রামমোহন রায়কে নিয়ে স্টেটসম্যানে রবিবার (01/08) এবং সোমবার (02/08) -- এই দু'দিন ধরে ভালো একটা আর্টিকেল বেরোলো।
ভারতের ঈশ্বর চেতনা নিয়ে আলোচনা নেই সেখানে। থাকার কথাও নয়। তবে লেখকের ঈঙ্গিতটা বেশ স্পষ্ট। উপনিষদকে কেন এতটা গুরুত্ব দিলেন রামমোহন রায়। আমাদের সমাজে সেদিন যত কুসংস্কার ছিল, সেসব যে সে উপনিষদজাত নয় তাও দেখিয়েছিলেন।
কথাটা অবশ্যই সম্পূর্ণ সত্য নয়। কোনো সৃষ্টিই সমাজের অভ্যাসের আর বোধের সীমাকে ছাপিয়ে পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে পারে না। তাই উপনিষদেও এমন কিছু কথা নিশ্চয়ই আছে যা উদার মানবিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটাকেই সব ধরে বসে থাকলে সমস্যা।
উপনিষদের চেতনা অবশ্যই মানব মনের বিকাশের এক উচ্চতম শৃঙ্গ। নইলে শোপেনহাওয়ারের মত অমন তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন মানুষকে তা স্পর্শ করত না। আমাদের সভ্যতার নবজাগরণের উন্মেষও তো ঘটল উপনিষদের বোধের মাধ্যমেই। বলা যেতে পারে নব বেদান্তের যুগের যেন সূচনা হয়েছিল।
উপনিষদ ততটা সৃষ্টি রহস্য নিয়ে কথা বলে না, যতটা অস্তিত্বকে প্রশ্ন করে। উপনিষদে অনেক বিষয় আছে। আমি যে অংশটুকু নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক তা হল - সৎ চিৎ আনন্দ বা 'সচ্চিদানন্দ' শব্দটিকে নিয়ে।
রামকৃষ্ণের ভাষায়, বেদে বলেছে সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম। পুরাণে বলেছে সচ্চিদানন্দ কৃষ্ণ। তন্ত্রে বলেছে সচ্চিদানন্দ শিব। এই সচ্চিদানন্দের ভুমা প্রকাশের সংকেত বেদ বলছে, ওঁ।
এই 'সচ্চিদানন্দ' কি তবে?
প্রথম কথা - সৎ। এর প্রথম অর্থ - আছে। মানে হ্যাঁ। অস্তি।
আছে তো আমিও জানি। আমি আছি। জগৎ আছে। আমার সঙ্গে এই জগতের একটা ভৌত সম্পর্ক আছে। শুধু কি এইটুকু? আর কিছু নেই?
আছে। আমার মন আছে। সে শরীরের থেকে আলাদা ব্যবহার করে। সে নিজের মত সুখ চায়। সে কার্যকারণে ডুবে নিজের অস্তিত্বের মূলকে জানতে চায়। কিন্তু পায় না।
উপনিষদ বলবেন, ওভাবে পাওয়া যায় না। তিনি তর্কের দ্বারা, মেধার দ্বারা, বাক্যের দ্বারা, মনের দ্বারা লব্ধ নন। তিনি যাকে বরণ করেন সে পায়।
সে কিরকম? তার সাধন কি?
উপনিষদ বলবেন, প্রথমে শোনো সমস্ত সংসার ঘিরে পরম এক অস্তিত্ব আছে। এ কথা বারবার শোনো। আর জানো যে সে অস্তিত্বের আভাস তোমার হৃদয়ে আছে। এ কথা বারবার ভাবো। আরো এগোও। সে অস্তিত্বের আনন্দে তোমার চিত্তের গভীরে সুখের মাণিক্য লুকিয়ে আছে। একে ধ্যান করো।
তবে কি দরজায় খিল দেব?
