সৌরভ ভট্টাচার্য
31 March 2020
গল্পটা এই রকম। একজন তার সারা গায়ে ট্যাটু করাবে ঠিক করল। এখন মানুষের শখ তো কত রকমের হয়। আমার এক ভাই যেমন যেখানেই বেড়াতে যায় সেখানেই একটা করে ট্যাটু করিয়ে ফেলে। যখন ঋষিকেশে গেল তখন হাতের উপর করল বুদ্ধের ট্যাটু। তারপর যখন রাজস্থানে গেল সেখানে করল ঘাড়ের উপর শিবের ট্যাটু। এখন সে হাতে বুদ্ধ, ঘাড়ে মহাদেবকে নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
প্রথমবারের ট্যাটুর সময় আমি ছিলাম। ঋষিকেশের আরেকটু উপরে একটা শহর তপোবন। পাহাড়ি পথ। বেশ ঘিঞ্জি গলি। একটা দোতলা দোকান, উপরের তলায় ট্যাটু হয়, নীচের তলায় ব্যাগ বিক্রি হয়। ভাইকে নিয়ে গেলাম সেখানে। উপরে উঠে দেখি একটা বড় বসার ঘর। সেখানে বেশ কিছু ইংরাজি পত্রিকা রাখা। একটা বইয়ের তাক, সেখানে বেশ কিছু ইংরাজি বই রাখা। ট্যাটুবিদ আমাদের অভ্যর্থনা জানালো, ভাইকে নিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে গেল, ডিজাইন ঠিক করা হবে। আমি একটা সোফায় বসে দূর থেকে ডিজাইন দেখতে লাগলাম, সাথে ট্যাটুবিদকে, তার বয়েস হবে এই তিরিশের আশেপাশে, মোটাসোটা, কিছু ফিট বডি, শরীরের যতগুলো অংশ খোলা, সব জায়গায় ট্যাটু, অর্থাৎ ভ্রাম্যমান জলজ্যান্ত বিজ্ঞাপন বলা যায়। কেশহীন চকচকে মাথা। কব্জীতে ড্রাগন। ঘাড়ে সিংহের মুখ। আরেক কব্জীতে মহাদেব।
ইতিমধ্যে ইয়া লম্বা ঢ্যাঙ্গা এক সাহেব ঢুকল। একটা হাফপ্যান্ট আর সবুজ টিশার্ট পরে, ঢুকেই আমায় বলল, হ্যালো। আমিও বললুম, হ্যালো। আমার সামনে সোফাতে বসেই ব্যাগ থেকে একটা বই বার করে পড়তে শুরু করল। মুখ ভর্তি খয়েরি রঙের দাড়ি, খয়েরি রঙের চুল, হলুদ হলুদ দাঁত। চোখদুটো ঢুলুঢুলু। পা নাচাতে নাচাতে সে বই পড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে হিমালয়ের উপর কোনো বই হবে। আমি আর কি করি, বইয়ের তাক থেকে একটা ওশোর বই নামিয়ে পড়তে শুরু করলাম, যৌন জীবনে আধ্যাত্মিকতা।
হুড়মুড় করে একজন সাহেবিনী ঢুকে পড়ল। ঢুকেই আমায় একটা ‘হাই’ ঠেলে দিয়ে সেই হলদেটে দাঁতের সাহেবের ঘাড় জড়িয়ে ঠোঁটের উপর ঝক্কাস করে চুমু দিয়ে সোফায় ডুবে গেল। ততক্ষণে আমার সেই ভাই আর ট্যাটুবিদ পিছনের কাঁচের দরজা আঁটা ঘরে ঢুকে গেছে। আমার সামনে ওশোর যৌনজীবনের সুক্ষ্ম ব্যাখ্যা, আড়চোখে সামনের সোফায় আর একবার দেখে নিলাম, চুমু আর বেশিদূর গড়াচ্ছে কিনা। না, মেয়েটি একটা ঢোলা টিশার্ট, লালরঙের, একটা থ্রিকোয়াটার্স প্যান্ট পরে সাহেবের গলা জড়িয়ে হামলে পড়ে বইয়ে কিছু দেখছে আর কথা বলছে। বুঝলাম এরা ইংরেজি বলছে না, খুব সম্ভবত ফরাসী ভাষা বলছে। আমার দিকে একবার শ্বেতাঙ্গিনী আড়চোখে দেখল দেখলাম, দেখারই কথা, ফুলহাতা পাঞ্জাবি আর একটা জিন্সের প্যান্ট পরে বসে আছি, ভাবছে নিশ্চয় এ ট্যাটু করলে কোথায় করবে, সব যে ঢাকা।
