সৌরভ ভট্টাচার্য
15 May 2019
জন্মসূত্রে সবাই নিজেদের অ্যাকাউন্টে বেশ খানিকটা সময় পেয়েছি। কেউ কম, কেউ বেশি। জানা নেই। জানার উপায়ও নেই। চেক ভাঙিয়ে সময় নিয়েছি। ইচ্ছামত নিজের ব্যক্তিগত কাজে খরচা করেছি। তাতে জমেনি কিছু। ক্ষয়েইছে শুধু।
সময় কি তবে বাড়ানো যায়? ব্যক্তিগত খাতে বাড়ানো যায় না। সমাজের খাতে বাড়ানো যায়। নিজের অ্যাকাউন্টের সময় সমাজের অ্যাকাউন্টে কিছুটা করে করে জমা রাখলে তা অক্ষয় হয়।
পৃথিবীর সব দেশে সব সময় এমন কিছু মানুষ জন্মেছেন যারা ব্যক্তিগত সময়ের পুরোটাই সমাজের খাতে দিয়ে অমর হয়েছেন - লাভে না, বস্তুর বৈভবে না, চিত্তের প্রাচুর্যে।
আমাদের মুশকিল হল আমাদের সমাজের খাতটা বহুদিন হল শূন্য যাচ্ছে। সবাই নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন একটা অস্তিত্বকে সমাজ জানছে। অর্থাৎ আমার বাড়ির বাইরের দরজায় যে দাঁড়িয়ে, ওই সমাজ। আমি আলাদা, পৃথক একটা সত্তা। আদতে তো তা নয়। আমার ঘরের অন্দরমহল থেকে শুরু করে শোবার ঘর, ঠাকুরঘর মায় শৌচালয় অবধি সমাজ। কারণ আমি নিজেই সমাজ। আমার মধ্যে হাজার একটা বিরোধ, দ্বন্দ্ব। সেই স্বাভাবিক। আমি মানু্ষটাকে আলাদা করে দাঁড় করাতে গেলেই বিস্তর ফাঁকি। তা কি করে হয়?
হয় কারণ আমার মধ্যে দুটো আমি আছে - এক, ছোটো আমি। দুই, বড় আমি। সমাজ ওই বড় আমিটার প্রতিনিধিত্ব করছে আমার মধ্যে আর ছোটো আমিটা একটা উন্নতমানের বায়োলজিকালি অস্তিত্ব বই কিছু না। যা কিছু সংঘাত এই দুইয়ের মধ্যে। বাইরেটা তার প্রতিফলন। আজ যে শক্তিতে এত ধুন্ধুমার কাণ্ড, তারা কারা? তারা সবাই আমি আপনি রাম শ্যাম যদু মধু। কেউ আকাশ থেকে পড়েনি। রাজনীতির ক্ষেত্র ক্ষমতার ক্ষেত্র। কিন্তু বাকি ক্ষেত্রগুলোতে? আমরা কি অত্যন্ত সংযত, সত্যনিষ্ঠ, স্বচ্ছ, দুর্বলের প্রতি সদয় সমাজ? ক্ষমতার ক্ষেত্রে যা হয় তা প্রবলভাবে হয় বলে তা বড্ড বেশি চোখে পড়ে। আর বাকি জায়গাগুলোতে সুক্ষ্মভাবে একই কাণ্ড ঘটে চললেও চোখ এড়িয়ে যায়, কারণ তার প্রাবল্য কম। কোনো রাজনীতিবিদ আমাদের সমাজের বাইরে থেকে আসেননি। এই সমাজটাই জন্ম দিয়েছে, লালিতপালিত করেছে তাদের। তবে কার দিকে আঙুল তুলবে? একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে চারটে দেওয়ালের পৃথক অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, কিন্তু বাইরে এসে দাঁড়ালে সে সব মিলিয়ে একটা বাড়ি। আমাদের মধ্যেও তাই হাজার একটা দল। সে দলে হাজার একটা গোষ্ঠী বানিয়ে টুকরো টুকরো হয়ে দলাভিমানে মত্ত হয়ে কাজের কাজ কিছু হয় কি? কিচ্ছু হয় না।
বড় হওয়ার দায়টা, বড় কাজের দায়টা শুধু অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে, ট্যাক্স দিয়ে আর ভোট দিয়ে যদি গণতন্ত্র চলত তবে আর কথাই ছিল না। চালাতে গেলে সবার মিলিত শক্তি লাগে। সে শক্তি ঘরের মধ্যের সমাজ থেকে তৈরি হয়ে ঘরের বাইরের সমাজে গিয়ে মেশে। সে শক্তির উৎস বড় চিন্তা হবে শুভ উদ্দেশ্য হবে - শুরুতে এমন কথাই ছিল। মনুষ্যত্বের অঙ্গীকার। হঠাৎ কেমন সব গুলিয়ে গেল। কিছু মানুষ বুদ্ধির বলে, কৌশলের বলে সব এলোমেলো করে দিয়ে ভাবল, এরকমটা চললেই তো বেশ হয়...চলুক এইভাবেই। কিন্তু তা হয় না। মানুষের সব চাইতে বড় শক্তি তার সহনশীলতা। তার শান্তিতে থাকার, সামঞ্জস্যে বাঁচার তাগিদ। সে ক্ষমতা নিজের ক্ষুদ্রতাকে জয় না করলে জন্মায় কি? তখন মনে হয় ওসব খুব কাপুরুষের কথা। কিন্তু ওই যে আছে না..."ধাইল প্রচণ্ড ঝড়, বাধাইল রণ - কে শেষে হইল জয়ী? মৃদু সমীরণ...."
সে মৃদু শুধু আস্ফালন করে না বলে। আদতে সেই চিরকালের পরম আশ্রয় মানুষের - বড় আমি। আমাদের মিলিত সামাজিক অ্যাকাউন্ট।