Skip to main content
shunya mandir mor

"এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর", বিদ্যাপতি লিখলেন। সুর তিনি কি করেছিলেন জানা নেই। রবীন্দ্রনাথ যে সুরটা করলেন, সেটা জানি। 

     বিদ্যাপতির লেখায় বিরহের সুর। শেষে প্রশ্ন, কি করে হরি বিনা দিন রাত কাটাবি? “বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া”। 

     গভীর রাত। বৃষ্টি পড়ছে আকাশ উপুড় করে। ভরা বাদর। বৃষ্টি পড়ে চলেছে অবিরাম। পাশে স্তব্ধ স্মার্টফোন। এত রাতে কে আর ফোনকে জাগায়? এখন ফোন জাগলে জগত জেগে যায়। আঙুলের ছোঁয়ায় এ লোক থেকে সে লোকে মন, চোখ আর কান ভেসে যায়। বুদ্ধি কখনও বিস্মিত, কখনও মোহাচ্ছাদিত, কখনও বিমূঢ়, কখনও বিভ্রান্ত। থাক। বরং বৃষ্টি হোক। বরং বিদ্যাপতিকে ডাকি। কণিকার কন্ঠস্বর মাথার মধ্যে থাকুক। “বিদ্যাপতি কহ কৈছে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া”। হরি বিনা দিনরাত কি করে কাটাবি? প্রশ্ন বিদ্যাপতির। রবীন্দ্রনাথের অনুভবে --- বড় কথাটা প্রশ্নে নয়, বড় কথাটা হল দিনরাত কাটানোর মত এমন একটা সম্পদ আমার আছে, হরি, এই কথাটা। রবীন্দ্রনাথ ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’ প্রবন্ধে লিখছেন এই কথাগুলো, এই গানের উল্লেখ করে।

     বিরহ আকুল বিদ্যাপতির মন। কৌতুহল নয়। বাসনা নয়। বিরহ। যন্ত্রণা। শূন্যতার সদর্থক যন্ত্রণা বিরহ। বিষাদ নয়। 

     বিদ্যাপতি যে আকুলতা নিয়ে রাত জাগছেন, আধুনিক যুগে সে আকুলতা কি আমাদের একদম হারিয়েছে? সম্পদ, পরিজন, সফলতা --- সব কিছুর মধ্যে কি আমাদের প্রাণে কখনও এক শূন্যতার ব্যথা জন্মায় না? ভাদ্রের রাতের অন্ধকারের বর্ষা তো সে ব্যথাকে আরো নিবিড়ভাবে জাগিয়েছে কেবল। “ব্যথা আমার কূল মানে না, বাধা মানে না। / পরান আমার ঘুম জানে না, জাগা জানে না”। সব ‘হ্যাঁ’-এর মাঝে এই ‘না’, আর সব ‘না’-এর মাঝে ‘হ্যাঁ’-কে শোনাই তো অভিসার। বাঁশির শূন্য শরীরে সুর ওঠে, সেই তো অভিসারের ডাক। যেখানে ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ মিলেমিশে একাকার। ‘আমি’ আর ‘তুমি’ মিলে এক। 

     চিকিৎসক ততক্ষণ আশা রাখেন যতক্ষণ শরীরে শ্বাসবায়ুর যাতায়াতে কোনো বাধা ঘটছে না। আমার সম্পদ, সফলতা, পরিজনের মধ্যে একটা ফাঁক থাকুক। যেমন আমার শরীরে শ্বাসবায়ুর যাতায়াতের পথ। নইলে যে দম আটকে আসবে! বিদ্যাপতি সেই ফাঁক, সেই শূন্যতাকে আহ্বান করছেন। জাগিয়ে দিচ্ছেন। প্রশ্ন করছেন। কি এমন সম্পদ আছে, যার ভার নেই? কি এমন সফলতা আছে যাতে অহমিকা নেই? কে এমন পরিজন আছে যে বেঁধে নেই? তাকে ছাড়া তোমার দিনরাত কাটবে কি নিয়ে? এই প্রশ্ন বিদ্যাপতির। 

     রুমি বলছেন, পাত্রের অন্তরে শূন্যতা বলেই তুমি সেখানে তোমার কাঙ্খিত জিনিস রাখতে পারো। শূন্যতা মানে অপেক্ষা। শূন্যতা মানে আলিঙ্গনের পূর্বাবস্থা। বিদ্যাপতি সেই শূন্যতাকে ডাকছেন। শূন্য মন্দির মোর। কার জন্য শূন্য? যে আমার চিরকালের তার জন্য। 