না। এইখানে আমাদের মস্ত এক ভুল হয়। আমাদের অল্পভাসে মনে হয় ফোনের মধ্যে যেমন সিম ভরা থাকে, তেমন আমার মধ্যে এক আত্মা বলে কিছু ভরা আছে। এ ভুল ধারণা।
আমার আমি বোধের মধ্যে যে অনুকম্পা আছে, অনির্বচনীয়, অনির্দিষ্ট যে অনুকম্পার বোধ আছে- সেই সে। কি করে বোধের মধ্যে আসবে?
একজন দুঃস্থ মানুষের মুখ কল্পনা করলে, বা রাস্তাঘাটে একজন অসহায় মানুষকে দেখলে যে যন্ত্রণা আমি অনুভব করি, সেই যন্ত্রণাই সে। কারণ সে আমার শরীরজাত নয়। আমার চিত্তের গভীরের কোনো ইঙ্গিতজাত। সে ইঙ্গিতের উৎস কেউ কোনোদিন জানতে পারে না। কিন্তু তার অস্তিত্ব অনুভব করে মানুষ। যেখানে যেখানে সে তাকে স্বীকার করে, সেখানে সেখানে সে সার্থক, সুখী, আনন্দময়; যেখানে যেখানে তাকে অস্বীকার করে মানুষ, সেখানে সেখানে সে ভীত, সন্ত্রস্ত, বিকারগ্রস্ত, দীন, অসুখী। শরীরের সুখের মাত্রা বাড়িয়ে চিত্তের সুখের বিকল্প খোঁজা মূর্খামি। তবে আর এত দীর্ঘ অভিব্যক্তির পথের দরকার হত না।
উপনিষদ মানুষের জীবনের সার্থকতা ঘোষণা করছেন একটি বাক্যে - যখন সমস্ত জগতকে নিজের মধ্যে ও সমস্ত জগতের মধ্যে নিজেকে অনুভব করা যায় তখনই সে মানুষের জ্ঞান পূর্ণতা পেয়েছে বলা যায়।
এই মানুষের আত্মদর্শন। আত্মদর্শন মানে টিভিতে যেভাবে দেখায় সেরকম নিজের মধ্যে ষাট ওয়াটে জ্বলা কোনো দিব্য এল.ই.ডি. বালবের দর্শন না। সহস্র ওয়াটে জ্বলা পাশের মানুষটাকে অনুভব করার ক্ষমতা। এ ক্ষমতাকে এত বিস্তৃতভাবে সেদিন দেখতে চাওয়া হয়েছিল বলেই মনুষ্যেতর প্রাণী থেকে শুরু করে বৃক্ষ-লতা-গুল্ম, নদ-নদী, সমুদ্র, আকাশ-বাতাস - সবার কথাই বলা হয়েছিল। যখন বলা হল এ দেহ পঞ্চভূতে গড়া, তখন 'কি বলা হল' থেকে যদি ভাবি 'কি বলতে চাওয়া হল' তবে তার অর্থ আরো স্পষ্ট হয়। উপনিষদ বলতে চেয়েছিলেন যে আমাদের যাবতীয় যা কিছু এই জগত থেকেই আহরিত। নিজেকে পৃথক অস্তিত্ব ভেবে যেন ভ্রমে না পড়ি। পঞ্চভূতে গড়া এ অস্তিত্ব চেতনার সমুদ্রে ক্ষণকালের জন্য। উপমা দেওয়া হচ্ছে, যেন সমুদ্রের তলায় রাখা এক পাত্র। যার মধ্যে জল, বাইরে জল। তবু এক আকারগত অস্তিত্ব।
এই 'চিৎ' বা 'চিদ্' মানে বলতে তবে বুঝি জ্ঞান, বা জানা। ততটা জানা নয়, যতটা জানার ক্ষমতা। আমাদের মধ্যে এ জগতকে জানার ক্ষমতা দেওয়া আছে। নইলে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রকে জানতাম কি করে? এরকম হাজার একটা জটিল সূত্রকে জানি কি করে? ওই চিৎ বা চিদ তত্ত্বের জন্য। অর্থাৎ, আমাদের জানার ক্ষমতা আছে। সে অসীম নয়। তাকে সামনের দিকে ছুটিয়ে আমরা যা পাই তাই জাগতিক নানা রহস্যের সমাধান। আবার সেই জানার ক্ষমতাকেই তার উৎসের দিকে ফিরিয়ে দিয়ে আমরা করি প্রজ্ঞার অনুসন্ধান। যা মানুষ কোনোদিন পায় না। কিন্তু বোধের মধ্যে এক গভীর অনাদি বোধের অস্তিত্বের আভাস পায়। যাকে সে সার্বজনীন বলে অনুভব করে। তাই সারাজগতে 'মানবধর্ম' বলে এক ধর্মকে আধুনিক মন আবিষ্কার করে ফেলেছে। যার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের নানা অধিকারগত আইন। বন, জল, মাটি, বায়ু, প্রাণী ইত্যাদি যা কিছুকে আমরা সংরক্ষণ করতে চাইছি সে আমাদের লাভের জন্য না। এগুলো কোনোভাবেই আমাদের ইনভেস্টমেন্ট নয়। এগুলো আমাদের ঔচিত্যবোধ।
আর রইল আনন্দের কথা। যত পুরাণ বা ঈশ্বরের নানা গল্প, উপকথা ইত্যাদি, তার উৎস এই আনন্দ। এমন এক আনন্দ যা আমার দেহনির্ভর নয়। সে আমার চেতনায় আমার বোধে সজীব। সেই আনন্দ। যে আনন্দকে ভেঙে আবার বলা যায়, আমাদের মধ্যে এক চিত্তগত সুখ পাওয়ার ক্ষমতা আছে। আমরা শিল্পে, বিজ্ঞানে, নানা আবিষ্কারে, নানা সৃষ্টিতে সুখ পাই। আমরা নানা আইডিয়া, নানা কল্পনায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে, এক বিমূর্ত অস্তিত্বে সুখ পাই। আমাদের মধ্যে সে ক্ষমতা আছে। অন্যকে আঘাত করলে সে আঘাতে সমস্ত অস্তিত্বের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। আমাদের চেতনা স্বার্থে কুয়াশাচ্ছন্ন হয়। আমাদের আনন্দ সরে গিয়ে আসে লোভ, উন্মাদনা। পৃথিবীর যত সাহিত্য আছে, সব সাহিত্যেই তাই বীর যারা তারা সর্বাঙ্গীণ অস্তিত্বকে রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে চেয়েছে বলেই তারা বীর। সেদিনের 'দন কিহোতে' থেকে আজকের 'বাহুবলী' অবধি, প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সব সাহিত্যে বীরেদের কাজ একটাই। এর অন্যথাকে আমরা দুর্বলতা বলি।
এইভাবে সত্যে, চেতনায় আর আনন্দে মহত্বকে অনুভব করার ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ পরম সত্তাকে নাম দিয়েছে - অনন্ত। অনন্ত মানে যার শুরু আর শেষ নেই নয়, অনন্ত মানে যার মধ্যে অনন্ত শুরু আর শেষ। তবু কিছু যা বাকি থাকার তাই থেকে যায়, এবং তা হল সবটাই। ভর ও শক্তি যেমন নিত্য। এও তেমন নিত্য। আবার প্রতি মুহূর্তে কালের খণ্ডে খণ্ডিত। যেমন যে ছাত্র ইতিহাস ক্লাসে বাবরের জীবনী পড়ছে, সেই ছাত্র যখন জীববিজ্ঞানের ক্লাসে মানুষের বিবর্তন পড়ছে তখন বাবর বা আকবরকে আলাদা করে খুঁজে পাচ্ছে না; আবার যেমন যে ছাত্র ভুগোল পড়ছে সেই যখন রসায়ন বা পদার্থবিদ্যা পড়ছে তখন আলাদা করে দেশের সীমা-পরিসীমা খুঁজে পাচ্ছে না; আবার যে ছাত্র সাহিত্যে নানা চরিত্রের কথা পড়ছে, সেই যখন মনোবিজ্ঞান পড়ছে তখন সে আর আলাদা করে কোনো চরিত্রর নাম খুঁজে পাচ্ছে না। এও তেমন। মাটির মধ্যে পুতুল হওয়ার ক্ষমতা আছে বলেই সে আমার ইচ্ছায় সাড়া দেয়। এই হল মূলতত্ত্ব।