একটা সময় ছিল যখন অ্যাড দেখতে ভালো লাগত। তখন অবশ্য অ্যাড বলা অভ্যাস ছিল না। তখন বলতাম ‘অ্যাডভ্যাটাইজমেন্ট’। সিনেমার মধ্যে মধ্যে, সিরিয়ালের মধ্যে মধ্যে, খেলার মধ্যে মধ্যে দেখাত। মুগ্ধ হয়ে দেখতাম।
আজকের দিনে এই রিল বা শর্টস একই জিনিস, কিছুটা মডিফায়েড। অ্যাড বা রিল কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে, বা মিনিটের মধ্যে একটা গল্প বলে দেয়, যা দর্শককে অ্যাপিল করার ক্ষমতা রাখে। পার্থক্য হল অ্যাডগুলোর অ্যাজেন্ডা ছিল জিনিস বিক্রি করা, রিলের অ্যাজেন্ডা হল আমাকে এন্টারটেইন করা। এবং সেই সুবাদে কিছু মানুষ টাকা উপার্জন করছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
মুশকিল হল অ্যাড কোনো জিনিস বিক্রি করার জন্য যে ধরণের মিথ্যার আশ্রয় নিত, সেই মিথ্যাগুলো ছিল অনেকটা নিরীহ প্রকৃতির বা কম ক্ষতিকারক। অতিরঞ্জিত। যেমন সে ওয়াশিং পাওডারে “দুধের মত” সাদা হওয়ার কথা, আদতে তা হয় না। যে শ্যাম্পুতে চুল ওঠা বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, তা হয় না ইত্যাদি। এই মিথ্যাগুলো ছিল লোকালাইজড মিথ্যা। একটা সীমার মধ্যে মিথ্যা। কিন্তু রিলের মাধ্যমে মনোরঞ্জন করানোর জন্য যে মিথ্যা প্রচার চলছে সেটা ভয়ানক। সুদূরপ্রসারী ক্ষতি তাতে।
হোয়াটসঅ্যাপ ইউনিভার্সিটি এখন একটা প্রচলিত শব্দ। তার মাধ্যমে কী বলতে চাওয়া হচ্ছে সেটা আমরা বুঝি। কিন্তু রিলের ইউনিভার্সিটিও এই মিথ্যা প্রচারে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। হোয়াটসঅ্যাপে মাথা বিগড়াচ্ছে বয়স্কদের বেশি, রিলে ভ্রান্ত তথ্যে বিপথগামী করছে অল্প বয়েসীদের।
কদিন আগে সিউডোসায়েন্স নিয়ে লিখেছিলাম। সিউডোসায়েন্স আর সায়েন্স ফিকশানের মধ্যে পার্থক্যটা ঘুচিয়ে দিতে বসেছে এই রিলের ছদ্মজ্ঞানীর দল। কী তার ফলাফল আমি প্রায় রোজই সম্মুখীন হচ্ছি আমার ছাত্রছাত্রী আর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের ছেলেমেয়েদের কাছে। তারা এমন সব জিনিসকে বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত বলে জানছে যার সঙ্গে বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্কই নেই।
আমাদের দেশে সঠিক অর্থে সেক্স এডুকেশনের ব্যবস্থা নেই। কিন্তু রিল আছে। পডকাস্ট আছে। আর সিউডোসায়েন্সর রমরমা বাজার আছে। কদিন আগে মেনস্ট্রুয়েশান সাইকেল পড়াচ্ছি, একজন ক্লাস টুয়েলভের ছাত্র বলল, মেয়েদের শরীর থেকে এই সময়ে একটা নেগেটিভ এনার্জি বেরোয় না? যার জন্য কোনো ভালো কাজ এই সময়ে করতে নেই বলে, ঠিক তো?
চমকে উঠলাম কথাটা শুনে। জিজ্ঞাসা করলাম, কে বলেছে? উত্তর এলো রিলে দেখেছে। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছে।
আমি একটা উদাহরণ দিলাম। আরো রিল-জাত তথ্য আছে। মাস্টারবেশন করলে নার্ভ সেল ড্যামেজ হয়। সেরিব্রাল কর্টেক্স কুঁচকে যায়। শুক্রাণু ঘাম দিয়ে বেরিয়ে যায়। ইত্যাদি ইত্যাদি। মজার বিষয় এর মধ্যে সদগুরুর মত জনপ্রিয় মানুষের ভিডিও আছে। যেখানে তারা আমিষ, নিরামিষ, মাস্টারবেশান, মেনস্ট্রুয়েশান সাইকেল ইত্যাদি সবার শুচি-অশুচিবাইকে শরীরবিজ্ঞানের সঙ্গে মিশিয়ে একাকার করে দেখাচ্ছে। এরপর আছে নানা অলৌকিক বস্তুর ব্যাখ্যা। কেউ কেন কৈলাসে ওঠে না। কারণ শিবের অভিশাপ লাগে। রামসেতুর প্রমাণ ইত্যাদি তো আছেই।
এই বিপদটা সেদিনের অ্যাডের জগতে ছিল না। এই সিউডোসায়েন্স, ভ্রান্ততথ্যের সচেতন মার্কেটিং সেদিন ছিল না। আজ আছে।
এখন কথা হল এই অভ্যাস থেকে ছেলেমেয়েদের সরানো সম্ভব নয়। আমি একদম শিশুদের কথা বলছি না। বা বয়স্কদের কথা বলছি না। আমার বলার উদ্দেশ্য কিশোর আর সদ্য যৌবনে পা দেওয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে। যারা বাড়িতে ভয়ে না দেখলেও টিউশান ব্যাচে বা স্কুলে অনায়াসে দেখছে আর ভ্রান্ত হচ্ছে।
এর থেকে বাঁচার উপায় কী?
