অ্যাদ্দিন মদনভস্মের গপ্পো পড়েছিলাম। শিবের ধ্যান ভাঙাতে মদন এয়েচিলো। যেই না একটা তীর মেরেচে কি মারেনি, অমনি গেল মহাদেবের ধ্যান ভেঙে। ব্যস, এমন ক্ষ্যাপা ক্ষেপলেন, দিলেন ভস্ম করে মদনদাকে। তারপর তো রতি, মানে মদনের বউ, অনেক আপিল টাপিল করে সিদ্ধান্ত হল, মদন থাকবে অনঙ্গদেব হয়ে। মানে মদনদা থাকবে, কিন্তু শরীর থাকবেনিকো। মানে নো অঙ্গ, অর্থাৎ অনঙ্গ।
তো এই হল গিয়ে আমাদের পুরাণের গপ্পো। আজ আর সে পুরাণ নয়, এক্কেবারে পরাণ পুড়িয়ে অনুভব করছি গো। সদ্য বসন্ত গেল। পলাশ ফুটল, শিমূল ফুটল। চারদিক লাল লাল হল। আবীর নিয়ে দোলটোল খেলা হল। বেশ একটা প্রেম প্রেম ভাব, মানে অনঙ্গদেবের নানা অঙ্গে আগমনের সময়। কিন্তু একি! তা বলে চল্লিশ ডিগ্রী! সব পুড়িয়ে ছাড়বি! মদন অনঙ্গ হয়েও কি রক্ষা পাচ্ছে! ত্রাহি ত্রাহি রব চারদিকে। তবে সেদিনের কবিরও একই হাল হয়েছিল? রক্তিম বসন্ত গ্রীষ্মের রক্তচক্ষুতে এমনই ঝলসে গিয়েছিল? তাই হবে, তবেই নিশ্চয়ই এই মদনভস্ম উপাখ্যান তৈরি হয়েছিল।
প্রেম আর তাপ সংসারে এ দুটোর সহাবস্থান কে না জানে। যে-ই প্রেমিয়েছে নিজের হৃদয়, সে-ই পুড়িয়েছে নিজেকে। কিন্তু হৃদয়ের তাপ তবু সহ্য হয়, কিন্তু এ সৌর্যিক তাপ যে বড়ই শুষ্ক। প্রেমের তাপ চোখের জল হয়ে বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ল। বালিশ ভিজল কি রুমাল ভিজল। কিন্তু এই তাপ! এ যে হইহই রব, ঘোল খাও, লস্যি খাও, টকদই খাও, এ সব তো প্রেমের তাপে হয় না। আজ অবধি শুনিনি রাধিকার কেঁদে ডিহাইড্রেশান হয়েছে বলে সখীরা তাকে নুন-চিনির জল গুলে এনে বলছেন, "ধরো ধরো সখী, এ সরবত পান করো/ কেষ্ট আসিবেন ঠিক, আগে নিজেকে হাইড্রেট করো"। না শুনিনি।
একবার ভেবে দেখুন রাধিকা বিয়াল্লিশ ডিগ্রি টেম্পারেচারে কুঞ্জবনে বসে আছেন। চারদিকে হল্কা। লু বইছে। রাধিকা কি আর বাঁশির অপেক্ষা করবেন? অসম্ভব। সে প্রেম যতই তুঙ্গে থাকুক না কেন, কোনো বৈষ্ণব কবিকে একবার বিয়াল্লিশ ডিগ্রী টেম্পারেচারে এনে দাঁড় করালেই পদ পরিবর্তন হবে। "চলো চলো রাই, গৃহপানে যাই / গোবিন্দ আসিবার আগে যম আসিবেক, চলো চলো ধনী, ধড়ে প্রাণ রাখা চাই"।
তবে মোদ্দাকথা হল হৃদয়ের তাপ তবু সহ্য হয়, কিন্তু এ তাপ বড়ই অকাব্যিক। প্রেমের জন্য বসন্ত দরকার। একান্ত দরকার।
একবার ভীষণ গরমে হেদিয়ে ক্লান্ত হয়ে দুপুরে লোকাল ট্রেনে কলেজ স্ট্রিট থেকে ফিরছি। খানিকবাদেই সামনে এসে বসল কলেজ পড়ুয়া যুবক যুবতী। পাশাপাশি। ঘেঁষাঘেঁষি। মেয়েটা ছেলেটার হাতটা নিজের হাতের উপর রাখল। ছেলেটা আরেকটা হাত দিয়ে শরীরটাকে মুড়িয়ে জিন্সের পকেট থেকে রুমাল বার করে কপাল মুছল। মেয়েটা বলল, আজ বিকেলে পড়তে আসবি?
ছেলেটা বলল, আসব। মেয়েটা বলল, মেজো মাসির মেয়েটার সঙ্গে ওই ছেলেটারই বিয়ে ঠিক হল জানিস!
ছেলেটা আরেকবার কপাল মুছে বলল, তাই?
আরে কোন ছেলেটা বল তো.. সেই মুম্বাইতে থাকে, সে নয়… যার ছবি তোকে দেখিয়েছিলাম… একটু ডার্ক সে নয়… এ ব্যাঙ্গালোরে থাকে….
ছেলেটা ঘামছে। আরো ঘামছে। আমি সিওর ছেলেটার মনে পড়ছে না। সে আদৌ আগ্রহীও নয় মেয়েটার মাসির মেয়ের কার সঙ্গে বিয়ে হবে তাই নিয়ে। কিন্তু "হ্যাঁ হ্যাঁ" বলে যাচ্ছে। বলে যেতেই হয়। নইলে প্রেম বাঁচে না। খানিকবাদেই মেয়েটার ফোন এলো। ছেলেটা মাথাটা এলিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে বলল, উফ!
অবশ্যই গরমের জন্যেই বলেছে। আর কি কারণ থাকতে পারে? কিছুই না। এ হল মহাদেবের সঙ্গে মদনের আদিম যুদ্ধ। মহাদেব আর মদনের সহাবস্থান কিছুতেই যে হয় না এই বসন্ত আর গ্রীষ্মই বুঝিয়ে দিচ্ছে হাড়েমজ্জায়। ছেলেটার হৃদয়ে শেষে কে জয়ী হয়েছিল জানি না, মদন কদ্দূর অবধি মরাল সাপোর্ট দিয়েছিল সেও জানি না। আমার নামার স্টেশান আগেই এসে গিয়েছিল। নেমে সাইকেলে করে ফিরছি। রেল কলোনির ফাঁকা রাস্তা। চূড়ান্ত দাবদাহ। হল্কা এসে পুড়িয়ে দিচ্ছে হাত মুখ। এরই মধ্যে ভর দুপুরে প্রাণ কাঁপিয়ে ডেকে উঠল এক কোকিল। আহা, কোকিল ডাকল মানেই কি বসন্তের ডাক রে মন… কোকিল তেষ্টাতেও তো ডাকে…. কোকিল বলে কি মানুষ নয়? বসন্তের কোকিল নিয়ে লেখা হয়েছে। কিন্তু গ্রীষ্মের কোকিল নিয়ে কোনো লেখা তেমন চোখে পড়েনি। সুচতুরভাবে কবিরা কোকিলের জৈবিক অধিকারটুকু কেমন অবহেলা করে গেছে। শুধু অমন একপেশে হ্রৈদিক অধিকার নিয়ে থাকলে চলে? ওরকম একপেশে হলেই মহাদেবের কোপে পড়তে হয়, পুড়তে হয়।