Skip to main content

অস্তমিত সূর্যের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ বসে। রাস্তাটা বেঁকে গিয়ে যে গ্রামটাতে গেছে, সে গ্রামের অনেককেই চিনি। তারাও চেনে আমায়। তবু এখন যেন সেই চেনাচিনি থেকে সরে আমি। সামনে অনেক দূর অবধি বিস্তৃত ধানক্ষেত। সবুজে সবুজ চারদিক। গরম তেমন নেই, আবার ঠান্ডার দাপটটাও নেই, বসে থাকতে ভালই লাগছে।

মন শান্ত না। খুব কাছের বেশ কয়েকজন মানুষ, খুবই দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। কোথাও মারণ রোগের রক্তচক্ষু, কোথাও রাজনৈতিক দ্বেষাদ্বেষি, কোথাও সাম্পর্কিক জটিলতার আবর্ত।
সামনের ঈষৎ অন্ধকার হয়ে আসা আকাশে নীড়ে ফেরা পাখির দল। কিছু দূরে একটা বড় বটগাছে ঘরে ফেরা পাখিদের কলরব। আমার পাশ দিয়ে মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছে একজন দুজন মানুষ। কেউ হেঁটে, কেউ রিকশায়, কেউ বাইকে। কেউ গল্প করতে করতে, কেউ গান শুনতে শুনতে, কেউ নীরবে। তারা চলে গেলে প্রকৃতি নিজের মত একা, পাশে আমি, একজন সাক্ষী। সাক্ষী তো সবাই, হয় তো সচেতন সাক্ষী।
মন ভাল নেই। নানান চিন্তা, দুশ্চিন্তা জট পাকাচ্ছে। কালো মেঘের মত মুখ ভার করে এমন স্নিগ্ধ, শান্ত পরিবেশেও মনকে ক্ষুব্ধ করে চলেছে। এত কিছু হচ্ছে চারপাশে। কত মত, কত ঘটনা, কত সৃষ্টি। আমি হঠাৎ করে যেন থেমে গিয়ে থমকে পড়েছি মাঝপথে। অনেকের ফোন এড়িয়ে যাচ্ছি, অনেকের রাগের কারণ হচ্ছি, অনেকের অভিমানের। জানি, তবু আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি। এত মানুষের এত যন্ত্রণার অসহায় দর্শক হয়ে থাকাটা যে কি শাস্তি! অথচ কিচ্ছু করার নেই। হাত পা খুব স্বল্প পরিসরে ছোঁড়াছুড়ি করে শেষে ক্লান্ত হয়ে মেনে নেওয়ার পালা। জানি সব। বুঝি সব। তবু ওই, "বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না।"
ঝোঁপের মধ্যে জোনাকি দেখা যাচ্ছে। আকাশে তারা উঠে গেছে বেশ কিছু। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলাম, না, চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। এটা কি পক্ষ? মনে পড়ছে না। যাক গে। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বসলাম।
পরিচিত অসহায় মুখগুলো ভেসে উঠল ভিড় করে। আচ্ছা, এরকম, ঠিক এই জায়গায় বসে আমার মতই কি কেউ একজন তার প্রিয় মানুষগুলোর জন্য কষ্ট পায়নি, বহু বহু যুগ আগে, কিম্বা কয়েক মাস আগেও, কিম্বা গতকালই? নিশ্চই পেয়েছে। সন্ধ্যার অন্ধকারে তারও চোখের কোল ভরেছে, নিবিড় স্নেহে, আরক্ত ভালোবাসায়। তবে কোথায় আলাদা আমি? আমার কোন কষ্ট, কোন যন্ত্রণাটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতভাবে আমারই জীবনে ঘটছে? আগে কারো কোনোদিন হয়নি? বা ভবিষ্যতেও হবে না?!
একটাও নেই। সব যন্ত্রণার পুনরাবৃত্তি হয়, শুধু মুখগুলো বদলে যায়। আমার ক্ষুদ্র, যন্ত্রণাক্লিষ্ট আমিকে সরিয়ে এ কোন আমি এসে দাঁড়াল? যে আমি আকাশ মর্ত্য পাতাল ব্যেপে দাঁড়িয়ে আছি, জেগে আছি অনন্তকাল ধরে। জেগে থাকবও। যেন ছোট আমিগুলো এই বড় আমিটার গায়ে বিন্দু বিন্দু লেগে। ফুলের রেণুর মত। যেন ঝরে পড়ে যাবে যে কোনো মুহুর্তেই। মিথ্যা হবে সে, শুধু এই বিশাল আমিটা ছাড়া। সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অণুতে অণুতে যেন এই বিশাল আমি-র যোগাযোগ। সব ক্ষতি, সব দুঃখ, সব সুখ, সব উল্লাস - শুধু ওই বিন্দু বিন্দু আমিগুলোর। এ অন্তহীন আমি-র নয়। এ চিরকাল শান্ত, স্থির, আনন্দে পরিপূর্ণ।
মন শান্ত হল। মন এই বিশাল সংসারের আমি-র মধ্যে যেন মিলিয়ে গেল তার সব তরঙ্গ নিয়ে। সমস্ত প্রকৃতির সাথে এ বিশাল অস্তিত্ব এক হয়ে দাঁড়াল। কোথাও যেন বিন্দুমাত্র নেই ফাঁক। আমার শান্ত বুকে জেগে সব আমি-র মিলিত আমি, সবার আমি। কোথায় আলাদা আমি কারোর থেকে? যারা গেছে, যারা ছেড়েছে তারা সব এই বিশাল একত্বে চিরকালের জন্যে বাঁধা। এ আমিটা যেন বিশাল প্রাচীন এক বটবৃক্ষ। ওই পাশের বটগাছটার মত। তাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনন্ত 'আমি' এসে চিরটাকাল বাসা বেঁধেছে। আবার কালের স্রোতে মিলিয়ে গেছে। প্রতিদিনের সুখ দুঃখ, আশা নিরাশা, হাসি কান্নায় গড়া সে ক্ষুদ্র আমি - মিথ্যা আমি। এই বৃহৎ আমিই সত্য। এই পারে এ দুঃসহ জীবনের ভার বইতে।

জানি প্রত্যহের সংসারে এ বড় আমিটাকে হারিয়ে ফেলব আবার। আবার ভয় পাব, আশঙ্কিত হব, কাঁদব। তবু, জানব এ মিথ্যা। এ শুধুই মিথ্যা।
আমার সব অশান্তিকে বুকে করে নিয়ে আছে যে পরম শান্তি, আমার সব শোককে বুকে করে নিয়ে আছে যে পরম আনন্দ তাকে আমি হারাতে পারি, সে পারে না। সে-ই সত্যি, আমার এই ভীতু, ক্ষুদ্র, দুর্বল আমিটা না। সে হতে পারে না। তা হলে এতবড় সৃষ্টিটা শুধুই মিথ্যা, ছলচাতুরী হত।
তাই যদি হত, তবে সংসার একটা বুদ্ধ, একটা খ্রীষ্ট কিম্বা একটা লালন জন্ম দিতে পারত না। সব খোঁজ, সব সাধন হত ব্যর্থ। সেই তো দিশা, সেই সে গানে -
"এ মানুষে সেই মানুষ আছে"