Skip to main content

খট করে একদম বাইরের গেটে আওয়াজ হল। ঘড়ির দিকে তাকালাম, পড়তে আসার সময় হল। নিশ্চয়ই এসেছে কেউ। ঘরের দরজা তো খোলা, আসছে না কেন, দু'মিনিট তো হল।

উঠে বাইরে গেলাম। সে বাগানে দাঁড়িয়ে, টিফিন বক্সটা সাইকেলের কেরিয়ারে রেখে গোগ্রাসে গিলছে। আমি থ হয়ে গেলাম। সে আমায় দেখে থতমত খেয়ে টিফিনবক্সটা তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল, আসলে স্কুল থেকে আসছি তো সরাসরি...

আমি বললাম, তো বাইরে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খেতে খেতে খাচ্ছিস কেন? আমরাও তো খাই... বাড়িতেই বসে খাই... আয়...

আমার গলায় কপট ধমকের সুর ছিল। কারণ দৃশ্যটা দেখে কষ্টটা চাপা দেওয়ার ওটাই একমাত্র উপায় তখন আমার।

সে কয়েকবার "না, না", বলে ঢুকল ঘরে। ডাইনিং টেবিলে বসতে বললাম। হাজার জড়তা নিয়ে বসল। নিজেকে যতটা সঙ্কুচিত রাখা যায় ততটাই চেষ্টা করল। জলের বোতল পাশে রাখলাম। সে আরো কুঁচকে গেল। আমি আমার ধমকের সুর আর ভাষাকে প্রাণপণে টিকিয়ে গেলাম। এত সংকোচ কেন? কারণ আমি তার শিক্ষক বলে নয়, তার সঙ্গে আমার আর্থসামাজিক ব্যবধান আছে বলে।

খাওয়া শেষ হল। সব কিছুর পর জিজ্ঞাসা করলাম, এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন বল তো...

সে বলল, রুটি তরকারি খেতে গিয়ে কোনো এক স্যারের বাড়ির মেঝেতে পড়েছিল। স্যার নাকি ব্যাচের মধ্যেই ধমক দিয়ে বলেছিলেন, ম্যানার্স শেখায়নি বাড়িতে?

মেয়েটার চোখে জল এলো। আমি উঠে গেলাম। আমারও তো সহ্য করার ক্ষমতা আছে।

ফিরে এলাম। ব্যাচে তখন অনেকে এসে গেছে। কথার ধারা বদলে গেছে। তার চোখের কোলও শুকনো। সে ব্যস্ত বন্ধুদের সঙ্গে।

একবার এক আয়ার মুখে শুনেছিলাম, এক বাড়িতে কাজের জন্যে গিয়ে, রাতের খাবার আনেনি বলে সে বাড়ি থেকে খাবারও জোটেনি তার। অথচ রুটি বেলা থেকে সবই তাকেই করে দিতে হয়েছিল।

এগুলো হয়। অনেক উদাহরণ নিজের চোখেই দেখেছি। কেন হয়? জানি না। তবে হয়। আহা রে, বেচারা রে… ওরা দুষ্টুলোক… ইত্যাদি আলোচনায় যাচ্ছি না। আসলে কথাটা অন্য। যাদের কথায় কথায় ইংরাজিতে "নিডি" ফ্যামিলি বলি, সেই 'নিড'টা কি একতরফাই শুধু? আমার মানবিক কোনো তাগিদ নেই?

কি হয় জানেন? মানুষ অপমানিত হতে হতে সমাজের একটা বড় স্তরকে ছিন্ন করে ফেলে আরেক স্তর থেকে। বিদ্বেষ একদিনে জমে না। তাচ্ছিল্য একদিনে ফল দেয় না। দিনে দিনে বিষাক্ত বাষ্প তৈরি হয়। তা সমাজের সব স্তরকে গ্রাস করে এসে। মানুষকে ছোটো দেখানোর ফিকির আমাদের দেশে বহু প্রাচীন। সে মহাভারতের কর্ণ, শূর্পণখা থেকে মনুসংহিতা হয়ে আধুনিক কালের নানাভাবে টিকে থাকা বর্ণাশ্রমপুষ্ট ছুঁৎমার্গ অবধি। এতো আছেই, সঙ্গে আর্থসামাজিক ছুঁৎমার্গ। শিক্ষিত অশিক্ষিতের ছুঁৎমার্গ। আজও বাংলার বহু আশ্রমে ব্রাহ্মণ আর অন্যজাতের মানুষদের খাবারের পঙ্‌ক্তি আলাদা হয়। এটা সংস্কৃতি না, এটা অসুস্থতা। মানসিক বিকার। কাউকে অপমান করতে একটা মানসিক বিকারের দরকার হয়। নইলে ধুম করে কাউকে অমন অযথা অপমান করা যায় না। এর মধ্যে সব চাইতে ঘৃণ্য পাপ বাচ্চাদের অপমান করা!

