সৌরভ ভট্টাচার্য
16 March 2018
মানুষ বাঁচে তিনটে রহস্যময়তায় --- অসীম আকাশ, অনন্ত সময় আর তার রহস্যময় অন্তঃকরণে। এই তিনটেকেই সে অল্পবিস্তর জানে।
যা জানে না তার কোন সীমা-পরিসীমা নেই। তার মধ্যে রাতদিন একটা অমীমাংসীত রহস্যের টানাপোড়েন। অথচ এই টানাপোড়েনের আয়ু অনন্ত নয়। তার চারপাশে অহর্নিশি যবনিকা পতনের আওয়াজ --- মৃত্যু। মৃত্যু মানে কি সময়? মৃত্যু মানে কি পরিবর্তন? মৃত্যু মানে কি শূন্যতা? বাইরের দিকে তাকিয়ে সে বলে, হয়তো তাই, শূন্যতা। নিজের ভিতরের দিকে তাকিয়ে মনে হয় সত্যিই কি শূন্যতা?
তার সারাজীবন এই তিনটে অনাদি স্রোতের তীরেই কাটে। এর বিপরীতে তার ক্ষিধে, তেষ্টা, ভয়, লোভ, যৌনতা --- সে-ও আছে। তারা প্রশ্ন করে না। তারা আদিম দাবী নিয়ে ফেরে। মিটলেই শান্তি। নইলে উৎপীড়ন। পৃথিবীর ইতিহাসে সক্রেটিস, বুদ্ধ, রামানুজ... গ্যালিলিও, কোপারনিকাস, নিউটন, আইনস্টাইন, হকিন্স –এর পাশাপাশি হিটলার, মুসোলিনী, স্তালিন, চেঙিজ খাঁ --- এরাও আছে। একদল প্রশ্ন করে, উত্তর খোঁজে; আরেকদল নিজের প্রবৃত্তির নৈতিক অনৈতিক যাবতীয় তৃপ্তিসাধনে মত্ত।
দিনের শেষে দু’জনেই অতৃপ্ত। না তো মেলে সব প্রশ্নের উত্তর; না তো হয় সব লোভের, সব বাসনার উপশম। মাঝামাঝি যারা তারা সমাজ বানিয়েছে, হাজার নীতি বানিয়েছে, প্রথা বানিয়েছে; তাতে নিজেকে শৃঙ্খলায়িত করে জীবনের একটা অর্থ দাঁড় করিয়েছে, সে অর্থ তার দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। সে তারার গতি নিয়ে ভাবে না, সে সময়ের সংজ্ঞা খোঁজে না। নিজেকে পারিবারিক তথা সামাজিক দায় দায়িত্বের বাইরে নিয়ে গিয়ে চিন্তা করে না। তারা সুখী। কারণ, প্রশ্ন আর প্রবল প্রবৃত্তি - দুটোই তাদের মধ্যে তেমন প্রবল না। তাই তাদের উপশমেরও কোন ব্যস্ততা তাদের নেই। তার জীবন মানে - আত্মরক্ষা, পরিবার রক্ষা, কিছু সমাজস্বীকৃত বাসনা পূরণ আর বাকিটা দায়িত্ব কর্তব্যের ঘরে টিক মার্ক দিতে দিতে চলা প্রাণপণ চেষ্টায়, কোনটায় যাতে ক্রশ না পড়ে। যদি পড়ে তবে সামাজিক মানসন্মানের অধঃপতন। যদি বা কখনও কোন প্রশ্ন মাথা তোলে তার জন্য রেডিমেড প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম-দর্শন-গুরু-আশ্রম-পূজো-যজ্ঞ রইলই। চিন্তা করার ক্ষমতা একটা জীবাণুর মত, যখন সারা মাথা ছড়িয়ে পড়ে, যাকে ‘মেটাস্টেসিস’ বলা যায়, তখন তার থেকে পাগল অথবা প্রতিভাসম্পন্ন স্বীকৃতি না পেয়ে বেরিয়ে আসার জো নেই। যদি সে প্রশ্নের সামাজিক স্বীকৃতি মেলে তবে তুমি প্রতিভাসম্পন্ন; যদি না মেলে তবে পাগল। ইতিহাসে বহু পাগলের শতাব্দীশেষে প্রতিভাসম্পন্ন বলে স্বীকৃতি পাওয়ার উদাহরণ ভুরি ভুরি। আবার বহু পাগলের ব্যর্থ জীবনের উপর কালের পলিস্তর।
