সৌরভ ভট্টাচার্য
5 December 2017
এ লেখাটা লেখার কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা অথবা সার্টিফিকেটের ছাড়পত্র
আমার নেই। তাই অনেকের কাছে এ লেখা বাতুলতার তুল্য হতেই পারে। তবু যেটুকু কথা দানা
বাঁধছে, তাকে সামনে রাখতে চেষ্টা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়, আমরা ভাবব বললেই ভাবতে পারি না,
যতক্ষণ না ভাবনা আমাদের ভাবিয়ে তোলে।
জিডি বিড়লা স্কুলে যে ঘটনাটা ঘটল, তাকে বিচ্ছিন্ন
একটা ঘটনা হিসাবে দেখতে হবে কি? একজন আমার অভিভাবকতুল্য
মানুষ বললেন, ধর্ষণের এই বারমাস্যা আর সহ্য হয় না। কথাটা তো
তাই, এ তো নিত্যনৈমিত্যিক ঘটনা এখন। ভাবনাটা মনের মধ্যে
ঘুরিয়েই চলে – কেন? কেন? কেন? আমি প্রতিবাদ করতে পারি, লেখায়,
মোমবাতির মিছিলে, ধর্না ধরে, কিন্তু তারপর? সেই তো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। এমন তো
নয় যে এরা সব যোগসাজশ করে এসব ঘটনা কোনো নির্দিষ্ট একটা দল ঘটিয়ে চলেছে। কিম্বা
সবাই একই পরিবারের লোকজন যারা এরকম ধরণের এক একটা জঘন্য ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু
একটা জায়গায় সবাই এক, আমরা একটা নির্দিষ্ট সমাজের, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর দিয়ে সবাই যাচ্ছি।
একজন মানুষ যখন বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন আমরা বলি
না, রোগজীবাণুগুলো অত্যন্ত বলশালী হয়ে উঠছে, কিম্বা জীবাণুগুলো উক্ত ব্যক্তির উপর পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে। আমরা বলি,
ব্যক্তিটির অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটি শক্তি দুর্বল হয়েছে। তবে কি
আমাদের সমাজের তথা সময়েরও একটা সমষ্টিগত দুর্বলতা তৈরি হচ্ছে কোথাও?
ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্য চুরি করে খাওয়া, কিম্বা
খাদ্যের জন্য হত্যালীলা চালানোর একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কিন্তু যে বঞ্চিত নয়
খাদ্য থেকে, তার যখন ক্ষুধার চাহিদা মাত্রা ছাড়ায় তখন আমরা
তাকে বিজ্ঞানের ভাষায় 'অসুস্থ' বলি,
আর চলতি ভাষায় 'বিকারগ্রস্থ' বলি। কাম শরীরের একটা চাহিদা। তাকে সুষ্ঠু পথে নিবারণ করার জন্য সমাজের
নানা ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তারাই এই ধরণের অপরাধের
সাথে জড়িত হয়ে যাচ্ছে যারা বঞ্চিত নয়, তবে কি তারা
বিকারগ্রস্থ? না, এত তাড়াতাড়ি সমাধান
টানলে তা অতিসরলীকরণের দোষে দুষ্ট হবে। কারণ 'বিকার' শব্দটার ব্যাপ্তি অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। তাই শব্দের আড়ালে পাশ কাটালে
চলবে না।
মানুষের সত্তায় বুদ্ধির পাশাপাশি আরেকটা অস্তিত্ব আছে - impulse. এই শব্দটার আভিধানিক অর্থ নানা। প্রবৃত্তি আর ক্ষণিক আবেগ – এই দুটো শব্দের একটা মিলিত রূপ আমার বোধে impulse, 'প্রবৃত্তি'
শব্দটাকেই বেছে নিলাম। যদিও প্রবৃত্তির আরো অন্য মাত্রাতেও অর্থ হয়।
impulsive মানে আবেগতাড়িত। কিন্তু এই শব্দটার অর্থের সাথে
অপরাধ জগতের মিল কতটা? এই বিষয়ে যখন আলোচনা করছিলাম আমার এক
বন্ধুর সাথে, সে আমায় দস্তয়েভস্কির ‘অপরাধ
ও শাস্তি’ বইয়ের খুনের দৃশ্যটার কথা মনে করালো। সে খুনটা
করেছিল একটা আবেগে না একটা অন্ধ প্রবৃত্তির দ্বারা তাড়িত হয়ে?
