উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর পরই প্রত্যেক পাড়ায় একটা করে ফায়ারিং স্কোয়াড খোলা উচিৎ। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন, ফায়ারিং স্কোয়াড। যারা মোটামুটি সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়ে অথচ ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি, বা আশানুরূপ রেজাল্ট করতে পারেনি, যারা সামনের দিনে রাস্তায় ঘাটে ঘেয়ো কুকুরের মত মরে পড়ে থাকবে.... মানে যে গল্পটা শোনানো হচ্ছে... তাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া যাক। চালানো হোক গুলি।
ঠাঁই... ঠাঁই... ঠাঁই.... গগনভেদী শব্দ উঠুক.... পাড়াপ্রতিবেশি, রাষ্ট্র, সমাজ সবাই জানুক.... মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের অনেক অনেক অকৃতকার্য ছেলেমেয়েগুলো সমাজে আর নেই.... শান্তি তো!
একদম, এইভাবে তিলে তিলে না মেরে আসুন না আমরা এক কোপে সেরে ফেলি। তারপর না হয় একটা শান্তি পাঠের আসর হোক। কান্নাকাটি আর কদ্দিন, ওসব সয়ে যাবে।
হাজার হাজার বাবা মা আছেন, যারা সারাদিন পরিশ্রমের পরও সবটুকু প্রয়োজন মেটাতে পারেন না, তবু ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াচ্ছেন, ভালো স্কুলে পড়াচ্ছেন, ভালো টিউশান দিচ্ছেন…. তাও ভালো রেজাল্ট হচ্ছে না। হয় না। তাদের সংখ্যাটা অনেক অনেক বড়।
আর বাড়ির পরিস্থিতি অনেক সচ্ছল বলেই, তার রেজাল্ট ভালো হতেই হবে, এ সমীকরণটার সঙ্গে রাজী হওয়ার তেমন কোনো কারণ তো দেখি না।
বাড়ির পরিবেশ মানে শুধু টাকাপয়সাই নয়। অনেক জটিলতা। বাবা-মায়ের অশান্তি, নানা সাংসারিক জটিলতা তো আছেই। মানসিক অবস্থা সেও আছে।
আর সবার উপর আছে মেধা আর আগ্রহের সমীকরণ। বিষয়টা এত সরলীকরণ কি করে হয়ে যায় আমার তাজ্জব লাগে। একজন মানুষ, তাকে একটা নিয়মে ফেলে দেওয়া হল, একটা অথোরিটি ঠিক করে দিল, কি কি যোগ্যতার মাপকাঠিতে সে এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে। সবাই ঢাকঢোল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
এগুলো সবটাই বাস্তব। কিন্তু একটা বাচ্চার মানসিকদিক নিয়ে কোনো স্কুল, কোনো পরিবার, কোনো শিক্ষক শিক্ষিকার নিয়মিত খেয়াল রাখার কোনো পরিকাঠামো নেই। সুইসাইড করল তো চোখের উপর জ্বলে উঠে নিভে গেল, তারা খসার মত, কিন্তু প্রতিদিন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া বাচ্চাগুলোর মানসিক অবস্থার পর্যবেক্ষণের জন্য পরিকাঠামো নিয়ে আমাদের ভাবনা চিন্তার অবসর নেই। আমাদের স্পিডি ট্রেন দরকার, ঝাঁ চকচকে শপিংমল দরকার, গোটা জীবন ডিজিটালাইজড করার দরকার…. কিন্তু প্রতিটা স্কুলে নিয়মিত মনোবিদের, মনোবিশেষজ্ঞের দরকার যে, সেটা আমরা বুঝি না। বাচ্চাদের আবার ওসব কি?
একটা বাচ্চা কি চায়? কিসে সে কম্ফোর্ট ফিল করে? কিসে সে আনন্দ পায়, কি করতে তার ভালো লাগে…. এ সবের খোঁজ ক্যাডবেরি খাওয়ার মত সোজা না। এর জন্য একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষের দরকার হয়। প্রতিটা মানুষ যদি সম্পদ হয়, তবে সে সম্পদকে আকরিক অবস্থা থেকে যত্ন না নিলে অনেক অনেক সম্পদ যে হেলায় নষ্ট হয় সে আমাদের রাষ্ট্র কবে বুঝবে কে জানে! সোনা উৎপন্ন হয়ে গেলে তা দিয়ে গয়না বানানো এমন কি গৌরবের কাজ? আকরিককে চেনা আর তাকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিষ্কাশনের উপায় খোঁজাই বিবেচনার কাজ। দুর্ভাগ্য হচ্ছে আমরা পেষণের রাস্তা জানি, নিষ্কাশনের রাস্তা জানি না। আমরা বিশ্বাস করি বাচ্চাগুলো সরষের মত, ঘানিতে যত পেষা যাবে তত তেল বেরোবে। চালাও ঘানি, চালাও পেষণ….. বার করো তেল।
আমি জানি না আর কোন শিক্ষিত দেশে একটা পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পর এইভাবে তা নিয়ে ঢাকঢোল পেটানো হয়। দিনের পর দিন তা নিয়ে এমন সুক্ষ্ম থেকে সুক্ষ্মতর বিশ্লেষণ চলে। তিলকে তাল করে, সূচকে খাঁড়া করে কত কত নিরীহ, নিরপরাধ প্রাণকে বিপন্ন করে তোলে। তাদের অপরাধ, তাদের সামাজিক অথোরিটির চাহিদা অনুযায়ী মেধার অভাব, মেধার সঙ্গে আগ্রহের অমিল… আরো আরো অনেক ফ্যাক্টর আছে। কিন্তু আমরা তো বিজ্ঞানের রাস্তায় চলি না, আমাদের চালিকাশক্তি তো আবেগ!