সে প্রসঙ্গে আসছি। কিন্তু তার আগে এই লেখার মাধ্যমেই ভারতের একজন কৃতী মনোবৈজ্ঞানিক সুধীর কক্কড় প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যিনি গতকাল মারা গেলেন। তিনি প্রথম যিনি ভারতের ধর্ম চেতনায় যৌনতার দিকটা নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন এবং অনেক অগম্য, অনালোকিত, অনালোচিত বিষয়ে আলোচনা করেছেন। ওঁর জীবনের শেষের দিকে কয়েকটা বিষয় নিয়ে ওঁর সঙ্গে ইমেলের মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছে, দেখেছি ওই বয়সেও কী তীক্ষ্মতার সঙ্গে ও দরদের সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন ও সংশয় দূর করেছেন।
যৌনতা এমন একটা জিনিস যাকে শাসনে দাবিয়ে রাখলে, ধর্মের অলীক যুক্তিতে ধোঁয়াশা করে রাখলে হিতে বিপরীত হয়। মুশকিল হচ্ছে যে, যে সময়টাকে আমরা ভারতের নবজাগরণ বলছি, সেই সময়েও যৌনতা নিয়ে ঢাকাঢাকি চলেছে ও তাকে বিজ্ঞানের আলোয় না দেখে, ধর্মীয় নানা মতামতকে অভ্রান্ত ও ধ্রুবসত্য জেনে সেই অনুযায়ী ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলেছে। ফলে অন্ধকার আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। যার থেকে বেরিয়ে আজও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পরিণত একটা দৃষ্টিকোণে আসতে পারেনি। যার জন্যে ‘'ও মাই গড- ২” সিনেমায় মাস্টারবেশন ও যৌনশিক্ষার প্রসঙ্গকে বিষয় করতে হচ্ছে। কিন্তু এ-তো সিনেমার বিষয় নয়, এ শিক্ষার বিষয়।
পূর্বপ্রসঙ্গে ফিরি, উপায়টা কী তবে? এই বিভ্রান্তিকর তথ্যের হাত থেকে কিশোর বয়সকে আর প্রথম যৌবনকে বাঁচানোর উপায় কী?
আবার আগের দিনের অভ্যাসে যাই। আগে কী হত, আমাদের অনেকেরই ডিকশনারি দেখার অভ্যাস তৈরি হত না। ফলে কোনো ইংরেজি শব্দের মানে আটকালেই যাকে হাতের কাছে পাওয়া যায় তাকেই জিজ্ঞাসা করে নেওয়া হত। হয় তো সঠিক উত্তর সব সময় পাওয়াও যেত না। কিন্তু কাজ চালিয়ে নিত অনেকে। কিন্তু তার মধ্যেই অনেকের আবার ডিকশনারি দেখার অভ্যাস গড়ে উঠত, শিক্ষকদের আর অভিভাবকদের প্রেরণায় বা বকাঝকায় যেভাবেই হোক।
ঠিক ওইটাই আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। রিল দেখা বন্ধ করা সম্ভব না। কিন্তু ক্রস চেকিং বা ফ্যাক্ট চেকিং করাটা শেখাতে হবে। যে ইন্টারনেটের সাহায্যে, যে মোবাইলে সে রিল দেখছে, সেই মোবাইলেই গুগলের মাধ্যমে বা এ-আই এর মাধ্যমে সঠিক তথ্যটা খুঁজতেও শিখতে হবে। ঠিক ঠিক বুকলেট ডাউনলোড করে পড়ার অভ্যাসটা করতে হবে। এটাই রাস্তা এখন। সবাই কী করবে? একদম না। সেদিনও যেমন ডিকশনারি খোঁজায় অলসতা ছিল তেমন অনেকেরই আজও থাকবে ফ্যাক্ট চেকিং করাতে। যা করতে কয়েক মিনিট লাগে। কিন্তু তবু আমাদের বারবার বলতে হবে এই কাজটা করার জন্য। আত্মদীপ ভব - এ সত্যকে অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন সেই কাজটাই অনেক সহজ করে দিচ্ছে এ-আই। শুধু সঠিক অভ্যাসটা ওই বয়সেই গড়ে তোলার শিক্ষাটা দিতে হবে। কয়েকজন যখন সঠিক তথ্যটা জানবে তারাই ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে কথা বলবে। মজার কথা হল আলোটাকে প্রচার করতে হয় না, অন্ধকারটাকে দূর করতেই যা বেগ পেতে হয়, আর আলোটা সামনে রাখলে সেটা আপনিই মিলিয়ে যায়। তাই তাদের অভ্যাসটা যাতে গড়ে ওঠে সে চেষ্টা করতে হবে। আর এ দায় আমাদের সবারই।