অবশেষে কী চায় মানুষ? অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে, অনেক ঝড়জল, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসে কী চায়? যদি তাকে তার ভাগ্য মানসিকভাবে সুস্থ রাখে শেষদিন অবধি, তবে সে কী চায়? মুক্তি? স্বর্গ?
সব ডাঁহা মিথ্যা কথা। চায় ছুটি। যে ছুটি মানে শান্তি। মানে আনন্দ। সে শান্তি মানে কি স্বর্গীয়, অধ্যাত্মিক শান্তি? সেও ডাঁহা মিথ্যা কথা। যদ্দিন মনে নানা আশা থাকে, যদ্দিন মনে রঙবেরঙের স্বপ্নের ফুলঝুরি ফোটে তদ্দিন ওসব অধ্যাত্মিক শান্তি, পুজোপাঠ, তীর্থ, জপতপ, প্রার্থনা, শুচি-অশুচি, আমি শুদ্ধ, তুমি অশুদ্ধ, আমি ঠিক, তুমি ভুল - ইত্যাদি ইত্যাদি করে দিন কাটায়। ওসবই ফক্কাবাজি। মনে হয় কিছু একটা হচ্ছে। আসলে কিচ্ছুটি হচ্ছে না।
কেমন জানো? মানে যেন সে একটা বড় মেলায় এসেছে। সেখানে নানা ধরণের খেলা। আমোদ। যার যেমন রুচি সে তেমন নাগরদোলায় চড়ে বসেছে। এটা ওটা চেখে দেখছে। একবার ভালো লাগছে, একবার ভালো লাগছে না। তিতা-মিঠা, মান-অপমান, ভালো-মন্দ, সুখ-দুঃখ সব এই মেলার গণ্ডীর মধ্যে। ওই ধম্মকম্মো, রাজনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষাদীক্ষা, জগত উন্নয়ন, আত্মউন্নয়ন ইত্যাদি ইত্যাদি যা বলো না কেন, সব এই মেলার চৌহদ্দির মধ্যে।
তারপর? দেখোনি, একটা বাচ্চা, যে মেলায় এসে নানা খেলায় মেতেছিল, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনোদিন এই মেলা ছেড়ে সে যেতে চাইবে না, যেন এইখান থেকে গেলেই সে মারা যাবে, সেও একসময় সব নাগরদোলা থেকে নেমে কেঁদেকঁকিয়ে বলে, মায়ের কাছে যাব।
ওই, ওই, ওই হল অবশেষে যা চায় মানুষ। মুক্তি নয়, স্বর্গ নয়, চায় শুধু ফিরতে। কোথায়? যে ছবিটা সে বুকের সব চাইতে তলার কোঠরে নিজের অজান্তেই এদ্দিন বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে, সেথায়। তার ছোটোবেলার কাছে। তার মায়ের কাছে। তার যাবতীয় সুখের খনি সে ছোটোবেলা। যত পা ক্লান্ত হয়, যত সে পশ্চিমপ্রান্তের দিকে আসে, তত সে বোঝে তার বুকের সেই ভিত্তি কোঠরের মধ্যে তার প্রাণভোমরা গুনগুন গান শুরু করেছে। “ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে, কী সঙ্গীত ভেসে আসে”। সে লক্ষ-কোটি স্বপ্ন, বাসনাকামনা নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। তারপর বেলায় রোদ উঠে কেটে যাওয়া কুয়াশার মত ধীরে ধীরে সে সব ফিকে হতে শুরু করে। সে চারদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে নিজেকে, আমি কোথায়? কার কাছে ফিরব? আবার সে পিছনের দিকে তাকায়। নিজের শৈশবের দিকে তাকায়। সেই তার স্বর্গ, সেই তার মুক্তি, সেই তার আদর্শ।
কিন্তু সবার ভাগ্যে এ উপলব্ধি আসে না। ভাগ্য ভীষণ নিষ্ঠুর হয় অনেকের জীবনে। সে মেলায় ঢোকে বটে। কিন্তু সে মেলার গভীরে নানা মানুষের ব্যবহারে, শোষণে নিষ্পেষিত হতে হতে ক্রমে বোধ-বুদ্ধি হারিয়ে বসে। পাগল হয়। এমন মানুষ অনেক দেখলাম সংসার প্রান্তে দাঁড়িয়ে। তার হাত ধরে পার করে দেওয়ার কেউ নেই। ফ্যালফ্যাল চোখে, শূন্য দৃষ্টিতে চারদিকে তাকিয়ে। তার শান্তি-অশান্তি, সুখ-দুঃখ কিছুই নেই। কারণ সে নিজেই নেই। যদি তুমি তার কাছে এসে জিজ্ঞাসা করো, তুমি কী চাও? সে তোমার হাত দুটো শক্ত করে ধরবে। আঁকড়ে। সভয়ে। তার সব গেছে। সব তার কাছে অস্পষ্ট। অস্বচ্ছ। সংসার পিষে দিয়েছে তাকে। অতিমূল্য চুকিয়েছে সে সংসারে। কিন্তু কেন চুকাতে হয়েছে তা সে নিজেও জানে না।
তাই, যদি তুমি অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে এসে থাকো সংসারে। যদি দেখো তারপরেও তোমার বোধ-বুদ্ধি কাজ করছে, তবে ভাই নিজেকে ধন্য মনে কোরো। সংসারে এর চাইতে বড় পাওয়া কিছু নেই। শেষদিন অবধি বোধবুদ্ধি সজাগ থাকা ছাড়া বড় অ্যাচিভমেন্ট সংসারে কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না। যাওয়ার আগে অন্তিমবার এই ধরিত্রীর মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বোলো, এই যে এসেছিলাম, আর এই যে ফিরছি, এই এতটা রাস্তা যে আমি আমাকে হারাইনি, এই আমার কাছে পরম পাওয়া।
আর একটা কথা জানো তো, ওই সব হারানো মানুষগুলো, মানে বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলা মানুষগুলোর কাছে দাঁড়িয়েও যদি একবার কানে কানে বলো, মায়ের কাছে ফিরবে? কিম্বা তার ছোটোবেলার স্মৃতির কোনো তন্ত্রীকে যদি ছুঁয়ে ফেলতে পারো, দেখবে ওই অগোছালো বোধবুদ্ধির ভিতর থেকেও তার চোখ দুটো ছলছল করে উঠবে। আমি দেখেছি। বহুবার দেখেছি। এত কিছু মধ্যেও ওটা হারায়নি সে। তার ছেলেবেলার স্মৃতি।
তাই মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, যদি শেষদিন অবধি এই বোধবুদ্ধি নিয়ে যেতে পারি, সে-ই হবে আসল যাত্রা, সার্থক জীবনযাত্রা। আর যদি হারিয়ে ফেলি, তবে ব্যর্থ বলব না, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক তো অবশ্যই। দুর্ভাগ্যও তো বাস্তব। কিন্তু তাকে দুর্ভাগ্য হিসাবে বোঝার মানুষটা আর নেই, এইটুকুই যা সান্ত্বনা।