Skip to main content

উনি চলে যাওয়ার পর অনেকেই বলল, তেমন কিছু করলেন না জীবনে….

উনি রেলে কাজ করতেন। অল্পবয়সে বাবা মারা যান। ভাই-বোনেদের বড় করেন। বিয়ে দেন। নিজে খেলতে ভালোবাসতেন, বেড়াতে ভালোবাসতেন। সেগুলো করেই গোটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। সংসার করলেন না। চলে যাওয়ার পর আশেপাশে অনেকে বললেন, উনি কিছু করলেন না জীবনে।

দুটো কারণে বললেন বলে মনে হল। এক, গোটা জীবন ভাই-বোনেদের দায়িত্ব শেষ করে শুধু নিজের জন্য বাঁচলেন বলে। দুই, কেউকেটা, বা কেষ্টবিষ্টু হয়ে উঠলেন না বলে।

আসলে আমরা করাটাকে যত গুরুত্ব দিই, না করাটাকে ততটা গুরুত্ব দিই না। একজন মানুষ প্রতিদিন সংসারে, সমাজে হাজার একটা প্রতিকূলতা সামলে, নিজের হাজার একটা অপূর্ণ বাসনা সামলে, নানা ক্ষোভ, রাগ, অশুভ অসামাজিক ইচ্ছা সামলে যে ভদ্রভাবে বেঁচে আছে, শালীনভাবে বেঁচে আছে, কমোন সেন্স না হারিয়ে, কাণ্ডজ্ঞান না হারিয়ে স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি নিয়ে বেঁচে আছে, এই বা কম কি!

আমরা দিনরাত প্রচুর ক্ষোভওয়ালা মানুষ দেখছি, প্রচুর উচ্চাশার লাশ বয়ে নিয়ে যাওয়া মানুষ দেখছি। সারাক্ষণ বিরক্ত মানুষ দেখছি। সারাক্ষণ রেগে থাকা মানুষ দেখছি। আমরা নিজেরাও তো তাই। আমাদের অপ্রকাশিত ‘আমি’কে কি আমরা চারদিকে ঘুরেফিরে বেড়াতে দেখি না? এর মধ্যে যদি কোনো মানুষ শান্ত থেকে, নীরবে, কাউকে বিরক্ত না করে একটা জীবন কাটিয়ে দেয়, সেকি খুব কম কথা?

বহুকাল আগে একবার এক বয়স্ক মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তিনি একটা দারুণ কথা আমায় বলেছিলেন, তিনি আমায় বলেছিলেন, তুই কথামৃত পড়েছিস? আমি বললাম, হ্যাঁ পড়েছি। তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বল তো আমরা যারা রামকৃষ্ণদেবের খুব ভক্ত বলে নিজেদের জাহির করি, তারা আগে গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা কেন নিই? আমি বললাম, কেন? উনি হেসে আমার পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন, যাতে কথামৃতে বলা কথাগুলো আমরা এড়িয়ে যেতে পারি... বেশ দু’বেলা আসন পেতে আরাম করে বসে পনেরো মিনিট কি আধঘন্টা মনে মনে আগডুম বাগডুম করে নিজেকে বোঝাতে পারি, এই তো বেশ শিষ্য হলাম। আমরা কি আর ওই নাগমশায় ইত্যাদির মত হতে পারব? আমাদের গলা অবধি ভোগের ইচ্ছা... মাথাভর্তি স্বার্থপরতা, বদমায়েশি, মতলবী বুদ্ধিতে, আমাদের কি আর রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য হওয়ার যোগ্যতা আছে রে? তাই দীক্ষা নেওয়াটা আমাদের একটা চাল... বুঝেছিস কিনা… ফাঁকি... ফাঁকি আর ফাঁকি…. আবার জোর গলায় বলি আমরা, এখানে দীক্ষা নিলে অতশত মেনে চলার কোনো বালাই নেই... হো হো হো...

আমি হাসলাম। উনি হাসলেন, আর গাইলেন, তোমার পুজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি…..

যার কথা দিয়ে শুরু করলাম, উনি ধম্মকম্মের ধার ধারতেন না। আসলে উনি কিছুই হতে চাইতেন না। শুধু নিজেকে নিয়ে খুশি থাকতেন, কাউকে না ঘাঁটিয়ে।

এরকম বহু মানুষ দেখেছি, ভবিষ্যতেও দেখব, যত বয়েস হচ্ছে তত আশ্চর্য হচ্ছি এত ডামাডোলের মধ্যে এদের ভয়ানকভাবে সুস্থ মাথায় বাঁচার ক্ষমতা দেখে। কিছু করার চাইতে, কিছু না করার ক্ষমতা যে কি প্রবল এদের, কাউকে গালিগালাজ না, ক্ষোভ উগরে রাতদিন এক অসন্তোষের পাঁচালি পড়া না, একে ওকে দোষী প্রমাণিত করে মানুষ উত্যক্ত করে তোলা না। শুধু নিজের কর্তব্যটুকু সমাধা করে কেমন সুন্দর নিজেকে নিয়ে মজে থাকার ক্ষমতা এনাদের! দুর্ভাগ্য এই মানুষদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কিছু না করার ক্ষমতাটা ক্রমে ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে যেন। আমাদের জিভ, আমাদের টাইপের আঙুলকে যেন কি ভূতে ধরে থাকে সারাক্ষণ। সে যেন আমাদের বশে থাকে না। তাকে কিছু একটা কাজ না দিলেই সে অনর্থ ঘটাবে, স্বামীজির সেই গল্পের মত। গল্পে আছে না? একজন ভূত, তাকে কাজ না দিলেই সে মালিকের ঘাড় মটকাতে চাইত? শেষে তাকে কুকুরের লেজ সোজা করতে দিয়ে মালিক বাঁচল। আমাদের জিভ আর হাতকে যেন সেই ভূতে পেয়েছে। কিছু না করা মানে কোনোরকম ধ্বংসাত্মক কাজে না জড়িয়ে, মাথাটা ঠাণ্ডা, জায়গায় রেখে, কিছু না হতে চেয়ে, কেউকেটা না হতে চেয়ে বাঁচাটা কি এতই কঠিন?

জানি আমাদের মিডিয়া, বিজ্ঞাপন, সিনেমা, সিরিয়াল, ওয়েব সিরিজ, পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকে রাতদিন বলবে, আমার যেন কিছু হওয়ার আছে। নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকে যদি জিজ্ঞাসা করি, সত্যিই কি আমার কিছু হওয়ার আছে? সে যদি বলে, না। আমি কি সত্যিই লজ্জা পাব? একদম না। একটুও না। বরং এই হইহট্টগোল ছেড়ে বেরোনোর রাস্তা খুঁজব। পিছনের দিকে কোথাও সরু একটা রাস্তা পেয়েও যাব। বাইরে এলেই সেই নিঃশব্দে চলে যাওয়া মানুষটাকে দেখব সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে একা। আমায় দেখেই বলবেন, পালিয়ে এলি? আয়। সব উস্কানি ছেড়ে পালাতে পারলে বেঁচে যাবি। শুধু তোকে ঠিক করে নিতে হবে, কি কি করবি না, ঠিক করে নে আগে। দেখ কেউ তোর শান্তি কাড়তে পারে কিনা!