Skip to main content

রাগ করতে নেই। ওভাবে বলতে নেই। ভালো হতে হয়। শান্ত হতে হয়। ভালো কথা বলতে হয়। মিষ্টি কথা বলতে হয়। মনকে উত্তেজিত হতে দিতে নেই।


    এ সবগুলোই হয় তো আপনার আমার দীর্ঘদিনের রোগের কারণ হতে পারে। হয়তো আপনি কোনো কিছুতে মন দিতে পারছেন না, সব সময় মনের মধ্যে বিরক্তি। কাউকে ভিতর থেকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। ফিল করতে পারছেন না। যা-ই দেখছেন শুনছেন সাময়িক ভালো লাগলেও আবার নিজের মধ্যে নিজের সঙ্গে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। মানসিক উদ্বেগ সারাক্ষণ। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না যে কেন এই উদ্বেগ। সব সময় মনে হচ্ছে হয় তো খারাপ কিছু একটা ঘটতে চলেছে আমার সঙ্গে। নয় তো একটা গিলটি ফিলিংস চলছে। হীনমন্যতা, অবসাদ ছাড়তেই চায় না। সব সময় নিজেকে মনে হচ্ছে, ধুর আমার দ্বারা কিছু হবে না। সবাইকে দেখে ঈর্ষা হচ্ছে আপনার। হয় তো নিজেকে ভাবছেন, কই আগে তো এরকম ছিলাম না, কিন্তু এখন কেন? এটা মনে হতেই আবার মন বিষণ্ণ। দমে যাওয়া।

    ক্রমশ সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। কাজের জায়গা নষ্ট হচ্ছে। অথচ আপনার মনে হচ্ছে কিছুই যেন আপনার হাতে নেই। সব কিছু আপনার বিরুদ্ধে ঘটে যাচ্ছে। সময়টাই খারাপ। আপনি হয় তো জ্যোতিষী দেখালেন। বাড়ির নক্সা বদলালেন। আরো নানা কিছু করে দেখলেন আদতে কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। ক্রমশ আপনি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। অনেকে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়লেন, কেউ দীক্ষা নিলেন; কেউ বেশি করে সৎসঙ্গ, পাঠচক্র ইত্যাদিতে যাতায়াত শুরু করলেন; মহাপুরুষের বাণী মুখস্থ করে করে হদ্দ হয়ে গেলেন --- কিন্তু কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। মনের মধ্যে যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার। 

    এ সবেরই কারণ আপনার ওপরসা ভালোত্ব। আপনার ভালো হতে যাওয়ার অতিচেষ্টা। যার বাইপ্রোডাক্ট হিসাবে আপনার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে জমেছে ক্ষোভ, চাপা রাগ। চাপা রাগ, ক্ষোভ ভিতরে ভিতরে কালো শিকড় বানিয়ে ফেলেছে। আপনার সমগ্র অস্তিত্বটার মালিকানা তার হাতে এখন। আপনার চোখে সবাই শত্রু। সবাই খারাপ এখন। আপনি কাউকে বিশ্বাস করছেন না। সুযোগ পেলেই কাউকে কোনো খারাপ কথা বলে দিচ্ছেন, যদি সে আপনার থেকে দুর্বল হয়। খারাপ না হলেও কঠিন কথা তো অবশ্যই। বলে নিজেও কষ্ট পাচ্ছেন। কারণ কথাটা সঙ্গত ছিল না। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতেও পারেন না আজকাল আগের মত। যখন তখন কেঁদে ফেলেন। অল্প আবেগে চোখে জল আসে। অল্প কথায় হেসে ফেলেন এমন যখন এতটা হাসি হয় তো স্বাভাবিক অবস্থায় আপনি হাসতেন না। আপনি বুঝতে পারছেন আপনি স্বাভাবিক আচরণ করছেন না। কিন্তু কোথায় যে এসবের সূত্রপাত ধরতেও পারছেন না।