হঠাৎ ট্যাটুবিদ কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে এসে বলল, আপনি ভিতরে আসতে পারেন, আপনার ভাইয়ের কাজটা শুরু হবে এখন।
ঢুকলাম। মাগো! একি! দেখি একটা খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আরেক সাহেব, টিশার্টটা বুকের কাছে দলা পাকানো, পায়াজামা হাঁটুর কাছে গোটানো। মধ্যখানে কিচ্ছুটি নাই, তিনি ঘাড় কাত করে দরজার দিকে ফিরে শুয়ে, মাঝে মাঝে কাতরে উঠছে, তার দুই ধবধবে শুভ্রফেনিল নিতম্ব জুড়ে সাগরের ঢেউ আঁকা হচ্ছে, যার মাথায় একটা মানুষের মাথার মত কিছু, যেটা কোমরের কাছটায় শেষ হয়েছে।
বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে, সূঁচের আগায় বিন্দু বিন্দু রক্ত জমছে, নিতম্বের ঢাল বেয়ে সে রক্তবিন্দু চুঁইতেই কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে। বাবা রে বাবা, কি শখ গা তোমার সাহেব, বলি গাঁজা চরস খেয়ে সাধ্যসাধনার তো হিড়িক বাইরে লেগেই আছে, তার উপরে একি সাধনা। আমার চড়কের কথা মনে পড়ল। সেও কি কম গা!
যা হোক, ভাই চেয়ারে বসে। তার হাতটা ট্যাটুবিদের হাতে ধরা। সে একটা স্পিরিট বা ওই জাতীয় কিছু তরল দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করছে, আমায় হেসে বলা হল, আপনি বসতে পারেন।
বসলাম, জানি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। যেই সে সূঁচটা ভাইয়ের হাতে ছুঁইয়েছে অমনি আমি সটান উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, আমি বরং বাইরে বসি, তোর হয়ে গেলে আয়। আমার কলিজার জোর দেখে ট্যাটুবিদ মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা।
আরে ভাই এতেও কি রক্ষে, এইতে তো ভুলেই গেছিলাম বাইরে আরো দুই মূর্তিমান বসে। কাঁচের দরজা ঠেলে যেই না বাইরে এসেছি, অমনি দেখি দুজনের সেকি ঘাড়ের উপর উঠে, মুখের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে... বলি এসব সিনেমায় দেখা ভালো লাগে, তা ধর্মতলাতেও না হয় দেখে নিতে পারি, তা বলে এমন তপোবনে? কেন রে, এখন একটু ধ্যানট্যান করে মনটাকে শান্ত করে নে না রে বাপু। আর তো এমন শান্ত, মনোমুগ্ধকর পরিবেশ পাবিটাবি না।
আমায় দেখেই অবিশ্যি জড়ামড়ি অবস্থাটা ছেড়ে, টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক হয়ে বসে পড়ল দুজন। আমি যেন হেডমাষ্টার, তারা যেন আমার স্কুলের ছাত্র, যত্তসব! আমি আমার পুরোনো জায়গায় বসে আবার যৌনজীবনে অধ্যাত্মিকতার খোলা পাতার দিকে তাকালাম। সেদিন এই লছমন ঝোলার সামনের ক্যাফেটাতে ঢুকতে দিল না, বলে কি না সাহেবসুবো ছাড়া অনুমতি নেই, স্পর্ধা!
