“সবাই যারে সব দিতেছে”...
"আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”...
“ওরা কাজ করে”...
"ওরা অকারণে চঞ্চল”...
‘সবাই’... 'ওরা’... এ দুটো শব্দের ব্যবহার নিয়ে নতুন করে আর কি বলার। অহরহ ব্যবহৃত হওয়া অতি প্রয়োজনীয় দুটো শব্দ। আমি আপনি জগাদা পটাদা কাকা মামা পিসে ভাগ্নে ভাগ্নী বন্ধু... আমরা সবাই ব্যবহার করছি। আবার মন্ত্রী খেলোয়াড় জ্ঞানীগুণী মানুষ... ওরাও ব্যবহার করছেন।
দেখুন, বলতে বলতেই, 'সবাই' আর 'ওরা' এই কথাদুটোর ব্যবহার করা হয়ে গেল। কে এই ‘সবাই’ আর ‘ওরা’?
সবাই
-----------
তা কে এই ‘সবাই’? সবাই মানে কি সম্পূর্ণ মানবজাতি? না একটা গোষ্ঠী বা দল বা সম্প্রদায়? কয়েকটা দিক থেকে ভাবা যাক। পৃথিবীর আদিমতম বিভাজনের মধ্যে অবশ্যই একটি বড় বিভজন কর্তা ধর্ম (religion অর্থে)। তাই দিয়েই শুরু করা যাক।
কিছু ধর্মনীতিতে ‘সবাই’ মানে সবাই। সেখানে পশুপাখী থেকে জড়পদার্থ অবধি এক, যদি তা 'বেদান্ত দর্শন' হয় বা 'Pantheism' বা এই ধরণের কোনো দর্শনভিত্তিক ধর্ম হয়। আর যদি বিশেষ সম্প্রদায়ের ধর্ম হয় তো তবে 'সবাই' মানে সেই বিশেষ ধর্মাবলম্বীরাই হবেন ‘সবাই’। অর্থাৎ ধর্মের ক্ষেত্রে ‘সবাই’ বললে, দেখতে হবে কোন সম্প্রদায়ের থেকে কথাগুলো উঠছে। যেমন বৈষ্ণব শাক্ত খ্রীষ্ট বৌদ্ধ মুসলমান ইত্যাদিরা যখন ‘আমরা সবাই’ বলেন তখন তা একটি বিশেষ বিশ্বাসের কথা মাথায় রেখেই বলেন। আর এই ‘সবাই’ এর সীমাটা যদি কেউ আত্মশক্তিতে বাড়িয়ে আরো বড় করে নেন, তখনই তৈরি হয় ইতিহাসের এক একটা অধ্যায়।
এবার দেশপ্রেমের কথায় আসা যাক। ‘আমরা ভারতীয়’... 'আমরা আমেরিকান’... 'আমরা বাংলাদেশী’... অর্থাৎ, এ ‘সবাই’ও সারা মনুষ্যজাতি নয়। একে আমরা Nationalism বলি। এও এক ধরণের ‘সবাই’, কিন্তু সবাই না।
এরপর আসে অর্থনীতি অনুযায়ী। ‘আমরা মধ্যবিত্তেরা’ – এক প্রকার 'সবাই'। ‘আমরা গরীব লোকেরা’ – আরেক প্রকার 'সবাই'। এরকম নানারকম 'সবাই'।
তারপর রাজনীতির 'সবাই'। ‘আমরা লাল’... 'আমরা সবুজ’... 'আমরা গেরুয়া’... আবার 'সবাই'য়ের লিস্ট। কিন্তু সব সবাই 'সবাই' না। অথচ ভাষণে দেখুন বলা হচ্ছে, ‘ভাইসবগণ, আমরা...’ ইত্যাদি। কোন লোকেরা ভাইসব আর কোন লোকেরা নন, তা ভোটের রেজাল্টের পর বোঝা যাচ্ছে।
তারপর শরীরের রঙ, উচ্চতা, সৌন্দর্য্য, যৌনতার নানান প্রকারের উপরে ‘আমরা সবাই’ আছে।এরপর খেলা, পেশা, শিক্ষা, রাজ্য, জেলা, পাড়া, বাঙাল-ঘটি, স্মার্টফোন-বেসিক ফোন, উত্তম-সৌমিত্র, দেব-জিৎ ইত্যাদির 'আমরা সবাই' দল তো আছেই। আরো কত উহ্য গেল।
তা দাঁড়ালো এই, সব ‘সবাই’ কিন্তু সবাই না। তা হলে কার 'সবাই' কতটা সেটা কিসের ওপর নির্ভর করছে? এ বলা শক্ত। আমরা যখনই উচ্চারণ করছি ‘সবাই’, তখনই ভাবখানা এমন যেন বলতে চাইছি বিশ্বশুদ্ধ সব্বাই। তা তো নয়। ‘সবাই’ মানে একটা দল। এইটাই সঠিক ব্যবহারযোগ্য ধারণা।
ওরা
--------
এখন এই ‘ওরা’টা তা হলে কারা? সহজ হিসাব। যারাই ‘সবাই’ এর মধ্যে পড়লেন না, তারাই হয়ে গেলেন ‘ওরা’।
এই ‘ওরা’ শব্দটার উপর আমাদের একটা গভীর ঈর্ষা বিদ্বেষ, আবার মনের গভীরে কোথাও একটা লোভও। ‘ওরা’র কিছুকে যদি ‘সবাই’ করে নেওয়া যায়, কেমন হয়? বেশ হয়, না? মানুষ নিশ্চিন্ত হয় ‘সবাই’ শব্দের আশ্রয়ে। বড় সংখ্যার গর্বে। কিন্তু ধরা যাক যদি, ‘ওরা’র চক্করে ‘সবাই’ এর সীমা কমতে শুরু করেছে, তখন? তখন আমি মনে মনে প্রমাদ গণি।
আমরা শ্রেষ্ঠ। আমরা আমরাই। ওরা ওরাই। আমরা আছি, ছিলাম আর থাকব। ওরা যে কেন আছে? বাড়তি লোকজন সব! আমাদের মতের বিরুদ্ধে যায়। আমরা আস্তিক, ওরা নাস্তিক। আমরা শাসক, ওরা বিরোধী। আমরা স্বাভাবিক, ওরা সমকামী, হিজড়া ইত্যাদি, মানে ভালো ভাষায় LGBT আর কি! আমরা সঠিক, ওরা সম্পূর্ণ ভুল না হলেও অতি ক্ষুদ্র অংশেই হয় তো বা ঠিক, যা ধর্তব্যের মধ্যেই আসে না আমাদের সাথে তুলনায়!
