Skip to main content
 
       দুরকম সাধনার কথা বলা হল। বাঁদরের ছানা আর বিড়ালের ছানার মত। বলে রামকৃষ্ণ ঠাকুর বললেন, তবে সংসারীদের জন্য বিড়াল ছানার ভাব। কিরকম? না, যে অবস্থাতেই আছি যেন সন্তুষ্ট থাকি। আর বাঁদরের ছানার ভাব? নিজের চেষ্টায় নিজের মনের কেন্দ্র ঠিক করে দাঁড়ানো। ডাইনে বাঁয়ে যেদিক থেকে বাতাস আসুক, নড়লে চড়লে হবে না। স্থির থাকার সাধন। বড্ড কঠিন। হাওয়া কি শুধু শরতের হাওয়া? কোন সময়ে হুস করে কালবোশেখি এসে পড়ে। তখন কলিজার অত জোর কোথায় যে নিজেকে স্থির করে রাখা যায়? একবিন্দুতে অটল-অচল-সুমেরুবৎ দাঁড়ানোর জো নেই তখন।
 
       তাই বললেন দক্ষিণেশ্বরের প্রদীপ জ্বালা ঘরে ছোট্টো ঘরটায় বসে, বেড়ালের ছানার ভাব। সংসারের যে মত অবস্থাতেই শান্ত থাকার সাধন। এখানে নিজেকে স্থির একবিন্দুতে রাখার জেদ নেই, এখানে মনের অপ্রসন্নতাকে ঠেকিয়ে রাখার সাধন। মনকে বলা, বাপু সব ছাড়লেও তুমি ছেড়ো না। প্রসন্ন থেকো। প্রসন্ন রেখো আমায়।
 
 
       কি করে? মাধবানন্দজী, বেলুড়মঠের প্রেসিডেন্ট। সেই যুগের মানুষ। বিশাল পণ্ডিত সজ্জন মানুষ। কিন্তু প্রচণ্ড রাশভারি মানুষ। স্নেহ আছে, কিন্তু শাসনহীন, বল্গাহীন নয়। তা তিনি প্রতিদিন দুপুরে আহারের পর একাগ্র চিত্তে বাইরের জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকেন। কোলের উপর ডান হাতের তর্জনী চিহ্নিত কথামৃতর খানিক আগে পড়া পাতা। সেবক প্রতিদিন দেখেন আর ভাবেন জিজ্ঞাসা করবেন, কি দেখেন আপনি অমন রোজ জানলার দিকে তাকিয়ে?
কিন্তু সাহসে কুলায় না। একবার থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, মহারাজ, কি দেখেন? 
       মাধবানন্দজীর মুখে স্মিত হাসি। বললেন, জানলার বাইরে ওটা কি গাছ?
       সেবক বলল, নারকেল গাছ। 
       মাধবানন্দজী বললেন, দেখ, ওই নারকেল গাছের পাতাগুলোর দিকে তাকা, যেমন যেমন হাওয়া আসছে তেমন তেমন নিজেরা দুলে দুলে সে হাওয়ার সাথে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে। তাই না এত খুশীতে আছে। জীবনেও এমন করে যদি চলা যায়, যেমন যেমন সময় তেমন তেমন হয়ে চলা যায়, তবে এত গোল হয় না।
 
 
       একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার এক সভায় ওনার বক্তৃতা অথবা দীক্ষা কিছু একটা আছে। উনি স্নানে যাবেন। ওনার হাইপাওয়ারের চশমা ছিল। সেবকের হাতের ধাক্কায় সেটা মাটিতে পড়ে গেল ভেঙে। সেবক ভয়ে কাঁটা, কি হবে এবার? এখনিই তো চশমা পাওয়াও যাবে না। 
       উনি শব্দটা পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল রে?
 
       সেবক কম্পিত কণ্ঠে যা ঘটেছে বলল। উনি হেসে বললেন, ও এই ব্যাপার? আরে স্বামীজি কি বলতেন শুনিস নি? এগুলো তো এইভাবেই যাবে, ওদের কি আর ম্যালেরিয়া টাইফায়েড হবে?
 
       বিড়াল ছানার সাধন কোনো বড় একটা ঘটনায় হঠাৎ শুরু হয় না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসন্তোষ জয়েই হয়। কিন্তু এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসন্তোষে কাবু হতে হতে এমন অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় যে হয় সুখী নয় অসন্তুষ্ট মন। ভাবে বুঝি অসন্তোষের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছু একটা লাভ হবে, বা কিছুটা সুখ মিলবে। তা হয় না। সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করাটা একটা সাধন। আজ বিজ্ঞাপন আর সামাজিক মাধ্যমের দাপানির যুগে তো আরো বড় সাধন। নইলে অসন্তোষ স্বভাব হয়। রাগ, ক্ষোভ, ভয়, উদ্বিগ্নতায় অন্তঃকরণ জেরবার। দাঁড়াবার শোবার জো নেই। ছোট ছোট সারাদিন। কেন ছুটছি সেও যেন জানা নেই।
 
 
       আজ বাবা মায়ের বিবাহবার্ষিকী ছিল। বাবা বললেন মন্দিরে পুজো দিয়ে এসো। বিকালে তার ঘরে গিয়ে দেখলাম, তিনি জানলার বাইরে তাকিয়ে বসে। বললাম, কি ভাবছ? বললেন, ভবিতব্যকে মেনে নিলেই শান্তি বাবু, কতটুকু আমাদের হাতে? তখনই উপরের কথাগুলো মনে পড়ল। 
       বাবা উঠলেন, রামকৃষ্ণদেবের ছবির সামনে মাথা নত করলেন। মায়ের জন্য প্রার্থনা করলেন না নিজের জন্য জানি না। একটা প্রসন্নতা যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের উপর বৈশাখের ভোরের শীতল বাতাসের মত বয়ে গেল। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম।
 
 
       জীবনের কোনো ব্যাখ্যা শান্তি দেয় না। বিশ্বাস যখন নিভৃত, আত্মগত, তখন সে কত প্রসন্ন, কত শান্ত। সেই যখন দলগত, মঞ্চগত, সেই কত উগ্র। বিশ্বাস আমার পরিচয় কি? নয় তো, বিশ্বাস আমার পথ।
 
       আবার ঠাকুরের কথা, শালাগুলো পথের কথা নিয়েই গোল করে, যেতে আর কেউ চায় না। 
       গেলেই পথ শেষ হয়। গোল মেটে।