একটা অন্ধপ্রবৃত্তি তাকে পেয়ে বসেছিল। তার চিন্তাভাবনা সব সেই নিয়ন্ত্রণ
করে যাচ্ছিল। চিন্তাভাবনারা ক্রমে পরিকল্পনা এবং ধীরে ধীরে কাজে বাস্তবায়িত হল।
মূল ছিল তার অন্ধপ্রবৃত্তি। তার দারিদ্র কি তাকে এই রাস্তায় আসতে বাধ্য করেনি?
তাই যদি হবে তবে দারিদ্র আর অপরাধ একটা সরল সমীকরণে এসে দাঁড়াবে।
কিন্তু তা কি সত্য? চরিত্র শব্দটা দাঁড়ায় কোথায় তবে?
'চরিত্র' শব্দটা এখন আর আগের অর্থে শোনা যায় না।
চরিত্রগঠন রাধাকৃষ্ণানের মতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়ার কথা। চরিত্রের একটা অর্থে
সদগুণাবলী হলেও, ব্যপক অর্থে তার মূল সত্তার বহমানতার ধারা।
সে ধারা সে নিয়ে জন্মায়। কিন্তু সবটাই কি সে নিয়ে জন্মায়? একই
বাড়ির দু'ভাই দু'রকম – এ উদাহরণ কি খুব অপ্রতুল? সেই অর্থে অবশ্যই কিছুটা
মানসিকতা সে নিয়েই জন্মায়। কিন্তু এই যদি শেষ কথা হত তবে 'শিক্ষা'
কথাটা প্রহসন হত, 'সভ্যতা' শব্দটা অলীক হত। এই প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ল। পড়েছিলাম ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ বইতে। ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বলা
গল্প। একজন ছেলেকে তার মাসি অত্যন্ত প্রশ্রয় দিতেন ছোটোবেলা থেকে। সব অপরাধ
নির্বিচারে মেনে নিতেন। অনেকে বারণ করত, তিনি শুনতেন না।
ছেলেটা বড় হল। একটা বড়সড় চুরি করে ধরা পড়ল। পুলিশ এলো ধরতে। যখন তাকে হাতকড়া পরিয়ে
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে পুলিশকে বলল, একটু
দাঁড়ান, মাসির সাথে আমার একটা কথা আছে, সেরেই আসছি। তাকে মসির কাছে আনা হল। সে মাসিকে বলল, মাসি,
একটা কথা শোনো কানে কানে। মাসি যেই না কানটা তার মুখের কাছে
বাড়িয়েছে, সে প্রচণ্ড জোরে কানটা কামড়ে ধরল আর বলল, যদি তুমি ছোটোবেলা থেকে আমায় ঠিকঠাক শাসন করতে তবে আজ এই দিনটা আমায় দেখতে
হত না।
এই তো গেল গল্প। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, বেড়ালের গলায়
ঘন্টাটা বাঁধবে কে? ন্যাশেনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলে গত বছর
একটা ছয় এপিসোডের তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল – দ্য স্টোরি অব
গড। অসামান্য তথ্যচিত্র। তাতে একটা এপিসোড ছিল, অমঙ্গলের উৎস
কি? সেই তথ্যচিত্রের দুটো ঘটনা এখানে উল্লেখ্যঃ
এক) একজন মনোবিদ কয়েকজন শিশুকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে একটা খেলা
