মূর্তিতে আর ফটোতে... আটকে গেছে...
চারদিক থেকে মালার গন্ধ, ধূপের গন্ধ, আরো নানা রকম মনের শুদ্ধতাবোধ আনয়নকারি আয়োজন... অবশেষে সব ব্যর্থ?
ইতিমধ্যে ভদ্রলোকের স্ত্রী আর মেয়ে চলে এসেছেন। তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কচুরী খাওয়া ঠিক হবে কিনা, নাকি বরানগরের আত্মীয়ের বাড়ি চলে যাবেন সোজা, এই নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হল। স্ত্রী ও মেয়ে দুজনেই বেশ ভারিক্কি চেহারার মানুষ। মেয়েও বিবাহিতা। কপালে পূজো দেওয়ার স্মৃতিচিহ্ন - বড় লাল সিঁদুরের ফোঁটা।
এরা পরিবার। সামনের গাছগুলোতে হনুমানের পরিবারের দাপাদাপি। হনুমান সন্দেহ করে? না, কোনো পশুই সন্দেহ করে না। করে মানুষ। সব চাইতে বেশি নিজেকে আর নিজেদের।
ওরা চলে গেলেন। বরানগরই যাবেন। মহিলা দু'জনের সাদা লাল পেড়ে শাড়ি, আরো একই রকম শাড়ির ভিড়ে মিলিয়ে যেতে লাগল। পাশে সেই ভদ্রলোকও মিলিয়ে গেলেন মানুষের ভিড়ে, যে মানুষদের মধ্যে আর বিবেকানন্দের দেখা ঈশ্বরকে দেখতে পাচ্ছেন না আর।
সারাটা দিন গড়ালো। সন্ধ্যে হব হব। কাশীপুরের রতনবাবুর ঘাট। সামনে গঙ্গা। ঘাটের আলোগুলো জ্বলেছে। বেশ কিছু মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। ওপারে দেখা যাচ্ছে বেলুড় মঠ। মঠের পাড় ধরে বসা সার দিয়ে অজস্র মানুষ। তাদের উপরে লাল রঙের ফুলের গাছ। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে গাছটা।
তার নীচে বসা মানুষের অতশত পোশাকের রঙ - যেন ফুলগুলো ঝরে ঝরে পড়েছে মনে হচ্ছে। তবু ওরা ফুল নয়, মানুষ।
একটা কান্নায় ঘোর ভাঙল। পাশেই কাশীপুর মহাশ্মশান। সেদিক থেকে আসছে। শ্মশানের কান্নাটা শুধুই কান্না। একজন অল্পবয়েসী মেয়ে কাঁদছে। কেন কাঁদছে? থাক, আর এগোলাম না। শ্মশানের কান্নায় কোনো ক্ষোভ থাকে না, হিসাব থাকে না, লজ্জা থাকে না, অহংকার থাকে না। মৃত্যু যে কাওকেই রেহাই দেয় না। মৃত্যুর মত এমন অমোঘ, অবুঝ, সমদৃষ্টির বালাই সংসারে আর কি আছে! শ্মশানের কান্না তাই পবিত্রতম কান্না। আত্মা নগ্ন হয়। সাজানো মানুষটা মৃত্যুর সামনে দাঁড়াতে পারে না। তাই মানুষটা পুরো মানুষ তখন।
আবার তাকালাম ওপারে। সার দেওয়া মানুষের সারি। পাশাপাশি বসে। মানুষ দূরেও থাকে পাশে থাকার জোরে। বাইরে না হোক অন্তরে, ভিতরে। মানুষ একা থাকতে পারে না। একা থাকতেও এক বুক অভিমান লাগে, মানুষেরই ওপর। স্বেচ্ছা একাকীত্ব? সে তো নিজেকে ছাড়িয়ে দ্বিগুণ জোরে সবার মাঝে আসার কৌশল... বর্ষার জল যেভাবে দূরে গিয়ে সজোরে সবেগে কাছে ফেরে... নইলে তো মহাশূন্যে হবে ব্যর্থ সব আয়োজন!
সন্ধ্যে হয়ে গেল। শাঁখ বেজে উঠল এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে। হাঁটতে হাঁটতে আমার আশেপাশে মানুষের ঢল। এ শুধুই অবিশ্বাস? কোথাও ভুল হচ্ছে কিছু।
এত দূর থেকে দেখি বলেই বুঝি মহাকাশের প্রতিটা গ্রহ-নক্ষত্রের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। মালাকে একসাথে দেখলেই তবে তার মাধুর্য, প্রতিটা ফুলকে আলাদা করে দেখলে তো নয়। প্রতিটা শব্দের থেকে সরে এসে না দাঁড়ালে যেমন একটা পরিপূর্ণ বাক্যের অর্থ বোঝা যায় না, এও তেমন। তাই একটু সরে এসে, একটু দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায়, বিশ্বাসটাই আছে। বিশ্বাসহীনতাটা দুর্যোগমাত্র। ইতিহাসে দুর্যোগগুলোই লেখে। নিত্য ঘটনাটা লেখা বাহুল্য। চিরটাকাল স্বাভাবিক আর নিত্যের জোরেই বাঁচে ব্যতিক্রম, ব্যতিক্রমের জোরে নিত্য তো নয়! তাই অনন্তকাল ধরেই মানুষ পাশেপাশেই থাকবে, হাঁটবে, বাঁচবে। এই একটু দূর থেকে সংসারটাকে দেখার অভ্যাসকেই বলা হয়েছিল - বৈরাগ্য। বৈরাগ্য চশমার কাঁচটার উপর জমা ধুলোগুলো সরানোর চেষ্টা। চশমাটাকেই বদলের কথা নয়। আর নিজের মধ্যে অন্যের অস্তিত্বের প্রয়োজনকে উপলব্ধি করার মত আস্তিকতা আছে নাকি মনুষ্যজন্মে আর কিছু? তখনই প্রতিদিনের তুচ্ছতার ক্লেদ ঘোচে মহাকালের অসীম ধৈর্য্যে, আশ্বাসে, বিশ্বাসে।
কান্নাটা শুনতে পাচ্ছি না আর, বহুদূর হেঁটে চলে এসেছি। তবু কান্নাটা এখনও বুকে বাজছে। ওই কান্নাটাই মোহ-মুদগর... নইলে নিজের হাত থেকে রেহাই নেই যে!