Skip to main content
বহুতে এক

        নানক দেখেছিলেন একটা অখণ্ড মানবজীবনের ছবি। শান্তিপূর্ণ ভারতের, তথা বিশ্বের ছবি। কবীর তার পথের অগ্রজ। তার দৃষ্টিতেও ছিল একটা অখণ্ড মানবজীবনের ছবি। অখণ্ড মানবজীবন - যে জীবন শ্রদ্ধা, অনুকম্পাস্নাত আর বিকাররহিত হবে। নানকের বাণীতে ঈশ্বরের তত্ত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা নেই, ঈশ্বরের স্বভাবের কথা আছে। আসলে তাঁর বাণী নেই, সঙ্গীত আছে। কিন্তু সেই স্বভাবের কথার মধ্যে ফাঁকির কথার অবকাশ নানক রাখেননি। কিরকম, আজকের তাঁর শুভজন্মদিনের অবকাশে একবার আলোচনা করা যাক। 
        গুরুগ্রন্থসাহেব, যা শিখধর্মের মূল গ্রন্থ, তা বহু সাধকের বাণী আর গান সম্বলিত। যেমন 'গীতগোবিন্দ' রচয়িতা জয়দেবের পদও সেখানে আছে। যেহেতু 'গুরুগ্রন্থসাহেব' গুরু, তাই তিনি হলেন 'গুরুগ্রন্থসাহেবজী'। শিখ কথাটা এক মতে হল - যে জীবনের দর্শন দাঁড়িয়ে আছে শিখ অর্থাৎ, শিক্ষা কথাটার উপর। মানুষের জীবন অর্থাৎ শিক্ষা। কি শিক্ষা? বাঁচতে শেখা, মাথার মধ্যে নানা তথ্যের ভাণ্ডার জমানো নয়, বরং বিকাররহিত বাঁচতে শেখা। সেই 'গুরুগ্রন্থসাহেব' শুরু হচ্ছে 'জপজী' সাহেব দিয়ে। সেই 'জপজী' নানকের বাণী সংকলন। যার প্রথম বাণী শিখধর্মের মূলমন্ত্র - 
        'তিনি এক। তাঁর নাম, এক সত্যনাম। তিনি কর্তা। তিনি নির্ভয়। তিনি নির্বৈর। তিনি নিরাকার। তিনি স্বপ্রকাশ, অজন্মা। তিনি গুরু কৃপায় প্রাপ্ত। তিনি ছিলেন, আছেন, যুগ যুগ ধরে থাকবেন, এই নানকের সত্যনুভব।'
        নাম হোক, সত্য নাম। নানকের শিক্ষার তিনটি স্তম্ভ। প্রথম এই সত্যনাম স্মরণ। কারণ? কেননা চিন্তা মিথ্যাকে সৃষ্টি করতে পারে, তাই সত্যকে স্মরণ করা। নানকের ঈশ্বর খুব স্বচ্ছ সাদামাটা। জটিল তত্ত্বের ধারণা ধারে না। তাই তার নামের নানা ফলাফলের গুণগান অলৌকিক না, চিত্তশুদ্ধির। যত সত্যনাম স্মরণে থাকবে তত নিজের চিত্তের মধ্যে সত্যের সাথে সম্পৃক্ততা বাড়বে। চিন্তাজাল মিথ্যার কুহক থেকে বেরিয়ে আসবে। তোমার বিভ্রান্তি কমবে। নানকের অনুভব এমনটাই মনের অনুশীলন। 
        