Skip to main content

ধর্মের দুটো অন্ধকার আছে। এক, ধর্মের কিছু কুসংস্কারের দিক, বা অন্ধবিশ্বাসের দিক। রামকৃষ্ণদেবের ভাষায় সব ধর্মেই কিছু না কিছু গোলমাল আছে। আর এক অন্ধকার হল, ধর্মকে না জানার অন্ধকার। 

    সমাজে বাস করতে গেলে যেমন ন্যূনতম আইনকানুন, হিসাব নিকাশ, ইতিহাস-বিজ্ঞান-সাহিত্য ইত্যাদি সম্বন্ধে জেনে সমাজে থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়, তেমন ধর্মের বহুত্ব নিয়েই সম্যক জ্ঞান থাকা দরকার বলে আমার মনে হয়। 

    বিজ্ঞানের এমন তুমুল অগ্রগতির পরেও যখন ধর্ম আছে তখন এটা মেনে নেওয়ার সময় এসে গেছে যে ধর্ম থেকেই যাবে। অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের সত্য ও নানাবিধ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই থেকে যাবে। কেন থাকবে, সে ব্যাখ্যায় গিয়ে লাভ নেই। বাস্তব সত্য হল, ধর্ম আছে। বহু বহু মানুষের জীবনে অনুশীলন হয়ে আছে। এ বাস্তব। 

    আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি বললে আসলে কিছুই বোঝায় না। ওটা আলগোছে বলা কথা। আমি রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ, মুহম্মদ, যীশু, রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, রামকৃষ্ণ, লালন, সাঁই ইত্যাদি কারোর না কারোর ভাবের ঈশ্বরকে মানি। এখন অনেকের ঈশ্বরের সঙ্গেই অনেকের ঈশ্বরের ভাব মেলে না। যে কারণে আমাদের ধর্মে বৈষ্ণব ও শাক্তের কোন্দল। একজনের পূজায় যা ব্রাত্য, আরেকজনের পূজায় তা-ই আবশ্যিক। 

    এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে যে কথাটা বলতে চাইছি, তা হল সব ধর্মের মধ্যে একটা সার্বজনীনতা অনর্থক না খুঁজে, ধর্মের মধ্যে বহুত্বকে জানাই দরকার। যেমন, ক্রিকেট আর দাবা দুটোই খেলা। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র একটা ক্যাটাগরিতে ফেলার জন্যেই 'খেলা' শব্দটা নির্বাচন করা, এও তেমন। বুদ্ধের নির্বাণের সঙ্গে ইসলামের স্বর্গের কোনো মিল নেই, না তো বৈষ্ণবের ঈশ্বর প্রেমের। কিন্তু আলগোছে বললে, সবটাই ধর্ম। আসলে না তো। এই বহুত্বকে তার পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী না জানলে আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে, যেখানে একজনের, একদেশের ফিসফিসানি সারা বিশ্বে মুহূর্তে রাষ্ট্র হয়ে যাচ্ছে, সেখানে শান্তিতে বাস করা খুব শক্ত। অসম্ভব। 

    অনেকে বলে থাকেন, সব ধর্মের মূল কথাই হল, ভালো হওয়া ও ভালো করা। স্বামীজির আদর্শ অনুযায়ী এ কথা বহুবার উদ্ধৃতও হয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মানুষ হিসাবে ভালো হওয়া আর একটা সম্প্রদায়ের মানুষ হিসাবে ভালো হওয়ার মধ্যে পার্থক্য তো আছেই। এক-এক সম্প্রদায়ের ভালো হওয়ার সংজ্ঞা বা বিধিনিষেধ এক-একরকম। 

    তবে যদি বলা হয় মানুষ হিসাবে ভালো হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, মানে সে অন্যের ক্ষতি করে না, চুরি করে না, মিথ্যা বলে না ইত্যাদি, তো সেগুলো তো কোনো ঈশ্বরে বিশ্বাস থেকে জন্মাতে হবে এমন কোনো কথা নেই, বা কোনো এক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই আছে এমনও কোনো কথা নেই। ওটা সামাজিক ধর্ম। বিশ্বাসের ধর্ম না। সমাজে বাঁচতে গেলে কিছু নীতি মেনে চলতে হয়, নইলে পুলিশে ধরে, মামলা-মোকদ্দমা হয়। তার সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগাযোগ নেই। বহু অসামাজিক, দুর্নীতিপরায়ণ মানুষকে আমরা ধর্মের রাজ্যে জানি, যাদের সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস তাদের অসামাজিক আচরণকে ঢেকে রাখতে সাহায্য করে। কিম্বা হয় তো সে যে অপরাধ করেছে সে বোধটাও হতে দেয় না। 

    আবার আগের কথায় ফিরি। এই ইন্টারনেটের যুগে আমরা এত কাছাকাছি যে আমাদের এখন ধর্মের বহুত্ব সম্বন্ধে একটা প্রাথমিকবোধ শিক্ষা দেওয়া খুব দরকার। যাতে কেউ কোনো বিরূপ মন্তব্য করলেই আমি বলতে পারি এটা ভুল বলা হচ্ছে। যেমন কেউ যদি বলে, দাবা খেলায় চারটে ছয় না মারলে জেতা যায় না, বা হাডুডু খেলায় বল হারিয়ে গেল বলে খেলা হল না, বা ক্রিকেটে বোড়ের আগে হাতির চাল দিতে নেই --- এ সব কথা যেমন আমাদের কানে অসংগত ঠেকে, ধর্মের বেলাতেও যেন তা-ই হয়। আমাদের প্রতিবেশীর ধর্ম নিয়ে অজ্ঞতা যেন কারোর আগুন জ্বালানোর ইন্ধন না হয়। আমরা যেন জানি অন্তত মূলভাবটুকুও। 

    এখন প্রশ্ন হতে পারে, জানা এক, আর হিংসা এক। তার বেলা? সেক্ষেত্রে আমার সাধারণ বুদ্ধি আর এদ্দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে এত এত যুগ ধরে এত লক্ষকোটি মানুষ এত এত বৈচিত্র আর বহুত্ব নিয়ে যে বেঁচে আছে সে আমাদের স্বভাবে শান্তিপ্রিয়তা আছে বলেই। সে শান্তিপ্রিয়তা কখনও কখনও বিগড়ে যায় না বলছি না, কিন্তু সে বিগড়ানোর জন্য কিছু না কিছু অনুঘটক কাজ করেই। নইলে এ জগৎ শুধু কয়েকজন মহাপুরুষের বাণীর দিকে তাকিয়ে বেঁচে নেই। মানুষ আদতে শান্তিপ্রিয় বলেই বেঁচে আছে। এই শান্তিপ্রিয়তাকে কায়েমি করতে গেলে আমাদের নিজেদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে, নানা ধর্মের প্রাথমিক জ্ঞান আর দেশে দেশে ধর্মের বহুত্বকে স্বীকার করে।