Skip to main content


“I would very much wish for him (Amartya Sen) to find a suitable biographer, this would have to be an enonomist familiar with philosophy, but who was not Sen’s student, and who is not a Bengali” ~ Ramchandra Guha


        আজকের 'দ্য টেলিগ্রাফ'র এডিটোরিয়ালে একটা প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, বুদ্ধিজীবী রামচন্দ্র গুহার মন্তব্য। শেষ কথাটায় ঠেক খেলাম, কেন একজন বাঙালি অমর্ত্য সেনের জীবনীকার হতে পারবেন না? পক্ষপাত, আবেগ আর স্বজনজনিত দুর্বলতা দুষ্ট হয়ে যাবে বলে? কথাটা কোথাও একটা খারাপ লাগা আনল। আমরা ভাবাবেগ তাড়িত জাত নিঃসন্দেহে, ভক্তিমার্গ আমাদের স্বচ্ছচিন্তাকে বারবার কুয়াশায় ঢাকে এও সত্য। কিন্তু সেকি শুধু বাঙালি বলেই? ভারতের কজন সঠিক নিরপেক্ষ জীবনী-লেখকের নাম আমরা করতে পারব? আমি কিছু ইংরাজিতে জানি, বেশ কিছু বাঙলায় জানি। কিন্তু সেই পক্ষপাতদুষ্ট কলম কি শুধু ভারতের মাটিতেই, পৃথিবীর অন্য ভাষায় নেই? মনুষ্যপ্রকৃতির দুর্বলতা কোনোদিন ভূগোলে সীমাবদ্ধ হয় না। সে দুর্বল দিক হয়ত কোনো দেশের চিন্তার, মননের জলবায়ুতে বেড়ে উঠতে পারে না সে আলাদা কথা। অর্থাৎ নিরপেক্ষ দিকটা হয়ত বেশি চর্চিত। 
        আমি যে ক’টা বাঙালী লেখকরচিত জীবনী পড়েছি, তার একটাও সে অর্থে নিরপেক্ষ হয়ত নয়। প্রশান্তকুমার পাল, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় -রবীন্দ্রনাথ। ইন্দ্র মিত্র- বিদ্যাসাগর। স্বামী সারদানন্দ - রামকৃষ্ণ। স্বামী গম্ভীরানন্দ - স্বামীজী। এর মধ্যে সব চাইতে দাগ কেটেছে ইন্দ্র মিত্রের বিদ্যাসাগর। যেমন জীবনী বলতে বুঝি অনেকটা যেন তেমন। কোথাও বিদ্যাসাগর সম্বন্ধে মিথগুলো দাঁড়াতে দেননি, অসম্ভব পরিশ্রমের ফসল অবশ্যই। বাকি জীবনীগুলো অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ, কিন্তু সেই অর্থে একটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী নির্ভর হয় তো নয়, প্রশান্তকুমার পাল অবশ্য কিছুটা লেগেছে। 
        একটা ঘটনা বলি, আমার অনেকের জীবনী বাংলায় পড়ে পড়ে রামচন্দ্রগুহের মত অনেকটা ধারণা তৈরি হয়ে যাচ্ছিল, যে বাঙালী হয়ত সত্য অর্থে জীবনীকার হতে পারে না। বেশ কয়েক বছর আগে বইমেলায় বিদ্যাসাগরের জীবনী খুঁজছি ইংরাজিতে, বাস্তবসম্মত জীবনী পড়ব বলে। একটা ইংরাজি বই হাতে নিয়ে দেখছিও, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আমায় বকা দিলেন, "কি করছেন এটা"? আমি চমকে গিয়ে বললাম, আজ্ঞে বিদ্যাসাগরের জীবনী খুঁজছি... উনি ফের দাবড়ানি দিয়ে বললেন, "যান আনন্দ থেকে ইন্দ্র মিত্রের বইটা কিনুন"। ওনার বলার মধ্যে এমন কিছু একটা নিশ্চয় ছিল যে আমি দৌড়ে গিয়ে বইটা কিনে ফেললাম। আর বাকিটা না বলাই ভালো, একটা রিভিউ লিখেছিলাম ফেসবুকে তো অবশ্যই, অনেককে কিনতেও অনুরোধ করেছিলাম। 
        আমি নিরপেক্ষ জীবনী বলতে কি বোঝাতে চাইছি। আমি বলতে চাইছি না যে একটা নিরপেক্ষ জীবনী মানে সেখানে তার অন্ধকার দিকটার শুধু উল্লেখ থাকবে আলোকিত দিকের পাশাপাশি। আমি সার্থক জীবনী বলতে বোঝাতে চাইছি তাতে অতিকথন যেন না থাকে। নিন্দা-প্রশংসা-স্তুতি কোনোটাই যেন না থাকে। যত প্রতিভাশালী মানুষই হোন না কেন, তিনি অবশেষে মানুষ, এই কথাটার মধ্যে একটা গর্ব আছে, সেই গর্বটাকে ছোটো করে তাকে অকারণ দেবত্বে, বা মহত্বে বড় যেন না করতে যাই। বিবেকানন্দের একটা কথা আমার অসম্ভব ভালো লাগে, একজন মানুষের যা গুণ সে তার নিজের চেষ্টার্জিত, কিন্তু তার যে দোষ তা আপামর মানবজাতির দোষ। এই কথাটা বড় দামী কথা। কারোর দোষের আলোচনা করাটাই একজনের স্বরূপ উদঘাটনের সত্য দায়ভার বহন করা নয়, তার ভালোমন্দ দুটোকেই পাশাপাশি রেখে, তার স্ববিরোধকেও স্বীকার করে যে মানুষটার চরিত্র দাঁড় করানো হয়ে থাকে, সেই সার্থক সৃষ্টি। মিথ্যা কিছুক্ষণের জন্য কুহক সৃষ্টি করতে পারে, কালের আকাশে সত্য সূর্য যদ্দিন না ওঠে। তা দিয়ে ক্ষণিকের কাজ চালানো যায়, ইতিহাসের পাতায় স্বাক্ষর রাখা যায় না। সেই সার্থক জীবনী লেখার কাজে বাঙালী অপারগ, এ আমি বিশ্বাস করি না। সেদিনের চৈতন্যচরিতামৃত, চৈতন্যভাগবত আজকের দিনে শুধুই ভক্তিগ্রন্থ। ঐতিহাসিক উপাদান তাতে অল্পই। রোঁমা রোঁলাও সেদিন রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দর জীবনী লিখতে গিয়ে এই একই জায়গার মধ্য যেন একটা সংশয়ে ভুগেছেন, কোথায় সমালোচনার কলম আবার ভক্তিতে ডুবিয়ে নরম করে নিয়েছেন, আর রামকৃষ্ণ মিশন সেই বইয়ের ফুটনোট দিয়ে দিয়ে ক্রমাগত সাফাই গেয়ে গিয়েছে। ফলে কোনোটাই ইতিহাস হয়ে ওঠেনি। তাতে রস আছে, কিন্তু সত্য কতটা আছে তা সংশয়ের। একজন পুরুষকে অবতার সৃষ্টি করতে গিয়ে যখন বলা হয়, তাঁর সাধনকালে মাসিকচক্র হত কিম্বা লেজ বেড়ে গিয়েছিলে হনুমান সাধনকালে - তখন সেটা আর জীবনী থাকে না, তখন তা সাধারণ যুক্তিবুদ্ধির বাইরে এমন কিছু একটা হয়ে দাঁড়ায়, হয় তাকে অন্ধ বিশ্বাসে স্বীকার করে নিতে হয়, অথবা বলতে হয়ে - অনৃত। তার সত্যকারের মহত্বও যেন কোথাও এই কুহকে চাপা পড়ে লজ্জায় মুখ লুকায়। 
        আমার পড়া অসামান্য কয়েকটা বায়োগ্রাফির একটা লুইজ ফিশারের 'গান্ধী'। দুই, ডেভিড হার্বার্ট ডোনাল্ডের 'লিঙ্কন'। দ্বিতীয় বইটা আমার মনের অনেক গভীরে ছুঁয়ে গেছে, কারণ ইতিহাসকে অবিকৃত রেখে এমন সরস একটা উপাখ্যান লেখা চাট্টিখানি কথা না। তাছাড়া আর্ভিং স্টোন তো রইলেনই। তাছাড়াও মাইকেল জ্যাকসন, ম্যাণ্ডেলা, মার্কেজ ইত্যাদি অনেকেরই পড়েছি। রামচন্দ্র গুহার যে গান্ধীর উপর বায়োগ্রাফিটা বেরোচ্ছে তা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। প্রথম ভাগ পড়া হয়েছে, পরেরভাগ এগারোই সেপ্টেম্বর বেরোচ্ছে, তার অগ্রিম বুকিং করে রেখেছি, শুনেছি অসম্ভব পরিশ্রম করেছেন বইটার জন্য। সেটা বিশ্বাস্য, কারণ প্রথম ভাগ 'গান্ধী বিফোর ইণ্ডিয়া' সেই সাক্ষ্য বহন করে। 
        অবশেষে বলি, রামচন্দ্র গুহা আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক, থেকেও যাবেন। তবে আজকের কথাটা কোথাও একটা খোঁচা আর খোঁজ একসাথে দিয়ে গেল। সত্যিই কি আমরা নিরেপক্ষভাবে একটা মানুষের জীবন বলে যেতে পারি না, তাকে দেবতা বা অসুর কোনোটাই না বানিয়ে?