কথাটা খানিক অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি, আমরা আজও বিশ্বাস করি অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকলে কিভাবে তার মেধাকে করুণার চোখে দেখে তাকে "পাইয়ে" দিতে হয়। সামাজিক পীড়ন, শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইটা, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পর যে শুধু রিজার্ভেশনের হাত ধরে হবে না, তার মাধ্যমে এক শ্রেণীর মানুষের মেধাকেই যে ঘুরিয়ে অপমান করা, সেটা আমরা মানতে নারাজ। রিজার্ভেশান নিয়ে যে আমাদের সত্যিই ভাবার সময় হয়েছে, তার যে প্রচুর অপব্যবহার হচ্ছে, সেটা আমাদের জেগে থাকা চোখে ধরা পড়লেও, আমাদের চেষ্টার দিকে হাত পা সরে না। তার কারণ আমাদের ওই অদ্ভুত অযৌক্তিক সমীকরণের অভ্যাস। যেমন চলছে চলুক।
কে কি রেজাল্ট করেছে, তার সঙ্গে তার বাবা মা কি করেন, এ গল্পটা জুড়ে এক অদ্ভুত কাহিনী সৃষ্টি কবে বন্ধ হবে? কবে বুঝব আমরা, এক বিশাল সংখ্যক বাচ্চাদের সামনে একপেশে এক আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য বলে চালানোর চেষ্টা করছি।
যারা নানাবিধ আর্থিক কষ্টের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে তাদের অবশ্যই অভিনন্দন, কিন্তু বারবার সেটাকেই হাইলাইট করা এক আংশিক সত্যকে পূর্ণ সত্য হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা। এ অন্যায়। অপরাধ। তার কৃতিত্বকে এভাবে ছোটো না করাই ভালো একপেশে করে দিয়ে।
দীর্ঘদিন শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় থেকে, দীর্ঘদিন সমাজের নানাস্তরের ছাত্রছাত্রীকে পড়িয়ে যা উপলব্ধি হয়েছে, ভালো স্কুল, ভালো শিক্ষক এগুলোর গুরুত্ব নিশ্চয়ই আছে নিজের জায়গায়, কিন্তু এর পরেও আছে বাচ্চার মেধা, মানসিক গঠন আর আগ্রহের জটিল সমীকরণ। মানুষ অমন একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক নয়। আর রইল ভালো পরিবেশের কথা, সেটা শুধুই আর্থিক সচ্ছলতার উপর নির্ভর করে কি? যিনি রিকশা চালান, কি বাজারে সব্জী বেচেন, তিনি রোজ মদ খেয়ে এসে বউকে মারেন, চীৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলেন, বাচ্চারা রাস্তার আলোয় পড়াশোনা করে…. এ যেমন একটা মিথ…. তেমনই সচ্ছল পরিবারের রাতদিন অখণ্ড শান্তি বিরাজ করে তপোবনের মত… এও মিথ।
প্রাচীন ভারত একদিন শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রমাণ করেছিল শিক্ষাদানের আর শিক্ষাগ্রহণের প্রধান শর্ত অর্থসম্পদ না…. সমমনস্কতা, সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ আর ভালোবাসা।
"ব্রহ্ম আমাদের উভয়কে সমভাবে রক্ষা করুন ও উভয়কে তুল্যভাবে বিদ্যাফল দান করুন; আমরা যেন সমভাবে বিদ্যালাভের সামর্থ্য অর্জন করতে পারি; আমাদের উভয়ের বিদ্যা সফল হোক; আমরা যেন পরস্পরের বিদ্বেষ না করি। ওঁ শান্তি শান্তি শান্তি।" উপনিষদের শান্তি পাঠ।