     আধুনিকোত্তর যুগ আমাদের শূন্য হতে শেখায়নি, নিঃস্ব হতে শেখাচ্ছে। দিনে দিনে আত্মহননের রাস্তাকেই একমাত্র পরিত্রাণের রাস্তা বাছছে মানুষ। আধুনিকোত্তর যুগের মানুষ। সফলতা, সম্পদ আর পরিজন --- এর মধ্যে সাম্য হারাচ্ছে। সফলতার স্পৃহা, সম্পদের স্পৃহা আর পরিজনকে বাদ দিয়ে অনুগামীর স্পৃহায় পাগল হচ্ছি। সামাজিক মাধ্যমে আমি অবতার হচ্ছি। আমি ডিভা হচ্ছি। আমি যে অনুসরণীয় তা যে করেই হোক তোমাকে বুঝিয়েই ছাড়ব। প্রতিভা ছাড়া মানুষ হয় নাকি? প্রতিভার বিজ্ঞাপন আমার এখন রাতদিনের রোগ। বহুকাল আগে 'ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ' বলে একটা সূত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। সৎ পথে সফলতা-সম্পদ-পরিজন আবৃত হয়েও চিত্তের বাধাহীন প্রসারের জন্য একটা মুক্তির রাস্তা খুলে রাখার কথা বলা হয়েছিল। যাকে 'মোক্ষ' বলা হয়েছিল। চিকিৎসকেরা যেমন বলেন, ভরপেট খেয়ো না, পেটের কিছুটা খালি রাখো স্বাস্থ্যের জন্যে, এও সেই। সৎ পথে সম্পদ-সফলতা-পরিজন লাভ করলেও চিত্তের সবটুকু এতেই ব্যয় করে বোসো না। ওতে মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হবে। একটা 'ফ্রি স্পেস' রাখো। মোক্ষ মানে পালিয়ে যাওয়া নয়, মোক্ষ মানে সব কিছুর মধ্যে একটা স্বাস্থ্যকর ফ্রি স্পেসে অভ্যস্থ হওয়া। যেমন দুটো শব্দের মধ্যে একটা শূন্যস্থান না রাখলে বাক্য হয় না, এও তেমন। 

     বাইরের জগত আমাদের দরিদ্র করতে পারে। কিন্তু নিঃস্বতার বোধ চিত্তের অনুভব। সবল চিত্ত নিঃস্বতা অনুভব করে না, সমস্যা অবশ্যই অনুভব করে। তার থেকে বেরোবার যুক্তিগ্রাহ্য উপায় খোঁজে। ধৈর্য ধরে। 

     সফলতা-সম্পদ-পরিজনের বাইরে গিয়ে নিজের মধ্যে বিদ্যাপতির এই ডাক। কিভাবে দিনরাত কাটাবি? আমি ভাববো কেন? আমার এত এত সম্পদ আছে, এত এত ফলোয়ার আছে, এত এত গেজেট আছে… আমি সেই নিয়ে মেতে থাকব! 

     বিদ্যাপতি জিজ্ঞাসা করবে, এ তো বাইরের, ভিতরে কি কোনো শূন্যতার অনুভব নেই? 

     আমি বলব, সে নিয়ে ভাবার আমার সময় নেই। আমি ভীষণ ব্যস্ত যে, দেখতে পাচ্ছ না?! 

     বিদ্যাপতি হাসবেন হয় তো ঈষৎ। বলবেন, একদিন এই বাইরের জগতে পর্দা পড়বে, মৃত্যুর কথা বলছি না, বলছি অবসাদের কথা। অবসাদের পর্দা। কিচ্ছু ভালো লাগবে না। সব অনর্থক লাগবে। সেদিন নিজের চিত্তের মধ্যে ডুবো। একটা ফাঁকা রাস্তা বানিয়ে নিয়ো। সে রাস্তায় অপেক্ষা কোরো। চিত্তের মধ্যেই মুক্তো বানানোর উপাদান আছে। ঝিনুকের বুকে যেমন থাকে। তোমার অন্তরে তুমি যত শূন্যতাকে অনুভব করবে তত জানবে সে আসছে, আরো কাছে। শূন্যতাকে ভয় কোরো না। ভয় পেয়ো নিঃস্বতাকে, যে বলে, তোমার কিছু নেই, তুমি দীনহীন। শূন্যতা বলে, তুমি তৈরি হও, বুক পেতে অপেক্ষা করো। আমি এসেছি তাকে ধারণ করব বলে। আমি ধারণের প্রাক যন্ত্রণা। আমায় স্বীকার করো। পূর্ণ হও। আনন্দিত হও। সার্থক করো নিজেকে।

 

(ছবি Aniket)