"এমন কোনো পরিস্থিতি নেই, যার ওপর রবীন্দ্রনাথের কোনো গান বা কবিতা পাওয়া যায় না।"
এ কথা আমিও আগে বিশ্বাস করতাম। বিশেষ করে গানের ক্ষেত্রে এ উক্তিটিকে ধ্রুবসত্য বলে জানতাম।
আজ মনে করি না। আজ সে কথা কেউ বললে ভাবি, হয় আপনি পুরো গীতবিতানের পথ হাঁটেননি, নতুবা মানুষটাকে বোঝেননি। অহংকারীর মত শোনালো?
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোঝা বলছি না। তবে তা অহংপ্রসূত হত। আমি বলছি, যে বোঝার ক্ষমতা ঈশ্বর আমাদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বোধের আকারে দিয়েছেন - সেই বোঝার কথা। তথ্যের বোঝা না।
একটা গাছের যতটুকু প্রকাশিত, তার অনেকখানি মাটির নীচে অপ্রকাশিত থাকে। সেখানে সে নীরব, একা। আমি খানিকটা সেই রবীন্দ্রনাথের কথা বলছি। নীরব রবীন্দ্রনাথের কথা। মহাশূন্যে, মহাকালের নিরিখে ব্রহ্মচিন্তা মগ্ন রবীন্দ্রনাথ শুধু নন। মানুষের সংসারের আঘাত, বিশ্বাসঘাতকতা, ক্ষুদ্রতা, নৃশংসতার - নীরব সাক্ষী রবীন্দ্রনাথ। গীতবিতানের দুটো পরপর গানের মধ্যে যে ফাঁক, দুটো কবিতার মধ্যে যে শূন্যতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প - সবকিছুর মধ্যে এক নীরব রবীন্দ্রনাথ আছেন। তা অধরা। তবু অনুমেয়।
আমার খুব মনে হয় কোনো মানুষের নীরবতার কাছে না পৌঁছালে, সে মানুষটাকে সম্পূর্ণ স্পর্শ করা যায় না। সে পৌঁছানোর উপায় কি? উপায় তাঁর প্রকাশিত রূপের অভ্যন্তরে ডুব দেওয়া। যেমন কোনো কিছু লিখতে গেলে দুটো শব্দ, বা দুটো বাক্যের মধ্যে একটা অর্থপূর্ণ ফাঁক রাখতে হয়, তেমন কোনো মানুষকে প্রাণের আলোয় অনুভব করতে গেলে তার বলার মধ্যে, না-বলাকে বুঝতে হয়। তবে সেই পূর্ণতাকে অনুভব করা যায় বলে আমার বিশ্বাস।
তবে কি সব পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথ নেই? আছেন। আমার শোকস্তব্ধ নীরবতায় তিনি আমার পাশে আছেন নীরব হয়েই। চেতনার বৃত্তি শুধু প্রকাশেই না, অপ্রকাশে সমাহিত থেকেও। রবীন্দ্রনাথের এই দুই-এর প্রকাশ যদি না আসে আমার চেতনায়, তবে আমি নিজেকে তাঁর সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলাম। সে বড় ক্ষতি। সে ক্ষতির ভার আমার মত দৈন্য প্রাণ বহন করবে কি করে?