রবীন্দ্রনাথ কখনও ছটপুজো নিয়ে লেখেননি। বিবেকানন্দ কখনও ছটপুজো ও বেদান্ত নিয়ে ভাষণ দেননি। যদিও অনেক বাঙালি আজকাল দেখি ছটপুজো করেন, তবে সে অন্য বাঙালিরা। যারা অত ‘সাংস্কিতিক মনোস্কো’ নন, তাঁরা করেন। কিন্তু অনেক বাঙালি পরিবেশ নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েন। “খোঁট্টা”-দের বিচার-বিবেচনাহীনতায় সোশ্যালমিডিয়া জুড়ে গ্রেটা থুনবার্গের বাঙালি সংস্করণদের পোস্টে রীতিমতো মেলা বসে যায়। প্রতি বছর রবীন্দ্রসরোবর আলোচনায় চলে আসে। এবং কিভাবে কলকাতা দূষণের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে সে নিয়ে আলোচনার পর আলোচনা হয়।
আমি সেগুলো সব মেনে নিয়ে আমার দেখা ছটপুজো নিয়ে লিখতে চাইছি। কেন চাইছি? তার একটা গপ্পো আছে। কদিন আগে, একটা অবাঙালি পাড়া দিয়ে যেতে যেতে প্যাণ্ডেল বাঁধা দেখে আমার এক বন্ধু বলে, এটা হয় তো বা ছটপুজোর জন্য হচ্ছে।
আমি বললাম, তা কেন হবে? এদিকে তো কোথাও পুকুর-টুকুর নেই। তাছাড়া এটা ঘাটে আর বাড়িতেই হয় সাধারণত। ঘাটের পাশে মঞ্চ হয়, মূর্তি বসে এসব হয়, কিন্তু তার তো কারণ আছে, পুজোর সঙ্গে জলাশয়ের যোগ আছে যে!
ওকে এই কথাগুলো বলতে গিয়ে জানলাম ছটপুজো নিয়ে আমার একটা ধারণা আমার অজান্তেই তৈরি হয়েছে।
ছটপুজো অবশ্যই বিহারের সব চাইতে বড় উৎসব। উত্তর প্রদেশেও হয় যদিও। সেইভাবে দেখতে গেলে এখন সারা ভারতে তো হয়ই, তাছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও নানা ডায়াস্পোরাতে হয়।
ছটের মত এত বড় একটা উৎসবে ব্রাহ্মণ লাগে না, পুরোহিত লাগে না। এইটা আমার সব চাইতে ভালো লাগে। সমাজে সব স্তরের মানুষের এই উৎসবে নিয়মকানুন এক। জাতপাতের ভেদ ছাড়া এতবড় উৎসব আর কি আছে? অনেক সেক্যুলার প্রগ্রেসিভ দুর্গাপুজোতেও দেখেছি ব্রাহ্মণ ছাড়া পুজো করানো হয় না। সেখান এতবড় উৎসব বিনা মন্ত্রে শুধু লোকগানের ভাষায়, এটা আমার ভীষণ ভালো লাগে।
আমাদের যেখানে তর্পণের দিন নিজের বাপ-মাকে স্মরণ করতে পুরুতের খুঁটো ধরতে হয়, যেখানে আমরা মেনে নিই যে, যে মানুষটা আমার সঙ্গে রীতিমতো বাঙলা চলিতে কথা বলে জীবন কাটালো, সে-ই নাকি আত্মা হয়েই তার ভাষা ভুলে গেল, সংস্কৃত ছাড়া আর কোনো ভাষার ডেটা নেই তার কাছে। কি তাজ্জব না? আপামর হিন্দু ভারতীয়েরই এই বিশ্বাস।
কিন্তু এইখানে, এই পুজোয় ভক্ত বিশ্বাস করে ছট মা তার দেহাতি ভাষার গান বুঝছেন। সে গানে দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি, সুখদুঃখ, জিনিসের দাম সাধ্যের বাইরে যাওয়া ইত্যাদি কি নিয়ে না কথা নেই!
ছটের অনেক পৌরাণিক মত আছে। কেউ বলেন শ্রীরাম ও সীতা লঙ্কা থেকে ফেরার পর এই পুজো করেছিলেন। কেউ বলেন, দ্রৌপদী এই পুজো করেছিলেন। কোনো মতে কোনো রাজার পুত্র হচ্ছিল না বলে এই পুজো করেছিলেন। আবার এও আছে যে কর্ণ, নিজের পিতা সূর্যদেবকে যে জল অর্পণ করতেন সেই থেকে এই পুজো চলে আসছে। আরো আছে, ছট মা ব্রহ্মার মানসকন্যা, সূর্যের বোন। কেউ বলেন তিনি কাত্যায়নীর রূপ। এরকম নানা গল্প তো আছেই। যত মানুষ তত ভাব। এই তো সত্য।
পুজোর অনেক অনুষঙ্গ। একদিন লাউভাত খাওয়া। একদিন ক্ষীরপুরী খাওয়া। তারপর প্রায় চল্লিশ ঘন্টা উপোস থেকে সন্ধ্যার্ঘ ও প্রভাত অর্ঘ্য দেওয়া জলে দাঁড়িয়ে।
পঙ্কজ ত্রিপাঠি আমার খুব প্রিয় অভিনেতা। তিনি আজকে একটা দৈনিক পত্রিকায় খুব সুন্দর লিখেছেন নিজের ছটের অনুভবের কথা। লিখছেন যখন ছোটো ছিলাম আমার বাড়ির ঠিক পিছনেই একটা নদী ছিল, তার পাড়েই আমরা ছটে যেতাম। তখন এত বাজারদোকান তো ছিল না। ফলে আমাদের ক্ষেতের আঁখ আমরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতাম। তাদের ক্ষেতের ফল তারা আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নিত। ছটের বিশেষত্বই হচ্ছে এ পুজোয় ক্ষেতের জিনিসই লাগে। ফসল, ফল ইত্যাদি। তখন আমাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা করে জামা তো বাবা আনতেন না, বড় ছিট কিনে আনতেন, সেটা কেটে কেটেই আমাদের জামা হয়ে যেত। আমরা যখন একসঙ্গে নদীর ধারে যেতাম সবাই দেখত সবারই এক ধরণের জামা। অনেক পরিবারেই তাই হত। আমরা ছেলেরা পুজোর আগেই নদীর ধার পরিষ্কার করার কাজে লেগে যেতাম। নদী ধার, পুকুরের ধার পরিষ্কার করা। সাজানো। সব আমাদের কাজ ছিল। আসলে পাড়াপ্রতিবেশি সবাই মিলে না এক হলে এ পুজো করা যায় না। মাকে দেখতাম যখন সন্ধ্যা বেলা নদীর জলে দাঁড়িয়ে অর্ঘ্য দিচ্ছেন, গান গাইছেন, সেই গানে পরিবারের সবার নাম করছেন। বৃহৎ পরিবারের কথা বলছি। এমনকি যার সঙ্গে মায়ের কিছু মনোমালিন্য হয়েছে তার নামও বাদ যাচ্ছে না।
পঙ্কজ ত্রিপাঠি শেষে লিখছেন যদি আমরা এইভাবেই সারা বছর আমদের রাস্তাঘাট, নদী-পুকুর-দীঘি পরিষ্কার রাখতে পারি কতই না ভালো হয়।
ভালো তো হয়, কিন্তু আমাদের নদী পুকুর তো দূরের কথা, মন্দিরের ভিতরে বাইরে যা অবস্থা করে রাখি! মহাত্মা গান্ধী তো কাশী ইত্যাদি ধর্মস্থানে গিয়ে আঁতকে উঠতেন যে, যে স্থানকে আমরা এত পবিত্র বলি, সেই স্থানকেই এত নোংরা করে রাখি কি করে!
কাঁচরাপাড়া বড় শহর। আজ বাজারে গিয়ে দেখি রাস্তার দুই ধারে আঁখ আর নানা ফল নিয়ে কত কত দোকান। অবাঙালি মানুষের ঢল। রাস্তায় যেতে যেতে ছটের গান কানে আসছে। আমাদের রামপ্রসাদী গানের মত, সুর শুনলেই চেনা যায়। টানা টানা গায়কীতে কি এক দরদ। পদ্মভূষণে ভূষিতা বিখ্যাত লোকগীতি গায়িকা ও বিশেষজ্ঞ ডক্টর শারদা সিনহা এক পত্রিকায় লিখছেন ছটে গানের অনুষঙ্গের কথা। কিভাবে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে গানের ভাষায় বদল হয়েছে। নিত্য জীবনের টুকিটাকি কথা উঠে আসে। যে কথা খানিক আগেই লিখছিলাম।
ছটে রাস্তায় দণ্ডি কাটতে দেখি প্রত্যেকবার। একবার লিখেছিলাম কাঁচরাপাড়া স্টেশানের এক ভিখারির দণ্ডি কাটার কথা। তখন আমি ছোটো। সে রাস্তায় দণ্ডি কাটছে আর তার পিছনে পিছনে তার দুই ছেলে আর বর যাচ্ছে, মাথায় ফলের ঝুড়ি নিয়ে। আমার বিস্ময় লেগেছিল দেখে, ওরও পরিবার আছে! আমার অনভিজ্ঞ কিশোর মনে ধারণা জন্মেছিল সে একা! নিতান্ত বেচারি। তার যে পরিবার আছে শুধু না, তার রাস্তায় সর্বসমক্ষে নত হওয়ার মত এমন বিশ্বাসও আছে ওই রুগ্ন শরীরের বুকের মধ্যে জেনে আশ্চর্যই হয়েছিলাম।
মানুষ যখন ভালোবেসে নত হয়, তার মধ্যে একটা সৌন্দর্য থাকে। ছোটো শিশুকে কোলে তুলে নিতে যখন নিজে নত হই, কাউকে নত হতে দেখি, আমার চোখে বুকে মাথায় কি আরাম লাগে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে লিখছেন, যদি বলি মানুষ স্বাধীনতা চায়, তবে মিথ্যা কথা বলা হয়, সে অধীন হতেই চায়।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন ভালোবাসার অধীন হওয়ার কথা। যে অধীনতাটুকু গেলে এমন কাঙাল হতে হয় যে গোটা বিশ্বের সব সম্পদও সে কাঙালপনা দূর করতে পারে না। আর এমন দুর্মতি ভর করে যে শিশুদের হত্যা করতেও বুদ্ধির কোনো কোণায় বাধে না।
যখন এ লেখা লিখছি, দূর থেকে ছটের সুর ভেসে আসছে। বেদবেদান্তে ছটের কথা লেখা থাকুক চাই না থাকুক, কিন্তু এই ঘর, ঘাট আর মহাকাশের জ্যোতিষ্কের মধ্যে যে মেলবন্ধন সে আমাকে বিস্মিত করে। মুগ্ধ করে। এ ততটা পুজো নয় যতটা আত্ম-নিবেদন আর সামাজিক মেলবন্ধনের উৎসব। মধ্যাহ্ন প্রীতিভোজের মেলবন্ধন বা প্যাণ্ডেল হপিং না। এ উৎসবের মেল বন্ধন। বিনা ব্রাহ্মণ্যবাদ, বিনা সামাজিক ছুঁৎমার্গ!
(ছবি: Debasish Bose এর আর্কাইভ থেকে।)