এক বাড়িতে আয়া তার অসুস্থ বাচ্চাটাকে নিয়ে গিয়েছিল বলে বাড়ির অধ্যাপক মালিক বলেছিলেন, বাচ্চার খাবারটা বাড়ি থেকেই এনো। আমার বাড়ির চাল দানছত্র খোলার জন্য নয়।

কথাটা ভীষণ তথাকথিত প্র্যাক্টিকাল নিশ্চয়ই। কিন্তু অমানবিক। কারণ কথাটা বাচ্চাটার সামনে বলা হয়েছিল। বাড়িতে বাড়িতে তো আর বিদ্যাসাগর জন্মান না যে দুটো চড় কষাতেন গালে। তাঁর অবশ্য হাত লাগত না, চোখের আর মুখের ভাষাই যথেষ্ট হত।

বাচ্চাদের অপমান করা ঘৃণ্যতম অপরাধের মধ্যে একটা। সে বাচ্চাটা যতই প্রতিভাশালী হোক না কেন, কিন্তু তার আত্মমর্যাদাবোধ ধুলোয় এসে মেশে। ইংরাজিতে যাকে সেল্ফ-এস্টিম বলে, সেটা ছাড়া বেঁচে থাকা যে কি দুঃসহ, নারকীয় জীবন হয়ে ওঠে, সে যার হয় সে-ই জানে। সে কাজের জগতে যতই উঁচুতে উঠুক না কেন। নিজেকে ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে সে কিছুতেই পারে না। প্রশংসা পেলে ভাবে অতিরিক্ত পাচ্ছে কিছু, নিন্দা পেলে ভাবে এটাই সে ডিজার্ভ করে।

যারা আমরা শিক্ষকতা করি, কি কোনোভাবে বাচ্চার অভিভাবক, সে যেভাবেই হই না কেন, এইটুকু যেন খেয়াল রাখি তার আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত করা সব চাইতে সহজ বলে সেটাকেই যেন ব্যবহার না করি। তার মধ্যে নরকের বীজ যেন না বুনি, তার ভালো করতে গিয়ে। তাকে তথাকথিত শাসনের মাধ্যমে।

জানি না আমি বলতে পারলাম কিনা। ভীষণ অস্বস্তি হয় এ ধরণেরর প্রসঙ্গের অবতারণায়। অনেক কথা, অনেক মুখ ভিড় করে আসে মাথার মধ্যে। সে সব সামলিয়ে গুছিয়ে লেখা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। আসলে এই যে আমরা কথায় কথায় বলি না যে মানুষ হল সামাজিক জীব, কথাটাকে তলিয়ে ভাবি না। মাছ যেমন জলজ প্রাণী। জলটা দূষিত হলে মাছটার রক্তেও বিষ ঢোকে, বিষাক্ত হয়ে ওঠে সে, তেমনই মানুষও। সমাজ দূষিত হলে মানুষও দূষিত হয়ে ওঠে। সমাজ মানে রাস্তাঘাট, হাস্পাতাল, মিউনিসিপালিটি, পঞ্চায়েত তো নয়। সমাজ মানে মানুষ। সহমর্মিতায়, উপযোগিতায় দলবদ্ধ মানুষ। সেই সহমর্মিতা আর উপযোগিতার সূত্রই যদি নড়বড়ে হল, একে অন্যকে শোষণ, পীড়ন করার জন্য ভিড় জমানো মানুষ যদি সমাজের সংজ্ঞা হয়, তবে তো সত্যিই বিপদ।

অসংবেদনশীল মানুষ সমাজে থাকবে না, তা বলছি না। থাকবেই। কিন্তু কিছু মানুষ যেন শুশ্রূষার জন্যেও থাকেন। সমাজে সবাই থাকে বলেই সমাজ। একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করি, এই যে এতগুলো পুজো গেল, বহু জায়গায় পাড়া থেকে খিচুড়ি প্রসাদ রাঁধা হয়, যে চায় তাকেই দেওয়া হয়। এর জন্যে কোনো পরিচয়পত্র লাগে না। কি ধর্ম, কি জাত এ প্রশ্নও আসে না। কারণ সেটা শুধু কোনো পুজোর প্রসাদ নয়, সেটা উৎসবের প্রসাদ এইটাই বড় কথা। উৎসব মানুষের মিলনের আনন্দ। সেখানে সব মিলে একাকার হয় বলেই আবার ধাক্কা লাগে সমাজে। সব সচল হয় আবার।

মানুষে মানুষে এক হলেই উৎসব হয়। যদি সেখানে বিকার না থাকে। সেই উৎসবের আনন্দেই বড়ছোটোর মধ্যে ব্যবধান ঘুচে যায়। সেই উৎসবের আয়োজনই চাই। নিত্য। বাচ্চারা সেই উৎসবেই বড় হোক। প্রাণের আলো নেভানো অন্ধকারে নয়।