আগে বেড়াতে না গিয়ে বেড়াতে যাওয়ার স্বাদ মেটাত ভ্রমণ কাহিনী। এখনও মেটায়। তবে এখন আরেকটা স্বাদ নতুন যোগ হয়েছে। নানা মানুষের বেড়াতে যাওয়ার ভিডিও। কী চমৎকার সব ভিডিও করেন। দেশের নানা জায়গা তো আছেই, আরো আছে বিশ্বের নানা অজানা ছোটো-ছোটো জায়গার ভিডিও। ট্রেন জার্নির উপর আমার ভীষণ আকর্ষণ। অনেকে কী ডিটেইলসে সে ভিডিওগুলো বানান। আগে ভাবতাম বোধহয় আমার একারই কি এই পাগলামি ট্রেন নিয়ে? এখন দেখি, না তো, অনেকেরই এ নেশা আছে। যেমন ট্রেনের কোচ কম্বিনেশন কেমন, কবে প্রথম চালু হয়েছিল, কোন মডেলের ইঞ্জিন টানে, কোন কোন ট্রেনের সঙ্গে রেক শেয়ারিং হয়, কী ধরণের কোচ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রচুর কৌতুহল আমার ট্রেন নিয়ে। আগে ভাবতাম বুড়ো হলে কমবে, এখন দেখছি উলটো, যত দিন যাচ্ছে আরো বাড়ছে।
আমি আগেও কোনো একটা লেখায় লিখেছিলাম, ভারতকে জানতে হলে রেলস্টেশানে এসো, মন দিয়ে দেখো, সময় কাটাও। সমাজের কত কত শ্রেণীর মানুষ। কত মানুষের তো জন্ম থেকে মৃত্যু স্টেশানেই কেটে গেল। একবার একজন স্টেশানবাসী মানুষের ঠাকুরঘরও দেখেছিলাম প্ল্যাটফর্মের এক কোণায়। পিজবোর্ড দিয়ে বানানো। তার মধ্যে মহাদেবের ছবি। সঙ্গে ক'টা ফুল। দু হাত জড়ো করে প্রণাম করেছিলাম, আজও করি মনে এলেই। করব না? চারদিকের এত চঞ্চলতায়, এমন প্রাচুর্যের মধ্যে, এমন স্থির কৈলাস, কী কাশী যে নির্মাণ করতে পারে সেকি সামান্য মানুষ?
অনেকেই কী যত্নের সঙ্গে ভিডিওগুলো বানান। লাইক করি। সাবস্ক্রাইব করি। উদাস হই। কতটুকু জীবন, কত স্বল্প জানা হল। ট্রেন ছাড়ে, আমি আমার অলিখিত সিটে সেই ভিডিও নির্মাতার সঙ্গে বসি। ট্রেন হাওড়া, কি শিয়ালদা, কি কলকাতা, শালিমার ছেড়ে বেরোয়। মন কেমন করে ওঠে, এক উত্তেজনা হয়, নতুন জায়গা, নতুন অভিজ্ঞতা। ভিডিও নির্মাতা দেখিয়ে চলেন, আমি দেখতে দেখতে ভেসে যাই, ডুবে যাই।
ভিডিওর আরো যে জিনিসগুলো ভালো লাগে সে হল তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসকেও সামনে আনা। যে মন একটা প্যাটার্নে সব কিছু দেখতে অভ্যস্ত সে বলে ধুর, এসব কেন বলছে, দেখাচ্ছে? কিন্তু যদি নিজের দিকে তাকাই, ভ্রমণ পিপাসু মনের সঙ্গে সঙ্গেই কী আরেক মন ঘোরে না? যে ঘরের কোণার জন্য হাপিত্যেশ করে চলতে চলতেও? পাহাড়ি রাস্তায় চলতে চলতে কোথাও গাড়ি দাঁড়ালো। ছোটো একটা দোকান। দোকানের সঙ্গেই লাগোয়া বাড়ি, তার পাতানো সংসার। এদিকে যেমন