    আসলে আপনি ক্ষমা করার ভান করেছেন। নিজেকে মিথ্যা কথা বলেছেন যে আপনি ক্ষমা করেছেন। আপনি ক্ষমা করেননি, কারণ অনেক হতে পারে। হতে পারে, অপরপক্ষ বেশি শক্তিশালী ছিল। হতে পারে সম্পর্ক নষ্ট হোক আপনি চাননি, কারণ হয় তো সে সম্পর্কটার উপর আপনি হয় ভীষণ আসক্ত, না হয় নির্ভরশীল। নির্ভরশীল অর্থের দিক থেকে বা মানসিক দিক থেকে যা কিছু হতে পারে। অথবা এমন হতে পারে যে রাগটা প্রকাশ করলে আপনার কাজের বা কেরিয়ারের পক্ষে তা থ্রেট হতে পারত। 

    এইভাবে সামাজিক, পারিবারিক, কাজের জগতে আমরা বহুবার নিজেদের অজান্তে রাগ 'হজম' করে নিই। মনের মধ্যে জন্মানো উষ্মাকে গিলে ফেলি। তারপর ভাবি সব ঠিক হয়ে গেছে। এই তো আমি আবার আগের মত হয়ে গেছি। আর এখনকার দিনে নিজের মনকে ডিস্ট্র‍্যাক্ট করার উপায় অগুনতি। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, ওটিটি, রিল, মিম - যা কিছুতে একটা ডুবে গেলেই হল। মনে মনে ভাবছি সব মিটে গেল। আদতে কিন্তু কিছুই মিটল না। হিলিং হল না, গুহায় চামচিকের বাসার মত, ওরা সংখ্যায় বাড়তে শুরু করল। ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করল। নিজেকে ডিস্ট্র‍্যাক্ট করে আপনি মনের সুপারফিশিয়াল দিকটার কিছু সাময়িক পরিবর্তন করতে পারেন। কিন্তু মনের কোর অঞ্চলে সে পদ্ধতি কোনো কাজে লাগে না। 

    মনের গভীরে গিয়ে মনের শুশ্রূষা দরকার। সে কি করে হবে?

    দেখুন আমাদের সামাজিক হয়ে ওঠার ট্রেনিং-এ নিজেকে সমাজের পোষ্য, বাধ্য করে তোলার সিলেবাস আছেই। নিজেকে চলনসই করে না তুললে অনেক সমস্যা। সে আছেই। কিন্তু সমাজ আপনার যত্ন নেবে না। ক'দিন আগে মহাত্মা গান্ধীর একটা উক্তি অনুবাদ করেছিলাম, যেখানে উনি বলছেন সমাজ ফলের জন্য আগ্রহান্বিত, মূলের দেখভালের দায়িত্ব আমার একার। তো এই মূলের দায়িত্ব তো আমাকেই নিতে হবে। 

    যীশুখ্রীষ্ট থেকে সারদাদেবী সবাই বলেছেন ক্ষমা করার কথা। সমাজে এই 'ক্ষমা' অবশ্যই একটা পজিটিভ সাংগঠনিক দিক। কিন্তু এটাও মনে রাখার দরকার, ক্ষমাকে বুদ্ধ, সারদাদেবী, সবাই তপস্যা বলেছেন। 

    তপস্যা' শব্দের অর্থ একভাবে হয় যা তাপ উৎপন্ন করে। তাপ উৎপন্ন হয় তখনই যখন মুখোমুখি সংঘাতে নামি। এড়িয়ে যাই না, বা বাইপাস করে দিই না। সেটা কি এতটাই সোজা? আজকের সামাজিক জীবন অনেক বেশি জটিল, এ যেমন সত্যি, আজকের সামাজিক জীবনে আমরা অনেক কিছু নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার সুযোগ পাচ্ছি এও সত্যি। 

