Skip to main content

নতুন বছরের সক্কাল হল। বাল্যকালের স্কুলের বন্ধু, দীর্ঘকাল যোগাযোগ নেই, হঠাৎ ভজন পাঠালো হোয়াটসঅ্যাপে। ওই অ্যাটেনবোরোর 'গান্ধী' সিনেমার শেষ অংশটুকু। শুনলাম। ভালো গান।

জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছিস? উত্তর এলো, খাসা আছি। বললাম, ভালো কম্পোজিশন, সে বলল হুঁ।

ব্যস কথাবার্তা নেই আর। বুঝলাম এ নিতান্তই বাল্ক মেসেজে আমি ঢুকে গেছি হয় তো, অথবা সক্কালবেলা জীব উদ্ধারের জন্য হয় তো বা আমার প্রতি এই অনাকাঙ্ক্ষিত করুণা। নইলে কুশল জিজ্ঞাসাটা তো উভয়পক্ষের হওয়াটাই ভদ্রতা। হল না কেন?

রবিবারের সকাল। তায় নতুন বছর। ছোটোবেলার বন্ধুর এমন শীতল ধর্মীয় যোগাযোগ। ভালো লাগল। নানা ভাবনা এলো। আজ আবার কল্পতরু উৎসব। মানে আর কি রামকৃষ্ণদেব যেদিন আশীর্বাদ করেছিলেন, তোমাদের চৈতন্য হোক।

হৃদে বলে একজন দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণদেবের সঙ্গে থাকতেন। তিনি আবার রামকৃষ্ণদেবের আত্মীয়ও বটে। তিনি ঠাকুরকে নানাভাবে, নানা সময়ে বেশ উৎপীড়ন করেন যা রামকৃষ্ণদেবের নিজের কথাতেই আছে। আবার পরক্ষণেই বলছেন, তবে ও আমার সেবাও করেছিল অনেক।

রামকৃষ্ণদেব নিন্দা করা অপছন্দ করতেন। প্রার্থনা করতে বলতেন যেন আমি পোকাটারও নিন্দা না করি। তো তিনি হৃদের নিন্দে কেন করবেন? শুধু সত্যিটুকুই জানাতেন, তাও তুল্যমূল্য। "সেবাও করেছিল অনেক"।

এক ঘটনায় হৃদেকে মন্দির কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করল। বহুদিন পর হৃদে দেখা করতে এসেছে। ঠাকুর তাঁর নিজের ঘরে বসে ভক্তদের সঙ্গে কথা বলছেন। একজন এসে খবর দিল হৃদে এসেছেন।

ঠাকুর উঠলেন। দরজার কাছে গিয়ে দেখলেন হৃদে দাঁড়িয়ে। মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ। তাই বাইরে থেকে কথা হচ্ছে। ঠাকুর কুশল সংবাদ নিচ্ছেন। হৃদে কাঁদছে। ঠাকুরও কাঁদছেন। এ ঘটনা যিনি লিখছেন সেই মাষ্টার মহাশয় অবাক হয়ে দেখছেন যে মানুষটা এত কষ্ট দিয়েছেন, সে মানুষটার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন রামকৃষ্ণ। অবাক হচ্ছেন। আগামী প্রজন্মের জন্য লিখে যাচ্ছেন এ সব ঘটনা। জীবন একটু হাল্কা হয় যদি ক্ষমা করে। কেঁদে। প্রার্থনা করে। দোষ যেন না দেখি।

আরো আগের ঘটনা। তখন হৃদে মন্দিরে। হৃদের হঠাৎ একদিন কি হল, বললেন, ওগো রামকৃষ্ণ তুমিও যে, আমিও তো সে….চলো আমরা জীব উদ্ধার করি।

রামকৃষ্ণদেবের ভাষায়, তারপর শালার বুকে হাত দিয়ে তাকে শান্ত করি।

রামকৃষ্ণদেব কি শান্ত করছেন? জীব উদ্ধারের ইচ্ছা। অহংকারের ইচ্ছা। রামকৃষ্ণদেব মেথরের বাড়ির পায়খানা নিজের চুল দিয়ে পরিষ্কার করছেন। কেউ ডাকলে তার বাড়ি যাচ্ছেন। নিজে থেকেও যাচ্ছেন। অপমান করলেও যাচ্ছেন। ভালোবাসলেও যাচ্ছেন। কেশব, বিদ্যাসাগরের বাড়িও যাচ্ছেন, আবার কোনো এক অতিসাধারণ বিধবা মহিলার বাড়িও যাচ্ছেন। যেখানে যাচ্ছেন উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে। বিধবা কেঁদে কুটিপাটি। "ওগো আমার এত সৌভাগ্য যেন সহ্য হয়, ওগো তোমরা আমায় আশীর্বাদ করো।" বিধবা আনন্দে পাগল হচ্ছেন। ভিড় করে আসা প্রতিবেশীদের বলছেন এ সব কথা। তারাও আনন্দে মত্ত। ঘরে আনন্দময়ীর আগমন, আনন্দময় রামকৃষ্ণ হয়ে।

রামকৃষ্ণদেবের অনুভবে জীব উদ্ধারের গল্প নেই। "জীবে দয়া" কথাটাও ভালো লাগেনি। বলেছেন, শিবজ্ঞানে জীবসেবা।

তাই তো দয়া কি? সেবা। নিজের মানুষকে আবার দয়া করা যায় নাকি? সে তো সেবা! দেহত্যাগের প্রাক্কালে সারদাদেবী যে কথাটা বলবেন, "কেউ তোমার পর নয়"। রামকৃষ্ণদেবের দর্শনে সব নিজের। সব এক। নিজেই বলছেন, আমি সব এক দেখি।

রামকৃষ্ণদেবের আঙিনায় শুধু বিবেকানন্দ প্রমুখেরাই তো নেই। হাজরা আছেন, হৃদে আছেন, খাজাঞ্চি আছেন… যারা ঠাকুরের জীবনে ঠাকুরের ভাষায় 'জটিলে-কুটিলে' ছিল। ঠাকুরকে যন্ত্রণা দিয়েছেন। ক্ষমা পেয়েছেন। ভালোবাসা পেয়েছেন। সব যে এক। সব যে মা। এই তো রামকৃষ্ণদেবের দর্শন। সোজা দর্শন। এক করার দর্শন। এক হওয়ার দর্শন। শান্তি, ভালোবাসা, আনন্দের প্রস্রবণ সেদিন দক্ষিণেশ্বর থেকে বয়েছিল। এমনকি শ্যামপুকুরবাটি, কাশীপুর থেকেও বয়েছিল, যখন গলায় কঠিন রোগাক্রান্ত, ক্যান্সার।

আজ কল্পতরু উৎসবের দিন। তিনি শুভবুদ্ধি দিন, নিজেকে একজন হনু, কি কেউকেটা ভাবার দুর্বুদ্ধি থেকে রক্ষা করুন, তবেই জীবন সার্থক হয়।

সবাই ভালো থাকবেন। আনন্দে থাকবেন। শুভ নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানবেন।