Skip to main content

        বঞ্চিত হওয়া আর ত্যাগ করা একই কথা তো নয়। দৃষ্টির সামনে যে অসীম জগত তার একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অস্তিত্বে নিজেকে স্বীকার করে বাঁচতে চাওয়ার অভ্যাস - এই তো কথা? একি সামান্য কথা? আমার এই 'আমি' জাগতের কাছে অতিতুচ্ছ একটা অস্তিত্ব হলেও, আমার নিজের কাছে তো সে আছে বলেই জগত সংসার! আমি না থাকলে জগতের তিলমাত্র অভাব হবে না, কিন্তু আমি না থাকলে আমার দেখা-শোনার এই জগতটাও যে সাথে সাথে হারিয়ে যায়। 
        এই ব্যক্তিগত আমির উপরে দাঁড়িয়ে যে সমষ্টিগত জগত - এ এক আজব রহস্য। পিলসুজের উপর রাখা প্রদীপ, তার শিখাতে অধিকার সমস্ত জগতের, কিন্তু পিলসুজের ভার একার আমার। কাউকে বলা যাবে না, "ভাই একটু আমার হয়ে প্রদীপটা ধরবে, আমি যে আর এ প্রদীপের ভার বইতে পারি না"। হয়ত সে ধরবে, তবে সে তার অনুকম্পা, আর যদি সে না শোনে তবে সে তার অধিকার, তার ইচ্ছা। দুই বাস্তব, দ্বিতীয়টার উদাহরণই প্রবল। 
        এই একার 'আমি' র উপর দাঁড়িয়ে যে 'দশের আমি' তাকে রক্ষা করে চলার দায় সম্পূর্ণ নিজের। 'দশের আমি' মানে নানা আমি, সে আমি দাদা, ভাই, শিক্ষক, বন্ধু, প্রতিবেশী ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এ সবের মূলে যে আমার 'একা আমি' সেই সে পিলসুজ। আমার অক্ষয় আনন্দ, আমার অক্ষয় সত্তা, আমার অক্ষয় অস্তিত্ব। অক্ষয় বললাম যে? হ্যাঁ অক্ষয় তো, কারণ সেই মূল ক্ষয় হলে যা থাকবে তাকে জানবে কে? তাই আমার সেই 'একা আমি' র বোধের সম্মুখে যে ঘটনাপ্রবাহ সেই আমার ক্ষয়শীল, আমি নই। এ আমি সেই বেদান্ত মতের অমর আত্মা নই। আমার এ আমি নিতান্ত আমার দেহ নির্ভর চেতনার স্রোত। জগতের কাছে যা লক্ষকোটি স্রোতের একটি, কিন্তু আমার নিজের কাছে যা একান্ত অবলম্বন, সম্বল। 
        কেন তবে আনন্দ বললুম? অবশ্যই আনন্দ। আমি যেখানে কেউ নই, যেখান আমার কোনো সমাজগত পরিচয় নেই, কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই, সেই যে মৌলিক একা আমি সেখানে যদি আনন্দের স্রোতের সন্ধান না পাই, তবে সমাজে আমার ভিখারির দশা থেকে মুক্তি দিতে স্বয়ং ঈশ্বরও অপারগ হবেন। আমার সেই মূল আমি, পিলসুজ আমিতে আমার আনন্দের বোধ - কিছু পেয়ে নয়, কিছু হারিয়ে নয়, সে আনন্দ আমার অস্তিত্বের গভীরতম আনন্দ। তাকে ভোগ করা যায় না। যে আনন্দ ভোগ্য, তা সুখ। সে আনন্দে আমি আনন্দময় হয়ে উঠি, আর বাইরে সে কিছু নয়। এর বাইরে সংসারে যা কিছু তাই হরণ যোগ্য, কেবল আমার এই হয়ে ওঠাটা বাদ দিয়ে। তাই সে আনন্দ আমার পিলসুজের আনন্দ। সে আনন্দের প্রস্রবণ আমার সমস্ত কাজে, চিন্তায়, একাকীত্বে, সঙ্গসুখে। সেই আমার পরম আশ্রয়, আমার নির্বিষাদ ঘন আমার মধ্যে আমার নিবিড় মুহূর্ত। 