এই উন্নাসিকতা মনের গোপনে সব ‘সবাই’ এর আড়ালে কিছুটা হলেও থাকে। এও দেখেছি, যারা কোনো ‘সবাই’ এর মধ্যে ঢুকতে পেলো না, তারাও নিজেরা একটা আলাদা ‘আমরা সবাই’ বানিয়ে নেয়।
'সবাই' আর 'ওরা' – দুটো স্বতঃবিরোধী শব্দ। তবে কি এর মীমাংসা হয় না?
হয়, একটা শব্দেই হয়। সেটা হল আধুনিক বিজ্ঞান। আমি বিজ্ঞান বলতে Technology বলছি না। আমি বিজ্ঞান অর্থে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বলতে চাইছি। তাত্ত্বিক বিজ্ঞান।
আর সেই বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে যে ধর্ম, তাকে বলি – মানবধর্ম। আমার খিদে যেমন পায়, তোমারও তেমন পায়। আমার হাড় ভাঙলে যেমন যন্ত্রণা হয়, তোমারও হয়। হয়তো তোমার সহ্যক্ষমতা আমার থেকে বেশি, তাই প্রকাশটা আলাদা কিন্তু যন্ত্রণাটা সমান।
এ যেন অনেকটা সেই গোল্ডেন রুলের মত কথা – অন্যের সাথে তেমন ব্যবহারই করো, যেমন ব্যবহার তুমি অন্যের কাছ থেকে আশা করো।
সেই বিজ্ঞানে এসে আমি তুমি রাম শ্যাম সব এক। বিজ্ঞানের দুনিয়ায় ‘ওরা’ শব্দের ঠাঁই নেই। যেখানে আছে সেখানেই সে ব্যর্থ। আর সঠিক দর্শনেও সেই ‘ওরা’ শব্দের অস্তিত্ব নেই। তাই যেখানেই এই মূল কথাটা থেকে ধর্ম সরে গেছে, সেখানে সে উগ্র হয়ে উঠেছে। আর বিজ্ঞানও যেখানে দল পাকাতে গেছে সেখানে সে আতঙ্ক হয়ে উঠেছে। তার ‘সবাই’-এর চারদিকে শক্ত বেড়া। ‘ওরা’ শব্দের অস্তিত্বটাকে তীব্রভাবে ঘৃণা করতে শিখেছে আর শিখিয়ে চলেছে তারা। তার সমাপ্তি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় – অপঘাতে।
তাই আমাদের সেই দর্শনের দিকে আরো জোর কদমে এগোতে হবে যে দর্শন আমাদের ‘সবাই’-এর পরিধি বাড়িয়ে ‘ওরা’কেও মিলিয়ে নেবে। তবেই শান্তিতে সহাবস্থান। খেয়াল করে দেখতে হবে, আমাদের ‘সবাই’-এর ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে কাউকে জোর করে না ঢুকিয়ে, ‘সবাই’টাকেই বাড়িয়ে নিলে হয়, যাতে ‘ওরা’ও আমাদের ‘সবাই’ এর আওতাতেই এসে পড়ে।
শ্রী সারদা দেবীর মৃত্যুর প্রাক্কালে উচ্চারিত সেই অমোঘ নিদানটি মনে পড়ল – "জগতে কেউ তোমার পর নয়, জগতকে আপনার করে নিতে শেখো।"
বিস্ময় জাগে এতবড় ক্ষমতা পেয়েছিলেন কি করে? আর শুধু তো বলেননি, করেও দেখিয়েছিলেন। এক তথাকথিত সমাজের অচ্ছুৎ মানুষের যখন তিনি এঁটো তুলছিলেন, একজন ভৎর্সনা করে বলেন, “কি ছত্রিশ জাতের এঁটো কুড়াচ্ছো? তুমি না বামুন?!”
সারদা দেবী তাকে জবাব দেন, “ছত্রিশ কইরে? সবই তো দেখি আমার।”
ইতিহাসে এমন অসামান্য চরিত্র আর ক'টি এসেছেন জানি না, আর আসবেন কিনা তাও জানি না। মহান কর্মক্ষেত্রে নয়, আটপৌরে জীবনযাত্রায়, প্রতিদিনের হাজার তুচ্ছতার মধ্যে এমন একটা জীবনী – খুব বড় একটা অনুপ্রেরণা তো অবশ্যই। এতবড় উদাহরণ ঘরের পাশে থাকতে আর এদিক ওদিক দৌড়িয়ে কি হবে? তবে সে অন্য আলোচনা।