যা হোক বসে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছি, ভিতরে কৈলাস আর বাইরে বৃন্দাবন – এমন অবস্থায় কি কর্তব্য ঠাওরাচ্ছি, এমন সময় রুমির একটা গল্প মনে পড়ল। বলি হ্যাঁ, শুনুন।
এই কথাটা দিয়ে আমরা লেখাটাও শুরু করেছিলাম। তা একজনের শখ হল সে ট্যাটু করাবে। গেছে সে ট্যাটুবিদের কাছে। একটা সিংহের ছবি আঁকাবে সে, শরীরে ট্যাটুর স্থানও নির্দিষ্ট করা গেছে। সে চেয়ারে আরাম করে বসেছে, কিন্তু যেই না ট্যাটুবিদ তার হাতে সূঁচটা বিঁধিয়েছে, সে চীৎকার করে উঠেছে, উফ, উফ, তুমি আঁকছ ট্যাটুবিদ?
ট্যাটুবিদ বলল, কেন ভাই, সিংহ?
সে কাতর স্বরে বলল, সিংহের কি আঁকছ?
ট্যাটুবিদ বলল, লেজ।
সে আবার কাতর স্বরে বলল, থাক থাক, তুমি লেজ ছাড়াই আঁকো।
ট্যাটুবিদ বলল, বেশ, তাই আঁকছি।
আবার যেই সে সুঁচটা বিঁধিয়েছে, এ আবার যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে বলছে, এবার কি আঁকছ?
সে বলল, সিংহের প্রথম পা’টা।
সে বলল, থাক থাক, তোমার পা এঁকে কাজ নেই, আমি পা ছাড়াই সিংহ নেব।
ট্যাটুবিদ বলল, আচ্ছা।
যেই না সে আবার সূঁচটা বিঁধিয়েছে, অমনি খদ্দের আবার চীৎকার করে বলে উঠেছে, কি, কি আঁকছ এখন?
সে বলল, সিংহের পেট।
খদ্দের বলল, থাক, তোমাকে ওর পেট আঁকতে হবে না...তুমি পেট ছাড়াই সিংহ আঁকো।
ট্যাটুবিদ সূঁচটা সরিয়ে রেখে বলল, ভাই আল্লহা স্বয়ং লেজ, পা, পেট ছাড়া সিংহ বানাতে পারেনি, আমি কি পারব? বলে সে কাজে ইস্তফা দিল।
তাই রুমি বলছে, দেখো দুঃখ তো তোমায় পেতেই হবে। কোন আছিলা থেকে সরে কোন আছিলায় যাবে? রবি ঠাকুর গাইতে শেখাচ্ছেন না? “দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?... এড়িয়ে তারে পালাস না রে, ধরা দিতে হোস না কাতর/ দীর্ঘপথে ছুটে ছুটে দীর্ঘ করিস পথটারে তোর।”
ভাইয়ের ট্যাটু হয়ে গেল। সেদিন রাতে এল তার জ্বর। কেউ বকল, কেউ শাসন করল, কেউ সাবধান করল। আমি কিছু বললাম না। ভাই না হয় বাইরে একটা ট্যাটুর শখে আজ জ্বর এনেছে, কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই কি জীবনের নানা বাঁকে, নানা অদৃশ্য ট্যাটু আঁকার শখে, নানা রকম মাশুল দিইনি? দিচ্ছি তো, ভবিষ্যতেও দেব। আমাদের ট্যাটুগুলো দেখা যায় না এই যা।
রুমি থেকে রামকৃষ্ণ যে ট্যাটুবিদের কাছে ট্যাটু করাতে যেতে বলেন, সে ট্যাটুবিদেরও কি কম বায়নাক্কা? “আঘাত দিয়ে কহো মোরে, এই তো আমার কর... আমার চোখ বেঁধে ভবের খেলায়... বলছ হরি আমায় ধর...” গাইছেন না অতুলপ্রসাদ?
এ ব্যথা সইতেই হবে। কথা হচ্ছে আমার ট্যাটুবিদ কে? ভালোবাসা, তুমি ছাড়া আর কে? পুড়িয়ে নাও... পুড়িয়ে নাও...