আস্থা। বিশ্বাস।
দুটো শব্দ ব্যাখ্যা করতে পারব না। অর্থটা বুঝি। অন্তত তাই ধারণা ছিল। আজ চারিদিকে যা দেখছি, সত্যি বলতে কি, আতঙ্কিত হচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত জীবনে আস্থাহীনতার অভিজ্ঞতা হয়নি এমন নয়। হয়েছে। ঝড় সামলে দাঁড়িয়েছি, এটা বেশি সত্যি আমার কাছে। "মাঝে মাঝে বটে ছিঁড়ে ছিল তার, তাই নিয়ে কে বা করে হাহাকার/ সুর তবু লেগেছিল বারেবার মনে পড়ে তাই আজি"।
কিন্তু এ আস্থাহীনতা, অশ্রদ্ধা ধীরে ধীরে সম্পর্কগুলোর পাকে পাকে জড়িয়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। ফেসবুক, ওয়াটস অ্যাপ ইত্যাদি আমাদের যত কাছে আনছে, এক এক সময় মনে হচ্ছে এতটা কাছাকাছি আসার যোগ্য কি আমরা করতে পেরেছি নিজেদের? জানি না। আমার পাশের মানুষটার সাথে চলাফেরা, ওঠাবসা, কথাবার্তা ইত্যাদির মাধ্যমে যে জীবন যাপন, তা কি এই বৈদ্যুতিক সামাজিক মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে পাওয়া আংশিক অস্তিত্বের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়া সম্ভব? কখনো না। আমার পাশের মানুষটার দোষগুণ সব মিলিয়ে তাকে নেওয়ার মধ্যে একটা সাধনা আছে। মানুষ নিজেকে আবিষ্কার করে সেই সম্পর্কে।
কিন্তু এই সহজলভ্য সামাজিক মাধ্যমে যে স্পর্শগুলো পাই, তা কতটা খাঁটি? কতটা বাস্তব? কতটা মূল্যবান? সে ভাবনার দরকার হয় না, কারণ তাৎক্ষণিক সুখটার মোহ অত্যন্ত বেশি।
তাই দেখছি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করছে ব্যভিচার। এটা নাকি আধুনিকতা। ব্যভিচার আগে ছিল না বলছি না। তবে এমন মহামারীর মত ছিল কি? বালিশের ওয়াড় বদলাবার মত বদলে বদলে যাচ্ছে প্রেম। শরীরের চাহিদা চিরটাকাল অপূরণীয়, অথবা দুষ্পূরণীয়। তা বিচিত্র যুক্তিজালে আষ্টেপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ছে এই সাংঘাতিক আন্তর্জালতন্ত্রের শিরা উপশিরা বেয়ে। প্রতিশ্রুতিবদ্ধতাকে ফাঁকি দিয়ে গোপন পথে বিকারের রাস্তায় খুঁজছে আত্মতৃপ্তির পথ। কারণ দুর্বল সবসময়ই বিকল্পতা খোঁজে গোপনে, সরাসরি লড়াইয়ের পথ ছেড়ে।
নীতিবাগীশের মত শোনাচ্ছে হয়তো কথাগুলো। তা শোনাক। নীতি কি জানি না। আস্থা কি বুঝি। যে ছাদটার তলায়, যে খাটের উপর বসে, এই লেখাটা লিখছি, সেই ছাদ আর খাটের উপর আস্থা রয়েছে বলেই সে নিশ্চিন্ততা অনুভব করছি।
আমার বারবার মনে হচ্ছে, এই সামাজিক মাধ্যমগুলো আমাদের যত কাছাকাছি এনে ফেলেছে, তত কাছাকাছি আসার যোগ্যতা আছে আমাদের? আমরা একে অন্যের প্রাইভেসি, শালীনতা, স্বাস্থ্যকর দূরত্ব বজায় রাখতে শিখেছি? আমরা কি অন্যের ইচ্ছা, বিশ্বাস, ইত্যাদিকে সম্মান জানিয়ে সম্পর্ক রাখাতে অভ্যস্ত হয়েছি? ভাবপ্রবণতার সাথে প্রেমকে গুলিয়ে তাৎক্ষণিক মদিরাপানে উদ্যত হওয়াকে কি চরম স্বাধীনতা বলে ভুল করছি না? চূড়ান্ত স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে নিজের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলছি না? হাতের একটা স্পর্শেই যখন যে কারোর কাছে আসতে পারছি যখন তখন, আর অসুবিধা কোথায়?
আমার মাথায় এই প্রশ্নগুলো হাতুড়ির বাড়ির মত মেরে ফিরছে। কবিতা, গল্প তো আছেই। তা সাহিত্যের বস্তু। তা জীবন থেকে জাত, জীবনের উদ্দেশেই। তাকে জীবনের থেকে বড়ো করে দেখতে হবে এমন কোনো দায় আমি অনুভব করি না। লিখতে ভাল লাগে, লিখে চলি। কিন্তু লিখতে এসে যা সব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাতে ভয় হচ্ছে, আমি কি এতটাই অনাধুনিক? এতটা পিছিয়ে আছি? তা হলে এ প্রশ্নগুলো এতটা ভাবাচ্ছে কেন?
কারণ একটাই, আস্থা হারাতে চাই না। আত্মসংযমকে আজও সভ্যতার কর্ণার স্টোন বা প্রাথমিক ভিত্তি বোধ হয়। তা বিপন্ন হলে সভ্যতা বিপন্ন। একটা একটা পরিবার মিলেই সভ্যতা। তাই চুপ করে উদাসীন হয়ে থাকা গেল না। ভাবের ঘরে চুরি করে আর যা হোক, কলম ধরা অসাধ্য।
লেখাটা যখন প্রায় শেষ, তখন ভোরের আলো ফুটছে পূবাকাশে। আমার বিনিদ্র রাত লক্ষবার ঈশ্বরের দরজায় ঘা দিয়ে ফিরল। উত্তর এল না। অবশেষে উত্তর এলো ভোরের দোরগোড়ায় এসে। রাস্তার বামদিক দিয়ে হাঁটার নিয়ম থাকলে, ডান দিক দিয়ে হাঁটবার ইচ্ছা হওয়াটাকেই বলে ব্যভিচারিতা। মানুষ বিশ্বাসে বাঁচে, তর্কে না। সে বিশ্বাসকে হনন করা আত্মহত্যারই সামিল।