শেখান। তারপর বলেন তোমরা একা একা এই ঘরটায় আসবে আর এই খেলাটা খেলবে। তাই হয়। সেই
মনোবিদ একটা গোপন ক্যামেরা সেই ঘরের এক কোনে লাগিয়ে দেন। আমরা দর্শকেরা দেখলাম
বেশির ভাগ বাচ্চাই অসৎ উপায়ে খেলাটা খেলল, যাকে বলা যায়, চিটিং করল।
এরপর তিনি আরেকটা গ্রুপকে নিয়ে একই নির্দেশ দেন আর সেই ঘরে একটা চেয়ার
দেখিয়ে বলেন যে এই চেয়ারটায় একজন অদৃশ্য রাজকুমারী বসে আছেন, যিনি তোমাদের খেয়াল রাখবেন। তারপর দেখা যায়, একটা
একটা বাচ্চা ঢুকছে আর খেলাটা সৎভাবে খেলার চেষ্টা করছে। কারণ চেয়ারে অদৃশ্য
প্রিন্সেস।
এইবার মনোবিদ একটা সিদ্ধান্ত টানেন যে, মানুষ একজনের
নজরদারির সামনে থাকলে বেশি সৎ হয়। এটা দেখতে দেখতেই আমার মনে পড়ল, নানা জায়গায় লেখা থাকে, আপনি কিন্তু ক্যামেরার
নজরদারির আওতার মধ্যে আছেন। সেদিনের ঈশ্বর আজকের সিসিটিভি ক্যামেরা!
দুই) একজন দাগী আসামী। সে অপহরণ, ধর্ষণ ও খুন -
সবই করেছে, তার সাথে আরো রক্তহিম করা অপরাধ। তাকে প্রশ্ন করা
হল, তোমার কোনো অনুশোচনা আছে? সে
ঠাণ্ডা গলায় বলল, না। সে বহু বছর জেলবন্দী। তাকে জিজ্ঞাসা
করা হল, তুমি কি বাইরের জগতে আসতে চাও? সে তেমনি ঠাণ্ডা গলায় বলল, কি লাভ? আমার মধ্যে তো কোনো অনুশোচনাই নেই। আমি হয়ত একই কাজ করব আবার। প্রশ্ন করা
হল, কেন করবে? সে বলল, কারণ আমি আপনাদের মত নই। আমি আমার impulse চাপতে
পারি না। কারণ আমি যতগুলো কাজ করেছি সে আমার অদম্য প্রবৃত্তির তাড়নাতেই করেছি।
আপনাদের মত সুস্থ মানুষদের সাথে আমাদের পার্থক্যই হল এই যে আমরা আমাদের প্রবৃত্তির
বেগ আটকাতে পারি না, আপনারা পারেন।
আমার নির্ভয়ার উপর বানানো তথ্যচিত্রটা মনে পড়ল। তার ধর্ষণকারীদের
যখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল তাদের মধ্যেও কিন্তু কোনো অনুতাপের লক্ষণ দেখা যায়নি।
বরং তারা ঘটনাটাকে জাস্টিফাই-ই করছিল একরকম।
প্রশ্নটা হল এইখানে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে,
কি সমাজগত জীবনে আগে একটা ধর্মের কিম্বা ঈশ্বরের ভয় ছিল। যে ভয়টা
নিজের ভিতর থেকে জন্মাতো। কারণ ঈশ্বর অন্তর্যামী, তিনি
সর্বত্র অবস্থিত, অর্থাৎ আমি যাই করি না কেন, তার দৃষ্টিগোচর তা হবেই, তাই আমায় ভালো হতে হবে।
আমাদের আইন-কানুন যাই থাকুক না কেন, পুলিশ তো আর
অন্তর্যামী হতে পারে না; কিম্বা সর্বত্র অবস্থিত হতে পারে
না। নির্ভয়ার ঘটনার পর অনেকেই দাবি করেছিলেন, দিল্লীর এত
