সমাজকে না জানলে নিজেকে জানা সম্পূর্ণ হয় না। সমাজের ভিত্তি মনুষ্যত্ব। মনুষ্যত্ব কি সে নিয়ে বাচিক তর্কে গিয়ে লাভ নেই। কাকে সবুজ রং বলে, কত প্রকারের সবুজ হয় - সে নিয়ে তর্ক অনেক দূর গড়ায়, কিন্তু চোখের সামনে সবুজ রং এলে তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না যদি না বর্ণান্ধতার সমস্যা থাকে।
মনুষ্যত্বও একই জিনিস। সে নিয়ে বাচিক তর্কে মীমাংসা হয় না। কিন্তু সামনে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটা মনুষ্যোচিত কি না, সে নিয়ে মীমাংসা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আপনিই হয়। নইলে একটা মর্মান্তিক মৃত্যুও কিভাবে বাচিক তর্কের ময়দানে অমানবিক হয়ে উঠতে পারে তা তো দেখলাম আমরা কয়েকদিন ধরেই।
মনুষ্যত্বের একটা প্রাথমিক পরাকাষ্ঠা অন্যের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ না করা। লকডাউনের সময় 'চা কাকু' বলে একজন মানুষ ভাইরাল হন। তাঁর অর্থনৈতিক দুরাবস্থার দিকটা সামনে আসাতে অনেকে অর্থ সাহায্য করেন। আমার এক পরিচিত মানুষ উক্ত চা কাকুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে প্রায় রোজ ঢুকে কত টাকা জমছে সেই নিয়ে আশেপাশের মানুষদের মধ্যে খবরাখবর দিতে থাকে। কারণ উক্ত চা কাকুর অ্যাকাউন্ট যে ব্যাঙ্কে, সে সেই ব্যাঙ্কের কর্মচারী। এই অভ্যাসটা অসামাজিক। সে যখন যুক্তি দিচ্ছে এত টাকা হয়ে যাচ্ছে তাও কেন লোকে টাকা পাঠাচ্ছে, অর্থাৎ সে নীতির প্রশ্ন আনছে। কিন্তু সে নিজে যখন ভুলে যাচ্ছে সে একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীর সন্তান হয়েও শুধুমাত্র রিজার্ভেশন এর সুযোগেই চাকরিটা পেয়েছে। সেখানে সে নীতির কথা বলছে না। সেখানে সে অপার্চুনিস্ট। সুযোগসন্ধানী।
সমাজকে শুধু যদি সুযোগের নিরিখে দেখি, তবে অনেক দায় এড়ানো যায়। যে সমাজে আমার যত বেশি সুযোগ সেই সমাজে তল্পিতল্পা গুটিয়ে অনায়াসে হাজির হওয়াই যায়। কিন্তু সমাজ বলতে তো শুধু সুযোগ উৎপন্নের কারখানাই নয়, সমাজ বলতে নিজের মনুষ্যত্বের বিকাশের ব্যায়ামাগারও তো বটে। যেখানে নিজেকে বাস্তবিক অর্থে আরো শক্তিশালী, আরো সার্থক করা যায়।
দুদিন আগে গৌরী সাওয়ান্ত আর রভি কান্ননকে নিয়ে কথা হচ্ছিল খবরের নানা মাধ্যমে। কারণ আছে অবশ্যই। গৌরি সাওয়ান্তকে নিয়ে কথা হওয়ার কারণ 'তালি' সিনেমাটা। আর রভি কান্ননকে নিয়ে কথা হওয়ার কারণ তিনি সদ্য ম্যাগসেসাই পুরষ্কারে ভূষিত হলেন, আসামে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে ক্যান্সারের চিকিৎসা করে যাওয়ার জন্য। রভি লিখছেন,
"There is nothing wrong with air or water which is a popular myth. People in the Northeast consume tobacco, betel nuts, and alcohol a lot. There is a lack of exercise and proper food. People are not even aware of the severity of cancer. Once it is detected, they become helpless and some people hide it. We have to fight this mindset and have been doing it for over a decade.”
এই জানাকে বলা হয় সমাজকে জানা। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন আমরা যেন রাস্তায় নেমে সমাজকে জানি। তবেই আমাদের কল্পনার ভারতমাতার আসল ছবিটা জানতে পারব। যে কথা গোখলে গান্ধীকে বলেছিলেন। বিবেকানন্দ পায়ে হেঁটে অনুভব করেছিলেন।
গৌরি বলছেন, "I adopted a daughter to show that even we can become mothers. I did it for my justice, for my rights so that people can recognise us,"............
“It is always the society that clichés us as being different. In my growing years, I did not feel like a Hijra or like a girl, back then I really did not even understand what a Hijra meant. But the society christened me as 'Hijra'.
