বাংলায় নারীশক্তি বললে প্রথমেই যার কথা মাথায় আসে আমার, তিনি হলেন মা কালী। কোনো আধ্যাত্মিক বা শাস্ত্রীয় বা দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছি না। একদম খাঁটি বিশুদ্ধ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছি। আমার বোধবুদ্ধির বয়েস হল বাম শাসনের যুগে। সে যুগেও দক্ষিণেশ্বরে পয়লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া, কালীপুজো, মায় পঁচিশে ডিসেম্বরেও যা ভিড় দেখেছি, আজও সেই। বাম এলো গেল, কিন্তু সমাজে বামের নিরীশ্বরবাদের দর্শনের কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না। এমনকি এত বছর ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে উচ্চবিদ্যালয়ের সিলেবাস চালিয়েও কোনো পরিবর্তন সমাজে হয়নি।
তাই বলছিলাম, বাঙালী সমাজে কালীই হলেন সব চাইতে শক্তিশালী নারীশক্তি। দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠ এগুলো হাইপ্রোফাইল কেন্দ্র। তার সঙ্গে কঙ্কালীতলা, রামপ্রসাদের ভিটে, শ্যামনগরের কালীবাড়ি এসব তো আছেই।
এরপরে বাঙালি সমাজে সব চাইতে বড় উৎসবের কথা দেখা যায় যদি, সেখানে দুর্গাপুজো। তারপর বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মী, সরস্বতী, মনসা এ সবের পুজো তো আছেই। বাঙালি সমাজে নারীশক্তির কাছে শিব, কৃষ্ণ গৌণ। রাম তেমন কল্কে পাননি কোনোদিন। যদিও বাঙালি সমাজে গোঁড়া বৈষ্ণব সম্প্রদায় আজও আছেন, তারা আবার কোনো নারীশক্তি মানেন না। তারা আসলে কিছুটা প্রাচীন সমাজের সূত্রধরে চলেন। আধুনিক বৈষ্ণবেরা, মানে যেমন ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, কি মহানামব্রত ব্রহ্মচারী - এনারা আবার শক্তির কথা বেশ মানেন। এদের সম্প্রদায়ে নারীশক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া আছে।
আবার শব্দের চক্করে গুলিয়ে যাওয়া সম্প্রদায়ও আছে। যেমন পুরুষোত্তম শব্দটা যখন উচ্চারিত হল, তখন এক সম্প্রদায়ের মানুষ ধরে নিলেন, পুরুষ মানে এখানে শুক্রাশয়, প্রস্টেট গ্ল্যাণ্ড, পুরুষাঙ্গধারী মানুষের ভাগটার কথা বলা হচ্ছে। ফলে তারা আবার নারীশক্তির দিকটাকে গৌণ করে দেখতে চান। পুরুষ মানে যে গীতায়, বা বেদান্ত দর্শনে একটা তত্ত্ব, সে বোঝানো তাদের দুঃসাধ্য।
বাঙালি সমাজে এরপর মা সারদা, আনন্দময়ী মা, মাদার টেরেসা --- এ সবও সেই এক নারীশক্তির কথাই। মানে বাঙালি সমাজ নারীশক্তি অনুগামী। অধ্যাত্মিক দিক থেকে।
কিন্তু মানুষের সমাজে বাঙালি নারীরা কি ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে আলাদা কিছু উপকার পেয়েছেন এই দর্শনে? না। বাঙলায় মেয়েদের মধ্যে কিছুটা খোলা হাওয়া এনে দিয়েছিল ব্রাহ্মসমাজ। আসলে আমরা যতই আমাদের কালী, দুর্গা ইত্যাদির দোহাই দিয়ে বাঙালিদের নারীশক্তির প্রতি অনুরাগের কথা বোঝাই না কেন, আমার মনে হয় বাঙালি পুরুষতন্ত্র কোথাও নারীশক্তিকে নিজেদের বশে এনে নিজেদের নানা বাসনার চরিতার্থতার পথই খুঁজেছিল। বাঙালি যে কৃষ্ণকে আহ্বান করেছিল মহাপ্রভুর সাধনায় সেখানেও পরের দিকে রাধাভাব, গোপীভাব এসে বাঙালির নৈতিক দিকটা খুব একটা উৎসাহ দিতে পেরেছিল বলে এমন কোনো প্রমাণ দেখি না। আর বাঙলার পুরুষ সে অর্থে কোনোদিনই পুরুষ শক্তির কাছে নৈতিকভাবে মাথা নত করেনি। বাঙালি সমাজে শিবের চরিত্রও খুব সুবিধার না।
রবীন্দ্রনাথ এই দোষটা ধরেছিলেন। পিতার মধ্যে শাসন আর মাতার মধ্যে প্রশ্রয়ের বায়না, এ আমাদের সামাজিক বোধে আছে। তাই ডাকাতি করতে কি খুনোখুনি করতেও শক্তিসাধনায় আমাদের বিবেকে লাগেনি, বরং মান্যতা পেয়েছে। পিতা মানে শাসন, আর মাতা মানে প্রশ্রয়, এ আমাদের মজ্জায় মিশে যাওয়া বিশ্বাস। ব্যতিক্রম এসে দাঁড়ালো, যতক্ষণ না আমরা বিদ্যাসাগরের জননীকে নিয়ে আলোচনা করছি।
বাঙালি মাতৃচরিত্রের উজ্জ্বলতম মণি বিদ্যাসাগরের জননী। সত্যি বলতে আমার অল্প বিস্তর পড়াশোনায় আমি ওঁর থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্রের সন্ধান আজও পাইনি। মানুষের সাহস তার পেশীতে না, তার বিবেচনাশক্তিতে। আমি স্তব্ধবাক হয়ে যাই ভগবতীদেবীর বিবেচনা শক্তিতে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের সপক্ষে সূত্র হাজার একটা শাস্ত্রের মধ্যে পেলেও, সত্যকে পেয়েছিলেন মায়ের সম্মতিতেই। “একবার কাজ যখন শুরু করেছ, সমাজের কর্তাদের ভয়ে পিছিয়ে এসো না, উপায় একটা বেরোবেই”... “আমি প্রসন্ন মনে আশীর্বাদ করছি, এই জন্মদুঃখিনীদের যদি কোনো গতি করতে পারো, তা বাবা এখনই করো”।
আচ্ছা, এ কোন মায়ের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়? তিনি কি জানতেন না এ কাজে তার ছেলের জীবনসংশয় অবধি ঘটে যেতে পারে! পণ্ডিতসমাজ কি কম পিছনে লেগেছিল মানুষটার? তবু তিনি বলেছিলেন।
ভগবতীদেবী শিখাতেই জ্বলেছিলেন বিদ্যাসাগর মশাল। যে মানুষ গয়না চান না, আড়ম্বরে পুজো চান না, গ্রামের ছেলেদের জন্য অবৈতনিক স্কুল চান, অন্নসত্র চান, গ্রামের সবার জন্য লেপ-কম্বল চান, তিনি কোন স্কুলে পড়েছিলেন? কোন ম্যানেজমেন্ট ক্লাস করেছিলেন? কোন মোটিভেশানাল কোর্স করেছিলেন? কোন গুরুর আশ্রমে গিয়ে দীক্ষা নিয়ে সাধন করেছিলেন?
এর সবক'টারই উত্তর তো, না। কিন্তু বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর ও ভগবতীদেবী ব্যতিক্রমই রয়ে গেলেন। প্রাতঃস্মরণীয় হলেন না। কারণ তারা কেউ অবতার নন। তাদের মধ্যে কোনো অধ্যাত্মিক শক্তি নেই। বাঙালি সমাজ নৈতিক শক্তি, মানবিক সম্পদ থেকে অধ্যাত্মসম্পদকে বেশি মানে। তিনি মনসা থেকে কালী হোন, তিনি নানা গুরু মা হোন, বাঙালি প্রশ্রয় চায়, সেবা চায়, আদর চায়, অভিমান চায়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের অনুগামী হতে চায় না। ভগবতীদেবীকে নিয়ে চর্চা চায় না।
সমাধি, কীর্তন, পুজো, সাধন, ভাবভক্তি, হাজার হাজার জ্যোতিষীতত্ত্ব - এ সবের অনেক উর্দ্ধে যে মনুষ্যত্বের ভিত্তিভূমি, সেদিকে কবে হাত বাড়াবো আমরা? যেদিন বাঙালির জননীর আদর্শ হবেন ভগবতীদেবী। যা পাঠে পুণ্যের ঝোলা ভর্তি হয় তো হবে না, কিন্তু পবিত্র হবে, সবল হবে চিত্ত। সমাজ দাঁড়ায় মানুষের শুভবুদ্ধির চর্চায়। সে শুভবুদ্ধিকে ফাঁকি দিয়ে, জপে-কীর্তনে কোনোদিন কেউ পায়নি। পেয়েছে সদিচ্ছার জোরে। শুভবুদ্ধি, নিঃস্বার্থবুদ্ধি নিয়ে ধর্মচর্চা আর আত্মপ্রশ্রয়ের ধর্মচর্চার মধ্যে যে পার্থক্য আছে, তা ভগবতীদেবী জানতেন। বিদ্যাসাগর সেই শিক্ষাই পেয়েছিলেন মায়ের কাছে। আর রবীন্দ্রনাথ তাই বিদ্যাসাগরের সম্বন্ধে প্রবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে সেদিন ভগবতীদেবীকে স্মরণ করেছিলেন অত বিস্তারিতভাবে, আবেগে, গভীরতায়। আমারও প্রণাম আজকের নারীদিবস উদযাপনের দিনকে উপলক্ষ্য করে আবার ভগবতীদেবীর স্মৃতিকেই।