Skip to main content
বাউল

মন বিষণ্ণ। মন পেলো না পারের খবর। আসা যাওয়া দেখছে সে জনমভর। প্রাণ আর জড়ের মধ্যে কোন চৈতন্যের বাস? কে বাসা করে মানুষের বুকে? কার ইঙ্গিতে বর্ষা বসন্ত নিয়ম করে আসে যায়? মন বোঝে তার গভীরে পাতাল সিঁড়ি, নামলে পরে নামতেই থাকে, নামতেই থাকে, নামতেই থাকে। চোখ কিসের সুখে আপনিই ভরে ওঠে, বুকের ভিতর দুধ ওথলানো, পাওয়া না-পাওয়ায় মেশা কান্না সুখ। কার মুখের আভাস ওই নীলাকাশে আবছা ভেসে ওঠে? কার স্পর্শ সন্ধ্যের উদাস বাতাস নিয়ে ফেরে?

মন তার একলা আঁধার ঘরে একলা ফেরে। ডুকরে কাঁদে। কাকে যেন ডাকতে চায়। কে যেন তার গোপন আপন। তার নাম যেন তার সবার নামে মেশা। তার চলতে ফিরতে বুকের মধ্যে একতারারই ভাষা। সে আনমনা হয়। সে উদ্বেল হয়। তার সীমার সাথে অসীমের বিবাহের খবর এসে পৌঁছায়। কিন্তু যেন পরিচয় আছে অনন্তকাল দূরে তবু একরাত্রি পরে।
বাউল এসে দাঁড়াল তার দরজায়। বাউলের চোখে পড়ল চোখ। তার মনের দীঘিতে লাগল ঢেউ। সে যেন পেল ভববৈদ্য। এ যেন তার কবেকার চেনা চোখ। তার গতজন্মের হারিয়ে যাওয়া খেলার সাথী। তার পোশাকে যেন সেই বঁধুর স্পর্শমাধুরী লেগে। সে বাউলকে বলল, ভেতরে এসো।
বাউল আসল ঘরে। বেজে উঠল একতারা। বাউল গাইছে নামগান। ঘরের পাঁচিল গেল সরে। তার ভুবন উঠল দুলে। নামের মালার ফুলের গন্ধ, তার বুকের মধ্যে এসে, গোপন দরজায় দিল নাড়া।
সে বাউলকে বলল, তোমার জাত কি?
বাউল বলল, "মায়েনসের কোনো জাত হয় না রে। হিঁদু, খেষ্টান, মোচলমান সবের ভিতর সেই আমার গোবিন্দ। এই যে পাতাখান", এই বলে বাউল জানলা ছুঁয়ে থাকা শিউলির পাতা দেখিয়ে বলল, "এই যে পাতাখান এর মধ্যিও যে গোবিন্দ, তোমার মধ্যিও সেই। আমার গুরু কি কইল জানো? বললে, মায়েনসেরে কখনো হিংসা করবি না। হিংসা করলি সাধন ভজন হয় না রে!" বাউল থামল। বললে, "মায়েনসের দুইখেন জাত - বাবা আর মা"।
বাউলের চক্ষে গুরুপ্রেমের বিন্দুজল, গালে বইল প্রেমধারা হয়ে। তার একতারা আবার উঠল বেজে। লালন বসলেন গোঁসাইয়ের কণ্ঠে ভক্তিমাখা হয়ে।
বাউল নামল পথে। সংশয়ী বললে, ওরে ভণ্ড কাজ কর, ভিক্ষা মাগিস গৃহে?
বাউল উঠল হেসে, বলল, "তোমায় গোবিন্দ দেছেন ঝাঁটা (সে সংশয়ী তখন ঝাঁটা হাতে গৃহস্বামীর বাগান পরিচর্যায় ছিল রত) আমায় দেছেন একতারা। তোমার কাজের শক্তি আর আমার গানের শক্তি দুই গোবিন্দের লীলা। কেন লীলায় বাধা দাও ভাই!"
আবার একতারা উঠল বেজে। নামের অগুরু পড়ল ছড়িয়ে চারিধার। ঘরে ফিরে মন দেখল চাবি। সে বাউল গেছে রেখে তার বুকের ভিতর অন্তঃপুরের সিঁড়ির ঘরের চাবি। তার প্রাণ উঠল দুলে।


(ছবি - Suman)