পারস্পরিক শ্রদ্ধা ব্যতীত কোনো ধর্ম নেই, মনুষ্যত্ব নেই এবং ফলস্বরূপ কোনো সুস্থ সমাজও নেই।
মানুষের সত্যটা হল মানুষ প্রভূত উন্নতমানের যান্ত্রিকতায় নিজেকে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না, যা পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যুক্ত পরিবেশে করে। যদিও নানা সময়ে নানা অসহায়তার সামনে দাঁড়িয়ে নিরুপায় হয়ে নিজেকে অসম্মানিত হতে দেখাকেও সে মেনে নেয়, কিন্তু সে মেনে নেওয়া। সেখানে তার মান নেই, স্বাচ্ছন্দ নেই, ভালোবাসা নেই, শ্রদ্ধা নেই। আসলে আমরা আমাদের পদমর্যাদার অভিমানে, পাণ্ডিত্যের অভিমানে ভুলে যাই যে একজন মানুষের সঙ্গে 'ভালো ব্যবহার' করাটা আমার কোনো অপশান নয়, আমার সভ্য হওয়ারই প্রথম শর্ত।
সেদিন এক ধর্মগুরু টিভির চ্যানেলে প্রকাশ্যে বললেন, ভারতের রাষ্ট্রগ্রন্থ হওয়া উচিৎ রামচরিতমানস ও ভারতের পিতা হওয়া উচিৎ রামচন্দ্রের।
তার কথাটা পাগলের প্রলাপ বলে উড়িয়েই দেওয়া যেত, কিন্তু দেওয়া যায় না যখন তারা সমাজের একটা বড় অংশকে নানা কৌশলে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তখন তাদের কথার বিরোধিতা করতেই হয়। না করাটাই অন্ধকারের পক্ষ নিয়ে দাঁড়ানো।
নিজের সমাজকে জানা প্রতিটা মানুষের প্রাথমিক কর্তব্য। এ তার শিক্ষার অঙ্গ হওয়া উচিৎ। সমাজকে সুস্থ গড়ে তোলার দায়িত্ব সবার। তার প্রাথমিক পাঠই শুরু হয় সমাজকে জানা দিয়ে। তার বৈচিত্র্যকে আর বৈচিত্র্যময়তার কারণগুলোকে বোঝার মাধ্যমে। তবেই জন্মায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা।
তবে শুধু নিজের সমাজ নয়, অন্যান্য সমাজের ইতিহাস গঠনকেও জানা দরকার নির্মোহের দৃষ্টিতে। নইলে আবার খ্রীষ্টকে সম্মান জানানো আধুনিকতা হয় আর লোকনাথবাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো গ্রাম্যতা হয়। খ্রীষ্টের জীবনের নানা ঘটনা মীর্যাকল হয় আর লোকনাথবাবার জীবনের ঘটনা গাঁজাখুরি হয়।
বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ইত্যাদি সবটুকুই থাক, কিন্তু সামাজিক শিক্ষাটাকে হেলা করলে আদতে কোনো শিক্ষাই মঙ্গলময় হয়ে উঠবে না। বিজ্ঞান অভিশাপ হবে, ধর্ম নানা বিকার আর কুসংস্কারের ঘড়া হবে আর ইতিহাস কয়েকজন সুচতুর মানুষের পক্ষপাতদুষ্ট দলিল হবে।
সমাজকে জানার দুটো পথ। এক সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা। দুই, নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আর নানা সাহিত্য, সিনেমা ইত্যাদির মাধ্যমে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা।
প্রথমটার অবকাশ সঙ্কীর্ণ। দ্বিতীয়টা নানা বালিতে চিনিতে মেশানো। এককালে সাহিত্যের দায় ছিল সমাজের দর্পণ হওয়ার। এখন যুগ এসেছে ডক্যু ফিল্ম, ডক্যুমেন্টারি, খবর ইত্যাদির। এখন কোনো কিছুকেই "সত্য ঘটনা অবলম্বনে" না আখ্যায়িত করলে কল্কে পাওয়া যাচ্ছে না। সেখানে অবশ্যই বালিতে চিনিতে মিশছে। কিন্তু তবু এই দলিলগুলো মূল্যবান। কোনো কাল্পনিক চরিত্রের মধ্যে দিয়ে না বলে এই যে বাস্তবের মানুষটা সামন আসছে, নিজের কথা বলছে, এ খুব গুরত্বপূর্ণ।
লেখা দীর্ঘ হল। উদাহরণ আরো অনেক অনেক দেওয়া যায়। কিন্তু আমি দুটোতেই সীমাবদ্ধ থাকলাম। মনে হয় যা বলতে চেয়েছি তা এই দুই চরিত্রের মাধ্যমে বলতে পেরেছি।
পরিবেশের সংকট, পানীয়জলের সংকট আর নানাবিধ সামাজিক বৈষম্য - এগুলো ফ্যাক্ট। এর বিরুদ্ধে লড়াই প্রাক্তনীদের কাজ নয়। আমাদের এখনের কাজ। যত তাড়াতাড়ি আবর্জনা সরানোর কাজে হাত লাগানো যায় নিজের নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী ততই মঙ্গল। আবারও বলি শুরুর কথাটাই, নিজেকে জানা কখনওই সম্পূর্ণ হয় না, যতক্ষণ না সমাজকে জানছি। অনুভব করছি। নানা মিথে আর সত্যেতে মিশে এ জটিল সমীকরণের ধাঁধার সমাধানের দায় আমারই। এই দুই নিয়েই তো সমাজ!