    শুরুতেই সব উচিৎ শিক্ষাকে কিছুক্ষণের জন্য দূরে রাখুন। নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করান। খুব শক্ত কাজ এটা। যমের মুখোমুখি অনেক কনফিডেন্সের সঙ্গে দাঁড়ানো যায় হয় তো। কিন্তু নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানো ভীষণ শক্ত। কিন্তু এ কাজটা করতেই হবে। 

    প্রথম যেটা খুঁজে বার করতে হবে, কোথায় কোথায় আমার নিজের উপর নিজেকে নিয়ে রাগ, ক্ষোভ। এই জায়গাটা ভীষণ সেনসিটিভ। তাড়াহুড়ো করে এ কাজ হওয়ার নয়। অনেক জায়গায় আমি অক্ষম, ব্যর্থ, নির্বোধ, বোকা --- হতেই পারে। সেগুলোকে খুব সহমর্মিতার সঙ্গে দেখুন। বৌদ্ধধর্মে একটা খুব চমৎকার কথা আছে --- সেল্ফ কমপ্যাশান। নিজের প্রতি নিজে নরম হোন। বুঝদার হোন। নিজেকে ক্ষমা করুন সবার আগে। কাজটা একটুও সোজা নয়। নিজেকে নিজে ক্ষমা করতে পারলেই অন্যকে ক্ষমা করা সহজ হয়ে যাবে অনেকটা। তখন যে রাগটা অবশিষ্ট থাকবে সেটা বিষ হবে না। 

    কোন আবেগটা আমাদের মধ্যে বিষ হয়ে যায় জানেন? যেটা আনজাস্টিফায়েড থাকে। যেটা সত্যি অর্থে জাস্টিফায়েড হয়ে যায় সেটা আর আমাদের মনের মধ্যে বিষ তৈরি করতে পারে না। যেমন ধরুন আপনার খুব নিকট একজন মানুষ মারা গেলেন। স্বাভাবিক মৃত্যু, কিন্তু অকালমৃত্যু। আপনার মনের মধ্যে সারাদিন কুরে কুরে খাচ্ছে, হয় তো এটা করা যেত, হয় তো সেটা করা যেত। এই আবেগটা বিষাক্ত করে দেবে আপনার বেঁচে থাকা, সারাক্ষণ অপরাধবোধ একটা। এটা ততক্ষণ চলবে যতক্ষণ না আপনি ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখবেন যে আপনার সত্যিই কিছু করার ছিল না। তাই বলছি, আনজাস্টিফায়েড ইমোশান, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাপা থেকে যায়, মানে সাপ্রেসড থেকে যায়, তারাই বিষ হয়ে ওঠে। 

    আপনি যখন নিজেকে ক্ষমা করতে অনেকটা সক্ষম হলেন, তখনই আপনার আত্মবিশ্বাস, আত্মসন্মানের বোধটা সুস্থ অবস্থায় আবার কর্মক্ষম হয়ে উঠবে। সে তখন নিজের মধ্যে জমে থাকা অনেক হিডেন ফোল্ডার বার করে নিজেই সমাধান করে ফেলতে পারবে সব এক এক করে। যা কিছু আনজাস্টিফায়েড, তা ধীরে ধীরে ট্রু জাস্টিফিকেশানের আলোয় এসে ধরা দেবে। আপনি অল্প অল্প আলোকিত হবেন। সুস্থ হয়ে উঠবেন ধীরে ধীরে। 

    দেরি করবেন না। এ কাজটা যত তাড়াতাড়ি শুরু করা যায় তত নিজের জন্য, নিজের চারপাশের পরিবেশের জন্য মঙ্গল। কোনো কিছুকেই বাইপাস নয়। যাই আসুক, 'সত্যেরে লও সহজে' বলেই মনের গোডাউনে আর চালান করে দেওয়া নয়। সহজে কিচ্ছু হয় না। সত্যরে লও জাস্টিফিকেশানে। এই হল কথা। তবেই সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন।