রাগ হতেই পারে। সে রাগের ন্যায্য কারণ থাকুক চাই না থাকুক। যদিও সব রাগেরই ন্যায্য কারণ নাকি সব সময় থাকে। রাগ মানে কি অসন্তোষ? তা তো নয়। আবার 'তা তো হয়' বললেই বা আপত্তি কি? রাগ মানে কি ক্ষোভ? রাগ মানে কি হতাশা? রাগ মানে কি অভিমান? রাগ মানে তবে ক্রোধ? রাগ মানে তবে অভিযোগ?
সবই যদি বলি? সেই ভালো। রাগের সাথে রাগারাগী করে আর লাভ কি? "ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে"... আহা কি সত্য কথা... কি কঠিন কথা! মাথার মধ্যে রাগের শব্দ আর ভালোবাসার শব্দরা পাশাপাশি বাস করে। এ পাড়া ও পাড়া মতন। যেন কত ভাব! ভাব তো আমাদের সাথে দুই পাড়ারই, যখন যাকে কাজে লাগে। বুকের মধ্যে এই তো ছিল উপবন। মৌমাছি গান গাহিতেছিল। পরীরা কলসি ভরে ভরে অমৃত সাপ্লাই করিতেছিল। মন্দমধু পবন সনসন করে বহিতেছিল। ব্রহ্মের সদ্য লন্ড্রী ফেরত ধুতির গন্ধে প্রাণটা মধুমধু হয়ে উঠতেছিল। সবই ঠিক চলিতেছিল, সহসা কি হইল?
এইটা বড় কঠিন কথা দাদা গো.. সহসা কি হইল... লোকে বলে নারী চরিত্র নাকি দেবতাও জানে না তো কি ছার্ মনুষ্য! কিন্তু ভাইরে মনের চরিত্রটিই বুঝি দুই দুগুণে চার? বুকের মধ্যে ছিল উপবন, হয়ে গেল ভিসুভিয়াস পলকেই। কিছু বোঝার আগেই উত্তপ্ত লাভা গরগর করে বেরোতে শুরু করল। প্রথম প্রথম চেপে রাখার চেষ্টা..... তারপর জিভের মধু বুকের তপ্ত লাভার তাপে শুকোতে শুরু করল... জিভের উত্তাপ বাড়তে আরম্ভ করল... তারপর? তারপর আর কি, রে রে রে রে! তবে রে হতচ্ছড়া ইস্টুপিট ঠেঙিয়ে তোরে করব টিট...
ভিসুভিয়াস জাগছে। চারদিকে ধোঁয়া ধোঁয়া হচ্ছে। বুদ্ধিটা কেমন গোল পাকায়ে পাকায়ে শূন্যের দিকে উড়ে যাচ্ছে। লাটাই ক্রমশ পাইপই করে ঘুরছে। বুঝছি এইবার থামতে না পারলে মহাবিপদ,পরে এর মেলা খেসারত দিতে হবে.. কিন্তু হলে কি হবে... অমন তপ্ত বুকেরও যে একটা সুখ আছে গো.. তারে ছাড়ি ক্যামনে। ভসভস... দুমদাম.. বোমা ফাটছে জিভে মাথায় বুকে। গলার পারা চড়তে চড়তে আকাশ ছুঁয়েছে, পাড়াপ্রতিবেশী বলছে নাকি কাকপক্ষী বসা দায় হয়েছে।.. আসলে যদিও এসব মিথ্যা কথা... আসলে তো আমার রাগ হয়েছে।
তো মাথার মধ্যে রাগের শব্দ আর ভালোবাসার শব্দরা মারামারি বাধিয়েছে। কিন্তু তাই কি? মাঝে মাঝে ভালোবাসার শব্দরাও রাগের পাড়ার শব্দ চুরি করে আনে। সে কথার সুর মিষ্টি। কিন্তু যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তার বুকে কুলের কাঁটা। বিছুটির জ্বালাপোড়া। প্রেমের শব্দরা অন্যপাড়া ঘুরে জিভের নাগালে এসেছে। চেনা কথা। চেনা শব্দ। চেনা মুখ। চেনা উচ্চারণ। চেনা চাহনি। তবু সব অচেনা। যেন মেন্ লাইনের গাড়ি ঘুরে কর্ড লাইনে। গন্তব্য এক। কিন্তু পথ ভিন্ন।
এতো গেল মিষ্টি রাগের কত। মুশকিল হল বিষাক্ত রাগের কথায়। যখন প্রেম নেই। মুশকিল কি জানেন, সংসারে মাছওয়ালার সাথে সব্জীওয়ালার প্রেম না থাকুক ক্ষতি নেই গো। উত্তর কলকাতার সাথে দক্ষিণ কলকাতার বিবাদ থাকুক, ক্ষতি নেই গা। কিন্তু বাপে মেয়ে বিষ ঢুকলে মুশকিল। ভাবছেন এ আবার কি কথার সাথে কি কথা পাড়লাম। বলছি ভেঙে।
সেই গুরগাঁও এর স্কুলটার কথা মনে আছে? আর মনে থাকবেই বা কি করে? সংসারে এতবড় সব ঘটনার মধ্যেখানে কে মনে রাখে কোন স্কুলে কোন বাচ্চাকে কোন ইলেভেনের দাদা বাথরুমে হত্যা করেছিল। কোন ক্রিকেটারের বিয়ে হানিমুন, গুজরাটে করা যেন এগিয়ে কারা যেন পিছিয়ে, দেশের এসব চিন্তা ছেড়ে এসব খুঁটিনাটি নিয়ে ভাবলে চলবে?
তবু বলি। কি তাজ্জব কথা দাদারা, সে ছেলেকে নিয়ে, মানে সেই ইলেভেনের ছেলেকে নিয়ে শিক্ষক শিক্ষিকা মহলে মেলা অভিযোগ গো! সে নাকি একবার স্কুলের জলের ট্যাংকে বিষ মেশানোর পরিকল্পনাও করেছিল। ওমা কি কান্ড হত বলুন? সারাদিন টিভিতে লাইভ ফুটেজ.. বাচ্চাদের সারিসারি মৃতদেহ.. মায়েদের আছাড়ি-পাছাড়ি কান্না.. আপনি চোখ মুছতে মুছতে টিভির সামনে এসে দাঁড়াচ্ছেন, ও মাগো বলে আর্তনাদ করছেন, মাঝে মাঝে চ্যানেল পাল্টিয়ে সিরিয়ালটা কদ্দুর এগোলো দেখে নিচ্ছেন, কিংবা খেলার স্কোরটা, আর নিউজ চ্যানেলের লোকেদের তো ছেড়েই দিন, তারা বাড়িতে ফোন করে বলে দিয়েছেন, আমায় কয়েকদিন কোনো ফোনটোন কোরো না বুঝলে, বিশাল TRP উঠবে এখন, অমুক চ্যানেলটা গতবার আমাদের থেকে বেশি ফুটেজ দিয়েছিল, এবারে ওদের আর চান্স দেওয়া যাবে না, আমাদের এডিটর বলেছেন, ভালো TRP এনে দিলে সপরিবার মরিশাসে এক হপ্তা, হুররে, বুঝলে?
তো সে ছেলের এ হেন পরিকল্পনার কথা শুনে আমার মটকাটা যা গরম হয়েছিল কি বলি, মনে হচ্ছিল দিক শালাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। কিন্তু একটা কথা সব ওলট পালট করে দিলে। সে নাকি সারাদিন বাপ্-মায়ের তুমুল ঝগড়াঝাটির মধ্যে বেঁচে থাকে, সে নাকি তার বাবা মা কারোর হৃদয়ের উষ্ণতা পাইনি, কারোর সাথে তার নৈকট্যের সম্পর্ক না গো। ভালোবাসা না পেলে একটা রাস্তার কুকুরই শুকিয়ে যায়, খেকুটে হয়ে যায়, আর এতো মানুষের বাচ্চা। ভাবছেন কি আদিখ্যেতা আমার না? একটা খুনিকে নিয়ে? আসলে তা নয় জানেন। আমি এই ছেলেটার কথা ভাবছি না। আমি ভাবছি আগামী যে খুনীগুলো আমাদের অহং এর তপ্ত তাওয়ায় সেঁকে এই সমাজে ছেড়ে দেব, তাদের কথা।
প্রেম না থাকুক। ভালোবাসা না থাকুক। বিষটাকে কি কিছুতেই এড়ানো যায় না? একটা understanding বলেও তো প্রক্রিয়া আছে সম্পর্কটাকে বাঁচিয়ে রাখার। তাতেও যদি না মেতে কাউন্সেলিং করা যায় না? সব সমাধানের পথ যে আমাকেই জানতে হবে তার কে মাথার দিব্যি দিয়েছে বলুন? কত প্রফেশনালসরা তো আছেন আপনার কথা শুনবেন বলে, আপনার আমার মনের অশান্তির ফিকিরগুলো খুঁজে খুঁজে আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলবেন, এগুলোকে আর বাড়তে দেবেন না। যেমন করে মানুষ শখের বাগানে আগাছাকে দূরে রাখে। সেকি আগাছার প্রতি ঘেন্নার জন্য না গোলাপের স্বাস্থ্যের জন্য? এটা ভাবার দায় যে নিজেদেরই নিতে হবে। নিজেদের জন্য না, গোলাপটার জন্য।
ছেলেটার কি শাস্তি হবে জানি না। কিছু একটা অবশ্যই হবে। আমি ভাবি ওই বাবা মায়ের কোনো সাজা কোনোদিন হবে না। কেউ তাদের কোনো প্রশ্ন করবে না। এই সমাজটার চারদিকে এত অসহিষ্ণুতা, এত বিষাক্ত জমাজলা, সে নিয়ে কেউ কোনো কথা বলবে না। ঘরে নারায়ণ পুজোর আয়োজন হবে, জ্যোতিষীর কাছে ছেলের মাথা ঠাণ্ডা হওয়ার পাথর, মাদুলি কেনা হবে। কার্পেটের নীচে ধুলো জমতেই থাকবে, জমতেই থাকবে, তবু পরীক্ষিত, বৈজ্ঞানিক উপায়ে সমাধানের পথে হাঁটার চেষ্টাটা হবে না, আরো আরো বেশি বেশি আলোচনা হবে না। এরকম আর কদ্দিন চলবে?
সৌরভ ভট্টাচার্য
21 December 2017