প্রশ্ন একটা জীবাণু। একটা সংক্রমণ। পৃথিবীর ইতিহাস বলতে কিছু প্রশ্নের আর কিছু প্রবৃত্তির আলোড়ন আর উৎপীড়নেরই ইতিহাস। বাকিটা তো গয়ংগচ্ছ। লোভীদের ইতিহাস, মানে যাকে প্রবৃত্তি বললুম, তাদের কীর্তিকলাপ সারা পৃথিবী জুড়ে মোটামুটি একই রকম। চুড়ান্ত ধ্বংসলীলা, আত্মস্থাপন - “স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে”, এই মোটামুটি। কিন্তু প্রশ্নের ইতিহাস বৈচিত্র্যময়। সক্রেটিস যখন প্রশ্ন করছেন ‘আমি কে?’; নিউটন যখন প্রশ্ন করছেন, ‘আপেল কেন মাটিতে পড়ল?’ --- সে একরূপ। আবার কখোনো কখোনো প্রশ্ন একটা সুনির্দিষ্ট রূপ না নিয়ে একটা বাধা হয়ে বারবার চিন্তার সামনে এসে দাঁড়াতে থাকে। সে বাধাটাকে ঠেলতে ঠেলতে আপেক্ষিকতাবাদ, ব্ল্যাক হোল থিওরী ইত্যাদির মতন তত্ত্বরা সামনে এসে দাঁড়ায়। তবু রহস্য ঘোচে না। যদি কেউ বলে, রহস্য বলে সংসারে কিছু নেই, তবে তার বোধের ক্ষমতার উপর সন্দেহ জাগে। রহস্যকে রহস্য বলে জানা, জ্ঞানপিপাসু’র অনুভব; রহস্যকে দুর্ভেদ্য অনড় প্রাচীর বলে জানা আত্মসুখীর আত্মপ্রবঞ্চক দর্শন। প্রশ্নের প্রতি দায়বদ্ধতা, সুখের প্রতি দায়বদ্ধতা আর লোভের কাছে বশ্যতা --- তিনটে শ্রেণী পুরাকাল থেকে চলে আসছে। মানুষ, দেবতা, অসুর। সংসারে যা কিছু প্রশ্নের উৎস ছিল মানুষ, দেবতা নয়। জগৎ সংসারকে দু’হাতে চিরে তার রহস্য ভেদ করতে চেয়েছে মানুষ। দু’হাতে নিংড়ে ভোগ করতে চেয়েছে পশু। আর আরামের খোঁজ করেছে দেবতা। ঈশ্বর থেকেছেন চিরকাল রহস্যাবৃত, অসীমের দ্যোতনা হয়ে।
প্রশ্ন তবে জীবাণু। প্রশ্নকর্তা তবে সংক্রামিত। সংক্রমণ যত গভীর তার উন্মত্ততা তত তীব্র। প্রশ্নের সাথে সুখের সহাবস্থান হয় না। প্রশ্নের কোন আয়ুস্কাল হয় না। প্রশ্নরা রক্তবীজের মতন। একটা পড়ে অসংখ্যকে জন্ম দেয়। একের সংক্রমণ আরেকে ছড়ায়। প্রশ্নরা ঘুমায় না। ঘুমাতে দেয় না। প্রশ্নকর্তা ঘুমিয়ে পড়লে প্রশ্নেরা অপেক্ষা করে মাথার কাছে। প্রশ্নরা সুখী নয়। প্রশ্নরা সুখী হতে দেয় না। কারণ, প্রশ্নই সুখ, প্রশ্নই আনন্দ, কিন্তু কার কাছে?