        আমার অস্তিত্ব আমার সত্তা। সময়ে অসময়ে তাকে ডাকার মত সাহস যেন আমার থাকে। সব কিছু হারালেও যেন নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলতে পারি, আসলে যা হারিয়েছি, তা এককালে পেয়েছিলুম বলেই হারিয়েছি, তারা আমার ছিল না। যা হারালো তা 'দশের আমি' থেকে কোনো এক 'আমি' র খসে পড়া। মন যেন একবার পিলসুজের দিকে তাকিয়ে দেখে, আসল যে আমি, তাকে হারানো যায় না, এ বিশ্বাস যেন সে রাখে। এ সত্তা যেন আমার চোখ। চোখ বন্ধ করলেই যেমন আমার পরিদৃশ্যমান জগত একটা অন্ধকার পর্দার আড়ালে বিলীন হয়ে যায়, এও সেরকম। আমার চোখের অস্তিত্বের মতই আমার সেই 'একা আমি'র দৃষ্টির সামনেই তারা সব দাঁড়িয়ে। সংসারের নানা ঘটনা থেকে দুঃখ, সুখ, আনন্দ, বেদনা যে ভোগ করছে সেও আমার সেই 'একা আমি' র একজন মিথ্যা প্রতিবিম্ব। সে মিথ্যা বলেই এত অল্পতে ভেঙে পড়ার অভিনয় করে, নানা ছদ্মবেশে সব কটা আমির মধ্যে যোগসূত্র তৈরি করে রাখে, তাকে আমরা বলি অহং - সে মিথ্যা, সে তোলা আদায়কারীর মতই মিথ্যা। তার আড়ম্বর, তার রাগ, অভিমান, ভয়, শোক সব মিথ্যা। সে সেজে থাকা রাজা। আসল রাজা আমার অভ্যন্তরের নীরব সাক্ষী। আমার 'একার আমি', পিলসুজের আমি। সে কি তবে নির্বিকার? তা নয়, সে শুধু নানা অভিজ্ঞতার জ্ঞাতা, তাতেই তার আনন্দ। আমার মিথ্যা অহং যখন মাথাকুটে মরছে, কারণ তার দীর্ঘদিনের প্রেমের স্বপ্ন বিশ্বাসঘাতকতার এক ধাক্কায়, এক লহমায় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তখন সেই 'একার আমি' তাকে বলে ওঠে - স্বপ্ন ভেঙেছে, কিন্তু সেই ভাঙার মধ্যে দিয়ে তুমি একটা সত্যকেও কি জানলে না? সেই সত্য কি এতই মূল্যহীন? মোহভঙ্গের দুঃখ ক্ষণিকের কিন্তু মোহভঙ্গের সুখ চিরকালের। একি সত্য নয়? 
        হ্যাঁ তাই সত্য। সেই সত্য যা আমার এই 'একা আমি' পিলসুজের মত ধারণ করে সংসারে নানা ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে। এর বাইরে যা, তাকে মিথ্যা বলি না, তবে তা আমার বলে সত্য বলি না, তা আমার ক্ষণিক প্রতিবেশীর মত সত্য। ক্ষণকালটাই সত্য, চিরকালটা শুধু আমার একার ঘরে আমি হয়েই সত্য। এই দুইয়ের ব্যবধানটা ঠিক ভাবে মেনে নিয়ে চলতে পারলেই দিশাহারা হই না। সুখী হতে হবে এমন দিব্যি দিয়ে তো কেউ পাঠায়নি, মূর্খ না হলেই হল। জীবনে তৃপ্তি থাকুক, পূর্ণতা থাকুক, আনন্দ থাকুক। এরা কেউ কিছুতে নির্ভরশীল নয়, এতেই বিশ্ব-সংসারের বাকি সুখগুলো নির্ভরশীল, এটা বুঝলেই আর এর দরজায় ওর দরজায় সুখের জন্য হাত পেতে ঘুরে বেড়াতে হয় না, নিজের দরজাটা হাট করে খুলে রাখলেই হল। আসা যাওয়া দুয়েতেই আনন্দ তখন। অভিজ্ঞতার আনন্দ, সুখের না। পিলসুজের আনন্দ। শিখা নিভলেও যে থাকে, অন্ধকারে একা।