ভারতের অন্যান্য মতে যেমন ঈশ্বরের নাম করলেই মুক্তির পথ, নানক জানতেন সেই পথে অনেক ফাঁকি এসে জমবে, তাই তাঁর মতে ঈশ্বরের প্রসাদ নিজের চিত্তে অনুভবের পথ হল, তাঁর হুকুম মানা। এই 'হুকুম' শব্দ পুরো 'জপজী' জুড়ে। কি হুকুম? দুটো প্রধান হুকুম। এক, কিরত করনি, অর্থাৎ সদুপায়ে জীবিকা নির্বাহ। জীবিকা দিয়ে জীবন শুরু, তাই জীবনের প্রথম শর্তই হল তা শুদ্ধ করা, দোষরহিত করা। এই হল প্রথম হুকুম। দ্বিতীয় হুকুম হল, বন্দ চাকনা, অর্থাৎ সেবা, মানবসেবা। ঈশ্বর তোমার সেবার দিকে তাকিয়ে বসে নেই। মানুষ আছে। তোমার উপার্জিত অর্থে সংসারের সব দুর্বলের অধিকার। কারণ নানকের দর্শনে দাতা একজনই, যিনি যুগাদিযুগ ধরে সত্যস্বরূপ। তুমি অনুভব করো তোমার সৎ শ্রম জাত অর্থ সেই দাতারই দান, তাকে একা নিজের মধ্যে নিঃশেষ কোরো না, তবে তা ভোগ, তোমায় বিকারগ্রস্থ করবে। কারণ যে কোনো বিকারের মূল কথা হল, লোভ। বাঁচো তার হাত থেকে, সেবায়, দানে। অহঙ্কার আপনিই নীচে নেমে আসবে, তুমি ত্রাণ পাবে। বিকাররহিত জীবনই আনন্দের মূল। নানকের এই শিক্ষাই আজও কিছুটা লঙ্গরখানা, করসেবা হয়ে শিখ ধর্মের অনুশীলনের মধ্যে বেঁচে আছে। 
        একটা গল্প আমি আগেও কোথাও লিখেছি। একবার উনি মর্দানার সাথে, (মর্দানা, যিনি ওনার সারা জীবনের পথের সঙ্গী। নানকের পায়ে হাঁটা পথটা সুদীর্ঘ, সম্ভবত ভারতের অন্যান্য মনীষিদের মধ্যে সব চাইতে বড়। যিনি পাঞ্জাব থেকে বাংলা হয়ে দক্ষিণ ভারত হয়ে মক্কা হয়ে আবার পাঞ্জাবে ফিরেছিলেন পায়ে হেঁটে।) বেণারসে এসে দেখেন, সবাই গঙ্গায় নেমে মাথার পিছন দিক থেকে জল পিছনে ছুঁড়ছে। উনি জিজ্ঞাসা করেন, এর কারণ কি? তারা বলে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের জল দিচ্ছে, যাকে আমরা তর্পণ বলি। তিনিও তাড়াতাড়ি জল নিয়ে পশ্চিমদিকে ছুঁড়তে লাগলেন। সবাই তাকে এরকম করার কারণ জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলেন, তিনি পাঞ্জাবে তার চাষের ক্ষেতে জল দিচ্ছেন। লোকে বলে তোমার কি মাথা খারাপ? এখান থেকে জল সেখানে যায়? নানক বলেন কেন যাবে না? এখান থেকে জল যদি পরলোকে যেতে পারে তবে সেখানেই বা যাবে না কেন? 
        নানকের কথা মনে করা আজ বড় দরকার। সেই সব মনীষার কথাই স্মরণ করা এই ক্ষণে দরকার যারা একটা অখণ্ড মানবধর্ম অনুভব করেছিলেন, সাথে সাথে নানা ভাষাভাষির মত নানা ধর্মের প্রকাশকেও স্বাভাবিক বলে বিশ্বাস করেছিলেন। নানকের ভাষায় মনের ধারা হয় দুইমুখী - গুরুমুখী মন আর হয় মনমুখী মন। অর্থাৎ এক মন, কখনও চেতনাযুক্ত কখনও অন্ধপ্রবৃত্তিমার্গী। দ্বিতীয়টা ভয়ের, কি ব্যক্তিজীবনে কি রাষ্ট্রজীবনে। যে 'বহু'তে শঙ্কা প্রকাশ করে, এ জগতে সে বেশিদিন টেকেনি, বহুর মধ্যে যে নিজের স্থান খুঁজে নেয়, সেই থেকেছে। এটা ভোলাতে চাইলেই ভুলব কেন?