চায়ের জল ফুটছে, ম্যাগির প্যাকেট ছিঁড়ে থালায় রাখা আছে, তেমন পাশের ঘরেই একটা বাচ্চা শুয়ে খাটে, বই পড়ছে, বাড়ির গৃহিণী রান্না চাপিয়েছে। ঘরের মধ্যে একটা আলমারি, ক্যালেন্ডার, জানলার উপর রাখা টুকিটাকি কৌটোবাটি, ব্রাশ, মাজন। জানলার ওপারে সবুজ পাহাড়। গৃহিণী মাঝে মাঝে পর্দা উড়িয়ে দোকানে আসছে, আবার ঘরে যাচ্ছে। তখন পথিক মন আবার ঘরের জন্য ছটফট করে না? সে বলে না, আমিও ফিরব, আমার জন্যেও অপেক্ষা করছে একটা শান্তিমাখা পৃথিবীর অতি তুচ্ছ কোণা।
খাওয়া হল, দোকানের বাইরে রোদে এসে দাঁড়ালাম। একটা ছোটো ফুলগাছ। সে গাছে যত্নের হাতের ছাপ। চোখে তো পড়ে? ঠিক যেমন চোখে পড়ে দুটো লাইনের মাঝে জন্মানো নামগোত্রহীন একটা ছোট্টো জংলী গাছ। ট্রেনটা মাঝ রাস্তায় সিগন্যাল না পেয়ে দাঁড়িয়ে। চারদিকে জঙ্গল। পড়ন্ত রোদ বলে, “হাম কো মিলি হ্যায় আজ, ইয়ে ঘড়িয়া নসীব সে/ জী ভরকে দেখ লিজিয়ে হাম কো করীব সে/ ফির আপ কে নসীব মে ইয়ে বাত হো না হো/ শায়দ ফির ইস জনম মে মুলাকাত হো না হো”.....
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে এক অদ্ভুত তত্ত্ব শিখিয়েছেন। একজন আট বছরের শিশুর চোখে দেখা হাওড়া স্টেশানের বয়সও তো আট বছর। আবার তার পঞ্চাশ বছরের হাওড়া স্টেশানের বয়েসও পঞ্চাশ বছর। এভাবেই তো আমরা দেখি না? যা দেখি আর যা মনে থাকে, সেকি আমার হাতে? কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ মুহূর্তেরাই ভ্রমণের স্মৃতি আটকে থাকে। অসংলগ্ন স্মৃতি। ছাড়া ছাড়া দৃশ্য। কিন্তু সম্পূর্ণ দৃশ্য। তার মানে নেই। কিন্তু অস্তিত্ব আছে।
আমার ক্ষুদ্র “আমি” কী অনায়াসে হাওড়া স্টেশানে এসে দাঁড়ালেই ছেড়ে যায়। কোনো মন্দির না, কোনো মন্ত্র না, কোনো মহাপুরুষের সঙ্গ না, কোনো দেবতার ধ্যান না। শুধুমাত্র হাওড়া স্টেশান। সব বদলে যায়। কোথায় নিজেকে নিয়ে ভাবনা চিন্তার অবসর তখন। এই যে সামনে, এ কী! এই তো জনসমুদ্র। এতে ডুব দেব না? এতে ডুব না দিয়ে অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে শুদ্ধ হতে চাওয়া নিতান্ত পাগলামি। মনের দুষ্টুমি। ফাঁদ সে। দরকার কী?
যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, মনের মধ্যে মনের বন্দীদশা ঘোচাতে এইসব ইউটিউব চ্যানেলগুলো আমার কাছে আশীর্বাদ। বইয়ের পাতার থেকে বেরিয়ে সামনে সচল ভ্রমণের ধারাভাষ্য। শুধু শব্দের তো না, চোখেরও তৃপ্তি। প্রাণের দরজা খোলা অজানার দিকে।