শরীরটা আমার বাইরের জিনিস, আর চিন্তাটা আমার ভিতরের – এমন একটা ভাগ আমাদের বোধে স্বতঃই এসে থাকে। আমার হাঁটাচলা, কথাবলা ইত্যাদি নানান অঙ্গভঙ্গী আমার এই বাইরের জিনিসটার সাথে – আমার শরীর। ভিতরের আমি কখনো তার থেকে আলাদা আবার কখনো একযোগে। এই বাইরে ভিতরের মাঝে এমন একটা জায়গা আছে, যাকে বলা যেতে পারে NO MAN’S LAND. সেখানে আমরা বুঝে উঠতে পারি না, আমরা একটা রাসায়নিক উন্নতমানের যন্ত্র, না চেতনাযুক্ত অস্তিত্ব? যে আমার অংশ বাইরের জগতের সাথে লড়ছে সেই কি করে ভিতরে সব কিছুর সাথে একাত্বতা অনুভব করে? এই স্বাতন্ত্র্যতাবোধ ও একাত্বতাবোধ যুগপৎ থাকে কি করে? সেদিন ট্রেনে একজন তার অসুস্থ বাচ্চার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। অনেকেই দিলেন, অনেকেই দিলেন না। ভাবছিলাম, এই যে প্রার্থনা, তা কার কাছে? আমার মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য আমি আছে তার কাছে? না যে আমিটা একাত্ম হয়ে আছে তার কাছে? উত্তরটা বুঝতে অসুবিধা হল না।
আমাদের এই শরীরটা যেহেতু বাইরের দিকে তাই এ আমাদের মধ্যে এই পৃথকত্বের বোধটাকে জাগিয়ে রাখে। তার স্থূল অস্তিত্বের কাছে সে নিজে যতবড় সত্য, আর কিছু তেমন না। সে কাড়াকাড়ি করে হোক, ছিনিয়ে হোক, অসৎ উপায়ে হোক – নিজেরটা চাই-ই চাই। এটাই শরীরের ধর্ম। তাই এটাকে আমরা পাশবিক বলে থাকি। কারণ পশুদের শুধু বাইরেটাই আছে। তাই তার কোনো ধর্মবোধ, নৈতিক বোধের সংজ্ঞা না জানলেও চলে। শরীর সবকিছুকে আলাদা করেই দেখে। সেটা দোষের না। সেটাই তার স্বভাব।
অন্তর দেখে একের মধ্যে। সে একের নাম – সমাজ হতে পারে, -ism হতে পারে, দেশাত্মবোধ হতে পারে ইত্যাদি। মোটমাট সে একের রশি খোঁজে। বাইরের থেকে বাঁধবে, গোদা বাণ্ডিলের মত, না মালার মত গাঁথবে সূতোর মত- সেটা নির্ভর করছে বাঁধনটার উপর। প্রেম, সহানুভূতি – এগুলো মালার সূতো। শাসন, রীতিনীতি – এগুলো কাতা দড়ি, পাকিয়ে বাণ্ডিল বানাবার। প্রথমটা এক করে। দ্বিতীয়টা শুধুই একত্র, এক না।
এই কারণেই সার্কাসে পশুকে যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হয়, মানুষকে সেভাবে দেওয়া যায় না। পশু চাবুক বোঝে, মানুষ বোঝে লজ্জা। সে লজ্জাবোধ হারিয়ে ফেললে সে শুধুই ওই বাইরেরটাই, অর্থাৎ শুধুই একতাল মাংসের প্রাণী। তখন তার শাস্তির মান আরো কঠোর। কারণ যার হৃদয় অপরাধের পর অনুতপ্ত না, তার শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণই তখন একমাত্র পথ।
ভিতরের এই অস্তিত্বের জন্যই আজ এমনধারা ছন্নছাড়া ভাব চারদিকে। হঠাৎ করে আমাদের সমাজ, সাহিত্য, শিল্প শরীরকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। তা কি করে, কেন, ইত্যাদি আলোচনা থাক। তা হয়ে উঠেছে এটা স্পষ্ট। শারীরিক সুখ কিনবার মাত্রা আকাশছোঁয়া। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন আবিস্কার সে দিকেই বিদ্যুৎগতিতে এগোচ্ছে। শরীর শরীর আর শরীর। আমাদের চিত্তবৃত্তিটাও যে শুধুমাত্র কতকগুলো রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল – এ বলতেও দ্বিধান্বিত হচ্ছেন না অনেকেই। এ চূড়ান্ত জড়বাদের উপর দাঁড় করাতে চাইছি নীতি-নিপুণ সমাজ – সোনার পাথরবাটি।
তা হয় না। শুধু যুক্তি, শুধু জড়বাদ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না – আমি যদি তোমায় খুন করে ভালো থাকি, তবে ভুলটা কোথায়? কি বলবেন? এরকম করতে নেই? কেন করতে নেই? তোমার সাথেও এরকম কেউ করতে পারে, তাই তুমিও কোরো না – এই বলবেন তো? সে বলবে, আমার সাথে করবে? কার ঘাড়ে ক'টা মাথা? আমার প্রহরী আছে, রক্ষী আছে, আগলাবে। আমি বলশালী, আমি যা ইচ্ছা করব, তুমি দুর্বল, তোমার জন্য ওসব ধর্মের বাণী, ন্যায়ের বাণী- আমার জন্য না। কি বলবেন?
এটাই হল পশুর সত্ত্বার ভাষা। আমার শরীরের ভাষা, আমার বাইরের দিকের ভাষা। এর কোনো দিশা নেই, ভিত্তি নেই। আছে যুক্তি, তার বিরুদ্ধ যুক্তি ইত্যাদি।
উপনিষদ বললেন, ভিতরের দিকে তাকাও। কেন তাকাব? ভয় থেকে মুক্ত হবে বলে, শান্তি পাবে বলে, আনন্দ পাবে বলে। যা বাইরে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছ। কি দেখব ভিতরে – অবিচ্ছিন্ন নিজেকে। কারণ যত গোল এই বিচ্ছিন্ন দেখা থেকেই। শরীর বিচ্ছিন্ন দেখে, নিজেকে পৃথক দেখে – ভুল দেখে। তাই এত ভয়, এত অশান্তি, এত দুঃখ। নিজেকে অবিচ্ছিন্ন দেখো, আলোর মধ্যে। কিসের আলো? প্রেমের, প্রজ্ঞার। INTELLECT না, INTUITION.
যুক্তি না, প্রজ্ঞা। অবসাদ না, ধৈর্য্য। ক্ষোভ না, সন্তোষ। ঈর্ষা না, অভিনন্দন। ক্রোধ না, উপেক্ষা।
এই ভিতরের ধর্ম। শরীরের না। এই সূতো মালা গাঁথার, কাতা দড়ি না পাকিয়ে দেওয়ার।