রাস্তা অন্ধকার কেন? রাস্তায় আলোর ব্যবস্থা হোক আরো বেশি করে,
কারণ আলোতে অপরাধ কম হয়। কথাটা আসলে আলো না, কথাটা
কারোর নজরদারির। পুলিশ না থাকলে কতজন মানুষ ভদ্র সেই নিয়ে সংশয় খোদ বিবেকানন্দও
প্রকাশ করেছিলেন, যার দর্শনের মূল কথাই নাকি –‘সর্বভূতে সেই প্রেমময়’।
তবে উপায় কি? আমাদের ঈশ্বরবোধ আর ধর্মবোধ বিজ্ঞান
কেড়েছে না বিজ্ঞানজাত ভোগবাদ কেড়েছে তা আমার কাছে স্পষ্ট নয় এখনও। অনেকের কাছেই নয়
বলে আমরা আধুনিকোত্তর যুগে অজ্ঞেয়বাদের দিকে ঝুঁকছি বেশি। সে না হয় দার্শনিক আর
দর্শনের সমস্যা। আমাদের এই প্রবৃত্তিমুখী জীবনস্রোতের হাল ধরবে কে? ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ বইতে বারবার পড়েছিলাম, প্রবৃত্তিমুখী জীবনের সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে ঝুঁকির কথা। তার উপায় হিসাবে
বলা হয়েছিল, একটা ideal নির্দিষ্ট না
হলে কোনোদিনই একটা সমাজ তথা ব্যক্তি নিজের অন্ধপ্রবৃত্তির উপর কাবু পেতে পারে না।
তার একটা আদর্শকে নিজের সামনে রাখতেই হবে নিজের জীবনের মূল্যবোধ স্থির করার জন্য।
নইলে সে নিজের প্রবৃত্তির দাস হয়ে নিজেকে নিজেই ধ্বংস করে ফেলবে। একজন সমাজবিদ
ওনাকে প্রশ্ন করছেন, তবে সে আদর্শ কি হওয়া উচিৎ? উনি বলছেন, এক, ধর্মের সঠিক
উপস্থাপনা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে। যেখানে ধর্ম অর্থে হল সমস্ত প্রকার দুর্বলতা
ত্যাগ করে, অকৃত্রিম হৃদয়ে নিজের ও নিজের চারপাশের বৃদ্ধি ও
বাঁচাকে কায়েম করার পথে চলা। দুই, সমস্ত আলোকিত মহাপুরুষদের
শিক্ষার মধ্যে যে একতা ও সমভাবাপন্ন করুণা আর আদর্শপ্রাণতার কথা আছে তাকে সামনে
রাখা।
মহানামব্রত ব্রহ্মচারী থেকে রাসেল অবধি সবার কথার মূলসুর একটাই – সবার সাথে মিলে চলার শিক্ষা না পেলে আদতে সব শিক্ষাই আমাদের পক্ষে
বিষতুল্য। "love is wise and hatred is foolish" - রাসেল বলছেন।
সবই জানছি, কিন্তু করাটা আর হয়ে উঠছে কই? আত্ম-প্রশ্রয়, অদৃষ্টবাদ আর আলস্য – আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বইছে। প্রেসক্রিপশান আছে কিন্তু ওষুধের দোকানগুলো
খুলতে বাধা। যদি বা ওষুধের দোকান খুলল তো তেঁতো ওষুধ গিলতে রুগীর অনীহা, আর পরিজনের অপ্রিয় হওয়ার ভয়ে রুগীকে ওষুধ গেলাতে পিছপা হওয়া। এ রোগ তবে
সারবে কবে?
শাস্তি কঠোর তো হতেই হবে, তার সাথে ঘোগ দিয়ে জল
বেরোনো যদি না আটকানো যায়, তবে?