রাস্তা তো অনেক রকম। একদিকে খাদ, আরেকদিকে পাহাড়ের ঢাল; একদিকে সবুজ মাঠ, আরেকদিকে নদী; দু’ধারে জঙ্গল, দু’ধারে মরুভূমি, কিম্বা সরু আল, দু’দিকে চাষের ক্ষেত --- রাস্তা কখোনো কখোনো সাঁকোর সামনে দাঁড় করায়; আবার কখোনো কখোনো সাঁকো বানিয়েও নিতে হয়, কারণ, চলাটা অব্যহত রাখতে হয়। এই সমস্ত পথের অভিমুখ আপাত দৃষ্টিতে বিকেন্দ্রিত মনে হলেও, চলতে চলতে এক পথের সাথে আরেক পথের দেখা হয়। পথে পথে জাল বোনা হয়। সমস্ত জাল জুড়ে একটা বৃত্ত রচনা হয়। সেই বৃত্তের উপলব্ধিতে পথিকের চলার অবসান হয়। পথের প্রান্তে কোন গন্তব্যে পৌঁছে নয়, পথকেই উপলব্ধি করে। বলা হয়, একটা সরলরেখাকে ক্রমাগত টানলে তা না কি একটা বৃত্ত হয়। কেউ তো টেনে দেখে নি, উপলব্ধি করেছিল। সমস্ত উপলব্ধি মানে বৃত্ত সম্পূর্ণ করা। বৃত্ত সম্পূর্ণ হওয়া মানে সব শেষ হওয়া না, কেন্দ্রে বসবাস করা। কেন্দ্র একটা স্থিতাবস্থা নয়, কেন্দ্রটা সাম্যাবস্থা। যুগে যুগে কেন্দ্র প্রতিস্থাপিত হয়, সবকিছু নতুনভাবে শুরু হয়। পুরোনোগুলো অপেক্ষা করে আবার তারা নতুন হবে বলে। কারণ, যুগের গতিপথও একটা আবর্তন। নাগরদোলা যেখান থেকে উঠিয়েছিল যেমন সেখানেই নামিয়ে দেয়; ওঠা আর নামার মধ্যে পার্থক্য থাকে একটা বৃত্তের অভিজ্ঞতার – এও তেমন।
কথা হচ্ছিল প্রশ্ন নিয়ে। প্রশ্নরা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হতে হতে একটা বৃত্ত তৈরী করে। সে বৃত্তেরও একটা কেন্দ্র থাকে। সে প্রশ্নও নয়, সে উত্তরও নয়। সে কেন্দ্রে পৌছানোর অধিকার একমাত্র দর্শনের। প্রশ্নের পিছনে শুধু কৌতুহল থাকলে তা স্বার্থ, প্রশ্নের পিছনে বিস্ময় থাকলে তা দর্শন। বিস্ময়ের উত্তর যদি বিস্ময়কেই স্তিমিত করে তবে তা উত্তর নয়, তা মতামত। বিস্ময়ের উত্তর যদি আরোও গভীর বিস্ময়ে এনে দাঁড় করায় তবে তা দর্শন। যার শেষ কথা, কিম্বা শুরুর কথা, ‘আমি জানি, আমি কিছুই জানি না।’ শেষের কথা শুরুর কথা হয় কি করে? ঐ যে বললাম, বৃত্ত। দু’জনে পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে, একজন পুবের দিকে তাকিয়ে, আর একজন পশ্চিমে। পুবের পথিক রিক্তহাতে যাত্রা শুরু করে, যাত্রাপথে হাতে ভরে ওঠে নানা সম্পদ, অর্ঘ্য। যাত্রাশেষে পশ্চিমে আসে আবার রিক্ত হয়ে। রিক্ত না হলে পশ্চিমমুখী দুয়ারে আসা যায় না। পশ্চিমমুখী দুয়ারে প্রবেশ করে দেখে, তার পাশেই পুবমুখী দুয়ার। বৃত্ত সম্পুর্ণ হয়। একটা সক্রেটিসের জন্ম হয় - 'আমি জানি আমি কিছুই জানি না'।